দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা – গৌরকিশোর ঘোষ
সম্পাদনা: সোহিনী ঘোষ
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রথম সংস্করণ: জুন ২০১৫
.
ভূমিকা
গৌরকিশোর ঘোষের পুত্র ও কন্যাদের কৃতজ্ঞতা জানাই, তাঁরা তাঁদের পিতার অত্যন্ত মূল্যবান কয়েকটি প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র একসঙ্গে জড়ো করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, সেই সঙ্গে হৃদয় মোচড় দেওয়া একটি মুখবন্ধে প্রবন্ধগুলি রচনার বিস্তীর্ণ পটভূমির বর্ণনা দিয়েছেন। ইন্দিরা গাঁধীর সেই বীভৎস ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার পর চার দশক অতিক্রান্ত, প্রবীণ মানুষজনের পুরনো স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে, আর নতুন প্রজন্মের কাছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। সুলিখিত গণতান্ত্রিক সংবিধান, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের সর্ববিধ অধিকার স্পষ্ট নির্দেশ করা সংবিধান, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা তথা স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কন্যা বেপরোয়া উদ্ধতিতে সংবিধানের সেই অঙ্গীকারগুলি নস্যাৎ করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এই মহাপাপ কর্মটি তিনি করেছিলেন নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিরাপদে রক্ষা করার স্বার্থে; এটা যেন স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ নয়, এটা তাঁর ও তাঁর পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে জীবন থেকে কী কী চরিতার্থতা পেলাম স্মৃতি খুঁড়ে যখন তার হিসেব কষতে বসি, অভাবনীয় গর্ববোধ করি এটা ভেবে যে, প্রথম যৌবন থেকে শুরু করে বরাবর গৌরকিশোর ঘোষের নিবিড় বন্ধুত্ব লাভ করেছিলাম। গত শতকের চল্লিশের দশকের উপান্তে তাঁর প্রথম পরিচয়, আমাদের জীবনের প্রবাহ বরাবর আলাদা স্রোতে বয়ে গিয়েছে, তাঁর জীবন যে বৃত্তে আবর্তিত হয়েছে আমার ঈষৎ অন্যরকম, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও যথেষ্ট ফারাক, তাতে কিছু যায় আসেনি, আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতি অনবচ্ছিন্ন থেকেছে, অনেকে জেনে হয়তো আশ্চর্য হবেন প্রথমবার আমার বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মুহূর্তে তিনি অন্যতম প্রধান কিন্তু সঙ্গোপন পরামর্শদাতা ছিলেন। বছর যতই গড়িয়েছে আমাদের দেখাশোনার বহর পাল্লা দিয়ে কমেছে, কিন্তু উভয়েই জানতাম আমাদের আত্মিক সম্পর্ক কখনও বিনষ্ট হওয়ার নয়।
জরুরি অবস্থার সেই ভয়ংকর দিনগুলিতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠন করতে যাঁরা অমিত সাহস দেখিয়েছিলেন গৌরকিশোর অবশ্যই তার পুরোভাগে, এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রবন্ধগুলি তার প্রগাঢ় পরিচয় দেবে। হঠাৎ মনে এল, যে পত্রিকার রাজনৈতিক সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধের জন্য তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তাতে আমারও একটি প্রবন্ধ ছিল, যার দুই শব্দের সমাপ্তি বাক্য: ‘এটা ধৰ্মযুদ্ধ’।
গৌরকিশোরের পরিবারের অধ্যবসায়ে সেই ধর্মযুদ্ধের দুঃসহ কাহিনিতে অনায়াসে বিচরণ করলাম, আমার পরম সুহৃদ গৌরকিশোরকে স্বগত শ্রদ্ধা নিবেদনের নতুন করে সুযোগও পেলাম।
অশোক মিত্র
মে, ২০১৫
‘ইতিকথা’
সেদিন ভোররাতে কলিংবেল বেজে উঠেছিল দু’বার। প্রথম ডাকেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সকলের। বেলটা সত্যিই জোরে বেজেছিল, নাকি ভোররাত বলেই শব্দটা জোর বলে মনে হয়েছিল— এখন আর মনে পড়ে না। আগের রাতেই ফিরে এসেছেন বাবা, বর্ধমানে একটি জরুরি মিটিং সেরে। যে-কোনও দিন এরকম ঘণ্টা বেজে উঠবে, যে-কোনও সময় সিঁড়িতে শোনা যাবে পুলিশের বুটের আওয়াজ— এমন প্রতীক্ষা চলছিলই কিছুদিন ধরে। তাই আকস্মিক ঘুম ভাঙতে ভয় অন্তত পায়নি বাড়ির লোক। ৬ অক্টোবর [১৯৭৫] ভোররাতে পুলিশের দ্বিতীয় ডাকে বাবা-ই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার বাইরে কাশীপুর থানার বড়বাবু, কিঞ্চিৎ বেসামাল— তিনি ঘরে ঢুকলেন না; দু’জন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার, তাঁরা এর আগেও বাড়িতে এসেছেন বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য; দু’-তিনজন মজুর শ্রেণির লোক, যাঁদের তুলে আনা হয়েছে চুনীবাবুর বাজারের সামনে থেকে, আকস্মিক ঘুম ভাঙানোয় বিহ্বল। অত্যন্ত ভদ্রভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসাররা নিবেদন করলেন, ‘আপনাকে যেতে হবে।’ বাবা উত্তর করলেন, ‘হ্যাঁ জানি, তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’ অফিসাররা জানালেন বাড়ি তল্লাশি করার হুকুম আছে তাঁদের ওপর। বাবা দেখতে চাইলেন না কোনও কাগজ, অনুমতি দিলেন। অফিসাররা নিয়মমাফিক ঘরে গেলেন, কোথাও হাত দিলেন না। কেবলমাত্র যে ঝোলাটা সবসময় তাঁর কাঁধে থাকত সেটি খুলে দেখলেন। তার ভিতরেই ছিল ‘কলকাতা’ পত্রিকার নিষিদ্ধ ‘বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা’। ঝোলাটি বাজেয়াপ্ত হল, সংখ্যাটিও। খাবার ঘরে বসে ‘সিজার লিস্ট’ তৈরি হল, পুলিশের সাক্ষী টিপ সই দিল। তাঁরা অবশ্য বাবার পক্ষ থেকে সাক্ষী রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই ভোররাতে আমাদের প্রতিবেশী নিমাইচন্দ্র দে শীল এবং তাঁর স্ত্রী উমা বাবার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকলেন। অত্যন্ত ভদ্রভাবে অফিসাররা বাবাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। বাবাকে বিদায় জানানোর জন্য আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাউসিং এস্টেটের গেট পর্যন্ত যাচ্ছি— তখন দেখি পুলিশে ছয়লাপ সমস্ত এলাকা!
পুলিশের নির্দেশমতো মা বেলায় গেলেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পুলিশ গৌরকিশোর ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল— বোমাবাজি, হুলিগানিজম এবং ইভ টিজিং-এর। ম্যাজিস্ট্রেট হেসে মামলা খারিজ করে দিলেন। পুলিশের জিজ্ঞাসা— ‘এখন আপনি কী করবেন?’ ‘আসামি’র প্রতি-প্রশ্ন— ‘ব্যাপারটা কী?’ জানা গেল আসামিকে মিসায় বন্দি করার কথা, কিন্তু সকালের উড়ানে সে আদেশনামা দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছয়নি, আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। ‘আসামি’ তখন পুলিশকে জানান, ‘আমি তবে অপেক্ষাই করি।’ ইতিমধ্যে কলকাতার স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে নির্দেশ এল ‘আসামি’কে লর্ড সিন্হা রোডের অফিসে উপস্থিত করানোর। নির্দেশ পালিত হল। ‘আসামি’কে পেশ করা হল অম্বিকা ভট্টাচার্যের সামনে [সম্ভবত তিনি তখন এস বি-৩]। নিজের অফিসে বসে অফিসার আরদালিকে নির্দেশ দিলেন ‘আসামি’র জন্য কিছু খাবার আনার। তাকে আরও জানালেন— তিনি এখন ‘ইন্টারোগেট’ করবেন, ফলে এখন কোনওভাবে তাঁকে বিরক্ত না করা হয়। অফিসারের দরজা বন্ধ হল, বাইরে লালবাতি জ্বলল। অফিসার ‘আসামি’কে একটা ইজিচেয়ার দেখিয়ে বলেন, ‘একটু ঘুমিয়ে নাও। আদেশনামা পৌঁছতে এখনও কয়েক ঘণ্টা লাগবে।’ আসামি ঘুমোন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকুক। আমরা বরং অন্যদিকে নজর ফেরাই।
২৫ জুন, ১৯৭৫— প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী সারাদেশে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করলেন। জনগণের সংবিধান-প্রণীত মৌলিক অধিকার খর্ব হল। ‘প্রেস সেন্সরশিপ’ চালু হল। ৩০ জুন ১৯৭৫ তারিখে প্রকাশিতব্য ‘দেশ” পত্রিকায় রূপদর্শীর নিয়মিত লেখা ছেঁটে ফেলা হল [সূচিপত্রে উল্লেখ আছে]। বাতিল হল আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য লেখাও। গৌরকিশোর নতুন করে আবার লিখলেন, আবার বাতিল হল। রাষ্ট্র সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার উপক্রম করছে-
সে বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় থাকল না। তিনি প্রতিবাদ জানালেন এক অভিনব পন্থায়। তিনি মাথা মুড়িয়ে ফেললেন। ঘন কালো কোঁকড়া সুন্দর চুলগুলির বদলে মুণ্ডিত মস্তক দেখে লোকে কৌতূহলী হয়ে পড়লে তিনি জবাব দিলেন— ‘আমি লেখক। আমার কলমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। আমার মাতৃবিয়োগের থেকে তা কোন্ অংশে কম?’ কেউ ভয় পেলেন, কেউ বিদ্রূপ করলেন। অগ্রজতুল্য শ্রদ্ধাভাজন মন্তব্য করলেন যে তিনি যাই করুন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে রাজা করবেন না। কৌতূহলী স্নেহাস্পদ প্রশ্ন করলেন— ‘এতেও কিছু না হলে?’ গৌরকিশোরের নির্বিকার উত্তর, ‘গলায় কুকুরের বকলস বেঁধে ঘুরব।’
অসন্তোষ জমছিল অনেকের মনেই। ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত পরিকল্পনা করলেন একটি ‘বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা’র। সেখানে অন্যান্য লেখার সঙ্গে গৌরকিশোরের সেই দুটি লেখাও প্রকাশ করা হবে যে দুটি লেখা ইতিপূর্বে সেন্সরবোর্ড বাতিল করে দিয়েছে। আরও প্রকাশিত হবে গৌরকিশোরের লেখা একটি চিঠি— যেটি নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক স্কুলের ছাত্র তাঁর ছেলেকে লেখা। চিঠিটি আপাতভাবে ব্যক্তিগত, কিন্তু তার সামাজিক অভিঘাত বিপুল। এই পরিকল্পনায় সোৎসাহে যুক্ত হয়েছিলেন শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের অধ্যাপিকা গৌরী আইয়ুব। ঠিক হল, এই পত্রিকা প্রকাশিত হবে সরকারি সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই। এর ফল যা হবে তা সহজেই অনুমেয়। সিদ্ধান্ত হল, প্রয়োজনে গৌরকিশোর গ্রেপ্তার বরণ করবেন। কিন্তু জ্যোতির্ময় ধরা দেবেন না, অন্তত ততদিন, যতদিন পর্যন্ত না এই সংখ্যার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পত্রিকা প্রকাশ হল। সরকার সেই পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। আর কে না জানে নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণ! রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক মানুষটিকে গরাদের বাইরে আর রাখতে বিশেষ সাহস করলেন না তদানীন্তন সরকার। তাঁকে MISA ( Maintenance of Internal Security Act)-য় বন্দি করা হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়!
প্রেসিডেন্সি জেল গৌরকিশোরের পরবর্তী এক বছরের ঠিকানা। প্ৰথমে তাঁকে ‘B-Class Prisoner’ হিসেবে জেলে রাখা হয়। স্ত্রী শীলার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত ‘C – Class Prisoner’-এর তকমা জোটে। জেলে A-B- C-র হিসেব কিছুটা অন্যরকম। A-Class Prisoner— চোর, পকেটমার, ডাকাত, খুনি, কালোবাজার কারবারি; B-Class Prisoner— সাধারণ রাজনৈতিক বন্দি; C-Class Prisoner— গণ্যমান্য নাগরিক/রাজনৈতিক বন্দি। অন্তত আমরা তখন তেমনই শুনেছিলাম। গৌরকিশোর সাধারণ রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে থাকতে চাননি। তিনি জানতেন, মিসা-বন্দি হিসেবে তিনি তাঁর গ্রেপ্তারি সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও প্রশ্ন বা অভিযোগ করতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও নিজেকে ‘সাধারণ রাজনৈতিক বন্দি’র শ্রেণিচ্যুত করে নিজের ‘সামাজিক সত্তা’-কে বজায় রাখলেন। অর্থাৎ জেলের হিসেবে গৌরকিশোর তখন এমন কয়েদি, যিনি একজন অ-সাধারণ সামাজিক যাঁকে রাষ্ট্র বন্দি করে রেখেছে। এই সময় থেকে তাঁকে নির্জন সেল-এ বন্দি থাকতে হয়েছে। অবশ্য এই সময় তিনি বইপত্র, লেখার কাগজ, কালি-কলম সবই ব্যবহার করতে পারতেন। যদিও সমস্ত লেখা তাঁর পাহারাদারদের দেখাতে হত।
জেলখানার এই কড়াকড়ির মধ্যে থেকেই অতি সংগোপনে তাঁর দুটি লেখা পাচার হয়ে বাইরে আসে। প্রথমটি— ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি’ [ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে গুটিকয়েক কথা]— ঠিকানা— প্রেসিডেন্সি জেল, দশ সেল; তারিখ: ১ ডিসেম্বর ১৯৭৫। দ্বিতীয়টি— ‘দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা!’ ঠিকানা— প্রেসিডেন্সি জেল, দশ সেল; তারিখ: প্রজাতন্ত্র দিবস, ১৯৭৬। দ্বিতীয় চিঠিটি ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রচারিত হয়। উল্লেখ থাকা ভাল যে এই দুটি লেখাই ভারতের বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানা সংবলিত লেখা দুটি জেলের বাইরে গেল— এ নিয়ে মস্ত গোল বাঁধল। এরই প্রতিক্রিয়ায় গৌরকিশোরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়া হল, এমনকী সপ্তাহে একদিন যে স্ত্রী-র সঙ্গে সাক্ষাৎকারের দিন, সেটাও কিছুদিন স্থগিত থাকল।
ইতিমধ্যে সলিটারি সেলের অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতসেঁতে ঘর গৌরকিশোরের দুর্বল হৃদ্যন্ত্রে ছোবল মারা শুরু করেছে। শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্সি জেলেই তাঁর তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকটি হয়। ইতিপূর্বে ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে হৃদযন্ত্রের বিকলতার কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের এই অসুস্থতায় তাঁর প্রাণসংশয় হয়ে উঠল। জেল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করলেন।
.
আমাদের বাড়িতে সেই আশ্চর্য ফোনটা যখন আসে, তখন সময়টা সন্ধে গড়িয়ে রাতের দিকে যাচ্ছে। সেই ফোনটা যে কে করেছিল, তা আজও আমাদের জানা হয়নি। এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি খবর দিলেন, প্রেসিডেন্সি জেলের কয়েকজন ব্যক্তি জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করায়, জেলের ভেতরে এক অস্থির, অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে— জেলে গুলি চলছে। আর গৌরকিশোর ঘোষকে দারুণ অসুস্থ অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানোর বন্দোবস্ত চলছে। এই প্রথমবার আমরা ভয় পেলাম। প্রেসিডেন্সি জেলের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চলল। বহু প্রচেষ্টায় একজন ফোন তুললেন। কিন্তু কোনও খবর পাওয়া গেল না। নিয়ম নেই! আমরা কি তবে সেই উড়ো ফোনটা বিশ্বাস করব? আমরা কি তবে বিশ্বাস করব না? শেষপর্যন্ত পরদিন সকালে এসএসকেএম হাসপাতালে যাওয়াই স্থির হল। মায়ের সঙ্গে আমরা দুই বোন, আমাদের মেজোমামা, আর সাংবাদিক সুদেব রায়চৌধুরী। হৃদরোগ বিভাগের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখি লিফটের সামনেই শোয়ানো আছে বাবাকে, মেঝেতে। নির্নিমেষ আমরা দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। শোনা গেল জেল কর্তৃপক্ষ অসুস্থ আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দায় সেরেছেন— কিন্তু দিল্লি থেকে চিকিৎসার অনুমতি না আসায় মিসা-বন্দির চিকিৎসা শুরু হতে পারছে না। সুদেব রায়চৌধুরী ছোটাছুটি শুরু করলেন। এরই ফাঁকে এসে গেল অনুমতি। তখন তৎপরতার চূড়ান্ত!
মিসা-বন্দি কয়েদি, হলেই-বা হৃদরোগে আক্রান্ত, শয্যা ঘিরে ফেলে পুলিশ। বিরক্ত চিকিৎসক জানালেন, তাঁর দ্বারা চিকিৎসা সম্ভব নয়। পুলিশ যদি রোগীর বিছানা ঘিরে থাকে, তিনি চিকিৎসা করবেন না। তখন পুলিশ ওইটুকু ছাড় দেয়, ঘরের বাইরে গিয়ে বসে। শুরু হয় চিকিৎসা— মরণাপন্ন এক রোগীকে জীবনদানের প্রাণপণ প্রচেষ্টা।
আর পুলিশ? যতদিন রোগীকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলল, ততদিন তাঁদের কড়া পাহারায় শৈথিল্য আসেনি। যখন থেকে বাবা সুস্থ হতে শুরু করলেন, তখন থেকে তো তাঁরাই বড় বন্ধু! বাবা তো ছিলেন মিসা- বন্দি। আমাদের তাই দেখা করতে হত জেলের নিয়মেই। অর্থাৎ সপ্তাহে একদিন। অধিকাংশ দিন হৃদরোগ বিভাগের নীচে বড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা, আর বাবা দাঁড়াতেন দোতলার বারান্দায়। ওই যা দেখাশোনা আমাদের! ক্বচিৎ কখনও আমাদের দুই বোনের সুযোগ এসে যেত বাবার কাছে চলে যাবার। সৌজন্য, বাবার পাহারাদার পুলিশ।
আর বাবা? কখনও নিদ্রাহীন রাতে দেখে ফেলেছেন পাহারাদারদের কষ্ট। মশা ছেঁকে ধরেছে তাঁদের। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে হুকুম হল, মশা তাড়ানোর ধূপ আনো, ওডোমস আনো। বাবা নিজে মশারির ভেতর সুরক্ষিত, আর পাহারাদাররা অরক্ষিত— মানতে পারতেন না। বহু সুখ-দুঃখের কথা বাবার পাহারাদাররা বলতেন, এমনকী পারিবারিক সমস্যাও। কখনও কখনও খাবার করে নিয়ে যেতে দেখেছি মা’কে। সেগুলো অবশ্য জুনিয়র ডাক্তারদের আবদারে! এখন তাঁরা কলকাতার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক।
একটু সুস্থ হতেই বাবার সাংবাদিক সত্তা জাগ্রত হয়ে উঠল। তাঁর জন্য এই এলাহি খরচের বহর জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। বাবার হিসেব অনুযায়ী— সেরা চিকিৎসা, চিকিৎসা সংক্রান্ত মোট ব্যয় ৭,০০০/- টাকার কিছু বেশি, আর পাহারা দেবার জন্য ওই একই সময়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০,০০০/- টাকা। চব্বিশ ঘণ্টায় তিনটে শিফ্ট। প্রতি শিফটে আটজন করে পাহারাদার। স্বৈরতন্ত্রের খেসারত! বাবা এই হিসেবটা অনেক বছর পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে শুনিয়েছিলেন। সময়টা ১৯৮১ সালের মে মাস— চতুর্থবারের জন্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে তখন ভর্তি। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ‘অসুস্থ বন্ধু’কে দেখতে এসেছিলেন।
জেলে বন্দি অবস্থায় যেমন, হাসপাতালে অন্তরীণ অবস্থাতেও তেমনি অনেক লিখছিলেন বাবা। চিঠিপত্র, নানান বিষয়ে মতামত, টুকরো চিন্তা— যখন যেমন মনে হয়েছে, যখন যেমন কাগজ পেয়েছেন, কলম পেয়েছেন, লিখে লিখে রেখেছিলেন। চিরকুটে, বইয়ের পাতায়, হাসপাতালের ছোট প্যাডের কাগজে, নানাখানা হয়ে ছড়িয়ে ছিল এসব লেখা। অনেক কাগজ হারিয়ে গেছে হাসপাতাল থেকে জেলে ফেরার সময়, কিছু হারিয়েছে জেল থেকে বাড়ি ফেরার সময়। বন্ধুদের লেখা চিঠিগুলি উদ্ধার করা গেল না অনেক চেষ্টাতেও। আর বাকি যা ছিল আমাদের কাছে, তাই দিয়েই সাজানো হল এই বই অপরিবর্তিত বানানে। গৌরী আইয়ুবকে লেখা চিঠিগুলো অন্তত পাওয়াটা জরুরি ছিল। পাওয়া গেল না। আফশোস।
ভেবেছিলাম একটা ভূমিকা থাকাই যথেষ্ট হবে এই বই-এর পক্ষে। বড় মানুষের কথা বড় মানুষেরই বলা সাজে। পরে মনে হল কিছু ইতিহাস গোপন হয়ে থাকবে তবে চিরকালের মতো। জানি, এসব ইতিহাস ব্যক্তিগত, একান্তই পারিবারিক। তবু এখানে দেওয়া রইল এই কারণে যে এই লেখাগুলির স্রষ্টাকে হয়তো বোঝা সম্ভব হবে এসব ঘটনা থেকে। সেই যে-সব পাহারাদার, তাঁরা যে কতরকমভাবে বেআইনি পথে আমাদের দুই বোনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছেন বাবার— সরকারি নিয়মকে পাশ কাটিয়ে! সেইসব জুনিয়র ডাক্তাররা, যাঁরা আড্ডা মারতে আসতেন বলে হাসপাতালে বাবার বন্দিজীবন সুসহ হয়েছিল। সেই যে নার্সরা, সর্বদা আগলে রাখতেন বাবাকে— তাঁদের ঋণ স্বীকার না করাটাই যে অপরাধ হয়ে থাকবে। সেইসব রাজনৈতিক বন্দিরা, যাঁরা প্রেসিডেন্সি জেলের দিনগুলোকে তর্কে-বিতর্কে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন, কিংবা সেই যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামি, সরকারি নিয়মে আমার বাবার ‘অ্যাটেনড্যান্ট’- যাঁর ছোটখাটো বউটি কখনও কখনও মায়ের কাছে এসে খবর দিয়ে যেত— তাঁদের সকলের কাছেই যে আমাদের পরিবারের অশেষ ঋণ!
লেখাগুলো যখন বই হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেই, অবশেষে— আমাদের পারিবারিক কৃতজ্ঞতাও না হয় থাক সকলের প্রতি!
অলমিতি—
সোহিনী ঘোষ
.
দ্বিতীয় সংস্করণের নিবেদন
দ্বিতীয় সংস্করণের নিবেদনকে একটা কৈফিয়ত বলা চলে। বইটির প্রথম প্রকাশের সময় ভাবা হয়েছিল বন্ধুবান্ধবদের কাছে পাঠানো হারিয়ে যাওয়া কিছু চিঠিপত্র ছাড়া আর বোধহয় কিছু ছাপতে বাকি রইল না— জরুরি অবস্থার দিনগুলোতে যা যা লেখা হয়েছে তার সবই সংকলিত হয়েছে দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা বইতে। ভুল ভাঙল অতি সম্প্রতি। গৌরকিশোর ঘোষের জন্ম-শতবৰ্ষ উদ্যাপনের আয়োজন শুরু হয়েছিল কোভিডের অতর্কিত প্রাথমিক আঘাত সামলানোর পর। ২০২০ সাল থেকে পারিবারিকভাবে যে ভাবনাচিন্তা চলছিল, পরের বছর তা গতি পেল ‘গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম-শতবর্ষ উদযাপন কমিটি’র প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার সময়। ইতিমধ্যে খুঁড়িয়ে হলেও চলছিল অগ্রন্থিত রচনাগুলিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য লেখা গোছানোর কাজ। সেই কাজের সূত্রে হাতে এল এক অমূল্য রত্ন! বেঁটে মোটা বাদামি রঙের একটা ডায়েরি, ১৯৭৬ সালের। ভেতরে প্রেসিডেন্সি জেলের সিকিউরিটি অফিসারের ‘সেনসর্ড্ অ্যান্ড পাড়’ লেখা ছাপা ও সই সম্বলিত (৯.২.১৯৭৬) পাতার ওপরে গৌরকিশোরের বাংলা স্বাক্ষর!
ডায়েরির প্রথম দিককার পাতাগুলিতে বহু মানুষের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর লেখা। আর আছে নানা রকম হিসেব— জেল থেকে পাওনা টাকা কিংবা যা যা জিনিসপত্র কেনা হয়েছে তার হিসেব। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেখা— ‘রাত্র ১১টা আজ প্রেসিডেন্সি জেল থেকে আমাকে SSKM-এ ভর্তি করা হয়।’ অনুমান করা হয়তো খুব অসংগত হবে না যে এটা পরবর্তী কোনও সময়ের সংযোজন। এক আশ্চর্য উড়ো ফোন মারফত আমরা শুনেছিলাম যে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্সি জেলের কয়েকজন বন্দি পালাবার চেষ্টা করেছেন এবং সেখানে গোলাগুলি চলছে। গৌরকিশোর আগেই কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। সেদিন তাঁর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। পরদিন সকালে আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছই, তখন দেখি, হার্ট ইউনিটের দোতলায় লিফটের সামনে তাঁকে শোয়ানো (প্রথম সংস্করণের ‘ইতিকথা’ অংশে উল্লেখ আছে)। তাঁর তখন যা শারীরিক অবস্থা তাতে তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না। তাঁর হাতের লেখা অন্তত সেকথা বলে না। ৪, ৫, ৬, ৭ মার্চের তারিখ ধরে যে দু’দিনের কথা বলা হয়েছে, ত সম্ভবত ৪ এবং ৬— দু’দিনের কথা। ৩১ মার্চ তারিখ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত যে ‘যোগ-ভিশন’-এর কথা আছে, সেগুলি নির্দিষ্ট তারিখেই লেখা বলে মনে হয়। ২০ এপ্রিলে— ‘খুকু এসেছিল, যুই আর গন্ধরাজ দিয়ে গেল। রাত্রে ঘর ম’ম করছে।’ (খুকু— বড়মেয়ে সাহানা) এবং ৮ মে তারিখে লেখা— ‘২৫ বৈশাখ (১৩৬৩—১৩৮৩)/২০ বছর পূর্ণ হলো [1956-1976]’— এগুলো সঠিক তারিখেই লেখা।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ডায়েরি তো প্রতিদিনের কথা লেখার জন্য, তা হলে আলাদা করে এসব কথা বলবার অর্থ কী? একটাই কারণ— এখানে আরও অনেক লেখা আছে, বিশেষ করে কবিতা (যেগুলো প্রথম সংস্করণেই গ্রন্থভুক্ত), সেগুলো একই পৃষ্ঠায় দুই বা তিন তারিখ দেওয়া ডায়েরির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর নীচে যে তারিখ দেওয়া আছে সেগুলোর সঙ্গে ডায়েরির পাতায় ছাপা তারিখের সম্পর্ক নেই। সেসব লেখার তারিখ নিয়ে যাতে সংশয় না থাকে তাই কথাগুলো বলা। হাসপাতাল থেকে জেলে ফিরে যাওয়ার পর কয়েকটা তারিখে লেখা হয়েছিল— ‘SSKM -এ put up’ হয়েছিল। অনুমান করছি সেগুলো ঠিক তারিখেই লেখা। ৫ অক্টোবর তারিখে লেখা আছে— ‘SSKM— to be put up’। সেটা আর হয়ে ওঠেনি গৌরকিশোরের আকস্মিক মুক্তিতে (২৮.৯.১৯৭৬)। এতই আকস্মিক ছিল সেই কারামুক্তি, যে তার আগে কোনও ইশারা বা পরে কোনও ঘোষণা, কোনওটাই নেই। তারপরের পাতাগুলো মোটের ওপর খালি। অনেক মাস পরে কয়েকটা পাতায় শুধুই নাম-ঠিকানা লেখা, সেগুলো কারাবাস পর্বের বাইরে। ‘এনগেজমেন্ট’-এর কয়েকটা পাতায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকা। সম্ভবত স্ত্রীকে দিয়ে আনানোর জন্য। কয়েকটা বইয়েরও উল্লেখ আছে— ১. ক্ষিতিমোহন সেনের দাদু এবং কবীর সম্পর্কে লেখা, ২. এক কপি ‘হারামণি’, ৩. এম. এন. রায়ের Reason, Romanticism and Revolution, From Savagery to Civilisation, 8. The West on trial, &. Seven Seas। হয়তো এসব আনানোর জন্যই তালিকা করেছিলেন। তাঁর এক বছরের কারাবাসে নিভৃত প্রকোষ্ঠে বহু বই জমেছিল তাঁর।
জেল এবং হাসপাতালে গৌরকিশোরের নানা কাণ্ড গল্প হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পরবর্তীকালে। মুখের কথায় সেসব কাহিনির বাস, সেগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের উপায় ছিল না এতদিন। এই দিনলিপিতে অন্তত দুটি ঘটনার উল্লেখ আছে— যেগুলো খুবই প্রচার পেয়েছিল সেই সময়ে। একটি হল এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ, আর অন্যটিও সত্যাগ্রহ, তা ব্যক্তিগতও বটে— কিন্তু অন্যকে বিব্রত করার পক্ষে অব্যর্থ! প্রথমটি ৬ মার্চ তারিখের। যেহেতু তিনি জেলবন্দি এবং হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক গ্রুপ-সি কয়েদি, সেহেতু তাঁর সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করার কথা জেল কর্তৃপক্ষের। অসুস্থ গৌরকিশোরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তাঁরা দায় সেরে দিয়েছেন। এদিকে তিনি কোনও জিনিসপত্র পাচ্ছেন না। এর বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহ। ৪ মার্চ তারিখে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মারফত সরকারকে তাঁর বক্তব্য জানান এবং দু’দিন সময় দেন। কোনও সাড়া না পেয়ে ৬ মার্চ থেকে অনশন শুরু করেন। দ্বিতীয়টি ১৮ মার্চ তারিখে। সেদিন হাসপাতাল থেকে তাঁকে তিনটে কাচা শার্ট পাঠানো হয়েছে, ধোপাবাড়ি থেকে কেচে আসেনি বলে কর্তৃপক্ষ পা-জামা দিতে পারেননি। গৌরকিশোর শুনলেন, তারপর পরিচারককে নির্দেশ দিলেন তাঁর গা স্পঞ্জ করে পাউডার লাগিয়ে দিয়ে শার্টটাই পরিয়ে দিতে বললেন। সেই অবস্থাতেই শুয়ে থাকলেন সারাদিন। হাসপাতালে হুলুস্থুল। কর্তৃপক্ষ দর্জির কাছ থেকে নতুন পাজামা আনিয়ে দিতে চাইলেন। তিনি অনড়। হাসপাতালের গাফিলতিতে তাঁর যে অসম্মান হয়েছে, তার জন্য লিখিত ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি নিজেই ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন যে সেদিনটা সারাদিনই ছিল সংগ্রামমুখর। ঘটনাগুলো মুখে মুখে শোনা এক বিষয়— তাতে গল্প শোনার মজাটা দারুণ জমে! কিন্তু গৌরকিশোরকে বুঝতে গেলে কেবল গল্প শুনলেই চলে না, তথ্যেরও প্রয়োজন। এই দিনলিপির পাতায় পাতায় থেকে গেছে সেসব তথ্য।
প্রথম সংস্করণের পর, দ্বিতীয় সংস্করণে তাই যুক্ত হল সেই দিনলিপি। একেবারে প্রতিলিপি হিসেবে ছাপার সিদ্ধান্তের কারণ তাঁর হস্তাক্ষরে লেখাটাকে গুরুত্ব দেওয়া। পুরোনো ডায়েরির লেখা ক্রমশ আরও অস্পষ্ট হবে, তার থেকে ছাপা হয়ে থাক। কালের করালগ্রাস থেকে যতটুকু রক্ষা করা যায়। সম্পাদক হিসেবে একটা স্বাধীনতা নিয়েছি, যে অংশগুলোর ততটা প্রয়োজন নেই বলে আমার মনে হয়েছে, সেগুলোকে এই বইয়ে রাখিনি। পাঠকেরা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন আশা রাখি।
আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃপক্ষ এইভাবে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার ঝক্কিটা যে নিয়েছেন সেজন্য সবিশেষ কৃতজ্ঞ। আজকাল সংস্করণ বদলের কাজটা খুব সহজ নয়। তাঁদের নমস্কার।
সোহিনী ঘোষ
কলকাতা
জুন, ২০২৩
Leave a Reply