দ্য পিরামিড – ইসমাঈল কাদরী
অনুবাদ : রাফিক হারিরি
রোদেলা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ – ঢাকা বইমেলা ২০০৯
প্রচ্ছদ – মাহবুব কামরান
THE PYRAMID By Ismail Kadere
Translated By Rafiq Hariri
First Published Dhaka Boimela 2009
Published By Riaz Khan, Rodela Prokashani
উৎসর্গ
অগ্রজ প্ৰতীম
খায়রুল আলম মনির ভাইকে
প্রসঙ্গ পিরামিড ও ইসমাঈল কাদরী
পিরামিড হলো মিশরের গিজায় অবস্থিত প্রাচীন মিশরীয় রাজা ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র। মাটি খুঁড়ে বা ছোট মিনার গড়ে তৈরি করা সাধারণ সমাধির মতো ছিলো না এই সমাধিক্ষেত্রগুলো। বরং এগুলো তৈরি করা হয়েছিলো পাথরের পর পাথরের স্তুপ দিয়ে বিশাল পিরামিড আকারে। এই পিরামিডের ভেতর সমাহিত করা হতো ফারাওদেরকে। ফারাওরা নিজেদের জীবিতকালেই তৈরি করতেন একেকটি পিরামিড। পিরামিডগুলোর মধ্যে ফারাও খুফু যিনি ফারাও চিওপস নামেও পরিচিত ছিলেন তার, পিরামিডটিই সর্ববৃহৎ। এই পিরামিডটি গিজার গ্রেট পিরামিড নামে সুপরিচিত।
ফারাও চিওপসের এই সমাধিক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রতীকিভাবে ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে সামনে রেখে আলবেনীয় ঔপন্যাসিক ইসমাঈল কাদরী রচনা করেছেন ‘পিরামিড’ উপন্যাসটিকে।
এক সকালে ফারাও চিওপস সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তার জন্য কোনো পিরামিড তৈরি করবেন না। তার এই সিদ্ধান্তে সভাসদ সবাই হতবাক হয়ে পড়লো। কোনো পিরামিড তৈরি হবে না! তাহলে কীভাবে রক্ষা পাবে এই দেশ। পিরামিড ছাড়া অশুভ ছায়া এ দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। পিরামিড যদি নির্মাণ করা না হয় তাহলে এ জাতিকে একটা কাজের মধ্যে দাসদের মতো আটকে রাখতে না পারলে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যাবে। অবশেষে সভাসদ আর প্রধান কৌশলী হেমিউনির যুক্তিতে ফারাও খুফু রাজি হলেন বিশাল আকৃতির এই সমাধি তৈরি করতে।
পাথর সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন প্রদেশের পাথর খাদগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। পিরামিড তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রাণ হানি ঘটলো। যারা পিরামিড তৈরিতে তাড়াহুড়ো করছিলো তারা সম্রাটের মৃত্যু কামনা করছে এই অজুহাতে তাদেরকে ফাঁসিতে চড়ানো হলো আবার যারা কাজে ধীরগতি অবলম্বন করছিলো তাদেরকে অলসতার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।
এভাবে সম্রাটের খেয়ালের বসে অনেক লোকের আত্মাহুতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন কাজের পর তৈরি হলো সম্রাটের সমাধিক্ষেত্র। এক স্বৈরশাসকের অন্তিম শয়ানের স্থান।
রূপক অর্থে ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপট নিয়ে ইসমাঈল কাদরী এমন এক সময়ে ‘দ্য পিরামিড’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন যখন তার নিজের দেশেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে স্বৈরশাসন। আর যখন তিনি নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন ফ্রান্সে।
আলবেনীয় ঔপন্যাসিক ইসমাঈল কাদরী তাঁর সময়ের স্রোতের বিপরীতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একজন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব।
১৯৬১ সনে আলবেনিয়া যখন সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে সাথে চীনসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সেই সময় থেকেই আলবেনিয়ায় গড়ে উঠতে থাকে সাহিত্য সংস্কৃতির নতুন এক প্রজন্ম। সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গী নিয়ে একদল লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে ইসমাঈল কাদরী, ফাটুস আরাপি, দ্রি টিরো অ্যাগোলি উল্লেখযোগ্য।
কাদরী বেড়ে উঠেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে। তিনি নিজ চোখে দেখেছেন তার দেশের স্বৈরশাসনকে, ইটালির ফ্যাসিষ্ট শাসক, জার্মানির নাজি আর সোভিয়েট ইউনিয়নের স্বৈরতন্ত্রকে। এ সব রূঢ় বাস্তবতার ভেতর দিয়েই তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছিলো। ইসমাঈল কাদরী প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন গিজিরোকস্ট্রায়। তারপর তিনি ইউনিভার্সিটি অভ্ তিরানায় সাহিত্য, ইতিহাস এবং ভাষাতত্ত্ব পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫৬-তে তিনি টিচার্স ডিপ্লোমা অর্জন করেন। কাদরী মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটে বিশ্ব সাহিত্যের উপর গবেষণা করেন।
ইসমাঈল কাদরী আলবেনিয়ার সাহিত্যে পরিচিত পাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যেও সমানভাবে তার আসন পাকাপোক্ত করেছেন। সারা বিশ্বে চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় তার গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান এবং শক্তিশালী লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে।
বেশ কয়েক বছর ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের একজন শক্ত প্রার্থী হিসেবে ইসমাঈল কাদরী তার অবস্থান অটুট রেখেছেন। যে কোনো সময় নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। ১৯৬০-এর পর থেকে আলবেনিয়ার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে বেশ দৃঢ় প্রভাব বজায় রেখে চলছেন ইসমাঈল কাদরী। তার সময়কার স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কলম হাতে পুরো দমে সোচ্চার।
ইসমাঈল কাদরী যদিও তাঁর সাহিত্য কীর্তির প্রথম দিকে কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন এবং বেশ সুনামও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু পরে উপন্যাস লেখার দিকে মনোযোগ দেন। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অভ্ দ্য ডেড আরমি’, প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৭০-এ প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য কেসেল’। এ সময় একটা কবিতা লিখে তৎকালীন স্বৈরশাসকের কোপানলে পড়লে তিন বছরের জন্য তাঁর লেখালেখি প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় কাদরীর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস থ্রি আরকেড ব্রিজ।’ একটা নদীর উপর ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ দিন ধরে তৈরি হওয়া একটা সেতু নিয়ে এর কাহিনী।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় কাদরীর একটি রাজনৈতিক উপন্যাস ‘দ্য প্যালেস অভ্ ড্রিমস’। উপন্যাসটির মূল চরিত্রে ছিলো মার্ক আলম নামে একজন যুবক যে সবাইকে নানা ধরনের স্বপ্ন দেখিয়ে বেড়াতো। নানা মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতো। স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে কীভাবে শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয় সেটা সে সবাইকে বোঝাতো। উপন্যাসটি মঞ্চস্থ হওয়ার পরপরই স্বৈরশাসক কর্তৃক এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর সকল প্রকাশনাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ইসমাঈল কাদরীর ‘দ্য কনসার্ট’, উপন্যাসটিকে সেরা উপন্যাসগুলোর একটা ধরা হয়। এই উপন্যাসটিকে ফ্রান্সের প্রধান সাহিত্য পত্রিকা বছরের সেরা গ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত করে।
কাদরী তার সমস্ত লেখনিতে হোক্সা শাসনের এবং সব ধরনের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ১৯৮৫ সনে হোক্সা মারা গেলে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে আসিন হয় রামিজ আলি। সে হোক্সার মতো ক্ষমতাধর রাজনৈতিক চরিত্র ছিলো না। ফলে কয়েক মাস পরেই কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে। কমিউনিষ্ট স্বৈরশাসনের পতনের কয়েক মাস পূর্বেই কাদরী ১৯৯১ সালে সপরিবারে ফ্রান্সে চলে যান।
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় কাদরীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য পিরামিড’ পিরামিড উপন্যাসটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় মিশরের কায়রোতে। এই পিরামিড উপন্যাসটিতে কাদরী তার সময়ের হোক্সা শাসনামলের স্বৈরশাসনের বিষয়টি প্রতীকি অর্থে ধরে এর প্লট নির্ধারণ করেছেন। ফারাও আমলের ফারাও খুফু যেমন সাধারণ মানুষের দুঃখ শোককে পাত্তা না দিয়ে নিজের বংশগত ঐতিহ্য রক্ষায় আর নিজের শাসন ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য জনগণকে প্রচণ্ড চাপের মুখে রেখে পিরামিড তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন ঠিক একই ভাবে কাদরীর সময়ের স্বৈরশাসক হোক্সা নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালিয়েছে আজীবন। এ বিষয়গুলো ইতিহাসের সংমিশ্রণে গভীর বিশ্লেষণের সাথে প্রতীকি অর্থে ইসমাঈল কাদরী তুলে ধরেছেন তার ‘দ্য পিরামিড’ উপন্যাসে।
Md Maruf Hossain
I want to be part of this website