দরিয়া-ই-নুর – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
Daria-E-Noor by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ : ডিলান
বাতিঘর প্রকাশনী
কিছু কথা
দরিয়া-ই-নুর লিখেছিলাম ‘প্রথম আলো’র ঈদ সংখ্যার জন্য; রোজার দিনে, লক-ডাউনের মধ্যে দমবন্ধ করা আটকাবস্থায়।
পত্রিকার জন্য লিখতে গেলে শব্দসংখ্যার বাধ্যবাধকতা থাকে, হাতখুলে লেখা সম্ভব হয় না। এমন সীমাবদ্ধতার মধ্যে গল্প-উপন্যাস লেখা একটু কঠিন, আর থৃলার-উপন্যাস লেখা বোধহয় সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং। মাত্র ১৬-১৭ হাজার শব্দের মধ্যে লিখতে হয়, ফলে বড় ক্যানভাস কিংবা চরিত্রবহুল গল্প লেখা যায় না। তারপরও চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম। শুরু থেকেই পরিকল্পনা ছিল, কম শব্দে বেশি গল্প বলবো। এরজন্যে দরকার পড়েছিল ভিন্ন ধরণের ন্যারেশনের; দৃশ্যকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। লেখাটা শেষ করার পর মনে হয়েছিল চ্যালেঞ্জটা উতরে গেছি।
ঈদ সংখ্যা প্রকাশ হবার পর পত্রিকার এক সিনিয়র সাংবাদিক প্রশংসার ছলে বলেছিলেন, ‘ছোট কাচামরিচের ঝাল বেশি!’ অগণিত পাঠকও বেশ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল দরিয়া-ই-নুর নিয়ে। তখনই ঠিক করেছিলাম লেখাটা যেভাবে আছে সেভাবেই বই আকারে প্রকাশ করবো, নতুন করে কিছু সংযোজন করবো না-কম শব্দে বেশি গল্প বলার নজির হয়ে থাকুক এটি।
সিনেমার জীবন, জীবনের সিনেমা।
দরিয়া-ই-নুর-এর গল্পটিকে এক লাইনে বললে এভাবেই বলতে হবে। রূপালি পর্দার আকর্ষণে কতো মানুষের জীবন বদলে যায়, কতো মানুষ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ক্লিষ্ট হয়…রকম কিছু গল্পের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়ও আছে আমার। এই কাহিনিতে সে রকম কিছু গল্পের চরিত্র আর উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে।
৫ই ফেব্রুয়ারি কলকতার স্বনামখ্যাত অভিযান পাবলিশার্স থেকে দরিয়া-ই-নুর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের পাঠকের জন্য এবার প্রকাশ করা হলো যথারীতি বাতিঘর প্রকাশনী থেকে। আশা করি ছোট পরিসরে লেখা এই উপন্যাসিকাটি পাঠকের ভালো লাগবে।
সবাইকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার শুভেচ্ছা।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
০৬/০২/২০২৩
উৎসর্গ :
বাল্যবন্ধু দেবুকে…
অনেকেই হারিয়ে গেছে, অনেকে দূরে সরে
গেছে…
সে এখনও হারিয়ে যায়নি।
অনেক স্মৃতি আছে তার সঙ্গে।
মুক্তির স্বাদ
জেলখানার প্রবেশ পথটি যে খুব দীর্ঘ তা নয়। তারপরও এইমাত্র মুক্তি পাওয়া মানুষটির কাছে একটু দীর্ঘই মনে হচ্ছে। আজকের আগে মাত্র একবারই এখানে ঢুকেছিল প্রিজন ভ্যানে করে, সেটাও বছর চারেক আগের ঘটনা—পুরনো জেলখানা থেকে তাদেরকে এই কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল তখন।
তার সঙ্গে আছে ছোট্ট একটা ব্যাগ। এতদিনকার ব্যবহার্য জামা-কাপড়, টুথব্রাশ, চিরুণীসহ জেলারের দেয়া নতুন দুটো শার্ট আছে তাতে। মুক্তি পাবার এক ঘণ্টা আগে তাকে জেলারের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলারের সঙ্গে কথা বলার সময় বার বার তার চোখ চলে যাচ্ছিল পুরনো দিনের দেয়াল ঘড়িটার দিকে। তার অস্থিরতা দেখে জেলারসাহেব অবশ্য একটুও অবাক হননি। মানুষ মুক্তি চায়। সোনার খাঁচায় রাখলেও সে মুক্তি চাইবে। দীর্ঘদিন জেলখানায় চাকরি করে এটা তিনি অন্য অনেকের চেয়ে ভালো বোঝেন।
“একটু পরই তুমি মুক্তি পাবে, মির্জা আশেক,” জরুরি কিছু কাগজপত্রে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে হাসিমুখে বলেছিলেন জেলার।
নিজের অভিজাত নামটা জেলারের মুখ থেকে সুন্দরভাবে উচ্চারিত হলো বলে খুব ভালো লেগেছিল তার।
“কাগজটা ভুলেও হারিয়ে ফেলো না।“
যে কাগজ তাকে পুণরায় জেলে ঢোকার হাত থেকে রক্ষা করবে সেটা সে কোনোভাবেই হারাতে পারে না!
“জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করো,” বলেছিলেন জেলার। “এখনও খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।”
বন্দি জীবনে এই লোকটা যে কী পরিমাণ সাহস আর সহযোগিতা করেছে তাকে, সেই ঋণ কখনও শোধ করতে পারবে না। আশেকের খুব ইচ্ছে করছিল জেলারকে জড়িয়ে ধরবে, কিন্তু কী এক সঙ্কোচে সেটা আর করতে পারেনি।
আজ থেকে তিন মাস আগে জেলারসাহেব তাকে একটা সুসংবাদ দিয়েছিলেন : সামনের ষোলোই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে সরকার কিছু বন্দির সাজা মওকুফ করবে, ঐ তালিকায় আশেকের নাম আছে।
আগাম মুক্তির কথা জানার পর থেকেই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। আর তার সঙ্গত কারনও আছে!
সময় যতো ঘনিয়ে আসছিল ততই উত্তেজনা বাড়তে থাকে তার মধ্যে। গত রাতে সেটা সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে পৌছায়। একদণ্ডও ঘুমোতে পারেনি। সারাটা রাত ছোট্ট সেলের মধ্যে পায়চারি করে কাটিয়ে দিয়েছে।
দীর্ঘদিন কোথাও থাকলে সে জায়গার প্রতি এক ধরণের মায়া জন্মে, আশেকের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই জেলে তার ঘনিষ্ঠ মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দীর্ঘ পনেরোটি বছর এটাই ছিল তার জগত। এখানে প্রচুর বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষি তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু একটু আগে সেল থেকে তাকে জেলারের অফিসে নিয়ে যাওয়ার সময় একবারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকায়নি। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আগের দিনই বিদায় নিয়ে নিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কোনো রকম নাটকীয় আবেগের সৃষ্টি হোক, চায়নি।
সময় হয়ে এলে জেলার তাকে নিয়ে বের হয়ে যান। মির্জা আশেকের জানা নেই, কোনো বন্দিকে মুক্তি দেবার সময় জেলার স্বয়ং তাকে নিয়ে মূল ফটক পর্যন্ত যান কী না। ফটকের সামনে থাকা গার্ড এবং জেলের কিছু কর্মচারীর চোখেমুখের অভিব্যক্তি দেখে অবশ্য জবাবটা পেয়ে গেল—এ রকমটা সচরাচর হয় না।
জেলার একটা ভাঁজ করা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন কারারক্ষির দিকে। লোকটা সেই কাগজ হাতে নিলেও পড়ে দেখল না, দ্রুত একটা সিল মেরে ফিরিয়ে দিলো। তারপরই আশেককে জড়িয়ে ধরলেন জেলার। কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললেন,
“গুড লাক!”
মির্জা আশেক ভেবেছিল জেলের বাইরে এসে মুক্ত বাতাসে বুকভরে নিশ্বাস নেবে কিন্তু ডিসেম্বরের ঘন কুয়াশা আর হাঁড় কাঁপানো শীতে রীতিমতো কাঁপতে লাগল সে। উলের সোয়েটার ভেদ করে কনকনে বাতাস আঘাত হানছে তার শরীরে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বিশাল ফটকের বাইরে এসে দেখতে পেল একটু দূরে, সবুজ রঙের একটা সিএনজির পাশে দাঁড়িয়ে আছে হ্যাংলা মতোন এক ছেলে। কানটুপি পরে দু-হাত ঘষছে সে। একটু এগিয়ে যেতেই পরিচিত মুখটা দেখে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
“আশেকভাই,” তাকে দেখামাত্র খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল ছেলেটার।
“চার্লি, কেমন আছোস তুই?”
ছেলেটা কিছু না বলে জড়িয়ে ধরলো তাকে। “ঈদের মতো খুশি লাগতাছে আমার!
“তোরা কেমন আছোস?” বেশ শান্ত কণ্ঠেই জানতে চাইলো।
চার্লি তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখে আনন্দের অশ্রু মুছতে মুছতে বলল, “ভালা…সবাই ভালা আছে, ভাই।”
বুক ভরে নিশ্বাস নিলো মির্জা আশেক। মুক্তির স্বাদই অন্য রকম।
“চলেন,” তাড়া দিয়ে বলল চার্লি।
আশেপাশে তাকালো আশেক। ম্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইলো, “রোজি আসে নাই?”
সিএনজিটা ইশারায় দেখালো চার্লি। খাঁচার মতো গ্রিল থাকার কারনে বুঝতে পারেনি ভেতরে একজন যাত্রী আছে। কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিতেই সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল তার। এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে মায়াভরা একটি মুখ। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার।
Fatima
টেলস ফ্রম দ্য ক্যাফে বইটা দিবেন প্লিজ