দারোগার দপ্তর ১ – প্ৰথম খণ্ড – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত দারোগার দপ্তর
সম্পাদনা—অরুণ মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪
‘দারোগার দপ্তর’ প্রসঙ্গে
‘দারোগার দপ্তর’ নামটি শুনলেই চলে আসে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৪, পৃ. ৩১৭) জানাচ্ছে, “প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন। নদিয়ার জয়রামপুরের চুয়াডাঙায়। তাঁকে বলা হয়েছে বাংলা গোয়েন্দা গল্পের পথিকৃৎ। পেশায় ছিলেন পুলিশ কর্মচারী। তিনি ‘দারোগার দপ্তর’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা ১২৯৭ বঙ্গাব্দ থেকে ১২ বছর চালিয়েছিলেন। এ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলি পরে ‘ডিটেকটিভ গল্প’ নামে পুস্তকাকারে ছাপা হয়। রচিত গ্রন্থ : ‘তান্তিয়া ভিল’, ‘ডিটেকটিভ পুলিশ’ (৬ খণ্ড), ‘ঠগিকাহিনী’, ‘বুয়ার যুদ্ধের ইতিহাস’ প্রভৃতি।” উৎস নির্দেশ থেকে জানা যাচ্ছে, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানের প্রধান সম্পাদক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও সম্পাদক অঞ্জলি বসু শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার সংকলিত ‘জীবনীকোষ’-কে গ্রহণ করেছেন। কর্মজীবনের সাফল্যহেতু ইংরেজ সরকার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। জানা যাচ্ছে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান হয় ২০ জুন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে।
শিশিরকুমার দাস সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ‘সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী’। এই গ্রন্থের (ফেব্রুয়ারি ২০০৩, প্রথম সংস্করণে) ৯৬ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে—
দারোগার দপ্তর (১৮৯২) : প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এই ডিটেকটিভ গল্পের ধারা শুরু করেন। অনেকগুলি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রিয়নাথ নিজে ছিলেন পুলিশ দপ্তরের কর্মচারী। প্রধানত নিজের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে এই গল্পগুলি লিখিত হয়। তবে কোনো কোনো খণ্ডে বিদেশি ডিটেকটিভ গল্পের অনুবাদও সংকলিত হয়। এর ১৩, ১৪ ও ১৫ সংখ্যার সমালোচনা প্রসঙ্গে ‘ভারতী’ (১৩০০ বঙ্গাব্দ, আষাঢ়) লিখেছিলেন, “ব্যাপারটি আমাদের দেশের পক্ষে নূতন।” এই গ্রন্থধারাকে বাংলা ডিটেকটিভ গল্পের আদি বলা চলে।
সুকুমার সেন ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ (ডিসেম্বর ১৯৮৮, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ১৫১)-তে লিখেছেন—“বাস্তব ও অবাস্তব ডিটেকটিভ কাহিনীর সূত্রপাত রীতিমতো করেছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৫৫—১৯৪৭)। ইনি কলকাতা ডিটেকটিভ পুলিশে কাজ করেছিলেন তেত্রিশ বছর ধরে। কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে তারিখে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, প্রিয়নাথ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ডিটেকটিভ পুলিশে চাকরিতে যোগদান করেন। আত্মজীবনীর উপক্রমণিকায় (১৩১৮ বঙ্গাব্দ) প্রিয়নাথ লিখেছেন, “দীর্ঘকাল ডিটেকটিভ পুলিশের কার্য করিয়া যে সকল মকদ্দমার কিনারা করিতে সমর্থ বা সময় সময় অকৃতকার্য হইয়াছি, তাহা আমি অনেক সময় দারোগার দপ্তরে প্রকাশ করিয়া থাকি।”
দারোগার দপ্তর মাসে মাসে বেরোত। প্রত্যেক সংখ্যায় প্রায়ই একটি কাহিনি থাকত। সুকুমার সেন বলছেন, দারোগার দপ্তরের প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৩০০ সালে অর্থাৎ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। অনেকেই তা কিনতেন। কি শহরে কি গাঁয়ে সর্বত্র শিক্ষিত ভদ্র বাঙালির ঘরে এই দু চার সংখ্যা দেখা যেত। ড. সেনের মতে, দারোগার দপ্তর পুলিশি কাহিনির এবং সেই স্বাদের রোমাঞ্চকর ক্রাইম সত্য কাহিনির মালা।
.
মূল দারোগার দপ্তরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, ১২৯৯ বঙ্গাব্দে দারোগার দপ্তরের সূচনা। বৈশাখ থেকে চৈত্র বাংলা বছর অনুযায়ী বারোটি সংখ্যায় বারোটি গল্প থাকত। প্রথম বর্ষের বারোটি সংখ্যায় ছিল : বৈশাখে ‘বনমালী দাসের হত্যা’, জ্যৈষ্ঠে ‘যমালয়ের ফেরতা মানুষ’, আষাঢ়ে ‘জুয়াচোরের বাহাদুরি’, শ্রাবণে ‘জালিয়াৎ যদু’, ভাদ্রে ‘জুয়াচোরের তীর্থযাত্রা’, আশ্বিনে ‘অদ্ভুত হত্যা’, কার্তিকে ‘চোরের গাড়ি চড়া’,অগ্রহায়ণে ‘চোরে চতুরে’, পৌষে ‘চোরের চক্ষুদান’, মাঘে ‘চোরের উপর বাটপাড়ি, ফাল্গুনে জুয়াচোরের শিবপূজা’, চৈত্রে ‘কৃত্রিম মুদ্রা’। দ্বিতীয় বর্ষের জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রকাশিত হল ‘আসমানী লাস’। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, শিরোনামে লেখা আছে ‘আসমানী লাস’ এবং তারপর প্রথম বন্ধনীর মধ্যে ভয়ানক লোমহর্ষণকর
অদ্ভুত ঘটনা’ লিখে দুটি আশ্চর্য-চিহ্ন দেওয়া। এর আগের সংখ্যায় বৈশাখে প্রকাশ পেয়েছে ‘কুলসম’। তাতে কিন্তু বন্ধনীর মধ্যে কিছু লেখা নেই। কোনো একটি গল্প হয়তো এক সংখ্যায় শেষ হয়নি। সেক্ষেত্রে দুই বা তিন মাস ধরে দুই বা তিনটি সংখ্যায় সেগুলি শেষ হয়েছিল। ইংরেজ ডাকাত’, ‘পথে খুন’, ‘রত্নদন্তিকা’, ‘খুনী খালাস’, ‘অদ্ভুত গ্রেপ্তার’, ‘রাণী না খুনী’, ‘কৃপণের ধন’, ‘কুঠিয়াল সাহেব’, ‘বিষম ভ্ৰম’, ‘কুবুদ্ধি’, ‘ডাক্তারবাবু’ ইত্যাদি দুই সংখ্যায় এবং ‘লাল পাগড়ি’, ‘মণিপুরের সেনাপতি’, ‘রাজাসাহেব’ ইত্যাদি তিন সংখ্যা জুড়ে বিধৃত।
.
প্রথম বছর অর্থাৎ ১২৯৯ বঙ্গাব্দের দারোগার দপ্তর-এর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল এভাবে—প্রথম থেকে দ্বাদশ সংখ্যক দারোগার দপ্তরের মূল্য ছিল একত্রে এক টাকা। যাঁরা ত্রয়োদশ সংখ্যা থেকে অগ্রিম মূল্য দিয়ে এক বছরের গ্রাহক হবেন, তাঁদের পক্ষে উপরোক্ত বারো খণ্ডের পুস্তকের মূল্য দেড় টাকা পড়বে।
দ্বিতীয় বছরের ভূমিকায় দারোগার দপ্তরের কার্য্য্যাধ্যক্ষ শ্রীবাণীনাথ নন্দী জানিয়েছেন, “ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে ডিটেকটিভের গল্প সম্বন্ধীয় পুস্তকের বহুল প্রচার থাকিলেও তথাকার পাঠকগণের পাঠকলালসা পরিতৃপ্ত হয় না। তাঁহারা আরও পাইবার জন্য সর্বদা উৎসুক থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে পাঠকগণের সেইপ্রকার ঔৎসুক্য জন্মিলেও সেই শ্রেণীর বাঙ্গালা ভাষার পুস্তক এদেশে পাওয়া যায় না। আমরা এই অভাব কথঞ্চিৎ পরিমাণে মোচন করিবার অভিপ্রায়ে বর্তমান বৈশাখ মাস হইতে নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে ‘দারোগার দপ্তর’ নামে একখানি ডিটেকটিভের মাসিক গল্প-পুস্তক প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
“গ্রন্থকার ও প্রকাশক দুইজন বিভিন্ন ব্যক্তি হইলে সেই উভয় কার্যে সুশৃঙ্খলার সম্ভাবনা অধিক বলিয়াই আমরা সেই পন্থা অবলম্বন করিলাম। ডিটেকটিভ পুলিশের বিখ্যাত কর্মচারী শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লিখিত অনেকগুলি ডিটেকটিভের গল্প আমাদের হস্তগত হইয়াছে, সেইগুলি ক্রমে ক্রমে ধারাবাহিকরূপে এই মাসিক পুস্তকে প্রকাশিত হইতে চলিল। বিশেষতঃ যাহাতে এই পুস্তকগুলি বাঙ্গালা ভাষার বাস্তবিক পরিপুষ্টি সাধন করিতে পারে, আমরা যথোচিত রূপে তাহার চেষ্টা করিব।”
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার থেকে প্রকাশ পেত দারোগার দপ্তর। কার্য্যাধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীবাণীনাথ নন্দী। ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখের ‘কুলসম’ গ্রন্থের ভূমিকায় বাণীনাথ নন্দী পাঠকদের উদ্দেশে জানিয়েছেন, “আমরা যে ব্রতে ব্রতী হইলাম, তাহা এদেশে নূতন; সুতরাং ইহাতে অনেক বাধাবিপত্তি আছে। সে সকল সত্ত্বেও আমরা সহৃদয় পাঠকবর্গের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া কর্তব্যপথে অগ্রসর হইলাম। আশা করি তাঁহারা আমাদের কর্তব্য আদ্যোপান্ত আলোচনা ও পুস্তকের গুণাগুণ সমালোচনা করিয়া আমাদের এই নূতন উদ্যমে ভাষার পরিপুষ্টি সাধনে ও সগ্রন্থ প্রচার কার্যে সহায় হইবেন ও যাহাতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়, তাহাই করিবেন।”
‘হিন্দুরঞ্জিকা’ পত্রিকার ১৪ বৈশাখ ১৩০০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘কুলসম’ গ্রন্থ সম্পর্কে লেখা হল “এই গল্পপাঠে লোকচরিত্র পর্যবেক্ষণ করিবার সুযোগ হইবে। অথচ সেই সঙ্গে গল্পপ্রিয় পাঠকের কৌতূহল পরিতৃপ্ত হইবে।”
১৩০০ বঙ্গাব্দের ১৫ই বৈশাখের উলুবেড়িয়া দর্পণ” লিখেছে, “দারোগার দপ্তর ত্রয়োদশ সংখ্যা (কুলসম) ডিটেকটিভ পুলিশের সুপ্রসিদ্ধ কর্মচারী শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত। মূল্য দুই আনা। প্রিয়নাথবাবু নিত্য কাৰ্য্যকালে যে সকল অদ্ভুত ঘটনার রহস্য বাহির করিয়াছেন তাহাই পুস্তকাকারে উক্ত নাম দিয়া প্রচার করিতেছেন। ইহা যে পাঠকগণের জানিতে বিশেষ কৌতূহল হইবে, তাহার সন্দেহ নাই।”
‘প্রতিকার’ পত্রিকার ১৬ বৈশাখ ১৩০০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় লেখা আছে “প্রিয়নাথবাবুর অন্যান্য পুস্তকের ন্যায় এখানি (কুলসম) বঙ্গীয় পাঠকের পক্ষে আমোদজনক সন্দেহ নাই। মাসে মাসে এইরূপ এক একখানি পুস্তক প্রকাশিত হইবে।”
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল তারিখের ‘হোপ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “Babu Priyanath Mukherjee is well known to the public as a writer of Popular Detective Stories and his latest volume KULSAM sustains his previous reputation. The publisher of the present volume is going to bring out a series of Detective Stories written by the same author in monthly volumes with the annual subscription of Re। and ans 8. We hope that the novel reading public will appreciate his efforts to entertain them. The book can be obtained of Babu Baneenath Nandee, at।2 Sikderbagan Street, Calcutta for 2 annas.” পরপর তিনটি লাইন জুড়ে বিজ্ঞাপন। বেশ বড়ো বড়ো হরফে। বিজ্ঞাপনের দিকে একটু চোখ দেওয়া যাক।
অভাবনীয় ঘটনা!
যাহা কখন ঘটে নাই, যাহা সহজে হইবে না,
আজ তাহাই হইতে চলিল।
২৪ সংখ্যক দারোগার দপ্তরের ক্রোড়পত্র হিসেবে এই বিজ্ঞাপন মুদ্রিত আছে। এছাড়াও রয়েছে উপহারের ডালি। মহাসমারোহে বিপুল আয়োজনের সহিত সন ১৩০১ সালের বৈশাখ হইতে দারোগার দপ্তরের তৃতীয় বৎসর আরম্ভ হইতেছে। দারোগার দপ্তর, ডিটেকটিভ পুলিশের প্রসিদ্ধ কর্মচারী এবং সুপ্রসিদ্ধ লেখক শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত হইয়া সকলের ঘরে ঘরে যেরূপ সমাদরে বিরাজ করিতেছে তাহা অনেকেই অবগত আছেন। দারোগার দপ্তরের মূল্য মায় ডাকমাশুল বার্ষিক ১।। দেড় টাকা মাত্র। আজ তাহার উপর আবার প্রায় দুই টাকা মূল্যের সারবান মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় তিনটি উপহার সেই দেড় টাকা মূল্যেই প্রদত্ত হইবে। উপহারগুলি হল—
১। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ঠগীকাহিনী’ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লেখক ঠগী দল সর্দার মহম্মদ আলির জীবনচরিত লিখেছেন। যে একে একে ৭১৯টি নরহত্যায় লিপ্ত ছিল। ইহার জীবনচরিত কি ভয়ানক ও কিরূপ বিভীষিকায় পরিপূর্ণ তা জানা যাবে ‘ঠগীকাহিনী’ পড়লে।
২। প্রাচীন ঋষিশ্রেষ্ঠ মহানুভব শংকরাচার্যের সুমিষ্ট লেখনী প্রসূত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্তব, মূল এবং বাঙ্গালা অনুবাদসহ পরিপাটিরূপে মুদ্রিত ‘পঞ্চস্তোত্র’ গ্রন্থ।
৩। সন ১৩০১ সালের একখানি পঞ্জিকা।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, তখন দারোগার দপ্তরের প্রচারের জন্য উপহারস্বরূপ বই দেওয়ার রীতি চালু ছিল।
দারোগার দপ্তর সম্পর্কে শ্রীদামোদর দেবশর্মার বক্তব্য উপস্থাপিত করার লোভ সামলাতে পারছি না। দামোদর দেবশর্মা অর্থাৎ দামোদর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত Detective Story—গুলি বঙ্গভাষায় মৌলিক Sensational Novel রূপে পরিগণিত হইবার উপযোগী।” দারোগার দপ্তর দামোদরবাবুর কাছে যেরূপে প্রতিভাত তা বলতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি বলছেন, “প্রিয়বাবুর পুস্তকগুলির অধিকাংশেই তিনি স্বয়ং প্রধান অভিনেতা প্রায় সর্বত্র তিনি অন্ধকার কোটর-মধ্যস্থ পাপীকে নিষ্কাশিত করিবার নিমিত্ত, উদ্যতভাবে দণ্ডায়মান। তিনি সুযোগ্য ও অসীম প্রতিভাসম্পন্ন রাজকর্মচারী। তাঁহার পুস্তকোক্ত অধিকাংশ পাপীকে, তিনি স্বয়ং হাতে-কলমে টানিয়া আনিয়াছেন। সুতরাং প্রত্যক্ষ সত্যের সম্মিলনে তাঁহার গ্রন্থোক্ত ঘটনাবলী সজীবভাবে পাঠকের নয়নসম্মুখে সমুপস্থিত হয়। প্রিয়বাবুর ভাষাও বড় সরল। অনুপ্রাসের কাননে প্রবেশ করিয়া শব্দপ্রসূন-চয়নে তিনি প্রয়াসী নহেন। অলঙ্কারের কণ্টকে তাঁহার ভাষাসুন্দরী শোণিত বিলেপিত কায়া নহেন। এই গ্রন্থগুলিতে সরল কথায়, সরলভাবে, সজীব চিত্র পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিয়া প্রিয়বাবু আপনার রচনাশক্তির বিশেষ পরিচয় দিয়াছেন। আমরা তাঁহার পুস্তকগুলি পাঠ করিয়া সাতিশয় প্রীতিলাভ করিয়াছি। আশা করি, সকলেই এই সকল গ্রন্থ পাঠ করিয়া আমোদলাভ করিবেন।”
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কেন যে দারোগার দপ্তরকে ‘প্রবন্ধ’ নামে উল্লেখ করলেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, প্রিয়নাথ নিজের অভিজ্ঞতার কথা ছাড়াও বিদেশি গল্পের অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়েছেন ‘দারোগার দপ্তর’ রচনাকালে। প্রিয়নাথের বক্তব্য, “দারোগার দপ্তর যখন প্রথম নিয়মিতরূপে মাসে মাসে বাহির করিতে আরম্ভ করি, সেই সময়ে আমার এইরূপ উদ্দেশ্য ছিল না যে, ইহাতে যত প্ৰবন্ধ বাহির হইবে, তাহার ঘটনা সমস্তই প্রকৃত, বা সমস্তই আমা-কর্তৃক অনুসন্ধিত। এই ভাবিয়া ‘Stories’ নামেই ইহার নামকরণ হইয়াছিল। কিন্তু দুই এক সংখ্যা বাহির হইবামাত্রই দেখিলাম, পাঠকগণ ‘Stories’ এই কথাটি ভুলিয়া গিয়া, ইহার সমস্তই প্রকৃত বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। সংবাদপত্র সম্পাদকগণও সমস্ত ঘটনাই প্রকৃত বলিয়া সমালোচনা আরম্ভ করিয়াছেন। কোন কোন বিজ্ঞ সমালোচক অনুসন্ধানকারীর কোনরূপ দোষ না থাকিলেও লেখকের প্রতি অন্যায় কটাক্ষ প্রদান করিতেও ত্রুটি করিতেছেন না। এইসকল অবস্থা দেখিয়া আমি এরূপ পন্থা অবলম্বন করিব মনে করিয়াছি যে, তাহাতে তাঁহারা প্রকৃত ও কল্পিত ঘটনাদ্বয়ের পার্থক্য বুঝিতে সমর্থ হন।”
(তৃতীয় বৎসরের ভূমিকা) উপায়? “পাঠকগণ পাছে প্রকৃত ঘটনাকে অপ্রকৃত এবং অপ্রকৃত ঘটনাকে প্রকৃত বলিয়া গ্রহণ করেন, এই নিমিত্ত এখন হইতে আমি নিয়ম করিলাম, যে সকল প্রবন্ধ পূর্বের ন্যায় প্রথম পুরুষে বক্তাভাবে লিখিত হইবে, তাহার সমস্তই প্রকৃত ঘটনা। কেবল অধিকাংশ স্থলে নাম ও ঠিকানার পরিবর্তন থাকিবে মাত্ৰ। প্ৰথম পুরুষ ব্যতিরেকে যে সকল ঘটনা লিখিত হইবে, তাহার সমস্তই অপ্রকৃত, স্বকপোলকল্পিত, অথবা ইংরাজি বা অপর কোনো গ্রন্থের ভাবাবলম্বনে লিখিত হইবে।”
এই যে বিভাজন, এতো দারোগার দপ্তরের পাঠকবর্গের চাহিদা অনুযায়ী। প্রিয়নাথের বক্তব্য আবার উদ্ধৃত করা যাক। “আমাকে বড়ই দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে যে, বিভিন্ন রুচির পাঠকগণকে সন্তুষ্ট রাখা, আমাদিগের সদৃশ ক্ষুদ্র লেখকের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে।” এতো লেখকের বিনয়ের কথা। তারপরই লিখছেন, “এই দারোগার দপ্তরে যখন দুই-একটি অপ্রকৃত ঘটনা বাহির হইল, তখন সর্বসাধারণে সেই সকল ঘটনাকে প্রকৃত বলিয়া আদরে গ্রহণ করিলেন। সুতরাং বাধ্য হইয়া আমি অপ্রকৃত ঘটনা একবারে পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল প্রকৃত ঘটনারই উপর লক্ষ্য রাখিলাম। যখন ক্রমাগত কতকগুলি প্রকৃত ঘটনা বাহির হইল, তখন আবার প্রিয় পাঠকবর্গের ভিতর অনেকেই বলিতে আরম্ভ করিলেন; সমস্তই প্রকৃত ঘটনা হইলে চলিবে কি প্রকারে? ইহার ভিতর কতক কল্পিত, কতক বা ইংরাজী ও অপর কোন বিদেশীয় ভাষার গল্প অবলম্বনে লেখা আবশ্যক।” পাঠকবর্গের রুচি বিভিন্নতা ও দারোগার দপ্তরের অসম্ভব জনপ্রিয়তা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে ধারাবাহিকভাবে ‘দারোগার দপ্তর’ লিখতে সাহায্য করেছিল।
জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ যখন এলই, উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে ক’টি কথা। বাণীনাথ নন্দী জানাচ্ছেন, “পরমেশ্বরের ইচ্ছায় উত্তরোত্তর ইহার গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া আসিতেছে; সুতরাং সাধারণ লোকে ইহার প্রয়োজনীয়তা ও আদর-যোগ্যতা যে ক্রমে বুঝিতে পারিয়াছেন, ইহাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এদেশে প্রেম—ভালোবাসার কাল্পনিক গল্প পুস্তকের প্রচার ও আদর অধিক, যে দেশের লোকে কল্পনার অতিরঞ্জিত চিত্র দেখিয়া ভাষা উপেক্ষা করিয়া, কেবলমাত্র গল্প পাঠেই মনোবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করেন, সেদেশে দারোগার দপ্তরের মতো প্রণয় রসবিহীন উৎকট বীভৎস রসপূর্ণ এতদ্দেশীয় চরিত্র-চিত্রপূর্ণ গল্প পুস্তকের আদর যে এত শীঘ্র বৃদ্ধি পাইবে, তাহা সহজে আশা করা যায় না। বাঙ্গালা ভাষায় এ পুস্তকের নূতনত্ব দৃষ্টি করিয়াই হউক, বা আনন্দের ঘটনা সন্নিবেশ বৈচিত্র্যেই হউক, এ পুস্তকের আদর ও প্রচারবৃদ্ধি শুভলক্ষণ বলিতে হইবে।”
প্রেম, প্রণয় ইত্যাদি কোমলাঙ্গের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত শুধুমাত্র রহস্যগল্প যে ধারাবাহিকভাবে বেরোতে পারে এ ভাবনা সম্ভবত লেখক, কাৰ্য্যাধ্যক্ষ কারোরই ছিল না। বাংলা সাহিত্যের পাঠক যে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে গোয়েন্দা সাহিত্যে প্রবেশ করেছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই কাৰ্য্যাধ্যক্ষ এমনও দাবি করেছেন, “আমরা যে কিয়ৎ পরিমাণে উপন্যাস পাঠকের রুচি ভিন্ন দিকে ফিরাইতে পারিয়াছি, তাহাতেই আমাদিগকে গৌরবান্বিত মনে করিতেছি।”
অষ্টম বর্ষে পদার্পণ করছে ‘দারোগার দপ্তর’ এবং সেই উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশকের মন্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, যে ‘দারোগার দপ্তর’ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, দেশীয়, বিদেশীয়, বাঙালি, আসামী, হিন্দুস্থানী, উড়িষ্যাবাসী, মহারাষ্ট্রীয়, শিখ, ইংরাজ প্রভৃতি বহুবিধ ব্যক্তিগণের কাছে আদর যত্ন পেয়েছে, সকলকেই সমানভাবে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে; এটাও যথেষ্ট গৌরবের কথা।
এমনও জানা গেছে, কেউ কেউ বলেছেন, দারোগার দপ্তর পাঠ করে পুলিশ কর্মচারী চুরি, জুয়াচুরি ধরার কৌশল শিখে থাকেন। চোর জুয়াচোররা তাদের উদ্ভাবিত উপায় কৌশল যাতে ধরা না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক হয়। কিন্তু এও শোনা গেছে, অনেক পল্লীগ্রামের পাঠক দারোগার দপ্তরে প্রকাশিত চুরি জুয়াচুরির কৌশল পাঠ করে সতর্ক ও সাবধান হয়ে অনেক সময় জুয়াচোরের হাতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছেন।
প্রত্যেক বছর দারোগার দপ্তরের সূচনায়, বৈশাখ মাসে ঈশ্বর, পরমেশ্বর, সর্বসিদ্ধিদাতা ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে পত্রিকার পাঠক-সংখ্যা বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছেন। পাঠক মনোরঞ্জনের দিকেও তাঁরা দৃষ্টি দিয়েছেন।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ দারোগার দপ্তরের প্রকাশক বাণীনাথ নন্দী তাঁর মন্তব্যে জানিয়েছেন, “আমাদের এক্ষণে এরূপ ভরসা আছে যে, প্রিয়নাথবাবু ও আমার জীবিতকাল পর্যন্ত ইহার অস্বিস্ত লোপ হইবে না; তবে ইতিমধ্যে অন্য কোন অনিবার্য দৈব-দুর্ঘটনার সংঘটন হইলে আমরা নাচার।”
ভাবতে অবাক লাগে, যে দৈব দুর্ঘটনার সংকেত বাণীনাথ নন্দী দিলেন, সেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল এক মাসের মধ্যেই। ৩২ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ শিরোনামে দারোগার দপ্তরের সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী হিসেবে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞাপিত করেছেন, “বিশেষ দুঃখের সহিত প্রকাশ করিতে হইতেছে, দারোগার দপ্তরের সহিত এতদিবস পর্য্যন্ত শ্রীযুক্তবাবু বাণীনাথ নন্দী মহাশয়ের যে সংস্রব ছিল, অদ্য হইতে তাঁহার সেই সংস্রব বিলুপ্ত হইল। কতকগুলি কারণে বাধ্য হইয়া তাঁহার হস্ত হইতে দারোগার দপ্তরের সমস্ত ভার গ্রহণ করিয়া, অদ্য হইতে নূতন কাৰ্য্যাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত বাবু উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী মহাশয়ের হস্তে সেই গুরুভার অর্পণ করিলাম। অদ্য হইতে দারোগার দপ্তরের সহিত বাণীবাবুর আর কোনরূপ সংস্রব রহিল না।”
উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী প্রিয়নাথের বিজ্ঞপ্তির পাদদেশে জানিয়েছেন, “অদ্য হইতে আমি দারোগার দপ্তরের কার্য্যাধ্যক্ষের গুরুভার গ্রহণ করিলাম। এখন হইতে টাকাকড়ি, চিঠিপত্র, বিনিময়-পত্রিকা প্রভৃতি আমার নামে নিম্নলিখিত ঠিকানায় পাঠাইবেন। ভূতপূর্ব কার্য্যাধ্যক্ষের সময়ে যাঁহার যে কোন অভিযোগ থাকে, তাহা আমাকে লিখিলেই আমি পত্র পাইবামাত্র তাহার প্রতিকার করিব। গ্রাহকগণ পত্রে গ্রাহকের নম্বর লিখিয়া দেবেন। গ্রাহক নম্বর না থাকিলে, সেই পত্রের কোন কার্য হয় না, ইহা যেন গ্রাহকগণের বিশেষ স্মরণে থাকে।” ঠিকানা লেখা ছিল ৭৯/৩/২ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলকাতা। পরবর্তী সময়ে ১৬২ বহুবাজার স্ট্রীট, ১৪নং হুজুরিমলস লেন, বৈঠকখানা এবং ৮৮/১ কেরানিবাগান ইস্টলেন ঠিকানা দারোগার দপ্তরের কার্যালয় ও প্রাপ্তিস্থান হিসেবে ছাপা হয়েছে।
ঠিকানা বদলে গেল। কাৰ্য্যাধ্যক্ষ বদলে গেল। লেখক কিন্তু একই ব্যক্তি রয়ে গেলেন। কারণ “এই দপ্তরে প্রিয়বাবু ব্যতীত অপর কাহারও একছত্র লিখিবার অধিকার নাই। প্রিয়বাবু সরকারি কার্যের গুরুভার স্কন্ধে লইয়া সেই কার্য সমাপনান্তর পুনরায় এই দপ্তর নিয়মিতরূপে যে লিখিতে সমর্থ হন, ইহাই আশ্চর্য।” জানিয়েছেন উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী মহাশয়। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, দারোগার দপ্তরের জন্য পাঠক রীতিমতো লালায়িত ছিল। আর তার ফল? পথে চুরি হয়ে যেত গ্রাহকের দারোগার দপ্তর।
দারোগার দপ্তর প্রণেতা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় একবার ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’ অংশে পাঠকদের জানালেন, “আজকাল আমাদের দারোগার দপ্তরের অনুরূপ অনেক পত্রিকা প্রভৃতিতে ডিটেকটিভের গল্প বাহির হইতেছে। সেই দেখিয়া যথায় তথায় বিস্তর লোক আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন এবং তদ্বিষয়ে রাশি রাশি পত্ৰও আমাদিগের হস্তগত হইয়াছে, যে, সেই সকল গল্প আমার লেখা কিনা। অতএব সাধারণের অবগতির জন্য আমি এই বিজ্ঞাপন দিয়া প্রকাশ্যে বলিতেছি যে, এই ‘দারোগার দপ্তর’ ব্যতীত অন্য কোন পত্রে বা পুস্তকে যে কিছু ডিটেকটিভ গল্প ছাপা হইতেছে তাহার সহিত আমার কোনও সংস্রব নাই। ‘দারোগার দপ্তর’ ভিন্ন অন্য কোনো পুস্তক বা পত্রিকায় আমার লেখা থাকে না। যদি কিছুতে থাকে, তবে তাহাতে আমার নাম থাকিবে। নাম না থাকিলে তাহা আমার লিখিত নয় জানিবেন।”
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর সৃষ্ট দারোগার দপ্তর-এর জনপ্রিয়তা কেমন ছিল? এটাও বোঝা যাচ্ছে, তৎকালীন পাঠক রহস্যকাহিনীর বেড়াজালকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা ভাবতেন, রহস্য গল্প মানেই প্রিয়নাথের লেখা। দারোগার দপ্তরের সাফল্যের এও এক মাইলস্টোন।
‘দারোগার দপ্তর’-এর কিছু নিয়ম ছিল। নিয়মগুলি নিম্নরূপ—
১। কি সহরে কি মফস্বলে দারোগার দপ্তরের অগ্রিম বার্ষিক মূল্য ডাকমাশুল সমেত ১॥০ দেড় টাকা মাত্র। অগ্রিম মূল্য না পাইলে দারোগার দপ্তর পাঠান হয় না। ভ্যালু-পেয়েবল পাঠাইতে হইলে দুই আনা অধিক লাগে।
২। প্রতিমাসে এক একটি ডিটেকটিভ গল্প শেষ হইবে; সুতরাং প্রতি মাসের সমান আকার হইবে না; কোন মাসে ৪৮, কোন মাসে ৫২, কোন মাসে ৬০ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত হইবে। এক বৎসরে বারো সংখ্যায় ৬০০ পৃষ্ঠার অধিক হইবে। প্রতি খণ্ডের বা নমুনা পুস্তকের নগদ মূল্য তিন আনা, ডাকমাশুল, অর্ধ আনা স্বতন্ত্র দিতে হইবে।
৩। প্রতি বাঙ্গালা মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দারোগার দপ্তর প্রকাশিত হইবে। কেহ কোন মাসে পুস্তক না পাইলে সেই মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে জানাইবেন। কোন মাসের পুস্তক না পাইবার কথা জানাইলে, তাহার পর মাসের পুস্তকের সহিত সেই পুস্তক প্রেরিত হইবে।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক জায়গায় জানিয়েছেন, “লেখক বলিয়া জনসমাজে আত্মপরিচয় দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নহে; কেবল বন্ধুবর্গের অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া এরূপ দুঃসাহসিক কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” যে দুঃসাহসিক কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন, তা বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্পের ধারাতে পথিকৃতের মর্যাদা পেল। এটাও কম কথা নয়।
প্রসঙ্গত আর একটি কথা বলা দরকার। ডিটেকটিভ পুলিশের বিভিন্ন খণ্ডের লেখাগুলি পরবর্তী সময়ে দারোগার দপ্তরে সংযোজিত হয়। এখানেও গ্রাহকদের চাহিদার কথাটিও আবার আসছে। প্রকাশকের বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, “ডিটেকটিভ পুলিশের অপরাপর খণ্ডগুলিও ক্রমে এই দারোগার দপ্তরের মধ্যে সন্নিবেশিত করিয়া ঐ সকল গ্রাহকদিগের অনুরোধ রক্ষা করিতে ত্রুটি করিব না, এইরূপ ইচ্ছা রহিল।”
মোট সংখ্যায় দারোগার দপ্তর কতগুলো বেরিয়েছিল? জানা যায়, ২০৬টি। অর্থাৎ ১৩১৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসই শেষ দারোগার দপ্তরের প্রকাশকাল হিসেবে ধরা যেতে পারে। ১৩১০ বঙ্গাব্দে দারোগার দপ্তর বেরোয়নি। অবশ্য তাতে দপ্তরের সংখ্যা সূচকে কোন অসুবিধা ঘটেনি।
অলোক রায় ও অশোক উপাধ্যায় সম্পাদিত গিরিশচন্দ্র বসু রচিত ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে (জানুয়ারি ১৯৮৩) ভূমিকা লেখক অলোক রায় জানিয়েছেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুসন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (পৃ. ৭)। এর আগে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ পেয়েছে প্রিয়নাথের লেখা আত্মজীবনী ‘তেত্রিশ বৎসরের পুলিশ কাহিনী বা প্রিয়নাথ জীবনী’। দেখা যাচ্ছে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুকাল নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান জানিয়েছে, সালটা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ, অলোক রায় জানিয়েছেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ, ‘বঙ্গসাহিত্যাভিধান’-এ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এবং সুকুমার সেন জানিয়েছেন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। বিতর্কটা থেকেই যাচ্ছে।
কিন্তু প্রিয়নাথের জন্মসন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দেই তাঁর জন্ম। ২০০৪-এ তাঁর জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে আমরা ‘দারোগার দপ্তর’ প্রকাশ করতে চলেছি। বইয়ের আকার বড়ো হয়ে যাওয়ার কারণে এবং পাঠকদের বইটি ব্যবহারের সুবিধার্থে আমরা দারোগার দপ্তরকে দুটি খণ্ডে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একশোটি দপ্তর আশা করি এই প্রজন্মের কাছে বাংলা সাহিত্যের এক দুষ্প্রাপ্য অধ্যায়কে তুলে ধরতে পারবে। দু বছরেরও বেশি সময় ধরে দারোগার দপ্তর সংগ্রহ করেছি। এ ব্যাপারে আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন কলকাতার হিরণ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক গোপালচন্দ্র দে। তাঁর সহৃদয় সাহায্য না পেলে দারোগার দপ্তর নতুনভাবে প্রকাশ করা যেত না। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। চৈতন্য লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক সৌমেন সেন ও সম্পাদক বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারিক শ্রীমতী অরুণা চট্টোপাধ্যায় দারোগার দপ্তরের অনেক সংখ্যা দেখতে দিয়েছেন ও প্রয়োজনে লিখতে দিয়েছেন। তাঁদের প্রতিও রইল কৃতজ্ঞতা। ছেঁড়া পাতা, পোকায় কাটা পাতা দেখে দেখে আমাকে সম্পাদনা করতে সাহায্য করেছেন আমার স্ত্রী আলো মুখোপাধ্যায় ও কন্যা তিথি।
‘দারোগার দপ্তর’ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী নিখিল সরকারের কাছে। তাঁর নির্দেশেই এ কাজ আমি করতে শুরু করি। প্রতি মুহূর্তে তাঁর সুচিন্তিত পরামর্শ আমাদের কাজে লেগেছে। তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম। সন্দীপ নায়ক ‘পুনশ্চ’ র পক্ষে এই বই প্রকাশ করছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। বাংলা ভাষার পাঠক যদি ‘দারোগার দপ্তর’ পড়ে শতবর্ষ পূর্বের গোয়েন্দা গল্প সম্পর্কে পরিচিত হন তাহলেই আমাদের শ্রম সার্থক হবে।
অরুণ মুখোপাধ্যায়
মোক্তারপাড়া, চন্দননগর, হুগলি
কলকাতা বইমেলা, ২০০৪
Leave a Reply