দি অ্যামফিবিয়ান ম্যান (উভচর মানব) – আলেকযান্ডার বেলায়েভ
০১. দক্ষিণ গোলার্ধ আর উত্তর গোলার্ধ
দক্ষিণ গোলার্ধ আর উত্তর গোলার্ধ যেমন বিপরীত দিকে, তেমনি আবহাওয়াগত দিক থেকেও সম্পূর্ণ উল্টো। জানুয়ারি মাসে উত্তর গোলার্ধে যখন বরফের মতো ঠাণ্ডা, দক্ষিণ গোলার্ধ তখন রীতিমতো উত্তপ্ত, ভ্যাপসা গরম। সেসময়ে অতলান্ত সাগরও থাকে উত্তাল। এক কথায় বলতে গেলে দক্ষিণ গোলার্ধ তখন পৃথিবীর বুকে নরক ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের কাহিনীর পটভূমিও অতলান্ত সাগরের তীরে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা। দক্ষিণের সেই তিয়েরা দেল কিউগো থেকে রিও ডি প্লাটা নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আর্জেন্টিনা দেশটির সাগর। বেলা।
রিও ডি প্লটার মোহনার কাছেই আর্জেন্টিনার রাজধানী, বুয়েন্স আয়ার্স বন্দর-শহর। মুক্তো আর ঝিনুক ব্যবসার জন্যে পৃথিবী বিখ্যাত এই সাগরবন্দর এবং রাজধানী।
বন্দরের কিছুটা বাইরে সমুদ্রে খাঁড়ির মুখে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা জাহাজ। জাহাজটির নাম জেলিফিশ। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করছে হাজারো কোটি নক্ষত্র। আকাশের কালো চাদরে মিটমিটে তারারাজি আর নিচে নিকষ কালো অতলান্ত মহাসাগর। শান্ত, নিঝুম পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে জাহাজটিতেও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। কিছু একটা ঘটবে সে আশায় চুপচাপ অপেক্ষা করছে যেন।
জাহাজটা মুক্তো শিকারীদের। শিকার আপাতত শেষ। ডেকে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল ক্লান্ত ডুবুরি। তাদের পরনে মোটা ক্যানভাসের কৌপিন। ওরা এতই ক্লান্ত যে পোশাক বদলানোর ইচ্ছেও জাগেনি কারও মনে। সাগব্র থেকে উঠেই গা মুছে শুয়ে পড়েছে জাহাজের ডেকে, সেঁটে ঘুম দিয়েছে।
মাঝে মাঝে ডুবুরিদের কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে টলমল পায়ে জাহাজের পেছনে যাচ্ছে। যেতে গিয়ে সঙ্গীদের গায়ে পা দিয়ে বিরক্তি উৎপাদন করছে। দোষ দেয়া যায় না তাদের। ঘুমের ঘোরে হাঁটতে গিয়েই যত বিপত্তি। জাহাজের পেছনে মাস্তুলের কাছে একটা পিপে রাখা আছে। সেটার সঙ্গে আছে একটা মগ। সেই মগে করে পানি খেয়ে কোনমতে একটু জায়গা করে নিতে পারলেই আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে ডুবুরিরা। ভীষণ ক্লান্ত তারা। সামান্য বিরাম নিয়ে সারাদিন সাগরের পানির নিচে ডুব দিয়েছে। পানির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় বলে দিনে এরা প্রায় কিছু খায় না বললেই চলে। সন্ধেয় যখন ছুটি মেলে, কোনমতে নাকে মুখে দুটো গুঁজে দিয়েই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। খাদ্য বলতে নোনা মাংস। বছরকে বছর ওই একই জিনিস। পুষ্টিকর কিন্তু বিস্বাদ খাবার।
জেলিফিশ জাহাজটার মালিক নিজেই জাহাজের ক্যাপ্টেন। নাম তার পেদরো জুরিতা। তার বিশ্বস্ত অনুচর আছে একজন। লোকটা রেড ইন্ডিয়ান। প্রায় সর্বক্ষণ ক্যাপ্টেনের সঙ্গে লেগে থাকে। নাম বালথযার। কম বয়সে বালথাযারও নামকরা এক ডুবুরি ছিল। অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ সময় পানির নিচে থাকতে পারত। কেউ তার এই ক্ষমতায় বিস্ময় প্রকাশ করলে হাসত বালথাষার
আগেপরে একটা কথাই বলে আসছে সে, আমাদের আমলে ডুবুরির বিদ্যা খুব যত্নের সঙ্গে শেখানো হতো। শিক্ষা শুরু হয়ে যেত প্রায় বাচ্চা বয়স থেকে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা আমাকে কাজ শিখতে হোসের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার মতোই শিক্ষানবীশ দশ-বারোজনকে নিয়ে পাল তোলা একটা জাহাজে করে সাগরে বেরিয়ে পড়ত হোসে। তার শেখানোর নিয়মটা ছিল খুব সুন্দর। একটা সাদা পাথর বা ঝিনুক পানির মধ্যে ফেলে দিয়ে নির্দেশ দিত, তুলে নিয়ে এসো! তুলে আনতাম আমরা। একটু একটু করে গভীর পানিতে পাথর বা ঝিনুক ছুঁড়ত সে। কেউ যদি তার পালার সময় ডুব দিয়ে হোসের পাথর তুলে আনতে না পারত, তাহলে তার কপালে জুটত চাবুকের ঘা। চাবুক পেটা করে তাকে আবার সেই একই জায়গায় ডুব দিতে বাধ্য করত হোসে। তার কারণেই ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠলাম আমি। প্রচুর আয়ও করেছি জীবনে।
বয়স বেড়ে যাওয়ায় ডুবুরির পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বালথাযার। এমনিতেও ছাড়তেই হতো। একটা হাঙর তার বাম পা জখম করে দিয়েছিল। তাছাড়া নোঙরের শিকলে চোট লেগে শারীরিক ভাবে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছিল সে।
বুয়েন্স আয়ার্সে সামুদ্রিক জিনিসের ছোট একটা দোকান করেছে বালথাযার। প্রবাল, মুক্তো, ঝিনুক, শামুক আর নানা ধরনের সামুদ্রিক সৌখিন জিনিস বিক্রি হয় তার দোকানে। ব্যবসা ভাল চলছে, কিন্তু পুরো মনোযোগ কখনোই দিতে পারে না বালথাযার। বয়স যতই হোক, সাগর তাকে আজও কাছে টানে প্রবল আকর্ষণে। মুক্তোশিকারীদের সঙ্গে সাগরে যাওয়ার সুযোগ ঘটলে জুটে পড়ে সে। মুক্তো ব্যবসায়ীরাও তাতে খুশি হয়। লা প্লটা মোহনা বা সাগরের বিভিন্ন জায়গায় কোথায় বেশি মুক্তো পাওয়া যাবে সেটা বালথাযারের চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না।
যুবক ডুবুরিরাও বালথাযার সঙ্গে থাকলে খুশি হয়। অনেক ব্যাপারেই তার সাহায্য পায়। শিখতে পারে নতুন কৌশল। কি করে বেশিক্ষণ দম রাখতে হয়, কিভাবে হাঙরের হামলা ঠেকাতে হয় থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই আছে তার শেখানোর ঝুলির মধ্যে। কি করে মালিকের চোখ এড়িয়ে দামি মুক্তো প্লিস করে দিতে হয় সেটাও তার কাছ থেকে শেখে গরীব ডুবুরিরা।
মালিকপক্ষের কাছেও বালথাযারের গুরুত্ব কম নয়। কোন্ মুক্তো বাজারে কততে বিকোবে সেটা মুক্তোয় একবার চোখ বুলিয়েই বলে দিতে পারে বালথাযার। এক পলকে বেছে দিতে পারে সেরা মুক্তোগুলো। বালথাযার জাহাজে থাকলে তাই মালিকরাও খুশি হয়।
ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরোর জাহাজে রাতে প্রহরার দায়িত্ব পড়েছে আজ বালথাযারের। একটা পিপের ওপর আয়েস করে বসে আছে সে, চুরুট টানছে। মাস্তুলে ঝোলানো লণ্ঠনটার এক চিলতে আলো এসে পড়েছে তার মুখে। আরাউকান ইন্ডিয়ানদের সমস্ত বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে মৃদু আলোয়। ঘুমে বুজে আসছে বালথাযারের দুচোখ, কিন্তু সতর্কতায় কোন ঢিল নেই। ডেকের ওপর ঘুমন্ত ডুবুরিদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ঘুমের ঘোরে বলা ডুবুরিদের কথাও কান এড়াচ্ছে না।
সাগর সৈকতের দিক থেকে বাতাস বইছে। সে বাতাস বয়ে আনছে ঝিনুক পচার উৎকট দুর্গন্ধ। মুক্তো সহজে বের করার জন্যে সাগর থেকে ঝিনুক তুলে সৈকতে ফেলে রাখা হয়। পচলে পরে ঝিনুকের ভেতর থেকে মুক্তো সংগ্রহ সহজ। সাধারণ মানুষ ঝিনুক পচার গন্ধে স্রেফ বমি করে দেবে, কিন্তু বালথাযারের কাছে গন্ধটা চমক্কার বলে মনে হয়। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে স্মৃতির অতলে ডুব দেয়। সে। তারুণ্যে ফিরে যায়। ফেলে আসা রোমাঞ্চকর অতীত রোমন্থন করে। সমুদ্রের অমোঘ নিরব আহ্বানে বুকের ভেতর শিরশির করে ওঠে তার।
হঠাৎ পূর্ণ সজাগ হলো বালথাযার। মনে হলো দূর থেকে অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেয়েছে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। তার পরপরই কমবয়েসী একজন পুরুষের চিৎকার ভেসে এলো।
আ-আ-আ!
ঠোঁট থেকে চুরুট খসে পড়েছে বালথাষারের। কান খাড়া করে অপেক্ষা করছে সে, আবারও শুনতে পেল, বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ আওয়াজটা হলো। আবার আ-আ-আ করে চেঁচিয়ে উঠল তরুণ কণ্ঠ। বাঁশির আওয়াজ আর তরুণের চিৎকার দুটোই নিরব পরিবেশে এত অদ্ভুত শোনাল যে গা শিরশির করে উঠল বালথাযারের। মনে হলো পার্থিব কোন আওয়াজ নয় ওগুলো।
পিপে ছেড়ে উঠে চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল বালথাযার। কালিগোলা অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। আওয়াজ থেমে গেছে। কানে পীড়া দেয়, এতই নিস্তব্ধ চারপাশ। অস্বস্তির বোধ কাটাতে পারল না, রেড ইন্ডিয়ান এক ডুবুরিকে বুটের গুঁতো দিয়ে ঘুম থেকে তুলল বালথাযার, নিজে কিছু শুনতে পাচ্ছে না, তবুও জিজ্ঞেস করল, শুনতে পাচ্ছ কিছু?
তার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই আর্তচিৎকার শোনা গেল।
আ-আ-আ!
ভয়ে কেঁপে উঠল রেড ইন্ডিয়ান ডুবুরি। এক পলকে কেটে গেল ঘুমের ঘোের। আতঙ্কগ্রস্ত অস্ফুট স্বরে বলল, এ ও ছাড়া আর কেউ না!
আরও কয়েকজন ডুবুরির ঘুম ভেঙেছে। একটু পরই একজনও ঘুমন্ত থাকল না। বালথাযারের দেখাদেখি লণ্ঠনের কাছে ভিড় করল তারা। আলো ওদের সাহস ফিরিয়ে দিচ্ছে। ভাব দেখে মনে হলো ওই আলো ওদের সমস্ত অপার্থিব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
নিচু স্বরে যার যার মতামত জানাচ্ছে সবাই। কেউ চুপ করে নেই। সবারই বক্তব্য আছে।
এ সেই সাগর-দানো ছাড়া আর কেউ নয়।
জানে বাচলে এই এলাকা ছেড়ে পালাব।
হাঙরের চেয়েও ভয়ানক ও!
ক্যাপ্টেনকে ডাকো কেউ একজন!
ডেকে হৈ-চৈয়ের আওয়াজ পেয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো পেদরো জুরিতা! এখনও ঘুম লেগে আছে তার চোখে। গরমের কারণে উর্ধাঙ্গে কোন পোশাক পরেনি সে। পরনে শুধু ক্যানভাসের প্যান্ট। বেল্টে রিভলভার খুঁজতে ভুল করেন। ডুবুরিদের কাছে এসে দাঁড়াল সে লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল তার রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলের কারণে ভয়ঙ্কর বদমেজাজী মনে হচ্ছে তাকে এমুহূর্তে চড়া গলায় বলল, কি ব্যাপার! কি হচ্ছে এখানে।
সবকজন এক সঙ্গে মুখ খোলায় মনে হলো সম্মিলিত চিঙ্কার জুড়েছে সবাই। একটা কথাও স্পষ্ট হলো না। হাত তুলে, হাঁকডাক দিয়ে সবাইকে চুপ করাল বালথাযার। উপযাচক হয়ে বলল, সাগর দানোর চিৎকার শুনেছি আমরা।
ঘুম থেকে উঠে এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি পেদরো জুরিতা। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে আজগুবি মনে হলো। বলে উঠল, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখেছ তোমরা।
স্বপ্ন না, প্রতিবাদ করল ডুবুরিরা। একটু আগেই তার চিৎকার শোনা গেছে। বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ সেই আওয়াজটাও ছিল।
বালথাযার উৎসাহী ডুবুরিদের থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজে। শুনেছি। সাগর-দানো ছাড়া ওভাবে কেউ তীক্ষ্ণ বাঁশি বাজায় না। চিকারও করছিল। আমার মনে হয় এখানে আমাদের না থাকাই উচিত হবে।
মুখ বাঁকাল পেদরো জুরিতা। যতসব গুজব। আর কিছু নয়।
জুরিতার কথা ডুবুরিদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। ভয় পেয়েছে ওরা। উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। একজোট হয়ে দাবি জানাল, এক্ষুণি জাহাজ এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ক্যাপ্টেন যদি তাদের কথা না শোনে তাহলে কাল সকালেই জাহাজ ত্যাগ করবে সবাই, ফিরে যাবে বুয়েন্স আয়ার্সে। বেতন যুতই হোক এজাহাজে আর কাজ করবে না।
রাগে গা জ্বলে গেল পেদরো জুরিতার। বিড়বিড় করে ডুবুরিদের অভিশাপ দিল। দুএকটা ধমকধামকও দিল, কিন্ত কোন কাজ হলো না। বাড়াবাড়ি করার আর সাহস হলো না, তার, ডুবুরিদের তখনকার মতো শান্ত করে তাদের কথা মতো জাহাজ সরিয়ে নেবে কিনা, সেব্যাপারে ভাবার জন্যে সময় দরকার এটা বলে নিজের কেবিনে ঢুকল।
মুখে ক্যাপ্টেন যাই বলুক, মনে মনে সে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কেবিনে পায়চারি করতে করতে ভাবনার জাল বুনে চলল।
গুজব রটেছে এদিকের সমুদ্রে একটা অদ্ভুত প্রাণীকে দেখা গেছে। ডুবুরি আর সাগর তীরের মানুষদের ওটা নাকি ভয় দেখাচ্ছে। সবই শোনা কথা। কেউ দাবি করেনি যে নিজের চোখে জন্তুটাকে দেখেছে। ওই জন্তু নাকি ক্ষতি যেমন করে তেমনি কারও কারও উপকারও করেছে। বুড়ো রেড ইন্ডিয়ানদের মত হচ্ছে ওটা শুধু একটা জম্ভ নয়, ওটা সাগরের দানো। সহস্র বছর পর পর পৃথিবীর বুকে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাগরের অতল থেকে উঠে আসে দানো।
বুয়েন্স আয়ার্স শহরেও এই সাগর-দানোর কাহিনী রটে গেছে। খবরের কাগজে আলোচিত হচ্ছে সাগর-দানো। বিভিন্ন বিজ্ঞ মতামত প্রকাশ করছেন সম্পাদকরা। সাগরে কোন দুর্ঘটনা হলেই হয়, সাগর দানোর সঙ্গে সেটাকে জড়িয়ে নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলে জেলেদের নৌকোতে বড় বড় মাছ ছুঁড়ে দিতে দেখা গেছে তাকে। অসহায় ডুবন্ত মানুষকে নাকি প্রাণেও বাঁচিয়েছে। অনেকে দাবি করছে সাগর-দানোকে তারা অস্পষ্ট ভাবে দেখেছে, ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করে সৈকতে রেখে গেছে।
কারও বর্ণনা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বুদ্ধিমান যে কেউ বুঝবে আসলে আজ পর্যন্ত জানোয়ারটাকে চোখে দেখেনি কেউ, আসর জমানোর জন্যে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে স্রেফ। কেউ বলছে সাগর-দানোর মাথায় শিং রয়েছে, থুতনির নিচে রয়েছে ছাগলা দাড়ি। তার হাত-পা নাকি ঠিক পশুরাজ সিংহের থাবার মতো। শোনা যায় মাছের মতো লেজও আছে তার। আবার কেউ কেউ বলছে, এই সাগর-দানো নাকি বিরাটাকার একটা ব্যাঙের মতো দেখতে।
বুয়েন্স আয়ার্সের সরকারী মহল প্রথমটায় এসব গুজবে কোন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু গুজব এতটাই ডানা মেলল যে ইচ্ছে করলেই চট করে উপেক্ষা করা যায় না। জেলেরা এমন ভয় পেয়েছে যে সাগরে তাদের মাছ ধরা বন্ধ। শহরে মাছের আকাল পড়েছে। নাগরিকদের খাদ্য সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতদিনে সরকারী ভাবে পদক্ষেপ নেয়া হলো। গোটা কয়েক স্টীমার আর লঞ্চ পাঠানো হলো, উপকূলে প্রহরা দেবে। নির্দেশ দেয়া হলো, যে জানোয়ার মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে সেটাকে যেভাবে হোক বন্দি করতে হবে।
জল-পুলিশের বিশ্রাম মাথায় উঠল, লা প্লাটা উপসাগর চষে বেড়াতে লাগল তারা। রাত নেই দিন নেই তন্ন তন্ন করে খোজা চলল। মিথ্যে গুজব রটানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজন লোক গ্রেপ্তারও হলো, কিন্তু আসল কাজ কিছুই হলো না। সাগর-দানোকে ধরা সম্ভব হলো না!
ব্যর্থতা স্বীকার করার চেয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া সহজ, কাজেই সাগর-দানোকে ধরতে না পেরে পুলিশের প্রধান বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন, সাগর-দানো বলে আসলে কিছু নেই, সব অশিক্ষিত মানুষের গালগল্প। বলে দেয়া হলো গুজব ছড়ানোর অপরাধে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। জেলেদের উদ্দেশে বলা হলো তারা যেন মানুষের কথায় কান না দিয়ে নির্দ্বিধায় সাগরে মাছ ধরতে যায়। কোন বিপদ হবে না।
আশ্বাস পেয়ে মাছ ধরতে শুরু করল জেলেরা। পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলো। লোকে হয়তো ভুলেই যেত সব, কিন্তু নতুন। করে আবার শুরু হলো সাগর-দানোর উৎপাত।
কিছুদিন পর এক গভীর রাতে ছাগলের ডাকের মতো বিকট একটা চিৎকারে ঘুম ভাঙল তীরবর্তী জেলেদের। ভয় পেলেও সমুদ্রের তীরে ছুটে গেল সবাই। কোথাও কিছু নেই! একের পর এক মস্ত বড় ঢেউ শুধু কল্লোল তুলে আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়িতে। খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
সমুদ্রে মাছ ধরছিল কিছু জেলে! জাল তোলার পর তারা দেখল কে যেন ছুরির মতো ধারাল কিছু দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে তাদের জাল।
আবার শুরু হয়েছে সাগর-দানোর উপদ্রব!
ব্যাখ্যার জন্যে সাংবাদিকরা গেল বৈজ্ঞানিকদের কাছে। আশা করা গিয়েছিল তাঁরা এর একটা জবাব দিতে পারবেন। কিন্তু তাঁরাও ব্যর্থ হলেন। জানালেন মানুষের মতো কাজ করতে সক্ষম এমন কোন সামুদ্রিক প্রাণীর কথা তাদের জানা নেই। আগের বার হাল ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। এবার বিজ্ঞানীরাও হাল ছাড়লেন। তবে পুলিশের মতোই তারাও অজ্ঞতা ঢাকার জনে বললেন, এসব গুজব। নিশ্চই কোন বাজে লোকের কীর্তি। তাকে ধরা পুলিশের কাজ, বিজ্ঞানীদের নয়।
বৈজ্ঞানিকদের পাশ কাটানো ব্যাখ্যায় অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারল। এমনকি বিজ্ঞানীদের মাঝেও দ্বিমত পোষণ করল কেউ কেউ। একজন শয়তান লোক এতদিন ধরে এসব কাণ্ডকীর্তি করছে, কিন্তু কিজন্যে? তার উদ্দেশ্য কি? কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সে এমন করছে। তাছাড়া কেউ তাকে দেখতে পেল না এটাও কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? আরও আছে, খুব কম সময়ের মধ্যে দূরবর্তী অনেক এলাকায়। উপদ্রব হয়েছে। কোন মানুষের পক্ষে অল্প সময়ে অত দূর এ সাঁতরে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। তারমানে যাকে সাগর-দানে বলা হচ্ছে সে অতি দ্রুত সাঁতার কাটতে সক্ষম।
চিন্তার জাল বুনছে আর চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে একটানা পায়চারি করছে পেদরো জুরিতা, কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। কথন ভোর হয়ে গেছে সে জানে না। জানল জানালা দিয়ে শিশু সূর্বের লাল রশ্মি প্রবেশ করতে। কেবিন ছেড়ে বের হলো সে, হাতমুখ ধুবে। মুখে পানি দিয়েছে মাত্র, এমন সময় শুনতে শে নাবিক আর ডুবুরিদের সম্মিলিত চিৎকার। উত্তেজিত চিৎকার নয়, আর্তচিৎকার! হাতের মগ নামিয়ে রেখে আওয়াজ লক্ষ্য করে ডেকের উদ্দেশে ছুটল জুরিতা।
ডুবুরিরা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, হাত-পা লেড়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করছে সবাই। তাদের দেখাদেখি তীরের দিকে তাকাল জুরিতা। সাগর বেলায় যতগুলো নৌকো বাঁধা ছিল, সবগুলোর বাঁধন কেটে দিয়েছে কে যেন। নৌকোগুলো ভাসতে ভাসতে সাগরে চলে এসেছিল, এখন সাগর থেকে বয়ে আসা বাতাসের ধাক্কায় আবার তীরের দিকে ফিরছে। একটা নৌকোতেও দাঁড় নেই, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কেউ। দাড়গুলোও নৌকোর আশেপাশে ভাসছে।
নৌকোগুলো ধরে নিয়ে এসো, নির্দেশ ঝাড়ল জুরিতা। বেশি দূরে নেই, অল্পক্ষণ সাঁতরালেই হবে।
মাঠে মারা গেল তার আদেশ। নড়ল না কেউ। আবার নির্দেশ দিল জুরিতা। অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল ডুবুরিদের মাঝে। কে একজন টিটকারি মেরে বলল, সাহস থাকলে নিজেই যাও না। সাগর-দানোর শিকার হয়ে মরার শখ নেই আমাদের।
রাগে সারাশরীর জ্বলতে শুরু করল জুরিতার, কোমরে বাঁধা হোলস্টারের কাছে হাত চলে গেল।
রেলিঙের কাছ থেকে সরে মাস্তুলের নিচে জড় হলো ডুবুরিরা। রাগান্বিত দৃষ্টিতে দেখছে তারা পেদরো জুরিতাকে। বিদ্রোহের আলামত সুস্পষ্ট! যে কোন সময় বেধে যেতে পারে সংঘাত।
লাগতো, কিন্তু দুপক্ষের মাঝে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধ বালথাযার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, আমি রেড ইন্ডিয়ান এই বালথাযার কোনদিন হাঙরকে ভয় পাইনি। সাগর-দানোকেও ভয় পাব
কেউ কিছু বলার আগেই রেলিঙের কাছে চলে গেল বালথাযার, দুহাত সামনে বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল সাগরে। একে তো বয়স অনেক, তারওপর একটা পা পুরোপুরি সক্ষম নয়, তবুও দ্রুত সাঁতরাচ্ছে। বালথাযার। একটা নৌকোয় গিয়ে উঠল। ভাসন্ত একটা দাঁড় তুলে। নিয়ে নৌকোটা নিয়ে তীরের দিকে চলল সে।
বালথাযারের কোন বিপদ হলো না দেখে অন্য জুবুরিদেরও সাহস ফিরল। তারাও ঝাঁপ দিল সাগরে। নৌকোগুলো নিয়ে তীরের দিকে ফিরতে শুরু করল।
সবাই খেয়াল করেছে, প্রত্যেকটা নৌকোর দড়ি যেন কেটে, দিয়েছে কেউ। কেটে দিয়েছে ধারা ছুরি বা ক্ষুর দিয়ে।
০২. মাত্র সকাল, অথচ গরম
মাত্র সকাল, অথচ গরম কড়াইয়ের মতো তাপ ঢালছে সূর্যটা। মাথার ওপর নীল আকাশ। একচিলতে মেঘ নেই আজ। বাতাস থমকে গেছে। সাগর শান্ত। বুয়েন্স আয়ার্স শহরের বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে এসে হাজির হলো জেলিফিশ জাহাজ। সামনে সাগরের বুকে মাথা তুলে এবড়োখেবড়ো দাঁত দেখিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছে দুসারি পাহাড়শ্রেণী। পাহাড় দুটোর মাঝে সরু একটা খাঁড়ি। বালথাযারের কথা অনুযায়ী সরু সেই খাঁড়ির ভেতর জাহাজ নিয়ে যাওয়া হলো।
কাজে নামল ডুবুরিরা। খাঁড়ির চারধারে নৌকো নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। প্রতি নৌকোয় দুজন করে ডুবুরি। একজন ডুব দেবে, অন্যজন নৌকোয় বসে থাকবে। ডুবুরিকে সাহায্য করবে সে উঠে আসার সময়। পরের দফা নামবে নৌকোয় বসা প্রথমজন। এভাবে পালা বদল করে সারাদিন চলবে ঝিনুক আহরণের কাজ।
তীরের সবচেয়ে কাছে যে নৌকোটা, সেটার ডুবুরি প্রকাণ্ড একটা প্রবালখণ্ডের সঙ্গে বাঁধা দড়িতে পা পেঁচিয়ে সাগরে ডুব দিল। সাগরের পানি বেশ উষ্ণ। এতই পরিষ্কার যে তলা পর্যন্ত দেখা যায়। নিচে একটা আলপিন পড়লেও তুলে আনা যাবে। সাগরের মেঝে যেন একটা অপূর্ব সুন্দর বাগান। নানা রঙের নানা আকৃতির প্রবাল সে বাগানের সৌন্দর্য। নিস্তব্ধ নিথরতায় আলোর ঝিলিকু জুলে ছুটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ। নানা রং তাদের। কোনটা সোনালি, কোনটা রুপোলি, আবার কোনটা বা লাল-নীল-হলুদ-সবুজ–বিচিত্র রঙা।
সাগরের মেঝেতে নেমে পড়েছে ডুবুরি। ঝটপট হাত চলছে তার। ক্ষিপ্র হাতে ঝিনুক কুড়িয়ে কোমরে বাঁধা থলিতে পুরছে। তার সঙ্গী দড়ির অপর প্রান্তে, নৌকোর ওপর থেকে ঝুঁকে তার কাজকারবার দেখছে। ওপরের লোকটা দেখল হঠাৎ কোন কারণে ভয় পেয়েছে ডুবুরি সঙ্গী। শরীরটা পানির নিচে একটা ঝটক খেল। দড়িতে ডুবুরি এত জোর টান লাগাল যে আরেকটু হলে নৌকো থেকে সাগরে গিয়ে পড়ত সে। তাড়াহুড়ো করে ডুবুরিকে দড়ি টেনে ওপরে তুলে আনল লোকটা। ভয়ে ডুবুরির তামাটে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। দুচোখ বিস্ফারিত, এখনই যেন অক্ষিকোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।
কি! কি হলো! হাঙরে তাড়া করেছিল? ডুবুরিকে দম নিতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
জবাব দিতে পারল না ডুবুরি, সংজ্ঞা হারিয়ে নৌকোর পাটাতনে ঢলে পড়ল।
সাগরের তলদেশে চোখ বোলাল সঙ্গী। কিসের যেন একটা চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে ওখানে। শিকারি বাজের হামলা হলে ছোট ছোট পাখি যেমন দিগ্বিদিক ছুটে পালায়, ঠিক তেমনি করে দিশে হারিয়ে ছুটছে ছোট মাছের দল। প্রবালের আড়ালে লুকাতে ব্যস্ত। একটা বড় পাথরের পাশে লাল ধোয়ার মতো কি যেন একটা ছড়িয়ে পড়ছে! আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে গেল তলার পানির রং। কালো কি একটা পড়ে আছে নিচে! হাঙর ওটা! হাঙরের লাশ। মরা হাঙরটা পাক খেতে খেতে একটা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। লালু ধোয়াটা বোধহয় মৃত হাঙরের রক্ত। এই মাত্র খুন করা হয়েছে দানবটাকে। কে করল? নৌকোর ওপর চিত হয়ে পড়ে থাকা ডুবুরি সঙ্গীর দিকে তাকাল সে। এখনও মুখ হাঁ করে পড়ে আছে ডুবুরি, ঘোলা চোখের দৃষ্টি আকাশের গায়ে। তাহলে? কে মারল হাঙরটাকে। আতঙ্কিত ডুবুরিকে নিয়ে জাহাজে ফিরল সঙ্গী।
জাহাজে তো ফিরল, কিন্তু ডুবুবির মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে। আতঙ্কে বোবা হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা তদবির করার পর শুধু দুএকটা কথা বলতে পারল সে।
স…স…সাগর-দানো! দেখেছি আমি!
অনেক সময় লাগল লোকটার স্বাভাবিক হতে। ততক্ষণে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ডুবুরিরা।
তাদের চাপাচাপিতে বলতে শুরু করল ডুবুরি: হঠাৎ দেখলাম একটা কালচে রঙের বিরাট হাঙর আমার দিকে তেড়ে আসছে। মুখটা হাঁ করে রেখেছে, সারি সারি ক্ষুরধার দাঁত দেখলাম। বুঝে গেলাম আজকে আমি শেষ। তারপর দেখলাম আরেকটা কি যেন আসছে!
ডুবুরি চুপ করায় দম আটকে যাওয়ার জোগাড় বাকিদের। একজন প্রশ্ন করল, কি আসছিল? আরেকটা হাঙর?
না। আসছিল সেই সাগর-দানো!
কেমন ওটা দেখতে? মাথা আছে? কিরকম?
মাথা তো আছে, কিন্তু চোখ দুটো বড় বড়, মনে হলো যেন কাচের তৈরি।
আর থাবা?
হ্যাঁ, থাবা আছে?
আছে। একেবারে ব্যাঙের মতো। লম্বা লম্বা সবুজ রঙের আঙুল। সেই আঙুলে ধারাল নখর। সারা গা আঁশে ভরা মাছের মতো। ছুটে এসে হাঙরটাকে এক থাবা মারল, তাতেই হাঙরের পেট চিরে রক্ত বেরোতে শুরু করল।
তো ভয় পেলে কাকে দেখে, হাঙর না সাগর-দানো?
সাগর-দানো আজকে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে কিন্তু হাঙরটাকে নয়, সাগর-দানোকেই ভয় লেগেছে বেশি।
এক বুড়ো ইন্ডিয়ান বলল, উনি সাগরের দানো। গরীবরা যখন সাগরে বিপদে পড়ে, তখন সাহায্য করেন।
দেখতে দেখতে চারপাশে খবর ছড়িয়ে পড়ল। কাজ অসমাপ্ত রেখেই তাড়াহুড়ো করে জাহাজে ফিরে এলো ডুবুরিদের নৌকোগুলো। ডুবুরিদের মুখে মুখে অতিরঞ্জিত হলো কাহিনী। শেষ পর্যন্ত সাগর দানোর চেহারা পালটে গেল। যে ডুবুরি দেখেছে সে পর্যন্ত তাজ্জব হয়ে গেল বর্ণনা শুনে।
সাগর-দানোর নাক দিয়ে হলকায় হলকায় লাল আগুন বের হয়। তার দাঁতগুলো যেমন বড় তেমনি ধারাল। কানগুলো হাতির কানের মতো নড়ছিল। দেহের দুপাশে দুটো পাখনাও ছিল। পায়ের বদলে নৌকোর হালের মতো তার লেজ।
ডুবুরিদের গালগল্প শুনতে শুনতে পায়চারি করছে পেদরো জুরিতা, ঠোঁটে চুরুট। তার ধারণা যে ডুবুরি হাঙর দেখেছে সে সাগর-দানোর ব্যাপারটা কল্পনা করে নিয়েছে।
কিন্তু তাহলে ওটা কি!
পাহাড়ের পেছন থেকে বাঁশির মতো চিৎকার!
সাগর-দানো!
মুহূর্তে ডুবুরিদের কথাবার্তা গালগপ্প থেমে গেল। হতবিহ্বল ডুবুরিরা নিষ্পলক চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। আতঙ্কে জমে যাবার অবস্থা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের।
জাহাজের সামান্য দূরে সাগরে খেলা করছিল একদল শুশুক। বাঁশির আওয়াজটা হতেই খেলা সাঙ্গ করে পাহাড়ের দিকে ছুটল ওদের একটা। মনে হলো যেন কেউ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জাহাজের ওরা। একটু পরই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল প্রত্যেকের। শুশুকটা ফিরে আসছে। তার পিঠে বসে আছে মানুষেরই মতো একটা প্রাণী। এই কি সেই সাগর-দানো? এরই কথা বলেছে আতঙ্কিত ডুবুরি? দানোর দেহ মানুষেরই মতো। অবশ্য চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড়, রোদের প্রতিফলন হওয়ায় জ্বলজ্বল করছে গাড়ির হেডলাইটের মতো। নীলাভ-রূপোলি তার গায়ের রং। হাতের আকৃতি একেবারেই ব্যাঙের মতো। আঙুলের ফাঁকগুলোয় চামড়ার ঝালর।
সাগর-দানোর হাঁটু রয়েছে সাগরের পানির নিচে, কাজেই পা মানুষের মতো নাকি মাছের মতো সেটা বোঝা গেল না। দানোর হাতে একটা প্যাচানো শঙ্খ। ওটা দিয়েই সে বাঁশির তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে। আরেকবার শঙ্খ বাজাল দানো। তারপর সবাইকে হতবাক করে দিয়ে খাঁটি স্প্যানিশে বলে উঠল, জোরে, লিডিং! আরও জোরে ছোট।
শুশুকের পিঠে আলতো করে চাপড় দিল সে। পা দিয়ে শুশুকের পেট স্পর্শ করল। গতি বেড়ে গেল শুশুকের, আরও জোরে ছুটতে শুরু করল।
উত্তেজিত স্বরে যার যার বক্তব্য বলতে শুরু করল ডুবুরিরা। আওয়াজটা কানে যাওয়ায় জাহাজের দিকে তাকাল দানো। মানুষ দেখতে পেয়েই কাত হয়ে চট করে লুকিয়ে পড়ল শুশুকের দেহের আড়ালে।
ডুবুরিরা দেখল, সবুজ একটা হাত আবার আলতো করে স্পর্শ করল শুশুকটাকে। এটা নির্দেশ। সঙ্গে সঙ্গে আরোহী সমেত ডুব দিল শুশুক, ফিরে চলল পাহাড়ের আড়ালে। একটু পরই শুশুক বা সাগর দানো কিছুই আর দেখা গেল না।
মাত্র মিনিট খানেক পার হয়েছে, কিন্তু ডুবুরিদের মনে হলো এক যুগ পেরিয়ে গেছে। সংবিৎ ফিরতে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল তাদের। একেকজন একেক রকম আচরণ করছে। কেউ দুহাতে মাথা চেপে উদ্দেশ্যহীন ছোটাছুটি করছে, কেউ আবার হাঁটু মুড়ে বসে সাগর দানোর কাছে প্রার্থনা করছে। তরুণ এক মেক্সিকান নাবিকের মাথায় কি ভূত চাপল, সোজা মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। নিগ্রো খালাসিরা লুকিয়ে পড়ল জাহাজের খোলে, যেন ওখানে তাদের স্পর্শ করতে পারবে না বিপদ।
যা ঘটে গেল তারপর আর ঝিনুক আহরণের প্রশ্নই ওঠে না। ক্যাপ্টেন পেদরো আর বালথাযার অনেক সাধ্যসাধনা করে নাবিক আর ডুবুরিদের মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনল। দেরি না করে জেলিফিশ জাহাজ রওনা হয়ে গেল খাঁড়ি ছেড়ে। উত্তর দিকে চলেছে।
০৩. মাথা আমার খারাপ হয়ে যায়নি
মাথা আমার খারাপ হয়ে যায়নি তো! কেবিনে ফিরে নিজেকে প্রশ্ন করল পেদরো জুরিতা। সাগর-দানো বলছে নির্ভুল স্প্যানিশ! স্বপ্ন দেখছি না তো! এক সঙ্গে সবার মাথা খারাপ হয় কি করে? তাহলে অবিশ্বাস্যকেই বিশ্বাস করতে হবে? তাহলে ওটা সাগর-দানো?
মাথা ঠাণ্ডা করতে এরইমধ্যে দুমগ পানি মাথায় ঢেলেছে পেদরো জুরিতা। এবার সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। প্রাণপণে ভেবে চলেছে।
সাগর-দানোর বুদ্ধি মানুষের মতো। ভাষাও। তার মানে ভেবেচিন্তে কাজ করার ক্ষমতা তার আছে। শুশুকের পিঠে বসে ছিল। তার মানে পানির তলায় যেমন তেমনি ডাঙাতেও সে শ্বাস নিতে পারে। ব্যবসা বুদ্ধি খেলল জুরিতার মাথায়। এমন একটা উভচর প্রাণীকে যদি মুক্তো খোঁজার কাজে ব্যবহার করা যায়? একজনই সে একশো ডুবুরির চেয়ে বেশি কাজ করতে পারবে। লাভ আরও বাড়বে, কারণ ডুবুরিদের চার ভাগের এক ভাগ টাকা দিয়ে দিতে হয়। সাগর-দানোক কাজে লাগাতে পারলে কিছু দিতে হবে না। প্রচুর টাকা আয় হবে তাহলে। কিন্তু পোষ মানাতে হবে ওটাকে।
রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে জুরিতা। একের পর এক বুনে চলেছে স্বপ্নের জাল। তার অনেক দিনের স্বপ্ন বড়লোক হবে। তীব্র আকাক্সক্ষা তাকে দুঃসাহসী করে তুলেছে। আর কেউ যেখানে যেতে ভয় পায় সেখানেও জাহাজ নিয়ে হাজির হয়ে যায় সে মুক্তো সংগ্রহের নেশায়।
ভবিষ্যতে ইরান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া এবং লোহিত সাগরে অভিযান চালানোর ইচ্ছে আছে তার। মেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ভেনিজুয়েলার উপকূলে পৃথিবীর সেরা মুক্তো পাওয়া যায়। এসব জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছেও সে পোষণ করে মনে মনে। এতদিনে চলেই যেত অভিযানে যেতে পারেনি শুধু তার পুরোনো এই জরাজীর্ণ জাহাজের কারণে। এ জাহাজ নিয়ে খোলা সাগর পাড়ি দেয়া যাবে না। তাছাড়া তার জাহাজে ডুবুরির সংখ্যাও কম! ব্যবসা বড় করতে হলে নগদ টাকাও দরকার। সেটারও অভাব রয়েছে। এসব নানা কারণে পেদরো শুধু আর্জেন্টিনার তীরেই নিজের ব্যবসা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এবার যদি সাগর-দানোর সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে বড়জোর। এক বছর, তারপরই সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হবে ওর। কোটিপতি হতে বেশিদিন লাগবে না। তখন শুধু আর্জেন্টিনাই নয়, পুরো আমেরিকার সবচেয়ে ধনী হওয়া তার ঠেকাচ্ছে কে! কে না জানে, টাকার সঙ্গে আসে ক্ষমতা। বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে যাবে সে। কিন্তু সাবধান! নিজেকে শাসাল পেদরো জুরিতা! যা করার তা করতে হবে গোপনেই। কেউ যদি বুঝে ফেলে তাহলে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে তার পরিকল্পনা।
ভেবেচিন্তে তার লোকদের ডাক দিয়ে জড় করল পেদরো জুরিতা, বলল, যারা ওই সাগর-দানোর কথা বলেছে তাদের কি হাল হয়েছে সেটা তোমরা জানো। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে। কাউকে জানানো যাবে না সাগর-দানোকে তোমরা দেখেছ। পুলিশ জানলে কিন্তু নির্ঘাৎ জেল। কাজেই সাবধান!
ডুবুরিদের সতর্ক করে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল জুরিতা। বালথাযারকে সঙ্গে নিয়ে কেবিনের ভেতর ঢুকল। ঠিক করেছে বালথাযারের কাছে নিজের মনের কথা গোপন করবে না। খুলে বলল সব।
সব শুনে সায় দিল বালথাযার বলল, কথা ঠিক। ওই সাগর দানোকে ধরতে পারলে এক হাজার ডুবুরির কাজ সে একাই করতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে ধরা যাবে কি করে?
জাল দিয়ে, তৈরি জবাব দিল পেদরো।
তা কি সম্ভব? যেভাবে হাঙরের পেট চিরে দেয় তাতে তো মনে হয় জালও কেটে বেরিয়ে যাবে।
তার দিয়ে যদি জাল তৈরি করি?
কিন্তু তাকে ধরতে রাজি হবে কেউ? আমার তো মনে হয় এক বস্তা সোনা দিয়েও কাউকে রাজি করানো যাবে না।
ঠিক আছে তোমার কথাই মানলাম, রাজি হবে না কেউ। কিন্তু তুমি? তুমি কি চেষ্টা করে দেখবে?
ওকে ধরা সহজ হবে না।
চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি! ভয় পেলে নাকি, বালথাযার? অত ভাবছ কি?
তেমন কিছু না। সাগর-দানো ধরা সাধারণ কাজ নয়। পানির মাছ যদি গাছে চড়ে তাহলে যেমন অবাক ব্যাপার হবে এই ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। কিন্তু অদ্ভুত শিকারের ঝুঁকি নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং ঝুঁকি নিতেই আমি ভালবাসি।
বালথাযারের বাহুতে হাত রাখল পেদরো। উত্তেজনায় আঙুল চেপে বসল মাংসে। ওকে যদি ধরতে পারো তো অনেক টাকা পাবে, বালথাযার। বেশি লোক জানানো চলবে না। বড়জোর পাঁচজন সেরা ডুবুরি সঙ্গে রাখবে তুমি।…আমার মনে হয় প্রথমে ওটার বাসা খুঁজে বের করা দরকার। জাল পাতলে ওখানে পাতাই ভাল হবে।
দ্রুত কাজ করল বালথাযার। সময় নষ্ট করা তার ধাতে নেই। বালথাযারের সঙ্গীসাথীরা নির্দেশ মতো তারের একটা জাল তৈরি করে ফেলল। দেখতে সেটা হলো পিপে আকৃতির। সেটার ভেতরে সাধারণ জাল রাখা হলো, যাতে সাগর-দানো সাধারণ জালে পেঁচিয়ে যায়।
জেলিফিশ জাহাজ তাদের তৎপরতা শুরু করল লা-পাটা উপসাগরের সেই জায়গায়, যেখানে প্রথম বারের মতো সাগর-দানোর দেখা পাওয়া গিয়েছিল। দানোর যাতে সন্দেহ না হয় সেজন্যে জাহাজটা রাখা হলো খড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। সৌখিন মৎস্য শিকারীদের অনুকরণে সদলবলে খাঁড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করল পেদরো জুরি। তিনজন নাবিককে সে পাহাড়ের ওপর রাখল। তাদের কাজ সাগরের দিকে লক্ষ রাখা।
সাত দিন পার হয়ে গেল কোন ঘটনা ছাড়াই। সাগর-দানোর দেখা নেই। সাগরবেলার কাছে যে সব রেড ইন্ডিয়ান চাষাবাদ করে দেয় তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে আলাপ হয়েছে বালথাযারের। তার মনে কোন সন্দেহ নেই যে ঠিক জায়গাতেই এসেছে তারা। রেড ইন্ডিয়ানদের অনেকেই শঙ্খের আওয়াজ শুনেছে। কেউ কেউ সাব্রতীরবর্তী বালিতে ওট। পায়ের ছাপও দেখেছে। দানোর গোড়ালি মানুষেরই মতো, কিন্তু আঙুলগুলো দীর্ঘ, হাঁসের পায়ের মতো মাঝখানটা চামড়া দিয়ে জোড়া। সাগর-দানো মাঝেমধ্যে বালির ওপর শুয়ে থাকে। সে ছাপও দেখা গেছে। আজ পর্যন্ত রেড ইন্ডিয়ানদের কোন ক্ষতি করেনি সাগর-দানো, কাজেই তারাও সাগর-দানোকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। দুবেলা খাবার জোগাড় করতেই তাদের সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। অত খবরে তাদের কাজ কী! তবে একটা কথা জানা গেল। চিহ্ন যতই দেখুক আজ পর্যন্ত সাগর-দানোকে চাক্ষুষ দেখেনি কোন ইন্ডিয়ান।
আরও দুসপ্তাহ পেরিয়ে গেল। খাঁড়ির মুখে অপেক্ষা করছে জেলিফিশ জাহাজ। সারাক্ষণ পালা করে সাগরে নজর রেখেছে পেদরো জুরির ভাড়াটে লোকরা, কিন্তু দেখা দিল না সাগর-দানো। ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে পেদরো জুরিভার। একেকটা দিন পার হওয়া মানেই লোকের বেতন টানা। তারওপর একটা সন্দেহ মনে আসায় মুষড়ে পড়ল জুরিতা। সত্যি যদি সাগর-দানো কোন প্রাণী না হয়ে দেবতা বা অশরীরী গোছের কিছু হয় তাহলে তাকে জাল দিয়ে ধরার কোন উপায় নেই। ধরতে গিয়ে কি বিপদ সৃষ্টি হয় কে জানে! ভয় পেতে শুরু করল কুসংস্কারাচ্ছন্ন পেদরো।
নানা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে তার মাথায়। একবার মনে হচ্ছে সাগর দানো আসলে অতৃপ্ত আত্মা। তাই যদি হয় তাহলে ওটাকে তাড়াতে যাজকদের সাহায্য নিতে হবে। আবার এমনও হতে পারে ওটা সাধারণ কোন মানুষ, দক্ষ সাঁতারু, দানো সেজে মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা পাচ্ছে। কিন্তু তাই যদি হতো তাহলে ডলফিনকে পোষ মানাল কি করে! আবার হতেও পারে! শোনা যায় ডলফিন পোষ মানে। নানা চিন্তায় মাথা গরম হয়ে গেল জুরির। শেষ পর্যন্ত এক বুদ্ধি এলো, তার মাথায়। ঘোষণা দিল, সাগর-দানোকে কেউ দেখতে পেলে তাকে সে পুরস্কার দেবে। পুরস্কারের লোভে আরও ভাল ভাবে সাগর দানোকে খুঁজবে সবাই, একথা ভেবে জেলিফিশ জাহাজ আরও কিছুদিন ওই শাড়ির কাছেই নোঙর করে রাখল সে।
তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে তার প্রতীক্ষার অবসান হলো, দেখা মিলল সাগর-দানোর।
সারাদিন মাছ ধরা শেষে মাছ ভরা নৌকো তীরে বেঁধে রেখে দেয় বালথাযার। পরদিন ভোর বেলায় সেই মাছ নিতে আসে মাছের ব্যবসায়ীরা। মাছ নিয়ে নগদে দাম পরিশোধ করে। সেদিনও যথারীতি নৌকো তীরে বেঁধে রেখেছে বালথাযার। সে গেছে এক রেড ইন্ডিয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। গালগপ্প সেরে ফিরতে বেশ দেরি হলো। এসে দেখে তার নৌকোয় একটা মাছও নেই। হতবাক হয়ে বালথাযার, ভাবল, এত মাছ গেল কই! অন্য কেউ নেবে না। বুঝতে পারল, এ সেই সাগর-দানোর কাজ না হয়েই যায় না।
সেরাতে পাহারার সময় এক রেড ইন্ডিয়ান শুনতে পেল শঙ্খের আওয়াজ। খাঁড়ির দক্ষিণ দিক থেকে আসছে আওয়াজটা।
তার দুদিন পর এক আরাউকানি রেড ইন্ডিয়ান তরুণ এসে জানাল সাগর-দানোর খোঁজ পেয়েছে সে। একটা ডলফিন সমেত সাগর-দানোকে দেখা গেছে। তবে এবার সে ডলফিনের পিঠে ছিল না, চামড়ার তৈরি লাগাম ধরে ডলফিনটার পাশে সাঁতার কাটছিল। খাঁড়ির কাছে এসে লাগামটা খুলে নিয়ে ডলফিব্রেপিঠে স্পর্শ করে সাগর দানো। ডলফিনটা চলে যায় আর সাগর-দানো ডুব দেয় পাহাড়ের কাছে, গভীর সাগরে। তাকে আর দেখা যায়নি।
আরাউকানি যুবককে পুরস্কার দেবে কথা দিয়ে পেদরো জুরিতা বলল, সাগর-দানো বোধহয় আজ আর বের হবে না। মনে হয় খাঁড়ির কোথাও তার বাসা আছে। পানির নিচে ডুব দিয়ে দেখা দরকার।
চুপ করে আছে সবাই, কারও মুখে রা নেই।
তোমাদের মধ্যে ডুব দিতে রাজি আছে কেউ? অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল জুরিতা।
এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কারও সাহস হচ্ছে না যে ঝুঁকিটা নেবে।
কিন্তু বালথাযার পিছিয়ে যাবার মানুষ না। মনের সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে বলল, আমি রাজি আছি। আমি ডুব দেব।
ঝুঁকি নিতে সাহস না করলেও মজা দেখার বেলায় কারও উৎসাহে কমতি নেই। খাঁড়ির উদ্দেশে রওনা হলো সবাই। দেখতে চায় বালথাযারের ভাগ্যে কি ঘটে।
কোমরে একটা দড়ি বেঁধে সাগরে নামল বালথাযার। সে যদি আহত হয় তাহলে ওই দড়ি ধরে তাকে টেনে তোলা হবে। একটা ছোরা ছাড়া অস্ত্র বলতে আর কিছু নেই বালথাযারের সঙ্গে। সহজে যাতে ডুবতে পারে সেজন্যে দুপায়ের ফাঁকে একটা পাথর নিয়ে ডুব দিল বালথাযার।
সে অদৃশ্য হওয়ার পর শুরু হলো প্রতীক্ষার প্রহর গোণা। উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই। পাহাড়ের ছায়া পড়ায় সাগর এখানে নীল। আলো কম। কেমন আঁধার আঁধার। রহস্যময় গভীর সাগর।
অতি ধীরে যেন কাটছে সময়।
পনেরো সেকেন্ড…বাইশ সেকেন্ড…পঞ্চাশ সেকেন্ড…এক মিনিট।
টান পড়ল দড়িতে!
দড়ি ধরে ওপরে টেনে তোলা হলো বালথাযারকে। অক্ষতই আছে বৃদ্ধ ডুবুরি? একটু সুস্থির হয়ে বলল, সরু একটা খাদ আছে পাহাড়ের নিচে দিয়ে। ভেতরটা কালিগোলা অন্ধকার। ওটাই সম্ভবত সাগর সানোর আস্তানা। খাদের সামনে পাথরের একটা দেয়ালও দেখলাম।
খুশি হয়ে উঠল পেদরো জুরিতা। বলল, খাদের ভেতর অন্ধকার। হওয়ায় ভাল হয়েছে। জাল পাতব ওখানে। এবার ঠিকই ধরা পড়তে হবে সাগর-দানোকে।
সন্ধে হতে না হতে দড়ি দিয়ে বেঁধে তারের তৈরি জালটা নামানো। হলো সুড়ঙ্গের মুখে। দড়ির শেষ মাথাগুলো শক্ত করে তীরের সঙ্গে বাধা হলো পড়িতে কয়েকটা ঘণ্টীও বেঁধে দেয়া হলো। হালকা একটু ছোঁয়া লাগলেই ঘণ্টীগুলো বেজে উঠবে।
পেদরো জুরিতা, বালথাযার এবং পাঁচজন রেড ইন্ডিয়ান অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তীরে, কখন বাজবে ঘণ্টী। বেশ দূরে জেলিফিশ, জাহাজটা দেখা যাচ্ছে। আজকে জাহাজে একজন লোকও নেই।
ধীরে ধীরে রাত নামল, আকাশে উঁকি দিল বাঁকা চাদ, সাগরের পানিতে প্রতিবিম্বিত হলো ক্ষীণ রুপোলি আলো। কোথাও কোন আওয়াজ নেই ঢেউয়ের ছল-ছল-ছলাৎ ছাড়া। একাগ্র হয়ে তিতিক্ষার পালা গুণছে সবাই। যেকোন সময় দেখা দিতে পারে সাগর-দানো।
প্রলম্বিত মুহূর্তগুলো পার হচ্ছে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে সবাই।
এভাবে কেটে গেল বহুক্ষণ। তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল ঘণ্টী!
ছুটে গেল সবাই দড়ির কাছে। দড়ি টেনে তাড়াহুড়ো করে জাল ওপরে তুলে আনছে। ওজন বেড়ে গেছে জালের। মনে হলো যেন। ভেতরে আটকা পড়া প্রাণীটা ছোটার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
পানির ওপর জাল তোলার পর চাঁদের আবছা আলোয় দেখা গেল অদ্ভুত এক প্রাণী আটকা পড়েছে। ওপরের অর্ধেক তার মানুষের মতো। যদিও সারাদেহে রুপোলি আঁশ রয়েছে, যেন মাছ! অর্ধেক পশু অর্ধেক মানুষ! জ্যোত্সার ক্ষীণালোকে বিরাট চোখ দুটো চকচক করছে। জালে তার একটা হাত আটকে গেছে! হাতটা ছোটানোর জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে! ঝটকামারছে থেকে যেকে। ছুটে গেল হাত। এবার কোমরের বেল্ট থেকে একটা ছোরা বের করল সাগর-দানো, জাল কাটার জন্যে জোরে জোরে পোঁচ মারতে শুরু করল।
চাপা গলায় উত্তেজিত বালথাযার বলে উঠল, জাল কাটতে পারবে না ও!
বালথাযারের ধারণা ভুল। অমানুষিক শক্তি সাগর-দানোর দেহে। ছোরার পোঁচে অনায়াসে কেটে ফেলছে সে তারের তৈরি শক্ত জাল। দেখতে দেখতে জালের মাঝে বড় একটা ফোকর তৈরি হলো। শীঘ্রি ওকে ডাঙায় তোলো, চেঁচাল পেদরো জুরিতা। দেরি হলে ছুটে যাবে।
তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! চেঁচাচ্ছে বালথাযার।
প্রাণপণে জাল টানছে সবাই। একবার তীরে ওঠাতে পারলে…।
কিন্তু হতাশ হতে হলো সবাইকে। জাল প্রায় তীরের কাছাকাছি, এমনসময় জালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো সাগর-দানো। দেরি না করে ঝাঁপ দিল সাগরে। হারিয়ে গেল সাগরের অতল গভীরে।
সবাই হতাশ, ক্লান্ত, টানা উত্তেজনার পর এই ব্যর্থতায়।
কিছুক্ষণ পর বালথাযার বলল, পানির নিচের কামাররা আমাদের কামারের চেয়ে অনেক ভাল। কি দুর্দান্ত ছুরি বানিয়েছে! লোহার তারের জাল পর্যন্ত অনায়াসে কেটে ফেলল!
থম মেরে আছে পেদরো জুরিতা। সাগর-দানো যেখানে ডুব দিয়েছে সাগরের সেখানে আটকে আছে তার দৃষ্টি। ভাব দেখে মনে হলো তার সারাজীবনের সঞ্চয় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শোক সামলে নিয়ে বলল, টাকা যত লাগে লাগুক, খাঁড়িতে ডুবুরি নামাব আমি। দরকার হলে ফাঁদ আর জাল দিয়ে খাঁড়ি ভরে ফেলব আমার হাত থেকে পালাতে পারবে না সাগর-দানো।
জেদী একগুঁয়ে লোক সে। দেহে বইছে স্প্যানিশদের তেজী রক্ত। উত্তেজনার খোরাক পেলে আর কিছুর তোয়াক্কা করে না সে।
এখন বোঝা যাচ্ছে সাগর-দানো ভূত-প্রেত অশরীরী নয়, রক্ত মাংসের প্রাণী। শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা সম্ভব। সম্ভব পরিকল্পনা মাফিক তাকে দিয়ে গভীর সাগর থেকে মুক্তো আহরণ করা।
পেদরো জুরিতা মনে মনে শপথ করল, সমুদ্রের দেবতা স্বয়ংও যদি সাগর-দানোর পক্ষ নেন তাহলেও পিছপা হবে না সে।
০৪. হতাশ না হয়ে বিশদ একটা পরিকল্পনা
হতাশ না হয়ে বিশদ একটা পরিকল্পনা করে কাজে নামল পেদরো জুরিতা। অর্থ খরচ করল হু-হু করে।
খাঁড়িতে জায়গায় জায়গায় জাল পাতা হলো। ফাঁদও বাদ গেল না। চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। কি কাজ হচ্ছে না। কোথায় যেন চলে গেছে সাগর-দানো। জালে শুধু মাছ ধরা পড়ছে। শঙ্খের আওয়াজও নেই আর। তবে সাগর-দানোর পোষা ডলফিনটাকে প্রতিদিন দেখা যায়। বারবার ভেসে ওঠে ওটা, ডাক ছেড়ে আবার ডুব দেয়। বোধহয় তার সঙ্গীকে খুঁজে বেড়ায়। কি সাগর-দানোর দেখা নেই। দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ডলফিনটাও হতাশ হয়ে পড়ল। একদিন খাঁড়ি ছেড়ে চলে গেল ওটা গভীর সাগরে।
ঋতুর পরিবর্তনে আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। ইদানীং পূর্ব থেকে জোর হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়ার বাড়িতে বড় হয়ে উঠছে সাগরের ঢেউগুলো। ঢেউ তুলে আনছে সাগরতলের বালি। পানি এখন আর স্বচ্ছ নয়। নিচে বেশিদূর নজর চলে না। তীরে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু বিক্ষুব্ধ সাগরের দিকে চেয়ে থাকে পেদরো জুধিতা। সাগরে ফেরার আগে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে ক্ষয়িষ্ণু ঢেউগুলো। ঢেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসে নুড়ি পাথর আর ছোট ছোট ঝিনুক। সাগরের দিকে যখন তাকায় না তখন মুখ নিচু করে উদাস হয়ে নুড়ি পাথর আর ঝিনুক দেখে জুরিতা। মাথায় তার একটাই চিন্তা: যে করে হোক সাগর দানোকে ধরতে হবে। সাগর-দানোকে ধরতে না পারলে গভীর সাগর থেকে মুক্তো আর নানা রকম রত্ন আহরণ সম্ভব নয়। ওই সাগর দানোক ধরতে পারলে গোটা আমেরিকার সবচেয়ে বড়লোক হয়ে, যাবে সে অল্পদিনের ভেতর। কিন্তু গেছে কোথায় সাগর-দানো? এত পরিকল্পনা, এত আয়োজন, এত খরচাপাতি-সবই কি তাহলে ব্যর্থ হলো?
এত সহজে হার মানার বান্দা না পেদরো জুরিতা! অন্য বুদ্ধি বের করল সে। অকুতোভয় বালথাযার তার সঙ্গী। বালথাষারকে বুয়েন্স আয়ার্সে পাঠাল সে। দুটো অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং দুপ্রস্থ ডুবুরির পপাশাক কিনে আনবে বালথাযার! সেরা জিনিসটা কিনবে, যাতে সহজে বাতাস চলাচলের টিউব কেটে দিতে না পারে সাগর-দানো। এছাড়া আরও লাগবে দুটো শক্তিশালী টর্চবাতি। সমস্ত খাঁড়ি এবার তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে।
সমস্ত জিনিস নিয়ে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ফিরে এলো বালথাযার। সঙ্গে দুটো বাড়তি জিনিসও নিয়ে এসেছে। দুটো ব্রোঞ্জের তৈরি ছোরা। ওগুলো পেদরো জুরিতাকে দেখিয়ে বলল, এগুলো আরাউকানি ইন্ডিয়ানদের ছোড়া। অনেক আগে ব্যবহার হতো। এগুলো দিয়েই সাদা চামড়ার মানুষদের হত্যা করত আমাদের পূর্ব পুরুষরা। পেদরো জুরিতার মুখ গোমড়া হয়ে গেল দেখে বলল, রাগ করলেন আমার কথায়? ছোরার ইতিহাস কিন্তু সত্যি। এখন আর পাওয়া যায় না এসব ছোরা, অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।
ছোরার ইতিহাস শুনে খুশি হতে না পারলেও ছোরা দুটো পেদরো জুরিতার বেশ পছন্দ হলো। ধারাল মজবুত জিনি সহজে ভাঙবে না। ভালই হয়েছে বালথযার এগুলো কিনে এনেছে। সাগরের তলায় নানা রকম বিপদ হতে পারে। বিপদ হলে ছোরা তখন কাজে লাগবে।
হাসল জুরিতা। প্রশংসার সুরে বলল, তুমি খুব সাবধানী লোক, বালথাযার!
জবাবে খুশি হয়ে হাসল বালথাযার।
উন্মাতাল বাতাসে সাগব্র রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছে, পাহাড়ের মতো বিশাল ঢেউগুলো তীরে এসে মাথা খুঁড়ছে। এখন সাগরে নামা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু পেদরো জুরিতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বালথাযারকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষুব্ধ সাগরে ডুবুরির পোশাক পরে নামল সে।
সাগরতলের সুড়ঙ্গ-মুখে জাল পাতা হয়েছিল, সেই জাল সরাতে বেশ কষ্ট হলো ওদের। সামনে অন্ধকার গুহা মুখ ব্যাদান করে আছে। জাল সরানোর পর গুহার ভেতরে ঢুকল ওরা। ভেতরে অন্ধকার যেন আরও জমাট! খানিক এগিয়ে টর্চ জ্বালল। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল প্রথমে ছোট মাছের ঝাঁক। কিন্তু একটু পরই আলোয় অভ্যস্ত হয়ে গেল, নীলচে আলোর দিকে ছুটে এলো ঝাঁকে ঝাকে। তাদের রুপোলি আঁশে টর্চের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে দুহাতে মাছের দলকে তাড়াতে শুরু করল পেদরো।
সুড়ঙ্গটা উচ্চতায় চার মিটার এবং প্রশস্তে, পাঁচ মিটারের কম হবে না। টর্চের আলোয় সামনের দিকটা সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সাগর দানো গুহাতে নেই। এখানে সে থাকে তেমন কোন চিহ্নও নেই। সাগ খেপে উঠলে বা বড় মাছ তাড়া করলে ছোট মাছের দল এই গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে এসে ঠাই নেয়। সতর্কতার সঙ্গে আরও সামনে এগোল জুরিতা আর বালথাযার। আস্তে আস্তে দুপাশ পেকে চেপে আসছে সুড়ঙ্গের দেয়াল। অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াতে হলে ওদের।
টর্চের আলোয় লোহার শিক দেয়া দরজাটা জেখা যাচ্ছে, পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে।
সাগর তলে এই জিনিস। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো পেদরো জুরিতার। শিক ধরে ঝাকি দিল সে। দরুজা খোলার চেষ্টা করল। খুলল না দরজা। শিকগুলো ওপরে-নিচে পাথরে গেঁথে দেয়া মজবুত জিনিস, উপযুক্ত যন্ত্রপাতি থাকলেও গাঁথুনি ভাঙা সহজ হতো না। দরজা শেকল পেঁচিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। শেকলে ঝুলছে একটা ভারী তালা।
এ কোন রহস্য! পেদরো আর বালথাযার বুঝতে পারল, জল দানো শুধু বুদ্ধিমান নয়, বেশ দক্ষও নানা কাজে। ডলফিনকে পোষ মানায়, আবার কামারের কাজও জানে! কামারের কাজ জানাটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। পানির তলায় কাজ করবে যে, আগুন পাবে কোথায়? তাহলে কি সাগর-দানো উভচর?
সিলিন্ডারে অক্সিজেন আছে, কিন্তু তবু মাথার ভেতরটা টাটাচ্ছে পেদরো জুরিতার। অসম্ভব উত্তেজিত বোধ করছে। সাগরে নামার পর। দশ মিনিটকে মনে হচ্ছে দশ যুগ। এখানে দেখার আর কিছু নেই। বালথাযারকে ইশারা করে ওপরে উঠতে শুরু করল জুরিতা। তার পিছু নিল বৃদ্ধ ডুবুরি।
ওদের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে উঠেছিল আরাউকানি ইন্ডিয়ানরা। আরও একটু দেরি হলে বিপদ অগ্রাহ্য করে সাগরে নামত। দুজনকে আস্ত দেহ নিয়ে সাগর থেকে উঠতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
ডাঙায় উঠেই সরাসরি কাজের কথা পাড়ল জুরিতা। সব দেখে কি বুঝলে, বালথাযার?।
মৃদু কাঁধ ঝাকাল হতাশ বালথাযার। মনে হচ্ছে এত সহজে ওকে ধরা যাবে না। যতদূর বুঝতে পারছি ও মাছ খেয়ে বাঁচে। তাই যদি হয় তাহলে তাকে গুহা থেকে বের হতে হবে না। গুহায় মাছের অভাব নেই। মনে হচ্ছে ডিনামাইট দিয়ে দরজাটা ভাঙা ছাড়া ওকে ধরা সম্ভব না।
এমন কি হতে পারে না যে গুহার দুটো মুখ-একটা ডাঙায়, আরেকটা সাগর-তলে?
জুরিতার কথায় কিছুক্ষণ ভাবল বৃদ্ধ ডুবুরি, তারপর বলল, হতেও পারে। অসম্ভব না।
: তাহলে আমাদের পরবর্তী কাজ আশেপাশের এলাকা ভাল করে খুঁজে দেখা, বলল পেদরো জুরিতা।
সায় দিল বালথাযার। জুরিতা ঠিকই বলেছে।
খোঁজার কাজ আরম্ভ করে দিল পেদরো জুরিতা। বেশি সময় ব্যয় হলো না, পেয়ে গেল যা খুঁজছিল।
উঁচু দেয়াল ঘেরা একটা জায়গা। বৃত্তাকার। অন্তত দশ হেক্টর জমি ঘেরা হয়েছে। দেয়ালের এক জায়গায় একটা লোহার দরজা বন্ধ সেটা! গায়ে ছোট একটা ফুটো। ওটা দিয়ে ভেতর থেকে দেখা হয় কে। এলো।
দেয়ালের বাইরে দিয়ে চক্কর মারল জুরিতা, বেশ আশ্চর্য হয়েছে। এতই দুর্লঙ্ যে বাইরে থেকে দেখে জেলখানা মনে হয়। এদিকের কৃষকরা এভাবে দেয়াল দিয়ে জমি ঘেরে না। আর এত উঁচু দেয়ালই বা কেউ দিতে যাবে কেন! একটু ফুটো নেই দেয়ালে, ফাটল বা খাজ নেই যে বেয়ে উঠে দেখা যাবে ভেতরে কি আছে।
জনবিরল এই নির্জন এলাকায় এত উঁচু দেয়ালের রহস্যটা কী! পাথরের গায়ে এখানে ওখানে কিছু শেওলা জাতীয় উদ্ভিত জন্মেছে, এছাড়া সবুজের নামগন্ধ নেই। রুক্ষ, ধূসর পাহাড়। সেই পাহাড়ের গা সাগরে এসে নেমেছে। খড়ির শুরু এখান থেকে।
কাউকে কিছু না জানিয়ে কয়েকদিন সেই দেয়ালের কাছে সময় কাটাল পেদরো জুরিতা। সর্বক্ষণ নজর রাখল দরজার ওপর। এরমধ্যে–একবারও দরজা খোলেনি। বের হয়নি কেউ, ঢোকেওনি কেউ। দেয়ালের ওপাশে কি আছে খোদা মালুম। ওদিক থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না।
সন্ধে। কালো আকাশের গায়ে মিটমিট করছে অজস্র ছোটবড় নক্ষত্র।
ঠোঁটে চুরুট, অস্থির হয়ে জেলিফিশ জাহাজের ডেকে পায়চারি করছে পেদরো জুরিতা। রেলিং ধরে আঁধার সাগরের দিকে উদাস চোখ মেলে চেয়ে আছে বালথাযার। তার সামনে হঠাৎ করেই থামল ক্যাপ্টেন। জিজ্ঞেস করল, ওই যে উঁচু দেয়াল ঘেরা জায়গাটা, ওখানে কে থাকে জানো?
সাগরের দিক থেকে চোখ ফেরাল বালথাযার। জানি। রেড ইন্ডিয়ানদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা বলল ডাক্তার সালভাদর থাকেন।
কে এই ডাক্তার সালভাদর?
তাকে ঈশ্বর বলা যায়, বলল বালথাযার।
বিস্ময়ে ভ্রূ জোড়া কপালে উঠল ক্যাপ্টেনের। একটু বিরক্তও বোধ করছে। মশকরা করছ নাকি, বালথাযার?
আপনার সঙ্গে কি মশকরা করা যায়? যা শুনেছি তা বললাম। এদিকের রেড ইন্ডিয়ানরা তাকে ঈশ্বর বলেই মনে করে। তিনিই নাকি ওদের উদ্ধারকর্তা!
ঈশ্বর! উদ্ধারকর্তা! মানে বুঝলাম না। একটু খুলে বলে।
মানুষকে মরার হাত থেকেও বাঁচাতে পারেন উনি। তাকে সর্ব শক্তিমান মনে করে রেড ইন্ডিয়ানরা। তিনি ইচ্ছে করলে খোড়াকে হাত-পা জুড়ে স্বাভাবিক করে তুলতে পারেন। শুনেছি অন্ধকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারেন। প্রাণের সঞ্চার করতে পারেন মৃতদেহে।
গোফে তা দিতে দিতে বালথাযারের কথা শুনল পেদরো জুরিতা। একমনে ভেবে চলেছে। বালথাযারের কথা শেষ হতে গোঁফের দুপ্রান্ত ওপরে ঠেলে দিয়ে বলল, পানিতে সাগর-দানো আর মাটিতে সর্ব শক্তিমান ডাক্তার সালভাদর। বালথাযার, এমনও তো হতে পারে দুটো ব্যাপারের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে। পারে না? হতে পারে একটা ব্যাপার আরেকটার সঙ্গে জড়িত।
ক্যাপ্টেন কি ভেবে কি করে বসে এই ভয়টা চেপে বসেছে বাথারের বুকে। ইতস্তত করে সে বলল, আমাদের বোধহয় এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।
কথাটা পাত্তা দিল না জুরিতা। জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে এমন কাউকে তুমি নিজের চোখে দেখেছ, বালথাযার?
দেখেছি। পা ভাঙা এক লোককে দেখেছি। ডাক্তার চিকিৎসা করার পর এখন সে একদম সুস্থ। মারা যাবার পর আবার বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে তেমন একজনকেও দেখেছি। রেড ইন্ডিয়ানরা বলে লোকটাকে যখন ডাক্তার সালভাদরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। মাথা ভেঙেছিল লোকটার। মগজও নাকি বের হয়ে এসেছিল। ডাক্তার তার চিকিৎসা করার পর একেবারে সুস্থ হয়ে যায় সে। কদিন আগে বিয়েও করেছে। বউটি নাকি বেশ সুন্দরী। রেড ইন্ডিয়ানরা বলে…
বাইরের মানুষের সঙ্গে ডাক্তার দেখা করে? বালথাযারকে থামিয়ে, দিয়ে প্রশ্ন করল অধৈর্য জুরিতা।
করেন, তবে রেড ইন্ডিয়ান হলে তবেই। দূর দূরাঞ্চল থেকে লোক আসে চিকিৎসার জন্যে। কেউ কেউ তো আমাজন, আটাকামা, আসুনসিওনের মতো অত দূর থেকেও আসে। এমনই ডাক্তারের সুখ্যাতি।
দুআঙুলে ডলে গোঁফ পাকাচ্ছে আর চিন্তা করে চলেছে পেদরো। জুরিতা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, তথ্য সংগ্রহের জন্যে বুয়েন্স আয়ার্সে যাবে।
দেরি না করে বুয়েন্স আয়ার্সে টু মারল সে। খোঁজ-খবর নিয়ে। জানতে পারল ডাক্তার সালভৰ্দর আসলেই শুধু রেড ইন্ডিয়ানদের চিকিৎসা করেন। তাঁর মতো দক্ষ শল্য চিকিৎসক গোটা দুনিয়ায় খুব কমই আছে। অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ। প্রতিভা থাকলে সচরাচর যা হয়, ডাক্তার সালভাদরও একটু পাগলাটে কিসিমের মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক চিকিৎসক হিসেবে তুলনাহীন কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে বুয়েন্স আয়ার্সের প্রান্তে জমি কিনে ফেললেন, দেয়াল দিয়ে সে জমি ঘিরে নিয়ে আস্তানা গাড়লেন। বাইরে তিনি বের হন না বললেই চলে। চিকিৎসা করেন শুধুমাত্র রেড় ইন্ডিয়ানদের। রাত দিনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেন গবেষণার কাজে।
পেদরো জুরিতা আরও জানল, ডাক্তার সালভাদরের সম্পত্তি পাহারা দেয় এক নিগ্রো। তার সঙ্গে থাকে ভয়ালদর্শন কয়েকটা প্রকাণ্ড হাউন্ড। ইদানিং নাকি আরও ঘরকুনো হয়ে গেছেন ডাক্তার। আগে তা ও অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, এখন আর বাড়ি থেকে, বেরই হন না। কাউকে বাড়ি আসতে উৎসাহিতও করেন না।
ভেবে চিন্তে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার উপায় বের করল জুরিতা। হাজার হলেও ডাক্তার, কোন রুগীকে ফেরাতে পারবে না। রুগী সেজে ওই দেয়ালের ওপাশে একবার ঢুকতে পারলে তাকে ঠেকায় কে! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জুতাি। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
*
দড়াম দড়াম করে আওয়াজ হচ্ছে। এক নাগাড়ে লোহার দরজা পিটিয়ে চলেছে পেদরো জুরি। অনেকক্ষণ হলো সে দরজা নিয়ে পড়েছে, এত আওয়াজ অথচ আসছে না কেউ দেখতে। মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। শেষমেষ চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে একটা পাথর যোগাড় করল সে, ওটা দিয়ে দরজায় আঘাত করতে শুরু করল। প্রচণ্ড আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাবার মতো অবস্থা।
এতক্ষণে খবর হয়েছে! দরজার ওপার থেকে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় কে যেন জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার! কি দরকার?
আমি রুগী, যতটা সম্ভব গলা করুণ করে বলল জুরিতা, দরজা খুলুন।
ভেতরের লোকটা সহজে বিশ্বাস করার বান্দা নয়। বলল, রুগী অত জোর কোথায় পাবে যে এভাবে দরজা পেটাবে? তুমি রুগী নও। দরজার ফুটোয় তার চোখ দেখা গেল। একটু বিরতি নিয়ে সে বলল, ডাক্তার সাহেব এখন কারও সঙ্গে দেখা করবেন না।
খেপে গেল পেদরো জুরিতা। তপ্ত স্বরে লোকটার ওপর ঝাল, ঝাড়ার ইচ্ছে ছিল তার, কিন্তু কথা শেষ হতে না হতে দরজার ফুটোর ঢাকনি বন্ধ হয়ে গেছে।
আর এখানে থেকে কোন লাভ নেই। গলাগাল করতে করতে পা বাড়াল জুরিতা। জাহাজে ফিরে চলেছে একবার ভাবল বুয়েন্স আয়ার্সে গিয়ে ডাক্তার সালভাদরের নামে অভিযোগ করবে। কিন্তু তাতে সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ হবে কিনা তাতে গভীর সন্দেহ আছে। শেষে সিদ্ধান্ত বদলাল। আপাতত ডাক্তারের বিরুদ্ধে কিছু করার দরকার নেই।
জাহাজে ফিরে নোঙর তোলার আদেশ দিল সে। একটু পর রওনা হলো জাহাজ। বুয়েন্স আয়ার্সের দিকে যাচ্ছে।
০৫. দুপাশে ভুট্টা আর গমের খেত
দুপাশে ভুট্টা আর গমের খেত, মাঝখানে ধুলোময় রাস্তা। রোদ অগ্রাহ্য করে সেপথে হেঁটে চলেছে এক বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। ক্ষীণকায় মানুষ সে, পরনে জীর্ণ মলিন পোশাক। দুহাতে আলতো করে ধরে রেখেছে বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চাটাকে। রোদ যাতে না লাগে সেজন্যে ওর মুখ ঢেকে রেখেছে পুরোনো একটা কম্বল দিয়ে।
বাচ্চার দুচোখ আধবোজা। দেখে মনে হয় অসুস্থ। গলার এক পাশে আলুর সমান বড় একটা ফেঁড়া। সামান্য ঝুঁকিতেই কাতর স্বরে আর্তনাদ করছে। যতটা সম্ভব সাবধানে এগোচ্ছে বৃদ্ধ, তারপরও মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। তার নিজের অবস্থাও খুব একটা ভূয়। তবু বাচ্চাটার দিকে খেয়াল আছে ঠিকই। ব্যথায় কাতরে উঠলে মুখে ফুঁ দিচ্ছে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে। আপন মনে স্বগতোক্তি করল, এখন সময় মতো পৌঁছুতে পারলে হয়।
চলার গতি বাড়িয়ে দিল ক্লান্ত বৃদ্ধ! আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এক সময় এসে দাঁড়াল প্রকাণ্ড লোহার দরজাটার কাছে। বাচ্চাটাকে বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে জোরে জোরে দরজার গায়ে আঘাত করল।
দরজার ফুটোর ওপর থেকে ঢাকনি সরে গেল, ফুটোয় চোখ রেখেছে কে যেন। সামান্য বিরতি, তারপরই খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল শঙ্কিত বৃদ্ধ। সামনে সাজানো বাগান। দরজা খুলেছে এক বয়স্ক নিগ্রো। চুলগুলো ধবধবে সাদা তার, পরনের আলখেল্লাটাও একই রঙের।
ডাক্তার সাহেবের কাছে এসেছি, নরম সুরে বলল বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। বাচ্চার অসুখ।
মাথা দোলাল নিগ্রো, দরজা বন্ধ করে সঙ্গে আসতে ইশারা করে পা বাড়াল।
একটা পাথুরে চত্বরে এসে থামল ওরা। চারপাশে তাকাল বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। মনে হলো ঠিক যেন একটা জেলখানায় এসে ঢুকেছে সে। এক ধারে একটা সাদা রং করা বাড়ি। বড় বড় জানালা তাতে। সেই বাড়ির উঠানে বসে আছে বেশ কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান। তাদের মধ্যে মহিলাও রয়েছে। আর আছে বাচ্চা ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গেই বসার জায়গা হলো বৃদ্ধের। তার হাতের বাচ্চাটির মুখ ক্রমেই নীল হয়ে উঠছে। যন্ত্রণা বাড়ছে। কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় মেয়েটির মুখে ঘনঘন ফুঁ দিতে শুরু করল বৃদ্ধ।
তার পাশে বসে আছে এক বৃদ্ধা রেড ইন্ডিয়ান মহিলা। পা বেটপ ভাবে ফুলে গেছে তার। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে বৃদ্ধের কাছে জিজ্ঞেস করল, তোমার মেয়ে?
আমার নাতনী।
চিন্তা কোরো না, সব রোগের চিকিত্সাই করতে পারেন ডাক্তার সাহেব। দেখবে ঠিকই সেরে গেছে তোমার নাতনী ডাক্তার এমনকি ভূত তাড়াতেও ওস্তাদ।
কিছু বলল না বৃদ্ধ, আস্তে করে মাথা দোলাল।
তার কোলের বাচ্চাটির দিকে নজর পড়তেই এগিয়ে এলো সাদা আলখেল্লাধারী নিগ্রো বুঝতে পেরেছে শীঘ্রি বাচ্চাটিকে ডাক্তার সাহেবের কাছে না নিয়ে গেলে বাঁচবে না মেয়েটি। বৃদ্ধকে একটা। দরজা দেখিয়ে যেতে ইশারা করল সে। আপত্তি জানাল না কোন রুগী। যথাসময়ে ডাক্তার দেখবেন তাদের।
নাতনীকে কোলে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেশ বড় একটা ঘরে উপস্থিত হলো বৃদ্ধ। ঘরের মেঝে পাথরের। ঘরের মাঝখানে সাদা চাদরে ঢাকা লম্বা একটা সরু টেবিল। ওটার ওপরে বোধহয় রোগী পরীক্ষা করা হয়।
এক মুহূর্ত পরে অস্বচ্ছ কাচের একটা দরজা খুলে ঘরে এলেন ডাক্তার সালভাদর। পরনে তার সাদা আলখেল্লা। চমৎকার সুঠাম দেহ। গায়ের রং একটু ফ্যাকাশে। কুচকুচে কালো। মাথায় এক গাছি চুল নেই। পুরো টাক। দেখলে মনে হয় কামানো। মাথা কামিয়ে রাখা তার অভ্যেসও হতে পারে! নেড়া মাথার রং একেবারে মুখের রঙের মতোই। বাদামী চোখে তার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন চাহনি। পলকহীন দৃষ্টি। ব্রিত বোধ করল বৃদ্ধ ইন্ডিয়ান। সামনে ঝুঁকে সম্মান দেখাল, তারপর ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিল নাতনীকে।
বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন ডাক্তার, প্রথমেই ওর পরনের ময়লা পোশাক খুলে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেললেন। এবার মেয়েটিকে সরু টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। এককোণে জড়সড় হয়ে ডাক্তারকে দেখছে বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। তার মনে হলো সামনে এই লোকটা বুঝি ডাক্তার নয়, বিরাট একটা শকুন, ছোট্ট একটা বাচ্চা পাখির ওপর ছো মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দারুণ! আঙুল দিয়ে ফোড়াটা টিপে মন্তব্য করলেন ডাক্তার।
ভাব দেখে মনে হলো খুব আনন্দ পাচ্ছেন ফোঁড়াটা টিপতে পেরে। ডাক্তারের আচরণ কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হলো বৃদ্ধের। হাতের আঙুলগুলোও যেন কেমন। বড় বেশি দীর্ঘ।
মেয়েটিকে পরীক্ষা শেষে মুখ তুললেন ডাক্তার, বৃদ্ধকে বললেন, আজ তো অমাবস্যা। পরের অমাবস্যায় এসে তোমার রুগীকে নিয়ে যেয়ো। আশা করছি ও ভাল হয়ে যাবে।
বিদায় নিল বৃদ্ধ। মেয়েটিকে নিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। অস্বচ্ছ কাঁচের দরজার ওপাশেই আছে গোসলখানা, অপারেশন ঘর আর রুগীদের থাকার ব্যবস্থা।
*
আটাশ দিন পর হাজির হলো বৃদ্ধ। মনে তার আশা নিরাশার নিরন্তর দোল। খুবই শঙ্কিত সে। ডাক্তার সাহেব ওর নাতনীকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন তো?
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে, অস্বচ্ছ কাঁচের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ডাক্তার সাহেব, সেই সঙ্গে বাচ্চা মেয়েটি। এখন তার গায়ে নতুন জামা। ফুটফুটে একটা পরীর মতো লাগছে, দেখতে। চেহারা ফিরেছে, গালে রক্তিম আভা।
মুহূর্তের জন্যে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল বৃদ্ধ নাতনীর দিকে, তারপর ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিল। কপালে চুমু খেয়ে গ্রীবা দেখল উৎসুক চোখে। লাল একটা দাগ ছাড়া আর কিছু নেই।
কৃতজ্ঞ বৃদ্ধের দিকে চেয়ে হাসলেন ডাক্তার। এবার তাহলে এসো। একেবারে ঠিক সময়ে এসেছিলে, আরেকটু দেরি হলে আমার পক্ষে কিছু করা বোধহয় সম্ভব হতো না।
টপটপ করে জল পড়ছে বৃদ্ধের দুগাল বেয়ে। নাতনীকে বুকে, জড়িয়ে ডাক্তার সাহেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল সে। আবেগ কম্পিত স্বরে বলল, আমার নাতনীকে আপনি জীবন দিয়েছেন। জানি না এই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করব। গরীব মানুষ আমি। নিজের জীবন ছাড়া আপনাকে দেয়ার মতো আর কিছু নেই।
হাসলেন ডাক্তার আবারও বললেন, তোমার জীবন নিয়ে কি করব আমি?
বুড়ো মানুষ আমি, ডাক্তার সাহেব, বিনীত স্বরে বলল বৃদ্ধ,–আপনি আমার যে উপকার করেছেন তা শোধ দেবার ক্ষমতা আমার নেই। বাকি জীবনটুকু আমি দিতে চাই আপনার সেবা করেই যেন বাকি জীবন কাটে। অক্ষমের এই আবেদন আপনি ফিরিয়ে নিয়েন না।
চিন্তিত বোধ করলেন ডাক্তার সালভাদর। নতুন মানুষ রাখার ব্যাপারে তিনি খুবই সাবধানী। তাছাড়া নতুন কাউকে রাখার ইচ্ছেও তার আপাতত নেই। রাখলে তিনি নিগ্রো লোকই রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু এই বৃদ্ধের আন্তরিকতা তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। শেষে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হলেন। তাঁর মালী জিম বাগানটা ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারছে না একা, বৃদ্ধকে তার সহযোগী হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
ঠিক আছে, এসো তুমি, বললেন ডাক্তার, কবে থেকে কাজে লাগাতে পারবে?
আমার নাম ক্রিস্টোফার…
ঠিক আছে তাহলে, নাতনীকে রেখে চলে এসো। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।
নিরবে সায় দিল ক্রিস্টোফার, নাতনীকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
০৬. ডাক্তার সালভাদর
কদিন পরই কথামতো ডাক্তার সালভাদরের কাছে ফিরে এলো বৃদ্ধ ক্রিস্টো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করে দেখলেন ডাক্তার, তারপর বললেন, ঠিক আছে, ক্রিস্টো, তোমাকে আমি কাজে নিচ্ছি। তোমার খাবার-দাবার সব এখানেই হবে। মাইনেও ভাল পাবে।
সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানাল ক্রিস্টো। আমার তো বেতনের দরকার নেই, ডাক্তার সাহেব, আমি শুধু আপনার সেবা করতে চাই। এভাবেই আমার মৃত্যুর পর হয়তো ঋণ শোধ হবে।
বেশ, বললেন ডাক্তার, তবে একটা কথা, এখানে যা দেখবে বা শুনবে তা কখনোই বাইরে প্রকাশ করতে পারবে না।
ক্রিস্টো বলল, আমি বরং মুখ খোলার চেয়ে কুকুর দিয়ে নিজের জিভ খাওয়াব, তবু বাইরে কোন কথা বলব না।
কথা বলে নিজের সর্বনাশ না করে সেদিকে খেয়াল রেখো, বললেন ডাক্তার সালভাদর। আমার আর কিছু বলার নেই।
এবার ঢোলা পোশাক পরা নিগ্রো লোকটাকে তিনি ডাক দিলেন, সে আসতে ক্রিস্টোকে দেখিয়ে বললেন, জিম, ওকে নিয়ে বাগানের সব কাজ বুঝিয়ে দাও।
ডাক্তার বিদায় নিতে নিগ্রোর পাশে পা চালিয়ে বাইরে চলে এলো ক্রিস্টো। চত্বর পার হয়ে লোহার দরজায় টোকা দিল জিম। দরজার ওপাশে কয়েকটা হাউন্ড ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। হালকা শব্দ করে ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজাটা। ক্রিস্টো দেখল দরজার ওপাশে আরেকজন নিগ্রো দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম নিগ্রো ক্রিস্টোকে বাগানের দিকে এগিয়ে দিয়ে অজানা ভাষায় দ্বিতীয় নিগ্রোকে কি যেন বলল। কথা শেষে চলে গেল প্রথম নিগ্রো।
ভয়াবহ হিংস্র গর্জন করতে করতে আজব কয়েকটা জানোয়ার তেড়ে এলো ক্রিস্টোর দিকে। তাড়াতাড়ি দেয়ালের কাছে গিয়ে কোণঠাসা হলো ক্রিস্টো।
জানোয়ারগুলোর গায়ের রং হলদেটে। হলদের ওপর কালো কালো ছোপও আছে। পম্পাস প্রেয়ারিতে এদের দেখতে পেলে ক্রিস্টো নিশ্চিত ভাবেই এগুলোকে কুগার ভাবত। আশ্চর্য! দেখাত বাঘের মতো হলেও এদের ডাক একেবারেই কুকুরের মতো। কিন্তু এতসব খেয়াল করার মানসিক অবস্থা এখন ক্রিস্টোর নেই জীন বাঁচানো ফরজ। তাড়াতাড়ি ক্রিস্টো একটা উঁচু গাছে চড়ে বল।
বাগানের নিগ্রো মালীক মুখ দিয়ে একরকম চাপা শব্দ করল, যেন সাপ ফুসছে। সঙ্গে সঙ্গে জল্পগুলো একেবারে শান্ত সুবোধ হয়ে গেল। গর্জন তো থেমেছেই, এবার সামনের দুপায়ের ওপর মাথা রেখে তারা শুয়ে পড়ল। সবকটার চোখ নিগ্রো মালীর দিকে।
ক্রিস্টোকে গাছ থেকে নামতে ইশারা করল নিগ্রো। ক্রিস্টো নামতে রাজি নয়। গাছের ওপর থেকেই বলল, তোমার কি জিভ নেই, ভাই? অমন সাপের মতো হিসহিস আওয়াজ করছ কেন? আমাকেও তো শুধু ইশারা করছ দেখছি!
ক্রিস্টোর কথার জবাবে নিগ্রোর মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বের হলো শুধু।
ডাক্তার সালভাদরের সতর্কবাণী ওর মনে পড়ে গেল। হতে পারে নিগ্রোটা আসলেই বোবা। ভেতরের কথা যাতে বাইরে না যায় সেজন্যে ডাক্তার হয়তো চাকরদের জিভ কেটে নেন। এই নিগ্রোরও হয়তো জিভটা গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে ক্রিস্টো। ফলে অসতর্ক হয়ে পড়ছে। আরেকটু হলেই গাছ থেকে পড়ে যেত। এখন ওর মাথায় শুধু এখান থেকে পালানোর চিন্তা ঘুরছে। গাছটা থেকে দেয়ালটা কতদূরে সেটা আন্দাজ করে দেখল সে, না ওই দেয়াল যথেষ্ট দূরে। দেয়াল টপকে পালাবার উপায় নেই। বিপদের ওপর বিপদ! গাছের নিচে এসে নিগ্রো ব্যাটা ক্রিস্টোর পা ধরে টেনে নামাতে চাইছে। আর কোন উপায় নেই দেখে আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্যে লাফ দিয়ে গাছ থেকে নামল ক্রিস্টো, মুখে হাসি টেনে এনে নিগ্রোর সঙ্গে করমর্দন করতে করতে জিজ্ঞেস করল, তোমার নামই তো জিম?
মাথা দুলিয়ে সায় দিল নিগ্রো। তার সঙ্গে করমর্দন করতে করতে ক্রিস্টো ভাবল, দোজখে যখন হাজির হয়েই গেছি তো ইবলিশকে যতটা সম্ভব হাতে রাখাই ভাল। মুখে বলল, তুমি কি বোবা, ভাই?
জবাব দিল না নিগ্রো। ক্রিস্টো আবার জিজ্ঞেস করল, জিভ নেই। তোমার?
এবারও চুপ করে আছে নিগ্রো।
নিগ্রোর মুখের ভেতরটায় একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পারলে বোঝা যেত, ভাবল ক্রিস্টো। কিন্তু জিমের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে না খাতির জমানোর কোন ইচ্ছে তার আছে। ক্রিস্টোর হাত আঁকড়ে ধরে হলদে বাঘা কুকুরগুলোর কাছে ওকে নিয়ে চলল নিগ্রো। মুখ দিয়ে আবার হিসহিস আওয়াজ করল। আওয়াজটা শুনতেই উঠে এগিয়ে এলো জম্ভগুলো, ক্রিস্টোকে একবার এঁকে দেখে শান্ত ভাবে চলে গেল। এতক্ষণে আটকে রাখা দম ছাড়ল ক্রিস্টো।
এবার জিম তাকে নিয়ে চলল বাগান দেখাতে। পাথর দিয়ে বাধানো চত্বর পার হয়ে বাগানটা দেখে অবাক হয়ে গেল ক্রিস্টো। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সাজানো গোছানো। ফুলে ভরে আছে গাছ। মিষ্টি গন্ধ বাতাসে। লাল ঝিনুকের গুঁড়ো ফেলা পথে হাঁটছে ওরা। কখনও কখনও গাছের সারির মাঝ দিয়ে গেছে পথ। বাগান না মাড়িয়ে পুরোটা ঘুরে দেখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কি গাছ নেই বাগানে! ফুলের সমারোহ তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে হরেক ফলের গাছ। পীচ, জলপাই আর মূল্যবান আগাভা গাছ বাগানে ছায়া দিচ্ছে। ছায়ার নিচে রঙিন ফুলে ভরা ঘন ঘাসে ঢাকা লন। সেই লনের মাঝে একটু পরপর সুন্দর ছোট জলাশয়। সেই জলাশয়গুলো থেকে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে ফোয়ারার সূক্ষ্ম পানির কুয়াশা। পানির কারণে পরিবেশটা স্নিগ্ধ আর শীতল লাগছে। মনে হচ্ছে এ যেন পৃথিবীর বুকে স্বর্গ।
হরেক রকমের পাখি কিচিরমিচির করে বাগানটাকে প্রাণের প্রাচুর্য দিয়েছে। নানা রকম জন্তুও আছে। তারাও ডেকে ডেকে নিজেদের–অস্তিত্ব জাহির করছে। এত রকমের প্রাণী আগে কোথাও কখনও দেখেনি ক্রিস্টো।
হলদে-সবুজ রঙের ঝিলিক দেখিয়ে এই মাত্র ছুটে চসে গেল। একটা ছয় পাওয়ালা গিরগিটি। একটা গাছে অলস ভাবে ঝুলছে একটা দুমুখো অজগর সাপ। সাপটা হিসহিস আওয়াজ করতেই ভয়ের চোটে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল ক্রিস্টো। কিন্তু জিম যেই আরও জোরে হিসহিস আওয়াজ করল, অমনি অজগর চট করে লুকিয়ে পড়ল ঘন পাতার আড়ালে। একটু পরই দুটো পাওয়ালা একটা সাপও দেখতে পেল ক্রিস্টো। লোহার জালের খাঁচায় একটা শুয়োর ছানা দেখা গেল। তার কপালে মাত্র একটাই চোখ।
লাল ঝিনুকের গুঁড়া মেশানো পথ ধরে ছুটে গেল দুটো সাদা ইঁদুর। ওদের দেহ একই সঙ্গে–জমজ। একটাই দেহ, কিন্তু মুখ দুটো। আটটা পা। ওদের মাঝে একটু পর পর, মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। ডানেরটা যেতে চাইছে বাঁয়ে, আবার বাঁয়েরটা যেতে চাইছে ডানে। ইচ্ছে পূরণ না হওয়ায় রাগ করে দুটোই কিচকিচ করে বিরক্তি প্রকাশ করছে। মাঝে মাঝে লড়াই বাধছে। শেষ পর্যন্ত মনে হলো এবারের লড়াইয়ে ডানেরটা জিতেছে। কারণ বয়ে যাচ্ছে ওরা এখন।
ইঁদুরদের মতোই জোড়া লাগা দুটো ভেড়াকেও দেখা গেল। ওরা। ইঁদুরদের মতো ঝগড়া করছে না। মতামতের ব্যাপারগুলো এরা বোধহয় আগেই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধা করে ফেলেছে। এবার দেখা গেল একটা রোমহীন গোলাপী কুকুর। ওটার পিঠের ওপর বাদরের মতো কি একটা জীব। ওটা মাথা নাড়ছে সর্বক্ষণ। সেই সঙ্গে চাপড় মারছে কুকুরটার পিঠে। ক্রিস্টোকে দাঁত খিচাল বাঁদরটা। পকেট থেকে লজেন্স বের করে ওটাকে দিতে যাচ্ছিল ক্রিস্টো, কিন্তু কে যেন ঝাঁপটা দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টো, আর কেউ নয়, নিগ্রো জিম। লোকটা ইশারায় বুঝিয়ে দিল বাঁদরটাকে খাবার দেয়া চলবে না। লজেন্সটা আবার পকেটে রাখবে সেই সৌভাগ্য হলো না ক্রিস্টোর। টিয়া পাখির মতো মাথাওয়ালা একটা চড়ই কোখেকে যেন উড়ে এসে লজেন্সটা কেড়ে নিয়ে দূরের একটা ঝোপে গিয়ে বসল। পাখির কাণ্ড দেখে খুব মজা পেল ক্রিস্টো।
এ এক আশ্চর্য বাগান! আজব যত জন্তুর সমারোহ এখানে। দূরে একটা ঘোড়া বাঁ-বাঁ করে ডেকে উঠল। ক্রিস্টো খেয়াল করে দেখল ঘোড়াটার মাথাটা অবিকল গরুর মতো।
ঘোড়ার মতো লেজ দুলিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল দুটো লামা। ঘাসের মাঝে থেকে, গাছের ভেতর থেকে বিচিত্র সব প্রাণী উঁকি দিয়ে ক্রিস্টোকে দেখছে। বেড়ালের মুণ্ডওয়ালা কুকুর, মোরগের মুণ্ডুওয়ালা হাঁস, শিংওয়ালা শুয়োর, ঈগলের ঠোঁট সমেত উট পাখি, পুমার মতো দেহের ভেড়া–কি নেই তাদের মধ্যে।
স্বপ্ন দেখছি না তো! মনে হলো ক্রিস্টোর। জোরে জোরে দুচোখ কচলে আবার চারপাশে তাকাল। মাথায় দিল ফোয়ারার সুশীতল পানি। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে মাথাটা তার আরেকটু গরম হলো। মাছের পাখনা আর মাথাওয়ালা সাপ, ব্যাঙের মতো পা সহ মাছ, টিকটিকির মতো লম্বা কোলাব্যাং–কি নেই!
সব দেখেশুনে পালিয়ে যাবার মতলবটা জোরাল হয়ে উঠল ক্রিস্টোর মনে। একি আজব পাগলের এলাকা। এখানে থাকলে কখন কি বিপদ ঘটবে বলা যায় না!
বালিময় প্রশস্ত একটা চত্বরে ক্রিস্টোকে নিয়ে এলো জিম। চত্বরের মাঝখানে খেজুর গাছ। গাছগুলোর ছায়ায় মুর স্থাপত্যরীতিতে গড়া একটা শ্বেতপাথরের বাড়ি। খেজুর গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে বাড়িটার থাম আর খিলান দেখা যাচ্ছে। সামনে একটা ফোয়ারা! সেটা থেকে, চারদিকে সূক্ষ্ম পানির কণা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে! ফোয়ারাটা তামার তৈরি। আকৃতি একেবারেই ডলফিনের মতো। ফোয়ারার নিচের জলাশয়ে সাঁতার কাটছে অসংখ্য সোনালী মাছ! সদর দরজার কাছে যে বড় ফোয়ারাটা আছে, সেটার মাঝখানে ক্রিস্টো দেখল ভলফনের পিঠে বসা এক তরুণের মূর্তি। মনে হয় উপকথার কোন দেবতা হবে। বোধহয়। দেবতার মুখে একটা বড় শঙ্খ। আশ্চর্য শিল্পকর্ম। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় যেন জীবন্ত। অত্যন্ত প্রতিভাবান কোন শিল্পির হাতে কাজ নিঃসন্দেহে।
শ্বেতপাথরের বাড়ির পেছনে বেশ কয়েকটা থাকার ঘর আছে। সেগুলোর পেছন থেকে শুরু হয়েছে ফণীমনসার কাঁটাভরা ঝোপ-জঙ্গল। দেয়ালের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে সে জঙ্গল।
হাঁটতে হাঁটতে ক্রিস্টোর সামনে আরও একটা দেয়াল পড়ল। শ্বেতপাথরের বাড়িটার পেছনের একটা ঘরে ক্রিস্টোকে নিয়ে এলো, জিম, ইশারা করে বুঝিয়ে দিল এই ঘরটিই তার থাকার জায়গা হিসেবে বরাদ্দ হয়েছে।
০৭. উদ্ভট বাগান আর বিদঘুটে পরিবেশ
এই উদ্ভট বাগান আর বিদঘুটে পরিবেশে শেষ পর্যন্ত নিজেকে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হলো না ক্রিস্টোর। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে বোধ করলেও শিগগিরই কাটিয়ে উঠল তা। বাগানের জম্ভ-জানোয়ার, পাখি আর সরীসৃপ যা আছে সবই আসলে পোষ মানা। কয়েকটা জানোয়ারের সঙ্গে তো রীতিমতো খাতির হয়ে গেল ক্রিস্টোর। কুগারের মতো দেখতে যে কুকুরগুলো ক্রিস্টোর আত্মার পানি শুকিয়ে দিয়েছিল সেগুলো এখন ক্রিস্টোর গায়ের কাছ ঘুরঘুর করে, সুযোগ পেলে গা চেটে কৃতজ্ঞতা জানায়। লামাগুলো ক্রিস্টোর হাত থেকে খেতে আনন্দ পায়। টিয়া পাখির দল উড়ে এসে ক্রিস্টোর কাধে বসে।
বাগান পরিচর্যায় আছে বারোজন নিগ্রো। তারা প্রত্যেকেই জিমের মতোই নির্বাক। কখনোই তাদের কোন কথা বলতে শোনেনি ক্রিস্টো। এমনকি নিজেদের মধ্যেও তারা কথা বলে না। চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যায় তারা। অবশ্য কাজের চাপ এততাই যে কথা বলার মতো। সময় বের করাও প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। সবার সর্দার জিম। সে-ই সবার কাজ ভাগ করে দেয়। কে কি করল, কিভাবে করল সেই নজরদারিত্বের দায়িত্ব জিমের।
ক্রিস্টোকে এই জিমেরই সহকারীর পূদ দেয়া হলো। কাজ ওর বেশি নয়। এখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও চমৎকার। কোন অসুবিধে নেই কোথাও, সুন্দর ভাবে কেটে যাচ্ছে জীবন। কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে মাঝে মাঝেই খোঁচায়। আচ্ছা, নিগ্রো লোকগুলো কথা বলে না কেন? ক্রিস্টোর মনে বিশ্বাস, জন্মেছে যে ডাক্তার সালভাদর ওদের জিভ কেটে নিয়েছেন। বিশ্বাসটা ওর মনে এততাই প্রভাব ফেলেছে যে ডাক্তার সালভাদর ডেকে পাঠালেই ওর বুকের ভেতরটা ধরা পড়া চড়ুই পাখির বুকের মতো কাঁপতে শুরু করে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ভাবে, এইবার বুবি জিভটা গেল। তবে ক্রিস্টোর ভাগ্যে তেমন মর্মান্তিক কিছু ঘটল না। দিনের পর দিন যখন তার জিভ কাটা হলো না তখন আস্তে আস্তে তার ভয়টা কমে গেল।
একদিন ক্রিস্টো দেখে একটা জলপাই গাছের নিচে সেঁটে ঘুম দিয়েছে জিম। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। এই তো সুযোগ। পা টিপে টিপে কাছে চলে গেল ক্রিস্টো। দেখতে হবে এই সুযোগে, জিমের জিভ আছে কি নেই। আশ্চর্য হতে হলো ওকে : জিমের জিভ যথাস্থানে। সগৌরবে অবস্থান করছে।
এই দেখে ক্রিস্টোর মাথা থেকে বিরাট একটা দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেল।
ডাক্তার সালভাদর একেবারে ঘড়ির কাটা ধরে চলেন। সকাল সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত তার রুগী দেখার সময়। নটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত তাঁর অস্ত্রোপচারের সময়। এরপর তিনি চলে যান নিজের বাড়িতে। সেখানে তিনি একা একা ল্যাবোরেটরিতে কাজ করেন। নানা পরীক্ষা তিনি করে থাকেন। কোন কোন পরীক্ষায় দরকার পড়ে জীবজন্তু। সেগুলোর ওপর অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রপচার বা অঙ্গ পুনস্থাপনের পর দীর্ঘ সময় নিয়ে রুগীকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। তিনি সন্তুষ্ট হলে তবেই সেই জন্তুকে বাগানে পাঠান।
ঘর পরিষ্কার করার সুযোগে ক্রিস্টো একবার। ল্যাবরেটরির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেছে, বিস্ময়ে চোখ দুটো আরেকটু হলে গর্ত থেকে খুলে আসত তার। টেস্ট টিউবের কোন অভাব নেই ঘরে। সেগুলোতে নানা তরল। সেই তরলে চুবিয়ে রাখা হয়েছে হরেক প্রাণীর অঙ্গ। সেগুলো প্রত্যেকটিই জীবন্ত, সজীর, নড়ে চড়ে। কোন অঙ্গ যদি স্পন্দিত না হয় তাহলে ডাক্তার আবার সেই অঙ্গে প্রাণের সঞ্চালন করেন।
ঘটনা দেখে ক্রিস্টোর চক্ষু চড়কগাছ। তার ওপর এতই আতঙ্ক ভর করল যে লাববারেটরির ধারেকাছে না গিয়ে সে বাগানের অদ্ভুত জন্তুদের মাঝে সময় কাটানোই বেশি নিরাপদ মনে করল।
ক্রিস্টোকে ডাক্তার সালভাদর বিশ্বাস করলেও তৃতীয় দেয়ালের ওপাশে যাওয়ার অধিকার তাকে দেননি। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। সে কারণেই তৃতীয় দেয়ালের ওপারে কি আছে জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে ক্রিস্টো। দুপুরে সবাই যখন বিশ্রাম নেয়, ক্রিস্টো তখন যায় ওই দেয়ালের কাছে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে রেড-ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের গলার স্বর। তাদের সঙ্গে চিকন গলায় কারা। যেন কথা বলে ভাষাটা একেবারেই অপরিচিত। কি বলে কিছু বুঝতে পারে না ক্রিস্টো। কৌতূহল বেড়ে যায় আরও।
একদিন ওর আশা পূরণ হলো। বাগানে ওকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন ডাক্তার। বললেন, একমাস হলো তুমি এখানে কাজ করছ, ক্রিস্টো। আমি তোমার কাজে খুশি হয়েছি। আমার ওদিকের বাগানের এক মালী অসুস্থ, ভাবছি তার জায়গায় তোমাকেই ওখানে পাঠাব কিনা। অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। একটা কথা মনে রেখো, আগেও বলেছি, যা কিছু দেখবে, যা কিছু শুনবে, বলতে পারবে না কাউকে। সেই কথাগুলো মনে আছে তো?
ক্রিস্টো জবাবে বলল, আপনার বোবা কর্মচারীদের সঙ্গে থেকে থেকে আমিও কথা বলা প্রায় ভুলে গেছি। কোন অসুবিধা হবে না, ডাক্তার সাহেব।
তবে তো ভালই হয়েছে, বললেন ডাক্তার। কথা না বললে সৌভাগ্যবান হওয়া যায়। প্রসঙ্গ পাল্টালেন। আচ্ছা ক্রিস্টো, আন্দেজ পাহাড়ী অঞ্চলটা কেমন চেনো তুমি?
ভাল। ওখানেই তো আমার জন্ম।
চমৎকার। আমার কিছু নতুন জন্তু-জানোয়ার দরকার। ওখানে যেতে হবে। আমার সঙ্গে তুমিওস্তাবে।…এখন যাও তাহলে, জিম তোমাকে ওদিকের বাগানের কাজ বুঝিয়ে দেবে।
দেয়ালের ওপাড়ে গিয়ে ক্রিস্টো যা দেখল তা ওর সমস্ত কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেল।
প্রকাণ্ড একটা মাঠের মধ্যে রোদের ভেতর খেলা করছে একদল উলঙ্গ শিশু। সবাই রেড ইন্ডিয়ান। তাদের সঙ্গে আছে বাদরের দল। শিশুদের সবাই ডাক্তার সালভাদরের রুগী। অনেকের দেহেই। অস্ত্রপচারের দাগ রয়েছে। সালভাদর ওদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন।
ক্রিস্টো বেশি অবাক হলো বাঁদর দেখে। এখানের বাঁদর কথা বলে। শিশুদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে ওরাও কিচির-মিচির করে প্রতিবাদের সুরে কি যেন বলে। তর্কও করে। যতই ঝগড়া করুক, একটু পরই মিটে যায় সব। মিলেমিশে মহা আনন্দে আছে সবাই। জীবনটা এখানে ওদের মস্ত একটা দীর্ঘ মজাদার খেলা।
এ বাগানটা আগের বাগানের চেয়ে আকারে ছোট। বাগানের একদিক সরাসরি নেমে গেছে সাগরে। ওই জায়গাটা পাহাড়ী। খাড়া একটা পাহাড় সমুদ্রে ওখানে নাক ডুবিয়েছে। ক্রিস্টো বুঝল, ওই পাহাড়ের ওপারেই আছে সাগ। দূর থেকেও ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জন শুনতে পাওয়া যায়।
পাহাড়টা কয়েকদিন দেখে তারপর ক্রিস্টো বুঝতে পারল ওটা আসল নয়, মানুষের নির্মিত পাহাড়। দেয়ালের কাজ দিচ্ছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে ঘন ঝোপ-ঝাড় জন্মেছে। তার ফাঁক দিয়ে ধূসর একটা দরজাও চোখে পড়ল ওর।
কৌতূহল ক্রিস্টোর একটু বেশিই। দরজার গায়ে একদিন কান পাতল সে। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কিছুই সে শুনতে পেল না। ওই ফটকের ওপারে সম্ভবত সাগর সৈকত আছে।
হঠাৎ শিশুদের উত্তেজিত চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল ও। আকাশের দিকে চেয়ে আছে সবাই। কোন এক ছেলের একটা লাল বেলুন হাত থেকে ফস্কে গেছে বোধহয়। ওটা ধীরে ধীরে হেলেদুলে উঠে যাচ্ছে আকাশের গায়ে। একটু পরই এত ওপরে উঠে গেল যে আর দেখাই গেল না।
সাধারণ একটা বেলুন। কিন্তু কেন কে জানে চিন্তিত হয়ে পড়ল ক্রিস্টো। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে শুরু করল। এদিকে যার জায়গায় ও এই বাগানে কাজে এসেছে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করল ক্রিস্টো, বলল, আমি কয়েক দিনের জন্যে আন্দেজ পর্বতে যেতে চাই। ফিরতে হয়তো কিছুদিন দেরি হতে পারে। মেয়ে আর জাতনীর কথা খুব মনে পড়ছে।
শীতল চোখে ক্রিস্টোকে দেখলেন ডাক্তার সালভাদর, তারপর আরও ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার সেই শর্তের কথা যেন মনে থাকে। মুখ একদম বন্ধ রাখবে। তোমাকে তিন দিনের ছুটি দেয়া হলো। এর মধ্যেই ফিরে আসবে। একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, তুমি। এখানে একটু দাঁড়াও। পাশের ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন হাতে একটা চামড়ার থলে নিয়ে! থলের ভেতর ঝনঝন আওয়াজ করল সোনার মোহর। থলেটা তিনি ক্রিস্টোর হাতে দিলেন। বললেন, এটা তোমার নাতনীর জন্যে। আর ভাল কাজ করেছ তুমি এ কদিন। মুখ বন্ধ রেখো। মনে কোরো এই টাকার একটা অংশ তোমার মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।
০৮. পুরু গোঁফে তা দিতে দিতে
পুরু গোঁফে তা দিতে দিতে অস্থির পায়ে পায়চারি করছে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা। তার পরনে এখন শহুরে পোশাক। মাথায় পানামা হ্যাট। তার সামনেই দাঁড়িয়ে বালথাযার।
বুয়েন্স আয়ার্স শহরের প্রান্তে যেখানে কৃষিজমি শুরু হয়েছে সেখান থেকেই পম্পাস প্রেয়ারির শুরু। শুধু ঘাস আর ঘাসজমি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে পেদরো বলে উঠল, সে যদি আজকেও না আসে তাহলে তোমার ভরসায় আর থাকা যাবে না, আরও দক্ষ আর যোগ্য কাউকে পাঠাতে হবে আমার।
মাথা নিচু করে ঘাসের ডগা ছিড়ছে বালথাযার অপরাধী ভঙ্গিতে। এখন তার আফসোস হচ্ছে কেন ডাক্তার সালভাদরের বাড়িতে গুপ্তচর হিসেবে নিজের বড় ভাইকে পাঠাল। বড় ভাই ওর চেয়ে দশ বছরের বড়, কিন্তু স্বভাবে মানুষটা অস্থির প্রকৃতির। তার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় না। ক্রিস্টোর কথা চিন্তা করে বালথাযার ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করল।
তোমার কি মনে হয়, বলল পেদরো! যে, বেলুনটা তুমি ছেড়েছিলে সেটা তোমার ভাইয়ের চোখে পড়েছে?
জবাব কি দেবে ঠিক করতে পারল না বালথাযার। এখন তার ইচ্ছে করছে এই ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে।
একটু পর টিলার ওপরে দেখা গেল ধুলো। কে যেন আসছে। সুরও ভঁজছে মৃদু স্বরে শিস দিয়ে।
মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠল বালথাযার! বলল, ওই তো! ও এসে, গেছে!
এলো তাহলে, আগের চেয়ে একটু উষ্ণ গলায় বলল দেরো।
দ্রুত পায়ে আসছে ক্রিস্টো ওদের দিকে। এখন তাকে বৃদ্ধ একটা রুগ্ন ভীতু রেড ইন্ডিয়ান বলে মনে হচ্ছে না, যেন চপল কোন তরুণ। শিস দিতে দিতে মন ভরা ফুর্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে। পেদরো আর বালথাযারের সামনে এসে থামল।
সরাসরি কাজের কথায় এলো পেদরো। সাগর-দানোর কোন খবর পাওয়া গেল?
না। এখনও কিছু পাইনি। তবে এটা ঠিক যে সে ওখানেই আছে। ডাক্তার তাকে একটা দেয়ালের ওপাশে রাখে। সেখানে যাওয়া সহজ নয়। অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। ডাক্তার এখন আমাকে বিশ্বাস করে। ঠিকই কাজ উদ্ধার করে আসতে পারব। নাতনীর উদ্বিগ্ন দাদা সেজে যে অভিনয়টা করেছিলাম তাতে পুরোপুরি পাশ করেছি আমি। ডাক্তারের মনে কোন সন্দেহই হয়নি।
নাতনী জোটালে কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করল পেদরো।
হাসল ক্রিস্টো। টাকা জোগাড় করতে যত কষ্ট। মেয়ে জোগাড় করা আর কতক্ষণের ব্যাপার। আমাদের দুপক্ষেরই উপকারও হলো মাঝখান থেকে। আমি পেলাম টাকা আর মেয়েটার মা পেল সুস্থ মেয়ে। নিজের ব্যাপারে ক্রিস্টো এতই তৃপ্ত যে মুচকি মুচকি হাসছে।
ডাক্তারের কাছ থেকে সোনার মোহর পাওয়ার কথাটা সে। বালথাযার আর পেরোকে জানাল না। মোহরের ভাগ কাউকে দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার।
ধীরেসুস্থে পেদরো আর বালথার্যারকে সে খুলে বলল ডাক্তারের বাগানের আজব অভিজ্ঞতা। তার কথা শেষ হওয়ার পর পেদরো জুরিতা বিরক্ত হয়ে বলল, এসব তো শুনলাম। আসল কাজের কি হবে! সাগর-দানোর খবরটাই তো তুমি আনতে পারলে না। কিছু ভেবেছ কিভাবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে?
ক্রিস্টো বলল ডাক্তার সাহেব আর কয়েকদিনের মধ্যেই আন্দেজ পর্বতে যাবেন পশু-পাখি সংগ্রহ করতে, তখন যদি বা কিছু করা যায়।
কথাটা শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল পেদরো জুরিতা। বলল, দারুণ! সালভাদরের বাড়ি জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সে যখন থাকবে না তখন হামলা চালাব আমরা, সাগর-দানোকে ধরে পাকড়াও করে নিয়ে আসব।
আপত্তির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ক্রিস্টো। অসম্ভব নয়। ডাক্তারের পোষা কুগারগুলো আপনাকে স্রেফ ছিঁড়েখুঁয়ে খেয়ে ফেলবে। তাছাড়া সাগর-দানো কোথায় থাকে সেটা এতদিন ওখানে থেকেও আমি এখনও জানতে পারিনি। হঠাৎ করেগিয়ে আপনি তাকে পাবেন কি করে!
কিছুক্ষণ জ্ব কুঁচকে ভাবল পেদরো, তারপর বলল, তাহলে আরেক কাজ করা যায়। সালভাদর যখন শিকারে যাবে সেই সুযোগে তাকে আমরা বন্দি করব। মুক্তিপণ হিসেবে তার কাছে সাগর-দানোকে দাবি। করব।
পেদরোর কোটের পকেট থেকে একটা চুরুটের প্রান্ত বেরিয়ে আছে। এটা দেখতে পেয়েই আলগোছে হাতে তুলে নিল ক্রিস্টো, চুরুটটা ধরিয়ে বুক ভরে ধোয়া টেনে নিয়ে অলস গলায় বলল, বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু কথা রাখবে না সালভাদর। বলবে সাগর-দানোকে দেব, কিন্তু আসলে দেবে না। ওর মতো স্প্যানিশগুলো উহ উহহু… খারাপ
একটা কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না ক্রিস্টো চুরুটের ধোঁয়ায়। কাশি পাওয়ায়।
তাহলে কি করা উচিত? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল জুরিতা।
ধৈর্য ধরতে হবে, বলল ক্রিস্টো। ধৈর্য ধরতে হবে, ক্যাপ্টেন। ডাক্তার আমাকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসের সীমা ওই চার নম্বর দেয়াল পর্যন্তই। বিশ্বাসটা আরও বাড়ক, নিজের লোকদের মতোই বিশ্বাস করতে শুরু করুন, নিশ্চয়ই তিনি সাগর-দানোকে দেখাবেন।
সে তো সময়ের ব্যাপার, হতাশ গলায় বলল পেদরো জুরিতা। তাহলে কি করা?
বুকের মাঝে আঙুল দিয়ে টোকা দিল ক্রিস্টো। ডাকাত পড়বে। ডাক্তারের যাত্রায়। আর মামি ভূমিকা নেব আরাউকানি প্রভুভক্ত এক সাহসী রেড ইন্ডিয়ানের। আমি ডাক্তারকে বাঁচাব। এর ফলে আমি তার আরও বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠব। তাহলেই আমার জানা হয়ে যাবে ডাক্তারের আস্তানার গোপন সব খবর।
বুদ্ধি খারাপ না, বলল পেদরো জুরিতা।
ক্রিস্টো কোন রাস্তা দিয়ে ডাক্তার সালভাদরকে নিয়ে পাহাড়ে যাবে সেকথা জুরিতাকে বলে দিল ক্রিস্টো আরও বলল রওনা হবার আগের দিন দেয়ালের ওপাশে একটা লাল পাথর ছুঁড়ে সে জানিয়ে দেবে যে তারা রওনা হচ্ছে আগামীকাল।
ক্রিস্টোর পরিকল্পনা নিটোল হলেও একটুর জন্যে মার খেয়ে যাচ্ছিল। পম্পাস প্রেয়ারির গাউচা উপজাতীয়দের মতোই পোশাক পরে ছদ্মবেশ ধরল পেদরো জুরিতা। বালথাযার বন্দর এলাকা থেকে ভাড়া করে আনল জনা দশেক মার্কামারা খুনী। প্রত্যেকেই সশস্ত্র।
অপেক্ষা করছে তারা সালভাদরের বাড়ির কাছ থেকে খানিক দূরে এক। সুবিধে মতো জায়গায়।
প্রত্যেকের কান খাড়া। ডাক্তার এলে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যাবে। সবই ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু ক্রিস্টো জানে না আগের মতো আর ঘোড়ায় চড়ে শিকারে যান না ডাক্তার। এখন তিনি মোটর গাড়ি ব্যবহার করেন।
একটু পরই গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে। তারপর দেখা গেল হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো। পেরার দল কিছু বোঝার আগেই চোখের পলকে ওদের পাশ কাটাল গাড়িটা। পেনরোরা ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ওগুলোর সাধ্য নেই গাড়ির গতির সঙ্গে পাল্লা দেয়। নিরুপায় হয়ে এ ওর দিকে তাকাল তা।
খিস্তিখেউড় শুরু করল পেদরো। বালথাযার হাসছে। পেরোকে সান্ত্বনা দিল, চিন্তার কিছু নেই। নির বেলা গরম হলে ডাক্তার রাতে বেরিয়েছেন। কিন্তু দিনে তো? কোথাও না কোথাও বিশ্রাম নিতে হবে। সেসময়ে তাকে আটক করব আমরা।
বালথাযারের পরামর্শে ঘোড়া নিয়ে এগোল পেদরো ভাড়া করা ডাকাত-দল। ধীরেসুস্থে চলেছে তারা। দুই ঘণ্টা পর সামনে একটা অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেল। সবাইকে থামতে নির্দেশ(দিল বালথাযার। বলল, ব্যাপারটা কি বোঝা দরকার। সবার যাওয়ার দরকার নেই। আমি একা গিয়ে দেখে আসি ঘটনা কি?
ঘোড়া থেকে নেমে ক্রল করে এগোল বালথাযার। অন্ধকারে তাকে আর একটু পরই দেখা গেল না। ফিরল সে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। যা জানাল তা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, ডাক্তারের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, সেটা এখন মেরামত চলছে। ক্রিস্টো ডাক্তারের সঙ্গেছে। পাহারা দিচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, হাতে বেশি সময় নেই। গাড়ি মেরামত হয়ে গেলেই আর ডাক্তারকে ধরা যাবে না সহজে।
এবার খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করল একের পর এক উত্তেজনাময় ঘটনা। পেদরো জুরিতার ভাড়াটে ডাকাতরা হঠাৎ করেই হামলা করে বসল ডাক্তার সাহেবের শিকারী দলের ওপর। মুহূর্তে বন্দি হয়ে গেলেন ডাক্তার। ক্রিস্টো আর ডাক্তারের তিন সহকারীও বাদ গেল না। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হলো তাদের। ক্যাপ্টেন পেদরো নিজেকে আড়ালে রেখেছে, যাতে তার জড়িত থাকা ডাক্তার না জানেন। ভাড়াটে ডাকাতদের মাধ্যমে ডাক্তারের কাছে মোটা অংকের মুক্তিপণ চেয়ে পাঠাল সে।
টাকা যা লাগে দেব, বললেন ডাক্তার, কিন্তু আমাদের ছেড়ে দাও।
এক ডাকাত বলল, বুঝলাম তোমার জন্যে টাকা দেবে। তোমার সঙ্গীদের জন্যে কিন্তু আলাদা ভাবে টাকা দিতে হবে।
কি একটু চিন্তা করলেন ডাক্তার, তারপর সত্যি কথাটাই বললেন, সবার টাকা একসঙ্গে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
একথা শুনে ডাকাতদের সর্দার চড়া গলায় বলল, তাহলে ওদের মরতে হবে। আর আমাদের ইচ্ছে মোতাবেক চলতে হবে তোমাকে, নইলে কাল ভোর হবার আগেই খতম করে দেব?
আমার অত টাকা নেই, সরাসরি স্বীকার করলে ডাক্তার।
সালভাদর ভয় পাননি মোটেও। তাঁর দৃঢ়তা ডাকাতদের অবাক–করল।
বন্দিদের বেঁধে রেখে টাকার সন্ধানে খোঁজাখুঁজি শুরু করল ডাকাতরা। গাড়ির পেছনের সীটের তলায় পাওয়া গেল খানিকটা স্পিরিট। মাতলামির শখ চাপল ডাকাতদের। মদের বদলে স্পিরিট গিলতে শুরু করল তারা বেহিসাবী মাত্রায়। একটু পরই কারও আর হুঁশজ্ঞান থাকল না।
ভোর হওয়ার আগে সালভাদরের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এলো এক লোক। সে আর কেউ নয়, ক্রিস্টো। ফিসফিস করে বলল, আমার বাঁধন খুলে ফেলেছি। ডাক্তার সাহেব, যে ডাকাতের কাছে বন্দুক ছিল তাকে মেরে ফেলেছি। অন্যরা নেশার ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। ড্রাইভারের বাঁধনও আমি খুলে দিয়েছি। গাড়ি নিয়ে সে তৈরি। এঞ্জিন মেরামত হয়ে গেছে। চলুন শিগগির। তাড়াতাড়ি!
দেরি না করে গাড়িতে ঢুকে বসল ডাক্তার সালভাদরের শিকারি দল। গাড়ি স্টার্ট দিল নিগ্রো ড্রাইভার। খুব দ্রুত স্পীড নিল গাড়ি, সাঁ সাঁ করে ছুটে চলল ঝড়ের বেগে। আবেগে কম্পিত হাতে ক্রিস্টোর হাত চেপে ধরলেন ডাক্তার।
বিরাট একটা সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে গেল পেদরো জুরিতার। কিন্তু আর উপায়ই বা কী! ক্রিস্টোর কাছ থেকে অনুকূল পরিবেশের খবর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা তাকে করতেই হবে।
০৯. ক্রিস্টোর মনে আশা জেগেছিল
ক্রিস্টোর মনে আশা জেগেছিল, সে যা করেছে তাতে করে ওকে একেবারে বুকে টেনে নেবেন ডাক্তার সালভাদর বলবেন তাঁর সমস্ত রহস্য। হয়তো এটাও বলতে পারেন যে এসো, ক্রিস্টো, তোমাকে আমার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটা দেখাই। আমার সাগর-দানো দেখে তাজ্জব হয়ে যাবে।
কিন্তু ক্রিস্টোর আশা পূরণ হলো না। বিপদ থেকে উদ্ধার করার কারণে ক্রিস্টোকে চাহিদার বেশি পুরস্কার দিলেন তিনি। এরপর ডুবে। গেলেন গবেষণার কাজে। সাগর-দানবের প্রসঙ্গ আর উঠলোই না।
এভাবে হবে না বুঝে মরিয়া হয়ে উঠল ক্রিস্টো। গোপনে সে চতুর্থ দেয়াল আর গোপন দরজা সময় সুযোগ মতো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। শিগগিরই রহস্য আর রহস্য থাকল না। দরজার গায়ে হাত বুলাতে গিয়ে উঁচ কি একটা যেন তার হাতে বাধল। জিনিসটাতে চাপ পড়তেই নিজে থেকে খুলে গেল দরজা। ব্যাঙ্কের ভল্টের মতো। মজবুত আর ভারী সেই দরজা। একার সাহায্যে খোলা মুশকিল হতো। যাই হোক, কৌতূহলবশত ক্রিস্টো ঢুকে পড়ল দরজা দিয়ে। সে মাত্র ঢুকেছে, অমনি পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। ভয় ধরে গেল ক্রিস্টোর প্রাণে। পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করল আর কোন বোতাম দিয়ে দরজাটা আবার খোলা যায় কিনা। বারবার খুঁজল, কিন্তু তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না। খুলল না অনড় দরজা। ক্রিস্টো স্বগতোক্তি করল, ফাঁদে পড়ে গেলাম নিজের দোষে।
করার কিছু নেই এখন। মনটাকেও ব্যস্ত রাখা দরকার, নইলে ভয়। দূর করা যাবে না। কাজেই ভেতরের বাগানে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল ক্রিস্টো। এখানে ফল-ফুলের গাছের চেয়ে ঝোপঝাড়ই যেন বেশি। বোঝা যায় যত্ন নেয়া হয় না তেমন বাগানটার। পুরোটা একটা দেয়াল ঘেরা গর্তের মতো। দেয়াল তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম পাহাড় প্রাচীর দিয়ে। পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। পাথুরে বেলাভূমিতে ঢেউয়ের বাড়িতে ছিটকে এসে লাগা নুড়ি পাথরের খটমটর আওয়াজটাও পাওয়া যাচ্ছে।
গাছপালা বাগানে যা আছে সব নোনা মাটিতে জন্মে তেমন। প্রকাণ্ড সব গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় সূর্যের আলো চুরি করে এসে পড়েছে মাটিতে। বাগানে চারধারে অন্তত বারোটা ফোয়ারা আছে। কাজ করছে প্রত্যেকটা শীতল জলের কণার কারণে এখানে বাতাসও ঠাণ্ডা। মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আর পরিবেশটা একেবারেই মিলে যাচ্ছে মিসিসিপির অববাহিকার সঙ্গে। বাগানের ঠিক মাঝখানে আছে সমতল ছাদের একটা পাথরের বাড়ি। তার চারধারের নিচু দেয়ালগুলো আগাছায় প্রায় ঢাকা পড়েছে। বাড়ির সবুজ রঙের কাঠের দরজা সবগুলোই বন্ধ। কেন কে জানে, ক্রিস্টোর মনে হলো এই বাড়িতে কেউ না কেউ থাকে। পুরোটা বাগান চষে বেড়াল সে। বাগান আর সাগরু খড়ির মাঝখানে সে দেখতে পেল একটা চৌকো পুকুর। আয়তনে পঞ্চাশ বর্গমিটার হবে। পানির গভীরতা অন্তত পাঁচ। মিটার। পুকুরের পাড় ঘিরে গাছ লাগানো হয়েছে। ওগুলো ছায়া দিচ্ছে পুকুরে।
ক্রিস্টো পুকুরের কাছাকাছি আসতেই কি যেন একটা প্রাণী ঝপ করে পানিতে নেমে গেল। কি না কি হয় ভেবে থমকে দাঁড়াল সতর্ক ক্রিস্টো। মনে একটাই চিন্তা: ওটাই বোধহয় সাগর-দানো। শেষ পর্যন্ত তাহলে ওটার দেখা পাওয়া গেল!
পুকুর পাড়ে এসে পানির নিচে তাকাল ক্রিস্টো। একদম কাচের মতো পরিষ্কার পানি। তলা পর্যন্ত দেখা যায়। দেখল একটা ডুবন্ত সাদা পাথরের ওপর চুপ করে বসে আছে একটা বড়সড় সাদা বাঁদর। চোখে ভয় আর কৌতূহল নিয়ে ক্রিস্টোকেই দেখছে। বিস্মিত না হয়ে পারল।
ক্রিস্টো। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পানির নিচে শ্বাস নিচ্ছে ওটা। শ্বাসের তালে তালে ওঠানামা করছে প্রশস্ত বুক।
হাসি পেল ক্রিস্টোর। ভাবছে, যে দানোর ভয়ে সবাই তটস্থ সে কিনা আসলে একটা বাঁদর! তবে এটা একটা অদ্ভুত বাঁদর। পানির ওপরে নিচে দুজায়গাতেই শ্বাস নিতে পারে।
প্রায় পুরো বাগান ক্রিস্টোর দেখা হয়ে গিয়েছে। উভচর বাঁদরটাকে দেখে তার বেশ হতাশ লাগছে। ভেবেছিল উত্তেজনাময় একটা কিছু আবিষ্কার করবে, আর করল আবিষ্কার একটা নিরীহ ভীতু বাঁদর। আসলে বাঁদরটার ব্যাপারে লোকের মুখে মুখে মিথ্যে বদনাম ছড়িয়েছে। সাধারণ এক বাঁদরকে কোরাকি বানিয়ে ছেড়েছে। অজানাকে ভয় পায় বলেই মানুষ কাল্পনিক দানব বানায়।
ক্রিস্টোর মাথায় ফেরার চিন্তা এলো। হাজারো চেষ্টা করল সে, কিন্তু দরজা আর খুলল না। বাধ্য হয়ে প্রাচীরের পাশের একটা বড়, গাছে উঠল সে, তারপর পা ভাঙার ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল প্রাচীরের ওপারে।
মাটি ছেড়ে সে তখনও ওঠেনি আত্মাটা লাফ দিল তার ডাক্তার সালভাদরের গলা শুনে।
ক্রিস্টো! ক্রিস্টো। তুমি কোথায়?
হাতের কাছে পাতা সরাবার একটা আঁচড়া পেয়ে চট করে ওটা তুলে নিল বুদ্ধিমান ক্রিস্টো। পাতা সরাতে সরাতে জবাব দিল, এই তো, আমি এখানে, ডাক্তার সাহেব।
ক্রিস্টোকে নিয়ে সেই গোপন দরজার সামনে থামলেন ডাক্তার। ফোলা জায়গাটায় চাপ দিয়ে দরজা খুলে বললেন, এই দরজা এভাবেই খোলে, বুঝলে?
ক্রিস্টো মনে মনে বলল, দেখাতে একটু দেরি করে ফেলেছেন। এই দানব আমার আগেই দেখা সারা।
ক্রিস্টোকে নিয়ে বাগানে ঢুকলেন সালভাদর। পাথুরে বাড়িটা ছাড়িয়ে চলে এলেন সেই পুকুরের কাছে। বাঁদরটা তখনও পানির তলাতেই বসে আছে। তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে পানির ওপর বুদ্বুদ উঠে আসছে। ক্রিস্টো ভান করল যেন সে এই মাত্র আশ্চর্য এই ব্যাপারটা দেখেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে সত্যি সত্যি অবাক হতে হলো।
বাঁদরকে হাতের ইশারা করলেন ডাক্তার সালভাদর। উঠে এলো বাঁদরটা, গা ঝাড়া দিয়ে পানি ঝেড়ে একটা গাছের ওপর চড়ে বসল। সালভাদর উৰু হলেন। ঘাসের মধ্যে লুকানো একটা সবুজ রঙের লোহার পাতে হাতের চাপ দিলেন। চাপা একটা হলো পুকুরের পানি কয়েকটা সুইস গেট দিয়ে হড়হড় করে বেরিয়ে গেল। এবার দেখা গেল একটা লোহার সিঁড়ি। পুকুরের তলা পর্যন্ত নেমে গেছে। ওটা।
এসে, ক্রিস্টো, ডাকলেন সালভাদর।
পুকুরের নিচে নামল ওরা দুজন। এবার আরেকটা লোহার পাতে চাপ দিলেন ডাক্তার। রহস্যের যেন কোন শেষ নেই। পুকুরের মাঝখানে খুলে গেল লোহার আরেকটা চৌকো দরজা। দেখা গেল সেখান থেকেও সিঁড়ি নেমেছে। এবার ওটা গেছে পাতালে।
ডাক্তারের পিছু পিছু সাবধানে নামতে শুরু করল ক্রিস্টো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামল। ওপরের দরজা দিয়ে যে সূর্যের আলো আসছিল এখানে সেই আলো পৌঁছোয়নি। চারদিকে কালিগোলা জমাট অন্ধকার। চোখের সামনে হাত নিলেও দেখা যায় না। এগিয়ে যাচ্ছেন সালভাদর। পেছনে ক্রিস্টো। গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদের জুতোর শব্দ। সাবধান, ক্রিস্টো, গম্ভীর গলায় সতর্ক করলেন ডাক্তার। হুমড়ি খেয়ে পোড়ে না। আমরা প্রায় এসে গেছি।
থেমে দাঁড়িয়ে একদিকের দেয়ালের গায়ে একটা সুইচ টিপলেন। সালভাদর। ইলেক্ট্রিক বালবের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হলো গুহা। ক্রিস্টো দেখল তারা উপস্থিত হয়েছে লাইম স্টোনের একটা সুড়ঙ্গের
মধ্যে। সুড়ঙ্গের সামনে একটা ব্রোঞ্জের দরজা দেখা গেল। দরজার পিতলের তৈরি সিংহের মুখ থেকে একটা কড়া ঝুলছে। ওটা ধরে টান দিলেন সালভাদর। সহজেই খুলে গেল ভারী ব্রোঞ্জের পাল্লা। ক্রিস্টোকে নিয়ে অন্ধকার একটা হলঘরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার।
সুইচ কোথায় তা তার নখদর্পণে। আবার একটা সুইচ টিপলেন। গোলাকার একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠল হলঘরে। ক্রিস্টো দেখল ঘরের একদিকের দেয়াল সম্পূর্ণ কাঁচ দিয়ে তৈরি।
আরেকটা সুইচ টিপলেন ডাক্তার। হলঘরের ভেতর অন্ধকার নামল, কিন্তু কাঁচের ওপাশটা দেখা গেল উজ্জ্বল একটা সার্চ লাইটের আলোয়। দেখে মনে হলো কাঁচের ওপারে এটা বুঝি বিশাল একটা আঁকুইরিয়াম। অথবা সমুদ্রের নিচের একটা কাচের বাড়িও বলা যায় ওটাকে। মাটিতে জন্মেছে অজস্র সামুদ্রিক উদ্ভিদ। প্রবালের স্তৃপও আছে। ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে অগুনতি ছোট মাছেরা। হঠাৎ ক্রিস্টো দেখল একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষের মতো। একটা প্রাণী। চোখ দুটো তার দেখার মতো। মনে হয় দুটো কাচের গ্লাস বসিয়ে দেয়া হয়েছে চোখের বদলে। পায়ের পাতগুলো একদম ব্যাঙের পায়ের মতো। গায়ে তার নীলচে-রুপোলি আঁশ। কাঁচের। দেয়ালের কাছে চলে এলো প্রাণীটা সাঁতরে। একবার মাথার ইশারা করল ডাক্তারকে, তারপর দরজা খুলে অন্য একটা কক্ষে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল আবার। হিসহিস করে বেরিয়ে গেল সেই কক্ষের সমস্ত পানি। অন্য একটা দরজা খুলে হলঘরে এসে দাঁড়াল সাগর-দানো!
চশমা আর গ্লাভস্ খুলে ফেলো, নির্দেশ দিলেন ডাক্তার।
নির্দেশ পালন করল প্রাণীটা। গগলস্ আর দস্তানা খুলতেই বিস্মিত ক্রিস্টো দেখল তার সামনে দাঁড়ানো সাগর-দানো আসলে সুদর্শন এক সুঠামদেহী তরুণ।
এ হচ্ছে, ক্রিস্টো, ইকথিয়ান্ডার। যাকে লোকে নানা নাম দিয়েছে। কারও কাছে ও সাগর-দানো, কারও কাছে মৎস্য-মানব আবার কারও কাছে উভচর-মানব।…আর এ হচ্ছে আমার সহকর্মী, ক্রিস্টো।
আন্তরিক হেসে ক্রিস্টোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তরুণ। ক্রিস্টোও হাত বাড়াল, কিন্তু তার বিস্ময় এখনও কাটেনি। সাগর
দানোকে স্প্যানিশ ভাষা বুঝতে দেখে ওর মাথা গরম হয়ে উঠছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ইকথিয়ান্ডারের নিগ্রো কাজের মানুষটার অসুখ হয়েছে। আগামী কয়েক দিন তার বদলে তুমিই এখানে ওর কাজ করবে, ক্রিস্টো। কাজে যদি সন্তুষ্ট করতে পারো তাহলে এখানেই তোমাকে রেখে দেয়া যাবে।
নিরবে মাথা দোলাল ক্রিস্টো।
১০. রাত প্রায় শেষ
রাত প্রায় শেষ। একটু পরই ভোর হবে। গ্রীষ্মের ভেজা বাতাসে ম্যাগনোলিয়া, টিউবরোজ আর মিনোনেট ফুলের সুবাস। হাওয়া নেই আজকে, কাজেই গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। চারদিক নিস্তব্ধ। বাগানের বালির পথ ধরে হাঁটছে ইকথিয়ান্ডার। ওর কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ছোরা। এক হাতে চশমা আরেক হাতে ব্যাঙের পায়ের মতো গ্লাভূস। ইকথিয়ান্ডারের পায়ের তলায় পিষে ভেঙে যাচ্ছে বালিতে পড়ে থাকা অসংখ্য ছোট শখ, শামুক আর গুগলি। দুপাশে রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড়গুলোকে কালো দেখাচ্ছে। বাতাস না থাকায় নিথর, মনে হচ্ছে অপেক্ষা করছে একটা কিছু ঘটবে। বাগানের জলাধার থেকে হালকা কুয়াশার মতো বাষ্প উঠছে। গাছের সারির মধ্যে দিয়ে চলেছে এখন ইকথিয়ান্ডার। দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। চোপে আসা অবাধ্য গাছের ডালগুলো। ভোরের শিশির জমেছে ইকথিয়ান্ডারের চুলে আর মুখে। বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা, স্ফটিকের মতো দেখাচ্ছে।
বাগানের একটা রাস্তা ঢালু হয়ে ডান দিক দিয়ে নেমে গেছে। পাথরে তৈরি একটা চাতালে এসে দাঁড়াল ইকথিয়ান্ডার, গগলস আর গ্লাভস পরে নিয়ে বড় করে দম ছাড়ল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পানির মাঝে। শীতল প্রশান্তিময় অনুভূতিতে ভরে গেল ওর সমস্ত দেহ। পানির ঠাণ্ডা স্পর্শ কানাকোয় লাগতেই নিয়মিত ছন্দে ওগুলো ওঠা-নামা শুরু করল স্বয়ংক্রিয় ভাবে। ওই এক মুহূর্তে মানুষ ইকথিয়ান্ডার রূপান্তরিত হলো সামুদ্রিক মাছে।
গ্লাভস্ পরা হাতের গুণে খুব কম সময়েই ও নেমে গেল পানির অনেক গভীরে। পুকুরের পাথরের দেয়ালে বসানো আঙটা ধরে ও এগিয়ে চলল পানি ভর্তি সুড়ঙ্গের দিকে। বাগানের পুকুরটা সাগরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু, কাজেই পুকুরের পানি সর্বক্ষণ সাগরে গিয়ে পড়ছে। সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল ইকথিয়ান্ডার। চিত হয়ে আছে। দুহাত বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা।
সুড়ঙ্গটা শেষ হতেই উপুড় হয়ে সামনের দিকটা দেখল ইকথিয়ান্ডার। সামনে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। সামনে দিকে হাত বাড়িয়ে লোহার শিক ছুঁলো ও। লোহার তৈরি দরজাটায় ঝুলছে একটা মজবুত তালা। চাবি দিয়ে তালাটা খুলে বাইরে খোলা সমুদ্রে বেরিয়ে এলো ও। নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল পেছনে লোহার দরজা।
সামনে এখন খোল সাগর। তবে অন্ধকার কাটেনি এখনও। পানির রং কালো কালির মতো। মাঝে মাঝে নকটিসির সৃষ্টি নীলচে আলোর কণা দেখা দিতে আঁধারে। জেলিফিশের গোলাপী আভাও চোখে পড়ছে কখনও কখনও। ভোর হতে আর বাকি নেই। পানিতে আলো পড়লেই রাতে আলো জ্বালা প্রাণীগুলো নিভিয়ে দেবে নিজেদের আলো। কানকো দিয়ে শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। মনে হচ্ছে সুই দিয়ে কেউ ঘন ঘন খোঁচা মারছে কানকোয়। তার মানে হচ্ছে অন্তরীপ পেরিয়ে শহুরে আবর্জনায় ভর্তি একটা স্রোতের মাঝে চলে এসেছে ও। কাদা আর বালিও অসুবিধে সৃষ্টি করছে। এখানে একটা নদী সাগরে এসে পড়েছে। সেকারণেই এই কাদা-বালি আর আবর্জনা। পানিতে ছোট ছোট ঘূর্ণিও আছে। তাছাড়া নদী কাছাকাছি হওয়ায় পানিতে লবণের পরিমাণ কম। লবণাক্ত পানি ছাড়া ইকথিয়ান্ডার ভাল করে শ্বাস নিতে পারে বিশেষ ভাবে সৃষ্টি তার কানকোগুলো মিষ্টি পানির উপযোগী নয় মোটেই। নদীর মাছ অত কাদা-বালি আর মিষ্টি পানিতে কি করে বেচে থাকে ভেবে অবাক লাগে ইকথিয়ান্ডারের।
সামান্য ওপরে উঠে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিল ও। একটু পরই আবার নামতে শুরু করল। এখানে পানি একদম পরিষ্কার। শীতল একটা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল ও। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে স্রোতটা পারানা নদীর মোহনা পর্যন্ত। এরপর স্রোতটা বেঁকে গেছে পুব দিকে। ওই স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দূর হতে দূরান্তরে।
মাঝে মধ্যে চোখ বুজে থাকছে ইকথিয়ান্ডার। বিপদের কোন ভয় নেই। চারদিক এখনও প্রায় অন্ধকার। সমুদ্রের আতঙ্ক যেসব প্রাণী, লারা এখনও ঘুম থেকে জাগেনি। সূর্য ওঠার আগে আরাম করে ভেসে থাকতে খুব ভাল লাগে ওর। দেহ ভরে যায় প্রশান্তিতে। কত অনুভূতি যে হয়। শরীরের সূক্ষ্ম যন্ত্র বলে দেয় পানির তাপ বাড়ছে কি কমছে। স্রোত দিক বদলাচ্ছে কিনা। হাজারো কম শব্দের জগৎ সমুদ্র। ইকথিয়াল্ডারের তীক্ষ্ণ কান সব শব্দই আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। এই মাত্র জাহাজের নোঙর তোলার আওয়াজ হলো। ঝন ঝন ঝন! কয়েক কিলোমিটার দূরে কয়েকটা মাছ ধরা জাহাজ তাদের নোঙর তুলছে।
সকাল প্রায় হয়ে এলো। ধকধক আওয়াজ করে চালু হলো একটা জাহাজের এঞ্জিন। ওটা ব্রিটিশ জাহাজ হাবোক্সের আওয়াজ, জানে ইকথিয়ান্ডার। বিরাট এই জাহাজটা ইংল্যান্ডের লিভারপুল আর আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের মধ্যে নিয়মিত চলাচল করে। সমুদ্রের নোনা পানিতে শব্দের গতি সেকেন্ডে মাত্র পনেরো মিটার, কিন্তু চল্লিশ কিলোমিটার দূরের হারোক্স জাহাজের এপ্রিনের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ইকথিয়ান্ডার, যেন সামান্য দূরেই আছে জাহাজটা। ভোরের ধূসর আলোয় দূর থেকে চমৎকার মায়াময় লাগছে জাহাজটাকে দেখতে। যেন একটা আস্ত শহর, আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের বুকে। ওই জাহাজটাকে আরও সুন্দর লাগে কাছ থেকে দেখতে। তাই, জাহাজ দেখতে ইকথিয়ান্ডারকে যেতে হয় আরও বহুদূর, গভীর সমুদ্রে। ওই জাহাজ যখন বুয়েন্স আয়ার্সে পৌঁছোয় তখন সকালের আলো ফুটে যায়। জাহাজের আলোও নিভে যায় তখন। জাহাজটা আসছে। প্রপেলারের আওয়াজ, এঞ্জিনের ধকধক আর পানির আলোড়নের শব্দে সমুদ্রের ঘুমন্ত প্রাণীদের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে হারোক্স জাহাজ। ইতিমধ্যেই ডলফিনরা জেগে গেছে। ছোট্ট একটা ঢেউয়ের বাড়িতে সচেতন হয়ে উঠল ইকথিয়ান্ডার। বুঝতে পারছে ডলফিনরা খেলার জন্যে জাহাজের দিকে রওনা হয়ে গেছে। অলসতা কাটিয়ে উঠে ইকথিয়ান্ডারও সাঁতরাতে শুরু করল।
পানির ওপর মাথা তুলে চারদিকে একবার তাকাল। আশেপাশে কোন জাহাজ বা নৌকো নেই। মাথার সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে গেল বুনো হাঁস আর গাঙচিলের দল। এতই নিচ দিয়ে উড়ছে যে মাঝে মাঝে পানি স্পর্শ করছে ওদের পাখা, থেকে থেকে পানি ঝরছে ডানা থেকে। গাঙচিলের ডাক একেবারে বাচ্চাদের কান্নার মতো। বিরাট প্রশস্ত ডানা মেলে, বাতাসে হুসহুস আওয়াজ তুলে মাথার ওপর দিয়ে। উড়ে গেল একটা অ্যালবাট্রস। লা-পাটা উপসাগরের দিকে চলেছে। ডানার বিস্তার চার মিটারের কম হবে না। ইকথিয়ান্ডারের আফসোস হলো, মনে হলো যদি ওরও অমন ডানা থাকত তাহলে কি ভালই না–হতো! নিমেষে উড়ে চলে যেত দূরদূরান্তে।
পাহাড়ের দিকে সরে যাচেছ অন্ধকার, আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠছে আকাশ। পুব দিগন্তে সূর্যের আভাস দেখা দিল। এখন সমুদ্রের ঢেউগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোলাপী আভা বুকে মেখে উড়ে যাচ্ছে গাঙচিলের দল।
সমুদ্রের সুনীল বিস্তারে নানা রকম নক্সার খেলা শুরু হয়ে গেছে। অপূর্ব! বাতাসের বাড়িতে ক্রমেই বাড়ছে বিচিত্র সব নক্সা, যেন সূর্যালোকের তুলি দিয়ে গভীর মনোযোগে আঁকছেন স্বয়ং ঈশ্বর।
মাছ-ধরা কয়েকটা জাহাজ এগিয়ে আসছে ইকথিয়ান্ডারের দিকে। ডাক্তার সালভাদরের নিষেধ আছে যেন সে মানুষের সামনে না যায়। ডুব সাঁতার দিয়ে পুবদিকে উন্মুক্ত সাগরের দিকে চলল ও। সাগরের পানি এই গভীরতায় কেমন যেন ছায়া ছায়া। নীলাভ পানিতে সাঁতার কাটছে অজস্র রংবেরঙের মাছ। কোনটা ডোরাকাটা, কোনটা বুটিদার, কোনটা লাল, হলুদ, কালো, বাদামী, সবুজ-হরেক রঙা। যেন প্রজাপতি, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে আপন আনন্দে।
পানির ওপরে গুড়-গুড় একটা একটানা আওয়াজ হচ্ছে। পানিতে লম্বাটে একটা ছায়া পড়ল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে কোন যুদ্ধ বিমান যাচ্ছে।–একবার একটা সী-প্লেনের ডানায় উঠে বসেছিল ইকথিয়ান্ডার। মারাত্মক দুর্ঘটনা হতে পারত। প্লেনটা হঠাৎ করেই উড়তে শুরু করল সংক্ষিপ্ত দৌড় শেষে। প্রায় তিরিশ ফুট ওপর থেকে হাত ফস্কে সাগরে পড়ে গিয়েছিল ইকথিয়ান্ডার। উচ্চতা আরও বেশি হলে হয়তো মারাই যেত।
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। সাগরের ওপরে উঠে এলো ইকথিয়ান্ডার। সূর্যটা মাথার ওপর আগুন ঝরাচ্ছে। চিকচিক করছে সমুদ্রের পানি, আগের মতো আর স্বচ্ছ নেই, তলায় কি আছে দেখা : যাচ্ছে না আলোর প্রতিফলনের কারণে। এছাড়া বাতাসও ছেড়েছে। সমুদ্রে ঢেউ উঠছে। সেটাও তলার কিছু দেখা না যাওয়ার একটা কারণ। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসল ইকথিয়ান্ডার, নেমে গেল ঢেউ মিলিয়ে যেতেই। খেলাটা বেশ পছন্দ করে সে।
উড়ক্কু মাছের দল ঢেউয়ের মাথায় উঠে দল বেঁধে লাফ দিচ্ছে, কয়েকশো গজ উড়ে গিয়ে আরেকটা ঢেউয়ের ভেতর ডুব দিচ্ছে। পুব থেকে পশ্চিমে উড়ে চলেছে দ্রুতগামী ফ্রিগেট পাখির ঝাঁক, দুপুরের বিশ্রামের জায়গায় চলেছে ব্যস্ত হয়ে। হঠাৎ করেই একটা পাখি ছোঁ মারল সাগরের বুকে, পানির তলায় গিয়ে পর মুহূর্তে উঠে এলো আবার। ওটার বাঁকা ঠোঁটের ফাঁকে চকচক করছে একটা রুপোলি মাছ। পাখিটার দুপুরের খাবার জোগাড় হয়ে গেছে।
আকাশে কয়েকটা অ্যালবাট্রসও উড়ছে। ইকথিয়ান্ডার বুঝতে পারল সাগরে একটা বড় ধরনের ঝড় আসন্ন। ঝড় অ্যালব্যাট্রসের খুব পছন্দ। বিদ্যুত্বহী মেঘের দিকে চলেছে তারা মহা উৎসাহে। ছোট জাহাজ আর নৌকোগুলোর আচরণ ঠিক ওদের উল্টো। চট জলদি করে। তীরের দিকে ছুটছে ওগুলো। ঝড় আঘাত হানলে মারাত্মক বিপদ হবে জলযানগুলোর।
সমুদ্রের পানি স্বজেটে হয়ে গেছে। সূর্য হেলে পড়েছে, আকাশে গোধূলির রং লাগছে। খিদে পেয়েছে ইকথিয়ান্ডারের। সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ লুকানোর আগেই ওকে তীরে ফিরতে হবে। দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করল ও।
সূর্যের আলো দেখে দিক ঠিক করে সাঁতরে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। সাগব্র উপকূলবর্তী পানি অপেক্ষাকৃত কম ঘন হয়, কিন্তু তাতে লবণ আর অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। এসব জায়গায় শ্বাস নিতে সুবিধে হয় ইকথিয়ান্ডারের। একবার জিভে সামান্য পানি ছোঁয়াল ও। দক্ষ নাবিকরাও এভাবেই বুঝে নেয় পরিচিত তীরের কাছে সে এসেছে কিনা।
পানিতে ডুবন্ত পাহাড়গুলোকে এখন চিনতে পারছে ও? ওগুলোর মাঝে ছোট ছোট মালভূমি আছে। ওসব পার হয়ে একটা পাথরের প্রাচীরের কাছে চলে এলো ও। পানির নিচে বিপদের সম্ভাবনা দেখলে এখানেই সে আশ্রয় নেয়। ঝড় যত প্রলয়ঙ্করীই হোক, এখানে পানি সবসময় থাকে শান্ত।
মাছরাও জানে এ জায়গা নিরাপদ। অসংখ্য মাছ এসে জুটেছে এখানে। ক্ষণিকের জন্যে তারা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আসছে একটু পরই। ঝড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে সরবে না ওরা।
সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাথরের তলায় রয়েছে অসংখ্য ঝিনুক-খাবারের অফুরন্ত ভাণ্ডার। ওখানে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। ওখানেই সে বিশ্রাম নেয়, খাওয়াটাও সারে। একের পর এক ঝিনুকের খোলা ছাড়িয়ে ভেতরের রসাল শাঁসগুলো মুখ ফেলছে ও, ঠোঁট ফাঁক করে বের করে দিচ্ছে শাঁসের সঙ্গে ঢোকা নোনা পানি। সামান্য নোনা পানি যে তার পেটে চলে যায় না তা নয়। কিন্তু ওটুকু অসুবিধে ইকথিয়ান্ডারের শরীরে সয়ে গেছে। বমির ভাব হয় না।
পেট ভরতেই চিত হয়ে শুয়ে থাকল ইকথিয়ান্ডার। ওর চারপাশে সামুদ্রিক উদ্ভিদের ছড়াছড়ি, যেন অদক্ষ কোন মালির হাতে তৈরি অগোছাল বাগান। বেশির ভাগ গাছই আগার, মেক্সিকান কাউলেরপ আর নরম গোলাপী অ্যালজি। আজকে উদ্ভিদগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে। পানির রং গোলাপী হয়ে আসছে। সাগরের নিচ থেকেও প্রচণ্ড ঝড়ের আওয়াজ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই গুড়-গুড় কড়াৎ শব্দে মেঘ ডাকছে, বাজ পড়ছে।
বিরাট ডানা মেলে একটা অ্যালবাট্রস উড়ে চলেছে। সাগরের পানিতে তার ছায়া পড়েছে। ক্রমেই সরে যাচ্ছে ছায়াটা। খুব নিচু দিয়ে উড়ছে। ওটার কমলা রঙের পা ইকথিয়ান্ডারের হাতের নাগালের মধ্যে। খপ করে পাখিটার পা দুটো চেপে ধরল ও। ধপাস করে : পানিতে পড়ল পাখিটা, পর মুহূর্তেই ওপরে ওঠার জন্যে সর্বশক্তিতে ডানা ঝাঁপটাতে শুরু করল। ওটার প্রবল টানের কারণে পানির ওপর উঠে আসছে ইকথিয়ান্ডার। অ্যালব্যাট্রসের বুকের নরম অংশের ছোঁয়া পেল ও। আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেলেই লাল ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে আহত করে দেবে পাখিটা। পানির ওপর উঠে আসার আগের মুহূর্তে পাখিটার পা ছেড়ে দিল ও। দেখতে দেখতে পুবদিকের পাহাড় পেরিয়ে অদৃশ্য হলো পাখিটা।
ইতিমধ্যে ঝড়ের প্রকোপ কমে গেছে। একটু পরই সম্পূর্ণ থেমে গেল। দূরে শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে এদিকের সাগরে।
খাওয়া এবং বিশ্রাম, দুটোই হয়ে গেছে ইকথিয়ান্ডারের, এবার পানির ওপর দেহের অর্ধেকটা তুলে আনল ও। আকাশ এখনও মেঘে কালে কাঁদছে প্রকৃতি ঝরঝর করে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলোতে ছোট ছোট ফোটা তৈরি করছে বৃষ্টির পানি। একেকটা ঢেউ পাহাড়ের মতো উঁচু, বেশ কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে নিঃশেষে বিপুল জলরাশির সঙ্গে।
সাধারণ মানুষ ঝড়-বৃষ্টি অপছন্দ করলেও ইকথিয়ান্ডারের প্রকৃতির লীলা দেখতে খুব ভাল লাগে। কখনও সে ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, আবার কখনও নেমে যায় ঢেউয়ের নিচে। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করতে তার ভাল লাগে। তবে এ খেলা বিপজ্জনক। একবার একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে মাথায় মারাত্মক চোট পেয়েছিল ও, জ্ঞান ছিল না। তলিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ হলে মারাই যেত, কিন্তু খানিক পর পানির তলায় জ্ঞান ফিরে পেতে ইকথিয়ান্ডারের অসুবিধে হয়নি। আঘাত সামলে সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
একসময় থেমে গেল বৃষ্টি। অনিঃশেষিত মেঘের দল হাওয়ায় ভরা দিয়ে চলে গেল পুব আকাশের এক কোণে। উত্তর গোলার্ধের উষ্ণ অঞ্চল থেকে ভেসে এলো গরম বায়ু। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিল আকাশের নীল। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের ঢেউয়ের ওপর, ওদের নিয়ে আলোছায়ার খেলায় মেতে উঠল। একটু আগের সেই সাগর আর নেই, এখন ধূসর রং বদলে গিয়ে নীল রং ধরেছে। বিপুল জলরাশি। রোদের কারণে মাঝে মাঝে পানির রং সবুজও
দেখাচ্ছে।
সূর্যের আলোয় সাগর, আকাশ আর দূরের পাহাড়শ্রেণী ভিন্ন রূপ ধরেছে।
সাগরের ভেজা সুশীতল বাতাস বুক ভরে টেনে নিল ইকথিয়ান্ডার। মাঝে মাঝে কানকো দিয়েও শ্বাসের কাজ চালাচ্ছে। ইকথিয়ান্ডার জানে, ঝড়-বাদলে-বজ্রপাতে বদলে যায় প্রকৃতি, এক হয়ে মিশে যায় সাগর আর আকাশ, পানির ওপরে আর নিচে দুজায়গাতেই বেড়ে যায় নিষ্কলুষ অক্সিজেনের পরিমাণ। সাগরে প্রাণের স্পন্দন বেড়ে যায়। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসে মাছের ঝাঁক। তারপর একসময় ঢেউ শান্ত হয়। তখন বের হয় জেলিফিশ, চিংড়ি, পর্পিতা, স্টেনোফোরা, সেস্টাস আর ভেনেরিসের মতো দুর্বল প্রাণীগুলো।
সামান্য দূরে ইকথিয়ান্ডারের বন্ধু কে পাল ডলফিন খেলা জুড়ে দিয়েছে নিজেদের মাঝে। একজন আরেকজনকে তাড়া করছে। লাফ দিচ্ছে আকাশে। ভাল লাগল ইকথিয়ান্ডারের, হাসিমুখে ওদের খেলায় সামিল হলো সে। একটু পরই খেলায় মেতে উঠল। ওদের সঙ্গেই সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে, তাড়া করছে হয়তো কাউকে। ওর মনে হয় এই আকাশ এই বাতাস এই ডলফিনের দল যেন শুধু ওর জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে।
একটু পরই সন্ধে নামবে। সূর্য পশ্চিমে অনেক দূর হেলে পড়েছে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই ইকথিয়ান্ডারের। আগে আকাশ কালো হোক, হাজারো নক্ষত্র তাদের উপস্থিতি জাহির করুক, তখন ডলফিন বন্ধুদের সঙ্গে খেলা সাঙ্গ করে বাড়িতে ফিরবে সে, তার আগে নয়। এখন সে ঢেউয়ের মাথায় উঠে হুটোপুটি খেলবে।
প্রতিটা ঝড়ের পরই দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটে। করুণ সেই দৃশ্য। ঝড়ের ঢেউয়ের ধাক্কায় অসংখ্য জেলিফিশ, কাঁকড়া, তারামাছ আছড়ে পড়ে তীরের বেলাভূমিতে। কখনও কখনও ডলফিনও রক্ষা পায় না। যারা সৈকতে গিয়ে পড়ে তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। তবে সময় মতো সাহায্য করলে তাদের বাঁচানো সম্ভব। ইকথিয়ান্ডার একবার সৈকতের দিকে চেয়ে দেখল কোন প্রাণীর তার সাহায্যের দরকার আছে কিনা। তীরের কাছে এখনও ফুসছে সাগর। বড় বড় ঢেউ বেলাভূমিতে আঘাত হানছে।
ঝড়ের পর সাধারণত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়ায় ইকথিয়ান্ডার, যেসব প্রাণীদের বাঁচানো সম্ভব সেগুলোকে সাগরে নিয়ে ছেড়ে দেয়। ওরা যখন জীবনীশক্তি ফিরে পেয়ে আপন ভুবনে ফেরে, বুকটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ইকথিয়ান্ডারের। ওর হাতের ভেতর মাছগুলো যখন হাঁপাতে থাকে, তখন ও সান্ত্বনা দেয়, আর একটু ধৈর্য ধরো, আমি তোমাকে ঠিক ঠিক বাঁচাব, দেখো!
অন্য সময় হলে হয়তো ইকথিয়ান্ডার মাছগুলো খেয়েই ফেলত। কিন্তু এখন তা ও কখনোই করবে না। ও তো এখন রক্ষক এবং বন্ধু। রক্ষক হয়ে সে ভক্ষক হবে কি করে?
সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ডুবে গেছে পুব আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে। মেঘের গায়ে লেগেছে সোনালী-লাল-গোলাপী আর ধূসর রং। নিচের সাগরে তাদের প্রতিফলন হচ্ছে। সাগর এখনও কিছুটা অশান্ত। মাঝে মাঝে ওপরে সাঁতরে আবার কখনও কখনও ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। আঁধার ঘনিয়েছে। এখন এমন এক সময় যখন সমুদ্রের জীব একে অপরের ওপর হামলা করে না। যেসব হিংস্র প্রাণী দিনে জাগে তারা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার রাতে যারা জাগে তারা এখনও শিকারে বের হয়নি। এসময়টা নিশ্চিন্তে ডুব সাঁতার দিয়ে মজা করার উপযুক্ত সময়।
সাগরের স্রোত চেনে ইকথিয়ান্ডার। ও জানে উত্তর থেকে আসা স্রোতটা একটু ওপর দিয়ে বয়ে যায়। দক্ষিণের শীতলতা ওই স্রোতকে শীতল করতে পারে না, উষ্ণ স্রোত হয়ে ওটা বয়ে যায়।
উল্টো আরেকটা স্রোত আছে সমুদ্রের আরও গভীরে। ওটা সুশীতল দক্ষিণ থেকে চলেছে উত্তরের উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। তীরের দিকে যেতে চাইলে এই ভিন্নমুখী স্রোতগুলোকেই কাজে লাগায় ইকথিয়ান্ডার, তাতে ওর পরিশ্রম অনেক কমে যায়।
আজকে উত্তরের স্রোত ধরে বহুদূর চলে গেল ইকথিয়ান্ডার। এবার। উষ্ণ স্রোতে গা এলিয়ে দিল। এই স্রোত ওঁকে নিয়ে যাবে বাড়ির কাছের সেই সুড়ঙ্গের মুখে। একবার এরকম ভাবে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ইকথিয়ান্ডার। সেবার অনেক দূরে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্রোতটা। আজকে ইকথিয়ান্ডার তাই জেগেই থাকল।
হাজার কোটি তারায় ভরা আকাশের মতোই সাগরেও জ্বলছে যেন। নক্ষত্রের দল। তারা নয়, সাগরের বুকে নিজেদের পিচ্চি দেহ নিয়ে আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্ৰ নকটিলুসি। অগভীর পানিতে আলো জ্বেলেছে তারা মাছেরা। কাছেই ইকথিয়ান্ডার একটা জেলিফিশ দেখতে পেল। গভীর পানিতে দেখা দিতে শুরু করেছে হিংস্ৰ নিশাচর মাংসাশী প্রাণীরা। শিকারের পেছনে ছুটছে তারা। ওদের দেহের আলোও জ্বলছে নিভছে।
পানির নিচে যেন সূর্য-চাঁদের কোন অভাব নেই। কোমল আলো জ্বলছে নিভছে সর্বক্ষণ। তাতে নানা ধরঙের বৈচিত্র্য। তুলনা করে দেখল ইকথিয়ান্ডার, আকাশের চেয়ে সাগরের গভীরতার রূপ অনেক অনেক বেশি সুন্দর।
বন্দরের কাছ থেকে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ। ইকথিয়ান্ডারের বুঝতে দেরি হলো না, হারোক্স জাহাজ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
আজ বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। রাত এখন প্রায় শেষ। কখন এত সময় পেরিয়ে গেছে সমুদ্রের রূপ দেখতে দেখতে ও জানে না। একটু পরই পুবাকাশে সূর্য উঠবে ফের। কখন মনের ভুলে একদিন একরাত সাগরের কাটিয়ে দিয়েছে সে। ডাক্তার সালভাদর নিশ্চই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। দেখা হলেই বকাবকি করবেন।
সুড়ঙ্গের দিকে চলল এবার ইকথিয়ান্ডার। একটু পরই চলে এলো গন্তব্যে। শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দরজা খুলে ঢুকল ঘন অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে। একটু পরই ভেসে উঠল, শ্বাস নিল ওপরের বাতাসে। ফুলের মিষ্টি সুবাস ওকে মুহূর্তের জন্যে আনমনা করে দিল।
ঘরে ফিরে গ্লাস্ আর গগলস্ খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। ডাক্তারের নির্দেশ তা-ই।
বড় ক্লান্তু ও। সারাশরীরে ভর করেছে পরিশ্রান্তি। একটু পরই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার।
১১. একদিন ঝড় পরবর্তী সময়ে
একদিন ঝড় পরবর্তী সময়ে সাঁতার কাটছে ইকথিয়ান্ডার সাগরে, পানির ওপর মাথা জাগাতেই চোখে পড়ল সাদা মতো কি একটা জিনিস। যেন মাছ-ধরা কোন জাহাজ থেকে পালের টুকরো খসে পড়েছে। কাছে যেতেই অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। যাকে ছেড়া পালের টুকরো মনে করেছিল সে আসলে এক যুবতী মেয়ে। মেয়েটার দেহ একটা তক্তার সঙ্গে বাঁধা আছে বলেই এখনও সে ভেসে আছে। মেয়েটি কি মারা গেছে? বিচলিত বোধ করল ইকথিয়ান্ডার। খুব রাগ। হলো কেন কে জানে ওর সমুদ্রের ওপর। জীবনে এই প্রথম সাগরের ওপর ওর এই রাগ।
শুধুই কি জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা? মেয়েটির মাথা তক্তার ওপর সোজা করে তুলে দিল ও, তত্ত্বাটাকে ঠেলে নিয়ে চলল তীরের দিকে। মাঝে মাঝেই ঢেউয়ের দোলায় মেয়েটার মাথা হেলে পড়ছে। সাঁতার থামিয়ে ওর মাথা ঠিক মতো তক্তায় রাখে ইকথিয়ান্ডার। সৈকতে আটকা পড়া মাছদের প্রতি যে দরদ মাখানো স্বরে সে কথা বলে ঠিক তেমনি করেই মেয়েটির কানের কাছে মুখ এনে সে ফিসফিস করে বলল, আর সামান্য দূর সহ্য করো। আমি তীরের কাছে এসে পড়েছি।
ইকথিয়ান্ডারের মনে প্রবল বাসনা জাগল, মেয়েটি যদি কথা বলত, একটু চোখ খুলে তাকাত! আবার ভয়ও পাচ্ছে ও, মেয়েটি ওকে দেখে ভড়কে যেতে পারে। আচ্ছা, গগ আর গ্লাভস্ খুলে ফেলবে নাকি? সেটা ঠিক হবে না। তাতে সাঁতরাতে অসুবিধে হবে। তাছাড়া কাজটা সময় সাপেক্ষ। তক্তাটাকে সামনে নিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে চলেছে ইকথিয়ান্ডার।
সাগরের এখানটায় ঢেউগুলো বড় বড় আর উত্তাল। সাবধানে সাঁতার কাটছে ও। ঢেউয়ের ধাক্কায় আপনাআপনিই এখন তীরের দিকে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে পা নামিয়ে পায়ের তলায় বালির স্পর্শ পেতে চাইছে ইকথিয়ান্ডার।
বেশ কিছুক্ষণ পর ওর পায়ে নিতে বালি পেল। তীরে পৌঁছে মেয়েটিকে সে তক্তার বাঁধন খুলে সৈকতে ঝোপঝাড়ের আড়ালে শুইয়ে দিল। আস্তে আস্তে শরীর মেসেজ করে দিচ্ছে যাতে শ্বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে। একটু পর মেয়েটির চোখের পাতা একটু যেন কেঁপে উঠল। মেয়েটির বুকের কাছে কান পাতল ও। মৃদু ধুকপুক শব্দে চলছে হৃৎপিণ্ড। বেঁচেই আছে মেয়েটা। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো ওর
একটু পরই চোখ মেলল মেয়েটা। ইকথিয়ান্ডারকে দেখে চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়ল। একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনার ছোঁয়া লাগল ইকথিয়ান্ডারের বুকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, মেয়েটি বেঁচে আছে। তাহলে!
এবার ইকথিয়ান্ডারকে চলে যেতে হয়। কিন্তু কিভাবে যাবে সে। অসহায় একটি মেয়েকে একা ফেলে! মেয়েটি যদি ভয় পায়?
বেশি ভাবনা চিন্তার সুযোগ মিলল না ওর, শুনতে পেল, কেউ। একজন আসছে বালিয়াড়ি পেরিয়ে। আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। ঢেউয়ে ডুব দিল ইকথিয়ান্ডার। সামান্য দূরে গিয়েই থামল। একটা পাথরের আড়ালে থেকে নজর রাখল সৈকতের দিকে।
বালিয়াড়ি মাড়িয়ে আসতে দেখা গেল কৃষ্ণবর্ণ এক লোককে। নাকের নিচে তার গোঁফ, চিবুকে ছাগলা দাড়ি। মাথায় বড় একটা টুপি। মেয়েটিকে দেখে লোকটি বলে উঠল, মা মেরি! যিশু। এই তো ও! এই তো পেয়েছি!
এবার সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। ঝট করে সাগরে একটা ডুব দিয়ে দেহ ভিজিয়ে নিল। তারপর মেয়েটির কাছে গিয়ে কৃত্রিম ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করল। তার দুচারটে কথা ইকথিয়ান্ডার শুনতে পেল।
…তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম।…এসব কি ধরনের পাগলামো!…কপাল ভাল তক্তার সঙ্গে বেঁধেছিলাম।
মেয়েটি চোখ মেলে তাকাল। সামান্য পরেই উঠে বসল। চেহারা দেখে মনে হলো না লোকটিকে দেখে একটা খুশি হচ্ছে সে। কিন্তু মেয়েটির চেহারার অনুভূতি পড়ার সময় নেই লোকটির, সে উত্তেজিত স্বরে কথা বলে চলেছে। মেয়েটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল একবার। মেয়েটি অতিরিক্ত দুর্বল, দাঁড়াতে পারল না। আরও আধঘণ্টা লাগল তার শক্তি সঞ্চয় করে দাঁড়াতে। যে পাথরের পেছনে ইকথিয়ান্ডার আছে সেটাকে পাশ কাটিয়ে চলল দুজন। মেয়েটি তখন। বলছে:
আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ঈশ্বর আপনাকে পুরস্কৃত করুন।
লোকটি বলল, ঈশ্বর কেন! আপনিই তো আমাকে পুরস্কৃত করতে পারেন।
কথাটায় গুরুত্ব দিল না মেয়েটি, বলল, আমার যেন মনে হলো একটা দানব দেখেছি।
ওটা স্বপ্নের ঘোর ছাড়া আর কিছু নয়, বলল লোকটি। কিম্বা অশরীরীও হতে পারে। হয়তো আপনাকে মরার কাছাকাছি দেখে আত্মা চুরি করতে এসেছিল। ঈশ্বরের নাম নিন। দুর্বল লাগছে? আমার গায়ে হেলান দিন। আমি আপনার কাছে থাকলে কোন ভূত-প্রেতই আপনাকে ছুঁতে পারবে না।
কৃষ্ণবর্ণ ছাগলা দাড়িওয়ালাকে মোটেই ভাল লোক বলে মনে হলো না ইকথিয়ান্ডারের। মিথ্যে বলে মেয়েটিকে প্রভাবিত করতে চাইছে লোকটা। কিন্তু করার কিছু নেই ওর। সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানানো চলবে না। মানুষের সামনে যেতে তাকে নিষেধ করা আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইকথিয়ান্ডার! যা হোক করুক ওরা। তার আর কিছু করার নেই। সে তার দায়িত্ব ঠিক মতোই পালন করেছে।
সাগরটা সুবিশাল আর ফাঁকা লাগছে এখন ওর। আবার বালিয়াড়ির দিকে তাকাল ইকথিয়ান্ডার। কাউকে দেখা গেল না। পাথরের আড়ালে চলে গেছে মেয়েটি আর ছাগলা দাড়িওয়ালা লোকটা।
একটা বিরাট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল সৈকতে। পানি সরে যেতেই ইকথিয়ান্ডার দেখতে পেলএকটা রুপোলি মাছ বালির ওপর ছটফট করছে। চারদিকে একবার দেখে নিল ইকথিয়ান্ডার। কেউ নেই কোথাও। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ও, মাছটাকে তুলে সমুদ্রে ছেড়ে দিল। মাছটা চলে যাওয়ার পর নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হলো ওর। কেন কে জানে! অনেকক্ষণ সৈকতে ঘুরে বেড়াল ও। বালিয়াড়িতে ঢেউয়ের ধাক্কায় যেসব প্রাণী উঠে এসেছে, একটু পর মারা যাবে, সেগুলোকে সে সাগরে ছেড়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ পর মনটা একটু শান্ত হলো ওর। ফিরে এলো স্বাভাবিক ফুর্তি। বাতাসে ওর কানকো শুকিয়ে যাচ্ছে, কাজেই মাঝে মাঝে সাগরে ডুব দিয়ে আসতে হচ্ছে ওকে। মনটা এখন ওর প্রসন্ন।
১২. ডাকাতদের পাল্লায়
ডাকাতদের পাল্লায় পড়ার পরও ডাক্তার সালভাদর তার আন্দেজ পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করেননি। তবে পরিকল্পনায় সামান্য পরিবর্তন এনেছেন তিনি। ঠিক করেছেন ক্রিস্টোকে বাড়িতেই রেখে যাবেন। ইতিমধ্যে ইকথিয়ান্ডারের চাকর হিসেবে বেশ ভাল দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে ক্রিস্টো। ডাক্তারের কথা শুনে সে-ও পুব খুশি। সালভাদর না থাকলে তো খুবই ভাল হয়। এবার নিয়মিত বালথাযারের সঙ্গে দেখা করতে আর কোন বাধা থাকবে না। বালুখার্যারকে জানানো হয়ে গেছে যে সাগর-দানোর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন ঠিক মতো তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।
লতাপাতা জড়ানো ইকথিয়ান্ডারের বাড়িতে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হয় ক্রিস্টোর। দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একাকী ইকথিয়ান্ডার খুব সহজেই ভালবেসে ফেলেছে ক্রিস্টোকে। তার কাছে ও শোনে পৃথিবীর কথা, মানুষের কথা, জীবনের কথা। বিনিময়ে ক্রিস্টোকেও সাগর-তলের গল্প বলে ও। সমুদ্রের এমন সব রহস্য ইকথিয়ান্ডার জানে যেগুলো কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেও জানা সম্ভব নয়। কোথায় কি আছে সাগরের তলায় তা ওর নখদর্পণে। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রাথমিক জ্ঞানও তার যথেষ্ট। নৌবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা বা পদার্থ বিজ্ঞান সম্বন্ধে বেশ ভালই জানা আছে ওর। কিন্তু অভাব হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানের। সেই ঘাটতিই ও ক্রিস্টোর কাছ থেকে পুষিয়ে নিতে চায়। ইতিহাস সম্বন্ধেও তার তেমন কোন ধারণা নেই। রাজনীতি আর অর্থনীতি সম্বন্ধেও তার জ্ঞান একেবারেই নেই।
দিনের বেলা যখন খুব গরম পড়ে, পানির নিচের সুড়ঙ্গ পথে। কোথাও না কোথাও শীতল পানিতে ভেসে যায় ইকথিয়ান্ডার। গরম কমলে ফিরে আসে। তখন সকাল পর্যন্ত সাদা বাড়িটাই থাকে। যদি বৃষ্টি হয় বা ঝড় ওঠে তাহলেও অবশ্য সে বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ সময়। মাটির ওপরের এই ভেজা পরিবেশ ওর একেবারে খারাপ লাগে না।
ইকথিয়ান্ডারের বাড়িটা খুব একটা বড় নয়। চারটে মাত্র ঘর। রান্নাঘরের কাছাকাছি নিজের জায়গা বেছেছে ক্রিস্টো। তার পাশেই ডাইনিং রূম। তারপর বিরাট একটা লাইব্রেরি। প্রচুর বই তাতে। ইংরেজি আর স্প্যানিশ, এই দুটো ভাষার ওপরই ভাল দখল আছে ইকথিয়ান্ডারের। লাইব্রেরির পর যে বড় ঘরটা আছে সেটাই ইকথিয়ান্ডারের শোবার ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা বাথটাবের মতো জলাধার আছে। খাট আছে দেয়ালের গায়ে লাগানো অবস্থায়। অবশ্য ঘুমাবার সময় খাটের তুলনায় জলাধারটাকেই বেশি পছন্দ ইকখিয়াল্ডারের।
এবার আন্দেজ পাহাড়ে যাবার আগে ডাক্তার সালভাদর ক্রিস্টোকে বলে গেছেন যাতে সে খেয়াল রাখে যে ইকথিয়ান্ডার যেন সপ্তাহে অন্তত তিনদিন খাটে ঘুমায়। সেটা নিশ্চিত করতে প্রতিদিন সন্ধেতে ইকথিয়ান্ডারের সামনে হাজির হতে হয় ক্রিস্টোকে। ইকথিয়ান্ডার খাটে শুতে না চাইলে জোর করে সে। অনুরোধ করে। প্রয়োজনে হুমকিও দেয়।
কিন্তু পানির তলায় ঘুমাতে আমার ভাল লাগে, ক্রিস্টো, প্রায়ই আপত্তি আর অনুযোগ জানায় ইকথিয়ান্ডার।
জবাবে ধমক দেয় ক্রিস্টো। ডাক্তার সাহেবের হুকুম, তোমাকে খাটেই শুতে হবে। তাঁর কথা শোনা উচিত। তারপর গলা নরম করে বলল। এসো তো, লক্ষ্মী ছেলের মতো শুয়ে পড়ো দেখি।
ডাক্তার সালভাদরকে ইকথিয়ান্ডার বাবা বলে ডাকে। কিন্তু। আসলেই তারা বাবা-ছেলে কিনা সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে ক্রিস্টোর। ইকথিয়ান্ডার ডাক্তার সালভাদরের চেয়ে অনেক ফর্সা। হতে পারে সেটা দীর্ঘ কাল পানির নিচে থাকার ফল। কিন্তু চেহারাতেও কোন মিল নেই ওর ডাক্তারের সঙ্গে। ইকথিয়ান্ডারের মুখের গড়ন ডিম্বাকৃতি, নাকটা খাড়া আর দীর্ঘ, ঠোঁট দুটো পাতলা, দুচোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। ও যেন আসলে আরাউকানি ইন্ডিয়ান! ক্রিস্টো নিজেও আরাউকানি, কাজেই ইকথিয়ান্ডারের চেহারার বৈশিষ্ট্য তার চোখে সহজেই ধরা পড়েছে। নানা সন্দেহের দোলায় দোলে ক্রিস্টোর মন।
বারবার মনে হয় যদি ইকথিয়ান্ডারের গায়ের রং দেখা যেত। তা আর হয়ে ওঠে না। একটা আঁশ সমৃদ্ধ পোশাক মতো পরে থাকে ইকথিয়ান্ডার সর্বক্ষণ। সারা দেহ আবৃত পোশাকটায়। কিছু বোঝার উপায় নেই যে আসলে উভচর মানুষটা কি বর্ণের। এ
ইকথিয়ান্ডারকে জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো, রাতেও ঘুমাবার সময় তুমি এই পোশাক খোলো না?
জবাবে ইকথিয়ান্ডার বলল, দরকার কি খোলার। আঁশের এই অবরণে আমার ভাল লাগে, আরাম পাই। কানকো দিয়ে নিঃশ্বাস নিতেও অসুবিধে হয় না। তাছাড়া আঁশগুলো অনেকটা বর্মের কাজ করে। হাঙরের দাঁত বা ছুরির মতো ধারাল কিছু এটা কাটতে পারে না।
গগল্স্ আর গ্লাভস্ কিসের জন্যে?
গ্লাভস পরলে দ্রুত সাঁতার কাটা যায়। আর সাগরের ঝড় তুফানে পানিতে বালির পরিমাণ বেড়ে গেলে গগলস্ আমার চোখ বাঁচায়। এটার আরও কাজ আছে। এটা পরলে আমি ভাল দেখতে পাই, না পরলেই সব ঝাঁপসা।
ক্রিস্টোকে বিশ্বাস করে ইকথিয়ান্ডার, কাজেই সব কথা বলে। খোলা মনে।
স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলল, ছোট ছিলাম যখন, বাবা আমাকে পাশের বাগানে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতে পাঠাতেন। গ্লাভস ছাড়া ওরা কিভাবে সাঁতার কাটে দেখে আমি অবাক হতাম। গ্লাভূসের কথা ওদের আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম, কিন্তু আমার কথা ওরা বুঝতেই পারেনি। গ্লাস্ কি সেটা ওরা জানত না। তারপর আর কখনও আমি ওদের সামনে সাঁতার কাটিনি।
সাগরের সেই খাঁড়িটায় তুমি কি এখনও সাঁতার কাটো? কৌশলে জানতে চাইল ক্রিস্টো। মতলব হাসিলের ফন্দি আঁটছে।
কাটি, জবাবে বলল ইকথিয়ান্ডার, তবে সুড়ঙ্গের কাছ থেকে বেশি দূর যাই না। একবার তো কারা যেন জাল দিয়ে আমাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল। সেই থেকে আমি সাবধান হয়ে চলাফেরা করি।
ক্রিস্টো মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছে। জানতে চাইল, তাহলে সাগরের নিচে একটা সুড়ঙ্গও আছে?
একটা নয়, অনেকগুলো আছে। ভাবতে আমার খারাপ লাগছে যে তুমি আমার সঙ্গে সাগরের তলায় ডুব দিয়ে আশ্চর্য সব জিনিস দেখতে পারবে না। জানো, কত কি আছে সাগর-তলায় আচ্ছা, ক্রিস্টো, তোমরা পানির নিচে থাকতে পারো না কেন?আহা, যদি পারতে তাহলে তোমাকে লিডিঙের পিঠে চড়িয়ে কত জায়গা যে ঘুরিয়ে আনতে পারতাম!
লিডিং! লিডিংটা কে?
আমার পোশ ডলফিন। এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছি যে ধরে নাও ও আমার পানির ঘোড়া। খুব সুন্দর সাঁতার কাটে। একবার বিরাট এক বিপদে পড়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় ডাঙায় উঠে পড়েছিল। অনেক কষ্টে ওকে আবার পানিতে নামাতে পারি। ডাঙায় যেন ওর ওজন বেড়ে গিয়েছিল। ডাঙায় নিজেকেও আমার ভারী বলে মনে হয়। যাই হোক, মাস খানেক নিয়মিত খাইয়ে লিডিংকে আমি সুস্থ করে তুললাম। সেকারণেই ও আমার সাঙ্তিক ভক্ত। অবশ্য সাগরের সব ডলফিনের সঙ্গেই আমার খাতির আছে। ওদের সঙ্গে খেলতে দারুণ মজা! জাননা, ক্রিস্টো, আমার কিন্তু অনেক মাছ বন্ধুও আছে। আমি যখন সাগরে সাঁতার দিই তখন তারা ঝাক বেঁধে আমার পেছনে ছোটে।
আচ্ছা, সাগরে তোমার কোন শত্রু নেই? জানতে চাইল ক্রিস্টো। সব সময় শুধু নিজের উদ্দেশ্য পূরণের পথ খুঁজে চলেছে ওর মগজ। জানতে চায় সমস্ত রহস্য।
হ্যাঁ, তা আছে। হাঙর আছে। অক্টোপাস আছে। তবে ওদের আমি ভয় পাই না। সঙ্গে সবসময় ছোরা রাখি আমি।
কিন্তু ওরা যদি তোমাকে পেছন থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে, তখন?
অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। কি যে বলো! আমি তো অনেক আগেই ওদের আসার আওয়াজ টের পেয়ে যাই। শুধু কি কান, আমি তো সারা শরীর দিয়ে শুনতে পাই, বুঝতে পারি। যে-ই সাঁতার দিয়ে আমার কাছে আসুক না কেন, তক্ষুণি আমি টের পেয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি হুঁশিয়ার।
আর ঘুমের সময়?
তখনও সব টের পাই। কেমন যেন একটা চেতনা থাকে।
মনে মনে ক্রিস্টো ভাবল, পেদরো জুরিতা এই সাগর দানোকে…নাহ, দানো একে কিছুতেই বুলা যায় না। মানুষের সমস্ত কোমল অনুভূতি আর মানবিক গুণ রয়েছে এর। বেশির ভাগ মানুষই এর তুলনায় অনেক নিচু শ্রেণীর। তাছাড়া ইকথিয়ান্ডার কারও ক্ষতি করে না, অথচ সাহসী আর শক্তিশালী। শিশুর মতোই সরলও। পেদরো ঠিকই করছে, একে ধরার জন্যে অর্থব্যয় মোটেই বাজে খরচ নয়। এবার যা যা জানা গেছে সেগুলো পেদরো জুরিতাকে জানাতে হয়।
ইকথিয়ান্ডারের কথা শেষ হয়নি। আবার শুরু করল ও, ক্রিস্টো, পানির নিচের জগন্টা যে কী সুন্দর! ওপরের পৃথিবী ধুলো আর ময়লায় ভরা, আমার মোটেই পছন্দ নয়। বিষাক্ত আর গুমোট ওপরের পৃথিবীর পরিবেশ। পানির নিচের জীবনই আমার ভাল লাগে। তোমাদের এই ওপরের জীবনটা যেন, অসহ্য!
আমাদের ওপরের জীবন বলছ কেন? বলল ক্রিস্টো। তুমিও কি। ওপরের মানুষ নও? তোমার মা কোন জগতের মানুষ ছিলেন?
কথাটা খানিকের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। তারপর বলল, তা বলতে পারি না। বাবার কাছে শুনেছি আমার জন্মের সময়েই মা মারা যান।
তাহলে নিশ্চয়ই ওপরের পৃথিবীরই মানুষ ছিল সে, মন্তব্যের ঢঙে বলল ক্রিস্টো।
তা হতে পারে, বলল চিন্তিত এবং অন্যমনস্ক ইকথিয়ান্ডার।
ক্রিস্টো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, জেলেদের সঙ্গে তুমি বাঁদরামো করো কেন? ওদের জাল কেটে দাও, নৌকো থেকে মাছ ফেলে দাও। কেন?
এজন্যে যে ওরা দরকারের তুলনায় অনেক বেশি মাছ ধরে।
কিন্তু সেতো ধরে বিক্রির জন্যে!
কথাটা বুঝতে পারল না ইকথিয়ান্ডার। সেটা বলায় ক্রিস্টো ভেঙে বলল: অন্য লোকরা খাবে বলেই ধরে ওরা।
পৃথিবীতে তাহলে অনেক মানুষ? বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করল ইকথিয়ান্ডার। পর মুহূর্তে বলল, ডাঙায় তো পশু-পাখির অভাব নেই। তাহলে ওরা সাগরের মাছ ধরে কেন?
সে তোমাকে বোঝানো যাবে না, বিরাট একটা হাই তুলল ক্রিস্টো। খুব ঘুম পেয়েছে। আমি গেলাম তাহলে। তুমি আবার পানির নিচে ঘুমিয়ো না, ডাক্তার সাহেব খুব রাগ করবেন।
ক্রিস্টো বিদায় নিল। ফিরল পরদিন সকালে। এসে দেখে ইকথিয়ান্ডার খাটে নেই। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে পানির ফোঁটা। আপন মনে গজর গজর করল সে, আবার পানির নিচে ঘুমিয়েছে। সকাল হতে না হতেই সাগরে গিয়ে হাজির! যত্তসব!
খাবার সময় পার হয়ে যাবার অনেক পরে ফিরল ইকথিয়ান্ডার। কেমন যে মনমরা হয়ে আছে। বাসন থেকে এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে বলল, আবার সেই মাংস? মাংস আমার ভাল লাগে না, ক্রিস্টো।
জবাবে ধমক দিল ক্রিস্টো, মাংসই তোমাকে খেতে হবে, ডাক্তার সাহেবের নির্দেশ আছে। কাঁচা মাছ খেতে পারবে না তুমি।…কি হলো, খেয়ে এসেছ বুঝি? আর পানির নিচেও ঘুমিয়েছ, তাই না? ডাক্তার সাহেব বলেছেন এমন ভাবে চললে পৃথিবীর ওপরে শ্বাস নেয়ার ক্ষমতা। তোমার একেবারে চলে যাবে। বাতাসের মধ্যে তোমার বুক ব্যথা করবে। আজকে ডাক্তার সাহেব আসুন, তোমার অবাধ্যতা সব বলব তাকে বলব আমার কথা তুমি এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দাও।
চুপ করে কি যেন ভাবল ইকথিয়ান্ডার, তারপর অনুরোধের সুরে বলল, কিছু বোলো না বাবাকে, ক্রিস্টো। আমি চাই না বাবা মনে কষ্ট পান। একটু থেমে বলল, জানো, ক্রিস্টো, সৈকতে আমি একটা মেয়েকে দেখেছি। কী যে সুন্দর দেখতে! মনে হচ্ছে ওপরের পৃথিবী বুঝি পানির তলার চেয়েও ভাল। ওই মেয়ের মতো অত সুন্দর কিছু পানির তলায় নেই।
হাসল ক্রিস্টো। তাহলে ওপরের পৃথিবীর অত দুর্নাম করো কেন?
জবাবটা এড়িয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার। বলল, লিডিঙের পিঠে বসে আমি যাচ্ছিলাম সাগরের তীর ঘেঁসে। প্রায় বুয়েন্স আয়ার্স বন্দরের কাছে চলে এসেছি, এমন সময় দেখলাম সেই মেয়েটিকে। নীল তার চোখ। চুলগুলো সোনালী! এত সুন্দর! কিন্তু আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। আমার তখন মনে হলো কেন যে গ্লাভস আর চশমা পরেছি! একটু বিরতি। কি যেন ভাবছে ইকথিয়ান্ডার। তারপর আবার বলল, একবার পানিতে ডুবে যাচ্ছিল একটা মেয়ে। তাকে আমি বাঁচিয়েছিলাম। তখন অত খেয়াল করে ওকে দেখিনি। আজ যেন মনে হলো এই মেয়েটিই সেই মেয়েটি। সেই মেয়ের চুলগুলোও সোনালী ছিল। চোখও নীল ছিল। এবার একটু নিশ্চিত গলায় বলল, হ্যাঁ, এ-ই সে। এই মেয়েই সে-মেয়ে। আমার মনে পড়েছে… আয়নার সামনে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। আপন মনে নিজের চেহারা দেখল আয়নায়।
তুমি তারপর কি করলে? জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো।
করুণ হাসল ইকথিয়ান্ডার। আকুলতা চাপতে পারল না। বলল, অপেক্ষা করলাম। অনেক, অনেকক্ষণ। কিন্তু ও আর ফিরল না। আচ্ছা, ক্রিস্টো, আর কি মেয়েটা কখনও সাগর সৈকতে আসবে না?
ক্রিস্টোর মাথায় তখন অন্য চিন্তা চলছে। বহুবার চেষ্টা করেছে সে ইকথিয়ান্ডারের মনে বুয়েন্স আয়ার্স সম্বন্ধে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে। চেয়েছে ওকে নিয়ে কোনভাবে ওখানে পৌঁছোতে। কখনোই ইকথিয়ান্ডারকে উৎসাহী মনে হয়নি। আজ মনে হচ্ছে ওকে বাগে পাওয়া যাবে। একবার ওকে বুয়েন্স আয়ার্সে নিয়ে যেতে পারলেই হয়, তাহলেই ওকে ওখান থেকে গায়েব করে দিতে পারবে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা।
কৌশল করল ক্রিস্টো, বলল, মেয়েটা হয়তো আর সাণৰু-সৈকতে আসবে না। কিন্তু তাতে কি আছে! শহরে যাবার মতো পোশাক পরে আমার সঙ্গে বুয়েন্স আয়ার্সে চলো তুমি, ঠিকই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পারব আমরা।
আনন্দে দিশেহারা দেখাল ইকথিয়ারকে। তাহলে…শহরে গেলে ওকে দেখতে পাব তো?
নিশ্চই পাবে, নিশ্চয়তা দিল ক্রিস্টো।
ইকথিয়ান্ডার আকুল গলায় বলল, তাহলে এখনই চলো।
আপত্তি করল ক্রিস্টো। আজ নয়। আজকে দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া…
শুনল না ইকথিয়ান্ডার। বলল, আজই, ক্রিস্টো। আজই। তুমি যাও হাঁটাপথে? আমি লিডিঙের পিঠে চেপে চলে যাব।
এত উৎসাহ কেন! হাসল ক্রিস্টো। বুঝতে পারছে প্রেমে পড়েছে উভচর মানব। যুক্তি দিয়ে বলল, আজ আর নয়। আজ গিয়ে কোন লাভ হবে না। কোথায় ওকে খুঁজব রাতে? তারচেয়ে কালকে ভোরে আমরা রওনা হবো। তুমি খাঁড়ির কাছে চলে এসো, তোমার জন্যে পোশাক নিয়ে এখানে আমি হাজির থাকব। এখন সেঁটে ঘুম দাও। শরীরটা চাঙা থাকা দরকার।
মনে মনে ভাবছে ক্রিস্টো, আজ রাতেই বালথায়ারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। জানাতে হবে উভচর মানব প্রায় তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে।
১৩. একটানা ডুব সাঁতার
একটানা ডুব সাঁতার দিয়ে সাগরের ঘড়ির কাছে পৌঁছোল ইকথিয়ান্ডার। ক্রিস্টো তার কথা রেখেছে। দাঁড়িয়ে আছে সে একটা সাদা স্যুট নিয়ে। ওটার দিকে ইকথিয়ান্ডারের তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো পোশাকটা যেন আসলে পোশাক নয়, সাপের কুৎসিত একটা খোলস। কিন্তু কি আর করা! দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পোশাকটা পরতে শুরু করল ও। জীবনে এধরনের পোশাক খুব কমই পড়েছে ও। স্যুট পরা হতেই ক্রিস্টো ওর গলায় একটা টাই বেঁধে দিল।
ক্রিস্টো ঠিক করেছে ইকথিয়ান্ডারকে অবাক করে মুগ্ধ করে দেবে। শহরের সবচেয়ে বড় রাস্তা, আভেনি-দ্য-অ্যালাভেয়ারে নিয়ে গেল সে। নিয়ে গেল বেতিস, ভিক্টোরিয়া চক, গির্জা, মূর সভ্যতার সময় সৃষ্টি অপূর্ব সুন্দর টাউন হল আর ছায়াময় নিরব গাম্ভীর্য ভরা রাষ্ট্রপতি ভবনে।
ইকথিয়ান্ডারকে অবাক করতে গিয়ে কাজটা ভাল করেনি ক্রিস্টো। যানবাহন, লোকজন, ভীড়-ভাট্টা, হৈ-চৈ, ধুলো আর ভ্যাপসা গরমে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। তবুও ওর চোখ যেন সর্বক্ষণ খুঁজছে কাকে। বারবার ক্রিস্টোর হাত আঁকড়ে ধরছে ও, নিচু স্বরে বলছে, ওই যে! ওই যে। ও-ই না ও?
কিন্তু ভুল দেখছে ইকথিয়ান্ডারের তৃষিত চোখ। নিজেই সামান্য পরে বুঝতে পারছে ভুলটা। হতাশ হয়ে যাচ্ছে ওর মন। আপন মনে বলছে, না, না, এ-তো সে নয়!
বুয়েন্স আয়ার্স বড় শহর। পথে-ঘাটে অসংখ্য মেয়ে। কোন এক নির্দিষ্ট মেয়েকে ঠিকানা ছাড়া খুঁজে বের করা যে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ এটা পরিশ্রান্ত হতাশ ইকথিয়ান্ডার এখনও জানে না। ইতিমধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে ওর। দম আটকে আসতে চাইছে।
ছোট একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামল ক্রিস্টো। বলল, এসো, হালকা কিছু খেয়ে নেয়া যাক। তারপর আবার খোজা যাবে।
ঘরটা মাটির তলায়, তাই বেশ ঠাণ্ডা। তবে ভেতরটা চুরুটের ধোয়া আর হট্টগোলে ভরপুর। অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরা লোকজন গিজগিজ করছে। ইকথিয়ান্ডারের দম বন্ধ হয়ে এলো। হাতে খবরের কাগজ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক জুড়েছে কয়েকজন, মাত করে রেখেছে গোটা রেস্টুরেন্ট। এতজন একসঙ্গে কথা বলছে যে কোন ভাষা সেটা বোঝাই মুশকিল। মাথার ভেতরটা কেমন যেন করতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডারের। কান ভোঁ-ভোঁ করছে। খাওয়া স্পর্শ পর্যন্ত করল না সে। শুধু পানি খেয়ে পেট ভরাল!
ক্রিস্টোকে বলল, এত মানুষের ভিড়ে নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে বের করা তো অসম্ভব। এর চেয়ে মহাসাগরে একটা চেনা মাছ খুঁজে বের করা অনেক সহজ কাজ হবে। ভাল লাগছে না আমার তোমাদের এই শহরে। পাঁজর ব্যথা করছে। চলো, বাড়ি ফিরে যাই।
বেশ তো, বলল ক্রিস্টো। আরেকটু অপেক্ষা করো। আমার আরেক বন্ধু আছে, তার সঙ্গে দেখা সেরেই ফিরে যাব।
না, আর কারও সঙ্গে দেখা করার অবস্থা নেই আমার।
কোত্থাও যেতে হবে না। ওর বাড়ি আমাদের ফেরার পথেই পড়বে।
কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে। একটু পরই রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলো ওরা, দুর্বল বোধ করছে তাই ক্রিস্টোর পেছনে পা বাড়াল ইকথিয়ান্ডার।
শহর শেষ হয়ে গেল, শহরতলিতে চলে এলো ওরা। এদিকে গাছগাছালি বেশি। ফণীমনসা জন্মেছে। পীচ আর জলপাইয়ের বাগানও আছে। ক্রিস্টো কৌশলে বন্দরের দিকে চলেছে। উদ্দেশ্য তার ভাই। বালথাযারের সঙ্গে দেখা করা।
কিছুক্ষণ পর সাগর তীরে, বন্দরে চলে এলো ওরা। সাগরের ভেজা বাতাস বুক ভরে টেনে নিয়ে একটু স্বস্তি বোধ করল ইকথিয়ান্ডার। ওর ইচ্ছে হলো গায়ের কাপড় খুলে ফেলে সাগরে ঝাঁপ দেয়। ক্রিস্টো : আন্দাজ করতে পারছে ওর মনোভাব। ত্রস্ত ভাবে বলল, এই তো এসে গেছি। আর বেশি দূরে নেই ওর বাড়ি।
একটা বাড়ির অন্ধকারাচ্ছন্ন আঙিনায় প্রবেশ করল ওরা। চোখে অন্ধকার সয়ে যেতেই অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। এ যেন কোন দোকান নয়, সাগর-তলেরই কোন স্থান। দোকানের তাকে, আলমারিতে, শো-কেসে আর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের শঙ্খ আর ঝিনুক শামুক। ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে প্রবালের খণ্ড, তারা মাছ, শুকনো কাঁকড়া, শুটকি মাছ এবং নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী। হরেক রকমের মুক্তো ছড়িয়ে আছে কাউন্টারের কাঁচের তলায় একটা আলমারিতে রয়েছে কিছু মুক্তো। ওগুলোর রং গোলাপী। দামি জিনিস।
পরিবেশটা পরিচিত ঠেকায় ইকথিয়ান্ডারের মন কিছুটা স্বস্তি পেল। একটা পুরোনো বেতের চেয়ারে তাকে বসতে দিল ক্রিস্টো। বলল, খানিক বিশ্রাম নিয়ে নাও, ইকথিয়ান্ডার। হাঁক ছাড়ল ভেতর পানে চেয়ে। বালথাযার! গুট্টিয়ার!
পাশের ঘর থেকে কে যেন সাড়া দিল। কে, ক্রিস্টো নাকি? ভেতরে চলে এসো।
দুঘরের মাঝের দরজাটা উচ্চতায় অত্যন্ত কম। কুঁজো হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো ক্রিস্টোকে।
এঘরটাকে বলা যেতে পারে বালথাযারের গবেষণাগার; অ্যাসিড দিয়ে ধুয়ে এখানে মুক্তোর চাকচিক্য বাড়ায় সে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ক্রিস্টো। ভাইকে বলল নিচু গলায়, সব ভাল তো, বালথাযার? গুট্টিয়ারা কোথায়?
আছি ভালই, জবাবে বলল বালার। মেয়েটা গেছে পাশের বাড়িতে ইস্ত্রি আনতে। এক্ষুণি ফিরে আসবে। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতার কি খবর?
কে জানে সে কোথায়। একটু বিরক্ত বালথাযার! কালকে তার সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে আমার।
কারণ কি? গুট্টিয়ারা নাকি?
আর বোলো না। মেয়েটার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে জুরিতা। গুট্টিয়ারাও আগের কথাই বলে যাচ্ছে। না, জুরিতাকে কিছুতেই বিয়ে করব না। ও বোঝে না যে পেদরোর মতো স্বামী পেলে যেকোন রেড ইন্ডিয়ান মেয়ে খুশিতে মনে মনে নাচতে শুরু করে দেবে। কিসের অভাব পেদোরা? টাকা আছে, নিজের জাহাজ আছে, ডুবুরি আছে। একটা মানুষের আর কি দরকার বলো, ক্রিস্টো? একটু থামল বালথাযার, তারপর বিরক্ত স্বরে বলল, কি জানি মনের দুঃখে পেদরো হয়তো এখন কোথাও বসে মদ গিলছে।
ওকে নিয়ে এসেছি, বালথাযার, নিচু স্বরে ভাইকে বলল ক্রিস্টো।
কোথায়? চমকে গেল বালথাযার।
ওঘরে বসে আছে।
দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিল বালথাযার কৌতূহল মেটাতে। কই? কোথায়? দেখছি না যে?
কাউন্টারের সামনে চেয়ারে বসে আছে।
কই! ওখানে তো দেখছি গুট্টিয়ারা।
দরজা খুলে তড়িঘড়ি দোকানে চলে এলো ক্রিস্টো আর বালথাযার।
ইকথিয়ান্ডার দোকানে নেই। দোকানে শুধু আছে বালথাযারের পালক মেয়ে গুট্টিয়ারা!
অপূর্ব সুন্দরী সে। চারপাশে ছড়িয়ে গেছে তার রূপের খ্যাতি। অনেকেই তাকে বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে একই জবাব দিয়েছে গুট্টিয়ারা। এখন আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।
ক্যাপ্টেন পপদরো জুরিতাও বউ করতে চায় গুট্টিয়ারাকে। বালথাযারেরও এই বিয়েতে মত আছে। একজন জাহাজ মালিকের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে পারলে সেটা বিরাট ব্যাপার। কিন্তু গুট্টিয়ারার সেই একই কথা। না।
কেমন আছো, মা? ভাতিজিকে জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো। ছোঁড়া গেল কোথায়? জানতে চাইল বালথাযার।
হাসল গুট্টিয়ারা। বলল, আমি ওকে লুকিয়ে রাখিনি। আমাকে দেখেই কেমন যেন চমকে মতো উঠল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। দেখে তো মনে হলো ভয় পেয়ে গেছে। তারপর বুক চেপে ধরে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।
আসল ঘটনা বুঝে ফেলল ক্রিস্টো। গুট্টিয়ারাই তাহলে ইকথিয়ান্ডারকে পাগল করা সেই অপূর্ব সুন্দরী পরী। না, আর কোন সন্দেহ নেই।
১৪. রাস্তাটা সাগরের ধার ঘেঁষে
রাস্তাটা সাগরের ধার ঘেঁষে। ওটা ধরে উন্মত্ত উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। শহর পেরোতেই সৈকতে একটা পাথরের আড়ালে চলে এলো সে, কাপড়চোপড় খুলে নেমে পড়ল সাগরে। শহরের বাতাসে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর। এখন কানকো ভরে দম নিয়ে তৃপ্তি বোধ করল। এত দ্রুত ও সাঁতার কাটছে যেমন ও কাটেনি কখনও। কিসের এক অজানা আকুতি আর তাড়া পেয়ে বসেছে ওকে।
এদিকের সাগরের সবই ওর চেনা। ওই তো দেখা যাচ্ছে টারব্যাট মাছের বাড়িটা। সামান্য দূরে ওই যে সেই নানা রঙা প্রবালের পাহাড়। ওটার ধারেকাছে ঘুরঘুর করছে লাল ফিনওয়ালা অসংখ্য খুদে মাছ, বড় মাছদের তাড়া খেলেই চট করে ঢুকে পড়বে প্রবালের খুঁজে-ফোকরে। ওই যে সেই ডুবন্ত জেলে নৌকো। ওখানে সংসার পেতেছে দুটো অক্টোপাস। ভারি ভাব দুটোতে। কিছুদিন আগেই ওদের বাচ্চা হয়েছে কয়েকটা। পাটকিলে পাথরটার নিচে আছে কাঁকড়াদের সংসার।
ওদের চেনে ইকথিয়ান্ডার। জানে ওদের সুখ-দুঃখ সাংসারিক সম্পর্ক এবং ভালবাসার খবর। ভাল একটা শিকার ধরতে পারলে ওদের যে আনন্দ হয় তা বলে বোঝানো যাবে না। আবার শত্রুর সঙ্গে লড়াই বেধে একটা দাঁড়া হারাতে হলে ওদের কষ্ট তা-ও বলার মতো নয়।
ওই যে দেখা যাচ্ছে সেই ডুবো পাথর। ওখানে আড্ডা গেড়েছে। ঝিনুকের দল। তাদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না।
ঢেউয়ের মাথায় একদল ডলফিন দেখতে পেয়ে ডাকল ইকথিয়ান্ডার, লিডিং! লিডিং!
ওদের মাঝেই লিডিং ছিল। ডাক শুনে ঝড়ের বেগে লেজ নাচিয়ে ইকথিয়ান্ডারের কাছে চলে এলো ও। তাকে জড়িয়ে ধরল। ইকথিয়ান্ডার।
চল, আমাকে নিয়ে চল। দূরে। অনেক দূরে কোথাও!
কে বলতে পারবে লিভিং ওর কথা বোঝে কিনা। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে ছুটল সে। মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে, তারপর ঢেউ ছাপিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে পানির নিচে, চলে যাচ্ছে গভীর গহীন সমুদ্রের তলায়। তাতেও যেন মন ভরছে না ইকথিয়ান্ডারের। মনে কিসের এক অশান্তি। তার মনের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। লিডিং জোরে ছুটে চলেছে, কিন্তু আজ তাতেও যেন আনন্দ পাচ্ছে না ইকথিয়ান্ডার। লিডিঙের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরও গভীর সাগবে ডুব দিল ও। শহরে সেই মেয়েকে দেখে আজ যে অনুভূতি তার হয়েছে। সেটা কিছুতেই কেন যে ভুলতে পারছে না বুঝতে পারছে না ওর মন। নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে আজ ও উদ্বেগ, প্রশ্ন আর নানা অস্পষ্ট কষ্টকর অনুভূতি জাগছে মনে। সাগরের গভীর অন্ধকারে একাকিত্ব জেঁকে বসেছে। তা-ই চায় ও। একটু একা থাকা দরকার। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। জানা দরকারী হয়ে পড়েছে আজ, কেন সে আর সব মানুষের মতো নয়। কেন সাগরে এবং ডাঙা, দুজায়গাতেই ও স্রেফ এক ক্ষণিক অতিথি আগন্তুক।
ধীরে ধীরে সাগরের গভীরে নেমে চলেছে ইকথিয়ান্ডার আস্তে আস্তে ওর দেহের ওপর বাড়ছে পানির চাপ। কষ্টকর হয়ে উঠছে শ্বাস নেয়া। সাগরের এত গভীরে মাছের সংখ্যাও কম। যাদের ও আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ওর অচেনা। নিরব এই কবরের মতো অন্ধকার স্থবির জগতে আগে আর কখনও আসেনি ও। কেমন যেন শিউরে উঠল ইকথিয়ান্ডারস্ট্রতবেগে সাঁতার কেটে ওপরে উঠতে শুরু করল।
পানির ওপরে যখন মাথা জাগাল, সূর্য তখন পাটে বসেছে। গোল একটা লাল থালার মতো। নিরুত্তাপ লাল আলো গায়ে মেখে নাচতে নাচতে ছুটছে তখন অসংখ্য ঊর্মি।
নৌকো সৈকতে ভোলার জন্যে হাঁটু পানিতে নেমেছে কয়েকজন জেলে। দূর থেকে তাদের দেখল ইকথিয়ান্ডার। পছন্দ করতে পারল না। তাদের উপস্থিতি। খামোকা চেঁচাচ্ছে লোকগুলো। কটু গন্ধওয়ালা চুরুট কুঁকছে। ওদের চেয়ে ডলফিনদের সংসর্গ অনেক আনন্দদায়ক। ওরা অনেক পরিষ্কার, অনেক মজার মজার খেলায় মেতে থাকে।
একটানা তিনদিন হলো মহাসাগরে রয়ে গেছে ইকথিয়ান্ডার। বুকের মাঝে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে ও। অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়েছে। অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও পায়নি। অসম্পূর্ণ আত্ম অনুসন্ধান অস্থির করে তুলছে ওকে। এ এক অজানা আকুতি
ওদিকে ক্রিস্টোর মাথা খারাপ হবার জোগাড়। তিনদিন হলো কোন খবর নেই ইকথিয়ান্ডারের। গেল কই ছোকরা? কোন বিপদ হলো না তো?
তৃতীয় দিন ইকথিয়ান্ডার ফিরে আসার পর অভিযোগের সুরে বলল সে, কোথায় ছিলে? আরেকটু হলে আমার চাকরি চলে যেত। এমন, আর কক্ষনো কোরো না।
সাগরের নিচে ছিলাম, সংক্ষেপে জবাব দিল ইকথিয়ান্ডার। এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন তোমাকে দেখতে?
জীবনে এই প্রথম মিথ্যে বলল ইকথিয়ান্ডার। আরেকটু হলে মারাই পড়তাম।
যে ঘটনা সে ক্রিস্টোকে বলল তা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবে ঘটনা ঘটেছিল অনেক দিন আগে। একটা ক্যানিয়নের ধার ঘেঁষে তখন সাঁতার কাটছিল ইকথিয়ান্ডার। ক্যানিয়নের খাদে নামতেই হঠাৎ করে কানকোয় তীব্র ব্যথা অনুভব করল। মাথা ঘুরছে। পানিতে কিসের যেন কটু গন্ধ। দেখল, একটা হাঙর হাঁসফাঁস করতে করতে তার পাশ দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে অন্তহীন গহ্বরে। হাঙরটা বোধহয় ওকেই আক্রমণ করতে আসছিল। কিন্তু বিষাক্ত এই খাদের কাছে এসে নিজেই মারা পড়ছে। শেষ পর্যন্ত মারা গেল হাঙরটা। ইকথিয়ান্ডার কোন রকমে ক্রল করে সরে এলো বিষাক্ত খাদের কাছ থেকে।
অবাক হয়ে শুনছে ক্রিস্টো। ডাক্তার সালভাদরের কাছ থেকে এঘটনার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরে শুনেছিল ইকথিয়ান্ডার। সেটাও গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিল। বলল, নিশ্চই ওই খাদে কোন বিষাক্ত গ্যাস জমছে। হাইড্রোজেন সালফাইড বা অ্যানহাইড্রাইড হতে পারে। সাগরের ওপরে এলে অক্সিজেনের সংস্পর্শে ওগুলো ক্ষতি করার ক্ষমতা হারায়। কিন্তু পানির তলায় ওই খাদ থেকে যেহেতু গ্যাস বের হচ্ছে, ফলে ওখানে পরিবেশটা সাজ্জাতিক বিষাক্ত। এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল ও। বলল, খিদে পেয়েছে খুব। কিছু একটা খেতে দাও তো, ক্রিস্টো।
ইকথিয়ান্ডার মোটামুটি স্বাভাবিক আছে দেখে বিরাট স্বস্তি পেল ক্রিস্টো। নিশ্চিন্তু বোধ করত, কিন্তু করতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা গোপন করছে ইকথিয়ান্ডার। মাত্র ভেবেছে জিজ্ঞেস করবে কথাটা, তখনই দস্তানা আর গগলস পরে আবার বের হয়ে গেল, ইকথিয়ান্ডার, থামানো গেল না তাকে।
১৫. নীল নয়না সুন্দরী
বালথাযারের দোকানে নীল নয়না সুন্দরীকে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল ইকথিয়ান্ডার, তারপর কি যে হলো, কোথায় যাবে, কি করবে, বুঝতে না পেরে সোজা সাগরে এসে নামল ও। অথচ প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছিল যেন ফিরে যায়। এখন সেই বোধ আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে, তীক্ষ্ণধার একটা ছুরি যেন, খুঁচিয়ে চলেছে ওকে। বাড়ি ফেরার পর মেয়েটির কাছে ফেরার তাগাদা আরও বেড়েছে ওর। ক্রিস্টোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় ক্রিস্টো উপস্থিত থাকবে এটা চাইছে না ও। প্রতিদিন সৈকতের সেখানে ফিরে যায় ও, যেখানে সেদিন দেখেছিল নীল নয়নাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একটা পাথরের আড়ালে বসে অপেক্ষা করে ও, যদি দেখা মেলে সেই মেয়েটির! এখন আর সে গ্লাভস এবং গগলস পরে না, পরে সেই সাদা স্যুট, যাতে মেয়েটি আবার ভয় না পায়। কখনও কখনও ওর সারা রাত কেটে যায় সাগর সৈকতে।
সেই দোকানে যাবে একবার? ভাবে ইকথিয়ান্ডার। একবার গেলও। কিন্তু দোকানে তখন এক বুড়ো ছাড়া আর কেউ ছিল না। এবার সৈকতে চলে এলো ও হতাশ হয়ে। চমকে যেতে হলো ওকে। ওই তো! ওই তো! ওই যে সেই মেয়েটি!!! আজ ওর পরনে সাদা একটা পোশাক। মাথায় খড়ের টুপি। চমৎকার লাগছে দেখতে। কিন্তু ও যেন একটু উৎসুক? মেয়েটি পায়চারি করছে সৈকতে, বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে, যেন কারও প্রতীক্ষায় আছে। ইকথিয়ান্ডারকে সে দেখেনি। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ইকথিয়ান্ডার।
কার উদ্দেশে যেন হাত নাড়ল মেয়েটি। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মেয়েটার হাত নাড়া লক্ষ্য করে তাকাল ইকথিয়ান্ডার। দেখল স্বাস্থ্যবান এক সুদর্শন যুবক দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে এদিকেই। মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়াল সে। কণ্ঠে মধু ঝরল।
শুভ সন্ধে, আমার গুট্টিয়ারা।
শুভ সন্ধে, অলসেন, জবাবে রিনিঝিনি করে উঠল গুট্টিয়ারার মিষ্টি কণ্ঠ।
হাতে হাত ধরল দুজম। বুকের ভেতর কি যেন নড়ে গেল ইকথিয়ান্ডারের। চোখে নিরব নিষেধ আর অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকল ও। নিজের অনুভূতি নিজেই বুঝতে পারছে না। চোখে অশ্রু চলে এলো।
যুবকের দৃষ্টি গুট্টিয়ারার গলার ওপর। একটা মুক্তোর মালা ঝিলমিল করছে বরাদে।
এনেছ, গুট্টিয়ারা?
মাথা দোলা মেয়েটি। এনেছি।
তোমার বাবা জানবে না তো?
না। এটা আমার নিজের জিনিস। বাবা কিছু বলবে না। যা খুশি আমি করতে পারি এটা নিয়ে…
আলাপ করতে করতে সাগরের কিনারায় চলে এলো যুবক-যুবতী। গলা থেকে মালাটা খুলল গুট্টিয়ারা, সূর্যের সোনালী আলোয় ওটা চোখের সামনে ধরে প্রশংসার সুরে বলল, দেখো, কি চমৎকার লাগছে রোদে। নাও, অলসেন…
হাত বাড়াল অলসেন। কিন্তু কপাল মন্দ তার! গুট্টিয়ারার হাত ফস্কে সাগরে পড়ে গেল মালা, মুহূর্তে ফিরতি ঢেউয়ের স্রোতে পড়ে হারিয়ে গেল সাগরের মাঝে।
গুঙিয়ে উঠল গুট্টিয়ারা। কি হবে এখন?
থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল দুজন। হতাশ হলেও অলসেন বলল, পানির তলায় একবার খুঁজে দেখলে হয়।
মাথা নাড়ল গুট্টিয়ারা। এখানে সাগর বেশ গভীর। আমাদের কপাল খারাপ। ওই মালা আর পাওয়ার আশা নেই।
বিমর্ষ গুট্টিয়ারাকে দেখে স্থির থাকতে পারল না। ইকথিয়ান্ডার, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল যুবক-যুবতীর সামনে উপস্থিত হয়ে গেছে সে। পাথরের আড়াল থেকে তাকে বের হতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল অলসেন। চোখে কৌতুক আর বিস্ময় নিয়ে গুট্টিয়ারাও তাকাল। ইকথিয়ান্ডারকে সে চিনতে পেরেছে। এই যুবকই সেদিন দোকানে অদ্ভুত আচরণ করেছিল, তাকে দেখে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল দোকান থেকে।
আমি কি আপনার মুক্তোর মালা সাগর থেকে তুলে দিতে পারি? অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে জানতে চাইল ইকথিয়ান্ডার। চেয়ে আছে গুট্টিয়ারার নীল চোখে।
আপত্তি জানাল গুট্টিয়ারা। পারবেন বলে মনে হয় না। আমার বাবা নামকরা ডুবুরি, কিন্তু সে-ও এত গভীর পানিতে মনে হয় কিছু করতে পারবে না।
একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক, বিনয়ের সঙ্গে কথাটা বলল। ইকথিয়ান্ডার, পর মুহূর্তে ওদের অবাক করে দিয়ে কাপড় না ছেড়েই ঝাঁপ দিল সাগরে, তলিয়ে গেল গভীর পানিতে।
কিছু বুঝতে না পেরে অলসেন বলল, কে লোকটা? হঠাৎ করে কোথেকে হাজির হলো?
দেখতে দেখতে অধীর প্রতিক্ষায় তিন মিনিট পার হয়ে গেল। উঠছে না লোকটা! উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে অস্থির হয়ে গেল দুজন। গুট্টিয়ারা বিড়বিড় করল, ডুবে গেল নাকি লোকটা?
যতক্ষণ ইচ্ছে পানির তলায় থাকতে পারে এটা গুট্টিয়ারা বা আর কাউকে জানানোর কোন ইচ্ছে ছিল না ইকথিয়ান্ডারের। কিন্তু সময়ের হিসেব ভুল হয়ে গেছে তার। মালাটা খুঁজে পেতে একটু দেরিই হয়ে যাচ্ছে।
দমের কথাটা মাথায় আসতেই শ্বাস নেবার জন্যে একবার পানির ওপর মাথা জাগাল ও। গুট্টিয়ারার উদ্দেশে হাসিমুখে বলল, আরেকটু দাঁড়ান। পানির নিচে পাথরের খাঁজ আর ভাঁজে ভরা। কোথায় যে মালাটা আছে তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু চিন্তা করবেন না, ঠিকই ওই মালা আমি তুলে আনব।
আবার তলিয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার।
ভাসল আবার দুমিনিট পর। অনিন্দিত দেখাচ্ছে তাকে। হাত তুলে মালাটা দেখাল গুট্টিয়ারাকে। উঠে এলো সাগর থেকে। গুট্টিয়ারার দিকে মালাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নিন।
ধন্যবাদ। মালাটা নিল গুট্টিয়ারা, দুচোখে বিস্ময়। চেয়ে আছে সুঠামদেহী ইকথিয়ান্ডারের দিকে।
বুকটা গর্বে ভরে উঠল ইকথিয়ান্ডারের। অলসেনকে পাত্তা না দিয়ে গুট্টিয়ারাকে বলল, আপনি বোধহয় মালাটা এই ভদ্রলোককে দিতে। চাইছিলেন?
হ্যাঁ। বিব্রত বোধ করছে গুট্টিয়ারা। বুঝতে পারছে তার উপস্থিতি দুই পুরুষকে মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
লসেনের হাতে মালাটা দিল ও। নিরবে সেটা নিল অলসেন, পকেটে ভরে রাখল।
একবার মাথা নোয়াল ইকথিয়ান্ডার গুট্টিয়ারার উদ্দেশে, তারপর সরে এলো ওদের কাছ থেকে। ওর মনে এখন অনেক অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। চিন্তার স্রোতে ডুবে যাচ্ছে ও, কোন খেই পাচ্ছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে, পৃথিবীর স্বাভাবিক মানুষ সম্বন্ধে তার জ্ঞান সত্যি খুব কম। বারবার মনের মাঝে প্রশ্ন জাগছে, গুট্টিয়ারার সঙ্গে ওই সুদর্শন সুদেহী যুবকটি কে? নিজের গলার মালা কেন তাকে খুলে দিয়ে দিচ্ছে গুট্টিয়ারা? কি নিয়ে কথা বলছিল ওরা?
অশান্ত মন আর শান্ত হতে চায় না। মনের আকাশে জমেছে ঘন কালো মেঘ, বজ্রবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে হৃদয়ের নরম জমিতে। বজ্র করতে চাইছে আঘাত, জল চাইছে হৃদয়ের জমিকে আরও কোমল করে দিতে।
সারারাত লিডিঙের পিঠে চেপে সাগরে ছুটে বেড়াল ইকথিয়ান্ডার। মাঝে মাঝেই চিৎকার করে ভয় দেখাল সে জেলেদের অন্ধকার চিরে দিল তার কণ্ঠস্বর। কিন্তু কিছুতেই আজ শান্ত হলো না ওর মন। অবুঝ আবেগে কাঁদছে হৃদয়।
পরেরদিনটা সাগরের তলায় কাটাল ইকথিয়ান্ডার। আজকে সে খুবই ব্যস্ত। সাগর-তলের বালির মাঝ থেকে মুক্তো-ভরা ঝিনুক খুঁজে খুঁজে বের করল। বাড়ি ফিরল অনেক রাত করে। ক্রিস্টোর বকাবকির পালা শেষ হলে প্রয়োজন মনে হলে দায়সারা জবাব দিল। তারপর সকাল হতেই ফিটফাট হয়ে চলে এলো ও যেখানে দেখেছিল গুট্টিয়ারা আর সেই যুবককে গুট্টিয়ারাকে খুব দরকার ওর। অনেক কথা জমে আছে বুকের মাঝে। আর…
বিকেলে সূর্যাস্তের সময় এলো গুট্টিয়ারা সৈকতে। দেরি না করে পাথরের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে তার সামনে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার।
ওকে দেখে হাসল গুট্টিয়ারা। ভদৃতার হাসি। তারপর উপহাসের সুরে জানতে চাইল, আমার পিছু নিয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ, সরল মনে স্বীকার করল ইকথিয়ান্ডার। যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই… চুপ হয়ে গেল ও। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি মুক্তো খুব ভালবাসেন, তাই না?
মাথা দোলাল গুট্টিয়ারা। কোন মেয়ে না মুক্তো ভালবাসে!
তাহলে আমার এই মুক্তোটা আপনি নিন, বলে একটা মুক্তো বাড়িয়ে ধরল ইকথিয়ান্ডার।
মুক্তো ব্যবসায়ীর মেয়ে গুট্টিয়ারা। মুক্তোর দাম সম্বন্ধে ভাল ধারণা রাখে। ধবধবে সাদা বিশাল আকারের অপূর্ব সুন্দর মুক্তোটা দেখে চোখ কপালে উঠল ওর। এত সুন্দর জিনিস আগে কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অন্তত দুশো ক্যারেট হবে ওটার ওজন। দশ লাখের কম হবে দাম, বেশি হতে পারে। ইকথিয়ান্ডারের দিকে গ্রহ নিয়ে তাকাল গুট্টিয়ারা। সামনে দাঁড়ানো লোকটা সুদর্শন, সুগঠিত দেহ, পরিপূর্ণ এক যুবক! অথচ কেমন যেন লাজুক ধরনের। লজ্জা পাচ্ছে তা পরিষ্কার বোঝাও যাচ্ছে। সে যে একটা সুন্দরী মেয়ের সামনে আছে, এখন যে তাকে পৌরুষ দিয়ে মেয়েটির মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে সে বিষয়ে যুবক যেন পুরোপুরি সচেতন নয়। বুয়েন্স আয়ার্সের বড়লোকের উদ্ধত ছোকরাদের মতো নয় মোটেও। অবাক লাগছে গুট্টিয়ারার। তার মতো স্বল্প পরিচিত একটি মেয়েকে কি করে উপহার দিতে চাইছে যুবক এত দামি একটা মুক্তো?
দয়া করে এটা নিন আপনি, বলল ইকথিয়ান্ডার।
আপত্তি জানাল গুট্টিয়ারা। না, না, তা কি করে সম্ভব! এত দামি উপহার আমি আপনার কাছ থেকে নিতে পারি না।
কে বলল দামি, উত্তেজনায় প্রায় হাঁফাচ্ছে ইকথিয়ান্ডার। একটু বাড়িয়েই বলল, সাগর-তলে এরকম হাজার হাজার মুক্তো পড়ে আছে। দয়া করে ওটা নিন আপনি।
না, না। তা হয় না।
বুকের মাঝে অজানা কষ্টে ছেয়ে গেল ইকথিয়ান্ডারের। জ কুঁচকে গেল অজান্তে। একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ঠিক আছে, নিজের জন্যে যখন দরকার নেই আপনার, নাহয় যাকে আপনি মালাটা দিয়েছেন সেই অলসেনকেই দিয়ে দেবেন।
এবার গুট্টিয়ারাও রেগে গেল। বলল, যা বোঝেন না তা নিয়ে খোঁচাতে আসবেন না। অলসেন নিজের জন্যে মালাটা নেয়নি। এব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না।
পুরুষমানুষ, জেদ চেপে গেছে ইকথিয়ান্ডারেরও। সে বলল, আপনি তাহলে মুক্তোটা নেবেন না?
না।
সাগরের পানিতে মুক্তোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ইকথিয়ান্ডার। ঘুরে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল সাগর-তীরের রাস্তাটা ধরে।
একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ল গুট্টিয়ারা। কে এই যুবক! কে এ? কে এমন যে দশ লাখের মুক্তো সামান্য একটা ঢিলের মতোই গভীর সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সামান্য কারণে? কেমন যেন লজ্জা লাগল গুট্টিয়ারার অভিমানী যুবকের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বুঝে পেছন থেকে ডাকল, এই যে, শুনুন! এই যে? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
অভিমানে ঠোঁট ফুলে গেছে ইকথিয়ান্ডারের, হেঁটেই চলেছে, মাথা নিচু করে। ছুটে এসে পেছন থেকে ইকথিয়ান্ডারের হাত ধরে ফেলল গুট্টিয়ারা। অবাক হয়ে লক্ষ করল ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে অভিমানী যুবকের দুগাল বেয়ে।
আগে কখনও কাঁদেনি ইকথিয়ান্ডার, কাজেই বুঝতে পারছে না বুকের মাঝে কেন এত কষ্ট, কেন চোখের সামনে ঝাঁপসা দেখাচ্ছে সবকিছু। মনে হচ্ছে যেন গগলস ছাড়া সাগরের কাদা-পানিতে সাঁতার কাটছে ও।
ইকথিয়ান্ডারের হাতে চেপে বসল গুট্টিয়ারার চাপা কলার মতো সুন্দর আঙুল। বিড়বিড় করে বলল গুট্টিয়ারা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি না বুঝে আপনার মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
১৬. ইকথিয়ান্ডার আর গুট্টিয়ারা
গত কদিন হলো নিয়মিত দেখা হচ্ছে ইকথিয়ান্ডার আর গুট্টিয়ারার। শহরের বাইরে, সৈকতে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রাখা পোশাক পরে পাহাড়ের কাছে চলে আসে ইকথিয়ান্ডার। গুট্টিয়ারা তার একটু পরই হাজির হয়। দুজন সৈকতে পাশাপাশি হাঁটে, আলাপ করে মগ্ন হয়ে।
নতুন এই বন্ধুর সত্যিকার পরিচয় জানে না এখনও গুট্টিয়ারা। তার কৌতূহল হয় না এমন নয়, কিন্তু এব্যাপারে কোন কথাই সে জিজ্ঞেস করে না ইকথিয়ান্ডারকে। নিজের কথা ইকথিয়ান্ডার বলেও খুব কমই। গুট্টিয়ারা শুধু এটুকু জানে যে ইকথিয়ান্ডার এক ডাক্তারের ছেলে। ডাক্তার সম্বন্ধে খুব একটা ভাল ধারণা পোষণ করে না। গুট্টিয়ারা। ও আলাপ করে দেখেছে ইকথিয়ান্ডারের জ্ঞান অনেক। ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। অনেক ব্যাপারে সে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জানে একথা সত্য, কিন্তু কোন কোন ব্যাপারে তার জ্ঞান পাঁচ বছরের শিশুর সমানও নয়। তবে বোকা ন ইকথিয়ান্ডার। রসিকতা বোধের কোন অভাবও নেই তার। যেকারণে কথা বলে মজা পায় গুট্টিয়ারা।
সাগরের কোলে সৈকতে বসে অসীম বিস্তারিত সুনীল পানির বিস্তৃতি দেখে ওরা দুজন পাশাপাশি। ওদের পায়ের কাছে প্রণতি জানায় সাগরের ঢেউ। গুট্টিয়ারার সঙ্গে কথা বলতে ইকথিয়ান্ডারেরও খুব ভাল লাগে। কেন কে জানে, বুক ভরে ওঠে আনন্দে।
এক সময় সন্ধে নেমে আসে। গুট্টিয়ারা মিষ্টি করে বলে, এবার তাহলে উঠতে হয়!
ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না ইকথিয়ান্ডারের। ইচ্ছে করে বুকের মাঝে ছোট্ট একটা ঝিনুকের মতো করে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু বিদায় দিতে হয়। শহরের কিনারা পর্যন্ত গুট্টিয়ারাকে এগিয়ে দেয় সে, তারপর ফিরে চলে সাগরের দিকে। পোশাক লুকিয়ে ফিরে যায় বাড়িতে।
মুক্তো ভালবাসে গুট্টিয়ারা, কাজেই মনের আনন্দে মুক্তো খুঁজে বেড়াতে শুরু করেছে ইকথিয়ান্ডার। সাগর-তলে সে বাছাই করা মুক্তোর একটা টিলা গড়ে তুলেছে একথা বললে বাড়াবাড়ি বলা হবে না! মুক্তোর এই স্কুপের দাম কত তা জানে না ইকথিয়ান্ডার। দামের কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে। সে ভাবে গুট্টিয়ারার কথা। ইকথিয়ান্ডার জানেও না যে কখন সে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোকে পরিণত হয়েছে। জানা তার জন্যে জরুরী বলেও কখনও বোধ হয় না। হৃদয়টা গুট্টিয়ারাকে দিয়ে নিশ্চিন্তে আছে ও। গুট্টিয়ারার কথা ভাবলেই মন ভরে ওঠে প্রশান্তিতে।
মাঝে মাঝে অবশ্য তার দুঃখও হয় গুট্টিয়ারার জনে!। বেচারি কত কষ্টই না পায় শহরের ভেতর ওই ধুলো-বালি আর ধোয়াভরা কুৎসিত পরিবেশে। কি জঘন্য হৈ-চৈ আর ভিড় ওখানে। দারুন হতো যদি গুট্টিয়ারা সাগরের প্রশান্তিময় নিরব পরিবেশে এসে থাকতে পারত। গুট্টিয়ারাকে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাত এই আজব জগৎটা। কিন্তু তা কি সব?
না।
ও নিজে পারবে না ডাঙায় থাকতে আর গুট্টিয়ারা পারবে না পানির তলায় বসবাস করতে।
বুঝতে পারছে ইকথিয়ান্ডার। বারবার নিয়ম ভঙ্গ করছে সে। যতটা সময় ডাঙায় থাকতে বলেছেন বাবা তার বেশি সময় সে থেকে যাচ্ছে ডাঙায়। ফলাফল ঘটতে শুরু করেছে। আবার ফিরে এসেছে পাঁজরের সেই ব্যথাটা। ওটা এখন প্রায়ই ওকে কষ্ট দিচ্ছে। কখনও কখনও ব্যথাটা অসহ্য হয়ে ওঠে। তোয়াক্কা করে না ইকথিয়ান্ডার, যতক্ষণ গুট্টিয়ারা বিদায় না নেয় ততক্ষণ সে-ও ওঠে না কিছুতেই।
মাঝে মাঝে তার মাথায় একটা চিন্তা দোলা দেয়, অজানা অনুভূতি কষ্ট দেয় হৃদয়টাকে কি কথা বলে গুট্টিয়ারা ওই সুদর্শন যুবকের সঙ্গে? জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। গুট্টিয়ারা যদি কিছু মনে করে!
একদিন গুট্টিয়ারা বলল, আগামী কাল আমি আসতে পারব না। কেন? জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার।
কাজ আছে।
কি কাজ?
জবাবে হাসল গুট্টিয়ারা। বলল, অত কৌতূহল ভাল নয় কিন্তু। আর একটা কথা, আজ আমাকে তোমার এগিয়ে দিতে হবে না।
একটু পরই আজ বিদায় নিল গুট্টিয়ারা। সাগরে ডুব দিল ইকথিয়ান্ডার, সারারাত মন খারাপ করে শুয়ে থাকল শ্যাওলা ধরা পিচ্ছিল পাথরের ওপর। ভোর হতে ফিরে চলল বাড়ির পথে।
ফেরার পথে একটা নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখে থামতে হলো ওঁকে। একদল জলে মাছ ধরতে এসেছে নৌকো নিয়ে। নতুন নিয়মে ডলফিন ধরছে তারা।
ডলফিন যেই পানির ওপর ভেসে উঠছে, অমনি বন্দুক নিয়ে গুলি করছে তারা। বিরাট একটা ডলফিন গুলির আঘাতে লাফিয়ে উঠেই অদৃশ্য হলো সাগরের তলে। চারপাশে সাগরের পানি ছিটকে গেল।
ভয়ে, আতঙ্কে অস্ফুট স্বরে শুধু বলতে পারল ইকথিয়ান্ডার, লিডিং!
আহত ডলফিন মরে ভেসে উঠবে সে আশায় পানিতে নেমে পড়েছে এক জেলে! মরা ডলফিনকে টেনে নৌকোর পাশে নিয়ে আসবে।
ডলফিনটা মরেনি। জেলের কাছ থেকে একশো মিটার দূরে ভেসে উঠেছে। দম নিয়ে আবার সাগরে ডুব দিল ডলফিন। তাকে ধরার জন্যে সাঁতার কেটে এগোল জেলে। ডলফিন দম নিতে আবার ভেসে উঠতেই হাতের নাগালে ওটাকে পেয়ে গেল সে, খপ করে পাখনা চেপে ধরে নৌকোর দিকে ঠেলে নিয়ে আসতে লাগল।
ডলফিনের বিপদ বুঝতে পেরে ডুব-সাঁতার দিয়ে এগোল ইকথিয়ান্ডার। জেলেকে কাছে পেতেই দাঁত বসিয়ে দিল তার পায়ে। জেলে ভাবল তাকে হাঙরে ধরেছে। হাতে একটা ছুরি আছে তার। ওটা দিয়ে ইকথিয়ান্ডারের ঘাড়ে গায়ের জোরে আঘাত করল সে। আজকে ইকথিয়ান্ডারের পরনে সেই বর্ম নেই। ঘাড়ে প্রচণ্ড চোট পেল ইকথিয়ান্ডার। সে পা ছেড়ে দিতেই জানের ভয়ে ডলফিনটাকে ছেড়ে নৌকোর দিকে সাঁতরে চলল জেলে।
ডলফিনটাকে নিয়ে সাগর-তলের এক গুহায় এসে ঢুকল ইকথিয়ান্ডার। এই গুহার ওপরের অংশে বাতাস আছে। ফাটল দিয়ে আছে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। ডলফিনের শ্বাস নিতে কোন কষ্ট হবে না। সেজন্যেই এখানে ওটাকে নিয়ে এসেছে ও ডলফিনের গুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখল ইকথিয়ান্ডার, গুরুতর কোন আঘাত নয়। চামড়া কেটে চর্বিতে ঢুকে বসে আছে বুলেট। আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে গুলিটা বের করে ফেলল সে, তারপর ডলফিনের পিঠ চাপড়ে সাহস দিয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই। ভাল হয়ে যাবি কদিনেই।
লেজ নাড়তে নাড়তে ফিরে চলল ডলফিন। আর ইকথিয়ান্ডার ফিরল বাড়িতে।
তার কাঁধের জখমটা দেখে ভয় পেয়ে গেল ক্রিস্টো। উদ্বিগ্ন স্বরে, জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার?
ডলফিনকে বাঁচাতে গিয়ে চোট লেগেছে বলল ইকথিয়ান্ডার।
কথাটা ক্রিস্টোর বিশ্বাস হলো না। ক্ষতটায় ব্যান্ডেজ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, আমাকে ছাই নিশ্চই সেই শহরে গিয়েছিলে, তাই না?
উত্তরে হাসল ইকথিয়ান্ডার, মুখে জবাব দিল না। ক্রিস্টো আবার বলল, কাঁধের কাছে তোমার আঁশটা একটু তোলা তো দেখি, জখমটা ভাল মতো দেখতে পাচ্ছি না।
. ঘাড়ের ক্ষত দেখার জন্যে আঁশ নিজেই সরাল ক্রিস্টো। পর মুহূর্তে আঁতকে উঠল। ইকথিয়ান্ডারের কাঁধে একটা লাল ক্ষতচিহ্ন! ভয়ঙ্কর আঘাত। আবার শিউরে উঠল ক্রিস্টো। ক্ষতচিহ্নে আঙুল বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে ওরা দাঁড় দিয়ে মেরেছে?
মাথা নাড়ল ইকথিয়ান্ডার। না। এই দাগটা জন্ম থেকেই আছে আমার।
জন্ম থেকেই?
তা-ই তো জানি।
নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেল ইকথিয়ান্ডার। একা একা ভাবনার জাল বুনে চলল ক্রিস্টো। অনেকক্ষণ পর সিদ্ধান্তে এলো সে। রওনা হলো বুয়েন্স আয়ার্সের পথে।
*
দোকানের কাউন্টারে বসে আছে গুট্টিয়ারা। তাকে দেখেই দেরি না করে প্রশ্ন ছুঁড়ল ক্রিস্টো। গুট্টি, তোমার বাবা বাসায়?
ঐ তো, ঐ ঘরে।
বালথাযার মুক্তো পালিশ করা ঘরে আছে। সেখানে এসে ঢুকল ক্রিস্টো। মনোযোগ দিয়ে মুক্তো পালিশ করছে। মেজাজ চড়া। মুখ তুলে ভাইকে দেখে বলল, জুরিতা কিন্তু আমাদের ওপরে ক্ষেপে গেছে। এখনও আমরা কেউ দানোর কোন খোঁজ বের করতে পারলাম না। এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। আর আর মেয়েকে নিয়েও হয়েছে এক জ্বালা। কি যে করে, কখন কোথায় যায়, স্রষ্টা জানেন। জুরিতার কথা ওর এক কান দিয়ে ঢোকে আর আরেক কান দিয়ে বের হয়। পাত্তাই দিচ্ছে না। এখনও বিয়ের কথা বললেই বলছে, না, বিয়ে করলে পেদরো জুরিতাকে করধনা। পেদরো জুরিতাও বাঘের বাচ্চা। বলেছে গুট্টি রাজি না হলে জোর করে বিয়ে করবে। তাতে কি
আর এমন খারাপ হবে? কয়েকদিন মন খারাপ থাকবে গুট্টিয়ারার, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
বালথাযারের কথা মন দিয়ে শুনল ক্রিস্টো, তারপর কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়ে দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল পেদরো জুরিতা। ঢুকেই ভেতরের পরিবেশের আঁচ পেয়ে গেল লোকটা। বলে উঠল, এই যে, দুভাইকে তাহলে একসঙ্গে পেয়েছি। দেখছি! আর কতদিন আমাকে জ্বালাবে, ক্রিস্টো? শুধু টাকা খেলেই। হবে? কাজ দেখাতে হবে না?
জবাবে অমায়িক বিনীত হাসল ক্রিস্টো। বলল, সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর ঐ দানো তো সাধারণ কোন মাছ নয়, জাল পাতলেই ধরা পড়ে যাবে। ওকে সেদিন ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিলাম এখানে। কিন্তু আপনি তখন ছিলেন না। এখানে থেকে পালায় ও। সেই থেকে আর
এদিকে পা বাড়াবার নামও নিচ্ছে না।
বিরক্ত পেদরো জুরিতা নিচু স্বরে বলল, অত কথায় আমার কাজ নেই। দুটো কাজ আমি এই সপ্তাহে করতে চাই। এক, সাগর-দানোকে। ধরা, দুই, গুট্টিয়ারাকে বিয়ে করা। ডাক্তার সাহেব কি আন্দেজ থেকে ফিরেছেন, ক্রিস্টো?
ফেরেননি এখনও। যেকোনদিন ফিরবেন।
ঠিক আছে। বেশ কয়েকজন লোক বেছেছি আমি আমার কাজটা করিয়ে নেয়ার জন্যে। তাদের দিয়েই কাজ সারা যাবে। দরজাটা শুধু খুলে দেবে তুমি, তারপর যা করার ওরাই করবে। বালথাযারের দিকে তাকাল সে। বালথাযার, বিয়ের ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে কালকে কথা বলব। মনে রেখো, কাল এব্যাপারে আমাদের শেষ কথা হবে।
এরপর কোন বাধাই মানব না আমি।
কথা শেষ করে কারও বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না পেদরো জুরিতা, গটগট করে হেঁটে চলে গেল দোকান ছেড়ে। তার আগে গুট্টিয়ারাকে কি যেন বলল গুট্টিয়ারার জবাব দুই ভাইয়েরই কানে এসেছে।
না! না!
ভাইয়ের দিকে চেয়ে হতাশ ভাবে একবার মাথা নাড়ল বালথাযার।
১৭. ভাল নেই ইকথিয়ান্ডারের শরীর
ভাল নেই ইকথিয়ান্ডারের শরীর। ঘাড়ের পেছনের আঘাতটা বড় কষ্ট দিচ্ছে। টিশটিশে ব্যথা। হালকা হালকা জ্বরও এসেছে। কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। তবুও পাহাড়ের কাছে সেই সৈকতে ইকথিয়ান্ডারের আসা থেমে নেই। শরীর যত খারাপই হোক, সবকিছু উপেক্ষা করে ওখানে হাজির হয় সে কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে। দিনে অন্তত একবার গুট্টিয়ারাকে
দেখলে আজকাল ওর মনে হয় বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই।
ঠিক দুপুর বেলায় এলো গুট্টিয়ারা। এসেই জানাল, আজ সে সাগর পাড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, বাবা কাজে বাইরে যাচেছ তাই দোকানে বসতে হবে আজকে ওর।
তাহলে চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই, ওর কথা শুনে বলল ইকথিয়ান্ডার।
শহরে পৌঁছোনোর সেই ধুলোভরা সরু রাস্তাটা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। ওদের মাথার ওপর আগুন ঢালছে দুপুরের খর সূর্য।
রাস্তার উল্টো দিক থেকে আসছে অলসেন। তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কোনদিকে অলসেনের খেয়াল নেই। মাথাটা ঝুঁকে আছে বুকের কাছে। কি যেন ভাবছে একান্ত মনে। তাকে ডাক দিল গুট্টিয়ারা। ইকথিয়ান্ডারকে বলল, ওর সঙ্গে আমার কথা আছে। একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
অলসেনের কাছে দাঁড়িয়ে দ্রুত নিচু স্বরে কি যেন বলছে গুট্টিয়ারা। ইকথিয়ান্ডারের মনে হলো অনুরোধ করছে মেয়েটা অলসেনকে।
অলসেন উত্তর করল, ঠিক আছে, তাহলে আজ মাঝরাতের পরই।
কথা শেষে হাত মেলাল দুজন আন্তরিক ভাবে, তারপর ইকথিয়ান্ডারের কাছে ফিরে এলো গুট্টিয়ারা। ততক্ষণে অভিমানে গুম মেরে গেছে ইকথিয়ান্ডার। অবুঝ অনুভূতি ওকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলেছে ইচ্ছে করছে অলসেনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে করতও, কিন্তু ভাষা খুঁজে পেল না আবেগে। কোনমতে শুধু বলল, আজ আমিও আর থাকতে পারছি না। কিন্তু একটা কথা। খুব জানা দরকার। আমার…তুমি…অলসেন…শুনলাম আজ রাতে তোমাদের দেখা হবে। তুমি আর অলসেন কি পরস্পরকে ভালবাসো?
নরম চোখের দৃষ্টিতে ইকথিয়ান্ডারকে দেখল গুট্টিয়ারা, তারপর কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল, বিশ্বাস করো তুমি আমাকে?
করি, ফিসফিস করল ইকথিয়ান্ডার, বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি তো জানো তোমাকে আমি ভালবাসি। খুব কষ্ট হয় আমার..যখন তুমি অন্য কারও সঙ্গে
ইকথিয়ান্ডার আজকে দৈহিক ভাবেও কাতর হয়ে পড়েছে। পাঁজরের সেই ব্যথাটা বেড়েছে আবার। তাকে হাঁপাতে দেখে জিজ্ঞেস করল গুট্টিয়ারা, তুমি কি অসুস্থ? মনের কষ্টে এমন হচ্ছে না তো? কষ্ট পেয়ো না। বিশ্বাস করো। আমাকে বিশ্বাস করো। তোমার কাছে আমি কিছুই লুকোইনি। শান্ত হও। ইকথিয়ান্ডার, শান্ত হও।।
একটু দূরেই আছে একজন অশ্বারোহী। দুলকি চালে যেন এদিকেই আসছে। গুট্টিয়ারাকে দেখে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলো সে। ইকথিয়ান্ডার তাকাল লোকটার মুখে। মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে আগে। শহরে, নাকি সাগরে নিশ্চিত হতে পারল না। অশ্বারোহীও চোখে কৌতূহল আর বিদ্বেষ নিয়ে তাকাল ইকথিয়াল্ডারের দিকে। হঠাৎ করেই গুট্টিয়ারার দিকে ফিরল সে, দুহাতে জোর করে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল ওকে। হাসছে সে হা-হা করে। ঠাট্টার সুরে বলে উঠল, কি, ধরা পড়ে গেছ, তাই না, জাদুমণি? একদিন পরে তোমার বিয়ে, আর এখনও তুমি ছেলেছোকরাদের সঙ্গে হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছ?
অশ্বারোহী পেদরো জুরিতা ছাড়া আর কেউ নয়।
রাগে, জেদে চেহারা লাল হয়ে গেছে গুট্টিয়ারার। দেহ মুচড়ে ঘোড়া থেকে নামার চেষ্টা করল।
পাঁজরের ব্যথাটা অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে ইকথিয়ান্ডারের। চোখের সামনে গুট্টিয়ারার এই অপমান সহ্য হচ্ছে না। দুঠোঁট নীল, জ্ঞান হারাবে যেকোন সময়ে, প্রবল ক্ষোভে-দুঃখে বলে উঠল, গুট্টিয়ারা! তাহলে এতদিন তুমি শুধু ছলনাই করলে আমার সঙ্গে?
আর কোন কথা বলল না ইকথিয়ান্ডার। বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে ওর। দৌড়ে সাগরের তীরে চলে এলো ও, ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের গভীর পানিতে। চোখের লোনা জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সাগরের লোনা জলের সঙ্গে।
হাহাকার করে উঠল গুট্টিয়ারা। পেদরো জুরিতাকে বলল, ওকে বাঁচান! একে বাঁচান!
কারও ডুবে মরার শখ থাকলে তাকে বাঁচানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার। অট্টহাসি হেসে বলল জুরিতা।
সে যাবে না বুঝে গুট্টিয়ারা নিজেই সাগরে ঝাঁপ দিয়ে ইকথিয়ান্ডারকে বাঁচানোর চিন্তা করল। লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে মেনে পড়ল ও। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। পেদরো জুরিতা ঘোড়া ছুটিয়ে দুপা যাবার আগেই ওকে আটকে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এত উতলা হবার কি আছে, গুট্টি? নিজেকে সামলাও! আজ বাদে কাল তোমার বিয়ে, ভুলে গেছ মনে হচ্ছে
এত শোক আর উত্তেজনা সইতে পারল না গুট্টিয়ারা, অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরতে দেখল তাকে বাবার দোকানে পৌঁছে দিয়ে গেছে। পেদারা জুরিতা।
ইকথিয়ান্ডারের জন্যে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল ওর। অদম্য : কান্নায় ফুলে ফুলে উঠল ওর পিঠ। মনে চিন্তা, ইকথিয়ান্ডারের মতো সে-ও কি লাফ দিতে পারে না সাগরে? তা পারে। ইকথিয়ান্ডারের জন্যে ও তা-ও পারে! ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে মানুষ হিসেবে অন্তঃসারশূন্য দাম্ভিক বড়লোকের ছেলেদের কোন তুলনাই হয় না। ইকথিয়ান্ডার সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
বাবার গলা শুনতে পেল ও। গজগজ করছে বালথাযার। কথায় বিলাপের সুর ফুটল।
বুঝছে না মেয়েটা! কিছুতেই বুঝছে না : আরে, আমার দোকানের আসল মালিকই তো হচ্ছে ওই পেদারো জুরিতা! নিজের বলতে দোকানের দশভাগের একভাগ মালও আমার না। আমি বেঁচে আছি শুধু মুক্তো বিক্রির মুনাফার একটা ছোট অংশ নিয়ে। ট্রি যদি ওকে বিয়ে
করে তাহলে দোকানের প্রায় সব মাল ফিরিয়ে নিয়ে যাবে জুরিতা। আমি পথের ফকির হয়ে যাব। গুট্টি কিছুই বুঝছে না।
আসলে সবই বুঝছে গুট্টিয়ারা, কিন্তু মন থেকে নিষ্ঠুর আর দাম্ভিক পেদরো। জুরিতাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। তারচেয়ে আত্মহত্যা করাও ভাল। চুপচাপ শুয়ে থাকল গুট্টিয়ারা। এদিকে গজগজ করেই চলেছে বালথাযার। কাজের ঘর থেকে তার আওয়াজ আসছে মৃদু।
১৮. বড় একটা নৌকোর ডেকে
বড় একটা নৌকোর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে অলসেন, রেলিঙে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে সাগরের পানির দিকে। দিকচক্রবালের নীলচে সুতোর ওপর নাচছে প্রথম ভোরের রক্তলাল সূর্য, তীর্যক কিরণ ছড়াচ্ছে। পানির গায়ে লালের ছোঁয়া, মনে হচ্ছে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে সাগরে। স্বচ্ছ পানি, বহু নিচে দেখা যায়।
সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সাগর-তলের সাদা বালিব ওপর মুক্তোর সন্ধানে ঝিনুক খুঁজে বেড়াচ্ছে কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান ডুবুরি। বারবার ভেসে উঠে দম নিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে তারা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখছে অলসেন। তার মনে এখন নতুন একটা চিন্তা উদয়। হয়েছে। তাকে ডুবুরির কাজ শিখতে হবে। ভাল মতো জানতে হবে। কিভাবে মুক্তো শাহরণ করা হয়।
সারাদিন তো বাকিই রয়েছে, এই জাৈরেই ভ্যাপসা গরম পড়ে গেছে। মন থেকে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলল অলসেন, তারপর কাপড় খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে। একটু পরই বোঝা গেল এই কাজে নতুন হলেও ফুসফুস পোক্ত হওয়ায় বেশিরভাগ ডুবুরির চেয়ে বেশিক্ষণ পানির তলায় থাকতে পারে সে। উৎসাহ বেড়ে গেল তার, মেতে উঠল পরিশ্রমসাধ্য সুকঠিন এই কাজে।
কিন্তু একটু পরেই ঘটল ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। ডুব দিয়েছে অলসেন, হঠাৎ দেখল সঙ্গের ডুবুরিরা ঝটপট ওপরের দিকে রওনা হয়েছে। হাঙর-টাঙর নাকি! করাত মাছ? না, ওই যে দেখা যাচ্ছে। আজব প্রাণীটাকে। হাত-পাগুলো ব্যাঙের মতো। অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক মাছ। রুপোলি তার আঁশ। চোখ দুটো বড় বড়, কাচের মতো।
অলসেন বালির ওপর দাঁড়াতেই জন্তুটা এসে তার চেপে ধরল। ভয়ে হতভম্ব–অলসেন লক্ষ করল প্রাণীর মুখ মানুষের মতোই। রীতিমতো সুদর্শন বলতে হয় একেচোখ দুটো তার। চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। কি যেন বলছে ওটা তাকে। পানির তলায় তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল না। শুধু ঠোঁট নড়তে দেখল ও।
দম ফুরিয়ে গেছে অলসেনের। দ্রুত পা নেড়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। জন্তুটাও তার সঙ্গে ওপরে উঠছে! ভেসে উঠে নৌকোর ধার ধরে ফেলল অলসেন, ঝাকি দিয়ে জটার হাত ছাড়িয়ে চট করে উঠে পড়ল নৌকোয়। হাত ফস্কে যাওয়ায় প্রাণীটা ঝপ করে সাগরের পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল।
আবার ভাসল ওটা। স্প্যানিশ ভাষায় বলল, অলসেন, গুট্টিয়ারার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল অলসেনের। গুট্টিয়ারার কথা যখন বলছে এ মানুষ না হয়ে যায় না। কিন্তু কে ও? অশরীরী অথবা পিশাচ হলে তো….
কৌতূহলী অলসেন বলল, বলো, আমি শুনছি।
সাগর থেকে উঠে এলো প্রাণীটা, নৌকোর কিনারায় বসল। চোখ দুটো বড় নয় তার, ওগুলো চশমার কাঁচ, এখন মনে হচ্ছে।
প্রাণীটাই কথা শুরু করল, নাম আমার ইকথিয়ান্ডার। তোমার মনে পড়ে আমাকে? সেদিন গুট্টিয়ারার মুক্তোর মালাটা আমিই সাগর থেকে তুলে দিয়েছিলাম।
বিস্ময় শুধু বাড়ছে অলসেনের। বলল, কিন্তু তখন তোমার চোখ মানুষের মতোই ছিল!
হাসল ইকথিয়ান্ডার। চশমা দেখাল। এটা চশমা। খুলে ফেলা যায়।
ইন্ডিয়ান ডুবুরিরা কেউ নৌকোয় নেই। ইকথিয়ান্ডারকে দেখে ভয় পেয়ে নৌকো ছেড়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা, তীরে পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। সহজে আর এমুখো হবে না কেউ। দূরে, পাথরের আড়াল নিয়ে ইকথিয়ান্ডার আর অলসেনকে দেখছে তারা কৌতূহলী হয়ে। দেখতে পাচ্ছে ওদের, দূরত্বের কারণে কথা শুনতে পাচ্ছে না।
ইকথিয়ান্ডার বলল, গুট্টিয়ারাকে তুমি খুব ভালবাসো, তাই না?
হ্যাঁ, বাসি, স্বীকার করল অলসেন।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইকথিয়ান্ডাকের বুক চিরে। আর গুট্টিয়ারা? সে-ও কি তোমাকে ভালবাসে?
হ্যাঁ। মনে হয় আমাকেও গুট্টি ভালবাসে।
কিন্তু ও যে আমাকেও ভালবাসে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানাল ইকথিয়ান্ডার।
অলসেন বলল, সেটা তার একান্ত নিজের ব্যাপার। এব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই।
নিজের ব্যাপার মানে! বিস্ময় প্রকাশ করল ইকথিয়ান্ডার। সে তোমার বাগদত্তা স্ত্রী নয়?
এবার অলসেনও বিস্মিত হলো। কই! কে বলল! না তো! গুট্টি আমার বাগদত্তা নয়।
কিন্তু সেই ঘোড়সওয়ার যে বলে গেল গুট্টিয়ারা বাগদত্তা? রাগ লাগছে ইকথিয়ান্ডারের। ওকে বোকা মনে করে খেলাচ্ছে নাকি অলসেন। কি তার উদ্দেশ্য?
আমার বাগদত্তা? বিস্ময় কাটছে না অললেনের।
ইকথিয়ান্ডারের মনে হলো কোথায় কি যেন একটা ভুল হয়েছে তার। একটু থতমত খেল ও। ঠিকই, ওই ঘোড়সওয়ার তো একথা বলেনি যে গুট্টিয়ারা অলসেনের বাগদত্তা। তাহলে কি সেই অশ্বারোহী লোকটাই গুট্টিয়ারার হবু স্বামী? কিন্তু তা কি করে সম্ভব! ওই লোকটা দেখতে ভাল নয়, তাছাড়া তার বয়সও গুট্টিয়ারার চেয়ে অনেক বেশি। না, সে নিশ্চই গুট্টিয়ারার কোন আত্মীয় হবে।
এখানে কি খুঁজছিলে? জানতে চাইল ইকথিয়ান্ডার। মুক্তো?
একের পর এক প্রশ্নে বিরক্ত বোধ করছে অলসেন। গম্ভীর চেহারায় বলল, এত প্রশ্ন যে করছ সেটা কিন্তু আমার ভাল লাগছে না। তবে তোমার কাছে আমার লুকাবার কিছু নেই। হ্যাঁ, আমি মুক্তো খুঁজছিলাম।
মুক্তো তোমার খুব পছন্দ?
অর্থনৈতিক বিষয়টির অবতারণা করল না অলসেন। একটু আপত্তির সুরেই বলল, আমি তো মেয়ে নই যে মুক্তো ভালবাসব। মেয়েরা মুক্তোর মালা গলায় পরে
দুজনের আলোচনা চলছে। ইকথিয়ান্ডারের সরলতা আর আন্তরিকতার কারণে অলসেনের মন থেকে বিরূপ ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে গেল। দুই বন্ধুর মতো আলাপ জুড়ল ওরা। অলসেনের কাছ থেকে জানতে পারল ইকথিয়ান্ডার, পেদরো জুরিতা ইতোমধ্যেই জোর করে গুট্টিয়ারাকে বিয়ে করে ফেলেছে।
নিরব হাহাকার গুমরে মরল ইকথিয়াল্ডারের বুকের ভেতর। শুধু বলল ও, কিন্তু ও যে আমাকে ভালবাসত।
ধীরেসুস্থে পাইপে তামাক ভরল অলসেন। তিক্ত হেসে বলল, আমারও তা-ই ধারণা ছিল। কিন্তু সেদিন তুমি নাকি ওর চোখের সামনে সাগরে তলিয়ে গিয়েছিলে! ওর ধারণা তুমি মারা গেছ।
নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো ইকথিয়ান্ডারের। কেন যে ও বলেনি সাগরের তলাতেও মাছের মতোই বেঁচে থাকতে পারে ও বহাল তবিয়তে! পাহাড়ী সৈকত থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লে সেটাকে যে গুট্টিয়ারা আত্মহত্যা ভেবে নিতে পারে একথা একবারও মাথায় খেলেনি ওর।
কিন্তু বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি করল কেন ও? ধরা গলায় জানতে চাইল ইকথিয়ান্ডার।
কারণ পেদরো জুরিতা তাকে বলেছে সেদিন সাগরে তলিয়ে যাওয়া থেকে সে-ই আসলে গুট্টিয়ারাকে বাঁচিয়েছে, বলল অলসেন। কিন্তু গুট্টিয়ারা বলেছিল অদ্ভুত এক ভয়ঙ্কর চেহারার প্রাণী নাকি তাকে বাঁচিয়েছিল!
থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকল ইকথিয়ান্ডার। তারপর ধল, কেন রাজি হলো গুট্টিয়ারা এই বিয়েতে?
কারণ ওর বাবা বুড়ো বালথাযারেরও জামাই হিসেবে পেদরো জুরিতাকে খুব পছন্দ, কাজেই…
ইকথিয়ান্ডার বলল, তুমি তো তাকে ভালবাসতে, তুমি কেন তাকে বিয়ে করলে না?
হাসল অলসেন। প্রথমে আমি আর গুট্টিয়ারা শুধুই বন্ধু ছিলাম। সম্পর্কটা আস্তে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। আর কদিন পরে কি হতো জানি। না, কিন্তু গুট্টিয়ারাকে আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে উত্তর আমেরিকায় চলে যেতে।
গেলে না কেন?
পথ খরচাও ছিল না আমার।
ইকথিয়ান্ডারের মনে পড়ে গেল, সাগরের নিচে মুক্তোর একটা টিলা গড়ে তুলেছে ও। সেখান থেকে কয়েকটা মুক্তো দিলেই তো ওদের পথখরচা হয়ে যেত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইকথিয়ান্ডার, আফসোস করে বলল, শুধু আমি যদি আগে জানতাম!।
তবু জাহাজের টিকেট আমাদের কাটা হয়ে গিয়েছিল, বলল অলসেন। কথা ছিল সকালে বালথাযারের দোকানে গিয়ে ওকে জানিয়ে আসব সেরাতে দশটার সময় জাহাজ ছাড়বে। কিন্তু গিয়ে শুনলাম গুট্টিয়ারা সেখানে নেই। বালথাযার আমাকে বলল, সে আর কোনদিনই এ দোকানে আসবে না থাকতে। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা তাকে গাড়ি করে নিয়ে গেছে তার ডলোরেসের বাড়িতে। জুরিতার মা এখানেই থাকে। বউকেও সে ওখানে রাখবে।
বিস্মিত ইকথিয়ান্ডার বলে বসল, ঐ বদমাশ পেদরো জুরিতাকে খুন করে গুট্টিয়ারাকে তুমি মুক্ত করে আনলে না কেন।
তিক্ত হাসল অলসেন, তারপর মাথা নেড়ে বলল, খুনের কথা বলছ? আমি করব খুন? তুমি বোধহয় খুন-খারাপিতে অভ্যস্ত?
লজ্জা পেল ইকথিয়ান্ডার। দ্রুত বলল, না, তা নয়! আসলে আমি…ভাবতেই পারছি না। অসহ্য লাগছে আমার। ওরা এত অবিবেচক! ওই পেদরো আর বালথাযার, দুজনই।
ঠিকই বলেছ, সায় দিল অলসেন। দুজনই ওরা খুব খারাপ লোক। ওদের ওপর রাগ হওয়ায় তোমাকে দোষ দিতে পারছি না। কিন্তু জীবনটাকে তুমি যেমন ভাবছ আসলে তা তেমন নয়। বড় জটিল, বড় কষ্টদায়ক এই জীবন, অথচ দেখো, মরে যেতে চাইলেও মৃত্যুর আগের মুহূর্তে বাঁচতে ইচ্ছে করে। আসলে, হাসল অলসেন, গুট্টিয়ারা নিজেই শেষে পালিয়ে যেতে আপত্তি করেছিল।
ও আপত্তি করল নিজে?
হ্যাঁ।
কেন?
তোমার মৃত্যু হয়েছে একথা ভেবে মনটা ভেঙে গিয়েছিল ওর। আমার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালবেসেছিল গুট্টিয়ারা। ও আমাকে বলেছিল, আমার জীবনের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, অলসেন। আর কোন কিছুতেই আমার কোন আগ্রহ নেই। তাই পেদরোর আনা পাদ্রি, যখন আমাকে বিয়ের আঙটি পরিয়ে দিল, তখন স্রষ্টার এ-ই ইচ্ছে ভেবে মেনে নিলাম আমি। স্রষ্টা যাদের একসঙ্গে করছেন, তাদের একসঙ্গে থাকাই ভাল।
উত্তেজিত ইকথিয়ান্ডার ক্ললে উঠল, স্রষ্টা! কিসের স্রষ্টা? আমার বাবা বলেন, স্রষ্টার কাহিনী ভূতের কাহিনীর মতোই, গাঁজাখুরি কাহিনী: ছাড়া আর কিছু নয়। একথা তুমি গুট্টিয়ারাকে বোঝাতে পারলে না?
পারতাম না। গুট্টিয়ারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। মিশনারিরা তাকে ভাল শিক্ষাই দিয়েছে। তবে একটা কথা, পেদারো জুরিতার মুখে শুনে আমাকে বলেছে গুট্টি, পাখি খাচায় ভরা গেছে, কিন্তু মাছটাকে এখনও ঘুরতে বাকি। মাছ বলতে পেদরো কাকে বোঝাচ্ছে কে জানে। সেই সাগর-দানোর কথা সম্ভবত। সে নাকি মাছের মতোই পানিতে থাকতে পারে। মাছেদের বন্ধু সে, ডুবুরি আর জেলেদের সেজন্যে ভয় দেখায়।
সতর্ক ইকথিয়ান্ডর নিজের সম্বন্ধে কিছু বলল না অলসেনকে। জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতার সাগর-দানোকে, কিজন্যে দরকার?
পেরো দানোকে দিয়ে মুক্তো তোলাতে চায়, বলল অলসেন। ও চায় মুক্তো বিক্রি করে আর্জেন্টিনার সরচেয়ে ধনী লোক হতে। সেকারণেই তার সাগর-দানোকে দুরকার। তুমি সাবধান থেকো। চোখের দিকে তাকাল অলসেন। তুমিই সেই সাগর-দানো নও তো?
হ্যাঁ, আমিই সেই দানো, স্বীকার করল ইকথিয়ান্ডার। কিন্তু আমি তো মানুষও। গুট্টিয়ারাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। যে করে হোক ওর সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। উত্তেজনায় নৌকোর পাটাতনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও।
ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অলসেন। ভাবছে এই যে সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন যুবক, এ তো একেবারেই মানুষের মতো। তাহলে লোকে একে দানো বলে কেন? একে নিয়ে এত আলোচনা, লেখালেখির কারণ কি? পানির নিচে থাকতে পারার অস্বাভাবিক গুণই কি শুধু এর কারণ, নাকি সত্যি কোন দানবীয় কাণ্ড করেছে যুবক! কিন্তু দেখে তো তেমন মানুষ বলে মনে হয় না যুবককে।
পেদরোর বাড়িটা কোথায় জানো? ইকথিয়ান্ডারের কথায় বাস্তবে ফিরল অলসেন। জানো কিভাবে ওখানে পৌঁছোতে হয়?
অলসেন বিনা দ্বিধায় ইকথিয়ান্ডারকে পেরোর বাড়ির হদিস জানিয়ে দিল। তার সঙ্গে হাত মেলাল ইকথিয়ান্ডার। বিদায়ের আগে আবেগ জড়িত স্বরে বলল, আমাকে ক্ষমা কোরো, অলসেন। প্রথমে তোমাকে আমি শত্রু ভেবেছিলাম। এখন বুঝছি তুমি আসলে আমার বন্ধু। বিদায় তাহলে, বন্ধু!
কথা শেষ করে সাগরের পানিতে নেমে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। ওর গন্তব্য এখন পারানা নদী। পারানা নদীর পাড়ে পারানা শহর, সেটাকে ছাড়িয়ে আরও উত্তরে যেতে হবে ওকে।
নৌকোয় দাঁড়িয়ে নতুন বন্ধুকে পেছন থেকে দেখছে অলসেন। দেখতে দেখতে ছোট একটা বিন্দু হয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার। আস্তে আস্তে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল।
১৯. লা প্লাটা উপসাগর ছাড়িয়ে
লা প্লাটা উপসাগর ছাড়িয়ে উত্তরমুখী হয়ে বয়ে চলেছে পারানা নদী। নদীর মোহনায় পানি সাঙ্তিক নোংরা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের, মনে হচ্ছে মুখবন্ধ একটা কুয়োর ভেতর আটকে গেছে সে। নদীর পানিতে আছে পারানা শহরের যত বর্জ্য পদার্থ। শহুরে নিষ্কাষণ ব্যবস্থার কারণে নদীর তলায় জমে আছে জীবজন্তুর কঙ্কাল, মানুষের মৃতদেহ, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র আরও বহুকিছু। মাথার খুলি ফাটা একটা মৃতদেহও দেখল ইকথিয়ান্ডার। গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে একটা বড় পাথর বাধা আছে। নিঃসন্দেহে কেউ তার অপকর্ম পাথর চাপা দিয়েছে এভাবে। নদীর মোহনার এই বিশ্রী জায়গাটা যত দ্রুত সম্ভব সাঁতার কেটে পার হয়ে যেতে চাইছে ইকথিয়ান্ডার।
এক সময় পেছনে পড়ে গেল নদীর মোহনা।
নদীর পানিতে লবণের পরিমাণ কম। তাছাড়া কাদার পরিমাণও বেশি। শ্বাস নিতে খুব অসুবিধে হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। লিডিঙের কথা একবার মনে এলো ওর। তাকে সঙ্গে আনলে দৈহিক পরিশ্রম, অনেক কম হতো। কিন্তু লিডিঙেরও কষ্ট হতো এই নোঙরা পানিতে। সেই বিচারে লিডিংকে সঙ্গে না এনে ভালই হয়েছে।
আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলেছে সময়। একসময় সন্ধে হয়ে গেল, অন্ধকার নামল সাগরের বুকে। সারাদিন প্রবল উত্তেজনায় খাওয়ার কথা মনে আসেনি ইকথিয়ান্ডারের, সন্ধে নামার পর ওর মনে হলো পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি সব সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। লাল মাটি ভরা নদীর তলদেশে তাকিয়ে দেখল ও, ঝিনুক বা মাছ নেই সেখানে। ওর ধারকাছ দিয়েই অবশ্য ছুটোছুটি করছে মিষ্টি পানির কিছু মাছ। কিন্তু সাগরের মাছের তুলনায় এগুলো অনেক ধূর্ত, সহজে ধরা যাবে না। রাতে একটা পাইক মাছ ধরল ইকথিয়ান্ডার। মাছটার স্বাদ অত্যন্ত খারাপ, মাংসে কাদা-কাদা গন্ধ, তবুও কাঁটাসহ মাছটাকে খেতে বাধ্য হলো ও খিদের জ্বালায়।
নদীর পানিতে অক্টোপাস কিংবা হাঙরের আক্রমণের ভয় নেই। সাগরের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ল ওর। একবার একটা গুহার ভেতরে অনেকগুলো অক্টোপাস ওকে আটকে ফেলতে চেয়েছিল। সেবার অনেক কষ্টে ওগুলোকে যুদ্ধে হারিয়ে মুক্তি পায় সে। নদীতে হাঙর বা অক্টোপাস নেই। এখানে বিপদ আসতে পারে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। খেয়াল রাখতে হবে ঘুমের সময় স্রোত যাতে তাকে। ভাটিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। বুদ্ধি বের করল ইকথিয়ান্ডার, তারপর বড় একটা পাথর জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।
তীব্র সাদা আলোর আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল ওর। চেয়ে দেখে, একটা স্টীমার এগিয়ে আসছে উজানের দিকে, তারই আলো। বুদ্ধি খেলল ইকথিয়ান্ডারের মাথায়। এমনিতেই খুব ক্লান্ত সে এখন! এটা সামনে একটা বিরাট সুযোগ। হেলায় হারানোর কোন মানে হয় না। স্টীমারের তলায় চলে এলো ইকথিয়ান্ডার, তলা আঁকড়ে ধরে ওটার। সঙ্গে চলল পারানা শহরের দিকে। পারানায় তাকে যেতেই হবে। যেতে হবে ডলোরেসে। ওখানে পেদরোর বাড়িতে গুট্টিয়ারা, আছে!
শহরের জেটিতে স্টীমার থামার পর ডুব সাঁতার কেটে একটা নির্জন জায়গায় চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। গগলস আর গ্লাভস খুলে ফেলল, নদীর কূলে বালির তলায় লুকিয়ে রাখল ওগুলো। রোদে শুকিয়ে নিল পরনের পোশাক। কোঁচকানো পোশাক দেখে তাকে মনে হলো চির ভবঘুরে এক নিঃসঙ্গ আগন্তুক।
অলসেন আগেই পথের হদিস রে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী নদীর ডান তীর ধরে হাঁটছে ইকথিয়ান্ডার; মাঝে মাঝে জেলেদের জিজ্ঞেস করে আরও নিশ্চিত হয়ে নিল, কোথায় পেদরোর ডলোরেসের বাড়ি।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপ। কাঠফাটা গরমে এখন রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে ইকথিয়ান্ডার। কাপড় ছেড়ে একবার নদীতে ডুব দিয়ে খানিক গা জুড়িয়ে নিল। পথ চলছে একটানা।
বিকেলে তার দেখা হলো এক বুড়ো চাষীর সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বুড়ো বলল, মাঠের মাঝ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা ধরে চলে যাও। ব্রিজ পার হয়ে টিলা পর্যন্ত গেলেই দেখা পাবে গোঁফওয়ালী ডলোরসের।
সেটাই নাকি পেদরোর বাড়ি?
তা ঠিক। ওই বাড়ির কত্রীর নাম ডলোরেস। মহিলার ঠোঁটের ওপর গোঁফ আছে বলে সবাই তাকে এক নামে ডাকে গুঁফো ডলোরেস। সে-ই পেদরো জুরিতার মা। বুড়োর ধারণা হয়েছে ইকথিয়ান্ডার ওই বাড়িতে মজুরি খাটতে যাচ্ছে, কাজেই শুভাকাক্ষী হিসেবে সে সাবধান করে দিয়ে বলল, ওখানে ভুলেও মজুর খাটতে যেয়ো না। ওই গুঁফো ডলোরেস আস্ত একটা ডাইনী। এত খাটা। খাটাবে যে স্রেফ মারা পড়বে। শুনছি পেদরো জুরিতা নাকি তরুণী এক মেয়েকে বিয়েও করেছে। শাশুড়ির অত্যাচারে সে বেচারি এখন টিকতে পারলে হয়। ইকথিয়ান্ডারকে আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে আরও বহু কিছু বলে গেল বুড়ো।
বাড়ির হদিস আবার জেনে নিয়ে একসময় পথে নামল ইকথিয়ান্ডার। পথ আর সামনে শেষ হয় না। গমের খেত, ভুট্টার খেত শেষ হতেই শুরু হলো দীর্ঘ ঘাসের প্রেয়ারি। অসংখ্য গরু ঘোড়া আর ভেড়া চরছে সেখানে। পায়ে হাঁটা পথটা মাঠের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে।
ভ্যাপসা গরমে কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। জলাশয় পেলে আরেকবার ডুব দিয়ে শরীরটা একটু জুড়িয়ে নিত। পাঁজরের সেই তীব্র ব্যথাটা ফিরে এসেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি, খিদেও লেগেছে খুব।
রাস্তার দুধারে পাথরের দেয়াল। ভেতরে ফলের বাগান। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে পীচ আর পাকা কমলালেবু। কিন্তু এ তো সাগর তল নয়, এখানে সবই কারও না কারও সম্পত্তি। এখানে সবকিছুই অধিকারের আওতাধীন, বেড়া দিয়ে ঘেরা। পাহারা দেয়া। আকাশের পাখিগুলোরই যেন শুধু মালিক নেই কেউ। পথ জুড়ে কিচিরমিচির করছে অনেক পাখি।
ইকথিয়ান্ডারের খেয়াল নেই, তার দিকে এগিয়ে আসছে উর্দিপরা। একটা মোটা লোক। বেশ চুপি সাড়ে অসছে সে। কোমরে ঝুলছে : রিভলভার। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। কাছে চলে এলো।
ইকথিয়ান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করল ডলোরেসের বাড়ি কোনদিকে।
জবাবে খেকিয়ে উঠল লোকটা। তাতে তোর কি, আঁ? কোথেকে আসা হয়েছে, শুনি?
বুয়েন্স আয়ার্স। ডলোরেসে একজনের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে।
হাত বাড়া সামনে, নির্দেশের সুরে বলল মোটকু।
দ্বিধার কোন কারণ নেই, কাজেই কথাটা শুনে লোকটার বাজে ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও হাত বাড়াল ইকথিয়ান্ডার। দেরি না করে সেই বাড়ানো হাতে পরিয়ে দেয়া হলো হাতকড়া। ইকথিয়ান্ডারের পাজরে একটা গুঁতো মারল মোটকু। এইবার ঠিক ঠিক ধরেছি, বাপু। চল, তোকে ডলোরেসে পৌঁছে দিচ্ছি।
হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার। আমাকে হাতকড়া পরালেন কেন?
আবার খেঁকিয়ে উঠল মোটকু। অত কথায় তোর কাজ কি? একদম চুপ। সামনে বাড়ু।
ইকথিয়ান্ডার জানে না, পাশের গ্রামে এক বাড়িতে গতকাল ডাকাত পড়েছিল। তারা খুনজখমও করে গেছে। তাঁদেরই খুঁজছে পুলিশ। কোঁচকানো ধূলিমলিন পোশাকে ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে সন্দেহজনক লাগছে সেটাও ওর খেয়ালে নেই। এখনও জানে না ডাকাত সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের লোক।
ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে থানায় চলল পুলিশ। সেখান থেকে তাকে জেলে পাঠানো হবে। এতক্ষণে বিষয়টি কিছু কিছু আঁচ করতে পারছে ইকথিয়ান্ডার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, প্রথম সুযোগেই পালাতে হবে তাকে।
ইকথিয়ান্ডারের পেছন পেছন হাঁটছে মোটা পুলিশ, আয়েস করে একটা চুরুট ধরাল। সাফল্যের আনন্দে আত্মমগ্ন। হাঁটতে হাঁটতে ডলোরেসের বাড়ির কাছে দিঘির পাশে চলে এসেছে ওরা। দিঘির ওপর দিয়ে ব্রিজ। সেই ব্রিজ পার হয়ে যেতে হবে। ব্রিজে উঠেই রেলিং টপকে পানির ভেতর ঝাঁপ দিল ইকথিয়ান্ডার।
মোটা পুলিশ ভাবতেও পারেনি ইকথিয়ান্ডার এরকম একটা কাজ করতে পারে। আর ইকথিয়ান্ডারও ভাবতে পারেনি মোটা পুলিশ এমন কীর্তি করবে। মোটা পুলিশও ওর পিছু নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বসেছে দিঘির ভেতর। তার মনে হয়েছে অপরাধী বোধহয় পানিতে ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। বিরাট বিপদে আছে বেচারী অপরাধী। এমনিতেই বিরাট দিঘি, তারওপর লোকটার হাতে হাতকড়া আছে। ওই হাতকড়া সহ লোকটা মারা গেলে কৈফিয়ত দিতে দিতে তার জীবন যাবে। ইকথিয়ান্ডারের পিছু পিছু ডুব সাঁতার দিয়ে তাকে ধরে ফেলল পুলিশ, তার চুলগুলো হাতের মুঠোয় পেয়ে ধরে ফেলল। কতক্ষণ থাকবে সে পানির নিচে? একটু পরই দম ফুরিয়ে যাওয়ায় তাকে ভেসে উঠতে হলো। মুক্তি পেয়ে কয়েক মিটার দূরে সরে পানির ওপর যখজাগাল ইকথিয়ান্ডার। তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলা মোটা পুলিশ, ডুবে মরবি তো! শীঘ্রি উঠে আয়!
ইকথিয়ান্ডারের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। চিৎকার করে উঠল ও, বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি…
ও কথা শেষ করেই পানির তলে ডুব দিল ও।
মোটা পুলিশও নাছোড়বান্দা ধরনের। কাজে বোঝা গেল সে বেশ করিৎকর্মাও বটে। লোকজন এবং নৌকো জোগাড় করে এনে পানিতে হুক ফেলে ইকথিয়ান্ডারকে খুঁজতে শুরু করল সে। যেখানেই ওরা খোঁজে, সেখান থেকেই সরে যায় ইকথিয়ান্ডার। এ যেন মজার এক খেলা। কিন্তু একটু পরই খেলাটা আর মজার থাকল না। বারবার পানির তলায় লুক নামানো-ওঠানো করায় পানিতে কাদার পরিমাণ বেড়ে গেল। অস্বচ্ছ পানিতে দেখতে অসুবিধে হতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডারের। শ্বাসকষ্টও বাড়ছে। কানকোতে কাদা ঢুকে গেছে। কড়কড় করছে সেগুলো। তীরের কাছে গিয়ে সাবধানে একবার মাথা জাগাল ও। দেখতে পেল পালানোর সুযোগ তার পানির ওপরে তৈরি করাই আছে। এতক্ষণ খুঁজে ইকথিয়ান্ডারকে না পেয়ে তাকে মৃত ধরে নিয়েছিল সবাই। এতক্ষণ পর ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেয়ে নির্ঘাত ভূত বলে ধরে নিল তারা। আসামী ভূত! ভূত আসামী! কখন কার ঘাড় মটকায় রাগে…
আঁ…আঁ করে আর্তনাদ করে উঠল এক পুলিশ। আরেকজন নৌকোর ওপর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। যে দুজন তীরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা যিশুর নাম নিতে নিতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল, ঠক ঠক করে কাপছে। নাছোড়বান্দা সেই মোটা পুলিশকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, এতক্ষণে বোধহয় মেইল ট্রেইনের মতো দ্রুত ছুটে মাইল খানেক পেরিয়ে গেছে।
এতটা সুযোগ পাওয়া যাবে সেটা ইকথিয়ান্ডার ভাবতেও পারেনি। এদের কাণ্ড দেখে এখন ওর মনে পড়ল, স্প্যানিশরা খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। নিশ্চই ওরা ভেবেছে প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে ভয়ঙ্কর জেদী আসামী ভূত। দুষ্ট বুদ্ধির অভাব নেই ইকথিয়ান্ডারের। উর মনে হলো এদের আরও একটু ভয় দেখানো যাক। দুই পুলিশ এখন জড়াজড়ি করে যিশুর নাম নিচ্ছে আর ঠকঠক করে কঁপিছে। দাত-মুখ খিচিয়ে চেহারা বিকৃত করে চিৎকার আর গর্জনের পাশাপাশি তীরের দিকে এগোতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডাঁর। মুঠোকর হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে রেখেছে। এতক্ষণ দুই পুলিশ ঠকঠক করে কাপছিল। এবার সেই কাঁপাকাঁপিও থেমে গেল। প্রচণ্ড গরমেও জমাট বরফের মতো স্থির হয়ে গেল ওরা। শুধু চোখ দুটো ইকথিয়ান্ডারের গগলসের মতো বড় হয়ে উঠল।
২০. ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা
নিজের ঘরে বসে হিসেবপত্র দেখছে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা, এমন সময়ে ঘরে ঢুকল তার বুড়ি মা। মহিলার মুখে পুরু গোঁফ, অত্যন্ত বিরক্তিকর একটা দৃশ্য। বিশ্রী লাগে তাকে দেখতে। তেমনই তার স্বভাবও বিদঘুটে। অত্যাচারী। ছেলের বউ উিয়ারাকে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। ছেলের ঘরে ঢুকেই বুড়ি বলে উঠল, হ্যাঁ, ওই মেয়ের রূপ আছে ঠিকই, কিন্তু দেখিস, ও নিয়ে ঝামেলাও কম পোহাতে হবে না। তার চেয়ে স্প্যানিশ মেয়ে বিয়ে করলে অনেক ভাল করতি। এমেয়ের রূপের কি গর্ব, বাপরে! হাতের তালু ধরে দেখলাম, নরম তুলতুলে। ওর বাপ কি বসিয়ে খাওয়াত ওকে, জমিদারের মেয়ে? দেখিস, ওকে দিয়ে ঘরসংসারের কোন কাজকর্মই হবে না।
হিসেব থেকে মুখ তুলল পেদরো, মাকে শান্ত করার জন্যে বলল, সব ঠাণ্ডা করে দেবো।
কিছুটা শান্ত হয়ে গজগজ করতে করতে বাগানে গেল বুড়ি। আজ জ্যোত্সা রাত। বাগান মৌ-মৌ করছে ফুলের সুবাসে। একটা বেঞ্চে বসে সংসারের চিন্তায় ডুবে গেল বুড়ি। পাশের বাগানটা তার কেনাই চাই। সেখানে কয়েকটা চালাঘর তুলবে সে। সেই চালাঘরগুলোতে মিহি লোমের ভেড়া রাখবে।
কুটকুট কুট! কুট!
ঠাস!! ঠাস!
এদের জ্বালায় একটু যদি শান্তি পেতাম। গজ গজ করে উঠল বুড়ি। মশা মারতে গিয়ে নিজের গালেই দুটো চাপড় বসিয়েছে সে। মাথাটা ঘুরে গেছে। সেজন্যেই কিনা কে জানে, হঠাৎ তার চোখে পড়ল ব্যাপারটা। পাথরের পাঁচিলের ওপরে ওটা যেন কার মাথা! কে যেন হাতকড়া পরা দুটো হাত সামনে নিয়ে লাফ দিয়ে দেয়ালের এপারে চলে এলো।
সাঙ্ঘাতিক ভয় পেল বুড়ি। নির্ঘাত কোন জেল পালানো বদমাশ। কয়েদী। ছুটে গেছে। ঢুকেছে এসে এখানে। চিকার করতে চেষ্টা করল বুড়ি। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। পালাতে চেষ্টা করল। ভয়ে তার শরীর নড়ল না। পা দুটো যেন আর কারও বেঞ্চে বসেই লোকটা কি করে দেখতে বাধ্য হলো বুড়ি। বড় বড় তার চোখ পুরুষমানুষ হলে হয়তো গোঁফে তা দিয়ে কোন না কোন সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করত। গোঁফ আছে বুড়ির, কিন্তু তা দেয়া বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।
সে যাই হোক, লোকটা এগিয়ে গেল বাড়ির জানালার কাছে। জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ভেতরে। আস্তে আস্তে ডাকছে।
গুট্টিয়ারা! গুট্টিয়ারা?
ডাকটা কানে যাওয়া মাত্র সাহস ফিরে এলো বুড়ির। সুন্দরী বউ সম্বন্ধে যেসব নোংরা সন্দেহ তার মনে এসেছিল সেসব যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। মনে মনে সে বলল, আচ্ছা! এই হচ্ছে রূপসী বউয়ের
কীর্তি! জেল পালানো বদমাশের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক? দাঁড়াও, বারোটা যদি আমি না বাজিয়েছি।
বাড়ির দিকে ছুট দিল বুড়ি। ছেলের উদ্দেশে মোটা গলায় হাঁক ছাড়ল, পেদারা রে, বাগানে একটা চোর ছুঁকেছে। তোর বউকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি আয়, কই গেলি!
ঘরদোর পুড়ে ছারখার হলো বুবি,এমন ভাবে বাগানের দিকে ছুটে গেল পেদরো জুরিতা। বাগানে একটা বেলচা পড়ে ছিল। পথে ওটা তুলে নিল।
লোকটা তখনও জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, ডাকছে, গুট্টিয়ারা! গুট্টিয়ারা!
গায়ের জোরে লোকটার মাথার ওপর বেলচা নামিয়ে আনল পেদরো। দাঁতে দাঁত চেপে হিসিয়ে উঠল, হারামজাদা! মানুষের বউয়ের সঙ্গে পিটিস পিটিস?
দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল জানালায় দাঁড়ানো লোকটা। আঘাতটা এত জোরে আর আচমকা পড়েছে তার মাথায় যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করারও সুযোগ হয়নি তার!
বড় করে শ্বাস ফেলল পেদরো বলল, শালা শেষ!
মেরে ফেলেছিস? আঁতকে উঠল বুড়ি।
পেদরো জুরিতা ভাবতে পারেনি ঘটনা এভাবে এতদূর গড়াবে। বিচলিত হয়ে পড়ল সে। মাকে সামনে দেখে তার কাছেই বুদ্ধি চাইল, কি করি এখন লাশটা নিয়ে?
দিঘিতে তৈরি জবাব দিল বুড়ি। ছেলের বিপদ তার মাথা খুলে দিয়েছে।
ভেসে উঠলে?
একটু দাঁড়া, ওটার পায়ে পাথর বেঁধে দিচ্ছি।
বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকল বুড়ি। লাশ ঢোকার মতো বড় বস্তা না পেয়ে শেষে একটা বালিশের ওয়াড় আর দড়ি সঙ্গে নিয়ে ফিরল। এদিকে কয়েদীর লাশ নিয়ে দিঘির পাড়ে চলে এসেছে পেদরো। মায়ের কাছ থেকে ওয়াড়টা নিল সে, কয়েকটা ওজনদার পাথর ভেতরে পুরে ওটা কয়েদীর পায়ের সঙ্গে বেঁধে লাশটা দিঘিফেলে দিল।
আকাশের দিকে একবার তাকাল পেরা। মেঘ জমেছে। আকাশে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। একটু পু্রেই বোধহয় বৃষ্টি নামবে। ভাল। ঘাসের ওপর থেকে রক্তের দাগ মুছে যাবে। পরনের পোশাকের দিকে চাইল। এটা বদলে ফেলতে হবে। গায়ে রক্তের ছিটে লেগে আছে। গুট্টিয়ারার কথা মনে আসতেই দাঁত কিড়মিড় করল পেদরো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, হারামজাদী, হারামির বাচ্চি।
এবার দেখ কেমন মানুষ তোর সুন্দরী বউ, তাকে আরও উস্কে দিল বুড়ি।
*
বাড়ির চিলেকোঠায় গুট্টিয়ারার থাকার ঘর দেয়া হয়েছে। রাতে তার ঘুম আসে না। ভ্যাপসা গরম, হাজার হাজার মশা আর মাথার ভেতর শত শত দুশ্চিন্তার মাঝে রাত জাগে ও ইকথিয়ান্ডারের সেই আত্মহত্যা আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ও! ফলে স্বামীকে ও ভালবাসতে পারেনি। আর শাশুড়ির ব্যবহারের কথা না বললেও চলে।
আজ রাতে তার একবার মনে হয়েছিল ইকথিয়ান্ডারের গলা শুনতে পেয়েছে। তার নাম ধরে যেন ডাকছিল ইকথিয়ান্ডার। তার একটু পরই বাগানের ভেতর হুটোপুটির স্লাওয়াজ হলো। কে যেন চাপা স্বরে কি বলল।
উত্তেজিত লাগছে, আজ রাতে আর ঘুম আসবে না, কাজেই বাগানে চলে এলো গুট্টিয়ারা মন শান্ত করতে।
ভোর প্রায় হয়ে এসেছে। বাগানটা যেন ঝিম মেরে আছে। কেটে গেছে মেঘ আকাশ খালি করে। বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত হয়নি। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল গুট্টিয়ারার।
বাগানের মাটিতে রক্তের দাগ!
ঘাসের ওপর একটা রক্তমাখা বেলচাও পড়ে আছে।
রাতে নিশ্চই এখানে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে গেছে!
রক্তের দাগ অনুসরণ করে দিঘির পাড়ে চলে এলো কৌতূহলী গুট্টিয়ারা। বুঝতে পারছে এখন, খুন করে লাশটা নিশ্চই দিঘির ভেতর ফেলে দেয়া হয়েছে। সবুজ জলাধারের দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকল গুট্টিয়ার।
ও কি ভুল দেখছে চোখে?
মনে হচ্ছে দিঘির ভেতর থেকে তারই দিকে চেয়ে আছে ইকথিয়ান্ডার! এও কি সম্ভব? পানির নিচে থেকে ইকথিয়ান্ডার তাকে দেখছে? পাগল তো হয়ে যাচ্ছে না ও? চোখ কি তাহলে ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে?
ধীরে ধীরে পানির ওপরে উঠে এলো ইকথিয়ান্ডারের মুখ। হাতে হাতকড়া, উঠে এলো ও দিঘির পাড়ে, হাত দুটো যতটা সম্ভব প্রসারিত করে আবেগ জড়িত গলায় ডাকল, গুট্টিয়ারা!
আতঙ্কে কেঁপে উঠল গুট্টিয়ারা। ফিসফিস করে বলল, তুমি! কিন্তু তুমি তো মারা গেছ! কেন এসেছ তুমি? অশরীরী হয়ে আমাকে ভয় দেখাতে? না, না, তুমি চলে যাও; চলে যাও, ইকথিয়ান্ডার!
আমি মরিনি, গুট্টিয়ারা। শোনো, গুট্টিয়ারা! পালিয়ে যেয়ো না। সবই তো জানো, চেনো আমাকে, কিন্তু একটা কথা তোমাকে কখনও বলা হয়নি। গুট্টিয়ারার বিস্ময় লক্ষ করে ব্যাখ্যা করল ইকথিয়ান্ডার। আমি বেঁচে আছি, গুট্টিয়ারা। পানির নিচেও আমি বাঁচতে পারি। আর সব মানুষের মতো নই আমি। পানির নিচে ইচ্ছে করলে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। সেদিন সাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম কারণ ওপরে বাতাসে আর থাকতে পারছিলাম না, অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। বলতে বলতে ধরে এলো ইকথিয়ান্ডারের গলা। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। কাল রাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকছিলাম। তোমার স্বামী পেছন থেকে এসে আমাকে আঘাত করে। জ্ঞান হারাই আমি। সে আমার হাত-পা বেধে দিঘিতে ফেলি য়ে। থলেতে পাথর ভরে সেটা আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল। সেসব খুলে ফেলেছি, কিন্তু হাতকড়াটা কিছুতেই খুলতে পারছি না। হাত তুলে হাতকড়াটা দেখাল সে।
গুট্টিয়ারা নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ওর বিশ্বাস হচ্ছে ইকথিয়ান্ডার মারা যায়নি। জিজ্ঞেস করল, হাতকড়া কেন তোমার হাতে?
পরে তোমাকে সব খুলে বলব, জবাবে বলল ইকথিয়ান্ডার। গলায় তাগাদার সুর। এখন চলো, পালিয়ে যাই আমরা। আমার বাবার বাড়িতে তুমি আর আমি থাকব। সেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। অলসেনের মুখে জানলাম সবাই নাকি আমাকে সাগর-দানো নামে চেনে। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করো, গুট্টিয়ারা, আমি আসলে মানুষ ছাড়া আর কিছু নই।
ক্লান্তি বোধ করছে, ঘাসের ওপর বসে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। কাছে এগিয়ে এলো গুট্টিয়ারা, ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখল। কোমল স্বরে বলল, সত্যি, অনেক কষ্ট তোমার মনে, ইকথিয়ান্ডার!
হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো পেদরো জুরিতোর টিটকারি মেশানো কণ্ঠস্বর। বাহ, বাহ্, ভালই জমেছে দেখছি! প্রেম!
কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। ওদের আলাপ শুনেছে। জেনে গেছে, যাকে এতদিন খুঁজেছে সেই সাগর-দানো এখন ওর আওতার ভেতর। বন্দি করলেই হয় এখন। মনের খুশি মনেই চেপে বিদ্রুপ মেশানো স্বরে সে বলল, তোমার বাবার বাড়িতে গুট্টিয়ারাকে নিয়ে যাবে? আরে বাপু, তুমি নিজেও তো ওখানে কোনদিন ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ।
কেন? জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার শান্ত গলায়। আমি তো অপরাধ করিনি!
তা বলতে পারবে পুলিশ। অপরাধ না করলে পুলিশের হাতকড়া তোমার হাতে কেন? এখন আমার উচিত পুলিশের হাতে তোমাকে তুলে দেয়া।
ওকে তুমি পুলিশে দেবে? ভয় মেশানো স্বরে জিজ্ঞেস করল গুট্টিয়ারা।
সেটাই উচিত, কঠোর চেহারায় বলল পেদরো জুরিতা।
সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ করতে এসময়ে সেখানে হাজির হলো বুড়ি ডলোরেস। এসেই তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠল। স্বামীকে অনুরোধ করছে গুট্টিয়ারা কাতর হয়ে যাও
ওকে তুমি ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও ঈশ্বরের শপথ, আমার কোন ক্ষতি ও করেনি কখনও।.
খনখনে গলায় বলে উঠল বুড়ি, খবরদার, ওর কথা শুনবি না, পেদরো। যে বউ কয়েদির সঙ্গে সম্পর্ক রাখে সে কেমন চরিত্রের মেয়েলোক সেটা বুঝতে আমার আর বাকি নেই।।
হঠাৎ করেই আচরণ বদলে গেল পেদরোর। নরম গলায় মাকে বলল, কি করব, বলো, মা। মেয়েরা অনুরোধ করলে সে অনুরোধ আমি না রেখে পারি না।
গজগজ করে উঠল বুড়ি ডালোরেস। বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের পায়ের তলায় চলে গেছিস দেখছি!
মাকে আশ্বস্ত করতে হাসল পেদরো জুরিতা। কর্তব্যপরায়ণতার চূড়ান্ত দেখাচ্ছে এমন স্বরে বলল, একটু অপেক্ষা করো, মা। একটু অপেক্ষা করো। দেখোই না কি হয়। ওর হাতকড়া আমি কেটে দেব, তারপর ভাল পোশাক পরিয়ে ধরে নিয়ে যাব আমার জাহাজে। গোঁফে তা দিল সে। মায়ের চেয়ে তার গোফ খানিক পুরু। স্ত্রীর উদ্দেশে বলল, কি, সেটাই ভাল হবে, তাই না?
গুট্টিয়ারার মনে হলো পেদরোকে সে যতটা খারাপ লোক বলে মনে করেছিল আসলে সে হয়তো ততটা খারাপ লোক নয়। কৃতজ্ঞতাবোধে অন্তর ছেয়ে গেল ওর।
কিন্তু বুড়ি ডলোরেস ছেলেকে ভাল করেই জানে। বুঝতে তার দেরি হলো না, ছেলে তলায় তলায় কোন একটা মতলব ভঁজছে। তবুও বুড়ি বউকে শুনিয়ে গজগজ করতে ছাড়ল না। একেবারে গেছিস তুই, গেদরো। একেবারে বউয়ের পায়ের তলায় চলে গেছিস।
২১. বালথাযারের দোকান
বালথাযারের দোকান।
দোকানে বসে আছে দুই ভাই, বালথাযার আর ক্রিস্টো। বেশ অনেকদিন পর আলাপ করছে মন খুলে। কথায় কথায় ক্রিস্টো জানাল, কাল আন্দেজ পাহাড় থেকে ফিরে আসছে ডাক্তার সালভাদর। এতদিন দেখা করতে পারিনি জ্বরের কারণে। অনেক কথা জমে আছে, বলতে হবে। মন দিয়ে শুনবি। মাঝখান থেকে কথা বলে আমার খেই হারিয়ে দিবি না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছে ক্রিস্টো। একটু পর শুরু করল, পেদরোর লোভ কিন্তু দিনকে দিন মাত্রা ছাড়িয়ে বেড়ে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখছে লোকটা। সেজন্যেই তার সাগর-দানোকে দরকার।
বালথাযার কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, ধমক দিয়ে তাকে থামাল ক্রিস্টো। চুপ করে শোন। বকবক করলে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে অসুবিধে হয় আমার। সে যাই হোক, যা বলছিলাম,সাগর দানোকে হাতের নাগালে পাওয়ার মানে বুঝিস? এক কথায় হাতে সব সম্পদ একবারে পাওয়া। দুনিয়ার বুকে স্বর্গ পারে যে তাকে ধরতে পারবে। সাগরের তলা থেকে রত্নের পাহাড় তুলে আনবে ওই দানো। শুধু মণি-রত্নই নয়, যেসব জাহাজ ডুবেছে, সেগুলোর সব সম্পদও তখন আহরণ করা যাবে। পেদরো সেই মতলবই করেছে।
বালথাযার আবার কি যেন বলতে হাঁ করেছিল, হাতের ঝাঁপটা আর ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে ক্রিস্টো বলে চলল, ছটফট না করে যা বলছি চুপ করে শোন্! পেদরো কেন সাগর-দানোকে ব্যবহার করে বড়লোক হবে? আমাদের বড়লোক হতে বাধা কোথায়? সমস্ত ধনরত্ন তো আমাদের জন্যেই তুলে আনতে পারে ওই দানো। বালথাযারের কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো ক্রিস্টো, ফিসফিস করে বলল, আর ওই দানো তো আসলে দানো নয়। ও হচ্ছে অসাধারণ এক মানুষ। ওর নাম ইকথিয়ান্ডার। তোর পালক মেয়ে গুট্টিয়ারাকে ভালবাসে ইকথিয়ান্ডার। জামাই হিসেবে পেরোর চেয়ে লক্ষগুণে ভাল হবে সে।
ভেবেচিন্তে দেখে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বালথাযার। কোন কথা বলল না।
ক্রিস্টো বলল, আরও বেশ কিছু ব্যাপার আ:ে তুই জানিস না। আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা, তোর মনে, তোর বউকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরছিলাম আমি? মনে নেই? মায়ের কবর দেখতে গিয়েছিল তোর বউ। মনে পড়ে? তোর বউয়ের একটা ছেলে হয়েছিল ফেরার পথে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়েই তো মারা গেল। বেচারি। আমার ধারণা হয়েছিল ছেলেটাও মারা গেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। পরে বুঝেছি, ঘটনা পঁাচ খেয়ে গেছে। ঘটনাটা ঘটে একটা রেড ইন্ডিয়ান গ্রামে। সেই গ্রামের কাছে থাকত ডাক্তার সালভাদর। ছেলের মা মারা গেলেও ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচে যায়। গ্রামের লোকরা আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলল যদি ভাতিজাকে বাঁচাতে চাও তাহলে ওই ডাক্তার সালভাদরের কাছে নিয়ে যাও। উনি স্বয়ং স্রষ্টারই প্রতিরূপ। তোমার ভাতিজা যদি বাঁচে তাহলে ওই ডাক্তার সালভাদরের কারণেই বাঁচবে। ভেবে দেখলাম আমার হাতে থাকলে তোর ছেলে মারা যাবে। শেষে সবদিক চিন্তা করে ডাক্তারের হাতেই তাকে তুলে দিই আমি।
মুখ হাঁ করে ভাইয়ের কথা গিলছে লালথার। চোখ চকচক করছে প্রবল উত্তেজনায়। তবে কি…
ক্রিস্টো বলে চলেছে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমি বসে থাকলাম ডাক্তারের দরজার সামনে। তারপরও অনেকক্ষণ কেটে গেল। একসময় ডাক্তারের নিগ্রো চাকর এসে খবর দিল, ছেলেটা মারা গেছে। ওখানে থেকে তাকে কবর দেয়ার মানসিক অবস্থা তখন ছিল না আমার। ভাঙা মন নিয়ে তোর এখানে ফিরে আসি। আসল ঘটনা এখানেই প্যাঁচ খেয়েছে। তোর ছেলের ঘাড়ে একটা লাল জন্মদাগ ছিল। জন্মদাগটা ঠিক কেমন তা আজও আমার মনে আছে। কয়েকদিন আগে ওই একই দাগ দেখলাম আমি ইকথিয়ান্ডারের ঘাড়ে। একটা চোট নিয়ে বাড়িতে ফিরেছিল ও, সেকারণেই দেখার সুযোগ হয়।
তাহলে কি ইকথিয়ান্ডার আমার ছেলে? আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না বালথাযার।
গম্ভীর হয়ে গেল ক্রিস্টোর চেহারা। বলল, আমার বিশ্বাস সেদিন ডাক্তার সত্যি কথা বলেনি। তোর ছেলে আসলে মরেনি। তাকেই সাগর-দানো বানিয়েছে ডাক্তার সালভাদর।
ওকে খুন করব আমি! উত্তেজিত স্বরে বলল বালথাযার। ওই ডাক্তারকে নিজের হাতে শেষ করে দেব।
ক্রিস্টো তার স্বাভাবিক বুদ্ধি হারায়নি। ভাইকে শান্ত করে সে বলল, এখন একদম চুপচাপ থাকতে হবে আমাদের। মুখ একদম বন্ধ! তোর চেয়ে ডাক্তারের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশি। তুই যা-ই বলিস তোর কথা বিশ্বাস করবে না কেউ। আর এমনও তো হতে পারে যে আমার কোন ভুল হচ্ছে? ওই ছেলে তোর, এটা যেমন সত্যি, তেমনি মিথ্যেও হতে পারে। খুব সাবধানে কাজ। এগোতে হবে আমাদের।
তাহলে এখন আমাদের কি করা উচিত?
প্রথম কাজ ডাক্তার সালভাদরের কাছে যাওয়া। তাকে বলতে হবে যে ছেলে আসলে তোর। দরকারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাহায্য করব আমি। সাক্ষ্যও দেব। তাতেও যদি ডাক্তার ইকথিয়ান্ডারকে তোর হাতে তুলে না দেয় তাহলে তোকে মামলা করতে হবে ডাক্তারের নামে। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলবি তখন, তোর ছেলেকে ডাক্তার নিজের ইচ্ছেমতো বিকলাঙ্গ করেছে। একটা কথা মনে রাখিস, যদি প্রমাণ হয় ইকথিয়ান্ডার তোর ছেলে নয়, তাহলেও গুট্টিয়ারার সঙ্গে ওকে বিয়ে। দিতে হবে। তোর মেয়েকে সে ভালবাসে। গুট্টিয়ারাকে বিয়ে করে আজীবন তোর নির্দেশ-পরামর্শ মানবে সে।
ছেলে! আমার ছেলে! ইকথিয়ান্ডার! কি কপাল আমার, হায়রে! বিড়বিড় করছে আর পায়চারি করছে বালথাযার। উত্তেজিত।
আহাজারি শুনে বিস্মিত হলো ক্রিস্টো। জিজ্ঞেস করল, কপাল নিয়ে সমস্যা কিরে, তোর কপাল তো খুলে গেল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বালথাযার। ধরা গলায় বলল, এতক্ষণ তোর কথা শুনলাম, নিজের কথা কিছু বলিনি। এবার শোন, আমার কপালের দোষ আছে রে। তুই তো গত কয়েকদিন আসিসনি। এরই মধ্যে গুট্টিয়ারার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে পেদরোর।
খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল ক্রিস্টো। ক্ষুব্ধ বালথাযার বলে চলল, আরও খারাপ খবর আছে। আমার ছেলে ইকথিয়ান্ডার এখন ক্যাপ্টেন পেদোর বন্দি।
চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল ক্রিস্টো। আপনমনে বলল, না, এ হতে পারে না।
জেলিফিশ জাহাজে ইকথিয়ান্ডার এখন বন্দি, জোর দিয়ে বলল বালথাযার। আজ সকালেই পেদরো এসেছিল। খুব গালাগালি করে গেল আমাকে। বলল আমরা নাকি তাকে চুষে ছিবড়ে বানিয়েছি শুধু, কোন কাজে আসিনি। আমাদের সাহায্য ছাড়াই সে ইকথিয়ান্ডারকে বন্দি করেছে। এখন থেকে সে আর এক পয়সা দিয়েও আমাদের সাহায্য করবে না। গুট্টিয়ারার চরিত্র নিয়েও বাজে বাজে কথা বলল।
বালথাযারের হতাশা প্রবল প্রভাব ফেলল ক্রিস্টোর মনে। সে নিজেও চরম হতাশা বোধ করছে। ভেবেছিল ইকথিয়ান্ডারের কাধের জন্মদাগের রহস্য জানিয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নেবে, কিন্তু ঘটনা যে এভাবে মোড় ঘুরবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বালথায্যারের কথায় এখন রীতিমতো ভয় লাগছে তার। ইকথিয়ান্ডার যদি সত্যিই বন্দি হয়ে থাকে তাহলে ডাক্তার কি আর তাকে আস্ত রাখবে? কালই ফিরছে ডাক্তার আন্দেজ পাহাড় থেকে। তখন? তার আগেই একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প দাঁড় করিয়ে নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিতে হবে তাকে। এই বয়সে নিশ্চিন্ত একটা চাকরি খোয়ানোর অর্থ পথে পথে ফকিরে মতো ঘুরে বেড়ানো। সে জীবন থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
*
পরদিন ভোর।
ডাক্তার তাঁর বাড়িতে ফিরেছেন। আগেই তৈরি হয়ে আছে ক্রিস্টো, চোখেমুখে তার শোকের চিহ্ন। আনুগত্য প্রকাশে আজ সে মহা পটু। ডাক্তারকে দেখেই প্রায় হাহাকার করে উঠল:
একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, স্যার! বারবার করে কতবার বললাম যাতে ইকথিয়ান্ডার খাঁড়ির দিকে সাঁতার কাটতে না যায়, কিন্তু ও শুনল না। হায়…
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন উৎকণ্ঠিত ডাক্তার, কি হয়েছে ইকথিয়ান্ডারের?
ধরা পড়ে গেছে। একটা জাহাজ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি…।
আর কোন কথা বলার সুযোগ ডাক্তার তাকে দিলেন না, একবার শুধু সামান্য নিয়ন্ত্রণ হারালেন, ক্রিস্টোর কাঁধে চেপে বসল এর হাতের আঙুলগুলো, পরমুহূর্তেই শিথিল হয়ে গেল বজ্রআঁটুনি। নিগ্রো চাকরকে ডাকলেন তিনি। অজানা একটা ভাষায় তাকে বেশক্ষিছু নির্দেশ দিয়ে ক্রিস্টোর দিকে ফিরলেন। আমার সঙ্গে তুমি যাচ্ছ, ক্রিস্টো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
কাপড় না বদলেই বাগানের দিকে চলে গেলেন ডাক্তার সালভাদর। তাঁর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে প্রায় দৌড়োতে হচ্ছে ক্রিস্টোকে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল সে, আমি স্যার কুকুরের মতো করে ইকথিয়ান্ডারকে পাহারা দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু…
তার কথা ডাক্তার শুনছেন বলে মনে হলো না। বাঁদর বসে ছিল যে পুকুরের নিচে সেখানে চলে এলেন তিনি। গোপন বোতামে চাপ দিয়ে পুকুরের সমস্ত পানি বের করে দিলেন। নিচে নামার সিঁড়িটার দিকে পা ব্যড়িয়ে বললেন, আমার সঙ্গে এসো, ক্রিস্টো।
অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছেন ডাক্তার সালভাদর। পেছনে হোঁচট খেতে খেতে ক্রিস্টো। সে বুঝতে পারল এই গুহা আর অন্ধকার সবই ডাক্তারের নখদর্পণে।
নিচে নেমে আর কোন সুইচ টিপলেন না ডাক্তার সালভাদর, অন্ধকারেই ডানদিকের একটা দরজা খুললেন, সামনে আরেকটা সুড়ঙ্গ পথ। ক্রিস্টোকে নিয়ে এগিয়ে চললেন সেই পথ ধরে।
অনেকক্ষণ পর ক্রিস্টোর মনে হলো ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এবার সালভাদর আলো জ্বাললেন। ক্রিস্টো দেখল তারা দুজন আংশিক পানি ভরা বিরাট একটা লম্বাটে গুহায় এসে উপস্থিত হয়েছে। গুহার গোল ছাদ দুপাশে ঢালু হয়ে পানির সঙ্গে মিশে গেছে। ওরা পাথর দিয়ে বাঁধানো যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার ঠিক ধারেই পানির ওপর ভাসছে একটা ছোট সাবমেরিন। সোজা সেটায় চড়লেন সালভাদর। ক্রিস্টোকেও উঠতে হলো। কেবিনের আলো জ্বাললেন ডাক্তার। একজন নিগ্রো চাকর ওপরের ঢাকনাটা এঁটে দিল, আরেকজন বসল এঞ্জিনে। সে এঞ্জিন স্টার্ট দিতেই সাকমেরিনটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, ধীরে ধীরে সামনের দিকে বাড়ছে
দুই মিনিটও লাগল না, সাগরের ওপরে শরীর জাগাল সাবমেরিন। এমন বাহনে চড়ার অভিজ্ঞতা ক্রিস্টোর কখনও হয়নি। সাবমেরিনের দ্রুতগতি দেখে ওর মনে হলো যন্ত্রের এঞ্জিনটা খুব শক্তিশালী।
ক্রিস্টোকে জিজ্ঞেস করলেন সালভাদর, ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে কোনদিকে গেছে সেই জাহাজটা?
উত্তর তীর বরাবর, জবাব দিল ক্রিস্টো। কিন্তু একটা কথা, স্যার…
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন সালভাদর। ক্রিস্টো ইতস্তত করছে দেখে তাগাদা দিলেন, কই, কি হলো! বলো?
আমার ভাই বালথাযারকেও আপনি সঙ্গে নিন, বলল ক্রিস্টো। বালথাযরি জানে জেলিফিশ জাহাজের মালিক পেদরো জুরিতা ইকথিয়ান্ডারকে জোর করে আটকে রেখেছে। ও আরও জানে যে ইকথিয়ান্ডারকে দিয়ে ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন পেনরো জুৰ্ধিতা মুক্তো তোলাবার স্বপ্ন দেখছে। সাগরে কোথায় ভাল মুক্তো পাওয়া যাবে সেখবরও জানে আমার ভাই। ও সহজেই বলতে পারবে কোথায় থাকতে পারে জেলিফিশ জাহাজ।
কথাগুলো একবার ভেবে দেখে বললেন ডাক্তার সালভাদর, ঠিক আছে, তোমার ভাইকেও সঙ্গে নেব। থাকে কোথায় সে?
আমি তাকে বলে রেখেছি, স্যার। বাঁধের ওপর তৈরি হয়ে অপেক্ষা করবে সে।
উপকূলের দিকে এগিয়ে চলল সাবমেরিন। সাঁতার কেটে সাবমেরিনে উঠে এলো বালথাযার। আপনাআপনি তার জ কুঁচকে গেল ডাক্তার সালভাদরকে দেখে, ভুলতে পারছে না এই ডাক্তারই তার ছেলেকে অপারেশন করে বিকলাঙ্গ করেছে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারকে সালাম জানাল সে। সালামের জবাব দিলেন ডাক্তার।
তীব্র গতিতে সাগরের পানি চিরে দিয়ে ছুটতে শুরু করল সাবমেরিন।
২২. ইকথিয়ান্ডারের হাতকড়া
ইকথিয়ান্ডারের হাতকড়া কেটে দিয়েছে পেদরো জুরিতা, দিয়েছে নতুন পোশাক আর জুতো। সবই অবশ্য নিজের স্বার্থে। বালির নিচে কোনো গ্লাভস আর গগলসও উদ্ধার করে আনা হয়েছে। খাতির করা হলেও ইকথিয়ান্ডার আসলে একজন বন্দি। সেটা বুঝতে একটু দেরি হলো ওর। ডেকে উঠতেই কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান ডুবুরি ওকে ঘিরে ধরে জোর করে জাহাজের খোলে ফেরত পাঠাল।
রসদ নেবার জন্যে জাহাজ একবার থামল বুয়েন্স আয়ার্স বন্দরে, তারপর রওনা দিল রিও ডি জেনিরো শহরের দিকে। বন্দরে জাহাজ যখন থেমেছে তখন খাণিক সময় করে নিয়ে বালথাযারের দোকানে গিয়েছিল পেদরো নিজের পিঠ নিজে চাপড়াতে। নিজের মুখে গর্ব করে বালথাযারকে নিজেরই সাফল্যের কথা বলে এসেছে সে, নইলে বালথাষার কিছুই জানতে পেত না।
পেদরো জুরিতা তার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার পুব তীর ধরে মুক্তো সংগ্রহ করতে করতে এগিয়ে যাবে ওরা, একসময় হাজির হবে ক্যারিবিয়ানে।
সঙ্গে করে গুট্টিয়ারাকেও নিয়েছে সে। বাগানের সেই ঘটনার পর থেকে মোটেও গুট্টিয়ারাকে বিশ্বাস করতে পারছে না পেদরো। মেয়েটাকে আপাতত শান্ত করতে মিথ্যে বলেছিল সে। বলেছিল ইকথিয়ান্ডারকে সে লা-প্লাটা উপসাগরে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মিথ্যেটা ধোপে টেকেনি। জাহাজের খোলের ভেতর থেকে গোঙানি আর চিৎকার শুনে বুঝে গেছে গুট্টিয়ারা, এই জাহাজেই আছে ইকথিয়ান্ডার। কিন্তু তার কিছু করার নেই। নিরুপায় সে। বাইরে থেকে তার কেবিনের তালা বন্ধ করে দিয়ে গেছে তার স্বামী। অনেকবার দরজা ধাক্কিয়ে হতাশ হয়ে সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে গুট্টিয়ারা। কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি, নিষেধ আছে।
ইকথিয়ান্ডারের চিঙ্কার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু বাড়ছে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে ইন্ডিয়ান এক সহযোগীকে নিয়ে জাহাজের খোলে নেমে আসতে বাধ্য হলো পেদরো জুরি। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হয়েছেটা কি? এত চেঁচাচ্ছ কেন?
আমার দম শেষ হয়ে যাচ্ছে, বলল ইকথিয়ান্ডার হাঁফাতে হাঁফাতে। মরে যাব। পানি ছাড়া মরে যাব মনে হচ্ছে। আমাকে সাগরে ছেড়ে দাও।
ডেকের ওপর চলে এলো অস্থির পেদোরা জুরিতা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সত্যি যদি সাগর-দানো মারা যায় তাহলে তার এত স্বপ্নের কি হবে? কোনমতেই ইকথিয়ান্ডারকে মরতে দেয়া যায় না।
সিদ্ধান্ত নিয়ে খালাসীদের মাধ্যমে একটা সমাধান করে ফেলল সে সমস্যার। একটা পিপেয় সাগরের পানি ভরে সেটা পাঠিয়ে দিল জাহাজের খোলে। দরকার হলে ইকথিয়ান্ডার বড় পিপেটায় ডুব দিয়ে দম নিতে পারবে।
ইকথিয়ান্ডারকে বলল, তুমি এটাতে একটু গোসল-টোসল সেরে নাও। সকাল হলে তোমাকে সাগরে নামানো হবে।
পিপের মধ্যে ঢুকে দম নিল ইকথিয়ান্ডার, সারা শরীর ভেজাতে শুরু করল। ইন্ডিয়ান খালাসীরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, অবাক হয়ে দেখছে তার কাণ্ড। ওরা শুনেছে, এই মানুষটাই নাকি আসলে সাগরের সেই ভয়ানক দানো।
এই, এখানে ভিড় কিসের! যাও, ডেকে যাও সবাই, খেঁকিয়ে উঠে খালাসীদের তাড়া লাগাল পেদরো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে বাধ্য হলো লোকগুলো।
এদিকে পানিতে ডুব দিয়েও শান্তি নেই ইকথিয়ান্ডারের। পিপে যত বড়ই হোক, হাত-পা না গুটিয়ে পানির নিচে ডুবে থাকা যাচ্ছে না। তাছাড়া পিপের গন্ধটাও অসহ্য লাগছে। এই পিপেতে থাকত নোনা মাংস। সেকারণে পানি থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। তবু কিছুই না থাকার চেয়ে সাগরের পানি ভর্তি এই পিপেটা থাকায় আপাতত প্রাণে বাচল ইকথিয়ান্ডার। জেলিফিশ জাহাজ উত্তর দিকে চলেছে। দক্ষিণ-পুর্ব থেকে পালে এসে লেগেছে সাগরের ঝিরঝিরে লবণাক্ত বায়ু।
ভোরের একটু আগে কেবিনে ফিরল পেদরো জুরিতা। সে ভেবেছিল তার বউ এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেবিনে ঢুকে দেখল একটা টেবিলে বসে আছে গুট্টিয়ারা, হাত দুটো চিন্তা করার ভঙ্গিতে মাথার দুপাশে ছাদ থেকে ঝুলন্ত লণ্ঠনের আলোয় গুট্টিয়ারার মুখটা ফ্যাকাশে লাগছে দেখতে, কেমন যেন দিশেহারা।
তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ, চাপা স্বরে অভিযোগ করল গুট্টিয়ারা।
না গুট্টি, পাখি পড়াল পেঁদরো। মিথ্যে গোপনের নানা কৌশল তার জন্মসূত্রে পাওয়া। প্রয়োগ করল বদগুণটা। বাঁকা হেসে বলল, আমি তো ওকে ছেড়েই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এই জাহাজে আছো জানার পর সে কিছুতেই যেতে রাজি নয় আর।
মিথ্যে কথা! মিথ্যেবাদী! তুমি একটা পশু! তোমার মুখ দেখতেও ঘৃণা হয়! টেবিল ছাড়ল গুট্টিয়ারা, চরকির মতো পাক খেল। হাতে দেয়ালের খাজে আটকানো ক্ষুরধার একটা ছোরা। সোজো পেদরোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গুট্টিয়ারা।
আচ্ছা! ছোটখাট একটা গর্জন ছাড়ল পেদরো। সহজেই গুট্টিয়ারার ছছারাসহ হাতটা ধরে ফেলল সে। জোরে মোচড় দিতেই হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল ছোরাটা লাথি মেরে হারাটা কেবিনের বাইরে বের করে দিল পেরে ভেতরটা রাগে জ্বলে গেলেও মুখে টেনে আনল ভদ্রতার হাসি। বলল, তুমি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। মাথা ঠাণ্ডা করো। এক গ্লাস পানি খেয়ে নাও, ভাল লাগবে।
কথা শেষ করে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। বাইরে থেকে কেবিনের তালা মেরে দিয়ে চলে গেল ওপরের ডেকে। যে মেয়ে তাকে আক্রমণ করার সাহস দেখাতে পারে তারই জাহাজে, সে মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমানোর মতো নির্বুদ্ধিতা করার তুলনায় অনেক চালাক লোক সে।
*
অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে পেনরো জুরিতার আদেশ। দুজন রেড ইন্ডিয়ান খালাসী ইকথিয়ারকে জাহাজের ডেকে নিয়ে এলো। দুর্বল হয়ে পড়েছে ইকথিয়ান্ডাব, তবু পালানোর সুযোগ আছে কিনা চোখ বুলিয়ে দেখে নিল একবার। খালাশিরা তাকে ছেড়ে দিতেই রেলিঙের দিকে দৌড় দিল। প্রাণপণে ছুটছে। রেলিং টপকে লাফ দেবে, তার আগেই ঝড়ের বেগে ওর পেছনে পৌঁছে গেল পেদরো জুরি, গায়ের জোরে ঘুসি বসিয়ে দিল মাথায়। ওই এক আঘাতেই জ্ঞান হারাল দুর্বল ইকথিয়ান্ডার, কাত হয়ে পড়ে গেল ডেকের ওপর।
উপদেশ দেবার সুরে বিড়বিড় করল পেদরো জুরিতা, এত তাড়াহুড়ো ঠিক নয়। ধীরেসুস্থে কাজ করো।
লোহার শেকল ঝনঝন শব্দ করছে। সরু এবং দীর্ঘ একটা শেকল নিয়ে আসা হয়েছে ডেকের ওপর। সেটার এক মাথা ইকথিয়ান্ডারের কোমরে জড়ানো হলো। তালা আটকে দেয়া হলো শেকলে টাইট করে।
এবার ওর মাথায় পানি ঢাললা, নির্দেশ দিল পেদরো।
একটু পর জ্ঞান ফিরল ইকথিয়ান্ডারের। কোমরে বাঁধা শেকলের দিকে অবাক হয়ে তাকাল ও। চোখ স্থির হলো পেদেরো জুরির ওপর।
যাতে পালাতে না পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা, জানাল পেদরো। এখন তোমাকে সাগরে নামানো হবে। বড় বড় মুক্তোভরা ঝিনুক তুলে আনবে তুমি আমাদের জন্যে। মুক্তো যত বড় হবে ততই বেশিক্ষণ তোমাকে সাগরে থাকতে দেব। মুক্তো যত পাওয়া গেলে তোমার কপালে পিপেয় গোসলের বেশি কিছু জুটবে না। বুঝতে পেরেছ কথা?
বিনা প্রতিবাদে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিল ইকথিয়ান্ডার। সাগরে নামল শেকল সহ। একটু চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল তার পক্ষে এই শেকল ছিঁড়ে মুক্ত হওয়া অসম্ভব। এবার কাজে মন দিল ও, কোমরের থলেতে মুক্তোভরা ঝিনুক ভরতে শুরু করল। কোমরে ব্যথা লাগছে ভারী শেকলের কারণে। তবুও ভাল। জাহাজের ওপরের ওই পিপের তুলনায় এখানে অনেক ভাল আছে সে।
সূর্য মাঝ আকাশে ওঠার আগে পর্যন্ত একটানা কাজ করল ও, তারপর ডাক দেয়ার জন্যে শেকলে টান দিল। থলেটা ততক্ষণে পেটমোটা লোকের মতো ফুলে উঠেছে।
জেলিফিশ জাহাজের খালাসীরা টেনে তুলল অসাধারণ ডুবুরিকে। প্রত্যেকেই কৌতূহলী। জানতে চায় ইকথিয়ান্ডার কেমন মুক্তো সংগ্রহ করছে।
এমনিতে ঝিনুক থেকে মুক্তো বের করার আগে ঝিনুকটাকে চার পাঁচদিন শুকনোয় রেখে পচিয়ে নেয়া হয়, যাতে মুক্তো বের করা সহজ হয়। কিন্তু ইকথিয়ান্ডার কি তুলেছে সেটা দেখার কৌতূহল এত তীব্র সবার যে দেরি করতে রাজি নয় কেউ। ছুরি দিয়ে ঝিনুকের মুখ খুলতে শুরু করল ওরা।
সব খোলা শেষে দেখা গেল এক ডুবে ইকথিয়ান্ডার যা তুলে এনেছে তার পরিমাণ রীতিমতো অবিশ্বাস্য। গোটা বিশেক মুক্তো একেবারে তুলনাহীন। ওগুলোর যে কোন একটা বিক্রি করে জেলিফিশের মতো জাহাজ কেনা যাবে। সামনে এখন বিপুল ঐশ্বর্য পাওয়ার পথ খুলে গেছে পেদরো জুরিতার।
কিন্তু সম্পদের সঙ্গে সঙ্গেই বিপদের ভয়ও বাড়ে। খেয়াল করল পেদরো, তার খালাসীরা চোখে নগ্ন লোভ নিয়ে মুক্তোগুলো দেখছে। ব্যাপারটা তার পছন্দ হলো না। মুক্তোগুলো ঝটপট সরিয়ে ফেলল সে। একটু পর ইকথিয়ান্ডারকে বলল, দারুণ ডুবুরি তুমি, ইকথিয়ান্ডার। ভাল কাজ দেখিয়েছ। পুরস্কার হিসেরে তোমার জন্যে একটা টিনের চৌবাচ্চার ব্যবস্থা করব ভাবছি। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, শেকল আমি কিছুতেই খুলব না। খুললেই তুমি তোমার কাঁকড়া বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা শুরু করে দেবে। নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা করে হাসল পেদরো।
পেদরোর সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিল না ইকথিয়ান্ডারের, কিন্তু যেহেতু ও পেদরোর হাতেই বন্দি, কাজেই সুবিধে অসুবিধের কথা তাকেই বলতে হয়। বাধ্য হয়ে ইকথিয়ান্ডার বলল, পিপের চেয়ে চৌবাচ্চা ভাল। কিন্তু পানিটা ঘনঘন বদলাতে হবে, নইলে আমি দম নিতে পারব না।
বদলাতে হবে কতক্ষণ পরপর?
আধঘণ্টা।
আরে বাপু, এ তো বসতে দিলে শুতে চায়! কাজ এখনও ঠিক। মতো শুরুই হয়নি তার আগেই এত দাবি কিসের!
অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় মাছ। পানি না বদলালে পানির অক্সিজেন কমে যাবে আমি শ্বাস নিতে থাকলে। একসময় আর দমই নিতে পারব না।
অত কথা বুঝি না। জানো তোমার চৌবাচ্চায় একটু পর পর পানি ভরতে কত খরচ পড়বে?
সেক্ষেত্রে আমি বলব, আমাকে সাগরে ছেড়ে দেয়া উচিত। ইকথিয়ান্ডারের চোখ ঘুরে এলো নীল সাগরের গা ছুঁয়ে।
লক্ষ করল পেদরো। হেসে উঠে বলল, বলো কী!
ছেড়ে দিন আমাকে, বলল ইকথিয়ান্ডার। পালাব না, কথা দিচ্ছি। আপনাকে আমি অনেক অনেক মুক্তো এনে দেব। গুট্টিয়ারা মুক্তো ভালবাসত দেখে ওর জন্যে মুক্তোর একটা স্তূপ করেছিলাম। ওই সমস্ত তূপ আপনাকে এনে দেব। ছেড়ে দিন আমাকে।
হা-হা করে হাসল পেরো, তারপর হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল, গুট্টিয়ারাকে তুমি এখনও ভালবাসো নাকি?
হ্যাঁ, বাসি।
কিন্তু সে এখন আমার স্ত্রী। সেকথা জানো?
তাতে কি! মানুষকে সবসময়েই ভালবাসা যায়।
কিন্তু সে এখন আমার মেয়েমানুষ।
কিন্তু মেয়ে হলেও তো সে মানুষ।
বিরক্ত বোধ করছে পেদরো। উভচর মানবের মনের সরলতা তাকে বিস্মিতও করছে। বুঝতে পারছে এভাবে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এসব বিষয়ের মীমাংসা হবে না। আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো পেদরো।
ছেড়ে দিলে তো আর কখনও ফিরবে না তুমি।
এবার ইকথিয়ান্ডারও বিরক্ত হলো। রেগে গিয়ে বলল, জীবনে আমি কখনও মিথ্যে কথা বলিনি।
তাহলে আমাকে বলো কোথায় আছে সেই মুক্তোর স্তূপ।
আছে সাগরের নিচে একটা গুহায়! লিডিং আর আমি ছাড়া আর কেউ চেনে না সেই গুহা,।
লিডিং! সে আবার কে? আমার পোষা ডলফিন। তাই নাকি?
ইকথিয়ান্ডারের কথাবার্তা কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে পেদরো জুরিতার। ভেবে দেখল। ইকথিয়ান্ডার মিথ্যে বলছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ব্যাপার যদি সত্যি হয়, সত্যি যদি মুক্তোর একটা তৃপ কোথাও থেকে থাকে তাহলে তা কল্পনাকেও হার মানাবে। এক নিমেষে বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোক হয়ে যাবে সে ওটা হাতাতে পারলে। আমেরিকার সেরা ধনী রস-চাইল্ড বা রকফেলার তখন তার তুলনায় রীতিমতো গরীব লোক! লাগামছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভেসে গেল পেদরোর মন।
কিন্তু ব্যবসায়ী মানুষ সে। পোক্ত বুদ্ধি। মানুষের কথা চট করে বিশ্বাস করার তুলনায় অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। মনে মনে ঠিক করল মুক্তোর তূপ কিভাবে দখল করবে। বাঁকা বুদ্ধি তার। হঠাৎ করে গুট্টিয়ারার কথা মনে পড়ল। এব্যাপারে টিয়ারা তাকে সাহায্য করতে পারবে। শুট্টি যদি অনুরোধ করে তাহলে এক্ষুণি ওই তূপের সন্ধান দিয়ে দেবে ইকথিয়ান্ডার। আরও একটু ভাবনা-চিন্তা সেরে নিয়ে সে বলল, দেখো, ইকথিয়ান্ডার, বন্দি হলেও তুমি আমার মেহমান। সেকারণে তোমার আরামের ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। সেজন্যে ভাবছি তোমার জন্যে বড় একটা লোহার খাঁচা তৈরি করাব। ঐ খাচায় করে নামিয়ে দেব তোমাকে। হাঙর, কুমির, অক্টোপাসের ভয় আর থাকবে না। তুমি আর আমি দুজনই এভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।
আমার কিন্তু বাতাসেও সময় কাটাতে হয়, জানাল ইকথিয়ান্ডার।
পেদরো এখন মস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী। কোন অসুবিধে নেই। মাঝে মাঝে খাঁচাটা তুলে আনলেই হবে।
এই নিয়মটা নিজেরই বেশ পছন্দ হলে পেদরোর। বিরাট একটা সমস্যার সমাধান তাহলে হলো। খুশি হয়ে উঠল পেদরো। এতই, যে উদার ভাবে নির্দেশ দিল, আজকে জেলিফিশ জাহাজের সবাইকে এক পাত্র করে মদ দেয়া হোক।
ইকথিয়ান্ডারকে আবার জাহাজের খোলে আটকে রাখা হলো। আশ্বাস দেয়া হলো তাকে, শীঘ্রি চৌবাচ্চা আর খাঁচা তৈরি হয়ে যাবে।
মুক্তোগুলো টুপিতে ভরে খুশি মনে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেল পেদরো। কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে মুক্তোগুলো গুট্টিয়ারাকে দেখিয়ে বলল, দেখো, তোমাকে কত ভালবাসি। সেজন্যেই তো কথা রেখেছি। এই যে, তুমি মুক্তো ভালবাসো, তাই তোমার জন্যে সেরা মুক্তোগুলো আমি নিয়ে এসেছি। এই দেখো।
মুক্তোগুলোর ওপর ঘুরে এলো গুট্টিয়ারার চোখ, স্থির হলো পেদরোর ওপর। মনে মনে বিস্মিত হলেও ওর মুখে ভাবের কোন প্রকাশ নেই। চোখ বোধহয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কারণ বিস্ময় দেখে বলল পেদরো, তুমি হবে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে ধনী মহিলা। হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মহিলা। কি চাই তোমার বলো একবার মুখ ফুটে। যা চাইবে তা-ই পাবে। তোমার জন্যে আমি এমন একটা প্রাসাদ বানাব যে দেখলেও রাজা-রাজড়াদেরও হিংসায় অন্তর জ্বলবে।
গুট্টিয়ারা কিছুই বলল না। উচ্ছাস সামলাতে না পেরে পেদরো বলেই চলল, এই মুক্তোগুলো তুমি রাখো। এগুলো আমার প্রতিশ্রুতির আগাম জামিন ইকথিয়ান্ডারকে দিয়ে তুলিয়েছি এগুলো। দুর্দান্ত ডুবুরি ও।
চোখ জোড়া এক পলকের জন্যে জ্বলে উঠল গুট্টিয়ারার। রাগ। চেপে শান্ত গলায় বলল, ঐ নোংরা ভাবে আহরিত মুক্তো আমার চাই। যাও তুমি এখান থেকে। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল পেদরো। গুট্টিয়ারার এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানে। রাগও হলো। বিব্রত বোধ করল। সেসব অনুভূতি চেপে ঠাট্টার সুরে বলল, আপনি কি চান না ইকথিয়ান্ডার মুক্তি পাক, জনাবা?
সম্বোধন এবং প্রস্তাব দুটোই অবিশ্বাস্য। গুট্টিয়ারা বলল, তারপর? আর কত মিথ্যে বলবে?
মিথ্যে বলছি না। কথা সোজা। যদি বোঝে। ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্য এখন তোমার হাতে। সাগরের নিচে কোথায় যেন সে মুক্তোর একটা তূপ করে রেখেছে। ওগুলো সে আমার জাহাজে ভুলে দিক, তাকে আমি ছেড়ে দেব। তাকে বলে এই কাজটুকু তুমি করিয়ে দাও, মুক্তি পাবে সাগর-দানো।
নিষ্পলক চোখে পেদরোর দিকে চেয়ে থাকল গুট্টিয়ারা। বুঝতে চেষ্টা করল কুটিল কোন দুরভিসন্ধি আছে কিনা পেদরোর মনে। একটু পর বলল, তোমার কথা তো শুনলাম। এবার তাহলে আমার কথাগুলোও শুনে রাখো। মুক্তোগুলো হাতে পাবার পর আবার তুমি ইকথিয়ান্ডারকে শেকলে বেঁধে রাখবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মাথা নাড়ল। কোনও নিশ্চয়তা নেই। শুনে নাও শেষ বারের মতো, আমাকে এসব নোংরা ব্যাপারে আর জড়াতে পারবে না। চলে যাও এখন এখান–থেকে, প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
ধুপধাপ পা ফেলে স্ত্রীর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো পেদরো। আর কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই সেটা বুঝতে তার দেরি হয়নি। নিজের কেবিনে ফিরল সে। সিন্দুকে সাবধানে ভরে রাখল মুক্তোগুলো। কেবিনের বাইরে এসে একটা চুরুট ধরাল। বিপুল ধনসম্পদের ভাবনায় মনটা তার কল্পনাবিলাসী হয়ে আছে। স্ত্রী তার যেমনই হোক, না-ই বা বাসুক ভালো, দুনিয়ার সেরা ধনী হতে চলেছে সে, এতে আর সন্দেহের তেমন কোন অবকাশ নেই। বিভোর হয়ে আছে পেদরো জুরিতা। এতই বিভোর যে লক্ষ করল না তার খালাসীরা ছোট ছোট জটলা করে নিচু স্বরে কি যেন আলাপ করছে। পরিবেশে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা।
২৩. আক্রমণটা হঠাৎ করেই এলো
আক্রমণটা হঠাৎ করেই এলো। খালাসীদের দলপতির নির্দেশে একযোগে পেদরো জুরিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেশ কয়েকজন খালাসী। তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, কিন্তু সংখ্যায় তারা অনেক। পেদো জুরিতাকে ঘায়েল করা তাদের জন্যে সহজ হলো না। দুজন খালাসী তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। তাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে পিছনে হটল পেদরো, রেলিঙে জোরে ধাক্কা দিল পিঠ দিয়ে। খালাসী দুজন আর্তনাদ করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বড় গেল ডোকর ওপর। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল পেদরো, সামনে বাড়ল দুহাতে ঘুসি মারতে মারতে।
আক্রমণটা এতই আকস্মিক যে কোমরে হাত দিয়ে হোলস্টার থেকে যে রিভলভার বের করবে সেই সময়টুকুওঁ পাচ্ছে না, পেরেরা। মাস্তুলের দিকে পিছু হটছে সে ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল আড়কাঠে, মাস্তুলের ওপর উঠতে চেষ্টা করছে।
এক খালাসী তার পা চেপে ধরল। রাখতে পারল না ধরে। মাথায় পেদরোর প্রচণ্ড লাথি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ডেকে। মাস্তুলে চড়ছে পেদরো, খালাসীদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। একেবারে ওপরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। গালাগাল করছে খালাসীদের। রিভলভার বের করে শাসাল।
কুত্তার বাচ্চারা! এক পা সামনে বেড়েছিস তো গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।
উদ্যত অস্ত্রটা দেখে একটু দমে গেল খালাসীরা। নাগালের বাইরে পেদরো আস্ফালন করছে। দ্রুত আলোচনা চলল খালাসীদের ভেতর, কি করা যায় এই পরিস্থিতিতে।
একটু পরই খালাসীদের দলপতির গলা পাওয়া গেল। ক্যাপ্টেনের কেবিনে বন্দুক আছে। চলো, দরজা ভেঙে ওটা নিয়ে আসি।
দলপতির কথায় চমকে গেল পেদরো। বড়লোক হবার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় অস্থির লাগল তার। বড়লোক হওয়া তো দূরের কথা, এখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি। বাঁচার সম্ভাবনা কতটা সেটা ভেবে দেখতে হবে।
হতাশ পেদরো সাগরের দিকে তাকাল। চোখ আটকে গেল তার সাগরে। যা দেখছে তা নিজেও বিশ্বাস করতে পারল না। ছোট একটা সাবমেরিন তীব্র গতিতে জেলিফিশ জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে!
প্রার্থনা শুরু করল পেদরো, সাবমেরিনটা যাতে পানির নিচে ডুব দিয়ে অন্যদিকে না যায়। দেখতে পেল একজন লোক সাবমেরিনের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মাঝে আশা জাগল পেদক্টের, লোকগুলো নিশ্চই তাকে দেখতে পাচ্ছে। ওরা জানে কী ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে সে।
প্রাণপণে চিৎকার করল পেদরো, বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে এরা খুন করে ফেলল!
সাবমেরিনের লোকজন বোধহয় তাকে দেখতে পেয়েছে। আওয়াজও শুনে থাকবে হয়তো। সাবমেরিনটা দ্রুত ছুটে আসছে জাহাজের দিকে।
এদিকে ডেকের ওপর বিশৃক্ষলা দেখা দিয়েছে। ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজা ভেঙে বন্দুক নিয়ে এসেছে খালাসীরা, কিন্তু সাবমেরিনটা দেখে তারাও চমকিত হয়ে থমকে দাঁড়াল। ওটা সামরিক সাবমেরিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের কপালে খারাবি আছে। পেরোকে হত্যার প্রচেষ্টায় তাদের না কঠিন শাস্তি হয়ে যায়!
মনে সাহস ফিরে পেল পেদরো জুরিতা। উল্লসিত হয়ে উঠল। কিন্তু সেই উল্লাস অতি অল্প সময় স্থায়ী হলো। সাবমেরিনের ডেকে এসে দাঁড়িয়েছে বালথাযার আর ক্রিস্টো। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকা এবং তীক্ষ্ণ নাক তাঁর। চেহারায় ব্যক্তিত্ত্বের ছটা।
চিৎকার করলেন ভদ্রলোক, ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা, ইকথিয়ান্ডারকে এক্ষুণি আমাদের হাতে তুলে দিন, তা নাহলে আপনার জাহাজ আমি ডুবিয়ে দেব। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। দেরি করলে নিজের সর্বনাশ করবেন।
বিশ্বাসঘাতক! বালথাযার আর ক্রিস্টোর দিকে চেয়ে মনে মনে বলল পেদরো। বুঝতে পারছে জাহাজডুবি হয়ে ভিখারি হবার চেয়ে ইকথিয়ান্ডারকে খোয়ানো অনেক ভাল। মাস্তুল থেকে নামতে শুরু করে চেঁচাল সে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। এক্ষুণি ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে আসছি।
খালাসীদের বুঝতে বাকি নেই এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ পালিয়ে যাওয়া। ঝটপট কয়েকটা নৌকো নামিয়ে ফেলল তারা সাগরে। কারও কারও সেটুকু তরও সইল না, লাফ দিয়ে সাগরে পড়ে সাঁতরে এগিয়ে চলল তীরের দিকে। যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে তার কেবিনে এসে ঢুকল পেদরো, সিন্দুক খুলে মুক্তোগুলো বের করে শার্টের পকের্টে রাখল, তারপর গেল গুট্টিয়ারার কেবিনে। গুট্টিয়ারাকে বের করে ডেকের ওপর নিয়ে এলো। সাবমেরিনের দিকে চেয়ে বলল, ইকথিয়ান্ডার অসুস্থ বোধ করছে। সে তার কেবিনে আছে।
একটা নৌকো পানিতে নামাল পেদরো। গুট্টিয়ারাকে নৌকোয় তুলে নৌকো ভাসিয়ে দিল। নিজে বসে আছে দাড়ীর আসনে। খুবই অগভীর পানিতে নৌকো সরিয়ে নিয়েছে চতুর পেদরো। এখন আর তাকে সাবমেরিন নিয়ে অনুসরণ করার কোন উপায় নেই।
সাবমেরিনের ডেকে বালথাযারকে দেখতে পেয়েছে গুট্টিয়ারা। চিৎকার করল মেয়েটা: বাবা, ইকথিয়ান্ডার জাহাজে আছে…ওকে তোমরা উদ্ধার…
তাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিল না পলাতক পেদরো, রুমাল দিয়ে স্ত্রীর মুখ বেঁধে ফেলল। হাত দুটো বাঁধল কোমর থেকে বেল্ট খুলে।
তার আচরণ লক্ষ করেছেন সালভাদর। তিনি চিৎকার করে বললেন, ওই মহিলাকে আপনি ছেড়ে দিন, পেদরো।
এ আমার স্ত্রী, জবাবে বলল পেদরো। আমাদের ব্যাপারে আপনি নাক গলাবেন না। দাঁড় টানার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত তীরের দিকে চলেছে নৌকো অগভীর পানি পাড়ি দিয়ে।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে এরকম আচরণ করার কোন অধিকার নেই আপনার, বললেন সালভাদর। নৌকো থামান, নইলে কিন্তু আমি গুলি করব।
রিভলভার তাক করে গুলি করলেন সালভাদর। নৌকোর গায়ে বিঁধল বুলেট।
সঙ্গে সঙ্গে গুট্টিয়ারাকে সামনে ঠেলে নিজে তার আড়াল নিল পেদরো। কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, গুলি করবেন বুঝি? করুন দেখি!
পেদরোর হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করছে গুট্টিয়ারা, পারছে না। পশু? রিভলভার নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন ডাক্তার।
নৌকোটাকে ধরবার জন্যে সাগরে নামল বালথাযার, সাঁতার দিয়ে নৌকোর গতির সঙ্গে পারল না। বারকয়েক দাঁড় টানতেই তীরে পৌঁছে গেল নৌকো! গুট্টিয়ারাকে জোর করে ধরে নামাল পেদরো, চলে গেল সৈকতের পাথরের স্তৃপগুলোর আড়ালে।
পেদরোকে ধরা যাবে না বুঝে জেলিফিশ জাহাজে এসে উঠল বালথাযার। ডেকে উঠে নোঙরের শেকল ছেড়ে খুঁজতে শুরু করল জাহাজ। কেবিন, ডেক, নিচের তলা-সবখানে খুঁজল। কোথাও ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেল না। চিৎকার করে সালভাদরকে বলল, ইকথিয়ান্ডার জাহাজে নেই।
কিন্তু এখানেই তার থাকার কথা, আপত্তি জানাল ক্রিস্টো। গুট্টিয়ারা বলে গেছে ও জাহাজে আছে।
হঠাৎ পানিতে চোখ পড়তে ক্রিস্টো দেখল পানির ওপর এক জায়গায় একটা মাস্তুলের ডগা উঁচু হয়ে আছে। দেখে মনে হয় কিছুদিন আগে এখানে জাহাজডুবি হয়েছে। এমন হতে পারে যে ইকথিয়ান্ডার ওই ডুবে যাওয়া জাহাজে লুকিয়ে আছে। পেদরো হয়তো নিজেই তাকে ওখানে পাঠিয়েছে ধনরত্ন আহরণের জন্যে।
সাবমেরিনের রেলিং ধরে চিন্তিত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার সালভাদর। তিনি বললেন, ওখানে ইকথিয়ান্ডার নেই, ক্রিস্টো। পেদরোর সঙ্গে লড়াইতে আমরা জিতলাম, কিন্তু ইকথিয়ান্ডারকে ফিরে পেলাম না।
২৪. জেলিফিশ জাহাজে কি ঘটেছে
সকালে জেলিফিশ জাহাজে কি ঘটেছে সেটা পেদরো জুরিতার অনুসরণকারীদের জানার কোন উপায় নেই।
আগের দিন পুরোটা সময় খালাসীদের মাঝে অস্ফুট কথোপকথন হয়েছে। সকালে তারা সিদ্ধান্ত নিল প্রথম সুযোগেই ক্যাপ্টেনকে খুন করে ফেলবে। একই সঙ্গে জাহাজ আর উভচর মানবের দখল নেবে ওরা।
ভোর। জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়াল পেদরো জুরিতা। বাতাসের গতি কমে গেছে, ফলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে জাহাজ। সাগরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পেদরোর চোখ। দূরবীন চোখে ডুবন্ত একটা জাহাজের রেডিয়ো মাস্তুল দেখছে সে। একটু পরই দেখতে পেল সাগরে ভাসছে একটা লাইফবেল্ট। নৌকো নামিয়ে লাইফবেল্টটা তুলে আনার আদেশ দিল পেদরো।
বেল্টের গায়ে মাফালতু জাহাজের নাম লেখা আছে। অবাক হলো পেরো। মনে মনে বলল, মাফালডু জাহাজ ডুবে গেছে?
যাত্রী এবং ডাকবাহী এই বিরাট আমেরিকান, জাহাজটার নাম পেদরোর অজানা নয়। এই জাহাজে অনেক সম্পদ থাকবে। সেগুলোকে উদ্ধারের জন্যে ইকথিয়ান্ডারকে কাজে লাগানো গেলে দারুণ হয়। কিন্তু সাগরের কত গভীরে ডুবেছে মাফালডু? ইকথিয়ান্ডারের কোমরের শেকল ওই পর্যন্ত খাবে? বোধহয় যাবে না। শেকল ছাড়া ইকথিয়ান্ডারকে সাগরে নামানোর ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ইকথিয়ান্ডার আর না-ও ফিরতে পারে।
খুব মাথা খাটাচ্ছে পেদরো। একদিকে সম্পদ আহরণের লোভ, অন্যদিকে ইকথিয়ান্ডারকে হারানোর ভয়। প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পেদরোর হৃদয়।
ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলের কাছে চলে এসেছে জৈলিফিশ জাহাজ। ডেকের ওপর রেলিঙের ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে এসে খালাসীরা। একজন খালাসী বলে বসল, আমি আগে মাফালতু জাহাজে কাজ করেছি। বড় জাহাজ। সাগরের বুকে আস্ত একটা শহর বললে মিথ্যে বলা হবে না। মাফালডুতে চড়তে পারত কেবল আমেরিকার সেরা বড়লোকরা।
ভাবছে পেদরো জুরিতা। ভ্রূ কুঞ্চিত। ডোবার আগে জাহাজটা সম্ভবত রেডিয়োতে সাহায্য চাওয়ার সুযোগ পায়নি। তা নাহলে এতক্ষণে আশেপাশের বন্দর থেকে একাধিক জাহাজ চলে আসত ওটার যাত্রীদের উদ্ধার করতে। সাগরে গিজগিজ করত ধনরত্ন আহরণে মত্ত অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এখানে কেউ নেই। এত বড় একটা দুর্ঘটনার কথা কেউ জানে না ওরা ছাড়া। এমন সুযোগ বারবার আসে না। দেরি করা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে শেকল ছাড়াই ইকথিয়ান্ডারকে নামাতে হবে সাগরে। কিন্তু ইকথিয়ান্ডারকে যদি হারাতে হয়? আচ্ছা এক কাজ করলেই তো হয়, মুক্তোর স্তূপটা ওর জামিন হিসেবে দখলে রাখল…
দাম কত হবে মুক্তোগুলোর? দামি মুক্তো তো? ইকথিয়াল্ডার মুক্তোর গুণাগুণ কি বোঝে! বাড়িয়ে বলেছে নিশ্চই?
দুরকম ভাবনার টানাপোড়েনে অস্থির লাগছে পেদরো জুরিতার। বুঝতে দেরি হয়নি, মাফালডুর সোনাদানা আর ইকথিয়ান্ডারের মুক্তোর স্তুপ, দুটোই দখল করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। মুক্তোগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। ইকথিয়াজার ছাড়া আর কেউ জানে না ওগুলোর অবস্থান। কিন্তু মাফালডু ডোবার খবর একটু দেরিতে হলেও জেনে যাবে সবাই। তখন আর একা সব ভোগ করার উপায় থাকবে না। আগে দরকার মাফালডু খালি করা।
সেখানেই সেই মাস্তুলের পাশেই জেলিফিশকে দাঁড় করাতে বলে কেবিনে ফিরে এলো পেদরো। একটা চিঠি লিখল। চিঠিটা পকেটে পুরে চলে এলো ইকথিয়ান্ডারের কাছে। কাগজটা পকেট থেকে বের করে ইকথিয়ান্ডারের হাতে দিতে দিতে বলল, তুমি তো পড়তে পারো, তাই না? এই চিঠিটা গুট্টিয়ারা দিয়েছে তোমাকে।
কাগজে চোখ বোলাল ইকথিয়ান্ডার।
চিঠিতে লেখা আছে:
ইকথিয়ান্ডার,
আমার একটা অনুরোধ রাখবে? আমাদের জাহাজের কাছে আরেকটা জাহাজ আছে, ডুবে গেছে। সেটা থেকে দামি যা কিছু আছে সেসব উদ্ধার করে তুমি আমাকে এনে দাও? আশা করি আমার এই অনুরোধ তুমি রাখবে। ক্যাপ্টেন পেদারো জুরিতা তোমাকে শেকল ছাড়াই সাগরে নামিয়ে দেবে। আমার কসম, ফিরে আসবে তুমি। আশা করি, আমার জন্যে এটুকু অন্তত করবে। আমি চেষ্টা করছি, শীঘ্রি তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে।
-গুট্টিয়ারা।
চিঠিটা পেদরো সামনে ধরল ইকথিয়ান্ডার, জিজ্ঞেস করল, গুট্টিয়ারা নিজে কেন এলো না?
ও অসুস্থ বোধ করছে, বলল পেদরো। তুমি কাজ সেরে ফিরে এসো, তখন ওর সঙ্গে দেখা হবে।
ইকথিয়ান্ডারের সন্দেহ দূর হয়নি। জিজ্ঞেস করল আবার, গুট্টিয়ারার এত ধনসম্পত্তির দরকার হয়ে পড়ল কেন হঠাৎ?
জবাব তৈরি, কাজেই অপ্রস্তুত না হয়ে আসল পেরো। তুমি যদি সাধারণ মানুষ হতে তাহলে এপ্রশ্ন করতে পারতে না। কোন্ মেয়ে না ভাল ভাল পোশাক আর গহনা পরতে চায়, বলো? সেসবের জন্যেই তো প্রয়োজন প্রচুর টাকা। ঐ ডুবে যাওয়া জাহাজে অনেক টাকা আছে। ওগুলোর এখন কোন মালিক নেই। গুট্টিয়ারারও টাকা দরকার। সত্যি যদি তুমি গুট্টিয়ারাকে ভালবেসে থাকো তাহলে কেন ওই পড়ে থাকা সম্পদ গুট্টিয়ারার জন্যে নিয়ে আসবে না? ঐ জাহাজের ডাক বিভাগের ঘরে ঢুকলে দেখবে অনেক টাকা, সোনার মোহর, গহনা ইত্যাদি পাবে। তাছাড়া যাত্রীদের গায়ে থাকবে।
রেগে গিয়ে ইকথিয়ান্ডার বলল, সোনাদানার জন্যে আমি কি মড়া ঘাটব? এটা নিশ্চয়ই গুট্টিয়ারা বলে দেয়নি? ও এমন লোভী মেয়ে নয় যে একাজ করতে বলবে আমাকে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে এখন, মনে হচ্ছে…
বিরক্তি বোধ করছে পেদরো। কিন্তু তা প্রকাশ করার কোন উপায় নেই। ইকথিয়ান্ডারের মন থেকে সন্দেহ দূর করতে না পারলে কোন কাজেই এগোনো যাবে না। জোর করে মুখে হাসি টেনে আনল পেদরো। ঠোঁট প্রসারিত করে বলল, নাহ্, তোমাকে ঠকাতে পারব না দেখছি। ঠিক আছে, যাও, সত্যি কথাই বলছি শোনো। মাফালতু জাহাজের সোনাদানা আমি নিজের জন্যে পেতে চাই। এর সঙ্গে গুট্টিয়ারার কোন সম্পর্ক নেই। ও না, আমি বড়লোক হতে চাই।
সেটা আমি আগেই বুঝেছি।
তাহলে তো কথা হয়েই গেল। তোমার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে আর কোন অসুবিধে থাকল না। ইকথিয়ান্ডার, মাফালডু জাহাজের সমস্ত সোনা চাই আমি। সমস্ত সোনার দাম যদি তোমার সেই মুক্তোর স্তূপের সমান হয় তাহলে সোনা এনে দেয়ার পরপরই তোমাকে ছেড়ে দেব আমি। সমস্যা এখন বিশ্বাসের, বুঝেছ? আমরা দুজন দুজনকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার তো ভয় হচ্ছে টিয়ারার ক্ষতি হবে জেনেও তুমি পালাতে পারো। সেকারণেই ভাবছি তোমাকে শেকল ছাড়া কিভাবে সাগরে নামাব।
গম্ভীর হয়ে গেল ইকথিয়ান্ডারের চেহারা। বলল শান্ত স্বারে, কাউকে কোন কথা দিলে আমি তা রাখি। আগেই বলেছি আমি পালাব না।
সত্যি বলো কিনা সেটা পরীক্ষার সুযোগ আমার এখনও হয়নি। আমি জানি, আমাকে তোমার পছন্দ নয়। সেকারণেই তুমি যদি কথা
রাখো তাহলে আমি বিস্মিত হবো না। কিন্তু গুট্টিয়ারাকে তো তুমি ভালবাসো। ওর অনুরোধ তুমি ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। সেকারণেই ওর সঙ্গে কথা বলেছি। ও চায় তোমাকে আমি মুক্ত করে দিই। চিঠি ও দিয়েছেও সেকারণেই। ও চাইছে তুমি যাতে সহজেই মুক্তি পাও!
এবার পেনরোর কথাগুলো অনেক বিশ্বাস্য মনে হলো ইকথিয়ান্ডারের। বুঝতে পারল না যে সামান্য কৌশল করেছে পেদরো। মুক্তি সে দেবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সোনার দাম হতে হবে মুক্তোর স্তূপের চেয়ে বেশি। দাম নির্ধারণ করতে হলে মুক্তোর স্তূপটা চোখে দেখতে হবে তাকে। ইকথিয়ান্ডার মুক্তো নিয়ে হাজির হলে মুক্তোর ও হাতে এসে যাবে পেরোর। তারপর ইকথিয়ান্ডারকে মুক্তি দিতে হবে এমন কোন কথা নেই।
পেরোর কৌশল ইকথিয়ান্ডার বুঝতে পারল না। ওর মনে হলো পেদরো খোলা মনে সব জানিয়েছে তাকে। আর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে গুট্টিয়ারা চিঠি দিয়েছে। পেদরোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ও।
বিরাট একটা স্বস্তির শ্বাস গোপন করল পেদরো জুরিতা। এখন তারও বিশ্বাস এসে গেছে, ইকথিয়ান্ডার তার কথা রাখবে। মুখে বলল, তাহলে চলো, দেরি না করে কাজ শুরু করে দেয়া যাক।
জাহাজ থেকে সাগরে নামল ইকথিয়ান্ডার। খালাসীরা খেয়াল করল, ইকথিয়ান্ডারের কোমরে কোন শেকল নেই। বুঝতে তাদের দেরি হলো না, মাফালডু জাহাজের সোনা উদ্ধার করতে চলেছে উভচর মানব।
উত্তেজিত হয়ে উঠল খালাসীরাচে সব কি একাই মেরে দেবে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা? না, তা স্থতে পারে না। ঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে তাকে রুখে দিতে হবে যে করে হোক। একটু পরই খালাসীদের দলপতির নির্দেশে পেদরোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই।
*
ডুবে যাওয়া জাহাজের ডেক থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের একটা চওড়া করিডরে। করিডরে ঘুটঘুটে আঁধার। চোখ সইয়ে নিতে ইকথিয়ান্ডার খেয়াল করল, দুপাশের খোলা দরজাগুলো দিয়ে আলোর হালকা আভা আসছে। একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ইকথিয়ান্ডার, দেখল পৌঁছে গেছে ও একটা সুসজ্জিত হল ঘরে। প্রকাণ্ড বড় হল ঘর। চেয়ার-টেবিল-সোফার কোন অভাব নেই। একসঙ্গে দুতিনশো লোক এখানে আপ্যায়িত হতে পারবে। হল ঘরের জানালাগুলো দিয়ে সূর্যের মৃদু আলো এসে পড়েছে মেঝেয়। ছাদ থেকে ঝুলছে অত্যন্ত দামি ঝাড়বাতি। ওটার ওপর সাঁতরে এসে বসল ইকথিয়ান্ডার, চারপাশে ভাল করে নজর বোলাল।–করুণ একটা দৃশ্য। যেকারও বুকে কাপ ধরিয়ে দেবে। চেয়ার টেবিল-সোফা, ভাসছে সব ছাদের কাছে, মুদু ঢেউয়ের দোলায় দুলছে ওগুলো। ঘরের এক কোণে পড়ে আছে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। মেঝেতে দামি কার্পেট বিছানো। দেয়ালে মেহগনি কাঠের প্যানেলিং। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি পাম গাছ। সবুজ পাতা দুলছে। তরতাজা লাগছে গাছগুলোকে দেখতে। আর কদিন পরই লোনা পানিতে মরে যাবে।
গাছগুলোর কাছে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। ওর মনে হলো কে যেন ওকে নকল করছে! কাছে চলে আসছে আরও! খেয়াল করতেই নিজের ভুল বুঝতে পারল ও। ওর সামনে দেয়াল জুড়ে আছে একটা মস্ত আয়না। সেটাতে নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখেছে জাহাজে ও ছাড়া জীবিত কোন মানুষ থাকার উপায় নেই।
আরও কয়েকটা কেবিনে ঢ়ুঁ দিল ইকথিয়ান্ডার। আমেরিকার সম্পদ-সমৃদ্ধির স্পষ্ট চিহ্ন বিলাসিতা থেকেখুঝে নেয়া যায়। মেঝেয় দ্যমি মদের বোতল পড়ে আছে। ফররুপোর ডিশ, ছুরি-কাটা আরও অসংখ্য দামি জিনিসের ছড়াছড়ি। আশ্চর্য! কোন মৃতদেহ এখনও দেখনি ও।
তৃতীয় ডেকে উঠে এলো ও। এবার চোখে পড়ল মর্মান্তিক দৃশ্যটা। একটা মৃতদেহ ফুলে উঠে ছাদের কাছে ভাসছে। এ দুর্ভাগাদের একজন। সময় মতো আর মানুষদের সঙ্গে লাইফ বোটে চড়তে পারেনি।
ঘুরতে ঘুরতে নিচের তলায় চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। এখানে গরীব যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা। গা গুলিয়ে উঠল এখানে এসে ইকথিয়ান্ডারের ও নিষ্ঠুর বীভৎস দৃশ্য!
নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু, কেউ এখান থেকে বেরোতে পারেনি। লাইফবোটে জায়গা হতো না, কাজেই বের হতে দেয়া হয়নি বোধহয়। ইউরোপিয়ান, চীনা, নিগ্রো, রেড ইন্ডিয়ান-হরেক জাতির মৃতদেহ ভাসছে ছাদের কাছে। বুঝতে পারল ইকথিয়ান্ডার, খালাসীরা আগে বড়লোকদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তারপর নিজেদের বাঁচিয়েছে। গরীবদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের ভাগ্যের ওপর। কয়েকটা কেবিনের দরজা মৃতদেহের চাপে এমন শক্ত ভাবে আটকেছে যে ওগুলোয় ইকথিয়ান্ডার ঢুকতেই পারল না। আতঙ্কের চরমে পৌঁছানো মানুষগুলো শেষ মুহূর্তে দরজার কাছে ভিড় করেছিল বের হবার জন্যে। নিজেদের চাপেই নিজেরা আটকে গেছে দরজার কাছে, বেরোতে পারেনি।
আবার করিডরে ফিরে এলো ইকথিয়ান্ডার। করিডরেও কয়েকটা লাশ ভাসতে দেখল। বীভৎস দৃশ্য। ফুলে পচে যাওয়া লাশ মৃদু ঢেউয়ে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠল ইকথিয়ান্ডারের। মনে হলো জানে বাঁচতে হলে দ্রুত এই ভয়ানক কুরবস্থান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে ওকে।
নিজেকেই প্রশ্ন করল ইকথিয়ান্ডার, গুট্টিয়ারা কি জানত কোথায় আমাকে পাঠাচ্ছে ও? মড়া ঘেঁটে অর্থ বিত্ত সংগ্রহের মতো একটা কাজ গুট্টিয়ারা কিছুতেই ভাবতেও পারবে না। পেদরো জুরিতার লোভ আর গুট্টিয়ারার সরলতা আজ এখানে উপস্থিত করেছে ওকে।
ঠিক করল, গুট্টিয়ারা সত্যি এই জাহাজ থেকে কিছু চায় কিনা সেটা জানতে হবে। পেদরো জুরিতা গুট্টিয়ারার মুখ দিয়ে পারলে বলাক, তাহলে এখানে ফিরবে সে, নইলে নয়। জাহাজ থেকে বেরিয়ে এলো ইকথিয়ান্ডার, জেলিফিশ জাহাজে এসে উঠল।
ক্যাপ্টেন পেদরো! গুট্টিয়ারা!
ওর ডাকের জবাব দিল না কেউ। ঢেউয়ের দোলায় নিঃশব্দে দুলছে জাহাজটা, পরিত্যক্ত।
গেল কোথায় সবাই! অবাক লাগছে ইকথিয়ান্ডারের। নতুন কোন কৌশল করল নাকি পেদরো জুরিতা? আবার ডাকল ও, গুট্টিয়ারা!
উপকূলের কাছ থেকে এবার জবাব পেল ও। পেদোর ক্ষীণ কণ্ঠ শুনতে পেল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বলছে: আমরা এখানে!
চারদিকে তাকাল ইকথিয়ান্ডার। নড়াচড়া দেখে একটা ঝোপের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো ওর। খুব সাবধানে ঝোপের পেছন থেকে মুখ বের করল ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা, চেঁচাচ্ছে, গুঠিয়ার অসুস্থ। শিগগির এখানে এসো, ইকথিয়ান্ডার!
সাগরে ঝাঁপ দিয়ে দ্রুত সাঁতার শুরু করল ইকথিয়ান্ডার! ভীনে উঠে ঝোপের কাছে প্রায় চলে এসেছে এমন সময় গুট্টিয়ারার অস্ফুট কণ্ঠ শুনতে পেল, ওকে সাবধান করছে, পালাও, ইকথিয়ান্ডার, ক্যাপ্টেনের কথা বিশ্বাস কোরো না।
ঘুরে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল ইকথিয়ার, আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে, চট করে ডুবে গেল। সময় মতোই তাকে সাবধান করেছে গুট্টিয়ারা। গুট্টিয়ারা চায় ও যাতে শয়তান ক্যাপ্টেনের হাতে ধরা না পড়ে।
ডুব সাঁতার দিয়ে অনেক দূরে সরে এলো ইকর্থিয়ান্ডার। ঢেউয়ের ওপরে মাথা তুলে তীরের দিকে চাইল, দেখল তীরের কাছে সাদা কি যেন একটা ভাসছে। যতদূর সম্ভব একটা রুমাল। বিদায় জানিয়েছে গুট্টিয়ারা। আর কখনও কি দেখা হবে ওর ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে? গুট্টিয়ারা ওর ভালবাসার প্রতিদান দিয়ে বিদায় নিল।
কিন্তু আমি কি দিতে পারলাম ওকে? নিজেকে প্রশ্ন করল ইকথিয়ান্ডার। নাহ, কিছুই ও দিতে পারেনি গুট্টিয়ারাকে। একটা সময় ছিল যখন সবই ও দিতে পারত গুট্টিয়ারাকে। কিন্তু সেই সুযোগ ও হারিয়েছে। আজ গুট্টিয়ারার কাছে নিজের ভালবাসা প্রমাণ করার আর কোন উপায় নেই।
গভীর পানিতে নেমে এলো ইকথিয়ান্ডার। কেমন একটা অভিমানে বুকটার ভেতর কষ্ট হচ্ছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, মানুষের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখবে সে এখন থেকে।
২৫. ডাক্তার সালভাদরের সঙ্গে
ডাক্তার সালভাদরের সঙ্গে সাবমেরিনে করে গিয়েও ইকথিয়ান্ডারকে না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছে বালথাযার। এদিকে খবর নেই গুট্টিয়ারারও। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা তাকে নিয়ে কোথায় যে ডুব মেরেছে তার কোন হদিস নেই। ইকথিয়ান্ডারকেও এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দোকানে বসে আছে বালথাযার, এসব নানা দুর্ভাগ্য নিয়েই মগ্ন হয়ে ভাবছে। এখন সে সাদা মানুষ দুচোখে দেখতে পারে না। রেড ইন্ডিয়ানদের ওই সাদা মানুষরাই নিজেদের দেশে পরবাসী করে রেখেছে। গোটা দক্ষিণ আমেরিকাই তারা দখল করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, রেড ইন্ডিয়ান মেয়েদেরও লুঠ করে নিয়ে যায় তারা, গিনিপিগের প্রতি বিজ্ঞানীরা যেমন আচরণ করে ঠিক তেমনি আচরণ করে ওরা রেড ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের ওপর। ধরে ধরে বিকলাঙ্গ করে দেয়।
মনের মাঝে অনেক ক্ষোভ জনেছে বালথাযারের। রাগে আজকাল অস্থির হয়ে পড়ে সে।
বাইরে থেকে ক্রিস্টোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল বালথায়ারের।
বালথাযার, আছিস নাকি? শীঘ্রি আয়, দারুণ একটা খবর আছে। ইকথিয়ান্ডারকে পাওয়া গেছে।
ব্যস্ত হয়ে ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে এলো বালথাযার। দোকান ঘরে চলে এলো। কি বললি, ক্রিস্টো? কি বললি? আবার বল। আমি ভুল শুনলাম নাতো?
আরে দাঁড়া। বলছি। বলছি। কথার মধ্যে কথা বলবি না তাহলে আমার সাজানো কথা সব গুলিয়ে যাবে। হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডারকে পাওয়া গেছে। ওই ডুবে যাওয়া জাহাজের মধ্যে ছিল ও। পেদবরা ওকে ওখানে পাঠিয়েছিল। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসার পর ইকথিয়ান্ডারও বাড়ি ফিরেছে।
ও এখন কোথায়?
সালভাদরের কাছেই আছে।
এবার আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছেলেকে দাবি করব। বলব ভালয় ভালয় সে যেন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়।
তা বোধহয় সে দেবে না। সাগরে বেরুতে ওকে একেবারে বারণ করে দিয়েছে ডাক্তার। ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গলা নিচু করে বলল ক্রিস্টো, তবে আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে ওকে সাগরে ছেড়ে দিই।
দিবিই তো, খ্যাপাটে গলায় বলল বালথাযার ওকে বেরোতে দিলে সালভাদরকে আমি খুন করে ফেল। উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। চল এখনই গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া সেরে ফেলি।
হাতের ইশারায় ভাইকে শান্ত করতে চেষ্টা করল ক্রিস্টো। বলল, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর। নাতনীর সঙ্গে দেখা করার নাম করে ছুটি নিয়েছি আমি। কাল ঠিক করা যাবে কি করব।
বালথাযারের তর সইছে না। ছেলেকে দেখার জন্যে মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে আছে। যেভাবে হোক, একনজর হলেও, ইকথিয়ান্ডারকে তার দেখাই চাই।
ক্রিস্টোকে আর কিছু বলল না। ক্রিস্টো বিদায় নেয়ার পর সাগরের সৈকতে চলে এলো সে। সারারাত সাগরের দিকে চেয়ে থাকল, যদি কোন ঢেউয়ের মাথায় নিজের ছেলেকে দেখতে পায়?
রাত যত বাড়ছে, উত্তাল হয়ে উঠছে সাগর। দক্ষিণের হাওয়া। হুটোপুটি শুরু করেছে, সেই দামাল হাওয়ায় মত্ত হয়ে উঠছে ঢেউগুলো, ক্রমশই বাড়ছে তাদের উচ্চতা, প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে এসে সাগর-সৈকতে।
আকাশে মেঘের চাদরের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ মামা। এই জ্যোৎস্না তো এই অন্ধকার। ঢেউগুলো একবার দেখাচ্ছে নীলাভ, পরক্ষণেই ঘুটঘুটে কালো। ঢেউয়ের মাথায় নাচছে সাদা ফসফরাস। একটা ঢেউ এসে চড়ে বসছে আগেরটার ওপর নিয়ত চলছে নতুন পুরাতনের ভাঙাগড়ার খেলা। একদৃষ্টে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বালথাযার! সারারাত তাকিয়ে থাকল, কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। টের পেল না কখন ভোর হয়ে এসেছে। নিশ্চল বসে আছে সৈকতে। একসময় সাগরের পানিতে নীলাভ-ধূসর সুরে ছায়া পড়ল।
হঠাৎই চমকে উঠল বালথাযার। ঢেউয়ের গায়ে কালো মতো ওটা কি?
মনে হচ্ছে যেন মানুষ! তাহলে ডুবে যাওয়া কোন মানুষ? না, তেমন তো মনে হচ্ছে না। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে মাথার নিচে হাত দিয়ে আয়েস করে শুয়ে আছে একজন নিশ্চিন্তে চলেছে ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে। তাহলে ও-ই কি ইকথিয়ান্ডার?
বালথাযার চোখে ভুল দেখেনি। আসলেই ও ইকথিয়ান্ডার। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালথাযার, প্রাণপণে চেঁচাল, ইকথিয়ান্ডার! ইকথিয়ান্ডার! আমার ছেলে!
সাগরে ঝাঁপ দিল বালথাযার, কিন্তু ঢেউ আজ এতই বেশি যে ওর মতো দক্ষ সাঁতারু সাগরের সঙ্গে যুঝতে পারল না। প্রকাণ্ড একটা ঢেউ তাকে ছুঁড়ে দিল সৈকতে। ভেজা শরীরে উঠে দাঁড়াল বালথাযার, প্রমত্তা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিশ্চিত গলায় বলল, আমি কি তাহলে ভুল দেখেছি।
সকাল হয়ে গেছে। কখন যেন ওর অজান্তে আকাশের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে সূর্যিমামা। এখন বেশ রোদ।
ভিজে কাপড় রোদে শুকিয়ে ডাক্তার সালভাদরের বাড়ির দিকে চলল বালথাযার। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ওই নির্জন বাগান বাড়িতে যাবেই যাবে ও।
বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছোতে। দরজায় জোরে জোরে টোকা মারল সে। একটু পর নির্দিষ্ট ফুটোয় উঁকি দিল এক নিগ্রো চাকর।
কাকে চাই?
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করব। জরুরী দরকার।
ডাক্তার সাহেব এখন কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। কথা শেষ করেই ফুটো বন্ধ করে দিল চাকর।
রাগে দমাদম দরজা পিটাল বালথাযার, দরজা খুলতে বলে চেঁচাতে শুরু করল। গেট খুলছে না। ওপাড় থেকে শোনা গেল ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুরের রক্ত হিম করা ডাক। ক্রিস্টোর কাছে শুনেছে বালথাযার, ওগুলো সাধারণ কুকুর নয়, আসলে জাগুয়ার, বশ মানানো হয়েছে অপারেশন করে কুকুরের মগজ ভরে দিয়ে।
বন্ধ ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চাপল বালথাযার, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শয়তান স্প্যানিয়ার্ড, তোর যদি বারোটা না বাজিয়েছি আমি!
*
কোর্ট থেকে সামান্য দূরেই রেস্টুরেন্টটা নাম লা পামেরা। পাথরের তৈরি নিচু বাড়ি, মোটা মোটা দেয়াল। সামনে সরু একটা বারান্দা। সেখানে ডোরাকাটা সামিয়ানার নিচে কাস্টোমারদের খাবার ব্যবস্থা-সারি সারি টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। সাজসজ্জা বলতে তেমন কিছু নেই টবে রাখা কয়েকটা ক্যাক্টাস গাছ ছাড়া। ওগুলো টেবিলের ফাঁকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই বারান্দায় আসর জমে সন্ধের পর। দিনের আলোয় খদ্দেরদের যাতায়াত নিচু ঘরগুলোতেই বেশিরভাগ সময় সীমাবদ্ধ।
দেখে মনে হয় রেস্টুরেন্টটা সামনের ওই কোর্টেরই বৰ্দ্ধিত একটা অংশ { মামলার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের লোকজন চা-নাস্তার ফাঁকে এখানেই আড্ডা জমায়। আদালত থেকে ডাক আসার আগে পর্যন্ত অনেকেই মদ গেলে। আদালতের নোংরা পরিবেশের চেয়ে এখানে একটু আরামে থাকাই তাদের লক্ষ্য।
বাচ্চা একটা চটপটে ছেলে বারবার আদালত আর রেস্টুরেন্টের মাঝে যাতায়াত করছে, জানিয়ে দিচ্ছে আদালতে এখন কোন মামলার কাজ চলছে। এতে করে অনেক সুবিধে। লোকজনকে দৌড়াদৌড়ি কম করতে হয়। সেকারণে কিছু আয়ও হয় ছেলেটার। লা পারো রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের লোক আসে। তাদের মধ্যে শয়তান মামলাবাজ লোক, দালাল আর মিথ্যে সাক্ষিরাও রয়েছে। মক্কেল শিকারের রয়েছে তাদের নানা রকমের ফন্দি।
দোকানের কাজে অনেকবার এখানে আগেও এসেছে বালথাযার। সে জানে মামলার আর্জি লেখার লোক এখানেই পাওয়া যাবে। ডাক্তারের নামে মামলা করতেই এখানে এসেছে সে।
বারান্দা পার হয়ে হলঘরের মতো বড় একটা ঘরে ঢুকে হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছল বালথাযার। কাছেই সংবাদদাতা ছেলেটা ছিল, তাকেই ও জিজ্ঞেস করল, লারা এসেছে নাকি?
দেরি না করে চটপট জবাব দিল ছেলেটা। ডন ফ্লোরেন্স দ্য লারা? হ্যাঁ, এসে গেছেন। নিজের জায়গাতেই আছেন। যান, গেলেই পাবেন।
ডন ফ্লোরেন্স দ্য লারা নামে যাকে আজকাল ডাকা হয়, সে আসলে ছিল আদালতের এক নিম্ন কর্মচারী। ঘুষ নেয়ার অপরাধে তার চাকরি যায়। চাকরি যাবার পর তার রাত খুলেছে, নিজের জন্যে চমৎকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে সে। অগুনতি মক্কেল তার। যাদেরই মামলা গোলমেলে, তারাই এসে লারাকে ধরে। ঠেকায় পড়ে বালথাযারও কয়েকবার এসেছে তার কাছে।
মোটা চৌকাঠ দেয়া একটা জানালার সামনে বসে আছে লারা। তার সামনের টেবিলে বীয়ারের বোতল আর একটা গ্লাস। পাশেই চামড়ার একটা ব্যাগ। কৈাটের বুক পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে ঝর্না কলম। লারা দেখতে মোটাসোটা, লালচে রঙ চামড়ার, মাথায় টাক, ক্লিন শেভড় মুখে প্রচণ্ড গর্বের স্থায়ী ছাপ। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে মাথার দুপাশের হালকা চুলগুলো ফুরফুর করে উড়ছে তার। দেখলে তাকে নতুন যে কেউ ভাববে স্বয়ং বিচারক বোধহয় বসে আছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন।
বালথাযারকে দেখে অবহেলার সঙ্গে মাথা দোলাল লোকটা। সামনের বেতের চেয়ারের দিকে ইশারা করল।
বসো। কি ব্যাপার? কথার ফাঁকে একটু বীয়ার চলবে নাকি?
বালথাযারের জানা আছে, লারা বীয়ারের অর্ডার দিলেও দামটা তার মক্কেলদেরই মেটাতে হয়। সেটাই নিয়ম। সেজন্যেই লারার কথা শোনেনি এমন নির্বিকার চেহারা করে বসল সে চেয়ারে। সরাসরি কাজের কথায় এলো। সাগর-দানোর গল্প শুনেছ, লারা?
হ্যাঁ, অনেক শুনেছি। দেখিনি তাকে কখনও।
তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু এটুকু জানা তোমার দরকার, তার নাম ইকথিয়ান্ডার। সে আমারই ছেলে।
বালথাযার, এসব কি বলছ? বেশি মদ টেনে আসোনি তো আজকে? বসো, সসা, বালথাযার, একটু ঠাণ্ডা হও। আজকে অবশ্য গরমটাও একটুগই পড়েছে।
বিরক্ত হয়ে রেগে গেল বালথাযার, টেবিলের ওপর প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসাল। কাল থেকে সাগরের দুএক ফোটা পানি ছাড়া আর কিছুই আমার পেটে পড়েনি। না, লারা, আমি মদ খেয়ে আসিনি।
ঠাট্টার সুরে লারা বলল, তাহলে অবস্থা এতই খারাপ যে তুমি মদ না খেয়েই…
তাকে থামিয়ে দিয়ে বালথাযার বলল, ভেবো না আমি পাগল হয়ে গেছি। মাথা আমার ঠিকই আছে। যা বলছি মন দিয়ে শোনো।
কিছু বাদ না দিয়ে পুরো কাহিনী লারাকে খুলে বলল বালথাযার। বাধা না দিয়ে পুরোটা শুনল লারা, মাঝে মাঝে কুঁচকে গেল। ধীরে ধীরে প্রভাবিত হয়ে পড়ল। টেবিল চাপড়ে ডাক দিল বয় ছেলেটাকে।
অ্যাই কোথায় গেলি!
সাদা অ্যাপ্রন পরা একটা ছেলে ময়লা তোয়ালে হাতে ছুটে এলো। কিছু আনতে হবে, স্যার?
দুবোতল বরফ দেয়া সর্টেন। তাকাল বালথাযারের দিকে। দারুণ একটা ঘটনা বললে তো! নিজের মাথা থেকেই এই পরিকল্পনা বের করেছ, নাকি কেউ ফন্দিটা শিখিয়ে দিয়েছে? জবাবের আশায় দেরি না করে বলল, তবে তোমার পিতৃত্বের দাবি খুব কাঁচা। প্রমাণ করা কঠিন হবে। অবশ্য কাঁচাকে পাকা করাই তো আমার কাজ। যদি মামলা টিকে যায় তাহলে প্রচুর টাকা-পয়সা আসবে তোমার পকেটে।
আপত্তি জানাল বালথাযার। টাকা-পয়সার দরকার নেই আমার। আমার ছেলেকে আমি ফিরে পেতে চাই।
টাকার সবারই দরকার,বলল গম্ভীর লারা। বিশেষ করে তোমার মতো লোকদের, যাদের সংসারের সদস্য বাড়ছে। ভ্রূ কুঁচকাল লারা। কপালে কয়েকটা ভঁজ ফেলে বলল, কি ধরনের অপারেশন ডাক্তার করছে সেটা জানা গেছে এটা একটা ভরসার কথা। তবে আসল কথা হলো, এই বিরাট বড়লোক ডাক্তারকে কোন প্যাঁচে ফেলে টাকা বের করতে হবে সেটা আমাদের আগে ঠিক করতে হবে। সেটাই আসল।
আমি আমার ছেলেকে চাই। ওকে পেলেই আমি খুশি। তা যাতে পাই সেরকম একটা মামলা করো তুমি।
আঁতকে উঠল লারা। বলো কী! ভুলেও মামলা করতে যেয়ো না। সব পণ্ড হবে। মামলা হচ্ছে শেষ পথ, আর কোন উপায় না দেখলে তখন।
তাহলে কি করতে বলো? জিজ্ঞেস করল ক্লান্ত বালথাযার। মাথায় কিছু আসছে না তার।
মোটা মোটা আঙুলগুলো মটকে নিয়ে লারা বলল, প্রথমে খুব নরম ভাষায় একটা চিঠি লিখব ডাক্তার সালভাদরকে। চিঠিতে বলব, তার বেআইনী অস্ত্রপচারের ঘটনা আমরা জানি। এসব দুঃখজনক ঘটনা আমরা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেব। তবে তিনি যদি আমাদের সঙ্গে কোন আর্থিক চুক্তিতে আসতে চান তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে কিছু টাকা খরচ করতে হবে তাকে। কিছু মানে ধরো এক লাখ। তার কম হলে চলবে না।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে বালথাযারের দিকে তাকাল লারা। আশা করল বালথাযার কিছু বলবে। ডুবুরি চুপ করে চেয়ে আছে দেখে সে বলল, আমাদের দুনম্বর কাজ হচ্ছে টাকা পাবার পর। তখন আমরা দ্র ভাষায় সালভাদরকে আরেকটা চিঠি লিখব। সেটাতে বলব, ইকথিয়ান্ডারের আসল বাবাকে পাওয়া গেছে। আমাদের হাতে প্রমাণও আছে। বাবা তার ছেলেকে ফিরে পেতে চায়। দরকার হলে মামলা করতেও তার আপত্তি নেই। আর এই মশলা সে করলে জনগণ জেনে যাবে কিভাবে অস্ত্রপচার করতে গিয়ে ইকথিয়ান্ডারকে বিকৃত করে দিয়েছেন ডাক্তার। সেটা বিরাট সর্বনাশা ব্যাপার হবে তার জন্যে। সুতরাং ডাক্তার যদি সত্যিই ইকথিয়ান্ডারকে নিজের হেফাজতে রাখতে চান, তাহলে যেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির হাতে নির্দিষ্ট জায়গায় দশ লাখ ডলার তুলে দেন।
লারার শয়তানী বুদ্ধির দিকে বালথাযারের খেয়াল নেই। রাগ হচ্ছে ওর এসব শুনতে। ইচ্ছে করছে বীয়ারের বোতলটা তুলে লারার মাথা ফাটায়। চোখের দৃষ্টি বদলে গেল তার। চোখ থেকে যেন বিষবাষ্প বের হচ্ছে।
চাহনির পরিবর্তনটা লারা লক্ষ করেছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তার আগেই বালথাযার চিৎকার করে বলল, কি বললে, টাকার জন্যে ছেলে বেচে দেব আমি! তুমি কি মানুষ? তুমি একটা কাঁকড়া বিছের চেয়েও খারাপ! বাবার স্নেহ কাকে বলে তুমি জানো না।
চুপ করে মোড়লী হাসি হাসছে লারা। হাত তুলে বালথাযারকে বসার ইঙ্গিত করে বলল, ধৈর্য ধরো, বালথাযার। ধৈর্য ধরো। আগে সালভাদরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করে নাও, তারপর দেখাও বাবার স্নেহ তোমার কত আছে। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় কোন কিছুই হয় না।
বীয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শেষ করল লারা, সবজান্তার মতো চেহারা করে বালথাযারের দিকে তাকাল, যেন তার যুক্তি কিছুতেই খণ্ডানো যাবে না। কিন্তু তার এত পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। সোজা হয়ে বসল বালথাযার, দৃঢ় স্বরে বলল, মামলার আর্জিটা লেখো। না লিখলে বলে দাও, অন্য উকিল ধরি।
লারা হতাশ। বুঝতে পারছে তার কথায় বালথাযার কাজ করবে। ব্যাগ থেকে কাগজ আর পকেট থেকে কলম নিয়ে অগত্যা সে মামলার আর্জি লিখতে বসল। বেশিক্ষণ লাগল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল আর্জি।
*
উকিলের অফিসে আর্জি জমা দিয়ে বেরোতেই বালথাযারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পেদরো জুরিতার। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বালথাযারকে দেখল পেদরো, গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার নামেই মামলা করলে নাকি?
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে বালথাযারের। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, তোমাদের সবার নামেই মামলা করা দরকার।
দিন যতই যাচ্ছে সাদা চামড়ার স্প্যানিয়ার্ডদের প্রতি ঘৃণা আর আক্রোশের পরিমাণ বাড়ছে বালথাযারের। তোমাদের বলতে স্প্যানিয়ার্ডদেরই বুঝিয়েছে সে। পেদরো তাকিয়ে আছে দেখে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, অভাব পড়েছে তোমাদের মতো লোকদের শায়েস্তা করার মতো মানুষের। আমার মেয়েকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
কি বললে? কথা শুনে রাগে শরীর জ্বালা করে উঠল পেদরোর, আমাকে তুমি করে বলছ? সাহস তো মাত্রাছাড়া বেড়েছে দেখছি। তুমি আমার শশুর, সেকারণে ক্ষমা পেয়ে গেলে। অন্য কেউ হলে পিটিয়ে তোমার হাড়গোড় গুঁড়ো করতাম।
বালথাযারকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিল সে। প্রকাণ্ড একটা ওক কাঠের দরজার ওপাশে চলে গেল। তাকে আর দেখা গেল না।
২৬. বুয়েন্স আয়ার্সের পাবলিক প্রসিকিউটর
বুয়েন্স আয়ার্সের পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন স্থানীয় গির্জার আর্চ বিশপ, হুয়ান দ্য গার্সিলাসো।
আদালতে বিশপের আগমন একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।
বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষ প্রসিকিউটর। চোখ-মুখ ফোলা ফোলা। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। গোঁফের দুপ্রান্ত মোম দিয়ে পালিশ করে ছুঁচাল করা। দেখলেই তাঁকে দক্ষ লোক বলে মনে হয়। আর্চ বিশপকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন তিনি, সসম্মানে স্বাগত জানালেন, তারপর বসতে সাহায্য করলেন চামড়ার গদিমোড়া আসনে।
বিশপের চেহারা প্রসিকিউটরের প্রায় উল্টো বললেই হয়। শীর্ণ মুখটা ফ্যাকাশে। নাকটি সরু ও খাড়া। চিবুকটাও শুকনো। নীলাভ বর্ণ ঠোঁটের। কথা বলার সময় তিনি কারও দিকে তাকান না, অথচ সবাইকেই মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেন। বুয়েন্স আয়ার্সে তার প্রচণ্ড পতিপত্তি। ধর্মীয় বিষয়াদি বাদ দিয়ে মাঝে মধ্যেই তিনি নামেন রাজনীতির নোংরা ময়দানে।
অভিবাদন বিনিময় শেষ হতে না হতে কাজের কথায় চলে এলেন বিশপ।
জানতে এলাম ডাক্তার সালভাদরের মামলাটা এখন কোন পর্যায়ে।
হ্যাঁ, ডাক্তার সালভাদর, সৌজন্য দেখাতে কার্পণ্য করছেন না প্রসিকিউটর, ওই মামলাটা সত্যিই চাঞ্চল্যকর। আপনিও বেশ কৌতূহলী, তাই না? মোটা একটা খাতার পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন তিনি। মুখও চলছে সেই সঙ্গে। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতার জবানবন্দি নিয়ে প্রফেস সালভাদরের ওখানে খানাতল্লাশি চালাই আমরা। দেখলাম ক্যাপেনের জবানবন্দি সঠিক। জীবজম্ভর ওপর আশ্চর্য সব অস্ত্রপচার করেছেন তিনি। ডাক্তার সালভাদরের বাগানটা বিকৃত প্রাণীদের বিরল একটা আবাস। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে ওখানে।
হ্যাঁ। সেসব তো কাগজেই দেখেছি, বললেন বিশপ। এবার বলুন, ডাক্তার সালভাদরকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?
হয়েছে, জানালেন প্রসিকিউটর। তাছাড়া সাক্ষি হিসেবে ইকথিয়ান্ডার নামের এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে এসেছি আমরা। সাগর দানো নিয়ে এই যে এত হৈ-চৈ, হট্টগোল, লেখালেখি, সেসবই নাকি এই যুবককে নিয়ে। এই যুবকই নাকি আসলে সাগর-দানো। কে ভাবতে পেরেছিল ডাক্তার সালভাদরের সংগ্রহে রাখা একটা আজব মানুষ সে! এখন বড় বড় ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা বিকৃত প্রাণী নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। সালভাদরের বাগান বা চিড়িয়াখানা যেটাই বলুন, মস্ত বড়। পুরো বাগান খালি করে শহরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়! কাজেই তা করা হয়নি। শুধু ইকথিয়ান্ডারকে আনা হয়েছে। আদালতের নিচের তলার একটা কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে। এই নিয়ে ঝামেলারও অন্ত নেই। মস্ত বড় একটা চৌবাচ্চা বানাতে হয়েছে তরি জন্যে। পানি ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। দেখলাম পানি নেই বলে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল তার। বোঝা যায়, ডাক্তার সালভাদর তার শরীরে অস্বাভাবিক সব পরিবর্তন এনেছেন। যুবক এখন উভচর মানব। আমাদের বিজ্ঞানীরা ওকে পরীক্ষা করে দেখছেন, চেষ্টা করছেন পরিষ্কার ভাবে সমস্যাটা বুঝতে।
এসব জানতে আমি আসিনি, শান্ত স্বরে জানালেন বিশপ। আমি জানতে চাই প্রফেসরের কি শাস্তি হবে। আইনের কোন ধারায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে? আপনার ব্যক্তিগত মতামতও জানতে চাই। তার কি শাস্তি হয়ে যাবে?
সালভাদরের মামলা আইনের চোখে এক অসাধারণ ঘটনা, বললেন প্রসিকিউটর। আইনের কোন ধারায় এই ভদ্রলোককে ফেললে সেটা ন্যায্য হবে তা আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে আমাদের কাজ সোজা হয়ে যাবে যদি বেআইনী অঙ্গ ব্যবচ্ছেদের অভিযোগ আনা হয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে। ওই ইকথিয়ান্ডারকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন বিশপ, আপনার ব্যক্তিগত মতামত কি, প্রসিকিউটর, সালভাদরের এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনে অপরাধের কোন ব্যাপার নেই?
আছে, ধীরে ধীরে বললেন প্রসিকিউটর। একথাও বলব যে অপরাধ প্রবণতা থাকতে বাধ্য। কিন্তু তা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। একটা আবেদন এসেছে, বালথাযার নামের এক রেড ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে, তার দাবি ইকথিয়ান্ডার তারই ছেলে। কিন্তু জোরাল প্রমাণ নেই তার হাতে। বিশেষজ্ঞরা যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে ইকথিয়ান্ডার তারই ছেলে তাহলে তাকে আমরা সাক্ষি হিসেবে কাজে লাগাতে পারব।
বিরক্ত চেহারায় শুনছিলেন বিশপ! এবার প্রসিকিউটর থামতে বললেন, তার মানে সালভাদরের বিরুদ্ধে চিকিৎসাবিধি অমান্য করার অভিযোগ আনা হবে। বলা হবে মা-বাবার অনুমতি না নিয়েই সে ইকথিয়ান্ডারের ওপর অস্ত্রপচার করেছিল, ব্যস? এই তো?
জ্বী। মোটামুটি এভাবেই মামলা সাজানো হচ্ছে। আসলে বিশেষজ্ঞদের হাতে পাড় মামলার মোড় ঘুরে গেছে। ওঁদের ধারণা ডাক্তার সালভাদর উন্মাদ, নইলে পশু-পাখির ওপর এমন ধরনের অপারেশন করে তাদের দেহ বিকৃত করতে পারতেন না। স্বাভাবিক কোন মানুষের আসলে এমন ইচ্ছেই জাগবে না অন্তরে। সালভাদরের পাগলামি জীবজন্তুদের বিকৃত করেই থেমেছে তা নয়, মানুষ ইকথিয়ান্ডারকেও সে বিকৃত করে তুলেছে। এখন আশঙ্কা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা হয়তো ডাক্তার সালভাদরকে উন্মাদ বলে ঘোষণা দেবেন।
পাতলা, নিলাভ ঠোঁট চাপলেন বিশপ, নিচু স্বরে বললেন, আপনার কাছ থেকে এতটা নির্বুদ্ধিতা আমি আশা করিনি, প্রসিকিউটর সাহেব।
থতমত খেয়ে গেলেন প্রসিকিউটর। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, ইয়োর হোলিনেস!
বিশপ বললেন, আপনি নিজেও নিশ্চিত নন যে ডাক্তার পাগল কি স্রষ্টার অবাধ্য এক অধার্মিক। আমার ধারণা কিন্তু পরিষ্কার। ঈশ্বরের একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে দুটো ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, শুনে রাখুন।
অবশ্যই, অবশ্যই!
ধর্মের কথা যেগুলো তার উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে তা থেকে সামান্য কিছু ঝাড়তে শুরু করলেন বিশপ। ক্রমেই তার গলার স্বর চড়ছে, সেই সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন।
…আপনি বলছেন সালভাদরের কর্মকাণ্ডের পেছনে কোন যুক্তি থেকে থাকতে পারে। যাদের ওপর সে অপারেশন করেছে তাদের কিছু নতুন গুণ অর্জিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কী সেটা আপনি ভেবে দেখেছেন? ঈশ্বর কি জীবজন্তু আর মানুষকে এতই অসম্পূর্ণ করে বানিয়েছেন যে ডাক্তার সালভাদরকে হস্তক্ষেপ করতে হয়?
মুখ নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন প্রসিকিউটর। তাঁর মনে হলো ধর্মীয় কাঠগড়ায় তারই বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তিনিই আসলে অপরাধী। অস্বস্তি লেগে উঠল তাঁর বিশ্বাস হতে চাইছে সামনে এসব ঘটছে।
বিশপ বলে চলেছেন, আপনি কি বাইবেলের কথা ভুলে যাচ্ছেন, প্রসিকিউটর? বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ে ছাব্বিশ নম্বর শ্লোকে কি বলা আছে মনে পড়ে? বলা আছে: মানুষকে আমি সৃষ্টি করব আমার মতো করে। এবার ভাবুন সাতাশ নম্বর শ্লোকে। ওখানে কি বলা নেই, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করলেন নিজের আদর্শে! তাহলে বুঝুন এই ঐশ্বরিক আদর্শ এবং সাদৃশ্যকে বিকৃত করেছে, করার স্পর্ধা দেখিয়েছে ডাক্তার সালভাদর। আর আপনারা তাকেই সমর্থন করতে চাইছেন। তার শয়তানীর পেছনে কৈফিয়ত খুঁজে বের করে তাকে ক্ষমা করানোর চেষ্টাও করছেন। সেই বিচারে আপনি নিজেও কম বড় অপরাধী নন। আপনিও পাপের ভাগী।
চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন প্রসিকিউটর, এবার মস্ত একটা ঢোক গিললেন। জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না। নরম স্বরে বললেন, আসলে ব্যাপারটা আমরা এভাবে ভেবে দেখিনি। আমাকে মাফ করবেন, ইয়োর হোলিনেস।
দৃপ্ত কণ্ঠে বিশপ শুরু করলেন আবার। ঈশ্বর কি নিজের সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ বলে মনে করেননি? শুনুন প্রসিকিউটর, পার্থিব আইন আপনার মনে থাকলেও ঐশ্বরিক আইনের ধারাগুলো আপনি ভুলে বসে আছেন। একবার একত্রিশ নম্বর শ্লোকের বাণী মনে করুন। ঈশ্বর যা সৃষ্টি করলেন তার দিকে চেয়ে দেখলেন। এবং বললেন, বাহ, চমৎকার হয়েছে। আর আপনাদের ঐ সালভাদর ভেবেছে খোদার ওপর খোদকারি করা দরকার। তার বুঝি ধারণা মানুষকে হতে হবে উভচর, যাতে পানিতেও সে দাপিয়ে বেড়াতে পারে! সে যা করার তো কারেইছে, এখন আপনাদের মতো বুদ্ধিমান মানুষরা ভাবছেন সে ঠিকই করেছে। আরও দুঃখের কথা, তার পক্ষ টেনে যুক্তিগুলো আপনারাই দাঁড় করাচ্ছেন? একটু ভেবে দেখুন, এসব কি ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ নয়? সালভাদর সৃষ্টিকে বিকৃত করছে আর আপনারা তাকে আইনের কোন ধারায় ফেলবেন সেটাই এখনও ঠিক করতে পারেননি।
মনে মনে আর্চ বিশপ মহা খুশি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, ভেঙে পড়েছে প্রসিকিউটরের প্রতিরোধ। চুপ করে শুনছেন ভদ্রলোক। মুখটা ফ্যাকাশে। আবার শুরু করলেন বিশপ। একটু একটু করে গলা চড়াচ্ছেন।
সালভাদরের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেটাই আমার আসল জানার দরকার। কিন্তু তাই বলে ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্যে কি হবে সেব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইকথিয়ান্ডার নামটাও খ্রিস্টান নাম নয়, গ্রীক নাম। গ্রীক ভাষায় ইকথিয়ান্ডার মানে হচ্ছে মৎস্যকুমার। সে যাই হোক, দোষ যদি কারও হয়ে থাকে সে সালভাদরের, ইকথিয়ান্ডারের নয়। আরেকজনের অপরাধের শিকার হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তারপরও আমি বলব ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ আর মানুষের ধৃষ্টতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সে। ওর অস্তিত্ব মানুষের মনকে দ্বিধান্বিত করে তুলতে পারে। সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ব্যাপারে মানুষের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। নানা জটিলতা দেখা দেবে। প্রসিকিউটর, সবচেয়ে ভাল হয় যদি স্রষ্টা ওকে নিজের কাছে ডেকে নেন। যদি নিজের বিকৃত অঙ্গের কারণে ছেলেটা মারা যায়… অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রসিকিউটরের দিকে তাকালেন বিশপ। বুঝতে পারছেন? স্বেচ্ছাচারিতার এক জলন্ত সাক্ষি হিসেবে তারও শাস্তি পাওয়া দরকার। সে মুক্ত থাকলে ঐশ্বরিক আইনের ঐতিহ্য নষ্ট হবে। তাছাড়া ও নিজেও তো বেশ কিছু অপরাধ করেছে। জেলেদের মাছ চুরি করা, জাল কেটে দেয়া, তাদের ভয় দেখানো, শহরে মাছের দুর্ভিক্ষ তৈরি করা—এসবের জন্যে তাকে দায়ী করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সে নাস্তিক সালভাদরের কুকীর্তির সাক্ষি। সালভাদরের এই অন্যায় আমার গির্জা সহ্য করবে না। ওদের দুজনকেই স্রষ্টার কাছে প্রোঠাননা অত্যন্ত জরুরী।
বিষণ্ণ মনে মাথা নিচু করে বসে আছে প্রসিকিউটর। বিশপের কথায় বাধা দিচ্ছেন না। তাঁর ভাল করেই জানা আছে এই লোকের প্রভাব কতখানি সুদূরপ্রসারিত।
২৭. মামলা হওয়ায়
মামলা হওয়ায় মনোবল মোটেও হারাননি ডাক্তার সালভাদর। তাঁর ধীরস্থির আত্মমগ্ন ভাবে কোন পরিবর্তন হয়নি। মামলার তদন্তকারী অফিসার এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন শিশুদের সঙ্গে কথা বলছেন।
অলস হয়ে পড়েননি তিনি। জেলে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন। প্রচুর লেখালিখি করেন, আর করেন জেল-হাসপাতালে রোগীদের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সব অস্ত্রোপচার। তার অন্যতম রোগিণী হলেন জেলার সাহেবের স্ত্রী। বিষাক্ত কার্বাঙ্কলে তার মৃত্যু ছিঃ সুনিশ্চিত। অন্য ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন আগেই। ডাক্তার সালভাদই তাকে অপারেশন করে সুস্থ করলেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য পারদর্শিতা ডাক্তার সালভাদরের। কিন্তু সেজন্যে রেহাই পেলেন না তিনি। বিচারের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতেই হলো।
আদালতের প্রকাণ্ড হলঘরে সেদিন আর স্থান সংকুলান হয় না। হলঘর ছেড়ে করিডরেও ভিড় করে দাঁড়িয়েছে অগণিত মানুষ। সামনের চত্বরও ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে। খোলা জানালা দিয়ে অনেকে উঁকি দিচ্ছে হলের ভিতরে কি ঘটছে তা দেখার জন্য কিছু উৎসাহী লোক আবার উঠে বসেছে আদালত প্রাঙ্গণের গাছের ডালে।
আসামীর আসনে শান্ত ভাবে বসে রয়েছেন ডাক্তার সালভাদর। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো আইনজীবীকে তিনি নিয়োগ দেননি। তার চেহারা অবয়ব এমনই ভাবগম্ভীর যে মনে হয়, তিনিই বুঝি আজকের বিচারক, আসামী নন।
অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি তার ওপর। তাঁর ব্যক্তিত্বময় দৃষ্টির সামনে কারও চোখ পড়লেই তাকে চোখ নামিয়ে নিতে হচ্ছে তখুনি।
মানুষের ঔৎসুক্য ইকথিয়ান্ডারকে নিয়েও কম নয়। তবে আদালতে তাকে আনা হয়নি। তার স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। একটা চৌবাচ্চার মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে। অসংখ্য কৌতূহলী চোখের দৃষ্টির যন্ত্রণা থেকে সে বেঁচে গেছে।
এই মামলায় তার ভূমিকা কেবল সাক্ষির ও প্রসিকিউটরের ভাষায় তার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাকে ধরে নেয়া হয়েছে জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে।
অবশ্য ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে অন্য মামলা আছে। সেগুলোর শুনানী হবে সালভাদরের মামলা নিষ্পত্তির পরে, আলাদাভাবে। আর্চ বিশপের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রসিকিউটরকে দুটো মামলা আলাদা ভাবেই সাজাতে হয়েছে। ভবিষ্যতে ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে যে মামলা হবে তার জন্য প্রসিকিউটরের লোকরা গোপনে এখনও তথ্য সংগ্রহ করছে।
আর্চবিশপ প্রথম থেকেই সেই এক কথা বলে চলেছেন, হতভাগ্য ইকথিয়ান্ডারকে ঈশ্বর যদি নিজের কাছে টেনে নেন তাহলে সব দিক থেকে মঙ্গল হয়।
সম্ভবত এই কারণেই কথাটার উপরে তিনি জোর দিয়ে চলেছেন। যে, সেক্ষেত্রে ভালভাবেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে মানুষে হস্তক্ষেপে ঈশ্বরের সৃষ্টির ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয় না। যেমন শিশুর হাতে কাঁচের গ্লাস তুলে দিলে অবধারিতভাবেই সেটা ভাঙবে।
বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনজন বৈজ্ঞানিক এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদালতকে তাঁদের বক্তব্য পাঠ করে শোনালেন। নিস্তব্ধ আদালতের প্রতিটি মানুষ অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে সে সমস্ত বক্তব্য শুনল।
বিশেষজ্ঞ দলের মুখপাত্র হিসাবে বিজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শেইন শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য: যে সমস্ত জীব-জন্তুর ওপরে অপারেশন চালিয়েছেন প্রফেসার সালভাদর, মহামান্য আদালতের নির্ধেশানুক্রমে তাদের আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। ইকথিয়ান্ডারকেও আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। প্রফেসার সালভাদরের ল্যাবোরেটরি আর অপারেশান থিয়েটারও আমরা দেখে এসেছি। আমরা সেখানে লক্ষ্য করেছি যে প্রফেসার সালভাদর শুধু বিদ্যুৎ-প্রয়োগে ব্যবচ্ছেদ পদ্ধতি আর আলট্রা ভায়োলেট-রশ্মি দিয়ে স্টেরিলাইজেশন ইত্যাদি সর্বাধুনিক পদ্ধতিতেই এই সমস্ত অপারেশন করেন না, তাঁর ঘরে এমন সমস্ত যন্ত্রও আছে যেগুলোর ব্যবহার দূরের কথা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সার্জনরাও ওগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে পর্যন্ত জানেন না।
প্রফেসারের অপারেশন সম্পর্কে আমি বেশি কিছু বলব না। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে এইটুকু বলব যে তাঁর পরিকল্পনা অসাধারণ ভাবে দুঃসাহসী আর সেগুলো কাজে পরিণত করাও হয়েছে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে। টিস্যু এবং সম্পূর্ণ অঙ্গের অন্য দেহে সংস্থাপনের যে নিদর্শন তিনি দেখিয়েছেন তা অসামান্য। তাঁর অপারেশন পদ্ধতি দেখে মনে হয়েছে দুটি প্রাণীকে একসঙ্গে জোড়া লাগানো, একশ্বাসী প্রাণীকে দ্বিশ্বাসী প্রাণীতে পরিণত করা, কিংবা দ্বিশ্বাসী প্রাণীকে একশ্বাসী প্রাণীতে পরিণত করা, পুরুষ-প্রাণীকে স্ত্রী-প্রাণীতে পরিণত করা, প্রাণীদের পূর্ণ- যৌবন ফিরিয়ে দেয়া-এ সমস্ত ব্যাপার প্রফেসার সালভাদরের কাছে কোন বড় ব্যাপার নয়। প্রফেসারের বাগানে কয়েক মাস বয়স থেকে শুরু করে চোদ্দ বছর পর্যন্ত নানা বয়সের কিছু রেড ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়েদেরও আমরা দেখেছি।
প্রসিকিউটর প্রশ্ন করলেন, প্রফেসার, দয়া করে বলুন কি অবস্থায় তাদের দেখেছেন?
সবাই তারা বেশ সুস্থ সবল। বাগানে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে তারা। অনেককেই প্রাণে বাঁচিয়েছেন প্রফেসার সালভাদর। সমস্ত রেড ইন্ডিয়ান সমাজই এখন বিশ্বাস করে প্রফেসার সালভাদর স্বয়ং স্রষ্টা প্রেরিত মানুষ। তারা ওঁকে ঈশ্বরের মতই বিশ্বাস করে। তাই আলাস্কা থেকে টিয়েরা-ডেল-ফিউগো পর্যন্ত সারা ভূখণ্ডের এস্কিমো, ইয়াগান, অ্যাপাচি, তুলিপাঙ্গি, পানো আর আরাউকানি উপজাতির মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসে সালভাদরের কাছে…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অধ্যাপক শেইন। প্রসিকিউটরও অস্থির হয়ে উঠলেন। বিশপের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি এখন আর শান্তভাবে সালভাদরের প্রশংসা শুনতে পারেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মনে করেছেন, অধ্যাপক শেইন, সালভাদরের অপারেশনগুলো মানুষের জন্যে মানব সভ্যতার জন্যে মঙ্গলজনক হয়েছে? সেগুলোর স্বপক্ষে কি কোনো যুক্তি থাকতে পারে?
অধ্যাপক শেইন যদি হ্যা বলে বসেন এই আশঙ্কায় বৃদ্ধ বিচারপতি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, বিজ্ঞানের প্রশ্নে বিশেষজ্ঞের ব্যক্তিগত মতামতে আদালতের কোনো আগ্রহ নেই। আপনি বলে যান ডা. শেইন, আরাউকানি উপজাতির তরুণ এই ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করে আপনারা কি বুঝলেন?
শেইন বললেন, আমরা দেখতে পেলাম, ইকথিয়ান্ডারের সারা শরীর এক ধরনের কৃত্রিম আঁশে ঢাকা। খুবই নমনীয় আর মজবুত সেই আঁশ। কিন্তু কোন উপাদানে এই আঁশ তৈরি করা হয়েছে সেটা আজও বিশ্লেষণ করা যায়নি। পানির নিচে ইকথিয়ান্ডার যে গগলস ব্যবহার করে সেটাও এক বিশেষ ধরনের ফ্লিট-কাচের তৈরি। ওটার রিফ্রাশন ইনডেক্স, অর্থাৎ প্রতিসরাঙ্গ প্রায় দুই। তার ফলে পানির নিচে সে। চমৎকার দেখতে পায়। ইকথিয়ান্ডারের শরীরের আঁশ ছাড়িয়ে নিয়ে আমরা দেখেছি তার কাঁধের হাড়ের নিচে দুদিকে রয়েছে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসের দুটো ফুটো। পাঁচটা পাতলা আস্তরণ দিয়ে সেগুলো। ঢাকা রয়েছে, অনেকটা হাঙরের কানকোর মতই।
বিস্ময়ের অস্ফুট গুঞ্জন শোনা গেল আদালত কক্ষের মধ্যে।
অধ্যাপক শেইন বলতে লাগলেন, অবিশ্বাস্য হলেও একথা বৈজ্ঞানিকভাবেই সত্য যে ইকথিয়ান্ডারের দেহে মানুষের ফুসফুসও, যেমন আছে, ঠিক তেমনিই তার দেহে হাঙরের কানকোও আছে। পানি আর ডাঙায়-দুজায়গাতেই ইকথিয়ান্ডার থাকতে সক্ষম।
বিদ্রুপাত্মকভাবে প্রসিকিউটর বলে উঠলেন, তাহলে কি ধরা হবে, ইকথিয়ান্ডার উভচর প্রাণী?
ডা. শেইন বললেন, হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডার নিঃসন্দেহে উভচর-মানব।
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে হাঙরের কানকো কোত্থেকে পেল ইকথিয়ান্ডার?
এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক শেই একবার হতাশভাবে হাত ঘোরালেন। অর্থাৎ, ব্যাপারটা তার জানা নেই। একটু থেমে ধীরে ধীরে বললেন, এ একটা অদ্ভুত রহস্য। হয়তো প্রফেসর সালভাদর আমাদের বুঝিয়ে দেবেন এই কানকো আর ফুসফুসের রহস্য! তবে আমাদের অভিমত এই রকম: হেকেলের সূত্র অনুযায়ী আমরা জেনেছি যে কোন প্রাণী তার যুগ-যুগান্তরের বিবর্তনে যে সমস্ত রূপ অতিক্রম করে বর্তমান রূপে এসে পৌঁছেছে-মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সে সমস্ত রূপের মধ্যে দিয়েই সে পূর্ণাবয়বে এসে পৌঁছোয়। সেদিক থেকে নিঃসংশয়ে আমরা জেনেছি যে মানুষের পূর্ব-পুরুষ একদা কানকো দিয়েই নিঃশ্বাস গ্রহণ করত।
প্রসিকিউটর কি যেন একটা বলবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই প্রধান বিচারপতি তকে ইঙ্গিতে থামিয়ে দিলেন।
অধ্যাপক শেই আবার বলতে লাগলেন, বিশ দিনের মাথায় মাতৃগর্ভে মানব ভ্রূণের দেহে পরপর চারটে কাকোর মত আস্তরণ গড়ে ওঠে। কিন্তু তারপরেই সেগুলো বদলে যায়। কানকোরূপী প্রথম আস্ত রণটার ওপরের অংশ পরিণত হয় শ্রবণ নালীসহ কানের হাড় আর ইউস্টেসিয়াম টিউবে। আর নিচের অংশটা পরিণত হয় মানুষের নিচের চোয়ালে। দ্বিতীয় আস্তরণটা পরিণত হয় হিয়য়েড অস্থিতে এবং তৃতীয় আস্তরণটা থাইরয়েড কার্টিলেজ প্রক্রিয়ায় পরিণতি হয় মানবদেহে।
আমরা মনে করি না যে ভ্রূণ অবস্থাতেই ইকথিয়ান্ডারের এই বিকাশ রোধ করতে পেরেছিলেন প্রফেসর সালভাদর। অবশ্য এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে পরিণত মানুষের দেহেও অবিকশিত কানকোর ছিদ্র রয়ে গেছে দেহের বিভিন্ন অংশে, যেমন-গলা, চোয়ালের নিচে ইত্যাদি-অর্থাৎ অ্যাঙ্কিয়াল ফিস্টুলায়। কিন্তু তার ফলে পানির নিচে শ্বাস নেবার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। জ্বণের বিকাশ যদি অস্বাভাবিক হয় তাহলে হওয়া উচিত দুয়ের একটি অর্থাৎ হয় কানকো বাড়তেই থাকবে এবং শ্রবণেন্দ্রিয় ও অন্যান্য দেহাংশের ক্ষতি হতে থাকবে। কিন্তু তাই যদি হত তাহলে ইকথিয়ান্ডার হতো আধা-মাছ এবং আধা মানুষের মাথাওয়ালা এক অদ্ভুত প্রাণী। কিংবা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশই তার দেহগঠনে প্রাধান্য পেত এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত তার কানকো। কিন্তু ইকথিয়ান্ডার স্বাভাবিক বিকশিত মানুষ। তার। শ্রবণেন্দ্রিয় স্বাভাবিক, নিচের চোয়ালের হাড় সুগঠিত, ফুসফুস স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সবকিছুর সঙ্গেই তার দেহে আছে সুপরিণত কানকো, যা কিনা একমাত্র জলচরদের শ্বাসকার্যেই লাগে। তার সেই কানকো আর ফুসফুস একই সঙ্গে কাজ করে কিভাবে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। ইকথিয়ান্ডারের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে তবেই হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব। আবার আমি বলছি, এ একটা গূঢ় রহস্য, এবং এই রহস্যের সমাধান একমাত্র প্রফেসার সালভাদরই করতে পারবেন। তিনিই একমাত্র বলতে পারবেন কি করে সম্ভব হলো কুকুরের দেহে জাগুয়ারের মাথা জোড়া লাগানো, কিংবা ইকথিয়ান্ডারের দোসর ওই উভচর বানরগুলোকে সৃষ্টি করা।
তাহলে আপনাদের শেষ সিদ্ধান্ত কি? জিজ্ঞেস করলেন প্রধান বিচারপতি।
অধ্যাপক শেইন নিজেও একজন বড় বিজ্ঞানী। শল্য চিকিৎসক হিসেবেও তিনি বিখ্যাত। দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই তিনি বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, কিছু আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না? শুধু এইটুকু বলতে পারি যে প্রফেসার সালভাদর যেসব ব্যাপার ঘটিয়েছেন তা কোন বিরাট, প্রতিভাবান মানুষের পক্ষেই শুধু সম্ভব। এটুকুও আমরা বুঝতে পেরেছি যে প্রফেসার সালভাদরের ধারণা হয়েছে যে সার্জারিতে তিনি এমনই অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন যে জীবজন্তু বা মানুষের দেহকে তিনি যেভাবে খুশি কেটে-কুটে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। তবে ব্যাপারটার মধ্যে চমৎক্ষরিত্ব থাকলেও, এবং কাজগুলোর মধ্যে দুঃসাহসের এবং কল্পনাশক্তির পরিচয় থাকলেও সেগুলো পাগলামিরই নামান্তর।
অবজ্ঞার হাসি হাসলেন সালভাদর ডক্টরের কথা শুনে। একথা তিনি বুঝতেই পারছেন না যে বিশেষজ্ঞরা তঁর মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তুলে কারাবাসের বদলে হাসপাতালের ব্যবস্থা করে তার দণ্ড লঘু করতে চেষ্টা করছেন।
সালভাদরের অবজ্ঞার হাসিটা লক্ষ করলেন অধ্যাপক শেইন। উদাত্তভাবেই আদালতকে তিনি জানালেন, আমি জোর দিয়ে একথা বলতে চাই যে প্রফেসার সালভাদর উন্মাদ। আমাদের ধারণা মানসিক চিকিৎসার স্যানাটরিয়ামে দীর্ঘদিন রেখে ওঁর মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করা। দরকার।
প্রধান বিচারপতি আপত্তি তুলে বললেন, মানসিক বিকারের প্রশ্নটা নতুন। বর্তমান মামলায় এটা আমাদের বিচার্য বিষয়ের বাইরে। এ ব্যাপারে নতুন কোন কথা উঠলে তখন আমরা আলাদাভাবেই তার বিচার করব। সালভাদরের দিকে ফিরলেন প্রধান বিচারপতি, প্রশ্ন করলেন, প্রফেসার সালভাদর, আদালতের বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক প্রসিকিউটরের কিছু প্রশ্নের উত্তর আপনি দেবেন কি?
দেব, দৃঢ় কণ্ঠে সালভাদর বললেন, কিন্তু সে-ই হবে আমার চূড়ান্ত উত্তর! তারপর আমাকে যেন আর বিরক্ত করা না হয়?
*
আদালতের অভিযোগ ও প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য শান্তভাবেই উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার সালভাদর। চারিদিকে তাকিয়ে কাকে যেন একবার খুঁজলেন। দর্শকদের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন বালথাযার, ক্রিস্টো আর ক্যাপ্টেন জুরিতা পেরোকে। সামনের সারিতে বসে ছিলেন আর্চ বিশপ। কিছুক্ষণ তার উপরে দৃষ্টি রাখলেন সালভাদর। চোখে তাঁর ফুটে উঠল ক্ষীণ হাসির রেখা। আবার যেন কাকে খুঁজছে তাঁর চোখ। তারপর একসময় বললেন, আমি যার ক্ষতি করেছি সেই লোকটিকে দেখছি না তো এখানে?
হঠাৎ লাঠিয়ে উঠল বালথাযার। চিৎকার করে সে বলল, ক্ষতি করেছ তুমি আমার! আমিই সেই লোক!
ভাইয়ের আস্তিন ধরে ক্রিস্টো তাকে টেনে বসিয়ে দিল।
প্রধান বিচারপতি সালভাদরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ ক্ষতির কথা বলছেন আপনি? যদি আপনার বিকৃত দেহ জীবজন্তুগুলোর কথা আপনি ভেবে থাকেন, তাহলে বলছি যে এই আদালত তাদের এখানে হাজির করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর যদি সেই উভচর মানব ইকথিয়ান্ডারের কথা বলেন তাহলে আমি বলছি, এই আদালত ভবনেই সে আছে।
শান্তভাবে এবং কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সালভাদর বললেন, আমি বলছি ঈশ্বরের কথা।
উত্তর শুনে হতবাক হয়ে গেলেন প্রধান বিচারপতি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিনি ভাবলেন, সত্যিই কি সালভাদর উন্মাদ? কারাদণ্ড এড়াবার জন্য পাগলামির ভান করছেন নাকি? বিচারপতি আবার প্রশ্ন করলেন, আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?
সালভাদর বললেন, আমার তো মনে হয়, এই আদালতের কাছে সেটা অজানা থাকার কথা নয়। আদালতের অভিযোগ অনুযায়ী আমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সেই ব্যক্তিটি হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। অভিযোগেই প্রকাশ করা হয়েছে যে আমার ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে তাঁর প্রতিষ্ঠা আমি ক্ষুণ্ণ করেছি। অনধিকার প্রবেশ করেছি তাঁর পবিত্র এখতিয়ারে। নিজের সৃষ্টি নিয়ে ভদ্রলোক নাকি বেশ ভালোই ছিলেন। হঠাৎ উটকো এক ডাক্তার এসে বলল, এসব ভালো করে সুষ্টি হয়নি, ঢেলে সাজানো দরকার। তারপর ঈশ্বরের সৃষ্টিকে নিজের মত করে অদল-বদল করতে শুরু করল সে…
নিজের ধর্মবোধে আঘাত লেগেছে, ফলে রুখে দাঁড়িয়ে প্রসিকিউটর জানালেন, ধর্মাবতার, এসব কথা বলে পরিষ্কার ঈশ্বরদ্রোহিতা করা হচ্ছে। আসামীর কথাগুলো নথিভুক্ত করে রাখা হোক।
শ্রাগ করে সালভাদর বললেন, আমার নামে অভিযোগপত্রে যা লেখ্য আছে তার মূল কথাটাই আমি বলেছি। আমার বিরুদ্ধে সমস্ত নালিশ কি কেবল এই একটা কথাকেই তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলছে না? নথিটা আমি পড়েছি। আমার বিরুদ্ধে প্রথমে শুধু এই অভিযোগই ছিল যে অপারেশন করে জীবজন্তুদের আমি দেহবিকৃতি ঘটিয়েছি। কিন্তু পরে দেখলাম আবার যোগ করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে ঈশ্বরের পবিত্রতাহানির অভিযোগ। এই হাওয়াটি এল কোথা থেকে? গির্জা থেকে নয়তো? আর্চ বিশপের দিকে একবার তাকালেন সালভাদর, তারপর বললেন, আপনারাই এই মামলাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে অদৃশ্য ফরিয়াদীর স্থান নিতে হয়েছে স্বয়ং ঈশ্বরকে। আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সঙ্গে সঙ্গে চার্লস ডারউইনও। আদালতে উপস্থিতদের মধ্যে কেউ হয়তো আমার কথায় আর একবার আহত হবেন, কিন্তু একথা আমি বার বার করেই বলে যাব যে পশুদের দেহ, এমনকি মানুষের দেহও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাদেরও সংশোধন দরকার। আশা কলি আদালত কক্ষে উপস্থিত গির্জার আর্চ বিশপ হুয়ান-দ্য গার্সিলাসো একথা সমর্থন করবেন।
একটা গুঞ্জন উঠল আদালত কক্ষে। পরিবেশে চাপা উত্তেজনা এখন টানটান উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে।
সালভাদর আবার বলতে শুরু করলেন, উনিশ শো পনেরো সালে আমি যুদ্ধে যাবার কিছু আগে শ্রদ্ধেয় বিশপের দেহে সামান্য একটু সংশোধন করতে হয়েছিল আমাকে। বিশপ-মহাশয়ের অ্যাপেনডিক্স নামের ক্ষতিকর ও নিপ্রয়োজনীয় অঙ্গটাকে পবিত্র দেহ থেকে আমাকে কেটে বাদ দিতে হয়। রোগ নিরাময়ের প্রয়োজনে মহামান্য বিশপের পবিত্র দেহের একাংশ ঐভাবে ছেঁটে ফেলে দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর দেহসাদৃশ্যের যে বিকৃতি আমি দুটিয়েছিলাম, আমার মনে পড়ে অপারেশন টেবিলে শোয়ার আগে আমার আধ্যাত্মিক রোগী তার কোন প্রতিবাদ জানাননি। বিশপের ওপর ঘুরে এলো তাঁর দৃষ্টি। চোখ দুটো হাসছে। আমি ঠিক বলছি কিনা, মহামান্য বিশপ?
আর্চ বিশপের দিকে আরও একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন সালভাদর।
নিশ্চল হয়ে বসে আছেন হুয়ান-দ্য-গার্সিলাসো। লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। সরু সরু হাতের আঙ্গুলগুলো তাঁর থরথর করে কাঁপছে।
সালভাদর আবার শুরু করলেন, তাছাড়া আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে প্র্যাকটিস করতাম, এবং বিশেষ করে নবযৌবন লাভের জন্য এক বিশেষ অপারেশান করতাম তখন সেই নবযৌবন লাভের আশাতেই আমার কাছে এসেছিলেন শ্রদ্ধেয় পাবলিক প্রসিকিউটর সিনর আগুস্তো দ্য…
কথাটার প্রতিবাদ করতে গেলেন প্রসিকিউটর, কিন্তু শ্রোতাদের তুমুল হাসির আওয়াজে তাঁর কথা চাপা পড়ে গেল।
কড়া সুরে বিচারপতি জানালেন, আপনি প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছেন, প্রফেসার সালভাদর।
সালভাদর বললেন, আমি নিরূপায়। কেননা, আদালত প্রসঙ্গটা এইভাবেই রেখেছেন। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখানে উপস্থিত সকলেই কিন্তু বিবর্তনের পূর্বযুগে মাছ, কিংবা বানর ছিল; তাঁরা কথা বলতে পারছেন কিংবা শুনতে পাচ্ছেন কেবল তাদের কানকোর উজগুলো বাগযন্ত্র ও শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হওয়ায়। কথাটা শুনে কেউ আঁৎকে উঠবেন না এখন, বর্তমান অবস্থায় ঠিক মাছ কিংবা বানর না হলেও সকলেই আমরা তাদেরই বংশধর।
প্রসিকিউটর অধৈর্য হয়ে উঠছেন দেখে সালভাদর তার দিকে ফিরে বললেন, চঞ্চল হবেন না, সিনর আগুস্তো। আমি এখানে বিবর্তনবাদ প্রচারের বক্তৃতা দিতে আসিনি। আমি শুধু বলতে চাইছি একটা নতুন কথা; আর কথাটা হলো এই যে, পশু থেকে মানুষ এসেছে এটা যেমন সত্য কথা তেমনি আরও রূঢ় সত্য এই যে মানুষ আসলে পশুই থেকে গেছে। রূঢ়তা, হিংস্রতা, নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদি পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো কিছুতেই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না।
প্রসিকিউটর এবার আর থাকতে পারলেন না, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে আমি প্রসঙ্গে ফিরে আসতে অনুরোধ করছি, প্রফেসার সালভাদর।
সালভাদর বললেন, হ্যাঁ, তাই আসছি। আমি সার্জন। আমার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ছুরি। সেই ছুরির সাহায্যে প্রায়ই আমাকে জীবদেহে নতুন করে বসাতে হয়েছে টিস্যু, প্রত্যঙ্গ আর বিভিন্ন গ্ল্যান্ড। আর সেই পদ্ধতিকে নিখুঁত করে তোলবার জন্যে জীবজন্তুর দেহে আমাকে বহু পরীক্ষাই চালাতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শেইন এবার প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ইকথিয়ান্ডারের। কেস্টার কি ব্যাখ্যা আপনি দিতে চান, প্রফেসার সালভাদর?
সালভাদর বললেন, হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডার। সে আমার গর্বের ধন। মানুষের দেহের গোটা প্রক্রিয়াটাই বদলে দেবার একটা আইডিয়া নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। আর সেই পরীক্ষার চরম পর্যায়ে আমি অপারেশান চালাই ইকথিয়াল্ডারের দেহে! একটা বাচ্চা হাঙরের কানকো আমি বসিয়ে দিই তার দেহে। ফলে সে পানিতে-স্থলে, দুজায়গাতেই থাকার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
শ্রোতাদের মধ্যে বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠল। হেড-অফিসে টেলিফোন করে এই বিস্ময়কর ব্যাপারটা জানাতে সাংবাদিকরা দ্রুত ছুটে গেলেন বাইরে।
ছুটোছুটি ও চাঞ্চল্য একটু কমতে উঠে দাঁড়িয়ে বিচারপতির উদ্দেশ্যে প্রসিকিউটর বললেন, আসামীকে আমি প্রশ্ন করতে চাই, এই উভচর মানব গড়ার আইডিয়াটা কোথায় তিনি পেলেন, কি তাঁর উদ্দেশ্য?
সালভাদর বললেন, এই আইডিয়ার মূল কথা আমি তো আগেই বলেছি। মানুষ সম্পূর্ণ নয়। বিবর্তনের ধাপ বেয়ে উঠে এসে মানুষ তার পূর্বপুরুষ জীবদের তুলনায় অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেও নিম্নস্তরের প্রাণীদের অনেক গুণই হারিয়েছে। যেমন, মাছের মত পানিতে বাস করতে সে পারে না। ভাবলাম, দেয়া যাক না কেন তাকে সেই সুযোগটা। তাছাড়াও মানুষ যদি আজ সাগরবাসী হতে পারত, তার জীবন হয়ে উঠত একেবারেই অন্যরকম। পানি নামক এই মহাপরাক্রান্ত ভৌতশক্তি তখন হত মানুষের বশীভূত। তাছাড়া বসবাসের একটা মস্ত বড় সমস্যার সুরাহা হত। কোটি কোটি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা হতে পারত সাগরের স্তরে স্তরে। তাছাড়া সাগরগর্ভে–খাদ্যের ব্যবস্থাও রয়েছে অফুরন্ত। চিরদিনের জন্যেই খাদ্যের অভাব মিটে যেত।
সাগরে রয়েছে এক অসীম শক্তিভাণ্ডার। মহাসাগর যে পরিমাণে সৌরভেজ শোষণ করে নেয় তা সাত হাজার নয়শো কোটি অশ্বশক্তির সমতুল্য। কিন্তু মানুষ কি তাকে কাজে লাগাচ্ছে? পারছে কাজে লাগাতে? না, পারছে না।
এছাড়া আছে সমুদ্রের তরঙ্গ, জোয়ার ভাটা আর সাগরস্রোতের শক্তি। তাকেই বা মানুষ কাজে লাগাচ্ছে কই?
মহাসাগরের অসীম সম্পদই বা মানুষ কাজে লাগাচ্ছে কই? বড় জোর সে মাছ ধরে, আর স্পঞ্জ, প্রবাল আর মুক্তো খুঁজে বেড়ায়। এবং এতেই তার উদ্যম শেষ। এটা কিন্তু তার দোষ বা অণ কিছু নয়। তার শরীর প্রকৃতিই তাকে পানির জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ডুবুরির পোশাক কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই যদি সে পানির নিচে থাকতে পারত আর নানা কাজ করতে পারত তাহলে সেটা হত এক অভূতপূর্ব ব্যাপার! কত সম্পদ সে আবিষ্কার করত সেখানে আমার ইকথিয়ান্ডারই তো আমাকে এনে দিয়েছে কত সব বিরল ধাতু আর আকরিকের নমুনা। এর কারণেই আমি সাগরতলের জিরাট সম্ভাবনাময় জীবনের নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছি।
আরও ধরুন না কেন, ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর কথা। উনিশশো ষোলো সালে লুজিতানিয়া জাহাজকে জার্মানিরা আয়ারল্যান্ডের কাছে ডুবিয়ে দেয়। সেই জাহাজের সম্পদের পরিমাণ ছিল বিশ কোটি ডলার। এছাড়াও লুজিতানিয়া জাহাজে ছিল দুটো বাক্স ভর্তি হীরে, যার দাম ছিল আরও কয়েক কোটি ডলার। বিশ্বের অন্যতম সেরা হীরে কালিফ ছিল সেই জাহাজে। আমি চেয়েছিলাম প্রাকৃতিক সম্পদ ও শক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার এই হারানো সম্পদগুলেও ফিরে পাবার শক্তি অর্জন করুক। তাই শুধু একজন ইকথিয়ান্ডার কেন, হাজার হাজার ইকথিয়ান্ডার সৃষ্টি করবার পরিকল্পনাই আমি করেছি।
আমার ইকথিয়ান্ডার খুব গভীর সাগরে নামতে পারে না। আরও উন্নত ধরনের ইকথিয়ান্ডার তৈরি করে তাদের আমি গভীর সাগরে নামিয়ে দিতাম, এই ছিল আমার…।
প্রসিকিউটর টিপ্পনি কেটে বললেন, আপনি কি তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকাই নিতে চাইছিলেন?
এই টিপ্পনি গ্রাহ্য না করেই সালভাদর বলে চললেন, মানুষ যদি পানিতে থাকতে পারত তাহলে মহাসাগর ও সাগরগর্ভকে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিত। সেদিন ওই সাগর আর ভয়ানক বিপদের কারণ হয়ে থাকত না মানুষের কাছে। আর ডুবে যাওয়া মানুষদের জন্য কাঁদবার প্রয়োজনও আমাদের ফুরিয়ে যেত।
সমস্ত আদালত কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে রইল। মনে হলো যেন শ্রোতাদের সকলের সামনেই ভেসে উঠেছে এক অপূর্ব কাল্পনিক ছবি! দুরন্ত ও ভয়াল মহাসাগর বিজিত হয়েছে।
বিচারপতি এবার প্রশ্ন করলেন, আপনার পরীক্ষার ফলাফলগুলো আপনি তাহলে প্রকাশ করেননি কেন?
হেসে জবাব দিলেন সালভাদর, আসামীর কাঠগড়ায় পৌঁছবার তাড়া ছিল না আমার। তাছাড়া ভয় ছিল, বর্তমান সামাজিক অবস্থায় আমার এই আবিষ্কার উপকারের চেয়ে মানুষের অপকারই করবে বেশি। এই তো দেখুন না, ইকথিয়ান্ডারকে দখল করবার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ওই তা ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো ইকথিয়ান্ডারকে চুরি করেছিল আমার কাছ থেকে।
সম্ভবত ওর কাছ থেকে ইকথিয়ান্ডারকে আবার চুরি করতেন নৌবহরের মহামান্য অ্যাডমিরালরা। ওকে তাঁরা শত্রু জাহাজ ডোবানোর কাজে লাগাতেন। হ্যাঁ, এইভাবেই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর লোভ মহত্তম আবিষ্কারগুলোকে পরিণত করে অভিশাপে, বাড়িয়ে তোলে মানুষের যন্ত্রণা। সেই কারণেই ইকথিয়ান্ডারের ব্যাপারটাকে আমি সাধারণ্যে প্রকাশ করতে চাইনি। লোকে ভাবে আমি উন্মাদ! কিন্তু না, উন্মাদ আখ্যালাভের সম্মানটুকু আমি সবিনয়েই প্রত্যাখ্যান করছি, এমনকি তার সঙ্গে প্রতিভাধর বিশেষণটুকু জুড়ে দিলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি। আসলে উন্মাদ আমি নই। বাতিকগ্রস্তও নই। আমি যা চেয়েছিলাম তাই করেছি। আমার কাজগুলো আপনারা উপস্থিত সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। এখন যদি মনে করেন সেগুলো। অপরাধ, তাহলে আইন অনুযায়ী যথার্থ দণ্ডই আপনারা আমাকে দেবেন। কোনরকম সুবিধা কিংবা ক্ষমা আমি চাই না।
সালভাদর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। তার কথা শেষ হবার পরও অনেক অনেকক্ষণ ধরে আদালত কক্ষে বিরাজ করতে লাগল এক থমথমে নিরবতা।
*
যে সব বিশেষজ্ঞরা ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করেছেন তারা যে শুধু তার দৈহিক বিশেষত্বই লক্ষ করেছেন তা নয়, তার মানসিক অবস্থাও তারা দেখেছেন।
এটা কোন সাল? কোন মাস? আজ কত তারিখ, কি বার? সাধারণ এসব প্রশ্ন ইকথিয়ান্ডারকে তারা করেছেন।
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে সেও জবাব দিয়ে গেছে একই কথায়, আমি জানি না।
অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতেও তার খুব অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু তবুও তাকে অপরিণত মস্তিষ্ক বলে ঘোষণা করা চলে না। যেভাবে তার জীবন গড়ে উঠেছে তাতে পার্থিব অনেক বিষয় তার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা শেষ পর্যন্ত তার সম্পর্কে রায় দিলেন: ইকথিয়ান্ডার অস্বাভাবিক। ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে আদালত তাকে অভিভাবকের হাতে সমর্পণ করতে নির্দেশ দিল।
আদালতের ঘোষণা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিভাবক হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো আর বালথাযার। আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দামী মুক্তো উপহার দিয়ে পেদরো তাদের হাত করে ফেলেছে। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার পথে আর বিশেষ বাধাও নেই। আপাতত ইকথিয়ান্ডারকে রাখা হলো জেলখানার নিরাপদ হেফাজতে।
এদিকে লারার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বালথাযারকে ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব দেয়া হলো না।
সেই থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থম মেরে বসে থাকে বালথাযার। আহার-নিদ্রা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তার! কখনও কখনও উত্তেজিত হয়ে। পায়চারি করে দোকানের ভিতরে। দুহাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে বলে, ছেলে আমার ছেলে আমার! প্রাণপণে সে গালিগালাজ করে শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিয়ার্ডদের।
হঠাৎ একদিন ক্রিস্টোকে ডেকে সে বলল, শোন ক্রিস্টো, একটা উপায় বের করেছি। আমার সেরা মুক্তোগুলো দিয়ে জেলখানার। সেপাইদের হাত করে ছেলের সঙ্গে দেখা করব। তাকে আমি বোঝাব। যে আমিই তার সত্যিকার বাবা। ছেলে কখনও বাবাকে না মেনে পারে? আমার রক্ত যে ওর মধ্যে কথা কইবে!
ক্রিস্টো অনেক চেষ্টা করল তার ভাই যাতে পাগলামি না করে। কিন্তু বালুথারের মতামত পরিবর্তিত হলো না। সে যাবেই।
শেষ পর্যন্ত গেল সে জেলখানায়। অনেকগুলো দামি মুক্তো প্রহরীদের ঘুষ দিয়ে ইকথিয়ান্ডারের জেল কুঠুরিতে গিয়ে পৌঁছল সে।
চৌবাচ্চার পানিতে ডুবে ছিল ইকথিয়ান্ডার। কাছে এসে বালথাযার আস্তে আস্তে ডাকল, ইকথিয়ান্ডার! ইকথিয়ান্ডার।
পানির ওপরে একটা কম্পন দেখা গেল, কিন্তু ইকথিয়ান্ডার উঠল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বালথাযার তার হাতটা ডুবিয়ে দিল চৌবাচ্চার পানিতে। তার হাত ঠেক ইকথিয়ান্ডারের কাঁধে।
পানি থেকে ভিজে মাথাটা তুলে ইকথিয়ান্ডার জিজ্ঞেস করল, কে? কে আপনি? কি চান?
আকুল স্বরে দুহাত বাড়িয়ে বালথাযার বলে উঠল, আমিই তোর সত্যিকার বাবা, ইকথিয়ান্ডার। ওই ডাক্তার তোর বাবা নয়। তোর জীবন সে নষ্ট করেছে। আমার দিকে একবার ভাল করে চেয়ে দেখ, বাবা! নিজের বাপকে তুই চিনতে পারছিস না?
অবাক হয়ে বৃদ্ধ বালথাযারের দিকে চেয়ে রইল ইকথিয়ান্ডার। তারপর ধীরে ধীরে সে বলল, আপনাকে তো আমি চিনি না।
কাতর কণ্ঠে বালথাযার বলল, ইকথিয়ান্ডার, বাবা আমার! ভাল করে চেয়ে দেখ আমাকে!
তারপর হঠাৎ ইকথিয়ান্ডারের মাথাটা নিজের বুকের কাছে টেনে আনল বালথাযার, সজল চোখে বারবার চুমু খেল কপালে।
এমন সময়ে কার একটা হাত এসে সজোরে বালথাযারের কলার চেপে ধরল এবং তাকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের এক কোণে। দেয়ালে জোরে মাথা ঠুকে যাওয়ায় ধপাস করে মেঝেতে পড়ল বালথাযার। দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো। মুঠোর মধ্যে কি যেন একটা কাগজ ধরে বিজয়ীর মত সেটাকে নাড়াচ্ছে সে, চিৎকার করে বলছে, এই দ্যাখ, ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব কোর্ট আমাকেই দিয়েছে। সেজন্যে আমি ওকে নিয়ে যেতে এনেছি।
একটা চাপা গর্জন করে উঠল বালথাযার। পর মুহূর্তেই সে বাঘের মত লাফিয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন পেনরোর ওপরে। দুজনের অধ্য শুরু হয়ে গেল হুলস্থূল লড়াই।
জেলখানার গার্ড দুপক্ষ থেকেই ঘুষ খেয়েছে তাই সে নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে। তবে পেদরো যখন বালথাযারকে মাটিতে ফেলে তার গলা টিপে ধরে শ্বাস রোধ করবার চেষ্টা করল তখন সে কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল।
কারাকক্ষের মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল সালভাদরের শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠস্বর: চমৎকার! চমৎকার অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছ তো ক্যাপ্টেন পেরো!
কখন তিনি এসে ঢুকেছেন তা কেউ লক্ষ করেনি। এবার গার্ডের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, হা করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? নিজের কর্তব্য ভুলে গেছ?
কথা শুনে মনে হলো সালভাদরই জেলখানার কর্তাব্যক্তি। তার ধমক শুনতে পেয়ে আরও কয়েকজন গার্ড ছুটে এলো। পেদরো আর বালথাযারকে দুদিকে সরিয়ে দিল তারা।
গার্ডদের হুকুম দিয়ে সালভাদর বললেন, গুণ্ডা দুটোকে তোমরা বাইরে নিয়ে যাও। আমি এখন ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে একা কথা বলতে চাই।
গার্ডরা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করলেন সালভাদর। দেখলেন, অনিয়মের ফলে তার শ্বাস-যন্ত্র বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন সালভাদর। মুখে বললেন, জেলখানা থেকে তোমাকে তাড়াতাড়ি বের করতে আমি চেষ্টা করছি, ইকথিয়ান্ডার। ভেঙ্গে পোড়ো না একদম!
ইকথিয়ান্ডারের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সালভাদর বেরিয়ে গেলেন।
*
কারাগারে নিজের সেলে বসে চিন্তায় ডুবে আছেন সালভাদর। ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্যের জন্য তিনি নিজেই দায়ী। ইকথিয়ান্ডার তার গর্ব, তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু জেলখানার এই বদ্ধ আবহাওয়ায় সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন সালভাদর। এ
দরজায় মৃদু টোকার শব্দ হলো।
সালভাদর বললেন, ভেতরে আসুন।
সেলের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব। আপনার অসুবিধা ঘটালাম না তো প্রফেসার?
সালভাদর বললেন, না, মোটেই না। আপনার বাড়ির সব খবর ভালো তো?
জেলার সাহেব সকৃতজ্ঞভাবে বললেন, হ্যাঁ, ভালই আছে। আপনি আমার স্ত্রীর জীবন দান করেছেন। আপনার এই ঋণ…
বাধা দিয়ে সালভাদর বললেন, এটা আমার কর্তব্য!
জেলার বললেন, কিন্তু ডাক্তার, আর সবাই যা বলে বলুক, আমি বুঝি আপনার মূল্য কত! তাই যখন শুনলাম আপনাকে ওরা চোর ডাকাতদের সঙ্গে এই জেলেই আটকে রাখবে বলে ঠিক করেছে তখন থেকেই ব্যাপারটা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বারবার মন বলছে, না, না, এ হতে পারে না।
তারপর মুখটা সালভাদরের কানের কাছে এনে জেলার ফিসফিস করে বললেন, বাড়ির লোকজনদের আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার শ্বশুরবাড়িতে। এবার আপনার পালাবার ব্যবস্থা করে আমি নিজেও পালিয়ে যাব। টাকার জন্যেই আমাকে এই চাকরি করতে হয়। কিন্তু এ চাকরিকে আমি ঘেন্না করি। আমাকে ওরা খুঁজে পাবে না, আর আপনিও দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, ডাক্তার। সালভাদরের কানের কাছে মুখটা আরও সরিয়ে এনে জেলার বললেন, আমি ভাল করেই খবর জেনেছি, যতই ওরা ঘুষ দিক না কেন, পেদারো বা বালথাযার কাউকেই ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব দেয়া হবে না। ইকথিয়ান্ডারকে মেরে ফেলা হবে বলেই ঠিক করেছে সরকারী কর্তারা।
চমকে উঠলেন সালভাদর।
জেলার আবার বলতে লাগলেন, ইকথিয়ান্ডারকে হত্যার জন্যে বেশি জেদ ধরেছেন আর্চ বিশপ হুয়ান দ্য গার্সিলাসো। আমাকে বিষ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওটা পটাসিয়াম সায়ানাই। আজ রাতেই ইকথিয়ান্ডারের চৌবাচ্চার জলে সেটা মিশিয়ে দেবার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সব দিক থেকে ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখেছি, ডাক্তার। আপনার পালাবার ব্যবস্থাও আমি করে ফেলেছি। ইকথিয়ান্ডারের জন্যে কি করতে পারব জানি না। তবে আপনাকে পালাতেই হবে। আপনার জীবন অনেক মূল্যবান। আপনি বেঁচে থাকলে আরও অনেক ইকথিয়ান্ডার তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু দ্বিতীয় সালভাদর সৃষ্টি করতে কেউ পারবে না।…আপনার পালাবার ব্যবস্থা করে আমিও পালিয়ে যাব।
সালভাদর বললেন, আপনার আত্মত্যাগের জন্য ধন্যবাদ, জেলার। কিন্তু এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আপনি বরং ইকথিয়ান্ডারের মুক্তির চেষ্টাই করুন। তাতে আমার উপকার হবে বেশি। আমার স্বাস্থ্য আছে, শক্তি আছে, বন্ধু-বান্ধবেরও অভাব নেই। আমার মুক্তির জন্যে অনেকেই চেষ্টা করবে। কিন্তু ইকথিয়ান্ডারকে বাঁচাতে হবে, নইলে নিজের বিবেকের কাছে চিরদিন আমি অপরাধী হয়ে থাকব।
বেশ, আপনার কথা মতই কাজ করতে আমি চেষ্টা করছি।
জেলার সাহেব সেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
*
ইকথিয়ান্ডারের পালাবার সব ব্যবস্থাই পাকা করে ফেলেছেন জেলার সাহেব। যাবার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করতে এলেন সালভাদর। পার্থিব ব্যাপারগুলো এখন কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে ইকথিয়ান্ডার। আইনের জালে সালভাদর আর সে নিজেও যে জড়িয়ে পড়েছে এ কথাটা অস্পষ্টভাবে হলেও সহজাত বোধশক্তি দিয়ে সে বুঝতে পেরেছে। এ কথাও সে জানতে পেরেছে যে তার পলায়নের সুব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবাকে রেখে কি করে সে পালাবে?
সালভাদর যখন তাকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে বেশ কিছুদিনের জন্যে, ইকথিয়ান্ডার। এখানে থাকা তোমার পক্ষে বিপজ্জনক। তাই তোমাকে চলে যেতেই হবে। না হলে…
বাকি কথাটা সালভাদর আর বলতে পারলেন না। বলবার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। আকুল কণ্ঠে ইকথিয়ান্ডার বলে উঠল, কিন্তু তোমার কি হবে, বাবা?
বিষণ্ণভাবে সালভাদর বললেন, আদালতের বিচারে অবশ্যই আমার জেল হবে। দুবছর কিংবা তারও বেশি সময় আমাকে জেলে থাকতে হবে। কিন্তু আমি যতদিন জেলে থাকব ততদিন তোমাকে থাকতে হবে কোন নিরাপদ জায়গায়, এবং এখান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের তুয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের একটা ছোট দ্বীপে চলে যেতে হবে তোমাকে। সেখানে পৌঁছানো তোমার পক্ষে খুব সহজ হবে না। কিন্তু এই লা-প্লটা উপসাগরে থাকলে তোমার সমূহ বিপদ। তার তুলনায় তুয়ামতু দ্বীপে যাওয়ার পথকষ্ট স্বীকার করাই তোমার জন্যে ভাল।
গন্তব্য পথটা ইকথিয়ান্ডারকে ভালমতো বুঝিয়ে দিলেন সালভাদর। পানামা খাল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়া যায়। কিন্তু খালের লক-গেটগুলোয় ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সেদিক দিয়ে
যাওয়াই ভাল। হর্ণ অন্তরীপ ঘুরে কিংবা ম্যাগেলান প্রণালী ঘুরে যাওয়াই বেশি নিরাপদ। আবার ওই দুই পথের মধ্যে হর্ণ-অন্তরীপ ঘুরে যাওয়ার নিরাপত্তা আরও বেশি, কেননা সেদিকে সামুদ্রিক খাদ্য ও পানীয়ের অভাব হবে না ইকথিয়ান্ডারের।
পথের নিশানাটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরেকবার বুঝিয়ে দিয়ে সালভাদর বললেন, হর্ণ-অন্তরীপ থেকে তুয়াম দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পথটা খুঁজে পাওয়া পানামা খাল থেকে যাওয়ার চেয়েও কঠিন হবে। তবে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ থেকে নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আমি একটা বিশেষ যন্ত্র বানিয়েছি। সেটা তুমি সঙ্গে রাখবে। আর একটা কথা, তুমি লিডিংকেও সঙ্গে নেবে। যন্ত্রটা সেই বইবে…
ইকথিয়ান্ডার বলল, হ্যাঁ, ওর কথা ভেবে আমার মন কেমন যেন করছে।
সালভাদর একটু হেসে বললেন, কার জন্যে কারও মন কেমন করছে সেটা বলা মুস্কিল। যাই হোক, ওকে তুমি সঙ্গে নেবে। তুয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে তোমাকে খুঁজে নিতে হবে একটা নির্জন প্রবালদ্বীপ। দেখবে একটা উঁচু মাস্তুলের ওপরে দিকচিহ্ন হিসেবে টাঙানো রয়েছে একটা মাছ! হ্যাঁ, ওই দ্বীপটায় পৌঁছতে তোমার দুতিন মাস লেগে গেলেও চিন্তার কিছু নেই…।
ইকথিয়ান্ডার প্রশ্ন করল, কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার কি হবে? কি পাব সেখানে?
সালভাদর বললেন, সেখানে গিয়ে তুমি পাবে বন্ধু, পাবে তাদের ভালবাসা। সেখানে থাকেন আমার পুরানো বন্ধু ফরাসী- বৈজ্ঞানিক আরমান্দ ভিলবুয়া বিখ্যাত মহাসাগর-বিজ্ঞানী তিনি। আমার এই চিঠিটা তাঁকে তুমি দেবে। তিনি হবেন তোমার পিতৃতুল্য অভিভাবক। তাঁর মত বিজ্ঞানীর সঙ্গে তুমি যদি থাকতে পারো, মহাসাগরের আরও বহু কিছুই তুমি জানতে পারবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তুমি যদি তার সঙ্গে কাজ করতে পারো তাহলে মহাসাগর-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তোমরা এমন কিছু দিয়ে যেতে পারবে যার ফলে যুগান্তর ঘটবে, সচকিত হয়ে উঠবে সারা পৃথিবী। তোমার নাম যুক্ত হয়ে থাকবে আরমান্দ ভিলবুয়ার নামের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে থেকে বিজ্ঞানের সেবা করবে তুমি আর সেই সঙ্গে করবে সমগ্র মানবজাতির সেবা। এতে আমারও তৃপ্তি হবে। বুঝব আমার সৃষ্টি কাজে লেগেছে। সেক্ষেত্রে আমার স্থির বিশ্বাস আরমন্দ ভিলবুয়ার পরিবারে একটা নিশ্চিত আশ্রয় আর শান্তির সন্ধানও তুমি পাবে।
এদেশে থাকলে তোমাকে খাটানো হবে মূখ আর অর্থলোলুপ মানুষের হীন স্বার্থ চরিতার্থে! হ্যাঁ, আরও একটা কথা। আজ রাত্রেই হয়তো ছাড়া পাবে তুমি। জলের নিচের টানেল দিয়ে সোজা গিয়ে উঠবে আমাদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে সেই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের যন্ত্রটা আর অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু নেবার সব নিয়ে লিডিংকে সঙ্গে করে হর্ণ-অন্তরীপের দিকে রওনা দেবে ভোর হওয়ার আগেই!…তাহলে বিদায়, ইকথিয়ান্ডার। না, বিদায় নয়, আসি, ইকথিয়ান্ডার।
জীবনে এই প্রথমবার ইকথিয়ান্ডারকে আবেগের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন সালভাদর। তারপর তার পিঠ চাপড়ে হেসে বললেন, তুমি তো চমৎকার ছেলে! তোমার আবার ভাবনা কি! তাই না?
২৮. কাজ থেকে ফিরে
কাজ থেকে ফিরে সবেমাত্র খেতে বসেছে অলসেন, এমন সময় তার দরজায় টোকা পড়ল। একটু বিরক্তভাবেই সে জিজ্ঞেস করল, কে?
দরজা খুলে ঘরে এসে যে ঢুকল তাকে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না অলসেন, আশ্চর্য হয়ে গেল।
গুট্টিয়ারা!
গুট্টিয়ারা? তুমি? তুমি এখানে?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অলসেন। এখনও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
গুট্টিয়ারা বলল, শুভ সন্ধ্যা, অলসেন। না, না, তোমাকে খাওয়া বন্ধ করতে হবে না। আমার কথাগুলো আমি দাঁড়িয়েই বলে যাচ্ছি, তুমি শোনো।
দরজা বন্ধ করে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল গুট্টিয়ারা। তারপর বেশ তিক্ত স্বরেই সে বলতে শুরু করল, আমার স্বামী আর শাশুড়ীর সঙ্গে আমি আর থাকতে পারছি না। হ্যাঁ, পেদারো আর তার মা বুড়ি ডলোরেসের কথাই বলছি। আমার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে পেদরো। তাই আমিও তাকে ছেড়ে এলাম। হ্যাঁ, একেবারেই ছেড়ে চলে এসেছি।
ইতিমধ্যেই অলসেনের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর এই বৃত্তান্ত শোনার পর খাবারের প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে বলল, সত্যি খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তোমার মতো ভাল মেয়ে… তোমার পা কাঁপছে, গুঠিয়ার। তুমি বসো।
সত্যি উত্তেজনায় পা কাঁপছে গুট্টিয়ারার। একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে অলসেন আবার বলল, কিন্তু তুমিই না বলেছিলে, স্রষ্টা যার সঙ্গে জীবন মিলিয়ে দিয়েছেন, মানুষের তাকে মেনে নেওয়াই উচিত? বিব্রত বোধ করছে গুট্টিয়ারা। খারাপ লাগল অলসেনের। থাক, ওসব কথা এখন থাক। কিন্তু ব্যাপার কি বলো তো? কোথায় উঠেছ? বাবার কাছে?
বাবা কিছুই জানে না। আর তাছাড়া ওখানে গেলে পেদরো আমাকে সহজেই খুঁজে বের করে ফেলবে। আবার আমাকে সে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তার বাড়িতে।
অলসেন বলল, তাহলে কোথায় উঠেছ?
উঠেছি এক বান্ধবীর বাড়িতে।
তারপর? এখন কি করবে তুমি?
আমি তোমার কারখানায় কাজে ঢুকব, অলসেন। সেই কথাই তোমায় বলতে এসেছি। তোমার বোতাম কারখানায় আমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দাও-যেকোন কাজ।
চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল অলসেন, তারপর বলল, সেটা এখন খুব সমস্যা। বাইরে কারও পক্ষে সেখানে ঢুকতে পারাই মুস্কিল। একটু : ভেবে অলসেন আবার প্রশ্ন করল, কিন্তু ধরো তোমাকে কাজ দিতে। পারলাম। তোমার স্বামী? সে কি বলবে?
তেজের সঙ্গে গুট্টিয়ারা বলল, আমি তা জানতেও চাই না।
অলসেন হেসে বলল, কিন্তু বউ কোথায় গেল, এটা তো স্বামী মাত্রেই জানতে চাইবে। ভুলে যেয়ো না যে তুমি আর্জেন্টিনায় আছো। পেদরো তোমাকে যখন খুঁজে বের করবে তখন কিন্তু…হ্যাঁ, জানোই তো, তোমাকে তখন আর সে শান্তিতে থাকতে দেবে না। আইন আর জনমত, দুই-ই তার পক্ষে থাকবে।
অন্যমনস্ক হয়ে গুট্টিয়ারা কি যেন ভাবছিল। একসময় দৃঢ় কণ্ঠে সে বলে উঠল, তাহলে চলে যাব কানাডায় কিংবা আলাস্কায়…
সঙ্গে সঙ্গেই অলসেন বলে উঠল, গ্রীনল্যান্ডে কিংবা উত্তর মেরুতে। তারপর পরিহাস ছেড়ে গম্ভীরভাবে সে বলল, কোথায় যাওয়া যায় সেটা না হয় পরেই ভেবে দেখা যাবে। তবে এখানে খাকাটা যে তোমার পক্ষে নিরাপদ হবে না সেটা আমারও মনে হচ্ছে। আর আমি নিজেও অনেকদিন থেকে কোথাও চলে যাবার কথাই ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে তাই ভাবি, কোন কুক্ষণে যে মরতে এসেছিলাম এই ল্যাটিন আমেরিকায়!
গুট্টিয়ারা তার দিকে একাগ্রভাবে তাকিয়ে আছে দেখে উৎসাহিত হয়ে অলসেন আবার বলতে শুরু করল, ..দুঃখের কথা, সেবার আমরা পালাতে পারলাম না। পেদরো তোমাকে জয় করে নিয়ে চলে গেল, ভাঙা একটা মন ছাড়া আর কিছুই রইল না আমার। এখন ইউরোপ যাবার টাকা আমার কাছে নেই, আর মনে হয়, তোমার কাছেও নেই নিশ্চয়। আবেগের উচ্ছাসে অলসেন আবার বলে উঠল, কিন্তু গুট্টিয়ারা, ইউরোপে আমাদের যেতেই হবে। তোমাকে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
গুট্টিয়ারা বলল, সত্যিই?
হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। অন্তত আমাদের পাশের দেশ প্যারাগুয়েতেও যদি পৌঁছতে পারি, আরও ভাল হয় যদি ব্রাজিলে গিয়ে পড়তে পারি, তাহলে পেদরোর পক্ষে তোমাকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে। আর আমরাও তাহলে উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপে পাড়ি দেবার সময় পেয়ে যাব। হ্যাঁ, জানো তো, ডাক্তার সালভাদর আর ইকথিয়ান্ডার এখন জেলে রয়েছে?
অস্ফুট স্বরে গুট্টিয়ারা বলে উঠল, ইকথিয়ান্ডার! তাকে পাওয়া গেছে তাহলে? কিন্তু জেলখানায় কেন?
অলসেন বলল, বিদঘুটে এক মামলায় ইকথিয়ান্ডার আর ডাক্তার সালভাদর দুজনেই আটক হয়ে আছে জেলে।
উদ্বিগ্নভাবে গুট্টিয়ারা বলল, ইকথিয়ান্ডারকে বাঁচানো যায় না?
অলসেন যেন কিছু একটা ভেবে নিল। তারপর বলল, তুমি না বললেও তাকে বাঁচার চেষ্টা আমি করেই চলেছি। এখনও কোন ফল হয়নি। তবে হঠাৎ একজন বন্ধু পেয়ে গেছি। ভদ্রলোক হলেন, স্বয়ং জেলার সাহেব। এই মাত্র তাঁর কাছ থেকে একটা চিরকুট পেয়েছি। আজ রাতেই ইকথিয়ান্ডারকে মুক্ত করতে হবে। আমার সাহায্য চেয়েছেন জেলার। আর ডাক্তার সালভাদরও একটা চিঠি পাঠিয়েছেন আমাকে।
গুট্টিয়ারা বলে উঠল, তোমার সঙ্গে আমিও যাব, অলসেন। ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে আমি দেখা করব।
আপত্তি জানিয়ে অলসেন বলল, তার সঙ্গে তোমার এখন দেখা না হওয়াই ভাল গুট্টিয়ারা!
কেন?
ইকথিয়ান্ডর এখন অসুস্থ।
তার মানে? কি হয়েছে তার?
অলসেন বল, স্থলচর মানুষ হিসেবে সে এখন অসুস্থ, তবে জলচর মাছ হিসেবে সে সুস্থই আছে। ইকথিয়ান্ডার এখন আর বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। ওর মানুষের ফুসফুস দুটো ক্রমশই শুকিয়ে আসছে। ওকে বোধহয় এবার পুরোপুরিভাবে জলেই থাকতে হবে।
কতকটা স্বগতোক্তির মতই গুট্টিয়ারা বলল, তাই থাকুক, তা-ও ভাল। তবে বেঁচে থাকবে তো?
অলসেন বলল, তা থাকবে বটে। কিন্তু তুমি এখন ওর সামনে যেয়ো না। তোমাকে দেখলে ওর মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাবে আর তাতে ওর শ্বাসকষ্টও বৃদ্ধি পাবে। আর তাছাড়া তোমাকে দেখলে। তোমার কাছেই ও থাকতে চাইবে, আর ডাঙায় বাস করলে একেবারেই ও মারা পড়বে।
মাথা নিচু করে গুট্টিয়ারা কি যেন একবার ভেনিল। তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি, অলসেন।
অলসেনও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বড়ই অভাগা ওই ইকথিয়ান্ডার। পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেশবার পক্ষে তার সামনে বিরাট বাধা ওই সাগর, আর এখন থেকে ওই সমুদ্রেই তাকে থাকতে হবে।
গুট্টিয়ারা বলল, কিন্তু কি করে সেখানে সে থাকবে? সেখানে তো শুধু মাছ, কাঁকড়া আর হাঙরই থাকে। একজন মানুষ একলা সেখানে কি করে থাকবে?
অলসেন বলল, এতদিন তো সে তা-ই ছিল। যত দিন না..
অলসেনের কথার ইঙ্গিত গুট্টিয়ারা বুঝতে পারল। লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল। অলসেন আবার বলল। এখন সে আর আগের মত জলের মধ্যে থাকতে পারবে না। তার মন পড়ে থাকবে…
কাতর স্বরে গুট্টিয়ারা বলে উঠল, আর বোলো না, আর বোলো, অলসেন।
অলসেন বলল, তবে সময়ে সবই সয়ে যায়। হয়তো ইকথিয়ান্ডার আবার এক সময় আগের মতই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠবে। মাছ আর কাঁকড়াদের মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দিয়ে বুড়ো হয়ে যাবে সে। আর মৃত্যু? সে তো জলে স্থলে সব জায়গাতেই সমান।
গোধূলির আলো আরও ম্লান হয়ে এল। অলসেনের ছোট ঘরে অন্ধকার ঘনিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, এবার আমাকে উঠতে হবে, গুট্টিয়ারা।
গুট্টিয়ারাও উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে অলসেনের সঙ্গে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল, তারপর কাতরভাবে বলল, কিন্তু দূর থেকেও আমি কি তাকে একবার দেখতে পারি না?
পারো। কিন্তু আড়াল থেকে। ওর সামনে তুমি এসো না।
বেশ। কথা দিচ্ছি, আসব ।
কথা বলতে বলতে অলসেন আর গুট্টিয়ারা পথ চলছে। অলসেনের গায়ে এখন ভিস্তিওয়ালার পোশাক। তার ভূমিকা এখন জেলখানার পানি সরবরাহকারীর।
২৯. গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে
একটা পানির গাড়ি চালিয়ে জেলখানার ফটক দিয়ে ভেতরের চত্বরে এসে দাঁড়াল অলসেন।
গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে।
প্রহরারত পুলিশ হাঁক দিল, কে যায়?
শেখানো কথাটা যন্ত্রের মতই আবৃত্তি করে গেল অলসেন, সাগর-দানোর জন্যে পানি নিয়ে যাচ্ছি।
জেলের কর্মচারীরা সবাই জানে, এখানে আছে এক অসাধারণ বন্দি যাকে রাখা হয়েছে একটা চৌবাচ্চার মধ্যে। সেই বন্দি আবার সমুদ্রের পানি ছাড়া থাকতে পারে না। তাই পিপে ভর্তি করে সমুদ্রের পানি নিয়ে আসা হয় তার জন্যে।
গার্ড বলল, যাও! কোণের সামনের রান্নাঘরটা ঘুরেই পাবে তার সেল!
আলসেন গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল জেলখানার মূল বাড়ির কাছে। জেলারের নির্দেশ সেরকমই। সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন জেলার সাহেব।
দরজায় যে সব প্রহরীরা ডিউটি করে তাদের তিনি নানা অছিলায় সরিয়ে দিয়েছেন। এবার দরজায় এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব। তাঁর সঙ্গে এসে দাঁড়াল ইকথিয়ান্ডার।
নিচু স্বরে জেলার সাহেব বললেন, চট করে গাড়ির ভেতরের ওই পিপটার মধ্যে ঢুকে পড়ো, ইকথিয়ান্ডার।
দ্বিরুক্তি না করে ইকথিয়ান্ডার ঢুকে পড়ল সেই পিপের মধ্যে। আর সঙ্গে সঙ্গে জেলার সাহেব আদেশ দিলেন, চালাও।
ঘোড়ার পিঠে লাগামের ঝাঁকুনি দিল অলসেন। জেলখানার চত্বর ছেড়ে গাড়িটা বেরিয়ে এল ফটক পার হয়ে। তারপর আভেনিদা-দ্য অ্যালভেয়ার রাস্তাটা ধরে ধীরে ধীরে তার গাড়ি এগিয়ে চলল রিতেরা রেল স্টেশন আর ম্যাল রেল স্টেশন পার হয়ে খেয়াল করলে যে কেউ দেখতে পেত অন্ধকারের মধ্যে এক নারী-মুর্তি নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছে অলসেনের পানির গাড়িকে।
বুয়েন্স আয়ার্স শহরের সীমানা পার হয়ে চলল অলসেনের গাড়ি। রাত গভীর হয়ে উঠছে। রাস্তা নির্জন। পথটা এঁকেবেঁকে গেছে সাগরতীর পর্যন্ত। গাড়ি চলেছে সেই পথ ধরে; আর সেই নারী-মূর্তিও চলেছে গাড়ি অনুসরণ করে। অল্প দূরে এবার শোনা গেল সগর্জনে তীরে এসে আছড়াচ্ছে সাগরের ঢেউ।
চারদিকে একবার চেয়ে দেখল অলসেন! সৈকত জনশূন্য। কিন্তু হঠাৎ একটা মোটরের হেডলাইটের তীব্র আলো ঝলসে উঠল অন্ধকারের মধ্যে। ঘোড়ার লাগাম টেনে গাড়ি দাড় করিয়ে একটু অপেক্ষা করল অলসেন। তারপর মোটরগাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যাবার পর পিছনের সেই নারী-মূর্তির উদ্দেশে একবার ইঙ্গিত করল।
অলসেন যাকে ইঙ্গিত করল, সে আর কেউ নয়, সে গুট্টিয়ারা। ইঙ্গিত অনুযায়ী একটা পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল গুট্টি। অলসেন আর একবার চারদিকে ভাল করে দেখে নিয়ে পিপের গায়ে টোকা মেরে বলল, বেরিয়ে এসো, ইকথিয়ান্ডার, আমরা পৌঁছে গেছি।
পিপের ভিতর থেকে মাথা তুলল ইকথিয়ান্ডার। চারপাশে একবার চেয়ে দেখল, তারপর লাফ দিয়ে নামল মাটিতে।
বিশালদেহী অলসেনের দিকে হাত বাড়িয়ে, করমর্দন করে সে বলল, ধন্যবাদ অলসেন। আজ বিদায়ের দিনে আমি বুঝে গেলাম যে এই মাটির পৃথিবীতে তুমি ছিলে আমার সত্যিকার এক বন্ধু। বিদায়!
কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। ঘন ঘন হাঁফাচ্ছে ও। আবার তার সেই শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেছে।
তার হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অলসেন বলল, ধন্যবাদের কিছু নেই, ভাই! তোমার জীবন নিরাপদ হোক, এই আমার কাম্য। মানুষের কাছ থেকে তুমি দূরে দূরেই থাকবে। মানুষ বড় লোভী জীব। সুযোগ পেলেই আবার তারা তোমাকে ধরবে। খুব সাবধানে থেকো। বিদায়।
বেশ শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেছে ইকথিয়ান্ডারের। কোনো রকমে সে বলল, হ্যাঁ, আমি চলে যাব অনেক দূরে, নির্জন এক প্রবাল দ্বীপে, যেখানে কোন জাহাজই যায় না। ধন্যবাদ, অলসেন। গুট্টিয়ারার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না ও! দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিঃশব্দে।
হাত মেলানো হয়েছে আগেই। এবার সে ছুটে গেল সাগরের দিকে। একটা বিশাল ঢেউ মাথা তুলে দাঁড়াল ইকথিয়ান্ডারের সামনে। ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের সাদা ফেনার মুকুট। এবার সেটা প্রচণ্ড গর্জনে আছাড় খেয়ে পড়বে তীরভূমিতে। অভ্যাস মত সেটা ভেঙে পড়ার আগেই লাফ দেবে ইকথিয়ান্ডার। কিন্তু পিছিয়ে এল সে। পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে কি যেন বলল।
ঢেউয়ের গর্জনের মধ্যেও অলসেন শুনতে পেল ইকথিয়ান্ডার বলছে, অলসেন! অলসেন! যদি কখনও গুট্টিয়ারার সঙ্গে দেখা হয় তাহলে তাকে আমার অভিনন্দন জানিয়ো। ওকে বোলো যে ওর কথা আমি চিরকাল মনে রাখব।
আর একটা বিশাল ঢেউ আবার সেইরকম ফেনার জটা মাথায় নিয়ে উঠে এল ইকথিয়ান্ডারের সামনে। বেদনার্ত, স্বরে সে একবার বলে উঠল, বিদায়, গুট্টিয়ারা! তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে পাথরের আড়াল থেকে মৃদু স্বরে গুট্টিয়ারা বলে উঠল, বিদায়, ইকথিয়ান্ডার!
কিন্তু সাগরের প্রবল গর্জনে ওর কথা কেউই বোধহয় শুনতে পেল না? হু-হু করে কোথা থেকে ছুটে এলো ঝড়ো বাতাস। নিজের পায়ের জোরে যেন আর দাঁড়াতে পারছে না গুট্টিয়ারা। এতটুকু বেসামাল হলেই তাকে মাটিতে ফেলে দেবে এই পাগলা হাওয়া। কোনো রকমে টলতে টলতে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে অলসেনের হাত ধরল গুট্টিয়ারা।
*
কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ করে সালভাদর ফিরে এসেছেন তাঁর বাড়িতে। নিজের গবেষণাতেই মনোনিবেশ করেছেন তিনি। শোনা যায়, কোন এক দূর দেশে যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছেন।
ক্রিস্টোর সংবাদ সেই একই রকম। সালভাদরের কাছেই সে এখনও চাকরি করছে। যেভাবেই হোক, তার কেন যেন মনে হয়েছে যে মানুষ হিসেবে সালভাদর পৃথিবীর আর সব মানুষের চেয়ে অনেক উঁচুতে। সুতরাং কোনভাবেই তাকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া যায় না।
ক্যাপ্টেন পেদরো একটা নতুন জাহাজ কিনেছে। সে এখন মুক্তো খুঁজে বেড়াচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে। সারা আমেরিকার মধ্যে সেরা ধনী হওয়ার স্বপ্ন তার সফল হয়নি। কিন্তু সেজন্যে ভাগ্যের বিরুদ্ধে তার কোন নালিশ নেই। সেটা স্পষ্টই বোঝা যায় তার পাকানো গোঁফের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে। এখনও সেই বেপরোয়াভাবেই সে ঘোরে, আর ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পেদরোর সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদের পর গুট্টিয়ারা বিয়ে করেছে অলসেনকে। তারা বাস করছে এখন নিউ ইয়র্ক শহরে।
*
লা-প্লাটা উপসাগরে এখন আর সাগর-দানোর কথা কেউ বলে না। শুধু মাঝে মাঝে গুমোট রাতের স্তব্ধতার মাঝে যখনই কোন দুর্বোধ্য শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, বয়স্ক লোকেরা তখন তরুণদের বলেই যে, শোনো। ওই ভাবেই শাঁখ বাজাত সেই দানো।
ইকথিয়ান্ডারকে শুধু ভুলতে পারেনি বুয়েন্স আয়ার্সের একটি মাত্র লোক। শহরের সবাই তাকে চেনে। সে হলো আধোন্মাদ বালথাযার। তাকে দেখতে পেলেই আঙুল দেখিয়ে লোকে বলে, ওই যে যাচ্ছে সাগর-দানোর বাবা!
এসব মন্তব্য গায়ে মাখে না বালথাযার। তার যত আক্রোশ স্প্যানিয়ার্ডদের ওপর। স্প্যানিয়ার্ড দেখলেই তাদের অভিশাপ দেয় সে, মাটিতে থুথু ছিটায়। তবে তার পাগলামি কারও ক্ষতি করে না বলে পুলিশও তাকে কিছু বলে না।
শুধু মাঝে মাঝে সাগরে যখন ঝড় ওঠে তখন যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে সে। ছুটে চলে যায় সাগর তীরে। উত্তাল ও বিপজ্জনক ঢেউকে গ্রাহ্য না করেই উঠে দাঁড়ায় একটা পিচ্ছিল পাথরের ওপর। ঝড় শান্ত না হওয়া পর্যন্ত দিল্লাত কেবল ডেকে চলে, ইকথিয়ান্ডার। ইকথিয়ান্ডার!
কিন্তু সাগর তার রহস্য বালথাযারের কাছে উন্মোচন করে না, কোন মানুষের কাছেই করে না।
Leave a Reply