তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি – সন্মাত্রানন্দ
প্রথম প্রকাশ – ডিসেম্বর ২০১৯
প্রচ্ছদ – সৌজন্য চক্রবর্তী
উৎসর্গ – মনুনদী নৈরঞ্জনাকে
.
বলে রাখা ভালো
সুপ্রাচীনকালে সর্বাস্তিবাদ থেকে মহাযান সৌগতপন্থায় আদৃত জীবনী ‘ললিতবিস্তর’, পালি ‘মহাবস্তু’, অশ্বঘোষ-প্রণীত ‘বুদ্ধচরিত’, আধুনিক যুগে স্যার এডুইন আর্নল্ডের ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’, পল ক্যারাস-বিরচিত ‘দ্য গসপেল অব বুদ্ধ’, এডোয়ার্ড কোঞ্জের মননঋদ্ধ গবেষণা কিংবা অতি সম্প্রতি ভিয়েতনামি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী-লেখক থিক নাথ হান-এর লেখা কাব্যগুণসমৃদ্ধ জীবনী-উপন্যাস ‘ওল্ড পাথ হোয়াইট ক্লাউডস’ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আবির্ভূত ঐতিহাসিক পুরুষ শাক্যসিংহ গৌতম বুদ্ধকে জানবার নির্ভরযোগ্য আকর। যাঁরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যসম্মত বুদ্ধকে নিরাবেগ চিত্তে জানতে চান, তাঁদেরকে যেতে হবে উপরের বইগুলির কাছেই।
এসব বইপত্র আমার আলোচ্যমান উপন্যাসটিরও উপাদান, সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যসম্মত তথ্যসমৃদ্ধ একটি বুদ্ধজীবনী নতুন করে লেখা আমার এ উপন্যাসের উদ্দেশ্য ছিল না। বুদ্ধচরিত্র অনুধ্যান করে নিজের মনকে শান্ত ও সুসমাহিত করার জন্যই আমি বইটি লিখেছি। অর্থাৎ এ উপন্যাস আমি লিখেছি প্রাথমিকভাবে আমার নিজের জন্যই নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। লিখবার পর মনে হল, এই পৃথিবীতে আমার মতন করে কেউ কেউ হয়তো চিন্তা করেন। তাঁরা আমার সমমনস্ক, সমভাবাপন্ন। তাঁদের সঙ্গে এই বইটির সূত্রে আমি যোগাযোগ করতে চাই। তাই, এই উপন্যাস প্রকাশ করা হয়েছে।
এ উপন্যাসে সিদ্ধার্থ কীভাবে বুদ্ধ হলেন, সেই কাহিনিটুকুই আমি নিজের মতো করে পরিবেশন করেছি। সেই ঘটনাটিকে কখনও বুদ্ধরিপু মারের দিক থেকে, কখনও নদীর দিক থেকে, কখনও নগরীর দিক থেকে, কখনও নানা মানুষের দিক থেকে বর্ণনা করেছি। অচেতন পদার্থগুলিও আমার উপন্যাসে কথা বলেছে। কিন্তু বুদ্ধ হবার পর সিদ্ধার্থের জীবনে কী কী ঘটল, সেসব কথা আমি লিখিনি। আমার আগ্রহ সাধনসমরনিরত সিদ্ধার্থের প্রতি। যুগপুরুষ বুদ্ধের প্রতি আমার আগ্রহ তত নয়।
এ কাহিনিতে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে আমি প্রচুর সৃজনশীল কল্পনা মিশিয়েছি। আমার কাছে আড়াই হাজার বছর আগেকার ‘তথ্য’ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয়। পরিবর্তে, আমার মনোলোকে সিদ্ধার্থের যে-ছবি ফুটে উঠেছে, আমি সেই ছবিই এঁকেছি। অতএব, এ উপন্যাসের বুদ্ধ ঐতিহাসিক বুদ্ধ নন। তিনি আমার ব্যক্তিগত বুদ্ধ। যাঁরা বুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাসসম্মত তথ্যেই একমাত্র আগ্রহী, যাঁরা বুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ জীবনীই একমাত্র পড়তে চান, এ বইতে তাঁরা কিছু পাবেন না। আমি তাঁদের জন্য এ বই লিখিনি।
সিদ্ধার্থের প্রচলিত ও প্রামাণিক জীবনীতে সুজাতার কথা আছে, যার দেওয়া পায়সান্ন আহার করে সিদ্ধার্থ তপশ্চর্যাকালে প্রাণরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সুজাতার স্বামীর কথা এসব জীবনীগ্রন্থে নেই। আমি সিদ্ধার্থজীবনীর অনুধ্যানসূত্রে সুজাতার স্বামী সৌদাসকে কল্পনা করেছি। পরজন্মে সৌদাস ভিক্ষু উদাত্তরূপে জন্মেছে, সুজাতা জন্মেছে শ্ৰেষ্ঠীকন্যা মল্লিকারূপে। তারও পরের কোনো জন্মে সাম্প্রতিককালে সৌদাস আবার জন্মেছে ময়ূখের রূপে, সুজাতা হয়েছে বনের হরিণী। জন্মজন্মান্তরব্যাপী এক ব্যাকুলতাভরা প্রণয়কাহিনি এই উপন্যাসে বুদ্ধকথার সঙ্গে মিশে গেছে। এসবই আমার কল্পনা এবং এরকম কল্পনা করতে পেরে আমি আনন্দিত।
এই ভূমিকাটির প্রথম অনুচ্ছেদে আমি যে সমস্ত আকরগ্রন্থগুলির কথা লিখেছি, সেগুলিতেও বুদ্ধপ্রসঙ্গে বহু অলৌকিক কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। যা আমাদের আটপৌরে যুক্তিচেতনার দ্বারা অনুমোদিত হয় না, যা আমাদের আটপৌরে অভিজ্ঞতার বাইরে, অনেকেই তাকে অলৌকিক বলে অবজ্ঞা করে থাকেন। আমার কাছে বুদ্ধচরিত্রকে বুঝতে কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনা (বা আরও ভালো করে বললে ‘মিথ’) অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অলৌকিক ঘটনা বা মিথ সমূহকে ছেঁটে দিয়ে কৃষ্ণ, বুদ্ধ বা জিশুর অনুধ্যান আমার কাছে সংবাদপত্রের রিপোর্টের মতন নিতান্তই নীরস। তাই, আমার বইতে পুনর্জন্মের কথা আছে। যাঁরা হিন্দু পুনর্জন্মবাদ (reincarnation) বা বৌদ্ধ পুনর্ভববাদ (rebirth)-এর মতো তত্ত্বগুলিকে অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার মনে করে সাহিত্যপাঠের সময়েও এদের থেকে দূরে থাকতে চান, এ উপন্যাস তাঁদের জন্য লেখা হয়নি।
উপন্যাসের ভাষাশৈলীতে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। পরিবেশরচনা ও আবহনির্মাণের প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়েছে। একই অধ্যায়ে কিন্তু দুরকম ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, রচনার বিষয়বস্তু বা ভাবই ভাষারীতি খুঁজে নেয়; ভাষারীতিকে লেখক বা লেখাটির সম্ভাব্য পাঠক নিয়ন্ত্রণ করেন না। তাই কোনো অধ্যায়ে আমি তৎসম শব্দবহুল ভাষা ব্যবহার করেছি, কোথাও বা সাধু গদ্যে লিখতে বাধ্য হয়েছি, কোথাও আবার চলিত গদ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে, এমনকি কোথাও গদ্যরীতির সঙ্গে এসে মিশেছে কবিতার চলন। যখন যেমন এসেছে, তখন তেমন লিখেছি। আধুনিক ফিচারধর্মী ‘ঝরঝরে’ গদ্যের ভাষায় আমি কিছুই লিখিনি। গদ্যকার হিসেবে এ আমার স্বাধীনতা বলে মনে করি। যাঁরা আমার এই স্বাধীনতা সহ্য করতে পারেন না, আবারও বলছি, এ বই তাঁদের জন্য নয়।
আর যাঁরা আমার এই স্বাধীনতাকে ভালোবাসেন, যাঁরা ইতিহাস আর ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসের পার্থক্য বোঝেন, সাহিত্যে সৃজনশীল কল্পনা যাঁদের মনে রংমহলের দরজা খুলে দেয়, জন্মান্তরের মতো ‘অলৌকিক’ ঘটনা যাঁদের মননকে উদ্দীপ্ত করে, যাঁরা নানারকম ভাষারীতিকে আবহনির্মাণের কৌশল বলে জানেন, সামান্য কঠিন ভাষাকে বুঝবার জন্য যাঁরা শ্রমস্বীকারে আগ্রহী, এবং যাঁরা এসব মেনে নিয়েই লেখাটি পড়ে আরও কীভাবে লিখলে ভালো লেখা যেত, সে-বিষয়ে আমাকে সুপরামর্শ প্রদান করে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করবেন, তাঁদেরই হাত ধরে আমি চলে যেতে চাই সেই কল্পলোকে, যেখানে নৈরঞ্জনা নদীতীরে উরুবেলা বনে বোধিতরুমূলে বসে সিদ্ধার্থ আজও বুদ্ধ হওয়ার তপস্যা করে চলেছেন, যেখানে প্রভাতবেলায় সৌদাসগৃহিণী সুজাতা নদী পার হয়ে আজও চলেছেন সিদ্ধার্থসকাশে পরমান্ন নিবেদন করবার জন্য।
যদি এমন অসম্ভব ঘটনাও ঘটে যে, আমি যেমন করে ভাবি, তেমন করে ভাবার একটিও সহমর্মী ও সমমনস্ক পাঠক-পাঠিকা আমি সমকালে না-পাই, তবে তাতেও আমি উদ্বিগ্ন নই। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, অনাগত কালে তথাগতকৃপায় আমার সমমনস্ক একজন পাঠক-পাঠিকা অন্তত কখনও কোথাও নিশ্চয়ই জন্মাবেন, যিনি আমার এই ব্যক্তিগত সিদ্ধার্থকে ভালোবাসবেন— তখন আমি হয়তো থাকব না, ভবিষ্য যুগের সেই অদেখা পাঠক-পাঠিকার জন্য আমি এই চিত্রধর্মী কথাকাব্যটি লিখে রেখে গেলাম।
এই বইয়ের পরিশিষ্টে ভদন্ত অশ্বঘোষ-রচিত ‘বুদ্ধচরিতম্’ কাব্যের নির্বাচিত সাতান্নটি শ্লোক ‘বুদ্ধকৈরবী’নামে অনুবাদ করেছি। শ্লোকগুলি এই উপন্যাস লেখার সময় আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
পাবলিশার্স ও বুক সেলার্স গিল্ড-এর বার্ষিক (১৪২৫) সাহিত্য পত্রিকা ‘বইমেলা’তে লেখাটি প্রাথমিকভাবে সংক্ষেপাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই আদিলেখনটি বহুভাবে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়ে বর্তমান উপন্যাসের রূপ নিয়েছে
সন্মাত্রানন্দ
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
Leave a Reply