দুচাকায় দুনিয়া – বিমল মুখার্জি
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত
প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৮৬
ভূমিকা
বিমল মুখার্জির ‘দুচাকায় দুনিয়া’ বইটির কথা কেন আমি কখনও শুনিনি, আমার গ্রন্থকীট বন্ধুরাও কেন এ বইয়ের কথা জানেন না, বইটি পড়বার পর সেকথা ভেবে আমি ভয়ানক অবাক হয়েছি। আমাদের ছেলেবেলা থেকে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের কথা জানি, তাঁর বইও আমাদের পড়া, অথচ প্রথম ভারতীয় ভূপর্যটক বিমল মুখার্জির নামই কখনও শুনলাম না, চেনা-জানাদের মধ্যে কেউ শুনেছেন বলেও জানি না, এ শুধু বিস্ময়ের নয়, দুঃখের ও ধিক্কারের কথা। এ আমরা কেমন জাতি যে তার স্বপ্নস্পর্শী স্বজনের কথা পাঁচ মুখে বলে না, এ আমাদের কেমন দেশ যে তার দিগ্বিজয়ী সন্তানকে সম্মান দেয় না!
কয়েক বছর আগের কথা, আমি তখন বিমল মুখার্জির অনেক পরবর্তীকালের আরেক ভূপর্যটক বিমল দে-র প্রায় দুষ্প্রাপ্য বইগুলি আবিষ্কার করে চিঠিতে-টেলিফোনে কলকাতা হৃষীকেশ জেনেভা ছুঁড়ে এই অভিযাত্রীর সন্ধান পাই ও তাঁর লেখার নির্বাচিত অংশ কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে ‘ভ্রমণ’-এ পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করি। সেই লেখা ছাপা হবার সময় ‘ভ্রমণ’-এরই একজন পাঠক আমাকে বিমল মুখার্জির ‘দুচাকায় দুনিয়া’ বইটির কথা জানান। তারপর কী করে বইটির প্রকাশকের খোঁজ পেলাম ও মাসের পর মাস প্রতিনিধি পাঠিয়েও বইটির একটি কপিও সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলাম, শেষ পর্যন্ত কার কাছে কীভাবে একটি কপি পাওয়া গেল, সে এক বিশদ আখ্যান। যেদিন পেলাম সেদিনই রাত জেগে বইটি শেষ করে পরদিনই মুগ্ধ হৃদয়ে বইয়ে মুদ্রিত লেখকের ঠিকানায় চিঠি পাঠাই, দীর্ঘদিন অবধি কোনও উত্তর না পেয়ে, একজন প্রতিনিধি মারফৎ পত্র পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত লেখকের পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারই পরিণামে ‘ভ্রমণ’-এ ১৯৯৫-৯৬এ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘দুচাকায় দুনিয়া’ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।
একটা খুব দুঃখের ও ক্ষোভের কথা এই যে, ‘ভ্রমণ’-এ বইটির পুনর্মুদ্রণ শেষ হলে, আমি লেখকের পুত্র সিদ্ধার্থ দাসমুখার্জিকে বইটি অবিলম্বে আবার নতুন করে প্রকাশের জন্য অনুরোধ করি। আমার আশা ও বিশ্বাস ছিল, ‘ভ্রমণ’-এ ধারাবাহিক প্রকাশের ফলে বইটি বহু বিশিষ্ট গ্রন্থপ্রকাশকের নজরে পড়েছে ও এরকম অনেক প্রকাশকসংস্থাই নিশ্চয়ই এবিষয়ে আগ্রহী হয়ে লেখকের ঠিকানা জানতে চেয়ে ‘ভ্ৰমণ’ কার্যালয়ে যোগাযোগ করবেন। শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটেনি, শেষ পর্যন্ত তাই এই স্বর্ণাক্ষর সংস্করণ। সামান্য সম্পাদিত, কিছুটা সংক্ষেপিত।
সম্পাদিত বলতে কখনও ছাপার ভুলে কখনও লেখকের অসতর্কতায় ভুল বানান, ভুল যতিচিহ্ন সাধ্যমতো সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বর্ণনা বা বিতর্কের অনাবশ্যক দৈর্ঘ্য কিছুটা হ্রাস করে মূল লেখার সম্পদ ও সংহতি সযত্নে রক্ষা করেছি। এ কাজ যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু এক জীবনে এমন দুঃসাহসিক বিশ্বভ্রমণের দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমরা যে কেউ অর্জন করতে পারি না, বিমল মুখার্জি পেরেছেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়ে তিনি যে এই মহাগ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন, সে আমাদের মহাভাগ্য।
বাঙালির হাতে দুচাকায় দুনিয়া’র মতো একটি বই তুলে দিতে পেরে আমরা ধন্য।
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সম্পাদক ‘ভ্রমণ’
কলকাতা
জানুয়ারি ১৯৯৮
লেখকের কথা
দেশ দেখতে কার না সাধ হয়। তবে হাতে একটা পয়সা না নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণের শখ মেটানো সময়সাপেক্ষ ও রীতিমতো কষ্টসাধ্য। আমার একযুগের ওপর সময় লেগেছিল। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭। টাকা রোজগার করেছি পথে— কখনও ফটোগ্রাফার, কখনও নাবিক, কখনও পাইলট, নানা বিষয়ে স্কুল-কলেজে বক্তৃতা দিয়ে— কখনও বা মাছ ধরার ট্রলারে নানারকম কাজ করে, কখনও স্কুলে পড়িয়ে, ডেয়ারি ফার্মে গো-পালন করে। শারীরিক পরিশ্রম করে কতভাবে অর্থোপার্জন করেছি তার ইয়ত্তা নেই। মনে হয় এক জীবনেই অসংখ্যবার আমি জন্ম পরিগ্রহ করেছি।
সব কাজের মধ্যে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে চেষ্টা করেছি। কত জাতের কত স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি। তারা আমার মনের প্রসার বাড়িয়েছে এবং অনেক সংস্কারমুক্ত হতে সাহায্য করেছে। সার্থক হয়েছে আমার ভ্রমণ।
মা বই লিখতে আমায় খুব উৎসাহিত করেছিলেন। বারো বছর ধরে সপ্তাহে একটা করে চিঠি দিয়েছি। মা লিখেছিলেন ‘তোমার জীবনের সব ঘটনা আমার কাছে ধরা আছে। ভ্রমণ শেষ করে বই লিখতেই হবে’। তাই এই বই। ভ্রমণ শেষ করার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে লেখা।
আমি ভারতের যুবগণকে বইটি উৎসর্গ করলাম।
বিমল মুখার্জি
কলকাতা-১৯
১লা জানুয়ারি, ১৯৮৬
Santanu Dutta
Thanks for posting a very rare and I think a long forgotten book.