দুর্ভোগ – ওয়েস্টার্ন – গোলাম মাওলা নঈম – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ: ২০০২
০১-২. কি ব্যাপার, লাইমি
কি ব্যাপার, লাইমি [লাইমি : ইংরেজ নাবিক, ব্যঙ্গার্থে বা তুচ্ছার্থে সম্বোধন করা হয়েছে], গরম লাগছে খুব?
সন্তর্পণে পরনের কোট খুলে চেয়ারের ব্যাক-রেস্টের সাথে ঝুলিয়ে রাখল জিম শেভার্ন। একটা সিগার ধরিয়ে প্রশ্নকর্তা, পাশের লোকটির দিকে তাকাল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে, খেলার দিকে মনোযোগ নেই তেমন, প্রায় সারাক্ষণই হেরেছে। যা গরম পড়ছে, আমার মনে হয় সবারই কোট খোলা উচিত! শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের ওপর তুলে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল শেভার্ন, চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
উল্টোদিকের লোকটিকে প্রায় শীর্ণদেহী বলা যাবে, বিল নামে সম্বোধন করছে অন্যরা, প্রায় বোঝা যায় না এমন ভাবে ক্ষীণ একটু হাসল সে। স্রেফ অলস মন্তব্য বলে ধরে নিয়েছে শেভার্নের কথাটা। অন্যজন বেশ মোটাসোটা, শেভার্নের প্রস্তাবে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। তুমি কি বলতে চাও চুরি করছি আমরা? আচমকা তড়পে উঠল সে, চোখে চ্যালেঞ্জ।
উঁহু, তেমন কিছু বলিনি আমি, নিরীহ সুরে সাফাই গাইল শেভার্ন; বলতে পারত সে না হলেও অন্তত একজন হাত সাফাই করছে। পরনে কোট না থাকলে কিছুটা হলেও সেই সম্ভাবনা কমে যায়।
তৃতীয় লোকটা কিছু বলল না, ইচ্ছে করেই ক্রমশ তেতে ওঠা পরিস্থিতিটায় ভ্রূক্ষেপ করছে না। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষায় আছে শেভার্ন, নাছোড়বান্দা মনে হচ্ছে ওকে-স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে কথাচ্ছলে আসলে অভিযোগই করেছে; অন্যরা কোট না খুললে চেয়ারে বসবে না, খেলাও শুরু হবে না। আচমকা নীরব হয়ে গেছে পুরো সেলুন, বারের কাছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ফিরে তাকিয়েছে পোকার টেবিলের দিকে। শেভার্নের প্রস্তাব আর মোটকুর চ্যালেঞ্জ জুয়েল পর্যন্ত গড়ালে বিস্মিত হবে না কেউ।
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিল নামের লোকটি, ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা ক্ষীণ হাসি প্রসারিত হলো একটু। আসলেই গরম পড়ছে খুব, কোট খোলার সময় একমত হলো সে।
এখনও দাঁড়িয়ে আছে শেভার্ন। পলকের জন্যে ওর উরুতে বাঁধা জোড়া হোলস্টারের দিকে তাকাল মোটকু, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তৎক্ষণাৎ। চেয়ারে বসেই কোট খুলতে শুরু করল। অসহায় দৃষ্টিতে সঙ্গীদের দিকে তাকাল তৃতীয়জন, নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়াল কোট খোলার জন্যে।
মিনিট দুই পর খেলা শুরু হলো আবার। শেভার্ন টের পেল ঘণ্টা খানেক আগে যেমন হয়েছিল, ভাল তাস পড়ছে ওর হাতে।
বিতৃষ্ণার সাথে হাতের তাসে চোখ বুলাল তৃতীয় লোকটা, তারপর টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলল তাসগুলো। আমি আর খেলছি না, খেলা শুরুর পর এই প্রথম মুখ খুলল সে, চেয়ার ছেড়ে বারের দিকে এগোল। জায়গাটা দখল করতে আগ্রহী হলো না অন্য কেউ।
কোট খোলার পরও অনবরত ঘামছে মোট, এবং এবারও জিতেছে শেভার্ন। শার্টের কিনারা আরও তুলে দিল ও, বুঝতে পারছে ভাগ্য খুব বেশি সহায়তা করছে ওকে। সব টাকা নিজের দিকে টেনে এনে তাস শাফল শুরু করল, নিদারুণ অবহেলার সাথে কাজটা সারছে। একটু আগেও খানিকটা সন্দেহ ছিল মনে, কিন্তু এখন নিশ্চিত জানে আসলে কে চুরি করছে।
বিল নামের লোকটা এজন্যেই হাসছিল। জানত তার জোচ্চুরি ধরা পড়ে যাবে, এবং এখন ইচ্ছে করেই জিততে দিচ্ছে শেভার্নকে, যাতে দোষটা ওর ঘাড়ে চাপাতে পারে। আরও তিনটা পট জেতার পর বিলকে জিততে বাধ্য করল ও। কিন্তু বিল তাস শাফল করার পর দেখা গেল একই কাণ্ড–আবারও জিতল শেভার্ন।
তোমার সাহায্য দরকার নেই আমার, নিস্পৃহ স্বরে বলল ও।
উৎসাহী দর্শকরা বিস্মিত হলেও নির্বিকার দেখাচ্ছে বিলকে। এখনও স্মিত হাসি লেগে আছে ঠোঁটে, বুকের সাথে প্রায় লেপ্টে ধরেছে নিজের তাস। কি বলতে চাও, লাইমি? নিচু কিন্ত স্পষ্ট করে জানতে চাইল সে।
সময় নিয়ে সিগারেটের গোড়া ছাইদানিতে পিষল শেভার্ন, অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজটা করছে, একবারের জন্যেও প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকায়নি। তেমন কিছু নয়, ছাইদানি থেকে চোখ তুলে সরাসরি লোকটার চোখের দিকে তাকাল ও। বলেছি তোমার কাছে সাহায্য চাইনি আমি।
কিসের সাহায্য? একটা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল লোকটা।
ন্যাকা! বেটাচ্ছেলেও ন্যাকা সাজে, এমন পরিস্থিতিতে, লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল শেভার্ন। আড়চোখে অন্যদের গম্ভীর মুখগুলো দেখল একবার। নিজেকেই সাহায্য করছ না কেন? বিদ্রুপের স্বরে শেষে জানতে চাইল
ক্রোধে জ্বলে উঠল লোকটার চোখ, ধৈর্য হারিয়েছে এতক্ষণে। আচমকা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল হাতের তাসগুলো। তাস সরে যেতে মুঠিতে ছোট্ট একটা ডেরিঞ্জার দেখা গেল। কোন ফাঁকে বের করে এনেছে কেবল সেই জানে।
টেবিলের কিনারা থেকে গুলি করল শেভার্ন। চেয়ার সহ পেছনে ছিটকে পড়ল জুয়াড়ী, কপালে ত্রিনয়নের সৃষ্টি করেছে বুলেটটা। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল হতভাগ্য বিল।
নির্বিকার মুখে প্রতিদ্বন্দ্বীর নিথর দেহটা দেখল শেভার্ন, তারপর চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল। কি মনে হয় তোমাদের, ডুয়েলটা ফেয়ার ছিল, তাই না? হোলস্টারে পিস্তল ফেরত পাঠানোর সময় মৃদু স্বরে জানতে চাইল ও।
কেউই কিছু বলল না। স্থির হয়ে নিজের চেয়ারে বসে আছে মোটকু, হাত জোড়া টেবিলের ওপর ফেলে রেখেছে। এখন আর লালচে দেখাচ্ছে না মুখ, বরং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু চাহনিতে চাপা রাগ, সেটা বিল নাকি শেভার্নের প্রতি বোঝা যাচ্ছে না।
টেবিলের সব টাকা পকেটে ঢোকাল শেভার্ন, কেবল একটা ডাবল ঈগল বাকি রাখল। আশা করি ওর সৎকারের জন্যে বিশ ডলারই যথেষ্ট হবে। লম্বা ঝুলঅলা কোট তুলে নিয়ে কাঁধের ওপর চাপাল ও, মুহূর্তের জন্যে ভাবল পরবে। পরমুহূর্তে মেক্সিকান বুল ফাইটারদের কথা মনে পড়তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। দুঃসাহসী বুল ফাইটাররাও কোন কোন সময়ে ষাঁড়কে উত্যক্ত করতে ক্লান্তি বোধ করে। কোট কাঁধের ওপর রেখেই সেলুন থেকে বেরিয়ে এল ও, পোর্চে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে একটা সিগারেট রোল করল।
রাস্তায় নেমে কয়েক পা এগোতেই পিছু হটতে বাধ্য হলো শেভার্ন। পাশের গলি থেকে ছুটে এল তপ্ত সীসা। আনাড়ীর মত একের পর এক গুলি চালাচ্ছে কেউ। কেবল প্রথমটাই কাছ দিয়ে গেল, কানের পাশে বিচিত্র শব্দ তুলে চমকে দিয়েছে ওকে।
হয়তো তৃতীয় লোকটাই খেপে গিয়ে আক্রমণ করেছে, ধারণা করল ও। তবে সঙ্গী জুটেছে তার। কোল্ট বের করে নিশানা ছাড়াই পাল্টা গুলি করল শেভার্ন। ক্ষীণ গোঙানি কানে এল ওর, মেয়েলি কণ্ঠই বলা উচিত; তারপর যেমন শুরু হয়েছিল, আচমকা শেষ হয়ে গেল লড়াই। পিস্তল হাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকল ও, শেষে বিপদের সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে হিচিং রেইল থেকে গ্রে-টাকে মুক্ত করল।
স্যাডলে চেপে শেষবারের মত চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালাল ও, বুঝতে চাইছে আরও কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে কি-না। ঘুমে অচেতন সারা শহর, দূরে গির্জার ঘণ্টা-ঘরে একটা বাতি জ্বলছে। আর কোন আলো নেই কোথাও। অশরীরীর মত দাড়িয়ে আছে বাড়ি আর দালানগুলো, চাঁদের ম্লান আলোয় একেবারে জীর্ণ, রুগ্ন লাগছে মধ্যরাতের সোডা স্প্রিং-কে।
দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাল শেভার্ন, কয়েকশো গজ ঘোটার পর শেষ বাড়িটাও পেছনে পড়ে গেল। পেছন ফিরে দীর্ঘ মূল রাস্তার ওপর নজর চালাল ও, কেউ পিছু নেয়নি বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত মনে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিল।
নিজের প্রাণ আর হাজার খানেক ডলার নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ও। খুশি হওয়া উচিত। স্যাডল ব্যাগে মৃদু চাপড় দিয়ে নিজেকে অভিনন্দিত করল শেভার্ন, ভাগ্যিস শহর ছাড়ার আগে শেষ ড্রিঙ্ক গলায় টালার জন্যে গোল্ডেন ঈগলে গিয়েছিল! সোডা স্প্রিং-কে পুরোপুরি আদর্শ শহর বলা যাবে না, বিক্ষিপ্ত মনে ভাবল ও, কিন্তু কোন একদিন এমন একটা শহরে পৌঁছার পর হয়তো থেকে যেতে ইচ্ছে হবে। পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন আরেকটা শহরে স্রেফ নিজের ভাগ্য যাচাই করেছে, সোডা স্প্রিং-এ ওর অভিজ্ঞতাকে এটুকুই বলা যেতে পারে।
ট্রেইলটা ক্রমশ চড়াইয়ে উঠে গেছে, ঘন্টা দুই চলার পর প্রায় সমতল জমিতে পৌঁছে গেল শেভার্ন। সোডা স্প্রিং-এর আশপাশে ছিল,স্যাগুয়েরো আর শোলা ক্যাকটাসের রাজত্ব, এখানে আছে কেবল খর্বাকৃতির জুনিপার আর ক্যাকটি ঝোপ। পর্যাপ্ত ঘাস নেই, পানির উৎসও নেই। তাছাড়া এমন এলাকায় প্রচুর র্যাটল থাকে, ঘোড়ার জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, ওর চেয়ে স্ট্যালিয়নটারই বেশি দরকার।
শেভার্নের থায় স্যাভিলানো হ্যাট। কালো ওটা, চওড়া ব্রিম, সমতল ক্রাউন; সাধারণত স্প্যানিয়ার্ডরাই এ ধরনের হ্যাট পরে। তলাটা, গভীর বলে ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর সময় গোল্ড প্যানের চেয়ে বেশি কাজে দেবে। কিন্তু এভাবে হ্যাটটা ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু গোল্ড প্যানের তলাও পানি ধরে রাখার মত তেমন গভীর নয়। এরচেয়ে অনাকর্ষণীয় কোন হ্যাট পরা উচিত, ভাবল শেভার্ন-যাতে ভবঘুরে বা ভ্রমণরত কোন স্প্যানিয়ার্ড মনে না হয় ওকে, কিন্তু ওর কালো চুল আর গোঁফ ধারণাটা আরও পাকা করে ফেলে; তবে এর একটা সুবিধাও আছে-ইংরেজ নয় এমন লোকের কদর বেশি এ দেশে!
ট্রেইল থেকে কিছুটা দূরে ঝোপের আড়ালে ক্যাম্প করল শেভার্ন। স্যাডল। ছেড়ে প্রথমে ঘোড়ার যত্ন নিল, স্যাভিলানোতে পানি ঢেলে খাওয়াল ওটাকে; মাথা মুছে শেষে দলাই-মলাই করে দিল। স্যাডল ব্যাগে সামান্য ওট অবশিষ্ট ছিল, তারই কিছু দিল স্ট্যালিয়নকে। তারপর বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ও। ক্লান্তি লাগছে না তেমন, তবু সুযোগটা হাতছাড়া করল না, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘোড়ার মৃদু হ্রেষাধ্বনি জাগিয়ে তুলল ওকে। প্রথমেই নড়ল না শেভার্ন, শুয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার প্রয়াস পেল। তারাজ্বলা আকাশে লেগে আছে দৃষ্টি, কিন্তু সজাগ প্রতিটি ইন্দ্রিয়। ক্ষীণ খুরের শব্দ কানে আসছে, একটা পাথর গড়ানোর শব্দ হলো কোথাও-খুবই কাছে!
গভীর রাতে যে-ই এই ট্রেইল ধরে যাতায়াত করুক, সৎ লোকও হতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে শেভার্ন, জোড়া পিস্তল চলে এসেছে ওর হাতে। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার, এবং নিঃসীম নীরবতা। কান সজাগ করে একই জায়গায় পড়ে থাকল ও, মিনিট কয়েক পর ধৈর্যের ফল মিলল-প্রথমে খসখসে একটা শব্দ, শেভার্নের সন্দেহ হলে হয়তো কোন ব্যাটলের চলার শব্দ সেটা, কিন্তু পরে স্যাড়লের খসখসে শব্দ শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল। ঝোপের কিনারে সরে এসে ট্রেইলের ওপর নজর রাখল ও, আশা করছে শিগগিরই দেখতে পাবে আগন্তুককে।
একজন নয়, দুজন।
চোখ কুঁচকে সামনের পথ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করল ও। সোডা স্প্রিং-এ শুনেছে সামনে কোথাও বসতি আছে। এই ট্রেইল ব্যবহার করার ষোলো আনা অধিকার আছে যে কারও; কিন্তু এ মুহূর্তে কারও সঙ্গ কামনা করছে না শেভার্ন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার চিবুক চেপে ধরল ও, পাছে ওটা কোন শব্দ করে ফেলে।
আচমকাই এল গুলিটা, নির্জন প্রান্তরের অটুট নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিল। বিচিত্র সুর তুলে কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল তপ্ত সীসা। অল্পের জন্যে ও বেঁচে গেলেও ঘোড়াটা ধরাশায়ী হলো ঠিকই। হুড়মুড় করে ঝোপের ওপর ঢলে পড়ল স্ট্যালিয়ন, গড়িয়ে সরে গেল একপাশে। দেহের কয়েকটা পেশী কেঁপে উঠল দুএকবার, তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।
বেজন্মরা ঠিকই জানে কোথায় আছি আমি, দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল শেভার্ন। গড়ান দিয়ে কয়েক হাত সরে এল ও, চোখ তুলে দেখল ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে দুই বেজন্ম-আবছা ভাবে সওয়ার সহ দুটো ঘোড়র কাঠামো চোখে পড়ছে। সামনের লোকটার বুকে নিশানা করল ও, তারপর ট্রিগার টেনে নিল।
আচমকা যেন পেছন থেকে টেনে ধরেছে কেউ, স্যাডলে স্থির হয়ে গেল লোকটা। ঘোড়ার দুলকি চালের সাথে দোল খাচ্ছে দেহটা, তারপর গড়িয়ে স্যাডল চ্যুত হলো। ঘোড়াটা ছুটতেই থাকল। পিছু পিছু আসছে দ্বিতীয়জন।
অকস্মাৎ বাহুতে টান অনুভব করল শেভান, নিশানা ছুটে গেল পরের গুলি করার সময়। বিড়বিড় করে খিস্তি করল ও, দেখল সরাসরি ওর দিকে ছুটে আসছে লোকটা। সমানে কমলা আগুন ওগরাচ্ছে হাতের পিস্তল। নিজের কোল্টের নল দিয়ে লোকটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল ও, কিন্তু একেবারে কাছে চলে এসেছে সে। চোখের সামনে তীব্র আগুনের ঝলক আর হাজারটা আতশ বাতি জ্বলে উঠতে দেখল শেভার্ন, পর মুহূর্তে আগের মতই অন্ধকার নেমে এল।
কয়েক সেকেন্ড পর কপাল আর চোখে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ অনুভব করল শেভার্ন। নিথর স্ট্যালিয়নের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ঘোড়ার শরীরের। উষ্ণতা পুরোপুরি সচকিত করল ওকে। তৎক্ষণাৎ আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন। হলো, জানে একজনকে নিকেশ করেছে, কিন্তু আশপাশেই আছে অন্য লোকটা। হাত চালিয়ে চোখ থেকে রক্ত মুছে ফেলল ও, আশা করল হয়তো দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে বসেনি। সন্তর্পণে পা নাড়ল। মনে হচ্ছে সবই ঠিক আছে। কিন্তু নড়াচড়া করার আগে অন্য লোকটাকে খুঁজে বের করা দরকার।
উল্টোদিকের পাহাড়ের দিকে তাকাল ও, বহু দূরে ক্ষীণ আলোর আভা চোখে পড়ছে। কাছেই করুণ সুরে ডেকে উঠল একটা কথোট। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করল ও। একখণ্ড মেঘের আড়ালে পড়ে গেছে চাঁদ, তবে বেরিয়ে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
একটু পরেই ভুলটা বুঝতে পারল, পাহাড়টা আসলে মেঘের টুকরো। কালিগোলা অন্ধকার ওর মত কয়োটটাকেও ঠকিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আলোকিত হয়ে উঠবে বেসিনের এই অংশ, রাইফেলে নিশানা করার মত আলো পাওয়া যাবে।
চাঁদিতে জ্বালা করছে ক্ষতটা, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। রক্ত আর দৃষ্টিভ্রমের উৎপাত বন্ধ করতে রুমাল চেপে ধরল ও জায়গাটায়। কেউ নিশ্চয়ই নজর রাখছে, অপেক্ষায় আছে কখন নড়ে উঠবে নির্জীব দেহটা। পেছনে একটা ঘোড়ার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল ও চোখের কোণ দিয়ে। দেখল কাছেই জুনিপার ঝোপের পাশে বেড়ে ওঠা ঘাস মুখে টেনে নিচ্ছে একটা স্ট্যালিয়ন।
নিজেকে মাতাল মনে হচ্ছে ওর, সম্ভবত চাঁদির ক্ষতটাই দায়ী সেজন্যে। মাথাটা ভারী লাগছে, ভোঁতা যন্ত্রণার পাশাপাশি দপদপ করছে লাগাতার; সুস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারছে না। অথচ এ মুহূর্তে সেটাই জরুরী, কারণ খুব কাছেই ওঁৎ পেতে আছে বিপদ।
গত কয়েকদিনে পারতপক্ষে ঝামেলা এড়িয়ে চলেছে শেভার্ন, জানে ওর চেষ্টায় গাফিলতি হয়নি। পেছনে কঠিন কিছু মানুষকে নিয়ে ট্রেইলে চলার ইচ্ছে নেই ওর। চলার মধ্যে কেটেছে দুটো মাস-একের পর এক শহর বা বসতি পেরিয়েছে, কিন্তু কোন চিহ্ন বা শক্রতা ফেলে যায়নি পেছনে। শুধু সোডা স্প্রিং এর বেলায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।
পেছনে ঘাসের সাথে কাপড়ের খসখসে শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। নিশ্চিত। ধরে নিয়েছে আগন্তকদের দুজনই জুয়াড়ী। শোধ নিতে এসেছে, এবং ওর স্যাডল ব্যাগের এক হাজার ডলার তাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তির খাতিরে বলা যায় এখনও ওকে দেখতে পায়নি লোকটা, নইলে অনেক আগেই এক গুলিতে কাজ সেরে ফেলত। রক্তের গন্ধে নাক ঝেড়ে অস্বস্তি প্রকাশ করল স্ট্যালিয়নটা। সন্তর্পণে খানিকটা পাশ ফিরল শেভার্ন, আশা করল হয়তো শব্দ হবে না।
কিন্তু আশা পূরণ হলো না ওর। জুনিপারের শুকনো একটা ডাল ভাঙল মটু করে। তৎক্ষণাৎ শব্দের পরোয়া না করে পুরো দেহ গড়িয়ে দিল ও। ভাগ্যিস, সময় মত সরে যেতে পেরেছে। নইলে এখনই ফুটো হয়ে যেত বুক। রাইফেলের নিশানা করাই ছিল যেন, শব্দ পেয়েই ভারী ক্যালিবারের গুলি পাঠিয়ে দিয়েছে। লোকটা। আরেকটা গুলি বিধল মরা ঘোড়াটার শরীরে।
শুয়ে থেকেই পাল্টা গুলি করল শেভার্ন, রাইফেলের ঝলকের দুপাশে পালাক্রমে গুলি চালিয়ে দুটো কোটই খালি করে ফেলল। গুলির প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মাটির সাথে রাইফেলের বাটের সংঘর্ষের শব্দ এল কানে। দীর্ঘক্ষণ মরা ঘোড়ার পেছনে নিথর পড়ে থাকল ও, কোল্টে তাজা বুলেট ভরে নিয়েছে। তারপর নিশ্চিত হয়ে হোলস্টারে কোস্ট ঢুকিয়ে চাদির ক্ষতের দিকে মনোযোগ দিল।
রুমাল দিয়ে আলতো ভাবে ক্ষতটা স্পর্শ করল ও, গভীরতা মাপল। ইতোমধ্যে রক্তক্ষরণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যান্টিন থেকে পানি ঢেলে রুমাল। ভিজিয়ে শেষে ক্ষতটা পরিষ্কার করল। জানে এজন্যে পরে হয়তো আফসোস করতে হবে, কারণ কাছাকাছি পানির উৎস অন্তত পঞ্চাশ মাইল দূরে।
মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ। জুয়াড়ীদের ঘোড়া দুটো শখানেক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সন্ত্রস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। জুনিপারের পাশে গজানো জিকেটনের সদ্ব্যবহার শুরু করেছে পুরোদমে। স্থানীয় ঘোড়া, ধারণা করল শেভার্ন। ওর বিশাল গ্রে ঘোড়াটা বিরান প্রান্তরের এসব ঘাসকে তুচ্ছ মনে করেছে।
শেভার্ন নিশ্চিত দুজনকেই ধরাশায়ী করেছে। কিন্তু সত্যিই কি মরেছে ওরা? দ্বিতীয় লোকটা হয়তো স্রেফ আহত হয়েছে। একটু আগে শেভার্নের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ওর দেহ পরখ করতে অবহেলা করেছে সে। একই অভিজ্ঞতা অর্জন করার ইচ্ছে নেই ওর। চোখ বন্ধ করে নিঃশাস আটকে রাখল ও, মানুষের ক্ষীণ নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে চাইছে। কয়েকশো ফুট দূরে স্টীম ইঞ্জিনের মত সশব্দে শ্বাস নিচ্ছে ঘোড়াগুলো, ব্রিডলের টুংটাং আর স্টির্যাপের ভোতা, আওয়াজ ছাড়াও ঘাস টানার মচমচে শব্দ শোনা যাচ্ছে-ওসব বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল, কিন্তু ওর সমস্যার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলোকে।
জীর্ণ হ্যাটটা খুঁজে পেল ও, ঠিক চূড়ায় ফুটো হয়ে গেছে। কোল্টের নলের আগায় বসিয়ে হ্যাটটা তুলে ধরল, বিপদের আভাস পেতে এরচেয়ে ভাল কিছু আপাতত মনে পড়ছে না। কোন গুলি ছুটে এল না। বড়সড় একটা পাথর তুলে লোকটার অবস্থানের দিকে ছুঁড়ে মারল ও। এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না, ঘোড়ার সচকিত সচকিত কান নাড়ার শব্দই কেবল শুনতে পেল শেভার্ন।
চাঁদের আলোয় আরেকবার চারপাশে সতর্ক নজর চালাল ও। ক্রল করে নিঃশব্দে কয়েক গজ সরে এল মরা ঘোড়ার কাছ থেকে, তারপর সন্তর্পণে মাথা তুলল। দ্বিতীয় লোকটিকে দেখতে পেল এবার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পড়ে আছে দেহটা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাওতা দিচ্ছে না। তারপরও ক্রল করে এগোল ও, সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে দেহটার ওপর। মিনিট কয়েক পর সিদ্ধান্তে পৌঁছল অন্তত একজন আর বিপজ্জনক নয় ওর জন্যে।
আরেকজন কোথায়? অজান্তে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। তেত্রিশ চলছে ওর, বাস্তবে যতটা সাহসী তারচেয়ে বেশি সাহসী হওয়ার ভান করে রুক্ষ কঠিন পশ্চিমে টিকে আছে বললে ভুল হবে। পড়ে থাকা রাইফেলটা সন্দিহান করে তুলেছে ওকে, জানে ক্ষীণতম নড়াচড়াই একজোড়া কোল্টকে গর্জে উঠতে প্ররোচিত করতে পারে।
ক্যাকটি ঝোপের কাছাকাছি পৌঁছল ও, ধারণা করেছে এবার অন্যজনের লাশ। দেখতে পাবে। কিন্তু তেমন কিছুই নেই। চাঁদের আলো এতটাই উজ্জ্বল প্রায় দিনের আলোর মত স্পষ্ট চোখে পড়ছে সবকিছু। মনে পড়ল ওর ঘোড়াটা পড়ে যাওয়ার সময় ট্রেইলেই ছিল দুই জুয়াড়ী। অহেতুক এভাবে জুনিপার ঝোপের। আশপাশে ক্রল করতে থাকলে যে কোন সময় একটা র্যাটল ছোবল মারতে পারে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঝটিতি মাথা তুলল ও, ইচ্ছে সংক্ষিপ্ত সময়ের। মধ্যে ট্রেইলের ওদিকটা দেখে নেবে।
স্যাডল থেকে খসে পড়ার পর ক্রল করে কয়েক ফুট এগিয়েছে লোকটা, রক্তের ছোটখাট একটা পুকুর তৈরি হয়েছে শেষ অবস্থানে। হাত বাড়িয়ে লোকটার কজিতে ধমনীর স্পন্দন পরখ করল শেভার্ন, নিশ্চিত হলো আর কখনও ক্রল করতে পারবে না জুয়াড়ী। কোল্ট হোলস্টারে ফেরত পাঠিয়ে উঠে দাঁড়াল ও এবার। ভাবছে ঘোড়া দুটোকে কিভাবে বাগে আনবে।
অকস্মাৎ অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল ওর চোখে। দৃষ্টি নামিয়ে পড়ে থাকা লোকটিকে নিরীখ করল। জুনিপারের ওপাশে পড়ে আছে মোটকু, কিন্তু এ লোক একেবারেই অচেনা। অবশ্য জুয়াড়ীদের কাউকেই আগে থেকে চিনত না। বিল নামের শীর্ণ জুয়াড়ী সেলুনেই পটল তুলেছে, কিন্তু এ লোক…খেলা ছেড়ে যাওয়া লোকটার সাথে কোন মিলই নেই। প্রায় তরুণ বলা যাবে একে, সতেরো বা আঠারো হবে বড়জোর। বয়স আর কখনও বাড়বে না তার। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘোড়া ধরতে এগোল শেভার্ন।
কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে ঘোড়াগুলোর অসহযোগিতা টের পেল ও। খুব দূরে সরে যাচ্ছে না কোনটাই, একেবারে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে নিচ্ছে। নিজেকে। লাগাম ধরার চেষ্টায় ইস্তফা দিয়ে এবার ভিন্ন পথে চেষ্টা করল শেভার্ন। ভাবছে পানির লোভ দেখিয়ে কাজ উদ্ধার করবে কি-না, পরমুহূর্তে মনে পড়ল ফুটো হয়ে গেছে হ্যাটটা।
পিছিয়ে গিয়ে এক জুয়ার হ্যাট তুলে নিল ও। কিন্তু এটাও ফুটো হয়ে গেছে। নতুন ফুটো নয় অবশ্য, স্টেটসনটার দশা একেবারে যাচ্ছেতাই, এতই জীর্ণ হয়ে গেছে যে কিনারার কাছে গাঁথুনি প্রায় খুলে গেছে। অন্য জুয়াড়ীর হ্যাট আলগা খড়ের তৈরি, কাজ হবে না। তারপরই ওর মনে পড়ল পানির গন্ধ আর ক্যান্টিন ভরা পানির শব্দই যথেষ্ট হবে।
মরা গ্রে-র কাছে এসে ক্যান্টিনের খোঁজে তল্লাশি চালাল। কিন্তু এবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হলো ওকে। ঘোড়ার শরীরের নিচে পড়ে গেছে ওটা, ফেটে যাওয়ায় সব পানি বেরিয়ে গেছে। পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে সামনে কোথাও পানি পাওয়া যাবে না।
একটা উপায়ই আছে এখন-সোডা স্প্রিং-এ ফিরে গিয়ে পানি আর নতুন ঘোড়া সংগ্রহ করতে হবে, এবং তারও আগে, অন্তত একটা ঘোড়া ধরতে হবে।
ফের চেষ্টা করতে গিয়ে এবার ভাগ্যের সহায়তা পেল শেভার্ন। সরে যাওয়ার। মুহূর্তে জুনিপারের ডালে জড়িয়ে গেল লাগামের প্রান্ত, আটকা পড়ল স্ট্যালিয়নটা।
সোডা স্প্রিং-এর দূরতু মাইল দশ বা বারের বেশি হবে না। এখনই যাত্রা করলে হয়তো সূর্য তেতে ওঠার আগেই কাজ সেরে আবার ট্রেইলে নামতে পারবে ও। সোডা স্প্রিং-এর মত ছোট্ট শহরে কেউ না কেউ আছে যে এ ঘোড়ার মালিককে চিনবে, কিভাবে ঘোড়াটা ওর কাছে এল সেই ব্যাখ্যা দিতে জান পানি হয়ে যাবে। ক্লান্তিকর ব্যাখ্যা এড়ানোর একটাই উপায় আছে।
স্ট্যালিয়নের স্যাডলে চেপে অন্যটাকে তাড়া করল শেভার্ন। মিনিট দশ পর দুটো লাশই আড়াআড়ি ভাবে বেঁধে ফেলল অন্য ঘোড়ার পিঠে। তারপর ফিরতি পথে যাত্রা করল সোডা স্প্রিং-এর উদ্দেশে।
তিক্ত কিছু অনুভূতি হচ্ছে ওর, এভাবে ফিরে যাওয়া পছন্দ করতে পারছে। পোকার বা জিতে নেওয়া এক হাজার ডলার কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও উপভোগ্য একটা আমেজ সৃষ্টি করেছিল ওর মনে, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
হয়তো শিগগিরই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, প্যাকহর্সের পিঠে চাপানো লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে এই চিন্তাটাই খেলে গেল জিম শেভার্নের মনে।
.
০২.
শেভার্ন যখন সোডা স্প্রিং-এ পৌঁছল ভোর হচ্ছে তখন, পুব আকাশে লালিমা ফুটে উঠেছে, ভোরের তাজা বাতাসে তাপদার্থ দিনের আভাস নেই। কিন্ত এখানকার অধিবাসীরা সবাই জানে ঘন্টা খানেক পরেই উত্তপ্ত হলকা ছড়াতে শুরু করবে সূর্য, তাতিয়ে উঠবে মাটির ওপর সবকিছু। উত্তাপ আর উকট ধুলোর অত্যাচারে এমনকি পশুরাও অধৈর্য হয়ে পড়বে। সেজন্যেই সাত-সকালে গেরস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই; লিভারি স্টেবল, সেলুন আর ড্যান্স হলগুলো পরিষ্কার করছে লোকজন।
দোকানের সামনের বোর্ডওঅক পরিষ্কার করছিল মার্কেন্টাইল স্টোরের মালিক টেকো মাথার উইলিয়াম কসবি, মুঠিতে পানি ভরা একটা বোতল ধরা তার-গ্রীন রীভারের পানি। একসময় হয়তো মিষ্টি পানি ছিল নদীটায়, কিন্তু ঘোলাটে রঙের ক্ষারীয় পানি হয়ে গেছে এখন। সেজন্যেই এ শহরের নাম সোডা প্রিং। লম্বা হাতলঅলা একটা ঝড় তুলে নিয়েছে মাত্র, অভ্যাসবশত কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল শহরে প্রবেশ করাঁ আগন্তুকের দিকে, পরক্ষণে বোতলটা হাত থেকে খসে পড়ল তার।
লাশগুলো কষলে মুড়ে নিয়ে এলেই ভাল হত, উপলব্ধি করল শেভার্ন। সাত সকালে মৃতদেহ দেখতে পছন্দ করে না কেউ, সেটা যারই হোক। বাড়তি কম্বল ছিল না সঙ্গে, থাকলেও অবশ্য কিছু যে-আসত না, কারণ আগে বা পরে শহরের লোকজন ঠিকই জেনে যাবে। ছফুট দীর্ঘ দুটো দেহ একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, পা বা মাথা বেরিয়ে পড়ত।
একই ভঙ্গিতে, শরীর টান টান করে স্যাডলে বসে এগোচ্ছে ও। বাম হাতে দুটো ঘোড়ার লাগাম, কি হোলস্টারের বাকলের ওপর স্থির হয়ে আছে ডান হাত। মুখ নির্বিকার কিন্তু চোখে সতর্ক চাহনি, সোডা স্প্রিং যে ওর জন্যে বিপজ্জনক জায়গা সেটা গতকালই প্রমাণিত হয়েছে। কারও কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা আশা করছে না, বরং তা এলেই বিস্মিত হবে।
সোডা স্প্রিং-এর অধিবাসীদের কারোই বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর প্যাকহর্সের পিঠে কি জিনিস রয়েছে, কিন্তু কাউকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী মনে হলো না, এমনকি একটা প্রশ্নও করল না কেউ। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দেখল কয়েক সেকেন্ড, তারপর বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেল। অবস্থা দেখে ছেলেবেলার প্রিয় একটা খেলনার কথা মনে পড়ল শেভার্নের একটা ঘড়ি ছিল ওর, ঘন্টা দেয়ার সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত একটা কোকিল, কয়েক ডাক দিয়ে ফের সেঁধিয়ে যেত গোপন কুঠরিতে।
কিন্তু ঘড়ির কোকিলের মত, এই মানুষগুলোর যে কেউ ডাক না দিয়ে একটা রিপিটার থেকে তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দিতে পারে ওর উদ্দেশে। যে কোন খেলার মতই, দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে এভাবে এগোনোর মধ্যে মোলো আনা ঝুঁকি আছে-টোপ হিসেবে কাজ করছে এ শহরের দুজন লোকের মৃতদেহ। কিন্তু এও সত্যি স্রেফ সামান্য জুয়াড়ী বা ঝামেলাবাজ লোক এরা, সাধারণ মানুষের কোন সহানুভূতি এদের প্রতি না থাকারই কথা।
কিন্তু ওদের একজন একেবারেই তরুণ। সতেরো বছরের একটা ছেলে কতটা বিতৃষ্ণা অর্জন করতে পারে? সম্ভব, ক্যাম্পাসের কনফেডারেট পন্থী প্রভাবশালী র্যাঞ্চার উইলিয়াম রেনারের কথা মনে পড়ে যেতে আনমনে হেসে উঠল শেভার্ন, গৃহযুদ্ধের সময় অনেকেই এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, এক জীবনে যতটা না শত্রুতা সৃষ্টি করা সম্ভব, এক বছরে তাই করেছে। কিন্তু ওর সন্দেহ সোডা স্প্রিং-এর অধিবাসীরা সামান্য এক তরুণকে খুন করার দায়ে খেপে গেলেও ওকে হাসতে দেখলে ঠিকই বিদ্বেষ বোধ করবে। স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় করা খুনও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয় মানুষ, যদি সাথে আনুষ্ঠানিকতা বা গাম্ভীর্যের ভান থাকে।
স্টোর আর বাড়ির সামনের বোর্ডওঅক ধরে এগোচ্ছে কেউ, পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল। গতিপথ না বদলে এগোতে থাকল শেভার্ন, লোকটার পায়ের শব্দ শুনতে পেলেও হৃক্ষেপ করছে না। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ওর সমান্তরালে এগোচ্ছে লোকটি-ছোটখাট গড়ন, তরুণই বলা উচিত। যে কাজেই ছুটছে ছেলেটা, নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না। এভাবে ফিরে আসা ঠিক হয়নি, আবারও উপলব্ধি করল শেভার্ন। কোন চিহ্ন না রেখে বিদায় নিতে চেয়েছিল, কি পরিস্থিতি মোটেই সাহায্য করছে না ওকে।
যদি পানির জন্যে সোডা স্প্রিং-এ ফেরত না-ও আসত, কেউ অনুসরণ করলে লাইমি বিরক্ত হয় সেটা দেখানোও অপরিহার্য ছিল বোধহয়। তবে ভিন্ন। একটা উপায়ও ছিল, লোকগুলোর মাথা ছিলে রেখে গেলেই চলত। অ্যাপাচীদের ভাগ্যেই যত বাহবা জুটত। এবং মরা মানুষের ঘোড়া নিয়ে অন্য শহরে পৌঁছতে সরোষে নিজের উদ্দেশে বিদ্রূপ করল শেভার্ন।
আনমনা হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই, ব্যাপারটা শঙ্কিত করল ওকে। আগেও এমন ঘটেছে, এবং অন্য লোকের ভাগ্যে এই অবহেলার করুণ পরিণতি ঘটতে দেখেছে ও। খুন করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে মানুষ, শেষ একটা ভুল করে বসে, প্রায়শই সেটা হয় ইচ্ছাকৃত। লাগাতার সাফল্য একই সঙ্গে অহঙ্কারী ও বেপরোয়া করে তোলে মানুষকে, ভুল ধারণা চেপে বসে মনে-সবকিছুই উৎরে যাবে কোন না কোন উপায়ে। পরোয়াহীন মানুষ প্রায় কফিনের কাছাকাছি বাস করে।
কিন্তু পরোয়া করে শেভার্ন। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ছেলেটার কাছে কোন পিস্তল নেই। অন্যদের মত ভান করছে না সে, শেভার্ন বা প্যাকহর্সের জোড়া লাশ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। নিজের চামড়ার ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া লাশ দুটো পৌঁছে দেওয়ার অন্য কোন সহজ পথ আছে কি-না, আনমনে ভাবল শেভার্ন। নেই, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও। মৃত মানুষের ঘোড়া রাইড করতে হলে লোকটি কিভাবে মারা গেছে সেটা প্রথম সুযোগেই স্পষ্ট করা উচিত। ১৩-দুভোগ
গোল্ডেন ঈগলের সুইং ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক, নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। ছেলেটা তাকে পেরিয়ে যেতে দৃষ্টি সরে গেল লোকটির। সতর্ক দৃষ্টিতে সেলুনটা জরিপ করল শেভার্ন, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ওখান থেকে কোন বিপদ আসবে না।
কি চায় ছেলেটা, নিজেকেই খুন করতে চাইছে? শেভার্ন আশা করছে আচমকা নায়ক হওয়ার খায়েশ হবে না কারও, এবং তারচেয়েও বেশি আশা করছে শেরিফের অফিস খুঁজে পেতে দীর্ঘ রাস্তার সবটুকু পাড়ি দিতে হবে না। ওকে।
অন্তত একটা প্রত্যাশা পূরণ হলো ওর, মেরুদণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে সোডা স্প্রিং-এর দীর্ঘ রাস্তার শেষ পর্যন্ত যেতে হলো না ওকে। আরও কয়েক গজ এগোনোর পর অফিসটা দেখতে পেল। দর্জি আর স্যাডলারির মাঝখানে সেটা, ভাঙা ফলস-ফ্রন্টের ফাঁক দিয়ে ডোবের কিনারা উঁকি দিচ্ছে। আড়চোখে দেখল শেরিফের অফিস থেকে কয়েক বাড়ি আগেই থেমে গেছে ছেলেটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যাডল ত্যাগ করল ও। রেইলে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
ডেস্কের পেছনে মাঝবয়সী এক লোক বসে আছে। পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল সে, চোখে বিস্ময়। কিন্তু শেভার্ন জানে পুরোটাই ভান। বাজি ধরে বলতে পারবে অতি উৎসাহী অন্তত একজন কোকিল কুঠুরি ছেড়ে পেছন দরজা দিয়ে এখানে এসে ওর আগমনের সংবাদ ঠিকই পৌঁছে দিয়েছে শেরিফের কাছে। ঘোড়াগুলোকে স্রেফ হটিয়ে নিয়ে এসেছে ও, ওর আগেই পৌঁছতে পারবে যে কেউ।
কি করতে পারি তোমার জন্যে? নিরুত্তাপ স্বরে জানতে চাইল শেরিফ।
এই ভদ্রলোকদের কাউকে চেনো তুমি? নির্বিকার মুখে জানতে চাইল শেভার্ন, দরজা পথে প্যাকহর্সের বোঝর দিকে ইঙ্গিত করল।
এবার যেন শহরের লোকজন বুঝতে পারছে প্যাকহর্সে সামান্য কোন বোঝা নেই! তাড়িঘড়ি দরজার দিকে এগোল ল-ম্যান, এতটা ক্ষিপ্রতা শেভার্নও আশা করেনি। অফিস থেকে বেরিয়ে হিচিং র্যাকের কাছে চলে গেল সে, প্যাকহর্সের চারপাশে ভিড় করা অতি উৎসাহী কিছু বাচ্চাকে খেদিয়ে দিল। কম্বল সরিয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখ দুটো দেখল মুহূর্ত খানেক, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরল ওর দিকে। হ্যাঁ, চিনি।
কি ধরনের লোক ছিল ওরা?
তোমার মত।
নিরপরাধ পথচারীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাইনি আমি, কিংবা অন্যের ঘোড়া নিকেশ করার অভ্যেসও নেই আমার। স্থির দৃষ্টিতে শেরিফকে নিরীখ করল শেভার্ন। আমাকে খুন করতে পারলেই বোধহয় খুশি হত ওরা, চেষ্টায় গাফিলতিও ছিল না। কিন্তু আমার ঘোড়ার ওপর দিয়েই যত ঝামেলা গেছে। তোমার কাছে নিশ্চই পরিষ্কার হয়েছে লড়াইটা আত্মরক্ষার খাতিরেই করতে হয়েছে আমাকে?
প্রয়োজন নেই, ক্লান্ত স্বরে বাধা দিল শেরিফ। তোমার মত টিনহর্নরা কে কাকে খুন করল তাতে কিছু যায়-আসে না আমার। নিরপরাধ কোন লোককে যখন নিয়ে আসবে তখন দেখবে কি করি!
এটা আশা করেনি শেভার্ন। আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করছ না?
না। যে ঘোড়ায় চড়ে শহর ছেড়েছ তুমি, ওদের মাসট্যাঙগুলোর সাথে তার কোন পার্থক্য নেই, গুরুত্বও নেই। আমার ধারণা আইন ভাঙোনি তুমি। আবারও লাশ দুটো পরীক্ষা করল সে, তারপর সশব্দে তামাকের রস ফেলল মাটিতে। মনে হচ্ছে ওরা মারা যাওয়ায় তোমার মতই সোডা স্প্রিং-এরও কিছুটা লাভ হয়েছে।
রাস্তার ওপাশে ফাইন ফার্নিচার অ্যান্ড ফিউনেরালস শপ। পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন লোক, একটা কফিন ধরে রেখেছে। শেরিফ নড়া করতে এগিয়ে এসে প্যাকহর্স থেকে লাশ নামাল তারা। লাগাতার একই অবস্থানে পড়ে থাকায় শক্ত হয়ে গেছে মৃতদেহ, ঘোড়ার খুরের মত বাঁকা হয়ে গেছে। কফিনে ঢোকানো সহজ হলো না। একসময় লাশ নিয়ে কেটে পড়ল লোক দুটো, ধমকে উৎসুক বাচ্চাদের আবারও দূরে সরিয়ে দিল শেরিফ।
ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো সে, স্থির দৃষ্টিতে জরিপ করছে শেভার্নকে। নীরবতা ভাঙছে না কেউই।
পুরো একটা দিন নষ্ট হলো আমার, শেষে মন্তব্য করল শেভার্ন।
উত্তর দিল না শরিফ।
কোন সাক্ষ্য বা বিবৃতি দিতে হবে?
না। ওদের বা তোমার, কারও অভাবই বোধ করবে না এই শহর। সোড়া স্প্রিং-এর চৌহদ্দিতে তোমার ছায়াও যদি আর না দেখি তাহলে বলতে হয়, ঝামেলা চুকে গেছে।
বহুদিন পর এভাবে শেভার্নের সাথে কথা বলল কেউ জানে ভ্রুক্ষেপ না। করাই উচিত, কিন্তু শেরিফের ঔদাসীন্য ত্যক্ত করছে ওকে। ভাবছিলাম…
কি ভাবছ আবার?
সত্যিই ঝামেলা চুকে গেছে কি-না।
ওদের কিছু বন্ধু আছে অবশ্য। কয়েকটা দিন ঘোরাঘুরি করো, দেখবে ঠিকই তোমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওরা।
তেমন কিছু ভাবছি না আমি, শেভার্ন জানে মুখ বন্ধ রাখা উচিত ওর। গ্রাহ্য করলেই হয়, কিন্তু মোটা গোঁফের ল-ম্যান অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত করছে ওকে, এতটা যে নিজের কাছেই মানতে পারছে না। এরকম বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে শেরিফ হিসেবে তোমার আচরণ সত্যিই আন্তরিক! একজন আগন্তুককে যেহেতু পক্ষপাতই দেখাচ্ছ, আশা করি কয়েকটা সুবিধাও দেবে আমাকে?
বলে যাও।
ধরে নিচ্ছি চলে যেতে অসুবিধে নেই আমার। নিশ্চই বুঝতে পেরেছ পানি বা সাপ্লাই দরকার না হলে লাশগুলো ফেরত দিতে আসতাম না আমি। সাপ্লাই জোগাড় করার আগে শহর ছাড়ছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চই শহরের লোকজনের পেশের মুখোমুখি হতে হবে। এ অবস্থায় আমাকে কোন পরামর্শ দিতে পারো?
তেমন কিছু মাথায় আসছে না আমার।
তাই? হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে রেইল থেকে লাগাম খুলতে শুরু করল ও। পাত্তা দিয়ো না, বেটা ভুড়ো ভামকে পাত্তা দেয়ার দরকার কি? শহর ছেড়ে চলে যাও! এক ধরনের অনীহা পেয়ে বসেছে ওকে, কিন্তু শেরিফের পরবর্তী মন্তব্যে সেটাও চলে গেল-উল্লাস বোধ করল শেভার্ন।
আসলে তুমি কি চাও, লাইমি? থমথমে মুখে জানতে চাইল শেরিফ।
টিনহর্ন বলে ডেকো আমাকে। তুমিই যেহেতু নামটা দিয়েছ…
বাজে প্যাচাল বন্ধ করো!
আমাকে তাড়ানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহী মনে হচ্ছে তোমাকে, যেন ভয়ে ভয়ে আছ পাছে কোন কিছু আবিষ্কার করে বসি কি-না।
সরু হয়ে গেল শেরিফের চোখ। আসলে তুমি কি চাও?
রিওয়ার্ডের টাকা।
শেরিফের চোখে-মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল শেভার্ন-প্রসঙ্গটা এখনই চেপে যাওয়া উচিত, এবং দুই জুয়াড়ীর জন্যে কোন রিওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়নি।
নিচু স্বরে কিন্তু শুনতে অসুবিধে হবে না এমন ভাবে বিষোগার করল শেরিফ। তুমি তো দেখছি আস্ত হারামী! ঘন্টা খানেকের মধ্যে এই শহরের। লোকেরা হয়তো মত বদলে একটা নেক-টাই পার্টির আয়োজন করে ফেলবে, তার আগেই সাপ্লাই নিয়ে কেটে পড়ছ না কেন?
স্যাভলে চেপে বসল শেভার্ন। হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে আলতো ভাবে স্পর দাবাল, মূল রাস্তা ধরে মার্কেন্টাইল স্টোরের দিকে এগোল ঘোড়া দুটো।
একবারের জন্যেও সরাসরি ওর দিকে তাকাল না টেকো দোকানি, ওকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে তার, যেন আশা করছে ছুটে এসে স্টোরে ঢুকবে কেউ। যত দ্রুত সম্ভব সাপ্লাই সগ্রহ করল শেভার্ন, এ নিয়ে একই জিনিস দুবার কিনতে হয়েছে ওকে। কিন্তু দুটো ঘোড়া নিয়ে রাইড করবে ও এবার, দেখা যাবে গ্রে-র চেয়ে স্থানীয় এই ঘোড়াগুলো দ্রুত ছুটতে পারে কি-না।
গ্রীন রীডারের এক বোতল পানি কিনল ও। এক হাতে প্যাকেট ভরা জিনিসপত্র নিয়ে দরজার দিকে এগোনোর সময় আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, তোমাদের শেরিফ কি সৎ লোক?
মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা, করল দোকানি। ইউনিয়নের পক্ষে লড়াই করেছিল মি. বেলহ্যাম।
জিম শেভার্নের জানা মতে বহু পাজি লোকই তাই করেছে। মন্তব্যটা প্রশংসাসূচক বলে ধরে নিল ও। নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হলো এবার, কিন্তু ঘুরে পোর্চে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। পাজি লোকের সমালোচনা করে কার্যত কোন লাভ হয় না। শেরিফ যদি সত্যিই সম্মানিত লোক হয়ে থাকে, তাহলে শেভার্নের পরোক্ষ অপমান বুঝতে অসুবিধে হত না তার, এবং নির্ঘাত উপযুক্ত জবাব দিত। নিকুচি করি এসব ফিটফাট ভদ্রলোকের! হাসিটা ম্লান হলো না ওর, পোর্চ ছেড়ে রৌদ্রোজ্জ্বল রাস্তায় পা রাখল।
মি. শেভার্ন!
ক্ষীণদেহী লোকটি এত আচমকা নড়াচড়া করেছে যে আরেকটু হলে মালপত্রের প্যাকেট ফেলে পিস্তল তুলে নিয়েছিল শেভার্ন। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও। উজ্জ্বল আলোয় চোখ সইয়ে নেওয়ার পর শেরিফের কথার সত্যতা উপলব্ধি করল-আরেকটু হলে সদ্য কৈশোর পেরুনো এক তরুণকে গুলি করে বসত। খুব বেশি হলে সতেরো হবে বয়েস, ভাল করে দাড়ি-গোঁফও গজায়নি। কি ব্যাপার, বাছা, মৃদু স্বরে জানতে চাইল ও। কি হয়েছে?
তোমার হয়ে ঘোড়াগুলোর ওপর নজর রাখছি আমি।
কিন্তু হিচিং রেইলটা যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে এই কাজ করছে, নিরুত্তাপ সুরে বলল শেভার্ন। এই ছেলেটাই একটু আগে বোর্ডওঅক ধরে শেরিফের অফিসের দিকে ছুটছিল। রাস্তার দুদিকেই সতর্ক দৃষ্টি চালাল ও, দ্রুত হাতে প্যাকহর্সের স্যাডল ব্যাগে জিনিসপত্র ঢোকাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওর ব্যাপারে মুখ খোলেনি শেরিফ, অন্তত শহরের কাউকে প্ররোচিত করেনি। কে যে কাকে ভুল বুঝেছে, আনমনে ভাবল শেভার্ন।
মালপত্র গুছিয়ে দেখল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। বিরক্তি লাগছে শেভার্নের, তরুণের গায়ে পড়া ভাব পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু আরেকবার পিস্তল নিয়ে কোন তরুণের মুখোমুখি দাঁড়ানোরও ইচ্ছে নেই। পকেট। থেকে দুটো কয়েন বের করে ছুঁড়ে দিল ও।
না, স্যার,কয়েন দুটো ফেরত দিয়ে দিল ছেলেটা।
স্যাডলে চেপে বসেছে শেভার্ন। তাহলে কি চাও তুমি?
তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও আমাকে।
আমার সঙ্গে! কোথায়?
যেখানে খুশি-এখান থেকে চলে যেতে পারলেই হলো!
ওহ, জেসাস! তেত্রিশ চলছে শেভার্নের, ছেলেটার বয়সে নিজে কেমন ছিল। প্রায় ভুলতে বসেছে-কয়েকটা যুদ্ধ ওর তারুণ্যের অস্থিরতাকে প্রশমন করেছে। কেন আমার সঙ্গে যেতে চাইছ?
বুশ হ্যারল্ড আর রোয়ান প্যান্টেলকে মেরেছ তুমি, আমার ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছ।
এই প্রথম লোকগুলোর নাম শুনল শেভার্ন। হাসি চাপতে কষ্ট হলো ওর। কোন একদিন নিশ্চই খাঁটি জিনিসে পরিণত হবে এই ছেলে-ততদিন যদি বেঁচে থাকে। প্রায়ই ওর জোড়া কোল্টের দিকে চলে যাচ্ছে ছেলেটার চকিত চাহনি। মনে হচ্ছে পরিবার বলতে কেউ নেই, তোমার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ও। নাকি তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে ওরা, কখনও তোমার চরিত্রের সৎ দিকটা উপলব্ধি করতে পারেনি?
বিস্ফারিত হলো ছেলেটার চোখ। ঠিক!
স্রেফ অভিমান করে এক আগন্তুকের সঙ্গে অজানার পথে পা বাড়াবে? নীরস একঘেয়ে জীবন ছেড়ে চলে যেতে চাইছ, কিন্তু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মুছে শেষে বিপজ্জনক এক পেশায় নাম লেখাবে?
হাঁ হয়ে গেছে ছেলেটার মুখ, মুখে কথা সরছে না।
রাস্তা ধরে ল-অফিসের দিকে তাকাল শেভার্ন, পুরো শহরের ওপর তীক্ষ্ণ নজর চালাল ফের। মনে পড়ল শহরের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন বিপদ হয়নি ওর, শুধু অভব্য শেরিফ সামান্য অপমান করার চেষ্টা করেছে ওকে। নিজস্ব ঘোড়া আর অস্ত্র আছে তোমার?
নড করল তরুণ।
স্যাডল এবং আর সব জিনিসপত্র?
এবার আর ততটা আত্মবিশ্বাসের সাথে নড় করল না ছেলেটা। তার মানে-শেভার্নের ধারণা-জিনিসগুলো কোত্থেকে চুরি করবে জানা আছে তার। পকেট থেকে ফের কয়েন দুটো বের করে তরুণের উদ্দেশে ছুড়ে দিল ও। একটা খাম আর এক তা কাগজ নিয়ে এসো।
মুহূর্তের মধ্যে কাজ সেরে মার্কেন্টাইল স্টোর থেকে ফিরে এল তরুণ। কাগজে লিখতে গিয়েও মত বদলে ফেলল শেভার্ন, কোটের পকেট থেকে একতাড়া তাস বের করে একটার ভেতরের পিঠে নোট লিখল, তাসটা খামে ভরে মুখ বন্ধ করে দিল। শেরিফ জেসনকে দিয়ে এসো এটা, ছেলেটার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলল ও। ফিরে এসে যোগ দিয়ে আমার সঙ্গে।
প্রথমে আনন্দিত হলেও, শেষে দ্বিধা দেখা গেল তরুণের চাহনিতে। আমি কি এখনই আসতে পারি না?।
আগে নোটটা দিয়ে এসো, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ও। একটা ঘোড়ায় রাইড করবে তুমি। অনায়াসে আমাকে ধরে ফেলতে পারবে।
বিষণ্ণ মুখে নড করল ছেলেটা, তারপর ল-অফিসের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল। স্পর দাবিয়ে এগোল শেভার্ন, ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেল শহর ছেড়ে। সকাল নটা বাজে তখন।
কেউ পিছু নিচ্ছে কি-না জানা নেই ওর, তবে সূর্য আছে ওর পেছনে। আগামী চার ঘণ্টায় যাত্রাপথে কোথাও ছায়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অন্তত আশা করছে না শেভার্ন। লিভারি স্টেবলের সামনে থেমে ক্যান্টিন ভরার ফাঁকে ঘোড়াগুলোকে পর্যাপ্ত পানি পান করার সুযোগ দিল। দূরে ল-অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ছেলেটা, শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল ও। চার ঘণ্টা পর সূর্যের অবস্থান বদলে যাবে, অন্তত সরাসরি ওর পিঠে অত্যাচার করতে পারবে না আর। বিকেল নাগাদ টানা এগোনোর ইচ্ছে আছে ওর।
নিকুচি করি কাঠখোট্টা শেরিফের! কি করে এতটা উদ্ধত হয় সে? অবশ্য ল ম্যান যে পুরোপুরি ভুল করেছে তা বলা যাবে না। আইন পড়া জিম শেভার্ন কি ধরনের মানুষ, বা ওর ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছে জানছে কে!
একটা শিশু নিখাদ সারল্য আর নিষ্পাপ মুখচ্ছবি নিয়ে জন্মায়, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সে মুখটা বদলে যায়–যা হওয়া উচিত, তাই হয়-কর্মফলের বহিঃপ্রকাশ।
তেত্রিশ চলছে আমার, নিজের বিবেকের সাথে তর্ক করল শেভার্ন।
যথেষ্ট কাছাকাছি, বলল ওর সত্তা।
কিন্তু আমি কোন টিনহর্ন নই।
উঁহু, বরং তারচেয়ে খারাপ।
কারণটা যুদ্ধ। একজন দেশপ্রেমিক ছিলাম আমি।
পাজি লোকের মল মাত্র, ড. জনসনের উক্তির প্রতিধ্বনি করল ওর বিবেক।
এখনও হইনি, স্বস্তির ব্যাপার অতীত জীবনের কিছু মানবীয় গুণাবলীর ছাপ রয়ে গেছে ওর মুখে। এবার সামলে নেওয়ার সময়, থিতু হওয়ার পালা। মানব গোষ্ঠীর সাথে শামিল হওয়ার উপযুক্ত সময়, পরিণতি ভাল বা মন্দ যাই হোক। হয়তো একটা সুযোগ পাবে ও।
ফেরার পথে অনেক কম বোঝা বইতে হচ্ছে মাসট্যাঙটাকে, ওর গ্রে-টা এরচেয়ে বেশি ওজন নিয়ে চলেছে। কিন্তু বেটা যেন মরুভূমির প্রখর তাপ উপভোগ করছে খুব। আর প্যাকহর্সটা ঠিক উল্টো মেজাজের, সকালে দুটো লাশ বয়ে নিয়ে গেছে ওটা, কিন্তু একবারের জন্যেও লীড রোপে টান পড়তে দিচ্ছে না। ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল শেভার্ন। ট্রেইল আর শহর দুটোই চোখে পড়ছে। তরুণের চিহ্নও নেই।
একটা লড়াই কি যথেষ্ট নয়?
যথেষ্ট, যদি আমরা জিততে পারি, জবাবে বলল শেভার্ন।
এখানেও কি দেশপ্রেমিক ছিলে তুমি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। ইদানীং প্রায়ই তর্কে হেরে যাচ্ছে। আজকে অন্তত ভাল একটা কাজ করেছি, সাফাই গাইল ও।
পেছনে, সোডা স্প্রিং-এ ওর ভাল কাজের নমুনা তখন ফলতে শুরু করেছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে তরুণ, বুঝতে পারছে না জিম শেভার্নের পিছু নেবে নাকি শেরিফের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বোনকে খুলে বলবে সব। লোকটার পিছু নিলে ঘোড়া চুরি করতে হবে, আবার শেরিফের প্রস্তাব মানলে নিজের ইচ্ছেকে গলা টিপে হত্যা করতে হবে।
ক্রমে খেপে উঠছে সে। সবকিছু বড় অস্বাভাবিক, অন্যায্য মনে হচ্ছে। ওর সম্পর্কে নোটে কি লিখেছে মি. শেভার্ন? নিশ্চই ডাহা মিথ্যে হবে। শেরিফকে এমন
খেপে উঠতে আর দেখেনি ও, রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ।
তরুণের উদ্দেশে বাঁকা দৃষ্টি হেনে ফের নোটের ওপর চোখ বুলাল শেরিফ জেসন বেলহ্যাম, দ্বিতীয়বারের মত পড়ল নোটটা:
শেরিক দয়া করে তোমার ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন শহরের এই নাগরিককে দেখে-শুনে রেখো, যতক্ষণ না আমার দুষ্ট এবং সংক্রামক সঙ্গ নিরাপদ দুরতে চলে যেতে পারে। আশা করি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে পারবে।
—জিম শেভার্ন
০৩-৪. শহুরে শব্দ আর বাড়ির ছায়া
শহুরে শব্দ আর বাড়ির ছায়াগুলো হারিয়ে গেল, ক্রমশ ছোট হয়ে এল দালানের আকৃতি, একসময় দৃষ্টির আড়াল হলো সোডা স্প্রিং-এর সবচেয়ে উঁচু দালান, গির্জাটাও। রুক্ষ ট্রেইল ধরে টানা এগোল জিম শেভার্ন, তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে সূর্য। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ঘোড়া দুটো, একসময় মৃত গ্রে টাকে খুঁজে পেল ও-ততক্ষণে ওটার শরীরে কামড় বসিয়েছে কয়োটের দল।
স্যাডল ছেড়ে নামল শেভার্ন। ঘোড়া বেঁধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসপত্র থেকে যে কটা ব্যবহার করা সম্ভব তুলে নিল। প্রায়ই মরা গ্রে-র দিকে চলে যাচ্ছে দৃষ্টি, বিষণ্ণ বোধ করছে। শেরিফ জেসন বেলহ্যামের মতে একেবারেই পাষাণ ও, কিন্তু ততটা বোধহয় হতে পারেনি এখনও। দুটো মাসট্যাঙ আর দুটো মৃতদেহ অসাধারণ একটা গ্রে-র বিপরীতে কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য লেন দেন হতে পারে না, যেখানে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে গ্রে-টা।
অকস্মাৎ দূরে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। ইন্ডিয়ানরা কি খেপে গেছে নাকি? সোডা স্প্রিং-এ কারও কাছ থেকে জেনে নিলে হত। শেষবারের মত জায়গাটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল ও। ইতোমধ্যে প্রায় শখানেক গজ উঁচু ট্রেইলে উঠে এসেছে ঘোড়া দুটো, কিন্তু সূর্য আর উত্তাপও উচ্চতার সাথে সঙ্গী হয়েছে।
গোল্লায় যাক সোডা স্প্রিং! কি কুক্ষণে যে শহরে ঢু মারতে ইচ্ছে হয়েছিল, এড়িয়ে গেলে এতক্ষণে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে যেত-ঝামেলা বা অযথা কিছু মূল্যবান সময় আর সম্পদ নষ্ট হত না।
দুই জুয়াড়ীও সুখী থাকত, এবং ও নিজে গ্রে-র স্যাডলে রাইড করত। মাসট্যাঙটা যথেষ্ট বাধ্য, কিন্তু আকারে ছোট হওয়ায় নিশ্চিন্তে স্যাডলে বসতে পারছে না শেভার্ন, প্রায়ই মনে হচ্ছে পায়ের ফাঁক গলে হয়তো সরে পড়বে ওটা।
দুরে আবারও পরপর দুটো গুলির শব্দ শোনা গেল, প্রতিধ্বনি হলো না একটারও। স্ট্যিাপের ওপর ভর দিয়ে সামনের এলাকা খুঁটিয়ে দেখল শেভার্ন, কিন্তু মাইলের পর মাইল বিরান প্রান্তর ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না। দূরে পর্বতমালার চূড়ায় তুষার জমা হয়েছে, শুভ্র বরফের মাঝখানে নীল শিরার মত উঁকি দিচ্ছে সবুজ গাছপালা। ট্রেইলের আশপাশে সবুজের কোন চিহ্ন নেই, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে কোন রকমে টিকে থাকা ফ্যাকাসে চেহারার জুনিপার ঝোপই চোখে পড়ছে শুধু। কোথাও কোন ছায়া নেই, জীবনের চিহ্ন নেই…
ঘণ্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেল, একসময় ওর সামনে চলে এল নিদাঘ সূর্য। সরাসরি চোখে পড়ছে আলো। হ্যাটের ব্রিম আরও নামিয়ে দিল শেভার্ন; শীতল ছায়াঘেরা কিছু জায়গার কথা মনে পড়ছে প্রায়ই, ঝামেলা এড়ানোর জন্যে থামেনি কোনটায়। মনে করতে থাকলে তো বেড়ে যাবে, সামান্য দুর্ভোগকেই দুর্বিষহ মনে হতে পারে ভেবে আমল দিল না। কিন্তু কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন বোধ করছে, হয়তো প্রচণ্ড উত্তাপই দায়ী সেজন্যে। জোর করে নিজেকে সচকিত করল শেভার্ন, তারপর আচমকাই উপলব্ধি করল: একা নয় ও!
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারবে না, কিন্তু নিশ্চিত জানে মাসট্যাঙ দুটো, জুনিপার ঝোপের কাছাকাছি আশ্রয় নেওয়া কাঁটাঅলা ব্যাঙের দল আর ও ছাড়াও অন্য কেউ এই খরতাপে দগ্ধ হচ্ছে। সন্দেহ চেপে রাখল শেভার্ন। কোন ইন্ডিয়ান যদি ওকে বুশওয়্যাক করতে চায়, ধরে নিতে হবে এরইমধ্যে সফল হয়ে গেছে সে। কোল্টের নাগাল থেকে হাত দুটো সরিয়ে রাখল ও, সতর্ক দৃষ্টিতে সামনের জমিতে নজর চালাচ্ছে। মাসট্যাঙের দুই কানের নড়াচড়া ওকে জানিয়ে দিল লোকটা বা জিনিসটা যাই হোক, সামনে কোথাও আছে।
দুই হাঁটু ঘোড়ার পেটের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল শেভার্ন, হাতের লাগাম যে কোন সময়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি। মাথা নেড়ে সামনে বাড়ল প্যাকহসটা। ঘোড়াকে আগে বাড়ানোর তান করল ও, লাগাম নেড়ে তাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর দাবাল। এই ফাঁকে পিস্তলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওর হাত। ঠিক তখনই মরা ঘোড়াটা দেখতে পেল।
বিশাল একটা রোয়ান পড়ে আছে ট্রেইলের পাশে। বেশিক্ষণ হয়নি মারা গেছে, সরু ধারায় ক্ষত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে এখনও। ঘোড়াটার বিশ কদমের মধ্যে। পৌঁছে গেল ও, আচমকা একটা রাইফেল দেখা গেল ঘোড়ার পিঠের ওপর। ওখানেই দাঁড়াও, মিস্টার! কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল।
লাগাম টেনে ধরল শেভার্ন। রাইফেলের নল স্থির হয়ে আছে ওর বুক বরাবর, বিন্দুমাত্র নডছে না। পলকের জন্যে রাইফেলের পেছনে ধূসর রঙের কিছু চুল দেখতে পেল। আজকে এরইমধ্যে দুজনের সঙ্গে লড়াই করেছি, একদিনের জন্যে যথেষ্ট এবং সাধ মিটে গেছে আমার, কয়েক সেকেন্ড পর নীরবতা ভাঙল শেভার্ন। স্যাডল ছাড়তে পারি?
ধীর-স্থির লোক বেশি দিন বাঁচে, এবং সুখে থাকে।
প্রবাদটার প্রয়োগ খুব সীমিত। আমি যদি যথেষ্ট ক্ষিপ্র না হতাম… কথাটা শেষ করল না ও, হাত থেকে লাগাম ছেড়ে দিল।
ধূসর চুলের একটা মাথা দেখা গেল রাইফেলের পেছনে, ইতোমধ্যে কণ্ঠ শুনে শেভার্নের ধারণা হয়েছে লোকটা বয়স্ক। দুঃখিত, স্ট্রেঞ্জার, এটা এমন এক দেশ যেখানে লোকজন প্রায়ই ভুলে যায় কিভাবে অন্যের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হয়, ব্যাখ্যা দিল সে।
আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গি, কিন্তু এই অঞ্চলের টান নেই। কয়েক মুহূর্ত ভাবার পর শেভার্ন ধারণা করল মরা ঘোড়ার পেছনে শুয়ে থাকা লোকটি জীবনের অন্তত কিছু সময় স্কটল্যান্ডে কাটিয়েছে। আচমকা টের পেল মাসট্যাঙ দুটো থেমে যাওয়ার পরই বরং গরম লাগছে বেশি, এতক্ষণ চলার পথে সূর্যের উত্তাপ এতটা অসহ্য মনে হয়নি।
মরা ঘোড়ার পেছনে উঠে দাঁড়াল লোকটি। বয়সটা নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে না, পঞ্চাশ থেকে সত্তর, যে কোন বয়সের হতে পারে। রোদপোড়া তামাটে তুক, ধূসর কাঁচাপাকা চুল। কোন হ্যাট নেই মাথায়, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এক কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
কাছের বসতিটা কত দূর? জানতে চাইল শেভার্ন।
ত্রিশ মাইল দূরে, এবং ওখানে কোন ডাক্তার নেই।
এখান থেকে সোডা স্প্রিংও একই দূরত্বে, শেভার্নের ধারণা।
তাছাড়া, ক্লান্ত, দুর্বল স্বরে একমত হলো বুড়ো। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার দিকে যাবে তুমি, বুলেট বের করতে পারবে এমন অন্তত একজন লোক আছে সোডা স্প্রিং–এ।
খোদা, আবার! নিজেকে সামলে নিল ও। রাইড করতে পারবে?
চেষ্টা করার আগে বলতে পারছি না।
আকাশের দিকে তাকাল শেভার্ন। সূর্য ডুবতে অন্তত আরও কয়েক ঘন্টা বাকি। সবগুলো ঘোড়াকে একত্রিত করে বাঁধল ও, তারপর ক্যান্টিন বের করে বুড়োর দিকে এগিয়ে দিল। ছোট্ট একটা চুমুক দিল সে প্রথমে, কাশি উঠতে নিরস্ত হলো ক্ষণিকের জন্যে। মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা, কাঁধ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে পুরোদমে।
একটু পর কিছুটা সামলে নিল বুড়ো। গেলার চেষ্টা না করে আগে বরং কিছুটা চুষে দেখা উচিত, মন্তব্য করল সে। খুব বেশি তেষ্টা পেলে অবশ্য ভিন্ন। কথা, সোডা স্প্রিং-এর কটু স্বাদের পানিও তোমার কাছে সুপেয় মনে হবে।
আমার সন্দেহ আছে কোন চোলাইখানা আছে ওখানে, নিরাসক্ত স্বরে বলল শেভার্ন, জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। ভাবছে তেরপলের কাছাকাছি কিছু বোল্ডার এনে রাখতে হবে যাতে কয়োটেরা দূরে থাকতে বাধ্য হয়।
আরেক চুমুক পানি পান করল বুড়ো, এবার অবশ্য কোন অসুবিধে হলো না।
ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ করেছে তোমাকে?
অদ্ভুত, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল বুড়ো। আমি নীল ম্যাকলেন্ডন, শেষে বলল
মৃদু নড করল ও, কিছুই বলল না।
তুমি কি নতুন এসেছ এদিকে?
এই প্রথম।
লোকজন জানে বরাবরই ইন্ডিয়ানদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল আমার, ব্যাখ্যা করল ম্যাকলেন্ডন।
দুই জুয়াড়ী? আনমনে ভাবল শেভার্ন-অসম্ভব। বুড়ো গুলি খাওয়ার বহু আগেই মারা গেছে ওরা। তাছাড়া উল্টো দিক থেকে এসেছিল লোকগুলো। এ অঞ্চলে হয়তো লোকজন বেশি নেই, শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তবে খারাপ লোকের সংখ্যা কম নয়।
আচমকা চুলের মতই ফ্যাকাসে হয়ে গেল বুড়োর মুখ। শেভার্নের ধারণা হলো পুরো এক চুমুক পানি দেয়া ঠিক হয়নি তাকে। কারণটা অবশ্য ভিন্ন। হ্যাট ছাড়া প্রখর সূর্যের নিচে কয়েক ঘণ্টা থাকতে হয়েছে তাকে, স্রেফ মনের জোরের ওপর টিকে ছিল। এখন সাহায্য পাবে জেনে জীর্ণ শরীর শিথিল হয়ে গেছে।
একটা কম্বলের ভাঁজ খুলে দুটো জুনিপারের সাথে টানটান করে বাঁধল ও। কিছুটা ছায়া পাওয়া যাবে এতে। ম্যাকলেন্ডনের ফ্যাকাসে মুখে রঙ ফিরে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। ব্যান্ডানা ভিজিয়ে বুড়োর মুখ মুছে দিল শেভার্ন। শার্ট খুলে ক্ষতটা জরিপ করল। রক্তক্ষরণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেঁচে যাবে তুমি, শেষে বলল ও। বুলেটটা বের করতে হবে। এ মুহূর্তে তাপই বরং তোমার আসল শত্রু। মনে হয় না ত্রিশ মাইল রাইড করতে পারবে, যদিও ঢালু পথ বেয়ে নামতে হবে।
ঠিকই বলেছ।
কাজটা কে করেছে, চেনো?
চিনি, স্মিত হেসে বলল বুড়ো। আর কোন ব্যাখ্যা দিল না।
মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো একটা অভিশাপই তাড়া করছে আমাকে। এখানে বসে থেকে তোমাকে মরতে দেখা উচিত, নাকি সাহায্যের জন্যে যাওয়া উচিত আমার?
মরতে যাচ্ছি না আমি! তিক্ত স্বরে বলল বুড়ো। শহরে গিয়ে শুধু বোলো ম্যাকলেন্ডন বিপদে পড়েছে।
নড করল শেভার্ন। কিন্তু তোমার বন্ধুরা? ওরা তো ফিরে আসতে পারে, তাই না?
মনে হয় না। হারামজাদারা ভেবেছে মরে গেছি আমি।
বুড়োর নাগালের মধ্যে একটা পানির ক্যান্টিন আর কিছু খাবার রাখল শেভার্ন। মুহূর্তের দ্বিধা শেষে গ্রীন রীভারের বোতলটাও পাশে রেখে দিল। ধীরে সুস্থে খেয়ো, বুলেটের চেয়েও বেশি মানুষ মরেছে এটার কারণে।
আসল হুইস্কি নেই তোমার কাছে? আচমকা স্কটিশ উচ্চারণে জানতে চাইল নীল ম্যাকলেন্ডন।
সহাস্যে মাথা নাড়ল ও। বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি।
একটা নাম তো আছে তোমার, নাকি?
জিম শেভার্ন। আর কিছু লাগবে তোমার?
বুড়োর জন্যে বাড়তি কিছু করার নেই আর। রাইফেলটা লোড করা আছে। নিজের জন্যে যা করতে পারত, নীল ম্যাকলেন্ডনের জন্যেও তাই করেছে-যতটা সম্ভব আরামের ব্যবস্থা করেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার চেষ্টা করব, প্রতিশ্রুতি দিল ও, ভাবছে ঘোড়াগুলো কত দ্রুত ছুটতে পারবে। ইতোমধ্যে প্রায় বিশ মাইলের মত পাড়ি দিয়েছে।
ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন, পেছন থেকে আবারও বলল বুড়ো, স্মিত হাসি দেখা গেল ফ্যাকাসে ঠোঁটের কোণে, নীল চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আচমকা; স্যাডলে চাপছে তখন শেভার্ন, যে কারণে বুড়োর হাসি বা উজ্জ্বল চাহনি কোনটাই দেখতে পেল না।
যাত্রা শুরু করার পর শেভার্ন খেয়াল করল খুঁড়িয়ে চলছে প্যাকহর্সটা। খোঁড়া ঘোড়া মরুভূমিতে খুব সহজেই মরে। অতিরিক্ত মাসট্যাঙটাকে লীড হর্স হিসেবে ব্যবহার করল ও, তারপর চলার পথে প্রায়ই ঘোড়া বদল করতে থাকল।
সোডা স্প্রিং-এ যখন আবারও পৌঁছল, রাত নেমেছে তখন। রাস্তায় আলো নেই, নেই চাঁদের আলোও। ল-অফিসে বোধহয় কাউকে পাওয়া যাবে না এখন, ভাবল ও। পুরা শহরে কেবল একটা বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে-গোল্ডেন ঈগলে, যেখান থেকে সমস্ত ঝামেলার শুরু হয়েছিল।
সেলুনের সামনে এসে থামল শেভার্ন। স্যাডল ছাড়ার সময় টের পেল সত্যিই ক্লান্ত বোধ করছে। হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকল ও। ছয়-সাতজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বারের আশপাশে। একটা টেবিল দখল করে আছে চারজন। সেলুনের একটা মেয়ে ওকে দেখতে পেল প্রথম। তারপরই আচমকা নীরব হয়ে গেল পুরো সেলুন। অদ্ভুত হ্যাট পরা লাইমি ফিরে এসেছে আবার! বিড়বিড় করে বলল কেউ।
শেরিফকে কোথায় পাব বলতে পারো কেউ?
শেভার্নের প্রশ্নে উৎকণ্ঠা বা অস্বস্তি যেন আরও জাঁকিয়ে বসল সেলুনে। সোডা স্প্রিং-এ ইতোমধ্যে কুখ্যাত হয়ে গেছে ও, উপযুক্ত কারণও আছে। প্রথমবার এসেই জুয়ার টেবিলে খুন করেছে একজনকে, তারপর চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই দুটো লাশ নিয়ে ফিরে এসেছে। স্বেচ্ছায় কে কথা বলতে চাইবে এমন মূর্তিমান আপদের সঙ্গে?
ওকে সাহায্য করার ব্ল্যাপারে কাউকেই উৎসাহী মনে হলো না, বরং প্যাকহর্সের পিঠে এবার কি নিয়ে এসেছে, সেটা দেখতেই বেশি আগ্রহী। অপেক্ষায় থেকে একসময় অধৈর্য হয়ে পড়ল শেভার্ন, কিন্তু সযত্নে বিরক্তি চেপে রাখল।
তিন দরজা যেতে হবে আরও, পরের বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ো-তাহলেই জায়গামত পৌঁছে যাবে-নরকে! প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে বলল বিশালদেহী বারটেন্ডার, শেষ পর্যন্ত অন্তত একজন সাহস সঞ্চয় করেছে।
শেরিফকে ডেকে আনছি আমি, বলে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।
অপেক্ষার ফাঁকে একটা বীয়ার নিল শেভার্ন। স্পষ্ট টের পাচ্ছে অন্যদের কৌতূহলী দৃষ্টি ফুড়ে যাচ্ছে ওকে, কিন্তু কেউই প্রশ্ন করছে না। নিজেও মুখ খুলল না ও। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেলুনে চুকল শেরিফ জেসন বেলহ্যাম; উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে ঘুমের রেশ লেগে আছে এখনও। একবার সতর্ক করেছি তোমাকে… সরোষে বলতে শুরু করল সে, চোখে তীব্র অসন্তোষ।
ম্যাকলেন্ডনের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছি আমি।
পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এল সেলুনে, স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখছে শেরিফ। শেষে বোধহয় বুঝতে পারল ঝগড়া করার তালে নেই শেভার্ন, হাল ছেড়ে দিল সে। বলে যাও, বিড়বিড় করল লম্যান।
একজন ডাক্তার আর একটা ওয়্যাগন নিয়ে যদি সময়মত পৌঁছতে পারো তাহলে হয়তো বেঁচে যাবে সে। আরেকটা দিন রোদের মধ্যে টিকতে পারবে না বুড়ো। এই ফাঁকে কেউ কি আমাকে একটা তাজা ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দেবে? যেটায় এসেছি মনে হয় না অতদূর পর্যন্ত যেতে পারব।
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থাকল শেরিফ, শেষে কোমল হয়ে এল চাহনি। আবার যাওয়ার দরকার নেই তোমার, এরইমধ্যে বোধহয় একশো মাইলের মত ঘোড়া ছুটিয়েছ।
কিন্তু এ শহরের ব্যাপারে কিছুটা অস্বস্তি আছে আমার, এবং নিশ্চিন্ত না হয়ে কোথাও রাতও কাটাই না। তাছাড়া ম্যাকলেন্ডন লোকটা যেই হোক, ওর কাছেই আমার মালপত্র রেখে এসেছি।
এবারও ব্যাখ্যা দিল না কেউ।
ডাক্তার আর লিভারি স্টেবলের হসলারকে জাগাতে দুজনকে পাঠাল শেরিফ। এই ফাঁকে বীয়ারে শেষ চুমুক দিল শেভার্ন, ভাবছে সামান্য বীয়ারই সহ্য করতে পারে কি-না এখন, শরীরে যা ক্লান্তি। শেষবার ঘুমানোর পর কত পথ যে পাড়ি দিয়েছে মনে করতে পারল না। কয়েকটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে শরীর সোজা করে দাঁড়াল ও, কঠিন হয়ে গেছে পেশীগুলো। সেলুনের লোকগুলোকে নিজের ক্লান্তি সম্পর্কে জানতে দিতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত সবকিছুরই ব্যবস্থা হলো। শেভার্নের জন্যে তাজা ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে, মাসট্যাঙের চেয়ে বড়জোর এক হাত লম্বা হবে, একটা বাকবোর্ডের পেছনে বেঁধে রাখা হয়েছে ওটাকে। তেরপল দিয়ে বাকবোর্ডটা এমন ভাবে ঢাকা যে প্ৰেয়ারির স্কুনারের মত দেখাচ্ছে। কষ্টেসৃষ্টে স্যাডলে চাপল শেভার্ন, তারপর শেরিফের পাশাপাশি এগোল। আগেই বাকবোর্ডে উঠে বসেছে স্বল্পভাষী ডাক্তার।
স্যাডল থেকে দুবার খসে পড়ার অবস্থা হলো ওর। একসময় ক্লান্তি আর ঘুমের সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাকবোর্ডে চড়ে বসল, শক্ত পাটাতনে শুয়ে পড়ল, বন্ধুর ট্রেইলে বাকবোর্ডের লাগাতার লাফ-ঝাপ বা ধীর গতি কোনটাই বিরক্ত করতে পারল না ওকে। চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এল। টানা ঘুমিয়ে জাগল। পরদিন ভোরে।
ঘুম থেকে উঠে চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল শেভার্ন, বুঝতে চাইছে কত দূরে এল। ঘণ্টাখানেক পর ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ততক্ষণে মারা গেছে নীল ম্যাকলেন্ডন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। মরা এক আগন্তুকের জন্যে এত খাটুনি! ভাবতেই অবাক লাগছে, নিজের ওপর কিছুটা বিরক্তিও জাগছে। ষাট মাইল বন্ধুর ট্রেইল পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া দুর্ভোগ কোন কাজে আসেনি বুড়োর, লাভের মধ্যে আরেকটা দিন খুইয়েছে ও। হয়তো এখানে থাকাই উচিত ছিল, ম্যাকলেন্ডনের মৃত্যুর সময় কিছুটা হলেও সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারত।
কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে মরার মত খারাপ ছিল না ম্যাকলেন্ডনের অবস্থা, অন্তত শেভার্নের তাই মনে হয়েছে। নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করল ও, এদিকে মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছে ডাক্তার।
ও গুলি খেয়েছে আমাদের বলোনি কেন? জানতে চাইল শেরিফ।
নিখাদ বিস্ময় নিয়ে মাঝবয়সী লোকটিকে দেখল শেভার্ন। তাতে কিছু যেত আসত? এ এলাকায় একেবারেই নতুন আমি, সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি এ অঞ্চলে সামান্য কারণেও মারা যেতে পারে মানুষ।
রাগে লাল হয়ে গেল শেরিফের মুখ, কিন্তু উত্তর দিল না।
দ্বিতীয় শটে মারা গেছে ম্যাকলেন্ডন, দীর্ঘ নীরবতা ভাঙল ডাক্তার।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল শেভার্ন। অসম্ভব!
তুমি কি ডাক্তার? প্রশ্ন করল চিকিৎসক।
আরে না! ওকে যখন রেখে গেছি, শুধু কাঁধে একটা ক্ষত ছিল। ওর বাঁচার সম্ভাবনা যদি নাই থাকত তাহলে এত পথ পাড়ি দিলাম কেন যেখানে ওই শহরে ফিরে যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই আমার?
ঠিক আছে! অধৈর্য স্বরে বলল সোডা স্প্রিং-এর ল-ম্যান। মানছি, নিজের দিকটা পরিষ্কার করেছ তুমি!
ওর রাইফেলটা এখনও লোড করা?
অস্ত্রটা পরীক্ষা, করল শেরিফ। ৫০ ক্যালিবারের স্প্রিংফিল্ড, চেম্বারে এক রাউন্ড তাজা বুলেট রয়ে গেছে তখনও।
সিঙ্গেল শট, তাই না?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল জেসন বেলহ্যাম, শেষে নড করল।
বাকবোর্ডে ম্যাকলেন্ডনের মৃতদেহ তুলল শেরিফ আর ডাক্তার, এই ফাঁকে নিজের জিনিসপত্র গোছাতে ফিরে গেল শেভার্ন। আচমকা টের পেল সন্দেহের দৃষ্টিতে ওকে দেখছে অন্য দুজন।
ম্যাকলেন্ডন কে, জানো তুমি?
মি. বেলহ্যাম, ক্লান্ত সুরে বলল শেভার্ন। আমি এমনকি এখনও জানি না তুমিই বা কে। এখানে নিজের সম্পর্কে মুখ খোলে না কেউ, দুদিনের অভিজ্ঞতায় একটা কথা নিশ্চিত জেনেছি-একমাত্র সেন্ট পলের দৃষ্টিভঙ্গিই সঠিক!
প্যাচাল বন্ধ করো তো! তুমি কি জানো কে গুলি করেছে ওকে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছে চেনে।
তো?
তো কি?
বলেনি তোমাকে?
তথ্যটা আমাকে দেয়ার মত যোগ্য লোক মনে করেনি মি. ম্যাকলেন্ডন, আচমকা অদ্ভুত একটা ব্যাপার মনে পড়ল শেভার্নের, ঘুরে মরা ঘোড়াটার দিকে তাকাল। সত্যিই মজার বিষয়! স্বগতোক্তি করল ও।
মজার বিষয়?
গ্রীন রীভারের একটা বোতল রেখে গিয়েছিলাম। ওটা দেখছি উধাও হয়ে গেছে!
কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নেমে এল। ইন্ডিয়ান? শেষে মন্তব্য করল ডাক্তার।
মি. ম্যাকলেন্ডন নিশ্চিত ছিল ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ করেনি ওকে।
দ্বিতীয় শটের কথা বলছি আমি। কাঁধের ক্ষতের জন্যে নয়, বরং নতুন একটা শটের জন্যে মারা গেছে নীল ম্যাকলেন্ডন। খুব কাছ থেকে ওকে গুলি করেছে কেউ।
সেটা যদি জানোই, তাহলে আমাকে সন্দেহ করছ কেন?
দলা পাকানো একটা কাগজ বের করল শেরিফ, সতর্কতার সাথে ভাজ খুলে মেলে ধরল ওর সামনে। পড়ল শেভার্ন:
দশ হাজার পশু, ঠিকমত দেখেন রাখতে পারলে সত্যিই লাভজনক সম্পত্তি হতে পারে। এক-তৃতীয়াংশ হবে তোমারও, শেভার্ন।
পড়তে পারছ? অধৈর্য কণ্ঠে জানতে চাইল শেরিফ।
নিশ্চয়ই।
হস্তাক্ষরের ব্যাপারে কি বলবে?
বুড়ো কোন মানুষের লেখা-হিজিবিজি, তবে পড়া যাচ্ছে। কি জানতে চাইছ তুমি?
সত্যিই কি বুড়ো লিখেছে এটা?
স্থির দৃষ্টিতে শেরিফের দিকে তাকাল শেভার্ন। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আসলে কি জানতে চাও তুমি?
আমাকে যে নোট পাঠিয়েছ হস্তাক্ষরটা কিন্তু সেটার মতই মনে হচ্ছে।
তোমাকে পাঠিয়েছি…? তারপরই গতদিনের ব্যাপারটা মনে পড়ল শেভার্নের। ওই ছেলেটার কথা বলছ তো? কিন্তু তাতে কি?
কিছুই না। দেখা যাচ্ছে একই হাতের লেখা।
শ্রাগ করল শেভার্ন। মি. ম্যাকলেন্ডন একজন স্কটিশ। আমরা বোধহয় একই। ধরনের শিক্ষকের কাছ থেকে পড়তে বা লিখতে শিখেছি।
তারপরও একই রকম মনে হচ্ছে।
ফালতু ব্যাপার! তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল ও। স্কটিশরা বরাবরই কপারপ্লেট হরফ পছন্দ করে, হয়তো কিছুটা ধীর-স্থির আর স্পষ্ট লেখা হয় বলেই। তোমরা আমেরিকানরা যা অস্থির, স্বভাবের মতই টেনে-টুনে পেঁচিয়ে লিখতে পছন্দ করো। স্পেন্সার হরফে হয়তো দ্রুত লেখা সম্ভব, কিন্তু কপারপ্লেট হরফের লেখা পড়া ততোধিক সহজ। যাকগে, মি. ম্যাকলেন্ডনের নোটের সাথে আমার সম্পর্ক কি? এতে কি স্পষ্ট হয় খুনটা আমিই করেছি?
উঁহু, নোটের লেখা কোন ভাবেই তোমাকে অভিযুক্ত করে না। ভাবতেই অবাক লাগছে নিজের সম্পত্তি এক আগন্তুককে দিয়ে গেছে মি. ম্যাকলেন্ডন, অথচ ওর পরিবার আছে!
আজব এক দেশ এটা এবং তারচেয়েও আজব চিড়িয়ায় ভরা! ঘুরে নিজের ঘোড়ার দিকে এগোল শেভার্ন, তারপর আচমকাই উপলব্ধি করল কাকে নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে বুড়ো ম্যাকলেন্ডন।
.
০৪.
ব্যাপারটা শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, রীতিমত খাপছাড়া, অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর। নীল ম্যাকলেন্ডনকে দেখে মনে হয়নি অসুস্থ ছিল, কিন্তু নিজের পরিবারকে বঞ্চিত করল কেন?
ঘুরে ডাক্তার আর শরিফের মুখোমুখি হলো শেভার্ন। তোমাদের কথা বুঝতে ভুল না হলে ধরে নিচ্ছি নিজের সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছে বুড়ো। এবার আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। যত দামই হোক, ম্যাকলেন্ডনের সম্পত্তি যদি সোডা স্প্রিং-এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যেও থাকে, সেটা গ্রহণ করছি না আমি! ফর্ক দিয়ে লোকজন পানি পান করে এমন যে কোন জায়গায় স্থির হতে পারি, কিন্তু এখানে থামছি না! এমনকি সোডা স্প্রিং-এর শেরিফ বদল হলেও মত পাল্টাবে না আমার।
বেশি দূরে যেতে হবে না, শুকনো স্বরে বলল শেরিফ, থমথমে মুখ দেখে বোঝা গেল অন্তত এবার নীরবে অপমান হজম করছে। দশ মাইল সামনে গেলেই নীল ম্যাকলেন্ডনের বাথান। শেভার্ন যেদিকে যাচ্ছিল সেদিক নির্দেশ করল সে। কিন্তু ওখানেও আমার কর্তৃত্ব রয়েছে। এবার প্যাচাল বাদ দিয়ে স্যাডলে চেপে শহরে ফিরে চলল।
দুঃখিত।
দুঃখিত?
সোডা স্প্রিং-এর কর্তৃপক্ষ আমাকে সতর্ক করেছে শহরে আমার আগমন ভাল চোখে দেখবে না কেউ।
নিকুচি করি তোমার! তুমি কি চাও বাগানে গিয়ে কেঁচো খুঁড়ে খাই আমি?
বিস্ময় নিয়ে দুজনের বাদানুবাদ দেখছে ডাক্তার।
কোন অপরাধের অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে?
না।
তাহলে নিজের পথে যেতে পারো তুমি, ঘোড়ার দিকে এগোল শেভার্ন, তারপর আচমকা লেখাটার কথা মনে পড়ল-কপারপ্লেট হরফের লেখাটা ওকে পড়তে দিয়েছিল শেরিফ।
কি ধরনের লোক হলে এমন সম্পত্তি হাতছাড়া করতে পারে!
নীরবতা নেমে এল। খুনীর সম্ভাব্য পরিচয় পেতে চারপাশে ট্র্যাক খোজা শুরু করল জেসন বেলহ্যাম, শেভার্ন নিজেও সাহায্য করল তাকে। কিন্তু তেমন কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না ওদের। ট্রেইল থেকে ক্যাম্পের দিকে সরে এসেছে বড়সড় একটা ঘোড়া, বিশ কদম দূর থেকে ম্যাকলেন্ডনকে গুলি করেছে অশ্বারোহী। তারপর গ্রীন রীভরের বোতলটা নিয়ে কেটে পড়েছে, অন্য কিছু স্পর্শ করেনি।
নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে একটা গোল্ড প্যান বের করল শেভার্ন, পানি ভরে এগিয়ে দিল ঘোড়ার উদ্দেশে। পানি শেষ করে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল ঘোড়াটা।
দেখে মনে হয় না কোন মাইনার তুমি, গোন্ড প্যানটার ওপর লেগে আছে শেরিফের দৃষ্টি।
তোমাকেও শেরিফ মনে হয় না আমার, বলতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিল
পরিবারটা বিপদে আছে।
একটা দলিল লিখে দিচ্ছি, ওই সম্পত্তি চাই না আমার।
ব্যাপারটা তা নয়, শুকনো, হতাশ সুরে বলল শেরিফ, খানিকটা হলেও বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। ম্যাকলেন্ডনদের ভাল-মন্দ দেখবে এমন লোককে কেবল কথায় নয়, কাজেও পারদর্শী হতে হবে।
ভাড়া খাঁটি না আমি।
না, আমারও তাই মনে হয়। যে ছেলেটাকে আমার কাছে পাঠিয়েছ তুমি, চেনো ওকে? ম্যাকলেন্ডনের ছেলে ও।
ঘুরে শেরিফের মুখোমুখি হলো শেভার্ন। আসলে আমার কাছে কি চাও
কৌতূহল হচ্ছে, জানতে চাইছি আসলে কি আছে তোমার মধ্যে। কেন নিজের পরিবারের চেয়ে তোমাকে শ্রেয় মনে করেছে ম্যাকলেন্ডন-সত্যিই যদি তাই করে থাকে! বেঁচে থাকতে বুড়োকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত লোকজন, কিন্তু একটা কথা বলত না কেউ।
নীরবে অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন।
কেউ বলেনি যে সে বোকা। …এবার কি দয়া করে সোডা স্প্রিং-এ গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করবে?
এত করে বলছ যখন! বিদ্রুপের স্বরে বলল শেভার্ন, স্যাডলে চেপে অপেক্ষায় থাকল। বাকবোর্ড ঘুরিয়ে এগোতে শুরু করল ডাক্তার।
আগে গেলে ধুলো কম লাগবে, বাতলে দিল শেরিফ।
এবং আমার পিঠ জরিপ করার লোকও বেশি থাকবে, মনে মনে বলল শেভার্ন। ক্ষীণ হেসে নড করল ও, কিন্তু বাকবোর্ডের পেছনেই থাকল।
আবারও যখন সোডা স্প্রিং-এ পৌঁছল ওরা, ডাক্তার আর শেরিফ তখন স্যাডলে বসেই ঢুলতে শুরু করেছে। গতরাতে কিছুটা হলেও বিশ্রাম পেয়েছে শেভার্ন, ক্লান্তি লাগছে না তেমন। সতর্ক দৃষ্টিতে শহরের একমাত্র রাস্তাটা জরিপ করল ও। ফাইন ফার্নিচার অ্যান্ড কিউনেরালস-এর সামনে থামল ওরা। তুমিই যেহেতু আসতে বাধ্য করেছ, নিস্পৃহ স্বরে বলল ও। এবার নিশ্চয়ই কোথায় থাকতে পারি সেই পরামর্শও দেবে?
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল শেরিফ, চিন্তাটা যেন মাথায় আসেনি তার। মিজ বোম্যানের ওখানে চলে যাও, স্বেচ্ছায় পরামর্শ দিল ডাক্তার।..
শহরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জায়গা, একমত হলো জেসন বেলহ্যাম, আঙুল তলে দেখিয়ে দিল।
নির্দেশ মত এগোল শেভার্ন।
মিসেস বোম্যান মোটাসোটা হাসিখুশি মহিলা, এক নজরেই পছন্দ হলো শেভার্নের। ভেতরে ঢোকার পরপরই ছোট একটা ছেলেকে ওর মালপত্র নিয়ে আসার ইঙ্গিত করল। ঘোড়া দুটোকে স্টেবলে নিয়ে গেল ছেলেটা। ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে তুলতে থাকল শেভার্ন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তরুণী এক মেয়েকে পেছনের আঙিনায় পানি গরম করার নির্দেশ দিল মহিলা।
পানি গরম করো তোমরা? আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে জানতে চাইল ও।
সোডা স্প্রিং-এর পানি খুব ঠাণ্ডা, ব্যাখ্যা দিল মিসেস বোম্যান, নিজেই দোতলার একটা কামরায় নিয়ে এল ওকে।
ধূলিমলিন জুতো খুলে মোটামুটি আরামদায়ক বিছানায় দীর্ঘদেহ বিছিয়ে দিল শেভার্ন। দারুণ ক্লান্তি লাগছে, দরজায় করাঘাতের শব্দে সচকিত হলো ও। তরুণী মেয়েটিকে অনুসরণ করে নিচে নেমে এল হলঘর হয়ে আরেক কামরায় ঢুকে রীতিমত বিস্মিত হলো। আশা করেছে গরম পানি পৌঁছে দেওয়া হবে কামরায়, কিন্তু টিনের তৈরি বাথটাব বসানো হয়েছে এখানে। সরু নালার ড্রেন পানি খালি করছে পেছনের বাগানে।
ওর কাপড়গুলো ধুতে নিয়ে গেল তরুণী। গা পরিষ্কার করতে প্রায় পুরো একটা সাবান খরচ করে ফেলল শেভার্ন, ফেনা হচ্ছে না তেমন। শেষে বিরক্ত হয়ে ইস্তফা দিল। শরীর থেকে ক্ষারের মিহি প্রলেপ ধুয়ে একটা কম্বল জড়াল গায়ে। হলঘরে ঢুকতেই থমকে দাড়াল, বাইরের দরজা খুলে গেছে।
যে মুখটা দেখতে পেল, মানতেই হলো বিষণ্ণ হলেও এমন অপূর্ব সুন্দর মুখ বহুদিন দেখেনি ও। শুধু কম্বলমোড়া একজন পুরুষকে সামনে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়ালে সরে গেল মেয়েটা। নিজের কামরায় ফিরে এসে কাপড় পরল শেভার্ন, বিছানায় শুয়ে একটা চুরুট ধরাল।
লাল-চুলো মেয়েদের নিয়ে পশ্চিমে বহু মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে, আদৌ এসবের কতটা সত্যি কে জানে। ভাবতেই বিস্ময় লাগছে ওর। তবে এরচেয়েও। বেশি বিস্ময় বোধ করছে নিজেকে নিয়ে-এভাবে ছন্নছাড়ার মত কাটাতে থাকলে কোথায় গিয়ে থামবে শেষে? অন্যদের মত সৌভাগ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ও, কারণ বরাবর যে কোন লড়াইয়ে বিজিতের পক্ষ নিয়েছে। এবার বোধহয় ভাগ্য পরিবর্তন করার সময় হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা এক লোকের কাছ থেকে একটা বাথান আর দশ হাজার পশুর উত্তরাধিকার নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, যেখানে নিজের পরিবারকে বঞ্চিত করেছে লোকটি? ক্ষণিকের পরিচয় হলেও ওর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাস রেখেছে বুড়ো, অথচ গৃহযুদ্ধের শুরুতে আঠারোশো চৌষট্টির গোড়ার দিকেই নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে ও।
ডিনারের ঘণ্টার শব্দে যখন ঘুম ভাঙল ওর, উঠে দেখল ধোয়া কাপড় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কামরায়, আগের চেয়ে কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। সাফসুতরো হয়ে নিচে নেমে এল ও। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় দেখল অন্য অতিথিরা আগেই টেবিলে এসে বসেছে।
নেহায়েত দায়সারা গোছের পরিচয় হলো অন্যদের সঙ্গে। হলে দেখা লাল চুলো মেয়েটি নেই টেবিলে। খাওয়ার দিকেই মনোযোগ দিল শেভার্ন। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় ঠিকমত পেটে পড়েনি কিছু। স্টু, বেকন, মাংস আর রুটি সহযোগে খাওয়া সারল ও। খাবারটা সুস্বাদু, রাধুনীর হাতের গুণেই বোধহয়-সোডা স্প্রিং-এর ক্ষার-মিশ্রিত পানি কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি খাবারের গুণগত মানে। সবশেষে কফি দেওয়া হলো, কিছুটা ক্ষারীয় স্বাদ। থাকলেও অন্তত খাওয়ার অযোগ্য হয়নি। মিসেস বোম্যান পুরোপুরি সফল।
অন্যদের নির্লিপ্ত আচরণে বোঝা গেল ইতোমধ্যে ওর খ্যাতি সম্পর্কে জেনে গেছে সবাই। খারাপ খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। বোম্যানস হাউসে প্রায়ই এরকম বিতর্কিত চরিত্রের অতিথির সমাগম হয় কিনা কে জানে, আনমনে ভাবল শেভার্ন।
সোডা স্প্রিং-এ আদপে কোন চার্চ নেই। ফিউনেরালের কাজ তাই কবরের পাশে সারা হয়। পরদিন ভোরে নীল ম্যাকলেন্ডনের ফিউনেরালে যোগ দিল শেভার্ন। লোকজনের সমাবেশ হতাশ করল ওকে, গুটি কয়েক লোক উপস্থিত? দূর থেকেই ওর উদ্দেশে নড করল ডাক্তার আর শেরিফ। কবরের পাশে চারটে চেয়ার রাখা, এর মধ্যে দুটো শূন্য।
কবরের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা, পাশেই এক তরুণ। পেছন থেকে দুজনকে দেখল শেভার্ন। একটু পর বুঝতে পারল এই মহিলাই বোম্যানস হাউজে দেখা সেই লাল-চুলো যুবতী, আর ছেলেটা ওর সঙ্গে সোডা স্প্রিং ছাড়তে চেয়েছিল। নীল ম্যাকলেন্ডনের পরিবার।
রহস্যময় চরিত্র একেকজন!
মোমের মত চটচটে চামড়ার এক প্রীচার গৎ বাঁধা সুরে প্রার্থনা করছিল, প্রায়ই কেশে উঠছে। কিছুটা হলেও শঙ্কিত দেখাচ্ছে তাকে, যেন আশঙ্কা করছে। কঠিন লোকটিকে ওর নিজ হাতেই কবরে শোয়াতে হবে।
ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন। নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে মিথ্যে বড়াই করেছিল বুড়ো, নাকি ভুল ধারণা করেছে? কিংবা সীমান্তের কাছাকাছি এই শহরের লোকজন নেহায়েতই অসামাজিক? গতকাল ভোরে সোডা স্প্রিং-এ ঢোকার ক্ষণটি মনে পড়ল ওর। সূর্য ওঠার আগেই প্রাত্যহিক কাজ শুরু করার জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বেশিরভাগ লোক।
ওদেরকে বোলো বিপদে পড়েছে ম্যাকলেন্ডন। বুড়ো বলেনি যে এখানে খুব জনপ্রিয় সে-শুধু বোঝাতে চেয়েছে সোডা স্প্রিং-এ পরিচিত।
প্রার্থনা শেষে কবরের দিকে এগোল লাল-চুলো যুবতী, পাশে ডাক্তার আর ছৈলেটা। কবরে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলল মেয়েটা, ঘুরে দাড়াল এরপর। শেভার্ন। খেয়াল করল শোকে কাতর নয় মেয়েটি, বরং কিছুটা হলেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কোমরের ওপর থেকে সারা শরীর আড়ষ্ট, নাড়াচাড়া করছে না। সেজন্যেই হাঁটার সময় ওকে সাহায্য করছিল অন্য দুজন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল শেভার্ন। সুন্দরী কোন মহিলার জন্যে মানসিক অক্ষমতা সত্যিই দুঃখজনক।
মি. শেভার্ন?
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ও। যুবতীই ডেকেছে ওকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, মুখ নির্বিকার, ভান করছে ওকে চেনে না।
তুমিই কি আমার বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলে?
নড করল ও।
বিকেলে বাবার উইল পড়ে শোনানো হবে, নিরুত্তাপ স্বরে বলল মেয়েটি।
শেভার্ন কোন উত্তর দেয়ার আগেই ফিরতি পথে এগোল যুবতী, ডাক্তার আর ছেলেটা সাহায্য করছে ওকে।
বদহজম হয়েছে যেন, এমন ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল জিম শেভার্ন, বিতৃষ্ণা বোধ করছে। চুরুট ধরানোর ফাঁকে কবরের দিকে নজর চালাল, বেলচা দিয়ে মাটি ফেলছে দীর্ঘদেহী এক লোক, নিখাদ পাথরের মত কঠিন মুখ লোকটার।
ঘুরে দাঁড়িয়ে লিভারি স্টেবলের উদ্দেশে এগোল ও। চলে যাচ্ছ? জানতে চাইল হসলার।
উঁহু, ঘোড়াগুলো দেখতে এসেছি, চুরুট নেভানোর সময় বলল ও। ঘোড়াগুলোর কোনটাকেই এখন আর ক্লান্ত মনে হচ্ছে না, যথেষ্ট বিশ্রাম আর দানাপানি জুটেছে। ঘোড়াগুলোর মালিকানার ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছে শেরিফ, আগের মালিকদের সম্পর্কে কিছু জানেনা তুমি?
শ্রাগ করার সময় থোক করে তামাকের রস মাটিতে ফেলল লোকটা। লাল মুখো মাসট্যাঙের মালিককে তুমি নিজেই নিয়ে এসেছ।
আমারও তাই মনে হয়েছে, হসলার সত্যিই সহজ সরল লোক নাকি ওর সঙ্গে রসিকতা করছে, বুঝতে পারল না শেভার্ন।
ফের শ্রাগ করে থুথু ফেলল হসলার। গোল্ডেন ঈগলে কিছু বেপরোয়া লোক সবসময়ই থাকে। শুনেছি ওখানে কয়েকটা পট জিতেছ তুমি। ওদের কেউই বোধহয় টাকাটা ফেরত নিতে চেয়েছিল।
নতুন কিছু জানা হলো না। অন্য ঘোড়র মালিক, তরুণ ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জানো?
নেহায়েত ড্রিফটার! মনে হচ্ছে যুদ্ধের পর থেকে দোজখে পরিণত হয়েছে দেশটা। নানা কিসিমের ধান্ধাবাজ আর বন্দুকবাজ গজিয়ে উঠছে, এদের সামাল দেয়ার লোকের অভাব পড়ে গেছে।
ম্যাকলেন্ডন কে?
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল হসলার। তুমিই তো নিয়ে এসেছ ওকে, তাই না?
সত্যি। কিন্তু নামটা ছাড়া ওর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না।
পশ্চিমের পাহাড়ে বিশাল একটা বাথান আছে ওর। ইদানীং পড়শীদের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছিল, আমার ধারণা ঝামেলা থেকে চিরতরে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে সে।
একমত না হয়ে উপায় নেই। হসলারকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেবল থেকে বেরিয়ে এল শেভার্ন। আরেকটা চুরুট ধরানোর সময় ভাবল কিভাবে সকালটা কাটাবে। সারা শহরে কেবল গোন্ডেন ঈগলে পোকার খেলা চলে, সেখানে কেউ যদি ওকে পেছন থেকে গুলি করার ফিকিরে না-ও থাকে, মনে হয় না খেলতে রাজি হবে কেউ। সোডা স্প্রিং-এর প্রায় সবাই জেনে গেছে জিম শেভার্ন ওরফে লাইমিকে পোকারে ঠকানোর ফলাফল স্বাস্থ্যকর হয় না।
রাস্তার উল্টোদিকে ডোরাকাটা একটা খুটি দেখতে পেয়ে এগোল ও। ভেতরে ঢুকতেই টের পেল নীরব হয়ে গেছে পুরো দোকান, বুঝতে অসুবিধে হলো না এখানেও ওর কুখ্যাতি পৌঁছে গেছে। চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষায় ছিল দুই লোক, কিন্তু আগে ওকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুজনেই।
অপেক্ষা করব আমি, বলল শেভার্ন। কিন্তু দুজনেরই হঠাৎ জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেছে, দ্রুত বেরিয়ে গেল একজন। অগত্যা একটা চেয়ারে বসে পড়ল শেভার্ন। কারও থালার খাবার কেড়ে নেই না আমি, নাপিত সাবানের ফেনা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলার আগে মৃদু স্বরে মন্তব্য করল ও।
ব্যক্তিগত ভাবে তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই, মি. লাইম জুস, চেষ্টাকৃত কোমল স্বরে বলল অপেক্ষারত অন্য খদ্দের। আসলে তোমার কাছাকাছি থাকারই ইচ্ছে নেই! বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
এই পানি দিয়ে কিভাবে এত ফেনা তৈরি করেছ? নাপিতের উদ্দেশে জানতে চাইল শেভার্ন।
নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল নাপিত। তোমার চুলের গাঁজলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ তোমাকে বলেনি, টাবের পাশে সবসময় সোডা অ্যাশের সরবরাহ থাকে। সাবান ব্যবহার করার আগে পানিতে কিছু সোড়া মিশিয়ে নিতে হয়, পানি নাড়াচাড়া করার পর ফেনাটুকু তুলে নিলেই ক্ষারের পরিমাণ কমে যায়। কাপড়ের ক্ষেত্রেও একই কাজ করা উচিত, যদি না কেউ প্যান্ট বা ট্রাউজারের পা-কে স্টিল্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।
ব্যাপারটা ধাঁধার মত লাগছে শেভার্নের কাছে, ক্ষার-মিশ্রিত পানির সঙ্গে আরও ক্ষার মেশালে পানির গুণগত মান না বাড়লেও অন্তত গ্রহণযোগ্য হয় কিভাবে? অবশ্য এ ধরনের আরেকটি রীতির কথা জানে ও-লোকোমোটিভ ট্রেনের বয়লারে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়।
প্রথম পোচ দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে নাপিত, তার দ্বিধা দেখে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করল শেভার্ন। কিন্তু পরমুহূর্তে শিথিল হয়ে গেল শরীর, অযথাই তটস্থ হয়েছে। নিচু খ্রিমের হ্যাট পরা এক লোক দরজায় উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখেই মত বদলে ফেলেছে।
ওই লোকটা কে, মনে হচ্ছে ওকে চেনা উচিত?
এ শহরে থাকতে হবে আমার।
আমিও থেকে যেতে পারি, উপহাসের সুরে বলল ও।
গুড লাক। তোমার এবং শেরিফ, দুজনেরই সৌভাগ্য কামনা করছি।
মুখ ক্ষৌরি শেষ হওয়ার পর মিসেস বোম্যানের হোটেলের দিকে এগোল। শেভার্ন, রাস্তায় যে কোন অস্বাভাবিক নড়াচড়ার ব্যাপারে সচেতন। খাবারের ঘন্টার ঠিক আগ মুহূর্তে পৌঁছল ও। এবারও লাল-চুলো যুবতী অনুপস্থিত থাকল টেবিলে।
খাওয়া শেষ করে পোর্চে এসে দাঁড়াল শেভার্ন, চুরুট ধরিয়ে মাত্র টান দিয়েছে এসময় পাশে কারও উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন হলো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল থামের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ ম্যাকলেন্ডন, কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। উইলটা পড়ে শোনানো হবে, বলল সে।
এখন?
নড করে পোর্চ থেকে নেমে গেল ছেলেটা।
অনুসরণ করল শেভার্ন, ল-অফিস ছাড়িয়ে অ্যাটর্নি-অ্যাট-লর অফিসের দিকে এগোল। খুশি হও, বাছা, পেছন থেকে বলল ও। তোমাকে ছাড়া খুব বেশি দূর যেতে পারিনি আমি, তাই না?
চুপ করে থাকল ছেলেটা, বোধহয় শেভার্নের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলতে পারেনি এখনও।
আগেই উপস্থিত হয়েছে লাল-চুলো। আড়ষ্ট হয়ে বসেছে চেয়ারে, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল শেরিফ।
কমবয়েসী আইনজ্ঞ ধবধবে ফর্সা, প্রচারের মতই গলে যাওয়া মোমের মত তুকের রঙ। গালে কয়েকটা লালচে দাগ। আচমকা শেভার্ন উপলব্ধি করল সোড়া স্প্রিং-এর অর্ধেক লোকই অস্বাভাবিক, তটস্থ। খারাপ পানি, বিশৃঙ্খল আইন, আড়ষ্ট মহিলা…বোধহয় এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে সবাই। স্বতঃস্ফূর্ততা। বা স্বাভাবিক স্পৃহা কারও মধ্যে নেই। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল ও। ডাক্তার।
আমার মনে হয় সবাই তৈরি আছি আমরা, গম্ভীর স্বরে বলল আইনজ্ঞ। কেউ আপত্তি না করায় উইলকারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিল সে কিছুক্ষণ।
সবিস্তারে ম্যাকলেন্ডনের যাবতীয় সম্পত্তির ফিরিস্তি দিল আইনজ্ঞ, খুব একটা ভ্রূক্ষেপ করল না শেভার্ন। অপেক্ষায় আছে কখন আসল কাজ সারবে, লোকটা। ঘোষণাটা যখন এল, কাউকেই বিস্মিত মনে হলো না। জুডাস ম্যাকলেন্ডন, এবং মেয়ে, মিসেস জুলিয়া ব্রুকসকে সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নিশ্চিত করা ছিল। জুডাসের সাবালকত্ব অর্জন এবং জুলিয়ার বৈবাহিক জটিলতা সহ সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং নিশ্চিতকরণের শর্তে মি. জিম শেভার্নকে এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়েছে।
মেয়েটা তাহলে বিবাহিতা? মি. ব্রুকস কোথায়? শেভার্নই বা এখানে কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। ভাবছে নিজের এমন কোন শশুর যদি থাকত, যে জীবনের। শেষ মুহূর্তেও চরম বিদ্রূপ করে গেছে, উইল পড়ার অনুষ্ঠানে নির্ঘাত অনুপস্থিত থাকত। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতির সাথে ওর চিন্তার খুব একটা হেরফের নেই।
কালো স্যাভিলানো হাতে তুলে উঠে দাঁড়াল ও। তোমাকে একটা দলিল লিখে দেব, মিসেস ব্রুকস, লাল-চুলোকে আশ্বস্ত করল। নিজের ভাগ গ্রহণ করার ইচ্ছে নেই আমার।
বিহ্বল দেখাচ্ছে আইনজ্ঞকে। আইন পড়েছ তুমি, মি. শেভার্ন?
কেমব্রিজে।
কিন্তু তোমার কথাবার্তা বা আচরণ মোটেই ইয়াঙ্কিদের মত নয়। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি একজন ইংরেজ।
কাকতালীয় হলেও, ইংল্যান্ডেও একটা কেমব্রিজ আছে।
আইনজ্ঞের বিভ্রান্ত মুখ দেখে বোঝা গেল ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান তার নিতান্তই কম। লোকটার প্রতি করুণা বোধ করল শেভার্ন। স্যাভিলানো মাথায় চাপিয়ে মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে বাউ করল ও, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আইনজ্ঞের দিকে ফিরল আবার। কাগজপত্র তৈরি করো, সই করে দিচ্ছি আমি।
না! তীক্ষ্ণ দৃঢ় স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস।
নিজের সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দান করতে চাইছ তুমি?
আমার স্বামী মারা গেছে, মি. শেভার্ন। ও একটা বাধা ছিল, কিন্তু এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না আর। জুডও শিগগিরই পূর্ণবয়স্ক হতে যাচ্ছে। তবুও আমাদের বাথানে তোমাকে স্বাগত জানাতে আপত্তি নেই আমার।
০৫-৬. মুহূর্তের জন্যে আবারও বিভ্রান্ত
মুহূর্তের জন্যে আবারও বিভ্রান্ত, বিহ্বল হয়ে পড়ল শেভার্ন। আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি, শেষে প্রতিবাদ করল। বুঝতে পারছ না এসব দলিল আসলে একটা সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে, ইচ্ছে করলে পরিচালনার ফি হিসেবে পুরো বাথানই দখল করে নিতে পারব আমি?
অজানা কোন কারণে এবার কিছুটা সন্তুষ্ট দেখাল শেরিফ জেসনকে। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দরজা মেলে ধরল সে। গুড লাক, বলে বেরিয়ে গেল।
আইনজ্ঞের দিকে তাকাল শেভার্ন, বিহ্বল দৃষ্টিতে ওকেই দেখছে সে। ফের যুবতীকে দেখল ও, তারপর জুডাস ম্যাকলেন্ডনের ওপর চকিত দৃষ্টি হেনে আইনজ্ঞের দিকে ফিরল। মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওদের! বিড়বিড় করে বলল ও। কাগজ তৈরি করে রেখো, সবার মাথা ঠাণ্ডা হলে এ ব্যাপারে আবারও আলাপ করব আমরা।
সবার মাথা ঠাণ্ডাই আছে, মি. শেভার্ন, বলল লাল-চুলো।
আমারটা নেই! বাউ করে বেরিয়ে এল শেভার্ন।
বাইরে তখন দারুণ গরম পড়ছে, দিনের সবচেয়ে উষ্ণ সময়। পুরো রাস্তাই ফাঁকা। বোর্ডওঅক ধরে শহরের মূল অংশের দিকে এগোল ও, বাড়ির কারণে কিছুটা ছায়া পাচ্ছে। ভাবছে ও, বোঝার চেষ্টা করছে কি থেকে কি ঘটেছে। ছোটবেলায় বহু নভেল পড়েছে যেখানে রেলরোড ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার পর এভাবেই পুরস্কৃত হয়েছে, তুচ্ছ ছেলেরা। কিন্তু বালক বয়স। থেকেই ও বুঝতে শিখেছে গল্প আর বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন-এবং সেলুনের হালকা খাবার যতই সুস্বাদু হোক, বিনে পয়সায় পাওয়া যায় না।
বুড়ো নীল ম্যাকলেন্ডনকে অসহায় ভাবে খুন করেছে কেউ, এবং আরও ঝামেলা আশঙ্কা করছে মিসেস ব্রুকস। মুখে না বললেও আচরণে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে, অন্তত শেভার্নের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তিনজন টা লোককে খুন করেছে ও, সেটা পরিস্থিতির কারণেই হোক, কিন্তু ফলশ্রুতিতে সোডা স্প্রিং-এ কঠিন, আপসহীন এক লোকের ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গেছে ওর। অতএব, ও একজন বিশেষজ্ঞ। এক দার্শনিকের মন্তব্য মনে পড়তে ক্ষীণ হাসল শেভার্ন: শহরের বাইরে একজন বিশেষজ্ঞ স্রেফ একজন জারজ।
মি. শেভার্ন?
ঘুরে দাঁড়াল ও। জুডাস ম্যাকলেন্ডন। কি ব্যাপার?
প্লীজ, কাজটা নাও তুমি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। নিজেও জানো আসলে কি বলছ? ছেলেটা উত্তর দেয়ায় খেই ধরল, আমাকে দায়িত্ব নিতে বলছ তুমি, কিন্তু সেদিন বোনকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছ কেন?
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল ছেলেটা। বাবা তখন বেঁচে ছিল।
এভাবে ভেবে দেখেনি শেভার্ন। এটা একটা কারণ বটে, স্মিত হেসে বলল। ভাবছে অস্বাভাবিক হলেও সত্যি যে বুড়ো ম্যাকলেন্ডনের মৃত্যুতে তার পরিবারের কাউকে খুব একটা হতাশাগ্রস্ত বা শোকাতুর মনে হচ্ছে না। নিজের বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার ঘটনা মনে পড়ল ওর, এই এতদিন পরও ঘটনাটা স্মরণ করতে পছন্দ করে না সে।
নেবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাকলেন্ডনের কথা মনে করল শেভার্ন, মৃত্যুশয্যায় ওকে দারুণ এক উপদেশ দিয়ে গেছে লোকটা: কেবল দুটো ব্যাপারে শঙ্কিত আমি-কখনও যদি পায়ে হাঁটতে বাধ্য হই এবং এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে। সোডা স্প্রিং-এ এসে নিজের ঘোড়া হারিয়েছে ও, এবং এক মহিলার ভূত ঘাড়ে প্রায় চেপে বসেছে!
জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে এড়িয়ে গেল শেভার্ন। বোম্যানস হাউসে এসে ভিন্ন, পথ ধরল, ছেলেটাকে জানাল ভদ্রলোকেরা দিনের এসময়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে কাটায়। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ও, ভাবছে।
বাল্যকালের উচ্ছ্বাস খুব অল্প বয়সেই বিদায় নিয়েছে ওর জীবনে, বদলে জোড়া কোন্টের ওপর আস্থা অর্জন করেছে। আস্থাটা হয়তো খুব বেশিই। এবার বোধহয় স্থির হওয়ার সময় হয়েছে। সোডা স্প্রিং থেকে অনেক দূরে, তুষারশুভ্র ওই পর্বতশ্রেণীর কাছাকাছি থাকতে কেমন লাগবে?
মনে পড়ল স্রেফ একটা বাথান দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে। এমন নয় যে কাঠখোট্টা মিসেস ব্রুকস ব্যক্তিগত ভাবে কিছু চাইবে ওর কাছে, এমনকি মহিলা চপলা এক তরুণীতে রূপান্তরিত হলেও অবস্থার হেরফের হবে না কারণ ও ওই মেয়ের চেয়েও তৎপর-দ্র, বনেদী এবং সুন্দরী কোন মহিলার বাড়ানো দুহাত এড়ানোর ক্ষমতা ওর আছে।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা গেল মিসেস ব্রুকসকে। আগের মত আড়ষ্ট দেখাচ্ছে না, প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে উইশ করল সবাইকে। জুডের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ করল শেভার্ন। পরে নাস্তা শেষ করে যখন পোর্চে বেরিয়ে এল পেছনে তাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তি বোধ করল, ধারণা করল বোন বোধহয় টাইট দিয়েছে জুডকে।
হার্নেস জুড়ছিল হসলার। দুটো বাকবোর্ড আর একটা ফ্রেইট ওয়াগন রয়েছে করালের পাশে, ওয়্যাগনের জ্যাক ঠিক করতে কসরৎ করছে এক লোক। গ্রীজ আর ময়লা লেগে আছে শার্টে। সোডা স্প্রিং-এর পানিতে ধুয়ে কখনও ওই দাগ উঠবে কি-না কে জানে, ভাবল শেভার্ন।
ঘুরতে যাচ্ছে কেউ? হালকা সুরে জানতে চাইল ও।
বাকবোর্ড বা ওয়্যাগনগুলো চেনো না তুমি? শিকলের সাথে একটা চামড়ার টিউব সেলাই করার ফাঁকে মুখ তুলে তাকাল হসলার। শেভার্ন মাথা নাড়তে হাসল সে। এগুলো তো তোমাদের ওয়্যাগন।
গতকাল ওকে ভয় পাচ্ছিল বেটা, কিন্তু আজ যেন পরম বন্ধু মনে করছে! বিরক্তি চেপে রেখে স্টেবল থেকে সরে এল ও। কিছুক্ষণ ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করল। গোল্ডেন ঈগলে গিয়ে এক পেগ বীয়ার গিলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। ঝামেলাবাজ কারও মুখোমুখি পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘ যাত্রার শুরুতে সামান্য একটা ঠাণ্ডা বীয়ার এমন কোন কাজ দেবে না। বোম্যানস হাউসে ফিরে এল ও।
রিসেপশনে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল মিসেস ব্রুকস, চামড়ায় মোড়া একটা চেয়ারে বসে আছে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। একটা লেজার দেখছিল নিবিষ্ট মনে, চোখ তুলে ওকে দেখতে পেয়ে মৃদু নড করল।
পাশের রকারে বসল শেভার্ন, স্যাভিলানো দিয়ে বাতাস করল নিজেকে। লিভারি স্টেবলের ওয়্যাগনগুলো সাজানোর নির্দেশ দিয়েছ, ম্যাম?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন। লেজারটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল যুবতী।
এখনও মনস্থির করিনি, বলতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে লেজারের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাল ও। এই কলামে ডি.বি বলতে কি বোঝানো হয়েছে, যেসব দেনা শোধ করতে হবে?
ডি.বি কিন্তু দেনার সংক্ষিপ্ত রূপ নয়। ডেথ বেনিফিট।
তাই? আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। নিছক ছন্নছাড়া বা মারকুটে স্বভাবের জন্যে একটা এস্টেটের এক-তৃতীয়াংশ অফার করা হয়নি ওকে। কলাম ধরে হিসাবের ওপর চোখ বুলাল ও, ভাবছে অন্য শব্দ সংক্ষেপগুলোর মানে কি হতে পারে-ডিপ., কাটু কিংবা পি. অ্যান্ড এল-এর মানে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু টি.আর.এন.কিউ মানে কি?
শ্রাগ করল ও। পরেও অর্থোদ্ধার করা যাবে এসবের। একেবারে শেষের লাইনটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। কেউ আশা করে না আকাক্ষিত জিনিসটা তার মুখে পুরে দেবে অন্যরা, মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরে জানতে চাইল শেভার্ন। কিন্তু নিজের সম্পত্তি ধরে রাখার চেষ্টা তো অন্তত থাকতে হবে। এখানে যেসব হিসাব আছে, তাতে মনে হচ্ছে আসলে তেমন কিছুই করোনি তোমরা।
ঠিকই ধরেছ। বাবার বয়স হচ্ছিল, ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারছিল না। সাহসী, দৃঢ়চেতা কাউকে দরকার ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একেবারে শেষ মুহূর্তে তোমাকে পেয়েছি আমরা। এর আগে অনেকেই এসেছে, আবার চলেও গেছে, শেভার্নের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করল না মিসেস ব্রুকস। যদি যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারো, হয়তো তোমার পুরস্কারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে।
প্রশংসনীয় সততা দেখাচ্ছ তুমি, ম্যাম! কে, এবং কতজন?
বুঝতে পারলাম না।
জানতে চেয়েছি কাকে এবং কতজনকে খুন করতে হবে?
বিদ্রূপ আর কটুক্তির জন্যে তৈরি ছিল শেভার্ন, কিন্তু অপরূপা লাল-চুলোর নিস্পলক দৃষ্টিই বরং শেষে অস্বস্তিতে ফেলে দিল ওকে। আমার কাজ তো সেটাই, তাই না? তোমার বাবা এ-ই চেয়েছে, এবং তোমরাও তাই আশা করছ।
হ্যাঁ।
কি করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছ যে তোমার পক্ষে যোগ দেব আমি?
কারণ সবকিছুরই পক্ষ-বিপক্ষ আছে। পুরো এলাকাই ভাগ হয়ে যাবে।
কিন্তু ভুল পক্ষ বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে আমার, বলল শেভার্ন, ভুলতে পারছে না জীবনে দুবার একই কাজ করেছে।
আমার ধারণা এরইমধ্যে একটা পক্ষ বেছে নিয়েছ তুমি, মি. শেভার্ন।
কারণ আমি একজন আগন্তুকের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছি?
খানিকটা। কিন্তু তারও আগে, আমাদের দুই শত্রুকে খুন করেছ।
ব্যাপারটা আগেই মাথায় আসা উচিত ছিল। আর কজন আছে কে জানে! এ পর্যন্ত যা শুনেছি তাতে কোন বিচক্ষণ বা সতর্ক মানুষ তোমাদের সবুজ তৃণভূমিতে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত হবে না।
তুমি কি সত্যিই সতর্ক মানুষ, মি, শেভার্ন? সতর্ক যদি হতেই, সোডা স্প্রিং এর সবচেয়ে কুখ্যাত সেলুনে পোকার খেলতে যেতে না! থেমে ওকে জরিপ করল মহিলা, তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে দৃষ্টি। আচ্ছা, তুমি কি ক্যান্সাসে গেছ কখনও? এখানে আসার আগে ক্যান্সাসে থাকতাম আমরা। গৃহযুদ্ধের সময় ওখানে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার কথা শুনেছ তো?
শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল শেভার্নের মেরুদণ্ডে। চোখের কোণ দিয়ে দেখল মেয়েটিকে, নিজেকে বোঝাল অযথাই কল্পনা করছে। খুব বেশি হলে তেরো বা চোদ্দ ছিল তখন লাল-চুলোর বয়স। মেয়েটি ঠিক কতটা জানে? ওর নিশ্চয়ই জানা নেই সদ্য জেল ফেরত এক তরুণ কাজ নিয়েছিল কনফেডারেট পন্থী উইলিয়াম রেনারের, কিন্তু ক্যাম্পাসে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর জঘন্য হামলার সময় রুখে দাড়িয়েছিল মালিকের বিরুদ্ধে? মন্দ অতীত আর বিশ্বাসঘাতকতার সস্তা গল্পের কারণে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর কুখ্যাত এক সদস্যের অপবাদ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এতগুলো বছর? এমনকি মেক্সিকো গিয়েও স্বস্তি বা অপবাদ থেকে মুক্তি পায়নি তরুণ। স্বার্থান্বেষী মহলের রোষের শিকার হতে হয়েছে তাকে, পরিস্থিতির ফিকিরে পড়ে আরেকটু হলেই প্রাণ হারাতে বসেছিল!
একটা পোস্টার, সেটা মিথ্যে আর সতিত যাই হোক যথেষ্ট শক্তিশালী। নিজের ক্ষেত্রে তিক্ততার সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে জিম শেভার্ন। উইলিয়াম রেনারের খুনের মিথ্যে অপবাদ, কিংবা কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক-সবকিছুর জের টানতে হচ্ছে ওকে। মরার আগে ওর চরম সর্বনাশ করে গেছে রেনার, সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে একটা ওয়ান্টেড পোস্টার ছাড়ার ব্যবস্থা ঠিকই করে গেছে। লোকটা খুন হয়ে যাওয়ায় মিথ্যেটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেরারী হয়ে কাটাতে হচ্ছে ওকে প্রায় দশটা বছর।
দশ বছর আগের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে সত্যটি কি আদৌ বের করা সম্ভব? পরিস্থিতি অন্যরকম হলে হয়তো সম্ভব হত, কিন্তু ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ লোকজন যুদ্ধের সময় উইল রেনারের ভূমিকা যেমন দেখেছে, তেমনি এও দেখেছে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার আগে রেনারের হয়ে কাজ করত শেভার্ন। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কারও সমস্যা হয়নি। দুএকজন যারা আসল সত্যটি জানে, অল্প বয়সে বখে যাওয়া জিম শেভার্নের কি হলো বা না-হলে তাতে কি যায়-আসে তাদের? তাছাড়া কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর মলার পরপরই আহত হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছে শেভার্ন, আর ও-মুখো হয়নি; গুটিকয়েক লোক জানে রেনার খুন হওয়ার দুদিন আগেই মেক্সিকোর পথে রওনা দিয়েছে ও।
মহিলা ওকে চিনতে পেরেছে, অন্য সবার মত ভাবছে সত্যিই কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ ছিল শেভার্নের? ওর অপর্যাপ্ত সতর্কতা বোধের প্রতি কটাক্ষ করতে দশ বছর আগের তিক্ত অতীত তুলে এনেছে আলোচনায়! সত্যিই তো, সতর্ক থাকলে কি উইল রেনারের হয়ে কাজ করত ও? কিংবা সোডা স্প্রিং এ এসে ঝামেলায় জড়ায় নিজেকে খুব বেশিদিন হয়েছে বিধবা হয়েছ তুমি? নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইল ও, সযত্নে এড়িয়ে গেল তিক্ত প্রসঙ্গটা।
মুহূর্তের জন্যে প্রশ্নটা নিজের মনে নাড়াচাড়া করল মহিলা, তারপর আঙুলের কর গুনতে শুরু করল।
তিন বছর?
না, তিন দিন।
প্রচণ্ড ধাক্কার মত লাগল বিস্ময়টা। সত্যি? সোডা স্প্রিং-এর পরিবেশ সত্যিই বেদনার, অনেকেই এখান থেকে সরে পড়তে চাইছে…
বিড়বিড় করে কি যেন বলল মহিলা, স্পষ্ট বোঝা গেল না। নীরবতা নেমে এল।
ম্যাকলেন্ডন এস্টেটের পরিবেশ কেমন?
পরিবেশটা সুন্দর, কিন্তু পরিস্থিতি সুখকর কিছু নয়। কেউ যদি সত্যিই জীবনকে উপভোগ করতে চায়, তাহলে থাকতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তুমি কি ফিরে যাবে?
তুমি কি সারা জীবন এখানে কাটাবে?
স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতার মুখে…, বলতে শুরু করল ও, তারপর যুবতীকে হাসতে দেখে থেমে গেল। এই প্রথম কোন ম্যাকলেন্ডনের মুখে হাসি দেখতে পেয়েছে।
বয়স্ক এক বোর্ডার বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, নাইস ডে, বলে পাশের রকারে এসে বসল বুড়ো।
খুশি হয়ে একমত হলো শেভার্ন, জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল মিসেস ব্রুকসের মুখ থেকে। রৌদ্রদগ্ধ রাস্তায় চোখ বুলাল ও, অন্যমনস্ক ভাবে শুনে গেল বুড়োর গল্প-যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছে লোকটা। আসল প্রসঙ্গ ধরতে কিছুক্ষণ সময় লাগল ওর, গৃহযুদ্ধ নয় বরং বহু পুরানো মেক্সিকান যুদ্ধের কথা বলছে সে।
নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ম্যাকলেনদের রক্তে প্রাণশক্তি আছে, তবে বেশিরভাগ সময় সেটা চাপা থাকে। এত সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে কিভাবে নির্লিপ্ত থাকতে পারে মিসেস ব্রুকস, ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না ওর। যে কোন মহিলার চেয়ে সম্রান্ত, গর্বিত আচরণ মিসেস ব্রুকসের। হয়তো বেদনা আর তিক্ততাই। গাম্ভীর্যের কারণ।
সমানে বকবক করে যাচ্ছে বুড়ো। শিগগিরই সোডা স্প্রিং ত্যাগ করবে কি, মিসেস ব্রুকসকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে শেভার্ন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ধূমপানের উসিলায় সরে এল ও। পোর্চে বেরিয়ে আসা মাত্র একটা পরিবর্তন উপলব্ধি করল-ক্ষণিকের জন্যে হলেও, একঘেয়েমি ভরা সোডা স্প্রিং এর নাগরিক জীবনে এখন আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নয় ও!
নতুন এক আগন্তক এসেছে। দীর্ঘদেহী, রোদপোড়া রঙ তার। চুলছে লোকটার ঘোড়া, সরাসরি স্টেবলের দিকে এগোচ্ছে। সেলুনের সামনে দাড়িয়ে আছে বারটেন্ডার, জীর্ণ সাদা অ্যাপ্রন সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আগন্তুককে দেখছে মার্কেন্টাইল স্টোরের মালিক। দুরে হার্নেসের ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। কিছুক্ষণের মধ্যে চারটে ফ্রেইট ওয়্যাগন ঢুকল শহরে।
সমস্যা হয়নি তো? জানতে চাইল হসলার।
হাতের চাবুক গুটিয়ে রাখার সময় মাথা নাড়ল প্রথম টীমস্টার। আসন ছেড়ে নামার পর গোল্ডেন ঈগলের দিকে এগোল, আচমকা চোখাচোখি হলো শেভার্নের সঙ্গে; মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল, চাহনিতে ক্ষীণ সংশয়-প্রায় বোঝা যায় না, তারপর নিজের পথে এগোল। তাপদগ্ধ স্তার চেয়ে সেলুনের আরামদায়ক পরিবেশই বেশি কাক্ষিত মনে হচ্ছে তার কাছে।
স্মৃতি হাতড়ে বেড়াল শেভার্ন, কিন্তু লোকটাকে চিনতে পারল না। দেখা হওয়া সব লোককে মনে রাখা সম্ভবও নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোর্চের আরও ভেতরের দিকে সরে এল, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফ্রেইটারদের কাজ দেখতে থাকল।
কয়েকজন মিলে মালপত্র সরাচ্ছে ওয়্যাগন থেকে। ছোট ছোট কিছু বাক্স ভোলা হচ্ছে ক্যানভাসের হুড দিয়ে ঘেরা বাকবোর্ডে, দেখেই আচমকা ওর মনে পড়ল কেন সোডা স্প্রিং-এ অপেক্ষা করছে মিসেস ব্রুকস…
ঘুরে বোর্ডিং হাউসে ঢুকে পড়ল শেভার্ন। কয়েক গজ এগোতে সামনে মিসেস ব্রুকসকে দেখতে পেল। মাথার ওপর একটা ছোট্ট প্যারাসল [ছাতা বিশেষ] ধরে রেখেছে, হাঁটছে ধীর এবং আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। লিভারি স্টেবলই বোধহয় গন্তব্য, একই সঙ্গে যেটা স্থানীয় ফ্রেইট টার্মিনাল, হার্নেস ও স্যাডলের দোকান হিসেবে সেবা উপহার দিচ্ছে।
এখনই? জানতে চাইল শেভার্ন।
হ্যাঁ।
সহজ কথায় কিভাবে বলা যায়, উপায় খুঁজতে শব্দের ভাণ্ডার হাতড়াতে শুরু করল শেভার্ন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল, শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে দীর্ঘ। বাকবোর্ড যাত্রায় যাওয়া উচিত হবে না-সেই পরামর্শ ওর কাছ থেকে পাওয়ার আশা নিশ্চয়ই করে না মহিলা। আর কিছু করতে হবে? শেষে জানতে চাইল ও।
মিসেস বোম্যানের লেনদেন চুকিয়ে ফেলল। সময়মত রওনা দিতে পারলে হয়তো সন্ধের আগেই মোটামুটি একটা দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারব আমরা।
নড করে হ্যাটের কিনারা স্পর্শ করল ও। ঘুরে বোর্ডিং হাউসের দিকে এগোতে শুরু করতে চোখের কোণ দিয়ে প্রথম টীমস্টারকে দেখতে পেল। শেরিফের অফিসের দিকে যাচেছ লোকটা।
ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করল শেভার্ন। কারও পক্ষেই সবকিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। শূন্য ল-অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে বিশালদেহী টীমস্টার। শেরিফ গেছে কোথায়? শহরে আসা ফ্রেইটারদের কেবল সে-ই দেখছে না?
মিসেস বোম্যানের পাওনা মিটিয়ে নিজের কামরায় এল শেভার্ন। সময় নিয়ে পরিষ্কার করল বহু পুরানো কোল্টজোড়া, তারপর মালপত্র গুছিয়ে নিচে নেমে এল। পোর্চে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের দেখা পেল ও, বাকবোর্ড চালিয়ে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা। তোমার মালপত্র তুলে নিচ্ছি, সোৎসাহে বলল সে। আমাদেরগুলোও তুলে নেব। তোমাকে লিভারি স্টেবলে যেতে বলেছে জুলিয়া, ওয়্যাগন বের করতে হবে।
ছয়টা মাসট্যাঙ জোড়া হয়েছে ওয়্যাগনে। ঘোড়াগুলোর আকার আর ষাট মাইল দীর্ঘ চড়াইয়ের ট্রেইল বিবেচনা করল ও, কিছু বোঝাও থাকবে। কিন্তু এবারই প্রথম নয়। এখানকার যে কেউ ট্রেইল সম্পর্কে ওর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে।
লিভারি স্টেবলের শেডের নিচে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ফ্রক, ভঙ্গিটা একটা পতাকার খুঁটির মতই ঋজু। ওয়্যাগনের চেয়ে কিন্তু বাকবোর্ডের গতি কম, মনে করিয়ে দিল লাল-চুলো। এখনই রওনা দিতে চাইলে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে তোমার।
সব তৈরি?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন। দয়া করে জলদি করো।
এত তাড়াহুড়ো করছে কেন মহিলা? শোেন আশা করল ওয়্যাগনের মত ও নিজেও তৈরি আছে। মনে করার চেষ্টা করল শেষ কবে ছয় ঘোড়ার বিশাল ওয়্যাগন রাইড করেছে। আসনে চড়ে লাগাম তুলে নিল ও, বুড়ো আঙুল আর অনামিকার ফাঁকে রাখল লীড হর্সের লাগাম, আর শেষ দুই আঙুলের ফাঁকে রাখল হুইলার টীমের লাগাম। ভাগ্য সহায়তা করলে হয়তো ঠিকমত ওয়্যাগন নিয়ে শহর ছাড়তে পারবে। লাগাম নেড়ে যাত্রা শুরু করল ও।
তন্দ্রালু বিড়ালের মত নড়ে উঠল ঘোড়াগুলো, দুপুরের তপ্ত রোদ থাকার পরও মাসট্যাঙের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে-কিংবা শেভার্নের নীরস হাতের কারণেই-যাত্রা শুরু করল। অর্ধেক মোড় ঘোরার সময় ছুটতে শুরু করল।
দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় হাতে লাগাম চেপে ধরল ও। একপাশের দুই চাকা মাটি থেকে উঠে গেছে কিছুটা, তারপর সোজা হয়ে গেল। রাস্তা ধরে এগোল এবার। লাগাম টেনে ধরার সাথে সাথে খিস্তি করা উচিত ছিল, ভাবল ও, তবে সুখের কথা মাইল খানেক পর্যন্ত রাস্তাটা সোজাসুজি চলে গেছে, এবং ওপরের দিকে উঠছে ক্রমশ। ঘোড়াগুলোর ছুটে পালানোর সময় এটাই। চোখের কোণ দিয়ে সেলুনের সামনে শেরিফ আর বিশালদেহী টীমস্টারকৈ দেখতে পেল মুহূর্তের জন্যে, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে দুজন।
আচমকা ঝাঁকি খেতে শুরু করল ওয়্যাগন। মাথা থেকে উড়ে গেল ওর হ্যাট, পেছনের ক্যানভাস ঢাকা মালপত্রের ওপর গিয়ে পড়ল। উরুতে বাড়ি খাচ্ছে। হোলস্টার জোড়া, শেভার্ন নিজেও স্থির থাকতে পারছে না সীটের সঙ্গে।
শেষ বাড়িটাও পেছনে ফেলে এসেছে ওয়্যাগন, মূল ট্রেইলে চলছে এখন। ধূলিময় ট্রেইল, পরিশ্রম হলেও তুমুল গতিতে ছুটছে ঘোড়াগুলো। সামলাতে পারবে না ভেবে প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল শেভার্ন, কিন্তু ঠিক সেই সময় রণে ভঙ্গ দিল বজ্জাতগুলো। ততক্ষণে প্রায় মাইল খানেক চলে এসেছে ওরা, ট্রেইলের পুরু বালির স্তর আর চড়াইয়ের কারণে ঘোড়াগুলোর উৎসাহে ভাটা পড়েছে। আরও কয়েকশো গজ পর দুলকি চালে এগোতে থাকল। প্রায় হাঁটছে ছয়টা মাসট্যাঙ, থামতে চাইছে।
চাবুক চালিয়ে ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করল ও, আরও আধ মাইলের মত এগিয়ে পশুগুলোর ইচ্ছে পূরণ হতে দিল। মনে হয় শিক্ষা পেয়েছিস তোরা! ক্রুদ্ধ। স্বরে গর্জে উঠল ও, কিন্তু ঠিকই জানে মোটেও শিক্ষা নেয়নি তাঁদোড় মাসট্যাঙগুলো, একেবারে শেষ মুহূর্তে ছাড়া কিছুই শিখবে না এরা।
আপাতত ঝামেলা হবে না নিশ্চিন্ত হয়ে ব্রেকের খুঁটির সঙ্গে লাগাম বেঁধে পেছনে পাটাতনের ওপর চলে এল শেভার্ন, মালপত্রের ফাঁকে খুঁজে পেল স্যাভিলানোটা। ক্যানভাসের চেরা দিয়ে পেছনে সোডা স্প্রিং-এর দিকে তাকাল ও। কেউই অনুসরণ করছে না। না কোন বাকবোর্ড, না শেরিফ।
চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকাল ও। ধারণা করল মাঝ দুপুর এখন। এ পর্যন্ত কবার এই ট্রেইলে যাওয়া-আসা করেছে? ঘোড়াগুলো গতি কমিয়ে হাঁটার গতিতে নেমে আসতে লাগাম নেড়ে তাড়া দিল ও।
একবার বেরিয়ে একটা অ্যাম্বুশে পড়েছে।
ফিরে এসেছে দুটো লাশ নিয়ে।
পানির সাপ্লাই নিয়ে বেরিয়েছে আবার।
নীল ম্যাকলেন্ডনের জন্যে সাহায্য চাইতে ফিরে এসেছে এরপর।
শেরিফ আর ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে আবার
ফিরে এসেছে ম্যাকলেন্ডনের মৃতদেহ নিয়ে।
শান্তিপূর্ণ এই ট্রেইলে সপ্তমবারের মত যাত্রা করেছে। আর কয়েকবার যাওয়া-আসা করতে হলে এই জায়গাটা ঘৃণা করতে শুরু কববে যে কেউ! ক্রোধের সাথে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। চাবুক চালাল আবার, কিন্তু অনীহায় পেয়ে বসেছে ঘোড়াগুলোকে, গতি বাড়ল না। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু বাগে আনা যাচ্ছে না ঘোড়াগুলোকে। অবশ্য লীড হসগুলো নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী। সূর্যের উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতে হ্যাটের ব্রিম নিচু করে দিল শেভার্ন, নড়েচড়ে বসল আনে। মনে আশঙ্কা এভাবে বসে থেকে হয়তো একসময় আড়ষ্ট হয়ে যাবে পাছার পেশীগুলো-ওয়্যাগনের রকিং বেঞ্চটা ক্রমশ অত্যাচারের একটা যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে।
পেছনে সোডা স্প্রিং চোখে পড়ছে এখনও, শহর থেকে বের হওয়া ট্রেইলে সাদা দুটো বিন্দু দেখা যাচ্ছে। বাকবোর্ড, ধারণা করল শেভার্ন। ওকে ধরতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে।
যদি এখনও অনীহা থাকে, দেখা যাক এবার কি করিস তোরা! চাবুক চালানোর সময় বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। বিস্মিত হয়ে খেয়াল। করল গতি বেড়ে গেছে ওয়্যাগনের। ঘোড়াগুলোর অস্বস্তির কারণ ধরতে অসুবিধে হলো না ওর। ট্রেইলের পাশে একটা স্যাটলকে দেখে ভয় পেয়েছে। ওয়্যাগন বেঞ্চের সাথে নিজের পশ্চাদ্বেশের সংঘর্ষ কিভাবে এড়ানো যায় ভাবতে শুরু করল। ও। মিসেস ব্রুকস কিভাবে ব্যাপারটা সামাল দিচ্ছে?
চাঁদির ক্ষতে হাত বুলাল শেভার্ন, প্রায়-বুজে এসেছে জায়গাটা। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, ভাবল ও। এখনও এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নীল ম্যাকলেন্ডনের খুনী। লিভারি স্টেবলের সমস্ত ওয়্যাগন আর বাকবোর্ডের ব্র্যান্ড দেখেছে ও। কোনটারই ছিল না। মিসেস ব্রুকসকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। কোন ব্র্যান্ডের হয়ে কাজ করছে স্বাভাবিক ভাবেই জানা উচিত ওর। আশপাশে কটা ব্র্যান্ড আছে, লাল-চুলোকে জিজ্ঞেস করতে পারত।
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, এবং এবারও ঘোড়াগুলোই সতর্ক করল ওকে। বুড়িয়ে যাচ্ছে, নাকি গরমে ত্যক্ত হয়ে গেছে? কিন্তু এরচেয়েও উষ্ণ অঞ্চলে বহু দিন কেটেছে ওর, সবকিছু ঠিকমতই চলছিল। চোখ-কান খোলা রাখতে না পারলে…
পাশাপাশি দুজন করে এগিয়ে আসছে চারজন লোক, ঢাল বেয়ে নামছে তারা, ফলে গতি ওয়্যাগনের চেয়ে অনেক বেশি। রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র ছড়িয়ে পড়ল লোকগুলো, নিজেদের মধ্যে একটা লাইন তৈরি করেছে। ওয়্যাগন থামিয়ে ব্রেক পোলের সাথে লাগাম বেঁধে রাখল শেভার্ন। পিছিয়ে যাও। চিৎকার করল ও, একটা কোল্ট বেরিয়ে এসেছে হাতে। বিশাল অস্ত্রটা দুই মুঠিতে চেপে ধরেছে, নিশানা ঠিক মাঝখানের লোকটির বুক বরাবর।
তৎক্ষণাৎ হাত তুলল লোকটা। আরে, এ তো নেহায়েত অন্যায়! কোন কথাবার্তা নেই ..।
তোমার প্রশ্নের জবাবে বলছি, এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যে কোন অঞ্চলেই শত্রুতা বা হামলার পূর্ব লক্ষণ-কাউকে ব্যাখ্যা করতে অসুবিধে হবে। আমার। তোমার লোকদের ফিরে আসতে বলো, কারও হাত যেন চোখের আড়ালে না থাকে। তারপর তোমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ করা যাবে।
ধাপ্পাটা কাজে লেগে যেতে স্বস্তি বোধ করল শেভার্ন। ধীর গতিতে নিশানা করা লোকটার কাছাকাছি হলে অন্যরা, যদিও এগিয়ে আসছে এখনও। একসময় পিস্তলের নিশানার মধ্যে পৌঁছে গেল।
কোন নরক থেকে এসেছ তুমি? জানতে চাইল লোকটা। বিশালদেহী মান্য সে, মুখটা লালচে। গোল্ডেন ঈগলে পোকারের প্রতিদ্বন্দ্বী মোটর কথা মনে পড়ল শেভার্নের।
পিস্তল নামাল না ও। এদিকে নতুন এসেছি, কিন্তু বদ মতলব নেই। যে কোন ট্রেইলে পাড়ি দেয়ার অধিকার আছে আমার, তাই না? কয়েকবার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে আমাকে।
উত্তরটা সন্তোষজনক নয়, স্ট্রেঞ্জার, ক্ষীণ হেসে বলল বিশালদেহী, ট্রেইল ধরে কেবল অল্প কয়েকটা জায়গায় যাওয়া সম্ভব।
সানফ্রান্সিসকো যাওয়া যায় নিশ্চয়ই?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, তারপর হেসে উঠল। এখন আর যায় না। রেলরোড এখান থেকে কয়েকশো মাইল উত্তরে। তাছাড়া, এই মাল নিয়ে পাহাড় ডিঙাতে পারবে না।
সত্যিই নিজের অবস্থান ভুলে গিয়েছিল শেভার্ন, মনে পড়ল উদ্যমী এখন আর সঙ্গে নেই। ওয়্যাগনের ব্যাপারে সচেতন হতে ভাবল ব্রেক পোয় সাথে লাগাম বেঁধে রাখা ঠিক হয়নি বোধহয়, নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত, ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করলে বিপদ হতে পারে।
ঘোড়া সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে দলের ডানদিকের লোকটার। কে ওপর লাগাম ফেলে রেখেছে সে, হাত দুটো মাথার ওপর তোলা। ঘোড়াটা ফিরতে ব্র্যাভটা দেখতে পেল শেভার্ন। অদ্ভুত ব্র্যান্ড। পাশাপাশি দুটো চ সাইকেলের মত দেখাচ্ছে। একটা চাকা অন্যটার চেয়ে ছোট।
দয়া করে এক আগন্তকের সামান্য কৌতূহল মেটাবে? জানতে চাইল তোমাদের ব্র্যান্ডের নাম কি? মালিক কে?
সত্যিই মজার লোক তুমি, স্ট্রেঞ্জার, সক্ষোভে বলল বিশালদেহী। এ কোন্টের মাজলের দিকে তাকিয়ে থাকা বোধহয় মেজাজ ধরে রাখার জন্যে য নয়। ম্যাকলেন্ডনদের হয়ে ফ্রেইটিং করছ অথচ এটেনভেন্টের ডাবল-ও ব্র্যা কথা শোনোনি ভাবতেই অবাক লাগছে!
চেনা উচিত?
য়ে ঘোড়াগুলো রাইড করছ ওগুলো কি তোমার? একটায় ডাবল-ও ব্র্যা কোত্থেকে পেয়েছ ওটা?
ভুল করে আমার ঘোড়াটাকে মেরে ফেলেছিল এক লোক, ব্যাখ্যা ব শেভার্ন। বেচারা এত অনুতপ্ত হয়েছিল যে শেষে নিজেরটা আমাকে কি দিয়েছে।
ডানদিকের লোকটা অন্যদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে।
আগে কি তুমিই মরতে চাও, নাকি মোটকুকে গুলি করব প্রথমে? শীতল রে জানতে চাইল শেভার্ন।
আগে থেকে সঙ্কেত দেয়া ছিল যেন, একই সঙ্গে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল ওপরজন। ডানদিকের লোকটা স্যাডল চ্যুত হলো প্রথমে, বিশালদেহীর উদ্দেশে পরের গুলি করল শেভার্ন, কিন্তু লোকটার ঘোড়া লাফিয়ে ওঠায় মিস্ হলো। গড়ান দিয়ে ওয়্যাগনের পাটাতনে চলে এল ও, গুলির তুবড়ি ছোটাতে শুরু করেছে।
গড়িয়ে মাটিতে পড়ল ও, ওয়্যাগনের সামনের চাকার কাছে। চিৎকার করে আগে বাড়ল মাসট্যাঙগুলো, ব্রেক লেভার থাকার পরও সামনে এগোল ওয়্যাগন। কয়েক ফুট উঁচু চাকার সামনে থেকে সময়মত সরে যেতে সক্ষম হলো শেভার্ন।
সে সমানে নিশানা ছাড়াই গুলি করছে তিনজন। ওয়্যাগনের নিচেও বাদ দিচ্ছে না। মুহুর্তের জন্যে নিজের ইতিকর্তব্য সম্পর্কে ভাবল শেভার্ন, ভাবছে ওয়্যাগনে যাবে কি না, তারপর ট্রেইলের পাশের একটা জুনিপারের আড়ালে সরে এল, ততক্ষণে সামনে থেকে সরে গেছে ওয়্যাগনটা।
একজন ধরে নিয়েছে এখনও ওয়্যাগনের নিচে আছে ও। নির্দ্বিধায় লোকটার দেহ ফুটো করল শেভার্ন। আরও দুটো গুলি করল, নিশ্চিত জানে অন্তত একটা বিশালদেহীর শরীরে গেঁথেছে। আচমকা রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে ঘোড়া দুজন, অপ্রত্যাশিত দিক থেকে আক্রমণ আসায় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে চলছে।
হাঁপাচ্ছে শেভার্ন, ওয়্যাগন থেকে লাফিয়ে পড়ায় কিছুটা হলেও আঘাত পেয়েছে কনুই আর বাহুতে। তেমন কিছু নয় অবশ্য। পিস্তল রিলোড করে হ্যাট তুলে নিল। শখানেক গজ এগিয়ে গেছে ওয়্যাগন, থেমে গেলেও মরিয়া হয়ে লাগাম ছেঁড়ার চেষ্টা করছে মাসট্যাঙগুলো। ছুটতে শুরু করল ও, ভাবছে সময়মত পৌঁছার আগেই উন্মত্ত পশুগুলো হার্নেস ছিঁড়ে ফেলে কি-না।
মিনিট কয়েক পরে ওয়্যাগনের পেছনে পৌঁছে গেল ও। হাত বাড়িয়ে লগেট চেপে ধরল, তারপর শরীর তুলে দিল পাটাতনে। দ্রুত সামনে এসে লাগাম তুলে নিল হাতে, ব্রেক রিলিজ করে দিল-বিড়বিড় করে শান্ত করার চেষ্টা করল পশুগুলোকে। পেছনে টান মুক্ত হতে যেন স্বস্তি বোধ করল ঘোড়াগুলো, দৌড়াতে শুরু করেছে আবার।
ওয়্যাগন থামালেই বোধহয় ভাল হত, ভাবল শেভার্ন। পেছনে হয়তো বেঁচে যেত দুজনের কেউ, পরখ করা দরকার। তবে ঝামেলার হবে কাজটা, ওয়্যাগন থামাতে থামাতে অন্তত কয়েকশো গজ পেরিয়ে যাবে। ট্রেইলের পাশে দুটো মরদেহ দেখে কি ভাববে মিসেস ব্রুকস?
ঘেমে গেছে ঘোড়াগুলো, থামতে চাইছে। কিন্তু থামল না শেভার্ন। তিক্ত মনে চাবুক চালিয়ে গেল। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের মুখ খুলে গেছে বোধহয়, টের পেল ভেজা ভেজা লাগছে। এক কনুইয়ের কাছে চামড়া ছড়ে গেছে, সারাক্ষণ জ্বালা করছে। বিড়বিড় করে কঠিন পাথুরে মাটিকে গাল দিল ও। ছুটতে থাক বেটারা, আগে শরীরে কিছু ক্ষত তৈরি কর, তারপর থামতে দেব। বহু পথ পড়ে আছে। সামনে। আরও মাইল খানেক ছুট, তাহলে হয়তো শিক্ষা হবে তোদের?
কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরই ইস্তফা দিতে হলো। সত্যিই হাঁপিয়ে গেছে ঘোড়াগুলো। বেচারা পশু! কখনও শিখবে না এরা। শেভার্ন নিজে কি শিখবে কখনও?
আর কিভাবে ব্যাপারটা সামাল দেওয়া যেত বিড়বিড় করল ও।
আন্তরিক একটা উত্তরে অযথা প্রাণনাশ এড়ানো যেত, বলল ওর বিবেক।
বুলেটও এড়ানো যেত?
বুলেটের ওপর নির্ভর করে যারা বেঁচে থাকে, বুলেটের কারণেই মারা পড়ে একদিন, পাল্টা যুক্তি দেখাল ওর সত্তা।
কিন্তু আমার দোষ ছিল না এতে।
অন্তত ফিরে যেতে পারতে তুমি, ওদের মৃত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতে। একজনও যদি বেঁচে থাকে, মিসেস ব্রুকস বা ছেলেটার ওপর চড়াও হতে পারে, তাই না?
আকাশের দিকে তাকাল শেভার্ন। হয়তো তোমারই সাহায্য করা উচিত ছিল-সঙ্কীর্ণ ট্রেইলে বেজন্মা এই ওয়্যাগনটা ঘোরাতে আরেকজনের সাহায্য দরকার ছিল আমার! উপলব্ধি করল অন্তত এবার বিবেককে যুক্তিতে হারাতে পেরেছে।
সোজাসুজি চলে গেছে ট্রেইল, অন্য দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হলো এবার। সীটের ওপর দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল ও। যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখা যাচ্ছে না, কিংবা জায়গাটা শনাক্ত করতে পারছে না, যদিও একেবারে সোডা স্প্রিং পর্যন্ত পুরো ট্রেইলই চোখে পড়ছে। চোখ কুঁচকে তাকাল ও, কয়েক মাইল দূরে সাদা ক্যানভাসের চলন্ত একটা আকৃতি দেখা যাচ্ছে।
ঘুরে ট্রেইলের দিকে মনোযোগ দিল শেভার্ন। কমে এসেছে সূর্যের তেজ, ঘন্টা খানেকের মধ্যে ডুব দেবে দিগন্তের ওপারে। ক্যাম্প করার মত যুৎসই একটা জায়গার খোঁজে চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি চালাল ও।
.
০৬.
ট্রেইল থেকে কিছুটা পাশে ক্যাম্প করেছে শেভার্ন। সূর্য তখন ডুবে গেছে, গোধূলির লালিমায় রঙিন হয়ে আছে পশ্চিম দিগন্ত। পাহাড়শ্রেণী থেকে ভেসে আসছে পাইনের গন্ধ মাখা সুবাসিত বাতাস। ওয়্যাগন থামিয়ে হার্নেস থেকে ঘোড়াশুলোকে ছাড়িয়ে নিল ও, ক্লান্ত পশুগুলোকে খাবার দিয়ে কুঠার হাতে এগোল পাশের ঝোপের দিকে। সূর্যের আলো থাকতে থাকতে কিছু শুকনো কাঠ সংগ্রহ করার ইচ্ছে।
সারা দিনে মোটামুটি মাইল ত্রিশের মত পাড়ি দিয়েছে। সন্তোষজনক কয়েক মিনিট পর ওয়্যাগন দুটো পৌঁছে গেল। এখনও পিঠ সোজা করে লীড ওয়্যাগনের আসনে বসে আছে মিসেস ব্রুকস, লাল চুল পরিপাটি। কিছুটা সমীহ আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন, তারপর আচমকা মহিলার ফ্যাকাসে মুখ নজরে পড়ল। কুঠার ফেলে দ্রুত এগোল ও। কৃতজ্ঞ চিত্তে ওর বাড়ানো হাত চেপে ধরল মহিলা, এতটাই ক্লান্ত যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল শেভার্নের শরীরের ওপর।
পেছনের বাকবোর্ড থেকে ছুটে এল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। দুজনে মিলে ঘাসের ওপর বিছানো বেডরোলে শুইয়ে দিল মিসেস ব্রুকসকে। হুইস্কির বোতলের খোঁজে নিজের ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করল শেভার্ন।
সত্যিই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে আমার! ক্লান্ত স্বরে স্বগতোক্তি করল লাল-চুলো।
সান-স্ট্রোক বলে একে। গরম আর আর্দ্রতার কারণেই এমন হয়েছে। তাপমাত্রা কমে গেলে ভাল লাগবে। পূর্ব প্রস্তুতি দূরে থাক, মনে হচ্ছে শুধু সান স্ট্রোকই নয়, ট্রেইলের দুর্ভোগ বা দুর্ভাগ্যের ব্যাপারেও কোন ধারণা নেই তোমার…ট্রেইলে যতক্ষণ আছ এত পুরু আর কয়েক প্রস্থ কাপড় না পরলেও চলে, তাই না?
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল জুলিয়া ব্রুকস, চোখ বুজে আছে।
শেভার্ন ধারণা করল এখানে মিসেস ব্রুকসের জীবন ওর মতই কিছুটা হলেও রোমাঞ্চকর। পুরো একটা দিন বাকবোর্ডের সীটে কাটিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে গেছে জুড। ছেলেটাকে ঘোড়াগুলো মুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে সাপ্লাইয়ের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও, আগুন জ্বেলে মাংস আর কন সহযোগে খাবার তৈরি করল। শেষে নিজের ব্যাগপত্রের কাছে ফিরে এল। গ্রীন রীভারের বোতলটা খুঁজে পেল এবার। একটা কাপে সামান্য হুইস্কি ঢেলে একই পরিমাণ পানি মেশাল। পানীয়ের গুণগত মান আর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ভাবছে। মিসেস ব্রুকসের কাছে ফিরে এল ও।
কি এটা?
অষুধ। স্বাদটা উপাদেয় নয়, সুতরাং এক চুমুকে খেয়ে ফেলল।
বিনা বাক্য ব্যয়ে নির্দেশ মানল মহিলা, চুমুক দেয়ার পরপরই মুখ বিকৃত হয়ে গেল, কিন্তু একটু পরে ফ্যাকাসে মুখে খানিকটা রঙ ফিরে এল। জঘন্য স্বাদ তোমার এই অষুধের! শুয়ে পড়ার সময় স্মিত হেসে মন্তব্য করল জুলিয়া ধ্রুকস। পানির সঙ্গে মিশিয়ে জিনিসটা নষ্ট করার দরকার ছিল না!
বাউ করল শেভার্ন। পরেরবার শুধরে নেব, পাল্টা হেসে বলল ও, আগুনের কাছে গিয়ে তিনটে থালায় খাবার তুলে নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখল কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছে মিসেস ব্রুকস।
সত্যিই অদ্ভুত, বিড়বিড় করল জুলিয়া ব্রুকস।
কি অদ্ভুত?
আমি তো জানতাম তোমার দেশের লোকেরা গমের তৈরি রুটি পছন্দ করে, অথচ তুমি কন পোন পছন্দ করো।
কিছু দিন দক্ষিণে ছিলাম আমি।
কনফেডারেটদের সঙ্গে? অননুমোদনের ক্ষীণ আভাস মহিলার কণ্ঠে।
আরও দক্ষিণে, মেক্সিকোয়।
তাতে বরং লাভই হবে।
কিভাবে?
আমাদের বেশিরভাগ লোকই ইংরেজি বলতে পারে না। ওদের সঙ্গে কথা বলতে হলে স্প্যানিশ জানা ছাড়া উপায় নেই।
নীরবে খাওয়া শেষ করল ওরা। ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল শেভার্ন, ভাবছে কিভাবে ট্রেইলের ঘটনাটা সম্পর্কে জানতে চাইবে। আসার পথে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার? কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল ও।
অস্বাভাবিক?
ট্রেইলে নতুন কিছু চোখে পড়েনি? দৃষ্টি সরিয়ে জুডের দিকে তাকাল ও, ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা।
মনে পড়ছে না কিছু। বোধহয় আরও মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল আমার।
তারমানে মিসেস ব্রুকস বা জুড, কারও চোখে পড়েনি মৃতদেহ দুটো। কেউ বোধহয় ফিরে এসে লাশগুলো সরিয়ে নিয়ে গেছে, ধারণা করল শেভার্ন। অন্তত একজন যে মারা গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যজনের ভাগ্যে কি ঘটেছে কে জানে। পেনি-ফার্দিং ব্র্যান্ডটা কি তোমার পরিচিত?
কি ব্র্যান্ড?
বাই-সাইকেলের মত দুটো চাকা, একটা আবার ছোট।
তুমি বোধহয় ওস্টেনভেল্টের কথা বলছ?
তোমার শত্রু?
বলা যায়।
আমিও তাই ভেবেছি। এদের চারজন প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল আমাকে।
তাই!? ঝামেলা হয়নি তো?
দুজন পালিয়ে গেছে।
ওহ! চিন্তিত দেখাল মিসেস ব্রুকসকে।
ভোরের আগে বোধহয় চাঁদ উঠবে না, ভাবল শেভার্ন। মিসেস ব্রুকস বা জুড দুজনেই দারুণ ক্লান্ত। এদিকে গত দুই রাত মিসেস বোম্যানের বোর্ডিং হাউসে ভালই ঘুমিয়েছে ও। সুতরাং রাতের প্রথম দিকটা ওরই পাহারা দেয়া উচিত।
জুডের আগে আমাকে ডেকো, বিড়বিড় করে বলল মিসেস ব্রুকস, বোঝা যাচ্ছে হুইস্কির প্রভাব শুরু হয়েছে।
নিভু নিভু, আগুনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল শেভার্ন, একটা জুনিপার ঝোপের কাছে বসল। নিবিষ্ট মনে রাতের শব্দ শুনছে। ঠাণ্ডা পড়ছে বেশ। গায়ে একটা কম্বল জড়াল ও, ধূমপান করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারল। আনমনে ভাবছে কিভাবে এত নির্লিপ্ত থাকছে মিসেস ব্রুকস। মাত্র তিন দিন আগে বিধবা হয়েছে-এখন বোধহয় চার দিনে পড়ল? সুখকর কিছু নয়। পশ্চিমে জন্ম কিংবা বড় হলেও মিসেস ব্রুকস মনেপ্রাণে একজন স্কট। আশাহতের যন্ত্রণা স্কটদের একটু বেশিই আহত করে, কারণ হৃদয়টা তাদের বরাবরই ভঙ্গুর। নইলে কেন এভাবে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বেদনা ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে মহিলা?
স্কটরা বরাবরই শেভার্নের কাছে ধাঁধার মত। বোঝা কঠিন মনে হয়েছে এদের। কিন্তু জানে এরা প্রায় প্রত্যেকেই উদার মনের মানুষ। হয়তো গরীব হতে পারে, কিন্তু ওদের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তার গল্প এমনকি সুদূর পশ্চিমেও চালু আছে।
কোথাও করুণ স্বরে ডেকে উঠল একটা কথোট। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুর মেলাল অন্যগুলো। গাঢ় কিছু ছায়া দেখা যাচ্ছে আকাশে, ওড়ার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। বাদুড়, ধারণা করল শেভার্ন।
তুমিও তো বিশ্রাম নিতে পারো, মি. শেভার্ন, ঘণ্টা তিনেক পর মিসেস ব্রুকসের কণ্ঠ শুনতে পেল ও।
আর তুমি?
আমার তো মনে হচ্ছে কেউ না জাগালে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাতে পারব।
ওয়্যাগন থেকে নামার মুহূর্তটি মনে পড়ল শেভার্নের, সত্যিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল মহিলা। ব্যথা আছে এখনও?
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নয়, ক্ষণিকের জন্যে থামল জুলিয়া ব্রুকস। হয়তো খেয়াল করেছ আমার চলাফেরা খানিকটা আড়ষ্ট। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, সেরে উঠতে বেশি দিন লাগবে না।
অস্ত্র আছে তোমার কাছে, ম্যাম?
একটা রাইফেল। কিন্তু যতবারই ওটা দিয়ে গুলি করেছি, কাঁধে চোট পেতে হয়েছে।
রাইফেলগুলো আসলে মেয়েদের শরীরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়নি, ব্যাখ্যা দিল শেভার্ন। দেখল উঠে বসেছে লাল-চুলো, গায়ে কম্বল জড়ানো। নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল ও, ঘুম নেমে এল চোখে। কিন্তু একটু পরই টের পেল কাধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে কেউ।
মি. শেভার্ন? ফিসফিস করে ডাকছে মিসেস ব্রুকস। কেউ বোধহয় আসছে এদিকে!
নিচের ট্রেইলে? পাল্টা ফিসফিস করল শেভার্ন, চোখ খুলে চারপাশে তাকাল, তবে উঠল না। কান খাড়া করতে ব্রিডলের ঝনঝন আর চামড়ার খসখসে শব্দ শুনতে পেল পরিষ্কার। দ্রুত উঠে বসে বুট জোড়া পায়ে গলাল ও, হোলস্টারে কোল্ট জোড়া পরখ করে নিল। গুটি গুটি পায়ে নিজের বেডরোলের দিকে চলে গেল মিসেস ব্রুকস, জুডের মুখ চেপে ধরল এক হাতে, তারপর জাগাল ছেলেটাকে।
চাঁদ নেই আকাশে, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ক্যাম্পের আগুন অনেক আগেই নিভে গেছে। তন্দ্রা চোখ জোড়া সচকিত করল শেভার্ন, ধারণা করল ভোর হতে এখনও অন্তত ঘণ্টা খানেক বাকি। ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে একটা ঘোড়া।
চোখ কুঁচকে ক্যানভাসে ঢাকা বাকবোর্ড আর বিশাল ফ্রেইট ওয়্যাগনের দিকে তাকাল শেভার্ন, ভাবছে তারার আলোয় কত দূর থেকে চোখে পড়বে ওগুলো। পকেট হাতড়ে বাড়তি গুলি বের করল, আনমনে ভাবছে আবারও সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি-না। এখনও একই ভাবে এগিয়ে আসছে নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী। তারপর, আচমকা থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা।
চোখ কুঁচকে নিচের ট্রেইলের দিকে তাকাল ও, আবছা আলোয় আগুয়ান ঘোড়া আর আরোহীকে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করছে। যে-ই এসে থাকুক, সাদা ক্যানভাস অন্তত চোখে পড়েছে তার। কোল্ট জোড়া বের করে অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন। ক্যানভাস ঢাকা ওয়্যাগন বা বাকবোর্ড থেকে নিরাপদ দূরত্বে ক্যাম্প করেনি কেন ও? চরতে চরতে ঘোড়াগুলো কত দূরে সরে গেছে কে জানে!
মিসেস ব্রুকস? পরিচিত একটা কণ্ঠ শোনা গেল, কিন্তু শনাক্ত করতে পারল শেভার্ন।
কে তুমি? পাল্টা প্রশ্ন করল মহিলা।
শেরিফ জেসন বেলহ্যাম।
সাবধানে এসো, হাতগুলো যেন দেখতে পাই, বলল ম্যাকলেন্ডন-কন্যা, যুবতীর বুদ্ধিমত্তায় সন্তোষ বোধ করল শেভার্ন।
ঘোড়াটা আবার এগোতে শুরু করেছে, একটু পর উপত্যকার শুরুতে তারার আলোর বিপরীতে শেরিফ বেলহামের ঋজু অবয়ব ফুটে উঠল। কিছুটা পিছিয়ে জুনিপারের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিল শেভার্ন, শেরিফের স্যাডল ত্যাগ করার অপেক্ষায় থাকল।
ইংরেজ লোকটা আছে তোমাদের সঙ্গে? প্রশ্নটা করার পর শেভার্নকে দেখতে পেল শেরিফ, মৃদু নড করল সে। এসবের জন্যে সত্যিই দুঃখিত আমি।
আমার স্বামীর নাকি আমার বাবার মৃত্যুর জন্যে? অদ্ভুত নির্লিপ্ত স্বরে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
এবার আরও ব্যথিত দেখাল শেরিফকে।
মাঝবয়সী লোকটার জন্যে করুণা বোধ করল শেভার্ন, কিন্তু নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। সত্যিই অদ্ভুত লাগছে, শেরিফ, মৃদু বিদ্রুপের স্বরে মুখ খুলল ও। এতটা পথ একা এসেছ তুমি!
হয়তো আজকের উসিলায় সারা বছরের কামাই নিশ্চিত হয়ে যাবে আমার! খেপা সুরে পাল্টা জবাব দিল ল-ম্যান।
আগে বা পরে ব্যাপারটা ঘটবেই, জানে শেভার্ন-ল-অফিসের দিকে টীমস্টারকে যেতে দেখার পর থেকেই ধরে নিয়েছে। আচমকা ওর উপলব্ধি হলো কেন তাড়াহুড়ো করে সোডা স্প্রিং ছাড়তে চেয়েছিল মিসেস ব্রুকস। শেরিফকে নিরীখ করল ও-যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক, কোমরের সাথে লেপ্টে থাকা একমাত্র পীসমেকারের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে হাত।
সোডা স্প্রিং-এ ঢোকার বা বেরোনোর রাস্তা একটাই, উদ্দেশ্যপূর্ণ স্বরে মন্তব্য করল শেরিফ।
শেভার্নের মনে হলো সত্যিই বোধহয় নিষ্কর্মা লোক ও, অবাঞ্ছিত ভাবে ঘোরাফেরা করছে সোডা স্প্রিং-এর আশপাশে, এ পর্যন্ত কয়েকবার শহরে প্রবেশ করেছে বা বের হয়েছে; অথচ সাফ্রান্সিসকোয় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ওর।
সোডা স্প্রিং থেকে বহু দুরে থাকি আমরা, নিরুত্তাপ স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাতের জন্যে এত পথ পাড়ি দেবে না কেউ। এর আগে কখনও আমাদের দেখতে আসোনি তুমি। হঠাৎ দরদী হয়ে উঠলে যে? ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল না, শেরিফ, শহরের নিরাপদ বেষ্টনী ছেড়ে আসতে হলো তোমাকে? সোডা স্প্রিং-এ দেখা করলেই পারতে, তাহলেই এত কষ্ট করতে হত না!
কথাগুলো সত্যিই কঠিন, জুলিয়া, তোমার মনের অবস্থা চিন্তা করলে তাই বলতে হচ্ছে। তুমি কি জানো কেন এখানে এসেছি আমি?
না, এবং জানতেও চাই না। অতীত ভুলতে চাইছে শান্তিপ্রিয় এমন যে কোন লোককে খুঁচিয়ে ত্যক্ত করতে সিদ্ধহস্ত তুমি, না চাইলেও হয়তো তোমার সঙ্গে ঝামেলায় জড়াবে কেউ কেউ। স্বামী আর বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম নির্লিপ্ততার মুখোশ খসে পড়ল জুলিয়া ক্লকসের, স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে রহস্যময় ঠোঁটের কোণে, তবে কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর স্পষ্ট। সময়মত নিজের দায়িত্ব যদি না-ই সারতে পারো, সরে গিয়ে অন্য কাউকে কাজটা করতে দাও বরং।
চালু মহিলা, আনমনে ভাবল শেভার্ন, আইন সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তারপরই ওর মনে পড়ল পুবের স্কুলে পড়াশোনা করেছে মিসেস ব্রুকস, ক্যাম্পাসে থাকত একসময়…গৃহযুদ্ধের শুরুতে…
এক মিনিট, বাধা দিল ও। ব্যাপারটা তুলতে চায়নি, অন্তত এখনই। জানতে পারি কি অভিযোগ নিয়ে সোডা স্প্রিং থেকে এত দূর ছুটে এসেছ?
তোমাকে প্রথম দেখার পরপরই বুঝেছি ঝামেলা তোমার আগে আগে চলে, ওর দিকে ফিরে সরাষে বলল শেরিফ।
অভিযোগটা কি?।
কিন্তু মিসেস ব্রুকসের কথা শেষ হয়নি এখনও, স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ পেল লাল-চুলোর কষ্টে। আইন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে মি. শেভার্ন, ও হয়তো বলতে পারবে বেআইনী কাজ আর বৈধ কোন কাজ অবৈধ ভাবে করার মধ্যে ঠিক কতটা পার্থক্য।
জুলিয়া ব্রুকসের দিকে ফিরল শেরিফ, অতিমাত্রায় সহিষ্ণু দেখাচ্ছে তাকে। আইনের কোন লোক যদি অসৎ উদ্দেশে ল-অফিস ব্যবহার করে, সেটা বেআইনী। কিন্তু বিপজ্জনক লোকের কাছে মার খাওয়ার চেয়ে ডেপুটিহীন কোন শেরিফ যদি নিজের বিবেকে কিছুটা সেলাই দেয়, তাহলে বেআইনী কাজটাই বদলে গিয়ে অবৈধ ভাবে করা কোন বৈধ কাজে পরিণত হয়।
আশা করি তোমরা দুজনেই বুঝেছ কি বলতে চাইছি, থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাঝবয়েসী লোকটি। ক্ষণিকের জন্যে মিসেস ঐকসকে নিরীখ করল, তারপর আনমনে মাথা নাড়ল। কেবল একটা ব্যাপার অবাক লাগছে আমার, তোমার মত স্মার্ট মহিলা কি করে বারবার একই ভুল করছে। আবারও সামান্য একজন টিনহনকে রক্ষা করার জন্যে জেদ ধরেছ। তোমার জন্যে সত্যিই লজ্জিত আমি, জুলিয়া। লাল চুল কোন উসিলা হতে পারে না-তুমি আর তোমার মা যখন ক্যাম্পাসে ছিলে, তখনও হয়নি।
মি, শেভার্ন কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে আসেনি, দৃঢ়, প্রায় অধৈর্য স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। যে কোন টিনহনই ব্রিটিশ বাচনভঙ্গি নকল করতে পারে। নিজের জন্ম বা অতীত সম্পর্কে ইতোমধ্যে যথেষ্ট ও সন্তোষজনক প্রমাণ দিয়েছে মি. শেভার্ন। আরও কিছু চাইলে আমি দিতে পারি।
ব্যাপারটা বিস্মিত করল শেভার্নকে। জানত মেয়েলি মেজাজের কারণে প্রায়ই নিজেদের বিপদে ফেলে দেয় মহিলারা, যুক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না অজান্তে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। বহুবার শুনলেও এই প্রথম ঘটতে দেখছে অদ্ভুত ঘটনাটা। কিন্তু ওর প্রতি মিসেস ব্রুকসের কোন অনুরাগ থাকলেও, তার বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি মহিলা। তারপরই ওর মনে পড়ল পিস্তলে হাত চালু এমন লোককে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের চেয়েও জরুরী কাজে ব্যবহার করার দরকার হবে বিধবা লাল-চুলোর।
হয়তো, শুকনো, চিন্তিত স্বরে বলল শেরিফ। এভাবে হয়তো ওই ফ্রেইটারকেও সন্তুষ্ট করা সম্ভব।
জুড, একটা মোম জ্বেলে কাগজ-কলম নিয়ে এসো তো। আমি নিশ্চিত একটা সাক্ষ্য লিখে দিতে আপত্তি করবে না মি. শেভার্ন, ঘুরে শেভার্নের দিকে ফিরল মিসেস ব্রুকস। যাকগে, মি. শেভার্ন, তেষট্টিতে কোথায় ছিলে তুমি?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন। অন্ধকারে কারও চোখের দৃষ্টি পড়া কঠিন হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছি না, শেষে বলল ও।
ভাল করেই জানো কি জানতে চেয়েছে ও, সীমাহীন বিরক্তি ঝরে পড়ল শেরিফের কণ্ঠে। আঠারোশো তেষট্টি সালে কোথায় ছিলে তুমি?
ভেবে দেখতে হবে।
ভাবার জন্যে দশটা বছর পেয়েছ তুমি।
উঁহু। আমার ধারণা ছিল গত কয়েকদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে এসেছ তুমি। ভাবিনি আমি লক্ষ্ণৌতে ছিলাম নাকি কানপুরে গিয়ে রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছি তা নিয়ে কোন মাথা-ব্যথা আছে তোমার।
শুনতে ভুল হলো নাকি, কোয়ান্ট্রিল বলেছ তুমি?
কোথায়?
কোথায় নয়, কার সঙ্গে।
লক্ষ্ণৌ বা কানপুর কোথায় জানো তুমি? জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
শুনেছি, বিরস মুখে বলল শেরিফ, অসন্তোষ চেপে রাখছে না। নিশ্চই আশা করো না পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যে যুদ্ধ হচ্ছে তার কথা জানবে সবাই? মিসৌরিতে উইলিয়াম সি. কোয়ান্ট্রিলের ভূমিকার খবর না রেখে ভারতবর্ষে কিছু ইংরেজের সাফল্যের খবর রাখব, কিভাবে আশা করো তুমি? লরেন্স বা ক্যান্সাসের কেউ কেউ হয়তো আগ্রহী হতে পারে। কিন্তু এখানে তেমন কিছু ঘটবে না। যুদ্ধের সময় তুমি অনেক ছোট ছিলে, জুলিয়া, হয়তো মায়ের কথাই ঠিকমত মনে নেই তোমার।
সারাক্ষণ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি জুডাস ম্যাকলেন্ডন। বিশ্বাস করা কঠিন কয়েকদিন আগে এই ছেলেটিই বিদ্রোহের বশে শেভার্নের সঙ্গী হতে চেয়েছিল। বাতি জ্বালিয়ে কাগজ আর কলম নিয়ে এল জুড। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাক্ষ্য লিখল শেভার্ন: তেষট্টির মাঝামাঝি থেকে পঁয়ষট্টি পর্যন্ত মেক্সিকোয় ছিল, যুদ্ধের ঠিক শুরুতে ক্যান্সাসে ছিল কিছুদিনের জন্যে, উইল রেনারের হয়ে কাজ করেছে মাস তিনেক।
উইল রেনার? সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল শেরিফ, কুঁচকে উঠেছে ভুরু। তার মানে কনফেডারেট তুমি?
আমি যাই ছিলাম, তাতে আর কিছু যায়-আসে না এখন।
যুদ্ধের সময় রেনার বা ওর সাঙ্গ-পাঙ্গের ভূমিকা কিন্তু ভুলে যায়নি মানুষ, ওর বেশিরভাগ লোকই কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তোমার নামে একটা পোস্টারও আছে। তাছাড়া অভিযোগ আছে রেনারকে খুন করেছ তুমি।
স্মিত হাসল শেভার্ন, কিন্তু কঠোর হয়ে গেছে মুখ। কিন্তু কোন প্রমাণ নেই।
আছে। অন্তত একজনকে সাক্ষী হিসেবে পেয়েছি আমরা।
নীরবে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন, শেরিফের উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে। ভাবছে ঠিক কতটা আগ্রাসী হতে পারে জেসন বেলহ্যাম।
বিবাদীর পক্ষে সাক্ষী আছে কি-না জানতে চাইলে না? আচমকা সহাস্যে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
বিব্ৰত দেখাল ল-ম্যানকে, ঘাড় ফিরিয়ে লাল-চুলোকে দৈখল শূন্য দৃষ্টিতে। এমন কারও কথা শুনিনি…।
যে কেউ এসে অভিযোগ করবে আর তা শুনে ছুটে আসতে পারবে তুমি, কিন্তু অন্য পক্ষেরও যে কিছু বলার থাকতে পারে, তা মানছ তো? মি. শেভার্নের হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি আমি। ক্যাম্পাসে রেনারের দুটো বাড়ি পরেই ছিল আমাদের বাড়ি। তখনকার মি. শেভার্নকে দেখেছি আমি, স্বচক্ষে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর মুখোমুখি হতে দেখেছি ওকে। সারা শহরে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ওরা। মি: শেভার্নের মত গুটি কয়েক দুঃসাহসী নোক রুখে দাঁড়িয়েছিল, তা যথেষ্ট ছিল না। বলেই হয়তো আজকে এই সন্দেহ, নইলে নতুন করে ক্যাম্পাসের ইতিহাস লিখতে হত।
কি মূল্য আছে তোমার কথার? উম্মার সঙ্গে জানতে চাইল জেসন বেলহ্যাম, সন্দিহান এখনও। তোমার হয়ে কাজ করছে ও, তুমি যে ওকে রক্ষা করতে চাইবে এ আর নতুন কি!
আরও দুটো পরিবারের কথা বলতে পারি তোমাকে, শেরিফ। ওদের ঠিকানা দেব তোমাকে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারো কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার সময় জিম শেভার্নের কি ভূমিকা ছিল। এরা অন্তত মিথ্যে বলবে না, কারণ এই পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজে আহত হয়েছিল সে।
তাদের মধ্যে তুমিও একজন? বাঁকা সুরে জানতে চাইল শেরিফ।
হ্যাঁ। মি, শেভার্নের হয়তো মনে নেই, বলার মধ্যেই শেভার্নের দিকে তাকাল লাল-চুলো, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। আমার সামনেই খুন হয়ে যায় মা। দুর্ভোগ
মা সহ স্কুল থেকে ফিরছিলাম। পথে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যাই। মি. শেভার্নই বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে, সদর দরজায় নামিয়ে দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে যায় ও। কোয়ান্ট্রিল বাহিনী তখন পিছু নিয়েছে ওর। তাড়া খেয়ে জনমের তরে ক্যাম্পাস ছাড়ল সে, স্মিত হাসল মহিলা। আমাদের কাউকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগও দেয়নি।
আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল শেরিফ, বুঝতে পেরেছে সুবিধে করতে পারবে না। শেভার্নের লেখা জবানবন্দিটা রোল করে পকেটে ভরল। তারপর পুরো ক্যাম্পের ওপর চোখ বুলিয়ে ত্যাগ করল। এত অল্পে সন্তুষ্ট নই আমি, জুলিয়া, অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে আরও নিরেট প্রমাণ দরকার হবে শেভার্নের। এখানে তোমার স্বার্থ দেখছে ও, সুতরাং তোমার সাক্ষ্যে কজন জুরি সন্তুষ্ট হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।
শহরে গিয়ে কাগজপত্র খুঁজতে থাকো, দেখো আমার নামেও একটা পোস্টার পাও কি-না! নিখাদ বিদ্রুপের স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস, শেরিফের ওপর চরম অসন্তুষ্ট হয়েছে তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না।
কিন্তু উইল রেনারের খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলবে না ওর, প্রায় ঘোষণার সুরে বলল সে, পরিস্থিতি যা গড়িয়েছে তাতে মোটামুটি সন্তুষ্ট। মেজাজ নিতান্ত খারাপ না হলে গ্রেফতার এড়ানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে এমন কাউকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে না, হয়তো এজন্যেও কিছুটা প্রসন্ন বোধ করছে। উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাটের কিনারা ছুঁল শেরিফ। পরেরবার শহরে এলে দেখা হবে, প্রতিশ্রুতি দিল সে, এ নিয়ে আরও আলাপ করব আমরা, জুলিয়া। তারপর নিচু ট্রেইল ধরে এগোল ভোরের আলো ফুটতে থাকা দিগন্তের দিকে।
সামান্য একটা কম্বলের উষ্ণতা বোধহয় মিসেস ব্রুকসের আড়ষ্টতা কাটাতে যথেষ্ট হয়নি। শেভার্ন যখন ছড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলোকে একত্রিত করে যত্ন নিচ্ছে, ভাইয়ের সাহায্যে তখন আগুন জ্বালাল মহিলা।
একটু পর আগুনের কাছে এসে বসল শেভার্ন, নতুন একটা পরিবর্তন খেয়াল করল-শারীরিক আড়ষ্টতা সত্ত্বেও সহজ, স্বতঃস্ফুর্ত দেখাচ্ছে জুলিয়া ব্রুকসকে। সবুজ চোখে গভীর চাহনি, দশ বছর আগের সামান্য একটা ঘটনা যে শেভার্নের জন্যে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কল্পনাও করেনি বোধহয়। শেরিফ অভিযোগ নিয়ে না এলে বোধহয় ব্যাপারটা কখনোই প্রকাশ পেত না।
সত্যিই কি তোমার নামে পোস্টার ছাড়া হয়েছে? মৃদু স্বরে নীরবতা ভাঙল মহিলা।
কফির মগে চুমুক দেয়ার সময় মাথা ঝাঁকাল ও।
মিথ্যে অভিযোগটা করেছে কে?
উইল রেনার।
বুঝেছি। তোমাকে বিপক্ষে যোগ দিতে দেখে খেপে গিয়েছিল বোধহয়। কিন্তু এতদিন পরও সামান্য এই অভিযোগটা…
সামান্য নয়, ম্যাম, বাধা দিল শেভার্ন। রেনার খুন হয়ে যাওয়ার পর কেউই সামান্য হিসেবে দেখেনি। তাছাড়া আমার অতীতও লোকজনকে সন্দিহান করার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
অতীত?
তরুণ বয়সের পাগলামি বলতে পারো। স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে একটা স্টেজ লুঠ করতে গিয়েছিলাম দুই বন্ধু। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি সত্যিই স্টেজে টাকা থাকতে পারে। পিঙ্কারটনের দুজন স্টেজ গার্ড ছিল সঙ্গে। বলে থেমে গেল। শেভার্ন, কফির মগ নামিয়ে রেখে সিগারেট রোল করতে শুরু করল।
তারপর?
একেবারে হাতে-নাতে ধরা পড়লাম। বিচারে ছয় বছরের জেল হলো।
ওহ! কত ছিল তোমার বয়েস?
ষোলো। বাড়ি ফিরে এসে টের পেলাম ছয় বছরেও পাপমোচন হয়নি, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হলো। জেল খাটা আসামীকে সন্দেহের চোখে দেখে সবাই, অবজ্ঞা, শীতল আচরণ… বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, বাউণ্ডুলের মত ঘুরছি সেই থেকে।
আনমনে মাথা নাড়ল জুলিয়া ব্রুকস। ইংল্যান্ডে গেলে কখন? মেক্সিকো থেকে পালিয়ে চলে গেলাম।
কখনও তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পাইনি আমরা, কিছুটা দ্বিধা প্রকাশ পেল জুলিয়া ব্রুকসের কণ্ঠে। এই এতদিন পর..কি হবে তাতে? বরং তোমাকে ছোট করা হবে, অথচ ক্যাম্পাসের জন্যেই তোমার জীবনে এত দুর্ভোগ নেমে এসেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. শেভার্ন!
আজ যা করেছ সেটাই যথেষ্ট, ম্যাম, সম্ভষ্টির সঙ্গে ঘোষণা করল শেভার্ন, সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবছে সকাল পর্যন্ত চারপাশে খানিকটা চক্কর দিয়ে সময়টা কাটিয়ে দেবে। ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে সরে এল ও, ঘোড়ার যত্ন নিল।
দিনের আলো বেড়ে গেলেও শেভার্ন খেয়াল করল মিসেস ব্রুকসের মুখের ঔজ্জ্বল্য বাড়েনি। এখনও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে যুবতীকে, যেন দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ভাবছে জুলিয়া ব্রুকস শেষ পর্যন্ত প্রায়শই রোগাক্রান্ত মহিলায় পরিণত হয়ে যায়। কি-না, কিংবা কে জানে হয়তো সময়ের আগেই সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতক্ষণ না নিজে মুখ খুলছে কৌতূহল নিবৃত্ত করার ইচ্ছে নেই ওর। বাকবোর্ডে উঠতে মহিলাকে সাহায্য করল ও।
রওনা দিল ওরা। মাসট্যাঙগুলো আজ ভিন্ন মেজাজে আছে, সূর্যের তেজ বেড়ে যাওয়ার আগেই যতটা সম্ভব পথ পাড়ি দিতে চাইছে যেন।
শেভার্ন জানে মোটেই সন্তুষ্ট হয়নি শেরিফ, আগে বা পরে সোডা স্প্রিং-এর ওই ফ্রেইটারের সাথে ব্যবসা চুকিয়ে ফেলতে হবে ওকে। ব্যাপারটার শ্রেয়তর দিক বিবেচনা করল। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে অন্তত একবারের জন্যে হলেও বিজয়ীর পক্ষ নিতে হবে, নইলে ম্যাকলেন্ডনদের সঙ্গেই ডুবতে হবে ওকে, এবং আরও কজন যে দাবি করবে কুখ্যাত কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল। ও…
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। গতরাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন বোধ করছে-ঠিক তন্দ্রালু নয়, ছয় ঘোড়র ওয়্যাগন চালানোর কাজটা মনের এক অংশ ঠিকই চালিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু অন্য অংশটা নিরবিচ্ছিন্ন সুখী ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনার ফানুস ওড়াচ্ছে, যেখানে প্রতি দশ বছর পর পর নতুন ভাবে জীবন শুরু করে লোকেরা: নতুন নাম, নতুন পেশা কিন্তু পুরানো দিনের কোন স্মৃতি নেই। সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিস বোধহয় এটাই: তিক্ত অতীতের অনুপস্থিতি।
নিজেকে সচকিত করল শেভার্ন। সূর্য এখন পিঠ তাতাচ্ছে, ক্লিফের দেয়ালে ঠিকরে যাচ্ছে সোনালি রোদ। ঢালের আকারে লাগাতার উঠে গেছে ট্রেইল, একেবারে দুর্গম না হলেও আয়াসসাধ্য। মেস্কিট, জুনিপার আর ক্রিয়োসোট রয়েছে প্রচুর, এবং পাহাড়ী এলাকা বলে ওগুলোর বৃদ্ধি একটু বেশিই। মাইল খানেক দূরে ফর্ক আকৃতির পাইনের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আকার বা আকৃতিতে প্রায় একইরকম-দেখতে দারুণ লাগছে। আর কিছু না হোক, খানিকটা ছায়া পাওয়া যাবে ওখানে।
হঠাৎ করেই গতি বেড়ে গেছে ঘোড়াগুলোর, সামনে কোথাও ছায়া পাওয়া যাবে ব্যাপারটা এরাও টের পেয়েছে। যথেষ্ট গরম পড়ছে, এবং দুপুর নাগাদ আরও পড়বে; প্রায় অসহ্য বোধ হচ্ছে শেভার্নের। সোডা স্প্রিং-এ মাঝ দুপুরেও এত গরম পড়ে না, হয়তো উচ্চতার কারণেই পাহাড়ে গরম বেশি। বুক ভরে শ্বাস টানল ও, ক্ষীণ কিন্তু সজীব পাইনের সুবাস টেনে নিল সানন্দে।
ওর ভারী ওয়্যাগনের চেয়ে যথেষ্ট দূরে আছে বাকবোর্ডগুলো, ধুলো থিতিয়ে। আসার মত দূরত্বে। পাইনের ঝাড়ের কাছে যখন পৌঁছল শেভার্ন, ততক্ষণে রান্নার আয়োজন করেছে জুলিয়া ব্রুকস। ঘন পাইনের মাঝখানে ছোট্ট একটা ওঅটর হোল রয়েছে, এর আগে কেউ খুঁড়েছিল বোধহয়। চুইয়ে পানি জমা হচ্ছে সেখানে, তবে ওদের জন্যে যথেষ্ট। ঘোড়ার তেষ্টা মিটিয়ে সব ক্যান্টিন খালি করে ফেলল জুড, তারপর ভরে নিল ওঅটর হোল থেকে। চোখে প্রশ্ন নিয়ে পানির দিকে ইঙ্গিত করল শেভার্ন।
সোডা স্প্রিং-এর পানির চেয়ে ভাল, ওকে আশ্বস্ত করল ছেলেটা। আর কত দূর যেতে হবে? পনেরো মাইল।
ঘোড়ার যত্ন শেষে হার্নেস জুড়ল শেভার্ন, ব্রিড়ল ঠিকমত লেগেছে কি-না পরখ করল, তারপর সব ঘোড়ার খুর আর মুখ নিরীখ করল। লাগাতার চড়াই বেয়ে উঠতে হলেও মোটামুটি ভাল অবস্থায় আছে ঘোড়াগুলো। ঘাড় ফিরিয়ে রান্নায় ব্যস্ত মিসেস ব্রুকসের দিকে তাকাল, মহিলার ক্ষেত্রে একই কথা বলতে পারলে বোধহয় খুশি হত-কারণ আগুনের পাশে ঢুলতে শুরু করেছে লাল-চুলো। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। শুয়ে পড়ছ না কেন তুমি? প্রস্তাব করল শেভার্ন। কর্ন পোন তৈরি হয়ে গেলে জানতে পারব আমি।
নিশ্চই পারবে, মি. শেভার্ন।
খানিকটা এগিয়ে ফ্যাকাসে, ক্লান্ত মুখটা জরিপ করল ও। আমাকে ঠিকমত চেনোও না, অথচ জেদী বাচ্চার মত আমার পক্ষে সাফাই গেয়েছ?
আগেরটা আগে সারতে দাও, মি, শেভার্ন।
স্টুয়ের পাত্র আর ডাচ আর্ডেনের দিকে তাকাল শেভার্ন, জুলিয়া ব্রুকসের নির্লিপ্ততার কারণ বোঝার চেষ্টা করছে। সব ঝামেলা বিদায় করে দেয়ার পর?
এখনই আলোচনা করা কি জরুরী?
যদি ইচ্ছে হয় তোমার। …আঘাতটা কি খুব ভোগাচ্ছে তোমাকে?
মনে হচ্ছে তুলনা করার মত অবস্থায় নেই আমি।
আগুনের দিকে তাকাল ও। আশা করছে এস্টেটে পৌঁছার পর মিসেস ব্রুকসের স্বাস্থ্য এবং মেজাজ, দুটোরই উন্নতি হবে। তবে এটা ঠিক গতকাল সকালে যাত্রা করার পর থেকে লাগাতার ধকল যাচ্ছে, তারপরও আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে মহিলাকে।
তুমি তো সৈনিক ছিলে একসময়, খেই ধরল মহিলা। কখনও গুলি লেগেছে তোমার?
কয়েকটা আঁচড় ছাড়া তেমন ভুগতে হয়নি আমাকে।
গুলি বিঁধেনি?
এক হাতে চাঁদির ক্ষতটা স্পর্শ করল শেভার্ন, নতুন চামড়া গজাচ্ছে। ইতোমধ্যে একবার ওটাকে তুলে ফেলেছে ও।
কাঁধের ক্ষত সারতে কদিন লাগে বলতে পারো?
ঝটিতি ফিরে তাকাল শেভার্ন। গুলি লেগেছে তোমার? কখন?
আমার স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই।
ডান বগলের কাছে জায়গাটা ইঙ্গিত করল মহিলা। গুরুতর কিছু নয়, তবে আঁচড়ের চেয়ে বেশিই হবে। কিন্তু নড়াচড়া করলেই মনে হচ্ছে ক্ষতের মুখ খুলে যাবে।
ট্রেইলে বেরোনো উচিত হয়নি তোমার, অন্যমনস্ক সুরে বলল শেভার্ন। সপ্তাহ খানেক বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। বিশদ জানার জন্যে উপযুক্ত এবং শালীন কিছু শব্দের খোঁজে শব্দের ভাণ্ডার হাতড়ে বেড়াল ও। গোল্লায় যাক দ্ৰতা!
চাইলেও তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জড়াতে হচ্ছে আমাকে, ম্যাম। হয়তো তোমার সঙ্গে তোমার বাবার বা স্বামীর সম্পর্কটা আরও ভাল করে জানা উচিত আমার।
স্রেফ বখে যাওয়া একজন মানুষ! শীতল স্বরে বলল মহিলা। নিজের কানেই তো শুনলে, শেরিফ ওকে টিনহর্ন বলছিল।
ক্ষোভ নাকি হতাশা প্রকাশ পেল বুঝতে পারল না শেভার্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। পঞ্চাশ বছরে বাবা যে জ্ঞান অর্জন করেছে আমি যদি আঠারোতে তা করতাম… শ্রাগ করে থেমে গেল মিসেস ব্রুকস, ভুরু কুঁচকে উঠেছে। সন্দেহ নেই ঠিকই বলেছে শেরিফ। আমার স্বামী আর তোমার মধ্যে বলতে গেলে কোন পার্থক্য নেই।
অস্ফুট একটা শব্দ করল শেভার্ন। সত্যি, মিসেস ব্রুকস! কিন্তু আমি তো তোমাকে বড়জোর অস্ত্রের ধরন সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারব?
ওহ, ওভাবে বোঝাতে চাইনি আমি! শেরিফ তোমাকে কুখ্যাত লোক হিসেবে দেখলেও, আমার মনে হচ্ছে তোমার বর্তমান আচরণ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। স্রেফ আমার মা-র কথা মনে করছিলাম।
দুঃখিত, প্রসঙ্গটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ক্যাম্পাসের ঘটনা তো তুমি জানোই। আমার চোখের সামনেই খুন হয়ে যায়। মা। শহরের প্রায় সবাই যেহেতু ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ করার পক্ষে ছিল তাই নির্বিচারে সবাইকে খুন করেছে কোয়ান্ট্রিল গেরিলারা। মানুষগুলো ছিল পুরোপুরি নিরীহ, কেউ কেউ হয়তো যুদ্ধেও যোগ দিয়েছে, কিন্তু যে কোন একটা পক্ষ বেছে নেওয়ার অধিকার যেমন ছিল, নিজেকে বাঁচানোর অধিকারও ছিল তাদের, তাই না? উইল রেনারের লোক বা গেরিলারা সেই সুযোগ দেয়নি কাউকে, নির মানুষগুলোর ওপর স্রেফ টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রেও তো অলিখিত কিছু নিয়ম থাকে, নিরস্ত্র শত্রুকে খুন করে না বিবেকবান কোন মানুষ। সামান্য এই দয়াটুকুও পায়নি ওরা।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন।
শুনেছি যুদ্ধ যুদ্ধই, মা তাই বলত আমাকে। সাম্প্রদায়িক যে কোন আচরণই বন্ধ হওয়া উচিত, কিন্তু এটাই ছিল যুদ্ধের মূলমন্ত্র। হিংস্রতা কেবল হিংস্রতারই জন্ম দেয় যদ্দিন না একেবারে শেষে মানুষের মনে অন্যের জন্যে দয়া এবং সহানুভূতি জন্মায়।
মহিলার স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে এসবের সম্পর্ক আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলো শেভার্ন। ভাবছে স্বচক্ষে স্বামীকে মরতে দেখেছে কি-না মিসেস ব্রুকস। নিশ্চই তাই ঘটেছে, কারণ সে নিজেও একটা গুলিতে আহত হয়েছে। ট্রেইলের কোথাও ঘটেছে ঘটনাটা?
কি বললে?
কোথায় মারা গেছে তোমার স্বামী?
সোডা স্প্রিং-এ,স্টুয়ের পাত্রের দিকে মনোযোগ দিল জুলিয়া ব্রুকস।
ঘোড়ার যত্ন শেষ করে একটা কফি পটে পানি নিয়ে এসেছে জুড, আগুনে বসিয়ে দিল কেতলিটা।
আমার স্বামী মানুষটা ঠিক সুবিধের ছিল না। শেষদিকে পরস্পরের প্রতি আবেগ বা সহানুভূতি কোনটাই ছিল না আমাদের। ঝামেলা এড়াতে বাবা প্রায়ই টাকাপয়সা দিত ওকে… থেমে গেল মহিলা, দ্বিধা ফুটে উঠেছে চোখে। বাবার শক্রদের সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা করত ও। ব্যাপারটা সত্যিই হতাশ করে আমাকে, প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কয়েকবার খবর পাঠিয়েছিলাম ওকে, কিন্তু দেখা করা দূরে থাক, উত্তর দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। শেষে বাধ্য হয়ে শহরে গেলাম, দেখতে চাইছিলাম বাবার দেয়া টাকা কিভাবে জুয়া খেলে নষ্ট করছে সে।
গল্পের শেষ দিকটা আঁচ করতে পারছে শেভার্ন। অনুভূতিটা সুখকর কিছু নয় ওর জন্যে। সোডা স্প্রিং-এ মাত্র একটাই জুয়ার হল আছে, বিরস মুখে বলল।
গোল্ডেন ঈগল। জোচ্চোর আর বুলি হিসেবে তখন কুখ্যাতি অর্জন করেছে আমার স্বামী। সেলুনের পেছনের দরজায় যখন পৌঁছলাম আমি, টের পেলাম কারও সঙ্গে তর্ক করছে ও। …বাধ্য হয়েই ড্র করেছ তুমি, তাই না?
স্থির দৃষ্টিতে মহিলাকে দেখছে শেভার্ন। জানতে আমার গুলিতেই আহত হয়েছ তুমি?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন।
এও জানতে তোমার স্বামীকে খুন করেছি আমি?
মাথা ঝাঁকাল মিসেস ব্রুকস, মুখ নির্বিকার।
কিন্তু আমার ওপর বিদ্বেষ অনুভব করছ না!
অস্ত্র নিয়ে তুমি যদি নিজের জীবন বাঁচাতে পারো, তাহলে নিশ্চই ম্যাকলেন্ডনদের পক্ষেও দাঁড়াতে পারবে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি মি. ব্রুকসের মধ্যে যা দেখতে পায়নি, তেমন কিছুই তোমার মধ্যে চোখে পড়েছে আমার বাবার।
কিন্তু সে জানত না তোমার স্বামী আমারই হাতে…
জানতে পারলে খুশিই হত।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল এবার। ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ করা ধাতে নেই শেভার্নের, তাছাড়া সেসব প্রকাশ করে হবেটা কি? ঘোড়া নিয়ে ব্যস্ত জুডাস ম্যাকলেন্ডনের দিকে তাকাল। আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছে কেন ও? শেষে নীরবতা ভাঙল, ও কি জানে না আমার কারণেই বিধবা হয়েছ তুমি এবং শরীরে একটা ক্ষত নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার ধকল পোহাচ্ছ?
সবই জানে ও, মি. শেভার্ন। ওকে সাথে না নিয়ে বেচারার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছ তুমি।
তাহলে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল ও!
আমার স্বামীকে পছন্দ করত জুড, একই রকম শান্ত স্বরে যোগ করল মিসেস ব্রুকস। মাঝে মধ্যেই ভাবি এই বয়সের ছেলেরা কেন যে ছন্নছাড়া বেপরোয়া লোককে পছন্দ করে!
এবং এভাবেই, সিদ্ধান্তে পৌঁছল শেভার্ন, বিজ্ঞতার খ্যাতি পেয়ে যাই আমরা। জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে অন্ধভক্ত এক তরুণ বলে ধরে নিয়েছিল ও! স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তির কারণে এড়াতে পেরেছিল ছেলেটাকে, নিজের অজান্তে তরুণ আর শেরিফ দুজনকেই বোকা বানিয়েছে। ছেলেটার পরিকল্পনা ও কিভাবে আঁচ করে ফেলেছে তা ভেবে নিশ্চই কূল পায়নি ওরা।
এখন?
এখন কি, মি. শেভার্ন?
জুড নিজের ইচ্ছে পূরণ করার আগেই নিজের চামড়া বাঁচাতে চলে যাওয়া উচিত নয় আমার?
তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই আর। ওকে বুঝিয়েছি আমি। তাই?
অদ্ভুত হলেও সত্যি, এক বাউণ্ডুলের ভূত মাথা থেকে সরতে না সরতেই আরেকজনের ভূত চেপে বসেছে ওর ঘাড়ে।
বলতে থাকো, ম্যাম। আমার আচরণ কি একেবারে অভব্য?
পুরোপুরি ভদ্র এবং খাঁটি ইংরেজদের মত!
জুডাস ক্যাম্পের কাছে আসতে আলাপে ছেদ পড়ল। সাপার তৈরি হয়ে গেছে। নিজের জন্যে এক বাটি স্টু আর কর্ন পোনের একটা চাক নিয়ে পাইনের সারির কাছাকাছি সরে এল শেভার্ন। খেয়াল করেছি রুটি খাও না তুমি, মি. শেভার্ন, হঠাৎ বলল লাল-চুলো। ইংল্যান্ডের সব লোকই কি কর্ন পোন খেতে পছন্দ করে?
০৭-৮. আরেকটু হলেই থালাটা
আরেকটু হলেই থালাটা হাত থেকে খসে পড়ে যাচ্ছিল, কোন রকমে সামলে নিল শেভার্ন। আসলে, থালাটা সন্তর্পণে নামিয়ে রাখার ফাঁকে সন্তোষজনক এবং বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যার খোঁজে মাথা খাটাচ্ছে। ইংল্যান্ডে কর্ন বলতে যা বোঝায় এখানে গম, বার্লি, রাই বা যে কোন শস্যই কর্ন নামে পরিচিত। কর্ন বলতে তোমরা যেটাকে বোঝে আমরা সেটিকে বলি মেইজ, কিংবা কোন কোন সময় ইন্ডিয়ান কনও বলি।
কিন্তু জিনিসটা খাও তো, নাকি?
গরীব কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে খায় বটে। গুজব আছে শেষবার দুর্ভিক্ষের সময় আইরিশদের কন উপহার দিয়ে আসলে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে খেই ধরল ও। কিন্তু মেক্সিকোতে খাওয়ার জন্যে এছাড়া তেমন কিছু নেই।
উষ্ণ অঞ্চলে গম জন্মায় না তেমন, সেজন্যে স্থানীয় লোকজনের পক্ষে শস্য আমদানি করাও কঠিন। সময়ে বদলে গেছে মানুষের মনোভাব, কর্ন টরটিয়া, কর্ন টেমালেস, কর্ন সুপ, কর্ন মেনডো কিংবা কর্নের তৈরি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সবাই। স্থানীয় ধর্ম অনুসারে মেইজ গাছের সঙ্গে দেবতাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে।
মেক্সিকোতে অনেক দিন ছিলে?
আঠারোশো সাতষট্টি পর্যন্ত।
চলে এলে কেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। উনিশে জুনের ভোরে কোয়েরেটাররার বাইরে ছোট্ট এক পাহাড়ের কোলে একটা ফায়ারিং স্কোয়াডের আয়োজন করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আরও বিশজনের সঙ্গে আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল ওরা। উইল রেনারের খুন কিংবা ক্যাম্পাসের ঘটনার জন্যে নয়, বরং আমার অপরাধ ছিল একটাই, ম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হইনি… বিস্ময় মিসেস ব্রুকসের মুখে, খানিকটা ভয়ও ফুটে উঠছে চাহনিতে। কিন্তু নির্বিকার মুখে বলে গেল শেভার্ন। দেশটা বেশ শান্তিপূর্ণ, যে কোন সরকারই আশা, করে কিছু সময় পাবে তারা-যতক্ষণ না হিংস্রতা নির্মূল হয় এবং ইয়াঙ্কিরা আবারও অনধিকার চর্চা শুরু করে। কিন্তু সুযোগ পাননি ম্রাট, হুয়ারেজ সময় দেননি তাকে, বরং ম্রাটকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে ওঁর সমস্ত অনুসারীকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন।
কিন্তু হুয়ারেজ তো জাতীয় বীর ছিল!
লোয়ার ক্যালিফোর্নিয়া বিক্রির প্রস্তাবের সঙ্গে দেশপ্রেমের সমন্বয় সাধন করা। বোধহয় সত্যিই কঠিন ছিল।
সত্যি, মি. শেভার্ন!
প্রস্তাবটা আমেরিকানরা ফিরিয়ে দেয় মাত্র একটা কারণে-দর কষাকষিটা ঠিক যুৎসই হয়নি, টেরিটরিটা স্বাধীন নাকি অধীন কোন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে সেটাই ঠিক করতে পারছিল না।
প্রস্তাবটা ব্যর্থ হতে ব্রাউনসভিল থেকে মাজালান পর্যন্ত রেলরোড বিক্রি করার প্রস্তাব দেন হুয়ারেজ। স্বভাবতই ওঁর দেশের অর্ধেকটা গায়েব হয়ে যায়।
বিশ্বাস করতে পারছি না, মি. শেভার্ন।
দলিলপত্র আছে। তোমাদের সংবাদপত্রেও এসেছে খবরটা। সম্রাট ছাড়াও স্থানীয় বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল হুয়ারেজকে। জেনারেল ডায়াজ আরেকজন খাটি দেশপ্রেমিক, হুয়ারেজের জীবদ্দশায় সুযোগ পেলেই ঝামেলা করেছেন। বছর পাঁচেক আপে হুয়ারেজ নির্বাচনে হারার পর বিদ্রোহ শুরু করেন ডায়াজ। এই বিদ্রোহের শেষদিকে মারা যান হুয়ারেজ। কেবল তারপরই জেনারেল। ডায়াজ জাতীয় বীর হিসেবে নিজের ভূমিকা রাখা শুরু করেন-চির প্রতিদ্বন্দ্বী মারা যাওয়ার পর।
আমি নিশ্চিত জেনারেলও লোক দেখানো কান্নার পেছনে মিটিমিটি হেসেছেন-হুয়ারেজের প্রস্তাব মত দুই মহাসাগরকে সংযোগ করার কথা, বিনিময়ে জেনারেলকে স্বদেশ বিসর্জন দিতে হত। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, হুয়ারেজের মাতৃভূমিও একই।
জ্বলজ্বল করছে মিসেস ব্রুকসের চোখ। জুডের মুখে কোন বিকার নেই।
মরিয়া হয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখেন সেনর হুয়ারেজ, একটু একটু করে হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চল। সম্রাটের অনুগত বাহিনী একসময় নিউ অর্লিঙ্গে সরে যেতে বাধ্য করে ওঁকে, সামান্য বিদ্রোহীর মত নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন হুয়ারেজ। নিজেদের মধ্যে তখন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত গ্রিংগোরা, প্রয়োজনীয় অস্ত্রের যোগানও ছিল না। তারপর গৃহযুদ্ধ থেমে যেতে, ইউরোপ থেকে শান্তি প্রক্রিয়ার চাপ আসার পর, নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেন হুয়ারেজ। প্রয়োজনীয় অস্ত্রের যোগান থাকায় ক্ষমতা ফিরে পেতে অসুবিধে হয়নি ওঁর।
এভাবেই নিজেকে অস্বস্তিকর এক অবস্থায় আবিষ্কার করেন জেনারেল ডায়াজ। জাতীয় এক বীরের বিরুদ্ধে নগ্ন ভাবে বিদ্রোহ করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। বীরদের সমাধিতে শিরোমাল্য অর্পণ আর নিজের চোখের জলে পানি ছিটিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না ওঁর।
সেনর হুয়ারেজ কেমন ধরনের বীর বা দেশপ্রেমিক ছিলেন সেটা তুমিই ঠিক করে নিয়ো, ম্যাম। যদি রাজা ক্যালিফোর্নিয়া বিক্রি করতে সফল হতেন তাহলে মেক্সিকোর ইতিহাস হয়তো নতুন করে লিখতে হত। ব্রাউনসভিল থেকে মাজাৎলান পর্যন্ত যদি কাল্পনিক একটা রেখা টানা হয়, এর উত্তরে যত মেইনল্যান্ড এবং যোজকের দক্ষিণের এলাকা, সবকিছু চলে যেত আমেরিকার দখলে। ম্যাসাচুসেটস-এর মত ছোট্ট একটা এলাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত জাতীয় বীরকে।
তুমি দেখছি দারুণ আপত্তি করছ, মি. শেভার্ন।
নিজের সম্পদ হারাতে চায় না কেউ। অন্য কিছু নয়, বরং সম্রাটের মানহানি করার চেষ্টাই বেশি ত্যক্ত করেছে আমাকে। গণতন্ত্রের কথা বলা খুব সহজ-গ্রীক পণ্ডিতরা নিজেরাই শিখেছে এতে খুব একটা কাজ হয় না। তোমাদের দক্ষিণে, প্রতিবেশী দেশে কি জনপ্রিয় কোন সরকার গঠিত হয়েছে কখনও? কিংবা ছন্নছাড়া, ঠিকানাহীন প্রতিটি মানুষ কি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে? আসলে সত্যিকার ভুক্তভোগী হচ্ছে তারাই-খেটে খাওয়া কিছু মানুষ যারা কখনও ভোটাধিকার দাবি করেনি, এতটাই অশিক্ষিত যে একটা ভোটের গুরুত্বও এদের অজানা, কিন্তু এদের প্রত্যাশা একটাই-সমৃদ্ধ নয় বরং শান্তিপূর্ণ একটা পরিবেশে বাস করার অধিকার।
কিন্তু একজন সম্রাট… প্রতিবাদ করতে চাইল লাল-চুলো।
খোদা রক্ষা করুন রাণীকে! বাধা দিল শেভার্ন। তিনি যেন আজীবন সমৃদ্ধি আর সুখে থাকেন। কিন্তু প্রতি নির্বাচনের সময় নতুন নতুন ধান্ধাবাজ লোকদের দেখতে হয় আমাদের, তাদেরকেই নির্বাচন করতে হয়।
নীরবে মগে কফি ঢালল মিসেস ব্রুকস।
গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শেভার্ন। কিন্তু জানে এখানেই শেষ হয়নি ব্যাপারটা। ভেবেছিল তর্ক করে হয়তো কিছুটা প্রাণশক্তি ফিরে পাবে মিসেস ব্রুকস, কিন্তু এখনও ফ্যাকাসে নির্লিপ্ত রয়ে গেছে মহিলা। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বিশ্রাম নেওয়া উচিত তোমার, খাওয়া শেষে বলল ও। শক্তি ফিরে পেতে হবে, নইলে যাত্রার ধকল সামলাতে পারবে না।
আমি ভালই আছি…
মোটেই না। তুমি যদি বিশ্রাম না নাও তাহলে হয়তো বিকল্প চিন্তা করতে হবে। আমার আপত্তিকর সামর্থ্য বাদ দিলেও, ক্ষতের পরিচর্যা করতে হলে কাপড় খুলতে হবে তোমার।
নিমেষে চুলের মত লাল হয়ে গেল জুলিয়া ব্রুকসের অপূর্ব সুন্দর মুখ। বিনা বাক্যব্যয়ে বেডরোলে শুয়ে পড়ল, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে শেভার্নের দিক থেকে। এই ফাঁকে থালা-বাসন ধুয়ে টুকিটাকি অন্যান্য কাজ সেরে ফেলল শেভার্ন আর জুড।
সামনের রাস্তা কেমন? জানতে চাইল শেভার্ন।
চলনসই, নিরুত্তাপ স্বরে বলল ছেলেটা।
পেছনে যে পথ ফেলে এসেছি তারচেয়ে ভাল?
প্রায় একই।
তোমার বোনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
বহু লোকের দুশ্চিন্তার খোরাক ও।
সেটা সত্যি, ভাল শেভার্ন। যতটা দেখাচেছ তারচেয়ে বেশি অসুস্থ ও। তুমি কি চাও না ও বেঁচে থাকুক?
আচমকা ধৈর্য হারিয়ে ফেলল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। তামাশা করছ?
ছেলেটাকে আশ্বস্ত করল ও, সত্যিই কোন তামাশা করছে না। সামনের ট্রেইল কেমন, আমার ওয়্যাগনের সাথে একটা বাকবোর্ড বেঁধে টেনে নেওয়া যাবে?
জুলিয়া যাতে শুয়ে থাকতে পারে?
হ্যাঁ।
ওয়্যাগনে আরও দুটো মাসট্যাঙ জুড়ল শেভার্ন, তারপর বাকবোর্ডের সঙ্গে জোড়া লাগাল। প্রায় দুপুর হয়ে গেল কাজটা সারতে। ওয়্যাগনের মালপত্র অদল বদল করল, খাবারের প্যাকেট দিয়ে শূন্য জায়গা ভরল। ওজনের ভারসাম্য থাকবে এবার। সবশেষে জুলিয়া ব্রুকসকে পাজাকোলা করে তুলে নিল, যতটা ভেবেছিল লাল-চুলোর ওজন তারচেয়ে বেশ কম মনে হওয়ায় রীতিমত বিস্মিত হলো। এবার নিশ্চই আরাম বোধ করছ? মহিলাকে বেডরোলের ওপর শুইয়ে দিয়ে জানতে চাইল ও। শিগগিরই যাত্রা শুরু করব আমরা, আর কিছু লাগবে তোমার?
শুধু রাইফেলটা।
বাকবোর্ড থেকে ভারী রাইফেলটা নিয়ে এল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। এবার আগে আগে চলল শেভার্ন, যাতে পেছনের বাকবোর্ডের ওপর নজর রাখতে পারে ছেলেটা। পাইনের সারির ফাঁক গলে মন্থর গতিতে এগোল ওয়্যাগন, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ছায়া পাচ্ছে ওরা। ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল শেভার্ন, বুঝতে চাইছে পরিবর্তনটা কিভাবে নিয়েছে মিসেস ব্রুকস। মহিলা তখন হয় ঘুমিয়ে পড়েছে নয়তো জ্ঞান হারিয়েছে।
আটটা মাসট্যাঙ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওয়্যাগন। আগে ছয়টাকে সামলাতে কসরৎ করতে হয়েছে, কিন্তু এবার যেন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে শেভার্নকে। তাছাড়া পেছনের বাকবোর্ড তো আছেই। প্রায়ই এদিক-ওদিক বেঁকে যাচ্ছে বাকবোর্ড, সামলে রাখা কঠিন হচ্ছে, মাসট্যাঙগুলোও বেয়াড়া আচরণ শুরু করেছে। আরেকটা টানা দৌড় দরকার, ভাবল ও, তাহলেই হয়তো শান্ত হবে। ঘোড়াগুলো।
লাগাতার চড়াই বেয়ে উঠতে হলেও ঘোড়াগুলোর উদ্যমে ঘাটতি দেখা গেল, হয়তো ট্রেইলের চারপাশে সবুজের সমারোহ বাড়ছে বলেই। পেছনে মরুভূমি ফেলে এসেছে ওরা, আশপাশে এখন অ্যাসপেন, পাইন, ট্যামারেক-এর বিক্ষিপ্ত বন চোখে পড়ছে। পাশের জমিতে ঘাস দেখা যাচ্ছে, একই সাইজের সব যে পশুই খেয়েছে প্রায় গোড়া পর্যন্ত ঘাস টেনে নিয়েছে। পশুদের মধ্যে এর আগে এতটা নিয়মানুবর্তিতা দেখেনি শেভার্ন। ফের পেছন ফিরে তাকাল ও, কি একই ভাবে স্থির পড়ে আছে মিসেস ব্রুকস।
তৃণভূমিতে পশু চরার কথা, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চোখে পড়বে। শেভার্ন ভাবছে কিভাবে এমন অনুর্বর জায়গায় র্যাঞ্চিং করছে ম্যাকলেন্ডনরা। কি মাস চলছে এখন? মে-র শেষ হবে বোধহয়। মে-তেই যদি ঘাসের এই দুরবস্থা হয় তাহলে সেপ্টেম্বরে কি দশা হবে? নিঃসন্দেহে বেসিনে ঝামেলা হওয়ার একটা কারণ এটা।
ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেল, কিন্তু সচল প্রাণের কোন নমুনা দেখা গেল না। সামনে পাহাড়শ্রেণীর বুকে তুষারশুভ্র বরফের চাঙড় চোখে পড়ছে, যেন মুক্তোর বিশাল দানা একেকটা। পর্যাপ্ত পানির যোগান রয়েছে এমন উপত্যকা আছে ওপরে কোথাও, সারা শীতেও ঘাস থাকার কথা কিন্তু হরিণ আর অ্যান্টিলোপ যে একচেটিয়া সুযোগ পাচ্ছে না, দেখেই বোঝা যায়। আশপাশে এমন কোন চিহ্ন নেই যাতে বোঝা যাবে গরু চরছে খর্বাকৃতির ঘাসে ভরা এই তৃণভূমিতে।
সামনে বিক্ষিপ্ত ভাবে জন্মেছে কিছু পাইন। আচমকা কামানের গোলার মত ওয়্যাগনের পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা কিছু। নিমেষে হোলস্টারে হাত বাড়াল শেভার্ন, তারপরই টের পেল উড়ন্ত একটা স্কুইরেল চমকে দিয়েছে ওকে। ফের নীরব হয়ে গেল ট্রেইল, আটটা মাসট্যাঙের লাগাতার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। শক্ত হাতে লাগাম চেপে ধরল ও, পাছে ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করে বেয়াড়া ঘোড়াগুলো।
জুড বলেছিল পনেরো মাইল। এতক্ষণে অন্তত অর্ধেকটা পাড়ি দিয়েছে ওরা। ঘোড়াগুলো নতুন উদ্যমে ছুটছে যেন সামনের বাঁক পেরুলেই বিশ্রাম পাবে। কিন্তু বাঁক পেরিয়ে আসতে জিপসীদের ক্যারাভানের মত একটা ওয়্যাগন দেখতে পেল শেভার্ন।
কাত হয়ে পড়ে আছে ওয়্যাগনটা। ক্যানভাসের আচ্ছাদন থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে এখনও। আসনের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ল শেভার্ন, লাগাম টেনে ধরেছে। একসময় থেমে গেল ওয়্যাগন। ব্রেক সেট করে লাফিয়ে নামল ও, ট্রেইলের পাশে এসে বিধ্বস্ত ওয়্যাগনের চারপাশ জরিপ করল। ওপাশে পড়ে আছে এক বুড়ো, ইন্ডিয়ান বা মেক্সিকান হবে। পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মৃত।
আরকেডিও! সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল জুড, বাকবোর্ড থামিয়ে ছুটে আসছে।
তোমাদের লোক?
নড করল ছেলেটা।
গুলিতে মারা গেছে বুড়ো। ডান বাহু উড়িয়ে দিয়েছে বুলেট, তারপর বুকের ভেতরে ঢুকে গেছে। মরার আগে প্রচুর রক্ত হারিয়েছে লোকটা। আড়চোখে জুড়ের দিকে তাকাল শেভার্ন, ভাবছে নির্মম ও কঠিন মৃত্যু তরুণ ম্যাকলেন্ডনের মধ্যে কি প্রভাব ফেলে। অস্থির বা উদ্বিগ্ন হলেও তা সযতে চেপে রাখতে সক্ষম হয়েছে জুডাস ম্যাকলেন্ডন, নির্বিকার মুখে তেরপল আনতে বাকবোর্ডের কাছে ফিরে গেল সে।
একটু পর মৃতদেহটা বাকবোর্ডে তুলল ওরা।
ক্যারাভান থেকে কিছু নিয়ে আসতে চাও? জানতে চাইল শেভার্ন।
কোত্থেকে?
ওয়্যাগন থেকে।
ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় ভুগল জুড, তারপর ক্রল করে উল্টে পড়ে থাকা ওয়্যাপনের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেঁকে যাওয়া কিম্ভুত কিমাকার যীশুর মূর্তি আর একটা ছবি নিয়ে বেরিয়ে এল সে একটু পর, এমন ছবি চার্চে দেখেছে শেভার্ন। প্রোট্যাস্ট্যান্ট হাতে বিধ্বস্ত কিন্তু পবিত্র জিনিসগুলো ধরতে হচ্ছে বলেই হয়তো কিছুটা বিব্ৰত দেখাচ্ছে জুডকে। রিটাবলো, ব্যাখ্যা করল সে। পরিবারের কাছে ওর গুরুত্ব অনেক।
বেঁচে থাকলে যতটা গুরুত্ব থাকত, ততটা বোধহয় আর নেই এখন, বলল শেভার্ন। দুজনে মিলে এরপর ট্রেইল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল ওয়্যাগনটাকে। আর কত দূর?
চার বা পাঁচ মাইল।
ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এল ও। আসনে বসে ব্রেক রিলিজ করার ফাঁকে পেছন ফিরে স্থবির পড়ে থাকা মিসেস ব্রুকসের দিকে তাকাল উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। মনে মনে গাল বকছে নিজেকে আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল ব্যাপারটা। সোডা স্প্রিং-এ সামান্য একটা প্রশ্ন করলেই সমস্ত রহস্য বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু অতি মাত্রায় সতর্ক ছিল ও, কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গিয়ে শেষে স্থানীয় কারও প্রতি ঋণী, হয়ে পড়তে চায়নি, কিংবা নতুন কোন আপদও জোটাতে চায়নি। শহর থেকে ষাট মাইল দূরে আর আট হাজার ফুট ওপরে চলে এসেছে এখন, দশ হাজার পশু আছে এমন একটা বাথানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ব্র্যান্ডহীন একটা বাথান। ম্যাকলেন্ডনরা যে এলাকায় জনপ্রিয় নয়, তাতে বিস্ময়ের কি আছে!
যে বুড়োর প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল ও, সে-ই বলতে পারত ওকে। অন্যরাও বলতে পারত। ওদের বোলো ম্যাকলেন্ডন খবর পাঠিয়েছে! ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে নিজের সুসম্পর্কের জন্যে গর্ব করেছে স্কটিশ বুড়া। প্রথম হয়তো সে-ই এসেছে এখানে, তার পুরস্কারও পেয়েছে। কিছু কিছু ব্যাপারে সহনশীল পশ্চিমের লোকেরা, ধৈর্য ধরে মেনে নেয় অপছন্দনীয় জিনিস; কিন্তু আগ বাড়িয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন করে না, যদি না কোন আগন্তুক ওর মত অন্যদের দৃষ্টি কাড়ে।
বংশানুক্রমিক ভাবে ঝামেলাবাজ এবং পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না এসব লোক; ক্ষমা করতে সক্ষম, এমনকি ভুলতেও সক্ষম, কিন্তু বাপের শত্রুতা পরের প্রজন্মের জন্যে রেখে যেতে অনিচ্ছুক। ম্যাকলেন্ডনদের কোন ব্র্যান্ড নেই, সেটাও ক্ষমা করতে প্রস্তুত, কিন্তু একটা পাপ ক্যাটলম্যানরা কখনও ক্ষমা করতে রাজি নয়।
দশ হাজার পশু, দেখে-শুনে রাখতে পারলে দারুণ সম্পত্তি হতে পারে, বিড়বিড় করল শেভার্ন।
কি বলছ? মিসেস ব্রুকসের কণ্ঠ শুনতে পেল শেভার্ন, শেষ পর্যন্ত জেগে উঠেছে।
দশ হাজার পশু, দেখে-শুনে রাখতে পারলে দারুণ সম্পত্তি হতে পারে, আবারও বলল ও।
আমার ধারণা ইতোমধ্যে সংখ্যাটা বোধহয় কমে গেছে। ঝামেলা শুরু হওয়ার পর আর রাউন্ড-আপ করিনি আমরা।
কত দিন ধরে চলছে?
কয়েক মাস।
তার আগে কখনোই ঝামেলা হয়নি?
না, যদ্দিন না অন্যরা আমাদের জমিতে গরু চরানোর চেষ্টা করেছে।
বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল শেভার্ন।
মনে হচ্ছে খেপে গেছ তুমি, মি. শেভার্ন? আমি যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম, এর মধ্যে কিছু ঘটেছে নাকি?
কয়েকটা ব্যাপার ঘটেছে, মিসেস ব্রুকস। কিন্তু সেজন্যে নয়, নিজের ওপরই বিরক্তি লাগছে আমার।
তাই?
পুরে মানবজাতিই টিকে আছে পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর, তিক্ত স্বরে বলল ও। নির্জলা মিথ্যে ত্যক্ত করে আমাদের, কারণ সেটা নিয়ম বা রীতির ব্যতিক্রম।
অস্বীকার করার উপায় থাকল না লাল-চুলোর।
কিন্তু সজ্ঞানে কাউকে বিভ্রান্ত করাকে কি বলবে? নাক সিটকে বলল শেভার্ন। কেউ নিশ্চই আমাকে বলতে পারত দশ হাজার পশু বলতে আসলে দশ হাজার ভেড়া বুঝিয়েছে মি. ম্যাকলেন্ডন!
.
০৮.
ইংল্যান্ডের লোক কি ভেড়া পোষে না? তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
নিশ্চই, প্রচুর, স্বীকার করল শেভার্ন। একশো বছর আগে দখলদার সব কৃষককে তাড়িয়ে না দিলে হয়তো আমেরিকাও এতদিনে পুরোপুরি স্পেন হয়ে। যেতে পারত, ভেড়ার জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ আর জায়গা তৈরি করত ওরা।
ভেড়া লালন-পালনের ব্যাপারে আপত্তি আছে তোমার?
আমার মতামতের দাম কি! তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো আত্মরক্ষা করার ন্যূনতম তাগিদও নেই আমার মধ্যে? নাকি খুশি হয়েই ভেড়াকে ঘৃণা করা উচিত? কিন্তু আদৌ কতটা কাজে আসবে ব্যাপারটা, যেখানে বিরোধী মতের লোকের সংখ্যা আমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি? ক্ষণিকের জন্যে থামল ও, তারপর বিষণ্ণ স্বরে যোগ করল: এমনকি মার্সেনারিরাও যৌক্তিক কারণ ছাড়া মরতে দ্বিধা করে।
কিভাবে অযৌক্তিক হলো, শি শেভার্ন? কি কাপড় পরেছ তুমি? সূতী কাপড় পরে ঘুমাও তো?
আমাকে প্রভাবিত করার দরকার নেই! অসন্তোষ চেপে রাখল না শেভার্ন, অজান্তে গলা চড়ে গেছে। বরং তোমার মাথামোটা প্রতিবেশীদের বোঝানোর চেষ্টা করো-ভেড়া কখনও ঘাস নষ্ট করে না কিংবা পানিও ঘোলা করে না।
এখানে আমরাই প্রথম এসেছি, তাতেও কিছু যায়-আসে না?
ইন্ডিয়ানদের আগে?
মনে আছে, ক্যাম্পাসের কথা বলেছিলাম তোমাকে? মা মারা যাওয়ার পর এখানে আসি আমরা, শোক আর যুদ্ধের সহিংসতা ভোলার জন্যেও এমন শান্তিপূর্ণ একটা জায়গা দরকার ছিল আমাদের। ঝামেলা চাননি বলেই পাহাড়ে বসতি করেছেন বাবা, শুরুতে খানিকটা অসুবিধে হলেও শেষপর্যন্ত ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেছেন। পাহাড়ে গরু পোষা যায় না, মি. শেভার্ন, ভেড়ার বাথান করাই সব দিক থেকে সুবিধাজনক। শান্তিতেই ছিলাম আমরা। ইদানীং বসতির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝামেলাও শুরু হয়েছে।
বিশ্রী একটা গন্ধ লাগছে, ধোয়ার গন্ধ। বাতাস ভারী হয়ে আছে। তর্ক করতে যেয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল শেভার্ন, আশা করছে মহিলাও নীরব থাকবে। দক্ষিণ থেকে ঝড়ো বাতাস বয়ে আসতে গন্ধটা প্রকট হলো আরও।
মনোবিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের মন্তব্য মনে পড়ল ওর, লোকটির অদ্ভুত ধারণার কারণে প্রায়ই তামাশা করত ছাত্ররা। অধ্যাপকের মতে দৃষ্টিগ্রাহ্য বা শ্রুতিমোগ্য যে কোন উদ্দীপনার চেয়ে সাধারণ বিষয়বুদ্ধিই মানুষের সত্তার গভীরতা স্পর্শ করতে সক্ষম। ভেড়ার ক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারলে খুশি হত শেভার্ন। জানে কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, প্রায় অবচেতন মন। থেকে আশা করল পেছনের ওই মহিলার সাথে এতটা অন্তরঙ্গ না হলেই বোধহয় ভাল হত।
কিন্তু ঠিক ওর পেছনে চলে এসেছে মিসেস ব্রুকস, একটা বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ নামিয়ে ওর দিকে তাকাল, শঙ্কা মহিলার চোখে।
একই আশঙ্কা আমিও করছি, মৃদু স্বরে একমত হলো ও।
ঢাল বেয়ে উঠে গেল ওয়্যাগন, ম্যাকলেন্ডন এস্টেট আর সামনের বিশাল আঙিনা স্পষ্ট চোখে পড়ল এবার। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল শেভার্ন, পোড়া কোন বাড়ি দেখতে কারোই ভাল লাগার কথা নয়।
একসময় বাড়ি ছিল, কিন্তু এখন কেবলই ধ্বংস তৃপ; পড়ে থাকা ছাইয়ের তুপ থেকে ধোয়া উঠছে। বাড়ি, স্টেবল, বার্ন কোনটাই আস্ত নেই। উপত্যকার ওপাশে পাইনের সারির ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা খুঁটি নীরবে নিষ্ঠুর কাজটার সাক্ষ্য দিচ্ছে! আঙিনার এক কোণে বসে ছিল বয়স্কা এক মহিলা, ওয়্যাগনের শব্দে ফিরে তাকাল-চোখে আশঙ্কা আর বিস্ময়। মিসেস ব্রুকসকে চিনতে পেরে অস্ফুট চিৎকার করে ছুটে এল মহিলা।
আট মাসট্যাঙের ওয়্যাগন থামিয়ে জুলিয়া ব্রুকসকে নামতে সাহায্য করল শেভার্ন। পরস্পরকে আঁকড়ে ধরল দুই মহিলা, অনর্গল স্প্যানিশে কথা বলে যাচ্ছে মিসেস ব্রুকস, কিন্তু স্কটিশ টান ঠিকই রয়ে গেছে।
পেছনে বাকবোর্ড নিয়ে পৌঁছে গেছে জুড, বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত বসতি আর শোকাতুর পরিবারের কাছে ফিরে আসার এমনই এক স্মৃতি ভেসে উঠল শেভার্নের মানসপটে কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। বাকবোর্ড আর ওয়্যাগন থেকে ঘোড়া ছাড়িয়ে নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও, আশা করল এই ফাঁকে নিজেদের সামলে নেবে ম্যাকলেন্ডনরা।
র্যাঞ্চ হাউসের জন্যে উপযুক্ত জায়গাই পছন্দ করেছিল ম্যাকলেন্ডন। সারা উপত্যকা জুড়ে অ্যাসপেন আর পাইনের ঝাড়, সারাক্ষণ ছায়া আর প্রশান্তি বিলাচ্ছে যেন। পেছনে পাহাড়শ্রেণী, আর পাশেই অগভীর ক্রীক। ঢেউ খেলানো উপত্যকায় নয়ন জুড়ানো সবুজ ঘাস, যে কেউ গর্বিত হবে এর মালিক হলে। কেবল একটা অসঙ্গতিই চোখে পড়ছে-নিরাপত্তার দিকটা ঠিক সংগঠিত নয়। উপত্যকার ওপাশ থেকে, কিংবা দুপাশ থেকে র্যাঞ্চ হাউসে আক্রমণ করতে পারবে যে কেউ। ইন্ডিয়ানদের ব্যাপারে নিশ্চই নিশ্চিন্ত ছিল নীল ম্যাকলেন্ডন, ধারণা করল শেভার্ন, নয়তো নিজের হেডকোয়ার্টার হিসেবে সুন্দর কিন্তু খোলামেলা জায়গা পছন্দ করত না।
হার্নেস থেকে ঘোড়া ছাড়িয়ে একপাশে সরিয়ে নিল শেভার্ন। জুড, তার বোন কিংবা বয়স্কা মহিলা এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি।
আয়ার, বয়স্কার কণ্ঠ কানে এল শেভার্নের, মানে গতকাল। সম্ভবত আগুন লাগার কথা বলছে মহিলা। পড়ে থাকা ছাইয়ের প থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার আর আংশিক পোড়া কিছু কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালাল ও। অন্যরা সামলে ওঠার আগেই সাপার তৈরি করে ফেলল।
আলগোনোস মুয়েরটস? বয়স্কাকে জিজ্ঞেস করল শেভার্ন, জানতে চাইছে আশপাশে কোন মৃতদেহ আছে কি-না। তৎক্ষণাৎ বাকবোর্ডে নিয়ে আসা মৃতদেহটার কথা মনে পড়ল। জুডের দিকে ফিরে তাকাল ও, তরুণ ম্যাকলেন্ডনও ভুলে গেছে লোকটার কথা। ওর স্বামী?
নড করল ছেলেটা।
আবারও বোধহয় শোকের পর্ব শুরু হবে। কাপুরুষের ভূমিকা নিতেই পছন্দ করল শেভার্ন, সরে এল আঙিনা থেকে। সাপারের দিকে খেয়াল রেখো, পুড়ে না যায় যেন, মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে বলল ও, আশা করছে ভাই-বোন মিলে দুঃসংবাদটা দেবে মহিলাকে। জুডের বাকবোর্ডে তল্লাশি চালিয়ে একটা কোদাল। খুঁজে পেল, সেটা তুলে নিয়ে আঙিনা ছাড়িয়ে কিছুটা এগোনোর পর কবরস্থানটা খুঁজে পেল। খোলা একটা জায়গা পছন্দ করে খুঁড়তে শুরু করল ও। পেছনে করুণ বিলাপের শব্দ শুনে বুঝতে পারল তিক্ত, জঘন্য কাজটা সেরে ফেলেছে ভাই বোনের যে কেউ।
স্বামীর উপযুক্ত সৎকার হোক, মনে-প্রাণে চাইছিল মহিলা, কিন্তু তাকে প্রভাবিত করতে কষ্ট হলো শেভার্নের-কোন প্রীস্ট বা ক্যাথলিক কোরামের অনুপস্থিতিতে এমন কিছু যাবে-আসবে না, সেজন্যে সারারাত জেগে থাকারও মানে হয় না। তোমার স্বামী যে ভাল মানুষ ছিল সেটা শুনিয়ে দেওয়ার জন্যে কাউকে দরকার নেই ঈশ্বরের, ব্যাখ্যা করল ও, কিন্তু বলল না যে প্রায় পুরো একটা দিন তপ্ত রোদে পড়ে ছিল লোকটি, সেটা পুষিয়ে দেওয়ার জন্যে কোন দয়া, সহানুভূতি বা ধর্মীয় নিষ্ঠাই যথেষ্ট নয়।
মেক্সিকানকে গোর দিতে দিতে আঁধার নেমে এল। লণ্ঠনের ফ্যাকাসে আলোয় অর্ধ-সিদ্ধ সাপার খেল ওরা। এখন কেমন বোধ করছ, ম্যাম? মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে জানতে চাইল শেভার্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাল-চুলো। আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. শেভার্ন।
কেন?
নিজেদের ঝামেলায় তোমাকে জড়িয়েছি আমরা।
শরীরে ক্লান্তি এতটাই যে নির্দোষ মিথ্যে বলতে ইচ্ছে করল না শেভার্নের। কাল এ নিয়ে আলাপ করব আমরা, জুডের দিকে ফিরল ও। জুড, রাতের প্রথম দিকটা পাহারা দিতে পারবে তো?
মনে হয় পারব।
কম্বলের ভাঁজ খুলে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল ও। ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ক্লান্তি সত্ত্বেও কাজটা সহজ হলো না। দশ হাজার পশু দেখাশোনা করার জন্যে-হোক না ভেড়া-বেশ কয়েকজন লোক লাগার কথা। কোথায় এরা? ভেড়াগুলোই বা কোথায়? সকালে বয়স্কা মহিলাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
আচমকা ঘুম টুটে গেল ওর। মুখ চেপে ধরে ওকে জাগাতে চাইছে কেউ। চোখ মেলতে মিসেস ব্রুকসের উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেল শেভার্ন। কি হয়েছে? মহিলা হাত সরিয়ে নিতে ফিসফিস করে জানতে চাইল ও।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এল লাল-চুলো মহিলা, মিষ্টি একটা সুবাস দোলা দিয়ে গেল শেভার্নকে।
এদিকে আসছে কেউ! ফিসফিস করে জানাল মিসেস ব্রুকস।
পায়ে বুট গলিয়ে ঝোপের দিকে সরে গেল শেভার্ন, পরখ করল হোলস্টারেই আছে কোল্ট দুটো। বয়স্কা মহিলাকে ঘুম থেকে তুলে আরেক দিকে সরে গেছে জুড আর মিসেস ব্রুকস। অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন, ঘন্টার মৃদু শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ করেই টের প্লে অযথা আশঙ্কা করছে। কোয়েইন!? শুধাল ও।
ইউসেবিও, স্প্যানিশে উত্তর দিল নোকটা।
অপেক্ষায় আছে শেভার্ন, দেখতে চাইছে লোকটি কে। একটা ব্যাপার নিশ্চিত: কোন কাউবয়ই ঘোড়ার গলায় ঘন্টা ঝোলায় না।
মাঝবয়সী মানুষ ইউসেবিও, বোদপোড়া রঙ তার। ঘন কালো গোঁফ, আর তারচেয়ে কুচকুচে কালো চুল, এমনকি কাঁধেও কিছু চুল গজিয়েছে। শেভার্নের। চেয়ে কিছুটা খাটো হবে সে, কিন্তু চওড়ায় প্রায় দ্বিগুণ। পাহাড়ে ভেড়ার তদারক করে, শেষবার মাসখানেক আগে এসেছিল। লবণের যোগান ফুরিয়ে যেতে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে।
আবছা অন্ধকার ভেদ করে এস্টেটের ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকাল সে, নমুনাগুলো দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আনমনে মাথা নাড়ছে, ঢোক গিলে অস্ফুট শব্দ করল। শেভার্নের বুঝতে সময় লাগল যে, মাঝবয়সী লোকটি সদ্য বিধবা হওয়া মহিলার ছেলে বা ভাতিজা জাতীয় কেউ হবে।
ওদিকে কোন সমস্যা হয়নি তো? স্প্যানিশে জানতে চাইল শেভার্ন।
না, কেন হবে? ইংরেজিতে বলল ইউসেবিও, কিন্তু শেভার্নের স্প্যানিশ যতটা শুদ্ধ মেষপালকের ইংরেজিও ততটাই বিশুদ্ধ। বক্স ক্যানিয়নে আছে সব ভেড়া। কদিন ওদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এ বছরটা মনে হয় ভালই কাটবে। নেকড়ে বা কয়োটের ঝামেলা নেই, কোন আচমকা ইংরেজির স্টক ফুরিয়ে গেল তার। ট্রোটানাও নেই।
চুলকানি, জানাল মিসেস ব্রুকস, কিন্তু তারপরও শেভার্ন বুঝতে পারেনি দেখে ব্যাখ্যা করল: মাঝে মধ্যে অদ্ভুত এক রোগে পেয়ে বসে ভেড়াগুলোকে, পাগলের মত আচরণ শুরু করে দেয়। পশম চুলকে চামড়া তুলে ফেলে ওরা, শেষ পর্যন্ত মরেই যায়।
প্রতিকার নেই?
অসুস্থ ভেড়াগুলোকে মেরে ফেলতে হয়, বলল ইউসেবিও। গত পাঁচ বছর তাই করতে হয়েছে আমাদের। এবারই ব্যতিক্রম।
সাধারণ আলাপচারিতা বোধহয় শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করল, অন্তত সাময়িক ভাবে। ঘুমাতে গেল অন্যরা, কিন্তু কম্বলের উষ্ণতায় নিজেকে মুড়ে রেখে ভোরের অপেক্ষায় থাকল জিম শেভার্ন। অনুতাপের সঙ্গে উপলব্ধি করল এমন একটা বয়সে পড়েছে যখন মাঝরাতে এক কাপ গরম কফিও সহ্য করছে না ওর পেট। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল, আর যাই হোক অন্তত কোন ভেড়া নয় ও, কোন চুলকানিও পেয়ে বসেনি ওকে। সারা দিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভেবে কাক্ষিত একটা সমীকরণে পৌঁছার চেষ্টা করল।
সবকিছু মোটামুটি সহজ। এখানে প্রথম এসেছিল নীল ম্যাকলেন্ডন, যেভাবেই হোক ইন্ডিয়ানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরি করেছিল, এবং উন্নতি করেছে নিজের। কিন্তু অন্যরা আসতে শুরু করল একসময়, ছোট ছোট হোমস্টেডার বা র্যাঞ্চাররা ভিড় করতে থাকল আশপাশে। এদের মনোভাব পরিষ্কার, দেশটা আর যাই হোক ভেড়ার জন্যে নয়, কিংবা ম্যাকলেন্ডনদের একারও নয়। সম্ভবত ম্যাকলেন্ডনরাও একই তিক্ততার শিকার।
সকালে হয়তো জানা যাবে ইউসেবিওর পালে কটা ভেড়া আছে, কিংবা ওর দলে কজন হার্ডার আছে। কে বলবে অন্য পালগুলো ক্যাটলম্যানদের সহিংস আক্রমণের শিকার হয়নি!
গরু, ভেড়া আর কৃষকের ত্রিমুখী চিরন্তন দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আগেও শুনেছে শেভার্ন। এই দেশে, এ পর্যন্ত কৃষকরা তেমন সুবিধে করতে পারেনি, তাই প্রতিযোগিতায় এদের ভূমিকা কমই। গরু আর ভেড়ার মালিকেরাই বরং পরস্পরের সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে বেশি। একজন আরেকজনের পালে স্ট্যাম্পিড করিয়ে মেরে ফেলেছে হাজার হাজার পশু। অপরের ব্যবসার ক্ষতি করার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেয়নি কেউ। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু ম্যাকলেন্ডনদের ভেড়াই মারছে না প্রতিপক্ষ, বরং সুযোগ পেলে ম্যাকলেন্ডনদের খুনও করছে।
গোলাপী আভা ছড়িয়ে উদয় হলো রক্তিম সূর্যের, ভোরের উন্মেষে তখন লাল। হয়ে গেছে শেভার্নের চোখ। কোল্ট জোড়া পরখ করে প্রাতঃকাজ সারার জন্যে ক্রীকের ধারে চলে গেল ও। ফিরে এসে দেখল অন্যরা জেগে গেছে। কিছুটা হলেও স্বাভাবিক দেখাচ্ছে মিসেস ব্রুকসকে, যদিও পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক বাকি। নতুন কোন ব্যথা অনুভব করছ না তো? জানতে চাইল ও।
না, মি. শেভার্ন। না হওয়ায়ই যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে মহিলাকে।
লন্ডন আর এডিনবার্গের মেডিক্যাল স্কুলে নতুন একটা রীতির প্রচলন হয়েছে। স্যার জোসেফ লিস্টারের মতে পুঁজ হচ্ছে পচনের মূল উপসর্গ, এবং সংক্রমণ ছাড়াই ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকায়।
শুনতেই অদ্ভুত লাগছে।
সত্যিই তো, নাকি? তিক্ত স্বরে বলল জিম শেভার্ন। হাত-পায়ের ক্ষত সারাতে বেশিরভাগ শল্য চিকিৎসকই পরের সন্ধির কাছে হাত বা পা কেটে ফেলত, মনে পড়ল ওর, কিন্তু সপ্তাহখানেক পরেই সংক্রমণ হয়ে যেত পরের সন্ধিতে। দুটো কেস করার মাঝখানে যন্ত্রগুলো সিদ্ধ করার ইচ্ছে বা সুযোগ বোধহয় কারোই ছিল না। সামান্য কিন্তু গুরুতুপূর্ণ এই তথ্যটি লন্ডন থেকে আমেরিকায় আসতে কয় শতাব্দী লাগবে? কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে, মহিলাকে আশ্বস্ত করল ও। হাতটা কয়েকদিন ব্যবহার না করলেই এ৩ সেরে যাবে।
হ্যাঁ, অন্যমনস্ক স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস। সবার আগে হয়তো নিজের স্বাস্থ্যই পুনরুদ্ধার করা উচিত আমার। ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
ম্যাকলেন্ডনদের মধ্যে শুধু তুমি আর জুডই বেঁচে আছ?
নড করল মহিলা।
শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে তোমাদের।
সিদ্ধান্ত?
সমস্ত পশু জড়ো করে বাজারে নিয়ে যেতে পারো তোমরা।
এবং সবকিছু ছেড়ে দেব? জেদ আর অসন্তোষে জ্বলে উঠল মিসেস ব্রুকসের চোখ, তৎক্ষণাৎ শেভার্ন জেনে গেল অন্তত এই ব্যাপারটা কখনও ভেবে দেখেনি মহিলা।
তোমার জন্যে ব্যাপারটা হয়তো ভিন্ন, ক্ষণিকের নীরবতা শেষে কোমল স্বরে যোগ করল লাল-চুলো। সেটাই স্বাভাবিক, মি. শেভার্ন। এখানে কোন সংস্পর্শ নেই তোমার, দায়ও নেই। আমাদের ঝামেলায় তোমাকে জড়ানোর জন্যে সত্যিই দুঃখিত আমি। বলো তো ঠিক কতটা ঋণ আমাদের, একটা ড্রাফট লিখে দিচ্ছি, তাহলেই মুক্তি পেয়ে যাবে তুমি।
বাউ করল শেভার্ন। কোন ঋণই নেই, মিসেস ব্রুকস, বরং আমিই তোমাদের প্রতি ঋণী।
পরিষ্কার বিস্ময় দেখা গেল লাল-চুলোর চোখে।
তীব্র সন্দেহ ধুকপুক করছে শেভার্নের মনে। তোমার স্বামীর নামের প্রথম অংশটা কি, ওকে কি বিল বলে ডাকত অন্যরা?
না।
তাহলে বলতেই হচ্ছে, মি. ব্রুকসও আমার মত দুর্ভাগ্য আর প্রতারণার শিকার। মনে আছে গোল্ডেন ঈগলে পোকার খেলছিলাম আমরা? বিল নামের ধুরন্ধর এক লোক চুরি করছিল, নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপানোর জন্যে আমাকে জিতিয়ে দিচ্ছিল সে। সে সমস্ত দক্ষতা ব্যবহার করে সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম আমি। পরিণতিতে… শ্রাগ করল শেভার্ন। ওখানে ছিলে তুমি, দেখেছ কি ঘটেছে।
আমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না, মি. শেভার্ন!
খেলাটা সৎ হলে শেষপর্যন্ত কে যে জিতত কিংবা পরিস্থিতি কত দূর গড়াত বলা মুশকিল। কিন্তু আমার ধারণা ভেড়া থেকেই এই ঝামেলার শুরু। অন্য লোকগুলো সম্ভবত মি. ঐকসের বন্ধু ছিল, এদের অন্তত একজন ওস্টেনভেল্ট বাথানের কেউ হবে। তাকে সন্দেহ না করে পরস্পরকে সন্দেহ করেছি আমি আর মি. ব্রুকস। অথচ ওই লোকটাই আসল চাল চেলেছে, রাগের বশে মি. ব্রুকস পিস্ত ল বের করায় আমাকেও ড্র করতে হয়েছে। কেউ টিনহর্ন বলে ডাকলে অসন্তুষ্ট হই আমি। আমার জেতা এক হাজার ডলার কি নেবে তুমি?
না, মি. শেভার্ন। কিন্তু বিনিময়ে যদি তুমি নিজের সার্ভিস দাও, কৃতজ্ঞ থাকব।
তর্ক করার সুযোগ রাখেনি মিসেস ব্রুকস, নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে শেভার্নের। তবে মহিলাকে এখন আর একটু আগের মত নিস্তেজ দেখাচ্ছে না। শুয়ে কিছুটা বিশ্রাম নাও এবার, নির্দেশ দিল ও। চারপাশে চক্কর দিতে যাচ্ছি আমি, দেখা যাক ব্যবহার করার মত কি কি জিনিস অবশিষ্ট আছে।
ছাইয়ের স্তূপ দিয়ে শুরু করল ও, জুড আর ইউসেবিও যোগ দিয়েছে সঙ্গে। লোহার তৈরি কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস পেল, বেশিরভাগই ব্যবহার করা যাবে আবার। হাতুড়ি আর কোদালে নতুন করে হাতল লাগাতে হবে। রান্নাঘরের ছাইয়ের নীচে কয়েকটা তামা আর কাদা মাটির তৈরি পাত্র পাওয়া গেল। তামার তৈরি একটা পালঙ্ক এমন ভাবে বেঁকে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না। মানুষ, ঘোড়া বা ভেড়া খেতে পারে এমন কিছু নেই, কিংবা তার ন্যূনতম অবশেষও নেই। এস্টেটে কজন লোক থাকত?
বলা মুশকিল, জানাল জুড। মাঝে মধ্যে বিশ, এমনকি ত্রিশজনও থাকত। অন্য সময়ে তিন-চারজন।
সোডা স্প্রিং–এ দেখা পে-রোলটা মনে পড়ল শেভার্নের। সব ডি.বি-ডেথ বেনিফিট নিয়ে, যদিও দেনা মনে করেছিল ও, তালিকাটা বিশাল ছিল। মাঝে মধ্যেই নিশ্চই মেষপালকদের অ্যাম্বুশ করেছে ক্যাটলম্যানরা।
খুঁটি দিয়ে ছাই সরাচ্ছে ওরা। অন্যদের মনে কি চলছে ধারণা করতে পারছে শেভার্ন-বাড়িটা আবার তৈরি করে কি হবে যদি পুনরায় বাচানোনা যায়, যদি আবারও হিংস্র প্রতিবেশীরা এসে পুড়িয়ে দেয়? কি যেন ব্র্যান্ডটার নাম, দুটো চাকার চিহ্ন? ওদের বাথান কত দূরে? জানতে চাইল ও।
ওস্টেনভেল্ট?
ওরাই কি সবচেয়ে কাছে?
কাছে, এবং সবচেয়ে বড়। ঢাল ধরে পনেরো মাইল নিচে ওদের জমি।
নিচে? কান খাড়া হয়ে গেছে শেভার্নের।
জুড আর ইউসেবিও নিশ্চিত করল ঠিকই শুনেছে ও।
ভাবছি এই ক্রীকটা যদি হঠাৎ দিক বদলে ফেলে তাহলে পনেরো মাইল নিচের লোকজনের কি হবে!
মুহূর্তের জন্যে বিহ্বল হয়ে পড়ল অন্য দুজন, শেষে তিক্ত হাসল জুডাস। ম্যাকলেন্ডন। নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি ওদেরকে খুঁজে বের করার ঝামেলা পোহাতে হবে না আমাদের!
খুব দ্রুত এখানে চলে আসবে ওরা, যোগ করল ইউসেবিও। কারণ ঢালের ওপাশে তখন আর কোন পানি থাকবে না!
এবার বলো জায়গাটা কোথায়, জানতে চাইল শেভার্ন। ঠিক কোথায় ক্রীকের গতিপথ বদলে দিতে পারি আমরা?
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আগ্রহ হারিয়ে গেল ওদের। শেভার্ন জানে পাহাড়ী ঝর্নার গতিপথ সাধারণত গভীর হয়, মাটির নিচে প্রবাহ থাকাও বিচিত্র নয়; যে কোন ক্যানিয়ন পানির মূল স্রোতকে বিভক্ত করে ফেলতে পারে, কিংবা ভুল দিকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি উপত্যকা থেকে না বেরিয়ে হয়তো ফিরে আসবে আবার, ভিন্ন কোন পথে।
তবে, ক্রীকের গতিপথ বদল করুক বা না-করুক, চারপাশে খানিকটা চোখ বুলিয়ে এলে বোধহয় মন্দ হবে না। এরকম কোন হুমকি কেউ দিয়েছে কখনও? জানতে চাইল ও। ওর ধারণা ঢালের নিচে লোকগুলোর মনে ভেড়ার প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা ছাড়াও অন্য কিছু আছে হয়তো-কে বলতে পারে সর্বক্ষণ এমন আশঙ্কার মধ্যে কাটছে না তাদের?
বুড়ো ম্যাকলেন্ডন যদি কখনও ওস্টেনভেল্টদের মনে এই ভয় ধরিয়ে দিয়েও থাকে, জুড বা ইউসেবিও কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানে না। মিসেস ব্রুকসকে জিজ্ঞেস করতে হবে, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল শেভার্ন। ক্রীকের পাড় ধরে নিচের দিকে নামতে শুরু করল ও, মনে করার চেষ্টা করল আসার পথে ওপরে ওঠার সময় কেমন দেখেছিল অঞ্চলটা। আসলে ট্রেইল আর আটটা ঘোড়ার ওপর পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল ওর, অন্য কোন দিকে নজর দিতে পারেনি।
ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে অন্য দুজন। দ্রুত লয়ে, কিছুটা বিকৃত স্প্যানিশে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।
সেনর?
ফিরে তাকাল ও, আগেই উত্তেজনার আঁচ পেয়েছে অন্য দুজনের কণ্ঠে। সবুজ এক উপত্যকায় পৌঁছে গেছে ওরা, এক কোণে সদ্য তৈরি একটা কবর দেখা যাচ্ছে। খুব বেশি হলে এক বা দুদিন আগের। ক্রীকের ঠিক দশ হাতের। মধ্যে ওটার অবস্থান।
কার এটা? বিস্ময় প্রকাশ করল জুড।
শঙ্কিত দৃষ্টিতে কবরটা দেখছে ইউসেবিও, হয়তো বিপদ বা অমঙ্গলের। পূর্বাভাস পেতে চাইছে। আসার পথে ট্রেইলের পাশে পড়ে থাকা মেক্সিকানের দেহটা মনে পড়ল শেভার্নের-ইউসেবিওর বাবা বা চাচা হবে লোকটি-পোড়া এবং বিধ্বস্ত একটা ক্যারাভানের পাশে পড়ে ছিল। খুনীদের নিষ্ঠুরতা আর হিংস্রতার পরিচয় স্পষ্ট। কিন্তু এখানে কাউকে গোর দিল কেন? তুমি বরং ক্যাম্পে ফিরে যাও, একটা কোদাল নিয়ে এসো, জুডকে প্রভাব করল ও।
ওটা খুঁড়বে নাকি?
যদি না সহজ কোন উপায় দেখাতে পারো-পরখ করে দেখতে চাই আমি, রে ইউসেবিওর দিকে ফিরল শেভার্ন। শত মাইলের মধ্যে কোন প্রীস্ট নেই, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল বিশালদেহী মেষপালক, এবং সেজন্যে কিছুটা হলেও যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। ক্রীকের ধারে এসে বসল ওরা, ইউসেবিওকে একটা চুরুট অফার করল শেভার্ন, অপেক্ষায় আছে কখন কোদাল নিয়ে ফিরে আসবে জুডাস ম্যাকলেন্ডন।
স্প্যানিশ শিখেছ কোথায়? হালকা সুরে জানতে চাইল ইউসেবিও।
দক্ষিণে।
ক্যাবরোনিস!
ওখানকার লোকজনদের পছন্দ করো না তুমি? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল শেভার্ন।
থোক করে মাটিতে থুথু ফেলল ইউসেবিও। বিপ্লবের নিকুচি করি! মেক্সিকোয় কি হচ্ছে তাতে কি যায়-আসে আমার? তুমি কি মনে করো আমি। একজন খাঁটি মেক্স?
শেভার্ন অবশ্য ঠিক তাই ধারণা করেছে।
স্পেন থেকে এসেছে আমার পূর্বপুরুষরা। তিনশো বছর ধরে আছি এখানে। দক্ষিণে বিপ্লব ঘটাতে চাইছে কিছু শুয়োরের বাচ্চা! ভাল কথা, কিন্তু আমি নিজে কোন বিপ্লব শুরু করতে যাচ্ছি না! স্প্যনিশ আর্মি, প্রীস্ট-একে একে সবাই চলে গেল। শত ঝামেলা সামাল দিয়ে থাকতে হলে এই আমাদের, ইন্ডিয়ানদেরও সামলাতে হলো। আমেরিকানরা এল একসময়, ভাল কথা। কিন্তু মেক্সিকানরা। আবারও বিপ্লব চাইছে, গোল্লায় যাক ওরা! নতুন করে ঝামেলা শুরু করার দরকার কি? ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে এমনিতেই যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
এখনও ঝামেলা হচ্ছে?
আগের মত বেশি নয় অতটা। সেনর ম্যাকলেন্ডন ওদের ভালই শিক্ষা। দিয়েছেন।
দ্বিতীয় মত পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আরও কিছু প্রশ্ন করার ছিল শেভার্নের, কিন্তু জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে ফিরে আসতে দেখে নিবৃত্ত করে নিল নিজেকে। খোড়াখুঁড়ির কাজটা ও-ই শুরু করল প্রথম।
নরম, আলগা মাটি। সহজেই খোড়া যাচ্ছে। জুড ওকে বিশ্রাম দেওয়ার আগে প্রায় ফুটখানেক খুঁড়ে ফেলল শেভা। দশ মিনিট নাগাদ আরও দুই ফুট আলগা মাটি সরিয়ে দিল ওরা, শেভার্নের কৌতূহল এবার বিস্ময়ে রূপ নিল। একটা কবরের অস্তিত্বই যেখানে অস্বাভাবিক, অন্যের জীবন কিংবা সম্পত্তির প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র দয়া নেই, নিয়ম মাফিক ছয় ফুট খোড়া তাদের পক্ষে আরও অস্বাভাবিক নয় কি? কবর খোড়ারই কি দরকার ছিল? কি মনে হয়, কাকে গোর দিয়েছে ওরা? জানতে চাইল ও।
কেউই কিছু বলল না। একে তো হার্ডারদের সংখ্যা বেশি, তারওপর প্রায় প্রত্যেকেই নিখোঁজ-নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না কার কবর হতে পারে এটা। আচমকা সন্দেহ হলো শেভার্নের, আন্দাজ করতে পারছে হতভাগ্য লোকটির পরিচয়। শিকারকে গোর দেয়ার ঝামেলায় যাবে না বুশহোয়্যাকাররা, তবে ন্যূনতম এই সম্মানটুকু নিজেদের কারও প্রতি দেখাবে। তাই বলে ত্রিশ মাইল দূরে মারা গেছে এমন একজন লোককে এখানে এনে কবর দেবে? বাড়িতে নিয়ে যায়নি কেন? ব্যাপারটা কেবলই ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর হয়ে গেল গর্তটা, খাটো ইউসেবিওকে এখন আর বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। হাত বাড়িয়ে তাকে উঠে আসতে সাহায্য করল শেভার্ন, নিজে নেমে গেল খোড়াখুড়ি করতে। ইঞ্চি কয়েক খুড়তেই শক্ত ধাতব কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষ হলো কোদালের। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও, তারপর সন্তর্পণে মাটি সরিয়ে দিল। নিশ্চিত হলো এর নিচে মাটি খোঁড়া হয়নি। প্রায় ছয় ফুটেরও বেশি খুঁড়েছে ওরা, কিন্তু ফলাফল-শূন্য একটা কবর!
শ্রাগ করল ইউসেবিও। কাউকে না কাউকে তো গোর দিতে এসেছিল ওরা, কিন্তু দিল না কেন? শুধু শুধুই ছয় ফুট মাটি খুঁড়েছে?
প্রশ্নটা ধাঁধার মত লাগছে শেভার্নের কাছে। সহজ প্রশ্ন, কিন্তু উত্তরটা জানা নেই। ক্রীকের কাছে এসে হাত-মুখ ধুয়ে চুরুট ধরাল, তারপর চিন্তিত মনে ক্যাম্পে ফিরে এল।
প্রথম সুযোগেই এখান থেকে সরে পড়া উচিত, মিসেস ব্রুকসকে নিজের মতামত জানাল ও
কোন কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না আমি!
আমিও না, নিস্পৃহ স্বরে বলল শেভার্ন। কিন্তু কাউকে প্রতিরোধ করা যাবে এখানে, ইচ্ছে করলেই আমাদের আক্রমণ করতে পারবে যে কেউ। খানিকটা ওপরে বা এমনকি নিচে নেমে যেতে পারি আমরা, এমন কোন জায়গায় ক্যাম্প করতে পারি যেখানে সহজে আক্রমণ করতে পারবে না শত্রুপক্ষ।
মিসেস ব্রুকস ওর যুক্তি মেনে নিলেও ধাঁধায় পড়ে গেল শেভার্ন, বুঝতে পারছে না কি করবে। জুড আর ইউসেবিওর উদ্দেশে নড করল ও, দুজনেই ঘোড়ার তদারক করছে। ইউসেবিওকে সমর্থ মানুষ মনে হচ্ছে, জুলিয়া ব্রুকসের দিকে ফিরে বলল। তোমার পক্ষে লড়াই করবে ও?
বলতে পারছি না, মি. শেভার্ন। কিন্তু, আমার ধারণা, যারা ওর বাবাকে খুন করেছে কিংবা ওর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের ওপর নিশ্চই খুশি হওয়ার কথা নয়?
তোমার ভাই?
আনাড়ী মনে হয় ওকে?
আনাড়ী তো অবশ্যই, কাজের সময় কতটা দৃঢ়তা দেখাতে পারবে তা বলতে পারছি না। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, রাইফেল ব্যবহার করতে গেলে ক্ষতের মুখটা খুলে যাবে।
আসলে কি বলতে চাইছ বুঝতে পারছি বোধহয়, চিন্তিত স্বরে বলল লাল চুলো। কিন্তু সব হার্ডারদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলে হয়তো কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। তাছাড়া আদৌ কজন বেঁচে আছে কে জানে! ফিরে না এলে কারও ব্যাপারেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
সত্যি কথা বলতে কি, এখানে থাকাটাই বিপজ্জনক। নিরাপদ কোথাও সরে যেতে পারলে ভাল হত। সোডা স্প্রিং-এ…।
উঁহু, ওখানে যাব না। মুহূর্তের জন্যেও শহরটায় নিরাপদ বোধ করিনি আমি!
দীর্ঘশ্বাস গোপন করল শেভার্ন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আশপাশে বন্ধু বা হিতাকাক্ষী নেই ম্যাকলেন্ডনদের। সম্ভবত পুরো পৃথিবীতেই নেই।
আরও কিছু অসুবিধে আছে, যোগ করল মিসেস ব্রুকস। ইউসেবিওর কথাই ধরো। বেশি দিন থাকতে পারবে না ও, হার্ডাররা তদারক করতে না পারলে দুএকদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে ভেড়ার পাল, নেকড়ের অসহায় শিকারে পরিণত হবে। রাউন্ড-আপ করতে হয়তো গ্রীষ্মের পুরো মরসুম চলে যাবে, যদি না ততদিনে সবগুলোই নেকড়ের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
ডাবল-ওর কজন গানহ্যান্ড আছে?
নিশ্চিত জানি না, তবে আমার ধারণা ওদের যে কটা গরু আছে, তার তুলনায় কাউহ্যান্ডের সংখ্যা বেশি।
শুধু ওরাই?
উঁহু, আরও কয়েকটা ছোট আউটফিট আছে, নিচে আমাদের জমি দখল করেছে সবাই।
তোমাদের জমি?
তোমার যা ইচ্ছে বলতে পারো, মি. শেভার্ন। কিন্তু ম্যাকলেন্ডনরাই আগে এসেছে এখানে।
কখনও নিজের বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছ তোমরা?
নিচের জমি কোন সময়েই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, অন্তত আমাদের কাছে। কারণ গরুর চেয়ে ভেড়া অনেক বেশি পরিশ্রমী প্রাণী, পাহাড়ে থাকতেই ভালবাসে এরা।
নড করে সরে এল শেভার্ন, বিধ্বস্ত বাথানের চারপাশে আরেকবার চক্কর দিল। মনে পড়ল গুটিকয়েক লোক উপস্থিত ছিল ম্যাকলেন্ডনের ফিউনেরাল অনুষ্ঠানে। নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, অন্যরা যতটা ভাবে নিজেকে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত নীল ম্যাকলেন্ডন। নিজের অদূরদর্শিতার কারণেই কি পরিবার আর সাধারণ এই মানুষগুলোকে বিপদে ফেলেনি সে?
অবশ্য নীল ম্যাকলেন্ডনের দূরদর্শিতা থাকলেও বোধহয় কাজ হত না। কারণ এদের শেষ দেখতে চাইছে কেউ-সম্ভবত ওস্টেনভেস্টরা। একবার যখন খবর ছড়িয়ে পড়বে যে ম্যাকলেন্ডনদের সাথে আছে জিম শেভার্ন…কিন্তু এরইমধ্যে ডাবল-ওর সঙ্গে লড়তে হয়েছে ওকে। এখন আর ফিরে আসার উপায় নেই।
দশ হাজার পশু। একটা ভেড়ার মূল্য কমপক্ষে এক ডলার। এর এক তৃতীয়াংশ নিয়ে কি করবে ও? মাত্র একটাই উপায় আছে। শত্রুর সংখ্যা যখন অনেক বেশি তখন অপেক্ষা করে লাভ হয় না।
একটা মাসট্যাঙে স্যাডল চাপিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল শেভার্ন। ঢেউ খেলানো জমি পড়ে আছে দুপাশে, ছোট ছোট দুটো পাহাড় টপকে আরও ওপরে উঠে এল, দৃষ্টিসীমার পরিধি বাড়ল এবার। দূরে বহু নিচে আবছা ভাবে সবুজ তৃণভূমি চোখে পড়ছে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা কেবিন, কিন্তু তৃণভূমিতে কোন গরু বা ভেড়া নেই।
বাঁক পেরিয়ে বিশাল এক মেসায় উঠে এল ও। পেছনে পাহাড়ের নিরেট শরীর, পাশেই ঢালু জমি ওপরে পাহাড়শ্রেণীর চূড়ায় গিয়ে মিশেছে। অন্তত মাইল খানেক হবে, চূড়ায় জমে থাকা বরফের চাঙড় দেখে ধারণা করল শেভার্ন। চোখ নামিয়ে নিচের জমির দিকে তাকাল, মেসাটা ক্রীক থেকে প্রায় সিকি মাইল ওপরে এবং এস্টেটের চেয়ে অনেক নিরাপদ। উচ্চতার কারণে পেছন বা পাশ থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। বরং এখান থেকেই অনায়াসে আক্রমণ করা যাবে। মেসায় উঠে আসার রাস্তা একটাই–ঢাল বেয়ে উঠে আসতে হবে, ঘুমিয়ে না থাকলে কোন ক্রমেই ওদেরকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।
ক্যাম্প করার জন্যে যুৎসই একটা জায়গা বেছে নিচে নেমে এল ও। ভাবছে ফ্রেইট ওয়্যাগনগুলো মেসায় ওঠানো যাবে কি-না। খুব বেশি ভারী। জুড আর। ইউসেবিওকে বাকবোর্ড থেকে মাল খালাস করার নির্দেশ দিয়ে একটা সুযোগ নিতে মনস্থির করে ফেলল। আটটা মাসট্যাঙকে বেশ খাটাল এবার। সব সাপ্লাই মেসায় শিফট করতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল, দুটো বাকবোর্ডও স্থানান্তর করে ফেলেছে। তেরপলের একটা অস্থায়ী শেড তৈরি করেছে একপাশে।
বয়স্কা মহিলা, যার নাম এখনও জানা হয়নি শেভার্নের, নিজেই ওপরে উঠে এল। কিন্তু মিসেস ব্রুকসকে নিয়ে সমস্যা হলো। বাকবোর্ডে চড়ে ওপরে উঠতে গেলে পড়ে যেতে পারে মহিলা, কিংবা জখম থেকে রক্তক্ষরণও শুরু হতে পারে। শেষপর্যন্ত কাঠ আর অ্যাসপেনের শাখা দিয়ে একটা চেয়ার তৈরি করল শেভার্ন। মিসেস ব্রুকসকে তাতে বসিয়ে জুড আর ও মিলে ওপরে নিয়ে এল। মহিলার তীক্ষ প্রতিবাদে কান দিল না দুজনের কেউ।
লবণ আর অন্যান্য সাপ্লাই নিয়ে ভেড়ার পালের কাছে ফিরে যাবে ইউসেবিও, প্যাকহর্সে মালপত্র চাপিয়ে পোড়া এস্টেটের কাছে অপেক্ষায় আছে সে। শেভার্ন ঢাল বেয়ে নেমে আসতে একটা হাত তুলল শুভেচ্ছার ভঙ্গিতে।
কাবার্ডে রাখা রাইফেলটা একনজর দেখল শেভার্ন, ভাবছে সাদাসিধে হার্ডার ঠিক কতটা দক্ষতা অর্জন করেছে। ওর ধারণা জুডের চেয়ে খুব বেশি চালু নয় সে। কখনও রাইফেলটা ব্যবহার করেছ?
ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে।
সতর্ক থেকো। এবার কিন্তু ইন্ডিয়ান নয়, সাদাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে ওটা।
নড করে স্যাডলে চাপল বিশালদেহী হার্ভার। দ্রুত হাতে ঘন্টাটা খুলে ফেলল ঘোড়ার গলা থেকে। ঢাল বেয়ে ফ্রীকের দিকে এগোল সে, একসময় হারিয়ে গেল পাইনের আড়ালে। ফিরতি পথে ওপরে উঠতে শুরু করেছিল শেভার্ন, ঠিক এসময় মৃদু শিসের শব্দ শুনতে পেল। তাকিয়ে দেখল মেসার ওপর এক ফালি কাপড় নাড়ছে বয়স্কা মহিলা।
ঘোড়ার পেটে স্পর দাবাল শেভার্ন, দ্রুত মেসায় পৌঁছতে চাইছে।
ওপরে ওঠার পর মহিলার উত্তেজনার কারণ দেখতে পেল। ক্রীকের কাছে দুজন তোক দেখা যাচ্ছে, ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে না বরং গতকাল যে পথ ধরে ওয়্যাগন নিয়ে উঠে এসেছে ও, সেটাই অনুসরণ করছে। অক্ষ দৃষ্টিতে লোকগুলোকে দেখল শেভার্ন, ভাবছে একটা স্পাই-গ্লাস হলে ভাল হত। অবশ্য তার দরকার হলো না, একটু পর স্পষ্ট দেখা গেল দুজনকে।
দুজনেই বিশালদেহী, তুলনায় ঘোড়াগুলোকে বেশ ঘোট লাগছে। শহুরে কাপড় পরনে-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি এবং হাল ফ্যাশনের। হোলস্টার বা পিস্তল দেখা না গেলেও স্যাডল বুটেকারবাইনের নল উঁকি দিচ্ছে। নিজেদের লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করছে না কেউ।
চেনো ওদের? মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে জানতে চাইল শেভার্ন।
মাথা নাড়ল মহিলা।
পোড়া এবং বিধ্বস্ত এস্টেটের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে লোক দুটো। এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে দুজনের কেউই আশা করেনি এখানে এসে ধ্বংস তৃপ। দেখতে পাবে। কাছাকাছি হলো দুটো ঘোড়া, মুহূর্তের জন্যে কি যেন আলাপ করল দুজনে। তারপর মুখ তুলে মেসার দিকে তাকাল একজন, দেখতে পেল ওদের।
মিসেস ব্রুকস? চড়া স্বরে ডাকল লোকটা।
হাত নাড়ল শেভার্ন।
ঢাল ধরে ঘোড়া ছোটাল দুই আগন্তুক। মি. ব্রুকস? কাছাকাছি এসে জানতে চাইল একজন।
আমি নই, স্বীকার করল শেভার্ন। কিন্তু মিসেস ব্রুকস আছে এখানে।
লোকগুলোর সঙ্গে টাকার সম্পর্ক আছে, অবচেতন মন বলছে শেভার্নকে। রেলরোড ব্যবসায়ীদের মত প্রচুর টাকা নয়, কিন্তু ব্যাংকার বোধহয়-তীক্ষ দৃষ্টিতে, দুজনের আভিজাত্য আর চাপা উৎসাহ লক্ষ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও। কিভাবে খবরটা এত দ্রুত পৌঁছল ওদের কানে?
পুড়ে যাওয়া র্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকাল একজন। ইন্ডিয়ান? জানতে চাইল সে। কিন্তু আমি তো শুনেছি এই অঞ্চলটা নিরাপদ।
প্রচুর অসভ্য লোক এখনও হ্যাট পরে, নিরুত্তাপ স্বরে বলল শেভার্ন। ঘুরে মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরল, কোন রকমে তৈরি একটা কাউচে বসে আছে মহিলা। কাউচের অর্ধেকটা চাদর দিয়ে ঢাকা। মিসেস ব্রুকস।
হ্যাটের কিনারা স্পর্শ করল ব্যাংকার। মাইকেল টেড্রো, নিজের পরিচয় দিল সে। সন্দেহ নেই মি. ব্রুকসের বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে অবগত আছ তুমি, ম্যাম?
কিছুটা।
থমকে গেল টেড্রো, ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধা দেখা গেল চাহনিতে, তারপর আড়চোখে ছাইয়ের তৃপের দিকে তাকাল। তুমি বোধহয় অসুস্থ, ম্যাম, গাম্ভীর্যের সুরে বললেও প্রায় আনুষ্ঠানিক শোনাল কথাটা। আমরা বোধহয় অসময়ে এসে পড়েছি?
মাইকেল টেড্রো মানুষটা চটপটে, ঘটে বুদ্ধিও রাখে বেশ। পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে বোধহয়। দিনে দুটোর বে শি ড্রিঙ্ক করে না কখনও, সিদ্ধান্তে পৌঁছল শেভার্ন। কিন্তু সঙ্গের লোকটি, বয়সে অনেক তরুণ এবং পরিপাটি পোশাক পরনে থাকলেও অস্বস্তি ধরিয়ে দিচ্ছে ওর মনে।
চাপা বিস্ময়ের সাথে শেভার্নকে দেখছে সে। এর আগে কোথাও দেখা হয়েছে আমাদের? জানতে চাইল সে, কণ্ঠে দ্বিধা।
পৃথিবীটা খুব ছোট জায়গা, লন্ডনের স্পষ্ট উচ্চারণে বলল শেভার্ন। এখানে সবই সম্ভব।
মনে হয় না।
মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। বিড়বিড় করে কি যেন বলল বয়স্কা মহিলা, বুঝতে পারল না শেভার্ন।
তুমি কি মিসেস ব্রুকসের প্রতিনিধিত্ব করছ?
না। ওর সঙ্গেই কথা বলতে হবে তোমাদের।
বিরক্ত দেখাল তরুণ ব্যাংকারকে, একটা ভুরু উঠে গেছে কপালে। মি. ব্রুকসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আমাদের, ওর অনুপস্থিতিতে অন্য কারও সঙ্গে রফা করার উপায় নেই, আইনও সেটা মেনে নেবে না…
আমারও তাই ধারণা, মুখ খুলল জুলিয়া ব্রুকস। বেহিসেবী স্বামীকে স্ত্রীর সম্পত্তি ওড়ানোর অধিকার দেয় আইন, কিন্তু স্ত্রীটি যখন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, আইন কোন সাহায্যই করে না তাকে।
অসুখী এবং ত্রুটিপূর্ণ এক পৃথিবীতে বাস করি আমরা, ম্যাম, দার্শনিক সুরে বলল টেট্রো।
কিন্তু এমন এক পৃথিবী যা কিছুটা হলেও এগিয়ে গেছে, বলল শেভার্ন। মিসেস ব্রুকস এখন আর কারও স্ত্রী নয়, বরং বিধবা ও।
পরস্পরের উদ্দেশে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল দুই অতিথি। ক্ষণিকের জন্যে হতাশা, তারপর মরিয়া দৃষ্টি ফুটে উঠল যুবকের চোখে। তাহলে, শ্রাগ করে বলল টেড্রো। বলতেই হচ্ছে সান্তা ফে থেকে দীর্ঘ পথ অযথা পাড়ি দিয়েছি আমরা, এবং ফিরতি রাইডটাও একই রকম দীর্ঘ ও নিষ্ফলা হবে। ঘুরে মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরল সে। যদি না মি. ব্রুকসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ওর ইচ্ছে পূরণ করো তুমি, ম্যাম। শর্তগুলো একই থাকবে।
কিসের শর্ত, এখনও কিন্তু কিছুই শুনিনি আমি!
এই বাথানটা বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিল মি. ব্রুকস। বিশ হাজার ডলার দিতে রাজি আছি আমরা।
০৯-১০. স্থির দৃষ্টিতে শেভার্নের দিকে
স্থির দৃষ্টিতে শেভার্নের দিকে তাকিয়ে আছে মিসেস ব্রুকস। আগে পাত্তা না দিলেও পরিস্থিতির পরিবর্তনে, সরাসরি বাথান বিক্রির প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে এখন-শেভার্নের মতামত জানতে চাইছে।
আরেকটু হলে শেভার্ন বলতে যাচ্ছিল টাকাটা নিয়ে বেসিন ছেড়ে কেটে পড়া উচিত, আচমকাই টের পেল গোলমালটা কোথায়। দেখল একই সময়ে বদলে গেছে লাল-চুলোর মুখোভাব, অসঙ্গতিটা সেও ধরতে পেরেছে-মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল অপূর্ব সুন্দর মুখটা, উদাস দৃষ্টিতে তাকাল তৃণভূমির দিকে। কামড়ে ধরায় ফ্যাকাসে হয়ে গেছে পুরু ঠোঁট জোড়া। বেচারী! ওই জঘন্য লোকটিই ছিল ওর স্বামী!
মি. ব্রুকসের স্বাক্ষর করা কোন কাগজ আছে তোমাদের কাছে? শান্ত স্বরে জানতে চাইল শেভার্ন।
কোটের পকেট থেকে একটা পোর্টফলিও বের করল টেড্রো। ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করে এগিয়ে দিল। হস্তাক্ষরটা দেখল শেভার্ন-আগে কখনও দেখেনি। চিঠির বক্তব্য একেবারেই পরিষ্কার:
সোডা শিং, উত্তর মেক্সিকো
প্রিয় মি. টেট্রা,
মনে হচ্ছে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। এখনও যদি ইচ্ছে থাকে পুরো জায়গাটাই পচিশ হাজার ডলারে পেতে পারো তুমি।
তোমারই বিশ্বস্ত,
জে ব্রুকস
নীরবে মিসেস ব্রুকসের হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিল শেভার্ন।
নির্বিকার মুখে চিঠিটা পড়ল মহিলা। কোথাও নিশ্চয়ই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, বলল শেষে, মুখটা পাথরের মতই ভাবলেশহীন, কিন্তু চোখ দেখে বোঝ যাচ্ছে নিজেকে সামলে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এই বাথান আমার বাবার, মি. ব্রুকসের কোন অধিকার নেই এখানে!
মি. ব্রুকস আর তোমার প্রস্তাবের মধ্যে পার্থক্য মাত্র পাঁচ হাজার ডলার, মন্তব্যের সুরে যোগ করল শেভার্ন।
দর কষাকষির সময় এরকম পার্থক্য থাকেই, ফের দার্শনিক সুরে বলল মাইকেল টেস্লো। যাই হোক, বাথানটা বিক্রি করতে না চাইলে কিছুই করার নেই আমাদের ব্যর্থ হয়েই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
চিঠিটা দরকার তোমাদের জানতে চাইল শেভার্ন।
শ্রাগ করল ব্যাংকার। তোমার দুরকার আছে?
স্থানীয় কোর্টে হয়তো মামলা উঠতে পারে, তেমন হলে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে। দাঁড়াবে ওটা।
সঙ্গীর দিকে তাকাল টেডড্রা, পরিস্থিতির পরিবর্তনে নিদারুণ অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে যুবককে। উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকাল সে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে দাও ওকে, শেষে বিড়বিড় করে সম্মতি দিল, কণ্ঠে হতাশা বা অসন্তোষ কোনটাই চাপা থাকল না।
চিঠিটা নিয়ে ধন্যবাদ জানাল শেভার্ন।
দুই ব্যাংকারকে রাতটা এখানেই থেকে যাওয়ার প্রস্তাব করল মিসেস ব্রুকস। নার্ভাস ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল টেস্রো। সত্যিই কি ইন্ডিয়ানদের ভয় নেই ট্রেইলে? শেষে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল সে।
ইন্ডিয়ানদের নিয়ে ভয় নেই, তথ্য যোগাল শেভার্ন। কিন্তু নিচে আমাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সতর্ক থেকো।
হ্যাটের কিনারা স্পর্শ করল মাইকেল টেম্রো, তারপর স্যাডলে চেপে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে চলে যেতে দেখল ওরা। দুই ব্যাংকার ক্রীকের ওপাশে পাইনের আড়ালে হারিয়ে যেতে চিঠির দিকে মনোযোগ। দিল শেভার্ন, আরেকবার পড়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তোমার স্বামীর লেখা, তাই না?
হ্যাঁ।
আমি সত্যিই দুঃখিত, ম্যাম।
কেন দুঃখ হবে তোমার? কিসের জন্যে? জুডের মেজাজী প্রশ্ন।
তরুণ ম্যাকলেন্ডনকে দেখল শেভার্ন, কিছু বলল না। ভাবছে ব্যাপারটা বোধহয় মিসেস ব্রুকসেরও বোধগম্য হয়নি।
চিঠিটা নিয়েছ কেন, মি. শেভার্ন? কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল লাল চুলো।
কিছু না বলে চিঠির তারিখের দিকে নির্দেশ করল ও।
তাতে কি? কৌতূহলী হয়ে উঠেছে জুড।
আইনত মি. ব্রুকস শুধুমাত্র তখনই বাথান বিক্রির প্রস্তাব দিতে পারে যখন তোমার বোন ওটার উত্তরাধিকার পাবে। এপ্রিলের তিন তারিখে লেখা হয়েছে চিঠিটা, অথচ তোমার বাবাকে আমি ট্রেইলে খুঁজে পেয়েছিলাম এর ঠিক তিন সপ্তাহ পর।
মুহূর্তে বদলে গেল ছেলেটার মুখ। কষে যেন গালে চড় মেরেছে কেউ, ফ্যাকাসে বিব্ৰত দেখাচ্ছে জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে। ক্ষণিকের জন্যে সন্দিহান চাহনি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, নিদারুণ বাস্তবতা তো উপলব্ধি করলই উপরন্তু সমস্ত জেদ আর অসন্তোষও হারিয়ে গেল ক্ষুব্ধ ম্যাকলেন্ডনের মন থেকে। মুহূর্ত খানেক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বোনের দিকে, তারপর ঘুরে হেঁটে চলে গেল।
মিসেস ব্রুকসের মন্তব্যটা মনে পড়ল শেভার্নের। উঠতি বয়সের তরুণরা কেন নিজের আদর্শ হিসেবে ছন্নছাড়া বেপরোয়া লোককে বেছে নেয়? বেচারা জুড! প্রথমে ওর নায়ককে খুন করেছে শেভার্ন। এবার নীল ম্যাকলেন্ডনের খুনের পেছনে ব্রুকসের সম্ভাব্য ভূমিকা উন্মোচন করেছে।
মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছে মি: টেড্রা, তিক্ত স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস।
কিভাবে?
সত্যিই ত্রুটিপূর্ণ এক পৃথিবীতে বাস করছি আমরা।
নিজ হাতে খুন করেছে এমন লোকের নিন্দা করে কাজের কাজ কিছু হবে না, জানে জিম শেভার্ন। আমি বরং ঘোড়াগুলোর ওপর নজর রাখছি, নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ বদল করল ও। চাই না কেউ আমাদের হাঁটতে বাধ্য করুক। শেষবারের মত চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল, তারপর স্যাডলে চেপে এস্টেটের কাছে নেমে এল। ল্যাসো ছাড়াই চরতে থাকা চারটে ঘোড়া ধরল। ফিরে এসে দেখল কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছে জুড, গম্ভীর মুখে বসে আছে বোনর পাশে।
ছেলেটার সঙ্গে প্রথম দেখার কথা মনে পড়ল শেভার্নের, ওর সঙ্গে শহর ছাড়ার জন্যে অধীর হয়ে পড়েছিল। ঘটনাটা যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হোক না কেন, জুড তখনও জানত না যে ওর বাবা মারা গেছে…কিন্তু সতেরো বছরের কোন তরুণের মনে আসলে কি চলছে কখনও কি নিশ্চিত বলতে পারে কেউ-সত্যিই কি প্রতিশোধ নিতে ওর সঙ্গী হতে চেয়েছিল জুড, নাকি ওকে দেয়া ব্যাখ্যাটাই নির্জলা সত্যি? নিজের অতীত স্মরণ করল শেভার্ন, তিক্ত অনেক ঘটনা ঘরছাড়া হতে বাধ্য করেছে ওকে-অপরিবর্তনীয়, ত্রুটিপূর্ণ এক পৃথিবী পাল্টে ফেলার নেশায়!
এই এত বছর পরও কিছুই বদলায়নি, কেবল ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয়েছে। মিসেস ব্রুকসের জন্যে হয়তো কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে ও, এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ম্যাকলেন্ডনদের স্নায়ুযুদ্ধে খানিকটা হলেও ভারসাম্য নিয়ে এসেছে; কিন্তু তারপরও বলা যায় বুটের ধুলো ঝেড়ে সানফ্রান্সিসকোর দিকে যাত্রা করার সুযোগ এখনও রয়েছে। ওর মত অস্থির স্বভাবের মানুষের জন্যে থাকার জায়গা হতে পারে না এটা। ভেড়ার বাথান? অসম্ভব!
হয়তো ওদের প্রস্তাবটা গ্রহণ করাই উচিত ছিল! ম্লান স্বরে স্বগতোক্তি করল জুলিয়া ব্রুকস।
হয়তো, অন্যমনস্ক স্বরে বলল শেভার্ন। তোমার স্বামীর হয়তো যথেষ্ট দূরদৃষ্টি ছিল-আজকের দিনটা দেখতে পেয়েছিল সে, তোমাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই বাথান বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমাদের জন্যে ওর সদিচ্ছা যদি সত্যিই থাকত, তাহলে বাবাকে এভাবে মরতে হত না!
মেসার এক পাশে রান্নার আয়োজন করেছে বয়স্কা মহিলা। মহিলাকে মাংসের সঙ্গে পেঁয়াজ আর মরিচ মেশাতে দেখেছে শেভার্ন, ওর ধারণা দক্ষিণ থেকে আসার পর এ পর্যন্ত যত স্টু খেয়েছে এটা বোধহয় সবচেয়ে গরম হবে। সাধারণ কর্নের তৈরি টরটিয়ার পরিবর্তে গমের ময়দা দিয়ে সোপাপিলা তৈরি করছে। মহিলা। ময়দার মণ্ড তৈরি করার পর বেলুনি দিয়ে রোল করল প্রথমে, তারপর ত্রিকোণাকৃতির রুটির মত কেটে ফেলল। শেষে মাংসের ছোট ছোট টুকরো ভেতরে ঢুকিয়ে গরম তেলে ভেজে ফেলল।
এই প্রথমবারের মত শেভার্ন অনুভব করল ঠিকই বলেছে ইউসেবিও। পোলিয়নের বিদ্রোহের সুযোগে নিউ স্পেনের স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই এখানে, পাহাড়ী অঞ্চলে বাস করছে এরা-বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ ভাবে। প্রতিবেশী মেক্সিকানদের প্রতি এদের না আছে কোন আগ্রহ, না আছে কোন সহানুভূতি। এমনকি মাতৃভূমি স্পেনের প্রতিও এদের কোন পিছুটান বা দায় নেই।
এভাবেই হয়তো তোমার সমস্যা মিটে যায়! জুলিয়া ব্রুকসের নিচু স্বরের মন্তব্যে সংবিৎ ফিরে পেল শেভার্ন।
কি বললে?
বাথানটা বিক্রি করে দিলেই সব সমস্যা চুকে যাবে। নিজের ভাগ নিয়ে চলে যেতে পারবে তুমি, আমি আর জুডও অন্য কোথাও গিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারব।
আমি ভেবেছি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। এছাড়া আর কি করতে পারি আমি!
আচমকা গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়ল জুডাস ম্যাকলেন্ডনের। লড়াই করব! সরোষে প্রস্তাব করল সে। এই অঞ্চল থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার আগেই ডাবল-ও-কে শায়েস্তা করতে পারি আমরা!
শ্রাগ করল শেভার্ন। বিকল্প কিছু নেই আমাদের সামনে। গুলি করতে পারো তুমি?
পিস্তলে আনাড়ী বলতে পারো, কিন্তু রাইফেলে কখনও নিশানা মিস করিনি।
সত্যিই টিপ ভাল ওর, একমত হলো বোন।
যা ভেবেছিল, বয়স্কার তৈরি স্টু গিলতে সত্যিই হিমশিম খেতে হলো শেভার্নকে। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছল ও, ভাবছে এই সুযোগে কানের ময়লাগুলো গলে বেরিয়ে যাবে কি-না। আড়চোখে দেখল নীরবে খাচ্ছে অন্যরা, কারও কোন সমস্যা হচ্ছে না। কোন রকমে স্টু শেষ করে আগুন গরম কফি গলায় ঢালল ও, ঝালটা চলে যাওয়ার পর একটা চুরুট ধরাল। অশান্ত একটা মাসট্যাঙকে দেখতে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে গেল জুড।
তোমাকে রক্ষা করার মত সামর্থ্য কি সত্যিই আছে ওর? কয়েক হাত দূরে বসা মিসেস ব্রুকসের উদ্দেশে জানতে চাইল শেভার্ন।
চলে যাচ্ছ তুমি? নিরুত্তাপ স্বরে জানতে চাইল লাল-চুলো।
অপূর্ব মুখটা জরিপ করল শেভার্ন, মহিলা হয় অসাধারণ অভিনেত্রী নয়তো ও থাকুক বা না-থাকুক সত্যিই তাতে কেয়ার করে না। দৃষ্টি সরিয়ে কোল্টের দিকে নজর দিল ও, মেকানিজম পরখ করার পর পকেট হাতড়ে বাড়তি অ্যামুনিশন বের করল। ভাবছি চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে আসব, পিস্তল রিলোড করার সময় পাল্টা নিরুত্তাপ স্বরে বলল ও। কারও মুখোমুখি পড়ে গেলে ক্যাম্পে ফিরে আসা বোধহয় ঠিক হবে না, জায়গাটা চিনে ফেলবে ওরা। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আস্তানার কথা ওরা না জানছে…
সেটা কি ঠিক হবে, মি. শেভার্ন?
কিন্তু শত্রুপক্ষের অপেক্ষায় এখানে বসে থেকেই বা কি লাভ! অবরোধ করে রাখলে পানি বা সাপ্লাই পাব না আমরা। মেসার ওপর থাকায় হয়তো খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারছি, কিন্তু একেবারে নিরাপদ নই আমরা। কেবল একটা সুবিধাই পাচ্ছি-আচমকা হামলা করে আমাদের চমকে দিতে পারবে না কেউ।
মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছ তুমি।
কালকের মধ্যে যদি ফিরে না আসি, সোডা স্প্রিং-এ চলে যেয়ো। ব্যাংকার দুজনকে বোধহয় পাবে ওখানে। প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখো তখন।
মাইকেল টেড্রোর কাছ থেকে নেওয়া চিঠিটা মিসেস ব্রুকসের হাতে ধরিয়ে দিল শেভার্ন। ক্যাম্প থেকে সরে এসে স্যাডলে চাপল, তারপর ঢাল বেয়ে এস্টেটের দিকে নামতে শুরু করল। দ্বিধায় ভুগছে ও, জানে না কাজটা ঠিক হচ্ছে কি-না। সাধারণ বুদ্ধি বলছে বিশ হাজার ডলারের এক-তৃতীয়াংশ কামাই করার এরচেয়েও সহজ উপায় আছে। ক্ৰীক ধরে মাইল কয়েক চলে এল ও, একসময় সোডা স্প্রিং-এর ট্রেইলে পৌঁছে গেল।
কাজটা কঠিন হবে না, এখান থেকেই ক্রীকের গতিপথ বদলে দেয়া সম্ভব। কিন্তু ফলাফলটা হয়তো আশানুরূপ না-ও হতে পারে, হয়তো শহরের দিকে চলে যাবে পানির স্রোত, মাঝখানের মরুভূমিই পুরোটা শুষে নেবে।
আকাশে জ্বলজ্বল করছে হাজার তারা, জোনাকি পোকারা ছুটাছুটি করছে ইতস্তত। যতই ভাবছে ক্রমে সন্দিহান হয়ে উঠছে শেভার্ন, পানির গতিপথ বদলানোর দরকার হবে না বোধহয়। তাতে বরং সতর্ক হয়ে যাবে শত্রুপক্ষ, পানি গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেনে যাবে ম্যাকলেন্ডনরা ফিরে এসেছে এস্টেটে।
ইতোমধ্যে, যদি সত্যিই মাথায় ঘিলু বলে কিছু থাকে ওর, চলার মধ্যে থাকলে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে যাবে একসময়। বিদ্বেষপূর্ণ এই অঞ্চল ছেড়ে যে কোন জায়গায় চলে যেতে পারলেই হলো। কখনও কি সংঘাত থেকে মুক্তি মিলবে, অন্যের ঝামেলায় নিজেকে জড়ানো ছাড়া পথ চলতে পারবে না? ওকে আটকে রাখার মত কিছুই নেই এখানে। আসলেই নেই-কেবল বিশ হাজার ডলারের এক-তৃতীয়াংশ ছাড়া। এমনকি মিসেস ব্রুকস যদি ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রকাশ করে, তা-ও নয়। কিভাবে ভেড়ার সঙ্গে রাত কাটায় লোকেরা?
কিন্তু তুমি নিজেই ঝামেলাটা তৈরি করেছ, মনে করিয়ে দিল ওর সত্তা।
উচিত হয়েছে। আমি যখন টেক্সাসের পথে ছিলাম তখনই চিঠিটা লিখেছে ব্রুকস, এতে কোন দায় ছিল আমার? এমন এক ট্রেইল পেছনে ফেলে যাচ্ছি পিঙ্কারটনের অন্ধ কোন গোয়েন্দাও গন্ধ শুকে শুকে ধরে ফেলতে পারবে আমাকে।
ব্রুকসকে খুন করেছ।
বরং বেচারীকে সাহায্য করেছি। ব্রুকসের হাতে যদি আমিই খুন হয়ে যেতাম তাতে মিসেস ব্রুকসের কোন লাভ হত?
বেরসিক ঘোড়াটা আচমকা হোঁচট খেতে বিবেকের উত্তর আর পেল না শেভার্ন। শক্ত পাথুরে জমির ওপর মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়েও কোন রকমে সামলে নিল মাসট্যাঙ। স্যাডল থেকে খসে পড়তে যাচ্ছিল শেভার্ন, স্টির্যাপ থেকে পা পিছলে গেছে। দুই পা দিয়ে ঘোড়ার শরীর চেপে ধরল ও, বিড়বিড় করে শান্ত করার চেষ্টা করল ঘোড়াকে।
কয়েক পা পিছিয়ে এসেছে মাসট্যাঙ। বেচারার রহস্যময় আচরণের কারণটা এবার দেখতে পেল শেভার্ন। একেবারেই অস্বাভাবিক। চোখ কুঁচকে তাকাল ও, তারার আলোয় খুব কমই চোখে পড়ছে। আরেকটু হলে ভোলা একটা কবরে পা রাখত ঘোড়াটা! কবরের বাইরে খুঁড়ে তোলা পাথুরে মাটিতে পা হড়কে গিয়েছিল ওটার।
ঘোড়াটাকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করল ও, চারপাশের শব্দ মন দিয়ে শুনল। অস্বাভাবিক কিছু নেই, দেখাও যাচ্ছে না যেটা বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তি বলছে খুব কাছেই বিপদ আছে কোথাও।
একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা, স্যাডলে এক চুলও নডছে না শেভার্ন। জোনাকি আর অন্যান্য নিশাচর পোকারা ছুটছে অবিরাম, মাঝে মধ্যে শরীরের সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে। স্যাডল ছেড়ে কবরের ভেতরটা দেখতে চাইছে ও, এবার হয়তো কোন লোক আছে ভেতরে; কিন্তু অবচেতন মন সতর্ক করছে ওকে, লাগাতার তাগাদা দিচ্ছে-এখান থেকে সরে পড়ো!
বুড়ো হয়ে যাচ্ছ, নিজের উদ্দেশে শুধাল শেভার্ন, এর আগে কখনোই এমন শঙ্কিত হওনি। চোখ কুঁচকে গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকাল ও, ক্রীকের মৃদু শব্দ শুনছে-নূ্যনতম ধারণা পেতে চাইছে যে মাসট্যাঙ আর ও একা নয় এখানে। কিন্তু তেমন কোন সাড়া নেই। তারপরও, স্যাডল থেকে নামল না শেভার্ন-মন সাড়া দিচ্ছে না।
পুরো ব্যাপারটাই যুক্তিহীন, প্রায় অর্থহীন। ফিরতি পথে এগোতে গিয়েও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল ও। নিজের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছে। হাল ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারে, হয়তো উপযুক্ত কারণও তৈরি করে নেবে মন; ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না কেউ। কিন্তু ও নিজে ঠিকই জানবে, অন্যরা জেনে যাওয়ার আগেই সমস্ত আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে।
দরকার নেই, শেষে বিপদে পড়বে! সতর্ক করল ওর সত্তা।
ভ্রূক্ষেপ করল না শেভার্ন। কিন্তু মুখের মত সাহসী হওয়ায় খুব একটা লাভ নেই বোধহয়। জানে খুব বেশি ঝুঁকি না নিয়েও গর্তের ভেতরটা দেখা সম্ভব। পকেট হাতড়ে দেয়াশলাই বের করল, বুটের সাথে কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল। তারপর জ্বলন্ত কাঠিটা ছুড়ে ফেলল গর্তের ভেতর। ডানাহীন জোনাকি পোকার মত খসে পড়ল কাঠিটা। গর্তের তলায় পৌঁছে কয়েক সেকেন্ড হিসহিস শব্দ করল, তারপর মোলায়েম সালফারে আগুন ধরল।
গর্তটা খালি নয়। স্নান আলোয় মুহূর্তের জন্যে জীর্ণ খবরের কাগজ, বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা আর ভাঙাচোরা একটা ক্রেট দেখতে পেল শেভার্ন। খবরের কাগজের এক প্রান্তের ছোঁয়া পেল আগুন, উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হলো পুরো গর্ত। শেভার্নের তটস্থ নার্ভে নাড়া দিয়ে গেল আলোটা, তাছাড়া আলোর বিপরীতে থাকায় বহু দূর থেকে স্পষ্ট চোখে পড়বে ওকে। লাগাম টেনে মাসট্যাঙকে পিছিয়ে আনল, আলতো স্পর দাবিয়ে সরে এল জায়গাটা থেকে।
শখানেক গজ দূরে থামল ও, অকারণ শঙ্কা বোধ করায় নিজের ওপর বিরক্ত, এবং লজ্জিত। শত্রুপক্ষের কেউ আশপাশে থাকলে অনায়াসে দেখতে পেত ওকে। এভাবে বোকার মত ঘোড়া ছোটানোও ঠিক হয়নি। যদি আরেকটা গর্তে পড়ে যেত?
থামার আগে আরও কয়েক গজ এগোল ঘোড়াটা। ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল শেভার্ন। কবরের মুখ থেকে লাগাতার ধোঁয়া উঠছে, যেন অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে কোন আগ্নেয়গিরি থেকে।
সাহস হারিয়ে ফেলেছ, নিজেকে তিরস্কার করল ও, ম্যাকলেন্ডনদের পক্ষে দাঁড়ানোর আশা বাদ দিয়ে তোমার বরং সানফ্রান্সিসকোর ট্রেইল ধরা উচিত। কি জন্যে ভয় পেয়েছে ও? কমবয়েসী ঘোড়া বা লংহনের পালের মতই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, কারণটা কি?
আচমকাই বিস্ফোরিত হলো কবরটা, কামানের গোলার মত বিকট শব্দ ভেঙে দিল নির্জন পাহাড়ী এলাকার নিস্তব্ধতা। আকাশে নিক্ষিপ্ত হলো ছোট ছোট নুড়িপাথর আর বালি।
তাহলে ধারণাটা একেবারে মিথ্যে ছিল না! সহজাত প্রবৃত্তির নির্দেশই মেনে চলা উচিত ওর। এখান থেকে চলে গেলেই ভাল করবে, গর্তটা পরখ করে দেখা উচিত হয়নি।
ইতোমধ্যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে ঘোড়াটা। প্রথমে অন্ধের মত ঘুটঘুটে আঁধারে ছুটতে হয়েছে, তারপর গর্তে বিস্ফোরণ, তীব্র আলোর ঝলকানি, নুড়িপাথরের ঝড় এবং স্যাডলে বসা লোকটির বেয়াড়া আচরণ-সব মিলিয়ে দ্বিধান্বিত, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ওটা। তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনি করে সামনের দুপা আকাশে তুলে দিল মাসট্যাঙ, সামলে নেওয়ার কোন সুযোগই পেল না শেভার্ন। পিঠ থেকে ওকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে ঘোড়াটা। স্টির্যাপ থেকে পা সরে গেছে ওর, স্যাডলে বসে থাকতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। টানের চোটে ওপরে উঠে গেল একটা স্টির্যাপ, শেভার্নের ঊরুতে আঘাত করল। তীব্র ব্যথায় দাতে দাঁত চাপল ও, ভয় হচ্ছে স্যাডল চ্যুত না হলেও হয়তো আগামী কয়েকটা দিন খুড়িয়ে হাটতে হবে।
দৃঢ় হাতে লাগাম টেনে ধরল ও, স্যাডলের সাথে চেপে বসেছে শরীর। ভদ্র আচরণ করার সময় নেই এখন। লাগামের প্রান্ত দিয়ে সপাটে আঘাত করল ঘোড়ার মুখে, একইসঙ্গে তীব্র গালের তুবড়ি ছোটাল। অবস্থা বেগতিক দেখে হাল ছেড়ে দিল ঘোড়াটা, কিংবা শুভবুদ্ধির উদয় হলো হঠাৎ, লাফ-ঝাপ বন্ধ করে ক্রীকের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করল। ইতোমধ্যে একটা স্টির্যাপ দখল করে নিয়েছে শেভার্ন, স্যাডলের সাথে মিশে আছে কোন রকমে। তীব্র বেগে দুটো গাছের মাঝখান দিয়ে ছুটে গেল ঘোড়াটা, মুক্ত স্টির্যাপটা ফের আঘাত করল ওর ঊরুতে।
মিনিট দশ পর হয়রানির শেষ হলো। তারার আলোয় নির্জন উপত্যকায় থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা, পরিশ্রমের কারণে হাঁপাচ্ছে। সত্যিই দুঃখিত, দুঃখ প্রকাশ করল শেভার্ন। সওয়ারী তোর মতই সমান রসিক বা বুদ্ধিমান হবে আশা করার অধিকার আছে তোর!
পরিশ্রান্ত মাসট্যাঙ ওর অজুহাত মেনে নেওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিল শেভার্ন। কোন কিছুই কি ঠিকমত ঘটতে পারে না? ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে ও, আত্মবিশ্বাসী দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। অথচ একটু আগেই আতঙ্কিত, দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল। নিশ্চিত জানে না ঠিক কি উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছিল কিংবা কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, কিন্তু বহু দূর থেকে শোনা যাবে এমন। কোন বিস্ফোরণ ঘটানোর ইচ্ছে অন্তত ছিল না। কিংবা নিজে খোড়া হয়ে ফিরে আসার সাধও ছিল না; ঘোড়া আর ওর ওপর দিয়ে ধকল কম যায়নি-আগামী কদিন হয়তো খোঁড়া হয়ে থাকবে দুজনেই।
ফাঁদটা যে-ই তৈরি করুক, ফলাফল দেখতে আসবে সে।
তীক্ষ দৃষ্টিতে চারপাশ জরিপ করল শেভার্ন, আশা করছে সহজ কোন পথে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারবে, এবং পথে আক্রান্ত হতে পারে এমন কোন জায়গায় যেতে হবে না কিংবা আকাশের বিপরীতেও অবস্থান নিতে হবে না। তাহলে অজ্ঞাত শক্রর জন্যে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
কিন্তু নিরাপদেই ক্যাম্পে ফিরে এল ও।
শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল ওস্টেনভেল্টদের উড়িয়ে দিয়েছ তুমি! কিছুটা উপহাসের সুরে মন্তব্য করল জুডাস ম্যাকলেন্ডন।
স্যাডল ত্যাগ করে ঘোড়াকে একপাশে নিয়ে এল শেভার্ন, কিছুটা হলেও খোড়াচ্ছে। ওর দুরবস্থা সম্পর্কে ভাইয়ের চেয়ে বোনকেই বেশি সচেতন মনে হলো। মনে হচ্ছে তোমাকেই উড়িয়ে দিয়েছে ওরা! হালকা সুরে মন্তব্য করল মিসেস ব্রুকস, তারপর বয়স্কা মহিলাকে বলল কি যেন-এত দ্রুত যে ধরতে পারল না শেভার্ন। লক্ষ করল তখুনি তৎপর হয়ে উঠেছে মহিলা, ওর ব্যাগ হাতড়ে গ্রীন রীভারের বোতলটা বের করে ফেলল।
খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! সময়ের কাজ সময়ে সারার বুদ্ধি মহিলাদের দিয়েছেন তিনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোতলের মুখ খুলল ও। দুই ঢোক গলায় ঢেলে, বুট খুলে কম্বলের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। ব্যথা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। পরে যখন ঘুম ভাঙল, দেখল মাঝ আকাশ পেরিয়ে গেছে রূপালি চাঁদ।
ওরা কিভাবে জানতে পারল গর্তের কাছে যাব আমি? ওর মনে কি চিন্তা চলছে কারও পক্ষেই আঁচ করা সম্ভব নয়, এমনকি ওর বিবেকের পক্ষেও জানা সম্ভব ছিল না। কে জানবে স্রেফ কৌতূহলের বশে দেয়াশলাইয়ের একটা কাঠি গর্তে ফেলবে জিম শেভার্ন?
এ ধরনের ফাঁদ আগেও দেখেছে ও-যুদ্ধক্ষেত্রে। পিছু নেওয়া শত্রুদের বোকা বানাতে এরকম ফাঁদের জুড়ি নেই। কিন্তু কোন রকম টোপ বা উস্কানি ছাড়া একেবারে জায়গামত পৌঁছে গেছে ও…বড় অস্বাভাবিক, নেহায়েত গর্দভ না হলে এরকম দৈবাৎ যোগাযোগ আশা করবে না কেউ। দূরে করুণ সুরে ডেকে উঠল একটা কয়োট, ডাকটা যেন ওর দ্বিধাকে আরও বাড়িয়ে দিল।
নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, ওকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে আয়োজন করা হয়নি ফাঁদটার। বরং স্রেফ কাকতালীয় ভাবে ফাঁদে পড়েছে ও। হয়তো কারও জন্যেই তৈরি করা হয়নি ওটা। পরে এর হোতা কিংবা টার্গেট সম্পর্কে জানতে পারবে। সেজন্যে সময় দরকার, দরকার ওর ক্ষতগুলো সেরে ওঠার ফুরসত।
মি. শেভার্ন, জেগে আছ? লাল-চুলোর মৃদু স্বর শুনতে পেল শেভার্ন।
দুর্ভাগ্যক্রমে।
তোমার আঘাতগুলো কি মারাত্মক?
উঁহু, তেমন গুরুতর নয়। কয়েকদিন বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে।
ভাবছি আমাদের মধ্যে কে আগে সেরে উঠবে।
কেমন বোধ করছ তুমি?
ভাল। মনে হয় তাপ আর রক্তক্ষরণের জন্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এখন যেহেতু যাত্রার ধকল নেই, আর পাহাড়ী পরিবেশও সামলে উঠতে সাহায্য করছে। আমাকে।
তারপরও লড়াই চালিয়ে যেতে চাইছ? খোদা যদি সাহায্য করে।
হ্যাঁ, অন্যমনস্ক স্বরে বলল শেভার্ন। ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করতে দোষ নেই, দায়ও নেই। এই ব্যাপারটা সবসময়ই উপকারী।
তুমি বোধহয় আস্তিক নও, মি. শেভার্ন? সেটা নির্ভর করে আমাকে কিসে বিশ্বাস করতে বলল তার ওপর।
অবশ্যই একমাত্র খোদায়! ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা শিব?
আলাপচারিতার সমাপ্তি হলো এখানেই। তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন, নিজের ইতিকর্তব্য ছাড়া আর সবকিছুই ভাবছে: এভাবে আর কত রাত কাটাতে হবে, যদ্দিন না কোথাও স্থির হওয়ার ইচ্ছে হবে? তেমন জায়গা কি আদৌ খুঁজে পাবে? হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়া উচিত। আরও দূরে কি কোন জায়গা আছে? সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে জানার চেষ্টা করবে।
ধীরে ধীরে অন্যদের মত সহজ, গভীর হয়ে এল জুলিয়া ব্রুকসের শ্বাস প্রশ্বাস, একা হয়ে গেল শেভার্ন। দুই ব্যাংকারের দৈবাৎ উপস্থিতি সম্পর্কে ভাবছে। বিশ হাজার ডলার কি যুক্তিসঙ্গত অফার? পরিস্থিতির বিচারে অবশ্য যৌক্তিকই মনে হয়, কারণ নাছোড়বান্দা শত্রুরা ম্যাকলেন্ডনদের চারপাশে ভিড় করেছে, বৃত্তটা ক্রমশ ছোট করে আনছে…
অফারটা ন্যায্য। বুড়ো নীল ম্যাকলেন্ডনের উইলে দশ হাজার পশুর কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি ভেড়ার দাম এক ডলার এবং বাথানটা চালু অবস্থায় থাকলে হয়তো অন্যায্য বলা যেত অফারটাকে। কিন্তু ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে র্যাঞ্চ হাউস, মেষপালকরা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দিকে। দয়া দেখাতে এত দূর ছুটে আসেনি ব্যাংকাররা।
বাবার শত্রুদের সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা করত আমার স্বামী!
ম্যাকলেন্ডনের শত্রু আর জামাতা জানে, এমন কি জানা নেই জুড বা জুলিয়া ব্রুকসের? নিজের হত্যাকারীর পরিচয় জানত বুড়ো, কিন্তু বলেনি ওকে। বললেই বোধহয় ভাল হত।
ব্যাংকার দুজন নিশ্চয়ই যাত্রা বিরতি করবে সোডা স্প্রিং-এ। দুএকদিন থাকাও বিচিত্র নয়। বেসিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর করবে, এটাই স্বাভাবিক, সান্তা ফের উদ্দেশে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার আগে অপেক্ষায় থাকবে বিপদগ্রস্ত ম্যাকলেন্ডনরা প্রস্তাবটা গ্রহণ করবে। হয়তো এখানকার ঝামেলার খবর শোনেইনি বেটারা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। কিছুই জানা নেই ওর। কোমরে লাগাতার ব্যথা হচ্ছে, আসলে পুরো শরীরেই চাপ চাপ ব্যথা। লাফ-ঝাপ দিয়ে ভালই ভুগিয়েছে। ওকে মাসট্যাঙটা। আজ রাতে আর ঘুম হবে না। কম্বল ছেড়ে উঠে পড়ল ও, তারপর তাজা একটা মাসট্যাঙে স্যাডল চাপাল।
আবার? তন্দ্রালু স্বরে উদ্বেগ প্রকাশ করল মিসেস ব্রুকস।
হ্যাঁ, দাঁতে দাঁত চেপে স্যাডলে চাপল শেভার্ন।
ঢালু পথ বেয়ে একশো গজ নেমে গেল ঘোড়াটা, প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে শেভার্নের শরীরে, এতটা যে পরে সমান জমিতে পৌঁছার পর মাসট্যাঙটা দৌড়াতে শুরু করলেও কোন ব্যথা অনুভব করল না, সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে গেছে স্নায়ুগুলো।
চড়াইয়ের মাঝপথ থেকে ভোলামেলা জায়গার শুরু, অন্য একটা ট্রেইলে যথেষ্ট আড়াল রয়েছে। সামান্য বিপদের আশঙ্কা থাকলেও ভোলা পথটাই পছন্দ করল শেভার্ন। ক্রীকের কাছে বিস্ফোরণের ফলাফল দেখতে যদি কেউ আসত, এতক্ষণে ম্যাকলেন্ডনদের পোড়া বাড়ির আশপাশে নিশ্চই উকিঝুঁকি দিত।
সোডা স্প্রিং-এর ট্রেইল পেরিয়ে আরও কয়েক মাইল এগোল ও। প্রতি মুহূর্তে শরীরে, বিশেষ করে কোমরে ব্যথা অনুভব করছে। গান পাউডারের পোড়া গন্ধ পাচ্ছে এখন। মাসট্যাঙের গতি কমিয়ে ক্রীকের পাড় ধরে এগোল ও। কবরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, গর্তটা বিশাল হয়ে গেছে এখন।
ঘোড়াটাকেও ক্লান্তিতে পেয়ে বসেছে। শেভার্ন নিজে যতটা না ক্লান্ত তারচেয়ে বেশি ব্যথায় পর্যদস্ত। ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে গেল, পুব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে, সূর্য উঠতে বড়জোর ঘন্টা খানেক বাকি। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ, ক্যাম্প ছাড়ার পর এই প্রথম চারপাশ কিছুটা হলেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, দুলকি চালে ঘোড়া ছোটানোর সুযোগ হলো।
ক্রীকটা খুব বেশি চওড়া নয় এদিকে, বরং কিছুটা সরু হয়ে এসেছে। নিচের বসতির দিকে ক্রীকের গতিপথ বদলে দেওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল জুডাস আর ইউসেবিও। উপত্যকাটা প্রায় আধ-মাইল প্রশস্ত, কিন্তু নিচে ঘাসের অভাব নেই, ম্যাকলেন্ডন এস্টেটের কাছাকাছি যেমন দেখেছে-ঘাসের গোড়া পর্যন্ত খেতে পারেনি ভেড়ার দল।
স্যাডল ছাড়ার সময় দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করল ও, জমির ঘাস পরখ করল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ভেড়ার দল চরেছে, কিন্ত তারপরও ক্ষুধার্ত একটা গরু চরতে পারবে কয়েক মাস, এই মুহূর্তে ওর ঘোড়াটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ওস্টেনভেল্টরা ঠিক কতটা জমি ক্লেইম করেছে? কটা গরু আছে ওদের? অথচ গরু চরানোর সামান্য চিহ্নও নেই আশপাশে!
আরও কয়েক মাইল এগোল ও, জানে ওস্টেনভেল্টদের হেডকোয়ার্টার থেকে বেশি দূরে নেই। নাক কুঁচকে বাতাসে গন্ধ শুকল, কিন্তু উল্টোদিকে কোন আগুন জ্বালানো হলেও বেরসিক বাতাস গন্ধটা এদিকে বয়ে নিয়ে আসছে না। পুব আকাশে রঙ ধরতে শুরু করেছে, ফুরফুরে বাতাস বইছে। পাইনের সুবাসিত বাতাস। কয়েকশো গজ দূরে দৃষ্টি চলে যাওয়ার মত আলো ফুটেছে। ধীরে ধীরে সন্দেহটা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে: চারপাশে প্রচুর ঘাস, দীর্ঘ তাজা এবং কিন্তু পর্যাপ্ত গরু চরছে না। ওস্টেনভেস্টরা তাহলে কিসের বাথান করছে?
প্রবল বিতৃষ্ণা বোধ করছে শেভার্ন। আজকের অভিযানও যদি অসম্ভবের পেছনে অর্থহীন ছোটাছুটি প্রমাণিত হয় তাহলে পুরো দিনটাই হারাতে হবে ওকে, কারণ ফিরে গিয়ে স্রেফ বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। পাহাড়ের কিনারার দিকে তাকাল ও, আচমকা ক্ৰীকের বাঁকের কাছে প্রথম গরুটা দেখতে পেল।
লংহর্ন। খুব একটা হৃষ্টপুষ্ট নয়। আমদানী করা ষাঁড়ের ব্রীডিং ঘটিয়ে যে গরুর জাতের উন্নতি করা সম্ভব, এখানকার লোকেরা তথ্যটা বোধহয় জানে না। ঘোড়া থামিয়ে উপত্যকায় সতর্ক নজর চালাল শেভার্ন। স্পার দাবাতে যাচ্ছিল, ঠিক এসময়ে বাঁকের মুখে কালো ধোয়া চোখে পড়ল। সন্তর্পণে এগোল ও, দেখল নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ধোয়াটা। কেউ বোধহয় নাস্তা তৈরি করার জন্যে আগুন জ্বালিয়েছে। ভাল করে তাকাতে দেখল পোলের তৈরি একটা দালান আছে। সেখানে।
দালান ছাড়িয়ে উপত্যকাটা আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে, শেষে ক্যানিয়নের মুখে দুভাগ হয়ে গেছে। ছোট ছোট চারণভূমি দেখা যাচ্ছে, আর আছে ঘন গাছপালা। অনায়াসে ওখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যাবে, তবে বসতির এত কাছাকাছি যাওয়া উচিত হবে না বোধহয়। গরুর জন্যে আকর্ষণীয় যে কোন জায়গা ওর জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ গরু মানেই রাইডার, আর রাইডার থাকা মানে কুকুরও থাকতে পারে। র্যাঞ্চ হাউসের এত কাছাকাছি কুকুরের উপস্থিতি একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।
ন্যাড়া ঢালের ওপর দৃষ্টি রেখে স্পর দাবাল ও, সচেতন যাতে র্যাঞ্চ হাউস থেকে কারও চোখে পড়ে না যায়। নিচে কোথাও ডেকে উঠল একটা মোরগ।
মিনিট বিশেক পরে, সিকি মাইল দূরের এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল ও, থেমে নিচের দিকে তাকাল। ঘোড়াটাকে পাহাড়ের ওপাশে রেখে এসেছে। ঘাসের ওপর বসে ক্যান্টিনটা পাশে রাখল। ধরেই নিয়েছে দীর্ঘ এবং তাপদ একটা দিন কাটাতে হবে এখানে। কেউ যদি স্রেফ ঘুরতেও এদিকে চলে আসে, অনায়াসে দেখে ফেলবে ওকে। তবে চুরুট টানার ইচ্ছেটাকে যেহেতু গলা টিপে রেখেছে, আপাতত কারও কৌতূহলী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।
ডাবল-ও র্যাঞ্চ হাউস জরিপ করল শেভার্ন। উপত্যকা থেকে দেখার সময় মাত্র একটা অংশ চোখে পড়ছিল, উচ্চতার সুবিধার জন্যে এখন মূল দালান ছাড়াও বার্ন, করাল…সবই দেখতে পাচ্ছে। পোল করালে প্রায় এক ডজন ঘোড়া; বাঙ্ক হাউসে লোকজনের সাড়া টের পাওয়া যাচ্ছে, ঘুম থেকে উঠছে বোধহয়। করাল ছাড়িয়ে কৃক শ্যাকের দিকে এগোল কয়েকজন।
এর আগে কোন র্যাঞ্চ হাউস দেখে কখনও করুণা বোধ করেনি শেভার্ন, আজ করতে হলো। স্রেফ কেবিন বলা যেতে পারে বড়সড় বাড়িটাকে, খুব বেশি হলে একটা কামরা আর বাঙ্ক হাউস আছে। অবশ্য কেউ যদি ভেতরটা পাল্টে ফেলে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা; কিন্তু বাইরে থেকে লগের তৈরি জোড়া চোখে পড়ছে না। সব মিলিয়ে হয়তো এক ডজন লোক থাকতে পারবে, যদি না ডাবলিং করে থাকে এরা। এক কোণে কৃক শ্যাক, ছাতের কিনারা ধসে পড়ায় লগের তৈরি একটা খুঁটি বেরিয়ে পড়েছে।
করালের খুঁটিতে ঘুণ ধরেছে, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হিচিং রেইলের কাঠ। ওঅটর ট্রাফগুলো এতটাই ক্ষয়ে গেছে যে পানি ধরছে না তেমন। করালের পেছনে মরচে পড়া একটা নিড়ানি যন্ত্র দেখা যাচ্ছে, কিন্তু শস্যের কোন চিহ্ন নেই সারা এলাকায়। সম্ভবত নতুন করে ঘাস গজিয়ে ওঠার আগে শেষবার ব্যবহার করা হয়েছিল ওটা।
চুরুটের জন্যে পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল শেভার্ন, মনে পড়ল সকাল এখন। চুরুট ধরানো ঠিক হবে না। দেখল কূক শ্যাক থেকে বেরিয়ে আসছে লোকজন, ঢেকুর তুলে দাঁত খিলাল করছে। তারপর করালে গিয়ে ঘোড়ার সাজ পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ঠিক ওর কানের কাছে নাক ঝাড়ল একটা ঘোড়া। চমকে ফিরে তাকাল শেভার্ন, ভাবছে কিভাবে পিকেট তুলে এখানে চলে এসেছে ঘোড়াটা। কিন্তু ঘোড়াটা ওর নয়। স্যাডল পরানো ইঁদুর রঙা একটা মাসট্যাঙ, খোড়াচ্ছে খানিকটা।
ঘোড়াটার খোঁজে কেউ এখানে চলে এলেই সর্বনাশের মোলোকলা পূর্ণ হবে। দ্রুত পিছিয়ে এল ও, কিন্তু অনুসরণ করল ঘোড়াটা। ভাগ বেটা, বাড়ি যা! চাপা স্বরে ঘোড়াটাকে ক্ষান্ত করার প্রয়াস পেল শেভার্ন, হ্যাট দিয়ে ওটার চিবুকে বাড়ি লাগাল। কিন্তু মুখ সরিয়ে নিল ঘোড়াটা, তারপর আচমকা ওর হ্যাট কামড়ে ধরে। কেড়ে নিল।
এমন ট্রিক ঘোড়াটা শিখল কোত্থেকে! বিম্ময় নিয়ে ভাবছে শেভার্ন। এদিকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না খোড়া মাসট্যাঙ, খেলাটা যেন দারুণ উপভোগ করছে, ওর কাছাকাছি হলো আরও। শেভার্ন হ্যাট পুনরুদ্ধার করতে হাত বাড়াতে মুখ সরিয়ে নিল, খোড়া পায়ে দুটো লাফ দিয়ে নাগালের বাইরে চলে গেল। ঘোড়াটা একটা মেয়ার, আবিষ্কার করল শেভার্ন।
কপালে ঘাম জমছে, টের পেল ও, নড়াচড়ার সময় কোমরে ব্যথা পাচ্ছে। বেরসিক মেয়ারটা নির্মম তামাশা করছে ওর সঙ্গে, কাছে গেলেই সরে যাচ্ছে। ব্যথা থাকায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে শেভার্নের চলা, রিফ্লেক্স ধীর হয়ে গেছে, খোড়া হলেও তাই প্রতিবারই ওকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলো মেয়ারটা। ধীর গতিতে ঢাল বেয়ে নেমে গেল ওটা, সরাসরি করালের দিকে এগোচ্ছে। দাঁতের সারির ফাঁকে শেভার্নের স্যাভিলানো হ্যাটটা ধরে রেখেছে এখনও।
.
১০.
যে-ই কৌশলটা শিখিয়ে থাকুক, নিশ্চই ভাবেনি কাউকে বিপদে ফেলবে অতি উৎসাহী নিরীহ ঘোড়াটা। মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগেই খোলা জায়গায় চলে যাবে মাসট্যাঙ, স্যাভিলানোটা অনেক দূর থেকে চোখে পড়বে যে কারও। এই অঞ্চলে এটাই বোধহয় একমাত্র স্যাভিলানো। র্যাঞ্চ হাউসের লোকজন নিশ্চই শুনেছে অদ্ভুত হ্যাটটার মালিক জিম শেভার্ন; দুদিন আগে ট্রেইলে ওর মুখোমুখি হয়েছিল চারজন, জীবিত দুজনের কেউ আশপাশে থাকলে ঠিকই চিনতে পারবে।
খেল খতম! নিচু স্বরে শিস বাজানোর সময় ভাবল শেভার্ন। আশা করছে করালের লোকগুলো ঘোড়ায় স্যাডল পরানোয় ব্যস্ত থাকবে, খোড়া মাসট্যাঙের খুরের শব্দ হয়তো কারও কানে যাবে না। প্রথমে থমকে দাঁড়াল মাসট্যাঙটা, তারপর ঘুরে ফিরল ওর দিকে, বড়বড় চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শেভার্ন, সিদ্ধান্ত নিল আর কখনও বিবেকের সাথে তর্ক করবে না।
ধীরে ধীরে ফিরতি পথে এগিয়ে এল ঘোড়াটা, ওর কাছ থেকে দুহাত দূরে থামল। শেভার্নের পায়ের কাছে ফেলল হ্যাটটা। স্যাভিলানো তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় চাপাল ও।
চলে যাচ্ছে না ঘোড়াটা, তেমন কোন লক্ষণই নেই। মাসট্যাঙের মালিক বোধহয় এরইমধ্যে খোঁজ করতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে এদিকে চলে আসবে নিশ্চই। নিজের ঘোড়ার লাগাম টাইট করল শেভার্ন, স্যাডলে চেপে বসতে উদ্যত হলো, স্যাডল হর্ন চেপে ধরেছে এক হাতে। চলে যা, বোকার হদ্দ! চাপা স্বরে গাল দিল ও, কিন্তু সাহসের চূড়ান্ত দেখাচ্ছে ঘোড়াটা। ওর পেটে গুতো দিয়ে পকেটে মুখ ঢোকানোর চেষ্টা করছে। চিনি নেই আমার কাছে! নে, চুরুট আছে! বলে বাড়িয়ে ধরল ও একটা।
চুরুটটা বোধহয় পছন্দ হয়েছে মাসট্যাঙের, আরেকটার জন্যে ওর কোমরে গুতো মারছে। হ্যাট দিয়ে সপাটে ওটার মুখে বাড়ি মারল শেভার্ন। পিছিয়ে গেল। ঘোড়াটা, অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। হ্যাট নেড়ে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করল ও, ভুলেই গিয়েছিল সারা শরীরে ব্যথা। তীব্র যন্ত্রণা বোধ করতে নিঃশ্বাস আটকে এল ওর, অজান্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, মুহূর্তের জন্যে দুটো সূর্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। কিন্তু কাজ হয়েছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে র্যাঞ্চ হাউঙ্গের দিকে এগোতে শুরু করেছে ইঁদুর রঙা মাসট্যাঙ, শেভার্নের সঙ্গে খুনসুটি করার কিংবা চুরুট খাওয়ার খায়েশ মিটে গেছে।
দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল ক্রমশ, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, স্পষ্ট অনুভব করতে পারল জিম শেভার্ন।
ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে কেউ, চিৎকার করছে লোকটা: নেলি, কোথায় গেলি? আরে কোত্থেকে এল ঘোড়াটা?
পাহাড়ের কোল থেকে খোলা উপত্যকায় ঢুকল লোকটা, ঠিক শেভার্নের মাথার কাছে। এখনও হাঁটুর ওপর বসে আছে শেভার্ন, দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। সূর্যের আলো চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে, হ্যাটটা মাথায় চাপাল ও।
শেভার্ন টের পেল ওর চেয়ে বরং আগন্তুকই বেশি বিহ্বল হয়ে পড়েছে, থমকে দাড়িয়েছে ঘোড়াটা। সওয়ারী এবং সওয়ার, দুজনেই দ্রুত লয়ে শ্বাস ফেলছে। স্রেফ রিফ্লেক্সবশত শেভার্নের হাতে উঠে এসেছে কোন্ট দুটো, আগকের বুক বরাবর নিশানা করে রেখেছে।
ওহ্, জেসাস! শ্বাস টানার ফাঁকে বিস্ময় প্রকাশ করল লোকটা, এ যে লাইমি!
নড়ল না শেভার্ন। এখনও হাঁটু গেড়ে আছে, দুহাতে দুই কোল্ট, ব্যথা চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। শেষে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল। একটা বে ঘোড়া দেখতে পেল সামনে, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। দেখে মনে হচ্ছে নডতেও ভুলে গেছে, মাথার ওপর হাত না তুললেও বুকের সামনে আড়াআড়ি করে রেখেছে।
তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, শান্ত স্বরে বলল ও। নেমে এসো তো, বাছা, সব খবর শোনাও আমাকে।
তাকিয়ে থাকল ছেলেটা, ঢোক গিলে সাহস সঞ্চয় করল। তারপর দ্রুত স্যাডল ছাড়ল।
একটা কোল্ট নেড়ে ইঙ্গিত করল শেভার্ন। আরাম করে বোসো।
আ-আমাকে খুন করবে না তো?
কোন কারণ দেখাতে পারবে যেজন্যে তোমাকে খুন করা উচিত?
আমি জানতাম না ঘোড়াটা ওই মহিলার।
কার?
জানি না!
ধীরে ধীরে ট্রিগারে চাপ বাড়াল শেভার্ন।
মিজ ব্রুকসের!
খুব খারাপ! একটা পিস্তল হোলস্টারে ফেরত পাঠাল ও, অন্যটা আগের মতই রইল।
কি খারাপ? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তরুণ।
ঘোড়া চোরদের শাস্তি নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার?
শঙ্কিত চাহনিই বলে দিচ্ছে জানে সে। সতেরো হবে ছেলেটার বয়েস, জুডাস ম্যাকলেন্ডনের বয়সী। ফর্সা মুখে কয়েকটা ফুটকি চিহ্ন রয়ে গেছে এখনও।
নাম কি তোমার? জানতে চাইল শেভার্ন, ছেলেটা উত্তর না দেওয়ায় যোগ করল: ঘোড়া চোর চেনা-অচেনায় অবশ্য কিছু যায়-আসে না, বয়সটাও যথেষ্ট হয়েছে তোমার।
কিন্তু ওরা সবাই একই কাজ করছে! প্রতিবাদ করল ছেলেটা।
তাহলে নিশ্চিন্তে বলা যায় দড়ির খুব কাছাকাছি আছে প্রত্যেকে।
আমি জানতাম না ঘোড়াটা মিজ ব্রুকসের!
কিন্তু এটা তো জানতে যে ঘোড়াটা তোমার নয়। যাকগে, প্রসঙ্গটা বরং কিছুক্ষণের জন্যে বাদ দেয়া যাক। কখনও এরকম জোড়া কোল্ট দেখেছ?
আর দেখতে না পেলেই বরং খুশি হব। কিন্তু তাতে কি, ফাঁসিতে না ঝোলালেও নিশ্চয়ই গুলি করে মারবে আমাকে!
সময়ই সেটা বলে দেবে, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল ও। এবার আমার ঘোড়াটা তৈরি করো তো। ঘোড়ার ওপাশে যেয়ো না আবার। তাহলে কিন্তু ঘোড়ার আশা ত্যাগ করতে হবে আমাকে, যদিও তোমারটা পেয়ে যাব।
নিজের ঘোড়াকেও গুলি করবে তুমি?
তুমি যদি বাধ্য করো।
নির্দেশ তামিল করল ছেলেটা। ইতোমধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছে শেভার্ন, তবে বিপর্যস্ত শরীরে তরুণের সামনে স্যাডলে চাপার ইচ্ছে নেই। মেয়ারটাকে একটা লীড রোপ দিয়ে বাঁধো এবার।
ম্যাকলেন্ডনদের কাছে ফিরিয়ে নেবে ঘোড়াটা?
তুমি নেবে।
পরিস্থিতিটা সুখকর নয়, তবে মৃত্যুর চেয়ে শ্রেয়তর, বুঝতে অসুবিধে হলো তরুণের। বিনা বাক্য ব্যয়ে নির্দেশ তামিল করল সে, মেয়ারটাকে নিয়ে এসে দেখল নিজের ঘোড়ার লাগাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে শেভার্ন, অন্য হাতে কোল্ট।
জনি! নিচে, র্যাঞ্চ হাউসের কাছে চেঁচাল কেউ। নিকুচি করি তোমার, ছোকরা! আবার কোথায় ডুব দিয়েছ?
শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ছেলেটা।
দরকার হলে খুন করব তোমাকে, স্রেফ খোশগল্প করছে যেন এমন সুরে বলল শেভার্ন। ব্যাপারটা তোমার ওপর নির্ভর করছে, কাউকে নিজের চেহারা না দেখিয়ে কিংবা কিছু না জানিয়ে যদি ক্রীকের কাছে পৌঁছে যেতে পারো, তাহলে কিছুই বলার নেই আমার। এবার এগোও, বাছা, নিঃশব্দে এবং গাছের আড়ালে থেকো। খুব বেশি জোরে ঘোড়া ছুটিয়ো না। আমার কোল্টগুলো কিন্তু একশো গজ দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করে। দেখেছ তো, এগুলো একটু ভিন্ন চেহারার? বুলেটগুলোও বিশেষ ভাবে তৈরি, এক্সপ্লোসিভ বুলেট! পঞ্চাশ গজ দূর থেকেও গুলি লাগলে নির্ঘাত তোমার মেরুদণ্ড গুড়িয়ে যাবে।
তেমন কিছুই করব না, বলে স্যাডলে চাপল ছেলেটা, মেয়ারের লাগাম হাতে এগোল অস্পষ্ট ট্রেইল ধরে।
মিনিট খানেক অপেক্ষা করল শেভার্ন, ছেলেটাকে কিছু দূর এগোতে দিল, তারপর নিজের ঘোড়ার স্যাডলে চাপল। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করল ও, হাঁটুর গুতোয় ঘোড়াকে এগোনোর তাড়া দিল।
জনি, কি হলো তোমার? এক্ষুণি ফিরে এসো!
আসছি, উত্তর দিল শেভার্ন, স্পার দাবিয়েছে এবার।
শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে এগোল ও, আশঙ্কা করছে উপত্যকায় ডাবল-ও রাইডারদের মুখোমুখি হয়ে পড়বে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না, হয়তো অন্য কোন উপত্যকায় চলে গেছে লোকগুলো। ছেলেটার ঠিক একশো গজ পেছনে থাকল ও। ইঁদুর রঙা মেয়ারের ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না, প্রায়ই মাথা নাড়ছে আর ছোটার সময় অ্যথা বেশি শব্দ করছে। মাঝে মধ্যে পিছিয়ে পড়ছে, ওটাকে লীড করে নিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে জনি।
এভাবে নিজেকে না জড়ালেও পারতে! ভেতর থেকে বলে উঠল শেভার্নের সত্তা। ওর মনে পড়ল পণ করেছে আর তর্ক করবে না বিবেকের সঙ্গে। ছেলেটাকে বিপদে ফেলেছ তুমি! ওর ওপর চড়াও হওয়ার কি দরকার ছিল?
ওকে যেতে দিলেই ভাল হত? ফিরে গিয়ে অন্যদের বলে দিত আমার কথা!
অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ! ছেলেটার একটা সুযোগ পাওয়া উচিত!
ম্যাকলেন্ডনরাও তা পেতে পারে-পাওয়া উচিত।
এবার আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না। কোমবে লাগাতার ব্যথা অনুভব করছে ও, কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। ভাবছে ছেলেটাকে নিয়ে শেষপর্যন্ত কি করবে। এই বয়সে বহু তরুণ ফাঁসিতে ঝুলেছে এই অপরাধে। কিন্তু আরেক তরুণের মৃত্যুর কারণ হওয়ার ইচ্ছে নেই শেভার্নের।
বিস্ফোরিত কবরের কাছে পৌঁছে গেছে ছেলেটা। মুহূর্তের জন্যে সেদিকে তাকাল জনি, তারপর নির্বিকার মুখে এগোল একই পথ ধরে। স্পার দাবিয়ে দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে আনল শেভার্ন, ভাবছে কিভাবে ফাঁসির আতঙ্কে অস্থির জনির সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলতে পারে। তুমি খুঁড়েছ এটা? জানতে চাইল ও।
বিস্ময় ছেলেটার চোখে।
জানো কে করেছে কাজটা?
আবারও মনে হলো উত্তরটা জানা নেই জনির।
ম্যাকলেন্ডনদের ঘোড়া চুরি করা ছাড়া আর কি অপরাধ করেছ?
কিছুই না! আতঙ্কের বদলে উমা প্রকাশ পেল জনির কণ্ঠে।
ভেড়া মেরেছ?
উত্তর নেই।
মেষপালকদের খুন করেছ?
হার্ডারদের খুন করার মধ্যে দোষের কি আছে! বিড়বিড় করে বিদ্বেষ প্রকাশ করল জনি।
সত্যিই দোষের কিছু নেই, যদি সেটা আইনের দৃষ্টিতে ঠিক হয়। কিন্তু কোন উস্কানি ছাড়া যদি কাউকে খুন করো, ঘোড়া চুরির মত একই সাজা হবে তোমার।
জ্ঞান দেয়ার দরকার নেই আমাকে! আগে বা পরে ঠিকই আমাকে খুন করবে। তুমি। তোমার সঙ্গে অহঙ্কারী, অত্যাচারী ম্যাকলেন্ডনদের পার্থক্য কি?
অহঙ্কারী এবং অত্যাচারী?
কোন উত্তর এল না এবার।
ম্যাকলেন্ডনরা কি ক্ষতি করেছে তোমার?
ইয়াঙ্কিদের নিকুচি করি!
এবার কিছুটা পরিষ্কার হলো বোধহয়, অন্তত শেভার্নের কাছে তাই মনে হচ্ছে। বেসিনের একটা অংশের লোক এখনও আঞ্চলিকতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, ভাবতেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ওর। আমিও একজন ইয়াঙ্কি*! [*(আমেরিকায়) নিউ ইংল্যান্ড বা উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক]
জানি না তুমি কি। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি কখনও কোন যুদ্ধে হারোনি।
হাসি চাপতে সত্যিই হিমশিম খেতে হলো ওকে। একটা নয়, স্বীকার করল শেভার্ন, কিন্তু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করল না আসলে দুটো যুদ্ধে হেরেছে এবং তৃতীয়টিতে প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন। গৃহযুদ্ধের সময় ব্যক্তিগত ভাবে কোন ক্ষতি হয়েছে তোমার? জানতে চাইল ও, ভাবছে খুব বেশি হলে সাত হবে তখন ছেলেটার বয়স। জেনে কি হবে ওর?
নিজেকে ছাড়া কিছুই হারানোর ছিল না আমার।
গৃহযুদ্ধের পরের কঠিন ও তিক্ত সময়টা স্মরণ করল শেভার্ন। ক্ষতিগ্রস্ত, স্বজনহারা পরিবারগুলো তখনও সামলে উঠতে পারেনি, ফসলের অপেক্ষার ফাঁকে আধপেটা অবস্থায় কাটাতে হয়েছে অনেককে। ওর নিজের ক্ষতিও কম হয়নি। ভাবছি কিভাবে তোমার জীবন ধাঁচানো যায়, অন্যমনস্ক স্বরে বলল ও।
জনিকে দেখে মনে হলো কথাটা যেন শুনতেই পায়নি, ট্রেইল আর মেয়ারের দিকে মনোযোগ।
আমি যেখানে বড় হয়েছি, ভেড়ামারার জন্যেও ওখানে ছেলেদের ফাঁসিতে ঝোলায় লোকজন।
এবারও কোন উত্তর এল না।
ছোট ছোট অপরাধের জন্যে অবশ্য কিছু ওঅর্ক-হাউস আছে, জেলখানা না বলে শুদ্ধিখানা বলা উচিত-গরীব হয়ে জন্মানো তেমনই একটা অপরাধ। স্কিলির কথা শুনেছ কখনও, ওঅর্ক-হাউসের সবচেয়ে চালু খাবার?
আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা শুধু তুমিই জানো।
হয়তো তুমিও কিছুটা জানো। ওঅর্ক-হাউসে পৌঁছার পর শুধু এ জিনিসই জুটবে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দেবে না ওরা, কিন্তু তুমি নিজেও চাইবে না কারণ ওটা এতই ঝাল। ছেলেরা প্রথম দিকে জিনিসটা খেতেই পারে না। ক্ষুধামন্দা কাটানোর জন্যে বারো ঘন্টা কাজ করতে হয় ওদের।
স্যাডল হর্নে স্থির হয়ে থাকল ছেলেটার চোখ! সেটাও মনে হয় খুব খারাপ নয়, শেষে বিড়বিড় করে বলল সে। নিদেনপক্ষে দিনে একবার তো খাবার দেয় ওরা, তাই না?
নিজের খেলায় হেরে গেছে ও। ছেলেটা সামনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বলে স্বস্তি অনুভব করল, কারণ আচমকা ওর চোখ ভিজে ওঠা দেখতে পায়নি সে। হয়তো ওর বিবেকই ঠিক বলেছে, আনমনে ভাবল শেভার্ন, বখে যাওয়া এই তরুণের একটা সুযোগ পাওয়া উচিত।
ক্রীকের পাশের ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে ঘোড় তিনটে, এখনও পেছনেই আছে শেভার্ন। ছেলেটাকে নিয়ে কি করবে তাই নিয়ে ভাবছে।
বহু লোককে খুন করেছ তুমি, এমনকি তরুণরাও বাদ যাচেছ না, বলল ওর বিবেক, কণ্ঠে উপহাস।
প্রশংসাটা ফিরিয়ে দিতে এদের প্রায় সবাই মুখিয়ে ছিল! ক্ষুব্ধ মনে উত্তর দিল শেভার্ন।
কি ব্যাপার, কার সঙ্গে কথা বলছ? বিস্ময়ের সুরে জানতে চাইল জনি।
কিছু না। অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
এখানে তো আর কেউ নেই!
সহসা উৎসাহ বোধ করল শেভার্ন, আশা করছে পটাতে পারবে জনিকে। টেলিগ্রাফের কথা শুনেছ কখনও?
মাথা নাড়ল ছেলেটা।
নতুন জিনিস। কেবল কথা বললেই হয়, তার বা সংযোগ লাগে না।
সত্যি? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
সোডা স্প্রিং-এর শেরিফের সঙ্গে।
স্পষ্ট অবিশ্বাস দেখা গেল ছেলেটার চোখে।
কি বললে? কাঁপতে থাকা ঘোড়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল শেভার্ন। হ্যাঁ, এবার শুনতে পাচ্ছি। তুমি কি অপেক্ষা করবে?
আমি কেন শুনতে পাচ্ছি না? দ্বিধান্বিত স্বরে জানতে চাইল জনি।
কারণ মেশিনটার সঙ্গে সংযোগ বা সংস্পর্শ নেই তোমার, ব্যাখ্যা করল ও, তারপর ফের কাল্পনিক টেলিগ্রাফ-এর দিকে মনোযোগ দিল। হ্যাঁ, শেরিফ, পাঠিয়ে দিচ্ছি ওকে। উঁহু, কাগজ লিখে দিতে পারব না। আমি বরং ওর বর্ণনা দেই… কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও, আড়চোখে দেখল সবিস্ময়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে জনি; অসম্ভব ঘটনাটা বিশ্বাস করবে কি-না বুঝতে পারছে না, কিছুটা হলেও প্রভাবিত হয়েছে শেভার্নের আচরণে, তবে দ্বিধাও কাটছে না। হয়তো বড়দের মুখে টেলিগ্রাফ, গ্যাসের বাতি, স্টীমবোট বা আধুনিক ট্রেনের কথা শুনেছে।
সতেরো-আঠারো হবে ওর বয়েস, ঘোড়ার কানের কাছে বলে যাচ্ছে শেভার্ন। বেয়াড়া পিচ্চি একটা আঁচিল! খড়ের তৈরি একটা হ্যাট ওর মাথায়, জুতার তলায় সোল নেই। মেটে রঙের একটা ডান মেয়ারে রাইড করছে, স্যাডলের বয়স ঘোড়াটার দ্বিগুণ হবে। থেমে ও-প্রান্তের কথা শোনার ভান করল ও, তারপর নির্বিকার মুখে জনির দিকে ফিরল। শেরিফ আমাকে আশ্বস্ত করেছে। শহরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করবে না তোমাকে।
কে বলল সোডা স্প্রিং–এ যাচ্ছি আমি?
আমিই ধরে নিয়েছি। চিন্তা কোরো না, শহরে পৌঁছার পরপরই তোমার ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করবে লোকজন, সেরকমই ব্যবস্থা করে রাখবে শেরিফ। ব্যস্ততার জন্যে যেতে পারব না আমি, কালপ্রিটরা যাতে নেক-টাই পার্টিটা ভেস্তে দিতে শহরে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমার।
কালপ্রিট?
র্যাঞ্চে তোমার বন্ধুদের কথা বলছি।
ওদের নিয়ে কি করবে তুমি?
বিচক্ষণ মানুষ ওরা, কি করছে পুরোপুরি সচেতন। এবার কি তুমি…
শহরে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে ওরা?
নিশ্চয়ই। কিন্তু র্যাঞ্চে তোমার বন্ধুরা এত সহজে ছাড়া পাবে না। ভাল করে শুনে রাখো, তুমি যদি শহর থেকে পালানোর চেষ্টা করো, নিশ্চিত ভাবে বলা যায় পিছু নেবে শেরিফ। সামান্য এক ঘোড়াচোরের পিছু নিয়ে মরুভূমি পাড়ি দিতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না ওদের, ধরা মাত্র ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে চাইবে। ক্ষণিকের জন্যে থামল শেভার্ন, ছেলেটাকে ভড়কে দেয়ার সময় দিল। সময় থাকতে রওনা দাও, সোডা স্প্রিং এড়িয়ে টেক্সাসের দিকে চলে যেয়ো না আবার। আইন পিছু নিয়েছে এমন সব লোকেরা অবশ্য ওখানে নতুন ভাবে জীবন শুরু করে, কিন্তু এতটা সাহস বা বয়েস হয়নি তোমার, বাছা। ছেলেটার মুখ জরিপ করল ও, জানে তথ্যটা ঠিকই মাথায় ঢুকেছে জনির, কিন্তু চেপে রাখতে চাইছে। যাকগে, সোডা স্প্রিং-এর ট্রেইলে চলে এসেছি আমরা।
তাহলে একাই আমাকে শহরে পাঠাচ্ছ?
ঠিক। যথেষ্ট স্মার্ট তুমি, আশা করি এখানে ফিরে আসার সাহস করবে না। শহরে যাওয়া ছাড়া তো তোমার কোন উপায় দেখছি না! জানো তো সোডা স্প্রিং এর ওপাশে বিশ মাইলের মধ্যে কোন ওঅটর হোল নেই? সুতরাং পালানোর চিন্তা ভুলেও মাথায় এনো না।
মাথা ঝাঁকিয়ে রওনা দিল জনি। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখল শেভার্ন, পুরো আধ-ঘণ্টা। একসময় দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল জনির অবয়ব।
মেয়ারের লীড রোপ হাতে তুলে নিয়ে এস্টেটের ট্রেইল ধরল শেভার্ন। দপদপে ব্যথা হচ্ছে কোমরে, ঘোড়ার নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে সেটা।
সূর্যের দিকে তাকাল ও। মাঝ-সকাল পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। খোলামেলা জায়গায় এভাবে ঘুরে বেড়ানো মোটেই উচিত হচ্ছে না, পেনি-ফার্দিং রাইডারদের কেউ যদি জনির খোঁজে এদিকে আসত? আতঙ্কিত একটা ছেলে ফিরে আসছে না নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আধঘণ্টা ট্রেইলে চোখ রাখার দরকার ছিল না। জনিকে চিনতে ভুল না হয়ে থাকলে, নিশ্চিত ভাবে বলা যায় টেক্সাসে পৌঁছার আগে থামবে না ছেলেটা। ঘোড়া চুরির দায়ে ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে বরং সুস্থ ঝামেলাহীন একটা জীবন শুরু করতে পারবে সে।
এস্টেট ছাড়িয়ে মেসার ট্রেইল ধরল শেভার্ন, নির্বিকার মুখে ছাইয়ের স্তূপ দেখল একবার। মেসার ওপর ছড়ানো ছিটানো বাকবোর্ডের মাঝখানে তৈরি ক্যাম্পে পৌঁছল একটু পর। জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আগের চেয়ে খানিকটা চাঙা লাগছে মিসেস ব্রুকসকে।
ব্লসম! সবিস্ময়ে চিৎকার করে ছুটে এল লাল-চুলো, উদ্ধার করা মাসট্যাঙের গলা জড়িয়ে ধরল আনন্দে।
স্যাডল ছেড়ে নিজের ঘোড়ার যত্ন নিল শেভার্ন, তারপর বাকবোর্ডের ছায়ায় বেডরোলে বসে পড়ল। জায়গাটায় কয়েক ঘণ্টা ছায়া থাকবে। শুয়ে স্যাভিলানো দিয়ে মুখ ঢাকল ও।
ঘুম থেকে ওঠার পর দেখল তখনও ফিরে আসেনি জুড। জুড ফিরে এলে ওকে. এখানেই থাকতে বোলো, লাল-চুলোর উদ্দেশে বলল শেভার্ন। তোমাদের ওপর চোখ রাখতে পারবে ও। তাছাড়া ক্যাম্পে অন্তত একজন পুরুষ থাকা উচিত।
শেষ বিকেলের লালিমার ছোপ লেগেছে আকাশে, চোখ কুঁচকে নিচের উপত্যকার দিকে তাকাল জুলিয়া ব্রুকস। ঘুরে শেভার্নের পাশে এসে দাঁড়াল। দোষটা আমারই, হাতে কোন কাজ না থাকায় অস্থির হয়ে পড়ছিল ও। আমিই ওকে…
কোথায় ও?
পাশে একটা ক্যানিয়ন আছে, ঘোড়াগুলো ওখানেই রেখেছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না দেখতে গেছে।
শেভার্ন খেয়াল করল ক্লান্তি, অসুস্থতা বা বিষণ্ণতার পরও পুরোপুরি রমণীয় দেখাচ্ছে জুলিয়া ব্রুকসকে-কোথাও এতটুকু ঘাটতি নেই, পরিপূর্ণ এক নারী।
এস্টেট হয়ে কারও পক্ষে কি আমাদের অগোচরে নিচের উপত্যকায় যাওয়া সম্ভব?
সম্ভব, তবে চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মহিলার দিকে তাকাল শেভার্ন।
চোদ্দ বছর বয়স থেকে এই পাহাড়ে কেটেছে আমার, ব্যাখ্যা করল লাল চুলো। বেশিরভাগ সময় ব্লসমের পিঠে। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, গুরুত্বহীন বিষয়ে আলাপ করে বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ নেই। ধন্যবাদ, মি. শেভার্ন। ফিরে আসার সময় কোন ঝামেলা হয়নি তো?
তেমন কিছু নয়, ব্যাখ্যা করল ও।
তুমি নিশ্চিত ছেলেটা ফিরে আসবে না?
শ্রাগ করল শেভার্ন।
তোমার কাছ থেকে অন্য কিছু আশা করেছিলাম।
তুমি কি মনে করো বাচ্চা ছেলেদের প্রলুব্ধ করছি আমি?
তা করছ না জেনে খুশিই হয়েছি।
কটা ভেড়া বা ঘোড়া আছে, ধারণা করতে পারছ? প্রসঙ্গ বদল করল ও।
উঁহু, পরিষ্কার কোন ধারণা নেই, স্রেফ আন্দাজ। সোডা স্প্রিং-এ যখন গিয়েছিলাম, কিছু হার্ডার ছিল তখনও; কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে এ তল্লাট ছেড়ে পালিয়েছে ওরা। এর সবই অবশ্য রোজাওরার ধারণা।
তাহলে এটাই বয়স্কা মহিলার নাম। ভেড়া?
কার তদারক করবে ওরা? ভেড়া নেই বলেই তো চলে গেছে।
তাহলে পেনি-ফার্দিং ভেড়াও মারছে?
কি বললে, মি. শেভার্ন?
নিচের উপত্যকার লোকগুলোর কথা বলছি-ওস্টেনভেল্ট বাথানের পাঞ্চার বা রাইডার।
হ্যাঁ, আমার ধারণা ওরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছোট ছোট আরও কয়েকটা আউটফিট আছে অবশ্য। কিন্তু এদের কেউই নিজের গরুর বদলে আমাদের ভেড়ার মাংস খাওয়া ছাড়া তেমন ক্ষতি করেনি, আমরাও কখনও পাত্তা দেইনি। এসব হবেই। এরচেয়ে খারাপ কিছু করছে কি-না জানা নেই আমাদের, অন্তত তেমন কোন ঘটনা ঘটতে দেখেনি কেউ। কিন্তু কি নামে যেন ডাকলে ওদের, পেনি…শব্দটা কি?
ব্যাখ্যা করল শেভার্ন। বড় চাকাঅলা একটা বাই-সাইকেল, যেটাকে ইংল্যান্ডের বড়সড় পেনির মত দেখায়, তুলনায় ছোট চাকাকে দেখায় ফার্দিং-এর মত।
ওভাবে কখনও ভাবিনি, অন্যমনস্ক স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। ঠিকই বলেছ তুমি।
কখনও কি ভেবেছ কেন বেসিন থেকে তোমাদের তাড়ানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা?
প্রশ্নটায় থমকে গেল মহিলা, ভুরু কুঁচকে উঠেছে। হয়তো ভেড়া আর গরুর চিরন্তন বিবাদের কারণেই।
অন্য কোন কারণ নেই?
না, মি. শেভার্ন।
প্রসঙ্গটার সমাপ্তি ওখানেই হলো। পানির মজুদ শেষ হয়ে গেছে ওদের, জুড না থাকায় একমাত্র পুরুষ হিসেবে কাজটা ওকেই করতে হবে। একটা ঘোড়ায় যতগুলো সম্ভব ক্যান্টিন আর পাত্র নিয়ে চেপে বসল শেভার্ন, চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিশ্চিন্ত হলো, তারপর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ক্রীকের উদ্দেশে।
পেনি-ফার্দিং বোধহয় ইতোমধ্যে জেনে গেছে তাদের আরও এক রাইডার নিখোঁজ হয়েছে। এ কদিনে ওদের কজন মারা গেছে? যে দুটো লাশ নিয়ে শহরে ফিরে এসেছিল ও, দুজনেই কি ডাবল-ও পাঞ্চার? পরে ট্রেইলের গোলাগুলিতে অন্তত একজন মারা গেছে এবং না মরলেও গুরুতর আহত হয়েছে আরেকজন, নিশ্চিত শেভার্ন। আরও কজনের মুখোমুখি হতে হবে ওকে?
ইতোমধ্যে হয়তো শত্রুপক্ষের ধারণা হয়ে থাকবে লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে ওরা; বেঁচে থাকা ম্যাকলেন্ডনরা হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে অন্য কোথাও, যাওয়ার আগে এস্টেটের ছাইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
দুরাশা! ওরা ঠিকই জানবে, জিম শেভার্ন ওরফে লাইমি বেঁচে আছে এখনও। বেসিনের সবাই, এমনকি কিছু ফ্রেইটারও জানে যে বেঁচে আছে ও। কিছুদিনের মধ্যে ওরা জেনে যাবে আবারও পাইকারী হারে খুন করতে শুরু করেছে জিম শেভর্ন।
তোমার বরং বাস্তব অবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
আবারও তুমি? কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর পরও কোমরের ব্যথাটা যায়নি ওর, বিবেকের সঙ্গে তর্ক করার মূড এখন মোটেই নেই।
জনি নামের ওই ছেলেটার মাথায় আজগুবি জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়ার বদলে বরং ওকে জিজ্ঞেস করতে পারতে পেনি-ফার্দিং-এর কজন রাইডার আহত বা নিহত হয়েছে, মোট কজন আছে ওদের, কিংবা ঠিক কত গরু আছে ডাবল-ও-র।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যান্টিন আর পাত্র ভরতে শুরু করল শেভার্ন। ক্লান্ত না হলে হয়তো ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারে আরও মনোযোগী হতে পারত। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবং সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে এখন। ও বরং অন্য এক তরুণকে নিয়ে ভাবছে এখন, ক্যাম্পের চারপাশে রেকি করার বুদ্ধিটা জুডের মাথায় আসতে পারে। ইচ্ছে করলে ক্রীকের ধারে কিংবা একেবারে নিচের উপত্যকায়ও চলে যেতে পারে সে, জুডের বয়সটাই এমন যে সুযোগ পেলে অতি উৎসাহী হতে দ্বিধা করবে না। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক।
আচমকা শীতল বাতাস দোলা দিল ওকে। দক্ষিণ আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। শেষ বিকেলের আলো ঝিমিয়ে এসেছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে হঠাৎ। যে কোন সময়ে বৃষ্টি নামবে। দ্রুত ক্যান্টিন ভরে যখন মেসার কাছাকাছি চলে এল ও, ততক্ষণে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
মিসেস ব্রুকসের সঙ্গে তেরপলৈর নিচে এসে দাঁড়াল শেভার্ন, দেখল উদাস দৃষ্টিতে তেরপলের কিনারা দিয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি দেখছে বয়স্কা মহিলা।
আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস, জোর বাতাস বইছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে ওদের শরীরে। ঝড় আর ঠাণ্ডার কারণেই কোমরের ব্যথাটা বেড়ে গেল কি-না, আনমনে ভাবছে শেভার্ন। বোধহয় না। পুরানো ব্যথা বা ক্ষতের ক্ষেত্রে সচরাচর এমন হয়। বৃষ্টিটা কি অনেকক্ষণ থাকবে?
বছরের এই সময়ে বেশিক্ষণ থাকে না, জানাল জুলিয়া ব্রুকস।
কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হলো, বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। জুডও ফিরে আসেনি। দূরে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে থাকা ঘোড়াগুলো দেখল শেভার্ন, মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সবকটা, বাকবোর্ডের চাকার সঙ্গে লাগাম বাধা। ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া উচিত, এ সুযোগে বিশ্রাম নিতে পারবে। ক্যানিয়ন থেকে তাজা ঘোড়া নিয়ে আসা দরকার, যেগুলোর তদারক করতে গেছে জুড। চোখ-কান খোলা রেখো, বলে একটা ঘোড়ায় চাপল শেভার্ন। ভাবছে ওর মতই মিসেস ব্রুকসের ক্ষতটাও একই পরিমাণ জ্বালাচ্ছে কি-না।
ঝড়ের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে না ও। এই অঞ্চলে বৃষ্টি নিশ্চয়ই আশীর্বাদের মত, কদাচিৎ দেখা যায়। স্বভাবতই বৃষ্টির মধ্যে কাজ করবে না কেউ। কিন্তু নিরাপদ ক্যাম্প থেকে বেলোনো ছাড়া উপায় নেই ওর, শিগগিরই ঘোড়াগুলো রাউন্ড আপ করতে না পারলে ছড়িয়ে পড়বে; শেষে অন্ধকারে খুঁজতে গিয়ে বিস্ফোরক ভরা আরেকটা গর্তে পড়বে না কে বলতে পারে!
পাশের উপত্যকায় নেমে আসার পর উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে ওঠা শুরু করল শেভার্ন। কয়েকশো গজ উঠে চারটে ঘোড়াকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। সব ঘোড়ার লাগাম একত্রিত করে ফিরতি পথ ধরল ও।
এখানে কি করছি আমি? বিরক্তির সঙ্গে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। ভেড়ার তদারকি করে নিশ্চয়ই সানফ্রান্সিসকো যাওয়া যাবে না?
মিসেস ব্রুকস নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় মহিলা, এবং পুরোপুরি সুস্থ হলে এখনকার চেয়েও কাক্ষিত, আকর্ষণীয় মনে হবে তাকে। বাবা, স্বামী কিংবা বগলের কাছে এক খাবলা মাংস হারানোর শোক ঠিকই সামলে নিতে পারবে লাল চুলো। আর জুডাস ম্যাকলেন্ডন এখনও ওর কাছে একটা ধাঁধার মত, একেবারে নিস্পৃহ থাকছে ছেলেটা…আচমকা শেভার্ন উপলব্ধি করল কেন এত চুপচাপ থাকছে তরুণ। ওকে খুন করার কোন পরিকল্পনা ছিল না তার। বেসিনের অশান্তি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল ছেলেটাকে, এতটাই যে ওর সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিল-যে কোন জায়গায় চলে যেতে পারলেই কৃতার্থ হত। কিন্তু এখন বিবেকের দংশন অনুভব করছে, পরিস্থিতি অসহায় করে তুলেছে ওকে-অসহায় বোনকে ছেড়ে গিয়ে ভুল করতে যাচ্ছিল এই উপলব্ধি অপরাধবোধ এনে দিয়েছে ছেলেটার মধ্যে।
ছেলেটা কোথায় আছে কে জানে। বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে পেনি-ফার্নিং রাইডারদের মুখোমুখি পড়ে যায়নি তো? তেমন হলে কপালে খারাবি আছে ওর। বয়স কম বলে কারও দয়া পাবে না। ম্যাকলেন্ডনদের খুন করছে ওরা, ভেড়া বা হার্ডারদের মারছে নির্বিচারে। বয়স কোন বাধা হতে পারে না নিষ্ঠুর লোকগুলোর কাছে।
হয়তো শুধু প্রতিহিংসার কারণেই ম্যাকলেন্ডনদের বিরুদ্ধাচরণ করছে না ওরা। ম্যাকলেন্ডনদের জমির ওপর লোভ নেই ওদের, কারণ জমির অভাব নেই এখানে; গরু আর ভেড়ার বিরোধকেও ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ শেভার্ন। জমি আর র্যাঞ্চিংই যদি আসল কারণ হত তাহলে হাড্ডিসার গুটিকয়েক গরুর দিকে মনোযোগ দিত ওস্টেনভেল্টরা। বেসিনের অশান্তির পেছনে এরচেয়েও গৃঢ় কোন কারণ আছে…সেটা পরিষ্কার না জানলেও আন্দাজ করতে পারছে ও। পরিচিত শত্রুর পরোয়া করছে না ওরা, ভয়ও পাচ্ছে না; হয়তো শেভার্নই অপরিচিত শত্রুকে ভয় পেতে বাধ্য করতে পারে ওদের।
ইতোমধ্যে খেলাটা ভালই শুরু করেছে ও, ভেবে খানিকটা প্রশান্তি অনুভব করল শেভার্ন। র্যাঞ্চ হাউসের এত কাছাকাছি থেকে একটা ঘোড়া আর তরুণ এক। ছেলের অদৃশ্য হওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তা করতে শুরু করেছে ওরা? বৃষ্টি থেমে গেলে, আবারও নিচের উপত্যকায় যাবে ও, প্রমাণ করবে ছাইয়ের ভস্ম থেকেও উঠে দাড়াতে পারে ম্যাকলেন্ডনরা।
মেসার কাছাকাছি এসেছে ঠিক এসময়ে ভারী রাইফেলের গুলির শব্দ ভেঙে দিল সুনসান নীরবতা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শেভার্ন, ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেছে। স্রেফ রিফ্লেক্সবশত হাতে উঠে এসেছে কোল্ট জোড়া। রাইফেলের শব্দ-ঠিক এরকম ভারী, গম্ভীর শব্দ শুনতে পেয়েছিল গোল্ডেন ঈগল থেকে বেরিয়ে আসার সময়, পেছন দরজা থেকে ওকে আক্রমণ করেছিল মিসেস ব্রুকস, তখন অবশ্য জানত না এসব। বোঝা যাচ্ছে কাঁধে চোট পাবে জেনেও ভারী রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছে মহিলা। ওকে সতর্ক করার জন্যে, নাকি সত্যিই বিপদে পড়েছে?
দ্বিতীয় শটের অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন, কিন্তু অনেকক্ষণ পরও এল না।
অবশ্য আসবে না, ধরেই নিয়েছে ও। হয়তো ভারী রাইফেলের রিকয়েলের ধাক্কায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মিসেস ব্রুকস, ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে নতুন করে।
দুরে কম ক্যালিবারের কিছু অস্ত্রের শব্দ শোনা গেল এবার। ভুয়া কি-না নিশ্চিত হতে পারল না. শেভার্ন। বোকার মত ভেবেছে বৃষ্টি বা ঝড়, থামার আগে এমন কিছু ঘটবে না। কিন্তু আগেই আঁচ করা উচিত ছিল। বহু দিনের সৈনিক জীবনে ও কি দেখেনি যুদ্ধের প্রথম দুর্লঙ্ঘ্য ও পবিত্র আইন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সারা উচিত সবচেয়ে খারাপ আবহাওয়ায়? শত্রু যখন আক্রমণ আশা করে না তখনই হামলা করার মোক্ষম সময়!
লড়াই কি বৃষ্টি নিয়ে এল, নাকি ডিমের কাছে ফিরে এসেছে মুরগীর বাচ্চা? বৃষ্টির মধ্যে এখানে অপেক্ষায় থেকে দর্শনশাস্ত্র চর্চা করলে হবে, নাকি ক্যাম্পে ফিরে মহিলাকে সাহায্য করা উচিত? ওপরে গিয়ে অন্যদের সাথে যোগ দিলেও, পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। রোজাওরা বোধহয় জানেই না কিভাবে গুলি ছুড়তে হয়। তাছাড়া, যা অন্ধকার, টার্গেট চোখে। পড়লে তো! হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে কয় রাউন্ড গুলি করতে পারবে জুলিয়া ব্রুকস?
একটা ঘোড়াও নেই ওদের সঙ্গে! ইতোমধ্যে ঘেরাও না হলেও, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেসা থেকে সরে যেতে পারবে না ওরা। ঘোড়া নিয়ে মেসায় চলে যেতে পারে শেভার্ন, কিন্তু চিহ্ন অনুসরণ করতে অসুবিধে হবে না পেনি-ফার্নিং রাইডারদের। মাথা নেড়ে আইডিয়াটা বাতিল করে দিল ও, তারপরই ধারণাটা এল মাথায়-শত্রুপক্ষ হয়তো ধরে নিয়েছে মহিলাদের সঙ্গে ওপরেই আছে শেভার্ন। হামলাকারীদের পেছনে গিয়ে অবস্থান নিতে পারলে ভাল হত। স্যাডল ছেড়ে একটা ঝোপের সঙ্গে ঘোড়া বেঁধে রাখল ও। কোমরের ব্যথায় কুঁচকে উঠেছে মুখ।
বৃষ্টি বেড়ে গেছে হঠাৎ, মুষলধারে পড়ছে এখন। দৃষ্টিপথে ধোয়াটে একটা পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছে যেন, আবছা অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শেভার্ন জানে। শত্রুপক্ষকে দেখতে পাবে না, একই অসুবিধে লোকগুলোরও হবে। গাছের আবছা কাঠামো, পাহাড়ের শরীর ঠাওর করতে পারছে কোন রকমে, কিন্তু জানে আচমকা ডাবল-ও রাইডারদের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে।
দাঁড়িয়ে কান সজাগ করল ও। বৃষ্টির লাগাতার শব্দ ছাড়া অন্য কিছু শোনা। যাচ্ছে না। ক্রীকের কি অবস্থা হবে? বাঁধ তৈরি করে ক্রীকের গতিপথ আর বদলাতে হবে না, বৃষ্টিতে অন্তত এই একটা লাভ হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ হাসল শেভার্ন, বেগার খাটুনি বেঁচেছে ওর!
লোকগুলো আছে কোথায়? একটু আগেও স্প্রিংফিল্ডের ভারী আওয়াজ আর পরবর্তীতে পিস্তলের বিরামহীন শব্দ কানে এসেছে। বোধহয় ওর মতই বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় আছে প্রতিপক্ষ। কিছু যখন চোখে পড়ছে না, তখন কি করার আছে আর?
ঠাণ্ডা লাগছে, শীতে গা কাঁপছে ওর। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে শরীর। আচমকা সামনে ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল, অন্তত ভোর্নের কাছে তাই মনে হলো, দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষায় থাকল ও। দ্বিধান্বিত হয়ে উঠেছে, কিন্তু শেষে বাতিল করে দিল সম্ভাবনাটা-স্রেফ মনের কল্পনা বোধহয়। মনে শঙ্কা জাগছে, ঠাণ্ডা পেয়ে বসলে বিপদ হবে, এমনিতেই ম্যালেরিয়ার জন্যে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে ওকে।
এক পা আগে বাড়ল ও, আশা করছে ধারে-কাছে একটা আশ্রয় খুঁজে পাবে। আচমকা শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে, দাঁড়িয়ে গেছে শরীরের সবকটা রোম। বিপদ! খুব কাছেই আছে কেউ!
বিপদ কি ওর জন্যে নতুন কিছু? নিশ্চয়ই না।
শেষ মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে কাদার মধ্যে শুয়ে পড়ল শেভার্ন। তীব্র আলোর ঝলক আর বজ্রপাতের মত শব্দে কানে তালা লাগার জো হলো। মাথা নিচু করে ঠায়। একই জায়গায় পড়ে থাকল ও, নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে বিচিত্র শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে তপ্ত সীসা।
মিনিট খানেক পর গোলাগুলি থেমে গেল, সুনসান নীরবতা নেমে এল উপত্যকায়। কান খাড়া করে শব্দ শোনার প্রয়াস পেল শেভার্ন, কিন্তু নিজের নিঃশ্বাস আর বৃষ্টির শব্দই কেবল শুনতে পাচ্ছে। ভেজা মাটির সঙ্গে চিবুক ঠেকিয়ে সামনের দিক দেখার চেষ্টা করল ও, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ছে না। শরীর টানটান, হাতে জোড়া কোল্ট তৈরি, টার্গেট দেখতে পেলেই গুলি করবে। জানে যে কোন সময়ে বেরিয়ে আসবে লোকগুলো, ওর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে অন্তত একজন তো আসবেই।
বৃষ্টির ছাঁট যেন চড় মারছে নাকে-মুখে, শেভার্নের অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শীতল বাতাস কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে, কিন্তু এতটুকু নড়ার সাহস হচ্ছে না। তাহলেই মরতে হবে, প্রতিপক্ষ ওর অবস্থান তো জানবেই উপরন্তু ঝোলার বিড়াল বেরিয়ে যাবে। শক্ররা যতক্ষণ ওকে মৃত বলে জানবে ততই সম্ভাবনা বাড়বে ওর। ঠিক কজনকে সামাল দিতে হবে জানা নেই, তবে শেভার্নের ধারণা অন্তত চারজন। হবে। সবাইকে একসঙ্গে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না, লোকগুলোকে চমকে দিতে পারলে হয়তো…
কাদায় পা পিছলে যাওয়ার শব্দ কানে এল ওর, কয়েক হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। চোখ পিটপিট করে চোখের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরিয়ে দিল শেভার্ন, তারপর পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখার চেষ্টা করল। হ্যাটটা কোথায় পড়েছে কে জানে, ওটা থাকলে ভাল হত। তুমুল বৃষ্টি কুয়াশার মত গাঢ় পর্দা তৈরি করেছে, আচমকা দুলে উঠল পর্দাটা। ঝড়ো বাতাস, নাকি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ?
শীতল শিহরণ বয়ে গেল মেরুদণ্ডে, আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীরের সমস্ত পেশী। দম বন্ধ করে পড়ে থাকল ও, চোখে অপলক দৃষ্টি। সেকেন্ড খানেক। পরই আবছা একটা কাঠামো ধরা পড়ল। ঠিকই দেখেছে, দশ হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে বিশালদেহী এক লোক। নীল রঙের একটা শার্ট লোকটার পরনে, বৃষ্টিতে ভেজায় কালচে দেখাচ্ছে। সন্তর্পণে দুপা আগে বাড়ল সে, চলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সতর্ক।
আরেক পা এগিয়ে আয়, বাপ! মনে মনে আওড়াল শেভার্ন। শরীর শিথিল হয়ে গেছে ওর, জানে ওকে দেখতে পাচ্ছে লোকটা। ঝুঁকিটা না নিয়ে উপায় নেই। ইচ্ছে করলে অনায়াসে লোকটাকে ফেলে দিতে পারে, কিন্তু তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে অন্যরা। চাইছে সবাই বেরিয়ে আসুক, একবারে কয়েকটা শিকার চাই ওর।
কাদায় বুটের শব্দ এবার স্পষ্ট শুনতে পেল শেভার্ন। বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে নীল শার্ট, বিপদের আশঙ্কা বোধহয় বাতিল করে দিয়েছে। পেছনে আরও দুজনকে দেখা যাচ্ছে।
খতম! নিচু স্বরে বলল একটা কণ্ঠ।
জেমস, দেখে এসো তো হারামজাদা সত্যিই মরেছে কি-না, চাপা স্বরে নির্দেশ দিল অন্য একজন। ওর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না হয়ে মেসার ওপরে যাওয়া যাবে না। এ লোক জিম শেভার্ন না হয়ে অন্য কেউও হতে পারে।
এবার, চাঁদ!
ঝটিতি উঠে বসল শেভার্ন, ওঠার মধ্যেই আগুন ওগরাল ডান হাতের কোল্ট। নীল শার্টের বুকে একটা ফুটো তৈরি হলো প্রথমে, বুলেটের ধাক্কায় থমকে দাঁড়াল সে, তারপর ধীর ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কিন্তু তার দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত নেই শেভার্ন বা অন্য কারও।
মাত্র দশ হাত দূরের টার্গেট, মিস হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু তারপরও হলো, ফস্কে গেল শেভার্নের পরের গুলি। অন্যদের মধ্যে সামনের লোকটাই বেশি চালু এবং সতর্কও বোধহয়, নীল শার্টের পতন দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাতের পিস্তল তুলে গুলি করেছে। গুলি করার ফাঁকে সরে গেল এক কদম, শেভার্নের গুলিটা পেছনের লোকটার পেট ফুটো করল। কাটা কলা গাছের মত দড়াম করে থকথকে কাদায় আছড়ে পড়ল সে।
উঠতে যাচ্ছিল শেভার্ন, আচমকা পা হড়কে যেতে থমকে গেল। নিমেষে আড়ষ্ট হয়ে গেল উরুর পেশী, শ্লথ হয়ে গেল গতি; তবে সেটাই শাপেবর হলো। লোকটার পরের গুলি ওর চাদিতে আলতো স্পর্শ দিয়েই চলে গেল। মাথা ঘুরে উঠল ওর, চারপাশে হাজারটা রঙিন বাতি জ্বলে উঠল। জ্ঞান হারানোর আগে একটা জিনিসই দেখতে পেল: ওর তৃতীয় গুলি ত্রিনয়নের সৃষ্টি করেছে লোকটার কপালে।
মাথায় দপদপে ব্যথা আর রজপাতের কড়াৎ শব্দে চেতনা ফিরে পেল শেভার্ন : আচ্ছন্নের মত লাগছে ওর, বজ্রপাতের তীব্র আলোর ঝলক চোখ ধাধিয়ে দিয়েছে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হতে টের পেল কাদার মধ্যে পড়ে আছে, ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানির ছিটা লাগছে নাকে-মুখে।
মেসার ওপরমহিলাদের ফেলে এসেছি আমি!
স্থির হয়ে পড়ে থাকল ও, মুহূর্ত খানেক পেরিয়ে গেল। তাহলে এভাবেই বজ্রপাতে মারা যায় মানুষ-পুরোপুরি সচেতন কিন্তু নড়াচড়ারও সুযোগ থাকে না? একটা গর্তে ফেলে ওকে মাটি চাপা দেওয়ার সময়ও কি এমন সচেতন থাকবে?
মনে হয় না তেমন কিছু হবে। ইতোমধ্যে ব্যতিক্রম অনুভব করতে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস নেওয়া দরকার। শরীর নাড়তে গিয়ে অনুভব করল পারছে না। বুক ফুলে উঠল, শ্বাস নিতে গিয়ে কাশি উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কাদা-মাখা পানি।
কাশির দমকে কাঁপছে সারা শরীর, গড়ান দিয়ে কিছুটা সরে গেল ও। অবস্থার উন্নতি হলো এবার, এখানে অন্তত ডুবে মরতে হবে না। ভাবছে সত্যিই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে, নাকি শুনতেই পাচ্ছে না। আবারও কাশি আর বমি শুরু হলো, এবার পুরোপুরি সংজ্ঞা হারাল শেভার্ন।
ফের যখন সচেতন হলো, অনুভব করল নডতে পারছে না। চারপাশে অন্ধকার কিন্তু পরিষ্কার আকাশে তারার মেলা দেখতে পাচ্ছে। বাতাস বা বৃষ্টি কোনটাই নেই এখন। নডতে গিয়ে ভুলটা বুঝতে পারল। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়নি, বরং হাত-পা বাঁধা ওর!
তবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে নিয়মিত। অনেকক্ষণ হবে বোধহয়, ধারণা করল শেভার্ন। মুখে এখনও বমির কটু স্বাদ অনুভব করতে পারছে। পাশেই আগুন জ্বালিয়েছে কেউ, আকারে বোঝা যাচ্ছে উত্তাপ নয় বরং স্রেফ আলোর জন্যে। দেখা যাচ্ছে না লোকটাকে, তবে জীর্ণ এক জোড়া বুট চোখে পড়ছে। বুটগুলো ওর পরিচিত, এর মালিককে আজ সকালেই টেক্সাসের উদ্দেশে চলে যেতে প্ররোচিত করেছে।
শোনা যাক হোটেলের সামনের লিঞ্চিং স্টেজে শেরিফের সাথে কি কথা বলেছ তুমি, বিদ্রুপের স্বরে বলল ছেলেটা।
বজ্রপাতে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে কি-না, আনমনে ভাবল শেভার্ন। সহসা মনে পড়ল অদ্ভুত এক যুক্তি দিয়ে ভাঁওতা দিয়েছিল ছেলেটাকে। আইডিয়াটা কাজে লাগানোর সুযোগ এখনও আছে।
এবার আমার ইচ্ছেমত খেল দেখাও তো, মিস্টার, নিস্পৃহ স্বরে বলল ছেলেটা, তবে কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর স্পষ্ট। ওদের নামিয়ে আনো এখানে।
তুমি নিশ্চয়ই মিসেস ব্রুকসের কথা বলছ না…
কার কথা বলছি ভাল করেই জানো তুমি। ওই শয়তানের বাচ্চাটাকে আনার। ব্যবস্থা করো!
বুঝতে পেরেছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল শেভার্ন। জুড কি ক্ষতি করেছে তোমার?
আমার ভাগের বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে!
ব্যাপারটা অবশ্যম্ভাবী, অন্তত শেভার্নের তাই ধারণা। প্রায় একই বয়সের দুজন-পুরো বেসিনে বোধহয় ওদের বয়সী আর কেউ নেই। অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং খেলার সঙ্গী হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
নিজের ওপর কিছুটা হলেও বিরক্তি বোধ করছে ও। ঘোড়া চুরির শাস্তি এ দেশে ফাঁসি, কিন্তু ছেলেটাকে মারেনি। এখন নিজেই বিপদে পড়েছে, ওকে খুন করতে যাচ্ছে জনি। সম্ভবত শিগগিরই কাজটা সারবে না। বুঝতে পারছি না কিভাবে মিসেস রুকসের সঙ্গে যোগায়োগ কবর বিড়বিড় করল।
ওভাবে নয়। চিৎকার করে ডাকো।
মানে?
চিৎকার করে ওই শুয়োরের বাচ্চাকে নেমে আসতে বলো-একা!
চোখ কুঁচকে দৃষ্টি পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল শেভার্ন। বোঝা যাচ্ছে পেনি ফার্দিংরা ধরতে পারেনি জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে। ওরা ভাবছে মেসার ওপরে মহিলাদের সঙ্গে আছে ছেলেটা। তাহলে কোথায় গেছে জুড?
ছোট্ট একটা বোল্ডারের ওপর এতক্ষণ বসে ছিল জনি, উঠে আগুনের চারপাশে চক্কর দিল। কাছে এসে লাথি হাঁকাল শেভার্নের উদরে। ছেলেটা জানল কিভাবে ওর কোন কোমরে ব্যথা, তিক্ত মনে ভাবল শেভার্ন। কোমর তো মাত্র দুটো, সুতরাং স্রেফ কাকতালীয় ভাবে দুর্ভোগ বেড়ে গেছে ওর।
জলদি! ফের লাথি হাঁকাল জনি।
প্রথমে স্ট্রির্যাপ, তারপর ঘোড়ার আঘাত, এবং এখন ঘোড়া চোরের বুটের খোঁচা! আবার কখনও হাঁটতে পারবে কি-না কে জানে, আনমনে ভাবল শেভার্ন। আসলে কি করতে বলছ আমাকে? বিষণ্ণ স্বরে জানতে চাইল ও, বুঝতে পারছে। মাথাটা পরিষ্কার করতে হবে শিগগিরই, যেভাবে হোক ঠকাতে হবে ছেলেটাকে।
হারামীর বাচ্চাটাকে নেমে আসতে বলো!
বাঁধন থাকার পরও শ্রাগ করল শেভার্ন, যতটা সম্ভব হলো। নড়াচড়ার ফলে ব্যথার একটা প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ল হাতে-পায়ে। চেষ্টা করতে খারাপ লাগবে না। আমার, কিন্তু অন্তত একটা কারণ দেখাতে পারবে যেজন্যে আমার কথা শুনবে ও?
কারণ নইলে তোমাকে খুন করব আমি!
কিন্তু তাতে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের কি আসে-যায়? লাথিটা মাঝপথে থেমে যেতে সন্তোষ বোধ করল শেভার্ন, স্মিত হেসে খেই ধরল: হতে পারে ম্যাকলেন্ডনদের পরোয়া করো না তুমি, কিন্তু জুডের বুটজোড়া পেলে ঠিকই পরবে!
ছ্যাঁচোড়দের বুট? প্রবল বিদ্বেষের সঙ্গে তাচ্ছিল্য করল জনি।
অন্য কোন দিন হলে হয়তো হাসত শেভার্ন। সময় বদলে যায়, ব্যাখ্যা করল, আগামী দশ বছরেও হাল ফ্যাশনের ওরকম একজোড়া বুট কেনার সামর্থ্য হবে না তোমার। এক হিসেবে কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারো, কারণ ছাচোড়দের বুট বদলে সাধারণ জুতোয় পরিণত করতে পারবে না তুমি, চামড়া বদলে ফেললেও ম্যাকলেন্ডনদের ছাপ তাতে থেকে যাবে, তাই না? যদি ততদিন বেঁচে থাকোও, দশ বছর পর দেখা যাবে তুমি বা তোমার বন্ধুরা শেষপর্যন্ত ঘঁাচোড়দের বুটই পরতে শুরু করেছ।
লাথি চালানোর জন্যে জীর্ণ বুটটা মাটি থেকে ওপরে তুলল ছেলেটা।
কিন্তু ব্যাপার কি জানো, দ্রুত বলল ও। এখান থেকে যতই চিৎকার করি আমি, আসলে তাতে কোন কাজ হবে না। হয়তো ডাবল-ও থেকে গরুর দল ছুটে আসতে পারে, কিন্তু আমার কথায় নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে নিচে নামবে না জুডাস ম্যাকলেন্ডন। অনায়াসে এক ডজন লোককে ঠেকিয়ে দিতে পারবে ওরা।
তোমাকে খুন করলেও নয়? লাথি না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনি, শেভার্নের একটা পিস্তল ক করল।
খুন করা সহজ, ব্লাফ দিল ও। আমি তোমার জীবন না বাচালে হয়তো আরও সহজ হত।
কিন্তু আমি তোমার জীবন বাঁচাতে যাচ্ছি না!
তেমন কোন কারণও দেখতে পাচ্ছি না। আগে-পরে, শেরিফ তোমাকে ধরতে পারলে ফাঁসি তোমার এমনিতেই হবে। ঘোড়া চোরদের ঝটপট ফাঁসি দেওয়া উচিত। লোকজন সাধারণত চাবুক চালিয়ে আসামীর দুপায়ের ফাঁক থেকে ঘোড়াটাকে সরিয়ে দেয়, তাতেই ঘাড় ভেঙে যায় লোকটার।
বহু পুরানো গল্প।
তাছাড়া, খুনের কারণে বাড়তি একটা সুবিধা পাবে আইন-একটু ভিন্ন ভাবে ফাঁসির আয়োজন করবে ওরা। মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে, আসামীকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে বাধ্য করে, তারপর ল্যাসোর টানে মাটি থেকে ওপরে তুলতে শুরু করে। শুনেছি সোডা স্প্রিং-এ এক লোক আছে যে কাজটায় দারুণ হাত পাকিয়েছে-শেষবার, বেচারা খুনীকে পুরো দুই ঘন্টা আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছে। থেমে ক্ষীণ হাসল শেভার্ন, তারপর খেই ধরল। মাঝে মধ্যে এরচেয়েও চমৎকার আয়োজন করে লোকজন। পুরো একটা দিন হয়তো ঝুলিয়ে রাখে, নামিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্যে। প্রতিটা খুনের জন্যে দুবার করে ফাঁসি দেয় ওরা।
শেভার্নের কৌশলে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না, অন্তত জনির। চেহারায় কোন শঙ্কা বা ভয় নেই; বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণা বা প্রতিহিংসা-সবই জ্বলজ্বল করছে কালো চোখে। হয়তো হাতে অস্ত্র আছে বলেই আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি।
ওকে নিচে আসতে বলো! প্রায় খেপা সুরে নির্দেশ দিল ছেলেটা, বোঝা যাচ্ছে শেভার্নের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বলে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
নিশ্চয়ই! কিন্তু কি বলব? এখানে এসে নিজের প্রাণের বিনিময়ে বোনের স্বামীর হত্যাকারীর জীবন বাঁচাতে?
মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল ছেলেটা। কাকে খুন করেছ তুমি?
আমার ধারণা লোকটার নাম ব্রুকস। মেসার ওপর থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে যেই মহিলা, ওর স্বামী বোধহয়।
বোকা বানানোর চেষ্টা করছ আমাকে!
কেন করব?
নীরব থাকল জনি, আনমনে কোল্টটা নাড়াচাড়া করছে হাতের মুঠিতে।
মনে আছে, তোমাকে বলেছিলাম এই পিস্তলের বুলেটগুলো একটু ভিন্ন। রকমের? এক্সপ্লোসিভ বুলেট। খুব কাছ থেকে গুলি করার জন্যে উপযুক্ত নয় মোটেই। আমাকে মারতে গেলে নিজের চামড়ার ঝুঁকি নিতে হবে তোমার।
পিছিয়ে যেতে পারব আমি।
নিশ্চয়ই। তাহলে কেন তোমাকে সতর্ক করছি?
জানি না। কেন?
কারণ এখনও তোমার মহামূল্যবান জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি আমি! প্রায় বিদ্রুপের সুরে বলল শেভার্ন।
উঁহু, মরতে যাচ্ছি না আমি। বরং তুমিই বিপদে আছ।
ঠিক আছে, তাহলে তাই করো।
উঠে দাঁড়াও! হঠাৎ করেই নির্দেশ দিল ছেলেটা।
আগে তাহলে অন্তত পায়ের বাঁধনটা খুলে দিতে হবে।
হতাশা দেখা গেল ছেলেটার চোখে-মুখে, মুহূর্তের জন্যে শেভার্নের ভয় হলো হয়তো সত্যিই গুলি করবে জনি। নির্বিকার মুখে দেখল ও ছেলেটাকে, দ্বিধায় ভুগছে তরুণ, আনমনে পায়চারি করছে আগুনের ধারে। তারপর এগিয়ে এসে ছুরির এক পোচে ওর পায়ের বাঁধন কেটে দিল।
গড়ান দিয়ে সরে এল শেভার্ন। অনেকক্ষণ রক্ত প্রবাহ বন্ধ ছিল, এবার চালু হওয়ায় শিরশিরে ব্যথা শুরু হলো। দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখল, শেষপর্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল-মাতাল মুষ্টিযোদ্ধার মত কাঁপছে। শরীর, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। কোথায় যাব?
এই যে এখানে, আঙুল তুলে কয়েক হাত দূরে খোলা একটা জায়গা নির্দেশ করল জনি। এমন জায়গায় দাড়াও যাতে ম্যাকলেন্ডন কুত্তীটা তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পায়!
ছেলেটার পিস্তলের খোঁচায় পাহাড়ের গোড়ার দিকে কয়েক গজ সরে যেতে হলো ওকে।
ঠিক আছে, দাঁড়াও এখানে! বেঁকিয়ে উঠল সে। পিছিয়ে গিয়ে আগুনে আরও কয়েকটা শুকনো ডাল ফেলল। শেভার্ন যতটা ভেবেছিল তারচেয়ে চাল ছেলে। আগুনের সামনে রেখেছে ওকে, কিন্তু নিজে রয়ে গেছে আড়ালে। মিজ ব্রুকস! চিৎকার করল সে এবার। তোমার লোককে ধরেছি আমি। ওকে যদি সুস্থ পেতে চাও, ভাইকে নিয়ে নিচে নেমে এসো।
না! চড়া, স্পষ্ট স্বরের জবাব এল মেসার ওপর থেকে।
জবাবটা মেসার ওপর থেকে এলেও পেছনে একটা নুড়িপাথর গড়ানোর শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল শেভার্ন। ঘুরে দাঁড়াল ও, উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেছে, কিন্তু দেখল ওর মতই বিস্মিত হয়েছে জনি। ঝটিতি দুপা পিছিয়ে অন্ধকারে আড়াল করতে চাইল নিজেকে।
কে ওখানে? অধীর, সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল জনি। অন্ধকারের উদ্দেশে পিস্তল বাগিয়ে ধরল, কিন্তু ভঙ্গিটা অনিশ্চিত। কমলা রঙের ঝিলিক দেখা গেল জায়গাটায়, অস্ফুট শব্দ করে হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিল জনি, দুহাতে পেট চেপে ধরে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে।
১১-১৩. তৎক্ষণাৎ নিজেকে সক্রিয়
তৎক্ষণাৎ নিজেকে সক্রিয় করল শেভার্ন, লাথি মেরে জনির নাগাল থেকে সরিয়ে দিল পিস্তলটা। ভাবছে কিভাবে সবার অজান্তে মেলা থেকে নেমে এসেছে মিসেস ব্রুকস। তারপর আচমকাই পুরো ব্যাপারটার তাৎপর্য ধরা পড়ল ওর মস্তিষ্কে-দল বেঁধে হামলা চালায়নি পেনি-ফার্দিংরা, স্রেফ তিন-চারজনের অতি উৎসাহী একটা দল মাথা-ব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল ওদের। জনি এই দলে থাকলেও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় মোক্ষম সময়ে পৌঁছেছে, অসহায় অবস্থায় পেয়ে গিয়েছিল ওকে।
সোডা স্প্রিং যাওয়ার পথে ট্রেইলের কোথাও সাহস ফিরে পেয়েছে ছেলেটা, শেভার্নের গাঁজাখুরি গল্পের অসারতা উপলব্ধি করে ছুটে এসেছে শোধ নিতে। কিন্তু এবারও, কেউ বোকা বানিয়েছে ওকে। এখনও সামনের দিকে ঝুঁকে আছে সে, বুক আর পেটের মাঝামাঝি জায়গাটা দুহাতে চেপে ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, প্রতিটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফোঁপানোর চাপা শব্দ হচ্ছে।
সত্যিই দুঃখিত, মিসেস ব্রুকস, শেষপর্যন্ত কোন মানুষকে গুলি করতে হলো তোমার, স্মিত হেসে বলল শেভার্ন। অকৃতজ্ঞ কাউকে দয়া দেখানোর খেসারত দিতে হবে জানলে… থেমে গেল ও, বুঝতে পারছে ভুল করছে। ভারী একটা রাইফেল দিয়ে মহিলার পক্ষে এত নিখুঁত ভাবে গুলি করা সম্ভব নয়।
অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে এল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। ছোটখাট একটা কোল্ট শোভা পাচ্ছে হাতে। সেলুন পিস্তল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে এল, জনির সামনে গিয়ে দাঁড়াল এরপর। চোখ তুলে তাকাল জনি, পলকহীন দৃষ্টিতে দেখছে। সমবয়সী শত্রুকে।
হ্যালো, জনি! সরোষে বলল জুড। খুব লাগছে?
নড করল ছেলেটা, কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না।
ভাল, আশা করি অন্তত এক সপ্তাহ বেঁচে থাকবে তুমি, বলে জনিকে ধাক্কা দিল জুড। ভেজা কর্দমাক্ত মাটিতে চিৎপটাং হলো তরুণ ঘোড়া চোর, পেটের ঠিক ওপরের দিকে একটা গর্ত। তাজা রক্তে শাট ভিজে গেছে, জনির দুহাতেও রক্ত লেগে আছে।
পকেট হাতড়ে একটা ছুরি বের করে শেভার্নের হাতের বাঁধন কেটে দিল জুড। হাতে সাড়া ফিরে পেতে মিনিট কয়েক লাগল, কাঁপা হাতে কোল্ট জোড়া পুনরুদ্ধার করল শেভার্ন। তাজা বুলেট ভরে হোলস্টারে রাখল পিস্তল দুটো। কোমরে ব্যথা অনুভব করছে এখনও, হাড় আর মাংস যেন কুরে কুরে খাচ্ছে কেউ। বজ্রপাত আর পিস্তলের লাগাতার অগ্নি ঝর্ক কিছুটা ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে ওকে, চোখে ঝাঁপসা দেখছে এখনও। বুঝতে পারছে না সত্যিই এসব ঘটছে কি না।
ঠিক আছ তো তুমি? হাঁটতে পারবে? জানতে চাইল জুড।
নড করল শেভার্ন।
অসহায় ভাবে মরার জন্যে আমাকে এখানে ফেলে যাবে তোমরা? স্নান, কিন্তু অধীর স্বরে জানতে চাইল জনি।
মনে হচ্ছে তোমাকে গুলিই করা উচিত, তিক্ত স্বরে বলল শেভার্ন।
তোমার মত টিনহর্নের কাজ নয় এটা! তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে জনি, সরোষে তাকে সামনের দিকে ঠেলে দিল জুড। ধাক্কার চোট হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও কোন রকমে সামলে নিল তরুণ।
আমার জন্যে কি পরিকল্পনা করেছিলে, জনি?
ওহ, লাগছে খুব!
নিখাদ আনন্দ নিয়ে শত্রুর দুর্ভোগ দেখছে জুড, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে উঠল চোখ দুটো, শেভার্নের ভয় হলো হয়তো খেপে গিয়ে এখনই ঝামেলা সেরে ফেলবে সে, কিন্তু এক পা এগিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল তরুণ ম্যাকলেন্ডন। ঘুরে আগুনের কুণ্ড থেকে একটা কাঠের চেলা তুলে নিল, শেভার্নের কাধ চেপে ধরে এগোল ঢালের দিকে। পেছনে পড়ে রইল জনি, প্রায় মরতে বসেছে। তবে মরার আগে হয়তো আরও কিছুক্ষণ ভুগতে হবে তাকে।
গুলি কোরো না, জুলি, চিৎকার করে নিজের অবস্থান জানান দিল জুড, গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ। ক্ষণিকের জন্যে হলেও তারুণ্য চপলতা উধাও হয়ে গেছে।
আচরণে। আমি আর মি. শেভার্ন আসছি।
শেভার্নের মনে হচ্ছে সত্যিই বোধহয় ঘটছে না এসব। বিদঘুঁটে দুঃস্বপ্ন, নিজেকে বলল ও-আরেকটা স্মৃতি। কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোনোর ফাঁকে সচেতনতা বোধ ফিরে এল, জানে রূঢ় বাস্তব প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে-পেছনে ধুকে ধুকে মরতে বসেছে তরুণ একটা ছেলে। তাজা প্রাণের অপচয়! আমি দুঃখিত, বিড়বিড় করে বলল ও, সত্যিই দায়িত্ব পালন করতে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে; সামান্য একটা ছেলেকে জড় উপড়ে ফেলতে বাধ্য করেছে।
কি জন্যে? ত্যক্ত স্বরে জানতে চাইল জুড।
সুযোগ পেয়েও ওকে খুন করিনি।
তাতে ক্ষতি হয়নি, এই দিনটার জন্যে বহু দিন অপেক্ষা করেছি আমি। আমার কুকুরটাকে খুন করেছিল জনি, সেই থেকে ভাবছিলাম কবে সুযোগ পাব।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিম শেভার্ন, জানে এভাবেই হয়তো নিষ্পত্তি হবে সবকিছুর-ঝামেলা উপড়ে ফেলার পদ্ধতি ওর পছন্দ হোক বা না হোক। কবেই বা খুব পছন্দ হয়েছে? পরিস্থিতির ফিকিরে পড়ে এ পর্যন্ত কতবার অস্ত্র দিয়ে অন্যের প্রাণ কেড়ে নিতে হয়েছে ওকে? একেকটা খুন মানেই বুকের গভীরে একেকটা ক্ষত তৈরি করা, একেকটা দুঃস্বপ্ন।
তোমাদের সঙ্গে অন্য কেউ নেই তো? মিসেস ব্রুকসের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল।
না। শুধু আমরাই।
ইস্টান সলোস? এবার স্প্যানিশে জানতে চাইল মহিলা।
প্রয়োজনীয় সতর্কতা, ভাবল শেভার্ন। ওরা একা কি-না নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন আছে মহিলার। উপত্যকায় পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে জনি, মাঝেমধ্যেই ফেঁপাচ্ছে দুঃসহ অসহায়ত্বে; দ্বিধান্বিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে প্রশ্নটার গভীর তাৎপর্য একটু পর উপলব্ধি করল ও, মিসেস ব্রুকস নিশ্চই নিশ্চিত জানে পেনি ফার্দিং রাইডাররা স্প্যানিশে কথা বলে না।
কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছে শেভার্ন, ম্যাকলেন্ডনরা মিথ্যে বলছে না। ওরাই প্রথম এসেছে এ এলাকায়; সময় আর শ্রম ব্যয় করে এখানকার নিয়ম কানুন শিখেছে। ম্যাকলেন্ডনরা যদি গরুর বদলে ভেড়াও পালন করে, নিজের জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার কি অধিকার আছে উড়ে আসা কিছু লোকের?
এবার স্প্যানিশে উত্তর দিল জুড, বোনকে নিশ্চিন্ত করল একাই আছে ওরা। মিনিট বিশেকের মধ্যে মেসার ওপর পৌঁছে গেল। চড়াই বেয়ে উঠতে হয়েছে, তাছাড়া শরীরে একটা ক্ষত, ক্লান্ত বোধ করছে শেভার্ন-এতটাই যে সরাসরি কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল।
আগুনের কাছে গিয়ে বসেছে জুড, মনোযোগের সঙ্গে পিস্তলের যত্ন নিচ্ছে। কোল্টের বাটে একটা আঁচড় পড়েছে, একেবারেই নতুন। সময় বা ধৈর্য ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বোধহয় ওটাকে ঝকঝকে করা সম্ভব নয়, ভাবল শেভার্ন। অস্ত্র পরিষ্কার করে তেল মেখে, মেকানিজম পরখ করল জুড। বোধহয় নিশ্চিন্ত হলো যে মরতে বসা বেয়াড়া জনি তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনি কোল্টের।
বজ্রপাতটা কি তোমার খুব কাছাকাছি পড়েছে? জানতে চাইল জুড।
একেবারে নাকের ডগায়! বলল ও, হাত-পায়ে ঝিঝি অনুভূতিটা ভুলতে চাইছে।
ব্যাপারটা বিস্ময়কর এবং অস্বাভাবিক। মেসার ওপর আঘাত না করে অনেক নিচুতে উপত্যকার একটা গাছের কাছাকাছি পড়ল কেন বাজটা? কিন্তু এরচেয়েও রহস্যময় অনেক ব্যাপার আছে এখানে। আজকের আগে নিচের লোকদের কাউকে গুলি করেছ কখনও?
ভাই-বোনের নিখাদ বিস্ময় দেখে বোঝা গেল তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি কখনও। আমরা অসভ্য বা নিষ্ঠুর নই, মি. শেভার্ন, কিছুটা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল মিসেস ব্রুক।
তেমন কিছু বোঝাতে চাইনি আমি, ম্যাম, মহিলার উষ্মা গ্রাহ্য না করার চেষ্টা করছে শেভার্ন, কিন্তু জুলিয়া ব্রুকসের অসন্তোষ এতটাই স্পষ্ট যে অস্বস্তির আকারে উপত্যকার নীরব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে যেন। কিন্তু বুঝতে পারছি না। সামান্য কয়েকটা গরু আর প্রচুর ঘাস থাকার পরও ভেড়ার ব্যাপারে কেন এত খেপে আছে ওরা।
তুমি নিজেই শুনেছ জনি কি বলে ডাকছিল আমাকে, বলল জুড়।
বোন-জামাই আর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে অদৃশ্য একটা অভিশাপ যেন তাড়া করছিল জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে, সারাক্ষণই মনমরা হয়ে থাকত। কিছুটা হলেও যেন সেটা কাটিয়ে উঠেছে এখন। ব্যাপারটা বিস্মিত করছে শেভার্নকে।
সোডা স্প্রিং-এ আসার পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটেছে, দক্ষতা আর অনমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে সেগুলোর মোকাবিলা করেছে জিম শেভার্ন; নিজের অজান্তে বেপরোয়া এবং লড়াকু লোক হিসেবে নাম কিনে ফেলেছে। বুড়ো ম্যাকলেন্ডন একাই নয়, জুডও প্রভাবিত হয়েছে ওর দৃঢ়তা দেখে। ওর ওপর ভরসা করেছে বুড়ো, আর জুড প্রায় নায়কের আসনে বসিয়েছে ওকে-উঠতি বয়সের যে কোন তরুণের জন্যে এটাই স্বাভাবিক, আদর্শ হিসেবে দেখেছে শেভার্নকে সারাক্ষণ কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছে। সন্দেহ নেই শেরিফকে পাঠানো ওর লেখা নোটেরও কিছুটা ভূমিকা আছে এতে। শেভার্নকে এখন অন্য। সবার মত মার খেতে বা পরাজিত হতে দেখে দূরত্বটা কমে এসেছে, ওর প্রতি আন্তরিক হয়ে উঠেছে জুড।
বৃষ্টিস্নাত উপত্যকার শীতল, নিরুপদ্রব পরিবেশে মেসার ওপর সত্যিই কি নিরাপদ ওরা, এমন ভাবে বসে আছে যেন নিচে জনির গালাগাল বা কাতরানি অন্য কেউ শুনতে পাবে না?
জনি মারা গেছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না, তবে চুপ হয়ে গেছে। কম বোরের একটা সেলুন পিস্তলের গুলিতে ধাক্কা কমই লাগার কথা, কিন্তু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ছেলেটা। জুডের প্রত্যাশা অনুযায়ী, সপ্তাহ খানেক না হলেও অন্তত একটা দিন হয়তো বেঁচে থাকবে জনি।
সি ফুয়েরা ক্যাবালো… বিড়বিড় করে কি যেন বলল বয়স্কা মহিলা।
কিন্তু ও তো ঘোড়া নয়, প্রতিবাদ করল জুড। এবং কোন ঘোড়াই আজীবন কাজে আসে না।
কিন্তু তোমার মত সুবিধা ছিল না ওর, নিস্পৃহ স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস। ঘুরে শেভার্নের দিকে তাকাল মহিলা, কিন্তু শরীরের ব্যথায় তখন কাতর শেভার্ন, বহু কষ্টে চিৎকার করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে নিজেকে। তোমার কি ধারণা, মি. শেভার্ন?
আমার দয়ার নমুনা আর ফল তো দেখেছ। সহজাত প্রবৃত্তির তাড়না যদি অনুসরণ করতাম, তাহলে এসবের কিছুই ঘটত না।
পা ভাঙা একটা ঘোড়ার মতই দয়া পাওয়া উচিত ওর, তাই না?
কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা ঝোলাবে কে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল মিসেস ব্রুকস। তোমাদের কেউ যদি একটা পিস্তল দাও আমাকে…
আমি যাচ্ছি, ঘোষণা করল জুড।
বিকৃত আনন্দ নিয়ে কাজটা করবে তুমি! প্রতিবাদ করল লাল-চুলো।
সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে শেভার্ন, ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ভাই-বোনের মধ্যে কে কাজটা সারল তাতে ক্ৰক্ষেপ করতে ইচ্ছে করছে না। ওর নিজেরই করা উচিত ছিল কাজটা।
শ্রাগ করল জুড। কিন্তু তাতে পার্থক্য কি? বাবার বেলায় কি করেছিল ওরা, মনে আছে? তাছাড়া, জনি আমার জন্যে এরকম আনন্দের ব্যবস্থাই করতে চেয়েছিল।
আমাদের সবার জন্যেই, নিচু স্বরে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। আর আমি…বুঝতে পারিনি কোনটা সাহস, বোকামি বা কাপুরুষত্ব-হয়তো এ কারণেই শত্রুরা বেঁচে আছে এখনও।
দীর্ঘ নীরবতা খোঁচাচ্ছে ওদের। সোডা স্প্রিং-কেই বলা যায় সবচেয়ে কাছের সভ্য বসতি, বহু দূরে আছে শহরটা এবং এটাই বাড়তি সুবিধা। ইচ্ছে করলেই সমস্যাটা চুকিয়ে ফেলতে পারে। নিচে অন্ধকার উপত্যকায় এখন মিনতি করছে। জনি-যা সে করেনি কখনও-অসহায়, অধীর সুরে দয়া চাইছে ওদের।
ঝিমুনি চলে এল, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল শেভার্ন। একসময় চোখ খুলে দেখল আগের মতই বসে আছে অন্যরা। আচমকা নিচের উপত্যকায় কারও ক্ষীণ, সতর্ক পদশব্দ শোনা গেল। না! প্লীজ! কাতর স্বরে অনুরোধ করল জনি, তারপরই নীরব হয়ে গেল। আর কোন অভিযোগ, অনুনয় বা কাতরানি শোনা গেল না। কাজটা সেরে ফেলেছে কেউ।
একটু পর মেসার মুখে রোজাওরাকে দেখতে পেল শেভার্ন। বিস্ময়ের ধাক্কাটা চড়ের মত আঘাত করল ওকে, ভাবতেই পারেনি এমন একটা কাজে যাবে। মহিলা। মহিলাকে বেরোতে দেখেনি ও। অন্যদের বিস্ময় দেখে বুঝল জুড বা মিসেস ব্রুকসও রোজাওরার অনুপস্থিতি টের পায়নি। নির্বিকার মুখে হাতের ছুরির রক্ত পরিষ্কার করছে মহিলা, নীরব শূন্য দৃষ্টিতে তা দেখছে ভাই-বোন।
উন ক্যাবরন মেনোস, বলল রোজাওরা।
আসলেই ঝামেলা শেষ! সমস্যার একেবারে গভীরে প্রবেশ করেছে মহিলা। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে সামান্য ব্যভিচার অসংখ্য সমস্যার বিপরীতে সামান্য উন্নতিই বলা যায়। নীরব অদ্ভুত সুন্দর এই উপত্যকায় আসার ক্ষণটি নিজেকে মনে করিয়ে দিল শেভার্ন, ট্রেইলে জ্বলন্ত একটা ক্যারাভানের পাশে পড়ে ছিল রোজাওরার স্বামীর মৃতদেহ। অন্তত একজন সমস্যাটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছে•••উঁহু, দুজন, জুডাস ম্যাকলেন্ডনের কথা মনে পড়তে সংশোধন করল ও।
তুমি বোধহয় অসুস্থ বোধ করছ, মি. শেভার্ন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জুলিয়া ব্রুকস, এগিয়ে এসে শেভার্নের পাশে বসল। হাতের চেটো ওর কপালে রেখে তাপমাত্রা পরখ করল। ইশশ! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!
অন্যের সমস্যা বুঝতে পারার স্কটদের চিরাচরিত মনটা পেয়েছ তুমি, স্মিত হেসে বলল ও।
কোন মন্তব্য না করে গ্রীন রীভারের বোতলটা এগিয়ে দিল মহিলা। গামলায় পানি ভরে এক খণ্ড নরম কাপড় ভিজিয়ে শেভার্নের উর্ধ্বাঙ্গ মুছে দিল, জলপট্টি দিল কপালে। তারপর আরেকটা কম্বল গায়ে চাপিয়ে দিল।
কিছুটা আরাম বোধ হওয়ায় চোখ বুজল ও, পাশে জুলিয়া ব্রুকসের উপস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। ক্ষীণ কিন্তু সুবাসিত একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে, পারফিউমের নয় নিশ্চিত শেভার্ন। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল মহিলা নিজেই অসুস্থ, শরীরে একটা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। চোখ খুলতে সরাসরি মিসেস ব্রুকসের সবুজ উজ্জ্বল চোখজোড়া দেখতে পেল। স্মিত হেসে গ্লাস ভরা গ্রীন রীভারের পানীয় এগিয়ে দিল লাল-চুলো।
আড়চোখে অন্যদের দিকে তাকাল শেভার্ন। জুডের হাতেও একটা গ্লাস দেখা যাচ্ছে, আর ডোনা রোজাওরা সাপারের আয়োজনে ব্যস্ত। আশা করি শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি, পানীয় গলায় ঢেলে দেওয়ার সময় টোস্ট করল ও।
সন্দেহ নেই তোমার চেয়ে ভাল আছি, সহাস্যে বলল জুলিয়া ব্রুকস।
সকাল হলো একসময়। ভাপসা বাতাস আর মাটিতে বৃষ্টির সোদা গন্ধ ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে আগের দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে; ক্রীকের পানি ফুসে উঠেছিল, কিন্তু আজ আগের লেভেলে নেমে গেছে। গোলাগুলির আগে ঘোড়াগুলো যেখানে রেখেছিল শেভার্ন, সেখানেই রয়ে গেছে।
কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল ও। মুখ বিকৃত হয়ে গেল ব্যথায়, কিন্তু সামস নিল কিছুক্ষণের মধ্যে, ব্যথাটা চলে গেল একসময়। ভাবছে গুরুতর কিছু হয়নি বোধহয়। নিজের জীবনের চেয়ে অন্যের জীবনকে কখনও গুরুত্ব দেবে না আর, তিক্ত মনে স্মরণ করিয়ে দিল নিজেকে। কখনোই নয়, অন্তত যদ্দিন না জীবন নিরর্থক ভাবার মত বয়েস হয় ওর।
ছেলেটাকে কবর দিতে হবে, ম্লান স্বরে মনে করিয়ে দিল লাল-চুলো।
জনি চাইত আমি যেন ওর মত একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে না পারি, সোজাসাপ্টা বলল জুড। আমি চাই না ম্যাকলেন্ডনদের মাটি কলুষিত হোক।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শেভার্নের দিকে তাকাল জুলিয়া ব্রুকস।
মনে হয় না বন্ধু হলেও ওকে কবর দেয়ার মত অবস্থা আছে আমার, ক্ষমা প্রার্থনা করল শেভার্ন।
নীরব হয়ে গেল ওরা, পার্থিব কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে অনিচ্ছুক। শকুন, কয়োট আর মাছির অত্যাচার শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে, আর আছে দৃষিত পানি। বিস্ফোরক ভরা গর্তের কথা মনে পড়ল শেভার্নের, কিন্তু এতদূর পর্যন্ত যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হবে না এখন।
আমি ওকে নিয়ে যেতে পারব, প্রস্তাব করল জুড।
আর তোমাকে একা পেয়ে যাক ওরা? দাবড়ানি দিল বোন। গতকাল কোথায় ছিলে তুমি?
ইউসেবিও আর অন্যদের দেখতে গিয়েছিলাম।
তো?
শ্রাগ করল তরুণ। ওরা ভালই আছে। ঝামেলা সব ঘটছে এখানে।
মাথাগুলো ছেটে দাও, তাহলেই অন্যরা আপসে সরে পড়বে-ভাবল শেভার্ন, এই হচ্ছে পেনি-ফার্দিংদের পরিকল্পনা। তাছাড়া আক্রমণ করার জন্যে ম্যাকলেন্ডনদের এস্টেট বা ডেরাই মোক্ষম জায়গা, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হার্ডারদের হামলা করা সে-তুলনায় অনেক কঠিন।
আর কোন উপায় আছে? জানতে চাইল লাল-চুলো।
লড়াই ছাড়া?
নড করল মহিলা। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি না। ইন্ডিয়ানদের সাথে ঝামেলা হয়েছে, কিন্তু তারপরও এখানে বসতি করতে বা থাকতে সমস্যা হয়নি বাবার। আমার মনে হয় না ওঁকে দয়ালু ভাবত কেউ। আসলে যতটা দৃঢ়তা দরকার তাই ছিল ম্যাকলেন্ডনদের, বেশিও নয় কমও নয়। কারও শত্রু হওয়ার চেষ্টা করিনি আমরা, সেধে কারও সঙ্গে ঝামেলায় জড়াইনি।
কিন্তু তারপরও শক্র পেয়ে গেছ। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত একটা পক্ষ থাকবে এখানে-হয় তোমরা, নয়তো ওরা।
আর আমরা কি-না ভাবছি উনিশ শতকে বাস করছি!
প্রস্তর যুগে বাস করছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধরে দিল শেভার্ন। ভারী রীপিটিং রাইফেল, চৌকস হ্যান্ডগান, শ্ৰাপনেল, টর্পেডো আর ডিনামাইটের যুগে!
তোমার কি মনে হয়, কজন বাকি আছে ওরা?
পেনি-ফার্দিং?
যাই বলল ওদের।
ভাবছে শেভার্ন। ডাবল-ও বাথানে যাওয়ার সকালটা মনে পড়ল, গুটি কয়েক শীর্ণকায় গরু দেখে বিস্মিত হয়েছিল ও। ছোট্ট বাঙ্ক হাউসে পাঞ্চাররা যদি না ডাবলিং করে থাকে… ডজন খানেক হবে বোধহয়, শেষে বলল ও। কয়েকজন। মারা গেছে অবশ্য। তবুও, অন্তত আট-নজন তো হবেই।
আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে।
দুজন। পুরো সুস্থ হতে আরও দুদিন লাগবে আমার।
ঠিকই বলেছ, অন্যমনস্ক সুরে বলল জুলিয়া ব্রুকস, দুশ্চিন্তায় একটা ভুরু কুঁচকে উঠেছে, দুই বাকবোর্ডের মাঝখানে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে পায়চারি শুরু করল। পানি ফুরিয়ে গেছে। রোজাওরা, জুডকে সঙ্গে নিয়ে যাও। ক্রীক থেকে পানি নিয়ে এসো।
আমি একাই পারব, একটা প্যাকহর্স বের করে বলল জুড।
তোমরা দুজনেই যাবে! কেউ হয়তো নজর রাখছে আমাদের ওপর। যাওয়ার পথে ওই ছেলেটার লাশের ওপর কিছু মাটি ঢেকে দিয়ো, নইলে মাছি বসতে শুরু করবে।
বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল জুড, তবে তর্ক করল না আর। রোজাওরার পাশাপাশি ঢাল বেয়ে নিচের ক্রীকের উদ্দেশে এগোল।
যাক, আশপাশে কেউ নেই এখন, মৃদু স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস।
কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল শেভার্ন, ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ফেলল। ঢাল হয়ে নিচের দিকে তাকাল ও। তাই তো মনে হচ্ছে, মহিলার দিকে তাকাতে এবার অস্বাভাবিক দৃষ্টিটা ধরা পড়ল চোখে, প্রসঙ্গটা বুঝতে পারল।
সারা শরীরে ব্যথা হচ্ছে, ব্যাখ্যা করল ও। কয়েক জায়গায় হয়তো পচনও শুরু হয়েছে। অন্তত কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিতে হবে, তবে গরম পানি দিয়ে কয়েকবার গোসল করতে পারলে হয়তো দ্রুত সেরে যাবে।
চুলের মতই লালচে আভা ছড়াল মিসেস ব্রুকসের মুখে। আমার নিজের অবস্থাও সুবিধের নয়, কিছুটা সামলে নিয়ে স্বীকার করল। ওদেরকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। যাকগে, এরচেয়ে ভাল সময় বা জায়গা পাওয়া সম্ভব নয়। তুমি কি আমার ক্ষতটা দেখবে একবার?
আমি ডাক্তার নই।
আমিও নই, এবং পঞ্চাশ মাইলের মধ্যেও তেমন কেউ নেই। রোজাওরাকে দেখাতে পারতাম, কিন্তু অদ্ভুত চিকিৎসা দিত ও-ভূত তাড়াতে ক্ষতে গোবর মেশাত। তোমার কথা শুনে মনে হয়েছে সংক্রমণ চিকিৎসার ব্যাপারে জানো তুমি।
ক্ষতটা চুলকাচ্ছে খুব। ওটা এমন জায়গায় আমি নিজে দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো পচন ধরেছে, তেমন হলে মরা চামড়া চেঁছে তুলে ফেলতে হবে।
নড করল শেভার্ন।
ঢালের উদ্দেশে চকিত দৃষ্টি হানল জুলিয়া ব্রুকস, তারপর ওর দিকে পেছন ফিরে বসল। ব্লাউজ আর পেটিকোট সরিয়ে ক্ষতটা উন্মুক্ত করল, আড়ষ্ট ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে কাজটা সে করছে প্রয়োজনে আর নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে। তবে বাম বগলের কাছে শুধু ক্ষতটাই দেখতে পেল শেভার্ন। দগদগে ঘার-র মত খানিকটা লাল হয়ে আছে জায়গাটা।
স্পর্শ করে দেখব? অনুমতি চাইল শেভার্ন।
নড করল মহিলা, মুখে কিছু বলল না। ঘাড়, এমনকি বগলের কাছেও ফর্সা তৃক লালচে আভা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে ক্ষতটা পরখ করল শেভার্ন, তুলনা করার জন্যে অন্য দিকটাও স্পর্শ করল। তারপর বেডরোলে শরীর এলিয়ে দিল ও।
কি দেখলে? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জুলিয়া ব্রুকস।
ভালই তো মনে হচ্ছে। একটা সপ্তাহ সময় দাও, সুস্থ হয়ে খুশি মনেই আরও ভাল মত পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়ে যাব আমি।
কথাটা না শোনার ভান করল মিসেস ব্রুকস। পচন ধরেনি?
না।
সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্লাউজ আর পেটিকোটের আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল জুলিয়া ব্রুকস, তারপর সন্তর্পণে তাঁবুর অপেক্ষাকৃত অন্ধকার কোণে সরে গেল, ওর দিকে ফিরে বসলেও সরাসরি তাকাল না। মি. শেভার্ন, এখন কি করব আমরা? অনিশ্চয়তা আর দ্বিধা প্রকাশ পেল মহিলার কণ্ঠে।
সম্ভাব্য কয়েকটা উত্তর বিবেচনা করল ও, দ্বিধা করছে। এখন যা পরিস্থিতি, নিজেদের টিকিয়ে রাখাই হবে আমাদের আসল কাজ। শেরিফ যেহেতু আইন প্রয়োগ করতে পারছে না, কিংবা করতে অনিচ্ছুক, আপাতত নিজেদের সীমিত শক্তি নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
কিন্তু সেটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ, তাই না? হয়তো সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে পারলেই ভাল হত।
রোজাওরা আর জুড ফিরে এসেছে, ঢালের মুখে দেখা যাচ্ছে দুজনকে। প্যাকহর্সে পানির ক্যান্টিন আর ব্যাগের বোঝ। এবার নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছ? তাচ্ছিল্যের সুরে বোনকে জিজ্ঞেস করল তরুণ।
চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল শেভার্ন, এদিকে রাগে ফেটে পড়া থেকে নিজেকে সামলে রেখেছে মিসেস ব্রুকস। সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করছে শেভার্ন, আনমনে ভাবছে আদৌ কখনও ব্যথা থেকে মুক্তি পাবে কি-না। শুনতে পেল রোজাওরার ভূমিকা নিয়ে তর্ক শুরু করেছে ভাই-বোন, কিন্তু স্বয়ং রোজাওরাও ভ্রুক্ষেপ করছে না। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকল শেভার্ন, ভাবছে নিকট ভবিষ্যতে আর কি করার আছে ওদের।
যতদূর বোঝা যাচ্ছে বিকল্প নেই কোন। মোটামুটি সুস্থ হলেই বেরিয়ে পড়তে হবে ওকে, নিচের উপত্যকায় গিয়ে পেনি-ফার্দিং রাইডারদের যে কজনকে পারে মেরে ফেলতে হবে, তাহলে কিছুটা হলেও সম্ভাবনা থাকবে ম্যাকলেন্ডনদের।
আগের চেয়ে কিছুটা হলেও সুস্থ বোধ করছে ও এখন। রোজাওরার সামান্য ব্যভিচার-এর শিকার হয়ে নিচের উপত্যকায় পড়ে আছে একজন। আরেকজন আছে এখানে। গতরাতের পর, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে আনাড়ী কোন তরুণ বা বালক হিসেবে গণ্য করবে না কেউ। যথেষ্ট পরিণত হয়েছে সে, গৃহযুদ্ধের সময় এভাবেই বহু তরুণ বা বালক আচমকা যুবকে পরিণত হয়েছে, পরিস্থিতিই বাধ্য করেছে। জিম শেভার্নের ধারণা ছিল অস্বাভাবিক এই পূর্ণতা শেষ হয়ে গিয়েছিল আঠারোশো পঁয়ষট্টিতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে আসলে তা হয়নি, দেশটার আনাচে-কানাচে বহু জায়গায় নিরন্তর এমন হাসিখুশি তরুণ বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকাল ও। সকাল হয়েছে মাত্র, দীর্ঘ একটা দিন পড়ে আছে সামনে। চাদিতে বুলেটের ছোঁয়া আর উরুতে স্ট্যিাপের আঘাতের পর থেকে মনে হচ্ছে ব্যথাগুলো কেবল বাড়ছেই, প্রতিদিন কিছুটা হলেও হাঁটাহাঁটি না করলে বোধহয় সারবে না। পেনি-ফার্দিংরা যদি আবার হামলা করে, তাহলেই চুকে যাবে সব। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল ও, প্রার্থনা করল রাইড করার সুস্থতা অর্জন করার আগে যেন ব্যাপারটা না ঘটে।
ওহ, খোদা! অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল মিসেস ব্রুকস।
চমকে চোখ মেলল শেভার্ন। হাত বাড়িয়ে পকেট থেকে তাজা বুলেট বের করল, মহিলার কণ্ঠে বিপদ আঁচ করেছে। কজন? কোল্টে বুলেট ঢোকানোর সময় নিস্পৃহ স্বরে জানতে চাইল ও। কত দূরে আছে ওরা? টের পেল নিতান্ত খামখেয়ালী ভাব প্রকাশ পেয়েছে কণ্ঠে, জানে সেজন্যে হয়তো প্রাণও দিতে হতে পারে ওকে। রাইফেল থেকে গুলি করলে ঠিক নিশানা বরাবর আঘাত করবে তো নাকি কিছুটা নিচে সরে যাবে বুলেট।
বাতাস আর বুলেটের ওজন কিছুটা সমস্যা করবে, উত্তরে বলল জুড। তবে টার্গেটের কিছুটা ওপরে নিশানা করাই ভাল। দুএকবার গুলি করলেই ব্যাপারটা আয়ত্তে চলে আসবে তোমার। প্রিংফিল্ডে তোমার হাত কেমন?
মিসেস ব্রুকসের মন্তব্য মনে পড়ল ওর, মহিলা বলেছিল রাইফেলে জুডের নিশানা অসাধারণ।
মনে হয় না ওটা ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে, নিরুত্তাপ স্বরে জানাল জুলিয়া ব্রুকস, বাকবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে, ঢালের নিচে আগুয়ান রাইডারদের দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার। ডাবল-ও-র রাইডার নয় ওরা।
এটাই তাহলে পেনি-ফার্দিংদের উপযুক্ত নাম!
কারা? জানতে চাইল তরুণ।
শেরিফ। এবার কি একা আসেনি সে।
আমি দুঃখিত, মিসেস ব্রুকস, বলল শেভার্ন।
কেন?
যদি রাইড করতে পারতাম, নিচে গিয়ে পেনি-ফার্দিং রাইডারদের যে কজনকে পারি খুন করে আসতাম প্রথমে।
প্রথমে?
তারপর শেরিফ আর ওর অনুগত পাসিকে আমাকে ধরার সুযোগ দিতাম, দেখতাম আসলেই কি প্রমাণ হাজির করেছে সে এবার।
কি বলছ!
তোমরা বরং অপেক্ষা করো, ওদের সঙ্গে ঝামেলা না করাই ভাল হবে। শত্রু বাড়িয়ে লাভ নেই।
আপসে আমার সেনাবাহিনীর অধিনায়ককে চলে যেতে দেব? বিরক্তি প্রকাশ করল মিসেস ব্রুকস, ঘুরে বাকবোর্ডের আড়ালে চলে গেল। মনে হয় না পাসি ওটা, যদি হয় তাহলে বলতে হবে পাসিটা খুব ছোট।
বাকবোর্ডের কিনারা ধরে উঠে বসল শেভার্ন, তারপর দাঁড়াতে সক্ষম হলো। চোখ কুঁচকে দূরের ট্রেইলের দিকে তাকাল। ব্যাংকার দুজন আছে শেরিফের সঙ্গে, তোমাদের বাথান কিনতে এসেছিল যারা।
ট্রেইল ধরে একসময় খোলা জায়গায় পৌঁছে গেল শেরিফ আর ওর দুই সঙ্গী। এস্টেটের কাছে এসে বিস্মিত, বিহ্বল মনে হলো জেসন বেলহ্যামকে। কারণটা বোঝার চেষ্টা করল শেভার্ন, ধাঁধার মত লাগছে ওর কাছে। শেরিফ এর আগে না এলেও, অন্য দুজন পোড়া এস্টেটটা দেখেছে সেদিন। ম্যাকলেন্ডন বাথানে আক্রমণের খবর নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে পেয়েছে ল-ম্যান। তারপরই অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল ওর চোখে, জনির মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে ওরা।
বাকবোর্ডের কিনারার দিকে সরে এল ও, নড়াচড়া করায় ব্যথা শুরু হয়েছে। আরামদায়ক একটা অবস্থান পেতে চাইছে, কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে হপ্তাখানেকের আগে আরাম বা স্বস্তি জুটবে না কপালে।
শেভার্ন? চিৎকার করে ডাকল শেরিফ।
গোল্লায় যাক বেটা! নিজেই খুঁজে বের করুক ওকে।
মিজ ব্রুকস, এখনও কি বিদ্রোহীটা আছে তোমার সঙ্গে?
তোমাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি, শেরিফ, উত্তরে বলল মিসেস ব্রুকস, কিন্তু খুশির লেশমাত্র নেই কণ্ঠে। শেষপর্যন্ত বেসিনে আইন প্রতিষ্ঠা করছ তুমি?
সেটা নির্ভর করছে তুমি একজন ফেরারীকে আশ্রয় দিচ্ছ কি-না তার ওপর, পাল্টা জবাবে জানাল শেরিফ। ঠিক পেছনে স্যাডলে স্থির হয়ে বসে আছে দুই ব্যাংকার। মেসার ওপর থেকে কেউ উত্তর দিল না দেখে যোগ করল শেরিফ, এবার কিন্তু তৃষ্ণার্ত কোন ফ্রেইটার নয়, স্বনামধন্য একজন ব্যাংকার নিশ্চয়ই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট হবে, তাই না?
নিজেদের অস্ত্র পজিশন মত নিয়ে এসেছে জুড আর মিসেস ব্রুকস। শেভার্নের সাথে চোখাচোখি এড়িয়ে যাচ্ছে দুজনেই। আমি অন্তত বিশ্বাস করি না! বিড়বিড় করে মন্তব্য করল তরুণ।
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে শেভার্নের দিকে তাকাল মিসেস ব্রুকস। খুব বেশি ব্যথা হচ্ছে? জানতে চাইল মহিলা, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে মনে তীক্ষ্ণ কাঁটার মত বিধতে থাকা প্রশ্নটা করতে পারছে না। তোমার জন্যে কিছু করতে পারি আমি?
কিছু কর্নপোন আর মিন্ট জুলেপ দিয়ে যাও আমাকে।
বিহ্বল দেখাচ্ছে লাল-চুলোকে, বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সামলে নিল নিজেকে। সামান্য দ্বিধার পর ধন্যবাদ দিল ওকে।
নিজেকে একজন ইংরেজ বলে দাবি করেছ তুমি, অভিযোগ করল জুড।
মনে পড়ছে না এরকম কিছু বলেছি।
অন্তত দশবার বলেছ কথাটা!।
মনোযোগ দিয়ে শোনোনি বোধহয়, নইলে ধরতে পারতে পার্থক্যটা। ইংল্যান্ডের স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমি। আরব, ইন্ডিয়ান বা হটেনটটদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
কিন্তু…।
কিন্তু মিথ্যে বা মনগড়া কিছু বলিনি, কোন অত্যাচারীর পতাকার প্রতিও মিথ্যে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেইনি। আমি জিম শেভার্ন, যেমন ছিলাম তেমনই আছি, এবং তাই বলেছি তোমাদের।
কিন্তু সেটাই ভাবতে বাধ্য করেছ আমাদের, সোজাসাপ্টা বলল মিসেস ব্রুকস, অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে খানিকটা। এখন দেখছি বিবেকের দংশন নিয়ে চিন্তা করারও সময় নেই!
তোমার মনগড়া কল্পনাগুলোই দেখছি ধারণা হিসেবে রয়ে গেছে এখনও, তিক্ত স্বরে বলল ও। বাকি যা থাকল, অমীমাংসিত ব্যাপারগুলো নিয়ে কি করব আমরা?
ওভাবে ভাবিনি আমি, ক্ষীণ হেসে বলল লাল-চুলো, হতাশা চেপে রেখেছে। শরীর টানটান করে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করল, তারপর চিৎকার করে ডাকল শেরিফকে। মি. জেসন! বেড়া ডিঙানোর দিন শেষ হয়ে গেছে তোমার। বেরিয়ে এসো!
কিছুই তো বুঝতে পারছি না এসবের, জুলিয়া। বিদ্রোহীটা তোমার সঙ্গে আছে?
বেসিনের লোকজনের প্রতি তোমার দায়িত্বের কথা বলছি, মি. জেসন। তুমি কি আমাদের পক্ষে, নাকি বিরুদ্ধে? তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকা শয়তানটা আমাদের শত্রু। শান্তিপ্রিয় লোকদের যদি মিথ্যে অজুহাতে এভাবে বিরক্ত করতে থাকো, ওকে গোর দিয়ে পারিশ্রমিক পেতে হবে তোমার।
ম্যাকলেন্ডনদের মাটিতে গোর দিয়ো না ওকে, আমি চাই না আমাদের জমি বিষাক্ত হোক! সরোষে বলল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। নিচের উপত্যকায় নিয়ে যাও ওকে!
এভাবে নিজেদেরই ক্ষতি করছ তোমরা। ঝামেলা করা ছাড়া আমাকে ওপরে উঠতে দেবে, নাকি চাও নিতান্ত বাধ্য হয়ে বেতন হালাল করি আমি?
শেরিফের ভূমিকা বা মানসিকতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, নিশ্চিত ধরে নিয়েছে ম্যাকলেন্ডনরাই এ লড়াই শুরু করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোল্টগুলো পরখ করল শেভার্ন, প্রতিটা নড়াচড়ার ফলে অনুভূত ব্যথা পরোয়া না করার চেষ্টা করছে। মাথা নিচু করে বাকবোর্ডের কিনারে সরে এল ও, দেখল পাহাড়ের কোলে জনির মৃতদেহের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে শেরিফ আর দুই ব্যাংকার। ইউনিয়নের হয়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে এমন লোকের জন্যে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, পরিকল্পনাটাও যুৎসই নয়। যথেষ্ট দূরে হলেও মেসার ওপর থেকে অনায়াসে তিনটা শটে তিনজনকেই খতম করে ফেলতে পারবে ও।
শেরিফও বোধহয় জানে সেটা, কিন্তু পরোয়া করছে না। তোমরা কি আপসে নিচে নেমে আসবে নাকি আমাকেই ওপরে আসতে হবে?
গুলি কোরো না ওকে, তাহলে এখানেই শেষ হয়ে যাবে তোমরা।
জানি আমি, মি. শেভার্ন, বিরক্তির সাথে বলল জুলিয়া ব্রুকস। কিন্তু কি করতে বলো আমাকে?
ওপরে আসছি আমি, জুলিয়া, নিচ থেকে চড়া কণ্ঠে জানাল ল-ম্যান। বেতাল কিছু করে বসো না আবার, তাহলে কিন্তু পস্তাবে শেষে! ওই নচ্ছার বিদ্রোহীটাকে আমার হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তোমরা বরং মনস্থির করে নাও।
যুদ্ধটা দশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে, শেরিফ।
খুনীদের জন্যে যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না, এমনকি ওদের পরনে ইউনিফর্ম না থাকলেও কিছু যায়-আসে না। ওপরে আসছি আমি।
নিচে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে। সরোষে বলল জুড।
ওকে আসতে দাও, নির্দেশ দিল শেভার্ন।
গুলি কোরো না! প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল লাল-চুলো।
ওরকম কোন ইচ্ছে নেই আমার।
মেসার কোণে বসে আছে রোজাওরা, সবই দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না।
বাকবোর্ডের কাঠামো ছাড়িয়ে শেভার্নের স্যাভিলানো দেখা যাচ্ছে, বুক টানটান করে দাড়িয়ে আছে ও। এসো, শেরিফ! সাথে তোমার বন্ধুদের নিয়ে এসো। তাড়াহুড়ো কোরো না। বলেছি তো গুলি করব না, জিম শেভার্নের প্রতিশ্রুতি পেয়েছ তুমি।
ঝট করে ওর দিকে ফিরল জুলিয়া কস। ওহ্, মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! ধরা দিতে চাইছ নাকি তুমি, মি, শেভার্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। মনে আছে কথাটা-তুমিই বলেছ-পুরো দেশটাই পক্ষ বেছে নিচ্ছে? আঙুল তুলে নিচের উপত্যকা নির্দেশ করল গৈভার্ন। ওদেরকেও একটা পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করব আমি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ভাই-বোন।
সময় নষ্ট করছ তোমরা, শেরিফ, ল-ম্যানের উদ্দেশে চিৎকার করল শেভার্ন। চাইলে সঙ্গে অস্ত্র আনতে পারো, কিন্তু ইতস্তত কোরো না। আমার মত বদলানোর আগেই ওপরে উঠে এসো।
ব্যাংকারদের দ্বিধা আর অস্বস্তি যেন ঘোড়াগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে, ছটফট করছে ওগুলো। পুরো মিনিট খানেক পর তিনজনের দলটা ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল।
পিস্তল তুলো না, ভাই-বোনকে উসখুশ করতে দেখে বিড়বিড় করল শেভার্ন। ওদেরকে বিপক্ষে ভিড়ে যেতে বাধ্য করতে চাও নাকি?
কিন্তু ওদেরকে ওপরে আসতে দেওয়া কি ঠিক হবে?
তিনটা অস্ত্র আছে ওদের, এবং এখনও কোন পক্ষ বেছে নেয়নি। অন্তত আমাদের বিরুদ্ধে তো যায়নি। আমার ধারণা এখনও কিছুটা সম্ভাবনা আছে আমাদের, অন্তত শক্রদের সঙ্গে এরা যোগ না দিলেই হলো।
ঠোঁট কামড়ে ধরল জুলিয়া ব্রুকস, আর নিজের অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে জুডাস ম্যাকলেন্ডন, মুখে কথা সরছে না। মেসার ওপরে থাকায় সামনের জমি আর নিচের উপত্যকার প্রায় পুরোটাই চোখে পড়ছে ওদের, যে সুবিধাটা শেরিফ পাচ্ছে না। তিনজনের দলটার ওপর চোখ রাখল শেভার্ন, ঘোড়া নিয়ে উঠে আসতে প্রয়াস লাগছে তাদের। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল অস্বস্তি তাড়া করছে। তিনজনকেই, শেভার্নের জোড়া কোল্ট হোলস্টারে রাখা দেখে স্বস্তি ফুটল মুখে। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাড়াল, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এল তিনটে ঘোড়া। বাকবোর্ডের কাছে এসে স্যাডল ছাড়ল সবাই।
না বেঁধে বরং ছেড়ে দাও ওদের, পরামর্শ দিল শেভার্ন।
সরু হয়ে গেল শেরিফ বেলহ্যামের চোখ। এখানে বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছে নেই আমাদের!
হয়তো, নির্বিকার মুখে বলল ও। কিন্তু গোলাগুলি শুরু হলে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে মাসট্যাঙগুলো। তোমরা গুলি করো বা না-করো, ছোটাছুটি শুরু করবে ওগুলো, আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলে দেবে।
কিসের বিপদ?
এবার স্মিত হাসি দেখা গেল শেভার্নের মুখে। বেসিনের লড়াইয়ে স্বাগতম। তোমার নিরপেক্ষতার দিন শেষ হয়ে গেছে, শেরিফ!
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ধরেই নিয়েছ তোমাকে গ্রেফতার করতে আসিনি আমি? প্রায় কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল সে, হোলস্টার থেকে পীসমেকার বের করে নিশানা করল শেভার্নের বুক বরাবর।
আমি নিশ্চিত ওটাই তোমার আসল উদ্দেশ্য, বলল শেভার্ন, আড়চোখে দেখল নীরবে ওদের কথা শুনছে ভাই-বোন, দৃঢ় হাতে অস্ত্র ধরে রেখেছে যদিও কোনটাই কারও দিকে নিশানা করা নেই। আমার যেমন আসল উদ্দেশ্য ছিল কোন ঝামেলা ছাড়াই এ অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়া, দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেই ধরল ও। কিন্তু আইনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তোমার ব্যর্থতা বা অনিচ্ছার কারণেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরিকল্পনাটা বদল করতে হয়েছে।
ওসব বদলে দিতে এখানে এসেছি আমি, বলতে শুরু করল শেরিফ।
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিল শেভার্ন, চেষ্টা করছে যাতে নিজের দুরবস্থা প্রকাশ না পায়। জীবন বড় অনিশ্চয়তার, মি. জেসন, দার্শনিক সুরে বলল ও। মুরগীর বাচ্চারা সন্ধের আগে ঘরে ফিরে কিভাবে, দেখেছ কখনও? সঠিক সময়ে কোন কাজ কি কখনও করতে পেরেছ তুমি? যদি করতে, তাহলে এসবের কিছুই ঘটত না।
সরাসরি কখনও কথা বলতে পারো না তুমি?
তোমার পছন্দের চেয়ে সরাসরিই বলেছি, নিস্পৃহ স্বরে বলল শেভার্ন। উপত্যকার দিকে তাকাও, দেখেছ? মুরগীর বাচ্চারা ছুটে আসছে এদিকে। চোখের নিমেষে বিদ্যৎ খেলে গেল ওর হাতে, ভোজবাজির মত উঠে এল একটা কোন্ট। নিশানা ছাড়াই উপত্যকার রাইডারদের উদ্দেশে একটা বুলেট পাঠিয়ে। দিল, তারপর যথাস্থানে ফেরত পাঠাল কোন্টটা। চিন্তা করারও সময় পায়নি। শেরিফ, অনায়াসে তাকে গুলি করতে পারত শেভার্ন-শেরিফের এই উপলব্ধি হওয়ার আগেই পিস্তলটা হোলস্টারে ফেরত চলে গেছে। পছন্দমত সমাধান বের করার উপায় আর থাকল না তোমার। ইচ্ছে না থাকলেও এখন থেকে আমাদের মত ভাবতে বাধ্য হবে তুমি।
উপত্যকার দিকে তাকাল শেরিফ। পেনি-ফার্দিংদের দলটা বিশাল, শেভার্নের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি লোক-বারোটা ঘোড়া, কিন্তু সওয়ারী এগারোজন। প্যাকহর্স হিসেবে ব্যবহার করছে একটা-পর্যাপ্ত সাপ্লাই নিয়ে এসেছে। বোঝা। যাচ্ছে ওদেরকে অবরোধ করতে চাইছে, অন্তত পানির ঘাটতি হওয়া পর্যন্ত আটকে রাখার চেষ্টা যে করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পাশ ফিরে পানির ক্যান্টিন আর পাত্রগুলো জরিপ করল শেভার্ন। চারজনের জন্যে যথেষ্ট, সপ্তাহ খানেক অনায়াসে চলে যাবে, যদি না শেরিফ আর দুই ব্যাংকারকে ভাগ দিতে হয়।
প্রতিপক্ষ কেবল সংখ্যায় বেশি নয়, প্রয়োজনীয় সাপ্লাই আর ক্রীকটাও রয়েছে ওদের হাতের নাগালে। স্যাডল ছেড়ে পজিশন নিচ্ছে ওরা। একটা রাইফেল, বলে হাত বাড়াল শেভার্ন, কিন্তু প্রতিপক্ষের ওপর থেকে চোখ সরায়নি। জনির মৃতদেহ আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে দুজন, সময় নিয়ে এদের একজনকে টার্গেট করল ও। গম্ভীর শব্দে গর্জে উঠল স্প্রিংফিল্ড, ওটার তীব্র ধাক্কা নতুন করে সারা শরীরের ব্যথা মনে করিয়ে দিল শেভার্নকে।
টার্গেটের পাশে মাটিতে ধুলো উড়তে দেখল ও, ঢোক গিলে বিতৃষ্ণা হজম করার চেষ্টা করল। বোঝা যাচ্ছে পাহাড়ে শূটিং করতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে, হিসেবটা ঠিক হয়নি। জুডাসকেই সুযোগ দেয়া উচিত।
নতুন শেল ঢুকিয়ে রিলোড করার ফাঁকে আড়ালে সরে গেল পেনি-ফার্দিং-এর দুই রাইডার, অন্যরা মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে। মেসার ওপর দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট।
সূর্যের দিকে তাকাল শেভার্ন। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, নিজের ধারণা প্রকাশ করল। দিনের আলোয় আক্রমণ করবে না ওরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের হাতে রাইফেলটা ধরিয়ে দিল ও, তারপর শেরিফ আর দুই ব্যাংকারের দিকে ফিরল। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না আজ। কিছু ঘটলে জানিয়ে আমাকে।
ঘোলা চোখের লোকটা–যার ধারণা জিম শেভার্ন আসলে জঘন্য এক বিদ্রোহী, কুখ্যাত কোয়ান্ট্রিলের সহচর-বিস্ফারিত হলো তার চোখ, কিন্তু কিছু বলল না। তারপরও ভরসা করতে পারছে না শেভার্ন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছে অন্যরা, তবে একটা কান খোলা রেখে ঠিকই ওর কথা শুনছে, হয়তো উচ্চারণ ভঙ্গি থেকে শেভার্নের সত্যিকার পরিচয় আঁচ করার চেষ্টা করছে।
এই লোকই, দৃঢ় স্বরে বলল নাম না-জানা ব্যাংকার। সেদিন ওকে দেখার পরপরই চেনা চেনা লাগছিল, খানিকটা দ্বিধা ছিল, কিন্তু এখন নিশ্চিত জানি।
ওদের সবার কাছেই রাইফেল আছে, বিষণ্ণ স্বরে বলল শেরিফ, মুখ দেখে বোঝা গেল না তরুণ ব্যাংকারের সাক্ষ্যে কতটা প্রভাবিত হয়েছে। আপাতত উপত্যকায় অবস্থান নেওয়া পেনি-ফার্দিং রাইডারদের দিকেই মনোযোগ বেশি।
ছয় মাস আগে যদি বুক ফুলিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, তাহলে এখানে ফাঁদে পড়ে আমাদের সঙ্গে মরার ঝুঁকি নিতে হত না তোমাকে, শেরিফের উদ্দেশে বলল মিসেস ব্রুকস।
বুড়ো বুল ওস্টেনভেল্ট যদি মাথা তোলে, প্রথম সুযোগটা আমাকে দিয়ে, ব্যাটার মাথা ভর্তা করে দেব! প্রায় নির্দেশের সুরে অন্যদের বলল জুড।
সান লস মিসস কুই নস কোয়েমারন লা ক্যাসা, হঠাৎ নিচু স্বরে বলল রোজাওরা।
বয়স্ক ব্যাংকার, মাইকেল টেড্রো, বোধহয় কেবল সেই শুনছে। এরাই কি তোমাদের বাথান পুড়িয়ে দিয়েছিল? প্রতিধ্বনি করল সে।
ই ম্যাটারন আ মি ভেইজু, জানাল মহিলা।
এক হাতে হ্যাটটা তুলে ধরল টেড্রো। ওরা তোমার স্বামীকে খুন করেছে জেনে খুবই দুঃখিত আমি, ম্যাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে তারচেয়েও বেশি দুঃখ হচ্ছে নিজের জন্যে কারণ ওরা বোধহয় আমাকেও খুন করবে। কিভাবে যে এর মধ্যে চলে এলাম! শেষের কথাগুলো প্রায় স্বগতোক্তির সুরে বলল সে।
এত লোভনীয় একটা অংরি তুমি ছাড়ো কিভাবে! হালকা সুরে মন্তব্য করল শেভার্ন।
ঝট করে ওর দিকে ফিরল ব্যাংকার। তুমি কি সত্যিই… শুরু করেও মাঝপথে থেমে গেল সে, বোধহয় মনে মনে গুছিয়ে নিল কথাগুলো। শুনেছি কোয়ান্ট্রিল গেরিলাদের সাথে রাইড করেছ যুদ্ধের সময়, কথাটা কি সত্যি?
আচমকা থমকে গেল সবাই, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে শেভার্নকে, এ মুহূর্তে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে ও। জর্জিয়ায় শেরম্যানের সাথে ছিলে তুমি? পাল্টা জানতে চাইল শেভার্ন। জেসি জেমসের ওয়ান্টেড পোস্টারের চেহারার সঙ্গে তোমার পার্টনারের দারুণ মিল আছে, খেয়াল করেছ কখনও, মি. টেড্রো? আমাদের সোডা স্প্রিং-এর শেরিফ জেসন বেলহ্যামকে দেখতে জেনারেল। ওয়ার্জের মত লাগছে না, যার খ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতিই বেশি? যাকগে, ক্রীকের। ধারে অবস্থান নেওয়া ওই লোকগুলো আমাদের খুন করার জন্যে মুখিয়ে আছে, আমরা কে কোন রাজা বা সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ত তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র আপত্তি করবে না।
তুমি? জানতে চাইল জুলিয়া ব্রুকস।
মহামান্য জারের সিক্রেট এজেন্ট আমি, সানফ্রান্সিসকো জয় করতে বেরিয়েছি!
কায়ো নস এসিস্টা! ফের স্বগতোক্তি করল রোজাওরা।
কে? জানতে চাইল শেরিফ।
অবশ্যই সানফ্রান্সিসকো। এবং প্রার্থনা করছি সেইন্ট ফ্রান্সিস যেন পানি আর গোলাবারুদের সাপ্লাই নিয়ে পৌঁছে যান সময়মত।
বিতৃষ্ণায় বেঁকে গেল শেরিফের মুখ, শেভার্নের হেঁয়ালিতে বিরক্ত। দুটো বাকবোর্ড, শহর থেকে আনা ব্যারেল আর ক্রেট ফেলে রেখে নিরাপদ একটা আড়াল তৈরি করেছে ওরা। সেদিকেই এগোল জেসন বেলহ্যাম। নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে শেভার্নের মালপত্র থেকে গোল্ড প্যানটা তুলে নিল, তারপর ঘুরে ওর চোখে চোখ রাখল। বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি কোন মাইনার নও!।
গোল্ড প্যানের ব্যাপারে দুই ব্যাংকারকেই বেশী আগ্রহী মনে হচ্ছে। অন্যদের উদ্দেশে জিনিসটা তুলে ধরল শেরিফ। মরচে কোথায়? জানতে চাইল সে, অন্য হাতের আঙুল দিয়ে গোন্ড প্যানের ভেতরের চকচকে পৃষ্ঠে হাত বুলাল। হয় এটাকে তৈরি করার সময় ঠিকমত পোড়ানো হয়নি, নয়তো স্রেফ অন্যদের ভাতা দেয়ার জন্যে নিজের সঙ্গে এটা রাখে ও। এই প্যান দিয়ে সোনা বা আকরিক প্যান করেনি কেউ।
কেউ কি কখনও রিপোর্ট করেছে এই এলাকায় সোনা পাওয়া গেছে? জানতে চাইল শেভার্ন।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল দুই ব্যাংকার, তারপর দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল। তাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।
দামটা এইমাত্র ত্রিশ হাজারে উঠে গেল! স্মিত হেসে ঘোষণা করল ও।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল নাম না-জানা ব্যাংকার।
হয়তো, স্মিত হেসে স্বীকার করল শেভার্ন। কিন্তু একইসঙ্গে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি-কিছুটা ব্যথায়, কিছুটা তোমাদের ভান করতে দেখে। যাকগে, রাতটা নিশ্চয়ই দারুণ আগ্রহের ব্যাপার হবে। দয়া করে তোমাদের নোংরা দরকষাকষি একটু নিচু স্বরে কোরো। নিজের মালপত্রের কাছে এসে গ্রীন রীভারের বোতলটা খুঁজে বের করল ও, বোতল উপুড় করে তলানিটুকু গলায় ঢেলে দিল। আড়চোখে দেখল ফিসফিস করে দুই ব্যাংকারের সঙ্গে কি নিয়ে যেন পরামর্শ করছে শেরিফ। ভ্রূক্ষেপ করল না শেভার্ন, বেডরোলে শুয়ে চোখ বুজল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল ও। নিচ থেকে মাঝে মধ্যে কোন টার্গেট ছাড়াই গুলি করছে পেনি-ফার্দিংরা, হয়তো নিজেদের অনড অবস্থান জানান। দিচ্ছে। সেগুলোর শব্দে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম টুটে যাচ্ছে ওর।
বিকেলে যখন ঘুম ভাঙল ওর, মনে হলো নাকের সামনে কুচকাওয়াজ করছে একটা ক্যাভালরি। বিশ্রাম নিয়ে লাভ হয়নি তেমন, কোমরের ব্যথার পাশাপাশি মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে এখন।
তাঁবুর ছায়ায় অবস্থান নিয়েছে অন্যরা, অনেকক্ষণ হলো নীরব হয়ে গেছে। ক্লান্তির ছাপ পড়েছে চোখে-মুখে, হাই তুলছে দুই ব্যাংকার। আগের মতই নির্বিকার দেখাচ্ছে শেরিফকে। এক কোণে শুকনো মরিচ গুড়ো করছে ডোনা রোজাওরা।
পক্ষ বদল করার সুযোগ পাওনি এখনও? প্রসন্ন স্বরে জানতে চাইল শেভার্ন। আমি আরও ভেবেছি এতক্ষণে নিচে নেমে গেছ, সমানে আমাদের উদ্দেশে বুলেট ছুঁড়ছ। যাকগে, একটা প্রশ্ন করব, মি. জেসন? কিভাবে মি. ব্রুকসের সাথে পরিচয় হয়েছিল এদের, জানো তুমি? ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে সামান্য একজন আগন্তুকের চিঠির সূত্র ধরে অযথা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে বেচারারা। নাকি ওদের পেশায় এ ধরনের ভূয়া প্রস্তাবের হিড়িক লেগেই থাকে?
মি. শেভার্ন, গুরুতুহীন বিষয় নিয়ে কথা বলে মেজাজ খারাপ করার দরকারটা কি! আপত্তি এল লাল-চুলোর কাছ থেকে। ওরা যে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসেনি, তা নতুন করে বলে কি হবে!
তোমার সঙ্গে একমত আমি, মিসেস ব্রুকস, কিন্তু আমরা গ্ল্যাডিয়েটররা সবসময়ই বিরুদ্ধ শক্তির বিপক্ষে সোচ্চার; যখন বুঝতে পারি এই শক্তি অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, মুখ বুজে থাকা তখন সত্যিই কঠিন। মরিচুরি টে স্যালুটেমাস, শেরিফ!
আমরা সবাই জানি ইংরেজ নও তুমি, ক্রুদ্ধ স্বরে গর্জন করল শেরিফ। রুচি বদলের জন্যে হলেও আমেরিকানদের মত কথা বলছ না কেন?
উক্তিটা আসলে ল্যাটিন। আমরা যারা এখানে মরতে যাচ্ছি, অভিবাদন জানাচ্ছি তোমাকে, শেরিফ; সীজারের ভাড়াটে খুনীরা এভাবেই অভিবাদন জানাত তাকে! থেমে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল শেভার্ন, ভাবছে আরেক বোতল গ্রীন রীভার পেলে ভাল হত। বলো তো, এখানে এমন কেউ আছে নিজের জীবনের বদলে অংশীদারিত্ব ত্যাগ করতে রাজি নয়?
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল জুলিয়া ব্রুকস। তুমি কি সত্যিই ঠিক আছ, মি. শেভার্ন? কিসের অংশীদারিত্বের কথা বলছ?
তোমার স্বামী, মি. ব্রুকস যে সোনার খনি বিক্রি করতে চেয়েছিল, তার অংশীদারিত্ব, হালকা সুরে বলল ও। সান্তা ফে-র মত কসমোপলিটন শহর থেকে ছুটে এসেছে ওরা, বৈরী ইন্ডিয়ান আর হিংসুটে সাদাদের ভয় এড়িয়ে শত মাইল পাড়ি দিয়েছে স্রেফ বিশৃঙ্খল একটা বাথানে টাকা খাটাতে?
ত্রিশ হাজার বলেছি, না? ঘুরে টেম্রো আর তার সঙ্গীর দিকে তাকাল ও। ধনী হয়ে মরার সুযোগ পাচ্ছ, বন্ধুরা। যতই ইতস্তত করবে, দাম কিন্তু তত বেড়ে যাবে। বত্রিশ হাজার পাঁচশো ডলার এখন!
ওকে বরং সূর্যের আলো থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও, মাথা খারাপ হয়ে গেছে এর! শুকনো কিন্তু বিদ্রুপের সুরে পরামর্শ দিল টেড্রা।
পঁয়ত্রিশ হাজার, এবং দামটা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে, চালিয়াতির সুরে বলল শেভার্ন। মিষ্টি কথায় হয়তো মিসেস ব্রুস বা জুডকে ভুলাতে পারবে তোমরা, কিন্তু আমার ভাগের এক-তৃতীয়াংশ পঁয়ত্রিশ হাজারে কিনতে হবে। দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে!
তোমার ভাগ?
নিশ্চয়ই ভাবছ না এত টেস্ট হোল আর অ্যাসে ওঅর্কের পরও তুচ্ছ একটা বাথানে পড়ে থাকব আমি!
তাহলে এজন্যেই কবরে কোন লাশ ছিল না! নিঃশ্বাস আটকে গেল জুডাস ম্যাকলেন্ডনের, বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ দুটো। আসলে গর্তটা ছিল টেস্ট হোল, সোনা আছে কি-না পরীক্ষা করেছে ওরা!
ঠিক। ভেড়ার বাথান বিক্রি করছিল না মি. ব্রুকস, বরং একটা সোনার খনি অফার করেছিল। খনিটার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ আছে কারও? পেনি-ফার্দিং বা ওস্টেনভেল্ড, যাই বলো না কেন-ওরা এতটাই আগ্রহী যে ঠিকমত নিজেদের গুটিকয়েক গুরুর যত্নও নেয় না।
ঘুরে জুড আর মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরল শেভার্ন। খনির সম্ভাবনা বা ঝুঁকি সম্পর্কে হয়তো সারা বিকেলই তোমাদের বলবে ওরা, এও বলবে সামান্য। একটা খনির পেছনে নিজেদের সব টাকা ঢেলে বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছে। কোন কাগজে স্বাক্ষর করার আগে মনে রেখো আমার অংশের দাম এইমাত্র সাইত্রিশ হাজার পাঁচশো-তে উঠে গেছে। এবার দয়া করে হৈচৈ আর ঝগড়া বন্ধ করো। ক্লান্তি লাগছে আমার, তারপরও মনে হচ্ছে সহ্মের পরপরই আমাকে দরকার হবে। তোমাদের। কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল ও, আনমনে ভাবছে ভীমরুলের চাকে খোঁচাটা ঠিকই দিয়ে ফেলেছে, অগ্রাহ্য করার জন্যে যথেষ্ট করেছে ইতোমধ্যে। বাড়তি কিছুই আর করার নেই, ছিলও না।
ঝগড়া, তর্ক সমানে চলতে থাকল। পরস্পরের ওপর প্রায়ই খেপে উঠছে দুই ব্যাংকার আর শেরিফ, চিৎকার করে দোষারোপ করছে অন্যকে।
কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে, একসময় রণে ভঙ্গ দিল ওরা। নীরব হয়ে গেছে মাইকেল টেস্রো। উপত্যকায় সোনার খনির অস্তিত্বের ব্যাপারে তাকে পূর্বাভাস দেয়নি কেউ, মিসেস ব্রুকসকে এই নিশ্চয়তা দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে অন্য ব্যাংকার। মেসার এক কোণে পায়চারি করছে শেরিফ জেসন বেলহ্যাম, ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে দেখছে অন্যদের। মাঝে মধ্যে ঘুমন্ত জিম শেভার্নের দিকে চলে যাচ্ছে তার সতর্ক দৃষ্টি। শেভার্ন তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, স্যাভিলানো দিয়ে মুখ ঢাকা।
উপত্যকায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে পেনি-ফার্দিং রাইডাররা। তাড়াহুড়ো করছে না ওরা। প্রতি দশ-পনেরো মিনিট পরপর মেসার। দিকে একটা বুলেট পাঠিয়ে দিচ্ছে। পানির একটা ক্যান্টিন ফুটো হয়ে যেতে খেপে গেল রোজাওরা, জুড সহ সমানে গুলি করতে শুরু করল। বেচাল দেখে আড়ালে চলে গেল ডাবল-ও রাইডাররা।
প্রতিপক্ষের বেশিরভাগ গুলিই মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন বোধ করছে শেভার্ন, মনে পড়ল পাহাড়ের ওপর থেকে নিচুতে কিংবা নিচ থেকে পাহাড়ের ওপরে নিশানা করা কতটা কঠিন কাজ। নির্চে ঢালের শুরুতে জায়গাটা ঘেরাও করে ফেলছে রাইডাররা, মাত্র একটা রাইফেলের অস্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে এখন। আচমকা লোকগুলোর উদ্দেশ্য আঁচ করতে পারল ও। সরাসরি আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে ওরা, আশা করছে নিচে পড়ার সময় টার্গেটে গিয়ে লাগবে। সবাই হ্যাট চাপাও মাথায়, পরামর্শ দিল শেভার্ন। পড়ন্ত বুলেট এসে লাগতে পারে মাথায়, বেশি কিছু না করলেও অন্তত মাথা ব্যথা যে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমিই বরং ওদের মাথা ব্যথার কারণ হতে যাচ্ছি, বিড়বিড় করে বলল জুড। হাঁটু গেড়ে বসেছে সে, বাকবোর্ডের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে প্রিংফিল্ডের দীর্ঘ নল বের করে নিশানা করছে। অনেকক্ষণ পর শেষে ট্রিগার টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই নিচে একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল।
মনে হচ্ছে জায়গামত লাগিয়েছ, বাছা, সোৎসাহে বলল শেরিফ। অন্য দশজনকে যদি এরকম মাথা ব্যথা উপহার দিতে পারো, তাহলে নিশ্চিন্তে তোমার লাইম-জুস বন্ধুকে গ্রেফতার করে শহরে ফিরে যেতে পারি আমি!
.
১২.
একটা পানির ব্যাগ খুঁজে পানি পান করল শেভার্ন। কঠিন সমস্যায় পড়েছ মনে হচ্ছে, শেরিফ? বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো, তাই না?
কিভাবে?
আমার পিস্তলের দক্ষতা দরকার তোমার। অথচ আমাকে বাধ্য করতে পারছ, ব্যাংকার বন্ধুদের নিয়েও সুবিধে করতে পারছ না। আমাকে যদি খুন করো-এখান থেকে জীবিত বেরোতে পারলেও শহরে ফিরে গিয়ে আবিষ্কার করবে ভুল লোককে খুন করেছ। ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্ট যদি জানতে পারে ইউনিয়নের সাবেক সদস্য নিরপরাধ একজন ব্রিটিশ নাগরিককে খুন করেছ, নিস্তার থাকবে না তোমার।
তুমি তো লাইমি নও!
কিংবা তুমিও যথাযথ কর্তৃপক্ষ নও। তোমার ব্যাংকার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করো কিভাবে মি. ব্রুকসের সাথে পরিচয় হয়েছে ওদের।
মনে হয় না তার দরকার আছে।
আমি তোমার জায়গায় থাকলে সমস্যার পুরোটা জানতে চাইতাম, অন্তত জুরিদের প্রভাবিত করার মত উপযুক্ত তথ্য জোগাড় করতাম যে স্রেফ সামান্য লাভের আশায় এত দূর ছুটে আসেনি ওরা। খবরটা প্রকাশ পেলে চারপাশ থেকে স্ট্যাম্পিড় হওয়া গরুর মত ছুটে আসবে শকুনের দল।
নিঃশ্বাস আটকে থাকল মিসেস ঐকস।
হ্যাঁ, খেই ধরল শেভার্ন। ভেবো না আদৌ এরকম কিছু ঘটবে না। ভাবতেই অবাক লাগছে কিভাবে এত দিন ধৈর্য ধরে ছিল লোভী লোকগুলো।
কিন্তু আমার বাবা
স্রেফ একজন সাদাসিধে বাগান মালিক ছিল। নিজের শান্তিপূর্ণ কিন্তু কিছুটা। হলেও সমৃদ্ধ জীবন নিয়েও সন্তুষ্ট ছিল। চায়নি সোনা-লোভী কিছু বেপরোয়া মানুষ এসে রক্তযুদ্ধ শুরু করে দিক ওর জমিতে। তাছাড়া নুয়েভা হেলভেসিয়ার মত দুর্ভাগা আবিষ্কর্তা হওয়ার ইচ্ছে ছিল না ওর। নিশ্চিত বলতে পারি অন্যের লোভের খেসারত দিতে গিয়ে নিজের এস্টেট বা বাথান ধ্বংস করতে চায়নি সে।
তাতে তোমার কি? মুখিয়ে উঠল টেড্রোর সঙ্গী। কোয়ান্ট্রিলের সাথে রাইড করার জন্যে ফেরারী তুমি।
তোমার সাক্ষ্যে?
আমার মত আরও অনেকেই সাক্ষ্য দেবে।
ওরাও কি তোমার মতই দ্র কাপড় পরা ভণ্ড? আমার তো ধারণা আমাদের পেঁয়ো শেরিফও জানে অভিযুক্ত কোন লোকের সাক্ষ্যের কতটা গুরুত্ব থাকে।
প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গীর দিকে তাকাল টেড্রো।
কোন একদিন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেব আমি! সরোষে প্রতিজ্ঞা করল। সে। আর আমি ভণ্ড বা অভিযুক্তও নই।
এখনও হওনি, কিন্তু জালিয়াতির অভিযোগ যখন আনা হবে, তখন কি হবে তোমার অবস্থা?
কি ব্যাপারে তর্ক করছ তোমরা, মি. শেভার্ন? মিসেস ব্রুকসের অধীর প্রশ্ন। তারপর আচমকা শেরিফের দিকে ঘুরে দাড়াল, চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেছে। জেসন বেলহ্যাম, আসলে তুমি একটা অকম্মার ধাড়ি। আমার সাক্ষ্যেও কি সন্তুষ্ট হওনি? আর কি চাও তুমি? মি. শেভার্নের ব্যাপারে এক বিন্দুও মিথ্যে বলিনি আমি, শপথ করে বলতে পারব।
পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শেরিফ, চোখের গভীরে সন্দেহ নাকি অবিশ্বাস খেলা করছে বোঝা গেল না।
হতাশায় ঝুলে পড়ল জুলিয়া ব্রুকসের কাঁধ।
অবিশ্বাসী মানুষকে বিশ্বাস করানো দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা, স্মিত হেসে বলল শেভার্ন। ও বিশ্বাস করতে না চাইলে তুমি করাবে কিভাবে? যাকগে, শোনো কি নিয়ে ব্যাংকার বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করছিলাম। টালবাহানা করে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে তোমার জমি কিনতে চেয়েছিল ওরা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ কিভাবে শুধু তোমার খাতিরেই উপযুক্ত শব্দটা উচ্চারণ করছি না…সান্তা যে এখান থেকে তিন দিনের পথ, তাই না? অন্তত পাঁচ দিন আগে রওনা না দিলে এত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারত না ওরা। অথচ তোমার বাবা মারা গেছে এই সেদিন! তার মানে তোমার বা ব্রুকসের হাতে বাথানের মালিকানা বর্ভাবে, এটা আগে থেকেই জানা ছিল ওদের। সমস্যা হয়েছে শুধু এক জায়গায়-বাগানের মালিকানার ব্যাপারে ব্রুকস ওদের নিশ্চিত করলেও নিজে যে আচমকা মারা যাবে তা বলে দিতে পারেনি, নইলে হয়তো বিকল্প একটা ব্যবস্থাও করে যেত!
দয়া করে, বাধা দিল টেট্রো, আমার অবস্থানটা ব্যাখ্যা করতে দাও। ব্যাংকের চাকুরি করি, স্বভাবতই মুনাফাদাতাদের স্বার্থ দেখতে হয় আমাকে। এখানে আসলে কি ঘটছে তা যদি জানতাম, আগেই ব্যাংক-কে এই চুক্তি থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতাম।
তাহলে এখানে কি করছ তুমি?
নোংরা টাকার পেছনে সাদা টাকা ঢালছি, আমার ধারণা, ঘুরে সঙ্গীর দিকে তাকাল মাইকেল টেট্রো। স্ট্যানলি, হয়তো তুমিই বলতে পারবে আসলে এখানে। কি করছি আমি।
ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছ কেন? সোজাসাপ্টা, নিস্পৃহ স্বরে বলল স্ট্যালি। চুক্তি অনুমোদনের আগেই জানা সবকিছু বলেছি তোমাকে, তাই না? ঘুরে শেভার্নের দিকে তাকাল সে, চোখ সরু হয়ে এসেছে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। তোমার কারণেই ফিরে এসেছি আমি।
দাঁত বের করে হাসল শেভার্ন। নিরাপদ দূরত্বে থাকার মত বুদ্ধি যদি তোমার থাকতই, তাহলে আমাকে দরকার হত না তোমার।
নিকুচি করি তোমার পিস্তলের দক্ষতার! কর্কশ স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করল স্ট্যানলি, মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরতে লালচে হয়ে গেল মুখটা। দুঃখিত, ম্যাম। মি. ব্রুকসের কারণেই এত কিছু ঘটেছে।
বিহ্বল দৃষ্টিতে ব্যাংকারকে দেখছে জুলিয়া ব্রুকস। ব্যাংকার হিসেবে নিশ্চয়ই প্রতিদিন আকর্ষণীয় সব প্রস্তাব পাও তুমি। কিন্তু মি. ব্রুকসের চিঠিতে এমন কি ছিল যে এত দূর ছুটে এসেছ?
ওকে বরং আমার বন্ধু বলতে পারো।
মানে?
দুহাত ছড়িয়ে অসহায় ভঙ্গি করল স্ট্যানলি। কিন্তু তাতে কি যায়-আসে এখন? শেষপর্যন্ত আমাদের সবাইকে খুন করতে যাচ্ছে ওরা।
পার্থক্যটা এখানেই যে আমি তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে যাচ্ছি নাকি তুমিই আমাকে ঝোলাবে, বলল শেভার্ন। অবশ্য তার আগে শকুনের ওই দলটাকে খেদিয়ে দিতে হবে। এবার মি. ব্রুকস সম্পর্কে আমাদের বলো তো!
হ্যাঁ, সাগ্রহে বলল টেড্রো। গল্পটা শুনতে আমারও ভাল লাগবে। মিসেস ব্রুকসের দিকে তাকিয়ে আছে স্ট্যানলি, একটা হাত তুলল সে।
আমার স্বামী একজন ভণ্ড বা প্রতারক ছিল বলতে বোধহয় বাধছে তোমার? জানতে চাইল লাল-চুললো। আমার তো ধারণা আমাদের দ্বিধান্বিত শেরিফও এ ব্যাপারে একমত হবে।
শ্রাগ করে বাকবোর্ডের দেয়ালের সাথে হেলান দিল স্ট্যানলি। কোত্থেকে একটা বুলেট এসে বিধল কাঠে, আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার অবস্থা হলো তরুণ ব্যাংকারের। তৎক্ষণাৎ বসে পড়ল সে, পারলে কেঁচোর মত কুঁকড়ে যায়। ব্রুকস আর আমি একসঙ্গে চাকুরি করতাম, বলতে শুরু করল সে। বাষট্টি থেকে চৌষট্টির শেষদিকে আলাদা হয়ে যাই আমরা। চাকুরিতে একেবারেই নতুন ছিলাম আমি। স্বার্থের কারণে আমাকে ব্যবহার করত ও, কিন্তু সেটা যখন টের পেলাম
ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবং বন্ধুত্বটাও গভীর হয়ে গেছে, অন্তত আমার দিক থেকে।
চাপা স্বরে হেসে উঠল জুলিয়া ব্রুকস।
এরচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষ আর দেখিনি, ওর সঙ্গ সত্যিই উপভোগ্য ছিল, বলে চলেছে স্ট্যানলি। ছোটখাট অন্যায় কোন ব্যাপারই ছিল না ওর কাছে। পোকারে তো দারুণ চলত ওর হাত। তবে একটা বড়সড় দাও-এর অপেক্ষায় ছিলাম আমরা-এমন উপায় খুঁজছিলাম যাতে দুজনেই ধনী হয়ে যাব। প্রয়োজনীয় মুনাফা নিয়ে আসার কথা ছিল আমার…।
আমাদের সঙ্গে স্বাগতম! বিদ্রূপ করল শেভার্ন।
অন্যকে সহজেই প্রভাবিত করতে পারত ও, স্বীকার করল মিসেস ব্রুকস। নিজে কত টাকা খাটিয়েছ তুমি, মি. স্ট্যানলি?
পনেরোশো ডলার।
শিস দিয়ে উঠল অন্যরা।
অরিগনে একটা বাড়ি ছিল আমাদের, সেটা বেচে দিয়ে টাকা জোগাড় করেছি আমি। ব্যাখ্যা করল ব্যাংকার। প্রায় সফল হতে যাচ্ছিলাম আমরা। আরও কিছু টাকা থাকলে অনায়াসে করা যেত কাজটা।
এত সহজে চিহ্ন মুছে দেওয়া যায় না, বিড়বিড় করল শেভার্ন।
কি বললে?
একজন শোষক, ব্যাখ্যা করল শেভার্ন। ঘুণাক্ষরেও আশা করে না তারও পতন হতে পারে। আত্মবিশ্বাসী একজন প্রতারক এমন ভাবে ঘটনাটা ঘটায় যাতে স্রেফ দুর্ভাগ্য মনে হতে পারে, দুর্ভাগা লোকটির টাকা নিয়ে চলে যায় সে। কিন্তু একজন শোষক বিদায় জানায়, একবারও ভাবে না প্রতিশোধ নিতে পারে কেউ।
তাহলে এত বছর পর তোমাকে দারুণ একটা প্রস্তাব দিয়েছে মি. ব্রুকস, অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চেয়েছে। বিনিময়ে কিছু টাকা খাটাতে হত তোমাকে। যদি ভুল বলি, শুধরে দিয়ে আমাকে।
সফল হতে পারতাম আমরা, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল স্ট্যানলি, বিষ দৃষ্টিতে দেখছে শেভার্নকে। এখনও কাজ হতে পারে। এই জায়গার যথেষ্ট মূল্য আছে। আরেকটা যুদ্ধ চালানোর জন্যে যথেষ্ট সোনা আছে এখানে।
মনে হচ্ছে এরই মধ্যে একটা শুরু হয়ে গেছে, নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল শেরিফ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঙ্গীর দিকে তাকাল টেড্রো। কোন্ সাহসে ব্যাংক-কে ডোবাতে যাচ্ছ…
তোমাদের মধ্যে কেউ কি আসলেই মাটি খুঁড়ে সোনা বের করেছ কখনও? জানতে চাইল শেরিফ।
বয়স্ক ল-ম্যানের দিকে তাকাল শেভার্ন, ঠোঁটে মৃদু হাসি। আইডিয়াটা বাতলে দিয়েছ বলে এক পেনি পাওনা হয়েছে তোমার, উপায়টা বাতলে দিলে বেস মেটালের পুরো রেশনই পেয়ে যাবে।
পলকের জন্যে শেভার্নের জোড়া কোল্টের ওপর ঘুরে গেল শেরিফের দৃষ্টি কি বুঝল বা চিন্তা করল কেবল সেই জানে। একটা ভুরু খানিক তুলল সে। তোমার সাথে লেন-দেন চুকানোর জন্যে প্রচুর সময় পড়ে আছে! শেষে সরোষে বলল।
উদ্ভট প্রলাপ বকছ তোমরা? বিরক্তি মিসেস ব্রুকসের অরে। মারা যাওয়ার আগে প্রায় কয়েক মাস বাথানে আসেনি আমার স্বামী, সুতরাং জমিতে খোড়াখুঁড়ি করার সুযোগ পায়নি সে।
করেনি সে, ব্যাখ্যা করল শেভার্ন। কিন্তু তোমার বাবার কানে তথ্যটা ঠিকই পাচার করেছে কেউ। একটা গর্ত খুঁড়েছিল নীল ম্যাকলেন্ডন, তারপর সেটা ভরাটও করে ফেলে, যা জানার ছিল জেনে যায় সে-এও চায়নি অন্যরা জেনে যাক সত্যটা।
ওহ ডিয়ার! নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষায় আছে মিসেস ব্রুক।
এটাই সত্যি! উত্তেজিত হয়ে উঠেছে জুড। এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে টাকা দরকার ছিল ওর! আমাকে প্রায়ই বলত পুবের বড় কোন শহরে চলে যাবে। নতুন ভাবে শুরু করবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যোগ করল শেভার্ন। সোনা পাওয়ার খবরটা ঠিকই চলে যায় ওস্টেনভেল্টদের কানে; কিভাবে, শুধু খোদাই জানে। চারপাশে বহু টেস্ট হোল খুঁড়ল ওরা, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারল না। কিছু গর্তে বারুদ আর গান-পাউডার রেখে ফাঁদ পাতল, নেহায়েত দুর্ভাগ্যবশত তারই একটার সলতেয় আগুন দিয়ে ফেললাম আমি-ব্যস, বুম!
দুহাত মাথার ওপর তুলে আস্ফালন করল টেড্রো, বিতৃষ্ণায় তিক্ত দেখাচ্ছে মুখটা। তাহলে সবাই জানে এমন একটা খবর গোপন আছে ভেবেই সান্তা ফে থেকে অযথা ছুটে এসেছি আমি? আসলেই কি সোনা আছে এখানে?
শ্রাগ করল শেভার্ন। কেউই আসলে নিশ্চিত নয়। বিচ্ছিন্ন ভাবে টেস্ট হোল খুড়েছে ওরা। কেউ কারও গর্ত পরখ করে দেখার সুযোগ পায়নি, অন্যরা দেখে ফেলার আগেই ভরাট করে ফেলেছে…।
মিসেস ব্রুকস আর জুডের দিকে ফিরল টেম্রো, রোজাওরার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভাই-বোন। তোমাদের কেউ জানো?
কোয়েই ডাইস? জানতে চাইল বয়স্কা মেক্সিকান।
কায়ে সি স্যাবিয়ামোস কোয়ে হে অরো পর আকা।
লোকোস, ঘুরে বাকবোর্ডের দিকে এগোনোর সময় বিড়বিড় করল রোজাওরা।
সবাই বঞ্চিত হয়েছি আমরা, প্রতারণার শিকার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল টেড্রো। যাই হোক, মিসেস ব্রুকস, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই আমার ব্যাংকের। ধরে নিচ্ছি, আমাদের সবাই না হলেও অন্তত একজন বেঁচে থাকবে, ব্যাংকের পুরানো অফারটা তখনও বহাল থাকবে-বিশ হাজার ডলার। আমার ধারণা অন্য কারও কাছে এরচেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ দাম হাঁকাতে পারবে তুমি। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আসল দামেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য আমি, এবং দাম বাড়ানোর কোন ইচ্ছেও নেই আমার।
কি অদ্ভুত! বিড়বিড় করল শেভার্ন।
কি বলছ?
একজন সৎ ব্যাংকার। এতটাই সৎ যে মক্কেলকে ঠকিয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে দারুণ সিদ্ধহস্ত।
সদ্য তৈরি ইটের মত টকটকে লাল হয়ে গেল টেড্রার মুখ। বিধবা বা এতিমদের না ঠকিয়েই দিব্যি চলে যাচ্ছে আমার, তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল সে। ব্যাংকের প্রস্তাবটা দিয়েছি আমি, তোমার পছন্দ হলে গ্রহণ করবে নয়তো করবে না। কাউকে তো জোর করছি না!
ষাট হাজার দেব! আচমকা প্রস্তাব করল টেড্রোর পার্টনার।
আমার আর জুডের শেয়ারের জন্যে? জানতে চাইল লাল-চুলো। নাকি মি. শেভার্নকেও ধরেছ?
বাজেয়াপ্ত করে ওর সম্পত্তি পেয়ে যাব আমি, নিশ্চিন্ত করল স্ট্যানলি।
স্রেফ ধারণা করছ তুমি, শীতল স্বরে বলল শেভার্ন। ভাবছ আমাকে খুন করে পার পেয়ে যাবে, আমার পরিবার বা স্বজনরা প্রতিশোধ নেবে না? ওরা যদি নিজের দায়িত্ব পালন করতে নাও পারে, আইন বাধা দেবে তোমাকে। কৃত অপরাধের ফলশ্রুতিতে একজন খুনী লাভবান হবে, এই নিয়ম পৃথিবীর কোন দেশের আইনেই নেই। তাছাড়া, মি. ম্যাকলেন্ডনের উইলটা যদি ঠিকমত পড়ে থাকি, আমার সম্মতি ছাড়া নিজের অংশ বিক্রি করতে পারবে না অন্য উত্তরাধিকাররা। তাহলে, মি. স্ট্যানলি, এবার বলো তো আমার কোন্ বুটটা আগে কামড়াবে?
তোমার মাথার জন্যে এক হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, বিড়বিড় করল স্ট্যানলি।
উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছ, না? আমাকে ধরিয়ে দিয়ে এক হাজার ডলার কামাতে পারো, কিন্তু এরচেয়ে শতগুণ টাকা বানানোর সম্ভাবনা তাহলে বাদ দিতে হবে। আচমকা ভিন্ন একটা ব্যাপার মনে পড়ল শেভার্নের। যাকগে, শেরিফ, মনে আছে গত সপ্তাহে দুজন লোককে নিয়ে এসেছিলাম আমি? ওদের নামে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে বোধহয়, তোমার কাছ থেকে অফিশিয়াল কোন মন্তব্য এখনও পাইনি।
তিক্ততার জন্যে একটা পিত্তথলী এমনিতেই পেয়ে গেছ তুমি! সরোষে গর্জন করল শেরিফ।
সঙ্গে দুটো কোল্ট পেয়েছি, আর নিজের গুরুতুও জেনেছি। যতক্ষণ না কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছি আমরা, বন্ধুদের নিয়ে বিপক্ষে যোগ দিতে পারো তুমি। অন্যরা যাতে ওর উদ্দেশ্য আঁচ করতে না পারে, সেজন্যে নিচের উপত্যকার দিকে একটা গুলি পাঠিয়ে দিল শেভার্ন।
চাইলেও রফা করার উপায় নেই আমার, ফের গর্জে উঠল শেরিফ।
না, আনমনা স্বরে বলল শেভার্ন। মনে হয় না তেমন কিছু পারবে। কিন্তু সুস্পষ্ট অভিযোগ বা প্রমাণ ছাড়া নিরপরাধ কোন লোকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেও সময় নষ্ট করতে পারো না তুমি।
মনে হয় করব, স্বীকার করল শেরিফ।
বহু দিন আগে দেখেছি লোকটাকে, দ্বিধান্বিত স্বরে বলল স্ট্যানলি। এতদিন পর সত্যিই বলা কঠিন লোকটির চেহারা আসলে কেমন ছিল।
স্মিত হাসল শেভার্ন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তরুণ ব্যাংকারকে দেখছে শেরিফ আর ম্যাকলেন্ডনরা, নিন্দা ঝরে পড়ছে চাহনিতে। আর উইলিয়াম টেড্রোযেন পার্টনারের শরীরে গুটি বসন্তের লক্ষণগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা প্রকাশ পাচ্ছে চাহনিতে।
আরে, এত গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছ কেন ব্যাপারটাকে! সান্ত্বনা দিল শেভার্ন।
তোমরা নিশ্চয়ই পার্টনার হিসেবে নিচ্ছ না ওকে? নিরাবেগ কণ্ঠে জানতে চাইল টেট্রো। যে ব্যাংকার মানুষের চরিত্র বিচার করতে পারে না, ব্যবসা করার কোন যোগ্যতা নেই তার!
হতাশ ব্যাংকারের উদ্দেশে মৃদু হাসি উপহার দিল শেভার্ন। বরং আমি মনে করি ব্যবসার জন্যেই জন্ম হয়েছে তোমার। যদি পারো তো পরিত্যাগ করো শিয়ালটাকে, জুড আর মিসেস ব্রুকসকে ওদের অংশ তোমার হাতে তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেব।
কথা শুনে মনে হচ্ছে কালকের দিনটাও বেঁচে থাকব আমরা! বিদ্রূপ ঝরে পড়ল শেরিফের কণ্ঠে।
শিয়ালটা মোটেই ক্ষান্ত হয়নি। জুড আর জুলিয়া ব্রুকসের দিকে ফিরল সে। প্রত্যেকের জন্যে ত্রিশ হাজার ডলার, চালিয়াতির স্বরে ঘোষণা করল স্ট্যানলি।
এখনই দেবে টাকাটা, নগদ? জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস। অত টাকা সঙ্গে আছে তোমার?
আছে, তবে একটু ভিন্ন উপায়ে দেনা শোধ করবে ও, জানাল টেট্রো। ওর টাকার বেশির ভাগই ব্যাংকের শেয়ারের বিপরীতে খাটানো।
শুনতে অদ্ভুত লাগছে না?
শ্রাগ করল বয়স্ক ব্যাংকার। নিঃসন্দেহে বলা যায় এখানে বিনিয়োগ করার মতই অনর্থক হয়রানি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। আসলে ব্যাংকের অবস্থা কিন্তু ততটা খারাপ নয়। ওর মত সুবিধাবাদী লোক বেরিয়ে গেলে বরং খুশি হব আমি, বদলে যদি তোমাদের দুজনকে পার্টনার হিসেবে পাই তাহলে কৃতার্থ হব, ঘুরে হ্যাটের কিনারা স্পর্শ করল সে। মি. শেভার্নও এলে খুশি হব।
আমার জন্যে মি. স্ট্যানলির ভিন্ন একটা প্রস্তাব আছে বোধহয়, স্মিত হেসে বলল শেভার্ন।
কি সেটা?
মি. স্ট্যানলি হয়তো ভাবছে শেরিফকে বলবে ভুল করেছে সে। এর আগে আমাকে দেখেনি ও, কিংবা আমার কথাও শোনেনি-বিনিময়ে নিশ্চয়ই আমার এক-তৃতীয়াংশ শেয়ার চাইবে!
স্ট্যানলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, বোঝাই যাচ্ছে নেহায়েত বিদ্রুপের সুরে বললেও অজান্তে তাকে একটা উপায় বাতলে দিয়েছে শেভার্ন।
এ তো স্রেফ জঘন্য ব্যবসা! মুখিয়ে উঠল জুলিয়া ব্রুকস, ঘুরে শেরিফের দিকে ফিরল। মি. শেভার্নের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছি আমি, অথচ ও আমার লোক এই উসিলায় সেটাকে গুরুত্ব দাওনি। কিন্তু ফিটফাট কাপড় পরা একজন প্রতারকের কথা ঠিকই বিশ্বাস করেছ। মি. স্ট্যানলির কথা যদি সত্যিও হয়, মি. শেভার্নকে কিনে নিচ্ছে সে-অর্থাৎ তোমার আইনকে কিনে নিচ্ছে, আর তুমি কি দাড়িয়ে থেকে মজা দেখছ!
আইনকে সবকিছুর উর্ধ্বে রাখার শপথ নিয়েছি আমি। শোনো, জুলিয়া, যদি কখনও দেখো আইনের বরখেলাপ হচ্ছে, জানিয়ে আমাকে। কিন্তু তুমি নিজেই যেহেতু জড়িত, হা-পিত্যেশ না করে বরং বলো কিভাবে নিচের লোকগুলোকে হটিয়ে দিয়ে শহরে ফিরে যেতে পারব আমরা, কোর্ট হাউসে যেতে না পারলে বিচার হবে কি করে?
ভাবছি ওরা জানে কি-না এখানে ঠিক কজন আছি আমরা, অন্যমনস্ক স্বরে বলল শেভার্ন।
কিন্তু এই লোকটা নিজেকেই মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণ করছে! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করল মিসেস ব্রুকস, বিতৃষ্ণার সঙ্গে দেখছে স্ট্যানলিকে।
তোমার পিস্তলেরো বন্ধুও তাই করছে, শেরিফের কথা শেষ হওয়া মাত্র প্রিংফিল্ডের ভারী গর্জনে চমকে উঠল সবাই। ফলাফল জানার আশায় নীরবে অপেক্ষা করল ওরা। চটজলদি ৫০-ক্যালিবার রাইফেল রিলোড করল জুড। পাহাড়ের তলায় লোকজনের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, কোন একটা ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠেছে লোকগুলো।
চালিয়ে যাও, বাছা, উৎসাহ দিল শেরিফ। হারামজাদারা তাহলে আড়াল ছেড়ে বেরোতে পারবে না!
আর কজন বাকি আছে ওদের? জানতে চাইল টেড্রো।
সন অকো, বলল রোজাওরা।
আমাদের পাঁচজনের বিরুদ্ধে আটজন, অন্যমনস্ক স্বরে বলল ব্যাংকার। চ্যান্সেলর্সভিলেও এরচেয়ে ভাল ছিলাম আমি!
ওহ্ গড! দেখো, আরও লোক আসছে ওদের! সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠ জুড।
বাকবোর্ডের কাছাকাছি যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের হতাশা সংক্রমিত হলো অন্যদের মধ্যে। পেনি-ফার্দিং বাথানের দিক থেকে আরেকটা দল আসছে। সশস্ত্র প্রত্যেকে। মিসেস ব্রুকসের তথ্যটা মনে পড়ল শেভার্নের, মহিলা বলেছিল পেনি-ফার্দিং ছাড়াও ছোট ছোট কয়েকটা বাথান আর হোমস্টেড আছে নিচের উপত্যকায়। সবাই একাট্টা হয়েছে এবার। অন্তত বিশজন হবে, ধারণা করল ও। স্যাডল হর্নে রাইফেল বা কোমরের হোলস্টারে অস্ত্র ছাড়াও বড়সড় স্যাডল ব্যাগের সাইজ দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রয়োজনে থাকার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
মরার আর জায়গা পেলাম না, এমন জঘন্য সব লোকের সঙ্গে মরতে হচ্ছে! বিতৃষ্ণা আর ক্ষোভের সঙ্গে গর্জে উঠল শেরিফ।
ল-ম্যানের দিকে ঘুরে তাকাল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। একই অনুভূতি আমাদেরও-আমার আর জুলিয়ার! অনেকক্ষণ তো বসে ছিলে, এবার কাজ দেখাও। নিজের পেট ছাড়িয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছ? তাহলে ওরা মেসার ওপর উঠে আসার আগেই দেখো কয়েকটাকে শুইয়ে দিতে পারো কি-না।
হেসে উঠল শেভার্ন। দেখো, কোথায় মাটি খুড়ছে ওরা।
হারামজাদারা! চিৎকার করে উঠল স্ট্যানলি, মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে তার। ওরা এটা করতে পারে না! এই খনি আমার!
তোমার জমি খুঁড়ছে না ওরা, শুধরে দিল ও। ভুলে গেছ এটা এখনও ম্যাকলেন্ডনদের সম্পত্তি?
সহজ জিনিসটাও বুঝতে পারছ না? বিরক্তির চেয়ে বিদ্বেষই ছাপিয়ে উঠল তরুণ ব্যাংকারের কণ্ঠে। একবার যদি প্যানিং শুরু করে, শেষে কি হবে আমার-আমাদের অবস্থা?
কেন, চুপচাপ বসে থাকব! হেঁয়ালি ভরা কণ্ঠে জবার দিল শেভার্ন, ঘুরে শেরিফের দিকে ফিরল। মনে হয় না ম্যাকলেন্ডনদের জমি ছাড়া অন্য কোথাও খোড়াখুড়ি করেছে ওরা, কিছু দেখেছ বা শুনেছ তুমি?
গত বিশ বছরে এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি।
সবই ছেঁকে নিয়ে যাবে ওরা, আমাদের জন্যে কিছু রাখবে না! বিড়বিড় করে হাহাকার করল স্ট্যানলি।
কাজটা করতে সময় লাগবে। সোনার গুড়োতে থলে ভরে গেলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে ওরা, কিন্তু যাবে কিভাবে? খরচ করবে কোথায়? প্রথমে যাবে সোডা স্প্রিং-এ, কারণ সবচেয়ে কাছের এবং একমাত্র শহর ওটাই। সোনার গুড়ো দিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনবে ওরা, এমন সোনা বাজেয়াপ্ত করার অধিকার থাকবে শেরিফের। তাই না, মি. জেসন বেলহ্যাম?
মনে হয় পারব।
তাই করতে যাচ্ছ তুমি, মুখিয়ে উঠল জুড়।
সোনা-জ্বরে আক্রান্ত স্ট্যানলির চোখে নতুন করে আশার সঞ্চার হলো। প্রত্যেককে ত্রিশ হাজার ডলার দেব, প্রতিশ্রুতি দিল সে। জুড বা তার বোনকে। উৎসাহ প্রকাশ করতে না দেখেও ক্ষান্ত হলো না, খেই ধরল প্রসন্ন স্বরে, নগদ এই আছে আমার। টেড্রোকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারো। কিন্তু তারপরও দশ হাজার করে দেব তোমাদের, তবে নগদ দিতে পারব না। আজ থেকে এক বছরের মধ্যে ওই টাকা পরিশোধ করব, এমন অঙ্গীকার পত্র লিখে দেব।
পুরো বাথানের জন্যে? জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
শুধু খনির অধিকার দরকার ওর, পরামর্শ দিল শেভার্ন। সোনার খোঁজে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হলে চলে যাবে উৎসাহী মাইনাররা, তুমিও নিশ্চিন্তে বাথানের কাজ। করতে পারবে।
ইচ্ছে হলে অবশ্য পাটনারশিপেও যেতে পারো, বলল টেড্রো।
শেভার্নের দিকে তাকাল জুলিয়া ব্রুকস। আর তুমি?
আমার আবার কি?
আমরা যদি ওর সঙ্গে চুক্তিতে সই করি, তোমার কি হবে? তুমিও তো এক তৃতীয়াংশের মালিক, তাই না?
নিচে এস্টেটের কাছে তক করছে দুটো দল। ওদেরকে অবরোধ করে রাখা। দলটা খোড়াখুঁড়ি করছে, লড়াইয়ের ব্যাপারে একেবারেই নিরুৎসাহী। কয়েকজন ইতোমধ্যে ছোট একটা সুইস বক্স সেট করে ফেলেছে। ক্রীকের পানিতে প্যানিং করছে অন্যরা।
মাটি খুঁড়ছে ওরা, প্যানিংয়ের কারণে পানি ঘোলাটে হয়ে যাবে। নোংরা পানি দেখেই সন্দেহ হবে অন্যদের, বেসিনের সমস্ত লোক সোনার লোভে এখানে চলে এলে একটুও অবাক হব না।
সুইস বক্সে ক্লান্তিহীন ভাবে পাথর আর মাটি ফেলছে এক লোক, তাকে নিশানা করল জুডাস ম্যাকলেন্ডন।
উঁহু, গুলি কোরো না, পরামর্শ দিল শেভার্ন। অপেক্ষা করেই দেখো, ওর নিজেরাই কামড়াকামড়ি শুরু করে দিতে পারে।
সত্যিই এমন কিছু হবে?
সকাল হওয়ার আগে আরও শখানেক লোক ভিড় করবে আশপাশে, ক্লেই বা জায়গার দখল নিয়ে নিজেরাই লড়াই শুরু করে দিতে পারে।
সর্বোচ্চ ষাট হাজার দেওয়ার ক্ষমতাই আছে আমার, পুনরাবৃত্তি করল স্ট্যানলি। মাথা পিছু নগদ ত্রিশ হাজার, আর দশ হাজার পরে শোধ করব এমন একটা নোট দেব প্রত্যেককে-ঠিক আছে, পনোরই দেব!
সীমাহীন বিতৃষ্ণা নিয়ে সঙ্গীকে দেখছে উইলিয়াম টেড্রো।
আমাকে কি দেবে? জানতে চাইল শেভার্ন। আমার স্বাক্ষর.ছাড়া কিন্তু কাজ হবে না।
নিচের উপত্যকায় গর্জে উঠল দুটো রাইফেল। শেভার্ন মনে করেছিল ওদের উদ্দেশে গুলি করেছে কেউ, কিন্তু দেখল হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে লোকগুলোর মধ্যে। দুদিকে আলাদা হয়ে গেছে দুটো দল। কিন্তু ওর প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছুই ঘটল না। দখলের লড়াই বাদ দিয়ে হঠাৎ ওদের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ল কয়েকজন, বাকিরা প্যানিং বন্ধ করে সরে গেল একপাশে। পেনি-ফার্নিং রাইডারদের সঙ্গে যোগ দিল কয়েকজন। মেসার দিকে গুলি করতে সুবিধে হবে এমন জায়গায় অবস্থান নিচ্ছে লোকগুলো। কিছু লোক রণে ভঙ্গ দিয়ে ক্রীকের দিকে সরে গেল।
আইডিয়াটা মন্দ নয়, অন্তত নরকে যাওয়ার জন্যে, তাচ্ছিল্যের হাসি শেরিফের মুখে, ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শেভার্নের দিকে। যেভাবেই হোক না কেন, হয় এখানেই তোমার মরণ নয়তো সোডা স্প্রিং-এ ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে যাচ্ছ।
তাই? ঘুরে স্ট্যানলির দিকে ফিরল শেভার্ন। তোমার অফারটা কি, স্যার?
অসহ্য! ঝামটে উঠল মিসেস ব্রুকস। মানুষের জীবনের কেনা-বেচাও দেখতে হচ্ছে আমাকে!
অন্যের জীবন নিয়ে কেনা-বেচা করছি না আমি, মিসেস ব্রুকস। কেবল নিজের জীবন নিয়ে রফা করছি। সন্ধি ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। দোষটা তোমাদের নীরস শেরিফের, নিরেট সাক্ষ্য বা যুক্তি কোনটাই মনে ধরছে না ওর। এ অবস্থায় ওর একমাত্র সাক্ষীকে…
নিশ্চিত হতে পারছি না, আসলেই তোমার নাম শুনেছি কি-না, বিরস মুখে বলল স্ট্যানলি।
কি মনে হয়, যথেষ্ট স্মৃতি লোপ পেয়েছে ওর?
ঠিক আছে! কখনও তোমার নাম শুনিনি। কস্মিনকালেও মিসৌরির ধারে কাছে যাইনি আমি।
খেপে যাচ্ছ দেখছি! এবার বলো তো, এত যে অপমান সহ্য করতে হলো আমাকে, তার বিনিময়ে কি পাচ্ছি?
গুলির তুবড়িতে কাঠ চেরাইয়ের শব্দে ভেঙে গেল সন্ধিটা। পরমুহূর্তে বাফেলো গানের কান ফাটানো তীক্ষ্ণ গর্জন শুনতে পেল শেভার্ন। আই! অস্ফুট স্বরে কাতরে উঠল রোজাওরা, হাড় জিরজিরে বাহুতে একটা স্পিন্টার ঢুকে গেছে।
বাকবোর্ডের দেয়ালের ফুটো দিয়ে উপত্যকার দিকে তাকাল শেভার্ন। দেখা যাচ্ছে লোকটাকে, ওপাশের পাহাড়ের ওপর বসে আছে। বাফেলো গান তাক করছে ফের। কোস্টের রেঞ্জের বাইরে, অসহায়ত্ব নিয়ে দেখল শেভার্ন, বিষণ্ণ মনে একপাশে সরে দাঁড়াল ও। পরমুহূর্তে গুলি করল জুড। অধীর অপেক্ষায় থাকল ওরা, কয়েক সেকেন্ড পর আবারও বাফেলো গানের কান ফাটানো গর্জন শুনতে পেয়ে বুঝল মিস্ করেছে জুড। বাকবোর্ডের চাকায় এসে লাগল বাফেলো গানের বুলেট, তেমন ক্ষতি না করলেও কেঁপে উঠল পুরো বাকবোর্ড।
যদি জানতাম তোমরা যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে, পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা শেরিফ আর ব্যাংকারদের উদ্দেশে বলল শেভার্ন। তাহলে আরও বড় একটা দুর্গ তৈরি করতাম। নিষ্ঠুরের মত তিনটে শরীরের ওপর দিয়ে ক্রল করে রোজাওরা আর মিসেস ব্রুকসের দিকে এগোল ও, তিনজনের অস্ফুট কাতরানি বা বিরক্তি কোনটাই গ্রাহ্য করল না।
ব্যথায় কাতরাচ্ছে না রোজাওরা, বরং নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করছে। স্প্লিন্টারটা বের করছে মিসেস ব্রুকস, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করল মহিলা। স্প্রিন্টার বেরিয়ে আসতে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াতে শুরু করল। দ্রুত নিজের পেটিকোট খানিকটা তুলে ফেলল মিসেস ব্রুকস, ক্ষণিকের জন্যে আকর্ষণীয় গোড়ালি আর সুঠাম পা জোড়া উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। জিনিসটা নতুন, ছিড়ছে না। ছুরি বের করে একটা পরতা কেটে দিল শেভার্ন, তারপর রোজাওরার বাহুতে বেঁধে দিল শক্ত করে।
ম্যাটালস, পরামর্শ দিল মহিলা। পেরো ডেসপ্যাসিও।
উঁহু, ধীরে কাজ সারতে পারব সেই প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না, বলল শেভার্ন। কিন্তু ওদের কয়েকজনকে যে খুন করব তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঘুরে মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরল ও, পেটিকোটের একটা অংশ হারালেও সৌন্দর্য বা স্বতঃস্ফূর্ততা, কোনটাই হারায়নি লাল-চুলো। কেমন লাগছে আজ? স্মিত হেসে জানতে চাইল ও। কিছুটা হলেও সতেজ দেখাচ্ছে তোমাকে।
শ্রাগ করল জুলিয়া ব্রুকস। বাকবোর্ডের কাঠে বিধল আরেকটা শট বুলেটের তুবড়িতে খসে পড়ল পুরু কাঠ, তবে হতাহত হলো না কেউ।
মেনে নাও, বিড়বিড় করে বলল শেভার্ন। অযথাই তর্ক করছ!
কি বললে?
চোখের ইশারায় মহিলাকে সতর্ক করল ও। টেম্রোর শরীরের নিচে চাপা পড়েছে স্ট্যানলি, ঘাস ফড়িংয়ের মত পিছলে বেরোনোর চেষ্টা করছে। শুধু খনির অধিকার ত্যাগ করতে হবে, ফিসফিস করে বলল শেভার্ন। চুক্তি সই করার সময় টেড্রো, শেরিফ আর অন্যদের সাক্ষী হিসেবে রেখো।
কিসের চুক্তি?
যেটার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি। ইচ্ছে হলে অনীহা প্রকাশ করতে পারো, কিন্তু স্বাক্ষর কোরো।
কিন্তু তোমাকে বাদ দিয়ে…।
আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। শেষপর্যন্ত ঠিকই পিছলে বেরিয়ে যেতে পারব, ফের মুখ খুলতে যাচ্ছিল মিসেস ব্রুকস, চোখের ইশারায় তাকে বাধা দিল শেভার্ন। মেক্সিকোয় আমাকে দেখেছে ও, নিচু স্বরে যোগ করল। রেনারের খুন আর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আমার বিচারের সময় হুয়ারেজের অধীন কোর্টে ছিল, স্ট্যানলি। হোক না প্রহসন মূলক বিচার, কিন্তু দেখেছে তো! আপাতত এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না, কারণ শেরিফও বিশ্বাস করছে ওকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বহু পুরানো একটা পোস্টার আছে আমার নামে। ওটা উপেক্ষা করা সত্যিই কঠিন।
কিন্তু এভাবে… ঠোঁট কামড়ে ধরল লাল-চুলো, কথাটা শেষ করল না।
কিছুটা ছাড় না দিলে স্ট্যানলিকে গাঁথা যাবে না। পরে ওকে, এমনকি শেরিফকেও সামাল দেয়া যাবে। আগে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হবে। নিজেদের শক্তি না বাড়ালে ওস্টেনভেল্টদের সঙ্গে টিকতে পারব না আমরা।
শ্রাগ করল জুলিয়া ব্রুকস, সংশয় ফুটে উঠেছে চাহনিতে।
ওর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে কাজ হবে না, লাইমি, এখান থেকে বেরোতে হলে অন্য কিছু করতে হবে তোমার! সতর্ক করল শেরিফ। তবে শেষপর্যন্ত দড়িতে ঠিকই ঝুলবে তুমি!
আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম তোমাকে, নাকি তোমার বন্ধুদের মধ্যে আগে কাকে নেকড়ের দলের মাঝখানে ছেড়ে দেব, নিস্পৃহ স্বরে বলল শেভার্ন, কথাটার ফল দেখার অপেক্ষায় থাকল না। ক্রেট আর ব্যারেলের ফাঁক গলে তাবুর একেবারে কোণে এসে কাগজ-কালি-কলম খুঁজে ফিরে এল মিসেস ক্লকসের কাছে।
শেষ ইচ্ছে এবং স্বীকারোক্তি? তামাশার সুরে উস্কানি দিল শেরিফ।
তাকে অগ্রাহ্য করল জিম শেভার্ন, দ্রুত কলম চালাচ্ছে। খনির অধিকার ইস্ত ন্তির এবং মূল্য পরিশোধের শর্তগুলো যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় লিখল। শেষ করে কাগজটা লাল-চুলোর হাতে ধরিয়ে দিল।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জুড। স্ট্যানলি যদি খুন হয়ে যায়, কিংবা পরে যদি টাকা দিতে অস্বীকার করে?
টেড্রোর দিকে ফিরল শেভার্ন। চুক্তিতে তোমারও সই দরকার হবে।
কেন?
কারণ একটা সই স্বাক্ষরকারীর চেয়ে শ্রেয়তর কিছু নয়। আমার সনে হচ্ছে শেষপর্যন্ত হয়তো সততার জন্যে দুঃখ করবে তুমি।
হাসল টেট্রো। ভাবছি ততক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকব কি-না।
যদি বেঁচে থাকো, এবং মি. স্ট্যানলি যদি কখনও মত পাল্টে ফেলে, ব্যাংকে ওর শেয়ার থেকে ষাট হাজার ডলার কেটে রাখার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে তোমাকে মি. টেট্রো। টাকাটা সমান ভাগ করে মিসেস জুলিয়া ব্রুকস আর জুড়াস ম্যাকলেন্ডনকে দেবে। যদি বাড়তি ত্রিশ হাজার ডলার জোগাড় করার ক্ষীণ সম্ভাবনাও থাকে, চুক্তি অনুযায়ী মি. স্ট্যানলির কাছ থেকে বা ওর যে কোন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার থাকবে তোমার।
যত ইচ্ছে হাসতে থাকো, আমুদে স্বরে বলল স্ট্যানলি। এবার সত্যিই ধনী হতে যাচ্ছি আমি!
তুমি কি নিশ্চিত? শেভার্নের উদ্দেশে নিচু স্বরে জানতে চাইল লাল-চুলো। যতটুকু সোনাই উত্তোলিত হবে, হয়তো একটা অংশ দাবি করা উচিত আমাদের…।
ফিরমালো! আচমকা অধৈর্য স্বরে বলে উঠল ডোনা রোজাওরা।
মহিলা ওর মনের কথাটা বলে দেওয়ায় কৃতজ্ঞ বোধ করল শেভার্ন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভাই-বোন। স্ট্যানলি স্বাক্ষর করার পর শেরিফ আর টেড্রোও সই করল, তারপর পুরো এক ঘণ্টা ধরে চুক্তির আরও চারটে কপি তৈরি করল শেভার্ন, প্রতিটিতে স্বাক্ষর সগ্রহ করল। জুড, জুলিয়া ব্রুকস, স্ট্যানলি প্রত্যেককে এক কপি দিয়ে নিজের কাছে দুই কপি রেখে দিল।
মি. স্ট্যানলি, বলল ও। বুঝতেই পারছ তুমি যদি মারা যাও, চুক্তির কিছুই এতটুকু বদলাবে না। ষাট হাজার ডলার কার্যত এখন ম্যাকলেন্ডনদের সম্পত্তি।
এবং সমস্ত সোনা আমার এর সম্পত্তি! নেকড়ের মত হাসল স্ট্যানলি।
প্রতিটি আউন্স, একমত হলো শেভার্ন। শেরিফ জেসন, মি. টেড্রো ও আমি সাক্ষী রইলাম, এবং সর্বোপরি স্বয়ং ঈশ্বর তো আছেনই! বাফেলো গানের তীক্ষ্ণ শব্দে ঘোষণাটা অস্পষ্ট হয়ে গেল। রোদের অত্যাচারে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া বাকবোর্ডের কাঠ খসে পড়ল দেয়াল থেকে ছুটে আসা স্প্রিন্টারের আঘাতে এ জায়গায় ফুটো হয়ে গেল তাবুর ক্যানভাস, তবে হতাহত হলো না কেউ।
ম্যাটালোস, পুনরাবৃত্তি করল রোজাওরা। নো ইমপোর্টা কোয়ে ডেসপ্যাসিও পেরো ম্যাটালোস।
একমত হওয়ার ইচ্ছে শেভার্নের। দেরি হলো বা না-হলো তাতে কিছু যায় আসে না এখন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বুশহোয়্যাকারদের খতম করতে হবে।
নিচের উপত্যকায় উঠে দাঁড়িয়েছে একজন, দুর্গ হিসেবে কাজ দেওয়া বাকবোর্ডের কি ক্ষতি হলো দেখার ইচ্ছে ছিল বোধহয়। প্রিংফিরে ভারী ক্যালিবারের গুলি লোকটার খায়েশ মিটিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ। গান পাউডারের ধোঁয়া তলিয়ে যাওয়ার আগেই রিলোড করল জুড। আন কার্বন মেনোস, সবকটা দাঁত বের করে রোজাওরার উদ্দেশে বলল ছেলেটা।
জুড! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। এভাবে অভদ্রের মত কথা বলো না।
খুনখারাবিতে ক্ষতি নেই, যত দোষ কেবল খিস্তি করলে! অসন্তোষের সঙ্গে বড়বিড় করল তরুণ ম্যাকলেন্ডন।
উত্তরটায় শুধু শেভার্নকেই সন্তুষ্ট মনে,হলো। সূর্যের দিকে তাকাল ও। সন্ধের অনেক বাকি এখনও। সকালের মতই পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। তাঁবুর নিচে অলস ঠাবে কাটিয়ে চলে গেছে একটা দিন, অস্থির মতির লোকগুলো ওর মেজাজ বদলে দিতে পারেনি এতটুকু। বাকবোর্ডের পাশে খোলা জায়গায় কনুইয়ে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল শেভার্ন, সচেতন সরাসরি বাফেলো গানের একটা বুলেট বাকবোর্ডে বিদ্ধ হলে প্লিন্টার বা কাঠের ফালি এসে পড়বে গায়ে।
ওর ঘুমানোর প্রস্তুতি দেখে অভিযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকল জুলিয়া ব্রুকস। কিন্তু নিজের ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিত শেভর্ন, বিবেকের দংশনও অনুভব করছে না। বুড়ো নীল ম্যাকলেন্ডনের উইলের শর্ত অনুযায়ী সামর্থ্যের মধ্যে সবই করেছে, বাকিটা এবার ঈশ্বরের কৃপার ওপর নির্ভর করছে। মুখের ওপর স্যাভিলানো চাপিয়ে দিল ও, আনমনে নিজের বিবেককে সতর্ক করল যাতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
হয়তো সৎ নৈতিক চেতনার কারণেই, ঘুমটা নিরবিচ্ছিন্ন হলো ওর। জেগে দেখল ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেছে, পশ্চিমাকাশে নেমে গেছে সূর্য। ছোট করে আসা আগুনের কাছে রান্নার আয়োজন করছে মিসেস ব্রুকস, আগুনটা এমন এক জায়গায় যে দূর থেকে সহজে চোখে পড়বে না কারও, নিচের উপত্যকা থেকে তো নয়ই। থালা-বাসন পরিষ্কার করছে ডোনা রোজাওরা। এখনও মাঝে মধ্যে দুএকটা গুলি ছুটে আসছে উপত্যকা থেকে, গভীর শব্দে বিধছে বাকবোর্ডের গায়ে, কিংবা শিস কেটে চলে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে, কিন্তু কেউই ভ্রুক্ষেপ করছে না তেমন।
আপাতত নিশ্চিন্ত, কিন্তু অনিশ্চয়তায় ভরা সময়টা পড়ে আছে সামনে, জানে ওরা সবাই।
.
১৩.
একটা ঘোড়াও নেই কোথাও, ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। পেনি-ফার্দিং রাইডাররা চুরি না করলেও পরে রাউন্ড আপ করতে হয়তো কয়েকটা দিন লেগে যাবে। রোজাওরার দিকে তাকাল শেভার্ন। তাঁবুর এককোণে বসে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে মহিলা, বাহুতে ব্যান্ডেজ বাধা, রক্তক্ষরণ অবশ্য হচ্ছে না এখন। উদাসীন মুখ, বৈরী পরিবেশে পুরো একটা জীবন কাটিয়ে অন্তত এই জিনিসটা শিখেছে। ইউসেবিওর কথা মনে পড়ল শেভার্নের, পাহাড়ের ওপরে আছে সে। সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ভেড়ার পাল ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও পারবে না, নির্ঘাত নিচের উপত্যকার লোকগুলোর রোষের শিকার হবে।
শেরিফের দিকে ফিরল শেভার্ন। চুল আর গোঁফের মতই ধূসর হয়ে গেছে ল ম্যানের মুখ। কথোটগুলো কি জানে এখানে আছ তুমি? সবকিছুর পরও তুমিই এখানকার শেরিফ, তাই না?
শ্রাগ করল শেরিফ। চাইছ উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরকে নিজের উপস্থিতির কশা বলি, আর বুলেট দিয়ে আমার মাথাটা উড়িয়ে দিক?
উপত্যকায় আগুন জ্বেলেছে লোকগুলো, বেশ বড়সড় করে। কয়েকটা পঞ্জিকল্পনা দোলা দিচ্ছে শেভার্নের মাথায়, কিন্তু কোনটাই নিচ্ছিদ্র নয়। ক্লান্ত ল ম্যানকৈ নিরীখ করল ও। তোমার প্রস্তাবের জন্যে এখনও অপেক্ষা করছি আমি।
এখানে একটা বুলেট, অথবা সোডা স্প্রিং-এ দড়্যিা ইচ্ছে বেছে নাও! বয়স কিংবা ক্লান্তির পরও অতি পরিচিত গোয়ার্তুমির চিহ্ন ফুটে উঠল শেরিফের মুখে। কেন তোমাকে কিছু অফার করব আমি?
কারণ, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে আমার সার্ভিস দরকার হবে তোমার। স্বচক্ষে দেখেছ কয়েকবার তোমার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় চৌকস সার্ভিস দিয়েছি আমি। ম্যাকলেন্ডনরা ওদের সমস্ত সম্পত্তির, এক-তৃতীয়াংশ অফার করেছে আমাকে, যার কারণে দারুণ একটা চুক্তির মাধ্যমে নগদ লাভ হয়েছে ওদের, আর আমি পেয়েছি দুবৃত্তের দুর্নাম।
অস্পষ্ট একটা ঘটনা আর অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার অফার পেয়েছি আমি, কিন্তু সেটার ভিত্তি খুব দৃঢ় নয়। মি. টেড্রো ছিল বলেই রক্ষা, আমার সঙ্গে কোন চুক্তি হয়নি ওর। রোজাওরার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোন অঙ্গীকার হয়নি, কিন্তু আমাদের দুজনেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন-নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য আছে আমাদের। শুধু তুমিই বাকি রইলে, তোমারও একটা অঙ্গীকারে আসা দরকার।
বুলেট অথবা দড়ি, একগুয়ে স্বরে পুনরাবৃত্তি করল বয়স্ক লোকটি। টিনহনদের নিয়ে কোন কাজ নেই আমার। প্রথম দেখার সমৃয়ই তোমাকে এ তল্লাট থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
মি. শেভার্ন, জানতে চাইল লাল-চুলো। আমরা সবাই তো একসঙ্গেই ছিলাম এখানে!
না, মিসেস ব্রুকস। সত্যি কথা বলতে কি, সারাদিন জুডই শত্রুদের ঠেকিয়ে রেখেছে। আমাদের পক্ষ নিয়ে একটা গুলিও কি করেছে অতিথিদের কেউ মহিলার মুখ দেখেই শেভার্ন বুঝল ঘুমানোর সময় কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হয়নি ও, প্রসন্ন স্বরে খেই ধরল: এখন বরং ভিন্ন ভাবে চিন্তা করছি আমি। তিনটে বন্দুক যাতে শত্রুপক্ষে যোগ না দেয় সেই চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ওরা যদি আমাদের নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে চায়, আমাদের খাবার বা পানির ভাগ চায়…
ওদেরকে তাড়িয়ে দেবে?
বিন্দুমাত্র দ্বিধা করা ছাড়াই নিরস্ত্র অবস্থায় চলে যেতে বাধ্য করব। মি. টেড্রোর কথা অবশ্য আলাদা, মনে হচ্ছে আমার মতই অন্যের অপরাধের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে ওকে। ঘুরে শেরিফের দিকে তাকাল শেভার্ন। আমার জীবনের বিনিময়ে কিছু ঘোষণা করোনি তুমি, কিন্তু তোমার জীবনের মূল্য কতটা?
কষ্টকৃত হাসি দেখা গেল ল-ম্যানের মুখে। তোমার কি মনে হয়, কতটা তেজ এখনও বাকি রয়েছে আমার?
এবার শেভার্নের হাসির পালা। অভিজ্ঞ নাবিকের মত, আমরা দুজনেই জানি কেবল বোকা আর তরুণরাই অযথা সাহসী হওয়ার ভান করে। এতদিন যখন টিকে আছ তোমাকে চালু লোকই বলতে হবে, তবে সময়মত সাহস দেখাতে কিছুটা অনীহা আছে তোমার।
আসলে তুমি কি চাও?
প্রশ্নটা ত্যক্ত করে তুলল শেভার্নকে। ঠিক নিশ্চিত নই আমি, তবে কেউ কিছু সাধছে, চিন্তাটাই ভাল লাগছে।
তোমার ধারণা আমাদের যে কারও চেয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তোমারই বেশি?
তোমার মতই, শেরিফ, বিপদ এড়িয়ে যাওয়ার সহজাত প্রবণতা তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে। কোন কিছু করার আগে পরিণতিটা ভেবে দেখি, ঝুঁকি বিচার করি। অতি উৎসাহী জুডের মত চাঁদের আলোয় নিজের মাথা উন্মুক্ত করে রাখতে রাজি নই আমি।
ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল ছেলেটা, লাল হয়ে গেছে মুখ, এবং নায়কোচিত ভাবটাও উধাও হয়ে গেছে ভাবভঙ্গি থেকে।
বুঝতে পারছি না আমার কাছ থেকে ঠিক কি চাও তুমি, যদি দেওয়ার ক্ষমতাও থাকত আমার। যাকগে, সারা দিনে তোমাকে তো তেমন কিছুই করতে দেখলাম না।
খেয়াল করেছ বলে ধন্যবাদ। ফ্যাবিয়াস বলে ডেকো আমাকে।
আমি তো জানতাম তোমার নাম শেভার্ন।
ফ্যাবিয়াস ম্যাক্সিমাস একজন রোমান, ব্যাখ্যা করল টেড্রা। মোক্ষম সময়ের জন্যে অসীম ধৈর্য ধরত সে, আর এভাবেই অসংখ্য যুদ্ধে জিতেছে। লোকটা।
মনে হচ্ছে এবার তোমার পালা এসে গেছে, বলল জুড।
শেলের আঘাতে ফুটো হওয়া বাকবোর্ডের তলা দেখল শেভার্ন, সূর্যের দিকে তাকাল এরপর। এত তাড়াতাড়ি এমন কিছু ঘটবে আশা করিনি, বিড়বিড় করল
নিচে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পেনি-ফার্দিং রাইডাররা। সোডা স্প্রিং থেকে যে ফ্রেইট ওয়্যাগনটা চালিয়ে নিয়ে এসেছিল শেভার্ন, ওটার জোয়াল আর ঘানি খুলে ফেলেছে। কেবল পেছনের চাকা দুটো আছে। অদ্ভুত আকৃতির এই ওয়্যাগন ঠেলে ঢালের দিকে নিয়ে আসছে লোকগুলো।
অদ্ভুত হলেও কার্যকর, স্বীকার করতেই হচ্ছে পেনি-ফার্দিং রাইডাররা হাতের কাছে যা পেয়েছে সেটাই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছে। ভারী ওয়াগনটা ধীরে ধীরে ঠেলে আনছে ওরা, তাড়া নেই। ওয়্যাগনের পাটাতনে অন্তত বিশজন লোক অবস্থান নিতে পারবে। পুরোদস্তুর কামান ছাড়া কোন মার্কসম্যানের পক্ষেই এদেরকে থামানো সম্ভব নয়।
টেস্টুডো! বিড়বিড় করল টেড্রো।
চাকার ব্যাপারটা বাদ দিলে, একমত হলো শেভার্ন। যদিও সত্যিকার টেস্টুডোর মত ছাত নেই এটার।
কি নিয়ে কথা বলছ তোমরা? বিরক্তি প্রকাশ করল শেরিফ।
টেস্টুডো। সীজারদের আমলে খুব কার্যকরী যুদ্ধ-বাহন ছিল জিনিসটা। প্রাচীর বা দুর্গের দেয়াল ভাঙার জন্যে ব্যবহার করত রোমানরা, মিলিত ভাবে সবার জন্যে শিরস্ত্রাণের কাজ করত ওটা।
শীতল হাসি দেখা গেল শেরিফের মুখে। এবার কি করবে, টিনহর্ন? কামান বা প্রয়োজনীয় গান পাউডারও নেই তোমার কাছে!
দেখা যাক কি করা যায়। বোঝাই যাচ্ছে তোমাদের কাছ থেকে কোন পরামর্শ বা সাহায্য পাব না। অদ্ভুত ফ্রেইট ওয়্যাগনটা দেখল ও, ঢাল বেয়ে উঠে আসছে ওটা। যুক্তির খাতিরে বলা যায়, ঢালের নিচ থেকে কাভার দেবে অন্যরা। কিন্তু কেউই গুলি করছে না। ক্রীকের কাছে কয়েকজন একগুঁয়ে মাইনার প্যানিং আর স্লুইসিং নিয়ে ব্যস্ত, এদিকে কি হচ্ছে সে-সম্পর্কে একেবারে উদাসীন।
তোমাদের পাহাড়ী লোকদের নিকুচি করি! তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বিদ্বেষ প্রকাশ করল স্ট্যানলি, গুলি করল সে-এই প্রথম। কিন্তু ওয়্যাগনের দিকে নয়, বরং প্লেসার* [*নদ্যাদিতে বালি, কাঁকর, নুড়ি প্রভৃতির অবক্ষেপ যা হেঁকে সোনা বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতু পাওয়া যায়।] মাইনাররা তার টার্গেট। বেলচা থামিয়ে মেসার দিকে তাকাল লোকগুলো, মুহূর্ত খানেক পরই ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার।
এস্টেটের কাছ থেকে ওয়্যাগনটাকে কাভার করছে না কেউ, ইচ্ছে করে গুলি করছে না? নাকি ওয়্যাগনের ভেতরে অবস্থান নিয়েছে সবাই? কোন রকমে ওয়্যাগনটা ধ্বংস করতে পারলে সমূলে বিনাশ হবে শত্রুপক্ষ। কিন্তু কিভাবে? চোখ কুঁচকে তাবু, বাকবোর্ড আর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্রের দিকে তাকাল শেভার্ন। বাকবোর্ডটা ওয়্যাগনের চেয়ে বেশ মজবুত, ব্যারেল আর ক্রেটগুলোর জন্যে আরও ওজন বেড়েছে ওটার।
বিপক্ষ কাছে চলে এলে হয়তো কয়েকজনকে হতাহত করতে পারবে ও, কিন্তু শেষপর্যন্ত বাকবোর্ড বা ওদের ক্যাম্পের নিশানাও রাখবে না প্রতিপক্ষ। পরিস্থিতিটা সত্যিই বিপজ্জনক।
গুলি করল জুড। ওয়াগনের গায়ে চল্টা ওঠাল গুলিটা, মজবুত কাঠের বুকে স্রেফ একটা ক্ষত তৈরি করল। আগের মতই ধীর নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে ওটা।
পুরোপুরি টেস্টুডো বলা যাবে না ওটাকে, বিড়বিড় করল টেড্রো।
বাড়তি গান পাউডার আছে আমাদের কাছে? জানতে চাইল শেভার্ন।
পোলভোরা?
নড করল ও। বোঝাই যাচ্ছে স্থানীয় লোকজন এখনও মাজল-লোডিং অস্ত্র ব্যবহার করে, অন্তত শটগানের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। ম্যাকলেন্ডনদের স্টোরে জিনিসটা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকার সম্ভাবনা কম, কারণ বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রয়োজন হয়তো এখানে পড়েইনি কখনও। তবে থাকলেই স্বস্তি বোধ করবে ও। ক্রীকের কাছে গর্তটার কথা মনে পড়ল ওর, আরেকটু হলে পৈত্রিক প্রাণটা হারিয়ে বসেছিল!
টেঙা, ভাল হাত দিয়ে টিনের একটা ক্যান ওর উদ্দেশে বাড়িয়ে দিল ডোনা রোজাওরা।
চোখ কুঁচকে ক্যানের গায়ের লেখাগুলো পড়ল শেভার্ন: এক পাউন্ড ডুপন্ট ব্ল্যাক পাউডার। শীতল ও শুষ্ক স্থানে রাখুন। ক্যান নেড়ে জানতে চাইল ও, এস টেড্ডা?
রোজাওরা ওকে নিশ্চিন্ত করল স্বামীর তাবৎ হান্টিং সাপ্লাইয়ের মধ্যে ক্যানের তলানির সামান্য এই মসলাই অবশিষ্ট ছিল। এস্টেট পুড়ে যাওয়ার পরও কিভাবে জিনিসটা অক্ষত রইল কে জানে; এরকম বিপজ্জনক জিনিস বাসস্থানের কাছাকাছি কেউই রাখে না। রোজাওরার স্বামীও রাখেনি নিশ্চয়ই।
চারপাশে তল্লাশ চালাল শেভার্ন, ব্যবহার করার মত কিছু যদি পেয়ে যায়। বিকেলে খাওয়া মাংসের স্টু জমাট বেঁধেছে একটা বাটিতে, পুরু চর্বির স্তর জমেছে। ওপরের দিকে, তারই কিছুটা সংগ্রহ করল ও। সেলুন-পিস্তলের এক মুঠি কার্তুজ খুঁজে পেল, বাকবোর্ডের আসনের কুশন থেকে সগ্রহ করল চামড়ার পাতলা ফালি। ব্ল্যাক পাউডারের সঙ্গে চর্বি আর কার্তুজ মিশিয়ে চামড়ার মোড়ক তৈরি করল এরপর, পুরোটাই ক্যানের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল।
ইয়া এল চিলি? দুমুঠো লাল পাউডার সরবরাহ করল রোজাওরা।
জিনিসটা চিনতে পারল শেভার্ন, মরিচের গুঁড়ো। এস্টেটে আসার পর থেকে এই জিনিসটাই ওর হজম শক্তিকে একহাত দেখে নিচ্ছে। বিস্ফোরকের মিশ্রণের সঙ্গে মরিচের গুড়া মেশাল ও এবার।
দ্বিতীয় কোন সুযোগ পাবে না তুমি, চাঁছাছোলা স্বরে বলল শেরিফ।
এভাবে চিৎকার করে খবরটা যদি শত্রুপক্ষের কানে দিতে থাকো, আমি হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করব তোমাকে!
কোন ভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি? সাগ্রহে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
পাহাড় টলিয়ে দেয় এমন বিশ্বাস রাখো, যার জোরে হয়তো অদ্ভুত ওই ওয়্যাগনটাকে পাশের কাউন্টিতে সরিয়ে দিতে পারব।
আমার বিশ্বাস এবং আস্থা, দুটোই তোমার ওপর, মি. শেভার্ন। দয়া করে হতাশ কোরো না আমাকে।
কয়লার তেল থাকলে জিনিসটা সম্পূর্ণ হত, ঢালের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক স্বরে বলল ও, ধীরে ধীরে উঠে আসছে ওয়্যাগনটা। যে হারে এগোচ্ছে, সন্ধের আগেই মেসায় পৌঁছে যাবে। সবাই লোড করেছ তো, তৈরি? শেষ মুহূর্তে হয়তো তোমাদের সাহায্য দরকার হবে। ওরা কেউ যেন ফিরে যেতে না পারে।
তোমার সঙ্গে আছি, আপাতত, বিরস মুখে জানাল শেরিফ বেলহ্যাম। ঝামেলাটা শেষ হলেই তোমার ব্যাপারে মনোযোগ দেব।
চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! দার্শনিক স্বরে মন্তব্য করল শেভার্ন।
আমার দিকে যখন বুলেট ছুটে আসে, দর্শন নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না, বলল টেড্রো। এই অনর্থক হয়রানির জন্যে সান্তা ফে থেকে বেরিয়েছি ভাবতেই দুঃখ হচ্ছে!
আমার সোনা চুরি করছে ওরা। হঠাৎ করেই খেপে উঠল স্ট্যানলি, প্রবল রোষের সঙ্গে সুইস বক্স নিয়ে কর্মরত মাইনারদের উদ্দেশে গুলি করতে শুরু করল, মুহূর্তের জন্যেও ভাবেনি রেঞ্জের বাইরে আছে লোকগুলো। রাইফেলটাও অল্প বোরের রিপিটার, গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে প্রচলন শুরু হয় ওটার। কেবল তীক্ষ্ণ মনোযোগের সঙ্গে নিশানা করতে পারলেই এ ধরনের রাইফেল দিয়ে টার্গেট বিদ্ধ করা সম্ভব। পরপর কয়েকটা গুলি পাঠিয়ে দিয়ে সম্ভষ্ট বোধ করল সে, যেন সত্যিই টার্গেটে লেগেছে গুলিগুলো।
উত্তরে কোন গুলি ছুটে এল না। ব্যাপারটা অশুভ মনে হলো শেভার্নের কাছে। সত্যিকার বিপদ এলে সাহায্যের চেয়ে বরং ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে স্ট্যানলি, একরকম নিশ্চিত ও। ঢালের দিকে তাকিয়ে দেখল ইতোমধ্যে আরও শখানেক গজ উঠে এসেছে ওয়্যাগনল।
মি. শেভার্ন, ভবিষ্যতে কিংবা আগামীকাল কি হতে পারে, ভেবেছ কখনও?
প্রচুর, মিসেস ব্রুকস। কিন্তু আমার ধারণা অযথাই এ বিষয়ে আলাপ করছি আমরা।
তাই?
সৃষ্টিকর্তার জন্যে কিছু প্রশ্ন জমে আছে আমার মাথায়। সর্ব শক্তিমানের তৈরি এত অসঙ্গতি চোখে পড়েছে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হয়তো বেগ পেতে হবে। তার।
নাস্তিক বলতে পারছি না তোমাকে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাসটা কি খুব দৃঢ় তোমার? আমার তো ধারণা মানুষই নিজের পথে নিজেকে চালিত করে, কর্মফলেই মানুষের নিয়তি।
হতে পারে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। মানুষ হচ্ছে একেকটা পুতুল, যে পরিবেশে যাকে রেখেছেন তিনি সেখানেই থাকতে হয় তাকে।
ঈশ্বর সবাইকে সাহায্য করুন! বিড়বিড় করল মাইকেল টেড্রা।
গর্জে উঠল জুডের স্প্রিংফিল্ড, ফ্রেইট ওয়্যাগনের ভেতরে কাতরে উঠল এক লোক।
ওটরো ক্যাবরন মেনোস! খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল রোজাওরা।
গুলি না করলেই ভাল হত, বলল শেভার্ন।
কেন? জানতে চাইল বিস্মিত জুডাস ম্যাকলেন্ডন।
কারণ ওয়্যাগনের শরীরে যত ফুটো তৈরি হবে, ভরাট করার চেষ্টা করবে ওরা। এখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। ততক্ষণে আঁধার নেমে গেলে সত্যিই বিপদ হবে।
লূপহোল থেকে কিছুটা পাশে সরে গেল জুড, রাইফেলটা পরিষ্কার করছে দক্ষ হাতে। শেভার্নের ধারণা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হলো। অদ্ভুত টেস্টুডোর লোকগুলো হতাশ বা হতোদ্যম হয়ে পড়েনি, বরং জুডের গুলি যেন সচেতন করে তুলেছে তাদের-সন্ধের আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। বিশ জন লোক যতটা জোরে সম্ভব ঠেলে নিয়ে আসছে ওয়্যাগনটাকে।
কপালে যাই থাকুক, নিয়তি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না! বিড়বিড় করল শেভার্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস ব্রুকস। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি সত্যিই খারাপ মানুষ, অন্তত কয়েকবার তো এই ধারণা জনন্মছে। বিপদ দেখেও কিভাবে এত নিস্পৃহ থাকতে পারো?
আনমনে হাসল শেভার্ন, জুলিয়া ব্রুকস কি জানে নিজে কতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে সে?
দ্রুত রাইফেল রিলোড করে ফেলল জুড।
এই মুহূর্তে নিচের বেপরোয়া ওই লোকগুলোকে প্রভাবিত করার চিন্তায় আছি আমি, গর্জে উঠল শেভার্ন, চারপাশে আরেকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালাল, বোঝার চেষ্টা করছে মুখোমুখি লড়াইয়ে ঠিক কতটা দৃঢ়তা দেখাতে পারবে ওরা, কিংবা প্রয়োজনীয় আড়াল বা কাভার কোথায় পাওয়া যাবে। ভাবছি জুডের মত আধ-ডজন বেপরোয়া তরুণের বদলে তোমার ভাগ্য বিক্রি করা যায় কি-না, অসন্তোষের সঙ্গে বলল ও।
তুমি কি সত্যিই সরাসরি, আমেরিকানদের মত কথা বলতে পারো না? বিরক্তি প্রকাশ করল শেরিফ।
পারি, শুধু আমেরিকানই নয়, বিশুদ্ধ স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ বা উর্দুও বলতে পারি। এই জঘন্য পাহাড়ী এলাকায় একটা বছর থাকতে দাও আমাকে, তাহলে নির্জলা ইন্ডিয়ানও বলতে পারব।
আমি প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম তুমি সত্যিই লাইম-জুসার।
অউসি মোই, আচমকা বলে উঠল মিসেস ব্রুকস।
মুহূর্তের জন্যে বিহ্বল হয়ে পড়ল শেভার্ন। অনর্গল স্প্যানিশ বা ইংরেজি বলতে পারে লাল-চুলো, কিন্তু ফ্রেঞ্চ? সম্ভব, পুবের স্কুলে পড়াশোনা করেছে, ফ্রেঞ্চও বলতে পারবে এটাই স্বাভাবিক।
ঠকলাম না জিতলাম এখনও পরিষ্কার বুঝতে পারছি না, একই ভাষায় খেই ধরল জুলিয়া ব্রুকস। কিন্তু তুমি যে নিজেকে ঠকিয়েছ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঝামেলা শেষ হলে হয়তো তোমাকে গ্রেফতার করবে শেরিফ, কারণ স্ট্যানলির। সঙ্গে রফা করে পরোক্ষ ভাবে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করেছ। কোন ভাবে কি প্রমাণ করার উপায় নেই আসলে উইল রেনারকে খুন করোনি তুমি কিংবা কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল না তোমার?
হয়তো, যদি তোমার কথা বিশ্বাস করে শেরিফ। কিন্তু মনে হয় না এ মুহূর্তে কোন কিছু বিশ্বাস করার মূড়ে আছে সে।
এই ঝামেলা শেষ হলেই ক্যাম্পাসে যোগাযোগ করব আমি, নিচু, দৃঢ় স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস। অনেকেরই হয়তো মনে আছে তোমাকে, অন্তত কয়েকটা পরিবারকে তো সাহায্য করেছ তুমি। এদের সাক্ষ্যে হয়তো সত্য বেরিয়ে আসবে।
রেনারের খুনের ব্যাপারে কিছু করার নেই…সন্দেহটা সবসময়ই থেকে যাবে।
স্পষ্ট হতাশা প্রকাশ পেল মিসেস ব্রুকসের কণ্ঠে, কারণ এবার ইংরেজিতে খেই ধরল লাল-চুলো। হ্যাঁ, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মহিলা। সন্দেহটা সবসময়ই থেকে যাবে।
হ্যামলেটের বাবার কানের বিষের মত, তাই না? সবকিছু ধীরে ধীরে বিষিয়ে তুলছে, নতুন ট্র্যাজেডির বীজ বপন করছে!
কথায় তোমার সঙ্গে পারা কঠিন, তিক্ত স্বরে বলল ম্যাকলেন্ডন-কন্যা।
খাসা বলেছ! অদ্ভুত হলেও সত্যি যে ওই সোনালোভী লোকগুলোকে ইচ্ছে করলে, থামিয়ে দিতে পারি আমি, সামান্য একটা কথায় ওদের সব উৎসাহ ফুরিয়ে যাবে। এই অশান্তির শেষ হবে, পেনি-ফার্দিংরা ওদের নোংরা গর্তে গিয়ে মুখ। লুকাবে।
চাপা মারছ? বিদ্রূপ করল শেরিফ। নইলে কিসের জন্যে অপেক্ষা করছ? ওদেরকে চলে যেতে বলল, তাহলেই শান্তিতে ফিরে যেতে পারি আমরা।
শেষে ঘাড় ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত যাতে আমাকে ঝুলিয়ে দিতে পারো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোডা স্প্রিং এর ল-ম্যান। মনে হয় না ফাঁসির দড়ি এড়াতে পারবে তুমি। যাকগে, স্ট্যানলির হয়েছে কি? ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে। সূর্যের আলোয় বেশিক্ষণ থাকার ফলে মাথা বিগড়ে গেছে?
খানিকটা সমস্যা আছে, জানাল শেভার্ন।
খোদার দোহাই, মি. শেভার্ন, রক্তপাত ছাড়া এই যুদ্ধের শেষ হওয়ার সম্ভাবনা যদি সত্যিই থাকে, প্রথমবারের মত আবেগ প্রকাশ করল মাইকেল টেড্রো। দয়া করে…
সত্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কি জানো, মি. টেড্রো? কেউই সেটা বিশ্বাস করতে চায় না।
আমাদের বলে দেখতে পারো, সুবোধ বালকের মত আব্দার জুড়ল শেরিফ।
আমার ধারণা তোমরা এরইমধ্যে জেনে গেছ। তোমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসে অবশ্য কিছু যায়-আসে না। বরং আগে ওই লোকগুলোকে বিশ্বাস করানো দরকার।
বলে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! আহ্বান করল জুড।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। উঠে দাঁড়ানোর সময় বুক ভরে বাতাস টেনে নিল, সতর্ক যাতে কাভারটা নষ্ট না হয়। বাড়ি ফিরে যাও, বোকার হদ্দরা! চিৎকার করে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করল ও। এখানে কোন সোনা নেই, কখনও ছিলও না! মিথ্যে বলে তোমাদের ঠকিয়েছে ব্রুকস। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে বলো, এতক্ষণ তো প্যানিং করেছ, কেউ কি এক চিমটে সোনাও তুলতে পেরেছ? এবার বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজেদের পাপের স্বর্গে ডুব দাও। একটু পরই বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুনীদের সন্ধান করবে শেরিফ, অভিযুক্ত লোকদের গ্রেফতার করবে।
মুহূর্তের জন্যে রুদ্ধশ্বাস নীরবতা নেমে এল, তারপর উচ্চকণ্ঠের হাসি শোনা গেল। শেভার্নের কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। তীক্ষ্ণ শব্দে বাকবোর্ডে আঘাত হানল বাফেলো গানের একটা গুলি, তারপর তুমুল গুলি বৃষ্টি শুরু হলো, মানে। আন্দাজের ওপর গুলি করছে লোকগুলো।
হয়তো সত্য জানতে পারলেই মুক্তি মিলবে তোমাদের! শয়তানি হাসি হেসে বলল শেভার্ন, মাথা নিচু করে ফেলেছে।
কিন্তু চরম সত্যটি ওদের অন্তত একজনের জন্যে অভাবনীয় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। মিথ্যে বলছ তুমি! হতেই পারে না! চিষ্কার করে উঠল স্ট্যানলি, খেপে বোম হয়ে গেছে। এই খনি আমার। তোমরা কেউ আমার সোনা ছুঁতে পারবে না! অন্য কেউ বাধা দেওয়ার আগেই বাকবোর্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে গেল সে। ঢালের উদ্দেশে ছুটছে, হাতের রিপিটার থেকে সমানে গুলি করছে। দেখতে দেখতেই অদ্ভুত টেস্টুডোর একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেল, কিন্তু ততক্ষণে অন্তত বিশটা গুলি বিধেছে হতভাগ্য ব্যাংকারের দেহে।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল ক্যাম্পে।
আর কেউ সত্যটা পরখ করে দেখতে চাও? শেষে জানতে চাইল শেভার্ন।
উত্তর দিল না কেউ।
দশ মিনিট সময় পাবে তোমরা।
ওরা আক্রমণ করার আগে?
নিকুচি করি আক্রমণের! দশ মিনিটের মধ্যে তোমরা সিদ্ধান্ত নেবে ওই মাথামোটা ব্যাংকারকে আত্মহত্যা করতে আমি ফুসলেছি কি-না, নয়তো পরে
শেরিফের মত তোমরাও বলবে এসবের জন্যে জিম শেভার্নই দায়ী।
আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. শেভার্ন।
নিশ্চয়ই!
কিন্তু তুমিই তো বলেছ, সন্দেহটা সবসময়ই থেকে যাবে।
অদ্ভুত ওয়্যাগনটা তখন ঢালের দুই-তৃতীয়াংশ পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। বাকবোর্ডের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শেভার্ন, সময়ের আগেই পাল্টা আক্রমণ করার ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে সময় নিয়ে ধরাল ও, নিস্পলক দৃষ্টিতে শম্বুক গতিতে আগুয়ান ওয়্যাগনটা দেখছে। বেশ মজবুত জিনিসটা, কিনারে বাড়তি কাঠের ফাঁকে মাঝে মধ্যে সবুট কিছু পা চোখে পড়ছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে না এলে একেবারেই নিরাপদ পেনি-ফার্নিং রাইডাররা। বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিল ও, সারা শরীরের ব্যথা ভুলতে চেয়েও পারছে না। বাড়তি বুলেটের কারণে ভারী হয়ে আছে ওর পকেট, জোড়া কোল্ট তুলে আনার অপেক্ষায় শিথিল হাত জোড়া ঝুলছে দেহের পাশে। ওপাশে পাহাড়ের আড়ালে পড়ে গেছে সূর্যের অর্ধেকটা, হালকা বাতাস বয়ে গেল জায়গাটায়। উপত্যকায় মৃত্যুর ছায়া পড়েছে যেন, আচমকা নীরব হয়ে গেছে সবাই।
এতটা বেপরোয়া বা নিষ্ঠুর না হলেও চলত তোমার, বলে উঠল ওর বিবেক।
তাহলে কিভাবে কাজটা সারতে তুমি?
কোন উত্তর এল না।
ফের চুরুটে টান দিল শেভার্ন। ঢালের মুখে ওয়্যাগনটাকে দেখা যাচ্ছে এখন, খুব বেশি হলে একশো গজ দূরে। যে কোন মুহূর্তে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে বেপরোয়া মানুষগুলো। অধীর আগ্রহ নিয়ে পাশে বসে থাকা রোজাওরার উদ্দেশে একটা হাত বাড়িয়ে দিল ও।
অ্যাকুই এস্টা, বলল রোজাওরা, ক্যানটা ধরিয়ে দিল শেভার্নের হাতে।
চুরুটে টান দিল ও, তারপর হাতে তৈরি ফিউজের আগায় ছোয়াল চুরুটের আগুন। কর্ডের তৈরি ফিউজে আগুন ধরে গেল, মুহূর্তের জন্যে মিইয়ে গেল, তারপর দ্রুত পুড়ে গেল কয়েক ইঞ্চি।
ছুঁড়ে দাও! নিখাদ ভয় আর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল অন্যরা। কিন্তু গ্রাহ্য করল না শেভার্ন, অদ্ভুত বোমাটা ধরে রেখেছে এখনও, অপেক্ষা করছে ফিউজ পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ার আগে টেস্টুডো থেকে লোকগুলো বেরিয়ে আসে কি-না। রুদ্ধশ্বাস কয়েকটা সেকেন্ড পেরিয়ে গেল, অপেক্ষার মুহূর্তগুলো বড় দীর্ঘ মনে হলো ওদের। একসময় আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করল না শেভার্ন, গায়ের জোরে ছুড়ে মারল ক্যানটা।
মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হলো হিসাবে ভুল করেছে, হয়তো মাঝপথেই ফেটে যাবে বোমাটা। সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়ায় টান পড়েছে হাতের পেশীতে, প্রায় অবশ লাগছে হাতটা। খেপা পশুর মত চাপা হিসহিস শব্দে টেস্টুডোর ভেতরে গিয়ে পড়ল ক্যানটা। শব্দটা বেড়ে গেল আচমকা, ঘন কালো ধোয়া বেরোচ্ছে সেই সঙ্গে; নিউ মেক্সিকোর মরিচের ঝাঁঝ ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাপা শব্দে একের পর এক ফাটতে শুরু করল সেলুন পিস্তলের কার্তুজ, চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র বেগে।
আচমকা ওয়্যাগনটা যেন ফুটন্ত একটা পাত্র হয়ে উঠেছে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেরিয়ে আসছে লোকগুলো। চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে, মরিচের ঝঝে গলা জ্বলছে; ছুটন্ত দুএকটা বুলেটও বিধেছে কারও কারও গায়ে।
বাস্তবে ফিরে এল জিম শেভার্ন, জোড়া কোল্ট শোভা পাচ্ছে ওর হাতে। ইতোমধ্যে একজনকে ফেলে দিয়েছে জুড। এবার স্রেফ শূটিং প্র্যাকটিস করল ওরা, শেরিফ বা টেড্রোও বসে নেই-ছুটন্ত টার্গেট পেলেই গুলি করছে। পাল্টা গুলি করছে লোকগুলো; কিন্তু সুবিধে করতে পারছে না। ব্যাপারটা সত্যিই বেদনার, কিন্তু একই সুযোগ প্রতিপক্ষ পেলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না, জানে শেভার্ন। বিবেকের দংশনকে অগ্রাহ্য করে টেস্টুডোর দিকে মনোযোগ দিল ও।
ক্রল করে ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন কিন্তু জুড বা শেরিফের রাইফেলের তোপের মুখে টিকতে পারছে না। নিশ্চিত হতে চাইছে আর কোন পেনি-ফার্দিং রাইডার পরে ফিরে এসে বিরক্ত করবে না। অতি উৎসাহী হয়ে বাকবোর্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে গেছে জুড।
ফিরে এসো, বোকার হদ্দ! চিৎকার করল শেভার্ন। কিন্তু থামানোর উপায় নেই জুডকে। বাধ্য হয়ে অনুসরণ করল ও, হাতে জোড়া কোল্ট। চোখ জুডকে। ছাড়িয়ে গেছে, দেখল শোয়া অবস্থা থেকে নিশানা করছে এক পেনি-ফার্নিং রাইডার। ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাড়াল জুড, সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
ছুটন্ত অবস্থায় গুলি করল শেভার্ন। লোকটার কাঁধে গিয়ে বিধল গুলিটা, নিশানা টলে গেল তার। মুহূর্তের ব্যবধানে দ্বিতীয় বুলেট পাঠিয়ে দিল শেভার্ন। এবার জায়গামত, একেবারে কপালে গিয়ে বিধল। পেনি-ফার্দিং রাইডারের বিদ্বেষের সমাপ্তি হলো সেখানেই।
নিঃশ্বাস আটকে আসছে, টের পেল শেভার্ন, মরিচের ঝঝে চোখ আর গলা জ্বলছে। মেক্সিকোয় সম্রাটের বাহিনীতে থাকার সময়ও এতটা কার্যকরী বোমার প্রভাব প্রত্যক্ষ করেনি ও। থমকে দাড়িয়ে চোখ, চারপাশ দেখার চেষ্টা করল, নিঃশ্বাস আটকে রেখেও লাভ হচ্ছে না। ঘুরে ক্যাম্পের দিকে তাকাতে চমকে উঠল, বাকবোর্ডের ঠিক পেছনেই ক্রল করে এগোচ্ছে এক লোক। লোকটার হাতে রাইফেল। কিভাবে ওখানে চলে গেছে খোদা মালুম; শেরিফ, টেড্রো বা কেউই লোকটার উপস্থিতি টের পায়নি।
ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল শেভার্ন। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, ঝাঁপসা ভাবে দেখতে পেল ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা, নিশানা করছে। মুহূর্তে গর্জে উঠবে রাইফেল।
অপেক্ষা বা নিশানা করার সময় নেই। পিস্তল থেকে তপ্ত সীসা পাঠিয়ে দিল ও, পরপর দুটো। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল লোকটা, বুক আর পেটে বিধেছে গুলি। পিছু পিছু ঢাল বেয়ে উঠে আসছিল আরও দুজন, কিন্তু ততক্ষণে সতর্ক হয়ে গেছে অন্যরা। তিনজনের গুলির তুবড়িতে নিমেষেই পটল তুলল লোক। দুটো।
পিস্তলে নতুন বুলেট ভরে এগোল শেভার্ন। পাহাড়ের আড়ালে পড়ে গেছে সূর্য, আঁধার ঘনিয়ে এসেছে উপত্যকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ জরিপ করল ও, ভাবছে আর কোন পেনি-ফার্দিং রাইডারের মুখোমুখি হতে হবে না বোধহয়। স্রেফ একতরফা লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে লোকগুলো, কেউ কেউ হয়তো ক্রল করে নিচে নেমে গেছে। তবে আবারও হামলা করার সাহস এদের হবে না, উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে।
আচমকা ক্ৰীকের ধারে চিৎকার শুনতে পেল ও। উল্লাস প্রকাশ করছে প্রেসার মাইনাররা। কারণটা বোঝার চেষ্টা করল শেভার্ন, বিভ্রান্ত বোধ করল মুহূর্তের জন্যে-সোনা পেয়েছে নাকি? অসম্ভব! যে জিনিস আদৌ নেই তা পায় কি করে? সহসাই পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। আবছা আলোয় নিচ থেকে স্পষ্ট দেখা সম্ভব নয়, লড়াইয়ের ফলাফল ধারণা করে নিয়েছে লোকগুলো। ভেবেছে শত্রুদের বিনাশ করেছে পেনি-ফার্দিং। সেটাই স্বাভাবিক ছিল, ম্যাকলেন্ডনদের তিন-চারজনের বিরুদ্ধে অন্তত বিশজনের একটা দল, কে ভাববে শেষপর্যন্ত এদেরই ভরাডুবি হয়েছে?
বাকবোর্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল টেড্রো আর শেরিফ, উফুল্ল দেখাচ্ছে দুজনকেই। পেছন থেকে শেভার্নকে ডাকল জুলিয়া ব্রুকস, কিন্তু ঢাল বেয়ে তখন নামতে শুরু করেছে ও, পিছু নিয়েছে অন্য দুজন। আর সবার আগে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের ক্ষীণ অবয়ব।
এখনও উল্লাস প্রকাশ করছে মাইনাররা, মাথার ওপর হ্যাট তুলে নাড়ছে। শেরিফ সহ ওদেরকে নামতে দেখে এবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল লোকগুলোর মধ্যে, কে কার আগে পালাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গুলি করে দুজনকে ফেলে দিল। জুড।
ক্ষুব্ধ মনে হলো টেডড্রা আর শেরিফকে। আমি…ভেবেছি আগে সতর্ক করে দেবে ওদের, হয়তো চলেও যেতে দেবে, বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল ব্যাংকার।
জোড়া কোল্ট চলে এসেছে শেভার্নের হাতে। একবার সেই চেষ্টা করেছি, তিক্ত স্বরে বলল ও। হয়তো খেয়াল করেছ একেবারে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হাঁটতে পারছি না আমি। কারণটা নিশ্চয়ই বুঝেছ? ঘুরে শেরিফের দিকে ফিরল ও। পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই, শেরিফ। আগে তোমার কাজ সেরে ফেলো। এটা তোমারই এলাকা। সময়মত দায়িত্ব সেরে ফেললে এখানেই সমস্ত ঝামেলার শেষ হবে।
জানি আমি, বিরস মুখে বলল ল-ম্যান।
আরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে তোমার।
শূন্য দৃষ্টিতে থমকে দাড়ানো মাইনারদের দেখছে জেসন বেলহ্যাম, অতি পরিচিত উদ্ধত ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। শোনন, তোমরা। আসলেই এখানে কোন সোনা নেই। এবার বাড়ি ফিরে যাও সবাই। ম্যাকলেন্ডনরা এই জমির মালিক, সুতরাং তোমাদের কোন অধিকার খাটবে না এখানে। সত্যি কথা বলতে কি, যেখানে বসতি করেছ তোমরা, নিচের ওই জমির মালিকও ওরাই। কিন্তু এ নিয়ে কখনও আপত্তি করেনি নীল ম্যাকলেন্ডন। সেজন্যে ওর প্রতি তোমাদের। কৃতজ্ঞই থাকা উচিত।
কিন্তু, শেরিফ, ভেড়ার বাথান করছে ওরা… বলতে চাইল একজন।
আগে এখানে কে এসেছে, ওরা নাকি তোমরা? এতদিন কেন আপত্তি করোনি? ওদের ভেড়া তোমাদের কি ক্ষতি করছে? বরং তোমরাই ওদের জমি, ক্রীকের পানি ব্যবহার করছ!
বোল-চাল বাদ দাও! তোমাদের মরিয়া হয়ে ওঠার আসল কারণ তো জানি এখন-সোনার লোভে ছুটে এসেছ সবাই। বোকার হদ্দরা, এখানে কোন সোনা নেই! থেমে বিহ্বল মুখগুলো দেখল শেরিফ, তারপর কিছুটা কোমল স্বরে খেই ধরল: দেখেছ তো, তোমাদের অতি উৎসাহী সঙ্গীদের কি পরিণতি হয়েছে? ম্যাকলেন্ডনদের সাথে ফের লাগতে যেয়ো না। এবার কিন্তু আইন পিছু নেবে তোমাদের। যে-ই ঝামেলা করবে তাকে দেশছাড়া করব আমি। বুল ওস্টেনভেল্ট কোথায়?
ওয়্যাগনে ছিল।
তার মানে…খতম! ওর দুই ছেলে?
বাপের সঙ্গেই ছিল।
আনমনে মাথা নাড়ল শেরিফ, কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত দেখাচেছ। পালের গোদাটা না থাকায় ভালই হয়েছে। বাড়ি ফিরে যাও এবার। যাকগে, সবাই মিলে আবার ডাবল-ও-র জমির দখল নিয়ে লড়াই শুরু কোরো না।
ধীরে ধীরে স্যাডলে চড়ল লোকগুলো, তারপর ক্রীকের পাড় ধরে আঁধারে মিলিয়ে গেল। শূন্য হয়ে গেল জায়গাটা; সুইস বক্স, গোল্ড প্যান, কোদাল সবই পড়ে থাকল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
নিচের উপত্যকায় যাচ্ছি আমরা, শেরিফ, মনে করিয়ে দিল শেভার্ন। প্রতিটা বসতিতে যাব। নিজের চরকায় তেল দিচ্ছে এমন কারও ব্যাপারে আপত্তি নেই আমার। কিন্তু অন্যরা, যারা ম্যকলেন্ডনদের শেষ দেখতে চেয়েছে এতদিন, স্পষ্ট বলে দেব দুটো পছন্দ তাদের-হয় বেসিন ছাড়ো, নইলে ঝামেলা না করে আজীবন থাকো।
এটা করতে পারো না তুমি! প্রতিবাদ করল শেরিফ।
কিন্তু তুমি পারবে, স্মিত হেসে বলল ও। আমার হয়ে তুমিই করবে কাজটা। আজ রাতে তুমিই সামনে থাকছ, লীড দেবে।
.
মেসার ক্যাম্পে যখন ফিরে এল ওরা, ততক্ষণে ভোর হচ্ছে। পুব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে, ঝিরঝিরে হিমেল বাতাস বইছে উপত্যকায়। ক্লান্ত বিপর্যস্ত বোধ করছে ওরা। যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল, তারচেয়ে সহজে সারা গেছে কাজটা। নিচের উপত্যকার বেশিরভাগ পরিবারই ওদেরকে দেখে স্বস্তি বোধ করেছে, জেনে খুশি হয়েছে কাউকে আর বেপরোয়া পেনি-ফার্দিং রাইডারদের জবরদস্তির শিকার হতে হবে না।
বিশ মাইল দূরের নিঃসঙ্গ একটা কেবিনে দুই বাচ্চা নিয়ে থাকত এক মহিলা, এমন একটা খবরই প্রত্যাশা করছিল সে। কয়েকদিনের উদ্বেগের কারণেই হয়তো। কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল মহিলাকে, শেভার্নের দেয়া গোল্ডেন ঈগলটা নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে নিল, কৃতজ্ঞতার কোন নমুনা প্রদর্শন করল না। ফিরে আসার পথে পেনি-ফার্দিংদের দালানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা, ঘোড়া আর গরুগুলোকে করাল থেকে বের করে ছেড়ে দিয়েছে।
চমকপ্রদ ব্যাপার আরও একটা আছে, হঠাৎ করেই শেভার্নের প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠেছে শেরিফ জেসন বেলহ্যাম। বিদ্বেষী মনোভাব উবে গেছে-হয়তো কদিনের উদ্বেগ আর ক্লান্তির কারণে, কিংবা নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছে-প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জুলিয়া ব্রুকসের সাক্ষ্য নেবে, যোগাযোগ করবে ক্যাম্পাসের কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে; জিম শেভার্ন সত্যিই দোষী কি-না যাচাই করে দেখবে। কারণটা বোধহয় লাল-চুলল, আনমনে ভাবল শেভার্ন, কোন এক ফকে শেরিফের সঙ্গে কথা বলেছে এ নিয়ে, নিশ্চয়ই ও ক্যাম্প ছেড়ে আসার পর কিংবা টেস্টুডো নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়। দুর্ভোগ
সাত বছরের ফেরারী জীবনে অনীহা আর ছোটাছুটির কারণে ও নিজে যা করতে পারেনি, নিজের সমস্ত প্রভাব খাটিয়ে ওকে দোষ-মুক্ত করার চেষ্টা করেছে জুলিয়া ব্রুকস। সন্দেহ নেই আবারও ম্যাকলেন্ডনদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বেসিনে; এবং তা আগের চেয়েও দৃঢ় হবে, কারণ নীল ম্যাকলেন্ডনের যা ছিল না তাই আছে তার বনেদী মেয়ের প্রয়োজনে কঠিন হওয়ার দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস বা সৎ সাহস, কোনটারই কমতি নেই।
ক্যাম্পের জিনিসপত্র গোছাতে সাত-সকালেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জুলিয়া ব্রুকস আর ডোনা রোজাওরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাইডারদের শরীরে মাছির অত্যাচার শুরু হয়েছে। স্যাডল ছেড়ে ক্লান্ত দেহে তাবুর দিকে এগোল শেভার্ন, মাঝপথে ওর হাতে ধূমায়িত কফির মগ তুলে দিল রোজাওরা। বিড়বিড় করে মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। আয়েশ করে বসল বেডরোলে। তেরপলের ফাঁক দিয়ে দেখল গরম কফি পান করে চাঙা হওয়ার পরোয়া করেনি অন্যরা, খোলা জায়গায় বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে।
টেড্রো বা জুড ওর মতই ক্লান্ত। কিন্তু করুণ দশা হয়েছে শেরিফ জেসন বেলহ্যামের, বেচারাকে একেবারেই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আগামী কয়েকদিন হয়তো বিশ্রাম নিয়ে কাটিয়ে দেবে সে, তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সোডা স্প্রিং-এ ফিরে যাওয়ার চিন্তা করবে।
নিচে গিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করা উচিত, কি মনে হয় তোমার? জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস। সবকিছুর পরও সতেজ, কমনীয় লাগছে ওকে; লাল চুলের প্রতিটিই পরিপাটি। নিঃসন্দেহে জুলিয়া ব্রুকস আকর্ষণীয় নারী।
প্রশ্নটা নিজের মনে নেড়ে-চেড়ে দেখল শেভার্ন। জীবনে কোন কিছুই নিশ্চিত নয়, ম্যাম। আবারও যে এখানে অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে না তা কে বলতে পারে! তবে আপাতত শান্তির সময়। তোমরা ভাই-বোন যে কোন সময়ের চেয়েও ধনী এখন। হয়তো সব তিক্ততা ভুলে অন্য কোথাও নতুন ভাবে শুরু করা উচিত।
আড়চোখে রোজাওরার দিকে তাকাল মিসেস ব্রুকস।
বুঝতে পেরেছি। ওরা তোমার লোক, তুমি না থাকলে…
অথচ আমাদের অপরাধের কারণে এদেরকেই ভুগতে হয়।
অপরাধ?
হ্যাঁ, মি, শেভার্ন। লরেন্স বা ক্যাম্পাসই শেষ নয়। আমরা সবাই সমান দোষী এখন। গণহত্যাই তো বলা উচিত এটাকে, যেভাবে খুন হলো নিচের লোকগুলো? হয়তো বিকল্প কোন উপায় ছিল, কিন্তু খুঁজে পাইনি আমরা। পরিস্থিতিই বাধ্য করেছে আমাদের।
স্যানস অম্বার দ্য মতে? ফ্রেঞ্চে জানতে চাইল শেভার্ন।
বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, প্রতিধ্বনি করল মহিলা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটা বিবেচনা করছে। অনেক কাজ পড়ে আছে-কবর খুঁড়তে হবে, অস্থায়ী ভাবে থাকার জন্যে কেবিন তৈরি করতে হবে, ভেড়ার পাল আর হার্ডারদের খুঁজে বের করতে হবে।
পুরোপুরি নিশ্চিত তুমি?
একসময় সবাইকেই থামতে হয়, মি. শেভার্ন।
লোভনীয় প্রস্তাব। দুরুদুরু করছে ওর বুক। জীবনে এরচেয়ে বেশি ক্লান্ত বোধ করেছে কি-না, কিংবা কখনও এরকম নীরব শান্তিপূর্ণ একটা জায়গারও প্রয়োজন বোধ করেছে, মনে করতে ব্যর্থ হলো শেভার্ন। ঠিক আছে, সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া পর্যন্ত থাকব আমি, তারপর না হয় ভেবে দেখা যাবে।
চাপা, রহস্যময় হাসি দেখা গেল মিসেস ব্রুসের ঠোঁটের কোণে। সরে এসে শেভার্নের পাশে বসল, চোখে চোখ রাখল। সঙ্গী হিসেবে আমি কি একেবারেই নীরস?
ক্ষীণ হাসল শেভার্ন। স্কট মেয়েরা বরাবরই চাপা, কিন্তু এদের চরিত্রের বিশেষত্ব-যা দেবে উজাড় করে দেবে, যদি ভালবাসে তো সেটা হবে গভীর ভালবাসা, অথচ মুখে হয়তো কখনোই স্বীকার করবে না।
হাত বাড়িয়ে জুলিয়া ব্রুকসের কোমর চেপে ধরুল ও, ভাবছে হয়তো ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে দেবে লাল-চুলো, বলবে এতক্ষণ স্রেফ তামাশা করছিল ওর সঙ্গে। আমি খুব খারাপ মানুষ!
আমিও খারাপ। তোমাকে থাকতে বাধ্য করেছি, মিথ্যে বলেছি।
কারণ আমাকে দরকার ছিল তোমার-লড়াই করার জন্যে?
শুরুতে প্রয়োজনটা তাই ছিল। কিন্তু এখন
এখন?
আমাদের অভিভাবক হবে তুমি, সবকিছু দেখাশোনা করবে, আর… চুলের মত লাল হয়ে গেল ফর্সা অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা, দুহাত তুলে শেভার্নের গলা জড়িয়ে ধরল জুলিয়া ব্রুকস, ফিসফিস করে শেষ করল কথাটা: আমাকে ভালবাসবে!
এটা কি অনুরোধ, না নির্দেশ? কৌতুক শেভার্নের স্বরে।
হুকুম!
যো হুকুম, ম্যাম! জুলিয়া ব্রুকসের ঠোঁটে আলতো স্পর্শ বুলিয়ে দিল শেভার্ন, তারপর লাল-চুলোকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। আচমকা ঘুরে দাড়াল ও, গম্ভীর হয়ে গেছে মুখটা। শেরিফের কথাটা মনে আছে, জুলিয়া, সামান্য একজন টিনহর্নের পক্ষ নিয়েছিলে তুমি? আবারও হয়তো একই ভুল করতে যাচ্ছ…হয়তো দেখা যাবে এবারও ভুল লোককে বেছে নিয়েছ!
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল জুলিয়া ব্রুকস, এগিয়ে এল। মুখটা হাস্যোজ্জ্বল, সবুজ চোখে অনিশ্চয়তা নেই কোন। হতে পারে, নিচু, স্পষ্ট স্বরে বলল, কিন্তু আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। ভুল লোককে যে বেছে নিইনি সেটা গত কয়েকদিনেই বোঝা গেছে। এও জানি, আমি ঠকব না।
তিক্ত হাসল শেভার্ন। লাল-চুলোর বিশ্বাস কি মাত্রাতিরিক্ত নয়? কিন্তু…
কিন্তু কি? ওর চোখে চোখ রাখল যুবতী।
নাহ, থাক!
স্মিত হাসল জুলিয়া, সামনে এসে শেভার্নের একটা বাহু চেপে ধরল। তারপর দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে এল তাঁবু থেকে। ঢালের কিনারে এসে দাঁড়াল ওরা, খেয়াল করল না কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওদের দেখছে জড আর বাজাওরা। দুর্ভোগ
শেভার্নের গা ঘেঁষে দাঁড়াল জুলিয়া, এক হাতে ওর বাহু জড়িয়ে ধরে রেখেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সত্যিই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম আমি, কারণ শেরিফ, প্রতিবেশী, আমার অভিজ্ঞতা…সবকিছুই ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। আবার, কখনও ম্যাকলেন্ডনদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এখানে, ভাবতেই অসম্ভব মনে হত। তুমিই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছ, জিম, একাই সামাল দিয়েছ সবকিছু। উপায়টা হয়তো পুরোপুরি সৎ ছিল না, কিন্তু সাফল্যটাই আসল। ভুলগুলো শুধরে নেব আমরা, নতুন করে শুরু করব আবার। আমার এই সুসময়ে সবচেয়ে বড় শুভাকাক্ষীকে ছাড়ি কিভাবে, যার জন্যে এতকিছু সম্ভব হয়েছে? অনেক ছুটাছুটি করেছ, জিম, থামো এবার, সরে এসে শেভার্নের বুকে মাথা ঠেকাল মহিলা, তারপর রুদ্ধ স্বরে শেষ করল কথাগুলো: আমার জন্যে! আমার পাশে থাকো!
দূরে পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় জমে থাকা শুভ্র বরফের চাঙড়, সবুজ পাহাড় আর নয়ন জুড়ানো উপত্যকায় চোখ বুলাল শেভার্ন, বুক ভরে টেনে নিল পাইনের মিষ্টি গন্ধ মাখা সুবাসিত বাতাস। জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, এবং এ মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসী এই নারীটির নিবিড় উপস্থিতি উপভোগ্য মনে হচ্ছে। একেবারে ওর মনের কথাটা বলেছে ম্যাকলেন্ডন-কন্যা, একসময় সবাইকেই থামতে হয়। থিতু হওয়ার জন্যে এরচেয়ে সুন্দর জায়গা সারা পৃথিবীতে আছে নাকি? কিংবা জুলিয়ার মত কাক্ষিত নারী? মনে হয় না, আনমনে ভাবল জিম শেভার্ন, অন্তত আমার জন্যে নেই কেউ।
Leave a Reply