দি একসরসিস্ট – হুমায়ূন আহমেদ
ভূমিকা
আমি একবার খুব অর্থকষ্টে পড়েছিলাম। আমেরিকা থেকে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেশে ফিরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যে বেতন পাওয়ার কথা–ছমাস তা পাচ্ছি না। কাগজপত্রের কি যেন অসুবিধা। এর তার কাছে ধার করতে হচ্ছে। তখন শুনলাম কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ভৌতিক বা গোয়েন্দা জাতীয় উপন্যাস অনুবাদ করে দিলে নগদ টাকা দেন। রাত জেগে অনুবাদ করলাম। উইলিয়াম পিটার ব্রেটির দি একসরসিস্ট। পাণ্ডুলিপি তার হাতে দেয়ামাত্র তিনি আমাকে দুহাজার টাকা দিলেন। টাকাটা খুব কাজে লাগল। এই অনূদিত গ্রন্থটি নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। কিন্তু কেন জানি না বেশ কিছু দিন ধরে পাঠকরা এই বইটি চাচ্ছে। পাঠকদের চাওয়া মানে প্রকাশকদের চাওয়া। আমি তাঁদের চাওয়াকে মূল্য দিলাম।
অনুবাদের জন্যে এই বইটি কেন বেছে নিয়েছিলাম তা একটু বোধহয় বলা দরকার–বইটিতে ভৌতিক ব্যাপারগুলির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করা হয়েছে যা আমার ভাল লেগেছে। একজন নাস্তিক পাদ্রীর চরিত্র আছে যে চরিত্রটিও আমাকে আকর্ষণ করেছিল। এই বইটি আমাকে আমার পরবর্তি ভৌতিক গল্পগুলি লেখার ব্যাপারে প্রভাবিত করেছে বলেই মনে হয়। এই কারণেই দি একসরসিস্টের গুরুত্ব অন্তত আমার কাছে অনেকখানি।
মূল বইটিতে অশ্লীল বর্ণনা আছে যা আমি যতটুক পারি বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিছু বোধহয় তারপরেও থেকে গেল। বইটি অপরিণত পাঠকপাঠিকাদের জন্যে নয়–এই কথা বলে শেষ করছি।
হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল
১৩.২.৯২
————-
প্রস্তাবনা
উত্তর ইরাকের মরুভূমি। খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ।
আজ রাতেই তাঁবু গুটিয়ে সবাই চলে যাবে। জিনিসপত্র যা পাওয়া গেছে বসে বসে এখন তার তালিকা তৈরি করছেন কিউরেটর। কিছু গহনা, ভাঙা হামামদিস্তা, হাতির দাঁতের বাক্স–খুব অসাধারণ কিছু নয়। জিনিসগুলো একটি লম্বা টেবিলে সাজানো। এরপর নম্বর দিয়ে দিয়ে বাক্সে সিল করা হবে।
একজন বৃদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। শান্ত পায়ে তিনি আসছেন। হাঁটছেন খানিকটা ঝুঁকে ঝুঁকে। লম্বা রোগী একজন মানুষ। তিনি টেবিলের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালেন। টেবিলে রাখা একটি মূর্তির দিকে তিনি এখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আমি কি এই মূর্তিটি একটু হাতে নিতে পারি?
কিউরেটর বললেন, অবশ্যই পারেন। ফাদার মেরিন এটি শয়তান পাযুযুর মূর্তি। পিশাচ।
আমি জানি।
ফাদার মেরিন মূর্তি হাতে নিতে গিয়েও নিলেন না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। এই অশুভ শক্তিটির সঙ্গে তাঁর যে আবার দেখা হবে, এই বিষয়ে তিনি এখন নিশ্চিত।
সূর্য এখন মাথার উপর, মরুভূমির অসহনীয় তাপ। তবু ফাদার মেরিনের শীত লাগতে শুরু করল। তিনি শীতে অল্প অল্প কাঁপছেন।
কিউরেটর অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে আপনার, ফাদার?
জবাব না দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন বৃদ্ধ। তাঁর মনে হল, হা-হা শব্দে কি একটা যেন উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। তিনি আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে কিউরেটরের মুখের দিকে তাকালেন, শান্ত স্বরে বললেন, আমাকে অনেক–অনেক দূর যেতে হবে।
Leave a Reply