দক্ষিণায়নের দিন – শওকত আলী
সম্পাদক ড. মোহাম্মদ হাননান
বিশ্বসাহিত্য ভবন
প্রথম প্রকাশ – মার্চ ২০১৬
প্রকাশক – তোফাজ্জল হোসেন
Sawkat Ali : Dhakkhinayoner Din (A Trilogy by the author), published by Tofazzal Hossain of Bishwashahittya Babhan,
উৎসর্গ
শামসুর রাহমান
হাসান আজিজুল হক
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
আপনারা আমার প্রিয় কবি ও লেখক।
প্রথম সংস্করণে আপনাদের স্বতন্ত্রভাবে উৎসর্গ করেছিলাম।
এই ত্রয়ী সংস্করণে এবার একত্রে ছাড়া গত্যন্তর দেখি না।
ভূমিকা
দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন গ্রন্থ তিনটি শওকত আলীর ‘ত্রয়ী উপন্যাস’ বলে স্বীকৃত। উপন্যাস তিনটিই বিশ শতকের সত্তর দশকের শেষদিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার পর পর কয়েক বছরের (১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮) ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় আরো অনেক পরে। ঢাকার এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে যে শওকত আলীর উপন্যাস শিরোনামে তিনটি খণ্ড (২০০০, ২০০১, ২০০৭ সালে) প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রচনাকালের দিক বিবেচনায়ও এই তিন উপন্যাস সেখানে স্থান পায়নি। আবার তিনটি উপন্যাসই শুধু দক্ষিণায়নের দিন শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে।
আলাদা করে শুধু পূর্বরাত্রি পূর্বদিন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তধারা (ঢাকা) থেকে ১৯৮৬ সালে। এর প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন হাশেম খান। লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। উৎসর্গপত্রে শওকত আলী লিখেন, “প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আপনাকে’। বইটির মূল্য ছিল সাদা কাগজে ৪০.০০ টাকা এবং লেখক কাগজে ৩০.০০ টাকা। বিশ শতকের আশির দশকে ঢাকার প্রকাশনা জগতে ‘লেখক কাগজ’ নামে একপ্রকার নিম্নমানের কাগজে বই প্রকাশিত হতো, যা ‘নিউজপ্রিন্ট’ থেকে সামান্য উন্নত ছিল।
পূর্বরাত্রি পূর্বদিন উপন্যাসের এই প্রথম প্রকাশনায় লেখক ছোট্ট এক ভূমিকাপত্রে জানিয়েছিলেন,
১৯৭৬, ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮-এ সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন যথাক্রমে প্রকাশিত হয়। একই পাত্র-পাত্রী থাকলেও রচনা তিনখানি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিলো। পূর্বরাত্রি পূর্বদিন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ ত্রয়ী রচনার শেষ উপন্যাস হিসেবে ঈষৎ পরিমার্জনা করে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো।
শওকত আলীর নিজস্ব ভাষ্য অনুযায়ী এখানে দুটো বক্তব্য স্পষ্ট। এক. তিনি বলছেন, ‘একই পাত্র-পাত্রী থাকলেও’ রচনা তিনখানি ‘পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস’ হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিল। অর্থাৎ দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন আলাদা আলাদা উপন্যাস, যদিও চরিত্রগুলো একই। দুই. ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ ত্রয়ী রচনার শেষ উপন্যাস’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে লেখকের বক্তব্যে আবার বোঝা যাচ্ছে, তিনটি উপন্যাস একই, ত্রয়ী বা ‘ট্রিলজি’, আর তার তৃতীয় খণ্ডটি পূর্বরাত্রি পূর্বদিন। অর্থাৎ দক্ষিণায়নের দিন প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড নামে প্রকাশিত হতে পারত, যেহেতু ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস। কিন্তু তা হয়নি, কারণ লেখক যুগপৎ একে ত্রয়ী এবং আলাদা উপন্যাসের মর্যাদায়ও রাখতে চেয়েছেন।
দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত আলাদাভাবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তা জানা যাচ্ছে না। তবে পূর্বরাত্রি পূর্বদিন আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ছোটো গল্পকার কায়েস আহমেদ জানিয়েছেন, ‘১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে দক্ষিণায়নের দিন নামে তাঁর দীর্ঘ উপন্যাসটি রচনা শুরু করেন শওকত আলী’। [কায়েস আহমেদ : ‘শওকত আলীর গল্প : একটি পুনর্বিবেচনা’, শিল্পসাহিত্য বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন নিসর্গ, বগুড়া, মার্চ ১৯৯২]। এ তথ্যটি নতুন। বোঝা যায়, দীর্ঘ প্রায় এক দশক লেগেছিল দক্ষিণায়নের দিন রচনা করতে।
কারণ আমরা যদি ধরে নিই, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর পরই তিনি দক্ষিণায়নের দিন লেখায় হাত দিয়েছিলেন, তাহলে এই ত্রয়ী লেখা শেষ করতে প্রায় এক দশক লেগেছিল। ত্রয়ী শেষ খণ্ড পূর্বরাত্রি পূর্বদিন প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রা’র ১৯৭৮ সালের ঈদ সংখ্যায়। এটা গ্রন্থিত হয়ে প্রকাশিত হয় আরো আট বছর পর, ১৯৮৬ সালে।
এর ঠিক দশ বছর পর ১৯৯৬ সালে ঢাকার বিদ্যাপ্রকাশ নামক প্ৰকাশনা সংস্থা থেকে দক্ষিণায়নের দিন শিরোনামে যে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, তাতে অন্তর্ভুক্ত হয় দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – তিনটি উপন্যাসই। এই প্রথম লেখকের পরিকল্পিত ত্রয়ী’র মর্যাদা নিয়ে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর গল্প-উপন্যাস পাঠ্য রয়েছে। লেখকের অনেক বই-ই বাজারে বর্তমানে সুলভ নয়। সেজন্য শওকত আলীর রচনাসমগ্র বর্তমানে একটি সম্পাদনা পরিষদের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলা পর্যন্ত চারটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, অন্য খণ্ডগুলোর কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ এবং প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মুল বাসনা এইসঙ্গে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো দক্ষিণায়নের দিন। দক্ষিণায়নের দিন নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা যা আগে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু লেখা নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, তা এ সংস্করণের পরিশিষ্টে ছাত্রদের সুবিধার জন্য সংযোজন করা হলো। আশা করি কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর পাঠকরা এতে আনন্দিত হবেন।
সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে
ড. মোহাম্মদ হাননান
১লা বৈশাখ ১৪২৩, ১৪ই এপ্রিল ২০১৬, ৬ই রজব ১৪৩৭
লেখকের কথা
আমার লেখা দক্ষিণায়নের দিন উপন্যাসটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। পরিণত বয়সে আমি আমার সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি ও মূল্যায়নের অনেক কিছু দেখে গেলাম। যদিও আমার স্মৃতিশক্তির ধার কমে এসেছে, তবুও আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার লেখালেখি নিয়ে বর্তমান প্রজন্মে আগ্রহের কমতি নেই। এই আগ্রহের প্রতিফলনেই হয়ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার লেখা গল্প-উপন্যাসগুলো পড়ানো হচ্ছে। আমি এতে আনন্দ প্রকাশ করছি।
দক্ষিণায়নের দিন উপন্যাসটি আমি লিখতে শুরু করেছিলাম ষাটের দশকের শেষ দিকে, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। গত শতকের ষাট দশকের প্রথমার্ধে সমগ্র দুনিয়াই ছিল তারুণ্যের জাগরণে উত্তাল। সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের অগ্নিশপথে ছাত্র-তরুণরা তখন দেশ-দেশান্তরে জেগে উঠছিল। আমাদের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি তরুণ-যুবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমি নিজেও এর থেকে দূরে থাকতে পারিনি। এই পটভূমিকে সামনে রেখেই আমি উপন্যাসটি রচনায় হাত দেই। ফলে এতে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি অনেকটাই জড়িয়ে আছে, একথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই।
আমার পরিকল্পনা ছিল এটিকে একটি ‘ট্রিলজি’ বা ‘ত্রয়ী’ উপন্যাসে রূপ দেওয়া। সে হিসেবে দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন রচিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বসাহিত্য ভবন সংস্করণে উপন্যাসটি প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব ও তৃতীয় পর্ব শিরোনামে বিভাজন করে একটি উপন্যাসের তিনটি পর্বের তিনটি নাম হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে, তিনটি আলাদা আলাদা নাম হলেও এটি আসলে একটি উপন্যাসই।
ঘটনার পারম্পর্য ও চরিত্রগুলোর বিকাশের ধারাবাহিকতাও উপন্যাস থেকে উপন্যাসান্তরে অক্ষুণ্ণ থেকেছে। তবে এটিকে তিনটি আলাদা আলাদা উপন্যাস হিসেবেও পাঠক গ্রহণ করতে পারবেন। তিনটি উপন্যাসে বা এই ত্রয়ীতে ‘রাখী’ চরিত্রটিকেই আমি প্রধানভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষণায় বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট নারী চরিত্র হিসেবে রাখী চরিত্রটি মূল্যায়নকৃত হবে।
দক্ষিণায়নের দিন নামকরণের একটা আভিধানিক অর্থও আছে। তবে এর সময়টা ছিল না শীত, না গ্রীষ্ম, এটা ছিল শরৎকালের একটা প্রেক্ষাপট। অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের পর ষাটের দশকের প্রথম থেকেই একটা ভালো দিন যে এগিয়ে আসছে, তার একটা পূর্বাভাস এ পর্বে লুকায়িত ছিল।
কুলায় কালস্রোত পর্বেও একই সুর অনুরণিত রয়েছে। একটি স্রোত ভেসে আসছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে যা সবকিছু উলটেপালটে দিতে চেয়েছিল। রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছিল এই সময়টায়, তৎকালীন রাষ্ট্রটির বিলীয়মান চিত্র খুব দ্রুত ধাবিত হয়ে আসছিল, যার পাশাপাশি আবার আশ্রয়টির ছায়াও ভেসে আসছিল।
শেষ পর্ব পূর্বরাত্রি পূর্বদিন-এ নতুন জীবন, নতুন সময় যে আসছে, ষাটের দশকের শেষটায়, তা দৃশ্যমান হয়েছে, তত্ত্ব ও প্রয়োগে যুগপৎভাবে।
আমি তো কখনোই গোছানো মানুষ ছিলাম না। আমার প্রিয় স্ত্রী আমার লেখালেখি সংরক্ষণ করে রাখতেন। তাঁর প্রয়াণে আমার জীবনের অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অনেক লেখাই তাই হয়ত এখন আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।
তবু এর মধ্যে আমার লেখালেখির জীবনে সুখের কথা যে, আমার রচনাসমগ্র প্রকাশিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত শওকত আলী রচনাসমগ্ৰ চতুৰ্থ খণ্ড দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হলো। শওকত আলী গল্পসমগ্রও এ বছর প্রকাশিত হয়েছে, যদিও সব গল্পই সম্পাদনা পরিষদ খুঁজে পাননি।
আমার বন্ধুরা আমাকে জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে কিছু কিছু গল্প সংগৃহীত আছে, এগুলো হাতে পেলে গল্পসমগ্র অনেকটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে থাকবে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আমার অনেক গল্প হয়ত অদূর ভবিষ্যতে কেউ না কেউ সংগ্রহ করে পাঠকের নজরে আনবেন। আমি তাঁদের জন্য দোয়া রেখে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ তাদের মঙ্গল করবেন।
বিশ্বসাহিত্য ভবনের স্বত্বাধিকারী প্রকাশক তোফাজ্জল হোসেনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, একরকম প্রকাশনার আনন্দ থেকেই তিনি আমার যাবতীয় সৃষ্টিকর্মকে এক জায়গায় গ্রথিত করছেন। এবার দক্ষিণায়নের দিন-এর পরিমার্জিত ও পুনর্বিন্যস্ত সংস্করণেও তাঁর সেই আগ্রহ আমাকে আনন্দিত করছে। গ্রন্থটি এখন বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হবে।
শওকত আলী
১৮/৪/২০১৬
৪২/ বি, হাটখোলা রোড
ঢাকা-১২০৩
TANMAY DAS
গবেষণার প্রয়োজনে এই বইটির পিডিএফ আমার খুব প্রয়োজন