সিমোন দ্য বোভোয়ার ও নারীবাদ
লন্ডন থেকে একটু দূরে এপিং বনভূমির কাছের এক পল্লীর গরিব কৃষকপরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন এক তরুণী, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, ১৭৯১-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে, মাত্র ৬ সপ্তাহে লিখেছিলেন ১৩ পরিচ্ছেদের একটি পারমাণবিক, এখন অমর বই : দি ভিন্ডিকেশন অফ দি ব্লাইট্স্ অফ ওম্যান, বেরিয়েছিলো। ১৭৯২-এ। সেদিন বিশ্বের একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটেছিলো। লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, এক সময় নিন্দিত, এখন বন্দিত নারীবাদের জননীরূপে। জননী? শব্দটি ঠিক হলো? নারীবাদ কি জরায়ু থেকে উৎপন্ন? এ-প্রথাগত অভিধাটি আজো ব্যবহৃত হয়, তাঁর ক্ষেত্রেও হয়। মননশীল কিন্তু আবেগাতুর, বিয়েবিরোধী কিন্তু প্রেম ও পুরুষের জন্য কাতর, একই সঙ্গে অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু, মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক, যিনি দেখা দিয়ে, জয় ক’রে, হয়েছিলেন ট্র্যাজেডি। ১৫৭ বছর পর দেখা দেন আরেক নারী, এবার ইংল্যান্ডে নয়, ফ্রান্সে, ১৯৮৯-এ দু-খন্ডে বেরোয় তাঁর ১০০০-এরও বেশি পৃষ্ঠার বইঃ ল্য দ্যকিয়েম সেক্সঃ দি সেকেন্ড সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ। তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার। তিনিও বন্দিত বিশশতকের নারীবাদের জননীরুপে; তাঁর বইয়ের পংক্তির পর পংক্তি থেকে জন্মেছে আধুনিক নারীবাদের বিচিত্র ধারা, অনুপ্রাণিত হয়েছেন পঞ্চাশ – ষাট ও পরের দশকগুলোর নারীবাদীরা! অ্যালিস শোয়ার্জার, দ্য বোন্ডোয়ারের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ ও ষাটের তমসায়, যখন নব নারী আন্দোলন দেখা দেয় নি, তখন দ্বিতীয় লিঙ্গ ছিলো এক গুপ্ত সংকেতবিধির মতো, যার সাহায্যে আমরা নতুন নারীরা পরস্পরের কাছে বার্তা পাঠাতাম। আর সিমোন দ্য বোভোয়ার নিজে, তাঁর জীবন এবং তাঁর কর্ম, ছিলেন এবং আছেন এক প্রতীক হয়ে।’ জননী হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না; মেরি তবু দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন, দ্বিতীয়টি জন্ম দিতে গিয়ে চ’লে গিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। দ্য বোভোয়ার সন্তানে ও বিয়েতে বিশ্বাস করেন নি; মননশীলতায় তিনি মেরির থেকে প্রায়-বিপরীত মেরুর, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মননশীলতার প্রতিমূর্তি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে মিল আছে তাদের; দ্য বোভোয়ার জাঁ-পল সাত্রের সাথে ৫১ বছর কাটিয়েছেন প্ৰেমবন্ধুত্বের সম্পর্কে, অন্য প্রেমেও পড়েছেন, মননশীল বই লেখার ফাঁকে অন্য প্রেমিককে লিখেছেন কাতর পত্র, গর্ভপাত করেছেন। দুজনেই তিরস্কৃত ও নন্দিত হয়েছেন বই প্রকাশের পর; বিরোধীরা মেরিকে বলেছে ‘পেটিকোটপরা হয়েনা’,‘দার্শনিকতাপরায়ণ সৰ্পিণী’; আর দ্য বোভোয়ারের বইয়ের একটি অংশ পত্রিকায় বেরোলে এক ফরাশি লেখক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি লেখিকার যৌনাঙ্গের বিস্তৃত বিবরণ পেয়েছেন, এবং বই বেরোনোর পর ক্যাথলিকদের ধর্মীয় দুর্গ ভ্যাটিকান তার বই অনৈতিক’ বলে নিষিদ্ধ করে, এক মার্কিন সাংবাদিক অপভাষায় লেখেন লেখিকার যা দরকার, তা হচ্ছে একটা উৎকৃষ্ট সঙ্গম। মেরি প্রচণ্ড বিদ্রোহী, তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন পুরুষের সভ্যতাকে, মুক্তি দিতে চেয়েছেন বন্দী নারীকে; দ্য বোভোয়ার প্রাজ্ঞ, সুধীর, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কাব্যিক, ব্যাখ্যা ও উদ্ঘাটন করেছেন, অদৃশ্য জীবাণুর মতো পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর ভেতরে ঢুকে তাকে জীৰ্ণ করেছেন। মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক হ’লে সিমোন দ্য বোভোয়ার নারীবাদের আইনস্টাইন। পুরুষের সাথেই তুলনা করতে হলো; তা-ই করতে হচ্ছে, কেননা দ্য বোভোয়ার, এবং সব নারীবাদীই, চান পুরুষের সাথে সাম্য; কেননা পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় সার্বভৌম পুরুষই প্রকাশ করে মানবপ্রজাতির সে-বৈশিষ্ট্য, যাকে দ্য বোভোয়ার বারবার বলেন- ‘ট্র্যান্সেন্ডেন্স’ : সীমাতিক্ৰমণতা, আর নারীকে আটকে রাখা হয়েছে ‘ইমানেন্স’-এ : সীমাবদ্ধতায়।
পুরোনাম সিমোন লুসি-এর্নেস্তিন-মারি-বেরত্রা দ্য বোভোয়ার, বিশ্ববিখ্যাত তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার (১৯০৮-১৯৮৬) নামে; তিনি দিয়ে গেছেন চিরকালের শ্রেষ্ঠ নামগুলোর একটি। দ্য বোভোয়ার জন্মেছিলেন প্যারিসে, ১৯০৮-এর ৯ জানুয়ারি মঁৎপারনাসের কাফে দ ল রঁতঁদের ওপরে। বাবা জর্জে বেরত্রা দ্যা বেরঁত্রা দ্য বোভোয়ার ছিলেন আইনজীবী, মা ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো; দুজন ছিলেন দু-রক্ম। দ্য বোভোয়ার ছিলেন পিতাতামার জ্যেষ্ঠ সন্তান, আরেকটি বোন ছিলো তাঁর, তাঁকে অনেকটা পুত্ররূপেই পালম করেন পিতা। তিনি লিখেছেন, “বাবা গর্বের সাথেই বলতো : সিমোনের মগজ পুরুষের; সে পুরুষের মত চিন্তা করে; সে পুরুষ।’’ তিনি বেড়ে উঠেন প্যারিসের চতুর্দশ ‘আঁরোদিসঁমা’বা এলাকায়, যেখানে থেকেছেন প্রায় সারা জীবন। মা ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক, বাৰা সন্দেহবাদী, প্যারিসীয়; এবং অল্প বয়সেই বোভোয়ার বুঝতে পেরেছিলেন চারপাশের পৱিস্থিতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে উঠলে দ্য বোভোয়ার দেখতে পান কী দুঃসহ ক্লাস্তিকার গৃহস্থালির কাজ করতে হয় তাঁর মাকে- যে-ক্লান্তির মর্মস্পশী বর্ণনা দিয়েছেন তিনি দ্বিতীয় লিংগ-এ; তখনই স্থির করেন কখনো গৃহিণী বা মা হবেন না। দ্বিতীয় লিংগ-এ এক তরুনীর কথা বলেছেন তিনি, যে মায়ের ক্লান্তিকর একঘেয়ে গৃহস্থালির কাজ দেখে ভয় পায় যে সেও বাঁধা পড়বে ওই নির্মম নিরর্থক নিয়তিতে, তখনি সে ঠিক করেন ফেলে সে কখনো মা আর গৃহিণী হবে না; ওই তরুণী দ্য বোভোয়ার নিজেই। ১৯২৯-এ ২১ বছর বয়সে সরবনে দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি; ফ্রান্সে এ-পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে লাভ করেন। এ-ডিগ্রি। পরীক্ষায় জা-পল সার্ত্র হন প্রথম, তিনি দ্বিতীয়, এবং জড়িয়ে পড়েন প্রেমে, বন্ধুত্ত্বে, এক ব্যতিক্রমী সম্পর্কে, যারা কখনো পরস্পরকে ছেড়ে যান নি, কিন্তু অন্য কারো সাথে না জড়ানোর, শুদ্ধ একনিষ্ঠ দেহ ও মনের সতীত্বের বাধ্যবাধকতায়ও থাকেন নি। সার্ত্রের সাথে দেখা হওয়ার পর বোভোয়ারের জীবন বদলে যায় চিরকালের মতো, এ-সাক্ষাৎ বিশশতকের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা, হয়তো বদলে গিয়েছিলো সার্ত্রের জীবনও, কেননা দ্য বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনের ‘অপর’ বা আদার’ হয়ে থাকার মতো নারী ছিলেন না।
কিশোরী বোভোয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে-ত্রাতার, রাজকুমারের, তাকে তিনি পান সার্ত্রের মধ্যে, এক সুদৰ্শন রাজকুমারের বদলে এক দার্শনিক! বোভোয়ার লিখেছেন : ‘পনেরো বছর বয়সে আমি কল্পনা করেছিলাম যে-ভাবাদর্শ, সার্ত্র হুবহু মিলে যান তাঁর সাথেঃ তিনি আত্মার এমন সঙ্গী, যার মধ্যে আমি পেয়েছি আমার সমস্ত রিপু, যেগুলো এতো উত্তপ্ত হয়ে উঠতো যে পৌছোতো ভাস্থরতায়। তার সাথে আমি অংশীদার হতে পারতাম সব কিছুর।’ এখানে সম্মানসূচক সর্বনাম ব্যবহারের কারণ হচ্ছে ৫১ বছর প্রেমে, মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও তারা পরস্পরকে সম্বোধন করতেন ‘আপনি’সর্বনামে। অদ্ভুত লাগে, তাহলে তাদের প্ৰেম, চুম্বন, সঙ্গমও ছিলো দার্শনিক- এক ধরনের বিয়িং অ্যান্ড নাথঃনেস? একসাথে ছিলেন ৫১ বছর, ১৯২৯এ পরিচয় হওয়ার সময় থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯৮০তে সার্ত্রের মৃত্যু পর্যন্ত। ঘনিষ্ঠতার পর তাৱা তাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করেন অস্তিত্ববাদী রীতিতে, সিদ্ধান্তে পৌছেন অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্যে কখনো কখনো ধরা দেবেন। ‘অনিশ্চিত’ বা ‘আকস্মিক’ বা ‘ঘটনাচক্ৰজাত’ বা ‘কান্টিঞ্জেন্ট’ প্রেমের কাছে, যা অনিবার্য নয়, নিতান্তু আকস্মিক, যা তারা দুজনেই করেছেন, এবং জানিয়েছেন। পরস্পরকে। সার্ত্র অবশ্য লুকোচুরি করেছেন। বিয়ে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক হতো আর্থিকভাবে, কিন্তু তারা তা বেচে নেন নি; কেননা বিয়ে, এমনকি একত্রবাস, মানুষের জন্যে ক্ষতিকর, তাতে ‘এক’ আরেককে পরিণত করতে চায় ‘অপর’-এ, এক হয়ে উঠতে চায় কর্তা, অপরকে পর্যবসিত করতে চায় কর্মে। সার্ত্র একটি মেয়ে দত্তক নিয়েছিলেন, বোভোয়ার তাও নেন নি; তিনি যেমন নিজের জরায়ু থেকে একটি নকল দ্য বোভোয়ার প্রসব করতে চান নি, তেমনি চান নি সার্ত্রের একটি প্ৰতিলিপি। ১৯৩০-এর দশকের জন্যে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো খুবই অসামাজিক, অপ্রথাগত। এতে বোভোয়ারের পরিবারে নানা গোলমাল দেখা দিয়েছিলো; তাঁরা একসাথেও থাকতেন না, লিভ টুগেদার করতেন না, কেননা এটাও এক ধরনের বিয়ে যা ধ্বংস করে মানুষকে; তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্বল্পকাল একসাথে ছিলেন। পৃথকভাবে থাকতেন তাঁরা, সাধারণত হোটেলে সন্ধ্যায় দেখা করতেন, পড়তেন ও সমালোচনা করতেন পরস্পরের লেখা। যখন বিখ্যাত হয়ে উহেন তাঁরা সাহিত্যজগতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাঁদের পক্ষে; তখন তারা সকলের চোখ এড়ানোর জন্যে কাফের পর কাফে বদলাতে থাকেন। বোভোয়ার বেছে নিয়েছিলেন। নারীদের জন্যে প্রথাগত পেশাই, শিক্ষকতা: বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, খুবই ক্ষুদ্র এলাকায়, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত মার্সেই ও রোয়েঁ-এ লিসে অর্থাৎ ফরাশি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দর্শন পড়াতেন কোন কোন প্লাতো আরিস্ততল? ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যস্ত শিক্ষকতা করেন প্যারিসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি দেখা দেন অস্তিত্ববাদী আন্দোলনের এক প্রধান রূপে।
তিনি ঘটনা বর্ণনা করতে, দার্শনিক তত্ত্ব তৈরি করতে, এবং স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করতেন, যা তিনি নিন্দে করেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ সীমাবদ্ধ, গৃহবন্দী, নারীদের এক প্রিয় ব্যাপার ব’লে: তিনি বর্ণনা করেছেন ছোটো মেয়ে বোভোয়ার মায়ের সাথে ভোরবেলা যাচ্ছে খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্ব উদযাপনে, মাসে; এর মধুর স্মৃতি সত্ত্বেও স’রে আসেন। তিনি ধর্ম থেকে, দেখতে পান ধর্ম একটা ধ্যাপ্পা; বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তাঁর বিদ্যালয়, ক্যুর আদেলি দেসির, কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে, এবং কৈশোরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন ধর্মে, এটা তাঁর ক্যাথলিক মা ও তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করে একটি দেয়াল। মগজ থাকলে হৃদয় থাকবে না। কাম থাকবে না, এটা কোনো কথা নয়; বরং দেখা গেছে মগজি নারীরা প্ৰেমে-কামে অদ্বিতীয়, এটাও এক সৃষ্টিশীলতা; ১৫ বছর বয়সে তার মনে হয় তিনি প্রেমে পড়েছেন খালাতে ভাই শাঁপিনেলের, যে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফ্রান্সের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখকের লেখার সাথে; তার মা ওসব বইয়ের আপত্তিকর পাতাগুলো পিন দিয়ে আটকে রাখতেন। শাপিনেলের সাথে প্ৰেম তেতো হয়ে ওঠে, যখন শপিনেলে তার বোহেমীয় জীবন ছেড়ে বিয়ে করে এক ধনী নারীকে, যে নিয়ে আসে একটা বড়ো মাপের পণ। পণের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ; ফ্রান্সে এটা ছিলো, এবং তিক্তিভাবে ছিলো দ্য বোভোয়ারের মনে।
তিনি নিজের মধ্যে মিলিয়েছিলেন কর্ম ও জ্ঞানকে; তাই তিনি থেকেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কেন্দ্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) তিনি নাটশি অবরোধের বিরুদ্ধে ফরাশি প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন; এ-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন লে মাদারে (১৯৫৪) উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাস উপস্থাপন করে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রধান সিদ্ধান্তগুলো, দ্য বোভোয়ার সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন একগুচ্ছ উপন্যাস দিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ল এভিতে (১৯৪৩: সে থাকতে এসেছে) এটিতে ব্যক্ত হয়েছে যে-দর্শন তা দেখা যায় দ্বিতীয় লিং-এ। এটিতে এক দম্পতির সাথে আরেকটি তরুণী বাস করে দীর্ঘকাল ধরে, এতে তাদের সম্পর্ক কী সূক্ষ্মভাবে ভেঙে পড়ে, তার রূপ দেখিয়েছেন তিনি; এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ যা দেখিয়েছেন পাতায় পাতায়। একটি সত্তার সাথে আরেকটি সত্তার সম্পর্কের সমস্যা, যাতে একটি সত্তা মৌলরুপে হয়ে উঠে খাদক, অন্যটি হয়ে ওঠে খাদ্য, শিকারী ও শিকার, এর বিকাশ ঘটে এ-উপন্যাসেই। এর ঘটনা এসেছে বোভোয়ার ও সার্ত্রের ব্যক্তিগত জীবন থেকেই, নিজের জীবনকে তিনি পরিণত করেন উপন্যাস : সার্ত্রের তরুনী ছাত্রী, ওলগা কোসাকিওইজ, থাকতো তাঁদের সাথে, থাকার মধ্যে ছিলো একটা প্রথাবিরোধী চুক্তি, যা রূপ নেয় উপন্যাসে। দ্বিতীয় উপন্যাসে, অন্যদের রক্ত-এ, আর ব্যক্তিগত জীবন নয়, বিষয় হয় দার্শনিক সমস্যা; এর নায়িকা হেলেন বেরত্রা যখন দেখে একটি ছোটো ইহুদি মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে গোস্টাপোরা, সে তখন অংশ নেয়। ফ্রান্সে জর্মন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধসংগ্রামে, এবং বিশ্বাস পোষণ কয়ে যে হিটলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার একটিই উপায়ঃ হিংস্ৰতা। যে-অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, তাতে মৃত্যুর প্রতি নিবদ্ধ হয় তার সংবেদনশীলতা, এবং তিনি লেখেন সব মানুষই মরণশীল (১৯৪৬)। এর নায়ক অমর, সে তেরো থেকে বিশশতক পর্যন্ত সাতটি শতাব্দী ভ্ৰমণ করে; এবং উপন্যাসটি বুঝিয়ে দেয় যে অমরতা কোনো সমাধান নয়, মৃত্যু থেকেই উঠে আসে জীবনের অর্থ।
১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর ল্য দ্যজিয়েম সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় অপর, অপ্রয়োজনীয়, খাদ্য, রুদ্ধ, সীমাবদ্ধ, বিকলাঙ্গ, দাসী ও কামসামগ্রির স্তরে থাকার জন্যে দণ্ডিত নারীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অদ্বিতীয় গ্রন্থ; ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, ও শিল্পসৌন্দর্যে যা অতুলনীয়।
দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর পর বোভোয়ার আক্কার ফিরে আসেন উপন্যাসে; লেখেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস লে মাঁদাঁরে (১৯৫৪: দি মান্ডারিন্স্ : মন্ত্রীরা)। ফরাশি মাদারে শব্দটি নেয়া হয়েছে সংস্কৃত ‘মন্ত্ৰিণ’ থেকে, তবে এটা এখন ঠিক মন্ত্রী বোঝায় না, বোঝায় শিক্ষিত অভিজাতদের। এটির জন্যে তিনি পান প্রি গকুর পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাশি বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে তাদের ‘ম্যান্ডারিন’ মর্যাদা ছেড়ে রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলো, এটি তার বিবরণে পূর্ণ। অনেকে মনে করে এটি লিখিত সার্ত্র, কাম্যু, ও তার নিজের সম্পর্ক নিয়ে, তবে দ্য বোভোয়ার তা স্বীকার করেন না, যদিও উপন্যাসের ঘটনাগুলোর সাথে মিল আছে তাদের জীবনের। তিনি চারটি দার্শনিক বইও লিখেছেন: এর একটি পুর ওঁয়ে মরাল দ্য ল অ্যামবিগুইতে (১৯৪৭; দ্ব্যৰ্থবোধকতার নীতিশাস্ত্ৰ)। ভ্ৰমণকাহিনীও লিখেছেন দুটি: লা লঁগ মার্শ: এসে সিইর ল চিন (১৯৪৭: দীর্ঘ যাত্ৰা); এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিয়ে ল’আমেরিক অ জুত্র দ্য জুর (১৯৪৮ আমেরিকা: দিনের পর দিন)। তারপর বোভোয়ার লিখতে শুরু করেন স্মৃতিকথা, ভঙ্গিতে যেগুলো অভিনব; তাঁর আত্মজৈবনিক বই চারটি : মেমোয়ার দা’ওঁয়ে জোন ফ্রিই রাঁজে কুঁৎ (১৯৫৮; কৰ্তব্যপরায়ণ কন্যার স্মৃতিকথা), ল ফার্স দ্য ল’আজ (১৯৬০; যৌবনকাল, এটি উৎসর্গ করেন সার্ত্রের নামে) ল ফর্স দে শোজে (১৯৬৩:অবস্থার চাপ), এবং তু কঁৎ ফো (১৯৭২: সব বলা ও করা হয়ে গেছে))। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার পেরিয়ে হয়ে উঠেছে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ফরাশি বুদ্ধুজীবীদের জীবন ও মননের চিত্র। নারীবাদ ছাড়া তার বিশেষ আগ্রহের বিষয় জরায়ণ ও মৃত্যু: হাসপাতালে মায়ের মৃত্যু নিয়ে লেখেন ওয়ে মর্ত ত্রে দুসে (১৯৬৪: একটি খুব সহজ মৃত্যু), বৃদ্ধদের প্রতি সমাজের ঔদাসীন্য সম্পর্কে লেখেন লৈ ভেইয়স। (১৯৭০: বৃদ্ধকাল)। ১৯৮১তে লেলেখেন সার্ত্রের শেষ জীবনের বেদনাদায়ক বিবিরণ ল সেরেমোনি দে অদিয় (বিদায়: সার্ত্রের প্রতি চিরবিদায়)।
দ্বিতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি ব্যাপার সম্পর্কে ভাবতে চাই, যা নারী ও পুরুষের জন্যে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এবং ছিলো দ্য বোভোয়ারের জন্যেও, তা হচ্ছে প্রেম ও শরীর। শেষ জীবনে তাঁর এমন একটি ভাবমূৰ্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো যেনো তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অকম্প্র মূর্তি, তাতে কোনো কামনা বাসনা হাহাকার অশ্রু নেই, তা কখনো কাপে না; তবে তিনি কোনো মর্মরে গঠিত মোমবাতি ছিলেন না। জ্ঞানের সাথে প্ৰেম কাম ক্ৰন্দনের কোনো বিরোধ নেই, বরং জ্ঞানীরা, সৃষ্টিশীলেরাই প্রেম কাম হাহাকারে হতে পারেন অদ্বিতীয়, আর সৃষ্টিশীল নারীরা প্রেমেকামে যে-চুড়ো ছোঁয়, তা পারে না একান্ত নারীধর্মী, সীমাবদ্ধ, পতিদের পরিচারিকা, ও কামসামগ্রি স্ত্রীরা। তারা ক্লান্ত সব কিছুতে, প্রেমেও, কামেও। প্রেম এবং কামও সৃষ্টিশীল ব্যাপার, তাঁর জন্যে প্রতিভা দরকার, তা শুধু যৌনাঙ্গের উত্তেজনা নয়, যদিও ওটা অবশ্যই থাকা দরকার, এবং সঙ্গে দরকার তীব্র মানবিক প্রতিভা; এটা দেখতে পাই সব প্রধান নারী ও পুরুষের মধ্যেই, দেখতে পাই মেরি ওলস্টোনক্রাফটে, যিনি কাঁপতেন প্রেমে ও কামে, দেখতে পাই সিমোন দ্য বোভোয়ারে; জাঁ-পল সার্ত্রের সাথে তিনি চিরসঙ্গীত্বে ছিলেন, তাতে অন্য প্রেমিকের জন্যে প্রেমে মন দুলতে, দেহে পুলক লাগতে তাঁর বাধে নি।
মেরি ছিলেন তীব্র প্রেমিকা, হয়তো প্রেমিকের পদতলে চুমো খেতে খেতে স্বপ্ন দেখতেন নারীমুক্তির; আমাদের বন্দিনী বিপ্লবী রোকেয়ার কথা জানা যায় না, তবে তাঁর চিঠিগুলো ভরে আছে কামহতাশার দীর্ঘশ্বাসে, কান পাতলেই সেগুলোর হাহাকার শোনা যায়। একটি বহুমূত্রগ্রস্ত বুড়োকে নিয়ে তাঁর দিনরাত্রিগুলোর কথা ভেবে আমরা শিউরে উঠি। দ্য বোভোয়ার অন্য বিশ্বের, সার্ত্রের সাথে ছিলো তাঁর আমৃত্যু সম্পর্ক, চুক্তি ছিলো তারা নিতে পারবেন অন্যান্য প্রেমিকপ্রেমিক। সার্ত্রের অনেক নারী ছিলো। বোভোয়ারও নিয়েছেন প্রেমিক, তাদের কথা তিনি লিখেছেনও; লিখেছেন। নেলসন অ্যালগ্রেন এবং পরে ক্লাদ লাঁজমান নামে আরেকজনের কথা; সমকামী সম্পর্কও তাঁর ছিলো; সম্প্রতি জানা গেছে মননশীলতার চূড়ান্তরূপ, রূপসী, দ্য বোভোয়ার ছিলেন পল্লীর রাখালী মেয়ের থেকেও আবেগপরায়ণ, রমণীয় ছিলেন অনারীবাদীরূপে যে ‘চিরন্তনী নারী’কে তিনি বাতিল করেছিলেন, সেটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন নিজেরই ভেতরে; ভাবতে কি পারি একটি পুরুষের জন্যে দ্য বোভোয়ার কাঁদছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বা ভাবছেন তাঁর কাপড় ইন্ত্রি করার কথা, তাঁর জন্যে রান্নার বা ঘর সাজানোর কথা? ক-বছর আগে বেরিয়েছে বোভোয়ারের প্রেমপত্র বিলাভেড শিকাগো ম্যান : লেটার্স টু নেলসন অ্যালগ্লেন ১৯৪৭-৬৪। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ১৭ বছর ধ’রে লেখা ৩০৪টি চিঠি! কে আলগ্নেন? এক গৌণ মার্কিন ঔপন্যাসিক। কাতর এসব চিঠি মনে করিয়ে দেয় জন মডেলটন মারিকে লেখা বিরহিণী ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডের চিঠিগুলোকে, যা উদ্ধৃত ক’রে দ্য বোভোয়ার দেখিয়েছেন প্রেমিকা কতোটা পাগল থাকে প্রেমিককে তাঁর প্রিয় জিনিশটি, এমনকি বক্ষবন্ধনীটি দেখানোর জন্যে। তাঁর চিঠিগুলোতে যা বিস্ময়কর, তা হচ্ছে প্রেমিকের প্রতি তাঁর অতিশয় আনুগত্য; প্রেমিককে তিনি ডেকেছেন ‘কুমির’ ‘পশু’ ও “আমার প্রিয়তম স্বামী”: নিজেকে বলেছেন “তোমার অনুগত আরব স্ত্রী, যে-আরব স্ত্রীর শোচনীয় রূপ এঁকেছেন তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ। তিনি যখন লিখেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ, তখনই আলগ্রেনের কাছে লিখছিলেন কোমল, কাতর পল্লীবালার চিঠি; ১৯৪৯-এর এক সন্ধ্যায় আলগ্রেনকে লিখেছেন, ‘হায় বিধাতা! নারীরা যতো বই লিখেছে ও নারীদের সম্বন্ধে যতো বই লেখা হয়েছে, আমি সব পড়েছি এবং আমায় ঘেন্ন ধ’রে গেছে। আমি আমার আপন পুরুষ চাই!’ ১৭ বছর ধরে দ্য বোভোয়ার ইংরেজিতে, মাঝেমাঝে মধুর ভুল ইংরেজিতে, আলগ্রেনকে লিখেছেন প্রেমপত্র। তিনি রূপসী ছিলেন, তবে আলগ্রেনের সাথে দেখা হওয়ার আগে রূপ নিয়ে ভাবেন নি। ১৯৪৩-এ তাঁর একটি দাঁত পড়ৈ যায়, তিনি সেটি বাঁধান নি, কেননা তা খুবই ব্যয়বহুল ও ক্লান্তিকর ও নিরর্থক’; কিন্তু ১৯৪৮-এ, তিনি লিখেছেন, “তোমার জন্যে সপ্তাহে তিনবার আমি গেছি। দন্তচিকিৎসকের কাছে।” তিনি চেয়েছিলেন যাতে আলগ্রেন “পায় সম্পূর্ণ হাসিসহ একটি মেয়ে’। তাদের দেখা হয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে: দা বোভোয়ার ৩৯, আলগ্রেন ৩৮। এর বারো বছর আগে বেরিয়েছিলো অ্যালগ্রেনের প্রথম উপন্যাস, তাতে টাকা বা খ্যাতি কিছুই আসে নি; ১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর সোনালি বাহুর পুরুষ, এটা তাকে কিছুটা অর্থ ও খ্যাতি এনে দেয়। দ্য বোভোয়ার তাকে সম্বোধন করেছেন ‘আমার চমৎকার, বিস্ময়কর, ও প্রিয় স্থানীয় তরুণ’, ‘আমার মূল্যবান, প্রিয়তম শিকাগোর পুরুষ’ এবং “আমার প্রিয়তম স্বামী। তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আলগ্রেন; তাঁর প্রতি বিশ্বস্তু ছিলেন বছরখানেক! বোভোয়ার লিখেছেন; আমি এখন বুঝি ওটা ছিলো বোকামি, কেননা কোনো বাহুই উষ্ণ নয়, যখন তা থাকে সমুদ্রের ওপারে।’ তিনি প্যারিস ছাড়তে পারতেন, কিন্তু সার্ত্রকে নয়। আলগ্রেনকে লিখেছেন, ”তোমার সাথে আমৃত্যু দিনরাত কাটিয়ে আমি সুখ পাবো শিকাগোতে, প্যারিসে বা চিচিকাস্টেনেসোতে; তোমাকে আমি দেহে ও হৃদয়ে ও আত্মায় যতোটা ভালোবাসি, তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসা সম্ভব নয়। কিন্তু যে আমার সুখের জন্যে সব কিছু করেছে, তাকে আঘাত দেয়ার থেকে বরং আমি মরে যাবো।” ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যতো পুরুষের সাথে ঘুমিয়েছেন, তাঁর থেকে বেশি ঘুমিয়েছেন নারীদের সাথে। সার্ত্রের সাথে তাঁর যৌনজীবন টিকেছে ন-বছর। বোভোয়ায় লিখেছেন : “তিনি সবখানেই উষ্ণ, প্রাণবন্ত পুরুষ, কিন্তু শয্যায় নয়। শিগগিরই বুঝতে পেরেছিলাম, যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না; এবং প্রেমিকপ্রেমিকা হিশেবে চালিয়ে যাওয়াকে একটু একটু ক’রে মনে হতে থাকে নিরর্থক, এবং এমনকি অশ্লীল।’
বিশশতকের প্রথমার্ধ ছিলো নারীদের জন্যে এক অন্ধকার মুক্তির সময়, মুক্তির কথা স্তব্ধ হয়ে গেছে, নারীদের ধাক্কিয়ে আবার ঢুকানো হচ্ছে ঘরসংসাড়ে, বড়ো ক’রে তোলা হয়েছে ‘নারী চিরন্তনী কে, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিব্য অরুণের মতো দেখা দেয় দ্য বোভোয়ারের ল্য দাজিয়েম সেক্স (১৯৪৯: দ্বিতীয় লিঙ্গ); এটি হয়ে উঠে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতির এক ধ্রুপদী দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, রাজনীতিক ভাষ্য, হয়ে ওঠে নবনারীদের মূলগ্রন্থ। ল্য দ্যজিয়েম সেক্সকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই ভিন্ন মনে হয় মেরি ওলস্টোনক্রাফট্এর ভেন্ডিকেশন থেকে, অনেক জটিল অনেক প্রাজ্ঞ এ-বই মেরির বইটি থেকে, মেরির বইয়ের ক্রোধ ও আক্রমণ নেই এতে, এমনকি তিনি কোনো দাবিও জানান নি, তিনি ব্যাখ্যা ও উদঘাটন করেছেন নারীর পরিস্থিতি, তবে এতে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে সে চিন্তাভাবনা, যার উন্মেষ ঘটেছিলো মেরির বইতে। মেরির আক্রমণের একটি বিষয় চিরন্তনী নারী ধারণা, যা পিতৃতন্ত্রের ধর্মে দর্শনে সাহিত্যে এবং সবকিছুতে এক ধ্রুব ব্যাপার বলে গৃহীত, মেরি তা বাতিল ক’রে দেন; দ্য বোভোয়ারের প্রধান বিষয় এটিই, তবে তিনি মেরির মতো আক্রমণ করেন। নি, ধর্ম পুরাণ মনোবিজ্ঞান সাহিত্য ঘেটে দেখান এর অসারত্ব। তিনি বলেছেন, “বিধানকর্তারা, পুরোহিতেরা, দার্শনিকেরা, লেখকেরা, এবং বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে এটা সুবিধাজনক। পুরুষের উদ্ভাবিত ধর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয় আধিপত্যের এ-বাসনা।’
তাঁর বিষয় সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতি; এটা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘অস্তিত্ববাদী নীতিশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে’। তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আমরা মানুষ, কেননা আমরা পেরিয়ে যাই প্রকৃতিকে; মানুষ হওয়ার অর্থ ক্ৰমশ হয়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, আবিষ্কার করা, সৃষ্টি করা, জীবনের মূল্য শুধু বেঁচে থাকায় নয়, বরং জীবনকে নিরস্তুর বিকশিত করার মধ্যে। মানবমগুলিতে আছে দুটি লিঙ্গ : পুরুষ ও নারী; এর মাঝে পুরুষ ‘বদলে দেয় পৃথিবীর মুখমণ্ডল, সে নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করে, আবিষ্কার করে, সে গঠন করে ভবিষ্যতের রূপ’; আর এটাই তাকে ভিন্ন ক’রে তোলে পশুর থেকে। আমাদের সংজ্ঞা কী? কর্ম ও আকাংখাই সংজ্ঞায়িত করে আমাদের। প্রজননের মাধ্যমে কেউ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, হয়ে উঠতে হয় সৃষ্টি ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে; তিনি বলেছেন, ‘স্ত্রীলিঙ্গ তাঁর প্রজাতির শিকার।’ পুরুষ নিজেকে মুক্ত ক’রে নেয় নিরর্থক জৈবিক পুনরাবৃত্তির কবল থেকে, নিরন্তর চেষ্টা করে নিজের জন্যে অধিকতর স্বাধীনতা সৃষ্টির। কিন্তু নারী? নারীর শোচনীয় ট্র্যাজেডি হচ্ছে ইতিহাসব্যাপী তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে আকাঙ্খা ও উচ্চাভিলাষের অধিকার থেকে, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে দেয়া হয় নি। তিনি ব্যবহার করেছেন দুটি ধারণা : আত্ম (সেম্বফ) ও অপর (আদার), যে-দুটিকে তিনি মানবিক চেতনার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁর মতে, প্রতিটি চেতনা বিরূপ অন্য প্রতিটি চেতনার প্রতি: একটি চেতনা নিজেকে ক’রে তোলে কর্তা, প্রয়োজনীয় বা অবধারিত, আর সে অন্য চেতনাকে ক’রে তোলে কর্ম, অপ্রয়োজনীয়, আকস্মিক! নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পারস্পরিকতা রক্ষা করা হয় নি, পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছে চিরন্তন ‘অপর’, তাকে ক’রে তুলেছে কর্ম, কখনো কর্তা হয়ে উঠতে দেয় নি! তাই নারী হয়ে আছে প্রকৃতি, রহস্যময়ী, অ-মানুষ; মানুষ হিশেবে তাঁর মূল্য নেই, তাঁর মূল্য অমূর্ত ধারণার প্রতিরূপ হিশেবে। নারী যতো দিন নারী হয়ে থাকবে ততো দিন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না। তিনি অসামান্যরূপে ব্যাখ্যা করেছেন কিংবদন্তি বা পুরাণে এবং সাহিত্যে নারীর বাভমূর্তি; আক্রমণ করেছেন উৎপাদিত অসার নারীভাবমূর্তিকে। বলেছেন, ‘পুরুষের দাসী না হ’লেও নারী সময়ই আশ্রিত থেকেছে পুরুষের; এ-দুটি লিঙ্গ কখনো পৃথিবীকে সমভাবে ভোগ করেনি। তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শন ব্যাবহার করেছেন, তাঁর দর্শন পুরোপুরি গহণযোগ্য নাও হ’তে পারে, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা নির্ভুল। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই পুরুষ নিজেকে ক’রে তুল্বছ্ব মানুষের পরম রূপ, অর্থাৎ পুরুষই মানুষ, আর নারী নিতান্তই নারী; পুরুষ হচ্ছে মানুষকে মাপার মানদণ্ড, নারীকে ওই মানদণ্ডে মেপে ঘোষণা করা হয়েছে নিকৃষ্ট বলে। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর প্রথম খণ্ডে তিনি অপূর্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরুষের পক্ষপাতিত্বের; দেখিয়েছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে”; অৰ্থাৎ পিতৃতন্ত্র ছাঁচে ঢালাই ক’য়ে উৎপাদনা করে একটি উপভোগ্য বস্তু : নারী। পুরুষ করে তুলেছে প্ৰভু; তিনি বলেছেন, ‘বহু শব্দ অনেক সময় ব্যবহৃত হয় চরম আক্ষরিক অর্থে, যেমন ফ্যালাস (শিশ্ন) শব্দটি বুঝিয়ে থাকে মাংসের সে-উত্থান, যা নির্দেশ করে পুরুষকে, তারপর এগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয় সীমাহীনভাবে এবং দেয়া হয় প্রতীকী অর্থ, তাই শিশ্ন এখন বুঝিয়ে থাকে পৌরুষ ও তাঁর পরিস্থিতি। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে যে শিশ্নই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। ধনাত্মকতা ও ঋণাত্মকতার, বা বৈপরীত্যের যে-ধারণা পরে প্রধান হয়ে ওঠে ভাষাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ও অন্যান্য বিদ্যায়, তা তিনি চমৎকারভাবে প্রয়োগ করেন। নারী ও পুরুষ ব্যাখ্যায়; দেখান যে পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে একরাশ বিপৰীত ধারণা, যার একটি ধনাত্মক বা প্রয়োজনীয় বা কর্তা, আরেকটি ঋণাত্মক বা অপ্রয়োজনীয় বা কর্ম, যেমন : পুংলিঙ্গ : স্ত্রীলিঙ্গ, সংস্কৃতি : প্রকৃতি, মানুষ : পশু, উৎপাদন : প্রজনন, সক্রিয় : অক্রিয়; এগুলোর মধ্যে প্রথমটি শুভ, বিপরীতটি অশুভ, এবং পুরুষতন্ত্র প্রথমটি রেখেছে নিজের জন্যে, বিপরীতটি নারীর জন্যে। তিনি বাতিল করেছেন ‘চিরন্তনী নারীত্ব’কে, তবে তিনি পুরুষকেই মানবমগুলির প্রতিনিধি হিশেবে গ্ৰহণ করেছেন, এবং নারীর জন্যে চেয়েছেন পুরুষেরই গুণ, যেমন বহু আগে অন্ধকারতম অঞ্চলের এক নারীবাদী, রোকেয়া, পুরুষকে প্ৰচণ্ড আক্রমণ, নিন্দা, পরিহাসের পর বলেছিলেন, ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ রোকেয়া পুরুষকে বলেছেন অপদাৰ্থ দুশ্চরিত্র পাপিষ্ঠ শয়তান পাশবিক, দ্য বোভোয়ার এমন তিরষ্কার করেন নি; রোকেয়া বলেছিলেন, ‘পুরুষদের স্বার্থ ও আমাদের স্বাৰ্থ ভিন্ন নহে- একই। তাহদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই’; দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে পুরুষকেই। এ-পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীনভাবে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করবে তাদের ভ্ৰাতৃত্ববোধ।’ রোকেয়ায় এ-ভ্রাতৃত্ববোধ নেই, রয়েছে একটা বিরোধ, কিন্তু দ্য বোভোয়ার চেয়েছেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ।
১৭৯২-এ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফুটের ভিডিকেশন-এর পর থেকে অনেকেই কাজ করেন, বাস্তবে ও তাত্ত্বিকভাবে, নারীমুক্তির জন্যে; গ’ড়ে তোলান একটি মৌলিক চিন্তাধারা, যাকে আজ বলা হয় নারীবাদ, তাঁর মধ্যে যেমন রয়েছেন রামমোহন রায়, লুসি স্টোন, কেড়ি স্ট্যান্টন, সুজান অ্যান্থনি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্টুয়ার্ট মিল, হেনরিক ইবসেন, বেগম রোকেয়া, হোসা লুক্সেমবার্গ, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এবং আরো অনেকে, যারাঁ বাস্তবিক ও তাত্ত্বিকভাবে তৈরি করেন নারীমুক্তির আন্দোলন। বিশশতকে নারীবাদের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ার; তিনি যখন দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তখন তিনি ছিলেন একা, তখন ভুলেই যাওয়া হয়েছিল নারীকে; তবে দু-দশকের মধ্যেই অন্ধকার কাটে, দেখা দেয় নারীবাদের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বা নবনারীবাদ, বেরোয় বেটি ফ্রাইডানের ফেমনিন মিস্টিক(১৯৬৩), কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯); দেখা দেন জারমেইন গ্রিয়ার, মেরি এলমান, সান্ড্রা গিলবার্ট, ফাতিমা মেরনিসসি, নওএল এল সাদাওয়ি, এলেন সিজো, ল্যুস ইরিগার, ক্রিস্তেভা, টাইগ্রেস অ্যাটকিন্সন, শুলামিথ ফায়ারস্টোন, শিলা রোওবোথাম এবং বিশ্ব জুড়ে আরো অজস্ৰ, যারা বদলে দেন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার চরিত্র; এবং তঁরা কোনো-না-কোনোভাবে ঋণী সিমোন দ্য বোভোয়ারের কাছে। নারীবাদী আর কোনো পশ্চিমি প্রপঞ্চ নয়, এটা বিশ্বজনীন!
নারীবাদের বিশশতকের প্রধান প্রবক্তা, সিমোন দ্য বোভোয়ার কি ছিলেন। নারীবাদী? প্রশ্নটিই হাস্যকর মনে হ’তে পারে; এমন যে খ্রিস্ট কি ছিলেন খ্রিস্টান, মার্ক্স কি ছিলেন মার্ক্সবাদী? দ্য বোভোয়ার যখন, ১৯৪৯-এ, দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তাঁর মনে হয়েছিলো সমাজতন্ত্রই নারীকে মুক্তি দেবে তাঁর দাসত্ব থেকে, তাই তখন তিনি নিজেকে মনে করেছেন একজন সমাজতন্ত্রবাদী, নারীবাদী নয়। কিন্তু এক সময় তাঁর ভুল ভাঙে, দেখতে পান সমাজতন্ত্র নারীকে মুক্তি দিচ্ছে না, ওটিও একটি পুংতন্ত্র। ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন ফ্রান্সের এমএলএফ-এ (নারীমুক্তি আন্দোলন), এবং প্ৰথমবারের মতো নিজেকে নারীবাদী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এ এমএলএফ (নারীমুক্তি আন্দোলন) স্থাপিত হওয়ার আগে ফ্রান্সে যে-সব নারীসংঘ ছিলো, সেগুলো ছিলো সাধারণত সংস্কার ও আইনপস্থি। তাদের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি। তুলনায় নবনারীবাদ আমূল্যবাদী। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষভাগে বলেছিলাম আমি নারীবাদী নই, কেননা আমি বিশ্বাস করতাম যে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের সাথে আপনা-আপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীর সমস্যা। নারীবাদী বলতে আমি বোঝাতাম শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবে বিশেষ নারীসমস্যা নিয়ে লড়াইকে। আমি আজো একই ধারণা পোষণ করি। আমার সংজ্ঞায় নারীবাদীরা এমন নারী- বা এমন পুরুষ- যারা, সংগ্ৰাম করছেন নারীর অবস্থা বদলের জন্যে, সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং তঁরা শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবেও, সমাজের সমস্ত বদলের ওপর নির্ভর না করে, নারীর অবস্থা বদলের জন্যে সংগ্ৰাম করতে পারেন। আমি বলবো, এ-অর্থেই আমি আজ নারীবাদী, কেননা আমি বুঝতে পেরেছি যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগে নারীর পরিস্থিতির জন্যে আমাদের লড়াই করতে হবে, এখানে এবং এখনই।’
সিমোন দ্যা বোভোয়ারের মৃত্যু হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৮৬তে প্যারিসে; তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারীর সাম্য ও অধিকারের সংগ্রামের বিশ্বজনীন প্রতীক।
ল্য দ্যজিয়েম সেক্স : দ্বিতীয় লিঙ্গ বই কেমন? বলবো কি কি এটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গদ্য বইগুলোর একটি; বলবো কি যদিও এ-দুটির মধেয় তুলনা চলে না, এটি ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর থেকেও উৎকৃষ্ট? কেনো বল্বো না? তলস্তয় পৌরাণিক অনেকাংশ ক্ষতিকর ও অতিমূল্যায়িত, আর দ্য বোভোয়ার ভবিষ্যতের। তত্ত্ব, দর্শন, ব্যাখ্যা প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিলেও থাকে অনন্য শিল্পিতা, সৌন্দর্য, অজস্র উৎকৃষ্ট কবিতার রুপক, উপমা, চিত্রকর জড়ো হয়ে আছে এ-বইয়ে, এর বর্ণনাগুলোতে আছে এমন নিবিড়তা, যা ক্ষণে ক্ষণে মন এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে দেয় পরম শিহরণ, যদিও মূল আমি পড়িনি। আমি অনুবাদ করেছি এইচ এম পার্শলির অসামান্য ইংরেজি অনুবাদটি থেকে, তবে পুরোটা অনুবাদ করি নি, তাহলে হাজার পাতায় পৌছোতে হতো; অনুবাদ করেছি আমার প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। আমি আন্তরিক থাকতে চেয়েছি পার্শলির প্রতি, যেমন তিনি চেয়েছেন। দ্য বোভোয়ারের প্রতি: কোথাও ভাবানুবাদ করি নি, মূলের মতোই উপস্থাপন করতে চেয়েছি বক্তব্য। অনুবাদে ভুগেছি নানা সমস্যায়, তার মধ্যে আছে পরিভাষা; তবে তা বড়ো নয়, ভঙ্গিটিই প্ৰধান সমস্যা। এবং সমস্যা সৰ্বনামের; ইংরেজিতে সর্বনামের পুং ও স্ত্রীলিঙ্গ রূপ রয়েছে, এবং রয়েছে বস্তু ও অবস্তুবাচক সর্বনাম, কিন্তু বাঙলা সর্বনাম লিঙ্গনিরপেক্ষ, এটা নারীবাদীদের কাছে সুখের হলেও অনুবাদকের জন্যে বড়োই অসুখের; হি’, ‘সি’র বিচিত্র রূপের, এবং ‘ইট’-এর কাজ শুধু ‘সে’ বা “তা’ দিয়ে কুলোনো যায় না; তাই অনেক সময় সর্বনামের বদলে বিশেষ্যই ব্যবহার করছি। পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে সংশোধন করা হলো অনেক কিছু, এবং বাড়লো একশো পাতার মতো; এবং আর বাড়বে না।
হুমায়ূন আজাদ
৪ শ্রাবণ ১৪৩৮ : ১৯ জুলাই ২০০১
১৪ই ফুলার রোড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা।
ভূমিকা
নারী সম্পর্কে একটি বই লেখা নিয়ে আমি দীর্ঘকাল ধরে দ্বিধায় ছিলাম। বিষয়টি বিরক্তিকর, বিশেষ করে নারীদের কাছে; এবং এটা নতুন নয়। নারীবাদ নিয়ে কলহে প্রচুর কালির অপচয় হয়েছে, এবং এখন সম্ভবত এ নিয়ে আর কিছু না বলাই ভালো। তবে এখনো এ-সম্পর্কে কথা ওঠে, কেননা গত শতকে এ-সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ বাজেকথা বলা হ’লেও তা সমস্যাটিকে একটুও আলোকিত করে নি। কোনো সমস্যা কি আছে আদৌ? যদি থাকে, সেটি কী? সত্যিই কি আছে আদৌ? যদি থাকে সেটা কি?সত্যিই কি আছে নারীরা? চিরন্তন নারীত্ত্বে বিশ্বাস করেন এমন লোক এখনো আছেন, যারা আপনার কানে ফিসফিস করে বলবেন; ‘এমনকি রাশিয়ায়ও নারীরা এখনো নারী’; এবং পন্ডিতজনেরা- কখনো কখনো একই ব্যক্তি- দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেনঃ ‘নারীরা তাঁর পথ হারিয়ে ফেলেছে, নারী বিলুপ্ত।’ কিন্তু যদি আজও থেকে থাকে নারী, যদি তারা থাকে চিরকাল, তারা থাকুক এটা বাঞ্চিত হোক বা না হোক, তাই ভাবতে ইচ্ছে করে পৃথিবীতে তারা অধিকার ক’রে থাকবে কোন স্থান, তাদের স্থান কি কোথাও হওয়া উচিত? একটি স্বল্পায়ু সাময়িকপত্র সম্প্রতি প্রশ্ন করেছে, ‘কী হয়েছে নারীদের?’
কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন করা দরকারঃ নারী কী? ‘তোতা মিউলিয়েন ইন ইউতেরো’ একজন বলেন, ‘ নারী হচ্ছে জরায়ু।’ তবে কোনো কোনো নারী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে রসজ্ঞরা ঘোষণা করেন তারা নারী নয়, যদিও অন্য নারীদের মতা তারাও জরায়ুসম্বলিত। সবাই এ সত্যটি স্বীকার করে যে মানব প্ৰজাতির ভেতরে স্ত্রীলিঙ্গরা রয়েছে; চিরদিনের মতো আজো তারা মানবমগুলির অর্ধেক। তবুও আমাদের বলা হয় যে নারীত্ব বিপন্ন, আমাদের বিশেষভাবে উপদেশ দেয়া হয় নারী হতে, নারী থাকতে, নারী হয়ে উঠতে; তাই মনে হয় যে প্রতিটি স্ত্রীলিঙ্গ মানুষই নারী নয়; নারীরূপে বিবেচিত হতে হ’লে তার থাকতে হবে সে-রহস্যময় ও বিপন্ন বৈশিষ্ট্য, যাকে বলা হয় নারীত্ব। এটা কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য, যা নিঃসৃত হয় ডিম্বাশয় থেকে? অথবা এটা কি কোনো প্লাতোয়ী সারবস্তু, কোনো দার্শনিক কল্পনার সামগ্রি? কোনো কোনো নারী এ-সারসত্তার প্রতিমূর্তি হওয়ার জন্যে ব্যগ্রভাবে চেষ্টা করলেও এর উৎপাদন অসম্ভব।
ধারণাবাদ তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে নি। জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান আর স্বীকার করে না চিরস্থির অপরিবর্তনীয় গুণাবলির অস্তিত্ব, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেগুলো চাপিয়ে দেয়া হয় নারী, ইহুদি, বা নিগ্রোদের ওপর। বিজ্ঞান কোনো বৈশিষ্ট্যকে আংশিকভাবে কোনো পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বলে গণ্য করে। আজ যদি নারীত্ব না থাকে, তাহলে তা কখনো ছিলো না। তবে নারী শব্দটির কি কোনো বিশেষ অর্থ নেই? যাঁরা বিশ্বাস করেন যুক্তিবাদ ও নামবাদী দর্শনে, তাদের কাছে নারী হচ্ছে সে-সব মানুষ, যাদের স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্দেশ করা হয় নারী শব্দটি দিয়ে। অনেক মার্কিন নাৱী মনে করে যে নারী বলে আর কিছু নেই; কোনো পিছিয়ে পড়া ব্যক্তি যদি নিজেকে নারী বলে মনে করে, তাহলে তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দেয় মনোসমীক্ষণের, যাতে সে এ-আবিষ্টতা থেকে মুক্ত করতে পারে নিজেকে। আধুনিক নারী : বিলুপ্ত লিঙ্গ নামে একটি বই সম্পর্কে ডরোথি পার্কার লিখেছেন : ‘যে- সব বই নারীকে নারী হিশেবে বিচার করে, সেগুলোর প্রতি আমি ন্যায়ানুগ হ’তে পারি না…. আমার ধারণা আমাদের সবাইকে, পুরুষ ও নারীদের, গণ্য করতে হবে মানুষ হিশেবে।” তবে নামবাদ একটি অসুষ্ঠ মতবাদ; আর নারীবাদবিরোধীদের এটা দেখিয়ে দিতে কোনোই কষ্ট হয় নি যে নারীরা পুরুষ নয়। নারী অবশ্যই, পুরুষের মতোই, একজন মানুষ; তবে এ-ঘোষণা বিমূর্ত। সত্য হচ্ছে প্রতিটি বাস্তব মানুষ সব সময়ই এক একলা, পৃথক সত্তা। চিরন্তন নারীত্ব, কৃষ্ণ আত্মা, ইহুদি চরিত্র ইত্যাদি ধারণা অস্বীকার করার অর্থ এই নয় যে আজ ইহুদি, নিগ্রো, ও নারীদের অস্তিত্ব নেই; এমন অস্বীকার এদের মুক্তি নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে বাস্তবতা থেকে পলায়ন। কয়েক বছর আগে একজন বিখ্যাত নারী লেখক লেখিকাদের একগুচ্ছ ছবির মধ্যে তাঁর ছবি অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি দেন নি; তিনি চান পুরুষদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হ’তে। তবে এ সুবিধা পাওয়ার জন্যে তিনি খাটান তাঁর স্বামীর প্রভাব! যে-নারীরা নিজেদের পুরুষ ব’লে দাবি করে, তারা নির্ভর করে পুরুষদের বিবেচনা ও শ্রদ্ধাবোধের ওপরই। ট্রটস্কিপস্থি এক তরুণী, যে দাঁড়িয়েছিল এক হৈহুল্লাপূর্ণ এক জনসভার মঞ্চে, নিজের দেহের ভঙ্গুরতা সত্ত্বেও যে গুষোঘুষির জন্য ছিলো প্ৰস্তুত, তার কথা আমার মনে পড়ছে। সে অস্বীকার করেছিলো তাঁর নারীসুলভ দুর্বলতা; তবে সে এটা করেছিলো এক উগ্র পুরুষের প্রতি প্রেম থেকে, যার সমকক্ষ সে হ’তে চেয়েছিলো। অনেক মার্কিন নারীর স্পর্ধা প্রবণতা প্রমাণ করে যে তারা তাড়িত হচ্ছে তাদের নারীত্ববোধ দিয়ে। সত্য হচ্ছে, চোখ খোলা রেখে একটু ঘুরতে গিয়েই দেখা যায় মানবমণ্ডলি দু-শ্রেণীর মানুষে বিভক্ত, যাদের পোশাক, মুখমণ্ডল, শরীর, হাসি, হাঁটাচলার ভঙ্গি, আগ্রহ, এবং পেশা সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। সম্ভবত এসব ভিন্নতা বাহ্যিক, হয়তো এগুলো লোপ পেয়ে যাবে। তবে যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে যে এসব সুস্পষ্টভাবে বিরাজমান।
যদি নারী হিশেবে কাজ কয়া নারীর সংজ্ঞা তৈরির জন্যে যথেষ্ট না হয়, যদি আমরা তাকে ‘চিরন্তন নারীত্ব’ ধারণা দিয়েও ব্যাখ্যা করতে অস্বীকার করি, এবং যদি আমরা, আপাতত, স্বীকার করে নিই যে নারীরা আছে, তাহলে আমাদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয় : নারী কী?
প্রশ্নটি করাই, আমার কাছে, একটি প্রাথমিক উত্তর নির্দেশ করা। আমি যে এপ্রশ্নটি করছি, এটাই তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো পুরুষই কখনো পুরুষ মানুষের উৎকট পরিস্থিতি সম্পর্কে একখানা বই লিখতে উদ্যত হবে না; কিন্তু আমি যদি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, সবার আগে আমাকে বলতে হবে : ‘আমি একজন নারী’; পরবর্তী সমস্ত আলোচনা রচিত হবে এ-সত্যের ওপর ভিত্তি ক’রে। পুরুষ কখনোই নিজেকে কোনো এক বিশেষ লিঙ্গের সদস্য হিশেবে উপস্থাপিত করে শুরু করে না; সে যে পুরুষ, এটা বলা বাহুল্য। পুরুষ ও নারী শব্দ দুটি প্রতিসমরূপে ব্যবহৃত হয় শুধু গঠন হিশেবেই, যেমন আইনের কাগজপত্রে। বাস্তবে এ-দু-লিঙ্গের সম্পর্ক দুটি বৈদ্যুতিক মেরুর সম্পর্কের মতো নয়, কেননা পুরুষ ধনাত্মক ও নিরপেক্ষ উভয়ই নির্দেশ করে, যা দেখা যায় ম্যান শব্দটির সাধারণ ব্যবহারে, এটা বোঝায় সমগ্র মানবমগুলি; আর সেখানে নারী নির্দেশ করে শুধুই নেতিবাচকতা। কোনো বিমূর্ত আলোচনার মাঝে পুরুষদের মুখে শোনা যায় এমন বিরক্তিকর কথা; তুমি নারী ব’লেই এমন কথা ভাবছো; কিন্তু আমি জানি আত্মরক্ষার জন্যে আমার একমাত্র উত্তর হচ্ছে : “এটা সত্য ব’লেই আমি একথা ভাবছি, এটা বলে আলোচনা থেকে আমি সরিয়ে নিই আমার মন্ময় সত্তাকে। এমন উত্তর দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না যে : “তুমি পুরুষ বলেই উল্টোটা ভাবছে, তার কারণ পুরুষ হওয়া কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। পুরুষ পুরুষ ব’লেই ঠিক; নারী হওয়াই অঠিক। এটা অনেকটা এমন : প্রাচীনদের কাছে ধ্রুব উল্লম্ব ব’লে একটা ব্যাপার ছিলো, যার সাথে তুলনা করে তারা নির্দেশ করতো তির্যককে, ঠিক তেমনি রয়েছে এক ধ্রুব মনুষ্যশ্রেণী, পুরুষ; নারীর রয়েছে ডিম্বাশয়, জরায়ু; এ-অস্বাভাবিকতাগুলো তাকে বন্দী ক’রে রাখে তার মন্ময়তার মধ্যে, আবদ্ধ রাখে তাকে তার নিজের স্বভাবের সীমার মধ্যে। মাঝেমাঝেই বলা হয় যে নারী চিন্তা করে তার লালাগ্রন্থির সাহায্যে। পুরুষ চমৎকারভাবে ভুলে যায় যে তাঁর দেহসংস্থানেও রয়েছে লালাগ্রন্থি, যেমন অন্ডকোষ; এবং এগুলো থেকে নিঃসৃত হয় হরমোন। সে নিজের শরীরের কথা ভাবে পৃথিবীর সাথে এক প্রত্যক্ষ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক পাতিয়ে রেখে, এবং মনে করে যে এটা সে অনুধাবন করছে বস্তুগতভাবে, আর সে নারীর শরীরকে মনে করে একটি প্রতিবন্ধকতা, একটি কারাগায়। ‘নারী বিশেষ কিছু গুণাবলির অভাবেই নারী, বৰ্লেছে আরিস্ততল, “আমরা মনে করবো যে নারীপ্ৰকৃতি প্রাকৃতিকভাবেই ত্রুটিগ্ৰস্ত।” সেইন্ট টমাস ঘোষণা করেছেন নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, একটি ‘অ্যাকস্মিক সত্তা’। এটাই প্রতীকিত হয়েছে হয়েছে আদিপুস্তক’-এ, বোসোর মতে যেখানে হাওয়াকে সমৃষ্টি করা হয়েছে আদমের একটি সংখ্যাতিরিক্ত অস্থি’ থেকে।
এভাবে মানবজাতি হচ্ছে পুরুষ এবং পুরুষেরা নারীকে নারী হিশেবে সংজ্ঞায়িত করে না, করে পুরুষের সাথে তুলনা করে; নারীকে গণ্য করা হয় না কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা রূপে। মিশেলে লিখেছেন : নারী, আপেক্ষিক সত্তা…।” রাপোর দ্য’ইউরিয়েল-এ বেন্দা লিখেছেন : ‘নারীর শরীরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও পুরুষের শরীর নিজেই অর্থ প্রকাশ করে, অন্যদিকে নারীর শরীর একলা নিজে তাৎপর্যহীন… পুরুষ নারীকে বাদ দিয়েও ভাবতে পারে নিজের কথা। নারী পুরুষ ছাড়া নিজের সম্পর্কে ভাবতে পারে না। নারী তা-ই, পুরুষ যা ঘোষণা করে; এজন্যেই তাকে বলা হয়। শুধু ‘লিঙ্গ’, যা দিয়ে বোঝানো হয় যে নারী পুরুষের কাছে শুধুই একটি লৈঙ্গিক প্রাণী; পুরুষের কাছে নারী লিঙ্গ, চরম লিঙ্গ, তার কম নয়। পুরুষের সাথে তুলনা ক’রে তাকে সংজ্ঞায়িত ও পৃথক করা হয়, নারীর সাথে তুলনা ক’রে পুরুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, যেখানে পুরুষ হচ্ছে প্রয়োজনীয়। পুরুষ হচ্ছে কর্তা, পুরুষ হচ্ছে পরম- নারী হচ্ছে অপর।
অপর ধারণাটি চেতনার মতোই একটি আদিম ধারণা। আদিমতম সমাজে, প্রাচীনতম পুরাণে পাওয়া যায় এক ধরনের দ্বৈততা- আত্ম ও অপরের দ্বৈততা। এ দ্বৈততা শুরুতে দু-লিঙ্গের বিভাজনের সাথে জড়িত ছিলো না; এটা নির্ভরশীল ছিলো না কোনো বাস্তব সত্যের ওপরও। গ্ৰানেতের চৈনিক চিন্তাধারা ও দিউমেজিলের পূর্ব ভারত ও রোম সম্পর্কিত রচনায় এটা দেখানো হয়েছে। শুভ ও অশুভ, সুলক্ষণ ও কুলক্ষণ, ডান ও বাম, বিধাতা ও লুসিফার প্রভৃতি বিপরীতাৰ্থক শব্দবন্ধে শুরুতে নারীউপাদান যতোটা ছিলো বরুণ-মিত্রা, ইউরেনাস-জিউস, সূৰ্য-চন্দ্র, এবং দিন-রাত্রি প্রভৃতি শব্দযুগলে নারী-উপাদান তার চেয়ে বেশি ছিলো না। মানুষের চিন্তাধারায় অপর একটি মৌল ধারণা।
কোনো গোত্রই কখনো নিজের বিপরীতে অপর ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত না করে নিজেকে এক বা আত্ম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে না। যদি তিনজন সহযাত্রী ট্রেনের এক কামরায় ওঠার সুযোগ পায়, এটাই কামরার অন্য যাত্রীদের বৈরী ‘অপর’-এ পরিণত করার জন্যে যথেষ্ট। সংকীর্ণদের চোখে নিজের গ্রামের অধিবাসী নয় এমন সব মানুষই ‘অপরিচিত’ ও সন্দেহজনক; এক দেশের মানুষের কাছে ভিন্ন দেশে বাস করে এমন সব মানুষই ‘বিদেশি’; ইহুদিবিরোধীদের কাছে ইহুদিরা ভিন্ন, মার্কিন বর্ণবাদীদের কাছে নিগ্রোরা নিকৃষ্ট, ঔপনিবেশিকদের কাছে ওই দেশের অধিবাসীরা ‘নেটিভ’, বিশেষাধিকারভোগীদের কাছে সর্বহারারা নিম্ন শ্রেণী।
বিভিন্ন ধরনের আদিম সমাজ সম্পর্কিত এক জ্ঞানগর্ভ রচনার শেষে লেভি-স্ট্রাউস পৌঁচেছেন নিম্নরূপ উপসংহারে : প্রকৃত অবস্থা থেকে সংস্কৃত অবস্থায় যাত্রা চিহ্নিত হয়ে থাকে মানুষের বিশেষ সামর্থ দিয়ে যা জৈবিক সম্পর্কগুলোকে একগুচ্ছ বৈপরীত্যের পরম্পরারূপে দেখতে পায়; দ্বৈততা, পর্যায়ক্রম, বৈপরীত্য, এবং প্রতিসাম্য, সুস্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবএতো বেশি প্রপঞ্চ সৃষ্টি করে না, যাকে সমাজবাস্তবতার মৌল ও জরুরি উপাত্ত বলে ব্যাখ্যা করতে হবে। মানব সমাজ যদি হতো কোনো মিটজাইন বা সংহতি ও বন্ধুত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সাহচর্য, তাহলে এসব প্রপঞ্চ হতো অবোধগম্য। সব কিছু সহজ হয়ে ওঠে যদি আমরা হেগেলকে অনুসরণ করে দেখি যে চেতনার নিজের ভেতরেই রয়েছে অন্য সব চেতনার বিরুদ্ধে বিরোধিতা; বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় কর্তা–সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অপরিহার্যরূপে, যার বিপক্ষে আছে অপর, অপ্রয়োজনীয়, কর্ম।
তবে অপর চেতনা, অপর অহং, জ্ঞাপন করে একটি পারস্পরিক দাবি। এক দেশের অধিবাসী পাশের দেশে গিয়েই আহত বোধ করে যে ওই দেশের অধিবাসীদের কাছে সে গণ্য হচ্ছে আগন্তুক’ বলে। আসলে বিভিন্ন গোত্র, জাতি, ও শ্ৰেণীর মধ্যে যুদ্ধ, উৎসব, ব্যবসা, চুক্তি ও প্রতিযোগিতার প্রবণতা হচ্ছে অপর-এর ধ্রুব তাৎপর্য থেকে তাকে বঞ্চিত করা, এবং তার আপেক্ষিকতাকে সুস্পষ্ট করে তোলা; ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় ব্যক্তি ও দলকে বাধ্য করা হয় তাদের সম্পর্কের পারস্পরিকতা স্বীকার করে নিতে। তাহলে এটা কী করে ঘটলো যে দু-লিঙ্গের পারস্পরিক স্বীকৃত হলো না, বৈপরীত্যসূচক একটি ধারণাই হয়ে উঠলো অপরিহার্য, এর সাথে সম্পর্কিত ধারণাটিকে অস্বীকার করা হলো, এবং অন্য ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করা হলো বিশুদ্ধ অপর রূপে? এটা কেননা হলো যে নারী বিরোধিতা করে না পুরুষের সার্বভৌমত্বের? কোনো কর্তাই স্বেচ্ছায় হতে চায় না কম, অপ্রয়োজনীয়; অপর কখনো নিজেকে অপর রূপে সংজ্ঞায়িত করে এককে প্রতিষ্ঠিত করে না। একই অপরকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে নিজেকে এক রূপে সংজ্ঞায়িত করার জন্যে। অপর যদি নিজের এক হওয়ার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে না পারে, তখন তাকে অনুগত হয়ে মেনে নিতে হয় বিরোধীর দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর ক্ষেত্রে এ-আনুগত্য কেমন করে ঘটলো?
এমন আরো অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে বিশেষ কোনো একটি ধারণা অন্য ধারণার ওপর কিছু সময়ের জন্যে আধিপত্য করতে পেরেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা ঘটে সংখ্যার অসমতার জনে–সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের শাসন চাপিয়ে দেয়। সংখ্যালঘুদের ওপর, বা চালায় অত্যাচার। কিন্তু নারীরা মার্কিন নিগ্রো বা ইহুদিদের মতো সংখ্যালঘু নয়; পৃথিবীতে যতো পুরুষ আছে নারীও আছে ততোই। আবার, দুটি গোত্র শুরুতে ছিলো স্বাধীন; তারা হয়তো জানতোও না একে অপরের কথা, বা হয়তো তারা স্বীকার করে নিতে পরস্পরের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ফলে শক্তিমানরা পরাভূত করে দুর্বলদের। ইহুদিদের ছড়িয়ে পড়া, আমেরিকায় দাসত্বপ্রথা প্রবর্তন, সাম্রাজ্যবাদের দিগ্বিজয় এর উদাহরণ। এসব ক্ষেত্রে নির্যাতিতরা অন্তত তাদের স্মৃতিতে বহন করেছে আগের দিনের কথা; সম্মিলিতভাবে তারা ধারণ করেছে এক অতীত, এক ঐতিহ্য, কখনো এক ধর্ম বা এক সংস্কৃতি।
বেবেল নারী ও সর্বহারার মধ্যে যে-সাদৃশ্য দেখিয়েছেন, তা এখানে ঠিক যে এরা কখনোই কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠি বা মানবমণ্ডলির মধ্যে একটি স্বতন্ত্র যৌথ একক গঠন করে নি। সর্বহারারা চিরকাল ছিল না, তবে নারী সব সময়ই ছিলো। নারীরা তাদের দেহসংস্থান ও শারীরবৃত্ত অনুসারেই নারী। ইতিহাস ভরেই নারীরা ছিলো পুরুষের অধীন, তাই তাদের অধীনতা কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ফল নয় বা তা কোনো সামাজিক বদল নয়–এটা এমন কোনো ব্যাপার নয় যা সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ সময়ে কোনো অবস্থা ঘটানো হলে অন্য কোনো সময়ে তা বিলুপ্ত করা সম্ভব, যা প্রমাণ করেছে হাইতির নিগ্রোরা ও অন্যরা; তবে এটা মনে হতে পারে যে কোনো প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। সত্য হচ্ছে কোনো কিছুর প্রকৃতিই চিরন্তন নয়। যদি অপ্রয়োজনীয় মনে হয় নারীকে, যে কখনো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে না, এটা এজন্যে যে নারী নিজেই পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ। সর্বহারারা বলে আমরা’; নিগ্রোরাও বলে। নিজেদের কর্তা বিবেচনা করে তারা বুর্জোয়াদের, শাদাদের রূপান্তরিত করে অপর’-এ। কিন্তু নারীবাদীদের কিছু সম্মেলন বা এ-ধরনের কিছু বিক্ষোভে ছাড়া। নারীরা বলে না আমরা; পুরুষেরা বলে নারীরা’, আর নারীরাও নিজেদের নির্দেশ করার জন্যে ব্যবহার করে এ-একই শব্দ। তারা কখনো অকৃত্রিমভাবে কর্তার মনোভাব গ্রহণ করে না। সর্বহারারা রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে, হাইতিতে ঘটিয়েছে নিগ্রোরা, ইন্দো-চীনে এর জন্যে সংগ্রাম করছে ইন্দো-চীনারা; কিন্তু নারীরা কখনো প্রতীকী বিক্ষোভের বেশি কিছু করে নি। তারা তা-ই লাভ করেছে, যা পুরুষ তাদের দিতে চেয়েছে; তারা কিছুই নেয় নি, তারা শুধু পেয়েছে।
এর কারণ হচ্ছে নারীদের এমন কোনো বাস্তব সম্বল নেই, যার সাহায্যে তারা নিজেদের সংগঠিত করতে পারে একটি এককে, যা পারে তাদের সাথে সম্পর্কিত এককটির মুখোমুখি দাঁড়াতে। তাদের নিজেদের কোনো অতীত নেই, ইতিহাস নেই, ধর্ম নেই; এবং সর্বহারাদের মতো তাদের নেই কোনো কর্ম ও স্বার্থের সংহতি। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে পুরুষদের মধ্যে; বাসগৃহ, গৃহস্থালি, আর্থিক অবস্থা, ও সামাজিক মর্যাদার সূত্রে তারা দৃঢ়ভাবে জড়িত থাকে কোনো পুরুষের সঙ্গে পিতা বা স্বামীর সঙ্গে–যা তারা থাকে না কোনো নারীর সঙ্গে। যদি তারা বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত হয়, তাহলে তারা ওই শ্রেণীর পুরুষের সাথে সংহতি বোধ করে, সর্বহারা নারীর সাথে করে না; যদি তারা শাদা হয়, তাহলে তারা শাদা শ্রেণীর পুরুষের সাথে সংহতি বোধ করে, নিগ্রো নারীর সাথে করে না। সর্বহারারা শাসকশ্রেণীকে হত্যা করার প্রস্তাব করতে পারে; এবং উগ্র কোনো ইহুদি বা নিগ্রো স্বপ্ন দেখতে পারে যে তার হাতে এসেছে আণবিক বোমা, এবং মানবমণ্ডলিকে সে ক’রে তুলেছে ইহুদি বা নিগ্রো; কিন্তু নারী পুরুষনিধনযজ্ঞের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। যে-বন্ধন তাকে বেঁধে রাখে। তার পীড়নকারীর সাথে, অন্য কিছুর সাথে তার তুলনা হয় না। লিঙ্গ বিভাজন একটি জৈবিক সত্য, এটা মানব ইতিহাসের কোনো ঘটনা নয়। নারী ও পুরুষ এক আদিম মিটজাইন-এ (সাহচর্য, সহবসবাস) পরস্পরের বিপরীতে বিন্যস্ত; নারী এটাকে ভাঙে নি। যুগল হচ্ছে এক মৌল ঐক্য, যার দু-অর্ধেককে একত্রে গেঁথে দেয়া হয়েছে, এবং লিঙ্গের রেখা ধরে সমাজে ফাটল ধরানো অসম্ভব। এখানেই পাওয়া যাবে নারীর মৌল বৈশিষ্ট্য : নারী অপর এমন এক সমগ্রতায়, যার দুটি উপাদান পরস্পরের কাছে প্রয়োজনীয়।
মনে করতে পারি যে এ-পারস্পারিকতা নারীর মুক্তিকে সহজতর করতে পারতো। হারকিউলিস যখন ওমফালের পায়ের কাছে বসে তাকে সাহায্য করেছিলো সুতো কাটায়, তখন তাকে বন্দী করে রেখেছিলো ওমফালের জন্যে তার কামনা; কিন্তু ওমফালে কোনো অর্জন করতে পারে নি স্থায়ী ক্ষমতা? জেসনের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে মিডিয়া হত্যা করেছিলো তাদের সন্তানদের; এ-নির্মম উপকথাটি নির্দেশ করে যে সন্তানদের প্রতি জেসনের ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মিডিয়া জেসনের ওপর বিস্তার করেছিলো এক ভয়াবহ প্রভাব। লাইসিসট্রাটায় আরিস্তোফানেস প্রমোদের সাথে এঁকেছেন একদল নারীর চিত্র, যারা পুরুষদের কাম পরিতৃপ্তির মধ্য দিয়ে লাভ করতে চায় সামাজিক সুবিধা; তবে এটা নাটমাত্র। সেদিন নারীদের উপকথায় দেখা যায় ধর্ষণকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্যে তারা বন্ধ্যা থাকার যে-পরিকল্পনা করেছিলো, তারা তা ত্যাগ করে অনতিবিলম্বে। যৌন কামনা ও সন্তান লাভের বাসনার পরিতৃপ্তির জন্যে পুরুষ নির্ভরশীল হয় নারীর ওপর, কিন্তু সত্য হচ্ছে যে পুরুষের প্রয়োজন মিটিয়ে নারী কখনো সামাজিক মুক্তি লাভ করে নি।
প্রভু ও দাস সম্পর্কিত হয় পারস্পরিক প্রয়োজনে; এ-ক্ষেত্রে প্রয়োজনটা। আর্থনীতিক, এবং এটা দাসকে মুক্ত করে না। প্রভুর সঙ্গে দাসের যে-সম্পর্ক, তাতে প্রভু গুরুত্বই দেয় না যে দাস তার প্রয়োজন, কেননা নিজের কাজ দিয়েই নিজের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা তার আছে; অন্য দিকে দাস থাকে অধীন অবস্থায়, আশায় ও ভয়ে, এবং সব সময়ই সচেতন থাকে যে তার প্রভু প্রয়োজন। যদিও প্রয়োজনটা দুজনেরই, তবু এটা সব সময় কাজ করে উৎপীড়কের পক্ষে ও উৎপীড়িতের বিপক্ষে। এজন্যেই শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তিতে বিলম্ব ঘটেছে।
পুরুষের দাসী না হলেও নারী সব সময়ই আশ্রিত থেকেছে পুরুষের; এ-দুটি লিঙ্গ কখনো পৃথিবীকে সমভাবে ভোগ করে নি। নারী আজো ভীষণভাবে প্রতিবন্ধকতাগ্রস্ত, যদিও বদলাতে শুরু করেছে তার পরিস্থিতি। কোনোখানেই তার আইনগত মর্যাদা পুরুষের সমান নয়, এবং অধিকাংশ সময়ই এটা তার জন্যে অসুবিধাজনক। যদিও কখনো তার অধিকার আইনগতভাবে স্বীকার করে নেয়াও হয়, তবু দীর্ঘকালের প্রথার ফলে তার বাস্তবায়ন ঘটে না। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ দুটি জাতের মতো; অন্য সব কিছু সমান থাকলেও পুরুষ পায় ভালো চাকুরি, বেশি বেতন, এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে তাদের সাফল্যের সুযোগও বেশি। শিল্পকারখানা ও রাজনীতিতে পুরুষ পায় অনেক বেশি পদ, তারাই দখল করে নেয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো। এ ছাড়াও তারা উপভোগ করে প্রথাগত মর্যাদা, কেননা বর্তমান পবিত্রভাবে রক্ষা করে অতীতকে–এবং অতীতে পুরুষেরাই সৃষ্টি করেছে সব ইতিহাস। এখন নারীরা পৃথিবীর কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেছে, তবে পৃথিবী এখনো পুরুষের অধিকারে–এ-সম্পর্কে পুরুষ সন্দেহহীন এবং নারীদেরও সন্দেহ সামান্য। অপর হওয়া প্রত্যাখ্যান করা, এ-লেনদেনে অংশীদার হতে অস্বীকার করা–নারীর জন্যে এটা হবে উচ্চবর্ণের সাথে মৈত্রী তাদের যে-সব সুবিধা দিয়েছে, সে-সব পরিত্যাগ করা। সার্বভৌম পুরুষ অধীন নারীকে দেয় আর্থিক নিরাপত্তা এবং প্রতিপাদন করে তার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা। এটা সত্য যে প্রতিটি ব্যক্তি যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব, তেমনি নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বস্তু হয়ে ওঠার প্রলোভনও কাজ করে তার মধ্যে। এটা এক অশুভ পথ, কেননা এ পথ যে ধরে–অক্রিয়, বিলুপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত সে–সে এর পর হয়ে ওঠে অন্যের ইচ্ছের প্রাণী। তবে এটা সহজ পথ; এ-পথ ধরলে খাঁটি অস্তিত্ব লাভের যন্ত্রণাগুলো থাকে না। নিজের সুস্পষ্ট শক্তির অভাবেই নারী কর্তার ভূমিকা লাভের দাবি জানাতে ব্যর্থ হয়, কেননা পুরুষের সাথে বন্ধনটাকেই সে চায়, পারস্পরিকতা চায় না, এবং অপর হিশেবে নিজের ভূমিকা নিয়ে সে অধিকাংশ সময়ই থাকে তুষ্ট।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে : এসব শুরু হয়েছিলো কীভাবে? সহজেই চোখে পড়ে যে লিঙ্গের দ্বৈততা, যে-কোনো দ্বৈততার মতোই, সৃষ্টি করে বিরোধ। এবং এতে যে জয়ী হয়, সে-ই ধারণ করে চরম মর্যাদা। কিন্তু পুরুষ কেননা প্রথম থেকেই জয়ী? এটা সম্ভবপর মনে হয় যে নারী হয়তো জয়ী হতে পারতো; বা ওই বিরোধের পরিণতি হতে পারতো ফলাফলহীন। এটা কীভাবে হলো যে পৃথিবী সব সময়ই থেকেছে পুরুষের অধিকারে এবং পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে এই সম্প্রতি? এ-পরিবর্তন কি ভালো জিনিশ? এর ফলে কি পুরুষ ও নারী পৃথিবীকে পাবে সমানভাবে?
প্রশ্নগুলো নতুন নয়, এবং এগুলোর উত্তর মাঝেমাঝেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু নারী যেহেতু অপর, তাই পুরুষেরা যে-সব উত্তর দিয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। এসব উত্তর দেয়া হয়েছে সুস্পষ্টভাবে পুরুষের স্বার্থ থেকে। সতেরো শতকের একজন স্বল্পপরিচিত নারীবাদী, পলাঁ দ্য লা বার, এটা প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘পুরুষেরা নারী সম্পর্কে যা কিছু লিখেছে, তার সবই সন্দেহজনক, কেননা পুরুষ একই সঙ্গে বিচারক ও বিবাদী।’ সবখানে, সব সময়, পুরুষেরা এটা বোধ ক’রে সন্তোষ প্রদর্শন করেছে যে তারাই সৃষ্টির প্রভু। সমস্ত প্রশংসা বিধাতার… যিনি আমাকে নারী করে সৃষ্টি করেন নি,’ ইহুদিরা প্রাতকালীন প্রার্থনায় একথা বলে, যখন তাদের স্ত্রীরা প্রতিবাদহীন স্বরে বলে : সমস্ত প্রশংসা বিধাতার, যিনি আমাকে তাঁর অভিলাষ অনুসারে সৃষ্টি করেছেন। যে-সব আশীর্বাদ লাভের জন্যে প্লাতো দেবতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে যে তাকে মুক্ত মানুষ হিশেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, দাস হিশেবে নয়; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাকে পুরুষরূপে সৃষ্টি করা। হয়েছে, নারীরূপে নয়। তবে পুরুষের পক্ষে এ-সুবিধা পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করা সম্ভব হতো না যদি না তারা বিশ্বাস করত যে এটা প্রতিষ্ঠিত পরম ও শাশ্বত ভিত্তির ওপর; তারা চেষ্টা করেছে তাদের প্রাধান্যকে অধিকাররূপে প্রতিষ্ঠিত করার। যারা আইন প্রণয়ন ও সংকলন করেছেন, তাঁরা পুরুষ ছিলেন, তাই তারা সুবিধা দিয়েছেন নিজেদের লিঙ্গকে, এবং বিচারকেরা এ-আইনগুলোকে উন্নীত করেছেন নীতির স্তরে, এটা পলাঁ দ্য লা বার থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি।
বিধানকর্তারা, পুরোহিতেরা, দার্শনিকেরা, লেখকের এবং বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে এটা সুবিধাজনক। পুরুষের উদ্ভাবিত ধর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয় আধিপত্যের এ বাসনা। হাওয়া ও প্যান্ডোরার উপকথায় পুরুষ নারীর বিরুদ্ধে নেমেছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। তারা ব্যবহার করেছে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বকে, যা দেখা যায় আরিস্ততল ও সেইন্ট টমাস থেকে উদ্ধৃতিতে। প্রাচীন কাল থেকেই ব্যঙ্গাকারেরা ও নীতিবাগীশেরা প্রচুর আনন্দ উপভোগ করে এসেছে নারীর দুর্বলতা দেখিয়ে দেখিয়ে। ফরাশি সাহিত্য ভরে নারীর বিরুদ্ধে যে-বর্বর অভিযোগ করা হয়েছে, তার সাথে আমরা পরিচিত। এ-বৈরিতা কখনো কখনো হয়তো সত্য, এবং অধিকাংশ সময়ই ভিত্তিহীন; তবে এগুলো কমবেশি সফলভাবে গোপন করে রাখার চেষ্টা করে নিজেকে ঠিক বলে প্রতিপন্ন করার বাসনা। যেমন মঁতেইন বলেছেন, অপর লিঙ্গটিকে ক্ষমা করার থেকে একটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ভোলা সহজ। অনেক সময় কী ঘটছে, তা বেশ স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, রোমান আইন নারীর অধিকার খর্ব করতে গিয়ে বলেছে নারীর মূঢ়তা, স্থিতিহীনতার কথা; এ-সময় দুর্বল হয়ে পড়ছিলো পারিবারিক বন্ধন, আর এতে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো পুরুষ উত্তরাধিকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার। নারীকে অভিভাবকের অধীনে রাখার জন্যে ষোড়শ শতকে আবেদন করা হয়েছিলো সেইন্ট অগাস্টিনের কর্তৃত্বের প্রতি, যিনি ঘোষণা করেছিলেন নারী এমন জীব, যে সিদ্ধান্তগ্রহণসক্ষম নয় স্থিরও নয়; এটা ঘটেছিলো এমন সময়ে যখন মনে করা হয়েছিলো যে একলা নারী নিজের সম্পত্তি দেখাশোনা করতে সমর্থ। নারীর নির্ধারিত ভাগ্য কতোটা খামখেয়ালিপূর্ণ ও অন্যায্য, তা স্পষ্ট বুঝেছিলেন মতেইন : নারী যখন তার জন্যে প্রণীত বিধিবিধান মানতে অস্বীকার করে, তখন সে একটুও ভুল করে না, কেননা নারীর সাথে আলোচনা করেই পুরুষেরাই প্রণয়ন করে এসব বিধিবিধান। ষড়যন্ত্র আর কলহের যে এতো ছড়াছড়ি, এটা কোনো বিস্ময় নয়। কিন্তু তিনি নারীর পক্ষে যোদ্ধা হয়ে ওঠেন নি।
বেশ পরে, আঠারে শতকে, সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক পুরুষেরা ব্যাপারটিকে বস্তুগতভাবে দেখতে শুরু করেন। আরো অনেকের মতো দিদেরো দেখাতে চেয়েছেন যে পুরুষের মতো নারীও মানুষ। পরে জন স্টুয়ার্ট মিল ঐকান্তিকভাবে দাঁড়িয়েছেন নারীর পক্ষে। এ-দার্শনিকেরা দেখিয়েছেন অসাধারণ নিরপেক্ষতা। উনিশ শতকে। নারীবাদী কলহ আবার হয়ে ওঠে দলভুক্তদের কলহ। শিল্পবিপ্লবের একটি পরিণতি ছিলো যে নারী প্রবেশ করে উৎপাদনমূলক শ্রমে, এবং এখানেই নারীবাদীদের দাবি তাত্ত্বিক এলাকা পেরিয়ে লাভ করে আর্থনীতিক ভিত্তি, আর তাদের বিরোধীরা হয়ে ওঠে আরো বেশি আক্রমণাত্মক। যদিও তখন ভূম্যধিকার বেশ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তবু বুর্জোয়ারা আঁকড়ে থাকে পুরোনো নৈতিকতা, যা পারিবারিক সংহতির মধ্যেই দেখতে পায় ব্যক্তিমালিকানার নিশ্চয়তা। নারীর মুক্তি এক সত্যিকার হুমকি হয়ে দেখা দেয় বলে নারীকে আবার আদেশ দেয়া হয় ঘরে ফেরার। এমনকি শ্রমজীবীদের মধ্যেও পুরুষেরা নারীর মুক্তি ঠেকাতে চেষ্টা করে, কেননা তারা নারীকে দেখতে শুরু করে বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে–বিশেষ করে এজন্যে যে নারীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলো কম মজুরিতে কাজ করতে।
এরপর নারীর নিকৃষ্টতা প্রমাণের জন্যে নারীবাদবিরোধীরা আগের মতো শুধু ধর্ম, দর্শন, ও ধর্মতত্ত্বের নয়, তারা সাহায্য নিতে শুরু করে বিজ্ঞানের–জীববিদ্যা, নিরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞান প্রভৃতির। নারীকে তারা সর্বোচ্চ যা দিতে সম্মত হয়, তা হচ্ছে ‘ভিন্নতার মধ্যে সাম্য’। ওই লাভজনক সূত্রটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; এটা উত্তর। আমেরিকার নিগ্রোদের জন্যে প্রণীত জিম ক্রো আইনের ‘সমান, তবে পৃথক’ সূত্রের মতোই। সবাই জানে এ-তথাকথিত সাম্যপরায়ণ বিচ্ছিন্নকরণের ফল হচ্ছে চরমতম বৈষম্য। যে-সাদৃশ্য এখানে দেখানো হলো, এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, কেননা যখনই কোনো জাতি, বর্ণ, শ্রেণী বা লিঙ্গকে নিকৃষ্ট অবস্থানে ঠেলে দেয়া হয়, তখন তার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা হয় একই পদ্ধতিতে। ‘চিরন্তনী নারী’ কথাটি ‘কৃষ্ণ আত্মা’ এবং ‘ইহুদি চরিত্র’ ধারণারই সমতুল্য। এটা সত্য যে ইহুদিদের সমস্যাটি অন্য দুটি থেকে ভিন্ন–ইহুদিবিরোধীদের কাছে ইহুদিরা নিকৃষ্ট নয়, তারা শত্রু, যাদের পৃথিবীতে টিকে থাকতে দেয়া যাবে না, নিশ্চিহ্নীকরণই তাদের জন্যে। নির্ধারিত নিয়তি। কিন্তু নারী ও নিগ্রোর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে গভীর সাদৃশ্য। এরা উভয়ই আজকাল মুক্তি পাচ্ছে একই ধরনের অভিভাবকত্ব থেকে এবং আগের প্রভুশ্রেণীটি চাচ্ছে তাদের নিজের জায়গায় রাখতে’–অর্থাৎ তাদের জন্যে নির্ধারিত স্থানটিতে রাখতে। উভয় ক্ষেত্রেই আগের প্রভুরা মুখর হয়ে ওঠে কমবেশি আন্তরিক স্তুতিতে, তারা প্রশংসায় মুখর হয় ভালো নিগ্রোর গুণাবলির, তার সুপ্ত, শিশুসুলভ, প্রফুল্ল আত্মার, অর্থাৎ অনুগত নিগ্রোর; অথবা সে-নারীর গুণাবলির, যার রয়েছে প্রকৃত নারীত্ব’, অর্থাৎ লঘু, বালখিল্য, দায়িত্বহীন–অনুগত নারীর। উভয় ক্ষেত্রেই আধিপত্যশীল শ্ৰেণীটি নিজের যুক্তিকে দাঁড় করায় এমন সব ব্যাপারের ওপর, যেগুলো সৃষ্টি করেছে তারা নিজেরাই। জর্জ বার্নার্ড শ এর সারকথা বলেছেন এভাবে, মার্কিন শাদারা কালোদের ঠেলে নামিয়ে দেয় জুতোপালিশকারী বালকদের স্তরে, এবং এ থেকে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে কালোরা জুতো পালিশ করা ছাড়া আর কিছুর উপযুক্ত নয়।’ এ-দুষ্টচক্রের দেখা পাওয়া যায় সদৃশ সমস্ত পরিস্থিতিতে; যখন কোনো ব্যক্তিকে (বা একদল ব্যক্তিকে) রাখা হয় নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে, তখন তাকে নিকৃষ্টই মনে হয়।
কিন্তু হওয়া ক্রিয়াটির তাৎপর্য ঠিকমতো বোঝা দরকার; প্রতারণার উদ্দেশ্যেই একে দেয়া হয় অনড় মূল্য, যদিও এটি নির্দেশ করে এক জিনিশ থেকে আরেক জিনিশ হওয়ার গতিশীল হেগেলীয় অর্থ। হ্যা, সব কিছু মিলিয়ে নারী আজ পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট; এর অর্থ হচ্ছে এ ছাড়া নারীর অন্য কিছু হওয়ার উপায় ছিলো না। প্রশ্ন হচ্ছে : এ-অবস্থা কি চলতে থাকবে?
অনেক পুরুষই আশা করে যে এটা চলবে; সবাই যুদ্ধে ক্ষান্ত হয় নি। রক্ষণশীল বুর্জোয়ারা নারীর মুক্তির মধ্যে আজো দেখতে পায় তাদের নৈতিকতা ও স্বার্থের প্রতি হুমকি। কিছু পুরুষ ভয় পায় নারীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে। সম্প্রতি এক ছাত্র হেবদোলাতিন-এ লিখেছে : প্রতিটি ছাত্রী, যে চিকিৎসাবিদ্যা বা আইন পড়ে, হরণ করে আমাদের একটি করে চাকুরি।’ পৃথিবীতে নিজের অধিকার সম্পর্কে তার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগে নি। আর আর্থিক স্বার্থই সব নয়। উৎপীড়ন উৎপীড়নকারীদের যেসব সুফল দেয়, তার একটি হচ্ছে তাদের মধ্যে অধমটিও নিজেকে গণ্য করে শ্রেষ্ঠতর বলে; এভাবে দক্ষিণের একটি ‘গরিব শাদা’ও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে একথা ভেবে যে সে ‘নোংরা কালা আদমি’ নয়–আর ধনশালী শাদারা এ-গর্বটিকে সুচতুরভাবে লাগায় নানা কাজে।
একইভাবে, পুরুষের মধ্যে চরম অধমটিও নারীদের তুলনায় নিজেকে মনে করে একটি নরদেবতা। এম দ্য মঁতেরলঁর পক্ষে নারীদের সামনে নিজেকে নায়ক মনে করা ছিলো খুবই সহজ, পুরুষদের মধ্যে পুরুষ হিসাবে অভিনয় করে সে তা মনে করতে পারে নি, যদিও বহু নারী ওই কাজ করেছে তার থেকে অনেক বেশি ভালোভাবে। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে ফিগারো লিতেরের-এর একটি রচনায় ক্লদ মারিয়াক, যাঁর মহৎ মৌলিকত্বের সবাই অনুরাগীনালী সম্বন্ধে লিখতে পেরেছিলেন : ‘আমরা শুনতে থাকি বিস্র উদাসীনতার স্বউদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীর মধ্যে, এটা ভালোভাবে জেনেই যে তার বোধশক্তি কমবেশি উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত করে এমন চিন্তাভাবনা, যা আসে আমাদের থেকেই।’ এটা সুস্পষ্ট যে-বক্তাটির কথা বলা হয়েছে, তিনি মারিয়াকের নিজের চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত করেন না, কেননা তার যে নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে এটা কারো জানা নেই। এমন হতে পারে যে ওই নারীটি পুরুষের মধ্যে উৎসারিত চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত করেন, তবে পুরুষের মধ্যেও এমন অনেক আছে যারা অন্যদের চিন্তাভাবনা আত্মসাৎ করেছে; প্রশ্ন করতে পারি যে ক্লদ। মারিয়াকের পক্ষে কি পাওয়া সম্ভব ছিলো না এরচেয়ে আকর্ষণীয় কথোপকথন, যা তাঁকে প্রতিফলিত না করে প্রতিফলিত করে দেকার্ত, মার্ক্স, বা জিদকে। যা সত্যিই অসামান্য এখানে, তা হচ্ছে যে আমরা ব্যবহার করে তিনি নিজেকে করে তুলেছেন সেইন্ট পল, হেগেল, লেনিন, ও নিটশের সমতুল্য, এবং তাদের মহিমার উচ্চতা থেকে অবজ্ঞার সাথে তিনি তাকান সে-নারীর ঝাকের দিকে, যারা একই সমতলে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথোপকথনের সাহস করেন। আমি একাধিক নারীকে জানি, যারা অস্বীকার করতেন মারিয়াকের ‘বিনম্র উদাসীনতার স্বর’-এর পীড়ন সহ্য করতে।
এ-উদাহরণটি নিয়ে আমি একটু বেশি সময় কাটিয়েছি, কেননা পুরুষালি প্রবণতা এটিতে দেখানো হয়েছে প্রতিপক্ষকে শক্তিহীন করে তোলার মতো অকপটভাবে। কিন্তু পুরুষ আরো অনেক সূক্ষ্ম উপায়ে লাভবান হয় নারীর অপরত্ব থেকে। যারা ভুগছে হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষায়, এখানে তাদের জন্যে রয়েছে এক অলৌকিক মলম, আর একথা সত্য যারা নিজেদের পৌরুষ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের থেকে আর কেউ নারীর প্রতি বেশি আক্রমণাত্মক, বা বিদ্বেষপরায়ণ নয়। আজকাল অধিকাংশ পুরুষ আর নারীকে নিকৃষ্ট বলে গণ্য করে না; তাদের মধ্যে এখন গণতন্ত্রের আদর্শ কাজ করে, তাই সব মানুষকে সমান মনে না করে কোনো উপায় নেই।
পরিবারের মধ্যে থেকে শিশু ও যুবকের চোখে নারী ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের একই সামাজিক মর্যাদা আছে বলে মনে হয়। পরে কামনা ও প্রেমময় ওই যুবক উপলব্ধি করে তার কাম্য ও প্রেমাস্পদ নারীটির প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা; বিয়ের মধ্যে নারীকে সে শ্রদ্ধা করে স্ত্রী ও মা হিশেবে, এবং দাম্পত্য জীবনের বাস্তব ঘটনাবলিতে নারীটি পুরুষটির কাছে দেখা দেয় এক স্বাধীন মানুষরূপে। তাই পুরুষটি মনে করতে পারে লিঙ্গ দুটির মধ্যে আর কোনো অধীনতা নেই এবং সব মিলিয়ে পার্থক্য সত্ত্বেও নারী তার সমান। তবে সে গুটিকয় নিকৃষ্টতা লক্ষ্য করে–তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে কোনো পেশার জন্যে নারীর অযোগ্যতা; সে মনে করে এর মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ। যখন সে নারীর সঙ্গে থাকে সহযোগিতামূলক ও সদাশয় সম্পর্কে, তখন তার বিষয়বস্তু হচ্ছে বিমূর্ত সাম্যের নীতি এবং যে-সব অসাম্য রয়েছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে সে তার মনোভঙ্গি গঠন করে না। কিন্তু যখন সে বিরোধে লিপ্ত হয় নারীর সাথে, তখন পরিস্থিতি উল্টে যায় : তখন তার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে বিরাজমান অসাম্য, এবং এমনকি এর মধ্যেই সে পায় বিমূর্ত সাম্যকে অস্বীকার করার যৌক্তিকতা।
অনেক পুরুষ যেনো সরল বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে থাকে যে নারী পুরুষের সমান এবং তাদের শোরগোল করার কিছু নেই, এবং একই সময়ে তারা বলে নারীরা কখনোই পুরুষের সমান হয়ে উঠতে পারবে না; তাদের দাবি নিষ্ফল। পুরুষের পক্ষে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণের গুরুত্ব বোঝা বেশ কঠিন, কেননা এটাকে নগণ্য মনে হয় বাহ্যিকভাবে, কিন্তু এটা নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে এমন গভীর নৈতিক ও মননগত প্রভাব যে মনে হয় ওগুলো উদ্ভূত হয়েছে তার মৌল স্বভাব থেকে। সবচেয়ে সহানুভূতিশীল পুরুষেরাও নারীর বাস্তব পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারে না। আর যে-পুরুষেরা নিজেদের সুবিধাগুলো রক্ষা করার জন্যে ব্যর্থ, তাদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই; তারা ওগুলোর পরিমাণ নিজেরাও পরিমাপ করতে পারে না। নারীর ওপর যতো আক্রমণ চালানো হয়, সেগুলোর সংখ্যা ও ভয়াবহতা দেখে ভয় পেলে চলবে না, আর ‘খাঁটি নারী’র বন্দনার ফাঁদে পড়লেও আমাদের চলবে না।
নারীবাদীদের যুক্তিগুলোও কম সন্দেহের চোখে বিচার করলে চলবে না, কেননা অনেক সময়ই তাদের বিতর্কিত লক্ষ্য তাঁদের বঞ্চিত করে প্রকৃত মূল্য থেকে। নারী সমস্যাটিকে যদি তুচ্ছ বলে মনে হয়, তার কারণ হচ্ছে পুরুষালি উগ্রতা একে পরিণত করেছে একটি ঝগড়ায়; এবং ঝগড়ারত মানুষ কখনো ঠিকমতো যুক্তি প্রয়োগ করে না। অনেকে বলে আদমের পর সৃষ্টি হয়েই নারী পরিণত হয়েছে একটি গৌণ সত্তায়; অন্যরা বলে এর উল্টো যে আদম ছিলো একটি অসমাপ্ত খসড়া এবং বিধাতা যখন হাওয়াকে সৃষ্টি করেন তখনই তিনি সফল হন বিশুদ্ধভাবে মানুষ সৃষ্টিতে। নারীর মস্তিষ্ক ক্ষুদ্রতর; হ্যাঁ, কিন্তু সেটি তুলনামূলকভাবে বৃহৎ। খ্রিস্টকে পুরুষরূপে। সৃষ্টি করা হয়েছিলো; হ্যাঁ, তা হয়তো তার মহত্তর বিনয়ের জন্যে। প্রতিটি যুক্তিই সাথেসাথে নির্দেশ করে তার বিপরীতকে, এবং দুটিই অধিকাংশ সময় বিভ্রান্তিকর। ব্যাপারটি বুঝতে চাইলে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এসব বাধাপথ থেকে; বাদ দিতে হবে উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট, সাম্য প্রভৃতি অস্পষ্ট ধারণা, যেগুলো দূষিত করেছে এবিষয়ের প্রতিটি আলোচনাকে। আমাদের শুরু করতে হবে নতুনভাবে।
বেশ, কিন্তু কীভাবে আমরা উপস্থাপন করবো প্রশ্নটি? আর আমরা এটি উপস্থাপনের কে? পুরুষ একই সাথে বিচারক ও বিবাদী; আর নারীও তাই। আমাদের দরকার একটি দেবদূত–পুরুষও নয় নারীও নয়। কিন্তু কোথায় পাবো দেবদূত? তারপর, এ-বিষয়ে দেবদূতের কথা বলার যোগ্যতা খুবই কম কেননা দেবদূত এসমস্যার মৌলিক সত্যগুলো সম্বন্ধে অজ্ঞ। উভলিঙ্গকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না, কেননা এ-ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হবে খুবই উৎকট; উভলিঙ্গ কোনো সম্পূর্ণ পুরুষ ও সম্পূর্ণ নারীর মিলিত রূপ নয়, বরং সে গঠিত প্রত্যেকের অংশবিশেষে; তাই সে নারীও নয় পুরুষও নয়। আমার মনে হয় কিছু নারী আছেন, যাঁরা নারীর পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্যে সবচেয়ে যোগ্য। আমরা যেনো এ-কূটতর্ক দিয়ে বিভ্রান্ত না হই যে এপিমেনিদেস যেহেতু ছিলেন ক্রিটের অধিবাসী, তাই অবশ্যই ছিলেন মিথ্যেবাদী; কোনো রহস্যময় কারণ পুরুষ ও নারীকে সরল বিশ্বাসে বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে কাজ করতে বাধ্য করে না, তাদের পরিস্থিতি তাদের সত্যসন্ধানে উদ্যোগী করে। আজকালকার নারীদের অনেকেই নিরপেক্ষ হতে সমর্থ। আমরা আমাদের আদর্শান্ধ অগ্রজাদের মতো নই; খেলায় আমরা অনেকটা জিতেই গেছি। নারীর মর্যাদা সম্পর্কে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক বিতর্কগুলোতে অবিচলভাবে মেনে নেয়া হয়েছে যে লিঙ্গের সাম্য এখন হয়ে উঠছে এক বাস্তবতা, এবং আমরা অনেকেই আমাদের নারীত্বের মধ্যে কোনো অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা বোধ করি নি। বিশেষ কিছু সমস্যা আছে যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে কিছু সমস্যাকে মনে হয় বেশি জরুরি; এবং এই নিরাসক্তির জন্যে আশা করতে পারি যে আমাদের মনোভাব হবে বস্তুনিষ্ঠ। পুরুষদের থেকে নারীর বিশ্বকে আমরা জানি অনেক বেশি অন্তরঙ্গভাবে, কেননা আমাদের শেকড় রয়েছে এর ভেতরেই, একটি মানুষের কাছে নারী হওয়ার অর্থ কী, তা আমরা জানি পুরুষের থেকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষভাবে; এবং আমাদের কাছে এ-জ্ঞানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলেছি আছে কিছু অধিকতর জরুরি সমস্যা, কিন্তু নারী হওয়া জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সে-সম্পর্কে প্রশ্ন করা থেকে এটা আমাদের বিরত করে না। আমাদের দেয়া হয়েছে কী কী সুবিধা এবং কী কী দেয়া হয় নি? আমাদের অনুজাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে কী ভাগ্য, কোন দিকে তারা এগোবে? এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে আমাদের সময়ে নারীদের সম্পর্কে নারীদের লেখা বইগুলোতে সাধারণত অধিকারের দাবি বেশি জানানো হয় না, বরং চেষ্টা করা হয় বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝাতে। আমরা যখন অতিরিক্ত বিতর্কের যুগ পেরিয়ে আসছি, তখন আরো অনেক কিছুর সাথে এ-মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণেরও একটি উদ্যোগরূপে উপস্থাপিত করা হচ্ছে এ-বইটি।
তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কোনো মানবিক সমস্যা পক্ষপাতহীন মনে আলোচনা করা অসম্ভব। যেভাবে উপস্থাপন করা হয় প্রশ্নগুলো, নেয়া হয় যেদৃষ্টিকোণ, তাতে থাকে স্বার্থের আপেক্ষিকতা; সব বৈশিষ্ট্যই নির্দেশ করে মূল্য, এবং তথাকথিত সব বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার পেছনেই থাকে বিশেষ নৈতিক পটভূমি। মূলসূত্রগুলো গোপন করে রাখার চেষ্টা না করে শুরুতেই সেগুলো খোলাখুলি বলে দেয়াই ভালো। এতে প্রতি পাতায় আর ব্যাখ্যা করতে হবে না উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট, ভালো, মন্দ, অগ্রগতি, প্রতিক্রিয়া, এবং এমন আরো অনেক শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে কী অর্থে। নারী সম্পর্কিত কিছু বই জরিপ করলেই দেখতে পাই যে বারবার নেয়া হয় একটি দৃষ্টিকোণ, সেটি হচ্ছে জনগণের মঙ্গল, জনগণের স্বার্থ; আর তাতে সমাজের মঙ্গল বলতে সব সময়ই বোঝান তারা সমাজকে যেভাবে রাখতে বা গড়তে চায়, সে-ব্যাপারটি। আমরা বিশ্বাস করি যা নিশ্চিত করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত মঙ্গল, তাই শুধু জনগণের মঙ্গল; আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিচার করবো এ-অনুসারে যে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ওগুলো কতোটা বাস্তব সুবিধা দিতে সমর্থ। ব্যক্তিগত স্বার্থের ধারণাকে ব্যক্তিগত সুখের ধারণার সাথে গুলিয়ে ফেলতে চাই না, যদিও এটি আরেকু সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। ভোটাধিকারী নারীর থেকে কি হারেমের নারীরা বেশি সুখী নয়? গৃহিণী কি বেশি সুখী নয় কর্মজীবী নারীর থেকে? তবে সুখী শব্দটি ঠিক কী বোঝায় তা অস্পষ্ট; আর এর মুখোশের আড়ালে কতোটা আছে সত্যিকার মূল্য তা আরো অস্পষ্ট। অন্যের সুখ পরিমাপের কোনো সম্ভাবনা নেই, এবং আমরা যে পরিস্থিতিকে সুখী বলতে চাই, তাকে সুখী বলে বর্ণনা করা সব সময়ই সহজ।
বিশেষ করে যাদের দণ্ডিত করা হয়েছে নিশ্চল নিরুদ্যমতায়, তাদের সাধারণত সুখী বলে ঘোষণা করা হয় এ-অজুহাতে যেনো নিশ্চল থাকার মধ্যেই আছে সুখ। আমরা প্রত্যাখ্যান করি এ-ধারণা, কেননা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অস্তিত্ববাদী নীতিবিদ্যার। প্রতিটি কর্তাই কাজ করে নিজের সীমা অতিক্রমের লক্ষ্যে; সে অন্যান্য মুক্তি অর্জনের ধারাবাহিক প্রয়াসের মধ্য দিয়েই শুধু অর্জন করে মুক্তি। বর্তমান অস্তিত্বের কোনো যৌক্তিকতা থাকে না, যদি না তা সম্প্রসারিত হতে পারে অনির্দিষ্ট মুক্ত ভবিষ্যতে। যতোবারই সীমাতিক্রমণ প্রবণতা পিছু হটে পরিণত হয় অন্তর্ভবতায়, নিশ্চলতায়, ততোবারই অস্তিত্ব অধঃপতিত হয় এ-সোয়ে বিশেষ অবস্থায় জীবনের পাশবিক বশ্যতায় এবং মুক্তি পর্যবসিত হয় সীমাবদ্ধতায় ও আকস্মিক ঘটনাচক্রে। কর্তা যদি এতে সম্মতি দেয়, তাহলে এ-অধঃপতন নির্দেশ করে তার নৈতিক ত্রুটি; এটা যদি চাপিয়ে দেয়া হয় তার ওপর, তাহলে দেখা দেয় হতাশা ও পীড়ন। উভয় ক্ষেত্রেই। এটা এক চরম অশুভ। প্রতিটি মানুষ, যে প্রতিপন্ন করতে চায় তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা, অনুভব করে যে মুক্তভাবে কাজ করার জন্যে তার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে নিজেকে অতিক্রম করার এক অসংজ্ঞায়িত প্রয়োজন।
এখন, যা উৎকটভাবে লক্ষণীয় করে নারীর পরিস্থিতি, সেটি হচেছ যে নারীঅন্যান্য মানুষের মতো এক স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সত্তা–দেখতে পায় সে বাস করছে এমন এক বিশ্বে, যেখানে পুরুষ তাকে বাধ্য করে অপর-এর অবস্থানে থাকতে। তারা তাকে একটি বস্তু হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, পর্যবসিত করতে চায় আকস্মিক ঘটনাচক্রে, কেননা তার অস্তিত্বের সীমাতিক্ৰমণতা ছায়াবৃত ও চিরকালের জন্যে সীমাতিক্রান্ত হয় আরেকটি অহং (নীতিচেতনা) দিয়ে, যেটি অপরিহার্য ও সার্বভৌম। নারীর নাটক ঘটে প্রতিটি কর্তার (অহং) মৌল আকাঙ্খর–যে সব সময় আত্মকে গণ্য করে অপরিহার্য বলে–এবং সে-পরিস্থিতির চাপের বিরোধের মধ্যে, যেখানে নারী হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়। নারীর পরিস্থিতির মধ্যে কোনো মানুষ কীভাবে লাভ করতে পারে সিদ্ধি? তার সামনে খোলা আছে কোন কোন রাস্তা? কোনগুলো বন্ধ? পরাশ্রিত অবস্থার মধ্যে কী করে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব স্বাধীনতা? কী পরিস্থিতি সীমিত করে নারীর স্বাধীনতা এবং সেগুলো পেরোনো যায় কীভাবে? এগুলোই হচ্ছে সে-সব মৌল প্রশ্ন, যেগুলোর ওপর আমি কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করবো। এর অর্থ হচ্ছে আমি ব্যক্তির ঐশ্বর্যের প্রতি আগ্রহী সুখের শর্তে নয়, বরং মুক্তির শর্তে।
যদি আমরা বিশ্বাস করতাম নারীর নিয়তি অবধারিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক শক্তি দিয়ে, তাহলে স্পষ্টত এ সমস্যা হতো তাৎপর্যহীন। এখন থেকে সবার আগে আমি আলোচনা করবো যে আলোক নারীকে দেখা হয়। জীববিদ্যায়, মনোবিজ্ঞানে, ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদে। তারপর আমি দেখাতে চেষ্টা করবো ঠিক কীভাবে আকার দেয়া হয়েছে ‘খাঁটি নারী’ ধারণাটিকে–কেননা নারীকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে অপর-রূপে, এবং পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ফল কী হয়েছে। তারপর আমি বিশ্বকে বর্ণনা করবো নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, যে-বিশ্বে অবশ্যই বাস করতে হবে নারীকে; এবং এভাবে আমরা মনে মনে ছবি আঁকতে সমর্থ হবে তাদের পথের বিপদগুলোর, যার মুখোমুখি হতে হবে তাদের এ-যাবৎ তাদের জন্যে নির্ধারিত এলাকা থেকে মুক্তির প্রয়সা চালাতে গিয়ে, যখন তারা পোষণ করে মানবজাতির পূর্ণ সদস্য হওয়ার আকাঙ্খা।
দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা
আজকের নারীরা ন্যায়সঙ্গতভাবে বর্জন করতে পারে নারীত্বের কিংবদন্তিটি; সুনির্দিষ্ট উপায়ে দৃঢ়ভাবে তারা ঘোষণা করতে শুরু করছে তাদের স্বাধীনতা; কিন্তু পরিপূর্ণরূপে মানুষের জীবন যাপনে তারা সহজে সমর্থ হচ্ছে না। নারীদের জগতে নারীদের দ্বারা লালিত হয়ে তাদের স্বাভাবিক নিয়তি হচ্ছে বিয়ে, যা বাস্তবে আজো বোঝায় পুরুষের অধীনতা; তার কারণ পুরুষের মর্যাদা আদৌ লুপ্ত হচ্ছে না, তা আজো দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় অর্থনীতিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর। তাই আমাদের নারীর প্রথাগত নিয়তি ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করতে হবে বিশেষ যত্নের সাথে। দ্বিতীয় খণ্ডে আমি বর্ণনা করতে চেষ্টা করবো নারী কীভাবে যায় তার শিক্ষানবিশির ভেতর দিয়ে, কীভাবে সে অভিজ্ঞতা লাভ করে তার অবস্থানের, কী ধরনের বিশ্বে সে আটকে আছে, কী তার মুক্তির উপায়। তাহলেই শুধু আমরা বুঝতে পারবো নারীর সমস্যাগুলো, যারা দুর্বহ অতীতের উত্তরাধিকারী, যারা চেষ্টা করছে এক নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির। যখন আমি ব্যবহার করি নারী বা নারীত্ব শব্দগুলো, তখন আমি অবশ্যই কোনো অপরিবর্তনীয় আদিরূপের প্রতি ইঙ্গিত করি না; আমার বহু মন্তব্যের শেষে পাঠকদের বুঝে নিতে হবে শিক্ষা ও রীতিনীতির বর্তমান অবস্থায়’ পদটি। শাশ্বত সত্য ঘোষণা এখানে আমাদের লক্ষ্য নয়, বরং আমরা বর্ণনা করতে চাই সে-সাধারণ ভিত্তি, যা আছে প্রতিটি নারী অস্তিত্বের ভিত্তিমূলে।
Leave a Reply