দীর্ঘ ঊ টি আছেন ঝুলে – ইন্দ্রনীল সান্যাল
.
॥ ১ ॥
বর্ধমান রোডের মল্লিকা অ্যাপার্টমেন্টের চোদ্দো আর পনেরো তলা জুড়ে যে ডুপ্লে তার বসার ঘরে ল্যাপটপ এ কাজ করছেন সুনীল সেন। ক্লিন শেভন, মাঝবয়সি, মাঝারি চেহারার সুনীলকে দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। আপাদমস্তক মাঝারি মানুষটি ‘এজেন্সি’ নামের একটি কোম্পানির মালিক।
‘এজেন্সি’-র মতো নিরীহ নামওয়ালা কোম্পানিটি আসলে একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। ভারত জুড়ে এজেন্সির ১২টা শাখা আছে। সব ক’টা শাখার কাজ দেখার সূত্রে সুনীল সারা মাস কলকাতার বাইরে থাকেন। কলকাতায় এলে মল্লিকা অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। যেটার মালিক তাঁর বোন আর জামাইবাবু।
এজেন্সির কলকাতা শাখার অপারেশন হেডের নাম উইলিয়াম শাজাহান চৌধুরি। ডাকনাম শাজাহান। সুনীল যখন কলকাতায় থাকেন তখন শাজাহান এখানে বডি ফেলে দেয়।
আজ ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখ। কলকাতার উপর দিয়ে উত্তর ভারত থেকে আসা শৈত্যপ্রবাহ বইছে। সকাল দশটার সময়ে কলকাতার তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি। সুনীল আর শাজাহান শাল মুড়ি দিয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপে এজেন্সির লাভ-লোকসান নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময়ে সুনীলের মোবাইল ফোন কলকল করে উঠল।
স্পিকার অন করে ফোন ধরলেন সুনীল। ওদিক থেকে শোনা গেল, “সুনীল সেন বলছেন তো? আমি অনিলাভ সান্যাল বলছি। ক’দিন আগে আপনার সঙ্গে আলাপ হল…”
শাজাহান ভুরু কুঁচকে সুনীলের দিকে তাকাল। অনিলাভ বকেই চলেছেন, ‘আমাকে ভুলে গেলেও ঊর্মি সান্যালকে নিশ্চয়ই মনে আছে। ঊর্মি আমার মেয়ে।
‘আপনাকেও মনে আছে’, অনিলাভকে থামিয়ে সুনীল বললেন, ‘ক্যালকাটা ক্লাবের পার্টিতে আলাপ হয়েছিল। ইয়োর ডটার ঊর্মি ইজ আ গুড অ্যাকট্রেস।’
“ইজটাকে ওয়াজ করে দিন। গতকাল রাতে ও মারা গেছে। আপনি একবার ‘বাগচী বাগিচা’-য় আসতে পারবেন?”
অনিলাভর আমন্ত্রণ পেয়ে ধাক্কা খেলেন সুনীল।
একটু থেমে বললেন, ““বাগচী বাগিচা’-টা কোথায় বলুন তো? শোনা শোনা লাগছে।”
‘জায়গাটা হাওড়ার বালিতে। বালিঘাট স্টেশনের পাশে, গঙ্গার ধারে। মনোজ বাগচী নামের এক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়ি।
‘এবারে বুঝতে পেরেছি। ওই বাড়িটা সিনেমা আর সিরিয়ালের শুটিংয়ের জন্যে ভাড়া দেওয়া হয়।’
‘ঠিকই বলেছেন’, কাঁদতে শুরু করেছেন অনিলাভ, ‘কাল রাতে এখানে একটা পার্টি ছিল। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমার মেয়েটা সিলিংয়ের হুক থেকে গলায় ওড়না জড়িয়ে ঝুলছে।’
‘শুনে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সুইসাইড বা হোমিসাইডের ক্ষেত্রে প্রাইভেট ডিটেকটিভের কোনও ভূমিকা নেই। এসব নিয়ে ডিল করার অধিকার একমাত্র পুলিশের।’
নাক টেনে অনিলাভ বললেন, ‘সেটা আমি জানি। আপনাকে ফোন করার কারণ হল, আমার স্ত্রী স্বস্তিকা সান্যাল পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে যে, আমি ঊর্মিকে মার্ডার করেছি।’
সুনীলের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল শাজাহান। বছরের শেষদিকে একটা কেস হাতে আসা এজেন্সির পক্ষে স্বাস্থ্যকর।
অনিলাভ বলছেন, ‘স্বস্তিকা ইজ রাইট। ঊর্মি খুনই হয়েছে। তবে ঊর্মিকে খুন আমি করিনি, করেছে স্বস্তিকা।’
সুনীল বিস্ময় চেপে বললেন, “এই কেসের ‘আইও’ বা ইনভেস্টিগেটিং অফিসার কে?”
‘বালি থানার বড়বাবু প্রবীর হালদার। উনি আপনাকে চেনেন বলেছেন।’
‘আমি আসছি। ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে।’ ফোন কাটলেন সুনীল। শাজাহান মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
পোশাক বদলে শাজাহানের সঙ্গে বেরলেন সুনীল। গাড়িতে উঠে চালকের আসনে বসে শাজাহানকে বললেন, ‘ঊর্মি সম্পর্কে কী কী জানলে বলে ফেলো।’
শাজাহান বলল, ‘ইন্টারনেট ঘেঁটে যা তথ্য পেলাম সেগুলো দিয়ে একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট বানিয়েছি। সেটা পড়ছি।’
সুনীল নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
“ঊর্মি সান্যালের বয়স এখন ২৮। আদি বাড়ি বসিরহাট। মা স্বস্তিকা সান্যাল গ্রুপ থিয়েটার করতেন। বাবা অনিলাভ সান্যাল এলাকার দাপুটে বামপন্থী নেতা ছিলেন। সরকার বদল হওয়ার পরে দু’জনেই এখন নন-এনটিটি।”
‘এসব কথা নেটে লেখা আছে?’
“ঊর্মি একটা সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছে। ছোটবেলা থেকেই ঊর্মির বাড়িতে অভিনয়ের চর্চা ছিল। ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময়ে মেগা সিরিয়ালে হাতেখড়ি হয়। যৌথ পরিবারের কূটকচালি নিয়ে তৈরি সেই মেগার নাম ‘ঊর্ণনাভ’। এই মেগার ছোট্ট একটা ট্র্যাকে ঊর্মির নাম ছিল ঊর্মিলা। ট্র্যাকটা এত পপুলার হয় যে, ঊর্মির রোল বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সিরিয়ালটা তিন বছর চলেছিল। শুটিংয়ের মধ্যেই পড়াশুনো করত।”
‘বারো ক্লাস পাস করেছিল?’
“হ্যা। করেছিল। ঊর্মির দ্বিতীয় মেগার নাম ‘উর্বশী’। পার্ক স্ট্রিটের এক বার-গায়িকা বা ক্রুনারকে নিয়ে এই মেগাটিও সাংঘাতিক জনপ্রিয় হয়। নস্ট্যালজিয়ার কারণে অ-বাঙালিরাও সিরিয়ালটি দেখতেন। ওপার বাংলা থেকে আসা রিফিউজি মেয়ের সংগ্রামের গল্প। সে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে, কোলে হারমোনিয়াম নিয়ে সাহেবি শরাবখানায় ন্যাট কিং কোল, জিম রিভস, জোন বায়েজ, হ্যারি বেলাফন্টের গান গাইত। কপালে সুয়েডের টিপে লেখা থাকত উর্বশীর আদ্যক্ষর, ‘উ’। এই মেগাটাও তিন বছর চলেছিল। কপালে ওই টিপের কারণে বাঙালির কাছে ঊর্মির নাম হয়ে গেল ‘দীর্ঘ ঊ’। গ্রামের দিকে মাচা করতে গেলে ফ্যানেরা ‘দিঘু’ বলে ডাকত।”
‘১৮ বছর বয়সে টেলি ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে ২৪ বছর পর্যন্ত মেগা করে কাটিয়ে দিল। শেষের চার বছর কী করল?’
“দুটো মেগার পরে ঊর্মি কাজ পাচ্ছিল না। প্রযোজক পঙ্কজ দত্ত একটা আর্ট হাউস সিনেমা বানান। সেটা একদমই চলেনি। কিন্তু ওটায় অভিনয় করে ঊর্মি ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাকট্রেস’-এর জন্যে ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিল। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পরে ওর গায়ে ‘সিরিয়াস’ অভিনেত্রীর ছাপ্পা পড়ে গেল। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি ঊর্মিকে আর কাজ দেয় না। বাধ্য হয়ে পঙ্কজের পরের ছবিতে ‘আইটেম নাম্বার’-এর সঙ্গে নেচেছে। পঙ্কজের প্রোডিউস করা নতুন মেগা সিরিয়াল ‘ঊর্মিমুখর’-র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে টিভির জগতে ফিরেছে। চরিত্রের নাম, আবারও, ঊর্মিলা। সেটাই এখন টিভিতে দেখাচ্ছে।”
‘তৃতীয়বারের জন্যে দীর্ঘ ঊ?’
‘তাই তো দেখছি।’ বলল শাজাহান, বসিরহাট থেকে কলকাতায় এসে কয়েক বছরের মধ্যে ঊর্মি এত রোজগার করেছে যে, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ইস্ট সিটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থ্রিবিএইচকে কিনেছে। আর একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য। ঊর্মির ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে। আউটডোরে গিয়ে একলা শুতে হয়। তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে না। বাড়িতে মায়ের পাশে শোয়। ব্যস! এইটুকু জানতে পেরেছি।’
গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের মোবাইল থেকে প্রবীরকে ফোন করলেন সুনীল।
কথা হচ্ছে হ্যান্ডস-ফ্রি সেটের মাধ্যমে।
ফোন ধরে প্রবীর বললেন, ‘সুনীলদা, কী খবর?
সুনীল বললেন, ‘বালির ড্রাগ পেড্লিং কেসটায় তোমাকে সাহায্য করেছিলাম। মনে আছে তো?”
‘একদম! বিনিময়ে কী চাই বলুন।’
‘ঊর্মি সান্যালের অ্যাবনর্মাল ডেথের ব্যাপারে নাক গলাতে চাই। ভিক্টিমের বাবা আমাকে ফোন করেছিলেন।’
দাঁতে দাঁত চিপে নিচু গলায় অনিলাভকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করলেন প্রবীর। গলা তুলে বললেন, ‘কথা যখন দিয়েছি, রাখব। আপনি এখন কোথায়?’
‘আমি আর শাজাহান এখন দমদম এয়ারপোর্টের কাছে। বেলেঘাটা এক্সপ্রেসওয়ে ধরলে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাব। কেসটা কী বলো।’
প্রবীর বললেন, “ঊর্মির মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক খুব খারাপ। ঊর্মি থাকত ওর মা স্বস্তিকা সান্যালের সঙ্গে ইস্ট সিটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। বসিরহাটের বাড়িতে থাকেন ঊর্মির বাবা অনিলাভ সান্যাল। গতকাল ‘বাগচী বাগিচা’য় ‘ঊর্মিমুখর’ নামের মেগা সিরিয়ালটার র্যাপ আপ পার্টি ছিল। সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ক্লোজ কয়েকজন মিলে ঊর্মির ঘরে পার্টি করছিলেন।”
‘তাঁরা মানে কারা?
“অনিলাভ এসেছিলেন বসিরহাট থেকে। স্বস্তিকা তো ছিলেনই। এছাড়াও ছিলেন ‘ঊর্মিমুখর’-এর প্রোডিউসার পঙ্কজ দত্ত, ওই মেগায় ঊর্মির কো-স্টার শিবেন্দু রায়, ঊর্মির পার্সোনাল মেক আপ আর্টিস্ট মিলি সাহা এবং মেগার স্ক্রিপ্ট রাইটার সোহম বিশ্বাস। রাত ১২টার সময়ে আসেন টালিগঞ্জের মহাতারকা অভিজিত। ভোর চারটের সময় পার্টি শেষ হয়। সবাই শুতে চলে যান। সকাল সাতটার সময়ে অনিলাভ বালি থানায় ফোন করে বলেন যে মেয়ে সুইসাইড করেছে। আমি সাড়ে সাতটার সময় এখানে এসে দেখি ঊর্মি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিংয়ের হুক থেকে ঝুলছে।”
সুনীলের গাড়ি ‘বাগচী বাগিচা’-র সামনে চলে এসেছে। সুনীল বললেন, ‘অনিলাভ আমাকে ফোনে বললেন যে এটা সুইসাইড নয়, মার্ডার। তুমি কী ভাবছ?’
‘আপনি কতদূর?’ উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন প্রবীর, ‘ফরেনসিক টিমের কাজ প্রায় শেষ। আপনারা দেখে নেওয়ার পরে বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠাব। মিডিয়া খবর পাওয়ার আগে লাশ বালি থানা এলাকার বাইরে পাঠাতে চাইছি।
গাড়ি থামিয়ে সুনীল বললেন, “আমরা ‘বাগচী বাগিচা’-র বাইরে। গেট খুলে দিতে বলো।”
॥ ২॥
বিশাল বড় ঘরের একপ্রান্তে একটি পালঙ্ক। তাতে শোওয়ানো রয়েছে ঊর্মির লাশ। পুলিশের ফোটোগ্রাফার একের পর এক ফোটো তুলে যাচ্ছেন। ফরেনসিক টিমের যিনি এসেছেন, তিনি গ্লাভস পরা হাতে স্যাম্পল কালেকশান করে জিপ লকে ভরছেন। প্রবীরদের দেখে দু’জনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
লাশ ঢাকা রয়েছে সাদা কাপড়ে। সেটা সরিয়ে সুনীল দেখলেন, ঊর্মিলার পরনে হালকা পিচ রঙের সালোয়ার কামিজ। গলায় প্যাঁচানো গাঢ় লাল রঙের ওড়না। চোখের নিচে কাজলের গাঢ় কালি ধেবড়ে আছে। মুখে চড়া মেক আপ। মুখ দিয়ে বেরনো গ্যাজলা ঠোঁটের লিপস্টিকে শুকিয়ে গিয়েছে। মারা যাওয়ার মুহূর্তে ঊর্মিলা প্রস্রাব এবং পায়খানা করে ফেলেছিল। যত সময় যাচ্ছে, শরীরের পচনও বাড়ছে। বিশ্রী, ভ্যাপসা গন্ধের মধ্যে পড়ে রয়েছে টিভি তারকা। ঊর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রবীর বললেন, “কপালের ‘দীর্ঘ উ’ লেখা টিপটা নেই। চড়া মেক আপের মধ্যে কপালে গোল চিহ্নটা দেখা যাচ্ছে।”
‘পার্টির সময় পড়েও যেতে পারে’, ক্যাজুয়ালি বললেন সুনীল, ‘ক্রাইম সিন দেখে বোঝা যাচ্ছে কাল রাতে অনেক বোতল মদ খাওয়া হয়েছিল।’
ঘরের অন্যপ্রান্তে বিশাল বড় টেবিল ঘিরে অনেকগুলো সোফা পাতা রয়েছে। টেবিলের উপরে রাখা রয়েছে তিনটে সিঙ্গল মল্টের খালি বোতল, সাতটা গ্লাস, একগাদা কাচের থালা-বাটি আর কাঁটাচামচ। সেগুলো দেখিয়ে প্রবীর বললেন, “পার্টি চলার সময়ে ‘বাগচী বাগিচা’র কেয়ারটেকার রাকেশ সাধুখী সারাক্ষণ উপস্থিত ছিল। ও বলেছে যে, সোফাগুলোয় পরপর বসেছিল ঊর্মি, স্বস্তিকা, শিবেন্দু, মিলি, সোহম, পঙ্কজ, অনিলাভ এবং অভিজিত।”
‘পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন আটজন। গ্লাস সাতটা কেন?’ ‘অভিজিত মদ খান না।’
প্রবীরের উত্তর শুনে ঘাড় নাড়লেন সুনীল, ‘ফরেনসিক টিম ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্যে এগুলো নেবে না?’
‘এতক্ষণে সব জিপ লকে সব ঢুকে যেত। আপনি আসছেন বলে ডিলে করলাম।’ হাত নাড়লেন প্রবীর। ফরেনসিক টিমের সদস্য ঘরে ঢুকে গ্লাভস পরা হাতে টেবিলের প্রতিটি জিনিস জিপ লকে ভরে তার গায়ে নম্বর লিখছেন। ঊর্মির গলায় জড়ানো ওড়নাও ঢুকে গেল জিপ লকে। পুলিশের ফোটোগ্রাফার আবার ছবি তোলা শুরু করেছেন।
সুনীল পালঙ্কের কাছে গিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দেখছেন ঊর্মির গলার ওড়নার প্যাচ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওড়না কেটে কে ঝুলন্ত লাশ নামিয়েছিল।’
প্রবীর বললেন, ‘ভিক্টিমের বাবা।’
‘ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না।’
‘উর্মির কুসট্রোফোবিয়া ছিল।’
‘ও হ্যা। সেটা আমি কিছুক্ষণ আগেই জানলাম।’
শাজাহানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু বললেন সুনীল। শাজাহান একটা ধাতব মই জোগাড় করে তার উপরে উঠে সিলিংয়ের হুকটা খুঁটিয়ে দেখছে। মোবাইলে ফোটো তুলছে। সুনীলের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ছে।
সুনীল প্রবীরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিলিংয়ের হুক পর্যন্ত ভিক্টিমের হাত গেল কী করে? খাট থেকে সিলিং অনেকটা উঁচুতে। ঘরের কোণে উলটে পড়ে থাকা টুল দেখিয়ে প্রবীর বললেন, ‘ওইটায় চড়েছিল। ওটাতে লাথি মারতেই…’
‘হুম।’ মই থেকে নেমে এসেছে শাজাহান।
প্রবীর বললেন, ‘আপনাদের দেখা শেষ হয়ছে? তাহলে বডি পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠিয়ে দেব।’
‘পাঠিয়ে দিন,’ ঊর্মিলার ঘর থেকে বেরলেন সুনীল, ‘তার সঙ্গে ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস রিপোর্ট তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্যে চাপ দিন।’
কনস্টেবল এসে কাপড় চাপা দেওয়া লাশ নিয়ে নিচে চলে গেল। প্রবীর বললেন, ‘ডিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে অ্যালকোহল আর ফুড পার্টিকল ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না। এটা প্লেন অ্যান্ড সিম্পল সুইসাইডের কেস। ভিক্টিমের মা-বাবার মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। তাই এত বাওয়াল হচ্ছে।’
সুনীল বললেন, ‘আনন্যাচরাল ডেথ যখন, তখন একটু খোঁজপাত্তা করা যাক। চলুন, ঊর্মির মা-বাবার সঙ্গে দেখা করি।’
প্রবীর বললেন, ‘আর একটা ইনফো দিই। পালঙ্কের উপরে ঊর্মির মোবাইল পড়েছিল। সেটা সাইবার বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে।’
‘ওরা কী বলল জানা জরুরি।’ প্রবীরের সঙ্গে একটি ঘরে ঢুকলেন সুনীল। ঘরটি ছোট। একটা ডাবল বেড, একটা আলমারি আর দুটো চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। দেওয়ালের দিকে মুখ করে খাটে বসে রয়েছেন অনিলাভ আর স্বস্তিকা। স্বামী-স্ত্রীর বয়স ষাটের আশেপাশে। সুনীলকে দেখে হাতজোড় করে অনিলাভ বললেন, ‘আসার জন্য ধন্যবাদ।’
‘সরাসরি কাজের কথায় আসছি। আমাদের হাতে সময় কম। বললেন সুনীল।
‘বলুন, কী জানতে চান।’
‘কলকাতায় এত বড় ফ্ল্যাট থাকতে আপনি বসিরহাটে থাকতেন কেন?’
“আমি ছ’মাস আগে রিটায়ার করেছি। তার আগে পর্যন্ত কর্মজীবন ছিল বসিরহাট। ওখানে থাকব, এটাই স্বাভাবিক।”
‘অবসরের পরে বউ আর মেয়ের সঙ্গে থাকা যেত না?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বিড়ি ধরিয়ে অনিলাভ বললেন, “আমি চিরকাল চেয়েছি মেয়েটা পড়াশুনো করুক। রং-তামাশা করার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। কিন্তু ওর মা সে-কথা শুনলে তো! ক্লাস সেভেন থেকেই নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, পিয়ানো ক্লাস, মার্শাল আর্ট – এসব হচ্ছে। লেখাপড়ার বেলায় অষ্টরম্ভা। আমি কি ‘গণনাট্য আন্দোলন’ করিনি। স্ট্রিট কর্নারের আগে গণসংগীত গাইনি? আমার গিন্নি তো নিয়মিত পথনাটক করত। তাহলে হঠাৎ টাকার জন্য এই বেলেল্লাপনা কেন?”
‘আগে বিড়িটা নেভাও। তোমার ওই কমরেড-মার্কা নোংরা ঝোলার মধ্যে মার্লবোরো লাইসের কুড়িটা সিগারেটের প্যাকেট আছে। তার থেকে একটা ধরিয়ে বিপ্লবের কথা বলো।’ ঝাঁজিয়ে উঠেছেন স্বস্তিকা।
‘আমি কখন বিড়ি খাব আর কখন মার্লবোরো— সেটা তুমি ঠিক করবে না কি? হুংকার দিয়ে উঠলেন অনিলাভ। ‘আজ ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বলে পালটি খেতে লজ্জা করে না।’ স্বস্তিকা চোখের জল মুছে বললেন, ‘না, করে না। তার কারণ হল ঊর্মি। ছোটবেলা থেকেই আমি জানি যে, ওর মধ্যে ট্যালেন্ট আছে।
ইশকুল-কলেজে পড়াশুনো করে সময় নষ্ট করার জন্য ও জন্মায়নি।’
‘পড়াশুনো না করলে ট্যালেন্টের কোনও দাম নেই।’ খিঁচিয়ে ওঠেন অনিলাভ।
দায়
স্বস্তিকা পালটা চিকুর ছাড়েন, ‘মেয়েটা শুধু ট্যালেন্টেড ছিল তা-ই নয়, ও ট্যালেন্ট স্পট করতেও পারত। তা না হলে ওর কী পড়েছিল ক্লাসফ্রেন্ড মিলির ডিজাইন করা পোশাক পরে মিলিকে ফেমাস করে দেওয়ার? ঊর্মির যখন ক্লাস ইলেভেন, তখন মিলি কোথা থেকে উড়ে এসে বসিরহাটে জুড়ে বসেছিল। বাবা-মা নেই। মেসোর বাড়িতে থাকত। ঊর্মির পার্সোনাল স্টাইলিস্ট হয়ে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছে মিলি। বলিউড থেকে ফিল্ম ডিরেক্টর রণজয় বনশালি ওকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। ঊর্মি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এসব হত?’
সুনীলের দিকে তাকিয়ে অনিলাভ বললেন, ‘কোথা থেকে কোথায় চলে গেল খেয়াল করলেন? আমি কেন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকতাম না, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।’
স্বস্তিকা হু হু করে কাঁদছেন আর বলছেন, “তুমি থাকো তোমার ডেড আইডিওলজি নিয়ে। আমার ওসব ফালতু ন্যাকামি নেই। আমি মেয়েটাকে গাধার মতো খাটিয়েছি। ক্লাস টুয়েলভের পরে কলেজে যেতে দিইনি। এটা করেছি বলেই ইস্ট সিটিতে ফ্ল্যাট হয়েছে। গ্যারাজে এসইউভি আর হ্যাচব্যাক হয়েছে, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হয়েছে। তুমি যদি বসিরহাটের ইঁট বের করা বাড়িতে বসে গণসংগীত শুনতে কমফর্টেবল থাক, তাহলে স্কচ খেতে ইস্ট সিটিতে আর ‘বাগচী বাগিচা’য় দৌড়ে আসো কেন? হিপোক্রিট কোথাকার!”
‘আমি স্কচ খেতে আসি না’ – বিড়ি নিভিয়ে ঝোলা থেকে মার্লবোরোর প্যাকেট বের করেছেন অনিলাভ। ‘আমি আসি তোমার অধঃপতন দেখতে। টাকার জন্য মেয়েটাকে পঙ্কজ দত্তর কাছে বিক্রি করে দিয়েছ। ওই প্রোডিউসারটা আমার বয়সি। ও ঊর্মির কাছে রোজ সন্ধেবেলা কেন আসে? আমি কিছু বুঝি না?’
‘তুমি একটা গাধা! তুমি কিছুই জানো না। ঊর্মি আর শিবেন্দুকে হিরো-হিরোইন করে পঙ্কজ একটা বই করার প্ল্যান করছিলেন। স্ক্রিপ্ট করেছে সোহম। ওজন্যই উনি নিয়মিত ইস্ট সিটির ফ্ল্যাটে আসতেন।’
সুনীল এতক্ষণ স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া শুনছিলেন। এবার বললেন, “আমি একটা ছোট্ট প্রশ্ন করেছিলাম। ‘অবসরের পরে বউ আর মেয়ের সঙ্গে থাকা যেত না?’ তার এত বড় উত্তর আশা করিনি। তবে ঝগড়াটা শুনে আমার লাভ হল। পঙ্কজ, মিলি, সোহম আর শিবেন্দুর সঙ্গে কথা বলার সময় পয়েন্টগুলো কাজে লাগবে।”
অনিলাভ আর স্বস্তিকা চুপ।
সুনীল স্বস্তিকাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। অনিলাভবাবু কেন মেয়েকে খুন করতে যাবেন? মেয়ে বেঁচে থাকলে স্কচের ফ্রি সাপ্লাই তো থাকবে।’
“আপনার কি ধারণা, ‘অনার কিলিং’ শুধু উত্তর ভারতে হয়?” ফুঁসে উঠেছেন স্বস্তিকা, “নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি, রবি ঠাকুর আর সত্যজিতের নাম আওড়ানো বামপন্থী বাঙালি এসবের বাইরে? তাহলে বলি, আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। আমার বর মেয়েকে দিন-রাত বলত, ‘অনিলাভ সান্যালের মেয়ে হয়ে তুই বেশ্যাবৃত্তি করছিস। শরীর বেচে গাড়ি-বাড়ি করেছিস।’ মেয়েটা কত সহ্য করবে বলুন তো? ও ডিপ্রেশনে ভুগছিল। রোজ মদ খেত। শেষ কোপটা বাবাই মারল। মেয়েটাকে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিল।”
অনিলাভ চুপ করে শুনছিলেন।
এবার পাশের ঝোলা থেকে একটা ব্যাঙ্কের পাস বই বের করে প্রবীরের দিকে এগিয়ে বললেন, ‘আমার বউ এটা আপডেট করতে আমাকে দিয়েছিল|”
সুনীল উকি মেরে দেখলেন জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে ঊর্মি সান্যালের নাম। সেভিংস অ্যাকাউন্টে কুড়ি লক্ষ টাকা রয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সেভিংস অ্যাকাউন্টে এত টাকা কেউ রাখে না কি?’
।’ আর স্বস্তিকা
অনিলাভ কেটে কেটে বললেন, “এরকম পাসবই আরও অনেক আছে। আছে এফডি, এসআইপি, শেয়ার, ফ্ল্যাটের দলিল এবং একাধিক গাড়ির কাগজ। সব ক’টা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। সব মেয়ে আর মায়ের নামে। ‘ইদার অর সার্ভাইভার’ করা আছে। এদিকে, আমার গিন্নি একজনের প্রেমে পড়েছেন। ডিভোর্সের জন্য মামলা করলে মেয়ে যদি রেগে যায়? তাহলে কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে। কী গিন্নি, ঠিক বলছি তো?”
‘তুমি বলতে চাইছ টাকার লোভে আমি মেয়েটাকে খুন করেছি? কোনও মা এই কাজ করতে পারে?’ সুনীলের দিকে তাকিয়ে জলভরা চোখে সমর্থন চাইছেন স্বস্তিকা।
অনিলাভ স্ত্রীকে ভেঙিয়ে সুনীলের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “কোনও বাবা মেয়ের ‘অনার কিলিং’ করতে পারে?”
স্বস্তিকার ভোল বদলে গিয়েছে। তিনি অনিলাভর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘শাট আপ!’
সুনীল মৃদু হেসে বললেন, “কাল রাতে আপনারা দু’জনেই এই ঘরে শুয়েছিলেন। একজন ঘর থেকে বেরিয়ে খুন করে এলেন। অন্যজন টেরও পেলেন না। এটা কীভাবে সম্ভব? না কি দু’জনে মিলেই খুনটা করে এখন ভাল সাজছেন?”
স্বস্তিকা আর অনিলাভ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁদের একলা থাকতে দিয়ে ঘর থেকে বেরলেন প্রবীর, সুনীল আর শাজাহান।
॥ ৩॥
বাড়ির বাইরে বেরিয়েই দেখা হয়ে গেল কেয়ারটেকার রাকেশ সাধুখাঁর সঙ্গে। বছর ত্রিশের লোকটি প্রবীরকে দেখে সেলাম ঠুকল। সুনীল জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি থাকো কোথায়?’
‘ওই তো স্যর! ওইখানে।’ রাকেশের তর্জনী ‘বাগচী বাগিচা’র গেটের পাশের একতলা কোয়ার্টারের দিকে।
‘চলো, একবার ঘুরে আসি।’ রাকেশের কাঁধে হাত রেখে এগলেন সুনীল।
কোয়ার্টারে ঢুকে দেখা গেল এক মহিলা রান্না করছে। মোটাসোটা, থলথলে চেহারা। চেহারায় বুড়োটে ভাব এসে গিয়েছে। মুখের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। রাকেশ বলল, ‘আমার মিসেস, আলোরানি সাধুখাঁ।’
আলোরানি খসখসে গলায় বলল, ‘নমস্কার।’
শাজাহান আলোরানিকে মন দিয়ে দেখছিল। সে বলল, ‘তোমার কি শরীর খারাপ?’
“আমার ‘থাইরড’-এর সমস্যা আছে”, শাজাহানের দিকে তাকিয়ে বলল আলোরানি।
‘ওষুধ খাচ্ছো না?’ জিজ্ঞাসা করল শাজাহান।
আলোরানি বলল, “ওষুধ খেলে আমার গা গুলোয়। অন্যভাবে ‘টিটমেন্ট’ হচ্ছে।”
শাজাহানের পিঠে হাত দিয়ে থামালেন সুনীল। রাকেশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি পার্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওখানে ছিলে? না এখানে চলে এসেছিলে?’
‘সারাক্ষণ ছিলাম,’ গর্বভরে বলল রাকেশ।
‘ভোর রাতে, এরকম ফাঁকা জায়গায়, উঁচু পালঙ্ক থেকে কাঠের টুল মার্বেলের মেঝেতে ছিটকে পড়ল। অথচ কোনও আওয়াজ হল না…’ ফিসফিস করে বলছেন সুনীল, ‘তুমি, আলোরানি আর
অভিজিত মদ খাওনি। তোমরা কেউ শুনতে পেলে না?’
রাকেশ চুপ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে বিন্দি পরতে পরতে আলোরানি বলল, ‘এত দূরে আওয়াজ আসে না। আপনি বরং অভিজিত স্যরকে জিজ্ঞাসা করুন।’
সোহম আর মিলির ঘরে ঢুকে সুনীল দেখলেন ওরা খাটে বসে স্মার্টফোনে লুডো খেলছে আর খুনসুটি করছে। দু’জনেরই বয়স ত্রিশের নিচে। সোহমের ছোটখাটো চেহারা। পরনে জিন্স আর বাসন্তী রঙের ফতুয়া, একগাল দাড়ি। কবি এবং চিত্রনাট্যকারকে যেমন দেখতে হওয়া উচিত, সেইরকম দেখতে। বি ফার্ম ডিগ্রি বাগিয়ে চলে এসেছে আর্টের লাইনে। কবিতা লিখে পেয়েছে খ্যাতি এবং বুদ্ধিজীবী তকমা। মেগা সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লিখে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে। একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণও হয়ে গেছে। শ্যামলা ত্বকের মিলির চেহারা বড়সড়। চোখ-মুখ ঝকঝক করছে। জি আর টপ পরা, স্মার্ট এবং গো-গেটার টাইপের মেয়ে। সুনীলদের দেখে দু’জনে উঠে দাঁড়াল। সুনীল নিজের পরিচয় দিতে মিলি বলল, ‘কী জানতে চাইছেন বলুন।’
সুনীল বললেন, ‘কাল রাতের পার্টির অকেশন কী ছিল?’
“ ‘ঊর্মিমুখর’ মেগার র্যাপ আপ পার্টি ছিল মূল অকেশন। মিডিয়া এসেছিল। প্রেস কন ছিল। সেখানে আমরা কেউই কিছু পান করিনি বা খাইনি। মিডিয়া চলে যাওয়ার পরে বন্ধুরা একসঙ্গে বসে খানাপিনা করছিলাম।’
‘আপনারা সবাই সবার বন্ধু? আপনি, সোহম, অনিলাভ আর স্বস্তিকা কি ঊর্মিলার বন্ধু?
‘উফ্! ওইভাবে কেন ভাবছেন!’ মিলি বিরক্ত, ‘আমি ঊর্মির পার্সোনাল স্টাইলিস্ট। আমি তো থাকবই। আর মেয়ের সঙ্গে বাবামা থাকবেন— এটাই স্বাভাবিক।’
‘আপত্তি নম্বর এক।’ তর্জনী তুলে বললেন সুনীল, ‘ঊর্মি থাকত তার মায়ের সঙ্গে, কলকাতায়। ওর বাবা থাকত বসিরহাটে। কাজেই মেয়ের সঙ্গে বাবা-মা থাকবে আপনার এই যুক্তি খাটছে না। আপত্তি নম্বর দুই হল, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারার আগে পার্সোনাল স্টাইলিস্ট লাগে না কি?’
মিলি অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ঊর্মিলা একজন স্টার। সে কখনওই ম্যাক্সির উপরে ওড়না জড়িয়ে কারও সামনে আসতে পারে না। ওতে স্টার ভ্যালু চলে যায়।’
‘বাবা-মা এবং বন্ধুদেরও স্টার ভ্যালু দেখাতে হয়?’
মিলি শ্রাগ করে বলল, ‘ফিল্মি লোকরা এইরকমই সেল্ফ অবসেস্ড হয়। আর তাদের পার্টিও এইরকমই হয়। মদ খেয়ে পিএনপিসি করা। যে নেই তার নামে নিন্দে, যে আছে তার প্রশংসা।’
‘এইরকম পার্টি ঊর্মির ফ্ল্যাটে নিয়মিত হত? না কি শুধু এখানেই হল?’
‘ইস্ট সিটির ফ্ল্যাটে নিয়মিত হত।’
শাজাহান হঠাৎ বলল, ‘সোহম চুপ কেন? আপনি কিছু বলুন। এসব পার্টিতে আপনার মতো বুদ্ধিজীবী কেন থাকেন?’
সোহম বলল, ‘আমি থাকি, কারণ লোককে অবজার্ভ করা আমার কাজের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমি এসব পার্টিতে আউটসাইডার। মধ্যবিত্ত ভ্যালুজ এখনও যায়নি। বাড়িতে শুয়ে বই পড়তে বা গান শুনতেই বেশি ভালবাসি।’
‘একই লোকদের বারবার অবজার্ভ করে নতুন কী পান?’
‘ভাল প্রশ্ন।’ হাসল সোহম, ‘র্যাপ আপ পার্টির পরে আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। মিলি আর ঊর্মি মিলে আমাকে থাকতে বাধ্য করে।’
‘প্রমাণ দেওয়ার জন্য ঊর্মি বেঁচে নেই। আমি কি ধরে নিতে পারি যে, বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ আপনি ছাড়তে চাননি?’ সুনীল মৃদু হাসলেন।
সোহম বলল, “আমি মিলিকে ভালবাসি। মিলিও আমাকে। আমার বাবা-মা এই সম্পর্কের কথা জানেন। শারীরিক মেলামেশার জন্য আমাদের জায়গার অভাব নেই। কলকাতা শহর ছেড়ে আমাকে আর মিলিকে বালিতে এসে সঙ্গম করতে হবে— এইরকম সংকটে আমরা ভুগি না। আমার এখানে আসার প্রধান কারণ হল, ‘বাগচী বাগিচা’ নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি। সেজন্য এখানকার লাইব্রেরিতে গতকাল সারাদিন পড়াশুনো করেছি। রাতে মিলির সঙ্গে সময় কাটানোটা উপরি পাওনা ছিল।”
মিলি সোহমের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘সাবাস পোয়েট! একদম মুহুতোড় জবাব দিয়েছিস।’
সুনীল মাথা নিচু করলেন। সত্যিই, তিনি সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে শাজাহান মিলিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল পার্টিতে কী কী হয়েছিল?
মিলি বিরক্তি চেপে বলল, ‘এসব পার্টিতে সত্যিই কোনও স্পেসিফিক কথা হয় না। আই মিন, যার সঙ্গে আপনি ঊর্মিলার ডেথকে রিলেট করতে পারেন।’
সুনীল বললেন, ‘পঙ্কজ দত্তর নতুন ছবি নিয়ে কোনও কথা হয়নি? যেটার হিরো শিবেন্দু আর হিরোইন ঊর্মি?’
মিলি ফিক করে হেসে বলল, ‘বোঝাই যাচ্ছে, আপনারা কাকু-কাকিমার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওঁরা ঝাঁপি খুলে বসলে কিছুই অজানা থাকে না। এনিওয়ে, কাল রাতে নতুন ছবি নিয়ে কথা হয়নি। তার একাধিক কারণ ছিল।
সুনীল বললেন, ‘কী কী কারণ?’
মিলি কিছু বলার আগে সোহম বলল, ‘আসলে, আমার মধ্যে কিছুদিন ধরে একটা অনুভূতির বীজ বড় হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ওই বীজ ডালপালা মেললে কবিতা হবে না, গদ্য হবে না, মেগা সিরিয়াল তো হবেই না। ওই অনুভূতিকে একমাত্র সিনেমার ভাষায় প্রকাশ করা যায়।’
শাজাহান বলল, ‘সোজা করে বলুন না। যে, আপনি একটা সিনেমা বানাতে চান।’
‘সহজ কথা বলতে আমায় কহো যে…’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোহম। “আপনাদের মতো করেই বলি তাহলে? আমি একটা চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। নাম রেখেছি, ‘চোখের আড়ালে’। প্রধান দুই চরিত্রের জন্য ভেবেছিলাম শিবেন্দু আর ঊর্মিকে। ফ্রেশ পেয়ার। টিভির কারণে অসম্ভব জনপ্রিয়। কিন্তু বড় পরদায় নতুন। পঙ্কজদা ছবিটা প্রোডিউস করতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু একটা সমস্যা হয়। অভিজিৎ চিত্রনাট্যটা পড়ে ফেলেন এবং পঙ্কজদাকে বলেন নায়ক চরিত্রে উনি অভিনয় করবেন। পঙ্কজদা এইবার সমস্যায় পড়লেন। অভিজিৎকে চটিয়ে টালিগঞ্জে কেউ একটাকা রোজগারও করতে পারে না। টালিগঞ্জের মহাতারকাকে চটালে পঙ্কজদার ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি উঠে যাবে। এসব ক্রস কারেন্টের কারণে কাল রাতে ওই ছবি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।”
মিলি বলল, ‘এনিওয়ে, এসবের সঙ্গে ঊর্মির মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের কূটকচালি
আজীবনকাল চলতে থাকে।
সুনীল মিলিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার আদি বাড়ি বসিরহাট। সোহমের বাড়ি কলকাতা শহরে। আপনাদের আলাপ হল কীভাবে?’
“আমি আর ঊর্মি ক্লাসমেট ছিলাম। বারো ক্লাসের পরে ও আর স্কুলে আসেনি, কিন্তু বন্ধুত্বটা রয়ে গিয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময়ে আমি ওকে পোড়ামাটির দুল, হার, বালা তৈরি করে উপহার দিতাম। পরের দিকে ফেলে দেওয়া মেটাল বা প্লাস্টিকের সঙ্গে পাখির পালক বা নুড়ি-পাথর মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে গয়না বানিয়ে দিতাম। মফস্সলি এলাকায় ওই গয়না খুব সাড়া ফেলেছিল। ঊর্মি কলকাতায় চলে আসার পরে ওর সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। ও রেয়ারলি বসিরহাটে আসত। তবে এলে দেখা করত। ও ‘দীর্ঘ ঊ’ নামে ফেমাস হওয়ার পরে আমি ‘দীর্ঘ ঊ’ লেখা সুয়েডের টিপ বানিয়ে ওকে উপহার দিই। সেটা খুব জনপ্রিয় হয়। তখন ওর অনুরোধে পোশাক পরিকল্পনা শুরু করি। সেই পোশাক মেগা সিরিয়ালে পপুলার হয়ে যাওয়ায় ঊর্মি আমাকে ওর পার্সোনাল স্টাইলিস্ট হিসাবে নিয়োগ করে। আমি কলকাতায় চলে আসি। টিভিতে প্রচুর কাজ করেছি। টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও। রিসেন্টলি মুম্বইয়ের ফিল্ম ডিরেক্টর রণজয় ভনশালি ফোন করে ওঁর পরের ছবির জন্য যোগাযোগ করতে বলেছেন। ভগবানের আশীর্বাদে আজ আমার কোনও অভাব নেই। সবকিছুর শুরু ঊর্মির জন্য।”
পাশ থেকে সোহম বলল, ‘ঊর্মি যে তোকে দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা দিচ্ছিল না, সেটা বলবি না?’
‘আহ! ওসব ছাড় না সোহম। যে মারা গেছে তার নামে নিন্দে করতে নেই।’ নিচু গলায় সোহমকে বকুনি দেয় মিলি।
‘আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সোহমের সঙ্গে আপনার আলাপ কীভাবে হয়েছিল।’ বললেন সুনীল।
মিলি বলল, “সে কথায় আসতে গেলে ঊর্মির কথা বলতেই হবে। সোহমের সঙ্গে আমার আলাপ ‘উর্বশী’ মেগার সেটে। ও স্ক্রিপ্ট লিখছিল। আমি ঊর্মির পার্সোনাল স্টাইলিস্ট। সেটে রোজই দেখা হত। সেই থেকেই…”
সুনীল বললেন, ‘আমি সোহমের কথায় ফেরত আসতে চাই। ঊর্মি কেন মিলিকে দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা দিচ্ছিল না?’
মিলি চুপ। সোহম বলল, ““তোর জন্য অনেক করেছি। আর পারছি না।’— এই ছিল ঊর্মির যুক্তি। ফেয়ার এনাফ। দু’জনেই দু’জনের জন্যে অনেক করেছে। বন্ধুকৃত্যেরও শেষ আছে। কিন্তু টাকা না দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়াটা ঘোর অন্যায়। তাই না?”
‘ঊর্মি কীভাবে মারা গেছে বলে আপনাদের মনে হয়?’
‘শি ওয়াজ সাফারিং ফ্রম ডিপ্রেশন।’ সোজাসাপটা উত্তর মিলির, “মেগার কমিটমেন্টের জন্য ও মুম্বইয়ের একাধিক কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ইন ফ্যাক্ট, রণজয় ভনশালি ওকেও ফোন করে পরের মুভির হিরোইনের রোল অফার করেছিলেন। টিভির প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে চুক্তির কারণে ও ‘না’ বলতে বাধ্য হয়েছে। নিয়মিত মদ খেয়ে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ছিল। তাছাড়া, ওর মা শিবেন্দুর সঙ্গে প্রেমটা মেনে নিতে পারেনি। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে রোজ ঝগড়া হত।”
“আপনারা দু’জনে সারারাত এই ঘরেই ছিলেন?” মিলিকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সুনীল।
‘হ্যা’, একসঙ্গে উত্তর দিল সোহম আর মিলি।
‘আত্মহত্যা করার সময়ে ঊর্মি লাথি মেরে টুল পালঙ্ক থেকে ফেলে দেয়। টুল পড়ে গেলে শব্দ হওয়ার কথা। আপনারা সেরকম কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন?’
সোহম আর মিলি একে অপরের দিকে তাকাল। মিলি দুষ্টু হেসে বলল, ‘এই ঘরের খাটে কাল রাতে এত আওয়াজ হচ্ছিল যে আমাদেরই লজ্জা করছিল। সেই অবস্থায় বাইরের আওয়াজ শোনা সম্ভব? আপনারাই বলুন?’
সুনীলরা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
॥৪॥
শিবেন্দু লম্বা, ফরসা, সুদর্শন। নায়কোচিত চেহারা। আদি বাড়ি বর্ধমান। টিভির মেগাতে কাজ করে যা টাকা কামিয়েছে, তাই দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে বাঁশদ্রোণীতে। আরও কিছু টাকা হলে টালিগঞ্জের আশপাশে শিফ্ট করবে। আপাতত ট্র্যাক প্যান্ট আর হুড়ি পরে, বাঁশস্রোণীর ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সুনীল আর শাজাহান যে আসবেন, এটা প্রবীর মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
শিবেন্দুর হাতের স্মার্টফোনে স্কুপ চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ, ““দীর্ঘ উ’টি আছেন ঝুলে।” সঞ্চালক পরিমল ঊর্মির অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিবরণ শোনাচ্ছে। দেখাচ্ছে মেগা সিরিয়ালের ক্লিপিং, ‘বাগচী বাগিচা’, ঊর্মির বসিরহাটের বাড়ি আর ইস্ট সিটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।
সুনীলদের দেখে শিবেন্দু বলল, ‘ঊর্মি মারা যাওয়ার পরে চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেল। পোস্টমর্টেমের পরে বডি দাহ পর্যন্ত হয়ে গেছে। এখন আপনারা কী জানতে এসেছেন?’
““দীর্ঘ ঊ’ নামটা নিয়ে ঊর্মি কখনও আপত্তি করেননি?” জিজ্ঞাসা করল শাজাহান।
শিবেন্দু বলল, “কেন আপত্তি করবে? নামটা যতই হাস্যকর মনে হোক না কেন, ওই নামের জন্যই পাবলিক ঊর্মিকে মনে রেখেছে। নির্দিষ্ট ইমেজে আটকে পড়াকে অতীতে অসুবিধাজনক বলে মনে
করা হত। এখন পাবলিক মেমরি ক্রমশ ছোট হচ্ছে। টিভির পরদায় মেগা সিরিয়াল শেষ হয়ে যাওয়া মানেই পাবলিক মেমরি থেকে ডিলিট হয়ে যাওয়া। ঊর্মি সৌভাগ্যবান যে ওর অভিনয় করা তিনটে মেগার নাম ছিল ‘ঊর্ণনাভ’, ‘ঊর্বশী’ আর ‘ঊর্মিমুখর’। প্রথম আর শেষ সিরিয়ালে ওর নাম ছিল ঊর্মিলা। ‘উর্বশী’-তে ও নামভূমিকায় ছিল। পাবলিক ওকে ‘দীর্ঘ ঊ’ বা ‘দিঘু’ নামেই মনে রেখেছে। শি ওয়াজ হ্যাপি অ্যাবাউট দ্যাট।”
সুনীল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ঊর্মিকে কতদিন ধরে চেনেন?’
““ঊর্ণনাভ’-তে ও আর আমি একই ট্র্যাকে ছিলাম। এনটি ওয়ানে শুট হত রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। কোনও বসার জায়গা পাওয়া যেত না। ঘরের তো প্রশ্নই নেই। দু’জনে ফ্লোরের বাইরের বেঞ্চিতে বসে গল্পগুজব করতাম।”
‘তখন থেকেই প্রেম?’
ম্লান হেসে বলল, ‘আমার তরফে তখন থেকেই।’
শিবেন্দু
‘এবার রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ঊর্মির তরফে প্রেমটা পরে এসেছিল।’
“রহস্যের কিছু নেই। ঊর্মি আমাকে ভালবাসত কি না, এটা আমি কখনও বুঝে উঠতে পারিনি। বড় অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে এটা হয়। কোনটা ‘রিয়েল লাইফ’ আর কোনটা ‘রিল লাইফ’— সেটা কাছের মানুষও বুঝে উঠতে পারে না। হয়তো তারা নিজেরাও পারে না।”
ছাইদানে নিবে যাওয়া সিগারেট গুঁজে দিল শিবেন্দু।
‘আপনি ঊর্মির উপরে এখনও অভিমান করে আছেন?’
‘ঊর্মি আর মানুষ ছিল না, জানেন….’ আবার সিগারেট ধরিয়েছে শিবেন্দু, “তারকা হওয়ার জন্য ও আত্মাকে শয়তানের কাছে বন্ধক রেখেছিল। প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুত্ব – এসব কথার কোনও মানে ছিল না ওর কাছে। ও আমার সঙ্গে প্রেম করার পাশাপাশি অভিজিতের সঙ্গেও প্রেম করত। কোনটা প্রেম আর কোনটা অভিনয় – তখন বুঝতে পারতাম না। আজ বুঝি, দুটোই অভিনয়। কারণ, আমাদের দু’জনের সঙ্গে প্রেম করার পাশাপাশি ও নিয়মিত পঙ্কজ দত্তর সঙ্গে শুত। ওই ষাট বছরের বুড়োটার সঙ্গে! ক্যান ইউ ইম্যাজিন?”
বাতাসে জাল বিছচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া। হাওয়া বওয়ার শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে। শিবেন্দু নিঃশব্দে কাঁদছে।
সুনীল বললেন, ‘ঊর্মি কেন আত্মহত্যা করেছে বলে আপনার মনে হয়?’
শিবেন্দু চোখের জল মুছে বলল, ‘ঊর্মি ওয়াজ ফুল অফ লাইফ। ও আত্মহত্যা করার মেয়েই না।’
‘তাহলে কি এটা মার্ডার?’
‘সেটা পুলিশ বলবে।’
‘পুলিশের বদলে আমিই বরং বলি।’ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে শাজাহান বলল, “ঊর্মি মার্ডার হয়েছে। ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে ওর শরীরে ‘ফেন্টানিল’ পাওয়া গেছে।” ‘এটা ওষুধ, না, বিষ?’
‘এটা আফিম জাতীয় ওষুধ। তবে আফিম তৈরি হয় গাছ থেকে। বিজ্ঞানীরা ফেন্টানিল তৈরি করেছেন ল্যাবরেটরিতে। এই ওষুধটা মরফিনের থেকে অনেক গুণ শক্তিশালী। যাদের ক্রনিক ব্যথা-বেদনা আছে, তারা এই ওষুধ খায়।’
‘ঊর্মির ক্রনিক পেন আছে বলে শুনিনি,’ উত্তেজিত হয়ে বলল শিবেন্দু, “তবে আমি জানি যে অভিজিতদা নিয়মিত কড়া ডোজের ব্যথা কমানোর ওষুধ খান। কম বয়সে স্টান্টম্যান ছাড়া অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিলেন। বুড়ো বয়সে এসে সেই চোট ‘লো ব্যাক পেইন’ হিসাবে জানান দিচ্ছে।”
‘অভিজিতের কথা এখন থাক।’ শিবেন্দুকে থামিয়ে দিল শাজাহান, ‘কম ডোজে ফেন্টানিল ওষুধ। বেশি ডোজে বিষ। ঊর্মির রক্তে প্রচুর পরিমাণে ফেন্টানিল ছিল।’
শিবেন্দু সিগারেটের শেষ অংশ ছাইদানে গুঁজে বলল, ‘ঊর্মি তো সিলিংয়ের হুক থেকে ওড়না গলায় জড়িয়ে ঝুলছিল!’
‘আমরা ক্রাইম সিন দেখেই আন্দাজ করেছিলাম যে এটা খুন। পুলিশকে কিছু বলিনি।’
‘কীভাবে আন্দাজ করলেন?’
‘সেটা সময়মতো জানাব। এখন নয়।’ বলল শাজাহান।
শিবেন্দু ঘাবড়ে গিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘আপনারা আমাকে সন্দেহ করছেন না কি?’
‘সন্দেহ না করার কোনও কারণ আছে কি?’ বললেন সুনীল, ‘সেক্সুয়াল জেলাসি মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। আপনি যাকে ভালবাসেন, সে অন্য একজনের সঙ্গে প্রেম করছে, তৃতীয় একজনের সঙ্গে রেগুলার শুচ্ছে। আপনার জায়গায় আমি থাকলে তো খুন করেই দিতাম। তারপরে জেল বা ফাসি হলে হবে।’
‘ধুর মশাই। ফালতু ভয় দেখাবেন না তো!’ ফ্যাকাসে হাসছে শিবেন্দু, ‘ওকে যদি কেউ খুন করে থাকে, তাহলে সেটা হল পঙ্কজদা। আমি জানি যে, ঊর্মি নিজেদের একটা সেক্স ভিডিও তুলেছিল।’
‘হুম!’ ঘাড় নাড়ছেন সুনীল, ‘তাহলে আপনি বলছেন যে, পঙ্কজ দত্ত ঊর্মিকে খুন করেছেন।’
‘আমি তা বলিনি!’ হুস হুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে শিবেন্দু, “আমি জাস্ট একটা সম্ভাবনার কথা বললাম। আর একটা কথা বলে রাখি। পঙ্কজদার মেয়ে তানিয়া নিউ ইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশান করে সদ্য কলকাতা ফিরেছে। বাবার প্রযোজনা করা ছবিতে অভিনয় করেই ও টালিগঞ্জে পা রাখবে। সোহমের লেখা ‘চোখের আড়ালে’-র স্ক্রিপ্টে আমার সঙ্গে তানিয়াকে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল পঙ্কজদার। কিন্তু অভিজিৎদা আর ঊর্মির আপত্তিতে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। ঊর্মি মরলে তানিয়ার রাস্তা ক্লিয়ার হয়।”
‘এটা বাজে যুক্তি হয়ে গেল। পঙ্কজ প্রোডিউসার। উনি যা চাইবেন, তাই তো হবে!’ আপত্তি করল শাজাহান।
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে অভিজিৎদা টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির স্বঘোষিত ভগবান। ওঁর অনুমতি ছাড়া নায়িকারা স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলাতে পারে না। হিরোরা কমোডে বসতে ভয় পায়। চোখের আড়ালে’-র স্ক্রিপ্ট আমার পড়া। এত ভাল কনটেন্ট গত ১৫ বছরে বাংলা সিনেমায় আসেনি। হিরো আর হিরোইনের জন্যে অথর-ব্যাকড রোল। অভিজিৎদা চাইছিল হিরোর রোলটা করতে। হিরোইন কে হবে, এই নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। অভিজিৎদা বললে পঙ্কজদা আমাকে আর ঊর্মিকে সরিয়ে তানিয়া আর অভিজিৎদাকে নিয়ে ছবিটা নামিয়ে দেবে। ঊর্মি খুন হয়েছে আর আমি খুন করেছি— এইটা হলেই ছক সম্পূর্ণ হয়। তাই না?”
সুনীল কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবলেন। মাথা তুলে জিজ্ঞাসা বললেন, ‘আপনি আর পঙ্কজ একঘরে শুয়েছিলেন। ঊর্মিকে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যে পঙ্কজ রুম থেকে বেরিয়েছিলেন কি না আপনার ভাল জানার কথা।’
‘আই ওয়াজ টু ড্রাঙ্ক!’
শাজাহান বলল, “উর্মির মোবাইল ঘেঁটে কলকাতা পুলিশের সাইবার সেল কিস্স পায়নি। যার হাতে মোবাইল পড়েছিল, সে ‘রেস্টোর ফ্যাক্টরি সেটিং’ অপশনে গিয়ে সবকিছু মুছে দিয়েছে। মোবাইল এখন নতুন স্লেটের মতো পরিষ্কার। কাজেই ওই সেক্স ভিডিওটা আর পাওয়া যাবে না।”
শিবেন্দু বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি জানতাম…’
সুনীল ফিসফিস করে শিবেন্দুকে বললেন, “আপনি আর পঙ্কজ দত্ত মিলে ঊর্মিকে খুন করেননি তো? দু’জনেরই স্ট্রং মোটিভ আছে। তাছাড়া মাতাল অবস্থায় একটা লাশকে সিলিং থেকে ঝোলানো সহজ কাজ নয়। গায়ের জোের লাগে।” .
শিবেন্দু ঘাবড়ে গিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘মাইরি বলছি স্যর, আমি ঊর্মিকে খুন করিনি।’
॥ ৫॥
পঙ্কজ দত্ত অফিসে বসে কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। প্রবীরের সঙ্গে সুনীল আর শাজাহানকে ঢুকতে দেখে বললেন, ‘আমার উকিল না আসা পর্যন্ত কোনও কথা বলব না।’
আজ ২৯ ডিসেম্বর। সুনীল আর শাজাহান মিলে ‘বাগচী বাগিচা’ গিয়েছিলেন গতকাল সকালে। আজ সকালে শিবেন্দুর সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন আসা হয়েছে পঙ্কজের কাছে। এখান থেকে অভিজিতের কাছে যাওয়া হবে।
পঙ্কজের কাছ থেকে বিরোধিতা আসবে, এটা আন্দাজ করে সুনীল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন প্রবীরকে। পঙ্কজের কথা বলার ধরন প্রবীরকে রাগিয়ে দিয়েছে। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ঊর্মি সুইসাইড করেনি। ও মার্ডার হয়েছে। এই তদন্তে আপনি অসহযোগিতা করছেন? ঠিক হ্যায়! আমি তাহলে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ কাস্টডিতে নিচ্ছি।’
‘মুখ সামলে।’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলেন পঙ্কজ। ‘জানেন আমি কে?’ সুনীল বললেন, ‘আপনি ঊর্মির সুগার ড্যাডি। মেয়ের বয়সি ঊর্মির সঙ্গে শুতেন। সেটা আপনার স্ত্রী রেবা আর কন্যা তানিয়াকে জানিয়ে দেব না কি?’
পঙ্কজের হাবভাব নিমেষের মধ্যে বদলে গেল। তিনি হাতজোড় করে বললেন, ‘মাফ করে দিন স্যর। আমার ভুল হয়ে গেছে। কী জানতে চান বলুন।’
প্রবীর কড়া গলায় বললেন, ‘ঊর্মির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক ছিল?’
‘সবই তো জানেন, নতুন আর কী বলব!’ নিচু গলায় বললেন পঙ্কজ, “আমাকে না বলে ও মোবাইলে একটা ভিডিও তুলেছিল। আমাকে এই বলে ভয় দেখাত যে ‘চোখের আড়ালে’-তে ওকে নিলে ভিডিওটা আমার বউ আর মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে শেয়ার করবে। ক্যান ইউ ইম্যাজিন? সেক্স ভিডিও শেয়ার হওয়া নিয়ে মেয়েরা ভয় পায়। এক্ষেত্রে মেয়েটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। আমি ধর্মভীরু মানুষ। পরিবারের সবাই মিলে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছি। নিরামিষ খাই, ভজন শুনি। বউ-মেয়ে জানলে কেলোর কীর্তি হয়ে যাবে স্যর।”
প্রবীর শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘ঊর্মির সঙ্গে শোওয়ার আগে এই কথাগুলো মাথায় আসেনি। যাকগে। ওসব বাদ দিন। আপনার কাছে ভিডিওটা আছে?’
‘আছে,’ পঙ্কজ টেবিল থেকে স্মার্টফোন নিয়ে আনলক করে প্রবীরের হাতে তুলে দিলেন। প্রবীর ফোন গ্যালারি থেকে ক্লিপিংটা বের করে ফেলেছেন। পঙ্কজ মাথা নিচু করে বললেন, ‘একটাই অনুরোধ। ভিডিওটা প্লিজ শেয়ার করবেন না। তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনও গতি থাকবে না।’
প্রবীর ভিডিও ক্লিপটা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নিজের মোবাইলে নিয়ে বললেন, ‘আমার ওয়ার্ক এথিক্স আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এটা আমার কাছ থেকে কোথাও যাবে না।’
পঙ্কজ বললেন, ‘ধন্যবাদ স্যর!’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললেন, ‘ভিডিওটা দেখিয়ে ঊর্মি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। তাও আমি ক্লিপটা ডিলিট করিনি। তার কারণ হল, ওটা দেখলে নিজেকে আবার যুবক বলে মনে হত।
‘ঊর্মি মারা যাওয়ার পরে কেন ডিলিট করলেন না?’
‘আমি জানতাম যে, এটার সন্ধানে আপনি আমার কাছে আসবেন।’
সুনীল বললেন, ‘ঊর্মি মারা যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’
“ঊর্মির ব্যবহারে সাংঘাতিক চেঞ্জ এসেছিল। আমাকে পুতুলের মতো আঙুলের ডগায় নাচাত। আমি ওর সংস্পর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম। আমি চাইনি যে ‘চোখের আড়ালে’ ছবিটা ও করুক।”
‘ঊর্মির খারাপ ব্যবহারই একমাত্র কারণ? না কি আপনি আপনার মেয়ে তানিয়াকে এই ছবির হিরোইন হিসাবে চাইছিলেন?’
‘আমি আমার মেয়েকে আমার ছবিতে নিলে কার বাবার কী?’ উত্তেজিত পঙ্কজ বললেন, “কিন্তু একদিকে ঊর্মি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। অন্যদিকে অভিজিৎ শাসাচ্ছিল, আমি যদি ওকে না নিয়ে শিবেন্দুকে নিই, তাহলে আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে। বাংলায় একটা কথা আছে, ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’। এই ছবিটা নিয়ে আমার সেই দশা হয়েছে।”
‘ঊর্মি মার্ডার হওয়ায় আপনার তাহলে সুবিধে হল।’ বললেন সুনীল, ‘এখন তানিয়া আর অভিজিৎকে নিয়ে ছবিটা করতে পারবেন।’
পঙ্কজ স্নান হেসে বললেন, ‘আমি ধর্মভীরু মানুষ স্যর। ওই প্রোজেক্ট নিয়ে আর কাজ করব না। ওটা অভিশপ্ত প্রোজেক্ট!’
সুনীল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঊর্মিকে কে খুন করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
‘নো আইডিয়া স্যর! আমরা সবাই ভোর চারটে পর্যন্ত আড্ডা মেরেছিলাম। তারপরে আমি আর শিবেন্দু একটা ঘরে শুতে যাই। আমার ঘুমের সমস্যা আছে। রাতে স্টং সেডেটিভ খেতে হয়। একবার শুলে আর উঠি না। ঊর্মির বাবার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙেছিল।’
‘শিবেন্দুর অ্যাক্টিভিটি তাহলে বলতে পারবেন না?’
‘ও কাল পার্টিতে চুপচাপ ছিল। কারও সঙ্গেই কথা বলছিল না। মদ খাচ্ছিল কম। ও খুব জোরে নাক ডাকে বলে কেউ ওর পাশে শুতে চায় না। আমি ঘুমের ওষুধ খাই বলে কিছু বুঝতে পারি না। আউটডোরে আমি আর শিবেন্দু রুম শেয়ার করি। পরশু রাতেও তাই করেছিলাম।’
‘শিবেন্দু অবশ্য বলল যে, ও প্রচুর মদ খেয়েছিল।’
‘বলল?’ নির্লিপ্ত মুখে পঙ্কজ বললেন, ‘তা হতে পারে। আমি অতটা খেয়াল করিনি।’
সুনীল হঠাৎ বললেন, “আচ্ছা, এটা তো হতে পারে যে, আপনি আর শিবেন্দু মিলে ঊর্মিকে খুন করেছেন। দু’জনে দু’জনের অ্যালিবাই।”
‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ চিৎকার করে উঠেছেন পঙ্কজ।
“আমি জাস্ট একটা সম্ভাবনার কথা ভাবছি। আপনাদের দু’জনেরই খুনের মোটিভ আছে। ঊর্মি মরলে আপনার সেক্স ভিডিও ফাঁস হবে না। আর শিবেন্দু প্রেমিকার উপরে প্রতিশোধ নেবে। আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। ঊর্মির মোবাইলে আপনাদের ওই ভিডিওটাও নেই।”
‘আমি যদি ঊর্মির মোবাইল থেকে ভিডিওটা ডিলিট করে থাকি, তাহলে নিজের ফোন থেকে করিনি কেন? সি গ্রেড বাংলা সিনেমাতেও এত বাজে প্লট থাকে না।’
বিরক্ত হয়ে বললেন পঙ্কজ।
‘ঊর্মি ওই সেক্স ভিডিওটার কথা কাউকে বলেছিল?’
‘জানি না।’
স্মার্টফোন পঙ্কজকে ফিরত দিয়ে প্রবীর বললেন, ‘আমরা আপাতত আসছি। দরকারে যেন আপনাকে ফোনে পাওয়া যায়। আর আমাকে না বলে কলকাতা শহর ছাড়ার চেষ্টা করবেন না। তাহলে ইউ উইল বি
ইন ডিপ শিট।
Flat থেকে বেরিয়ে পুলিশের জিপে উঠে সুনীল প্রবীরকে বললেন, ‘ভিডিও ক্লিপটা আমি একবার দেখব।’ হাতে মোবাইলের গ্যালারি খুলে সুনীলের মোবাইল ধরিয়ে দিলেন প্রবীর। সুনীল আর শাজাহান ক্লিপিংটা দেখছেন।
শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছে রেকর্ডিংয়ের কথা পঙ্কজ জানেন না। গোপন জায়গায় মোবাইল বসিয়ে ক্যামেরার ফ্রেম আগে থেকে ঠিক করা আছে। সম্পূর্ণ নগ্ন ঊর্মি পঙ্কজের হাত ধরে খাটের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গেল। ফ্রেম জুড়ে এখন পঙ্কজ আর ঊর্মি। শাজাহান বলল, “বিদেশি পর্নো মুভিতে মেয়েদের গায়ে পোশাক না থাকলেও পায়ে হাই হিলটা ঠিক থাকে। এখানে ঊর্মির গায়ে একটা সুতোও নেই। কিন্তু ‘দীর্ঘ ঊ’ মার্কা টিপটা ঠিক আছে।”
‘ওটা দিশি পর্নোর টাচ!’ হাসছেন প্রবীর। “ব্র্যাজার’ বা ‘পর্নহাব’-এ এই ফ্যান্টাসি পাবেন না মশাই।”
পঙ্কজকে খাটে বসিয়ে মোবাইল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসল ঊর্মি। লুকিয়ে থামস্ আপ দেখাল, চোখ মারল। তারপরে এক এক করে পঙ্কজের কাপড়-জামা খুলতে লাগল ।
‘পঙ্কজের জন্য মায়া হচ্ছে।’ ক্লিপটা দেখে মন্তব্য করলেন সুনীল, ‘অভিজিতের বাড়ি আর কতদূর?’
॥৬॥
অতীতে তিনটে বিয়ে আর তিনটে বিচ্ছেদের শেষে অভিজিৎ এখন ‘হ্যাপিলি সিঙ্গল’। বছরে দু’টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন। অফার থাকলেও হিন্দি ছবি করেন না। জাতীয় স্তরে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি বলতে লোকে অভিজিৎকেই বোঝে।
অভিজিতের বাড়ি সাউথ এন্ড পার্কে। এই জায়গাটায় এখনও পুরনো কলকাতা রোদ্দুরে গা মেলে আড়মোড়া ভাঙে। ফ্লাইওভারের ওপারের রুদ্ধশাস দৌড় এপার থেকে বোঝা যায় না তত।
পুরনো আমলের বাড়ির গাড়িবারান্দায় পুলিশের জিপ পার্ক করে প্রবীর, সুনীল আর শাজাহান গাড়ি থেকে নামছেন এমন সময় প্রবীরের মোবাইলে ফোন এল। ফোন ধরে ‘হ্যা’ আর ‘আচ্ছা’ বলে লাইন কেটে তিনি বললেন, ‘ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস রিপোর্টের ফলো আপ এল। ঊর্মির ব্লাড লেভেল ফেন্টানিলে ভরপুর থাকলেও স্টমাকে ফেন্টানিল পাওয়া যায়নি।’
‘গ্লাসে কিছু পাওয়া যায়নি?’ জিজ্ঞাসা করল শাজাহান।
দারোয়ান এসে ওঁদের নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। প্রবীর নিচু গলায় বললেন, ‘খাবার বা পানীয়, গ্লাস, প্লেট, মদের বোতল – ক্রাইম সিনের কোথাও একফোঁটা ফেন্টানিল পাওয়া যায়নি। কেসটা পুরো ‘গুলিয়ে গেল।’
তিনজনে এখন অভিজিতের ড্রয়িং রুমের দরজার বাইরে। নিচু গলায় প্রবীর বললেন, ‘আসব?’
দরজা খুলে দিলেন অভিজিৎ। পঞ্চাশ পেরিয়েও যুবকদের মতো চেহারা। শরীর বা মুখে একটিও বয়সের দাগ পড়েনি। পরনে সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি। গায়ে জড়ানো দামি কাশ্মীরি শাল। হাতে গ্রিন টিয়ের পেয়ালা। নিচু গলায় বললেন, ‘আসুন।’
সুনীল ঘরে ঢুকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘কলকাতার কেন্দ্রে এত নিরিবিলি জায়গা আশাই করা যায় না।’
অভিজিৎ কোনও কথা না বলে সবুজ চায়ে চুমুক দিলেন।
‘ঊর্মি আত্মহত্যা করেনি। ও খুন হয়েছে। জানেন তো?” অভিজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন সুনীল, ‘আপনি তো টিভি দেখছিলেন। জানার কথা।’
অভিজিৎ ডিশ টিভির সেট টপ বক্সের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ডিসপ্লে প্যানেলে এখনও আলো জ্বলছে। তিনি সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে সুইচ অফ করে বললেন, ‘হ্যা জানি। তবে কীভাবে খুন সেটা মিডিয়া এখনও জানতে পারেনি। ফেন্টানিল পয়জনিং হয়েছে, কিন্তু স্টমাকে কেন ফেন্টানিল নেই, তা নিয়ে চেঁচাচ্ছে।’
‘কে খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়।’ সোফায় বসে অভিজিতকে প্রশ্ন করলেন সুনীল।
‘সিনেমাতে অনেক জেরার সিনে অভিনয় করেছি’, স্মিত হেসে বললেন অভিজিৎ, “ইন ফ্যাক্ট, নতুন যে ছবিটায় অভিনয় করছি, তার ওয়ার্কিং টাইটেল ‘জেরা’। তাতে আমি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে ইন্ডিয়া চলে এসেছি কোনও কাগজপত্র ছাড়াই। ইন্ডিয়ার সীমান্তবর্তী জেলায় কিছুদিন বসবাস করে রাজনীতির পান্ডাদের ঘুষ দিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ জোগাড় করছি। হঠাৎ পুলিশ সব জানতে পেরে আমাকে জেরা করতে শুরু করল। চারদিন আগে বসিরহাট আর টাকিতে আউটডোর সেরে এলাম। কাল থেকে এনটিওয়ানে ইনডোর শুরু হবে। কিন্তু ওসব হল অভিনয়। সত্যিকারের জেরা এই প্রথম ফেস করছি।”
“জেরা কেন ভাবছেন? আড্ডা ভাবুন না। সব হত্যাকাণ্ডই আসলে অনেকগুলো ব্যাকস্টোরির চরম পরিণতি। সবার সব গল্প না জানলে ‘হু হ্যাজ ডান ইট’ তার উত্তর পাওয়া যায় না।”
‘হুডানিট।’ শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ে চোখ ছলছল করছে অভিজিতের। “আমার আদরের ঊর্মি লাশ হয়ে গেছে। এখন চলছে ‘হত্যাকারী কে’— এই প্রশ্নের উত্তর
খোঁজার পালা। হায় রে।”
অভিজিতের চোখে চোখ রেখে সুনীল বললেন, ‘আপনি ঊর্মিকে ভালবাসতেন?’
‘আমি অভিনেতা! ভালবাসার অভিনয় করা আমার পেশা। আপনি আমার অভিনয়ে ভুলবেন না। আমার আর ঊর্মির ফোনালাপের ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড় করুন। তাহলেই জানতে পারবেন, আমি ওকে কতটা ভালবাসতাম। বিয়ে করার জন্য অনেকবার বলেছি। আমি জানি যে আমাদের মধ্যে বয়সের অনেক ফারাক। আমার তিনটে বিয়ে ছিল। প্রাক্তন তিন স্ত্রী আমার মতো মেগালোম্যানিয়াক, সেল্ফ অবসেস্ড সোশিওপ্যাথের সঙ্গে থাকতে না পেরে ডিভোর্স করে চলে গেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমি ঊর্মির প্রেমে পড়েছিলাম। এবং জীবনে এই প্রথম আমি বুঝতে পারছিলাম না ঊর্মি আমাকে ভালবাসে, না কি ভালবাসার অভিনয় করে।
‘শিবেন্দুও একই কথা বলেছে। ও-ও ঊর্মিকে ভালবাসত। কিন্তু ঊর্মি ওকে ভালবাসত কি না, সেটা বুঝতে পারেনি।’ ‘জানি। ঊর্মির মা
আমাকে সবই বলতেন।’
‘তার মানে আপনি জানতেন। সেকেন্ড কোয়েশ্চেন। পঙ্কজ ঊর্মির সুগার ড্যাডি ছিলেন। এটা আপনি জানতেন?’
‘পঙ্কজের সঙ্গে একবার শুতে বাধ্য হয়েছে, জানি। ওটা আপনাদের মতো পেটি মিডল ক্লাসের কাছে ইস্যু। আমার কাছে নয়।’
‘একবার নয়, বহুবার। শুতে বাধ্য হয়েছে নয়, নিজের থেকে শুয়েছে। এবং নিজেদের একটা সেক্স ভিডিও বানিয়ে ঊর্মি পঙ্কজকে ব্ল্যাকমেল করছিল। এটাও তো আপনি জানতেন? এবং এটাও আপনার কাছে পেটি মিডল ক্লাস ইস্যু। তাই তো?’
অভিজিৎ ম্লান হেসে বললেন, ‘খবরটা আমার জানা ছিল না।’
সুনীল মৃদু হেসে বললেন, ‘সবাই বলে যে আপনার অনুমতি ছাড়া টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে গাছের পাতাও নড়ে না। কাজেই এত বড় খবরটা আপনি জানতেন না, এটা আমি মানতে পারছি না।’
‘আমি সত্যিই জানতাম না।’ ভাবলেশহীন মুখে বললেন অভিজিৎ। “অন্য প্রসঙ্গে আসি। সোহমের লেখা ‘চোখের আড়ালে’-র
স্ক্রিপ্টটা আপনি পড়েছিলেন? না কি এটার কথাও জানতেন না?” ‘পড়েছিলাম।’
‘পঙ্কজ চাইছিলেন শিবেন্দু আর ঊর্মিকে নিয়ে ছবিটা করতে। আপনি এটা জানতেন?
‘জানতাম। আমি পঙ্কজকে বলেছিলাম, ওই রোলটা আমার চাই। শিবেন্দুকে নিলে ছবিটা আমি হতে দেব না।’
‘আপনি কি জানতেন যে, পঙ্কজ তাঁর মেয়ে তানিয়াকে এই ছবিটার মাধ্যমে টালিগঞ্জে এন্ট্রি দিতে চাইছেন?’
অভিজিৎ চুপ করে রয়েছেন। সুনীল বললেন, ‘ঊর্মি মার্ডার কেসে শিবেন্দুকে খুনি প্রমাণ করতে পারলে নায়ক-নায়িকা সিন থেকে আউট। আপনি আর তানিয়া হিরো-হিরোইন। তাই না? তাছাড়া, আপনি ঊর্মিকে ভালবাসেন। কিন্তু ঊর্মি আপনাকে ভালবাসে কি না, বুঝতে পারছেন না। ঊর্মির হাত ধরে নতুন হিরো শিবেন্দু তরতর করে উঠে আসছে। ওকে তো থামাতে হবে। আপনার খুনের মোটিভের অভাব নেই
অভিজিৎবাবু।’
অভিজিৎ শো-কেসের দিকে তাকালেন। সেখানে অজস্র পুরস্কার সাজানো রয়েছে। তিনি বললেন, ‘এই ইন্ডাস্ট্রিতে টানা ২০ বছর এক নম্বর জায়গায় থাকতে গিয়ে অনেক পাপ করেছি। কখনও উঠতি
হিরোর বারোটা বাজিয়েছি, কখনও নতুন জুটি তৈরির জন্য পুরনো বান্ধবীকে ছুড়ে ফেলেছি, কখনও ছবি ফ্লপ করা মাত্র ডিরেক্টরের মোবাইল নম্বর ব্লক করে দিয়েছি। কিন্তু আমার দৌড় ওইটুকুই। খুন করার কথা কখনও ভাবিনি।’
‘আপনি তো সেদিন মদ বা খাবার খাননি।’ ক্যাজুয়ালি বললেন সুনীল।
‘গত ২০ বছর ধরে আমি স্যুপ, স্যালাড, গ্রিন টি আর স্পার্কলিং ওয়াটার ছাড়া কিছু খাই না।’
‘আমি যদ্দুর জানি, কোমরের ব্যথার জন্য হাড়ের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি নিয়মিত ফেন্টানিল খান। স্যুপ, স্যালাড আর গ্রিন টি ছাড়া আপনার কাছে ফেন্টানিলও আছে। তাই না?’
‘ওটা ওষুধ। খাবার নয়।’ রেগে গিয়েছেন অভিজিৎ। ‘সেই রাতে আপনি একা শুয়েছিলেন।’
‘আমার ওই একটাই বিলাসিতা। আউটডোরে গেলে কারও সঙ্গে রুম শেয়ার করি না।’
‘সবার শেষে কে শুতে গিয়েছিল বলতে পারবেন?’
‘আমিই সবার শেষে শুতে যাই। প্রথমে গেলেন অনিলাভ আর স্বস্তিকা। তারপরে শিবেন্দু আর পঙ্কজ। সোহম আর মিলি আগেই উঠে যেতে চাইছিল। কিন্তু মাতাল ঊর্মি হঠাৎ মিলিকে বেজায় ধমকাতে থাকে।’
‘কী নিয়ে?’
। ‘ঝগড়াঝাটি শোনা আমি পছন্দ করি না। যেটুকু কানে এসেছিল, তার থেকে বুঝতে পারছিলাম যে মিলি ঊর্মির কাছে অনেক টাকা পায়। সেটা ওর প্রফেশনাল ফি। ঊর্মি টাকাটা দিতে রাজি নয়। মিলি বলল যে, ও কাজ ছেড়ে দেবে। তখন ঊর্মি ভয় দেখাল যে পুলিশে খবর দেবে। সেই শুনে কাঁদতে কাঁদতে মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সোহম।’
‘তার মানে আপনিই শেষ ব্যক্তি, যিনি ঊর্মিকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন?’
অভিজিতের মুখে বিন্দুমাত্র রাগ বা বিরক্তি দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘আমি আর ঊর্মি সওয়া চারটে পর্যন্ত গল্প করেছিলাম। ঊর্মি ইনকোহেরেন্ট কথা বলতে থাকে। মুখ থেকে মেক আপ না তুলে, পোশাক না বদলে পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। সেই দেখে আমি নিজের ঘরে চলে যাই। আমি চলে যাওয়ার পরে কেউ ওই ঘরে ঢুকেছিল কি না, জানা নেই।’
‘আপনি যে সওয়া চারটে থেকে বাকি সময়টা নিজের ঘরেই ছিলেন, তার কোনও প্রমাণ আছে?’
‘অ্যালিবাই?’ হাসলেন অভিজিত, ‘না নেই। কিন্তু বাকিদের কি আছে?’
‘সবাই জোড়ায় জোড়ায় শুয়েছিল। একজন উঠলে অন্যজন জানতে পারতেন।’
‘আপনার কথা অনুযায়ী আমি একজন সাসপেক্ট। আমার খুনের মোটিভ আছে। আমার কোনও অ্যালিবাই নেই। যা দিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা আমার কাছে ছিল। কিন্তু একটা কথা বলুন তো? আমি খুনটা কী করে করলাম? আমি কি ঊর্মির সঙ্গে আড্ডা মারার সময়ে ওর পশ্চাদ্দেশে ফেন্টানিল গুঁজে দিয়েছিলাম?’
খুব ঠান্ডা মাথায় অপশব্দটি প্রয়োগ করেছেন অভিজিৎ। বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেদম রেগে গিয়েছেন। কিন্তু মুখে কোনও এক্সপ্রেশন নেই। প্রবীর কী বলবেন, বুঝতে না পেরে হাত কচলাচ্ছেন আর বলছেন, ‘রাগ করছেন কেন স্যর। এসব তো আপনার ভালর জন্যই। আপনার নাম ক্লিয়ার করার জন্যই…?
সুনীল একগাল হেসে বললেন, “সহযোগিতা করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। কাল আপনার সঙ্গে এনটিওয়ানে, ‘জেরা’ সিনেমার শুটিংয়ের ফ্লোরে দেখা হচ্ছে।”..
॥৭॥
দুপুর দুটোর সময়ে এনটিওয়ানে পৌঁছে প্রবীর দেখলেন, সবাই মেক আপ রুমে জড়ো হয়েছে।
মলিন দেওয়ালে আয়নার গায়ে কটকটে আলো জ্বলছে। আয়নার কোণে অজস্র টিপ সাঁটা রয়েছে। মেঝেতে বিছানো রয়েছে ছেঁড়া পাটের কার্পেট। এককোণে পড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের নোংরা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট। সেটা খালি সিগারেটের প্যাকেট আর পানমশলার পাউচে ভর্তি।
শাজাহান একগাদা মোল্ডেড প্লাস্টিকের চেয়ার জোগাড় করেছে। তাতে বসে রয়েছেন অনিলাভ আর স্বস্তিকা, মিলি আর সোহম, শিবেন্দু আর পঙ্কজ, রাকেশ আর আলোরানি। একটি চেয়ার খালি। অভিজিৎ আর সুনীলকে দেখা যাচ্ছে না।
প্রবীরকে পঙ্কজ বললেন, ‘আজ সকালে ফোন করে সুনীলবাবু এমনভাবে তলব করলেন যেসব কাজ ফেলে দৌড়ে এলাম। এখন দেখি গোয়েন্দাই গায়েব!’
অনিলাভ বললেন, ‘সুনীলবাবু কাল রাতে আমার বসিরহাটের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমাকে হুকুম করলেন আজ দুপুর দুটোয় এনটিওয়ানে চলে নাসতে। আমি সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। উনি তখন বসিরহাট থানায় গিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে গল্প করছিলেন।’
শিবেন্দু জিজ্ঞাসা করল, “বসিরহাট আর টাকিতে আউটডোর সেরে অভিজিৎ ক’দিন আগেই ফিরেছেন। কালকেই সুনীলবাবুকে ওখানে যেতে হল?”
কেউ উত্তর দিল না।
কারণ ঘরে একসঙ্গে ঢুকলেন অভিজিৎ আর সুনীল। তাঁদের দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল। একমাত্র ফাঁকা চেয়ার দেখিয়ে শাজাহান অভিজিৎকে বলল, ‘আপনি ওখানে বসুন।’
শাজাহান আর প্রবীর দরজার কাছে দাঁড়ালেন। সুনীল সবাইকে বললেন, “আমি আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছি। টুকটাক দু’-একটা কথা বলব। দু’—একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব। তারপরে অপরাধী প্রবীরের সঙ্গে থানায় চলে যাবেন। বাকিরা বাড়ি। সিম্পল ব্যাপার।”
সবাই সুনীলের দিকে ঘুরে বসেছেন। সুনীল বললেন, ‘ক্রাইম সিন দেখে প্রবীর ভেবেছিলেন যে, ঊর্মি গলায় ওড়না জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি কিন্তু প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলাম যে, এটা মার্ডার।’
‘কীভাবে?’ জিজ্ঞাসা করলেন প্রবীর। পুলিশ হিসাবে তাঁর আঁতে ঘা লেগেছে।
““পোস্টমর্টেম হ্যাঙ্গিং’ বলে ডাক্তারি পরিভাষায় একটা কথা আছে। সোজা বাংলায় যার মানে হল, মৃতদেহকে ঝুলিয়ে দেওয়া। একজন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, আর একজনকে খুন করে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে— এই দুই মৃতদেহের মধ্যে কিছু তফাত থাকে। যেমন ধরুন…” পকেট থেকে একটা নাইলনের দড়ি বের করে শিবেন্দুর হাতে দিয়ে সুনীল বললেন,‘আপনি গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করতে চান। গলায় দড়িটা বাঁধুন দেখি!’
শিবেন্দু ঘাবড়ে গেলেও দড়িটা হাতে নিয়ে গলায় জড়িয়ে গিঁট দিতে গেল।
‘দাঁড়ান!’ শিবেন্দুকে থামালেন সুনীল, ‘আপনি গিটটা গলার কোনদিকে বাঁধছেন?”
গিঁট ছুঁয়ে শিবেন্দু বলল, ‘গলার ডানদিকে। কারণ আমি ওদিকে গিঁট বাঁধতেই কমফর্টেবল ফিল করছি।’
“কাজের কথাটা বলে দিলেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ‘নট’ বা গিঁট থাকে গলার ডানদিকে, কানের তলায়। কারণ ডানহাতি মানুষের সেটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। বাঁহাতি হলে এটা উলটে যায়। কিন্তু উর্মির ‘নট’ ছিল গলার মাঝখানে। অন্য লোকে গিঁট বাঁধলে এইটা হয়। কারণ সে নিজের গলায় দড়ি বাঁধছে না। দ্বিতীয় কথা হল, আপনি দড়ির অন্য প্রান্ত সিলিংয়ের হুকে বেঁধে ঝুলে পড়লে, হুকের সংস্পর্শে এসে দড়ি বা ওড়নার ফাইবার একরকমভাবে ছিঁড়বে। আর যদি আপনার মৃতদেহের গলায় ওড়না বেঁধে, অন্যপ্রান্ত হুকের মধ্যে ঢুকিয়ে আপনার বডি হিচড়ে তোলা হয়, তাহলে ফাইবার অন্যভাবে ছিঁড়বে। ক্রাইম সিনে ঢুকেই আমি আর শাজাহান বুঝে গিয়েছিলাম যে, ঊর্মিকে খুন করা হয়েছে। কীভাবে হয়েছে— সেটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ক্লিয়ার হল। এবং তখনই বুঝেছিলাম যে, টুল পড়ে যাওয়ার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি কেন। কারণ টুলটা শব্দহীনভাবে উলটে রাখা হয়েছিল। আওয়াজ শুনে কেউ উঠে পড়লে সব ভেস্তে যাবে।”
অনিলাভ বললেন, ‘আমি ঠিকই বলেছিলাম। ঊর্মিকে খুন করা হয়েছে। গলায় দড়ি দিয়ে, না, বিষ খাইয়ে— সেটা সেকেন্ডারি।’
দেখে
“সব খুনের পিছনেই মোটিভ থাকে। ঊর্মি মার্ডার কেসেও আছে। সেই রাতে যাঁরা ‘বাগচী বাগিচা’-য় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে চারজনের কোনও মোটিভ ছিল না। এরা হল সোহম, মিলি, রাকেশ আর আলোরানি। বাকি সবার স্ট্রং মোটিভ ছিল। এবং এঁদের মধ্যে অভিজিৎ ছাড়া সবাই রুম শেয়ার করেছিলেন। এইরকমটা হতে পারে যে অভিজিৎ খুনটা করেছেন। আবার এমনও হতে পারে যে, একই ঘরের দু’জনে মিলে খুন করেছেন।” ।
‘খুনটা হল কীভাবে?’ জিজ্ঞাসা করলেন স্বস্তিকা
সুনীল বললেন, ‘ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে জানা গেল খুনের কারণ ফেন্টানিল পয়েজনিং। কিন্তু ঊর্মির স্টমাকে ফেন্টানিল পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ওকে ফেন্টানিল খাওয়ানো হয়নি। তাহলে ফেন্টানিল ঊর্মির শরীরে ঢুকল কী করে? গতকাল অভিজিৎ একটা কথা বলে আমাকে এ বিষয়ে সাহায্য করেছেন।’
অভিজিৎ অবাক হয়ে সুনীলের দিকে তাকালেন।
সুনীল বললেন, “অভিজিৎ আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কি ঊর্মির সঙ্গে আড্ডা মারার সময়ে ওর পশ্চাদ্দেশে ফেন্টানিল গুঁজে দিয়েছিলাম?’ এ কথাটা আমার চোখ খুলে দেয়।”
‘কীভাবে?’ জিজ্ঞাসা করলেন পঙ্কজ।
‘সেই প্রসঙ্গেই আসছি। অভিজিতের কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল আলোরানির কথা।’
রাকেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমার বউয়ের নামে আজেবাজে বলছেন কেন? ও অসুস্থ।
‘বোসো!’ পুলিশি হুংকার ছেড়েছেন প্রবীর।
রাকেশ চেপে ধরেছে আলোরানির হাত। আলোরানি ভয়ের চোটে ঠকঠক করে কাঁপছে।
‘তোমার থাইরয়েডের সমস্যা আছে না?’ জিজ্ঞাসা করলেন সুনীল।
‘হ্যাঁ স্যর।’ কোনওরকমে বলল আলোরানি, ‘ম্যাডামের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না স্যর।
“ম্যাডামের ব্যাপারে তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে না। আমি তোমার চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলব। তুমি বলেছিলে, ওষুধ খেলে আমার গা গুলোয়। অন্যভাবে ‘টিটমেন্ট’ হচ্ছে।” ঠিক বললাম তো?”
‘হ্যাঁ স্যর।’
সোহমের দিকে তাকিয়ে সুনীল বললেন, ‘তদন্তের একদম গোড়ায় আলোরানির এই মন্তব্য, আর তদন্তের একদম শেষে অভিজিতের ওই মন্তব্য মিলে যেটা দাঁড়াল, সেটা হল ফেন্টানিল স্টমাকে পাওয়া যায়নি মানে, সেটা খাওয়ানো হয়নি। অন্য কোনও রুটে শরীরে ঢুকেছে।’
‘ইঞ্জেকশন!’ সন্ত্রস্ত গলায় বলল সোহম।
‘কিন্তু তার দাগ থাকবে তো!’ বললেন পঙ্কজ।
‘ইনহেলার।’ বলল মিলি।
‘এইটা হতে পারে।’ বললেন অভিজিৎ।
সুনীল সবার কথা চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, “কীভাবে ঊর্মি খুন হল, এইটা জানতে আপনারাই আমাকে সাহায্য করেছেন একাধিক সূত্র দিয়ে। সূত্র নম্বর এক। স্বস্তিকা সান্যাল বলেছিলেন, ‘ঊর্মির যখন ক্লাস ইলেভেন, তখন মিলি কোথা থেকে উড়ে এসে বসিরহাটে জুড়ে বসেছিল। বাবা-মা নেই। মেসোর বাড়িতে থাকত।”
‘ভুল কী বলেছিলাম?’ খেঁকিয়ে উঠেছেন স্বস্তিকা।
‘ভুল কেন বলবেন? আমি জাস্ট কথাটা মনে করালাম’, হাসলেন সুনীল, ‘এবার দ্বিতীয় সুত্র। সোহম বলেছিল, ঊর্মি মিলিকে দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা দিচ্ছিল না।’
‘হ্যা। আমি বলেছিলাম।’ সুনীলকে সমর্থন করল সোহম।
‘তৃতীয় সুত্র আমি পেয়েছি অভিজিৎবাবুর কাছ থেকে। উনি বলেছেন, খুনের রাতে ঊর্মির সঙ্গে মিলির কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মিলি ঊর্মির কাছে তার প্রাপ্য টাকা চাইছিল। ঊর্মি টাকাটা দিতে রাজি হচ্ছিল না। ঊর্মির পার্সোনাল স্টাইলিস্টের কাজ মিলি ছেড়ে দিতে চায়। তখন ঊর্মি ভয় দেখায় যে, পুলিশে খবর দেবে। এই শুনে কাঁদতে কাঁদতে মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে যায় সোহম। অভিজিৎবাবু, ঠিক বললাম?’
অভিজিত ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন। মিলি বলল, ‘আমাদের মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকত। অনেক দিনের পুরনো বন্ধুত্ব।
মিলির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সুনীল বললেন, “চার নম্বর সূত্র পেলাম পঙ্কজ দত্তর কাছ থেকে। ওঁর আর ঊর্মির সেক্স ভিডিওর ক্লিপ আমি দেখেছি। সেই ভিডিওয় ঊর্মি কিচ্ছু পরে নেই। কিন্তু কপালে ‘দীর্ঘ ঊ’ মার্কা সুয়েডের টিপ ঠিক পরে রয়েছে। ঠিক এইরকম।” মেক আপ রুমের আয়নার কোণে সাঁটা অনেক টিপ থেকে একটা টিপ খুলে নিয়ে সবাইকে দেখালেন সুনীল। বললেন, ‘আবার ফিরে আসি আলোরানির কাছে। তোমার থাইরয়েডের চিকিচ্ছে কীভাবে হয়? তুমি তো ওষুধ খাও না।’
‘গরমেন্ট থেকে আমাদের আয়োডিন বিন্দি দেয়।’ খসখসে গলায় বলল আলোরানি। “ওই বিন্দির মধ্যে যে আয়োডিন থাকে সেটা কপালের চামড়া দিয়ে ঢুকে যায়। রক্তে আয়োডিন বাড়ে। ‘থাইরড’ ভাল হয়ে যায়।”
“আমি খবর নিয়ে জেনেছি, ‘আয়োডিন বিন্দি’ কেন্দ্রীয় সরকারের একটা প্রোজেক্ট। যেসব এলাকার মহিলাদের রক্তে আয়োডিন কম আছে, তাদের জন্য এই প্রকল্প। ওষুধ খেতে দিলে কেউ খাবে না, অথবা খেতে ভুলে যাবে। কিন্তু টিপ পরতে দিলে পরবে। মাসের প্রতিটি দিনের জন্যে নতুন একটা টিপ। সবাই আনন্দের সঙ্গে পরে। ও কী! সোহম, কোথায় যাচ্ছ?”
সোহম চেয়ার থেকে উঠে বেরনোর চেষ্টা করছিল। সুনীলের কথা শুনে বলল, ‘একটু বাথরুম যাব।’
‘তুমি ফার্মাকোলজির ছাত্র, না?’ জিজ্ঞাসা করলেন সুনীল, “ডার্মাল প্যাচে ফেন্টানিল ব্যবহার করলে সেটা স্কিন দিয়ে অ্যাবজর্ব হতে পারে এই ধারণা তোমার আছে। মিলির ডিজাইন করা ‘দীর্ঘ ঊ’ মার্কা সুয়েডের টিপে ফেন্টানিল ভরে দেওয়ার প্ল্যানও তোমার। তুমি মিলিকে টিপ বানিয়ে দিয়েছ। মিলি সেই টিপ ঊর্মিকে পরিয়ে দেয়।”
‘এসব করে আমার লাভ?’ মিলি চিলচিৎকার করে উঠল।
‘লাভ না থাকলে তুমি ঊর্মির কপাল থেকে টিপ খুলে নিয়েছিলে কেন? যে মেয়ে সেক্স করার সময় টিপ খোলে না, সে মরার সময় কেন পোশাক ইনট্যাক্ট রেখে টিপ খুলে নিতে যাবে? যদি খুলেও নিয়ে থাকে, তাহলে সেই টিপ ক্রাইম সিনে পাওয়া যাবে না কেন?’
‘কিন্তু আমার লাভটা কী?’ সুনীলের দিকে তেড়ে গিয়েছে মিলি। সোহম তাকে চেপে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়েছে।
সুনীল বললেন, “টিপে এত বেশি পরিমাণ ফেন্টানিল ছিল যে, ঊর্মির চামড়া দিয়ে রক্তে মিশে ওকে মেরে ফেলে। দিনটা ভেবেচিন্তেই বাছা হয়েছিল। অনেক সাসপেক্ট থাকবে। আত্মহত্যা নয়— এটা পুলিশ বুঝতে পারলে, সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স আছে অনেকগুলো। মিলি বা সোহম ঊর্মির স্মার্টফোন নিয়ে ‘রেস্টোর ফ্যাক্টরি সেটিং’ করে দেয়। এর ফলে সন্দেহ যাবে পঙ্কজের উপরে। অভিজিৎ নিয়মিত ফেন্টানিল খান। উনিও সাসপেক্ট হয়ে যাবেন।”
অভিজিৎ নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন।
সুনীল বললেন, ‘সবাই মাল খেয়ে আউট হয়ে বেঘোরে ঘুমবে। ঊর্মি আউটডোরে গেলে ঘরের দরজায় খিল না দিয়ে ঘুময়— এটা সব্বাই জানে। ভোর হওয়ার আগে ঊর্মির ঘরে ঢুকে মিলি আর সোহম মিলে মৃত ঊর্মির গলায় ওড়না জড়িয়ে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কপাল থেকে টিপ খুলে নিয়েছিল। একটা টুল নিঃশব্দে পালঙ্কের পাশে উলটে রেখে দিয়েছিল। তারপরে নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। অনিলাভ আমাকে না ডাকলে ঊর্মির মৃত্যু আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।
প্রবীরের কথাটি পছন্দ হয়নি। তিনি দরজার কাছ থেকে বললেন, ‘সবটাই তো ক্লিয়ার হল। কিন্তু খুনের মোটিভ কী? আমাকে তো কোর্টে কেসটা জাস্টিফাই করতে হবে। তখন তো আর প্রাইভেট ডিটেকটিভের কথা কেউ শুনবে না।”
‘খুনের মোটিভ জানতেই কাল বসিরহাটে গিয়েছিলাম’, প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন সুনীল।
তারপর মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা মিলি, বসিরহাটে মেসোর বাড়িতে আসার আগে তুমি কোথায় থাকতে? তোমার বাবা-মা কীভাবে মারা গেছেন?’
মিলি মাথা নিচু করে ফুঁসছে।
সুনীল বললেন, “তুমি যখন বলবে না, তখন আমিই বলে দিই। মিলির আদি বাড়ি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। মিলির বাবা ছিলেন ওই দেশের মৌলবাদ-বিরোধী এক নেতা। সব ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে তিনি জনমত সংগঠিত করতেন। দুই মৌলবাদী একদিন বাড়িতে ঢুকে মিলির বাবা-মা’কে কুপিয়ে খুন করে। মিলিকে ধর্ষণ করতে যায়। মিলি তাদের বঁটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসে। ওর এদেশে কোনও মেসোর বাড়ি নেই। মেসো বলে যে লোকটি আছে, সে একজন ফড়ে। টাকার বিনিময়ে মিলিকে থাকতে দিয়েছিল। জাল ভোটার কার্ড, জাল আধার কার্ড, জাল প্যান কার্ড বানিয়ে দিয়েছিল। স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনো শুরু করে মিলি। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। মিলি একটাই ভুল করে। সে তার প্রিয়তম বান্ধবীকে সত্যিটা বলে দেয়। তারপরে ঊর্মি বিখ্যাত হল। ঊর্মির রিফ্লেক্টেড গ্লোরিতে বিখ্যাত হল মিলিও। এবং এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হল যে, মুম্বই থেকে রণজয় ভনশালির ডাক দু’জনেই পেলেও প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে চুক্তির কারণে ঊর্মি যেতে পারবে না। কিন্তু মিলি যাবে। ইশকুলের স্বার্থহীন বন্ধুত্ব আস্তে আস্তে মরে গেল। ঊর্মি তখন প্রবল ঈর্যায় ভুগছে। পার্সোনাল স্টাইলিস্টের কাজ করিয়ে মাসের পর মাস মিলিকে টাকা দিচ্ছে না। মিলি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেই ব্ল্যাকমেল করছে।”
প্রবীর বললেন, ‘এর মধ্যে সোহম ঢুকলেন কী করে?’
“প্রেম বড় সাংঘাতিক জিনিস প্রবীর! মিলি নিজের পাস্ট লাইফ সোহমকে বলল। বলল ব্ল্যাকমেলের কথাও। তখন সোহম এই খুনের প্ল্যান সাজাল। ‘দীর্ঘ ঊ’ মার্কা টিপে ফেন্টানিল ভরে দিল সোহম। মিলি সেটা পরিয়ে দিল ঊর্মিকে।”
‘আপনি এত কথা জানলেন কী করে? জিজ্ঞাসা করলেন পঙ্কজ।
সুনীল বললেন, ‘আমি গতকাল বসিরহাট থানার বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে মিলির বাড়িতে গিয়েছিলাম। মিলির মেসো ওরফে ওই ফড়েটি সব স্বীকার করেছে। ওকে অলরেডি পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। প্রবীর, আপনি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারপরে যোগাযোগ করতে হবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পুলিশের সঙ্গে। আপনার এই কেস অনেক দূর গড়াবে।’
মিলির চোখে জল। সোহম চেয়ার থেকে উঠে আয়নার গা থেকে একটা লাল সুয়েডের টিপ তুলে মিলির কপালে সেঁটে দিয়ে বলল, ‘আমাদের বিয়ে হয়ে গেল রে মিলি! বাকি জীবন আমরা একসঙ্গে দগ্ধে দগ্ধে মরব। তুই চিন্তা করিস না। আর কেউ না থাকুক, আমি তোর পাশে রইলাম। টিল ডেথ ডু আস অ্যাপার্ট।’
স্টুডিওর ফ্লোর থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘প্যাক আপ।’
***
Leave a Reply