তুমি সেই মায়াজম (অনুকবিতা গ্রন্থ)
কোয়েল তালুকদার
উৎসর্গ –
বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী
তৌফিকুর রহমান রাঙা – কে
এই ছেলেটা আমাকে দিয়ে জোর করে
কবিতা লেখায়,
এবং সেই কবিতা আবৃত্তি করে
মানুষকে শোনায়।
১.
ধরতে চেয়েছি আঙ্গুল তুমি এগিয়ে
দিলে হাত,
ধরতে গিয়েছি হাত, তুমি এগিয়ে
দিলে বক্ষ,
বলেছিলে — বুভুক্ষু আমি, এই বুক চৌচির প্রান্তর।
শীতল করো, অমৃত সুধা করো পান।
২.
ছায়া রোদ্দুর বিকালে কোথায় যেন গান বাজে
কে যে গায় গান, তাকে আমি চিনিনা
আমার কেবলই ঘুম পায়,
মনে হয় রাত্রি নেমে এল তারই করুণ সঙ্গীতের সুরে সুরে।
মাঝে মাঝে তার ছায়াখানি দেখি —
রোদ্দুরের উত্তাপ হিমেল বাতাসে হিম হয়ে ভাসে
তখন সত্যি যে রাত হয়,
আমার ঘুম পায়, তবু জেগে থাকি যদি সে আসে।
৩.
যে পথে আমার যাওয়া হয়নি
আমি চলে যাচ্ছি সেই পথ ধরে অনেক দূর
কেমন যেন অবশ লাগছে আমার পা
কেমন যেন দুঃখ ছেয়ে আছে
পথের ধুলোর উপর।
যেথায় যাচ্ছি সেখানে তুমি নেই
সেথায় তাই দুঃখও নেই —
ক্লান্তির ছায়া পড়ে আছে পথে পথে
পায়ে পায়ে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।
৪.
কঠিন প্রস্তরের উপর খোদাই করে লিখে রেখে যাব আমাদের নাম ও কিছু নির্মল শব্দাবলি। প্রাণহীন এবং অনুজ্জ্বল সেই শব্দগুলি চেয়ে থাকবে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর স্বরূপের দিকে। দূর্বা ঘাস আর শিলালিপির উপর হেমন্তের শিশির ঝরে পড়বে নির্জন রাত্রি প্রহরে।
খোদাই করা এই অভিজ্ঞান চিহ্ন থাকবে অনন্তকাল,
এখানেই পড়ে রইবে আমাদের স্বপ্নের কথা, আমাদের আরক্ত মুখচ্ছবি।
৫.
আদিমতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সভ্যতায় থাকতে চাই
বর্বরতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সম্প্রীতিতে থাকতে চাই
ধংস তুমি উন্মত্ত হইও না, আমরা শান্তির জনপদ এখানে নির্মাণ করেছি
আগুন তুমি জ্বলে উঠো না, আমরা শীতল আবাস এখানে গড়েছি।
৬.
তোমাকে ভালোবাসতে কখনও ক্লান্ত হই না। তোমার ‘না’ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।
৭.
অভিমান করলে আমিই তা ভাঙিয়ে দেই। না ভাঙলে ভালোবাসা হেরে যায়। আর, অভিমান আছে দেখেই ভালোবাসা জিতে যায়।
৮.
কতটুকু তোমাকে ভালোবাসলে আকাশে মেঘ হবে,
মেঘগুলো জল হবে, পূর্ণতা পাবে নদী —
কতটুকু ভালোবাসলে বসন্তে ফুটবে ফুল
মৌবন হবে শোভিত, মৌমাছিরা গুনগুন করবে চারদিক ,
কতটুকু ভালোবাসলে তোমার কস্তরী ঠোঁট সপ্রতিভ হবে, কাজল চোখে তারা জ্বলবে,
কুচবরণ কেশে গন্ধ ছুটবে !
কতটুকু ভালোবাসলে তুমি হবে নির্জনে
নগ্নিকা একজন।
৯.
যদি কখনও নাম ধরে তোমাকে ডেকে বলি — ভালোবাসি।
আর ঠিক তখনই যদি কল্লোলিত হয়ে ওঠে সমুদ্র,
যদি প্রচণ্ড ঢেউ ব্যেপে এসে বলে — আমার জলে তোমাদের স্থান নেই।
আর ঠিক তখনই আকাশ তার ছায়া ফেলে বলে — স্হান দিতে না পারি, ছায়ামাখা রোদ্রের দিন তোমাদের দেব।
তবুও তুমি বলে দাও — ভালোবাসি।
১০.
যার ভিতরে মায়া নেই, তার সাথে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। আর জড়িয়ে পড়লেও তাকে ছেড়ে আসতে অসুবিধা হয় না।
১১.
যতই কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দাও
বংশী নদীর জলে,
ততই দূর থেকে কাছাকাছি চলে আসি।
যতই বুকের পাজরে বেঁধে রাখো তুমি
সুনিপুণ শৃঙ্খলে —
ততই তোমাকে আমি বেশি ভালোবাসি।
১২.
কী বেদনা লুকিয়ে রাখি অন্তরে
কী যাতনা পুষে রাখি গোপনে।
দিবা নিশিতে ভরে থাকে বিষণ্নতা, অবসাদ নিয়ে করি জীবন যাপন।
ইচ্ছা হলে ছড়িয়ে দিও মাধুরীমাখা ভালোবাসা,
বড়ই কাঙ্গাল হয়ে উঠি সময়ে অসময়ে।
১৩.
পরমেশ্বরী, তুমি আছ আমার ভূবনে
আঁধারের উপর আলো ফেলে,
কত রাত্রিতে কত নক্ষত্র আভায়
করেছ তুমি দান তোমার সকল কুসুমসুধা
পরশ-কম্পিত প্রাণে।
আমি ক্ষণিক নহি, তুমি নহ ক্ষণিকা —
তোমার মাধুরী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বাতাসে
তুমি রবে জনমে জনমে পরজনমে,
সে কথা আমার মন জানে।
১৪.
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
কথা আছে তোমার চোখের সঙ্গে আমার
চোখের পাতার।
তোমার ঠোঁটের সঙ্গে আমার ঠোটের
আশ্লেষের।
তোমার হৃদয়ের সঙ্গে আমার রক্তকণিকার
তোমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার প্রশ্বাসের…
১৫.
তোমার সকল অস্তিত্ব আমার মাঝে উঞ্চতায় ধরা দেয় বারবার
তোমার উষ্ণতার উত্তাপে জ্বলে পুড়ে হৃদয় হয় সব ছারখার
তুমি ভস্ম হও, আমাকেও ভস্ম করো , হয়ে যাই রক্তিম অঙ্গার
তুমি শুচি হও, শূচি হয় আমার দেহ, সুরে ভরে ওঠে কোমলগান্ধার।
১৬.
রাতের মায়াকে অন্ধকারে বিলীন করে দিতে নেই। কোনো বিনিদ্র চোখ যদি আঁধারে কাঁদে তা দেখা যায় না। তাই তাকে খেয়াল করে রাখতে হয় ভোরের আলো পর্যন্ত।
১৭
দিঘি থেকে প্রতিদিন জল তুলি । দিঘির জল আমার হয়। কিন্তু দীঘি জানে আমি কখনোই দিঘির নই।
১৮.
তুমি ভালোবাসা দাও বুকের গভীর থেকে। আমি গ্রহণ করার জন্য করতল পেতে রাখি,
তোমার বুকের বাহিরে।
১৯.
আমি নিঃশ্বাস নেই তোমার শরীর থেকে ছুঁয়ে আসা বাতাস থেকে। আমি প্রশ্বাস রেখে যাব তোমার নিঃশ্বাসের বাতাসে।
২০.
আমি যা রেখে যাব, খুঁজলে দেখতে পাবে অসীম শূন্যতা সেখানে। একসময়ে যেখানে ভালোবাসা পরিপূর্ণ ছিল। তখন তুমি তা দেখতে পেতে না।
২১.
তুমি নেই, তৃষ্ণা যত ক্রন্দনের। মর্মরধ্বনি তাই বাতাসে।
২২.
নির্জন পথবেশ্যা ভোর থেকে শিশিরে ভিজে, রোদ্দুরে শুকিয়ে যায় তার হেমন্ত গন্ধ শাড়ি
তারও প্রতিক্ষা আছে, পাশে দিয়ে হেঁটে যায় নির্মাণ শ্রমিক, যদি বলে সে — চলো ঐ ঝোপের আড়ালে
শয্যা পাতো শিশির ভেজা ঘাসের উপর।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর।
২৩.
আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, জোনাকীরা জ্বালিয়েছে সব আলো
একে একে জ্বলে উঠেছে সব তারা–
অরূন্ধতী,স্বাতি, ধ্রবতারা।
নয়ন মেলে দেখ আর একবার
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সব চুম্বনগুলো দিয়ে দাও
যত পারো যেখানে,
যদি আর ঘুম না ভাঙে কাল সকাল বেলায়।
২৪.
চন্দ্রিমা উদ্যানে আজ মেঘের ছায়া পড়বে না
সপ্তপদি পাতার ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ্দুর পড়বে তোমার মুখে,
এলমেল হাওয়ায় উড়বে চুল,
অসতর্কে খসে পড়বে বুক থেকে মখমলের ওড়না।
একটি দুরন্ত গিরগিটি লুকাবে চকিতে লতা গুল্মে।
ঘাসফুলের গন্ধে উন্মূখ হব দুজন,
কত মাধুরীময় প্রেম সেখানে … আঙুলের স্পর্শে দেহ পটে কত ছবি আঁকা…।
২৫.
তোমাকে ঢেকে রাখি গোপন আলোয় আঁধার গুহায়।
তারপরও সেখানে তুমি জ্বলতে থাকো।
আমি চাই –
সেথায় তুমি অপ্রকাশিত থাকো।
২৬.
মনে হয়,
জগতের সকল অন্ধকার দিয়ে তোমাকে রাখি ঢেকে। রাখিও তাই।
আর তখন তুমি শত সহস্র আলোকবর্তিকা হয়ে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে ওঠো। আর মুহূর্তেই যেন আমার অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়।
২৭.
তোমার কাছে প্রেম চাই তোমার কাছে সুখ
মুছে দাও যাতনা যত মুছে দাও মলিন মুখ
নয়ন খুলে দেখতে চাই দেখতে চাই আলো
তোমাকেই সারা জনম বাসিতে চাই ভালো।
২৮.
মালকোষ রাগে ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’
আর ভূপালিতে ‘একি এ সুন্দর শোভা’।
যারা গান করেন তারা জানেন, মালকোষ ও ভূপালি রাগ দুটো খুব কাছাকাছি, এবং নিবিড় একে অপরে। কিন্তু আবার ভিন্ন অনেক কিছুতে এর তাল এবং লয়ে।
আর রাগ দুটো যদি হয়, সে এবং আমি।
২৯.
হিম আঙুলের স্পর্শে শিলীভূত করতে চাই তোমার হৃদয়।
প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, মৃত্তিকার অতল থেকে উত্থিত সকল অগ্নুৎপাত ধপ করে নিভে যাবে।
৩০.
তখন পড়ে রইবে আমার ছায়া, তখন বাজবে না বাঁশি,
গাইবে না আর কেউ কোনো গান !
তখন সব স্বপ্ন মিশে থাকবে পৃথিবীর স্বপ্নের ভিতর।
৩১.
ভালবাসা জৈব, ভালবাসা যৌন, শরীর না থাকলে কিছু্ই থাকে না ভালবাসায়। প্রেম কখনই এই দেহকে অতিক্রম করতে পারে নাই।
আবার উল্টোও আছে —
ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই। দুষ্প্রাপ্য আমাজান লিলির মতো মনোলোভা। এমন নিষ্কাম প্রেম, শুধু দু’হাত ভরে দিয়ে যায়।
একটি বেগ, আরেকটি আবেগ।
৩২.
ভৈরবী রাগের যে গানটি আমি লিখলাম, সেই গানে তোমার কথা লেখা আছে।
তোমার প্রাণে যে অনুরাগ
আমার গানে যে সুর,
তা আজ তোমার চরণধ্বনি হয়ে বাজছে।
এখন শুধু গানের মুহূর্ত। এখন শুধু গান শোনাবার কাল। এসো, শিশির তলে। এসো, মহুয়া বনে। গান শোনাব আজ।
৩৩.
যে প্রেম কথা বলে না, চিৎকার করে না,
আশা করে না। অপ্রকাশিত থাকে।
অপেক্ষা করতে করতে জীবন ফুরিয়ে যায় , তবু বলে না — ভালোবাসি।
এমন প্রেম আহম্মকেরা কেন যে করে, কেন যে তারা দুঃখ দূর্দশায় জড়ায়।
৩৪.
আজ রুপালি সমুূ্দ্রে সাঁতার কাটলাম। ঝলাৎ ঝলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। ভেঙ্গে পড়ছিল দুপাড়। এত ভাঙ্গন আর এত উথাল পাথাল ! সে এক অবিস্মরণীয় জলপতনের খেলা।
৩৫.
দুহাতে খু্ঁজেছিলাম পাহাড়ের চূড়া। ঠিক উঠতে উঠতে। আবার নামতে নামতে। দেখি মণিমুক্তা খচিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। একবার চূড়োয়। একবার তার পাদদেশে। একবার হিমাদ্রিতে। কী যে আনন্দময় পরিভ্রমণ ছিল !
৩৬.
যে ছেড়ে চলে যায়, সে জানে সে চলে যাবে। তাই সে প্রস্তুতি নেয় আগে থেকেই। তার ভিতর কোনো আক্ষেপ থাকে না। বিদায়কালীন সময়ে চোখ থেকে একবিন্দু জলও ঝরে না।
কিন্তু যাকে ছেড়ে গেল সেই জানে হঠাৎ এই শূন্যতার হাহাকার কী? সেই প্রাণপাত করে। সেই জলশূন্য নদীর মাছের মতো ছটফট করে….
৩৭.
এই রাত্রিতে শিশির ঝরছে অন্তহীন
আজ ভাসিয়ে দাও
তোমার হৃদয়ের আমন্ত্রণে আমাকে নাও
হে নিশীথিনী।
এই জল, এই অন্ধকার, এই নক্ষত্র বীথিকে —
আকুল করে তোলো,
দেহকে স্নাত করো ক্ষণকাল।
৩৮.
ভালোবাসার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম কোনও নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে,
মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে, বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায়, প্রাণখোলা বসন্তবাতাসে, শরতের ঔদার্যে, হেমন্তের পেলবতায়,
সৌন্দর্যে আর বীভৎসতায়, উৎস আর মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালে, ধূসর সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ সেই সব শব্দগুলির সাথে তোমার নামটিই জড়িয়ে আছে।
৩৯.
মাধবী নামটির সাথে মাধুরী জড়ানো আছে। একদিন মাধবী বলেছিল, পৃথিবীতে দুটো জিনিসেই মাধুরী আছে –
এক. বাগদাদের ফুল, আর দ্বিতীয়. রাজস্থানের মীরা বাঈ এর গান। আমি এর কোনোটাই নই। তাই আমার ভিতরে কোনো মাধুরী খুঁজো না।
৪০.
কখন অস্তমিত হয়ে গেল বেলা
কখন ফুরিয়ে গেল ক্ষণ,
শূন্য করে ভরে দেওয়া যার খেলা,
তার জন্য রয়েছিনু বসে
সারা জীবন।
৪১.
চলতে চলতে পথে ক্লান্তিতে যখন আর
চলতে পারি না,
তখন কোথা থেকে তুমি এসে হাতটি ধরো —
বলো, থেমে যেও না।
ক্ষুদ্র প্রাণের ঘাসফড়িং প্রজাপতি উড়ে
ফুলে ও পত্রপল্লবে —
ধরে আছি হাত আমরাও চলি ওদের মতো আনন্দে প্রফুল্লে।
৪২.
যদি কোনো রাত্রির মধ্যাহ্নে
চন্দ্রকিরণতলে দাঁড়িয়ে কেউ ললাটে চুম্বন দিত!
জোছনাধারা বইত ধীরে —
কুয়াশা-নিবিড় নির্জনতায় চলে যেতাম
বাঁশ ঝাড়ের ছায়া মর্মর পথের উপর…
বলতাম,
নাও তুমি আমার অনন্ত ভালোবাসা।
৪৩.
নয়নে নয়ন রেখে দেখলাম তোমাকে, তুমি বললে অন্তরে দেখো।
অন্তরে অন্তর ছু্ঁয়ে ভালোবাসতে চাইলাম,
তুমি বললে বুকে তুলে নাও।
বুকে বুক রাখতেই শীতের সকাল আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে গেল দেহ থেকে দেহান্তরে। তুমি জ্বললে, আমাকেও জ্বালালে। ছাই ভস্ম হয়ে দেহ দুটি এখন আকাশে উড়ছে।
৪৪.
প্রিয় মানুষকে ভালোবাসি গোপনে।
তার প্রতি মায়া করি লুকিয়ে। বুঝতে দিই না তাকে ভালোবাসার অসীমতা।
কারণ, আমি যখন থাকব না, সে তখন সইতে পারবে না আমার দেওয়া মায়াময় অভিজ্ঞান
ও আমার শূন্যতা।
৪৫.
আজন্ম প্রেমিক আমি, বুদ হয়ে থাকি আনন্দে
আনন্দ আমার পূর্বপুরু্ষ থেকে পাওয়া অধিকার।
তুমি কি আনন্দ করতে পারবে ?
পারলে পারবে, না পারলে চলে যাবে
যেমন চলে গেছে পূর্বের অক্ষম প্রেমিকারা।
আমি তো ভিখারী রাঘব নই
আমৃত্যু আনন্দ করা আমার অধিকার।
৪৬.
তুমি রবে না
আমি রবো না
রবে না এই সময়।
শুধু রবে আমাদের পায়ের চিহ্ন
যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে চলে গেছি।
কোনও কথা থাকবে না
শুধু গল্প থাকবে –
পূর্ণিমানিশীথের কোনও এক দেবযানীর
স্বপ্নের ভিতর।
৪৭.
এই দুঃখময় জগতে যা কিছু সুন্দর সে তুমি,
সে তোমার প্রেম। জন্ম মৃত্যুর কালচক্রে সেই প্রাপ্তিকেও একদিন হারাতে হবে।
৪৮.
তুমি তুলে দিয়েছিলে হাতে ভালোবাসবার ভার
তোমাকে ভালোবেসে আজ আমি নির্ভার,
অপার ভালোবাসা বুকে যার
কেমনে ফিরাই তারে সেই দুঃসাধ্য আছে কী আমার?
৪৯.
আমরা ভেসে যাই উদ্দাম সমুদ্রের নীরে
বাধা উপেক্ষা করে ভীতিহীন ,
জীবনের পথে পথে আমরা হাঁটি ধীরে
থাকি পাশাপাশি চিত্ত অমলিন।
৫০.
তুমি আসতে যদি –
কপাল জুড়ে চন্দনের টিপ দিতাম
গাল ভর্তি আবীর মেখে দিতাম
গোলাপ ঠোঁটে কনকচাঁপার রঙ ভরাতাম, বুক থেকে লোধ্ররেণুর সুবাস নিতাম।
৫১.
আমি যাব
তুমি না বললেও যাব
মহাসমুদ্র পাড়ে নৌকা নিয়ে মাঝি একজন অপেক্ষা করছে।
ঐ নৌকায় উঠে আমি একদিন চলে যাব
ঐ মহাসমুদ্রের ওপাড়ে।
৫২.
মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।
প্রতিরাতে বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।
৫৩.
একটুখানি চেয়ে দেখাতে সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে নেয়া যায়।
একটুখানি ছুঁয়ে দেখাতে কারোর সারা জীবনের প্রাণ স্পন্দন অনুভব করা যায়।
কিছু প্রাপ্তি আসে,
জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকে। কোনো আফসোস ব্যাতিত এই জগৎ জীবন
থেকে চলে যাওয়া যায়।
৫৪.
কখনই দেখিনি তোমাকে কোনও নিশীথ অন্ধকারে,
এই মহাবিশ্বজীবনে।
কে তুমি ৷ জানিও নাই তুমি কে৷ চিনিও নাই।
শুধু এইটুকু জানি — সেই তোমারই জন্য
এই রাত্রির অন্ধকারে
জ্বালায়ে ধরেছি আমার অন্তর প্রদীপ-খানি৷
আজ তোমার জন্মদিন,
অঞ্জলী লহো ভালোবাসা মোর।
৫৫.
কেন যে জীবন এলো
কেন যে সে জীবনে তুমি এলে
কেন যে মায়ায় বাঁধলে
কেন যে কাছে আসলে নিভৃত চরণে।
কখন যে কে একা হবে
কখন যে কে চলে যাবে
কোথায় যে কে পড়ে রবে
পৃথিবী কী রাখবে আমাদের স্মরণে।
কোয়েল তালুকদার
উৎসর্গ –
বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী
তৌফিকুর রহমান রাঙা – কে
এই ছেলেটা আমাকে দিয়ে জোর করে
কবিতা লেখায়,
এবং সেই কবিতা আবৃত্তি করে
মানুষকে শোনায়।
১.
ধরতে চেয়েছি আঙ্গুল তুমি এগিয়ে
দিলে হাত,
ধরতে গিয়েছি হাত, তুমি এগিয়ে
দিলে বক্ষ,
বলেছিলে — বুভুক্ষু আমি, এই বুক চৌচির প্রান্তর।
শীতল করো, অমৃত সুধা করো পান।
২.
ছায়া রোদ্দুর বিকালে কোথায় যেন গান বাজে
কে যে গায় গান, তাকে আমি চিনিনা
আমার কেবলই ঘুম পায়,
মনে হয় রাত্রি নেমে এল তারই করুণ সঙ্গীতের সুরে সুরে।
মাঝে মাঝে তার ছায়াখানি দেখি —
রোদ্দুরের উত্তাপ হিমেল বাতাসে হিম হয়ে ভাসে
তখন সত্যি যে রাত হয়,
আমার ঘুম পায়, তবু জেগে থাকি যদি সে আসে।
৩.
যে পথে আমার যাওয়া হয়নি
আমি চলে যাচ্ছি সেই পথ ধরে অনেক দূর
কেমন যেন অবশ লাগছে আমার পা
কেমন যেন দুঃখ ছেয়ে আছে
পথের ধুলোর উপর।
যেথায় যাচ্ছি সেখানে তুমি নেই
সেথায় তাই দুঃখও নেই —
ক্লান্তির ছায়া পড়ে আছে পথে পথে
পায়ে পায়ে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।
৪.
কঠিন প্রস্তরের উপর খোদাই করে লিখে রেখে যাব আমাদের নাম ও কিছু নির্মল শব্দাবলি। প্রাণহীন এবং অনুজ্জ্বল সেই শব্দগুলি চেয়ে থাকবে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর স্বরূপের দিকে। দূর্বা ঘাস আর শিলালিপির উপর হেমন্তের শিশির ঝরে পড়বে নির্জন রাত্রি প্রহরে।
খোদাই করা এই অভিজ্ঞান চিহ্ন থাকবে অনন্তকাল,
এখানেই পড়ে রইবে আমাদের স্বপ্নের কথা, আমাদের আরক্ত মুখচ্ছবি।
৫.
আদিমতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সভ্যতায় থাকতে চাই
বর্বরতা তুমি ফিরে এসো না, আমরা সম্প্রীতিতে থাকতে চাই
ধংস তুমি উন্মত্ত হইও না, আমরা শান্তির জনপদ এখানে নির্মাণ করেছি
আগুন তুমি জ্বলে উঠো না, আমরা শীতল আবাস এখানে গড়েছি।
৬.
তোমাকে ভালোবাসতে কখনও ক্লান্ত হই না। তোমার ‘না’ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।
৭.
অভিমান করলে আমিই তা ভাঙিয়ে দেই। না ভাঙলে ভালোবাসা হেরে যায়। আর, অভিমান আছে দেখেই ভালোবাসা জিতে যায়।
৮.
কতটুকু তোমাকে ভালোবাসলে আকাশে মেঘ হবে,
মেঘগুলো জল হবে, পূর্ণতা পাবে নদী —
কতটুকু ভালোবাসলে বসন্তে ফুটবে ফুল
মৌবন হবে শোভিত, মৌমাছিরা গুনগুন করবে চারদিক ,
কতটুকু ভালোবাসলে তোমার কস্তরী ঠোঁট সপ্রতিভ হবে, কাজল চোখে তারা জ্বলবে,
কুচবরণ কেশে গন্ধ ছুটবে !
কতটুকু ভালোবাসলে তুমি হবে নির্জনে
নগ্নিকা একজন।
৯.
যদি কখনও নাম ধরে তোমাকে ডেকে বলি — ভালোবাসি।
আর ঠিক তখনই যদি কল্লোলিত হয়ে ওঠে সমুদ্র,
যদি প্রচণ্ড ঢেউ ব্যেপে এসে বলে — আমার জলে তোমাদের স্থান নেই।
আর ঠিক তখনই আকাশ তার ছায়া ফেলে বলে — স্হান দিতে না পারি, ছায়ামাখা রোদ্রের দিন তোমাদের দেব।
তবুও তুমি বলে দাও — ভালোবাসি।
১০.
যার ভিতরে মায়া নেই, তার সাথে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না। আর জড়িয়ে পড়লেও তাকে ছেড়ে আসতে অসুবিধা হয় না।
১১.
যতই কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দাও
বংশী নদীর জলে,
ততই দূর থেকে কাছাকাছি চলে আসি।
যতই বুকের পাজরে বেঁধে রাখো তুমি
সুনিপুণ শৃঙ্খলে —
ততই তোমাকে আমি বেশি ভালোবাসি।
১২.
কী বেদনা লুকিয়ে রাখি অন্তরে
কী যাতনা পুষে রাখি গোপনে।
দিবা নিশিতে ভরে থাকে বিষণ্নতা, অবসাদ নিয়ে করি জীবন যাপন।
ইচ্ছা হলে ছড়িয়ে দিও মাধুরীমাখা ভালোবাসা,
বড়ই কাঙ্গাল হয়ে উঠি সময়ে অসময়ে।
১৩.
পরমেশ্বরী, তুমি আছ আমার ভূবনে
আঁধারের উপর আলো ফেলে,
কত রাত্রিতে কত নক্ষত্র আভায়
করেছ তুমি দান তোমার সকল কুসুমসুধা
পরশ-কম্পিত প্রাণে।
আমি ক্ষণিক নহি, তুমি নহ ক্ষণিকা —
তোমার মাধুরী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বাতাসে
তুমি রবে জনমে জনমে পরজনমে,
সে কথা আমার মন জানে।
১৪.
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
কথা আছে তোমার চোখের সঙ্গে আমার
চোখের পাতার।
তোমার ঠোঁটের সঙ্গে আমার ঠোটের
আশ্লেষের।
তোমার হৃদয়ের সঙ্গে আমার রক্তকণিকার
তোমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার প্রশ্বাসের…
১৫.
তোমার সকল অস্তিত্ব আমার মাঝে উঞ্চতায় ধরা দেয় বারবার
তোমার উষ্ণতার উত্তাপে জ্বলে পুড়ে হৃদয় হয় সব ছারখার
তুমি ভস্ম হও, আমাকেও ভস্ম করো , হয়ে যাই রক্তিম অঙ্গার
তুমি শুচি হও, শূচি হয় আমার দেহ, সুরে ভরে ওঠে কোমলগান্ধার।
১৬.
রাতের মায়াকে অন্ধকারে বিলীন করে দিতে নেই। কোনো বিনিদ্র চোখ যদি আঁধারে কাঁদে তা দেখা যায় না। তাই তাকে খেয়াল করে রাখতে হয় ভোরের আলো পর্যন্ত।
১৭
দিঘি থেকে প্রতিদিন জল তুলি । দিঘির জল আমার হয়। কিন্তু দীঘি জানে আমি কখনোই দিঘির নই।
১৮.
তুমি ভালোবাসা দাও বুকের গভীর থেকে। আমি গ্রহণ করার জন্য করতল পেতে রাখি,
তোমার বুকের বাহিরে।
১৯.
আমি নিঃশ্বাস নেই তোমার শরীর থেকে ছুঁয়ে আসা বাতাস থেকে। আমি প্রশ্বাস রেখে যাব তোমার নিঃশ্বাসের বাতাসে।
২০.
আমি যা রেখে যাব, খুঁজলে দেখতে পাবে অসীম শূন্যতা সেখানে। একসময়ে যেখানে ভালোবাসা পরিপূর্ণ ছিল। তখন তুমি তা দেখতে পেতে না।
২১.
তুমি নেই, তৃষ্ণা যত ক্রন্দনের। মর্মরধ্বনি তাই বাতাসে।
২২.
নির্জন পথবেশ্যা ভোর থেকে শিশিরে ভিজে, রোদ্দুরে শুকিয়ে যায় তার হেমন্ত গন্ধ শাড়ি
তারও প্রতিক্ষা আছে, পাশে দিয়ে হেঁটে যায় নির্মাণ শ্রমিক, যদি বলে সে — চলো ঐ ঝোপের আড়ালে
শয্যা পাতো শিশির ভেজা ঘাসের উপর।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর।
২৩.
আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, জোনাকীরা জ্বালিয়েছে সব আলো
একে একে জ্বলে উঠেছে সব তারা–
অরূন্ধতী,স্বাতি, ধ্রবতারা।
নয়ন মেলে দেখ আর একবার
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সব চুম্বনগুলো দিয়ে দাও
যত পারো যেখানে,
যদি আর ঘুম না ভাঙে কাল সকাল বেলায়।
২৪.
চন্দ্রিমা উদ্যানে আজ মেঘের ছায়া পড়বে না
সপ্তপদি পাতার ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ্দুর পড়বে তোমার মুখে,
এলমেল হাওয়ায় উড়বে চুল,
অসতর্কে খসে পড়বে বুক থেকে মখমলের ওড়না।
একটি দুরন্ত গিরগিটি লুকাবে চকিতে লতা গুল্মে।
ঘাসফুলের গন্ধে উন্মূখ হব দুজন,
কত মাধুরীময় প্রেম সেখানে … আঙুলের স্পর্শে দেহ পটে কত ছবি আঁকা…।
২৫.
তোমাকে ঢেকে রাখি গোপন আলোয় আঁধার গুহায়।
তারপরও সেখানে তুমি জ্বলতে থাকো।
আমি চাই –
সেথায় তুমি অপ্রকাশিত থাকো।
২৬.
মনে হয়,
জগতের সকল অন্ধকার দিয়ে তোমাকে রাখি ঢেকে। রাখিও তাই।
আর তখন তুমি শত সহস্র আলোকবর্তিকা হয়ে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে ওঠো। আর মুহূর্তেই যেন আমার অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়।
২৭.
তোমার কাছে প্রেম চাই তোমার কাছে সুখ
মুছে দাও যাতনা যত মুছে দাও মলিন মুখ
নয়ন খুলে দেখতে চাই দেখতে চাই আলো
তোমাকেই সারা জনম বাসিতে চাই ভালো।
২৮.
মালকোষ রাগে ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’
আর ভূপালিতে ‘একি এ সুন্দর শোভা’।
যারা গান করেন তারা জানেন, মালকোষ ও ভূপালি রাগ দুটো খুব কাছাকাছি, এবং নিবিড় একে অপরে। কিন্তু আবার ভিন্ন অনেক কিছুতে এর তাল এবং লয়ে।
আর রাগ দুটো যদি হয়, সে এবং আমি।
২৯.
হিম আঙুলের স্পর্শে শিলীভূত করতে চাই তোমার হৃদয়।
প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, মৃত্তিকার অতল থেকে উত্থিত সকল অগ্নুৎপাত ধপ করে নিভে যাবে।
৩০.
তখন পড়ে রইবে আমার ছায়া, তখন বাজবে না বাঁশি,
গাইবে না আর কেউ কোনো গান !
তখন সব স্বপ্ন মিশে থাকবে পৃথিবীর স্বপ্নের ভিতর।
৩১.
ভালবাসা জৈব, ভালবাসা যৌন, শরীর না থাকলে কিছু্ই থাকে না ভালবাসায়। প্রেম কখনই এই দেহকে অতিক্রম করতে পারে নাই।
আবার উল্টোও আছে —
ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই। দুষ্প্রাপ্য আমাজান লিলির মতো মনোলোভা। এমন নিষ্কাম প্রেম, শুধু দু’হাত ভরে দিয়ে যায়।
একটি বেগ, আরেকটি আবেগ।
৩২.
ভৈরবী রাগের যে গানটি আমি লিখলাম, সেই গানে তোমার কথা লেখা আছে।
তোমার প্রাণে যে অনুরাগ
আমার গানে যে সুর,
তা আজ তোমার চরণধ্বনি হয়ে বাজছে।
এখন শুধু গানের মুহূর্ত। এখন শুধু গান শোনাবার কাল। এসো, শিশির তলে। এসো, মহুয়া বনে। গান শোনাব আজ।
৩৩.
যে প্রেম কথা বলে না, চিৎকার করে না,
আশা করে না। অপ্রকাশিত থাকে।
অপেক্ষা করতে করতে জীবন ফুরিয়ে যায় , তবু বলে না — ভালোবাসি।
এমন প্রেম আহম্মকেরা কেন যে করে, কেন যে তারা দুঃখ দূর্দশায় জড়ায়।
৩৪.
আজ রুপালি সমুূ্দ্রে সাঁতার কাটলাম। ঝলাৎ ঝলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। ভেঙ্গে পড়ছিল দুপাড়। এত ভাঙ্গন আর এত উথাল পাথাল ! সে এক অবিস্মরণীয় জলপতনের খেলা।
৩৫.
দুহাতে খু্ঁজেছিলাম পাহাড়ের চূড়া। ঠিক উঠতে উঠতে। আবার নামতে নামতে। দেখি মণিমুক্তা খচিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। একবার চূড়োয়। একবার তার পাদদেশে। একবার হিমাদ্রিতে। কী যে আনন্দময় পরিভ্রমণ ছিল !
৩৬.
যে ছেড়ে চলে যায়, সে জানে সে চলে যাবে। তাই সে প্রস্তুতি নেয় আগে থেকেই। তার ভিতর কোনো আক্ষেপ থাকে না। বিদায়কালীন সময়ে চোখ থেকে একবিন্দু জলও ঝরে না।
কিন্তু যাকে ছেড়ে গেল সেই জানে হঠাৎ এই শূন্যতার হাহাকার কী? সেই প্রাণপাত করে। সেই জলশূন্য নদীর মাছের মতো ছটফট করে….
৩৭.
এই রাত্রিতে শিশির ঝরছে অন্তহীন
আজ ভাসিয়ে দাও
তোমার হৃদয়ের আমন্ত্রণে আমাকে নাও
হে নিশীথিনী।
এই জল, এই অন্ধকার, এই নক্ষত্র বীথিকে —
আকুল করে তোলো,
দেহকে স্নাত করো ক্ষণকাল।
৩৮.
ভালোবাসার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম কোনও নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে,
মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে, বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায়, প্রাণখোলা বসন্তবাতাসে, শরতের ঔদার্যে, হেমন্তের পেলবতায়,
সৌন্দর্যে আর বীভৎসতায়, উৎস আর মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালে, ধূসর সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ সেই সব শব্দগুলির সাথে তোমার নামটিই জড়িয়ে আছে।
৩৯.
মাধবী নামটির সাথে মাধুরী জড়ানো আছে। একদিন মাধবী বলেছিল, পৃথিবীতে দুটো জিনিসেই মাধুরী আছে –
এক. বাগদাদের ফুল, আর দ্বিতীয়. রাজস্থানের মীরা বাঈ এর গান। আমি এর কোনোটাই নই। তাই আমার ভিতরে কোনো মাধুরী খুঁজো না।
৪০.
কখন অস্তমিত হয়ে গেল বেলা
কখন ফুরিয়ে গেল ক্ষণ,
শূন্য করে ভরে দেওয়া যার খেলা,
তার জন্য রয়েছিনু বসে
সারা জীবন।
৪১.
চলতে চলতে পথে ক্লান্তিতে যখন আর
চলতে পারি না,
তখন কোথা থেকে তুমি এসে হাতটি ধরো —
বলো, থেমে যেও না।
ক্ষুদ্র প্রাণের ঘাসফড়িং প্রজাপতি উড়ে
ফুলে ও পত্রপল্লবে —
ধরে আছি হাত আমরাও চলি ওদের মতো আনন্দে প্রফুল্লে।
৪২.
যদি কোনো রাত্রির মধ্যাহ্নে
চন্দ্রকিরণতলে দাঁড়িয়ে কেউ ললাটে চুম্বন দিত!
জোছনাধারা বইত ধীরে —
কুয়াশা-নিবিড় নির্জনতায় চলে যেতাম
বাঁশ ঝাড়ের ছায়া মর্মর পথের উপর…
বলতাম,
নাও তুমি আমার অনন্ত ভালোবাসা।
৪৩.
নয়নে নয়ন রেখে দেখলাম তোমাকে, তুমি বললে অন্তরে দেখো।
অন্তরে অন্তর ছু্ঁয়ে ভালোবাসতে চাইলাম,
তুমি বললে বুকে তুলে নাও।
বুকে বুক রাখতেই শীতের সকাল আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে গেল দেহ থেকে দেহান্তরে। তুমি জ্বললে, আমাকেও জ্বালালে। ছাই ভস্ম হয়ে দেহ দুটি এখন আকাশে উড়ছে।
৪৪.
প্রিয় মানুষকে ভালোবাসি গোপনে।
তার প্রতি মায়া করি লুকিয়ে। বুঝতে দিই না তাকে ভালোবাসার অসীমতা।
কারণ, আমি যখন থাকব না, সে তখন সইতে পারবে না আমার দেওয়া মায়াময় অভিজ্ঞান
ও আমার শূন্যতা।
৪৫.
আজন্ম প্রেমিক আমি, বুদ হয়ে থাকি আনন্দে
আনন্দ আমার পূর্বপুরু্ষ থেকে পাওয়া অধিকার।
তুমি কি আনন্দ করতে পারবে ?
পারলে পারবে, না পারলে চলে যাবে
যেমন চলে গেছে পূর্বের অক্ষম প্রেমিকারা।
আমি তো ভিখারী রাঘব নই
আমৃত্যু আনন্দ করা আমার অধিকার।
৪৬.
তুমি রবে না
আমি রবো না
রবে না এই সময়।
শুধু রবে আমাদের পায়ের চিহ্ন
যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে চলে গেছি।
কোনও কথা থাকবে না
শুধু গল্প থাকবে –
পূর্ণিমানিশীথের কোনও এক দেবযানীর
স্বপ্নের ভিতর।
৪৭.
এই দুঃখময় জগতে যা কিছু সুন্দর সে তুমি,
সে তোমার প্রেম। জন্ম মৃত্যুর কালচক্রে সেই প্রাপ্তিকেও একদিন হারাতে হবে।
৪৮.
তুমি তুলে দিয়েছিলে হাতে ভালোবাসবার ভার
তোমাকে ভালোবেসে আজ আমি নির্ভার,
অপার ভালোবাসা বুকে যার
কেমনে ফিরাই তারে সেই দুঃসাধ্য আছে কী আমার?
৪৯.
আমরা ভেসে যাই উদ্দাম সমুদ্রের নীরে
বাধা উপেক্ষা করে ভীতিহীন ,
জীবনের পথে পথে আমরা হাঁটি ধীরে
থাকি পাশাপাশি চিত্ত অমলিন।
৫০.
তুমি আসতে যদি –
কপাল জুড়ে চন্দনের টিপ দিতাম
গাল ভর্তি আবীর মেখে দিতাম
গোলাপ ঠোঁটে কনকচাঁপার রঙ ভরাতাম, বুক থেকে লোধ্ররেণুর সুবাস নিতাম।
৫১.
আমি যাব
তুমি না বললেও যাব
মহাসমুদ্র পাড়ে নৌকা নিয়ে মাঝি একজন অপেক্ষা করছে।
ঐ নৌকায় উঠে আমি একদিন চলে যাব
ঐ মহাসমুদ্রের ওপাড়ে।
৫২.
মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।
প্রতিরাতে বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।
৫৩.
একটুখানি চেয়ে দেখাতে সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে নেয়া যায়।
একটুখানি ছুঁয়ে দেখাতে কারোর সারা জীবনের প্রাণ স্পন্দন অনুভব করা যায়।
কিছু প্রাপ্তি আসে,
জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকে। কোনো আফসোস ব্যাতিত এই জগৎ জীবন
থেকে চলে যাওয়া যায়।
৫৪.
কখনই দেখিনি তোমাকে কোনও নিশীথ অন্ধকারে,
এই মহাবিশ্বজীবনে।
কে তুমি ৷ জানিও নাই তুমি কে৷ চিনিও নাই।
শুধু এইটুকু জানি — সেই তোমারই জন্য
এই রাত্রির অন্ধকারে
জ্বালায়ে ধরেছি আমার অন্তর প্রদীপ-খানি৷
আজ তোমার জন্মদিন,
অঞ্জলী লহো ভালোবাসা মোর।
৫৫.
কেন যে জীবন এলো
কেন যে সে জীবনে তুমি এলে
কেন যে মায়ায় বাঁধলে
কেন যে কাছে আসলে নিভৃত চরণে।
কখন যে কে একা হবে
কখন যে কে চলে যাবে
কোথায় যে কে পড়ে রবে
পৃথিবী কী রাখবে আমাদের স্মরণে।
Leave a Reply