দ্য আর্ট অব ওয়ার – সান জু / রূপান্তর : মাহফুজ আলম
[দ্য আর্ট অব ওয়ার বইটি ২ হাজার বছরেরও বেশি আগে লেখা। প্রাচীন চীনা জেনারেল সান-জু বইটি আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে রচনা করেন। হাজার বছরের পুরনো হলেও দি আর্ট অব ওয়ার আজও মিলিটারি ও বিজনেস লিডারদের জন্য একটি অপরিহার্য গাইড। বইটি মূলত লেখা হয়েছিল যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করার কৌশল বিষয়ে।]
দ্য আর্ট অব ওয়ার – সান জু
রূপান্তর : মাহফুজ আলম
.
উৎসর্গ আমার প্রিয় চাচ্চু
নাইমা-কে
.
ভূমিকা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সু-সু-মা চেন-এর স্মৃতিস্তম্ভ একশ শতাব্দির কাছাকাছি সময়ে নির্মান করা হয়। এই স্মৃতিস্তম্ভ থেকে জানা যায়, সানজু ছিলেন চিঈ রাজ্যের বাসিন্দা। তিনিই ষষ্ঠ শতাব্দির শেষের দিকে রাজা হো-লু-এর কাছে তার ‘রণনীতি বা যুদ্ধকৌশল’ বা ‘আর্ট অব ওয়ার’ পেশ করেন। এই রাজা হো-লু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন বর্বর প্রজাতির মানুষ।
তবে অনেক চাইনিজ পণ্ডিতজজ্ঞ তার জীবনী লেখনীর সময়কাল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন। এর ইংরেজি অনুবাদক এস.বি. গ্রিফথ এর মতানুসারে, বইটি চতুর্থ শতাব্দীতেই লেখা হয়েছিল।
অতীত সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ যেমন কম থাকে ঠিক তেমনি সানজুর এই প্রবন্ধ সিরিজ আকর্ষণ না করলেও ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ বা রণনীতিগুলো শুধুমাত্র রণনীতি বা যুদ্ধ কৌশলের চেয়েও বেশি কিছু। এটি ব্যাপক চিন্তার খোরাক যোগায় যেখানে আমাদের মননশীলতাকে প্রাচীন চাইনিজ সামরিক ইতিহাস সাহিত্য সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে।
পাশ্চাত্যে সানজুর সর্বপ্রথম পরিচয় ঘটে খ্রিষ্ট মিশনারী ফাদার জে.জে.এস অমিত এর মাধ্যমে। তার অনুদিত ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ প্যারিসে ১৭৭২ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়, ঠিক সে সময়টাতে ফ্রান্সের শিল্পি, বুদ্ধিজীবিরা চাইনিজ আর্ট এবং সাহিত্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুঁদ হয়েছিল। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা-জার্নালের বদৌলতে অমিতের এই অনুদিত গ্রন্থ যথেষ্ট পরিমাণে আলোচিত সমালোচিত হয়। ১৭৮২ সালে বইটি পুনঃ গ্রন্থিত হয়। আর ধারণা– করা হয়, নেপোলিয়ানও বইটি পড়েছিলেন।
তারপর জার্মানি, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয় বইটি।
সানজু অনুভব করতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ হল ‘একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’, যেটা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হওয়া উচিত; আর তার এই আলোচনাই হল সামরিক অভিযানের ইতিহাসে প্রথম পঠন-পাঠন। তবে বেশিরভাগ গ্রিক আর রোমান লেখকদের মত সানজু নির্দিষ্ট একটা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তার কৌশলগুলি রচনা করেননি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল শাসক এবং সেনানায়কদের জন্য যারা যুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে চায়। তার বিশ্বাস ছিল শত্রুর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ না করেও তার কৌশলগুলি অনুসরণ করে শত্রু সৈন্যকে পরাজিত করতে পারবে, শহর অবরুদ্ধ না করেই তা দখল করতে পারবে, এবং শত্রুর রাজ্য দখলে আনতে পারবে কোন প্রকার অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই।
সানজু খুব ভালো করেই জানতেন যুদ্ধ শুধুমাত্র সৈন্যসামন্তের মধ্যে লড়াই করা ছাড়াও অনেক বেশি কিছু। তিনি নৈতিকতা, পাণ্ডিত্য এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন উপাদানকে শারীরিক যুদ্ধের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, এবং যে সকল শাসকবর্গ ও সেনানায়ক শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি যুদ্ধকে শুধুমাত্র হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে চান না; বরং একেবারে অক্ষত বা না হলেই নয় এমন ক্ষতি করে জয়ী হওয়াকে যথাযথ কৌশল বলে বিবেচনা করেন।
সানজুর মতে, উপযুক্ত কোন পরিকল্পনা শত্রুর সম্পর্কে যথাযথ তথ্যের উপর ভিত্তি করে গঠন করা হলে সামরিক অগ্রগতিতে ক্ষিপ্রতা এনে দেয়। তিনি বলেছেন, ‘কোন রাষ্ট্রই দীর্ঘ সময় ধরে চলমান কোন যুদ্ধ থেকে উপকৃত হতে পারে না।’
চাইনিজ এবং জাপানি সামরিক যুদ্ধ ইতিহাসে সানজুর ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাও সে তুং এবং চাইনিজ সেনাবাহিনীর বহু কৌশল সানজুর এই ‘আর্ট অব ওয়ার’ থেকে উদ্ভূত। পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে চিহ্নিত এটি। আর তাই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ এই দুই রাষ্ট্র ছাড়াও বর্তমানের আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে তাদের সামরিক কৌশলে ব্যবহারের জন্য বহুল প্রচলিত ও পঠিত একটা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
মাহফজু আলম
.
সূচিপত্র
সানজুর পরিচয়
প্রথম অধ্যায় – অনুমান
দ্বিতীয় অধ্যায় – ওয়েজিং ওয়ার
তৃতীয় অধ্যায় – আক্রমণের কৌশল
চতুর্থ অধ্যায় – রণকৌশলগত বিন্যাস
পঞ্চম অধ্যায় – কমান্ডার হিসেবে আপনার সক্ষমতা যাচাই করুন
ষষ্ঠ অধ্যায় – সক্ষমতা এবং দুর্বলতা
সপ্তম অধ্যায় – রণকৌশল
অষ্টম অধ্যায় – রণকৌশলের ব্যতিক্রমী নয় ভাবনা
নবম অধ্যায় – দ্য মার্চ
দশম অধ্যায় – দ্য টেরেইন
একাদশ অধ্যায় – যুদ্ধে উদ্ভুত নয় ধরনের পরিস্থিতি
দ্বাদশ অধ্যায় – অ্যাটাক বাই ফায়ার
ত্রয়োদশ অধ্যায় – গুপ্তচর নিয়োগ
………..
০. সানজুর পরিচয়
চিঈ (Ch’i) রাজ্যের বাসিন্দা সানজু। সমর কৌশলের উপর তার লেখা পড়ে অউ (Wu) রাজ্যের রাজা হো-লু (Ho-lu) তাকে ডেকে বললেন, আমি আপনার লেখা তেরটা চ্যাপ্টার পড়েছি। আপনি কি সৈন্যদের একটা ছোট মহড়া করে দেখাতে পারবেন?
সানজু জবাব দিলেন, ‘অবশ্যই পারবে।’
হো-লু আবারো প্রশ্ন করলেন, ‘মহড়াটা কি আপনি মহিলা সৈনিক নিয়েও করতে পারবেন?’
জবাবে সানজু বলেন, হ্যাঁ, পারবো।
রাজা এবার খুশি হয়ে প্রাসাদ থেকে একশ আশি জন সুন্দরি নর্তকি পাঠালেন মহড়ার উদ্দেশ্যে।
সানজু তাদেরকে দুটো ভাগে ভাগ করে রাজার খুবই পছন্দের দুজন সুন্দরি নর্তকিকে তাদের নেতা বানিয়ে দিলেন। প্রথমে তাদেরকে শেখালেন কিভাবে অস্ত্র ধরতে হয়। তারপর বললেন, ‘তোমরা কি জান কোথায় হৃদপিন্ড থাকে, কোনদিক ডান আর বাম, আর কোনদিকটাই বা পেছনকে নির্দেশ করে?
নর্তকিরা সবাই জবাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা জানি।’
এবার সানজু বললেন, আমি যখন কমান্ড দেব “সামনে”, তখন তোমরা হৃদপিন্ড বরাবর সামনে অস্ত্র তাক করবে; যখন বলব “ডানে” তখন ডানে ফিরবে; আবার যখন বলব “বামে” তখন বামে ঘুরে যাবে; আর যখন বলব “পেছনে” তখন পেছনে ঘুরে যাবে।
নর্তকিরা সবাই জবাব দিল, হ্যাঁ, বুঝেছি।
সানজু নর্তকিদেরকে নিয়ম কানুনগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আর অন্যদিকে তাদের জন্য আনা অস্ত্রগুলো যার যার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছিল।
সানুজু তার বুঝিয়ে দেয়া কমান্ডগুলো তিনবার করে বুঝালেন আর পাশাপাশি কমান্ডগুলো পাঁচবার করে ড্রিল করালেন। তারপরই তিনি ড্রামে জোর শব্দ করে ডানে ঘুর’ বলতেই নর্তকিরা সবাই হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।
নর্তকীদের কান্ড দেখে সানজু বললেন, যদি নিয়মগুলো সৈন্যদের কাছে বোধগম্য না হয় আর সৈন্যরা কমান্ডগুলো যদি ভালো করে রপ্ত করা না করতে পারে তবে সেটা কমান্ডারেরই ভুল। তাই তিনি আবার সেই কমান্ডগুলো তিনবার ড্রিল করে পাঁচবার রপ্ত করিয়ে ড্রামে শব্দ করে বামে ঘুরার কমান্ড দিলেন। নর্তকীরা এবারও অট্ট হাসিতে লুটিয়ে পড়লো।
সানজু আবার বললেন, ‘যদি নির্দেশনাগুলো সৈন্যদের কাছে বোধগম্য না হয় এবং ভালোভাবে রপ্ত করানো না হয়, তবে সেটা কমান্ডারকে দোষারূপ করা হয়। কিন্তু যখন সেগুলো সকলের কাছে বোধগম্য হয়েছে আর তারা মানতে বাধ্য হচ্ছে না, মিলিটারি আইন অনুযায়ী তখন সেটা দলপতির উপর গিয়ে বর্তায়।’ এটা বলেই সানজু ডান এবং বামের দলপতিকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করলেন।
এতক্ষণ অউ রাজা তার আসনে বসে সানজুর পরিচালিত সামরিক মহড়ার কার্যক্রম লক্ষ্য করছিলেন। তিনি দেখলেন তার খুব প্রিয় দুজন নর্তকীকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এটা দেখে তিনি রেগে গিয়ে দ্রুত দূত পাঠিয়ে সানজুকে জানালেন: ‘ইতোমধ্যেই আমি বুঝে গেছি, জেনারেল তার কাজে যথেষ্ঠ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এই দুজন নর্তকী ছাড়া আমার খাবারে কোন স্বাদ থাকে না। তাই আমি চাই তাদের দুজনকে যেন হত্যা করা না হয়।’
জবাবে সানজু বললেন: ‘আপনার এই সেবক ইতোমধ্যে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং এই সৈন্যদলের প্রধান হিসেবে সৈন্যদের উপর সব ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করার অনুমতি আমার রয়েছে।’
পরিণতিতে সৈন্যদল প্রধান দুজনের গর্দান গেল আর সানজু তাদের পরবর্তী দুজন সিনিয়র সৈন্যকে দুই দলের নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা করলেন।
তারপর তিনি ড্রামে জোর শব্দ করে নির্দেশ প্রদান করলে নর্তকীরা সবাই বামে, ডানে, সামনে, পেছনে, হাটু গেড়ে বসে আর শেষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ি ড্রিল করল। সৈন্যরা কোন টু-শব্দ করা সাহস পর্যন্ত করল না।
সানজু এবার দূত পাঠালেন রাজার কাছে এই তথ্য দিয়ে যে: ‘সৈন্যরা এখন যথেষ্ট পরিণত। মহারাজা এখন ইচ্ছা করলেই মহড়া দেখতে পারেন। তারা এখন রাজার সেবায় নিয়োজিত। তারা রাজার ইচ্ছায় পানি এমনকি আগুনে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত।’
অউ রাজা জানালেন, জেনারেল এখন তার তাবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। এইমুহূর্তে আমি তার মহড়া দেখতে প্রস্তুত নই।
সানজু বলে পাঠালেন, ‘জাহাপনারা শুধু ফাঁকা বুলি আওড়ানো শুনতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এর বাস্তবায়নটা দেখতে চান না।’
হো-লু রাজা এবার কমান্ডার হিসেবে সানজুর সক্ষমতা বুঝতে পারলেন এবং তাকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলেন। পরবর্তীতে সানজু পরাশক্তি রাজ্য চু (Chu)-কে পরাজিত করে পশ্চিমে ইং (Ying) পর্যন্ত; উত্তরে চি (Chi) আর চিন (Chin) পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। দেখা যায় চৈনিক সাম্রাজ্যবাদের তালিকায় অউ (Wu) রাজ্যের দহরম মহরম আদতে অনেকটাই এই সানজুর অবদান। উয়েহ চুয়েহ শু (Yueh Chueh Shu) এর ভাষ্যমতে, ‘অউ রাজ্যের প্রধান ফটকের দশ লি দুরে যে বিশাল সামধিক্ষেত্র দেখা যেত, সেটা ছিল এই সানজুর।’
সানজু মৃত্যুর একশ বছর পেরিয়ে গেলে ও (O) এবং চুয়ান (Chuan) এর মধ্যবর্তী সময়ে সে রাজ্যে জন্ম নিল সান পিন। সান পিন হলেন সানজুর ই। পরবর্তী বংশধর। তিনি ছিলেন সামরিক শিক্ষায় পাং চুয়ান এর সহপাঠি। পাং চুয়ানের সামরিক শিক্ষা সমাপ্তি হলে অয়েই (Wei) রাজ্যের রাজা তাকে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন। তবে পাং চুয়ান বুঝতে পারলেন তার সামরিক দক্ষতা সান পিনের সমকক্ষ নয়। আর তাই সান পিনকে গোপনে তার আস্তানায় আসার অনুরোধ করে দুত পাঠালেন। পিন এসে পৌঁছলে ঈর্ষান্বিত পাং চুয়ান তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। সে রাজ্যের আইন অনুযায়ি সান পিনের পা কেটে দেয়া হল। এছাড়াও তার মুখে কলব লাগিয়ে দেয়া হল দাগি আসামি হিসেবে সকলের সামনে প্রতিয়মান হওয়ার জন্য। এরপর তাকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হল যেখান থেকে কেউ তাকে দেখতে না পায়।
একদিন চি রাজ্য থেকে তা লিয়াং (Ta Liang) নামে এক পদস্থ কর্মকর্তা এলেন সেখানে। সান পিনকে একজন আসামি হিসেবেই গোপনে তা লিয়াং তার সাথে দেখা করেন। চি রাজ্যের পদস্থ কর্মকর্তা তাকে একজন অসাধারন ব্যাক্তি ভেবে গোপন পথে সান পিনকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন।
চি রাজ্যের প্রধান সেনাপতি তিয়েন চি সান পিন কে একজন অতিথী হিসেবেই গ্রহণ করল। অন্যদিকে তিয়েন চি প্রায়ই চি রাজ্যের রাজকুমারদের সাথে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজি ধরত। সান পিন লক্ষ্য করলেন দুই দলের ঘোড়াগুলো শক্তির দিক থেকে বেশি একটা পার্থক্য নেই। ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা হত মুলত তিন শ্রেনীর ঘোড়ার পরস্পরের সাথে। সান পিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে তিয়েন চি কে বললেন, আপনি যদি এই প্রতিযোগিতায় জিততে চান তবে আমি আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিতে পারি যেখানে আপনার জয় সুনিশ্চিত।
সান পিনকে বিশ্বাস করে তিয়েন চি রাজা আর তার পুত্রদের সাথে প্রতিটা প্রতিযোগিতায় এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বাজি ধরল। সান পিন তাকে বললেন, ‘আপনার দুর্বল ঘোড়াটি রাজার সবচেয়ে শক্তিশালি ঘোড়ার সাথে প্রতিযোগিতায় পাঠান, তারপর আপনার সবচেয়ে শক্তিশালি ঘোড়াটি রাজার মাধ্যম শক্তিশালি ঘোড়ার সাথে আর শেষে আপনার আপনার মধ্যম শক্তিশালি ঘোড়া রাজার দুর্বল ঘোড়ার সাথে।’ প্রতিযোগিতা শেষ হলে দেখা গেল তিয়েন চি প্রথম প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেও পরের দুটোতে জয় লাভ করায় তার হাতে রয়ে গেল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
এরপর সান পিনকে রাজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তিয়েন চি। রাজা সামরিক বাহিনী নিয়ে কিছু আলোচনা করে অভিভুত হলেন তার জ্ঞানের পরিধী দেখে। পরে তাকে সেখানকার সামরিক বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।
কিছু দিন পরে যখন চাও রাজ্য অয়েই (Wei) রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হল, চাও রাজ্য থেকে চি রাজার কাছে দ্রুত সাহায্যের জন্য অনুরোধ করল। অয়েই রাজা সান পিনকে তাদের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দানে ইচ্ছা প্রকাশ করলে সান পিন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তা নাকোজ করে দিয়ে বলেন; যেহেতু পুর্বে আমি একজন দাগি আসামি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছি সেহেতু এই পদটা আমার জন্য শোভা পায় না। পরবর্তীতে তিয়েন চি কমান্ডার ইন চিফ আর সান পিন নিযুক্ত হলেন তার প্রধান উপদেষ্টা।
সান পিন যাত্রা শুরু করলেন সৈন্যদলের মালামালের একটা গাড়িতে করে। যাওয়ার পথেই তিনি যুদ্ধের ছক একে নিলেন। তবে তিয়েন চি চেয়েছিল সরাসরি চাও রাজ্যের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু সান পিন পরামর্শ দিলেন: ‘একটা এলোমেলো সুতার গিট খুলতে যেমন পুরো গিটটাকে একসাথে ধরতে নেই ঠিক তেমনি যুদ্ধ-বিগ্রহের মিমাংশা কখনও শুধুমাত্র অস্ত্রের মুখে সম্ভব নয়। আঘাত যদি করতেই হয় তবে শক্রর একেবারে মুলে অথবা তাদের কোন অরক্ষিত অংশে আঘাত করতে হবে। আর যখন দু পক্ষেরই মধ্যে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, তখন পরিস্থিতি আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে অয়েই আর চাও দুদিক থেকেই আক্রমণ চলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে উভয়ের সৈন্যদের এখন নাকানি চুবানি অবস্থা। আর বাড়িতে দুর্বল আর বৃদ্ধরাও ক্লান্ত। তাই এটাই মোক্ষম সুযোগ তা লিয়াং আক্রমণ করে প্রধান রাস্তা আর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। এখনই তাদের রাজধানী সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। সেখানে আক্রমণ করলে ওয়েইরা দ্রুত চাওদেরকে ফেলে নিজেদের রাজধানী বাঁচানোর জন্য পড়ি কি মরি ছুটবে। এভাবেই আমরা চাও রাজ্যকে অয়েইদের দ্বারা আক্রমণ থেকে রক্ষাও করতে পারবো অন্যদিকে অয়েইদের পরাজয়ও সুনিশ্চিত।
সান পিনের পরামর্শ মেনে নিলেন তিয়েন চি। অয়েই সৈন্যরা নিজেদের রাজধানী রক্ষার্থে হান তাই (চাও এর রাজধানী) অবরোধ ছেড়ে দিয়ে পথিমধ্যে কুয়েই লিংয়ে চি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে চি সৈন্যদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
পনের বছর পরে চাও রাজ্যের সাথে মিত্রতা গড়ে অয়েই রাজ্য আক্রমণ করে বসল। হান দেরি না করে চি এর সহযোগিতা কামনা করলে চি রাজা তিয়েন চি কে আদেশ দিলেন তা লিয়াং আক্রমণ করার আদেশ দিলেন।
তখনকার অয়েই কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন পাং চুয়ান। সে খবর পেয়ে হান ছেড়ে দিয়ে নিজ দেশ রক্ষার্থে ছুটে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে চি সৈন্যরা বর্ডার পার করে অয়েই রাজ্যের পশ্চিমে ঢুকে পড়েছে।
যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সান পিন তিয়েন চি কে বলেছিলেন; “চিনের তিনটা রাজ্যেরই সৈন্যরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, সাহসি আর তার চি রাজ্যের সেনাদেরকে কাপুরুষ ভেবে সবসময়ই অবজ্ঞা করে। দক্ষ যোদ্ধারই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে এখানে ফায়দা লুটে। রননীতি (The Art of War) অনুযায়ী, যদি কোন সেনাবাহিনী একশ লি (এক লি সমান ৫০০ মি.) দুরে থেকে যুদ্ধে জিততে চায় তবে তাদের সামনের দলের কমান্ডার শত্রুদের হাতে ধরা পড়বে; যদি পঞ্চাশ লি দুরে থেকে জিততে চায় তবে তাদের মাত্র অর্ধেক সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে। তারপর তিনি নির্দেশ দিলেন যখন চি সেনাবাহিনী বর্ডার পার করে অয়েই রাজ্যে ঢুকে পড়বে তখন তারা যেন প্রথম রাতে এক লক্ষ, দ্বিতীয় রাতে পঞ্চাশ হাজার আর তৃতীয় রাতে ত্রিশ হাজার সৈন্য শিরিরের রান্নার চুলা জ্বালায়।
পাং চুয়ান তিন দিন ধরে শত্রু শিবির লক্ষ করে আসছিল। সে খুবই আনন্দিত হয়ে বলল; আমি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম, চি সৈন্যরা যে কাপুরুষ। তারা আমাদের আক্রমণ করতে মাত্র তিন দিনই এখানে আছে আর ইতোমধ্যে তাদের অর্ধেকেরও বেশি অফিসার আর সৈন্য নিশ্চিন্ন হয়ে গেছে!
এটা নিশ্চিত হয়ে পাং চুয়ান তার নিয়মিত শক্তিশালি ভারী অস্ত্রসস্ত্রের বাহিনী রেখে হালকা বর্মের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেল শত্রুর মোকাবেলা করতে। আর অন্যদিকে সান পিন হিসাব করে দেখলেন পাং চুয়ান সন্ধানাগাদ এসে পৌঁছুবে। আর মা লিং রাস্তাটা সরু এবং দু পাশে খানা খন্দে ভরা যেখানে তার সৈন্যরা অনায়াশেই গর্তে পড়ে যাবে।
সান পিন রাস্তার দুপাশের চোখে পড়ার মত বড় বড় সব গাছের ছাল বাকল তুলে নিয়ে সেগুলোর গায়ে লিখে রাখলেন, ‘পাং চুয়ান এই গাছের নিচেই মারা পড়বে।’ রাস্তার ঝোঁপঝাড়ে সান পিন দক্ষ দশ হাজার তীরন্দাজ নিযুক্ত করলেন যাদের উপর নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন পাং চুনের সৈন্যদের জ্বালানো আগুন লক্ষ্য করা মাত্রই সেখানে তীর নিক্ষেপ করতে। আসলেই পাং চুয়ান সে রাতে এসে পৌঁছল তীরন্দাজদের এলাকায়। আর যখনই সে গাছের গায়ে লেখা পড়ার জন্য আলো জ্বালালো সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাকে তীর এসে পড়ল তাদের উপর পাং চুনের সৈন্যরা একেবারে হতবিহল হয়ে পড়ল। পাং চুয়ান তখনই বুঝতে পারল যে তার যতই সৈন্য-শক্তি থাকুক না কেন সে নিশ্চিত সান পিনের কাছে হেরে যাবে। সাথে সাথে সে নিজের টুটি কেটে আত্মহত্যা করল, আর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে বলে গেল, অতঃপর আমিও সেই হতচ্ছাড়াটার খ্যাতি ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখে গেলাম।
এই সুযোগে সান পিন তার সমস্ত শক্তি নিয়ে আঘাত হানলেন অয়েই সৈন্যদের শিবিরে। তাদেরকে সম্পূর্ণ পরাস্থ করেন এবং অয়েইদের পরবর্তী উত্তরসুরীকে বন্দী করেন। এরপর তিনি নিজ রাজ্য চি ফিরে যান।
সান পিনের এই যুদ্ধ কৌশলের জন্য পুরো পৃথিবীতে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তার পরবর্তী বংশধর পর্যন্ত সেই খ্যাতি অক্ষুণ্ণ থাকে।
deb
good