দ্য গ্রেট ট্রান্সফর্মেশন : আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সূচনা – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
ওসিআর ভার্সন / প্রুফ সংশোধন করা হয়নি / তথ্যসূত্র সংযোজন করা হয়নি
অনুবাদ: শওকত হোসেন
প্রথম কালোহরফ সংস্করণ: ২০১৬
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
বরাবরের মতো আমার লিটারেরি এজেন্ট ফেলিসিটি ব্রায়ান, পিটার গিন্সবার্গ এবং অ্যান্ড্রু নানবার্গ ও সম্পাদক জেন গ্যারেট, রবার্ট আমার লান ও যাঁর মাথা থেকে এই গ্রন্থের ধারণা বেরিয়েছে, টোবি মান্ডিকে ধন্যবাদ জানাতেই হচ্ছে। অনেক বছর ধরে ওদের উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং আমার পক্ষে নিবেদিতপ্রাণ পরিশ্রম একাধারে অপরিহার্য ও আনন্দের উৎস হয়ে আছে। ফেলিসিটি ব্রায়ানের অফিসের মিশেল টপহ্যাম ও ক্যারল রবিনসনকেও তাদের অব্যাহত সাহায্য ও সংকট মুহূর্তে প্রশান্ত সমর্থনের জন্যে ও দারুণ বিবেচক মধ্যস্থতাকারী হিসাবে এমিলি মোলানিফি ও অ্যালিস হান্টকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়। সবসময়ের মতো নির্ভুলতা ও আভিজাত্যের প্রতি অনুরাগের জন্যে নফে’র প্রডাকশন টিমের চাক অ্যান্টনি (কপিরাইটার), প্যাট্রিস সিলভাস্টেইন ও চাক টম্পসন (প্রুফরীডার), ক্লেয়ার ব্র্যাডলি অঙ (প্রোডাকশন), অ্যান্থিয়া লিঙ্গারম্যান (ডিজাইনার), ডেভিড লিন্ডরথ (মানচিত্রকর) এবং এলেন ফিল্ডম্যান (প্রডাকশন এডিটর) এর প্রতিও আমি দারুণ কৃতজ্ঞ। এবং বর্তমান রচনার ক্ষেত্রে এখনও অবদান রাখা বাকি থাকলেও প্রচারণা বিভাগের আমার বন্ধু শিলা কেই, ফ্রান্সিয়ান শুরসমা এবং শিলা ও শিয়ার কথা আমি ভুলতে পারি না। সবশেষে আমার কাজিন জেন্ট্রি ওয়েম্যানের ভালোবাসা ও সমর্থন বিনা আমার পক্ষে এই বইটির কাজ শেষ করা সম্ভব হতো না।
তবে আমার অকৃত্রিম ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই বইটি মিচেল ও জেরান্ডিনের প্রতি উৎসর্গ করা হলো যারা সহানুভূতির মানে বোঝে
সূচনা
সম্ভবত প্রতিটি প্রজন্মই নিজেদের ইতিহাসের এক বাঁকে এসে পৌঁছেছে বলে মনে করে, কিন্তু আমাদের বিভিন্ন সমস্যাকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণের অতীত মনে হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমানহারে অনিশ্চিত ঠেকে। আমাদের বহু সমস্যাই এক গভীরতর আধ্যাত্মিক সংকটকে আড়াল করে। বিংশ শতাব্দীতে আমরা নজীর বিহীন মাত্রায় সহিংসতার বিস্ফোরণ লক্ষ করেছি। অন্যের ক্ষতি করার, ক্ষতবিক্ষত করার ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্য দুঃখজনকভাবে অসাধারণ অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আমরা যেন আমাদের আগ্রাসী মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ এবং একটি নিরাপদ ও উপযুক্ত সীমানায় বেঁধে রাখার মতো প্রজ্ঞার অভাবে ভুগছি। হিরোশিমা ও নাগাসাকির আকাশে প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির অসাধারণ সাফ্যল্যের একেবারে অভ্যন্তরে বাস করা বিনাশী আত্মধ্বংস-কে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীকে আর পবিত্র না ভেবে স্রেফ ‘সম্পদ’ মনে করি বলেই পরিবেশগত বিভিন্ন বিপর্যয় ঘটাই। কারিগরি মেধার সঙ্গে তাল মেলানোর মতো এক ধরনের আধ্যাত্মিকতার অস্তিত্ব না থাকলে আমাদের গ্রহটিকে বাঁচানোর বেলায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। একেবারে খাঁটি যৌক্তিক শিক্ষা পর্যাপ্ত প্রমাণিত হবে না। অনেক ক্ষতি স্বীকার করে আমরা জানতে পেরেছি যে নির্যাতন শিবিরেরই একেবারে লাগোয়া মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে। প্রতিটি মানব সন্তানের পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তা বিস্মৃত হলে কি ঘটতে পারে অশউইত্য, রুয়ান্ডা, বসনিয়া এবং বিশ্ব-বাণিজ্য কেন্দ্রের ধ্বংস সেটাই তুলে ধরে।
যে ধর্মের আমাদের এই মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করার কথা, প্রায়শঃই যেন আমাদের কালের সহিংসতা ও হতাশাই প্রতিফলিত করে সেটা। প্রায় প্রতিদিনই ধর্ম-প্রণোদিত সন্ত্রাস, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার নজীর দেখতে পাই আমরা। বর্ধিত হারে মানুষ প্রথাগত ধর্মীয় মতবাদ ও অনুশীলনকে অপ্রাসঙ্গিক ও অবিশ্বাস্য আবিষ্কার করে চলেছে। মানুষের প্রয়োজন বলে অনুভূত দুয়ে অভিজ্ঞতার জন্যে শিল্পকলা, সঙ্গীত, সাহিত্য, নাচ, খেলাধুলা, বা মাদকের শরণ নিচ্ছে তারা। আমরা আমাদের মানব সত্তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে পরিপূর্ণভাবে অধিকার করি যখন এবং অন্তস্থলে স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতি লাভ করে নিজেদের সীমার অতীতে উত্থিত হই, প্রত্যেকেই তখন পরমানন্দ ও পুলকিত মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা করি। আমাদের জীবনে তাৎপর্য ও মূল্য আবিষ্কার করতে না পারলে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। কেউ কেউ ধার্মিক হওয়ার নতুন উপায়ের খোঁজ করছেন। ১৯৭০ দশকের পর থেকেই বিশ্বের বহু অঞ্চলেই আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। আমরা যাকে প্রায়শঃই ‘মৌলবাদ’ বলে থাকি সেই উগ্র ধার্মিকতা আমাদের উত্তর আধুনিক কালের আলোকন সন্ধানের একটি প্রকাশ মাত্ৰ।
আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের বর্তমান দোলাচলের ভেতর আমরা জার্মান দার্শনিক কার্ল জেস্পারস যাকে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলেছেন মানুষের আধ্যাত্মিকতার বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সেই সময়কালে অনুপ্রেরণার খোঁজ পেতে পারি। আনুমানিক ৯০০ থেকে ২০০* বিসিই সালে চারটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে মানবজাতিকে বিকশিত করে চলা মহান বিশ্ব ঐতিহ্যগুলো অস্তিত্ব লাভ করে: চীনে কনফুসিয়বাদ ও দাওবাদ; ভারতে হিন্দু ধর্মমত ও বুদ্ধ ধর্মমত; ইসরায়েলে একেশ্বরবাদ এবং গ্রিসে দার্শনিক যুক্তিবাদ। বুদ্ধ, সক্রেটিস, কনফুসিয়াস এবং জেরেমিয়ার কাল; উপনিষদ, মেনসিয়াস এবং ইউরিপিদিসের কাল ছিল এটা। প্রবল সৃজনশীলতার এই সময়ে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক প্রতিভাবানরা এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানবীয় অভিজ্ঞতায় অগ্রণী ভুমিকা রাখেন। তাঁদের অনেকেই ছদ্মনামে কাজ করেছেন, কিন্তু মানুষের কেমন হওয়া উচিত, আমাদের সেটাই দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। অ্যাক্সিয়াল যুগ ছিল লিখিত ইতিহাসের বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের সবচেয়ে উদ্ভাবনী কাল; আমাদের নতুন বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি আধুনিক কাল গড়ে তোলা মহান পাশ্চাত্য পরিবর্তনের আগে এর সঙ্গে তুলনীয় আর কিছুই থাকবে না।
[* ভিন্নভাবে উল্লেখ করা না হলে সমস্ত তারিখ সাধারণ শতকের।]
কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের এমনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে জীবন কাটানো সাধুরা কিভাবে আমাদের বর্তমান সময়ের অবস্থার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতে পারেন? আমরা সাহায্যের জন্যে কনফুসিয়াস বা বুদ্ধের শরণ নিতে যাব কেন? আমাদের যেখানে নিজস্ব জগৎকে প্রতিফলিত করার মতো একটি উদ্ভাবনী বিশ্বাস সৃষ্টি করার প্রয়োজন, সেখানে এমনি এই সুদূর অতীত নিয়ে গবেষণা নিশ্চিতভাবেই আধ্যাত্মিক প্রত্নতত্ত্বের চর্চা হতে পারে মাত্র। কিন্তু, তারপরেও বাস্তবক্ষেত্রে আমরা অ্যাক্সিয়াল যুগের দূরদৃষ্টিকে কোনওদিনই অতিক্রম করে আসতে পারিনি। আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংকট-কালে দিকনির্দেশনার জন্যে নারী-পুরুষ ক্রমাগতভাবে এই যুগটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারা অ্যাক্সিয়াল যুগের আবিষ্কারসমূহকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু কখনওই সেগুলোকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি I উদাহরণ স্বরূপ, রাব্বিনিয় ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলাম অ্যাক্সিয়াল যুগেরই পরবর্তী কালের বিকাশ। এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখব, এই তিনটি ধর্মের প্রতিটি অ্যাক্সিয়াল যুগের দর্শনকে পুনরাবিষ্কার করে তাকে তাদের কালের পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিতে পারার মতো একটি ভাষায় অনুবাদ করেছে।
অ্যাক্সিয়াল যুগের কবি, অতীন্দ্রিয়বাদী, দার্শনিক ও কবিরা এতটাই অগ্রসর ছিলেন এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই বিপ্লবাত্মক ছিল যে, পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাকে কোমল করার প্রয়াস পেয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায়ই তারা সেই ধার্মিকতাই নির্মাণ করে বসেছে অ্যাক্সিয়াল সংস্কারকরা যা থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিলেন। আধুনিক বিশ্বেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের একালের জন্যে অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে, কিন্তু আজকের দিনে নিজেদের যারা ধার্মিক মনে করেন তাদের অনেকের কাছেই তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি বিস্ময়কর—এমনকি হতবুদ্ধিকরও—মনে হবে। যেমন, প্রায়ই এটা ধরে নেওয়া হয় যে, ধর্মবিশ্বাসের মানে কতগুলো বিশ্বাসের প্রস্তাবনা মেনে নেওয়ার ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষেই, ধার্মিক ব্যক্তিদের ‘বিশ্বাসী’ আখ্যায়িত করা সাধারণ ব্যাপার, যেন বিশ্বাসের বিধিবিধানের প্রতি সম্মতি দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের বেশিরভাগ দার্শনিকের মতবাদ বা অধিবিদ্যা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বুদ্ধের মতো একজন ব্যক্তির কাছে কারও ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস নেহাতই অনীহার বিষয় ছিল। কোনও কোনও সাধু তো বিচ্যুতকারী ও ক্ষতিকর বলে সরাসরি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেই অস্বীকার গেছেন। অন্যরা অনেকে ধর্মের কাছে পরম নিশ্চয়তা যোগানোর প্রত্যাশাকারীকে অপরিপক্ক, অবাস্তব এবং বিকৃতি বলে যুক্তি দেখিয়েছেন।
অ্যাক্সিয়াল যুগে বিকশিত সকল ঐতিহ্য মানুষের চেতনাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং তাদের সত্তার মূলে এক দুয়ে মাত্রা আবিষ্কার করেছে, কিন্তু একে মোটেই অতিপ্রাকৃত মনে করেনি তারা এবং বেশির ভাগই এ নিয়ে আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা অনির্বচনীয় হওয়ার কারণেই শ্রদ্ধা মেশানো নীরবতাই ছিল একমাত্র উপযুক্ত পদ্ধতি। সাধুরা নিশ্চিতভাবে অন্যের উপর পরম বাস্তবতার নিজস্ব মত চাপিয়ে দেননি। বরং বিপরীতক্রমে: তাঁরা বিশ্বাস করেছেন, কারওই অন্যের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ বা লাভ করা উচিত নয়। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে গিয়ে সবকিছুকে প্রশ্ন ও পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক। আমরা দেখব, আসলে কোনও পয়গম্বর বা দার্শনিক বাধ্যতামূলক মতবাদের উপর জোর দিতে শুরু করলে সেটা সাধারণত অ্যাক্সিয়াল যুগের গতি হারানোর লক্ষণ ছিল। বুদ্ধ বা কনফুসিয়াসকে তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কিনা প্রশ্ন করা হলে হয়তো কিঞ্চিত কুকড়ে যেতেন, তারপর ব্যাখ্যা করতেন—দারুণ সৌজন্যের সাথেই-এটা সঠিক প্রশ্ন নয়। আমোস বা ইযেকিয়েলকে তিনি একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী ‘একেশ্বরবাদী’ কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও হয়তো সমান বিভ্রান্ত হতেন। একেশ্বরবাদ প্রশ্ন ছিল না। বাইবেলে খুব কমই একেশ্বরবাদের দ্ব্যর্থহীন উল্লেখ দেখতে পাই আমরা, তবে-কৌতূহলোদ্দীপকভাবে-এইসব মতবাদগত বিবৃতির কোনও কোনওটা আসলে অ্যাক্সিয়াল যুগের আবিশ্যিক চেতনা থেকে বিচ্যুতি।
আপনি কি বিশ্বাস করেন তা নয়, বরং আপনার আচরণই মুল। আপনাকে গভীরতর স্তরে বদলে দেয়, এমন কিছু করাই ছিল ধর্ম। অ্যাক্সিয়াল যুগের আগে ধর্মীয় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আচার এবং পশুবলী কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। আপনাকে অভিজ্ঞতার ভিন্ন স্তরে নিয়ে যাওয়া আজকের দিনের মহান নাট্যাভিনয়ের মতো পবিত্র পালায় ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতেন আপনি। অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধুরা বদলে দিয়েছিলেন একে; তখনও তাঁরা আচার-অনুষ্ঠানকে মূল্য দিতেন বটে, কিন্তু একে এক নতুন নৈতিক তাৎপর্য দিয়ে আধ্যাত্মিক জীবনের মূলে নৈতিকতাকে স্থান করে দিয়েছিলেন। লোকে যাঁকে ‘ঈশ্বর’, ‘নির্বাণ’, ‘ব্রাহ্মণ,’ বা ‘পথ’ বলে তাঁর সামনে হাজির হওয়ার একমাত্র উপায় একটি সহানুভূতিময় জীবন যাপন। প্রকৃতপক্ষেই ধর্ম ছিল সহানুভূতিময়। আজকের দিনে আমরা প্রায়ই ধর্মীয় জীবন গ্রহণ করার আগে আমাদের অবশ্যই ‘ঈশ্বর’ বা ‘পরম’ একজন আছেন বলে নিজেদের সন্তুষ্ট করতে হবে বলে ধরে নিই। বৈজ্ঞানিক চর্চা হিসাবে এটা ভালো; প্রথমে আপনাকে নীতি খাড়া করতে হবে, কেবল তখনই একে প্রয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধুরা একে বলবেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো। সবার আগে অবশ্যই নৈতিক জীবনের অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে আপনাকে; তারপর আধ্যাত্মিক অঙ্গীকার নয়, শৃঙ্খলিত ও সহজাত ঔদার্যই আপনাকে কাঙ্ক্ষিত দুর্ভেয়ের স্পর্শ যোগাবে।
এর মানে ছিল বদলে যাওয়ার জন্যে তৈরি থাকতে হবে আপনাকে। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা তাঁদের শিষ্যদের আবার নতুন উৎসাহে সাধারণ আত্মকেন্দ্রিক জীবনে ফিরে যেতে সক্ষম করে তোলার জন্যে তাদের সামান্য নৈতিক উন্নতির পথ বাৎলে দিতে আগ্রহী ছিলেন না। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ গড়ে তোলাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। সকল সাধুই সহানুভূতি ও দয়ার আধ্যাত্মিকার প্রচার করেছেন; জোরের সঙ্গে বলেছেন মানুষকে অবশ্যই অহম ও লোভ বিসর্জন দিতে হবে, বলী দিতে হবে সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতাকে। অন্য মানব সন্তানকে হত্যাই ভুল নয়; আপনি এমনকি একটি বৈরী কথাও উচ্চারণ করবেন না বা বিরক্তিসূচক ভঙ্গিও করতে পারবেন না। এছাড়া, অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রায় সকল সাধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, কেবল আপন লোকদের ভেতরই আপনার উদারতাকে সীমিত পারবেন না: আপনার উদ্বেগ কোনওভাবে গোটা বিশ্বের প্রতি চালিত হতে হবে। আসলে, লোকে যখনই তাদের দিগন্ত ও সহানুভূতিকে সীমিত করতে শুরু করে, অ্যাক্সিয়াল যুগের অবসানের আরেকটি লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা। প্রতিটি ঐতিহ্য নিজস্ব স্বর্ণবিধি নির্মাণ করেছে: অন্যের কাছে যেমন আচরণ প্রত্যাশা করেন না সেই আচরণ অন্যের প্রতি করবেন না। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা যতদূর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন, সকল সত্তার পবিত্র অধিকারের প্রতি সম্মানই-গোঁড়া বিশ্বাস নয়-ছিল ধর্ম। মানুষ উদরতা ও দয়া দিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে আচরণ করলে বিশ্বকে বাঁচাতে পারবে।
অ্যাক্সিয়াল যুগের এই রীতিকে আমাদের আবার আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের এই বৈশ্বিক পল্লীতে আমরা আর সংকীর্ণ বা বর্জনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারব না। এমনভাবে জীবন যাপন ও আচরণ করতে শিখতে হবে যেন আমাদের দেশ থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে বাস করা মানুষগুলো আমাদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধুরা স্বপ্নসমাহিত পরিবেশে তাঁদের সহানুভূতিপূর্ণ নীতিমালা গড়ে তোলেননি। আমাদের সমাজের মতোই সহিংসতা আর যুদ্ধ- বিগ্রহে অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে মারাত্মকভাবে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় থাকার সময়ই সমাজে প্রতিটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে; প্রকৃতপক্ষেই, সাধারণভাবে সাধুদের চারপাশে প্রত্যক্ষ করা আগ্রাসনের নৈতিক প্রত্যাখ্যানই ছিল ধর্মীয় পরিবর্তনের প্রথম অনুঘটক। মানস জগতে সহিংসতার কারণ খুঁজতে শুরু করতে গিয়েই অ্যাক্সিয়াল দার্শনিকরা নিজেদের অন্তস্থঃ জগতে প্রবেশ করে এযাবৎ মানুষের অনাবিষ্কৃত জগৎ অনুসন্ধান করেছেন।
অ্যাক্সিয়াল যুগের ঐকমত্য মানবজাতির আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের সর্বসম্মতির বাঙ্ময় প্রমাণ। অ্যাক্সিয়াল যুগের সব জাতিই সহানুভূতির নীতি কার্যকর বলে আবিষ্কার করেছে। এই সময়ে সৃষ্ট সকল মহান ঐতিহ্য দয়া ও উদারতার পরম গুরুত্বের বিষয়ে একমত ছিল। এটা আমাদের মনুষ্যত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানায়। আমাদের বিশ্বাস অন্যদের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে মেলে আবিষ্কার করাটা নিশ্চয়তা যোগানো অভিজ্ঞতা। সুতরাং, আমরা নিজস্ব ঐতিহ্য-বিচ্যুত না হয়ে অন্যদের কাছ থেকে সহানুভূতিপূর্ণ জীবন যাপনকে আরও উন্নত করে তোলার কৌশল শিখতে পারি।
আগে কি ঘটেছে তার সঙ্গে পরিচিত না হলে আমরা অ্যাক্সিয়াল যুগের সাফল্যকে উপলব্ধি করতে পারব না; সুতরাং, প্রাথমিক প্রাচীন কালের অ্যাক্সিয়াল-পূর্ববর্তী ধর্মকে আমাদের বুঝতে হবে। অ্যাক্সিয়াল যুগের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হওয়ার মতো এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, বেশির ভাগ সমাজেরই পরম ঈশ্বরের প্রাথমিক বিশ্বাস ছিল, স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় তাঁকে আকাশ দেবতা ডাকা হতো। দুর্জ্ঞেয় হওয়ায় ধর্মীয় চেতনা থেকে মিলিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল তাঁর। কেউ বলেছে, তিনি ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছেন, অন্যরা বলেছে তিনি অধিকতর গতিশীল তরুণ দেবতাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। লোকে পবিত্রকে সাধারণত চারপাশের জগতে সর্বব্যাপী উপস্থিতি হিসাবে অনুভব করে থাকে। দেবতা, নারী-পুরুষ, পশু-পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ আর পাথর একই ঐশী জীবনের অংশীদার বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করে। সবাই সবকিছুকে অস্তিত্ব দেওয়া এক স্বর্গীয় নিয়মের অধীন। এমনকি দেবতাদেরও এই নিয়ম মেনে চলতে হতো, সৃষ্টির ঐশী শক্তিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে মানুষের সঙ্গে সহযোগিতা করতেন তাঁরা। এগুলো নবায়িত না হলে বিশ্ব আদিম শূন্যতায় হারিয়ে যেতে পারত।
প্রাচীন বিশ্বে পশু-বলী সর্বজনীন ধর্মীয় অনুশীলন ছিল। এটা ছিল জগৎকে অস্তিত্ব দেওয়া ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে নবায়িত করার একটা উপায়। জীবন ও মৃত্যু, সৃষ্টি ও ধ্বংস পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে জোরাল বিশ্বাস ছিল। লোকে বুঝতে পেরেছিল যে, কেবল অন্য প্রাণী তাদের জন্যে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার কারণেই বেঁচে থাকতে পারছে তারা, ফলে আত্মবিসর্জনের জন্যে বলীর পশুকে সম্মান দেখানো হতো। এমনি মৃত্যু ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে না বলে সময়ের সূচনায় কোনও বিসর্জনের কারণেই এই জগৎ অস্তিত্ব পেয়েছিল বলে কল্পনা করেছিল কেউ কেউ। অন্যরা বিশৃঙ্খলা থেকে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে স্রষ্টা ঈশ্বরের ড্রাগন-আকারহীন ও অজ্ঞাতের একটি সাধারণ প্রতীক-হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেছে। এই পৌরাণিক ঘটনাপ্রবাহ আনুষ্ঠানিক অর্চনায় পুনরাভিনয়ের সময় উপাসকরা তাদের নাজুক পার্থিব জীবনকে স্বর্গীয় শক্তি যোগাতে নিজেদের পবিত্র সময়ে প্রক্ষিপ্ত হওয়ার অনুভূতি লাভ করত। প্রায়শঃই আদি সৃষ্টিকর্মকে নতুন করে তুলে ধরা আচারের মাধ্যমে একটি নতুন প্রকল্পের সূচনা ঘটাত তারা। এভাবে ‘প্রাণবন্ত’ করা না হলে বা ‘আত্মা” যোগানো না হলে কোনও কিছুই টিকে থাকতে পারবে না।
বেশিরভাগ প্রাকআধুনিক সংস্কৃতিতে কোনও না কোনও ভাবে প্রাচীন ধর্ম বর্তমান ছিল বলে সর্বজনীন সত্যের দর্শনের উপর নির্ভরশীল ছিল। পৃথিবীর বুকে প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তু, বা অভিজ্ঞতা ছিল স্বর্গীয় জগতের বাস্তবতার অনুকৃতি-আবছা ছায়া।” সুতরাং, পবিত্র জগৎ ছিল মানবীয় অস্তিত্বের আদিরূপ, এটা পৃথিবীর যেকোনও কিছুর চেয়ে সমৃদ্ধতর, শক্তিশালী এবং অধিকতর হওয়ায় নারী-পুরুষ মরীয়া হয়ে এতে অংশ নিতে চাইত। আজকের দিনেও কোনও কোনও স্থানীয় গোত্রের ক্ষেত্রে সর্বজনীন সত্যের দর্শন প্রধান উপাদান হয়ে আছে। উদাহরণ স্বরূপ, অস্ট্রেলিয় আদিবাসীরা স্বপ্নকালকে বাস্তব জগৎ থেকে ঢের বেশী পবিত্র বলে অনুভব করে। ঘুম বা দিব্যদৃষ্টির বিশেষ মুহূর্তে স্বপ্নক্ষণের চকিত দেখা পেয়ে থাকে তারা; এটা সময়হীন এবং ‘সার্বক্ষণিক’। এটা
অব্যাহতভাবে মৃত্যু, নিরন্তর পরিবর্তন এবং অন্তহীন পরিবর্তনে দুর্বল হয়ে চলা সাধারণ জীবনের একটি স্থিতিশীল পটভূমি গড়ে তোলে। একজন অস্ট্রেলিয় শিকারে যাওয়ার সময় নিজের আচরণকে সেই প্রথম শিকারীর সঙ্গে এমন একাত্ম করে তোলে যে, নিজের অধিকতর সক্ষম বাস্তবতার নাগাল পেয়ে নিজেকে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ এক মনে করে। পরে সেই আদিম সমৃদ্ধি থেকে সরে এলে তার মনে ভীতির সৃষ্টি হয়, বুঝি সময়ের রাজ্য তাকে গ্রাস করে নেবে, তাকে এবং তার সমস্ত কাজকে তুচ্ছ-হীন করে তুলবে। প্রাচীন কালের মানুষের অভিজ্ঞতাও ছিল এমন। যখন স্রেফ আচার-অনুষ্ঠানে দেবতাদের অনুকরণ করে সেক্যুলার জীবনের নিঃসঙ্গ, নাজুক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিত তখনই বাস্তবিক পক্ষে বেঁচে থাকত তারা। কেবল নিজেদের মতো থাকা হতে বিরত হয়ে অন্যের ভাবভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করলেই মানবতাকে পূর্ণ করে তুলত।
মানুষ গভীরভাবে কৃত্রিম।* আমরা ক্রমাগত প্রকৃতির উপর প্রাধান্য লাভের সংগ্রাম করি এবং কোনও আদর্শের কাছাকাছি যেতে চাই। এমনকি বর্তমান কালেও, যখন আমরা আদিম সর্বজনীন চির সত্যের দর্শনকে ত্যাগ করেছি, লোকে স্বার্থপরের মতো চলমান সৌন্দর্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলতি ফ্যাশনের নির্দেশমতো তাদের চেহারা ও শরীরে সহিংসতা আরোপ করে। সেলিব্রিটির কাল্ট দেখায় যে, আমরা এখনও ‘অতিমানবত্বকে মূর্ত করে তোলা মডেলদের শ্রদ্ধা করি। অনেক সময় লোকে তাদের আইডলদের দেখতে বহুদূর যায়; তাদের উপস্থিতিতে এক ধরনের তুরীয় পুলক বোধ করে। তাদের পোশাক ও আচরণ অনুকরণ করে তারা। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই আদিআদর্শ রূপ ও নজীরের দিকে আকৃষ্ট হতে চায় বলে মনে হয়। অ্যাক্সিয়াল যুগ এই আধ্যাত্মিকতার অধিকতর খাঁটি ধরন গড়ে তুলেছিল এবং মানুষকে নিজের ভেতরই আদর্শ আদিরূপকে খোঁজার শিক্ষা দিয়েছে।
অ্যাক্সিয়াল যুগ নিখুঁত ছিল না। নারীদের প্রতি নিস্পৃহতা ছিল প্রধান ব্যর্থতা। এইসব আধ্যাত্মিকতার প্রায় সবগুলোই সামরিক শক্তি এবং আগ্রাসী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য বিশিষ্ট শহুরে পরিবেশে গড়ে উঠেছিল, নারীরা যেখানে অধিকতর গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভোগ করা মর্যাদা হারাতে শুরু করেছিল। অ্যাক্সিয়াল যুগে কোনও নারী সাধু ছিলেন না। এমনকি নারীদের নতুন ধর্মবিশ্বাসে কোনও রকম ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার সময়ও সাধারণভাবে তাদের পার্শ্বরেখায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা নারীদের ঘৃণা করতেন, এমন নয়; বেশির ভাগ সময় স্রেফ তাদের খেয়ালই করতেন না তাঁরা। তাঁরা ‘মহান’ বা ‘আলোকিত মানুষে’র কথা বলার সময় ‘নারী ও পুরুষ’ বোঝাতেন না-যদিও চ্যালেঞ্জ করা হলে বেশির ভাগই সম্ভবত নারীরাও এই মুক্তির উপযুক্ত বটে বলে স্বীকার করতেন।
অ্যাক্সিয়াল যুগে নারীর প্রশ্নটি এমনি প্রান্তিক ছিল বলেই আমি দেখেছি এই প্রসঙ্গে কোনও স্থিতিশীল আলোচনা বিচ্যুতকারী। এই বিষয়টি সামাল দেওয়ার সব প্রয়াসেই একে অনুপ্রবেশমূলক মনে হয়েছে। আমার মনে হয়, এর ভিন্ন গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাক্সিয়াল সাধুরা ফাদার অভ চার্চের কারও কারও মতো যারপরনাই নারী বিদ্বেষী ছিলেন, এমন নয়। তাঁরা ছিলেন তাঁদের কালের মানুষ এবং তাঁদের নিজস্ব লিঙ্গের আগ্রাসী আচরণে আচ্ছন্ন ছিলেন যে বিরল ক্ষেত্রে নারীদের কথা মনে আনতেন। আমরা অন্ধভাবে অ্যাক্সিয়াল সাধুদের অনুসরণ করতে পারব না; প্রকৃতপক্ষে, তেমন কিছু করলে মৌলিকভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনাকেই লঙ্ঘন করে বসব, যেখানে জোর দেওয়া হয়েছে যে, এই ধরনের সমরূপতা মানুষকে নিজেদের নিম্ন ও অপরিপক্ক দর্শনে বন্দী করে ফেলে। আমরা যা করতে পারি সেটা হলো, সর্বজনীন উদ্বেগের অ্যাক্সিয়াল আদর্শকে নারীসহ সবার প্রতি প্রসারিত করা। অ্যাক্সিয়াল দর্শন নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করার সময় আমাদের অবশ্যই আধুনিকতার সেরা অন্তর্দৃষ্টিসমূহকেও সামনে তুলে ধরতে হবে।
অ্যাক্সিয়াল জাতিগুলো সমানভাবে বিকশিত হয়নি। প্রতিটি যার যার নিজস্ব গতিতে গড়ে উঠেছিল। অনেক সময় তারা এমন একটি দর্শন লাভ করেছিল যা অ্যাক্সিয়াল যুগের জন্যে সত্যিই মূল্যবান, কিন্তু তারপর এ থেকে পিছু হটে গেছে। ভারতের জনগণ সবসময়ই অ্যাক্সিয়াল প্রগতির পুরোভাগে ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্বাসিত হওয়ার আগপর্যন্ত ইসরায়েলে পয়গম্বর, পুরোহিত এবং ইতিহাসবিদরা বিক্ষিপ্তভাবে আদর্শের দিকে চালিত হয়েছেন এবং অসাধারণ সৃজনশীলতার একটি সংক্ষিপ্ত কালের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে কনফুসিয়াস প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতা গড়ে তোলা পর্যন্ত চীনে ধীর, ক্রমবর্ধমান প্রগতি কাজ করছিল। একেবারে গোড়া থেকেই গ্রিকরা অন্য জাতিসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছিল।
অ্যাক্সিয়াল যুগ আসলে যেমন ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সমকালীন ছিল বলে বিশ্বাস করেন জেস্পারস। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বুদ্ধ, লাওসে, কনফুসিয়াস, মোজি এবং জরাথ্রুস্ট মোটামুটি একই সময়ে জীবন যাপন করেছেন। আধুনিক পণ্ডিতরা এই সময়কালকে পরিমার্জনা করেছেন। এটা এখন নিশ্চিত যে জরাথ্রুস্ট ষষ্ঠ শতাব্দীর নয় বরং আরও আগের মানুষ ছিলেন। এইসব আন্দোলনের কোনও কোনওটার সঠিক সময়কাল স্থির করা বেশ কঠিন, বিশেষ করে ভারতে, যেখানে ইতিহাসের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ ছিল না এবং সঠিক ঘটনাক্রম রক্ষারও কোনও প্রয়াস ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এখন একমত যে, এর আগে যেমন মনে করা হয়েছিল বুদ্ধ তার চেয়ে একশো বছর আগে জীবন যাপন করেছেন। এবং জেস্পারস যেমন অনুমান করেছেন দাওবাদী সাধু লাও যি ষষ্ঠ শতাব্দী কালের ছিলেন না। কনফুসিয়াস ও মোজি’র সমসাময়িক হওয়ার বদলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই তৃতীয় শতাব্দীর মানুষ ছিলেন তিনি। আমি একেবারে সাম্প্রতিক পণ্ডিতসুলভ বিতর্কের সঙ্গে তাল রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু বর্তমানে এইসব সময়ের অনেকগুলোই আনুমান নির্ভর এবং সম্ভবত কোনওদিনই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না।
তবে এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধারণ বিকাশ সত্যিই এই গুরুত্বপূর্ণ আদর্শের আধ্যাত্মিক বিকাশ সম্পর্কে আমাদের কিছু পরিমাণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়। আমরা পাশাপাশি চারটি অ্যাক্সিয়াল যুগের জাতির অগ্রগতিকে অঙ্কন করে সময়ানুক্রমিকভাবে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করব, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্রমে জায়গা করে নিতে দেখব, এবং সবশেষে তুঙ্গে উঠে তৃতীয় শতাব্দীর শেষে অবশেষে মিলিয়ে যেতে দেখব। তবে এটাই গল্পের শেষ নয়। অ্যাক্সিয়াল যুগের অগ্রগামীগণ অন্যদের গড়ে তোলার ভিত্তি দিয়ে গেছেন। প্রতিটি প্রজন্ম তাদের নিজস্ব বিশেষ পরিস্থিতিতে এইসব মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োগের প্রয়াস পাবে আর আজকের দিনে আমাদের কাজও তাই।
Leave a Reply