দিদিমাসির জিন – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৭
দিদিভাই (শ্রীমতী ইন্দিরা ঘোষ)-কে
শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায়
১
তীর্ণা, যশজিৎ, অনীক, গোপাল আর রাংতা— মোট এই পাঁচজনের একখানা দল। যশজিৎ আর গোপাল মাঝে-মধ্যেই ট্রেকিং-এ যায়, রাংতা যায় হংকং, সিঙ্গাপুর, তীর্ণা আর অনীক ভদ্র মধ্যবিত্ত বাঙালির সাধ্য ও আয়ত্তের বাইরের রাজ্যে এখনও গিয়ে উঠতে পারেনি। ওরা যাবে—সান্দাকফু বা মণিমহেশ নয়— রোমা ভেনিজিয়া পাহরী এসবও নয়। নেহাতই কেন্দুলিতে। ‘মন দিতে মন খুলিতে’ ও নয়। নিতান্তই কৌতুহলের টানে।
তৎসত্ত্বেও তীর্ণা-অনীকের মা কাজল খুঁতখুঁত করছিলই। করছিলই।
—কে যশজিৎ, আমি চিনি না। জানি না। কোনদিন নাম শুনিনি, ধাম শুনিনি।
—তুমি চেনো না বলেই একটা আছে মানুষ তো নেই হয়ে যেতে পারে না মা!
অনীক হাসি-হাসি মুখে মায়ের ভয় ভেঙে দিতে চেয়েছিল।
আসল কথা, গোপালকে কাজল মোটে পছন্দ করে না। তার ধারণা হয়েছে, যাচ্ছে শুধু অনীক তীর্ণা আর গোপাল, বাকি নামদুটো স্রেফ ব্ল্যাঙ্ক শট। বানানো। এবং তীর্ণা ও গোপালের ঘনিষ্ঠতায় সহযোগিতা করতেই অনীকের দাদাসুলভ এই বদান্য আয়োজন।
—আছে, অথচ আমি কোনদিন শুনলুম না? সে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে।
—গোপালের বন্ধুর কথা তুমি কী করে শুনবে মা? তুমি কি কখনও গোপালের সঙ্গে দু মিনিটও কথা বলেছ?— তীর্ণা বলল।
—দু মিনিট কেন, পাঁচ মিনিটও বলেছি দশ মিনিটও বলে থাকতে পারি, তবে আমি বলিনি তোমাদের গোপাল বলেছে। আর কাউকে কথা বলতে দেয় নাকি সে? ঝড় যেন একটা!
—ঝঞ্ঝাবাত্যা— অনীক শুদ্ধ করে দিল।
—রাংতা আবার কারও নাম হয় নাকি? কাজলের দ্বিতীয় খুঁতখুঁতুনি শুরু হয়।
— তা সত্যি, রাংতা সিগারেটের প্যাকেটে থাকে, রাংতা প্রতিমার গয়নায় থাকে। আর কোথায় কোথায় থাকে মা?
মা এবার সত্যি সত্যি রেগে যায়।
তখন দু ভাইবোনে গান ধরে—
‘কাজল কাজল কুমকুম
শিউলি ঝরে ঝুমঝুম।
সোনার আলোয় ভাসিয়ে তরী চলছে মেঘের মরশুম।’
মা রাগ করে সবুজ আঁচল দুলিয়ে চলে যাবার উপক্রম করে। তারপর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে— কী জানি, রাংতা-টাংতা নাম শুনলে আমার খুব সন্দেহ হয়।
—কেন তুমি আমার বন্ধু চইয়ের নাম শোননি? চই যদি হতে পারে, রাংতা কেন নয়?
—কেমন একটা মিথ্যে-মিথ্যে গন্ধ ছাড়ছে নামটা থেকে।
—মা!!! তুমি আমাদের মিথ্যেবাদী, ভাবছ? সন্দেহ করছো? তীর্ণা এবার ভীষণ আহত গলায় বলে।
—দেখো মা, তোমার মতো পাকা এবং জেদী মেয়ে খুব কমই আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে, ছেলের নাম ঠিক হয়ে গেল। ক্লাস এইটে পড়ে, মেয়ের নাম ঠিক হয়ে গেল … সবাইকার মা তো আর এ রকম নয়!— অনীক মাকে মোক্ষম জায়গায় মোচড় দিয়েছে।
কাজল আর দাঁড়ায় না। তার এইসব ছেলেবেলাকার গল্প এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে করা মানে তাদের হাতে নিজের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে দেওয়া। সেই বোকামিটাই সে করেছে। সবাই জানে, বাচ্চারা একটা স্টেজে বাবা-মাদের ছোটবেলার গল্প শুনতে চায় এবং কাজল তখন কথাগুলো ওদের বলে ফেলেছিল।
—জানিস আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখনই ঠিক করে ফেলেছিলুম—মেয়ে হলে, হবেই একটা, তার নাম দেবো তীর্ণা। আর ছেলে হলে অনীক।
—আর বাবার নাম? বাবার নাম ঠিক করোনি?
এইটে কাজল বলতে গিয়েও বলেনি। কী জানি বাবা কার মনে কী রি-অ্যাকশন হয়! তীর্ণা-অনীকের নাম নিয়েই যা তুলকালাম! নার্সিংহোমে জ্ঞান ফিরতেই শ্বশুরমশাইয়ের মুখ— যাক মা ঈশ্বরের প্রসাদে সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। শিবপ্রসাদের ওজন সাড়ে ছ পাউন্ড। হী ইজ ডুয়িং ওয়েল।
—শিবপ্রসাদ কে?— দুর্বল কণ্ঠে নতুন জননীর জিজ্ঞাসা।
—কে আবার? আমার প্রথম পৌত্র?
কাজল লাজ-লজ্জা ভুলে হেঁকে উঠেছিল—ও মা, ও বাবা ওর নাম যে অনীক। শিবপ্রসাদের মতো সেকেলে বিচ্ছিরি নাম আমি মোটেই দেবো না।
শ্বশুরমশাই আর নার্সিংহোম-মুখো হননি, তবে মেয়ে হতে গম্ভীরভাবে বলেছিলেন— কী বউমা, ইটি কি অনকিনী? সে ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সশস্ত্র হতে হবে।
—না বাবা, ও তীর্ণা।
—তীর্ণা? তা তোমার তীর্ণা বড়ই জীর্ণা এবং শীর্ণা হয়েছেন। মনে হচ্ছে আমার ঠাকুমাই আবার ধরায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি যে রকম ভুগতেন তাতে করে আমার পৌত্রী উপসর্গবিহীন হলেই ভালো।
কাজল ছেলেমেয়েকে যেটা বলেনি সেটা হচ্ছে— বরের নামটাও সে ঠিক করে ফেলেছিল, এবং ওই ক্লাস এইটে পড়তেই। নামটা ধীমান। এবং এই বরের নাম নিয়ে যা ভোগা তাকে ভুগতে হয়েছিল, সে এক মহাভারত বিশেষ। বাড়িতে মেয়ের বর খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু বড়দের তো আর বলা যায় না ধীমান নামের বর খোঁজো। খোঁজা হচ্ছে, হোক। ইতিমধ্যে কাজলও খুঁজতে থাক। এক বন্ধুর বাড়িতে তার দিদি না দাদার বিয়েতে গিয়ে লুচি ছিঁড়তে ছিঁড়তে কানে এলো ‘ফিশ ফ্রাইয়ের ঝুড়িটা এদিকে ধীমানদা!’ আর খাওয়ায় মন নেই। কোন পরিবেশনকারীটি ধীমানদা বোঝবার জন্যে সে তখন ছোট বড় কটাক্ষ পাঠাচ্ছে। ইতি-উতি। ফিশ ফ্রাইয়ের ঝুড়ি নিয়ে অবশেষে ধীমানদা এলো। কাজল জীবনে অত মোটা লোক দেখেনি। চুল কাঁচা-গোঁফ পাকা। দুটি গাল দুটি খাগড়াই কাঁসার জামবাটির মতো। ধীমানের পেছন পেছন এলো ধীমানের সদ্য-তরুণ তনয়। ‘উঃ বাবা! তুমি যদি একবার বেকায়দায় হেলো না, এখানে একটা ঘটোৎকচ পাত হয়ে যাবে, ট্রেটা আমাকে দাও।’
—‘আর তুই?’ ধীমান রেগে বললেন, ‘তুই যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। অর্ধেক ফিশ ফ্রাই পরিবেশন করবি, বাকি অর্ধেক তোর নিজের পেটে ইতি গজ হয়ে যাবে! মশায়রা এই ছোকরা মহা সেয়ানা, নজর রাখবেন।’ বলে ধীমানবাবু কোনক্রমে তাঁর বিপুল বপু দুই পঙ্ক্তির মধ্যিখান থেকে সরালেন।
তবু অঘটনও তো ঘটে! একদিন কান খাড়া করে কাজল শুনল, বাবা মাকে বলছেন— পাত্র ভালো। সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বি কম পাশ করে ছোকরা ল পড়ছে। এখনও পড়ছে। বাবা অবশ্য উকিল। রেডি পসার, তবু পড়ুয়া ছেলেই তো! নামে যেমন ধীমান, ঘটে বুদ্ধিও যদি তেমনি থাকে তাহলে তো …
মা বললেন— না বাপু, ও সব পড়ুয়া-টড়ুয়া ছাড়ো। ছোট ঠার্কুদার উদাহরণ চোখের সামনে থাকতেও যে কী করে তোমরা …
বাবা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন— আরে বাবা তখনকার দিনে সব্বাই পড়ুয়া পাত্রের সঙ্গেই মেয়ে বিয়ে দিত।
—সে সব তো আর বিয়ে ছিল না, ছিল পুতুল খেলা। তার ফল হয়েছে বিষময়।
—কী যে বলো! সব ফলই অমনি বিষময় হয়ে গেল!
যাই হোক, বাবার আগ্রহে ধীমান পিতা এবং বন্ধু সহযোগে এলো।
পিতা বললেন— ‘দেখুন মশাই আমরা আইন বেচে খাই। উই আর অ্যাকাসটমড টু কল আ স্পেড আ স্পেড। আপনার মেয়েটি কালো। মানে, ইচ্ছে করলে আপনি শ্যামবর্ণ বলতে পারেন, আপনি ডিফেন্সে আছেন, আমি কিন্তু সরকার পক্ষের কৌঁসুলি, ছাড়ব না এক কথায়। রং পেনসিল, ভুষো কালি, চেলপার্ক সব মজুত রেখে মিলিয়ে মিশিয়ে প্রমাণ করব পাত্রী কালো। এখন সে ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু জরিমানা দিতে হয়। বিশ হাজার ধার্য করলুম ক্যাশে, সোনা দেবেন ত্রিশ ভরি। বাসন-কোশন, আসবাবপত্র আপনার রুচি-অনুযায়ী। যাই হোক, আসুন আমরা একটু আড়ালে যাই আমার পুত্রেরও কিছু জেরা ন্যাচারালি আছে।’
ধীমান এবং তার বন্ধুরা এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে রসগোল্লা, পানতুয়া ইত্যাদি উদরস্থ করছিল এবং খাদ্যগুলির গুণাগুণ বিচার করছিল। যেমন ‘রসগোল্লাটা নবীনের পাক, কিন্তু পানতুয়াটা কোথাকার বল তো! চিত্তরঞ্জনের?’ ‘রাবড়ি ননীর না হয়েই যায় না’, ‘খাস্তার নিমকি নির্ঘাৎ গাঙ্গুরামের’।
দুই পিতা অদৃশ্য হতে শ্রীমান ধীমান বলল— আচ্ছা, আপনাদের নির্ঘাৎ গাড়ি আছে, না?
—হ্যাঁ।
—কী করে ধরলুম, জিজ্ঞেস করলেন না তো?
কাজল চুপ করে রইল। সারা কলকাতা পদব্রজেই কি তারা খাবারের স্যাম্পল পরীক্ষা করে থাকে, এ প্রশ্ন তার মনে উঠেছিল। ধীমানের শার্লক হোমস গিরির চেয়েও তীব্র এ কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। কিন্তু সে চুপ।
আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনারের পেরি মেসন কেসেস পড়েছেন?
—না।
—স্ট্যানলি গার্ডনারের কোর্ট সিনগুলো না পড়লে ওকালতিতে কি করতে পারবেন না।
কাজল এতক্ষণে বলল— আমাকে তো কেস প্লীড করতে হবে না, হবে আপনাকে।
—হিয়ার হিয়ার—এক বন্ধু সোৎসাহে বলে উঠল।
—শুনেছিলুম অনার্স গ্র্যাজুয়েট, এ দিকে হ্যাঁ আর না ছাড়া কিছুই শুনছি না। যাক বোবা নয়।
কাজল ততক্ষণে বুঝেছে এই ফাজিল ফিচেল ছোকরার দল তাকে পছন্দ করেনি, স্রেফ ভাঁড়ামো করছে। সে উঠতে উঠতে বললে— বাকি মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলুন, আখেরে কাজ দেবে। সারা নর্থ ক্যালকাটা ঢুঁড়ে আনা। —এই বলে সে সেবার রণে ভঙ্গ দেয়। এবং ধীমান নামের ওপর তার এতই বিতৃষ্ণা হয়ে যায় যে সে গঙ্গাপ্রসাদ নামের পাত্রকে বিয়ে করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি।
ছেলেমেয়ে চালাক কম নয়। সুবিধে পেলেই জিজ্ঞেস করে— আচ্ছা মা, যে তরুণ-তরুণীর নাম অনীক এবং তীর্ণা এবং যাদের মায়ের নাম কাজলরেখা, তাদের পিতার নাম কী করে গঙ্গাপ্রসাদ হয়? দিস সীমস এ মিস্ত্রি।
বেশি চাপাচাপি করতে কাজল গম্ভীরভাবে বলেছিল— বাবাদের, মানে বরেদের তো আর স্ত্রীরা অন্নপ্রাশন, নামকরণ ইত্যাদি করতে পারে না!
—তা পারে না, কিন্তু চুজ করতে পারে, পারে না? কী করে গঙ্গাপ্রসাদে রাজি হলে মা?
এই সময়ে গঙ্গাপ্রসাদ স্বয়ং ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তিনজনকে জমায়েত দেখে ইউরেকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন : এই তোমরা। তোমাদের তিনজনের মধ্যেই কেউ।
—কী বাবা? আমাদের তিনজনের মধ্যে …
—মাল্যবান।
—মাল্যবান? কী রকম রামায়ণ রামায়ণ গন্ধ ছাড়ছে না?
—পড়ো তো খালি হ্যারল্ড রবিনস আর হেডলি চেজ। রামায়ণের কী জানো? জীবনানন্দের উপন্যাস ‘মাল্যবান’, পাওয়া যায় না। আমি জেরক্স করিয়ে নিয়েছিলুম। কোথাও পাচ্ছি না।
—পাবে বাবা পাবে, তোমার অতি সন্নিকটেই পাবে।
বাবা ঝড়ের মতো চলে গেলেন।
অনীক বলল : আহা, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা …’
আচ্ছা মা, এই লাইনটা বাবা নিশ্চয় তোমায় ফুলশয্যার রাতে বলেছিল। বলেনি? হ্যাঁ ঠিক ধরেছি।
কাজলের মুখ লাল হয়ে উঠছে। সত্যিই বলেছিল তার বর। এই ছেলেগুলো কী রকম এঁচড়ে পাকা দেখো, যে ফুলশয্যার ঘরে আড়ি পাতবার তাদের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না, সেখানকার সংলাপ স্রেফ বুদ্ধি আর অনুমান দিয়ে … ‘হ্যাঁ বলেছিলো, তোকে বলেছে কানে ধরে।’ কাজল যথেষ্ট তীব্র প্রতিবাদ করে। কিন্তু কাজ দেয় না সেটা। ওদিকে তীর্ণা ততক্ষণে ধরে ফেলে—
‘আমি যদি হতাম বনহংস
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে …’
এটা অন্তত মা, নিশ্চয়ই। কাজলের লালিমা আরও বেড়ে যায়। কারণ এটাও … এবং ওই ফুলশয্যার রাতেই। গঙ্গাপ্রসাদের জীবনানন্দ-প্যাশন তার ছেলেমেয়ে স্ত্রী সবাই জানে।
২
শাল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঝরঝরে বাসটা বেয়াড়াভাবে ছুটছিল। গাছের ডালগুলো আছড়াচ্ছে বাসের টিনের ছাদে, নিচে পুরোপুরি শালপাতার মেঝে তাতে শব্দ হচ্ছে খড়মড় করে। ড্রাইভার-ব্যাটা বোধহয় সামান্য টেনেছে। লাল ধুলোয় তার আপাদমস্তক যেন চাদর ঢাকা। মনে ফুর্তি। সে একটু জোরে চালাতে চাইছে, কিন্তু চারপাশের প্রকৃতি বারবার তার পথ আটকে ধরছে। তাই সে এমন অসাধারণ পরিবেশেও চোখা চোখা গালাগালি দিয়ে উঠছে।
—শালা হারামজাদা তোর মুখে আমি মুতে দিই।
ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম কনডাক্টর খুব রসিক লোক। ছোকরা মতন। যশজিৎদের থেকে ছোটই হবে। সে বলল— কার মুখে গো বিপিনদা— ওই শালা বাবলাঝোপের মুখে। —তো ওর ভালোই হবে। যা তুমি ফেলো, ও তাই গেলে। আরও ফুলে ফেঁপে ঝাঁপানো ঝাঁড়ালো হয়ে উঠবে এখন। নেক্সট টাইম তোমার ইস্পিড আরও কমে যাবে বলে—অ্যাসিস্ট্যান্ট বাইরের দিকে মুখ করে জোরে জোরে দুবার বিড়ি ফুঁকে নিল।
তীর্ণা আর যশজিৎ বসেছে একটা সিটে। এত সরু সিটগুলো যে দুজনে ভালোভাবে বসা যায় না। বিশেষ করে এক একটা ঝাঁকুনিতে যশজিতের হাঁটু সামনের সিটের পেছনে বিশ্রীভাবে ঠুকে যাচ্ছে।
তীর্ণা বলল— একদম সামনের সিটটায় একটা ফাঁকা হলেই তুমি গিয়ে বসবে।
যশজিৎ বলল—একটা ফাঁকা হলেই! তোমাকে বলেছে! ফাঁকা হবে!
গোপাল পেছনের সিটে সাত-আটজনের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে ছিল, চেঁচিয়ে বলল— হ্যাঁ রে অনীক, আমাদের দলে একজন বাঁধাকপির চাষ করে, মাসিমাকে বলেছিলি?
অনীক বলল— ধুর, তাই কখনও বলে! তোর আঁতেল দাড়ি আর পাকা জুলফিতেই মা আধমরা হয়ে আছে।
যশজিৎ মাথার গোল্ডেন ব্রাউন রঙের পাগড়িটাতে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল— বাঁধগোবিকী নীচে ফুলগোবি ভি হ্যায়।
সারা বাসের লোক হেসে উঠল। একটি ছেলে বলল— আমার নাম অশোক সাঁতরা, আপনারা কি কোনও কাগজ-টাগজের রিপোর্টার? না …
—আমরা ধান্দাবাজ— গোপাল গাল ফুলিয়ে বলল।
অশোক সাঁতরা আবার হেঁকে বলল—বাসে কেউ রিপোর্টার আছেন?
—কেন দাদা, মারবেন নাকি?
—এই ধরেছি, কোন কাগজ থেকে?
—বেনাচিতি।
—অর্থাৎ?
—বেনাচিতি বাজারে আমাদের ফার্নিচারের দোকান আছে, রিপোর্টার নই।
অশোক সাঁতরা বলল— যাই বলুন দাদা, রিপোর্টাররা কিন্তু মেলাটার চার্ম হাফ নষ্ট করে দিয়েছে।
—কোন হাফ? আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন।
—বলতেসি কোন হাফ, ব্যাটার হাফ নয় তো?— আবার এক দফা হাসি উঠল।
রাংতা বলল— আমি কিন্তু ডিমসেদ্ধগুলো বার করছি অনীক। আর থাকতে পারি না। ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে।
—দেড় সের জিলিপি খেলি সকালে, সব হাওয়া?
—দেড় সের? টোটাল এক সের নেওয়া হয়েছিল, তার হাফই যশজিৎ একা সাবড়েছে।
—অনীক আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল— ব্যাটার হাফ?
ছোট্ট খানিকটা হেসে উঠতেই গোপাল, পেছন থেকে হেঁকে উঠল—ভদ্রমহোদয়গণ, পাবলিকে প্রেম প্রহিবিটেড হওয়া উচিত কি উচিত না বলুন। একখানা কনসেনসাস চাইছি।
রাংতা বলল— বা রে, আমি তো শুধু একটু হেসেছি!
গোপাল বলল— হাসি? হাসি খুব সন্দেহজনক সিমটম। হাসি হল প্রিলিউড। হাসি থেকেই কান্না, কান্না থেকে আর্না, আর্না মানে আরো। দ্যাট মীনস দিল তোড়ো। অর্থাৎ কিনা কুছকুছ হোতা হ্যায়।
গোপালের পাশের ছেলেটি, গ্রাম্য-গ্রাম্য লাজুক লাজুক দেখতে। সে বলল—দাদা, আপনার বোধহয় অসুবিধে হচ্ছে। আমি কি উঠে দাঁড়াবো? মানে কিছুক্ষণের জন্যে?
—আমার তো দারুণ অসুবিধে হচ্ছে, একেবারে গলে মার্মালেড হয়ে গেছি। কিন্তু তার জন্যে আপনি উঠে দাঁড়াতে যাবেন কেন? এ হেন স্যাক্রিফাইস!
—না, মানে আপনি র্যাপ লাগিয়েছেন তো! অ্যাকশনও বেশ দিচ্ছেন। ভালো করে হাত খুলে দিতে পারছেন না। তবু তাতেই যা দু-একটা …
—এ হে হে দাদা— আপনার লেগে গেছে! যাঃ। সরি। ভেরি সরি। এক্সট্রিমলি সরি। কী নাম আপনার?
—গোপাল।
—গোপাল? এ যে সেমসাইড হয়ে গেল ভাই।
—তা বলতে পারেন। ছেলেটি তেমনি লাজুক লাজুক হেসেই বলল— তবে আমার পুরো নাম গোপালগোবিন্দ, মানে অভিভাবকরা কোনও চান্স নিতে চাননি আর কী!
—কিসের চান্স, কেন চান্স?
অনেকেই জানতে চাইল।
ছেলেটি গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল— ছেলেমেয়েদের ঠাকুরদেবতাদের নাম দেবার পেছনের সাইকলজিটা জানেন আশা করি?
—কী সাইকলজি? নামকী পিছে আবার সাইকলজি আসে কেন?— যশজিৎ জিজ্ঞাসু।
গোপালগোবিন্দ বলল— ও জানেন না? সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরে তপস্যা—ঘোর তপস্যা না করলে ঈশ্বর পাওয়া যেত না, জানেন তো? হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বমুখ ঝুলে থাকা। সারাদিন সূর্যের দিকে চেয়ে থাকা, গাছ থেকে আপনি যে পাতাটি খসে পড়বে শুধু সেইটে খেয়ে শরীর ধারণ করা ইত্যাদি ইত্যাদি …
—হ্যাঁ হ্যাঁ— বোগাস সব— অনীক, অশোক সাঁতরা উভয়েই বলে উঠল।
গোপাল দু হাত তুলে বলল— আহা, বাধা দিচ্ছো কেন ওঁকে, বলতে দাও— গোপালগোবিন্দ বলল— কিন্তু কলিতে শুধু নাম। শুধু নাম করলেই জীব উদ্ধার পায়। তাই আমাদের বাবা-মা, দাদু-দিদিমা, ঠার্কুদা-ঠাকুরমা ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের নাম দিতে থাকলেন জগন্নাথ, হরিপদ, নারায়ণ, লক্ষ্মী, দুৰ্গাময়ী বুঝলেন তো? যতবার নামগুলো ধরে ডাকছেন, দেবতাদের নাম নেওয়া হচ্ছে,—আর কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা। সব উদ্ধার হয়ে যাচ্ছে।
—তা আপনার নামে চান্স না নেওয়ার ব্যাপারটা কী? গোপাল জিজ্ঞেস করল।
—ওঃ, ধরুন গোপাল ডাকটা যদি—গোলোকের গোপালের কান ফসকে যায়, আর একটা আরও জবরদস্ত একটা রইল, গোবিন্দ! এই আর কি! আপিসে আমাকে সংক্ষেপে জি.জি. বলে। কিন্তু ঠার্কুদাদা এখন এই তিরাশি বছর বয়সেও গলা ছেড়ে পরিষ্কার উচ্চারণে ডাকেন গোপা—ল গো-ও-বিন্দ-হরি-নারায়ণ-ওম্ শ্রীবিষ্ণো
—এই বাকিগুলোও কি আপনার নাম না কী?
তীর্ণা, রাংতার এগিয়ে দেওয়া ডিম আধখানা খেয়ে বলল।
—বাকিগুলো নাম নয়, তবে ঠার্কুদাও একজন র্যাপ-আর্টিস্ট আর কি, ইন হিজ ওন ওয়ে।
আই অ্যাম ফেথফুল টু দী ইন মাই ওন ফ্যাশন— গোপালের মন্তব্য।
তীর্ণা বলল— কবিতা-টবিতার স্যাংটিটি আর রাখতে দিলি না।
গোপাল বলল— আর। দেব-দেবীরই স্যাংটিটিই থাকছে না। তার কবি-কবিতা।
—কবি কি পিছে ক্যা হ্যায়? যশজিৎ জিজ্ঞেস করলো।
—তখন থেকে এই ধুমসোটাকে অশ্লীল ফিলমি গানের পিশাচে পেয়েছে। অনীক বিরক্ত হয়ে বলল।
—আরে বাবা, থোড়া সোচো তো! ফিল্মি গান কী বাত ছোড়ো। ঠিকসে সোচকে বাতাও কবিকে পিছে ঔর দেবীকী পিছে ক্যা হ্যায়? ক্যা চীজ! থিংক সীরিয়াসলি?
তীর্ণা আমতা-আমতা করে বলল— কী? ভক্তি?
রাংতা বলল— ভাব?
—হাঁ হাঁ, লেকেন থোড়া আগে বাঢ়িয়ে।
আগে কহো আর— হেঁড়ে গলায় গোপাল চেঁচায়।
গোপালগোবিন্দ নামে সেই ছেলেটি বলে উঠল—ইম্যাজিনেশন?
—রাইট য়ু আর। যশজিৎ নিজের ঊরুতে চাপড় মেরে বলে উঠল— ভক্তি, ভাব, ইম্যাজিনেশন সোব সোব কম পঢ়ে যাচ্ছে ভাই। কিছুরই আর স্যাংটিটি নাই। নাই নাই সে পৃথিবী নাই।
৩
এই সময়টায় কাজল খুব নিশ্চিন্তে চান-টান সেরে তার নাতিসরু সিঁথির ওপর যত্ন করে সিঁদুর পরছিল। বাব্বা। ছেলেমেয়ে এবং তাদের বাবা না থাকলেই সময়টা কত বিশাল, কত ঘনিষ্ঠ কত আদরের হয়ে যায়। শীতের দিন। শীতটা পড়ব না-পড়ব না করেও ভালোই পড়েছে। তবে একটু জলো। কাজলের ছেলেবেলার শীতটা এতো জলো হত না। ঠিক ভোর চারটেয় জ্যাঠামশাইয়ের হুড়মুড় করে বালতি বালতি জল মাথায় ঢেলে চান করার শব্দ আসত। মগ-টগ নয়, বালতি। এবং টাটকা জল নয় চৌবাচ্চার বাসি জল। শব্দটা শুনে লেপের ভেতর মায়ের কাছে আরও ঘনিয়ে যেত কাজল। ঘুমচোখেই মা তাকে আচ্ছা করে ঠেসে নিতেন নিজের পেটের সঙ্গে। পাঁচ ছটি ছেলেমেয়েদের যিনি জন্ম দিয়েছেন তাঁর পেট তো একটু থলথলে হবেই। থলথলে সেই মাতৃ-পেট কাজলদের কাছে স্বয়ং ধরিত্রীর সমান ছিল। সে আর তার পরের ভাই বিলু মার পেটটাকে নিয়ে খেলা করত, এই দ্যাখ এইখানটায় আফ্রিকা— ভীষণ জঙ্গল, কঙ্গো নদীর অববাহিকায় ডেভিড লিভিংস্টোন হারিয়ে গেছেন। এইখানটা হচ্ছে উত্তমাশা অন্তরীপ। কত যে নাবিক প্রাণ হারিয়েছে … সেটা হল আসলে মায়ের নাভি। নাভিতে সুড়সুড়ি লাগলেই মা ‘এই কী হচ্ছে, কী করছিস?’ বলে পাশ ফিরে শুতো। তখন বিলু বলত—যাঃ গ্লোবটা উল্টে গেল। কাজল কিন্তু দমত না। বলত—ভালোই তো আমাদের এখনও অস্ট্রেলিয়া দেখা হয়নি। অবহেলিত মহাদেশ। মায়ের ডান পাশটাতে অস্ট্রেলিয়া এবং সেখানে এমু পাখিরা চরছে ওরা দেখতে পেত,— ‘কিউয়ি, কিউয়ি’ বিলু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। বুমেরাং দিয়ে কিউয়িগুলোকে মারছে অস্ট্রেলিয়ার মাওরি উপজাতি, কিউয়ির ঝোল খেতে ওরা খুব ভালোবাসে। কাজল ফিসফিস করে বলে অস্ট্রিচ-অস্ট্রিচ। ঠাস করে এক চড় পড়ে কাজলের গালে। —তোরা কি আমাকে ঘুমোতে দিবি না? উঃ সারাদিন খেটেখুটে … বললুম একটু হাত বুলিয়ে দে—তা না…’ চোখ বুজিয়েও মার চড়টা যে কীভাবে অব্যর্থ— কাজলের বাঁ গালে পড়ত! বিলু অত কিউয়ি কিউয়ি করে চিৎকার করল তাতে ঘুম ভাঙল না, অথচ কাজল ফিসফিস করতেই … বেশ!
বিলুর রিফ্লেক্স খুব ভালো। সে ততক্ষণে সাত হাত সরে গেছে, এবং গ্লোব পর্যবেক্ষণের সাময়িক অসুবিধেটাকে উড়িয়ে দিয়ে কাজলের সঙ্গে তর্ক জুড়েছে। অস্ট্রিচ অস্ট্রেলিয়ার নয়, অস্ট্রিচ আফ্রিকার। অস্ট্রেলিয়ায় যা পাওয়া যায়, তার নাম হল রিয়া। এ তর্কের মীমাংসা তক্ষুনি হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং সেটা মুলতুবি রেখে দুজনে আলুপোড়া খেতে যায়। এটা কাজলের এলাকা। বিলুর কাজ শুধু লুব্ধ চোখে চেয়ে থাকা। ঝুড়ি খুঁজে কয়েকটি সুগোল খুব-বড়-নয় আবার খুব ছোটও নয় ননিতাল আলু বার করতে হবে। চিমটে দিয়ে নিভে যাওয়া ঝিম ধরা উনুনের হৃদয় খুঁজে বেদনার মতো একটু ধিকি ধিকি আগুন আবিষ্কার করতে হবে, তারপর আলুগুলি তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে হবে এবং চিমটে দিয়ে তার ওপর সাদাটে হয়ে যাওয়া পোড়া কয়লার আবরণ টেনে দিতে হবে।
যতক্ষণ আলুপোড়া হতে থাকে বিলুর ভীষণ টেনশন হতে থাকে। সে থেকে থেকেই বলবে— এই কাজলা, আলুগুলো যে পুড়ে গেল! এই টেনশন থেকে বিলেটাকে মুক্তি দিতেই কাজলকে ছাদের চিলেকুঠুরিতে উঠতে হয়, সেখানে সারি সারি আচারের বোয়াম। নলিদির অত সাধের ছড়া-তেঁতুল, বা কুলের আচার সে তার অপবিত্র শরীরের অপবিত্র ডান হাত ঢুকিয়ে টেনে বার করে এবং বিলুকে একবার মাত্র ওয়ার্নিং দিয়েই ভাগ দেয়— এই, কাজলা বললে দোব না কিন্তু।
বিলু তখনকার মতো নিঃশেষে এ নির্দেশ মেনে নেয়। কিন্তু এবংবিধ ঘটনার পরবর্তী সংস্করণে আবার কাজলা— আবার তর্জন-গর্জন এবং আবার আচার।
কয়েক ফোঁটা সিঁদুর কাজলের নাকের ডগায় ঝরে পড়ল। চিরুনির ডগা কিংবা সিঁদুর পরার কাঠি দিয়ে পরতে গেলে একটু আধটু ও রকম ঝরে পড়বেই আর তাই নিয়েই মেয়েরা বানিয়েছে তাদের বিশ্বাস। নাকের ডগায় সিঁদুর পড়লেই নাকি স্বামীসোহাগী হয়। বেচারিরা! নিজেকে কীভাবে ভোলানো! সিঁদুরের গুঁড়োগুলো নাকের ডগাটাকেই সব চেয়ে সম-উচ্চতায় পায়! কে বোঝাবে!
শীতের দিনে চান করতে কাজল বারোটা পার করে দেয়। তখন ছাতের ট্যাংকের জল এমনিতেই গরম হয়ে যায়। সেই গরম জলে প্রাণ ভরে চান করে, হলুদের ওপর নীল খড়কে ডুরে পরে হাতে পায়ে মুখে ক্রিম ঘষে, খাবারগুলো গ্যাস জ্বেলে প্রেশার কুকারের মধ্যে গরম করতে দেওয়া। তারপর … কাজের কী আর শেষ আছে? কাচা কাপড় মেলো, ছাড়া কাপড় তোলো, ছাড়া পাঞ্জাবির বা শার্টের পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার কি পঞ্চাশ টাকার নোট আরও কিছু খুচরো পেয়ে যাও, মহানন্দে তাদের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকাও। তারপর শপাং শপাং করে ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে বিছানাগুলো ঝেড়ে সব পাটসাট করে প্রেশার কুকারটা নিয়ে এসে টেবিলের মধ্যিখানে বসাও। গরম ভাত, তাতে কাসুন্দি, মৌরলা মাছ ভাজা, বাটি চচ্চড়ি, পালং শাকের ঘণ্ট, আর কী চাই? পোনা মাছের ঝালটাকে কাজল বিরস বদনে তুলে রেখে দেয়। কী করেই যে তার ছেলেমেয়ে দিনের পর দিন এই ডাবডেবে মাছগুলো খায়! আর কী করেই যে তার বর এগুলো এভরি ডে আনে! এভরি ডে! অবশ্য যার নাম গঙ্গাপ্রসাদ তার থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু কাজলের অসহ্য লাগে। তার বাবাও প্রোফেসর ছিলেন। কিন্তু মাছ খেতে জানতেন। খয়রা, দিশি ট্যাংরা, পুঁটি, কুঁজো ভেটকি, চিংড়ি মাছ তো তাদের বাড়িতে হবেই। চিংড়ি মাছ ছাড়া আবার পেঁয়াজকলি খাওয়া যায় তা কাজল শ্বশুরবাড়ি এসে শুনল। মোচা-চিংড়ি নামক একরকম চিংড়ি আছে। আরেক চিংড়ির নাম কড়ানে চিংড়ি, ঘেসো চিংড়ি, কাদা চিংড়ি, এসবের নাম শুনে এরা ভুরু কুঁচকে চেয়ে থাকে।
তার বর বলে থাকে—চিংড়ি কিন্তু মাছ নয়, কাজল। চিংড়ি হল একরকম জলজ পোকা। ঠিক যেমন আরশুলা স্থলজ পোকা! … ওয়াক ওয়াক … আরশুলায় কাজলের ভয়ানক ঘেন্না। অনীক যখন তার হাওয়াই চটি তুলে হঠাৎ চটাস শব্দ করে আরশুলা মারে, তখন কাজল সে দৃশ্যে থাকে না, তবে পরক্ষণেই দৃশ্যমান হয়ে বলে— যা যা চটিটাকে ফেলে দিয়ে আয়। যা!
—কেন? হতভম্ব অনীক জিজ্ঞেস করে।
—কী করলি ওটা দিয়ে? এক্ষুনি!
—ওহ্, জাস্ট একটা স্ট্রে আরশুলা মেরেছি বলে চটিটাকেই ফেলে দিতে হবে?
—তো কী করবি? কী করতে চাস?
—জাস্ট পেছনটা স্ক্রেপ করে নিয়ে, সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলব …
—কী দিয়ে স্ক্রেপ করবি?
—কী দিয়ে? ধরো তোমার চুলের কাঁটা দিয়ে …
—খবর্দার অনীক—কাজল ভীষণ গলায় বলে
—তবে মাখন লাগানোর ছুরিটা দিয়ে … আইডিয়্যাল হবে!
—শুনছো! দেখছো?—কাঁদো কাঁদো গলায় এতক্ষণে সে স্বামীর কোর্টে আপিল করে।
গঙ্গাপ্রসাদ একটা পেপার-কাটার তুলে ধরে বলেন— এতে হবে।
—হবে না মানে? চমৎকার হবে। আইডিয়্যাল হবে, দি টুল ফর দ্য জব।
বিজয়গর্বে পেতলের পেপার কাটারটা নিয়ে অনীক চলে যায়।
পরে অবশ্য গঙ্গাপ্রসাদ সেটা বহুদিন খুঁজে পাননি। এবং অনীক জিনিসটা সাবান দিয়ে ধুয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়েছিল এ কথা তামা- তুলসী-গঙ্গাজল হাতে নিয়ে শপথ করে কবুল করা সত্ত্বেও দোষটা তারই ওপরে পড়ে। গঙ্গাপ্রসাদ বিরক্ত মুখে বলেন— আমি কি বলেছি তুমি ওটা চুরি করেছ, পেতলটা বিক্রি করে সিগ্রেট খাবে বলে? ইটস নট দ্যাট। মিসপ্লেসড অ্যাজ ইউসুয়াল, বাই ইউ। পেপার-কাটার কি আরেকটা পাওয়া যায় না! যায়? তবে ওটা বাবা আমায় দিয়েছিলেন। বাবাকে দিয়েছিলেন, অনীক বলে তাঁর বাবা, তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা তাঁকে…এ এক ধরনের রেকারিং-এর অঙ্ক, আমি জানি বাবা। তবে কথাটা হল তোমার ওই এয়ারলুম অনীক মিত্তির মিসপ্লেস করেনি।
প্রায় সমস্ত তর্কাতর্কিটাই কাজল আড়াল থেকে আলনা গোছাতে গোছাতে শোনে। এবং বিকেলবেলা ছায়া বাসন মাজতে এলে চুপিচুপি বলে— হ্যাঁ রে কাগজে মুড়ে তোকে সেই একটা পেতলের জিনিস দিয়েছিলুম না, কী করেছিস রে?
—তেঁতুল দিয়ে ছাই দিয়ে মেজে একেবারে সোনার মতো করে ফেলেছি মা। তারপর— তারপর আমাকে দিয়ে যাস, বাবার শখের জিনিস আমি বুঝতে পারিনি। তোমাকে অন্য একটা কিছু দিয়ে দেবো!
জিনিসটা ছায়া এনে দেয় ঠিকই। তবে তার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেলে বলে— ‘নিজেই কালীঘাটের কুকুর হবে, আমার আর কী?’
গঙ্গাপ্রসাদের খুঁজে না পাওয়ার অনেক জিনিস আছে। সেই জন্যে আজকাল কোন কিছু হারালে তিনি যথেষ্ট জোরের সঙ্গে তাঁর নালিশ পেশ করতে পারেন। না। পেতলের পেপার কাটারটা যখন পেয়ে যান তিনি তাই টুঁ শব্দ করেন না। জানা কথাই কিছু সরু কিছু মোটা গলার হি হি হো হো উঠবে। আমি তো আগেই বুঝেছিলুম, বলেছিলুম … কিংবা বাবা তুমি না, একটা
—কী? গাধা? গঙ্গাপ্রসাদ চমশার ফাঁক দিয়ে চেয়ে বলবেন।
—এ মা। আমি তাই বলেছি?
—বলোনি। বলতে যাচ্ছিলে। দুটোর মধ্যে তফাত আর কী!
—আমি আসলে বলতে যাচ্ছিলুম তুমি একটা ইমপসিবল, ইনকরিজিবল
—একই হল। একটা বাংলা, আরেকটা ইংরেজি। …
বাবা তাদের এভাবে কোণঠাসা করলে ছেলেমেয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থাকে। কিন্তু হারটা গঙ্গপ্রসাদেরই হয়।
পেপার-কাটারটা যে হঠাৎ তার কলঙ্ক বিমোচন করে স্বর্ণসম প্রতিভাত হচ্ছে, এই পরিবর্তনটা থেকেও তিনি কিছু বুঝতে পারেন না।
গঙ্গাপ্রসাদ যে সব জিনিস হারান, তার তালিকা দীর্ঘ। বইপত্র তো আছেই। আমার ডায়েরিটা? আমার ডায়েরি-ই-ই।
কাজল ছুটে এসে টেবিলের ওপর থেকে ডায়েরি তুলে চোখের সামনে নাচায় —এটা কী?
—আঃ, ওটা না। ওটা না। সবুজ রঙের রেক্সিনের মলাট।
পুরো ডিটেল বলতে পেরে গঙ্গাপ্রসাদ খুব গর্বিত। কিন্তু তাঁর গর্বে জল ঢেলে কাজল বলে—ও সেই নীলটা? যেটা বিকাশবাবু দিয়েছিলেন।
—নীল নয়, সবুজ, সবুজ।
—ছেলেরা সব সময়েই নীলকে সবুজ বলে, রঙ কানা। ওই নাও তোমার —‘সবুজ রঙের ডায়েরি, বইয়ের থাকে গুঁজে রেখেছিলে।
—অল রাইট। তো এটা কী রঙ?
নীল না সবুজ?
—ন্যাচারালি সবুজ।
—উঃ তুমি চোখের মাথা তো খেয়েইছো, বুদ্ধির মাথাও কি খেয়েছো?
বুদ্ধির প্রতি নিত্যদিন কোনও না কোনও কার্যকারণে এই কটাক্ষ গঙ্গাপ্রসাদের আর সহ্য হয় না। তিনি সে তল্লাট ত্যাগ করেন।
ডায়েরি ছাড়াও গঙ্গাপ্রসাদ হারান চশমা, যা তাঁর পাঞ্জাবি বা প্যান্টের পাশ-পকেট থেকে পাওয়া যায়, হারিয়ে থাকেন পেন যা তাঁর শার্টে গোঁজা থাকে, আর হারান টাকা, যা অবশ্যই তাঁর স্ত্রী কাজলরেখা পেয়ে যায় এবং নিজস্ব গোপন ব্যাঙ্কে জমা করে। এই একটিমাত্র হারানো জিনিস গঙ্গাপ্রসাদ কখনওই ফেরত পান না। ফলে কাজলরেখার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ক্রমশই স্ফীত হতে থাকে। এবং সে অদ্ভুত অদ্ভুত বদান্যতা দেখাতে থাকে। যেমন ননদের মেয়ের বিয়েতে দু ভরির সোনার হার দেওয়া হবে, গলদঘর্ম হয়ে ঠিক হয়।
গঙ্গাপ্রসাদ অনেক কষ্ট করে মানে যুক্তি-তর্ক খরচ করে বোঝাতে চান— সোনা দিতে নেই। সোনা দেওয়া ঠিক নয়।
—কেন? কেন?
—সোনা আটকে রাখা মানে দেশের টাকা আটকে রাখা। আটকে রাখলে টাকায় ছাতা ধরে।
—আর ছত্তর খুলে দিলে মিনিস্টারদের পেটে যায়!
—পেটে নয়, পকেটে— তীর্ণা সংশোধন করে।
কাজলরেখা উত্তেজিত হয়ে বলে— সোনা মেয়েদের একমাত্র স্ত্রীধন, একমাত্র সম্বল— সোনা কেড়ে নেওয়া মানে মেয়েদের একেবারে অসহায়, নিঃসহায়, নিঃসম্বল করে ছেড়ে দেওয়া— যে কাজটা ওই ভূতপূর্ব মোরারজী করেন। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তদের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে বালাটা চুড়িটা সব বার করে নিলেন, ওঁকে আমি কোনওদিন ক্ষমা করব না। কোনও মেয়েই করবে না। কই, তিরুপতির সোনা বার করতে পেরেছিল? বিজনেসম্যানদের?
—আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে, মা, অন্য কোনও দেশে তো মেয়েরা সোনা পরে না! মোরারজীর ওপর তোমার এত রাগ কেন?
—রাগ কেন? গোল্ড কন্ট্রোল করে তো আমার দফা সেরে দিলে। পিসিমা বেচারি নিজের গয়না মার গয়না সব বার করে আমাকে দিয়ে দিলেন। একটা গিনি সোনা উপহার পেলুম না। সব ওই চোদ্দ ক্যারাট। ছিঃ।
—টাকা সার্কুলেট করতে হয় মা, না হলে বাড়ে না।
—সোনাও সার্কুলেট করে আজ্ঞে, যেমন গিনি সোনার কিছু ছুটকো ছাটকা উপহার পেলে আজ আর রানীর বিয়ের উপহারের জন্যে ভাবতে হত না। আর অন্য দেশের লোক সোনা পরে না? চিনেরা সোনার দাঁত পরে, বুঝলে? সলিড সোনা। আর অন্য দেশের সুন্দরীরা যে সব হিরে-টিরে পরেন, তার কাছে আমাদের এই সামান্য ফাঁস হার, মটরমালা নস্যি।
গঙ্গাপ্রসাদ এই সময়ে ইন নিতে চেষ্টা করেন। —কিন্তু কাজল, সোনা দেওয়া মানে মেয়েটাকে বিপদের মধ্যে ফেলা।
—কেন? তোমার ওই দু ভরি দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকের লোভ বেড়ে যাবে? বধূহত্যা?
—ছি ছি! রীণার শ্বশুরবাড়ি অতি ভদ্রলোক, সে কথা বলছি না, চোর-ডাকাত ছিঁচকে চোরের কথা বলছি।
—ও, দিদি নিজে এই বাজারে কুড়ি ভরি সোনা দিচ্ছে, সবই অবশ্য ওল্ড স্টক, তা তাতে চোর-ডাকাতের লোভ হবে না, হবে তোমার ওই দু ভরিতে?
বারবার হতচ্ছেদ্দার মতো করে দু ভরি উচ্চারিত হওয়ায় গঙ্গাপ্রসাদ ভারি ক্ষুন্ন হন, বলেন— আমি সামান্য মাস্টার, দু ভরি দেবার ক্ষমতাই বা আমার কই? আর দিতে পারছি না, অথচ লোক দেখানোর জন্যে গলায় গামছা দিয়ে …
তাঁকে কথা শেষ করার সুযোগ কাজল কোনদিনই দেয় না, এই সময়ে সে তীব্র সুরে বলে— গামছার কথা তুমি উচ্চারণ করবে না। বহু কষ্টে আমি তোমায়। গামছা ছাড়িয়েছি।
—ভেতরে কিছু পরা ছিল তো?— অনীক প্রশ্ন করে,
—ভেতরে কিছু পরা, মানে?
—মানে যখন গামছাটা ছাড়ালে, লোকে সাধারণত বাথরুমেই গামছাটা পরে …
—জন্মদিনের সাজের ওপর …
—উঃ— কাজল ছেলের পিঠে গুম গুম করে কিল মারতে থাকে।
—সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলাইটিস হলে তোমারই কষ্ট— অনীক নির্বিকারভাবে বলে, তার মায়ের কিল থেমে যায়। তবে কাজলের স্মৃতিশক্তি প্রখর, কোনও পয়েন্টই সে ভোলে না। এবার সে একটা ভিন্ন পয়েন্ট ধরে খপ করে।
—আর লোক-দেখানো বললে যে? কোন লোক-দেখানো গো? একমাত্র মামার বাড়ি থেকে একটা হার দেওয়া মানে লোক-দেখানো? ঠিক আছে ওইটুকু লোক আমি দেখাবো। গরিবি দেখাতে পারব না।
—হাজার দশেক তো অন্তত লাগবে।
—ঠিক আছে আমি হাফ দেবো। কাজলরেখার এই ঘোষণায় শুধু গঙ্গাপ্রসাদ কেন, তার ছেলেমেয়েও স্তম্ভিত, বিমূঢ় হয়ে যায়।
—তুমি! তুমি কোথা থেকে দেবে? তুমি কি রোজগার করো?
—কেন? কেন রোজগার করি না? কেন করব না? আমি যে সংসারের গুচ্ছের কাজ করি সে সবের জন্যে আমার অ্যালাউয়েন্স পাওয়া উচিত নয়? এই তো সেদিন টিভিতে বলছিল …
তীর্ণা বলল— অবশ্যই পাওয়া উচিত মা। একশ বার। গৃহবধুদের সম্মান-দক্ষিণার যে প্রশ্নটা তুমি তুললে—সেটা এখন মোস্ট কারেন্ট ফেমিনিস্ট ইস্যু। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, তুমি তো সেটা পাও না, অথচ দশ হাজারের হাফ পাঁচ হাজার … তুমি এক কথায় …
—আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ-ট্রদীপ কিছু পেয়েছো না কি? … অনীকের বিস্মিত প্রশ্ন।
আশ্চর্য প্রদীপ পেলে মাত্র পাঁচ হাজার চাইবো? আমি কি পাগল না …
—ঠিক আছে বাকিটা নাই বললে— তীর্ণা বলল, কিন্তু মা …
—উত্তরটা খুব সোজা, সংসার খরচ থেকে বহু আয়াসে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সম্মান-দক্ষিণাহীন গৃহবধূরাও কিছু জমা করে থাকেন সময়-অসময়ের জন্যে।
—কী অসম্ভব তোমার সঞ্চয়-প্রতিভা মা। তুমি যে ব্যাঙ্ককে অনায়াসে হার মানিয়ে দিলে!
—ব্যাঙ্ককেও—গঙ্গাপ্রসাদ কী রকম বোকার মতন বলেন— সেখানেও সিম্পল হোক কম্পাউন্ড হোক, ইন্টারেস্টের একটা অঙ্ক আছে! বলতে বলতে তাঁর মাথার মধ্যে ছোট বড় নানা নোট ঘুরতে থাকে। পাশ পকেটে সেই পঞ্চাশ টাকার নোট দুটো! থাকের শেষের পিন গাঁথা ছিল.. কোথায় যে গেল, কমলা রঙের বিশ টাকার নোট আজকাল রেয়ার হয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুকাল আগে ছিল না। একশো ভাঙিয়ে বিশ তিনি প্রায়ই ঘরে আনতেন। এইসব বোধহয় হারিয়ে-যাওয়া নোটেরা তাঁর মাথার মধ্যে একটা খুব শক্ত প্রব্যাবিলিটির অঙ্ক সাজাতে থাকে। কিন্তু বাংলার মাস্টারমশাই তিনি, অত শক্ত অঙ্কের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন কেন? এর চেয়ে এম.ফিলের পাঁচখানা ডিসার্টেশন লিখিয়ে ফেলা অনেক সোজা ছিল। তিনি ক্রমশই বোকা বনতে বনতে একটা ভীষণ আনপার্লামেন্টারি উক্তি করে ফেলেন।
—কী করে বাঁচালে কাজল! আমরা তো দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি। তুমিও যে খাচ্ছো না তা কই চেহারা দেখে … শাড়িটাড়িও প্রায়ই কিনছ …
কাজলরেখা এবার অভিমানিনীর মতো ফুঁসে ওঠে— তুমি আমার খাওয়ার খোঁটা দিলে? পরার খোঁটা দিলে? জানো একটা রাতদিনের কাজের লোকেরও মাস গেলে শ তিনেক টাকা পাওনা হচ্ছে আজকাল, চারটে ছটা শাড়ি? খাওয়া ছাড়া এবং সে খাওয়া আমার চার গুণ অন্তত। জানো, কুচো মাছের বাটি-চচ্চড়ি দিয়ে লাঞ্চ সারি … জানো রাত্তিরে তোমাদের মাছ দিয়ে নিজে রুটি গুড় … ক্রমশই কাজলরেখার সুর সান্ত্বনাহীন কান্নার দিকে যেতে থাকে।
মাঝখান থেকে তীর্ণা বলতে থাকে— খাওয়ার খোঁটা … পরার খোঁটা … খাওয়ার খোঁটা .. পরার খোঁটা .. এসব তো ঠাকুমাদের আমলের কথা, মায়ের মুখে। কেমন আঁশটে মানে ফিশি লাগছে …
রেগেমেগে কাজলরেখা স্থানত্যাগ করে।
তীর্ণা চেঁচিয়ে বলে— পেটে কী শত্রুরই না ধরেছি-টা বললে না মা!
—মনে মনে বলছি— কাজলের অপস্রিয়মাণ মূর্তির দিক থেকে ভেসে আসে।
যাক গে মৌরলা মাছের বাটি-চচ্চড়ি দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ তৃপ্তি সহকারে শেষ করে কাজল কিছুক্ষণ মৌরি চিবোতে চিবোতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের পাড়ার কিছু গৃহবধূ এমন কি কর্মরতা মহিলাদের মধ্যেও কিছুদিন হল খুব পানের ফ্যাশন হয়েছে। তরল নয় সলিড। অনেকেই বেশ ভালো জর্দা খেতে শিখে গেছে। কাছে এলেই নানা কিসিমের জর্দার ঠাকুমা-ঠাকুমা কিংবা উত্তর ভারত-উত্তর ভারত গন্ধ ছাড়তে থাকে। এই ধরনের পান-বিলাসী বন্ধুরা পান চিবোতে চিবোতে তাদের বাড়িতে এলেই কাজল তাঁদের চৌকি চেয়ার মোড়া ইত্যাদিতে সাদরে বসিয়ে, নিজে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে হাসি-হাসি মুখে চোখ বুজিয়ে থাকে।
—ও কি রে কাজল? কথা বল! —চোখ বুজিয়ে আছিস কেন? আমাদের কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে!
দু-একবার চোখের পাতা পটপট করে তারপর কাজল চোখ খুলে ফেলে, মন। ভোলানো একটা হাসি দিয়ে বলে— তোমাদের কী রকম দেখাচ্ছে, এখনও দেখিইনি! আসলে একটু বেনারস ঘুরে এলুম। সেই কবে গিয়েছিলুম! দশাশ্বমেধের ঘাট! মণিকর্ণিকার গলি, লকসার রোড, বাঙালিটোলা, পানিফলের জিলিপি, মালাই …
—আমাদের দেখেই অমনি তোর স্মৃতিচারণের সাধ গেল! এই শিবানী, লিলি, চল তো চল।
—মৎ যা মৎ যা শিবানী— কাজল ডুকরে ওঠে। তোরা আসতেই ভুরভুর করে বেনারসের গলির গন্ধ পেলুম— মাইনাস ষাঁড়ের নাদ। তাই একটু …
—ওঃ জর্দার কথা বলছিস? এ রসে তো তুই বঞ্চিত। কিছুতেই কিছু করতে পারলুম না।
—আর করতে পেরে কাজ নেই ভাই। আমি মৌরিতেই মজে আছি। দাঁতগুলোকে আর মজাতে চাই না।
দু পাটি ঝকঝকে দাঁত কাজলের একটা বড় ঐশ্বর্য। কাজলরেখা এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। দাঁত সম্পর্কে পত্র-পত্রিকার যে সব টিপস বেরোয় সেগুলো সে খুঁটিয়ে পড়ে। যথা সম্ভব পালন করবার চেষ্টাও করে। অম্বল দাঁতের যম। সুতরাং সে অম্লরোগ থেকে বাঙালির পক্ষে যতটা সম্ভব দূরে থাকে। কোনদিন খাওয়া-দাওয়া করে অ্যাসিডিটির সম্ভাবনা মনে হলেই অ্যান্টাসিড খেয়ে নেয়। দাঁত সুন্দর হলেই হাসি সুন্দর, কথা সুন্দর। সুতরাং কাজল তার দাঁতকে পারিবারিক সামাজিক সমস্যায় বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারে।
যেমন এই বড় ননদের মেয়ে রীণার বিয়েতেই। কাজল বিয়ে বাড়িতে সকালে যেতে পছন্দ করে না। বড্ড খাটতে হয়। বড্ড অব্যবস্থা হয়। সব যেন ছত্রাকার। তার ওপর গিন্নিবান্নি জাতীয় মানুষদের যেন খাওয়া-দাওয়া বা বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। একাধিক বিয়ে-বাড়ির ঘরযোগে শুধু ছ্যাঁচড়া আর মুগের ডাল দিয়ে সাড়ে চারটের সময়ে ভাত খেতে বাধ্য হয়েছে। প্রত্যেকবারই তাতে তার পেটে শূলবেদনা হয়েছিল। সেই থেকে কাজল বিয়ে বাড়িতে সকালে যায় না। বেলা দুটো নাগাদ চারটি ঝোলভাত খেয়ে, এক টিপ ঘুমিয়ে নিয়ে, ঢাকাই জামদানিটি পরে, পিঠে রুপোর চাবিগাছটি ফেলে, কপালে বড় একটা কুমকুমের টিপ পরে, গলায় পাটিহার, কানে কানপাশা, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে একগোছা করে চুড়ি পরে যখন গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন হয়তো কেউ বলল— বা্বাঃ রাত্তিরের সাজটা যে এখনই দিয়েছ গো!
কাজল ঝকঝকে হাসে।
—শেষ পর্যন্ত এলি? আসতে পারলি?
—কী করব বলো বড়দি! তোমার ভাইটিকে তো জানো। আজ তাঁর দেরিতে ক্লাস। এদিকে কী এক তাড়া কমপিটিটিভ পরীক্ষার খাতা নিয়ে এসেছে, দেখতে দেখতে তার ঝোল ডাল জ্ঞান থাকছে না। বড়া ভাজা ভেবে, গোটা মাছটাকে মুখে পুরে দিল। চিন্তা করো তার অবস্থাখানা, বিষম খেয়ে, কাঁটা লেগে, নাকের জলে, চোখের জলে হয়ে …
—কাঁটা বেরিয়েছে তো?
—বেরোবে না মানে?— কাজল ঝকঝকে হাসে— তারপরে তোমাদের এদিকে কী করতে হবে বলো।
—এদিকের কাজ কি পড়ে আছে না কি? বরণ ডালা সাজানো, গায়ে হলুদ, তত্ত্ব গোছানো, স-ব শেষ। বরং খেতে বসে যা।
ননদের এই ঠেস গায়েই মাখে না কাজল।
—খাওয়ার তদারকি করতে হবে? তাই বলো!
একবার ছাদ থেকে ঘুরে এলো সে। বিদঘুটে গরম। তার ওপর অভয়বাবু আছেন। অভয়বাবু নামে রীণাদের এই প্রতিবেশী একাই দুশো। অ্যাটলাসের মতন সমস্ত যজ্ঞি বাড়িটাকে মাথার করে রেখেছেন। কাজেই ফার্স্ট ব্যাচকে তার হাসি এবং কিছু সরস কথা উপহার দিয়ে কাজল নিচে নেমে আসে। কনের কাছে। এই স্থানটিই সবচেয়ে নিরাপদ। ‘তুমি আমাকে সাজাবে তো মামী?’ নিশ্চয়— কাজল সান্ত্বনা দেয় এবং সাজবার জন্যে কনের সঙ্গে কনে-সাজানে মামীরও যে একটু শীতল বিশ্রামের প্রয়োজন সেটা যে-সব মহিলা তাকে গোলমেলে কাজে শামিল করতে চেষ্টা করেন, তাঁদের বুঝিয়ে দেয়।
এবার চারটের সময়ে খেতে দিল তো বয়ে গেল। সে ভাত ছ্যাঁচড়া ডাল ঠেলে সরিয়ে রাখে, মুড়িঘণ্ট চাখে, মাছ ধুয়ে খেয়ে নেয়, গোটা চারেক সন্দেশ রসগোল্লা উদরে চালান করে সঙ্গে গায়ে হলুদের তত্ত্বের বোম্বাই সিঙাড়া এবং বালিশের মতো চিত্রকূটের আধখানা। বিকেলের টিফিন তো? একরকম টিফিডিনার হয়ে গেল। কারণ, রাতে অত অতিথি-আপ্যায়নের হাসি হাসবার পর এবং নানাবিধ খাবারের গন্ধ সহ্য করবার পর আবার প্রবৃত্তি থাকবে কি না বলা শক্ত। দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট তো নিশ্চয় খেতে হবে কিন্তু তারপর নিশ্চিন্ত। একরকম দাঁতের কল্যাণেই ননদের মেয়ের বিয়ের নান্দনিক দিকটা সে-ই নাকি উদ্ধার করেছে এবংবিধ প্রশংসা তার প্রাপ্য হয়।
মেয়েরাই মেয়েদের ভালো বোঝে। বিশেষ করে আজকালকার মেয়েরা মায়েদের। তীর্ণা বাড়ি এসে মুচকি হেসে বলে— একটার সময়ে কলেজে গেছি, তখনও তুমি পৃথু আর রুষাকে নিয়ে বিছানায় মগ্ন। কখনই বা গেলে, আর কখনই বা বড়পিসিদের উদ্ধার করলে? কাজের মধ্যে তো দেখলুম রীণাদির বন্ধুদের ইনস্ট্রাকশন দিয়ে দিয়ে সাজালে, আর দারুণ একখানা পাটোলা পরে কুটুমবাড়ির লোকদের সঙ্গে গল্প করলে।
এসব সমালোচনাকে পাত্তা দেয় না কাজল। বলে কনসালট্যান্ট ডাক্তার যেমন আছে, আর্টিস্টও তেমন আছে। বুঝলি তীর্ণা। আর কুটুমবাড়ির লোকেরা ওই এক রাত্তিরের নবাব। তাদের মিষ্টি কথা দিয়ে খুশি করা একটা পুণ্যকর্ম, বুঝলি?
—কেন? এক রাত্তিরের কেন?— অনীকও যোগ দেয়।
—বাঃ এর মাস দু-তিনের মধ্যেই তো মেয়ের কল্যাণে জানা যাবে কে কতটা হাড়-হাভাতে পাজি। তখন দেঁতো হাসি ছাড়া ওদের আর কী জুটবে রে?
৪
হা-হা বালির মধ্যে ওদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা ঝড়ঝড় করতে করতে চলে গেল। —এটা কী বল তো?— গোপাল জিজ্ঞেস করল।
রাংতা বলল—কী আবার? অজয় নদীর চড়া।
গোপাল বলল— অজয় টেকনিক্যালি নদী নয়, নদ। সিন্ধু অজয় ভৈরব এ সব হল নদ। তা সে যাক, এটা আসলে তাকলামাকান মরুভূমি এক্সটেন্ডিং ওভার থাউজ্যান্ডস অফ স্কোয়্যার মাইলস।
রাংতা বলল— দেখেছিস তীর্ণা, ছেলেদের কেমন একটা অভ্যেস আছে, মেয়ে দেখলেই জ্ঞান দেয়, জ্ঞান দেখায়।
তীর্ণা বলল— যা বলেছিস!
গোপাল হো-হো করে হেসে উঠল— হায় হায়, আমার রসিকতা, কবিত্ব দুটো প্রচেষ্টাই মাঠে মারা গেল। অনেকেই বলে মেয়েদের সেন্স অফ হিউমার নেই। বিশ্বাস করছি এখন সেটা। মেয়েদের কবিত্ববোধ নেই।
— যা ইচ্ছে বলে যা— তীর্ণা বলল বেপরোয়াভাবে।
গোপাল বলল— তোরা তো দুর্গম স্থানে টানে যাবার সুযোগ পাসনি! তোদের কল্পনাশক্তিটাকে একটু উসকে দেবার চেষ্টা করছিলুম। তা দেখছি বৃথা।
তারপর সে যশজিতের দিকে ফিরে চুপিচুপি বলল— কী রে যাশ, মেয়ে দুটোকে সঙ্গে এনেছি বলে কোনও অসুবিধে হবে না তো?
যশ গভীর চিন্তামগ্ন। সে মাথা নেড়ে অসুবিধে নেই জানাল। তারপর বলল— ডিকয়ডাক জানিস?
তখন পরিষ্কার আকাশ দিয়ে বক উড়ে যাচ্ছে। বালির ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে অনেক রকম, অনেক-পা। কাঁধে পুঁটলি, মাথায় পুঁটলি, লাঠির আগায় পুঁটলি, খালি গায়ে পুঁথির মালা ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে-বউ, বুড়ি-সুড়িও আছে। তাদের সঙ্গে ঘরের হাট্টাকাট্টা পুরুষরাও। হাঁড়ি বইছে বাঁকে, মাথায়। মেয়েরাও। মেলার বেসাতি।
অনীক তীর্ণার কোনও প্রশ্নের উত্তরে বলল— তা তুই কি ভেবেছিলি এটা শুধু আধ্যাত্মিক মেলা?
রাংতা জলে নামল। সে-ই সবচেয়ে আগে আগে যাচ্ছিল। অন্যরা পিছিয়ে পড়েছে লক্ষ্য করেনি। গাঁওয়ালিদের জিজ্ঞেস করে করে সে তার সালোয়ার ক্রমশ হাঁটু অবধি তুলে অজয়ের রোগা, অগভীর জলে পা ডুবিয়ে আহ্লাদে হি হি করছিল। এ রকম অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি।
যশজিৎ গোপালকে বলল— দিস ইজ দা থার্ড টাইম। তিনবার হতে যাচ্ছে। জানি না আমাদের জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে।
গোপাল বলল— তুই তো আমাকে আগে একবারও বলিসনি।
—ভেবেছিলাম একাই ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবো।
যশজিতের পাগড়ি-পরা দাড়ি-অলা মুখে বিশুদ্ধ বাংলা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগে। বিশেষ করে গ্রামবাসীদের। কিন্তু যশজিৎ ভবানীপুরের শিখ। তার বাংলার টান-টোনও বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয়। সে যখন বঙ্কিম বাংলা বলে, ইচ্ছে করেই বলে।
এই সময়ে জি.জি. বা গোপালগোবিন্দ তাদের পাশে এসে গেল।
সে গলার সুর তুলে বলল— আপনাদের অসুবিধে করলুম না তো!
গোপাল বলল— যাচ্ছি আউল বাউলের মেলা দেখতে, এর মধ্যে অসুবিধের কথা এলে চলবে কেন?
—না, মেলাই দেখুন আর পর্যটনই করুন, সঙ্গী একটা মস্ত ব্যাপার। সঙ্গী না পছন্দ হলে …
আপাদমস্তক তাকে দেখে নিয়ে গোপাল বলল— এ রকম ঘটনা কি প্রায়ই ঘটে?
—কী রকম ঘটনা।
—না, লোকে আপনাকে অপছন্দ করছে … এরকম ঘটনা।
তীর্ণা অনীককে বলল—তুই ক্রমাগত রাংতার দিকে যেতে চাইছিস কেন? হতে পারে মেয়েটা অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু আমিও তো তোর বোন। দেখতে পাচ্ছিস না গরম বালিতে পা চলছে না, কী রকম হাঁসফাঁস করছি!
—সেটা বোকার মতো শাড়ি পরেছিস বলে। কোনও ভ্রমণে কখনও শাড়ি পরে বেরোতে হয় না—এই সহজ সত্যটাই যে জানে না তার আর বেড়াতে আসা কেন!
—আমি থাকাতে তোর খুব অসুবিধে হচ্ছে, না রে দাদা? সব কিছুর একটা সাক্ষী থেকে যাচ্ছে!
অনীক বলল—ও! অলরেডি আমি অপরাধ করে ফেলেছি? সেটা কী? রাংতার দিকে ধাবিত হওয়া? ফর ইয়োর ইনফর্মেশন রাংতা অলরেডি মাঝনদীতে, এবং আমার সাহায্য ছাড়াই।
—মাঝনদীতেই যে ভরাডুবি হয় রে! —ছদ্ম-করুণ স্বরে তীর্ণা বলল।
—হোক, আমি এখন এই মালটিকে টেনে সামনে এগোবার বৈধ চেষ্টা করে যাই। বলে অনীক তীর্ণার হাতে একটি হিসেবি হ্যাঁচকা দিল। এবং সে হ্যাঁচকায় বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তীর্ণা বলল—আমাকে মাল বললি?
—বললুম, এখন চ’, আর দ্যাখ ওই সাঁওতালিরা তোকে কী বোঝাচ্ছে, কয়েকটি সাঁওতালি বৌ-ঝি কাপড় পরেছে হাঁটুর ওপরে। মাথায় ঝুড়ি পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে স্বছন্দে চলেছে। তারা ইঙ্গিতে তীর্ণাকে নিজেদের শাড়ি পরার ভঙ্গি দেখাল। তীর্ণা করুণ চোখে চারদিকে তাকায়, কোথাও একটা কাঁটাঝোপ পর্যন্ত নেই।
অনীক বলল—খুব হয়েছে দে দে, নিজের ব্যাগটা আমাকে দে। ভার বওয়াতে ওস্তাদ।
অজয়ের জলে পায়ের পাতা ডুবিয়েই তীর্ণা এমন চিৎকার করে উঠল যে সামনে থেকে যশ, গোপাল, জি.জি সবাই ফিরে তাকাল।
পেছন থেকে কে বলল—ওটা আর্তনাদ নয় দাদা হর্ষধ্বনি। গরম বালির পর নদীর জলের ছোঁয়া আর কি! তারপর শহুরে মেয়ে …
গাল কাত করে একবার চেয়ে দেখল তীর্ণা, মুখে বিরক্তি। সেই অশোক সাঁতরা না কী! তার পরেই আবার হেসে ফেলল।
গোপাল পেছন ফিরে বলল—ওই গাঁওয়ালিরা যে পথ ধরে যাচ্ছে, সেই পথ ধরে এসো। ওরা ঠিক জানে। তারপর খুব নিচু গলায় বলল—আগের দুবারে পেয়েছিলি?
—পাবো না কেন? লেকিন ধরতে পারিনি ভাই।
—এবারে পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?
—না এসে যাবে কোথায়? আর ধরবার জন্যেই তো এবার তোদের …
অশোক সাঁতরা সবার পেছন থেকে সবার সামনে এসে, ডাঙায় উঠল একলাফে, তারপর বলল—মহাশয়রা যাচ্ছেন কোথায়? জয়দেব-পদ্মাবতীর কুটির না দেখেই চলে যাবেন?
ডান দিকে নদীর পাড়ে অর্ধেক বসে-যাওয়া একটা কুটির। রাংতা অবাক হয়ে বলল—এইখানে জয়দেব থাকতেন?
তীর্ণা বলল—এইখানেই সেই দেহি পদপল্লবমুদারম?
গোপাল বলল—গীতগোবিন্দের এই পার্টটা তোদের মেয়েদের বড্ড পছন্দ না রে? পায়ে ধরে সাধা, আহা, রা নাহি দেয় রাধা।
তীর্ণা বলল—তোর কাব্যবোধের একটা পরীক্ষা হয়ে গেল।
—অত সহজ নয়! দেহি পদপল্লবম-এর সঙ্গে তোমাদের আবিশ্ব ফেমিনিস্ট কমপ্লেক্স জুড়ে রয়েছে। বললেই তো হবে না! জয়দেব থেকে ফেভারিট লাইনস যাতে হিউমারও আছে, কবিত্বও আছে—এমন একটা বল দিকিনি!
—হিউমার আর কবিত্ব কক্ষনও একসঙ্গে যায় না।
গোপাল বলল—
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দর তিমিরমতি ঘোরম্।
স্ফুরদধরসীধবে তব বদনচন্দ্রমা
রোচয়তি লোচন চকোরম।
পুরো মানেটা না বুঝিস ‘দন্তরুচিকৌমুদী’টুকু অন্তত শরদিন্দুর কল্যাণে ফ্যামিলিয়ার নিশ্চয়ই!
তীর্ণা হঠাৎ রাগ না করে বলল—সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, না?
গোপালও তার তর্কের জাল অপ্রত্যাশিতভাবে গুটিয়ে ফেলে বলল—অদ্ভুত তো! আমারও। দাঁতের জ্যোৎস্না। তা আবার দূর করছে মুখগহ্বরের অন্ধকার! এবং তা আমার চকোরের মতো লোচনগুলির বড় ভালো লাগছে। জয়দেব রাধাকে ভেবে তো নয়ই, পদ্মাবতীকে দেখেও নয়, কাজলমাসিকে দেখেই লাইনগুলো লিখেছিলেন। আর তোরা যদি জানতিস ওই দন্তরুচিকৌমুদী দেখবার আশায় আমার লোচনচকোর কী পরিমাণ উদগ্রীব হয়ে তোদের বাড়ি যায়! কিন্তু হায় দেখতে পায় না! কথা বললেই একটু ঝিকিয়ে উঠবে, কিন্তু কথা বলবেন না, বলবেন না, গোপালের সঙ্গে কাজলমাসির আড়ি।
যশজিৎ বলে উঠল—তুই চানস দিস তো?
গোপাল একটু ভেবে নিয়ে গম্ভীর চালে বলে—ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট দেয়ার।
—এই ভাই অশোক না সাঁতরা, আমাদের আর একটু গাইডগিরি করো না ভাই!
—আমি অশোক এবং সাঁতরা দুইই। কেন দাদা, আগে দুটোর কম্বিনেশন কি দেখেননি? আর গাইডগিরি আর কি করবো? কাল মানে সময় এবং বোধহয় বাংলাদেশের আবহাওয়া আমার জন্যে কিছু রাখেনি। নদীর ধারে বাড়ি নিয়ে এক আমাদের পাঁচালির বিভূতিদাই আদিখ্যেতা করতে পারেন, বাস্তবে নদীর ধারে বাড়ি মানে এই। সামান্য যে অজয় আর অসামান্য যে পদ্মা উভয়েই একই প্রকার কীর্তিনাশা। এই ঘরের আদ্যোপান্ত দেখলে আপনাদের লক্ষ্মণ সেনের ওপর আরও রাগ ধরে যাবে। আর জয়দেবের কবি অ্যাসপেক্টের কথা যদি ধরেন, আপনারা যেটুকু জানেন আমি সেটুকুও জানি না। মোহমুদগরের সঙ্গে গীতগোবিন্দর শ্লোক বড্ড গুলিয়ে ফেলি। খালি আমার অল্পতর বয়সের একটা বিস্ময়ের কথা বলতে পারি মেয়েরা মাইন্ড না করলে …
—কেন, মেয়েদের মাইন্ড করার কী আছে?—যশ বলল।
গোপাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—অনেক কিছু আছে, মানে বাইরে বাইরে মাইন্ড করবার আর ভেতরে ভেতরে ডগোমগো হবার। তবে সাঁতরা কোথায় সাঁতরাবে তা বলতে পারছি না।
রাংতা খুব সপ্রতিভভাবে বলল—মাইন্ড করার কী আছে!
সাঁতরা বলল—আসলে ছোটবেলায় ভাবতুম শ্লোক মানেই নীতিকথা জাতীয় কিছু। শ্লোক মানে যে কবিতা, তা তো জানতাম না। যেমন সুক্তো শুধু তেতোই হয় জানতুম। সূক্ত আবার টক টক ঝাল ঝাল হয় এ আবিষ্কার করে তো আমি আবেগে প্রায় মারা পড়ি।
—হ্যাঁ আপনার আবেগটা বরাবরই একটু বেশি। —অনীক বলল। বিনীতভাবে সায় দিয়ে সাঁতরা হঠাৎ এক ঝটকায় মাথাটা অনীকের দিকে ফিরিয়ে বলল—আপনি কী করে জানলেন? আপনি কি আমার বাল্যবন্ধু, না এক গেলাসের ইয়ার?
অনীক বলল—সেই বাস থেকেই দেখতে দেখতে আসছি কি না! অদেখা রিপোর্টারদের উদ্দেশে আপনি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।
—আপনার জানা জয়দেবের লাইনটা কিন্তু শোনা হচ্ছে না—গোপাল খুবই উৎকণ্ঠিত।
অশোক সাঁতরা যথাসম্ভব জোর গলায় বলল—রচয়তি শয়নং সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।
যশজিৎ বলল—ধুস। এ শালাকে বায়রনের মেময়ার্সটা একবার পড়িয়ে দিলে হয়।
দলটি মেলার সঙ্গে সঙ্গে চলল। দুধারে পেঁয়াজি বেগুনির দোকানে দোকানে জটলা। দিন যে এবার মধ্যদিন হয়ে উঠছে প্রায়, সেদিকে গ্রামবাসীদের কারও খেয়াল নেই দেখা গেল।
অশোক সাঁতরা বলল—কাছাকাছি বহু গাঁ থেকে লোকে এই মেলায় কেনাকাটা করতে আসে। ঘর গেরস্থালির জিনিস, চাষের জিনিস। আর বাউল গানটা এরা সকলেই ঠিক গান হিসেবে শোনে না, বুঝলেন দাদা—একটা ধর্ম করছি ধর্ম করছি ভাব … কীর্তনের বেলা যেমন, শ্রীকৃষ্ণ অথবা গৌরাঙ্গের লীলার নাম করে বাঘা বাঘা প্রেমের গানও শুনে সব ধর্মের কান্না কাঁদে এ-ও কতকটা তাই। দাঁড়ান দাঁড়ান এইখানে একটা ফটো তুল নিই। অশোক সাঁতরা পাঁই পাঁই করে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে একেবারে এক্সপার্ট কায়দায় ব্যাগের ভেতর থেকে ক্যামেরা বার করলে। লেনসের ওপর কীসব ফিট-টিট করে নিল তারপর ঘুরে ঘুরে ফটো নিতে লাগল।
ক্যামেরা মুড়ে রেখে বলল—আপনাদেরও নিয়েছি।
—এক দফাতেই তো দশ বারোখানা নিয়ে নিলেন দাদা—ক’ রিল খরচ করবেন। ক্যামেরাটা তো দেখছি জব্বর!
—আরে, তা তো হবেই রিল যা খরচ হবে ওরা দেবে। আমি প্রেস ফটোগ্রাফার কি না! রিপোর্টারও বলতে পারেন।
রাংতা আর তীর্ণা প্রাণপণে হাসি চাপতে লাগল। এতক্ষণে তীর্ণার শাড়ি-টাড়ি শুকিয়ে গেছে। হাঁটতে আর অসুবিধে হচ্ছে না। শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে, খালি রোদ চড়া রয়েছে বলে তার ধার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গোপাল বলল—আগে একটা ঘর খুঁজি বুঝলি, মেয়েগুলো সঙ্গে রয়েছে।
৫
গঙ্গাপ্রসাদের মেজাজ খুব খারাপ। সাধারণত তিনি মেজাজ খারাপ করেন না। কিন্তু কিছুদিন ধরেই তাঁর মেজাজটা ভেতরে ভেতরে চড়ছে। যা প্রথমে হাসির বিষয় ছিল, তা ক্রমশ জটিল হয়ে ধোঁয়ার জট পাকিয়ে মনের আকাশ ছেয়ে ফেলছে।
কিছুদিন আগে টেস্ট গেল। গঙ্গাপ্রসাদ ইনভিজিলেশন দিচ্ছেন। তত্ত্বগতভাবে এই ডিউটিটিকে স্বীকার করেন না গঙ্গাপ্রসাদ। ইনভিজিলেশন আবার কী? তিনি প্রথমেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেন—আমি এখানে তোমাদের কাগজ-টাগজ সাপ্লাই করবার জন্যে বসে আছি। প্রশ্নপত্র সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। কিন্তু প্রশ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন নয়। বলে, তিনি পরীক্ষার্থীদের ভীতি উৎপাদন করবার জন্যেও বটে, নৈতিক সাহস জোগাবার জন্যেও বটে, আবার এগজাম্প্ল সেট করবার জন্যেও বটে—একটি অতিশয় মোটা বই খুলে দাগ দিয়ে দিয়ে পড়তে থাকেন। কিন্তু পড়তে কি ওরা দেবে? কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই একজন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকতে থাকে।
—কী ব্যাপার?
—সার অ্যাডমিট কার্ড আনতে ভুলে গেছি, কী হবে?
—টেস্টের আবার অ্যাডমিট কার্ড কী?
—ওই ফি-বইটা সার। বাড়ি খুব কাছে সার, ছুট্টে যাবো আর আসবো। যাবো?
—না-বলে বইয়ের পাতায় তিনি চোখ নামান।
ছেলেটি গুনগুন করে বলতে থাকে—আমি যে ডিফল্টার নই সেটা প্রমাণ করার একটা সুযোগ সার …
গঙ্গাপ্রসাদ আধখানা চোখে চেয়ে বললেন—কালকের পরীক্ষায় আনলেই হবে, আমি নোট করে রাখছি।
আবার তিনি পাতা উল্টোন। উল্টে দেখেন, বুঝতে পারছেন না। অর্থাৎ আগের পাতাটা পড়া হয়নি। এতক্ষণেও! ছিঃ! বিবেকানন্দ, আশুতোষের দেশের ছেলে তিনি! ছেলে আর নন, ভদ্রলোক। যাই হোক, তিনি নিজেকে ছেলে ভাবতেই অভ্যস্ত। রাস্তায়-ঘাটে কেউ যদি ‘অ মশায়’ বলে ডাকে, তিনি সাড়া দেন না। বাড়িতে কাজের লোক তাঁকে বাবু পর্যন্ত বললে কিছু অসুবিধে নেই। কিন্তু একজন বাবা ডাকাতে তার চাকরি গিয়েছিল। কাজল অনেক বোঝায়, কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ বোঝেন না, তিনি একমাত্র তাঁর নিজের ছেলেমেয়েরই বাবা, কিংবা বুড়ো-বুড়ি মানুষরা স্নেহার্থে তাঁকে বাবা ডাকতে পারেন, কিন্তু অন্য কারও বাবা হতে তিনি একেবারেই রাজি নয়। তাঁর মনোগত ইচ্ছে এরা তাকে দাদাবাবু ডাকে, যেমন বাবা-মা বেঁচে থাকতে ডেকে এসেছে। কাজল তাঁর এই মনোগত ইচ্ছে খুব ভালোই বোঝে, বলে, ঠিক আছে, এর পর থেকে ওরা তোমাকে খোকাবাবু ডাকবে। তাহলে খুশি হবে তো?
কাজল একটা কথা বুঝি-বুঝি করেও বোঝে না। এখন গঙ্গাপ্রসাদের বাবা-মা নেই। মাসি-মেসো, পিসি-পিসে, এঁরাও নেই। এখন গঙ্গাপ্রসাদ নিজেই বাবা, মেসো, পিসে। কিন্তু একজন বাবাকে ভীষণ দায়িত্ববান হতে হয়, এত গুরুদায়িত্ব দিবারাত্র কাঁধে বয়ে বেড়ানো, সে একরকম, কিন্তু অনবরত বাবা-বাবা ডাকে সবাই যদি তা মনে করিয়ে দিতে থাকে? নাই বা থাকলেন বাবা-মা, দাদাবাবু ডাকলে একটা স্বপ্ন-জগৎ সৃষ্ট হয় যেখানে মাথার ওপরে বাবা-মারা এমনকি ঠাকুর্দা-ঠাকুমারাও আছেন, দায়িত্বটা হালকা হয়ে যায়। এত কথা কাজল বোঝে না, খালি বলবে গঙ্গাপ্রসাদ খোকা সাজতে চান। অথচ সত্যি-সত্যি খোকা সাজতে চাইলে কি গঙ্গাপ্রসাদ গত দশ বছর ধরে এক কালো লাইব্রেরি-ফ্রেমের চশমা পরতেন? ঠাট্টা-ইয়ার্কি ফাজলামি বাদ দিয়ে অমন গুরু-গম্ভীর হয়ে থাকতেন?
যাই হোক, আরেকটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে।
—কী চাই?
—কাগজ স্যার?
—পনের মিনিট গেল না, এর মধ্যে কাগজ! —গঙ্গাপ্রসাদ হৃষ্ট হবেন না রুষ্ট হবেন, ভেবে পান না। কাগজ দিতে গিয়ে বললেন—দেখি, কেমন লিখেছ? তিন পাশে এক বিঘত করে মার্জিন রেখে ছেলেটি পরপর আট আনা সাইজের সিঙাড়া বসিয়ে গেছে। তার যে আরও আগে কাগজ প্রয়োজন হয়নি এটাই আশ্চর্য। কাগজের বর্তমান রিম প্রতি দাম এবং অপচয়ের বদভ্যাস সম্পর্কে একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসেছেন, এমন সময়ে দুটি ছেলে কথা বলছে লক্ষিত হয়। কয়েকবার সতর্ক করে দেবার পরও যখন তারা নিচু গলায় কথা বলেই যায় তিনি উঠতে বাধ্য হন।
—কী ব্যাপার!
—না স্যার, আসলে আমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছিল।
—তর্কের জন্যে বিতর্ক সভা আছে।
—তা তো ঠিকই সার … তবে এটা, এ ব্যাপারটা আর্জেন্ট কি না!
—কী রকম আর্জেন্ট শুনি?
—প্রশান্ত বলছে শেষের কবিতাটা একটা কবিতা। রবীন্দ্রনাথের শেষ, সর্বশেষ কবিতা।
—আর তুমি কী বলছো?
ছেলেটি হাসে—আমি সার ন্যাচারালি বলছি ওটা একটা প্রবন্ধ—ঠিক বলেছি না?
—ঠিক বলেছ এবং চমৎকার বলেছ, উভয়েই। গঙ্গাপ্রসাদ রেগে মেগে বলেন।
ছেলেটি বোদ্ধার মতো হেসে প্রশান্তর দিকে তাকায়—কী রে, কী বলেছিলুম!
পাশের বেঞ্চের আর একটি ছাত্র এতে সাহস পেয়ে বলে—একটা প্রশ্ন করবো সার?
—প্রশ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারো, বুঝতে না পারলে। তার বেশি কিছু নয়। গঙ্গাপ্রসাদের থমথমে গলা।
—না সার প্রশ্ন সম্পর্কেই, প্রশ্ন সম্পর্কেই।
গঙ্গাপ্রসাদ গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, আশপাশের ছেলেরা কলম হাতে উদগ্রীব, ছাত্রটি জিজ্ঞেস করল—সাহিত্যের ইতিহাসের প্রশ্নটা সার। স্বামী বিবেকানন্দর রচনা সম্পর্কে। উপন্যাস, কবিতা সব কিছুরই নাম করতে পেরেছি, খালি নাটকটা যদি সার বলে দিতেন, অন্তত পক্ষে একটা।
—কোনও নামই কি তোমার মাথায় আসছে না?
গঙ্গাপ্রসাদের মুখ দেখলে যে কোনও লোক ভয় পাবে, কিন্তু পরীক্ষার্থী ছেলেরা মরিয়া টাইপের হয়। সে ভয় পেল না, বলল—মনে এসেছে সার, কিন্তু শিওর হতে পারছি না, নীলদর্পণটা মাইকেল মধুসূদন দত্তর না নরেন্দ্রনাথ দত্ত মানে স্বামী বিবে…
গঙ্গাপ্রসাদ ছেলেটির খাতা কেড়ে নিলেন। পরক্ষণেই আবার ফেরত দিয়ে দিলেন। খাতা কেড়ে নেওয়ার কোনও বৈধ কারণ আপাতত নেই।
যাই হোক সেই থেকে তাঁর মেজাজটা খারাপ হচ্ছিল। আজ বঙ্কিমচন্দ্রের নামে শেষ বেঞ্চের কোন অজ্ঞাত ছাত্র সিটি দিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রে হিন্দি ফিলমি নৃত্য-গীতের মতো সিটিযোগ্য কোনও ব্যাপার আছে কি না তিনি স্টাফরুমে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাতে তাঁরই বিভাগের এক কলিগ বলেন—সিটি কলেজের ছেলেরা তো সিটি দেবেই।
—আ-আ আপনি … এর চেয়ে বেশি কথা স্বভাবতই গঙ্গাপ্রসাদ বলতে পারেননি।
তাতে আরেকজন কলিগ বলেন—এতে রাগ করবার কী আছে গঙ্গাপ্রসাদবাবু! সারা দেশটাকে যখন শুদ্ধু ফিল্ম স্টারের নাম ধাম দিয়ে মগজধোলাই হচ্ছে আর গুটিকতক ভাগ্যবান মিনিস্টার, মিনিস্টার অফ স্টেট, তখন আপনি কী করে আশা করেন ছেলেরা বঙ্কিমকে জানবে এবং মানবে! তার ওপরে আজকাল জোর প্রচার, বঙ্কিম কোনও কম্যুন্যাল রাজনৈতিক দলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্লাস থিংক-ট্যাঙ্ক।
আরেকজন কলিগ বললেন—আচ্ছা আপনি সঞ্জয় বলতে কী বোঝেন?
—ন্যাচার্যালি মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের সচিব সঞ্জয়, যিনি দিব্যদৃষ্টি পেয়ে পুরো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা …
—বাস বাস ঠিক আছে। আপনাকে পরীক্ষা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু আজকালকার জেনারেশন সঞ্জয় বলতে সঞ্জয় দত্তকে বোঝে।
—কে সঞ্জয় দত্ত?
—একটি লম্বা চুল ফিলম স্টার, টাডায় ধরা পড়ে যে আরও জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে, গঙ্গাপ্রসাদ অর্জুন বলতে তুমি কী বোঝ?
—স্বভাবতই তৃতীয় পাণ্ডব,
—আজকালকার ছেলেরা বোঝে অর্জুন সিং।
—আচ্ছা, আমীর খান বলতে তোমার কার কথা মনে আসে?
—আহা আমীর খাঁ, অসাধারণ গায়ক, সদারঙ্গে ওঁর মালকোষ আমি কখনো ভুলব না—গঙ্গাপ্রসাদ খানিকটা আবেগে খানিকটা উৎসাহে মুহুর্তকালের জন্য টগবগ করে উঠেছিলেন।
—আজ্ঞে না, আমীর খান আর একটি ফিলম স্টার যার হিট ছবির নাম কিউ.এস., কিউ.টি।
—কোনও ছবির নাম এরকম হয় না কি?
—হয়, হয় গঙ্গাপ্রসাদ, পপুলারিটির জোয়ার, নতুন যুগের নতুন ডায়ালেক্ট—সবই সম্ভব। ছবিটির নাম কেয়ামৎ সে কেয়ামৎ তক্। কিন্তু ভারতের আপামর জনসাধারণ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে, কেবল তুমি ছাড়া এই নামেই ছবিটাকে জানে। এখন ধরো ঢোঁড়াই চরিত মানসকে কেউ কখনও ঢো.চ.মা. বা ডি.এইচ.এম বানিয়েছে? কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথাকে পি.এন.ই.সি? এসব পপুলারিটিতে হয়। বুঝলে গঙ্গাপ্রসাদ? আমি প্রেডিক্ট করছি, আর গোটা পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের তেত্রিশ কোটিতে আরও দুটি দেবদেবী যোগ হবেন। বেশিও হতে পারেন। তবে দুটি হবেন। তাঁরা কারা জানো?
—বলল শুনছি—গঙ্গাপ্রসাদ অবশেষে টিফিন খাওয়া শুরু করেছেন লুচি আলুর দমে তাঁর গাল ফুলে উঠেছে—
কলিগ বললেন—মুম্বইতে দেব অমিতাভ বচ্চন আর তামিলনাড়তে দেবী জয়ললিতা।
গঙ্গাপ্রসাদ এইসা বিষম খেলেন যে টিফিন খাওয়া তো তাঁর মাথায় উঠলই, বেয়ারা রজনী দয়াপরবশ হয়ে তাঁর মাথায় ঘাড়ে জায়গা মতো থাবড়া-থুবড়ি দিয়ে না দিলে সহকর্মীরা তাঁকে চ্যাংদোলা করে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ অর্থাৎ স্বয়ং কালসদনে নিয়ে গিয়ে তাঁর দফা সেরে দিত।
গঙ্গাপ্রসাদ চশমা ছাড়া উশকো খুশকো চুলে, ভিজে জহর কোটের ওপর শাল চাপিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁকে দুরস্ত করবার জন্য রজনী জল থাবড়েছিল। সহকর্মীরা জোর করে চশমা খুলে শুইয়ে দেয়। মেয়েদের কলেজ তো আর নয় যে, বাড়ি ফেরবার সময় সব সাজিয়ে গুছিয়ে দেবে। জহরকোট ভিজে যাওয়ায় প্রবল শীত করছিল, তিনি শালটাকে ভাল্লুকের মতো জড়ালেন। চশমা স্টাফরুমের টেবিলে ফেলে কোনও বাসের নম্বর দেখতে পান না। চারদিকে হাতড়াচ্ছেন দেখে একটি ইয়াং ম্যান এগিয়ে এসে হাত ধরে বলল—অন্ধ মানুষকে কি কেউ একটু দয়াও করবে না? চলুন, চলুন দাদু, আমি আপনাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসছি।
রেগে মেগে গঙ্গাপ্রসাদ তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাকসি ধরলেন, ছেলেটিও উঠতে যাচ্ছিল, তাকে প্রায় ঠেলে ফেলে দিলেন। এবং জবুথবু অবস্থায় বাড়ি ফিরতে তাঁর চব্বিশ বছরের পরিণীতা স্ত্রী কাজলরেখা প্রথম প্রশ্ন করল।
—কী ব্যাপার? এরকম শালপ্রাংশু চশমখোর হয়ে কোথা থেকে ফিরলে?
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন—আমার চশমা?
—দ্বিতীয়টা এনে দিচ্ছি—বলে কাজল দ্রুত তাঁর চশমা নিয়ে ফিরে আসে। তিনি গর্জন করে বলেন—সঞ্জয় কে?
—হঠাৎ কুইজ আরম্ভ করলে যে!
—বলোই না।
—দত্ত না কাপুর?
—অর্জুন কে? দ্বিগুণ গর্জন করলেন গঙ্গাপ্রসাদ
অরুণ না অর্জুন? অর্জুন সিং-এর কথা বলছো? অরুণ নেহরু তো সেই কবেই ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে গেছে। পলিটিকস আমার গুলে খাওয়া।
—আর আমীর খান?—ত্রিগুণ গর্জন।
উত্তর এলো কিউ.এস.কিউ.টি-র হিরো। গানগুলো দারুণ।
—কী? পাশ করেছি? কাজলের সহাস্য জিজ্ঞাসা।
তুত তুত্ তুমি…একটা অনার্স গ্র্যাগ্ গ্র্যাজুয়েট? এ ছাড়া গঙ্গাপ্রসাদ আর কিছুই বলতে পারলেন না।
৬
রাংতা বলল—বড্ড বিড়ির গন্ধ, যাই বল তীর্ণা।
—আমি শুধু শুধু কিছু বলতে যাবো কেন?
শালগাছের তলায় ছেড়া চটের শামিয়ানা দিয়ে একটা আসর। যথেষ্ট লোক জমায়েত হয়েছে। এইখানে ওদের বসিয়ে দিয়েছে ছেলেগুলো। অশোক সাঁতরা বলল—বেস্ট, অবশ্য বেস্ট বলে এখানে কিছু নেই। একেক জায়গায় একেক রকম রস পাবেন। স্টিল্ল্—আপনারা যখন প্রথম, তখন বিশুদ্ধ বাউলাঙ্গ গানের জন্য এখানেই অপেক্ষা করা ভালো। ঠেলেঠুলে সামনে এগিয়ে যান, আরও সামনে। তা ঠেলতে ঠেলতে দ্বিতীয় সারিতে এসে বসেছে দুই মেয়ে। আজ শাড়ি পড়লে কোনও অসুবিধে ছিল না, কিন্তু তীর্ণার ইতিমধ্যেই শাড়ির ওপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে। সে রাংতা দুজনেই দুটো রঙচঙে সালোয়ার কামিজ পরেছে। সস্তা দামে এ.সি. মার্কেট থেকে কিনেছিল রাংতা, তীর্ণা বোধহয় নর্থের কোনও দোকান থেকে করিয়েছিল। যাই হোক এই রঙচঙে ঢোলা সালোয়ার কুতা পরে ওদের আরও বাচ্চা লাগছে। রাংতার চুল তো একেবারে বয়ছাঁট। আর তীর্ণার হল, ওই মা যাকে বলে আলুথালু, অর্থাৎ স্টেপকাট। এখন রাংতার সঙ্গে তীর্ণার বেশ ভাব হয়ে গেছে। রাংতাকে এ দলে জুটিয়েছে গোপাল। না কি ওর প্রতিবেশী। কিন্তু গোপাল যে পাড়ায় থাকে, সেখান থেকে ঠিক রাংতার মতো মেয়ে বেরোয় না বলে তীর্ণার ধারণা। তার ওপর সে নাকি ছুটি-ছাটায় সিঙ্গাপুর-হংকং-এ মার্কেটিং করতে যায়। এই ধরনের মেয়েরা একটু উন্নাসিক, একটু চালবাজ, কিংবা ন্যাকা হয়ে থাকে বলে তীর্ণার ধারণা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাংতা এর কোনওটাই নয়। সে একবারও সিঙ্গাপুর-হংকং-এর উল্লেখ করল না। নিজের বাবা-মা, গাড়ি, লোকজন এসবের সম্পর্কেও কোনও আলোচনায় সে যেতে চায় না। এই আসরে ঢুকেই সে রোমাঞ্চিত কণ্ঠে তীর্ণাকে বলেছিল—এখন কটা বাজে জানিস?
—কটা?
—মিড নাইট।
—তাইই—তীর্ণার চোখ গোল। মনেই হচ্ছে না, এত বেজে গেছে।
—আসরটা একেবারে টিপিক্যাল, বল?
—কিসের টিপিক্যাল?
—মানে এক্কেবারে জেনুইন, এথনিক, ঠিক যেন মনে হচ্ছে ভারতবর্ষের, না, না বাংলার বুকের মধ্যে এসে বসেছি।
—তা তাই-ই তো বসেছিস!— তীর্ণা বলল।
আসরের ওদিকে একটি আধা মোটাসোটা স্ত্রীলোক চা তৈরী করছিল। সি.টি.সি পাতার বিশ্রী গন্ধ-অলা চা।
আর, একটি পুরুষ, গায়ে সামান্য একটা ফতুয়া এবং নস্যি রঙের চাদর, সে হাঁটুর ওপর হাঁটু চাপিয়ে বসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিল।
—কে যেন বলল—ওই তো অনুকূল দাস।
তীর্ণারা শুনেছিল অনুকূল দাস খুব বড় বাউল। এই লোকটির গালে একদিনের খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় অনেক চুল। মুখটা ভাঙাচোরা, বিড়িখোর বিড়িখোর গড়ন। সে বলল—বাব্বা এ-ই গাইবে না কি?
পেছন থেকে কে মৃদুস্বরে বলল—‘শুধু গাইবে নয়, নাচবেও’—ওরা মুখ ফিরিয়ে দেখল অশোক সাঁতরা।
স্ত্রীলোকটি এই সময়ে তার নিজের লোকেদের মধ্যে চা বণ্টন করতে করতে আসরের উদ্দেশে হাঁক পেড়ে বলল—আপনারা কেউ চা-সেবা করবেন নাকি গ?
তার কস্তাপেড়ে শাড়ির ঘোমটা এখন খুলে গেছে। মুখটি বেশ গোলগাল। গোলা সিঁদুরের টিপ পরেছিল বোধহয়, সেটা বেশ ধেবড়েছে। হাতে মাঝারি সাইজের কেটলি, তার তলাটা হনুমানের মুখের মতন। আসরের লোকেরা গান শুনতে এসেছে, চা খেতে আসেনি। তাছাড়া ওই মাঝারি কেটলি থেকে যে বাউলনী ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া জাতীয় কোনও ম্যাজিক দেখাবে, তা-ও সম্ভব না। তবু কয়েকজন চেয়ে চেয়ে খেল।
সাঁতরা বলল—একেই বলে টসটসে ঢলঢলে চেহারা। অনুকূল দাস একে দেখছি এ বছরই জোগাড় করেছে।
রাংতা বলে উঠল—অশ্লীল কথা বলতে হলে আমাদের কাছ থেকে উঠে যান। —তার স্বর বেশ কঠোর।
—যা ব্বাবা অশ্লীল কথা আবার কোথায় বললুম! তখন জয়দেব কোট করলুম আপত্তি করলেন না আর…
—সেটা ছিল সংস্কৃত, সবটা বোঝা যায় না, আর এখন যা বলছেন, তা হল কাঁচা বাংলা।
রাংতার স্মার্টনেস এবং শব্দসম্পদে তীর্ণা রীতিমতো অবাক হয়ে যায়।
—আচ্ছা ‘বাংলার বধূ বুকভরা মধু’ বললে আপনাদের অশ্লীল লাগে না?
—না—রাংতা জোর গলায় বললে।
—সুখে ঢলোঢলো, উদাস বিভল—বললে?
—না—
—এগুলো পাকা বাংলা, না?
—আচ্ছা, তু চীজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত বললে?
ভীষণ রেগে তীর্ণা বলল—আপনি চুপ করবেন?
এই সময়ে অনুকূল দাসের চা-পান এবং বিড়ি-পান শেষ হয়েছে মনে হল, সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার গাবগুবাব না কী যেন যন্ত্রটা তুলে নিল, তার পর বাজনা বাজাতে বাজাতে নিচু হয়ে একপাক ঘুরে নিয়ে, ঊর্ধ্বমুখ করে তার দীর্ঘ চুলে একটা মোক্ষম ঝাঁকানি দিয়ে ও-ও-ও বলে ক্রম ঊর্ধ্বায়মান একটি পূর্ণদাসী সুর ছাড়ল। একটু পরে প্রায় দু সপ্তক নিচে নেমে ধরল—
পড়েছি বড়ই মুশকিলে—এ—এ
চড়ার দাম আর দামের চড়া, খাচ্ছে তিমি তিমিঙ্গিলে-এ
পড়েছি ভাই,
পড়েছি ভাই বড্ড মুশকিলে।
মুশকিলে পড়ে বাউল ঘুরতে থাকে। ইতিমধ্যে টসটসে চেহারার বাউলনী গাছকোমর বেঁধে নিয়েছে। সামনে পেছনে কয়েকবার ছন্দে পা ফেলে সে বোধহয় তাল মিলিয়ে নিল তারপর অপ্রত্যাশিত রকম চড়া এবং জোরালো প্রায় বাজখাঁই গলায় ধরল :
আসমান জমিন জমিন আসমান
কে করবিরে মুশকিল আসান
(বলে) ফাটকা খেলে আটকা করো চড়া দামের উকিলে
(পড়েছি) বড়ই মুশকিলে।
তীর্ণা অবাক হয়ে গেল। মেয়েটিকে একেবারে সাধারণ গ্রামবধূ বলে মনে হয়, তার গলায় ওই রকম শাঁখের মতো আওয়াজ আর এতটুকুও আত্মসচেতনতাহীন ঘোরাফেরা। অদ্ভুত গান, ঈষৎ ভারী শরীরে নাচ … লোকটিই বা কী! রাস্তার ধারে ইট পেতে বসা নাপিতের মতো দেখতে। যখন নাচছে! তীর্ণা সত্যিই ভুলে গিয়েছিল, সে গঙ্গাপ্রসাদ-কাজলরেখার মেয়ে, অনীক মিত্তিরের বোন তীর্ণা মিত্তির। এবং সে একটি অজ পাড়াগাঁয়ের বিড়ির গন্ধ-অলা গানের আসরে গন্ধগোকুল সব গ্রামবাসীদের সঙ্গে একটি দুদিনের চেনা মেয়ের সঙ্গে বসে আছে, যাকে সে এক দিন আগেও পছন্দ করতে পারছিল না, এবং পেছনে অশ্লীল কথার ঝুড়ি নিয়ে হুমো দিয়ে আছে অশোক সাঁতরা নামে রিপোর্টার না ফটোগ্রাফার!
শেষ রাতে বাউল-বাউলনী আর একবার চা-বিরতি দিলে ওদের খেয়াল হল, সম্ভবত শখানেক অচেনা গ্রামজনের মধ্যে ওরা মাত্রই দুটি মেয়ে বসে আছে। ওদের দলের অন্যরা, অর্থাৎ যশ, গোপাল বা অনীক তো নেই-ই, অশোক সাঁতরা কখন কেটে পড়েছে!
রাংতা বলল—এই তীর্ণা কটা বাজে জানিস?
—জানি। সাড়ে তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট।
—তোর কাছে টর্চ আছে?
—আছে।
—আমার কিন্তু ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এই আসরে ঘুমিয়ে পড়লে সেটা কীরকম হবে বল তো! বিশ্রী না?
—খুব অকোয়ার্ড। বিশেষ করে আমার পক্ষে।
—চল, আমরা ঘরে যাই।
—কিন্তু চিনে যেতে পারবো?
—সেই জন্যেই তো টর্চের কথা জিজ্ঞেস করছি।
—টর্চের আলোয় পথ দেখতে পেতে পারি, কিন্তু ঘরটা চেনা…
—আমি খড়ির দাগ দিয়ে রেখেছি, চল।
—খড়ির দাগ? আলিবাবার গল্প না কি রে? তীর্ণা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল। তার পায়ে অসম্ভব ঝিঁঝি ধরেছে, রাংতা না ধরলে সে পড়ে যেত।
কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল রাংতার খড়ির দাগ বিশেষ কাজে লাগছে না। গল্পটা সত্যিই আলিবাবার গল্প। প্রথম যে ঘরটাতে ওরা খড়ির দাগ দেখে ধাক্কা দিল তার ভেতর থেকে নেশাজড়িত কণ্ঠে ভেসে এলো— কে বাবা, এতো রাত্তিরে গুঁতোগুঁতি করছো! সবকটি গো-জাতীয়ই তো গোষ্ঠে ঢুকেছে, তবে তুমি কি ভিন গোয়ালের গরু?
রাংতা সভয়ে বলল—এটা আমাদের নয়, আমাদের নয়।
ওরা ভালো ঘর পায়নি। পেয়েছিল একটি মাটির ঘর। ওপরে খড়ের চাল, এবং মেঝেতে কিছু খড় বিছোনো, খড়ের ভেতরে বিছে থাকতে পারে এই ভয়ে তীর্ণা এমন কাতর হয় যে, ঘর ভাড়া দেনেঅলা মালিক খড়গুলো তুলে নেয়। বলে ‘মাঝরাতে ট্যার পাবেন।’ ঘরটা এতই ছোট যে পাশাপাশি আটিশুঁটি করে শুলেও পাঁচজনের জায়গা হওয়া সম্ভব নয়। এ কথা জানাতে ঘর ভাড়া দেনেঅলা বলে—‘মেয়েগুলা কলে নিয়ে শুবেন!’
এই অশ্লীল কথার পর তারা আর কথা বাড়ায়নি। যশ বলে, তারা তো আর ঘুমোতে মেলায় আসেনি। মেয়েরা প্রয়োজন হলে ঘরটাকে ঘুমোবার জন্যে ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া ঘরটা আসলে হবে ওদের ক্লোকরুম। আরও কিছুক্ষণ অন্ধের মতো ঘোরবার পর ওরা ঘর খুঁজে পেল। তালা দেওয়া। চাবি খুলে দেখল ভেতরে কাপড়ের ব্যাগগুলো ডাঁই করা আছে। গোপালের ব্যাগ থেকে একটা গরম চাদর বেরোল, যশের ব্যাগ থেকে সার্জের না কিসের সাফারি সুট। এইগুলো পেতে ধড়াচুড়ো সমেত অর্থাৎ কার্ডিগ্যান ও শাল সমেত শুয়ে শুয়ে ওরা হিহি করে কাঁপতে লাগল।
তীর্ণা বলল—কলে কলে শোয়ার কথা লোকটা কেন বলেছিল এখন বুঝতে পারছি। হি হি হি বুবুবু।
রাংতা বলল—তুততুই না হয় তোর দাদ্দার কোলে শুতিস? আমি! আআমি তো কোককোনো দাদ্দা আনিনি।
তীর্ণা বলল—কেন ত্তোর গো গ গোপাল
—গোগগোপাল কোনও জন্মেও আম্মার নয়।
তীর্ণা বলল—তা যদি বলিস দাদ্দার কলে শোওয়াটাও যথথেষ্ট অশ্লীল।
রাংতা বলল—আমরা কি পার্মানেন্টলি তোত্ তোত্ তোত্
—উঁহু শীতের জজন্যে, কাল রোদ উঠলে দেখা য্ যাবে।
যশ আর গোপাল ঘুরছিল এক দিকে। অনীক জি.জির সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল। চারজনে প্রথমে এক দিকেই যায়। ভীষণ শীতের রাত জাগতে হলে সবাই যেদিকে যায়। …জি.জি… একবার সাবধান করল—এখানে ওসব মাতলামো চলে না কিন্তু। ভীষণ মুশকিলে পড়ে যাবেন।
—আরে না না, স্রেফ শরীর গরম করা আবার কী? আমাদের বলে কত কাজ! যশ গোপালের দিকে আড়চোখে চাইল।
মেলার চত্বর থেকে একটু দূরে ওরা বসেছিল, বড় বড় হাঁড়িতে মহুয়া। অল্প খেল তিনজনে। জি.জি একটুও না। আবার মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে এলাচও দিল। অনীক দু দিকে দু হাত ছুঁড়ে বললে—অ্যাই এখন আমরা সব্বাই কবি শক্তি চাটুজ্জে।
গোপাল বলল—তাই নাকি? তবে দু লাইন পদ্য বলো তো চাঁদু …
অনীক উঁচুর দিকে মুখ করে বলল—যদি তারা টেঁশে যায় করাল কালের স্রোতে ধরা পড়ে গিয়ে
অ্যাই অ্যাই— জীবনানন্দ জীবনানন্দ গন্ধ ছাড়ছে…গোপাল আপত্তি করে উঠল।
তখন অনীক ঘুরে ঘুরে বাউলের ভঙ্গির নকল করে বলতে লাগল
‘সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
ধরে বেঁধে নিতেও পারো তবু সে মন ঘরে যাবে না।’
—এই অনীক মারবো এক চড় এটা তো শক্তি চাটুজ্জেরই কবিতা!
তখন অনীক হঠাৎ আশিরনখ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল—গোপলা তুই বাংলা কবিতাও পড়িস? পড়িস তা হলে?
গোপাল বলল—তোর বাবা বাংলার মাস্টার বলে বাংলা কবিতা কি তোদের মৌরুসীপাট্টা নাকি রে? বল বল নিজের দু লাইন বল, নইলে হয়ে যাবে এক হাত।
অনীক বলল—
এই শালাদের ভিড়ভাট্টায় বহুৎ ঘুরেছি
ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না ছিঃ।
নেমকহারাম ইয়ার বক্সি জানিস কোথায় কী?
এডিথ কোথায়? এডিথ কোথায়? এডিথ কোথায়? …
বাকি তিনজনেই চমকে উঠল। যশ তাড়াতাড়ি বলল—অনীক হাই হয়ে গেছে, চলো কেটে পড়ি।
এরপর ঘুরতে ঘুরতে ওরা একটা আসরে বসে। অনীক হাই হয়ে না গেলেও, তার মহুয়া-টহুয়া খাওয়ার অভ্যাস একেবারেই নেই, সে একটু বেসামাল হয়েছিল। জি.জি ওকে একলা ছাড়তে পারছিল না। আসরে বসেই অনীক ঘুমিয়ে পড়ল।
যশ আসর থেকে বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল—তুই অনীককে বলে দিয়েছিস?
—অন গড, নো।
—তা হলে ও কী করে?
—কোনও সময়ে আমাদের আলোচনা শুনে ফেলেছে হয়ত। আর অত ঢাকঢাক গুড়গুড়ই বা কিসের? হেল্প চাই বলেই তো ওকে আনা।
—না, তা নয়। কিন্তু ওই চার্জটা রয়েছে বলেই আরও ভাবনা! আচ্ছা গোপাল আমরা এডিথ শুনে দারুণ চমকে ছিলুম তো ঠিক আছে। লেকিন ওই জি. জি. ডিসটিংটলি চমকালো। কেন?
—কবিতা শুনে বোধ হয়।
—নট ইমপসিব্ল, বাট ইমপ্রব্যাব্ব্ল। কেমন একটা ফিলিং হচ্ছে আমার। আনক্যানি।
—সমস্ত ব্যাপারটাই তো আনক্যানি।
৭
সারা পৌষ মাস ধরেই কাজলরেখার মাসি-দিদিমার বাড়িতে পিঠে হয়। হরেক রকম পিঠে—এ বাংলার, ও বাংলার।
সেসব অন্য কোথাও, অন্য কোনও বাড়িতে কেউ খেতে পাবে না। এই পিঠেপুলির ঐতিহ্য জিইয়ে রেখেছেন অবশ্যই মাসি-দিদিমা, যাঁকে কাজল দিদিমাসি বলে ডাকে। কাজলের বাপের বাড়ি বলতে এখন প্রায় এই দিদিমাসির বাড়িই। নিজের বাপের বাড়ি শূন্য ঢনটন করছে।
সকালের রান্না-বান্না সারতে না-সারতেই ফোন পেল কাজল। ফোনের ওধারে দিদিমাসির গলা, কি রে কাজলা মনে করেছিস কী?
—কী আবার মনে করবো?
—কী মনে করবি? মনে করবি দিদিমাসি টেঁসেছে। আর কী!
—বালাই ষাট।
—তবে আসছিস না কেন? খবর্দার গঙ্গার দোষ দিবি না, গঙ্গা আমার কোনদিনই বউয়ের আঁচল-ধরা নয়।
—তবে কার আঁচল ধরা?
—কারো আঁচল যদি ধরতেই হয়, তবে দিদিমাবুড়ির, আর কার? শোন, আজই একবার আসবি।
দিদিমাসির একবার আসবি বলা মানে জোর তলব, খুবই দরকার পড়েছে। কাজল গঙ্গাপ্রসাদকে সেদিন তাড়াতাড়ি খাইয়ে বাড়ির বার করে দিল।
গঙ্গাপ্রসাদ দু-একবার প্রতিবাদ করবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন—এক্ষুনি খাবো কী? আমার দুটোয় ক্লাস।
—একেক দিন একেক রকম সময়ে খেলে শরীর খারাপ হয়।
—কই এতদিন তো …
—বাজে তর্ক করতে তোমার জুড়ি নেই। খাও দাও, বেরিয়ে পড়ো, পুরুষ
মানুষের আবার অত ঘরে বসে থাকা কী, জুটেছেও তেমনি চাকরি! সবার বর দেখো হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, আমারটি দুপহর বেলা পর্যন্ত বিছানায় লুটোচ্ছেন।
গঙ্গাপ্রসাদ সম্প্রতি একটি বাংলা বিশ্বকোষের কিছু কাজ পেয়েছেন। অত্যন্ত মন দিয়ে সেই কাজই করছিলেন। টেবিল বই-কণ্টকিত, তিনি তাঁর বিছানার ধারে চেয়ারটা টেনে এনেছেন, শয্যাটাকেই আপাতত টেবিল হিসেবে ব্যবহার করছেন। মোটা মোটা অভিধান, নোট নেওয়া সব ডায়েরি, কালো এবং ‘সবুজ’ চারপাশে ছড়ানো। এই হচ্ছে তাঁর বিছানায় লুটোনো। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন—তোমার কি কোথাও যাবার আছে?
—হ্যাঁ, গোয়াবাগান
—ঠিক আছে। খেয়ে নিচ্ছি, কিন্তু এখন বেরোতে পারবো না।
—দরজায় খিল দিতে মনে থাকবে?
—থাকবে?
—বেল বাজলে খুলে দিতে?
—হ্যাঁ।
—তিন সত্যি করো।
—দিব্যি গালাটালা আমার দ্বারা হবে না।
—তাঁহলে বেঁরোও না বাঁবা—এবার কাজল মোক্ষম অস্ত্র ছাড়ল। কাকুতিমিনতি করতে লাগল গঙ্গাপ্রসাদকে বেরোবার জন্যে।
বেগতিক দেখে, আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গঙ্গাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন, তখন সাড়ে দশটাও বাজেনি। দুজনে একইসঙ্গে বেরোলেন এবং তাকে গোয়াবাগান পৌছে দিতে হবে কাজলের এই বায়না তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন।
—কেন তুমি কি একা-একা কোথাও যাও না?
—যাই তো! কিন্তু দিদিমাসির বাড়িতে তুমি না গেলে…
—আমি না গেলে কী!
—যে কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি তুমি সঙ্গে না গেলে—
—না গেলে কী-ই?
—কেমন বিধবা-বিধবা লাগে।
এর পর গঙ্গাপ্রসাদ আর এক মিনিটও দাঁড়াননি।
শ্যামবাজারে যেদিন পিঠে হয় সেদিন অন্য কিছু হয় না। সংক্রান্তির এখন দেরি আছে। কিন্তু তার আগেই দু-তিন দিন পিঠে উৎসব হয়ে যায় একে দিদিমাসি বলেন মহড়া।
কাজল ঘরে ঢুকতে দেখল উঁচু পালঙ্কের ওপর দিদিমাসি বসে আছেন, সামনেই একটা জলচৌকিতে কী সব আয়োজন! দিদিমাসি পাঁচালি পড়ছেন:
যমজ ভগিনী ছিল সুশীলা সরলা।
গুণে সরস্বতী আহা রূপেতে কমলা॥
সুশী সরি নাম দেন দাদামহাশয়।
শীলাসলা দাস-দাসী-পড়োশিতে কয়॥
সুশীতলা সরোবালা বলে ঠাকুমাতা।
জলের প্রপার্টি কন্যা পাবে এই কথা
ঠার্কুদাদা গর্বভরে রটান চৌদিকে।
অন্য সব কন্যাদের যশ হল ফিকে॥
বয়স বাড়িলে দুয়ে ডফ স্কুলে যায়।
যতেক স্কটিশ মিস গুণগান গায়॥
অল্প দিনে রপ্ত হল পিয়ারিমোহন।
ঐক্য বাক্য মাণিক্যেও করিল যতন॥
বাইবিল পাঠ ক’রে খৃষ্টতত্ত্ব আহা।
বুঝায় ভগিনীদ্বয় লোকে বলে বাহা॥
কংগ্রেস ভজেন পিতা গণয়ে প্রমাদ।
গৌরীদানে প্রথমেতে মনে নাহি সাধ॥
ঈশ্বরচন্দ্র, রাজারাম, মহর্ষির নাম।
না লইয়া কভু না করেন জলপান॥
সাধ ছিল কন্যা দিগে করেন যোড়শী।
কমলা ও বাগ্দেবী উভয়েরে তোষি॥
কিন্তু একে মেমমিসে বাইবিল গায়।
তাহে পিছে ফুলবাবু ফিটনেতে ধায়॥
সুশীলা দুর্বলা বড় নারিলেন তাই।
প্রাণ ধরে দিতে তারে বড় ঘরে ঠাঁই॥
অধ্যাপক বেহাইয়ের একটি সন্তান।
কালীঘাট ভদ্রাসন সুশী সেথা যান॥
সরলার জন্য পিতা খুঁজেন ভূস্বামী।
বৃহৎ সংসার, সরি হবে রাজরাণী॥
অ্যানাবেল মেমসাব পিতারে ডাকেন।
এমন মেধাবী কন্যা বাল্য বিয়ে দ্যান?
বয়স এগার মোটে জানে না কিছুটি।
সংসার জটিল অতি, এরচে’য়ে বিছুটি
হাতেপায়ে ঘষে কন্যা জলে ফেলে দ্যান।
কিম্বা এই কন্যারত্ন আমাদেরে দ্যান॥
পাঠাবো এডিনবরা হইবে ডাক্তার।
কিম্বা লন্ডন যাবে হবে ব্যারিস্টার॥
শুনিয়া রায়ান কহে শুনো হে ম্যাডাম।
ভূস্বামীতনয় পুত্র অতি রূপবান॥
স্বর্ণময় শস্যক্ষেত্র স্বর্ণময় গোলা।
সরির শ্বশুরঘরে বড় বোলবোলা॥
দিঘিতে থই থই মৎস্য গোহালের দীপ।
শতেক গাভীর চক্ষে ঝলসায় টিপ॥
পরিবার পরিজন বহু আছে ম্যা’ম।
লন্ডনেতে যেমতি আপনকার বাকিংহ্যাম॥
হবে ব্যারিস্টার সরি, লন্ডনেতে নয়।
ভেনু হবে জিলা মৈমনসিঙেতে নিশ্চয়॥
এত বলি রায় অট্টহাসে মহাসুখে।
অ্যানাবেল মিসিবাবা ফেরে ম্লানমুখে॥
শুনো শুনো সুশীসরি জীবন-আখ্যান।
বসুজায়া কহে, শুনে শ্রোতা মুহ্যমান॥
দিদিমাসি পাঁচালি বন্ধ করলেন। সামনে কী সব মাটির ঢিপি চাপা ছিল তাতে কিছু ফুলতুলসী দিলেন। চোখ বুজে দু মিনিট চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—বল্।
—বল্ মানে? এসব কী? তোমার সামনে ও চৌকিতে কিসের মূর্তি?
—মূর্তি কেন হবে?
—আচ্ছা বাবা দেব দেবী।
—দেবদেবীও নয়।
—তবে?
—ওই যে পাঁচালি শুনলি, ওই ঢিপি দুটো হচ্ছে সুশী-সরি।
—বাবা বা, নিজেকেই নিজে ফুল-তুলসী-গঙ্গাজল দিচ্ছো?
—অনেক সময়ে নিজের ছেরাদ্দটাও নিজে করতে হয়, তা জানিস? অনেক দিন ধরে সুশী-সরির পাঁচালি লিখছিলুম। শেষ হয়েছে, তাই সারা মাস ধরে পড়ব, আর ফুল-তুলসী দোব। তুই কিছু করতে পারবি?
—যত্ত সব অলুক্ষুণে কাণ্ড।
দিদিমাসি চিন্তিত মুখে বললেন—সুশীর ধারা পেয়েছিস।
—কী রকম?
—সুশীটা বড্ড ভিতু ছিল। বাবা যখন বিয়ের ঠিক করছিল, বলেছিলুম চল—মিস অ্যানাবেলের কাছে পালিয়ে যাই। ব্যারিস্টার হবো, ডাক্তার হবো …। তা বললে অলুক্ষুণে কথা বলিসনি। যেমন ভয়, তেমন কুসংস্কার। তা সেই ভূতগুলো বা বলতে পারিস জিনগুলো তোর মধ্যে একটু একটু ঢুকেছে। তা মাঝখান থেকে প্রথম সন্তান বিইয়েই সে মরে গেল। অত ভয়, ভক্তি, ছেদ্দা কোনও কাজে এলো না। অথচ আমি দেখ—তেরটা বিইয়েছি। তার মধ্যে তিনটে অসময়ে মরেছে। নিজে নব্বুইয়ে ঘা দিতে চললুম। দিব্যি আছি। থাকলেও দিব্যি, না থাকলেও দিব্যি। যা, এখন খেয়ে আয়।
—খেয়ে আয় মানে? আমি এখানে তোমার সামনে বসে খাবো। কী কী হয়েছে গো আজ?
—পাটিসাপটা, পাটিজরা, রসবড়া, মুগসামলি, কলার বড়া দিয়ে নতুন গুড়ের পায়েস, নারকোল-চিঁড়ে।
—মুখ যে বড্ড মিষ্টিয়ে যাবে গো!
—মটরশুটির কচুরি আর আলুর দম তবে হল কী জন্যে?
—তুমি কোনটা করেছ দিদিমাসি?
—সে তোকে খেয়ে বলতে হবে।
কাজলকে আর উঠতে হল না, তার এক মামিমাই এই সময়ে বড় কাচের প্লেটের ওপর কলাপাতা পেতে হরেকরকম সাজিয়ে এনে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে একটা কাচের বাটিতে বাদামি রঙের পায়েস।
কাজল খাচ্ছে আর জিভে তারিফের টক্টক্ শব্দ করছে। দিদিমাসি বললেন—তুই কি ঘড়ি হয়ে গেলি নাকি রে কাজলি?
—না গো, সবগুলোই তোমার তৈরি বলে মনে হচ্ছে যে।
দিদিমাসি হাসতে লাগলেন রহস্যময়ভাবে—এক মায়ের দশটি সন্তান, তারা সবাই মায়ের কিছু কিছু হয়ত পেয়েছে। কিন্তু একজন পেয়েছে এমন নির্ভুলভাবে যে তাকে মায়ের সন্তান বলে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারা যায়। কেমন, কি না? তোর মামিরা তো শিখেচে সবই আমার কাছে। প্রত্যেক বছর তার পরীক্ষাও হয়ে থাকে। কাজেই …
—রসবড়া—হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠ্ল কাজল। —ঠিক বলেছি?
—একেবারে ঠিক। সারা বঙ্গদেশে এরকম রসবড়া যদি আর কেউ তোয়ের করতে পারে তাহলে জানবি সে এই বংশের না হয়েই যায় না।
খেয়েদেয়ে মুখ ধুয়ে এসে, এক কাঁসার ঘটির জল খেয়ে কাজল বলল—যাঃ পেটটা ফুলে গেল যে গো!
দিদিমাসি একটা কৌটো থেকে কী এক মুখশুদ্ধি বার করে তাকে দিলেন—খা। গিলে ফেলবি না, আস্তে আস্তে তারিয়ে তারিয়ে খা। পেট নেমে যাবে। এ তো আর সে পেটফোলা নয়?
—সে পেট ফোলা কী গো?
—কেন আমাদের? তেরো-চোদ্দ বছর থেকে আরম্ভ হত আর কারও চল্লিশ, কারও বেয়াল্লিশ তবে নিষ্কৃতি।
—উঃ, তুমি বড্ড অসভ্য দিদিমাসি।
—অসভ্য! না? তোমার হলে তুমি বুঝতে।
বারো মাস বমি হচ্ছে হুড়হুড় করে, মাথা ঘুরচে, বুক ধড়ফড় কচ্চে। চাদ্দিকে বেশির ভাগ খাবার-দাবারেই নরকের সোয়াদ-গন্ধ জানিস না? আমি তো তেরো বছর থেকে বিয়োতে শুরু করলুম, দু বছর অন্তর অন্তর। তেরোটা বিইয়ে তার পর বেওয়া হলুম। শান্তি!
—শান্তি কী গো? কী বলছো দিদিমাসি!
—আরে বাছা ঘাটের দিকে পা আর কি মিছে কথা বললে সাজে? বাবা তো রূপবান ভূস্বামী তনয় দেখে রাজরানি করে দিলেন। তা সে তনয় তো ছিল কম্মের ঢিপি, বিরাট জমিদারি, নায়েব, গোমস্তা, খাজাঞ্চি, বাজার সরকার আর দোর্দণ্ড প্রতাপ তার বাপ রয়েছেন, সে তো খালি কোঁচা দুলিয়ে ঘুরে বেড়াত আর আমার ওপর তম্বি করত। আধপাগলা গোছের। তোর মামাদের কটাকে দেকিস না? সব ওই ধারা পেয়েছে। যেটা পালালো, সেটাও তো ওই ধারা।
—আচ্ছা, দিদিমাসি, এই যে সব দোষ দাদুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছো …
—কিসের দোষ?
আমতা আমতা করে কাজল বলল—এই তেরোটা সন্তান হেন-তেন।
শুনে দিদিমাসি অনেকক্ষণ কিছুটা কৌতুক—কিছুটা বিদ্রূপে ভরা শাণিত চোখে কাজলের দিকে চেয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত কাজলের মুখ লালচে হয়ে গেল, সে মুখ নামাতে বাধ্য হল। দিদিমাসি বললেন—বাপু হে বিশ একুশ বছর বয়সে গুচ্ছের বই-টই পড়ে জ্ঞান সংগ্রহ করে সাতাশ বছরের নাতজামাইকে বে করেচিস। তের বছুরে ছুঁড়ির জ্বালা তুই কী বুঝবি? গ্রামদেশের দুধ-ঘি খেয়ে গুচ্ছের কুস্তি-কাস্তা করে সে তো একটা দশাসই মিনসে। তার ওপর দুর্বাসা মেজাজ। খাবার পছন্দ হল না, লাতি মেরে ফেলে দিল, জামা-কাপড় এয়েছে, কেমন ফিনফিনে দেখতে ফড়-ফড় করে ছিঁড়ে ফেলল। হাটে গেচে বেগুন পছন্দ হয়েচে বড় বড় মুক্তকেশী বেগুন। যার কাছে যত ছিল সব কিনে নিয়ে এয়েছে। বেগুনভাজা, বেগুনপোড়া, বেগুনি, বেগুনের ঝোল, দই-বেগুন— সব্বাই ভয়ের চোখে দুবেলা খেয়ে যাচ্চে। শেষে সাত দিনের দিন ছোটবোন বেগুন খেতে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে, তখন সেই সমস্ত বেগুন হুকুম দিয়ে মাটিতে পোঁতালে। তা বলি নাতনি-সুন্দরী সেই লোকের সঙ্গে রস আসে? তার সামনে টুঁ করতে পারবি?—সরি তা-ও করেছিল। তখন বোধহয় বছর পনেরো বয়স। বললুম—আমি বচর-বিউনি হতে পারবো না।
—কী বললে?
—বছর-বিউনি। লোকে বলচে আর হাসচে আমাকে দেখে।
—কে কে লোক? মুখ রাগে লাল।
—আমি বললুম—সব লোক, যে যেখানে আচে।
এক রাম থাপ্পড়ে আমাকে পালঙ্কে ফেলে দিলে। শেষরাতে পালালুম। তিনদিন পরে সইয়ের বাড়ি থেকে খুঁজেপেতে আমার শ্বশুর আমায় নিয়ে এলেন। কলকাতা থেকে মা-বাবা এসে হাজির। নিতে এয়েচেন। খুব আনন্দ। এবার বোধহয় আমাকে ত্যাগ দিচ্চে। হে ভগবান, হে কেষ্ট ঠাকুর, হে যেশুকৃষ্ট তাই যেন হয়। নাচতে নাচতে বাপের বাড়ি ফিরলুম। বাড়ি এসে দেখি ও হরি এ যে ছোড়দার বে, তাই। ছোড়দার বউও অষ্টমঙ্গলা গেল আমাকেও সে মিনসে এসে পদ্মাপারে নিয়ে গেল।
—আচ্ছা দিদিমাসি, একটু, এই এতটুকুও কি ভালোবাসতে না?
—খুনে-পাগলকে কি ভালোবাসা যায় দিদি, বড্ডজোর একটু করুণা করা যায়। যখন গেল, এমন কিছু তো বয়স হয়নি, আমার চোক দিয়ে একফোঁটাও জল কেউ বার করতে পারেনি। সবাই বললে শোকে পাতর হয়েচে। ঠুকেঠুকে শাঁখাগুলো সব ভাঙলে। সিঁদুরটুকু আমি নিজেই মুচে সারলুম। সরু কালাপাড় শাড়ি এনে দিলে বড় দেওর। দেকে রাগ হল, বললুম—থান আনো, একবারে সাদা। সবাই বললে—কী জাজ্বল্য সতী। বাপ রে বাপ!
দিদিমাসির কথার ধরনে কাজল হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বলল—দিদিমাসি তোমার মনে কি খুব দুঃখ?
—কিসের দুঃখু রে কাজলা?
—এই, লেখাপড়া শিখে দশজনের একজন হতে চেয়েছিলে, পারলে না। ভালোবাসার মতো বর পাওনি। এত বুদ্ধি নিয়ে সংসারের মধ্যে বদ্ধ থাকতে হয়েছে। তারপরে ধরো তোমার যমজ বোন আমার দিদিমা মারা গেল, তোমার তেরোজন ছেলেমেয়ের মধ্যেও পাঁচজন মোটে বেঁচে। …
সরলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—তেমন কোনও দুঃখু নেই রে কাজলা।
—সে কি গো? বিপুল বিস্ময়ে কাজল বলল।
—এতখানি বয়সে পোঁচে আর কোনও শোক থাকে না বোধহয় দিদি। সমস্ত জীবনটা যেন একটা লম্বা গরমের দিন। প্রচণ্ড বিষ্টি, ভাদুরে গুমোট, জলে ভিজে জ্বর, ঝুড়ি ঝুড়ি আঁব, নিচু, কালোজাম, জামরুল, ঝমঝম বিষ্টিতে ভেজা, কাগজের নৌকো ভাসানো, কালো মেঘে ভরা আকাশের বুকে লক লকে বিদ্যুৎ … সবাই যেন খেলুড়ি। যার যতক্ষণ দম ততক্ষণ খেলছে তা পরেই মোর, বাড়ি চলে যাচ্ছে। আমার ফুরোলে আমিও যাবো … আর এ পাইনি ও পাইনি এমনটা ছোটতে একটু একটু ছিল বইকি! কিন্তু যখন দেখলুম কিছুতেই অন্যকিচু হবার নয়, তখন নালিশগুলো কেমন গুটিয়ে গেল।
—অর্থাৎ দিদিমাসি তুমি এত বুদ্ধিমতী উদ্যোগী এসব হয়েও কিন্তু আজকাল যাকে বলে প্রতিবাদী চরিত্র তা নও। একখানা সিমোন হতে পারোনি।
—সে আবার কে রে?
—সে আছে একজন।
—খুব ত্যাড়া নাকি রে?
—হ্যাঁ, মানে বিয়ে না করা বরের সঙ্গে থাকতেন, তা ছাড়াও সব অনেক ফ্রেন্ড-টেন্ড ছিল আর কি?
অম্লানবদনে দিদিমাসি বললেন—ওমা আমিও তো ওইরকম খানিকটা ছিলুম রে!
কাজল চমকে উঠে বলল—বলছো কী?
—আমার অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল, বাপের বাড়িতে অরুণদা, প্রভাতদা, পল্টু, শ্বশুরবাড়িতেও ছিল শম্ভু, রঞ্জিত আমার সইয়ের ভাই সব, আর দ্যাওরের সঙ্গে তো এত ভাব ছিল যে তাকে তোরা আজকালকার দিনে প্রেমই বলবি।
—তবু, কারো সঙ্গে তো মানে কিছু …
—কী যে বলিস কাজলা, বয়ফ্রেন্ডরা দু-একবার হাত ধরবে না, দু-একটা চুমু-টুমু খাবে না তা হতে পারে? সবই তোদের কালে, ভুঁই থেকে গজালো? না কী? তবে হ্যাঁ গভ্ভের ছেলেমেয়েগুলো সবই তোর সেই দুর্বাসা দাদুর।
কাজল লজ্জা পেয়ে বলল—উঃ দিদিমাসি, তুমি যে কী অসভ্য, কী অসভ্য!
—না খোলাখুলি সব কবুল করাই তো ভালো রে। থাকলে বলে দিতুম। তখন ওরকম একটা-আধটা হয়ে যেত। বড় বড় সব সংসার। যত শ্বশুর, তত ভাসুর, তত দ্যাওর, তার ওপরে বাইরের থেকে অমুকতুতো তমুকতুতোরা আসচেই আসচেই। ও সব হত। কিছু টের পাওয়া যেত না। কিছু পাওয়া যেত। গেলেও প্রমাণাভাবে হজম, আর কিছুর জন্যে বিষ, গলায় দড়ি, পুকুরে ডোবা,
এই সব কথা হতে হতে দিদিমাসি একটা বিদেশি খাম তার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, পড় তো দেখি কাজল। কী লিখচে?
পড়ে টড়ে কাজল অবাক। কে এক মিঃ সিং ওকলাহোমা, ইউ.এস.এ থেকে লিখছেন, তাঁর মেয়ে এডিথ পালিয়ে গেছে। সম্ভবত সে ভারতবর্ষের, কলকাতায় ৩ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটে যাবে। মিসেস বোস বা তাঁর আত্মীয়রা যেন তাকে যেভাবে হোক আটকে রাখেন এবং মিঃ কাপুরকে একটা ফ্যাক্স করে দ্যান। ফ্যাক্স নম্বর দেওয়া আছে। কিন্তু কে এই এডিথ এবং মিঃ সিং, তার কোনও উল্লেখই চিঠিতে নেই। এভরিথিং উইল বী এক্সপ্লেইন্ড লেটার।
কাজল বলল—এ চিঠি তোমাকে কে দিল? কেন দিল?
সরলা বললেন—ওরে ওপরে পষ্ট আখরে লেকা মিসেস সরলা বোস। না হলে তোর দুই মামীর কাউকে দিত হয়তো হরিনাথ।
—এই জন্যে ডেকেছো?
—ডেকেছি পিঠে খেতে, তার সঙ্গে এইটুকু পিঠোপিঠি। এই চিঠিটা তুই জিরক্স করে নে। নাতজামায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরামর্শ কর। কী ব্যাপার…
ছেলেমেয়ে তো গেছে জয়দেবের মেলায়।
—আরে বাপু ফিরবে তো! না সেখানেই বাউল-বাউলি হয়ে থেকে যাবে? তোর ছেলেটার খুব বুদ্ধি। মেয়েটারও। তবে বাচ্চা তো! এখনও তেমন পাকেনি। মিত্তির বাড়ির, ঘোষ বাড়ির জিন পেয়েছে সব। আমারগুলো সবই বসু-পরিবার।
—জিন-টিন কী সব বলছো দিদিমাসি? এ সব তুমি জানো?
—বাঃ জানবো না? পত্র-পত্রিকাগুলো সব পাশে ডাঁই করা থাকে, ভাবিস বুঝি খালি নবেল পড়ি! ডি এন.এ. জিন, ক্রোমোজাম স-ব জানি। বুজলি?
—তা তোমার ছেলেমেয়ে বসু-পরিবার বললে কেন? বসু-পরিবার তো বসুই হবে।
—কাজলা, তুই সুশীর এই মাটির ঢিপিটার মতো হয়েছিস। আসল সুশী আরও অনেক বুদ্ধিমতী ছিল।
—বেশ বোকা আছি, আছি। তুমি বুঝিয়ে বলো।
—আরে আমার নিজের দশটা ছেলেমেয়ে। যে তিনটে অল্প বয়সে গেছে তাদের কথা ছেড়ে দিচ্চি। তা এ দশটার কেউ-কেউও তো আমার মতো বা আমার বাড়ির মতো হবে। বড় নবতারা-বসানো ওর ঠাকুমা, চেহারায়, চাল-চলনে, মেজ ললিতা—ওর বাপের মতো, সেজ নরহরি তো দেখেছিসই—খ্যাপাটে, দশাসই, এক চড় ওঠালে তোকে সাত চড়ে শায়েস্তা করে দেবে। ন’ ভজ, ভজহরি—একেবারে ওর কাকার মতো!
—যে কাকার সঙ্গে তোমার প্রেম ছিল দিদিমাসি?
—মোটেই না, সে আমার থেকেও ছোট ছিল, বাড়িতে একমাত্তর মানুষের মতো। তার মতো হলে তোর কেচ্ছা করার খুব সুবিদে হয়, না?
কাজল এত্ত বড় করে জিভ কেটে বলল—কৌতুহল, বিশ্বাস করো জাস্ট কৌতূহল!
—সে ছিল একটা ভোঁদলা কাকা। কথা বললে ভেবলে চেয়ে থাকবে। তিনবার জিজ্ঞেস করলে একবার জবাব দেবে। ভজ সেই কাকার মতো হয়েছে।
—তারপর?
—কনে লাবণ্য—বাপের মতো, চেহারায়, স্বভাবে আবার সেই ভোম্বুলে কাকার মতো। নতুনের নামও তো নতুন, সে কেমনধারা ছিল আমার ভালো মনে নেই—খ্যাপাটে তো বটেই। বউটাকে আমার ওপর ফেলে নিরুদ্দেশ হল। মরতে চল্লুম এখনও তার কোনও হদিশ নেই। রাঙা হল সুচরিতা, সব রবীন্দ্রনাথ থেকে নাম দিয়েছিলুম—ওর পিসির মতো—অমনি ছিঁচকাদুনে হেঁশেল-অন্ত প্রাণ। হেঁশেলের চাবি নিয়ে বউয়েদের সঙ্গে কী কাণ্ডই না করচে। ফুল হল গিয়ে—ক্যামেলিয়া নাম দিয়েছিলুম—এনারা বদলে করে দিলেন—কমলা, তো কমলা-ও চলে গেল—ও-ও ঠাকুমার মতো ছিল। সোনাটা ছিল সোনা ব্যাং, মাকাল ফল, বাপের মতো চেহারা, কিন্তু পাঁড় অলস, কিচ্ছুটি করবে না, যাক সে তো আর নেই, সব ছোট্ট কুট্টিটা তো বছর পনেরো বয়সে পালিয়ে গেল। যতদূর মনে পড়ে সে-ও ছিল খ্যাপাটে, বদমেজাজি, বাপের জিরক্স কপি। তা এই তো হিসেব দিলুম। তোর মামাত-মাসতুত ভাই-বোনেদের তো দেখতেই পাস, বলি আমার জিনটা গেল কোথায়? এত কষ্ট করে করে যেসব জন্ম দিলুম, সায়েন্স বলচে চারটের মধ্যে তিনটে যদি এর মতো হয় তো অন্তত একটা অন্যের মতো হবে। তা কই রে? মানুষ শুনেচি বংশবৃদ্ধি করে নিজেকে ফিরে ফিরে দেখবার বাসনায়—আমি নিজে বন্দী হয়ে গেচি, কিচু করতে পারিনি যা চেয়েচি—সে অন্য কথা। কিন্তু এ তো বড় একটা বংশ তোয়ের করলুম তার কোথ্থাও আমি নেই—এটা আমার বড্ড লেগেচে রে!
দিদিমাসি এমনভাবে বললেন যেন তাঁর কোনও নিকট আত্মীয়ই তাঁর মনে ব্যথা দিয়েছে।
সে দিদিমাসিকে সান্ত্বনা দিতে বলল—তোমার জিন আরব্যোপন্যাসের জিন হয়ে গেছে, তাকে কেউ ঘড়ায় পুরে, মুখ এঁটে সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়েছে। এখন কোথায় গিয়ে ঠেকে দেখো।
৮
অনীকের হঠাৎ একটা কেমন সটকায় ঘুম ভেঙে গেল। নিশুতি রাত। মাথার ওপর এমনভাবে তারা জ্বলজ্বল করছে, এত অগণিত, এত ঘেঁষাঘেঁষি এবং এত নিচে যেন মনে হচ্ছে সে আকাশেই বসে আছে। কনকন করছে শীত। তার গায়ে ছিল বাবার একটা খুব গরম কুলুর শাল। সেইটা দিয়ে কান-মাথা ঢেকে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল জি.জি-র গায়ে ঠেস দিয়ে। প্রায় তৎক্ষণাৎ ঘুম ভাঙার কারণটা বুঝতে পারল অনীক। কেউ তার শালটা হাতিয়েছে। জি.জি. ভাগলবা। অর্থাৎ জি.জি-ই সেই শাল চোর। ছিঃ! তার গায়ের কোট স্লিপোভার ইত্যাদি ভেদ করে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ শীতের ছুঁচ গায়ে বিঁধছে। আশেপাশে বেশির ভাগ লোকই ঘুমোচ্ছে। আবার অনেকে জেগে জেগে। বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে এক বৃদ্ধ বাউল মৃদুস্বরে গান করে যাচ্ছেন। বাউলনী খুব ফর্সা, যদিও চুলগুলো একেবারেই পাকা। তিনি শুধু তাল দিয়ে যাচ্ছেন হাতের যন্তরটা দিয়ে। কাছেই কোথাও মাইক লাগানো হয়েছে, বেশ আলোকিত মঞ্চ। সেখান থেকেও গান ভেসে আসছে। সে কণ্ঠটি কচি।
—এ ছোকরা আজকাল শহর-বাজারে খুব নাম করিচে—পাশের লোকটি অনীককে বলল—তবে কী জানেন? আসল ধারাটি এ নয়, বাউল গান সাধনের অঙ্গ তো। সে তো আর কণ্ঠের ক্যারদানি—কসরৎ দেখাবার জন্যে সিষ্টি হয়নিকো। এই সব ছোকরা-ছেলেরা দুটো দিন খুব গাইবে, তাপর আজ্ঞে ডুবে যাবে। হদিশ পাওয়া যাবে না।
উঠতে গিয়ে অনীক দেখল সে যেন জমে গেছে। সারা শরীরে খিল ধরে গেছে। পাশের লোকটি তার অবস্থা বুঝে বলল—আমি আপনার পায়ের আঙ্গুল চেপে ধরচি, আপনি আস্তে আস্তে পা ঠুকুন।
—আপনি পা চেপে ধরলে আমি কী করে পা ঠুকব?
—তা-ও তো বটে! তয় আপনি পা ঠুকুন। আমি আপনাকে ধরে আছি।
—আমার পাশে একটি ছেলে বসেছিল, সে কতক্ষণ উঠে গেছে, জানেন?
—কত জনা আসে, কত জনা যায়, কে কার খপর রাখে দাদা।
পা ঠোকার ফলে তখন অনীকের সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফুটছে। সে রেগে-মেগে বলল—আমার শাল চুরি করে নিয়ে গেছে! জানেন?
—বন্ধুতে বন্ধুর শাল-চাদর চুরায় এই পেরথম শুনছি।
—বন্ধু না আরও কিছু, একটা গোপালগোবিন্দ কোথাকার। বলতে বলতে টলে টলে অনীক ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে গ্রামের পথ দিয়ে চলেছে অনীক। মনের ভেতরে ভীষণ রাগ। কারবাইডের আলো জ্বলছে একটা আসরে, তার তীব্র আলো তার ঘুমপিয়াসী চোখে পড়ে বিঁধছে বিশ্রীভাবে। কয়েকবার জগিং করে সে শরীরটা একটু গরম করে নিল। আলো জ্বলা আসরটা থেকে যশ আর গোপাল বেরিয়ে এলো। দিব্যি চামড়ার উইন্ডচিটার পরা দুজনের। কদম কদম চলছে, কোনও ক্লান্তি-ফান্তি নেই। আসরের আলোয় বোধ হয় চোখ ঝলসে আছে। অনীককে দেখতেও পেল না। নিজেদের কথাতেই মগ্ন হয়ে চলেছে।
উত্তুরে হাওয়া ওদের দিক থেকে সনসনিয়ে বয়ে আসছে অনীকের দিকে। কানে এলো যশ বলছে—আগের দুবার তবু দেখতে পেয়েছি। এবার যেন হাওয়া হয়ে গেল, অথচ আংকলকে আমি কথা দিয়েছি। তা ছাড়া আমারও তো একটা রেসপো আছে।
—কথা বলেছিস?
—আরে বাবা, আমার কাছেই তো আংকল-এর রেফারেন্সে এসেছিল। রিসার্চ করছে বাংলার বাউলদের ওপর।
গোপাল বলল—আচ্ছা যশ, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস আজকাল এই সাহেব মেমদের বাংলার এটা-ওটা নিয়ে রিসার্চের ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে বেড়ে গেছে! তুই এখন যে কোনও ইউনিভার্সিটিতে ঝোলা তাপ্পিমারা বারমুডা আর ফতুয়া পরা কটাশে চোখ-নীল চোখ পশ্চিমাদের ঘুরতে দেখতে পাবি। কাজ চালানোর মতো বাংলাও এঁরা জানেন। কেউ শিশু সাহিত্যের ওপর, কেউ জীবনানন্দ, কেউ সেই রবীন্দ্রনাথ, তারপর ভাদুগান, আলকাপ, পটুয়া—এসবও আছে, প্রচুর প্রচুর। কেন বল তো?
যশ বলল—আরে, ওদের নিজেদের তো কোনও হিসট্রি নেই। নিজেদের নিয়ে কত আর করবে? ওদিকে অ্যালেক্স হেইলির পরে এখন সব রুটস খোঁজার ফ্যাশন হয়েছে। আসল আমেরিক্যান বলতে যে রেড ইন্ডিয়ান তাদের তো মেরে তুবড়ে দিয়েছে। যারা রয়েছে তারা রাশিয়ান, জাপানি, আইরিশ, স্কটিশ, স্প্যানিশ, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান, ইটালিয়ান, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ইরানি—কে নয়? সব এখন সুড়সুড় করে যে যার শেকড় খুঁড়ছে। কিংবা গুরু খুঁজছে। সাবজেক্ট সব একজস্ট করে ফেলেছে, কাজেই এখন ইন্ডিয়ার দিকে ফিরছে—এরকম একটা রিচ হিসট্রি—এত লোকশিল্প …
—আর কোথাও নেই বলছিস? গোপাল বিদ্রূপের সুরে বলল—তোদের এই বাঙালিদের আত্মগরিমার অভ্যেস আর গেল না।
—হেই হেই আমি বাঙ্গালি নই, শিখ আছি—যশ বলল। গোপাল বলে উঠল—শিখ তুই ধর্মে, কিন্তু তোরা তিন পুরুষ ভবানীপুরে বাস করছিস, বুকে হাত দিয়ে বল তো একবার তুই বাঙালি নয়! পাঞ্জাবি!
—আরে তা যদি বলিস পাঞ্জাবে লাহোরে দাঙ্গা হল আমাদের ফ্যামিলি তো ভাই দিল্লি গিয়ে এখানে চলে এলো। বললে সিকিওর জায়গা, বঙ্গালি বহুৎ অচ্ছা ইনসান আছে। দ্যাখ গোপাল রুটস খুঁজতে গেলে দেখব পঞ্জাবে আমাদের কমসে কম একটা খেতি-বাড়ি ভি নেই। তো আমরা কী?
—আহা দুঃখু করিস কেন? তুই বাঙালি রে।
অনীক ওদের পায়ে পায়েই হাঁটছিল। যশকে বলতে শুনল—আর একটা কথা গোপাল—আত্মগরিমা বললি না? পৃথিবীতে এমন কোনও জাত নেই যে আত্মগরিমা করে না। জার্মান বলল—আমরা শ্রেষ্ঠ, য়িহুদি বলল—আমরা চোজ্ন্ রেস। ইংরেজদের তো কথাই নেই। সবাই গর্ব করে, তবে আমরা বাঙালিরা বড্ড আত্মগ্লানিও করে থাকি। এটা ভালো নয়, একটা জাতিকে জুজুবুড়ি করে দেয়।
—তা বলে আত্মসমালোচনা থাকবে না?
—অবশ্যই থাকবে, এবং লাইক চ্যারিটি, সেল্ফ ক্রিটিসিজম শুড বিগন ফ্রম হিয়ার, দ্যাট ইজ হিয়ার অ্যান্ড নাউ—বলতে বলতে অনীক সামনে এগিয়ে গেল।
—আরে অনীক, শালা উল্লু কাঁহিকা। কুথাকে ছুপিয়ে ছিলি বাবা?
—আমরা তো ভাবলুম অনীক শালা আবার সেই পথের ধারে ফিরে গেছে। ঢুকু ঢুকু চালাচ্ছে—মাইরি তুই দেখালি বটে!
—কী দেখালুম? দেখাচ্ছিস তো তোরা—একটা হাফনোন সন্দেহজনক চরিত্রের সঙ্গে আমাকে ভিড়িয়ে দিয়ে নিজেদের গোপন মিশন নিয়ে অভিযান চালিয়েছিস। বাদই যদি দিবি, তো আনলি কেন?
—আরে বাদ দোব না বাদ দোব না, ইউ মিসআনডারস্ট্যান্ড আস। আগে একটা কথা বল—এখানে এত আসরে তো ঘুরলি কোথাও অল্পবয়সী গোরী গোরী বাউলনী দেখলি?
ভেবেচিন্তে অনীক বলল—গোরী গোরী তো দেখেছি, কিন্তু অল্পবয়সী নয়। মাথার চুল রীতিমতো পাকা। কিন্তু সব কিছু আমায় খুলে না বললে আমি তোমাদের সঙ্গে আর নেই। একটি কথাও আর বলছি না। মুখে কুলুপ।
ভীষণ ধাক্কায় তীর্ণার ঘুম ভেঙে গেল। দেখে আধো অন্ধকারের মধ্যে রাংতা তাকে প্রাণপণে ঠেলছে। তীর্ণা চোখ মেলেছে কিন্তু ভালো করে মেলতে পারছে না। ঘুমের মাসি ঘুমের পিসি চোখ জুড়ে পিঁড়ি পেতে বসে এখনও। শরীরটাও কীরকম শিথিল হয়ে আছে।
রাংতা বলল—তীর্ণা, তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছো না, এখানে কোনও বাথরুম নেই। মাঠে-ঘাটে যেতে হবে।
মুহূর্তের মধ্যে তীর্ণা টানটান, ঘুম চোখ থেকে এক লাফে নেমে পালিয়েছে। সে ভারী-ভারী ধরা গলায় বলল—তা হলে উপায়?
—উপায় একটা নির্জন স্থান খুঁজে বার করা। শিগগির চল বেরিয়ে পড়ি।
একটা ব্যাগে ওরা নিজেদের জামাকাপড় তোয়ালে সাবান পেস্ট সব গুছিয়ে নিল। তীর্ণা বলল—চান করার তো প্রশ্নই নেই। সারা দিনই প্রকৃতি আমাদের ঠাণ্ডা জলে চান করিয়ে চলেছে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ে খানিকটা এসেই ভীষণ ঘেন্নার দৃশ্য দেখতে পেল। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার দুধারে মেয়েপুরুষ সব বাথরুম সারছে। তীরবেগে ওরা মেলার চত্বর থেকে বেরিয়ে এলো। রাংতা বলল—ছেলেগুলো কোথায় গেল বল তো? এত সংগীতভক্ত ওরা কিন্তু আগে ছিল না।
তীর্ণা বলল—তুই কাদের কথা বলছিস। আমি যদুর জানি আমার দাদা খুবই সংগীতভক্ত, আর গোপাল এইসব লোকসংগীতের নাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠে। তা হলে? যশ? যশ সম্পর্কে অবশ্য আমি কিছু জানি না।
রাংতা খুব কায়দা করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।
ক্রমশ ওরা কেঁদুলি ছাড়িয়ে ধানক্ষেতে ভরা অন্য কোনও গাঁয়ে এসে পড়ল। দিগন্ত পর্যন্ত শুধু ধানক্ষেত, তা-ও বেশির ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে, ক্ষেতময় নাড়া উঠে উঠে আছে। কোথাও কোথাও আবার কপিক্ষেত, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন।
পরস্পরের দিকে ওরা হতাশ চোখে চেয়ে রইল। এরকম ঝোপঝাড়হীন প্রকৃতি ওরা আগে কখনও দেখেনি।
তীর্ণা বলল—থেমে কী হবে? চল।
গ্রামের পরে গ্রাম পেরিয়ে চলেছে। ক্রমশই ওরা অজয়ের তীর ঘেঁষে চলছে। অজয়ে বড় বড় বালির চড়া। মাঝে মাঝে পরিষ্কার জল।
যেতে যেতেই ওরা সূর্য ওঠা দেখল। অবশ্য দেখল যখন বেশ কিছুটা উঠে গেছে।
তীর্ণা বলল—কখন কোথা দিয়ে ভদ্রলোক উঠলেন। টের পেলুম না।
রাংতা বলল—কেস আরও খারাপ হয়ে গেল।
এমন সময়ে ওরা দেখল সামনে দিয়ে হন হন করে একটি মেয়ে আসছে। তাদেরই মতো সালোয়ার কামিজ পরা। রংটা খুব ফর্সা। পাঞ্জাবি-পাঞ্জাবি চেহারা। ওদের দেখে মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছাকাছি হতে বলল—বেড়াচ্চে?
রাংতা বলল—বেড়ানোটা ইনসিডেন্টাল, উই আর লুকিং ফর আ বুশ। তার মুখে অপ্রস্তুত হাসি।
—জোপজাড় আছে, একটু এগোচ্চে, নদীর ধারে। সুবিদে আচে। আচ্চা, বিদায়, নোমোস্কার।
মেয়েটি হাসিমুখে নমস্কার করে চলে গেল।
তীর্ণা বলল—কীরকম আড়ষ্ট উচ্চারণ, ও কোন দেশি বলো তো?
রাংতা বলল—কীরকম দোআঁশলা দোআঁশলা টাইপ।
যাই হোক ওরা ওদের প্রার্থিত ঝোপঝাড় পেয়ে গেল।
রাংতা বলল—অজয়ের জল আমাকে টানছে কিন্তু।
তীর্ণা বলল—আমাকেও।
—দুজনে একসঙ্গে নামলে আমাদের ব্যাগ কে দেখবে?
—দুর, কে নেবে এখানে? বলতে বলতে রাংতা নামতে লাগল, এবড়ো-খেবড়ো পাড় বেয়ে বেয়ে। খানিকটা চড়া তারপর জল, তারপর আবার চড়া। জলটা এত স্বচ্ছ যে তলার নুড়ি, মাছের খেলা সবই দেখা যাচ্ছে। দুজনে মুখ হাত ধুতে গিয়ে, জলে একেবারে শুয়ে পড়ল।
—ঠিক একটা বাথটাবের মতো জায়গাটা। দেখেছিস?
—একটুও শীত করছে না দেখেছিস!
—কী আরাম!
—এত বড় বাথরুম, এত বড় বাথটাব জীবনে দেখিনি। কী অপূর্ব, না রে?
দুজনে আরামে সাঁতার দিতে লাগল।
—কোনটা বেশি ভালো? রাংতা জিজ্ঞেস করল—কাল রাত্তিরের গান না আজ সকালের চান?
তীর্ণা হেসে বলল—তুই তো পদ্য করে ফেললি একটা। সাধে কি আর কবিরা ইনসপিরেশনের জন্যে প্রকৃতির কাছে যান। ও মা আবার পদ্য হয়ে গেল। দুজনে খিলখিলিয়ে হাসল।
রাংতা বলল—আমার কথাটার জবাব দে!
—দুটো দুরকম ভালো। রাংতা। এটা দেখ শরীরের আরাম। ওটা ইসথেটিক…
—আমি তা মানি না। এই নদীতে চানটাও ইসথেটিক। ওই গান আর এই চান আমাকে অন্তত একইভাবে স্টিমুলেট করছে।
—তুমরা তো বাঙালি?
ওরা অবাক হয়ে দেখল সেই মেয়েটি কোথা থেকে সাঁতার দিতে দিতে ওদের খুব কাছে এসে পড়েছে।
—তুমি এখানে?
—আমি অজয় জলে সাঁতার দিতে বালোবাসছে।
—আমরাও ভালোবাসছে। বলে তীর্ণা হাসতে লাগল
রাংতা বলল—আমি রাংতা, ও তীর্ণা, তুমি?
—রাং রুং রুংটা অ্যান্ড টির্না, টিনা নোয় মাঝকানে আর, টির্না। রুংটা টাইট্ল হয়, জানে।
—আমারটা টাইটল নয়, নাম। আমার টাইটল চ্যাটার্জি।
—রুংটা চ্যাটার্জি।
রাংতা ওর নামের উচ্চারণ সংশোধন করে দিল না আর।
মেয়েটি বলল—তুমরা বাঙ্গালিরা এ তো ইংরেজি মসালা দিয়ে কথা বলো কেন? তখন বলচিলে ইসথেটিক। নান্ডনিক বললে কী হোয়? স্টিমুলেট না বলে প্রেরণা দিচ্ছে বলতে পার তো।
ওরা অবাক হয়ে গেল। অবাক মানে একেবারে অ-বাক।
—আমি বাংলা পড়ছি—ফাদার জেনকিনসের কাছে। আমি টেগোর বলি না, বলি—টাকুর।
তীর্ণা চুপি চুপি বলল—কী রে ইমপ্রুভমেন্ট হল কিছু? এ যে ঢেঁকুর ঢেঁকুর শোনাচ্ছে।
মেয়েটি আপন কথায় মশগুল, বলল—
আজি এ প্রভাটে রবিড় কড়
কেমনে পশিল প্রাণেড় পড়
কেমনে পশিল গুহাড় আঁধাড়ে প্রভাট পাখিড় গান
না জানি কেন ড়ে, এটদিন পড়ে ঝাগিয়া উটিল প্রাণ
—বিস্ময়কর! অদ্ভুত! বলতে বলতে তীর্ণা হাততালি দিতে লাগল, রাংতাও তাতে যোগ দিল।
—আমি আঢুনিক কবিও জানি
আলো অনঢকারে যাই মাঠার ভিতড়ে
কোনও এক বোঢ কাজ কড়ে
বলতে বলতে মেয়েটি সাঁতরাতে লাগল। দূর থেকে ভেসে এলো—বোঢ জন্ম লয় বোঢ জন্ম লয়। কোনও এক বোঢ …
ওরা দুজনেই এত আশ্চর্য আর অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে জল থেকে উঠতে মনে ছিল না। বাথটাবের মতো জায়গাটাতে মুখোমুখি শুয়ে শুয়ে ওরা পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
তীর্ণা বলল—রাংতা তুমি খুব সুন্দর।
রাংতা বলল—আশ্চর্য, আমি এই কথাটাই তোমায় বলতে যাচ্ছিলাম। ইউ আর লাভলি।
—ধুর, আমি তো কালো।
—তাতে কী হলো, তাতে তোমাকে আরও ভালো দেখায়। দা বিউটি অফ আ স্পেশ্যাল কাইন্ড। আমি যদি ছেলে হতাম তো ঠিক তোমার প্রেমে পড়তাম।
তীর্ণা হেসে বলল—সত্যি-সত্যি ছেলে হলে আর কথাটা বলতে না। তখন গোরে গোরে মুখড়েপে কালা কালা চশমা …
দুজনেই হেসে উঠল। এবং তখনই ওদের খেয়াল হল ওই অদ্ভুত পাঞ্জাবি না সিন্ধি মেয়েটির কোনও পরিচয়ই নেওয়া হয়নি, এমনকি নামটা পর্যন্ত জানা হয়নি।
তীর্ণা বলল—মেয়েটিকে আমি যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। ভীষণ চেনা মুখ। বলতে বলতে সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। যেন স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছে মেয়েটির মুখের খোঁজে।
ওরা জল থেকে উঠছে দূর থেকে তিন পুঙ্গবকে আসতে দেখা গেল। ওদের দেখে দূর থেকেই মুখের দুপাশে হাত রেখে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠল।
তীর্ণারা ভাব দেখালো যেন ওদের দেখতেই পায়নি।
শীতের বাতাস ভিজে শরীরে লেগে ওরা তখন হি-হি করে কাঁপছে। রাংতা বলল আমি ঝোপের পেছনে যাচ্ছি, তুই আমায় গার্ড কর।
দুজনেই জামাকাপড় বদলে, ঘাসের ওপর বসে আয়না বার করে চুল আঁচড়াচ্ছে। তিন পুঙ্গব লেফ্ট-রাইট লেফ্ট-রাইট করতে করতে এগিয়ে এলো।
—কী রে? ইন্ডিপেন্ডেন্ট?
—আমাদের সঙ্গে কথা বলবি না?
—হঠাৎ লেডিজ সিট হয়ে গেলি যে!
এতক্ষণে উত্তর দিল রাংতা—আমরা হইনি, আমাদের করা হয়েছে, ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তো আমরা নিজেদের পথ নিজেরা দেখে নিচ্ছি।
যশ উবু হয়ে বসে বলল—কসুর মাফ কিজিয়ে মেমসাব।
—বাঙালি মেয়েকে মেমসাব বললেই খুশি করা যায় না। মার্জনা ভিক্ষাও হয় না।
—যাব্বাবা—গোপাল বলে উঠল কর্নার কিকে গোল করে দিলে বাবা। একটা চান্স দিলে না?
অনীক বলল—মার্জনা ভিক্ষা? অদ্ভুত তো? কনভেন্ট-এডুকেটেড নব্য বঙ্গ মেমরা কথাটা জানে?
রাংতার হাতে একটা ছোট পার্ফুমের শিশি ছিল, সেটা সে জোরে ছুঁড়ল অনীককে লক্ষ্য করে।
অনীক সেটা লুফে নিয়ে বলল—
বাঁচিয়ে দিলুম রাংতার গায়ে অভ্রের কুচিগুলকো
আজ প্রাতরাশে জুটবে বোধহয় ময়দার লুচি ফুলকো।
গোপাল বললে—তুই তো সত্যি-সত্যি কবি হয়ে গেলি রে অনীক। শালা! আজ তো মহুয়া-টহুয়া …
যশ তাকে চোখ টিপে থামিয়ে দিল।
রাংতা গম্ভীরভাবে বলল—আমি অবশ্য কনভেন্টে পড়া কালো মেম, কিন্তু ‘গুলকো’ কী জিনিস তা আমার জানা দরকার।
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক—গোপালও বলল—গুলকোটা কী?
অনীক বলল—পরের লাইনটা আগে মনে এসেছিল বুঝলি? ফুলকোর সঙ্গে মিল দিতে তাই গুলোটাকে ‘গুলকো’ করে দিলুম।
যশ উদারভাবে বললে—গ্রান্টেড। ‘গুলকো’ ইজ গ্রান্টেড। অনীক সত্যি-সত্যি কবি হয়ে উঠছে। ওকে আমাদের একটা প্ল্যাটর্ফম যোগাড় করে দেওয়া দরকার। ইট ইজ আর্জেন্ট।
রাংতা বলল—আমি না হয় কালো মেম, কিন্তু তোরা বাঙালির ছেলে হয়ে কথায় কথায় এত ইংরেজি বুকনি ঝাড়িস কেন? ‘গ্রান্টেড’ না বলে ‘অনুমতি দেওয়া হল’ বলা যেত না? প্ল্যাটফর্মের জায়গায় বরং রঙ্গমঞ্চ, আর্জেন্ট-এর জায়গায়—দরকারি কি জরুরি বলা যেত না?
অনীক বলল—রঙ্গমঞ্চ? ওহ আয়্যাম বোল্ড। মাঠের ওপর সে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিয়ে বললে—
রাস্তা তুমি তো চোস্ত বুলির বস্তা ঝাড়তে ব্যস্ত
এই সুযোগেতে আমরা তিস্তা খেয়ে আসি রুটি-গোস্ত
অনীককে উঠতে না দিয়ে গোপাল তাকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে বলল—কবি হতে পারিস, কিন্তু তুই একটা দুঃকবি, রাস্তা আর তিস্তা শব্দের প্রয়োগ যদি বোঝাতে না পারিস তোকে আজ এইখানে বেঁধে রেখে যাবো।
অনীক বললে—আহ্, ছাড় ছাড় লাগছে, এটা কি ডানলোপিলোর গদি পেয়েছিস? চতুর্দিকে কাঁকর, কাঁটা …। আমি সোলোকটা এখুনি ব্যাখা করে দিচ্ছি—রাংতাকে রাস্তা বানিয়েছি অনুপ্রাসের খাতিরে। রাস্তা, চোস্ত, বস্তা, ব্যস্ত। অনুপ্রাস কনটিনিউড ইন দা নেক্সট লাইন। আমরা তিনজন ‘ত্রয়ী’ বলতে পারিস তিস্তা বললেই বা ক্ষতি কী? অনুপ্রাসটা যখন হচ্ছে!
যশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে—ব্যস্তর সঙ্গে গোস্ত্ কী করে মিলবে?
—স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মেলাচ্ছেন, আর আমি মেলালেই দোষ, না? আরে বুঝলি না মেলাবেন তিনি মেলাবেন—কবিরা সব বলছেন। আমরা যতই গুবলেট করি সব মিলে যাবে।
গোপাল বলল, যাই হোক একটা জিনিস খুব স্পষ্ট। এই কবি দুঃকবি হলেও এর খিদে পেয়েছে, এ প্রথমে ফুলকো লুচির কথা বলেছিল, এখন রুটি-গোস্তের কথা বলছে, এরপর যদি আরও শক্ত কিছুর কথা বলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। বাবা রাংতা ক্ষ্যামা দে। মা তীর্ণা!
—এঃ, তীর্ণাকে মা বলে ফেললি? তোর আর কোনও চান্স রইল না—অনীক বলল।
—যেন কোনদিন ছিল! বলে তীর্ণা পা চালাল, শিগগির চলো, আমার কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে।
৯
গঙ্গাপ্রসাদের হয়েছে নানা দিকে মুশকিল। একে কাজল তাঁকে প্রতিদিন দশটা সাড়ে দশটায় বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছে। দিদিমাসির বাড়ি সে রোজ কী পাঁচালি শুনতে যায়, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া। ছেলেমেয়ে বাড়ি নেই তার খুব মজা। অন্যত্র খাওয়া থাকলে, বাড়িতে রান্না করতে না হলে কাজলরেখা আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে দুদিন এক জিনিস রাঁধলে খাবে না। সুতরাং তারা থাকলে কাজলরেখার সমূহ মুশকিল। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে না-হচ্ছে তাঁর খেয়ালও থাকে না। সুতরাং রোজ কাজল আলুকপি বড়ি মাছ দিয়ে একটা ঝোল রাঁধছে। ডাল আর গোটাকয়েক সবজি ভাতে ফেলে দিয়েছে। তারপর সাড়ে নটা বাজতে না-বাজতেই সে পড়ার ঘরে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়। —কী গো তোমার হলো? কী গেঁতো কী গেঁতো? বাপরে বাপ।
—আমার অভিধানটা কে লিখবে? —গঙ্গাপ্রসাদ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করেন।
—আর একটু সকাল-সকাল উঠলে পারো।
—আরও সকাল? সাড়ে চারটেয় উঠেছি। ওদিকে রাত্তিরে একটা দুটো পর্যন্ত নয়জি ফিল্ম দেখবে, ঘুমোবো কতটুকু?
—বয়সে ঘুম কমে যায়, তা জানো?
—আমার তা হলে তত বয়স হয়ে গেছে?
—তোমার সঙ্গে কথা বলাই আমার ঝকমারি হয়েছে। না তুমি খোকাবাবু তোমার বয়স হয়নি।
শীতকালের দিনে সকালে ব্রেকফাস্টে একটা করে ডিম বরাদ্দ গঙ্গাপ্রসাদের। কিন্তু পাছে তাঁর সাড়ে ন’টায় খিদে না পায় তাই এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট ছাড়া কদিনই তিনি কিছু পাচ্ছেন না। তবে কাজলরেখার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি নেই। ডিমটা সে ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে দিচ্ছে।
সাড়ে ন’টার সময়ে ভাত বেড়ে দিয়ে, সে বেশ মনোযোগী গৃহিণীর মতো সামনে বসে।
—সকালে আমার ডিমটা!
—এই নাও তোমার ডিম—ডিম থেকে ভাত ছাড়াতে ছাড়াতে কাজল বলে।
—এই নাও কাঁচকলা সেদ্ধ—আয়রন। ধুঁধুল সেদ্ধ—ফাইবার আছে। আর ঝোলে তো সব। সব।
তৃতীয় দিনে গঙ্গাপ্রসাদের কেমন সন্দেহ হয়। তিনি বলেন আচ্ছা— এই ঝোলটাই গত দুদিন ধরে দু বেলা খাচ্ছি, না?
—ইস্স্, তোমার কী সন্দেহ বাতিক! কাজল গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে।
—কেন, সন্দেহের এর মধ্যে কী হল?
—এক রকমের ঝোল বলতে পারো, ‘এই ঝোলটা’ বললে সন্দেহবাতিক বলব বইকি! আর এক রকমেরই বা কেন? একদিন পাঁচফোড়ন, একদিন জিরে, আর একদিন রাঁধুনি দিয়ে সাঁতলেছি। তফাত নেই! জিভের তোমার কোনও সুক্ষ্মতা নেই, পড়তে দিদিমাসির হাতে!
—আহা, তিনি স্বয়ং তো আগেই দাদামেসোর হাতে পড়ে গিয়েছিলেন— গঙ্গাপ্রসাদ সংক্ষেপে বলে।
—তা পড়েছিলেন— কাজল কী রকম অর্থপূর্ণভাবে বলে।
—মশলা খাবে না?
—খাওয়াটা আগে শেষ করি, তারপর তো মশলা! তুমি কি খাওয়ার মাঝ মধ্যেখানেই ভাতের দলার মধ্যেই মশলা ঢুকিয়ে দেবে?
এইবার কাজলের ধৈর্যচ্যুতি হয়। তার আবার একটু সাজগোজের বাহার আছে কি না! সে মশলার প্লেটে মশলা রেখে দিয়ে বলে—তুমি খেতে থাকো, আমি আসছি।
আর আসে না।
গঙ্গাপ্রসাদ তৈরি হয়ে হাতে তালা-চাবি নিয়ে রেডি। তখন কাজল ঘর থেকে বেরোয়। ফুলিয়ার খড়কে ডুরে শাড়ি, কালো ফুল-ছাপ ব্লাউজ। কপালে এত্ত বড় কালচে খয়েরি টিপ। ঝমঝম করছে গয়নার শব্দ।
—অত গয়না পরে রাস্তায় বেরোনটা ঠিক না।
গঙ্গাপ্রসাদের চোখের সামনে হাতটা নাচিয়ে নিয়ে কাজল বলে— সব নকল, নিক না কে কত নেবে! এয়োস্ত্রী মেয়ে গয়না না পরলে মানায়? গঙ্গাপ্রসাদ এয়োস্ত্রী কথাটা কাজলের মুখে যেন নতুন শুনলেন। শব্দটার ব্যুৎপত্তি ভাবতে ভাবতে তিনি দরজায় তালা লাগালেন, কাজল টেনে দেখল। তারপর দুজনে দুদিকে। ফেরবার সময়ে রোজ গঙ্গাপ্রসাদকে দিদিমাসির বাড়ি থেকে কাজলকে সংগ্রহ করে বাড়ি আসতে হয়। এই নতুন ডিউটিটা গঙ্গাপ্রসাদ মোটেই পছন্দ করছেন না, কলেজের পর তাঁকে রোজ কলেজ স্ট্রিটে যেতে হয় অভিধানের কাজ সংকলনের ব্যাপারে। সেখান থেকে ফিরতে আটটাও হতে পারে, নটাও হতে পারে, তারপরে এগিয়ে গিয়ে কাজলকে নিয়ে আসা— না, না সে তাঁর খুব বিরক্ত লাগে। তিনি হতাশের মতো দেখেন ওইয্ যাঃ, তাঁর নিজের গোয়াবাগানের গলি পেরিয়ে গেল। এখনও তিন চারটে স্টপ তাঁকে এগিয়ে যেতে হবে। তারপর গলির মধ্যে হাঁটো …। কিন্তু উপায়ই বা কী? কাজল নইলে আসবে না। বলে দিয়েছে। সে যে স্বামী-পরিত্যক্তা নয় এইটা বোঝাতে নাকি গঙ্গাপ্রসাদের নিয়ম করে রোজ রাত্তিরে দিদিমাসির বাড়ি থেকে তাকে এসকর্ট করে নিয়ে আসতে হবে। তারপর রোজ সেখানে কাজলের মামিমারা তাঁকে খেয়েদেয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করবেন। তাঁদের খাওয়ানো মানে, রাত্তির দশটা কি এগায়োয় কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে খাগড়াই কাঁসার বাসনে ফুলকো ফুলকো সাদা লুচি গণ্ডা গণ্ডা বা বলা উচিত আগণ্ডা, কব্জি ডুবোনো কচি পাঁঠার মাংস, ভেটকি মাছ, কপি, বেগুন সে এক এলাহি কাণ্ড। প্রথম দিন অগত্যা রাজি হয়েছিলেন। ভজমামা বলে একটি মজাদার মামা আছে কাজলের, চোখ গোল গোল করে তাঁর সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করছিলেন। জামাই খেতে রাজি হয়েছে শুনেই, হঠাৎ উঠে গোঁত্তা মেরে পেছন দিয়ে পালিয়ে গেলেন। পরে খেতে বসে বোঝা গেল— ভজমামার কেরামতি। গঙ্গাপ্রসাদ ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন— কেন বাড়িতে যা হয়েছে তা কি খেতে দেওয়া যায় না!
ভজমামা বলল— ওরে বাবা, বাড়িতে যা হয়েছে সে একেবারে এলাকাঁড়ি। দেবে কী?
সামনে আবার পালঙ্কের ওপর দিদিমাসি বসা। তিনি বললেন— কেন দেওয়া যাবে না? তবে সে নাতজামাই যদি নাতজামাইয়ের মতনটি না হয় তবেই।
—লুচি মুখে গঙ্গাপ্রসাদ হাঁ। এ আবার কী ধাঁধা রে বাবা। নাতজামাই—নাতজামাইয়ের মতো হবে না?
ব্যাখ্যা করে বললেন দিদিমাসি— রোজ আসা-যাওয়া করো তো বুঝি, কুটুম-বাটুম নয়, আপনার লোক, তখন বাড়ির জিনিস ধরে দেওয়া যায়। তুমি আসবে বচ্ছরে একবার তো তোমাকে এমনিই খেতে হবে।
যাই হোক, কাজলকে আনতে না গেলে সে আসবে না। সুতরাং চলো শ্যামবাজার। সত্যি-সত্যি একদিন না আনতে গিয়ে দেখেছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। সাড়ে ন’টায় বাড়ি ফিরলেন তালা খুলে। সব অন্ধকার। পাওয়ার কাট। কারণ সুইচ টিপতে জ্বলল না। নিজের ব্যাগে খুঁজে দেখলেন টর্চ নেই। তাঁর ব্যাগ সাধারণত তিনি নিজেই গুছিয়ে নেন। তবে কাজল এটা-ওটা মনে করিয়ে দেয়।
—কলম নিয়েছ?
—পড়ার চশমা? ‘সবুজ’ ডায়েরি? —টর্চ? —টিফিন বাক্স? —এই রকম। তা এ কদিন দিদিমাসির বাড়িতে যে কী মধুর সঞ্চার হয়েছে : কাজল একেবারে উন্মনা।
টর্চ ছাড়া দোতলায় উঠতে গিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ দু-তিনবার ঠোক্কর খেলেন। তারপর দোতলায় উঠে কোনও নরম জিনিসের ওপর ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলেন। নরম জিনিসটা ঘ্যাঁও করে আওয়াজ করে লাফিয়ে পালাল। কোনক্রমে উঠে গঙ্গাপ্রসাদ দেখলেন আশপাশের বাড়ি আলো ঝলমল করছে। তিনি দালানের চল্লিশ পাওয়ারের বালবটা জ্বেলে দেখতে লাগলেন কোথাও বেড়ালের আঁচড় আছে কি না। থাকলে তাঁকে এক্ষুনি টক্সয়েড নিতে যেতে হবে। হয়ত সেই বারোটা মারাত্মক অ্যান্টির্যাবিজও। হাঁটুটা ছড়ে গেছে। সেটা পড়ে না আঁচড়ে? গঙ্গাপ্রসাদ স্থির করতে পারলেন না। কোনক্রমে জিনিসপত্র যথাস্থানে রেখে খুঁজেপেতে ডেটল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করলেন। তারপর ঢং ঢং করে দশটা বাজার আওয়াজে চমকে উঠে ফোন করলেন।
—কাজল আছে?
—বলছি।
—দশটা বাজল।
—তা বাজল।
—কাজল আমায় বোধ হয় বেড়ালে আঁচড়েছে।
—বেড়াল আবার কে? ফেণী? ও কাউকে আঁচড়ায় না।
—না ফেণী নয়, বোধ হয়, কোনও হুলো, অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি।
—তাহলে ও যে হুলো সে কংক্লুশনে আসছো কী করে?
—কী রকম ঘ্যাঁও মতো আওয়াজ ছাড়ল।
—তুমি তোমার দু মনি দেহ নিয়ে ওইটুকু তুলতুলির গায়ে দমাস করে পড়বে, তো ও ঘ্যাঁও করবে না তো কি আও আও করবে?
—কিন্তু হাঁটু ছড়েছে।
—ডেটল লাগাও। আশা করি পেয়েছ।
—পেয়েছি।
—পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য সম্ভব করেছ, এখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো।
—কী খাবো? গঙ্গাপ্রসাদ কাঁদো-কাঁদো। তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে।
—ফ্রিজটা খুলে দেখো, কিছুমিছু নিশ্চয় আছে, গরম করে নাও, নিয়ে টেবিলে বসো, খাও, বাসনগুলো সিঙ্কে নামিয়ে দাও, টেবিলটা পোঁছো। তারপর অভিধান লেখো গিয়ে— বোঝাই যাচ্ছে কাজল রেগে গুম হয়ে আছে।
ক্ষীণস্বরে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— দশটার সময়ে কি আর তোমায় আনতে যাওয়া যায়? না তুমিই একা আসতে পারো? আচ্ছা ভজমামাকে বললে হয় না? যদি তোমায় পৌঁছে দেন!
ওদিকে ফোন রেখে দেওয়ার কটাং শব্দটা হল।
গঙ্গাপ্রসাদ ফ্রিজ খুলে দেখলেন। একটু ভাত আছে এবং আছে সেই ঝোল। একবাটি। তিনি বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ডিম রয়েছে যথেষ্ট, পাঁউরুটি রয়েছে, এক প্যাকেট দুধ রয়েছে। ফল-ফুলুরির মধ্যে ফ্রিজের মাথায় একছড়া কলা।
শীতের রাত, কী করেন গঙ্গাপ্রসাদ? ঠিকাছে, পাঁউরুটি সেঁকে নেওয়া যাবে, আর দুধ, সেই সঙ্গে একটা ডবল ডিমের ওমলেট।
হঠাৎ দুম করে মনে পড়ে গেল— গ্যাস জ্বালতে তো তিনি জানেন না? গ্যাস খুব গোলমেলে জিনিস। নিজের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নিজে বেগুন পোড়ো হওয়ার চেয়ে উপবাস ভালো। সর্বনাশ! ফ্রিজ থেকে বার করা দুধের প্যাকেট পাঁউরুটি আর ডিমের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন গঙ্গাপ্রসাদ। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে, অবশ্য একটা উপায় বার হল। পাঁউরুটি সেঁকার একটা ইলেকট্রিক টোস্টার রয়েছে অসুবিধে নেই। দুধটা গঙ্গাপ্রসাদ একটা বাটিতে ঢাললেন, ইস্ত্রিটা গরম করলেন। এবার সেটাকে উল্টো করে ধরে দুধের বাটি বসিয়ে গরম করে নিলেন, এবার ডিমের পালা, ইস্ত্রি যা গরম হয়েছে তাতে করে এবার সুইচ অফ করে দিলেই হয়। তারপর তিনি ইস্ত্রির ওপরটা এক-চামচ তেল মাখিয়ে নিলেন। ডিম দুটো বাটিতে ভেঙে রেখেছিলেন। গরম তেল মাখানো ইস্ত্রির ওপর চড়াৎ করে সেটা ফেলে দিলেন, মুহূর্তের মধ্যে ডিমের স্বচ্ছ অংশ সাদা হয়ে ফুটে উঠল, হলদে দুটো টিপি হয়ে রইল। তবে ইস্ত্রি থেকে ডিম ছাড়াতে গঙ্গাপ্রসাদকে বিস্তর বেগ পেতে হল। পুড়ে গেল, ডিমের হলদে গড়িয়ে গেল। যাই হোক, খাওয়াটা মোটামুটি হল। হয়ে গেল।
পরদিন ভোরবেলা গিয়েই কাজলকে নিয়ে এলেন। কাজল ফ্রিজ খুলে বলল— সবই তো রয়েছে দেখছি। কী খেলে?
—পাঁউরুটি টোস্ট, ডবল ডিম ভাজা, গরম দুধ।
—বলো কি? কে করে দিল?
—তুমি। তুমিই করে দিলে— রহস্যময় মুখ করে বললেন গঙ্গাপ্রসাদ।
—আমি? আমি করলুম? মানে?
—মানে আবার কি? তুমি যে আমার স্ত্রী সেটা স্বীকার করো তো? না, কী?
—না করে উপায়?
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন স্ত্রীকে তো ইস্ত্রিও বলা যায়? যায় না?
—কাজল বিমূঢ়ভাবে চেয়ে থেকে বললে— ইস্ত্রি? হ্যাঁ, মুখ্যুসুখ্যু গাঁয়ের লোকেরা বলতে পারে—
—যারাই বলুক, কাজে লাগে সবারই, ইতর-ভদ্র, মূর্খ-বিদ্বান। বড় কাজের .. যাই বলো।
কাজল বোকার মতো চাইতে চাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এর দশ মিনিট পরে কাজলের চিল-চিৎকার। এ কী? আয়রনটা এরকম করলে কে? এ কী? পোড়াপোড়া এসব কী? ডিমের গন্ধ বেরোচ্ছে! এর মানে! কে এমন করেছে?
—আমি, আমি, আমি।
কাজল গালে আঙুল দিয়ে বিস্মিত-চণ্ডী মূর্তিতে এসে দাঁড়ায়!
—আর কে-ই বা আছে আমি ছাড়া?
—এতক্ষণ বলোনি?
—বলিনি মানে? অবশ্য বলেছি। প্রথমেই। বললুম না ওই আয়রনই আমাকে খাইয়েছে দাইয়েছে, গতকাল!
—তার মানে? তুমি তো বলছিলে, আমিই নাকি ….
—তুমি আমার কে হও সেটা ভাবো একবার।
—বউ।
—আহা শুদ্ধ করে বলো!
—স্ত্রী।
—অ্যায়। ঠিকই বলেছ। স্ত্রীকে ইস্ত্রিও তো বলা চলে!
কাজল বাক্যহারা হয়ে যায়। তবে এইভাবেই তার দিদিমাসির পাঁচালি শুনতে নিত্য যাতায়াতের পথে কাঁটা পড়ে।
গঙ্গাপ্রসাদের একদিকে মুশকিল আসান হলেও আর একদিক থেকে মুশকিলের ফ্যাঁকড়া বেরোয়। তাঁর নাকি একটি ছাত্রী জুটছে। ছাত্র-ছাত্রী গঙ্গাপ্রসাদের স্বভাবতই আছে। কলেজের ছাড়াও প্রাইভেট কোচিং। দু-চারজন অনার্স ও এম-এর ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে বিশেষ তালিম নিতে যে আসা-যাওয়া করে না তা নয়। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ এটা প্রশ্রয় দেন না। তাঁর অভিধান আছে। নানা পত্রপত্রিকায় বুক-রিভিউ আছে। তিনি এসব নিয়েই বেশ সুখে আছেন। বেশ কয়েক বছর আগে ফাদার জেনকিন্স বলে এক অস্ট্রেলীয় সাধুকে তিনি বাংলা পড়িয়েছেন। এম.এ কোর্স। ফাদার জেনকিনস গ্রিক, লাতিন, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, জার্মান, এগুলো সবই জানেন, বাংলা দিয়ে এশীয় ভাষা শেখা আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতটাও কোনও টোলের পণ্ডিতের কাছে শিখছিলেন। এঁকে পড়াতে গিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ একেবারে নাকের জলে চোখের জলে হয়েছিলেন। একটা বাংলা প্রবাদ শুনলে তিনি তার সুইডিশ আওড়াবেন, বাংলা শব্দের সঙ্গে জার্মান শব্দের মিল খুঁজবেন। এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য কোনও জায়গা পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ সেটা অন্য একটা ভাষায় অনুবাদ করতে আরম্ভ করে দেবেন। এর ফলে, যা এক ঘণ্টায় হয়ে যায় তা শেষ করতে সাত ঘণ্টা লাগছিল। তাঁর কোর্স শেষ হবার পর গঙ্গাপ্রসাদের সত্যিই মনে হয়েছিল গঙ্গাতে দুটো ডুব দিয়ে আসলে ভালো হত। বাব্বাঃ!
তা সেই ফাদার জেনকিনস কলেজে ফোন করেছিলেন একটি মার্কিন ছাত্রী গঙ্গাপ্রসাদকে পড়াতে হবে।
—ভয় নেই, ছাত্রীটি বেশ প্রাগ্রসর— ফাদার জেনকিনস বললেন।
গঙ্গাপ্রসাদ ক্ষীণকণ্ঠে বললেন— মানে অ্যাডভানস্ড? আপনার মতো?
—না না না, সে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ বলতে পারলেও পারতে পারে কিন্তু তেমন কিছু জানছে না। বাংলার বাউল নিয়ে কাজ করছে। কিছু কিছু জায়গার ব্যাখ্যা হয়ত আপনার কাছে চাইবে।
—কেন? আপনার কাছে চাইলেও তো পারতো? আপনি যথেষ্ট কমপিটেন্ট।
—প্রোফেসর মিত্র আমি এখন বেশ কয়েকটি ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তা ছাড়া উর্দু, পার্সিয়ান শেখা শেষ করে এখন চাইনিজ ধরেছি। বড্ড কঠিন।
—কিন্তু আমার অভিধান?
—লক্ষ্মীটি, সোনাটি, মণিটি, আমার প্রিয়তম, মধুটি অধ্যাপক মিত্র, ছাত্রীটিকে সাহায্য করুন।
গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গে কথা বলবার সময়ে ফাদার জেনকিনস পারতপক্ষে ইংরেজি বলেননি। এবং সব ইংরেজি বাংলা করার সময়ে তিনি অত্যুৎসাহবশত এরকম উদ্ভট কিছু কিছু বলেন।
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— কিন্তু বাবা জেনকিনস।
—কী বললেন? অধ্যাপক মিত্র …
—কিছু না। আপনি সব প্রিয় সম্বোধনের বাংলা করেছেন দেখে আমার বড় লজ্জা হল, তাই আমি ফাদার না বলে বাবা বললুম।
—কিন্তু বাবাটা বাঙালিরা নিজ বাবা ব্যতীত আর কাউকে ডাকে?
—হ্যাঁ বাবা জেনকিনস। বাঙালি কেন আপামর ভারতীয় একজনকে বাবা আমতে বলে ডাকে। মহাত্মা গান্ধীকেও সব গান্ধীবাবা, বা গাঁধিবাবা বলত। তাতে আর হয়েছে কী?
ফাদার জেনকিনস কেমন মুষড়ে পড়লেন। বললেন— ঠিক আছে। সব কিচ্ছু উৎকৃষ্ট আছে। ছাত্রীটি শীঘ্রই এসে পৌছবে। নিয়ে যাবো আপনার কাছে। আপনার পদবীর অর্থ বন্ধু। নয় কী?
তাই বলে আমাকে আর অধ্যাপক গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধু বলে লজ্জা দেবেন না বাবা জেনকিনস।
—না না, সে বড় উদ্ভট হবে।
ফাদার জেনকিনস ফোন রেখে দিলেন।
উদ্ভটত্বর একটা ধারণা তাঁর ছাত্রকে দিতে পেরেছেন ভেবে গঙ্গাপ্রসাদ কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন, কিন্তু মার্কিন ছাত্রীর কাঁটাটা রয়েই গেল।
১০
ফুটফুটে সকাল। বা বলা ভালো ফটফটে সকাল। মেলা প্রাঙ্গণের চেহারা এখন সম্পূর্ণ অন্য রকম। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলছে, সওদা নিয়ে পথের ধারে ধারে বসে গেছে লোক। কেনাকাটি শুরু হয়ে গেছে। লোক আসছে আরও। চানের যাত্রীও বহু। চান করে সব পটাপট জামাকাপড় বদলে ফেলছে। মায়ামি বীচ-টীচ দেখা থাকলে কোনও অসুবিধে হয় না। এরা স্টার প্লাস-এ দেখেনি যে এমন নয়, তবু তীর্ণা মন্তব্য করল— উঃ নদীর ধারে দাঁড়ানো যায় না, এই দাদা, লজ্জা করে না? চ’ অন্য দিকে!
অনীক বলল— আই টেক অবজেকশন তীর্ণা, তখন থেকে আমি নদীর দিকে পেছন ফিরে আছি।
গোপাল বললে— সাইকলজিটা বুঝছিস না? সব পাপ ধুয়ে যাচ্ছে, কেঁদুলির মেলাস্থানে যাবতীয় পাপ ত্যাগ করে শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সব এক বছরের মতো। সেই কারণেই একটা দিলখোলা, ডেভিল মে কেয়ার অ্যাটিচুড। মানে কাঁচা বাংলায় কাছা খোলা।
তীর্ণারা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। হোগলার বেড়া দিয়ে মাথায় গোল পাতার ছাউনি দিয়ে দিব্যি বিল্বদাজ রেস্টোরান্ট খুলেছে। তীর্ণা রাংতাকে নিয়ে শনশন করে সেখানে ঢুকে গেল। অগত্যা বাকি তিনজনও। এবং এইখানেই অনীক পেছন থেকে গিয়ে খপ করে ধরল জি.জি-কে।
—এই যে গোপালগোবিন্দ ডবল ভগবান, মামলেট খাচ্ছো? অত দামি শালটা বেচে মোটে মামলেট হল?
জি.জি— তার হাতের চামচ-সুদ্ধ শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। অন্যরা কেউই কিছু জানে না। অনীক এদিকে জি.জি-র কলার ধরে ফেলেছে। বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে দৃশ্যটা।
গোপাল শান্তভাবে বলল— মুকদ্দর কা সিকন্দর।
অনীক কলারটা চেপে রেখে পাশ ফিরে বলল— এই লোকটি আসলে একটি …
গোপালগোবিন্দ হাউমাউ করে উঠল—গণধোলাইয়ে মারা যাবো দাদা, উচ্চারণ করবেন না কথাটা। আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি, চাদর আপনার ঘরে রেখে এসেছি।
—মানে?
—আমাকে আগে খাওয়াটা, নাঃ খাওয়া মাথায় উঠে গেছে খিদে নেই।
দোকানের অন্যান্য লোকজনও সব খাওয়া-দাওয়া ফেলে এদিকে ফিরে তাকিয়েছে। একজন মস্তান গোছের ছোকরা এগিয়ে এসে মোটা গলায় বলল—কী দাদা, কাউকে ধোলাই দিতে হবে?
যশ বলল— দরকার হলে আমরাই পেরে যাবো। — সে তার বালাটা খানিকটা নাচিয়ে নিল।
গোপাল বলল— ওরা তো তোর হেডড্রেসটা দেখতে পাচ্ছেই, আবার বালা নাচাচ্ছিস কেন?
যশ বলল— হেডড্রেসটার কথা মনে ছিল না ইয়ার।
রাংতা বলল— আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি অর্ডার দিচ্ছি, তোমাদের ইচ্ছে হয় মারামারি করো। এই খোকা শোনো—দুটো মোগলাই পরোটা, চারটে আলুর দম, তীর্ণা আলু খাস তো? দুটো করে অমৃতি, গজা আছে? জিবে গজা,—হ্যাঁ দুটো। আর কি আছে? এক পট চা।
খোকা বলল— পটের চা নেই, আমরা খালি টসের চা করি।
রাংতা বলল— শাববাস! তো তাই আনো।
অনীক পাশ ফিরে বলল— বা বা বা। দুজনের মতো অর্ডার! আমাদের আর খাওয়ার দরকার নেই!
তীর্ণা বলল— কেন? তোর তো মারামারি করেই পেট ভরে গেছে বলে আমাদের ধারণা।
গোপাল বলল— ঘাবড়াচ্ছিস কেন সিকন্দর, আমাদের কি মুখ নেই? আমরা কি অর্ডার দিতে জানি না? এই খোকা, তিন-চারে বারোটা ডালপুরী, তিন চারে বারোটা আলুর দম, তিন চারে বারোটা জিবে গজা। মাংসের চপ আছে?
—না ওগুলো ভিজিবিল চপ।
—হাঁ বাবা ইনভিজিবল যে নয়, তা দেখতেই পাচ্ছি, আচ্ছা ওগুলোও কি তিন চারে।
—না ওগুলো একই রেটে খেলে খুব সম্ভব টেঁসে যাবো। ওগুলো তিনটে।
গোপালগোবিন্দ বলল— আপনি তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, হঠাৎ দেখি একটা চেনা-চেনা গুণ্ডা প্রকৃতির লোক— অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমার দিকে কটকট করে চেয়ে আছে। স্রেফ প্রাণের ভয়ে আপনার শালটা নিয়ে আমি মাথা মুড়ি দিয়ে কেটে পড়েছি। চাদরটা আপনাদের ঘরেই রেখে এসেছি আবার।
অনীক বলল— এ তো দেখছি অসম্ভব সন্দেহজনক? চেনা গুণ্ডা প্রকৃতির লোক? শুনছিস গোপলা, গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেরা এর পেছনে ঘুরে বেড়ায়। তারা আবার চেনা এর। স্মাগলার, ডেফিনিট।
জি.জি ককিয়ে উঠল— চেঁচাবেন না, অত চেঁচাবেন না প্লিজ। আমি একটু আধটু পলিটিকস করি কিনা, তাই ওই ধরনের লোকেদের এড়াতে পারি না।
—ডেঞ্জারাস! যশ বলল।
অনীক বলল— চাদর আমাদের ঘরে রেখে এসেছেন মানে! ঘর আইদার ভেতর থেকে অর বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আপনি কি সিঁদ কেটেছেন?
—না। কাঁদো-কাঁদো গলায় গোপালগোবিন্দ বলল— তখন আপনাদের ওই বোন দুটি দরজা খুলে বেরোচ্ছিল— আমি ওদের হাতে দিয়ে এসেছি।
—এ কথা সত্যি?— অনীক তীর্ণার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল।
—হ্যাঁ।
—তা এতক্ষণ সেটা বলিসনি কেন?
—কিসের জন্য ও ভদ্রলোক মার খাচ্ছে, আমি জানবো কী করে?
—যাক গে এখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হল আপনাকে, ওমলেটটা শেষ করতে পারেন।
জি.জি কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল— আর ওমলেট! ও অনেকক্ষণ গুবলেট হয়ে গেছে।
সে বেরিয়ে গেল।
তীর্ণা বলল— তুই একটা লোককে শুধু শুধু কলার ধরলি, যা-তা বললি, একটা ক্ষমাপ্রার্থনা পর্যন্ত করলি না?
রাংতা বলল— রাইট। ভোর চার-সাড়ে চার নাগাদ আমরা সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোচ্ছি, ও এসে বললে আপনার দাদা আসরে ঘুমিয়ে পড়েছেন শালটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, নির্ঘাত চুরি হয়ে যাবে তাই নিয়ে এলুম। সো গুড অফ হিম আর তোম … বলতে বলতে রাংতা চোখ বড় বড় করে থেমে গেল।
—কী ব্যাপার, কী হল?— তীর্ণা জিজ্ঞেস করল।
—কিন্তু ও তো অনীকের শালটা আত্মগোপন করার জন্য ঠিক চুরি না বলেও ধারই নিয়েছিল! আমাদের তো কই সে কথা …
তীর্ণাও চোখ বড় বড় করে বলল— আমাদের ঘরটাও তত ওর চেনবার কথা নয়? যশ এতক্ষণে ইন নিল, সে আঙুলে আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল— তার মানে ইদার ও চুপিচুপি আমাদের ঘরটা জেনে নিয়েছে। লক্ষ্য রেখেছে। কথা হচ্ছে টু হোয়াট এন্ড? উদ্দেশ্যটা কী, অর, চাদরটা ওর দেবার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। রাংতাদের ঘরের সামনে জাস্ট অ্যাকাসিডেন্টালি দেখে ফেলে উর্বর মস্তিষ্ক থেকে ও সবটা বানায়। শালটা হজম করা ওর হয় না।
গোপাল বলল— সন্দেহজনক চরিত্র। অনীক যদি ওকে খামকা অপমান করে থাকে, তাহলে ও ক্ষমাপ্রার্থনাটা দাবি করতেও তো পারতো।
চারদিকে প্রচুর লোকে খাচ্ছে। মেলায় শহর-টহর থেকে ভালো ভালো জামাকাপড় পরা সব অতিথি এসেছে প্রচুর। উচ্চৈঃস্বরে ট্রানজিস্টর বেজে উঠল, একজন আবার গত রাত্তিরে বাউল গান টেপ করেছে, সেই টেপ চালাচ্ছে।
—ফ্যানটাসটিক!
—আসলে অ্যাটমসফিয়ার বুঝলি? বাতাবরণ। বন্যেরা বনে সুন্দর, বাউলরা কেন্দুলিতে।
—রেডিও টিভির বাউল গানের সঙ্গে কী তফাত।
—তা ছাড়া একটা আধ্যাত্মিক …
—মারো গোলি, আধ্যাত্মিক না আরও কিছু। দিব্যি লিভিং টুগেদার হচ্ছে ভাই, আজ এ বাউলনী, কাল ও বাউলনী, একটা বুড়ো আবার মেম জুটিয়েছে দেখেছিস?
যশ-গোপাল-অনীকের কান খাড়া।
ওদিকে কথা চলছে— মেম! কী রকম?
—হ্যাঁ রে শালা, মেম বাউলি— ওই বটতলায় মনোহরদাস বাউলের গান শুনছিলুম না! ওর বাউলনী, মেম। মাথায় সাদা চুল দেখে লোকে অন্ধকারে বুড়ি ভাবে। আসলে কিন্তু বুড়ি নয়। বাউলরা অত বোকা নয়। এ হল মেমদের সাদা চুল। ওদের মধ্যে অনেক রঙের চুল হয় না!
—তুই কী করে বুঝলি, মেম?
—আমার চোখকে ফাঁকি দেবে এমন মেম আজও জন্মায়নি, বুঝলি?
—তুই কি মেম-স্পেশালিস্ট?
—সে তুই যা বলেই মজা করিস, কপালে রসকলি কেটে, ঘোমটা দিয়ে আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না।
—তা এর মধ্যে এতো লুকো ছাপারই বা কী আছে? সেই হিপিদের সময় থেকেই তো ওরা এ চত্বরে ঢুকছে, কে কৃষ্ণভক্ত, কে রজনীশ-ভক্ত, বাউল হতেই বা বাধা কিসের?
—এ একরকম ভালো, বুঝলি? এইভাবে হিন্দুধর্ম প্রচার হয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরে গেল।
যশ খুব গম্ভীর মুখ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— তোরা খাওয়া শেষ কর। আমি চললুম। কাজ আছে।
গোপাল বলল— হয়ে গেছে, আমারও হয়ে গেছে।
অনীক ফিসফিস করে বলল— কাল আমি বটতলায় এই মেম বাউলনীকে দেখেছি বোধহয়।
—সে কী? এতক্ষণ তো বলিসনি?
—বুঝতে পারিনি। একটু কেমন-কেমন লেগেছিল, কিন্তু বুঝতে পারিনি।
গোপাল বলল— মনোহরদাস যদি আমার চেনা মনোহারদাসই হন তাহলে কিন্তু টেকনিক্যালি বাউল নয়, বৈষ্ণব।
যশ বলল— মারো গোলি। উই আর ইন্টরেস্টেড ইন মনোহরদাস অ্যাজ লঙ অ্যাজ হি হ্যাজ এ মেম লিভিং উইথ হিম।
তিনজনে গটমট করে বেরিয়ে গেল।
রাংতা বলল— কী ব্যাপার বল তো! এরা তো মনে হচ্ছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছে, আমরা যার কিছুই জানি না।
তীর্ণা রেগে আগুন হয়ে বলল— ওদের সঙ্গে আমি অন্তত আর কোনও সম্পর্কই রাখছি না। আমি ফিরে যাচ্ছি। তুই যাবি?
রাংতা বলল— সেটাই ঠিক হবে। দিস ইজ টু মাচ।
শীতের দিনের দুপুরের রোদ গায়ে খুব মিঠে লাগে। যথেষ্ট ক্রুদ্ধ থাকলেও ওরা মেলায় ঘুরে ঘুরে লোকেদের জিনিস কেনা দেখতে লাগল।
—এগুলো কী রে? তীর্ণা জিজ্ঞেস করল।
পেছন থেকে কেউ জবাব দিল— লাঙলের পার্টস। কিনবেন?— অশোক সাঁতরা
—আমরা কিনব? লাঙলের পার্টস— রাংতা অত্যন্ত বিরক্ত।
অশোক সাঁতরা বলল— আহা। কিনবেন কেন কেনবার ভান করবেন।
—ভানই বা করতে যাবো কেন— তীর্ণা প্রায় তেড়ে উঠল।
—রাগছেন কেন? সব কিছুরই একটা কারণ আছে। আমি রিপোর্টার, এতক্ষণে জেনে গেছেন নিশ্চয়, আপনাদের লাঙল- কিনতে-রত অবস্থায় একটা ছবি নিতাম। স্টোরি হত। টু বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল ফার্মিং এন্টারপ্রেনার্স।
—তার চাইতে আমরা আপনার একটা ছবি তুলি না কেন? আ ড্র্যাব বাট ডিউটিফুল ফেক রিপোর্টার।
—ফেক? আপনারা বিশ্বাস করছেন না?
—কেউই বিশ্বাস করবে না। রিপোর্টারদের এ রকম অ্যামেচারিশ হাবভাব হয় না। অভিনয় শেখার ছোটখাটো স্কুল এখন কলকাতায় অনেক হয়েছে। শিখে নেবেন।
—প্রেস কার্ড দেখবেন?
—দেখি
—অশোক সাঁতরা তার জিনসের পকেট, শার্টের পকেট, কার্ডিগ্যানের পকেট হাতড়ালো— এইয্ যাঃ। বোধহয় ঘরে ফেলে এসেছি। সব্বোনাশ। আচ্ছা, আপনাদের ওই দাদারা কোথায় গেলেন?
তীর্ণা বলতে যাচ্ছিল, ‘মেম খুঁজতে।’ কিন্তু ‘মে’টুকু বলার পরই রাংতা তাকে এমন চিমটি কেটে ধরল যে, সে কথাটা পাল্টে নিয়ে বলল— মে-মেসোপটেমিয়ায়।
—ঠাট্টা করছেন? অশোক বিগলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
—বুঝতে পেরেছেন তাহলে? বলে ওরা মেলাচত্বরের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অশোক সাঁতরার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
—তা যদি বলিস, সব ছেলেই ফেক। —রাংতা মন্তব্য করল।
তীর্ণা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বলল— অনীককে তো আমি এই প্রথম দেখছি। কিন্তু গোপাল আর যশকে তো চিনি। মানে ভাবতুম চিনি। এখন দেখছি, মোটেই চিনি না। এই মেম-সন্ধানী যশ আর গোপালকে আমি চিনি না জানি না, বলতে বলতে রাংতা রুমাল বার করল। সেটাকে মুখের ওপর থাবড়ে থুবড়ে আবার পকেটে পুরে ফেলল।
তীর্ণা সন্দিগ্ধ সুরে বলল— তুই কি রুমালের মধ্যে খানিকটা কেঁদে নিলি নাকি।
—কেঁদে নেবো? হোয়াট ননসেন্স!
হাঁটতে হাঁটতে ওরা ততক্ষণে নিজেদের সেই অদ্ভুত ঘরের সামনে এসে পড়েছে। তালা খুলে ঘরটায় ঢুকে ওরা নিজেদের জিনিসপত্র নিতে লাগল।
তীর্ণা হঠাৎ গোছানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করল— রাংতা একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবি না?
—মনে করার মতো হলে …
—এই দলে তুই কী হিসেবে ..
—তোর কী মনে হয়?
কিছু মনে করিস না, আমার মনে হয়েছিল, আমার দাদা তোর অনেক দিনের চেনা। ও-ই তোকে ঢুকিয়েছে।
রাংতা হাসল— সবাই তাই ভাবে।
—মানে?
—আমার লোকেদের সঙ্গে খুব সহজে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হয়তো জীবনেও কখনও দেখিনি, দেখব না, লোকে বলবে বাবা কতদিনের বন্ধুত্ব।
—সত্যিই তুই দাদার ইয়ে নোস?
আজ্ঞে না। তবে তুমি যে গোপালের ইয়ে সেটা…
—খবর্দার রাংতা, ঝগড়া হয়ে যাবে। গোপাল ইজ জাস্ট এ ফ্রেন্ড। এই একবিংশ শতকের দোরগোড়াতেও একটা দাড়ি-ঝুলপিঅলা ছেলের সঙ্গে ইয়ার্কি মারলে যদি সবাই মিলে বলতে শুরু করে
যেয়োনাক অই যুবকের সাথে …
মা থেকে, বন্ধুরা থেকে— সব্বাই, তখন কিন্তু জেদ চেপে যায় সাঙ্ঘাতিক।
—আচ্ছা আচ্ছা, ও কথা আর বলব না। তোকে তোর দাদা অনীক মিত্তির ঢুকিয়েছে। অল রাইট?
—আর তোকে?
—আমি মানে ইয়ে…
—কোথায় যেন থাকিস! গোপাল বলছিল, ভোলা ময়রা লেনে।
রাংতা চোখ বড় বড় করে বলল— বলেছে বুঝি? তাহলে ওই ভোলা ময়রাতেই থাকি।
—তার মানে? তুইও কি একটা সন্দেহজনক চরিত্র?
—দ্যাখ গোপাল যখন বলেছে— আমি ভোলা ময়রা লেনে থাকি তখন গোপালের মন রাখবার জন্যেও অন্তত আমার ওই লেনটায় স্টিক করে থাকা দরকার। কোথায় রে লেনটা? চিনিস?
—নিজের গলি আমাকে চেনাতে বলছিস? উঃ, সত্যি আমি এবার পাগল হয়ে যাবো।
তীর্ণা চুপ করে গেল। গম্ভীরও। কেউ যদি নিজের বাসস্থানের কথা বলতে না চায় তাহলে তাকে জোর করে বলবে, এমন মেয়েই তীর্ণা নয়। কৌতূহল আছে বটে তার মায়ের।
গোপাল যেদিন প্রথম তাদের বাড়িতে এলো!
—গোপাল হালদার? এই নাম তো একজন বিখ্যাত লোকের।
—আমার মতো অবিখ্যাত লোকেরও ওই একই নাম, বিশ্বাস করুন?
—বিশ্বাস করার কথা বলছো কেন? তাহলে নিশ্চয় অবিশ্বাসের কিছু আছে? তারপর— অনীকের বন্ধু তুমি তো তীর্ণার নাম ধরে ডাকলে কেন?
—এ সময়ে অনীক থাকবে না আমি জানি।
—তীর্ণা থাকবে, কী করে জানলে? টেলিফোনে অ্যাপো করে নিয়েছিলে?
—মাসিমা চান্স নিয়েছিলুম।
—কী চান্স? যে মাসিমা বাড়ি থাকবে না!
এরপর কার কী বলবার থাকতে পারে?
—তারপর —তীর্ণার সঙ্গে কোথায় আলাপ হল?
—ট্র্যামে।
—ইস্স, দারুণ ফিলমি ব্যাপার, কিন্তু চিনলে কী করে অনীকের বোন বলে?
—অনীক সঙ্গে ছিল।
—এতো জমল কী করে?
—তীর্ণা খুব জমাট মেয়ে মাসিমা!
—কই আমি তো বুঝি না! আমার সঙ্গে তো কই জমে না!
এর পরেই বা কার কী বলার থাকবে?
এত সত্ত্বেও মার নালিশ গোপাল নাকি এত কথা বলে যে, মাকে কথা বলতেই দেয় না।
ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। হঠাৎ তীর্ণা লক্ষ্য করল রাংতা গুম হয়ে বসে আছে।
—কী হল তোর?
—আমার সঙ্গে যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তা কখনও বুঝিনি!
—কে?
রাংতা কোনও জবাব দিল না।
—কি রে, আমরা যে চলে যাবো ঠিক হল?
এবারেও রাংতা কোনও জবাব দিল না।
সে কিছু ভাবছে।
তীর্ণার এইবারে রাগ হয়ে গেল। এমনিতে সে যথেষ্ট মাথা-ঠাণ্ডা মেয়ে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটছে, তাতে করে মাথার ঠিক রাখা শক্ত। সে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াল,— আমি যাচ্ছি রাংতা।
রাংতা নিজের ভাবনায় মগ্ন। — বলল— ও যাচ্ছিস?
তীর্ণা দরজাটাকে নিজের পেছনে দুম করে বন্ধ করল। মানে করার চেষ্টা করল। এমন বিদঘুটে দরজা যে কোনও আওয়াজই হল না।
আগেই সে ঠিক করেছিল, দুর্গাপুরের দিকে আর ফিরবে না। বোলপুরের দিক দিয়ে চলে যাবে। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে। আরেক দিন বাউল গান শোনা হল না। ওরা নাকি অনেকে মিলে আসর বসায়। গানের মধ্যে দিয়ে কী সব গূঢ় তত্ত্বের আলোচনা করে। গূঢ় তত্ত্বের ওপর তার বাবার লোভ থাকতে পারে, তার নেই। কিন্তু আলোচনাটা যদি গানের ভেতর দিয়ে হয়। এবং সে গান এমন সুশ্রাব্য, তাহলে তাতে তার যথেষ্ট লোভ আছে। দাদার জন্যে, স্রেফ দাদার জন্যে সে আশ মিটিয়ে বাউল গান শুনতে পেল না। প্রথমটা তো আসার পথে রাংতার সঙ্গে সেঁটে রইল। এখন দেখা যাচ্ছে রাংতা তাকে পাত্তা দেয় না।
সে গটগট করে হাঁটে। রাস্তায় কারো সঙ্গে দেখা হয় না। শুধু মেলার কেনাবেচার হট্টগোল, সেই রেস্টোরান্টের খোকাটা ‘এদিক আসুন দুপুরে বিড়িয়ানি হচ্ছে, দুপুরে বিড়িয়ানি’ বলে আপ্রাণ চেঁচাচ্ছে, কয়েকজন বলতে বলতে গেল—আজ মনোহরদাসের ওখানে মোচ্ছব। তিন রকমের ডাল, সাত রকমের তরকারি। শীর্ষা সম্প্রদায়ও— অতিথি সেবা করছে। … ওদের ওখানে বড্ড কুঠেরা যায়, ওদিকে যাচ্ছি না। যদিও শুনছি তিন রকমের চাটনি করেছে। যা খাবি সব হজম হয়ে যাবে … আজ রাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মঞ্চে … বুঝলি? পতিতদাস বলে এক ছোকরা দারুণ গাইছে। বুড়োদের ওই খ্যানখেনে গলার গান আমায় তেমন অ্যাপিল করে না …
তীর্ণা পা চালাল। একটা বিরাট এপার-ওপার শালুতে একটা চানাচুরের বিজ্ঞাপন। সেটা পেরোলেই বোলপুরের রাস্তা।
এইবারে তীর্ণার একটা সুবিধে হয়ে গেল।
—কোথা থেকে কে ডাকছে— টিনা টিনা, হাললো টিনা।
কিছুক্ষণ শুনতে শুনতে তার মনে হল, এখানে কোনও টিনা নেই। তাকেই ডাকছে কেউ। ভালো করে এদিক ওদিক চাইতে একটা কালো মারুতি ভ্যান থেকে সকালে দেখা সেই মেয়েটি বেরিয়ে এলো। এখন তার পরনে জিনস আর একটা ফতুয়া মতো টপ, শীতে কোনও বিকার নেই।
—হাললোলা টিনা, কোথায় যাচ্ছে?
—শান্তিনিকেতন যাবো।
—কী মধুর! আমিও তো যাবো! তা তোমার সঙ্গিনী সেই কী যেন নাম … রুংটা? ও? কোথায়?
—ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে। উই হ্যাভ কোয়ারলর্ড।
মেয়েটি খুব বুঝদারের মতো বলল— লুদের মধ্যে ওর্কোম হোয়।
—লু? লু আবার কী?
—লু? লেসবিয়ানদের আমরা লু বলি।
তীর্ণার মুখ গনগনে লাল। সে তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে চলতে লাগল।
—হাই টিনা। কুথায় চললে। হোয়াঁটস রং? লু তো কী হয়েছে? তীর্ণা লাল মুখ ফিরিয়ে বলল।
—ও সব লু ফু আমরা নই। শী ইজ জাস্ট এ ফ্রেণ্ড। আমি চললুম।
—দুঃখিত দুঃখিত। টিনা, আমি জানি না তুমি এর্কম রাগ কর্বে। শুনো শুনো। আমিও শাণ্টিনিকেটন যাচ্ছি। সঙ্গে কার আছে। লক্ষ্মীটি, সোনাটি আমার সঙ্গে চলো।
এমন অনুনয় করতে লাগল মেয়েটি যে, টিনা বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারল না। বিশেষত কালো গাড়ির দরজা ঠেলে আবার এক ফর্সা ফাদার নেমে এলেন।
—সাক্ষাৎ করো টিনা, ইনি ফাদার জেনকিনস। আমি এঁর কাছে বাংলা শিখেছি। ইনি আমার গুরু, তোমাদের যেমন টাকুর তেমনি।
তীর্ণার খুব হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। ফাদার জেনকিনস দেখা গেল তাঁকে গুরু বলায় এবং টাকুরের সঙ্গে তুলিত হওয়ায় ভীষণ খুশি। প্রায় ফুলে উঠেছেন।
তীর্ণা বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।
ফাদার জেনকিনস বললেন— এডিথ, তুমার তোথ্য কোতো সংগ্রহ হল?
তীর্ণা চমকে বলল— এডিথ? তোমার নাম এডিথ?
—ইয়া। এডিথ সিং কাপুর
—তুমি আমেরিকান বললে না?
—ইয়া। তবে আমি ভার্তের সিটিজেনশিপের জন্য দরখাস্ত্ করছি।
—তুমি কি মনোহরদাসের আখড়ায় বাউলনী সেজে ছিলে?
—ইয়া। মনোহরদাসই তো আমায় কোতো তোথ তোথ্ তোত্থ দিলে।
—তুমি কি কাল রাতে মনোহরদাসের সঙ্গে গান গাইছিলে?
—গান গাইনি। অতিশয় কোঠিন। আমি বাজা বাজাচ্ছিলুম।
—তোমার চুল শাদা ছিল?
এবার এডিথ ফিক করে হেসে দিল।
বলল— মাথায় সাদা উইগ ছিল, কপালে চিমটার মতো কলি ছিল। —ছাই-ভসস ছিল। গলায় তুলসি কাঠের কণ্ঠী ছিল। ওকার কালার্ড শাড়ি ছিল। তুমি আমাকে দেখলে চিনটেই পারছে না।
—এরকম ড্রেস করেছিলে কেন?
—শিকবার জন্যে। বাউল-ওম্যান কী পরে, কী খায়, কেমন ঘোরে। অ্যাণ্ড দেয়ার ওয়াজ অ্যানাদার রীজন।
—সেটা কী?
—কিচু খারাপ লোক আমার পিছু ঘুরছে।
তীর্ণার মুখ কালো হয়ে গেল। চোখের সামনে তিনটি মূর্তি ভেসে উঠল।
ফাদার জেনকিন্স্ বললেন— এডিথ এখন তুমি নিরাপদ তো?
—আই থিংক সো।
তীর্ণা ফিসফিস করে বলল— এই খারাপ লোকেদের তুমি চেনো? নাম জানো?
—চিনছি সবাইকে না। নাম জানি খালি একজনের। যশজিৎ সিং।
তীর্ণা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। যাক্ অন্তত…।
১১
শীতের লম্বা বেলা। কাজলরেখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার চুলের জট ছাড়াচ্ছে। দেখতে পেল অনীক ফিরছে। যেন বিধ্বস্ত সাবমেরিন, চুলে চিরুনি পড়েনি। জিনস-টিনস যেন সব দোমড়ানো মোচড়ানো, পেছনে যে ব্যাগটা ঝুলছে, সেটা যেন কতকাল মাটিতে পোঁতা ছিল। বার করে এনেছে। কাজল আপন মনেই বলল— বাব্বাঃ, মেলা দেখে ফিরল না তো যেন যুদ্ধে হেরে ফিরল।
এমন সময়ে মোড়ের মাথায় আরও কয়েক মূর্তি দেখা দিলেন। গোপাল, একে কাজলরেখা আগেই হাড়ে হাড়ে চেনে। এর ঝুলপি আরও ঝুলেছে। দাড়িতে গোঁফেতে মুখটা একেবারে যাচ্ছেতাই নোংরা হয়ে আছে। একটা উইণ্ডচীটার পরেছে, তার বুকের জিপার খোলা। একে বেঁটে, তাকে আরও বেঁটে দেখাচ্ছে একটি লম্বা শিখ যুবক পাশে থাকায়। শিখটি ওরই মধ্যে পাগ-টাগ বেঁধে একটু ভদ্রস্থ।
কাজল পাগড়ির রংটা দেখে বেশ পুলকিত হল। শকিং পিংক। পিওর সিল্কের ওপর যা খুলবে না! শিখ যুবকের পর একটু দূরে একটি মড মেয়ে হাঁটছিল। বয়-ছাঁট, যা কাজল দুচক্ষে দেখতে পারে না। তবে তা সত্ত্বেও মেয়েটা দেখতে বেশ। একটা বেশ ললিতে-কঠোরে ভাব আছে। ওমা সবগুলোই তাদের বাড়িতে ঢুকছে যে। কাজল ভেবেছিল শিখটা আর বয়-ছাঁট মেয়েটা রাস্তা পার হয়ে সার্কুলার রোডের দিকে চলে যাবে, গোয়াবাগান দিয়ে শর্টকাট নিচ্ছে।
নিচের দরজাটা এখন খোলাই থাকে। কে চোদ্দবার নিচে যাবে আর দরজা খুলবে বন্ধ করবে। ওপরে সিঁড়ির মুখে কোল্যাপসিব্ল গেট লাগানো। কাজল তালা খুলতে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। গঙ্গাপ্রসাদ বাড়ি আছেন। ক্যোল্যাপসিব্ল গেটের অদূরেই আছেন কিন্তু তিনি অভিধানে ধ্বস্ত। একটু আগে ধোপা এসেছিল। তার আগে একজন ছাত্র। দুবার তালা খুলতে হয়েছে অভিধান ছেড়ে। আবার উঠতে হলে গঙ্গাপ্রসাদ বোধ হয় গঙ্গাযাত্রাই করবেন। কথাটা কাজল মনে মনে ভাবে।
—মা, এই হল যশ। বিরাট ট্রেকার। এভারেস্টে গেল বলে।
অনীকের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে কাজল বলল— এভারেস্টে তো এখন মেয়েরাও উঠে গেছে। তা তুই তো বলিসনি যশজিৎ শিখ।
সারা ভারতবর্ষ শিখে গেল কারো জাত-ধর্ম নিয়ে কথা বলতে হয় না। অনীকের মা শিখল না।
এই হল অনীকের মা। বন্ধুবান্ধবের সামনে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যায়। অনীক যথাসাধ্য মেজাজ ঠাণ্ডা করে মুখে একটা দেঁতো হাসি টেনে এনে বলে— কেন? শিখ জানলে কি যেতে দিতে না?
কাজলরেখা গালে হাত দিয়ে বলে— ওমা! যেতে দেবো না কেন? কিন্তু জ্বলন্ত পাঞ্জাবের একজন নাগরিক, সবুজ পাঞ্জাবের একজন নাগরিক…
গোপাল বলল— ও জ্বলন্ত বা সবুজ পাঞ্জাবের নাগরিক নয় মাসিমা। নেহাতই নিরামিষ কলকাতার ভবানীপুরের তিন পুরুষের বাসিন্দা। রেস্তোঁরার ব্যবসা আছে।
—রেস্তোঁরা মানে তো ধাবা? তরকা-রুটি?
—না, আমাদের সব রকম হয় মাসিমা। মাংস, মাছ, পেঁয়াজের বড়া, চাইনিজ।
—ওমা! শিখ বাঙলা বলছো!
—বাঙালিই তো হয়েছি মাসিমা। আমার সঙ্গে এই গোপালের কোনও পার্থক্যই নেই।
—তা যদি বলো, গোপালের সঙ্গে তোমার অনেকই পার্থক্য।
গোপাল কাঁচুমাচু মুখ করে বলল— বুঝলি যশ, মাসিমা আমাকে একেবারে দেখতে পারেন না।
অনীক বলল— আর এ হচ্ছে মা, সেই বিখ্যাত রাংতা।
কাজল বলল— যশের গার্লফ্রেণ্ড?
যশ রাম বোকার মতো মুখ করে বলল— কী করে বুঝলেন?
—ও বোঝা যায় ঠিক— কাজল উড়িয়েই দিল প্রশ্নটাকে— বলল— বসো সবাই, যা চেহারা করে এসেছ! একটু চা খাবে তো?
—হয়ে যাক মাসিমা, গোপাল বলল।
কাজল তার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, অনীক বলল— মা, বাবা কি কলেজে?
—না, ডিকশনারিতে।
—আর তীর্ণা?
—তীর্ণা? তীর্ণাকে এখানে কোথায় পাবে? সে তো তোমাদের সঙ্গেই ফিরবে?
মুহূর্তে সবার মুখ ছাইয়ের মতো হয়ে গেল।
—কেন ও কোথায়? ও নেই তোমাদের সঙ্গে? তাই আমি ভাবছি কী যেন নেই, কে যেন নেই!
—মা ঠাট্টা বন্ধ করো— অনীক গম্ভীর মুখে বলল— তীর্ণা বাড়ি যাচ্ছি বলে রাংতার সঙ্গে গুড বাই করে চলে এসেছে।
—একা রাংতার সঙ্গে কেন? তোমরা? তোমরা কোথায় ছিলে?
—আমরা একটু এদিক-ওদিক…
রাংতা হঠাৎ মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল।
কাজল রীতিমতো ভয় পেয়ে বলল, ও কি? রাংতা কাঁদছে কেন? ও কি তীর্ণার সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া করেছে?
রাংতা ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল— তেমন কিছু নয় মাসিমা। বিশ্বাস করুন। আমরা দুজনেই চলে আসব ঠিক করি, গোপালদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে।
—গোপালের ব্যবহারে বিরক্ত হবারই কথা। কিন্তু আর দুজন কী করল?
—কিছুই করিনি মাসিমা।— যশ বলল— আমাদের আসলে কেঁদুলি যাবার একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমরা একটি—
অনীক বলল— আমেরিকান মেয়েকে…
যশ বলল— খুঁজতে গিয়েছিলাম। মেয়েটি আমার কাকার। উনি অনেক দিন ধরে স্টেটসে সেটল্ড্। আমাকে ফোন করে ওকে এখানে সাহায্য করবার কথা উনিই বলেছিলেন। তিন বছর আগে। কিন্তু এখন মুশকিল হচ্ছে, ও আমাদের থেকেও পালিয়ে গেছে। ও বাউল নিয়ে কাজ করছিল, ভালো বাংলা শিখেছে… কেন যে.. পালিয়ে বেড়াচ্ছে…
এই সময়ে গঙ্গাপ্রসাদ একটা ঘরের মধ্যে থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এসে বললেন— আরও অ্যামেরিকান মেয়ে পড়াতে আমি পারবো না। একা, ফাদার জেনকিনসেই রক্ষা নেই… তারপর ছেলেকে দেখতে পেয়ে বললেন— ওঃ তুমি! চারদিকে তাকিয়ে বললেন— নো মোর স্টুডেন্টস্ প্লীজ।
কাজল বলল— তোমার মেয়ে হারিয়ে গেছে আর তুমি স্বার্থপরের মতো বকে যাচ্ছ! এরা তোমার কাছে পড়তে এসেছে, কে বলেছে?
—আমার মেয়ে হারিয়ে গেছে? মানে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। একজন মার্কিন মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে এরা একজন বাঙালি মেয়েকে, নিজেদের ঘরের মেয়েকে, নিজেদের বোনটিকে হারিয়ে এসেছে—বলতে বলতে কাজল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
গোপাল আবেগের সঙ্গে বলল— মাসিমা, তীর্ণাকে আমরা খুঁজে বার করবই। আপনার কোনও ভাবনা নেই। মেসোমশাই, আপনি নিশ্চিন্তে অভিধান লিখুন, গোপাল হালদার থাকতে আপনাদের কোনও ভাবনা নেই।
কাজল ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল— গোপালের ভরসা তুমি করো না। ওর কথার সঙ্গে কাজের মিল পাবে না। দেখো ও-ই হয়ত ষড়যন্ত্র করে মেয়েটাকে সরিয়ে ফেলেছে!
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— থামো থামো। তোমরা কী বলছো বলো তো! আমার তো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনু কোথায়? এই ছেলেটি তাকে কোথায় সরিয়ে ফেলবে? কেনই বা?
কাজল বলল— কায়দাটা বুঝলে না? মেয়েটাকে সরিয়ে ফেলেছে। এখন বলছে, কোনও ভাবনা নেই, তাকে খুঁজে বার করবই। লুকোনো জায়গা থেকে তাকে বার করে এনে বলবে মেসোমশাই— এই নিন মেয়েকে কত কষ্ট করে উদ্ধার করে এনে দিলুম। এবার তার সঙ্গে আমার বিয়ে দিন।
গোপাল দারুণ রেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— আই অবজেক্ট। আমার কোনও মোটিভ নেই। তীর্ণা পৃথিবীর শেষতম মেয়ে যাকে আমি বিয়ে করব, কেননা কাজলামাসির মতো শাশুড়ি পৃথিবীর শেষতম মহিলা যাঁকে আমি শাশুড়ি করব, কেননা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তিনি একটি দুঃস্বপ্ন।
কাজল কান্না ভুলে বলে উঠল— তা তো বলবেই! সমস্ত চালাকি ধরে ফেলেছি কিনা!
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— কিন্তু এ সব কথা আমার মনঃপূত হচ্ছে না। তিনুকে সরিয়ে ফেলবে কী করে? তিনু কি একটা মালপত্র? তিনুকে সরাতে হলে তার নিজের মত থাকা চাই। এবং যদ্দুর জানি তিনুর মতামত খুব স্ট্রং।
—ধরো যদি দুজনে মিলেই এই প্লট বানিয়ে থাকে? কাজল কাঁদো কাঁদো মুখে বলল।
—কেন? বিয়ের জন্যে? ননসেন্স। তিনু একটা বোকা-হাবা নয়। সে আমার মেয়ে।
—তার মানে বলতে চাও— আমি বোকা-হাবা।
—কখন আমি তা বললুম! গঙ্গাপ্রসাদ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
যশ এবং রাংতা ঘটনার গতি দেখে খুব ঘাবড়ে গেছিল। গঙ্গাপ্রসাদ রাংতার দিকে চেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন— আমি কি একবারও বলেছি, তোমাদের কাজলামাসি বোকা-হাবা!
—না তা আপনি মোটেই বলেননি। অগত্যা রাংতা বলে, কিন্তু এবার তার ললিত কঠোর-এর কঠোর দিকটা চট করে প্রকাশ পায়— তা আপনি বলেননি, কিন্তু ওই যে বললেন, তিনু আমার মেয়ে-সে একটা বোকা-হাবা নয়— এতে করে একটা ইমপ্লিকেশন থেকেই যায় যে…
কাজল উৎসাহিত হয়ে চোখ মুছে বলে— বলো, বলো, বলেনি আমি একটা বোকা-হাবা! আমার জিন পেলে মেয়েটা বোকাই হতো!
—কিন্তু আপনার জিন তো ও ইন এনি কেস পেয়েইছে, মাসি।
এই সময়ে ফোনটা একবার বাজল। অনীক গিয়ে সেটা খপ করে ধরল— হাললো অনীক বলছি। ওপারের উত্তরটা শুনে সে বলল— বাবা তোমার ফোন।
—কে?
—বললেন ফাদার জেনকিন্স্।
—অ্যাাঁ? গঙ্গাপ্রসাদ প্রায় মূর্ছা যান আর কি!
—নমস্কার— অ্যাঁ— অ্যাঁ— অ্যাঁ
পরপর কতকগুলো জোরালো অ্যাঁ ছাড়া গঙ্গাপ্রসাদকে আর কিছুই বলতে শোনা গেল না।
অনীক বলল— আমি পুলিসে ডায়েরি করতে যাচ্ছি। যশ তোরা বাড়ি যা। গোপাল চ’।
রাংতা বলল— আমিও যাবো। আমার সাক্ষ্য পুলিসের কাজে লাগতে পারে।
—ঝামেলা বাড়াস না।
যশ বলল— থোড়ি বাড়ি যাবো। সেনসিব্ল্ কিছু বলল ইয়ার।
চারজনে বেরিয়ে গেল।
কাজল মন্তব্য করল— যার মেয়ে তার মনে নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। বাপ অভিধান লিখতে চলল। এদিকে মেয়ে ভাগলপুর।
গঙ্গাপ্রসাদ মুচকি হেসে বললেন— মেয়ে ভাগলপুর? অর্থাৎ গোপাল হালদারের ওপর থেকে অ্যালিগেশনটা তুমি তুলে নিলে? ভালো ভালো। তোমার মেয়েকে তুমিই বুঝবে ভালো।
—এর মানে? কখনও বলছো আমার মেয়ে, কখনও বলছো তোমার মেয়ে। তীর্ণা আমাদের দুজনেরই মেয়ে এতে যেন তোমার সমূহ সন্দেহ মনে হচ্ছে!
—জিন, জিন, কাজল জিন। একটু আগে জিনের কথা বলছিলে না? আমার জিনের ফলে মেয়ে বোকা হাবা নয় আর তোমার জিনের ফলে মেয়ে ভাগলপুর হয়। ভেগে যাবার এই প্রতিভাটি তিনু ওর মায়ের থেকেই পেয়েছে।
—আমি আবার ভাগলুম কবে? আই অবজেক্ট— কাজল ভীষণ উত্তেজিত।
—সুযোগ পাচ্ছো না, তাই ভাগছো না। এই যে কদিন রোজ আমার জন্যে বাসি বাসি ঝোল রেঁধে দিদিমাসির বাড়ি চলে যাচ্ছিলে, সেটা কি ভাগা নয়?
—বলে গঙ্গাপ্রসাদ বীরদর্পে চশমা হাতে নিয়ে অভিধানের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
তাঁর পিঠের দিকে তাকিয়ে কাজল বলল— অদ্ভুত! মেয়ে হারিয়ে গেছে, এই পরিস্থিতিতে দাম্পত্যকলহ করছে। ঠিক দাদামেসোর মতো।
দাদামেসোর মত বললে কেন? —গঙ্গাপ্রসাদ ঝাঁ করে ফিরে দাঁড়ালেন— দাদামেসোকে তুমি দেখেছ?
—আজ্ঞে না, দাদামেসোকে দেখতে হলে আমাকে আমার জন্মের অনেক আগে জন্মাতে হত।
—তাহলে?
—না দেখলেও শুনেছি!
—আমি যদ্দূর জানি তিনি একজন পাগলাটে, বদরাগী, খামখেয়ালি লোক ছিলেন। আজকালকার দিনে হলে যাঁর সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসা হত… আমি কোনখানটায় তাঁর মতো! শুনি!
—জানো, দিদিমেসোর ছেলেমেয়েরা যখন মারা যেত, দাদামেসো রেগে কাঁই হয়ে দিদিমাসিকে বকাবকি করতেন!
—কারণ!
—কারণ আবার কী? হয়ত তাঁর ধুতি কোঁচানো হয়নি, কি পাঞ্জাবি ঠিকমতো গিলে হয়নি, কি মিছরি শরবৎ দেওয়া হয়নি কি, আমলকী ভেজানো জল দেওয়া হয়নি…
—তুমি আমাকে দিনের পর দিন বাসি ঝোল খাইয়ে গেছো আমি কি তোমার ওপর চড়াও-টরাও হয়েছি যে তুমি…। দাদামেসোর সঙ্গে তুলনা গঙ্গাপ্রসাদের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না এটুকু বোঝা যায়। —যাই হোক, আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দাও, আমি কাল সকালে শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। ফাদার জেনকিন্স্ ডেকেছেন।
কাজল বিস্ময়ে প্রায় নির্বাক হয়ে যায়, তারপরে কোনক্রমে বলতে পারে—শান্তিনিকেতন যাবে? এ কথা তুমি বলতে পারলে? মেয়ে হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন অশান্তিনিকেতন আর তুমি যাচ্ছো…
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— কেন তোমার তো সুবিধেই হবে? রোজ রোজ গোয়াবাগানে ভোজ খেতে যাবে! আর তিনু? ও ঠিক এসে পড়বে এখন। বলে গঙ্গাপ্রসাদ চলে যান।
১২
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ইন করতেই প্ল্যাটফর্মে গঙ্গাপ্রসাদ তীর্ণার হাসি-হাসি মুখখানা দেখতে পেলেন। সে অবশ্য পেছনে ছিল, সামনে ফাদার জেনকিনসের গাবদা গোবদা মুখ, কিন্তু বাপের চোখ! ফাদার জেনকিনসকে ভেদ করে গঙ্গাপ্রসাদ তীর্ণাকে দেখতে পেলেন। এবং উৎসাহ উদ্বেলিত স্নেহ ইত্যাদির বশে নামতে গিয়ে পা ফসকে প্ল্যাটফর্মে প্রায় উড়ে অবতীর্ণ হলেন।
তীর্ণা তাড়াতাড়ি ছুটে এল, — বাবা, বাবা, পা মচকায়নি তো?
গঙ্গাপ্রসাদ দু পায়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে বললেন— না না, হয়ত ভেঙে থাকতে পারে কিন্তু কখনোই মচকায়নি। কী ফাদার জেনকিনস? তিনি ফাদার জেনকিনসের দিকে মিটমিটে হাসি হাসি চোখে তাকাতে লাগলেন।
তীর্ণা ব্যস্ত হয়ে বলল— ভেঙেছে কী? যাঃ, সর্বনাশ।
ফাদার জেনকিনস এগিয়ে এসে হাসি মুখে বললেন— ভাংগে তুবু মচকে না। কী? সঠিক বলেছি তো অধ্যাপক মিত্র?
—চমৎকার, চমৎকার বলেছেন বাবা জেনকিন্স্।
আবার বাবা জেনকিনস শুনে ফাদার একটু ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু তাড়াতাড়ি আবার সামলে নিয়ে বললেন। —আপনার নুতুন ছাত্রীকে সাক্ষাৎ করুন অধ্যাপক, এই হল সেই এডিথ সিং কাপুর।
সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল— এডিথ টুকু উৎকৃষ্ট আছে। কিন্তু কডডুর সিং কাপুর তা বিবেচনা কোরা হবে।
—এ কি বাবা জেনকিনস? আপনি তো অলরেডি একে সবই শিখিয়ে ফেলেছেন!
ফাদার জেনকিন্স্ খুব লজ্জিত ভঙ্গি করে বলতে লাগলেন— না না, আমি আর কী! আমি ট্যামন কিছু।…
একটি চমৎকার বাংলো বাড়ি। একেবারে রতনপল্লীর বুকের মধ্যে। প্রচুর মরসুমি ফুল ফুটেছে। বাড়িটিতে একটি খুব বশংবদ কেয়ারটেকার তার পরিবার নিয়ে একদিকের একটি ঘরে থাকে। ফাদার জেনকিনসের জন্য বরাদ্দ একটি ঘর। অন্যটি তীর্ণা ও এডিথের। অগত্যা গঙ্গাপ্রসাদেরও ফাদার জেনকিনসের ঘরেই ব্যবস্থা হয়।
চমৎকার ভুনি খিচুড়ি রেঁধেছে কেয়ারটেকারের স্ত্রী। কুড়মুড়ে আলু ভাজা, বাঁধাকপির শুকনো শুকনো ঘন্ট, ভেটকি মাছ ভাজা আর টোম্যাটোর চাটনি।
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— আঃ, খেয়ে যেন মুখটা ছেড়ে গেল।
ফাদার জেনকিনস বললেন— আপনার মুখ, আপনাকে চেড়ে চোলে গেল? হোয়াট আ সিচুয়েশন!
—আঃ, ফাদার এটা একটা ইডিয়ম… তীর্ণা বলল— এর মানে…
—আমি বুঝেচি বুঝেচি এর মানে আপনার মুখ আপনাকে চেড়ে চোলে ছিল। এখন ফিরে এসেচে। জাস্ট দি অপোজিট! কেমন কি না? আচ্ছা অধ্যাপক মিত্র, এর প্রয়োগটা আর একটু উডাহরণযোগে…
—ধরুন আপনি রোজ ঝোল মানে কারি খাচ্ছেন। রোজ। সপ্তাহের সাত দিনই। কী অবস্থা হবে আপনার?
—আয়্যাম ক্রেজি অ্যাবাউট কারি, অধ্যাপক মিত্র।
—আঃ! বিরক্তির শব্দ করলেন গঙ্গাপ্রসাদ।
—আচ্ছা ধরুন, সপ্তাহের সাত দিনই আপনি সুপ খাচ্ছেন।
—সুপ তো খাতেই হয়, রোজ।
গঙ্গাপ্রসাদ অসহায় বোধ করেন। এই ইংরেজ-অস্ট্রেলিয়ান এরা একঘেয়ে খেতে ওস্তাদ।
তীর্ণা তাঁকে উদ্ধার করে, বলে— আচ্ছা ফাদার, আজ এই খিচুড়ি, ভাজা এসব খেয়ে আপনার কেমন লাগল।
—উৎকৃষ্ট, চমৎকার, এর পর নাই।
—রোজ যা খান তার থেকে অন্য রকম তো?
—সম্পূর্ণ। সবটাই।
—এই নূতনত্বটাকে বলবেন মুখ ছেড়ে যাওয়া।
গঙ্গাপ্রসাদ উৎসাহিত হয়ে বললেন— তীর্ণাই তো এডিথের বাংলা শেখার ভারটা নিতে পারে।
সে চলা বাংলা, কিন্তু বাউল ভাষা, বাউল গান? ক্ষিতিমোহন উপেন্ড্রনাঠ এসব পোড়াতে হবে। ‘মোনের মানুষ কেলছে দ্বিডলে।’ ইনটারপ্রেট কোর্তে হবে। —কার বা আমি কে বা আমার। আসল বস্টু টিক নাহি টার—কী মানে হচ্ছে?
—‘ফাদার, কেমন পাকেড়ছি?’ এই ধরনের একটা ভাব করে গঙ্গাপ্রসাদের দিকে চেয়ে থাকেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরবেলায় সামনের বাগানটাতে পায়চারি করতে করতে তীর্ণা বলল— বাবা, তুমি দাদাকে বলো নি তো? আমি এখানে আছি?
—একেবারেই না। তুই যেই বললি আমি শান্তিনিকেতনে—অমনি আমি বললাম— অ্যাঁ—এটা বিস্ময়সূচক—যেই বললি ফাদার জেনকিনসের কাছে, আমি আরেকটা অ্যাাঁ দিলুম। এটা স্রেফ ভয়ে বুঝলি তো? আর যখন বললি— কাউকে বলল না তখন আরেকটি অ্যাাঁ এটা সম্মতিসূচক। এই তিনটি অব্যয় ছাড়া আমার মুখ থেকে আর কিচ্ছু বেরোয় নি।
—মা শুনে কী বলল?
—অশান্তিনিকেতন-টন কী সব বলছিল আমি গ্রাহ্য করিনি।
—আসতে চাইল না?
—তার এখন মেয়ে ভাগলপুর, মাথার ঠিক আছে? সে আসতে চাইবে?
—সে কি? তুমি মাকেও বলো নি?
—তুই তো কাউকে বলতে বারণ করলি?
—সে আমি দাদাদের মিন করেছিলুম, ওদের একটু ভোগা উচিত। মেলার মধ্যে আমাকে আর রাংতাকে ছেড়ে উধাও হয়ে গেল এডিথের খোঁজে। কিন্তু মাকে না বলে তুমি খুব অন্যায় করেছ। দাঁড়াও আমি একটা ফোন করি।
—কেন, ও-ও একটু ভুগুক না!
—আহা মা তো আর কোনও দোষ করে নি।
—তোর কাছে হয়ত করে নি। আমার কাছে হয়ত করেছে।
—সে তুমি বুঝবে। আমি মাকে খবর দিয়ে আসি।
—শোন শোন, গোয়াবাগানে হয়ত মাকে পাবি না, শ্যামবাজারে ওর মামার বাড়িতে করিস।
কিন্তু তীর্ণা, মাকে গোয়াবাগানেই পেল।
ফোন বেজেই যাচ্ছে, তীর্ণা ভাবছে ছেড়ে দেব এমন সময়ে মা ফোন ধরল।
—কে?
—মা, আমি তীর্ণা …
—কে?
—তীর্ণা মা।
—কোথাত্থেকে কথা বলছো? ম্যারেজ রেজিস্ট্রার? রেজিস্ট্রেশন ফিনিশ্ড্?
—আচ্ছা মা, তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো?
—যেমন ভাবাও তেমনি ভাবি।
—উঃ! তুমি না একটা ইমপসিব্ল্! শোনো আমি শান্তিনিকেতনে রয়েছি।
—সে কী! তোমার পিতৃদেবও তো শান্তিনিকেতনে।
—হ্যাঁ আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমরা একসঙ্গে ফিরব, ভেবো না।
বাবার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পেছনে যে ষড়যন্ত্র সে-সব তীর্ণা আর ফাঁস করল না। মায়ের মেজাজ বিশেষ ভালো না।
হঠাৎ তীর্ণা জিজ্ঞেস করল— আচ্ছা মা, শ্যামবাজার স্ট্রিটে সরলাবালা বোস কে?
—কেন, দিদিমাসি!
—দিদিমাসি! সত্যি! সত্যি! সত্যি! কী আশ্চর্য! কী-ই আশ্চর্য!
—হ্যাঁ, মিথ্যে হবে কেন? এতে এত আশ্চর্য হবারই বা কী আছে? তোমাদের আদিখ্যেতার একটা সীমা থাকা দরকার!
কিন্তু ততক্ষণে তীর্ণা ফোন ছেড়ে দিয়েছে।
কাজল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল। যাক বাবা এবার আরাম করে একটু হাত-পা মেলা যাবে। অনীকটা সাতসকালে বেরিয়ে গেছে, হন্যে হয়ে ঘুরছে। অনুমান হয় সঙ্গে গোপালও রয়েছে। হয়ত সেই যশ ছোকরাও। ও ঘুরুক, ওদের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার।
রাত্তির দশটার সময়ে অনীক হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরে ধড়াচুড়া সমেত শুয়ে পড়ল। মাথার তলায় দুই হাত। চোখ কড়িকাঠে।
—কী রে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিবি আগে!
—নাঃ খাবো না!
—বাইরে থেকে খেয়ে এলি বুঝি? চাইনিজ না মোগলাই?
—মা। তোমার ফাজলামোগুলো একটু বন্ধ রাখবে? নিজের মেয়ে হারিয়ে বসে আছে আর তুমি চাইনিজ না মোগলাই… —উঃ ভাবতে পারা যায় না কারুর মা এই রেটে ফাজিল হতে পারে। গোপাল ঠিকই বলে।
—গোপালের কথা উচ্চারণ করলে আমি আর তোমাকে খেতে সাধবোও না।
বলে কাজল আঁচলের চাবি ঝমঝমিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
অনীক নিজের ঘরে গিয়ে আবার মাথার তলায় দু হাত দিয়ে শুয়ে পড়ল। তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে রাংতার ওপরে। দুজনে ফিরে আসবি ঠিক করেছিলি তো মত বদলালি কেন? আর যশজিৎকে নিয়ে যদি এতই জেলাসি তো আর পাঁচজনের সঙ্গে কেঁদুলির মেলায় আসার দরকারটা কী? ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ-টঞ্জে গেলেই তো হত, শোনা যায় সেখানে হনিমুনের চমৎকার ব্যবস্থা, বড় বড় লেখক, বড় বড় ফিল্ম্ স্টাররা বাড়ি কিনে ফেলে রেখে দিয়েছেন। কিংবা অত দূরে না যেতে চাস— ডায়মন্ডহারবার যা, পূর্বরাগের পক্ষে আইডিয়্যাল জায়গা। নিদেনপক্ষে বকখালি। বলেই তো দিয়েছে বক আছে সেখানে, খালি বক। বক দেখাও, বকবক করো, বকাবকি ঝকাঝকি করো, কেউই দেখতে আসবে না। পাঁচজনের সঙ্গে জুটে মেলা-টেলায় যাবে কারা? যাদের সেরকম মানসিকতা। পাঁচে এক, একে পাঁচ। গোপালের ওপরেও অনীকের দারুণ রাগ হচ্ছে। তার বরাবরের ধারণা গোপালটার তীর্ণার ওপর একটু ইয়ে আছে। তো দ্যাখ! সে মেয়েটাকে যত্ন কর! নিদেন তার দিকে নজর রাখ, না যশের এক আদি্খ্যেতার আত্মীয় তাকে খুঁজতে গোয়েন্দাগিরি করছে। দিদিমাসি হলে বলত ‘আ মলো যা!’ ঠিকই বলত! দিদিমা-ঠাকুমাদের মুখনিঃসৃত এইসব উক্তি এতো এক্সপ্রেসিভ! হঠাৎ দিদিমাসির কথা কেন মনে পড়ল? অনীক নিজের এ প্রশ্নের জবাব পেল না। কিন্তু দিদিমাসির কথা তার কেন কে জানে বারে বারেই মনে পড়ছে। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার সেই সাদা-চুল বাউলনীর কথা মনে পড়ল, ও-ই নাকি যশের সেই আত্মীয় এডিথ সিং কাপুর। এই আমেরিক্যান মেয়েগুলোর কোনও একটা ইয়ে নেই। একটা নোংরা বুড়ো বাউলের পাশে ছদ্মবেশে বাউলনী সেজে বসে আছে। শুধু বসে কি আর আছে? ঘুরছে, থাকছে! ম্যা গো! আবার একটা দিদিমাসি ব্যবহৃত অব্যয়। ভারি এক্সপ্রেসিভ। সিলিং-এ বাউলীর বদলে দিদিমাসির মুখ। ধবধবে ফর্সা। বড় বড় চোখগুলো এখন কোটরে ঢুকেছে। চোখ ঘিরে গাঢ় কালি। মাথায় ধবধবে সাদা ঢেউ খেলানো চুলের একটা ঝুঁটি। নকল দাঁতগুলো চালের দানার মতো মনে হল। আশ্চর্য লাল ঢেউ খেলানো ঠোঁট। হাসিটা গাল-ভরা। দেখলেই মনে হবে এমন সুখে আর ভূ-ভারতে কেউ নেই, কখনো ছিল না। অথচ অনীক শুনেছে দিদিমাসির বর ছিলেন খ্যাপাটে, বদমেজাজি, দিদিমাসি ছেলেমেয়েদের নিয়েও প্রচুর ভুগেছেন। দুজন তো বেপাত্তা। তার ওপরে দেশভাগের সময়ে ওঁদের জমিদারি-টারি প্রায় সবই যায়, কোনমতে যা বেঁচেছে সে-ও হয়ত অনেক। তবে দিদিমাসি নাকি গা-ভরা গয়না পরে টাকার গদির ওপর বসে থাকতেন। এখনও যে পালঙ্কটাতে বসেন অনীকের মায়ের ধারণা সেই পালঙ্কে দিদিমাসির বসবার আসনটার তলায় টাকা-ফাকা সোনা-দানা আছে। দূর হোক গে, দিদিমাসির গুষ্টির পিণ্ডি! এসব কথা আজ এতো মনে হচ্ছে কেন কে জানে! অনীক তো ভাবছিল বোনের কথা। তার বোন তীর্ণা। কেন যে সে ওই শিখটার সঙ্গে জুটতে গেল গোপালের কথায়! আবার দুটো মেয়েকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনাও যশজিতের। ওরা নাকি ঘাই-হাঁস। দুটো মেয়ে আরেকটা সমবয়সী মেয়েকে টেনে আনবে। যশ একটা মড ছেলে হয়ে যে এই ধারণা কী করে করল? একটা মার্কিন মেয়ে অত সরলমতি হবে? তা ছাড়া মার্কিন মেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে কাছে আনতে যদি কেউ পারে সে কখনোই সমবয়সী মেয়ে হবে না। সমবয়সী কিংবা বেশ বয়স্ক পুরুষ হবে। চাই কি ওই বাউলটির মতো বুড়োও হতে পারে।
আহা তীর্ণা! তীর্ণা! ছোট্ট বাধ্য বোনটি অনীকের! কোথায় যে গেল! খুদে সেই তাকলামাকান পার হবার সময়ে অভিমান করেছিল বটে। ভেবেছিল সে রাংতার প্রতি মনোযোগী। তীর্ণা জানত না রাংতা যশের ইয়ে। রাংতার প্রতি অনীক সাধারণ ভদ্রতা আর বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই বোধ করে নি। অনীক এখনও তার যে ইয়ে হতে পারে তাকে খুঁজে পায় নি। খুঁজে পেলেও সে তার ছোটবেলার সাথী তীর্ণা বোনটিকে কখনো অবহেলা করবে না। এবারে অবহেলা করে যা শাস্তি পেল! আচ্ছা তীর্ণাকে যদি আর পাওয়া না যায়! তারা লালবাজারে ডায়েরি করে এসেছে। কিছুদিনের মধ্যেই দূরদর্শনে তীর্ণার ছবি দেখানো হবে। …কিন্তু মেয়েটাকে যদি এরা মধ্যপ্রাচ্যের প্লেনে অলরেডি তুলে দিয়ে থাকে!
দুর্ভাবনায় অনীক আর বসে থাকতে পারল না। সে তড়াং করে উঠে পড়ল, দুবার পায়চারি করল, তারপর বাইরে বেরিয়ে দেখল তার মা আঙুল চাটতে চাটতে রান্নাঘরের দিক থেকে আসছে।
—কি রে খাবি? কাজল প্রশ্ন করল।
—না।
—তুই না খেলে যে আমিও খেতে পারছি না।
—কেন। তোমার তো দিব্যি খাওয়া-দাওয়া শেষ দেখছি। আঙুল-ফাঙুল চাটছো!
—ওঃ। ও তো আচার! ছেলে না খেলে মা খেতে পারে! বল! তাই একটু আচার খাচ্ছিলুম!
উঃ, মা, তুমি পারোও। তীর্ণাটা কোথায় গেল তার নেই ঠিক, আর তুমি আচার খাচ্ছো!
—কেউ হারালে তাকে খোঁজা ব্যাটাছেলের কাজ। তুই আছিস, তোর বাবা আছে। নাঃ সে আবার নেই। সে শান্তিনিকেতনে বিদ্যে ফলাতে গেছে। তোর অকালকুষ্মাণ্ড বন্ধুগুলো আছে। তোরা যা পারিস করবি। আমার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করতে চাইছিস কেন? জানিস না আমার গ্যাসট্রিক? আমি গৃহবধূ, গৃহ-মা বলেই না তোদের এত অবহেলা। গ্যাসট্রিক থেকে আলসার-আলসার থেকে অপারেশন, দশটি হাজার ডাক্তারের টেবিলে না রাখলে ছুরি ধরবে না, তা জানিস? তখন তোদের টনক নড়বে। বিপদ, ইন টার্মস অফ মানি।
—মা, তুমি চুপ করবে?— অনীক প্রায় চিৎকার করে উঠল।
—হ্যাঁ, এবার তোর ওই অকালকুষ্মাণ্ড, এঁচড়ে পাকা বন্ধুর মতো বল কাজলরেখা মিত্তির পৃথিবীর শেষতম মহিলা যাকে আমি মা বলে ডাকব …
অনীক দুম দুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
কাজল আপনমনেই বলল— বোন হারিয়েছ, বাড়িতে খেতে বড্ড লজ্জা করছে তাই হোটেলে-মোটেলে খেতে গেলে। তোমাদের আমি চিনি না? আমিও দিদিমাসির নাতনি! অতটা বুদ্ধি না ধরতে পারি। কিন্তু বোকা বলে কি আর কাজল অতই বোকা?
বলে-টলে কাজল রান্নাঘরে গিয়ে খাবারের ঢাকা খুলল।
১৩
কদম গাছের পেছন থেকে কৃষ্ণ-টৃষ্ণ বেরোতে পারে। নিদেন সুদামা বা সুবল সখা, কিন্তু অশোক সাঁতরা যে বেরোতে পারে এ কথা তীর্ণা স্বপ্নেও ভাবেনি। সে ভীষণ অবাক হয়ে পশ্চাদপসরণ করল।
—ও কী? ও কী? পালাচ্ছেন কেন? পালালে আমার নিজেকে খুব খারাপ লোক মনে হবে। অশোক সাঁতরা বেশ সপ্রতিভভাবে বলল— গোলঞ্চ গাছ দেখছিলেন দেখুন না!
—এটা গুলঞ্চ নয়। এটা কদম।
—ওই হলো। যাঁহা গোলঞ্চ তাঁহা কদম— বলতে বলতে অশোক সাঁতরা তীর্ণার দিকে ক্যামেরা তাক করতে লাগল।
—ও কী? আমার ছবি নিচ্ছেন কেন? অনুমতি নিয়েছেন? তীর্ণা ভীষণ রেগে গেছে।
—রিপোর্টাররা ছবি তুলতে কক্ষনো অনুমতি নেয় না। কারণ ওটা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বুঝলেন রাংতাদিদি?
—আমার নাম রাংতা নয়। আমি কারুর দিদি-টিদিও নই।
—আহা রাগ করছেন কেন? আপনারা দুজনেই এমন একরকম যে কে রাংতা আর কে পান্তা আমার বড় গুলিয়ে যায়।
তীর্ণার এত রাগ হল যে সে তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে নিজেদের আস্তানার পথ ধরল। প্রথমত পান্তা। তার মা বিয়ের আগে থেকে ভেবে ভেবে তার এমন একখানা নাম দিয়েছে যে সব্বাই শুনে এক বাক্যে বলে বাঃ, আর এই নোকটা তাকে পান্তা বলল? তা ছাড়া রাংতার সঙ্গে তার মিল? কোন খানটায়? রাংতার বয়-ছাঁট, তার স্টেপ, রাংতা ফর্সা, সে কালো। রাংতার ফীচার্স একটু ভোঁতা ভোঁতা যে যাই বলুক, তার গুলো চোখা চোখা। খালি দৈর্ঘ্যে দুজনে মাথায় মাথায়। আর এই লোকটা স্বচ্ছন্দে দুজনকে এক দেখল? পেছন থেকে কে বলল— এই ধরুন ঘুঘু আর পায়রায় যেমন মিল? কিংবা ধরুন ময়ূরে আর মাছরাঙায়, কিংবা বাঘে আর বেড়ালে, বা নেকড়ে আর অ্যালসেশিয়ানে!
আড়চোখে চেয়ে তীর্ণা দেখল অশোক সাঁতরা তার পেছু পেছু আসছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলল— ছবি নেওয়া হয়ে গেছে। কদমতলায় কৃষ্ণা। ক্যাপশনটা কেমন?
তীর্ণা প্রচণ্ড রেগে বলল— আর ফটোগ্রাফারের নামটাও লিখবেন তো?
—নিশ্চয়, ছবিটা তো প্রাইজ পাচ্ছে, এটা রিপোর্টের ছবি নয় তো!
—তা হলে সেই নামের জায়গায় লিখবেন পান্তভূত।
অশোক মাথা চুলকে বলল, পুরোটা লিখব না বলছেন? ‘পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা’ না বললে কি পরিচয়টা কমপ্লিট হয় দিদি?
তীর্ণা এবার এমন তড়বড় করে হাঁটতে লাগল, এবং এমন এঁকেবেঁকে যে তাকে হাঁটা না বলে ছোটাই বলা উচিত। যতক্ষণ না অশোক সাঁতরা গাছের ফাঁকে অদর্শন হল সে এইভাবে চলল, তারপর হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
উঃ!!!
তীর্ণার চোখে জল এসে গেছে। একটা ছোট ইঁটের টুকরো উঠে আছে মাটি থেকে। হাঁটুটা বোধ হয় ছেচে গেল। সে উঠতে পারছে না। চেষ্টা করছে অথচ পারছে না।
—আমি কি আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারি?— চেনা-চেনা গলা না? গোপালগোবিন্দ কোথা থেকে বেরিয়ে এসে তীর্ণাকে একেবারে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
—বলুন এবার কোথায় পৌঁছে দিতে হবে।
তীর্ণা প্রথমটা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে সে নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেল। বলল আমায় নামিয়ে দিন। আমি একাই যেতে পারবো।
—আপনার পা ভীষণ মচকেছে, পারবেন না।
—না পারলে হামাগুড়ি দিয়ে যাবো।
—হামা দিতে হলে তো আপনাকে মাটিতে নামতে হবে, যেই না নামবেন এমন ঝনকা দিয়ে উঠবে যে …
—আপনি এখানে কী করে এলেন?
—যেভাবে সবাই আসে? আপনিই বা কী করে এলেন? যদি জিজ্ঞেস করি।
এমন সুন্দর শীতের দিন, শান্তিনিকেতন না দেখে কি আর ফেরা যায়? আপনিই বলুন না! এখন কোন দিকে যাবেন সেটা বলে দিন।
গাঁয়ের হাট্টাকাট্টা জোয়ান বটে গোপালগোবিন্দটা। অমন ম্যাদামারা মুখ হলে কী হবে! গায়ে খুব জোর। অগত্যা তীর্ণা তাকে রতনপল্লীর বাংলোবাড়ির পথ বাৎলে দিতে থাকে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ডাইনে চলুন, ওই যে দেওয়ালে বড় বড় সব ছবি আঁকা … ওইটে হচ্ছে ল্যান্ডমার্ক। এবারে ঢুকুন, রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো দেখে-দেখে,— হেই হেই হ্যাট হ্যাট।
গোপালগোবিন্দ বলল— আপনি শেষ পর্যন্ত আমাকে হ্যাট হ্যাট করলেন? ছিঃ দিদি!
—কী আশ্চর্য! আপনাকে হ্যাট হ্যাট করব কেন? গরু আসছে দেখছেন না? মমতাদিদের গরু, চরতে বেরিয়েছে।
—মমতাদি কে?
—কে জানে কে! সবাই বলে ওইরে মমতাদিদের গরু বেরিয়েছে, তাই আমিও বলি।
—সব গরুকেই বলেন নাকি?
—গরু আবার আলাদা করে চেনা যায় না কি? তা ছাড়া আপনি গেঁয়ো ভূতের মতো আমাকে দিদি-দিদি করবেন না, আমার একটা নাম আছে। —তীর্ণা। বুঝলেন! মাতৃপ্রদত্ত নাম।
—আচ্ছা তীর্ণাদেবী …
—আপনি কি উপন্যাসের ডায়ালগ দিচ্ছেন? আমার মাকে কলেজ ডেজ-এ একজন কাজলদেবী বলে ডেকেছিল বলে তার কী হয়েছিল জানেন?
—কী?
—বন্ধুরা নাম পাল্টে দিয়েছিল।
—মলাট তো আর পাল্টায়নি …ইস … সরি … আপনার সামনে …
—সরি? কিসের জন্যে? মলাট পাল্টানো? ওসব আমি আমরা জানি, ব্যবহারও করি।
—ব্যবহারও করেন?
—মাঝে মাঝে।
—ভালো ভালো, তা আপনার মাকে যে দেবী বলে ডেকেছিল, বন্ধুরা তার নাম কী দিয়েছিল? জানা হল না তো!
—দেবীপদ।
—আসল নামটা কী ছিল?
—হরিপদ।
—কী অদ্ভুত মিল!
—কিসের মিল?
—আমার বাবারও নাম ছিল হরিপদ, অ্যাফিডাভিট করে সেটাকে দেবীপদ করে নিয়েছিলেন।
—তাই নাকি? তা হলে তো আমার মায়ের সঙ্গে আপনার বাবার আলাপ করিয়ে দিতে হচ্ছেই! কে জানে কোনও কলেজি রোম্যান্সের সন্ধান পাওয়া যাবে কি না!
—আচ্ছা তীর মানে তীর্ণা। আপনার মায়ের সরলবালা বোস বলে কোনও আত্মীয় আছে?
—আপনি কী করে জানলেন?— তীর্ণা তড়াক করে জি.জি-র কোল থেকে নামতে গিয়ে প্রায় ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। আর সেই ডাকে সামনের বাংলোর ভেতর থেকে ফাদার জেনকিনস আর এডিথ বেরিয়ে এলো।
—কী হয়েছে আমার সোনাটি, মণিটি! ফাদার জেনকিনস ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। তীর্ণাকে ধরে ধরে তাঁর পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে গোপালগোবিন্দ বলল— কিছু না, মগডালে বউ-কথা-কও দেখতে গিয়ে পা মচকে গেছে। চুনে হলুদে গরম করে দিতে বলুন, কদিনেই সেরে যাবে।
তীর্ণা অবাক হয়ে দেখল এডিথের একপাশে অশোক সাঁতরা, আর এক পাশে গোপালগোবিন্দ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
—গোপালগোবিন্দ বলল— উই অ্যারেস্ট ইউ।
এডিথ একবার এর দিকে আর একবার ওর দিকে চেয়ে বলল— অ্যারেস্ট। মানে গ্রেপ্তার? কেন? কারণ কী? হোয়াট ইজ দা রিজন?
অশোক সাঁতরা বলল— অন চার্জেজ অফ হাই ট্রিজন এগেনস্ট আওয়ার কানট্রি।
গোপালগোবিন্দ গোঁয়ারগোবিন্দর মতো বলল— অন চার্জেজ অফ স্মাগলিং হেরইন ইন অ্যান্ড আউট অফ আওয়ার কানট্রি।
ফাদার জেনকিনস ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বললেন— অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করুন।
প্রোফেসর মিত্র? ও প্রোফেসর মিত্র?
দ্বিতীয়বারের ডাকটা খুব জোরালো হওয়ায় অভিধানে-মগ্ন গঙ্গাপ্রসাদ বেরিয়ে এলেন।
কাঁদো কাঁদো মুখে ফাদার জেনকিনস বললেন— আপনি এবার সত্য সত্য মিত্র হোন অধ্যাপক ফ্রেন্ড সার, এরা আমার শিষ্যা এডিথকে কোতল করছে।
—কোতল! সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে গঙ্গাসপ্রসাদ একটা সিঁড়ি ফসকে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলেন।
তীর্ণা প্রায় কেঁদে ফেলে বলল— বাঁবাঁ, এই নিয়ে দুঁবার হলো। তুমি কি পঁপাত হবার জন্যেই শান্তিনিকেতন এসেছো?
গঙ্গাপ্রসাদ ফাদার জেনকিনসের সাহায্যে উঠতে উঠতে বললেন— তুইও তো পড়েছিস দেখছি, জিন যাবে কোথায়, বল! তবে হ্যাঁ পুরোপুরি আমার ধাত পেতিস যদি তোরও সারা গায়ে ডানলোপিলো ফিট করা থাকত, পড়লেও চট করে লাগত না। কিন্তু চেহারায় তোর মায়ের জিন প্রবল, তাই পড়লেই পট-পটাং।
—অধ্যাপক বন্ধু, অধ্যাপক বন্ধু আপনি পারিবারিক সমস্যা বৈজ্ঞানিক সমস্যা ইত্যাদি এখন বিস্মৃত হোন, — ফাদার জেনকিনস করুণস্বরে আপীল করেন— এখন এখানে গুরুচণ্ডালি সমস্যা দেখা দিয়েছে, এডিথকে যে এরা নিয়ে যায়! এডিথ ওদিক থেকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি চারদিকে হেনে বলল— হু ইজ অ্যারেস্টিং হুম? কে হচ্ছো আপনারা?
—আমরা সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি,— অশোক সাঁতরা বুক ফুলিয়ে বলল।
—বলতে হচ্ছে না, বলতে হচ্ছে না, হোয়্যার আ ইয়ো ক্রেডেনশ্যালস? গেট দেম আউট! কুইক!
এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে সাঁতরা একটা কার্ড বার করে, এবং সেটাকে সবাইকার নাগালের বাইরে রেখে নাচাতে থাকে।
এডিথের দু হাত দুজনে ধরেছিল, কিন্তু এডিথ কী কায়দায় কে জানে ঝট করে ডান হাতটা মুক্ত করে কার্ডটা ছিনিয়ে নেয়। এবং জোরে জোরে পড়তে থাকে— ট্রাবল শুটার্স ডিটেকটিভ এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।
পড়ে-উড়ে সে অট্টহাস্য হাসতে থাকে— স্ল্যুথ! প্রাইভেট! হেঃ হো, হাঃ হা, আমার বিরুদ্ধে আনফাউন্ডেড চার্জ আছে, তিন উইটনেস আছে। আমি ল জানি। তোমাদের স্যু করবো। ইয়র কম্প্যানি উইল হ্যাভ টু পে মি থ্রু দা নোজ। বুঝেছিলে?
—গোপালগোবিন্দ তখনও বলতে থাকে—নেভার দি লেস উই অ্যারেস্ট য়ু … এডিথ সিংহ কাপুর অন চার্জেজ অফ হাই ট্রিজন এগেনস্ট …
তীর্ণা চেঁচিয়ে বলে— গোঁয়ারগোবিন্দ।
—তুমাদের কার এনগেজ করার সাহস হল? বলো কুইক!
এডিথ গোপালগোবিন্দর মুখের সামনে একটা তুড়ি মেরে বলল— স্পিল আউট! ফাস্ট, ম্যান ফাস্ট!
ফাদার জেনকিনস বললেন— শীগ্র শীগ্র শীগ্রং কুরু, অধ্যাপক বন্ধু স্যানস্কৃটো উচ্চারণটা সাউথের হয়েছে তো? আমি মহান শ্রী পট্টাভি রাম শাস্ত্রীর শিষ্যর নিকট শিক্ষিত হচ্ছি।
এডিথ ততক্ষণে অশোক সাঁতরার কার্ড, ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং গোপালগোবিন্দকে বলছে— হে য়ু ডাবল গড, আ য়ু প্লান্টেড হিয়া! সে প্রাণপণে গোপালগোবিন্দকে নড়াবার চেষ্টা করেও পারছে না। শেষ কালে কী একটা প্যাঁচ মারল গোপালগোবিন্দ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধড়াস করে পড়ে গেল যেন পা-ভাঙা পুতুল।
—নাও য়ু টেল আস হু এমপ্লয়েড য়ু।
—দুজনেই চুপ। তখন এডিথ বলল— ও রাইট, আমি বলছে। তুমাদের চাকরি দিচ্ছে ইদার দলজিৎ সিংহ অর মাধু কাপুর, রাইট?
গোপালগোবিন্দ উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করে অশোকের দিকে চাইল। অশোক বলল— ঠিক আছে। এখন প্রাইভেট। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ করতে পারলেই পুলিশের কাছে যেতে কতক্ষণ? তখন পুলিশ, কোর্ট। এখানকার পুলিশ আর কোর্ট তো জানো না? টাডার আসামী জেলে বন্দী থাকবে কদ্দিন তার ঠিক নেই! কোর্টে মামলা উঠতে উঠতে জন্ম কাবার।
—কাবা মেক্কায়, কাবায় আমার জন্ম হচ্ছে না। বুঝলেন মেশা?— এতক্ষণ ধরে ভালো বাংলা বলতে পেরে এডিথ গর্বে দশ হাত।
তীর্ণা ককাতে ককাতে বলল— দলজিৎ সিংহ আর মাধু কাপুর কে এডিথ?
—সাপোজড টু বি মাই পেরেন্টস অলদো আমি কারো রক্ত বইছি না, কারো জিন না।
—সে আবার কী?
—আমি সোমস্তটা ক্লীয়ার করবে, যখন তুমরা আমাকে সোরোলাওয়ালা বোসের কাছে নিয়ে যেতে পারছে।
গোপালগোবিন্দ সটান দাঁড়িয়ে উঠে বলল— আমিও যাচ্ছি। কারো চাদর মুড়ি দিয়ে নয়। সোজা সোজা হেঁটে হেঁটে যাবো।
অশোক সাঁতরা বলল— আমিও। ওই সরলা বোসই এদের দলপতি মক্ষিরানি। মিসেস বোসকে ধরতে পারলেই …
তার কথা শেষ হল না, একটা অদ্ভুত শব্দ। গঙ্গাপ্রসাদ কেমন লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছেন। তাঁর ভুঁড়ি কাঁপছে। শেষকালে তিনি কোনও মতে বললেন— বাবা জেনকিনস, আপনি আমায় একটু ধরুন, আমার পেটটা এবার ফেটে যাবে।
তখন বোঝা গেল গঙ্গাপ্রসাদ হাসছেন। একটু পরেই পায়ের ব্যথা ভুলে তীর্ণা সেই হাসিতে যোগ দিল।
১৪
সরলাবালা পাঁচালি পড়ছেন :
সরোবালা সুশীলার কইল সংবাদ।
জ্বরে জরোজরো সুশী গণে পরমাদ॥
সরো বলে খ্যাপা স্বামী দুর্বাসার রাগ।
তিন সত্য করি সুশী তারে দিব ত্যাগ॥
ত্যাগ দিয়া কী করিবি সুশী ভয়ে কয়।
আবার বিবাহ সুশী করিব নিশ্চয়॥
সরলাবালা সরি-সুশীর ঢিপি-ঢাপা মূর্তিতে একটু ফুলবেলপাতা ফেলে দিলেন। ভজমামা ঢুকে বলল— শীতকালে কিসের শিবপুজো বুঝিনে বাপু! শিবপুজো করতে হয় বোশেখ মাসে। মায়ের সবই কেমন এলাকাঁড়ি।
সরলা ভজমামার কথায় কানও দিলেন না আবার পাঁচালি আরম্ভ করলেন :
সুশী কয় পোড়ামুখী মুখে নাই আঁট
কথাবাত্রা ছোট্ট হতে বড্ড কাঠ-কাঠ।
ভজমামা বলল—তা ভূতনাথ ভৈরব। তার কথা তো কাঠকাঠ হবেই।
সোয়ামিরে ত্যাগ দেওয়া কোন শাস্ত্রে কয়?
সরি বলে আমাদের নিশ্চিত প্রত্যয়॥
শাস্ত্রে যথা লিখিতং বিধবার বিয়ে
তথা নানা কথা আছে বদ স্বামী নিয়ে॥
শুধু বদ নয় এ যে বদখত বুড়ো
ইচ্ছে করে মুখে তার জ্বেলে দিই নুড়ো॥
—ভজমামা উবু হয়ে বসে বিড়ি ধরিয়ে বললে— পাঁচালি শুনতে বেড়ে লাগে, খাসা লাগে, উমার মা শিবঠাকুরকে একেবারে গোবেড়েন দিচ্ছে। জামাই বলে রেয়াৎ করছে না। সব শাউড়িদের ব্যাপারটা শিকে নেওয়া উচিত। ওহ! জামাই বলে সব যেন মাথা কিনে নিয়েছে। রাতবিরেতে পাঁঠার মাংস আনো, দই আনো, রাবড়ি আনো, পেস্তাবাদাম-কাজু-খোয়া। একেবারে এলাকাঁড়ি কাণ্ড!
এই সময়ে কাজল ঝড়ের মতো ঢুকে বলল— আহা হা হা, তোমাদের জামাই কি একবারও বলেছে এই আনো ওই আনো, সে তো খেতেই চায় না, যদি বা চায় বলে যা রয়েছে ঘরে তাই দাও।
ভজমামা বলল— আ-হা! ও তো মায়ের নাতজামাই! আমি বলছি জামাইদের কথা। তুইও যেমন!
কাজল বলল— দিদিমাসি গো তোমার বাড়ি অনেক অতিথি আসছে যে!
সরলাবালা পড়ে চললেন :
পিতৃধাতু পায় বড় পুত্র নরহরি
ভয়ে তার কাঁপে সারা গ্রাম থরহরি॥
মেজপুত্র করিলেক অকালে প্রয়াণ
ভজহরি সেজপুত্র ভ্যাবাগঙ্গারাম॥
তারও পরে গৌরহরি বিবাহ করিলা
দিবারাত্র নাকি তার সংসারেতে জ্বালা॥
লোটা কম্বলধারী গৌর হিমালয়ে যায়
সেথা বড় শীত দেখে কন্খলে পালায়॥
গজহরি চতুর্থটি রাঙামুলো ছিল
বলহরি ছোটছেলে কোথা পলাইল॥
অবধান করো সবে সুশী সরি কথা
বসুজায়া কহে, শুনে পুণ্যবান যথা॥
আবার কতক ফুলবেলপাতা অঞ্জলি দিয়ে সরলাবালা পাঁচালি বন্ধ করলেন। ভজমামা ঢুলতে ঢুলতে বললেন দেখিচিস কাজলা, মা শিবের পাঁচালিতে আমার নামটা ঢুকিয়ে দিয়েচে কেমন। একেই বলে মায়ের মন!
সরলাবালা পাঁচালি থামিয়ে বললেন— বল এবার কী বলবি!
কাজলের উত্তেজনা পাঁচালির কারণে এখন অনেক থিতিয়ে এসেছে। সে বলল— তোমার বাড়ি যে মেম আসছে গো!
দিদিমাসি ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে তুলতে তুলতে বললেন— এখন আর আমায় কী মেম দেখাবি কাজলা, আমার বাপেরবাড়িতে কত মেম এয়েচে। মিস অ্যানাবেল, মিস শার্লট, মিস মাগারেট…স্কটল্যান্ডের প্রেজবিটেরিয়ান চার্চের মিশন থেকে কত মেম ইন্ডিয়া দেখতে আসত। আমাদের সঙ্গে ডেকে ডেকে আলাপ করত। শ্বশুরবাড়িতেও এয়েচে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেম, পুলিস-সুপারের মেম, মেম কি একটা? এসে এসে সব জিজ্ঞেস করত তোমার ইন-লজ খাইসি, করসি কথা কয় তুমি কেন আলাদা? আমি বলতুম— আ অ্যাম আ ক্যালকাটান ম্যাডাম, দা ডায়ালেক্ট আই স্পীক ইজ দা মোস্ট পলিশ্ড্ ইন বেঙ্গল।
কাজল বলল— জীবনের অনেকটা সময়ই তো বাঙাল দেশে কাটালে। তাও কী করে কলকাতিয়া ভাষা বলে জানিনে বাপু, আমরা ঘটিরাও তো আজকাল হালুম হুলুম গেলুম করলুম বলি না। তুমি তো নেবু, নুচি পজ্জন্ত ধরে আছে।
—আছি, থাকবও, বুজলি! ভাষাটা লুপ্ত হয়ে যাবে নাকি শেষে? ভজটাকে ছোট্ট থেকে কলকাতার ভাষা রপ্ত করিয়েছি। মেয়েগুলোর বেলায় একেবারে ফেল। সবসময়ে ঠাকুমা পিসিমাদের সঙ্গে ঘুরঘুর করতো তো! শেষে এমন হল নবটার চাটগাঁয়ে বে হল। ফিরে এল যখন আমি তার মা তার কথা বুঝতে পারি না। বলে হেই দ্যাহো, হালার পুতে লইঠ্যা শুঁটকি বুজে না। ললিতাটাকে কত ‘ও ললিতে চাঁপাকলিতে’ বলে ভুলিয়েছি দোল দিয়েছি, কিন্তু মুখ দিয়ে ভাষা বেরোল পিতৃভাষা।
তোমার নাতজামাই কিন্তু বলে—ভ্যারাইটি, বাংলা ডায়ালেক্টের এত ভ্যারাইটি তাই ভাষাটা এত রিচ।
—তা থাক গে না, আমি কি বারণ করেচি? তবে আমার আঁব, নুচি, গেলুম খেলুমও কেড়ে নিতে দোব না।
এই সময়ে ভজমামা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে বললে— মা, তোমার পাঁচালি থামাও। জৈল সিং। জৈল সিং এয়েচে।
—সে কি রে? জৈল সিং যে কদিন আগে মারা গেছেন!
—মারা যেতে পারে কিন্তু এয়েচে।
ভজমামার ছেলে নুটু শ্যামবাজার অঞ্চলের নামকরা গেঁজেল; সে ঢুকে বলল— সরলাবালা কি আমার ঠাকুমার নাম না মার নাম? যে-ই হোক তাকে এখন লুকিয়ে পড়তে হবে কারণ পুলিস এসচে।
—পুলিস? কাজল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াল।
—ও ভজমামা, পুলিশ কেন আবার? এই বললে জৈল সিং!
আর ভজমামা। ভজমামা হাওয়া। নুটু বলল— আমি চললাম, আমার কাজ আছে। সরলাবালা যদি ভালো চাও তো লুকোও।
দিদিমাসি তেরিয়া হয়ে বললেন— কেন? আমি খুন করেছি না রাজদ্রোহ করেচি যে নুকোবো? আজকের দিনের শাউড়ি হয়ে একটা বধূহত্যা পজ্জন্ত করিনি, নুকোতে হয় তারা বাপ-বেটায় নুকোগে যা।
ভজমামির পেছন পেছন যশজিৎ আর গোপাল এসে ঘরে ঢুকল।
—ওঃ তুমি! সেই যশ না রস না? কাজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল।
—আজ্ঞে আমি সেই যশই। রসটস কিছু না।
—অমন লাল পাগুড়ি পরেছ কেন? আমার নুটুদাদা তোমায় পুলিস ভেবেছে যে?
গোপাল জিভ কেটে বলল— এ ছি ছি কাজলামাসি, লাল পাগড়ি পুলিসেরা পরত ব্রিটিশ আমলে, সে-সব আমরা দেখিইনি।
—তোমাকে কি আমি ফোড়ন কাটতে বলেছি? পাঁচফোড়ন কোথাকার!
—কিন্তু কাজলামাসি আপনি যদি খামখা একটা ঐতিহাসিক ভুল করেন, তা হলে…
যশ বলল— তা ছাড়া এটা ঠিক লাল কি? ব্রিক রেড নয়?
—আজ্ঞে না। রঙের ব্যাপারে আমাকে শিক্ষা দিতে এসো না। একে বলে খুন-খারাপি লাল। আমার বিয়ের বেনারসীখানা ঠিক এই রঙের।
—আচ্ছা আচ্ছা, খুনখারাপিই আছে। আমি এ পাগড়ি আর পরছি না, যদি সবাই এত ভয় পান, যশ বলল।
—ভয় মানে? —পালঙ্ক থেকে বলে উঠলেন দিদিমাসি, —ভয়ের কথা হচ্ছে না। লাল পাগুড়ি আমাদের সে যুগের মানুষের কাছে একটা অপমান, একটা অত্যেচার, একটা জঘন্য সরকারি চক্রান্তের প্রতীক। তা জানো থোকন! এই কাজলা নাতনিরা তারই শেষমেষ দেকেচে।
এমন সময়ে ভজমামি সালোয়ার-কামিজ পরা রাংতাকে নিয়ে ঢুকলেন। সে ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল— আমি কি সময়ের আগেই এসে পড়েছি?
কাজল এগিয়ে গিয়ে বলল— শোনো রাংতা এই হলেন আমার মাসি-দিদিমা বা দিদিমাসি। উনি খুব আপ-টু-ডেট হতে পারেন। কিন্তু ওঁর নাতনি হওয়া সত্ত্বেও আমি অতটা নই। আমার মামারবাড়ি তোমাদের মিটিং প্লেস না ডেটিং ভেনু হওয়ায় আমার খুব আপত্তি। খুব খারাপ লাগছে আমার। তুমি একা এসো, যশ একা আসুক, কিন্তু আগে থেকে চক্রান্ত করে দুজনে এখানে ঠোকাঠুকি হয়ে যাওয়া, যেহেতু আমার দিদিমাসি খুব লিবর্যাল—এ আমি সহ্য করব না। ইট উইল সেট এ ব্যাড প্রিসিডেন্স, কোনও কোনও দুষ্কৃতকারী এর সুযোগ নিতে পারে। রাংতা অপমানিত লাল মুখে বলল— আমি এখুনি চলে যাচ্ছি। তীর্ণা আমাকে ফোন করে জানাল বলেই না খুঁজে খুঁজে…
গোপাল বলল— ব্যাড প্রিসিডেন্সের ব্যাপারটা কাজলামাসি যদি আমাকে কটাক্ষ করে বলে থাকেন তা হলে সেটা মাঠে মারা গেল কারণ কাজলামাসির মামারবাড়িতে কারুর সঙ্গে মিট করবার কোনও বাসনাই আমার কোনদিনও ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।
কাজল বলল— সবার মাঝে পড়ল কথা যার কথা তার গায়েই বাজে। আমি কি তোমাকে কানে ধরে বলতে গেছি গোপাল, গোপাল, তুমি ঠাকুরঘর থেকে কলা খেয়েছ!
রাংতা রাগত মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল এমন সময়ে উদভ্রান্ত অনীকের সঙ্গে তার চৌকাঠের ওপর ঠোক্কর লেগে গেল।
অনীক বলল— আরে রাংতা তুই? এইসব চৌকাঠ-ফৌকাঠ একেবারে থার্ডক্লাস ব্যাপার? এ কী? দিদিমাসি! তীর্ণা কই? তীর্ণা ছাড়া তো দেখছি সব্বাই আছে!
দিদিমাসি বললেন— ও নাতকুড় আমার, সাত রাজ্যের ধন এক মানিক, কবে থেকে ডাক পেড়ে বসে আছি, পিঠে-পাঠা তোয়ের করে, তা সেই বলে না কথায়—হায়রে সাধের তুমি। তোমার জন্যে চাল ভিজিয়ে চিবিয়ে মলাম আমি॥ কেন্রে এমন নিঠুর কঠোর কেন তুই?
অনীক লজ্জা পেয়ে দিদিমাসিকে একটা পেন্নাম ঠুকল গিয়ে। দেখাদেখি যশ, গোপাল আর রাংতাও ঠুকল। অনীক বলল— ব্যাপারটা খুবই মিস্টিরিয়াস। সাম আননোন পার্সন আমাকে ফোন করে বলল— দিদিমাসির বাড়িতে এলে তীর্ণাকে পাবো। তাই..
—তিনুর খোঁজে এইচিস! তবে রে মুখপোড়া! আমি বলি আমার জন্যে নাতকুড়টা হেদোয়।
—দিদিমাসি তুমি জানো না তীর্ণা হাওয়া হয়ে গেছে। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার দিনেরাতে ঘুম নেই। আর এদিকে তোমার নাতনি আমাদের এই কাজলামা দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছেন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
ভজমামি বললেন— আহা আমাদের কাজললতা ভাগ্নীকে খাওয়ার খোঁটা দিও না নাতি, কে আর আমাদের সেকালের রান্নার অত কদর করবে তা হলে?
এইবারে ঢুকলেন গৌরমামি— মা, কতকগুলান সাহেব-মেম লইয়া নাতজামাই আসে। সব্বগোরা ধইরলে অনেকগুলান মানুষ। সা পাতা লাগব। ভাঁরার গরের সাবি দিয়া থুন।
দিদিমাসি আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে গৌরমামির হাতে দিলেন। ভজমামা পালঙ্কের তলা থেকে মুখ বার করে বললেন— আমি তা হলে বেরুই? কি গো মা!
অনীক ভজমামা অর্থাৎ তার ভজদাদুকে বেরোতে সাহায্য করল।
দিদিমাসি বললেন— সিঙাড়াগুলো গরম দেখে আনবি, আর স্পঞ্জ রসগোল্লা। ভজমামা খাবার কিনতে বেরিয়ে গেলেন।
—আমরা কি আসতে পারি? গঙ্গাপ্রসাদ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন।
—আপনারা জুতোগুলো খুলুন বাবা জেনকিন্স্! ওহে টিকটিকিরা তোমাদের ওই কায়দার জুতো সব খুলে-টুলে ঢোকো। —গঙ্গাপ্রসাদ পেছন ফিরে বললেন।
প্রথমে ঢুকল তীর্ণা, পরনে ছাপা শাড়ি, সে নেংচাতে নেংচাতে ঢুকল।
কাজল বলল— ও কি রে তীর্ণা। তোকে অমন জখম করলে কে?
অনীক তার জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে বলল— বোধ হয় কারুর বাড়ি ল্যাং ল্যাং করে গিয়েছিল। সেই ভেঙেছে ঠ্যাং।
তীর্ণা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দাদার দিকে তাকিয়ে তারপর রাংতার দিকে চাইল। রাংতা চোখ নামিয়ে নিল।
তীর্ণা বলল— থ্যাঙ্কস্ রাংতা।
রাংতার মুখের ভাব এখন এমন কাঁচুমাচু যে ঘরে উপস্থিত অনেকেই ভাবল তীর্ণার জখম পা-এর পেছনে রাংতার কিছু অবদান আছে। মামিদ্বয় তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন।
ওদিকে ফাদার জেনকিনস, অশোক সাঁতরা আর গোপালগোবিন্দকে একরকম ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
কাজল ফিসফিস করে তীর্ণাকে বলল— কি রে আরও ক্যানডিডেট? তোর টেস্টের প্রশংসা করতে পারছি না বাপু।
তীর্ণা বলল— উঃ মা! তুমি একটু থামবে!
অভিমানহত কাজল থমথমে মুখে চুপ করে গেল।
এইবার গঙ্গাপ্রসাদ এডিথকে নিয়ে ঢুকে বিজয়গর্বে চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন— মাসিদিদিমা, (দিদিমাসি ডাকটা তিনি কোনদিনই পছন্দ করেননি, যদিও অভিধানে ঢোকাবেন কি না ভাবছেন) একে চিনতে পারেন?
একটা কালো স্কার্ট আর সাদা টপ পরা এডিথ সিং কাপুর আর সাদা ধবধবে থান পরিহিতা সরলাবালা বসু এখন মুখোমুখি।
উপস্থিত সকলেই একটা প্রচণ্ড বিস্ময়ের আওয়াজ করল গলা দিয়ে। সমস্ত ঘরে এমন নিস্তব্ধতা যেন রাতদুপুরের কবরখানা। কয়েক মিনিট পরে দিদিমাসির পরিষ্কার গলা শোনা গেল : চিনব না কেন? এ নিশ্চয়ই আমার সেই হারানো জিন। বোতলে ভরে কালসমুদ্দুরে মুখপোড়া বিধাতা ফেলে দিইছিল। তা কোন সাগরের তীরে উঠল শুনি?
—অ্যাটল্যান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর— গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, গালফ অফ মেক্সিকো, কি আর্কটিক ওসান যদি না-ই ধরেন। মানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
—তুই কি আমার কুট্টির মেয়ে? মেয়ে না নাতনি?
—আমার পিত্রিদেব শ্রীল শ্ৰীযুত ব্যলহরি ভোস মাত্রিদেব মাদাম আনেৎ ভোস। মাদাম সরলাওবালা ভোস আমার পিটামহীর নাম। —বলতে বলতে এডিথ দু পা এগিয়ে পালঙ্কে উঠে পড়ল এবং দিদিমাসির গলা জড়িয়ে চক্চক্ শব্দ করে চুমু খেতে লাগল।
—মাই ওনলি লিভিং রিলেটিভ। সে চুমুর ফাঁকে ফাঁকে বলতে লাগল, বোঝা গেল সে আবেগে ফোঁপাচ্ছে।
তীর্ণা আর অনীক প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল—তাই গোড়ার থেকেই ওকে এত চেনাচেনা লাগছিল। যেন কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি।
কাজল বলল— তা যদি বলো এডিথ আমরাও তো তোমার আত্মীয় বাপু, একা সরোবালা কেন? তুমি তো তা হলে আমার মাসতুতো মামাতো বোন হলে! না কী?
তখন এডিথ দিদিমাসিকে ছেড়ে চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছে কাজলকে চুমু খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তীর্ণা বলল— তুই আবার ওকে দেখলি কোথায়?
অনীক বলল— কেন? মনোহরদাসের আসরে, বোষ্টুমী না বাউলনী সেজে বসে ছিল!
—চতুর্দিকে চকচক চুমু খাওয়ার শব্দ। খালি যশজিৎ ভারি খুঁৎ খুঁং করতে লাগল—
—তাহলে আমার ফাংশানটা কী দাঁড়াল? এডিথ আমার হচ্ছে টা কে?
এডিথ ভজমামার খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি ভরা গালে চুমু খাচ্ছিল। শেষ করে ভজমামীর দিকে যেতে যেতে বলল— তুমি আমার কেউ হয় না। আমার পিতা শ্ৰীযুট ব্যলহরি ভোস আমার মাতা মাদাম আনেৎকে বিচ্ছে … বিচ্ছে … ও মাই গড ডিভোর্স করলে মাদাম আনেৎ বিভা করেন মিঃ রাদারফোর্ডকে। জিম রাদারফোর্ড। জিম আমার স্টেপ ফাদার। আনেৎ মারা গেলে আমি পা ব্যলহরির কাছে ফিরতে চাচ্ছে— কিন্তু খোজ পাচ্ছে না। জিম তোখন বিভা করে মাধু কাপুরকে। কী করতে পাচ্ছে, আমাকে ওদের সঙ্গেই থাকতে হচ্ছে। জিম মাধুকে বিছে-বিচ্ছে ও মাই গড ডিভোর্স করে নাইজিরিয়া চলে যাচ্ছে। আমার নাইজিরিয়া ভালো লাগছে না। মাধু কাপুর বিভা করছে দলজিৎ সিংকে। কী করতে পাচ্ছে, ওদের সঙ্গেই থাকছে। দো শী ইজ আ বিচ, দলজিৎ ইজ আ ডার্টি অ্যাডভেঞ্চারার। আমি মাইনর আছে, আনেতের ডলার আছে, ওরা আমাকে ছাড়ছে না, দলজিৎ মোটেল চালাচ্ছে, ফ্রেন্ডের সঙে ডেলিক্যাটেসিনে কাজ করে, আনেতের ডলার ওদের চাই। ওদের তিনটে ছেলে, বডমাস। আমি স্কুল থেকে এসে কুকিং ক্লীনিং, ভ্যাকুয়াম এভরিথিং করি। একদিন স্কুলে এক সলিসিটর ফোন করছে।
—তুমি এডিথ ভোস?
আমি বলছি— আমি এডিথ সিং কাপুর।
—নো-ও তুমি ভোস, তোমার বাবার নাম ব্যলহরি ভোস কী?
—তোখন মনে পড়ছে, বলছি— রাইট।
—তো কাম কুইক।
—তোখন আমার হাই স্কুল হচ্ছে। সলিসিটর তার লোক্যাল অফিসের অ্যাড্রেস দিচ্ছে। আমি যাচ্ছি। সলিসিটর বলছে— তুমার বাবা ব্যলহরি আর বিভা করছেন না, তিনি মরছেন। তাঁর অনেক সম্পাটি, থ্রি মিলিয়ন ডলার্স মতো হোবে। তুমি পাচ্ছে। সো য়ু আন্ডাস্ট্যান্ড ইয়শ্ তুমি আমার কেউ হচ্ছে না!
যশ বলল— ওয়েট এ মিনিট। তুমি দলজিৎ আঙ্কলের স্টেপ-ডটার ঠিক?
অশোক সাঁতরা বলল— উঁহুঃ, ও দলজিৎ সিঙের বউ মাধু কাপুরের স্টেপ-ডটার।
গোপালগোবিন্দ বলল— মোটেই না। ও হল জিম রাদারফোর্ডের স্টেপ-ডটার।
রাংতা বলল— সে ক্ষেত্রে এডিথ দলজিৎ আঙ্কলের স্টেপ-স্টেপ-স্টেপ ডটার। থ্রি টাইমস রিমুভড। অর্থাৎ কেউই হয় না।
এডিথ তখন ছুট্টে গিয়ে রাংতাকে চুমু খেয়ে বলল— রাইট। রাইট য়ু আ রুংটা ডার্লিং। তাপর হাই স্কুল করে আমি প্রিটেন্ড করছি কি ইন্ডিয়ায় পেপার করতে আসছি। ভীষণ আসছি।
মানে?— তীর্ণা জিজ্ঞেস করল। ভীষণ আসছ মানে?
ফাদার জেনকিনস উদ্ধার করলেন। বললেন— মানে আসতে চাইছে, তাই না। এডিথ, সোনাটি?
—রাইট। এডিথ উজ্জ্বল মুখে ফাদার জেনকিনসের দিকে তাকায়।
—তারপর?— যশের জিজ্ঞাসা।
—তার পোরে, সলিসিটার ফাদার জেনকিনসের সঙ্গে করেসপন্ডেন্স করতে বলছে। ফাদার জেনকিনস ভাবছে আমাকে সাবজেক্ট দিতে হোবে স্টাডির। তো বাউল দিচ্ছে। দলজিৎকে বলছি। দলজিৎ ভাবছে ভালো হচ্ছে, আনেতের ডোলার ছলে-কোশলে বার করবে। আমাকে নেফিউর কাছে পাঠাচ্ছে। আমার ভালো। আমি ভালো বাংলা শিকচি, মেলা যাচ্ছি, কোতো দেকছি, জানছি। ওদিকে, সলিসিটর পা-র নোটবুক দিয়েছে, বাস সেটা ফেলে আসছি। দলজিৎ-মাধু পোড়েছে, সোব জানছে। আর আমার সরলাওয়ালা ভোস আর সিয়ামবাজা ছারা কিছু মনে নেই। ট্রাম্প কার্ড দলজিতের হাতে। আনেতের সম্পাটির পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি মাধুর। চারদিকে গোয়েন্দা পাটাচ্ছে। ফিরতে পাচ্ছে না, থাকতেও পাচ্ছে না, ঘুরে ঘুরে বেরাচ্ছে। থাকার জন্য ডলার চাই। ওদের লিখতে হচ্ছে। এমন সোময় টিনা অ্যান্ড আঙ্কল গাঙ্গা গাঙ্গা ও মাই গড আংকল পরসাদ সরলাওয়ালার আড্রেস দিচ্ছে। আমি গ্রেট ফুল, সো গ্রেটফুল টু দেম।
কাজল বলল— তুমি আবার টিনার বাবাকে আঙ্কল বলছো কেন? ও যে তোমার ব্রাদার-ইন-ল হল। আমি তোমার কাজিন।
এডিথ ঝকঝকে মুখে বলল— থ্যাংকস, মেনি থ্যাংকস। তো ব্রাদার ইন ল’র বাংলা আমি বালো জানছে। এখন থেকে শালা পরসাদ বলবে।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— আমি বাড়ি যাচ্ছি। কাজল চাবিটা দাও।
কাজলই সবচেয়ে বেশি হাসছিল, বলল— ধ্যাৎ, এখন যেতে আছে, নাকি, তুমি ওই চেয়ারটায় চুপটি করে বোসো। আরও কত মজা হবে।
ফাদার জেনকিনস হাসি-হাসি মুখে বোকার মতো বললেন— মোজ মোজা, সকস আই নো। অলসো ফান।
দিদিমাসি বললেন— ওরে এডিথ, আমার নাতজামাই গোঁসা করেছে। কাজলা যদি রাগ না করে তো ওকে আরেকটা …
গঙ্গাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন— এডিথ, তোমার গল্প শেষ হয়েছে?
—দ্যাট্স্ অ্যাবাউট ওল—বলে এডিথ দিদিমাসির গা ঘেঁষে বসে পড়ল। তার চোখ ছলছল করছে।
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— তাহলে অশোক সাঁতরা, গোপালগোবিন্দ! তোমরা দলজিৎ সিঙের অ্যাপয়েন্টেড গোয়েন্দা! তা এডিথকে স্মাগলার, স্পাই এ সব বলছিলে কেন শুধু শুধু?
এডিথ পালংকের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লিবার্টির স্ট্যাচুর ভঙ্গিতে বলল— আমি ওদের স্যু করবো। অ্যানাদার মিলিয়ন ডলার্স।
গোপালগোবিন্দ শুকনো মুখে বলল— এটা ভারতবর্ষ, এখানে লোকেরা ক্ষমাশীল। কোয়ালিটি অফ মার্সি ইজ নট স্ট্রেইন্ড।
অশোক সাঁতরা বলল মুখ বেঁকিয়ে— এটা তো অ্যামেরিকা নয়, এখানে অত সহজে স্যু ধরা যায় না। মিলিয়ন ডলার্স তো দূরের কথা। বড় জোর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটু সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে বা পঞ্চাশ টাকা ফাইন। তাতে তোমার লাভ?
এডিথ বলল— ইজ দ্যাট সো?— তার দিদিমাসির দিকে মুখ। দিদিমাসি সারাক্ষণ হাসি-হাসি মুখে এডিথকে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। এবার আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়লেন। তারপর বললেন— দ্যাখ দ্যাখ দেখে নে কাজলি, ওই বয়সটায় তোর দিদিমাসি কেমনটা ছিল। ছ’টা তখনই হয়ে গেছে। দুটো অক্কা। নব, নর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সইয়ের ভাই রঞ্জিতের সঙ্গে কলকাতা পালিয়ে যাবো সব ঠিকঠাক, তো রঞ্জিত ব্যাটা ভয়ে পেছিয়ে গেল।
ভজমামা বিরক্ত হয়ে বলল— আঃ, এখন আর ওসব ফ্যামিলি-কেচ্ছা কেন?
—কেচ্ছা নয়, কেচ্ছা নয় রে, অ্যাডভেঞ্চার। আমি ডাফ স্কুলে মিস অ্যানাবেলের কাছে পালাতে চেয়েছিলুম। মিস অ্যানাবেল আমায় নিউ ইয়র্কে পাঠাবেন সব ঠিক-ঠাক করছেন। তা দ্যাখ সেই মার্কিন দেশেও তো মেয়েটার কম খোয়ার হল না, বলে তিনি এডিথকে কোলে টেনে নিলেন।
এডিথ ছলছল চোখে বলল— কেউ আমাকে কোখনও আদর করছে না। পা বিষণ মারছে দোষ হলেই। আনেৎ বাড়িতে থাকছেই না। তার পোরে তো ইট ওয়াজ আ ডগস লাইফ!
—বলহরিটা ঠিক ওর বাপের মতো উগ্রচণ্ডা মারকুটে ছিল বটে, দিদিমাসি বললেন।
—আনেৎকেও মারত। এডিথ বলল।
—মারবেই, জিন যাবে কোথায়! তার বাবা তার মাকে মেরে ধামসে দিয়েছে। সেও তার বউকে মেরে ধামসে দেবে।
ভজমামা বললেন, আঃ মা ছাড়ো না ওসব ফ্যামিলি-কেচ্ছা। সিঙাড়াগুলো যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
তখন কাজল আর ভজমামি মিলে রসগোল্লা আর সিঙাড়া পরিবেশন করল, দিদিমাসি তাঁর কৌটো থেকে সরেস নারকোল নাড়ু বার করে দিলেন। গৌরমামি বিরাট কেটলিতে চা নিয়ে এসে বললেন, পটে সব্ব গোরা বারো কাপ আসে। আর লাগব?
ধীরে ধীরে বাইরের লোকেরা সব চলে গেলে দিদিমাসি বললেন— হ্যাঁ রে এডিথ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বলহরিটা অত টাকা কি করে রোজগার করল রে? আমি তাকে যদ্দুর জানি সে খালি ওড়াতে জানে। এত টাকা! আমার হিসেব যে সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে!
এডিথ বলল— পা’র তোতো কথা তো আমি জানে না। হী ওয়াজ ভেরি হ্যান্ডসাম। আনেৎ মডলিং করে অনেক টাকা আর্ন করতো। পা কী করত জানি না। কিন্তু থ্রি মিলিয়ন ডলার পা পেয়েছিল ডক্টর্সদের স্যু করে। একটার পর একটা স্যু করত। বেশির-টাই আসে পার ডেথের পোর। শেষে, ক্যানসার হচ্ছে তো কেনো এই থেরাপি ওই থেরাপি কোরছে না, ডক্টর বলছে ইউসলেস। আর এক ডক্টরকে উইটনেস ধরছে, সে বলছে—কোরে দেখা কোর্তব্য আছে। সো হী গট পটস অ্যান্ড পটস ভ ডলার। বাট মোস্টলি আফটার হিজ ডেথ।
১৫
এডিথের আজকাল নাম হয়েছে অদিতি। ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে তার আর বড় দেরি নেই। গঙ্গাপ্রসাদ আর তীর্ণা তাকে জোর বাংলা শেখাচ্ছেন। ফাদার জেনকিন্সও ছাড়ছেন না। তিনি ওকে স্যান্স্ক্রিটও শেখাবেনই শেখাবেন, পট্টাভিরাম শাস্ত্রীর শিষ্যের দক্ষিণী উচ্চারণ সমেত। গোপালগোবিন্দ, অশোক সাঁতরা শুধু-গোপাল, যশজিৎ সবাই-ই এখন এডিথের বন্ধু। তীর্ণা আর রাংতা তো বটেই। যশজিৎ এখন যেহেতু তার আঙ্কল দলজিতের ঘোর বিপক্ষে সেহেতু এডিথ তাকে আর ব্যাড ম্যান মনে করছে না। তবে এডিথের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন সরলাবালা বোস। তাঁর পাঁচালির আসরে এডিথ নিয়মিত উপস্থিত থাকে। তার চুলের রঙ, চোখের রঙ সরলাবালার মতো, ঠোঁটের ঢেউ, ভুরুর বাঁক সরলাবালার মতো, হাসি-কান্না তা-ও সরলাবালার মতো। তবে সবচেয়ে মিল দুজনের সাহসে আর উৎসাহে। অদিতি তার পোশাকি নাম। সরলা কিন্তু তাকে আদর করে ডাকেন— জিনু বলে।
সবে বসন্ত পড়তে শুরু করেছে। গাছের পাতা সব চকচকে। কাজলদের গোয়াবাগানের বাড়ির বাগানে নিমগাছের মগডালে বোকা কাক-কাকিনী বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। চড়ই শালিখ কোথা থেকে খড়কুটো এনে ঘর নোংরা করছে, এমন দিনে কাজলরেখা দিদিমাসির ফোন পেল।
—কি রে কাজলা, দেখা নেই কেন?
—আমার বুঝি কাজ নেই সংসারের?
তোর আবার কাজ নেই! গ্যাসটা জ্বালবি, বাটিটা চাপাবি, তাতে জলটা দিবি, গোটা কতক ডিম ফেলে দিবি, সেদ্ধ হলে ঠাণ্ডা জলে ছাড়বি, খোসা ছাড়াবি…
—আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। কাজল কম্মের ঢিপি, এখন বলো কী করতে হবে।
—আয় না, একবারটি আয়!
কাজল বিকেল চারটের সময়ে পিচ রঙের পিওর সিল্ক শাড়ি পরল। কপালে ছোট্ট মেরুন টিপ দিল। কোমরে চাবির গোছা, নাকে হীরের নাকছাবি। নতুন কোলাপুরি চপ্পল পায়ে দিয়ে নদীয়ার দোকান থেকে দিদিমাসির জন্যে সরপুরিয়া-সরভাজা কিনে সে একটা রিকশা নিল।
দিদিমাসি পালং আলো করে বসে আছেন। রূপ যেন আরও খুলেছে। একগাল হেসে বললেন— কি রে? মান হয়েছে, মানিনীর?
—কাজলের মুখ ভার, ঠোঁট ফুলেছে, সে বলল, তুমি তো তোমার জিন পেয়ে আর সবাইকে ভুলে গেছো! আমাদের আর দরকার কী? আমরা বাবা তোমার জিনুর মতো সুন্দরীও নই আর বুদ্ধিমতীও নই, অত সাহসও আমাদের নেই।
তখন দিদিমাসি কাজলের থুতনি নেড়ে আদর করে বললেন :
তুই যে আমার প্রথম নাতনি
বাপের ঘরের আসল গাঁথনি
সুশীতলা বোনের স্মৃতি তুই যে সরোর আয়ি
তোমাকে না দেখলে সরোর পরাণ আই ঢাই।
তুমি আমার গ্যাসের আলো
তোমায় দেখলে থাকি ভালো
তুমি আমার বরফি গুঁড়ো মুড়কি মেখে খাই।
তোমাকে না দেখলে আমার প্রাণ করে আইঢাই॥
চোদ্দ মেয়ের মা হয়েছি তাতে হয়েছে কী?
আমার প্রথম মেয়ে সরেস মেয়ে, আর সকল মেয়ে ঝি!
Leave a Reply