দি অ্যাডভেঞ্চারস অভ হাকলবেরি ফিন – মার্ক টোয়েন
০১. দুঃসাহসী টম সয়্যার বইটা পড়া না থাকলে
দুঃসাহসী টম সয়্যার বইটা পড়া না থাকলে আমার ব্যাপারে কিছুই জান না তোমরা। অবশ্য তাতে ক্ষতি নেই কোন, কারণ এখন আমার অভিযানের সব কথাই বলতে যাচ্ছি আমি।
স্টম সয়্যার বইখানার লেখক মিস্টার মার্ক টোয়েন। কিছু কিছু ব্যাপার একটুআধটু বাড়িয়ে বলার চেষ্টা থাকলেও, মূলত সত্যি কথাই বলেছেন তিনি ওই বইতে। বাড়িয়ে বলাটা এমন কিছু দোষের না। একেবারে মিথ্যে বলে না এমন মানুষ আমি দেখিনি আজতক। তবে টমের পলিখালা আর সেই বিধবা-মানে ডগলাস সাহেবের বিধবা স্ত্রীর কথা আলাদা। মেরিকেও বোধহয় ফেলা যায় ওই দলে। টম সয়্যার বইয়ে আছে ওদের কথা।
ওই বই শেষ হয়েছে এভাবে: গুহার ভেতর ডাকাতেরা যে ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিল, টম আর আমি সেগুলো পেয়ে প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়েছি। ভাগে ছহাজার ডলার করে পেয়েছি আমরা—সবই সোনা। ওগুলো এক জায়গায় জড় করে দেখলে চোখ ঠিকরে পড়ার দশা হয়। জাজ থ্যাচারের কাছে গচ্ছিত আছে সোনা। ঠিক হয়েছে, সুদ হিসেবে রোজ এক ডলার পাব আমরা। এক ডলার রোজ, কম নয়-একজনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক।
আমার বাবা মাতাল। তার হাত থেকে বাঁচাতে ডগলাস সাহেবের বিধবা স্ত্রী দত্তক নিয়েছে আমাকে। তার দায়িত্ব আমাকে মানুষ করা। জীবনটা ওখানে বড্ড কড়াকড়ি, আমার হাল হয়েছে খাঁচায় আটকা পাখির মত। রোজ স্নান করে ধোপদুরস্ত জামা-জুতো পরতে হয়। মন চাইলেই খেতে পারিনে: সময় বাধা আছে খাবার, তখন খেতে হয়। বিধবা ঘণ্টা বাজালে টেবিলে বসে ছুরিকাটা দিয়ে খেতে হয়। রাতে কোথাও বেরুনোর উপায় নেই। আমার জন্যে এ এক বিড়ম্বনা। রাতে আমার অভ্যেস জঙ্গলে ঘুমানো, নয়ত রাস্তায় টো টো করা। তবে, স্বীকার না করে উপায় নেই, বিধবা আমাকে সত্যিই খুব ভালবাসে। অথচ সেখানে আমার মন টেকে না। শেষে একদিন সটকে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম আমার পুরোন ছেড়া কাপড় আর গলায় ঝুলানোর চিনির পাত্রটা। কিন্তু বন্ধু টম সয়্যার বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বুড়ির কাছে ফেরত পাঠাল আমায়।
হাক, বলল টম, একটা ডাকাত দল গড়তে যাচ্ছি আমি। জো হার্পার আর বেন রজার্স যোগ দিচ্ছে। তুমিও আসতে পার, হাক। তবে তার আগে ওই বিধবার কাছে ফিরে যেতে হবে তোমাকে। আদব-কায়দা শিখতে হবে। এখন তুমি চিন্তা করে দেখ, কী করবে।
টমের প্রস্তাবটা নিয়ে বহু চিন্তাভাবনার পর বিধবার কাছে ফিরে গেলাম।
আমাকে ফিরে পেয়ে বিধবার সে কী কান্না। দুষ্টুমির জন্যে স্নেহের সুরে শাসন করল। তবে ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু নয়। আমাকে আবার কাপড় পরাল নতুন করে। আমার আর কিছু করার ছিল না, কেবল বসে বসে ঘামতে লাগলাম। আবার সে-ই পুরোন কাণ্ড শুরু হল। রাতে খাবার পালা চুকলে বাইবেল থেকে নানান গপ্পো শোনায় বুড়ি। একদিন মুসা নবী আর বুলরাশারদের কাহিনীটা শোনাল। মুসা নবীর গল্প শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার, ঘামে ভিজে গেল শরীর।
কিন্তু যখন বুড়ি, মিসেস ডগলাস, বলল মূসা অনেক কাল আগেই মারা গেছে, সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম আমি। কারণ মরা মানুষের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই।
খুব শিগগিরই ধোঁয়া টানার ইচ্ছে জাগল আমার। বিধবাকে সে কথা জানাতেই আমাকে বারণ করল সে। বলল, ওটা নাকি খুব বাজে নেশা, আমি যেন কক্ষনও না করি। কিছু মানুষের থাকে এরকম, সবতাতেই বাড়াবাড়ি। বুড়ি নিজে নস্যি নেয়, তাতে দোষ নেই; অথচ আমাকে তামাক খেতে দেবে না।
এর মাঝে একদিন বেড়াতে এল মিস ওয়াটসন, বিধবাটির বোন। কুমারী হলে কী হবে বয়েস তাই বলে নেহাত কম না মিস ওয়াটসনের। বডি: লম্বা ছিপছিপে; চোখে রঙিন চশমা। প্রায়ই আমাকে নিয়ে বানান শেখাতে বসে সে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমার ওপর চলে বানানের ব্যায়াম। তারপর বিধবা এসে খানিক বিশ্রাম দেয় তার বোনকে। এ আমার সহ্যের বাইরে। মৃত্যুর মত নিরানন্দ একটা ঘণ্টা, কিসসু করার নেই। খালি উশখুশ। মাঝেমধ্যে মিস ওয়াটসন বলে, তোমার পা ওখানে রেখ না, হাকলবেরি; ওরকম খখশ শব্দ কোরো না—সোজা হয়ে বস। আবার কিছুক্ষণ পরেই বলে, অমন করে হাই তুলে পা ছড়িয়ে বোসা না, হাকলবেরি-ভদ্রতা বজায় রাখ। তারপর যতসব ভয়ঙ্কর জায়গা আছে, সে সবের গপ্পো শোনায়।
ইস্! যদি যেতে পারতাম ওখানে, বলি আমি। শুনেই খেপে যায় বুড়ি। আমার কিন্তু ও কথা বলার ভেতর নষ্টামি কিছু ছিল না। আসলে একভাবে আটকা থেকে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কোথাও যাওয়া, তা সে যেখানেই হোক না কেন, দরকার হয়ে পড়েছিল ভীষণ। মোটকথা, একটা পরিবর্তন চাইছিলাম।
ওসব কথা আর কখনও বলবে না, হাক, বলে মিস ওয়াটসন। অন্যায় করেছ বলে। তারপর বলে, সারা পৃথিবীটা দিয়ে দিলেও নাকি অমন কথা বেরুবে না তার মুখ দিয়ে। আরও বলে বাস করার জন্যে কোন ভাল জায়গায় চলে যাবে সে। সেখানে কোন পাপী-তাপী নেই। কিন্তু আমি দেখলাম তার সাথে গিয়ে লাভ নেই। তাই মনে মনে স্থির করলাম, আমি যাব না। তবে আভাস দিলাম না তা; ঝামেলা বাড়ত তাতে, লাভ হত না কোন।
এরপর বলবার মত একটা কিছু পেয়ে আরও খানিকক্ষণ বকবক করে বুড়ি। স্বর্গের গপ্পো শোনায়। সেখানে নাকি অনন্ত সুখ। লোকের কাজ বলতে, ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া আর বেহালা বাজান। ওই জায়গার কথাও তেমন ভাল লগে না। আমার, তবে সে কথাও বলি না তাকে। শুধু জিজ্ঞেস করি, টম সেখানে যাবে কি-না। মিস ওয়াটসন জানিয়েছে তেমন সম্ভাবনা খুব কম। শুনে ভারি খুশি হয়েছি। আমি। কারণ আমি টমের সাথে থাকতে চাই।
এদিকে মিস ওয়াটসনের কথা আর থামতে চায় না, শুনতে শুনতে কান পচে যায় আমার। ক্রমে কাজকাম সারা হয় সবার। নিগ্রো চাকরদের ডেকে আনা হয় ঘরে, প্রার্থনা সেরে যে যার বিছানায় চলে যায়।
আমি এক টুকরো মোমবাতি হাতে ওপরে আমার কামরায় যাই। মোমটা টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসি জানলার ধারে। মজার কোন কথা ভাবতে চেষ্টা করি। কিন্তু ফল হয় না কোন। ভীষণ একা লাগে, ইচ্ছে হয় মরে যাই। তারা ঝকমকে আকাশ, গাছের পাতার খশখস—হুঁ হুঁ করে ওঠে মনটা। একটা পেঁচা, অনেক দূরে কেউ হয়ত মারা গেছে তার শোকে, কাঁদছে হুঁ হুঁ করে। একটা হপোবিল পাখি আর একটা কুকুর কেউ মারা যাবে বলে চেঁচাচ্ছে। ফিসফিস করে বাতাসও যেন কী বলতে চায় আমাকে, ঠাওর করতে পারি না। একটা হিম স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। ভূতে যখন মনের কথা বলতে চায় কিন্তু না পারার বেদনায় অস্থির হয়ে শব্দ করে কবর থেকে, তেমনি সব কান্নার মত আওয়াজ প্রতি রাতে ভেসে আসে দূরের জঙ্গল থেকে। আমার গা ছম ছম করে ওঠে। ইচ্ছে যায়, সঙ্গী হিসেবে পাই কাউকে!
হঠাৎ একদিন একটা মাকড়সা আমার কাঁধ বেয়ে উঠল। দু আঙলে টোকা দিতেই মোমশিখার ওপর গিয়ে পড়ল ওটা; আমি কিছু করার আগেই ঝলসে গেল মাকড়সাটা। খারাপ লক্ষণ, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কপালে দুর্ভোগ আছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। তাড়াতাড়ি গায়ের জামাকাপড় ঝাড়লাম। উঠে ঘরের ভেতর তিন পাক ঘুরলাম, প্রতিবার ঘোরার সময় ক্রুশচিহ্ন আঁকলাম বুকে। তারপর ডাইনীদের তাড়াবার জন্যে সুতো দিয়ে মাথায় ঝুটি বাঁধলাম। তবে এসবের পরেও ভরসা পেলাম না তেমন। কারণ, আমি শুনেছি, কুড়িয়ে পাওয়া ঘোড়ার নাল দরজার ওপর পেরেক দিয়ে আটকে না রেখে, কেউ যদি হারিয়ে ফেলে সেটা—তখন কাজ দেয় এসব টোটকায়। কিন্তু মাকড়সা মারলে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারে কিছু শুনিনি কারো কাছে।
আবার বসলাম চেয়ারে, শরীর কাঁপছে থরথর। তামাক খাওয়ার জন্যে পাইপ বের করলাম। মরার মত ঘুমুচ্ছে সবাই, বিধবা তো আর জানছে না এর কথা! কতক্ষণ পর বলতে পারব না-তবে অনেকক্ষণ হবে-হঠাৎ চমক ভাঙল আমার। দূরে ঢং ঢং করে বারটার ঘণ্টা বাজছে টাউন হলের ঘড়িতে। তারপর আবার সব চুপচাপ, সূঁচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে। আচমকা মনে হল, অদূরেই মট করে একটা গাছের ডাল ভাঙল যেন একটা কিছু ঘটছে। কান পাতলাম আমি।
মা-ও! মা-ও! বেড়াল ডাকার ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল নিচ থেকে।
আহ! বাঁচলাম! যতটা সম্ভব মিহি সুরে বললাম, মা-ও! মা-ও! তারপর আলো নিবিয়ে জানলা টপকে কারনিসে নামলাম, সেখান থেকে বারান্দার চাল বেয়ে মাটিতে। তারপর বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলাম ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ঠিক—টম সয়্যারই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
০২. গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা
গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে বাগানের শেষ মাথায়, তারপর বেড়া। বেড়ার ওপারে পাহাড়, জঙ্গল। ওই রাস্তা ধরে পা টিপে টিপে এগোতে লাগলাম আমরা। উবু হয়ে আছি, যেন মাথা ঠুকে না যায় গাছের ডালে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা একটা গাছের শেকড়ে বেধে হোঁচট খেলাম আমি। পড়ে যাবার শব্দ হল। টম আর আমি মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম চুপচাপ। রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে ছিল জিম, মিস ওয়াটসনের নিগ্রো গোলাম। বাতির দিকে পিঠ দিয়ে আছে ও, পরিষ্কার তাকে দেখতে পাচ্ছি আমরা।
শব্দ শুনে উঠে দাঁড়াল জিম। গলা বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী ব্যাপার, তারপর বলল, কে?
নিঃসাড়ে পড়ে রইলাম আমরা। কান খাড়া করে আরও কিছু শোনার চেষ্টা করল জিম। তারপর পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে আমাদের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে এল। আঁধারে প্রায় গা ঘেঁষে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল এভাবে, ঠায় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জিম, কথা বলছে না কোন। আমার পায়ের গোড়ালির এক জায়গায় চুলচুল করে উঠল। চুলকোতে সাহস হল না। একটু পর কানের কাছে চুলকোতে লাগল। তারপর পিঠ–ঠিক দুকাঁধের মাঝখানে। মনে হল, চুলকোতে না পারলে মরেই যাব বুঝি। ওই ঘটনার পর বহুবার লক্ষ্য করেছি: বড্ড বেমক্কা চুলকানি পেয়ে বসে মানুষকে। এমন কোন আসরে বা সমাজে, যেখানে হয়ত চুকোনো চলবে না, ঠিক সেখানেই হাজার বারের বেশি চুলচুল করে শরীর।
কে? সাড়া দাও! খানিক বাদে আবার শোনা গেল জিমের গলা! এই গ্যাট হয়ে বসলাম। ফের আওয়াজ না শোনা অবধি উঠছি না।
টম আর আমার মাঝখানে একটা গাছের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসল ও। পা দুখানা এমন ভাবে ছড়িয়ে দিল, ওর একটা পা আমার পা ছোয়-ছোয়। এবার নাক চুলকোতে লাগল আমার। চুলকানির ঠেলায় পানি এসে গেল চোখে। কিন্তু চুলকোতে সাহস পেলাম না। একটু বাদে নাকের ভেতরটা চুলচুল করে উঠল, তারপর কাপড়ের তলায়। অধৈর্য হয়ে উঠলাম আমি। ছ-সাত মিনিট চলল এরকম। কিন্তু সময়টা আরও দীর্ঘ মনে হল। আমার দেহের প্রায় এগার জায়গায় চুলকোচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে আর এক মিনিটও সহ্য করা সম্ভব নয় বুঝি। শেষে দাঁতে দাঁত চেপে চুলকোবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ ভারি হয়ে এল জিমের নিশ্বাস-তারপর নাক ডাকতে শুরু করল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।, টমের ইশারায় আবার রওনা হলাম আমরা। তিন চার হাত গিয়েছি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল টম।
জিমকে গাছের সাথে বাঁধতে পারলে বেশ মজা হয়, হাক, ফিসফিস করে বলল ও।
নিষেধ করলাম। জেগে গিয়ে চেঁচামেচি বাঁধাবে। ধরা পড়ে যাব আমরা, বললাম।
তখন টম জানাল, তার কাছে বেশি মোমবাতি নেই। চট করে রান্নাঘরে ঢুকে গোটা কয়েক মোম আনতে চায়। তাতেও আমার আপত্তি; কেননা, জিম জেগে ওঠার ভয় আছে। কথাটা জানাতে টম বলল, ঝুঁকিটা সে নেবে। অগত্যা চোরের মত ঢুকে রান্নাঘর থেকে তিনটে মোম নিলাম আমরা। দাম বাবদ টেবিলের ওপর পাঁচটা সেন্ট রাখল টম। ওখান থেকে সরে পড়ার জন্যে ঘেমে নেয়ে উঠলাম আমি, কিন্তু টমের ওসব বালাই নেই। গুটিসুটি মেরে জিমের দিকে এগিয়ে গেল সে। ওর জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। চারদিকে সবকিছু নীরব-নিথর।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এল টম। বাগানের বেড়ার পাশ দিয়ে পথ কেটে বাসার উল্টোদিকে যে পাহাড়টা, তার চুড়োয় গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। জিমের হ্যাটটা গাছের ডালের সাথে বেঁধে ঠিক ওর মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখে এসেছে সে, টম জানাল। জিম অবশ্য একট নড়াচড়া করেছিল, তবে জাগেনি।
ক্রিকের ধারে এগিয়ে গেলাম আমরা। দূর-নিচে, গ্রামে কয়েকটা বাতি জ্বলছে। মিটমিট করে—বোধহয় কারও অসুখ। মাথার ওপর তারার হাট বসেছে যেন, ঝিকমিক জ্বলছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মাইলখানেক চওড়া নদী, ভয়ঙ্কর রকমের স্তব্ধ আর সুন্দর। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামলাম। দেখলাম, জো হার্পার, বেন রজার্স এবং আরও দু তিনটে ছেলে চামড়ার কারখানায় লুকিয়ে আছে। ঘাটে বাঁধা একটা নৌকো খুলে নিলাম আমরা। প্রায় আড়াই মাইলটাক যাবার পর পাহাড়ের একটা ফাটলের ধারে ভেড়ালাম নৌকোটা। পাড়ে উঠলাম।
প্রথমে একটা ঝোপের ভেতর গিয়ে বসলাম। সেখানে টম গোপনীয়তা রক্ষার শপথ করাল আমাদের। তারপর পাহাড়ের গায়ে, যেখানে ঝোপ ঘন, একটা গুহা দেখাল ও। মোম জ্বেলে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম গুহার দিকে। দুশ গজ মত যাবার পর স্পষ্ট নজরে এল ওটা। টম এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভেতরে ঢোকার রাস্তা খুঁজতে লাগল। পাহাড়ের ঢালের গায়ে একটা কিছু চোখে পড়ায় উবু হয়ে দেখল, নিচের দিকে একটা ঝোপের আড়ালে ভেতরে যাবার রাস্তাটা ঢাকা পড়েছে। হঠাৎ দেখলে ওটাকে গুহামুখ বলে চেনা মুশকিল। সরু করিডর ধরে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে একটা গুহার ভেতর গিয়ে হাজির হলাম আমরা।
এবার আমরা ডাকাত দল গড়ব, ঘোষণা করল টম। এর নাম হবে টম সয়্যারের ডাকাত দল। এই দলে যারা যোগ দিতে চায় তাদের সবাইকে শপথ নিতে হবে। আর রক্ত দিয়ে তাদের নাম লিখতে হবে।
সবারই সমান উৎসাহ যোগ দেয়ার। একটা কাগজে শপথটা লিখে পড়ে শোনাল টম: দলের নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কোন গোপন কথা ফাঁস করা চলবে না। দলের কাউকে কেউ কিছু বললে, যে সদস্যকেই হুঁকুম দেয়া হবে, সে নির্দয়ভাবে সেই লোক বা তার পরিবারকে খুন করবে। কাজটা করতে না পারা পর্যন্ত খাওয়া-ঘুম হারাম করতে হবে তাকে। খুন করার পর মৃত ব্যক্তির বুকে দলের চিহ্ন এঁকে দিতে হবে। দলের সদস্য ছাড়া আর কেউ এই ছাপ ব্যবহার করতে পারবে না। করলে, তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। এরপরেও যদি সে কথা না শোনে, তাকেও খুন করা হবে। দলের কেউ গোপন কথা ফাঁস করলে তার গলা কেটে ফেলা হবে। এবং তার লাশ পুড়িয়ে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া হবে সেই ছাই। তারপর তালিকা থেকে রক্ত দিয়ে কেটে দেয়া হবে তার নাম। এবং কঠিন অভিশাপ দিয়ে তাকে ভুলে যাবে সবাই।
শপথনামাটা মনে ধরল সবার। টমকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা, এটা তার নিজের মাথা থেকে বেরিয়েছে কি-না। জবাবে সে জানাল, কতকটা তা-ই বটে। তবে ডাকাতদের গল্প-কাহিনী থেকেও নিয়েছে কিছু।
কেউ কেউ প্রস্তাব দিল, যেসব সদস্য গোপনীয়তা ফাঁস করবে, তাদের পরিবারকে মেরে ফেলা উচিত। প্রস্তাবটা পছন্দ হল টমের। শপথনামায় ধারাটা সে যোগ করল।
আস্থা, হাকফিন, বলল বেন রজার্স, যার কেউ নেই তার বেলায় কী হবে?
কেন, তার কি বাপও নেই! বলল টম।
হ্যাঁ, আছে, বললাম আমি। যেমন আমার কথাই ধর। বাবাকে আজকাল আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একসময় মাতাল অবস্থায় শুয়োরপালের সাথে চামড়ার গুদামের উঠোনে শুয়ে থাকতে দেখা যেত, কিন্তু এখন বছর খানেক হল তার আর খোঁজ-পাত্তা নেই।
আলোচনায় বসল দলের সবাই। কেউ কেউ বলল দল থেকে আমাকে বাদ দিতে। কারণ প্রত্যেকেরই খুন করার মত স্বজন থাকা উচিত। নয়ত অন্যের প্রতি সেটা সুবিচার হবে না। কোন সুরাহা বের করতে পারল না কেউ। কেমন যেন চুপসে গেল সবাই, চুপ করে বসে রইল। আমার তখন প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। হঠাৎ মনে হল, হ্যাঁ, উপায় তো আছে একটা। স্বজন হিসেবে মিস ওয়াটসনের নাম পেশ করলাম আমি। বললাম, তাকে খুন করলেও তো চলতে পারে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে হলেও চলবে। ঠিক আছে, হাক থাকছে দলে, একযোগে বলল সবাই।
এরপর একটা পিন ফুটিয়ে আঙুল ছ্যাঁদা করলাম আমরা। রক্ত দিয়ে সই করলাম কাগজে।
আচ্ছা, বলল বেন, কী ধরনের কাজ করব আমরা?
ডাকাতি, নরহত্যা-ব্যস। বলল টম।
কোথায়? বাড়ি-ঘরে, না পশু-টশু…
ধেৎ! পশু ছিনতাই আবার একটা কাজ হল। ও তো স্রেফ চুরি, বিরক্তি প্রকাশ করল টম। আমরা চোর নই। চুরি কোন উঁচুদরের কাজ নয়। আমরা ডাকাত। মুখোশ এঁটে স্টেজ বা ওয়াগনের ওপর চড়াও হব। সওয়ারিদের খুন করে তাদের মালসামান লুট করব।
খুন-খারাপি কি আদৌ জরুরি?
আলবত। ওটাই তো সবার সেরা। এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। তবে বেশির ভাগ ডাকাতই মনে করে হত্যা করাটাই সবচেয়ে ভাল। কখন-সখন গুহায় আটকে রাখাও যেতে পারে। মুক্তিপণ দিলে ছাড়া পাবে।
মুক্তিপণ? সে আবার কী?
আমি নিজেও জানি না, বলল টম। বইতে পড়েছি। আমাদেরও করতে হবে।
কিন্তু না জানলে করব কীভাবে?
একটা কাজ করা যায়। আমরা যদি ওদের আমরণ আটকে রাখি তবে মুক্তিপণ জানার মত একটা কিছু ঘটবে নিশ্চয়ই। আর তা ঘটলেই জানাটা সহজ হয়ে যাবে।
তা ঠিক। কিন্তু ওরা সব কিছু খেয়ে সাবড়ে দেবে…এবং পালাতে চেষ্টা করবে।
কী যে বল, বেন। একগাল হাসল টম। একজন পাহারাদার থাকবে না? কুটোটা নাড়লেও গুলি করবে সে।
পাহারাদার! চমৎকার! তা কে সারারাত জাগবে শুনি?
কিচ্ছু করার নেই। বইতে যা লেখা আছে, তার বাইরে যেতে পারব না আমরা।
বেশ। এবার বল, মহিলাদেরও খুন করব?
বেন রজার্স! ঝাঁঝাল সুরে বলল টম, বোকার মত কথা বলছ কেন? মেয়েদের খুন করার প্রশ্নই ওঠে না। গল্পের ডাকাতরা গুহায় নিয়ে আসে তাদের। মিষ্টি ব্যবহার করে। কিছুদিন পর ডাকাতদের প্রেমে পড়ে যায় ওরা এবং ওদের ছেড়ে যাবার নামও আনে না মুখে।
তারমানে, বলল বেন, অল্পদিনের ভেতর ফালতু মানুষে ভরে উঠবে গুহা। আমাদের থাকার জায়গা থাকবে না। তা হোক। আমার আপত্তি নেই।
ঘুমে ঢলে পড়েছিল ছোট্ট টমি বার্নস। ডেকে তোলা হল তাকে। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল টমি। বলল, বাড়ি যাবে। ডাকাত হবার শখ নেইI
ছিচকাঁদুনে বলে তাকে খ্যাপালাম আমরা। ভীষণ চটে গেল টমি। ভয় দেখাল, সব ফাঁস করে দেবে। ওকে পাঁচটা সেন্ট ঘুষ দিয়ে শান্ত করল টম!
এরপর টমকে দলপতি বানানো হল। ঠিক হল, ও না থাকলে নেতৃত্ব দেবে বেন। আসছে রোববারেই প্রথম অপারেশন করতে চাইল বেন, সপ্তাহের ওই দিনটাতে তার কোন কাজ থাকে না। কিন্তু অন্য ছেলেরা রাজি হল না। বলল, ওইদিন ডাকাতি করা উচিত হবে না। তখন ঠিক হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার একত্র হব আমরা। এবং সেই মিটিংয়েই দিন ধার্য করা হবে।
একটু পর বাড়ি-মুখো হলাম আমরা। আমি কারনিস বেয়ে জানলা গলে ঘরে ঢুকলাম। পুবের আকাশে আলো ফোটেনি তখনও, সবে ফরসা হতে শুরু করেছে। আমার নতুন জামা-কাপড় সব কাদামাটিতে একাকার, ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর।
সকালে বেশ একচোট ঝড় বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। নোংরা পোশাকের জন্যে বকাবকি করল মিস ওয়াটসন। তবে বিধবা কিছু বলল না, নীরবে গলা মোম আর কাঁদার দাগ সাফ করল কাপড় থেকে। বিষন্ন দেখাচ্ছিল তাকে। ঠিক করলাম, পারলে, অন্তত কয়েকটা দিন ভাল থাকার চেষ্টা করব।
আমাকে প্রার্থনা করতে উপদেশ দিল মিস ওয়াটসন। এতে নাকি যা চাওয়া যায়, তা-ই পাওয়া যায়। একদিন জঙ্গলে গিয়ে ভাবলাম বিষয়টা নিয়ে। প্রার্থনাতে যদি লাভই হবে, পাদ্রি উইল মাংস কিনতে গিয়ে যে-টাকাটা খোয়ালেন, সেটা ফেরত পেলেন না কেন? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। বিধবা কেন তার হারানো নস্যির কৌটো ফিরে পেল না? আর মিস ওয়াটসনই-বা মোটাতাজা হয় না কেন? নাহ্! নিজেকে বোঝালাম, প্রার্থনায় কিস্যু হয় না।
বছরখানেক হল বাবার কোন খোঁজ ছিল না। এতে অবশ্য সুখেই ছিলাম আমি। হুঁশ অবস্থায় আমাকে হাতের কাছে পেলেই উত্তম-মধ্যম দিত বাবা। হঠাৎ একদিন শুনলাম বাবা নাকি মারা গেছে। শহর থেকে বার মাইল দূরে নদীতে একটা লাশ ভাসতে দেখে পাড়ে এনে তাকে গোর দিয়েছে লোকেরা। মুখ দেখে লোকটাকে শনাক্ত করা যায়নি। বহুক্ষণ পানিতে থাকায় চেহারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তবে দেহের গড়ন আর দীর্ঘ চুল থেকে সবার অনুমান, লোকটা আমার বাবা-ই হবে। ওদের কাছ থেকে এ-ও শুনলাম, লাশটা নাকি চিত হয়ে আসছিল।
বাবার মৃত্যু-খবর শুনে খুব বেশি শান্তি পেলাম না। কারণ মাথায় তখন একটা চিন্তা এসে ঢুকেছে: পুরুষ মানুষ মরলে চিত হয়ে ভাসে না, ভাসে উপুড় হয়ে। তার মানে, ওটা বাবার লাশ না; নিশ্চয়ই বেটাছেলের পোশাকে কোন মেয়েলোক হবে। একটা অস্বস্তি এসে ভর করল আমাকে। নির্ঘাত বুড়ো একদিন এসে হাজির হবে আবার-যদিও মনে মনে চাইছিলাম, কোনদিন সে না এলেই ভাল।
০৩. প্রায় মাসখানেক ডাকাত-ডাকাত খেললাম
প্রায় মাসখানেক ডাকাত-ডাকাত খেললাম আমরা। তারপর ইস্তফা। আমরা কারও ওপর রাহাজানি করিনি, খুনও করিনি কাউকে। কেবল ভান করেছি সেরকম। জঙ্গল থেকে হুঁট করে বেরিয়ে এসে রাখাল বা মেয়েদের ওপর, যারা বাজারে সবজি বিক্রি করে, হামলা করতাম। তবে ক্ষতি করিনি কখনও। টম শুয়োরগুলোকে বলত সোনা, সবজি আর অন্য আনাজপাতিকে অলঙ্কার। কিন্তু এতে মন ভরছিল না আমাদের।
একদিন জ্বলন্ত মশালহাতে একটা ছেলেকে শহরে পাঠাল টম। ওটা নাকি পরদিন দলের সবাইকে এক জায়গায় জড় হতে বলার সঙ্কেত।
গুপ্তচর মারফত খবর এসেছে, বলল ও, আরব আর স্পানিশ বণিকদের একটা দল আমাদের গুহার কাছে ছাউনি ফেলবে কাল। তাদের সঙ্গে থাকবে দুশ হাতি, ছশ উট আর এক হাজার মালবাহী খচ্চর-সব হীরে বোঝাই। ওদের মেরে হীরে-জহরত ছিনিয়ে নেব আমরা। তলোয়ার-বন্দুক নিয়ে তৈরি হও, বন্ধুগণ।
টমের কাজের এই এক ধরন, গাজরের গাড়ি আক্রমণ করতে হলেও বন্দুক বাগিয়ে যাওয়া চাই। আসলে ওগুলো ছিল কঞ্চি আর ঝাড়ুর শলা, কিন্তু ঢালতলোয়ার হিসেবে কল্পনা করে নিতাম আরকি! আমার বিশ্বাস-ই হল না, ওইসব খেলনা দিয়ে একটা বিশাল বণিক দলকে হারাতে পারব আমরা। আমার আগ্রহ উট আর হাতি দেখবার। তাই পরদিন, মানে শনিবার, ঝোপের ভেতর ওত পাতলাম। আক্রমণের সঙ্কেত পাওয়ামাত্র পিল পিল করে নেমে এলাম পাহাড় বেয়ে। কিন্তু, ওমা, কোথায়ই-বা বণিকদল, আর কোথায়-বা হাতি-ঘোড়া। ইশকুলের কিছু ছেলেপুলে পিকনিকে এসেছে, তাও আবার নিচের ক্লাসের। ওদের ধাওয়া করলাম। কিন্তু কয়েক টুকরো কেক আর অল্প জেলি ছাড়া কিছুই মিলল না। ইতিমধ্যে বাচ্চাদের টিচারেরা এসে পড়ায় সব কিছু ফেলে চম্পট দিলাম আমরা।
কই, তোমার হীরে-মানিক কই? টমকে জিজ্ঞেস করলাম। বণিক আর হাতিগুলোই-বা কোথায়?
ছিল, সত্যি, আমাকে বোঝাল টম। কই, দেখলাম না তো?
আরে, বুন্ধু, বলল টম, ডন কিহোতে বইটা পড়া থাকলে বোকার মত প্রশ্ন করতে না। সব ভোজবাজি, ওখানে লোক-লস্কর, হাতি, ধনরত্ন-সবই ছিল। আর ছিল আমাদের শত্রু, জাদুকর। আমাদের দুচোখে দেখতে পারে না ওরা। তাই ওদের পিকনিক পার্টিতে বদলে দিয়েছিল।
মানলাম, বললাম। তাহলে এখন থেকে জাদুকরদের পাকড়াও করতে হবে!
তুমি একটা আহাম্মক, বলল টম।
কেন?
জাদুকর ইচ্ছে করলেই দৈত্য-দানো ডেকে আনতে পারে। মুখের কথা সরতে সরতে ওরা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে আমাদের। জান না, দৈত্যদানোরা গাছের মত লম্বা আর গির্জার থামের মত ইয়া মোটাসোটা হয়।
বেশ, বললাম। আমরাও তো দৈত্যের সাহায্য নিতে পারি। তাহলেই তো ওদের হারান যায়।
কীভাবে নেবে?
জানি না। ওরা কী করে পায়?
কেন, পুরোন পিদিম, অথবা লোহার আংটি ঘষে। ঘষলেই চারদিক আঁধার করে, ঝড় তুলে হাজির হয় দৈত্যেরা। তখন ওদের যা বলা যায়, তা-ই করে। এমন কি, দুর্গের বিশাল গম্বুজ পর্যন্ত গোড়াসুদ্ধ উপরে ফেলতে পারে।
কাদের ডাকে আসে ওরা?
যে কেউ আনতে পারে। ওই পিদিম অথবা আংটি থাকলেই হল। আংটি, পিদিম যার কাছে থাকবে, তার গোলাম ওরা। ওদের যদি বলা হয় চল্লিশ মাইল লম্বা একটা হীরের রাজপ্রাসাদ বানিয়ে, সেটা চুয়িংগাম দিয়ে ভরে দিতে, দেবে। যদি বল, বিয়ে করার জন্যে চীনের রাজকন্যাকে উড়িয়ে আনতে হবে-আনবে। আরও আছে, সেই রাজপ্রাসাদ তুমি যেখানে বলবে, সেখানেই রেখে আসবে তারা।
তোমার এই দৈত্যেরা, টম, বললাম আমি, সব মাথা মোটা। বাড়িটা নিজেদের জন্য না রেখে, তা দিয়ে যা-তা করা কেন, বাপু? আমি দৈত্য হলে কারও ডাকে আসার আগে শয়তানের সাথে পরামর্শ করে নিতাম।
হাকফিন! বিস্মিত গলায় বলল টম, কী বলছ পাগলের মত। ওই বাতি ঘষে ডাকলে তোমাকে আসতেই হত, তুমি চাও বা না চাও।
খেপেছ! ওই রকম গাছের মত লম্বা আর গির্জার থামের মত মোটাসোটা হলে, ডাকল আর মনি ছুটে এলাম! আর এলেও, দেশের সবচেয়ে উঁচু গাছের মগডালে চড়িয়ে ছাড়ব না ব্যাটাস্থেলেকে।
ধেৎ! আহত সুরে বলল টম, তোমার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, হাকফিন। তুমি কিছু বুঝতে চাও না—আহাম্মক! ব্যাপারটা নিয়ে দুতিন দিন অনেক চিন্তা করলাম। শেষে স্থির করলাম, এর ভেতর সত্যিই কিছু আছে কি-না, দেখব। একটা অতি পুরোন পিদিম আর লোহার আংটি জোগাড় করে জঙ্গলে চলে গেলাম। আচ্ছাসে ঘষলাম দুটো। ইচ্ছে, একটা রাজপ্রাসাদ বানিয়ে বেচে দেব। ঘষতে ঘষতে ঘাম ছুটে গেল, কিন্তু জ্বিনের দেখা পেলাম না। পরে বিচার করে দেখলাম, সব টমের বানানো-গুলতাপ্লি!
দেখতে দেখতে তিন চার মাস পেরিয়ে গেল। শীতের মাঝামাঝি। মাঠেঘাটে পুরু বরফের চাদর। মাঝের এই সময়টায় প্রায় রোজই ইশকুলে গিয়েছি। এখন আমি এক-আধটু বানান করতে, আর লিখতে-পড়তে পারি। নামতাও শিখেছি ছয় সাতে পঁয়তিরিশ অবধি। অঙ্ক দেখলেই গায়ে জ্বর আসে; বুঝতে পারছি, এর চেয়ে ভাল করা, অন্তত আমার কষ্মে নয়।
প্রথম প্রথম খুব ঘেন্না করতাম ইশকুলকে, পরে সয়ে এল ধীরে ধীরে। যখন একঘেয়ে লাগে, তখন ক্লাস পালাই। এর জন্যে পরদিন পিঠে কিছু কিল-পুঁতো পড়লে ফের চাঙা বোধ করি। যত বেশি গেলাম, ততই ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল আমার কাছে। বিধবার কথামত চলাফেরাটাও রপ্ত করে নিলাম একরকম। নিপাট বিছানায় ঘুমুতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। তবে শীত জঁকিয়ে বসার আগে সময় করে বাইরে গিয়ে জঙ্গলেও ঘুমিয়েছি মাঝেমধ্যে। ওটাই আমার কাছে সবচেয়ে আরামের। পুরোন অভ্যেসগুলোই বেশি পছন্দ করি আমি, তবে একটু একটু করে নতুনগুলোও ভাল লাগতে শুরু করেছে। মনে হয়, বিধবাও আমার ওপর এখন বেশ খুশি।
একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে নুনের পাত্রটা উল্টে ফেললাম। এটা কুলক্ষণ, জানি, বাঁ-কাঁধের ওপর দিয়ে এক চিমটে লবণ ফেলে না দেয়া অবধি রক্ষে নেই। তাড়াতাড়ি হাত বাড়ালাম পাত্রটার দিকে, কিন্তু বাদ সাধল মিস ওয়াটসন।
হাত সরিয়ে নাও, হাকলবেরি, বলল সে। কী বাদর ছেলেরে, বাবা!
বিধবাটি অবশ্য সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু তাতে কী? আমার দুর্ভাগ্য তো আর ফেরান যাবে না। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে উঠে পড়লাম নাস্তার টেবিল থেকে। কেবল একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর-না জানি কপালে কী আছে। বাগানে গেলাম, সোপান বেয়ে বেড়ার ওপাশে নামলাম। সিড়ির গোড়ায়, লক্ষ্য করলাম, কিছু বরফকুচি পড়ে রয়েছে। তাজা। একসারি পায়ের ছাপও দেখতে পেলাম। খনির দিক থেকে এসেছে লোকটা, ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর বেড়ার ধার ঘেঁষে ঘুরে গিয়েছে ওপাশে। লোকটা ভেতরে ঢুকল না কেন? ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কূলকিনারা পেলাম না। ব্যাপারটা কৌতূহলী করে তুলল আমায়। উবু হয়ে বসে ছাপগুলো পরখ করতে লাগলাম। শয়তানকে দূরে রাখার জন্যে বাম বুটের গোড়ালির কাছে ক্রুশচিহ্ন আঁকা। তড়াক করে উঠে পড়লাম আমি। পাহাড় বেয়ে দ্রুত নামতে লাগলাম নিচে, ভয়ে ভয়ে। থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকালাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না কাউকে। অল্পক্ষণের ভেতর পৌঁছে গেলাম জাজ থ্যাচারের বাসায়।
কি ব্যাপার, বাছা, হাঁপাচ্ছ কেন? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। সুদের জন্যে এসেছ?
না, স্যার। সব নিয়ে নেন আপনি। ওই ছহাজার ডলারও। প্লিজ, নেন, স্যার। কোনও প্রশ্ন করবেন না—তাহলে মিথ্যে বলতে হবে না আমাকে।
চিন্তিত মনে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন জাজ থ্যাচার। তারপর একটা সাদা কাগজে কিছু লিখে বাড়িয়ে ধরলেন। বুঝেছি, বললেন তিনি, সম্পত্তিটা বিক্রি করতে চাও আমার কাছে-দান নয়। দাম হিসেবে এই এক ডলার নাও। আর সই কর।
আমি সই করে ডলারটা নিয়ে চলে এলাম। মিস ওয়াটসনের নিগ্রো চাকর জিমের কাছে একটা চুলের বল ছিল। দেখতে অনেকটা খোপার মত, এক মুঠির সমান বড়। বলটা নাকি একটা ষাঁড়ের চতুর্থ পাকস্থলীর ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই বল দিয়ে জাদু দেখাত জিম। বলত, ওর ভেতর একটা সবজান্তা ভূত আছে। সে রাতে ওর কাছে গেলাম আমি। বললাম, বাবা এসেছে। বরফে তার পায়ের ছাপ দেখেছি। বাবার মতলবটা এখন কী, জানা দরকার আমার।
সেই চুলের তৈরি বলটা বার করল জিম। বলের ওপর বিড়বিড় করে কিছু পড়ল, তারপর ওটা উঁচু করে ধরে গড়িয়ে দিল মেঝের ওপর। ধপাস করে বলটা পড়ে গড়িয়ে গেল ইঞ্চিখানেক। আবার ও-ই করল জিম, তারপর আরও একবার। প্রতিবারই বলটা একই রকম গড়িয়ে গেল। বলটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল জিম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কিছু। লাভ হল না।
জিম বলল কথা বলবে না ওটা। অনেক সময় পয়সা না দিলে মুখ খোলে না বলটা। বললাম ওকে একটা পুরনো ঘষা সিকি আছে আমার কাছে। তবে চালানো যাবে না, চটা উঠে ভেতরের তামা বেরিয়ে পড়েছে। অবশ্য আগেই ঠিক করেছিলাম, জাজ সায়েবের কাছ থেকে যে ডলারটা এনেছি, সেটার কথা বলব না জিমকে।
সিকিটা মেকি, বললাম আমি, তবে চুলের ওই বলটাতো আর তা বুঝতে পারবে না।
সিকিটা শুঁকে দেখল জিম, দাঁত দিয়ে একটু কামড়াল। একটু ঘষল, তারপর বলল, এতেই চলবে। আরও জানাল, কাঁচা আইরিশ আলু কেটে তার ভেতর পুরে রাখবে পয়সাটা। পরদিন কেউ ধরতেই পারবে না যে সিকিটা অচল। ফলে শহরের যে-কেউ ওটা নিয়ে নেবে-চুলের কল তো কোন ছার।
আমি অবশ্য জানতাম, আলুতে এরকম কাজ হয়; তবে ভুলে গিয়েছিলাম সেটা।
সিকিটা চুলের বলের নিচে রাখল জিম। কান পেতে কিছু শুনল, তারপর বলল, তোমার বুড়ো বাপ এখনও জানে না কী করবে সে। একবার বলছে থাকব। আবার বলছে, চলে যাব। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে, ওই বুড়ো মানুষটাকে তার নিজের মতই চলতে দাও। দুটো জ্বিন তার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা সাদা ঝকঝকে, অন্যটা কালো। হুঁ, সাদাটা তাকে ঠিক পথে চালাতে চায়। আর কালোটা সব ফুসমন্তর দেয়। শেষ অবধি কী হয় বলা মুশকিল।
তবে তোমার চিন্তা নেই। তুমি জীবনে অনেক কষ্ট পাবে, আবার আনন্দও পাবে প্রচুর। দুটো মেয়ে আসবে তোমার জীবনে। একটা ফরসা, অন্যটা শ্যামলা। একটা ধনী, আরেকটা গরিব। প্রথমে ওই গরিবটাকে বিয়ে করবে তুমি। পরে ধনীকে। আর যতটা পার, ঝামেলা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে, কারণ, যা দেখা যাচ্ছে, ফাসি লেখা আছে তোমার কপালে।
এরপর নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে মোমবাতি ধরালাম। দেখি, বাবা বিছানায় বসে, অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। খোলা জানলা-পথে ঢুকে পড়েছে ঘরে। বাবাকে আমি সব সময়েই ভয় করতাম। কারণ আমাকে খুব মেরামত করত সে। অনুভব করলাম, তাকে এখানে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছি। পরমুহূর্তে বুঝলাম, ওটা আমার মনের ভুল। আসলে হঠাৎ দেখে প্রথম ধাক্কায় দম বন্ধ হবার জো হয়েছিল, এখন সেটা নেই।
বাবার বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। দেখতেও সেরকম। চুল লম্বা, জট পাকান তেলচিটে। ঝুলে পড়েছে কাঁধ অবধি। চোখজোড়া চকচক করছে, যেন পাকা টুসটুসে আঙুর। ইয়া কাঁচা-পাকা গোঁফ। মাছের পেটের মত ফরসা মুখ; তাতে দাড়ির জঙ্গল। দেখলেই গা শিরশির করে ওঠে, কুঁকড়ে আসতে চায় শরীর। পরনের কাপড় শতছিন্ন, ময়লা।
পায়ের ওপর পা তুলে বসে ছিল বাবা। বুটের ডগাটা ফাটা, ভেতর থেকে উঁকি মারছে একজোড়া আঙুল। থেকে থেকে আঙুল দুটো নিয়ে খেলা করছে সে। টুপিটা পড়ে আছে মাটিতে। কালো, বিদঘুটে একটা জিনিস; ওপরটা গুহার মত, টোপ খাওয়া। কেমন বোঁটকা একটা গন্ধ আসছে তার গা থেকে।
মোমের আলোয় আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল বাবা। হুঁম! ইস্তিরি করা জামাকাপড় পরা হয়েছে, বলল। ভালো-কী মনে কর নিজেকে, কেউকেটা, আঁ? আবার শুনি লেখাপড়াও শিখহুঁ। ওরে আমার শিক্ষিত রে! কে বলেছে এই আহাম্মকি করতে? কার বুদ্ধি এটা?
বিধবার।
অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে কে বলেছে তাকে?
কেউ না, কেউ বলেনি।
বেশ। পরের ব্যাপারে বা-হাত দেয়ার মজা তাকে বোঝাব আমি। আর দ্যাখ, বাপু, তুমি ওই ইশকুল ছাড়। শুনছ, ফের যেন ওখানে ঘুরঘুর করতে না দেখি তোমায়। মরার আগে পর্যন্ত তোমার মা লেখাপড়া জানত না। গুষ্টির কেউ কোনদিন ওই কম্মোটি করেনি। আর তুমি কিনা এখানে থেকে বিদ্যের জাহাজ হয়ে উঠছ! দেখি, কেমন পড়তে পার।
একটা বই নিয়ে জেনারেল ওঅশিংটন সম্পর্কে কিছু পড়তে শুরু করলাম। আধ মিনিট মত পড়েছি; খপ করে হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল বাবা। ছুড়ে ফেলল ঘরের আরেক মাথায়।
হুঁ, এইত দেখছি পড়তে পার, বলল বাবা। এবার শোন। ফের ওমুখো হয়েছ কি পিটিয়ে তোমার ছাল তুলে নেব।
খানিক বাদে আবার গজগজ করতে লাগল সে। বলল, বেশ ফুলবাবু হয়ে উঠছ দেখছি। বিছানায় চাদর, আয়না, মেঝেতে কার্পেট-আর, ওদিকে তোমার বাবা ঘুমায় শুয়োরপালের সাথে। বাহ্! এমন ছেলে জন্মেও দেখিনি। শুনলাম, মস্ত বড়লোক হয়ে গেছ তুমি। সত্যি?
না, মিছে কথা।
দ্যাখ, ছোকরা, ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। দুদিন হল শহরে এসেছি, সবাই তোমার বড়লোক হবার কথা বলছে। সেজন্যেই এসেছি আমি। কাল ওই টাকা আমাকে এনে দেবে তুমি।
আমার কাছে টাকা নেই।
মিথ্যে কথা। জাজ থ্যাচারের কাছে আছে তোমার টাকা। ও টাকা আমার চাই।
বলছি তো নেই। জাজ থ্যাচারকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে, উনিও একথাই বলবেন।
বেশ, জিজ্ঞেস করবখন। এখন বল, তোমার পকেটে কত আছে? মোটে এক ডলার। ওটা দরকার…
চোপ! দে…
ডলারটা নিয়ে বিদায় হল বাবা। যাবার আগে বলে গেল, মদ গিলতে শহরে যাচ্ছে।
০৪. পরদিন বেহেড মাতাল অবস্থায়
পরদিন বেহেড মাতাল অবস্থায় জাজ থ্যাচারের কাছে গেল বাবা। টাকা দাবি করল, চোখ রাঙাল। কিন্তু চিড়ে ভিজল না, টাকা দিলেন না জাজ। তখন আদালতে যাবার হুমকি দিল বাবা; বলল, আইনের সাহায্যে জোর করে আদায় করবে টাকা।
আমার ব্যাপারে আদালতের শরণ নিলেন জাজ থ্যাচার আর ওই বিধবা, তাদের কাউকে যেন আমার অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আদালতের বিচারক ভদ্রলোকটি ছিলেন নতুন, সদ্য এসেছেন। বুড়োর স্বভাব-চরিত্র জানতেন না কিছু। ফলে, আমাকে বাবার কাছছাড়া করতে রাজি হলেন না তিনি।
এতে মহা খুশি বাবা, অ্যাদ্দিন মনে শান্তি ছিল না তার। আমাকে এসে বলল, তাকে কিছু টাকা এনে না দিলে মেরে লাশ করে দেবে আমাকে। অগত্যা জাজ থ্যাচারের কাছ থেকে ধার করে তিন ডলার এনে দিলাম। টাকাটা নিয়ে দেদার মদ গিলল সে, তারপর রাত দুপুর অবধি শহরময় মাতলামি করে বেড়াল। এজন্যে তাকে এক হপ্তা গারদে পুরে রাখল ওরা। কিন্তু বাবা নির্বিকার: ছেলের হর্তাকর্তা হতে পেরে তার নাকি ফুর্তি করার শখ চেপেছিল।
হাজত থেকে বেরুবার পর তাকে মানুষ বানানোর দায়িত্ব নিলেন জাজ থ্যাচার। নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন বাবাকে। এমন ব্যবহার করলেন তার সাথে যেন ছেলেবেলার ইয়ার। মদ খেতে বারণ করলেন। এক পর্যায় কেঁদে ফেলল বাবা। বলল, এতকাল বোকার মত কাজ করেছে। এবার নতুন করে জীবন শুরু করবে, যাতে তাকে নিয়ে আর কাউকে মুখ-খাওয়া হতে না হয়। বাবার কথা শুনে জাজ থ্যাচার আর তার স্ত্রীর চোখেও পানি এল। মিসেস থ্যাচার তার হাতে চুমু খেলেন। জীবনে আর কখনও খারাপ কাজ করবে না, এই মর্মে একটা হলফনামায় সই করল বাবা।
তারপর বুড়োকে ওই বাড়িরই একটা সুন্দর কামরায় নিয়ে গেলেন ওঁরা। সেখানে তার আরামের বন্দোবস্ত করলেন। রাতে ভয়ানক তেষ্টা পেল বাবার। জানালা দিয়ে গাড়ি-বারান্দার ছাতে নামল, সেখান থেকে থাম বেয়ে নেমে গেল নিচে। পরনের নতুন কোর্তাটার বিনিময়ে একটা দশসেরি মদের পিপে কিনে আবার পিলার বেয়ে ফিরে এল ঘরে। ভোর রাতে নেশায় বুদ হয়ে আবার বেরোল বাবা। কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে হুঁড়মুড় করে গাড়ি বারান্দা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে। বাঁ-হাতের দু জায়গায় ভেঙে গেল। বরফে জমে আর একটু হলেই মারা যেত, সূর্য ওঠার পর তাকে একজন দেখতে পেয়েছিল তাই রক্ষে।
একটু বাদেই আবার চাঙা হয়ে পাগলামি শুরু করল বাবা। জাজ থ্যাচারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যে কোর্টে গেল। আমাকেই ধরার চেষ্টা করতে লাগল, কেন আমি ইশকুল ছাড়ছি না-এ-ই তার রাগ। বার দুই বাগে পেয়ে ভীষণ পেটাল আমাকে। আগে ইশকুলে যেতে ভাল লাগত না। কিন্তু মার খেয়ে রোখ চেপে গেল, রোজ যেতে লাগলাম। কোর্টের ব্যাপার-স্যাপার বড্ড শামুকের গতিতে চলে, বাবার মামলাটা শুরু করবার মত চাড় দেখা গেল না কারও। ফলে, মাঝে-মধ্যেই ধার করে দু-তিন ডলার এনে দিতে হয় তাকে। না-দিয়ে উপায় নেই, চাবুকপেটা করে আমাকে। টাকা পেয়েই মদে চুর হয় বাবা। তারপর মারমুখী হয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা শহরে। এজন্যে বারকয়েক হাজতেও গেল।
ইতিমধ্যে শীত চলে গিয়েছে, এখন বসন্ত। গাছে-গাছে নতুন পাতা; ফুল ফোটেনি, তবে ফুটি-ফুটি। একদিন আমাকে পাকড়াও করল বাবা। একটা ছোট্ট ডিঙিতে চড়ে মাইল তিনেক দূরের এক জঙ্গলে গিয়ে উঠল। জায়গাটা নদীর যে তীরে ইলিনয়, সেইদিকে। সেখানে একটা পুরোন কাঠের কেবিনে কয়েদ করে রাখল আমাকে। চারিধারে গভীর বন। পথের হদিস না-জানলে বের করতে পারবে না কেউ।
বাবার একটা বন্দুক ছিল; বোধহয় চুরি করা। ওটা দিয়েই শিকার-টিকার করে খাচ্ছি। এভাবে কাটল কিছুদিন। পরে অবস্থা এমন হল, আমাকে আটকে রেখে বাবা রোজই চলে যায় নদীর ধারে তিন মাইল দূরে যে-ফেরিগুদামটা আছে, সেখানে। খাবারের বদলে মদ কিনে আনে। তারপর মাতাল হয়ে আমাকে ধোলাই দেয়। কীভাবে খোঁজ পেল জানি না, আমাকে নিতে লোক পাঠাল বিধবা। বন্দুক হাতে বাবা তাড়া করল তাকে।
ধীরে ধীরে ওখানকার জীবন সয়ে এল আমার: কাজ-কাম নেই, গা ঢিলে দিয়ে চলা। খাও-দাও আর ফুর্তি করো। দুমাস কিংবা তারও বেশি হবে, দাখ-দ্যাখ করে। চলে গেল যেন। কাপড়চোপড় ছিড়ে-ছুটে গেছে, চিতি পড়ে গেছে ময়লায়। বিধবার ওখানে আঁটসাট জীবন কী করে যে ভাল লাগত, ভাবতেই অবাক লাগে এখন। আমার আর ফিরে যাবার ইচ্ছে নেই। গাল দেয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম, বিধবা পছন্দ করত না, আবার ঝালাই করলাম সেটা। বাবারও এতে আপত্তি হল না কোন।
বনে-বাদাড়ে সময় আমার ভালই কাটছিল, কিন্তু বাবার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। রোজই আমাকে আটকে রেখে চলে যায়। একবার তো তিনদিন ফিরল না। আমার সাংঘাতিক একলা মনে হতে লাগল নিজেকে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই ডুবে মরে গেছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, আর বুঝি বেরোতে পারব না ওখান থেকে। স্থির করলাম, যেভাবেই হোক পালাতে হবে। এর আগেও কয়েকবার ওই ঘর থেকে বেরুর চেষ্টা করেছি, পথ পাইনি। বড় জানালা নেই যার ভেতর দিয়ে একটা কুকুর গলতে পারে, আমি তো কোন ছার! চিমনি-পথে পালানোও সম্ভব নয়, খুবই সরু। দরজার পাল্লাগুলো যেন গাছের গুড়ি, ওক কাঠের তৈরি।
বাবা খুব সেয়ানা, বাইরে যাবার সময় একটা চাকুও রেখে যায় না ঘরে। এই ব্যাপারে তার কড়া খেয়াল। বেশ মনে আছে, তন্নতন্ন করে না-হলেও একশ বার খুঁজেছি। আমার সময়, ধরতে গেলে, ওই করেই কাটছিল। জোর বরাত, একটা পুরোন করাত পেয়ে গেলাম একদিন-মরচেপড়া, হাতলবিহীন। ছাতের কড়িকাঠের ভেতর লুকোন ছিল করাতটা।
তেল দিয়ে সাফ করলাম ওটা। কেবিনের শেষ মাথায়, একটা টেবিলের পেছনে দেয়ালের সাথে পেরেক দিয়ে একখানা কম্বল সাঁটা ছিল। কাঠের ফাঁক দিয়ে বাতাসের ঝাপটায় যেন মোমবাতি নিভে না যায়, সেজন্যে এই ব্যবস্থা। গুড়ি মেরে টেবিলের তলায় ঢুকলাম আমি, কম্বলের একটা পাশ তুলে করাত চালিয়ে ফাঁকটা বড় করতে লাগলাম, কোনমতে যাতে ওই ফোকর গলে বেরুন যায় ওখান থেকে। সময়সাপেক্ষ কাজ; প্রায় শেষ করে এনেছি, এমন সময় কানে এল বাবার বন্দুকের আওয়াজ।
করাতটা লুকিয়ে ফেললাম চট করে। কম্বলটা আবার আগের জায়গায় রেখে নিশ্চিত হলাম, আমার কীর্তির আলামত দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বাবা এসে ঢুকল। তিরিক্ষে মেজাজ। উকিল জানিয়েছে মামলায় তার জেতার সম্ভাবনা আছে, বলল সে, কিন্তু এসব কাজ ঢিমেতালে কীভাবে চালাতে হয়, জাজ থ্যাচার তা ভালই জানেন। তাছাড়া, আমাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে বিধবাও নাকি মামলা ঠুকতে পারে।
শেষের কথাটায় মন খুঁতখুঁত করতে লাগল আমার। কারণ, আর সবার মত জবুথুবু হয়ে সভ্য হবার ইচ্ছে আমার নেই।
আমাকে ডিঙির কাছে নিয়ে গেল বুড়ো। সেখানে এক বস্তা ময়দা, কিছু মাংস, চার গ্যালনের এক বোতল মদ আর গোলা-বারুদ ছিল। ওগুলো কেবিনে নিয়ে এলাম আমি।
রাতে খাবার পর ফের মদ গিলতে শুরু করল বাবা। আর ঘণ্টাখানেক বাদেই বদ্ধ মাতাল হয়ে যাবে বুড়ো, মনে মনে বললাম, চাবিটা চুরি করে তখনই চম্পট দেব।
এক সময় বিছানায় ঢলে পড়ল বাবা। তবে আমার কপাল খুলল না; ঘুমোয়নি গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝেতে, গোঙাচ্ছে অস্ফুট স্বরে। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল আমার, হাজার চেষ্টাতেও খুলে রাখতে পারলাম না। আমি কী করব, তা ঠিক করার আগেই ডুবে গেলাম ঘুমের অতলে। বাতিটা জ্বালানোই রইল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ চিৎকার শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। হিংস্র হয়ে উঠেছে বাবা, চোখজোড়া ভাটার মত জ্বলছে, ছুটোছুটি করছে ঘরময়।
সাপ! সাপ! চেঁচিয়ে উঠল সে। তাড়া করছে আমাকে! উফ, কামড়ে দিয়েছে। গালে!
কোন লোককে এতটা হিংস্র হতে আমি আর দেখিনি। এভাবেই চলল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল বাবা, হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। চারিদিক ভীষণ নিঝুম। দূর-বনে পেঁচা ডাকছে, একটা নেকড়ের ডাক ভেসে এল। গা ছমছম করে উঠল আমার।
হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল বাবা, বুনো দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। আমার দিকে চোখ পড়তেই তেড়ে এল; হাতে ছুরি।
তোকে চিনি, চেঁচিয়ে উঠল সে, তুই আজরাইল। আমার জান কবচ করতে এসেছিস। পারবি না, আমি-ই আগে শেষ করব তোকে।
বাবা, আমি হাক, কেঁদে ফেললাম। দেখতে পাচ্ছ না তুমি, বাবা, আমি হাক।
কলজে-কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়ল বাবা। ভয়ে আমার পিলে চমকে গেল। বাবা ধেয়ে এল আমার দিকে। খপ করে পেছন থেকে চেপে ধরল কোটের কলারটা। মনে হল, এক্ষুনি বুঝি মরে যাব। বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে, বাউলি কেটে কোটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণ বাঁচালাম।
একটু বাদেই ঝিমিয়ে পড়ল বাবা, দরজায় ঠেস দিয়ে পড়ল চুপ করে।
দাঁড়া, জিরিয়ে নেই এক মিনিট, তারপর খুন করব তোকে, হুমকি দিল। ছুরিটা নিজের কাছেই রাখল। ঘুম থেকে উঠে বোঝাব মজা।
আস্তে আস্তে ঝিমুতে লাগল বাবা। আমি পা টিপে টিপে চেয়ারের ওপর উঠে বন্দুকটা পাড়লাম। পরখ করে দেখলাম টোটা ভরা কি-না। বাবার দিকে তাক করে গাজরের পিপেটার ওপাশে বসে পড়লাম। অতি ধীর লয়ে বয়ে চলল সময়।
০৫. পিটপিট করে তাকালাম
অ্যাই, হাক! ওঠ, হতচ্ছাড়া!
পিটপিট করে তাকালাম; চারপাশে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, আমি কোথায়। রোদে স্নান করছে ঘর; অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি, মরার মত। বাবা আমার উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কিছুটা অসুস্থ দেখাচ্ছে।
বন্দুক দিয়ে কী করছিলি? জিজ্ঞেস করল।
কাল রাতের কথা, অনুমান করলাম, মনে নেই তার। বললাম, রাতে কেউ ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তাই খাপ পেতে বসেছিলাম।
আমাকে ডাকিসনি কেন?
ডেকেছি, তুমি ওঠনি।
হুঁম! তো আর বাজে না বকে বাইরে গিয়ে দ্যাখ চারে মাছ-টাছ কিছু পড়ল কি-না। নাস্তা খেতে হবে। আমি এই এলাম বলে।
দরজা খুলে দিল বাবা। নদীর ধারে গিয়ে দেখি পানি বাড়তে শুরু করেছে। হরেক রকমের জিনিস গাছের ডাল, ছাল-বাকল ভেসে আসছে স্রোতের টানে। এখন শহরে থাকলে কী মজা-ই না হত। জুন মাসে বানের সময় প্রতিবারই কপাল খুলে যায় আমার। বড় বড় কাঠের টুকরো কিংবা ভেলা ভেসে আসে জোয়ারে। আমার কাজ কেবল ওগুলো ধরে ধরে ওই লাকড়ির দোকান, বা করাতকলে বিক্রি করা।
তীর ধরে হাঁটছি; একটা চোখ বুড়োর পথের দিকে, কখন আবার এসে পড়ে। অপরটা রইল নদীর দিকে, যদি কিছু ভেসে আসে নেবার মত। হঠাৎ দেখি, একটা ডিঙি ভেসে আসছে। সুন্দর দেখতে, তের চোদ্দ ফুটের মত লম্বা। রাজহাঁসের মত দুলছে ঢেউয়ের মাথায়। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি, ডিঙিটা ধরে লুকিয়ে রাখলাম ঝোপের ভেতর। একবার ভাবলাম বাবাকে দেখাব ডিঙিটা। ওটা দেখলে ভারি খুশি হবে বুড়ো-কমপক্ষে দশ ডলারে বিকোবে ডিঙিটা। পরক্ষণেই বিদ্যুচ্চমকের মত একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায় পালাবার সময় কাজ দেবে ওটা। ডিঙিতে চেপে পঞ্চাশ মাইল ভাটিতে গিয়ে আড্ডা গাড়ব কোথাও। তাহলে আর মিছেমিছি হেঁটে মরতে হবে না আমাকে। ডিঙিটা যেখানে লুকোলাম, সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় আমাদের কেবিন। একটা উইলো ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিলাম সেদিকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা পাখির দিকে বন্দুক তাক করছে বাবা। হাঁফ ছেড়ে বাচলাম, কিছুই দেখতে পায়নি বুড়ো। তাকে আসতে দেখে ছিপ হাতে মাছ ধরার ভান করলাম। আলসে বলে আমাকে বকাঝকা করল বাবা। বললাম, নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম, সেজন্যে দেরি হল এত। তাছাড়া, আমি জানতাম, আমার ভিজে জামাকাপড় দেখে নানা প্রশ্ন করবে বাবা। পাঁচটা মাঝারি সাইজের মাছ ধরে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা।
নাস্তার পর দুজনেই শুয়ে পড়লাম একটু ঘুমিয়ে নিতে, ক্লান্তি ভর করেছে আমাদের। শুয়ে-শুয়ে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কী ভাবে পালান যায়। এমন একটা ফিকির বের করতে হবে যাতে, আমার অনুপস্থিতি বাবা আর ওই বিধবা টের পাবার আগেই, বহুদূরে পালিয়ে যেতে পারি।
একটু বাদেই উঠে আর এক ব্যারেল পানি খেল বাবা। তারপর আমার দিকে ঘুরে বলল, ফের যদি কাউকে ঘুরঘুর করতে দেখিস এখানে, আমাকে ডাকবি। বুঝলি? ব্যাটা বিনা মতলবে আসেনি। ধরতে পারলে ওকে গুলি করব আমি। কথা শেষ করে শুয়ে নাক ডাকতে লাগল বাবা। চকিতে আশার আলো দেখতে পেলাম তার কথায়। এবার, আপনমনে বললাম, এমনভাবে জাল গোটাব যে আমার পিছু নেয়ার কথা চিন্তাও করবে না কেউ।
দুপুর বারটা নাগাদ আবার নদীর ধারে গেলাম আমরা। জোয়ারে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে পানি। প্রচুর কাঠের টুকরো ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। এক সময় কাঠের গুড়ির তৈরি ভেলাও ভেসে এল। নটা গুঁড়ি একত্রে বাধা। ভেলাটাকে তীরে নিয়ে এলাম আমরা। তারপর কেবিনে ফিরে দুপুরের খাওয়া সারলাম। বাবার জায়গায় আর কেউ হলে সারাদিন নদীর পারে বসে থাকত আরও জিনিস পাবার আশায়। কিন্তু সেটা ওর ধাতের বাইরে। একযাত্রায় নটা গুড়িই ঢের। এবার ওগুলো শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মদ গিলবে সে। তা-ই হল, বেলা সাড়ে তিনটের দিকে আমাকে আটকে রেখে রওনা হয়ে গেল বাবা। অনুমান করলাম, আজ রাতে আর ফিরছে না। বাবা রওনা হওয়া মাত্র কাজে নামলাম আমি। দ্রুত করাত দিয়ে কেটে দেয়ালের সেই ফাঁকটাকে বড় করলাম। তারপর সেখান দিয়ে গলে বাইরে এলাম। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দূরে একটা বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে বাবার ভেলাটা।
এবার ধীরে ধীরে প্ল্যানমাফিক এগুতে লাগলাম। প্রথমে এক বস্তা ভুট্টার ছাতু নিয়ে গেলাম লুকোনো ডিঙিটার কাছে। ডাল, লতা-পাতা সরিয়ে ওটার ওপর রাখলাম বস্তাটা। পরের বার কিছু মাংস নিলাম। তারপর মদের জগ, এবং যতটা কফি আর চিনি ছিল, তার সবটুকুই নিলাম। এরপর খানিকটা ন্যাকড়া, একটা বালতি, লণ্ঠন, টিনের বাটিও নেয়া হল। কার্তুজ, করাত, দুখানা কম্বল, রান্নার বড় চামচ, কফির পাত্র—এগুলোও রেখে এলাম। ছিপ, বড়শি, ম্যাচ-সোজা কথায় এক পয়সাও দাম আছে যার এমন কোন জিনিসই বাদ রাখলাম না; নিয়ে নিয়ে খালি করে ফেললাম ঘরটা। এবার একটা কুড়োল দরকার। ঘরে নামমাত্র একটা ছিল; ওটাই বা রেখে যাই কেন, ভাবলাম। সব শেষে নিলাম বন্দুকটা।
ফোকরের ভেতর দিয়ে বারবার যাতায়াতের ফলে মেঝেটা ক্ষয়ে গিয়েছিল খানিকটা। তাই, যতটা পারা যায়, ধুলো মাটি দিয়ে সমান করলাম জায়গাটা। তারপর ফাঁকের মাঝে কাটা গুড়িটাকে খুঁজে খাঁজে বসিয়ে তলায় দুটো পাথর দিয়ে ছিপি এটে দিলাম, যাতে পড়ে না যায় গুড়িটা। এখন চার-পাঁচ হাত দূর থেকে হঠাৎ দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না, করাত দিয়ে কাটা হয়েছিল ওটা।
এরপর চারদিক ঘুরে ভালমত দেখলাম, আমার কোন ট্র্যাক রয়ে গেছে কি-না পেছনে। না, নেই। কেবিন থেকে ডিঙি পর্যন্ত মাটি ঘাসে ছাওয়া, অক্ষতই রয়েছে মাথাগুলো। চারিদিকে চেয়ে সবকিছু যখন নিরাপদ মনে হল, বন্দুক হাতে বনের ভেতর ঢুকলাম। পাখি শিকারের জন্যে ঘুরছি, আচমকা চোখে পড়ল একটা বুনো শুয়োর, কারো খোঁয়াড় থেকে পালিয়েছে হয়ত-বা।
শুয়োরটাকে মেরে নিয়ে এলাম কেবিনের কাছে। কুঠার দিয়ে তালা ভেঙে ওটাকে নিয়ে ঢুকলাম ঘরে। টেবিলের কাছে গিয়ে কুঠারের এক কোপে দুফাক করে ফেললাম শুয়োরটার গলা। মেঝের ওপর রক্ত চুয়ানোর জন্যে সেখানেই ফেলে রাখলাম ওটাকে। এবারে বড় বড় পাথরের টুকরো দিয়ে একটা বস্তা ভর্তি করে হেঁচড়ে নিয়ে গেলাম নদীর ধারে, তারপর পানিতে ফেলে দিলাম বস্তাটা। পাথরের ভারে তলিয়ে গেল ওটা। এখন দেখে মনে হবে কোনকিছু টেনে আনা হয়েছে মাটির ওপর দিয়ে। টম সয়্যার এসময়ে থাকলে ভাল হত। এসব ব্যাপারে, আমি জানি, ও খুউব চালু-তুলির শেষ আঁচড়টা দেয় চমৎকার।
এরপর আমার মাথার চুল ছিড়লাম এক গোছা। কুড়োলটায় আচ্ছাসে রক্ত মাখিয়ে তাতে আটকে দিলাম চুলগুলো। তারপর ঘরের পেছন দিকে এক কোণে ফেলে রাখলাম ওটা। শুয়োরটা এবার সরিয়ে ফেলতে হয়, ভাবলাম। কোটের ল্যাপেলের সঙ্গে ভাল করে চেপে ধরলাম ওটাকে, যাতে রক্ত নিচে পড়তে না পারে। হঠাৎ মেঝেতে এক টুকরো কাপড় চোখে পড়ল। ওই কাপড়টা দিয়েই রক্ত পড়া বন্ধ করলাম। তারপর শুয়োরটাকে নদীতে ফেলে এলাম।
এবার আরেকটা চিন্তা মাথায় এল। ফের ডিঙিতে গিয়ে ছাতুর বস্তা আর করাতটা নিয়ে এলাম ঘরে। করাত দিয়ে বস্তার তলায় একটা ছ্যাঁদা করলাম। তারপর বাড়ির পুবদিকে একশ গজ দূরে ঘাস ও উইলো ঝোপের ভেতর দিয়ে হ্রদের পাড়ে টেনে নিয়ে এলাম বস্তাটা। পাঁচ মাইল চওড়া হ্রদ। শীতের সময়ে হাঁসে পরিপূর্ণ থাকে। হ্রদের ওপাশ দিয়ে একটা খাল বা খড়ি অন্যদিকে চলে গিয়েছে। কোথায়, জানি না—তবে নদীতে নয়। ছাতুর গুড়ো ঝরে ঝরে হ্রদ অবধি যাবার একটা চিহ্ন তৈরি হয়েছে। বাবার শান দেবার পাথরটাও রেখে দিলাম ওখানে। দেখে মনে হবে কোন দুর্ঘটনায় হয়েছে অমনটা। তারপর ফুটোটা ভাল করে আটকে, করাতসহ, বস্তাটা আবার ডিঙিতে নিয়ে গেলাম।
ইতিমধ্যে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ডিঙিটাকে উইলো পাতা দিয়ে ঢেকে রেখে চাঁদ ওঠার অপেক্ষায় রইলাম। একফাকে খেয়ে নিলাম কিছু। তারপর ডিঙিতে শুয়ে পাইপ টানতে টানতে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলাম। বুঝতে পারছি, বস্তা-টানা চিহ্ন ধরে লোকজন নদীর তীরে আসবে, এবং জাল ফেলে আমার লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করবে। ছাত ঝরে যে-রাস্তাটা তৈরি হয়েছে সেটা ধরে হ্রদের দিকেও যাবে তারা। যে-ডাকাতেরা আমাকে মেরে মালসামান নিয়ে উধাও হয়েছে, তাদের ধরার জন্যে তোলপাড় করবে খাঁড়ি। নদীতে আমার লাশ ছাড়া অন্য কিছু খুঁজবে না ওরা। এবং অচিরেই ক্লান্ত হয়ে আমার ব্যাপারে চিন্তা করা ছেড়ে দেবে। এবং সবকিছু শান্ত হয়ে গেলে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারব আমি। জ্যাকসনের দ্বীপটা আমার জন্যে চমৎকার জায়গা। ওই দ্বীপ আমার চেনা; কেউ যায় না ওখানে। রাতে সেখান থেকে শহরে গিয়ে হাতের কাছে যা পাব নিয়ে আসব। হ্যাঁ, জ্যাকসনের দ্বীপই উপযুক্ত জায়গা।
দারুণ ক্লান্ত লাগছে, ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে উঠে মিনিট খানেকের জন্যে ঠাহর করতে পারলাম না কোথায় আছি। উঠে বসলাম। চারদিকে চেয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে স্মরণশক্তি ফিরে এল আমার। নদীটাকে মনে হল যোজনবিস্তৃত। থালার মত চাঁদ, পাড় থেকে কয়েক শ গজ দূর দিয়ে ভেসে যাওয়া কাঠের গুড়িগুলোকে গোনা যাচ্ছে অনায়াসে। চারপাশে সব নিঝুম, মৃত্যুর মত। আন্দাজ করলাম, অনেক রাত হয়েছে; বাতাসে যেন নিশুতি রাতের গন্ধ পেলাম।
একটু সময় নিয়ে হাতপায়ের খিল ছাড়িয়ে নিলাম। রওনা দেব এমন সময় একটা শব্দ ভেসে এল দূর থেকে। একটু বাদেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। ছোট ছোট খেপ মেরে বৈঠা চালানোর মত নিয়মিত একটা একঘেয়ে শব্দ। এরকম শব্দ গভীর রাতে স্পষ্ট শোনা যায়। উইলো ডালের আড়াল থেকে উঁকি মারলাম। একটা ডিঙি, এগিয়ে আসছে আড়াআড়িভাবে। ডিঙিটা কাছে আসতে দেখলাম মাত্র একজন লোক রয়েছে ওতে। মনে হল বাবা, যদিও তাকে আশা করিনি আমি। স্রোতের টানে আমার পেছন দিকে চলে গেল ডিঙিটা, তারপর আবার একটু একটু করে ঘুরে এগিয়ে আসতে লাগল তীরের দিকে। হ্যাঁ, বাবাই তো। বৈঠা চালানোর ধরন দেখে বুঝলাম মাথাটা শান্তই আছে তার।
আর সময় নষ্ট করলাম না আমি। পরমুহুঁর্তেই ঘুরে ভাটির দিকে নিঃশব্দে অথচ দ্রুত গতিতে আঁধারের ভেতর মিলিয়ে গেলাম। এভাবে আড়াই মাইল যাবার পর আবার চলে এলাম মাঝ নদীতে। কারণ তা না-হলে ফেরিঘাটের পাশ দিয়ে যেতে হবে, এবং ঘাট থেকে দেখতে পেয়ে লোকজন ডাকবে আমাকে। ভেসে যাওয়া তক্তাগুলোর কাছে চলে এলাম আমি। পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়ে ইচ্ছেমত চলতে দিলাম ডিঙিটাকে। চিৎ হয়ে শুয়ে নীরবে ধূমপান করতে লাগলাম। নির্মেঘ আকাশ, জোছনা রাতে গভীর আর বিরাট মনে হচ্ছে আকাশটাকে। এরকম রাতে কতদূর থেকে যে কথা শোনা যায় আগে জানতাম না। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ফেরিঘাটের কলরব। ক্রমে সেগুলো দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল।
এক সময় অনুভব করলাম ফেরিঘাট থেকে দূরে চলে এসেছি। উঠে বসলাম। অদূরেই দেখা যাচ্ছে জ্যাকসনের দ্বীপ। আড়াই মাইল দূরে, ভাটিতে। গাছপালায় ভরা, নদীর ভেতর দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপটা। বেশ বড়; ঘন অন্ধকারে ঢাকা। যেন বাতিহীন একখানা জাহাজ দাঁড়িয়ে। দ্বীপের সামনে বালিয়াড়ির কোন চিহ্ন নেই, পানির নিচে ডুবে রয়েছে।
অল্পক্ষণের ভেতর পৌঁছে গেলাম সেখানে। দ্বীপের মাথার দিকে স্রোতের টান খুব বেশি, তরতর করে চলে গেলাম আমি। পাড়ে নেমে ডিঙিটাকে একটা খাঁজের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। জায়গাটা আমার চেনা। ডিঙিটা বেঁধে উইলোর ডালপালা দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিলাম। এখন আর বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না ওটা।
এবার ওপরে উঠে দ্বীপের মাথায় একটা গুড়ির ওপর গিয়ে বসলাম। নদীর পানে চেয়ে দেখি, দুরে শহরের দিকে ভেসে যাচ্ছে কালো কাঠের টুকরোগুলো। মিটমিট করে জ্বলছে তিন-চারটে বাতি। মাঝ-দরিয়ায় একটা প্রকাণ্ড গুড়ির ভেলা, ভাটির দিকে ভেসে আসছে। ভেলাটার মাঝখানে লণ্ঠন জ্বলছে।
ডানদিকের ঘাটে ভেড়াও। ভেলা থেকে ভেসে এল একটা গলা। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে পুবের আকাশ। বনের ভেতর পা চালালাম আমি। সকালে নাস্তার আগে একটু ঘুম দরকার।
০৬. যখন ঘুম ভাঙল বেলা চড়ে গেছে
যখন ঘুম ভাঙল বেলা চড়ে গেছে। সূর্যের অবস্থান থেকে মনে হল আটটার বেশি হবে। ছায়ায় ঘাসের ওপর শুয়ে নানান চিন্তা এল মাথায়। বিশ্রামের পর বেশ হালকা আর ঝরঝরে লাগছে। চারদিকে বড় বড় গাছ, পাতার ফাঁক দিয়ে স্নান সূর্যের আলো এসে পড়েছে খানিকটা। মাটিতে ডালপালার ছায়াগুলো নড়ছে বাতাসে। ছোট্ট একটা ডালে বসে আছে একজোড়া কাঠবেড়াল। বেশ মিতালি ওদের মধ্যে। আমার দিকে তাকিয়ে কুট কুট করে কী যেন বলছে। আলসেমি লাগছে, উঠে গিয়ে নাস্তা বানাই ইচ্ছে করছে না। ঝিমুনি আসছে। হঠাৎ বুম্ বুম্ করে বিকট শব্দ ভেসে এল নদীর দিক থেকে। তন্দ্রার ভাবটা ছুটে গেল, কনুইয়ের ভরে কান পাতলাম। একটু বাদেই আবার ভেসে এল আওয়াজটা। ব্যাপার কী দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল মন, লাফিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। ডালপালার ফাঁক দিয়ে তাকালাম বাইরে। নদীর ওপর জায়গায় জায়গায় ধোঁয়ার মেঘ, যাত্রীবাহী একটা ফেরি নৌকো যাচ্ছে। বুঝলাম ঘটনাটা। ফের বুম্ করে শব্দ হল। ফেরির পাশ থেকে ভক্ করে বেরিয়ে এল খানিকটা সাদা ধোঁয়া। ওপর থেকে পানির ভেতর কামান দাগছে ওরা, যাতে আমার লাশ ভেসে ওঠে।
এদিকে দারুণ খিদে পেয়েছে আমার, কিন্তু আগুন জ্বালব তার উপায় নেই। ধোঁয়া দেখে ফেলবে ফেরির লোকেরা। তাই, বসে বসে কামান দাগা দেখতে লাগলাম। নদীটা ওখানে প্রায় মাইল খানেক চওড়া। ওদের খোঁজাখুঁজি বেশ উপভোগ করছিলাম আমি। আফসোস একটাই খাবার কিছু নেই। হঠাৎ একটা কথা। মনে পড়ল: আরে একটা রেওয়াজ আছে না কেউ ডুবে মরলে একটা পাউরুটির ভেতর পারদ পুরে ভাসিয়ে দেয়া হয় সেটা? লাশটা যেখানে ডুবে থাকে সেখানে গিয়ে থামে রুটি। দেখতে হয়, ভাবলাম মনে মনে, এরকম কোন রুটি ভেসে আসে কি-না। ভাগ্যপরীক্ষা করতে দ্বীপের যেদিকটায় ইলিনয়, সেদিকটায় গেলাম। নিরাশ হতে হল না। একটা বড় স্যান্ডউইচ ভেসে আসছে। লম্বা একটা লাঠি দিয়ে সেটাকে ধরবার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে পা ফসকে গেল আমার। রুটিটাও ভেসে চলে গেল বেশ খানিকটা দূরে। এদিকটায় স্রোতের বেগ বেশি, আমি জানি। একটু বাদে আরও একটা রুটি ভেসে এল। এবার আমিই জিতলাম। ছিপি খুলে ঝাঁকিয়ে বের করে দিলাম ভেতরের পারদটুকু। তারপর খাওয়া শুরু করলাম। ভাল কারিগরের তৈরি রুটি, মজা লাগল খেতে।
খাওয়া শেষে পাইপ ধরালাম। ঠিক করলাম, ওই নৌকোয় কারা আছে দেখব। ফেরিটা ভাটি বেয়ে আমার দিকে আসার আগেই শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে। ইতিমধ্যে নিবিয়ে ফেলেছি পাইপ।
আস্তে আস্তে স্রোতের তোড়ে পাড়ের কাছাকাছি চলে এল ফেরি। সাবধানে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিলাম। সব চেনা মুখ বাবা, জাজ থ্যাচার, জো হারপার, টম সয়্যার। খুনের ব্যাপারেই আলোচনা করছে সবাই।
এই দেখ, হঠাৎ ওদের কথার মাঝখানে বলল ক্যাপ্টেন, স্রোতটা এখানে তীব্র। এমনও হতে পারে স্রোত ওর লাশটা ঠেলে পাড়ে এনে ফেলেছে, এবং সে হয়ত নদীতীরের গাছপালার ভেতর আটকে রয়েছে। অন্তত আমার তা-ই ধারণা।
ডেকে ভিড় জমাল সবাই, ঝুঁকে দেখতে লাগল রেলিংয়ের ওপর দিয়ে। কারো মুখে কথা নেই, দৃষ্টি যতটা সম্ভব প্রখর করে দেখছে। গুড়ির আড়াল থেকে ওদের স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, তবে ওরা দেখতে পেল না আমাকে।
পিছে হটো! সুর করে বলল ক্যাপ্টেন। পরক্ষণেই কামান দাগার শব্দে কানে তালা লেগে গেল আমার। ধোঁয়ায় অন্ধ হয়ে গেল চোখ। মনে হল বুঝি খতম হয়ে গেছি। ভাগ্যিস গোলার ভেতর বুলেট নেই, নইলে ওরা যে-লাশটা খুঁজছে, সেটাই পেয়ে যেত হয়ত। হাঁফ ছেড়ে শোকর আদায় করলাম। ধীরে ধীরে দ্বীপের ওপাশ দিয়ে ঘুরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল ফেরি। দূর থেকে ভেসে আসছে তোপ দাগার আওয়াজ।
ক্রমে, এক ঘণ্টা পর, আর শুনতেই পেলাম না শব্দ। দ্বীপটা লম্বায় তিন মাইল। সম্ভবত শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে ওরা, ভাবলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, মিসৌরির দিকে যে-নালাটা বেরিয়ে গেছে, সেদিকে গোলা ফেলা হচ্ছে। তারপর এক সময় ক্ষান্ত দিয়ে সবাই ফিরে গেল যে যার বাসায়।
বুঝলাম, এবার আমি নিরাপদ। আর কেউ পিছু ধাওয়া করে আসবে না শিকারির মত। ডিঙি থেকে পোটলা-পুঁটলি নিয়ে এসে ঘন জঙ্গলে আস্তানা গাড়লাম। কম্বলগুলোকে তাঁবু বানিয়ে তার তলায় জিনিসপত্র রাখলাম। একটা ট্রাউট ধরে রান্না করে খেলাম। তারপর, সকালে নাস্তার জন্যে যদি কিছু মাছ মেলে এই আশায় একটা বড়শি পেতে রাখলাম নদীতে।
এইভাবে গেল তিনদিন আর তে-রাত্তির। কোন তফাত নেই, বাঁধা গৎ। চতুর্থ দিন নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায় ঘুরে দেখতে লাগলাম দ্বীপের চারদিক। এখন এই দ্বীপের মালিক আমি। এর সবকিছুই ধরতে গেলে আমার। তাই ভাল করে ওয়াকিফহাল হতে চাইলাম দ্বীপটা সম্পর্কে। আসলে আমার উদ্দেশ্য সময় কাটানো। অসংখ্য স্ট্রবেরি চোখে পড়ল। পাকা, টসটসে। গ্রীষ্মকালের কাঁচা আঙুর দেখলাম। রাজবেরিও আছে কিছু, কালো কালো জাম ধরতে শুরু করেছে সবে। হিসেব করে দেখলাম দরকারমত এগুলো এক এক করে পাওয়া যাবে হাতের কাছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে গভীর বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে এক সময় মনে হল দ্বীপের শেষ মাথায় এসে পৌঁছেছি। হাতে গাদা বন্দুকটা থাকলেও, কোন শিকার করিনি। এটা রেখেছিলাম, মূলত, আত্মরক্ষার জন্যে। ভাবলাম, তাঁবুর কাছাকাছি এসে কিছু শিকার করব। আরেকটু হলেই একটা সাপের ওপর পা পড়ত। আমার কপাল ভাল, সাপটা সরে গেল পেছনে, ঘাস আর ফুলের ভেতর দিয়ে চলে যেতে লাগল। আমিও সেটাকে গুলি করার জন্যে এগিয়ে গেলাম পেছন পেছন। শক্তহাতে বাগিয়ে ধরলাম বন্দুকটা। পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ক্যাম্পফায়ারের ছাইয়ের ওপর হঠাৎ পা পড়ল আমার। ছাইয়ের গাদা থেকে তখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে একটু একটু। ধড়াস করে উঠল বুকটা। বন্দুকের সেফটি ক্যাচ নামিয়ে দ্রুত পা-টিপে পালিয়ে এলাম। মাঝে দুএক জায়গায় থামলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। কান পাতলাম কিছু শোনার আশায়। কিন্তু আমার বুকের ধুকপুকানি ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না। গাছের কাটা গুঁড়ি দেখলেও মানুষ বলে ভুল হতে লাগল।
তাঁবুতে ফিরেও অস্বস্তির ভাবটা গেল না। পালাব, ঠিক করলাম মনে মনে। তাড়াতাড়ি মালপত্র ডিঙিতে তুললাম, যাতে সেগুলো চোখের আড়ালে থাকে। আমার জ্বালানো আগুনটা নিবিয়ে ছাইগুলো এমনভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিলাম যেন দেখে মনে হয় গত বছর কেউ এসে আস্তানা গেড়েছিল ওখানে। তারপর একটা গাছে চড়লাম। প্রায় দুঘন্টার মত কাটালাম সেখানে। কিছুই চোখে পড়ল না বা শুনলাম না। তবু মনে হল যেন শুনছি, দেখছি হাজারও জিনিস। এক সময় নেমে এলাম, ঝোপের আড়ালে বসে নজর রাখলাম চারপাশে।
সন্ধের ঠিক আগে চাগিয়ে উঠল খিদে। চাঁদ ওঠার আগেই কেটে পড়লাম সেখান থেকে। প্রায় পোয়া মাইল দূরে, ইলিনয় তীরের দিকে, বনের ভেতর ঢুকলাম। আগুন জ্বেলে খাবার তৈরি করলাম রাতের। ঠিক করলাম, ওখানেই কাটাব রাতটা। হঠাৎ কানে এল একটা খটর-খট শব্দ। ঘোড়া আসছে, সান্ত্বনা দিলাম মনকে। পরক্ষণেই মানুষের গলা শুনতে পেলাম। তাড়াতাড়ি সবকিছু ডিঙিতে নিয়ে রাখলাম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গলের ভেতর দেখার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কী। একটু যেতেই কানে এল একজন বলছে: আমরা এখানেই তাবু ফেলি। তারপর দেখব কোন ভাল জায়গা মেলে কি-না। ঘোড়াগুলোর দম তো প্রায় ফুরিয়ে গেছে।
আর অপেক্ষা করলাম না। ডিঙি নিয়ে ফিরে গেলাম সেই আগের জায়গায়, যেখানে প্রথম এসে নেমেছিলাম। ঠিক করলাম, নৌকোতেই ঘুমাব। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না।
দেখা দরকার দ্বীপে আমার সাথে আর কে আছে, বললাম আপনমনে। বৈঠা মেরে রওনা হলাম আবার। জলের ওপর চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে যাচ্ছে। ওপাশে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বনানী। কোথাও কোন প্রাণের আভাস নেই, কেবল বৈঠা বাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ঝিরঝির বাতাস বইছে। দ্বীপের শেষ প্রান্তে এসে তীরে নামলাম, জঙ্গলের ভেতর ঢুকে বসলাম একটা গুড়ির ওপর। তারপর উঁকি দিলাম ঘন পাতার ভেতর দিয়ে। চাঁদের পাহারা দেবার পালা শেষ হয়ে এসেছে, নদীটাকে কম্বলের মত ঘিরে ফেলছে অন্ধকার। একটু বাদেই গাছপালার মাথার ওপর দেখা দিল মরাটে আলো। বুঝলাম, ভোর হতে চলেছে। যেখানে নিভন্ত আগুন দেখেছিলাম, বন্দুক হাতে দৌড়ে গেলাম সেদিকে। পথে প্রতি দুএক মিনিট অন্তর থেমে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন শব্দই কানে এল না। হঠাৎ গাছের ফঁকি দিয়ে চোখে পড়ল একটা মৃতপ্রায় আগুন। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। একটা লোক মাটিতে শুয়ে আছে, মাথায় কম্বল জড়ান। দৃশ্যটা দেখে ভড়কে গেলাম। দেখে মনে হচ্ছে, আগুনের ভেতর পড়ে রয়েছে মাথাটা। ফুট দুই দূরে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে ইতি-উতি। একটু পরেই হাই তুলে হাত-পা ছড়াল লোকটা, মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলল কম্বল।
ওমা! এ যে দেখি মিস ওয়াটসনের চাকর, জিম! আরে, জিম? বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম ঝোপের আড়াল থেকে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল জিম, খ্যাপার মত চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর হাঁটু গেড়ে জোড়হাতে বলল, মেরো না আমাকে। কোন ভূতের ক্ষতি করিনি আমি। বরং মরা মানুষকে পছন্দ-ই করি। যাও, নদীতে ফিরে যাও তুমি।
আমি যে মরিনি, সেটা ওকে বোঝাতে সময় লাগল না বেশি। ওকে দেখে খুশিই হলাম বরং, দূর হয়ে গেল একলা ভাবটা। বললাম, আশা করি আমার কথা কাউকে বলবে না সে। নীরবে কথা শুনে যেতে লাগল ও।
কদ্দিন থেকে এখানে আছ, জিম? জিজ্ঞেস করলাম।
যেদিন তুমি খুন হলে তার পরের রাত থেকে। তুমি?
যেদিন খুন হলাম, সেই রাত থেকে।
এরপর নাস্তার জোগাড়ে বসলাম আমরা। একটা ট্রাউট ধরলাম আমি। জিম ভাজল। নাস্তা তৈরি হয়ে গেলে আধশোয়া অবস্থায় খেতে লাগলাম গরমগরম। গোগ্রাসে গিলতে লাগল জিম, ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল ও। খাওয়ার পর শুয়ে পড়লাম।
আচ্ছা, হাক, ওই রাতে তাহলে খুন হয়েছিল কে? প্রশ্ন করল জিম।
পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম ওকে। শুনে তারিফ করল। বলল, টম সয়্যারও নাকি এর চেয়ে ভাল ফন্দি আঁটতে পারত না।
তুমি এখানে এলে কেন, জিম? প্রশ্ন করলাম। আর এলেই-বা কীভাবে?
প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল জিম। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, বলব, যদি কাউকে না বল। আগে কথা দাও, হাক।
বলব না।
বেশ, করলাম বিশ্বাস। আমি…আমি পালিয়ে এসেছি।
বল কী, জিম!
হ্যাঁ। কিন্তু মনে রেখ, হাক, কথা দিয়েছ তুমি, কাউকে কিছু বলবে না।
না, বলব না। সত্যি বলছি। জানি, দাসপ্রথার বিরোধিতা করছি বলে লোকে খারাপ বলবে আমাকে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তাছাড়া, আমি তো আর ফিরে যাচ্ছি না ওখানে। এবার বল, কীভাবে পালালে।
জিম জানাল, ওর মনিব, মিস ওয়াটসন, খুব খারাপ ব্যবহার করত ওর সাথে। একদিন রাতে বাড়ি ফিরে ও শোনে, এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে ওকে বিক্রি করার মতলব এটেছে বুড়ি। আটশ টাকায়, অরলিয়ন্সে। সে-রাতেই পালিয়েছে ও। রাতটা কাটিয়েছে নদীর পাড়ে যে-ভাঙা দোকানঘরটা আছে, সেখানে। পরের সকালটাও ওখানেই ছিল। পথচারীদের ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথায় বুঝতে পেরেছে আমি খুন হয়েছি। খবরটা শুনে দারুণ দুঃখ পেয়েছিল ও। তবে এখন, আমি বেঁচে আছি দেখে, আর খারাপ লাগছে না। বেলা ডোবার পর মাইল দুই হেঁটে নদীতে নামে। একটা ভেলা চোখে পড়ায় সাঁতরে সেটায় গিয়ে ওঠে। ওর বরাত মন্দ, লোক ছিল ভেলাতে। সে পেছনে আসার উপক্রম করতেই চুপিসারে ফের পানিতে নেমে পড়ে ও। তারপর বহু কষ্টে সাঁতরে উঠেছে এখানে এসে। সেই থেকে ফলমূল খেয়ে আছে, আর কিছু পেটে পড়েনি।
কথা চলছে, এমন সময় উড়ে এল কয়েকটা পাখির বাচ্চা। বাচ্চাগুলো একবার উঠছে, একবার নামছে। জিম বলল বৃষ্টি হবে। এটা তারই চিহ্ন। যখন মুরগির বাচ্চা অমনভাবে ওড়ে, তখন নাকি বৃষ্টি হয়। সুতরাং পাখির বাচ্চা যখন ওভাবে উড়ছে তখন, ওর ধারণা, তা-ই হবে। পাখিগুলো ধরতে গেলাম আমি, বাধা দিল জিম। বলল, এর অর্থ মৃত্যু। ওর বাবা একবার খুব অসুখে পড়েছিল, সেসময় ওদের এক আত্মীয় নাকি একটা পাখি ধরেছিল। সেই দেখে ওর বুড়ি দাদি বলেছিল, জিমের বাবা মারা যাবে। আর সত্যি সত্যিই মারা যায় সে।
দ্বীপের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে একদিন গুহা আবিষ্কার করলাম আমরা। একটা পাহাড়ের ওপরে গুহাটা, আয়তনে তিন-চারটে বড় কামরার সমান। গুহার ভেতরটা ঠাণ্ডা। আমাদের মালপত্র সরাসরি ওখানে এনে রাখার পক্ষে মত দিল জিম। কিন্তু আমি রাজি হলাম না, কারণ সব সময় ওই রকম বেয়ে ওঠানামা সইবে না আমার ধাতে।
জিম যুক্তি দেখাল। বলল, এতে লাভ আছে। দ্বীপে কেউ এসে আমাদের খোঁজ করলে, ওখানে এসে লুকোতে পারব আমরা। তাছাড়া, সেই পাখির ছানাগুলো যেভাবে উড়ছিল তাতে ওর ধারণা, বৃষ্টি হবেই। সেক্ষেত্রে ভিজে যাবে জিনিসপত্র।
ফিরে গেল সে। বৈঠা মেরে ডিঙিটাকে এনে রাখল গুহা বরাবর। টেনে টেনে সব মাল নিয়ে এল গুহায়। তারপর নৌকোটা লুকিয়ে রাখতে উইলো ঝোপের ভেতর একটা জায়গা খুঁজে বের করলাম আমরা।
সন্ধে নাগাদ ঘোর হয়ে এল চারদিক। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল ঘন ঘন। পাখির বাচ্চা ওড়ার ব্যাপারটা তো তাহলে ঠিক, ভাবলাম। একটু পরেই শুরু হল বৃষ্টি, ঝেঁপে। এত জোর-বাতাস কখনও দেখিনি আমি।
শুরু হল ঝড়ের মাতম। ক্রমশ গাঢ় হয়ে এল অন্ধকার, কালচে নীল হয়ে গেল আকাশ। ভারি সুন্দর লাগছে। পাহাড়ের গায়ে জোর ঝাপটা মারছে বৃষ্টি; আবছা দেখা যাচ্ছে অদূরের গাছপালা, যেন মাকড়সার জাল। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় নুয়ে যাচ্ছে মাথাগুলো, তখন স্পষ্ট চোখে পড়ছে পাতার নিচের ফ্যাকাসে অংশ। পরক্ষণেই এক-একটা ঝটকা বাতাস এসে ডালপালা এমনভাবে ওলটপালট করছে যে মনে হচ্ছে, সেগুলো আকাশে হাতপা ছুঁড়ে নাচছে পাগলের মত।
জিম, দ্যাখ, কী সুন্দর! বললাম। আর কোথাও যাবার একটুও ইচ্ছে নেই আমার।
সারা রাত চলল বৃষ্টি। জোয়ারের পানিতে ফুসে উঠল নদী, পাড় ছাপিয়ে গেল। ভেসে গেল দ্বীপের নিম্নভাগ। তবে যে-দিকে মিসৌরি, সেদিকটা ডুবল না; পাড় সেখানে খাড়া, পাহাড়ের মত।
বানের পানিতে ভেসে এল নানা ধরনের জিনিস; পাখির ছানা, খরগোশও ছিল তার ভেতর। ওগুলো ধরে ধরে গুহার ভেতর পালতে লাগলাম।
একদিন রাতে একটা ভাঙা ভেলা ধরলাম—বেশ মজবুত, পাইনতক্তার তৈরি। বার ফুট চওড়া, পনের-ষোল ফুট লম্বা; সমতল মেঝে, পানি থেকে ছ-সাত ইঞ্চি উঁচু।
আরেক দিন, ভোরের আলো ফুটবার ঠিক আগে, দেখতে পেলাম পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসছে একটা কাঠের কুঁড়ে, ভাঙাচোরা। ডিঙি বেয়ে সেখানে গিয়ে উঠলাম আমরা। একটা খাট, টেবিল, খান দুয়েক পুরোন চেয়ার আর কিছু আজেবাজে জিনিস ছড়িয়ে আছে ঘরের ভেতর। এক কোণে পড়ে আছে একটা লোক।
লোকটার কাছে গেল জিম। আরে, এ দেখছি মারা গেছে, হাক, বলল ও। পেছন থেকে গুলি করে মারা হয়েছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ো না। একটা পুরোন কাপড় দিয়ে লাশটা ঢেকে দিল ও। আমি তাকালাম না, ইচ্ছেও করছিল না।
ময়লা তেলচিটে অনেকগুলো তাস ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। গড়াগড়ি খাচ্ছে কয়েকটা মদের বোতল। দেয়ালময় কয়লা দিয়ে হিজিবিজি কী সব লেখা। দুটো পুরোন ময়লা সুতি কাপড়ও আছে দেখলাম। রোদ থেকে বাঁচার জন্যে একটা টুপি, আর মেয়েদের কিছু কাপড় ঝুলছে হুঁকে। সেগুলো এনে ডিঙিতে তুললাম—সময়ে কোন কাজে লেগে যেতে পারে। শোলার টুপি ছিল একটা, নিলাম সেটাও। কাজে লাগতে পারে এমন সব খুঁটিনাটি জিনিস-লণ্ঠন, কসাইদের চাপাটি, লেপ-কিছুই বাদ রাখলাম না।
ওখান থেকে ফেরার সময়ে দেখলাম দ্বীপ থেকে প্রায় পৌনে এক মাইল দূরে সরে এসেছি। এদিকে ভোরও হয়ে এসেছে। জিমকে ডিঙিতে শুইয়ে লেপ দিয়ে ঢেকে দিলাম। কারণ বসে থাকলে দূর থেকেও নিগ্রো বলে চেনা যাবে ওকে। আমি বৈঠা মেরে এগিয়ে গেলাম ইলিনয় তীরের দিকে। প্রায় আধ মাইল ঘুরে পৌঁছুলাম দ্বীপে।
০৭. নাস্তার পর কুড়িয়ে আনা মালপত্র ঘঁটতে বসলাম
নাস্তার পর কুড়িয়ে আনা মালপত্র ঘঁটতে বসলাম আমরা। যেসব কাপড় চোপড় এনেছিলাম সেগুলো দেখলাম নেড়েচেড়ে। পুরোন একটা কম্বল দিয়ে তৈরি ওভারকোটটার লাইনিংয়ের ভেতর পেলাম আটটা ডলার। জিম বলল ওর ধারণা, যে-লোকগুলো ওই কাঠের বাড়িটায় ছিল, তারা কোথাও থেকে চুরি করেছে কোটটা। কারণ, তারা ওই টাকার খবর জানলে রেখে যেত না। আমার ধারণা ওই লোকগুলোই ওই মৃত লোকটিকে খুন করেছে। কথাটা জিমকে জানাতে ও এই ব্যাপারে আলাপ করতে রাজি হল না। বলল, মরা লোকের ব্যাপারে কথা বলা ঠিক নয়, ওতে কপালে দুঃখ আসে।
তোমার মতে এটা আমাদের দুঃখ বয়ে আনবে, বললাম, কিন্তু, জিম, পরশু যখন সাপের চামড়া ধরেছিলাম আমি, তখনও তুমি বলেছিলে সাপের চামড়া হাত দিয়ে ধরলে কপালে দুঃখ আসে। এই কি তোমার সেই দুঃখের নমুনা? এই যে এত সব জিনিস খুঁজে পেলাম আবার উপরি এল আট আটটা ডলার, এ কেমন দুঃখ! আমি চাই, জিম, এমন দুঃখ যেন হররোজ আসে আমাদের জন্যে।
তুমি দেখ, বলল জিম, খারাপ কিছু একটা হবেই।
সত্যিই হল। যেদিন আমরা কথাটা আলাপ করেছিলাম, সেদিন ছিল মঙ্গলবার। শুক্রবার রাতে খাওয়াদাওয়ার পর পাহাড়ের ওপর দিকটায় ঘাসের ওপর শুয়ে আছি আমরা। তামাক শেষ হয়ে গিয়েছে দেখে গুহার ভেতর আনতে গেলাম আমি। গিয়ে দেখি একটা বিষাক্ত সাপ। সাপটাকে মেরে কুণ্ডলী পাকিয়ে জিমের কম্বলের পায়ের কাছে রাখলাম। এমন ভাবে রাখলাম যেন জ্যান্ত মনে হয় ওটাকে। ভাবলাম, জিম দেখলে ভারি মজার ব্যাপার ঘটবে। পরে ভুলে গেলাম সাপটার কথা। রাতে শোয়ামাত্রই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল জিম। লণ্ঠনের আলোয় দেখলাম ফণা তুলে আছে মরা সাপের সঙ্গীটা, আরেকবার ছোবল দেবার জন্যে তৈরি। চোখের পলকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে সাপটাকে খতম করলাম আমি। জিম তাড়াতাড়ি জগ থেকে মদ ঢালতে শুরু করল পায়ের ওপর।
খালি পায়ে ছিল ও, সাপটা কামড় বসিয়েছে গোড়ালিতে। এ সবই ঘটল আমার বোকামিতে। আমার মনে ছিল না, একটাকে মারলে তার সাথীও এসে হাজির হয় সেখানে। জিম বলল মাথাটা কেটে বাদ দিয়ে, সাপের চামড়া ছিলে তার একটা টুকরো ভেজে দিতে। এতে নাকি ভাল হয়ে যাবে সে। সাপ দুটো নিয়ে মাথা নিচু করে বাইরে এলাম আমি, ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দূরের ঝোপে। জিমকে বললাম না আমার দোষেই হয়েছে এসব।
চারদিন চাররাত বিছানায় পড়ে রইল ও। তারপর ফোলা ভাবটা চলে গেল। সাপের চামড়া আর কখনও ছোঁব না, মনে মনে শপথ করলাম আমি।
জিম সুস্থ হয়ে ওঠার পর একদিন সকালে বললাম, বড্ড এক ঘেয়ে কাটছে দিনগুলো। উত্তেজনা দরকার। নদীর ওপারে গিয়ে দেখে আসি, কেউ কিছু বলছে। কি-না আমাদের ব্যাপারে।
যাও, রাজি হল জিম। তবে রাতে গেলেই ভাল করবে। আর বেশিক্ষণ থাকবে না। এক কাজ কর, মেয়েলোকের ছদ্মবেশে যাও। ঠিকমত অভিনয় করতে পারলে, হাক, কেউ চিনতে পারবে না তোমাকে।
প্রস্তাবটা মনে ধরল আমার। ওই পুরোনো কাপড়গুলোর ভেতর কয়েকটা গাউন ছিল, তারই একটা কেটে ছোট করে নিলাম; পাজামার ঝুল গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত এনে পরলাম সেটা। ভেতর দিকে হুঁক দিয়ে আটকে দিল জিম। তারপর মাথায় একটা বড় টুপি পরে, সেটার ফিতে বেঁধে দিলাম থুতনির নিচে। ছদ্মবেশ পরখ করে সন্তুষ্ট হল জিম। বলল, এবার দিনেও কেউ চিনতে পারবে না আমায়। বারবার ওগুলো পরে স্বচ্ছন্দ করে নিলাম নিজেকে। কিন্তু জিমের খুঁতখুঁতি গেল না। তোমার হাঁটার ধরন মেয়েদের মত না, বলল। ঈশ্বরের দোহাই, ওই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাবার অভ্যেসটা ছাড়।
রাতের অন্ধকার নামার পর ইলিনয়ের দিকে রওনা হলাম। শহরের যেদিকটায় ফেরিঘাট, তার একটু ভাটির দিকে গেলাম। তীরে ডিঙি বেঁধে পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। অদূরেই একটা কুঁড়ে ঘরে বাতি জ্বলছিল। নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। উঁকি দিলাম জানালা দিয়ে। বছর চল্লিশেকের এক মহিলা টেবিলের ওপর। বাতির ধারে বসে কী যেন বুনছিল। অচেনা চেহারা; বুঝলাম, নতুন এসেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, সৌভাগ্যই বলতে হবে। পরিচিত লোক হলে গলার স্বরে চিনে ফেলত আমাকে। নির্ভয়ে টোকা দিলাম দরজায়। ভুললে চলবে না আমি একটি মেয়ে, আপনমনে বললাম।
ভেতরে এস, দরদ মাখা গলায় বলল ভদ্রমহিলা। চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস।
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। ছোট, উজ্জ্বল চোখজোড়া দিয়ে আমাকে ভাল করে দেখল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী, বাছা?
সারা উইলিয়ামস।
কোথায় থাক?
হুঁকারভিল। এখান থেকে সাত মাইল ভাটিতে। আমার মায়ের অসুখ, হাতে পয়সা নেই। শহরের ওপ্রান্তে আমার কাকা থাকেন। নাম, অ্যাবনার মুর। তাঁর কাছেই এসেছি। আপনি হয়ত চেনে তাঁকে।
না, চিনি না। সবে দশ দিন হল এসেছি এখানে। তোমার কাকার বাসা তো এখান থেকে বেশ দূর। আজ রাতটা বরং এখানেই থাক। নাও, টুপি খুলে আরাম কর।
না, খালা, থাকার উপায় নেই। একটু জিরিয়ে আবার রওনা হব আমি।
আমার স্বামী তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এক্ষুনি ফিরবে ও। এত রাতে একাকী যাওয়া ঠিক হবে না তোমার। এরপর মহিলা তার স্বামী এবং পরিবারের আর সবার ব্যাপারে নানান গল্প করল। আমার খুনের ঘটনাটাও বলল।
কাজটা করল কে? প্রশ্ন করলাম।
হুঁকারভিলেও সবাই বলাবলি করছে ঘটনাটা নিয়ে, অথচ কেউ-ই জানে না হাকফিনের খুনি কে।
প্রথমটায় সবাই ভেবেছিল এটা ওর বাবারই কীর্তি। তবে এখন বলছে, জিম নামের এক পলাতক নিগ্রোর কাজ এটা। যে-রাতে হাকফিন খুন হয়, সেই রাতেই পালিয়েছ ও। কেউ ওকে ধরতে পারলে তিনশ ডলার পুরস্কার পাবে।
এখনও জিমকে খুঁজছে ওরা?
নিশ্চয়ই। তিনশ ডলার কম টাকা হল। আমার মনে হয় খুব বেশি দূরে যায়নি ও। সম্বত জ্যাকসনের দ্বীপে লুকিয়ে আছে। গতকাল ওই দ্বীপ থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি আমি। আমার স্বামীকে বলেছি ব্যাপারটা। আজ রাতে সাথে আরেকজনকে নিয়ে ওখানে যাচ্ছে ও।
মহিলার কথা শুনে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম, উশখুশ করতে লাগলাম। কিছু একটা করা দরকার, তাই সূঁচে সুতো পরাতে লেগে পড়লাম। ভদ্রমহিলা লক্ষ্য করল, আমার হাত থরথর কাঁপছে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
তিনশ ডলার অনেক টাকা, বললাম, ইস! আমার মা এই টাকাগুলো পেলে খুব উপকার হত। আপনার স্বামী তো আজ রাতেই যাচ্ছেন ওখানে, তাই না?
হ্যাঁ। মাঝরাতের দিকে যাবে। সঙ্গের লোকটাকে নিয়ে শহরে গেছে ও। নৌকো জোগাড় করতে গেছে, কারো কাছে আরেকটা বন্দুক ধার পাওয়া যায় কি, সে-চেষ্টাও করে দেখবে।
এসব শুনে আমার চেহারায় একটা আতঙ্কের ছাপ ফুটে থাকবে, আরেকবার কৌতুকমাখা চোখে আমার দিকে তাকাল মহিলা। তোমার নামটা যেন কি বললে, বাছা? জিজ্ঞেস করল।
মেরি উইলিয়ামস।
প্রথমে সারা বলেছিলে না?
হ্যাঁ, খালা, বলেছিলাম। সারা মেরি উইলিয়ামস। সারা আমার ডাকনাম। কেউ কেউ আমায় সারা বলে, আবার মেরি বলেও ডাকে অনেকে।
ও, আচ্ছা, বলল মহিলা। হঠাৎ করেই একেবারে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিল সে। ইঁদুরের জ্বালায় টেকা দায় হয়ে উঠেছে এখানে। এমন উপদ্রব করে যে মনে হয় এ যেন ওদেরই রাজত্ব। এইটা নাও, আমার দিকে একটা পাথরখণ্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এরপর ইঁদুর দেখামাত্র ছুড়ে মারবে।
মারলাম, অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আমার হাতের টিপ দেখে ভদ্রমহিলা বলল, সত্যি করে বল তো বাছা, তোমার নাম কী? বিল, টম নাকি বব?
বুঝলাম, ধরা পড়ে গেছি। বেতপাতার মত কাঁপতে লাগলাম ভয়ে। দোহাই আপনার, খালা, একটা গরিব মেয়েকে নিয়ে ঠাট্টা করবেন না, অতিকষ্টে কাঁদো কাঁদো সুরে বললাম। এখানে আসায় আপনার যদি কোন অসুবিধা হয়ে থাকে তবে…
বোসো, লক্ষ্মীটি। তোমাকে সাহায্য করব আমি। আমার স্বামীও করবে। বুঝেছি, কোন কারখানা থেকে পালিয়েছ তুমি, অত্যাচার সইতে পারনি। সব খুলে বল আমাকে—এই তো লক্ষ্মী ছেলে।
বললাম, আমার মা-বাবা দুজনাই মারা গেছে বহুদিন আগে। আইন মোতাবেক এক বদমেজাজি বুড়োর কাছে কাজ শিখতে দেয়া হয়েছিল আমাকে। অসহ্য হয়ে উঠেছিল তার দুর্ব্যবহার। দুদিনের জন্যে বাইরে গেছে সে। তারই সুযোগ নিয়েছি আমি। পরনের কাপড়গুলো তার মেয়ের, চুরি করে এনেছি। আমার বিশ্বাস, আমার চাচা হয়ত আমার যত্ন নেবেন। তাই এই গশেন শহরে এসেছি আমি।
গশেন! কি বলছ তুমি? এটা তো সেন্ট পিটসবার্গ। গশেন তো দশ মাইল উজানে। কে বলল তোমাকে, এটা গশেন?
কেন, এক লোক, পথে তার সাথে দেখা হয়েছিল, সেই বলল। লোকটা বলল, যখন দেখব রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, তখন ডানের রাস্তা ধরে চলতে শুরু করব। এভাবে পাঁচ মাইল চললেই পৌঁছে যাব গশেনে।
লোকটা বোধহয় মাতাল ছিল। ভুল বলেছে।
হতে পারে। ওরকমই লাগছিল তাকে। তো আমাকে এখন উঠতে হয়। তাহলে সকাল হবার আগেই গশেনয়ে পৌঁছে যাব।
এক মিনিট দাঁড়াও। কিছু খাবার দেই তোমাকে। সময়ে কাজে লাগবে তোমার।
খাবার দিয়ে মহিলা বলল, আচ্ছা বল তো, শোয়া অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর সময় গরুর কোন্ অংশ আগে ওঠে?
পেছনের অংশ।
বেশ। ঘোড়ার?
সামনের অংশ।
গাছের কোন দিকে শ্যাওলা পড়ে?
উত্তর দিকে। বেশ! বেশ! বুঝলাম গ্রামে বাস করেছ তুমি। তা, তোমার আসল নাম কি?
জর্জ পিটার, খালা।
এই নামটা ভুলো না যেন। আবার ভুলে গিয়ে হয়ত বলবে আলেকজান্ডার। তারপর যখন ধরা পড়বে তখন বলবে যে জর্জ আলেকজান্ডার। আর ওই মেয়ে সেজে থেকে না সুবিধে হবে না। সুচে সুতো পরানোর সময় সুতো স্থিরভাবে ধরে রেখে তাতে সুঁই পরাবে না, সুঁই স্থির রেখে ফুটোতে সুতো পরাবে। মেয়েরা সেভাবেই পরায়, কিন্তু পুরুষরা উলটোটা করে। ইঁদুর বা আর কারো দিকে কিছু ছুড়ে মারার সময় হাত যতটা সম্ভব মাথার ওপর তুলে মারবে, যাতে সেটা লক্ষ্যবস্তূ থেকে অন্তত ছ-সাত ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। শক্তি সঞ্চয় করবে কাঁধের কাছ থেকে, মেয়েরা তা-ই করে। ছেলেদের মত শরীরের এক পাশে হাত রেখে কবজি বা কনুয়ের জোরে মারবে না। সুচ-সুতো পরন দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুমি আসলে ছেলে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, জর্জ। আমার নাম মিসেস জুডিথ লোফটাস। বিপদে পড়লে খবর দিয়ো। কেমন?
ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নদীর তীর ধরে উজানের দিকে পঞ্চাশ গজের মত গেলাম। তারপর উলটোপথে ফিরে এসে ডিঙি বেয়ে পৌঁছুলাম দ্বীপে। দেখলাম, ঘুমে কাদা হয়ে আছে জিম। জাগলাম ওকে, ওঠ, জিম। সময় নষ্ট কোরো না। পালাতে হবে। আমাদের ধরতে আসছে ওরা।
নিঃশব্দে মালপত্র ভেলায় তুললাম, ভয়ে দুজনেই কাঁপছি। আধ ঘণ্টা পর ভাটি বেয়ে রওনা হলাম আমরা।
০৮. রাত প্রায় একটার দিকে দ্বীপের শেষ প্রান্তে
রাত প্রায় একটার দিকে দ্বীপের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ভেলা। যদি কোন নৌকো আমাদের খোঁজে এসে পড়ে, ডিঙি নিয়ে ইলিনয়ের দিকে পাড়ি জমাব আমরা। কপাল ভালই বলতে হবে, কোন নৌকো এল না।
পুব-আকাশে ভোরের আলো ফোটামাত্রই একটা বাঁকের মাথায় বাধলাম ভেলাটা। কটনউড ঝোপ থেকে ডালপালা কেটে এনে এমনভাবে ঢেকে দিলাম যে দেখে মনে হবে কোন গুহা আছে ওখানে। বাঁকের মাথায় চর; তাতে কটনউডের সারি, নিড়ানি মইয়ের দাঁতের মত ঘন।
নদীর ওপাশে মিসৌরি, তীর ঘেঁষে আকাশ ছুঁয়েছে পাহাড়, আর এপাশে, ইলিনয়ের দিকে, বড় বড় গাছের সারি। ঠিক ওই জায়গাতেই স্রোতধারা মিসৌরির তীর ঘেঁষে চলে গেছে। ফলে, হঠাৎ কেউ আমাদের দেখতে পাবে এমন ভয় নেই। সারাদিন ঝোপের ভেতর শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। সামনে দিয়ে গয়না নৌকো, স্টিমার যাচ্ছে উজান ঠেলে।
আঁধার নামার পর আশ্রয় ছেড়ে বেরুলাম। তক্তা দিয়ে ভেলার ওপর একটা ছই বানাল জিম, যাতে রোদ-বৃষ্টিতে ঠাই নিতে পারি। তারপর এক ফুট উঁচু একটা পাটাতন তৈরি করা হল। এখন আর স্টিমারের ঢেউতে ভিজবে না জিনিসপত্র। ছইয়ের ঠিক মাঝখানে কাদামাটি দিয়ে একটা চুলোমত তৈরি করলাম। এবার ঠাণ্ডা কিংবা স্যাঁতস্যাতে দিনে ওর ভেতর আগুন জ্বালানো যাবে। ঘেরা থাকায় চোখে পড়বে না কারো। বাড়তি একটা হালও তৈরি করা হল, জোড়ারটা ভেঙে বা নষ্ট হয়ে গেলে কাজে লাগবে। সবশেষে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখার জন্যে আংটার মত করে একটা লাঠি গেঁথে দিলাম। রাতে যখন কোন স্টিমার আসবে, তখন বাতি না দেখালে হুঁড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে পারে। অবশ্য উজানে যে স্টিমারগুলো যাবে, তাদের বাতি দেখানোর দরকার হবে না।
দ্বিতীয় রাতে সাত-আট ঘণ্টা চললাম, বেশির ভাগ সময় গা ভাসিয়ে দিলাম স্রোতের অনুকূলে। মাছ ধরলাম, গল্পগুজব করলাম। মাঝেমধ্যে ঘুম তাড়াতে সাঁতারও কাটলাম খানিক। অধিকাংশ সময় কাটল তারা দেখে। চমৎকার আবহাওয়া। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটল না সেইরাতে—এমনকি পরের দুরাতেও না। প্রতি রাতেই কোন না কোন শহর অতিক্রম করলাম আমরা। পঞ্চম রাতে পেরিয়ে এলাম সেন্ট লুইস। আলো ঝলমলে শহর। সেন্ট পিটসবার্গে শুনেছিলাম, সেন্ট লুইসে নাকি বিশ-তিরিশ হাজার লোকের বাস। কিন্তু এবার চোখে দেখার আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করিনি সেকথা। এখন অবশ্য প্রাণের সাড়া নেই শহরে, সবাই যেন ঘুমিয়ে আছে পরম নিশ্চিন্তে।
এখন প্রায় প্রতি রাতেই ডিঙি নিয়ে তীরে যাচ্ছি আমি। গ্রামের দোকান থেকে খাবার জিনিস কিনে আনি। আর মওকামত কোন মুরগি-টুরগি পেলে ধরে নিয়ে আসি চুপি চুপি। বাবা সব সময়েই বলত, মোরগ-মুরগি পেলেই তার একটা নিয়ে নেবে। কারণ তুমি না-নিলেও, অনন্য নেবে সেটা।
ভোর হবার আগেই ঢুকে পড়ি কোন শস্য-ক্ষেতে। রোজই কিছু না কিছু ধার করতে লাগলাম সেখান থেকে। বাবা বলত, যদি কোনদিন ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকে, তবে এরকম ধার করায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু ওই বিধবা বলত, এটাও এক ধরনের চুরি। ভদ্রলোক একাজ করবে না। জিম বলল, ওর মতে দুজনের কথাই ঠিক। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে আমাদের তালিকা থেকে দুতিনটে জিনিস বাদ দেয়া, এবং মনে করা সেগুলো আমরা ধার করব না। সেক্ষেত্রে, অন্যগুলো ধরি করলে দোষ হবে না। অতএব আলাপ-আলোচনা করে আমরা ঠিক করলাম, বুনো নাশপাতি আর পিসিমন, এই দুটো জিনিস বাদ দেব তালিকা থেকে। এ দুটো বাদ যাওয়ায় মনে মনে খুশিই হলাম আমি। বুনো নাশপাতি খেতে বিচ্ছিরি, আর পিসিমন অন্তত আরো দুতিন মাসের আগে পাকবে না।
পঞ্চম রাতেই ঝড়ে পড়লাম আমরা। দুপুর রাতের পর মুষলধারে নামল বৃষ্টি। থেকে থেকে আকাশটা চিরে দিচ্ছে বিজলিচমক। বাজ পড়ার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। ছইয়ের ভেতর আশ্রয় নিলাম আমরা, ভেলাটাকে ইচ্ছেমত চলতে ছেড়ে দিলাম। বিজলির আলোয় দেখলাম নদীর দুপাশে উঁচু পাড়। অদূরেই কাত হয়ে পড়ে আছে একটা স্টিমার। ডুবে যাচ্ছে ওটা। আমাদের ভেলাটা সেদিকেই ভেসে যাচ্ছে। এই নির্জন নদীতে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখে অন্য যেকোন বাচ্চা ছেলের যে অনুভূতি হবে, আমারও তা-ই হল। ওতে উঠে ঘুরেফিরে দেখতে ইচ্ছে জাগল।
চল, জিম, জাহাজে গিয়ে উঠি, বললাম। জিমের তাতে ঘোরতর আপত্তি। বোকামি কোরো না, বলল ও, পাহারাদার থাকতে পারে।
পাহারাদার না তোমার মাথা, বললাম। কিস্যু নেই ওর ভেতর। এই দুর্যোগের রাতে কে আসবে জান খোয়াতে। তাছাড়া, আমাদের নেয়ার মত কোন জিনিস মিলেও যেতে পারে।
নিমরাজি হল জিম। বলল, ওখানে গিয়ে বিশেষ কথা বলব না আমরা। আর যাও-বা বলব, খুব আস্তে। জাহাজের সামনের দিকে একটা কপিকল ছিল। কপিকলটার সাথে বাধলাম ভেলাটা।
ডেকটা বেশ উঁচুতে। নিঃশব্দে দেয়াল বেয়ে পেছনের দিকে অন্ধকারে নামলাম আমরা। পা দিয়ে পথ অনুমান করে বসার ঘরের দিকে এমনভাবে এগোলাম, যদি কোন লোক হাতড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তাকে যেন ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে পারি। আমাদের এ সিদ্ধান্তের কারণ, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। একটু পরেই একটা পোর্টহোলের কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা, ওটা বেয়ে উঠলাম। পরক্ষণে এসে পড়লাম ক্যাপ্টেনের ঘরের দরজার সামনে। ভেতরে বাতি জ্বলছে। হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে এল দূর থেকে।
ফিসফিস করে জানাল জিম, অসুস্থ বোধ করছে সে। আমাকে ফিরে যেতে বলল ও। ফিরে যাব, এমন সময় একটা কাতর গলা শুনতে পেলাম: দোহাই লাগে, এটা কোরো না তোমরা! কসম কেটে বলছি, এবার আর কাউকে কিছু বলব না আমি।
মিথ্যে বলে লাভ হবে না, জিম টার্নার। আরেকটা মোটা কর্কশ গলা শোনা গেল। এর আগেও এমন করেছ তুমি। সকলের চেয়ে বেশি ভাগ চেয়েছ, পেয়েওছ। কারণ, না-দিলে হুমকি দিয়েছ, সব ফাঁস করে দেবে। তোমার মত এরকম হারামি আর বেঈমান এই তল্লাটে আর একটাও নেই।
ইতিমধ্যে ভেলায় ফিরে গেছে জিম। দারুণ কৌতূহল বোধ করলাম আমি। টম সয়্যার এক্ষেত্রে পিছপা হত না, বললাম মনে মনে, আমিও হব না।
হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের সরু প্যাসেজ বেয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের অন্ধকারের দিকে। একটা স্টেটরুম থেকে ক্ষীণ আলোর ছটা এসে পড়েছে বাইরে। ওই আলোয় দেখলাম, একটা লোক হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চিত হয়ে পড়ে আছে মেঝেয়। দুজন লোক ওর পাশে দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে একটা টিমটিমে লণ্ঠন, অপরজনের হাতে পিস্তল। বন্দির দিকে পিস্তলটা উচিয়ে আছে সে। দেই শেষ করে। শালা একটা আস্ত শয়তান, বলল লোকটা।
না…না, মের না। দোহাই ঈশ্বরের, চেঁচিয়ে উঠল বন্দি।
ওর অনুনয় শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল অপর দুজন। পিস্তলটা সরাও, বিল, বলল লণ্ঠনধারী, এমনিতেই ভিরমি খেয়েছে ব্যাটা। আর ভয় দেখাতে হবে না।
ওকে মেরে ফেলাই উচিত, প্যাকার্ড, বলল বিল। বুড়ো হ্যাটফিল্ডকে মেরেছে ও। কাজেই এটা ওর পাওনা।
লণ্ঠনটা পেরেকে ঝুলিয়ে আমি যেখানে বসে আছি, সেদিকে ইশারায় বিলকে আসতে বলল প্যাকার্ড। চিংড়িমাছের মত তিড়িং করে দু গজ পিছিয়ে এলাম আমি। কিন্তু সুবিধে হল না, স্টিমারটা ভীষণ রকমের কাত হয়ে আছে। ওরা যাতে আমার গায়ের ওপর এসে না-পড়ে সেজন্যে বসার ঘরের ভেতর দিয়ে চট করে বেরিয়ে এলাম। ঘেমে নেয়ে উঠেছি, শীত-শীত করছে। অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলাম। আলকাতরার মত অন্ধকার। ডেকরেলিংয়ের ওপর উঠে ফিসফিস করে ডাকলাম জিমকে। আমার কনুইয়ের কাছ থেকে কো কো করে উত্তর নিল ও।
জলদি কর, জিম, বললাম। ওখানে একদল খুনি রয়েছে। এদের নৌকোটা খুঁজে ভাসিয়ে দিতে হবে, নইলে ওদের একজন ভীষণ বিপদে পড়বে। আর ভাসিয়ে দিতে পারলে সব কটাই বিপাকে পড়বে। নাও, তাড়াতাড়ি কর। আমি পেছনের দিকটায় খুঁজছি। তুমি সামনেটা দেখ…
হায় হায়, ভেলা কই গেল, আঁতকে উঠল জিম। আরে, ওটা দেখছি দড়ি ছিড়ে চলে গেছে। এখন কী হবে!
০৯. জিমের কথা শুনে ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর
জিমের কথা শুনে ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাবার দশা হল। ডাকাত দলের সাথে এই ভাঙা স্টিমারে আটকা পড়লে আর রক্ষে নেই। যে করেই হোক নৌকোটা পেতেই হবে, মনে মনে বললাম। দুরু দুরু বুকে স্টারবোর্ড সাইডের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। নাহ! নৌকোর চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। ভয়ে আর এগুতে চাইল না জিম। অনেক বলে-কয়ে ওকে রাজি করালাম। ইতিমধ্যে পানির নিচে জাহাজের অনেকটা তলিয়ে গেছে। স্কাইলাইটের খড়খড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে স্টার্নের দিকে রওনা দিলাম আমরা। হলঘরের দরজার কাছাকাছি এসে সত্যি সত্যি দেখা পেলাম নৌকোটার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। নৌকোয় উঠব, এমন সময়ে দরজা খুলে প্রায় আমার নাকের ডগায় ডাকাতদের একজন উঁকি দিল। ধড়াস করে উঠল আমার বুক, মনে হল এই বুঝি ধরা পড়লাম।
কিন্তু না, পরক্ষণে ঝট করে মাথা ভেতরে টেনে নিল লোকটা। বিল, লণ্ঠনটা আড়াল কর! বলল সে। তারপর মালবোঝাই একটা বস্তা নিয়ে এসে নৌকোয় চাপল। লোকটা প্যাকার্ড। ওর পেছন পেছন বিলও এসে নৌকোয় উঠল।
সব ঠিক? তাহলে এবার রওনা দেই, বলল প্যাকার্ড।
এদিকে আমার হাত ধরে এসেছে, খড়খড়ি ধরে ঝুলে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ বিল বলল, থাম। ওর পকেট দেখেছ?
না। তুমি?
না। ওর সব টাকা পকেটে আছে।
তাহলে আবার চল। নগদ টাকা রেখে খালি মালপত্র নেয়ার কোন মানে হয় না।
নৌকো থেকে উঠে আবার জাহাজের ভেতর ঢুকে গেল ওরা। আমিও আর দেরি না করে নৌকোর ওপর লাফিয়ে পড়লাম, জিমও এসে পড়ল ঝটপট। চট করে ছুরি দিয়ে বাঁধন কেটে দিলাম আমি। আবার ভেসে চললাম আমরা।
নিঃশব্দে বসে আছি। তরতর করে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে নৌকো। চারদিকে সব নিঝুম-নিস্তব্ধ। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর ভাঙা স্টিমার থেকে প্রায় একশো গজ দূরে চলে এলাম আমরা। দেখতে দেখতে অন্ধকার যেন শুষে নিল জাহাজটাকে।
একটু বাদেই শুরু হল ঝড়, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। নদীতীরে কোন আলোর লেশমাত্র নেই। শো শো করে স্রোতের টানে ভেসে চললাম আমরা। অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি থামল, তবে মেঘ কাটল না। হঠাৎ বিজলিচমকের আলোয় দেখলাম সামনেই কালো মত কী একটা যেন ভাসছে। কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা আমাদের ভেলা।
আর তিন রাত চললেই কায়রোতে পৌঁছুব আমরা, জিমকে বললাম। কায়রো শহরের কাছে ওহাইয়ো নদী মিসিসিপির সাথে মিশেছে। আগেই ঠিক করেছিলাম সেখানে গিয়ে ভেলাটা বেচে দেব আমরা। তারপর স্টিমার ধরে ওহাইয়ো হয়ে যে-সব রাজ্যে নিগ্রোদের স্বাধীনতা আছে, সেগুলোর কোন একটায় চলে যাব। তখন আমাদের আর কোন বিপদ থাকবে না।
দ্বিতীয় রাতে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল চারদিক। এ অবস্থায় পথ চলা ঠিক হবে না। তাই ভেলাটা তীরে বাধার জন্যে দড়িহাতে ডিঙিতে চড়লাম আমি। বৈঠা মেরে পাড়ে পৌঁছে দেখলাম, সবই ছোট ছোট চারাগাছ, ভেলা বাঁধবার মত কোন বড় গাছ নেই। প্রচণ্ড স্রোত বইছে নদীতে। কোনমতে একটা গাছের সাথে পেঁচিয়ে রশিটা বাঁধলাম। কিন্তু একটা হ্যাচকা টানে সেটাকে জড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে ছুটে চলল ভেলা। ঘন কুয়াশার ফলে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেলাম আমি, নড়াচড়া পর্যন্ত করতে ভুলে গেলাম। ঘোর কাটতে লক্ষ্য করলাম ভেলাটা দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ডিঙিতে উঠে বৈঠা ধরলাম। কিন্তু ডিঙি একচুলও এগোল না। তাড়াহুঁড়ো করতে গিয়ে পাড়ে বাঁধা দড়ি খুলতে ভুলে গিয়েছিলাম। চটু করে উঠে দড়ি খোলার চেষ্টা করলাম। তীব্র উত্তেজনায় শরীর তখন কাঁপছে, ফলে খুলতে বেশকিছুটা সময় লাগল।
অবশেষে ডিঙি নিয়ে বাঁক ঘুরে যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়ে চললাম ভেলার সন্ধানে। আমার চারপাশে সাদা ঘন কুয়াশার চাদর। কোন দিকে যাচ্ছি কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। বুঝলাম বৈঠা বাওয়া বৃথা, এই অবস্থায় স্রোতের টানে ভেসে চলা ছাড়া উপায় নেই। মুখের কাছে দুহাত তুলে হপ হপ শব্দ করলাম। উত্তর শোনার আশায় কান পেতে রইলাম। দূর থেকে ছোট্ট একটা হুঁপ শব্দ ভেসে এল। ক্ষীণ আশা জাগল আমার মনে। শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম কুটিল কুয়াশা চিরে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম শব্দটা যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে না গিয়ে ডানদিকে সরে যাচ্ছি আমি। পরমুহূর্তে দেখলাম এবার শব্দটার বাঁ-দিকে যাচ্ছি। দিশাহারা অবস্থা হল আমার, খালি একবার এদিক একবার ওদিক ঘুরছি। হঠাৎ খাড়া পাড়ের সাথে পুঁতো খেল ডিঙিটা। আঁধারে বিশাল গাছগুলোকে ভূতের মত দেখাচ্ছে। স্রোতের টান আমাকে ঠেলে বয়ে নিয়ে গেল।
কয়েক সেকেন্ডের ভেতর আবার সবকিছু নীরব-নিথর হয়ে গেল। কেবল আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক ছাড়া কোন শব্দ কানে আসছে না। মনে হল মিনিটে একশ বার লাফাচ্ছে ওটা। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার।
হাল ছেড়ে দিলাম। ব্যাপার আসলে কী, বুঝলাম। যেটাকে বাঁক মনে করেছিলাম, সেটা আসলে দ্বীপ। জিম ওই দ্বীপেরই অপরদিকে আছে। অনুমান করলাম দ্বীপটা পাঁচছয় মাইল লম্বা এবং আধ মাইল চওড়া হবে। এই গোলকধাঁধার ভেতর ছোটাছুটির ফলে ইতিমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শুয়ে পড়লাম ডিঙির মধ্যে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুম এসে গেল। যখন জাগলাম, আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা। মেঘ পুরোপুরি কেটে গিয়েছে। একটা বাঁকের মুখে ভাসছে ডিঙিটা। প্রথমটায় বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। ভাবলাম, স্বপ্ন দেখছি বুঝি। তারপর যখন সবকিছু মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে হল এরই মধ্যে এক হপ্তা কেটে গিয়েছে।
নদীটা এখানে বেশ চওড়া। দুপাশে লম্বা, ঘন গাছের সারি। তারার আলোয় নিরেট দেয়ালের মত দেখাচ্ছে। কিছু দূর যেতেই ভেলাটা চোখে পড়ল। জিম দুহাটুর ভেতর মাথা গুজে ঘুমুচ্ছে। একটা দাঁড় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ডালপালার আবর্জনায় ভরে আছে ভেলাটা। দেখেই বোঝা যায়, বেশ বড়রকমের ঝড় বয়ে গেছে ওটার ওপর দিয়ে।
আমি চট করে এগিয়ে গিয়ে জিমের পাশে শুয়ে পড়লাম। আমাকে জাগাওনি কেন জিম? ওকে ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলাম।
ধড়মড় করে উঠে বসল জিম। চমকে উঠল আমাকে দেখে, যেন ভূত দেখছে। অতিকষ্টে বোঝালাম ওকে, আমি মরিনি। সব শুনে আশ্বস্ত হল ও। আমি বেঁচে আছি। দেখে ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া আদায় করল।
তারপর আরও দুচারটে কথা বলে আবার শুয়ে পড়লাম আমরা। দিনভর ঘুমিয়ে ফের রাতে রওনা দিলাম। ভাসতে ভাসতে একটা বড় বাঁকের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। নদী এখানটায় চওড়া। দুতীরে স্তূপীকৃত কাঠ দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, গুমট গরম।
কায়রোতে পৌঁছুলেও আমরা তা আদৌ টের পাব কি-না, তা নিয়ে আলোচনা চলল আমাদের ভেতর। বোধহয় পাব না, বললাম আমি। সেখানে নাকি মোটে দশ-বার ঘরের বাস। তারা বাতি না জ্বালালে বুঝব কী করে যে একটা শহর পার হয়ে যাচ্ছি আমরা?
যেখানে দেখবে দুটো বড় নদী এসে মিশেছে, সেটাই কায়রো, বলল জিম। কিন্তু জিমের কথায় মোটেও আশ্বস্ত হতে পারলাম না আমি। কেন-যেন মনে হতে লাগল, একটা দ্বীপের চারপাশ ঘুরে বারবার সেই একই নদীতে পড়ছি আমরা। কথাটা জিমকে জানাতেই ভড়কে গেল ও। জিজ্ঞেস করল, তাহলে উপায়?
এক কাজ করা যায়, বললাম, বাতি দেখামাত্র ডিঙি নিয়ে সেখানে যাব আমি। তাদের বলব, পেছনে একটা মহাজনি নৌকোয় আমার বাবা আসছেন। তিনি নতুন ব্যবসায়ী। এখান থেকে কায়রো কত দূর তা-ই জানতে চান।
প্রস্তাবটা জিমের মনে ধরল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলাম আমরা, যদি কোথাও কোন আলোর রেখা চোখে পড়ে। অপেক্ষার কাল যেন আর ফুরোতে চায় না। এক সময় আমাদের দুচোখের পাতা ভারি হয়ে এল। কোথাও ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়লেই জিম চেঁচিয়ে উঠছে: ওই যে কায়রো!
আসলে ওগুলো জোনাকির ঝাঁক। বেশ বুঝতে পারছি, মুক্তির এত কাছাকাছি এসে জিমের আর সবুর সইছে না, ছাড়া পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে মন।
ক্রমশ প্রলাপ বকতে শুরু করল ও। বলল, স্বাধীন এলাকায় গিয়ে টাকা সঞ্চয় করবে। যখন প্রচুর টাকা জমবে, মিস ওয়াটসনের বাসার কাছেই যে-খামারবাড়িতে ওর বউ কাজ করে, সেখানে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনবে টাকা দিয়ে। তারপর দুজনের রোজগার জমিয়ে ওদের দুই সন্তানকে মুক্ত করবে। আর ওদের মনিব যদি ওদের বেচতে না চায়, তবে যারা দাসপ্রথার বিরোধীতাদের কাউকে দিয়ে বাচ্চা দুটোকে চুরি করাবে।
জিমের কথা শুনে ঠাণ্ডায় প্রায় জমে গেলাম আমি। ওর পালানোর প্রচেষ্টায় সাহায্য করছি বলে বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলাম। ঠিক করলাম, ধরিয়ে দেব ওকে। এই নতুন সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথে যেন একটা পাষাণভার আমার বুকের ওপর থেকে নেমে গেল। তীর দেখার আশায় উদগ্রীব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আপন মনে একটা গানের কলি ভাঁজতে লাগলাম।
আর কোন ভয় নেই। আমরা বেঁচে গেছি, আচমকা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল জিম।
চমকে উঠলাম আমি। দূরে কয়েকটা টিমটিমে বাতি চোখে পড়ল। যাই, আমি গিয়ে দেখে আসি আগে, বললাম।
খুশি মনে ডিঙি সাজিয়ে দিল জিম। আমাকে বসতে দেয়ার জন্য ওর পুরোন কোটটা আসনের মত করে বিছিয়ে দিল। তারপর হাতে বৈঠা ধরিয়ে দিয়ে বলল: শিগগিরই খুশিতে চিৎকার করে আমি বলব, কেবল হাকের জন্যেই এটা সম্ভব হল। এখন আমি স্বাধীন। জিম তোমাকে কখনও ভুলবে না, হাক। তুমি আমার একমাত্র বন্ধু।
ওর কথায় কেমন যেন মিইয়ে গেলাম আমি। তীরে যাবার সব উৎসাহ যেন হারিয়ে গেল। ধীর গতিতে রওনা হলাম। গজ পঞ্চাশেক যাবার পর আবার চেঁচিয়ে উঠল জিম, ওই যে হাক যাচ্ছে। সত্যবাদী হাক। জীবনে এই প্রথম একজন শ্বেতাঙ্গ দেখলাম যে জিমের কাছে তার কথা রাখছে।
বড় অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু মনকে বোঝালাম আমার কর্তব্য আমাকে করতেই হবে। ধরিয়ে দিতে হবে জিমকে। কিছুদূর যেতেই একটা নৌকো এগিয়ে এল। বন্দুকহাতে দুজন লোক বসে। ওদের দেখে ডিঙি থামালাম আমি। ওরাও থামল।
ওই ভেলাটা কি তোমার? ওদের একজন জানতে চাইল।
হ্যাঁ, স্যার। কেউ আছে এতে?
আছে, স্যার।
দেখ, আজ রাতে পাঁচ জন নিগ্রো ভেগেছে। ওই যে দূরে যে-বাঁকটা দেখছ, ওখান থেকেই পালিয়েছে ওরা। তা তোমার লোকটা সাদা না কালো?
চট করে উত্তর জোগাল না আমার মুখে। একবার মনে হল, দিই বলে জিমের কথা। পরক্ষণে দুর্বলতা অনুভব করলাম ওর জন্যে। একটু ইতস্তত করে বললাম, সাদা।
আমরা দেখব।
আমিও চাই আপনারা দেখুন, বললাম। ওই ভেলায় আমার বাবা রয়েছেন। হয়ত দয়া করে ভেলাটাকে টেনে পাড়ে আনতে সাহায্য করবেন আপনারা। বাবার ভীষণ অসুখ। মা আর মেরি অ্যানেরও সেই অবস্থা।
ঠিক আছে, খোকা। চল।
বাবা আপনাদের মেহেরবানিতে খুশি হবে, খানিকটা যাবার পর বললাম আমি। কেউ রাজি হচ্ছে না ভেলাটা পাড়ে নেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে।
কেন, তোমার বাবার কী অসুখ? সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করল একজন।
বাবার…মানে…তেমন কিছু হয়নি। ওরা দাড় টানা বন্ধ করল। ভেলার প্রায় কাছে চলে এসেছি আমরা।
মিথ্যে কথা! খেকিয়ে উঠল একজন। সত্যি করে বল, খোকা, কী হয়েছে তোমার বাবার।
বলব, স্যার। কসম বলছি। দয়া করে চলে যাবেন না আপনারা। ভেলার কাছে না এলেও চলবে, আপনারা নাহয় দূর থেকেই গুণ টানবেন।
জন, নৌকো ঘোরাও! চেঁচিয়ে উঠল একজন। খোকা, তুমি দূরে থাক। তোমার বাবার বসন্ত হয়েছে। খুব ছোয়াচে। তুমি রোগ ছড়াতে চাও নাকি?
দেখুন, স্যার, গলা করুণ করে বললাম, এর আগে প্রত্যেককে বলেছি আমি। কিন্তু তারা শোনামাত্র চলে গেছে।
বেচারা! শোন, কী করতে হবে তোমাকে বলছি আমি। এখান থেকে কুড়ি মাইল ভাটিতে নদীর বাঁ-ধারে একটা শহর পড়বে। সেখানে গিয়ে সাহায্য চাইবে। বলবে, তোমার আত্মীয়রা সর্দি-জ্বরে ভুগছে। খবরদার, আর যেন বোকামি কোরো না। মনে হচ্ছে, তোমার বাবা গরিব। এই বিশ ডলারের একটা গিনি এই কাঠের টুকরোর ওপর রাখলাম। এটা যখন ভেসে তোমার কাছে যাবে, তুলে নিয়ো।
দাঁড়াও, পার্কার, বলল জন। এই নাও, আমিও কুড়ি ডলার দিলাম। এবার তাহলে আসি, খোকা। মিস্টার পার্কার যা বললেন সেভাবে চললে, আর কোন অসুবিধে হবে না তোমার।
আর শোন, খোকা, বলল পার্কার, কোন নিগ্রোকে পালিয়ে যেতে দেখলে ধরিয়ে দিয়ো। এতে করে কিছু রোজগারও হবে তোমার।
নিশ্চয়ই, স্যার, বললাম আমি।
লোক দুটো চলে যাবার পর ভেলায় ফিরে এলাম। জিমকে ধরিয়ে দিইনি বলে আবার বিবেকের শাসানি শুরু হল। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারলাম ওকে ধরিয়ে দিলে আমি অনুশোচনায় ভুগব। কারণ জিমকে ভালবাসি আমি। আর তাছাড়া ঠিক কাজটা করে লাভ-ই বা কী? তাই শেষমেষ ঠিক করলাম এ নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। ছইয়ের ভেতর গিয়ে দেখলাম জিম নেই। হকচকিয়ে গেলাম আমি। জিম! ডাকলাম ওকে।
এই যে, হাক, আমি এখানে। হালের নিচে কেবল নাক ভাসিয়ে ও ঘাপটি মেরে ছিল। ওই দুজন লোক চলে গেছে শুনে ভেলায় উঠে এল। সত্যি, হাক, তোমার জবাব নেই। কেমন সুন্দর বোকা বানালে ওদের, বলল জিম। আজ আমার জীবন বাঁচিয়েছ তুমি। তোমার কথা এই বুড়ো জিম কোনদিন ভুলতে পারবে না।
১০. ওই লোক দুজনকে কীভাবে বোকা বানালাম
ওই লোক দুজনকে কীভাবে বোকা বানালাম তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করলাম আমরা। ওরা কুড়ি ডলারের যে-দুটো গিনি দিয়ে গেছে, তা নিয়েও আলাপ করলাম।
স্টিমারের টিকিট কাটার পরও বেশকিছু পয়সা আমাদের হাতে থাকবে, জিম বলল। ওই টাকা দিয়ে যেখানে নিগ্রোদের স্বাধীনতা আছে, স্বচ্ছন্দে সেখানে যেতে পারব আমরা।
ভোর হতেই নদীর পাড়ে একটা ঝোপের ভেতর ভেলাটাকে লুকিয়ে রাখলাম আমরা। জিম জিনিসপত্র গোছগাছে তৎপর হয়ে উঠল, যাতে কায়রোতে পৌঁছামাত্র সটকে পড়া যায়।
সেই রাতে, প্রায় দশটার দিকে, দূরে একটা বড় শহরের বাতি চোখে পড়ল। ওটাই কায়রো কি-না জানার জন্যে ডিঙি নিয়ে রওনা হলাম আমি। অল্প দূরে যেতেই একজন লোকের সাথে দেখা হল। নদীতে মাছ ধরছে লোকটা।
ভাই, ওই শহরটাই কি কায়রো?
কায়রো? না। তুমি একটা আস্ত গবেট।
তবে ওটা কোন্ শহর?
ইচ্ছে হয় জেনে আস গিয়ে। এখানে ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না।
ভেলায় ফিরে এলাম আমি। জিম হতাশায় মুষড়ে পড়ল। ওকে উৎসাহ দেবার জন্যে বললাম, কুছপরোয়া নেই, জিম। দেখ, ঠিক এর পরের শহরটাই হবে কায়রো।
ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে আরও একটা শহর পেরিয়ে এলাম আমরা। আমি ডিঙি নিয়ে দেখে আসতে চাইছিলাম, কিন্তু জিম মানা করল। বলল, শহরটা কায়রো নয়, কারণ ওটা পাহাড়ি এলাকা। কায়রোয় পাহাড় নেই। আমরা তীর ঘেঁষে একটা বাঁকের মুখে সারাদিন শুয়ে কাটালাম। একটা সন্দেহ কাঁটার মত খচখচ করছে আমার মনে।
সেই রাতে আমরা বোধহয় কায়রো ছেড়ে এসেছি, বললাম আমি। কুয়াশার মাঝে ঠাহর করতে পারিনি।
এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ো না, হাক, কান্না জড়ান গলায় বলল জিম। হতভাগ্য নিগ্রোদের কপাল কখনও ভাল হয় না। এসব ওই সাপের চামড়া ধরার ফল। আরও দুঃখ আমাদের কপালে আছে।
জিমের কথাই ঠিক। সকাল হতেই দেখলাম আমরা সত্যি সত্যি কায়রো ফেলে এসেছি। ওহাইয়ো নদীর স্বচ্ছ পানিতে আমাদের ভেলা ভাসছে। এখন উপায়? তীরে যাবার উপায় নেই, জিমের বিপদ হবে। আবার ভেলা নিয়ে যে উজান ঠেলে পেছনে যাব, তেমন সাধ্যও আমাদের নেই। সবচেয়ে ভাল উপায় হল রাতের আঁধারে ডিঙিতে চেপে কায়রো যাবার চেষ্টা করা। তাই, সন্ধে অবধি তুলোঝোপের ভেতর ঘুমিয়ে রইলাম আমরা। রাত ঘনাতেই ভেলায় ফিরে গেলাম। কিন্তু একি! ডিঙিটা নেই, কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।
কোন কথা সরল না আমাদের মুখে। এ নির্ঘাত সেই সাপের চামড়ার কারসাজি। আমরা ঠিক করলাম ভেলা নিয়ে আরও কিছুটা আগে বেড়ে একটা ডিঙি কেনার চেষ্টা করব। মালিকবিহীন নৌকো ধার নেয়ার যে-কায়দা বাবার কাছে শিখেছি, সেটা এক্ষেত্রে নিরাপদ মনে হল না। কারণ তাতে পেছনে লোক লেলিয়ে দেবে ওরা।
অন্ধকার নামার পর রওনা হলাম। যতটা সম্ভব তীর ঘেঁষে চলেছি, কারণ নৌকো বিনিকিনি ওখানেই হয়। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক চলার পরও কোথাও কোন ডিঙি চোখে পড়ল না। এদিকে ঘন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে, এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। চারিপাশে কেমন যেন গা ছমছমে ধূসর অন্ধকার। থমথমে পরিবেশ।
হঠাৎ আমাদের কাছেই একটা স্টিমারের শব্দ পেলাম। তাড়াতাড়ি একটা লণ্ঠন জ্বাললাম, যাতে স্টিমার-চালক দেখতে পায় আমরা কোথায় আছি। যেসব বড় নৌকো বা জাহাজ উজানে যায়, তারা সাধারণত ছোটখাট নৌকো বা ভেলার কাছাকাছি আসে না-বালির চড়া ধরে মরা স্রোত দিয়ে এগিয়ে যায়। তবে এরকম রাতে অনেক সময় ভুল করে সোজাসুজি চলে আসে বড় নৌকো বা জাহাজগুলো।
প্রচণ্ড বেগে পানি ভাঙার শব্দ এগিয়ে আসছে। এই স্টিমারগুলো প্রায়ই এরকম করে; দেখতে চায়, ধাক্কা না দিয়ে কতটা কাছ ঘেঁষে যাওয়া যায়। অনেকসময় ভেলার গায়ে প্রায় দাঁত বসিয়ে চলে যায় প্রপেলার। আর সারেং বেটা মাথা বার করে হাসতে থাকে যেন খুব বাহাদুরির কাজ করেছে একখানা।
দেখতে দেখতে স্টিমারটা আমাদের ঘাড়ের ওপর উঠে এল। যেন অসংখ্য জোনাকি-ঘেরা একখানা মেঘ আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল হঠাৎ—ভাটার মত জ্বলছে ফার্নেস। জিম আর আমি ঝাঁপ দিলাম পানিতে। ভেলা চুরমার করে এগিয়ে গেল স্টিমার।
প্রপেলারের ধাক্কা এড়াতে গভীর পানিতে ডুব দিলাম আমি। প্রায় দেড় মিনিট পর যখন দম নিতে ভেসে উঠলাম, স্টিমারটা বহু দূরে চলে গেছে। সামান্য ভেলাওয়ালাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না ওরা। চেঁচিয়ে জিমকে ডাকলাম বারকয়েক, সাড়া পেলাম না। আমার পাশ দিয়েই একটা ভাঙা তক্তা ভেসে যাচ্ছিল। তক্তাটাতে ভর দিয়ে প্রায় দুমাইল সাঁতরে পাড়ে এসে উঠলাম। পাথুরে এবড়োথেবড়ো জমির ওপর দিয়ে সিকি মাইল যাবার পর একটা পুরোনো ঢঙের কাঠের দোতলা খামারবাড়ির সামনে এসে পড়লাম। দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ার তাল করলাম, কিন্তু আচমকা কয়েকটা কুকুর ভেতর থেকে ধেয়ে এল। আর এক পাও এগোনর সাহস পেলাম না আমি।
জানলা দিয়ে হেঁড়ে গলায় একজন লোক জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?
আমি, স্যার, জবাব দিলাম।
বলি আমিটা কে?
জর্জ জ্যাকসন, স্যার।
এত রাতে কী চাই?
কিছু না, স্যার। আমি চলে যাব, কিন্তু কুকুরগুলো যেতে দিচ্ছে না।
এখানে ঘুরঘুর করছ কেন?
কই? না, স্যার। স্টিমার থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি।
অ! পড়ে গিয়েছিলে? আচ্ছা। অ্যাই, কে আছিস, আলোটা জ্বালা তো দেখি। তোমার নামটা যেন কী বললে?
জর্জ জ্যাকসন, স্যার। বাচ্চা ছেলে।
সত্যি বলে থাকলে কোন ভয় নেই তোমার। কেউ তোমাকে মারবে না। নড়ো না তুমি, যেখানে আছ, সেখানেই থাক। অ্যাই, বব আর টমকে জাগিয়ে দে। আমার বন্দুকটা নিয়ে আয়। তা, জর্জ জ্যাকসন, আর কেউ আছে নাকি তোমার সাথে?
না, স্যার, নেই।
বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠেছে, যেন ডাকাত পড়েছে। একটা বাতি জ্বলে উঠল। জানলায় দাঁড়ান লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, বাতিটা সরাও, বেটসি। এখনও তুমি সেই বোকার হদ্দই রয়ে গেলে দেখছি। দরজার পেছনে মেঝের ওপর রাখ। বব, তুমি টমকে নিয়ে পজিশন নাও।
নিয়েছি।
আচ্ছা, জর্জ জ্যাকসন, বলল জানলায় দাঁড়ান লোকটা, শেফার্ডসন পরিবারের কাউকে চেন তুমি?
নামই শুনিনি কস্মিনকালে।
বেশ। এবার তুমি ভেতরে এস। তাড়াহুঁড়ো করবে না, ধীরেসুস্থে এস। সাথে কেউ থাকলে বাইরেই রেখে আস। ভেতরে আসার চেষ্টা করলে গুলি খাবে সে।
লাগামটানা ঘোড়ার মত এগিয়ে গেলাম। বুকের ধুকপুক ছাড়া কোন শব্দ কানে যাচ্ছে না আমার। কুকুরগুলো ছায়ার মত অনুসরণ করছে। দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেলাম। ধীরে ধীরে দরজাটা ফাঁক করলাম একটু।
ঢের হয়েছে, ভেতর থেকে বলল একজন, এবার মাথা গলিয়ে দাও।
তা-ই করলাম আমি। কাঁপছি, প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছে এই বুঝি আমার খুলি উড়ে গেল। চৌকাঠের সামনেই একটা মোমবাতি জ্বলছে। দশাসই চেহারার তিনজন লোক বন্দুক তাক করে আছে আমার দিকে। ওদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড়, তার বয়েস প্রায় ষাট। পাকা চুল। বাকি দুজনের তিরিশ কিংবা তার কিছু বেশি হবে। প্রত্যেকেই দেখতে বেশ সুন্দর, ছিমছাম। ওদের ঠিক পেছনেই একজন বয়স্কা মহিলা দাড়িয়ে। মিষ্টি চেহারা। তার দুপাশে দুজন সুন্দরী যুবতী।
এস, ভেতরে এস, বললেন বুড়ো ভদ্রলোক।
আমি ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ করে দিল ওরা। তারপর আমাকে নিয়ে বিশাল ড্রইংরুমে গিয়ে বসল। মেঝেতে ছেঁড়া শতরঞ্চি পাতা। লক্ষ্য করলাম, জানলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসেছে সবাই। মোমের আলোয় আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ওরা।
না, এ শেফার্ডসনদের কেউ নয়, একবাক্যে রায় দিল সবাই। পরক্ষণেই সহজ হয়ে এল ওদের ব্যবহার।
এটাকে নিজের বাড়ি মনে কর, বললেন বৃদ্ধ। সব খুলে বল আমাদের।
এত তাড়াহুঁড়োর কী আছে, স্যল, বললেন বৃদ্ধা। দেখছ না, ভিজে ঝোড়ো কাকের মত হাল হয়েছে বেচারার। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই।
তাই তো, র্যাচেল। ভুলেই গিয়েছিলাম আমি।
এই সময়ে আমার সমবয়সী একটা ছেলে এসে ঢুকল ঘরে। ঘুম তাড়াবার জন্যে এক হাত দিয়ে চোখ কচলাচ্ছে, আরেক হাতে পিস্তল।
বাক, বললেন বৃদ্ধা, এই ছেলেকে নিয়ে যা। তোর কোন শুকনো কাপড় পরতে দে ওকে।
ঘাড় কাত করল বাক। ঘুম জড়ান চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, শেফার্ডসনদের কেউ আসেনি আজকে?
না, ওকে বললেন বৃদ্ধ।
আমাকে দোতলায় ওর ঘরে নিয়ে গেল বাক। ওর কাপড় বার করে পরতে দিল।
কদ্দিন থাকবে এখানে? প্রশ্ন করল ও। এবার খুব মজা করা যাবে। পরীক্ষা শেষ, স্কুলে লম্বা ছুটি।
কাপড় বদলান সারা হলে আমাকে নিচে নিয়ে গেল ও। সেখানে আমার জন্যে খাবার নিয়ে বসে ছিল ওরা। ভুট্টার রুটি, মাংস, মাখন আর ঘোল খেলাম। এত মজাদার জিনিসের স্বাদ এর আগে পাইনি কখনও। খিদেয় নাড়িভুড়ি চোঁ চোঁ করছিল, নেকড়ের মত সব চেটেপুটে খেলাম।
খাওয়ার পর শুরু হল জেরা। বললাম, আরকান-সয়ের দক্ষিণে থাকত আমাদের পরিবারের সবাই। সেখানে একটা গোলাবাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা। আমার বোন, মেরি অ্যান, পালিয়ে বিয়ে করেছে। বহুদিন বোনের কোন খবর না পেয়ে বিল বেরিয়েছে তার খোঁজে। সেই থেকে সে-ও লাপাত্তা। দিনকয়েক আগে বাবা এবং আমার আর দুভাই টম আর মেট মারা গেছে। অগত্যা সামান্য যা সম্বল ছিল, তা-ই নিয়ে জাহাজে চেপে কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলাম। পথে নদীতে পড়ে যাওয়ায় এখানে এসেছি।
আমার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে দয়া হল ওদের মনে। বাছা, স্নেহার্দ্র গলায় বললেন বৃদ্ধা, তোমার যদ্দিন খুশি থাক এখানে।
ইতিমধ্যে প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, আমরা সবাই শুতে গেলাম। বাকের ঘরে একটা বাড়তি বিছানায় জায়গা হল আমার। শোয়র সঙ্গে সঙ্গে কাটা গাছের গুঁড়ির মত ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙতে খেয়াল হল, আমার নাম মনে করতে পারছি না। পাশ ফিরে বাককে জিজ্ঞেস করলাম, বাক, বানান করতে পার তুমি?
হ্যাঁ, বলল ও। আমি বাজি ধরে বলতে পারি আমার নামের বানান পারবে না তুমি।
পারব। বাজি?
বেশ।
জি-ই-ও-আর-জি-ই, জর্জ। জে-এ-এক্স-ও-এন, জ্যাকসন।
ঠিক, বললাম আমি। মনে মনে শপথ করলাম আর কিছুতেই নামটা ভুলব না। গোপনে লিখে রাখলাম বানানটা। বলা যায় না, কেউ হয়ত আমাকেই বানান করতে বলে বসবে।
১১. বাকের পরিবারের সবাই খুব ভাল
বাকের পরিবারের সবাই খুব ভাল, চমৎকার ব্যবহার। বাড়িটাও সুন্দর। সামনের দরজায় পেতলের হাতল। বসার ঘরে খাট-পালঙ্ক নেই, অথচ শহরের অনেক বৈঠকখানায় অমনটা দেখেছি আমি। ইটের তৈরি বিশাল ফায়ারপ্লেস। ম্যাপিসের ঠিক মাঝখানে একটা আজব ধরনের ঘড়ি। ঘড়িটার নিচের অংশে কাচের ওপর একটা শহরের ছবি আঁকা। তার মধ্যিখানে সূর্যের মত গোল ফাঁকা অংশ। সেখান দিয়ে পেন্ডুলামের দোলা দেখা যায়। তবে সবচেয়ে মজার জিনিস ওটার বাজনা। দেড়শবার না বেজে ক্লান্ত হয় না।
ঘড়ির দুপাশে দুটো টিয়া পাখি। চকমাটি জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। বেশ রংচঙে। একটা টিয়ার সামনে বেড়াল, আরেকটার সামনে কুকুর রাখা। দুটোই চিনেমাটির। কামরার মাঝখানে একটা টেবিল। তার ওপর চিনেমাটির আপেল কমলা আঙুর থরে থরে সাজান। ওগুলো দেখতে আসলের চেয়েও সুন্দর। কেবল দুএক জায়গায় চটা উঠে যাওয়ায় নকল বলে চেনা যায়।
টেবিলের ওপর চমৎকার অয়েক্লথ পাতা। তাতে ডানা মেলা লাল-নীল ঈগলের ছবি। ছবির চারদিকে রঙিন বর্ডার। অয়েলক্লথটা ফিলাডেলফিয়া থেকে আনা, জানাল ওরা। টেবিলের চার কোণে থাক থাক বই। ওগুলোর ভেতর একটা আবার বিরাট আকারের পারিবারিক বাইবেল, ছবিতে ভর্তি।
দেয়ালে ছবির গ্যালারি। বেশির ভাগই ওঅশিংটন, লাফায়েত এ ধরনের নামকরা লোকেদের। যুদ্ধের ছবিও আছে কয়েকটা। রঙিন পেন্সিলে আঁকা ছবি দেখলাম। ওগুলোকে নাকি ক্রেয়ন বলে, ওরা জানাল।
এগুলো আমার এক বোনের আঁকা, বলল বাক। ওর নাম এমেলিন। ওর বয়স যখন পনের, তখনকার আঁকা। মারা গেছে সে।
এতদিন আমি যেসব ছবি দেখেছি, তার সাথে এগুলোর মিল নেই। সাধারণত যা দেখা যায় তার চেয়ে একটু বেশি কালো। একটা ছবি আমার কাছে ভারি অদ্ভুত ঠেকল। ছবিটা অসম্পূর্ণ। লম্বা সাদা গাউন পরা এক যুবতী, ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে লাফিয়ে পড়ার জন্যে। চুল পিঠ বেয়ে নেমেছে। চাঁদের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। দুচোখে অশ্রুর ধারা। হাত বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। এছাড়াও আরও চারটে হাত আঁকা ছবিতে। তার এক জোড়া সামনে প্রসারিত, বাকি দুহাত চাঁদের দিকে তোলা। ছবিটা শেষ করার আগেই মারা যায় এমেলিন। ওর ইচ্ছে ছিল সবচেয়ে সুন্দর হাত দুটো রেখে বাকিগুলো মুছে দেবে। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত।
বাকের বাবা, কর্নেল গ্র্যানজারফোর্ড খাঁটি ভদ্রলোক। অমায়িক। লম্বা, ছিপছিপে গড়ন। তামাটে রং। মুখে একগাছা দাড়ির চিহ্ন নেই, রোজ সকালে ক্ষৌরি করা চাই। পাতলা ঠোঁট। বাঁশির মত খাড়া নাক। ঘন ভ্রু, আর এক জোড়া গভীর কালো চোখ। তাকালেই মনে হয় যেন অন্তস্তল পর্যন্ত সব দেখে নিচ্ছেন। উঁচু, চওড়া কপাল। ধবধবে সাদা বাবরি চুল। তার মত অমন দীর্ঘ, সরু হাত আমি আর কখনও দেখিনি। রোজ সকালে ধোয়া শার্ট আর সাদা স্যুট পরেন। এত সাদা যে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রোববারে পরেন একটা নীল টেইল কোট। তাতে পেতলের বোতাম লাগান। যেখানেই যান, মেহগনি কাঠের একখানা ছড়ি থাকে তার হাতে। সেটার বাট রুপো দিয়ে বাঁধানো। কখনও জোরে কথা বলেন না। অত্যন্ত দয়ালু। দেখামাত্র এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে মনে ধরেছিল আমার।
সবার বড় বব। তারপর টম। দুজনেই সুপুরুষ। চওড়া কাঁধ। দীর্ঘকালো চুল। আর ঠিক বাপের মত গভীর কালো চোখ। ওরাও, বৃদ্ধের মতই, সাদা স্যুট আর চওড়া শোলার টুপি পরে।
ওই দুজনের পরেই জিম শার্লট। পঁচিশ বছর বয়েস। দীর্ঘকায়। চমৎকার ব্যক্তিত্ব। দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে, ঠিক তার বাবার মত।
মিস সোফিয়ার স্বভাব আবার একদম এর উল্টো। ঘুঘুর মত শান্ত আর মিষ্টি। বয়েস মাত্র কুড়ি। এদের প্রত্যেকেরই একজন করে খাসচাকর আছে। নিগ্রো।
এরা ছাড়াও আরও তিন ভাই ছিল ওদের। খুন হয়েছে তারা। আর এমেলিনের কথা তো আগেই বলেছি। গ্র্যানজারফোর্ডরা বেশ কয়েকটা খামারের মালিক। নিগ্রো চাকর একশোর ওপর। প্রায়ই দূর-দূরান্ত থেকে ঘোড়ায় চড়ে অনেক লোক আসে এদের বাসায়। পাঁচ-ছদিন থাকে। খুব আমোদ-ফুর্তি হয় তখন।
এদের সমকক্ষ আর একটি মাত্র বংশ ছিল ওই এলাকায়। ওরাই হচ্ছে শেফার্ডসন পরিবার। এই দুই পরিবারের মধ্যে আবার শত্রুতা ছিল। একদিন তার নমুনা দেখলাম আমি।
বাক আর আমি জঙ্গলে শিকারে গেছি, হঠাৎ ঘোড়র পায়ের আওয়াজ পেলাম।
জলদি! শিগগির ঝোপের আড়ালে লুকোও, বলল বাক।
তা-ই করলাম আমরা। একটু বাদে দেখলাম, সুদর্শন এক যুবক ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। সৈনিকের মত দেখাচ্ছে তাকে। জিনের সামনে বন্দুক ঝোলান। ওকে আগেও দেখেছি আমি—হারনি শেফার্ডসন। চোখের পলকে বাকের গুলিতে হারনির টুপি উড়ে গেল। হারনি ঘোড়া ছুটিয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে আসতেই চম্পট দিলাম আমরা। বাককে নিশানা করে দুবার গুলি ছুড়ল সে, কিন্তু লাগাতে পারল না। তারপর, হয়ত টুপিটা উদ্ধার করতেই, যেদিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকে চলে গেল হারনি। আমরাও বাসায় ফিরে এলাম।
সব শুনে বৃদ্ধের চোখ জ্বলে উঠল- আমার মনে হল আনন্দেই হল অমনটা-তারপর মুখের পেশিতে ঢিল পড়ল, স্নিগ্ধ হয়ে এল চেহারা। ঠিকই করেছ, বললেন তিনি। তবে এরকম পেছন থেকে গুলি ছোড়া আমি পছন্দ করি না। তুমি রাস্তায় উঠে এলে না কেন, বাবা?
ওরাও তো বরাবর পেছন থেকেই হামলা করে, বাবা।
বাকের গল্প শোনার সময়ে মিস শার্লটের চোখজোড়া জ্বলে উঠল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল ওদের বড় দুভাই। মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ক্রুদ্ধ হয়েছে তারা। কিন্তু মিস সোফিয়ার মুখ প্রথমে মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল; তারপর যেই শুনল হারনির কিছু হয়নি, স্বাভাবিক হয়ে এল চেহারা।
পরে এক সময় বাককে জিজ্ঞেস করলাম আমি, বাক, তুমি কি ওকে খুন করতে চেয়েছিলে?
আলবত।
তোমার কোন ক্ষতি করেছে সে?
না।
তবে?
এ আমাদের পারিবারিক বিবাদ।
পারিবারিক বিবাদ? সে আবার কী জিনিস?
পারিবারিক বিবাদ এইভাবে হয়, বাক বলল, মনে কর, দুজন লোকের ঝগড়া। একজন আরেকজনকে মেরে ফেলল। তখন নিহত লোকের ভাই বদলা নিল, খুন করল সেই লোককে। এরপর এল আর ভাইয়েরা। এদিকে যেমন এল, ওদিকেও তেমনি এসে একে অপরকে মারতে লাগল। তারপর এল তাদের চাচাত ভাইয়েরা। এভাবেই সবাই খতম হয়ে যায়, এবং শত্রুতাও শেষ হয়। তবে ব্যাপারটা খুবই ঢিমেতালে এগোয়, সময় লাগে প্রচুর।
তোমাদের ঝগড়া কী নিয়ে, জমি?
ঠিক জানি না। বাবা হয়ত জানে। তা প্রায় তিরিশ বছরের লড়াই; কী থেকে এর সূত্রপাত, আজ আর কারো মনে নেই বোধহয়।
পরের রোববার গির্জায় গেলাম আমরা। শেফার্ডসনদের দেখলাম সেখানে। দুপক্ষই বন্দুক নিয়েছে সঙ্গে। দুহাঁটুর মাঝখানে, কিংবা কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছে, যাতে দরকারমত হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। খুব সাদামাঠাভাবে ভ্রাতৃপ্রেমের ওপর বক্তৃতা দিল পাদ্রি। একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। তবে ওরা সবাই বলল, ভালই হয়েছে বক্তৃতাটা। ফেরার পথেও ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই একই কথা বিশ্বাস, সৎকাজ, ভাগ্যের লিখন, যার মাথামুণ্ডু বুঝি না আমি বলল ওরা। আমার মনে হল জীবনে এ পর্যন্ত যে কটা বিরক্তিকর রোববার কাটিয়েছি, এটা তার একটা।
লাঞ্চের পর ঝিমুতে লাগল সবাই। রোদ-ছাওয়া ঘাসে টানটান হয়ে ঘুমুচ্ছে বাক আর একটা কুকুর। কেমন যেন বিষন্ন পরিবেশ। আমিও ঠিক করলাম একটু গড়িয়ে নেব। দোতলায় যেতেই মিস সোফিয়া তার ঘর থেকে ডাকল আমায়।
জর্জ, আমি ঘরে ঢুকতেই বলল সে, চার্চে আমার বাইবেলটা ফেলে এসেছি। তুই এনে দেনা, ভাই। কাউকে বলিস না যেন, কেমন!
কথা দিলাম মিস সোফিয়াকে, কাউকে বলব না। নিশ্চয়ই এর ভেতর কোন কিন্তু আছে, গির্জায় যাবার পথে মনে হল আমার। নইলে সামান্য একটা বাইবেরে জন্যে অমন ঘেমে উঠবে কেন মেয়েটা। বাইকেলটা হাতে নিতেই ওটার ভেতর থেকে একটা কাগজ টুপ করে মাটিতে পড়ল। তার ওপর পেন্সিলে লেখা: আড়াইটে। বাইবেলটা ভাল করে দেখলাম উলটে-পালটে, কিন্তু আর কিছুই পেলাম না। লেখাটার কিছুই বুঝলাম না আমি। কাগজটা আবার বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম।
বাসায় ফিরে দেখলাম আমার জন্যে দরজায় অপেক্ষা করছে মিস সোফিয়া। আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। কাগজটা বের করে পড়ল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই খুব ভাল।
লক্ষ্য করলাম, খুশিতে তার মুখ লালচে দেখাচ্ছে। দুচোখে তারার উজ্জ্বলতা। নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। মিস সোফিয়ার অদ্ভুত ব্যবহারের কথা ঘূর্ণির মত পাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার নিগ্রো চাকর পেছন পেছন আসছে। বাড়িটা চোখের আড়াল হতেই দৌড়ে এল সে।
মাস্টার জর্জ, ও বলল, চলেন আপনাকে জংলী তরমুজের ক্ষেত দেখিয়ে আনি।
ওর কথায় একটু বিস্মিত হলাম, এর আগেও একদিন আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছে ও। অথচ জংলী তরমুজ খায় না লোকে। তবু, কৌতুহল দমন করতে না পেরে, গেলাম ওর সঙ্গে।
প্রায় মাইলটাক দূরে আমাকে নিয়ে গেল সে। বেশির ভাগ জায়গাই জলা, থিকথিকে কাদা। অবশেষে ছোট্ট একটা দ্বীপে এসে উঠলাম আমরা। শুকনো, খটখটে। চারদিকে ঘন ঝোপ আর আঙুর লতায় ভরা।
যান, মালিক, দেখে আসুন গিয়ে, জ্যাক বলল।
কথা শেষ করে চলে গেল সে। আমি ঝোপের ভেতর ঢুকলাম। খানিক যেতেই একটা ফাঁকা জায়গায় পৌছুলাম। জায়গাটা আয়তনে একটা কামরার সমান। আঙুর লতায় ঢাকা পড়েছে চারপাশ। একটা লোক ঘুমিয়ে আছে সেখানে। আরে, একি! চমকে উঠলাম। লোকটা আর কেউ নয়, আমার বন্ধু জিম। ঠেলা দিয়ে জাগালাম ওকে। আমাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল জিম।
কী হয়েছিল তোমার? জিজ্ঞেস করলাম।
সে-রাতে তোমার ঠিক পেছনেই ছিলাম, শুরু করল জিম। তোমার ডাক শুনেছি, কিন্তু উত্তর দিতে সাহস পাইনি। কারণ তাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। চোট পাওয়ায় তোমার সাথে তাল মিলিয়ে সাঁতরাতে পারিনি। তাই যখন দেখলাম, তুমি ওই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে, আমি পাশেই জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রইলাম। পরদিন খুব সকালে কয়েকজন নিগ্রোর সাথে দেখা হয়। তারাই আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। চারদিকে পানি, কুকুর আমার গন্ধ পাবে না। রোজ রাতে ওরাই আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসে। তুমি কেমন আছ না আছ, জানায়।
জ্যাককে বললেই পারতে আরও আগেই আমাকে এখানে নিয়ে আসতো।
একটু গুছিয়ে নিতে চাইছিলাম আরকি। এখন আর আমাদের কোন অসুবিধে নেই, হাক। হাঁড়িপাতিল কিনেছি। ভেলাটাও মেরামতের…
কোন ভেলা, জিম? ওর কথার মাঝে বাধা দিলাম।
আমাদেরটা!
কিন্তু সেতো চুরমার হয়ে গেছে?
না। কেবল একপাশে একটু ভেঙেছিল।
ওটা পেলে কী ভাবে?
পাড়ে ডাল-পালায় বেঁধে আটকে ছিল। এই খামারের নিগ্রোরা দেখতে পেয়ে একটা ঝাউ-ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে।
উফ! জিম! দারুণ!
১২. পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে শোব, হঠাৎ মনে হল, সব যেন চুপচাপ। মনেই হচ্ছে না, কেউ আছে বাড়িতে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঠেকল না আমার কাছে। কাপড় পাল্টে নিচে গেলাম। কোথাও কোন জনমন্যিষ্যির চিহ্ন নেই। থমথমে পরিবেশ। বাইরের উঠোনে গিয়ে দেখলাম লাকড়ির গাদার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক।
ব্যাপার কী, জ্যাক?
আপনি জানেন না, হুঁজুর?
না।
মিস সোফিয়া পালিয়েছেন। হারনি শেফার্ডসনের সাথে। সবাই নদীর ধারে গেছে, মিস্টার হারনিকে খুন করবে! ওঁদের ধারণা মিস সোফিয়াকে নিয়ে নদী পথেই পালাতে চেষ্টা করবেন তিনি।
ফেরিঘাটের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগালাম আমি। কিছুদূর যেতেই গুলির আওয়াজ পেলাম। চটপট একটা তুলো গাছের দোতলায় উঠে বসলাম। গাছটার সামনেই স্তূপাকারে সাজান কাঠ। প্রথমে ওই কাঠের গাদায় পালাব ভেবেছিলাম। ভাগ্যিস পালাইনি।
জনা পাঁচেক ঘোড়সওয়ার কাঠ-গুদামের সামনের উঠোনে হৈ-হল্লা করছিল। স্টিমারঘাটের কাছেই আরেকটা কাঠের স্তূপ। ওটার পেছনে দুটো বাচ্চা ছেলে লুকিয়ে রয়েছে। ওদের সেখান থেকে বের করাই ঘোড়সওয়ারদের উদ্দেশ্য। কিন্তু ছেলে দুটো কিছুতেই বেরুতে পারছে না। সে চেষ্টা করলেই গেলেই রাইডাররা গুলি ছুড়ছে ওদের লক্ষ্য করে। ছেলে দুটো পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। ফলে দুপাশেই নজর রাখতে পারছে।
এক সময় লোকগুলো পাঁয়তারা থামিয়ে গুদামের দিকে এগিয়ে গেল। আচমকা একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের তাক করে গুলি ছুড়ল। গুলির আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল একজন। অন্যেরা তখন ঘোড়া থেকে নেমে আহত লোকটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল গুদামের দিকে। ঠিক সেই অবসরে ছেলে দুটো আমি যে গাছে বসে আছি সেদিকে দৌড়ে এল। মাঝপথেই ওদের ওপর চোখ পড়ল লোকগুলোর। নিমেষে ঘোড়া নিয়ে তেড়ে এল তারা। কিন্তু কিছু করার আগেই ছেলে দুটো কাঠের গাদার আড়ালে গা ঢাকা দিল। ওদের একজন বাক। অন্যজনকে আমি চিনি না। বছর উনিশ বয়েস তার।
লোকগুলো প্রথমে তোলপাড় করে খুঁজল ওদের, তারপর চলে গেল ঘোড়া ছুটিয়ে। ওরা দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতেই বাককে জানান দিলাম, ঠিক ওর মাথার ওপরেই বসে রয়েছি আমি।
নজর রাখ, জর্জ, বাক চেঁচিয়ে বলল। ওদের আবার দেখলেই জানাবে।
আমার খুব ইচ্ছে হল গাছ থেকে নামি। কিন্তু সাহসে কুলালো না। বাক জানাল, তার বাবা আর বড় দুভাই মারা গেছে। বিপক্ষেরও দুতিনজন খতম হয়েছে।
মিস সোফিয়া, হারনি—এদের খবর কী?
নদীর ওপারে।
ওরা নিরাপদে আছে শুনে খুশি হলাম আমি। কিন্তু সেদিন হারনিকে মারতে না পারায় আফসোস করতে লাগল বাক।
গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম! আচমকা একঝাক গুলি ছুটে এল। লোকগুলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পেছন থেকে চুপিসারে এগিয়ে এসেছে। বাক আর তার সঙ্গী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীর ধরে ওদের পিছু নিল লোকগুলো। অনবরত গুলি ছুড়ছে আর বলছে, মার শালাদের! মার! কথাটা দারুণ অস্থির করে তুলল আমাকে, আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলাম গাছ থেকে।
সন্ধে অবধি গাছের ওপরই বসে রইলাম, ভয়ে নিচে নামলাম না। মাঝেমধ্যে দূর-জঙ্গল থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দু-দুইবার গুদাম ঘরের পাশ দিয়ে বন্দুক হাতে কয়েকজন ঘোড়সওয়ার ছুটে গেল। বুঝলাম, গোলমাল চলছে এখনও। ভীষণ দমে গেল আমার মন। গ্যানজারফোর্ডদের বাড়িতে আর যাব না, স্থির করলাম মনে মনে। অনুশোচনা হল, আমার দোষেই এসব ঘটেছে। মিস সোফিয়ার বাবাকে ওই কাগজটার কথা জানান উচিত ছিল আমার। তাহলে হয়ত মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতেন তিনি। এবং এতসব কাণ্ড ঘটত না।
গাছ থেকে নেমে নদীর তীর ধরে বুকে হেঁটে চললাম। পথেই দুটো লাশ দেখতে পেলাম, জলের কিনারে পড়ে আছে। লাশ দুটো ডাঙায় টেনে তুলে তাদের মুখ ঢেকে দিলাম। বাকের মুখ ঢেকে দেয়ার সময়ে আমার দুচোখ জলে ভরে এল। ওর সাথে দারুণ ভাব ছিল আমার।
ইতিমধ্যে আঁধার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে! জিম যেখানে আছে, দ্রুত এগিয়ে গেলাম সেদিকে। কিন্তু জিমকে পেলাম না দ্বীপে। তখন নদীর বাঁক লক্ষ্য করে ঝাউবনের ভেতর দিয়ে ছুটে চললাম। ভেলা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ভেসে পড়া যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু বাঁকের মুখে পৌছুতেই রক্ত হিম হয়ে এল-ভেলা নেই। গলা ফাটিয়ে ডাকলাম জিমকে।
কে, হাক? কয়েক হাত দূর থেকে ওর গলা ভেসে এল।
জিমের সাড়া যেন আমার কানে মধু ঢালল। নদীর কিনার ধরে দৌড়ে গিয়ে ভেলায় উঠলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরল জিম। গদগদ সুরে বলল, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, বাছা! আমার তো ভয় হয়েছিল, এবার নিশ্চয়ই মারা গেছ তুমি। উফ! তোমাকে জ্যান্ত দেখে কী খুশিই-না লাগছে!
মিসিসিপি নদীতে আবার এসে না পড়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পেলাম না মনে। দুমাইল যাবার পর মাঝ-নদীতে পৌঁছে সঙ্কেত-লণ্ঠনটা ঝুলিয়ে দিলাম। নিজেদের আবার মুক্ত-স্বাধীন মনে হল। দুদিন যাবৎ অভুক্ত, ভুট্টার মোয়া, মাংস আর শাকসবজি দিয়ে খেতে দিল জিম। গোগ্রাসে খেতে লাগলাম আমি। ওই ভয়ঙ্কর পারিবারিক যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরতে পেরে আনন্দ লাগছে। জিমও খুশি, জলাভূমি থেকে পালাতে পেরেছে সে।
ভেলার মত বাসা আর হয় না, বললাম।
ঠিক। অন্ধকারে জিমের দাঁত দেখা গেল। আরও তিনদিন পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে। মনে হচ্ছে, যেন তরতর সাঁতরে চলে যাচ্ছে সময়, সুন্দর শান্ত ভঙ্গিতে। সামনে বিশাল রাক্ষসী নদী। কোথাও কোথাও মাইল দেড়েক চওড়া। রাত্তিরে চলি আমরা, সকাল হবার আগেই মরা পানি দেখে কোন বাঁকের মাথায় ভেলা বেঁধে রাখি। ছোট ছোট ডালপালা কেটে ঢেকে দিই ভেলাটা। মাছের চার ফেলে নদীতে নেমে সাঁতরে নিই। বেশ ঝরঝরে লাগে শরীরটা। তারপর বালুচরে বসে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় থাকি।
কোনখানে টু শব্দ নেই। নীরব-নিস্তব্ধ। গোটা পৃথিবী যেন ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল থেকে থেকে কোলা ব্যাঙের ডাক ভেসে আসে। পানির ওপর আবছা একটা রেখা দেখা যায় ওপাশের জঙ্গল। এছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না তখন। তারপর একটু একটু করে ফরসা হতে শুরু করে আকাশ, কবুতরের ডিমের বরণ হয়, নদীর ওটাও ফিকে হয়ে আসে, তত কালো আর দেখায় না। ধীরে ধীরে লাল হয়ে ওঠে পুব-আকাশ। সতেজ, ঠাণ্ডা বাতাস ফুলের বুক থেকে মিঠে গন্ধ বয়ে আনে। একটু পরেই হেসে ওঠে সূর্য।
আরও কিছুক্ষণ পরে উঠে নাস্তা সারি। তারপর অলসভাবে বসে নদীর একাকিত্ব দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি এক সময়। জাগি, আবার ঘুমোই। কখনও হয়ত চোখে পড়ে দূর থেকে একটা স্টিমার এগিয়ে আসছে—থেকে থেকে খুক করে কেশে উঠছে ওটা। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক আবার সব নিঝুম। চারদিকে কেবল নিরেট নির্জনতা।
এইভাবে বেশ কাটছে দিনগুলো। মাঝেমধ্যে অনেকক্ষণের জন্যে নদীটা একান্তই আমাদের হয়ে যায়। তখন আশপাশে কোথাও কোন জনপ্রাণী চোখে পড়ে না। মাথার ওপর তারার মেলা। একদিন কথায় কথায় জিম বলল, ওগুলো নাকি চাঁদের ডিম। কথাটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। কারণ ব্যাঙও এরকম ডিম পাড়ে, আমি দেখেছি। যেসব তারা আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে, সেগুলোও লক্ষ্য করি আমরা। জিম বলে, ওগুলো পচে গেছে, তাই বাসা থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। কোন কোন রাতে দেখি এক-একটা স্টিমার অন্ধকার চিরে চলে যাচ্ছে। অনেক সময়ে সেগুলোর চিমনি দিয়ে, আগুনের ফুলকি বেরোয় বৃষ্টির মতো নদীর ওপর ঝরে পড়ে।
দুপুর রাতের পর নদীতীরের লোকেরা ঘুমোতে যায়। তখন দুতিন ঘণ্টার জন্যে ফের সবকিছু অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। কোন ঘরের জানলা দিয়ে আলোর রেখাও বাইরে আসে না আর। ওই ক্ষীণ আলোটুকুই আমাদের ঘড়ি। আবার যখন কোন ঘরে বাতি জ্বলে ওঠে, আমরা বুঝতে পারি সকাল হতে আর দেরি নেই। তাড়াতাড়ি লুকোবার মত একটা জায়গা খুঁজে পেতে সেখানে বেঁধে ফেলি ভেলাটাকে।
একদিন ভোরে, পুবের আকাশ পুরোপুরি ফরসা হয়নি তখনও, কেবল কালো রেখাটা লাল হয়ে গিয়েছে, কপালগুণে একটা ডিঙি পেয়ে গেলাম আমি। ডিঙিটা নিয়ে পাড়ে গেলাম, ইচ্ছে ফল-মূল কিছু মেলে কি-না দেখব। হঠাৎ দেখলাম দুজন লোক গায়ের দিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে।
আমাদের বাঁচাও, কেঁদে পড়ল ওরা। আমাদের পেছনে ওরা কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে। ওরা লাফিয়ে আমার ডিঙিতে ওঠার চেষ্টা করল।
ভুলেও এ কাজ কোরো না, বললাম। এখন পর্যন্ত কোন কুকুর বা ঘোড়ার শব্দ পাচ্ছি না। তোমাদের হাতে এখনও সময় আছে। ঝোপের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালাও। খানিকটা গিয়ে এই নালায় নেমে পানি ভেঙে আমার এখানে এস। তাহলে গন্ধ শুকে শুকে কুকুরগুলো ধরতে পারবে না তোমাদের।
তাই করল ওরা। সাথে সাথে ডিঙি খুলে ভেলার উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি। কয়েক মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম ভেলায়।
ওদের একজনের বয়েস সত্তর বা তার কিছু বেশি। মাথাটা শান বাঁধান স্টিমারঘাটের মত চকচকে। পাকানো গোঁফ, ঝাঁটার মত। পরনে তেলচিটে নীল পশমি শার্ট আর ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট। প্যান্টের ঝুল বুটের ভেতর আঁটসাট করে ঢোকান।
অপরজনের বয়েস অনেক কম, তিরিশের বেশি নয়। মলিন বেশ। দুটো চটের থলে আছে ওদের সাথে; জীর্ণ, তালি মারা।
তুমি বিপদে পড়লে কীভাবে? যুবককে জিজ্ঞেস করল ঝাটা-গোঁফ।
দাঁতের মাজন বিক্রি করতাম আমি। মাজনটা ভাল, দাগ তুলে ফেলে, তবে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে লোকজন খেপে গেল, মারবে আমাকে। তাই পালিয়েছি। আঁটাগোঁফের দিকে ঘুরল সে, জিজ্ঞেস করল তুমি?
গেল হপ্তা থেকে মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করি আমি। ভালই আয় হচ্ছিল প্রথম দিকে, প্রতি রাতে ছ ভলারের মত। তারপর কী করে যেন রটে গেল আমি আসলে একটা মাতাল। সর্বদা মদ লুকোনো থাকে সঙ্গে। আজ ভোরে এক নিগ্রো ঘুম ভাঙিয়ে জানাল, গোপনে তৈরি হচ্ছে সবাই, আমাকে সঙ সাজিয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে সারা গা ঘোরাবে। একথা শোনার পর আর দেরি করিনি।
বুড়ো খোকা, বলল যুবক, এস আমরা দুজন হাত মেলাই।
আমার আপত্তি নেই। কী কী কাজ পার তুমি?
ছাপাখানার কাজ। এক-আধটু ডাক্তারি। মাঝেমধ্যে রুচি বদলের জন্যে মাস্টারি। অভিনয়ও পারি, দুঃখের নাটক হলেই জমে ভাল। তোমার?
জীবনের বেশি সময় কেটেছে ডাক্তারি করে, বলল আঁটাগোঁফ। ভাগ্য গুনতেও জানি, মক্কেল সম্পর্কে আগেভাগে কিছু জানতে পারলে নেহাত মন্দ করি। আবার ধর্মপ্রচারেও বেশ হাতযশ আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল যুবক।
কী হল? জিজ্ঞেস করল ঝাটা-গোঁফ।
ঘেন্না হচ্ছে নিজের ওপর, কী সব লোকের সাথে দিন কাটাচ্ছি! বলল যুবক। তারপর শার্টের খুঁট দিয়ে একটা চোখের কোণ মুছে বলল, যাক! এই নিষ্ঠুর পৃথিবী হয়ত আমার সবকিছু ছিনিয়ে নেবে, কিন্তু কবরটা তো আর নিতে পারবে না। সেখানেই আমার দুঃখী আত্মা শান্তিতে ঘুমুতে পারবে।
ব্যা! ভেংচি কাটল আঁটা-গোঁফ। কেন, আমরা আবার কী ক্ষতি করলাম তোমার? জিজ্ঞেস করল রাগত সুরে।
তোমরা কিছুই করনি। সব দোষ আমার। নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছি। কোন্ ঘরে আমার জন্ম, তোমরা হয়ত বিশ্বাসই…
কোন ঘরে?
ভাইয়েরা, গম্ভীর গলায় বলল যুবক, আমার কথা শোন তোমরা। জন্মসূত্রে আমি একজন ডিউক।
জিম আর আমি দারুণ চমকে উঠলাম, আরেকটু হলেই পড়ে যেতাম ভেলা থেকে।
জি, বলল যুবক। আমার দাদার দাদা, ডিউক অব ব্রিজওয়াটারের বড় ছেলে, পঞ্চাশ বছর আগে এদেশে আসেন। এখানেই বিয়ে করেন তিনি, এবং এক ছেলে রেখে মারা যান। ওই সময় তার বাবাও মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর ছোট ছেলে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু আসল ডিউক তখন দুধের শিশু, কিছুই পেলেন না তিনি। আমি সেই শিশুরই বংশধর, ব্রিজওয়াটার রাজ্যের আইনসঙ্গত ডিউক! একটু থেমে যোগ করল যুবক, অথচ এখন, কতগুলো দুর্বৃত্তের সাথে ভেলায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
লোকটার জন্যে ভীষণ দুঃখ হল আমাদের। সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু ও বলল, খালি কথায় কোনই লাভ হবে না আমার। তোমরা সত্যিই আমার ভাল চাইলে, ডিউক-এর সম্মান দেখাবে আমাকে। কথা বলার আগে কুর্নিশ করবে। মালিক অথবা হুঁজুর বলে ডাকবে। শুধু ব্রিজওয়াটার বললেও চলবে। কারণ এটা কোন নাম নয়, পদবি। আর আমার খাওয়ার সময়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যখন যা বলব, করবে।
জিম আর আমি রাজি হলাম ওর কথায়। কিন্তু বুড়ো লোকটা ঠিক পছন্দ করল না এটা। গুম মেরে গেল। ওইদিন বিকেলেই সে বলল, দ্যাখো, ব্রিজওয়াটার, সত্যি আমার দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্যে। তবে, কথা হচ্ছে গিয়ে তুমি একাই দুর্ভাগ্যের শিকার নও। তারপর কান্নাজড়িত গলায় বলল, ব্রিজওয়াটার, তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?
আলবত।
আমি ডফিন, যার কথা সবাই ধরে নিয়েছে সে মারা গেছে। জিম আর আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
কী? চমকে উঠল ডিউক।
হ্যাঁ, বন্ধু। আমিই ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের হারিয়ে যাওয়া ছেলে ডফিন। ফ্রান্সের আইনসঙ্গত সম্রাট সপ্তদশ লুই।
বুড়োর জন্যে খুব দুঃখ হল জিম আর আমার। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
এসবে হবে না, বলল সে। আমাকে সম্রাট বলে অবশ্যই কুর্নিশ করবে। কিছু বলতে চাইলে আগে সম্মানসূচক শব্দ জাহাপনা ব্যবহার করবে। খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকবে। এবং আমি হুঁকুম না-দেয়া পর্যন্ত বসবে না।
এবারেও জিম আর আমি আপত্তির কিছু দেখলাম। কিন্তু ডিউক মনমরা হয়ে রইল।
ব্রিজওয়াটার, বলল সম্রাট, মুখ ভার করে আছ কেন? নাও, এস, হাত মেলাও।
সম্রাটের সাথে করমর্দন করল ডিউক। জিম আর আমি খুশি হলাম; কারণ মানুষ যখন বন্ধুর মত ব্যবহার করে, জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়।
তবে এরা দুজন যে ডাহা মিথুক, ঠগ-সেকথা বুঝতে বেশি সময় লাগল না আমাদের। অবশ্য সেটা জানতে দিলাম না ওদের। সম্রাট বা ডিউক বলে ডাকলে ওরা যদি খুশি হয়, আমাদের এই পরিবারের শান্তি বজায় থাকে, আমাদের আপত্তির কিছু নেই।
১৩. এক দুজন নানান প্রশ্ন করল আমাদের
এক দুজন নানান প্রশ্ন করল আমাদের। জানতে চাইল, আমরা কেন রাতের বেলায় চলি, আর দিনে লুকিয়ে রাখি ভেলা।
জিম কি পলাতক নিগ্রো? ওরা জিজ্ঞেস করল।
পাগল! আঁতকে ওঠার ভান করলাম, তাহলে কি আর দক্ষিণে যায়। এরপর আমাদের এহেন আচরণকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে একটা গল্প খাড়া করলাম: মিসৌরির পাইক কাউন্টিতে থাকতাম আমরা। সেখানেই আমাদের জন্ম। আমার বাবা, আমি আর ছোট ভাই আইক ছাড়া সবাই মরে হেজে গেছে। বাবা ঠিক করল আমার বেন কাকার ওখানে গিয়ে থাকৰে। অরলিয়স থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে বেন কাকার ছোট্ট একটা কুঁড়ে আছে। বাবা ছিল গরিব, কিছু ঋণও ছিল তার। ফলে ঋণ শোধের পর তার কাছে মাত্র ষোলটি ডলার আর আমাদের এই নিগ্রো চাকর জিম ছাড়া কিছুই রইল না। কিন্তু ওই পয়সায় তো আর স্টিমারে চৌদ্দশ মাইল পাড়ি দেয়া যায় না। জোর বরাত, একদিন নদীতে যখন জোয়ার এল, বাবা ভেসে আসা এই ভেলাটা ধরে ফেলল। ঠিক হল, এটাতে চেপেই অরলিয়ন্স যাব আমরা। কিন্তু বাবার এই সৌভাগ্য শেষ অবধি টিকল না। ভেলার ওপর একটা স্টিমার চড়ে বসায় পানিতে ডুবে যাই আমরা। পরে জিম আর আমি ঠিক মত উঠলেও বাবা এবং আইক আর কোনদিনই উঠল না। বাবা ছিল বেহেড মাতাল, আর আইকের বয়েস তখন মাত্র চার বছর। এর পরের দুতিনটে দিন ভয়ে ভয়ে কাটে আমাদের। নৌকোয় যারাই জিমকে দেখেছে তারাই ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ওরা মনে করত জিম নিশ্চয়ই কোন পলাতক নিগ্রেী। সেই থেকে আমরা দিনের বেলায় চলাফেরা বাদ দিয়েছি।
ওদের হাবভাবে মনে হল আমার গুল বিশ্বাস করেছে। দেখি চিন্তাভাবনা করে, বলল সম্রাট, দিনের বেলায় চলাফেরার কোন মতলব ঠাওরান যায় কি-না। এমন একটা ফন্দি আঁটব, সব একদম ঠিক হয়ে যাবে।
রাতের দিকে ঘোর হয়ে এল চারদিক। মনে হল বৃষ্টি নামবে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গাছের পাতা কাঁপছে তিরতির। অনুমান করলাম একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। আমরা সবাই মিলে গোছগাছ করতে লেগে পড়লাম।
রাত একটু গভীর হতেই ছেড়ে দিলাম ভেলা। প্রায় দশটা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হল, সঙ্গে ঝড়। বাইরে আমাদের দুজনকে পাহারায় রেখে সম্রাট আর ডিউক ছইয়ের ভেতর আশ্রয় নিল। বারটা অবধি আমার পাহারা দেয়ার কথা। কিন্তু শোবার মত জায়গা পেলেও বাইরে থেকে নড়তাম না আমি। এরকম ঝড় দেখার সৌভাগ্য খুব কম মেলে। বাতাসের ভয়াবহ শো শো গর্জন। প্রতি এক সেকেন্ড পরপর আকাশটা ফালাফালা করে দিচ্ছে বিজলিচমক। সেই আলোয় আধমাইল এলাকা আলোকিত হয়ে উঠছে। বৃষ্টিধারার মাঝে ধুলোটে দেখাচ্ছে দ্বীপগুলো। কয়েকবার পাহাড় সমান ঢেউ ভেলা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল আমায়। কোন কাপড় ছিল না আমার পরনে, তাই কিছু হল না। হানাহুঁটো গাছের ডালপালা উড়ে আসার কোন ভয় ছিল না আমাদের, চোখ ধাঁধানো বিজলিচমকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আশপাশ।
এক সময় ঘুমে ঢলে পড়লাম আমি। বৃষ্টিবাদলের পরোয়া করলাম না, দিনটাও ছিল বেশ গরম। হঠাৎ একটা ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নেয়ার উপক্রম করল। ওই দেখে জিমের সে-কী হাসি। অগত্যা আবার পাহারায় বসলাম। জিম শুয়ে নাক ডাকতে লাগল। ধীরে ধীরে থামল ঝড়ের দাপাদাপি, প্রকৃতি একেবারে নিথর হয়ে গেল। তীরে, একটা কেবিনে আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে জাগালাম সবাইকে। তারপর ভেলাটা লুকিয়ে রাখলাম এক জায়গায়। থিয়েটারে অভিনয় করেছ কখনও? নাস্তার পর সম্রাটকে প্রশ্ন করল ডিউক।
না।
করবে। এর পরের শহরটাতেই নেমে গিয়ে মঞ্চ ভাড়া করব আমরা। সেখানে তৃতীয় রিচার্ড-এর তলোয়ার যুদ্ধ আর রোমিও-জুলিয়েট-এর ব্যালকনি দৃশ্য অভিনয় করব।
অভিনয়ের অ-ও জানি না আমি, ব্রিজওয়াটার, বলল সম্রাট। আমাকে শিখিয়ে নিতে হবে।
কুছপরোয়া নেই। এখনই পাঠ শুরু হোক!
সম্রাটকে রোমিও-জুলিয়েটের পরিচয় জানাল ডিউক। ওরা একে অন্যকে ভালবাসত; কিন্তু বিয়ে হয়নি, দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া ছিল। তাই মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে তারা। সবশেষে ডিউক যোগ করল, সে বরাবর রোমিও হয়; অতএব, সম্রাটকে জুলিয়েট হতে হবে।
তা কী করে হয়, প্রতিবাদ করল সম্রাট। আমার মাথায় টাক, গোঁফ সাদা, ঝাটার মত। মেয়েলোকের চেহারায় বেখাপ্পা দেখাবে না?
সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার লোকজন সব গেঁয়ো, অশিক্ষিত। কিস্যু টের পাবে না। তাছাড়া মেক-আপ থাকবে।
ঝোলার ভেতর থেকে কয়েক প্রস্থ পোশাক বের করল ডিউক। পর্দার কাপড় দিয়ে তৈরি। ওগুলোর দুটো দেখিয়ে বলল, এগুলো তৃতীয় রিচার্ড এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীর যুদ্ধের পোশাক। তারপর একটা নাইটি আর নাইট-ক্যাপ দেখিয়ে বলল, এগুলো জুলিয়েটের পোশাক।
কাপড়গুলো দেখে সন্তুষ্ট হল সম্রাট। ডিউকের নির্দেশমত নাটকের মহড়া দিতে লাগল।
বাঁকের তিন মাইল ভাটিতে ছোট্ট একটা জনপদ পড়ল। ডিনারের পর জায়গাটা ঘুরে দেখে আসতে ডাঙায় গেল ডিউক। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে আমাদের একটা ছাপানো বিজ্ঞপ্তি দেখালো। তাতে জিমের ছবি আঁকা। নিচে লেখা: ধরিয়ে দিন। পুরস্কার দুশ ডলার।
এবার, বলল ডিউক, দিনেও চলতে পারব আমরা। কাউকে আসতে দেখলে জিমকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখব। আর যারা আসবে তাদের ইস্তাহারটা দেখিয়ে বলব, ওকে ধরিয়ে দিতে যাচ্ছি।
পরদিন নাস্তার পাট চুকে যাবার পর পার্ট মুখস্থ করতে বসল সম্রাট, রোমিও জুলিয়েট নাটকের। বেশ কিছুটা আয়ত্তে আসার পর মহড়া শুরু করল। কীভাবে সংলাপ বলতে হবে, বারবার তাকে দেখিয়ে দিল ডিউক। বুকের ওপর হাত রেখে কেমন করে হা-হুঁতাশ করতে হয় শেখাল। সম্রাটের কাজ দেখে সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়।
ভালই হচ্ছে। তবে, সম্রাটকে বলল ডিউক, ওরকম ষাঁড়ের মত গলায় রোমিও বললে হবে না। নরম, কাতর স্বরে, রুগীর মতো করে বলতে হবে; রো-ও-ও-মি-ই-ও। জুলিয়েট শিশুর মত মিষ্টি একটা মেয়ে। সে গর্দভের মত চেঁচায় না।
এরপর ওরা দুটো কাঠের তলোয়ার দিয়ে ডুয়েলের মহড়া দিতে লাগল। সে এক দেখার মত জিনিস বটে। ভেলাজুড়ে নেচে কুঁদে বেড়াচ্ছে। একবার এ ওকে ধরে তো আরেকবার সে তাকে মারে। হঠাৎ এক সময় পা ফসকে পানিতে পড়ে গেল সম্রাট। আর সেই সাথে ওদের মহড়াও শেষ হল সেদিনের মত।
প্রথম সুযোগেই নাটকের কিছু বিজ্ঞাপনও ছেপে নিয়েছিল ডিউক। পরের দুতিনটে দিন ভেসে চললাম আমরা। ওদের মহড়ায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠল ভেলাটা। বেশির ভাগই তৃতীয় রিচার্ড নাটকের। একদিন সকালে ছোট্ট একটা শহরে এসে পৌঁছুলাম। শহরটা ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা খাড়ির ভেতর বাঁধলাম ভেলা। খাড়িটা ঘন সাইপ্রাস গাছে ছাওয়া। জিমকে ভেলায় রেখে ডিঙি নিয়ে শহরে গেলাম আমরা। উদ্দেশ্য, সেখানে নাটক করা যাবে কি-না দেখব ঘুরে।
আমাদের ভাগ্য ভাল, ওইদিন বিকেলেই সার্কাস হবে সেখানে। ভাঙাচোরা ওয়াগন আর বেতো ঘোড়ায় চড়ে গা থেকে লোক আসছে সমানে। সন্ধের পরপর সার্কাস পার্টি চলে যাবে, সহজেই শো করতে পারব আমরা। ডিউক একটা হল ভাড়া করল। আমরা শহরময় পোস্টার সাঁটলাম। পোস্টারে লেখা:
আবার শেক্সপিয়র!!!
বিরাট আকর্ষণ!
কেবল এক রাতের জন্যে!
ট্র্যাজেডি-সম্রাট ডেভিড গ্যারিক (ছোট), ড্রারি লেন
থিয়েটার, লন্ডন, এবং এডমন্ড কিন (বড়), রয়্যাল হে মার্কেট থিয়েটার, লন্ডন, ও
কন্টিনেন্টাল থিয়েটার্স
রোমিও-জুলিয়েট-এর ব্যালকনি দৃশ্য
রোমিও মিস্টার গ্যারিক
জুলিয়েট মিস্টার কিন
নতুন পোশাক, নতুন দৃশ্যসজ্জা!
এবং (বিশেষ অনুরোধে)
তৃতীয় রিচার্ড
রক্তহিম অসি-যুদ্ধের ভয়াবহ দৃশ্য
তৃতীয় রিচার্ড মিস্টার গ্যারিক
রিচমন্ড মিস্টার কিন
প্রবেশ মূল্য মাত্র ২৫ সেন্ট
শিশু ও চাকরদের জন্যে দশ সেন্ট
সন্ধের পর শেষ হল সার্কাস। বেশ জমাট ছিল। ভাল লাগল আমার। ঠিক করলাম, যখনই এরকম সার্কাস পাব, পকেট খালি করে হলেও দেখব।
আমাদের নাটকও হল সে-রাতে। মাত্র দশ-বারোজন দর্শক। কোনমতে খরচটা উঠে গেল। অভিনয় দেখে দর্শকরা হেসেই কুটিকুটি। ডিউক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এতে। শো ভাঙার আগেই সব লোক চলে গেল। কেবল একটা বাচ্চা ছেলে শেষ পর্যন্ত ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
এই গেঁয়ো ভূতগুলো শেক্সপিয়র বোঝে না, বলল ডিউক। সস্তা ভাঁড়ামি চায়। ঠিক আছে তা-ই পাবে ওরা।
১৪. পরদিন সকালে নতুন আরেকটা বিজ্ঞাপন
পরদিন সকালে নতুন আরেকটা বিজ্ঞাপন সাঁটলাম আমরা। ওতে লেখা:
কোট হাউসে!
মাত্র তিন রাত্রির জন্য!
ডেভিড গ্যারিক (ছোট)
এবং
এডমন্ড কিন (বড়)
রোমাঞ্চকর ট্র্যাজেডি পালা
দ্য রয়াল নানসাচ!!!
প্রবেশ মূল্য পঞ্চাশ সেন্ট।
মহিলা ও শিশুদের প্রবেশ নিষেধ
বিজ্ঞপ্তিটা ডিউকের মনে ধরেছিল। এরপরেও যদি মেয়েদের সঙ্গে না আনে ওরা, বলল সে, আরকান-সায়ের লোকদের এখনও চিনতে পারিনি আমি।
সে-রাতে দর্শক হুঁমড়ি খেয়ে পড়ল হলে, তিলধারণের জায়গা রইল না আর। শো শুরুর তখনও ঢের দেরি। শো আরম্ভ হবার আগমুহূর্তে স্টেজে এসে দাঁড়াল ডিউক। পালা আর এডমন্ড কিনের প্রশংসা করে লম্বা লম্বা বোলচাল দিল। তারপর মঞ্চের পর্দা উঠল। ব্যাঙের মত লাফাতে লাফাতে স্টেজে এল সম্রাট। প্রায় ন্যাংটো, সারা গায়ে বিচিত্র রঙের আঁকিবুকি। বুড়ো ভামের কীর্তি দেখে দর্শকরা হেসেই খুন।
একটু বাদেই ড্রপসিন নামিয়ে আবার দর্শকদের সামনে এল ডিউক। কুর্নিশ করে জানাল, এই পালা আর মাত্র দুদিন চলবে। কারণ লন্ডনে শো আছে। সব টিকেট গেছে সেখানে।
ডিউকের কথা শেষ হতে না হতেই কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, একি? শেষ হয়ে গেল?
হ্যাঁ, বলল ডিউক।
অমনি রোল উঠল দর্শকসারিতে, শালা ঠকিয়েছে। মঞ্চের দিকে ধেয়ে এল সবাই। এমন সময় এক দীর্ঘদেহী তাগড়া লোক একটা বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়াল।
থাম! বাজখাই গলায় বলল সে। আমার কথা শোন তোমরা।
সবাই চুপ করল। আমাদের বোকা বানিয়েছে তাতে ভুল নেই, লোকটা বলল। কিন্তু আমরা গোটা শহরের হাসির খোরাক হতে চাই না। অতএব, অন্যদেরও বোকা বানাতে হবে। ঠিক কি-না?
ঠিক। ঠিক। একযোগে সায় দিল সবাই। তাহলে বাসায় গিয়ে সবাইকে বলবে, চমৎকার নাটক। না-দেখলে পস্তাবে।
পরের রাতে আবার লোক ঠকালাম আমরা। তৃতীয় রাতেও হল গমগম করছিল লোকে। নতুন কেউ আসেনি; আগের দুরাতে যারা ঠকেছিল, তারাই এসেছে। ওদের হাতে পচা ডিম, টমেটো। আমাকে পেছন দরজা দিয়ে কেটে পড়ার নির্দেশ দিল ডিউক।
জলদি হাঁট, বলল সে। ভাগতে হবে।
রেকর্ড টাইমে ভেলায় পৌঁছে রওনা দিলাম আমরা। বেচারা সম্রাটের জন্যে দুঃখ হল আমার। নির্ঘাত ওকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাবে দর্শকেরা।
সম্রাটের কপালে খারাবি আছে, ডিউককে বললাম।
ঠোটের ফাঁক গলে আমার কথা বেরুনোর অবসর পেল না, ছইয়ের নিচ থেকে বেরিয়ে এল সম্রাট। এবার ওদিককার খবরাখবর বল, ডিউক। দাঁত কেলিয়ে হাসল সে।
অর্থাৎ, সম্রাট আদৌ শহরে যায়নি!
ওই শহর ছেড়ে দশ মাইল যাবার পর আলো জ্বেলে ডিনার সারলাম আমরা। তারপর গ্রীন হর্নস-এর লোকদের কীভাবে বুদ্ধু বানিয়েছে তাই নিয়ে মজাসে গল্প জুড়ল দুই ঠগ। টাকা গোনার সময় পাটাতনের ওপর গড়াগড়ি খেল। তিন রাতের রোজগার চারশ পঁয়ষট্টি ডলার।
কিছুক্ষণ পর ঘুমোতে গেলাম আমি। আমার পাহারা দেয়ার পালা এলেও জিম জাগাল না। প্রায়ই এমনটা করে সে। সকালে জেগে দেখলাম, দুহাঁটুর মাঝে মাথা গুজে আপন মনে হা-হুঁতাশ করছে জিম। ব্যাপারটা না-দেখার ভান করলাম। জানি, বাড়ির জন্যে বড্ড উতলা হয়ে পড়েছে ওর মন। বউ-ছেলেদের কথা চিন্তা করে কাতর হয়ে পড়েছে। বেচারা জিম! জীবনে কখনও বাড়ির বাইরে থাকেনি।
পরদিন সকালে একটা উইলো গাছের নিচে আস্তানা গাড়লাম। ভেলার মুখ মাঝনদীর দিকে তাক করা রইল। নদীর দুতীরেই গাঁ। ঠক দুজন ফন্দি আঁটতে বসল, কীভাবে সেখানে গিয়ে কাজ হাসিল করা যায়।
আমাকে বেঁধে রেখে যেয়ো না, মিনতি করল জিম। খুব কষ্ট হয়।
ঠিক আছে, বলল ডিউক।
ওর মাথায় প্রচুর বুদ্ধি। জিমকে কিং লিয়ারের জোব্বা, সাদা পরচুলা পরাল। ঝাটা-গোঁফ লাগিয়ে দিল নাকের নিচে। তারপর সারা গায়ে ফ্যাকাসে নীল রং মাখিয়ে দিল যাতে ওকে পানিতে ডোবা লোকের মত দেখায়। বীভৎস হয়ে উঠল জিমের চেহারা। ওরকম ভয়ানক চেহারা জীবনে দেখিনি আমি। ডিউক এবার গোটা গোটা হরফে একটা সাইনবোর্ড লিখল:
অসুস্থ আরব। বিপজ্জনক।
ছইয়ের সামনে বোর্ডটা টাঙিয়ে দিল সে। জিমকে বলল, কেউ আসছে টের পেলে খ্যাপা কুকুরের মত ঘেউ করে বেরিয়ে আসবে। তাহলেই ব্যাটারা ভেগে যাবে।
খাঁটি কথা বলেছে ডিউক, ভাবলাম। জিমকে এই অবস্থায় দেখলে অতি বড় সাহসীরও পিলে চমকে যাবে। মরা মানুষের চেয়েও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ওকে!
গায়ে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিল সম্রাট। নতুন কালো স্যুটে চমৎকার মানিয়ে গেল তাকে। চেহারায় আভিজাত্যের ভাব ফুটে উঠল। সামান্য পোশাক কী করে যে একজন অতি সাধারণ লোককেও অসাধারণ করতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। একটা স্বর্গীয় ভাব ফুটে উঠেছে সম্রাটের মুখে, যেন এইমাত্র রথে চেপে নেমে এসেছে মর্ত্যে। জিম ডিঙিটা সাফ করল। দূরে একটা স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে, মাল তুলছে।
এই পোশাকে, সম্রাট বলল, সেন্ট লুইস কিংবা সিনসিন্যাটির মত বড় কোন শহর থেকে আসা উচিত আমার। চল, হাকলবেরি, ওই স্টিমারে চড়েই গাঁয়ে আসব আমরা।
স্টিমারে চড়ার লোভে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। বৈঠা মেরে এগিয়ে গেলাম। পথে গোবেচারা টাইপের এক গ্রাম্য যুবকের সাথে দেখা হল। একটা গাছের গুড়িতে বসে কপালের ঘাম মুছছিল। তার সঙ্গে দুটো বিরাট সুটকেস। যুবককে দেখে ডিঙি তীরে ভেড়াতে বলল সম্রাট।
কোথায় যাচ্ছ? ডাঙায় উঠে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল সে।
স্টিমার ধরতে। নিউ অরলিয়ন্স যাব, যুবক বলল।
ডিঙিতে এস, সম্রাট আমন্ত্রণ জানাল। আমার এই চাকর ছোড়া তোমার স্যুটকেস নামিয়ে আনবে। যাও, এডোলাস, আমাকে উদ্দেশ করে বলল সম্রাট, সাহায্য কর ভদ্রলোককে।
আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ডিঙিতে উঠল যুবক। আবার রওনা দিলাম আমরা। আমাদের নতুন যাত্রী একটু বাচাল প্রকৃতির।
এই গরমে মালসামান নিয়ে চলা খুবই কঠিন ব্যাপার, মুখ খুলল সে। প্রথমে তোমাকে হার্ভে উইলকস্ মনে করে ভাবলাম যাক তাহলে সময় মতই এসে পড়েছ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল সে-তো ভাটির দিক থেকে আসবে, উজান থেকে নয়। তুমি তো হার্ভে নও, নাকি?
না, বলল সম্রাট। আমার নাম ব্লজেট, আলেকজান্ডার ব্লজেট। মিস্টার উইলকসের জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার। আহা! দেরি হওয়ায় বেচারার না জানি কত লোকসান হচ্ছে।
সম্পত্তি অবশ্য মার যাবে না, তবে ভাই মারা যাবার সময় সেখানে থাকতে পারল না, এটাই যা দুঃখ। ওর ভাই, পিটার, গত রাতে মারা গেছে। বহুকাল আগে ছাড়াছাড়ি হয়েছে দুজনার। সেই ছেলেবেলায়। আর একদম ছোট ভাই, উইলিয়মকে তো দেখেইনি কোনদিন। সে আবার বোবা-কালা। পিটার আর জর্জ—এই দুই ভাই এখানে এসে বসত গাড়ে। জর্জ গেল বছর মারা গেছে। এর মাসকয়েক পর তার স্ত্রী। এখন কেবল হার্ভে আর উইলিয়মই বেঁচে রইল। দুর্ভাগ্য ওদের, ভাইকে দেখতে পেল না।
খবর দেয়া হয়নি?
হয়েছে। পিটার বিছানায় পড়ার পরপরই-তাও প্রায় দুমাস হল। মরার আগে দুভাইকে দেখতে চেয়েছিল পিটার। হার্ভের নামে একটা চিঠি লিখে গেছে সে। তাতে জানিয়েছে কোথায় আছে তার টাকা-পয়সা। আর সম্পত্তি এমনভাবে ভাগ করতে বলেছে যাতে জর্জের মেয়েরা কোন অসুবিধেয় না পড়ে।
হার্ভের আসতে দেরি হচ্ছে কেন? কোথায় থাকে?
ইংল্যান্ডে। শেফিল্ড বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে। ওখানকার পাদ্রি সে।
বোধহয় চিঠি পায়নি, বলল সম্রাট। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, জর্জের মেয়েরা কত বড়?
মেরি জেনের উনিশ, সুসান পনের আর জোয়ানা চোদ্দ।
জিভ নেড়ে চুকচুক্ শব্দ করল সম্রাট। আহা! বেচারাদের না জানি কত কষ্ট হচ্ছে!
আরও খারাপ হতে পারত। পিটারের বন্ধুরা আছে বলেই বাঁচোয়া। ওরাই মেয়ে তিনটের দেখভাল করছে। পাদ্রি হবসন, লট হভে, বেন রাকনার, অ্যাবনার শ্যালফোর্ড, উকিল লেভি বেল, ডাক্তার রবিনসন। এদের বউরাও আছে। আর আছে এক বিধবা। মিস্টার বার্টলের স্ত্রী। এদের প্রত্যেকের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছে পিটার। এখানে এসে হার্ভে অনেক বন্ধু পাবে।
এসব ব্যাপারে সম্রাটকে অতি উৎসাহী মনে হল আমার। নানান জেরায় যুবকের কাছ থেকে পিটার উইল সম্পর্কে অনেক তথ্য বের করে নিল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, তলে তলে কোন মতলব আঁটছে বুড়ো ঝাঁটা-গোঁফ।
পিটার কী অনেক বড়লোক? জিজ্ঞেস করল সে।
বড়লোক? তা বলা যায়। একটা বাড়ি আর কিছু জায়গা আছে। অনেকে বলে নগদ চার-পাঁচ হাজার ডলারও নাকি লুকোন আছে কোথাও।
অন্ত্যেষ্টি নিশ্চয়ই কাল?
হ্যাঁ। দুপুর নাগাদ।
ইতিমধ্যে স্টিমারে পৌঁছে গেলাম আমরা। লোকটাকে স্যুটকেস নিয়ে জাহাজে উঠতে সাহায্য করলাম আমি। হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।
স্টিমারে যাওয়ার ব্যাপারে সম্রাট তার খানিক আগের মত বদলাল। ডাঙায় নামিয়ে দিতে বলল তাকে।
জলদি ভেলায় ফিরে গিয়ে ডিউককে পাকড়াও কর, বলল আমাকে। নতুন স্যুটটা পরে আসতে বলবে। সঙ্গে যেন নতুন স্যুটকেস দুটোও আনে।
নির্দেশ মত ডিউককে নিয়ে এলাম। সেই যুবকের কাছ থেকে যা-যা শুনেছে তাকে জানাল সম্রাট।
ব্রিজওয়াটার, আমাদের সামনে সুদিন, বলল ঝাঁটা-গোফ। তারপর দুজনেই হাসল একচোট। শালাদের মতলবটা কী? ভাবতে লাগলাম।
১৫. দুপুরের দিকে একটা বড় জাহাজ এল
দুপুরের দিকে একটা বড় জাহাজ এল। আমরা হাত দেখাতেই থামল ওটা। একটা বোট পাঠিয়ে দিল তীরে। ওই বোটে চেপে সম্রাট, ডিউক আর আমি জাহাজে উঠলাম। জিম ভেলাতেই রয়ে গেল। সিনসিন্যাটি থেকে আসছে জাহাজটা। আমরা মাত্র চার-পাঁচ মাইল যাব শুনে জাহাজের ক্যাপ্টেন রেগে কাই হয়ে গেল। বলল, নামিয়ে দেবে না আমাদের। শেষে সম্রাট যখন জানাল আমরা মাইল প্রতি এক ডলার ভাড়া দিতে রাজি, তখন সুর নরম করল সে।
গ্রামের কাছে এসে আমরা জালি বোটে চেপে ডাঙায় গেলাম। বোট আসছে দেখে বেশ কিছু লোক জমা হয়েছিল পাড়ে।
আপনাদের কেউ বলতে পারেন, পিটার উইলকস্ কোথায় থাকেন? লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করল সম্রাট।
দুঃখিত, স্যার, বলল একজন। আমরা বড়জোর বলতে পারি গত রাত পর্যন্ত কোথায় থাকত সে।
চোখের পলকে শয়তান বুড়ো যেন ভেঙে পড়ল একথা শুনে। কাঁদতে লাগল অঝোরে। দুর্বোধ্য ইশারায় কিছু বোঝাল ডিউককে। সে-ও কাঁদতে লাগল হাপুস নয়নে।
ব্যাপার দেখতে প্রচুর লোক জড় হয়ে গেল সেখানে। ভাঙা-ভাঙা গলায় সম্রাট বলল, পিটার উইলকস তাদের ভাই। পিটারের অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে এসেছে তারা। গ্রামের লোকেরা নানাভাবে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করল ওদের। পিটারের শেষমুহূর্তের সব কথা সম্রাটকে খুলে বলল। সে আবার ইশারায় বুঝিয়ে দিল ডিউককে। ওরা তারপর পিটার উইলকসের বাসায় নিয়ে গেল আমাদের। ইতিমধ্যে খবর রটে গেছে গাঁয়ে। পিটারের বাসায় সবাই ভিড় জমিয়েছে। তিনটে ফুটফুটে মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দোরগোড়ায়। ওরাই জর্জের মেয়ে। মেরি জেন-এর মাথার চুল লালচে। দুই কাকাকে দেখে তার দুচোখে খুশির বান ডাকল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সম্রাটের বুকে। এই মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখে উপস্থিত মহিলারা সুর করে কাঁদতে লাগল।
সম্রাট এরপর ধরা গলায় বর্ণনা দিল কীভাবে চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সে আর উইলিয়ম ছুটে এসেছে ভাইকে একনজর দেখার জন্যে। অথচ সেই ভাই-ই কিনা…! পিটারের বন্ধুদের ওইদিন রাতে খেতে বলে কথা শেষ করল সে। বলল, দাওয়াত কবুল করলে সে আর তার ভাইঝিরা খুশি হবে কারণ বন্ধুদের কথা প্রত্যেক চিঠিতেই উল্লেখ করত পিটার। মিস্টার হবসন, লট হভে, বেন রাকনার, অ্যাবনার শ্যাফোর্ড, লেভি বেল, ডাক্তার রবিনসন-এদের নাম করল সম্রাট। ওদের স্ত্রী এবং বিধবা মিসেস বার্টলের কথাও বাদ দিল না।
পাদ্রি হবসন আর ডাক্তার রবিনসন ছিল না, দরকারি কাজে গাঁয়ের আরেক প্রান্তে গেছে। ব্যবসার কাজে লেভি বেলও বাইরে, তবে আর সবাই ছিল। এগিয়ে এসে সম্রাট আর ডিউকের সাথে করমর্দন করল তারা।
সম্প্রতি গায়ে যা-যা ঘটেছে সেসব ব্যাপারে ওদের সাথে আলাপ করল সম্রাট। বলল পিটারের চিঠিতে এসব কথা থাকত। বেমালুম একের পর এক গুল মেরে গেল সে; কোথাও ঠেকল না। জাহাজঘাটার সেই লোকটার কাছ থেকে সব কথাই জেনে নিয়েছিল শয়তানটা।
মেরি জেন তার পিটার কাকার উইল নিয়ে এল। উইলটা পড়ার সময় কাঁদতে লাগল সম্রাট। তিন হাজার ডলার পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা আর তার বাড়িটা তিন ভাইঝিকে দিয়ে গেছে পিটার। ট্যানারি, এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি, যার দাম প্রায় সাত হাজার ডলার, পাবে হার্ভে ও উইলিয়ম। এছাড়াও দুই ভাইকে তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে গেছে পিটার। ভাড়ার ঘরে লুকোন আছে মোহরগুলো।
টাকাপয়সা এখনই ভাগ করব আমরা, বলল সম্রাট। হাকলবেরি, একটা মোম নিয়ে আমাদের সাথে এস।
ভাঁড়ারে গিয়ে মোহরভর্তি ব্যাগ পেলাম আমরা। দুই ঠগ মোহরগুলো ঢেলে দিল মেঝেতে। এক সঙ্গে এত সোনা দেখে ওদের চোখ চকচক করে উঠল। ঝটপট মোহর গুনতে বসল ওরা। পুরো ছহাজার হল না, চারশো পনের ডলার কম।
ডিউক, এখন উপায়? জিজ্ঞেস করল সম্রাট। প্রত্যেকেই সন্দেহ করবে, টাকাটা মেরে দিয়েছি আমরা।
আমাদের ঘাটতি পুরিয়ে দিতে হবে, বলল ভিউক। পকেট ঝেড়ে নিজের সব কটা ডলার বের করল সে। সম্রাটও তার সব টাকা দিল।
ওপরে গেলাম আমরা। মোহরভর্তি ব্যাগটা টেবিলে রাখল ওরা। সম্রাট টাকা গোনার সময় সবাই হুঁমড়ি খেয়ে পড়ল। গোনা শেষ করে আরেকদফা ভাষণ দিল ঝাটা গোঁফ।
বন্ধুগণ, শুরু করল সে, আমার মরহুঁম ভাই এই এতিম মেয়েগুলোকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসত। আমার বিশ্বাস, পাছে আমরা, মানে উইলিয়ম আর আমি, দুঃখ পাই তাই সব টাকা এদের দিয়ে যায়নি সে। নইলে তা-ই করত। আমরাও ভাইয়ের বিদেহী আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। মেরি জেন, সুসান, জোয়ানা, তোমরা এদিকে এস। এই টাকা তোমাদের প্রাপ্য, তোমরাই নাও। পিটারের আত্মা শান্তি পাবে এতে।
আনন্দে কেঁদে ফেলল তিন বোন। সম্রাট আর ডিউককে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। কাকা, তোমরা সত্যিই মহান! বলল ওরা।
মেয়েগুলোর কথা শুনে ভিড়ের ভেতর থেকে এক লোক হো-হো করে হেসে উঠল। খানিক আগেই এসেছে সে। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ। তার এই আচরণে মর্মাহত হল সবাই।
রবিনসন, তুমি শোননি কিছু? বলল অ্যাবনার শ্যাফোর্ড। ও হার্ভে উইল।
স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিল সম্রাট। তুমি নিশ্চয়ই ডাক্তার, পিটারের বন্ধু, বলল।
তোমার সাথে হাত মেলাব না আমি, গম্ভীর গলায় বলল ডাক্তার। তুমি একটা ভণ্ড।
মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেল সকলে। অনেক করে বোঝাতে চেষ্টা করল ডাক্তারকে, এই লোকই যে হার্ভে তাতে সন্দেহ নেই কারও। নানাভাবে সে প্রমাণ করেছে তা। এমনকি গায়ের কুকুরগুলোর নাম পর্যন্ত ঠিক ঠিক বলেছে।
কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা। সম্রাটের কথা বলার ঢং নাকি একজন ইংরেজের মত নয়, খুবই নিচুস্তরের নকলমাত্র। তোদের বাবার বন্ধু আমি, মেয়েগুলোর দিকে ঘুরে বলল সে। অতএব তোদেরও বন্ধু। আমার কথা শোন, নিজেদের ভাল চাস তো এখুনি বের করে দে এই জোচ্চরগুলোকে। নইলে পস্তাতে হবে পরে।
এই নিন আমার জবাব, মোহরের থলেটা সম্রাটের হাতে দিয়ে বলল মেরি জেন। কাকা, তুমি যেটা ভাল মনে কর, তাতেই এই ছ হাজার ডলার খাটাও।
করতালির ধুম পড়ে গেল ঘরে, মনে হল যেন ঝড় উঠেছে। গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল সম্রাট, ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি। রোমান সম্রাটের মত।
বেশ, যা ভাল বোঝ কর তোমরা, বলল ডাক্তার। আমার আর কোন দায়দায়িত্ব রইল না। পরে বলতে পারবে না যে সাবধান করিনি। খুব শিগগিরই নিজেদের বোকামি বুঝতে পারবে তোমরা। ধীর গতিতে প্রস্থান করল ডাক্তার রবিনসন।
সবাই চলে যাবার পর সম্রাট মেরি জেনকে শুধাল তাদের বাড়তি কোন কামরা আছে কি-না। মেরি জানাল, আছে। সে-ঘরে উইলিয়ম কাকা থাকবে। নিজের ঘরটা সে হার্ভে কাকার জন্যে ছেড়ে দিচ্ছে, এ কামরা আগেরটার চাইতে একটু বড়। আর সে নিজে বোনেদের ঘরে শোবে। সেখানে একটা ক্যাম্পখাট আছে। এছাড়া আরও একটা ঘর আছে, চিলেকোঠা। খড়ের গদি বিছান আছে সেখানে।
ওখানে আমার চাকর থাকবে, বলল সম্রাট। চাকর বলতে আমাকে বোঝাল ব্যাটা ঝাটা গোঁফ।
রাতে বিরাট ভোজের আয়োজন করা হল। ও বাড়ির বন্ধু-বান্ধবরা সবাই এল। তিন বোনই মধুর ব্যবহার করল আমার সাথে, চাকর বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল না।
মেহমানরা চলে যাবার পর বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম আমি, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একটা কথাই মনে হচ্ছিল বারবার, নেমকহারামি করছি। ফুলের মত নিস্পাপ তিনটে মেয়ের সর্বনাশ করা উচিত হচ্ছে না। যে করেই হোক। রক্ষা করব ওদের, প্রতিজ্ঞা করলাম, সব ফাঁস করে দেব। পরক্ষণে বুঝলাম, বলে দিলে লাভ হবে না কোন। ঝেড়ে অস্বীকার করবে সম্রাট, আমাকে নাকাল করবে। অনেক মাথা খাটিয়ে উপায় ঠাউরালাম একটা: টাকাগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে রেখে চুপিসারে সটকে পড়ব এখান থেকে। পরে চিঠিতে সব জানাব মেরি জেনকে। টাকাগুলো কোথায় পাওয়া যাবে তাও লিখব।
চিলেকোঠা থেকে নেমে পা টিপে টিপে সম্রাটের ঘরে গেলাম। অন্ধকার কামরা। কিন্তু বাতি জ্বালাতে সাহস হল না। হাতড়ে ফিরতে লাগলাম। হঠাৎ দুজোড়া পায়ের শব্দ পেলাম। বুঝলাম, আসছে ওরা। ঝট করে একটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। বাটপার দুটো ঘরে ঢুকে বিছানায় বসল।
ব্যাপার কী, এই অসময়ে? ডিউককে প্রশ্ন করল সম্রাট।
ভয় করছে, ডিউকের জবাব। বিশেষ করে ওই ডাক্তার লোকটাকে সুবিধের মনে হচ্ছে না। সূর্য ওঠার আগেই সোনা নিয়ে এখান থেকে আমাদের কেটে পড়া উচিত।
ভূতে পেয়েছে। বাকি সম্পত্তি বিক্রি না-করেই! না বাপু!
এক থলে মোহরই তো যথেষ্ট, মিনমিন করল ডিউক। তাছাড়া ওই মেয়েগুলোর মাথায় বাড়ি দিতে চাই না আমি। আমাদের খুব যত্ন-আত্তি করছে ওরা।
বোকার মত কথা বলো না, খেঁকিয়ে উঠল সম্রাট। পরে সবাই যখন টের পাবে আমরা আসল লোক নই, তখন আমাদের কবলা খারিজ হয়ে যাবে। ফলে ওদের বাড়িঘরদোর ওদেরই থাকবে। মাঝখানে থেকে ফাঁকতালে বাজি মারব আমরা।
ঠিক আছে, হাল ছেড়ে দিল ডিউক। তবে টাকাগুলো ভাল করে লুকিয়ে রাখা দরকার।
ঠিক, সায় দিল সম্রাট। আমি যে পর্দার আড়ালে রয়েছি সেদিকে এগিয়ে এল সে। আমার পেছনেই মেরি জেনের অালনা। আলনাটার পেছনে আশ্রয় নিলাম। পর্দা সরিয়ে ভেতরে এল সম্রাট, ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। তবে একটুর জন্যে আমাকে দেখতে পেল না ঝাঁটা গোঁফ। যা খুঁজছিল, সেই ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল।
কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখ, পরামর্শ দিল ডিউক। ওর কথা মেনে তা-ই করল সম্রাট। তারপর দুজনাই বেরিয়ে গেল।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার আগেই থলেটা বাগিয়ে নিলাম আমি, অন্ধকারে পথ হাতড়ে চিলেকোঠায় ফিরে এলাম। জানি, থলে বাসায় রাখা ঠিক হবে না। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজবে ওরা। ধরাচুড়া নিয়েই শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসবে না জানি, কাজ না-সারা অবধি শান্তি নেই। একটু বাদে পায়ের শব্দ পেলাম দোতলার সিঁড়িতে। আমার দোরগোড়া থেকে কাঠের মই নেমে গেছে দোতালায়। সেটার ধাপিতে থুতনি রেখে নিচে তাকিয়ে রইলাম, কিছু ঘটে কি-না দেখব।
ঠায় উপুড় হয়ে আছি সে-ই তখন থেকে, পেটের পেশিতে লাগছে চিনচিন করে। মাঝরাতের পর সব কোলাহল থেমে গেল। মওকা বুঝে সুড়ুৎ করে নিচে নামলাম আমি।
নিঃসাড়ে এগিয়ে গিয়ে সম্রাটের দরজায় কান পাতলাম। তারপর ডিউকের দরজায়। দুজনেই যেন নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নিচতলায় নেমে গেলাম। কোথাও কোন শব্দ নেই। মুর্দাফরাশেরা ঘুমে অচেতন। হঠাৎ পেছনে শব্দ, মনে হল কেউ আসছে। দৌড়ে বসার ঘরে ঢুকলাম। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম একবার, কোথায় লুকোন যায় থলেটা। কফিনের ওপর আমার চোখ স্থির হল। ডালা সরে যাওয়ায় ফাঁক হয়ে আছে কফিন। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কাফনে মোড়া লাশের মুখ। চটপট পিটারের একটা কনুইয়ের নিচে মোহরের থলে চালান করে দিলাম আমি। জিনিসটা রাখার সময় গা শিরশির করে উঠল। লাশের হাত দুটো বরফের মত ঠাণ্ডা। তারপর একছুটে কবাটের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম।
মেরি জেন ঘরে ঢুকল। সোজা কফিনের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল। উঁকি দিল ভেতরে। তারপর রুমালে মুখ ঢাকল। আওয়াজ না পেলেও বুঝলাম কাঁদছে।
চুপিসারে আবার ফিরে গেলাম ঘরে। মনটা দমে গেছে, বোধহয় মাঠে মারা গেল এত খাটনি!
সকালে যখন নিচে নামলাম তখন বৈঠকখানা বন্ধ। পাহারাদারেরা চলে গেছে।
ধারেকাছে ওই তিন বোন, বিধবা মিসেস বার্টলি এবং আমরা ছাড়া কেউ নেই। শয়তান দুটোর মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম রাতের ঘটনার কথা ওরা জানে কি-না। মনে হল জানে না, নির্লিপ্ত চেহারায় বসে আছে উভয়ই।
দুপুরের পর কবরে নামান হল লাশ। শেষবারের মত পিটারের মুখ দেখিয়ে কফিনের ঢাকনা পেরেক মেরে বন্ধ করে দিল মুর্দাফরাশেরা। বুড়ো পিটার উইলসের সাথে মোহরের থলিও কবরবাসী হল।
১৬. সন্ধ্যায় ঘুরে ঘুরে সবার সাথে দেখা করল সম্রাট
সন্ধ্যায় ঘুরে ঘুরে সবার সাথে দেখা করল সম্রাট। তার মিষ্টি সুরের সান্ত্বনা মন জয় করে নিল সবার। এমন ভাব দেখাল যেন ইংল্যান্ডে তার শিষ্যরা অধীরভাবে অপেক্ষা করছে, তাই তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার তার। এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হচ্ছে বলে দুঃখে আমার কলজেটা ফেটে যাচ্ছে। চোখ মুছল সম্রাট। কিন্তু কী করব, উপায় নেই। তাই ঠিক করেছি মাবাপ-হারা মেয়েগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব! আর এখানকার সয়-সম্পত্তি বেচে দেব।
আনন্দে চিৎকার করে উঠল তিন বোন, চোখে খুশির ছটা। বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিক্রির ব্যবস্থা করতে। ওদের খুশির ভাব দেখে আমার বুক টনটন করে উঠল। স্পষ্ট বুঝতে পারছি বোকা বানানো হচ্ছে এই সহজ-সরল মেয়েগুলোকে। কিন্তু কীভাবে এই বিপদ ঠেকাব, বুঝতে পারলাম না।
অন্ত্যেষ্টির পরের দিন দুজন দাস-ব্যবসায়ী এল। নিগ্রো চাকরগুলোকে কিনবে ওরা। দুজন দুজায়গার লোক। একজন মেমফিসের, অপরজন অরলিয়ন্সের। নিগ্রো ছেলে দুটোকে কিনল মেমফিসের ব্যবসায়ী। আর ওদের মা চলল অরলিয়ন্সে। মেয়েগুলো এই ঘটনায় খুব আঘাত পেল। বলল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি ওদের বেচে দেয়া হবে অন্য কোথাও। সেদিন নিগ্রো চাকরদের গলা জড়িয়ে ওদের কান্নাকাটির দৃশ্যটা জীবনেও ভুলব না আমি। এই বিক্রি শেষপর্যন্ত টিকবে না, একথা আগে থেকে জানা না-থাকলে হয়ত হেস্তনেস্ত করে ফেলতাম একটা।
ব্যাপারটা গাঁয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করল। অনেকেই এর নিন্দা করল। সন্তানের কাছ থেকে মাকে আলাদা করা অন্যায়, বলল ওরা। এতে জোচ্চরগুলোর ইজ্জত কিছু কমল বটে, কিন্তু বুড়ো শয়তান আদৌ ভ্রুক্ষেপ করল না। তবে মনে হল ডিউক কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু তার ওজর-আপত্তি কানে তুলল না সম্রাট।
নিলামের দিন খুব সকালে হারামি দুটোর হাকডাকে ঘুম ভাঙল।
পরশু রাতে আমার ঘরে গিয়েছিলে? আমাকে জিজ্ঞেস করল সম্রাট।
না।
আর কাউকে যেতে দেখেছ?
চাকর-বাকরদের।
ওদের হাতে কিছু ছিল?
জানি না। খেয়াল করিনি। কেন, কোন সমস্যা?
তা দিয়ে তোমার দরকার কী? খ্যাক করে উঠল সম্রাট। ডিউকের দিকে ঘুরে বলল, ব্যাপারটা আমাদের বেমালুম চেপে যেতে হবে। মুখ খোলা ঠিক হবে না।
দেখতে দেখতে সকাল হয়ে এল। ধীরে ধীরে মই বেয়ে নিচে নামলাম আমি। মেয়েগুলোর কামরার কাছে যেতে দেখলাম, দরজা খোলা, বিছানার ওপর একটা সুটকেস আধ-গোছানো অবস্থায় পড়ে। পাশেই দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে মেরি জেন। দেখে ভারি খারাপ লাগল।
মিস মেরি জেন, ভেতরে ঢুকে বললাম, আপনি কারো কষ্ট সইতে পারেন না। আমিও না। আমাকে বলুন, কাঁদছেন কেন?
ওই চাকরগুলোর কথা ভেবে, ডুকরে উঠল সে।
দেখবেন, দুহপ্তার ভেতরে ফিরে আসবে ওরা, কথাটা বলেই বোকা হয়ে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে।
একথা বলছ কেন? দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল মেরি জেন।
কোণঠাসা অবস্থা হল আমার। একটু ভেবে দেখলাম, মিথ্যে বলার চেয়ে সত্যি বলা অনেক নিরাপদ। মিস জেন, কাছেপিঠে এমন কোন জায়গা আছে, যেখানে গিয়ে দু-চার দিন থাকতে পারবেন আপনি?
হ্যাঁ, মিস্টার লরথ্রপ-এর ওখানে। কেন, বল তো?
অনুমতি নিয়ে দরজায় খিল তুলে দিয়ে এসে বসলাম। চেঁচাবেন না, বললাম আমি। সব শোনার জন্যে আপনার মনটাকে শক্ত করুন, মিস জেন। এই লোক দুটো আসলে জালিয়াত, আপনার কাকা নয়।
চমকে উঠল মেরি জেন, কিন্তু আমি চড়া পেরিয়ে গিয়েছি ততক্ষণে। তরতর করে বলে দিলাম সর্ব—সেই স্টিমারযাত্রী বোকা যুবকের সাথে দেখা হওয়া থেকে এখানে আসা পর্যন্ত কিছুই গোপন করলাম না। মোহরের থলেটা কোথায় লুকিয়েছি তাও জানালাম।
জানোয়ার, বলল মেরি জেন। অস্তাচলগামী সূর্যের মত তার মুখ জ্বলছে।
এরপর তাকে বুঝিয়ে বললাম, কী করতে হবে। রাত নটা-সাড়ে নটা অবধি মিস্টার লরথ্রপের বাসায় কাটিয়ে এখানে ফিরে আসবে সে। যদি এগারটার আগেই পৌঁছে যায় তাহলে ঘরের জানালায় মোম জ্বেলে দেবে। আমি রাত এগারটার মধ্যে না ফিরলে ধরে নেবে চম্পট দিয়েছি। তখন খবরটা ফাঁস করবে, চোদ্দশিকে পুরবে শয়তান দুটোকে।
বাজারের কাছেই একটা ফাঁকা চত্বর, সেখানই নিলামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিকেলের দিকে শুরু হল নিলাম। একের পর এক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব। সম্রাট কাছেই দাঁড়িয়ে, উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। মাঝেমধ্যে দু-একটা ধর্মীয় বোলচাল আর মিষ্টি কথায় আসর জমিয়ে রেখেছে ব্যাটা। ডিউক এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, বোবার অভিনয় করে সকলের সহানুভূতি কাড়বার চেষ্টা করছে।
নিলামের শেষ পর্যায়ে ঘাটে একটা জাহাজ ভিড়ল। মিনিট দুয়েক পর দেখা গেল সরব জনতার মিছিল এগিয়ে আসছে একটা। মিছিলের সামনে দুজন ভদ্রলোক, পরিপাটি বেশভূষা তাদের।
পিটার উইলকসের এই আরেক জোড়া উত্তরাধিকারী, হাসতে হাসতে বলল জনতা। নাও, এবার তোমরাই ঠিক কর জিনিসের দাম কাকে দেবে।
আগন্তুক দুজনের একজন বৃদ্ধ, অপরজন অল্প বয়েসী। দুজনেই সুদর্শন। যুবকের ডান হাত ভাঙা, ব্লিং-এ ঝুলিছে।
আমি পিটার উইলসের ভাই হার্ভে, বললেন বৃদ্ধ, আর এ আমাদের ছোট ভাই উইলিয়ম। পথে বিপদে পড়েছিলাম আমরা। উইলিয়মের হাত ভেঙেছে, আমাদের মালপত্র খোঁয়া গেছে জাহাজ থেকে। সম্ভবত ভুল জায়গায় ওগুলো খালাস করা হয়েছে।
হাত ভেঙেছে, কুৎসিত ভেংচি কাটল সম্রাট। মালপত্র হারিয়েছে। বাহ! বেড়ে অজুহাত খাড়া করেছে বলতে হবে। চালু মাল সন্দেহ নেই। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। জনতার একাংশেও তার ঢেউ উঠল। কিন্তু ডাক্তার রবিনসন আর উকিল লেভি বেল হাসল না। নিচু গলায় কী যেন পরামর্শ করল তারা। বার কয়েক আড়চোখে তাকাল সম্রাটের দিকে।
সবাই আমার কথা শোন, বলল ডাক্তার। এই নবাগত দুজন জালিয়াত কি-না জানি না তবে, সম্রাট ও ডিউকের দিকে ইশারা করল সে, ওই দুজন যে ঠগ সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা আসলে কী, না-জানা পর্যন্ত পালাতে দিও না এদের। চল সবাই, দুপক্ষের মোকাবেলা করাই। তাহলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা।
এমন একটা মজার খোরাক পেয়ে পাগল হয়ে উঠল যেন জনতা। ওই দুই ভদ্রলোক যে-হোটেলে উঠেছেন সেদিকে রওনা হল সবাই। সূর্য প্রায় ডুবু-ডুবু। ডাক্তার আমার হাত ধরে রাখল। মনে হল আমার প্রতি তার সহানুভূতি আছে, কিন্তু তাই বলে হাত ছাড়ল না।
আমরা সবাই হোটেলের একটা বড় কামরায় জড় হলাম। কয়েকটা মোম জ্বালানো হল। তারপর নবাগত দুজনের সামনে জেরা শুরু হল।
শুরুতেই ফেঁসে গেল দুই ঠগ। এরা নির্দোষ হলে, সম্রাট আর ডিউককে দেখিয়ে বলল ডাক্তার, মোহরের থলেটা আনতে পাঠাবে কাউকে। একটা কিছু রফা না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে থলেটা।
ঠিক! ঠিক! সায় দিল সবাই।
দুঃখিত হওয়ার ভান করল সম্রাট। বলল, থলেটা থাকলে তো কোন কথাই ছিল না। এখুনি আনিয়ে সব ঝামেলার ইতি করতাম। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ওটা নেই। কেউ চুরি করেছে।
সব ধাপ্পা, ধমকে উঠল ডাক্তার।
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমি, সম্রাটের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। আমাকে একজন জিজ্ঞেস করল, নিগ্রোদের ওগুলো চুরি করতে দেখেছি কি-না? বললাম, চুরি করতে দেখিনি, তবে কামরায় চুপিচুপি ঢুকতে-বেরুতে দেখেছি।
কি হে, ছোকরা, তুমিও ইংরেজ নাকি, আচমকা আমাকে প্রশ্ন করল ডাক্তার।
হ্যাঁঁ, বললাম।
হো-হো করে হেসে উঠল সবাই। লেভি বেল বলল, বসে পড়, ছোকরা। বুঝেছি, মিথ্যে বলার অভ্যেস তোমার নেই। আরও চর্চা দরকার।
সেদিনই যদি তুমি থাকতে এখানে, লেভি…
লেভি বেল! ডাক্তারের মুখের কথা কেড়ে নিল সম্রাট। দাদার প্রতিটা চিঠিতে তোমার কথা থাকত। কী সৌভাগ্য! উকিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
করমর্দন করল লেভি বেল। হাসল, খুশি হয়েছে মনে হল। সম্রাটকে এক প্রান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিচুস্বরে আলাপ করল কিছু। তারপর বলল, হ্যাঁ, সব ঠিক করে ফেলব। লিখে দাও তুমি, তোমরা ভাইকে সই করতে বল। কোর্টের বাকি কাজ আমি করব।
কাগজ-কলম আনা হল। সম্রাট বসল। ঘাড় বেঁকিয়ে জিভ কামড়ে লিখল কিছু, তারপর ডিউকের হাতে দিল কলমটা। ডিউক সই দিয়ে কাগজটা উকিলের হাতে দিল।
স্যার, দয়া করে আপনি কি এটা কপি করে দেবেন? বুড়ো ভদ্রলোককে বলল উকিল। আপনার ভাইয়ের সইও লাগবে। তবে তার হাত ভাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা।
এইভাবে ধূর্ত উকিল পিটার উইলকসের ভাই বলে দাবি করছে এমন তিনজনের হাতের লেখা জোগাড় করল। তারপর পকেট থেকে বের করল কিছু পুরোনো চিঠি। সেগুলোর হাতের লেখা ওই তিনজনের লেখার সঙ্গে মেলাল।
এই চিঠিগুলো, জনতাকে বলল লেভি বেল, হার্ভে উইলসের লেখা। এ তিনজনের একজনের সাথেও এই লেখার মিল নেই। বিশেষ করে, বুড়ো ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল, ওনারটা তো আদপে কোন লেখাই নয়, কিছু হিজিবিজি দাগমাত্র।
সমস্যাটা ব্যাখ্যা করতে দিন আমাকে, বললেন বুড়ো ভদ্রলোক। উইলিয়ম ছাড়া আমার হাতের লেখা কেউই পড়তে পারে না। তাই ও-ই আমার চিঠিপত্র লিখে দেয়। ওই চিঠিগুলো আসলে আমার জবানিতে ওর লেখা।
তবে তো উইলিয়মের হাতের লেখা পরখ করতে হয়, বলল উকিল।
কিন্তু বাঁ-হাতে ও লিখবে কীভাবে, প্রতিবাদ করলেন বুড়ো ভদ্রলোক। বরং এক কাজ করতে পারেন, ওখানে ওর নিজের চিঠিও আছে। সেগুলো মেলাতে পারেন আমারটার সাথে।
হুঁম, চিঠিগুলো পরখ করে বলল উকিল, মনে হচ্ছে ঠিক কথাই বলছেন আপনি। অন্তত একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যাছে, ধাই করে সম্রাট আর ডিউকের দিকে ঘুরল সে, এই দুজন জালিয়াত।
১৭. বাটপার দুটো হাল ছাড়ার পাত্র নয়
বাটপার দুটো হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এটা ন্যায়বিচার হল না, মিনমিন করে বলল সম্রাট।
এক কাজ করুন, আচমকা বললেন বুড়ো ভদ্রলোক। পিটার উইলকে কবরে শুইয়েছে এমন কেউ আছে এখানে?
হা, বলল একজন। আমি আর অ্যাবি টার্নার।
সম্রাটের পানে তাকালেন বৃদ্ধ। বললেন, আচ্ছা বলুন তো, মৃতের বুকের ওপর কী উল্কি আঁকা ছিল?
হঠাৎ পিনপতন নীরবতা নেমে এল। সবাই জবাবের আশায় সম্রাটের মুখের দিকে তাকাল। ম্লান হয়ে গেছে তার মুখ। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, ছোট্ট একটা নীল তীর। এত ছোট যে প্রায় দেখাই যায় না।
বুড়ো ভদ্রলোক অ্যাবি টার্নার আর তার সঙ্গীর দিকে তাকালেন। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ। ওনার কথা আপনারা শুনলেন, বললেন তিনি। এবার বলুন, পিটারের বুকে অমন কোন চিহ্ন আপনারা দেখেছেন?
না, স্যার। দেখিনি, দুজনেই একযোগে জবাব দিল।। দেখার কথাও নয়, বললেন বৃদ্ধ। আসলে আপনারা তিনটে অক্ষর দেখেছেন। এইভাবে লেখা, লিখে দেখালেন বৃদ্ধ, পি-বি। ঠিক কি-না?
আবার দুজন একত্রে বলল, না আমরা তাও দেখিনি।
বারুদের মত তেতে উঠল ঘর। সব শালা ঠগ, হইহই করে উঠল জনতা। ওদের পিঠের ছাল তুলে লবণ মাখিয়ে দাও।
লেভি বেল একলাফে টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়াল। থাম তোমরা, গলা ফাটিয়ে বলল সে। চল, লাশ তুলে এদের কথা যাচাই করে দেখি।
হুঁররে! সমস্বরে চেচাল সবাই। চার ভাইসহ আমাকে করস্থানে নিয়ে এল ওরা। আমি ভয়ে কাঁপছি। কথা সত্যি না হলে নির্ঘাত আমাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলান হবে।
বন্যার মত গায়ের সবাই হুঁমড়ি খেয়ে পড়েছে কবরখানায়! গোর খুঁড়তে যতগুলো গাইতি-শাবল দরকার তার একশ গুণ দেখা গেল ওখানে। তখন রাত প্রায় নটা, অথচ কেউ লণ্ঠন আনেনি সঙ্গে। মাইল খানেক দূরের এক বাসা থেকে লণ্ঠন আনতে একজনকে পাঠাল ওরা।
তারপর অন্ধকারের মধ্যেই কবর খুঁড়তে লাগল। হঠাৎ ভয়ঙ্কর আঁধার হয়ে এল চারদিক। বৃষ্টি শুরু হল, সাথে শোঁ শোঁ বাতাস। কিন্তু প্রবল উত্তেজনায় ঝড়বাদল গায়ে মাখল না কেউ, কাজ নিয়ে মেতে রইল।
এক সময়ে কফিনটা ওঠান হল ওপরে। পেরেক খোলার সময় আরেক দফা হুঁড়োহুঁড়ি বাধল জনতার মাঝে, কার আগে কে ভেতরে উঁকি দেবে তা-ই নিয়ে প্রতিযোগিতা।
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের আলোয় দিনের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল সব কিছু। ঠিক তখনি কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, যিশুর কিরে মোহরের থলেটা কফিনের ভেতর!
হাতে ঢিল পড়েছে, অনুভব করলাম। যে-লোক আমার হাত ধরে ছিল, সে-ও তামাশা দেখার জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করে দিয়েছে। এই সুযোগ, ভাবলাম। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে প্রায় উড়ে চললাম আমি। গাঢ় অন্ধকার, থেকে থেকে বিজলির চমক, ঝড়বৃষ্টির মাতম উপেক্ষা করে নদীর দিকে ছুটে চললাম।
তীরে এসে দেখলাম ঘাটে একটা নৌকো বাঁধা। নৌকোটা খুলে নিয়ে ভেলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ভেলার গায়ে ওটা যখন ভিড়ল, ক্লান্তিতে কেবল শুয়ে পড়তে বাকি আমার। কোনমতে বললাম, জিম, শিগগির কর। ভেলা ছেড়ে দাও।
ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল জিম। ঠিক ওই সময়ে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। জিমকে দেখে ভয়ে আমার পিলে চমকে গেল। পিছু হঠতে গিয়ে পড়ে গেলাম নদীতে। আসলে ভুলে গিয়েছিলাম, রাজা লিয়রের পোশাক পরে আছে জিম। ওর সারা গায়ে নীল রং মাখান হয়েছে যেন দেখলে মনে হয় পানিতে-ডোবা কোন আরব। যাক, যেভাবে মাছ তোলে তেমনিভাবে আমাকে টেনে তুলল জিম। ওই শয়তান দুটোকে খসাতে পেরেছি দেখে খুশি হল।
দুসেকেন্ড পরই রশি কেটে মাঝ-নদীতে গিয়ে পড়লাম আমরা। কিছুদূর যেতেই পেছনে বৈঠা বাওয়ার শব্দ পেলাম। পরক্ষণে বিজলিচমকের আলোয় দেখলাম, একটা ছিপ নৌকোয় চেপে ছুটে আসছে সম্রাট আর ডিউক। বজ্জাত দুটোকে দেখে এত মুষড়ে পড়লাম যে আরেকটু হলেই রাগে-দুঃখে আমি কেঁদে ফেলতাম।
ভেলায় উঠে আমার কলার চেপে ধরল সম্রাট। বাঁদর ছোঁড়া কেটে পড়ার মতলব, আঁ? ঘেউ ঘেউ করে উঠল সে।
না, জাঁহাপনা। একটুও না। ছাড়ুন, লাগছে।
সত্যি করে বল, নইলে পিটিয়ে ছাতু করে ফেলব।
বলছি, বলছি, হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম। যে-লোকটা আমাকে ধরে রেখেছিল। সে খুব ভাল ছিল। বলল, আমার মত এক ছেলে ছিল তার। ছেলেটা গত বছর মারা গেছে। তাই আমাকে বিপদে পড়তে দেখে তার খুব দুঃখ লাগছে। সবাই যখন কফিনের ভেতর মোহর দেখতে ব্যস্ত তখন সে আমাকে বলল, এই বেলা পালাও নইলে তোমাকেও ফাঁসিতে ঝোলাবে ওরা। আর আমিও দে-ছুট। আর যা-ই হোক ফাসিতে ঝুলতে চাই না আমি।
গুল মারার জায়গা পাস না, ধমকে উঠল সম্রাট, ঝাঁকুনি দিল আমার কাঁধ চেপে ধরে।
ছেড়ে দাও ওকে, বলল ডিউক। ওর জায়গায় তুমি হলেও এটাই করতে। সম্রাট ছেড়ে দিল আমাকে, ওই গায়ের বাসিন্দাদের বাপ-মা তুলে গাল দিল।
বরং নিজেকে গাল দাও, ডিউক বলল তাকে। তুমি-ই তো সব নষ্টের গোড়া। তোমার গোঁয়ার্তুমিতেই আমরা সবাই আজ মরতে বসেছিলাম।
চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে চোরের মত ছইয়ের ভেতর ঢুকে গেল সম্রাট। বসে বসে মদ গিলতে লাগল। একটু বাদে ডিউকও তার বোতল নিয়ে পড়ল। আধঘণ্টার মধ্যেই, যেমন চোরদের হয়, ভাব হয়ে গেল ওদের। নেশা গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে ভালবাসাও প্রগাঢ় হয়ে উঠল। তারপর এক সময় গলাগলি ধরে নাক ডাকতে লাগল দুজন। যখন নিশ্চিত হলাম ঘুমে কাদা হয়ে আছে ওরা, জিমকে সব খুলে বললাম আমি।
ওই ঘটনার পর বেশ কদিন কেটে গেছে, ভয়ে কোথাও থামতে সাহস পাই না আমরা। দক্ষিণে এগিয়ে চলছে ভেলা; ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে আবহাওয়া। এদিকে এখন গ্রীষ্মের মওশুম। বাড়ি থেকে দূরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। শুকনো হলুদ ঝুরি দাড়ির মত ডাল বেয়ে মাটি ছুঁয়েছে। এরকম দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম আমি। শুনশান বনানী, কেমন যেন মরা-মরা ভাব। জোচ্চর দুজন যখন বুঝতে পারল বিপদ কেটে গেছে, আবার ফটকাবাজি শুরু হল তাদের।
এক জায়গায় তারা মদ না-খাওয়ার পক্ষে বক্তৃতা দিল, কিন্তু ভালমত মদ যে খাবে, সে পয়সাটাও জোটাতে পারল না। আরেক খানে খুলল নাচের ইশকুল। অথচ ক্যাঙারু যতটুকু নাচে, ওরা তার সিকি ভাগও জানে না। ফলে যা হবার তা-ই হল, ধাওয়া খেল গায়ের লোকদের। এরপর বজ্জাত দুটো বক্তৃতার স্কুল খুলল। প্রথম বক্তৃতা দেয়ার সাথে সাথে শ্রোতারা এমন গাল দিল যে পালিয়ে বাঁচল ওরা। এরপর ডাক্তারি, ভাগ্য গণনা, সম্মোহনবিদ্যা-বহুকিছুই চেষ্টা করল, কিন্তু বরাত খুলল না। শেষপর্যন্ত ওদের পকেট গড়ের মাঠ হয়ে গেল, ওরা হতাশায় মরিয়া হয়ে উঠল।
সর্বক্ষণ ফিসফিস করে কী সব শলাপরামর্শ করে। জিম আর আমি খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম এতে। মনে হল এ যাবত ওরা যা করেছে, তার চাইতেও বড় দরের কোন শয়তানি মতলব আঁটছে। বিষয়টা নিয়ে বারবার আলোচনা করলাম আমি আর জিম। মনে হল, এবার ওরা কারো বাসায় বা দোকানে সিদ কাটবে। ভয় ধরে গেল আমাদের। এরকম কিছু করলে, জিম আর আমি ঠিক করলাম, ওরে সাথে সম্পর্ক রাখব না।
একদিন খুব সকালে ভাল একটা জায়গা খুঁজে ভেলাটা লুকিয়ে রাখলাম আমরা। ওখান থেকে পাইভিল গ্রাম দুমাইল সামনে। সম্রাট ডাঙায় গেল। যাবার আগে বলল, এখানকার লোকেরা রয়্যাল নানসাচ পালার কথা জানে কি-না সেটা দেখতে যাচ্ছে। যদি দুপুরের মধ্যে ফিরে না আসি, বলল সে, বুঝবে সব প্ল্যানমাফিকই এগুচ্ছে। তোমরাও তখন চলে আসবে গায়ে।
দুপুর এল, কিন্তু সম্রাটের টিকিটি নেই। আমি খুশিই হলাম, যাক এবার হয়ত পালাবার মওকা মিলবে। আমাকে নিয়ে গায়ে গেল ডিউক। অনেক খোজাখুঁজির পর সম্রাটের সন্ধান মিলল। নোংরা একটা ভাটিখানার পেছনে মদে চুর হয়ে পড়ে আছে। কতগুলো রকবাজ ছোকরা হাসিমশকরা করছে তাকে নিয়ে। সে-ও জড়ান গলায় গাল দিচ্ছে ওদের। কিন্তু ওঠার শক্তি নেই বলে কিছু করতে পারছে না।
তুমি একটা আস্ত উজবুক, সম্রাটকে গাল দিল ডিউক।
সম্রাটও অকথ্য ভাষায় পাল্টা গাল দিল। ওদের চেঁচামেচি জমে উঠতেই সটকে পড়লাম আমি। নদীর দিকে হরিণের মত ছুটে চললাম। এই সুবর্ণ সুযোগ। একবার পালাতে পারলে, ভাবলাম মনে মনে, ওরা আর ধরতে পারবে না আমাদের। খুশিতে ডগমগ হয়ে আমি ঘাটে পৌঁছুলাম।
ভেলা ছেড়ে দাও, জিম। শিগগির, চিৎকার করে বললাম।
কোন উত্তর নেই, কেউ ছইয়ের ভেতর থেকে বেরোল না। জিম নেই। আবার গলা ফাটিয়ে ডাকলাম ওকে। না, কোন সাড়া নেই। চলে গেছে বুড়ো জিম। জঙ্গলের ভেতরেই বসে পড়লাম আমি। দুচোখ ছাপিয়ে জল নামল, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না মনে। খানিক বাদে আবার রাস্তায় উঠলাম। কী করা যায় ভাবছি, হঠাৎ দেখলাম আমার বয়েসী একটা ছেলে যাচ্ছে ওই পথ দিয়ে।
আজব চেহারার কোন অচেনা নিগ্রোকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করলাম ছেলেটাকে।।
ওপরে-নিচে মাথা দুলিয়ে ছেলেটা জানাল দেখেছে।
কোথায়?
এখান থেকে দুমাইল দূরে। সাইলাস ফেলপস-এর গোলা বাড়িতে। একজন পলাতক নিগ্রোকে পাকড়াও করেছে তারা। দুশ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে ওর নামে।
কীভাবে ধরল?
বদখত চেহারার এক বুড়ো মাত্র চল্লিশ ডলারে স্থানীয় একজনের কাছে তথ্যটা ফাঁস করে দিয়েছে। তার নাকি তাড়া আছে, নদীপথে যাবে কোথাও, তাই অপেক্ষা করতে পারেনি পুরো টাকাটার জন্যে।
ভেলায় ফিরে গিয়ে চুপচাপ চিন্তা করতে লাগলাম, কী করব। কিন্তু কোন মীমাংসায় পৌঁছুতে পারলাম না। এক সময় মাথাটা ব্যথা করতে লাগল, তবু কুলকিনারা পেলাম না। এতখানি রাস্তা এক সাথে চলা, ওদের জন্যে এতটা করা—সবই পানিতে পড়ল। মাত্র চল্লিশটা ডলারের জন্যে জিমকে ধাপ্পা দিতে এতটুকু বাধল না লোকগুলোর।
একবার নিজেকে বোঝালাম, জিমকে যদি দাস থাকতেই হয়, তবে যেখানে তার বউ-ছেলে রয়েছে সেখানে থাকাই ভাল। ঠিক করলাম টম সয়্যারকে চিঠি দেব। ওকে বলব মিস ওয়াটসনকে জানাতে, কোথায় পাওয়া যাবে জিমকে। পরক্ষণে ইচ্ছেটাকে বাতিল করতে হল। কারণ এতে হয়ত জিমের বিপদ আরও বাড়বে। রেগে গিয়ে দূরে কোথাও তাকে বিক্রি করে দেবে মিস ওয়াটসন। আর যদি তা নাও দেয়, তবু লোকে হীন চোখে দেখবে জিমকে। অকৃতজ্ঞ ভাববে। তাছাড়া আমার অবস্থাটাও চিন্তা করে দেখতে হবে। সবাই জানবে, হাকলফিন একজন নিগ্রোকে পালাতে সাহায্য করেছে। তারপর কখনও ওই শহরের কারো সাথে দেখা হলে আমার মুখে থুতু দেবে সে।
এই রকম নানান চিন্তা ভিড় জমাল মাথায়। বিবেকের চিমটিতে জ্বলতে লাগলাম। জিমকে পালাতে সাহায্য করেছি বলে ভীষণ নীচ মনে হল নিজেকে। মনে হল, আমাকে এজন্যে অনন্ত নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। শিউরে উঠলাম। তাড়াতাড়ি এক টুকরো কাগজ পেন্সিল নিয়ে মিস ওয়াটসনকে চিঠি লিখতে বসলাম।
চিঠিটা শেষ করে একটু ভাল বোধ হল। জীবনে এই প্রথম যেন সব পাপ ধুয়েমুছে পাক-সাফ হলাম। ঠিক করলাম এবার আমার আত্মার মুক্তির জন্যে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করব।
তখনই মনে পড়ল ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। জিমের কথা মনে পড়ল, তুফান মাথায় করে ভেসে চলেছি আমরা; কথা বলছি, গান গাইছি; হাসছি। ওর সাথে শত্রুতা করার মত কোন ছুতো খুঁজে পেলাম না। সবসময় আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে সে। আমি যাতে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি, সেজন্যে সারা রাত জেগে একা পাহারা দিয়েছে, মুহুঁর্তের তরেও ডাকেনি। মনে পড়ল, সে আমাকে সোনামানিক বলে ডাকত। ওকে বাঁচিয়েছিলাম বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিল এই দুনিয়ায় তার যত বন্ধু আছে তাদের মধ্যে আমিই সেরা…।
আবার বর্তমানে ফিরে এলাম। চিঠিটা চোখে পড়ল। তুলে নিলাম ওটা। আমার শরীর কাঁপছে, দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে আমাকে। কোনটা তা ঠিক করে ফেলেছি ইতিমধ্যে। শ্বাস বন্ধ করে আবার পড়লাম চিঠিটা। বেশ তা-ই হোক, বললাম মনে মনে, নরকেই যাব আমি। কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেললাম চিঠিটা।
সব চিন্তা ঝেটিয়ে দূর করে দিলাম মাথা থেকে। নষ্টামির মধ্যেই যখন বেড়ে উঠেছি, বললাম আপনমনে, তখন পাশের পথই আমার পথ। সে-পথেই চলব আমি! চুরি করব জিমকে, যে করেই হোক।
তারপর চিন্তা করতে বসলাম কীভাবে কাজ শুরু করব। অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করলাম একটা। কাজ হাসিল করার জন্যে একটা দ্বীপও দেখে রাখলাম নদীর একদিকে। তারপর অন্ধকার একটু জেঁকে বসতেই ভেলাটা সেখানে নিয়ে গেলাম। ওখানেই ঘুমোলাম রাতে। ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সারলাম। আমার জিনিসপত্র যা ছিল গুছিয়ে নিলাম একটা বোঁচকায়। ডিঙি নিয়ে সাইলাস ফেলপসের গোলাবাড়ির কাছেই এক জায়গায় নোঙর করলাম। পাথরখণ্ড ভরে ডুবিয়ে দিলাম ডিঙিটা। কাপড়ের পোটলাটাও লুকিয়ে রাখলাম একটা ঝোপের ভেতর।
তারপর রাস্তায় উঠলাম। একটু যেতেই একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। তাতে লেখা: ফেলপসের করাতকল। আরও কিছুদুর এগিয়ে আশপাশ দেখে নিলাম ভাল করে; যখন নিশ্চিত হলাম-কেউ দেখেনি আমাকে, রওনা দিলাম শহরের উদ্দেশে। পথেই দেখা হল ডিউকের সাথে, দেয়ালে রয়্যাল নানসাচ নাটকের বিজ্ঞাপন সঁটছে। আমাকে দেখে বিস্মিত হল সে।
কী হে, তুমি কোখেকে? বলল ডিউক। ভেলাটা কোথায়?
আমারও তো সেই একই প্রশ্ন, বললাম।
কেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমারই তো ভাল জানার কথা।
আমি জানি না। রাতে নদীর পাড়ে গিয়ে ভেলা নেই দেখে ভাবলাম, তোমরা বোধহয় কোন বিপাকে পড়ে পালিয়েছ ওটা নিয়ে। তাহলে গেল কই ভেলাটা? আর বেচারা জিমেরই-বা কী হল?
জানি না, ডিউক বলল। রাতে নদীতীরে গিয়ে আমরা দেখলাম ভেলা নেই। তখন মনে করলাম আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছ তুমি।
গেলে জিমকে রেখে যেতাম না।
এটা অবশ্য ভেবে দেখিনি আমরা। আচ্ছা, তোমার কি ধারণা, ওই নিগ্রো শালা আমাদের জারিজুরি সব ফাঁস করে দেবে? দিলে ওর পিঠের চামড়া তুলে নেব আমি।
কী করে বলবে, ও তো পালিয়েছে?
না, পালায়নি। ওই বুড়ো হারামি চল্লিশ ডলারে বিক্রি করেছে ওকে। আমাকে এক পয়সাও ডাগ দেয়নি, একা সাবড়েছে।
বিক্রি করেছে? কোথায়? ওকে আনতে যাব আমি।
পারবে না। তবে যদি কথা দাও আমাদের কথা বলবে না কাউকে, তোমাকে ওর ঠিকানা দিতে পারি।
দিলাম কথা।
আব্রাহাম ফস্টার নামে এক লোকের কাছে আছে। এখান থেকে চল্লিশ মাইল দূরে। লাফায়েত যাবার পথেই ফস্টারের খামার পাবে।
জানি, মিথ্যে বলছে শয়তানটা। আমাকে এখান থেকে দূরে কোথাও সরিয়ে দেয়াই ওর মতলব! যা-ই কে, ওর কথা বিশ্বাস করার ভান করলাম।
ঠিক আছে, সেখানেই যাচ্ছি তাহলে, ওকে বললাম। তারপর লাফায়েতের পথে মাইলটাক যাবার পর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ফের সাইলাস ফেলপসের বাসার পথ ধরলাম।
১৮. ফার্মে পৌঁছে দেখলাম
ফার্মে পৌঁছে দেখলাম, সবকিছু এক্কেবারে রোববারের দিনটার মত শুনশান। কেউ নেই কোথাও। মজুরের মাঠে কাজ করতে গেছে। বাতাসে মশামাছির গুঞ্জন নির্জনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে কেউ বেঁচে নেই। গাছের পাতার ঝিরঝির শব্দকে মনে হচ্ছে যেন মরা মানুষের ফিসফিসানি।
গাছের সামনেই একটা বড় আঙিনা, মরাটে ঘাসে ছাওয়া। তার ওপ্রান্তে দোতলা বাড়ি। সাদা চামড়ার লোকেরা থাকে সেখানে। রান্নাঘরটা মূল বাড়ির লাগোয়া। উঠোনের এক প্রান্তে, বেড়ার ধার ঘেঁষে, ছোট্ট একটা কুঁড়ে। একটু দূরেদূরে আরও কয়েকটা ঘর। একটা ঘরের খোলা দরজাপথে ভেতরের আসবাব দেখা যাচ্ছে। সাবান জ্বাল দেয়ায় বড় কেতলি আর একটা ছাইদানি। রান্না ঘরের সামনেই বেঞ্চি, তার ওপর এক বালতি পানি আর একটা কুমড়ো রাখা। একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে গাছের ছায়ায়। বেড়ার ধারেই কিছু ফলমূলের ঝোপ। বেড়ার ওপাশে বাগান। খানিকটা তরমুজের খেত, তারপর তুলোর আবাদ। একেবারে শেষপ্রান্তে জল।
বেড়া টপকে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলাম। অর্ধেক রাস্তা গেছি এমন সময় প্রথমে একটা, পরে আরও একটা কুকুর এসে আমাকে হেঁকে ধরল। দাঁড়িয়ে গেলাম স্থাণুর মত। চক্রাকারে আরও কয়েকটা কুকুর, প্রায় গোটা পনের হবে, ঘিরে ধরল আমাকে। এদের চিৎকারে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেল।
একটা নিগ্রো ঝি বেলুন হাতে ছুটে বেরুল রান্নাঘর থেকে। ভাগ, টাইনি! ভাগ, স্পটি! কুকুর দুটোর পিঠে কষে দু ঘা বসল সে। কুঁই কুঁই ডাক ছেড়ে পালাল কুকুর দুটো। ওদের দেখাদেখি অন্যগুলোও ভাগল, কিন্তু পরমুহুঁর্তে আবার তেড়ে আসল কয়েকটা।
ঝি-টার পেছনে দুটো নিগ্রো ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। তারা তাদের মায়ের গাউনের সাথে লেপ্টে রইল। সচরাচর বাচ্চারা যেমন করে, তেমনিভাবে মায়ের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। এবার একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা বেরোল। বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়েস, মুখে একগাল হাসি। আমার দিকে এগিয়ে এল সে।
শেষপর্যন্ত এলি তাহলে! খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল মহিলা, জড়িয়ে ধরল আমাকে। চোখে মুক্তোর মত চিকচিক করছে আনন্দাশ্রু।
তুই তোর মায়ের মত হোসনি দেখতে, বলল বুড়ি। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা শ্বেতাঙ্গ ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এসেহে ঘর থেকে। তাদের দিকে ঘুরে বলল, অ্যাই, দ্যাখ তোরা, কে এসেছে। তোদের খালাতভাই, টম। নে, জিজ্ঞেস কর ওকে, কেমন আছে সে।
বাচ্চাগুলো বুড়ো আঙুল মুখে পুরে মহিলার পেছনে লুকাল। আমাকে হাতে ধরে ঘরে নিয়ে এল মহিলা। বাচ্চারাও এল পিছু পিছু। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে বুড়ি নিজে একটা মোড়ায় বসল। তারপর আমার দুহাত চেপে ধরল।
দাঁড়া, এবার ভাল করে দেখি তোকে, বলল। কদ্দিন ধরে আশা করে আছি তোকে দেখব, তা অ্যাদ্দিনে এলি তুই। এত দেরি হল কেন আসতে? পথে জাহাজ কোন চড়ায় ঠেকেছিল?
হ্যাঁ, ম্যাডাম…জাহা…
ওসব ম্যাডাম-ফ্যাডাম ছাড়, স্যালিখালা বলে ডাকবি আমাকে। তোর খালু আজ হপ্তাখানেক হল রোজই একবার করে শহরে যাচ্ছে তোকে আনতে। আজও গেছে। পথে হয়ত দেখে থাকবি তাকে—বুড়ো মত একজন…
না, খালা, দেখিনি, বললাম আমি, ভেতরে ভেতরে দারুণ অস্বস্তি বোধ করছি।
মিসেস ফেলপস আমার উশখুশ খেয়াল করল না, সমানে বকবক চালিয়ে গেল। হঠাৎ তার একটা কথায় আমার শিরদাড়া বেয়ে হিম রক্তস্রোত বয়ে গেল।
কই, বুবু কিংবা বাসার আর কারো কথা তো বললি না কিছু? জিজ্ঞেস করল বুড়ি। আমি বরং জিবটাকে একটু বিশ্রাম দেই, তুই সেই ফাঁকে বাসার কে কেমন আছে বল।
আচ্ছা গ্যাড়াকলে পড়লাম; এ-পর্যন্ত ভাগ্য আমাকে ভালই সাহায্য করেছে, কিন্তু এবার একেবারে চড়ায় আটকে দিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছি আর এগোনোর চেষ্টা বৃথা, সত্য কবুল না-করে উপায় নেই। মুখ খুলতে যাব সব বলার জন্যে, আচমকা আমাকে ঠেলে খাটের তলায় চালান করে দিল বুড়ি। বলল, ওই যে, আসছে ও। চুপ করে বসে থাক এখানে। টু শব্দ করিস না। ও যেন বুঝতে না পারে তুই আছিস এখানে। ওকে একটু চমকে দেব আমি।
সাইলাস ফেলপস ঘরে ঢুকল।
কি হল, আসেনি? মিসেস ফেলপস জিজ্ঞেস করল।
না। বুঝতে পারছি না কেন আসছে না এখনও। বড্ড চিন্তা হচ্ছে আমার। আলবত এসেছে। নিশ্চয়ই তুমি রাস্তায় হারিয়ে ফেলেছ ওকে।
না, স্যালি। বিশ্বাস কর।
জানলার দিকে ইশারা করল মিসেস ফেলপস্। বলল, দ্যাখো, সাইলাস, কে যেন আসছে এদিকে!
কে আসছে দেখার জন্যে সাইলাস ফেলপস জানলার ধারে যেতেই আমাকে খাটের তলা থেকে টেনে বের করল বুড়ি। ওদিকে বাইরে কাউকে দেখতে না পেয়ে মিস্টার ফেলপস্ ঘোরামাত্রই তার চোখ আমার ওপর পড়ল। মিটিমিটি হাসতে লাগল তার স্ত্রী। ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোক।
কে? জিজ্ঞেস করল সে।
আবার কে, টম সয়্যার, বলল তার স্ত্রী।
ঘরে বাজ পড়লেও বোধকরি এতটা চমকাতাম না আমি। মনে হল, পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে, তরতর করে পাতালে প্রবেশ করছি আমি। তাহলে এরা আমাকে টম সয়্যার ঠাউরেছে! আমার পুরোন ইয়ার, টম সয়্যার!
আমার হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল খালু। খালা হেসে গড়াগড়ি খেল। তারপর নানান জেরায় ওরা অতিষ্ট করে তুলল আমাকে। টমের ভাই সিড, ওর বোন মেরি এবং পলিখালার কথা জিজ্ঞেস করল। স্যালিখালা আবার পলিখালার বোন। আমিও সোৎসাহে সয়্যার পরিবার সম্পর্কে সত্যি-মিথ্যে বানিয়ে অনেক গল্প শোনালাম ওদের। এমন সব ঘটনা বললাম যা গত দশ বছরে ঘটেনি ও-বাড়িতে।
আচমকা নদীতে একটা স্টিমারের ভোঁ শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। হয়ত টম সয়্যার আসছে এই জাহাজে, মনে মনে বললাম। সে যদি এখানে এসে বলে, সালিখালা, আমি টম সয়্যার, তখন কী উপায় হবে? উপলব্ধি কমলা এখুনি রাস্তায় গিয়ে ঠেকাতে হবে ওকে, সব কথা খুলে বলতে হবে।
খালা, বললাম, আমার জিনিসগুলো আনার জন্যে একটু শহরে যাচ্ছি।
চল, ওয়াগন নিয়ে আমিও সঙ্গে যাই।
না। আপনাকে খামোকা কষ্ট করতে হবে না। আমি চালাতে পারব। সাইলাস ফেলসের ওয়াগন নিয়ে শহরের দিকে যাত্রা করলাম আমি। খানিকটা যেতেই দেখলাম একটা ঘোড়া গাড়ি আসছে জাহাজঘাটার দিক থেকে। টম সয়্যার ওই গাড়িতে বসে।
দাঁড়াও, টম! চেঁচিয়ে বললাম আমি।
আমাকে দেখে ওর চোয়াল ঝুলে পড়ল, ভূত ঠাউরাল আমাকে। বলল, তোমার তো কোন ক্ষতি করিনি আমি। তবে আবার পিছু নিয়েছ কেন?
ভয় নেই, টম, বললাম, আমি ভূত না।
মরনি তুমি?
না, টম। ওদের ফাঁকি দিয়েছি। বিশ্বাস না হয়, আমাকে চিমটি কেটে দেখ।
চিমটি কেটে আশ্বস্ত হল সে, আমি হাক, এবং সত্যি সত্যি বেঁচে রয়েছি। আবার আমার দেখা পেয়ে খুব খুশি হল টম।
বল, হাক, সব খুলে বল আমাকে, টম বলল। না জানি কত মজাই করেছ তুমি।
পরে, টম। পরে সব বলব। ঠিক এই মুহূর্তে আমি ভীষণ বিপদে আছি। শোন, টম, বিপদটা কী তা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমার কী করা বল?
ঠোঁট কামড়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করল টম। তারপর বলল, আমার সুটকেস নিয়ে বাসায় যাও তুমি। এমন ভান কর যেন এগুলো তোমার। খুব আস্তে গাড়ি চালিয়ে যাবে। এর কিছু পরেই আমি গিয়ে হাজির হব এবং নিজেকে সিড বলে পরিচয় দেব।
ঠিক আছে, টম। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার, খুবই গোপনীয়, কেউ যেন না জানে। এখানে এক নিগ্রো আছে। আমি ওকে চুরি করে মুক্তি দিতে চাই। ওকে চেন তুমি। মিস ওয়াটসনের চাকর জিম!
কী! আঁতকে উঠল টম। বল কী, জিম তো পলাতক।
জানি। কিন্তু তবু ওকে সাহায্য করব আমি। তুমি হয়ত খারাপ বলবে এটাকে, তবু করব। কথা দাও, কাউকে কিছু জানাবে না।
তোমাকে সাহায্য করব আমি, টম বলল। নতুন অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্নে ওর চোখ চকচক করছে।
ওর কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। ও খুব বড় ঘরের ছেলে, আর বড় ঘরের লোকেরা নিগ্রোদের পালাতে সাহায্য তো করেই না, বরং কেউ করলে তাকে ঘৃণা করে।
টম, জিজ্ঞেস করলাম আমি; যা বলছ ভেবে বলছ তো?
আলবত, দৃঢ় সুরে বলল ও। আমিও আর কথা বাড়ালাম না।
টমের প্যাটরা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। এর আধঘণ্টা পর ওর গাড়ি এসে ফটকের কাছে থামল। স্যালিখালা জানলা দিয়ে টমকে দেখে ভাবল কোন ভিনদেশি হবে হয়ত।
বাচ্চাদের একজনকে ডেকে বলল, যা তো, জিমি, এক দৌড়ে লিজিকে বলে আয় খাওয়ার টেবিলে আরেকটা থালা লাগাতে।
বাসার সবাই দৌড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বিদেশি কেউ প্রতি বছরেই আসে না। তাই, পীতজ্বর হলে যেমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, নতুন কেউ এলেও প্রায়
সেরকমই হয়। ভারিক্কি চালে আমাদের সামনে এল টম। খুব যত্নের সাথে মাথার টুপিটা খুলল, মনে হল সেটা এমন এক বাক্সের ঢাকনা যার ভেতর প্রজাপতি ঘুমিয়ে আছে। এবং সে তাকে জাগাতে চায় না।
আপনিই তো বোধহয় মিস্টার আর্চিবল্ড নিকলস্? সাইলাসখালুকে জিজ্ঞেস করল ও।
না, বাবা, বলল খালা। গাড়িঅলা ঠকিয়েছে তোমায়। নিকলসের বাসা এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে। এস, ভেতরে এস।
আমরা সবাই ওকে নিয়ে খাওয়ার টেবিলে গেলাম। নিজেকে সে উইলিয়ম টমসন বলে পরিচয় দিল। বলল, ওহায়য়ো রাজ্যের হিভিল থেকে আসছে।
খেতে খেতে হঠাৎ উঠে পড়ল টম। স্যালিখালাকে চুমু দিয়ে আবার এসে বসল নিজের চেয়ারে।
হাতের উল্টোপিঠে মুখ মুছে চিৎকার করে উঠল খালা, বেয়াদব ছোড়া! আমাকে চুমু দিলি কেন তুই?
আ…আমি…মনে করলাম আপনি হয়ত পছন্দ করবেন, আমতা আমতা করে বলল টন।
কেন মনে করলি, বল?
ওরা সবাই বলল যে!
কারা?
চেয়ার ঠেলে উঠে দাড়াল টম। হতভম্ব হওয়ার ভান করল। তারপর টুপিটা হাতে নিয়ে বলল, দুঃখিত, আমি আশা করিনি এটা। তারা অবশ্য আমাকে বলেছিল, চুমু দেবে তাকে। তিনি খুশি হবেন। আর করব না এমন।
হ্যাঁ, করবে না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল স্যালিখালা। টম, তোমার কী মনে হয়, আমার দিকে ঘুরল টম সয়্যার, স্যালিখালা যদি জানে আমি সিড সয়্যার…
টমের কথা শেষ হবার আগেই স্যালিখালা বুকে জড়িয়ে ধরল ওকে, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখ।
বুবু তো লেখেনি, তুইও আসছিস, সিড। সত্যি, দারুণ অবাক হয়েছি আমরা।
খালা প্রথমে আসতে দিতে চায়নি। বহু কষ্টে পটিয়ে এসেছি।
সেদিন সারাটা বিকেল নানান গল্প-গুজব হল আমাদের মাঝে। কিন্তু একজন পলাতক নিগ্রো ধরা পড়েছে, এমন কথা শুনলাম না কারো কাছে।
তবে রাতে খেতে বসে ওদের এক ছেলে খালুকে বলল টম আর সিডকে নিয়ে সে শহরে রয়্যাল নানসচ নাটক দেখতে যেতে চায়।
না; যাওয়া হবে না, বলল ওদের বাবা। ওই নাটকের কথা পলাতক নিগ্রোটার মুখে শুনেছি আমরা। সবাই খেপে উঠেছে ওই বাটপার দুটোর ওপর। মেরে-ধরে তাড়িয়ে দেবে। হয়ত দিয়েওছে এতক্ষণে।
একথা শুনে খারাপ লাগল আমার। শোবার ঘরে গিয়ে ঠগ দুটোর কথা বললাম টমকে। সব শুনে টম বলল, এটা তাদের পাওনা। আমি একমত হলাম ওর সাথে, কিন্তু সেই সঙ্গে অনুভব করলাম, ওদের আমার সতর্ক করে দেয়া উচিত।
জানলা দিয়ে কার্নিসে নামলাম আমরা, সেখান থেকে লাইটপোস্ট বেয়ে নিচে। শহরে গিয়ে দেখলাম চৌরাস্তার মোড়ে মিছিল করছে লোকজন। সকলের হাতে মশাল, কেউ ক্যানেস্তার পেটাচ্ছে কেউ-বা ফুঁকছে শিঙ্গা। একটা খাটিয়ার ওপর বসে আছে সম্রাট আর ডিউক। ওদের হাত-পা বাঁধা। দেখে চেনার জো নেই। সারা গায়ে আলকাতরা, তাতে পাখির পালক সাঁটা। সব মিলিয়ে কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে ওদের। দেখে করুনা হল আমার। কেউ কারো ওপর এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারে ভেবে পেলাম না।
১৯. জিম কোথায় আছে আমি জানি
জিম কোথায় আছে আমি জানি, ফেরার পথে বলল টম। রান্নাঘরের ওপাশেই যে-ছোট্ট কুঁড়েটা, ওখানে। কেন, লক্ষ্য করনি তুমি, আমরা যখন ডিনার খাচ্ছিলাম, একটা চাকর খাবার নিয়ে ওদিকে গেল?
হ্যাঁ, দেখেছি। তবে ভেবেছিলাম, কোন কুকুরের খাবার হবে হয়ত।
উহুঁ, কুকুরের না, হাক।
কেন?
কারণ, ওর ভেতর ফলও ছিল। কুকুরকে কেউ ফল খেতে দেয় না, নাকি?
তা-ই, টম।
তারপর, ধর, লোকটা যখন ওই ঘরে গেল তখন তালা খুলে ভেতরে ঢুকল, আবার বেরিয়ে এসে তালা লাগাল। খাওয়া সেরে আমরা টেবিল থেকে ওঠার সময়ে চাবিটা সে খালুকে ফেরত দেয়। ফল থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওই ঘরে মানুষ আছে, আর তালা থেকে বোঝাচ্ছে, সে বন্দি হয়ে আছে। এবং আমি নিশ্চিত লোকটা আর কেউ নয়-জিম।
তাহলে তো, টম, শুতে যাবার আগে এক চক্কর দেখে আসতে হয় কুঁড়েটা, বললাম আমি।
কুঁড়ের চারপাশ ঘুরে দেখে এলাম আমরা। পেছন দিকে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে। একটা মোটা তক্তা তেরছাভাবে ওটার ওপর মারা।
ওই কাঠটা খসাতে পারলেই জিম বেরোতে পারবে, টমকে বললাম আমি। তারপর আগে যেমন করেছি, তেমনি করেই রাতে চলব আমরা আর দিনে পালিয়ে থাকব। কী বলো?
মন্দ না, বলল টম। ঠিক যেন ইদুর-বেড়াল লড়াইয়ের মত। জটিলতা একটুও নেই। পানসে। বুঝলে, হাক, একটা সাবানের দোকান ভেঙে চুরি করলে যতটুকু হইচই হয়, এতে তাও হবে না। নাহ, আর একটু জটিল কিছু বের করতে হবে।
বেড়া কেটে বের করলে কেমন হয়? আমি তো সেবার খুন হবার আগে ওইভাবেই বেরিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, এটা চলতে পারে, সায় দিল টম। এতে রহস্য আছে, কষ্টকরও বটে। কিন্তু এর চেয়েও কঠিন কিছু চাইছি আমি; এমন, যাতে বেশি সময় লাগে।
কুঁড়েটার পাশেই একটা বারান্দামত লম্বা ঘর। বন্ধ দরজায় তালা ঝুলছে। টম সাবান জ্বাল দেয়ার কেতলিটার কাছে গেল। চারদিক খুঁজে দেখল। তারপর ঢাকনি তোলার ছেনিটা নিয়ে এসে বাড়ি মেরে তালা খুলে ফেলল। ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম আমরা। দেশলাই জ্বেলে ভেতরটায় দ্রুত চোখ বোলালাম। বাগান করার সাজসরঞ্জাম সব-কোদাল, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি। ওগুলো দেখে টমের মাথায় প্ল্যান খেলে গেল।
পেয়েছি, হাক। গর্ত খুঁড়ে ওকে বের করব আমরা, বলল ও। এক হপ্তা সময় লাগবে এতে।
এরপর বাসায় ফিরে গেলাম আমরা। আমি খিড়কিপথে ভেতরে ঢুকলাম। ওই দরজাটা খোলাই থাকে সবসময়। একটা দড়ি আছে, টানলেই বাটের হুঁড়কোটি খুলে যায়। কিন্তু টমের কাছে ওভাবে যাওয়াটা নেহাতই মামুলি মনে হল। পাঁচবারের চেষ্টায় ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকল সে।
পরদিন খুব সকালে বিছানা ছাড়লাম আমরা। উদ্দেশ্য, বাইরে গিয়ে কুকুরগুলোর সাথে ভাব জমাব। ন্যাটের সাথেও খাতির করতে হবে। ও-ই খাবার দেয় জিমকে।
ন্যাট লোকটা বেশ হাসিখুশি। ভূত-প্রেতে তার দারুণ ভয়। তাই ভূত তাড়াবার জন্যে মাথার চুলে ঝুঁটি বেঁধেছে। রোজই নাকি সে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে, জানাল। অদ্ভুত সব শব্দও শোনে।
কার খাবার? ওর হাতের থালা দেখিয়ে টম শুধাল। একসারি ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল। দেখবেন, চলেন, ন্যাট বলল।
আমার যাবার ইচ্ছে ছিল না, জিম আমাদের দেখলেই চিনবে। তাতে ঝামেলা বাড়তে পারে আরও। কিন্তু টম যাওয়ার জন্যে একপায়ে খাড়া, অগত্যা আমাকেও যেতে হল।
যা ভেবেছি তা-ই, আমাদের দেখেই চেঁচিয়ে উঠল জিম, আরে, হাক! ওটা কে সঙ্গে, মাস্টার টম না?
ওমা! ন্যাটের চোখ কপালে উঠল। এ ব্যাটা আপনাদের চেনে?
কী বলব, বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। কিন্তু টম ঘড়েল। তাজ্জব হওয়ার ভান করল, বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল ন্যাটের দিকে।
কার কথা বলছ? কে চেনে আমাদের? টম প্রশ্ন করল, ওকে।
কেন? এই পলাতক নিগ্রোটা।
কই, না। না তো।
তবে যে আপনাদের নাম ধরে ডাকল?
যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেছে এমন ভাব করল টম। তুমি তো ভারি অদ্ভুত কথা বলছ হে, আস্তে আস্তে বলল ও। কখন ডাকল? এ লোক তো মুখই খোলেনি। আমার দিকে তাকাল টম। তুমি কিছু শুনেছ, হাক? জিজ্ঞেস করল।
না, আমি বললাম।
এবার জিমকে আপাদমস্তক এমন ভাবে মাপল টম, যেন জীবনে এই প্রথম দেখছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, কিছু বলেছ তুমি? এর আগে কখনও আমাদের দেখেছ?
না, স্যার। দেখিনি, স্যার।
টম এবার ওই বাড়ির চাকরটার দিকে ঘুরল। তোমার মাথা ঠিক আছে তো, ন্যাট? বলল ও।
সব ওই ভূত-পেত্নীর কাণ্ড, স্যার। দোহাই আপনাদের, মালিককে বলবেন না এসব। উনি শুনলে বকবেন। ভূত-পেত্নীতে বিশ্বাস করেন না মালিক।
ন্যাটকে একটা তামার পয়সা দিল টম। ওকে আশ্বস্ত করল কাউকে কিছু বলবে না। পয়সাটা ভাল করে দেখার জন্যে ন্যাট দরজার কাছে গেল, দাঁতে কেটে পরখ কল আসল না নকল। আর সেই ফাঁকে জিমকে ফিসফিস করে টম বলল, আমাদের না-চেনার ভান করবে। রাতে কেউ গর্ত খুঁড়ছে টের পেলে বুঝবে আমরা। জিম, আমরা তোমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি।
উত্তেজনায় ছটফট করছি আমরা, কখন মাটি খুঁড়ব আর কখনই-বা বের করব জিমকে। কিন্তু হঠাৎ করেই উল্টো সুর প্রল টম।
নাহ্ হাক, সব যেন বড় বেশি সাদামাঠা হয়ে যাচ্ছে, বলল। কোন পাহারাদার নেই যে তাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াব। কুকুরগুলোও আমাদের চেনে, চিল্লাবে না। অথচ ওদেরও ঘুমের বড়ি দেয়া দরকার। তারপর জিমের কথাই ধর। দশফুট শেকল দিয়ে একটা চৌকির পায়ার সাথে বাধা। পায়াটা তুলে শেকল বের করলেই হল। খালুও আমার নেহাত সোজা মানুষ, চাকরের হাতে চাবি পাঠিয়ে দেয়। ফলে কষ্টের কিছুই দেখছি না, হাক। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টম, তারপর উফু স্বরে বলল, না আছে তো কী হল, মাথা খাটিয়ে বের করে ফেলব একটা কিছু।
টম এরপর রাজ্যের ঝামেলা হাজির করল। বারবার বলল, পালানোটা বইয়ে যেমন লেখা থাকে সে-রকম হতে হবে। চালাঘর থেকে কুঁড়ে পর্যন্ত সুরঙ্গ খোঁড়ার বেলায়, বলল ও, চাকু ব্যবহার করতে হবে। প্রথমে তা-ই করলাম, কিন্তু শিগগিরই ব্যথা ধরে গেল হাতে। কাজও এগুলো অল্প। তখন বাধ্য হয়ে গাইতিশাবল তুলে নিলাম। এরপর পানির জন্যে একগাছা দড়ির মই, লেখার জন্যে একটা মোমবাতি আর কাগজ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে একটা টিনের থালা যোগাড় করতে বলল টম। জিম কালি কোথায় পাবে জিজ্ঞেস করায় ও জানাল, গায়ের রক্ত দিয়ে লিখবে। এগুলো সব আমার কাছে ফালতু ব্যাপার মনে হল। কিন্তু টম গো ধরে বসে রইল, কারণ ও যেসব বই পড়েছে তাতে নাকি এ ধরনের কথাই লেখা আছে।
দড়ি কোথায় পাব? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
খুঁজে-পেতে দেখ, টমের উত্তর।
এক কাজ করলে কেমন হয়, বললাম, স্যালিখালা যখন রোদে কাপড় শুকোতে দেয়, তখন না হয় তার একটা চাদর ধার করি। মই বানান যাবে।
কর। এই সাথে আরও একটা পরিকল্পনা মাথায় ঢুকিয়ে দিল টম। একটা শার্টও আনবে, বলল ও।
শার্ট দিয়ে কী হবে? জিমকে দেব। ডায়েরি লিখবে। ডায়েরি না হাতি-ও তো লিখতেই জানে না। ধরে নাও জানে।
পরদিন সকালে চাদর আর শার্ট ধার করলাম আমি। টম অবশ্য বলল এটা ধার নয়, চুরি। তবে যেহেতু আমরা একজন বন্দির প্রতিনিধি, এবং বন্দিরা জিনিস কোথেকে আসবে তার পরোয়া করে না, সুতরাং এই চুরি জায়েজ।
ওদিকে টমও একটা টিন আর চামচ চুরি করে এনেছে। একটা পিতলের মোমদানিও এনেছে সে, ওটা দিয়ে কলম তৈরি করে দেবে জিমকে। মোম এনেছে ছটা। সেরাতে দশটার পর থাম বেয়ে নিচে নামলাম আমরা। একটা মোম সঙ্গে নিলাম, জিমের জানলায় কান পেতে বুঝলাম নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মোমটা ঘুলঘুলি দিয়ে ভেতরে ফেললাম। কিন্তু ও জাগল না। তারপর আমরা ঘূর্ণিবেগে গাইতি-শাবল চালালাম। আড়াই ঘণ্টা বাদে কাজ শেষ হল। সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে বুকে হেঁটে জিমের ঘরে গেলাম। হাতড়ে হাতড়ে ধরালাম মোমটা। আমাদের দেখে খুশিতে জিম কেঁদে ফেলল।
টম জানাল, পিঠার মধ্যে ভরে ওর কাছে দড়ির মই পাঠাব আমরা। ন্যাট নিয়ে আসবে সেটা। ও যাতে কোন সন্দেহ না করে তার ব্যবস্থাও করা হবে।
পরদিন ভোরে ন্যাটের সাথে জিমের ঘরে গেলাম আমরা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর খাওয়া দেখছি, হঠাৎ ওর খাটের তলা থেকে একজোড়া কুকুর বেরিয়ে এল। তারপর একে একে এগারোটা এসে জড়ো হল। হায় ঈশ্বর! রাতে চালাঘরের দরজা বন্ধ করিনি, মনে পড়ল আমার। নিগ্রো ন্যাট একবার শুধু চেঁচিয়ে উঠল, তারপর সটান মাটিতে শুয়ে গোঙাতে লাগল ভয়ে।
টম দরজাটা ফাঁক করল একটু, জিমের খাবার থেকে এক খন্ড মাংস ছুড়ে দিল বাইরে। মাংসের লোভে কুকুরগুলো বাইরে যেতেই ঝট করে দরজাটা টেনে দিয়ে সে-ও বেরিয়ে গেল। একটু বাদে ফিরে এল আবার। চালাঘরের দরজা বন্ধ করে এসেছে, আন্দাজ করলাম আমি।
পরে ন্যাটকে বলল টম, দ্যাখ, বাপু, আমার মনে হচ্ছে পেত্নীগুলোর পেটে দানাপানি পড়েনি অনেক দিন, তাই ওরা টমের খাওয়ার সময় আসছে বারবার। তুমি এক কাজ কর, ডাইনী পিঠে তৈরি করে দাও ওদের।
কীভাবে বানাব, মাস্টার সিড? জিজ্ঞেস করল ন্যাট। আমি তো বানাতে জানি না।
ঠিক আছে, আমি বানিয়ে দেব, টম আশ্বস্ত করল ওকে। তবে খুব সাবধান, বানানোর সময় পেছন ফিরে থাকবে তুমি। আর জিম যখন ওটা নেবে তখন মুখ ঘুরিয়ে রাখবে। দেখলে কিন্তু কাজ হবে না। ডাইনীরা আসতেই থাকবে।
আচ্ছা, মাস্টার সিড।
২০. পিঠার খামির তৈরি শেষ
তিনদিন পর।
পিঠার খামির তৈরি শেষ। তবে এজন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাদের। তিন তিন বার ময়দা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ধোঁয়ায় চোখ কানা হবার দশা হয়েছে। পিঠা বানানো শেষ করে চাদরটা ফালি করে ছিড়লাম আমরা। ভোর হবার আগেই পাকিয়ে চমৎকার দড়ি তৈরি করলাম একটা, তারপর পুর দেয়ার মত করে পিঠার ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম সেটা। এবার একটা পেতলের পাত্রে ঢেকে পিঠা বেক করতে লাগলাম। পনের মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল আবার।
জিমের থালে ডাইনী-পিঠাটা আমরা রাখার সময় ভুলেও সেদিকে তাকাল না ন্যাট। সেই অবসরে টিনের বাসন আর কলমরুপী চামচগুলোও দিয়ে দিলাম জিমকে। তারপর একলা হওয়ামাত্রই পিঠার ভেতর থেকে দড়িটা বের করে বিছানার খড়ের গাদার নিচে লুকিয়ে রাখল ও। একটা টিনের থালে দুর্বোধ্য কিছু আঁকিবুকি কেটে ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।
সেদিন রাতে আবার জিমের ঘরে গেলাম আমরা। সেখানে বসে কাগজে কয়েকটা কথা লিখল টম। সে ওটার নাম দিল বন্দির আর্তনাদ। এই কথাগুলো পালাবার আগমুহূর্তে দেয়ালে লিখতে হবে জিমকে, টম জানাল। কারণ সকলেই নাকি ওরকম লিখেছে। কী লিখেছে, আমাদের পড়ে শোনাল টম: সাঁইত্রিশ বহুর দুঃসহ কারাভোগের পর গৃহ-স্বজনহারা এক রাজপুরুষ এই ঘরে মারা গেছে।
আমার মনে হল, জিমের এবার পালান উচিত। টমকে বললাম সে-কথা।
আরও এক জিনিস বাকি, ও বলল।
কী?
একটা উড়োচিঠি।
সেটা আবার কী?
এর সাহায্য আসন্ন বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে দেয়া হয়। কিন্তু তলায় কারও সই থাকে না।
চিঠিটা নেহাত জরুরি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হ্যাঁ, জিদ ধরল টম। আমি লিখে দিচ্ছি। হাক, তুমি ওটা সামনের দরজার চৌকাঠের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে।
ছোট্ট একটা চিরকুট লিখল টম, টেলিগ্রামের মত:
সাবধান। বিপদ আসছে। কড়া নজর রাখুন।
-অচেনা বন্ধু।
ওই রাতেই টমের কথামত চিঠিটা রেখে এলাম আমি। জিম রক্ত দিয়ে দুটো হাড়ের ক্রুশচিহ্নের ওপর একটা মরা মানুষের খুলি আঁকল। পরের দিন রাতে সামনের দরজায় সেঁটে দিলাম ওটা। তৃতীয় রাতে পেছনের দরজায় একটা কফিনের ছবি টাঙিয়ে দিলাম।
বাড়ির সবার টনক নড়ল এবার। কোন পরিবারকে ভয়ে এমন ঘামতে দেখিনি আমি। দরজায় করে শব্দ হলেও স্যালিখালা চমকে উঠছে। কিছু পড়ল তো ওরে বাবা গেলাম বলে চেঁচাচ্ছে। অন্যেরাও, তার মত, ভয়ে অস্থির। শুয়ে-বসে কোথাও শান্তি নেই কারও।
টম বলল আরও ভয় রাতে হবে ওদের মনে। সুতরাং পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের আরেক খানা চিঠি তৈরি হয়ে গেল। তবে এ চিঠিটা ড্রপ করা একটু কষ্টকর হয়ে উঠল। প্রতি দরজাতেই একজন করে নিগ্রোকে রাতে পাহারায় বসিয়েছে খালু। টম লাইটপোস্ট বেয়ে নিচে গেল কী হচ্ছে দেখতে। পেছনের দরজায় পাহারারত নিগ্রোটা ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। তক্ষুনি ওর ঘাড়ের পেছনে চিঠিটা লটকে দিল।
ওতে লেখা:
আজ রাতে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের একদল গলাকাটা আপনাদের কাছে যে পলাতক নিগ্রো আছে, তাকে চুরি করতে আসছে। এরাই আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে, যাতে ঘরের ভেতর থাকেন আপনারা। আমিও এই দলেরই সদস্য, কিন্তু ধর্মভীরু। আমি ভাল হতে চাই। তাই ওদের মতলব ফাঁস করে দিচ্ছি। ওরা দুপুর-রাতে উত্তর দিক থেকে আসবে। ওদের কাছে নকল চাবি আছে। সেটা দিয়ে নিগ্রোটার ঘর খুলবে। ওরা আসামাত্রা আমি ভেড়ার ডাক ডেকে সতর্ক করে দেব আপনাদের। আজ আপনারা ধরতে পারবেন ওদের। এর জন্যে আমি কোন পুরস্কার আশা করি না; মানুষের ভালর জন্যে কিছু একটা করতে পারছি-এটাই আমার সান্ত্বনা।
-অচেনা বন্ধু
নাস্তা সেরে ডিঙি নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেলাম আমরা। সময়টা ভালই কাটল, ভেলাটাও দেখলাম। রাতের খাবার খেতে একটু দেরি করে বাসায় ফিরলাম। খাওয়া-দাওয়ার পরপরই আমাদের বিছানায় শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হল। কেন, কী ব্যাপার, বলল না কেউ। আমরা অর্ধেক সিড়ি পর্যন্ত উঠে সুট করে নেমে গিয়ে মাটির নিচের ভাড়ার ঘরে ঢুকলাম। সেখান থেকে পরদিন দুপুরের খাবার জোগাড় করে ফিরে এলাম আমাদের কামরায়। প্রায় সাড়ে-এগারোটার দিকে উঠলাম আমরা। টম খাওয়ার জিনিসগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে ভাড়ার থেকে মাখন জোগাড় করে আনতে বলল আমায়। কলল, জিমের ঘরেই আমার জন্যে ও অপেক্ষা করবে।
ভাঁড়ারে গেলাম আমি। এক খাবলা মাখন নিয়ে যেই ওপরে উঠেছি, অমনি স্যালিখালার সামনে পড়ে গেলাম। তাকে দেখেই টুপির নিচে লুকিয়ে ফেললাম মাখনটা।
ভাঁড়ারে গিয়েছিলি? খালা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
কেন?
এমনি, খালা।
উহুঁ, ঠিক করে বল, টম। নিশ্চয়ই কোন মতলব ঘুরছে তোর মাথায়। আমাকে হিড়হিড় করে বসার ঘরে নিয়ে এল খালা।
লোকে গিজগিজ করছে বৈঠকখানা। প্রায় জনা পনের হবে, কৃষক। তাদের সবার হাতে বন্দুক। দেখেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। ভীষণ উশখুশ করছে লোকগুলো, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একটা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। ভেতরে ভেতরে ঘেমে নেয়ে উঠলাম আমি।
চল, এখুনি যাই, ওদের একজন বলল। ওই ঘরে ঢুকে ডাকাতদের জন্যে অপেক্ষা করি গিয়ে। এখানে বসে গুলতামি মারার মানে হয় না কোন।
ঠিক বলেছ, সায় দিল আরেকজন। কখন সঙ্কেত আসবে সেই জন্যে বসে থাকতে হবে, ইয়ার্কি নাকি, আঁ!
ওদের কথাবার্তা শুনে আমার পিলে চমকে গেল, চাঁদি গরম হয়ে উঠল। টুপির নিচ থেকে মাখন গলে গলে পড়তে লাগল কপাল বেয়ে।
হায় ঈশ্বর? ছেলেটার হল কি? চোখ কপালে তুলে আঁতকে উঠল খালা। ওর ঘিলু বেরিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই চাঁদি গরম হয়ে গেছে।
সবাই দৌড়ে দেখতে এল। টুপিটা মাথা থেকে খুলে নিল খালা। অমনি তার চোখে পড়ল মাখনের বাকি অংশটুকু।
কী দস্যি ছেলে রে, বাবা! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি একেবারে, আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল খালা। বললেই হত মাখন খাবি, আমি এনে দিতাম। নে, এখন ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়। সকাল হবার আগে আর যেন না দেখি তোকে।
ছাড়া পেয়েই জিমের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম আমি। টম, আসছে ওরা, হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম। যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে। ওদের সবার হাতে বন্দুক আছে!
তোফা, বলল টম। উফ, হাক, যা একখানা মজা হবে না, কী বলব!
চল চল! এসে পড়ল বলে। জিম কোথায়?
তোমার পাশেই আছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে।
কই, চল? কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, কুঁড়ে ঘরের দরজার সামনে কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। তালাটা ধরে নাড়ল কেউ। বললাম না, অনেক আগে এসে পড়েছি আমরা। এই দেখ তালা আটকানই আছে, বলল একজন।
আরেকজনের গলা শোনা গেল, চল, ভেতরে ঢুকি। চাবি আছে আমার কাছে। তোমাদের কেউ বাইরে থেকে লাগিয়ে দেবে তালাটা। ভেতরে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকব আমরা।
ভেতরে ঢুকল ওরা, কিন্তু অন্ধকার বলে আমাদের দেখতে পেল না। নিঃশব্দে সুরঙ্গ-পথে চালাঘরে এলাম আমরা। দাঁড়িয়ে কান পাতলাম অন্ধকারের মধ্যে। বেশ কিছু পদশব্দ শোনা গেল কাছাকাছি কোথাও, তারপরেই সমস্ত কোলাহল থেমে গেল। একেবারে চুপচাপ। বেড়ালের মত বেরিয়ে এলাম আমরা, হামা দিয়ে এগিয়ে গেলাম বেড়ার দিকে। জিম আর আমি ঠিকমতই বেড়া ডিঙালাম, কিন্তু টমের প্যান্ট কাঁটাতারে ফেঁসে গেল। টানাটানি করে ও ছাড়িয়ে নিল বটে, কিন্তু, ওদের একজনের কানে আওয়াজ গেল।
কে ওখানে? একটা হেঁড়ে গলা ভেসে এল। জবাব দাও, নইলে গুলি করব। কোন সাড়া দিলাম না আমরা, যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটে চললাম।
গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম! পেছন থেকে একঝাঁক গুলি ছুটে এল আমাদের দিকে। শিস তুলে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম, নদীর দিকে যাচ্ছে, নদীর দিকে। দেখ, পালাতে পারে না যেন! কুকুর লেলিয়ে দাও।
লোকগুলো প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল, আমরা বাউলি কেটে ঝোপের ভেতর দিয়ে ছুটে চললাম। শর্টকাট রাস্তায় পৌঁছে গেলাম ডিঙির কাছে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ডিঙি বাইতে শুরু করলাম, ভীতচকিত হরিণের মত এসে পড়লাম মাঝনদীতে। তারপর ধীর গতিতে সেই দ্বীপের দিকে যাত্রা করলাম, যেখানে আমাদের ভেলাটা লুকোনো আছে। এখন আর কোন শব্দ পাচ্ছি না পাড় থেকে, বহুদূরে চলে এসেছি আমরা। চারদিকে অথৈ পানি। শান্ত। মাথার ওপর চাঁদ ডানা মেলেছে নদীতে। আরা এখন নিরাপদ।
জিম, আবার তুমি মুক্ত-স্বাধীন, ভেলায় উঠেই বললাম আমি।
সত্যি, তোমরা, তুমি আর টম, জব্বর ঋেল দেখিয়েছ, বলল জিম। একদম লা-জবাব। এর চেয়ে ভাল কোন প্ল্যান হতে পারে না।
আমরা সকলেই ভীষণ খুশি, টম টগবগিয়ে ফুটছিল। আমার পায়ে গুলি লেগেছে, গর্বের সুরে বলল ও। ওর কথায় জিম আর আমি মোটেও খুশি হতে পারলাম না।
দরদর করে রক্ত পড়ছিল পা থেকে। তাড়াতাড়ি ছইয়ের ভেতর শুইয়ে দিলাম টমকে। ডিউকের একটা পরিত্যক্ত শার্ট ছিড়ে পট্টি বেঁধে দিলাম সেটা দিয়ে।
এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট কোরো না, অসহিষ্ণু গলায় বলল টম। রওনা দাও।
জিম আর আমি দৃষ্টিবিনিময় করলাম। জিম, তুমিই বল, তোমার কী ইচ্ছে, বললাম আমি।
একটা ডাক্তার না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে নড়ছি না আমি, ঘোষণা করল জিম। আজ যদি মাস্টার টম ভাল থাকত, আর আমাদের কেউ গুলি খেত, তখন কী হত? সে-ও কি একথা বলতনা? না, যাব না আমি। দরকার হলে এখানে চল্লিশ বহুর অপেক্ষা করব।
ঠিকই ধারণা করেছিলাম, জিম দেখতে কালো হলেও ওর ভেতরটা সাদা। সেখানে কোন কালিমা নেই। এমন কিছুই বলবে সে, আমি জানতাম। ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি আমি, বললাম টমকে। আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল ও, কিন্তু কিছু করার মত শক্তি ওর ছিল না তখন।
বেশ যাও, অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল টম। তবে ডাক্তারের বাসায় গিয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে। তারপর কষে ওর চোখ বাঁধবে, শপথ করিয়ে নেবে যেন সে কবরের মত নিশ্চুপ থাকে। একটা মোহর দেবে তার হাতে। তারপর এই গলি সেই গলি বেয়ে নানা জায়গা ঘুরে এখানে আসবে। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে তার গা, যেন চক জাতীয় কিছু না থাকে। নইলে ভেলাতে চিহ্ন দিয়ে রাখবে। পরে সেই চিহ্ন দেখে ওরা ধরে ফেলবে আমাদের।
টমকে অভয় দিলাম আমি। বললাম, ওর কথামতই কাজ করব। স্থির হল, ডাক্তারকে আসতে দেখলেই জিম জঙ্গলে লুকোবে। ডাক্তার চলে গেলে বেরিয়ে আসবে আবার।
২১. ডাক্তার লোকটার বয়েস হয়েছে
ডাক্তার লোকটার বয়েস হয়েছে, বুড়োই বলা যায়। হাসিখুশি ভাব, দয়ালু চেহারা।
স্যার, আমি বললাম, আমার ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছে। ঘুমের ঘোরে তার বন্দুকে লাথি মেরেছিল সে। গতকাল বিকেলে শিকারে গিয়েছিলাম আমরা। রাত নামায় বাসায় আর ফিরিনি। সঙ্গে ভেলা ছিল, সেখানেই আশ্রয় নিই। ভাই ওখানেই আছে।
বুড়ো আমার কথা বিশ্বাস করল কি-না বুঝলাম না, তবে ব্যাগহাতে উঠে দাঁড়াল। কোথায় গেলে ভেলাটা পাওয়া যাবে আমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। যাবার আগে বলল, যাও, খোকা, বাসায় গিয়ে মা-বাবাকে খবর দাও।
উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে বাসায় আর গেলাম না আমি। একটা কাঠের গাদার ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ইচ্ছে, খানিক ঘুমিয়ে নেব। যখন ঘুম ভাঙল, সূর্য পুবের আকাশের অনেকটা পথ অতিক্রম করেছে। দৌড়ে ডাক্তারের বাসায় গেলাম, কিন্তু পেলাম না তাকে। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। দ্বীপে ফিরে যাব বলে নদীর দিকে ছুটলাম। মোড় ঘুরতেই সাইলাস খালুর ভূঁড়িতে গুতো
খেল আমার মাথা।
টম, ধমকে উঠল খালু, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
সিডের সাথে। ওই নিগ্রোটাকে ধরতে বেরিয়েছিলাম।
ওদিকে তোদের খালা চিন্তায় মরছে।
পাহারাদারদের পেছনেই ছিলাম আমরা। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর ওদের হারিয়ে ফেলি। তখন ভাবলাম নদীর উজানে দেখে আসি গিয়ে। তো ঘুরে-ঘুরে পায়ে ব্যথা ধরে গেল অথচ কারো পাত্তা পেলাম না। শেষে হার মেনে নদীর তীরেই শুয়ে পড়ি। মাত্র ঘুম থেকে উঠে আমি এদিকে আসছি, আর সিড পোস্ট অফিসের দিকে গেছে, বাড়ির কোন খবর এল কি-না জানতে।
খালুর সাথে পোস্ট অফিসে গেলাম। জানা কথা, সিডকে পাব না সেখানে। খালুর হাতে একটা চিঠি দিল পোস্ট মাস্টার। চিঠিটা পকেটে রেখে আমাকে বাসায় যেতে বলল খালু।
আমাকে দেখে স্যালিখালা ভীষণ খুশি হল। তবে বাসায় প্রচুর লোক থাকায় তার সাথে বিশেষ কথা হল না আমার। ওদের খাবারের জোগাড়েই ব্যস্ত রইল সে।
পরে তাকে একা পেয়ে সাইলাসখালুকে যা বলেছিলাম তা-ই বললাম আবার। নাহ, তোরা ছেলেমানুষই রয়ে গেলি, স্নেহের সুরে বলল খালা।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। এখনও বাড়ি ফেরেনি টম। ওর খবর জানার জন্যে ছটফট করছি আমি। খালার চোখেও উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠেছে। শেষে এক সময় অধৈর্য হয়ে বলল, সিড গেল কোথায়?
আমিও দেখলাম এই সুযোগ। আমি শহরে গিয়ে দেখে আসি? বললাম।
না, তোকে আর যেতে হবে না। চুপ করে বসে থাক। রাতের খাওয়ার আয় এলে তোর খালুই যাবে।
খাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসল কিন্তু সিড লাপাত্তা। ওর খোঁজে খালু শহরে গেল। একটু বাদে শুকনো মুখে ফিরে এল। তুমি দেখে নিও, স্যালি, কাল সকালে ও ঠিক ফিরে আসবে, খালাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল খালু। চল, শোবে চল।
আমার এখন ঘুমানোর মত মনের অবস্থা না, খালা বলল। ওর জন্যে জেগে বসে থাকব।
খালাকে শুভরাত্রি জানালাম আমি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল খালা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হল আমার। আমাদের জন্যেই আজ তার এত বিপত্তি!
টম, বাবা আমার খালা বলল, আজ রাতে আর বাইরে যাসনে, বাপ! আমার মাথা খা, বল যাবি না।
বাইরে যাবার ইচ্ছে থাকলেও খালার কথায় বাতিল করে দিলাম সেটা। সারা রাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম। কে জানে টম আর জিম কেমন আছে এখন? পা টিপে টিপে দুবার বারান্দায় এসে দেখলাম বসার ঘরের বাতি জ্বলছে। জানালার কাছে ঠায় বসে আছে খালা। পুবের আকাশ কচি লেবু পাতার রং হতেই বিছানা ছাড়লাম আমি। নিচে এসে দেখলাম খালা তখনও ওখানে বসে। মোমবাতি জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছে। হাতের তালুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে খালা।
আহা, বেচারি স্যালিখালা!
২২. সকালে নাস্তার আগে আরেক দফা
সকালে নাস্তার আগে আরেক দফা শহরে গেল সাইলাসখালু কিন্তু এবারেও খালি হাতে ফিরতে হল তাকে। খালা-খালু দুজনাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
এমন সময় খালুর একটা কথা মনে পড়ল। স্যালি, কাল পোস্ট অফিসের ওরা একটি চিঠি দিয়েছিল, এটা তোমাকে দিয়েছি।
না।
যাই, নিয়ে আসি গিয়ে।
চিঠিটা স্যালিখালার হাতে দিল সাইলাসখালু। খাম খুলতে যাবে খালা হঠাৎ তার চোখ পড়ল দরজার ওপর। চেঁচিয়ে উঠল খালা। কয়েক জন লোক সিড কে বয়ে আনছে খাটিয়ায় করে। ওদের পেছনেই ডাক্তার, জিম, এবং আরও অনেকে।
চিঠি ফেলে রেখে সিডের কাছে ছুটে গেল খালা। হায়! হায়! মরে গেছে ও। কেঁদে ফেলল খালা। ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল টম, বিড়বিড় করে বলল কিছু।
বেঁচে আছে! ও ঈশ্বর! ধন্যবাদ! ঝরঝর করে খালার গাল বেয়ে জল নামল, এবার খুশিতে। এটা কর, ওটা কর, বলে বাড়ি মাথায় করে তুলল। টমের বিছানা ঠিক করতে ছুটে বাসার ভেতর ঢুকে গেল খালা, পেছন পেছন খালুও গেল।
আমি ওখানেই রয়ে গেলাম, জিমের কপালে কী আছে জানতে হবে। সবাই গাল দিচ্ছে ওকে, কিন্তু জিম নিশ্চুপ। মুখে রা নেই। আমাকে চেনে এমন কিছুই প্রকাশ পেল না তার ভাবভঙ্গিতে। ওকে নিয়ে আবার কুঁড়ে ঘরে আটকে রাখল ওরা।
বুড়ো ডাক্তার কুঁড়ে পর্যন্ত গেল। ওকে মেরো না, লোকগুলোকে বলল সে। ও লোক খারাপ না। ইচ্ছে করলেই পালাতে পারত। কিন্তু উল্টো আমাকে সাহায্য করেছে। ওর সাহায্য না পেলে এই ছেলেটাকে বাঁচানো কঠিন হত। জীবনে এত ভাল নার্স আমি দেখিনি। সত্যি, ওর জুড়ি মেলা ভার।
জিম সম্পর্কে ডাক্তারের কথা শুনে খুশি হলাম আমি। সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, জিমের একটা পুরস্কার পাওয়া উচিত।
পরদির সকালে আমাকে জানাল ওরা, সিড এখন ভালর দিকে, সারা রাত জেগে ওর শুশ্রষা করেছে স্যালিখালা। ক্লান্ত দেহে খালা এখন একটু বিশ্রাম নিতে গেছে। চোরের মত সিডের ঘরে ঢুকলাম আমি। শান্তিতে ঘুমুচ্ছে ও। বিছানার পাশে বসে অপেক্ষায় রইলাম কখন ও উঠবে, আর কখন দুজনে শলা করে একটা গল্প ফাদব। গল্পটা আবার এমন হতে হবে যেটা শুনে বিশাস করে লোকে। স্যালিখালী ফিরে এল। ওখানেই বসে রইলাম আমরা। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি সিডের দিকে। কিছুক্ষণ পর নড়েচড় উঠল ও। চোখ মেলল।
হ্যালো! আমাকে বলল টম। আমি এখন কোথায়? কী হয়েছিল? ভেলা কই?
আছে।
জিম?
ভাল।
ভাল হলেই ভাল। স্যালিখালাকে বলেছ সব? আমি মুখ খোলার আগেই খালা জিজ্ঞেস করল, কী বলবে, সিড?
কেন, টম আর আমি কিভাবে জিমকে মুক্ত করেছি তা-ই! সবকিছু আমায় খুলে বল, সিড? আমি বাধা দেয়ার আগেই গরগর করে খালাকে সব বলে দিল টম।
স্তম্ভিত হয়ে ওর কথা শুনল খালা। তারপর ঢোক গিলে বলল, বাপের জন্মেও এমন শুনিনি আমি। পাজি, নচ্ছার, তোরাই তাহলে সব নষ্টের গোড়া। চাবকে তোদের পিঠের ছাল তুলে ফেলব। খবরদার, ভুলেও যেন আর জিমের কাছে না দেখি তোদের। দেখলে…
আমার দিকে ঘুরল টম। ও পালাতে পারেনি? জিজ্ঞেস করল।
না, পারেনি, বলল স্যালি খালা।
মুহূর্তে বিছানায় উঠে বসল টম। চোখজোড়া জবা ফুলের মত লাল হয়ে গেছে। নাকের পাটা দুটো মাছের ফুলকোর মত খুলছে-বন্ধ হচ্ছে। ছেড়ে দাও ওকে! এখুনি! এই মুহূর্তে! ক্ষিপ্ত সুরে বলল টম। ওকে আটকে রাখার অধিকার কারো নেই।
শান্ত হ, বাবা, শান্ত হ, টমকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল স্যালিখালা।
কিন্তু কোন কথাই কানে তুলল না টম। শোন, স্যালিখালা, বলল ও, জিমকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি। এই যে টম রয়েছে এখানে, এ-ও চেনে। বুড়ি মিস ওয়াটসন দুমাস আগে মারা গেছে। মরার আগে ওকে মুক্তি দিয়ে গেছে।
যে-লোক আগেই মুক্তি পেয়েছে তাকে আবার ছাড়াতে গিয়েছিলি কোন দুঃখে?
সে তুমি বুঝবে না, খালা। আমি মজা করতে… আচমকা টমের গলায় মাছের কাটা ফুটল যেন, পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠল, আই বাপ! পলিখালা!
সত্যি-ই, চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পলিখালা। মুখে স্বর্গীয় হাসি তৃপ্তির ছাপ। তাকে জীবনে আর না দেখলেই ভাল হত, ভাবলাম মনে মনে।
স্যালিখালা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বোনকে। টানতে টানতে নিয়ে এল খাটের কাছে। আবহাওয়া গরম হতে যাচ্ছে, আন্দাজ করলাম আমি। খাটের তলাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠেকল আমার কাছে। সুট করে ঢুকে পড়লাম সেখানে। একটু মাথা বের করে দেখলাম, চশমার ফাক দিয়ে টমের দিকে তাকিয়ে আছে, পলিখালা।
হ্যাঁ, আমি, বলল খালা। আমার দিকে তুই তাকাস না, টম।
পলি, আঁতকে উঠল স্যালিখালা, কি বলছ আলতাবল। ও তো সিড। আর এই হচ্ছে টম…আরে টম আবার কই গেল। এইত একটু আগেও এখানে ছিল।
ওর নাম হাকফিন, স্যালি। অ্যাই, হাকফিন, খাটের নিচ থেকে বেরো। সব কথা শোনা চাই আমার।
আমাদের কথা শুনে স্যালিখালা হকচকিয়ে গেল। সাইলাস খালুর অবশ্যি ভাবান্তর হল না কোন। চুপ করে রইল সে। পলিখালা টমকে সমর্থন করল। বলল, হ্যাঁ, মিস ওয়াটসন মরার আগে মুক্তি দিয়ে গেছে জিমকে। এখানে তার আসার পেছনে কারণও ব্যাখ্যা করল খালা।
যখন দেখলাম স্যালি লিখেছে টম আর সিড নিরাপদে পৌঁছেছে। তখনই খটকা লাগল আমার। কারণ সিড বাসাতেই ছিল আমার সাথে। ব্যাপার কী জানার জন্যে তোর কাছে আমি দুটো চিঠি লিখেছি, স্যালি। কিন্তু কোন জবাব দিসনি তুই।
কই, কোন চিঠি পাইনি আমি।
টমের দিকে ঘুরল পলিখালা। বলল, টম, চিঠিগুলো দে।
কোন চিঠি?
সে তুই ভালই জানিস, কোন চিঠির কথা বলছি আমি।
আমার বাক্সে আছে। পড়িনি।
চাবুক পেটা করা উচিত তোকে। দাঁড়া, ভাল হয়ে নে আগে, তারপর দেখাচ্ছি মজা। স্যালি, আমার শেষ চিঠিটা পেয়েছিস? আমার আসার কথা ছিল এতে।
হ্যাঁ, পেয়েছি, বলল স্যালি খালা। কাল এসেছে। তবে এখনও পড়ার সুযোগ হয়নি।
২৩. টমকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম
টমকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি, এত সব ঝামেলা সে কেন করতে গেল।
নদীর মোহনা পর্যন্ত গিয়েই জিমকে ওর মুক্তি পাওয়ার কথা জানাতাম, টম বলল। তারপর শান-শওকতের সাথে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম ওকে। ব্যান্ড বাজাতাম, মিছিল করতাম। তখন ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যেত। আর সেই সঙ্গে আমরাও।
আমরা সময় নষ্ট না করে জিমের শেকল খুলে দিলাম। বাসার সবাই যখন জানল, টমকে বাঁচানোর জন্যে জান-প্রাণ দিয়ে খেটেছে ও, সকলেই ওকে মাথায় তুলে নাচল। আটক থাকার সময় ভাল ব্যবহারের জন্যে টম ওকে চল্লিশটা ডলার দিল।
টাকা পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়ল জিম, মারা যায় আরকি! কেমন, হাক, বলল সে, বলেছিলাম না আমার বুকে লোম আছে। এর অর্থ অনেক টাকা হবে আমার। কেমন হল তো। হুঁ-হুঁ, বাবা! চিহ্ন-টিহ্ন মান একটু।
এরপর টম আর আমি নতুন অভিযানের প্ল্যান আঁটতে বসলাম।
চল, কেটে পড়ি এখান থেকে, আমাকে বলল ও। হপ্তা দুয়েকের জন্যে রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ থেকে বেরিয়ে আসি গিয়ে।
যেতে পারলে ভালো হত, আমি বললাম, কিন্তু ফুটো পয়সাও নেই হাতে। বাড়িতেও পাব বলে মনে হয় না, কারণ বাবা হয়ত অ্যাদ্দিনে ফুকে দিয়েছে সব।
না, দেয়নি, বলল টম। সবই আছে—ছহাজার ডলার আর তার সুদ। ওই ঘটনার পর তোমার বাবা আর ফেরেননি। অন্তত আমি আসার আগে তো নয়ই।
তিনি আর কোন দিনই ফিরবেন না, হাক, ভরাট অথচ দরদী গলায় বলল জিম।
কেন?
নদীতে ভেসে আসা সেই কুঁড়েটার কথা তোমার মনে আছে, হাক? একটা লোক মরে পড়ে ছিল সেখানে, লোকটার মুখ দেখতে তোমায় মানা করেছিলাম আমি, মনে আছে? সেই লোক ছিল তোমার বাবা।
টম এখন বেশ ভালো হয়ে গেছে। তবে আগের মতই রাজ্যের যত উদ্ভট খেয়াল কিলবিল করে তার মাথায়। সেগুলো কাজে লাগানোর জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় আছে ও। যাক, আমার কথাও ফুরিয়ে এসেছে, লেখার মত বিশেষ আর কিছুই নেই। লেখা জিনিসটা এত কষ্টের, আগে জানলে কখনই এ-কাজে হাত দিতাম না। তাই, এখানেই শেষ করছি। তবে তার আগে একটা কথা বলে নিই, আবার এখান থেকে পালাব আমি। স্যালিখালা আমাকে পুষ্যি নিয়েছে, উদ্দেশ্য আমাকে ভদ্দরলোক বানাবে। এ আমার একেবারে সহ্যের বাইরে। আগেও এমন কাণ্ড ঘটেছে। সুতরাং ও-পথে আর নয়!
***
Leave a Reply