দেবযানী (গল্পগ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
ভূমিকা
‘দেবযানী’ কোয়েল তালুকদারের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। এর আগের বই দুটো ছিল ‘পূর্ণিমানিশীথিনী-সম’ ও ‘মহুয়া বনে’। এক পূর্ণিমা নিশীথে অনেক পথ পেরিয়ে মহুয়া বনে প্রবেশ করে আমরা যে সুবাস নিয়েছিলাম, তার সৌরভে আমাদের মনপ্রাণ ভরে উঠেছিল। মহুয়া বনের সেই পূর্ণিমার আলোছায়াময় আলো দেখে মনে হয়েছিল, বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন আলো আসছে।
সেই অপার্থিব আলোর পথ ধরে কোয়েল তালুকদার এবার লিখেছেন ‘দেবযানী’। দেবযানীর সব গল্প আমি পড়েছি। গল্পে বিষয় ভাবনায় নতুনত্ব শুধু নয়, ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিমায় স্বতন্ত্র রীতির প্রকাশ ঘটেছে। গল্পগুলোর কথনরীতিতে এক অভিনবত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। মানবজীবনের নানা জটিলতা ও সংকটের চিত্রও ধরা পড়েছে। জীবনের পরম ধন প্রেমকেও কোয়েল তালুকদার এঁকেছেন সুনিপুণভাবে, দেখেছেন তিনি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
দেবযানীর গল্পগুলো বিভিন্ন সমাজ জীবন, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সময়কে ধারণ করে লেখা হয়েছে। মানুষের সম্পর্কের বিভিন্ন জটিলতা, প্রেমের তীব্র আকুতি আশ্চর্য এক শিল্পসুষমায় প্রকাশ করা হয়েছে। নরনারীর স্বাভাবিক শরীরী বাসনার মিলন ঘটিয়েছেন অত্যন্ত রূপকাশ্রিত ভঙ্গিতে―
‘.. এই বনেই সুপ্রতীকের সাথে প্রথম শরীর সাক্ষাৎ হয় মেঘবতীর। জারুল, তমাল, মেহগনি, নাগলিঙ্গমের ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে পাগল করা জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছিল। বনের ভিতর লুকিয়ে থাকা হরিণীদের চোখে চকিত নিদ্রাভঙ্গ ঘটে।’ ― মেঘবতী।
‘মূর্তি গড়তে গড়তে মাধব দেখতে পায়, নারীদেহের সব রহস্যময় জগত। লাল মাটির কাদা মাখা হাত গৌরীর স্তন ছেনে। পিচ্ছিল হাত কাদা মাখতে মাখতে নাভী পর্যন্ত চলে আসে। নাভীর নিচে দেখতে পায় গোলাপি জলের প্রশ্রবণ। এ এক অবিস্মরণীয় ঝর্ণা ধারা যেন।’ ―পুণ্যবাস।
বইটিতে অসম্ভব সুন্দর কিছু গল্প আছে।যেমন―আনন্দলোক, ঘুম, বেগম বাহার, দেবযানী, ২৪ নং দক্ষিণ গাঁও ও লাবণ্য হোটেল। বহুমাত্রিক চিন্তায়, চেতনায়, বিষয়ভাবনা ও প্রকাশভঙ্গিমায় গল্পগুলো অভিনব হয়ে উঠেছে। চিন্তা প্রয়োগগত কৌশলের বৈচিত্র্য ও বহুমুখীনতার কারণে গল্পগুলো ব্যতিক্রমী। যাঁরা অপজাত, অবজ্ঞাত জনতার কথা শোনান, ফুটপাত বস্তির আর পরিত্যক্তের জীবন কথাকে সাহিত্যের পাতায় জায়গা করে দেন, কোয়েল তালুকদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সমাজ, প্রেম, যৌনতা, ব্যক্তির একাকীত্ববোধ ও নিঃসঙ্গ মানসিকতার অন্তর্লীন বাস্তবতা ইত্যাদি বিষয়কে স্বকীয় চেতনার আলো জ্বেলে বহু কৌণিক দিক থেকে তুলে ধরেছেন। গল্পগুলো পড়লে মনে হবে, জীবনের অলিন্দ দিয়ে উপচিয়ে আলো আসছে।
— আফজালুল বাসার
সমাজচিন্তক ও প্রাবন্ধিক।
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ইং, ঢাকা।
১. লাবণ্য হোটেল
তখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে পাবনা থেকে নগরবাড়ি হয়ে ঢাকা আসছিলাম। আমাদের বাসটি যখন নগরবাড়ি ঘাটে এসে থামে, দেখি, ফেরী নেই। ফেরী আসতে তখনও অনেক দেরি হবে।
আমি বাস থেকে নেমে নদীর কূল ধরে হাঁটতে থাকি। তখন ফেরী ঘাটে এত যানজট ছিল না। হালকা পাতলা বাস ট্রাক। লোক জনেরও এত সমাগম ছিল না। খুব ভালো লাগছিল নদীর কূল ধরে হাঁটতে। জায়গায় জায়গায় বিকট শব্দ করে পাড় ভেঙে পড়েছিল। যমুনার বুক ভরে অথৈ জল। তীব্র স্রোত ধেয়ে যাচ্ছিল গোয়ালন্দের দিকে। হয়ত পদ্মার জলের টানে এই স্রোতের ধেয়ে চলা। কী সুন্দর মূর্ছণা। কখনো দাঁড়িয়ে থাকি, কখনো চলতে চলতে কান পেতে শুনি নদীর জলের গুঞ্জরণ। কী সুন্দর শীতল হাওয়া। নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের মতো আমার মাথার চুল বাতাসে এলমেল করে উড়ছিল।
বেখেয়াল হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হয় এবং থেমে যাই। ফিরে আসতে থাকি ঘাটের দিকে। ফেরার পথে দেখি, একটি ছোট টিনের চালার খাবার হোটেল। সামনে কোনো বেড়া নেই। ছোট্ট সাইনবোর্ড লাগানো আছে। নাম: লাবণ্য হোটেল, নগরবাড়ি ঘাট, পাবনা।
হোটৈলটি ঘাটের দিকে থেকে সবার শেষে। বেশ দূরে এবং নিরিবিলি। এই নদীর কূলে, একটি টিনের চালের খাবার দোকান। নাম কিনা লাবণ্য হোটেল? লাবণ্য নামটি আমার সবসময় প্রিয়। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা যতবার পড়েছি, ততবার আমি লাবণ্যের প্রেমে পড়েছি। আজও এই নামে প্রেমে পড়লাম। আমি ঢুকে যাই লাবণ্য হোটেলে।
ভিতরে একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে ষাটোর্ধ্ব একটি লোক বসা আছে। সম্ভবত সেই মালিক। আর একজন এগারো বারো বছরের কর্মচারী। পিছনের দিকে পাট সোলার বেড়া দিয়ে আড়াল করা রান্নার ঘর। লোকটি বেশ রাশভারী প্রকৃতির মনে হলো। আমি ওনাকে বললাম — চাচা চা হবে?
লোকটি বলল: চা অইবো না। তবে ব্যবস্থা কইরা দেয়া যাইব।
আমি বেঞ্চের উপর বসি। লোকটি বালকটিকে বলছিল : তর মায়েরে একটু ডাক দে।
বালক রান্না ঘরে চলে যায়। একটু পর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের একজন মহিলা বের হয়। আটপৌরে শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা আছে। গায়ের রং বাদামী। পরনের কাপড় পরিচ্ছন্ন। দেখতে অত সুন্দর না হলেও মোটামুটি সুন্দরী। মুখায়বে একজন মার্জিত রমণীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
লোকটি ঐ মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল : তুমি এই ছোয়ালডারে চা বানাইয়া খাওয়াতে পারবা?
— পারব।
আমি বললাম, না, চা’র দরকার নাই। আমি ভাত খাবো।
লোকটি মহিলাকে বললো: তয় তুমি ভিতরে যাও।
আমি বললাম: কী তরকারি হবে?
লোকটি: ইলিশ মাছের ডিম, ইলিশ মাছ, বড়ো ইচা মাছ ও বাঘার মাছ।
আমি মনে মনে ভাবলাম, সবগুলোই খাব। তবে ভাত কম খাব। পকেট তো গরমই আছে। বাবা তিন মাসের হোস্টেল খরচ দিয়েছে। মা আলাদা করে আরো টাকা দিয়েছে।
আমি ওনাকে বললাম, চাচা, আমি সবগুলোই খাব। একটু আস্তে আস্তে। প্রথম দেবেন ইলিশ মাছের ডিম।
লোকটি ছেলেটিকে বলল, এই খাবার লাগা। প্রথম ইলিশের ডিম দিবি।
তখন বেলা মাত্র বারোটা হবে। আর কোনো কাস্টমার নাই।
আমি লোকটিকে বলি: চাচা, এই হোটেলের নাম লাবণ্য হোটেল কেন দিলেন?
— তোমার চাচীর নামে হোটেল। সেই মালিক। আমি খালি দেখভাল করি।
— চাচীর নাম কী?
— মোছাঃ লাবণ্য খাতুন।
— এত সুন্দর নাম, কে রেখেছিল এই নাম?
— সে অনেক কাহিনী। তুমি পোলাপান মানুষ। এত কিছু বুঝবা না।
— একটু বলেন, আমি বুঝতে পারব।
আমি চাচার সাথে একটু খাতির করার চেষ্টা করি।ইলিশ মাছের ডিম খেতে খেতে বলি — আমাকে ইলিশ মাছের একটি গাদা ও একটি পেটি দেন।
লোকটি বলছিল: তোমার চাচী দৌলতদিয়া থাইকা আমার সাথে পলাইয়া আইছিল। ওর আসল নাম আমি জানি না। তোমার চাচীও কখনো কয় নাই। ওখানকার সর্দারনী নাম দিয়াছিল লাবণ্য। সেই বার দূর্ভীক্ষের সময় ওকে নাকি পঞ্চাশ টাকায় নাগেশ্বরীর এক লোক পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল। তখন সে নিতান্তই বালিকা ছিল।
তোমাকে একটু কইলাম, তুমি জানিলে কিছু অইব না। ফেরী আইলেই তুমি চইলা যাইবা। তুমি কাউকে বলবা না। তোমাকে দেইখা খুব ভদ্র মনে হইতেছে, তাই বললাম।
— আপনার হোটৈলের রান্না খুব সুস্বাদু হয়েছে। তা চাচীই বুঝি রান্না করে?
— তোমার চাচীই রান্না করে।
— খুব ভালো রান্না করে চাচী। আমাকে এক পিস বাঘার মাছ দেন।
চাচা খুব খুশি হলেন। আমি বললাম, তা চাচী কে আপনি বিয়ে করলেন কেন? উনি মনে হয়, আপনাকে খুব ভালবাসে?
— আমি এর আগে তিন বিয়া কইরাছিলাম। প্রথম জন খুব সুন্দরী ছিল, তিন বছর ঘর করার পর এক পানসি নৌকার মাঝির লগে ভাইগা যায়। দ্বিতীয় আবার বিয়া করি, সেও দুই বছর বাদে এক শাড়ি কাপড়ের ফেরিওয়ালার লগে পলাইয়া যায়। তারপর আবার বিয়া করি এক চোখ কানা এক বিধবাকে। সেও এক বছর পর এক কামলার সাথে নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। এমনি করে এক এক কইরা সবাই আমাকে ছাইড়া চইলা গেছে। তারপর আর বিয়া করি নাই। দৌলতদিয়াতে লাবণ্যের লগে আমার পরিচয় হয়। সেই থেইকা ওকে আমার ভালো লাগে। ও আমাকে ভালবাসে।
— কী ভাবে ওনাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন? আর বিয়ে করলেন কখন?
—- সেও অনেক বড়ো কেচ্ছা। তোমার লগে আবার যদি কোনো দিন দেখা হয় তখন বলিব। শুধু এইটুকুই বলতাছি, আমরা লঞ্চে মির্জাগঞ্জ ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজারে যাইয়া মাজার ছুঁইয়া, ওনাকে সাক্ষী রাইখা বিবাহ কইরেছি। আমাদের কোনো হুজুর বিয়া পড়ায়নি। আমাদের কোনো কাবিননামা নাই।
— কাবিন করেননি, হুজুর বিয়ে পড়ায়নি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?
— কেন অসুবিধা হইব? সবই মনের ব্যাপার। কাবিন কইরা, হুজুর দিয়া বিয়া পড়াইয়া তিন বিয়া কইরাছিলাম। কোনো বিয়া টেকেনি। সবাই চইলা গেছে। এই যে, তোমার এই চাচীর কথা কইলাম, সে কোনো দিন আমারে ছাইড়া চইলা যাইব না। আমাদের ভালবাসা দুজন দুজনকে ধইরা রাইখছে।
— এখানকার মানুষ সব জানে না?
— না জানে না। সবাই জানে সে আমার বিয়া করা পরিবার।
ঘাটের অদূরে নদীতে দেখা গেল ফেরী আসছে। ভেঁপু বাজাচ্ছে। আমি হোটেলের বিল পরিশোধ করে বলি — ‘চাচা আমি আসি।’ দেখি সেই মুহূর্তে লাবণ্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আমাকে চা দিয়ে বলে — ‘তুমি চা খেতে চেয়েছিলে। এই নাও, খাও।’
২. তার দেওয়া কাজল
একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি — অতিথি রুমে আলো জ্বল তো ণছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলি, ‘কে এসেছে, আলো জ্বলছে যে ঐ ঘরে।’
আমার স্ত্রী বলে, তোমার দেশের বাড়ি থেকে দুজন মানুষ এসেছে। সম্ভবত ওনারা স্বামী স্ত্রী।’
— তাই। তুমি কী ওনাদের আগে দেখনি?
— না। মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি তোমার কী হই? আমি যখন বলি, আমি তোমার বউ হই। তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি আমাদের রঞ্জনের বউ! ও মা, কত সুন্দর তুমি! তারপর আমাকে যত সব আদর করা শুরু করেছিল।’
আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই অতিথি রুমে যাই। দেখি, পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা ও একজন পুরুষ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার মুখ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ওঠে। ওনারও আমাকে চিনতে পারছিল না। আমার স্ত্রী মহিলাকে বলে, ইনি হচ্ছেন আপনাদের রঞ্জন, আপনাদের ছেলে।’
মহিলা আমার পরিচয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এবং বলে — ‘তুমি এত বড় হয়ে গেছ!’
মহিলা বলেন, তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। সেই ছোট বেলায় আমাকে দেখেছ। আমি তোমার ‘ জহুরা বুবু। মনে পড়ছে আমার কথা? মনে পড়ে কী আমাকে? সেই কত বছর আগের কথা।”
ফ্ল্যাশ ব্যাক। পঁচিশ বছর আগে।
ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। স্কুল থেকে বাড়িতে
ফিরলে আমাকে খেতে দিত — হয় মা, না হয় জহুরা বুবু। জহুরা বুবু আমার জন্মের আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল। সেই নাকি কোলে পিঠে আমাকে লালন পালন করেছে। আমাকে দেখে শুনে রেখেছে।
একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, জোহরা বুবু চোখে মোটা করে কাজল পরে আছে। আমি তার চোখের দিকে বিস্ময়ে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকি। জহুরা বুবু আমাকে বলে — ‘কী দেখছ তুমি?’
আমি আঙুল দিয়ে জহুরা বুবুর চোখ দুটো দেখাই।
জহুরা বুবু বলে ওঠে —‘ওরে আমার ভাইটা।’
বলেই তার চোখ থেকে আঙ্গুল দিয়ে কাজল মুছে মুছে আমার চোখে পরিয়ে দেয়। জহুরা বুবুর দেওয়া তার চোখের কাজল আমার চোখে এখন আর নেই। তা মুছে গেছে কবে।
একদিনের কথা মনে আছে। আমার খুব জ্বর এসেছিল। দু-তিন দিনেও জ্বর নামছিল না। এই জহুরা বুবু মাকে কিছুতেই রাত জাগতে দেয়নি। সেই একটানা চার রাত আমার সিয়রে বসে জেগে থেকেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। দুচোখের পাতা একটু সময়ের জন্য সে বন্ধ করেনি।
আমার শিশুকালে জহুরা বুবু কত যে সেবা যত্ন করেছে, কত যে বিরক্তি ও যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে সব কথা আমার মনে নেই। আমি শুধু আমার মার কাছে থেকে সে সব কথা পরে শুনেছি।
আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, এক বর্ষার দিনে জহুরা বুবুর বিয়ে হয়ে যায়। মা বাবাই সমস্ত বন্দোবস্ত করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় দূরের এক গ্রামে। আমার শুধু মনে আছে, শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় জহুরা বুবু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ফূঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নৌকায় উঠে সারা পথ নাকি সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল।
বিয়ে হয়ে যাবার পর জহুরা বুবু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত। তারপর তার সংসার ব্যস্ততায় খুব বেশি আসত না। তারপর একদম না। তারপর চলে গেছে অনেক বছর। জহুরা বুবু আস্তে আস্তে সবার কাছে বিস্মৃত হয়ে যায়।
এই বিস্মৃত জহুরা বুবু কে দেখে যতটুকু খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি বিষাদে মনটি ভরে উঠল। জহুরা বুবু কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। মনে হল, সে বড় ধরণের কোনো রোগে দুঃখে ভুগছে।
জহুরা বুবুই বলছিল, ‘আমি তোমাদের বাড়ি থেকে ঠিকানা নিয়ে তোমার এখানে এসেছি। আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে মনে হয়। ওখানে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই অসহায় হয়ে তোমার এখানে চলে এলাম। এই ঢাকা শহরে আমাদের আপন কেউ নেই। তোমার কথা মনে হল। তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।’
আমি জহুরা বুবু কে বলি, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখাব। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবে। জহুরা বুবু কিছু টাকা বের করে আমার হাতে দেয়। বলে, ‘জানি না, কত খরচ হবে। তুমি এখান থেকে খরচ করবে।’ আমি ঐ মুহুর্তে জহুরা বুবু কে কোনো করুণা করতে চাইনি। আমি তার হাত থেকে টাকা নিয়ে নেই।
রুমে এসে আমি আমার স্ত্রীকে বলি — ‘ জানি, তোমাকে না বললেও তুমি ওনাদের জন্য অনেক করবে। তবুও বলছি, তুমি বিরক্ত হবে না।’
তোমাকে একটা কথা বলি — ‘এই জহুরা বুবু আমার বড় বোনের মতন, আমার মায়ের মতন। আমার সর্ব শরীরে ওনার মায়া, মমতা, আদর স্নেহ লেগে আছে।’
আমার ছলো ছলো চোখ দেখে, ও শুধু বলল, ‘ওনাদের কোনও অসম্মান ও অবহেলা হবে না। তুমি দেখ।’
শহরের সবচেয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জহুরা বুবু কে দেখাই। ওনার সমস্ত কিছু চেক আপ করানো হয়। সব গুলো রিপোর্ট পেতে দুই তিন লেগে যায়। ইতোমধ্যে ঔষধ ও খেতে থাকে। সুন্দর চিকিৎসা পেয়ে জহুরা বুবুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
একদিন রাতে টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, আমার খাওয়া দেখে জহুরা বুবু আমার স্ত্রী কে বলছিল, ‘বউ মা, তুমি রঞ্জনকে এত ঝাল ভাত খাওয়াও কেন? ওতো ছোটবেলায় ঝালভাত খেত না। দুধ আর সর্বিকলা দিয়ে ভাত খেত। ও কোনো সময় নিজ হাত দিয়ে ভাত খেত না। চাচি আম্মা, না হয় আমি তুলে খাওয়াতাম।’
আর একদিন আমার মাথার চুলে তেল নাই দেখে, হ্যাপিকে বলছিল , ‘বউ মা, তুমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দাও না কেন? সরিষার তেল নিয়ে আসো, আমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দেই।’ এ রকম আরও অনেক কিছু ঐ অল্প কয়দিনে আমাকে পেতে হয়েছে।
ইতোমধ্যে সমস্ত রিপোর্ট গুলো পেয়ে যাই। জহুরা বুবু কে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট সব দেখলেন। রিপোর্ট দেখে তাঁর মুখটি বিমর্ষ হয়ে উঠে। তিনি নতুন করে আরও ঔষুধ দিলেন। এবং ইংরেজিতে আমাকে বললেন– ‘আপনি ওনাদের বাইরে রেখে এসে আমার সাথে দেখা করুন।’ আমি জহুরা বুবু কে বাইরে রেখে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করি।
ডাক্তার বললেন, ওনার লিউকেমিয়া ধরা পড়েছে। রক্তের ক্যান্সার। খুব বেশি হলে উনি তিন মাস বাঁচতে পারে। এই চিকিৎসা এখানে এখনও ঐ রকম নেই। খুব ব্যায়বহুল। আর করেও লাভ হবে না।
জহুরা বুবু তার স্বামীসহ আমার বাসায় আরো তিন দিন ছিল। আমি জহুরা বুবুকে বলি, ‘ডাক্তার সাহেব তোমাকে তিন মাসের ঔষধ দিয়ে দিয়েছে। তুমি যদি ভালো না হও, তিন মাস পর আবার এস।’
যেদিন জহুরা বুবু চলে যাবে, সেদিন বুবুকে বলি, ‘বুবু তুমি আমার চোখে একটু কাজল পরিয়ে দাও না!’
হ্যাপির কাছে কাজল ছিল। ও কাজল নিয়ে আসে। জহুরা বুবু আমার চোখে কাজল পরিয়ে দেয়। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। দেখি, জহুরা বুবু অঝোরে কাঁদছে।
তারপর আরও কত বছর চলে গেছে। জহুরা বুবুর দেওয়া সেই কাজল এখন আর আমার চোখে নেই। তা কবে মুছে গিয়েছে!
৩. বেগম বাহার
রাউজানে এক শেষ যতি চিহ্ন পড়া বিকালে বনের
রাস্তা ধরে হাঁটছলাম। পথ চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থেমে যাই। ধূলোমাটির রাস্তার উপরে বনের ঝরা পাতা পড়ে আছে। আমি সেই মরা পাতার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকি সামনের দিকে। অদূরে দেখি একটি মাজার। প্রবেশ মুখে লেখা আছে — হযরত সৈয়দ চাঁদ শাহ এর মাজার শরীফ, কদলপুর, রাউজান, চট্টগ্রাম। সেখানে অনেক ফকিরি মানুষ, বাউল, কাঙাল সহ অনেক নারী পুরুষের উপস্থিতি দেখতে পাই।
মাজার প্রাঙ্গণে হাঁটতে থাকি। ঘুরতে থাকি। দেখতে থাকি। কত বিচিত্র মানুষ এখানে। ফকির, বাউল, পাগল, সন্ন্যাসসহ কত মানুষ। এত মানুষের ভিতর একজনকে দেখে আমার খুব ভাল লাগল। পরনে লাল রঙের পিরান। মাথায় লাল পাগড়ি বাঁধা। মুখে দাড়ি। গোঁফও আছে। চল্লিশের মতো বয়স তার। দেখে মনে হলো, সে একজন গায়েন হবে।
আমি তাকে সালাম দেই। বলি, ‘আমার খুব তেষ্টা পাইয়াছে। এখানে জল কোথায় পাওয়া যাইবে?’
লোকটি সালাম গ্রহণ করে বলে, ‘তুমি আমার সহিত আইসো।’
সে আমাকে মাজারের পিছন দিকে নিয়ে যায়। দেখি, ওখানে বহু বছরের পুরনো একটি টিউবওয়েল। পাড় পাকা করা নেই। লোকটি বলল — ‘আমি চেপে দিতেছি। তুমি আঁজলা ভরে খাও।’
পানি খাওয়া শেষ হলে লোকটি বলে — ‘ তুমি আমার সহিত চলো।’
আমি তাকে অনুসরণ করি। সে আমাকে মাজার থেকে বেশ দূরে একটি জারুল গাছের নীচে নিয়ে যায়। ঘাসের আচ্ছাদিত বড় মাটির ঢিপির উপর দুইজন বসি। লোকটি আমার নাম জিজ্ঞাসা করে। আমি আমার নাম বলি। তাকেও তার নাম জিজ্ঞাসা করি — লোকটির নাম, ‘মোহাম্মাদ আয়ুব আলী ফকির।’
আয়ুব আলী ফকির তার ঝোলনা ব্যাগ থেকে একটি পাতার তৈরি চুরুট ধরিয়ে টানতে টানতে বলে — ‘ তুমি কী কাউকে মুর্শিদ বানাইতে এখানে আসিয়াছ?’
আমি বললাম — জ্বী।
আমি ওনাকে বলি, ‘আপনার মুর্শিদ কে?’
আয়ুব আলী আমার প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। দেখলাম, সে চুরুটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। আরো কিছু সময় নিরব থাকার পর সে বলল, ‘ তাঁর নাম — সবুর আলী ফকির।
আমি বললাম, আমি এ নামে তো পীর দরবেশের নাম কখনও শুনি নাই।
—- সে অনেক কথা।
আমার বয়স তখন বারো বছর। শিশু কালে মা বাবা হারাই। ভাই বোন কেউ ছিল না। এমন কেউ ছিল না যে, তার জন্য ঘরে থাকতে হবে। তাই ঘর ছাড়লাম। পথে নেমে কত পথ যে ঘুরলাম। ঘুরতে ঘুরতে একবার সুনামগঞ্জে যেয়ে ঘেটুর দলে যোগ দেই। আমি দেখতে বেশ নাদুসনুদুস ও সুন্দর ছিলাম। ঘেটু দলের মালিক আমাকে খুব পছন্দ করত। ভালো বাসত। আদর করত। একবার এক ভরা বানে, চাঁদনী রাইতে সর্দার আমাকে একটি উদাম ডিঙি নৌকা করে হাওরের অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়।
খুব ভাল লাগছিল রাতের হাওর। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ। জলের উপর ভাসছিল চাঁদ। জোৎস্নার রোশনাইতে ভেসে গিয়েছিল বিজন নির্জন চারদিকে। হঠাৎ নৌকাটি মাঝ দরিয়ায় থেমে যায়। সর্দার সুন্দর একটি গান গেয়েছিল হাছন রাজার। খুব আশেকি গান। খুব দরদ দিয়ে গাইছিল। গাইতে গাইতে সে গানও এক সময় থেমে যায়।
আমি তো কোনও সুন্দর বালিকা ছিলাম না। সর্দার আমাকে সে রাতে বালিকা বলে ভ্রম করে, বলে — ‘তোকে আমি খুব ভালোআবাসি।’ সর্দার আমার উপরে হামলে পড়ে। তার আচরণে আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার কান্নার শব্দ হাওরের শূন্য আকাশে মিলে গিয়েছিল। কী করব? আমি পরের দিন ঘেটু দল ছেড়ে পালিয়ে চলে আসি।
—- আমি বললাম, তারপর কোথায় আসলেন?
—- পথে পথে ঘুরতে থাকি। ঘুরতে ঘুরতে ফরিদপুরের রাজবাড়ী যাই। ওখানে একটি যাত্রার দলে যোগ দেই।
আমি বললাম, তা যাত্রার দলে এখন নেই কেন? এই ফকির বেশে মাজারে মাজারে ঘুরছেন?
— আমি যাত্রার দলে ছয় বছর ছিলাম। প্রথম প্রথম বালক পাঠগুলো করতাম। আমি গানও গাইতাম যাত্রার দলে। আমাকে মালিক ও মালিকান খুব ভালো বাসত। আমি কোনো টাকা নিতাম না। টাকা নিয়ে আমি কী করব? আমার তো ঘর নেই। সংসার নেই।
— তো, ভালই তো ছিলেন।
— ভালো ছিলাম। আবার ভালো ছিলাম না। এবার আর মালিক আমাকে ভালো বাসলো না। এবার আমাকে ভালো বাসলো মালিকান। সে ছিল আনন্দময়ী সুলেখা। চল্লিশোর্ধ হয়েও সিরাজউদদৌলা পালায় আলেয়া চরিত্রে দারুন অভিনয় করত।
সেই বার এক ভরা বর্ষার সময়ে গৌরনদী থেকে যাত্রাপালা শেষ করে পুরো দল লঞ্চে করে গোয়ালন্দ আসছিলাম। আমরা সবাই ড্যেকে বসেছিলাম। রাত তখন অনেক। কেউ ঘুমাচ্ছিল। কেউ ঝিমুচ্ছিল। আমার চোখে ঘুম আসছিল না। আমি ড্যেক থেকে উপরে দোতালায় চলে আসি। দেখি, পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। ভরা বর্ষায় খোলা নদীর আকাশে চাঁদ ! কী যে ভাল লাগছিল।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম একাকী। দেখি, সুলেখা মালকিন এসে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রেলিং এর উপর আমার হাত ছিল, সেই হাতের উপর মালকিন তার হাত রাখে। বলে– ‘চলো, আমরা চুপিচুপি ভাগ্যকূল ঘাটে নেমে পড়ি। রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাত কোথাও চলে যাই।’
—- তারপর কী দুইজনেই নেমে পড়েছিলেন সেই রাতে, সেই ঘাটে?
—- নেমেছিলাম, তবে দুইজন নয়। পালিয়ে আমি একা।
—- তারপর?
বহু ঘাট পেরিয়ে এইখানে এই মাজার প্রাঙ্গণে চলে
আসি। এখাণেই পরিচয় হয় সবুর আলী ফকিরের সাথে। সে গান গাইত। মারফতি গান। আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করি। সে ছিল সংসার বৈরাগ্য এক মানুষ। মুখে মুখে গান বানাইত, মুখে মুখেই সুর দিত।
আমার এই মুর্শিদ আমাকে বলত, জীবনে কখনো সংসারী হবি না। আল্লাহ নবীকে স্মরণ করবি। গানের ভিতর আত্মার শান্তি খুঁজবি। আধ্যাত্ম জীবন শ্রেষ্ঠ জীবন। এই খানে যে সুখ পাইবি, সে সুখ ঘরে পাবি না। এই দেখ, আমার দিকে চেয়ে। সত্তর বছর পার করলাম। এখনো ঘর নেই।
—- তা তিনি কোথায়? তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তাঁর মুরিদ হব। তাঁকে মুর্শিদ মানব। ওনার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
উনি নেই। আজ পাঁচ বছর ধরে সে নিরুদ্দেশ। আমাদের দলে কুলত্যাগিনী একজন ফকিরনী ছিল। নাম বেগম বাহার। সেও সবুর আলী ফকিরের মুরিদ ছিল। ওনার বয়স ষাট পেরিয়ে গিয়েছিল। তারপরও মলিন কাপড়ের নীচে অপূর্ব সুন্দর রূপ লুকানো ছিল। বহু ফকির তার আশিকী নিতে চেয়েছিল। এই বেগম বাহারের সাথে আমার মুর্শিদের আশিকী হয়।
এ জন্য সে অনুতপ্ত ও ছিল।
— দারুন তো! তারপর?
একদিন এক ফাল্গুনের চাঁদনি রাতে বেগম বাহার কে নিয়ে আমার মুর্শিদ নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যায়। তারা কোথায় চলে গেছে? কোথায় আছে? মরে গেছে না বেঁচে আছে। কিছুই জানি না।
—- রোমাঞ্চময় কিছু গল্প কাহিনি শুনে অদ্ভুত কিছু অনুভূতি নিয়ে আয়ুব আলী ফকিরের কাছে থেকে সেদিন ফিরে এসেছিলাম। এই জীবনে আমার আর কাউকে মুর্শিদ বানানো হয় নাই। সংসারও ত্যাগ করিনি। ঘরেই আছি।
৪. ধীরে বহে সন্ধ্যা নদী
ছেলেটি বয়সে আমার জুনিয়র। কিন্তু ওর সাথে বন্ধুত্ব ছিল বন্ধুর মত। একটা মেয়ের সাথে ওর পূর্বরাগ চলছিল। দুজনের ভিতর একটি ভাললাগা গড়ে উঠছিল। ও খুব অস্থির থাকত, যেন ঐ মেয়ের সাথে প্রণয় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে থাকে। যেন মেয়েটি দূরের হয়ে
না যায়। ঐ মেয়ে যেন কখনও ওকে ছেড়ে চলে না যায়। এই ব্যাপারে ছেলেটি আমার পরামর্শ চাইত। আমি যেন একজন প্রেম গুরু।
ছেলেটির নাম কাজল। কাজল নাম হলেও যেন ও হলুদ ফিঙে ফুল। দেখতে একদম নির্মল জলছবি। এই ছেলেকে কেউ যে কখনও ফেরাতে পারেনা, সে আমি বুঝতে পারতাম। ওর অবশ্য একটি চির দুঃখ ছিল। চোখে পুরু লেন্সের চশমা পরত। কালো ফ্রেম আর পুরু লেন্সের ওপাশে হয়ত কোনও জল গোপন করত। কেউ তা দেখতে পেত না।
একদিন রাতে টেবিলের উপর ল্যাম্প জ্বেলে বসে বসে ইডিপাস পড়ছিলাম। পরের দিন হেনা স্যার রাণী জোকাস্টার চরিত্রের উপর একটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেবে। সোফোক্লিস কীভাবে যে এই রমণীকে অন্তর্দাহে পুড়িয়েছেন। করুণায় সিক্ত হচ্ছিলাম আমি। রাণীর অন্তর দাহে আমার চিত্ত যখন দহন হচ্ছিল, ঠিক তখনই কাজল আমার কাছে এসে বসে।
: রঞ্জন দা, আমাকে কয়েক লাইন কবিতা লিখে দিবেন? আপনার এই কবিতা কোথাও কারোর নামে ছাপা হবে না।
: বুঝতে পারছি, তুমি তোমার দীপ্তি কে দেবে। আচ্ছা, লিখে দিচ্ছি।
কবিতার খাতায় লিখলাম —
‘ এ কী ভাবনা আমার, এ কী ক্লান্তি মোর
এ কী দাহ প্রেমের,
স্বপ্নরা সবুজ ঘাসের উপর ঘাটফুল হয়ে ফুটে থাকে
এ কী ভয় আমার, এ কী বেদনা ধারা বহে নয়নে,
যদি তুমি না থাক সকল স্বপ্নে আমার।’
কবিতার খাতার পাতাটি ওকে ছিঁড়ে দিয়ে দেই।এইরকম করে প্রায়ই কাজল আমার কাছে থেকে কবিতা লিখে নিয়ে যেত। কবিতা গুলো ও দীপ্তিকে দিয়ে দিত।
কোনো কোনো দিন কাজলকে খুব হাসি খুশি লাগত, কোনো কোনো দিন মনখারাপের। একদিন কাজল বলছিল —
: রঞ্জন দা, আপনি দীপ্তিকে দেখবেন না? ওকে আপনার কথা অনেক বলেছি। ও আপনার খুব ভক্ত। পত্রিকায় আপনার কবিতা পড়ে।
: দেখব তোমার দীপ্তি কে। আমার পরীক্ষা শেষ হোক। মৌলিতে বসে আমরা একদিন লাঞ্চ করব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়ে যায়। আমি আর খুব বেশি ওদের ভালোবাসার খোঁজ খবর নেইনি।কাজল চলে যায় ওর গ্রামের বাড়ি বরিশালে। ও যখন বিদায় নিয়ে আমার কাছে থেকে চলে যায়, তখন ওকে বলেছিলাম —
‘ আমি কখনো বরিশাল যাইনি। কী যে ইচ্ছা করে, ধানসিঁড়ি নদী দেখতে। নদীর তীরে বিশালাক্ষী মন্দির। পিছনে ধানক্ষেত। ধানক্ষেত পেরুলেই লাশ কাটা ঘর। যে পথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল জীবনানন্দ দাশ। দেখতে ইচ্ছা করে কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা নদী।
কাজল বলেছিল —
: আপনি আমার সাথে চলেন। মা খুব খুশি হবেন। মা’কে আপনার কথা চিঠিতে অনেক বলেছি।
বলেছিলাম —
: আচ্ছা, যাব একদিন। দেখে আসব তোমার মাকে। দেখব ধানসিঁড়ি নদী।
প্রায় দেড়মাস ছুটি কাটিয়ে কাজল ঢাকা চলে আসে। ও আমাকে বলে, রঞ্জন দা, ‘একটি ছোট্ট কবিতা লিখে দিবেন?’ আমি কখনই ওর এই আবদারকে ফিরাইনি। আজও ফিরালাম না। কবিতার খাতায় একটি ছোট্ট কবিতা লিখে পাতাটি ছিঁড়ে ওকে দিয়ে দেই। ও আমার কবিতাটি নিয়ে বলে — ‘দীপ্তির সাথে আজ আমার দেখা হবে।’
বিকালে হলের রুমে একাকী বসে আছি। ভালো লাগছিল না মনটা। পূর্বের জানালার পাশে বসে দেখছিলাম এলিফ্যান্ট রোড। শাহবাগ বিপনি
বিতান। দেখছিলাম পিজি হাসপাতাল। হর্ণ বাজিয়ে চলে যাওয়া শত শত গাড়ি। হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, কত রোগী এখানে বিছানায় শুয়ে আছে। যন্ত্রনায় কতজন কাতরাচ্ছে। কতজন ভালো হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। কেউ আবার জীবন ছেড়ে চলে যাচ্ছে জীবনের ওপারে।
কী এক ভয়ংকর কাকতালীয় ভাবনার নিঠুর মিল। ঠিক ঐ সময়ই জরুরি বিভাগে কাজল জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে রাস্তা পার হওয়ার সময় ও নাকি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে পড়ে যায়। আঁধার দেখছিল সব। ঠিক তখনই একটি চলন্ত বাস এসে ওকে চাপা দেয়।
খবর পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসি। হলের পূর্ব পাশ দিয়ে দৌড়ে পিজি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে চলে যাই। দেখি, জরুরি বিভাগের রুম রক্তে ভেসে গেছে। থেঁতলে যাওয়া কাজলের দেহে তখনও কী প্রাণ ছিল? ওর রক্ত মাখা হাতখানি আমি ধরি। ওকে আমি ডাকি ‘কাজল’ ‘কাজল’। কাজল আমার ডাক শুনতে পেয়েছিল কী না জানি না। কিছুক্ষণ পর কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন — ‘Sorry, he has expired.’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাজলের লাশ ওর গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। আমি শুধু ওর পকেট থেকে আমারই লেখা কবিতাটি নিয়ে চলে আসি। যে কবিতাটি দীপ্তি কে দেওয়ার কথা ছিল। কবিতার সেই কাগজটি ছিল রক্ত মাখা।
দীপ্তি আগেই জেনে গিয়েছিল ওর প্রিয়তম সহপাঠী চিরদিনের জন্য চলে গেছে। খুব ইচ্ছা হল ওর সাথে একবার দেখা করার। সপ্তাহ খানেক পর শামসুন্নাহার হলে ওর সাথে দেখা করতে যাই। দেখাও পাই ওর। আমি দীপ্তিকে এর আগে কখনও দেখিনি। ওকে বলি — ‘আমি তোমাদের রঞ্জন দা।’ দীপ্তি আমার হাত ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
খুব বেশি কথা বলতে পারিনি। ওকে রক্ত মাখা কবিতার কাগজটি দিয়ে বলি — ‘এই কাগজটি কাজলের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল। দেখ, একটি কবিতা লেখা আছে — ‘কবিতাটি তোমাকে দেওয়ার জন্যই মনে হয় ও লিখেছিল।’
সেই কবিতাটিতে লেখা ছিল —
‘ তোমার চোখে দেখি — আমার জীবনকে, আমার পৃথিবীকে,
আমার পুরু লেন্স ফুঁড়ে স্বপ্ন বিচ্ছুরিত হয়,
কত স্বপ্ন আসে, কত স্বপ্ন দেখি তোমার চোখে।’
সাত বছর পর:
একটি সরকারি কাজে গিয়েছিলাম বানরীপাড়া। একদিন বিকেলবেলা একাকী হাঁটছিলাম সন্ধ্যা নদীর তীরে। কী শান্ত নদীটি বয়ে চলেছে। আমি খুঁজছিলাম বিশালাক্ষী মন্দির। মন্দিরের পিছনে লাশ কাটা ঘর। কোথায় কাজলদের বাড়ি? দুচোখ ভরে দেখছিলাম ধানক্ষেত। দেখছিলাম ধানের পাতার উপর উড়তে থাকা হলুদ ফিঙে ফড়িং।
সন্ধ্যা নদীতে ভেসে যাচ্ছিল কত নৌকা। মাঝিমাল্লারা গেয়ে যাচ্ছে গান। শুনছিলাম কূলকুল জলের শব্দ। পশ্চিম আকাশে লাল আভার মেঘ ছিল। মনে পড়ছিল, সেই কত বছর আগের একটি নির্মল নিষ্পাপ মুখকে। কানের কাছে সে যেন ফিসফিস করে বলছিল — ‘রঞ্জন দা, একটি কবিতা লিখে দিবেন?’
৫. আনন্দলোক
কোলকাতা থেকে ভোরে ছেড়ে আসা তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল দশটার মধ্যেই দীঘা স্টেশনে এসে পৌঁছায়। আসার পথে দেখেছিলাম পথের প্রাকৃতিক শোভা। সবুজ ধান ক্ষেত, মেঠো পথ, দূরের ছোট্টো গ্রাম আর সেই গ্রামকে জড়িয়ে বয়ে চলা নদী। দ্রুত গতির রেলের জানালা দিয়ে চোখে পড়েছিল এই বাংলার রূপ-রস-গন্ধ। যা ছবির মত স্থান করে নিয়েছে মনের মনি কোঠায়। সে এক অপূর্ব সুন্দর চলমান ‘ল্যান্ড স্কেপ’ ছিল।
আমার সাথে ভ্রমন সঙ্গিনী ছিল আজীবনের চিরসখা আমার স্ত্রী। আমরা উঠেছিলাম সাগর উপকূলে ঝাউবন বেষ্টিত একটি ছোট্ট কটেজ ‘আনন্দলোকে’। সত্যি এক অবিস্মরণীয় আনন্দলোকে ক্ষনকালের জন্য ঠাঁই করে নিয়েছিলাম এক রাত্রির জন্য।
রুমে ব্যাগবাক্স রেখে দাঁড়িয়েছিলাম এসে বারান্দায়। সম্মুখে অতলান্ত সমুদ্র। জল আর ঢেউয়ের বিশাল আয়োজন। এমন রুপালি জলে আকাশই কেবল অবগাহন করে না। আমরাও করব। আমরাও এখানে সে জন্য এসেছি।
একটার পর একটা, ক্লান্তিহীন, অবিরত সমুদ্রের বুকে তৈরি হওয়া বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটের বালিয়াড়িতে। যতদূর চোখ যায়, ঠিক যেখানে জল আর আকাশ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে ঠিক সেই জায়গাটায় অন্ধকার সরিয়ে নাকি প্রথম ভোর হয়।
দিগন্তের ঐ পাড় থেকে খুশির রক্তিম আবির ছড়িয়ে হয় এখানে সূর্যোদয়। রাতের গভীর অন্ধকার উত্তীর্ণ হয়ে চরাচর জুড়ে ধ্বনিত হয় ভৈরবী রাগ। সূর্যের প্রথম ছটা বিচ্ছুরিত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সমুদ্র। ঘুম থকে জেগে ওঠে সমুদ্র সুন্দরী দীঘা।
কটেজের পশ্চিম পাশটায় ঝাউবন। কোনো হোটেল মোটেল নেই। বনের ফাঁকে ফাঁকে বালিয়ারি। হালকা লতাগুল্ম, ঝিনুক শামুক শঙ্খ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখি, ঝাউ তলায় ষাটোর্ধ্ব একটি পাগল গোছের লোক বসে আছে। এবং তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। বিশেষ করে আমার স্ত্রী কে।
আমরা বারান্দায় আর দাঁড়ালাম না। ভিতরে চলে আসি। আনন্দলোকের তত্ত্বাবধায়ককে বলি, ‘বাইরে ঝাউ বনের ও পাশটায় এক পাগলকে দেখলাম — কে সে? আমরা একটু ভয় পাচ্ছি।’
তত্ত্বাবধায়ক বলল : ভয় পাবেন না। ওর নাম সুশ্রুত। সুশ্রুত চক্রবর্তী। মেদেনীপুরের কুবাই নদীর তীরে ওর বাড়ি। খুব ভালো অংকন শিল্পী ছিল। একবার ওর নব পরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে এক বর্ষার শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিতে এখানে বেড়াতে এসেছিল। এই যে আনন্দলোক দেখছেন, এটি তখন এখানে ছিল না। এখানটায় ছিল আরও ঘন ঝাউবন।
সুশ্রুত ওর স্ত্রীকে নিয়ে এখানে এই ঝাউ তলে দাঁড়িয়ে রেখে ছবি আঁকত। ওর স্ত্রী হয়েছিল ওর মডেল। আলো আঁধার, জোৎস্না, আর সমুদ্র — আর একজন তনু তন্বী রমণী। এই ছিল ওর ছবির ক্যানভাস। সুশ্রুত নাকি সেই ছবিটি আঁকা শেষ করতে পেরেছিল না।
তত্ত্বাবধায়ক গোপাল সাহা সামনের সাগর কূল দেখিয়ে বলছিল — সেই পূর্ণিমা তিথিতে ওর স্ত্রী বিভাবতী হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্র জলে যেয়ে নেমে পড়েছিল। জলে ভেসে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ, অলৌকিক সুন্দর জ্যোৎস্নার ঢেউ, নাকি চোরবালি টেনে নিয়ে গিয়েছিল বিভাবতীকে জলধি অতলে, সে কথা জানা যায়নি।
তারপর থেকে সুশ্রুত বদ্ধ পাগল। কোথায় কোন্ জায়গায়, কোন্ স্টেশনে স্টেশনে সে ঘুরে বেড়ায় কেউ জানেনা। হঠাৎ মাঝে মাঝে এখানে ওকে দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ণিমা শ্রাবণ তিথিতে।
কী আশ্চর্য! নাকি কাকতালীয়! আমরা যেদিন আনন্দলোকে ছিলাম সেদিন ছিল শ্রাবণ বর্ষার পূর্ণিমা তিথি। বিকালে গিয়েছিলাম চন্দ্রনেশ্বর মন্দিরে। ফেরার পথে দেখে আসি — অমরাবতী লেক। পথে পথে বালুর উপরে কতজনের পায়ের ছাপ পড়ে আছে। এই বালুর উপর অনেক বছর আগে হেঁটে বেড়িয়েছিল ওয়ারেন হেস্টিংস এবং তাঁর স্ত্রী। আজ আমরা হাটছি এই সাগরে বালুকাবেলায়। কী আফসোস ! আমাদের এই পায়ের ছাপ কেউ কোনো দিন চিনবে না।
সন্ধ্যা নামে দীঘায়। সোলার বাতি জ্বলে ওঠে। ছোট ছোট খাবার দোকান গুলোতে ভ্রমণার্থীদের ভীড়। আমরা কটকের বিখ্যাত স্পাইস নান রুটির সাথে পমফ্রেট আর চিংড়ি ভাজা খাই। হ্যাপি কখন কিনেছিল শঙ্খমালা এক বালকের কাছ থেকে জানি নাই। দেখলাম, মালা খানি আমার বিবি পড়ে আছে। দক্ষিণের সাদা বালুচুড়ি শাড়ির সাথে শঙ্খমালা দারুন মানিয়েছিল।
সন্ধ্যার পর ফিরে আসি আনন্দলোকে। শ্রাবণ পূর্ণিমা রাত নেমেছে ঝাউবনে, সমুদ্র উপকূলে। আমরা এসে দাঁড়াই বারান্দায়। চরাচর জুড়ে আলোর রোশনাই। সমুদ্র জল সে আলোয় চিকচিক করছে। কী শব্দ ভেসে আসছিল দূর থেকে। মলয় পর্বত কত দূরে, দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু মলয় বাতাস ভেসে আসছিল জলের শব্দের সাথে মিশে। যদি এই রাতে সুচিত্রা মিত্র এসে আমাদের গান শোনাত!
‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্–
হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল,
বাদল-হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাসে
যূথীবনের বেদন আসে–
ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল।’
নাহ্ এখানে কোনো কেয়া বন নেই। আনন্দলোকের দুপাশে কেবলই ঝাউবন। কেমন জ্যোৎস্নায় ভেসেছিল সেই ঝাউবনে? দুজনেরই দেখবার খুব সাধ হল। আমরা সমুদ্র থেকে চোখ ফিরিয়ে আনি ঝাউবনে। দেখি — বারান্দার রেলিংএর ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে পাগল সুশ্রুত চক্রবর্তী। ও জোৎস্নার আলো আঁধারে চেয়ে আছে আমার স্ত্রীর মুখের দিকে।
ঐ চোখে কী করুণা ছিল ? নাকি মায়া ছিল? নাকি লালসা ছিল? অন্ধকারে বুঝতে পারি নাই। আমরা দুজন দ্রুত কটেজে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেই। এবং মনে মনে ওকে ভর্ৎসনা করি। আমাদের আজকের এই পূর্ণিমা শ্রাবণ তিথির সকল সৌন্দর্য সুধা পান করা নস্ট করে দিল।
সকালে বাক্স পোটড়া গুছিয়ে স্টেশনে চলে আসব। দরজা খুলে পা ফেলতেই দেখি একটা কাগজ পড়ে আছে। পুরনো জীর্ণ ল্যান্ড স্কেপ কাগজের উপর ছবি আঁকা। ছবির অর্ধেক অনেক পুরানো রং তুলির আঁকা। বাকি অর্ধেক মনে হল গত রাত্রিতে কেউ এঁকেছে। ছবিটির মুখশ্রী দেখতে অনেকটা আমার স্ত্রীর মত। লাবণ্য, তনু, মায়াবতী কেউ যেন।
ঝাউবনের ঐ পাশটাতে একবার সুশ্রুত চক্রবর্তীকে খুঁজবার চেষ্টা করি। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু কোথাও ও নেই। বনের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে আছে শুধু ঝিনুক, শঙ্খ, আর কতকগুলি অস্পষ্ট পায়ের চিহ্ন।
৬. মেঘবতী
ভবঘুরেদের নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই। আবাস নেই। বসত স্থান নেই। ঘুরতে ঘুরতে যেথায় রাত্রি নামে, সেখানেই সে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে ঘাসের উপরই হোক, কিংবা দীঘির কোনো সোপানের উপর। শরীরের উপর কখনও মেঘমেদুর আকাশের ছায়া পড়ে। কখনও ফোঁটা ফোঁটা টিপটপ বৃষ্টি ঝরে। আবার তারা ভরা পূর্ণিমা রাত্রির জোৎস্নাও ঝরে পড়ে।
পুণ্ড্রনগর থেকে ভবঘুরে এক তরুণ ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে হাজির হয়েছিল সারনাথ বৌদ্ধ মন্দিরে। ওর নাম সুপ্রতীক। সে মুসলিম নয়, হিন্দু নয়, বৌদ্ধ ও নয়। ধর্মের কোনো পরিচয় নেই তার। সে ঘর ছাড়া এক ধূলোমাখা বাউন্ডুলে। এই ভবঘুরে ছেলেটার ভিতরে দুটো প্রতিভা ছিল। সে কাব্য রচনা করতে পারত এবং সুমধুর ললিতে গান গাইতে পারত।
সুপ্রতীক বসে ছিল বরুণা নদীর কূলে। আলুলায়িত চির বিরহিনীর শাড়ির আঁচলের মত সূর্য ডুবে যাচ্ছিল পশ্চিম দিগন্তে। কোথাও কেউ নেই। নেই কোনো ভিক্ষুক, ভিক্ষুকনি, সন্ন্যাস, স্নানার্থি ও পূণ্যার্থী। নিভৃত জনমানবহীন নদীর কূলে বসে সে ভাবছিল, তার ঘর ছাড়ার কথা। স্বগোতক্তি করে বলছিল — ‘কিসের টানে ঘর ছাড়লাম। এখানকার শ্রেষ্ঠী কন্যা মেঘবতীকে জীবনে পাব বলে?’
সেদিন ছিল আষাঢ়ি দিন। সকালে যখন সে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা করছিল তখন শ্রেষ্ঠী পুত্র যশ তাকে হুঁশিয়ার করে বলেছিল — ‘হয় তুমি প্রণয় ছাড়বে, নতুবা এই সারনাথ মন্দির এলাকা ছেড়ে চলে যাবে।’ বরুণা নদীর জল বয়ে চলেছে সর্পের মত কিলবিল করে। কোথায় শেষ এই জলের পথ চলা, সুপ্রতীক তা জানে না।
নদীর পাড়ে কলাগাছ থেকে কলাপাতা ছিঁড়ে বাঁশের কাঠি দিয়ে লিখছিল প্রাচীন বাংলা বর্ণমালায় হিবিজিবি করে একটি নাম — মেঘবতী।
মেঘবতী শ্রেষ্ঠী কন্যা। যিনি ‘মন্দির ত্যজি যব পদচারি আইনু, নিশি দেখি কম্পিত অঙ্গ,
তিমির দুরন্ত, পথ হেরই না পারই, পদযুগ বেড়ল ভুজঙ্গ।
একে কুলকামিনী, তাহে কুহু যামিনী, ঘোর গহন অতি দূর,
আর তাহে জলধর বরখিয়ে ঝর ঝর, হাম যাওব কোন পুর।’
এখানকার মৃগদাবে কত হরিণী ছোটাছুটি করে। তারা একবার ছুটে যায় বনের গভীরে, আর একবার নদীর কূলে। এদের মায়াবী চোখ সুপ্রতীকের ভাল লাগত। কেন এমন ভাল লাগত এই হরিণী নয়নাদের?
সেদিন ঝর ঝর করে ঝরছিল বৃষ্টি। মন্দিরের বারান্দায় মাদুরের উপর বসে সুপ্রতীক দেখছিল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল তার উদোম গাত্র। ধবধবে পিঠের উপরে রুপালি মুক্তার মত বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছিল। মাথার চুল ছিল দীঘল। সেই দীঘল চুল ঘাড়ের উপর এলমেল ছড়ান ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে সেই চুল থেকে চুপসে পড়ছিল জল, ঘার পিঠ বেয়ে সেই জল কোমড়ের বাঁধা ধূতিতে এসে পড়ছিল।
ঠিক তখনই মন্দিরের সম্মূখ উদ্যানের ওপাশের ধামেক স্তুপ থেকে খালি পায়ে এক প্রস্ত কাপড় পরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হেঁটে আসছিল মেঘবতী। তার চোখ যেন মৃগ দাবের হরিণীর মত চকিতনয়না, সেও ছিল কেশবতী। চুল গলার দুপাশে দিয়ে টেনে এনে বুক ঢেকে রেখেছিল। উতল বর্ষাবৃষ্টিস্নান-সম ভিজিয়ে দিয়েছিল মেঘবতীর উত্তপ্ত শরীর। যেন —
‘অনোন্যমুৎপীড়য় দুৎপলাক্ষ্যাঃ স্তনদ্বয়ং পান্ডু তথা প্রবুদ্ধম্।
মধ্যে যথা শ্যামমুখস্য তস্য মৃণাল –সূত্র্ন্তরমপ্যলভ্যাম।”
মন্দিরের বারান্দায় উপবিষ্ট এই বাউন্ডুলে তরুণটির সাথে মেঘবতীর চকিত নয়ন পাত ঘটে। সেই নিরব দৃষ্টিপাতের ভিতর দুজনই কী কথা বলেছিল, ঠিক সেই ক্ষণে মন্দির বিহারের অন্য কোনও মনুষ্য বুঝতে পারে নাই।
সুপ্রতীক প্রণয় কাব্য লিখতে শুরু করে। তার কাব্যের রস উপপাদ্য মেঘবতী। সে রাত্রি জেগে শুকনো তালপাতার উপর শ্লোক লিখতে শুরু করে। প্রাচীন বাংলা থেকে রূপান্তর করলে এই রুপ পাওয়া যায়–
‘ওগো কল্যাণি! নিরুপায় আমি, রহিয়াছি একা নিজেরে লয়ে
তুমিও আমার দুঃখ অপার কোনওমতে প্রিয়ে থাকিও সয়ে।
যেথা বেশি সুখ, দুখ ততোধিক, সুখ দুখ নহে চিরস্থায়ী,
চাকার মতই ঘুরিতেছে তাই, উপরে ও নিচে দুয়েরে পাই!’
সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সুপ্রতীক মেঘবতীকে বলে রেখেছিল, মৃগ দাবে অর্থাৎ হরিণ বনে তার সাথে দেখা করতে। ঠিক সিদ্ধার্থের গৃহ ত্যাগের মত পূর্ণিমার রাত ছিল। মেঘবতী গোপনে এক খন্ড সাদা কাপড় পরে স্তুপ থেকে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে হরিণ বনে চলে আসে। এই বনেই সুপ্রতীকের সাথে প্রথম শরীর সাক্ষাৎ হয় মেঘবতীর। জারুল, তমাল, মেহগনি, নাগলিঙ্গমের ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে পাগল কাড়া জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছিল। বনের ভিতর লুকিয়ে থাকা হরিণীদের চোখে চকিত নিদ্রা ভঙ্গ ঘটে। মর্মর জীর্ণ পল্লবের উপর তাদের বাসর শয্যা হয়।
তাদের মিলন সম্পূর্ণ হয়েছিল কিনা কেউ বলতে পারে নাই। শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ মেঘবতীকে অনুসরণ করে বনের ভিতর চলে এসেছিল। সে মেঘবতীকে টেনে হেঁচড়ে স্তুপের দিকে নিয়ে যায়।
সুপ্রতীক বরুণা নদীর তীরে বসে ভাবছিল মেঘবতীর কথা। সে জানে, ইহকালে মেঘবতীর সাথে তার আর দেখা হবে না। যশ আজ সকালবেলা এও হুঁশিয়ার করেছে — ‘তোকে টুকরো টুকরো করে বরুণার জলে ভাসিয়ে দিব।’
সুপ্রতীক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে সারনাথ ত্যাগ করবে না। সে এই মৃগ দাবেই থেকে যাবে। সে থেকে গিয়েছিল কিনা কেউ বলতে পারে না। ধামেক স্তুপের মনুষ্য সকল তাকে সারনাথে আর দেখতে পায় নাই। কথিত আছে মেঘবতীকে সুরঙতলে ফেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছিল শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ।
সুপ্রতীক আর মেঘবতীর প্রণয় কাব্য লেখার বড়ই সাধ হয়েছিল এই বঙ্গেরই নামযশহীন এক কবির। সে গিয়েছিল সারনাথে। সেখানে সে দেখতে পেয়েছিল হরিণ বন। বন থেকে ছুটে এসেছিল একটি মায়াবী হরিণী। তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল কবি। হরিণীর চোখ ছিল অশ্রু মন্ডিত। যেন ঠিক কয়েক শত বছর আগের কোনো এক মেঘবতীর চোখের অশ্রুজলের মত।
—————————–
ডিসক্লেইমার: আখ্যান তথ্য ঋণ সন্মাত্রানন্দ। পুরো লেখাটা আমার কল্পনাপ্রসুত। সত্যের সাথে কল্পনা মিশে আছে।
৭. দেবযানী
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বইয়ের র্যাকে খুঁজছিলাম বিভূতিভূষণের দেবযান। খুঁজতে খুঁজতে বইটিতে হাত রাখতেই ওপাশ থেকে খুঁজতে আসা একটি মেয়ে হাত রাখে একই বইয়ের উপর। সেও খুঁজছিল দেবযান। একটু বিব্রত হই। দুইজনের হাত বইটির উপরে। তাকিয়ে আছি একে অপরের দিকে। একটি মাত্রই কপি।
আমি বলি — আপনি পড়বেন?
একই মুহূর্তে মেয়েটি বলে ওঠে — আপনি পড়বেন বইটি?
আমি বলি — আচ্ছা, আপনি নিয়ে নেন।
সেও বলে ওঠে — আপনি নিয়ে নেন।
একই সময়ে একই নিবেদন। শেষ পর্যন্ত সেদিন বইটি আমিই নিয়ে পড়েছিলাম।
মেয়েটির নাম কামরুন নাহার কেয়া। দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিল সে। আমি বাংলা বিভাগের। একই ইয়ারমেট। লাইব্রেরিতে পড়তে এসে প্রায়ই কেয়ার সাথে আমার দেখা হত। কথাও হত।
দুজনই ছিলাম স্বল্পভাষী। প্রথম যেদিন লাইব্রেরি বারান্দায় বসে দুজন কথা বলছিলাম — মুখে কোনও কথা ছিল না। কেয়া ছিল, লাইব্রেরি আঙিনায় নভেরা আহমেদের ধবল শিল্পকর্মের মত নিশ্চল। মূর্তিতে প্রাণ নেই। গভীর দৃষ্টিতে প্রাণ খুঁজে নিতে হয়। সে প্রাণ অন্তরে স্পন্দিত হয়। অনির্বচনীয় কোনও আত্মার অনুভবের মত।
কাউকে ভালবাসতে চাই না। আবার কাউকে না কাউকে ভালবাসতে মন চায়। কিছু চোখ থাকে, যে চোখে জগতের অনেক স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। এই সব চোখে স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে। নিজেকে নিজে বলি– ‘স্বপ্ন দেখ না তুমি। বহু অশ্রু জলের দাম দিতে হবে তোমাকে।’
কী ভয়ংকর সুন্দর চোখ ছিল কেয়ার। খুব ইচ্ছা হত, ঐ চোখে আমার পৃথিবী দেখি।
ফাল্গূনের পাতা ঝরার দিন ছিল তখন। লাইব্রেরি লনের ঘাসগুলো ছিল ম্রিয়মাণ। প্রাণ আছে, প্রাণ নেই। কড়ই গাছ থেকে একটি দুটি করে টুপটাপ করে মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। মনে হয়েছিল, আমরা দুজন কত কথা বলতে চাই। কত আপনার কথা প্রাণ ভরে। কিন্তু সেই প্রথম দিনের দেবযান বইটির উপর দুজনের দুটি হাত থেমে থাকার মত আমাদের কণ্ঠ যেন রোধ হয়ে ছিল। কে করবে নিবেদন, কে করবে গ্রহণ। কেন ছিল দ্বিধা। ভালবাসা প্রকাশ করতে কেন ছিল ভয়?
একা একা তো ভালই আছি, দুইজন হয়ে গেলে জগতের সুখ আর আনন্দ হয়ত পেলাম। কিন্তু দুজন হয়ে কখনও যদি আবার একা হয়ে যাই? তখন পূর্বের সেই একা থাকার ভাললাগা আর কী ফিরে পাব? এই সব ভাবনা নিয়েই একদিন কেয়া’র একটি খাতার শেষের পাতায় লিখেছিলাম —
যদি স্থান দাও গৃহ কোণে
যদি থাকি দুজনে বিশ্ব ভূবন তলে
যদি বলো কম্পিত কণ্ঠস্বরে
ভালবাসি, ভালবাসি।
কেয়া বলেছিল — ‘তোমার কবিতাটি অনেক সুন্দর হয়েছে।’ আমি মনে মনে বলি — ‘এ তো কবিতা নয়। এ আমার অর্ঘ্য তোমার জন্য, এ আমার নিবেদন।’
বিবর্ণ ঘাসের খড়কুট উড়িয়ে নিচ্ছিল বসন্ত বাতাস।
চত্বরে এত বৃক্ষ, কিন্তু পাতাগুলো লালচে হয়ে গেছে। এত শাখা প্রশাখা, কোথাও একটি পাখি ডাকল না। কেমন যেন চৌচির লাগছিল। আমি তাকাই কেয়ার চোখের দিকে। সেই চোখ ছিল অব্যক্ত। কবিতার পংক্তি গুলো লেখার সময় আমার চোখ ছিল স্মিত হাসির, কিন্তু মুহূর্তেই সেই চোখ হয়ে গিয়েছিল তা দুঃখের মত শান্ত।
কয়েকদিন লাইব্রেরিতে কেয়াকে দেখতে পেলাম না। টেবিলের উপর বিভূতিভূষণের দেবযান বইটি বের করে একাকী পাতা উল্টাই। কয়েক পাতা পড়ি, পড়তে পড়তে থেমে যাই। বন্ধ করে রাখি। চেয়ে থাকি মলাটের দিকে। এই বইটিতে একদিন পড়েছিল দুজনের হাত। এই বইয়ে কেয়ার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। স্পর্শ আছে, কিন্তু তা দেখা যায় না।
হলে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম, কেয়া কী আমার সাথে আর দেখা করতে চাইছে না। নিজেকে নিজেই স্বগোতক্তি করি — প্রেম নিবেদন করে আমি কী ভুল করলাম? আমি কী ওর অযোগ্য?
আচ্ছা, দেখা হলে কেয়ার কাছে থেকে আমার নিবেদন ফিরিয়ে নেব। কিন্তু, এই কথা বলব কী ভাবে? ওর সাথে দেখা হলে আমি তো কোনও কথাই বলতে পারি না। তারচেয়ে একটি চিঠি লিখে রাখি। দেখা হলে — এই চিঠিটি ওকে দিয়ে দিব।
একদিন লাইব্রেরি আঙিনায় দেখা হয়ে যায় ওর সাথে। প্রথম যেদিন বারান্দায় যে জায়গায় বসেছিলাম, ঠিক আজও বসলাম সেখানে দুজন। কথা বেশি বলা হয়না । সেই স্বল্প কথার এক ফাঁকে কেয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে যে কথা বলেছিল — ‘ তোমাকে একটি কথা বলা হয়নি, আমি বিবাহিতা।’
খুব স্বাভাবিক ভাবেই আজও কড়ই গাছ থেকে মরা পাতা ঝরে পড়ছিল ধূলোর উপরে। আজও ফাল্গুন বাতাসে উড়ছিল ঝরা পাতা। কোথা থেকে উড়ে এসে বসল চত্বরের বিবর্ণ ঘাসের উপরে একটি শালিক। খরকুট ঠকরে ঠকরে সে উড়ে চলে গেল।
কেয়া বলল — যাই।
আমি বললাম — আচ্ছা।
যে চিঠিটি কেয়ার জন্য লিখেছিলাম, তা আর দেয়া হলো না। কী লিখেছিলাম ছোট্ট সেই চিঠিতে?
দেবযানী,
দেবযানী নামটি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। আজ
এই নামেই সম্বোধন করলাম। অবশ্য এইটি প্রথম ডাক তোমাকে, এইটিই শেষ ডাক। বিভূতিভূষণের দেবজান পাঠকদের কাছে চিরকাল থাকবে। কিন্তু আমার দেবযানী আমার চিরকালের হলো না।
একটা ভুল করেছিলাম আমার লেখা কয়েকটি পংক্তিতে। আসলে ঐটি কবিতা ছিল না। ঐটি ছিল আমার অর্ঘ্য, আমার প্রেম।
তুমি বলেছিলে — কবিতা। আজ বলছি, ঐটি কবিতাই ছিল। কোনও অর্ঘ্য ছিল না।
তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না।
—— রঞ্জন।
চিঠিটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ধূলোর উপর ফেলে দেই। জীবনের কত কিছু কত দামি মনে হয়। আবার সেই দামি কতকিছুই ধূলোর উপরে খড়কুট হয়ে পড়ে থাকে।
৮. টিউলিপের গন্ধে ভাসি
একজন অদ্ভুত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের ওয়েস্টার্ণ বেলিভিউয়ের একটি মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে। লোকটির নাম ছিল বিলি উইল্ডার। বয়স সত্তর বছর হবে। আগ বাড়িয়ে বিলি নিজেই আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল। বিলি মুহূর্তে দেখা মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারত। যেমন আপন করে নিয়েছিল আমাকে।
বিলি একা মানুষ। তাই হয়ত তার ভিতর মানুষকে কাছে টানার টান ছিল প্রগাঢ়। সে উইকেন্ডে আমার গ্রামের্সি প্লেসের হোস্টেলে এসেছিল বেশ কয়েকবার । সত্তর বছর বয়স তার। অথচ সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করত। একদিন অনেকটা জোর করেই সে আমাকে তার রাইটউডের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।
সেদিন ছিল বসন্তের এক উজ্জ্বল দিন। বৃষ্টির মেঘ নেই আকাশে। ঝিকিমিকি রোদ্দুরের নিচ দিয়ে গাড়ি চলছিল। লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির বাইরে আর একটি ছোট শহর রাইটউড। সেই শহরের শহরতলিতে বিলির বাড়ি। যেতে যেতে পথের দুপাশে অজস্র টিউলিপ ফুলের প্রান্তর পড়ে। এত ফুল একসাথে এর আগে কখনও আমি দেখিনি। কী এক অদ্ভুত গন্ধে বর্ণে উদ্ভাসিত ছিল চারদিকে। বিলি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিল। গাড়ির স্টেরিওতে একজন অজ্ঞাত শিল্পীর একটি মেলোডি গান বাজছিল। খুবই মায়াবী ছিল সে সুর। অপূর্ব ছিল গানের কথা। যার অর্থ — ‘পথেই পথ মিলে আর একটি পথের, আমরা দুজন চলছি , সেই পথের দিকে। আমরা মিলব ঐ সুদূরে।’
রাইটউডের শহরতলির একটি নির্জন গ্রেভইয়ার্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গ্রেভইয়ার্ডের শেষ প্রান্তে একটি নিরিবিলি বাড়ির সামনে যেয়ে গাড়িটি থামে। আশেপাশে অন্য আর কোনও বাড়ি নেই। আমি বিলিকে বলি — ‘এইটি কী তোমার বাড়ি?’—- হ্যাঁ, এইটি আমার বাড়ি।
বাড়িটিতে অন্য আর কোনও মানুষ নেই। চার কক্ষ বিশিষ্ট একতলা বাগান বাড়ি। বাড়ির সামনে রাস্তার ঐ পাশটায় গ্রেভইয়ার্ডের সীমানা। কবরস্থানটা খুবই মনোরম। টিউলিপ ফুলসহ নানারঙের, নানা বর্ণের ফুলে ফুলে শোভিত।
আমি বিলিকে বলি —- ‘তোমার কী আর কেউ নেই?’
—- আমার দুইটি ছেলে আছে। ওরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্য স্টেটে, অন্য শহরে থাকে।
—- তোমার স্ত্রী নেই?
—- আছে। ঐ যে গ্রেভইয়ার্ড দেখেছ, এর মাটির তলায় সে শুয়ে আছে।
বিলির কাছে থেকে যা জানতে পারি, তার স্ত্রী ছিল একজন সঙ্গীত শিল্পী। ছোট ছোট ঘরোয়া পার্টিতে ও মিউজিক রেস্টুরেন্টে গান গাইত সে। নাম ইভা গ্যাবর। আর, বিলি উইল্ডার নিজে ছিল একজন গীতিকার ও সুর শিল্পী। গাড়িতে আসতে আসতে যে গানটি শুনেছিলাম, সেই গানটি গেয়েছিল ইভা গ্যাবর। আর গানটি লিখেছিদ ও সুর করেছিল বিলি উইল্ডার।
বিলি আর ইভার ছিল বিয়াল্লিশ বছরের সুখের দাম্পত্য জীবন। প্রেম করে ওরা বিয়ে করেছিল। বিলির লেখা গান ও সুরে কন্ঠ দিত ইভা। গান লিখতে লিখতে, গানের সুর তুলতে তুলতে, আর গান গাইতে গাইতে দুজনের ভিতর প্রণয় গড়ে ওঠে। তারপর বিয়ে করে। ঠিক তার বিয়াল্লিশ বছর পর ইভা বিলিকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়। বিলি হয়ে যায় একা।
বিলি ঘুরে ঘুরে ওর স্টুডিও রুমটি দেখাচ্ছিল। দেয়ালের গায়ে অনেক গুলো ইভার ছবি সাঁটা আছে। ঘর ভর্তি গানের ইনস্ট্রুমেন্ট। আমি বিলির চোখে মুখের দিকে তাকাই। কী অবাক বিষণ্ন চাহনি। সে গরগর করে বলে যাচ্ছিল — ইভার যত সফলতার কথা।
আমি কৌতুহল ভরে বিলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি জৌলুস পূর্ণ লস অ্যাঞ্জেলেস ছেড়ে এই ছোট্ট শহরে, এই নির্জনে কবরস্থানের পাশে কেন বাড়ি কিনলে? কেন এখানে থাক? এখানে একাকি থাকতে তোমার ভয় করে না?
বিলি উত্তর দিয়েছিল, দিনের একাকীত্বে, নিঃসঙ্গ রাত্রির মধ্য প্রহরে আমি মগ্ন চিত্তে ওর গান শুনি। মন খারাপ লাগলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সমাধির পাশে। বসে থাকি চেরী ফুলের ছায়ায়। টিউলিপের গন্ধে ভাসি। দূর কোথাও থেকে ওর গান ভেসে আসে। নির্জনে যে ওকে আমি নিবিড় করে কাছে পাই।
বিলির জন্য, ইভার জন্য আমারও মনটি কেঁদে উঠে। পৌঢ় বিলি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে এত ভালবাসে? আমি বিলিকে বলি — ‘ চল ইভার সমাধির পাশে। আমি ওর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করব।’
বিলি আমাকে নিয়ে যায় ইভার সমাধির পাশে। কবরের চারিদিকে কত রকমের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। দূর্বা ঘাসের উপর কতো বৃষ্টি ঝরে পড়ে। কত ফুলের সুবাসে ভরে আছে এখানের বাতাসে। শ্বেত পাথরের সোপানের উপর লেখা আছে :
Here lies my wife, I bid her Goodbye
She rest in peace.
EVA GABOR
( 1948 — 2009 )
” Where have you gone for beyond me,
Far away
How many songs written about you
How many tune old …..”
ইভার কবরের কাছে নিরবে দাঁড়িয়েছিলাম আমি আর বিলি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। দূরের সান গ্যাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে ভেসে আসছিল সজল বাতাস। টিউলিপ ঝাড়ের ফুলগুলো মৃদুমন্দ দুলে উঠেছিল। একবার চেয়েছিলাম বিলির চোখের দিকে। দেখি, তার চোখের কোণ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা ঝরে পড়ছে।
৯. তার চোখে জল
একদিন এক সন্ধ্যা পূর্ব বিকালে আমি আমার স্টুডিওতে বসে আলস্য সময় পার করছিলাম। ঠিক সেই সময়ে একজন পঁয়ত্রিশোর্ধো লোক রুমে প্রবেশ করে। লোকটি অচেনা। পূর্বে কখনও দেখেনি। লোকটি সালাম দিয়ে আমাকে বলে — ‘ভাই, আমি একটি কাজ করাতে আপনার এখানে এসেছি।’
— কী কাজ ? আপনি বসেন।
লোকটি তার ব্যাগ থেকে ইনভিলপে রাখা একটি পুরনো ছবি বের করে। এবং আমাকে দেখিয়ে বলে, দেখুন না — ‘ছবিটি অনেক জায়গায় নস্ট হয়ে গেছে। আপনারা যদি রিপিয়ার করে ঠিক করে দিতেন।’
আমি ছবিটি হাতে নিয়ে দেখলাম, ছবিটি অনেক আগে কোনো স্টুডিওতে তোলা। সাদা কালো ছবিটি জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ছবিটির এমন অবস্থা যে, আর কিছু দিন পরে এর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। আমি ছবিটি দেখে, লোকটিকে বললাম — ‘আমরা এই কাজ গুলো করি না।’
লোকটি খুব বিষণ্ন হলো। মন খারাপ করে বলছিল, ‘খুব আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। এখন কি করব? কোথায় যাবো। আমি এই শহরের পথঘাট ভাল করে চিনি না।’
আমি বললাম, ‘এই পুরোনো কাজগুলো যারা করেন তাদের ঠিকানা আমি আপনাকে বলে দিব।’
দেখলাম, লোকটি সেই পুরোনো ছবিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। মনে হলো, তার চোখের কোণে জল জমে উঠেছে। লোকটি চশমা খুলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে সেই জল মুছে ফেললেন। আমি বললাম, ছবির এই মেয়েটি কে?
—– আমার স্ত্রী।
মনে মনে ভাবলাম, লোকটির স্ত্রী হয়ত মারা গিয়েছেন। তাই তার চোখে জল। বললাম — ‘উনি এখন কোথায়?’
— ‘সে অনেক দুঃখের কথা। হয়ত সে এখন আপনাদের এই শহরেই আছে। কিংবা অন্য কোথাও। কিংবা সে এখন বেঁচে নেই।’
— একটু খুলে বলবেন কী ?
লোকটি বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন —
আমার বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী। বাবা মার পছন্দে বিয়ে করেছিলাম পাশের থানা বোয়ালমারী’র এক পল্লীতে। তখন আমার বয়স একুশ বছর। বিয়ের ছয়মাস পর বউকে নিয়ে ঢাকা শহরে মামা শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। গাবতলীতে বাস থেকে নেমে বউকে টার্মিনালে বসিয়ে রেখে আমি বাথরুমে যাই।
এইটুকু বলে লোকটি থেমে যায়। আমি বলি, তারপর?
—- ‘বেসিনে মুখ ধুবো বলে দাঁড়িয়েছি। ঠিক তখনই পিছনে থেকে কে যেন আমার মুখে রুমাল চেপে ধরে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি — আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।’
— তারপর?
— আমার স্ত্রী কে আমি এই শহরে হারিয়ে ফেলি। কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি। না টার্মিনালে, না অন্য কোথাও। বাড়িতেও ফিরে যায়নি।
— তারপর আর কোনও খোঁজ কী পাওয়া যায়নি তার?
লোকটি আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। মনে হলো, আবারও সে কাঁদছে। এবারও চশমা খুলে আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণ মুছলেন। সে তার ব্যাগটি খুলে একটি পোস্ট অফিসের পুরোনো খাম আমার হাতে দিয়ে বললেন — ‘ এই চিঠিটি হারিয়ে যাওয়ার একবছর পর সে আমাকে লিখেছিল। এই একটিই চিঠি।’
খামটি সে সযত্নে রাখলেও খামের উপর ঠিকানাটা অস্পষ্ট হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। ঠিকানা লেখা —
মোঃ সেকেন্দার আলী,
গ্রাম ও পোঃ নিশ্চিন্ত পুর
মধুখালী, ফরিদপুর।
খামের ভিতর থেকে চিঠিটা বের করে আমি পড়তে থাকি —
প্রিয়,
আমি আপনার কাছে থেকে এখন অনেক দূরে। এই ঢাকা শহরে রঙিন আলো ঝলমলে জীবন আমার। কত মানুষের কত বিচিত্র ভালোবাসা আমি পাই। ঘাটের জল একবার এই পাত্রে, আর একবার অন্য পাত্রে।
কোনো দিন আর আপনার কাছে ফিরে যাওয়া হবে না। এই মন এই দেহ আর আপনার নেই। পচে গলে নস্ট হয়ে গেছে।
খুব মনে পড়ে, মধুমতি নদীর কথা। কত সন্ধ্যা বিকালে ঘুরেছি তীরে। কত মধুপূর্ণিমায় আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে আমরা তারা দেখেছিলাম। আমার জন্য মন খারাপ করবেন না। আপনি আর একটি বিবাহ করে নিবেন।
ইতিঃ
শেফালী।
অজান্তেই আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। খুব মায়া লাগছিল সেকেন্দার আলীর জন্য। আমি ওনাকে বলি — আপনি নিশ্চয়ই আর বিয়ে করেননি?
—- না।
—- বিয়ে আর কোনও দিন করবেন না?
—- না।
আমি সেকেন্দার আলীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার চোখে জল।
১০. পুণ্যবাস
এই যে নদীটি দেখছি আমি। এর নাম ছোট যমুনা নদী। নদীটি পাহাড়পুর আর সোমপুরে বহমান। এখন যে রূপে নদীটি দেখছি, তখন সেই রূপ ছিল না। হিমালয় থেকে এসেছে সে। কত গ্রাম চিরে, কত মাটি ছেনে, কত বাঁক ছিন্ন করে হয়েছে সে আত্রাই, কখনও পুনর্ভবা, কখনও তুলশী গঙ্গা, কখনো এই ছোট যমুনা। আজ যে যমুনাকে দেখছি, এখন সে মরা গাঙ। দূপাশে ধান ক্ষেত। বাতাসে পাতা দোলে। প্রজাপতি উড়ে। বক চ্রিহি চ্রিহি করে ডেকে উড়ে চলে যায়।
এখনও এই নদীর তীরে পোড়ামাটির স্নান ঘাট আছে , ভাঙ্গা সোপান আছে, বহু পুরোনো অশ্বত্থ গাছ আছে। ভগ্ন মন্দির আছে। আছে অদূরে বৌদ্ধ সোমপুর বিহার। সবই ভগ্ন স্তুপ। সবই ইতিহাসের ধূলি ধূসর কালের। আমি লাল মৃত্তিকার ধূলো পথে হেঁটে হেঁটে ঘাটের একটি ভগ্ন সোপানের ইটের উপর যেয়ে বসি। তাকিয়ে দেখি, ক্ষয়ে যাওয়া নদীর শুকনো ঘোলা জল। বাতাসও বয়ে আসছিল দূর দিগন্ত থেকে। মেঘের ছায়া পড়েছিল আমার উপর। গা কেমন হিম হিম করে উঠছিল। কেমন নির্জন, কোথাও কেউ নেই।
লাল আভা বিচ্ছূরিত অস্তাচলের দিকে মুখ করে বসে আছি। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল, কেউ একজন আসছে ঘাটের দিকে। ঘুরে তাকাতেই দেখি, একজন চল্লিশোর্ধ লোক। সারা শরীর তার লাল মাটিতে আকীর্ণ। সুঠাম দেহ বল্লর। খালি গা। পরনে স্বল্প বসন নেংটি। নাভীর সাথে কালো মোটা সুতায় বেঁধে পেঁচিয়ে রেখেছে এক টুকরো কাপড় সামনে পিছনে করে। তার উরু যুগল দুপাশে উন্মুক্ত। শুধু শিশ্নটি ঢেকে রেখেছে।
শান বাঁধানো ঘাটের সোপান বেয়ে লোকটি নদীর স্বচ্ছ জলে নেমে পড়ে। ঝিরিঝিরি স্রোত ধারায় লোকটি তার শরীরে লেগে থাকা লাল কাদা মাটি ধুয়ে ফেলে।
এই লোকটি আজ থেকে প্রায় বারো শত বছর আগে অদূর মথুরাপুর গ্রাম থেকে এসেছিল। মাত্র আট নয় বছর বয়সে সে ঘর ছেড়ে আসে এখানকার গন্ধেশ্বরী মন্দিরে। অনেকটা সন্ন্যাসব্রত হয়েই সে ঘর ছেড়েছিল। ওর নাম মাধব। পুরো নাম শ্রীমান মাধব চন্দ্র দেব। প্রথম প্রথম সে মন্দিরে আগত সন্ন্যাসী, ভিক্ষুদের সাদা পোশাক গুলোতে লালমাটি মিশিয়ে একধরনের গৈরিক রং করে দিত। ক্রমে মাধব যার শিষ্য হয়, তিনি ছিলেন মৃৎ ও প্রস্তুর শিল্পী। সব ধরনের মূর্তি বানানোর শিক্ষা এই বালক তার গুরুর কাছে থেকে শিখে নেয়। গুরু ইহধাম ত্যাগ করলে, সে এই পাহাড়পুর অঞ্চলে একমাত্র মৃৎ মূর্তি শিল্পী হয়ে ওঠে।
গন্ধেশ্বরী মন্দিরের পাশেই দ্বীপগ্রামে মাধব একটি মাটির বাড়িতে থাকে। ছোনের চালা। ঘরের তিনদিকে ছোট্ট তিনটি জানালা। চারিদিকে বন বেষ্টিত। আশেপাশে তেমন ঘর বাড়ি নেই। পিছনের জানালাটি খুললে নিবিড় বন দেখা যায়। পাখপাখালি কিচিরমিচির করে সর্বক্ষণ। সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ ডাকে। জোনাকি আলো জ্বেলে ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে।
মাধব মূর্তি বানায় লাল মাটি আর পাথর খোদাই করে।
তার কোনো সাহায্যকারী নেই। সে একাই মূর্তি গড়ে। কখনও লাল মাটি দিয়ে, কখনও পাথর খোদাই করে। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে, সোমপুর, পাহাড়পুর এলাকায়। এই তল্লাটেই সে থিতু হয়। কিন্তু সে বিবাহ করে নাই। সে সন্ন্যাসব্রত নিয়ে ঘর ছেড়েছিল। সংসার তার জন্য নয়।
একটি সাত আট বছরের ডোম বালিকা মাধবের কুটিরে প্রায়ই এসে দাঁড়িয়ে থাকত। বালিকা দেখত, কীভাবে সে মূর্তি তৈরি করে। প্রথম প্রথম বালিকা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। পরে আস্তে আস্তে সে মাধবকে সাহায্য করে। তাকে মাটি ছেনে দেয়। ছেনী ও জল এগিয়ে দেয়। সন্ধ্যা হলে কুপি জ্বেলে তুলে ধরে। মাধবও বালিকাকে খুব স্নেহ করে।
একদিন বালিকা মাধবকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা দাদাভাই, তুমি শুধু ছেলেদের পূর্ণ মূর্তি গড়ো, মেয়েদের সম্পূর্ণ মূর্তি গড়ো না। শুধু মুখের অংশ টুকু গড়ো। কেন গড়ো না মেয়েদের পূর্ণ মূর্তি?
— সে তুমি বুঝবে না। তুমি বড়ো হও। তখন বুঝবে। তখন তোমাকে বলবো।
বালিকার নাম গৌরী। গৌরি প্রায় প্রতিদিনই আসে। সারাদিন থাকে। সন্ধ্যায় দীপ জ্বেলে দিয়ে পর্ণকুটিরে চলে যায়। গৌরী যখন প্রথম মাধবের বাড়িতে আসে, তখন গৌরীর শরীরের উপর অংশ থাকত উদাম। গৌরীর স্তন তখনও বরোই সম হয়নি। নিম্ন অংশ একটি ডুমা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখত।
গৌরী এই ভাবেই মাধবের ঘরে আসে। মাধবের ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আবার আসে। আবার যায়। গৌরী ক্রমে বড়ো হয়ে ওঠে। সে এখন ষোড়শী পূর্ণবতী তরুণী। পরনে তার ডুমা। শরীরের উপরের স্তনদ্বয় পরিপূর্ণ। সে এখন ব্লাউজ পড়ে। মাধব এতগুলো বছরেও খেয়াল করেনি গৌরী বড়ো হয়ে উঠেছে। সে সন্ন্যাস না হলে হয়ত এমন করে ভাবত — ‘রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা । তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।’
তখন ভরা বর্ষাকালের প্রসন্ন বিকাল। বাদল গাছির ছোট যমুনা নদী জলে ফেঁপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাধব কুমার তার ঘরের জানালা খুলে পিছনে বনের দিকে চায়। সারা বনময় কদম আর কেতকী ফুল ফুটে আছে। বর্ষার দখিনা হিম বাতাসে গন্ধ এসে সারা ঘর সুবাসে ভরে উঠেছে। সেই কত বছর হয়ে গেছে ঘর ছেড়ে এসেছে সে। তারপর আর ঘরে ফিরে যায় নাই। সংসারহীন এই মানুষটি এ জীবনভর শুধু মূর্তি গড়েই গেল। কী বৈরাগ্য তার অন্তরে বাসা বেঁধেছে। কোনই যৌবন জীবন সে ভোগ করতে পারে নাই।
হঠাৎ খিরকি খুলে গৌরী গৃহে প্রবেশ করে। মাধব তখন দুবলহাটীর মহারানীর মূর্তি গড়ছিল। আবক্ষ মূর্তি নয়, শুধু মাত্র মুখাবয়ব। গৌরী মাধবকে জিজ্ঞাসা করে — ‘দাদা ভাই, আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। তুমি বলো, কেন তুমি নারীর আবক্ষ মূর্তি গড়ো না?’
অদূরে যমুনায় কলকল জলের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। তার কূল থেকে বয়ে আসা সমুষ্ণ বাতাস বনের ভিতর দিয়ে ঝোঁপা ঝোঁপা ফুটে থাকা কদম্ব আর কেতকী ফুল ছুঁয়ে ঘরে প্রবেশ করে। মাধবের মন উন্মনা হয়ে ওঠে। সে দেখছিল গৌরীর কৌতুহল মাখা উন্মুখ চোখ। দেখছিল মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবক্ষ দেহ। যে রমণীদেহ এত বছর খুঁটে খুঁটে সে কখনও দেখে নাই। সেই দেহ দেখবার তার সাধ হল। কখনই ভাবে নাই– রণণীদের স্তন যুগল কেমন হয়? তাদের নাভী কেমন? নাভীর নীচে জঙঘা, উরুসন্ধি, লম্বা খালি পদদ্বয়, উন্মোচন করা নগ্ন দেহ।
মাধব গৌরীকে বলে — হ্যাঁ, তোমাকে আমি বলিয়াছিলাম, তুমি বড় হইলে তোমাকে আমি বলিব। আমি একজন সন্ন্যাসব্রত একাকী মানুষ। আমি কখনই রমণীদের প্রতি দুর্বল হইতে চাহি নাই। নারীর আবক্ষ মূর্তি গড়িতে গেলে নারীর স্তন, নাভী, উরু, জঙ্ঘা দেখিতে হইবে। আমি তো এইসব পারিব না। এই সবই আমার ধর্মব্রত সমর্থন করে না।’
গৌরী বলে — ‘আপনি শিল্পী। আপনাকে সব পারিতে হইবে।’
পিতলের বড়ো গামলায় লাল মাটি ছানা করা আছে। গামলা হতে মাটি আঁজলা ভরে তুলে নিয়ে মাধবকে দিয়ে বলে — ‘আপনি রমণী মুর্তি গড়ুন।’
এই বলে গৌরী তার বক্ষের কাপড় উন্মোচন করে। পরনের ডুমা খুলে ফেলে। তারপর মাধবকে বলে — ‘আমাকে দেখিয়া দেখিয়া নারী মূর্তি গড়ুন।’
মূর্তি গড়তে গড়তে মাধব দেখতে পায়, নারী দেহের সব রহস্যময় জগত। লাল মাটির কাদা মাখা হাত গৌরীর স্তন ছেনে। পিচ্ছিল হাত কাদা মাখতে মাখতে নাভী পর্যন্ত চলে আসে। নাভীর নিচে দেখতে পায় গোলাপি জলের প্রশ্রবণ। এ এক অবিস্মরণীয় ঝর্ণা ধারা যেন। সেই জলের ধারায় মাধব, ডুবতে থাকে। চিরকালের এক অস্বাদিত অমৃত সুধা সে পান করতে থাকে। সে বুঝতে পারে এই জীবন একাকীর নয়, জীবন দুজনের। জীবনের পূর্ণতা মেলে সঙ্গমে। ‘প্রস্থানং তে কথমপি সখে লম্বমানস্য ভাবি, জ্ঞাতাস্বাদো বিবৃতজঘনাং কো বিহাতুং সমর্থঃ’ এ যেন স্বর্গীয় পুণ্যবাস।
দুজনের দেহেই লাল কাদামাটি লেগে একাকার হয়ে গিয়েছিল। দুজনেই যেন অচেনা মানব মানবী। সেই সন্ধ্যায় মাধব আর গৌরী ঘরের খিরকি খুলে বনের পথ ধরে কোথায় যেন চলে যায়। হয়ত গভীর বনের ভিতর তারা অজ্ঞাত বাস করে, নতুবা উত্তাল ভরা যমুনার জলে নেমে আত্মাহুতি দিয়েছিল।
এরপর পাহাড়পুর আর সোমপুর বিহারের মানুষ তাদেরকে কখনই দেখতে পায় নাই।
১১. দৌড়
আশির দশকের কথা। চৈত্রের সন্ধ্যা রাত্রি।
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম। তখন বাস, গাড়ি, বেবী ট্যাক্সি কিছুই চলত না। ইট বিছানো ভাঙাচোরা রাস্তায় শেয়ারিং রিক্সায় কোনও মত শৈলাভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত আসি। ঘাটে পৌঁছে ঘড়িতে চেয়ে দেখি, রাত নয়টা বাজে। গ্রামে তখন রাত নয়টা মানে গভীর নিঝুম রাত্রি।
খেয়া নৌকায় নদী পার হই। এরপর পুরো আড়াই মাইল হেঁটে যেতে হবে। দুজন সঙ্গী পেলাম। তারা সামনে সাহান গাছা পর্যন্ত আমার সহযাত্রী হয়। তারপর আমি একা হয়ে যাই। ঘড়িতে চেয়ে দেখি, রাত সাড়ে দশটা বাজে। চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ। মৃত্যু পুরীর মতো নিথর পথ ঘাট। মানুষের কোনো জন কোলাহল নেই।
সাহান গাছা থেকে আমাদের গ্রামে যাওয়ার দুটো পথ আছে। একটি শুকনো মরা নদী পার হয়ে পাথারী মেঠো পথ দিয়ে যাওয়া যায়। আর অন্যটি কাঁচা ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে গেলে বেশ ঘুরে যেতে হয়। এবং পথে বেশ কয়েকটি জায়গায় বটবৃক্ষ পড়ে। শুনেছি, ঐ বটগাছ গুলোতে ভূত বসবাস করে। আমি তাই ঐপথে না যেয়ে পাথারী মেঠো পথ বেছে নেই।
চৈত্র মাসের খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় ভাসা ত্রয়োদশী চাঁদের রাত্রি। প্রান্তরে চেয়ে দেখি, কোথাও ফসল নেই। সব ক্ষেতগুলো শুকনো ঢিলে ভরা। কৃষক চাষ করে রেখেছে পরবর্তী ফসল বোনার জন্য। কেউ কেউ বুনেছেও পাট, আউষ ধান, আর আখ। আমি চাঁদের আলো আঁধারেই দেখতে পেলাম বিস্তৃর্ণ প্রান্তর। আর একটি পিটেসরা গাছ। ঐ প্রান্তর পাড়ি দিলেই আমাদের কুসুমপুর গ্রাম।
আমি মরা নদীটি পাড় হয়ে নদীর কূল ধরে মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। বুকের ভিতর সাহস রাখলাম, কোথাও কেউ নেই। এই প্রান্তরটি যদি ছোট্ট পৃথিবী হয়, সেই পৃথিবীতে আমি একা একজন মানুষ। নিজেকে খুব এ্যাডভেঞ্চারী মনে হল। বানভাসি চাঁদের জ্যোৎস্নায় আমি হাঁটছি। মাঝে মাঝে ব্যাঙ ধপ ধপ করে নদীর জলে নেমে যায়। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। জোনাকি আলোর সংকেত দিয়ে উড়ছে।
একটা রোমান্টিক রোমান্স নিয়ে পিটেসরা গাছটির কাছে এসে যাই। আমার খেয়াল ছিল না, ঐ গাছটির পাশে নদীর কূলে শ্মশান ঘাট। একটু ভয় ভয় লাগছিল, গা ছমছম করে উঠল। ভাবছিলাম, হায় আল্লাহ! আরো অর্ধেক প্রান্তর পাড়ি দিতে হবে। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ছিলাম, আর জোরে জোরে হাঁটছিলাম।
হঠাৎ সেই নিঝুম নিশীথ বেলায় কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটি ক্রমশ আমার দিকে ধেয়ে আসছে। একবার মনে হলো, বাম দিকের শ্মশান ঘাট থেকে শব্দটি আসছে। আমি হাঁটছি। অজ্ঞাত সেই পায়ের শব্দ একদম আমার পিছনে চলে আসে। মনে হল, আমাকে এখনই সে ছুঁয়ে ফেলবে। আমি আরো জোরে হাঁটতে শুরু করি। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটি রাগত মেয়ে কন্ঠ শুনতে পাই — ‘দাঁড়াও।’
আমি ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যাই। এক পা সামনে এগুতে পারলাম না। মেয়েটি আবার ধমক দিয়ে বলছে– ‘আমার দিকে তাকাও।’ আমি ঘুরে মেয়েটির দিকে তাকাই। দেখি, সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা মাথায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমি একটু সাহস করে বলি — তুমি কে? এত রাতে আমার পথ আটকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছো?
মেয়েটি: আমাকে তুমি চিনতে পারছ না? আমি ঊষা চক্রবর্তী। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। তুমি আমার
সহপাঠী ছিলে। ফুলকোচা স্কুলে আমরা পঞ্চম
ক্লাস পর্যন্ত একসাথে লেখা পড়া করেছিলাম।
আমি: সে কবেকার কথা। চিনতে পারব কেমনে? তারপর কত বছর চলে গেছে। তোমাকে আমি দেখি নাই এরপরে। শুনেছি, তোমার
নাকি বিয়ে হয়েছিল। এবং বিয়ের কয়েক দিন
পর তোমাদের বাড়ির বকুল গাছের ডালে
ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছ।
ঊষা চক্রবর্তী আমাকে ধমক দিয়ে বলে — ‘চলো ঐ গাছ তলায়। তোমাকে আজ আমি ডালে ঝুলিয়ে মেরেই ফেলব। আমাকে তুমি পেত্নী ভেবেছ? তোমার স্পর্ধা কত বড়!’
ঊষার কথা মতো আমি ভয়ে ভয়ে গাছের নিচে এগুতে থাকি। ঊষা আগে আগে আর আমি পিছে পিছে। ভূত পেত্নীদের পা নাকি মাটি থেকে উপরে থাকে। আমি পরখ করার চেষ্টা করলাম, ঊষার পা মাটি থেকে উপরে কিনা? হায়, সত্যিই দেখি, ঊষার পা মাটি থেকে উপরে। আমি ভয়ে পাথর হয়ে যাই।
আমি মনে মনে চিন্তা করি, ঊষা তো সত্যি সত্যি একটি পেত্নী। ও আমাকে ক্ষতি করবে নিশ্চয়ই। ঊষা, বিড়বিড় করে বলছিলও:
‘অনেক দিন পর তোমাকে বাগে পেয়েছি । আমি তোমাকে দেখে ছাড়ব রঞ্জন। কী ভেবেছ তুমি। দেখি, তোমাকে আজ কে বাঁচায়?’
ভাবলাম, আমার তো মহাবিপদ হবে। কী চিন্তা করে একটু ঘুরে দাঁড়াই এবং মুহূর্তেই ক্ষেত পাতাইলা বাড়ির দিকে ঝাইরা দৌড় দেই। পিছনে আর ফিরে তাকাই না।আমাকে তখন আর পায় কে?
১২. ১০৪ জিগাতলা ১ম লেন
সেদিন একটি কাজে গিয়েছিলাম ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে। যে কাজে গিয়েছিলাম, সে কাজটির জন্য দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কী করব এতক্ষণ? ভাবলাম, ঝিগাতলায় যেয়ে দুটো স্মৃতিময় বাড়ি দেখে আসি। দুটো বাড়ি মানে, একটি ছিল অনেক আগে সিটি কলেজের ছাত্রদের জন্য মেস। আর অন্যটি হচ্ছে ঐ মেসের সামনে দু-তিনটি বাড়ি পর অন্য একটি বাড়ি।
সেই কতবছর আগেকার কথা। চার দশক পেরিয়ে গেছে। সব রাস্তা ও গলি অপরিচিত লাগছে। কিছুই চিনতে পারছিলাম না। অনুমান করে চিনবার চেষ্টা করি। কোথায় সেই গলি, সেই ১০৪ নং জিগাতলার ১ম লেনের টিনশেড বাড়ি? নাহ্, নম্বর গুলোও পরিবর্তন হয়ে গেছে।
খুঁজতে খুঁজতে অনেক কিছু মিলিয়ে স্থির হতে পারলাম, পশ্চিম দিকের এই গলিটিতেই আমাদের কলেজের মেস ছিল। দেখলাম, মেস বাড়িটি এখন ছয় তলা ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। আশে পাশের কোনও বাড়িই আর টিনসেড নেই। সব বাড়ি বহুতল অট্টালিকা হয়ে গেছে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! আমাদের হোস্টেলের সামনে দু-তিন টি বাড়ি পর অন্য যে বাড়িটির কথা বলেছিলাম, সেই ছোট্ট দোতলা বাড়িটি তেমনই আছে। পার্থক্য বাড়িটি সেই তখনকার মতো চকচকে নেই। মনে হল, কত বছর ধরে রং করা হয় না। পলেস্তারা খসে গেছে। জায়গা জায়গায় পরগাছায় ভরে উঠেছে। সামনের লনটাতে বাগান ছিল। পাতাবাহার, জবা, বেলী, চেরী ফুল গাছ ছিল। এখন কিছু নেই। আগাছায় পুরো লনটা জঙ্গল হয়ে আছে।
আস্তে আস্তে বাড়িটি দেখছিলাম, আর সেই বহু বছর আগের কোনও এক মার্চ এপ্রিলের সোনালী সকালের কথা মনে পড়ছিল। হোস্টেল থেকে আমরা চারটি ছেলে বই খাতা হাতে নিয়ে এই গলি পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে কলেজে যেতাম। এই বাড়িটির কাছে এসে আমাদের পা কেঁপে কেঁপে উঠত। ঐ বাড়ির জানালা দিয়ে একটি মেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। মেয়েটি হয়ত দেখত — আমাদের পায়ে পায়ে চলার ভঙ্গি, পরনের পোশাক, সদ্য জেগে ওঠা গোঁফ, মাথার ঝাকরা চুল, চোখের চাহনি, কেমন করে কথা বলতে বলতে আমরা চলে যাই।
মেয়েটি ছিল আমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড়। গাত্র রং ফর্সা, কালো কুচকুচে কুন্তল, লম্বা প্রকৃতির দেহ গরণ, হরিণী মায়া চোখ, ছিপছিপে নাসিকা, ভরা নদীর মত শরীরী গঠন। তরুণ চতুষ্টয়ও ঐ মেয়েটিকে দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয় এবং ঐ মেয়েটির চরম ভক্ত হয়ে যায়।
আমাদের ভিতরে একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আমরা সুন্দর সুন্দর কাপড় চোপড় পড়তাম। পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতাম। বেলবটম প্যান্ট পড়তাম। টেন্ডী জুতা পায়ে দিতাম। আমরা সিওর হতে পারছিলাম না, মেয়েটি আসলে কাকে পছন্দ করে। আমরা নিজ নিজ ভাবে ধরেই নিতাম– হয়ত আমাদের নিজ নিজেকেই মেয়েটি পছন্দ করে।
কিন্তু, কেউই এই মেয়েটির সাথে কথা বলিনি। ওর বুড়ো বাবাটি ছিল খুব কড়া। আমরা যখন ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে কলেজে যেতাম, তখন ওর বাবা প্রায়ই বাগান পরিষ্কার করত। মেয়েটিকে জানালার পাশে দাঁড়ানো দেখলেই গম্ভীর গলায় ধমকের সুরে বলত — দিলরুবা জানালা বন্ধ করে দাও।
আমাদের এই লুকোচুরি খেলার ভাললাগালাগি বেশি দিন চলতে পারে নাই। ইতোমধ্যে হোস্টেলটি স্থান পরিবর্তন করে গ্রীন রোড চলে যায়। আমি চলে যাই মিরপুরে বোনের বাসায়। দিলরুবার সাথে আমাদের এই অসম প্রণয়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
যাহোক, আমি বাড়িটির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। আশা করছিলাম, ভিতর থেকে কেউ বের হয় কিনা? সত্যি সত্যি, দরজা খুলে একজন পৌঢ়া বের হয়ে আসে। তার মাথার চুল সম্পূর্ণ পেকে গেছে। কপালে বলিরেখা। কন্ঠের নীচে চামড়া ঝুলে গেছে। আমি ঠিকই ওনাকে চিনে ফেলি। এ যে আমাদের তারুণ্যের সেই রূপময়ী দিলরুবা। যাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখতাম। ইনি যে দিলরুবা, তা আরও সিওর হতে পারি যে, তার নাকের পাশে সুজাতার মত একটি তিল ছিল। সুজাতার তিলটা ছিল বামপাশে, আর দিলরুবার তিল ডানপাশে। আজও সেই তিলটি সেখানেই দেখতে পেলাম।
আমি একটু দ্বিধা নিয়েই ওনাকে বলি — ঐ যে ছয়তলা বাড়িটি দেখছেন, ওখানে অনেক আগে একটা ছাত্র মেস ছিল।
পৌঢ়া একটূ চিন্তা করে স্মরণে এনে বলল, হ্যাঁ ছিল। সে তো বহু বছর আগে।
— আমি সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। ঐ মেসে কয়েক মাস ছিলাম।
পৌঢ়া আমাকে স্মরণ করতে পারল না। অনেকটা বিরক্ত হয়েই গেট বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির ভিতরে সে চলে গেল।
১৩. ঝিনুকে নেই সমুদ্রে নেই
তখন সাঁজ পূর্ব বিকাল। সাগর কূলের অদূরে একটি ভিটায় ঘাসের উপরে বসে আছে পঞ্চাশোর্ধ একটি লোক। বিনম্র চোখে তাকিয়ে দেখছিল সাগর। শীত শীত পরন্ত বিকালে সেই আবীর মুহূর্তে এলমেল মেঘের আকাশ নুয়ে পড়েছে সমুদ্র জলে। লোকটি যেন কোথাও কাউকে খুঁজছে।
লোকটিকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। যেন বহু জীবন পথ পাড়ি দিয়ে এসে বসেছে অখ্যাত এই সাগর বেলায়। পিছনে কেওড়া গাছের পাতায় অস্তমিত সূর্যের লাল আভা। এমন মনময় মূহুর্ত, এমন স্থির সাগর জল, ঢেউহীন শব্দহীন জলের উপরে উড়ছিল ছোট ছোট সাগর পাখি।
একটু পর অস্তমিত সুর্যটি তলিয়ে যায় জলের অতলে। কেওড়া পাতার উপর লাল আভা সরে গিয়ে সেথায় নেমে আসে বিষণ্ন অন্ধকার।
লোকটি ভবঘুরে। মুখে অযত্নে বড় হয়ে গেছে মোছ ও দাঁড়িগুলো। বন্য ঘাসের মতো তা রুক্ষ এবং এলমেল হয়ে আছে এবং অর্ধেকেরও বেশি পেকে গেছে। সীতাকুণ্ডের সাগর বেলায় সে আজই এসেছে। কেউ তাকে চিনতে পারছে না। সে কে?
ঐ যে দূরে জেলেপাড়া দেখছেন, ঐ জেলে পাড়ায় সে প্রথম এসেছিল ১৯৮৫ সালে। একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষক হয়ে। মাত্র বছর খানেক সে এই অস্থায়ী স্কুলে শিক্ষকতা করেছিল।
লোকটির নাম সুরুজ আলী। তারুণ্যে সে সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখত। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু খুব একটা বিখ্যাত হয়ে উঠেতে পারেনি সে। একটি কবিতার বই ও প্রকাশ হয়েছিল, ‘ঝিনুকে নেই সমুদ্রে নেই।’
সুরুজ আলী ছিল প্রান্তিক পরিবারের মানুষ। অদম্য ইচ্ছা ছিল তার কবি হওয়ার। কিন্তু কবি না হয়ে সে শিক্ষক হয়ে এল, সমুদ্র উপকূলবর্তী উপদ্রুত জেলে পাড়ায়। বয়স্ক নারী পুরুষদের অক্ষর জ্ঞান শিখায়। একটি আলোর শিখা তুলে ধরেতে চায় সে।
বনতলে ছোট্ট একটি মাটির ঘরে তাঁর থাকবার জায়গা হয়। চারদিকে জারুল আর কেওড়া গাছ ছেয়ে আছে। সন্ধ্যায় এখানে অতসী ফুলের ঝাড়ে জোনাকিদের আলো জ্বলে ওঠে। কেরোসিন কূপী জ্বলত তার ঘরে। সুরুজ আলী মৌন নিবিড় আলোয় ভাঙ্গা একটি কাঠের টেবিলে ঝুঁকে পড়ে লিখত কবিতা!
সে লিখেছিল –‘এই বন ছায়ে, অদূরে অকুল সাগরে রাত্রি নামছে কুন্তল কালো অন্ধকারে। কার দিকে চেয়ে থাকি আমি, এই নিঃস্বীম আঁধারে খুলে অলিন্দ। ঝিঁঝিঁ ডাকুক, কালো পেঁচা চেঁচিয়ে উড়ে যাক। আমি এখনই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ব। ঐ সাগর আমাকে ডাকে। আমি পায়ে পায়ে চলে যাব, রাত্রির নৈঃশব্দ্যে। ভাঙা ঝিনুক যদি পায়ে বিঁধে, বিঁধুক।’
তার ক্লাসের ছাত্র ছিল হারান, কাশেম, জুলেখা, সৌদামিনী, অখীল, রুপালি, নৃপেন ও আরও অনেকে। ঠিক সন্ধ্যায় ক্লাস শুরু হত। হেজাকের আলোয় পড়াত সে। রাত আটটায় ক্লাস শেষ হয়ে যেত। একটি মাত্র বই। বিদ্যাসাগরের বর্ণমালা পরিচয়। ক, খ, গ, ঘ, ঞ। কর কর। খর খর। জল পড়ে। পাতা নড়ে।
একদিন ক্লাস শেষে সুরুজ আলী ঘরে আসছিল। পথে অন্ধকারে কে যেন পিছন থেকে ডাক দেয়। রমণী কণ্ঠ।
‘মাষ্টার মশাই।’
অন্ধকারে চিনতে পারছিল না। রমণী অবগুন্ঠিত। কন্ঠ শুনেও বুঝতে পারছিল না, কে এই রমণী?
— তুমি কে?
— আমি রুপা, রুপালি।
— কেন, কী জন্য, কী বলবে?
— আমি কি রন্ধন কাজে আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?
— না।
রুপালি শ্রেণীতেও অবগূণ্ঠিত। সে উজ্জ্বল মাঝির বউ। দশ বছর আগে উজ্জ্বল সাগরে মাছ ধরতে যেয়ে ট্রলার ডুবিতে মারা যায়। রুপা অকাল বিধবা। কোনও সন্তান নেই।
সেদিন বিকাল থেকেই ঝরো ঝরো বৃষ্টি ঝরছিল। এই রকম মেঘলা দিন হলে ক্লাস হত না। সুরুজ আলী ঘরেই বসে আছে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি অনেকটা ছেড়ে যায়। সবুজ আঁধার নেমে আসে লোকালয়ে।
হঠাৎ দরজা ঠেলে প্রবেশ করে রুপালি। অবগুণ্ঠনের নীচে থেকে সে বলে — ‘মাষ্টার মশাই, আমি রান্না করতে এসেছি।’
— তুমি চলে যাও। লোকে দেখলে খারাপ বলবে।
— না, আমি যাব না।
ঘরে কুপী জ্বালানো ছিল না। রুপালি ই আলো জ্বালিয়ে দেয়। রান্না করে দিয়ে সে চলে যায়।
অনেক রাত পর্যন্ত সুরুজ আলীর চোখে ঘুম এল না। কিছুই লিখতে তার ইচ্ছা হল না। সেই কবে কোথায় পড়েছিল :
স্বপন-মিলনে যদি কভু প্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে ধরিতে যায়/ শূন্য আকাশে প্রসারিয়া বাহু বৃথাই কেবল দুঃখ পাই!/ হেরি অভাগার গভীর যাতনা দেবতারও আখিঁ সজল হয়,/ তরু কিশলয়ে অশ্রু মুকুতা ঝরি’ ঝরি’ পড়ে বেদনাময়!’
সেদিন ছিল হেমন্তের নিঝুম দুপুর। রুপালি এসেছিল কবি কুটিরে। কবি লিখেছিল তার কবিতার খাতায়–
‘এই বনকুঞ্জবন থেকে আমি একদিন চলে যাব, সন্ধ্যার অতসী ঝাড়ে সেদিনও গুঞ্জন করে গান গাইবে জোনাকিরা। সমুদ্রের উপরে আকাশে এমনি লাল আভা ছড়াব সেদিনের সাঁজের সূর্য। এই পর্ণকুটিরে কে এসেছিল কখন অবগুণ্ঠনে, চকিত সেই চোখে লাজুকতা কী ছিল সন্ধ্যা তারার মতো? কণ্ঠে নেই তার চন্দ্রহার। কর্ণে নেই তার কুসুম কলি। বক্ষপথে নেমে গেছে গোলাপী জলের নদী, ঐ সমুদ্রে। পাড়ে খুঁজি ঝিনুকের ভিতর মুক্তা। কিন্তু মুক্তা ঝিনুকেও নেই, সমুদ্রেও নেই।’
সেই নিরালায় অবগুন্ঠিত এক নিরক্ষর রমণী বলে উঠেছিল, কী লিখছেন আপনি?
কবি কেঁপে কেঁপে তার করতলে হাত রাখে। শীতল সে হাত। কোনও উষ্ণতা নেই।
কবি বলেছিল রমণীকে — তুমি কী আসবে আমার ঘরহীন ঘরে?
তড়িৎ রমণী মুখ লুকায়ে ফেলে কবির বুকে। অসম্ভব নিরবতার ভিতর গুমরে গুমরে কাঁদছিল সে। যেন বর্ষার প্রথম জলবিন্দু নয়নের রোমাবলিতে পড়ছে। ক্ষণকাল অধরে পড়ত। তারপর চূর্ণিত জলগুলি নেমে আসে শরীরের সিমান্ত রেখে বেয়ে নীচে।
কোনও কথা না বলে রুপালি বেরিয়ে গেল।
কখনও লোক চক্ষুর সামনে কখনও লোক চক্ষুর অন্তরালে রুপালি মাষ্টার মশাইয়ের ঘরে আসত। রান্না করে দিয়ে যেত। লোকে কানাঘুষা করতে থাকে। কানে কানে কথা অনেক কানে ছড়িয়ে গেল। কেউ বলে, জাত গেল, কেউ বলে মান গেল। কেউ বলে মাষ্টার মশাইকে এখান থেকে খেদাতে হবে।
সকাল থেকেই আকাশ গুমোট বদ্ধ ছিল। এই প্রতিকূল মেঘমালার দিনেই জেলেপাড়ায় শালিশ বসে। শালিশে সাব্যস্ত হয় — মাষ্টার মশাইকে এই তল্লাটে ছেড়ে চলে যেতে হবে। এবং তা আগামীকালই প্রত্যুষে সূর্য ওঠার আগে।
হঠাৎ বিকাল থেকেই সাগর ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। রেডিওতে ঘোষণা আসছে সাত নম্বর সতর্ক সংকেত। রাতের মধ্য প্রহরে ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানতে পারে। অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে এই লোকালয়।
সন্ধ্যা থেকেই প্রবল বেগে বাতাস বইতে থাকে। সুরুজ আলী তার ঘরে একা ছিল। কুপীও জ্বালিয়েছিল সে। কিন্তু দমকা বাতাস এসে সে বাতি নিভে দিয়ে যায়। বাতাসের সাথে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে রুপালি। ঘূর্ণি বাতাসে ঘরের চাল উড়ে যায়। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। রুপালি সুরুজ আলীর বক্ষে জড়িয়ে থাকে সর্পের মতো।
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। ভিজে চুপসে যায় দুজন। ঘরের ভেতর হাঁটু জল হয়ে যায়। পানি আসছে সাগর থেকে। শোঁ শোঁ গর্জনে কান তালা লেগে যায়। সুরুজ আলী রুপালিকে বাহু লগ্না করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পায়, কোথা থেকে একটি ছোট ডিঙি নৌকা ভেসে এসেছে। ওরা সেই ডিঙি নৌকায় গিয়ে ওঠে। প্রবল বাতাসে বসে থাকতে পারছিল না। দুজন শুয়ে পড়ে নৌকার পাটাতনের উপর।
এই দুইটি আদিম নরনারীর উপরে বারিপাত হতে থাকে। রুপালির স্বর্ণ মেখলা ঝড়ের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হল। চন্দনচিহ্ন মুছে যায়। “চচাল বালা স্তনভিন্ন বল্কলা। স্তোকনম্রস্তনা শ্রোণি ভারাদলাসগমনা।’ সেই ঝড় জলোচ্ছ্বাসের রাতে দুটো মানব মানবী আদিম উৎসবে মেতে উঠেছিল মৃত্যু ভয়কে পরাজিত করে।
তারপর অন্ধকারে নৌকাটি কোথায় ভেসে যায়, কোথায় উড়ে যায়, কোথায় ডুবে যায়, কেউ তা জানে না।
ভবঘুরে লোকটির তিরিশ বছরের জীবন কাল কেমন ছিল? কোথায়, কীভাবে কাটিয়েছে এত বছর? আর রুপালি বা কোথায়? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানবার আগেই ঐ সন্ন্যাসী লোকটা ঐ তল্লাটে হতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
১৪. রোড টু বেনাপোল
আষাঢ়ের গুরি গুরি এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় জামগরা বাস স্ট্যান্ডে বাস থেকে নামে একটি মেয়ে। সে একটি সরু গলি পথ ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল সামনের দিকে। একটি ছেলে আগ বাড়িয়ে যেয়ে কথা বলে মেয়েটির সাথে —
‘তোমাকে আমি প্রতিদিন দেখি। এমন সময়েই তুমি বাস থেকে নামো। এবং এই গলি পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাও। তা তোমার নাম কী?’ সে কোনো কথা বলল না। চুপ করে আছে।
মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল। ছেলেটি তার হাতের ছাতাটি মেলে ধরে মেয়েটির মাথায় উপরে। ততক্ষণে অনেকটা ভিজে গিয়েছে মেয়েটির মাথার চুল, ওড়না, এবং কামিজ।
মেয়েটি তাকায় ছেলেটির দিকে। সুঠাম সুন্দর দেহ বল্লরের এক যুবক। মায়াবী চোখে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। এই চোখ কী কথা যে বলতে চায়, তা সে বুঝতে পারে। মেয়েটি তার আনত চোখ নীচের দিকে নামিয়ে বলে — আমার নাম রাসু।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আরও প্রবল আকার ধারণ করে। এক ছাতার নীচে দুজনই ভিজে যাচ্ছিল। ছেলেটি বলে — তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।
— ‘না। মহল্লার লোকেরা দেখলে মন্দ বলবে। আপনি চলে যান। আমি একাই চলে যাব।’ মেয়েটি ছাতার নীচে থেকে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে হেঁটে গলি পথে সামনের দিকে চলে যায়। ছেলেটি মেয়েটিকে আর সেদিন অনুসরণ করে না।
এরপরে বেশ কয়েকদিন ছেলেটি মেয়েটিকে অনুসরণ করে। এত সুন্দর একটি ছেলে তাকে পছন্দ করে, তার সাথে যেছে কথা বলতে চায়। ভালোই লাগে তার। মেয়েটি স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্ন ঘোর চোখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি একদিন বলে — ‘তোমাকে আমার ভাল লাগে। আমি তোমাকে ভালবাসি।’
সেদিন রাত্রিতে ওর ঘুম আসছিল না। ছোট্ট ঘরে মা আর ছোট একটি ভাইকে নিয়ে সে থাকে। নবীনগরে একটি পুতুল ফ্যাক্টরীতে সে কাজ করে। বাবা অনেক আগেই আর একটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। সারারাত সে ঘুমাল না। ওর মা একবার ওকে জিজ্ঞাসা করে — রাসু তোমার কী হয়েছে? রাসু বলে — না, মা কিছু হয়নি আমার।
ইতোমধ্যে মেয়েটি ছেলেটির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। তারা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। রেস্টুরেন্টে খায়। সিনেমা দেখে। এর আগে মেয়েটি ছেলেটির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল, তার নাম আহমেদ আলী বাবু। বি,এ ক্লাসে পড়ে। বাড়ি বেনাপোল, যশোর। এখানে এক আত্মীয়ের কাছে বেড়াতে এসেছে।
বাবু একদিন রাসুকে সরাসরি প্রস্তাব দেয় তাকে বিয়ে করবে। রাসু আর কোনো দ্বিধা করেনি। ওর মায়ের সম্মতিতেই নোটারি পাবলিকের কাছে যেয়ে বিয়ে করে। বিয়ের দেনমোহর ছিল এক লক্ষ এক টাকা।
ওদের বাসর ঘর হয়েছিল রাসুদের ছোট্ট টিনের ঘরে। সেদিনও প্রথম দিনের পরিচয়ের দিনের মতো গুরি গুরি বৃষ্টি ছিল। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল, আর বৃষ্টিও বেশি করে ঝম ঝম করে নেমে পড়েছিল। বৃষ্টি মুখর রাতে রাসু বাবুর বুকে মুখ রেখে অঝোর ধারায় কেঁদেছিল। বাবু রাসুকে কাছে টেনে শোনায়েছিল অনেক স্বপ্নের কথা। বলেছে — ‘কালই তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। ওখানে কয়েক দিন থাকব। তারপর আবার আমরা জামগরাতে ফিরে আসব। তুমি তোমার মা ভাইয়ের কাছেই থাকবে।’
পরের দিন সকালেই তারা বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাসুর পরনে লাল রঙের বিয়ের শাড়িটাই পরা ছিল। হাতে পায়ে ছিল নেইল পালিশের আলপনা আঁকা। কপালে ছিল টিপ। হাতে কানে গলায় ছিল ইমিটেশন গহনা। ফেরীতে যখন নদী পার হচ্ছিল, তখন দুজনেই এসে দাঁড়িয়েছিল রেলিংয়ের ধারে। নদীর শীতল বাতাসে উড়ছিল রাসুর মাথার চুল। সে শক্ত করে ধরে রেখেছিল বাবুর একটি হাত। দুজনেই চুপচাপ। যেন — ‘বাতাসের কথা সে তো কথা নয়, রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে, আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই, যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।’ রাসু তখনকার সেই রোদ্র করোজ্জ্বদ বিকালে বাবুর বাহু পাশে হেলান দিয়ে শুনছিল নদীর শব্দ, জলের ধ্বনি। দেখছিল দূরের সবুজ বৃক্ষ, ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। আর ভাবছিল, গত রাতের স্বপ্ন মধুর কথা।
বাস যখন বেনাপোল পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গত হয়ে গিয়েছে। ওরা দুজন একটি হোটেলে বসে কিছু খেয়ে নেয়। রাসু বাবুকে জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের বাড়ি এখান থেকে কতদূর? বাবু বলে — এখান থেকে তিন মাইল দূরে, একটি নদীও পার হতে হয়।
কেমন যেন ঘুটঘুটে আঁধার রাত্রি। একটি ভ্যান গাড়িতে দুজন ওঠে। কাঁচা রাস্তায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভ্যান গাড়িটি চলতে থাকে। পথের পাশে জলাশয়ে ব্যাঙ ডাকছে। ঝিঁঝিঁ পোকা উড়ছে। দুরে পাটক্ষেত থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। অপরিচিত এই নির্জন পথে রাসু ভয়ে কাঁপছিল। কিন্তু সে ধরে রেখেছিল তার পরম প্রিয় স্বামীর হাত। কোনও ভয় নেই। সে একবার অন্ধকার পথের দিকে তাকায়। আর একবার আকাশের দিকে। অন্ধকারে সে দেখছিল তার স্বামীর চোখ। সেই প্রথম বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যায় মায়াময় চোখের মতোই এই চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
ভ্যানটি একটি নদীর কূলে এসে থামে। অদূরে ঘাটে মাঝারি ছইওয়ালা একটি নৌকা বাঁধা আছে। ভিতরে দুইতিন জন লোক আছে মনে হল। নৌকা থেকে একজন লোক নেমে এসে বাবুর সাথে কী যেন কথা বলে নেয়। লোকটি আবার ফিরে যায় নৌকায়। বাবু রাসুর একটি হাত ধরে নৌকার দিকে এগিয়ে যায়। বাবু রাসুকে বলে — নৌকায় ওঠো।
রাসু নৌকায় ওঠে। বাবু আর ওঠে না। নৌকা ছেড়ে মাঝ দরিয়ায় চলে যায়। ভিতর থেকে রাসুর কোনও আওয়াজ শোনা গেল না। হয়ত ওর মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। রাতের আঁধার ভেদ করে নৌকাটি ওপারে বনগাঁর দিকে চলে যেতে থাকে।
১৫. বাইরে জোৎস্না দেখো
অনেক বছর আগে আমার যৌবন দিনে ঈশ্বরদী থেকে একবার ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ ফিরছিলাম। শীতের মধ্য রাতের ট্রেন। যাত্রীর অত ভীড় ছিল না। কামরায় অল্প কজন মানুষ। সবাই চাদর গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। কেউ চাদরে মুখ লুকিয়ে ঘুমুচ্ছে। কেউ আবার বসে বসে ঝিমুচ্ছে। আমার এমনিতেই চোখে ঘুম কম। ভ্রমণে আরও ঘুম আসে না।
বাইরে কনকনে শৈত্যপ্রবাহের হাওয়া। কামরার জানালা গুলো সব বন্ধ। ট্রেনের ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছিলাম ট্রেনটি বড়াল ব্রীজ পার হচ্ছে। কাঁচের জানালার উপর দিয়েই একবার বাইরে খুব তাকাতে ইচ্ছা হল। তাকালামও। শীতের শিশিরে কাঁচ ঘোলা হয়ে থাকাতে বাইরের কিছুই দেখতে পেলাম না। মন খারাপ করে তাই চুপচাপ বসে থাকলাম। চোখ বন্ধ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকবার চেষ্টা করি। তন্দ্রাও এল না। কানের কাছে কেউ একজন ফিসফিস করে তখন বলছিল — ‘বাইরে জোৎস্না দেখো!’
কামরায় বসে থাকা লোকগুলো যেহেতু শীতে কাঁপছে। আমি কীভাবে জানালা খুলে দেখি বাইরের আকাশ? কনকনে বাতাস যে কামরায় ঢুকে পড়বে। বসে থাকা লোকগুলো আমাকে ভর্ৎসনা করবে। আবারও মনখারাপ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আবারও কানের কাছে কোমল কণ্ঠ জড়ানও কন্ঠে সেই একই কথা শুনতে পেলাম — ‘বাইরে আজ পূর্ণিমা রাত্রি। জোৎস্না দেখো তুমি।’
ট্রেনটি চলছে। ভিতরে বসে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, সবাই কেমন ঘুম ঘুম। আমি জানালার গ্লাস উঠিয়ে ফেলি। বাইরে তাকিয়ে দেখি — চারদিকে কী অদ্ভুত জোৎস্নার ধূঁধূ প্রান্তর। দূরের গ্রামের উপর দিয়ে চাঁদ ভাসছে। ছোট্ট একটি স্টেশন ট্রেনটি ক্রস হল, স্টেশনটির নাম দিলপাশার। ভরা বর্ষায় এই এলাকাটি জলে ভেসে থাকে। আজ দেখলাম, সেখানে থৈ থৈ জোৎস্নার প্লাবন।
কামরার লোকগুলো আরও বেশি করে তখন শীতে কাঁপছিল। আমি জানালার গ্লাসটি বন্ধ করে দেই। শৈত্যের হিম হাওয়ায় আমারও গা শীতল হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাসছিল, বাইরের জোৎস্নার ঢেউ। কী এক আবেশে তখন! আমি আপ্লুত হয়ে মনে মনে তাকেই ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম, যে ছায়া মেয়েটি আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল — ‘বাইরে জোৎস্না দেখো।’
খুব করে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছিল সেই ছায়া মেয়েটিকে নিয়ে ও আজকের এই রাত্রিটিকে নিয়ে। খাতা এবং কলম কিছুই ছিল না আমার সাথে, কোথায় আমি কবিতা লিখব? মনে মনে তাই কবিতার পংক্তি সাজাচ্ছিলাম —-
বাইরে উতল শৈত্য প্রবাহ আজ , জোৎস্নার বন্যায় ভাসছে প্রান্তর,
আমার উড়োউড়ো মন কী চায় আজ।
কী কথা বলে দিল সে কানে কানে,
উন্মুল নয়নে দেখতে পাচ্ছি ঐ মেয়ের জোৎস্নায় ভেজা খোলা শরীর ,
গাবফুলের মত সাদা পাগলকরা গন্ধ যেখানে।
ঝাপসা আলো-ছায়াময় এই পথ বহুদুর পর্যন্ত নির্জন হয়ে আছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে তার মুখ, বুকের পাশে দিয়ে খোলা নদী, উন্মুক্ত নাভিমূল, গোলাপী রঙের জল…।
কোনো বিষাদ নেই।
তার শরীরে’র নকশাগুলো সালভেদর দালির ছবির মতন কত না সুখের চিত্র হয়ে এঁকে আছে।
———————-
ট্রেনটি জামতৈল স্টেশনে এসে থেমে যায়। ক্রসিং হবে সেখানে। শীতের শেষ রাত। কী কাকতালীয় ব্যাপার! একটু দূরেই মায়াবতীদের বাড়ি। এই মায়াময় মেয়েটিই কী আমার কানের কাছে যেয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, — ‘বাইরে জোৎস্না দেখ।’
১৬. ঘুম
নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে যেদিন আমি চলে আসি, উঠোনে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল — ‘কয়েক দিনের জন্য হলেও তোমার কাছে আমাকে একবার নিয়ে যেও। আমি তোমার ঘরটি গুছিয়ে দিয়ে আসব।’ আমি কিছু বলিনি। একটি টিনের বাক্স হাতে করে হাঁটতে হাঁটতে স্টীমার ঘাটের দিকে চলে এসেছিলাম। বয়রা ঘাট থেকে ভেঁপু বাজিয়ে স্টীমার ছেড়ে আসে। আমি অন্ধকারে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে যমুনার জলে তার বিষণ্ণ চোখের ছায়া খুঁজেছিলাম। তার চোখ দেখতে পাইনি সেদিন। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ভিতরে শুধু তার কান্না শুনেছিলাম।
মাসখানেক পর পরমাপত্নী রনিজাকে একটি পত্র লিখি।
কল্যানীয়াসু,
বাড়বকুণ্ডে একটি চটকলে অস্থায়ী চাকুরী পাইয়াছি। বেতন খুবই সামান্য। চটকল হইতে দূরে পাহাড়ি টিলার ঢালে ছোট একটি টিনের কামড়া ভাড়া নিয়াছি। কাঠের চোকি কিনিয়াছি। চোকির উপরে তোমার দেওয়া কাঁথা বিছাইয়া নিয়াছি। হাঁড়ি পাতিলও কিনিয়াছি। আমি নিজেই রান্না করিয়া খাই।
তোমাকে খুব মনে পড়ে। আমি সামনের মাসে বেতন পাইয়া বাড়িতে যাইব, এবং তোমাকে কয়েক দিনের জন্য এখানে লইয়া আসিব। আমি যেখানে থাকি — সেখান হইতে সাগর দেখা যায়। তুমি এখানে যখন আসিবে, তখন তোমাকে লইয়া সাগর পাড়ে বেড়াইতে যাইব। শরীরের প্রতি খেয়াল রাখিও।
ইতি — তোমার রঞ্জন।
পরের মাসে আমি রনিজাকে এখানে নিয়ে আসি। একমাস সে থাকবে। তারপর ওকে আবার আমাদের কুসুমপুর গ্রামে রেখে আসব। আমার ছোট্ট ঘর রনিজার কী আর গোছাবার আছে? আমিই গুছিয়ে নিয়েছি। ছোট্ট একজনের চোকি। থাকি দুইজনে। পাশাপাশি শুইলে রনিজার নিঃশ্বাস লাগে আমার চোখে মুখে। গায়ের সাথে গা ঠেসাঠেসি হয়ে থাকে। ঘুম আসে না। রনিজাকে বলি– ‘আমার ঘুমাইতে অসুবিধা হইতেছে।’
রনিজা আমার বুকে মাথা রেখে করুণ করে বলে— ‘একটি মাস না হয় ঠিকমত ঘুমালে না। তোমার বুকের ভিতর আমি মুখ লুকিয়ে রাখি। আমার বুক ছুঁয়ে থাকে তোমার শরীরের সাথে। আমার কী যে শান্তি লাগে। আমার এমন ঘুমহীন হয়ে সারা জীবন থাকতে ইচ্ছা করে।’
আমি মনে মনে একটু বিরক্ত হই। বুঝতে দেই না ওকে। সারাদিনের চটকলে পরিশ্রমের ক্লান্তি থাকে। অবসাদ আসে শরীরে। ঘুম আসে চোখে। রনিজার চোখ দুটো আমার চোখের সাথে লেগে থাকে। আমি দেখি ওর বিষণ্ণ চোখ। কী যে মায়া লাগে। ঐ চোখের দিকে চেয়ে থাকলে, ঘুমের চোখে আর ঘুম আসে না।
দিনগুলি আমার চলছিল ভালোই। আমার রান্না করতে হয় না, কাপড় ধুতে হয় না। নিজ হাতে মশারি টানাতে হয় না। একদিন রনিজা বলছিল — ‘আমি তোমার এখানে এলাম। আর তুমি কি না একদিনও ছুটি পেলে না। ছুটির দিনে ওভার টাইম করো। রাতে ফেরো। তুমি পত্রে লিখেছিলে– আমাকে সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে। কই, নিয়ে গেলে না তো? আমাকে নিয়ে যাবে গো! সমুদ্র দেখাতে?’ আমি রনিজাকে সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় পাইনি।
খুব তাড়াতাড়ি দিন গুলো শেষ হয়ে যায়। সেদিন ছিল আমার এই টিনের ঘরে রনিজার শেষ রাত। ছোট চকিতে দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। আজও ওর নিঃশ্বাস লাগছিল আমার চোখে মুখে। আজকের নিঃশ্বাসের বেগটা একটু বেশি মনে হচ্ছিল। রনিজা দুঃখ করে বলছিল — ‘এরপর থেকে তোমার আর ঘুমুতে অসুবিধা হবে না। আমি চলে যাব, থাকব না। তোমার সুন্দর ঘুম হবে।’
পরের দিনই বাড়বকুণ্ড স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠি। কত স্টেশন পাড় হই। কত রেল পথ। ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলতে থাকে। তারপর যমুনা নদী পাড়ি দেই স্টীমারে। কত জল ঠেলে স্টীমার চলে আসে। বয়রা ঘাট থেকে কত মাঠ, কত মেঠো পথ পেরিয়ে রনিজাকে আমি কুসুমপুর গ্রামে রেখে আসি।
বাড়বকুণ্ডে আমার এই ছোট্ট টিনের কামড়ায় এখন একাই থাকি। সারা বিছানা জুড়ে কী সুন্দর আরামে শুয়ে থাকি। চোখে ভাল ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুম আসে না। বালিশ থেকে ওর চুলের গন্ধ পাই। কভারে কাজলের দাগ। ওর চোখের অশ্রুর ফোঁটাগুলোও কাজলের দাগের সাথে মিশে আছে। আলো নিভিয়ে দেই। জানালা দিয়ে অন্ধকারে দূরের পাহাড় দেখি। নির্জন আকাশে দেখতে পাই নির্জিব তারা। ঘুম আসে না। রাত ফুড়িয়ে যায়।
ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে দূরের সমুদ্র দেখতে পাই। কানে বাজে একটি আক্ষেপ। ‘আমাকে তুমি সমুদ্র দেখাতে নিয়ে গেলে না।’ যদি কখনও আবার রনিজাকে এখানে নিয়ে আসি, ওকে নিয়ে সত্যি একদিন সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাব।
তারপর এই বাড়বকুন্ডে কত রোদ্দুর উঠেছে। কত বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির মেঘে অন্ধকার হয়ে এসেছে পাহাড়ী টিলার আঙিনায়। অবহিত শরীরের ঝিমন্ত ঘুম ছড়িয়ে পড়েছে বিছানার উপরে। আবার নোনা ধরা জানালার লোহার শিক ছুঁয়ে কখনও ঢুকে পড়েছে হুহু বাতাসের মন খারাপিয়া বিবাগী স্পর্শ।
বাড়বকুন্ডে এরপর যতদিন ছিলাম, আমি কখনই আর ঠিক মত ঘুমুতে পারিনি।
১৭. পরবৃক্ষ
ঋষিকেশ দাস লেনের পলেস্তারা খসে পড়ে যাওয়া একটি বাড়িতে প্রথম রাত্রি। যেখানে শুয়েছিলাম ঠিক জানালার ওপাশে নামহীন পরগাছার পত্র পল্লবে ছাওয়া। ওপাশে কী আছে ভালো করে দেখা যায় না। ঘুম হয়নি ক্ষণিক তরেও। মনে পড়ছিল অনেক কথা, অনেক দৃশ্য। ফেলে আসা সেই বড়াল ব্রীজ স্টেশন, বড়াল নদীর জল। শুনতাম সেখানে ট্রেনের হুইসেল, আর প্রভাত পাখির গান।
আজ ঘুম ভাঙাহীন ভোরে শুনতে পেলাম পুরোনো কাঠের জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসা একটি অচেনা মেয়ের গান। পাশের বাড়ির দোতালার একটি কক্ষ থেকে গানটি শোনা যাচ্ছিল। হারমোনিয়ামে কন্ঠ সাধছিল সে। তার কন্ঠের সুরই কেবল শুনতে পাচ্ছিলাম, মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিল না।
প্রভাতের সূর্য শিখা তখনও জ্বলে ওঠেনি। কেমন যেন শান্ত ও গম্ভীর। গবাক্ষপথে ধূসর কুয়াশার ধূম্রবর্ণ তখনও কাটেনি। ভেবেছিলাম, পাশের কোনও বৃক্ষ থেকে ভোরের পাখিদের গান শুনতে পাব, যেমন শুনতে পেতাম, বড়াল ব্রীজ স্টেশনে আমার সেই কোয়ার্টারের পাশে আকন্দ গাছ থেকে রাঙা বুলবুলির অদ্ভুত শীষ।
আজ শুনতে পেলাম —
‘আমরা এমনই এসে ভেসে যাই
আলোর মতন, হাসির মতন,
কুসুমগন্ধরাশির মতন,
হাওয়ার মতন, নেশার মতন
ঢেউয়ের মতো ভেসে যাই।’
অদ্য এই প্রভাতে আলোর চক্রে জানালার পাশে উপবেশন করেই অনুভব করছিলাম, আজ অনেক কিছু পাওয়া হবে আমার। সত্যই তাই। ঈশ্বর আমার চাওয়া গ্রহণ করেছেন।
নতুন কর্মস্থল ফুলবাড়িয়া স্টেশন। গলির মোড়ে যতীন বাবুর হোটেল থেকে ঘিয়ে ভাজা দুটো পরোটা ছানা মাখিয়ে খেয়ে নেই। এবং গুরুর দুধের এক কাপ গরম চা। তারপর একটি সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অফিসে চলে আসি। কানে তখনও ভোরের সেই গানের সুর। সেই অমিয় কন্ঠ। মেয়েটি কে? তাকে কেবল দেখতে ইচ্ছা করছে।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসি। জানালা খোলা আছে। পরগাছার পাতাগুলো বাতাসে নড়ছে। পাতার ফাঁক দিয়ে ওপাশে তাকালাম। ওখানেও কাঠের জানালা। পুরোনো পর্দা বাতাসে উড়ছে। কাউকে দেখা গেল না। কোনও কথাও নেই।
বিছানায় বসে আছি। একলা মানুষ কার সাথে কথা বলবো? এখন কোনও গানও নেই। রাতের বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ ঘুম ঘুম লাগছে খুব। ভাবলাম, গভীর ঘুম হোক। রাত্রি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক। ভোরে ঐ মেয়ের গান শুনব।
খুব সুন্দর একটি ঘুমে রাত্রি পোহালো। মনে হলো, কাননে কুসুমকলি ফুটিয়া উঠিল। আমি উঠে জানালার কাছে গিয়ে বসি। কান পেতে থাকলাম। আজ কোনও গান আর শুনতে পেলাম না।
ঐ বাড়ির এক প্রৌঢ় বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কাল বিকালে দোতলার ঐ পরিবারটি অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে চলে গেছে।
যে চলে যায় সে সব শূন্য করেই চলে যায়। তারপর অনেক দিন চলে গেছে। বুড়িগঙ্গা নদী হতে কত উন্মথিত বাতাস এসে এই বাড়ির জানালার পরগাছার পাতায় এসে পাক খেয়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে দেখেছি কখনো আবার সেই বড়াল নদী। কোথা হতে কত খড়, ধূলা, জীর্ণ বাঁশপাতা উড়ে আসে। নয়নতারা ফুল ঝরে পড়ে। আকন্দের ঝোপ থেকে সন্ধ্যাকালে ডেকে ওঠে রাঙা বুলবুলি। শিস দিয়ে ডেকে থেমে যায়।
১৮. কুসুমকলি
শামসুর রাহমানের কবিতার একটি চরণ ছিল এই
রকম — ‘চৈত্র দুপুরে চোখ পুড়ে যায় তবু চেয়ে থাকি, যদি তুমি আসো।’ না, কারোর পথের দিকে চেয়ে ছিলাম না। যদি মরা গাঙে পানি না-ও থাকে, ঘরের ভিতরেই যদি উথলিয়া ওঠে নদী। যদি ভরা থাকে ঘটে জল। মন তাই এই সময়ে চাতকের চঞ্চু বানাতে চাই না।
তারপরও নদীর জল অনেক সময় স্থির হয়ে থাকে। কানায় কানায় উপচে পড়ে না। তখনই কোথাও
নেই-নেই একটি শূন্যতা অনুভূত হয়। এই রকম একটি অস্থির শূন্যতার চৈত্র দুপুরে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গুলো দেখছিলাম।
কুসুমকলি তার নাম। প্রোফাইলে একজন মধ্যবয়সী রমণীর ছবি। চোখে রোদ চশমা। হালকা নীল রঙের শাড়ির আঁচলে মাথায় ঘোমটা দেয়া। প্রোফাইল ছবিটিতে ক্লিক করে জুম করতেই চোখের সামনে ঝরা পাতার মত একটি মেয়ে মুখকে দেখতে পেলাম। রৌদ্রে পোড়া পাখির চোখের তৃষ্ণার মত ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। থুতনির পাশে ছোট্ট একটা কালো তিল। পরিচিত ওষ্ঠাগত ভাঁজে সেই লুকানো হাসি। কালো গ্লাসের চশমার নীচে কোনও মায়াবি চোখ কী আমাকে তাকিয়ে দেখছে? নাকি জীবনের কোনও অভিমান আজও লেগে আছে সেই চোখে।
কেমন যেন আবীর মাখা আনত মুখ। একটু চমকে উঠি। মনে হলো এ তো অনেক দিনের চেনা মুখ। কালো ফ্রেমের নীচে চোখ দেখতে না পেলেও, মনে হলো — এই চোখে কত শ্রাবণ বর্ষার জল ঝরতে দেখেছি। চোখ সরিয়ে কন্ঠের দিকে নিয়ে আসি। আবারও সেই বিস্ময় দৃষ্টি আমার! একটি দাগ। মনে হলো যেন বহু পুরোনো ছোট্ট একটি জখমের ক্ষতচিহ্ন।
তার প্রোফাইলে ঢুকে যাই। মনে হলো মেয়েটি লেখালেখি করে। প্রথম স্ট্যাটাসটি ছিল —
‘হাওয়ায় যে ঘ্রাণ সে তোমার শরীরের। ধ্বনিত যে শব্দ তা বহুকাল আগের আমাদের পদধ্বনি।
দৃষ্টি সীমায় যতদূর চোখ যায়, সেখানে তোমার ছায়া ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্য নেই।’
প্রোফাইলের ‘অল ফটো’তে ক্লিক করি। একটি মাত্র সাদা কালো ছবি সেখানে। ছবিটি আউটডোরে তোলা। জায়গাটা দেখে চমকে উঠি। এ যে আমার পরিচিত জায়গা। পিছনে সেই নদী। একটি কদম গাছের নীচে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।
এ তো কুসুমকলি নয়। এ তো ইছামতী নদীর পাড়ে কুসুমপুর গ্রামের সেই সুলতার মত লাগছে। সুলতা এত বছরে কুসুমকলি হয়ে গেছে তাহলে। ছবিটি নস্ট হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। মুখ দেখে চেনা যাচ্ছে না, এই সেই কী সুলতা? যাকে এই ছবিটির মত চিনতেও পারছি না। যাকে আমি ভুলে গেছি।
বাইরে চৈত্রের রোদ্দুর খাঁ-খা করছে। এই নির্জন তপ্ত দুপুরে কেমন যেন গলাটা শুকিয়ে আসছে। তৃষ্ণার্ত পাখির মত তাকিয়ে থাকি খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে। নীল আকাশও ভাল লাগছিল না। মেঘের আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছিল। যদি বৃষ্টি নামত ঝমঝম করে!
ইছামতীর সেই জলস্রোত এখন আর নেই। দু’পাড়ে এখন আর জলের ঢেউ ভেঙে পড়ে না। এখন সেখানে কাশবন আর ফসলের ক্ষেত। সেই কবেকার অনেক রাতের পূর্ণিমার অনন্ত জোৎস্নার ঢেউ সেখানে এখন আছড়িয়ে পড়ে।
আমি কী ভুল কিছু ভাবছি? যা দেখছি তা কী ভ্রান্তি? আপাত স্থির-জলের ভেতর অফুরান তরঙ্গমালা ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আবার খুব ইচ্ছা করছে, এভাবে জলের ঢেউ দেখবার আশায় ইছামতীর নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকি।
কুসুমপুর অনেক দূর।
১৯. টক অফ দ্যা টাউন
অনেকদিন আগের বাবলির সাথে এক বিকেলের কথা।পাবলিক লাইব্রেরীতে বসে বাবলীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাতা উলটাচ্ছিলাম ‘খেলারাম খেলে যা’-র। জাহেদা আমার মনকে স্থির করতে পারেনি। ওকে পাশে রেখে ‘বেগম শেফালী মির্জা’। ভালোই লাগছিল মির্জা বউকে।
বাবলী আসলো এক ঘন্টা লেটে। সে এসেই বলে — বাসায় দশটা মিথ্যা কথা বলতেও তো দশ দু’গনা বিশ মিনিট লেগে যায়।
বললাম, কোথায় যাবে ?
বাবলী বলে — কোথায় আবার যাবো ? বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
বললাম — ঠো্ঁটের লিপস্টিক এবড়ো থেবড়ো কেন ? টান টান জবাব বাবলীর — সৌমেন ঠিকমতো চুমু খেতে পারেনি।
বললাম — সৌমেন কে ?
বাবলীর জবাব — কাল রাতের স্বপ্নের। আমি ওকে চিনিনা।
বাইরে তখনো বৃষ্টি। শাহবাগ বৃষ্টিতে ভিজছে। জলে ভিজছে রিকশাওয়ালা। জলে ভিজছে কাক। জলের ছিটা লাগছে সিঁড়িতে বসা এক জোড়া তরুণ তরুণীর। ওরা যুগল কিনা জানি না।
বাবলীকে বললাম — চলো রিকসায় যেয়ে বসি। হূট তোলা থাকলে তোমাকে নিবিড় ভাবে কাছে পাওয়া যাবে।
এবারও বাবলীর উত্তর — না।
বললাম — আসলে তো দেরীতে, এতো চটাং চটাং করছো কেন ?
বাবলী একটু রেগে বলে— এ জন্যে অসুল করতে চাও ? কোথায় যাবে ? চলো।
বললাম — ‘টক অফ দ্যা টাউন’।
‘টক অফ দ্যা টাউন’ মিরপুর রোডে ধানমন্ডি পা্ঁচ নম্বর সড়কের দোতালাৃতে অবস্থিত একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট।আমি আর বাবলি সেই রেস্টুরেন্টে চলে যাই।
বসে আছি দু’জন পাশাপাশি। শহরের কোনো কথা নেই। বাইরে তখন বৃষ্টি নেই। চীনা মাটির প্লেটে চামচের টুংটাং শব্দ। বাবলীর কাঁচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ। বাইরে গাড়ীর হর্ণ। ভালোবাসায় কখনও শব্দ হয় ? কখন প্রাণের বীণা বাজে?
আমরা কান পেতেছিলাম বুকের শব্দ শোনার। শুনেছিলামও সেদিন ‘টক অফ দ্যা টাউন’-এ সারা বিকেল।
২০. মাধবীলতা
মাধবী /
প্রোফাইলের ছবি দেখে তো চিনতেই পারছিলাম না, এই তুমি সেই তুমি? যাকে আমি দেখেছিলাম, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের করিডোরে। সেদিন তুমি নিতান্তই ছিলে এক উচ্ছল ছলছল তরুণী। দূর হতে তোমাকে একটু দেখলাম। হঠাৎ দেখি, আহমদ শরীফ স্যার খটখট জুতার শব্দ তুলে আমাদেরই সামনে দিয়ে হেটে চলে যা্চছে। তাকে দেখে ভয়ে চলে যাই ইংরেজি বিভাগের করিডোরের দিকে।
তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল এইটুকুই। সেইদিনের সেই প্রথম দেখার মুখটির সাথে, আজকের তোমার প্রোফাইল ছবির মুখটির সাথে মিলালাম অনেক কিছুই। কত কিছুই অমিল দেখলাম। কত কিছুই বদলে গেছে। ছবি দেখেই মনে হলো মাঝখানে চলে গেছে অনেক বছর। বলতে পার তুমি, কত বছর চলে গেছে? আর, তুমি কী আছ সেই কী তুমি?
——– রঞ্জন।
রঞ্জন/
কত বছর চলে গেছে, তা আজ আর মনে নেই। তবে কত শত বছর পার হলে তোমাকে আমি ভুলতে পারবো, তা জানে শুধু ঈশ্বর। তুমি দেখতে পেয়েছ কেবল আমার অবয়বের কুঞ্চিত হয়ে যাওয়া রূপ লাবণ্যকে। আর কিছু দেখতে পাওনি। আমার ভিতরে একটি বদলে না যাওয়া রূপ আছে, তা তুমি আগেও দেখতে পাওনি। এখনও পাওনি। কোনো দিন হয়ত পাবে না।
আমার সৌভাগ্য ছিল, তোমার মতো একজন ভীতু ও উদাসীন একটি বন্ধু আমার কপালে জুটেছিল। শুধু জানতে মেয়েদের মন ভুলানো কবিতা লিখতে। এক একদিন এক একটা কবিতা লিখে এনে আমাকে পড়িয়ে শোনাতে। সেই সব কবিতায় কত প্রেমের কথা, কত উচ্ছাস ছিল! তা শুনে এক আহাম্মক তরুণী বিশ্বাস করত সেই বেগ আর আবেগ।
মনে আছে তোমার? একদিন লাইব্রেরী বারান্দায় দুজন বসেছিলাম। আমি খেতে চেয়েছিলাম, ঝালমুড়ি। তুমি বললে, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের গরম সিঙ্গাড়া খাবে। খেলাম সেদিন গরম সিঙ্গাড়াই। ক্ষতি যা হবার তা আমারই হলো। তুমি আমাকে সেদিন কী যেন বলতে চেয়েছিলে। কিন্তু তা আর বললে না। বললে, ‘গরম সিঙ্গাড়া খেয়ে আমার জিভ পুড়ে গেছে। আজ আর কিছু বলতে পারব না।’
তারপর কতদিন চলে গেছে। তুমি তোমার সেই কথা আমাকে কোনো দিন বলো নি। আচ্ছা, সেই দিন তুমি আমাকে কী বলতে চেয়েছিলে? তোমার সেই না বলা কথাটি আজও যে আমার শুনতে ইচ্ছা করে।
—– মাধবী লতা।
মাধবী/
এমন করে কোনো কিছু লিখতে নেই। যা পড়ে বিষাদে ডুবে থাকতে হয়। তোমার আক্ষেপের কথা পড়লে ভালোবাসাহীন পৃথিবীও ডুকরে কেঁদে ওঠে। মাধবী, তোমার মনে আছে? একবার এক রুক্ষ দুপুরে পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে তারাশঙ্করের ‘কবি’ থেকে তোমাকে শোনায়েছিলাম—
“এই খেদ আমার মনে-
ভালোবেসে মিটল না সাধ, কুলাল না এ জীবনে!
হায়- জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?”
আসলে তারাশঙ্করের মন একরকম। আমার মন আরেকরকম। তুমি এত চমৎকার একটি মেয়ে ছিলে যে, যাকে নিয়ে রাত জেগে কেবল কবিতা লেখা যায়। কখনো মনে হয়নি, এই মেয়ে আমার জীবনকে স্বপ্নের রঙে রাঙিয়ে দিতে পারে। আমি শুধু ভেবেছি, জীবন খুব ছোট। এই ছোট জীবনে তোমার মতো এত সাধারণ একজনকে ভালোবেসে সাধ মিটবেনা। আর এখন? আক্ষেপ নিয়ে মরতে হবে আমাকে। প্রতিদিনই আমি এক নীল রঙা পৃথিবীতে বসবাস করছি।
সুখের পৃথিবীতেও বিষাদ থাকে। আমি জানি, এখনো পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে রুক্ষ হাওয়ার দুপুর নামে। সেই রৌদ্রতাপে এখনো হয়ত কোনো নবীন প্রেমিক প্রেমিকার অশ্রু সজল চোখ শুকিয়ে যায়। আমারও মনে পড়ে অনেক গ্লানির কথা। কত সহজেই না তোমাকে আমার জীবনের করে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি না হতে পেরেছি তোমার জীবনের, না তুমি এসেছ আমার জীবনে। এই পৃথিবীতে কতো মানুষ কতো রকমের আক্ষেপ নিয়ে যে বেঁচে আছে।
মনে পড়ে মাধবী, ধীরাশ্রমের কাছে রেললাইনের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে আমাদের গল্প বলার কথা? একবার ময়মনসিংহ যেতে ট্রেনের জানালা দিয়ে সেই গাছটিকে আমি খুঁজেছিলাম। দেখি, গাছটি নেই। নেই সেদিনকার সেই প্রসন্ন বিকেলটি। এক অস্ফুট মনখারাপ নিয়ে আমি সেদিন সারা ট্রেন পথে ময়মনসিংহ চলে গিয়েছিলাম। কাকে সেদিন শূন্য করে মনে পড়েছিল? বিষাদী সেই বিকেলে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কাকে খুঁজেছিল আমার চোখ?
এই জগৎ সংসারে অনেক কিছুই এত নিষ্ঠুর কেন? মানুষের কত যে স্বপ্ন কেড়ে নেয়। তুমি অনেক কথার উত্তর জানতে চেয়েছ। সব কথার উত্তর হয় না। সবকিছুর উত্তর জানতেও নেই। আমি বরং তারচেয়ে মগ্ন দুঃখের অনুতাপে ডুবে থাকি।
—— রঞ্জন।
রঞ্জন/
তোমার সব গল্প কথা, সব কল্পনার কথা, সব রূপকথা আমার ভাল লাগে। তোমার সব কথা শুনে আমার অন্তরের ভিতরে বেদনার বাঁশি বেজে ওঠে। সেই বাঁশির কোমল সুর দেশ পারাপার ছাড়িয়ে চলে যায় বহুদূর। তুমি যদি কখনও বংশী নদীর কূলে যেয়ে সেখানকার বাতাসে কান পাতো, তাহলে হয়ত আমার অন্তরের মর্মরিত সেই স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পাবে।
রঞ্জন, অনেক সময় নিজের দিক থেকে কোনো কিছু করার থাকে না। জীবন কখন কোথায় বাঁক নেয় নদীর মতো। নদী যেমন করে নিজের ছন্দে মাঠ পেরিয়ে, গ্রামের ঘাট পেরিয়ে, সরষে খেতের পাশ দিয়ে, তাল বনের ধার দিয়ে, আলতা পরা পা ধুয়ে, বুনো ফুলের গন্ধ মেখে অজানা কোনও দেশে, কোন্ অপরিচিত পৃথিবীর দিকে চলে যায়। কেউ তা বলতে পারে না। আমিও পারিনি।
তুমি কী একবারও ভাবো না, আমি তোমার কী না হতে পারতাম। কিন্তু তোমার ঔদাসীন্য বুঝত না আমার আকাঙ্ক্ষার কথা। আমি যখনই কোনো গভীর কথা বলতে চেয়েছি, ঠিক তখনই তুমি ভানু চক্রবর্তীর কবিতা আবৃত্তি করে আমাকে শোনাতে –
‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝল্কানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।’
তুমি বলেছ আমি যেন আমার স্বামীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ঘুরি তো তার সাথে। একবার এক বসন্ত দিনে আমার স্বামীর সাথে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম ভিয়েনার অরণ্যে । কী মনোমুগ্ধকর ছিল প্রকৃতি শোভা! গাড়ি থামিয়ে বনপথে দুজন হাঁটছিলাম। আর দেখছিলাম দূরের আল্পস্ পর্বতমালা। বনপথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল — রাজেন্দ্রপুরে পিকনিকের কথা।
তুমি আর আমি বনের মাঝে সে বার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পত্ৰপল্লবময় বৃক্ষরাজি দেখতে দেখতে পথ ছেড়ে ভুল করে চলে গিয়েছিলাম অরণ্য গভীরে। কত শুকনো পাতা ঝরে পড়েছিল, কত কুরচি ফুল ফুটে শোভা পাচ্ছিল ছায়া তলে। ভেবেছিলাম, ফুল তুলে তুমি আমার খোঁপায় পরিয়ে দেবে। মনে করেছিলাম, তুমি ধরবে আমার হাত। তুমি তা ধরোনি। আমাকে একটু ছুঁয়েও দেখনি। তুমি ছিলে নির্বিকার।
আচ্ছা রঞ্জন, আমার জীবন নদীর বাঁক কেন এইভাবে এই দূর দেশে দানিয়ুব নদীর মোহনায় এসে বাঁক নিল? তোমার কী কোনই দায় ছিল না? আমাকে তুমি কী কেবলই বন্ধু মনে করতে? কখনও কোনও নিঝুম স্বপ্ন প্রহরে আমার অনুপস্থিতির জন্য তোমাকে কী একটুও একা মনে হয়নি?
——- মাধবী লতা।
মাধবী/
‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো’
১লা ভাদ্র, ১৩৯২ বঙ্গাব্দ। রবিবার। শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। নক্ষত্র পূর্ব ফাল্গুনী। রঞ্জন মাধবীকে একটি পত্রে লিখেছিল —
আজ সকাল থেকে এই চিঠির কাগজে কেতকীর পাপড়ি ছিঁড়ে রেখেছিলাম। পত্রখানি হাতে নিলেই তুমি এর ভিতর কেতকীর সুবাস পাবে ………
তারাময় আকাশের নীচে আর কী কখনও আমাদের কথা হবে? যদি হয়, নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে শ্বাস নিতে পারব কী আর যমুনা তীরে ফুটে থাকা কেতকী ফুলের! আর কোনও দিন কি সেই প্রশান্ত সন্ধাবেলায় সুন্দর একটি রাত নামবে না?………
মাধবী লিখেছিল,
দানিয়ূব নদীর তীরে আজ বিকালে আমার স্বামীর
হাত ধরে হাঁটছিলাম। ওপাশে পাহাড়ের ঢালে কত রডোডেন্ড্রন ফুটে আছে। মুগ্ধ চোখে দেখতে না দেখতে মুহূর্তেই সব রডোডেন্ড্রন ফুলগুলো কেতকী ফুলের ঝাড় হয়ে গেল।
মনে আছে রঞ্জন, একবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে কেতকী ছিঁড়তে যেয়ে তোমার হাতে রক্ত ঝরেছিল। রক্তের দাগ লেগেছিল কেতকীর সাদা পাপড়িতে। আমি সেই পাপড়িটি রেখে দিয়েছিলাম গীতবিতানের পাতার ভেতরে। সেই রক্তমাখা পাপড়িটি আজও গীতবিতানের পাতা খুলে দেখি।
ঝরঝর বৃষ্টি হয় এখানে শ্রাবণের মত। কত খুঁজি কেয়া ফুলের ধাপি। কত কথা বলতে ইচ্ছা করে সঙ্গোপনে। সিক্ত হতে মন চায় খুব। কত পথ পেরিয়ে এখানে চলে এলাম। এত কাছে ছিলাম তোমার। অথচ কাছে টেনে জড়াও নি একটুও।
‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে..’ গীতবিতানের পাতায় এই গানের পংক্তির সাথে তোমার দেওয়া কেতকীর পাপড়িটি শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে আছে, ওগো কল্যাণীয়েষু।
মাধবী/
যে প্রেম হৃদয়ে মাখা ছিল, যে প্রেম আঁধারে ছিল না ঢাকা। বুঝি সে অভিসারে যাবে ছায়া ঘেরা কোনো বনে। খুব মনে পড়ে তারে। যদি দেখা হয় আবার চন্দ্র তারা খচিত আকাশ তলে।
গোপনে গোপনে কেয়া ফুল ফুটবে বর্ষার জলে ভিজে। আমার কেবল নিদ্রাহীন রাত্রি ঘুরে ফিরে আসে। আমি যে সব হারিয়ে খুঁজে পাই তারে সরিয়ে দিয়ে সব মেঘ আর কুহেলী রাত্রি।
মাধবীলতা, মনে পড়ে তোমাকে আবার। আল্পস পর্বতমালার পাশে দাঁড়িয়ে দানিউব নদীর জল তুমি যখন দেখ, তখন কী তোমার মনে পড়ে অন্য আর একটি নদীর কথা? তুমি তো ইচ্ছা করলে কুসুমপুরের কেউ হতে পারতে। সেখানেও ছিল নদী। শীতল হাওয়া সেখানেও বয়ে আসে হিমালয় থেকে।
—— রঞ্জন।
রঞ্জন/
আমি তোমাকে বুঝেছি কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে পারোনি। যদি আমাকে বুঝতে, তাহলে এখনও আমাকে তারাহীন সুক্ত রাত্রিতে আকাশের কান্না শুনতে হত না। তোমার এলমেল জীবন ধারা আমার পছন্দ হত কী না? তা বলিনি কখনও। তুমি একদিন আমার ব্যাগ থেকে ওথেলো বইটি নিয়ে শেষ সাদা পাতায় কয়েক চরণ কবিতা লিখেছিলে —-
‘আমরা মিশতে পারতাম অনন্ত জোৎস্নায় ভিজে
পূর্ণিমা প্রহরে
আমরা উড়তে পারতাম মুক্ত ডানার চিল হয়ে আকাশের নীলে
আমরা ভাসতে পারতাম রাজহংসের মতো উত্তাল ঢেউয়ের উপরে।
কিন্তু,
আমরা মিশিনি বিহ্বলতায় জোৎস্নায়
আমরা উড়িনি মুক্ত ডানায় কোনও মেঘের নীলে
আমরা ভাসিনি কোনও স্বেদ জলে।’
এই শহরে কোনো হেমন্ত আসে না। কোনো রাত্রিতেই বাতাসে ভাসে না হৈমন্তী ফুলের গন্ধ। কোনও কোনও দিন সন্ধ্যায় একাকী যেয়ে বসে থাকি দানিয়ুব নদীর তীরে। ছেঁড়া জীন্স পরে কত ছেলে এখানে ঘুরে বেড়ায় তাদের বান্ধবীর হাত ধরে। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে জড়িয়ে থাকে বাহুডোরে। আমি তখন তোমার রূপ খুঁজি। ভাবি, সেই কত বছর আগে এমনই করে কেউ যদি আমাকে বাহুডোরে বেঁধে রাখতো বুড়িগঙ্গার পাড়ে। কোনও উন্মূল তরুণ তার দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে যদি বলতো — ‘তুমি এসো আমার বুকে, তোমাকে বাঁধবো আমার বাহুডোরে।’
আচ্ছা রঞ্জন, তোমার কেন এত দ্বিধা ছিল? তুমি কেন এমন উদাসীন ছিলে? কেন আমাকে রেখে দিতে অনাহুত করে। মাঝে মাঝে ভীষণ রকম উতলা হয়ে ওঠে দানিয়ুব নদীর শীতল বাতাস। আমি খুব ক্লান্ত হই। কবেকার কোন্ এক উদাসীন ছেলে আমাকে ভালো বেসেছিল, কী বেসেছিল না, তা নিয়ে শুধুই কেন মর্মর শ্বাস ফেলি? কেনই এখনও তার জন্য চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল চিকচিক করে ওঠে। আচ্ছা রঞ্জন, কেন ওঠে?
—– মাধবী
মাধবী/
কী কথা বলতে চেয়েছিলাম, তা কি এত কাল পরে মনে থাকে? তারপর এই জীবনের উপরে কত ধূলি পড়েছে। জীবনের কাগজে কত হিবিজিবি কথা লিখেছি। কত জনের নাম লিখে তা কেটে দিয়েছি। লিখেছি কত বসন্ত গানের কথাও। সঞ্চারী মিলাতে যেয়ে কত যে কাটাকুটি করেছি। কত মাধবী রাত ছিল নিদ্রাহীন, কত স্বপ্ন যে ভেঙ্গে গেছে। রাত জেগে জেগে তারাহীন আকাশে কেবলই অরুন্ধতীদের খুঁজেছি।
তুমি বুঝতে পেরেছিলে গৃহের প্রতি আমার অনাসক্তির কথা। আবার গৃহে যেন থাকি, সেই শুভকামনাও করেছ। তোমার মনে আছে? সেদিন ছিল চৈত্রের খর দুপুর। তুমি আমি দুজন হাঁটছিলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের উপর দিয়ে। উদ্যানের গাছগুলো তখন এত বড় ছিল না। রোদ্দুর ঝরছিল ঝুমঝুম তপ্ত বৃষ্টির মতো। খুব পুড়ে যাচ্ছিল মাথার চুল। একবার মনে হয়েছিল, তোমার শাড়ির আঁচল টেনে আমার মাথার উপর রাখি। কিন্তু, সাহস পাইনি। কেন সাহস পাইনি তা কী তুমি জানো?
তপ্ত দুপুরেরও অনেক আকুতি থাকে। মেঘ এবং বৃষ্টি কেউই এসব জানতে পারে না। আর তুমি তো ছিলে মাধবী লতা। তুমি কেমন করে বুঝবে এসব আকুলতার কথা?
খুব খিদে লেগেছিল আমার। বলেছিলাম– হাঁটতে ভাল লাগছে না।
— কোথাও বসবে?
— না।
— কিছু খাবে?
— না।
— কেন?
— এই উদ্যান গড়ের মাঠ।
তুমি বলেছিলে, ঐ যে পুকুর পাড়ে দেখো, কড়ই গাছ। ওখানে ছায়া আছে।
আমি বললাম, তুমি আমাকে একটুও মায়া করোনা।
মাধবী রাগ হয়েছিল।
তুমি বললে — আমি চলে যাচ্ছি।
আচ্ছা মাধবী, তোমার কাছ থেকে একটু মায়াই চেয়েছিলাম। তুমি তা দাওনি, নাকি বুঝতে পারো নি আমাকে? আমার কাউবয় স্বভাব তোমার পছন্দ হতো না? এই যেমন, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পরনে জিন্স, পায়ে স্পঞ্জের চপ্পল, এই সব?
সেদিন তো, এই সব অপছন্দের কোনো কথাই বলো নি। আজ না হয় বললে। কী বলবে না মাধবী?
—– রঞ্জন।
****** ******
Leave a Reply