তোমার প্রত্যাশায় – কাসেম বিন আবুবাকার
(প্রেম ও স্বপ্নের দ্বিতীয় খণ্ড)
প্রথম প্রকাশ – অক্টোবর ১৯৯৭
উৎসর্গ
দোহার থানার ইকরাশি গ্রামের
বিয়াই জনাব এ. বি. খালেক মিয়া
ও
বিয়ান রাজিয়া সুলতানা–
(১) হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেনঃ “পৃথিবীর সব কিছুই সম্পদ। এই পার্থিব সম্পদের মধ্যে উৎকৃষ্ট সম্পদ হল-সাধ্বী স্ত্রী।”
–বর্ণনায়: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রঃ)-মুসলিম।
(২) “মানুষ সৎ স্বভাবের দ্বারা মানুষ বলিয়া গণ্য হয়, আকৃতির দ্বারা নহে।”
–জুনাইদ বাগদাদী (রঃ)।
ভূমিকা
“পরম দাতা-দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি” এই বইটি প্রেম ও স্বপ্নের দ্বিতীয় খণ্ড হলেও একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস। তবে যারা প্রেম ও স্বপ্ন বইটি পড়েন নি, তাদেরকে উক্ত বইটি পড়ার পর এই বইটি পড়ার অনুরোধ করছি।
নায়ক-নায়িকার প্রেম ও স্বপ্ন কিভাবে প্রত্যাশায় পরিণত হল, সেই ঘটনা এই বইটির প্রতিপাদ্য।
ওয়াস সালাম
কাসেম বিন আবুবাকার
২৫শে শ্রাবণ ১৪০৪ বাংলা
৪ঠা রবিউস সানি ১৪১৮ হিজরী
৯ই আগষ্ট ১৯৯৭ইং
এক
মাহবুবদের বাড়ি থেকে সকাল আটটায় রওয়ানা দিয়ে বিকেল চারটেয় মাহবুবা ঢাকায় পৌঁছাল। তখনও আনিস সাহেব বাসায় ফেরেননি।
শামীমা বেগম ড্রাইভারকে গাড়ির বনেট থেকে একটা বেশ বড় মাটির ভাঁড় নামাতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এতে কি আছে?
ড্রাইভার বলার আগে মাহবুবা বলল, মাছ!
শামীমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, মাছ? মাছ কোথায় পেলি?
মাহবুবদের বিরাট একটা পুকুর আছে। মাহবুবের বাবা সেই পুকুরে গতকাল ছিপ ফেলে প্রায় ছয়-সাত কেজি ওজনের একটা রুই মাছ ধরেন। মাহবুবের মা জ্বাল দিয়ে। তোমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। তারপর জিজ্ঞেস করল, বাবা এখনো ফেরেনি?
না। তুই ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি বুয়াকে নাস্তা দিতে বলি।
আমি গোসল করে আসছি বলে মাহবুবা নিজের রুমে চলে গেল। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে বাথরুমে ঢুকল। সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। আট ঘণ্টা জার্নি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে সেই ক্লান্তি দূর করল। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে প্রসাধন করার সময় শরীর ও মন বেশ ফ্রেস অনুভব করল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, কিগো মেয়ে, মাহবুবের প্রতি যে সন্দেহ করেছিলে তা মিথ্যে, তাই না? এবার তাকে খুঁজে বের করাই হবে তোমার প্রধান কর্তব্য।
ততক্ষণে আনিস সাহেব ফিরলেন। স্ত্রীর মুখে মাহবুবার ফেরার কথা শুনে বললেন, এই কয়েকদিন খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কোনো কিছু অসুবিধা হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করেছ?
শামীমা বেগম বললেন, না করিনি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে এস, নিজেই জিজ্ঞেস করবে।
নাস্তা খাওয়ার সময় আনিস সাহেব মেয়েকে বললেন, কিরে মা, কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
মাহবুবা বলল, না বাবা।
প্রবলেম সলভ হয়েছে?
হয়েছে, তবে মাহবুব বাড়িতে চিঠি দিলেও ঠিকানা দেয়নি। তাই ঢাকার ঠিকানা। তার বাবা দিতে পারলেন না। পরবর্তীতে মাহবুব ঠিকানা দিলে আমাকে চিঠি দিয়ে জানাবেন বলেছেন। জান বাবা, ওদের একটা বিরাট পুকুর আছে। সেটার চারদিকের পাড়ে চারটে পাকা ঘাট। আর নানা-রকম ফলের গাছ। মাহবুবের বাবা প্রথম দিন জাল ফেলে প্রায় পাঁচ কেজির মতো একটা মাছ ধরে মেহমানি করিয়েছেন। পরের দিন মানে গতকাল ছিপ ফেলে ছয়-সাত কেজি একটা রুই মাছ ধরেছিলেন। সেই মাছটা মাহবুবের মা জ্বাল দিয়ে তোমাদের জন্য পাঠিয়েছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ বাবা, আমি নিতে রাজি না হতে বললেন, আপনারা বরফ দেওয়া নদীর মাছ খান, পুকুরের টাটকা মাছ খেয়ে দেখবেন কত স্বাদ।
বাড়ি ঘরের পরিবেশ কেমন দেখলি?
পুরোনো আমলের ছয় কামরা এক তলা পাকাবাড়ি, বাড়ির এরিয়াটা খুব বড়।
ওর মা-বাবাকে কেমন মনে হল?
খুব ভালো মানুষ।
তা হ্যাঁরে, তোকে তো তারা চেনেন না, ম্যানেজ করলি কিভাবে?
ভার্সিটিতে পড়ি, মাহবুবের সঙ্গে পরিচয় আছে, বলার পর মাহবুবের বাবা বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। মাহবুব বাড়িতে গিয়ে তার অসুখের সময় আমি যে তাকে সাহায্য করেছি, সে কথা বলেছিল। তার মা-বাবা পরিচয় পেয়ে খুব আদর যত্ন করেছেন। পরের দিন চলে আসতে চাইলে জোর করে দুদিন রেখে দিলেন।
আনিস সাহেব বললেন, ঠিক আছে,তুই রেষ্ট নে, আমি একটু বেরোব। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য রুমে চলে গেলেন।
রাত্রে বাসায় ফিরে আনিস সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রবলেমটা কিভাবে সলভ হল?
মাহবুবা বলল, তুমি যা বলেছিলে তা ঠিক নয়। মাহবুব আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অন্য কারণে।
তা হতে পারে। কারণটা বলতে শুনি।
মাহবুবের বাবা ছেলেকে না জানিয়ে ঐ বড় পুকুরটা সাত বছরের জন্য একবারে বন্ধক রেখে এক লাখ টাকা নিয়ে তাকে ঢাকায় পড়াচ্ছেন। যে লোক পুকুর রেখে টাকা দিয়েছেন এবারে দেশে গিয়ে তার কাছ থেকে মাহবুব ঘটনা জেনে যায়। তার মা বললেন, জানার পর থেকে মাহবুবের মন খুব খারাপ। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, বাকি দু’বছরের মধ্যে টাকাটা কিভাবে পরিশোধ করবে। সেই চিন্তায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে আমার ধারণা।
আনিস সাহেব বললেন, একবার তার সঙ্গে আলাপ করে যতটা বুঝেছি তাতে তোর, ধারণাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু মা, যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার নাগাল পাবি কি করে? আর পেলেও তাকে ক্যাপচার করতে পারবি বলে মনে হয় না। আমার কথা শোন, একটা গ্রাম্য ছেলের পিছনে ছোটা তোর মতো মেয়ের উচিত নয়। আমার বন্ধুদের অনেকে তোকে ছেলের বৌ করার জন্য আমাকে অস্থির করে তুলেছে। তুই যে সোসাইটিতে মানুষ হয়েছিস, তার সঙ্গে মাহবুবদের সোসাইটির ফার ডিফারেন্স। আমার কথাগুলো ভেবে দেখ, তারপর না হয় বলিস।
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, বাবা, ভেবে দেখার কিছু নেই। আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে পাওয়ার চেষ্টা করব।
আনিস সাহেব একটু রাগের সঙ্গে বললেন, এই বয়সটা আবেগের। আবেগের বশে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। আবেগ আর বাস্তব এক জিনিস নয়।
আমি তা জানি বাবা। কিন্তু এটাও ঠিক সব জিনিষের ব্যতিক্রম আছে। আমি সেই ব্যতিক্রম। তোমরা আমার ভালোর জন্য যা কিছু কর না কেন, আমি মাহবুবকে ছাড়া অন্য কারো হতে পারব না। তাতে যদি চিরকুমারী থাকতে হয় থাকব। আমি জানি, আমার কথা শুনে তোমরা কষ্ট পাচ্ছ; কিন্তু আমি যে কত কষ্ট পাচ্ছি, তা তোমরা জান না। তোমাদের একমাত্র সন্তান কষ্ট পাচ্ছে, সেই কষ্ট দুর করার চেষ্টা করা কি তোমাদের উচিত নয়? শেষের দিকে কান্নায় মাহবুবার গলা ভেঙ্গে এল।
শামীমা বেগম সেখানে ছিলেন। বললেন, নিশ্চয় উচিত। কিন্তু সন্তান ভুল পথে চলে যদি নিজেই কষ্ট ডেকে আনে, তা হলে আমাদের কী উচিত নয়, সন্তানকে ভুল পথ। থেকে ফিরিয়ে আনা?
মা, কথাটা তুমি ঠিক বললেও এক্ষেত্রে ঠিক নয়। আমি এখন ম্যাচিওর। উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছি। আমার জীবন সাথী পছন্দ করার জ্ঞান যেমন আছে, তেমনি অধিকারও। আছে। মাহবুবদের গ্রাম্য সোসাইটি হলেও সেখানে সুখ আছে, শান্তি আছে। তোমাদের উচ্চ সোসাইটিতে ভোগবিলাস থাকলেও সুখ শান্তি নেই। ভোগবিলাসে মানুষ হলেও দু’দিনের জন্য গ্রাম্য সোসাইটিতে যে সুখ ও শান্তি পেয়েছি, তার তুলনা নেই।
তুই কি তাহলে গ্রামে থাকতে চাস?
ভাগ্যে লেখা থাকলে থাকব। ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই।
একটা গ্রাম্য ছেলের জন্য তুই মা বাবাকে ত্যাগ করবি?
ত্যাগ করার কথা বলছ কেন? আমি তো সে কথা বলিনি, বলেছি ভাগ্যের কথা। তোমাদেরকে তো বলেছি, মাহবুবকে আমাদের মতো করে গড়ে নেব।
আনিস সাহেব নিজের মেয়েকে ভালোভাবেই চেনেন। সে যে মাহবুবকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে গ্রহণ করবে না, তা বুঝতে পেরে বললেন, ঠিক আছে, তুই যা ভালো বুঝিস কর। আমরা আর তোকে বাধা দেব না।
বাবা, এটা তুমি রাগ করে বলছ, তোমাদের সাহায্য না পেলে মাহবুবকে পাব কি করে? আর তাকে আমাদের মতো করে গড়বই বা কি করে?
ঠিক আছে, চিন্তা করে দেখি কি করা যায়। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চল খেতে দেবে।
দুই
মাহবুব একেবারে পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এল। এই তিন চার মাসের মধ্যে চিঠি দিলেও ঠিকানা দেয়নি। তাই সুলতান খাঁন মাহবুবাকে তার ঠিকানা জানাতে পারেননি।
মরিয়ম খাতুন ও সুলতান খাঁন ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। আগের মতো মুখে প্রফুল্লতা নেই। সব সময় গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করে।
একদিন স্বামীর সামনে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি হয়েছে? সব সময় মন খারাপ করে থাকিস? বেশ রোগাও হয়ে গেছিস।
মাহবুব আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা এখন বলতে চায় না। তাই মৃদু হেসে বলল, কই, কিছু হয়নি তো। পরীক্ষার সময় অনেকরাত জেগে পড়েছি, তাই হয়তো একটু রোগা হয়ে গেছি। কয়েকদিন তোমাদের কাছে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
সুলতান খাঁন বললেন, আলাউদ্দিন মীরের কাছে পুকুর সাফকাওলা রেখে টাকা নেওয়ার কথা জেনে তুমি বোধহয় মনে কষ্ট পেয়েছ। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমাকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে মানুষ করব, এটাই আমাদের স্বপ্ন ছিল! আল্লাহ সেই স্বপ্ন আজ পূর্ণ করলেন, তাই তাঁর দরবারে জানাই লাখো কোটি শুকরিয়া। পুকুরের বদলে তোমাকে শিক্ষিত করে মানুষ করা কর্তব্য মনে করেছি। এখনো দু’বছর সময় হাতে আছে, আশাকরি তুমি উপার্জন করে এই সময়ের মধ্যে আলাউদ্দিন মীরের টাকা পরিশোধ করতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যদি তোমার তকৃদিরে রাখেন, তাহলে তিনিই এর ব্যবস্থা করে দেবেন। তবু যদি আমাদের এই কাজ করা ঠিক হয়নি মনে করে থাক, তাহলে মা-বাবা মনে করে আমাদেরকে মাফ করে দিও।
মাহবুব আব্বার দু’পা জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এ আপনি কী বলছেন আব্বা? মা-বাবা যা কিছু করেন সন্তানের ভালোর জন্য করেন। আলাউদ্দিন মীরের কাছে শুনে প্রথমে আমার মনে কষ্ট হলেও পরে যখন আল্লাহর রসুল (দঃ) এর কথা মনে পড়ল, “তোমরা পিতা-মাতার দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না।” তখন থেকে আর কোনো কষ্ট নেই। সেই থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া চাই, তিনি যেন ঋণ পরিশোধ করার তওফিক আমাকে দেন। মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করবেন না। পিতা মাতাকে সন্তুষ্ট রাখতে ও তাদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করতে আল্লাহ কোরআনপাকে বলেছেন। পিতা মাতার সন্তুষ্টিই সন্তানের জন্য বেহেস্ত ও অসন্তুষ্টি সন্তানের জন্য দোযখ সাব্যস্ত হয়।
সুলতান খাঁন ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে বসতে বলে বললেন, তোমার অসুখের সময় মাহবুবা নামে যে মেয়েটা তোমাকে সাহায্য করেছিল, সে কয়েক মাস আগে তোমার খুঁজে এখানে এসে দু’দিন ছিল। তার কাছে শুনলাম, তুমি তার সঙ্গে দেখা করনি, আমার কাছে তোমার ঠিকানা চেয়েছিল। তুমি দাওনি বলে আমিও দিতে পারিনি। এর মধ্যে তার সঙ্গে কী দেখা হয়েছে?
জ্বি না।
কেন? যে মেয়ে তোমার বিপদের সময় সাহায্য করল, তার সঙ্গে দেখা না করা কী উচিত হয়েছে?
মাহবুব কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
কিছু বলছ না কেন?
মাফ করুন আব্বা, এ ব্যাপারে এখন কিছু বলতে পারব না।
ঠিক আছে, এবার কী করবে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছ?
জ্বি না, ঢাকায় ফিরে চিন্তা করে কিছু করার চেষ্টা করব। আল্লাহ রাজি থাকলে একটা না একটা কিছু করতে পারব। আপনারা শুধু দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমাকে আপনার ঋণ পরিশোধ করার তওফিক দেন।
সুলতান খাঁন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার মাথার উপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে বোধহয় ভুল করে ফেলেছি। আল্লাহ তোমার সহায় হোক, তিনি তোমাকে ঋণ পরিশোধ করার তওফিক দান করুক।
আব্বার কথাগুলো মাহবুবের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদের দোয়া থাকলে ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হবই।
রাত্রে ঘুমাবার সময় মরিয়ম খাতুন ছেলের রুমের দরজার কাছে এসে বললেন, মাহবুব, ঘুমিয়েছিস?
মাহবুব শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল, রেজাল্ট কবে বেরোবে তার কোনো ঠিক নেই। তার আগেই চাকরির চেষ্টা করতে হবে। আবার ভাবল, ভালো চাকরি আজকাল সোনার হরিণের মতো। তিন চার হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেলেও দু’বছরের মধ্যে একলাখ টাকার ঋণ শোধ করতে পারব না। টাকাও নেই যে ব্যবসা করব। মায়ের গলা পেয়ে উঠে বসে বলল, না ঘুমাইনি আম্মা, তুমি এস।
মরিয়ম খাতুন এসে ছেলের পাশে বসে বললেন, কয়েকটা কথা বলতে এলাম। তখন তোর আব্বার সামনে বলা ঠিক হবে না ভেবে বলিনি।
মাহবুব বুঝতে পারল, আম্মা মাহবুবার কথা জিজ্ঞেস করবে। বলল, বেশ তো এখন বল।
মাহবুবা আসবে তুই জানতিস?
না।
টাকা তাকে দিয়েছিস?
দিয়েছিলাম, নেয়নি।
কেন? নিল না কেন?
এই কথার উত্তর মাহবুব দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
মরিয়ম খাতুন বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন তার সাথে দেখা হয়নি?
গতবার বাড়ি থেকে যাওয়ার দিন পনের পরে একবার দেখা হয়েছিল। সে সময় টাকাটা দিতে চেয়েছিলাম। তারপর আর দেখা হয়নি।
দেখা হয়নি, না তুই দেখা করতে চাসনি?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে মাহবুব চুপ করে রইল।
কিরে চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে।
ও খুব বড় লোকের মেয়ে, ওর কথা বাদ দাও আম্মা, অন্য কথা থাকলে বল।
মাহবুবা এখানে এসে দুদিন ছিল, তার সবকিছু জেনেছি। যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দে।
আম্মা, তুমি শহরের বড়লোকের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে কিছুই জান না। ওরা যেমন খামখেয়ালী তেমনি আবেগপ্রবণ। যা জেনেছ তা হয়তো ঠিক; কিন্তু কোটিপতির একমাত্র মেয়ের সঙ্গে আমার মেলামেশা করা কী উচিত? সে আমাকে ভালবাসে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তার মা-বাবা রাজি না হলেও একমাত্র মেয়ের জীদে রাজি হয়েছেন। তাই বলে তাকে বিয়ে করা আমার কী উচিত হবে? আর তোমরাও কী তা মেনে নিতে পারবে? না তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পারবে? তাছাড়া তারা। একমাত্র মেয়েকে নিশ্চয় স্বামীর সংসার করতে গ্রামে পাঠাবেন না। তারা জামাইকে কাছে রেখে নিজেদের ব্যবসায় লাগাবেন। তোমরা কি চাও, তোমাদের ছেলে ঘরজামাই হয়ে তাদের কথা মতো চলুক। আরো অনেক রকমের সমস্যা আছে, যা বলতে গেলে সারারাত লেগে যাবে।
মরিয়ম খাতুন বললেন, তুই কী মনে করেছিস, আমি এসব সমস্যা চিন্তা করিনি? সাংসারিক সমস্যার কথা কতটুকু জানিস? যে সব মেয়েরা জ্ঞানী ও স্বামীভক্ত হয়, তারা স্বামীর জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতে পারে। সাঁতার না জানলেও পানিতে ঝাঁপ দিতে পারে। তুই তাকে কতটা ভালবাসিস জানি না, আমি যতটুকু জেনেছি, সে তোকে নিজের থেকে বেশি ভালবাসে, এতদিন দেখা না করে খুব ভুল করেছিস। এবারে গিয়ে দেখা করবি। একটা কথা মনে রাখিস, কারো মনে কষ্ট দেওয়া যেমন শক্ত গোনাহ তেমনি ভবিষ্যতে তাকেও কষ্ট পেতে হয়। তাই বলছি, তার মনে কষ্ট না দিয়ে তার সাথে দেখা কর। তোদের দুজনের সমস্যার কথা আলাপ-আলোচনা কর। আর একথা তো সবাই জানে, কেউ তক্বদিরকে বদলাতে পারে না। আমার কথা শুনে আবার মনে করিস না, আমি টাকা পয়সা ও সোনাদানার লোভে বড় লোকের মেয়েকে বৌ করতে চাচ্ছি। যা বাস্তব ও সত্য তাই বললাম, এবার তুই ভেবেচিন্তে যা করার করবি। তুই-ই ধরতে গেলে আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর কিছু হলে আমরা সহ্য করতে পারব না। আর একটা কথা, আলাউদ্দিন মীরের মেয়ে তাহেরার সঙ্গে তোর কী জানাশোনা আছে?
মাহবুব খুব অবাক হয়ে বলল, তার কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করছ কেন?
সে কথা পরে, আগে আমার কথার উত্তর দে।
গ্রামেরই মেয়ে, জানাশোনা থাকবে না কেন? তবে তুমি যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে জিজ্ঞেস করে থাক, তাহলে বলব, নেই।
মরিয়ম খাতুন মৃদু হেসে বললেন, এটাই আমরা আশা করেছিলাম।
মাহবুব আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, আমরা মানে, আব্বা কী তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছেন?
না সে বলেনি। আলাউদ্দিন মীর তোর আব্বার কাছে মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন।
মাহবুবের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল। বলল, তাই নাকি?
শুধু তাই নয়, আমরা রাজি হলে একলাখ টাকার দলিল ফিরিয়ে দেবেন, দশ বিঘে জমি তোর নামে লিখে দেবেন। তাছাড়াও মেয়ে জামাই সাজিয়ে দেবেন।
আব্বা তাকে কি বলেছেন?
আলাউদ্দিন মীরের সাহস দেখে খুব রেগে গিয়ে কিছু না বলে চুপ করে ছিল। বুঝতে পেরে আলাউদ্দিন মীর ভেবেচিন্তে জানাবেন বলে চলে যান। সে কথা তোর আব্বার মুখে শুনে আলাউদ্দিন মীরকে বলতে বলেছি, মাহবুব ঘরে এলে তার সঙ্গে
পরামর্শ করে তারপর জানাতে। এ ব্যাপারে তোর কি কোনো মতামত আছে?
মাহবুব কি বলবে চিন্তা করতে লাগল।
কিছু বলছিস না যে?
আমি আবার কি বলব? তোমরা জান, আমি তোমাদের কথার অবাধ্য কখনো। হইনি।
তা জানি, তবু তোর নিজস্ব একটা মতামত আছে, সেটাই বল।
আমি বংশ গরীমা মানি না। এটা ইসলামের পরিপন্থী। আর পাত্রী হিসেবে তাহেরা খারাপ নয়। তবু বলব, তাকে আমার পছন্দ নয়। আর যারা অর্থ সম্পদের লোভ দেখিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়, তাদেরকেও আমি পছন্দ করি না।
মরিয়ম খাতুনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে, আর কিছু জানার নেই। যা এবার ঘুমিয়ে পড়। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন স্ত্রীকে ছেলের রুমে যেতে দেখেছেন। কি কথাবার্তা হল শোনার জন্য জেগে অপেক্ষা করছিলেন। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের সাথে এতক্ষণ ধরে কী কথা হল?
মরিয়ম খাতুন মাহবুবা ও তাহেরার সম্বন্ধে মাহবুবের সঙ্গে যে সমস্ত কথা হয়েছে। সব বললেন।
সুলতান খাঁন কিছু না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
না ভাবছি।
কী ভাবছেন?
ভাবছি, আলাউদ্দিন মীর অমতের কথা শুনে খুব রেগে যাবেন। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না। তবে টাকাটা ঠিক সময় মতো ফেরৎ দিতে না পারলে তার পরিণতির কথা চিন্তা করছি। আর মাহবুবার ব্যাপারে মাহবুব কী করবে তাও চিন্তা করছি।
আপনি ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আল্লাহ তকৃদিরে যা লিখেছেন তাই হবে। আমরা দোয়া করব, আল্লাহ ওকে সহিসালামতে রেখে ঋণ পরিশোধ করার তওফিক এনায়েৎ করুক। এখন ঘুমিয়ে পড়ন অনেক রাত হয়েছে।
সুলতান খাঁন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন; এই দোয়া তো অনেক আগে থেকেই করছি। তারপর পাশ ফিরে শুলেন।
.
মাহবুব বড় বোনের বাড়ি কয়েক দিন বেড়িয়ে ফিরছিল। পথে আলাউদ্দিন মীরের। সঙ্গে দেখা হতে সালাম বিনিময় করে বলল, চাচা, কেমন আছেন?
আলাউদ্দিন মীর বললেন, আল্লাহ একরকম ভালই রেখেছে। তা তুমি কেমন আছ?
আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।
কবে এলে? আমাদের বাড়িতে আসনি কেন?
প্রায় দশবার দিন এসেছি। কাল চলে যাব।
তাহলে এখন চল না আমার সঙ্গে।
না চাচা, মাফ করবেন, এখন বুবুদের ওখান থেকে ফিরছি। আবার যখন আসব তখন যাব। আপনার সঙ্গে দু’একটা কথা বলতে চাই।
বেশ তো সন্ধ্যের দিকে আমাদের বাড়িতে এস।
না চাচা, কাল চলে যাব তো, কিছু কাজ আছে। যদি অনুমতি দেন, এখনই বলতে চাই।
আলাউদ্দিন মীর বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ না করে বললেন, বেশ, বল কি বলবে।
আপনি আব্বার কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সম্ভব নয়। চার পাঁচ বছরের মধ্যে আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। ততদিন তাহেরাকে বসিয়ে না রেখে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেন। আমি হয় তো ছোট মুখে বড় কথা বলে বেয়াদবি করে ফেললাম, সে জন্যে মাফ চাইছি।
আলাউদ্দিন মীর শুনে খুব রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আর কিছু বলবে?
জ্বি না।
তা হলে তুমি যাও, আমি একটু বাজারে যাব। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর হাঁটতে শুরু করলেন।
মাহবুব বুঝতে পারল, আলাউদ্দিন মীর খুব রেগে গেছেন। সেটা গ্রাহ্য না করে ঘরে এসে কথাটা মাকে বলে বলল, আব্বাকেও জানিয়ে দিও।
আলাউদ্দিন মীর সুলতান খাঁনের কাছে মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার মাস খানেক পর দেখা করেছিলেন। সুলতান খাঁন বলেছিলেন, মাহবুব পড়াশোনা শেষ করুক তারপর তার মতামত নিয়ে জানাব। আলাউদ্দিন মীর সেদিন খুশি হতে না পারলেও আর কিছু না বলে চলে এসেছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে মাহবুব ফিরেছে শুনে সুলতান খাঁনের কাছে একদিন যাব যাব করছিলেন। আজ বাজারে যাওয়ার পথে মাহবুবের সঙ্গে দেখা এবং তার কথা শুনে খুব রেগে গেলেও মেয়ের কথা চিন্তা করে তা প্রকাশ না করে বাজারে চলে গিয়েছিলেন। বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে মাহবুবের কথাগুলো বলে বললেন, সুলতান খাঁনের নাক আমি ভাঙব। সাত বছর শেষ হতে আর দু’বছরেরও কম সময় বাকি আছে। এর মধ্যে একলাখ টাকা সুলতান খাঁন পাবেন কোথায়? টাকা। থাকলে মেয়ের জন্য ছেলের অভাব আছে নাকি? প্রয়োজনে মাহবুবকে যা দেব। বলেছিলাম, তার ডবল দেব।
রোশনি বিবি বললেন, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? বেশি কিছু না দিলেও তাহেরার মতো মেয়ের জন্য ছেলের অভাব হবে না! কথা তো সেটা নয়, তাহেরাকে নিয়েই সমস্যা। সে মাহবুবকে পছন্দ করে। সেই জন্য এতদিন বিয়েতে রাজি হয়নি। মেয়ের কথা ভেবে আমাদেরকে বুদ্ধি খরচ করে সুলতান খাঁনকে রাজি করাতে হবে। মাহবুব বাপের কথা না রেখে পারবে না।
আলাউদ্দিন মীর বললেন; তুমি তো সুলতান খাঁনকে চিনো না, আমি চিনি। তিনি বেঁচে থাকতে আমাদের সাথে আত্মীয়তা করবেন না।
আমি যে একদম চিনি না তা নয়। তিনি যে রাজী হবেন না তাও জানি। আমার মনে হয় মাহবুবের মাকে যদি রাজী করানো যায় তাহলে তিনি স্বামীকে রাজী করাতে পারবেন।
কিন্তু মাহবুবের মা খুব পর্দানশীন মহিলা। তাকে রাজি করাবে কে?
আমি একদিন গিয়ে মাহবুবের মাকে রাজি করাবার চেষ্টা করব।
রোশনী বিবি লেখাপড়া জানা বড় লোকের মেয়ে। টাকার জোরে আলাউদ্দিন মীর তাকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করে সব কাজ করেন। স্ত্রীর বুদ্ধিতেই তার আরো উন্নতি হয়েছে। এখন স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, বেশ, একদিন তোমাকে নিয়ে যাব। কবে যেতে চাও বল।
এখন নয়, মাহবুব ঢাকায় চলে যাওয়ার পর যাব। তুমি খোঁজ রেখ মাহবুব ঢাকা গেছে কিনা।
তিন
মাহবুবা একমাস অপেক্ষা করেও যখন সুলতান খাঁনের চিঠি পেল না তখন একদিন মাসুমের মেসে গেল। মাসুম তখন মেসেই ছিল। সালাম দিয়ে বলল, আপনাকে বিরক্ত করতে আর আসব না বলে ওয়াদা করে গেলেও তা রক্ষা করতে পারলাম না। সেজন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মাসুম মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বলল, ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দেবেন না। বরং আপনাকে সাহায্য করতে পারিনি বলে অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। সেজন্য আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।
আপনি অপরাধী হবেন কেন? যাকগে ওসব কথা, এতদিনে নিশ্চয় বন্ধুর খোঁজ পেয়েছেন?
তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব। ‘
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মাহবুবের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। যে নাকি প্রেমিকার ভয়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেল, তার পিছনে ছুটছেন কেন? আপনার উপযুক্ত ছেলে আশা করি বাংলাদেশে অভাব নেই।
মাহবুবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, আপনি তো প্রেমে পড়েননি, পড়লে একথা জিজ্ঞেস করতেন না।
কিন্তু মাহবুব তো পড়েছে। তবু সে কেন আপনার সঙ্গে এরকম করছে?
আমার সঙ্গে তো মাত্র কয়েক মাসের পরিচয়। আপনি তাকে অনেকদিন থেকে চেনেন এবং আপনাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। কেন করছে, অনুমান করতে পারেন নি?
তা পেরেছি, তবে যে কোনো কারণই থাক না কেন, আপনার কাছ থেকে আত্মগোপন করবে কেন? আর আমাকেই বা বলবে না কেন বুঝতে পারছি না। প্রেমিকার সঙ্গে এরকম তারাই করে, যারা নাকি গার্জেনদের চাপে তাদের মনোনীত পাত্রীকে বিয়ে করে।
আপনি কি মনে করেন মাহবুবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
প্রথম দিকে মনে না করলেও এখন করি।
আপনার ধারণা ভুল। আপনার কাছ থেকে ঠিকানা নেওয়ার পর একদিন তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম তার পালিয়ে বেড়ানোর কারণ জানার জন্য।
মাসুমের কাছ থেকে যখন মাহবুবা গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নেয় তখন মাসুম ভেবেছিল, কাউকে পাঠিয়ে হয়তো খোঁজ খবর নেবে। কিন্তু নিজেই যাবে এতটা ভাবেনি। তাই অবাক হয়ে বলল, সত্যি বলছেন?
আমি মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করি।
কদিন ছিলেন?
দু’দিন।
তাহলে তো সব কিছু জেনেছেন।
হ্যাঁ জেনেছি, তবে ঢাকার ঠিকানা জানতে পারিনি।
কেন? তার মা-বাবার কাছে তো জেনে নিতে পারতেন?
মাহবুব মা বাবাকে চিঠি দিলেও ঢাকার ঠিকানা দেয়নি।
ফিরে এসে নিশ্চয় কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
নূতন করে আবার কি সিদ্ধান্ত নেব? যা নেওয়ার আগেই নিয়েছি। তাই তো ওয়াদা খেলাফ করে এলাম, এতদিনেও যদি ওর ঠিকানা পেয়ে থাকেন।
গতবারে আপনি আসার কয়েকদিন পর এসেছিল, তাড়িয়ে দিয়েছি।
মাহবুবা অবাক হয়ে বলল, তাড়িয়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ, তাড়িয়ে দিয়েছি, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? সে যখন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারল, আমি কেন তাড়াতে পারব না?
মাসুমের কথাগুলো মাহবুবার কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, কিন্তু মন থেকে তো তাড়াতে পারেন নি। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, ওর এরকম হওয়ার কারণ। জানেন কিনা।
জানি, মাহবুব আপনাকে জানাতে নিষেধ করেছিল বলে তখন মিথ্যা বলেছি। জানেন আমিও মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করি। শুধু ওয়াদা করিয়েছিল বলে সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম। ও এতবড় নিষ্ঠুর, ওর জন্য মিথ্যা বললাম, আর ও কিনা আমার কথা রেখে চলে গেল।
একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
বলুন।
আবার যদি আসে দয়া করে তাড়াবেন না। বুদ্ধি করে ওর ঠিকানাটা নেবেন। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বলল, দয়া করে ফোনে আমাকে জানাবেন। আর এটাও রাখুন। এখান থেকে গিয়ে এই ঠিকানায় কিছু দিন ছিল! ওখানে নজু মিয়া নামে এক বয়স্ক লোক আছেন, তার কাছে মাহবুবের পরবর্তী ঠিকানার ক্ল পেতে পারেন। এবার আসি তাহলে বলে মাহবুবা দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাসুম বলল, প্লীজ, আর একটু বসুন। এতক্ষণ কথা বলে নিশ্চয় গলা শুকিয়ে গেছে, চা খেয়ে যাবেন। কথা বলতে বলতে আপ্যায়নের কথা ভুলেই গেছি।
মাহবুবা বসে পড়ে বলল, আপনার কথাই ঠিক। আগে এক গ্লাস পানি দিন। তারপর চায়ের ব্যবস্থা করবেন।
চা খেয়ে মাহবুবা চলে যাওয়ার পর মাসুম বেরোবার কাপড় পরে আজিমপুর মেসে গিয়ে নজু মিয়ার সঙ্গে দেখা করে মাহবুবের ঠিকানা জানে কিনা জিজ্ঞেস করল।
নজু মিয়া বললেন, ঠিকানা জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, তিনি যে দুজন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতেন, যাওয়ার সময় তাদের বাসায় লজিং পেয়েছেন। বলেছিলেন।
মাসুম একবার মাহবুবের সঙ্গে ঐ ছাত্র-ছাত্রীর বাসায় গিয়েছিল। ঠিকানা মনে নেই, তবে লোকেসানটা মনে আছে। ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় এসে একটা রিকসায় উঠে কলাবাগান যেতে বলল। রিকশা চলতে শুরু করার পর ভাবল, সেদিন তার কোনো কথা না শুনে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ সেও যদি আমাকে তাড়িয়ে দেয়? তার মন বলে উঠল, তা দিতে পারে। কিন্তু সেখানে আছে কিনা সিওর হতে পারবে তো?
মাহবুব কলাবাগানের বড় রাস্তার পূর্বদিকে গলির একটা পাঁচতলা বাড়িতে পেয়িংগেষ্ট হিসাবে থাকে। আর বাড়ির মালিকের দুটো ছেলে মেয়েকে পড়ায়।
অনেক দিন আগে মাসুম একবার মাত্র এসেছিল। রিকশা থেকে নেমে গলিতে গিয়ে বাড়িটা ঠিক চিনতে পারল না। তাছাড়া পাশাপাশি বাড়িগুলো সব একরকম। কোন বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর করবে ঠিক করতে না পেরে বড় রাস্তায় ফিরে এসে গলির মুখে একটা কনফেকশনারী দোকানের একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, এই গলির কোনো এক বাড়িতে মাহবুব নামে একটা ছেলে লজিং থাকে, চেনেন নাকি?
কর্মচারীটা বলল, উনি কি ভার্সিটিতে পড়েন?
মাসুম বলল, হ্যাঁ।
কর্মচারীটা বলল, গলির ডান দিকের চারটে বাড়ির পরের বাড়িটায় থাকেন।
মাসুম ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির গেটে এসে কলিংবেলের বোম দেখতে পেয়ে চাপ দিল। কেউ খুলছে না দেখে বিরতি দিয়ে আরো দুবার চাপ দিল, তবু কেউ খুলল না।
তৃতীয়বার চাপ দেওয়ার জন্য বোতামে হাত দিতে যাবে এমন সময় গেটের ছিটকিনি খোলার শব্দ পেয়ে হাত নামিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে একজন শ্যামলা রং-এর
তরুণী গেট খুলে বলল, কাকে চান?
তরুণীর দিক থেকে মাসুম দৃষ্টি সরাতে পারল না। জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখলেও শ্যামলা মেয়ে যে এত সুন্দরী হয়, তা কখনো দেখেনি।
তাকে হ্যাঁ করে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে তরুণীটি বলল, কাকে চান বলছেন না কেন? মনে হচ্ছে ঠিকানা ভুল করেছেন।
মাসুম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এখানে মাহবুব নামে কোনো ছেলে থাকে?
হ্যাঁ থাকে। কে হয় আপনার?
মাসুম তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ও কি এখন বাসায় আছে?
না। কিছুদিন আগে দেশের বাড়িতে গেছেন।
কবে ফিরবে কিছু বলে গেছে?
তা বলতে পারব না। মা-বাবার কাছে হয়তো বলে গেছেন।
ঠিক আছে, পরে আসব বলে মাসুম ফিরে আসার জন্য ঘুরতেই—
তরুণীটি বলল, দাঁড়ান।
মাসুম দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুরল না।
তরুণীটি তার সামনে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এত সুন্দর চেহারা, কাপড় চোঁপড়ও কেতাদুরস্ত, মনে হয় কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়েন। কিন্তু ভদ্রতা জ্ঞান নেই কেন? গ্রাম থেকে এসেছেন নাকি?
মাসুম তরুণীটির কথা শুনে ভ্যাবাচাখা খেয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, বুঝলাম না।
আমি যে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে হয় আপনার, সে কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন?
মাসুম মৃদু হেসে বলল, মাঝে মাঝে অভদ্র হতে ইচ্ছে করে। তাই আর কি? তাছাড়া শহরে লেখাপড়া করলেও গ্রামের ছেলে তো, সব সময় ভদ্রতার কথা মনে থাকে না। আচ্ছা, চলি বলে তাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
তরুণীর নাম কান্তা। কান্তারা এক ভাই এক বোন। কান্তাই বড়। এক বছরের ছোট ভাই সাগর। সাগরের ভালো নাম তানভীর। কান্তা এ বছর এস. এস. সি. পরীক্ষা দেবে। আর সাগর এ বছর টেনে উঠেছে। তাদের বাবা আসাদ সাহেব বিজনিসম্যান। মাসুমের কথা শুনে কান্তা রেগে গিয়েছিল। তারপর তাকে চলে যেতে দেখে আরো রেগে গিয়ে বলল, গেও ভুত।
কথাটা শুনতে পেয়ে মাসুম ফিরে এসে বলল, আমি গেঁও ভূত হলে আপনি শহুরে পেত্নী। কথা শেষ করে হন হন করে চলে গেল।
কান্তা তার দিকে তাকিয়ে থেকে রাগে ফুলতে লাগল। মাসুম বড় রাস্তায় উঠে আড়াল হওয়ার পর বাসায় ঢুকল।
মাসুম ফেরার পথে নিউমার্কেট পোষ্ট অফিস থেকে মাহবুবাকে ফোন করল। মাহবুবার মা শামীমা বেগম ফোন ধরে বললেন, কে বলছেন?
মাসুম সালাম দিয়ে নাম বলে বলল, আমি মাহবুবার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন?
আমি মাহবুবার মা। ধরুন দিচ্ছি। তারপর রিসিভার রেখে একজন আয়াকে বলল, মাহবুবাকে বল তার ফোন এসেছে।
আয়া মাহবুবার রুমে গিয়ে বলল, আপা, আপনার ফোন এসেছে।
মাহবুবা ফোনের কাছে এসে রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, আমি মাহবুবা বলছি।
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি মাসুম।
কি খবর মাসুম ভাই?
মাহবুবের ঠিকানা পেয়েছি লিখে নিন।
আনন্দে মাহবুবার হার্টবিট বেড়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল, প্লিজ এক মিনিট।
তারপর রিসিভার রেখে কাগজ কলম নিয়ে এসে বলল, বলুন।
মাসুম ঠিকানা বলল।
মাহবুবা ঠিকানা লিখে নিয়ে বলল, ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না। ও কয়েক দিন আগে দেশের বাড়ি গেছে। কবে ফিরবে ওরা জানে না। এবারে রাখি তাহলে?
সালাম বিনিময় করে মাহবুবা রিসিভার রেখে রুমে এসে চিন্তা করল, এক সপ্তাহ পরে যাবে।
এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে মাহবুবা পারল না। তিন দিনের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে রওয়ানা দিল।
ঠিকানা মতো পৌঁছে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বলল, গলির রাস্তাটা চওড়া নয়। আর একটা গাড়ি এলে সাইড দেওয়া যাবে না। আমি বরং বড় রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করি।
মাহবুবা গাড়ি থেকে নেমে বলল, ঠিক আছে, যান। তারপর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার পাশে কলিংবেলের সুইচ দেখতে পেয়ে চাপ দিল।
আজও কান্তা দরজা খুলে একজন অপরিচিত মেয়েকে দেখে বলল, কাকে চান?
এখানে মাহবুব সাহেব থাকেন?
হ্যাঁ, কে হয় আপনার?
মাহবুবা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, উনি কি এখন আছেন?
না, কিছুদিন আগে দেশের বাড়ি গেছেন, কবে ফিরবেন বলে যাননি।
কান্তাকে দেখে মাহবুবা মুগ্ধ হল। ভাবল, শ্যামলা মেয়েও যে এত সুন্দর হয়। জানতাম না। মাহবুবের সম্পর্কে আরো কিছু জানার জন্য বলল, আপনার নাম কি?
কান্তা।
বাহ, খুব সুন্দর নাম তো? বড্ড পিয়াস লেগেছে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারেন।
সেদিনকার ছেলেটার মতো এই মেয়েটাও তার কথার উত্তর দেয়নি। তাই কান্তা রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। পানি খাওয়ার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বলল, ভিতরে আসুন। তারপর তাকে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে বলল, বসুন, পানি নিয়ে আসছি।
পানি খেয়ে জিজ্ঞেস করল, মাহবুব সাহেব আপনার টিচার তাই না?
হ্যাঁ। আমি ও আমার ভাই সাগর ওঁনার কাছে পড়ি।
মাহবুবা লক্ষ্য করল, কান্তা মুখ গম্ভীর করে কথা বলছে। বলল, আমি আসাতে আপনি কী বিরক্ত হয়েছেন?
না, রাগ হচ্ছে।
মাহবুবা বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন?
কয়েকদিন আগে একটা হ্যাঁণ্ডসাম ছেলে স্যারের খোঁজে এসেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার আপনার কে হয়। উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বললেন। অবশ্য সেজন্য আমি তাকে অনেক কড়া কথা শুনিয়েছি। আজ আবার আপনি স্যারের খোঁজে এলেন। আপনাকেও ঐ কথা জিজ্ঞেস করলাম; কিন্তু আপনিও এড়িয়ে গেলেন। তাহলে রাগ হওয়াটা কি উচিত নয়?
মাহবুবা বুঝতে পারল, কান্তা বাবা-মার খুব আদরের। তাই সেন্টিমেন্টাল। মৃদু হেসে বলল, নিশ্চয় উচিত। সেদিন যে ছেলেটা এসেছিলেন, তিনি কেন আপনার কথার উত্তর দেননি, তা তিনিই জানেন। আর আমার ব্যাপারটা আজ বলব না, আপনার স্যারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আবার যেদিন আসব, সেদিন বলব। ও-ভালো কথা আপনাদের নিশ্চয় ফোন আছে।
হ্যাঁ, আছে।
নাম্বারটা দেন তো।
কান্তা একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দেওয়ার সময় বলল, আপনার ফোন। নাম্বারটা দিন।
মাহবুবা একটু চিন্তা করে বলল, দু’টো শর্তে দিতে পারি।
বলুন।
আমি আপনাদের স্যারের খোঁজে এসেছি, সেকথা ওঁকে বলতে পারবেন না। আর উনি আসার পর আমাকে ফোন করে জানাবেন।
তা না হয় জানাব; কিন্তু আপনার আসার কথা বলতে নিষেধ করছেন কেন? এসে ফিরে গেছেন, সে কথা স্যারকে বলাই তো উচিত।
তা উচিত। এর মধ্যে কারণ আছে, তাই নিষেধ করছি। আবার যেদিন আসব, সেদিন কারণটাও বলব।
ঠিক আছে, এবার নাম্বারটা দিন।
মাহবুবা ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বলল, স্যার ফিরলে আমাকে ফোন করবেন।
এতক্ষণ মাহবুবার সঙ্গে কথা বলে কান্তার রাগ পড়ে গেছে। বলল, বসুন, চা খেয়ে যাবেন। তারপর বলল, আপনার নাম বলুন, তা না হলে ফোনে কাকে চাইব?
মাহবুবা নাম বলে বলল, আজ কিছু খাব না। ঐদিন শুধু চা নয় আরো কিছু খাব। তারপর বিদায় নিয়ে বড় রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠল।
প্রায় আট দিন পর রাত আটটার সময় আয়া এসে মাহবুবাকে বলল, আপা, আম্মা বললেন কান্তা নামে একটা মেয়ে আপনাকে ফোন করেছেন।
মাহবুবা তখন পড়ছিল। আয়ার কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরে বলল, কান্তা, কি খবর বলুন?
কান্তা বলল, প্রথম খবর হল, আমাকে আপনি করে বলেন কেন? তুমি করে বলবেন। আমি তো আপনার ছোট বোনের মতো।
ঠিক আছে, দ্বিতীয় খবরটা বল।
স্যার আজ বিকেলে ফিরেছেন।
শর্তের কথা মনে আছে তো!
আছে, আপনি কবে এবং কখন আসবেন?
কখন গেলে তোমাদের স্যারের সঙ্গে দেখা হবে?
সকালে নটা পর্যন্ত আমাদের পড়ান, তারপর নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যান। কোনোদিন দুপুরে ফেরেন। আবার কোনোদিন সন্ধ্যার আগে ফেরেন।
ঠিক আছে, কাল সকাল নটায় আসব! আশা করি তুমি গেটে অপেক্ষা করবে। এবার রাখি তাহলে?
রাখুন বলে কান্তা রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে দিল।
চার
অনেক রাত পর্যন্ত মাহবুবা ঘুমাতে পারল না। আজ প্রায় চার মাস মাহবুবকে দেখেনি। কাল গেলে কি ফিরিয়ে দেবে? বাসার সবার সামনে নিশ্চয় ফেরাতে পারবে না। দেশে গিয়ে মা-বাবার কাছে আমার কথা শুনে কি মনে করেছে কি জানি। কাল আমাকে দেখে নিশ্চয় খুব অবাক হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেও পারল না।
পরের দিন ঠিক নটার সময় মাহবুবা কান্তাদের বাসায় গিয়ে কলিংবেল বাজাল।
কান্তা আজ পৌণে নটায় স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে কলিংবেলের অপেক্ষায় ছিল। কলিংবেল বেজে উঠার সাথে সাথে দরজা খুলে দিয়ে হাসি মুখে সালাম দিয়ে বলল, আসুন আপা।
মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে যেতে যেতে বলল, আজ সালাম দিলে যে, সেদিন তো দাওনি।
কান্তা লজ্জা পেয়ে বলল, ভুল হয়ে গেছে। তারপর বলল, সেদিন আপনি চলে যাওয়ার পর মা জিজ্ঞেস করল, কার জন্য পানি নিয়ে গেলি? বললাম, একটা মেয়ে স্যারের খোঁজে এসেছিলেন, তিনি খেতে চেয়েছিলেন। শুনে মা আমার সাথে অনেক রাগারাগি করে বলল, অতিথিকে শুধু পানি দিতে নেই। তাছাড়া তোর স্যারের খোঁজে যখন এসেছিল, নিশ্চয় তার পরিচিত কেউ অথবা আত্মীয়। তারপর বলল, আপনি কি স্যারের রুমে যাবেন, না ড্রইংরুমে দেখা করবেন?
তার রুমেই যাব।
তাহলে ঐ পর্দা ঝোলান রুমে যান, ওটাই স্যারের রুম।
উনি কি রুমে আছেন?
না নাস্তা খাচ্ছেন।
ঠিক আছে তুমি যাও, আর শোন, আমার আসার কথা স্যারকে বলো না।
কান্তা সাবালিকা। সব কিছু বোঝার জ্ঞান হয়েছে। স্যারের সঙ্গে যে মাহবুবার কিছু একটা সম্পর্ক আছে বুঝতে পেরেছে। তাই শুধু মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে গেল।
মাহবুবা রুমে ঢুকে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসল। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখল, রুমটা বেশ ছিমছাম। আলনায় কাপড় চোপড় ও টেবিলের উপর বইপত্র সুন্দর করে গুছানো। বিছানার চাদর ও টান টান করে বিছান। টেবিলের উপর আলাদা একটা মোটা বই দেখে হাতে নিয়ে নামটা পড়ল। “পথহারা উম্মতের পথ নির্দেশ”। পাতা উল্টে দেখল, মূল লেখক হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলি থানবী (রঃ)। অনুবাদ করেছেন মাওলানা আখতার ফারুক।
এমন সময় মাহবুব পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকে মাহবুবাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাহবুবার ডান সাইডে দরজা, সে মাহবুবকে ঢুকতে দেখেনি। অনুবাদকের নাম ও সূচিপত্র পড়ার সময় ভাবল, বইটা পড়া উচিত। তারপর বই বন্ধ করে দরজার দিকে তাকাতেই মাহবুবকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে সেও একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। এক সময় মাহবুবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তাই দেখে মাহবুব সামলে নিয়ে সালাম দিল।
মাহবুবকে এতদিন পর দেখে মাহবুবা সামলাতে পারছে না। তাই সালামের উত্তর দিতে না পেরে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
তার অবস্থা বুঝতে পেরে মাহবুবের চোখেও পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে তার মাথায় একটা হাত রেখে বলল, আমি কি ক্ষমা পেতে পারি না?
এই কথায় মাহবুবা আরো বেশি বেসামাল হয়ে ফোঁপাতে লাগল।
মাহবুব কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে তার দুটো হাত ধরে মুখের উপর থেকে সরিয়ে বলল, “আল্লাহ ক্ষমাকে ভালবাসেন, যে ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করে, তিনি তাকে ভালবাসেন।” এটা হাদিসের কথা। তারপর বলল, সালামের উত্তর না দিলে গোনাহগার হবে তো।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাহবুবা ভিজে গলায় সালামের উত্তর দিল। তারপর চোখ-মুখ মুছতে মুছতে বলল, ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী করো না। কথা দাও, এভাবে আর কাঁদাবে না।
মাহবুব বলল, ঠিক আছে, দিলাম। এবার বল, কেমন আছ?
মাহবুবা ভিজে গলাতেই বলল, আমি তো তোমার দুশমন। দুশমনের ভালোমন্দ জেনে কি লাভ?
তাই যদি মনে কর, তাহলে আমার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলে কেন? আবার এইখানেই বা এসেছ কেন?
আচ্ছা, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? তোমার দীলে কী এতটুকু দয়া-মায়া নেই?
সে কথা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক জানেন।
তিনি তো তাঁর সৃষ্ট জগতের সবকিছুই জানেন। আর কারো দীলে দয়া-মায়া আছে কিনা তা তার ব্যবহারে জানা যায়।
তোমার কথা অবশ্য ঠিক, তবে সব ক্ষেত্রে নয়। ক্ষেত্রবিশেষে নরম দীলের মানুষও কঠোর ব্যবহার করে।
তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না। চল বাইরে কোথাও যাই।
এমন সময় দরজার পর্দার বাইরে থেকে কান্তা বলল, আসতে পারি স্যার?
মাহবুব বলল, এস।
কান্তা ভিতরে এসে বলল, মা আপাকে নিয়ে যেতে বললেন।
মাহবুব অবাক হয়ে বলল, ওকে তোমরা চেন নাকি?
সে কথা পরে শুনবেন বলে কান্তা মাহবুবার একটা হাত ধরে বলল, আসুন আপা।
মাহবুবের দিকে তাকিয়ে মাহবুবা বলল, একটু অপেক্ষা কর আসছি।
মেয়ের মুখে সেদিনের মেয়েটি এসেছে শুনে সায়রা বেগম নাস্তা খাওয়ার জন্য কান্তাকে ডেকে নিয়ে আসতে বলেছেন।
কান্তা মাহবুবাকে মায়ের কাছে নিয়ে এসে বলল, মা।
মাহবুবা সালাম দিল।
সায়রা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, এস মা বস। সেদিন কান্তা তোমাকে শুধু পানি খাইয়েছিল শুনে খুব রাগারাগি করেছি।
মাহবুবা বলল, ওকে শুধু শুধু বকাবকি করলেন কেন? আমার খুব পিয়াস লেগেছিল, তাই পানি খেতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া ও তো চা দিতে চেয়েছিল, আমিই না করেছিলাম।
সায়রা বেগম বললেন, তবুও অন্যায় করেছে। শুধু তোমার সঙ্গে নয়, যে কোনো মেহমান এলে তাদের সঙ্গেও ঐরকম করে। নিজের ইচ্ছা মতো সবকিছু করে। মেরে ফেললেও কারো কথা শোনে না। তবে মাহবুব স্যারকে খুব মানে, তাকে ভয়ও করে। শুধু তার কথা শুনে। আগে তো কাউকেই গ্রাহ্য করত না। মাহবুব স্যার এ বাড়িতে আসার পর অনেকটা শুধরেছে। তারপর মেয়েকে দেখতে না পেয়ে একটু উঁচু গলায় বললেন, কান্তা কোথায় গেলিরে মা, নাস্তা নিয়ে আয়।
কান্তা জানে মা মাহবুবার কাছে সেদিনের ব্যাপারে তার কথা বলবে। তাই মাহবুবাকে পৌঁছে দিয়ে রুমের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। ডাক শুনে কিচেনে গিয়ে ট্রে করে চা নাস্তা নিয়ে ফিরে এল।
সায়রা বেগম বললেন, সেদিনের ব্যবহারের জন্য ওঁর কাছে মাফ চা।
অন্য কারো কাছে হলে কান্তা মাফ চাইত না। মাহবুবাকে তার ভালো লেগেছে। তাই তার দিকে তাকিয়ে বলল, মাফ করে দিন আপা।
মাহবুবা কান্তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, খালাআম্মা শুধু শুধু মাফ চাইতে বলছেন, তুমি কোনো অন্যায় করনি। এস আমার সঙ্গে নাস্তা করবে।
কান্তা বলল, আমি একটু আগে নাস্তা খেয়েছি, আপনি খান। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেল।
সায়রা বেগম বললেন, তুমি খাও মা, ও আমাদের সঙ্গেও কিছু খায় না, একা একা খায়। এটাও ওর একটা বদ অভ্যাস।
মাহবুবা বলল, আমি তো নাস্তা খেয়ে এসেছি। চা দেন বরং।
তবু অল্প কিছু খাও, চা দিচ্ছি। তারপর টি পট থেকে চা কাপে ঢেলে দুধ চিনি মিশিয়ে দিলেন।
মাহবুবা অল্প কিছু খেয়ে চায়ে চুমুক দিল।
সায়রা বেগম বললেন, কান্তার কাছে তোমার নাম শুনেছি, বাবার নাম কি?
আনিসুর রহমান, সবাই আনিস সাহেব বলে জানে।
সায়রা বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন, তুমি কি বিখ্যাত ব্যবসায়ী আনিস সাহেবের মেয়ে?
জ্বি, চেনেন মনে হচ্ছে।
আনিস সাহেবকে চেনে না বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসায়ী নেই। তুমি তার মেয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছ, এ যে ভাবতেই পারছি না। কান্তার বাবা শুনলে বিশ্বাস। করবে কিনা জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুব স্যারের সঙ্গে তোমার কি রকম পরিচয়?
ভার্সিটিতেই পরিচয়। তারপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, এবার আসি খালাম্মা?
এতটুকুতেই সায়রা বেগম যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, আবার এস মা। তারপর কান্তাকে ডেকে বললেন, একে তোর স্যারের রুমে নিয়ে যা।
কান্তারা দোতলায় থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচতলায় এসে কান্তা বলল, স্যারের রুম চিনতে পারছেন তো? এবার আমি যাই?
মাহবুবা মৃদু হেসে বলল, যাও। তারপর রুমে ঢুকে মাহবুবকে বাহিরে যাওয়ার কাপড় পরে রেডি হয়ে থাকতে দেখে বলল, সরি, খালাম্মার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল।
মাহবুব বলল, ঠিক আছে, চল কোথায় যাবে বলছিলে।
বড় রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে মাহবুবা ড্রাইভারকে বলল, চিড়িয়াখানায় চল।
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর মাহবুব বলল, চিড়িয়াখানায় সব সময় ভীড় থাকে।
আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসব।
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে পৌঁছে ড্রাইভার গেটের পাশে গাড়ি পার্ক করল। টিকেট কেটে ঢোকার আগে মাহবুব বাদাম ও বুট ভাজা কিনল। ভিতরে গিয়ে পছন্দ মতো একটা গাছের ছায়ায় বসল।
প্রথমে কিছুক্ষণ দু’জনেই চারপাশের গাছপালা দেখল। তারপর প্রথমে মাহবুবা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে কি মনে কর বলবে?
মাহবুব কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে বলল, আগে যা মনে করতাম।
মাহবুবা চোখ মুছে বলল, তাহলে আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ কেন?
কষ্ট আমিও যে পাচ্ছি তা বুঝি জান না?
জানি বলেই তো তোমাকে হন্যি হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট শিশি বার করে বলল, এটা কি বলত?
মাহবুব শিশিটার গায়ের লেখা পড়ে চমকে উঠে বলল, ওটা তো বিষ, সঙ্গে রেখেছ। কেন?
আসবার সময় অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। ভেবেছিলাম, সেদিনের মতো আজও যদি তাড়িয়ে দাও, তাহলে ফেরার সময় এটা খেয়েই গাড়িতে উঠব।
মাহবুব আর একবার চমকে উঠে গম্ভীর স্বরে বলল, ওটা আমার কাছে দাও। জান না, কাপুরুষরাই আত্মহত্যা করে? যারা দুনিয়ার জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, তারা মৃত্যুর পর থেকে দুনিয়ার জ্বালা যন্ত্রণার চেয়ে লক্ষ্য কোটিগুণ বেশি যন্ত্রণা অনন্তকাল ভোগ করবে। প্রমিশ করো জীবনে আর কখনো আত্মহত্যার কথা ভাববে না। তারপর তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, কই দাও।
মাহবুবা কাঁপা হাতে শিশিটা দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুমিও প্রমিশ কর, আমার প্রতি আর কখনো নিষ্ঠুর হবে না।
তক্বদির আমাকে নিষ্ঠুর করেছিল, প্রতিজ্ঞা করছি আর হব না।
আমিও প্রমিশ করছি আর কখনো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করব না। এবার একটা কথা বলি?
বল।
কিছু ডিসিসান নিয়েছ?
কোন ডিসিসানের কথা জানতে চাচ্ছ?
পুকুরের টাকা পরিশোধ করার।
মাহবুব বুঝতে পারল, মাহবুবা মায়ের কাছ থেকে পুকুরের ব্যাপারটা জেনে গেছে এবং সেই জন্যে যে আমি তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি তাও বুঝতে পেরেছে। বলল, হ্যাঁ নিয়েছি। একটা গাড়ি ইম্পোর্ট কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানে যদি চাকরি পাই এবং বেতন সম্মানজনক হয়। তাহলে দু’বছরের মধ্যে ইনশাআল্লাহ টাকাটা পরিশোধ করতে পারব। আর যদি চাকরিটা না হয়, তাহলে চিন্তা করেছি দু’রুমের একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে কয়েক ব্যাচে ছাত্র পড়াব। আমার এক বন্ধু আছে এম. এ. পাশ। সেই আমাকে বুদ্ধিটা দিল।
মাহবুব যে কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছে, সেটা মাহবুবার বাবার। মাহবুবা বুঝতে পারল, মাহবুবকে ক্যাপচার করার জন্য এটা বাবারই একটা ফাঁদ। মনে মনে খুশি হলেও তা প্রকাশ না করে বলল, কয়েক ব্যাচে ছাত্র পড়ালে শরীর টিকবে? তাছাড়া ব্রেনের উপরও চাপ পড়বে।
তোমার কথা অস্বীকার করব না। তবে আমি তো আর সারাজীবন পড়াব না, মাত্র দুতিন বছর। তারপর গ্রামে গিয়ে কিছু একটা করার ব্যবস্থা করব।
তবু দুতিন বছর বলে কথা, দোয়া করি আল্লাহ যেন চাকরিটা পাইয়ে দেন।
মাহবুব আমিন বলে বলল, সেই সাথে বেতনটাও যেন সম্মানজনক হয়।
মাহবুবাও আমিন বলে বলল, বাবার মুখে শুনেছি, ওটা খুব বড় কোম্পানী। ইনশাআল্লাহ বেতনও নিশ্চয় সম্মানজনক হবে।
মাহবুব বলল, ওসব কথা রেখে এখন বাদাম, বুট খাই এস। তারপর ঠোঙা দু’টো সামনে রেখে বলল, খাও।
মাহবুবা বাদাম ছাড়িয়ে তার হাতে দিয়ে বলল, আমি ছাড়িয়ে দিই তুমি খাও।
কেন? আমার কি হাত নেই?
ঠিক আছে, এগুলো অন্ততঃ নাও। আমি বাদাম খেতে পারি না। কেমন গন্ধ লাগে। বুট খেতে ভালবাসি।
তাহলে তাই খাও বলে মাহবুব কয়েকটা বুট নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে গেল।
মাহবুবা একটা পনের ষোল বছরের ছেলেকে বালতিতে ফান্টার বোতল নিয়ে তাদের কাছে এসে গেছে দেখে মাহবুবের হাতটা ধরে ফেলে হাসি মুখে বলল, ফান্টাওয়ালা দেখছে। তারপর বুটগুলো নিজের হাতে নিয়ে খেল।
ততক্ষণে ফান্টাওয়ালা ছেলেটা সামনে এসে বলল, ফান্টা খাবেন? বালতিতে বরফ দিয়ে রেখেছি, ঠাণ্ডা আছে।
মাহবুব বলল, দু’টো দাও।
ফান্টা দিয়ে ছেলেটা চলে যাওয়ার পর মাহবুবা বলল, আমি কিন্তু তোমার কাছে সপ্তাহে অন্ততঃ দু’বার আসব।
মাহবুব সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ভালো কথা, কান্তারা কী তোমাদের আত্মীয়?
না।
তাহলে ওরা তোমার সঙ্গে আত্মীয়র মতো ব্যবহার করল কেন?
মাহবুবা প্রথম দিন আসার কথা ও কান্তার আচরণের কথা বলে বলল, কান্তার মা মেয়ের কাছ থেকে জেনে ঐদিন তার সাথে রাগারাগি করেছিলেন। তাই আজ এরকম করলেন।
মাহবুব বলল, হ্যাঁ কান্তার স্বভাব আরো খারাপ ছিল। প্রথম যখন পড়াতে আসি। তখন তো মনে হয়েছিল, ওর মাথায় ছিট আছে। এখন তো অনেক ভালো। তবু মাঝে মাঝে বাইরের লোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলে।
কান্তার মাও তাই বললেন।
মাহবুব পাঁচশ টাকার বিশটা নোট একটা খামে ভরে এনেছিল। এখন পকেট থেকে সেটা বার করে তার হাতে দিয়ে বলল, বাসায় গিয়ে খুলবে। মাহবুবা অনুমান করে বলল, ঋণ শোধ করছ?
ঋণ শোধ করাই তো উচিত।
তোমার উপর আমার কি কোনো অধিকার নেই?
আছে, তবে সেটা বিয়ের পর পাকাপোক্ত হবে।
তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। তারপর বলল, সপ্তাহে দু’দিন আসব বললাম, কিছু বললে না যে?
চল এবার ফেরা যাক বলে মাহবুব দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাহবুবাও দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাহবুব চলতে শুরু করে বলল, এত ঘন ঘন এলে ওঁরা কি ভাববেন?
তাহলে তুমিই বল কোথায় আমাদের দেখা হবে?
তুমি তো জান আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। কখন কোথায় থাকি তার কোনো ঠিক নেই। তারপর একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বলল, আমি প্রতিদিন বেলা দশটা থেকে দু’টা পর্যন্ত বন্ধু রকিবের বাসায় থাকি। একটু আগে যে বন্ধুর কথা বললাম এটা তারই নাম্বার। ফোন করো, আর তোমার নাম্বারটা দাও, আমিও মাঝে মাঝে করব। দেখা করার ব্যাপারটা ফোনে আলাপ করে ঠিক করব। আমি কান্তাদের বাসায় পেইং গেষ্ট হিসাবে আছি। আমাকে বাসার সবাই সম্মান করে। ওখানে তোমার আসাটা ঠিক হবে না। তারপর বলল, কান্তাদের বাসার ঠিকানা কি করে পেলে?
মাসুম ভাইয়ের কাছে। তিনিও জানতেন না। কয়েক দিন আগে তার কাছে গিয়ে তোমার ঠিকানা জোগাড় করে দেওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করি। তারপর কিভাবে মাসুম ভাই ঠিকানা জোগাড় করে জানিয়েছেন বলল।
ততক্ষণে তারা গার্ডেনের বাইরে এসে গাড়িতে উঠল। মাসুমের নাম শুনেই মাহবুবের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, মাসুম আমাকে ভুল বুঝে আমার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছে। তার মতো বন্ধু আমার আর ছিল না। এখনো তাকে তাই ভাবি। তার কাছে যেতেও খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু দুর্ব্যবহারের কথা মনে পড়লে যেতে আর ইচ্ছা করে না।
মাহবুবা বলল,তুমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছ বলে মাসুম ভাইকে দোষ দিচ্ছ। আর তোমার ব্যবহারে যে, সে খুব ব্যথা পেয়েছে, তাও বুঝতে পারছ না। একটা কথা বলব রাখবে?
বল।
তোমার ও তার সম্পর্কের কথা এবং তোমাদের বিচ্ছেদের কথা সবকিছু মাসুম ভাই আমাকে বলেছেন। আমার মনে হচ্ছে তোমরা দুজনেই দোষ করেছ। অভিমান করে কেউ কারো সঙ্গে দেখা করছ না। তোমার অসুখের সময় কিভাবে তোমাকে সাহায্য করেছেন ভেবে দেখ। আমি তোমাদের ভুল বোঝাবুঝি ও অভিমান ভাঙ্গিয়ে মিল করিয়ে দিতে চাই। এখনই চল না যাই?
মাহবুব ভাবল, মাহবুবা ভালো কথাই বলেছে। যতই সে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করুক না কেন, অসুখের সময় সে সাহায্য না করলে হয়ত মারাই যেতাম।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মাহবুবা বলল, কি ভাবছ?
ভাবছি, তোমার কথাই ঠিক। অসুখের সময় মাসুম যা করেছে, সে ঋণ অপরিশোধ্য।
মাহবুবা ড্রাইভারকে স্বামীবাগ যেতে বলল।
মাহবুব বলল, এখন কি সে মেসে আছে?
থাকতেও তো পারে। না থাকলে অন্যদিন যাওয়া যাবে।
মাসুম মেসেই ছিল। ওদের দুজনকে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাহবুব সালাম দিয়ে বলল, কিরে, সেদিনের মতো আজও তাড়িয়ে দিবি নাকি?
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, সেদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, ভাবির সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করেছিলি বলে। আর আজ ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিস, তাড়াব কোন দুঃখে। তারপর মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, মাফ করে দে দোস্ত।
মাহবুবও ভিজে গলায় বলল, যার ভয়ে পালিয়ে বেড়ালাম সে যখন সবকিছু জেনে গেছে তখন তোর উপর রাগ করে থাকতে পারলাম না। ভুল করেছি বুঝতে পেরে এলাম। তুইও আমাকে মাফ করে দে দোস্ত।
তাদের মিলন দৃশ্য দেখে মাহবুবার চোখেও পানি এসে গেল। সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, ছেলেতে ছেলেতে যে এত বিরহ ব্যথা হয়, তা জানতম না। তারপর বলল, মাসুম ভাই, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভেজাবার ব্যবস্থা করুন।
মাসুম আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে চোখ মুছে বলল, এক্ষুনি করছি। তারপর ডিবা থেকে বিস্কুট-চানাচুর বার করে দু’গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে বলল, তোরা খা, আমি চা বানাচ্ছি।
চা খাওয়ার সময় মাহবুব মাসুমকে বলল, দুপুরের ভাত কি সকালেই বেঁধেছিস?
মাসুম বলল, না। এত গরমে ভাত পানিসরা হয়ে যায়। তাই সকালে রান্না করি না। রাত্রে চাল এক মুঠো বেশি করে রান্না করি, সকালে পান্তা খাই।
আজ দুপুরের রান্না করেছিস?
না, রান্না করব করব ভাবছি, তোরা চলে এলি।
তিন জনের রান্না কর আমরাও খাব।
ভাবি, আপনি সাক্ষি রইলেন, না খেলে ওর বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব।
আরে তুই ওকে বার বার ভাবি বলে লজ্জা দিচ্ছিস কেন? আমাদের কি বিয়ে হয়েছে?
না হয়েছে তো কি হয়েছে? একদিন তো হবেই। আজকাল সব কিছুতেই এ্যাডভান্স দিতে হয়। আমিও না হয় এ্যাডভান্স ভাবি ডাকলাম। তারপর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি অন্যায় কিছু বললাম ভাবি?
মাহবুবা লজ্জায় রাঙা হয়ে কিছু বলতে না পেরে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।
মাহবুব বলল, যা বলার বলেছিস, আর বলবি না। তুই বাজার থেকে খাসির গোস্ত নিয়ে আয়, আমি ততক্ষণ ভাতটা চড়িয়ে দিই। অনেক দিন খাসির গোস্ত খাইনি। যাদের বাড়িতে থাকি, তারা কেউ খাসি খায় না।
ভাবির সঙ্গে এসেছিস, তুইও মেহমান। তোকে কিছু করতে হবে না। আমি ভাত চড়িয়ে দিয়ে বাজারে যাব, তোরা গল্প কর। তারপর মাহবুবকে বড় বড় চোখে তার দিকে চাইতে দেখে বলল, ভাবি রয়েছেন, আজ তোর চোখ রাঙানীকে ভয় করছি না।
মাহবুবা মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাসুম ভাই যা ইচ্ছা করুক, আজ কিছু বলো না।
মাহবুব বলল, তাই বলে নিষেধ করা সত্বেও বার বার তোমাকে লজ্জা দিবে?
দিকগে, আমি কিছু মনে করছি না।
যা বাবা, যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর।
মাসুম চাল ধুয়ে এনে ভাত চুলোয় চাপিয়ে দিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় মাহবুবকে বলল, তোরা যদি রাজি থাকিস বল, বাজার করে ফেরার সময় কাজি সাহেবকে বিকেলে আসবার কথা বলে আসব।
মাহবুব বলল, একটু আগে তুই আমার বারোটা বাজাবি বললি না, দাঁড়া, তার আগেই আমি তোর চৌদ্দটা বাজাচ্ছি। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
মাহবুবা খপ করে তার একটা হাত ধরে বলল, আহ কি হচ্ছে?
মাসুম বাজারের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ভাবি ওকে সামলান।
মাহবুব বলল, তুমি না থাকলে সত্যিই আজ ও মার খেত।
মাহবুবা হাসতে হাসতে বলল, আমি না থাকলে মাসুম ভাই তোমাকে রাগাতেন না।
মাহবুব হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বসে বলল, ওর কথায় সত্যিই তুমি কিছু মনে করনি?
এতে মনে করার কি আছে? মাসুম ভাই খুব সরল ও রসিক ছেলে।
তুমি তো ওকে চেনো না, আমি যদি রসিকতা করে কাজি আনার কথা বলতাম, তাহলে ও সত্যি সত্যি নিয়ে আসত। তখন ব্যাপারটা কি হত?
কি আবার হত? আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিত। অবশ্য তুমি যদি রাজি হতে।
তোমার মা বাবাকে না জানিয়েই?
হ্যাঁ, না জানিয়েই।
তারা যদি এ বিয়ে মেনে না নিতেন?
সেটা আমি বুঝতাম।
যাক, বিয়ের কথা তুলে ভালই করেছ। এ ব্যাপারে তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
বেশ তো বল।
তুমি তো আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলে, মা-বাবাকে কেমন মনে হল?
ওঁনাদের মতো ভালো মানুষ সমাজে আছে, না দেখলে জানতাম না।
গ্রামের পরিবেশ কেমন লাগল?
খুব ভালো।
থাকতে পারবে?
অফকোর্স।
দুতিন বছর অপেক্ষা করতে পারবে?
শুধু দু’তিন বছর নয়, সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব। তবে তোমার সঙ্গে দেখা না হলে খুব কষ্ট হবে।
সারাজীবন নয়, মাত্র দুতিনটে বছর অপেক্ষা করলেই হবে। তারপর ইনশাআল্লাহ আমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ হবে।
চাকরির জন্য ইন্টারভিউ কবে দিয়েছ?
পরশু।
আমার মন বলছে ইনশাআল্লাহ দু’একদিনের মধ্যে তুমি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবে। পাওয়ার পর আমাকে জানাবে। নচেৎ খুব চিন্তায় থাকব।
নিশ্চয় জানাব, তোমাকে জানাব না তো কাকে জানাব? আমার কিন্তু আরো কিছু বলার ছিল।
বেশ তো বল না।
তুমি কী ইসলামিক বই কিছু পড়েছ? না পড়ে থাকলে আরম্ভ কর। আর সেই সঙ্গে ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা কর। তুমি নিশ্চয় আমাদের বাড়ির পরিবেশ কি রকম জেনেছ। আম্মা-আব্বা আপটুডেট মেয়ে একদম পছন্দ করেন না।
তা আমি গিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। তারপর তোমার মা কোরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে অনেক উপদেশ দিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে আমি সে সব মানার জন্য বই কিনে পড়তে শুরু করেছি। নামায পড়ার জন্য যা কিছু দরকার সেগুলো মুখস্থ করছি। কোরআনের ব্যাখ্যা যত পড়ছি তত মনে হচ্ছে এটা যেন একটা জীবন্ত শাসন ব্যবস্থা। আর কোরআন হাদিসের বাণীগুলো এত বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ, যা কল্পনা করা যায় না। তাই বোধহয় অন্যান্য ধর্মের জ্ঞানী গুণিজনেরা কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে ইসলাম। ধর্ম গ্রহণ করছেন।
হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ। যে কোনো ধর্মের মানুষ যদি কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে, তাহলে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। মেয়েদের হিজা (পর্দা) সম্বন্ধে অনেক লেখকের বই আছে, পড়ো। অবশ্য কোরআন শরিফেও আছে। আর হাদিসে তো আছেই।
তোমার টেবিলে “পথ হারা উম্মতের পথ নির্দেশ” নামে একটা বই দেখলাম। সুচিপত্র পড়ে বুঝতে পারলাম, পড়া উচিত। ভাবছি, ফেরার পথে কিনব। আচ্ছা উম্মত কাদেরকে বলে?
আল্লাহ মানুষকে ধর্মের পথে চালাবার জন্য একলাখ বা দুলাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের সময়ে যে সব মানুষ তাদের কথা মতো ধর্মের পথে চলেছেন, তারা সেই পয়গম্বরের উম্মত। যেমন আমরা আমাদের পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর উম্মত, খৃষ্টানরা হযরত ঈসা (আঃ) এর উম্মত, ইহুদীরা হযরত মুসা (আঃ) এর উম্মত। তুমি কি আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) জীবনী পড়েছ?
না।
গোলাম মোস্তফার লেখা বিশ্বনবী নামে বইটা পড়ো। তাহলে আমাদের নবী (দঃ) এর জীবন কথা জানতে পারবে। তাছাড়াও ইসলাম প্রচার হওয়ার আগে এবং ইসলাম কিভাবে প্রচার হল, কিভাবে দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়ল সবকিছু জানতে পারবে।
এমন সময় মাসুম ফিরে এসে মাহবুবের শেষের কথাগুলো শুনে মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, কার পাল্লায় পড়েছেন, দু’চার দিন ওর সঙ্গে থাকলে মৌলভী করে ছাড়বে। আমি তো কলেজে কমিউনিষ্ট করতাম। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর যখন ওর সঙ্গে এই মেসে এলাম তখনও করতাম। ও জানতে পেরে কোরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে এমন তালিম দিতে লাগল যে, বাপ বাপ করে কমিউনিষ্ট ছেড়ে ইসলামিষ্টে ঢুকে পড়তে বাধ্য হলাম।
তার কথা শুনে মাহবুবা হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ, ইসলাম এমন একটা জিনিস, যে ভালোভাবে ইসলামকে জানবে, সে ইসলামে ঢুকতে বাধ্য হবে।
মাসুম বলল, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, আজকালের মুসলমানেরা ইসলামকে না জেনে অনান্য ইজমের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। শুধু তাই নয়, তারা ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশোনা না করেই ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলছে। অবশ্য এর পিছনে বিদেশী ও বিজাতীয় এন.জিওদের চক্রান্ত রয়েছে।
মাহবুব বলল, তুই লেকচার থামিয়ে তরকারী রান্না কর। খিদেয় পেট চোঁ চো করছে।
মাহবুবা বলল, বাসায় একটা ফোন করা দরকার। নচেৎ মা-বাবা চিন্তা করবে। ড্রাইভার ও গাড়িতে অপেক্ষা করছে।
মাহবুব বলল, ফোন করার দরকার নেই। ড্রাইভারকে বলে দিই, সে চলে যাক। বিকেলে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
ঠিক আছে তাই বলে দাও।
.
বিকেলে মাহবুবা বাসায় যখন ফিরল তখন আনিস সাহেব ও শামীমা বেগম বৈকালিক জলযোগ সেরে চা খাচ্ছিলেন। মেয়েকে দেখে শামীমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?
মাহবুবের বাসায়।
ও বাসা নিয়েছে নাকি?
না, একজনের বাসায় পেয়িং গেষ্ট হিসাবে আছে। তারপর টাকার খামটা বাবার হাতে দিয়ে বলল, ক্লিনিকের বিলের টাকা। অবশ্য মাহবুব অনেক আগে দিতে চেয়েছিল, আমি নিইনি।
আজ নিলি কেন?
এমনভাবে দিল, না নিয়ে উপায় ছিল না। টাকার কথা থাক বাবা, শুনলাম: দুইদিন আগে মাহবুব তোমার কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছে।
কার কাছে শুনলি? মাহবুবের কাছে?
হ্যাঁ, মনে হয় তোমাকে চিনতে পারেনি।
চিনে ফেলবে ভেবে ওর ইন্টারভিউর সময় আমি ছিলাম না।
কিন্তু পরে যখন জানতে পারবে, তখন কি হবে?
সে ব্যবস্থাও করেছি। শোন, তুই তো খুব চালাক। তোকে সাহায্য করার জন্য যে মাহবুবকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছি, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস।
মাহবুবের কাছে ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি। এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছ?
আজ ম্যানেজারকে পাঠাতে বলেছি। এবার মাহবুবকে ক্যাপচার করার দায়িত্ব তোর।
মাহবুবা নিজের হাতে টি পট থেকে লিকার কাপে নিয়ে দুধ ও চিনি মিশিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার বেশ ভয় করছে বাবা, যা সেন্টিমেন্টাল ছেলে, যদি তোমার ফাঁদ পাতার কথা জানতে পারে, তাহলে আমরা সবাই ওর কাছে ছোট হয়ে যাব। আর মাহবুব যে কি করবে, তা আল্লাহ মালুম।
আমি ভেবেছি জানার আগে তোদের বিয়েটা দিয়ে দেব।
বিয়ের কথা শুনে মাহবুবা লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ রইল। তারপর বলল, কিন্তু ওতো পুকুরের লোন পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি হবে না।
তুই রাজি করাবি। কোম্পানির কাছ থেকে এ্যাডভান্স বা লোন নিয়ে পুকুরের টাকাটা দিয়ে দিতে বলবি।
ও যদি বুঝে ফেলে?
তোকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম, ততটা চালাক তুই না। দেখছি আমাকেই সবকিছু করতে হবে।
বাবা, ওকে তুমি কি পোষ্টে এবং কত স্যালারী দেবে বলবে?
ওকে আমাদের কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভের পোষ্ট দিচ্ছি। আর স্যালারী পনের হাজার। সেই সঙ্গে গাড়ি ও কোয়ার্টার। তা ছাড়া বছরে অন্ততঃ দু’তিন বার বিদেশে নতুন মডেলের গাড়ি কেনার অর্ডার নিয়ে টুর করবে। তখন আবার অন্যান্য ফেসিলিটিও পাবে।
মাহবুবা খুশিতে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, সত্যি বলছ বাবা?
হ্যাঁরে সত্যি, হবু জামাইকে কি আর যা তা একটা পোষ্ট দিতে পারি? মাহবুব যাতে কোনো রকম সন্দেহ না করে, সে ব্যাপারে ম্যানেজার ও এ্যাসিসটেন্ট ডাইরেক্টরকে নির্দেশ দিয়েছি। যতদিন না তোদের বিয়েটা দিতে পারছি ততদিন আমি ঢাকার অফিসে থাকব না। চিটাগাং অফিসে সপ্তাহে দুদিন বসব। এতকিছু করার পরও তুই যদি তাকে ম্যানেজ করতে না পারিস, তাহলে আমাদের কথা তোকে মেনে চলতে হবে। তখন আর তোর কোনো কথাই আমরা শুনব না। মনে রাখিস, আমরা তোর মা বাবা, তুই-ই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর সুখের জন্য আমরা আমাদের মনের ইচ্ছা বিসর্জন দিয়েছি। এবার তোর ভাগ্য।
মাহবুবা ছলছল চোখে বলল, আমি কথা দিলাম, ইনশাআল্লাহ মাহবুবকে ক্যাপচার করতে পারব। আর যদি না পারি, তাহলে ভাগ্যকে মেনে নেব।
পাঁচ
মাহবুব ঢাকায় চলে গেছে জেনে আলাউদ্দিন মীর স্ত্রীকে কথাটা জানালেন।
রোশনী বিবি জিজ্ঞেস করলেন, কবে গেছে?
তিন দিন আগে।
কাল মাগরিবের নামাযের পর আমরা যাব। তুমি সুলতান খাঁনের কাছে নিজের থেকে বিয়ের প্রস্তাবের কথা তুলবে না। উনি যদি তোলেন, বুঝেসুঝে কথা বলো, আমি ওঁর স্ত্রীকে যা বলার বলে রাজি করাবার চেষ্টা করব।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে সুলতান খাঁনের স্ত্রীও রাজি হবে না।
উনি যে রাজি হবেন না তা আমিও জানি। তবে এমন টোপ ফেলব, রাজি হতে বাধ্য হবেন। আমাদের একটাই মেয়ে, আমার সর্বস্ব দিয়ে হলেও তাহেরাকে সুখি করবই।
আমি কিন্তু অনেক কিছু দেওয়ার কথা বলেও সুলতান খাঁনের মন ভেজাতে পারি নি।
সুলতান খাঁন পুরুষ। তাই তার দীল শক্ত। মেয়েদের দীল নরম। আশা করি, আমি তার স্ত্রীকে রাজি করাতে পারব।
বেশ কাল নিয়ে যাব, চেষ্টা করে দেখ পার কিনা।
পরের দিন মাগরিবের নামায পড়ে আলাউদ্দিন মীর স্ত্রীকে নিয়ে সুলতান খাঁনের বাড়িতে যখন এলেন তখন তিনি পাড়ার রহিম শেখের সঙ্গে সদরে আলাপ করছিলেন।
এই গ্রামে শেখেরাও খুব উচ্চ বংশ। তাদের মধ্যে রহিম শেখ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। তার তিন ছেলে দুই মেয়ে, বড় ও মেজ ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। ছোট ছেলে স্কুলের শিক্ষক। অবসর সময়ে গৃহস্থের কাজ কর্মও দেখাশোনা করে। তিন ছেলে ও বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সবার ছোট জয়নাব। এ বছর এস. এস. সি পাশ করেছে। রহিম শেখ জয়নাবের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
প্রস্তাব শুনে সুলতান খাঁন বললেন, আমরা এখনও মাহবুবের বিয়ের কথা চিন্তা করিনি। সে একটা চাকরি বাকরি কিছু করুক তারপর চিন্তাভাবনা করব।
রহিম শেখ বললেন, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। বেকার থাকা অবস্থায় ছেলের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। মাহবুবের মতো ছেলে আশেপাশের কয়েকটা গ্রামে নেই। আর জয়নাব দেখতে শুনতে কেমন তার স্বভাব চরিত্র কেমন, তাতে আপনি জানেন। গ্রামের অনেকে মাহবুবকে জামাই করতে চায় জানতে পেরে আগাম প্রস্তাব দিয়ে গেলাম। আশা করি, সবার আগে আমার কথাটা মনে রাখবেন। লেনদেনের কথা বিয়ের সময় ভোলা ইসলামে নিষেধ। সে কথা আমার চেয়ে আপনি বেশি জানেন। তবু আপনার বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করে মেয়ে জামাইকে আর পাঁচজনের চেয়ে আল্লাহ চাহে তো বেশিই দেব।
রহিম শেখ সুলতান খাঁনের সমবয়সী। স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। খেলাধুলাও করেছেন। বড় হওয়ার পর থেকে এখনোও একসঙ্গে ওঠাবসা করেন। মাহবুবা যদি না আসত, তাহলে হয়তো প্রস্তাবটা মেনে নিতেন। বললেন, আপনার কথা মনে রাখব না তো কার কথা রাখব। ঠিক আছে, মাহবুবের চাকরি হওয়ার পর যখন গ্রামে আসবে তখন তাকে আপনার কথা বলব। জানেন তো, আজকাল ছেলেদের মতামত না নিয়ে কিছু করা ঠিক নয়।
রহিম শেখ বললেন, বিয়ে-শাদির ব্যাপারে ছেলে মেয়েদের মতামত নিতে ইসলামও বলেছে।
সুলতান খাঁন তাকে যখন আপ্যায়ন শেষে বিদায় দিচ্ছিলেন তখন আলাউদ্দিন মীর স্ত্রীসহ এসে স্ত্রীকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে সদরে ঢুকলেন। তারপর রহিম শেখকে দেখে প্রমাদ গুনলেন। ভাবলেন, সেও নিশ্চয় মেয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। যদি তাই হয়, তাহলে সুলতান খাঁন নিশ্চয় রাজি হবেন। কারণ তার চেয়ে রহিম শেখের বংশ অনেক উঁচু। তার সঙ্গে ওঠাবসাও করেন। মনে মনে রেগে গেলেও সৌজন্য রক্ষার জন্য। সালাম দিয়ে বললেন, কেমন আছেন রহিম ভাই?
রহিম শেখ সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ ভালই রেখেছেন। তা আপনি কেমন আছেন? বাড়ির সবাই ভালো?
হ্যাঁ ভাই ভালো।
তা কি মনে করে এসেছিলেন?
এই সুলতান ভাইয়ের খোঁজ খবর নিতে। অনেকক্ষণ হল এসেছি, এবার আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের আসার কারণ বুঝতে পেরে বিরক্তবোধ করলেও স্বাভাবিক কণ্ঠে বসতে বলে বললেন, কি খবর বলুন।
আলাউদ্দিন মীর বসতে বসতে বললেন, খবর তো আপনি বলবেন। কয়েকদিন আগে মাহবুবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এত করে বাড়িতে যেতে বললাম, গেল না। বলল, “কাল ঢাকায় চলে যাব, কাজ আছে।”
আলাউদ্দিন মীর যে আবার আসবেন তা সুলতান খাঁন জানতেন। তাই কি বলবেন ভেবে রেখেছিলেন। বললেন, দেখুন মীর ভাই, বিয়ে শাদি তকৃদিরের লিখন। আল্লাহ যার সাথে যার জোড়া রেখেছেন তার সাথেই হবে। এই গ্রামের ও ভিন গ্রামের অনেকে প্রস্তাব নিয়ে আসছে। সে কথা মাহবুবের মা মাহবুবকে বলে মতামত জানতে চেয়েছিল। তাকে বলেছে, “সে এখন বিয়ে করবে না। চাকরি বাকরি করে স্বাবলম্বী হবে, তারপর দেখা যাবে।” জানেন তো, আজকাল এসব ব্যাপারে ছেলেমেয়েরা মা-বাবার কথা রাখে না।
আপনারা কি আমার প্রস্তাবের ব্যাপারটা মাহবুবের সঙ্গে আলাপ করেছেন?
আমি করিনি, ওর মাকে করতে বলেছিলাম। সে আলাপ করে ঐ কথাই আমাকে বলল।
এমন সময় জমিরন চা-বিস্কুট নিয়ে এলে বললেন, নিন একটু চা খান।
ওদিকে মরিয়ম খাতুন ঘরের দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে একটা হাদিসের বই পড়ছিলেন। জমিরন পাশে বসে শুনছিল। গায়ে মাথায় চাদর জড়িয়ে একজন মহিলাকে আসতে দেখে বলল, চাচি আম্মা, একটা মহিলা আপনার কাছে আসছে।
মরিয়ম খাতুন বইটা বন্ধ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ তো কে?
জমিরন দাওয়া থেকে নেমে তাদের কাছে এসে বলল, কেগো আপনি?
রোশনী বিবি দাঁড়িয়ে পড়ে জমিরনের আপাদমস্তক দেখে বললেন, তুমি কে?
আমি জমিরন, এ বাড়িতে কাজ করি।
আমি মীর বাড়ি থেকে মাহবুবের আম্মার কাছে এসেছি।
আসুন আমার সঙ্গে বলে তাকে নিয়ে দাওয়ায় উঠে বলল, ইনি মীর বাড়ি থেকে আপনার কাছে এসেছেন।
মরিয়ম খাতুন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় আলাউদ্দিন মীরের স্ত্রী। সালাম দিয়ে বললেন, আসুন বসুন।
রোশনী বিবি মরিয়ম খাতুনের রূপ গুণের কথা অনেক শুনেছেন। এখন দেখে মনে হল। যা শুনেছেন বাস্তবে তার চেয়ে বেশি বই কম না। সালামের উত্তর দিয়ে তার পাশেই বসলেন। তারপর বললেন, আপনি নিশ্চয় মাহবুবের আম্মা?
হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন।
আমি কে ধরতে পারেন নি?
আপনি নিশ্চয় তাহেরার আম্মা?
রোশনী বিবি হেসে উঠে বললেন, আপনিও ঠিক ধরেছেন। আমার নাম রোশনী বিবি। আপনার নামটা বলবেন আপা?
মরিয়ম খাতুন।
সত্যিই আপনি মা মরিয়মের মতো দেখতে। আপনার রূপ গুণের কথা পাড়ার মেয়েদের কাছে অনেক শুনেছি। তাই আপনাকে দেখার ও আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা অনেক দিনের। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে তা হয়ে উঠেনি। তাই আজ তাহেরার আব্বা মাহবুবের আব্বার কাছে আসবে শুনে তার সঙ্গে এলাম। আমাকে ভিতরে পাঠিয়ে উনি সদরে গেলেন।
মরিয়ন খাতুন যা বোঝার বুঝে গেলেন। জমিরনকে বললেন, সদরে চা দিয়ে এখানেও দেওয়ার ব্যবস্থা কর।
জমিরন চলে যাওয়ার পর রোশনী বিবির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাহবুবের আব্বার মুখে আপনাদের অনেক কথা শুনেছি।
তাতো শুনবেনই। মেয়েরা তো স্বামীদের কাছেই পাড়া প্রতিবেশীর খবর শুনে থাকে। খান্দানী ঘরের মেয়েরা তো আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় না।
আমি কিন্তু একটা আব্দার নিয়ে এসেছি। শুনেছি, আপনার কাছে কেউ কোনো আব্দার করে বিমুখ হয়নি।
মরিয়ন খাতুন বুঝতে পারলেন, রোশনি বিবি লেখাপড়া জানা বুদ্ধিমতি মহিলা। মৃদু হেসে বললেন, সবাই তিলকে তাল করে বলে।
ওসব বলে আমাকে ভোলাতে পারবেন না। আমার আব্দার রাখবেন কিনা বলুন?
রোশনি বিবি যে, মাহবুবকে জামাই করার ব্যাপারে অনুরোধ করবেন তা নিশ্চিত হয়ে মরিয়ম খাতুন বললেন, এমন কিছু আব্দার করবেন না, যা রাখতে পারব না। তবে রাখার মতো হলে ইনশাআল্লাহ রাখব।
তাহেরার আব্বা মাহবুবকে জামাই করার জন্য কিছুদিন আগে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আপনি সেই প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে আমাদের ধন্য করুন আপা।
মরিয়ম খাতুন কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে বললেন, এ ব্যাপারে আমার একার কোনো হাত নেই। মাহবুব ও তার আব্বার মতামতের উপর নির্ভর করছে। নচেৎ আপনার আব্দার রাখতে পারতাম।
আমি জানি আপনার মতামত মাহবুব ও তার আব্বা মেনে নেবেন। দেশে ছেলের অভাব নেই; কিন্তু মাহবুবের মতো ছেলে লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ। আপা ভুল বুঝবেন না; তাহেরার আব্বা বিয়েতে যা কিছু দেবেন বলেছেন, তাছাড়াও আমি আমার মা-বাবার কাছ থেকে যেসব সোনাদানা পেয়েছি তাও দেব। আর আমার বাবার সম্পত্তি থেকে আমি যে দশ বিঘে জমি পেয়েছি তাও দেব। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, মেয়েটা মাহবুবকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসতে চায় না। ঐ একটা মেয়ে আমাদের, ওকে আমরা সুখি দেখতে চাই। তারপর চোখ মুছে বললেন, তাহেরা যদি আপনার মেয়ে হত, তাহলে কি করতেন এ অবস্থায় একবার ভেবে দেখুন।
এমন সময় জমিরন চা-বিস্কুট নিয়ে এলে মরিয়ম খাতুন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সদরে দিয়েছিস?
জমিরন বলল, জ্বি চাচি আম্মা দিয়েছি।
ঠিক আছে,তুই এখন যা। তারপর রোশনি বিবির দিকে তাকিয়ে বললেন, নিন আপা চা-খান।
চা-খাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন বললেন, তাহেরা আমার মেয়ে হলে আপনারা যা করছেন, আমিও হয়তো তাই করতাম। সে আপনাদের মেয়ে হলেও তার কথা যা শুনেছি, তাতে তাকে বৌ করতে আমিও চাই। কিন্তু সোনাদানা জমি-জায়গার কথা আপনারা যা বললেন, তা শুনে দুঃখ পেলাম। আল্লাহ নর-নারীকে জোড়ায় জোড়ায় পয়দা করেছেন। এটা তারই ঈশারাতে হয়। লোভ-লালসা অপবিত্র জিনিস। বিয়ে-শাদি পবিত্র জিনিস। পবিত্র জিনিসের সঙ্গে অপবিত্র জিনিস মিশে গেলে সবটাই অপবিত্র হয়ে যায়। আর লোভ-লালসা দেখিয়ে কোনো কাজ করান উচিতও নয়। আপনি বোধ হয় জানেন, আজকালের ছেলে মেয়েরা বিশেষ করে যারা শহরে লেখাপড়া করে, তারা। নিজেদের পছন্দ ছাড়া মা-বাবার পছন্দ মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না। তাহেরা যে মাহবুবকে পছন্দ করে, সে কথা মাহবুবের আব্বার মুখে শুনেছি। তাহেরার মতো ভালো মেয়েও খুব কম দেখা যায়। কিন্তু তবুও আমি আপনার আব্দার রক্ষা করতে পারব না। কারণ এবারে মাহবুবকে আপনাদের প্রস্তাবের কথা বলে মতামত জানতে চেয়েছিলাম। বলল, “তাহেরার মতো ভালো মেয়ে খুব কম হয়। তবু আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না।” কেন জিজ্ঞেস করতে বলল, “ঢাকার একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি। সেও আমাকে পছন্দ করে। এই পর্যন্ত বলে মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমাদের ঐ একটাই ছেলে, তার মতের বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করতে পারব না। ভয়। হয় বেশি জোর করলে ছেলে যদি ঐ মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকায় থেকে যায়। আজকাল ভালো ছেলে পেলে ঢাকার ধনী লোকেরা জামাই করে রুজী রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয়। এক মেয়ে হলে ঘরজামাইও রাখে।
রোশনি বিবি বললেন, কথাটা আমিও শুনেছি। তবে মাহবুবের মতো ছেলে কখনই। এরকম হবে না।
তাঁ, আমাদেরও তাই বিশ্বাস, তবু বেশি জোর খাটাতে সাহস হয় না।
রোশনি বিবি স্বামীর কাছে শুনেছিলেন, ঢাকার একটা সুন্দরী মেয়ে সুলতান খাঁর বাড়িতে এসে দুদিন থেকে গেছে। বললেন, কিছুদিন আগে যে মেয়েটা আপনাদের বাড়িতে এসেছিল, তাকেই কি মাহবুব পছন্দ করে?
মরিয়ম খাতুন বললেন, হ্যাঁ।
মেয়েটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল শুনেছিলাম, নিশ্চয় বড় লোকের মেয়ে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আপা আপনি ভেবে দেখেছেন, শহরের বড় লোকের মেয়ে কি পাড়া গাঁয়ে এসে থাকতে পারবে?
ভেবে আর কি করব আপা? তকৃদিরে যা আছে তা হবেই।
তা হলে আমি কি নিরাশ হয়ে ফিরে যাব?
আপনি মনে কষ্ট নেবেন না। তকদিরের উপরে কারোর হাত নেই। আপনারা ভালো ছেলে দেখে তাহেরার বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
রোশনী বিবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সে চেষ্টা অনেক দিন আগে থেকে করছি। তাহেরা কিছুতেই রাজি হয়নি। কিছু দিন আগে, মাহবুব যেদিন টাকা আনতে গিয়েছিল, সেদিন তার সঙ্গে তাহেরার কথাবার্তা শুনে জানতে পারি সে মাহবুবকে পছন্দ করে। আরো জানতে পারি, তার জন্যই এতদিন বিয়েতে রাজি হয়নি। জানার পর ওর আব্বাকে প্রস্তাব নিয়ে পাঠিয়েছিলাম। আজ আবার আপনাদের মতামত জানতে দু’জনে এসেছি। আপনার কথাই ঠিক, তক্বদির ছাড়া মানুষের গতি নেই। মেয়েটার ভাগ্যে-কি আছে-আল্লাহকেই মালুম। এবার আসি বলে রোশনি বিবি উঠে দাঁড়ালেন।
মরিয়ম খাতুন জমিরণকে ডেকে বললেন, সদরে গিয়ে তোর চাচার সঙ্গে যিনি কথা বলছেন, উনাকে বলবি আপনার বেগম সাহেব বাড়ি যাবেন।
ফেরার পথে আলাউদ্দিন মীর সুলতান খাঁনের সঙ্গে যা আলাপ হয়েছে স্ত্রীকে বলে বললেন, তোমার খবর কি বল,টোপ গিলেছেন?
রোশনি বিবি বললেন, টোপ গিলেছেন ঠিকই; কিন্তু কাজ হাসিল করতে পারিনি!
এ আবার কি বলছ? টোপ গিলল, অথচ কাজ হাসিল হল না?
ছেলের মা টোপ গিললে কি হবে? ছেলে তো ঢাকার একটা মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে। তোমার অনুমানই ঠিক। কিছু দিন আগে যে মেয়েটা এসেছিল, সেই মেয়েটাকেই নাকি মাহবুব পছন্দ করে। মেয়েটাও মাহবুবকে পছন্দ করে। তাই বোধ হয় সব কিছু দেখতে এসেছিল। মাহবুবের মা তো বললেন, খুব বড় লোকের মেয়ে।
আমারও তাই মনে হয়েছিল। এখন কি করবে বল!
তুমি খুব বড় ঘরের একটা ভালো ছেলের সন্ধান কর, মেয়েকে আমি রাজি করাব।
তাতো করবই। তবে আমিও সুলতান খাঁনকে ছেড়ে কথা বলল না। দু’বছরের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে তখন কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দেব।
আমি কিন্তু আশা ছাড়িনি। মাহবুবের মা টোপ যখন গিলেছেন তখন স্বামীর সঙ্গে আলাপ নিশ্চয় করবেন। আর সুলতান খাঁন যদি টোপ গিলেন, তা হলে মাহবুব মা বাপের কথা ফেলতে পারবে না।
আমার কিন্তু মনে হয় না সুলতান খাঁন টোপ গিলবেন।
সোনা-দানা, জমি-জায়গা ও টাকা পয়সার প্রতি লোভ হয়না, এমন মানুষ দুনিয়াতে আছে নাকি?
তোমার কথা অবশ্য ঠিক; কিন্তু একদম যে নেই, তা নয়। শয়ের মধ্যে দু’একজন আছে। আর আমি সুলতান খাঁনকে যতটা জানি, তিনি ঐ দু একজনের দলে।
দেখা যাক তোমার কথা কতটা সত্য। মাস খানেক পরে আমি একা আবার যাব।
.
মাহবুব এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে মাহবুবাদের বাসায় ফোন করল। কাজের বুয়া ধরে সালাম দিয়ে বলল, কাকে চান?
মাহবুবা আছে?
জ্বি আজে-একটু ধরুন ডেকে দিচ্ছি। তারপর রিসিভার পাশে রেখে মাহবুবার। কাছে-গিয়ে বলল, আপা আপনার ফোন।
মাহবুবা ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, হ্যালো মাহবুবা বলছি।
মাহবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি মাহবুব।
তাতো গলা শুনে বুঝতে পেরেছি। কি খবর বল।
একটা সুখবর শোনাবার জন্য-ফোন করেছি।
মাহবুবা জানে আজ-মাহবুব এ্যাপয়েন্টম্যান্ট লেটার পাবে। তবু না জানার ভান করে বলল, তাড়াতাড়ি শোনাও।
কি খাওয়াবে বল?
যা চাইবে তাই খাওয়াব।
যদি চুমো খেতে চাই? কথাটা আবেগে বলে ফেলে মাহবুব লজ্জিতস্বরে বলল, সরি, হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। প্লীজ, কিছু মনে করোনা।
মাহবুবা হাসতে হাসতে বলল, কিছু মনে করব কেন? তুমি পারলে খেও। না পারলে শরিয়ত মত ব্যবস্থা কর। এবার সুখবরটা বল।
চাকরিটা পেয়ে গেলাম। দু’একদিনের মধ্যে-জয়েন করতে বলেছে।
চাকরিটা করবে নাকি?
করব।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে বেতন সম্মান জনক?
হ্যাঁ, শুধু তাই নয়, সেই সাথে গাড়ি ও কোয়াটার।
তাহলে তো খাওয়াতেই হয়।
না-না, তুমি খাওয়াবে কেন? আমারই তো খাওয়ানো-উচিত।
তাহলে বললে কেন?
খুশিতে।
আমিও খুশিতে খাওয়াতে চাচ্ছি।
ঠিক আছে, কাল সকালে চলে এস, তুমি ব্রেক ফাস্ট করাবে, আমি লাঞ্চ করাব।
ছেলেরা সব সময় আগে থাকতে চায়।
ইসলাম কিন্তু তাই বলে।
আর ইসলাম যে সমান অধিকারের কথা বলেছে?
তা বলেছে, সেই সাথে নারীদেরকে রক্ষা করার কথাও পুরুষদেরকে বলা হয়েছে। পুরুষদের রক্ষার জন্য নারীদেরকে বলা হয়নি। রক্ষাকারী আগে থাকে, পিছনে নয়।
তুমি না, খুব সামান্য কথা-নিয়েও তর্ক কর।
কি জানি, হয় তো হবে। এখন কিন্তু তুমি প্রথমে তর্ক শুরু করেছ।
তোমার সঙ্গে কথায় পারব না, হার মানছি।
তাহলে কাল নিশ্চয় আসছ?
ইনশাআল্লাহ আসব।
এবার রাখি বলে মাহবুব সালাম বিনিময় করে ফোন রেখে দিল। তারপর চাকরির খবরটা মাসুমকে জানাবার জন্য তার মেসে গেল।
মাসুম মেসেই ছিল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে মাসুম বলল, নিশ্চয় কোনো সুসংবাদ শোনাতে এসেছিস?
মাহবুব বলল, কি করে বুঝলি? দুঃসংবাদও তো হতে পারে?
তা হতে পারে, তবে তোর চোখ মুখ দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
হ্যাঁ, তোর কথা ঠিক। আল্লাহ পাকের অসীম দয়ায় আমি একটা ভালো চাকরি পেয়েছি।
আলহামদুলিল্লাহ বলে মাসুম তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই খুব ভাগ্যবান।
আর তোর বুঝি দুর্ভাগ্য?
তা নয় তো কী? পরীক্ষার পর বাড়ি গিয়েছিলাম, বেশি দিন থাকতে পারলাম না। পালিয়ে এলাম।
মাহবুব আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বলল, পালিয়ে এলি মানে?
মানে আব্বা আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাই পালিয়ে এলাম, তুই তো জানিস, ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট। তুই-ই বল; উপার্জনের কিছু ব্যবস্থা না করে কি বিয়ে করা উচিত?
তা অবশ্য উচিত নয়; কিন্তু তোর আব্বা যখন চাচ্ছেন তখন নিশ্চয় এর মধ্যে। কোনো কারণ আছে।
তোর অনুমান ঠিক; আব্বা-আম্মা এবছর হজে যাবেন, তাই আমার বিয়ে দিতে চান। আমি বেকার অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি না হতে বললেন, মেয়ের বাবা আমাকে ঢাকায় ব্যবসা করে দেবেন।
এটা তো খুব ভালো কথা, তুই রাজি হলি না কেন?
তুই এত ব্রিলিয়েন্ট হয়ে স্টুপিডের মতো কথা বলতে পারলি? আরে স্টুপিড, যে মেয়ের বাবা জামাইকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা করে দেবে, সেই মেয়ে যে কত ভালো হবে, তুই বুঝতে পারছিস না কেন? তা ছাড়া যারা শশুরের কাছ থেকে এরকম। সুযোগ গ্রহণ করে, তাদের দলে আমি নেই। আর লেন-দেনের শর্তে বিয়ে করা ইসলামের নিষেধ, তা তুই তো আমার চেয়ে ভালো জানিস।
এসব কথা তুই মা-বাবাকে জানাতে পারতিস?
তা আর জানাই নি; কিন্তু তারা আমার কথা কানেই নেয় না। বলেন, আমরা তো শর্ত দিইনি। ছেলে বেকার জেনে মেয়ের বাবাই বলেছে।
তা হলে তো তোর মা-বাবার কোনো দোষ নেই। জানিস না, মা-বাবার কথার অবাধ্য হতে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) নিষেধ করেছেন?
তা জানব না কেন? তাদেরকে দোষও দিচ্ছি না। আমার নিজের একটা প্রিনসিপল আছে না? তা ছাড়া যাকে নিয়ে সারা জীবন চলব তাকে পছন্দ হতে হবে তো।
তুই মেয়ে দেখেছিস?
তাকে ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি।
তোদের আত্মীয়ের মধ্যে নাকি?
মামাতো বোন।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, সে কথা আগে বললেই পারতিস। এত প্যাচাল পাড়ার কী দরকার ছিল বাবা? তা হরে, মামাতো বোনকে তোর পছন্দ নয় কেন বল তো?
কিছু মনে করিস না, সেটা আমাদের পরিবারিক ব্যাপার, বলতে পারব না। তাছাড়া বলাটাও উচিত হবে না। শুধু এটুকু বলতে পারি, জেনে শুনে কেউ ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে না।
মাহবুব যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, এখন কি করবি ভেবেছিস?
কি আর করব, আসার সময় অপারগতার কথা জানিয়ে, মাফ চেয়ে চিঠি লিখে রেখে এসেছি। আরো জানিয়েছি, যতদিন না কিছু একটা করতে পারছি, ততদিন বাড়ি ফিরব না। আসবার সময় প্রায় খালি হাতে এসেছি, কিছু টাকা দিতে পারবি?
মাহবুব পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, এটা এখন রাখ, পরে দেখা করিস বেশি করে দেব।
দু’টো টিউশনী জোগাড় করেছি। আর দু’একটা হলে টাকার চিন্তা থেকে রেহাই পেতাম। তোর সন্ধানে যদি থাকে জানাস।
ঠিক আছে, তুই আমার কাছে আসিস জানাব। এবার গলা ভেজাবার ব্যবস্থা কর। তোর সাথে প্যাচাল পেড়ে পেড়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
চা খেয়ে মাহবুব বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরল।
আজ সকাল থেকে মাসুমের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। মাহবুব চলে যাওয়ার পর বেশি খারাপ লাগতে লাগল। রাতে বেশ জ্বর উঠল। জ্বরে প্রায় এক সপ্তাহ ভুগে সুস্থ হয়ে একদিন বিকেলে কলাবাগানে মাহবুবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। কলিংবেল বাজাতে কান্তা দরজা খুলে মাসুমকে চিনতে পেরে বলল, স্যারের খোঁজে নিশ্চয় এসেছেন?
তাকে দেখে প্রথম দিনের মতো আজও মাসুম মুগ্ধ হল। তার কথার উত্তর না দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।
কান্তা তার উত্তর না পেয়ে রেগে গেল। রাগতস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি কী লেখাপড়া করেন না?
রেগে গেলে কান্তাকে আরো সুন্দর দেখায়। সেইদিন প্রমাণ পেয়ে মাসুম ইচ্ছা করে আজও তার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। কয়েক সেকেণ্ড সৌন্দর্য উপভোগ করে মৃদু হেসে বলল,রাগলে আপনাকে খুব সুন্দর দেখায়।
কান্তা আরো রেগে গিয়ে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে ইডিয়েট বলে দরজা বন্ধ করতে গেল।
মাসুম হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে দরজার পাল্লায় ঠেস দিয়ে বলল, মহৎ লোকেরা ইডিয়েটদের অন্যায় ক্ষমা করে থাকেন। তারপর হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা চাইছি। এবার আপনাদের স্যারকে ডেকে দিন।
মাসুম ক্ষমা চাইতে কান্তার রাগ পড়ে গেল। বলল, স্যার তো আর এখানে থাকেন না। দুতিন দিন আগে চলে গেছেন।
কোথায় গেছে জানেন?
স্যার একটা কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছেন। কোম্পানী থাকার জন্য কোয়াটার দিয়েছে।
ঠিকানা জানেন?
আমি জানি না, তবে মা হয়তো জানেন। আপনি দাঁড়ান, মাকে জিজ্ঞেস করে আসি। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বলল, স্যারের খোঁজে একটা ছেলে এসেছে। ছেলেটা কিছুদিন আগেও একবার এসেছিল। তখন স্যার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। স্যার এখান থেকে চলে গেছে বলতে কোথায় গেছেন ঠিকানা জানতে চাচ্ছেন।
সায়মা বেগম মেয়ের স্বভাব জানেন। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছিস?
না, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
সায়মা বেগম রাগের সঙ্গে বললেন, তোকে কতবার বলেছি, কেউ বাসায় এলে তাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে কথা বলবি। বড় হলি, কলেজে পড়ছিস, তবু এই জ্ঞানটা আর হল না। যা, ছেলেটাকে ড্রইংরুমে এনে বসা, আমি আসছি।
কান্তা ফিরে এসে মাসুমকে বলল, ভিতরে আসুন মা আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বসতে বলে বলল, স্যার আপনার কি হয়?
বন্ধু। আমরা ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। এক সঙ্গে অনেক দিন একই মেসে থেকেছি।
কান্তা চমকে উঠে বলল, ছিঃ ছিঃ! না জেনে আপনাকে অনেক কিছু বলে অপমান করেছি। ক্ষমা করে দিন। কি জানেন, কেউ যখন আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলে তখন আমি খুব রেগে যাই। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যাতা বলে ফেলি। চেষ্টা করেও এই বদঅভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি।
মাসুম বুঝতে পারল, মেয়েটা খুব সরল; কিন্তু মাথা গরম। বলল, ঠিক আছে কিছু মনে করিনি। বললাম না, আপনাকে রাগাবার জন্য ইচ্ছে করে প্রশ্নের উত্তর দিইনি।
এমন সময় সায়মা বেগম পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকলেন।
মাসুম দাঁড়িয়ে সালাম দিল!
সায়মা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, মাহবুব স্যার আমার ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। আপনি তার কে?
মাসুম একটু আগে কান্তাকে যা বলেছিল, তাই বলল।
সায়মা বেগম মেয়েকে চা নিয়ে আসতে বলে মাসুমের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাহবুব স্যার চাকরি পেয়ে কয়েক দিন আগে কোম্পানীর কোয়াটারে চলে গেছেন। তারপর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা তার ঠিকানা।
মাসুম কাগজটা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, এবার আসি।
সায়মা বেগম বললেন, আর একটু বসুন, চা খেয়ে যাবেন। মাসুমকে দেখে ও তার কথাবার্তা শুনে সায়মা বেগমের ভালো লাগল। ভাবলেন, একে ছেলেমেয়েদের টিউটর হিসাবে রাখতে পারলে ভালো হত। তাই চা খাওয়ার পর মাসুমকে বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, মাহবুব স্যারকে আমাদের বাসায় একবার আসতে বলবেন।
জ্বি বলব বলে মাসুম সেখান থেকে বেরিয়ে মাহবুবের অফিসে গেল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে মাসুম বলল, এই কদিন জ্বরে ভুগলাম। আজ কলাবাগান গিয়ে জানতে পারলাম, তুই সেখানে আর থাকিস না। তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এলাম।
মাহবুব বলল, সে কথা জানাবার জন্য আমিই তোর কাছে যাব-যাব করেও সময় করে উঠতে পারিনি। তারপর জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছিস?
কাল থেকে জ্বর নেই। তোকে যে ছাত্র জোগাড় করে দিতে বলেছিলাম, তার কি করলি? তা না হলে তোর অফিসেই একটা ব্যবস্থা করে দে।
সে চেষ্টা তো করবই। কিছু দিন সময় লাগবে এই যা। আর ছাত্রের কথা যে বললি, সে ব্যাপারে মাহবুবাকে বলেছিলাম। বলল, তোমার পুরানো জায়গায় মাসুম ভাইকে ব্যবস্থা করে দাওনা। তুই যদি চাস ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
চাই না মানে? কথাটা তুই না বললে, আমিই বলতাম। কান্তার মা তোকে যেতে বলেছেন।
কান্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?
হয়েছে।
কেমন বুঝলি? ও কিন্তু একটু উগ্র মেজাজের মেয়ে। সামলাতে পারবি তো?
তুই যখন পেরেছিস, ইনশা-আল্লাহ আমিও পারব।
ঠিক আছে, আজই ওদের বাসায় যাব। তুই নিশ্চিত থাক, ইনশাআল্লাহ ব্যবস্থা করে দিতে পারব। তারপর এক হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, কান্তাদের বাসা হয়ে আজই তোকে খবরটা দিতে যাব।
মাসুম টাকাটা পকেটে রেখে বলল, তোর অসুবিধা হবে না তো?
প্রথম দিনই কোম্পানী এক মাসের বেতন এ্যাডভান্স দিয়েছে। আরো লাগলে বল।
না-না, আর লাগবে না। সেদিন পাঁচশ দিলি, আজ আবার এক হাজার দিলি কি না, তাই বললাম। যাক, এবার আসি হলে?
আর একটু বস, কিছু আনাই। খেয়ে যাবি।
নারে কিছু খাব না। জ্বর হয়ে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু খেতে পারি না। সব তিতা লাগে।
কিছু ফল কিনে নিয়ে যা, খেতে ভালো লাগবে। ডাক্তার দেখিয়েছিস?
হ্যাঁ দেখিয়েছি। তারপর বলল, আমারকাছে আসতে তোর বোধ হয় সন্ধ্যে হয়ে যাবে?
হ্যাঁ, মাগরিবের নামাযের পর যাব।
মাসুম সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরল।
.
অফিস ছুটির পর মাহবুব কান্তাদের বাসায় গেল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর আপ্যায়ন করার সময় সামাদ সাহেব বললেন, আপনি তো চাকরি পেয়ে কোম্পানীর কোয়াটারে চলে গেলেন। এদিকে ছেলে-মেয়ের সামনে পরীক্ষা। এত তাড়াতাড়ি ভালো টিচার পাওয়াও মুশকিল। ওরা তো টিচারের জন্য আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আপনার জানাশোনা কেউ থাকলে ব্যবস্থা করে দিন।
স্বামীর কথা শেষ হতে সায়মা বেগম বললেন, আজ সকালের দিকে আপনার এক বন্ধু আপনার খোঁজে এসেছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, আপনারা নাকি একসঙ্গে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন, একই মেসে থেকেছেন? বেশ ভালো ছেলে বলে মনে হল। তাকে ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না।
সায়মা বেগমের কথা শুনে মাহবুব মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, হ্যাঁ, ওর নাম মাসুম। আমার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। ওর মতো ভালো ছেলে খুব কম হয়। আমি বললে না করতে পারবে না। ঠিক আছে, ওর সঙ্গে কথা বলে দু’একদিনের মধ্যে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।
মাসুমের সঙ্গে আলাপ করে কান্তারও ভালো লেগেছে। স্যারের কথা শুনে খুব খুশি হল। মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, ভুলে যাবেন না তো স্যার?
মাহবুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে খুশির আভা দেখে বুঝতে পারল,মাসুমকে কান্তার পছন্দ হয়েছে। একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে তার হাতে দিয়ে বলল, কাল পরশুর মধ্যে.যদি না আসি, তা হলে ফোন করে স্মরণ করিয়ে দিও। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাসুমের মেসে রওয়ানা দিল।
ছয়
মাহবুব আজ তিন মাস চাকরি করছে। চাকরি পাওয়ার কথা চিঠি দিয়ে মা-বাবাকে জানিয়েছে। পনের দিন আগে কোম্পানী তাকে জাপান পাঠিয়েছিল। গতকাল ফিরেছে! আজ অফিসে এসে লাঞ্চ আওয়ারে মাহবুবার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের বাসায় ফোন করল।
শামিমা বেগম ফোনের কাছে ছিলেন। রিং হতে শুনে রিসিভার তুলে বললেন, হ্যালো কাকে চান?
মাহবুব বুঝতে পারল, মাহবুবার মা-ফোন ধরেছেন। সালাম দিয়ে বলল, খালাআম্মা, আমি মাহবুব বলছি, মাহবুবাকে একটু দিন।
শামীমা বেগম বললেন, হাতের কাছে-কাগজ-কলম আছে?
জ্বি আছে।
শামিমা বেগম মাহবুবার নাম্বার দিয়ে বললেন, ওকে এই নাম্বারে পাবে। তারপর বললেন, তুমি আসনি কেন? একদিন এস কেমন?
জ্বি আসব বলে লাইন কেটে দিয়ে মাহবুব ভাবল, কি ব্যাপার? মাহবুবা কী অন্য কোথাও আছে? তারপর শামীমা বেগমের দেওয়া নাম্বারে ফোন করল।
রিং বেজে উঠতে মাহবুবা ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, মাহবুবা বলছি।
মাহবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তাতো বুঝতে পারছি; কিন্তু তুমি এখন কোথায়?
কেন? বাসায়।
মাহবুব অবাক কণ্ঠে বলল, বাসায়?
জ্বি বাসায়।
তোমাদের তাহলে দুটো ফোন?
আগে ছিল না। কয়েকদিন আগে বাবা আমার জন্য এই ফোনটা নিয়েছেন।
তাই বল। আমি আগের নাম্বারে ফোন করতে খালাআম্মা ধরেছিলেন। নাম্বার দিয়ে বললেন, “এই নাম্বারে ফোন কর ওকে পাবে।” আমি মনে করেছিলাম, তুমি অন্য কারো। বাসায় গেছ। যাকগে, কেমন আছ বল?
আল্লাহর রহমতে ভালো তুমি?
আমিও তোমার মতো।
কবে ফিরলে? জানালে এয়ার পোর্টে যেতাম।
ফেরার ঠিক ছিল না, তাই জানাতে পারিনি। কাল বিকেলে ফিরেছি। শোন, দু’একদিনের মধ্যে বাড়ি যাব।
কত দিনের ছুটি পেয়েছ?
চার দিনের।
অফিসে তো একদিনও যেতে বললে না, কাল আসব? দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
কাল নয়, বাড়ি থেকে আসি তারপর।
কেন কাল গেলে কি হয়?
পনের দিন ছিলাম না, অনেক কাজ জমে আছে। বাড়ি যাওয়ার আগে পর্যন্ত ব্যস্ত থাকব।
তাহলে কখন দেখা হবে বল।
ঠিক বলতে পারছি না।
মনে হচ্ছে তোমার দাম খুব বেড়ে গেছে।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, তাই মনে হচ্ছে বুঝি?
হচ্ছে বলেই তো বললাম।
সবার কাছে বাড়লেও তোমার কাছে নয়।
তাহলে দেখা করার কথা বলতে ব্যস্ততার অজুহাত দেখাচ্ছ কেন?
নতুন চাকরি ঠিক মতো কাজ করতে হবে না?
মাহবুবা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, এখন কাজের ক্ষতি হচ্ছে না?
লাঞ্চ আওয়ার এখনো শেষ হয়নি। এই শোন, কাল সকাল আটটার মধ্যে কোয়াটারে আসবে। এক সঙ্গে নাস্তা করব।
মাহবুবা গলা ভার করে বলল, যাব না।
কেন?
তুমি বড় নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুরের প্রেমে পড়লে কেন?
বড় চাকরি পেয়ে খুব ভাট বেড়ে গেছে দেখছি।
ছোট করে দাও।
কি বকমবাজ লোকরে বাবা! কোনো কথাতেই যদি হারাতে পারি।
হারাতে যখন পারছ না তখন নিশ্চয় কাল সকালে আসছ?
ছেলেরা মেয়েদেরকে হারিয়ে আনন্দ পায়।
মেয়েরাও পায়, তুমি পারছ না বলে ছেলেদের দোষ দিচ্ছ। আসবে কিনা বল।
মাহবুবা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, হয়েছে বাবা হয়েছে, আসব। কোয়াটারের ঠিকানা বল।
ঠিকানা বলে মাহবুব বলল, সময় শেষ। তারপর সালাম বিনিময় করে রিসিভার রেখে দিল।
.
পরের দিন সকালে মাহবুবের কোয়াটারে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নাস্তার টেবিলে এলে শামীমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন কিরে কোথাও যাবি নাকি?
মাহবুবা বলল, হ্যাঁ, মাহবুবের কোয়াটারে নাস্তা খাব। জাপান থেকে ফিরে কাল ফোন করে যেতে বলেছে।
শামীমা বেগম বললেন, ওকে আসতে বলবি।
বলব বলে মাহবুবা বেরিয়ে গেল।
মাহবুবের কোয়াটারে পৌঁছে দেখল, সে অফিস যাওয়ার ড্রেস পরে বারান্দায় বসে পেপার পড়ছে। সালাম দিয়ে বলল, বোধ হয় একটু দেরি করে ফেললাম।
সালামের উত্তর দিয়ে মাহবুব ঘড়ি দেখে বলল, হ্যাঁ পাঁচ মনিট। তারপর বসতে বলে বুয়াকে ডেকে নাস্তা দিতে বলল।
বুয়া নাস্তা নিয়ে এলে তাকে মাহবুব বলল, মেহমানের ড্রাইভারকে ড্রইংরুমে বসিয়ে চা নাস্তা দিয়ে এস।
বুয়া চলে যাওয়ার পর খেতে শুরু করে মাহবুবা বলল, মা-তোমাকে-যেতে বলেছে। আজ বিকেলে যাবে নাকি?
গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসে একদিন যাব। আমি চাকরি করছি তোমার মা-বাবা জানেন?
হ্যাঁ, আমি বলেছি।
তোমাকে ফোন করার পর এম. ডি. ডেকে পাঠিয়ে বললেন, বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর ছয় মাসের কোর্সে পড়াশোনা করার জন্য আমেরিকা পাঠাবেন। পাশ-পোর্টের জন্য কয়েক কপি ফটোও দিতে বললেন।
তাই নাকি? এটাতো খুব ভালো সংবাদ, তা তুমি কি বললে?
বললাম, বাড়ি থেকে ফিরে জানাব।
বাড়ি থেকে ফিরে কেন?
বারে, আব্বা আম্মার অনুমতি নিতে হবে না? তা ছাড়া তোমারও মতামত আছে।
তোমার মা বাবা যা বলবেন আমিও তাই বলব।
গতকাল আম্মার চিঠি পেয়েছি, কি লিখেছে-জান?
বললে জানব কি করে? ওঁনারা ভালো আছেন?
হ্যাঁ। লিখেছে-যত শিঘ্রী সম্ভব দু’একদিনের জন্য হলেও তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।
নেবে নাকি সঙ্গে?
না।
আমি যেতে চাইলেও নেবে না?
না।
কেন?
অনেক কারণ। তার মধ্যে প্রধান ও প্রথম কারণ হল, বিয়ের আগে এভাবে যাওয়া শক্ত-গোনাহ। দ্বিতীয় কারণ হল, এটা খুব অশোভনীয়। তৃতীয় কারণ হল, গ্রামের লোকের কাছে আমাদের বংশের সম্মান ছোট হয়ে যাবে। তাছাড়া কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব?
তা হলে বিয়ে করেই নিয়ে চল?
বিয়ে করতে খুব সখ হচ্ছে বুঝি?
হওয়াটা কি অন্যায়?
না, তা কেন?
তোমার হচ্ছে না?
হচ্ছে।
ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে রুমালে মুছতে মুছতে মাহবুবা বলল, তাহলে আজ কালের মধ্যে-বিয়ে করে ফেলি এস। ঐ যে কথায় আছে না, বিবি-মিয়া রাজি, তো কেয়া করে গা কাজি। কথাটা শেষ করে হেসে উঠল।
মাহবুবও হেসে উঠে বলল, হলে ভালই হত; কিন্তু সম্ভব নয়।
কেন সম্ভব নয়?
কারণটা তোমার অজানা নয়।
তা জানি, তবে আমার যাওয়ার ব্যাপারে একটা উপায় আছে।
কিছু না বলে মাহবুব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
যাওয়ার আগে আমরা কাবিন করে নিতে পারি।
মাহবুবেরও খাওয়া শেষ। হাত মুখ ধুয়ে কেতাল থেকে চা ঢেলে এক কাপ তাকে দিয়ে নিজেও এক কাপ নিল। তারপর চুমুক দিয়ে বলল, তাও সম্ভব নয়। আম্মা আব্বাকে না জানিয়ে কিছুই করতে পারব না।
তুমি কি মা-বাবার অনুমতি না নিয়ে কিছুই কর না?
না। কারণ সন্তানের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে মাতা-পিতা অসন্তুষ্ট হন। মাতা পিতার প্রতি কর্তব্যকে রাসুলুল্লাহ (দঃ) আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের পরেই স্থান দিয়েছেন। মাতার স্থান পিতার উর্ধ্বে স্থাপন করা হইয়াছে। কোরআনে আল্লাহপাক বলিয়াছেন, “আর আমি মানুষকে তাহার পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহার করিতে নির্দেশ দিয়াছি। তাহার মাতা তাহাকে অতি কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করিয়াছে এবং অতি কষ্টে প্রসব করিয়াছে। আর তাহাকে গর্ভে ধারণ করাও দুধ ছাড়ান, ত্রিশ মাস।” [সূরা-আহক্বাফ ১৫নং আয়াতের প্রথম অংশ পারা ২৬।] হাদিসে। আছে, “এক ব্যক্তি রাসুল (দঃ) কে জিজ্ঞাসা করিল, সন্তানের উপর পিতা-মাতার কি হক (দাবি) আছে? তিনি বলিলেন, তাহারা উভয়েই তোমার বেহেস্ত ও তোমার দোযযাখ।” [বর্ণনায়: হযরত আবু ওমামাহ (রাঃ)-মিশকাত।] এখন তুমিই বল, সব কিছুতে পিতা মাতার অনুমতি নেওয়া উচিত কিনা।
ঠিক আছে, এবার তাদের অনুমতি নিয়ে আসবে।
অনুমতি নিতে হবে না। সময় মতো তারাই ব্যবস্থা করবে। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, আর সময় দিতে পারছি না। অফিসের টাইম হয়ে গেছে। চল তোমাকে গাড়িতে তুলে দিই।
মাহবুবার গাড়ি চলে যাওয়ার পর মাহবুব গাড়ি নিয়ে অফিসে গেল।
.
আনিস সাহেব সপ্তাহে দু’দিন চিটাগাং অফিসে বসেন। গতকাল সেখান থেকে ফিরেছেন। আজ সকালে মাহবুবা বেরিয়ে যাওয়ার পর নাস্তা খেয়ে মাহবুবের ব্যাপারে কি ষ্টেপ-নিয়েছেন, সে সব স্ত্রীকে বলছিলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে-মাহবুবাকে ফিরতে দেখে কাছে ডেকে বসতে বললেন। বসার পর জিজ্ঞেস করলেন, কিছু এগুতে পারলি?
মাহবুবা বলল, খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে। তারপর বিয়ের ব্যাপারে যা কথা বার্তা হয়েছে বলে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার বলল, পুকুরের টাকাটা কি ভাবে কি করবে ভেবেছ?
আনিস সাহেব বললেন, তুই চিন্তা করিস না। ওকে ছ’মাসের জন্য-আমেরিকা পাঠাচ্ছি। ছ’মাসের বেতন ও ট্রাভেল এলাউন্স বাবদ-প্রায় দেড় লাখ টাকা ওর বাবার কাছে-পাঠাবার ব্যবস্থা করব। ঐ টাকায় ওর বাবা নিশ্চয় পুকুরের টাকা শোধ করে দেবেন। শোন, মাহবুব আমেরিকা থেকে ফিরে এলে কোম্পানীর ডাইরেক্টরপদে-প্রমোশন দেওয়ার ব্যবস্থা করব। তারপর তোদের বিয়ে দেব। এর মধ্যে আমাদের যা কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আছে সব তোদের দু’জনার নামে-ফিফটি ফিফটি উইল করে দেব।
মাহবুবা ভায়ার্তস্বরে বলল, কিন্তু ও যদি টের পেয়ে যায়। তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছ?
তা আর ভাবি নি? তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি এমন ব্যবস্থা করব, বিয়ের পাঁচ দশ বছরের মধ্যে টের পাবে না। তারপর টের পেলেও মনে হয় সব কিছু মেনে নেবে।
তুমি ওকে চেনো না বাবা। ওর আত্মসম্মান জ্ঞান প্রচণ্ড। পাঁচ দশবছর পর কেন, যদি বিশ ত্রিশ বছর পরেও জানতে পারে আমরা ওকে হাত করার জন্য এই সমস্ত করেছি, তাহলে তখনও আমাকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে। তোমার এত ঐশ্বর্যও ধরে রাখতে পারবে না।
তোর কথা অস্বীকার করব না! তবে কি জানিস মা, এই পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরে কম লোকের সঙ্গে ওঠা বসা করিনি। ঐশ্বর্য এমন জিনিস, একে ত্যাগ করার মতো কাউকেই। দেখিনি।
কিন্তু বাবা, তুমি দেখনি বলে যে, তেমন কেউ নেই, এটা ভাবা ঠিক নয়। তাছাড়া….।
মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে আনিস সাহেব বললেন, তা আমিও জানি। যদি সত্যিই মাহবুব সেই ধরণের ছেলে হয় এবং সে রকম কিছু ঘটে, তাহলে স্ত্রী হিসাবে তাকে কন্ট্রোল করার দায়িত্ব তোর।
মাহবুবা বলল, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব তাকে ধরে রাখার। যদি ব্যর্থ হই, তোমরা কষ্ট নিও না। উইলের ব্যাপারে যা বললে, সে সব বিয়ের পরে করো। আর করারই বা দরকার কি? আমি তোমাদের ঐশ্বর্য চাই না, শুধু মাহবুবকে চাই। তোমাদের ঐশ্বর্য আমাদের মধ্যে যেন বিচ্ছেদ সৃষ্টি না করে, সেই ব্যবস্থা করো।
একমাত্র সন্তানের কথা শুনে আনিস সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, তাই হবে মা, তুই যা চাস তাই হবে।
মাহবুবা মায়ের পাশে বসেছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কিছু বলছ না কেন মা?
মেয়ের ও স্বামীর কথা শুনে শামীমা বেগম রেগে গেলেন। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একটা গ্রাম্য ছেলের জন্য মেয়েকে নিয়ে তুমি যা করছ, তা কোনো জ্ঞানী লোক করে না। আমার মতে কোনো কিছু গোপন না করে মাহবুব ও তার মা-বাবাকে জানিয়েই সব করা উচিত। তাতে যা ঘটার ঘটবে। মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেল না। তুমি মেয়ের বাবা হতে পার, আমিও যে মা, সে কথা ভুলে যাচ্ছ কেন। আর এটাও নিশ্চয় জান, মাহবুব গ্রামের ছেলে জানার পর থেকে তাকে ঠিক পছন্দ করতে পারি না।
স্ত্রী যে লম্পট ভাইপোকে জামাই করতে চায়, তা আনিস সাহেব জানেন। তাই স্ত্রীর কথায় রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বললেন, মাহবুব গ্রামের ছেলে হতে পারে, কিন্তু শহরের ছেলেদের মতো লম্পট নয়। তোমার লম্পট ভাইপো রাজনীতি করে আমার এত কষ্টের অর্জিত সম্পত্তি উড়িয়ে দেবে, তা হতে দিচ্ছি না। একটা কথা জেনে রেখ, মাহবুবের সঙ্গে মাহবুবার বিয়ে না হলেও তোমার ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে দেব না। কথা। শেষ করে তিনি রুমে চলে গেলেন।
মাহবুবা এতদিন জানত, মাহবুব গ্রামের ছেলে বলে মা তাকে পছন্দ করে না। আজ বাবার কথা শুনে মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। মামাতো ভাই রানা এম.এ. পাশ করেছে। দেখতে শুনতেও ভালো। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়ার সময় পার্টি পার্টি করে চরিত্র বলতে তার এখন কিছু নেই। পাশ করার পরও নোংরা রাজনীতি করে বেড়ায়। এইসব কথা মাহবুবাও জানে। বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভিজে গলায় বলল, আমার জন্য বাবার সঙ্গে তোমার মনোমালিণ্য। বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই আমার ভালো। শোন মা, একটু আগে তো বললাম তোমাদের ঐশ্বর্য আমি চাই না। তুমি তোমার অংশের সবকিছু রানা ভাইকে দিও। আর। বাবাকেও বলব, তার সব কিছু দেশের কোনো মহৎ কাজে ব্যয় করতে। তাতেও তুমি যদি মাহবুবকে জামাই করতে না চাও, তবে ভাতে বিষ মাখিয়ে দিও। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, তোমাদের মনে ব্যথা দিয়ে আমি সুখি হতে চাই না। আজই মাহবুবের। কাছে শুনলাম, হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন “মা বাবার সন্তুষ্টিই বেহেস্তের পথ, আর তাদের অসন্তুষ্টি দোযখের পথ।”
স্বামীর কথা শুনে শামীমা বেগম খুব রেগে গেলেও মেয়ের কথা শুনে ও তাকে কাঁদতে দেখে রাগ পড়ে গেল। তার মন ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল, একমাত্র মেয়ের সুখের জন্য মা হয়ে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়। নিজের নিষ্পাপ মেয়েটাকে লম্পট ভাইপোর। সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করাও পাপ। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, তুই আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিস মা, আমি আর তোর বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে মনোমালিন্য করব না। তার কোনো কাজে বাধাও দেব না। তুই যাতে সুখি হস, তাই করব।
মাহবুবা মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, যাই, বাবাকে তোমার কথা বলে আসি।
সাত
সুলতান খাঁন ও মরিয়ম খাতুন ছেলে ভালো চাকরি পেয়েছে জেনেছেন, কিন্তু সেই সাথে কোম্পানী গাড়ি দিয়েছে জানতেন না। তাকে গাড়ি নিয়ে আসতে দেখে খুব অবাক হলেন।
মাহবুব মা-বাবাকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে কুশল বিনিময় করল।
মরিয়ম খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কোম্পানীর গাড়ি বুঝি?
হ্যাঁ, কোম্পানী গাড়ির ব্যবসায়ী। এটা আমার ব্যবহারের জন্য দিয়েছে। শুধু তাই নয়, থাকার জন্য কোয়ার্টারও দিয়েছে।
ঠিক আছে, তুই কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
মাহবুব যখন নাস্তা খাচ্ছিল তখন সুলতান খাঁন এসে পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চিঠিতে লিখেছিলে জাপান যাবে, গিয়েছিলে?
জ্বি আব্বা, গিয়েছিলাম। পনের দিন থেকে তিন চার দিন হল ফিরেছি। কোম্পানী সামনের মাসে আমাকে আমেরিকায় একটা কোর্সে ট্রেনিং নিতে পাঠাতে চায়। আমি তোমাদের অনুমতি নেওয়ার কথা বলে বলেছি, বাড়ি থেকে ফিরে এসে জানাব।
সুলতান খাঁন বললেন, কোম্পানী তোমার উন্নতির সুযোগ দিচ্ছে; আমরা অনুমতি দেব না কেন? আল্লাহ তোমাকে কামিয়াব করুক।
মরিয়ম খাতুন বললেন, দোয়া করি আল্লাহ তোর আরো উন্নতি দিক, তোকে সহিসালামতে রাখুক। আমেরিকা যাওয়ার আগে আর আসবি না?
ঠিক বলতে পারছি না। নূতন চাকরি ঘন ঘন ছুটি দেবে কিনা জানি না। যদি দেয়, তাহলে দু’একদিনের জন্য হলেও তোমাদের দোয়া নিতে আসব। তারপর খাওয়া শেষ হতে রুম থেকে কাগজে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট এনে মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এতে দু’মাসের বেতন বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা আছে। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রয়োজন হলে খরচ করবেন। আমেরিকা থেকে ফিরে ইনশাআল্লাহ আলাউদ্দিন মীরের সব টাকা এক সঙ্গে দিয়ে দেব।
সুলতান খাঁন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, বেতনের সব টাকা দিয়ে দিচ্ছ তোমার কিছু লাগবে না।
না আব্বা, বেতন ছাড়াও বিভিন্ন এলাউন্স পাই। তাতে আমার খরচ চলে যায়।
সুলতান খাঁন বললেন, আজ রাত্রে আলাউদ্দিন মীরের মেয়ের বিয়ে। রাজশাহীর উচ্চ ফ্যামিলির ছেলে। ঢাকায় প্রফেসারী করেন। গ্রামের ধনী-গরিব সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। আলাউদ্দিন মীর নিজে এসে যাওয়ার জন্য বলে গেছেন।
কথাটা শুনে মাহবুব খুব খুশি হয়ে চুপ করে রইল।
সুলতান খাঁন ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বললেন, গ্রামের কাজ, সবাই আসবে, আমিও যাব ভাবছি।
মাহবুব বলল, যাবেন না কেন? নিশ্চয় যাবেন।
মরিয়ম খাতুন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই যাবি না?
না আম্মা, আমি যাব না।
সুলতান খাঁন এশার নামাযের পর আলাউদ্দিন মীরের বাড়ি চলে গেলেন।
মরিয়ম খাতুন, ছেলেকে নিয়ে ভাত খাওয়ার সময় বললেন, এত চিঠি দিলি, একটাতেও মাহবুবার কথা লিখলি না। তার সঙ্গে দেখা করিস নি?
করেছি।
টাকাটা দিয়েছিস?
হ্যাঁ।
মরিয়ম খাতুন ভাবলেন, টাকা যখন নিয়েছে তখন দু’জনের মধ্যে নিশ্চয় যোগাযোগ আছে। জিজ্ঞেস করলেন, তুই ওদের বাসায় যাস?
মাহবুব মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, অনেক দিন আগে ওর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মাত্র একবার গিয়েছিলাম, ও মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করে। আমরা ফোনেও কথা বলি।
ওর মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
প্রথম যেদিন ওদের বাসায় গিয়েছিলাম তখন হয়েছিল। তারপর আর যাইনি। অসুখ হয়ে যখন ক্লিনিকে ছিলাম, তখন তারা দু’তিনবার দেখতে এসেছিলেন।
একটা কথা তোকে বলা হয়নি, মাহবুবা এসে দুদিন থেকে যেদিন ফিরে গেল তার আগের দিন তোর আব্বা ছয়-সাত কেজি ওজনের একটা রুই মাছ ছিপ ফেলে ধরেছিলেন। যাওয়ার সময় জ্বাল দেওয়া সব মাছ তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছি। মাহবুবা অবশ্য প্রথমে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। তোর আব্বা যখন বললেন, তোমরা নদীর বরফ দেওয়া মাছ খাও, পুকুরের টাটকা মাছের স্বাদ শহরের লোক কি জিনিস জানে না, তখন আর না করল না।
আব্বা ঠিক কথাই বলেছেন, পুকুরের মাছের স্বাদ শহরের মানুষ জানে না। তারপর লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলল, মাহবুবার মা আসার আগের দিন বাসায় যেতে বলেছিলেন। আমি বলেছি বাড়ি থেকে ফিরে যাব।
বেশতো যাবি।
কিন্তু তারা যদি আমার মতামত……লজ্জায় মাহবুব কথা শেষ করতে পারল না। ততক্ষণ খাওয়া শেষ হয়েছে। মাথা নিচু করে মুখ হাত ধুতে লাগল।
মরিয়ম খাতুন ছেলের না বলা কথাটা বুঝতে পারলেন। তার আগেই খাওয়া শেষ হয়েছিল, ছেলের মুখ হাত ধোয়া শেষ হতে বঁটা বাসন পেয়ালা সরিয়ে নেওয়ার সময় বললেন, মাহবুবাকে আমারও খুব পছন্দ। মনে হয় তোর আব্বাও অমত করবেন না। মতামত জানতে চাইলে জানাবি। ওকে যে সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্য চিঠিতে জানিয়েছিলাম, সে কথা জানিয়েছিলি?
হ্যাঁ।
আসতে চায় না, না তুই নিয়ে এলি না?
আসতে চেয়েছিল, আমি আনিনি।
নিয়ে এলি না কেন? মেয়েটা খুব সুন্দর। বার বার দেখতে ইচ্ছা করে।
আম্মা, তুমি যে কি? বার বার এলে লোকে কি বলবে? ওসব কথা রেখে যা বলছি শোন, আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর মাহবুবার মা-বাবা হয়তো বিয়ের কথা বলবেন। তুমি আব্বার সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে জানাবে।
মরিয়ম খাতুন শোকর আল-হামদুলিল্লাহ বলে বললেন, তোর আব্বা শুনে খুব খুশি হবেন। ঠিক আছে, আমি তার সঙ্গে কথা বলে তোকে জানাব।
সুলতান খাঁন রাত বারটার সময় বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসে স্ত্রীকে হাদিস পড়তে দেখে সালাম বিনিময় করে বললেন, মাহবুব ঘুমিয়েছে?
মরিয়ম খাতুন হাদিস শরীফটা তাকের উপর রেখে বললেন, জ্বি ঘুমিয়েছে। তারপর বললেন, বিয়ের কাজ ভালো ভাবে মিটেছে?
হ্যাঁ মিটেছে। তারপর বললেন, পাত্রের সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, দেখে তাই মনে হল। দোয়া করি তাহেরাকে আল্লাহ সুখী করুক।
মরিয়ম খাতুন বললেন, এবার মাহবুবের বিয়ের কথা চিন্তা করুন।
তা-তো করবই। আমরা তাহেরাকে বৌ করতে রাজি হলাম না বলে আলাউদ্দিন মীর খুব ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিলেন, তার মেয়ে ফেলনা নয়। মাহবুব আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর ইনশাআল্লাহ আমরাও ছেলের বিয়েতে যা করব, তা তার চেয়ে কম হবে না।
এটা কিন্তু আপনি ঠিক বললেন না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আলাউদ্দিন মীরের উপর আপনার জেলাস হয়েছে। আমাদের নবী (দঃ) কারো প্রতি জেলাস হতে নিষেধ করেছেন।
তওবা পড়ে সুলতান খাঁন বললেন, আল্লাহ মাফ করুক। হাদিসটা মনে ছিল না। তুমি আমাকে অনেক বড় গোনাহ থেকে বাঁচালে। এই জন্যেই আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল ধার্মিকা স্ত্রী।” [বর্ণনায়: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-মুসলিম।] তারপর বললেন, কালকেই হাফিজ ঘটককে মাহবুবের জন্য মেয়ের খোঁজ নিতে বলব।
তা না হয় বললেন; কিন্তু তার আগে মাহবুব ঢাকার কোনো মেয়েকে পছন্দ করে কিনা জানা দরকার নয় কি?
সুলতান খাঁনের মাহবুবার কথা মনে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুব কি তোমাকে কিছু বলেছে?
জ্বি বলেছে। মাহবুবা নামে ঢাকা থেকে যে মেয়েটা এসেছিল তার কথা নিশ্চয় আপনার মনে আছে?
তা থাকবে না কেন; কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, “সে খুব বড় লোকের একমাত্র মেয়ে। তাই মেয়েটা মাহবুবকে পছন্দ করলেও মাহবুব তাকে এড়িয়ে চলে।”
তা বলেছিলাম। তখন পুকুরের ব্যাপার নিয়ে মাহবুবের মন খুব খারাপ ছিল, তাই এড়িয়ে চলত। এখন তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। তারপর মাহবুব যা বলতে বলেছিল বললেন।
সুলতান খাঁন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
কিছু বলছেন না কেন? মাহবুবাকে কী আপনার পছন্দ হয়নি?
মাহবুবা অপছন্দ করার মতো মেয়ে নয়। ভাবছি, কোটিপতি বাবা কী একমাত্র মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দেবেন? তাছাড়া মেয়ে কী শহরের আয়েশ-আরাম ছেড়ে গ্রামে আসতে চাইবে? ভয় হয়, শেষে যদি ছেলে শহরে থেকে যায়?
কথাটা আমিও যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু মাহবুব যখন ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তখন আমাদের বাধা দেওয়া কি উচিত হবে?
হ্যাঁ, সেটাই তো চিন্তা করছি।
মরিয়ম খাতুন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মা হিসাবে তোমার চেয়ে আমি মাহবুবকে যতটুকু জানি, সে আমাদেরকে ফেলে বৌ নিয়ে শহরে কিছুতেই থাকবে না।
সুলতান খাঁন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তা আমিও জানি। তবু যেন কেমন ভয় লাগছে। আজকাল গ্রামের অধিকাংশ ছেলেই শহরে পড়তে গিয়ে চাকরি পাওয়ার পরে থেকে যাচ্ছে। ন-মাসে-ছ-মাসে এক-আধবার বৌ-ছেলে মেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসে। মা-বাবা কত কষ্ট করে ছেলেকে শহরে লেখাপড়া করতে পাঠায়। তাদের খোঁজ খবর কটা ছেলেই বা রাখে? শিক্ষিত ছেলেরা শহরে থেকে যাচ্ছে; তাই গ্রামের কোনো উন্নতিও হচ্ছে না।
মরিয়ম খাতুন বললেন, আপনার কথা অবশ্য ঠিক। তবে মাহবুব যে সে রকম করবে না, তাতে আমি নিশ্চিত। তাকে কি বলব বলুন। সে আপনার মতামত জানতে চেয়েছে।
সুলতান খাঁন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি তো জান, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া রেখেছেন, মিলন তার সঙ্গে হবেই। ওদের দুজনকে যদি আল্লাহ জোড়া করে পয়দা করে থাকেন, তাহলে আমরা বাধা দিলেও হবে। শুধু শুধু অমত করে ছেলের মনে কষ্ট দেব কেন?
আমিও আপনার সঙ্গে একমত। তারপর মরিয়ম খাতুন বললেন, এবার ঘুমিয়ে পড়ন রাত হয়েছে। যা বলার আমি মাহবুবকে বুঝিয়ে বলব।
.
মাহবুব ঢাকায় ফিরে এসে পরের দিন মাহবুবাকে ফোন করল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে মাহবুবা জিজ্ঞেস করল, কবে ফিরেছ?
কাল।
আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে মা-বাবা অনুমতি দিয়েছেন?
হ্যাঁ, দিয়েছেন।
কতদিনে যাচ্ছ তাহলে?
পাসপোর্ট ভিসা হয়ে গেলেই যাব।
আজ বিকেলে আমাদের বাসায় এস।
একা যেতে পারব না, তুমি এস, তোমার সঙ্গে যাব।
ঠিক আছে, ক’টায় আসব?
পাঁচটায়।
এবার রাখি তাহলে?
ঠিক আছে বলে মাহবুবা সালাম বিনিময় করে ফোন রেখে দিল। তারপর বাবার কাছে গিয়ে দেখল, সেখানে মাও আছে। বলল, মাহবুব ফোন করেছিল। কাল ফিরেছে। বিকেলে ওকে নিয়ে আসব।
. আনিস সাহেব বললেন, ভালই হল। কয়েকদিনের মধ্যে ওকে আমেরিকায় পাঠাচ্ছি। আজ তোদের বিয়ের ব্যাপারে ওর সঙ্গে আলাপ করব ভাবছি।
বিয়ের কথা শুনে মাহবুবা লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু বাবা, ওর মতের উপর কোনো চাপ সৃষ্টি করো না যেন।
আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, সেকথা তোকে বলে দিতে হবে না।
.
মাহবুবা পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি থাকতে মাহবুবের অফিসের গেটের সামনের রাস্তার উল্টো দিকে গাড়িতেই অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক পাঁচটা পাঁচ মিনিটের সময় তাকে গেট থেকে বেরোতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলল, আপনি বাসায় চলে যান।
মাহবুব গেটের বাইরে এসে গাড়িতে ওঠার আগে চারদিকে তাকিয়ে দেখার সময় মাহবুবাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে মৃদু হাসল।
মাহবুবাও ততক্ষণে মাহবুবকে দেখতে পেয়েছে। তাকে মৃদু হাসতে দেখে সেও, মৃদু হেসে হাত তুলল।
মাহবুব গাড়ি নিয়ে তার কাছে এসে পাশের গেট খুলে দিল। তারপর সালাম দিয়ে বলল, উঠে এস।
মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
মাহবুব গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমার মা-বাবা ভালো আছেন?
হ্যাঁ ভালো, আছে।
আমার আমেরিকা যাওয়ার কথা ওঁনারা জানেন?
তুমি ফোন করার পর আমি বলেছি।
আজ তোমাকে নিয়ে বেড়াতে খুব ইচ্ছা করছে।
ঠিক আছে বাসায় নাস্তা খেয়ে তারপর না হয় বেড়াতে যাব।
মাহবুব কিছু না বলে গাড়ি চালাতে লাগল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাহবুবা বলল, তুমি কী অসন্তুষ্ট হলে?
মাহবুব তার মুখের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, প্রেমিকার সঙ্গে তাদের বাসায় যেতে কেউ অসন্তুষ্ট হয় বুঝি?
তা হলে কিছু বলছ না কেন?
একটা কথা ভাবছিলাম।
কি কথা?
তোমার না শোনাই ভালো।
ভালো নাই হোক, তবু শুনব।
তুমি তো খুব জেদী মেয়ে।
জেদী কিনা জানি না, তবে আমি যা ভালো বুঝি, তা করেই ছাড়ি।
তা অবশ্য আমি অনেক আগেই বুঝেছি।
তাহলে কথাটা বলছ না কেন?
বললে আমার মতো তুমিও ভাবতে শুরু করবে।
তবু বল, প্লীজ।
এম.ডি সাহেব বললেন, দশ বারো দিনের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা রেডি হয়ে যাবে। শোনার পর তোমাকে ছেড়ে আমেরিকায় যেতে মন চাইছে না।
তার কথা শুনে মাহবুবা খুব খুশি হল। ভাবল, এতদিন আর্থিক কারণে তাকে এড়িয়ে চললেও এখন আগের থেকে আরো বেশি গভীরভাবে ভালবাসে। সে ভাবটা গোপন করে ম্লান মুখে বলল, তোমার আমেরিকা যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে আমার মাথায়ও ঐ কথা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে।
ততক্ষণে তারা বাসার গেটে পৌঁছে গেল। দারোয়ান সালাম ঠুকে গেট খুলে দিতে মাহবুব গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকল।
মাহবুবা গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বলল, একটু বস আসছি। তারপর বাবার কাছে গেল।
আনিস সাহেব মেয়েকে দেখে বললেন, কিরে, মাহবুব আসেনি?
এসেছে, তাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছি।
ঠিক আছে তুই যা, আমি তোর মাকে নিয়ে আসছি।
মাহবুবা ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর আনিস সাহেব ও শামীমা বেগম ড্রইংরুমে এলেন।
মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আনিস সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, দাঁড়ালে কেন বস। তারপর নিজেরাও বসলেন।
মাহবুবা আসছি বলে ড্রইংরুমের বাইরে এসে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।
আনিস সাহেব কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললেন, মাহবুবার কাছে শুনলাম, তুমি কাল গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেছ, তোমার মা-বাবা ভালো আছেন?
মাহবুব বলল, জ্বি ভালো আছেন।
শুনলাম, ভালো চাকরি পেয়েছ। তা কেমন লাগছে?
জ্বি ভালো।
কোম্পানী তোমাকে নাকি আমেরিকা পাঠাচ্ছে?
জ্বি।
আমরা তোমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানি। তাই আমেরিকা যাওয়ার আগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই। ভাবছি, দু’একদিনের মধ্যে তোমাদের গ্রামে গিয়ে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলব। এ ব্যাপারে তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পার।
মাহবুব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন তা সম্ভব নয়। আমেরিকা থেকে ফেরার পর যা করার করবেন।
বেশ, তাই হবে। আচ্ছা, তোমার মা-বাবা কী তোমাদের সম্পর্কের কথা জানেন?
জ্বি, জানেন।
আমাদের সম্পর্কেও?
জ্বি।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মাহবুবাকে পুত্রবধু করতে তাদের কোনো অমত নেই; তাই না?
জ্বি।
ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করব না।
মাহবুবা এতক্ষণ দরজার বাইরে থেকে তাদের কথা শুনছিল। আয়াকে নাস্তার ট্রে নিয়ে আসতে দেখে সেও তার সঙ্গে ভিতরে ঢুকল।
নাস্তা খাওয়ার পর মাহবুবা বলল, বাবা, আমি একটু ওর সঙ্গে বাইরে যাব।
বেশ তো যাও।
মাহবুব তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে মাহবুবাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাওয়া যায় বলতো?
মাহবুবা বলল, এ সময়ে কোনো পার্কেই তিল ধারণের জায়গা পাওয়া মুশকিল। তার চেয়ে সংসদ ভবনে চল।
মাহবুব গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, সেখানেও একই অবস্থা। তবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে।
সংসদ ভবনের সামনে মাঠের একপাশে গাড়ি পার্ক করে দু’জনে কিছুক্ষণ হাঁটল।
তারপর মাহবুবা বলল, একটু বসলে হত, ক্লান্তি লাগছে।
মাহবুব বলল, বেশ তো গাড়ির কাছেই বসি চল।
বসার পর মাহবুবা বলল, বাবার ও তোমার সব কথা দরজার আড়াল থেকে শুনেছি।
আমার কথা শুনে তুমি কী মনে কষ্ট পেয়েছ?
কষ্ট পাব কেন? বরং খুশি হয়েছি। তবে, বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
থামলে কেন? তবে কি বলবে তো।
আমি বাবার সঙ্গে একমত ছিলাম।
মাহবুব মৃদু হেসে বলল, ছিলাম বলছ কেন? এখন মত পাল্টে গেছে নাকি?
হ্যাঁ, তোমার মতামত শুনে পাল্টে ফেললাম। আমার একটা আব্দার রাখবে?
সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় রাখব। তোমার আব্দার রাখব না তো কার রাখব?
আগে প্রমীশ কর।
প্রমীশ করে যদি রাখতে না পারি, তাহলে গোনাহগার হয়ে যাব। তাছাড়া বললাম না, সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় রাখব?
আমেরিকা যাওয়ার আগে মাত্র একরাতের জন্য তোমাকে একান্ত করে পেতে চাই। প্রমীশ করছি, ব্যাপারটা আজীবন গোপন রাখব।
এ তুমি কী বলছ? বিয়ে ছাড়া এটা তো সম্ভব নয়। আর বিয়ে যে এখন কেন আমি করতে পারব না, তা তো তুমি জানই।
জানি। বিয়ে যেভাবে হয়, সেভাবে না করে আমরা কাজি অফিসে করতে পারি। তাই তো আজীবন গোপন রাখার কথা বললাম। তুমি আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর গার্জেনরা তাদের মতো করে আমাদের বিয়ে দেবেন।
মাহবুব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা হয় না মাহবুবা। তুমি পারলেও আমি মা-বাবাকে গোপন করে কিছু করতে পারব না। প্লীজ মাহবুবা, আমাকে ক্ষমা কর। এটা ছাড়া অন্য কিছু আব্দার কর, প্রাণের বিনিময়ে হলেও আমি তা পূরণ করব।
মাহবুবা প্রেমের আবেগে কথাটা বলেনি, মাহবুবকে ক্যাপচার করার প্রথম স্টেপ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। তার কথা শুনে বুঝতে পারল, সে মনে ব্যথা পেয়েছে। সেই ব্যথা মাহবুবার মনেও আঘাত করল। তাই তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ভিজে গলায় বলল, কথাটা বলে আমি অপরাধ করেছি, তার উপর ক্ষমা চেয়ে আমাকে আরো বেশি অপরাধী করো না। আমি কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছি। বল আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?
মাহবুব তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, অপরাধ মানুষ মাত্রই করে। যারা তা বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় তারা মহৎ।
মাহবুবা বলল, আর যারা ক্ষমা প্রার্থিকে ক্ষমা করে তারা আরো মহৎ।
মাহবুব ঘড়ি দেখে বলল, চল এবার ফেরা যাক, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে।
আট
আমেরিকা থেকে ফেরার পর দশটা বছর মাহবুবের স্বপ্নের মতো কেটে গেল। কোম্পানীর ডাইরেক্টর হওয়া, মাহবুবাকে বিয়ে করা ও বিয়ের তিন বছর পর আতিয়ার জন্ম, সবকিছু যেন স্বপ্ন বলে মাহবুবের মনে হয়। এই দশ বছর ঢাকায় চাকরি করলেও প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে গেছে। গ্রামের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছে। দুতিন মাইলের মধ্যে হাইস্কুল থাকলেও কলেজ ছিল আট নয় মাইল দূরে। তাই নিজেদের গ্রামে একটা ডিগ্রী কলেজ করেছে। মক্তব ছাড়া কোনো মাদ্রাসা ছিল না। মক্তবটাকে হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও একটা দাখিল মাদ্রাসা করেছে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পাঠাগার করেছে। গ্রামের গরীব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প, ডেইরীফার্ম, হাঁস-মুরগীর চাষ ও মাছের চাষের ব্যবস্থা করেছে। অশিক্ষিত নারী-পুরুষদের শিক্ষিত করার জন্য আলাদা আলাদা নাইট স্কুলের ব্যবস্থা করেছে।
আতিয়ার চার বছর বয়স পর্যন্ত মাহবুবা বছরের বেশির ভাগ সময় শ্বশুড়বাড়িতে থেকেছে। আতিয়াকে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করানোর পর মাহবুবা ঢাকায় থাকলেও মা বাবার কাছে থাকেনি। স্বামীর কোয়ার্টারে থাকে। অবশ্য প্রায় প্রত্যেক দিন অনেকটা সময় মা-বাবার কাছে কাটিয়ে আসে।
একদিন আনিস সাহেব মেয়েকে বললেন, তুই তো বলেছিলি মাহবুবকে ক্যাপচার করে নিবি। তোর সুখের জন্য আমরা যা কিছু করেছি আজকাল কেউ করেছে কিনা জানি না। কিন্তু এতদিনেও তুই তাকে ক্যাপচার করতে পারলি না। বরং সেই তোকে ক্যাপচার করে নিয়েছে। এখনো তাকে সবকিছু জানাতে পারলি না। এমন কি এ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও করতে পারলি না। আর কতদিন এসব গোপন রাখবি? আমার শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। ভাবছি, তুই যখন তাকে জানাতে পারলি না তখন আমিই জানিয়ে সব কিছুর দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দেব।
এই দশ বছরের মধ্যে মাহবুবা অনেকবার সব কিছু জানাবার কথা ভেবেছে; কিন্তু জানার পর সে যদি তার উপর রাগ-অভিমান করে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়, সেই ভয়ে জানাতে পারেনি। তারও খুব ইচ্ছা,–বাবার সঙ্গে এ বাড়িতে থাকার। কিন্তু ঐ একই কারণে তা স্বামীর কাছে প্রকাশ করতে পারেনি। এখন বাবার কথা শুনে দীর্ঘনিশ্বাস। চেপে রেখে বলল, না বাবা, তুমি কিছু বলল না; আমিই বলব।
বেশ, তুই যখন বলবি বলছিস তখন আর আমি বলব না।
.
ঐদিন ফিরে এসে মাহবুবা চিন্তা করে ঠিক করল, আজই সবকিছু জানাবে।
বেলা তিনটের সময় স্বামীকে মন খারাপ করে হন্তদন্ত হয়ে ফিরতে দেখে মাহবুবার বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভাবল, আমি জানাবার আগেই সবকিছু জেনে গেল নাকি? মনের ভাবটা সামলে নিয়ে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? শরীর খারাপ করেছে নাকি?
মাহবুব বলল, আমার কিছু হয়নি। আব্বার ভীষণ অসুখ, আম্মা লোক পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক্ষুনি রওয়ানা দেব। আতিয়াকে আনার জন্য ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে পাঠিয়েছি; তুমি তৈরি হয়ে নাও।
.
আনিস সাহেব ও শামীমা বেগমের ইচ্ছা ছিল, মেয়ে জামাইকে কাছে রাখার। কিন্তু তা যখন হল না তখন মনের ইচ্ছা মনে চেপে রেখেছিলেন। তারপর নাতনি আতিয়া হওয়ার পর দু’জনে পরামর্শ করেছিলেন, পাঁচ-ছ’বছরের হলে তাকে নিজেদের কাছে রাখবেন। তাই সে ক্লাশ থ্রীতে ওঠার পর কথাটা মেয়ে জামাইকে শামীমা বেগম জানান।
শ্বশুর-শ্বাশুড়ী মনে কষ্ট পাবে ভেবে মাহবুব বলেছিল, আতিয়া থাকতে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি কী বল?
মাহবুবা মা-বাবার মনের কথা আগেই জানত। বলল, তুমি যা বললে, সেটা আমারও কথা।
আতিয়া নানা-নানির খুব ভক্ত। তাকে যখন মাহবুবা জিজ্ঞেস করল, তুমি নানা নানির কাছে থাকবে? তখন আতিয়া বলল, দিনের বেলা থাকব আর রাতে তোমাদের কাছে থাকব।
এভাবে একবছর থাকার পর এ বছর ফোরে উঠে আতিয়া নিজেই একদিন মা বাবাকে বলল, দু’জায়গায় থাকলে পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারি না। এবার থেকে নানুর কাছে রাতেও থাকব।
মাহবুব বা মাহবুবা আপত্তি করেনি।
মাহবুবা ফোন করে মাকে বলল, আমার শ্বশুরের কঠিন অসুখের খবর নিয়ে লোক এসেছে। আমাদের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গেছে আতিয়াকে আনার জন্য, পাঠিয়ে দিও। আমরা এক্ষুনি রওয়ানা দেব। তারপর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে তৈরি হওয়ার সময় চিন্তা করল, এখন কিছু বলা ঠিক হবে না, ফিরে এসে জানাবে।
বাড়িতে পৌঁছাতে মাহবুবদের রাত নটা বেজে গেল। আব্বার মুমূর্ষ অবস্থা দেখে মাহবুব মাকে বলল, আব্বার অসুখের কথা আগে জানাওনি কেন?
মরিয়ম খাতুন ভিজে গলায় বললেন, কয়েকদিন আগে জ্বর ও আমাশা হয়েছিল। ডাক্তারের ঔষধ খেয়ে কমেছিল। হঠাৎ পরশু থেকে খুব জ্বর উঠে অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন, রোগটা অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। বাড়িতে থাকলে বিপদ হতে পারে। রূপপুর হাসপাতালে বা ঢাকায় চিকিৎসা করাবার ব্যবস্থা করুন। তাই কাল নাইট কোচে তোকে নিয়ে আসার জন্য জলিলকে পাঠিয়েছি।
মাহবুবের বড় বোন মাহফুজা ও দুলাভাই সেখানে ছিল। মা থেমে যেতে মাহফুজা বলল, আমাদেরকেও আগে জানাইনি। গতকাল খবর পেয়ে এসেছি।
মাহবুব বলল, কাল সকালেই আব্বাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। কিন্তু রাতেই অজ্ঞান অবস্থায় সুলতান খাঁন মারা গেলেন।
লাশের গোসল দেওয়ার সময় মাহবুবা স্বামীকে বলল, ঢাকায় মা-বাবাকে খবর দেবে না?
মাহবুব বলল, দাফন করার পর দেব।
মাহবুবা বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন? খবর দিলে মা-বাবা তো আসতেন। বাবা দাফনে শরীক হতেন।
তোমার কথা ঠিক, তবে কি জান, ওঁদের অপেক্ষায় থাকলে আজ আর দাফন করা যাবে না। হাদিসে আছে, “লাশ বেশিক্ষণ রাখতে নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করা উচিত। আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করে লাশ রেখে দেওয়া উচিত নয়।” আবার কেউ অন্য দেশে মারা গেলে, সেখান থেকে লাশ নিয়ে এসে নিজের দেশে দাফন করে। এটাও ঠিক নয়। নিয়ম হল, যে দেশে যে মারা যায়, সেই দেশেই তার দাফন করা।
মাহবুবা বলল, একথা আমি জানতাম না।
কয়েকদিন পর গ্রামের সবাইকে আব্বার কুলখানির দাওয়াত দেওয়ার সময় মাহবুব আলাউদ্দিন মীরের বাড়িতে গিয়ে চাকর রহিমকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা আছেন?
রহিম বলল, না।
ওঁর ছেলেরা কেউ নেই?
না।
ঠিক আছে, পরে আসব বলে ফিরে আসতে লাগল।
রহিম জানত, তাহেরা আপা মাহবুব ভাইকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তার মা-বাবা জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়েছে। ছুটে মাহবুবের সামনে এসে বলল, আপা। আছেন, কেন এসেছেন তাকে বলবেন?
মাহবুব বলল, হ্যাঁ বলব। তারপর রহিমের সঙ্গে ফিরে আসার সময় জিজ্ঞেস করল, তোমার আপা শ্বশুর বাড়ি থেকে কবে এসেছে?
রহিম বলল, আপা তো অনেক বছর হয়ে গেল এখানেই আছে।
মাহবুব বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন?
আপনি কী আপার ব্যাপারে কিছু শোনেন নি?
নাতো; কি ব্যাপার বলত?
বিয়ের তিন বছরের মধ্যে দুলাভাই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন। সেই থেকে আপা এখানে।
কথাটা শুনে মাহবুবের মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
“ইন্নালিল্লাহ…..রাজিউন” পড়ে বিষণ্ণ মুখে বলল, তাই নাকি? এতদিনেও আমি কথাটা শুনলাম না?
ততক্ষণে তারা সদরের কাছে এসে পড়েছে। রহিম বলল, আপনি সদরে বসুন, আপাকে ডেকে দিচ্ছি। তারপর বাড়ির ভিতরে গিয়ে তাহেরাকে বলল, আপা, খান বাড়ির মাহবুব ভাই চাচার কাছে এসেছিলেন। চাচা নেই শুনে আবার আসব বলে চলে যাচ্ছিলেন, আপনি আছেন বলতে সদরে এসে বসেছেন।
মাহবুবের বিয়ের ওলিমায় সুলতান খাঁন গ্রামের ধনী গরিব সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেন। তাহেরা মায়ের মুখে শুনেছিল, মাহবুবের মা-বাবা তাকে পছন্দ করলেও মাহবুব ঢাকার এক মেয়েকে পছন্দ করে। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাহেরাকে তারা বৌ করতে পারেননি। সেই মেয়ে কেমন দেখার জন্য ওলিমার দিন গোপনে মাহবুবদের বাড়ি গিয়েছিল। মাহবুবাকে দেখে তার মনে হয়েছিল। এরকম রূপসী মেয়েকে ফেলে মাহবুব তাকে ভালবাসবে কোন দুঃখে। নিজের দুঃখ চেপে রেখে সেদিন তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেছিল।
স্বামী মারা যাওয়ার পর আজ প্রায় সাত আট বছর হতে চলল তাহেরা বাপের বাড়িতে রয়েছে। মাহবুব গ্রামের উন্নতির জন্য যা কিছু করেছে বাবা ও ভাইদের মুখে শুনেছে। অনেকবার ইচ্ছা হয়েছে তার সঙ্গে ও তার বৌ এর সঙ্গে দেখা করার; কিন্তু করেনি। তারপর দ্বিতীয় বার মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল সুলতান খাঁন মারা যাওয়ার দিন। সেই দিন নাহবুব তাকে না দেখলেও সে মাহবুবকে দেখেছিল। তবে তার স্ত্রী মাহবুবার। সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। আজ এত বছর পর রহিমের মুখে মাহবুব আব্বার সঙ্গে কথা বলতে এসে তার সঙ্গে দেখা করবে শুনে মনে পুলক অনুভব করল। বলল, তুই তোর কাজে যা, আমি আসছি।
রহিম চলে যাওয়ার পর সামান্য প্রসাধন করে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে একগ্লাস সরবত ও একগ্লাস পানি নিয়ে সদরে এল তারপর সালাম দিয়ে বলল, মাহবুব ভাই, কেমন আছ?
মাহবুব তাকে আজ প্রায় একযুগ পরে দেখল। সালামের উত্তর দিয়ে তার আপাদমস্তক দেখতে লাগল। তখনকার তাহেরা এখন আর নেই। বেশ মোটা হয়েছে, রং ও যেন ফুটেছে। কিন্তু মুখে হাসি হাসি ভাব থাকলেও বেদনার ছাপ স্পষ্ট।
চোখে চোখ পড়তে তাহেরা জিজ্ঞেস করল, অমন করে কি দেখছ মাহবুব ভাই? কেমন আছ বললে না যে?
মাহবুব দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, ভালো আছি। আব্বা মারা গেছেন শুনেছ নিশ্চয়?
হ্যাঁ শুনেছি। আম্মার সঙ্গে সেদিন চাচাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তা আব্বার কাছে কি মনে করে?
কুলখানির দাওয়াত দিতে।
কবে করবে?
সামনের শুক্রবারে।
ঠিক আছে, আব্বা ঘরে এলে বলব। এবার মুখে পানি দিয়ে সরবতটা খেয়ে নাও। গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দিতে বেরিয়ে রোদে মুখ শুকিয়ে গেছে।
মাহবুব সরবত খেয়ে বলল, তোমার খবরটা আগে শুনিনি। আজ একটু আগে রহিমের কাছে শুনলাম। শুনে খুব দুঃখ পেলাম। তোমাকে সমবেদনা জানাবার ভাষা আমার নেই। একটা কথাই জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না বল?
তুমি যত কঠিন কথা বল না কেন, কিছু মনে করব না, নিশ্চিন্তে বল।
এভাবে সারাজীবন কাটাবে কি করে? চাচা-চাচি কী আবার তোমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি?
অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমি রাজি হইনি।
কিন্তু কেন? তুমি কি মনে কর, এভাবেই জীবন কাটাতে পারবে?
তা জানি না। আল্লাহ আমার তকদিরে যা লিখেছেন তাই হবে। এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
ভাবিকে না পেলে তুমি কী করতে?
মাহবুব বুঝতে পারল, তাহেরা আজও তাকে ভালবাসে। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
তাহেরা বলল, জানি, এ প্রশ্নের উত্তর তুমি দিতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখ, পুরুষেরা প্রেমিকাকে না পেলে দুঃখ পায়, কিন্তু বিয়ে করে সুখেই সংসার করে। একসময় প্রেমিকাকে ভুলেও যায়। আর মেয়েরা যাকে একবার মন দেয়। তাকে আজীবন ভুলতে পারে না, সম্ভব হলে আজীবন তার জন্য অপেক্ষা করে।
মাহবুব বলল, তোমার কথা অস্বীকার করব না। তবে সব পুরুষ সমান নয়। আর মেয়েদের মধ্যেও কম বেশি এরকম আছে। তার প্রমাণ তুমি নিজেই। কাউকে যদি ভালবেসেই ছিলে, তবে বিয়ে করেছিলে কেন?
তাহেরা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, বিয়ে আমি করিনি, মা-বাবা জোর করে দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলাম কিনা আল্লাহ জানেন। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে তাই করতাম। আর এটা তো তুমি জান, মেয়েরা পুরুষদের হাতে বন্দী। এখনও মা বাবা ও ভাইভাবিরা আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্টা করছে না। আমি সাফ বলে দিয়েছি, বেশি বাড়াবাড়ি করলে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।
এটা তোমার অন্যায়। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীদের বিয়ে করা ইসলামে নিষিদ্ধ বা দোষের কিছু নয়।
তা আমিও জানি। কিন্তু আমি কেন করছি না তা আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। আমার কথা থাক, ভাবি ও মেয়ে কেমন আছে?
ভালো বলে মাহবুব বলল, এবার আসি। চাচাকে কথাটা জানাতে ভুলো না। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
তাহেরা তার চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল জানতে পারল না। এক সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
রহিম যখন তাহেরাকে মাহবুবের আসার কথা বলে তখন রোশনি বিবি রান্নাঘরে ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে তাহেরাকে দেখতে না পেয়ে কাজের মেয়ে শাহেদাকে জিজ্ঞেস করল, তাহেরা কোথায়?
শাহেদা বলল, আপা সদরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।
রোশনি বিবি কয়েকবার তাহেরার নাম ধরে ডেকে সাড়া না পেয়ে সদরে গিয়ে দেখলেন, সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বললেন, কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?
মায়ের গলা পেয়ে তাহেরা তাড়াতাড়ি চোখ মুখ মুছে বলল, না, কিছু হয়নি।
তুই নাকি কার সঙ্গে কথা বলছিলি? কে এসেছিল?
মাহবুব ভাই চাচার কুলখানির দাওয়াত দিতে এসেছিল।
রোশনি বিবি মেয়ের কান্নার কারণ বুঝতে পারলেন। প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হবে। ভেবে বললেন, তোর আব্বা ফিরলে আমি তাকে বলব। যা গোসল করতে যা, এক্ষুনি। জোহরের আযান হবে। কথা শেষ করে ফিরে আসার সময় বিড় বিড় করে বললেন, আল্লাহ গো, ওর মন থেকে মাহবুবের কথা ভুলিয়ে দাও।
.
খবর পেয়ে কুলখানিতে আনিস সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে এলেন। এক সময় আনিস সাহেব স্ত্রীর সামনে মেয়েকে বললেন, তোর শ্বশুরের মৃত্যুর খবরটা মাহবুব দিল না কেন? দিলে আমি অন্ততঃ দাফনে শরীক হতে পারতাম।
মাহবুবা বলল, আমি তোমাদেরকে খবর দিতে বলেছিলাম। তারপর হাদিসগুলো শুনিয়ে বলল, এই জন্য তোমাদেরকে খবর দেয়নি।
আনিস সাহেব আর কিছু বললেন না। তিন চার দিন থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন।
আব্বা মারা যাওয়ার প্রায় বিশ পঁচিশ দিন পর মাহবুব স্ত্রীর সামনে মাকে বলল, কাল আমরা ঢাকা যাব। কয়েকদিন থেকে অফিসের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চাকরি ছেড়ে একেবারে চলে আসব।
মরিয়ম খাতুন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, এতবড় চাকরিটা ছেড়ে চলে আসবি; কাজটা কি ঠিক হবে?
ঠিক বেঠিক আমি বুঝি না। আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন, তাতে ইনশাআল্লাহ আমাদের ভালোভাবে চলে যাবে। আব্বাকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। গ্রামের সব কিছুর দায়িত্ব তাঁর উপর ছিল। এখন আমাকেই তো সে সব দেখাশোনা করতে হবে। তাছাড়া এখানে তোমাকে একা ফেলে রেখে আমরা কিছুতেই ঢাকায় থাকতে পারব না।
তবু তোর চাকরি ছাড়া ঠিক হবে না। আমার জন্য তোরা কোনো চিন্তা করিস না। তুই তো প্রত্যেক মাসেই আসিস। বৌও মাঝে মাঝে এসে থাকে। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তুমি কী বল বৌমা বলে মরিয়ম খাতুন মাহবুবার দিকে তাকালেন।
স্বামীর কথা শুনে মাহবুবা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। শাশুড়ীর কথায় সাহস পেয়ে বলল, আমি আপনার সাথে একমত। তারপর বলল, আপনিও মাঝে মাঝে ঢাকায় আমাদের কাছে থাকবেন। তবে আপনার ছেলে যা ভালো বুঝবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
মাহবুব মাকে বলল, আমি তোমাদের কারো কথা শুনব না। তোমাকে একা ফেলে কিছুতেই ঢাকায় থাকতে পারব না। আমাদের বিষয় সম্পত্তি ও চাষ-বাস দেখাশুনা করবে কে? তাছাড়া অসুখ-বিসুখ হলে কে তোমার সেবা-যত্ন করবে? হাদিসে আছে, “হযরত জাহেমা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এর নিকট আসিয়া বলিল,আমি জেহাদে যোগদান করিতে চাই। আপনার সহিত আমি পরামর্শ করিতে আসিয়াছি। তিনি বলিলেন, তোমার মা আছে? সে বলিল, হ্যাঁ, আছে। তিনি বলিলেন, তাহার নিকট থাক, কেননা বেহেশত তাহার পায়ের নিকট অবস্থিত।” [বর্ণনায়: হযরত মাবিয়া বিন জাহেমা (রাঃ)-নিসায়ী।]
হাদিসে আরো আছে, “এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (দঃ)-কে জিজ্ঞেস করিলেন, সন্তানের উপর তার পিতা-মাতার কি হক (দাবি) আছে? তিনি বলিলেন, তাহারা উভয়েই তোমার বেহেশত ও তোমার দোযখ।” [বর্ণনায়: হযরত আবু ওমামাহ (রাঃ)-মিশকাত।]
হাদিসে আরো আছে, “এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (দঃ)-কে জিজ্ঞেস করিল, আমার সঙ্গে থাকার সর্বাপেক্ষা অধিক অধিকার কাহার? তিনি বলিলেন, তোমার মাতার। সে প্রশ্ন করিল, তারপর কাহার? তিনি বলিলেন, তোমার মাতার। সে জিজ্ঞাসা করিল, তারপর কাহার? তিনি বলিলেন, তোমার মাতার। সে প্রশ্ন করিল, তারপর কাহার? তিনি বলিলেন, তোমার পিতার। অন্য বর্ণনায়: তোমার পিতার, তারপর তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের, অতঃপর তোমার নিকটতর আত্মীয়-স্বজনের।” [বর্ণনায়: আবু হোরায়রা (রাঃ)-মুসলিম।] পিতা মাতার সেবা-যত্ন করার জন্য আল্লাহর রাসুল (দঃ)-এত তাগিদ দিয়েছেন, আর আমি তাঁর উম্মত হয়ে তোমার সেবা-যত্ন না করে ঢাকায় স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে থাকব এটা ভাবলে কী করে? তারপর মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমার কথা কখনো অমান্য করিনি, তাই পায়ে ধরে বলছি, এব্যাপারে আর কিছু বলো না। আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতে দাও আম্মা।
মরিয়ম খাতুন ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে হাত ধরে পাশে বসিয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ গো, তুমি মাহবুবকে দান করে আমাকে ধন্য করেছ। সেজন্য তোমার পাক দরবারে জানাই লাখো-কোটি শুকরিয়া। তুমি আমার এই লালকে ইহকালে ও পরকালে তোমার নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো। নবী করিম (দঃ)-এর রওজা মোবারকে হাজার হাজার দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তুমি আমার দোয়া কবুল কর। আমিন।” দোয়া শেষ করে বললেন, আমি আর তোকে কিছু বলব না, তুই যা ভালো বুঝিস কর।
পরের দিন মাহবুব স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকা ফিরে এল।
মাহবুব চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে থাকবে শোনার পর থেকে মাহবুবার মনে একবিন্দু শান্তি নেই। সে যাতে তার মনের খবর বুঝতে না পারে সে জন্য সব সময় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। ঢাকায় ফিরে ভাবল, আজ জার্নি করে এসেছে, শরীর ও মন ক্লান্ত, কাল রাতে বলবে।
পরের দিন মাহবুব অফিসে গিয়ে জি. এম. (জেনারেল ম্যানেজার) কে ডেকে বলল, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন, আমার আব্বা মারা গেছেন।
জি. এম. বললেন, জ্বি শুনেছি।
আমি মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বাড়িতে আম্মা একা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চাকরিতে রিজাইন দিয়ে গ্রামে চলে যাব।
জি. এম. খুব অবাক হয়ে বললেন, কী বলছেন স্যার? আপনি তো এই কোম্পানীর অর্ধেক মালিক; আর বাকি অর্ধেক আপনার স্ত্রী!
মাহবুব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবাক কণ্ঠে বলল, কী বলছেন আপনি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
জি. এম. বুঝতে পারলেন, সাহেব এখনও সবকিছু গোপন রেখেছেন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যা বলেছি সত্য। আপনি যে দিন এখানে প্রথম জয়েন করেন, তার আগের দিন আমাদের সাহেব অফিসের সমস্ত স্টাফদের ডেকে বলেছিলেন, আপনি যেন জানতে না পারেন, তার অফিসে কাজ করছেন। তারপর সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ের আগেও আমাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি মনে করেছিলাম, এতদিনে আপনি সবকিছু জেনেছেন। কিন্তু এখন দেখছি…বলে থেমে গেলেন।
জি. এম. এর কথা শুনে মাহবুব খুব অপমান বোধ করল। সেই সাথে স্ত্রীর উপর প্রচণ্ড ঘৃণা হল। ভাবল, তাহলে বাবা ও মেয়ে পরামর্শ করে আমাকে ক্যাপচার করার জন্য একের পর এক ফাঁদ পেতেছিল। মাহবুবার ভালবাসাও কি তাহলে মিথ্যা?
তার মুখের অবস্থা দেখে জি. এম. বলল, কথাটা বলে আমি বোধহয় ভুল করে ফেললাম। সাহেব জানতে পারলে আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাববেন। বিশ্বাস করুন, আপনার রিজাইন দেওয়ার কথা শুনে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন।
মাহবুব বলল, মাফ চাওয়ার মতো কোনো ভুল বা অন্যায় আপনি করেননি, মাফ চাইছেন কেন? বরং কথাটা জানিয়ে বন্ধুর মতো উপকার করলেন। এতবড় উপকারী বন্ধুকে তার সাহেবের কাছে বিশ্বাসঘাতক বানাব ভাবলেন কি করে? আজ থেকে আপনি আমার বন্ধু। বলুন বন্ধুত্ব স্বীকার করলেন? তারপর দাঁড়িয়ে মোসাফা করার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিল।
জি. এম. ও দাঁড়িয়ে মোসাফা করে বললেন, আপনার মতো এত ভালো মানুষ আমি কখনো দেখিনি। আপনি আমাকে বন্ধু করে নিলেন জেনে ধন্য হলাম।
তাহলে শুনুন, আমি এক্ষুনি এখান থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। আপনার কথা আজীবন গোপন রাখব, এমন কী আমার স্ত্রীকেও জানাব না।
জি. এম. চমকে উঠে বললেন, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা….।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাহবুব বলল, আমাদের ব্যাপারটা আমরা বুঝব। আর শুনুন, আমি পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। আপনি শুধু সবকিছু গোপন রাখবেন এটাই আমার অনুরোধ। এবার আপনি আসুন।
জি. এম. চলে যাওয়ার পর মাহবুব রিজাইন লেটার লিখে কলিংবেল বাজাল।
পিয়ন বসির দরজার বাইরে একটা টুলে সব সময় বসে থাকে। কলিংবেল বাজতে ভিতরে ঢুকল।
মাহবুব রিজাইন লেটারটা খামে ভরে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা জি. এম. সাহেবকে দাও।
পিয়ন চলে যেতে বাসায় ফোন করল।
মাহবুবা ফোন ধরে সালাম দিল।
মাহবুব গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, বিয়ের আগে তুমি আমাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতে তাই না?
অফকোর্স, এখনো বাসি।
তাহলে আমাকে ক্যাপচার করার জন্য বাবা-মেয়েতে ফাঁদ পেতেছিলে কেন? এতদিন জানতাম প্রেম দিয়ে প্রেমকে জয় করা যায়। এখন দেখছি ছলনা করে ঐশ্বর্যের ফাঁদ পেতেও জয় করা যায়। ছিঃ ছিঃ তুমি আমার প্রেমের সঙ্গে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে ভাবতেই পারছি না। আমি তোমার ও তোমার বাবার দয়ায় এত বড় হয়েছি জেনে নিজেকে খুব ঘৃণিত মনে হচ্ছে। এরপর কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তাই গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। তারপর রিসিভার ক্যাডেলে রেখে ব্রীফকেস হাতে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল। গাড়ি না নিয়ে রাস্তায় এসে একটা খালি স্কুটার থামিয়ে উঠে বসে বলল, গাবতলী বাসষ্ট্যাণ্ডে চল।
মাহবুবের কথা শুনে মাহবুবা চমকে উঠে কয়েক সেকেণ্ড কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কিছু বলতে যেয়ে যখন বুঝতে পারল, যে ফোন ছেড়ে দিয়েছে : তখন ডায়েল করল।
পিয়ন বসির ফোন ধরে সালাম দিল।
মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কে বলছেন?
আমি পিয়ন বসির বলছি।
সাহেব নেই?
জ্বি না, এক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন।
ঠিক আছে রাখুন বলে মাহবুবা লাইন কেটে দিল। তারপর জি, এম কে ফোন করল।
জি, এম, ফোন ধরে বলল, জি. এম বলছি।
মাহবুবা সালাম দিয়ে বলল, মিসেস মাহবুব বলছি। আমি ওকে ফোন করেছিলাম। পিয়ন বসির বলল, এক্ষুনি বেরিয়ে গেছেন। কোথায় গেছে জানেন?
জি. এম ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়ে সংযত কণ্ঠে বললেন, জ্বি না বলতে পারব। তবে কয়েক মিনিট আগে পিয়নের হাতে আমার কাছে রিজাইন লেটার পাঠিয়েছেন।
ঠিক আছে রাখুন বলে মাহবুবা নিজেই লাইন কেটে দিয়ে ভাবল, আমার সঙ্গে দেখা না করেই কী গ্রামের বাড়িতে চলে গেল? তাকে ক্যাপচার করার জন্য বাবা ফাঁদ পাতলেও আমি যে পাতিনি সে কথা বলার সুযোগও দিল না। আজ দশ এগার বছর আমাকে নিয়ে সংসার করছে। আমি তাকে নিজের থেকে বেশি ভালবাসি কিনা সে কী জানে না? এইসব ভেবে মাহবুবের উপর তার যেমন খুব অভিমান হল, তেমনি রাগও হল। একসময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। হঠাৎ আতিয়াকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার কথা মনে পড়তে ঘড়ি দেখে কাজের ময়েকে ডেকে বলল, আতিয়াকে নিয়ে আসার জন্য ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে যেতে বল।
বিয়ের সময় আনিস সাহেব মেয়ে জামাইকে গাড়ি দিয়েছেন। মাহবুব অফিস থেকে আগেই গাড়ি পেয়েছে। নূতন গাড়িটা মাহবুবাই ব্যবহার করে।
তার এখন কি করা উচিত ভেবে না পেয়ে মাহবুবা বাবাকে ফোন করল।
আনিস সাহেব ফোন ধরে মেয়ের গলা বুঝতে পেরে বললেন, কবে ফিরলি?
কাল। তারপর বাবা….বলে ফুঁপিয়ে উঠল।
আনিস সাহেব খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, কি হল? কাঁদছিস কেন?
মাহবুবা সামলে নিয়ে বলল, তোমাদের জামাই রিজাইন দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।
কী পাগলের মত কথা বলছিস?
সত্যি বাবা, কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফোন করে সে কথা জানিয়ে চলে গেছে।
চলে গেছে সিওর হলি কি করে?
এত কথা ফোনে বলতে পারব না। আতিয়া স্কুল থেকে ফিরে এলে আমি আসছি।
তাই চলে আয় বলে আনিস সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
শামীমা বেগম সেখানে ছিলেন না। একটু পরে এসে স্বামীর গম্ভীর মুখ দেখে বললেন, কী ব্যাপার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? প্রেসার মাপার যন্ত্রটা নিয়ে আসব?
আনিস সাহেব সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, মাহবুবারা কাল ফিরেছে। একটু আগে ফোন করে বলল, জামাই রিজাইন দিয়ে দেশে চলে গেছে।
শামীমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? তা হঠাৎ এরকম করল কেন?
আমি কি করে বলব? মাহবুবা আসছে, তার কাছেই বিস্তারিত শোনা যাবে।
.
ঘন্টা খানেকের মধ্যে মাহবুবা আতিয়াকে নিয়ে বাবার বাসায় এল।
আনিস সাহেব ও শামীমা বেগম তাদের অপেক্ষায় ছিলেন। আতিয়া সালাম দিয়ে ছুটে এসে শামীমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল, নানু কেমন আছেন?
শামীমা বেগম তার মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, ভালো আছি, ভাই তুমি ভালো আছ তো?
জ্বি ভালো আছি।
মাহবুবা আয়াকে ডেকে বলল, আতিয়াকে এখান থেকে নিয়ে যাও। তারপর মেয়েকে বলল, মা-মণি, তুমি এখন আয়ার সঙ্গে খেলনা নিয়ে খেলা করতে যাও। আমি তোমার নানা-নানুর সঙ্গে কথা বলব।
আয়া আতিয়াকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আনিস সাহেব মেয়েকে বললেন, এবার সবকিছু খুলে বলতো।
মাহবুবা বলল, ঢাকায় আসার আগের দিন তোমাদের জামাই আমার শাশুড়িকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে থাকবে বলে। তারপর মা ও ছেলের মধ্যে যে সমস্ত কথাবার্তা হয়েছিল বলল।
শামীমা বেগম বললেন, বেয়ান সাহেবা তো খুব ভালো কথা বলেছেন। তখন তুই কিছু বলিসনি?
আমি আমার শাশুড়ির সাথে একমত বলেছিলাম। কিন্তু তোমাদের জামাই মায়ের সেবা-যত্ন করার ব্যাপারে কয়েকটা হাদিস শুনিয়ে বলল, সে কিছুতেই ঢাকায় থাকবে না। বাড়িতে থেকে মায়ের সেবা-যত্ন করবে।
আনিস সাহেব বললেন, তা না হয় বুঝলাম! কিন্তু জামাই তোর সঙ্গে দেখা না করে অফিস থেকে চলে গেল কেন? যা কিছু জানাবি বলেছিলি, জানিয়েছিলি বুঝি?
জানাবার সুযোগই তো পেলাম না। তোমার সঙ্গে যেদিন কথা হল, সেদিন ভেবেছিলাম জানাব; কিন্তু সেদিন আমার শুশুরের অসুখের খবর আসতে দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। তারপর শ্বশুর মারা গেলেন। কাল ফিরে এসে ভেবেছিলাম, আজ রাতে জানাব। তারপর অফিসে যাওয়ার পর মাহবুব ফোন করে যা কিছু বলেছে সব বলল।
আনিস সাহেব কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন, বোঝা যাচ্ছে, অফিসের কেউ না কেউ বলেছে।
শামীমা বেগম বললেন, তাতে কি হয়েছে? বাসায় ফিরলে তো মাহবুবা তাকে সব বলতই।
তা বলত, তবে কি জান, খুব সেন্টিমেন্টাল ছেলে তো, অফিসের লোকের কাছে শুনে খুব অপমান বোধ করেছে। যাক গে, এ নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। দেখি কি করা যায়।
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, ওকে আমি ভালোভাবেই চিনি বাবা, তুমি কিছুতেই ওকে দেশ থেকে আনতে পারবে না। কথা শেষ করে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
শামীমা বেগম তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বললেন, তাই যদি জানতিস, তবে ঐ পথে পা বাড়িয়েছিলি কেন? এখন কেঁদে কি করবি?
আনিস সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, আহ! এসব কথা এখন বলছ কেন? তুমি ওকে ওর রুমে নিয়ে যাও। আমাকে একটু একা চিন্তা করতে দাও।
ঐ রাতেই আনিস সাহেব হার্ট-এ্যাটাকে মারা গেলেন।
মাহবুব তার সঙ্গে দেখা না করে গ্রামে চলে যেতে মাহবুবার মনে যে রাগ ও অভিমান হয়েছিল, বাবা মারা যেতে তা আরো বেড়ে গেল। ভাবল, তার কারণেই বাবা মারা গেল।
মাহবুবা সকালে মাহবুবের বন্ধু মাসুমকে ফোন করে বলল, রাতে বাবা হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।
মাসুম ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন পড়ে বলল, আপনারা ফিরলেন কবে?
পরশু।
ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি আসছি।
মাহবুবা লাইন কেটে দিয়ে ঢাকার অফিসে ফোন করে বাবার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে দিল।
.
মাহবুব মাসুমকে কান্তা ও তার ভাই সাগরকে পড়াবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তারপর আমেরিকা থেকে ফিরে এসে ডাইরেক্টর হওয়ার পর তাকে একটা কোম্পানীতে লাগিয়ে দিয়েছিল। আজও তাদের বন্ধুত্বে এতটুকু ফাটল ধরেনি। মাসুম চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। তারপর কান্তাকে পছন্দ করার কথা তাদেরকে বলে। তারা ঢাকায় এসে কান্তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে তাকে বৌ করে ঘরে তোলেন। কান্তা ঢাকাতে স্বামীর কাছেও থাকে, আবার শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছেও থাকে। এতদিনে তাদের দুই মেয়ে ও একছেলে হয়েছে। কয়েকদিন আগে ছুটিতে মাসুম সবাইকে নিয়ে দেশে গিয়েছিল। ফেরার সময় মায়ের শরীর খারাপ জেনে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে রেখে একা এসেছে।
আজ মাহবুবা যখন ফোন করে তখন মাসুম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। মাহবুবা লাইন কেটে দেওয়ার পর অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিল, সে আজ অফিসে আসতে পারবে না। তারপর মাহবুবের শ্বশুরের বাসায় রওয়ানা দিল।
বাসায় পৌঁছে মাহবুবকে দেখতে না পেয়ে মাহবুবাকে জিজ্ঞেস করল, ভাবি, মাহবুবকে দেখছি না যে?
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, সে গত কাল দেশে গেছে।
মাসুম খুব অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার? পরশু এসেই কাল গেল কেন?
সে কথা পরে শুনবেন। এখন বাবার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করুন।
মাহবুবকে খবর দিয়ে অপেক্ষা করবেন না?
আপনি কী জানেন না, “লাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করে ফেলার কথা হাদিসে আছে?”
হ্যাঁ, তা জানি। মাহবুব মনে কষ্ট পাবে ভেবে বললাম। ঠিক আছে, আমি সব ব্যবস্থা করছি।
দাফন করে ফিরে এসে মাসুম মাহবুবাকে বলল, আজ আসি ভাবি। কাল অফিসের পর বিকেলে আসব।
মাহবুবা বলল, হ্যাঁ, তাই আসুন। আজ অনেক পরিশ্রম করেছেন। কালকে অবশ্যই আসবেন। আপনার সঙ্গে আলাপ আছে।
পরের দিন বিকেলে মাসুম মাহবুবাদের বাসায় এল। সালাম বিনিময় করে মাহবুবাকে বলল, কাল যেন কি আলাপ করবেন বলেছিলেন?
মাহবুবা আয়াকে ডেকে চা-নাস্তা দিতে বলে বলল, আপনার বন্ধু আসার আগের দিন মাকে বলে এসেছিল, তার সেবাযত্ন ও গ্রামের কাজ করার জন্য কয়েকদিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে গ্রামের বাড়িতে চলে আসবে। কিন্তু আমার উপর রাগ করে পরশু চলে গেল।
কী বলছেন ভাবি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?
বললেই বুঝবেন। বলছি শুনুন, মা-বাবাকে যখন মাহবুবকে পছন্দ করার কথা বলি তখন তারা তাকে বাসায় নিয়ে আসতে বললেন। বাসায় নিয়ে আসার পর মাহবুবের সঙ্গে আলাপ করে গ্রামের ছেলে জেনে মা-বাবা অসন্তুষ্ট হন। পরে আমাকে সে কথা। বলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেন। আমি বললাম,তা সম্ভব নয়। আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। আরো বললাম, আমি তাকে আমাদের সোসাইটির মত করে গড়ে নেব। তারপরও তারা অনেক কিছু বলে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি আমার মতামত দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করি। শেষে আমাকে যখন একান্ত বাগে আনতে। পারলেন না তখন মাহবুবকে ক্যাপচার করার জন্য বাবা ফাঁদ পেতে চাকরি দেন। তারপর চাকরি পাওয়ার পর থেকে চাকরিতে রিজাইন দেওয়ার ঘটনাও গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় ফোনে মাহবুব যা কিছু বলেছে সব বলল। কথা শেষ করে মাহবুবা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আপনিই বলুন তো ভাই, এতে আমার দোষ কোথায়? ন্যায় হোক আর অন্যায় হোক, আমাদের ভালোর জন্য যা করার বাবা করেছেন। তাই বলে সেই দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে আমার ভালবাসাকে অপমান করে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করল না।
মাসুম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি তো ওকে প্রথম থেকে জানেন খুব সেন্টিমেন্টাল ছেলে। বিয়ের পর আপনি না বলতে পারলেও আমাকে জানাতে পারতেন। আমি যেমন করে হোক ম্যানেজ করতাম। যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বলুন, কিভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। যদি বলেন, আমি ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।
না-না, তা করবেন না। কিছু দিন চিন্তা ভাবনা করে দেখি, তারপর চিঠি দেব। তাতে কাজ না হলে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব।
ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বুঝেন, করুন।
এমন সময় আয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলে মাহবুবা পরিবেশন করে বলল, অফিস থেকে এসেছেন, এগুলো খেয়ে নিন।
নাস্তা খেয়ে চা খাওয়ার সময় মাসুম বলল, আপনাদের ব্যবসা এখন কে দেখাশোনা করবে চিন্তা ভাবনা করেছেন?
মাহবুবা বলল, বিয়ের পর বাবা আমাদের দুজনের নামে সবকিছু উইল করে দিয়েছেন। মাহবুব সে কথা জানত না, ঐ দিন হয়তো জেনেছে। ব্যবসার ব্যাপারে এখনো চিন্তা করিনি।
মাসুম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আজ আসি, প্রয়োজন মনে করলেই ফোন করবেন। তারপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
নয়
মাহবুব প্রায় রাত বারটার সময় বাড়িতে এসে পৌঁছাল। মরিয়ম খাতুন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কাজের মেয়ে জমিরনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে বললেন, কি হয়েছে? ডাকাডাকি করছিস কেন?
জমিরন বলল, ভাইসাহেব এসেছেন।
মরিয়ম খাতুন আতঙ্কিত স্বরে বললেন, সে কিরে? মাত্র কালকেই তো গেল।
ততক্ষণে মাহবুব মায়ের কাছে এসে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না, ঢাকার পাট চুকিয়ে একেবারে চলে আসব?
মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে বললেন, তাই বলে কাল গিয়ে আজ চলে এলি? আতিয়াকে দেখছি না যে? তাদেরকে আনিসনি?
মায়ের কাছে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, সে কথা আসার সময় মাহবুবের মনে হয়েছে। তাই কি বলবে ভেবে রেখেছিল। বলল, ওরা আমার শ্বশুর বাড়িতে আছে। কিছুদিন পরে আসবে।
মরিয়ম খাতুনের কেমন যেন সন্দেহ হল। ভাবলেন, এত রাতে কিছু বলা ঠিক হবে, পরে এক সময় জিজ্ঞেস করা যাবে। বললেন, তোর রুমে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
মাহবুব বলল, আমি বাস থেকে নেমে খেয়ে এসেছি, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তারপর মায়ের কাছ থেকে নিজের রুমে চলে এল।
পরের দিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মরিয়ম খাতুন ছেলেকে বললেন, তুই তো বলে গেলি, কয়েকদিনের মধ্যে অফিসের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে আসবি। পরশু গিয়ে কাল একা চলে এলি, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। অফিসে কোনো গোলমাল হয়নি তো?
মাহবুব বলল, না আম্মা, ওসব কিছু নয়। পরে এক সময় তোমাকে সবকিছু বলব। এখন শুধু এটুকু শুনে রাখ, তোমার ছেলে কোনো গোলমালের মধ্যে নেই।
ঐদিন থেকে মাহবুব নিজের ও গ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখাশুনা করতে লাগল।
মাহবুব ঢাকা থেকে চলে আসার মাস খানেক পর মাহবুবার চিঠি পেল। চিঠিতে মাহবুবা লিখেছে–
প্রিয়তম,
পত্রে আমার সালাম ও ভালবাসা নিও। আম্মার পবিত্র কদমে আমার সালাম দিও। আশাকরি আল্লাহর রহমতে ভালো আছ। আমি কেমন আছি, তা আল্লাহ জানেন। তবে আতিয়া ভালো আছে। সে তোমার কথা বার বার জিজ্ঞেস করে। মায়ের শরীর তত ভালো নয়। অবশ্য ভালো থাকার কথাও নয়। কারণ তুমি ওভাবে চলে গেছ জেনে বাবা। এতবড় আঘাত পেয়েছিলেন যে, ঐ রাতেই হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। তোমাকে খবর। দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর দাফনের ব্যাপারে যে কথা তুমি বলেছিলে, সে কথা মনে পড়তে আর দিইনি, সামনের মাসের তিন তারিখে কুলখানি। অতি অবশ্যই আসবে। আমার কোনো কথা না শুনে যা করেছ, তাতে শুধু আমাকে ও আমার ভালবাসাকে অপমান করনি, নিজেকে এবং নিজের ভালবাসাকেও করেছ। যে। কারণে তুমি আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছ, তা সত্য না মিথ্যা, তার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জানালাম না। কারণ তুমি যখন আমার ভালবাসাকে অবিশ্বাস করতে পারলে তখন আমার কথাও অবিশ্বাস করবে। আমাদের বিয়ের পর বাবা তার সবকিছু তোমার ও আমার নামে যে উইল করে দিয়েছেন, তা তুমি হয়তো জেনেছ। এসব দেখাশোনা করা তোমার ও আমার দায়িত্ব। সবকিছু ছেড়ে আতিয়াকে নিয়ে তোমার কাছে চলে যেতে পারতাম; কিন্তু বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যের কি হবে? তাছাড়া তুমি যে কারণে তোমার মাকে একা রেখে ঢাকায় থাকতে চাওনি, সেই একই কারণে আমিও আমার মাকে একা রেখে তোমার কাছে যেতে পারছি না। তুমি আমার থেকে সব বিষয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী, ভালো বুঝবে করবে। আশা করি, এই পত্র পেয়ে একদিনের জন্য হলেও আসবে। আমি নারী, তার উপর জ্ঞানও কম। যদি ভুল-ত্রুটি করেই থাকি, স্ত্রী হয়ে ক্ষমা চাইছি। একটা হাদিস মনে পড়ে গেল, না বলে পারছি না। বেয়াদবি হলে ক্ষমা করে দিও। রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “কোনো মুমীন (বিশ্বাসী) স্বামী কোনো মুমীনা (বিশ্বাসিনী) স্ত্রীকে ঘৃণা করিবে না। তাহার একটি দোষ পাইলে, অন্য গুণের কারণে তাহাকে ভালবাসিবে।” [বর্ণনায়: হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-মুসলিম।]
আম্মার পবিত্র কদমে সালাম দিও। আল্লাহ পাকের দরবারে তোমাদের সার্বিক কুশল কামনা করে শেষ করছি।
ইতি–
তোমার মাহবুবা।
মাহবুব এই চিঠির উত্তর দিল না এবং ঢাকায় গিয়ে দেখাও করল না।
মরিয়ম খাতুন একদিন ছেলেকে বললেন, তুই বলেছিলি বৌমা আতিয়াকে নিয়ে। কয়েকদিন পরে আসবে; কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেল এখনও এল না। তুই গিয়ে নিয়ে আয়।
মাহবুব বলল, আমি চলে আসার পর আমার শ্বশুর মারা গেছেন। তোমাদের বৌকে সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে, আসবে কি করে?
“ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন” পড়ে মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে বললেন, বিয়াই সাহেব মারা গেলেন, বৌমা একটা খবরও দিল না? মারা গেছেন কবে?
আমি যে দিন ঢাকা থেকে চলে আসি, সেদিন রাতে হার্টফেল করে মারা গেছেন।
এতদিন পরে বৌমার খবর দেওয়ার সময় হল? তা তুই কবে যাবি?
আমার এখন যাওয়ার সময় নেই। নূতন একটা প্রজেক্টে হাত দিয়েছি।
সে কিরে? না গেলে বিয়ান কী মনে করবেন? তাছাড়া তোর মুখেই শুনেছি বিয়াই সাহেবের বিরাট ব্যবসা। সে সব দেখা-শোনার ব্যবস্থা করতে যাবি না? বৌমা কী ওসব পারবে?
তোমাদের বৌমা শিক্ষিতা পারবে না কেন?
তবু তোর একবার যাওয়া উচিত।
বললাম না, এখন আমি যেতে পারব না। কথা শেষ করে মায়ের কাছ থেকে মাহবুব চলে গেল।
মরিয়ম খাতুনের মনে সন্দেহ হল। ভাবলেন, ছেলে-বৌ এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো ব্যাপারে মনোমালিণ্য হয়েছে। তারপর থেকে বৌমা ও নাতনিকে নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দিতে লাগলেন।
একদিন মাহবুব মাকে বলল, আম্মা, বেয়াদবি মাফ করো। তোমাদের বৌমা যদি সারাজীবন নাও আসে, তবু আমি তাকে নিয়ে আসতে যাব না। তুমি তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে আর কোনোদিন বলো না।
মরিয়ম খাতুনের কানে ছেলের কথাগুলো কান্নার মতো শোনাল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, জানি তুই কখনো কোনো অন্যায় করিসনি। তবু তোর সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করে বলছি। ঠিক আছে, তুই যখন নিষেধ করছিস আর বলব না।
দশ
আজ বার-তের বছর হতে চলল, মাহবুব যেমন স্ত্রী ও মেয়ের খবর নেয়নি, তেমনি মাহবুবাও স্বামী ও শাশুড়ীর খবর নেয়নি।
মাসুম অনেকবার মাহবুবাকে বলেছে, আমি গিয়ে মাহবুবের সঙ্গে দেখা করে আপনাদের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দিই। কিন্তু মাহবুবা কিছুতেই রাজি হয়নি। বরং তাকে তার অফিস থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের অফিসে লাগিয়েছে। মাসুমের সাহায্যে মাহবুবা নিজেই বাবার ব্যবসা চালাচ্ছে।
মাহবুব এসব খবর জি. এম. এর কাছ থেকে জেনেও স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
মাস ছয়েক আগে কয়েকদিনের জ্বরে হঠাৎ মরিয়ম খাতুন মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছেলেকে বললেন, শহরের বড় লোকের মেয়েকে বৌ করে আমরা বুঝি ভুল করেছি। আমাদের মাফ করে দিস। আর তোদের যদি ছাড়কাট (তালাক) না হয়ে থাকে, তাহলে মিটমাট করে নিস।
মাহবুবও চোখের পানি রোধ করতে পারল না। ভিজে গলায় বলল, মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। তোমরা যা করেছ, আমার ভালোর জন্য করেছ। তাছাড়া আমিই তোমাদেরকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছি। এটাই আমার তকৃদিরের লিখন। এর উপর কারো হাত নেই। তোমার কথা রাখার চেষ্টা করব।
এর কিছুক্ষণ পর মরিয়ম খাতুন মারা যান।
মা মারা যাওয়ার পর মাহবুব কাজের মধ্যে ডুবে রইল। ঠিকমতো গোসল, খাওয়া দাওয়া ও না ঘুমানোর ফলে শরীর ভেঙ্গে পড়ে। আজ প্রায় মাসখানেক হল সে শয্যাশায়ী।
.
মাহবুবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে থাকার কথা তাহেরা শুনেছিল। তখন ভেবেছিল, ন’মাসে, ছ-মাসে হলেও তার সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু বছর খানেক পরে যখন শুনল, ভাবি আসেনি ও মাহবুব ভাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি তখন ভাবল, ভাবির সঙ্গে নিশ্চয় মাহবুব ভাইয়ের মনোমালিণ্য হয়েছে। শোনার পর থেকে মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাদের বাড়িতে যেতে খুব মন চাইত, গ্রামে দুর্নাম রটবার ভয়ে যায়নি। মরিয়ম খাতুন মারা যাওয়ার খবর পেয়ে মায়ের সঙ্গে এসেছিল। সেদিন সুযোগ পাওয়া সত্বেও কিছু বলতে পারেনি। এই বার-তের বছরের মধ্যে মাত্র কয়েকবার যখন আলাউদ্দিন মীরের সঙ্গে মাহবুব দেখা করতে এসেছে তখন তাকে দেখলেও তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।
কাল রাতে আব্বার মুখে তার অসুখের কথা শুনে তাহেরা সারা রাত ঘুমাতে পারল না। ভাবল, কে তার সেবা-যত্ন করছে? পরের দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ির সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে তখন তাহেরা ভালো করে গায়ে চাদর জড়িয়ে কাজের মেয়ে শাহেদাকে নিয়ে মাহবুবকে দেখতে এল।
জমিরণ কাপড় হাতে করে পুকুর ঘাটে গোসল করতে যাচ্ছিল। তাদেরকে দেখে তাহেরাকে চিনতে পেরে বলল, ভাই সাহেবকে দেখতে এসেছেন? তারপর একটা ঘরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ ঘরে আছে। আপনারা যান, আমি গোসল করে আসি। কথা শেষ করে পুকুরঘাটের দিকে চলে গেল।
তাহেরা কাজের মেয়েকে বারান্দায় অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকে দেখল, মাহবুব খাটে শুয়ে আছে। তার কংকালসার শরীরের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ভিজে গলায় বলল, মাহবুব ভাই, তোমার এরকম অবস্থা হয়েছে, ভাবিকে খবর দাওনি?
মাহবুবের উঠে বসারও ক্ষমতা নেই। শুয়ে শুয়ে স্ত্রী ও মেয়ের কথা চিন্তা করছিল। মেয়েটার কথা মনে পড়লে তাকে দেখার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে উঠে। আর মাহবুবা তাকে ভুলে যাবে, এটা সে কল্পনাও করেনি। তাহেরার কথা কানে যেতেই তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে বলল, ও তুমি। তোমাকে অনেক দিন পর দেখলাম। কেমন আছ?
তাহেরা চোখ মুছে বলল, আমার কথা থাক। তুমি এতদিন অসুখে ভুগছ, কাউকে দিয়ে আমাকে জানাতে পারতে। যতটা পারতাম সেবা-যত্ন করতাম। গত রাতে আব্বার মুখে শুনে দেখতে এলাম।
মাহবুব তাকে বসতে বলে বলল, যার করার কথা সে যখন করল না, তখন আর কারো সেবা-যত্নের দরকার নেই।
খবর দিলে ভাবি নিশ্চয় আসত।
যে নাকি আজ বার-তের বছর স্বামীর খোঁজ নিল না, তাকে মরে যাওয়ার আগে খবর দিতে মন চাইনি। আমার কি মনে হয় জান? তোমার মনে কষ্ট দিয়ে যে পাপ। করেছি, এটা তারই প্রতিফল।
তুমি কী পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছ?
একরকম তাই।
তাই যদি মনে কর, তাহলে ভাবির সঙ্গে মনোমালিন্য করে তার মনে আবার কষ্ট দিয়ে পাপ বাড়াচ্ছ কেন? কী ব্যাপারে দু’জনেই এতদিন একে অপরের কাছ থেকে দুরে রয়েছ বলবে?
সে কথা বলে তোমার কষ্ট বাড়াব না। শুধু এতটুকু বলতে পারি, অন্যায় করেছিল মাহবুবা। তা জানতে পেরে আমি না হয় রাগ করে চলে এসেছিলাম। তাই বলে সে আমাকে এতদিন ছেড়ে থাকবে ভাবতেই পারিনি। মেয়েদের এত অভিমান থাকা কি উচিত?
না উচিত নয়।
জান তাহেরা, খুব ইচ্ছা হয় মরার আগে আতিয়া ও তার মায়ের কাছে মাফ চেয়ে নিতে।
বেশতো, আমি আজ কালের মধ্যে সবকিছু জানিয়ে চিঠি লিখে আতিয়াকে নিয়ে ভাবিকে আসতে বলব।
না-না, তা করো না। তাদের কাছে আমাকে আর ছোট করো না।
একমাত্র মেয়ের কথা মনে পড়ে না?
পড়ে তাহেরা পড়ে। মেয়ের কথা, মেয়ের মায়ের কথা সব মনে পড়ে। দয়া করে তাদের প্রসঙ্গ আর তোলো না; বড় কষ্ট হয়। আর কয়দিনই বা বাঁচব? মরে গেলে তাদের চিন্তা থেকে রেহাই পাব। সব সময় আল্লাহকে জানাই, তিনি যেন মা মেয়েকে হেফাজত করেন, সুখী করেন। এতক্ষণ কথা বলে মাহবুব হাপাতে লাগল।
এমন সময় জমীরন গোসল করে ফিরে এসে মাহবুবকে হাঁপাতে দেখে বুঝতে পারল, অনেক কথা বলেছে। তাহেরাকে বলল, ভাই সাহেবের বেশি কথা বলা ডাক্তারের নিষেধ। আপনি এখন যান।
তাহেরা মাহবুবের কথা শুনে বুঝতে পারল, ভাবির সঙ্গে রাগ বা অভিমান করে এতদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও এখন সেই রাগ বা অভিমান নেই। কিছু বলতে যাচ্ছিল, জমিরনকে দেখে থেমে গিয়েছিল। জমিরনের কথা শেষ হতে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাহবুব ভাই, আজ আসি। কাল আবার আসব।
ফেরার সময় তাহেরা ভাবল, মাহবুব ভাইয়ের অবস্থার কথা লিখে ভাবিকে চিঠি দিয়ে জানাবে। তার ধারণা হল, চিঠি পেলে ভাবি নিশ্চয় মেয়েকে নিয়ে না এসে পারবে না। মাহবুবের বিয়ের ওলিমার সময় মাহবুবাকে দেখতে গিয়ে আলাপ করার সময় ঠিকানা দিতে বলে বলেছিল, আমার স্বামী ঢাকা কলেজের প্রফেসার। রায়ের বাজারে আমাদের বাসা। মাঝে মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব। মাহবুবা একটা কাগজে ঠিকানা লিখে তাকে দিয়ে বলেছিল, এলে খুব খুশি হব। ঘরে ফিরে তাহেরা ঠিকানাটা বাক্সে তুলে রেখেছিল। কিন্তু ঢাকায় তিন বছর থাকলেও কোনোদিন মাহবুবার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। আজ মাহবুবের কাছ থেকে ঘরে এসে প্রথমে বাক্স থেকে ঠিকানাটা বের করল। তারপর মাহবুবাকে চিঠি লিখতে বসল।
ভাবি,
পত্রে আমার সালাম নেবেন। আশাকরি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমাকে আপনার নিশ্চয় মনে আছে। আমি আলাউদ্দিন মীরের মেয়ে তাহেরা। এবার আসল কথায় আসি। আজ বার-তের বছর মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ নেই। কেন নেই, জানি না। জানার ইচ্ছা থাকলেও জানা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আপনি জানেন কিনা জানি না, মাস ছয়-সাতেক আগে মাহবুব ভাইয়ের আম্মা মারা গেছেন। আজ একমাস হতে চলল, মাহবুব ভাই অসুখে শয্যাশায়ী। গতকাল সে কথা আব্বার মুখে শুনে আজ তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। কংকালসার শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। কাজের মেয়ে জমিরন তার সেবা-যত্ন করছে। দেখে মনে হল, বেশি দিন বাঁচবে না। তোমাদেরকে খবর দিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বলল, “এক যুগের বেশি যারা আমার খোঁজ নিল না, মরার সময় তাদেরকে খবর দিয়ে কি হবে।” আরো বলল, “মাহবুবা এমন কিছু অন্যায় করেছিল, যা আমার ব্যক্তিত্বে প্রচন্ড আঘাত লাগে। সেই জন্য আমি চলে আসি। মনে করেছিলাম, ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে এসে ক্ষমা চাইবে। তার বদলে অভিমান করে সে যে আমাকে এত কষ্ট দেবে, তা কল্পনাও করিনি।” তারপর তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলাম, মরার আগে, তোমাকে ও আতিয়াকে একবার দেখতে চায়। আমি যে এই চিঠি দিচ্ছি তা সে জানে না। সে আমাকে চিঠি দিতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় দিতে বাধ্য হলাম। আপনি আমার থেকে শিক্ষিতা। তবু দু’একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। প্রবাদ আছে “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।” আমার মনে হয়, কথাটা মেয়েদের ব্যাপারে শতকরা সত্তর ভাগ সত্য। বাকি ত্রিশ ভাগ পুরুষদের। সংসারের সুখ-শান্তি, উন্নতি অবনতি মেয়েদের উপর নির্ভর করে। অবশ্য সর্বক্ষেত্রে স্বামীর সহযোগীতা প্রয়োজন। আমার মতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে অল্প সময়ের মধ্যে মিমাংসা করে নেওয়া উচিত। তা না হলে যত দেরি হবে, তত মানষিক অশান্তি বাড়ার সাথে সাথে দু’জনের দাম্পত্য জীবনের মধুর সম্পর্কে গরল ঢুকতে থাকে। আর এ ব্যাপারে স্ত্রীর অগ্রভূমিকা নেওয়াই উত্তম। কারণ স্বামীর কাছে নতিস্বীকার করা অপমান নয় বরং ভালো। ইসলামও তাই বলে। তবে যে সব পুরুষ ইতর ও ছোটনোক, তাদের সঙ্গে মিমাংসা করার নিয়মও ইসলাম বলে দিয়েছে। গ্রাম সুবাদে মাহবুব ভাইকে যতটা জানি, তার মতো চরিত্রবান ছেলে, এ যুগে আছে কিনা সন্দেহ। তবু কেন যে তোমাদের সম্পর্ক এমন হল, তা বুঝতে পারছি না। হয়তো এটাই তোমাদের তকৃদিরের লিখন। তকৃদিরে যাই থাকুক না কেন, তবু মানুষকে সবকিছুর জন্য চেষ্টা করতে হয়। মনিষীরা বলেন, “মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের কদর বুঝে না, সময় থাকতে সময়ের মূল্য বুঝে না, স্বাস্থ্য থাকতে স্বাস্থ্যের কদর বুঝে না, স্বামী থাকতে মেয়েরা স্বামীর কদর বুঝে না।” আমি বিয়ের তিন বছর পর বিধবা হয়েছি, স্বামী কি জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “যদি কোনো ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির সিজদা করিবার আদেশ দিতাম, তবে আমি স্ত্রীকে বলিতাম তাহার স্বামীকে সিজদা করিতে।” [বর্ণনায়: হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-তিরমিজী।] আমাদের নবী (দঃ) আরো বলিয়াছেন, “যে নারীর মৃত্যুর সময় তাহার স্বামী তাহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, মৃত্যুর পরে সেই নারী বেহেস্তে প্রবেশ করিবে।” [বর্ণনায়: হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ)-তিরমিজী।]
আপনি হয়তো বলবেন, নবী (দঃ) শুধু মেয়েদেরকে স্বামীর মন সন্তুষ্ট করতে বলেছেন, স্বামীদেরকে স্ত্রীর মন সন্তুষ্ট করতে বলেননি? হ্যাঁ, তাও বলেছেন। যেমন, নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “যখন কোনো মুসলমান পুণ্য লাভের আশায় তাহার স্ত্রীর জন্য। কিছু ব্যয় করে, ইহা তাহার পক্ষে একটি দানের তুল্য।” [বর্ণনায়: হযরত আবু মাসউদ (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম।।] তিনি (দঃ) আরো বলিয়াছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তাহার স্ত্রীর সহিত উত্তম ব্যবহার করে। স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারে তোমাদের মধ্যে আমি উত্তম। যখন তোমার সঙ্গীর মৃত্যু হয় তাহাকে ত্যাগ কর।” [বর্ণনায়: হযরত আয়েশা (রাঃ)-তিরমিজী।]
আর একটা হাদিস বলে ইতি টানব। হাদিসে আছে; “আমার পিতা রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, আমাদের কোনো রমনীর তাহার স্বামীর উপর কি হক আছে? তিনি বলিলেন, যখন তুমি খাদ্য গ্রহণ কর, তাহাকে খাদ্য দান করা, যখন বস্ত্র পরিধান কর তাহাকে বস্ত্র প্রদান করা, তাহার মুখমন্ডলের উপর আঘাত না করা, তাহাকে তিরস্কার না করা এবং নিজ ঘর ব্যতীত অন্য ঘরে তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া না যাওয়া।” [বর্ণনায়: হযরত হাকিম বিন মাবিয়া-আবু দাউদ, ইবনে মায়াহ।]
আমার একান্ত অনুরোধ, এই চিঠি পাওয়া মাত্র আতিয়াকে নিয়ে চলে আসুন। মনে রাখবেন, মানুষ মাত্রই ভুল করে। যারা প্রকৃত মুমীন, তারা ভুল সংশোধন করে নেয়। আর নয়-এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি–
তাহেরা।
যথাসময়ে চিঠিটা পেয়ে মাহবুবা পড়ে চোখের পানি রোধ করতে পারল না। তখন তার মনে বিগত জীবনের সব ঘটনা একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেই সব সুখময় দিনগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।
মাহবুব যখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায়, তখন আতিয়ার বয়স সাত বছর। মাকে নানুর বাড়িতে থাকতে দেখেও বাবাকে আসতে না দেখে প্রথম প্রথম প্রায় জিজ্ঞেস করত, বাবা আসে না কেন? তুমি আমাদের বাসায় যাওনা কেন?
মেয়ের কথা শুনে মাহবুবার চোখে পানি এসে যেত। চোখ মুছে আদর দিয়ে বলত, তোমার বাবা বিশেষ কাজে গ্রামের বাড়িতে গেছে, ফিরে এলে ঐ বাসায় যাব।
তারপর যতবার জিজ্ঞেস করেছে, ততবার মায়ের চোখে পানি দেখে আতিয়া বলেছে, বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই তুমি শুধু কাঁদ। ঠিক আছে, আমি আর জিজ্ঞেস করব না।
বড় হয়ে মা ও নানুর মুখে যতটুকু শুনেছে, তাতে আতিয়ার মনে হয়েছে, বাবা তাদের সাথে অন্যায় করেছে, তাই বাবা আসে না, আর মাও তার কাছে যায় না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একদিন মাকে বলল, তোমার ও বাবার মধ্যে না হয় কিছু হয়েছে। তাই বলে একমাত্র সন্তান আমারও কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি কেন?
মাহবুবা বলল, সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? তোর বাবাকে চিঠি দিয়ে জেনে নে।
যে বাবা আজ এত বছর একমাত্র মেয়ের খোঁজ-খবর নেয়নি, সেই বাবাকে চিঠি দিতে আতিয়ার ইচ্ছা করেনি বলে দেয়নি। আজ কলেজ থেকে ফিরে মায়ের রুমে এসে তাকে বেলকুনীতে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে দেখে ভাবল, নিশ্চয় বাবার কথা মনে করে কাঁদছে।
এই বেলকুনীটা মাহবুবার বেডরুমের পিছনে। এখানে কারো আসার অনুমতি নেই। এমনকি আতিয়ারও নয়। মাহবুবের কথা মনে পড়লে যখন মাহবুবা খুব অস্থির বোধ করে তখন এখানে নিভৃতে বসে চোখের পানি ফেলে মনকে হাল্কা করে। আজ অফিস থেকে ফেরার পর যখন মাহবুবা চা খাচ্ছিল তখন বুয়া চিঠিটা দেয়। হাতের লেখা দেখে চিনতে না পারলেও প্রেরকের ঠিকানা পড়ে বুঝতে পারল, রংপুর থেকে এসেছে এবং খুব সম্ভব মাহবুবের খবর আছে। তাই এই বেলকুনীতে এসে চিঠিটা পড়ে।
মাকে ঐ অবস্থায় দেখে আতিয়ার বুকটা ব্যথায় টন-টন করে উঠল। পরক্ষণে বাবার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হল। রাগ সহ্য করতে না পেরে মায়ের নিষেধ থাকা সত্বেও কিছু বলার জন্য কাছে এসে দেখল, তার হাতে একটা চিঠি। ভাবল, নিশ্চয় বাবা দিয়েছে। বাবা কি লিখেছে জানার আগ্রহ দমন করতে না পেরে চিঠিটা আস্তে, করে নিয়ে পড়তে শুরু করল।
আতিয়া চিঠিটা নিতেই মাহবুবা সম্বিত ফিরে পেয়ে ভাবল, আতিয়া ছাড়া আর কারো এত সাহস হবে না। চিঠি পড়ে মেয়ের অনুভুতি কী হয়, জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
আতিয়া চিঠির হেডিং পড়ে বুঝতে পারল, বাবার চিঠি নয়। তবু সবটা পড়ল। পড়ে বাবার প্রতি যে রাগ ও বিদ্বেষ ছিল, তা দূর হয়ে গেল। কিন্তু স্ত্রীর উপর রাগ করে এত বছর মেয়ের খোঁজ নেয়নি ভেবে তার উপর প্রচণ্ড অভিমান হল। পরক্ষণে বাবা মৃত্যুশয্যায় মনে পড়তে তাকে দেখার জন্য মনের মধ্যে প্রচন্ড তাগিদ অনুভব করে মা বলে ডাকল।
মাহবুবার কানে আতিয়ার মা ডাক কান্নার মতো শোনাল। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বলল, কিছু বলবি?
আতিয়া বাবাকে সাত বছর বয়সের পর থেকে দেখেনি। তার কথা যতটুকু মনে আছে, তাতে মনে হয়েছে, তার বাবার মতো ভালো মানুষ আর নেই। দীর্ঘ এত বছর পর চিঠিটা পড়ে সেই বাবাকে দেখার জন্য তার মন পাগল হয়ে উঠল। মা বলে বসে পড়ে তার কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, তাহেরা ফুফু তোমার ও বাবার ব্যাপারে যা লিখেছে, তা কী সত্য?
স্বামী মৃত্যুশয্যায় তাদেরকে দেখতে চায় জানার পর মাহবুবা এতদিনের রাগ অভিমানের কথা ভুলে গিয়ে কাঁদছিল। মেয়ের কথা শুনে বলল, হ্যাঁ সত্যি। আমাকে সুখী করার জন্য তোর নানা যে ভুল করেছিলেন, তোর বাবা তা জানত না। তোর নানা যা করেছিলেন, সেটা আমি করেছি মনে করে তোর বাবা রাগ করে চলে গেছে। আর। আমিও তার উপর রাগ ও অভিমান করে ভুল ভাঙ্গাবার চেষ্টা করিনি। তোর তাহেরা ফুফু চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেই ভুল সংশোধন করতে বলেছে।
চল না মা আজই আমরা রওয়ানা দিই। বাবাকে দেখার জন্য আমারও মনটা খুব ছটফট করছে।
আজ যাওয়ার সময় নেই, কাল ভোরে রওয়ানা দেব।
পরের দিন ফজরের নামায পড়ে মা ও মেয়ে তৈরি হল। ড্রাইভারকে মাহবুবা গতকাল রাতে ভোরে রওয়ানা হওয়ার কথা বলে গাড়িতে তেল ভরে রাখতে বলেছিল। সে গাড়ি বার করার পর মাহবুবা মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
.
মাহবুব শয্যাশায়ী হওয়ার পর গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ বণিতা প্রতিদিন দেখতে আসে। জমিরন দুপুর থেকে আসর পর্যন্ত কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। এই সময়ে তাহেরা আসে। আজ আটদিন হয়ে গেল তাহেরা মাহবুবাকে চিঠি দিয়ে তাদের আসার অপেক্ষা করছে। ডাক্তারের নির্দেশ মতো ওষুধ ও পথ্য খাওয়ানোর ফলে এবং তাহেরার সেবা যত্নে গতকাল থেকে মাহবুব একটু সুস্থতা অনুভব করছে। আজ এসে যখন তাহেরা তাকে ওষুধ ও পথ্য খাওয়াল তখন বলল, তোমার সেবা-যত্নে আল্লাহ এ যাত্রা বোধ হয় আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। তোমার ঋণ ইহকালে শোধ করতে পারব না।
কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাহেরা ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর মর্জি থাকলে পরকালে না হয় শোধ করে দিও।
জমিরন পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল। গোসল সেরে ঘাটে উঠে মাহবুবা ও আতিয়াকে সদরগেটে গাড়ি থেকে নামতে দেখে খুশিতে কাপড় পাল্টাবার কথা ভুলে গেল। তাড়াতাড়ি ঘাট থেকে উঠে ঘরের দিকে ছুটল।
তাহেরার কথা শেষ হয়েছে এমন সময় জমিরন ভিজে কাপড়েই তাদের কাছে এসে বলল, ভাবি সাহেব আতিয়াকে নিয়ে এসেছেন।
ততক্ষণে মাহবুবা ও আতিয়া দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
জমিরনের কথা শুনে মাহবুব চমকে উঠে তাহেরার দিকে এক পলক চেয়ে নিয়ে দরজার দিকে তাকাল।
বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। এক সময় সকলের চোখ পানিতে ভরে উঠল।
মাহবুব চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? ভিতরে এস। আজ তেরটা বছর তোমাদেরই প্রত্যাশায় রয়েছি।
Leave a Reply