থানা থেকে আসছি – অজিত গঙ্গোপাধ্যায়
‘থানা থেকে আসছি’ নাটক প্রসঙ্গে — বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বিভিন্ন অপেশাদারী নাট্যসংস্থা এই নাটকটি মঞ্চে সফল উপস্থাপনা করেছে যেমনঃ চতুর্মুখ, মাস থিয়েটার্স ইত্যাদি।
এই নাটকটি দুইবার চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।
‘থানা থেকে আসছি’-র প্রথমবার চলচ্চিত্র হয় ১৯৬৫ সালে।
সুর সংযোজনা – তিমিরবরণ, পরিচালনা হীরেন নাগ, পরিবেশনা -চণ্ডীমাতা ফিল্মস প্রাঃ লিঃ। রূপায়ণে — উত্তম কুমার, ছায়াদেবী, কমল মিত্র, দিলীপ মুখার্জী, জহর রায়, অঞ্জনা ভৌমিক ও মাধবী মুখার্জী।
‘থানা থেকে আসছি’-র দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্র হয় ২০১০ সালে।
পরিচালনা — সারণ দত্ত, পরিবেশনা – মরফিউস মিডিয়া ডেনচার্,।
রূপায়ণে — সব্যসাচী, পাওলি, পরমব্রত, রুদ্রনীল, দুলাল ইত্যাদি।
‘থানা থেকে আসছি’-র মঞ্চে পেশাদার প্রযোজনা ১৯৭৮ সালে অগাস্ট মাসে। আলো — তাপস সেন, পরিচালনা – শ্যামল সেন, অভিনয়ে – অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, এন বিশ্বনাথন. দেবরাজ রায় ইত্যাদি।
‘থানা থেকে আসছি’-র মঞ্চে স্বপ্ন সন্ধানীর প্রযোজনা ২০১৩ সালের মে মাসে। পরিচালনা — কৌশিক সেন। অভিনয়ে — কাঞ্চন মল্লিক, কৌশিক সেন, রেশমি সেন ইত্যাদি।
.
অজিত গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা নাট্যজগতের এক স্বনামধন্য পুরুষ। জন্ম — কলিকাতায়, ২৮শে জুন, ১৯২১ । শিক্ষা — কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় – অর্থনীতির ও গণিতের ছাত্র। গভীর জীবনবোধ, কাব্যময় সংলাপ, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, বাস্তব মনস্তত্ত্বের চুলচেলা বিচার এঁর প্রত্যেক নাটকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য মৌলিক নাটক — নচিকেতা, মৃত্যু, পোষ্টমাস্টারের বৌ, সূর্যের মত সমুদ্র, এই সব স্বগোতক্তি ইত্যাদি। বিদেশী নাটক এবং উপন্যাস অনুসরণে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান — শকুন্তলা রায় (হেড্ডা গাবলার) নির্বোধ (ইডিয়ট), আকাশ বিহঙ্গী, (সীগার্ল) মালবাজারের মা মালতী, (ডি হাইলিশে ইয়োহান্না ডের সলাখট হফে), থানা থেকে আসছি (এ্যান ইন্সপেক্টর কলস) প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘যে’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মুচিরাম গুড়’-এর নাট্যরূপ তাঁর বিস্ময়কর কৃতিত্ব। এই নাট্যকার কৃত শেক্সপীয়রের হ্যামলেট ও রিচার্ড দি থার্ড’ -এর বঙ্গানুবাদ বিশেষ সুপ্রসিদ্ধি পেয়েছে। অজিতবাবুর নাটক সম্বন্ধে বহু বিদ্বজন বিভিন্ন সময়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এঁর হ্যামলেটের বঙ্গানুবাদকে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘পাস্তেরনাকের’ রুশ ভাষায় অনুবাসের সঙ্গে সম তুলনা করেছেন। সাহিত্যিক প্রমথ নাশ বিশী বলেছেন— ‘ইব সেনের হেড্ডাগাবলার অজিতের হাতে হয়ে উঠেছে সার্থক রক্ত মাংসের শকুন্তরা রায়। নাট্যবিদ উৎপল দত্ত বলেছেন — ‘নাটকে সাহিত্য রস সঞ্চরিত করার কাজে অজিত ছিলেন বর্তমান নাট্যজগতে অনন্য। প্রতিটি বাক্যের ব্যাকরণগত সঠিকতার সঙ্গে যোজিত হত ধবনিগত মাধুর্য। যেমন — নচিকেতা নাটক, গ্রীক নাট্যশৈলীকে, খাঁটি দেশজ ভাবের বাহন করেছে নচিকেতা।” বহুরূপী থেকে রূপকার, এলটিজি থেকে নান্দীকার, চতুর্মুখ থেকে চতুরঙ্গ — প্রমুখ নাট্যসংস্থা এঁর বিবিধ নাটক মঞ্চে সফল উপস্থাপনা করেছে। অজিতবাবুর অকাল প্রয়াণ (৫ জুলাই,১৯৮৪)। বাংলা নাট্যজগত এক দেদীপ্যমান জ্যোতিষ্ককে হারাল।
.
চরিত্রলিপি
চন্দ্রমাধব সেন – বিখ্যাত ধনী, কয়েকটি বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ও ডিরেক্টর
রমা সেন – চন্দ্রমাধব সেনের স্ত্রী
শীলা সেন – ঐ কন্যা
তাপস সেন – ঐ পত্র
গোবিন্দ – ঐ ভৃত্য
অমিয় বোস – চন্দ্রমাধব সেনের বন্ধুপুত্র
তিনকড়ি হালদার – পদ্মপুকুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর
স্থান – পদ্মপুকুরে চন্দ্রমাধব সেনের ড্রয়িং-রুম
কাল – ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহের এক সন্ধ্যা
.
প্রসঙ্গক্রমে
এ নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে নাট্য-আন্দোলনের বয়ঃকনিষ্ঠ পরিচালকরা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হবেন। এদিকে লিটল থিয়েটার গ্রুপও এ নাটকের মহড়া দিয়েছেন এবং প্রয়োগপদ্ধতি সম্বন্ধে আমরা কিছু চিন্তা করেছি। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনদের কিছুটা লাভ হতে পারে এই আশায় আমাদের বক্তব্য উপস্থিত করছি।
এ নাটক অন্ততঃ একটি জটিল তত্ত্বকাহিনীর মধ্যে জড়িয়ে আছে। অলাতচক্রের মত সময়ের গতি, কোনো এক মুহর্তে মশাল নিভিয়ে দিলেও সে অলাতচক্রের আভাস অন্ধকারের বুকে কিছুক্ষণ জেগেই থাকে। একটি সুখী পরিবারের চায়ের আসরেও এমনি দপ করে কৃত্রিম আনন্দের মশাল নিভিয়ে দেওয়া যাক। কি দেখতে পাব? তাদের জীবনের বৃত্ত আরো কয়েক পাক ঘুরে গেল, প্রায় অবাস্তব আলেয়ার আলোর মত। আর সেই অস্পষ্ট আলোয় যে মুখগুলি দেখতে পাচ্ছি সেগুলি বড় ভীষণ। আবার মশাল জ্বলতেই সেই আনন্দোচ্ছল সুখী পরিবার। “Time moves in a spiral” বলেছেন জনৈক ইংরাজ মনীষী, তাই সেই ঘোরানো সিঁড়ির যে কোনো ধাপই নিন না কেন তার থেকে একটা লম্ব মাটিতে টানলে তার তলার অসংখ্য ধাপ এক লাইনে গাঁথা হয়ে যাবে। অতএব, একই ঘটনা বার বার ঘুরে আসে সময়ের বৃত্তাকার ঊর্ধ্বারোহণে যদিও প্রতিবারেই সে আরো উন্নত রূপ পরিগ্রহণ করতে থাকে। তাই বর্তমানএবং ভবিষ্যতের মাঝে যে দুর্লঙঘ্য প্রাচীর আমরা কল্পনা করে থাকি, বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। অতএব ধরা যাক কোনো অভাবনীয় উপায়ে (এ ক্ষেত্রে এক পুলিস অফিসারের মাধ্যমে) আগামী ঘটনার একটা ছায়াময় পূর্বাভিনয় বর্তমানেই ঘটে গেল, অবস্থাটা কি দাঁড়ায়?
কিন্তু নাটক মঞ্চস্থ করতে গেলে তত্ত্বের অংশটি সচেষ্ট হয়ে বাদ না দিলেও অন্ততঃ অবহেলা করা উচিত। কারণ ও তত্ত্বটা গৌণ হয়ে গেছে, মুখ্য হয়ে উঠেছে কাহিনীর বিন্যাস এবং বিষয়বস্তু। শুধুমাত্র ঐ ধরনের সূক্ষ্মতত্ত্ব বিচারে নিমজ্জিত থাকলে নাটক নাটকই হোত না!
তবে ইন্সপেক্টর কে? পূর্ববর্ণিত লম্ব বেয়ে তিনি উপরের ধাপ থেকে সময়-বৃত্তের নীচের ধাপে নেমে আসতে পারেন, কিন্তু বাস্তব জীবনের কঠিন পরিবেশে তিনি কি অবলম্বন করে আসবেন? ভৌতিক অফিসার হলে আবার প্রশ্ন থাকে তিনি এত সত্য কথা জানলেন কি করে? প্ল্যানচেটে মর্ত্যে আহূত হয়ে তিনি যে সমাজের স্তম্ভস্বরূপ ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রিসার্চ চালাবার সময় পাবেন তা তো মনে হয় না। তবে তিনকিড় হালদার কে?
এমনও হতে পারে তিনকড়ি হালদার চন্দ্রমাধববাবুদের বিবেক। এবং এই সকল বড়লোকদের বিবেকের গায়ে যে পুলিসদের উর্দি থাকবে এটা তো সহজেই অনুমেয়। ভয় তাঁরা করেন একমাত্র পুলিসকে, কোর্টকে, সংবাদপত্রকে। আদর্শের বা প্রতিবেশী মানুষের প্রতি মনত্ববোধের পার্ট তাঁরা অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়েছেন, না দিলে হয়তো তিনকুড়বাবু আবার ক্রসে ঝুলে তাঁদের চক্ষু উন্মীলিত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা করিলে এঁরা আজকাল হেসে বলেন – যাক ধরতে পারেনি। তিনকড়িবাবু কৌপীন পরে নদীয়ার পথে চন্দ্রমাধববাবুর ড্রয়িং-রুমে পৌঁছুলে কলসির কানা-ই পেতেন, প্রেম দেওয়া আর হয়ে উঠত না। কিন্তু এঁরা টিট হয়ে গেলেন ঐ চামড়ার বেল্ট, টুপী আর খাকী পোশাকের সামনে। বাস্তব জীবনে পুলিস হিসাবে খাতা দখেতে চাইলে কয়েকটি টাকা গুঁজে দিয়ে, এবং দাতব্য হাসরপাতালে কিছু দান করে হাসিমুখে চায়ে চুমুক দেওয়া যায়, কল্পনার তিনকড়িবাবু ডিউটিতে সিগারেটও খান না। এ হেন কুলিশ কঠিন পুলিস অফিসারকে অনেক ধনীই রাত্রে নিভৃত দুঃস্বপ্নে দেখেন, আঁতকে ওঠেন, এবং পরদিন অনিদ্রা রোগের ঔষুধের চাহিদা বাড়ে — এটা বর্তমান যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই সেই দুঃস্বপ্নই মূর্তিমান কায়াময় হয়ে থানা থেকে এস হাজির হয়েছে ট্যাক্স ফাঁকি থেকে শুরু করে নারীহত্যা পর্যন্ত সব তাঁর নঘদর্পণে। নাট্যকার এইখানেই তাঁর মননশীলতার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন। এদিকে থেকে তিনকড়ি হালদার আমাদের যাত্রার বিবেকের নব্যতান্ত্রিক রূপ, উত্তরাধিকারী, এবং সে শুধু নাটকের মূল বক্তব্যকে তুলে ধরে না, সে অভিযুক্ত করে অপরাধীদের, সে যুগধর্ম পালন করে।
এটুকু স্পষ্ট হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ অত্যন্ত সহজ। আমরা যতদূর ভেবেছি—তাতে মনে হয়েছে একটি হঠাৎ বড়লোকের উগ্র রুচির ছাপ থাকা উচিত ট্রয়িং-রুমের দেয়ালে, পিয়ানোয়, আসবাবে, রেডিওগ্রামে। প্রথমাংশে অভিনয়ও হওয়া উচিত সাবলীল, স্বাভাবিক। আর যে মুহূর্তে ভৃত্য ঘোষণা করে — ‘থানা থেকে ইন্সপেক্টরবাবু এসেছেন।’ — সে মুহূর্ত থেকে আলো যেন কেমন করে আসে, চন্দ্রমাধববাবুদের হাঁটাচলা, কথা বলায় আসে কেমন একাট মাদকতা, একটা সম্মোহিতের ভাব। তিনকুড়িবাবু ভাবভঙ্গিতে হবেন পুরোদস্তুর পুলিস অফিসার, এবং বোধহয় তাঁর বসা উচিত দর্শকের দিকে পেছন ফিরে, নীচু ধরনের কোনো আসনে — আর তাঁর সামনে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে থাকবে অভিযুক্তের দল।
আবার আরো স্পর্ধিত পরীক্ষা চালাবারও অনেক সুযোগ রয়েছে, যেহেতু পুরো জিনিসটাই কয়েক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখছেন বলা চলে। অতএব অত্যন্ত রংচঙে কিছু সার্কাস-মার্কা ক্লাউন যদি একটা বিষম রঙীন পর্দার সামনে লাফা-ঝাঁপি করতে থাকেন, তাহলেও চন্দ্রমাধববাবুদের চায়ের আসরের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে না কি? আবার তিনকড়িবাবু টেনে টেনে তাঁদের এনামেল করা চকচকে মুখোসগুলো খুলে দিলে বীভৎস কঙ্কালসার কতকগুলি অবয়ব বেরিয়ে পড়লেই বা কেমন হয়?
এক কথায় পরিচালক অনেক কিছুই করতে পারেন এ নাটক নিয়ে। উপরের কথাগুলি তাঁদের কল্পনাশক্তিকে পূর্বনির্ধারিত কোনো পরিকল্পনার গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে ফেলার জন্যে বলা হয়নি, তাঁদের কল্পনাকে আরো উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই বলা হোলো। এমনও হতে পারে শক্তিমান যুবক পরিচালক উপরোক্ত মন্তব্য পড়ে হেসে উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব ধারায় নাটকটিকে ঢালবেন! সেটাই আমাদের কাম্য। তবে প্রগতিশীল সংগঠনের কাছে আমাদের একটি আবেদন ঃ তিনকড়ি হালদারের শেষ ক’টি লাইন অনুধাবন করুন। শ্রী অজিত গঙ্গোপাধ্যায় বহুবার প্রমাণ করেছেন যে তিনি প্রগতিশীল নাট্য-আন্দোলনের একজন শক্তিমান লেখক। এ নাটকেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যে ইংরাজী নাটক দ্বারা এ নাটক অনুপ্রামিত, সে নাটকের প্রথম অভিনয় ইংলণ্ডে হয়নি, হয়েছিল প্রগতির যাঁরা শিখরে উঠেছেন — সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে।
উৎপল দত্ত
Leave a Reply