তুমি মাধুকরী (কাব্যগ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
উৎসর্গ –
লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক
ফেরদৌস জেসমীন-কে।
এই মেয়েটিকে আমি চোখে দেখিনি
কিন্তু সে আমার কল্যাণকামী।
১. তুমি এসো
এত কাছে আসতে নেই অগ্নিমুখ প্রজ্জ্বলিত করে
দীর্ঘ চুম্বনের পথ পাড়ি দিয়ে
হঠাৎ জ্বলে ওঠা প্রথম আলোর মূর্ছণার মতো।
এত ভালো বাসতে নেই
সব প্রেমচিহ্নর পথ মাড়িয়ে আবাস গড়ো এসে
যেখানে নদী আছে
জ্যোতির্ময় অরন্যানী আছে
বসন্তদীঘি আছে
যেখানে হাত ডোবালেই পেয়ে যাও অমৃতের শুদ্ধতা।
তুমি আলো হয়ে আলো ছড়াও নির্জনতার ভিতর
মহাকাশ ছুঁয়ে থাকে যেমন পৃথিবীর বুকে —
তোমার দীপ্তিময় মুখে বিষণ্নতার বিলাপ নেই
তুমি ঘুমঘোরে জড়িয়ে ধরো
অঙ্গার করো
ছাই করো
ভস্মীভূত করো
আপন কক্ষপথে জ্বলে ওঠে যত নক্ষত্র-বীথি।
এত কাছে জড়াতে নেই
যেখানে নক্ষত্রে নক্ষত্রে সংঘর্ষ হয়
আলিঙ্গন তৈরি হয়
নৈঋত থেকে ঝড় ধেয়ে আসে, হৃদয় তোলপাড় হয়
রক্তক্ষরণ হয়,
বসতি ধ্বংস হয় —
আমি এই প্রেম চাইনা।
এসো প্রিয়তমা
অন্ধকারের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে সকল শূন্যতা পূর্ণ করো
পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলো ঝলমলিয়ে এসে আলোকবর্তিকা হও।
২. হাওয়ার মতো জোছনার মতো
তোমাকে নিয়ে একদিন এমন কোথাও চলে যাব যেখানে নির্জনতা ছাড়া আর কেউ থাকবে না
আমাদের দেখবে ফুল পাখি আর বন্য হরিণেরা
প্রাণে প্রাণ ছুঁয়ে বলব কথা।
আমাদের কথা ওরা কেউ বুঝবে না,
আমরা গাইব গান, সে গানে পিয়ানোর মতো সুর তুলবে সেখানকার স্বচ্ছতোয়া নদীর জলকলরল,
নিসর্গের মর্মরে আমরা নিশ্চুপও থাকব
ঘাসের উপর শুয়ে দেখব রাতের তারার আকাশ,
তুমি বলবে — চলো, আমরাও তারা হয়ে যাই ঐ দূর আকাশে…
আঁধারে তখন বিপুল নৈঃশব্দ্যের স্তব্ধতা
কোনও কথা নেই আর কারোর –
প্রেম তখন ছুঁয়ে থাকবে শরীরে শরীরে!
মহাকালের বুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার জন্য
উন্মত্ত উদ্দীপনায় আমরা উন্মুখ হবো তখন!
আমরা ভেসে যাব রাতের গাঢ় অম্বরে হাওয়ার মতো, জোছনার মতো…
৩. এলোমেলো ভাবনা
কবিতা নয়, গল্প নয়, একটি ব্যঞ্জনাময় বাক্যও নয়। সেই কতকাল থেকে একটি মাত্র শব্দকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু তার দেখা আমি আজও পাইনি।
আগে ঘরের চালে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যেত। এখন অঝোর ধারায় ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি হলেও ঘুম ভাঙ্গে না।
ছোটবেলায় সূর্য নিঃশেষিত সন্ধ্যায় ধনিদহ বিলে পাখিদের পালক খুঁজতে যেতাম। এখন সন্ধ্যার বুকে নিজেই ছটফটে পাখি হয়ে থাকি।
এখানে জানালার পাশে বড় বড় অট্টালিকা উঠছে। নীল আকাশ দেখা যায়না। দক্ষিণের বাতাস নেই। ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাইনা।
একটি সুন্দর ঝলমলে রোদ্দুরের দিন খুঁজছি। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে, হাওয়াই চপ্পল পায়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যাব।
আমার খুব ঘুম পায়। ঘুমিয়ে থাকার এক অনন্ত খিদে। কোথায় সেই সবুজ ঘাসের বিছানা? যেথায় রাতভর জ্যোৎস্না ঝরবে আর ভোরের শিশির বিন্দু।
৪. পাখি উড়ে গেছে
যে পাখি উড়ে গেছে, তার পিছু আর যেওনা। নতুন আকাশে মেঘের আড়ালে সে বাসা বেঁধেছে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যবর্তী ধূসরে এখন তুমি একা।
যে পাখি উড়ে গেছে, তাকে আর পিছু ডাক দিওনা। এখন সে উৎসবে ব্যস্ত । আলো ঝলমলে স্বপজাল তার চোখে মুখে। তাকে অনুসরণ কোরো না।
যে পাখি উড়ে গেছে, যতটা সম্ভব ছিন্ন পর্ব থেকে ভুলে যাও তাকে। বারবার তাকে ডেকো না। পুরাতন ডাক শুনলে সে চমকে উঠবে। বিরক্ত হবে।
৫. আসব তোমার কাছেই
আসব তোমার কাছেই যদি মেলে দাও
তোমার আকাশ,
যদি ভিজাও বহতা নদীর কুলকুল জল ধারায়।
যদি দেখাও উপত্যকা, হামাগুড়ি দেব তার ঢালে,
পুকুর নালায় উপচে পড়বে ঝর্ণার জল।
যদি নিয়ে যাও পূর্ণিমার আলোয় পথ ধরে নিরুদ্দেশ কোথাও।
যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে থেকে থেকে জোনাকি জ্বলে। যেখানে রাতভোর স্নাত হওয়া যায় শিশিরে।
৬. ভালো আছি, ভালো নেই
সবকিছুই কেমন যেন ভুলো ভুলো
সব রং কখন আবির হলো
কবে কখন কাকে বুকে জড়িয়েছিলাম
কার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলাম।
পাঁজরেই কি ঠাঁই ছিল!
চুম্বনেই কি বাঁধা ছিল?
সব নিয়ম যে ভুল হলো
রাতটাও দেখি শেষ হয়ে গেল।
সকালে তোমার চুলের গন্ধ ভাসে
ভালোবাসার সেই আবেশ আসে
কখন যে সবকিছু নিয়ে গেল সেই
ভালো আছি, আবার ভালো নেই।
৭. অবগাহনের সময়
আমরা হাত ধরে চলে যাই ধূঁ-ধূ মাঠের প্রান্তরে
সেখানে মধ্যরাতে আদিগন্ত শূন্যতার বুকে জ্যোৎস্নার প্লাবন নামে।
অসংলগ্ন শরীরময় লতগুল্ম ঝিঁঝি পোকারা জড়িয়ে ধরে
ঘর হয়ে যায় নির্ঘর, তখন নদীও যেন কাছে টানে,
তখন নেমে পড়ি জলে,
অবগাহনের সময় ঘরে ফেরার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
৮. প্রতীক্ষা
কত দূরের পথ যেতে চাইলে বলে যেতে হয়
কত দূরে চলে গেলে কারোর প্রতিক্ষা করতে হবেনা,
সোনাজঙ্গ পাখিরা উড়ে চলে যায় বহু দূর —
তারা কী কাউকে বলে যায়?
বরফ দেশে যেয়ে তারা হিম হয়ে থাকে।
নদী বেগে ধেয়ে যায়, তার বাঁকে বাঁকে স্রোতের ধারা থেমে থাকে না —
কত দূরদেশ, কত মৃত্তিকা ভেঙ্গে, অথৈ সাগরে মিলে যায়, সে নদী কী কাউকে কিছু বলেছিল?
বর্ষার সুগন্ধি ফুল ফোঁটে,
সে ফুল ঝরে যায়
রোদ্রের উত্তাপ মেখে, সেও বলে না তার ঝরে যাবার মর্মবেদনার কথা।
কোথাও কোনো পথে ধুলোটি নেই,
সব পরিপাটি, সব মসৃণ মখমলে,
সেই পরিচ্ছন্ন পথ ধরে সে যে কবে চলে গেছে অনন্ত পথে — বলে যায়নি তা কাউকে,
তার জন্যেই যে আমি আজও চির প্রতিক্ষায় আছি।
৯. যদি নাও প্রেম
চারপাশের শুন্যতারা মিথ্যে হোক, ভালোবাসার
সুগভীর ছায়া পড়ুক এই জীবনে
তোমার ভিতরে ছড়িয়ে দেব আমার প্রাণ, আমার প্রেম
ঈশ্বরের নির্মিত এই বুকে যতোই বাজুক
গভীর যত ক্রন্দনের আওয়াজ।
আত্মার মধুর আলোকে দ্যুতি ছড়িয়ে দেব তোমার অন্তরাত্মায়
প্রিয় তুমি, সবই হতে পারে তোমাকে নিয়ে
এই পৃথিবীর ধুলোয়
আমার রক্ত কণিকায় জাগাও তোমার সকল প্রবাহমান প্রেম, সকল মায়া –
তুমি এসে চূর্ণ করো আমার অন্তর্গত সকল গ্লানি।
তোমাকেই ভালবাসা অর্পণ করি
তর্পন করি মায়া মমতা
আমার দু’হাতের আজলায় উপচিয়ে পড়ে প্রেম
যদি ভরে নাও সেই প্রেম, যদি থাকো কাছাকাছি
তুমি কখনোই পরাজিত হবেনা।
১০. রক্তাক্ত দোলনচাঁপা
সেই সব কুমারী মেয়েরা করে যায় ভুল,
তারা জানেনা তাদের বিষয় সম্পদ কতো দামি
কেউই জানেনা হীরক খণ্ড কি
তারা জানে কেবল সমুদ্র বেসাতি,
তারা জানে ঝিনুক থেকে কিভাবে মুক্তা হয়
তারা সমুদ্র কন্যাও।
দু’চোখ নাশপাতি তার, ঠোঁট-দু’টিতে কমলার রং মাখা
বুকে তাদের মহুয়ার গন্ধ
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে তপ্ত আগুন হয়ে বালুর উপরে
দারুচিনিও ভস্ম হয়, দেহটি কোথায় পড়ে থাকে
কোনও ভাবে জানল না তো কেউ
খুঁজেছিল তারা সমুদ্রপাড়ে কুমারীদের আত্মার ভিতরে,
শুক্তির ভিতরকার শুভ্র মুক্তার জন্য গাইত যারা গান।
দোলনচাঁপার মাঠে তাকে তারা খুঁজেছে অনেক
যেখানে আগের রাত থেকে পড়েছিল অন্তর্বাসের ছেঁড়া ফিতা, একখানি চপ্পল আর চাপচাপ কিছু রক্ত!
১১. এই শহর আমার জন্য নয়
পার্কের পাশে লাইটপোস্টের নীচে স্ট্রীট বেশ্যারা উন্মাতাল –
চারপাশে দেখে তারা চর্বিওয়ালা লোকের চাহুনি
আর অসংখ্য মদ পিপাসু মানুষ – আমি তখনো সঙ্গীবিহীন
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেঁটে যাই
উদ্বাস্তু উদাসীনতার রাজপথে ধরে।
এই শহর আমার জন্য নয়
লাল আলোর জানালার ধারে মায়াবী চোখ দেখি, সিগারেট হাতে
মৃদু সঙ্গীত আর চোলীর মাঝখানে লুকানো ক্লান্তি
সেইসব রমণীর দিকে আমি ফিরে তাকাতে চাইনা
সেখানে রাত গভীর হতে থাকে পাপের গভীরে।
এই শহর আমার জন্য নয়
এখানে সেই ইছামতির সচ্ছ জল নেই
প্রথম স্বাদ প্রাপ্তির জলপথ দিয়ে ঘুরতে থাকি অবিরাম বৃত্তাকারে
সিগারেটের ধুঁয়ায় সেই মায়াবী চোখ খু্ঁজি
যার আঁচল তলে মুখ ঢাকতে চাই পুণ্যতার জন্য।
১২. আলোক ধারা
নির্জন রাত্রি দুপুরে তোমাকে নিয়েই রচিত হয়
আমার কবিতার চরণগুলো
আমি চোখে চোখ রাখি অন্তরে খুঁজি উচ্ছাস যত।
তুমি আমাকে যেন ভুলে না যাও
আমার গান আমার রাত জাগার বাঁশির সুর, আমার ভালোবাসা এবং আমার যত অনুভাবনা।
তুমি অমৃতসুধা ঢেলে দাও
শরীর থেকে শরীরে জ্বালাও আলোর শিখা, আমি জেগে জেগে প্রসারিত করি দীর্ঘ এক স্বপ্ন।
আমি হাঁটি মাইল মাইল পথ
আমার চরণে বাঁজে তোমার চরণধ্বনি
তুমি থেকে যাও আমার কর্মে,
আমার সৃষ্টিতে, আমার সকল আলোক
ধারায়।
১৩. সুগন্ধি লোবান
ক্রমেই দিনগুলি বিষণ্ন হয়ে আসছে
যেমন বিষণ্ন হলো আজকের বিকেলও
একগুচ্ছ রক্তিম ক্যামেলিয়াও
বিষণ্ন হয়ে রইল হাতের করতলে,
স্বপ্নগুলো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই ভেঙ্গে গেল
কষ্টগুলো তোমার বুকেই ঘুমিয়ে গেল
নিভৃত ক্রন্দনধ্বনিতে।
এ কোন্ মায়া পুড়ে ছারখার হয় নিষ্ঠুর ছায়াধূপে
সকল কর্মের পরিসমাপ্তি কি আসন্ন তবে —
যেথায় যে বাগান আছে তা আর থাকবে কি?
যেথায় যে ফুল ফুটবার কথা তা আর ফুটবে কি?
সাদা পাঞ্জাবী টুপি পরে মৌলানা সাহেব আসবেন
আসবেন তার নবাগত শিষ্যরাও
সুর করে সুরা ফাতিহা পাঠ করবেন
কফিনের পাশে সুগন্ধি লোবান জ্বলবে,
তোমাকে দেখতে পারবে কি আর আমার চোখ?
শেষবারের মতো আর একবার।
১৪. একটি অপ্রেমের কবিতা
বসন্ত আসার আগেই ঝরা পাতা উড়িয়ে দিলাম —
মল্লিকার বনও পুড়ে বিরাণ হলো
এ কোন্ আগুনে?
এই শ্রাবণে বৃষ্টির জন্য তাই এত হাহুতাস।
তোমাকে ভালোবাসি অসম্ভবের মতো অসংলগ্ন
ঈশ্বরের নাম আসেনা মুখে জপি তোমার নাম
সারারাত ধরে কবিতার শিরোনাম হও তুমিই —
এইসবই কি ভ্রান্ত তবে?
মৃত্তিকায় মিশিয়ে দিতে চাই এ প্রেম,
এ মাধুরী–
বুভুক্ষ পিঁপড়ার দল এসে পুরোয়
তার উদোর,
সব প্রেম অপ্রেম হয়ে জড়ো হয় তোমারই কাছে।
বাগানের ফুল তুলতে গিয়ে খুলে ফেলি তোমার খোঁপার ফুল, সময়ে অসময়ে কিংবা মধ্যরাতে।
১৫. নিবেদন
তোমাকে দিলাম আমার সন্ন্যাস
আমার ছিন্ন পাতা, অনাস্বাদিত অপূর্ণ প্রেম, আমার দীনতা, ও আমার সকল গ্লানি।
তুমি দাও আমাকে সপ্তপর্ণী সবুজ পাতা,
নীলকন্ঠ পাখির পালক, শূভ্র মেঘের জল কণা
তোমার সৌধ, ঐশ্বর্য, তোমার সৌন্দর্য সুধা।
দাও নিস্তব্ধতা, অমরত্ব, মর্মরিত বেদনা
এবং ঘন আকুল নিঃশ্বাস।
১৬. হেঁটে গেছি সন্ধ্যাতারার দিকে
এখনও স্বপ্নে দেখি আমার নদীটাকে।
হেঁটে গেছি কত প্রান্তরের পর প্রান্তর মেঠো পথ ধরে পথই টেনে নিয়ে গেছে যেদিকে নদী আছে ।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে পাড়ে চলে যাওয়া।
তারপর শুনেছি এর জলতরঙ্গের গান,
কতো সন্ধ্যা মগ্ন হয়েছে রাতের আঁধারে। সব তারা ডুবে যেত যমুনার জলে।
নদীর পাড় ধরে আমি হেঁটে গেছি কত সন্ধ্যাতারার দিকে, নদীর ঝুমঝুম শব্দগুলো চোখের জলপতনের শব্দ হয়ে ফিরে অসতো ।
আমি আজও অলস পায়ে হাঁটি ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে। হাঁটি আর হাঁটি। কোনও ক্লান্তি নেই।
মাটির সোদা গন্ধ চিনিয়ে নিয়ে যায় নদীর টানে।
তখন দখিনের হাওয়া উতাল হয় , বেগ পায় নিঃশ্বাসের বাতাস
তখন আমার সারা অন্তর্ময় করুণ এক গানের সুরে কা্ঁদতে থাকে-
‘যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে’।
১৭. রূপকথার রাজপুত্র
সোনা মেয়ে, কেন তুমি রাগ করো অসময়ে
কেন তুমি সঁপে দিতে চাও পাংশু দেহ।
চোখে কাজল নেই,
মুছে ফেলেছ তা বহু রাত জেগে।
কোন্ দুঃখে তুমি বিপথে যেতে চাও?
এক রাজকন্যার রূপের হাসি
কবে ডুবে গেছে মেঘলোকের অন্ধকারে
এখন আলোহীন নিভু নিভু নক্ষত্র তুমি।
তোমার চোখ তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণ গহবরে
খোঁজো সেখানে জ্যোতির্ময় কাউকে
আমি নেই সেখানে।
আমি কারোরই নই , নই তোমারও —
রূপকথার রাজপুত্র দূরের কোনও ভুবনের।
১৮. আনন্দ কাব্য
এই বিশাল মহাজগতে ছোট্ট এ পৃথিবী, তার মাঝে ক্ষণিকের এই জীবন–
সেই ক্ষণকালের জীবনটিকে আমি আনন্দে ভরে রাখি।
আমি জানি, জগতের বুকে দুঃখই বেশি।
এই ঝলমলে রোদ,
এই পাখির কলকাকলি,
গাছের পাতায় হাওয়ার দোলায় এই ঝিরঝির শব্দ, ভোরের খোলা হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেওয়া —
এসবই আমি উপভোগ করি। এর মাঝেই জীবনের আনন্দ।
১৯. ভালোবাসা কারে কয়
তুমি বঙ্গোপসাগরের লোনাজল,
নাকি পলিমাটি মিশানো যমুনার স্রোতধারা?
তোমার প্রেম শীত না বসন্ত, নাকি নাতিশীতোষ্ণ!
সবকিছুই দ্বিধায় ঢেকে রেখেছ।
নাকি ভালোবাসা এই রকমই —
যেমন তুমি আবক্ষ জলে নামলে শীৎকার করো
আবার ডাঙ্গায় তপ্ত রোদ্রে ছটফট করো
তোমাকে কাছে টানলেই সমস্ত মেঘ
জল হয়ে ভুবন ভাসে।
আবার তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখলে
সমস্ত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হয়ে যায় ঈ্ষাণ কোণে
তুমি আগুন হয়ে জ্বলে পোড়া মাটি করো
আবার জল হয়ে নদীও হয়ে যেতে পারো।
তোমাকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা নেই
তুমিই শিখিয়েছ কিভাবে ভালোবাসতে হয়
তুমি শিখিয়েছ, ভালোবাসা কারে কয়!
২০. বাসনা কুসুম
আমার এই জীবনে তুমি একমাত্র রমণী
তুমিই একমাত্র সহচরী কিংবা রাজ রাজেশ্বরী
যে তুমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ আমার পাশে,
ময়ুরের পেখম মেলে কথা বলি তোমার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভাষায় —
যেন রাত্রিও সচকিত হয়ে ওঠে।
তুমি কখনো হতে পারোনি সম্পূর্ণ রমণী
কোনো বসন্ত শেষ করতে পারোনি
হয়ে থাকলে বাসনা কুসুম —
কত রাত শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রুমাল বানিয়েছি
কত রাত দাবা খেলায় রাণীর হেরে গেছে
ধাবমান অশ্ব ক্ষুরে, সৈনিকের তলোয়ারের খোঁচায়।
জীবন ফতুর হয়ে গেল
সব আয়ুষ্কাল ভাঙ্গা প্রদীপের নীচে নিভে গেল
এ এক দুঃসহ ক্লেদ আমার —
একটি রাজ্যও এখনো জয় করতে পারিনি।
২১. ভালোবাসা জেগে আছে
সেই কবে রক্ত কণিকায় লুপ্ত হয়েছিল ভালোবাসা
সেই কবে এক্কা দোক্কা খেলতে যেয়ে পায়ে বেজে উঠেছিল ঝুমুর সুরে তোমার ঘুঙুর —
আমার প্রথম গান ধ্বনিত হয়েছিল সেইদিন থেকে।
কেমন যেন মেঘ মেঘ ছিল কাল রাত
কেমন যেন বৃষ্টি বৃষ্টি ছিল সময় —
কেমন যেন কম্পিত হচ্ছিল শিরা উপশিরা
যেন বিদ্যাপতির রাধিকা নেমে এসেছিল পথে
নিবিড় করে ভিজছিল তোমারও আঁচলখানি।
কয়দিন আগে দীপাবলীর সব দীপ নিভে গেছে
দীপ নেই আলো নেই এই রাতে
বৃষ্টি তো আছে, দেখ তুমি — অন্তরে তোমার ভালোবাসা জেগে আছে।
২২. সুস্মেলী
সুস্মেলী, সেই যে তুই চলে গেলি
তারপর একবারও ফিরে না এলি
তুই কি আমার মতো একলা থাকিস
নাকি কাউকে আবার ভালোবাসিস
নাকি চেয়ে দেখিস নিঃসঙ্গ সন্ধ্যাতারা
নীল জোনাকি খোঁজে তোকে ছন্নছাড়া
নির্জনতায় কি ঘুরে বেড়াস চিত্রাপারে
ইচ্ছে হলেই আমায় ডাকিস চুপিসারে
সুস্মেলী, আমি যে তোকে ভালোবাসি
রাত গভীর হলে তোর জন্য জলে ভাসি।
২৩. প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা
কথা ছিল মেঘ বৃষ্টির নীচে শুয়ে রবো এই ভরা শ্রাবণ নদী সন্ধ্যায়।
কতোটা আঁধার পেলে এ রাত একা
হয়ে যায়।
নিজস্ব শাড়ির আড়ালে বিপন্ন বেহাগ, কেঁপে ওঠে চাঁদের শরীর।
দূর কোন অতীতের পাখি উষ্ণতা নিয়ে উড়ে যাবে আরো দূর ইপ্সিত অন্ধকারে।
নরম নৈঃশব্দের মতো আমিও হেঁটে যাবো প্রগাঢ় তৃষ্ণার দিকে।
কে আমার প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা।
কার কাছে হারাবো,
ভেসে যাবো জলের তরলে অমৃতের জোৎস্নায়।
২৪. রাতের পদাবলী
কবিতা লিখব বলে রাত জেগে আছি
নিশাচর পাখিরা এলো
তারারা ছুটে এলো
বাতাস এলো
নৈঃশব্দ্যের গান শোনা গেল
জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসল
তোমার পদধ্বনি বাজল
সকাল বেলা খাতা খুলে দেখি —
সেখানে কোনো পদ নেই
কোনো পদাবলী নেই
কোনো কবিতা নেই
সারা পাতা জুড়ে তোমারই নাম লেখা।
২৫. ফিরে যেতে চাই
আমি চলে যেতে চাই সেই বেলায়
যে বেলায় ঘুরে বেড়েয়েছি ইছামতীর তীরে
যে বেলায় শ্রাবণের মেঘের বৃষ্টিতে ভিজেছি
যে বেলায় গোল্লাছুট খেলতাম স্কুল মাঠে
যে বেলায় বিকালের হাওয়া লাগাতাম গায়ে
যে বেলায় কোনো শ্যামল কালো বালিকা
হাত ধরে নিয়ে যেত সোনাল বনে
যে মেয়ের মুখ দেখতান খাঁ খাঁ রোদ্দুরে
যে বেলায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতাম
যে বেলায় কবিতা লিখতাম ছন্দ খুঁজে খুঁজে।
আমি ফিরে যেতে চাই সেইসবের কাছে।
২৬. মনে কি পড়ে
মনে কি পড়ে কোভা? ব্যস্ত শহরে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল
তুমি ভেজা হাইওয়ে ধরে
চলে গিয়েছিলে লং ড্রাইভে অনেক দূরে
কি নিঝুম বৃষ্টি ছিল ! রিমঝিম উড়ছিল পথের ক্লান্তি
মনে কি পড়ে কোভা? আমি ছিলাম তোমার পাশে।
চোখ মেলেছিল ডানা উড়ন্ত গাংচিলে
দূরে ঝাঁও বনে ঝরছিল বৃষ্টি অনবরত
আরও বেশি স্তব্ধতার ভিতর তুমি ছিলে ভাবলেশহীন,
মনে কি পড়ে কোভা?
কি মোহময় সেই বৃষ্টিপাত! কি অবিরাম
জলের ধারা
বাহুর আশ্রয়ে জানিয়েছিলে প্রথম ভালোবাসার নিমন্ত্রণ
বলেছিলে –‘ তোমাকে ভালোবাসি। ‘
তুমি বিস্মৃত হয়োনা কোভা —
সেই বিনম্র মুখের হাসি সেই মায়াবী দৃষ্টিপাত
নগরীর সমস্ত সভ্যতা ভেঙে চুরমার হয়েছিল
বৃষ্টির শব্দে পথ চলতে চলতে সেই বিকেল!
বিস্মৃত হয়োনা কোভা
শান্তা মনিকার তীরে আমাদের সেই শেষ আলিঙ্গন!
প্যাসিফিকের জল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল
তারও আগে
যা আজ আর মনে পড়েনা।
২৭. ভালো থেকো পৃথিবী
তোমার দেখা পেলাম না এজন্য মনখারাপ নেই
আমি চলে যাচ্ছি একাকী পাখির মতো
শূন্যে ডানা মেলে,
আমার স্বপ্নগুলোও নিয়ে যাচ্ছি
ওরাও অসীমে উড়ে চলে যাচ্ছে আমার সাথে,
তোমার চারপাশে একটিও স্বপ্ন রেখে
গেলাম না…
আমার কী যে ঘুম পাচ্ছে এখন,
কোনও ভার নেই আর,
কেমন নির্ভার অবসাদে জড়িয়ে আসছে শরীর,
এমন অনন্ত ভালো লাগা এই পৃথিবীতে নেই..
যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আমার স্বপ্ন ও শান্তিরা অপেক্ষায় আছে..
ভালো থেকো পৃথিবী, বিদায়!
২৮. এই প্রেম সেই প্রেম ছিলনা
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস থেকে জেনে নিয়েছি
যে হাওয়া বইছে আজ এখানে
যে গানের সুর ভেসে আসছে পূরবী ঝংকারে
সেই সুর ঝংকার আমার জন্য বাজেনি –
তোমার ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত কাপড় বলে দিচ্ছে
গর্ভধারণের আড়ালে যে তুমি
সে তুমি কখনোই আমার ছিলে না।
এই প্রেম, সেই প্রেম ছিলনা কস্মিনকালেও
এ ছিল প্রেমহীনতার উৎসব উৎসব খেলা
প্রেমের আড়ালে ছিল শুন্য করে দেবার দহন
জ্যোৎস্নার আড়ালে যে উদ্বাস্তু প্রান্তর ছিল
সেখানে হতো কেবল বেদনাহতদের কান্নার উৎসব।
এই রকম শোকাচ্ছন্ন উৎসবের রাতে —
এই রকম অন্ধকার পথের প্রান্তের উপর
অনিশ্চিত গোপণ রক্ত ক্ষরণের ভিতর
পূর্ব পুরুষদের বিদ্ধ করতে চাইনা কোনো পাপ স্খলণে।
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস সেই বার্তাই দিয়ে গেল।
২৯. দূরের সুবর্ণরেখা
কপালে পরেছিলে টিপ যেন লেগে রয়েছিল চাঁদ
পুর্ণিমার আকাশ থেকে
মুখ তোমার আলোয় হেসেছিল
মায়াবী ছোঁয়ায় চুল ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠের উপরে
যেন আদিগন্ত ছায়া পড়েছিল সেখানে
স্থির হয়েছিল তোমার গ্রীবার ভঙ্গি
ভ্রূ বেঁকেছিল তৃতীয়া চাঁদের মতো ধনুকের।
চোখ ছিল চোরাবালির বালি, পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার
এসে ডুব দিয়েছিল সেখানে —
তারপরও ভালোবাসার চিহ্নগুলি খুঁজেছিলাম দূরের সুবর্ণরেখায়।
৩০. আমার রোদ্রের দিন
এত ভালোবাসা এত ভালোলাগা এত মায়া
ভেবেছিলাম তুমিই আমার সম্পূর্ণ কবিতা হবে,
না হলে না, তুমি অসম্পূর্ণ হয়েই থাকলে।
এত পরিচর্যা এত যত্ন এত জল ঢালা
তবুও একটি সম্পূর্ণ ফুল হয়ে ফুটতে পারোনি
তুমি অপ্রস্ফূটিত করে রাখলে তোমার পাঁপড়ি।
শ্রাবণের মেঘ সব সরিয়ে দিলাম
শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে,
মেঘে মেঘে ভেসে এসে না হতে পারলে জল
না হতে পারলে আমার রোদ্রের দিন।
৩১. যখন তুমি থাকবে না
এই প্রেম তোমার, এই নির্জনতাও তোমার
সমস্ত স্মৃতিতে বিস্মৃতির ধুলো জমবে একদিন
যখন তুমি থাকবে না।
শোক বিহবল শয়ন কক্ষের অসীম নীরবতায়
মন ছুটে চলবে দিগন্তে, যেখানে ওড়ে একাকী চিল
তার ডানা মেলার কোনো শব্দ নেই
মেঘ আকাশ জলরাশি নক্ষত্রমণ্ডলী
প্রত্যেকেই আর্তনাদ করবে তোমার অনুপস্থিতিতে।
পার্কের পাশে পাইন গাছ ছিল
ছাতিম গাছের তলায় নির্জনতাও ছিল
লেকের জল স্থির হয়ে ছিল
দুইজনের নিঃশ্বাস মাতাল করতে পারতো হাওয়া।
অবসর আর কর্মহীন প্রহরে তোমার ছায়া পড়বে না
পাখি কলরব করবে মোয়াজ্জিনের আযান হবে
মন্দিরে শঙ্খধবনি বাজবে, গীর্জায় নিনাদ হবে
এই আকাশ এই নক্ষত্র সবই থাকবে যেখানে আছে
শুধু তুমি থাকবে না।
তখন মাতাল হবেনা কোনো বাতাস
তখন মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকবে না কোনো আকাশ।
৩২. নিষিদ্ধ পদাবলী
যাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। যারা সবচাইতে প্রিয়জন। যাদের জন্য বহুকাল বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। তারাই যদি ঘৃণা করে,
তারাই যদি আর ভালো না বাসে
তারাই যদি মৃত্যু কামনা করে —-
তখনই খুব সুবিধা হয়,
এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবার।
এই সংসার থেকে অনেক দূরে চলে যাবার।
সেই সুদূরের পথ কী খুব বেশি দূর?
কেমন হবে সেই প্রস্থানের ক্ষণ?
কোনো অন্ধকার রাত্রি ?
কোজাগরি চাঁদনি রাত ?
ঝুমঝুম শ্রাবণ বৃষ্টির দিন?
প্রভাত কিরণের উজ্জ্বল সময়?
মর্মর পাতা ঝরার কোনো স্তব্ধ দুপুর?
নাকি সন্ধ্যার অস্তরাগের মুহূর্ত !
জীবন বড়ই নির্ভার মনে হইতেছে।
বাতাসে কোথাও মায়ার শব্দ শুনিতে পাইতেছি না।
নেই কোনো ক্রন্দন ধ্বনিও।
৩৩. জানি নাই
কখন কে এসে আমার পথে এঁকেছিল
তার প্রথম পদচিহ্ন?
কখন আমাকে বলেছিল প্রথম সম্ভাষণ প্রেমের!
তখন প্রণয় বুঝিনি
তখন কুঞ্জবনে পাখিদের গানের অর্থ বুঝিনি
তখন ঝলমল করে উচ্ছসিত হয়নি কাঁচা প্রাণ।
তখন শুনতে পাইনি কোনো জাতিস্মরের বাঁশি
তখন বিন্দু বিন্দু করে ঝরে পড়েনি
কোনো অশ্রু জলের মায়া —
তারপর কখন সেই পায়ের চিহ্ন ধরে তুমি এলে
তারপর বিস্মরণের খেয়ায় পার হবার জন্য
বসেছিলাম দু ‘জন জীবন নদীর তীরে —
এসব তখন কিছুই জানি নাই।
৩৪. সেই বারান্দাটি
তোমাকে ভালোবাসি
এই কথাটি তোমাকে আমি বোঝাতে পারিনি।
যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস ফুল ছুঁয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসি। সেই কথাটি বিশ্বাস করলে না তুমি।
ভালোবাসি এই কথাটি বিশ্বাস করেছিল সেদিনের ঝাউবনের হরিৎ পাতা,
গাঁদা ফুল, শিশির ভেজা ভোরের হাওয়া আর হলুদ প্রজাপতি।
যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে বলেছিলাম ভালোবাসি, সেই বারান্দায় এখন অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
সেই বারান্দাটি এখন আর আমাদের নেই।
৩৫. চাই অমৃতভোগ
শরৎ সন্ধ্যায় আজ রং ছিল
তোমার মনে আজ ঢং ছিল
পরনে লাল শাড়ি ছিল
তোমার সাথে আড়ি ছিল
শরীরটাতে নদীর বাঁক ছিল
পরান তোমাকে ডাকছিল।
রাতের মধ্যে স্বপ্ন আছে
বুকের তলায় রত্ন আছে
রূপবতীর রূপ আছে
স্বপ্নলোকে আলো আছে।
শরৎ রাতে বাজছে গান
লীলাবতীর হাসছে প্রাণ
রাতের রংএ রাঙ্গিল এক রাধা
কৃষ্ণের প্রেমে থাকল না বাধা।
স্পর্শে কা্ঁপল তার দেহলোক
চাই অসীমে যত অমৃতভোগ
এসো তবে তব তাই হোক।
৩৬. উড়নচণ্ডী
ভালোবেসেছিলি ঠিক ছিল
ভালোবাসা দিয়েছি।
কেন আবার বিয়ে করতে চাস?
অভাব সন্তাপ সইতে পারবি তো?
অবহেলা করবি না জানি
অযত্নও করবি না তুই
চোখের জল রাখার মতো আছে তো যমুনা চোখ?
নিতে পারবি শোক?
হাওয়ায় আঁচল উড়ে তোর
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে তোর চুলে
তুই আকাশের নীল দেখিস
স্বপ্ন দেখে তোর চোখ
তুই কি ঘর করতে পারবি এই উড়নচণ্ডীর?
আচ্ছা, আসবি যখন আয়
আগুন যখন লাগিয়েছিস লাগুক
তুই যদি জ্বলতে পারিস আমিও জ্বলব
তুই যদি ছাই হতে পারিস আমিও হব
ভালোবাসা পুড়ুক।
ঘর নেই, দোর নেই!
দুজনেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকব।
রৌদ্র ঝড়ুক। বৃষ্টি পড়ুক।
পাখি হয়ে উড়ে যাব শূন্য দিগন্তে। ফুল হয়ে ফুটে থাকব পুষ্প কাননে।
( এই কবিতাটি যখন আমি লিখেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল একুশ। পুরোনো জীর্ণ খাতা থেকে উদ্ধার করা।
লেখার তারিখ ছিন্ন।)
৩৭. বদলে গেছো
তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধরো। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে।
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।
এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে করো। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাওনা হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাওনা সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হওনা
গান গাওনা
গল্প শোনাও না।
যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে!
সে চোখে আর কোনও মায়া নেই,
জল নেই, ঘুম নেই।
যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে,
সে বুকে এখন ক্লান্তি।
শান্তি নেই।
আদর নেই।
কাছে টানতে অনিহা।
কেমন অবহেলা। কেমন অনাদর ছুঁয়ে আছে…।
৩৮. মহুয়া বনে
চলতে চলতে পথে অচেনা কোনও স্টেশনে
হঠাৎ ট্রেন থেকে নেমে পড়ব
সেখানে দেখব মহুয়া আর আমলকীর বন
কী দারুণ ধূপছায়া গন্ধ ভাসে
চন্দ্রকান্তমণির মতো জ্যোৎস্না-গলা সে গন্ধ।
সময় হয়েছে জেনে চলে যাব প্রস্তুতিহীন
অজানা কোনও পথ ধরে বহুদূর ….
মনে পড়বে অতীত কোনো মধুময় চুম্বনের কথা
প্রতিধ্বনিত হবে বনের গভীরে প্রিয়ের শ্বাস
যে ছিল যে আজ নেই কোথাও।
ঝুমঝুম বৃষ্টির মতো অতৃপ্ত ভালোবাসারা ঝরে যাবে
দীর্ঘশ্বাস বেগ পাবে ধূপছায়ার সেই মহুয়া বনে।
৩৯. অমিমাংসিত ভালোবাসা
আমরা দুজন দুজনের হাত ধরেছিলাম
ভালোবাসার টানে
কেউ না জানুক সে কথা আমাদের মন জানে
কেউ না বুঝুক এর মানে মিথ্যা ছিল না।
কোনও এক হেমন্ত দিনে
এই শহরের ডাক বাক্সে প্রথম চিঠি এসেছিল
বাতাস এসে কথা বলেছিল কানে কানে-
বলেছিল ভালোবাসার কথা,
আজ কেমন আঁধার নেমেছে চারদিকে
নিজেকে দেখাচ্ছে হাভাতে কাঙালের মতো।
কত কথা মনে হয় কত বেহিসেবি চুম্বনের কথা
কত সঙ্গম সম্পূর্ণ হয়েছিল অনাচ্ছাদিত ঘাসের উপর,
শরীর মনের কত ঋণ শোধ হয়েছে
কত অমিমাংসিত ভালোবাসার গল্প করেছি,
দুজন কত যে নয়ন জলে ভেসেছি।
৪০. মধ্যরাতের পংক্তিমালা
মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নের ভিতর কবিতার শব্দেরা কেঁদে ওঠে কবিতার চোখেও ঝরে বিন্দু বিন্দু জল।
পাথর আর ফুল এক নয়। যে কথা আমি কবিতায় লিখি, তা প্রেম নয়, প্রেম আর পরকীয়া এক নয়।
ভালোবাসতে হলে বুকের ভিতরে অজস্র আবেগ থাকতে হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে ভুলও হয়ে যায়।
ভালোবাসার মানুষটির ভিতরটাকে ছুঁতে হয়। যেখানে শ্বাসপ্রশ্বাস তৈরি হয় সেখানে।
হৃদয় ভাঙে, একবার নয়, দুই বার, তিনবারে আর ভালোবাসা হয়না। তখন সে মরে যায়।
তুমি দিয়ে গেছ অনেক কিছু। কান্নার বদলে মেঘলা আকাশ। এখন রাতভর বৃষ্টি হয়।
দিয়েছ পাখিদের ঝরা পালক। কবরের মাটি শ্মশানের দাহ। ধুপের ধোঁয়া আর কর্পুরের গন্ধ।
৪১. স্বপ্নপ্রহরে দেখা মেয়েটি
আমি যখন দূর অরণ্যে উদাস চোখে খু্ঁজছিলাম কোনো এক মানসীকে,
তখন তুমি অপেক্ষায় ছিলে তোমারই বাড়ির আঙ্গিনায়।
তখনও তুমি আমাকে দেখনি,
দেখনি এক স্বপ্নবাজ তরুণের ঝাঁকড়া চুল,
যে কবিতা লিখে নিশীথের চন্দ্রপ্রহরে। যে কবিতায় তুমি কখনই ছিলেনা।
কোনো এক স্বপ্নপহরে তাকে আমি প্রথম দেখলাম,
দেখলাম বাড়ির অলিন্দে বসে থাকা সেই মেয়েটির কাজল কালো চুল
দেখলাম তার আনত চোখ,
দেবী প্রতিমার মতো আ্ঁকা তার দেহখানি
যেখানে শরতের কা্ঁচা রোদ্রের মতো শুভ্র রং ছু্ঁয়ে আছে
দেখলাম সেই স্বপ্ন দেখা মেয়েকে যাকে আমি খু্ঁজেছিলাম স্বপ্নপ্রহরে,
আমার সকল দিনরাত্রিতে, আমার সকল কবিতায়।
৪২. হাজার তারার ভিতর
অনেক আগে অরুন্ধতি হয়ে সে এসেছিল একবার
এখন ছায়ার মতো অন্ধকার!
অনেক আগে যে নদীর ঘাটে ভিড়াতাম নৌকা
এখন সেখানে কেবল ধূঁ-ধূ বালুচর —
অনেক আগে কাঁঠালি চাঁপা ফুটে থাকতো যেখানে
এখন সেখানে বুনো নাগকেশরের গন্ধ।
এখন হেমন্ত এসেছে –
এখন চলে যাবার সময় সেখানে
এখন সেখানে আছে পাকা ধানের মাঠ,
বিস্তৃত সরিষার ক্ষেত –
হলুদ গালিচার উপরে শুয়ে থাকবো
রাতভর চেয়ে থাকবো নক্ষত্রের দিকে,
আর খুঁজবো তোমাকে হাজার
তারার ভিতর।
৪৩. জ্যোতির্ময় করো
আমাদের পদচারণায় চঞ্চল হয়ে উঠিছিল
অরণ্যের বৃক্ষাদি
পল্লবিত হয়ছিল সবুজে শ্যামলে
মধ্যহ্নের সূর্য রশ্মিতে তপ্ত হয়েছিল পর্বতমালা
জলপ্রপাত বেগ পেয়েছিল পাথরে পাথরে
ঝর্নায় স্নাত হয়ে শীতল হয়েছিল দেহখানি।
এখনও সবুজে মাতাল হয় অরণ্য, এখনো উষ্ণ হয়
সেখানকার পাহাড়
এখনও বহে নির্মল বাতাস
এখনও জলপ্রপাতের জলে স্নান করে অনাগত মানুষ
এখনও ঝর্নাধারায় জল ঝরে অবিরত।
এসো আমাকে আলিঙ্গন করো ঐ নদীর মতো
জড়িয়ে ধরো ঐ সাগরের মতো
মিশে যাও ঐ মোহনার মতো
চুম্বন দাও মাতৃক্রোড়ে ঐ দেবশিশুর মতো।
এসো বাহু বন্ধনে-
এসো জ্যোতির্ময় করো ঐ সূর্যের মতো।
৪৪. ভালোবাসা জেগে আছে
সেই কবে রক্ত কণিকায় লুপ্ত হয়েছিল ভালোবাসা
সেই কবে এক্কা দোক্কা খেলতে যেয়ে পায়ে বেজে উঠেছিল ঝুমুর সুরে তোমার ঘুঙুর —
আমার প্রথম গান ধ্বনিত হয়েছিল সেইদিন থেকে।
কেমন যেন মেঘমেঘ ছিল কালরাত
কেমন যেন বৃষ্টিবৃষ্টি ছিল সময় —
কেমন যেন কম্পিত হচ্ছিল শিরা উপশিরা
যেন বিদ্যাপতির রাধিকা নেমে এসেছিল পথে
নিবিড় করে ভিজছিল তোমার আঁচলখানি।
কয়দিন আগে দীপাবলীর সব দীপ নিভে গেছে
দীপ নেই আলো নেই এই রাতে
বৃষ্টি তো আছে, দেখ তুমি —
অন্তরে তোমার ভালোবাসা জেগে আছে।
৪৫. কেউ অপেক্ষায় নেই
কবি হতে চেয়েছি রাত্রিদিন।
দুহাতে পায়রা উড়ায়েছি।
অকাতরে প্রেম নিয়েছি ।
বড়ো করে চুল রেখেছি।
আঁতেল মনে করেছি নিজকে।
লেখার টেবিলে কেটেছে সারাবেলা, চেতনায় দিয়েছি শান।
রাজকুমারের মতো হেঁটে গেছি সহস্র দৃষ্টির সামনে দিয়ে।
পাপবদ্ধতা নয়, একধরণের ভান ছিল, কারোর দিকে ফিরে না তাকানো।
আজ দূর, বহুদূর হেঁটে এসে দেখি কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। দেখি শূন্যতা চারদিক, দেখি কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নেই ।
৪৬. হঠাৎ তুমি ছাড়া
আমি জানি তুমি ছাড়া পুড়ে খাক হয়ে যায়
সবুজের প্রান্তর, ফসলের মাঠ
চৌচির হয়ে যায় উর্বর মাটি
বিরাণ হয়ে যায় লতা গুল্ম বৃক্ষ, সারি সারি তরু।
তুমি না থাকলে গান নেই
গৌরীপ্রসন্নের কলম থেমে যায়
বেটোফোনের ভায়োলিন করুণ সুরে ভেসে যায়
কানে বাজে রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাই
তুমি না থাকলে দূরাগত কোনো নিক্কণ বাজেনা।
সুখ নেই, প্রশান্তির বুক নেই, ভালোবাসা নেই
তুমি না থাকলে শুকিয়ে যায়
দীঘির শান্ত জল,
সব কিছুই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘে মেঘে ভেসে যায়।
আমার সকল মায়া সুধা, হৃদয় গহীনের সকল আকুলতা, সকল ভাবনা,
তিস্তা পারের দু ‘কূলের সকল দীর্ঘশ্বাস-
হঠাৎ তুমি ছাড়া সব কিছুতেই হাহাকার করে ওঠে।
৪৭. আমিই ওর নিঃসঙ্গতা
আমিই ওর নিঃসঙ্গতা। আমিই ওর একাকীত্ব এই অনুভব অনুপ্রবেশ করেছে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। অথবা আমি সেই গন্ধবিধুর বাতাস ভেজা অস্তিত্ব,
যা ভেসে বেড়ায় ওর যাপিতদুঃখে।
সোনালি হলুদ চন্দ্রমল্লিকাদের সূর্যের দিকে চোখ,
শরীর জুড়ে হাসির হিল্লোল।
কিন্তু আমি জানতেই পারি না। এই অনন্ত অন্ধকারের কথা।
আর ওর দিকে তাকিয়ে যেন শুনতে পাই রাতচরা পাখির কান্না।
মুহূর্ত বিলীন হয় অনুকম্পার দিগন্তরেখায়। আমি অনুভব করি মন্দলয়ে… কামনার সুর, আবেগমদির….
আমি ওকে দখল করি চাঁদের আলোয় ভেসে।
বাঁধা দেয়না।
আমি দেখি.. ওই হাসিটি এখন ওর ঠোঁটে … কিন্তু যে কান্না আমি কোনওদিন স্পর্শ করতে পারব না …
কেমন অক্লেশে গড়িয়ে যায় ওর জ্বরতপ্ত গাল দু’টি বেয়ে …
চাঁদের আলো মেখে … স্বর্নীল মুক্তা বিন্দু যত…।
৪৮. মায়াবী ছায়া
কেমন যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ,
পত্র পল্লব।
বৃষ্টির মেঘ কোথাও নেই। বাতাসে জ্বলে উঠছে আগুন। তপ্ত রোদ্রে শুকিয়ে যাচ্ছে জল।
এই উতল রুক্ষ পৃথিবীতে কেমনে তোমাকে ভালবাসা অর্পণ করব?
তর্পণ করব কিভাবে অন্তরের মায়া?
এই নাও আঁজলা ভরা জল।
আমার জীবন একদিন যখন নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তখন তুমি মায়াবী ছায়া হয়ে এসো। আসবে তো নিশ্চয়?
৪৯. বিসর্জন দাও
দূর থেকে তাকে আজ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে
হেঁটে হেঁটে সে এসেছিল আরমানীটোলা থেকে।
নবাব বাড়ির গেটে এসে
থমকে দাঁড়িয়েছিল সে একবার।
আমি তার নাম জানিনা,
সে কি কৃষ্ণা? নাকি দীপালী? নাকি বিজলী?
কপালে তার সিঁদুর ছিল না,
সেকি মীর্জা বাড়ির মেয়ে তবে ?
নাকি সাঁওতাল, হরিজন দাসী কেউ?
মেয়ে তুমি যেই হও, চিত্ত আজ বিমুগ্ধ তোমাকে দেখে।
পায়ে ঝুমঝুম মল বেজেছিল
হাতে ছিল শাঁখারী বাজারের শাঁখা
কানে ঝুলেছিল ঝুমকা , মাথার চুলে চন্দনের গন্ধ
লালবাগের কেল্লার লাল রং মেখে বিস্ময়ে দাঁড়িয়েছিল।
তুমি কি বিসর্জন দেবে এই গঙ্গার জলে?
পার্বতী আজ ফিরে যাবে কৈলাসে মানস সরোবরে
যাবে সে শ্বশুরবাড়ি, শিব সংসারে —
মেয়ে, তোমার তো কোনও শ্বশুরবাড়ি নেই।
যদি সন্ন্যাস হতে হয় হবো , যদি বেদুইন হতে হয় হবো
যদি সাঁওতাল হতে হয় হবো
হরিজন হরিদাশ হতে হলে তাই হবো —
তবুও বিসর্জন দাও এসে তোমাকে আমারই হৃদ যমুনায়।
৫০. কালের দীর্ঘশ্বাস
শতবছর পরে এমনই এক স্থবির বিকেলে
কেউ একজন বিষণ্ণ চোখ মেলে বসে থাকবে
এই বাড়ির বারান্দায়,
অফিস থেকে ফিরে আসবে আমারই মতো কেউ একজন কর্মক্লান্ত শরীরে…
ঐ দুজন আমাদেরই বংশ পরম্পরার কেউ হবে।
অথচ ওরা জানবে না —
শতবছর আগে এখানে এই বারান্দায়
ওদের মতো করে কেউ একজন বসে থাকত মায়াচোখে পথের দিকে ,
কারোর ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।
****
হ্যাপি রহমান
চমৎকার সব কবিতা। কবিতাগুলো আগে ফেসবুকে পড়েছিলাম। অসম্ভব ভালোলাগা সব কবিতা। মন প্রাণ ছুঁয়ে যায়।