দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে (গদ্যকবিতা গ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
উৎসর্গ –
আমার স্ত্রীকে।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে নয়, সে আমার ঘরেই বসবাস করছে শুরু থেকে, এবং জীবনমৃত্যু পর্যন্ত।
১. রাত্রিভূক অনাহারী
রাত গভীর হলেই দরজা খুলে বনের নিবিড়ে যেতে মন চায় । যেখানে বন পাশেই স্বচ্ছতোয়া নদী বয়ে চলেছে । নদী থেকে শীতল বাতাস বয়ে আসে। অন্ধকারে চোখ মেলে খুঁজব কাউকে। মন বলবে – কোথাও আমার কেউ নেই, কেউ নেই।
তারপরও ডাকব কাউকে- ‘এসো, এসো তুমি রাতের নিভৃতে তারার আলোয় ছায়াপথ ধরে এই বনকুঞ্জে, এই নদীর কূলে।’
আমার আর্ত ডাক কী শুনতে পাবে না কেউ ! এসো গো তুমি। এসো। বড়ই রাত্রিভূক অনাহারী আমি এই রাতে । বড়ই কাঙাল আমি ভালোবাসা পেতে।
২. নীল নীল- নীল আকাশ
দিনের বেলায় অনেকটা অসময়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি ছেলেবেলার। সাবানের ফেনায় ফু্ঁ দিয়ে শতশত বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছি আকাশের দিকে। উড়ে যাওয়া বেলুন দেখতে দেখতে — ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে শুনতে পাই ঘরের কার্নিশে বসে একটি কাক কা-কা করে ডাকছে। ডাকটা কর্কশ মনে হলো না। ও তো পাখি। এটি ওর কথা। কান্নাও হতে পারে।
খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। নীল মেঘে ঢাকা নীল আকাশ দেখতে পাই। আহা ! পাখি কিংবা মেঘ হয়ে যদি উড়ে যেতে পারতাম। মনে মনে ভাবি — আকাশের ঐ নীল মেঘ হয়ে থাকা অনেক ভালো ! নীল মেঘেই যেন জীবনের সৌন্দর্যগুলি লুকিয়ে আছে !
৩. দুই বিন্দু নয়নের জল
এক.
সারাটা জীবন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যেন একদিন আর এক রাত্রির সমান। দিন শেষে ঘুমালাম, ঘুম ভেঙ্গে দেখি– জীবনই শেষ। কত স্বপ্ন ছিল, সে সব আর দেখা হলো না। সব স্বপ্নই কি এক রাত্রিতে দেখে শেষ করা যায় ? সব চাওয়া পাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল।
দুই.
প্রতিক্ষায় থাকি তুমি আসবে, তাই ঘরের দরজা খুলে রাখি। উঠানের কাছে এসে থেমে গেলে তুমি। মনে হলো পথ ভুল করেছ। না চিনেই চলে গেলে। তুমি না আসো। আমার দেহ এক সময় নীল হবে। নীল পাথরের দ্যূতি ছড়াবে তোমার ঘরের পথ পর্যন্ত। সে আলোয় তুমি পথ খু্ঁজে পাবে আমাকে খু্ঁজে পাবার। তখন এসে পাথরে লিখ তোমার নাম।
৪. সন্ধ্যার অভিবাদন
মন ভালো লাগছিল না। বাসা থেকে তাই একাকী হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দিয়াবাড়ী। সাদা কাঁশফুলের পাশের পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। পড়ন্ত বিকালের নির্মল বাতাসে ফুলগুলি দুলছিল। ফড়িং প্রজাপতিরা তখনও উড়ছিল ফুলে ফুলে। লেকের পাড়ে যেয়ে বসে থাকি কতোক্ষণ। দেখলাম, দূর দিগন্তে বৃক্ষরাজির আড়ালে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যার কি এক আশ্চর্য মায়াবী আলোয় ছেয়ে গেল দিয়াবাড়ীর আকাশ। মনটা আমার ভালো হয়ে গেল। আজকের এই হেমন্ত সন্ধ্যার এই ভালোলাগা পাঠিয়ে দিচ্ছি তাই সবার করে, যে যেখানে আছে পৃথিবীর যে প্রান্তে !
৫. অপার আনন্দধারায়
তুমি আমার কাছে এসেই ত্রস্ত হরিণীর মতো ছটফট করো, তাড়া করো চলে যাবার। দ্রৌপদীও এমন করে না দেবতার সাথে মিলন পর্বে। তোমার অম্লান দেহখানিি ধূসর ধূলায় মিশিয়ে দাও। আমি পেতে চাই সৃষ্টির সুখের উল্লাস। ভালোবাসার আকুলতায় কোনও কান্না রাখতে নেই। তুমি থেকে যাও এখানেই, আমার বাহু লগ্নে, এই অপার আনন্দধারায়।
৬. জলস্রোতের কান্না
কেমন করে তোমাকে এত ভালবাসি। কেমন করে তোমাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখি। তুমি তো ভেসে যাবে কোনও নদীর মতো জলস্রোতে একদিন। কত কথা হয়েছিল, কত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল আমাদের চার চোখ মিলে। সব কথা, সব স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়ে যাবে? তুমি চলে গেলেই কী ভালোবাসার মৃত্যু হবে? জানিনা মৃত্যু কী, জানিনা বিচ্ছেদ কী?
আমি কী তোমাকে আমার দুঃখ বেদনাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম কোনও মর্মরিত জীবনের উঠান থেকে বস্তুবৃক্ষের ঝরা ফুলের মতো।
৭. দাঁড়িয়ে আছ
কাল থেকে শরীরটা একটু খারাপ ছিল। এখন এমন হয়েছে যে, শরীর সামান্য খারাপ হলেই মন বিষাদ হয়ে যায়। এই যে মন খারাপ হয়ে যাওয়া, তা কিসের জন্য হয়? তা কি পৃথিবীর জন্য হয়? নাকি স্ত্রী সন্তানদের জন্য। কেন যে এই মায়াগুলো নিজের জীবনের উপর এসে পড়ে।
এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আজ দুপুরে অসময়েই ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি — একটি কোমল হাত আমার কপালে ছুঁয়ে আছে। যেন দাঁড়িয়ে আছে কেউ আমার জীবনের পাড়ে। বুঝতে পারি, পৃথিবীর মায়াগুলো এমনি করেই জীবনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
৮. রুপালি জলে স্নান
তারা ভরা ঐ আকাশটার আজ অনেক নেশা ধরেছে। যে-নেশায় এক অখ্যাত প্রেমিক রাত্রির আকাশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চাইছে। যে আকাশের টানে ঘর ফেলে সে বাইরে চলে যেতে চাইছে। জ্যোৎস্নার ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে যেতে চাইছে তার প্রেয়সীকে নিয়ে। রুপালি জলের ধারায় আজ স্নাত হবে তারা।
৯. বসন্তের পদধ্বনি
ঘরের দুয়ারে বসন্তের পদধ্বনি শুনতে পাই। যে বাতাস বইবে আসন্ন বসন্ত দিনে, তা কি আমার জীবনের পূর্ণতাকে ধুলো বালিতে ঢেকে দিবে ? আমার জীবন পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার শক্তি দিয়ে জীবনের বাকী পথ চলে যেতে পারব। আর যদি না পারি তুমি তো আছোই আমার পাশে।
১০. আমাদের অসম্পূর্ণ প্রেম
আমাদের ভালোবাসা কেমন? সম্পূর্ণ না অসম্পূর্ণ? সম্পূর্ণ প্রেম শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অসম্পূর্ণ প্রেম নিঃশেষ হয় না। সেই প্রেম পূর্ণিমা নিশীথের মতো কাছে টানে। বহু যুগ আগে কোথায় কখন একটি গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, কে ছিল সেই গল্পের দুই মানব মানবী? সেই গল্পের কাহিনী এখনও যে শেষ হয়নি। তারা দুজনই পাশাপাশি হাঁটছে পৃথিবীর পথে। এখনও দুজন দুজনের হাত ধরে আছে।
কত পায়ের ছাপ পড়ে আছে কত পথে। কত পথের ধুলো উড়েছে তাদের পায়ে পায়ে। কত কৃষ্ণচূড়া, কত বাবলা বৃক্ষ, কত অশত্থের ছায়া পড়েছে তাদের উপর। কেউ তা দেখতে পায়নি কখনও।
কত যুগের কত ভালোবাসার মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। কত ভালোবেসে যৌবন শেষ করেছি আমরা। এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে দিয়ে আমরা হাঁটিনি। পথের ধারে কত রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েছি। কত নদী মরুপথ, ট্রেনে বাসে, রিক্সায়, নৌকা লঞ্চে চলেছি। কত ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলাম। আলিঙ্গনে বিমুগ্ধ হয়ে কত সময় পার করেছি। কোনও প্রেমই সম্পূর্ণ করতে পারেনি এই অতৃপ্ত যুগল।
কোনো এক সময় আমরা কেউ কোথাও থাকব না।
বুড়ো হাবরা হয়ে মরে মিশে যাব একদিন এই মৃত্তিকা তলে। আমাদের ভালোবাসার সৌরভ অনাদিকাল সেই সব রাস্তার অলিতে গলিতে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে।
বহু যুগ পরে হয়ত আমাদের হেঁটে যাওয়া রাস্তাগুলো দিয়ে অনাগত কোনও যুগল বর্ষার সন্ধ্যাতে হেঁটে যাবে। আর হঠাৎ করে সেই কবেকার আমাদের অসম্পূর্ণ প্রেমের শিরশিরে বাতাস তাদের গায়ে লাগবে। তখনকার তাদের সেই অনুভব অচিন কোনও প্রান্ত থেকে আমরা কী তা বুঝতে পারব?
এই গানটা যতবার শুনি —-
‘অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে
কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে।
সে কি তোমার মনে আছে তাই শুধাতে এলেম কাছে–
রাতের বুকের মাঝে মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে।’
আজ এত বছর পরে অনেক ভাবনাই বেশি বেশি করে মাথায় জেঁকে বসে। ঠিক যেন মনে হয় দুটো মানুষ তাদের জীবনে উপান্তে এসে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাচ্ছে ফেলে আসা অসম্পূর্ণ প্রেম গুলোর দিকে। যেখান থেকে তারা পার্থিব কিছু পায় নি। কিন্তু শিখেছে অনেক, ঋদ্ধ হয়েছে অনেক।
১১. বসন্ত দুপুরের পংক্তিমালা
এখনও রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে
হঠাৎ মনে পড়ে যায়, কেউ একজন আসবে বলে আর আসেনি। কেউ একজন আসবে বলে আয়োজন করেছিলাম অনেক কিছুই। তার পুরোনো চিঠিগুলোতে আছে অনেক কবিতা, সুন্দরতম শব্দমালা। আছে মুগ্ধ করা অনেকগুলো মূহুর্ত। অনেক হৃৎস্পন্দনের অনুরণন…
কেমন যেন হাহাকার বুকের মাঝে। ঠিক কষ্টেরও না, কেমন যেন। সবাইকে লুকিয়ে একলা রাতে বালিশে মুখ গুঁজে রাখতে মন চায়। হাতের সব কাজ ফেলে দিয়ে মনে হয় স্টেশনের সেই কাঠের বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসে থাকি। মনে হয় বসন্তের ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর উপর মর্মর আওয়াজ তুলে হাঁটতে হাঁটতে দূরে কোথাও চলে যাই।
১২. পরজনম
যেদিন আকুল হয়ে বইবে বসন্ত বাতাস, যেদিন সবুজ বৃক্ষরাজির পল্লব ঝিরি ঝিরি করে দুলে উঠবে, যেদিন পূর্ণিমা রাতের ধূসর ছায়া পড়বে পদ্মপুকুর জলে —
সেদিন সেই দিনে, সেই রাত্রিতে আমি আসব তোমার কাছে, হাজার বছরের অন্ধকার রাত্রির পর হলেও আমি আসব।
১৩. প্রেম
প্রেমে পড়া কাকে বলে? এই যে আৃমি —
এই শহরটাকে ভালোবেসে পৃথিবীর অন্য কোনো ঝলমলে শহরে থিতু হইনি,
সন্ধ্যাবেলা বের হলে কোনো না কোনো বাড়ি হতে ধুপের গন্ধ পাই,
কবরস্থানে দাঁড়িয়ে নীল আকাশ যেমন দেখি
আবার বুড়িগঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে দেখি বিকালের বিষণ্ণ সূর্যাস্ত,
রেল স্টেশনে থেমে থাকা ট্রেনের জানালা দিয়ে কেউ না কেউ অপলক চেয়ে থাকে,
সকাল বেলা হাঁটতে যেয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের বড়ো পুকুরটাতে কস্তরি ফুল ফুটে থাকতে দেখি –
বাঁশঝাড়ের তলায় যত নিঃশব্দেই হাঁটি না কেন, শুকনো পাতার মরমর ধ্বনি শুনতে পাই,
বাড়ির সম্নূখে পিচঢালা রাস্তাটাতে হাঁটার সময় মনে পড়ে এখানে আগে মেঠোপথ ছিল,
প্রাইমারি স্কুলে নতুন কুঁড়িরা যখন হেঁটে যায়, তখন মনে পড়ে আমার কৈশোর কথা!
আমি এইসবের প্রেমে পড়ি, এইসব কী প্রেম নয়?
১৪. এসো
এসো আমার হাত ধরো, অচেনা পথ ধরে চলে যাই কোথাও। যেখানে কোনো সভ্যতা নেই। আছে চাঁদের পাহাড়, আছে নদী। বনারণ্য আড়াল করে রাখবে আমাদের। আকাশও ঢেকে রাখবে। এমন মনুষ্যহীন লোকালয় কোথায় আছে ? যেখানে প্রথম কথা হবে আমাদের। প্রথম কোলাহল, প্রথম পায়ের চিহ্ন আমরাই এঁকে আসব।
মেঘ থম্ থম্ করছে। বৃষ্টিও ঝরছে। হোক বাদল দিন। তারপরেও বেরিয়ে পড়ব ঐ অচেনা পথেই। আনন্দময় হোক পথ চলা।
১৫. কোনো বসন্ত দিনে
এইসব অন্ধকার দিন, এইসব নিবিড় তিমির রাত্রি পেরিয়ে একদিন ঠিক দেখা হবে চাঁপাগন্ধ কোনো বসন্ত দিনে। তখনই খোঁপায় বেঁধে দেবো নিশি চন্দন। সেই অপার্থিব সাক্ষাৎ মূহুর্তে আমি স্থানু হয়ে গ্রহণ করব পার্থিব যত সুখ…..
১৬. আত্মার অনুভব
আচ্ছা, মরে গেলে তো মাটিতে চিহ্নহীন হয়ে যাবে এই দেহ। আর সেই মাটির উপর যদি মাধবীলতার ঝাড় হয়। যদি তার গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে কোনো সন্ধ্যা।
কিংবা রাত্রি জোনাকীরা গুণগুন করে গান গায় সেই মাধবীলতার ঝাড়ে।
যদি কোনো কিশোরী ঐ মাটি ছেনে পুতুল বানিয়ে খেলা করে কোনো নিঝুম দুপুরে!
আমার আত্মা কী এইসবের কোনো অনুভবই পাবে না তখন?
১৭. আঁধারে আলো
এই পৃথিবীতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ কেমন যেন আঁধার নেমে আসে। চারদিক থেকে সব আলোগুলো নিভে যেতে থাকে। তখন আর পথ চলতে পারি না। লিখতে পারি না কোনো কবিতা। অনিঃশেষ আঁধারে কেমন যেন পথ হারিয়ে ফেলি।
আঁধার সরাতে তখন তোমার প্রদীপখানিতে একটু আলো জ্বালিয়ে তুলে ধোরো।
১৮. শেষ দৃষ্টি
তোমার কোমলময়ী করপুট থেকে সব ঝরে যায় – প্রেম, মায়া মমতা, স্পর্শ সব।
তোমাকে না দেখে আমি চলে যাব না কোথাও, স্থবির ও অবশ হয়ে যায়নি এখনও অনুভবের স্পন্দন।
চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অন্তত আর একবার দেখে নেব তোমার চোখ, দেখব সেখানে কোনও অশ্রুবিন্দু লেগে আছে কী না।
১৯. সেই চোখ
সেই চোখ যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, দীঘির স্বচ্ছ জলে তা ছিল প্রতিবিম্বিত, জলোচ্ছ্বাসের মতো সিক্ত, বিস্মিত মিলন অভিলাষী ও অশ্রুপাতক্ষম। কোনও কথাই বলিতে চাহিল না। শুধু মায়াটুকু রাখিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িল।
২০. অপ্রস্ফুটিত ফুল গলি
সেই কবে অপ্রস্ফূটিত ফুলগুলি বিকশিত না হয়েই
ঝরে গেছে, যারা কলি মেলেছিল আমার প্রথম যৌবনের মৌবনে।
দখিনা বাতাসের কানে কানে তারা বলে গিয়েছিল চির বিরহিনীর নিশ্বাস ফেলে-
‘তোমার আছে বিশ্ব, আছে অনন্ত আকাশ। তুমি সেথায় নক্ষত্র হয়ে বিচরিত। তুমি সেথায় মুখরিত।’
কিন্তু, তারা দেখতে পায়নি,
মুখরিত নক্ষত্রেরও চোখে জল আছে ।
২১. আমার স্বপ্ন
একদিন আমার স্বপ্ন চোখে যখন তুমি এসে ধরা দিলে, মনের মধ্যে তখন যেন অদ্ভুত এক মুক্তির আনন্দ বয়ে গেল। এ মুক্তি অব্যবহিত অন্তর্জালকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে জানান দিল জগতে প্রেম আছে। শরীর নয়, আত্মার কাছকাছি স্বর্গীয় সুধা আছে। তোমার প্রেরণায় জীবন আমার এগিয়ে গেল। যুগ বয়ে যাচ্ছে তোমাকে নিয়ে। তোমাকে কতটা যে ভালোবাসি, এতটা যে কোন পাহাড়ের ক্ষমতা নেই পরিমাপের, এতটা যে কোন আকাশে না এ বিস্তৃত হবে, এতটা যে না কারো চিন্তায় এর জায়গা হবে।
২২. অস্তকাল
মানুষ একটা সময়ে স্নিগ্ধ কোমল স্বভাবের হয়ে যায়। সেকি তখন দূরাগত পরপারে্র ডাক শুনতে পায়। এই কারণে ? নাকি কিছু সময় আসে শুধু ভালোবাসবার। পৃথিবীর ধূলো বালি মাটি খড়কুটোও তখন প্রিয় হয়ে ওঠে।
কোনো মৃত্যু চেতনা থেকে নয়, মৃত্যু ভয় থেকেও নয়, একটা সময় মানুষ ভালোবাসে চিরদিনের নীল আকাশকে, স্ব্প্ন দেখানো মানুষকে, নদী সাগর জনারণ্যকে।
আমি কি সেই রকম কোনো সময়কাল অতিক্রম করছি ? নিজকে কেমন যেন কাঙ্গাল লাগে। সবাইকে ভালোবাসতে ই্চ্ছা করে। সবার কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে। আর, পৃথিবীটাকেও স্বর্গীয় মনে হয় !
২৩. দূরের তুমি
দুরে চলে গেছ। তবু তোমার ছায়া পড়ে থাকে। বর্ণিল ছবি আঁঁকা থাকে মেঘে। দুরে চলে গেছ। তবু বাতাসে গন্ধ ভাসে তোমার চুলের।
উড়ে গন্ধ যেন অমরাবতীর। বাতাসও মাতাল হয় সে রঙে বহু বর্ণময় হয়ে। যেন গান শেষ তবুও তার সিম্ফনী মিশে যায় দশ দিকে।
আজ তোমাকে অন্য নামে ডাকতে ইচছা করছে। নাম কী দেবো তার?
যদি ডাকি অমরাবতী ।
২৪. পথের যত ভাবনা
পথকে নিয়েই পথিকের যত ভাবনা। পথের উপর যাদের চরণপাত পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়েছিল আজ তারা কি কোথাও নেই?’ পথ কি নিজের শেষকে জানে? যেখানে লুপ্ত ফুল আর স্তব্ধ গান বেদনাহত হয়। যেখানে পথিকরা পথ হারায়।
২৫. আমাদের মংপু নেই
একঘেয়ে লাগছে। আমাদের তো মংপু নেই। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িও নেই। যেখানে গিয়ে মন পরিবর্তন করে আসব। সেই গলিমুখের বাড়ি। একই ঘরের ছাদ। জানালা খুললে একই আকাশ। এমন করে থাকলে অনেক কথাই মনে পড়ে। ভুলে যাওয়া কথাও। ভুলে থাকা মুখ। ধুলোয় জমে থাকা প্রিয় পোট্রেট। কাল রাতে খুব খারাপ লাগছিল, রক্ত প্রবাহে কেমন ভাটার টান। সেই পুরনো বেদন নতুন করে।
খুব মনে পড়ে। মাঝে মাঝে অনেক বেশি। এক নিঝুম একাকী বিকেলে ইন্দিরা রোডের একটি বাড়িতে শেষ পড়েছিলাম, সেও বত্রিশ বছর আগে। মন খারাপের উপর মন খারাপ এসে তাড়া করে। আজ আবার মনে পড়ছে নিজের মতো করে — ‘আমার এই পুরুষের বাহু নিশ্চেষ্ট থাকতে চায় না। ইচ্ছা করে, স্বর্গমর্তের সমস্ত শাসন বিদীর্ণ করে তোমাকে তোমার জীবনের ব্যর্থতা থেকে উদ্ধার করে আনি। তার পরে এও মনে হয়, তোমার দুঃখই তোমার অন্তর্যামীর আসন। সেটি হরণ করবার অধিকার আমার নেই।’
সবই এলমেল কথা এই যাপিত জীবনের। কদিন অন্য কিছু নিয়ে থাকব। অন্য ভাবনা। অন্য কর্ম। পাণ্ডুলিপি পাণ্ডুর হয়ে পড়ে আছে। ঐদিকেই ধাবিত হোক এই প্রাণ। ওখানেই প্রাণ খুঁজে পাব। ফিরে যাব দেবযানীর কাছে।
২৬. এই গৃহ এই সন্নাস
আমি সংসারেই খু্ঁজেছি সুখ, সংসারেই পেয়েছি শান্তি, স্ত্রী সন্তানদেরই করেছি মায়া। এখন এই মায়া ছিন্ন করে চলে যেতে হবে পরপারে। এই যে চলে যাবার ভাবনা, এই যে কষ্ট পাওয়া- তারচেয়ে যদি সিদ্ধর্থের মতো প্রথম জীবনেই গৃহ ছেড়ে চলে যেতাম কোনো আশ্রমে, কিংবা ফকির দরবেশদের মতো পড়ে থাকতাম কোনো মাজারে, সেই মনে হয় ভালো হতো। এতো মায়াও করতে হতো না, চলে যাবার এই যে বেদনা তাও পেতে হতো না। ঐখানেই জীবন নিঃশেষিত হতো। ঐখানেই মরে পড়ে থাকতাম । কেউ জানতোও না, কেউ কাঁদতোও না।
২৭. তোমার সত্ত্বা
তোমার সত্ত্বা আমার ভালোবাসার সুবাস নিক। তোমার পায়ের পাতা স্পর্শ করুক যেখানে আমরা হেঁটেছি এক সাথে। আমি চাই আমার মমতার ছোঁয়া লাগুক তোমার দ্রোহে আর ঘৃণায়। আমার সমস্ত গীতিকবিতা যাকে নিয়ে, সেই তুমি, আমার গভীরতম ভালোবাসায় নিয়ত পুষ্পিত, পল্লবিত হও। এভাবেই আমার প্রেমের নির্দেশে তুমি স্পর্শ করো আমার সত্তা। আমরা একদিন থাকব না, আামাদের পদচিহ্নগলো থাকুক এই পার্থিবে অনন্তকাল।
২৮. সীমান্ত
বয়স হয়ে গেল এখনও স্বপ্ন দেখা শেষ হলো না। শুক্লপক্ষের রাতেও স্বপ্ন দেখি, কৃষ্ণপক্ষের রাতেও দেখি। কিন্তু সেই সবই দুঃস্বপ্ন ও ক্লান্ত নিশিচারণের। আর কয়েকবছর পর মাথার চুলগুলো গুণে বলে দিতে পারব। কপালের ভাজগুলোও আঙুলে ধরা পড়বে। আগে দৌড়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতাম। এখন হেঁটে হেঁটে চলে যাই পার্কে ও লেকের ধারে। চাইলেই আর হাত পা ঝাপিয়ে পুকুরে সাঁতরাতে পারব না।
ছায়া পড়ে উঠোনে। রোদ্দুরে ঢেকে যায় দুপুর। একটি একাকী শালিক চুপচাপ বসে থাকে কার্নিশে। উড়ে গেলে পড়ে থাকে দুই একটি পালক। চাইলেই আগের মতো শিস মেলাতে পারব না কোনও সাদাকালো দোয়েলের সাথে।
পিয়ানোর রিডের উপর আর আঙুল চলবে না আগের মতো। চাইলেই গানও গাইতে পারব না। ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ হবে কণ্ঠে। পারব না একটি গীতিকবিতা লিখতেও। কলম যে চলতে চাইবে না।
২৯. দিবারাত্রির কাব্য
কেমন যেন বিষণ্ণের দিন। কেমন যেন বিষণ্ণের রাত্রি। একাকীত্বের অস্থিরতা। নৈঃশব্দ্য চারদিক। কিছুই হলো না। এখন শুধুই ক্লান্তি।
তোমার কী হয়েছে? কেউ জানে না। অন্ধকার জানে। বিষাদ রাত্রি জানে।
এলমেল ভাবনা যত। তোমাকে অনেক নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ডাকব? আজকে তুমি প্রথম শ্রাবণ। সঙ্গে চাঁপার গন্ধ মাখব।
কত কথা মনে পড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পশ্চিম পাড়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি কত পদ্মার ঢেউ। ব্রিজের লাল পাতে লিখে রেখেছিলাম সাহানা জোয়ার্দারের নাম।
সে নাম মুছে গেছে। এখন সবই চাঁদের রাতের আবছায়া অন্ধকার। তারপর এল তোমার নাম। সে নাম নিয়ে কবিতা লেখা হয়। সে তুমি আমার সকল দিবারাত্রির কাব্য।
৩০. স্বপ্নের কথা
আজ এই হেমন্তের সকালে প্রথম মনে পড়ল – রাতের ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের কথা। জ্যোৎস্নার আকাশ ভেসে গেছে অন্ধকারে। আমার গল্পের কথা বলা ছিল সেখানে। সেখানেই ছিলে তুমি বিরাজমান। খুঁজতে হয়নি দূরে কোথাও গিয়ে। যখন স্বপ্ন ভাঙ্গল- দেখি, তুমি দূরে চলে গেছ। কাছ থেকে তোমাকে খুঁজলাম, পেলাম না। দূরে তাকিয়ে দেখি – তুমি কাছেই আছ।
৩১. এই পথ যেন শেষ না হয়
আমি নিরন্তর পথ চলছি। এ চলার যেন শেষ নেই। কাশবনের ছায়া দিয়ে,পলাশ ডাঙ্গার মাঠ মাড়িয়ে,পদ্মফুলের গাঙ পেরিয়ে যে পথ চলে গেছে সামনে, সেই পথ দিয়ে আমি দেশ গা্ঁ ছাড়িয়ে চলে গেছি বহূদর !
আমি একাই পথ চলেছি। পথ চলবে বলে যারা আমার সাথি হয়েছিল, তারা মাঝ পথ থেকেই আমাকে ফেলে চলে যায়।
তারপর কখন কোন্ স্বর্নালী প্রভাত বেলায় তুমি আমার পথের প্রান্তে এসে সাথি হলে।
তারপর থেকে তোমাকেই নিয়েই পথ চলছি, আর এই পথ চলা যেন কোনও দিন শেষ না হয়।
৩২. আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবী
আশ্চর্য রকমের সুন্দর আমাদের এই পৃথিবী। কত রহস্য ধারণ করে আছে এই পৃথিবীতে। কত সৌন্দর্যই না আছে এখানে। সেই সৌন্দর্যের শুধুমাত্র সূচীপত্রে চোখ বুলাতে গেলেও মানুষের একজীবন শেষ হয়ে যাবে । পৃথিবীর সব সৌন্দর্য দেখবে সে কখন ! ঈশ্বর যদি আমাকে সহস্র বছরের জীবন দিয়ে বলত– কোন্ গ্রহে আবার ফিরে যেতে চাও তুমি ? আমি বলতাম— আমি আমার অসম্ভব সু্ন্দর পৃথিবীতেই আবার ফিরে যেতে চাই । সহস্র বছর ধরে বে্ঁচে থেকে দেখতে চাই, পৃথিবীর সব রূপ রস সৌন্দর্যগুলি।
৩৩. কমলদীঘি
একদিন এক অস্তগামী সূর্যের বিকালে স্নান সারিয়া রমণী বসিয়াছিল কমলদীঘির শান বাঁধানো ঘাটের সোপানে। বিনম্র কুচভারে সে জলের দিকে তাকিয়া ভাবিতেছিল, ‘তোমাকে আমি প্রাণ দেবো তবুও আমার প্রেম থাকিবে আমার অন্তরে।’
দক্ষিণের দিকে হইতে ঝিরিঝিরি বাতাস বহিতেছিল। মাথার কালো কেশ এলমেল উড়িতেছিল। কী কথা ভাবিয়া সে আবার সোপানে পা রাখিল। জলে নামিয়া কমল ছিড়িল। সে নিজেই মৃণাল পরিধান করিল খোঁপায়। বিমুগ্ধ ছিল রমণী। জলের পরিধি কত, সে বুঝিতে পারিল না।
সে ছিল কমলিনী। রাজ্যের সব মানুষ তাহাকে কমল বলিয়া ডাকিত। তাহাকে কেউ খুঁজিয়া পায় নাই। কিন্তু সে যে অজস্র কমলের মাঝে কালকালান্তর ধরিয়া ফুটিয়া আছে। সে যে ভাসিয়া বেড়ায় দীঘিতে। তাহার ভেজা পাপড়িতে অশ্রু-সম-জল লাগিয়া থাকে। রোদ্রে তাহা শুকিয়া যায়। সবাই ঐ দীঘিকে কমলদীঘি বলিয়া ডাকে।
আজও কোনো উন্মূল প্রেমিক ঐ দীঘির পাড়ে বসিয়া ভাবে — ‘তার রূপ-রত্নাকরে ;
মগ্ন হয়ে, তারে আমি সঁপিলাম মন!’
৩৪. গতস্য শোচনা নাস্তি
যারা একদিন ভালবেসে ভালবাসা পায়নি, তারা অনেকেই নক্ষত্র হয়ে চলে গেছে। কত অসমাপ্ত চুমুর দাগ পড়ে আছে নির্গন্ধহীন। রাতে সারা ঘর অন্ধকার হলে পাশে ঝোপের ভিতর জ্বলে ওঠে দু-একটি জোনাকি। কবেকার নির্মাল্য ভালবাসার কথা মনে পড়ে যেয়ে মনখারাপ হয়।
স্টেশনের হুইসেল বাজে দূর থেকে। শুনি বাঁশি। এমন গভীর রাতে, অনেক দূরের সুর ভেঙে হঠাৎ গান ভেসে আসে।
কে যে বাঁশি বাজায়? যেই বাজাক বাঁশি।
মনে পড়ে প্রেমিকার ঠোঁট। ঠোঁট কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করি। এই আঁধারেও অজস্র ঘাসফড়িং উড়ে চরাচরে। ‘সুরে সুরে বাঁশি পুরে তুমি আরও আরও আরও দাও তান…।’ কথা বলে কে যেন। বলে, ঘুমালে নাকি?
শিউলিবনে ভালবাসার মানুষ কোমল গান্ধারে কাকে যেন কী বলে। বলে — তোমার ঠোঁটে ধানের ছায়া। কুসুমপুরের আমছায়ার মতো সুনিবিড়। সেই নিবিড় গহীন ছায়ায় হারিয়ে যায় এই শহরের এক রাখাল বালক।
জীবনের কত হাস্নাহেনা সুরভিত দিন গ্লানিতে ভেসে গেছে। এইসব নিয়ে ভাবিনা তা। ভেবে কী লাভ? গতস্য শোচনা নাস্তি।
৩৫. গোলাপ বউ
নিঝুম ছিমছাম বাড়িতে সেই প্রথম একবার পরী তার পালক খুলেছিল। আবার কি তবে মনে মনে চাইব তোমাকে? পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছ সুখের সেই তুমি। বাতাসের গান জলে ডুবছে ভাসছে। আবার তুমি যদি রাতে নেমে আসো এই বাড়িতে? প্রদীপের পাশে এসে ফিসফিস করে বলো, ‘জানিনা আমি জানিনা। তুমি জানো?’
ছাতিম ফুল নাকি মনের কথা শোনে। নীলকণ্ঠ পাখির দেশে কানে কানে বলবে, চলো ওই একলা যুবকের বুকে। যে একা একা এই শহরে ঘোরে, তার হাত ধরে একবার হেসে ওঠো। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছাতিম ফুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা সুখের শিশিরে তুমি ঠোঁটের দাগ রেখে চলে যাও। যে যায় সে আর আসে না। যে আসে সে এখন যুবকের সন্ধ্যার বুকে একাকী টবে রাখা গোলাপ বউ।
৩৬. আকাশ ও নদী
আকাশ আর নদীর দূরত্ব যোজন যোজন দূরে। তবুও নদী ভালোবাসলো আকাশকে। আকাশ তার দূরের নীলিমার নীলের মেঘ থেকে ঝিরিঝিরি জল ঝরে দিত নদীতে। আবার কখনও অজস্র নক্ষত্র বীথির ছায়া ফেলত আবক্ষ নদীর জলে। আবার কখনও প্রচণ্ড রবি কিরণের আলোকসম্পাত এসে পড়ত উচ্ছল বাঁকে। উত্তপ্ত হয়ে উঠত পাড়ের লতা গুল্মও।
প্রেমিকার কিছু করার নেই। সে শুধু তার উদাসি প্রেমিক আকাশের কাছে থেকে জল আর রবি কিরণই গ্রহণ করতে পারত। প্রাণের কোনো সারাৎসার জলবিন্দুর সাথে মিশিয়ে দিয়ে কখনই সে তা আকাশের কাছে পৌঁছাতে পারত না।
৩৭. হেমন্তের ভোর
হেমন্তের ভোর সবসময় বিন্দু বিন্দু শিশির বিন্দুর মতো শুচি শুভ্র মনে হয়। আজ প্রভাতে হাঁটতে যেয়ে তা মনে হলো না। কেমন যেন আজ আকাশ। সারা আকাশে বিবর্ণ মেঘরাশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাঁটতে পারছিলাম না। ব্যথা লাগছিল পায়ে! পথের উপরে পা থেমে আসছিল।
আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য কখনও দেখিনি। আজ মনে হলো যেন সব খণ্ড খণ্ড হচ্ছে। মনে হলো এই বিশ্ব চরাচর বিমুখ। নীরব নিথরে কী গান বাজছিল দূরে, অনেক দূর থেকে সেই সুর আসছিল ভেসে —
‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে–
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।’
৩৮. বাউল দুপুর
ইচ্ছা করে কোনও বাউল দুপুরে একটি ছন্দহীন কবিতা লিখি। একাকী কোনো পাখি ক্লান্ত চোখে যেমন চেয়ে থাকে,
তেমন করে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থেকে ভালোবাসার কোনও গান শুনি।
কেউ কী নেই? নিস্তব্ধ দুপুরের এই নিস্তরঙ্গ শব্দগুলোকে
বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের সুরের মতো মায়াবী করে কন্ঠে তুলে নিতে?
৩৯. এসো ছুঁয়ে থাকি
কত কালচে রাত্রির অন্ধকার। কত পথ ঘুরে তবুও যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে কুসুমপুর তুমি কতদূর!এই প্রবাস বিভূঁইয়ে মরতেও ইচ্ছা করে না।
কার্তিকের পাঁকা ধানের মতো তুমি নুয়ে আছ, তোমার শরীর জুড়ে শস্যের অপার গন্ধ। হাত ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, নরম ঠোঁটের স্পর্শ নিতে ইচ্ছা করে। যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে, খুব তাড়া করে এই হেমন্তেই।
অমাবস্যার রাত্রিতে নক্ষত্রেরা ছুটে আসে এই পৃথিবীতে। সেই সব নক্ষত্ররাজীর আলোয় গোপন পথগুলো আমাকে ঠিকই চিনে নিয়ে যাবে একজন অন্তরাক্ষীর কাছে।
হেমন্তের চিবুক ছোঁয়া আলোয় থিতু হবো সেখানে। এসো তোমাকে ছুঁয়ে থাকি।
৪০. দুঃস্বপ্নবাস
যখন অবসাদ নেমে এল শরীরে তখনই দুচোখের ঘুম এল। জীবন এত ক্লান্ত হলো কেন? একদুপুর ঘুমিয়ে কাটল প্রহর। তারপরই সেই দুঃস্বপ্নটি দেখা। কেন আর্তনাদ করে উঠলাম। সৃষ্টিকর্তার নাম মুখে আনলাম। নাকি অসহায় সমর্পণ তারই কাছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন, আর তখনই এই দুঃস্বপ্নে জেগে ওঠা।
‘কোন্ দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে, তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।
বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা , গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি– হার মানি তার অজানা জনের সাজে।’
বিছানায় বসে নিঃশব্দে রোদন করলাম। যেখানেই চোখ মেলি, দেখি চারদিকে কংক্রিটের দেয়াল। কোনো অলিন্দ্য নেই। কাঁচের দরজার ওপাশে পুরু কাপড়ের পর্দা ছিল। একবিন্দু শীতল হাওয়ার জন্য বিফল চাওয়া। এক ঝিলিক আলোর জন্যেও। কি দুঃসহনীয় অতিক্রান্ত সময়কাল ! কেউই দেখতে পেল না আমাকে। আমার চোখও না, এবং লুকায়িত অশ্রু…।
৪১. নির্জন নীরবতা
হেমন্তের শীত এখনও জেঁকে আসেনি পৌষের শীতের মতো। সন্ধ্যা রাতের আঁধারও তেমন প্রগাঢ় হয়নি। বিকাল থেকে পাঁজরের নীচে তীব্র ব্যথাটি ওর ছিল না। তবুও হাত ধরে উঠোনে নিয়ে যেয়ে নারিকেল গাছ তলায় কাঠের চেয়ারে যেয়ে দুজন বসি। আঙ্গিনায় নিয়ন বাতি জ্বালানো ছিল না। নির্লিপ্ত চোখে আকাশ দেখছিলাম। দেখি, কোথাও চাঁদ নেই।
রাত্রির নিভৃত আকাশও চেয়ে দেখছিল যেন আমাদের। কোনও কথা নেই। কেমন নির্জন নীরবতা। খুব বলতে ইচ্ছা করেছিল ওকে। কোনও মিনতি করেও নয়। এমনি কপালে কপাল রেখে —
‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো। আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।’
৪২. একি তৃষ্ণা
জীবন কাটে না এ জীবনে আর, জীবন ভরেও না এক জীবনে। একি তৃষ্ণা আমার। একি ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকি। অনেক কাছে থেকে দেখি অনেক দূরের আশার বিন্দু! আজ দক্ষিণের দুয়ার খোলা আছে। আসুক বাতাস আজ দক্ষিণ থেকেই।
৪৩. আত্ম প্রকৃতি
আমি সবসময় উদাসীন প্রকৃতির একজন মানুষ। নিজেকে কখনো যাযাবর, কখনো স্বার্থপর, কখনো ক্রুর, কখনো পলাতক মনে হয়। আমি চিনতে পারি না নিজেকে। কে ভালবাসে, কে বাসে না। তাও জানিনা । জীবন কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কেমন তার পথচলা, কেমন তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সে হিসাবও কখনো করি নাই ।
যমুনার চরে উথাল পাথাল ঢেউ খায় কাঁশবনের ঝাড়ে। কেমন তার জীবনকথা, কেমন তার দিন লিপি। কেউ প্রাণ খুলে কখনো তা জানতে চায়নি।
৪৪. প্রিয়ন্তী
তোমার নীল নয়নে শ্রাবণ মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক। কন্ঠে মধুমঞ্জরির মালা। দেহলতায় পদ্মদামের লাবণ্য। তোমার শরীর অমল ধবল জ্যোৎস্নায় স্নাত। চোখের পাতায় নাগকেশরের স্পর্শ। হে আমার প্রিয়ন্তী, তোমার কেশ কুন্তলের গন্ধে মদির এই ঘর। আমাকে তুমি দীপ্ত করো।
৪৫. আমার আনন্দ
চলে যাব বলে যে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে আর ফিরে আসে না। কারণ, সে তার গন্তব্য জানে। ফিরে তারাই আসে, যারা পথে নেমে পথ হারিয়ে ফেলে। চারিধারে যারা আঁধার দেখে।
এই সব পথহারা, ঘরহারা মানুষদের পথ চিনে দেওয়াই আমার আনন্দ।
৪৬. অস্তিত্ব
তুমি প্রতিক্ষণ আমাকে অসীম এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছ। মুক্ত করে নিতে চেয়েছ নিজেকে। আমার জীবনের সকল অস্তিত্ব থেকে, সকল বাঁধন থেকে, সকল টান থেকে তোমাকে মুক্তি দিলাম। তুমি সুবিমল আকাশে মুক্ত হয়ে বিচরণ করো। এখন থেকে তুমি চিরকালের জন্য আকাশের। আমার অস্তিত্ব, আমার প্রেম তোমার কোনো কিছুতে রেখ না। না শরীরে, না মনে।
৪৭. কেউ আসেনি
আমার চোখ সেই পথের দিকে চেয়ে থাকে, যে পথের সকল লতা গুল্ম ঘাস পায়ে মাড়িয়ে তুমি চলে গেছ। তারপর আকাশে জমেছে মেঘ, ঝরেছে জল, সব পথ কা্দাজলে ভেসে গেছে কিন্তু মেঘের নীচে সেই কাদা পথে হেঁটে কেউ আর ফিরে আসেনি । এই যে এত জল, এত মেঘ — যে জলে ভিজে ভিজে আমি একাই হাঁটছি, আমার এই বৃষ্টি ভেজা একাকী ভালোবাসা উপভোগ করল না কেউ।
৪৮. অশেষ করেছ
দিনের বেলায় ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়ে একাকী শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কোনও আলো যেন চোখে না লাগে। কোনও কোলাহল যেন শুনতে না পাই। নৈঃশব্দের মধ্যে কাটুক আমার সময়। জীবন যখন শুকায়ে যায় তখন কি এই ইচ্ছাগুলো হয় !
কেন যে সংসারে থাকি ! জগতের সব আনন্দ করুণ ধারায় কা্ঁদে। তারপরেও স্তব্ধ এই অন্ধকার থেকে বা্ঁধ ভাঙ্গা আলোয় বেরিয়ে যেতে মন চায়। কেউ একজন আমার জন্য আজও সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়ে রাখে। তার জন্যেই আমার এই পৃথিবী, আমার সন্তানেরা। সেই আমার জীবনকে মহিমান্বিত করেছে।
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’
৪৯. দাঁড়াও সময়
পৃথিবীর বয়স কতো কিংবা মহাকালের? পৃথিবী এবং মহাকাল আরো কতো শ’ কোটি বছর ধরে চলবে? ধর্মে যাই থাক, মানুষের আয়ু এত ক্ষুদ্র কেন? একটি ঢিল জলে ফেলতে যতটুকু সময় লাগে, মহাকালের তুলনায় তা একটি অণুমুহূর্ত মাত্র। মানুষ এইটুকু অণুমহুর্তের আয়ু নিয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। অথচ এই পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে বেশি আবেগ দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসে।
আর সেই কী না এই মায়াময় পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ের জন্য বেঁচে থাকে।
৫০. অনীহা
তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধর। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে।
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।
এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে কর। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাও না। হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাও না। সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হও না। গান গাও না। গল্প শোনাও না।
যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে! সে চোখে আর কোনো মায়া নেই, জল নেই, ঘুম নেই। যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে, সে বুকে এখন ক্লান্তি। শান্তি নেই। আদর নেই। কাছে টানতে অনিহা। কেমন অবহেলা। কেমন অনাদর ছুঁয়ে আছে……….
৫১. ধূসর অন্ধকার
আমি প্রেম চাই না। ঘৃণাও না। এখানে আমার ভালো লাগেনা। এই ভূবনে যত কোলাহলে । নির্জনতা আমার ভালো লাগে। তোমরা আমার মৌনতাকে ভেঙ্গে দিও না। আমি চলে যেতে চাই। যে পথ দিয়ে আমি হেঁটে যেতে চাই, সে পথ তোমরা কেউ অনুসরণ করো না। জীবন এখানে ভঙ্গুর। কোনও স্বপ্ন নেই। তোমরা কেউ স্বপ্ন দেখাতেও পার না। তারচেয়ে চলে যাই। যেখানে যাব, সেখানে শান্তি হয়তে নেই । আছে ধূসর নির্জন কোনও অন্ধকার! সেখানে যেয়ে শুনব বিবর্ণ জীবনের সঙ্গীত।
একাকী দেখব সেখানে প্রভাতী সূর্যের লাল আভা। আমি আমার আত্মার মাঝে অনুভব করতে পেরেছি, সেখানেও আছে, পাখির কলতান। আছে ইছামতি নদী। ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলা দোল দেবে সেখানেও। সেই নির্জন তীরে আর কেউ থাকবে না। একাকী দেখতে পাব সূর্যাস্ত। সন্ধ্যার মেঘমালায় ভাসাতে পারব আমার ভেঙে যাওয়া সকল দুঃস্বপ্নের বেদনার ছায়া।
সেখানেও রাত নামে স্তব্ধতায়। আমার ঘূম পায়। ঐ ধূসর আঁধারেই তোমরা আমাকে ঘুমাতে দাও।
৫২. দুটি প্রাণ
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। কোনও মানুষ রবে না আর সেখানে। যদি সেই বিরাণ পৃথিবীর মাটিতে বুঁদবুঁদ করে কোথাও কোনো প্রাণ জেগে ওঠে। তবে সেই প্রাণ বা প্রাণ দুটো কার হবে? সে কী মানুষের প্রাণ হবে? নাকি পাখি, জীবজন্তু, কিংবা কোনও সরীসৃপের? যদি মানুষের প্রাণ হয়, তবে কোন্ দুইজনের প্রাণ জেগে উঠবে মাটি থেকে?
যদি তুমি আর আমি হই সেই দুইটি প্রাণ। যদি মানুষ হয়ে আবার ফিরে আসি এই পৃথিবীতে? যদি গড়ি আবার আবাস ! কেমন হবে?
সেদিন প্রাণের সাথে প্রাণের মিলন হবে।
৫৩. গন্তব্য
এই ভূলোকের কোথায় হবে আমার গন্তব্য। কোন অরণ্য বনছায়ায় চলতে হবে পথ। কোথায় আছে পাহাড়,নদী, উপত্যকা। কোথায় সেই সিংহ দুয়ার, জীবনের অনন্ত ঝর্ণাধারা। একাকী নদী তীরে অনাহুতের মতো রয়েছি দাঁড়িয়ে। বেলা পড়ে যাচ্ছে । বালুচরে কোনও বক, ডাহুক, পানকৌড়ি নেই। শিকারীরা ধনুক হাতে ফিরে গেছে লোকালয়ে। জল জেলেরাও চলে গেছে সন্ধ্যা কুটিরে। মেঘগুলো ভেসে বেড়ায় দূর নদীর প্রান্তর জুড়ে। সন্ধ্যা-আকাশ বয়ে আনছে কি অনাস্বাদিত কোনও বার্তা ? কি ঘটতে চলেছে, এই বালুচরবর্তী জনহীন জনপদে। এমন ধূসর সময় তো কখনো আসেনি। নিস্প্রভ রৌদ্রগুলি চরাচরে মিলে যাচ্ছে। আঁধার ধেয়ে আসছে। কেমন নৈঃশব্দ চারদিক। কৃষ্ণ গহবরে কি গন্তব্য আমার ? যেখানে নিঃশেষিত হবে প্রাণ।
৫৪. গল্পগুলো ভালোবাসার
আচ্ছা ভালোবাসা গুলো কেমন হয়? ধরুন, একটি ব্যস্ত রাস্তা পার হবো। সেই ক্ষণে সে যদি এসে আমার হাত ধরে বলে — দুদিকে দেখে সাবধানে রাস্তা পার হবে।
আমার হাতে বেশ ওজনের বাজারের ব্যাগ। সে হতদ্যোম হয়ে কাছে এসে যদি বলে — তুমি নেবে না। আমাকে দাও। তোমার বুকে ব্যথা হবে।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে। মুখে তুলে ঔষধ খাওয়ার সামর্থ্যটুকু তার ছিল না। কেন ডাকা হলো না আমাকে? এই কথা বলতেই সে যদি বলে — তোমার ঘুম আমি ভাঙ্গাতে চাইনি।
আবার এমনও আছে — সেই কবে তার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে আইলাইনার বের করে চোখের কাজলরেখা ঠিক করে দিয়েছিলাম। সেই কথাটি সে মনে রেখেছে এখনও যত্ন করে।
এলমেল হয়ে যাওয়া তার শাড়ির কুচিগুলো রাস্তার উপর পায়ের কাছে বসে সেই কবে ঠিক করে দিয়েছিলাম, এই কথাটিও সে মনে রেখে আজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে।
আমি টিপ পরা খুব পছন্দ করি — তাই সাজতে গিয়ে এই কথাটি নাকি তার আগে মনে থাকে — টিপ পরতে হবে।
এমন আরও কত কিছু আছে। ধরুন, হাঁটতে গেছি — উদোম আকাশের নিচে পথের ধারে এক লোক চা বিক্রি করছে। কেটলি থেকে ঢেলে দিল কাগজের কাপে গরম দুকাপ চা দুজনকে। এখানেও নাকি সুন্দর ক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়।
গুগল ঘাটছিলাম । হঠাৎ চোখে পড়ল এই নিউজটি। বিষয় বার্ষিকীতে স্বামীকে কিডনি দিয়ে প্রাণ বাঁচালেন স্ত্রী। ভালোবাসার জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করে ! এ কী মানুষ? নাকি ঈশ্বরী। এইভাবে বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।
৫৫. তুমি
তুমি যখন ছিলে না:
কোনোদিন ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি
ঘরের দেয়ালে আর ছাদে ঝুল জমে থাকতো
টেলিফোনের রিসিভারের নীচে জমে থাকতো ধূলো
বাড়ির আঙ্গিনা আগাছায় ভরে যেতো
সকালের ঘুম ভাঙ্গতো দুপুরে, সন্ধ্যাকে মনে হতো সকাল
দুপুরের ভাত খেতাম রাতে-
রাতের ঘুমগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে যেতো নির্ঘুমে।
তুমি যখন আসলে:
ট্রাউজার্স পরিপাটি, হ্যাঙ্গারে ইস্ত্রি করা সার্ট ঝুলে থাকে
জুতার সক্ গুলোতে সুগন্ধি দেওয়া থাকে, ফুলদানিতে ফুল
মেঘের আকাশ হয় তারাভরা রাত, আলোয় ভরে ওঠে ভূবন
মেঝেতে বে্ঁজে উঠলো তোমার পায়ের শব্দ
আমার একাকীত্বগুলো পেলো প্রাণ, প্রেম হলো গান
সন্ধ্যার কলিরা ফুল হয়ে ফোটে রাতের পূণ্যতায়।
তুমি যখন থাকবে না:
সাদা চুলগুলোতে আর কলপ মাখা হবে না
গো্ঁফ হয়ে যাবে ঋষিদের মতো শুভ্র সমুজ্জল
পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকবো রৌদ্রছায়ায়
ঘরে ফেরা হবে না অস্ত সন্ধ্যাবেলায়
রেল লাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে বিপন্ন পথিকের মতো
হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব দূরের কোনও স্টেশনে
হূইসেল বাজিয়ে ট্রেন আসবে, ট্রেন চলে যাবে
উদাসীন পথে হেঁটে হেঁটে আর ফেরা হবে না ঘরে।
৫৬. ক্যামেলিয়ার সুবাস
বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে যে আকাশ আজ দেখলাম, সে আকাশ যেন মৌনতায় কাঁদছে। বাগানে যে ক্যামেলিয়া ফুলগুলো হেমন্তের গোলাপ হয়ে ফোটার কথা ছিল, ওরা আজ তা ফোটে নাই। গোবিন্দগঞ্জের ঐ কালো সাঁওতাল মেয়েটার কানে আজ আর ক্যামেলিয়া ফুল নেই। এই সুন্দর শ্যামল মাটিতে নেই আর সেই সোঁদা গন্ধ। ভেবেছিলাম ক্যামেলিয়ার সুবাস মেখে আজকের দিনটা শুরু করব, তা আর হলো না।
৫৭. যদি থাকি কাছাকাছি
সংসারের জন্যে, উত্তর পুরুষের জন্যে, সভ্যতা তৈরির জন্য মানুষ যুথবদ্ধ হয়। নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য মানুষ তার সঙ্গী বেছে নেয়। যুগলবন্দী সেই সংসারে মানুষ কত যে সংগ্রাম করে। কত যে ভালোবাসা হয় লেনদেন।
অনেক দুঃখ জড়াও আছে, আছে ভাঙ্গা গড়াও। তারপরও মানুষ একা হয়। হৃদয়ের গভীরে একাকীত্ব অন্তঃশীল হলে বুঝতে পারে, সে আসলেই নিঃসঙ্গ এবং সঙ্গীহীন।
এই বেদনাক্লীষ্ঠ পৃথিবী থেকে একদিন চলে যেতে হবে। হয় তোমাকে আগে, না হয় আমাকে। তখন কী কেউ একজন সত্যি একা হয়ে যাবে? এর কী কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে না? ধরো, আমি আগে চলে গেলাম। তুমি কী তখন একা হয়ে যাবে? মনে করবে — তুমি একা হও নাই। আমি শুধু এই ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেছি। কাছাকাছিই আছি ঠিক পাশের ঘরেই।
৫৮. আমাদের ভালোবাসা
হেমন্তের বিকেলের শেষ রোদ তার মুখের উপর এসে উপচে পড়েছিল। নোলক পরা মুখখানি সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল। ধূপছায়া রঙের শাড়িটি তার হয়নি বিবর্ণ । বিকাল আর সন্ধ্যার এমনই মায়াবি সন্ধিক্ষণে বুকের উপরে কপাল রেখে সে বলেছিল — ওগো, আমার খুব ভয় হয়। আমাদের ভালোবাসা কখনই যেন ঘৃণায় শেষ না হয়।
৫৯. ধূসর সন্ধ্যা
আজ এই ধূসর সন্ধ্যায় মন কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কি ভেবে এই মন খারাপ হওয়া বুঝতে পারছি না। জীবন তো ভালোই চলছে, তবে কেন এই বিষাদ, এই বিষণ্ণতা ! অতীতের কোনও গ্লানি কিংবা কোনও কিছু না পাওয়ার আর্তি নয় তো? যা গোপনে এই সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝরে পড়ছে।
৬০. দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে
দুয়ারে তুমি দাঁড়িয়ে , কেমনে বলি তুমি ফিরে যাও, কেমনে বন্ধ করে দিই মুখের উপর দুয়ার?
আবার কেমনেই ঘরে তুলে নিই তোমাকে, এই ঘরে যে আর একজনের বসবাস – বহুদিন ধরে পরম বিশ্বাসে সেই আমার জীবনব্যাপি জড়িয়ে আছে।
Leave a Reply