তোমারই জন্য – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১
উৎসর্গ – কবি ও সাহিত্যিক মুহাম্মদ শফি
.
১। “আপনি মুসলমান পুরুষদিগকে বলিয়া দিন, যেন তাহারা স্বীয় দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজ নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, ইহা তাদের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কথা, নিশ্চয় আল্লাহ সবই জানেন-তাহারা যাহা কিছু করিয়া থাকে।”- আল কুরআন ও সূরা-নূর, আয়াত নং-২০, পারা-১৮।
২। “আমি কি তোমাদের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধনসম্পদ সম্পর্কে সংবাদ দেব না, যা তোমাদের সঞ্চয় করা উচিত? তা হচ্ছে পূর্ণময়ী স্ত্রী।”-আবু দাউদ।
৩। “সৎ স্বভাব ও উত্তম চালচলন আল্লাহপাকের গোস্বাকে ঠাণ্ডা করিয়া দেয়।”-সুফইয়ান সাওরী (রঃ)
.
০১.
তানভীর সাহেব বেলা দুটোর সময় একটা ভালো হোটেলের রুম ভাড়া করলেন। তারপর মেয়েকে ফোন করে সেকথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে শফি ফোন করেছিল?
ডালিয়া বলল, ঘণ্টাখানেক আগে করেছিল। বলল, চারটের সময় ঢাকা পৌঁছে যাবে। বাস থেকে নেমে আবার ফোন করবে বলেছে।
তানভীর সাহেব বললেন, আমি সাড়ে চারটে থেকে রিসেপশনে থাকব। শফি ফোন করলে তাকে হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে তুইও আসবি। তারপর লাইন কেটে দিলেন।
শফি সোয়া চারটের সময় বাস থেকে নেমে ডালিয়াকে ফোন করল।
ডালিয়া সালাম ও কুশল বিনিময় করে হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে বলল, একটা ট্যাক্সী নিয়ে চলে এস, আমি রিসেপসনে থাকব।
হোটেলের নাম শুনে শফির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ঠিক আছে, আসছি।
শফি পৌঁছাবার আগে ডালিয়া পৌঁছে বাবাকে দেখে নিশ্চিন্ত হল। আসবার সময় বাবা সময় মতো থাকবে কী না থাকবে ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিল।
তানভীর সাহেব মেয়ের হাতে রুমের চাবি দিয়ে রুম নাম্বার বলে। জিজ্ঞেস করলেন, শফি ফোন করেছিল?
ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, করেছে। তারপর তাকে যা বলেছে বলল।
তানভীর সাহেব বললেন, শফি তো আমাকে চেনে না। আসার পর তুই তাকে নিয়ে রুমে চলে যাবি। আমি আধ ঘণ্টা পরে আসব, তখন পরিচয় করিয়ে দিবি।
প্রায় পনের মিনিট পর শফিকে রিসেপশনে ঢুকতে দেখে ডালিয়া বাবাকে ফিসফিস করে বলল, সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবীপরা ব্রিফকেস হাতে ছেলেটা শফি। তারপর এগিয়ে এসে শফিকে সালাম দিল।
বোরখাপরা ও মুখে নেকাব দেয়া একটা মেয়েকে আসতে দেখে শফি সাইড দিতে যাচ্ছিল। তারপর তাকে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে চিনতে পারল। সালামের উত্তর দিয়ে সুবহান আল্লাহ বলে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
ডালিয়াও অল্পক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, এস আমার সঙ্গে। তারপর তাকে সঙ্গে করে রুমে এসে মুখের নেকাব সরিয়ে কদমবুসি করে বলল, আল্লাহ আমার মনের বাসনা পূর্ণ করলেন, সেজন্যে তাঁর পাক দরবারে হাজারবার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
শফি কিছু না বলে অপলক নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
ডালিয়াও কিছুক্ষণ ঐভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, এতক্ষণ ধরে কী দেখছ?
দেখছি আমার মানসপ্রিয়াকে। যাকে দেখার জন্য এতদিন পাগল হয়েছিলাম। তারপর বলল, ফোনে আলাপ করে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছ, এতটা ঝুঁকেছ বুঝতে পারিনি। তোমার পরিবর্তন দেখে এত খুশি হয়েছি, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
ডালিয়া লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, তোমার ভালবাসা আমার পরিবর্তন এনে দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিবের পথে চলার প্রেরণা দিয়েছে।
শফি আবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, একটা কথা বোধ হয় তুমি জান না, কদমবুসি করা উচিত নয়। যদিও এই প্রথাটা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। শুধু মুখে সালাম দেয়া উত্তম। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমাদের ব্যাপারটা তোমাদের কেউ জানেন?
ডালিয়া বলল, প্রথমে চিন্তা করেছিলাম, কোনো রেস্টুরেন্টে অথবা কোনো পার্কে তোমাকে আসতে বলব। পরে আবার চিন্তা করলাম, ব্যাপারটা খুব অসৌজন্যমূলক হবে। শেষে ভাবিকে ব্যাপারটা জানিয়ে পরামর্শ চাইলাম। ভাবি আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। তাই প্রথমে একটু আধটু রাগারাগি করে পরে বলল, বাবাকে সবকিছু জানাও। তিনি সবার থেকে তোমাকে বেশি ভালবাসেন। শুনে রাগারাগি করলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। ভাবির কথাটা ভালো মনে করে বাবাকে জানাতে বাধ্য হয়েছি। তিনিই এখানে আমাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন।
শুনে বাবা নিশ্চয় তোমাকে খুব রাগারাগি করেছেন?
ওসব কথা পরে ফোনে আলাপ করব। আমাদের হাতে মাত্র আধ ঘণ্টা সময়। আধ ঘণ্টা পরে বাবা আসবেন।
বাবা নিশ্চয় রিসেপশনে আছেন?
হ্যাঁ, তারপর বাবা যা বলেছে বলল।
শফি বলল, হাতে যখন সময় বেশি নেই তখন চুপ করে সোফায় বস, প্রাণভরে তোমাকে দেখি।
ডালিয়া মৃদু হেসে বলল, আমাকে বসিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝি? তারচেয়ে তুমি সোফায় বস, আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।
তা হতেই পারে না বলে শফি খাটে বসে তাকে সোফায় বসতে বলল।
ডালিয়া বসার পর দু’জন দু’জনের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। এক সময় ডালিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তাই দেখে শফি বলল, এতদূর থেকে তোমার কান্নাভেজা মুখ দেখতে আসিনি, এসেছি হাসিমুখ দেখতে।
ডালিয়া চোখ মুছে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমাকে দেখে আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না। তাই চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অবশ্য আরও একটা কারণে চোখে পানি আসছে।
কারণটা বল।
আল্লাহ আবার কবে তোমাকে দেখাবেন, সেকথা ভেবেও সামলাতে পারছি না।
আল্লাহর কাছে সবর করার তওফিক চাও। আর দোয়া করতে থাক, তিনি যেন আমাদের একসঙ্গে থাকার তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন।
তাতো প্রত্যেক নামাযের পর করছি। এই শোন, আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। বাবা হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বেন।
এমন সময় তানভীর সাহেব দরজার বাইরে থেকে মেয়ের নাম ধরে ডাকলেন।
ডালিয়া দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এস বাবা।
তানভীর সাহেব রিপেসশনে অল্পক্ষণের জন্য শফিকে দেখলেও তার বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব ও সুন্দর চেহারা দেখে খুশি হয়েছেন। এখন রুমে ঢুকে ভালো করে তার আপাদমস্তক দেখে বুঝতে পারলেন, শফি আলতু-ফালতু ঘরের ছেলে নয়।
ডালিয়ার কথা শুনে শফিও দাঁড়িয়ে পড়েছে। তানভীর সাহেব রুমে ঢুকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন দেখে সালাম দিয়ে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।
তানভীর সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে সোফায় বসে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, পুরোটা না হলেও অল্প কিছু তোমার বায়োডাটা ডালিয়ার কাছে শুনেছি। তোমাদের দুজনের সম্পর্কের কথাও শুনেছি। তুমি তো আরবি লাইনে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছ; তা হলে প্রেম ভালবাসার পথে পা বাড়ালে কেন? এটাতো ইসলামে বৈধ নয়।
শফি বলল, এ ব্যাপারে ডালিয়া আপনাকে কতটুকু বলেছে জানি না, তাই বলছি, ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা বলতে যা বোঝায়, তা। আমাদের মধ্যে হয়নি। দেখা-সাক্ষাত, মেলামেশা বা আলাপ করেও হয়নি। তবু কেন হল? কী করে হল? তাও আমরা দুজনের কেউ-ই বলতে পারব না।
তাই যদি হয়, তা হলে ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছ কেন? এটাও তো ইসলামে বৈধ নয়?
তা আমিও জানি। তবু কেন এসেছি বলছি শুনুন, দৈব ঘটনার মাধ্যমে দু’তিনবার দু’জন দুজনকে দেখি। তাতেই আল্লাহ পাকের ইশারাই আমাদের মনে প্রেমের বীজ বপন হয়ে যায়। এতদিনে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা মেলতে চাচ্ছে। আর সেই জন্যে আমাদের দেখা সাক্ষাত হওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে, তাই এসেছি। তবে এটাও ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। ইসলাম পরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে। তাই আমাদের মধ্যে ফাইনাল সিদ্ধান্ত দিতে ও নিতে এসেছি। সিদ্ধান্ত পজেটিভ হলে আপনার সঙ্গে দেখা করে নিশ্চয় বিয়ের প্রস্তাব দিতাম।
তোমরা কি আলাপ করে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
জ্বি, নিয়েছি।
পজেটিভ না নেগেটিভ?
পজেটিভ।
শুনেছি, তোমার বাবা অনেক বিষয় সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। কর্মজীবন সম্পর্কে কোনো কিছু ভেবেছ?
জ্বি ভেবেছি। আমাদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপালের পোস্টের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছি। আশা করি, ইনশাআল্লাহ পোস্টটা পেয়ে যাব।
তোমাকে যদি এখানে পঁচিশ-ত্রিশ লাখ বা তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে কোনো ব্যবসা করে দিই, তা হলে কি ঐ চাকরি ছেড়ে দেবে?
কিছু মনে করবেন না, আমি কখনও কারও কাছ থেকে এতটুকু সাহায্যের আশা করিনি। যা চাওয়া আল্লাহপাকের কাছে চাই। তা ছাড়া আল্লাহপাকের অশেষ দয়ায় পৈত্রিক সম্পত্তি যা আছে বসে বসে খেলেও দু’তিন পিড়ি ভালোভাবে কেটে যাবে। এর বেশি কামনাও করি না। কারণ বেশি ধন-দৌলত আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয়। এসব কথা হয়তো আপনার মনঃপুত হচ্ছে না, তবু বলব, মুসলমানদের তথা মানুষের আসল ও চিরস্থায়ী ঠিকানা হল পরকাল। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত ক্ষণস্থায়ী ইহকালের ভোগবিলাসের উচ্চ আশা না করে পরকালের জন্য কাজ করা। আমি হয়তো ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম। সেজন্যে মাফ চাইছি। তারপর শফি চুপ করে গেল।
তানভীর সাহেব রুমে আসার সময় একজন বেয়ারারকে নাস্তা ও পানিয়ের অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। তাকে নাস্তার ট্রে-টেবিলে নিয়ে ঢুকতে দেখে শফি ও মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এস, নাস্তা খেয়ে নিই, তারপর আলাপ করা যাবে।
শফির কথা শুনে তানভীর সাহেব সন্তুষ্ট হয়েছেন। নাস্তা শেষে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান, ডালিয়ার মামাত ভাই মহসিনের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ঠিক হয়ে আছে?
জ্বি, জানি।
তবু এ পথে এগোলে কেন?
জানার পর কেন জানি মনে হয়েছিল, এ বিয়ে হবে না। আপনার মেয়েও জানত, তবুও কী করে কী হয়ে গেল, তা আমরা জানি না।
কিন্তু ডালিয়ার মা তার ভাই ভাবির সঙ্গে অনেক আগেই ওদের বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা আলাপ করে রেখেছে। তার কথার নড়চড় হবে না, হতেও দেবে না। কীভাবে কী হবে না হবে খুব চিন্তার বিষয়। আমি তো ভেবে…।
শফি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার কথার উপর কথা বলছি বলে মাফ চাইছি। আপনি আমাদের ব্যাপার নিয়ে এতটুকু চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ইশারাতে যখন আমরা একে অপরকে জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন যা করার তিনিই করবেন। আমি নিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ আমাদের আশা পূরণ হবে। এজন্যে হয়তো আল্লাহ আমাদেরকে বিপদ আপদ দিয়ে পরীক্ষা করবেন। আশা করি, তিনিই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করাবেন।
তার কথা শুনে তানভীর সাহেব অবাক হয়ে শফির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তাই দেখে শফি বলল, মনে হয় আপনার স্ত্রীর কারণে ডালিয়া ধর্ম থেকে দূরে ছিল এবং উচ্ছল জীবন যাপন করত। হঠাৎ সে এত ধর্মের। দিকে ঝুঁকে পড়ল কেন ভেবেছেন কি? এ ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, এতটুকু আলাপ পর্যন্ত হয়নি। তবু তার এই পরিবর্তন হল কী করে? নিশ্চয় এটাও আল্লাহর ইশারা। আবার বলছি, আমাদেরকে নিয়ে এতটুকু দুশ্চিন্তা করবেন না। এতকিছু বলে হয়তো বেয়াদবি করে ফেললাম, দয়া করে মাফ করে দেবেন। এবার অনুমতি দিন, আমাকে আজই বাড়ি ফিরতে হবে।
শফির কথা শুনতে শুনতে তানভীর সাহেবের মনে হয়েছে, ডালিয়ার কথাই ঠিক, কারও সঙ্গে তার তুলনা হয় না। তার শেষের কথা শুনে বললেন, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য এই রুম ভাড়া নেয়া হয়েছে। আজ এখানে থেকে যাও, কাল না হয় যাবে।
শফি বলল, মাফ করবেন, থাকা সম্ভব নয়। দাদিকে বলে এসেছি আজই ফিরব। না ফিরলে উনি খুব চিন্তা করবেন। সেজন্য রিটার্ন টিকিট কেটে এসেছি। তা ছাড়া জীবনে কোনোদিন কথার বরখেলাপ করিনি।
তানভীর সাহেব বললেন, তা হলে তোমাকে আর বাধা দেব না। তোমরা এস, আমি রিসেপশনে অপেক্ষা করছি বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
এতক্ষণ ডালিয়া শফির কথা শুনতে শুনতে কখন খুশিতে আবার কখন বিরহের কথা চিন্তা করে বারবার চোখের পানি মুছেছে। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর শফির দিকে চেয়ে ছলছল চোখে বলল, বেশি দিন তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না।
শফি তাকে চোখের পানি ফেলতে নিষেধ করে বলল, এত ভেঙ্গে পড়ছ। কেন? আগেই বলেছি না, প্রেমের পথ বড় দুর্গম। মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছাতে হলে দু’জনকেই ঐ দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে? চোখ মোছার পরও ডালিয়ার চোখ থেকে পানি পড়তে দেখে আবার বলল, মহসিন কিছুদিনের মধ্যে মা বাবাকে না জানিয়ে বন্ধুর বোনকে বিয়ে করবে। তারপর আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আর কোনো বাধা থাকবে না।
কথাটা শুনে ডালিয়া খুব অবাক হলেও আনন্দের আতিশর্যে শফিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল।
শফি তার হাত দুটো খপ করে ধরে বাধা দিয়ে বলল, এ কী করছ? বিয়ের আগে এরকম করা নিষেধ জান না?
ডালিয়া লজ্জা পেলেও বলল। সরি, কথাটা জানা থাকলেও ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, মহসিন ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারটা তুমি জানলে কী করে?
তা জানি না। মন বলল, তাই বলে ফেললাম।
তা হলে আমাকে মিথ্যে বলে প্রবোধ দিলে?
আল্লাহর মুমেন বান্দা মিথ্যে বলতে পারে না।
তা হলে বলছ না কেন, কী করে বললে?
এখন বলা যাবে না, তবে কিছুদিনের মধ্যে সবাই জানতে পারবে। এবার চল, আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। তোমার বাবা আমাদের জন্য রিসেপশনে অপেক্ষা করছেন ভুলে গেছ বুঝি?
না ভুলিনি বলে ডালিয়া বেরিয়ে আসার সময় বলল, প্রতিদিন ফোন করব। কখন করব বলে দাও।
শফি বলল, রাত সাড়ে দশটার পর, তবে তুমি প্রতিদিন করবে না। আমি একদিন, তুমি একদিন এভাবেই চলবে বুঝেছ বালিকা?
ডালিয়া হেসে ফেলে বলল, আমি বালিকা হলে তুমি নিশ্চয় বালক?
তুমি যখন বলছ তা হলে তাই।
ততক্ষণে তারা রিসেপশনে এসে গেল।
শফি বিদায় নেয়ার কথা বললে তানভীর সাহেব বললেন, চল, তোমাকে বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আমরা বাসায় ফিরব।
.
০২.
নাজিয়া ননদকে শ্বশুরের সঙ্গে ফিরতে দেখেছে। তাই সন্ধ্যার পর এক ফাঁকে তার রুমের দরজার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?
ডালিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এস ভাবি। তারপর আবার বলল, সেদিনের হাদিসটা অনুসরণ করছ জেনে খুব খুশি হয়েছি। সেই সাথে আল্লাহর শুকরিয়াও জানাচ্ছি।
নাজিয়া বলল, মুসলমান হিসাবে কুরআন হাদিসের কথা অনুসরণ করাই তো উচিত। তারপর বলল, এসব কথা পরে আলাপ করব। এখন কেন এসেছি নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
ডালিয়া হেসে ফেলে বলল, তা আর পারছি না।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে মিশন সাকসেসফুল?
হ্যাঁ ভাবি, আল্লাহর ইচ্ছায় সাকসেসফুল।
তোমার প্রেমিক এসেছিলেন তা হলে?
মুখে না বলে ডালিয়া মাথা নেড়ে সায় দিল।
কী করে মিশন সাকসেসফুল হল বল তো শুনি।
তোমার কথামতো বাবাকে সবকিছু বললাম। শুনে বাবা খুব রাগারাগি করল। তারপর যেসব কথা বলে বাবাকে ম্যানেজ করেছে ডালিয়া বলল।
তা হলে বাবাই তোমাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন?
হ্যাঁ।
বাবা ওনার সঙ্গে কথা বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছে।
ওনাকে বাবার পছন্দ হয়েছে?
ওকে যে দেখবে সেই পছন্দ করবে।
তা হলে সত্যি সত্যি মহসিন ভাইকে ক্যান্সেল করে দিলে?
আমার আগে সে-ই আমাকে করেছে।
একই গ্রামে যখন বাড়ি তখন মহসিন ভাই ওনাকে দুশমন ভেবে ওনার ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন।
যতদূর মনে হয় মহসিন ভাই তা করবে না। আর করলেও ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তা ছাড়া দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি দুটো গ্রামে।
কী করে বুঝলে মহসিন ভাই ওনার ক্ষতি করতে পারবে না?
মহসিন ভাইদের বাড়িতে থেকে দু’বারে দুটো প্রমাণ পেয়েছি।
দুটো কী প্রমাণ পেয়েছ বলতো?
প্রথমবার হুন্ডায় করে বেড়াতে গিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা এবং দ্বিতীয়বার মহসিন তাদের বাড়ির সামনে যে ঘটনা ঘটিয়েছিল সেসব জানিয়ে ডালিয়া বলল, আমার কী মনে হয় ভাবি জান, ও সব বিষয়ে পারদর্শী।
নাজিয়া জিজ্ঞেস করল, বাবা ওনার পুরো বায়োডাটা নিয়েছেন।
হ্যাঁ।
তুমি আগে ওনার বায়োডাটা জানতে?
মামার কাছে অল্পকিছু শুনেছিলাম।
আচ্ছা, তুমি তো রাজধানীর বুকে আধুনিক সমাজে মানুষ হয়েছ, তবু ওরকম একটা গ্রামের মোল্লা মার্কা ছেলের প্রেমে পড়ে গেলে কী করে? অথচ তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে না। এমন কী কিছুক্ষণের জন্যও মেলামেশা করনি।
এই প্রশ্নের উত্তরে ডালিয়া বাবাকে যেসব কথা বলেছিল, ভাবিকেও সেসব কথা বলে বলল, তার পৌরুষত্ব, বুদ্ধিমত্তা ও আদর্শ চরত্রের কথা যে জানবে, শ্ৰেণীমতো সে-ই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালবাসতে বাধ্য হবে।
এমন সময় কাজের বুয়া এসে নাজিয়াকে বলল, বেবী কাঁদছে ভাইয়া আপনাকে ডাকছেন।
নাজিয়া বলল, তুমি যাও আমি আসছি। তারপর ডালিয়াকে বলল, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। এখন আসি।
স্ত্রীকে রুমে ঢুকতে দেখে তওফিক জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি এই সময়ে আসি জান, তার উপর বেবী কাঁদছে। এরকম তো আগে কোনোদিন হয়নি।
বেবীকে কোলে তুলে নিয়ে নাজিয়া বলল, আগে তুমি ফ্রেস হয়ে নাও, আমি চা নিয়ে আসি তারপর বলব।
চায়ে চুমুক দিয়ে তওফিক বলল, কই বল।
আর এক মিনিট বলে নাজিয়া বেবীকে শাশুড়ির কাছে দিয়ে এসে বসে বলল, ডালিয়ার কাছে গিয়েছিলাম।
ননদের কাছে গিয়েছিলে ভালো কথা, তাই বলে স্বামীর ফেরার কথা ভুলে যাবে, এটা কেমন কথা? মনে হচ্ছে পুরানো হয়ে গেছি বলে স্বামীর কদর কমে যাচ্ছে।
তোমার ধারণা ভুল। ননদের একটা গুরুতর ঘটনা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করছিলাম।
ওর আবার গুরুতর ঘটনা কী?
তোমার বোনের কারণে মহসিন ভাই যে এখান থেকে চলে গিয়ে বন্ধুর বাসায় পেয়িংগেস্ট হয়ে আছে তা জান?
তাই নাকী? কই জানি না তো? তুমিও তো বলনি। তা মহসিন কবে এখান থেকে চলে গেছে?
হ্যাঁ, প্রায় পনের বিশ দিন হবে।
ডালিয়ার কারণে চলে গেছে বলছ কেন? মহসিনের পরীক্ষার পর তো ওদের বিয়ে হবার কথা? আর একথা ওদের ছোটবেলা থেকে ঠিক হয়ে আছে। সেকথা ওরাও জানে।
তা আমিও জানি; কিন্তু এখন দু’জনের কারও মত নেই। ইদানিং ডালিয়া যে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে সে খবর রাখ?
তা রাখব না কেন? একদিন কী দরকারে যেন ওর রুমে গিয়েছিলাম। দেখলাম বুকসেলফে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য বহু ইসলামিক বই রয়েছে। তা ছাড়া নিয়মিত নামায পড়ছে, বোরখা পরে ভার্সিটি যায় তাও জানি।
নাজিয়া বলল, এই জন্যেই দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য।
তওফিক বাবার মতো হয়েছে। ধর্মের অন্য কিছু না মানলেও নিয়মিত নামায রোযা করে। তাই বলল, ডালিয়া ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলছে, এটাতো খুব ভালো কথা। আমরা এখন ধর্মের অনেক কিছু মেনে চলছি না বলে সারাজীবন যে মেনে চলব না তাতো নয়। একটু বয়স হলে সব মুসলমানই মেনে চলে। তা এটা নিয়ে মহসিনের সঙ্গে ডালিয়ার মনোমালিন্য হবে কেন?
কারণ মহসিন ভাই ধর্ম কর্ম একদম পছন্দ করেন না। ডালিয়া আগের মতো প্যান্ট শার্ট পরে হুন্ডায় চড়ে বেড়ায় না, বোরখা পরে বাইরে যাতায়াত করে। এসব ব্যাপার নিয়ে একদিন দুজনের মধ্যে তুমুল বচসা। তার দুদিন পর মহসিন ভাই এখান থেকে চলে গেছে। শুধু তাই নয়, ডালিয়াকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়েও দিয়েছে। ডালিয়াও মহসিন ভাইকে একই কথা জানিয়ে দিয়েছে। বাবা মা জেনে ডালিয়াকে ভীষণ রাগারাগি করেছেন।
তওফিক বলল, বাসায় এতকিছু হয়ে গেল অথচ আমি কিছুই জানলাম না।
নাজিয়া বলল, তুমি সকালে অফিসে যাও, ফিরো রাত আটটা নটার সময়। চা খেয়ে দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত অফিসের খাতাপত্র দেখ। তারপর খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, বাসায় কী হচ্ছে না হচ্ছে জানার সময় কোথায় তোমার।
তওফিক বলল, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। আচ্ছা, হঠাৎ ডালিয়া ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ল কেন বলতে পার?
সেই কথাই তো এতক্ষণ ওর কাছে শুনছিলাম। ও এবারে মহসিনের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে পাশের গ্রামের একটা ধার্মিক ছেলেকে ভালবেসে ফেলেছে। ছেলেটাও নাকি ওকে ভালবেসে ফেলেছে। সেই জন্য ডালিয়া ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করছে বলে নাজিয়া হেসে ফেলল।
তওফিক অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী?
তা এতে হাসবার কী হল? ডালিয়ার ঘটনা মা জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখেছ?
নাজিয়া বলল, ভেবে আর কী করব? ঘটনা আরও অনেক দূর গড়িয়েছে। আজ সেই ছেলেটা এসেছিল ডালিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। ডালিয়া বাবাকে ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়ে ওনাকে দিয়েই তাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়েছে। বাবা কীভাবে কী করলেন, সে সব কথাও ডালিয়ার কাছে শুনছিলাম। তাই তোমার ফেরার কথা স্মরণ ছিল না।
তওফিক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল।
নাজিয়া মৃদু হেসে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? না হলে নিজের বোনকে ডেকে জিজ্ঞেস কর।
তওফিক বলল, এতক্ষণ যেন তোমার মুখে এক কল্পকাহিনী শুনছিলাম। তারপর বলল, এটা গল্প উপন্যাসের কাহিনী হতে পারে। তাই বলে বাস্তবে হওয়া কী সম্ভব? যাই হোক, এনিয়ে তুমি বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করো না। একটু আগে তুমিই তো বললে, ডালিয়ার উপর ভীষণ রেগে আছে। এখন যদি শুনে বাবা মেয়ের হয়ে এই কাজ করেছে, তা হলে আগুনে ঘী ঢালার মতো হয়ে যাবে।
নাজিয়া বলল, সেকথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। আমি সবকিছু জেনেও মাথা ঘামাই না। আজ সকালে ডালিয়া আমার কাছে এসে ছেলেটার আসার কথা জানিয়ে কীভাবে কী করবে পরামর্শ চেয়েছিল। আমি অপারগতা জানিয়ে বললাম, বাবাকে ধর। তিনি কিছু করতে পারেন। সন্ধ্যের পর তাকে বাবার সঙ্গে ফিরতে দেখে কী হল না হল জানার জন্য ওর কাছে গিয়েছিলাম।
তওফিক বলল, আমরা যে এসব জানি তা একদম ভুলে যাও। চুপচাপ দেখে যাও এরপরের ঘটনা কী হয়।
.
০৩.
শফি গ্রামের যুবক ছেলেদের নিয়ে একটা পাঠাগার তৈরি করল। সেই সাথে “সবুজ সংঘ” নামে একটা সংগঠনও করল। এসবের সিংহভাগ খরচ সে-ই দিয়েছে। এমনকি পাঠাগারটা নিজের জায়গায় নিজ খরচে করেছে। এশার নামাযের পর নীরক্ষর লোকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর প্রতিদিন সবুজ সংঘের সদস্যদের আত্মরক্ষার বিভিন্ন কলাকৌশল ও লাঠিখেলার প্রশিক্ষণ দেয় শফি। বন্ধু রবিউল সব সময় তার সাথে থাকে। এসব করার পেছনে রবিউলের অবদান কম নয়। সেও অনেক টাকা এসবের জন্য শফির হাতে তুলে দিয়েছে। শফিকে অফিসের কাজের জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়, তাই রবিউলকে পাঠাগার ও সবুজ সংঘের সবকিছু পরিচালনা করতে হয়। স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সেয়ানা ছাত্রীদের কোনো বখাটে যেন ইভটিজিং না করে সেজন্যে শফি একদিন মিটিং ডেকে সবাইকে সচেতন থাকতে বলল। আরও বলল, যারা ইভটিজিং করে তারা আমাদের কারও না কারও ভাই বা ছেলে। আমরা যদি তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে ইভটিজিং-এর ভয়াবহ পরিণতি ও শাস্তির কথা বুঝিয়ে বলি এবং তাদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখি, তা হলে কেউ আর ইভটিজিং করতে সাহস পাবে না। আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও নৈতিক চরিত্র গঠনের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ যেমন সরকার নিচ্ছে না, তেমনি ছেলেমেয়েদের গার্জেনরাও নিচ্ছেন না। তাই সংক্রামক ব্যাধির মতো ইভটিজিং গ্রামে, গঞ্জে ও শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। আর একটা কথা আপনাদের মনে রাখতে হবে, সেয়ানা মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় পর্দা করে পাঠাবেন। আর পর্দার প্রধান উপকরণ হল বোরখা। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) মেয়েদেরকে পর্দা করে বাইরে যাতায়াত করতে বলেছেন। আজকাল। অনেক মেয়ে অথবা মহিলা টাইট ফিট ও রং-বেরং-এর বোরখা পরে। আবার অনেকে বোরখা পরলেও মুখ খোলা রাখে। এসবের কোনোটাই ইসলামে জায়েয নেই। কারণ বোরখার উদ্দেশ্য হল মেয়েদের দেহ সৌষ্ঠব্য ও সৌন্দর্য ঢেকে রাখা। যাতে করে পর পুরুষদের কুদৃষ্টি তাদের উপর না পড়ে। কিন্তু উল্লিখিতভাবে বোরখা পরলে পরপুরুষের দৃষ্টি বেশি পড়বে। আর একটা জিনিস আজকাল বেশি দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীরা সাইড ব্যাগে বই নিয়ে সেটা পায়ের গোছ পর্যন্ত অথবা তার থেকে আরও নিচে ঝুলিয়ে দেয়। এটা মোটেই ঠিক নয়। কারণ বই হল বিদ্যা। আর বিদ্যা হল জ্ঞানের উপকরণ। সেটাকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেয়া বিদ্যার চরম অপমান। তাই এটার প্রচলন বন্ধ করা উচিত। মনে রাখবেন, বিদ্যার অপমান মানে আল্লাহকে অপমান করা। কারণ তিনি হলেন সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার ও সর্বশক্তিমান। কোনো বিষয়েই তাঁর সমতুল্য বিশ্বব্রহ্মান্ডে কেউ নেই। আর বেশি কিছু বলে আপনাদের বিরক্ত করব না। তারপর সালাম দিয়ে চুপ করে গেল।
এইসব করার ফলে শফির সুনাম আগের থেকে আরও বেশি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। তার সহযোগী হিসাবে রবিউলেরও সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
.
রাহেলা শফির কাছে প্রেম নিবেদন করে বিফল হবার কারণ জেনে কিছুদিন তীরবিদ্ধ হংসীর মতো ছটফট করেছে। তারপর হঠাৎ একদিন শফি ও রবিউল মোবাইল সেট নিতে আসার ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেদিন তারা চলে যাওয়ার পর ডালিয়া রবিউল স্যারের সম্পর্কে যা কিছু বলেছিল সে কথাও মনে পড়ল, “রবিউল স্যার প্রেমের দৃষ্টিতে তোর দিকে সারাক্ষণ চেয়েছিলেন।” তখন কথাটা তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিলেও এখন ডালিয়ার কথাটা বারবার মনে পড়ছে। ইদানিং শফির সঙ্গে রবিউল স্যারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে জেনে ভাবে, রবিউল স্যার কি সত্যিই তাকে ভালবাসেন? তখন তার মন বলে উঠল, নিশ্চয় ভালবাসেন। তা না হলে স্কুলে পড়ার সময় তোকে চোরাচোখে দেখতেন কেন? আর এখন ক্লাসে এসে তোকে প্রথমে দেখে তারপর লেকচার দেন। খোঁজ নিয়ে দেখ, তোর কারণে আজও তিনি বিয়ে করেন নি।
এই কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শফি মোবাইলে যে কথা বলেছিল মনে পড়ল, “একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় নি।” তা হলে সেও কি ডালিয়ার মতো বলতে চেয়েছিল? অনুমানটা যাচাই করার জন্য রাত দশটার সময় ফোন করল।
নাম্বার দেখেই শফি বুঝতে পারল, রাহেলা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
তাকে তুমি করে বলছে শুনে রাহেলার কলজেটা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠল। তাই সামলানোর জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
শফি বলল, কথা বলবে না তো ফোন করলে কেন?
সামলে নিয়ে রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহ এরকরকম রেখেছেন। আপনি কেমন আছেন?
শফি বলল, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তারপর আবার বলল, ভাই বোনের মধ্যে আপনি করে বলা শোভনীয় নয় বলে আমি তুমি করে বলছি। তুমিও তাই বলবে। এবার বল কেন ফোন করেছ?
শফির কথা শুনে রাহেলা দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, বোন ভাইয়ের খোঁজ নিতে পারে না?
নিশ্চয় পারে।
তা হলে ফোন করার কারণ জিজ্ঞেস করলে কেন?
হঠাৎ মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেছে, কিছু মনে করো না। তবে ফোন করে ভালই করেছ। সেদিনের না বলা কথাটা কয়েকদিন ধরে বলব বলব করেও কাজের চাপে সময় মতো ফোন করতে মনে থাকে না।
বেশ তো এখন বল।
কথাটা শুনে তুমি অন্য কিছু মনে করতে পার। তাই ভাবছি কথাটা বলা ঠিক হবে কি না।
ঠিক বেঠিক যাই হোক তুমি বল, আমি মনে কিছু করব না।
রবিউলকে তোমার কেমন মনে হয়?
তার অনুমানটা ঠিক ভেবে রাহেলা বলল, আমাদের কলেজের শিক্ষক হিসেবে যতটুকু জানি, উনি ভালো। ইদানিং তোমার সঙ্গে ওনারও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। আফটার অল তোমার বন্ধু তোমার মতই তো হবে। তা হঠাৎ ওনার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
কারণ ও তোমাকে স্কুল লাইফ থেকে ভালবাসে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
সেদিন ফোনে এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলে তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
তুমি ওনার হয়ে ওকালতি করছ?
না, বোনের জন্য করছি।
বুঝলাম না।
বোন বলে যখন গ্রহণ করেছি তখন তার উপযুক্ত পাত্র দেখতে হবে না? তুমি রাজি থাকলে আমি ব্যবস্থা করব।
আমার মন মানসিকতা এখন খারাপ। যদিও বুঝতে পেরেছি, তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখিত হয়ে যে আঘাত পেয়েছি, রবিউলের কথা বলে সেই আঘাতে মলম লাগাতে চাচ্ছ, তবুও বলব এখন এই ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না বলে সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
শফি চিন্তা করল, তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে, রাহেলা মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
এমন সময় মোবাইল বেজে উঠতে ডালিয়ার কথা মনে পড়ল। ভাবল, আজ তার ফোন করার পালা। এতক্ষণ নিশ্চয় অনেকবার ফোন করে এনগেজ জেনে কী মনে করছে কী জানি। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে ডালিয়া বলল, এতক্ষণ কার সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিলে? এদিকে আমি রিং দিতে দিতে পেরেশান।
শফি বলল, সেজন্যে আমার উপর রাগ হয়নি?
ডালিয়া বলল, না। তবে এই সময়ে আমি ফোন করব জেনেও অনেকক্ষণ অন্যের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিলে বলে একটু অভিমান হয়েছিল। অবশ্য এখন আর তা নেই। এবার বল কে সে, যার কারণে আমাকে এতক্ষণ ভোগালে?
শফি বলল, রাহেলা ফোন করেছিল। ও নিশ্চয় তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করেছে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
তার আগে বল, কথাটা আমাকে জানাওনি কেন?
মেয়েদের জেলাস বেশি। জানালে তোমার ওর প্রতি জেলাস হত। তা। ছাড়া কথাটা জানিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি। এবার নিশ্চয় বলবে কী করে জানলে?
রাহেলাই বলেছে।
আর কিছু বলে নি?
বলেছে, তোমাকে শুধু ভালবাসেনি, জীবন সাথীও করতে চাই। সেজন্য তুমি ধার্মিক জেনে সেও ধার্মিকা হওয়ার চেষ্টা করছে।
ওর কথা শুনে তোমার মনে কিছু হয়নি?
না, কিছু মনে হয়নি। তোমাকে তো আগেই বলেছি, “দুনিয়াতে যদি কাউকে বিশ্বাস করি সে তুমি।” তবে রাহেলার জন্য খুব চিন্তা হয়। তোমার আমার সম্পর্কের কথা জানার পর কী করবে কী জানি।
শফি বুঝতে পারল, রাহেলার সঙ্গে ভাইবোন সম্পর্কের কথা ডালিয়া জানে না। বলল, যেদিন রাহেলা প্রেম নিবেদন করে সেদিনই অপারগতা জানিয়ে ভাইবোন সম্পর্ক করেছি। তাই বলছি, ওর জন্য চিন্তা করার কিছু নেই।
তুমি যা করেছ তার তুলনা হয় না; কিন্তু ও যখন তোমার আমার সম্পর্কের কথা জানবে তখন কি করবে বা ভাববে, সেটা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ও যা জেদী মেয়ে, হয়তো চিরজীবনের জন্য ওর শত্রু হয়ে যাব।
ওর ব্যাপার নিয়ে তুমি এতটুকু দুশ্চিন্তা করবে না। আমাদের সম্পর্ক জানার পর হয়তো দুঃখ পাবে। মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের পাকা কথা হওয়া সত্ত্বেও আমার জন্য তুমি তাকে গ্রহণ করনি জেনে তোমার উপর বেশি দুঃখ পেলেও মহসিন ভাই তার বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছে জানার পর অতটা দুঃখ থাকবে না। আর আমার উপরও তার তেমন রাগ বা দুঃখ থাকবে না। কারণ ভাইবোন সম্পর্ক করার পর বন্ধু রবিউল যে তাকে স্কুল জীবন থেকে ভালবাসে সেকথা জানিয়েছি এবং তার বাবাকে রাহেলার সঙ্গে আমার ভাইবোনের সম্পর্কের কথা জানিয়ে বলেছি, বড় ভাই হিসাবে রাহেলার জন্য পাত্র ঠিক করে রেখেছি।
রবিউলের কথা শুনে রাহেলা কী বলল?
রাহেলা যা কিছু বলেছিল সেসব বলে শফি বলল, আমার ধারণা ইনশাআল্লাহ কিছুদিনের মধ্যে সে রবিউলকে ভালবাসতে শুরু করবে।
ডালিয়া অভিমানী কণ্ঠে বলল, এতকিছু ঘটনা ঘটল অথচ আমাকে কিছুই জানাওনি কেন? তুমি না, তুমি না বলে থেমে গেল।
শফি বলল, তুমি না, তুমি না বলে থেমে গেলে কেন? সেন্টেন্সটা পুরা কর।
ডালিয়া একই কণ্ঠে বলল, তুমি একটা পাজি ছেলে।
আমি পাজি ছেলে হলে তুমি পাজি মেয়ে।
আমি আবার পাজি মেয়ের মতো কী করলাম?
রাহেলা আমার কাছে প্রেম নিবেদন করেছে সেকথা জেনেও আমাকে না। জানিয়ে পাজি মেয়ের মতো কাজ করেছ।
তা হলে আমরা কি পাজি ছেলে মেয়ে হয়েই থাকব?
না, থাকব না। ভালো হবার চেষ্টা করব।
আচ্ছা, তোমার দীল এত শক্ত কেন?
প্রমাণ কর।
কতদিন হয়ে গেল তোমাকে দেখিনি। আমার কষ্ট হয়নি বুঝি? দীল নরম হলে নিশ্চয় একদিন এসে দেখা দিয়ে যেতে।
তোমার ধারণা ভুল। এতদিন তোমাকে না দেখে আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। তবু ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছি না। কারণ মাসখানেক হয়ে গেল নলছটী কামিল মাদরাসায় প্রিন্সীপাল পদে জয়েন করেছি। নতুন চাকরি, তার উপর সমাজকল্যাণের কাজও করতে হচ্ছে। তাই সময় করে উঠতে পারছি না। তবে আশা করি, ইনশাআল্লাহ আর দু’তিন মাসের মধ্যে সবকিছু সামলে নিতে পারব। তারপর কার দীল শক্ত আর কার দীল নরম জানতে পারবে। আমাদের আর সময় নেয়া ঠিক হচ্ছে না, রাত প্রায় তিনটে। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
প্রিন্সীপালের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় শফিকে প্রচুর খাটতে হচ্ছে। তার উপর প্রতিদিন পাঁচ মাইল করে দশ মাইল হাঁটতে হচ্ছে। তাই ভেবেছে এবারে অফিসের কাজে ঢাকায় গেলে হুন্ডা কিনে নিয়ে আসবে।
একমাসের বেশি হয়ে গেল রাহেলাকে তিনজন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করার কথা রবিউলকে বলা হয়নি। আজ রাহেলার সঙ্গে ফোনে আলাপ করার সময় সে কথা মনে পড়েছে। ভেবে রাখল, কাল ফজরের নামায পড়ে তার সঙ্গে দেখা করে কথাটা জানাবে।
পরের দিন ফজরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে রবিউলের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
রবিউল প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে এক ঘণ্টা মর্নিংওয়াক করে। আজ মর্নিংওয়াক করার সময় শফিকে দেখে সালামও কুশল বিনিময় করে বলল, কী ব্যাপার, এত সকালে যে কোনো দুঃসংবাদ আছে না কী?
শফি বলল, দুঃসংবাদ ও সুসংবাদ দুটোই আছে।
রবিউল বলল, তাই না কী? তা হলে বলে ফেল।
শফি প্রথমে রাহেলার দুর্ঘটনা ও তাকে উদ্ধার করার কথা বলে বলল, কিছু মনে করিস না, ঘটনাটা প্রায় একমাস আগে ঘটলেও সময় সুযোগের
অভাবে তোকে বলা হয়নি। জানিস তো প্রিন্সীপালের কাজের কত চাপ?
রবিউল রাগতস্বরে বলল, তা জানব না কেন? তাই বলে এমন একটা ঘটনা এতদিন না জানানো তোর উচিত হয়নি। রাহেলাকে উদ্ধার করেছিস বলে মাফ করে দিলাম, নচেৎ করতাম না। এবার সুসংবাদটা বল।
শফি বলল, কয়েকদিন আগে রাহেলা ফোনে আমার কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল। কথাটা বলে রবিউলের মুখের দিক চেয়ে রইল তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
রবিউল তাই দেখে হেসে ফেলে বলল, আবে, আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখছিস? রাহেলাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করে একরকম তাকে পুনর্জন্ম দিয়েছিস। তোর কাছে প্রেম নিবেদন করাই তো উচিত। তা তুই তাকে কী বললি?
শফি রাহেলাকে যা কিছু বলেছে, সে সব বলে ভাইবোন সম্পর্কের কথাও বলল।
রবিউল বলল, খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস। তা হলে এটাকেই সুসংবাদ বলছিস?
এটা সুসংবাদের একটা ছোট অংশ। বড় অংশটা হল, গতরাতে রাহেলা ফোন করেছিল। কথা প্রসঙ্গে বললাম, তুই তাকে স্কুল লাইফ থেকে ভালবাসিস।
রবিউল প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল, সত্যি বলছিস?
তুই তো জানিস আমি কখনও মিথ্যা বলি না।
সরি, কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। তোর কথা শুনে রাহেলা কী বলল?
এ ব্যাপারে রাহেলার সঙ্গে শফির যা কিছু কথা হয়েছে জানিয়ে বলল, আমার মনে হয় একদিন না একদিন রাহেলা তোকে ভালবাসবেই। তুই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর।
আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব। তুই দোয়া কর, “আল্লাহ যেন ধৈর্য ধরার তওফিক দেন।” তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর ডালিয়ার খবর কী? সেই যে দেড় দু’মাস আগে দেখা করতে গিয়েছিলি তারপর আর তো যাসনি?
যাবার সময় পেলাম কই? অফিসের কাজে সামনের মাসে ঢাকা যাব ইনশাআল্লাহ। ফেরার সময় মাদরাসায় যাতায়াতের জন্য একটা হুন্ডা কিনে নিয়ে আসব।
ডালিয়ার সঙ্গে দেখা করবি না?
ইনশাল্লাহ নিশ্চয় করব। এবার আমাদের কথা রেখে তোদের কথায় আসি, রাহেলার মোবাইল নাম্বার বলছি তোর মোবাইলে সেফ করে নে। মাঝে মাঝে ওকে ফোন করবি।
রবিউল বলল, কথাটা মন্দ বলিস নি। তবে তোর কাছ থেকে নাম্বার নেব না, ওর কাছ থেকে নেব।
শফি বলল, গুড, ভেরী গুড। সেটাই ভালো হবে।
কিন্তু নাম্বার চাইলে যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলে অথবা খারাপ ব্যবহার করে?
আরে না, ওসব করবে না। হাজার হোক সে তোর ছাত্রী। তুই অত ভীতু কেন? জেনে রাখ, মেয়েরা সাহসী ছেলেদের পছন্দ করে। এবার আসি, প্রায় পাঁচ মাইল হেঁটে মাদরাসায় যেতে হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে শফি চলে এল।
.
পরের দিন ডালিয়া সকালে নাস্তা খেয়ে রাহেলাকে ফোন করল।
রাহেলা নাম্বার দেখে ডালিয়া ফোন করেছে বুঝতে পেরে সালাম দিয়ে বলল, এবারে অনেক দিন পরে যে ফোন করলি?
সালামের উত্তর দিয়ে ডালিয়া বলল, তুইও তো ঐ দোষে দুষী?
রাহেলা বলল, আমার মন-মানসিকতা ভালো নেই, তাই কোনো কিছুই ভালো লাগে না।
জেনেও না জানার ভান করে ডালিয়া বলল, নিশ্চয় শফির কারণে তোর মন খারাপ?
ঠিক বলেছিস।
তোর মনের কথা তাকে জানাসনি?
রাহেলা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, জানিয়েছি; কিন্তু বলে চুপ। করে গেল।
চুপ করে গেলি কেন? কিন্তু কী বলবি তো?
রাহেলা কিছু না বলে চুপ করেই রইল।
কীরে, কিছু বলছিস না কেন? শফি কি তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ, ফিরিয়ে দিয়েছে।
কারণ বলেছে?
একটা মেয়ের সঙ্গে নাকী মন দেয়া নেয়া হয়েছে। এমন কী বিয়ের কথাও পাকা হয়ে গেছে।
ডালিয়া মেকী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তাই নাকি? তা মেয়েটার পরিচয় জানতে চাসনি?
নিষ্প্রয়োজন মনে করে জানতে চাইনি।
তুই যে খুব দুঃখ পেয়েছিস সেকথা শফি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে?
হ্যাঁ, পেরেছে।
বুঝতে পেরেও কিছু বলল না?
কী আর বলবে? অপারগতার জন্য ক্ষমা চেয়ে ভাইবোন সম্পর্ক করেছে। আমাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য।
ডালিয়া অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই কিন্তু দুটো ভুল করেছিস।
বল কী কী ভুল করেছি।
প্রথমটা হল, শফির মনের কথা না জেনে তার কাছে প্রেম নিবেদন করা। দ্বিতীয়টা হল, রবিউল স্যারের মনের খবর জেনেও তাকে এড়িয়ে চলা। আসল কথা কী জানিস, কাউকে মন দিতে হলে আগে তার মনের খবর নিতে হয়। যদি নিতিস, তা হলে এই পরিস্থিতিতে পড়তিস না। অপর পক্ষে রবিউল স্যার তোকে ভালবাসলেও তোর মনের খবর জানেন না। তাই সেকথা তোকে জানাতে পারছেন না। আমার মনে হয় তুই যদি ওনাকে একটু সুযোগ দিতিস, তা হলে নিশ্চয় তিনি তোকে মনের খবর জানাতেন। একদিন একটু সুযোগ দিয়ে দেখ আমার কথা ঠিক হয় কি না।
রাহেলা বলল, কী ব্যাপার বলতো? একদিন শফি ভাই রবিউল স্যারের কথা বলল, আজ আবার তুই বলছিস, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ওনার হয়ে ওকালতি করছিস কেন? উনি কি তোকে কিছু বলেছেন?
ডালিয়া বলল, রবিউল স্যার তোর শফি ভাইয়ের বন্ধু, তাই হয় তো বন্ধুর হয়ে কিছু বলতে পারেন। আমি ওকালতি করতে যাব কেন? তোদের ঘরে সেই একবারই যা ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। সেদিন ওনার চোখ মুখ দেখেই বুঝেছি, উনি তোকে ভীষণ ভালবাসেন। তোর মনে আছে কিনা জানি না, কথাটা কিন্তু ঐদিনই তোকে বলেছিলাম। যা বলছি শোন, শফিকে যখন ভাই ডেকেছিস তখন তাকে ভাইয়ের আসনে রেখে রবিউল স্যারের কথা চিন্তা কর, তা হলে শফিকে না পাওয়ার দুঃখ ভুলতে পারবি। আমি মামার মুখে শফি ও রবিউল স্যারের পারিবারিক অনেক কথা শুনেছি। শফির থেকে উনি কোনো অংশে কম না। তা ছাড়া আমার দৃষ্টিতে উনি শফির থেকে বেশি হ্যান্ডসাম। তোর ভালোর জন্য কথাগুলো বললাম। চিন্তা ভাবনা করে যা ভালো বুঝবি করবি।
রাহেলা আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, তোর কথা ভেবে দেখব। এবার তোর খবর বল।
ডালিয়া বলল, আমার আবার কী খবর?
কেন, যে ছেলেটার কারণে ধার্মিক বনে গেলি, যার কারণে মহসিন ভাইকে ত্যাগ করলি, সেই ছেলেটার খবর জানতে চাচ্ছি।
কী বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ডালিয়া চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।
একটু অপেক্ষা করে রাহেলা বলল, কী রে, কিছু বলছিস না কেন? তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি?
হয়েছে।
কী করে হল?
ফোনের মাধ্যমে।
তোর মনের কথা ওনাকে জানাতে পেরেছিস?
পেরেছি।
ওনার মনের খবর তুই জানতে পেরেছিস?
পেরেছি।
তা হলে সত্যি সত্যিই মহসিন ভাইকে বিয়ে করবি না?
না। কেন করব না সেদিন তো তোকে বলেছি, তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন? তা ছাড়া মহসিন ভাইও আমাকে বিয়ে করবে না জানিয়ে আমাদের বাসা থেকে চলে গেছে।
মহসিন ভাই কেমন আছে জানিস? অনেক দিন হয়ে গেল কোনো যোগাযোগ করেনি।
তুই ফোন করিসনি?
করেছি, রিং হয় না। মনে হয় সীম চেঞ্জ করেছে। তুই ওর ঠিকানা জানিস?
না। ভাইয়াকে বলব ওর ঠিকানা জানার জন্য।
ঠিকানা পেলে জানাস। এবার রাখি কলেজ যাবার সময় হয়ে গেছে বলে রাহেলা লাইন কেটে দিল।
.
০৪.
আজ রবিউল ক্লাস নিতে এলে ডালিয়ার কথা মনে পড়ল রাহেলার, “রবিউল স্যার কোনো অংশে শফির থেকে কম না, তা ছাড়া আমার দৃষ্টিতে উনি শফির থেকে আরও বেশি হ্যান্ডসাম। শফি যেদিন ওনাকে নিয়ে মোবাইল সেট নিতে এলেন, সেদিন চোখ মুখ দেখে বুঝেছি উনি তোকে ভীষণ ভালোবাসেন। তোর ভালোর জন্য কথাগুলো বললাম।”
ডালিয়ার কথাগুলো মনে পড়তে রাহেলা রবিউল স্যারের দিকে চাইতেই চোখে চোখ পড়ল। কারণ প্রতিদিনের মতো রবিউল আজও ক্লাসে এসে লেকচার দেয়ার আগে একবার রাহেলার দিকে চেয়ে নেয়। আজ কয়েক সেকেন্ড কারও চোখের পলক পড়ল না। আগে কখনও যদি হঠাৎ দুজনের চোখে চোখ পড়ত তখন রবিউল বুঝতে পারত, রাহেলা অবজ্ঞাভরে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিত। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে রবিউলের তনুমনুতে আনন্দের শিহরণ অনুভব করল। তাই পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
রাহেলার ক্লাসমেট ও বান্ধবী অঞ্জু সব সময় পাশাপাশি বসে। এক সময় রাহেলা তাকে রবিউল স্যারের ব্যাপারটা বলেছিল। তাই আজ তাদেরকে ঐভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রাহেলার হাতে একটু জোরে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, স্যারের দিকে ঐভাবে চেয়ে রয়েছিস কেন? সব ছেলেমেয়েরা তোদেরকে লক্ষ্য করছে।
রবিউল আগে তাকে আড় চোখে দেখত। তাই রাহেলা রেগে যেত বলে তিনি দেখতে ভালো না খারাপ বুঝতে পারেনি। আজ স্যারের দিকে ভালো করে চেয়ে বুঝতে পারল, সত্যি শফি ভাইয়ের থেকে স্যার বেশি হ্যান্ডস্যাম। অঞ্জু চিমটি কাটতে ও তার কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, অত জোরে চিমটি কাটলি কেন, লাগেনি বুঝি?
অঞ্জু বলল, এতদিন তো স্যার তোর দিকে চাইলে অবজ্ঞা ভরে দৃষ্টি সরিয়ে নিতিস, আজ এতক্ষণ ধরে চেয়েছিলি কেন? এদিকে ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা দৃশ্যটা দেখে কী ভাবল?
রাহেলা বলল, এখন চুপ কর, দেখছিস না স্যার লেকচার দিচ্ছেন? পরে তোর কথার উত্তর দেব।
ক্লাস শেষে রবিউল স্যার চলে যাবার পর অঞ্জু বলল, এখন অফ পিরিয়ড, কমনরুমে যাই চল। ওখানে তোর কথা শুনব।
রাহেলা বলল, ওখানে মেয়েদের ভীড়। তারচেয়ে বারান্দায় একপাশে দাঁড়াই চল।
বারান্দায়ও ছেলেমেয়েদের ভীড় কম নয়। এখানে ওখানে তিন চারজন। করে দলবেঁধে কথা বলছে। ওরা বারান্দার শেষ মাথায় এলে অঞ্জু বলল, যা বলার এখানেই বল। এর থেকে নিরিবিলি জায়গা পাবি না।
রাহেলা বলল, তুই শুনে অবাক হবি, রবিউল স্যার যখন ক্লাস টেনে পড়েন তখন থেকে আমাকে ভালবাসেন। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম। আমি অবশ্য তখন সেকথা জানতাম না। যাই হোক, স্যার এস.এস.সি পাশ করে এই কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। তারপর ঢাকা ভার্সিটি থেকে এম.এস.সি পাশ করে এই কলেজেই কয়েক মাস হল শিক্ষকতা করছেন। প্রথম থেকেই উনি ক্লাস নেয়ার সময় আড়চোখে আমাকে দেখতেন। সেজন্যে ওনার উপর আমার রাগ হত সেকথা তুইও জানিস। তখনও জানতাম না উনি আমাকে সেই স্কুল লাইফ থেকে ভালবাসেন। স্যার একটু লাজুক টাইপের। তাই হয়তো সেকথা আমাকে জানাতে পারেন নি। কিছুদিন আগে শফি ভাই আমাকে সেকথা জানায়। আরও জানায়, সে নাকি স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চায়।
অঞ্জু বলল, তোর তো একটাই ভাই। যার নাম মহসিন।
রাহেলা বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। কিছুদিন আগে আমি একবার সন্ত্রাসীদের হাতে পড়েছিলাম। সে সময় শফি ভাই এসে আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে। সেদিন শফি ভাই ঠিক সময়মতো না আসলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো পথ থাকত না। সেই থেকে তাকে ভাই বলি। আর সেও আমাকে ছোট বোনের মতো মনে করে।
অঞ্জু বলল, তুই কোন শফির কথা বলছিস? যিনি আশপাশের কয়েকটা গ্রাম থেকে বখাটে ছেলেদের ধর্মের পথে এনেছেন?
রাহেলা বলল, হ্যাঁ, ওনারই কথা বলছি।
অঞ্জু বলল, তুই খুব ভাগ্যবতী। তাই ওনাকে ভাই হিসাবে পেয়েছিস। আমাদের গ্রামের সবাই ওনাকে দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আমি ওনাকে মাত্র একবার দেখেছি। দেখতেও দেবতার মতো সুন্দর বলে দু’হাত জোড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করল।
রাহেলা বলল, কেন তোদের গ্রামের সবাই শফি ভাইকে দেবতার মতো মনে করিস?
আমার জ্যাঠাত বোন সুশীলা খুব সুন্দরী। সে ক্লাস টেনে পড়ে। স্কুলে যাবার পথে আমাদের গ্রামেরই বড়লোকের একটা বখাটে ছেলে কাশীনাথ সুশীলাকে প্রায় উত্যাক্ত করত। সুশীলা সেকথা বাবাকে জানাতে তিনি কাশীনাথের বাবাকে জানান। কাশীনাথের বাবা ছেলেকে খুব শাসন করেন। তার ফলে হিতে বিপরীত হল। একদিন কাশীনাথ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে স্কুল ফেরত সুশিলাকে ধরে একটা মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করছিল। সুশীলার চিৎকারে লোকজন এগিয়ে এলে কাশীনাথ ও তার বন্ধুরা বোমা ফাটিয়ে ভয় দেখিয়ে মাইক্রোতে সুশীলাকে তুলে পালাবার চেষ্টা করে। গাড়ির সামনে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাশীনাথ পিস্তল তাক করে বলল, সরে যাও নচেৎ..
কাশীনাথ কথাটা শেষ করার আগেই আগন্তুক এগিয়ে এসে তার পিস্তল ধরা হাতটা ধরে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে বললেন, সবাই গাড়ি থেকে নাম, নচেৎ প্রত্যেককে গুলি করে রাস্তায় শুইয়ে দেব।
ওদের মধ্যে রমেশ নামে একটা ছেলের কাছেও পিস্তল ছিল। আগন্তুকের কথা শুনে তাড়াতাড়ি পিস্তল বের করে গুলি করতে গেল।
তার আগইে আগন্তুক তার হাতে গুলি করতে পিস্তলটা হাত থেকে পড়ে গেল। আগন্তুক সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি সবাই নেমে এস, নচেৎ বাকিগুলোকেও গুলি করতে বাধ্য হব।
এবার ছেলেগুলো ভয় পেয়ে একে একে নেমে এল।
আগন্তুক নিজের সাইড ব্যাগ থেকে রশি বের করে পিছমোড়া করে তাদের দু’হাত বেঁধ্যে ফেললেন। তারপর সুশীলা ও অন্যান্য মেয়েদের এবং যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল, তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাদেরকে আর কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এরা আর কখনও যেন কোনো মেয়েদের দিকে কুদৃষ্টিতে না তাকায় সেই ব্যবস্থা করছি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কেউ এদেরকে চেনেন? অনেকেই বলল, হ্যাঁ, চিনি।
আগন্তুক বললেন, তা হলে এদের গার্জেনদেরকে ডেকে নিয়ে আসুন। কথা শেষ করে ছেলেগুলোকে এবার বললেন, তোমাদের কারও বোনকে যদি আমি বা যে কেউ ফুর্তি করার জন্য এভাবে তুলে নিয়ে যাই, তা হলে তোমরা কী করবে।
ছেলেগুলো কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে রইল।
আগন্তুক খুব কড়া মেজাজে বললেন, আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? উত্তর দাও বলছি, নচেৎ আমি কিন্তু উত্তর আদায় করার কৌশল জানি। আর সেই কৌশলটা হল, তোমাদের চোখ উপড়ে নেব।
কাশীনাথ ছাড়া সবাই ভয়ার্তস্বরে বলল, প্রতিজ্ঞা করছি, কখনও কোনো মেয়ের দিকে কুদৃষ্টিতে তাকাব না এবং এরকম গর্হিত কাজও করব না।
আগন্তুক কাশীনাথকে বললেন, তুমি কিছু বলছ না কেন? আমি জানি বিয়ের উপযুক্ত জয়া নামে তোমার একটা বোন আছে, তুমি কি চাও তাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করুক?
কাশীনাথ প্রথম থেকেই আগন্তুকের উপর খুব রেগে রয়েছে। এখন। আবার বোন জয়াকে নিয়ে কথা বলতে খুব অবাক হলেও আরও রেগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এসবের জন্য তোমাকে একদিন আফসোস করতে। হবে।
আগন্তুক বললেন, তাই নাকি? তারপর বলল, তুমি যে রেগে গেছ, জানো না, রেগে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আমার কাছে কিন্তু রাগ কমাবার ওষুধ আছে। এই কথা বলে আগন্তুক কাশীনাথের পিছমোড়া করা বাধা হাত দুটোর নিচ থেকে একটা হাত ঢুকিয়ে তার ঘাড় ধরে উপরের দিকে ধীরে ধীরে তুলতে লাগলেন।
কাশীনাথ প্রায় ছয়ফুট লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আগন্তুক তাকে এক হাতে শূন্যে তুলে ফেলতে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হল। কাশীনাথ বুঝতে পারল, এইলোক সাধারণ কেউ নয়। আর একটু দেরি করলে দুটো হাতই ভেঙ্গে যাবে। অসহ্য ব্যথা অনুভব করে ঝাঁকিয়ে উঠে বলল, প্লীজ, এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। ভবিষ্যতে আর কখনও কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইব না।
ততক্ষণে কাশীনাথের ও তার বন্ধুদের বাবারা এস গেছেন। তারাও দৃশ্যটা দেখে খুব অবাক হলেন। সবার আগে কাশীনাথের বাবা দেবনাথ আগন্তুককে বললেন, আপনি ওকে আরও কঠিন শাস্তি দিন। ও আমার বংশের কুলাঙ্গার সন্তান। ওকে আমার ছেলে ভাবতে ঘেন্না লাগে।
আগন্তুক কাশীনাথকে মাটিতে নামিয়ে সবার হাত খুলে দিয়ে বললেন, এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। ভবিষ্যতে যদি এরকম কাজ কর, তা হলে চোখ তুলে অন্ধ করে দেব যাতে কোনো মেয়ের দিকে কুদৃষ্টি না দিতে পার। একটা কথা মনে রাখবে, তোমরা পুরুষ, তোমাদের পৌরুষত্ব থাকা উচিত। পৌরুষত্ব বজায় রাখার জন্য মেয়েদের শ্ৰেণীমতো ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে। তা হলে মেয়েরাই তোমাদের পিছনে ঘুরবে।
দেবনাথ বললেন, আপনি ওদের ছেড়ে না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিলে খুশি হতাম।
আগন্তুক বললেন, আজকাল পুলিশদের চরিত্র বলতে কিছু নেই। ওরা ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেবে।
দেবনাথ বললেন, কেন, ইদানিং পেপারে পড়ছি, যারা এরকম গর্হিত কাজ করছে, তাদেরকে একমাস থেকে এক বছর পর্যন্ত জেল দিচ্ছে।
আগন্তুক বললেন, এ রকম শাস্তি ভোগ করার পর জেল থেকে বেরিয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য আরও বেশি এরকম কাজ করবে এবং যারা পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তাই আমি জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা না করে ওদের বিবেকের দরজা খুলে দিতে চেষ্টা করলাম। আমার মনে হয় ওরা আর এরকম কাজ করবে না। প্রত্যেক পিতামাতার উচিত ছোটবেলা থেকে সন্তানদের সৎ উপদেশ ও ধর্মীয় অনুশীলনে মানুষ করা। তা হলে বড় হয়ে তারা কোনো খারাপ কাজ করতে পারত না। যাই। হোক, এবার আসি বলে হাঁটতে উদ্দ্যত হলেন।
দেবনাথ পথ আগলে বললেন, কে বাবা আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
আগন্তুক বললেন, আমি আপনার ছেলের মতো। আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বলুন। তারপর বললেন, আমার নাম শফি, বাবার নাম মরহুম আমিনুল ইসলাম, বাড়ি চরদৌলতখান।
দেবনাথ বললেন, আমি তোমাদের মুরুব্বিদের চিনি। তোমার বাবা খুব ভালো লোক ছিলেন। তাইতো তুমিও বাবার মতো হয়েছ। যদি আমাদের। ঘরে গিয়ে একটু জলযোগ করে যেতে, তা হলে খুব খুশি হতাম।
শফি বললেন, আজ ক্ষমা করুন। আমি মাঝে মাঝে এদিকে আসি। আবার যখন আসব তখন আপনাকে খুশি করব।
সুশীলার বাবা কিছুক্ষণ আগে এসে সবকিছু শুনছিলেন। শফি থেমে যেতে সুশীলাকে দেখিয়ে বললেন, আমি ওর বাবা। তুমি আজ আমার যা উপকার করলে, সে ঋণ শোধ করতে পারব না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, “তিনি তোমার মঙ্গল করুন।” তারপর মেয়েকে বললেন, এই ছেলে মানুষ না দেবতা। দেবতাকে প্রণাম কর।
ওনার কথা শুনে অপরাধী ছেলেদের বাবারাও ছেলেদেরকে বললেন, তোমরাও দেবতাকে প্রণাম কর।
তারা প্রণাম করতে এলে তাদের থামিয়ে দিয়ে শফি বললেন, প্রণাম করতে হবে না। মানুষের কাছে মাথা নত করা আমাদের ধর্মে নিষেধ।
এমনিই দোয়া করছি “আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বদা সৎপথে চলার তওফিক দিন, তোমাদেরকে সুখী করুন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করুন।” তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
এই পর্যন্ত বলে অঞ্জু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমিও জেঠার সঙ্গে এসেছিলাম। আসার আগে যা কিছু ঘটেছে, পরে সুশীলার কাছে শুনেছি। সত্যি কথা বলতে কী, উনি দেখতে সত্যিই দেবতার মতো। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, চল, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
যেতে যেতে রাহেলা বলল, হ্যাঁ, তোর কথাই ঠিক, শফি ভাই দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর।
অঞ্জু বলল, রবিউল স্যারও দেখতে খুব সুন্দর। উনি তোকে ভালবাসলেও যখন লজ্জায় কথাটা জানাতে পারছেন না তখন তোকেই ওনার লজ্জা ভাঙ্গাতে হবে।
রাহেলা বলল, তুই কথাটা ঠিকই বলেছিস; কিন্তু লজ্জা ভাঙ্গাবার উপায়টা বলে দিবি তো।
অঞ্জু একটু চিন্তা করে বলল, একটা কাগজে তোর মোবাইল নাম্বার লিখে স্যারকে দিয়ে ফোন করতে বলবি। তা হলে দেখবি স্যারের লজ্জা ভেঙ্গে যাবে।
রাহেলা তার পিঠে আস্তে করে একটা চড় মেরে বলল, তোর তো দারুণ বুদ্ধি? এই সামান্য কথাটাও মাথায় আসেনি। তারপর বলল, আমার হয়ে তোকেই কাজটা করতে হবে। দাঁড়া এক্ষুনি মোবাইল নাম্বার লিখে দিচ্ছ বলে ক্লাসে এসে খাতা থেকে এক টুকরা কাগজ ছিঁড়ে লিখে দিল।
অঞ্জু হেসে উঠে বলল, কেন, তুই দিতে পারবি না?
রাহেলা বলল, পারলে তোকে বলতাম না।
.
কলেজ থেকে ঘরে এসে রাহেলার মনে হতে লাগল, রবিউল স্যার আজ রাতে নিশ্চয় ফোন করবেন। তাই সন্ধ্যের পর পড়তে বসলেও পড়ায় মন বসল না। কেবলই স্যারের কথা মনে পড়তে লাগল। সে প্রতিদিন রাত এগারটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। আজ পড়ায় মন বসাতে পারছে না বলে। দশটার সময় খেয়ে এসে ঘুমাতে গেল। বালিশে মাথা রেখে ভাবল, স্যার ফোন করলেন না কেন? ঠিক এই সময় মোবাইল বেজে উঠতে বুকটা আনন্দে ধক করে উঠল। চিন্তা করল, নিশ্চয় স্যার ফোন করেছেন। ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, কে আপনি? কাকে চান?
কলেজে অঞ্জু যখন কাগজটা দিয়ে বলল, স্যার, এতে রাহেলার ফোন নাম্বার আছে, আপনাকে ফোন করতে বলেছে তখন থেকে রবিউলের মনে আনন্দের জোয়ার বইছে। এখন তার কথা শুনে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি রবিউল, তুমি নিশ্চয় রাহেলা?
জ্বি, কেন ফোন করেছেন বলুন।
দুষ্টুমি হচ্ছে?
দুষ্টুমি কোথায় করলাম? আমি তো শুধু ফোন করার কারণ জিজ্ঞেস করলাম।
ফোন নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বলার পর কারণ জিজ্ঞেস করাটা দুষ্টুমি নয়তো কী?
আগে তা মনে হয়নি, আপনি বলার পর তাই মনে হচ্ছে। সরি, মাফ করে দিন।
মাফ করতে পারি, যদি তুমি প্রতিদিন আমাকে ফোন কর।
রাহেলা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, অন্যায় যখন করেছি তখন মাফ পাওয়ার জন্য শর্তটা তো মানতেই হবে।
আবার কিন্তু দুষ্টুমি করছ?
তাই নাকী? তা হলে আবার মাফ চাইছি।
রবিউল বলল, আর কোনো দুষ্টুমি নয়, আজ হঠাৎ ফোন নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বললে কেন?
এইজন্যে আপনি কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন?
না। বরং এত সন্তুষ্ট হয়েছি, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, এক যুগ আগের থেকে তোমাকে ভালবাসি। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কতটা সন্তুষ্ট হয়েছি?
আমিও কথাটা তখন থেকেই জানতাম; কিন্তু আমি ওসব পছন্দ করতাম না। তাই তখন আপনার উপর খুব রাগ হত। অবশ্য এখন তা হয় না।
কেন হয় না। শুনতে পারি?
শফি ভাইয়ের কাছে আপনার পরিচয় পেয়ে ও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে শফি ভাইয়ের সঙ্গে আপনারও সুনাম শুনে সেই রাগ অনুরাগে পরিণত হয়েছে।
রাগ হওয়ার কারণ জানালে, অনুরাগের কারণটা বললে খুশি হতাম।
ভালবাসার কথা জানান নি বলে। শেষ মেস যখন বুঝতে পারলাম, আপনি খুব লাজুক ও আপনার সৎ সাহসের অভাব তখন আমাকেই অগ্রভূমিকা নিতে হল।
রবিউল আনন্দে আপ্লুত হয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, সে জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আসলে এই ধন্যবাদ শফি ভাইয়ের পাওনা। কারণ সে যদি আপনার পরিচয় ও মনের খবর না জানাত, তা হলে হয়তো অগ্রভূমিকা নিতে পারতাম না। এবার দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সঠিক উত্তর পেতে চাই।
উত্তর জানা থাকলে ইনশাআল্লাহ সঠিকই দেব। বল কী জানতে চাও।
শফি ভাই কি মানুষ, না অন্য কিছু?
আমি ও শফি একই গ্রামে জন্মেছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। যাকে বলে বাল্যবন্ধু। সে যখন দশ বছর বয়সে আমাদের সঙ্গে একদিন খেলতে খেলতে হারিয়ে গেল তখন অনেক দিন ওর জন্য কেঁদেছি। দীর্ঘ বিশ বছর পর যখন ফিরে এল তখন আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। ছোটবেলায় ও আগাম অনেক কিছু বলতে পারত। এখনও পারে। কী করে পারে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, সন্তোষজনক উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছে, “আমার মন আমাকে যা বলে তাই বলি ও করি।” ওর সম্পর্কে আর কিছু জানতে চাও?
হ্যাঁ, শফি ভাই কি কোনো মেয়েকে ভালবাসে?
হ্যাঁ, ভালবাসে।
ঐ মেয়ের পরিচয় জানেন?
রবিউল জানে মহসিনের সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। তাই ডালিয়াকে শফি ভালবাসে বলা ঠিক হবে না ভেবে অনেকক্ষণ চুপ করে কী বলবে চিন্তা করতে লাগল।
রাহেলা বলল, এতক্ষণ চুপ করে আছেন কেন? শফি ভাই যাকে ভালবাসে তার পরিচয় জানেন বললেন, তবু বলছেন না কেন?
আগে ওয়াদা করতে হবে, শফিকে বা ঐ মেয়েকে এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবে না এবং ওদের উপর এতটুকু মনে কষ্টও নেবে না।
ডালিয়ার সঙ্গে ফোনে আলাপ করার সময় রাহেলার সন্দেহ হয়েছিল, শফি ডালিয়াকে ভালবাসে আর ডালিয়াও শফিকে ভালবাসে। তাই এখন রবিউলের ওয়াদা করার কথা শুনে সেই সন্দেহটা দৃঢ় হল। দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসছিল, সেটা চেপে রেখে বলল, ঠিক আছে, ওয়াদা করলাম।
রবিউল বলল, তোমার ফুপাতো বোন ডালিয়া।
রাহেলা এবার দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রাখতে পারল না। তাই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, সঠিক উত্তর দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক রাত হয়েছে, এবার আমাদের ঘুমান উচিত।
রবিউল বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ, শোন, কোথাও আমাদের দেখা সাক্ষাত হলে সালাম ও কুশল বিনিময় ছাড়া বেশিক্ষণ আলাপ করব না। এতে তুমি যেন আবার মনে অন্য কিছু করো না। এবার রাখি বলে সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
রাহেলা মোবাইল সেট বালিশের নিচে রেখে চিন্তা করল, ডালিয়া খুব ভাগ্যবতী। তাই আল্লাহপাক শফি ভাইকে উপলক্ষ্য করে মহসিন ভাইকে তার কাছ থেকে সরিয়ে দিলেন। পরক্ষণে ডালিয়া এতদিন কথাটা গোপন রেখেছে ভেবে তার উপর রেগে গেল। তাকে ভালো মন্দ কথা কিছু শোনাবার জন্য ফোন করার ইচ্ছা হলেও করল না। ভাবল, এত রাতে করা ঠিক হবে না, সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ততক্ষণাৎ রবিউলের কাছে ওয়াদা করার কথা মনে পড়তে আল্লাহর কাছে মাফ চাইল। তারপর রবিউলের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
.
০৫.
সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পর রাহেলা যখন বাবাকে বলেছিল শফির এতটুকু ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না তখন সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান যা কিছু বলেছিলেন মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। দু’দুবার শফি ছেলেকে অপমান করেছে, তার শক্তি সামর্থ, সর্বোপরি তার সুনাম চেয়ারম্যানের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই মেয়ে রাহেলাকে শফি পুনর্জন্ম দিলেও সেই আগুন আরও বেড়ে গেছে বই কমেনি। কয়েকদিন চিন্তা ভাবনা করে কীভাবে শফিকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেবেন তার প্ল্যান প্রোগ্রাম করলেন। তারপর একদিন কালকিনী গেলেন এমপি বসির মোল্লার সঙ্গে দেখা করতে।
ওনাকে দেখে এমপি সাহেব বললেন, আরে চেয়ারম্যান যে, কয়েকদিন থেকে আপনার কথা মনে হচ্ছিল। এসে ভালোই করেছেন, নচেৎ ডেকে আনার জন্য লোক পাঠাতাম। তারপর বসতে বলে একজন কাজের লোককে নাস্তা নিয়ে আসতে বললেন।
নাস্তা খাওয়ার পর এমপি সাহেব বললেন, ইলেকশানের সময় আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি।
চেয়ারম্যান বললেন, আমি কোনো চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারে আসিনি। এসেছি একটা ছেলেকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে।
এমপি সাহেব বললেন, বেশ তো ছেলেটার পরিচয় বলুন।
চেয়ারম্যান বললেন, যে ছেলেটা আপনার একমাত্র ছেলে ও তার দু’জন বন্ধুকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে।
এমপি সাহেব শুনে খুব রেগে গেলেন। বড় বড় চোখ বের করে কিছুক্ষণ চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন, তাকে আপনি চেনেন?
চিনি বলে চেয়ারম্যান শফির পরিচয় জানিয়ে বললেন, আপনি থানায় কেস দিয়ে এরেস্ট করিয়ে মেরে হাড় গোড় ভেঙ্গে ওকেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।
এমপি সাহেব কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললেন, সে ব্যবস্থা না হয় করা যাবে; কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, জেনেছি ঐ ছেলেটাই আপনার মেয়েকে উদ্বার করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। তবু কেন তাকে এরকম শাস্তি দিতে চাচ্ছেন?
চেয়ারম্যান শফির ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়ার ও বিশ বছর পর ফিরে আসার কথা জানিয়ে বললেন, ফিরে আসার কিছুদিন পর থেকে নিজের ও আশপাশের গ্রামে মাস্তানী করে বেড়াচ্ছে। এমন কি আমার ছেলে ও তার কয়েকজন বন্ধুকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে দিয়েছে। তা ছাড়া লেঠেল সর্দার মোবারকের একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামের যুবক ছেলেদের নিয়ে “সবুজ সংঘ” নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেছে। প্রতিদিন রাতে ঐসব ছেলেদের নানারকম অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা দিয়ে গুন্ডা বানাচ্ছে। আপনি ইচ্ছা করলে তাকে ও তার সঙ্গীদের জেএমবির সদস্য বলে গ্রেফতার করাতে পারেন। আমি চাই, শফিকে যেভাবেই হোক গ্রেফতার করিয়ে মেরে পঙ্গু করে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। তা হলেই আমার উপকার করা হবে। আর আপনার ছেলে জুলহাসের বর্তমান অবস্থার প্রতিশোধ নেয়াও হবে। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, কিছুদিন হল শফি নলছটি কামিল মাদরাসার প্রিন্সীপালের পদে চাকরি করছে।
এমপি সাহেব বললেন, তাই নাকী? আমি তো ঐ মাদরাসা পরিচালনা কমিটির ভাইসপ্রেসিডেন্ট। ইন্টারভিউর দিন আমারও থাকার কথা ছিল। সংসদে অধিবেশন চলছিল বলে সে সময় কয়েকদিন ঢাকায় ছিলাম। শফির খুব সুনাম শুনেছি। সেই ছেলে এরকম কাজ করবে ভাবতেই পারছি না।
চেয়ারম্যান বললেন, আমিও ছেলেটাকে খুব ভালো বলেই জানতাম; কিন্তু তলে তলে সে যে একটা কালপিট জানতাম না।
এমপি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন, চিন্তা করে দেখি কী করা যায়।
চেয়ারম্যান সালাম বিনিময় করে চলে যাওয়ার পর এমপি সাহেবের ছেলে ও তার দু’বন্ধুর পকেটে যে চিরকূট পাওয়া গিয়েছিল সে কথা মনে পড়ল। তাতে লেখাছিল, “আবার যদি কোনো মেয়ের দিকে কুদৃষ্টিতে চাও অথবা এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাও, তা হলে এখন যতটা শাস্তি পেয়েছ তার চেয়ে আরও বেশি শাস্তি পেতে হবে।” কথাটা মনে পড়তে এমপি সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে শফির উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললেন, তোকে জেএমবির কেসে ফেলে পুলিশ দিয়ে মেরে তোর হাড়গোড় গেঁড়ো করব, তারপর ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করব।
এমন সময় দাড়ি টুপিওয়ালা একটা হ্যান্ডস্যাম যুবককে আসতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আগন্তুক কাছে এসে সালাম দিলে এমপি সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন। বসার পর বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারছি না, কে আপনি?
আগন্তুক বলল, আমার দুটো পরিচয়, কোনটা শুনতে চান?
তার কথা শুনে এমপি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, একটা মানুষের আবার দুটো পরিচয় থাকে নাকি?
নিশ্চয় থাকে। যেমন আগে আপনি গ্রামের শুধু একজন প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। এখন আপনার পরিচয় এমপি। তাই এখন আপনার দুটো পরিচয়। তারপর বলল, আমারও দুটো পরিচয়। প্রথমটা হল আমি চরদৌলতখান গ্রামের মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে শফি। আর দ্বিতীয়টা হল নলছটি কামিল মাদরাসার প্রিন্সীপাল।
এমপি সাহেব তার কথা শুনে ও তার আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলেন, ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান; কিন্তু এই ছেলে সব রকমের মারামারিতে দক্ষ বিশ্বাস করতে পারলেন না। আরও বিশ্বাস করতে পারলেন না, জুলহাস ও তার দু’বন্ধুকে পঙ্গু করার, চেয়ারম্যানের ছেলে ও তার বন্দুদের হাত পা ভেঙ্গে দেয়ার ও লেঠেল সর্দার মোবারকের হাত ভেঙ্গে দেয়ার কথা। তার দিকে তাকিয়ে এইসব চিন্তা করছিলেন।
এমন সময় জুলহাস এসে শফিকে চিনতে পেরে খুব রেগে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই ছেলেটাই আমার এই দশা করেছে।
এমপি সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি জানি, তুমি ঘরে যাও।
জুলহাস চলে যাওয়ার পর শফি বলল, সেদিন আপনার ছেলের ও তার দু’বন্ধুর শাস্তিটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। সে জন্য মাফ চাইতে ও যাতে ওনারা আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা দেয়ার জন্য এসেছি।
এমপি সাহেব বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, তাই নাকি? কিন্তু ডাক্তাররা তো রায় দিয়েছেন, ওরা আর কখনও আগের জীবনের মতো স্বাভাবিক হবে না।
শফি বলল, ডাক্তারদের রায় অনেক সময় ভুল হয়। তা ছাড়া ওনারা। ঠিক রায় দিলেও আল্লাহপাক ইচ্ছা করলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। ইনশাআল্লাহ আমি চিকিৎসা করে ওনাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে পারব। তবে কয়েকটা শর্ত আছে।
এমপি সাহেব আগের মতো বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, কী কী শর্ত শুনি।
শফি বলল, প্রথমতঃ আপনি, আপনার ফ্যামিলী ও আহতদের সবাইকে ঠিকমতো নামায পড়তে হবে। তারপরের শর্তগুলো হল, কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না, গরিবদের প্রতি সহানুভুতীশীল হতে হবে। কখনও অন্যায়ের আশ্রয় নেবেন না, কারও অনিষ্ট চিন্তা করবেন না। আর চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষণ আগে আমার বিরুদ্ধে যা কিছু বলে গেলেন সেসব ভুলে যেতে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করে যদি আপনি আপনার সিদ্ধান্ত না পাল্টান, তা হলে তার পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী হবেন এবং সেজন্য আফসোসের সীমা থাকবে না। অনেক কিছু বলে হয়তো বেয়াদবি করে ফেললাম, দয়া করে মাফ করে দেবেন। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড টেবিলের উপর রেখে বলল, যদি শর্তগুলো মেনে চিকিৎসা করাতে চান, তা হলে ফোন করে জানাবেন। কথা শেষ করে সালাম বিনিময় করে চলে। গেল।
.
সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান এমপি সাহেবের কাছ থেকে ফেরার পথে শফিকে বিলের পাশে একটা কাঁঠাল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেন। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আজ মাদরাসায় যাওনি? এখানেই বা দাঁড়িয়ে আছো কেন?
শফি ওনার কথার উত্তর না দিয়ে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
ভালো আছি বলে চেয়ারম্যান বললেন, বাড়ি গেলে চল একসঙ্গে যাওয়া যাক।
শফি বলল, আমি মাদরাসায় যাব। তার আগে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
বেশতো বল।
আপনি এদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?
একটা দরকারী কাজে এমপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
দরকারী কাজটা কী বলবেন?
চেয়ারম্যান রেগে উঠে বললেন, সে কথা তুমি জিজ্ঞেস করার কে? আর আমিই বা তোমাকে বলব কেন?
আপনি না বললেও আমি জানি কী দরকারে এমপি সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন।
চেয়ারম্যান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, জানই যদি, তা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
সাবধান করার জন্য।
মানে? কী বলতে চাচ্ছ তুমি?
শফি বিলের পাড়ে কাশবনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বলল, ওখানে যে তিনটে ছেলে রাহেলার ইজ্জত লুটে তার মুখ এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, তাদের কী পরিণতি হয়েছে নিশ্চয় জানেন?
শফিকে দেখে প্রথম থেকেই চেয়ারম্যানের ভয় ভয় করছিল। এখন তার কথা শুনে ভয়টা বেড়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, হ্যাঁ জানি।
শফি বলল, ওরা জঘন্য অপরাধ করেছিল, তাই ওদেরকে শাস্তি দিয়েছি; কিন্তু আমি কী এমন অন্যায় করেছি, যার ফলে আমাকে ওদের চেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্য এমপি সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে এলেন। যদি বলেন, আপনার ছেলেকে একবার অপমান করেছি এবং আরও একবার তাকে ও তার বন্ধুদের মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিয়েছি। তাই আমাকে শাস্তি দিতে। চাচ্ছেন। তা হলে বলব, আপনার ছেলে ভীষণ অহংকারী। নিজের দোষে মার খেয়েছে ও অপমানিত হয়েছে। সেসব ভালো করে খোঁজ নেয়া উচিত ছিল আপনার। আপনি আমার বিরুদ্ধে যেসব কথা বলে আমাকে যে শাস্তি দেয়ার কথা এমপি সাহেবকে বলে এলেন, তা কি উচিত হয়েছে? এখন আমি যদি ঐ কাশবনে আপনাকে নিয়ে গিয়ে এমপি সাহেবের ছেলে ও তার দু’বন্ধুর মতো আপনারও অবস্থা করি, তা হলে কেমন হয়?
চেয়ারম্যান লম্বা, চওড়া ও স্বাস্থ্যবান এবং খুব প্রভাবশালী লোক। ভয় ডর কাকে বলে জানেন না। তবু শফির শেষের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেলেন। তখন মোবারক লেঠেল সর্দারের সঙ্গে শফির লাঠিখেলার দৃশ্য মনে পড়ল। কী করবেন, কী বলবেন ভেবে ঠিক করতে না পেরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ওনার অবস্থা দেখে শফি মৃদু হেসে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যা বললাম তা করব না। আর এমপি সাহেবকে যা কিছু করতে বলে এলেন, তা যাতে না করেন, সে ব্যবস্থা করে এলাম। এটা নিয়েও কোনো চিন্তা করবেন না। রাহেলা আমাকে ভাই ডেকেছে। তার কারণে আজ বেঁচে গেলেন। ভবিষ্যতে যদি আমার পেছনে লাগেন, তখন কিন্তু ছেড়ে দেব না। আর শুনুন, আপনার ছেলে মহসিন তার বন্ধুর বোনকে বিয়ে করে তাদের বাড়িতে আছেন। যত শীঘ পারেন ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসুন। ছেলেকে আর ঢাকায় পাঠাবেন না। তাকে আপনার ব্যবসায় লাগিয়ে দেবেন। তার বন্ধুর বড় বাই আন্ডারগ্রাউন্ডের লোক। ওখানে থাকলে মহসিন ভাইও ওদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন। আল্লাহ আপনাকে বিষয়-সম্পত্তি, মান-সম্মান অনেক দিয়েছেন। তবু কেন অন্যায় পথে পা বাড়ান। বরং আল্লাহর শোকরগুজার করে তার ও তাঁর রসুল (দঃ) ওর বিধি-বিধান মেনে চলাই তো উচিত। আল্লাহ শোকর গুজার বান্দাকে ভালবাসেন। তাই বলব, এবার সব রকমের কুচিন্তা ও কুকাজ ছেড়ে দিয়ে ধর্মের পথে চলুন। আর পরিবারের সবাইকে ধর্মের পথে চালাবার চেষ্টা করুন। আর একটা কথা, রাহেলাকে আমিও বোন বলে গ্রহণ করেছি। তাই বড় ভাই হিসাবে ওর বিয়ের পাত্রও চয়েস করে রেখেছি। আশা করি, পাত্রকে আপনাদের সবার পছন্দ হবে। যখন ওর বিয়ে দেবেন তখন পাত্র ও পাত্রপক্ষের সবকিছু জানাব। আমি হয়তো আপনার সঙ্গে অনেক বেয়াদবি করে ফেললাম, দয়া করে মাফ করে দেবেন। তারপর আসি আল্লাহ হাফেজ বলে শফি মাদরাসার পথে হাঁটতে লাগল।
চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন জ্ঞান হবার পর থেকে কখনও কারও কাছে হার স্বীকার করেননি। আজ শফির কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ওনার দৃঢ় ধারণা হল, শফি কিছুতেই মানুষ হতে পারে না। কী করবেন না করবেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করে শফির কথা মেনে নেয়াই উচিত ভেবে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। সারা রাস্তা শফির কথাগুলো চিন্তা করতে করতে ঘরে এসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে সোফায় চুপচাপ বসে রইলেন।
আখতার বানু স্বামীকে মন খারাপ করে ফিরতে দেখেছেন। তাই হাতের কাজ ফেলে এক জগ পানি ও এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে বললেন, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মুখে হাতে পানি দিয়ে সরবত খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও।
চেয়ারম্যান জগ নিয়ে বারান্দায় এসে মুখে হাতে পানি দিয়ে ফিরে এলে আখতার বানু গামছা এগিয়ে দিলেন।
গামছায় মুখ হাত মুছে চেয়ারম্যান সরবত খেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মহসিন বিয়ে করেছে তুমি জান?
আখতার বানু খুব অবাক হয়ে বললেন, কে তোমাকে একথা বলেছে?
চরদৌলতখান গ্রামের শফিকে চেন?
হ্যাঁ, চিনি।
সে বলেছে।
সে মিথ্যে বলেছে।
আমি জানি, সে কখনও মিথ্যা বলে না।
আখতার বানু রাগতস্বরে বললেন, নিজের ছেলের চেয়ে শফিকে বেশি বিশ্বাস কর?
করি। যারা শফিকে চেনে, তারা সবাই জানে সে কখনও মিথ্যা বলে না। এক্ষুনি মহসিনকে ফোন কর, তা হলে শফি সত্য বলেছে, না মিথ্যা বলেছে প্রমাণ হয়ে যাবে।
আখতার বানু ঘর থেকে মোবাইল এনে মহসিনকে ফোন করলেন। রিং হয়ে হয়ে লাইন কেটে গেল। আবার ফোন করতে দু’তিন বার রিং হবার পর মেয়েলী কণ্ঠ শোনা গেল, কাকে চান?
আখতার বানু বললেন, মহসিনকে চাই।
পনের বিশ মিনিট পরে ফোন করুন, উনি বাথরুমে।
কচি গলা শুনে আখতার বানু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে বলছ?
আমি ওনার ওয়াইফ।
আখতার বানু ছেলের উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগ সামলাবার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
সাদিয়া সুলতানা, ডাক নাম জুঁই। আপনি কে বলছেন?
আমি মহসিনের মা। বাথরুম থেকে বেরোলে বলবে আমি ফোন করতে বলেছি। তারপর লাইন কেটে দিলেন।
স্ত্রীকে লাইন কেটে দিতে দেখে চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, শফি সত্য বলেছে, না মিথ্যে বলেছে?
আখতার বানু রাগে কথা বলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কত শখ ছিল ডালিয়াকে বৌ করে আনব। সেকথা তার মা বাবাকে বলে বিয়ের কথা একরকম পাকা করে রেখেছিলাম। এখন তোমার বোন ও বোন জামাইকে কী বলব? তাদের কাছে মুখই বা দেখাব কী করে? মহসিন সেকথা জেনেও এমন কাজ করবে ভাবতেই পারছি না।
চেয়ারম্যান বললেন, ওসব কথা পরে ভেব, শফি আরও অনেক কিছু বলেছে। সেসব শুনলে পীলে চমকে উঠবে।
আখতার বানু রেগে উঠে বললেন, এসব ঐ শফিরই চক্রান্ত। সেই আমার ছেলের পেছনে লেগেছে। সে কলকাঠি নেড়ে এই কাজ করিয়েছে।
চেয়ারম্যানও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, একেই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি। শফি কখনও কারও পেছনে লাগেনি; বরং আমরাই পেছনে লেগে তার ক্ষতি করতে চেয়েছি। সে আরও কী বলেছে আগে শোন তারপর শফি যেসব কথা বলেছে, সেসব জানিয়ে বললেন, এখন বল, শফি আমাদের ভালো চায়, না মন্দ চায়?
আখতার বানু বললেন, কিন্তু শফি এতসব খবর জানল কী করে? সে থাকে গ্রামে, ঢাকায় মহসিনের বিয়ের কথা…
স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান বললেন, শফি কী করে জানল, সেটা তো বড় কথা নয়, বড় কথা যা বলেছে তা তো সত্যি? সে আরও একটা কথা বলেছে, তারপর রাহেলার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছে বললেন।
আখতার বানু কী বলবেন না বলবেন ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলেন।
চেয়ারম্যান বললেন, চুপ করে আছ কেন? এটাকেও কি শফির চক্রান্ত বলবে?
ভাইয়া ডালিয়াদের বাসা থেকে বন্ধুর বাসায় চলে গেছে জানার পর সে অনেকবার তাকে ফোন করেছে; কিন্তু রিং হলেও ভাইয়া রিসিভ করেনি। তাই সেদিন ডালিয়াকে সেকথা জানিয়ে বলেছিল, ভাইয়া মনে হয় সীম চেঞ্জ করেছে। তুই তার ফোন নাম্বার জেনে আমাকে জানাবি। ডালিয়া চার পাঁচদিন আগে ফোন করে জানাবার পর প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করেছে; আগের মতো রিং হলেও ভাইয়া ধরেনি। এখন মাকে ঐ নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে শুনে খুব অবাক হয়েছিল। তারপর অন্য কেউ ফোন রিসিভ করেছে বুঝতে পেরে ভাবল, আমি ফোন করলে ভাইয়া মোবাইলে আমার নাম্বার দেখে ফোন রিসিভ করে নি। এখন মা ফোন করতে নাম্বার চিনতে না পেরে নিশ্চয় ভাবি রিসিভ করেছে। ভাইয়া থাকলে মায়ের নাম্বার দেখে হয়তো রিসিভ করত না।
রাহেলা এতক্ষণ আড়ালে থেকে মা বাবার কথা শুনছিল। মাকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার সামনে এসে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি তোমার সঙ্গে একমত। শফি ভাই যেমন কখনও মিথ্যা বলে না, তেমনি কখনও কারও অনিষ্ঠ চিন্তা করে না। তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি যদি শফি ভাইয়ের সঙ্গে অল্পক্ষণ আলাপ করতে, তা হলে বুঝতে পারতে সে মানুষ হলেও ফেরেশতার মতো তার আচরণ। তুমি বাবার কাছে জানতে চেয়েছ শফি ভাই গ্রামে থেকেও মহসিন ভাইয়ের ব্যাপারে এতকিছু জানল কী করে? বাবা উত্তর দিতে না পারলেও আমি পারব। আল্লাহ তাকে এমন কিছু একটা ক্ষমতা দিয়েছেন, যার ফলে সে আগাম অনেক কিছু। বলতে পারে এবং প্রয়োজনে আট দশজন মানুষের ক্ষমতা ধরতে পারে। তারপর বাবাকে আবার বলল, তুমি দেখেছ ভাইয়া ও তার পাঁচ বন্ধুকে শফি ভাই একা কীভাবে লড়াই করে তাদের হাত পা ভেঙ্গে দিতে এবং লাঠি খেলার সময় লেঠেল সর্দার মোবারক চাচার একটা হাত ভেঙ্গে দিতে। আর আমি দেখেছি, এমপি সাহেবের ছেলে জুলহাস ও তার দু’বন্ধুকে কীভাবে পঙ্গু করল। জুলহাসকে ধরে যখন আছাড় মারছিল তখন মনে হল একটা পাঁচ-ছ বছরের ছেলেকে আছাড় মারছে। তারপর বলল, শফি ভাই যা কিছু বলেছে সব সত্য। সে যা কিছু করতে বলেছে, তা তোমাদের করাই উচিত। বলে আমি মনে করি।
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ মা, তুই ঠিক বলেছিস। আমি দু’চার দিনের মধ্যে ওদেরকে নিয়ে আসতে যাব। তারপর স্ত্রীকে বললেন, মহসিন ফোন করলে তার ঠিকানা জেনে নিও।
.
০৬.
মহসিন গোসল করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যখন কাপড় পরছিল তখন জুঁই বলল, তোমার মা একটু আগে ফোন করেছিলেন। আমি নাম্বার না দেখে ভুল করে রিসিভ করি। উনি তোমাকে চাইলেন। বললাম তুমি গোসল করছ। বললেন, গোসল করা হয়ে গেলে ফোন করতে বলবে।
মহসিন বলল, তোমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
আমি কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। বললাম, আমি ওনার স্ত্রী জুঁই।
আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
না।
তোমার পরিচয় পাওয়ার পর রেগে গেছে কিনা বুঝতে পারনি?
কই, তেমন কিছু বুঝতে পারিনি।
মহসিন চিন্তিত মুখে বলল, আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি মা বাবাকে জানাতে চাইনি। একটা ভালো চাকরি পাওয়ার পর জানাতে চেয়েছিলাম।
ভাইয়া তো তোমাকে তার অফিসে বড় পোস্ট দিতে চেয়েছিল, তুমি নিলে না।
ভাইয়া যে আন্ডারগ্রাইন্ড দলের লিডার তা জুঁই জানে না। মহসিনও জানে না। জুঁই-এর অনুরোধে তার ভাইয়া রাসেল একদিন মহসিনকে অফিসে নিয়ে গিয়ে বড় অংকের বেতনের কথা জানিয়ে এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের পোস্ট দেয়ার কথা বলেছিল। তখন মহসিন বলেছিল, সেসন জট না হলে তিন মাস পরে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। ভেবেছি পরীক্ষার পর যা করার করব।
রাসেল বলেছিল, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ, কিন্তু জুঁই তো সে কথা আমাকে বলেনি। ঠিক আছে, পরীক্ষার পর না হয় জয়েন করো।
এখন স্ত্রীর কথা শুনে মহসিন বলল, কেন ভাইয়ার অফিসে চাকরিটা নিলাম না তোমাকে বলেছি। তবু ঐ কথা বলছ কেন? যাই হোক, মা যখন বিয়ের কথা জেনেই গেছে তখন মোবাইলটা দাও ফোন করি। তার আগে তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি, মা চেয়েছিল তার ননদের মেয়ে ডালিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে। ডালিয়াকে বোধ হয় আমার সঙ্গে তুমি দু’একবার দেখে থাকবে। তুমি তো জান এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমি ওদের বাসায় থেকে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছি। ডালিয়া মোটামুটি সব দিক থেকে ভালো এবং মায়ের ইচ্ছার কথা জানা সত্ত্বেও কেন কী জানি তাকে আমার ভালো লাগেনি। অবশ্য তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো মা বাবার কথামতো অনিচ্ছা সত্ত্বেও একদিন তাকে বিয়ে করতে হত। ইদানিং ডালিয়া ধর্মের দিকে খুব ঝুঁকে পড়েছে। মনে হয় কোনো ধার্মিক ছেলের পাল্লায় পড়ে সেও ধার্মিক হবার চেষ্টা করছে। একদিন তাকে বললাম, ধর্ম-কর্ম হল বুড়ো বয়সের ব্যাপার আর যৌবনকাল হল আনন্দ ফুর্তি করার সময়। তাই ধর্ম-কর্ম আমি এখন পছন্দ করি না, তুমিও ঐ পথ থেকে সরে এস।
আমার কথা শুনে ডালিয়া খুব রেগে গেল। বলল, “ধর্ম-কর্ম বুড়ো বয়সের ব্যাপার এ কথা ঠিক নয়। ছোটবেলা থেকে মা বাবা ছেলে মেয়ে দের ধর্মিয় শিক্ষা দিয়ে সেইসব অনুস্মরণ করিয়ে মানুষ করবে। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে ধর্মের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। তাই তোমাকেও ধর্মের আইন এখন থেকে মেনে চলতে হবে। যদি না চল, তা হলে জেনে রাখ, আমাদের বিয়ের পাকা কথা হয়ে থাকলেও আমি তোমাকে কিছুতেই বিয়ে করব না।”
এই ঘটনার আগে তোমাকে দেখে ও তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালবেসে ফেলেছি। কী করে ডালিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে না হয়, সেই সুযোগ খুঁজছিলাম। ডালিয়া নিজেই যখন ঐ কথা বলে বিয়ে করবে না বলল, তখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। বললাম, ঠিক আছে, তুমি নিজেই যখন আমাকে বিয়ে করবে না বলছ তখন আমিও কোনোদিন এ ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলব না। তার দুদিন পরে আমি ওদের বাসা থেকে তোমাদের বাসায় চলে আসি। তখন ভেবেছিলাম, পরীক্ষার পর কিছু একটা আয় করার পথ করে তোমাকে বিয়ে করব; কিন্তু ডালিয়া যদি মত পাল্টে আমাকে বিয়ে করতে চায়, সে কথা ভেবে মা বাবাকে না জানিয়ে তোমাকে বিয়ে করি। বিয়ের আগে ডালিয়ার ব্যাপারটা তোমাকে জানান উচিত ছিল। কিন্তু জানাব জানাব করেও জানান হয়নি। তুমি কিছু মনে করনি তো?
জুঁই সত্যিকার মহসিনকে ভালবেসেছিল। তার ভালবাসার মধ্যে এতটুকু খাদ ছিল না। তাই তার কথা শুনে বলল, আগে যা জানান উচিত ছিল তা যখন জানাওনি তখন আর এখন জানাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। তোমার অতীত নিয়ে সেই ভালবাসায় গরল ঢোকাতে চাই না। তুমি তোমার মাকে ফোন কর।
মহসিন জানে, মায়ের মোবাইল নেই। বাবার মোবাইলে ফোন করতে সহাস হল না। তাই রাহেলার মোবাইলে ফোন করল।
রিং হচ্ছে শুনে রাহেলা মোবাইল হাতে নিয়ে বুঝতে পারল, ভাইয়া ফোন করেছে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন আছ?
মহসিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, তুইও ডালিয়ার মতো ধার্মিক হয়ে গেছিস?
রাহেলা বলল, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ধর্মকে জানাও মানা অবশ্য কর্তব্য। এটা হাদিসের কথা। তা আমি ধার্মিক হয়ে গেছি বুঝলে কী করে?
এই যে ফোন ধরেই সালাম দিলি। আগে তো দিতিস না।
আগে ধর্ম কি জিনিস জানাতম না, তাই দিই নি। এখন একজনকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ হেদায়েত দিয়েছেন। তাই ধর্মিয় বই পুস্তক পড়ে ধার্মিক হবার চেষ্টা করছি।
তা হ্যাঁরে, তোরা আমার বিয়ের কথা আগে জেনেছিস, না মা ফোন করে তোর ভাবির সঙ্গে আলাপ করার সময় জানতে পারলি?
আগে আমরা কেউ জানতাম না। আজ দুপুরের দিকে শফি ভাই বাবাকে জানিয়েছে। বাবা ঘরে এসে মাকে জানায়, মা শুনে বিশ্বাস করে নি। বাবা তোমার কাছে ফোন করতে বলে। মা ফোন করলে ভাবি। ধরেছিল। তার সঙ্গে কথা বলার পর বিশ্বাস করে।
শফির কথা শুনে মহসিন খুব রেগে গেল। রাগের সাথে জিজ্ঞেস করল, তুই কোন শফির কথা বলছিস? চরদৌলতখানের শফি নয়তো?
হ্যাঁ, সেই শফি।
মহসিন আরও রেগে উঠে বলল, শালা হারামীর বাচ্চা এখনও আমার দুষমনী করছে। সময় সুযোগ মতো শালাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে না দিয়েছি তো আমার নাম পাল্টে রাখব।
ভাইয়া, না জেনে এসব তুমি কী বলছ? তুমি চলে যাবার পর শফি ভাই এই কয়েক মাসে এখানে অনেক কিছু করেছে। যা শুনলে তুমি অবাক হবে। আর তাকে তুমি কিনা গালাগালি করছ?
মহসিন রাগের সঙ্গেই বলল, তুই তাকে বারবার শফি ভাই শফি ভাই বলছিস কেন? ও আমাকে দু’বার যা অপমান করেছিল, তার প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাব না। তুই তার পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস জেনে খুব অবাক হচ্ছি।
রাহেলা বলল, সে সব বলতে গেলে দু’চার ঘণ্টা সময় লাগবে। শুধু এইটুকু শুনে রাখ, শফি ভাইকে চিনতে আমরা সবাই ভুল করেছি। সে মানুষ হলেও তার চরিত্র ফেরেশতার মতো। তারপর এমপি বসির মোল্লার ছেলে জুলহাস কী ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং শফি কীভাবে তাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করল, সেসব বলে বলল, সে সময় যদি শফি ভাই এসে না পড়ত, তা হলে অনেক আগেই আমার মৃত্যুর খবর পেতে। পরে আরও অনেক কিছু বিস্তারিত বলব। এখন তোমার ঠিকানা বল।
ঠিকানা জানতে চাচ্ছিস কেন?
বাবা তোমাদেরকে নিয়ে আসতে যাবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তাই।
কবে আসবে কিছু বলেছে?
নির্দিষ্ট করে কিছু বলে নি। বলল, কয়েকদিনের মধ্যে যাবে। তুমি ঠিকানা বলবে তো?
মহসিন ঠিকানা বলে বলল, হ্যাঁ রে, বিয়ে করেছি জেনে মা বাবা আমার উপর খুব রেগে আছে তাই না?
বাবা রেগেছে, তবে কতটা রেগেছে বলতে পারব না, কিন্তু মা তোমার উপর যেমন রেগে আছে, তেমনি মনে দুঃখও পেয়েছে। মা ডালিয়াকে বৌ। করে আনবে অনেক দিনের ইচ্ছা, তা জেনেও তুমি বন্ধুর বোনকে বিয়ে করলে কেন? মা বাবা, ফুপা-ফুপির কাছে কত ছোট হয়ে গেল। তুমি এমন করবে আমরা কেউ চিন্তাই করতে পারিনি।
মহসিন বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, এর জন্য ডালিয়াই সম্পূর্ণ দায়ী। সে এবারে আমাদের বাড়ি থেকে এসে ধার্মিক বনে গিয়ে আমাকে খুব অবহেলা করত। তা ছাড়া আমি যখন তাকে ধর্ম-কর্ম বাদ দিয়ে আমার মতে চলতে বললাম তখন সে রাজি তো হলই না বরং ধর্মের পথে না এলে আমকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দিল।
রাহেলা বলল, ওসব কথা মা বাবাকে বলল। এখন বল ভাবি কেমন হয়েছে?
মহসিন বলল, ভালো। তবে কতটা ভালো বাড়িতে যাওয়ার পর তোরা বলবি।
ভাবি তোমার কাছে আছে?
একটু আগে ছিল, এখন নেই। ডাকব কথা বলবি?
রাহেলা মাকে আসতে দেখে বলল, পরে বলব। মা এসেছে আগে তার। সঙ্গে কথা বল। তারপর মায়ের হাতে মোবাইল দিয়ে বলল, ভাইয়া।
সবকিছু জেনেও মহসিন গোপনে বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছে জানার পর আখতার বানু ছেলের উপর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কোনোদিন ছেলে বৌকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না; কিন্তু স্বামী যখন বলল, ওখানে থাকলে ওর সমন্ধি ওকে বেলাইনের কাজে লাগিয়ে দেবে তখন রাগ পড়ে যায়। এখন সে ফোন করেছে শুনে মোবাইল কানের কাছে নিয়ে কান্নাজড়িত স্বরে বললেন, তুই এরকম কাজ করবি স্বপ্নেও ভাবিনি। তোর ফুপা ফুপুর কাছে মুখ দেখাব কী করে?
মহসিন বলল কেন এরকম কাজ করলাম সেসব বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে, এখন বলা সম্ভব নয়, বাড়িতে গিয়ে বলব। আর ফুপা ফুপির কথা যে বললে ও নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। ওনারা জানেন ডালিয়ার জন্যই এরকম ঘটনা ঘটল। বরং ওনারাই ভাবছেন কীভাবে তোমাদের কাছে মুখ দেখাবেন। এক হাতে যে তালি বাজে না তা তুমি জানই। ডালিয়া দোষী জেনেই ওনারা তোমাদেরকে এ ব্যাপারে কিছু জানান নি। তারপর জিজ্ঞেস করল, বাবা নাকি আমাদের নিয়ে যেতে আসবেন?
আখতার বানু বললেন, তোর বাবা তো তাই বলল। কবে যাবে বলেনি। শুধু বলল, তাড়াতাড়ি তোদের নিয়ে আসতে যাবে। আচ্ছা, বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছিস চরদৌলতখানের শফি জানল কীকরে বলতে পারিস?
তখনও সেখানে রাহেলা ছিল। ভাইয়া কিছু বলার আগে মায়ের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বলল, ভাইয়া পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব, এখন রাখছি বলে লাইন কেটে দিয়ে মাকে বলল, এসব কথা ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করছ কেন? শফি ভাই কী করে জানল, সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। আর ভাইয়ার জানা একেবারেই সম্ভব নয়। তখন বললাম না, শফি ভাইয়ের আল্লাহর দেয়া এমন কিছু শক্তি আছে যার ফলে কেউ কোনো অন্যায় করলে অথবা কোথাও কোনো অন্যায় ঘটনা ঘটলে জানতে পারে। তা না হলে বাবা তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এমপি সাহেবকে যা কিছু বলেছিল তা শফি ভাই জানল কী করে?
আখতার বানু বললেন, যদি ছেলেটা কখনও আসে, আমাকে বলবি, তাকে দেখব।
রাহেলা বলল, ঠিক আছে, দেখাব।
কাল শফি মাদরাসার অফিসের কাজে ঢাকা যাবে। তাই আজ রাতে ডালিয়াকে ফোন করল।
ডালিয়া ফোন রিসিভ করে সালাম ও কুশল বিনিময় করে অভিমানী কণ্ঠে বলল, আজ এক সপ্তাহ নিজেও ফোন করনি আর আমার ফোন রিসিভও করনি। এর কারণ বলবে?
শফি বলল, সে জন্যে আমার উপর তোমার রাগ অভিমান হয়নি?
রাগ হয়নি, তবে অভিমান হয়েছিল। তুমি ফোন করতে তা আর নেই।
এটাই তোমার কাছে আশা করেছিলাম। দোয়া করি, “আল্লাহ তোমাকে আরও বেশি ধৈর্য ধরার তওফিক দিক।”
আমিন বলে ডালিয়া বলল, আমার কথার উত্তর দিলে না যে?
তোমার ধৈর্যশক্তি পরীক্ষা করার জন্য ও তোমার অভিমানী কণ্ঠ শোনার জন্য। তোমার অভিমানী কণ্ঠ শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।
তা হলে তো বিয়ের পর অভিমানী কণ্ঠ শোনার জন্য খুব জ্বালাবে মনে। হচ্ছে?
ঠিক বলেছ, তবে খুব জ্বালাব না, অল্প অল্প জ্বালাব।
আসলে তোমার দীল খুব শক্ত। তা না হলে কয়েক মাস হয়ে গেল আমাকে দেখতে আসনি কেন? এদিকে আমি তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছি।
আমার দীল শক্ত না নরম সময় হলেই বুঝবে।
সেই সময়টা কবে হবে বলবে তো?
সেকথা আল্লাহপাক জানেন—
তিনি তো সবকিছুই জানেন। তুমি চেষ্টা করছ না কেন?
করছি না আবার, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করছি। দোয়া কর আল্লাহ। যেন আমার শ্রম সার্থক করেন। এবার একটা সুখবর শুনবে?
না বললে শুনব কী করে?
এখন নয়, আগে আলাপ শেষ করি, তারপর বলব।
না, আগে সুখবরটা বল, তারপর যত ইচ্ছা আলাপ করবে। নচেৎ খুব রাগ করব।
তোমার রাগি চেহারা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
ডালিয়া হেসে উঠে বলল, প্রথমত তুমি আমার রাগি চেহারা কখনও দেখনি, তা হলে ভালো লাগে বললে কী করে? দ্বিতীয়ত এখন তো দেখতেই পাবে না।
তোমার কথা ঠিক হলেও আমি মনের চোখে তোমার সবকিছু দেখতে পাই। এমন কী তুমি এখন কী পোশাক পরে রয়েছ তাও বলে দিতে পারি।
ডালিয়া চিন্তা করল, ও কখনও মিথ্যা বলে না। তাই অবাক হয়ে কী পোশাক পরে আছে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা হলেও করল না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, এসব কথা বাদ দিয়ে সুখবরটা শোনাও।
আমার প্রিয়তমাকে দেখা দেয়ার জন্য ইনশাআল্লাহ কাল সকালে রওয়ানা দেব।
ডালিয়া আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তুমি দুষ্টু জানতাম; কিন্তু এত দুষ্টু জানতাম না। মনে রেখ, এই খবরটা দেরিতে দেয়ার জন্য একদিন কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
শফি হেসে উঠে বলল, তোমার দীল তো নরম, কঠিন শাস্তি দেবে কী করে?
সময় হলেই বুঝবে, নরম দীলের মেয়েরা কত কঠিন শাস্তি দিতে পারে।
তা না হয় সময় হলে বুঝব, এখন এমন একটা সুখবর দিলাম কিছু পুরস্কার দেবে না?
না, দেব না। এটাই হল দুষ্টুমীর অল্প একটু শাস্তি। কঠিন শাস্তিটা ঐ সময়ের জন্য মুলতবি রাখলাম।
ঐ সময় বলতে কোন সময় বলবে তো?
সে কথাও এখন বলব না, ঐ সময়েই বলব।
শফি একটা মেকী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, সুখবরের বদলে যদি শাস্তি প্রাপ্য হয়, তা হলে ঐ প্রসঙ্গ বাদ। এবার বল, আমার আসবার কথা এবারেও তোমার বাবাকে জানাবে নাকি?
আমার মতে না, তবে তুমি যা বলবে তাই হবে।
তোমার মতটাই ঠিক। শোন, কাল বিকেল চারটের সময় বাস কাউন্টারের অফিসে থাকবে। ফেরীর জন্য লেট না হলে ঐ সময়ে পৌঁছাব। দেরি হলে ফোন করে জানাব।
ঠিক আছে, তাই হবে।
এবার রাখি, রাত অনেক হয়েছে। ইনশাল্লাহ কাল দেখা হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে শফি লাইন কেটে দিল।
.
পরের দিন শফি ঢাকায় পৌঁছে বাস কাউন্টারের অফিসে ঢুকে বোরখাপরা একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে ভাবল, নিশ্চয় ডালিয়া।
ততক্ষনে ডালিয়া তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
শফি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এস আমার সঙ্গে। সে ফোন করে আগেই হোটেলের রুম বুক করে রেখেছিল। একটা ট্যাক্সী করে ডালিয়াকে নিয়ে সেখানে উঠল। তারপর বেয়ারাকে দু’জনের নাস্তার অর্ডার দিল। বেয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার পর ডালিয়াকে বলল, একটু বস, টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি।
নাস্তা খাওয়ার পর শফি বলল, আমরা যে দিনের পর দিন ফোনে আলাপ করছি এবং এই যে দেখা সাক্ষাত করছি, বিয়ের আগে এসব করা ইসলামে নিষেধ। আমরা জেনেশুনে যদি নিষিদ্ধ কাজ করি, তা হলে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাব কী করে? তাই যাতে নিষিদ্ধ কাজ সিদ্ধ হয় সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানি না সিদ্ধান্তটা তোমার মনঃপুত হবে কিনা।
তাকে থামিয়ে দিয়ে ডালিয়া বলল, আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর, তুমি কোনো খারাপ সিদ্ধান্ত নিতে পার না। বল কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমি কায়মনোবাক্যে মেনে নেব।
শফি কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তোমার গার্জেনদের না জানিয়ে এবারেই কাজী অফিসে কাবিন করে আমরা বিয়ে করব। যদি রাজি থাক, তা হলে আজকালের মধ্যে কাজটা সেরে ফেলতে চাই; অবশ্য তুমি ভালো মনে করলে তোমার বাবাকে জানাতে পার। আরও বলল, আমাদের বিয়ে হলেও আমরা যেমন আছি তেমনই থাকব। তোমার ফাইনাল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। পরীক্ষার পর যা কিছু করার করে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব।
বিয়ের কথা শুনে ডালিয়ার মনে দেড়শ দুশ মাইল বেগে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। তাই কিছু বলতে না পেরে মুখ নিচু করে আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল।
শফি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, চুপ করে আছ কেন? তুমি যা বলবে তাই হবে। তোমার মতের বিরুদ্ধে কিছু করব না। তারপরও যখন ডালিয়া চুপ করে রইল তখন বলল, যদিও হাদিসে আছে, মেয়েদের চুপ থাকাটাই সম্মতির লক্ষণ, তবু একজন শিক্ষিত প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের মুখে হা বা না শুনতে চাই। তারপর তার চিবুক ধরে মুখটা তুলতেই দেখতে পেল, ডালিয়ার আপেলের মতো নিটোল দু’গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। চিবুক নাড়া দিয়ে আবার বলল, এই মেয়ে কাঁদছ কেন? বিয়ের আগে মেয়েদের অনুমতি নেয়া ইসলামের আইন। তাই অনুমতি চেয়েছি। তা ছাড়া প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করার অধিকার ইসলাম দিয়েছে। হ্যাঁ বা না যাই বলনা কেন, কোনোটাতেই তোমার প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট হব না। কথা শেষ করে চিবুক ছেড়ে দিল।
এতক্ষণ ডালিয়ার মনে আনন্দের তুফান বইছিল বলে উত্তর দিতে পারেনি। এখন আর চুপ করে থাকতে পারল না। সামলে নিয়ে চোখ মুছে লজ্জিত কণ্ঠে বলল, বিয়ের কথা শুনে আনন্দে বাকশক্তি হারিয়ে। ফেলেছিলাম। সেজন্যে তোমার কথার উত্তর দিতে পারিনি। জীবনে কখনও তোমার মতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলব না এবং কোনো কাজও করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ হাদিসে পড়েছি, “আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) এর পরে নারীদের কাছে স্বামীর স্থান। যদি কোনো মুমেন নারী আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর হুকুম মোতাবেক মুমেন স্বামীর কথা মতো চলে, তা হলে ইহকালে যেমন তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে, তেমনি পরকালে সে ঐ স্বামীর সঙ্গে বেহেশতে যাবে।”
সুবহান আল্লাহ বলে শফি বলল, তুমি খুব মূল্যবান কথা বলেছ। দুনিয়ার সব নারীরা যদি তোমার মতো জ্ঞান পেত, তা হলে দুনিয়ার চেহারা পাল্টে যেত।
ডালিয়া বলল, আজ বাবাকে তোমার কথা ও আমার মতামত জানিয়ে কাজী অফিসে আমাদের বিয়ের কাজটা করে দিতে বলব। আশা করি, ইনশাল্লাহ রাজি করাতে পারব। যদি না পারি, তা হলে তাকে ছাড়াই আমাদের কাজ আমরাই সম্পন্ন করব।
শফি বলল, খুব সুন্দর কথা বলেছ। আমিও তোমার সঙ্গে একমত। আর একটা কথা বলে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব। আমাদের বাড়ি থেকে কর্মস্থল বেশ দূরে। তাই এবারে একটা হুন্ডা কিনে নিয়ে যাব। আল্লাহ রাজি থাকলে কাল কাজী অফিসের কাজ শেষ হবার পর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কিনব। তুমি ডিজাইন ও কালার পছন্দ করে দেবে।
আলহামদুলিল্লাহ বলে ডালিয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, শুনে খুব খুশি হলাম। তারপর বলল, একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।
বল কী জানতে চাচ্ছ?
গতবারে তুমি বলেছিলে মহসিন ভাই কিছুদিনের মধ্যে তার বন্ধুর বোনকে বিয়ে করবে, কয়েকদিন আগে ফোনে আলাপ করার সময় জানালে, বন্ধুর বোনকে ভাইয়া বিয়ে করেছে। কী করে কথাটা বলেছিলে বলবে?
তার আগে আমার কথার উত্তর দাও, মানুষের মন কটা থাকে?
ডালিয়া মৃদু হেসে বলল, কটা আবার, একটা।
আমার কিন্তু দুটো আছে।
ধ্যাৎ, তা হয় না কি?
হয় কিনা জানি না, তবে আমার আছে। আর ঐ দ্বিতীয় মনটা আগাম অনেক কিছু বলতে পারে।
তা হলে বল কাল কাজী অফিসে বিয়ের ব্যাপারে বাবা রাজি হবে কিনা এবং কাল আমাদের বিয়ে হবে কি না?
ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আমি বলব কী করে?
তুমি তো এক্ষুনি বললে, তোমার দ্বিতীয় মন আগাম অনেক কিছু বলতে পারে।
ঐ মন অনুমান করে যা বলে তার বেশিরভাগ সত্য হয়।
এখন অনুমান করেই বলুক।
বললে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। তারচেয়ে কাল কী হবে না হবে তা কালই জানতে পারবে।
তোমার কথাতে বুঝতে পারছি কাল কাজী অফিসে আমাদের বিয়ে হবে না।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
তাই যদি জানতে, তা হলে বিয়ে করার কথা বললে কেন?
তখন তো দ্বিতীয় মন কিছু বলে নি।
যাহ, তুমি দুষ্টুমী করছ।
সত্য কথাটা বলা ঠিক হবে না ভেবে শফি বলল, তুমি যখন বলছ তা হলে তাই। এবার চল, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই। তারপর হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সী নিয়ে ডালিয়াকে তাদের বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে বলল, এই ব্যাপার নিয়ে মোটেই দুশ্চিন্তা করবে না। আল্লাহ রাজি থাকলে কালই আমাদের বিয়ে হবে, নচেৎ তিনি যখন রাজি হবেন তখন তো হবেই।
ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, তা হলে কি বিয়ের ব্যাপারটা বাবাকে জানাব না?
শফি বলল, নিশ্চয় জানাবে এবং ওনাকে দিয়েই কাজী অফিসে কাজটা সম্পন্ন করাবার চেষ্টা করবে। আর আমি অনুমান করে যা বলেছি ভুলে যাও। তারপর সালাম বিনিময় করে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল।
ডালিয়া বাসায় ঢুকতে কাজের বুয়া বলল, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? খালুজান অফিসের বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছেন। ভাইয়া ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে ভাইয়া খালা আম্মাকে ফোন করে সে কথা জানাতে তিনি হাসপাতালে গেছেন। যাওয়ার সময় আপনার খোঁজ করছিলেন।
ডালিয়া চমকে উঠে মনে মনে বাবাকে সুস্থ করে দেয়ার জন্য দোয়া করে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল ভাবিও হাসপাতালে গেছে?
ননদ ফিরেছে বুঝতে পেরে নাজিয়া রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, বেবীর খুব জ্বর, তাই আমি যেতে পারিনি। তোমার ভাইয়া গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল, মা একা গেছেন।
ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, বাবাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে?
নাজিয়া বলল, পপুলারে।
আসরের আজান হচ্ছে শুনে ডালিয়া নামায পড়ে ভাবিকে বলে একটা সি.এন.জি নিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দিল। যাওয়ার পথে শফিকে মোবাইলে বাবার স্ট্রোক করার কথা জানিয়ে বলল, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।
শফি সবেমাত্র আসরের নামায পড়ে কিছু কেনাকাটা করার জন্য মার্কেটে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ডালিয়ার ফোন পেয়ে বলল, আল্লাহ ওনাকে সুস্থতা দান করুণ, হাসপাতালের নাম বল।
পপুলার। তুমি আসবে না কি?
ইনশাআল্লাহ আসব। শোন, বাবার জন্য বেশি চিন্তা করো না। আল্লাহ চাহেতো উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। এবার রাখছি বলে সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিয়ে শফি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
তানভীর সাহেব স্ট্রোক করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোমায় দিয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর সুস্থ বোধ করতে কেবিনে আছেন।
শামিমা বেগম স্বামীর মাথার দিকে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ডালিয়া বেডের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
শফি দরজার পর্দা সরিয়ে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
পাইজামা পাঞ্জাবী পরা ও দাড়ি টুপিওয়ালা শফিকে দেখে শামিমা বেগম চিনতে না পেরে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ডালিয়া চিনতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে ঈশারা করে বলল, মা।
শফি শামিমা বেগমকে বললেন, মা, আপনি একটু ওদিকে যানতো বলে ডালিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।
শামিমা বেগম শফির সৌম্য শান্ত ও বলিষ্ঠ চেহারা দেখে হাসপাতালের কেউ মনে করেছিলেন। ডালিয়ার দিকে যেতে বলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি?
শফি বলল, পরিচয় বললেও আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না। আপনার স্বামী আমাকে চেনেন। ওনার অসুখের খবর শুনে দেখতে এলাম। প্লীজ, দয়া করে ও দিকে যান বলে আবার ডালিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।
শামিমা বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
শফি এগিয়ে এসে প্রথমে সূরা ইয়াসীন পড়ে তানভীর সাহেবের বুকে ফুক দিল। তারপর আরও অনেক কিছু পড়ে ফুক দিয়ে বলল, আপনারা কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ, দু’তিন দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় যেতে পারবেন।
তানভীর সাহেব তন্দ্রাভূত হয়ে চোখ বন্ধ করেছিলেন। শফির কথা শুনে তন্দ্রাভাব কেটে গেছে। চোখ খুলে তাকিয়ে শফিকে চিনতে পেরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
শফি নিজের ঠোঁটে শাহাদাত আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করে থাকতে ঈশারা করে বলল, এখন আপনার কথা বলা একদম নিষেধ। তারপর আসি আল্লাহ হাফেজ বলে সালাম দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
ডালিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বেরিয়ে এসে তাকে চলে যেতে দেখে বলল, একটু দাঁড়াও না।
শফি তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
ডালিয়া কাছে এসে বলল, কিছু না বলে চলে যাচ্ছ যে?
শফি বলল, মায়ের সামনে কিছু বলা ঠিক হবে না বলে চলে যাচ্ছি। অবশ্য পরে ফোনে তোমার সঙ্গে আলাপ করতাম। এবার ফিরে যাও, নচেৎ দেরি হলে মায়ের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বলে চলে গেল।
ডালিয়া কেবিনে ফিরে এলে শামিমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটাকে চিনিস?
ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, চিনি। আর বেশি কিছু জানতে চেও না, বলতে পারব না। বাবা সুস্থ হবার পর তার কাছ থেকে জেনে নিও।
তানভীর সাহেব আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ডালিয়া বুঝতে পেরে বলল, ডাক্তার তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন, তবু বারবার কথা বলতে চাচ্ছ কেন?
তওফিক ডাক্তারের কথামতো একটা ওষুধ কিনতে গিয়ে ছিল। ফিরে এসে ডালিয়ার কথা শুনতে পেয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা, কথা বলা তোমার একদম নিষেধ।
রাত দশটার সময় শফি ফোন করে সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কেমন আছেন?
ডালিয়া বলল, কিছুক্ষণ আগে হাসপাতাল থেকে ফিরলাম, দেখে এসেছি আগের থেকে একটু ভালো ।
শফি বলল, আমরা যে প্রোগ্রাম করেছিলাম তা করা এখন সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় নিশ্চয় বুঝতে পারছ। আল্লাহপাকের ইচ্ছা ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না, কোনো ঘটনাও ঘটে না। পরে যখন তাঁর ইচ্ছা হবে তখন তিনিই আমাদের প্রোগ্রাম সমাধান করে দেবেন। পরশুদিন আমাকে ফিরে যেতেই হবে। তাই কাল দুপুরের মধ্যে ইনশাআল্লাহ অফিসের কাজ শেষ করে বিকেলে হুন্ডা কিনবো। চারটের সময় রিসেপশনে থাকব, তুমি আসবে।
ডালিয়া বলল, ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ আসব।
.
হুন্ডা কিনে ডালিয়াকে পিছনে বসিয়ে পাঁচটার সময় শফি পপুলার হাসপাতলের সামনে এসে ডালিয়াকে বলল, তুমি যাও, আমি আসছি।
আজ বেবীর জ্বর কমেছে। তাই তাকে নিয়ে নাজিয়া স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরকে দেখতে এসেছে।
শামিমা বেগম দুপুরে বাসায় গেছেন। একেবারে রাতে স্বামীর খাবার নিয়ে এসে সারারাত থাকবেন।
ডালিয়াকে কেবিনে ঢুকতে দেখে তওফিক বলল, কীরে, কোথায় গিয়েছিলি? অফিস থেকে ফিরে তোর ভাবিকে নিয়ে আসার সময় তোকে পেলাম না।
ডালিয়া বলল, একটা দরকারে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
এমন সময় দরজার পর্দার আড়াল থেকে শফি সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?
তওফিক মনে করল, হয়তো ডাক্তার কোন কারণে এসেছেন। তাই সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আসুন।
শফি ভিতরে ঢুকে বেডের কাছে এসে তানভীর সাহেবকে বলল, মাদরাসার অফিসের কাজে এসেছিলাম, কাল সকালে চলে যাব। তাই দেখা করতে এলাম। এখন কেমন আছেন?
তানভীর সাহেব বললেন, আল্লাহর রহমতে আগের থেকে ভালো। তারপর ছেলে ও তার বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, পরিচয় করিয়ে দিই-এ হল শফি, মহসিনদের গ্রামের পাশের গ্রামে বাড়ি। এবারে ডালিয়া মামা বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়। বেশ কিছুদিন আগে যখন ঢাকায় এসেছিল তখন হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাই এবারে এসে মনে হয় ডালিয়ার কাছে আমার অসুখের কথা শুনে দেখতে এসেছে। তারপর শফিকে বললেন, আমার বড় ছেলে ও তার স্ত্রী।
শফি তাওফিক ও তার স্ত্রীর সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুশি হলাম।
তওফিক ও নাজিয়া শফির দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবল, তা হলে এই ছেলের কারণেই ডালিয়ার এত পরিবর্তন এবং মহসিনের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না।
শফি তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, মাফ করবেন আমার হাতে সময় কম, আর থাকতে পারছি না। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ডালিয়াকে ঈশারা করে আসতে বলল।
ডালিয়া বেরিয়ে এসে তার সাথে যেতে যেতে ভিজে গলায় বলল, আবার কবে আসবে?
তার ভিজে গলা শুনে শফি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে কাল রাতে বললাম না, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডে কোনো কিছু ঘটে না। তোমার বাবার স্ট্রোক করাও আমাদের প্রোগ্রাম বাতিল সবকিছুই তাঁরই ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা প্রত্যেক মুমীন নর-নারীর কর্তব্য এবং সবর করাও কর্তব্য। প্রিয়জনকে কান্না মুখে নয় হাসিমুখে বিদায় দিতে হয়।
ডালিয়া চোখ মুখ মুছে কান্না মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সেজন্যে কাঁদছিলাম না, অনির্দিষ্ট কাল তোমাকে দেখতে পাব না বলে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।
শফি বলল, এবার তুমি যাও, নচেৎ সবাই অন্য কিছু ভাবতে পারে। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
ডালিয়া ফিরে এলে তাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা তওফিকের হলেও বাবা রয়েছে বলে করল না।
বাসায় ফিরে তওফিক স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, শফিকে কেমন দেখলে?
নাজিয়া বলল, দেখতে তো বেশ হ্যান্ডসাম। তবে শুধু একবার মাত্র দেখে কি কারও সম্পর্কে ভালো না মন্দ বলা যায়? অবশ্য ওনার সম্পর্কে ডালিয়ার কাছে যতটুকু শুনেছি তা যদি সত্য হয়, তা হলে বলব ডালিয়া খুব ভাগ্যবতী।
তওফিক বলল, আমিও তোমার সঙ্গে একমত। ভাবছি, মহসিন জানতে পারলে শফিকে সহজে ছেড়ে দেবে না। সে নিশ্চয় মনে করবে শফির কারণেই ডালিয়াকে পেল না।
নাজিয়া বলল, তুমি অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। তবে ডালিয়ার মুখে। শুনেছি সব ধরনের মারামারীতে শফি খুব পটু। আরও শুনেছি মহসিন ভাই নাকী দু’বার শফিকে মারধর করতে চেয়েছিল; কিন্তু উল্টে শফি মেরে তার হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।
তওফিক বলল, তাই নাকী? তা হলে তো ওদের সম্পর্কের কথা জেনে আরও বেশি শত্রুতা করবে। তা ছাড়া মামা ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। তিনি সবকিছু জানার পর ছেলের হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শফিকে ছেড়ে কথা বলবেন না। এমনকি গ্রাম্য পলিটিক্সের প্যাঁচে ফেলে জেলেও পাঠাতে পারেন।
নাজিয়া বলল, সে কথা শফি নিশ্চয় জানেন। তা ছাড়া বাবাও নিশ্চয় মামার সঙ্গে পরামর্শ না করে কী আর শফির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন? এবার ওদের কথা থাক, হাসপাতালে ভাত পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
.
০৭.
শফি এমপি সাহেবের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর জুলহাস বাবার কাছে। এসে বলল, তোমাকে বললাম ঐ ছেলেটাই আমার এই অবস্থা করেছে, তবু তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে? আমি মনে করেছিলাম, তোমার লোকদের দিয়ে মেরে হাড়গোড় গুড়ো করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে।
এমপি সাহেব বললেন, আমি তাই-ই করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে করিনি।
জুলহাস রেগে উঠে বলল, কেন সম্ভব নয়?
শফি কেন এসেছিল এবং যা কিছু বলে গেছে এমপি সাহেব সেসব বলে বললেন, এই সব কারণে তার কিছু না করে এমনিই ছেড়ে দিলাম।
জুলহাস রাগের সঙ্গেই বলল, সে কী বলল না বলল সে কথা শুনেই ছেড়ে দিলে? তারপর টেবিলের উপর ভিজিটিং কার্ডটা নিয়ে পড়ে বলল, ওকে ফোন করে বল, আমরা সবাই ওর শর্ত মানতে রাজি। কবে ও কখন আসবে জেনে নিবে। আমি লোকজন নিয়ে গ্রামের শেষ মাথায় রেডি থাকব। দেখব শালা কুত্তার বাচ্চা কেমন করে আমাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে না দিয়েছি তো আমার নাম পাল্টে রেখ।
এমপি সাহেব শফির সম্পর্কে চেয়ারম্যানের কাছে যতটুকু শুনেছেন এবং আজ তাকে দেখে ও তার সঙ্গে আলাপ করে যা বুঝেছেন, তাতে মনে হয়েছে শফি আর দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা। তাই ছেলের কথা শুনে রেগে উঠে বললেন, কোনো কাজ তাড়াহুড়ো না করে ভেবে চিন্তে করতে হয়। আমি চাই, তোর বন্ধুদের সবকিছু জানিয়ে সবাই ঠিকমতো নামায পড়তে শুরু কর। তারপর শফিকে ডেকে তোদের চিকিৎসার ব্যবস্তা করতে বলব। যদি চিকিৎসা করে তোদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে, তা হলে জানা যাবে সত্যিই সে একজন গুণী ছেলে। আর যদি না হয়, তা হলে দিন তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সুযোগমতো তোদের মনে যা আসে করিস।
জুলহাস বলল, কিন্তু ওতো তোমাকে ও আমাদের ফ্যামিলীর সবাইকে নামায পড়তে বলেছে?
এমপি সাহেব বললেন, ওর চিকিৎসার ফলাফলের জন্য আমিও নামায পড়ব এবং ঘরের সবাইকেও পড়তে বলব।
জুলহাস কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, বন্ধুদের বলে দেখি ওরা কী বলে।
জুলহাসের দু’বন্ধুর নাম আনিস ও শাহিন। পরের দিন সে তাদেরকে শফির পরিচয় জানিয়ে তার চিকিৎসা করানোর ও শর্তের কথা বলল।
আনিস ও শাহিন দু’জনেই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। প্রথমে আনিস বলল, তাই না কী? শালার প্রিন্সীপালগিরী না ছাড়িয়েছি তো আমি বাপের বেটাই নই। কয়েকজন লেঠেল নিয়ে আমরা রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকব। শফি যখন মাদরাসা থেকে ঘরে ফিরবে তখন রাস্তায় ওকে শেষ করে দেব। তারপর জুলহাসকে জিজ্ঞেস করল, তোর কী মত?
জুলহাল বলল, আমারও একই মত। তবে তোরাও তো শুনেছিস, শফি লাঠিখেলায় ওস্তাদ। লেঠেল সর্দার মোবারকের একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। তাই ভেবেছি, সাত আটজন লেঠেলকে একসঙ্গে ওকে আক্রমণ করতে বলব। আর সুযোগমতো আমরা ওর দুটো পায়ে কয়েকটা গুলি করব, যাতে দুটো পা-ই কেটে বাদ দিতে হয়।
আনিস বলল, কথাটা ভালই বলেছিস।
শাহিন বলল, হ্যাঁ, এটা করাই ঠিক হবে।
জুলহাস বলল, বাবাকে দেখানোর জন্য আজ থেকেই আমরা নামায পড়ব এবং তাকে বলব, “আমরা শফির শর্তে রাজি আছি। তুমি শফিকে ফোন করে আসতে বলে কবে আসবে জেনে নাও।” যেদিন শফি আসবে তার আগের দিন আমরা অপারেশন চালাব। তা হলে বাবা বুঝতে পারবে না আমরা কাজটা করেছি।
জুলহাস থেমে যেতে শাহিন বলল, তোর প্ল্যানটা খুব ভালো। তা হলে এটাই আমাদের পাকা সিদ্ধান্ত।
দু’তিন দিন পর জুলহাস বাবাকে বলল, আমরা শফির শর্ত মেনে নিয়ে নামায পড়ছি। তুমি তাকে ফোন কের আসতে বল।
এমপি সাহেব সেদিনই এক সময় শফিকে ফোন করে ছেলে ও তার বন্ধুদের শর্ত মেনে নেয়ার কথা জানিয়ে আসতে বললেন।
শফি সালাম বিনিময় করে বলল, জুলহাস আপনার কাছে মিথ্যে বলেছে। তারপর সে বন্ধুদের সঙ্গে কী প্ল্যান করেছে বলল।
এমপি সাহেব খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওদের প্ল্যানের কথা জানলেন কেমন করে?
শফি বলল, এমন একজন কেউ আছে, যে কেউ আমার ক্ষতি করার জন্য কোনো কিছু করলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানিয়ে দেয়। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেই সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন। শুনুন, ওদের জানিয়ে দেবেন ওদের ভালোর জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু দুঃখের বিষয় ওরা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে ওদের প্ল্যান সাকসেসফুল করতে চাই। যাই হোক, কেউ যদি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে চাই, সেখানে আমার কিছু করার নেই। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
এমপি সাহেব ছেলের উপর ভীষণ রেগে গেলেন। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে কী করবেন চিন্তা করে জুলহাসকে ডেকে পাঠালেন।
জুলহাস এসে বলল, কেন ডেকেছ বল।
এমপি সাহেব বললেন, তোরা নাকি শফিকে শায়েস্তা করার জন্য প্ল্যান করেছিস এবং প্ল্যান সাকসেসফুল করার জন্য লোক দেখানো নামায পড়ছিস?
কথাটা শুনে জুলহাস খুব অবাক হলেও রাগের সঙ্গে বলল, এ কথা তোমাকে কে বলেছে?
এমপি সাহেব বললেন, শফি বলেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, নিশ্চয় কথাটা সত্য?
বাবার কথা শুনে জুলহাসের রাগ জেঁকের মুখে নুন পড়ার মতো অবস্থা হল। কী বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
কী রে, চুপ করে আছিস কেন? কথাটা সত্য না মিথ্যা বলবি তো?
জুলহাস তখন চিন্তা করছে, আমাদের প্ল্যানের কথা শফি জানল কী করে? তা হলে কী আমাদের মধ্যে কেউ বেঈমানী করেছে, না অন্য কেউ গোপনে কান পেতে শুনে শফিকে জানিয়েছে?
ছেলের অবস্থা দেখে এমপি সাহেব যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, তোর ঐ দু’জন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে আয়, তোদেরকে কিছু কথা বলব। তারপর তোরা ডিসিশান নিবি কী করবি না করবি।
জুলহাস আনিস ও শাহিনের কাছে গিয়ে বলল, আমাদের প্ল্যান প্রোগ্রামের কথা শফি জেনে গেছে।
আনিস ও শাহিন কথাটা শুনে একসঙ্গে বলে উঠল, তা কী করে হয়? আমাদের প্ল্যানের কথা সে জানবে কেমন করে?
জুলহাস বলল, সে কথা আমি বলব কি করে? বাবা ফোন করে আমাদের চিকিৎসার জন্য তাকে আসতে বলেছিল। তখন শফি বাবাকে কথাটা জানিয়েছে। বাবা তোদেরকে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে এখন পাঠাল।
যাওয়ার সময় আনিস বলল, আমাদের প্ল্যানের কথা শফি জেনে গেছে, এটা খুব আশ্চর্যের কথা।
শাহিন বলল, এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।
জুলহাস বলল, তোদের মতো আমারও তাই মনে হয়েছে।
এমপি সাহেব ওদের জন্য বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছিলেন। কাছে এলে বসতে বললেন।
আনিস ও শাহিন সালাম বিনিময় করে বসল।
এমপি সাহেব বললেন, যা কিছু বলব তোমরা মন দিয়ে শোন, শফিকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে ও তার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে সে যেমন নিজে কখনও কোনো অন্যায় করে না, তেমনি কেউ অন্যায় করলে সহ্য করতে পারে না। তাকে নিয়ে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সবগুলো অনুসন্ধান করে দেখেছি, তার কোনো দোষ নেই, বিপক্ষ দলের লোকেরাই দোষী। তাই সে তাদেরকে শাস্তি দিয়েছে। সে জানে আইনের হাতে দোষীদের তুলে দিলে আইনের লোকেরা ঘুষ খেয়ে তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেবে এই জন্য দোষীদের আইনের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেই শাস্তি দিয়েছে। অবশ্য আইনের চোখে এটা ঠিক নয়। যাই হোক, আমি চাচ্ছি, তোমরা তার বিরুদ্ধে না লেগে তার কাছে স্যারেন্ডার কর এবং তার চিকিৎসার সুবিধে গ্রহণ করো। যদি তোমরা সুস্থ্য জীবন ফিরে পাও, তা হলে তো কোনো কথাই নেই। আর যদি তা না হয়, তখন তোমাদের মনে যা চায় তাই করো। তোমরা হয়তো বলতে পার, শফিকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে কঠোর শাস্তি দেয়ার কথা; কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ যে কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো প্ল্যান প্রোগ্রাম করলে, তা সে জানতে পারে। এবং তার সঙ্গে আলাপ করে মিমাংসা করে নেয়। এখন যে তোমাদের সঙ্গে যা কিছু আলাপ করছি, এ কথাও সে হয়তো জেনে যাবে।
জুলহাস বলল, কিন্তু বাবা, এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে এসব কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? না বিশ্বাস করা উচিত?
এমপি সাহেব বললেন, না, কেউ বিশ্বাস করবে না এবং বিশ্বাস করাও উচিত নয়। প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। তাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওদের প্ল্যান প্রোগ্রাম তুমি জানলে কী করে? বলল, আমার এমন কেউ একজন আছে, আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম করলে, সে খবরটা আমাকে জানিয়ে দেয়।
জুলহাস বলল, এ কথাও কেউ বিশ্বাস করবে না। সে তোমাকে ঐ কথা বলে বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে।
এমন সময় শফি এসে এমপি সাহেবকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন। আছেন?
জুলহাস ও তার দু’বন্ধু খুব অবাক হলেও এমপি সাহেব হলেন না। সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন আছেন?
শফি বসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তারপর জুলহাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি আমার ব্যাপারে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা যে। বললেন, তা যেমন ঠিক, তেমনি আমি যে কথা আপনার বাবাকে বলেছি তাও ঠিক। আর ওনাকে বোকা বানানোর কথাটা যা বললেন, তা ঠিক নয়।
তাকে দেখে ও তার কথা শুনে জুলহাস ও তার দু’বন্ধু অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
এমপি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমরা এখন যা কিছু আলাপ করলাম সে সব আপনার সেই কেউ একজন নিশ্চয় জানিয়েছে?
শফি মৃদু হেসে বলল, জ্বি, জানিয়েছে। আপনার প্রপোজাল ওনারা মনে নেবে ভেবেই তো চলে এলাম।
জুলহাসের এক বন্ধু শাহিন জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয় এখানে আসার আগে মাদরাসায় ছিলেন?
শফি বলল, হ্যাঁ, ছিলাম।
তা হলে বলুন তো, কে সেই একজন যে আনপাকে আমাদের আলাপ জানিয়েছে এবং আপনিই বা এতদূর থেকে এত তাড়াতাড়ি চলে আসলেন কী করে?
শফি বলল, এখন বলা যাবে না। তবে এসব কথা জানতে হলে আপনাদেরকে ধৈর্য ধরে আমার শর্তগুলো পালন করতে হবে। দু’দশ দিন। পালন করবেন, তারপর করবেন না, তা হলে কিন্তু জানতে পারবেন না। আর চিকিৎসায় কোনো ফলও পাবেন না। এবার আসল কথায় আসি, তারপর কিছু হেকিমী ওষুধ ও শিকড়-বাকড় সাইড ব্যাগ থেকে বের করে এক একজনকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহারের পদ্ধতি বলে দিয়ে বলল, এসব ওষুধের ভালো করার ক্ষমতা নেই, যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুম এই ওষুধগুলোর উপর না আসে। এমন কি দা, ছুরি, ছোরা ও যে কোনো অস্ত্র আল্লাহর হুকুমে কাজ করে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ কুরআন হাদিসে রয়েছে। আমরা ঈদুল আজহার দিন যে গরু, ছাগল, উট, মহিষ বা দুম্বা কুরবানী করি, সেই ঘটনার মধ্যেও এর প্রমাণ রয়েছে। ঘটনাটা মুসলমান মাত্রই জানে, তবু বলছি, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে এগার বার বছরের প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানী করার জন্য তার গলায় ছোরা চালালেন তখন আল্লাহ ছোরাকে হুকুম করলেন, খবরদার, ইসমাইল (আঃ)-এর গলার চামড়া তো দূরের কথা একটা পশমও কেটো না। তাই ইবরাহিম (আঃ) পুত্রের গলায় ছোরার কয়েকটা পোচ দিলেও ইসমাইল (আঃ) অক্ষত রইলেন। তখন আল্লাহ জীবরাইল (আঃ) নামে এক মহান। ফেরেশতাকে বললেন, ইসমাইল (আঃ) কে সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায়। একটা দুম্বা শুইয়ে দাও।
পুত্রকে কুরবানী করার সময় যাতে মনে মমতা জেগে না উঠে সে জন্যে ইবরাহীম (আঃ) দু’চোখ বেঁধে নিয়েছিলেন। তাই কুরবানী করার পর যখন দেখলেন, পুত্র ইসমাইল (আঃ) পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা দুম্বা কুরবানী হয়েছে তখন তিনি ভীত ও সন্ত্রস্থ হয়ে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বন্ধু ইবরাহীম (আঃ) কে বললেন, “ভীত বা চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য পুত্রকে কুরবানী করতে আদেশ দিয়েছিলাম। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।”
সেই থেকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কুরবানী করা ওয়াজেব সাব্যস্ত হয়েছে। এখন নিশ্চয় আপনারা বুঝতে পারলেন। আল্লাহর হুকুম ছাড়া সারা দুনিয়াতে কারো কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। এমন কি জড় পদার্থেরও নেই। আপনারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে এসব ওষুধ ব্যবহার করুন। ইনশাল্লাহ কিছুদিনের মধ্যে ওর ফলাফল পাবেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। একটা কথা মনে রাখবেন, ছলনার বা কপটতার মাধ্যমে মানুষকে ঠকানো বা কষ্ট দেয়া যায়; কিন্তু তার বেশি কিছু করা যায় না। ইসলামে কপটতার স্থান নেই। এটা মোনাফেকের লক্ষণ। কুরআনে “আল্লাহ মোনাফেকের স্থান জাহান্নাম বলেছেন। আর জাহান্নাম অতি নিকৃষ্ট স্থান।” আর একটা কথা, ওষুধ ব্যবহার করার সাথে সাথে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়তে শুরু করবেন এবং তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামকে জানার ও মানার তওফিক দিক, আমিন। তারপর এমপি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাকে ঐসব করার অনুরোধ করছি। এবার আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন।
এমপি সাহেব হাঁ করে শফির কথাগুলো গিলছিলেন। তার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছেন। সে চলে যাওয়ার অনুমতি চাইতে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, সে কী? নাস্তা পানি না খেয়ে যেতে দিচ্ছি না।
শফি বলল, মাফ করবেন, আমি কখনও বাইরের কারও বাড়িতে কিছু খাই না। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
শফি চলে যাওয়ার পর এমপি সাহেব ছেলে ও তার বন্ধুদেরকে বললেন, বলেছিলাম না, শফি তোমাদের মতো অন্য দশটা ছেলের মতো না? এখন আমার কথা নিশ্চয় বিশ্বাস হল? আশা করি, ওর কথা মতো সবকিছু মেনে চলবে। শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি, ভুলেও ওর বিরুদ্ধে লাগার চিন্তাও করবে না। এবার তোমরা যে যার ঔষুধপত্র নিয়ে ঘরে যাও।
.
আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। শফির ওষুধ খেয়ে দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে ওরা একটু একটু সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। তাই দেখে কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়ে ক্রমশঃ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগল। এমপি সাহেবও ঐসব পড়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
একদিন তিনি চেয়ারম্যানকে ডেকে পাঠালেন।
চেয়ারম্যান আসার সময় চিন্তা করলেন, শফির ব্যাপারে ওনাকে যা কিছু করতে বলেছিলাম সে সব যদি করে থাকেন, তা হলে সর্বনাশ।
চেয়ারম্যান পৌঁছাবার পর এমপি সাহেব সালাম বিনিময় করে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন?
এমপি সাহেবকে আগে সালাম দিতে দেখে ও ওনার মাথায় টুপি দেখে চেয়ারম্যান অবাক হলেন। বললেন, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
তা এর মধ্যে শফির সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
শফির কথা শুনে চেয়ারম্যান ভয়ে ভয়ে বললেন, আপনার কাছে যেদিন এসেছিলাম, সেদিন ফেরার পথে দেখা হয়েছিল। তারপর থেকে আর হয়নি।
এমপি সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি। ঐদিন আপনি চলে যাবার পর শফি আমার কাছে আসে, তারপর আপনার সঙ্গে দেখা করে। সেদিন এমন অনেক কথা বলে, যা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি। ঐ দিন আপনাকেও নিশ্চয় কিছু বলেছে?
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, বলেছে। সেসব শুনে আমি খুব অবাক হয়ে তার ক্ষতি করার চিন্তা বন্ধ করে দিয়েছি।
এমপি সাহেব বললেন, তা হলে এতদিনে শফিকে ভালোভাবে চিনতে পেরেছেন?
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, পেরেছি।
আমিও পেরেছি বলে এমপি সাহেব বললেন, প্রায় মাস খানেক আগে আমার কাছে এসেছিল। তারপর কেন এসেছিল সেসব জানিয়ে বললেন, সত্যিই ওর মতো ছেলে দ্বিতীয় আর হয় না। আপনার কথা শুনে ওকে ভুল বুঝেছিলাম। সেদিন ঐ-ই সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আমাদের সবাইকে হেদায়েতের পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কথাটা শুনে খুশি হবেন, আমার ছেলে ও তার দু বন্ধু তারই চিকিৎসায় আল্লাহর রহমতে সুস্থ হতে চলেছে।
চেয়ারম্যান বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। শফি হল পরশমণি। যত খারাপ মানুষই তার সংস্পর্শে আসুক না কেন, সে মানিক হয়ে যাবে। আমার ছেলে নষ্ট হতে যাচ্ছিল। সে কথা শফি আমাকে জানায় এবং তাকে ভালো করার পথ বাতলে দেয়।
এমপি সাহেব আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, শফির পেছনে যাতে না লাগেন, সে কথা জানাবার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম। এখন আপনার কথা শুনে খুশি হলাম। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন।
.
০৮.
প্রথম যেদিন শফিকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে এমপি সাহেবের কাছে গিয়ে আলাপ করার পর চেয়ারম্যান ফিরছিলেন তখন পথে শফি যা কিছু বলেছিল, তাতেই ওনার জ্ঞানের চোখ অর্ধেক খুলেছিল। এবারে এমপি সাহেব ডেকে পাঠিয়ে শফির ব্যাপারে যা কিছু বলেছেন, সেসব শুনে পুরো জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে। তাই ছেলে ও তার স্ত্রীকে নিয়ে আসার আগে স্ত্রীকে এমপি সাহেবের পরিবর্তন ও তার কারণ জানিয়ে তারও জ্ঞানের চোখ খুলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নিজে দাড়ি রেখেছেন, সব সময় মাথায় টুপি দিয়ে থাকেন, নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত নামায পড়ছেন। বাড়ির চাকর-বাকরদেরকেও নামাযী করেছেন।
বাবার পরিবর্তন দেখে রাহেলা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মাকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে নামায ধরিয়েছে।
একদিন আখতার বানুকে স্বামী বললেন, প্রায় মাস খানেক আগে বলেছিলে ছেলে বৌকে নিয়ে আসার জন্য ঢাকা যাবে। কই, গেলে না তো?
চেয়ারম্যান বললেন, ছেলে বৌকে ধর্মের পথে আনতে হলে আগে মা বাবাকে ধার্মিক হতে হয়। তাই এই এক মাস ধার্মিক হবার চেষ্টা করেছি। ইনশাআল্লাহ আগামী কাল ওদের নিয়ে আসতে যাব।
পরের দিন সকালে রওয়ানা হবার সময় স্ত্রীকে ও মেয়েকে বললেন, মহসিনকে ফোন করে আমার রওয়ানা হবার কথা জানাবে না। প্রথমে আমি শামিমার বাসায় উঠব। তাদের কাছে আসল ঘটনা জানার পর পরামর্শ করব কীভাবে ছেলে বৌ নিয়ে আসব। তারপর যাবার পথে বাস থেকেই মোবাইল করে আসার কথা বোন শামিমা বেগমকে জানালেন।
.
মহসিন ও ডালিয়া যখন কিশোর কিশোরী সে সময় একদিন দুজনের মা ওয়াদা করেছিলেন, ওদের লেখাপড়া শেষ হলে বিয়ে দেবেন। কথাটা ওরা যেমন জানত তেমনি দুই ফ্যামিলীর সবাইও জানত। তারপর কলেজে ভার্সিটিতে পড়ার সময় এ ব্যাপারে দুজনে মাঝে মাঝে আলাপও করেছে। কেউ এতটুকু অমত করেনি। বছর খানেক আগে একদিন মহসিন বন্ধু। সাজ্জাদদের বাসায় গিয়েছিল। সেদিন তার বোন জুঁইকে দেখে খুব মুগ্ধ হয়। তখন তার মনে হয়েছিল, ডালিয়ার থেকে জুঁই হাজার গুণ বেশি সুন্দরী। জুঁই তার মনে এত গভীর দাগ কাটে যে, সেখানে ডালিয়ার এতটুকু জায়গা হল না। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ডালিয়াকে নিয়ে বেড়ালেও তার মন পড়েছিল জুঁইয়ের কাছে। তার কথা মন থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও সরাতে পারেনি। তারপর এবারে ঢাকায় ফিরে বন্ধু সাজ্জাদকে থাকার অসুবিধের কথা বলে তাদের বাসায় পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকার ব্যবস্থা করে চিন্তা করতে লাগল, কীভাবে ডালিয়ার মনে তার প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করবে এবং কীভাবে তাদের বাসা থেকে চলে আসবে? ডালিয়াকে তাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে সুযোগটা পেয়ে গেল। প্রথমে ডালিয়ার সঙ্গে ধর্ম ও আধুনিকতা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক শুরু করল। শেষে ডালিয়া যেদিন বলল, তোমার মতো অধার্মিক ছেলেকে বিয়ে করবে না। তার দুদিন পর সেখান থেকে বন্ধুর বাসায় চলে আসে।
তানভীর সাহেব ও শামিমা বেগম ব্যাপারটা জেনে মেয়েকে ভীষণ রাগারাগি করেন। তানভীর সাহেব মেয়েকে প্রথমে অনেক বুঝিয়ে বললেন, তোরা এখন ছেলেমানুষ। রাগের বশে ঐরকম বলেছিস। আমি মহসিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
সেখানে শামিমা বেগমও ছিলেন, স্বামী থেমে যেতে বললেন, হ্যাঁ, তাই কর, ভাইয়া ভাবি শুনলে কী মনে করবে?
ডালিয়া বলল, না বাবা, তুমি তাকে নিয়ে আসতে যাবে না। আমার যতদূর বিশ্বাস, সে অন্য কোনো মেয়েকে ভালবাসে, তাই তোমাদেরকেও না। জানিয়ে চলে গেছে। তা ছাড়া যাওয়ার সময় সেও বলে গেছে, “আমি ধর্মের পথ থেকে সরে না এলে আমাকে বিয়ে করবে না।” তারপর কুরআন হাদিসের কথা উল্লেখ করে বলল, যারা ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলে না তাদের সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়া উচিত নয়। তা ছাড়া যেখানে বিয়ের ব্যাপারে বয়স্ক ছেলেমেয়েদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার ইসলাম দিয়েছে, সেখানে আমাদের মতের বিরুদ্ধে তোমরা জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছ কেন? ছেলেমেয়ের মতের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিলে সে বিয়ে শুদ্ধ হয় না।
মেয়ের কথা শুনে তানভীর সাহেব আর কিছু না বললেও শামিমা বেগম যা তা বলে ভৎর্সনা করেন।
আজ ভাইয়া ফোন করে যখন বলল, সে আসছে তখন শামিমা বেগম ভাবলেন, মহসিন ও ডালিয়ার ব্যাপারে নিশ্চয় আসছে।
তানভীর সাহেব ছেলে তওফিকের সঙ্গে অফিসে চলে গেছেন। শামিমা বেগম ডালিয়া ও বড় বৌ নাজিয়াকে ভাইয়ার আসার কথা জানালেন। তারপর ডালিয়াকে বললেন, তোর বাবাকে কথাটা জানিয়ে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল।
তানভীর সাহেব হাসপাতাল থেকে ফিরে পনের দিন রেষ্টে ছিলেন। তারপর অফিসে যাচ্ছেন। মেয়ের ফোন পেয়ে ছেলেকে তার মামার আসার কথা বলে বেলা তিনটের সময় বাসায় ফিরলেন।
মহসিন যে বিয়ে করেছে, সে কথা শফির কাছে ডালিয়া জানলেও তার মা বাবা জানে না।
স্বামী বাসায় ফেরার পর শামিমা বেগম তাকে বললেন, ভাইয়া যখন জানবে মহসিন এখানে থাকে না বন্ধুর বাসায় থাকে তখন কী মনে করবে? তোমার মেয়ের জন্যে ভাইয়ার কাছে আমরা খুব ছোট হয়ে যাব।
তানভীর সাহেব বললেন, এতদিন হয়ে গেল কথাটা ভাইয়াকে জানাওনি?
কোন মুখে জানাব? আমার তো মনে হচ্ছে, খবরটা জেনেই ভাইয়া আসছে। আমি কিন্তু খুব আন-ইজি ফিল করছি।
তা হতে পারে। তাই বলে তুমি আনইজি ফিল করবে কেন? সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারে শুধু ডালিয়া দোষী নয়, মহসিনেরও দোষ আছে। যাই হোক, এই নিয়ে এত টেনশন করার কিছু নেই। ভাইয়া আগে আসুক, তারপর অবস্থা বুঝে যা করার করা যাবে। তুমি এখন ওনার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর।
সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি। আমি চিন্তা করছি ভাইয়া যখন মহসিনের এখান থেকে চলে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করবে তখন কী বলব?
বাবা ফিরেছে ডালিয়া জানে। তাই মা বাবার মধ্যে কী কথাবার্তা হয় আড়াল থেকে এতক্ষণ শুনছিল। মায়ের শেষের কথা শুনে তাদের সামনে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি এ ব্যাপারে মোটেই টেনশান করবে না। মামা কিছু জিজ্ঞেস করলে তোমাদের উত্তর দেয়া লাগবে না, যা বলার আমিই বলব।
মেয়ের কথা শুনে শামিমা বেগম খুব রেগে গেলেন। ঝংকার দিয়ে বললেন, তোর জন্য আজ আমরা ভাইয়ার কাছে অপদস্থ হব। তুই দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে, কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে উঠলেন।
ডালিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যিই আমি খুব বড় অন্যায় করেছি। সেজন্যে যত বড় শাস্তি দিতে চাও দাও। তবু আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তানভীর সাহেব মেয়েকে বললেন, তুই এখন যা, তোর মাকে আমি দেখছি।
যাচ্ছি বাবা বলে ডালিয়া বলল, তুমি এ ব্যাপারে এতটুকু চিন্তা করো না। কিছুদিন আগে তুমি স্ট্রোক করেছিলে। তারপর মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, আমি তো তোমার পেটের মেয়ে, আমাকে মাফ করে দেয়া যায় না? মাফ না করতে পারলে ভাতের সঙ্গে বিষ মাখিয়ে দিও। খেয়ে চিরকালের মতো তোমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাব।
শামিমা বেগম ভিজে গলায় বললেন, তোকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব বলে কি মানুষ করেছি?
ডালিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, তা হলে বল মাফ করে দিয়েছ?
তানভীর সাহেব মেয়েকে ঈশারা করে চলে যেতে বললেন।
ডালিয়া চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে যেতে বলল, আমি বেঁচে থাকতে তোমাদেরকে মামার কাছে ছোট হতে দেব না।
মেয়ে চলে যাবার পর তানভীর সাহেব স্ত্রীকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, যা হবার তাতো হয়েই গেছে, সেটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? দেখ, আমি বলছি ভাইয়া মহসিনেরই দোষ দেবেন।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠতে তানভীর সাহেব কাজের বুয়াকে গেট খুলে দিতে বললেন।
ডালিয়া বুয়াকে বাথরুমে যেতে দেখেছে। তাই বেসিনে চোখ মুখ ধুয়ে গেট খুলে দারোয়ানের সঙ্গে মামাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, মামা কেমন আছেন? মামা দাড়ি রেখেছেন, মাথায় টুপি দিয়েছেন দেখে ডালিয়া বেশ অবাক হল ও খুশি হল।
সালাউদ্দিন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো আছি মা। তোরা সবাই ভালো আছিস?
হ্যাঁ, ভালো আছি বলে ডালিয়া মামাকে নিয়ে ড্রইংরুমে আসার সময় একটু উঁচু গলায় বলল, মা, বাবা, মামা এসেছেন।
শামিমা বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি যাও আমি আসছি। তারপর বেসিনে চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এসে ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে অবাক হলেন। কদমবুসি করে বললেন, কেমন আছ ভাইয়া? ভাবিকে নিয়ে এলে না কেন?
সালাউদ্দিন দোয়া করে বললেন, আমরা ভালো আছি। একটা কাজে এসেছি, তাই তোর ভাবিকে আনিনি। তা তোরা সবাই ভালো আছিস?
শামিমা বেগম বললেন, বেশ কিছুদিন আগে ডালিয়ার আব্বা স্ট্রোক করেছিল। এখন ভালো আছে।
তানভীর সাহেব স্ত্রীর আগে এসে সমন্ধির সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বসেছিলেন।
তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সালাউদ্দিন বললেন, তাই না কি? কই, তোরা তো সেকথা জানাস নি?
শামিমা বেগম বললেন, আমি জানাতে চেয়েছিলাম। ডালিয়ার বাবা বলল ছোটখাট স্ট্রোকের কথা জানাতে হবে না। উনি চেয়ারম্যান মানুষ। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। শুনে হয়তো দরকারী কাজ ফেলে চলে আসবেন।
সালাউদ্দিন ছোট বোনের স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা একটা কথা হল? আত্মীয় স্বজনের বিপদে যতই দরকারী কাজ থাকুক না কেন আসতেই হবে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
জ্বি, ভালো।
তানভীর কী করছে? তারে দেখছি না কেন?
ও তো আমার ব্যবসা দেখাশোনা করছে। অফিস থেকে এখনও ফেরেনি।
শামিমা বেগম বললেন, তোমরা কথা বল, আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
মিনিট দশেক পরে মায়ের সঙ্গে ডালিয়া নাস্তার ট্রে-টেবিলে নিয়ে এসে তিন প্লেট নাস্তা পরিবেশন করে বলল, মামা, নাস্তা খেয়ে নিন। তারপর মা বাবাকে বলল, তোমরাও খাও।
নাস্তা খাওয়ার অল্পক্ষণ পরে নাজিয়া মেয়েকে নিয়ে এসে মামা শ্বশুরের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে কদমবুসি করল।
সালাউদ্দিন দোয়া করে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর দিতে দিতে বললেন, তোমার মেয়ে তো খুব সুন্দরী হয়েছে। কী নাম রেখেছ?
নাজিয়া বলল, ফাবিহা সুলতানা। ডাক নাম বেবী।
তওফিক ফিরবে কখন?
জ্বি, উনি ফেরেন সাধারণত মাগরিবের নামাযের সময়। এক আধদিন এশার নামাযের সময়। আজ আপনার আসার কথা জানিয়েছি। বললেন, বাসায় এসে মাগরিব পড়বেন।
.
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই একসঙ্গে বসে কথা বলার সময় সালাউদ্দিন বললেন, তোমরা কি জান, মহসিন এখান থেকে গিয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে আছে?
ভাইয়া মহসিনের খোঁজ করলে কি বলবে ভেবে শামিমা বেগম এতক্ষণ আতঙ্কিত ছিলেন। এখন তার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অবাক কণ্ঠে বললেন, কই, আমরা তো কিছুই জানি না। তারপর ডালিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানিস না কি?
ডালিয়া বলল, আগে জানতাম না। কিছুদিন আগে জেনেছি। মা যদি জিজ্ঞেস করে কার কাছে শুনেছিস। শুনেও আমাদের জানাসনি কেন? তাই তাড়াতাড়ি মামাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কার কাছে শুনেছেন।
সালাউদ্দিন বললেন, বেশ কিছুদিন আগে চরদৌলতখানের শফির কাছে। তার কাছে শুনেই তো মহসিন ও তার বৌকে নিয়ে যেতে এসেছি। তাকে তো তুই চিনিস?
শফির নাম শুনে ডালিয়ার তনুমনুতে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ মামা চিনি।
তানভীর সাহেব শফির নাম শুনে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হতে দেখেছেন। শফি কেমন ছেলে জানার জন্য। সমন্ধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গ্রাম্য একটা ছেলে কী বলল না বলল, তার কথা বিশ্বাস করে ছেলে বৌকে নিয়ে যেতে চলে এলেন? সত্যি সে বিয়ে করেছে কিনা খোঁজ নিয়েছেন?
সালাউদ্দিন বললেন, খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। কথাটা সত্য না হলে ডালিয়া জানল কী করে? তা ছাড়া শফির কাছে শুনে তোমার ভাবিকে বলতে সে মহসিনকে ফোন করে জেনেছে। আর শফির কথা যে বললে, তাকে যদি চিনতে, তা হলে ওকথা বলতে পারতে না। আমার এত বয়স হল ওর মতো সৎ, পরোপকারী, ধার্মিক ও চরিত্রবান ছেলে দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। শুধু তাই নয়, মারামারিতেও ওস্তাদ। খালি হাতে পাঁচ ছয়জনকে সহজেই কাবু করতে পারে। তা ছাড়া সবরকমের অস্ত্রবিদ্যায়ও পারদর্শী। এমনকি হেকিমী চিকিৎসাতেও পারদর্শী। আশপাশের কয়েকটা গ্রামে যে সব বখাটে ছেলেরা স্কুল কলেজের মেয়েদের ইভটিজিং করত, তাদেরকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে এনেছে। বর্তমানে আমাদের। এলাকায় কোনো বখাটে ছেলে নেই। এগুলো হল তার একটা দিক। অপর দিক হল, আরবি ও ইংরেজীতে উচ্চশিক্ষিত। একটা কামিল মাদরাসার প্রিন্সীপাল। ওর সঙ্গে কারও তুলনা করা যায় না। ওর তুলনা ও নিজেই। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপর হল, তাকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না তার মধ্যে এত গুণ। একজনের মধ্যে যে এত গুণ থাকে, তা ওকে না জানলে বিশ্বাস করতাম না। এক কথায় বলতে গেলে শফি পরশমণি। তার সংস্পর্শে যত খারাপ লোকই আসুক না কেন ভালো হতে বাধ্য। এই যে আমার
পরিবর্তন দেখছ, এটাও ওর সংস্পর্শে যাওয়ার কারণে।
তানভীর সাহেব শুনে ভীষণ খুশি হলেন। ভাবলেন, ডালিয়া উপযুক্ত পাত্রকে ভালবেসেছে। সমন্ধি থেমে যেতে বললেন, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না, একজনের মধ্যে এত গুণ থাকতে পারে।
ডালিয়া মামা বাড়িতে গিয়ে শফির কিছু কিছু গুণের কথা জেনেছিল। এখন মামার মুখে তার আরও গুণের কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।
তওফিক ও নাজিয়া শফির গুণাগুণ শুনে খুব খুশি হয়ে অনুচ্চস্বরে বলাবলি করল, ডালিয়ার তকৃদির খুব ভালো। তাই এমন একটা ছেলের সঙ্গে মন দেয়া নেয়া করেছে। মা নিশ্চয় শফিকে জামাই করতে অমত করবেন না।
শামিমা বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন। ভাইয়া যে শফির কথা বলছে, সেই-ই শফি কি তোমাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল?
তানভীর সাহেব বললেন, হ্যাঁ, সেই শফির কথাই ভাইয়া বললেন।
শামিমা বেগম বললেন, কিন্তু তাকে তো মৌলভী ধরনের ছেলে বলে মনে হল। কিসব পড়ে তোমার গায়ে ফুক দিল।
তানভীর সাহেব কিছু বলার আগে সালাউদ্দিন বললেন, তবে আর। এতক্ষণ ধরে ওর সম্পর্কে বললাম কী? ঝাড় ফুক করে, তাবিজ দিয়েও অনেকের অনেক রোগ ভালো করেছে। তারপর তানভীর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হঠাৎ সে হাসপাতালে তোমাকে দেখতে গিয়েছিল কেন বুঝতে পারছি না।
ডালিয়া চিন্তা করল, বাবা যদি সত্য ঘটনা বলে, তা হলে মা বাবার উপর ও তার উপর ভীষণ রেগে যাবে। তাই বাবা কিছু বলার আগে বলল, কয়েক মাস আগে একদিন আমি যখন ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম তখন কাকতলীয়ভাবে শফির সঙ্গে দেখা। সালাম ও কুশল বিনিময় করে বললেন, চলুন কিছু খাওয়া যাক। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার দিয়ে বললেন, আপনার বাবাকে ফোন করে এখানে আসতে বলুন। আমি ওনার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। আমি বললাম, তা হলে বাসায় চলুন। উনি বললেন, পরে একদিন যাব, আজ এখানে পরিচিত হতে চাই। আমি বাবাকে ফোন করে আসতে বলি। আসার পর বাবার সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ করে। শফি বাবাকে নাস্তা খাওয়ার কথা বলেন। বাবা রাজি না হতে আমাকে বললেন, আপনার বাবার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলাপ করব, আপনি বাইরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করুন। আমি বাইরে আসার পর বাবার সঙ্গে উনি কী আলাপ করেছিলেন বাবা আমাকে বলেন নি আর আমিও বাবাকে জিজ্ঞেস করিনি। এবারেও ঢাকায় এসে ফোন করে আমার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেন। সে সময় আমি বাবার স্ট্রোক করার কথা বলি। তাই বাবাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন। তারপর ডালিয়া বাবার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে চুপ করে গেল।
মেয়ের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে তানভীর সাহেব খুশি হলেও বেশ অবাক হলেন। সমন্ধির দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ডালিয়া ঠিকই বলেছে।
সালাউদ্দিন ভাগনির কথা শুনে বুঝতে পারলেন, তার অনুমানই ঠিক, সে শফিকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই যেদিন শফি মহসিন ও তার বন্ধুদের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল, সেদিন শফির সম্পর্কে তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। আর শফিও নিশ্চয় তাকে ভালবাসে। সেই কারণেই শফি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য দু’বার ঢাকায় এসেছিল। ভাগনির মনের খবর বুঝতে পেরে খুশি হয়ে তানভীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন শফি তোমার সঙ্গে কী ব্যাপারে আলাপ করেছিল?
তানভীর সাহেব চিন্তা করলেন, সত্য কথা বলার এটাই সুযোগ। স্ত্রী ভাইয়ার সামনে তাকে বা মেয়েকে রাগারাগি করতে পারবে না। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শফি সেদিন ডালিয়াকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
কথাটা শুনে ডালিয়া লজ্জা পেয়ে সবার অলক্ষ্যে রুমের বাইরে এসে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়াল মামা কী বলে শোনার জন্য।
সালাউদ্দিন আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কী বলেছিলে?
মহসিনের কথা চিন্তা করে বলেছিলাম, ভেবেচিন্তে পরে জানাব।
পরে তাকে জানিয়েছিলে?
না। মহসিনের ব্যাপারে ডালিয়ার মায়ের সঙ্গে ও আপনার সঙ্গে আলাপ করে জানাব ভেবেছিলাম। আমার অসুস্থতার কারণে তা হয়নি।
শফির সবকিছু তো শুনলে, এই কাজ হলে আমি খুব খুশি হব। আর ডালিয়াও যে সুখী হবে তা আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর। আশা করি, শামিমা ও তুমি খুশি হবে। তারপর শামিমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে, শফি জামাই হলে তুই খুশি হবি না?
হাসপাতালে শফিকে দেখে মোল্লাহ বলে মনে হয়েছে শামিমা বেগমের। মোল্লাদের তিনি বড় একটা পছন্দ করেন না। মনে করেন মোল্লারা তাদের মতো মডার্ন সোসাইটির অযোগ্য। এখন ভাইয়ার মুখে তার গুণের কথা শুনে অবাক হয়ে ভাবলেন, মোল্লাদেরও তা হলে এত গুণ থাকে? ভাইয়া খুশি হওরার কথা জিজ্ঞেস করতে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ডালিয়া খুশি মনে যদি শফিকে বিয়ে করতে চায়, তা হলে আমিও খুশি। তবে মহসিন জামাই হলে আরও বেশি খুশি হতাম।
সালাউদ্দিন বুঝতে পারলেন, মহসিন বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছে বলে মনে খুব আঘাত পেয়েছে। বললেন, তকদিরের উপর কারও হাত নেই। আল্লাহ ওদেরকে জোড়া করে পয়দা করেন নি। তাই ওরকম হল। এইটা নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। শফির সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ের ব্যাপারে তোমাদেরকে কিছু করা লাগবে না, যা করার আমিই করব। এখন ওসব কথা বাদ দিয়ে যা বলছি শোন, মহসিন ও তার বৌকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তোমরা কী বল?
শামিমা বেগম বললেন, মহসিন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে, এটা তোমার মান-সম্মানের ব্যাপার। বিয়ে যখন করেই ফেলেছে তখন ওদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়াই উচিত বলে আমি মনে করি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?
সালাউদ্দিন বললেন, শফির কাছে বিয়ে করেছে শোনার পর যখন তোর ভাবি ও রাহেলা ওর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে তখন মহসিন বিয়ের কথা স্বীকার করে তোর ভাবির কাছে মাফ চেয়েছে। যাই হোক, তোরাও চল বৌমা কেমন হয়েছে দেখে আসবি। তারপর কথাবার্তা বলে ওদেরকে যেদিন দেশে নিয়ে যাব, সেদিন তোরাও আমাদের সঙ্গে যাবি।
শামিমা বেগম স্বামীকে বললেন, ভাইয়া ঠিক কথা বলেছে। মাকে অনেক দিন দেখিনি। তাকে দেখার জন্য কয়েকদিন থেকে মন খুব ছটফট করছে। চল না যাই।
শফির সঙ্গে ননদের বিয়ের কথা শুনে নাজিয়া খুব খুশি হয়েছে। শাশুড়ি থেমে যেতে বলল, হ্যাঁ বাবা, আপনি ও মা যান মামার সঙ্গে।
সালাউদ্দিন নাজিয়াকে বললেন, তুমি তো মাত্র একবার গিয়েছিলে? শ্বশুর শাশুড়ির সাথে তুমিও চল।
নাজিয়া বলল, পরে যাব। এখন গেলে আপনাদের ছেলের অসুবিধে হবে।
স্ত্রীর কথা শুনে তওফিক বলল, এখন মা বাবা আপনাদের সঙ্গে যাক, ওনারা ফিরে আসার পর আমি আপনাদের বৌমাকে নিয়ে যাব।
.
০৯.
সালাউদ্দিন বোন শামিমা বেগম ও বোনের স্বামী তানভীর সাহেবকে নিয়ে ছেলে-বৌসহ বাড়িতে আসার তিন দিন পর খুব ধুম-ধাম করে ওলিমা করলেন। ওলিমায় মহসিনের শ্বশুরবাড়ির সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। গ্রামের প্রায় এক হাজার গরিব বড়লোককে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালেন। একে চেয়ারম্যান, তার উপর অবস্থাপন্ন গৃহস্থের একমাত্র ছেলের ওলিমা বলে কথা। শফিকেও দাওয়াত দিয়েছিলেন; কিন্তু সে আসেনি। রাহেলার কথায় সালাউদ্দিন কলেজের সব শিক্ষকদেরও দাওয়াত দিয়েছিলেন। শিক্ষকদের সঙ্গে রবিউল এসেছিল।
শফি আসেনি শুনে রাহেলা তাকে ফোন করে সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বলল, তুমি এলে না কেন?
শফি বলল, বিশেষ কারণবশতঃ যেতে পারিনি।
বিশেষ কারণটা জানতে চাই।
বলা যাবে না।
আমার মনে কষ্ট হয় না বুঝি?
রবিউল তো গেছে, ওকে ভালো করে খাওয়া, তা হলে কষ্ট লাঘব হবে।
কথাটা ঠিক বলেছ কিনা জানি না, তবে তোমাকে খাওয়ালে যতটা সুখ পেতাম, তোমার বন্ধুকে ভালো করে খাইয়েও অতটা সুখ পাব না। মনে হয়। আমাদের বাড়িতে খাবে না বলে আসনি।
কথাটা ঠিক বলিসনি। তোকে বোন বলে যখন স্বীকার করেছি তখন খাব না কেন? তবে আজ সম্ভব নয়। তোর বিয়ের ব্যাপারে যখন কথা বলতে। যাব তখন খাব। শোন, আজকের অপারগতার জন্য বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের কাছে ক্ষমা চাইছি। আর তোকে তুই করে বলছি বলে মনে কিছু করিস না। যদি করিস, সে জন্যেও ক্ষমা চাইছি।
তার কথা শুনে রাহেলার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, বড় ভাই ছোট বোনকে তুই করে বলবে না তো কী আপনি করে বলবে? সে জন্যে ক্ষমা চাওয়া তোমার উচিত হয় নি। আর আসতে না পারার জন্যেও ক্ষমা চাইছ কেন? বরং আমি তোমাকে আসার জন্য অনেক কিছু বলে বিরক্ত করেছি। সে জন্য আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত। বল ক্ষমা করে দিয়েছ?
ছোট বোন হিসাবে তুই যা করেছিস তা অন্যায় নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক, ক্ষমা চাইছিস কেন? তবু বলছি, আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুক। আর কিছু বলবি?
রাহেলা বুঝতে পারল, শফি ভাই আর কথা বলতে চাচ্ছে না। তাই বলল, না আর কিছু বলব না। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
রাহেলা এক ফাঁকে কাজের ছেলেটাকে দিয়ে রবিউল স্যারকে আড়ালে ডেকে সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, আপনার বন্ধু এল না কেন জানেন?
রবিউল বলল, হ্যাঁ, জানি। ওকে কখনও কারও বাড়িতে খেতে দেখিনি। বিশেষ করে কোনো বিয়ে বাড়িতে আর ফাংশনে তো নই-ই।
আপনাদের বাড়িতেও খায় না?
খায়, তবে খুব কম দিন।
এমন সময় কাজের ছেলেটা এসে রাহেলাকে বলল, আম্মা আপনাকে ডাকছে।
রাহেলা রবিউলকে বলল, এখন আসি, রাতে ফোনে কথা বলব। তারপর বিদায় নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কেন ডেকেছ বল?
আখতার বানু জিজ্ঞেস করলেন, চরদৌলতখানের শফি এসেছে? তাকে দেখাবি বলেছিলি না?
রাহেলা বলল, না, আসেনি।
কেন এল না রে, তোর বাবা বলল, শফিকে দাওয়াত দিয়েছে?
হ্যাঁ, বাবা দাওয়াত দিয়েছিল। আসেনি শুনে আমি তাকে ফোন করেছিলাম। বলল, বিশেষ কারণে আসতে পারেনি। অন্যদিন আসবে বলেছে। এলে সেদিন তোমাকে দেখাব। আমাদের কলেজের রবিউল স্যারের বাড়িও চরদৌলতখান। ওনার সঙ্গে শফি ভাইয়ের খুব বন্ধুত্ব। উনি এসেছেন। ওনাকে শফি ভাই আসেনি কেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, “শফি বিয়ে বাড়িতে বা কোন ফাংশানে খান না।”
সালাউদ্দিন মেয়ের খোঁজে এসে তাকে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, শফি এল না কেন বলতে পারিস?
রাহেলা মাকে যা কিছু বলেছে, বাবাকেও সেসব বলল।
সালাউদ্দিন আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
.
আত্মীয়-স্বজন ও বাইরের মেহমানরা চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে মহসিন বন্ধুদের কাছে ও গ্রামের লোকজনের কাছে শফির গুণের কথা শুনেও তার মনের পরিবর্তন হল না। কিভাবে অপমানের প্রতিশোধ নেবে সেই চিন্তা করতে লাগল। একদিন বন্ধুদেরকে সেকথা জানিয়ে বলল, তোরা কোনো একটা উপায় বের কর, প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।
বন্ধুরা বলল, প্রতিশোধ নেয়ার কথা মাথা থেকে দূর করে দে। নচেৎ প্রতিশোধ নিতে গেলে আবার অপমান হবি।
মহসিন রেগে উঠে বলল, তোরা কাপুরুষ। তাই তোদের ঠাং ভেঙ্গে দিলেও প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিস না।
বন্ধুদের একজন বলল, সেদিন তোর কথা শুনে শফি ভাইয়ের সঙ্গে মারামারী করে মারাত্মক ভুল করেছি। কারণ পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তুই আমাদের কাছে ওনার বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা কথা বলেছিস।
সে থেমে যেতে অন্য বন্ধু বলল, তুই তো অনেক দিন বাড়িতে ছিলি না, গ্রামের খবর রাখবি কী করে? শুধু আমাদের গ্রামের নয়, আশপাশের গ্রামে যেখানেই কোনো অন্যায় ঘটনা ঘটেছে, সেখানেই শফি ভাই গিয়ে অন্যায়কারীকে শাস্তি দিয়ে সৎপথে চলার পথ বাতলে দিয়েছেন। আমরা শফি ভাই সম্পর্কেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি, উনি যেমন এতটুকু অন্যায় করেন, তেমনি কেউ অন্যায় করলে বরদাস্ত করতে পারেন না। তাই অন্যায়ের প্রতিকার করেন। তুই জানিস কি না জানি না, আমাদের এমপি সাহেবের ছেলে দু’জন বন্ধুকে নিয়ে একটা কলেজ ছাত্রীর ইজ্জৎ লুটতে গিয়েছিল। কেমন করে যেন শফি ভাই জানতে পেরে তাদেরকে এমন মার দিয়েছিলেন যে, সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন পরে তিনিই আবার তাদেরকে সুস্থ করার জন্য চিকিৎসা করছেন। শুনেছি, তারা নাকী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।
ঐ বন্ধু থেমে যেতে আর এক বন্ধু বলল, তুই এখন বিয়ে করেছিস; আমরা চাই ভাবিকে নিয়ে সুখশান্তিতে সংসার ধর্ম কর। অযথা শফি ভাইয়ের পেছনে লাগিস না।
বন্ধুদের কথা শুনেও মহসিনের বোধোদ্বয় হল না। বরং আরও বেশি রেগে গিয়ে তাদের কাছ থেকে চলে আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, কীভাবে শফিকে শায়েস্তা করবে। শেষে ভেবে ঠিক করল, এখানকার কাউকে দিয়ে শফিকে শায়েস্তা করা যাবে না। ঢাকা থেকে গুন্ডা আনিয়ে কাজটা করতে হবে।
কয়েকদিন পর মহসিন জুঁইকে সঙ্গে নিয়ে একদিন মা বাবাকে বলল, আমার সামনে পরীক্ষা। দু’একদিনের মধ্যে আপনাদের বৌমাকে নিয়ে ঢাকা যেতে চাই।
আখতার বানু স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চুপ করে রইলেন।
সালাউদ্দিন বললেন, পরীক্ষা দিয়ে কাজ নেই। তুমি আমার এক ছেলে। এবার আমার ব্যবসা ও বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা কর। আল্লাহ কখন কাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেবেন, তা কেউ জানে না। তাই আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে চাই।
মহসিন বলল, পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে পরীক্ষা শেষ হবে, তারপর তোমার কথামতো সবকিছু করব।
সালাউদ্দিন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি তোমার বাবা আর তুমি আমার ছেলে। এখন তুমিই বল, বাবার কথা ছেলে শুনবে, না ছেলের কথা বাবা শুনবে?
মহসিন অসন্তুষ্ট গলায় বলল, তুমি এরকম কথা বলছ কেন। বললাম না, পাঁচ ছয় মাস পরে তোমার কথামতো কাজ করব।
না, আমি যা বললাম তাই করবে। এটাই আমার শেষ কথা, এবার তুমি যাও।
এতক্ষণ জুঁই চুপ করে বাবা ও ছেলের কথা শুনছিল। শ্বশুরের শেষের কথা শুনে বলল, বাবা, আমি একটা কথা বলতে চাই।
সালাউদ্দিন বললেন, বেশতো মা বল।
জুঁই বলল, ওঁর তিনচার মাস পরে পরীক্ষা শুরু হবে জেনেও কেন ঢাকা যেতে দিচ্ছেন না বুঝতে পারছি না।
সালাউদ্দিন এক পলক জুঁই-এর দিকে তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন, সে কথা বলা যাবে না। তবে এতটুকু জেনে রাখ, তোমাদের ভালর জন্য যেতে দিচ্ছি না।
জুঁই বলল, আর একটা কথা বলব, ওঁর পরীক্ষার পর আমার ভাইয়া তার অফিসের ম্যানেজার করার কথা বলেছে। বেতন ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজারের কম নয়, বরং বেশিই হবে।
তার কথা শুনে সালাউদ্দিন আরও রেগে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে সংযত কণ্ঠে বললেন, বৌমা, তোমার স্পর্ধা দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা কেন, এক লাখ টাকা বেতন দিলেও আমি ওকে আর ঢাকা যেতে দেব না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। ও ঢাকায় যাবে কোন দুঃখে? তোমার মন চাইলে কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে পার।
বাবার কথা শুনে মহসিন খুব রেগে গেল। জুঁইকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলে এস। তারপর নিজের রুমে চলে এল।
স্বামীকে চলে যেতে দেখে জুঁই আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এল।
জুই রুমে এলে মহসিন তাকে বলল, বাবা কেন যে আমাকে ঢাকা যেতে নিষেধ করছে বুঝতে পারছি না। আগে আমার কোনো কথা বা কাজে বাবা কখনও বাধা দেয় নি।
জুঁই বলল, আমার মনে হয় রাহেলা আপা হয়তো কারণটা জানে।
মহসিন বলল, তুমি ঠিক বলেছ। ওকে ডেকে নিয়ে এস।
রাহেলা আড়াল থেকে বাবা ও ভাইয়ার কথা শুনেছে। তাই জুঁই যখন তার রুমে এসে বলল তোমার ভাইয়া ডাকছে তখন বুঝতে পারল ভাইয়া কেন ডাকছে। ভাবির সঙ্গে এসে ভাইয়াকে বলল, কেন ডেকেছে বল।
মহসিন বলল, আমি নিশ্চিত তুই জানিস বাবা কেন আমাকে ঢাকা যেতে নিষেধ করছে।
ভাইয়া যে তাকে এরকম প্রশ্ন করবে রাহেলা জানত। তাই কী বলবে ভেবে ঠিক করে রেখেছিল। এখন ভাইয়া জিজ্ঞেস করতে বলল, শফি ভাই বাবাকে বলেছে, “তোমাকে ঢাকা না পাঠিয়ে তার ব্যবসায় লাগাতে। আরও বলেছে, ঢাকা গেলে তুমি খুব বড় বিপদে পড়বে।”
শফির নাম শুনেই মহসিন রাগে জ্বলে উঠল। বলল, মনে হচ্ছে হারামীটাকে একেবারে শেষ না করলে সারাজীবন আমাকে জ্বালাবে।
রাহেলাও রেগে উঠে বলল, আহ,, ভাইয়া, শফি ভাইকে গালাগালি করছ কেন? সেদিন তোমাকে ফোনে বললাম না, ওর মতো ভালো মানুষ এ তল্লাটে কেউ নেই।
মহসিন রাগের সঙ্গে বলল, আমার সামনে তুই বারবার শফি ভাই শফি ভাই করবি না। তোকে বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, তাই হয়তো
সে তোর কাছে ফেরেশতা। আর কোনোদিন তার নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবি না বলে দিচ্ছি। ওকে দুনিয়া থেকে বিদায় না করেছি তো আমার নাম মহসিন নয়। রাহেলা কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে আবার বলল, তোর আর একটা কথাও শুনতে চাই না, এখান থেকে চলে যা।
রাহেলা ভাইয়ার আচরণে মনে খুব কষ্ট পেয়ে চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে যেতে যেতে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, যদি জানতে শফি ভাই কেন। তোমাকে ঢাকায় যেতে নিষেধ করেছে, তা হলে এরকম কথা তাকে বলতে পারতে না।
ভাই বোনের কথা শুনে জুঁই-এর মনে হল, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে। আরও মনে হল রহস্যটা রাহেলা নিশ্চয় জানে। ভাবল, পরে তার কাছ থেকে যেমন করে হোক রহস্যটা জানতে হবে।
রাহেলার চলে যাবার পর মহসিনকে বলল, এখানে আসার পর থেকে দেখছি তুমি সামান্য কথাতে রেগে যাও। এটা ঠিক না। এই যে বাবা তোমাকে ঢাকা যেতে নিষেধ করায় রেগে গেছ, রাহেলা আপা শফির কথা বলতে তার উপর রেগে গেছ, এগুলোও ঠিক না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সবকিছুর কারণ জানার চেষ্টা করা উচিত। আর শফিই বা কে? তার নাম শুনলেই খুব রেগে যাও, তার কারণই বা কী? একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে। তোমার বাবা খুব নামি দামি ও প্রভাবশালী লোক। বিষয় সম্পত্তিও প্রচুর আছে। তুমি তার এক ছেলে। ভবিষ্যতে একদিন তুমিই হবে এসবের মালিক। তাই হয়তো বাবা সেসব দেখাশোনা করার জন্য তোমাকে তৈরি করতে চাচ্ছেন। শফি কে জানি না, তার কথায় যদি বাবা তোমাকে ঢাকা যেতে না দেন, তা হলে জানতে হবে কেন সে বাবাকে বলেছে ঢাকা গেলে তুমি খুব বড় বিপদে পড়বে। মাথা গরম না করে চুপ-চাপ কয়েকদিন থাক। এর মধ্যে আমি রাহেলা আপার কাছ থেকে সবকিছু জানার চেষ্টা করব।
স্ত্রীর কথা শুনে মহসিনের রাগ কিছুটা কমল। বলল, শফি একটা গুন্ডা ধরনের ছেলে। গুন্ডাগিরী করে এই এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবু যে কেন সবখানে তার গুনগান শুনি বুঝতে পারছি না। তারপর বলল, ঠিক আছে, যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। কথা শেষ করে বাইরে চলে গেল।
জুঁই স্বামীর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ননদের রুমে গিয়ে দেখল, সে চুপ করে বসে চোখের পানি ফেলছে। এগিয়ে এসে নিজের ওড়নায় তার চোখ মুছে দেয়ার সময় বলল, তোমার ভাইয়ার খারাপ ব্যবহারের জন্য তার হয়ে আমি মাফ চাইছি।
রাহেলা বলল, ভাইয়ার খারাপ ব্যবহারের জন্য কাঁদিছ না, কাঁদছি ভাইয়া শফি ভাইকে ভুল বুঝে তাকে শত্রু মনে করে বলে। তুমি তো জান না ভাবি, শফি ভাই শুধু বখাটেদের হাত থেকে হিন্দু, মুসলমান, উঁচু-নিচু সব বংশের শতশত মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করেছে তাই নয়, সেই সব বখাটে ছেলেদের কুরআন হাদিসের কথা ও উপদেশ দিয়ে সৎপথে এনেছে। তা ছাড়া কত লোকের যে কত রকমের উপকার করেছে তার হিসাব নেই।
জুঁই জিজ্ঞেস করল, শফির বাড়ি কি এই গ্রামেই?
না, পাশের গ্রাম চরদৌলতখানে।
উনি কী করেন?
এখান থেকে চার পাঁচ মাইল দূর নলছটী গ্রামে একটা কামিল মাদরাসা আছে। শফি ভাই ঐ মাদরাসার প্রিন্সীপাল।
ওমা তাই না কী? তা হলে তো উনি আরবি লাইনে উচ্চ শিক্ষিত এবং একজন বড় আলেমও?
বড় আলেম তো বটেই। আর শুধু আরবিতে নয়, ইংরেজীতেও উচ্চশিক্ষিত। তা ছাড়া এমন কোনো বিদ্যা নেই, যাতে শফি ভাই পারদর্শী নয়।
জুঁই অবাক হয়ে বলল, তাই যদি হয়, তা হলে তোমার ভাইয়া ওনাকে গুন্ডা বলল কেন? আর শক্রই বা ভাবে কেন?
দুষ্টুদের দমন করতে হলে তো মারামারি করতেই হয়। সেইজন্যে ভাইয়া তাকে গুন্ডা বলেছে। আর আমি বলব, সে গুন্ডাদের উস্তাদ। কারণ আজ পর্যন্ত মারামারিতে কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠে না। ভাইয়া দু’বার তার সঙ্গে লেগেছিল; কিন্তু একবারও তার এতটুকু ক্ষতি করতে পারেনি। বরং উল্টে তার হাতে মার খেয়ে আহত হয়েছে। আমার মনে হয় সেই কারণেই শফি ভাইয়ের উপর ভাইয়ার খুব রাগ এবং তাকে শত্রু ভাবে।
তোমার ভাইয়া শুধু শুধু তার সঙ্গে লাগতে গেল কেন?
সে কথা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে।
লাগুক অনেক সময়, তবু শুনব। তার আগে বল, তোমার ভাইয়া যাকে শত্রু মনে করে, তাকে তুমি অত সম্মান কর কেন?
তখন ভাইয়া বলল “শুনলে না, বখাটেদের হাত থেকে শফি ভাই আমার ইজ্জৎ রক্ষা করেছে বলে তাকে আমি ফেরেশতার মতো মনে করি?” কথাটা ভাইয়া ঠিকই বলেছে। শুধু আমি নই, আশ-পাশের গ্রামের লোক ও স্কুল কলেজের পড়ুয়া মেয়েরা তাকে তাই ভাবে। আর হিন্দুরা তো তাকে দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তারপর কীভাবে বখাটেদের হাত থেকে তাকে ও সুশীলাকে রক্ষা করার কথা এবং লেঠেল সর্দার মোবারকের হাত ভেঙ্গে দেয়া ও তার চিকিৎসার জন্য দশ হাজার টাকা দেয়ার কথা একের পর এক বলল।
তারপর শফির কাছে প্রেম নিবেদন করতে সে অপারগতা ও তার কারণ জানিয়ে ভাই বোন সম্পর্ক করেছে, সে কথা বলা ঠিক হবে না ভেবে বলল, বখাটেদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার পর থেকে তাকে আমি শফি ভাই বলে ডাকি। আর সেও আমাকে ছোট বোনের মতো মনে করে। শফি ভাই এমন একজন মানুষ, যে কেউ অল্পক্ষণের জন্যে তার সংস্পর্শে আসবে, সে যতই খারাপ লোক হোক না কেন, ভালো হবার প্রেরণা পাবে।
জুঁই বলল, এবার বল তোমার ভাইয়া ওনার সঙ্গে দু’বার লেগেছিল কেন?
রাহেলা বলল, দুটো ঘটনার প্রথমটা বলছি। প্রায় বছর খানেক আগে আমার ফুপাতো কোন ডালিয়া ঢাকা থেকে আমাদের এখানে বেড়াতে আসে। তখন সে ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরত। একদিন ভাইয়ার হুন্ডায় করে বেড়াবার সময় এক অন্ধ ভিক্ষুককে চাপা দিতে যাচ্ছিল। শফি ভাই ভিক্ষুককে রাস্তা পার করে দিচ্ছিল। সে যদি ভিক্ষুককে দ্রুত টেনে না নিত, তা হলে নির্ঘাত এক্সিডেন্ট হত। হুন্ডা চালাচ্ছিল ডালিয়া আর ভাইয়া তার পিছনে বসেছিল। তাই শফি ভাই ডালিয়াকে বলেছিল, ভালোভাবে গাড়ি চালাতে না শিখে রাস্তায় গাড়ি চালান উচিত নয়। আরও বলেছিল, মেয়েদের পুরুষদের পোশাক পরা উচিত নয়। কারণ হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলেছেন, “যে সকল পুরুষ নারীর বেশ ধারণ করে এবং যে সকল নারী পুরুষের বেশ ধারণ করে, আল্লাহ তাহাদিগকে অভিশাপ দেন।” [ বর্ণনায় : হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-বুখারী] তার কথা শুনে ভাইয়া তাকে বলল, হাদিস শোনাবার আর জায়গা পেলে না। তারপর কথা কাটাকাটি করতে করতে একসময় শফি ভাইকে ঘুষি মারতে গেল। শফি ভাই হাতটা ধরে ফেলে কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়। ভাইয়া রেগে গিয়ে রিভলবার বের করে গুলি করতে যায়। শফি ভাই দ্রুত এগিয়ে এসে রিভলবার কেড়ে নিয়ে উপরের দিকে ফায়ার করে চেম্বার খালি করে ফেরত দিয়ে ডালিয়াকে বলেছিল, ইনাকে হয় কোনো মেন্টাল। ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাবেন, আর না হয় পাবনা হেমায়েতপুরের হাসপাতালে পাঠাবেন। দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরে শফি ভাই গ্রামের রাস্তা দিয়ে তার নানার বাড়ি গিয়েছিল, সেখান থেকে ফেরার পথে আমাদের গ্রামের রাস্তায় যখন এল তখন ভাইয়া ও তার চার পাঁচজন বন্ধু লাঠি নিয়ে তাকে আক্রমণ করে। শফি ভাই খালি হাতে তাদের একজনের কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে সবাইয়ের একটা করে পা ভেঙ্গে দেয়। তাই দেখে ভাইয়া রিভলবার বের করে শফি ভাইকে গুলি করতে চায়। শফি ভাই তার রিভলবার ধরা হাতে লাঠির আঘাত করে হাত ভেঙ্গে দেয়। তারপর রিভলবারটা নিয়ে উড়ো ফায়ার করে চেম্বার খালি করে ফেরত দিয়ে চলে যায়। আমার দুর্ভাগ্য দুটো ঘটনাই আমি দেখিনি, ডালিয়ার কাছে শুনেছি। দ্বিতীয় ঘটনার সময় আমি কলেজে ছিলাম। অবশ্য বাবা দেখে তখন শফি ভাইয়ের প্রশংসা করলেও পরে ছেলের হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার প্ল্যান করেছিল, কিন্তু শফি ভাই কীভাবে যেন জানতে পারে। তারপর বাবার সঙ্গে দেখা করে এমন কিছু কথা বলে, যার ফলে বাবা প্রতিশোধ নেয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে হেদায়েত হয়ে গেছে। দাড়ি রেখে নিজেও যেমন নিয়মিত নামায পড়ছে, তেমনি ঘরের সবাইকেও পড়াচ্ছে। আমিও আগে নামায পড়তাম না, বোরখা ব্যবহার করতাম না। শফি ভাই যেদিন আমাকে বখাটের হাত থেকে রক্ষা করে, সেদিন এমন কিছু কথা বলেছিল, যা শুনে আল্লাহ আমাকেও হেদায়েত দিয়েছেন। তারপর থেকে আমি নামায পড়ছি আর বোরখাও ব্যবহার করছি। তুমি কিছু মনে করো না ভাবি, আমি তো ভাইয়াকে চিনি, সে একটু অহঙ্কারী। নামি, দামি ও প্রভাবশালী লোকের এক ছেলে, তাই নিজেকে কেউকেটা ভাবে। কয়েকদিন আগে কুরআনের ব্যাখ্যায় পড়লাম, “আল্লাহ অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না।” গতকাল হাদিসে পড়লাম, আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন। “যাহার অন্তরে একটি সরিষার বীজ পরিমাণ ঈমান আছে সে দোযোখে যাইবে না এবং যাহার অন্তরে একটি সরিষার বীজ পরিমাণ অহংকার আছে সে বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায় : হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ)- মুসলিম]
জুঁই জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাইয়া ঢাকা গেলে খুব বড় বিপদে পড়বেন শফি বলেছেন; কিন্তু কোন ধরনের বিপদ বলেছেন?
বলাটা উচিত হবে না ভেবে রাহেলা মিথ্যে করে বলল, তা জানি না।
জুঁই আবার জিজ্ঞেস করল, বাবা জানেন?
তাও জানি না। তুমি ভাইয়াকে বোঝাও, সে যেন ঢাকা না যায়।
আমি বোঝালে তোমার ভাইয়া শুনবে না। আচ্ছা, একটা কথা বল তো, ঢাকা গেলে তোমার ভাইয়া বিপদে পড়বে, সে কথা শফি জানলেন কী। করে? আর তোমরাই বা বিশ্বাস করলে কী করে?
রাহেলা মৃদু হেসে বলল, আজ পর্যন্ত শফি ভাই আগাম যা কিছু বলেছে, তা প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। তাই তার কথা শুধু আমরা নই, সবাই। বিশ্বাস করে।
জুঁই বলল, কিন্তু আমি দাদির কাছে শুনেছি, আল্লাহ ছাড়া কেউ ভবিষ্যতের কথা বলতে পারে না। এটা নাকি কুরআন হাদিসেও আছে।
রাহেলা বলল, উনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরাও তাই জানি ও মানি। আর শফি ভাইও তাই বলে। রবিউল নামে আমাদের কলেজের একজন টিচার আছেন। উনি শফি ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়িও একই গ্রামে। ঐ স্যারের কাছে শুনেছি, উনি একবার শফি ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কী করে আগাম ঘটনা বলিস? উত্তরে সে বলেছিল, তার নাকি দুটো মন। দ্বিতীয় মন যা বলে তা হয়। এমন কী কেউ যদি তার ক্ষতি করার প্ল্যান করে, তা সে জানতে পারে এবং তার কাছে গিয়ে প্ল্যান ত্যাগ করতে বলে কুরআন হাদিসের বানী শুনিয়ে হেদায়েত করে।
জুঁই শফির কথা যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, ওনার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?
ফোনে যোগাযোগ আছে।
তা হলে ঢাকা গেলে তোমার ভাইয়ার কী বিপদ হবে ফোন করে জেনে নিতে পারবে না?
পারব; কিন্তু বলবে বলে মনে হয় না। তারপর মিথ্যে করে বলল, কারণ। যখন কথাটা বলেন তখন বাবা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। বলল, সে কথা আল্লাহপাক জানেন।
হঠাৎ জুঁইয়ের মনে হল, ডালিয়ার সঙ্গে মহসিনের বিয়ের কথা অনেক আগে থেকে পাকা হয়ে থাকা সত্ত্বেও সে আমাকে বিয়ে করেছে। সেই জন্যে ডালিয়ার বাবা ও ভাইয়া তাকে কোনো বিপদে ফেলবে না তো? আবার ভাবল, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়েও কী এমন কাজ করতে পারবে?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাহেলা জিজ্ঞেস করল, কী চিন্তা করছ ভাবি?
জুঁই বলল, তোমার ভাইয়ার কাছে শুনেছি, তার সঙ্গে নাকি ডালিয়ার বিয়ে হবার কথা পাকা হয়েছিল?
হ্যাঁ ছিল।
হল না কেন?
রাহেলা হেসে উঠে বলল, শফি ভাইয়ের কারণে হল না।
জুঁই কপাল কুঁচকে বলল, শফির কারণে হল না, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
রাহেলা বলল, কিছুক্ষণ আগে শফি ভাইয়ের সাথে ভাইয়ার যে দুটো ঘটনার কথা বললাম তার প্রথম ঘটনা ডালিয়াকে নিয়ে আর দ্বিতীয় ঘটনা ডালিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। ঐ দুটো ঘটনা শফি ভাইয়ের কথাবার্তা ও আচার আচরণ ডালিয়ার মনে দাগ কাটে। তারপর তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ না হলেও সেই দাগ গভীর প্রেমে পরিণত হয়। অপরপক্ষে শফি ভাই ভাইয়ার সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ের কথা জানা সত্ত্বেও ঐ দু’বার ডালিয়াকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সে চুপ থাকলেও ডালিয়া থাকে ধার্মিক জেনে ধার্মিক হবার চেষ্টা করে পর্দানশীন মেয়ে হয়ে যায়। ভাইয়া ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলে। তাই ডালিয়ার পরিবর্তন দেখে ভীষণ রেগে যায় এবং তাকে ঐ সব ছাড়তে বলে। ডালিয়া রাজি না হয়ে বলে তুমিও ধার্মিক হয়ে যাও, নচেৎ আমাদের বিয়ে হবে না। ভাইয়াও তাকে বলে তুমি বরং আগের জীবনে ফিরে এস, নচেৎ আমিও তোমাকে বিয়ে করব না। তারপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আমার যতদূর মনে হয় ধর্মটা আসল ফ্যাক্টর নয়। আসল ফ্যাক্টর হল, ডালিয়া যেমন শফি ভাইকে দেখে ও তার কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে, তেমনি ভাইয়াও তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করে।
জুঁই ভাবল, এখানে আসার আগে মহসিন যে কথা বলেছিল তার সঙ্গে রাহেলার অনুমান প্রায় মিলে যাচ্ছে। তাই বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। যাই হোক, এখন তোমার ভাইয়ার ব্যাপার নিয়ে চিন্তা কর, আমি তো ভেবে কিছু পাচ্ছি না।
এমন সময় কাজের বুয়া রোশনী দরজার পর্দা সরিয়ে রাহেলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপা, চরদৌলতখান থেকে মেহমান এসেছে, খালাআম্মা আপনাকে ডাকছে।
কথাটা শুনে রাহেলা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ক’জন মেহমান এসেছে?
রোশনী বলল, একজন।
তুই যা আমি আসছি বলে রাহেলা ভাবিকে বলল, মনে হয় শফি ভাই। এসেছে।
তাই নাকী বলে জুঁই বলল, চল তো দেখি।
.
১০.
পনের দিন মাদরাসা গরমের ছুটি থাকায় শফির ব্যস্ততা কমেছে। তাই আজ সকালে রবিউলের বাবা জহির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বলল, চাচা, আমি রবিউলের জন্য একটা পাত্রি দেখেছি। আপনি অনুমতি দিলে পাত্রি পক্ষের সবকিছু জানাব।
জহির উদ্দিন শফিকে শুধু ছেলের বন্ধু হিসাবে নয়, খুব ভালো ছেলে হিসাবেও জানেন। তারই সংস্পর্শে এসে রবিউল হেদায়েত হয়েছে তাও জানেন। তার কথা শুনে চিন্তা করলেন, শফি যখন পাত্রি দেখেছে তখন পাত্রি ও পাত্রিপক্ষ যে ভালো হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বললেন, ঠিক আছে পাত্রির সবকিছু বল।
শফি বলল, শিখরমন্ডলের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের মেয়ে। ওনার সবকিছু তো আপনি জানেন?
চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের ছেলে মহসিনের সঙ্গে শফির মারামারির কথা জহির উদ্দিন জানেন। তারই বোনের সঙ্গে রবিউলের বিয়ের কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ওনার অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে পেরে শফি মুদু হেসে বলল, এক মুসলমান আর এক মুসলমানের সঙ্গে শত্রুতা রাখতে নেই। কারণ আল্লাহ কুরআন পাকে বলেছেন, “মুমিনরা পরস্পর ভাই।” ভাই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কারণে ঝগড়া হলে অথবা মনোমালিন্য হলে উভয়পক্ষ আলাপ আলোচনার মধ্যে তা মিমাংসা করে নিতে হয়। হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন, “কোনো মুসলমান যদি কোনো কারণে অন্য মুসলমানের সঙ্গে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হবার ফলে তিনদিনের বেশি কথা বলে, তবে সে আমার দীন থেকে বাদ হয়ে যাবে।” হাদিসে আরও আছে, মনোমালিন্য বা ঝগড়া হবার পর যে প্রথমে সালাম দিয়ে কথা বলবে এবং মিলমিশ করার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে ভালবাসবেন এবং সমাজে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। তাই আমি নিজেই ওদের সঙ্গে মিলমিশ করে নিয়েছি। চেয়ারম্যানের মেয়ে আমাকে ভাই ডেকেছে। আমিও তাকে বোনের মতো মনে করি। রবিউল যে কলেজের টিচার সেও ঐ কলেজের ছাত্রী। আমি রবিউলের মতামত নিয়েই কথাটা বলেছি। আপনি রাজি থাকলে চেয়ারম্যানের কাছে প্রস্তাব দেব। উনি রাজি হলে আপনারা উভয় পক্ষ দেখা সাক্ষাত করে বিয়ের পাকা কথাবার্তা বলবেন।
জহির উদ্দিন বললেন, রবিউল যখন রাজি তখন আমি অমত করব। কেন? তুমি যা ভালো বুঝ কর।
শফি জানে রবিউল তার নানার বাড়ি গেছে। তাই ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার পথে তাকে ফোন করে তার বাবার মতামত জানিয়ে বলল, আজ বিকেলে প্রস্তাব দিতে শিখরমন্ডল যাব। তুইও যাবি নাকী? গেলে এক্ষুনি রওয়ানা দে।
রবিউল হেসে উঠে বলল, বোকার মতো কথা বলছিস কেন? পাত্র নিজে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হবু শ্বশুর বাড়িতে গেছে, এরকম কথা কখনোও শুনেছিস? এটা খুব নির্লজ্জতা হয়ে যাবে না?
শফি বলল, বোকা হলেও আমি শরীয়তের পরিপন্থী কিছু বলিনি। তুই যাবি কিনা বল?
রবিউল বলল, তুই পাগল না কী? না, আমি যাব না।
ঠিক আছে, আমি একাই যাব বলে লাইন কেটে দিল।
.
মহসিন রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলেবেলার বন্ধু জামালের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
জামালদের বাড়ি গ্রামের শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার ধারে। সে গ্রামে খুব কম থাকে। ঢাকাতে বেশিরভাগ সময় থাকত। কংফু ক্যারাটে পারদর্শী। আগে একটা চাঁদাবাজী গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওসব ছেড়ে দিয়ে এখন চিটাগাং-এ ব্যবসা করে। ছয়ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতির পেটাই শরীর। চার-পাঁচজন ছেলে তার কাছে কিছুই না।
শফি গতকাল সন্ধ্যায় শুনেছে, অনেকদিন পর জামাল বাড়ি এসেছে । আজ তার সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় ভাবল, জামালকে দিয়ে শফিকে শায়েস্তা করতে হবে। তাদের ঘরের কাছে এসে একটা দশ বার বছরের ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
তোমার নাম কী?
রেজাউল।
জামাল তোমার কে হয়?
ছোট চাচা।
জামাল ঘরে আছে?
আছে।
তাকে ডেকে দাওতো। বলবে চেয়ারম্যানের ছেলে এসেছে।
একটু পরে জামাল এসে সালাম দিয়ে বলল, আরে দোস্ত তুই? কেমন। আছিস বল?
মহসিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো নেই।
সে কী রে, এসেই শুনলাম তুই বিয়ে করেছিস। কদিন আগে এলে তোর বিয়ে ওলিমা খেতে পারতাম। ভালো নেই বলছিস কেন? বৌ কী মনের মতো হয়নি?
তুই যা ভাবছিস তা নয়। তুই বোধ হয় জানিস না, আমি ঢাকাতেই প্রেম করে বিয়ে করেছি। বৌ খুব ভালো হয়েছে। অন্য কারণে ভালো নেই।
কারণটা বলবি তো?
চরদৌলতখানের শফি নামে একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করছে।
তোর মতো ছেলেকে অন্য গ্রামের ছেলে ডিস্টার্ব করছে, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না, ব্যাপারটা খুলে বল।
মহসিন শফির সম্পর্কে সত্য মিথ্যা মিশিয়ে সব ঘটনা জানিয়ে বলল, তুই যদি মেরে ওর হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতিস, তা হলে ওর যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যেতাম। বাবা ওর বিরুদ্ধে ছিল এবং তাকে কঠোর শাস্তি দিতেও চেয়েছিল; কিন্তু এবারে বাড়িতে এসে দেখছি, সে এখন তার মিত্র। চার-পাঁচ মাস পরে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। শফি নিষেধ করেছে বলে বাবা ঢাকা যেতে দিচ্ছে না। সে বাবাকে বলেছে, ঢাকা গেলে আমার নাকী ভীষণ বিপদ হবে। তুই-ই বল, এসব কী সহ্য হয়? এক এক সময় ভাবি, ওকে গুলি করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিই; শুধু বাবার কারনে তা করতে পারছি না।
জামাল বলল, তোর কথা কতটা সত্য জানি না, চার পাঁচ মাস আগে বাড়িতে এসে কয়েকদিন ছিলাম। তখন গ্রামে ছেলেবুড়া এমন কী মেয়েদের মুখেও শফির প্রশংসা শুনেছি। সে যদি খারাপ হত, তা হলে সবাই তার প্রশংসা করত না। তা ছাড়া জেনেছি, সে এখন নলছটি কামিল মাদরাসার প্রিন্সীপাল। তোকে দু’বার মারামারী করে অপমান করেছে বলে তাকে তুই এরকম কঠিন শাস্তি দিতে চাচ্ছিস কেন বুঝতে পারছি না।
এমন সময় হুন্ডা আসার শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে শফিকে আসতে দেখে মহসিন বলল, ঐ তো শফি আসছে। এখনই যদি তুই শাস্তিটা দিতিস, তা হলে বুঝতাম তুই আমার প্রকৃত বাল্যবন্ধু।
সেদিকে একবার চেয়ে নিয়ে জামাল বলল, ঠিক আছে, দেখি কতটা কী করা যায়।
শফি কাছে এসে হুন্ডা থামিয়ে সালাম দিয়ে নেমে হুন্ডা স্ট্যান্ডে রাখল।
মহসিন সালামের উত্তর না দিলেও জামাল দিয়ে বলল, আপনার পরিচয়?
শফি মৃদু হেসে বলল, একটু আগে মহসিন ভাই তো আমার পরিচয় আপনাকে বলেছেন?
জামাল খুব অবাক হয়ে বলল, সে কথা আপনি জানলেন কেমন করে?
শফি বলল, মানুষের মনে দুটো ইচ্ছা কাজ করে। একটা সৎ আর একটা অসৎ। সৎ ইচ্ছা থাকলে মানুষ অনেক কিছু জানতে পারে।
তা হলে বলুন তো, মহসিন কেন আমার কাছে এসেছে?
আপনি ওনার বাল্যবন্ধু। আপনি কুংফু ক্যারাটে পারদর্শী। আপনাকে দিয়ে আমাকে কঠোর শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করে এসেছেন এবং সে ব্যাপারে আপনাকে পুরো কনভিন্স করতে পারেন নি। তার আগেই আমি এসে পড়লাম।
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন চমকে উঠে, জামাল তেমনি চমকে উঠে বোবা দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
শফি আবার মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তাই না? অবশ্য হবারই কথা। যাই হোক, কী চিন্তা করলেন, বন্ধুর মনের অশান্তি দূর করার জন্য আমাকে মহসিন ভাইয়ের কথা মতো শাস্তি দেবেন? তবে যাই করুণ না কেন, আমার অনুরোধ, আমাকে শাস্তি দেয়ার আগে মহসিন ভাইয়ের বাবা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে আমি কী দোষ করেছি সত্য মিথ্যা যাচাই করেবন। তারপর মহসিনের দিকে চেয়ে বলল, রাহেলা আপনার ছোট বোন, আপনার মতো অত লেখাপড়াও করেনি। তার চেয়ে আপনার বিবেক বিবেচনা বেশি হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তা নেই কেন জানেন? ধর্মিয় জ্ঞানের অভাব। এই কারণে আপনি অহংকারী। আল্লাহ কুরআন পাকে বলেছেন, “অহংকারীকে তিনি ভালবাসেন না।” তাই বলব, ধর্মিয় বইপত্র পড়ন, ধার্মিক লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করুন, তা হলে আল্লাহ নিশ্চয় আপনাকে হেদায়েত দেবেন এবং আপনার অহংকারও দূর হয়ে যাবে। তারপর জামালকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি রাহেলার বিয়ের পয়গম নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাচ্ছিলাম। যাব? না তার আগে মহিসন ভাইয়ের কথামতো শাস্তি দেবেন?
জামাল শফির সম্পর্কে আগে যতটুকু শুনেছিল, এখন তাকে দেখে ও তার কথা শুনে তার থেকে অনেক বেশি জানতে পেরে তার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনার মতো এদেশে কয়েকটা ছেলে জন্মলই দেশের এত অধঃপতন হত না। শাস্তি দেয়ার কথা বলে লজ্জা দেবেন না। মহসিন বড়লোক চেয়ারম্যানের এক ছেলে বলে একটু অহংকারী। তাই আপনাকে চিনতে পারেনি। আশা করি, এখন চিনতে পেরেছে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ওকে ক্ষমা করে দিন। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে মহসিনকে বলল, দোস্ত, ঠিক কথা বলিনি?
মহসিন এতক্ষণ চিন্তা করছিল, জামাল কুংফু-ক্যারাটে পারদর্শী ও তাকে দিয়ে শফিকে শাস্তি দেয়ার কথা জানল কী করে? জামালের কথা শুনে বলল, হ্যাঁ দোস্ত, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তারপর শফির দিকে চেয়ে বলল, সত্যিই আপনাকে চিনতে আমি ভুল করেছি। তাই এতদিন শত্রু ভেবে আপনার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। প্লীজ, মাফ করে দিন।
শফি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে। মাফ করুন।
জামাল বলল, আপনার অনেক গুণাগুণ শুনেছি। সে সবের প্রমাণও পেয়েছি; কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করলে আপনি জানতে পারেন, এটা মাথায় ঢুকছে না। দয়া করে যদি বলতেন, তা হলে খুশি হতাম।
জামাল থেমে যেতে মহসিন বলল, আমি তো একথা বিশ্বাসই করতাম না। এখন প্রমাণ পেয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। আমিও এ ব্যাপারটা জানতে পারলে খুশি হতাম।
শফি বলল, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আপনাদেরকে খুশি করতে পারছি না বলে দুঃখিত। কারণ বললেও আপনাদের বিশ্বাস হবে না।
জামাল ও মহসিন একসঙ্গে বলে উঠল, বিশ্বাস নাই হোক, তবু বলুন।
শফি বলল, সব মানুষের মন একটা; কিন্তু আমার দুটো। একটা মন সব মানুষের মতো সাধারণ। আর অন্যটা অসাধারণ। ঐ অসাধারণ মন আমাকে আগাম অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। তারপর মহসিনকে বলল, এবার চলুন আপনাদের বাড়িতে।
হ্যাঁ, চলুন বলে মহসিন জামালকে বলল, তুইও চল না আমাদের সঙ্গে।
জামাল বলল, না দোস্ত, আমার কাজ আছে। তুই ওনাকে নিয়ে যা।
শফি হুডায় চাপতে যাচ্ছে দেখে মহসিন বলল, এইটুকু রাস্তা হেঁটে যাই চলুন। তারপর যেতে যেতে বলল, শফি ভাই আমার একটা অনুরোধ রাখতেই হবে।
শফি বলল, আপনাকে ঢাকা যেতে নিষেধ করেছি কেন এবং গেলে কী ক্ষতি হবে জানতে চাচ্ছেন তাই না?
মহসিন বলল, হ্যাঁ, তাই।
শফি বলল, কথাটা না জানাই আপনার মঙ্গল। জানলে ক্ষতি হবে।
মহসিন বলল, প্লীজ, আপনি নিশ্চয় জানেন, সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। সব সময় খুব টেনশন ফিল করছি। তাই ক্ষতি হলেও জানতে চাই।
শফি বলল, আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে বলতাম না। তবু বলা উচিত নয় জেনেও বলব। তবে তার আগে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে, এ ব্যাপারে সারাজীবনেও আপনার স্ত্রীকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।
মহসিন বলল, ঠিক আছে, ওয়াদা করলাম।
ওয়াদা কি জিনিস জানেন?
জানি। ওয়াদা অর্থ প্রতিজ্ঞা।
আপনি তো কুরআন হাদিস পড়েন নি, পড়লে জানতেন, ওয়াদা ভঙ্গ করা কঠিন গুনাহ। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। এটা কুরআন পাকের কথা। আশা করি, এবার থেকে কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য ইসলামিক বইপত্র পড়বেন এবং ইসলামের বিধি-বিধান মনে চলবেন। আপনার স্ত্রীকেও তাই করতে বলবেন, যা বললাম তা যদি করেন, তা হলে আমাকে নিয়ে আপনাদের মনে যেসব প্রশ্ন উদিত হয়, তার উত্তর পেয়ে যাবেন।
মহসিন বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? কথা দিচ্ছি, যা বললেন পালন করার চেষ্টা করব।
আলহামদুলিল্লাহ বলে শফি বলল, আপনার সমন্ধি আন্ডার গ্রাউন্ডের লিডার। ওনাদের বাসায় আরও কিছুদিন থাকলে ভাল চাকরির কথা বলে আপনাকে নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে দিতেন। কিছুদিনের মধ্যে উনি খুব বড় বিপদে পড়বেন। এটাই হল আসল কারণ। তা ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে যা শোনা আপনার ঠিক হবে না। তবে একটা কথা জেনে রাখুন। আপনার স্ত্রী ওনার বড় ভাইয়ের কাজ কারবারের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। শুধু জানেন ভাইয়া একজন বড় ব্যবসায়ী। উনি যে খুব ভালো মেয়ে তা আপনি জানেনই। ওনার মনটাও খুব ভালো। তাকে নিয়ে সুখে জীবন। কাটাতে পারবেন। ওনার বড় ভাইয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে দাম্পত্য জীবনে অশান্তির আগুন জ্বালাবেন না। পাশ করে তো চাকরি করবেন না, তা হলে পরীক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? ঐ চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করুন। আল্লাহ আপনার বাবাকে ধন-সম্পদ ও মান সম্মান অনেক দিয়েছেন। আর বেশি কিছু আশা করা উচিত নয়। কারণ যারা ঐশ্বর্যের প্রত্যাশী, তারা যতই ঐশ্বৰ্য্য পাবে ততই আরও পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলেছেন, “মানুষ যদি পৃথিবী সমপরিমাণ ময়দান ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা পায়, তারপরও সে ঐ পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা পেতে চাইবে।” আর কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেছেন, “পার্থিব জীবন তো কিছুই নহে প্রতারণার সামগ্রী ব্যতীত।” [সূরা আল-ইমরান, পারা-৪, ১৮৫ নং আয়াতের শেষ অংশ।]
ততক্ষণে তারা মহসিনদের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল।
বৈঠকখানায় চেয়ারম্যান কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। মহসিনের সঙ্গে শফিকে আসতে দেখে খুব অবাক হলেও খুশি হলেন। তাড়াতাড়ি লোকগুলোকে বিদায় করে দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শফি হুন্ডাটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বৈঠকখানায় এসে চেয়ারম্যানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, কেমন আছেন?
চেয়ারম্যান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তারপর তাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছ?
শফি বলল, জ্বি, আল্লাহর রহমতে ও আপনার দোয়ায় ভালো আছি।
চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ আগে ছেলেকে বেজার মুখে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। এখন তার মুখের অবস্থা ভালো দেখে চিন্তা করলেন, নিশ্চয় শফির কারণেই এটা হয়েছে। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়িয়ে রয়েছ। কেন? মেহমানের মেহেমানীর ব্যবস্থা কর।
মহসিন যেতে উদ্দ্যত হলে শফি বলল, মহসিন ভাই, মেহমানি পরে হবে, আপনি বসুন। যে কথা বলার জন্য এসেছি, তা শোনা আপনারও দরকার।
চেয়ারম্যান বললেন, নাস্তা পানির পর আপনার কথা শুনব। তারপর ছেলেকে বললেন, তুমি গিয়ে তোমার আম্মাকে শফির আসার কথা বলে এস।
রাহেলা ও জুঁই চরদৌলতখান থেকে শফি এসেছে কিনা দেখার জন্য সদর গেটের কাছে এসেছে, এমন সময় মহসিনকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই সাথে মুখে হাসি হাসি ভাব দেখে দু’জনেই অবাক হল।
মহসিন রাহেলাকে জিজ্ঞেস করল, তোর ভাবিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? ঘরে চল, শফি এসেছে। তার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করবি।
দু’জনেই অবাক হয়ে ভাবল, কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যে নাকী শফিকে দুশমন মনে করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইছিল, সে কিনা তাকে নাস্তা খাওয়াবার কথা বলছে?
তাদেরকেসহ মহসিন মায়ের কাছে এসে বলল, চরদৌলতখানের শফি এসেছে। বাবা নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলল।
আখতার বানুও ছেলের পরিবর্তন দেখে অবাক হলেন। বললেন, সে কথা বুয়া বলেছে। তুই যা, আমি ব্যবস্থা করছি।
মহসিন ফিরে আসার পর শফি চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল, বেশ কিছুদিন আগে আপনাকে বলেছিলাম, রাহেলার জন্য আমি ছেলে পছন্দ করে রেখেছি। আজ ছেলেও তার বাবার সঙ্গে আলাপ করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। ছেলে হল আমার বন্ধু রবিউল। তাকে ও তার ফ্যামিলীর সম্পর্কে আপনি তো সবকিছু জানেন। কিছু মনে করবেন না, রাহেলার মতামত আগেই নিয়েছি। আশা করি, ইনশাআল্লাহ ওরা সুখী হবে। আপনারা রাজি থাকলে কিছুদিনের মধ্যে ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই।
চেয়ারম্যান বললেন, রাহেলাকে যখন বোন বলে মেনে নিয়েছ তখন কী আর তার জন্য বড় ভাই খারাপ ছেলে পছন্দ করতে পারে? তোমার চাচি আম্মার সঙ্গে আলাপ করে দু’একদিনের মধ্যে তোমাকে ফোন করে জানাব। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পার।
মহসিন বলল, আমি তোমার সঙ্গে একমত।
শফি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এখন রাহেলা যেন একথা জানতে না পারে। জেনে গেলে লজ্জায় আমাকে নাস্তা খাওয়াতে আসবে না। আমি চলে যাবার পর জানলে কোনো অসুবিধে নেই।
চেয়ারম্যান ছেলেকে বললেন, তোমার মাকে গিয়ে বল, নাস্তার সঙ্গে যেন মিষ্টি দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে রাহেলা ভালো করে গায়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বুয়ার সঙ্গে নাস্তা নিয়ে এসে শফির সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আজ আমার কী সৌভাগ্য তোমাকে নাস্তা খাওয়াব। তারপর তিন প্লেট নাস্তা পরিবেশন করল।
আখতার বানু জুঁইকে সঙ্গে নিয়ে রাহেলার পিছন পিছন এসে আড়াল থেকে শফির নূরানী চেহারা দেখে খুশি হলেন। অনুচ্চস্বরে বৌ-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, মনে হয় মহসিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শফির সঙ্গে দেখা হয় এবং তার সঙ্গে কথা বলে পরিবর্তন হয়েছে।
জুঁই বলল, হ্যাঁ মা, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
বিদায় নেয়ার সময় শফি বলল, আপনাদের সবাই রাজি থাকলে আমাকে ফোনে জানাবেন। আমি রবিউলের বাবাকে জানিয়ে দু’চারদিনের মধ্যে বিয়ের পাকা কথাবার্তার ব্যবস্থা করব।
শফি চলে যাবার পর মহসিন ঘরে এলে জুঁই বলল, মনে হচ্ছে শফির সম্পর্কে তোমার যে ধারণা ছিল তার পরিবর্তন হয়েছে?
মহসিন বলল, কী করে বুঝলে?
না বোঝার কী আছে? পরিবর্তন না হলে তাকে ডেকে এনে নাস্তাও খাওয়াতে না। আর তার ঘটকালিতে তারই বন্ধু রবিউলের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিতে রাজিও হতে না। তা ছাড়া তাকে যেভাবে আপ্যায়ন করালে তাতে করে মনে হল, সে শত্রু থেকে মিত্রতে পরিণত হয়েছে।
তুমি তা হলে আড়াল থেকে সবকিছু দেখেছ।
স্বামীর শত্রু বাড়িতে এসেছে, দেখতে মন চায় না বুঝি? শুধু আমি না, মাও দেখেছে।
তা হলে আমাদের কথাবার্তাও তোমরা শুনেছ?
হ্যাঁ, শুনেছি। এবার বল, তোমার শত্রু মিত্র হল কী করে?
মহসিন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, শফিকে ভুল বুঝে এতদিন তাকে শত্রু ভাবতাম। আজ সে-ই ভুল ভাঙ্গিয়ে মিত্র করে নিয়েছে। সত্যিই আল্লাহ ওকে সবরকমের গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
জুঁই বলল, নিশ্চয় রাস্তায় কোনো ঘটনা ঘটিয়েছিলে?
ঘটনা আমি ঘটায়নি, বন্ধু জামালকে দিয়ে ঘটাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ঘটনা ঘটাবার আগেই শফি আমাদেরকে তার গুণের দ্বারা কনভিন্স করে মিত্র বানিয়ে ফেলল। তারপর বন্ধু জামালের কাছে যাবার উদ্দেশ্য ও তার সঙ্গে যেসব কথা হয়েছিল এবং শফির আসার পর কীভাবে কী ঘটল বলে বলল, রাহেলার কথাই ঠিক, “শফিকে যদি জানার চেষ্টা করতাম, তা হলে তাকে শত্রু ভাবতে পারতাম না।”
জুঁই বলল, আমি রাহেলা আপার কাছে ওনার অনেক গুণের কথা শুনেছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি ওর বন্ধুকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। তারপর রবিউলের বায়োডাটা জানিয়ে বলল, সে যে কলেজের টিচার, রাহেলা সেই কলেজের ছাত্রী।
ওমা তাই নাকি বলে জুঁই হেসে উঠে বলল, তা হলে মনে হয় দু’জনের মধ্যে লাইন টাইন আছে?
মহসিন বলল, শফির কথায় তাই তো মনে হল।
তুমি রবিউলকে দেখেছ?
দেখব না কেন? পাশের গ্রামেই তো বাড়ি।
আচ্ছা, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করনি?
করেছি।
কী বললেন?
মহসিনের তখন শফির কাছে ওয়াদা করার কথা মনে পড়ল। তাই মিথ্যে করে বলল, শুধু আমাকে নয়, তোমাকেও অন্ততঃ এক বছর যেতে নিষেধ করেছে। যদি যাই, তা হলে দু’জনেরই ভীষণ বিপদ হবে।
সে কী, এক বছর ঢাকা না গিয়ে থাকব কি করে? আচ্ছা, কী বিপদ হবে জিজ্ঞেস করনি?
তাও করেছি। বলল, সে কথা বলা যাবে না। আরও বলল, আমাদের দু’জনকেই কুরআন-হাদিস ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়ে সে সব মেনে চলতে হবে।
স্বামীর কথা শুনে জুঁই-এর মন খারাপ হয়ে গেল।
তাই দেখে মহসিন বলল, এতে মন খারাপের কী আছে? রোজ ফোন করে তো ঢাকার খবরা খবর নিচ্ছ। ওনারাও ফোন করে তোমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তা ছাড়া ওনাদের তো আসতে নিষেধ নেই। ওনাদের দেখতে ইচ্ছা হলে ফোন করে আসতে বলে দেবে।
তা না হয় হল; কিন্তু তোমার পরীক্ষার কী হবে?
ভেবেছি, এ বছর পরীক্ষা দেব না, সামনের বছর দেব। কারণ ঢাকায় গিয়ে মাথায় বিপদের চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট মোটেই ভালো হবে না।
কথাটা অবশ্য ঠিকই বলেছ। তা কতদিনে বোনের বিয়ে দিচ্ছ?
দু’একদিনের মধ্যে ছেলের গার্জেনরা আসবেন বিয়ের দিন ঠিক করতে। মনে হয় দশ পনের দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। দিন ঠিক হবার পর তোমার ভাইয়াদেরকে আসার জন্য নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠাব।
.
১১.
শিখরমন্ডল থেকে শফির ফেরার অপেক্ষায় রবিউল গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল।
শফি তাঁকে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, চেয়ারম্যান প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। দু’ একদিনের মধ্যে লোকজন নিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করতে আসবেন। চল, তোর বাবাকে কথাটা জানাই।
রবিউল বলল, তুই মাঝে মাঝে বোকার মতো কথা বলিস।
শফি বলল, এখন আবার বোকার মতো কী বললাম? কথাটা বলেই হেসে উঠে বলল, ও বুঝেছি। ঠিক আছে, আমি একাই যাই বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
জহির উদ্দিন সদরে ছিলেন। শফি গাড়ি থেকে নেমে সালাম বিনিময় করে সবকিছু জানাল। তারপর ওনার থেকে বিদায় নিয়ে মাতব্বর দাদুর সঙ্গে দেখা করে সালাম দিয়ে বলল, দাদু, কেমন আছেন?
মাতব্বর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, এতদিন পরে দাদুর খোঁজ নিতে এসেছ?
শফি বলল, কী করব বলুন, যে গুরুভার আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তা বহন করতে গিয়ে দিন ক্ষণের কথা মনেই থাকে না। তবু ক্ষমা চাইছি।
আরে ভাই তা কী আমি জানি না। তা ছাড়া সমাজ কল্যাণেরও যে কাজ করছ তাও জানি। অন্যদিকে খেয়াল করার সময় কোথায় তোমার। দেরিতে হলেও মাঝে মাঝে এই বুড়ো দাদুর খোঁজ নিতে এস।
আপনি দোয়া করুন, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় আসব। দাদু এবার একটা সুখবর দিই, আমার বন্ধু রবিউলের বিয়ের ঘটকালি করে এলাম শিকরমন্ডলের সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের মেয়ের জন্য। দু’একদিনের মধ্যে চেয়ারম্যান লোকজন নিয়ে এসে বিয়ের দিন ঠিক করে যাবেন বলেছেন।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মাতব্বর বললেন, শুনে খুশি হলাম। দোয়া করি, আল্লাহ যেন কাজটা তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করে দেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সুসংবাদ কবে শুনব?
শফি বলল, আল্লাহ যেদিন রাজি হবেন।
আরে ভাই, তা তো বটেই; কিন্তু তোমাকে তো চেষ্টা করতে হবে ।
তা আবার করিনি। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার নাত বৌ পছন্দ করে রেখেছি।
আলহামদুলিল্লাহ বলে মাতব্বর বললেন, তা হলে দেরি করছ কেন?
না, আর দেরি করব না। রবিউলের বিয়ের পরপরই করব।
তা কেন? আমি চাই দু’বন্ধুর বিয়ে এক সঙ্গেই হোক।
শফি হেসে ফেলে বলল, তা হলে আপনি ঘটকালি করুন।
মাতব্বরও হেসে উঠে বললেন, আরে ভাই, আমার কী আর সে শক্তি আছে? বাতের জন্য বেশি হাঁটা চলা করতে পারি না। তা পাত্রির পরিচয় বল দেখি।
শফি বলল, সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাগ্নি।
এ্যাঁ–কী বললে? সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের ভাগ্নি? চেয়ারম্যানের বোনের বিয়ে হয়েছে তো ঢাকায়। তার মেয়ের খোঁজ তুমি পেলে কী করে?
তার খোঁজ আল্লাহ দিয়েছেন। বাকিটা যখন সে নাত বৌ হয়ে আসবে তখন তার কাছ থেকে জেনে নেবেন।
কিন্তু চেয়ারম্যান কি রাজি হবেন?
আল্লাহর ইশারায় উনি শুধু রাজি হন নি, খুশিও হয়েছেন।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মাতব্বর বললেন, শুনে আমিও খুশি হলাম। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমাদের জোড়া কবুল করেন।
তা হলে এখন আসি দাদু বলে শফি সালাম বিনিময় করে চলে এল।
ঘরে এসে শফি দাদিকে বলল, বন্ধু রবিউলের বিয়ের ঘটকালি করে এলাম।
জমিলা খাতুন বললেন, বন্ধুর বিয়ের ঘটকালি করেছিস ভালো কথা, এবার নিজের বিয়ের কথা চিন্তা করবি না?
শফি হেসে উঠে বলল, সে ব্যবস্থা তো আপনারা করবেন। এতদিন করেন নি বলে নিজেরটা নিজেই করে রেখেছি। শুধু কলমা পড়তে বাকি।
জমিলা খাতুন বললেন, দেখ, দুষ্টুমি করবি না। জাকির তোর মাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল, তার আগের পক্ষের মেয়ে নাসিমার সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে চায়। নাসিমা খুব সুন্দরী, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তুই তাকে দেখেছিস? রাজি আছিস কিনা বল?
শফি জাকির চাচার মতলব বুঝতে পেরে বলল, আগে আপনার মতামত বলুন।
জমিলা খাতুনও দেওর পুতের মতলব বুঝতে পেরেছেন। তবু মা মরা মেয়েটার কথা চিন্তা করে রাজি হতেন যদি নাসিমা মুখরা ও খুব রাগি না হত। তাই বললেন, আমি আর ক’দিন বাঁচব, তুই যদি তাকে নিয়ে সারাজীবন চলতে পারবি বলে মনে করিস, তা হলে অমত করব কেন?
শফি বুঝতে পারল, দাদি রাজি নন। জিজ্ঞেস করল, মায়ের মতামত জেনে নেন নি?
জানা দরকার মনে করিনি বলে জিজ্ঞেস করিনি। দরকার মনে করলে তুই তোর মাকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।
তার আর দরকার নেই। মা বা চাচা এলে জানিয়ে দেবেন, দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছি। মেয়েটাও আমাকে পছন্দ করে। শুধু তাই নয়। আমরা বিয়ে করার ওয়াদাও করেছি।
জমিলা খাতুন অবাক হয়ে বললেন, সত্যি বলছিস, না দুষ্টুমী করছিস?
শফি বলল, যেদিন হাদিসে পড়েছি, আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন, “দুষ্টুমী বা কৌতুক করেও মিথ্যে বলতে নেই।” সেদিন থেকে দুষ্টুমী বা কৌতুক করেও মিথ্যে বলি না।
মেয়ে পছন্দ করে রেখেছিস এতদিন বলিসনি কেন?
এতদিন বিভিন্ন কাজে যে ব্যস্ত ছিলাম তা তো আপনি জানেন। তাই বলার ইচ্ছা থাকলেও সময় সুযোগ পাইনি। তা ছাড়া কাজের চাপে বিয়ে করার চিন্তাই হয়নি। আল্লাহর রহমতে এখন কাজের চাপ কমেছে। তাই ভেবেছি, বন্ধুর বিয়ে দিয়ে আমিও বিয়ে করব।
তা মেয়েটার সবকিছু বলবি তো? কার মেয়ে, কোথায় বাড়ি, দেখতে কেমন, কতদূর লেখাপড়া করেছে, নামায-রোযা ঠিক মতো করে কিনা, পর্দা করে চলাফেরা করে কি না, গরিবের মেয়ে, না বড়লোকের মেয়ে, নিচু বংশের না উঁচু বংশের? তা ছাড়া মেয়ের বাবা কী করে?….
শফি হাত তুলে দাদিকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনি যদি উকিল হতেন, তা হলে খুব নাম করতে পারতেন এবং সেই সাথে প্রচুর টাকা রোজগার করতে পারতেন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এক এক করে দিচ্ছি, শিখরমন্ডলের সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের বোনের মেয়ে। বাড়ি ঢাকা, নাম ডালিয়া, এ বছর বি. এ. পরীক্ষা দেবে, অপূর্ব সুন্দরী না হলেও দেখতে শুনতে ভালো, সব থেকে তার বড় গুণ, খুব ধার্মিক।
আর একবার অবাক হয়ে জমিলা খাতুন বললেন, তুই থাকিস গ্রামে, আর মেয়ে থাকে ঢাকায়। কী করে তোরা একে অপরকে শুধু পছন্দ করিসনি, বিয়ে করারও ওয়াদা করেছিস?
সে অনেক কথা। সে সব শোনার ও শোনাবার দরকার নেই। শুধু এতটুকু বলতে পারি, যা হয়েছে আল্লাহপাকের ইশারাতেই হয়েছে।
সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান তোদের সম্পর্কের কথা জানেন?
জানেন এবং জেনে খুশিও হয়েছেন।
আর মেয়ের মা বাবা?
তারাও তাই।
কিন্তু চেয়ারম্যান ও ওনার ছেলে তো তোকে শত্রু মনে করে?
আগে করলেও এখন আর করেন না। তা না হলে ওনার মেয়ের জন্য রবিউলের ঘটকালি করলাম কী করে?
জমিলা খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, চেয়ারম্যানের ভিলেজ পলিটিক্সের জালে জড়িয়ে পড়িসনি তো? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
শফি হেসে উঠে বলল, না দাদি, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আল্লাহর ইশারায় তার এই নাদান বান্দাকে উপলক্ষ করে শুধু চেয়ারম্যান নয়, ওনার ফ্যামিলীর সবাই হেদায়েত হয়ে গেছেন।
তবু তুই এই ব্যাপারটা নিয়ে তোর মাতব্বর দাদুর সঙ্গে আলাপ কর। উনি আল্লাহওয়ালা ও খুব বিচক্ষণ লোক।
একটু আগে ওনার সঙ্গে আলাপ করেছি। শুনে খুশি হয়ে দোয়া করলেন, যাতে কাজটা সুষ্ঠুভাবে তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়। তারপর বললেন, দু’বন্ধুর বিয়ে যাতে একই দিনে হয় সেই ব্যবস্থা করতে।
উনি যখন খুশি হয়ে দোয়া করেছেন তখন আর আমার সন্দেহ রইল না। এখন বল, তোর মা বা চাচা এলে কী বলব?
একটু আগে যা বললাম তাদেরকে তাই বলবেন।
তোর মা হয়তো বিশ্বাস করবে; কিন্তু তোর চাচা করবে বলে মনে হয় না।
ওনারা বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, যা সত্য তাই বলেছি। তারপর শফি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল ফজরের নামায পড়ে ঢাকা রওয়ানা দেব আপনার হবু নাত বৌকে দেখতে, আর সেই সাথে হবু শ্বশুরকে বলব, “চেয়ারম্যানের মেয়ের যেদিন বিয়ে হবে, সেদিন আমার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা তাদের বাড়িতেই করবেন।”
জমিলা খাতুন নাতির কথা শুনে এত অবাক হলেন যে, কোনো কথা বলতে না পেরে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
এমন সময় মাগরিবের আজান শুনে শফি বলল, যাই, মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।
.
রাতে ঘুমাবার সময় কাল ঢাকা যাবার কথা ফোন করে ডালিয়াকে জানাবার ইচ্ছা হলেও জানাল না। শুধু তাই নয়, রাত এগারটা থেকে বারটা পর্যন্ত ডালিয়া অনেকবার ফোন করলেও রিসিভ করল না। ভাবল, আচানক গিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেবে।
পরের দিন শফি বেলা একটায় বাস থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে ডালিয়াদের বাসার অল্প একটু দূরে রাস্তার মোড়ে এসে ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলল। ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করার পর গাড়ি থেকে নেমে ডালিয়াকে ফোন করল।
ডালিয়া গতরাতে শফিকে অনেকবার ফোন করেছে। রিং হয়েছে; কিন্তু শফি রিসিভ করেনি। সে জন্যে তার উপর খুব রাগ বা অভিমান হয়নি। কারণ সে জানে মাঝে মাঝে এরকম করে শফি তার ভালবাসাকে পরীক্ষা করে।
আজ শফি যখন ফোন করল ডালিয়া তখন বাথরুমে গোসল করছিল। তাই জানতে পারল না।
বারবার রিং হচ্ছে শুনে শামিমা বেগম বাথরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন, ডালিয়া কে যেন বারবার তোর মোবাইলে রিং দিচ্ছে।
মায়ের কথা শুনে ডালিয়া বলল, আসছি, আমার গোসল হয়ে গেছে। একটু পরে রুমে এসে মোবাইল দেখে জানতে পারল কে যেন ছয়টা মিসকল দিয়েছে। বোতাম টিপে শফির নাম্বার দেখে কলজেটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি রিং দিল।
শফি রিসিভ করে সালাম বিনিময় করে বলল, কখন থেকে রিং দিচ্ছি ধরনি কেন? গতরাতের বদলা নিচ্ছ, না আমার মতো প্রেমের পরীক্ষা নিচ্ছ?
ডালিয়া বলল, কোনটাই নয়, গোসল করছিলাম।
খুব ক্ষিধে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি চলে এস। দু’জনে হোটেলে খাব। তারপর দু’টো সুখবর শোনাব।
ডালিয়া বুঝতে পারল, শফি ঢাকায় এসে ফোন করেছে। প্রায় ছ মাস পরে তাকে দেখতে পাবে ভেবে খুশির চোটে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
কী হল, কথা বলছ না কেন? বললাম না খুব ক্ষিধে পেয়েছে?
ডালিয়া সামলে নিয়ে বলল, কোথায় আসব বলবে তো?
বাসা থেকে বেরোলেই জানতে পারবে।
ডালিয়ার মনটা আর একবার আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, সরি, বুঝতে পারিনি, ক্ষমা করে দাও।
যে কাপড় পরে আছ তার উপর বোরখা চাপিয়ে এলেই ক্ষমা পাবে।
জোহরের নামায না পড়েই যাব?
না। বিশ মিনিট সময় দিলাম নামায পড়েই আসবে। তারপর লাইন কেটে দিয়ে সামনে মসজিদ দেখতে পেয়ে শফি ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে নামায পড়তে গেল।
ডালিয়া বড় তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোন ধরেছিল। শফি লাইন কেটে দেয়ার পর তাড়াতাড়ি সালোয়ার কামিজ পরে নামায পড়ল। তারপর কোনো সাজগোজ না করে বোরখা পরে রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের সামনে পড়ে গেল।
শামিমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, কী রে, ভাত না খেয়ে এমন সময় কোথায় যাচ্ছিস? তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কে ফোন করেছিল?
ডালিয়া যেতে যেতে বলল, শফি নামে যে ছেলেটা বাবাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল, সে ফোন করেছিল। আমার ফিরতে দেরি হবে, তোমরা খেয়ে নিও।
শামিমা খাতুন এতদিনে মেয়ের কথায় কুরআন হাদিস পড়ে ধর্মকে আর এড়িয়ে চলেন না, বরং ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলেন। বৌমা নাজিয়ার কাছে শুনেছেন, শফির কারণেই ডালিয়া ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর সেই কারণেই মহসিনকে বিয়ে করতে চায় না, শফিকে করতে চায়। এখন তাকে না খেয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভাবলেন, শফির সঙ্গে বোধ হয় হোটেলে খাবে, কিন্তু বিয়ের আগে এটা তো ঠিক নয়?
ডালিয়া বাসা থেকে বেরিয়ে অল্প দূরে ট্যাক্সি ক্যাবের গায়ে শফিকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল।
শফিও তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, সারপ্রাইজটা কেমন লাগছে?
ডালিয়া বলল, দারুণ। এতবড় সারপ্রাইজ জীবনে কখনও পাইনি।
ধন্যবাদ, কেমন আছ?
আগে যাই ছিলাম না কেন, এখন নিজেকে পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে সুখী মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে কল্পনাও করি নাই, আজ আমার জন্য এতবড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। সেজন্য আল্লাহ পাকের দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানিয়ে তোমাকে অসংখ্যবার মোবারকবাদ জানাচ্ছি। তুমি কেমন আছ বল।
আমিও আগে যাই ছিলাম না কেন, এখন নিজেকে পৃথিবীর সমস্ত সুখী মানুষের চেয়ে বেশি সুখী মনে হচ্ছে। সেইজন্য আমিও আল্লাহপাকের দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানিয়ে তোমাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। তারপর বলল, আর কোনো কথা নয়, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ। ক্ষিধেয়। নাড়িভূড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে।
হোটেলে খাওয়া দাওয়ার পর কোল্ড ড্রিংক পান করার সময় শফি বলল, দুটো সুখবর আছে।
ডালিয়া মৃদু হেসে বলল, একটা সুখবর আমি জানি।
শফি বুঝতে পারল, চেয়ারম্যান নিশ্চয় গতকাল ফোন করে বোন ও বোন জামাইকে রাহেলার বিয়ের সমন্ধ হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবু জিজ্ঞেস করল, কই, বলতো?
ডালিয়া আবার মৃদু হেসে বলল, মামা গতরাতে ফোন করে রাহেলার বিয়ের সম্বন্ধের কথা জানিয়েছেন। আরও জানিয়েছেন, বন্ধু রবিউলের হয়ে তুমি ঘটকালি করেছ। কি, ঠিক বলিনি?
শফি বলল, হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
ডালিয়া বলল, এবার দ্বিতীয় সুখবরটা বল।
শফি বলল, দ্বিতীয় সুখবরটা বলব না, করে দেখাব। তারপর তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
এই দুষ্টু এতক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখছ?
দেখছি আমার হবু বৌকে।
তাকে কি আগে দেখনি?
আগে প্রেমিকাকে দেখেছি।
ডালিয়া লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল, হবু বৌ শুধু বৌ কবে হবে?
যদি বলি, আজ এক্ষুনি?
সুবহান আল্লাহ, আমার এতটুকু আপত্তি নেই।
শফিও সুবহান আল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তা হলে চল তাই করে ফেলি। তারপর হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে কাজি অফিসে যেতে বলল।
কাজি অফিসের কাজ সেরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বলল, এটাই ছিল দ্বিতীয় সুখবর যেটা আল্লাহ সম্পন্ন করিয়েছেন। সেইজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার বার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
শফি ড্রাইভারকে সারাদিনের জন্য ভাড়া চুক্তি করে কখন কোথায় যেতে হবে বলে রেখেছে।
তাই তাদেরকে সেই আগের হোটেল করিডোরে এসে ড্রাইভার গাড়ি থামাল।
শফি ঢাকা রওয়ানা দেয়ার আগে ফোন করে আগে হোটেলের রুম বুক। করে রেখেছিল। ডালিয়াকে নিয়ে এসে সেখানে উঠল। তারপর তাকে বলল, বাসায় ফোন করে বলে দাও ফিরতে তোমার দেরি হবে।
ডালিয়া বলল, আসবার সময় মাকে সেকথা বলে এসেছি।
গুড, ভেরী গুড বলে শাফি তার বোরখা খুলে দিয়ে দু’হাতে মুখটা অঞ্জলী করে ধরে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
ডালিয়া প্রিয়তম স্বামীর প্রথম স্পর্শ পেয়ে লজ্জায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
শফি তা বুঝতে পেরে তার গোলাপী নরম তুলতুলে ঠোঁটে চুমো খেয়ে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এভাবে তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি, তোমার প্রেম করতে বাধ্য করিয়েছে। বল আমাকে মাফ করে দিয়েছ?
ডালিয়া তখন স্বামীর কার্যকলাপে আনন্দের সাগরে সাঁতার কাটছে। তার কথা শুনে সেই আনন্দ আরও বেড়ে গেল। কথা বলার শক্তি না থাকলেও কোনোরকমে ফিসফিস করে বলল, এ তুমি কী বলছ? আর মাফই বা চাইছ কেন? আমার প্রেম তোমাকে যা করতে বাধ্য করেছে, তা পাওয়ার জন্য তোমার প্রেম আমাকে এতদিন তপস্যা করিয়েছে। সেই তপস্যা আল্লাহ কবুল করেছেন জেনে তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজারবার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
শফি তাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলল, বিয়ের পর মা বাবার দো’য়া নিতে হয়। চল, তোমাদের বাসায় যাই।
Leave a Reply