দ্য গড ডিল্যুশন – রিচার্ড ডকিন্স
দ্য গড ডিল্যুশন – রিচার্ড ডকিন্স
The God Delusion – Richard Dawkins
অনুবাদ – কাজী মাহবুব হাসান
.
মূল লেখকের উৎসর্গ:
ডগলাস অ্যাডামস
(১৯৫২-২০০১)
এর স্মৃতির প্রতি নিবেদিত
বাগানটা যে সুন্দর, শুধু এটা দেখাই কি যথেষ্ট না, সেখানে গাছের নীচে পরীরা বাস করে সেটা কেন বিশ্বাস করতেই হবে?
.
ক্লিন্টন রিচার্ড ডকিন্স
(জন্ম: মার্চ ২৬, ১৯৪১)
লেখক পরিচিতি
রিচার্ড ডকিন্স ক্লিনটন রিচার্ড ডকিন্স সুপরিচিত রিচার্ড ডকিন্স নামেই। তাঁর প্রশিক্ষণ আর পেশাগত ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞান, বিশেষ করে ইথোলজী (প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যাক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন) এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান। ব্রিটিশ সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা বাবার কাজের সুবাদে তাঁর জন্ম এবং শৈশব কাটে আফ্রিকায়। বাবা এবং মা, দুজনেরই আগ্রহ ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, আর পারিবারিক সেই আগ্রহটিও সঞ্চারিত হয়েছিল শিশু ডকিন্সের মনে। জীবজগতের দৃশ্যমান নানা রুপ আর বৈচিত্র্যময়তার একটি বিকল্প ব্যাখ্যা হিসাবে মধ্য কৈশোরেই চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বটি তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল; উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জীববিজ্ঞান। অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে ১৯৬২ সালে স্নাতক এবং বিশ্বসেরা ইথোলজিষ্ট ও জীববিজ্ঞানী নিকোলাস টিনবার্গেন (১) এর তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি শেষ করেন ১৯৬৬ সালে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বাকলীতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ডকিন্স তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন, কিন্তু শিক্ষক ‘নিকো’ টিনবার্গেন তাঁর প্রিয় মেধাবী ছাত্রটিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অক্সফোর্ডে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭০ সালে অক্সফোর্ডে প্রাণিবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে এই বিভাগের রিডারও (২) হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বিখ্যাত সফটওয়্যার প্রকৌশলী চার্লস সিমমানী (৩) বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য আর জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে অক্সফোর্ডে রিচার্ড ডকিন্সের জন্য একটি বিশেষ অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন, Simonyi Professorship for the Public Understanding of Science (৪), এই পদ থেকে ২০০৮ এ অবসর গ্রহন করেন তিনি।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন বিষয়টি নিয়ে বহু জীববিজ্ঞানীর মধ্যেই কিছু মৌলিক ভ্রান্ত ধারণার অস্তিত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (৫), জন মেনার্ড স্মিথ(৬), ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন(৭) ও রবাট ট্রিভার্স (৮) এর কিন সিলেকশন, অ্যালটুইজম বা পরার্থবাদীতা, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ সংক্রান্ত গাণিতিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো বিষয়গুলি নিয়ে একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার জন্য। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে সৃষ্ট বিদ্যুত সরবাহ ঘাটতির সময় যখন তাঁর ঝিঁঝি পোকা (ক্রিকেট) নিয়ে গবেষণার কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সেই অবসরে ধারণাগুলো তিনি লিখে ফেলেছিলেন একটি বহনযোগ্য ছোট টাইপরাইটারে, ১৯৭৬ সালে সেই ভাবনাগুলো তাঁর প্রথম বই ‘দ্য সেলফিশ জিন (The Selfish Gene)’ রুপে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘দ্য সেলফিশ জিন’ খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে। এখানেই প্রথমবারের তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনী চাপের শক্তি যে ইউনিট বা এককের উপর তার প্রভাব ফেলে ক্রম বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, সেই জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটি সুপরিচিত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন, একই সাথে তিনি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একক হিসাবে মিম (Meme) ধারণাটিও প্রস্তাব করেছিলেন। তার এই বইটির নামকরণ নিয়ে ভিত্তিহীন বিতর্ক চলেছে বহুদিন, তারই প্রত্যুত্তরে ১৯৮২ সালে বিবর্তন জীববিজ্ঞানে তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা করেন, ‘দি এক্সটেডে ফেনোটাইপ (The Extended Phenotype) বইয়ে, জিনের ফিনোটাইপিক (পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এমন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য) প্রভাব শুধু সেই জিন বাহকের শরীরেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্প্রসারিত হতে পারে প্রাকৃতিক পরিবেশে এবং এমনকি অন্য কোন জীবের শরীরেও। অতিপ্রাকৃত কোন পরিকল্পক, সৃষ্টিকারী সত্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ডকিন্স ব্রিটিশ হিউম্যানিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন(৯ ) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ব্রাইটস মুভমেন্টের(১০) সমর্থক। তিনি সুপরিচিত ধর্মভিত্তিক সৃষ্টিতত্ত্ববাদ আর এর ছদ্মরুপে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদের বিরুদ্ধে তার সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার (The Blind Watchmaker) বইটিতে তিনি উইলিয়াম পেইলির (১১) ‘ওয়াচমেকার’ বা ঘড়ি নির্মাতা রুপকটির বিপক্ষে তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করে ব্যাখ্যা করেন, জীবজগতে দৃশ্যমান সব গঠনগত জটিলতা ব্যাখ্যা করার করার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। তিনি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূল চালিকা শক্তি প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই চিহ্নিত করেন ‘অন্ধ’ ওয়াচমেকার হিসাবে।
বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা বিষয় বোধগম্য করার লকেব তিনি আরো বেশ কিছু বই লিখেছেন, যেমন, River Out of Eden: A Darwinian View of Life (sada), Climbing Mount Improbable (১৯৯৬), Unweaving the Rainbow (১৯৯৭), A Devil’s Chaplain (২০০৩), The Ancestors Tale (২০০৪)। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্য গড ডিল্যুশন (The God Delusion) বইটি। যেখানে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, অতিপ্রাকৃত কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই এবং ধর্মীয় বিশ্বাস একটি ডিশন বা বিভ্রান্তি বা স্থির ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস মাত্র। ২০১০ সালের মধ্যেই বইটির বিক্রি দুই মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে যায় এবং তাকে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
ডারউইন জন্মদ্বিশতবার্ষিকীতে বিবর্তনের সপক্ষে গবেষণালব্ধ। প্রমাণগুলো হালনাগাদ করে তিনি প্রকাশ করেন The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution (2001); ২০১১ সালে কিশোরদের উপযোগী করে লেখেন The Magic of Reality: How We Know What’s Really True; O আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব An Appetite for Wonder: The Making of a scientist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে, যার দ্বিতীয় পর্ব Brief Candle in the Dark: My Life in Science প্রকাশিত হবার কথা ২০১৫ র শেষে । তাঁর সর্বশেষ 78 Science in the Soul: Selected Writings of a Passionate Rationalist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে।
রেডিও ও টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠান ও বিতর্কে তাঁর উপস্থিতি একসময় ছিল বেশ নিয়মিত, এছাড়াও লিখেছেন বহু প্রবন্ধ। বহু পুরস্কারে সম্মানিত রিচার্ড ডকিন্স বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা, ছদ্মবিজ্ঞান, ধর্মীয় ও অন্যান্য নানা কুসংস্কার নিয়ে তার আজীবন যুদ্ধের অংশ হিসাবে তৈরী করেছেন বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র, যার সাম্প্রতিকতমটি হচ্ছে ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত The Unbeleivers। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি বই বিশ্বের সব প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিজ্ঞানমনষ্কতা আর মুক্ত চিন্তার প্রসারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়া ডকিন্স প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স অ্যান্ড fista (Richard Dawkins Foundation for Reason and Science । ফাউেন্ডশনটি ২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনকোয়ারীর (Center for Inquiry) সাথে একীভূত হয়েছে।
.
অনুবাদক
কাজী মাহবুব হাসান
পেশাগত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসা অণুজীববিজ্ঞান, রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য। অনুবাদক, আগ্রহের ক্ষেত্র জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ও শিল্পকলার ইতিহাস, সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মিথস্ক্রিয়া। ব্যক্তিগত ব্লগ, “জীবনের বিজ্ঞান। প্রকাশিত কিছু অনুবাদ: দ্য গড ডিলুশন (অনার্য), ওয়েজ অব সিইং (অনার্য), দর্শনের সহজ পাঠ (দিব্য প্রকাশ), সভ্যতা: একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি (দিব্য প্রকাশ), দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ (দিব্য প্রকাশ)।
.
পাদটীকা
(১) নিকোলাস ‘নিকো’ টিনবার্গেন, ডাচ জীববিজ্ঞানী (১৯০৭-১৯৮৮), কার্ল ভন ফ্রিশ, কনরাড লরেন্জ এর সাথে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতেছিলেন।
(২) যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রিডার’ পদটি নির্দিষ্ট কোন ঊর্ধ্বতন গবেষকের জন্য, যার গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি আছে।
(৩) চার্লস সিমোনী, হাঙ্গেরীয় আমেরিকান এই প্রকৌশলী মাইক্রোসফট এর সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন বিভাগের প্রধান ছিলেন, এবং তার তত্ত্বাবধানে মাইক্রোসফট অফিস সুইটটির জন্ম হয়েছিল।
(৪) এই পদে বর্তমানে আসীন গণিতজ্ঞ মার্কাস পিটার ফ্রান্সিস দু সোতয়।
(৫) জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (১৯২৬-২০১০) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক অ্যাট স্টোনি ব্রুক এর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সুপরিচিত ছিলেন গ্রুপ সিলেকশন ধারণাটির ঘোরতর বিরোধী হিসাবে। তার গবেষণা ৬০ এর দশকে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটিকে সংগঠিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
(৬) জন মেনার্ড স্মিথ (১৯২০-২০০৪) ব্রিটিশ তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী এবং জিনতাত্ত্বিক। মূলত তিনি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সময়, পরে জীববিজ্ঞানী জে. বি. এস, হলড়েনের অধীনে জিনতত্ত্ব নিয়ে পড়েন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বিবর্তনের তাত্ত্বিক ধারণায় গেম থিওরীর প্রয়োগ, এবং তিনি লিঙ্গ বিবর্তন ও সিগনালিং তত্ত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবও করেন।
(৭) উইয়িলাম ডোনাল্ড ‘বিল’ হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিবর্তন তাত্ত্বিক হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। হ্যামিলটনের সবচেয়ে বড় অবদান প্রকৃতিতে দৃশ্যমান কিন সিলেকশন (একই জিন বহনকারীদের মধ্যে পারস্পরিক পরার্থবাদী) এবং অ্যালট্রইজিম বা পরার্থবাদীতার জিন ভিত্তিটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা। এবং এই অসাধারণ অন্তদৃষ্টিটি পরবর্তীতে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনীয় ধারণাটি সুসংগঠিত করেছিল। তাকে সোসিওবায়োজলজীর অগ্রদূত হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, যে ধারণাটি পরে ই, ও, উইলসন জনপ্রিয় করেছিলেন। হ্যামিলটন লিঙ্গ অনুপাত এবং বিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৮৪ থেকে তার মৃত্যু অবধি তিনি অক্সফার্ডের রয়্যাল সোসাইটি রিসার্চ অধ্যাপক ছিলেন।
(৮) রবার্ট লুডলো ‘বব’ ট্রিভার্স ( জন্ম ১৯৪৩) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও সোসিওবায়োলজিষ্ট, রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লেখক। ৭০ এর দশকের শুরুতে ট্রিভার্স রেসিপ্রোকাল অ্যালটুইজম (পারস্পরিক পরার্থবাদী ও প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট (সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ, প্যারেন্ট-অফস্প্রিং কনফ্লিক্ট ( পিতামাতা ও সন্তানের দ্বন্দ্ব, ফ্যাকালটেটিভ সেক্স রেশিও ডিটারমিনেশন (প্রয়োজানুসারে লিঙ্গ অনুপাত নির্ধারণ) নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি সেলফ ডিপেশন বা আত্মপ্রবঞ্চনাকে একটি অভিযোজনীয় কৌশল চিহ্নিত করে বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাবনাও করেছেন।
(৯) British Humanist Association
(১০) ব্রাইট মুভমেন্টস, প্রকৃতিবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষদের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন (http://www.thebrights.net/ movement/)
(১১) উইলিয়াম পেইলী, ১৭৪৩-১৮০৫, ইংলিশ যাজক, দার্শনিক, তিনি সুপরিচিত তার প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব বা ন্যাচারাল থিওলজীর জন্য যেখানে তিনি টেলিওলজিকাল বা পরমকারণ যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য তার Natural Theology or Evidences of the Existence and Attributes of the Deity, যেখানে আমরা তার ওয়াচমেকার বা ঘড়ি নির্মাতার উদাহরণটি পাই।
(১২) https://richarddawkins.net/
(১৩) http://kmhb.wordpress.com/
.
অনুবাদকের ভূমিকা
ইতিমধ্যে বহু ভাষায় অনূদিত হওয়া রিচার্ড ডকিন্সের ‘দ্য গড ডিলুশন’ (১) বইটির এটি প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রচেষ্টা। নিজস্ব ব্লগের জন্য বইটির অনুবাদটি শুরু করেছিলাম ২০০৯ এর কোন এক সময় ও পরে ধারাবাহিকভাবে ২০১১ সাল থেকে। যারা আমার ব্লগে (জীবনের বিজ্ঞান) এসেছেন, তারা ইতিমধ্যেই অনুবাদটির সাথে কিছুটা পরিচিত, এই বইটি সেই ধারাবাহিক অনুবাদের পূর্ণাঙ্গ সম্পাদিত রুপ। মূলত এটি একজন পাঠকের অনুবাদ, যার সূচনা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ রিচার্ড ডকিন্সের প্রতি বইটি বাংলা অনুবাদ করতে আমাকে সদয় অনুমতি দেবার জন্য।
চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে কিছুটা পরিচিতি থাকলেও সত্যিকারভাবে ধারণাটির সাথে আমার পরিচয় ঘটে রিচার্ড ডকিন্সের লেখার মাধ্যমে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন তার ‘দ্য সেলফিশ জিন’ (২) বইটির প্রথম সংস্করণের একটি কপি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সময় আমার জন্য খুব সহজবোধ্য ছিল না বইটি, তবে বইটি বহু প্রশ্নের উত্তর যেমন দিয়েছিল, তার চেয়েও আরো বেশী প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল মনে, আর পাঠকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করতে পারার মধ্যেই থাকে যে কোনো বইয়ের সত্যিকারের স্বার্থকতা।
নব্বই দশকের শুরুতে বিজ্ঞানীদের নিজেদের লেখা এই ধরনের জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই– যেখানে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করাও হয়েছে, এবং একই সাথে অতিসরলীকৃতও করা হয়নি– খুব সহজলভ্য ছিল না দেশে। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে সেই সময় বহু বই থাকলেও রিচার্ড ডকিন্সের অনুপস্থিতি আমাকে বিস্মিত করেছিল, অবশ্য ২০০০ এর পরে আমার অভিজ্ঞতা সেখানে ছিল ভিন্ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে প্রভাষক থাকাকালীন যখন ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমাকে ভারত ভ্রমণে সাথী হতে হয়েছিল ২০০১ এ, তখন কলকাতার কফি হাউসের উপর তলার একটি বইয়ের দোকান থেকে সেই অবধি প্রকাশিত রিচার্ড ডকিন্সের সব বইগুলো একসাথে সংগ্রহ করার সুযোগ হয়েছিল।
রিচার্ড ডকিন্স এর কোনো বইই কৌতূহল জাগানোর প্রচেষ্টায় কখনো ব্যর্থ হয়নি। তাঁর হাত ধরেই আরো অনেক বই পড়ার তাড়না অনুভব করেছি। বাংলাদেশ এর সেরা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েও আমি যে সত্যিকারের শিক্ষকের অভাব অনুভব করেছিলাম, আমার জন্য সেই শূন্যস্থানটি পূরণ করেছিলেন যে দুইজন বিজ্ঞান লেখক, রিচার্ড ডকিন্স ছিলেন তাদের একজন (অন্য জন অবশ্যই কার্ল সেগান)। যে কোনো শিক্ষকের একটি প্রবণতা থাকে তার আগ্রহের বিষয়গুলো কারো না কারো মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য, আর কিছুটা সময় শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সেই প্রবণতা থেকে আমিও মুক্ত নই। তাই ডকিন্সের সবগুলো বই বাংলায় অনুবাদ করার পরিকল্পনাটি প্রায় এক যুগের বেশী পুরোনো। কিন্তু অনুবাদের কাজগুলো বিক্ষিপ্তভাবে শুরু করলেও নিয়মিত ভাবে করা শুরু করেছিলাম ২০১১ র প্রথম দিকে, আর ‘দ্য গড় ডিলুশন’ তাদের মধ্যে একটি। এছাড়া অনুবাদ করার অন্য একটি উদ্দেশ্য, আমি যেমন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই ধরনের কোনো বই পড়ার সুযোগ পাইনি, ভবিষ্যতে ‘আমার মত কেউ যেন অন্তত জানেন এধরনের বইয়ের অস্তিত্ব আছে তার মাতৃভাষায়।
বিবর্তন বিরোধী ধর্মীয় ধারণাপুষ্ট সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা (৩) সবসময়ই শঙ্কিত ছিলেন রিচার্ড ডকিন্স পাণ্ডিত্য, শিক্ষকসূলভ পরিমিত সরলতায় সবার কাছে বিবর্তনের ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে পারার ঈর্ষণীয় দক্ষতা এবং বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর সুদৃঢ়, যৌক্তিক অবস্থানের জন্য। ১৯৯৭ সালে একবার অক্সফোর্ডে তাঁর বাসায় সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল অষ্ট্রেলিয়ার একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও কর্মীরা, এই সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীরা আসলে বিবর্তন বিরোধী, সৃষ্টিতত্ত্ববাদ সমর্থনকারীদের একটি দল, যারা তাঁকে ফাঁদে ফেলতে এসেছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি ইতস্তত করছিলেন, এই দলটিকে কি তার বাসা থেকে বের করে দেবেন, নাকি তাদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো সংশোধনের উদ্দেশ্যে বিস্তারিতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। পবরর্তীতে এই টিভি টীমটি খুবই কৌশলে অসৎভাবে ডকিন্সের এই ইতস্ততাগুলোকেই কেবল সম্পাদনা করে প্রামাণ্য চিত্রটি প্রকাশ করেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিবৃদ্ধিক স্তরে তিনি এখনও সন্দিহান, সেটি উপস্থাপন করা।
এভাবেই বিবর্তন জীববিজ্ঞান নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কারণে তাঁকে সৃষ্টিতত্ত্ববাদী ও ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের নানা ধরনের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে বহুবার। অন্তত তাঁরা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল, তাদের ভিত্তিহীন বিশ্বাস আর অবৈজ্ঞানিক অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে রিচার্ড ডকিন্স আসলেই সমীহ জাগানো এক অনন্য প্রতিপক্ষ। ‘দ্য গড ডিলুশন’ এর আগেই বিবর্তন জীববিজ্ঞান নিয়ে প্রকাশিত অন্য বইগুলোয় তিনি অসাধারণ মেধা আর স্বচ্ছ লেখনী ইতিমধ্যেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের যুক্তিগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন। সেই যুক্তির বিরুদ্ধে আর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পেরে তাদের যুক্তি রুপ নিয়েছে argumentum ad hominem এ অর্থাৎ আক্রমণের লক্ষ্য ব্যক্তি রিচার্ড ডকিন্স।
স্পষ্টতই ডকিন্সকে দমিয়ে রাখতে পারেননি তারা, আর তিনি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী বিপক্ষ হয়েই আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর দ্য গড ডিলুশন বইটিতে। আবারো তাঁর প্রাণবন্ত লেখনী, আবেগময় যুক্তিতর্কের উপস্থাপন এই বইয়ের যে কোনো ধরনের বিশ্বাসধারী মনোযাগী পাঠককে আন্দোলিত করতে বাধ্য। আর বিশেষ করে ধর্মীয় মৌলবাদীতার বিস্ময়কর উত্থানের এই সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় উৎসাহী যে কোন পাঠকের কাছে বইটি এখন আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। কোনো ধরনের অস্পষ্টতা তিনি রাখেননি নিজস্ব অবস্থানের বিষয়ে, তার নিজের ভাষায়, “আমার আগের কোনো বইয়েরই এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না যে, বইটি কারো মন পরিবর্তন করবে, তবে এই বইটির উদ্দেশ্য সেটি। এখানেই তিনি সুস্পষ্টভাবে তার নিরীশ্বরবাদী অবস্থানের কথা বলেছেন, আর বইটি হচ্ছে তাঁর সেই অবস্থানে পৌঁছানোর একটি স্বাক্ষ্যপ্রমাণ।
২০০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য গড ডিল্যুশন’; একজন জীববিজ্ঞানীর পক্ষে এ ধরনের কোন বিষয় নিয়ে লেখা অনেককে বিস্মিত করলেও এই বইয়ের যে কোন মনোযোগী পাঠকরা ঠিকই অনুধাবন করতে পারবেন একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে এ ধরনের একটি বই লেখাই সম্ভব। কোনো সন্দেহ নেই যে, বইটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত, এর পক্ষে বিপক্ষেও প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু পূর্ণাঙ্গ বই, অসংখ্য মন্তব্য প্রতিবেদন। বইটির ভিত্তিতে আছে তার মূল প্রস্তাবটি, অবশ্যই কোন অতিপ্রাকৃত স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই, এবং কোনো একটি ব্যক্তিগত ‘ঈশ্বর’ ধারণার প্রতি সব প্রমাণ বিরুদ্ধে বিশ্বাস ধরে রাখাঁটি একটি ডিলুশন বা বিভ্রান্তি হিসাবে চিহ্নিত হবার দাবী রাখে, এবং নৈতিকতার জন্য ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই, এবং ধর্ম এবং নৈতিকতার উৎস আমরা ধর্মীয় চিন্তাধারার বাইরে থেকেই ব্যাখ্যা করতে পারি।
জীবনের ব্যাখ্যায় ধর্মীয় ধারণাপুষ্ট সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বা ক্রিয়েশনিষ্ট অথবা ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন (৪) প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ডকিন্স বিবর্তন নিয়ে লেখা তাঁর সবগুলো বইতেই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’ (৫) বইয়ে তিনি প্রমাণসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন এবং কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন প্রক্রিয়াটি প্রকৃতিতে আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান ‘পরিকল্পনা’ বা ‘ডিজাইন’ এর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। আর ২০০৬ এর দ্য গড ডিল্যুশন বইটিতে তিনি আরো বিস্তারিত করেন তাঁর সেই ক্রমশ সুদৃঢ় হতে থাকা যুক্তিতর্কের বলয়টি, যেখানে অতিপ্রাকৃত কোনো সত্তার উপস্থিতির পক্ষে বিপক্ষে সবগুলো প্রস্তাবনাকে তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছেন বিস্তারিত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং স্বভাবসুলভ ব্রিটিশ হাস্যরসের পরিমিত ব্যবহারে। ধর্মকে সমালোচনা করে বই এর আগেই লিখতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু প্রকাশকদের উপদেশ দীর্ঘায়িত করেছিলো প্রক্রিয়াটি। বিংশ শতাব্দীর শেষাংশেই স্নায়ুবিজ্ঞান, পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ববিদ্যা, সামাজিক-জীববিজ্ঞান, দর্শনের কিছু শাখায় ক্রমশ মানব আচরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার বলয়ে ‘বিষয় হিসাবে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হতে থাকে, এবং ২০০০ সাল নাগাদ বেশ কিছু বই ধর্ম, নৈতিকতার বিষয়টিকে নতুন করে পাঠকদের আলোচনায় নিয়ে আসে, যেমন, পাসকাল বয়ের (৬) এর রেলিজিয়ন এক্সপ্লেইন্ড (৭), ড্যানিয়েল ডেনেট (৮) এর ব্রেকিং দ্য স্পেল রেলিজিয়ন অ্যাস ন্যাচরাল ফেনোমেনা’(৯), স্টিভেন পিংকার (১০) এর ‘দ্য ব্ল্যাঙ্ক স্লেট: মডার্ন ডিনায়েল অব হিউম্যান নেচার’ (১১), মার্ক হাউসার
(১২) এর ‘দ্য মোরাল মাইন্ডস: হাউ নেচার ডিজাইন আওয়ার ইউনিভার্সাল সেন্স অফ রাইট অ্যাণ্ড রঙ’ (১৩), স্কট অ্যাটরান (১৪) এর ‘ইন গডস উই ট্রাষ্ট: ইভোল্যুশনারী ল্যান্ডস্কেপ অব রেলিজিয়নস’(১৫) ইত্যাদি। বইগুলো মানব সংস্কৃতিতে ধর্মবিশ্বাসের সর্বজনীন উপস্থিতি এবং তাদের স্থায়ীত্ব, নৈতিকতার সাথে যোগসূত্রতা নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্ভর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিল। আরো সরাসরি ধর্মের সমালোচনা করে পরে প্রকাশিত হয় স্যাম হ্যারিস (১৬) এর ‘দি এণ্ড অফ ফেইথ: রেলিজিয়ন টেরর অ্যাণ্ড ফিউচার অব রিজন’ (১৭)। বিজ্ঞান ও ধর্মের ক্রমবর্ধিষ্ণু সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন ডকিন্স তাঁর দ্য ডেভিল’স চ্যাপলিন (১৮) বইটিতে এবং এই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে স্বঅবস্থানে দৃঢ় হতে থাকা ধর্মীয় অযৌক্তিকতা, সন্ত্রাসের চালিকা শক্তি হিসাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপক ব্যবহার প্ররোচিত করেছিলো ডকিন্সকে বিষয়টিকে সব দিক থেকে পর্যালোচনা করে একটি স্বতন্ত্র বই লেখার জন্য– তার সেই যুক্তিগুলো তিনি উপস্থাপন করেছেন ‘দ্য গড ডিল্যুশন’ এ। এর পরের বছরই প্রকাশিত হয়েছিল ক্রিস্টোফার হিচেন্স(১৯) এর ‘গড ইজ নট গ্রেট: হাও রেলিজিয়ন পয়জনস এভরিথিং’(২০)। প্রকাশিত হবার পর ‘দ্য গড ডিলুশন’, নিউ ইয়র্ক টাইমসের বহু বিক্রীত বইয়ের তালিকায় ছিল দীর্ঘদিন ধরে, ২০১০ সালেই বইটির বিক্রি দুই মিলিয়ন কপি অতিক্রম করে। দ্য গড ডিল্যুশন তিনি উৎসর্গ করেছেন ব্রিটিশ লেখক,নাট্যকার এবং হিউমরিষ্ট ডগলাস অ্যাডামসকে, যাকে রিচার্ড ডকিন্স তাঁর একমাত্র কনভার্ট (ডগলাস অ্যাডামস এর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী রিচার্ড ডকিন্স এর বই তাঁকে অতিপ্রাকৃত কোন সত্তার অস্তিত্ব নেই এমন একটি যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল) হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন।
দ্য গড ডিল্যুশন বইটির প্রথম অংশে আমরা দেখি রিচার্ড ডকিন্স ক্রমান্বয়ে সেই যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেছেন যা দাবী করে কেন অবশ্যই কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, এবং পরবর্তী অংশে আলোচনার মূল বিষয়, ধর্ম আর নৈতিকতা, এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কর মূল রুপ। ভূমিকায় তিনি আশা করেছেন, তাঁর এই বইটি চারটি বিশেষ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে: প্রথমত, যারা নিরীশ্বরবাদী, তারাও সুখী, ভারসাম্যপূর্ণ, নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেন (যদিও সমাজ ভেদে সেই অবস্থাটি অর্জন করা কঠিন হতে পারে), দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন এবং সমরুপী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং তত্ত্বগুলো একটি কাল্পনিক ঈশ্বর ধারণা কিংবা গড হাইপোথিসিস (২২) বা অনুকল্প থেকে শ্রেষ্ঠতর, যে হাইপোথিসিসটি একটি অতিপ্রাকৃত সত্তার উপস্থিতিকে আবশ্যক মনে করে জীবজগত ও মহাবিশ্ব বা কসমসে বৈচিত্র্যময়তা, আপাতদৃষ্টিতে ডিজাইনের মোহনীয় বিভ্রমকে ব্যাখ্যা করার জন্য। তৃতীয়ত, শিশুদের অবশ্যই তাদের পিতামাতার অনুসৃত ধর্ম দ্বারা চিহ্নিত করা উচিৎ নয় কখনোই, যেমন, ‘মুসলিম শিশু বা ‘ক্যাথলিক’ শিশু, ঠিক যেমন করে আমরা কখনো বলিনা ‘মার্ক্সবাদী’ শিশু, ‘রক্ষনশীল’ শিশু। এই শব্দগুলো যেন যে কোন সভ্য মানুষকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে। চতুর্থত, নিরীশ্বরবাদীদের গর্বিত হওয়া উচিৎ তাদের অবস্থানে, কোন কারণই নেই তাদের ক্ষমা প্রার্থনা করার, কারণ নিরীশ্বরবাদীতা সুস্থ আর স্বাধীন মনের পরিচায়ক।
‘আইনস্টাইনীয় ধর্ম’ আর ‘অতিপ্রাকৃত ধর্মের মধ্যকার পার্থক্যটি উপস্থাপন করে তিনি সূচনা করেন এই বইটির প্রথম অধ্যায়: গভীরভাবে ধার্মিক একজন অবিশ্বাসী। শুরুতেই বইটিতে ব্যবহৃত ‘ঈশ্বরের সংজ্ঞা তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেখানে ঈশ্বর হচ্ছেন বহুবিধ নামে ডাকা হয় এমন একজন অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তা, যিনি উপাসনাযোগ্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা, যেমন, আইনস্টাইন (২৩) এবং হকিং (২৪) তাদের লেখায় ‘ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করেছেন এক ধরনের প্রায়-অতীন্দ্রিয়, সর্বেশ্বরবাদের ধারণায় সম্পৃক্ত কোন প্রাকৃতিক সত্তাকে ইঙ্গিত করতে, কিন্তু এই ধরনের ধার্মিকতার সাথে ঈশ্বরবাদী ধর্মের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে, যা আমরা বর্তমানে সংগঠিত সব ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে দেখি। যেখানে ঈশ্বর তার সৃষ্টির সব কিছুর মধ্যেই হস্তক্ষেপ করে থাকেন, এই ধরনের কোন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবী ডকিন্স প্রস্তাব করেন ‘গড হাইপোথিসিস’ হিসাবে। কারণ মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপকারী কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিংবা নেই, সেই বিষয়টি অবশ্যই বৈজ্ঞানিক, কারণ হস্তক্ষেপকারী কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকলে, সেই মহাবিশ্বের প্রকৃতি অবশ্যই ভিন্ন হবে ঈশ্বরহীন কোন মহাবিশ্ব থেকে। সুতরাং তার অস্তিত্বের ব্যপারটি নীরিক্ষাযযাগ্য একটি প্রশ্ন, যা প্রমাণের দাবী রাখে এবং তাত্ত্বিকভাবে এটি আবিষ্কারযোগ্য, যদিও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্ভব নাও হতে পারে। ঈশ্বররে সপক্ষে সব এ যাবৎ প্রস্তাবিত ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক যুক্তিগুলোকে তিনি ব্যবচ্ছেদ করেন পরবর্তী অধ্যায়গুলোয়, টমাস অ্যাকোয়াইনাসের (২৫) ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রস্তাবিত পাঁচটি প্রমাণ থেকে শুরু করে, পাসকাল (২৬) এর ওয়েজার বা বাজী এমন কি স্টিফেন আনউইনের (২৭) বায়েসীয় (২৮) তত্ত্ব ব্যবহার করে ঈশ্বরের সম্বাবনা প্রমাণের প্রচেষ্টাটিও তিনি আলোচনা করেন। এখানে ডকিন্স স্টিফেন জে, গুল্ড (২৯) এর ‘নন অভারল্যাপিং ম্যাজিস্টেরিয়া’ বা ‘নোমা’ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। ‘নোমা’র এই প্রস্তাবটি দাবী করে: বিজ্ঞান আর ধর্মের প্রভাবের বলয়টি পৃথক, কেউ কারো কর্তৃত্বে অনুপ্রবেশ করে না। এবং বিজ্ঞান কিভাবে প্রশ্নটির উত্তর দেয়, আর ধর্ম উত্তর দেয় ‘কেন’ প্রশ্নটির। খুব পরিচিত বিজ্ঞান আর ধর্মের পারস্পরিক হস্তক্ষেপ না করার এই যুক্তিটি ধর্মবাদীরা একটি কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন বহু দিন ধরে।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রস্তাবিত দার্শনিক যুক্তিগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি যুক্তি তিনি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন পূর্ণাঙ্গ একটি অধ্যায়ে: আর্গুমেন্ট ফ্রম ডিজাইন, যে যুক্তিটি দাবী করে জীবজগতের বিস্ময়কর সাংগঠনিক জটিলতা আবশ্যিকভাবে কোন ডিজাইনের উপস্থিতি ইঙ্গিত করে তথা একজন ডিজাইনার সৃষ্টিকর্তার, আপাতগ্রাহ্য এই মোহনীয় যুক্তিটিকে প্রত্যাখ্যান করে ডকিন্স ব্যাখ্যা করেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রকৃতিতে আপাতদৃশ্যমান এই ডিজাইনকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করে। দি সেলফিশ জিনের সূচনা বাক্যটিকে তিনি পুনরায় মনে করিয়ে দেন যে, মানব জাতির বুদ্ধিমত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল ব্যাখ্যা করা যে, কিভাবে মহাবিশ্বে জটিল আর অসম্ভাব্য পরিকল্পনার উদ্ভব হতে পারে।
ডকিন্স এখানে প্রস্তাব করেন যে, বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য এখন আমাদের কাছে আছে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব: প্রথমত, একটি হাইপোথিসিস যেখানে একজন ডিজাইনার বা পরিকল্পক আছেন, যিনি আমরা জীবজগতে যে জটিলতা বহু রুপ দেখি, সেটির অস্তিত্বের কারণ জটিল একটি অতিপ্রাকৃত সত্তা। দ্বিতীয় হাইপোথিসিসটি হচ্ছে, সেই হাইপোথিসিসটি যার সপক্ষে তাত্ত্বিক এবং বাস্তব প্রমাণ আছে, যা ব্যাখ্যা করতে পারে কিভাবে খুব সাধারণ একটি সূচনা ও মূলনীতিসমূহ অনুসরণ করে খুব জটিলতর কোন কিছুর উদ্ভব হতে পারে। এভাবেই তিনি তার মূল যুক্তিগুলো উপস্থাপন করে, এবং সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের দখল করে নেয়া ও ভুল প্রসঙ্গে ব্যবহার করা ফ্রেড হয়েল (৩০) এর ‘বোয়িং ৭৪৭’ (৩১) যুক্তিটাকেই ব্যবহার করে প্রমাণ করেন যে, প্রথম যুক্তি প্রচেষ্টাটি নিজেই নিজেকে খণ্ডন করে, কারণ দৃশ্যমান এই জটিলতাকে সৃষ্টি করতে সক্ষম কোনো সত্তাকে তার সৃষ্টি অপেক্ষা জটিলতর হতে হবে, আর সেই জটিলতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না, কারণ যে পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যে ঈশ্বরের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে সেই ঈশ্বর ততোধিকই অসম্ভাব্য। সুতরাং ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টায় সফল হবার সম্ভাবনা আছে কেবল দ্বিতীয় হাইপোথিসিসটির।
চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে সব যুক্তি তর্ক শেষে তিনি প্রস্তাব করেন প্রকৃতিতে দৃশ্যমান সব ডিজাইনগুলোকে সত্যিকারের ডিজাইন হিসাবে মনে করার প্রলোভন একটি বিভ্রম এবং ভ্রান্ত, কারণ কোনো ডিজাইনার হাইপোথিসিস আরো একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় সেটি হচ্ছে কে তাহলে সেই ডিজাইনারকে ডিজাইন করেছে। ফ্রেড হয়েল এর ‘বোয়িং ৭৪৭’ প্রস্তাবটির মাধ্যমে আমেন্ট ফ্রম ইমপ্রবাবিলিটির বা ‘অসম্ভাব্যতা থেকে যুক্তি’র প্রস্তাব করা হয়েছে, আর ডিজাইনারের উপস্থিতি যে অসম্ভাব্যতার সমাধান হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই সমাধানটি আরো বেশী অসম্ভাব্যতার দিকে ইঙ্গিত করে।
এছাড়াও ডকিন্স এখানে বিবর্তন সংক্রান্ত সর্বব্যাপী ভ্রান্ত একটি ধারণাকে প্রকাশ করেন, সেটি হচ্ছে বিবর্তন প্রক্রিয়াটি– যেমনটি সাধারণত মনে করা হয়, আদৌ চান্স নির্ভর কোন প্রক্রিয়া নয়, কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ন্যাচারাল সিলেকশন প্রক্রিয়াটি একটি নন-র্যানডোম প্রক্রিয়া, এখানে চান্সের (৩২) (যে প্রক্রিয়াটিকে সাধারণত এর ইংরেজী শব্দার্থ ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করা হয়ে থাকে) অবকাশ নেই এবং এটি তথাকথিত ডিজাইনার হাইপোথিসিস এর বিকল্প। এখানে তিনি ‘ওকাম’স রেজর’ (৩৩) এর ব্যবহার করে প্রস্তাব করেন, সরলতর ব্যাখ্যা শ্রেয়তর, কারণ একজন সর্বশক্তিমান আর সর্বজ্ঞ ঈশ্বর অবশ্যই অসম্ভাব্য পরিমান জটিল একটি প্রস্তাব, কারণ একই সাথে সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান কোন সত্তা অসম্ভব, আর এখানেই তিনি দাবী করেন, ঈশ্বরবিহীন কোনো মহাবিশ্বের তত্ত্ব অবশ্যই ঈশ্বরসহ মহাবিশ্বের হাইপোথিসিস থেকে শ্রেয়তর এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্ধত্বে আক্রান্ত মানুষের মন এই যৌক্তিক ব্যাখ্যাটি বুঝতে অক্ষম, আর এই ধর্মীয় বিশ্বাসের উৎসের সন্ধান করেন তিনি দ্য গড ডিশনের দ্বিতীয়ার্ধে।
সব মানব সংস্কৃতিতে কেন আমরা ধর্মের উপস্থিতি লক্ষ করি? এখানে ডকিন্স নানা প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বের মধ্যে তাঁর সমর্থিত যুক্তিটি ব্যাখ্যা করেন, সেটি হচ্ছে ধর্ম সম্ভবত কোন একটি প্রয়োজনীয় ও উপযোগী অভিযোজনীয় প্রক্রিয়ার ভ্রান্তি বা দূর্ঘটনাবশত সৃষ্ট একটি উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট। অর্থাৎ এখানে তিনি ধর্মকে প্রস্তাব করেন টিকে থাকার জন্য উপযোগী কোন একটি প্রক্রিয়ার ভুল বা দূর্ঘটনাবশত সৃষ্ট একটি ফলাফল, যা প্রক্রিয়াটির মূল উদ্দেশ্যের কোন অংশ ছিল না। আগুনের উন্মুক্ত শিখার প্রতি মথদের আকর্ষণ ও আপাতদৃষ্টিতে আত্মাহুতির উদাহরণ উল্লেখ করে তিনি ধর্মকে চিহ্নিত করেন এখনও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি এমন কোন টিকে থাকার প্রক্রিয়ারই অত্যন্ত একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে সক্রিয় ওঠা হিসাবে। দ্য গড ডিলুশন বইটিতে রিচার্ড ডকিন্স আরো একটি মৌলিক প্রস্তাব করেন, কেন ধর্ম এত সফলভাবে মানব সংস্কৃতিতে টিকে আছে সেই প্রশ্নটিতে, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে এবং সারা বিশ্বব্যাপী এটি আরো তীব্র হয়ে ফিরে আসার প্রেক্ষাপটে। ডকিন্স এখানে ১৯৭৬ সালে তার প্রস্তাবিত সামাজিক ধারণার বিবর্তনের একক মিমের প্রস্তাব করেন; মিম হচ্ছে জিনের অনুরুপ একটি একক সেখানে বংশগতি নয়, বরং সামাজিক কোন ধারণা হস্তান্তরিত হয় প্রজন্মান্তরে। এখন ডারউইনবাদী হিসাবে তিনি প্রশ্ন করেন, টিকে থাকার ক্ষেত্রে ধর্মের উপকারিতাটি আসলে কি? ধর্মীয় মিমগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হবার মানবিক দূর্বলতাকে তিনি দাবী করেন, বহু সমাজে কিভাবে ধর্মীয় ধারণার বিস্তার ঘটে মনের ‘ভাইরাস সংক্রমণের মত। এর পর ডকিন্স তার আলোচনার নিয়ে আসেন নৈতিকতা আর নৈতিক আচরণ করার জন্য ধর্মের আবশ্যিকতার প্রসঙ্গটি; ধর্মবাদীদের অন্যতম প্রিয় যুক্তিটি, যদি ঈশ্বরই না থাকে তাহলে মানুষ কেন ভালো আচরণ করবে? এর প্রত্যুত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন; আপনি যদি জানেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, তাহলে কি আপনি হত্যা, ধর্ষণ কিংবা অন্য কোন অনৈতিক কাজ করবেন? খুব কম মানুষই এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলবেন। কারণ শুধু ঈশ্বরকে খুশী করার কারণটি, ভালো কাজ করার কারণ হিসাবে খুবই অদ্ভুত একটি যুক্তি, এটি মানবতারই অপমান। যা সুস্পষ্টভাবে নৈতিক আচরণ করার জন্য ধর্মের আবশ্যিকতা আছে এই দাবীটাকে দুর্বল করে।
তাঁর যুক্তির কেন্দ্রেই আছে, আমাদের নৈতিক আচরণ বা ভালো কাজের জন্য ধর্মের কোন আবশ্যিকতা নেই, কারণ আমাদের নৈতিকতার ডারউইনীয় ব্যাখ্যা আছে, পরার্থবাদী জিন, বিবর্তনের প্রক্রিয়া নির্বাচিত হবার মাধ্যমে মানুষের ভিতর প্রাকৃতিকভাবে সহমর্মিতার জন্ম দেয়। তাঁর এই যুক্তির সপক্ষে তিনি নৈতিকতার ইতিহাসের একটি পর্যালোচনা করেন, এবং যুক্তি দেন সমাজে একটি নৈতিকতার জাইটগাইষ্ট বা যুগধর্ম ক্রম বিবর্তিত হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্তবাদী নৈতিকতা থেকে উদারনৈতিকতার দিকে এবং ক্রমশ অগ্রসরমান এই নৈতিক ঐক্যমত কিভাবে প্রভাবিত করেছে ধর্মীয় নেতাদের তাদের তথাকথিত অপরিবর্তনযোগ্য পবিত্র গ্রন্থ ব্যাখ্যা করার জন্য। এভাবে ডকিন্স তার পাঠকদের সামনে উন্মোচন করেন, যা কিছু আমরা মানবিক এবং নৈতিকতাময় মনে করি তার উৎস বাইবেল নয়, বরং আমাদের নৈতিক অগ্রগতি আধুনিক ধর্মবিশ্বাসীদের ইঙ্গিত করেছে বাইবেলের এর কোন অংশটি আমরা গ্রহন করবো আর কোন অংশটি বর্জন করবো।
ওল্ড টেষ্টামেন্টে (৩৪) বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতিহিংসা পরায়ন রুপটি দেখিয়ে তিনি দাবী করেন, এটি কোনো নৈতিকতা শিক্ষা দেবার গ্রন্থ হতে পারেনা, এছাড়া যে ধর্মীয় আবহের সাথে তিনি সবচেয়ে সুপরিচিত, সেই খ্রিস্টান ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থটি মূলত পরস্পরের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিছিন্ন কিছু ডকুমেন্টের সমষ্টি হিসাবে চিহ্নিত করেন। শিক্ষিত ধর্ম বিশ্বাসীদের দাবী, তারা প্রকৃতার্থে জেনেসিসে বর্ণিত কাহিনী আক্ষরিকার্থে বিশ্বাস করেন না, উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বাসীরা যেমন অবিশ্বাসীদের অভিযুক্ত করেন তারা মিশ্র একটি দর্শনের বিশ্বাসী, যেখানে তারা বেছে নেন, মানবতা, যুগের সাথে মানানসই যৌক্তিক সমাধানগুলো, এখানে তারাও ঠিক একই কাজ করছেন, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা অনুযায়ী তারাও সুনির্দিষ্টভাবে বেছে নেন নৈতিকতার সাথে মানানসই অংশগুলো। এখানে ডকিন্স তার সূতীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণটি প্রকাশ করেন; তিনি বলেন এটি ধর্মবাদীদের একটি কপটতা আর বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা যা সাথে ধর্মীয় অসারতাগুলোকেই টিকিয়ে রাখছেন। হয়তো তারা নিজেদের মত ধর্মগ্রন্থ থেকে বাছবিচার করে তাদের জীবন দর্শন ঠিক করছেন ঠিকই কিন্তু ধর্মগ্রন্থটি অপরিবর্তনযোগ্য এবং একটি ঐশী প্রত্যাদেশ এবং সংশোধনযোগ্য নয় এমন একটি ধারণা তারা দ্বিধাহীনভাবে তাদের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন, সুতরাং একটি পর্যায়ে তারা মধ্যপন্থী হয়েও কিছু ক্ষেত্রে মৌলবাদী। এভাবে তথাকথিত মৃদুপন্থীরা ধর্মীয় মৌলবাদীতাকে লালন করে যাচ্ছেন পরোক্ষভাবে। তবে সুশিক্ষিত, মৃদুপন্থীরা যাই দাবী করুন না কেন, ধর্মগ্রন্থ তারা আসলেই অর্থ সহকারে পড়েছেন কিনা সেই সন্দেহের অবকাশ রেখেও, এখনও বিশ্বব্যাপী ভীতিকর একটি পরিসংখ্যান হলো, বহু মানুষই তাদের ধর্মগ্রন্থকে প্রশ্নাতীতভাবে, আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করেন। আর সারা বিশ্বের নিরাপত্তা এখন তাদের একাংশের কারণেই আজ হুমকির সম্মুখীন।
স্পষ্টতই শুধুমাত্র নিরীশ্বরবাদীতার সমর্থনের মধ্যে তিনি তাঁর। আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেননি, ডকিন্স সরাসরি ধর্মকে আক্রমণ করেছেন, ধর্মকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, কিভাবে বিজ্ঞান শিক্ষাকে বাধাগ্রস্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কিভাবে মৌলবাদীতাকে ধর্ম অন্ধের মত সমর্থন করছে, সমকামিদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাময় ঘৃণাকে উৎসাহিত করছে। স্কুলে ধর্ম শিক্ষা দেবার প্রথাটিকে ডকিন্স। তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন, যাকে তিনি মন্ত্র দীক্ষা দেবার একটি পক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন। পিতামাতা ও শিক্ষকদের ধর্ম। দীক্ষা দেবার প্রক্রিয়াটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন এক ধরনের মানসিক নিপীড়ণ হিসাবে। মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান হিসাবে শিশুকে চিহ্নিত করাকে তিনি শিশুদের ‘বামপন্থী’ শিশু বা ‘ডানপন্থী’ শিশু হিসাবে চিহ্নিত করার মত একটি বিষয় হিসাবে সচেতন হবার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ কোন অবস্থাতেই শিশুদের মানসিক স্তর যথেষ্ট পরিমান প্রাপ্তবয়স্ক নয় যে তারা মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বে তাদের অবস্থান সংক্রান্ত কোন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার ক্ষমতা রাখতে পারে।
তাঁর বিরুদ্ধে আনা একটি পরিচিত অভিযোগ– তিনি একজন মৌলবাদীর মতই মৌলবাদী নিরীশ্বরবাদী– প্রত্যাখ্যান করেন, এবং একজন সত্যিকারের মৌলবাদীর সাথে তিনি তাঁর নিজের পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করেন, তিনি বলেন তাঁর অবস্থানের বিরুদ্ধে যদি সত্যিকারের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, তিনি সাথে সাথে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে প্রস্তুত আছেন, কিন্তু একজন সত্যিকারের মৌলবাদী তার অবস্থানেই সারাক্ষণই অনঢ় থাকেন, তার অবস্থানের বিরুদ্ধে যতই যৌক্তিক এবং বাস্তব প্রমাণ থাকুক না কেন। এছাড়াও দীর্ঘসময় ধরে গণতান্ত্রিক সহনশীল পরিবেশে আমরা এই ধরনের বহু অপ্রমাণিত বিশ্বাসকে বহুসাংস্কৃতিকতাবাদ কিংবা বৈচিত্র্যময়তার অজুহাতে বিস্তৃত হবার সুযোগ দিয়েছি, কিন্তু তাসত্ত্বেও আমাদের সব কিছু ধর্মনিরেপেক্ষতার মূলমন্ত্রকে আগ্রাসন করবে না, এমন ধরনের একটি বিশ্বাস এখন হুমকির মুখে। সহিষ্ণু সমাজের ভিতর শিকড় বিস্তার করছে ধর্মীয় অহসিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ। এখন এটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। সারা পৃথিবী জুড়েই সমাজগুলো তাদের চিহ্নিত করতে ব্যস্ত ধর্মীয় পরিচয়ে, যেখানে তাদের মতাদর্শগত বৈষম্য পারস্পরিক সহাবস্থানকে ক্রমশ কঠিনতর করে তুলছে। রিচার্ড ডকিন্স দ্য গড ডিলুশনে এই ধর্মনিরপেক্ষ উদারগণতান্ত্রিকতা, সহিষ্ণু সমাজে ক্রমশ শক্তিশালী ও মৌলবাদী হয়ে ওঠা ধর্মীয় প্রভাবের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি প্রতি গুরুত্ব দেবার আহবান জানিয়েছেন। বইটির শেষাংশে ডকিন্স আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেন, কেন ধর্ম, তার সংশ্লিষ্ট নানা সমস্যাসহ, মানুষের জীবনের একটি প্রয়োজনীয় শূন্যস্থান পূরণ করার দাবী রাখে? যাদের প্রয়োজনে এটি সান্ত্বনা কিংবা অনুপ্রেরণা দেয়। ডকিন্স প্রস্তাব করেন এই সব শূন্যস্থানই ধর্মীয় নয়, এমন অন্য প্রক্রিয়াতেও পূরণ করা সম্ভব, যেখানে দর্শন এবং বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি প্রস্তাব করেন নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে যেভাবে পরিপূর্ণ করে, জীবনের রহস্যকে সত্যিকারভাবে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, ধর্ম সেটি করতে পারেনা, কখনই পারেনা।
প্রত্যাশিতভাবেই বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সমর্থক এবং নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদীরা প্রধান যে দাবীটি করে সেটি হচ্ছে তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিমান গবেষণা করেননি, এবং যথারীতি তিনি যে ধর্মের কথা বলেছেন, সেটি তাদের পরিচিত ধর্ম নয়, এই সব সমালোচনার জবাব তিনি দিয়েছেন, ২০০৮ এ প্রকাশিত তার পেপারব্যাক সংস্করণের দীর্ঘ ভূমিকায়, যা এখানে অনুবাদ করা হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে তার বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলোর একটি মূল সূত্র যা পরবর্তীতে উন্মোচিত হয় সেটি আসলেই প্রমাণ করে বইটির মূল বক্তব্যটি অনেকেই ধরতে ব্যার্থ হয়েছেন, বইটি আসলেই বর্তমান ধর্মকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে আর্থসামাজিকরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিশ্বব্যাপী সমস্যার অপ্রয়োজনীয় একটি অংশ হিসাবে। দ্য গড ডিল্যুশন প্ররোচিত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসা ধর্ম আর বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিতর্কে ডকিন্স দাবী করেন, “ঈশ্বরের অস্তিত্ব একটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প, স্টিভেন জে. গুল্ড এর মত যে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান আর ধর্মকে ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃত্বের বলয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চান, সেটি আসলে একটি রাজনৈতিক কৌশল যা ধর্মীয় মধ্যপন্থীদের সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টার অংশ। কিন্তু এই ধারণাটি ভিত্তিহীন,বহু ক্ষেত্রে ধর্ম প্রভাবিত করছে বিজ্ঞানকে, যে কোন অলৌকিকতা শুধুমাত্র বাস্তব তথ্য নির্ভর বিজ্ঞান-বিরুদ্ধ, ঠিক তেমনি এটি বিজ্ঞানের মূল মন্ত্রের পরিপন্থী। যে সমস্ত দার্শনিকরা দাবী করে, বিজ্ঞানের এখতিয়ারের বাইরে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা শুধু ধর্মের আছে, কিংবা দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিকদের শুধু আছে, ডকিন্স তাদের পাল্টা যুক্তি দেন, মহাজাগতিক বা কসমোলজিক্যাল প্রশ্নের উত্তরে ধর্মতাত্ত্বিকরা কি এমন বিশেষ জ্ঞান প্রদর্শন করতে পারেন, যা বিজ্ঞানীরা পারেন না। ডকিন্স তাঁর সমালোচনার একটি উত্তরে লিখেছিলেন, যে বিশ্বাস প্রমাণ ও যুক্তি ব্যবহার করে তার অবস্থান সমর্থন করতে প্রস্তুত, সেই বিশ্বাসটি শুধুমাত্র ঐতিহ্য,কর্তৃত্ব আর ঐশী প্রত্যাদেশের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশী ভিন্ন।
আমি পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাই এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি পাঠ করার জন্য; আমি নিশ্চিৎ যে, অস্তিত্বের একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন নিয়ে রিচার্ড ডকিন্সের যুক্তি, তর্ক আর আলোচনা অবশ্যই পাঠকের মনে কৌতূহলের জন্ম দেবে, সুযোগ করে দেবে আরো বেশী প্রশ্ন করার। পেশাগত ব্যস্ততা আর সম্পাদনা করার সময়ের সমন্বয়ের প্রায় সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা অনুবাদে বহু অনাকাঙ্খিত ভ্রান্তির কারণ হতে পারে, আমি পাঠকদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আশা করছি ক্রটিগুলো সংশোধন করার সুযোগ দেবার মত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হবার সম্ভাবনাটা বাস্তব রুপ পাবে। এই বইটি আমি আমার একটি সামান্য প্রচেষ্টা হিসাবে উৎসর্গ করছি বাংলাদেশে মুক্ত চিন্তার প্রসারে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া সেই সব মানুষগুলোকে, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার স্তরে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন, নির্ভীক, কৌতূহলী মনগুলোকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বব্যাপী মুক্তমনাদের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে।
কাজী মাহবুব হাসান
সেপ্টেম্বর, ২০১৮
পাদটীকা:
(১) এই অনুবাদে আমি অনুসরণ করেছি ২০০৮ সালে দ্য গড ডিলুশন বইটির উত্তর আমেরিকায় প্রকাশিত সংস্করণটি : The God Delusion, Richard Dawkins, Houghton Mifflin Harcourt, January 16, 2008, Trade Paperback
(২) Richard Dawkins (1976). The Selfish Gene. Oxford University Press.
(৩) ক্রিয়েশনিজম বা সৃষ্টিতত্ত্ববাদ হচ্ছে একটি মতবাদ যা দাবী করে যে এই মহাবিশ্ব এবং সকল জীবের সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গীয় স্রষ্টার দ্বারা বিশেষভাবে সৃষ্টি হবার মাধ্যমে। এদের মধ্যে যারা ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিষ্ট, তারা আক্ষরিক অর্থে বাইবেল এর বুক অফ জেনেসিস এ বর্ণিত সৃষ্টিকাহিনী বিশ্বাস করেন এবং তারা বিবর্তনের ধারণা বিরোধী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন বৈজ্ঞানিক ধারণা বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছিল, তখন বিভিন্ন একেশ্বরবাদী (আব্রাহামিক) ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত সষ্টি কাহিনীগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। যারা বিশ্বাস করতেন যে প্রজাতিদের পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের সাধারণত বলা হতো অ্যাডভোকেটস অফ ক্রিয়েশন বা খুব সাধারণ ভাবে ক্রিয়েশনিষ্ট বা সৃষ্টিতত্ত্ববাদী। ক্রিয়েশনিষ্ট ও বিবর্তনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেলে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা মূলত পরিচিতি পায় বিবর্তন বিরোধী বা অ্যান্টি-ইভ্যোলুশনিষ্ট হিসাবে। ১৯২৯ এ যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিয়েশনিষ্ট শব্দটি প্রথম সংশ্লিষ্ট হয় খ্রিষ্টীয় মৌলবাদীদের সাথে, বিশেষ করে যখন তারা মানব বিবর্তনের ধারণাটি প্রত্যাখ্যান ও পৃথিবীর বয়স জেনেসিসে বর্ণিত সময়ের সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাস করে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে। যদিও শব্দটি নিয়ে আপত্তি আছে যা ওল্ড আর্থ সৃষ্টিতত্ত্ববাদী এবং যারা বিবর্তনবাদী সৃষ্টিতত্ত্ববাদী, তাদের মধ্যে, যারা সৃষ্টি সম্বন্ধে ভিন্ন মতে বিশ্বাস করেন, যেমন পৃথিবীর বয়স এবং বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত বিবর্তনের ধারণা।
(৪) ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন (আইডি) একটি ছদ্মবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যা দাবী করে, মহাবিশ্বের ও জীবজগতের কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যদি বলা হয় তাদের সৃষ্টি করেছে কোনো বুদ্ধিমান সত্তা, এবং বিবর্তনের নৈর্ব্যাক্তিক প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ার চেয়ে। তাদের কাছে এই ব্যাখ্যাটি বেশী গ্রহনযোগ্য সৃষ্টির কারণ হিসাবে। বৈজ্ঞানিক সমাজ, দার্শনিকরা এবং শিক্ষাবিদরা সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছেন যে, আইডি হচ্ছে মূলত ধর্মীয় যুক্তি, সৃষ্টিতত্ত্ববাদেরই একটি রুপ, যার কোনো পর্যবেক্ষণ মূলক প্রমাণ বা পরীক্ষাযযাগ্য কোনো অনুকল্প নেই। যদিও তারা দাবী করেন আইডি সৃষ্টিতত্ত্ববাদ নয় এবং পরিকল্পিতভাবে তারা তাদের ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারকে কোন বিশেষ সত্তা দ্বারা চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকেন, যদি এই তত্ত্বের প্রস্তাবক অনেকেই তাদের বিশ্বাস প্রকাশ করেন এই বলে যে এই ডিজাইনার হচ্ছেন খ্রিষ্টীয় ঈশ্বর।
(৫) Richard Dawkins (1986). The Blind Watchmaker. New York: W. W. Norton
(৬) প্যাসকাল বয়ের, ফরাসী নৃতত্ত্ববিদ, বর্তমানে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেইন্ট লুইসের অধ্যাপক। তিনি প্রস্তাব করেন যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ইনট্যুইটিভ থিওরী অফ মাইন্ড এর ভিত্তি যা আমাদের সামাজিক সম্পর্ক, নৈতিকতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হবার প্রবণতাকে পরিচালিত করে। বয়ের প্রস্তাব করেন যে এই সব জন্মগত মানসিক পদ্ধতি মানুষকে বিশেষ কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যেমন অতিপ্রাকৃত কোন সত্তার প্রতি বিশ্বাস। (9) Religion Explained: The Evolutionary Origins of Religious Thought (2002) Basic Books.
(৮) ড্যানিয়েল ক্লেমেন্ট ডেনেট (তৃতীয়) (জন্ম: ১৯৪২) আমেরিকার দার্শনিক, লেখক এবং কগনিটিভ বিজ্ঞানী, যার গবেষণার বিষয়, ফিলোসফি অফ মাইন্ড, ফিলোসফি অব সায়েন্স এবং ফিলোসফি অফ বায়োলজী, বিশেষ করে সেই ক্ষেত্রগুলো যেখানে বিবর্তন জীববিজ্ঞান ও কগনিটিভ বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট।
(৯) Breaking the Spell: Religion as a Natural Phenomenon (Penguin Group 2006)
(১০) স্টিভেন আর্থার পিংকার ( জন্ম ১৯৫৪) কানাডায় জন্মগ্রহনকারী যুক্তরাষ্ট্রের এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিষ্ট,কগনিটিভ সায়েন্টিষ্ট,ভাষাতত্ত্ববিদ এবং লেখক। বিবর্তন মনোবিজ্ঞান এবং কম্পিউটেশনাল থিওরী অব মাইন্ড এর সমর্থক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
(১১) The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature (2002)।
(১২) মার্ক ডি হাউসার (জন্ম ১৯৫৯) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, প্রাইমেট আচরণ এবং অ্যানিমেল কগনিশনের গবেষক।
(১৩) Moral Minds: How Nature Designed a Universal Sense of Right and Wrong (Harper Collins/Ecco, NY 2006).
(১৪) স্কট অ্যাটরান (জন্ম ১৯৫২) যুক্তরাষ্ট্র-ফরাসী নৃতত্ত্ববিদ, প্যারিসের Centre National de la Recherche Scientifique এর পরিচালক।
(১৫) In Gods We Trust: The Evolutionary Landscape of Religion Oxford University Press, 2002
(১৬) স্যামুয়েল (স্যাম) বি, হ্যারিস ( জন্ম ১৯৬৭) আমেরিকার লেখক, দার্শনিক, এবং নিউরোসায়েন্টিষ্ট। প্রোজেক্ট রিজনের সহ প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী।
(১৭) The End of Faith: Religion, Terror, and the Future of Reason (2004). W. W. Norton
(১৮) Richard Dawkins (2003). A Devil’s Chaplain. Boston: Houghton Mifflin
(১৯) ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্স ( ১৯৪৯-২০১১) ব্রিটিশ আমেরিকান লেখক, দার্শনিক, বিতার্কিক এবং সাংবাদিক।
(২০) god is not Great: How Religion Poisons Everything, Twelve/Hachette Book Group USA/Warner Books
(২১) ডগলাস নোয়েল অ্যাডামস (১৯৫২-২০০১) ইংরেজ লেখক, হিউমরিষ্ট, নাট্যকার।
(২২) হাইপোথিসিস (hypothesis, বহুবচনে hypotheses) হচ্ছে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব কোনো ঘটনার প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা। এবং কোন হাইপোথিসিসকে বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস হতে হলে সেটিকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষাযোগ্য হতে হবে। বিজ্ঞানীরা সাধারণত তাদের হাইপোথিসিস প্রস্তাব করেন পূর্বে গবেষণালদ্ধ উপাত্ত ও উপসংহার কিংবা পর্যবেক্ষণ থেকে, যার গ্রহনযোগ্যতা তারা পরীক্ষা করে দেখেন।
(২৩) আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের দার্শনিক।
(২৪) স্টিফেন উইলিয়াম হকিং (জন্ম ১৯৪২) ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং কসমোলজিষ্ট।
(২৫) টমাস অ্যাকোয়াইনাস (১২২৫-১২৭৪) ডমিনিকান ফ্রায়ার এবং ক্যাথলিক যাজক, ধর্মতাত্ত্বিক।
(২৬) ব্লেইস পাসকাল (১৬২৩-১৬৬২) ফরাসী গনিতজ্ঞ, খ্রিষ্টীয় দার্শনিক, লেখক।
(২৭) স্টিফেন ডি আনউইন, ব্রিটিশ পদার্থবিদ।
(২৮) থমাস বেইস (১৭০১-১৭৬১) (একজন ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ, গনিতজ্ঞ, দার্শনিক) এর প্রস্তাবিত একটি তত্ত্ব। বায়েসীয় তত্ত্বটি প্রমাণ নির্ভর সম্ভাবনার পরিমান নির্ণয় করার একটি পদ্ধতি, যেখানে বেইসীয় কোন সম্ভাবনাবিদ পূর্বেই কিছু সম্ভাবনা সুনির্দিষ্ট করেন, এবং বর্তমান প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সেই সম্ভাবনাটিকে হালনাগাদ করা হয়।
(২৯) স্টিফেন জে. গুল্ড ( ১৯৪১-২০০২) আমেরিকার জীবাশ্মবিদ,বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক।
(৩০) ফ্রেড হয়েল (১৯১৫-২০০১) ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যিনি সুপরিচিত নক্ষত্রের কেন্দ্রে নিউক্লিওসিনথেসিস ব্যাখ্যা করার জন্য। প্রায়শই তিনি বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছেন, যেমন তিনি বিগ ব্যাঙ থিওরীকে বিশ্বাস করতেন না, এছাড়া বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যপারে তার বিতর্কিত অবস্থান ছিল। এছাড়া তিনি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক ছিলেন।
(৩১) বোয়িং ৭৪৭ এর যুক্তিটি ফ্রেড হয়েল এর বলে মনে করা হয়, তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি হবার সম্ভাবনা কোন একটি লোহা লক্কড়ের পরিত্যাক্ত এলাকায় ঝড় বয়ে গেলে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া লেগে নিজে নিজে একটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ তৈরী হবার মত অসম্ভাব্য। ফ্রেড হয়েল প্যানস্পার্মিয়ার সমর্থক ছিলেন। যা দাবী করে মহাবিশ্বে প্রাণ ছড়িয়ে আছে এবং ধূমকেতু, উল্কাপিণ্ড ইত্যাদির মাধ্যমে এটি মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, অণুজীবরুপে।
(৩২) বিবর্তন জীববিজ্ঞানে কোন একটি ‘চান্স’ ঘটনা হচ্ছে শুধুমাত্র এমন কোনো ঘটনা যার কারণ সেই জীব নিজে নয় এবং প্রারম্ভিক যে পরিস্থিতি ছিল, এবং সেই সমন্ধে আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান যতটুকু আছে সেই ঘটনাটি আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব না, যা সেই জীবের টিকে থাকার উপর প্রভাব ফেলে (যেমন, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ) অথবা এর জিনগত তথ্য ( যেমন, কোন মিউটেশন); আর বিবর্তনে কিংবা যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে চান্স হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা সম্বন্ধে আংশিক পরিমাপ করা সম্ভব এমন একটি প্রস্তাব– প্রারম্ভিক পরিস্থিতিগুলো সম্বন্ধে আমাদের সঠিক জ্ঞানের অভাব বা কিভাবে কোন সুনির্দিষ্ট শেষ পরিস্থিতিটি নির্বাচিত হয়েছে সেই সম্বন্ধে আমাদের বোঝর ঘাটতি। চান্স অবশ্যই বিবর্তনে একটি ভূমিকা পালন করে তবে এখানে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও মনে রাখতে হবে। নির্বাচন চান্সের বিপরীত। চান্স, মিউটেশনের মাধ্যমে জিনগত বৈচিত্র্যময়তা আর প্রকরণ সৃষ্টি করে, আর সেটাই হচ্ছে কাঁচা মাল যার উপর প্রাকৃতিক নির্বাচন তার কাজ করে। এই সব জিনের বৈচিত্র্যময় ভিন্ন রুপ থেকে নির্বাচন বাছাই করে সেই প্রকরণগুলো যা এর বাহকে টিকে থাকতে ও প্রজনন সফল হতে সহায়তা করে।
(৩৩) ওকাম’স রেজর বা ওকহাম রেজর ( ল্যাটিন লেক্স পারসিমোনি (Occam’s razor/lex parsimoniae) হচ্ছে সমস্যা সমাধানের একটি মূলনীতি যা প্রস্তাব করেছিলেন উইলিয়াম অফ ওকহাম ( ১২৪৭-১৩৪৭), যিনি ইংরেজ ধর্মযাজক ও ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক ছিলেন। এই মূলনীতিতে তিনি প্রস্তাব করেন যে, কোন কিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী হাইপোথিসিসগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে সরল, যেখানে সবচেয়ে কম প্রাক-ধারণার প্রয়োজন আছে সেটাকেই নির্বাচন করা উচিৎ। অন্যার্থে, অপেক্ষাকৃত জটিল সমাধানগুলো হয়তো সঠিক বলে প্রমাণিত হতে পারে। তবে যত কম প্রাক-ধারণা করা যায়,ততই উত্তম।
(৩৪) খ্রিষ্টীয় বাইবেল এর প্রথমাংশ, এর ভিত্তি হিব্রু বাইবেল।
.
পেপারব্যাক সংস্করণের ভূমিকা
দ্য গড ডিল্যুশন (The God Delusion) এর শক্ত-বাধাই সংস্করণটিকে বেশ ব্যাপকভাবেই ২০০৬ সালে অপ্রত্যাশিত আর বিস্ময়করভাবেই বহু-বিক্রীত হওয়া একটি বই হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা আর উৎসাহের সাথে বইটিকে গ্রহন করেছিলেন অধিকাংশ পাঠক, যাদের অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত পর্যালোচনা আর মন্তব্য পাঠিয়েছিলেন আমাজন (১) ওয়েবসাইটে (এই লেখাটি লেখার সময় সেই সব মন্তব্যের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করেছে); তবে সে ধরনের উদাত্ত কোনো সমর্থন অবশ্য পাওয়া যায়নি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর পর্যালোচনায়। একজন নৈরাশ্যবাদী হয়তো ব্যপারটাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন এই সব পত্রিকাগুলোর পুস্তক পর্যালোচনা সমালোচকদের কল্পনাশক্তিহীনতা জনিত একটি সহজাত প্রতিক্রিয়ার ফলফল হিসাবে : এর শিরোনামে যেহেতু God শব্দটি আছে, সুতরাং কোনো পরিচিত ধর্মবাদী সমালোচকের কাছে এটিকে পর্যালোচনা করার জন্য পাঠানোই উত্তম হবে। কিন্তু ব্যপারটা সেভাবে ভাবা হয়তো আসলেই একটু বেশী মাত্রায় নৈরাশ্যবাদ হবে। তবে বেশ কিছু বিরুপ সমালোচনা যা শুরু হয়েছে, সেই বিখ্যাত বাক্যটি দিয়ে, বহুদিন আগেই যে বাক্যটিকে সাধারণত ভয়ঙ্কর অশুভ বার্তাবাহী বলে মনে করতেই আমি শিখেছি : “আমি একজন নিরীশ্বরবাদী, ‘কিন্তু’ .., যেমনটি, ড্যান ডেনেট (২) বলেছিলেন তাঁর Breaking the spell বইটিতে, ‘হতবাক করে দেবার মত বিশাল একটি সংখ্যার বদ্ধিজীবিরা আসলেই বিশ্বাসে বিশ্বাস করেন; যদিও তাদের নিজেদের কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস নেই, কিন্তু এই সব ‘অন্য কারো অনুভূতি কল্পনা করে’ অনুভব করা দ্বিতীয় পর্যায়ের ধর্মবিশ্বাসীরা প্রায়শই মূল ধর্মবিশ্বাসীদের চেয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে থাকেন, আর তাদের এই উৎসাহ বহুগুণে বেড়ে যায় অনুগ্রহভাজন হবার নিমিত্তে তাদের প্রদর্শিত উদার মানসিকতায়: “হায়!, আমি যদিও আপনার মত ধর্মে বিশ্বাসী নই, তবে আমি তা ‘শ্রদ্ধা করি ও তার প্রতি আমি সহানুভূতিশীল।
‘আমি একজন নিরীশ্বরবাদী ‘কিন্তু’ ….., এই বাক্যের পরবর্তী অংশ আসলে কখনোই কোন আলোচনায় উপকারে আসেনা, বরং সবসময়ই নাস্তিবাদী(৩) বা আরো মন্দ; বাক্যটি পূর্ণ একধরনের অতি আনন্দময় নেতিবাচকতায়। প্রসঙ্গক্রমে লক্ষ করুন, একই ঘরানার আরো একটি জনপ্রিয় মন্তব্য থেকে এর পার্থক্য: “আমি এক সময় নিরীশ্বরবাদী ছিলাম, কিন্তু…, এটিও খুবই পুরাতন একটি কৌশল, যা ব্যবহার করেছেন লেখক সি, এস, লিউইস (৪) থেকে শুরু করে এমনকি আজকের ধর্মবাদীরাও। এটি এক ধরনের জনপ্রিয় মতামত প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে, আর বিস্ময়কর ব্যপারটা হলো বহু ক্ষেত্রে এটি কাজেও দেয়; এধরনের কৌশলের প্রতি সে কারণে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
আমি RichardDawkins.net ওয়েবসাইটটির জন্য একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, । am an aethist, BUT.. (“আমি একজন নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু…’) শিরোনামে, এবং সেখান থেকেই আমি ধার করেছি এখানে পরবর্তীতে বর্ণিত সমালোচনামূলক তবে নেতিবাচক উল্লেখযোগ্য কিছু আলোচনার বিষয়বস্তু, যেগুলো শক্ত বাধাই হিসেবে প্রকাশিত ‘দ্য গড ডিল্যুশন’ এর বিভিন্ন প্রকাশিত সমালোচনা আর পর্যালোচনা থেকে আমি সংগ্রহ করেছিলাম। সেই ওয়েবসাইটি– যা পরিচালনা করছেন অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণ জশ টিমোনেন– ইতিমধ্যে অসংখ্য পাঠকের মতামত আকৃষ্ট করেছে, সব মতামতই সুস্পষ্টভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছে এইসব সমালোচনাগুলো– যেগুলো আমার বা আমার প্রাতিষ্ঠানিক সহকর্মীরা যেমন, এ. সি. গ্রেলিঙ (৫), ড্যান ডেনেট (২), পল কার্টজ (৬), স্টিভেন ওয়াইনবার্গ (৭) এবং অন্যান্যরা যারা ছাপার অক্ষরে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন– তাদের সবার চেয়েই আরো অনেক বেশী খোলামেলা আর সুস্পষ্ট।
ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানগর্ভ বইগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে আপনি কিছুতেই ধর্মের সমালোচনা করতে পারেন না :
‘অবাক করে দেয়ার মত বহু বিক্রীত একটি বই?’ একজন অতি আত্মসচেতন বুদ্ধিজীবি সমালোচক যেমন মন্তব্য করেছিলেন, আমি যদি অ্যাকোয়াইনাস(৮) ও ডানস স্কোটাস (৯) এর মধ্যে এপিসটেমিওলজিকাল বা জ্ঞানগত উৎসের পার্থক্য বোঝার জন্য আরো বেশী প্রচেষ্টা করতাম; কিংবা আমি যদি সাবজেক্টিভিটি বা আত্মগত ধারণা বোধ বিষয়ক এরিজানা’র (১০) লেখা, গ্রেইস বা করুণা, দয়া কিংবা অনুগ্রহ বিষয়ে রাহনার(১১) বা আশার উপর মোল্টম্যান (১২) এর ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনাগুলো বোঝার জন্য সত্যিকারভাবে চেষ্টা করতাম (যেমনটি তিনি অনর্থক আশা করেছিলেন, কাজটি আমি করবো), তাহলে বইটি শুধু ‘অপ্রত্যাশিত বা অবাক করা সর্বাধিক বিক্রীত বইই হতো না, বহু- বিক্রীত হওয়া অলৌকিক একটি বইও হত। কিন্তু প্রসঙ্গটা আসলে ভিন্ন। স্টিফেন হকিং(১৩) এর ব্যতিক্রম ( যিনি বইতে প্রতিটি প্রকাশিত ফরমুলা তার বই বিক্রয় অর্ধেক কমিয়ে দেবে এমন পরামর্শ গ্রহন করেছিলেন) আমি খুব আনন্দের সাথে সর্বাধিক বিক্রিত বই এর খেতাব প্রত্যাখ্যান করতে পারবো, যদি সামান্যতমও আশা থাকতো, ড্যান স্কোটাস, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিনা, আমার এই মৌলিক প্রশ্নটির বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে পারতেন। ধর্মতাত্ত্বিক রচনাগুলোর একটি বিশাল অংশ প্রথমত আগে থেকেই ধরেই নেয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এবং সেখান থেকেই তারা তাদের আলোচনা শুরু করে। সুতরাং আমার প্রয়োজনে আমি শুধু সেই সব ধর্মতাত্ত্বিকদের বিবেচনা করার দরকার মনে করেছি যারা গুরুত্বের সাথে এর বিপরীত সম্ভাবনাটিকে গ্রহন করেছেন এবং যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এর বিপরীতটি, আমি মনে করি এই বইটির অধ্যায় ৩ সেই কাজটি করেছে, যথেষ্ট পরিমান উন্মুক্ত মানসিকতা আর বোধগম্য ব্যাখ্যা এবং অবশ্যই নির্মল রসিকতার সাথে।
আর যখন নির্মল হাস্যরসের উল্লেখ করতে হয়,তখন পি. জে. মায়ার্স(১৪) এর ফ্যারিস্টুলা (১৫) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাঁর Courtier’s reply (বা উজিরের জবাব) এর চেয়ে আরো ভালো কিছু আমি লিখতে পারবো না:
আমি জনাব ডকিন্সের প্রতি আনীত অসন্মানজনক অভিযোগগুলো এ বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতার ঘাটতি দেখে তীব্র হতাশাসহ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছি। তিনি আপাতদৃষ্টিতে সম্রাটের জুতার চামড়ার চমৎকার আর অসাধারণত্ব বিষয়ে কাউন্ট রডরিগো দ্য সেভিইয়া’র বিস্তারিত কোন আলোচনাই পড়েননি। এমনকি তিনি এক মুহূর্ত সময় দেননি বেলিনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ On the luminescence of emperor’s feathered hat গ্রন্থটিকে; বেশ কিছু নিবেদিত প্রাণ লেখক আমাদের মধ্যে আছেন, যারা সম্রাটের পরিচ্ছদের সৌন্দর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সমৃদ্ধ বই লিখেছেন এবং প্রতিটি প্রধান সংবাদপত্র একটি বিশেষ অংশ পুরোপুরি নিবেদন করেছেন সম্রাটের ফ্যাশন সংক্রান্ত বিদগ্ধ আলোচনায়…..। ডকিন্স অত্যন্ত অহংকারের সাথে এই গভীর দার্শনিক আলোচনাকে অস্বীকার করেছেন ও স্কুলভাবে সম্রাটকে তার নগ্নতার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত ডকিন্স প্যারিস আর মিলান এর দোকানে প্রশিক্ষিত না হবেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি ফোলানো আর কুচি দেয়া প্যান্টের মধ্যে পার্থক্য করা শিখতে না পারবেন, আমাদের সবার এমন ভান করা উচিৎ যে, তিনি সম্রাটের নগ্নতা ও তার রুচি নিয়ে কোন কথাই বলেননি। জীববিজ্ঞানে তার প্রশিক্ষন হয়তো তাকে সম্রাটের ঝুলে থাকা যৌনাঙ্গ শনাক্ত করার যোগ্যতা দিয়েছে যখন তিনি তা চাক্ষুষ দেখতে পেরেছিলেন, কিন্তু কিভাবে কাল্পনিক কাপড় সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হয় সেই প্রশিক্ষণ তিনি অবশ্যই পাননি সেখান থেকে (১৬)।
এই প্রসঙ্গটাকে খানিকটা সম্প্রসারিত যদি করি, আমরা কিন্তু সবাই মোটামুটি ফেয়ারী বা বাগানের পরী, জ্যোতিষবিদ্যা, উড়ন্ত স্প্যাগেটি দানবের অস্তিত্ব আনন্দের সাথে অস্বীকার করি, আমাদের কিন্তু সেই সংক্রান্ত কোনো বই, যেমন ধরুন পাসতাফারিয়ার ধর্মতত্ত্ব (১৭) ইত্যাদি, গভীরভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন পড়ে না।
এর পরের সমালোচনাটিও প্রায় একই রকম: সেই বিখ্যাত ‘স্ট্র ম্যান’ (১৮) যুক্তি নির্ভর আক্রমণ।
আপনি সব সময় ভালো বিষয়গুলো এড়িয়ে ধর্মের খারাপ বিষয়গুলোকে সমালোচনা করেন:
‘আপনি সবসময় ঐসব স্কুল, চিৎকার করে গলা ফাটানো সুযোগসন্ধানী ধর্মব্যবসায়ী যেমন টেড হ্যাঁগার্ড (১৯), জেরী ফলওয়েল (২০) আর প্যাট রবার্টসনদের (২১) মত মানুষদের সমালোচনা করেন শুধু শিক্ষিত, সভ্য ধর্মতাত্ত্বিক যেমন টিলিখ(২২) বা বনহোয়েফারের (২৩) মত মানুষদের বাদ দিয়ে, তারা যে ধর্ম শেখান, আমি তো সেই ধর্মে বিশ্বাস করি।‘
কিন্তু হায়! শুধু যদি এধরনের সংবেদনশীল আর মৃদুপন্থী ধর্মের প্রাধান্য থাকতো এই পৃথিবীতে, কোন সন্দেহ নেই পৃথিবী অপেক্ষাকৃত আরো সুন্দর হতো এবং আমিও অন্য কোন বিষয় নিয়ে বই লিখতাম। অত্যন্ত দুঃখজনক একটি সত্য হচ্ছে এই ধরনের আদৌ উগ্র নয়, সুশীল, সংশোধনবাদী ধর্ম সংখ্যায় অতি নগন্য। বিশ্বব্যাপী একটি বিশাল সংখ্যক বিশ্বাসীদের কাছে ধর্ম হচ্ছে যা আপনারা হ্যাঁগার্ড, ফলওয়েল, রবার্টসনের, ওসামা বিন লাদেন বা আয়াতোল্লাহ খোমেনির মত মানুষদের মুখে শুনে থাকেন। এরা কোন মামুলী কাকতাড়ুয়া মানুষ নয়, তাদের যথেষ্ট প্রভাব আছে। এবং আধুনিক বিশ্বে সবাইকে এধরনের লোকদের সাথে বোঝাঁপড়া করতে হচ্ছে সবসময়।
আমি একজন নিরীশ্বরবাদী, তবে আপনার মত তীক্ষ্মস্বরের কর্কশ, অসহিষ্ণু, নিয়ন্ত্রণহীন, ভর্ৎসনাপূর্ণ ভাষা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই:
আসলেই আপনি যদি ‘দ্য গড ডিলুশন’ এর ভাষা লক্ষ করেন, সাধারণত যেধরনের ভাষার মুখোমুখি আমরা হয়ে থাকি তার চেয়ে এটি বরং অনেক কম কর্কশ কিংবা লাগাম ছাড়া, যেমন ভাষা আমরা হরহামেশাই দেখি কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষায় বা থিয়েটার, শিল্পকলা কিংবা বই সমালোচকদের ভাষায়। আমি নীচে সাম্প্রতিক কিছু সংবাদপত্র থেকে বাছাই করে কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট সমালোচনার ভাষার উদাহরণ দিচ্ছি ব্যপারাটিকে বোধগম্য করার জন্য:
‘খুবই কঠিন, যদিও একেবারে অসম্ভব না, কারো পক্ষে এমন একটি রেস্টুরেন্ট কল্পনা করা, এমন কি ঘুমের মধ্যেও, যার বিশেষত্বহীন খাদ্য প্রায় অখাদ্যের পর্যায়ে পড়ে।
‘সবকিছু বিবেচনা করার পর অনায়াসে বলা যায় এটি লন্ডনের সবচেয়ে খারাপ রেষ্টুরেন্ট, হয়তো সারা বিশ্বে ..যেখানে জঘন্যতম খাবার পরিবেশন করা হয় প্রতিহিংসার সাথে এমন একটা কক্ষে, যা ১৯৭৬ সালের ইতালীয় কোন ওয়েটারের রুচিবোধের কাছেও মিউজিয়ামের মত মনে হতে পারে।
‘আমার জীবনে এর চেয়ে খারাপ খাওয়ার সুযোগ হয়নি। খুব সামান্য মাপে না, আমি আসলেই বোঝাতে চাইছি, সবচেয়ে খারাপ, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জঘন্য।
‘(যা) দেখতে ক্ষুদ্রাকার কোনো সামুদ্রিক খনি, আমার জীবনে স্বাদ নেয়া সবচেয়ে জঘন্য জিনিস, যা আমার শৈশবে কেঁচো খাওয়ার স্বাদকেও হার মানায়।’
এই ধরনের ভাষার তুলনায় ‘দ্য গড ডিলুশন’ বইয়ে ব্যবহৃত সবচেয়ে কর্কশতম ভাষাও আসলেই অনেক পোষ মানানো, মৃদুভাবাপন্ন, যদি সেটাকেও কারো অসহিষ্ণু মনে হয়, তাহলে সেজন্য দায়ী, প্রায় বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত (ডগলাস অ্যাডামসের এ বিষয়ে উদ্ধতিটি লক্ষ করুন প্রথম অধ্যায়ে) যে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে সবসময়ই বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন রাখতে হবে, যা কিনা যে কোন ধরনের সমালোচনার উর্ধে। কোনো একটা রেষ্টুরেন্টকে অপমান করা আসলেই অতি তুচ্ছ মনে হয় ঈশ্বরকে অপমান করার তুলনায়। কিন্তু রেষ্টুরেন্ট বা সেখানে কর্মরত শেফদের কিন্তু বাস্তব অস্তিত্ব আছে এবং তাদের অনুভূতি আছে, যেখানে আঘাত লাগতে পারে। অন্যদিকে ব্লাসফেমী বা ধর্মনিন্দা হচ্ছে, একটি বুদ্ধিদ্বীপ্ত বাম্পার স্টিকার যেমন বলে, ‘ভিক্টিম বা শিকারহীন একটি অপরাধ।
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সংসদ সদস্য হোরেশিও বটোমলী যেমন প্রস্তাব করেছিলেন, যুদ্ধের পর (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ), আপনি যদি কোনদিন লক্ষ করেন যে, রেষ্টুরেন্টে আপনার খাবার পরিবেশন করছে কোনো জার্মান পরিবেশক, আপনি তার কুৎসিত মুখের দিকে স্যুপ ছুঁড়ে মারবেন। আপনি যদি লক্ষ করেন কোন জার্মান কেরানীর পাশে আপনি বসে আছেন, আপনি তার কুৎসিত মাথার উপর কালির পট উল্টো করে ঢেলে দেবেন।… বেশ এটাই হচ্ছে কর্কশ আর অসহিষ্ণুতার ভাষা (এবং আমার ভাবা উচিৎ ছিল, এমন কি তার সেই সময়ে এই কথাগুলো হাস্যকরও ছিল, কোন কাজে আসেনি); এর সাথে অধ্যায় ২ এর শুরুর পংক্তিটার বৈপরিত্যটা খেয়াল করুন। যে অনুচ্ছেদটিকে তীব্র হিংসাত্মক, কঠোর আর তীব্র অপমানজনক হিসাবে প্রায়ই উদাহরণ দেয়া হচ্ছে। আমার পক্ষে বলা ঠিক না আমি কতটুকু সফল হয়েছি তীক্ষ্ম তীব্রতার সাথে কোনো বাক্যবান ছোঁড়ার বদলে বরং পাকাঁপোক্ত ভাষায় আর হাস্যকৌতুকের সাথে আমার মূল বক্তব্যটাকে তুলে ধরবার প্রয়াসে। কোন উন্মুক্ত সভায় জনসাধারণের জন্য ‘দ্য গড ডিল্যুশন’ থেকে পাঠ করার সময় অবধারিত ভাবে এই অনুচ্ছেদটি শ্রোতাদের হাস্যরসের কারণ হয়। সে কারণে আমি এবং আমার স্ত্রী এই অনুচ্ছেদটা ব্যবহার করি নতুন শ্রোতাদের সাথে প্রাথমিক শীতলতা কাটাতে। আমি যদি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করি কেন এই হাস্যরস কাজ করে, আমার মনে হয় এটি মানানসই একটি সম্পর্কর কারণে, এর মূল বিষয়টি, যা তীব্র সমালোচনা পূর্ণ কর্কশ ভাষায় আরো কুৎসিতভাবে প্রকাশ করা যেত অথচ সেখানে সত্যিকারভাবে ল্যাটিনীয় ছদ্মবিজ্ঞতার নানা শব্দ ব্যবহার করে এই দীর্ঘ তালিকা তৈরী করা হয়েছে (যেমন Filicidial, Megalomaniacal, Pestilential); এখানে আমার মডেল হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা রসিক লেখক ইভলীন ওয়াহ (২৪), কেউই যাকে কর্কশ আর তীব্রভাষা ব্যবহারের অপবাদ দিতে পারবে না (আমি এমনকি তার নামও প্রকাশ করে দিয়েছি এর পরের অনুচ্ছেদে একটি ঘটনার বিবরণ দিতে যেয়ে)।
কোনো বই কিংবা থিয়েটার সমালোচকরা খুবই ব্যঙ্গাত্মকভাবে নেতিবাচক হতে পারেন এবং তাদের সেই সব ব্যবচ্ছেদ করা সমালোচনার জন্য তাদের বেশ প্রশংসাও জোটে। কিন্তু যখনই ধর্মের সমালোচনা করা হয়, তখন সেখানে এমনকি সুস্পষ্ট যৌক্তিকতা ও স্বচ্ছতা কোনো ভালো গুন হিসাবে বিবেচ্য হয়না এবং আক্রমণাত্মক আর শত্রুভাবাপন্ন বিদ্বেষপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। একজন রাজনীতিবিদ তার প্রতিপক্ষকে নির্দয়ভাবে সমালোচনা করতে পারেন আক্রমণাত্মক ভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে এবং তার এই দৃঢ় আক্রমণ আর হিংস্র ভাষার জন্য তিনি তার সহকর্মীদের স্বশব্দ সমর্থন আর উৎসাহ পান। কিন্তু কোন ভদ্র যৌক্তিক ধর্মের সমালোচককে সেই কথাগুলো বলতে দিন, যা কিনা অন্য কোনো প্রসঙ্গে বিবেচিত হতে শুধু সরাসরি কিংবা স্পষ্টবাদী হিসাবে, সেটাই এ ক্ষেত্রে বর্ণিত হবে আক্রমণাত্মক অসহিষ্ণু ভাষা হিসাবে। ভদ্র সমাজ ছি ছি করবে আর তাদের মাথা ঝাঁকাবে; এমনকি ভদ্র, সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ তারাও, বিশেষ করে সেকুলার সমাজের সেই অংশ যারা কিনা ভালোবাসেন বলতে.. ‘আমি নিরীশ্বরবাদী.. কিন্তু…।
আপনি কেবল সমমনা মানুষেদের কাছে তাদের জানা কথাই প্রচার করছেন, এর কি কোন অর্থ আছে?
শুধুমাত্র RichardDawkins.net এর convert’s corner, এই দাবীটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। কিন্তু যদি প্রশ্নটি কেবল প্রশ্নের স্বার্থে গ্রহনও করা হয়, সেক্ষেত্রে এর উত্তরে বেশ কিছু বলার আছে। একটি হচ্ছে ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের সংখ্যা কিন্তু অনেক বিশাল, অনেকেই সাধারণত যা মনে করে থাকেন, তার চেয়েও অনেক বেশী। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু আবারো, বিশেষ করে, এই যুক্তরাষ্ট্রে এই অবিশ্বাসীরা হচ্ছে মূলত লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাসী, এবং তাদের বের করে আনার জন্য খানিকটা উৎসাহর একান্ত প্রয়োজন, বিশেষ করে বই স্বাক্ষর দেবার অনুষ্ঠান নিয়ে উত্তর আমেরিকা ভ্রমনের সময় নানা জায়গা থেকে পাওয়া ধন্যবাদের পরিমান দেখে তা সহজে অনুমেয়। স্যাম হ্যারিস (২৫), ড্যান ডেনেট (২), ক্রিষ্টোফার হিচেন্স (২৭) এবং আমি এধরনের মানুষগুলোকে যেভাবে উৎসাহ যোগানোর সুযোগ পেয়েছি, তার জন্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতাও পেয়েছি প্রচুর।
সমমনা মানুষদের গ্রুপের কাছে এই কথা প্রচার করার আরো একটি সূক্ষ্ম কারণ হচ্ছে, তাদের সচেতনতার স্তরটি বাড়ানোর প্রয়োজন। যখন নারীবাদীরা আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল সব লিঙ্গবৈষম্যমূলক সর্বনামগুলো ব্যবহারের ব্যপারে, তারাও তখন তাদের প্রস্তাবের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের কাছে তাদের মতামত প্রকাশ করেছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু নারী অধিকার, এবং তাদের প্রতি বৈষম্যের কুফলগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে, কিন্তু সেই সুশীল সমাজের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল তাদের দৈনন্দিন ভাষায়। আমরা যতই দৃঢ় সংকল্প হইনা কেন, অধিকার আর বৈষম্য বিষয়ে নৈতিক অবস্থানে, তারপরও আমরা ভাষার শব্দগত ব্যবহারে সেই বৃত্তেই বন্দী থাকি, যেখানে মানব জাতির অর্ধেক অংশ অনুভব করেছিল তারা বঞ্চিত।
পুরুষবাদী সর্বনাম ছাড়া আরো ভাষাগত অন্যান্য কিছু প্রচলিত ব্যবহার আছে এবং সেখানে নিরীশ্বরবাদীরাও বাদ পড়েন না। আমাদের সবারই প্রয়োজন আছে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য। নিরীশ্বরবাদী এবং বিশ্বাসীরা উভয়ই অবচেতনভাবেই সমাজের প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করেন, যার ফলে নম আর শ্রদ্ধার সাথে আমরা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আচরণ করে থাকি। এবং আমি কখনোই ক্লান্ত হবে না সেই বিশেষ ক্ষেত্রে, যেখানে সমাজের নীরব সম্মতি, যা শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের পিতা-মাতার ধর্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। আর অবিশ্বাসীদের এই অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠতে হবে: ধর্মীয় মতামত হচ্ছে পিতামাতার এক ধরনের মতামত • প্রায় সর্বজনীনভাবে যা স্বীকৃত– যা কিনা শিশুদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়, যারা সত্যিকারভাবেই বয়সে এত ছোট যে তাদের নিজের মতামত কি সেটাই তারা জানে না বা বোঝে না। খ্রিষ্টান শিশু বলে কিছু নেই: আছে শুধু খ্রিষ্টান বাবা ও মায়ের সন্তান। যখনই সুযোগ পান, বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করুন।
আপনি যাদের সমালোচনা করছেন, আপনি কিন্তু ঠিক তাদের মতই মৌলবাদী:
মোটেও না, দয়া করে এমন তুলনা করবেন না, কোনো বিষয়ের প্রতি সত্যিকারের তীব্র আবেগময় আগ্রহ যা কিনা পরিবর্তন হতে পারে, তার সাথে মৌলবাদের তুলনা করে খুব সহজে ভুল করা হয়, যা কখনোই তার মত বদলায় না। গোঁড়া মৌলবাদী খ্রিষ্টানরা বিবর্তনের ধারণাটির ঘোর বিরোধী, আমি যেমন এর ঘোর সমর্থক। আমাদের এই ক্ষেত্রে প্রায় একই অবস্থান, এবং সেটাই অনেকের মতে আমরা সমানভাবে মৌলবাদী এমন একটি ধারণার জন্ম দেয়। কিন্তু একটি প্রবাদ বাক্য দিয়ে যদি বিষয়টি বোঝাতে চাই (যদিও প্রবাদ বাক্যটির মূল উৎস আমি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি), তা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি মতের দৃষ্টিভঙ্গি যখন একই দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করা হয়, তখন সত্যকে এর মাঝামাঝি কোন অবস্থানে থাকতে হবে এমন কোন আবশ্যিকতা নেই। খুবই সম্ভব এর কোনো একটি ভুল, আর এটি অন্যপক্ষের তীব্র আবেগময় অবস্থানের যথার্থতার জন্য যথেষ্ট।
মৌলবাদীরা জানেন তারা কি বিশ্বাস করেন এবং তারা এটাও জানেন কোন কিছুই তাদের মন পরিবর্তন করতে পারবে না। এই বইয়ে উল্লেখিত কার্ট ওয়াইজ (২৭) এর একটি উদ্ধৃতি সব বলে দিচ্ছে : ‘সারা মহাবিশ্বের সকল প্রমাণ যদি ক্রিয়েশনিজম বা সৃষ্টিতত্ত্ববাদের বিরুদ্ধেও থাকে, আমি প্রথম তা স্বীকার করবো, কিন্তু তারপরও আমি সৃষ্টিতত্ত্ববাদী থাকবো কারণ ঈশ্বরের নিজের কথা সেটাই ইঙ্গিত করছে, এটাই আমার অবস্থান। বাইবেল নির্ভর মৌলবাদের সাথে একই রকম বিজ্ঞানীদের প্রমাণের জন্য আবেগময় অবস্থানের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটি চিহ্নিত করার বিষয়টি উপর গুরুত্ব আরোপ করা অত্যন্ত প্রয়োজন, আর এর প্রয়োজনীয়তা কখনোই হ্রাস পায়না। মৌলবাদী কার্ট ওয়াইজ দাবী করছেন, মহাবিশ্বের কোন প্রমাণই পারবে না তার মন পরিবর্তন করাতে। একজন সত্যিকারের বিজ্ঞানী, তিনি যতই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করুন না কেন বিবর্তন প্রক্রিয়ার সত্যতার উপর, তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার মন পরিবর্তনের জন্য কোন জিনিসটা জরুরী: সেটা হচ্ছে প্রমাণ। যেমন, জে, বি, এস, হলডেন (২৮) বলেছিলেন, তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিবর্তনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ কি হতে পারে? ‘প্রি-ক্যামব্রিয়ান (২৯) পর্বের শিলাস্তরে খরগোশের জীবাশ্ম। কার্ট ওয়াইজের বিপরীত আমাকে আমার মত করে একটি ম্যানিফেস্টো তৈরী করতে দিন : যদি মহাবিশ্বের সব প্রমাণ সৃষ্টিতত্ত্ববাদের সপক্ষে প্রমাণিত হয়, তা স্বীকার করার জন্য আমি হবো প্রথম ব্যক্তি এবং আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার মন পরিবর্তন করবো। তবে বর্তমানে যে তথ্য আমাদের হাতে আছে, যে প্রমাণ জড়ো করা হয়েছে (এবং তার পরিমান বিশাল) সেগুলো বিবর্তনের সপক্ষে। এবং এই কারণে, শুধু এই কারণে আমি বিবর্তনের সপক্ষে এত আবেগের সাথে তর্ক করি, সেই আবেগ যারা এর বিপক্ষে তর্ক করেন তাদের কাছে তীব্র আবেগের মত মনে হয়। আমার এই অবস্থান প্রমাণের উপর ভিত্তি করে, আর তাদেরটা প্রমাণের মুখে খুড় কুটোর মতোই উড়ে যায়, সেকারণেই তা সত্যিকারের মৌলবাদী অবস্থান।
আমি নিজে একজন নিরীশ্বরবাদী, তবে ধর্ম কোনদিনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না; সুতরাং এটা মেনে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করুন :
‘আপনি ধর্মকে উপড়ে ফেলতে চান, বেশ চেষ্টা করুন, আপনি ভাবছেন আপনি ধর্মকে উচ্ছেদ করতে পারবেন? কোন গ্রহে আপনি বাস করেন? ধর্ম এর একটি স্থায়ী অংশ, ব্যপারটা মেনে নেবার চেষ্টা করুন। আমি এই সব নেতিবাচক কথা হয়তো সত্যিই হজম করতে পারতাম, যদি কিনা সেগুলো উচ্চারণ করা হতো নিদেনপক্ষে কিছুটা অনুশোচনা বা চিন্তিত স্বরে বরং এই কণ্ঠস্বরগুলো মাঝে মাঝেই উল্লাসময়তায় পরিপূর্ণ। আমি মনে করি না এটি মর্ষকামী। খুব সম্ভবত আমরা আবার একে সেই বিশ্বাসে বিশ্বাস করার ধারণার ছাঁচে ফেলতে পারি। এই মানুষগুলো নিজেরা ধর্ম না মানলেও, তারা অন্য মানুষরা যে ধর্ম মানে এই বিষয়টি ভালোবাসে। এরপর আমি শেষ ধরনের বিরুদ্ধবাদীদের কথায় আসি।
আমি নিজে নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু মানুষের ধর্মের প্রয়োজন আছে :
ধর্মের জায়গায় আপনি তাহলে কি বসাবেন, আপনি কিভাবে শোকাহত মানুষকে সান্ত্বনা দেবেন? আপনি তাদের সেই প্রয়োজন কি দিয়ে পূর্ণ করবেন?
বাহ! নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবার কি অহংবোধ। আমি এবং আপনি অবশ্যই, যথেষ্ট বুদ্ধিমান, যথেষ্ট শিক্ষিত যাদের ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘আম জনতা’, সেই অরওয়েলিয় প্রোলরা (৩০), হাক্সলী’র ডেল্টা (৩১), এপসিলন (৩২) আধা মুখদের শুধু প্রয়োজন আছে ধর্মের। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের একটি বক্তৃতার কথা আমার মনে পড়ছে এবং যেখানে আমি তীব্রভাবে বিজ্ঞানকে অতিসরলীকরণ বা বোধগম্য করার প্রচেষ্টা বা dumbing down এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মন্তব্য করেছিলাম। এবং শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বের সময়ে উপস্থিত দর্শকশ্রোতাদের সারিতে একজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করেন যে, এ ধরনের dumbing down এর প্রয়োজন আছে নারী ও সংখ্যালঘুদের বিজ্ঞানে স্বাগতম জানানোর জন্য। তার কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবেই বলে দিচ্ছিল, তিনি আন্তরিকভাবে নিজেকে আসলেই উদারপন্থী আর প্রগতিশীল বলেই ভাবছেন। আমি শুধু কল্পনা করতে পারি দর্শকের সারিতে থাকা নারী ও সংখ্যালঘুরা এই মন্তব্য শুনে তার সম্বন্ধে কি ভাবতে পারেন।
মানব জাতির সান্ত্বনার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটাতে ফিরে আসি, অবশ্যই এটা সত্যি, কিন্তু মহাবিশ্ব আমাদের সান্ত্বনা দিতে বাধ্য এমন কোনো কিছু ভাবার ব্যপারটা কি খুব ছেলেমানুষী মনে হয়। না? আর অধিকার, আইজাক আজিমভ (৩৩) অপবিজ্ঞানের এধরনের শিশুসুলভ মানসিকতা সংক্রান্ত মন্তব্যটি ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য: ‘অপবিজ্ঞানের প্রতিটি অংশ ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুন এবং আপনি সেখানে নিরাপত্তার একটা চাদর দেখতে পাবেন, পাবেন চোষার উপযোগী একটি বৃদ্ধাঙ্গুল, বা ধরার জন্য কোন মায়ের আচলের প্রান্ত। উপরন্তু আরো যে বিষয়টি বিস্ময়কর, সেটি হচ্ছে কত অগণিত মানুষ বুঝতে পারেন না যে, ‘ক’ মনে। শান্তি দেয়, সান্ত্বনা দেয়’ ঠিক আছে, তবে এর মানে ‘ক’ সত্য তা কিন্তু নয়।।
একই ধরনের একটি আবদার দাবী করে জীবনের একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে’র প্রয়োজনীয়তার উপর। কানাডীয় এক সমালোচকের মন্তব্যকে উল্লেখ করা যেতে পারে:
‘নিরীশ্বরবাদীরা হয়তো সঠিক হতে পারেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যপারে, কে বলতে পারে তা? কিন্তু ঈশ্বর থাকুক বা না থাকুক, এটা তো স্পষ্ট যে মানুষের আত্মার প্রয়োজন আছে এমন একটি বিশ্বাসের, যে আমাদের জীবনের একটি অর্থ আছে যা বস্তুবাদী বাস্তব জগতকেও অতীন্দ্রিয় একটি অনুভূতিতে স্পর্শ করে। যে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, আপনার চেয়ে-যুক্তবাদী কোন অভিজ্ঞতাবাদী, যেমন ডকিন্স হয়তো মানব চরিত্রের এই অপরিবর্তনযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি বুঝতে পারবেন… আসলেই কি ডকিন্স মনে করেন যে এই পৃথিবী আরো বেশী মানবিক স্থান হবে যদি আমরা সবাই বাইবেল-এর পরিবর্তে ‘দ্য গড ডিল্যুশন’ এর প্রতি দৃষ্টি দেই সত্য, সান্ত্বনা আর শান্তির জন্য।
আসলেই হ্যাঁ, যেহেতু আপনি ‘মানবিক’ কথাটা উল্লেখ করেছেন। হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি, কিন্তু আমি আবারো বলছি, আরো একবার, কোনো একটি বিশ্বাসের সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা তার সত্যি হবার গুণাবলী বৃদ্ধি করেনা। অবশ্যই আমি অস্বীকার করছি না যে, মানসিক সান্ত্বনার কোনো প্রয়োজন নেই। এবং আমি দাবী করতে পারিনা যে, বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমি এই বইটিতে প্রকাশ করেছি তা হয়তো কোন শোকার্তকে মাঝারী মাত্রার চেয়ে বেশী কোন সান্তনা দিতে পারে। কিন্তু যদি ধর্ম যে সান্ত্বনার বাণী দিচ্ছে তা যদি হয় স্নায়ু-বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব কোনো একটি প্রস্তাব, যেমন, আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হলেও আমরা আসলে বেঁচে থাকি, সেটা কি আপনি আসলেই আমাকে সমর্থন করতে বলছেন? যাই হোক, আমার মনে হয়না কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে এমন কারো সাথে আমার কখনো দেখা হয়েছে যিনি স্বীকার করেননি মূল প্রার্থনার চেয়ে ধর্মীয় নয় এমন অংশগুলো যেমন, স্মৃতিচারণ, স্তুতিবাক্য পাঠ বা মৃত ব্যক্তির প্রিয় কবিতা পাঠ বা সঙ্গীত বাজানো, অনেক বেশী আবেগময় আর হৃদয়স্পর্শী।
‘দ্য গড ডিল্যুশন’ পড়ার পর, ডেভিড অ্যাশটন, একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক, ২০০৬ এর বড় দিনে তার সতেরো বছরের ছেলে লুকের আকস্মিক মৃত্যুর বিষয়ে আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। লুকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তারা দুজনে যুক্তি এবং বিজ্ঞানকে উৎসাহ দেবার জন্য আমার শুরু করা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে প্রশংসাসূচক আলোচনা করেছিলেন। আইলে অব ম্যান (৩৪) এ লুকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে, তার বাবা উপস্থিত সবাইকে প্রস্তাব করেছিলেন, যদি তারা কেউ কোনোভাবে লক এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কিছু দান করতে চান, তারা যেন সেটি রিচার্ড ডকিন্সের ফাউণ্ডেশনে অনুদান হিসাবে পাঠিয়ে দেন, যা লুক নিজেও চাইতো। প্রায় ২০০০ পাউণ্ডের প্রায় ৩০ টি চেক আমি পেয়েছিলাম, যার মধ্যে ৬০০ পাউন্ডের একটি চেক ছিল স্থানীয় পানশালায় ভোলা একটি চাঁদারও। কোন সন্দেহ নেই ছেলেটিকে সবাই ভালোবাসতো। যখন আমি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ধারাবিবরণী পড়েছি, আক্ষরিক অর্থেই আমি কেঁদেছিলাম ( যদিও কোনদিনও লুকের সাথে আমার দেখা হয়নি) এবং আমি সেটিকে richarddawkins.net সাইটে প্রকাশ করার জন্যে অনুমতি চেয়েছিলাম। একজন বংশীবাদক তার বাশীতে বাজাচ্ছেন ম্যাঙ্গস (৩৫) দুঃখ প্রলাপ, এলেন ভানিন (৩৬) এর সুর,যার আবহে দুই বন্ধু পাঠ করছে স্তুতি কাব্য, ডাঃ অ্যাশটন নিজেও আবৃত্তি করেছেন ডিল্যান টমাস (৩৭) এর সুন্দর কবিতা ‘ফার্ন হিল’ (Now as I was young and easy, under the apple boughs—অসময়ে হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যের প্রতি হৃদয়স্পর্শী শব্দমালা) এবং তারপর আমার আবেগে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলতে যে, তিনি আমার ‘আনউইভিং দি রেইনবো’ (৩৮) বইটির শুরুর অনুচ্ছেদটি পাঠ করেছিলেন, যে পংক্তিগুলোকে আমি আমার নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পাঠ করা হবে বলে চিহ্নিত করে রেখেছি।
অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে, তবে আমার সন্দেহ অনেক মানুষের এভাবে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকার কারণ কিন্তু ধর্মের সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতার জন্য না বরং আসলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের বঞ্চিত করেছে এবং তাদের ধারণাই নেই যে অবিশ্বাস করাটাও কোন একটি উপায় হতে পারে। এটি অবশ্যই সত্যি বহু মানুষের জন্য যারা মনে করেন তারা আসলেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদী। তাদেরকে আসলেই কোনদিনও ভালোভাবে ডারউইনের দুর্দান্ত বিস্ময়কর বিকল্পটি শেখানোই হয়নি। সম্ভবত একই ভাবে এটি সত্য সেই অপমানজনক মিথ বা লোককথাটির ক্ষেত্রেও, যা দাবী করে মানুষের ধর্ম প্রয়োজন। ২০০৬ সালে একটি কনফারেন্সে একজন নৃতত্ত্ববিদ ( একটি আমি নিজে নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু….. এর চমৎকার নমুনা), গোল্ড মেয়ার (৩৯) এর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন, যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কিনা, তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন: ‘আমি ইহুদী জনগনকে ভালোবাসি, আর ইহুদী জনগন ঈশ্বরকে ভালোবাসে। এরপর আমাদের সেই নৃতত্ত্ববিদ সেখানে তার নিজের সংস্করণ তৈরী করে বলেন: ‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি, আর মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে। আর আমি যা বলতে চাইবো তা হলো, ‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি এবং প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে, তাদের যদি নিজেদের মাথা খাঁটিয়ে চিন্তা করার মত প্রয়োজনীয় তথ্য যা বর্তমানে আমাদের কাছে আছে তা দিতে পারি, প্রায়শই আমরা দেখবো তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেই পরিপূর্ণ আর সন্তুষ্টির জীবন কাটাচ্ছে, যা– আসলেই– ‘মুক্ত’ একটি জীবন।
এই নতুন পেপারব্যাক সংস্করণে আমি কিছুটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও কিছু ছোটখাট ভুল সংশোধন করার সুযোগ নিয়েছি যেগুলোর প্রতি আগের শক্ত বাধাই সংস্করণের পাঠকেরা অনুগ্রহ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
পাদটীকা:
(১) http://www.amazon.co.uk/
(২) ড্যানিয়েল ক্লেমেন্ট ডেনেট (৩য়) ( জন্ম মার্চ ২৮,১৯৪২) যুক্তরাষ্ট্রের একজন দার্শনিক, লেখক এবং কগনিটিভ বিজ্ঞানী। ড্যান ডেনেট এর গবেষণার ক্ষেত্র মনোজগতের দর্শন, বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের দর্শন।
(৩) নাস্তিবাদী বা নিহিলিজম হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রচলিত,ধ্যান ধারণা, নৈতিকতা, বিশ্বাস সবকিছুকে অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়।
(৪) ক্লাইভ স্টেপলস লিউইস (১৮৯৮-১৯৬৩), যিনি পরিচিত সি. এস, লিউইস নামে; উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে জন্ম নেয়া কবি, ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, সখের ধর্মতাত্ত্বিক এবং খ্রিষ্ট ধর্ম সমর্থনবাদী।
(৫) অ্যানথনী ক্লিফোর্ড ( এ সি) গ্রেলিঙ (জন্ম ১৯৪৯) ব্রিটিশ দার্শনিক ও লেখক।
(৬) পল কার্টজ (১৯২৫-২০১২), দার্শনিক, আমেরিকার সুপরিচিত সন্দেহবাদী বা স্কেপটিকস ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী। তাকে সেকুলার হিউমানিজম এর জনক হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে।
(৭) স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ( জন্ম ১৯৩৩) আমেরিকার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক। আব্দুস সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশোর সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে।
(৮) থমাস অ্যাকোয়াইনাস (১২২৫-১২৭৪), ইতালীয় যাজক, অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক।
(৯) জন ডানস স্টোটাস (১২৬৬-১৩০৮) উত্তর মধ্যযুগের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক।। (১০) ইয়োহানেস স্কোটাস ইরিজানা ( ৮১৫ – ৮৭৭) আইরিশ ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক।
(১১) কার্ল রাহনার, জার্মান জেসুইট যাজক এবং ধর্মতাত্ত্বিক, যাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিক মনে করা হয়।
(১২) হুরগেন মোল্টমান (জন্ম ১৯২৬) জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক, আধুনিক ধর্মতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
(১৩) স্টিফেন উইলিয়াম হকিং (জন্ম ১৯৪২) ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, কসমোলজিষ্ট।
(১৪) পল যাকারী ( পি যি) মায়ারস (জন্ম ১৯৫৭), জীববিজ্ঞানী এবং ফ্যারিঙ্গুলা বিজ্ঞান ব্লগের প্রতিষ্ঠা।
(১৫) http://freethoughtblogs.com/pharyngula/
(১৬) http://scienceblogs.com/pharyngula/2006/12/24/the courtiers-reply/
(১৭) ফ্লাইং স্প্যাগেটি মনষ্টার বা উড়ন্ত স্প্যাগেটি দানব হচ্ছে চার্চ অফ দি ফ্লাইং স্প্যাগেটি মনস্টার বা পাসটাফারিয়ানিজম ধর্মের মূল দেবতা। এই আন্দোলনটি মূলত পাবলিক স্কুলে সৃষ্টিতত্ত্ববাদ বা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন (বিশ্বের সব কিছু সৃষ্টি করেছে কোনো বুদ্ধিমান সত্তা এমন মতবাদ) পড়ানোর বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন যা ধর্মকে উপহাস করে, যদিও এই ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের সত্যিকারের ধর্ম মনে করেন, কিন্তু গণমাধ্যমে এটি দেখা হয় মূলত একটি প্যারোডী ধর্ম হিসাবে। ২০০৫ সালে ক্যানসাস স্কুল বোর্ডের কাছে লেখা ববি হেনডারসনের লেখা প্রহসন মূলক চিঠিতে প্রথম ফ্লাইং স্প্যাগেটি মনষ্টারের বিষয়টি প্রথম উল্লেখিত হয়েছিল।
(১৮) একটি স্ট্র ম্যান বা straw man বা straw person কিংবা যুক্তরাজ্যে Aunt Sally যুক্তি হচ্ছে বিতর্কে ব্যবহৃত হয় এমন এক ধরনের যুক্তি এবং এক ধরনের ভ্রান্ত যুক্তি যা প্রতিপক্ষের অবস্থানকে প্রথমে ভুল ভাবে উপস্থাপন করে, এবং যখন বলা হয় to attack a straw man সেটা হচ্ছে আসলে একটি প্রস্তাব বা যুক্তিকে খণ্ডন করা হয়েছে বলে এমন একটি বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়। যেখানে মূল যুক্তিটির অনুরুপ কোনো যুক্তি যা মূল যুক্তির মত মনে হলেও সমতুল্য না (যেমন straw man, আসল মানুষের বদলে) এমন কোনো যুক্তি দিয়ে তা প্রথমে প্রতিস্থাপিত করা হয় এবং পরে সেই যুক্তিটিকেই খণ্ডন করা হয়, মূল যুক্তিটিকে পাশ কাটিয়ে; সাধারণত প্রকাশ্য গণবিতর্কে প্রায়ই স্ট্র ম্যান যুক্তির আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। যেমন: একটি কাল্পনিক মাদক বিরোধী বিতর্ক দেখা যাক:
ক, আমাদের বিয়ার পানের উপর আরোপিত আইনগুলো শিথিল করা উচিৎ
খ. না, যে সমাজে মদ জাতীয় তরলের ব্যবহার করার উপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে কোন কাজের নীতি বলে কিছু থাকে না, সেই সমাজে সাময়িক তৃপ্তি নিবারণ ছাড়া আর কিছু থাকে না।
এখানে মূল প্রস্তাবটি হচ্ছে বিয়ার পানের উপর আইন শিথিল করা, কিন্তু ‘খ’ এই প্রস্তাবটি যা না তার চেয়ে বেশী বাড়িয়ে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, সেখানে এই প্রস্তাবটি সমর্থন দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যেমন: কোন বাধাহীনভাবে মদ্য জাতীয় তরল পানের সুযোগ। এটাই যৌক্তিক ভ্রান্তি, কারণ ‘ক’ কিন্তু কখনোই এই দাবী করেনি।
(১৯) টেড আর্থার হ্যাঁগার্ড (জন্ম ১৯৫৬), আমেরিকার একজন ইভানজেলিকাল যাজক, নিউ লাইফ চার্চ, কলোরাডো, ডেনভার এর প্রতিষ্ঠাতা।
(২০) জন লেমন ফলওয়োল সিনিয়র ( ১৯৩৩-২০০৭) আমেরিকার ইভানজেলিকাল যাজক, থমাস রোড ব্যাপ্টিষ্ট চার্চের প্রতিষ্ঠাতা যাজক।
(২১) মারিওন গর্ডন ‘প্যাট’ রবার্টসন (জন্ম ১৯৩০) আমেরিকার মিডিয়া মোগল, যাজক, ক্রিশ্চিয়ান ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্কের এর চেয়ারম্যান।
(২২) পল ইয়োহানেস টিলিখ (১৮৮৬-১৯৬৫) জার্মান আমেরিকান খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মতাত্ত্বিক।
(২৩) ডিয়েট্রিখ বোনহয়েফার (১৯০৬-১৯৪৫) জার্মান যাজক, ধর্মতাত্ত্বিক, যিনি নাৎসিবাদের বিরোধী ছিলেন, কনফেশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে হত্যা করে নাৎসীরা।
(২৪) আর্থার ইভলিন সেইন্ট জন ওয়াহ (১৯০৩-১৯৬৬), পরিচিত ইভলিন ওয়াহ হিসাবে, ইংরেজ লেখক, সাংবাদিক ও সমালোচক।
(২৫) স্যামুয়েল বি.’স্যাম’ হ্যারিস (জন্ম ১৯৬৭) আমেরিকার দার্শনিক, লেখক, স্নায়ুবিজ্ঞানী। সুপরিচিত পডকাস্ট ওয়েকিং আপ এর প্রতিষ্ঠাতা।
(২৬) ক্রিষ্টোফার এরিক হিচেন্স ( ১৯৪৯-২০১১) ব্রিটিশ আমেরিকান লেখক, সাংবাদিক, বিতার্কিক।
(২৭) কার্ট প্যট্রিক ওয়াইজ, হার্ভার্ড প্রশিক্ষিত ভূতাত্ত্বিক যিনি ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিষ্ট (যারা পৃথিবীর বয়স বাইবেলে জেনেসিসে বর্ণিত বয়সের সমান হিসাবে বিশ্বাস করেন (৫৭০০-১০,০০০ বছর)।
(২৮) জন বার্টন স্যান্ডারসন হলডেন (১৮৯২-১৯৬৪) ব্রিটিশ জিন বিজ্ঞানী (পরে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহন করেছিলেন), জিনতত্ত্ব, বিবর্তন জীববিজ্ঞানে তার বিশেষ অবদান আছে।
(২৯) প্রিক্যামব্রিয়ান ( অথবা প্রি-ক্যামব্রিয়ান) পৃথিবী ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাসের দীর্ঘতম পর্ব। এটি বিস্তৃত পৃথিবী সৃষ্টি, প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে থেকে ৫৪১ মিলিয়ন বছর আগের ক্যামব্রিয়ান পর্বের সূচনা পর্যন্ত, যে পর্বে শক্ত খোলশ যুক্ত প্রাণিদের প্রথম ব্যাপক হারে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। প্রিক্যামব্রিয়ান পর্ব বলা হয় কারণ এটি ক্যামব্রিয়ান পর্বের আগে, প্রি-ক্যামব্রিয়ান পর্ব মোট ভূ তাত্ত্বিক সময়ের ৮৮ শতাংশ। এই পর্বে কোন স্তন্যপায়ীর প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়।
(৩০) ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল (এরিক আর্থার ব্লেয়ার, ১৯০৩-১৯৫০) এর ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ উপন্যাসে বর্ণিত কাল্পনিক দেশ ওসিয়ানিয়া’র শ্রমিক শ্রেণী।
(৩১) ব্রিটিশ লেখক অ্যালডস লিওনার্ড হাক্সলী’র (১৮৯৪-১৯৬৩) ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে বর্ণিত নিম্ন বর্ণের শ্ৰেণী।
(৩২) হাক্সলী’র ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে বর্ণিত আরো একটি নিম্ন বর্ণ, যারা শুধু মাত্র কায়িক পরিশ্রমের উপযুক্ত।
(৩৩) আইজাক আজিমভ, ১৯২০-১৯৯২, আমেরিকার জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নের অধ্যাপক। তিনি প্রায় ৫০০ র বেশী বই লিখেছিলেন।
(৩৪) গ্রেট ব্রিটেইন ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যবর্তী আইরিশ সাগরে একটি স্বায়ত্বশাসিত দ্বীপ (স্থানীয় ভাবে পরিচিত এলান ভানিন নামে)।
(৩৫) আইলে অব ম্যান এর স্থানীয় ভাষা।
(৩৬) এলেন ভানিন মাঙ্গস ভাষায় এর অর্থ আইল্যান্ড অফ ম্যান, এটি একটি কবিতার শিরোনাম, ১৮৫৪ সালে যেটি লিখেছিলেন Eliza Cravcer Green এবং পরে এর সুর দিয়েছিলেন সম্ভবত J. Townsen 71 F, H. Townend
(৩৭) ডিল্যান টমাস (১৯১৪-১৯৫৩), ওয়েলশ কবি। (Ob) Richard Dawkins (1998). Unweaving the Rainbow: Houghton Mifflin.
(৩৯) গোল্ডা মেয়ার (১৮৯৮-১৯৭৮) ইসরায়েল এর চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী।
.
ভূমিকা
শৈশবে, আমার স্ত্রী তার স্কুল ঘৃণা করতেন এবং সবসময় চাইতেন যদি স্কুল ছেড়ে দেয়া সম্ভব হতো। বহু বছর পর, যখন তার বয়স বিশের কোঠায়, তিনি তার জীবনের এই অসুখী অধ্যায়টির কথা তার বাবা মাকে বলেছিলেন, এবং তার মা রীতিমত হতবাকও হয়েছিলেন। কিন্তু, মা, তুমি কেন আমাদেরকে সেটা আগে বলোনি?” আর লালা’র উত্তর ছিল, আমার আজকের লেখার বিষয়, “কিন্তু আমার তো জানা ছিল না যে, আমি সেটা করতে পারি।
‘আমার তো জানা ছিল না, আমি সেটা করতে পারি।’
আমি সন্দেহ করছি– নাহ, বরং আমি বেশ নিশ্চিভাবেই বলছি, অনেক মানুষ আছেন যারা কোনো না কোনো একটি ধর্মীয় আবহে প্রতিপালিত হয়েছেন এবং সেই বিশ্বাসের আবহে তারা সুখী নন, হয়তো বিশ্বাসই করেন না বা ভাবেন তাদের সেই ধর্মের নামে কত অশুভ হিংস্রাত্মক কর্মকাণ্ড করা হয়েছে। সেই মানুষগুলো তাদের পপরুষদের ধর্ম পরিত্যাগ করার জন্যে হালকা একটি আকাঙ্খা অনুভব করেন এবং ইচ্ছা পোষণ করেন যদি তারা সেটি করতে পারতেন, কিন্তু তারা শুধু একটা জিনিস অনুধাবন করতে পারেন না তা হলো, তাদের সেই ধর্ম পরিত্যাগ করা কিন্তু একটি উপায় হতে পারে। আর আপনি যদি তাদের কেউ হন, তাহলে এই বইটি আপনার জন্য। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই সচেতনতার স্তরটিকে উন্নীত করা; সচেতনতার স্তরটিকে এমনভাবে উন্নীত করা যেন কারো পক্ষে অবিশ্বাসী হওয়াটা একটি বাস্তবসম্মত ইচ্ছা হতে পারে, একটি সাহসী আর চমৎকার ইচ্ছা। আপনি একজন নিরীশ্বরবাদী হতে পারেন, যে কিনা সুখী, ভারসাম্যময়, নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সৎ ও পরিপূর্ণ। এটি হচ্ছে সচেতনা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমার প্রস্তাবিত বার্তাগুলোর প্রথমটি। আমি সচেতনতা বাড়াতে চাই আরো তিনটি উপায়ে, যে বিষয়ে আমি পরে আলোচনা করছি।
জানুয়ারী ২০০৬ এ আমি দুই পর্বের একটি প্রামান্য চিত্র উপস্থাপনা করেছিলাম ব্রিটিশ টেলিভিশনের (চ্যানেল ফোর) জন্যে, যার শিরোনাম ছিল Root of All Evil?, একেবারে শুরু থেকেই শিরোনামটি আমার পছন্দের ছিল না। ধর্ম একাই অশুভ সবকিছুর মূল কারণ না, কোনো একটি জিনিস একাই কোনো কিছুর একমাত্র কারণ হতে পারে না। কিন্তু জাতীয় পত্রিকাগুলোয় চ্যানেল ফোরের সেই অনুষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন দেখে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। সেখানে নিউইয়র্কের ম্যানহাটন স্কাইলাইনের একটি ছবি ছিলো, যার নীচে উপ-শিরোনামে লেখা ছিল, Imagine a world without religion; কিন্তু কি সংযোগ এ দুটির মধ্যে? ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার দুটোই ছবিতে স্পষ্টভাবেই উপস্থিত ছিল।
জন লেননের (১) এর সাথে কল্পনা (Imagine) (২) করুন ধর্ম ছাড়া এমন একটি পৃথিবীর। কল্পনা করুন কোনো আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ছাড়া একটি পৃথিবী, কোন ৯/১১ (৩) বা ৭/৭ (৪) ছাড়া একটি পৃথিবী, কোনো ধর্মযুদ্ধ নেই, কোন উইচ হান্ট বা ডাইনী আখ্যা দিয়ে নিরীহ মানুষ শিকার বা অবিশ্বাসীদের নিপীড়ন নেই, কোনো গোলবারুদের ষড়যন্ত্র নেই, কোনো ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগি নেই, কোনো সার্ব/ক্রোয়াট/মুসলিম গণহত্যা নেই, যীশুর হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করে কোন ইহুদী নিপীড়ন নেই, কোন উত্তর আয়ারল্যাণ্ড সমস্যা নেই, কোনো পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড বা অনার কিলিং নেই, কোনো চকচকে কোট পরা মাথায় ফোলানো চুলসহ টেলিভিশনের উন্মত্ত ধর্মযাজকের দল নেই, যারা বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের মন সহজে ভুলিয়ে তাদের অর্থ শুষে নিচ্ছে (তারা বলেন ঈশ্বর নাকি সবাইকে দিতে বলেছে তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে)। কল্পনা করুন অতি প্রাচীন কোন বৌদ্ধ মুর্তি বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়া তালিবানরা নেই, ধর্মনিন্দার অভিযোগে জনসমক্ষে শিরোচ্ছেদ করা হবে না কারো, নারীর চামড়ায় বেত্রাঘাত হবে না, সেই চামড়ার সামান্য কিছু অংশ প্রদর্শনের অভিযোগে। ঘটনাচক্রে আমার সহকর্মী ডেসমন্ড মরিস(৫) আমাকে জানিয়ে ছিলেন যে, জন লেননের এই অসাধারণ গানটি মাঝে মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে গাওয়া হয় and no religion too বাক্যটিকে বাদ দিয়ে। একটি সংস্করণ এমনকি এই পংক্তিটিকে বদলে and one religion too করার ঔদ্ধত্বও দেখিয়েছে।
হয়তো আপনি মনে করেন অ্যাগনস্টিজম বা অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত অবস্থান আর সেই নাস্তিক্যবাদ তো ধর্মীয় বিশ্বাসের মতই গোঁড়া আরও একটি গোঁড়া মতবাদ? তাই যদি হয়, তাহলে দ্বিতীয় অধ্যায় আপনার মন পরিবর্তন করতে সহায়তা করবে, আপনাকে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করবে যে ঈশ্বর হাইপোথিসিস বা অনুকল্পটি একটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প যা এই মহাজগত সংশ্লিষ্ট, যার বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে একই সন্দেহবাদীতার সাথে, যা আমরা অন্য অনেক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে মনে করি। হয়তো আপনি ভাবছেন বা আপনাকে শেখানো হয়েছে যে, দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিকরা ঈশ্বরের অস্তিতকে বিশ্বাস করার সপক্ষে বহু জোরালো যুক্তি প্রদান করেছেন। আপনিও যদি তা ভেবে থাকেন, হয়তো তৃতীয় অধ্যায়টি আপনি উপভোগ করবেন, সেখানে দেখবেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রস্তাবিত যুক্তিগুলো আসলেই চূড়ান্তভাবে দুর্বল যুক্তি। হয়তো আপনি ভাবছেন এটা অবশ্যম্ভাবী যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, তা না হলে এই পৃথিবী আর সব কিছুই বা আসলো কোথা থেকে? তাছাড়া কিভাবেই বা উৎপত্তি হলো জীবনের.. এর সব সমৃদ্ধতা, বৈচিত্র্যময়তা সহ, যেখানে প্রতিটি প্রজাতিকে দেখলে বিলক্ষণ মনে হয় যে তাদের বিশেষভাবে পরিকল্পনা বা ডিজাইন করে বানানো হয়েছে? যদি আপনার চিন্তা এই ধরনের হয়ে থাকে, আমি আশা করি আপনি চতুর্থ অধ্যায় থেকে বেশ কিছু শিক্ষণীয় বিষয় জানতে পারবেন, যে অধ্যায়ের বিষয়, কেন প্রায় নিশ্চিৎ ভাবে বলা সম্ভব কোনো ঈশ্বর নেই। একজন স্বর্গীয় পরিকল্পকের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ তো দূরের কথা, জীবজগতে ডিজাইন এর বিভ্রমকে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব আরো অনেক কার্যকরী উপায়ে ও বিস্ময়কর সৌন্দর্যের সাথে। আর যখন প্রাকৃতিক নির্বাচন নিজে সীমাবদ্ধ জীব-জগতের বৈচিত্রকে ব্যাখ্যা করতে, এটি আমাদের সচেতনাতার স্তরকে উন্নীত করে সমরুপ ব্যাখ্যার সেই ‘ক্রেইন’(৭) এর স্তরে, যা মহাজগতকে বুঝতে আমাদের সহায়তা করে। এই রুপক ‘ক্রেইন’ এর শক্তি, যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচন, হচ্ছে আমার চারটি সচেতনতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার দ্বিতীয়টি।
হয়তো আপনি মনে করেন অবশ্যই ঈশ্বর বা ঈশ্বরদের প্রয়োজন আছে কারণ নৃতত্ত্ববিদ আর ইতিহাসবিদরা তাদের গবেষণায় প্রকাশ করেছেন যে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরা সব মানব সংস্কৃতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আপনি যদি তা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন, তাহলে পঞ্চম অধ্যায়টি পড়ুন, ধর্মের মূল বা শিকড়, এর উৎপত্তি সংক্রান্ত যে অধ্যায়টি ব্যাখ্যা করেছে, কেন ধর্ম বিশ্বাসের উপস্থিতি সর্বব্যাপী। বা আপনি কি মনে করেন কোনো যুক্তিযুক্ত নৈতিকতাবোধ থাকার জন্য ধর্মীয় বিশ্বাস অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি পূর্বশর্ত? আমাদের কি ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই, ভালো হবার জন্য? তাহলে দয়া করে অধ্যায় ৬ ও ৭ পড়ে দেখুন, কেন বিষয়টি যে তা নয় সেটি বোঝার জন্য। আপনার কি এখনও কিছুটা দুর্বলতা আছে, আপনি কি ভাবেন ধর্ম পৃথিবীর জন্য ভালো, এমন কি যখন আপনি নিজে যখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন এর উপর। অধ্যায় ৮ আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবে এমনভাবে চিন্তা করতে যে, যেখানে ধর্ম আদৌ এই পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু না। আপনি যদি আপনার পূর্বপুরুষদের ধর্মের মধ্যে নিজেকে আটক বলে অনুভব করেন,আমার মনে হয় এর প্রয়োজনীয়তা আছে আপনার নিজেকে প্রশ্ন করা, কেমন করে বিষয়টি ঘটলো। এর উত্তর হলো এটি শৈশবে দীক্ষা নেবার মত একটি ব্যপার। আপনি যদি ধার্মিক হন আদৌ, প্রবলতম সম্ভাবনা আছে যে, আপনার ধর্ম আর আপনার বাবা মার ধর্ম একই। আপনি যদি আরকানসাস এ জন্ম নেন এবং মনে করেন খ্রিষ্টান ধর্ম সত্যি আর ইসলাম মিথ্যা এবং আপনার খুব ভালো ভাবেই জানা আছে আপনি ঠিক এর বিপরীতটাই ভাবতেন যদি আপনার জন্ম হতে আফগানিস্থানে। আপনি শৈশবে ধর্ম দীক্ষার শিকার, শুধু যা পরিবর্তন করা প্রয়োজন এর বিপরীতমুখী চিন্তার জন্য সেটি হলো, আপনি কোথায় কোন পরিবেশে জন্ম নিয়েছেন।
শৈশবে ধর্মের দীক্ষা দেবার পুরো ব্যপারটাই অধ্যায় ৯ এর মূল বিষয়, যা আমার তৃতীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করার উপাদান। ঠিক যেভাবে নারীবাদীরা নড়ে চড়ে বসেন যখন তারা He শোনেন ‘He অথবা She’ একসাথে শোনার বদলে বা Human এর বদলে শুধু men; আমি আশা করি সবাই যেন ঠিক একই ভাবে বিব্রত বোধ করেন যখনই আমরা এমন কোন বাক্য শুনি যেমন ‘ Catholic child বা Muslim child’ (ক্যাথলিক’ শিশু বা মুসলিম শিশু) বরং আপনি চাইলে বলতে পারেন, ক্যাথলিক পিতা মাতার সন্তান। কিন্তু যদি আপনি কখনো শোনেন যে কেউ কোনো ‘ক্যাথলিক’ শিশুর কথা বলছেন, তাদের বিনয়ের সাথে বাধা দিন এবং বলুন শিশুদের কারোরই বোঝার মত এমন কোন বয়স হয়নি যে তারা এ বিষয়ে মতামত দিতে পারে, ঠিক যেমন করে অর্থনীতি বা রাজনীতির কোন বিষয়ে তাদের পক্ষে মতামত দেয়া সম্ভব না। এবং সুনির্দিষ্টভাবে যেহেতু আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সচেতনতার স্তরকে উন্নীত করা আমি তাই আদৌ ক্ষমাপ্রার্থনা করবো না বিষয়টি ভুমিকাতে উল্লেখ করার জন্য, এবং অবশ্যই নবম অধ্যায়ে তো বটেই। বিষয়টি বার বার বললেও কম হয়, আমি আবার বলতে চাই। যে কোন মুসলিম শিশু না, বরং মুসলিম পিতামাতার শিশু। শিশুটি বয়সে নিঃসন্দেহে অপরিপক্ক তার ধর্ম বোঝার জন্য, সে কি মুসলিম বা অন্য কিছু। মুসলিম শিশু বলে কিছু নেই, যেমন খ্রিষ্টান শিশু বলে এমন কোন কিছু নেই।
অধ্যায় ১ ও ১০, এই বইয়ের শুরু আর শেষে ব্যাখ্যা আছে, ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে, কিভাবে অসাধারণ এই বাস্তব পৃথিবী সম্বন্ধে প্রকৃত বোধটি পারে– কখনই ধর্মে রুপান্তরিত না হয়ে– অনুপ্রেরণার সেই শূন্যস্থানটি পূর্ণ করার দ্বায়িত্ব পালন করতে যা ঐতিহাসিক আর অপ্রতূলভাবে ধর্ম পালন আত্মসাৎ করে এসেছে।
চতুর্থ সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টাটি হচ্ছে অ্যাথিষ্ট প্রাইড বা নিরীশ্বরবাদীদের গর্ব। অবিশ্বাসী হবার কারণে জবাবদিহি বা ক্ষমা চাইবার কোন কারণ নেই, বরং এর বিপরীত, বিষয়টি নিয়ে গর্ব করা উচিৎ, বহু দূরের প্রশস্ত দিগন্তর দিকে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর মত, কারণ নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ, প্রায় সবসময়ই ইঙ্গিত করে মনের একটি স্বাস্থ্যকর স্বাধীনতার এবং আসলেই একটি সুস্থ মনের। অনেক মানুষই আছেন যারা জানেন যে তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তারা আসলে অবিশ্বাসী, কিন্তু তারা তাদের পরিবারের কাছে তা স্বীকার করতে সাহস পান না, এমন কি নিজেদের কাছেও না। কারণ নাস্তিক শব্দটাকেই ধীরে ধীরে খুবই চেষ্টার সাথে গড়ে তোলা হয়েছে ভয়ঙ্কর এবং ভীতিকর একটি শনাক্তকারী চিহ্ন বা লেবেল হিসাবে। অধ্যায় ৯ এ যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত কমেডিয়ান জুলিয়া সুইনীর বাবা আর মায়ের খবরে কাগজের মাধ্যমে তাদের কন্যার অবিশ্বাসী হয়ে যাবার সেই ট্রাজিকমিক কাহিনীটি আমি উল্লেখ করেছিঃ “ঈশ্বরের বিশ্বাস করে বিষয়টি তারা কোন মতে হজম করতে পারলেও… কিন্তু তাই বলে একজন নাস্তিক.. একজন নিরীশ্বরবাদী (তার মায়ের গলার আওয়াজ আরো উঁচু পর্দায় উঠেছিল)’?
আমেরিকার পাঠকদের আমার কিছু বলা প্রয়োজন বিশেষ করে এই মূহুর্তে, কারণ আমেরিকার ধর্মপ্রীতি আসলেই বিস্ময়কর, চোখে পড়ার মত। আইনজীবি ওয়েন্ডি কামিনের খুব সামান্যই বাড়িয়ে বলেছিলেন যখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধর্ম নিয়ে উপহাস করাটা আমেরিকার লিজিয়ন (প্রাক্তন সৈন্যদের সংগঠন) হলে আমেরিকার পতাকা পোড়ানোর মতই ঝুঁকিপূর্ণ। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সমকামিদের যে অবস্থা ছিল, আমেরিকায় নিরীশ্বরবাদীদের অবস্থা এখন তেমনি। আমেরিকার গে প্রাইড আন্দোলনের পর, এখন এটি সম্ভব, যদিও এখনও খুব সহজ না কাজটি, তারপরও কোন সমকামি, সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে পারেন। ১৯৯৯ সালে একটি গ্যালপ পোল (জনমত জরিপ) আমেরিকাবাসীদের জিজ্ঞাসা করেছিল, তারা ভোট দেবেন কিনা এমন কোনো প্রার্থীকে যারা অন্য সবক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থী, যদি তিনি হন: একজন নারী ( ৯৫ শতাংশ বলেছে হ্যাঁ), রোমান ক্যাথলিক (৯৪ শতাংশ বলেছে হ্যাঁ), ইহুদী (৯২ শতাংশ বলেছে হ্যাঁ), কৃষ্ণাঙ্গ ( ৯২ শতাংশ), মর্মন (৭৯ শতাংশ), সমকামি (৭৯ শতাংশ) এবং নিরীশ্বরবাদী (৪৯ শতাংশ);
স্পষ্টতই আমাদের, নিরীশ্বরবাদীদের আরো বহু দূর পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু নিরীশ্বরবাদীরা আসলে সংখ্যায় অনেক বেশী, বিশেষ করে শিক্ষিত এলিটদের মধ্যে, সাধারণত যা মনে করা হয় তার চেয়েও বহু বেশী। আর উনবিংশ শতাব্দীতেও তাই ছিল, যখন জন স্টুয়ার্ট মিল (৮) বলতে পেরেছিলেন: “এই পৃথিবী অবাক হয়ে যেত, যদি জানতো এর সবচে উজ্জ্বল রত্নগুলো, যারা সবচেয়ে বিখ্যাত তাদের মেধা আর গুণে, এমন কি সাধারণ মানুষের অনুমানেও, তাদের বিশাল একটি অংশ ধর্ম নিয়ে পুরোপুরি সন্দিহান। আর বর্তমানে এমনকি এটি আরো বেশী সত্যি এবং আসলেই তার প্রমাণও দিয়েছি তৃতীয় অধ্যায়ে,একমাত্র যে কারণ, মানুষ নাস্তিকদের লক্ষ করছে না তাহলে নিরীশ্বরবাদীরা সাধারণত সবার সামনে তাদের অবিশ্বাসের ফিরিস্তি দিতে অনিচ্ছা পোষণ করে থাকেন। আমার স্বপ্ন হলো এই বইটি তাদের সেই উৎকণ্ঠা কাটাতে সাহায্য করবে, তারা প্রকাশ্যে তাদের অবিশ্বাসের কথা। বলবেন। ঠিক যেমনটা হয়েছিলে, গে বা সমকামিদের আন্দোলনে, যত মানুষ তাদের অবিশ্বাসের কথা উন্মুক্ত ভাবে বলবে ততই তাদের সাথে যোগ হওয়া সহজ হবে আরো বহু মানুষের। সেই চেইন রিঅ্যাকশনটি শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রিটিকাল মাস হয়তো আছে। আমেরিকার জনজরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অবিশ্বাসী এবং অজ্ঞেয়বাদীদের সংখ্যা ধর্মপালনকারী ইহুদী কিংবা আরো কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে অনেক বেশী। ইহুদীদের ব্যতিক্রম, যারা কিনা খুবই বিশেষভাবে সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অত্যন্ত কার্যকরী রাজনৈতিক লবীর জন্য কিংবা ইভানজেলিকাল খ্রিষ্টানদের থেকে ভিন্ন, যাদের এখন আরো অনেক বেশী রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, অবিশ্বাসী আর অজ্ঞেয়বাদীরা কিন্তু। তাদের মত সংগঠিত না, সেকারণে তাদের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতাও প্রায় শূন্যের কোঠায়। আসলেই নিরীশ্বরবাদীদের একজায়গায় জড়ো করাকে তুলনা করা হয় বিড়ালের পালকে এক জায়গায় রেখে পোষ মানানো, কারণ মুক্তচিন্তার মানুষগুলোর প্রবণতা আছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার যারা সাধারণত কোন কর্তৃত্ব মানতে পছন্দ করেনা। তবে একটি উত্তম পদক্ষেপ হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যার সমমনার নিয়ে একটি ক্রিটিকাল মাস তৈরী করা যারা নিজেদের অবিশ্বাসী বলে পরিচয় দিয়ে রাজী হবেন, যা অনুপ্রানিত করবে অন্যদের একই কাজ করার জন্য। এমনকি যদিও তাদের একদলে আনা যাবে না ঠিক, কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক বিড়াল প্রচুর আওয়াজ করতে পারে, যাদের উপেক্ষা করা কঠিন হবে।
আমার বইটির শিরোনাম delusion (ডিলুশন) বা বিভ্রম শব্দটির ব্যবহার বেশ কিছু মনোচিকিৎসা বিজ্ঞানীকে খানিকটা চিন্তিত করেছে, তাদের কাছে শব্দটি টেকনিকাল, চিকিৎসা জগতে যা একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দ্বারা চিহ্নিত, যেখানে সেখানে শব্দটির অপব্যবহার করা ঠিক না। তাদের তিন জন আমাকে লিখেছেন একটি বিশেষ টেকনিকাল শব্দ এই ধর্মীয় ডিলুশন বা বিভ্রমের বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার না করার জন্য প্রস্তাব জানিয়ে, relusion শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে, হয়তো শব্দটা একসময় প্রচলিত হবে। কিন্তু আপাতত আমি ‘ডিলুশন’ শব্দটাই ব্যবহার করবো। তবে আমি কেন ব্যবহার করছি সেটার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন। Penguin English Dictionary অনুযায়ী কোনো ডিলুশন বলতে বোঝায়, একটি মিথ্যা বিশ্বাস বা ধারণা। বিস্ময়করভাবে, শব্দটির উদাহরণসূচক উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ফিলিপ ই, জনসনের একটি মন্তব্য: ‘ডারউইনবাদ হচ্ছে সেই বিভ্রম থেকে মানবতার মুক্তির গল্প, যে বিভ্রম দাবী করছে তাদের নিয়তি তাদের চেয়ে উচ্চতর কোন শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইনি কি সেই একই ফিলিপ ই. জনসন হতে পারেন? যিনি আজকে যুক্তরাষ্ট্রে ডারউইনবাদের বিরদ্ধে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন? আসলেই তাই, এবং এই উদ্ধৃতিটি আমরা যা অনুমান করতে পারি, মূল প্রসঙ্গের বাইরে ব্যবহৃত হয়েছে। আশা করি, আমি যে এতটুকু উল্লেখ করলাম বিষয়টি দৃষ্টি এড়াবে না, কারণ এই একই ধরনের ভদ্রতা আমার প্রতি দেখানো হয়নি যখন সৃষ্টিবাদীরা আমার অসংখ্য উদ্ধৃতি তাদের স্বার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করে থাকেন মূল প্রাসঙ্গিকতার বাইরে অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে। জনসনের নিজের এই কথার অর্থ যাই হোক না কেন, তার এই বাক্য যা বলছে আমি আনন্দের সাথে সেটা সমর্থন করতে রাজি আছি। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড সাথে সরবরাহকৃত অভিধানটি Delusion শব্দটির অর্থ করেছে এমন ভাবে: ‘একটি দীর্ঘস্থায়ী মিথ্যা বিশ্বাস, এমন কি যখন এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ বিদ্যমান। বিশেষ করে মানসিক রোগের উপসর্গ হিসাবে। প্রথম অংশটি খুব চমৎকার আর নির্ভুলভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল সুরটিকে ধরতে পেরেছে, তবে এটি কোন মানসিক রোগের উপসর্গ কিনা, এ বিষয়ে আমি ‘জেন অ্যান্ড দি আর্ট অব মটর সাইকেল মেইনটেনান্স’ (৯) এর লেখক রবার্ট এম, পিরসিগকেই (১০) সমর্থন করবো, যখন তিনি বলেছিলেন, “যখন একটি মাত্র মানুষ বিভ্রমে ভোগে, তাকে বলা হয় পাগলামি, কিন্তু যখন বহু মানুষ বিভ্রান্তিতে ভোগে, তাকে বলা হয় ধর্ম।
আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে যদি বইটি তার কাজ করে, সকল ধর্মবাদী পাঠক যারা কিনা পড়ার জন্য বইটি খুলবেন, তারা সবাই রুপান্তরিত হবেন অবিশ্বাসীতে যখন বইটি তারা শেষ করে নামিয়ে রাখবেন। কি ঔদ্ধত্বপূর্ণ একটি আশাবাদ। অবশ্যই অস্থি মজ্জায় খাঁটি বিশ্বাসীদের কোনো যুক্তিই স্পর্শ করবে না, তারা সব যুক্তি থেকে সুরক্ষিত। আর তাদের এই প্রতিরক্ষা ধীরে ধীরে, তাদের শৈশবের সেই দীক্ষা থেকে বছরের পর বছর গড়ে উঠেছে। এই দীক্ষার প্রক্রিয়া বহু শতাব্দী ধরে শাণিত হয়েছে (হয় বিবর্তন কিংবা ডিজাইন এর মাধ্যমে), প্রতিরক্ষামূলক নানা পন্থার মধ্যে একটি হচ্ছে অনেক বেশী কার্যকর সতর্কবাণী, তা হচ্ছে এমন কোন বই যেন কোনভাবেই খোলা না হয় পড়ার জন্য, নিশ্চিভাবে এই বই কোনো শয়তানের কাজ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি বহু খোলা মনের মানুষ আছেন, যাদের শৈশবের ধর্মীয় দীক্ষা এত ভয়ঙ্কর না বা অন্য কোন কারণে সেভাবে মনের মধ্যে গেথে যায়নি বা যাদের নিজেদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা আছে এটিকে অতিক্রম করার।এই সব খোলা মনের মানুষ এর শুধু একটু উৎসাহ র প্রয়োজন ধমের যাতাকল থেকে নিজেদের পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য। নিদেনপক্ষে আমি আশা করি, যে কেউই, যারা কিনা যে এই বইটি পড়েছেন, তারা যেন বলতে পারেন, আমার জানা ছিল না আমিও পারি।
এই বইটির বাস্তব রুপ দেবার জন্য আমি বহু বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তাদের সবার নাম হয়তো উল্লেখ করতে পারবো না এই স্বল্প পরিসরে। তবে তাদের মধ্যে আছেন আমার লিটারারী এজেন্ট জন ব্ৰকমান, আমার সম্পাদকরা, স্যালি গামিনারা (ট্রান্সওয়ার্ল্ড এর) এবং এয়ামন ডোলান (হটন মিফলিন), তারা দুজনেই আমার বইটি পড়েছেন সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিদ্বীপ্ত বোধগম্যতা নিয়ে এবং আমাকে সমালোচনা আর উপদেশের একটি উপকারী মিশ্রণ দিয়ে সহায়তা করেছেন সবসময়। বইটি নিয়ে তাদের অকৃত্রিম উৎসাহ এবং বিশ্বাস আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে ভীষণভাবে। গিলিয়ান সমারস্কেল একজন অসাধারণ কপি এডিটর, তার গঠন মূলক সমালোচনা ও সংশোধনী বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে নানাভাবে। নানা পর্যায়ের ড্রাফটে যারা গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা করেছেন এবং যাদের কাছে আমি বিশেষভাবে কতজ্ঞ, তারা হলেন জেরী কয়েন, জে, অ্যান্ডারসন থমসন, ই, এলিজাবেথ কর্নওয়েল, উরসুলা গুডএনাফ, লতা মেনন এবং বিশেষ ভাবে কারেন ওয়েনস, অসাধারণ সমালোচক, প্রতিটি ড্রাফটে নানা পরিবর্ধন আর পরিমার্জন সম্বন্ধে যার ধারণা প্রায় আমার মতই বিস্তারিত। এই বইটির কিছুটা (এর বিপরীতও) ঋণ আছে আমার টিভি প্রামাণ্য চিত্র Root of All Evil? এর কাছে; জানুয়ারী ২০০৬ সালে বিবিসি’র চ্যানেল ফোর যে প্রামাণ্য চিত্রটি আমি উপস্থাপনা করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানটির সাথে জড়িত সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, যেমন ডেবোরাহ কিড, রাসেল বার্নস, টিম ক্রাগ, অ্যাডাম পেসকোড, অ্যালান ক্লিমেন্টস ও হামিস মিকুরা। সেই প্রামাণ্য চিত্র থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে সম্মতি দেবার জন্য আমি আই ডাবলিউ সি মিডিয়া ও চ্যানেল ফোরকে ধন্যবাদ জানাই। Root of All Evil? ব্রিটেনে খুবই ভালো রেটিং অর্জন করেছিল, যা অষ্ট্রেলিয়ার ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশনও প্রচার করেছে। তবে এখনো দেখার বাকী আছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোন টেলিভিশন চ্যানেলের এটি দেখানোর সাহস আছে কিনা (যদিও বেআইনী কপি যুক্তরাষ্ট্রের নানা ওয়েবসাইটগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ডাউনলোড করা হচ্ছে। তবে আলোচনা চলছে আইনগতভাবে ডিভিডিটি বাজারজাত করার জন্য। এই বইটি প্রেসে যাবার সময় এই আলোচনা ছিল অসম্পুণ– এ বিষয়ে পরবতীয় খবরগুলো www.richarddawkins.net ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হবে নিয়মিতভাবে।
এই বইটির মূল সুর আমার মনে দানা বেধেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এই সময়ে অবশ্যই বেশ কিছু ধারণা আমার নানা বক্তৃতায় নিশ্চয়ই এসেছে, যেমন হার্ভার্ড দেয়া আমার ট্যানার লেকচার, কিংবা খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনের নানা প্রবন্ধে। Free Inquiry পত্রিকায় আমার নিয়মিত কলামের পাঠকদের বিশেষ করে এই বইটির অনেক অনুচ্ছেদ পরিচিত মনে হতে পারে। এই অসাধারণ পত্রিকাটির সম্পাদক টম ফ্লিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, আমাকে নিয়মিত কলাম লিখতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেবার জন্য, যখন তিনি আমাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই বই লেখার জন্য সাময়িক বিরতি শেষে আমি আশা করছি আবার আমার কলামটি লেখা শুরু করতে পারবো, এবং কোনো সন্দেহ নেই এই বই প্রকাশের পর পবরর্তী পরিস্থিতির ও প্রতিক্রিয়ার প্রত্যুত্তর দেবার জন্য কলামটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বহুবিধ কারণে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, ড্যান ডেনেট, মার্ক হাউসার, মাইকেল সিরাট, স্যাম হ্যারিস, হেলেন ফিশার, মার্গারেট ডাওনি, ইবন ওয়ারাক, হারমাইওনি লী, জুলিয়া সুইনী,ড্যান। বার্কার, জোসেফিন ওয়েলশ, আয়ান বেয়ার্ড এবং বিশেষভাবে জর্জ স্কেলস এর প্রতি। ইদানীং কোন বইই সম্পূর্ণ হয়না যদি না বইটি কোন একটি সচল ওয়েবসাইটের বাড়তি নানা তথ্যাবলীসহ একটি ফোরামের নিউক্লিয়াস এ পরিণত না হয়, যেখানে প্রশ্নোত্তর, আলোচনা সব কিছুই থাকবে-কে জানে ভবিষ্যতে কি হতে পারে? আমি আশা করি Richard Dawkins Foundation for Reason and Science এর ওয়েব সাইট www. richarddawkins.net সে দ্বায়িত্বটি পালন করার জন্য চেষ্টা করবে। এবং আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ জশ টিমোনেনের প্রতি, যার অসাধারণ সৃজনশীলতা, পেশাদারিত্ব এবং কঠোর পরিশ্রম এই সাইটটিকে বিশেষায়িত করেছে। সর্বোপরি আমি আমার স্ত্রী লালা ওয়ার্ডকে জানাই ধন্যবাদ, সমস্ত ইতস্ততা আর নিজের সন্দেহগুলো কাটিয়ে উঠে বইটি লেখা শুরু করার ক্ষেত্রে যার অনুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। শুধু নৈতিক সমর্থন বা আরো পরিবর্ধণ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশই শুধু না, লালা ওয়ার্ড পুরো বইটি আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন, এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে, যেন আমি বুঝতে পারি বইটি আমি ছাড়াও কোনো পাঠকের কেমন লাগতে পারে। আমি এই কৌশলটিকে ব্যবহার করতে অন্যান্য লেখকদেরও উপদেশ দিতে চাই, তবে আমি অবশ্যই সতর্ক করে দিতে চাই, কৌশলটির ভালো ফলাফলের জন্য এর পাঠককে অবশ্যই পেশাদার অভিনয় শিল্পী হতে হবে, ভাষার সঙ্গীতময়তার সাথে যার কণ্ঠস্বর আর শোনার সংবেদনশীলতা সুপরিচিত।
পাদটীকা
(১) জন উইনস্টোন লেনন (১৯৪০-১৯৮০) ইংরেজ সঙ্গীতশিল্পী, গায়ক ও গান রচয়িতা, বিশ্বখ্যাত পপ সঙ্গীত দল বিটলস (Beatles) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
(২) ইমাজিন, জন লেননের লেখা একটি সুপরিচিত গান, এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের মে মাসে।
(৩) ৯/১১, ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদা সন্ত্রাসী হামলার বিষয়টি ইঙ্গিত করে।
(৪) ৭/৭, ২০০৫ সালে ৭ জুলাই, লণ্ডনে ইসলামবাদী সন্ত্রাসীদের হামলার বিষয়টি ইঙ্গিত করে।
(৫) ডেসমন্ড জন মরিস (জন্ম ১৯২৮) ব্রিটিশ প্রাণিবিজ্ঞানী, ইথোলজিস্ট, শিল্পী।
(৬) অজ্ঞেয়বাদ, দাবী করে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবীর সত্যতা– বিশেষ করে ধর্মীয় এবং অধিবিদ্যামূলক দাবীসমূহের– যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিংবা নেই, সেই স্বর্গীয় অথবা অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্ব সংক্রান্ত– অজানা এবং হয়তো সেগুলো জানাও সম্ভবপর নয়।
(৭) ক্রেইন হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্র, যার একটি হয়েষ্ট,তার বা শিকল এবং শিভস থাকে, যার প্রধান কাজ কোন কিছু উপরে তোলা বা নীচে নামানো, কিংবা আনুভূমিকভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো। ক্রেইন-এর রুপকটি ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ সূচনা থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্রিয়া ধাপে ধাপে জটিল সংগঠনের জীবের উদ্ভব ঘটার প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করার জন্য, যেমন, মাটি থেকে ভারী কোনো কিছুকে ক্রেইন যেভাবে ধীরে ধীরে উপরে উত্তোলন করে। এটি অন্য রুপক স্কাইহুক-এর বিপরীত, স্কাই হুক কোন কিছু আপাতদৃষ্টিতে কোন ভিত্তি বা ব্যাখ্যা ছাড়াই অবিশ্বাস্য সব জটিলতা উদ্ভব ঘটায়, যেমনটি সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা দাবী করেন। সুতরাং ডারউইরীয় বিবর্তনের ধারণাটিকে বোঝাতে ক্রেইন এর রুপকটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এটি সি. এস, লুইসের প্রস্তাবিত ভ্রান্ত মিথ্যা-বিবর্তনীয় ধারণা থেকে ডারউইনীয় বিবর্তনের ধারণাটিকে পৃথক করেছে। এই শব্দটি ডকিন্স ধার করেছেন দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেটের প্রস্তাবনা থেকে। এটি বিবর্তনের ধারণাটিকে বোঝানোর জন্য উপযোগী কারণ, বিবর্তন আর প্রাকৃতিক নির্বাচন এই দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে বিবর্তনের প্রক্রিয়া, এবং এছাড়াও এই রুপকটি বিবর্তনের মেকানিজম সংক্রান্ত আরো কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাবকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ করে দেয়।
(৮) জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ, উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী এই দার্শনিকের বহু অবদান সোস্যাল থিওরী, পলিটিকাল থিওরী এবং পলিটিকাল ইকোনমীর ক্ষেত্রে।
(৯) Zen and the Art of Motorcycle Maintenance: An Inquiry into Values, William Morrow & Company, 1974
(১০) রবার্ট মেনার্ড পিরসিগ (জন্ম ১৯২৮) যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, দার্শনিক।
Zeesan
ফন্টগুলো যদি সরাসরি কাল হত তাহলে চোখের জন্য আরামদায়ক কনট্রাস্ট পাওয়া যেত! এটা একটু বিবেচনা করলে ভালো হয় !
Bangla Library
ডার্ক করে দেয়া হলো। ধন্যবাদ।