তুমি পিশাচ – অনীশ দেব
তুমি পিশাচ
৷৷এক৷৷
আমার চলার কোনও শেষ নেই৷ আমি সত্যিকারের পথিক—পথই যার জীবন৷ আমার চলার পথের যেমন কোনও শেষ নেই, তেমন আমারও কোনও শেষ নেই৷ এমনই আমার জীবন৷
মানুষের সঙ্গে আমার মিল অনেক—কিন্তু আবার গরমিলও প্রচুর৷ আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি৷ তাই বুঝতে পারি মানুষ কেমন হয়৷ অর্থাৎ, মানুষের মন আর চেহারা দুই-ই দেখতে পাই৷ কিন্তু আমাকে কেউ দেখতে পায় না—শুধু অনুভব করতে পারে৷
মানুষ আমার খুব পছন্দের, খুব প্রিয়৷ তাই মানুষ দেখলে আমি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ি৷ এক অদ্ভুত টানে দু, তিন, কিংবা চার টুকরো হয়ে নানান মানুষের ভেতরে আশ্রয় নিই৷ তাই আমার বাসা হল মানুষ—মানুষই আমার ঠিকানা৷ কারও মধ্যে আমি পঞ্চাশ, ষাট কি একশো বছর ধরে থাকি৷ আবার কারও শরীরে থাকি পাঁচ, সাত কি দশ দিন৷ কতদিন কোথায় থাকব সেটা নির্ভর করে আমার মরজির ওপরে৷
যে-যে মানুষের মধ্যে আমি আশ্রয় নিই তাদের মধ্যে অনেকগুলো নতুন-নতুন গুণ দেখা যায়৷ কিন্তু সেই গুণগুলো হয়তো মানুষের চোখে দোষ৷ তাই আমি খুব চেষ্টা করি গুণগুলো আড়াল করে রাখতে৷
কী আশ্চর্য আমার জীবন! মানুষের এত কাছাকাছি আমি বাস করি অথচ তা সত্ত্বেও মানুষ আমাকে ভাবে অমানুষ৷ আমাকে কিছুতেই আপন করে নিতে পারে না৷
আমি জানি, এক ঠান্ডা গভীর অন্ধকার থেকে আমার উৎপত্তি৷ তারপর পথ চলা৷ শুধু পথ চলা৷ আমার বিনাশ বলে কিছু নেই৷ মানুষ আমাকে কখনও-কখনও ধ্বংস করে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই সাময়িক৷ তখন আমি ফিরে যাই সেই ঠান্ডা অন্ধকার গহ্বরে৷ শীতঘুমে সময় কাটিয়ে দিই৷ তারপর…৷
তারপর? তারপর যখন আবার খিদে টের পাই, তেষ্টা টের পাই, মানুষের টান টের পাই—তখন আমি জেগে উঠি৷ শীতঘুম ছেড়ে বেরিয়ে আসি বাইরের আলোর জগতে, লোকালয়ে৷ যেমন এখন৷
ওই তো চোখে পড়ছে একটা বিশাল পাঁচিল ঘেরা এলাকা৷ তার ভেতরে, অনেকটা দূরে, একটা বাড়ি৷ বাড়ি তো নয়, যেন প্রাসাদ৷ না, শুধু প্রাসাদও নয়—তার সঙ্গে রয়েছে ছোট-ছোট কয়েকটা বাড়ি আর ঘিরে থাকা বাগান৷ বাগানে কত বড়-বড় গাছ৷ গাছে কত পাতা৷ সেই পাতার ছায়ায় গাছের নীচটা দিনের আলোতেও অন্ধকার-অন্ধকার দেখাচ্ছে৷ আর সেই অন্ধকারে মাথাচাড়া দিয়েছে অজস্র আগাছা৷
প্রকাণ্ড এলাকাটা রং-চটে-যাওয়া পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ তারই এক জায়গায় সিং-দরজা৷ সব কিছু দেখে মনে হয় রাজা-রাজড়াদের ফেলে যাওয়া বাগান আর প্রাসাদ৷ এককালে তাদের হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া৷ আজ সবই পুরোনো স্মৃতি৷ শুধু রাজবাড়িটা অতীতের সাক্ষী হয়ে চুপচাপ মনের দুঃখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আর তাকে ঘিরে বিষণ্ণ গাছগুলো৷
কিন্তু তাই কী? এখানে এখন কেউ থাকে না তা তো নয়!
কারণ, আমি মানুষের ঘ্রাণ পাচ্ছি৷ একটা-আধটা নয়, অনেক মানুষের৷
শুধু তাই নয়, এত দূর থেকেও আমি কত মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি ছেলেদের গলা, মেয়েদের গলা৷
উঁহু, বাড়িটা পুরোনো জীর্ণ হলেও এখানে অনেক মানুষ থাকে৷ আমাকে ওরা কোন অদৃশ্য টানে টানছে—কাছে টানছে৷
আমি আকাশের দিকে তাকালাম৷
আকাশে মেঘ জড়ো হচ্ছিল সকাল থেকেই৷ তার সঙ্গে দম আটকানো গুমোট৷ বৃষ্টি যে হবে তার গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম৷ এও বুঝতে পারছিলাম, মেঘ আরও ঘন হবে, আরও কালো হবে৷ এখন দেখলাম আকাশটা একেবারে ছাই রঙের হয়ে গেছে৷ আর সেই রং-টা ক্রমশ কালোর দিকে ঢলে পড়ছে৷
বৃষ্টির জল আমার ভালো লাগে না৷ বৃষ্টির জল ওপর থেকে আসে৷ প্রাকৃতিক পবিত্র জল৷ ওই জল গায়ে লাগলে আমরা—মানে, আমি আর আমার মতো যারা—নিস্তেজ হয়ে পড়ি৷ তাই ঠিক করলাম, আপাতত এই বাড়িটায় আমি আশ্রয় নিই৷ অনেক মানুষে ভরা এই আস্তানাটা আমার মন্দ লাগবে না৷
সেদিকে এগোতে গিয়েই সিং-দরজার মাথায় বসানো হোর্ডিং-টা আমার চোখে পড়ল৷ তাতে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে :
রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল
ও, এটা তা হলে স্কুল!
ওঃ, ক’শো বছর আগে যে আমি স্কুলে পড়তে গিয়েছিলাম তা মনে নেই৷ কিন্তু যুগে-যুগে আমি মানুষের কাছ থেকে শিখেছি৷ যখনই আমি কোনও মানুষের শরীর আর মন দখল করেছি তখনই তার সব অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে৷ আমি বহু শতকের প্রাচীন হলেও সবসময় নবীনের কাছাকাছি থেকে শিখেছি৷ তাই প্রাচীন হলেও আমি সবসময় আধুনিক৷
এখনও চিনতে পারোনি আমাকে?
আমি একজন পিশাচ—যার মধ্যে রয়েছে অতি প্রাচীন এক অমানুষ প্রেতাত্মা৷
আমি একা৷ তবে ইচ্ছে হলেই অনেক হতে পারি—অ্যামিবার মতো৷
আর যদি আমি তোমার ওপরে ভর করি, তোমার মধ্যে বাসা বাঁধি, তা হলে তখন তুমি পিশাচ৷ হ্যাঁ, হ্যাঁ—তুমি৷
আকাশ থেকে বৃষ্টির দু-একটা ফোঁটা পড়ল৷
নাঃ, আর দেরি নয়৷ আমি সিং-দরজার দিকে এগোলাম৷ তালাবন্ধ দরজার জং ধরা লোহার রডের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ দারোয়ানরা কেউ আমাকে দেখতে পেল না—কারণ, আগেই বলেছি, আমাকে দেখা যায় না—শুধু টের পাওয়া যায়৷
সুন্দর পিচবাঁধানো রাস্তা আর ঘাসজমির ওপর দিয়ে প্রাচীন বাড়িটার দিকে যাওয়ার সময় আমি হঠাৎই একটা চেনা গন্ধ পেলাম৷ স্কুলবাড়ির দিক থেকেই আসছে গন্ধটা৷
চমকে উঠলাম আমি৷ এ তো আমার মতোই গন্ধ! আমার একজন বন্ধু তা হলে রয়েছে ওই স্কুলবাড়িতে! আমার আগেই আমার মতো কেউ এসে আশ্রয় নিয়েছে এখানে! অথবা আস্তানা গেড়েছে ওই বাড়ির মানুষজনের ভেতরে! আনন্দ আর খুশিতে মনটা নেচে উঠল৷
বৃষ্টির ফোঁটা হঠাৎই জোরে ঝরতে লাগল৷
আর আমিও দেরি না করে ঢুকে পড়লাম স্কুলবাড়ির ভেতরে৷
.
৷৷দুই৷৷
ইতিহাসের ক্লাস এমনভাবে চলছিল যেন টিভির নিউজ চ্যানেলে কোনও রোবট পরপর দুঃখের খবর পড়ে চলেছে৷
রনিতা ম্যাডাম এভাবেই ক্লাস নেন বরাবর৷ আর সেই জন্যই পড়ার দিকে ইলিনার মন ছিল না৷ ও অনুষ্কার কথা ভাবছিল৷ মাত্র সাতদিন হল অনুষ্কা ওদের ক্লাসে ভরতি হয়েছে৷
ইলিনার ডেস্কের ওপরে ইতিহাস বইয়ের পাতা খোলা ছিল৷ তার নীচে একটা রাফ খাতা৷ সেই খাতার শেষ পাতায় ইলিনা বারবার নিজের নাম লিখছিল৷ একবার ইংরেজিতে, আর-একবার বাংলায়৷ বেশ সুন্দর ডিজাইন করে অক্ষরগুলো তৈরি করছিল ও৷ সেগুলোর দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় ওর অলঙ্করণের হাত বেশ ভালো৷
ইলিনার খুব শখ ও ট্যাটু আর্টিস্ট হবে৷ এ পর্যন্ত ও প্রায় চল্লিশটা ট্যাটুর ডিজাইন এঁকেছে—লাল আর নীল কালি দিয়ে৷ সেগুলো একটা বাঁধানো ড্রইং খাতায় আঁকা আছে৷ সেটার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর নিত্য-নতুন নকশার আইডিয়া মাথায় আসে৷
মাঝে-মাঝে ও বন্ধুদের হাতে বা পায়ে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে ছোট-ছোট ট্যাটু এঁকে দেয়৷ অবশ্য বন্ধুদের পারমিশান নিয়ে তবেই৷ একবার গীতাঞ্জলির কনুইয়ের ওপরদিকটায় একটা বাজপাখির ডিজাইন এঁকে দিয়েছিল৷ সেটা রনিতা ম্যাডামের চোখে পড়ে গিয়েছিল৷ গীতাঞ্জলিকে তিনি বেশ বকুনি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু গীতাঞ্জলি ইলিনার নাম বলেনি৷ বরং ট্যাটু আঁকার দায়টা ওর এক কাল্পনিক ভাইয়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল৷
ইলিনার নামের অক্ষরের ডিজাইনগুলো অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো দেখাচ্ছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা সেগুলো বেশ খুঁটিয়ে বিচার করছিল৷ হঠাৎই ক্লাসরুমের খোলা জানলায় একটা শালিখ এসে বসায় ওর সেদিকে চোখ গেল৷
ক্লাসরুমের বাইরের দিকের দেওয়ালে দুটো বড়-বড় জানলা৷ তাতে ঝিলমিল লাগানো বিশাল পাল্লা৷ পাল্লার ওপরে ফুটদুয়েক চওড়া ঝিলমিল বসানো কাঠের পাটি৷ বহু পুরোনো আমলের রাজা-রাজড়াদের বাড়িতে যেমন থাকত৷ রাজা চন্দ্রভানুও বোধহয় সেরকম কেউকেটা কোনও রাজা কিংবা মহারাজা ছিলেন৷ তাঁর সেই রাজপ্রাসাদ প্রায় একশো বছর আগে স্কুল হয়ে গেছে৷
শালিখ দেখতে গিয়ে ইলিনার চোখ গেল অনুষ্কার দিকে৷ মনে হল, ইলিনার মতো ওরও ইতিহাসে মন নেই, আর ও-ও যেন আনমনাভাবে খাতায় আঁকিবুকি কেটে চলেছে৷
অনুষ্কাকে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হয় ইলিনার৷ মাত্র সাতদিন আগে মেয়েটা ক্লাস টেন-এ ওদের সেকশানে এসে ভরতি হয়েছে৷ ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন৷ ঝাড়খণ্ড থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় এসে পড়েছেন৷ তাই অনুষ্কা এই স্কুলে ভরতি হতে পেরেছে৷ নইলে ইলিনাদের স্কুলে ক্লাস টেন-এ কাউকে ভরতি নেওয়া হয় না৷
অনুষ্কাকে দেখতে খুব সুন্দর৷ এত সুন্দর যে, অন্য মেয়েরা যখন-তখন ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ ইলিনার খুব বিশ্বাস, কোনও ফিল্ম ডিরেক্টর ওকে দেখামাত্র সিনেমা কি টিভি-তে চান্স দিয়ে দেবে৷
রনিতা ম্যাডাম আনমনা অনুষ্কাকে খেয়াল করেছিলেন৷ তাই ওকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য ওর দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘অনুষ্কা, তুমি বলো..৷’
অনুষ্কা শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল৷ নিষ্পাপ ফুটফুটে মুখে তাকাল ম্যাডামের দিকে৷
রনিতা ম্যাডাম ক্লাস নাইন-এর কয়েকটা চ্যাপ্টার রিভাইজ করাচ্ছিলেন৷ তাই সম্রাট অশোকের ধর্মের বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন৷
অনুষ্কাকে রনিতা ম্যাডাম জিগ্যেস করলেন, ‘সম্রাট অশোক যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম তফাত কোথায় ছিল?’
রনিতা ম্যাডামের রোগা চেহারা৷ চশমার পিছনে চোখ দুটো বেশ রাগি৷ কপালে ভাঁজ৷ সবসময় ছাত্রীদের হেনস্থা করেন, শাস্তি দেওয়ার ফিকির খোঁজেন৷
ইলিনা বুঝল, আজ অনুষ্কার রেহাই নেই৷ কপালে চূড়ান্ত বকুনি আছে৷ তারপর, যদি কপাল আরও খারাপ হয়, তা হলে ক্লাস সিক্সের রুমের সামনে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷
ইলিনার বুকের ভেতরটা অকারণেই ঢিপঢিপ করতে লাগল৷ ও স্থির চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ অপেক্ষা করতে লাগল৷
কিন্তু কী আশ্চর্য!
অনুষ্কা মিষ্টি গলায় ধীরে ধীরে উত্তর দিল, ‘ম্যাডাম, বৌদ্ধধর্মের তুলনায় অশোকের প্রচার করা ধর্ম অনেক বেশি উদার আর মানবতাবাদী ছিল৷ অশোক তাঁর ধর্মে ব্যক্তিগত জীবন আর সমাজজীবনকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন৷ সেই কারণেই তিনি দান, দয়া প্রভৃতি বারোটি গুণের অনুশীলন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তাঁর প্রচলিত ধর্মে নানা ধর্মের সার কথাগুলো জায়গা পেয়েছিল…৷’
রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন৷ শিকার হাতছাড়া হওয়ার দুঃখের চেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটাই বেশি করে ফুটে উঠল ওঁর মুখে৷ তিনি স্পষ্ট দেখেছেন, মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে খাতায় কী যেন করছিল৷ তা হলে কী করে ওঁর এইমাত্র পড়ানো লাইনগুলো হুবহু বলে দিল!
অনুষ্কা কি ওঁর বলা কথাগুলো খাতায় টুকছিল? তারপর প্রশ্নের উত্তরে সেই লেখাগুলোই রিডিং পড়ে দিল?
কিন্তু উত্তর দেওয়ার সময় মেয়েটা তো খাতার দিকে তাকায়নি!
মরিয়া হয়ে ডায়াস থেকে নেমে এলেন রনিতা ম্যাডাম৷ মেয়েটার খাতাটা একবার দেখা দরকার৷
‘দেখি, তোমার খাতাটা দেখি—৷’ চটপটে পায়ে জানলার পাশ দিয়ে হেঁটে অনুষ্কার কাছে চলে এলেন৷
অনুষ্কা কোনও কথা না বলে ডেস্কের ওপরে রাখা খোলা খাতাটা দিদিমণির দিকে এগিয়ে দিল৷
রনিতা ম্যাডাম দেখলেন৷ পাতা দুটোয় কিছু লেখা নেই৷ শুধু ডানদিকের পাতার নীচের কোনার দিকে কয়েকটা হিজিবিজি দাগ৷
খাতাটা ওকে ফেরত দিয়ে সামান্য ধমকের সুরে ‘বোসো’ বলে ডায়াসের দিকে ফিরে গেলেন৷ ওঁর ফিরে যাওয়ার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা ‘হেরে যাওয়া’ ভাব ছিল৷
ইলিনার খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ ওর মনে হল অনুষ্কা যেন রনিতা ম্যাডামকে পালটা একটা ‘শিক্ষা’ দিল৷ অনুষ্কাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করল ওর৷ ওর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করতেও ইচ্ছে করল৷
কিন্তু সেটা বোধহয় সম্ভব নয়৷ কারণ, প্রথম দিন থেকেই ইলিনা লক্ষ করেছে, অনুষ্কা ভীষণ একা-একা আর চুপচাপ থাকে—কারও সঙ্গে মিশতে চায় না৷ ইলিনা দু-একবার আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কথাবার্তা তেমন এগোয়নি৷
রনিতা ম্যাডাম মঞ্চে উঠে আবার পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ওঁর যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে কেমন যেন চিড় ধরে গিয়েছিল৷ তাই পড়ানোর তাল আর লয় বারবার গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল৷
ইলিনা ভাবছিল, পিরিয়ডটা শেষ হলে বাঁচি৷ কারণ, তারপরই টিফিন৷ তখন অন্তত আধঘণ্টা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে৷
আজ ওর পড়াশোনার মুড নেই৷ শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করছে আর গান শুনতে ইচ্ছে করছে৷ কে জানে কেন—হয়তো আকাশটা মেঘলা বলেই৷ আর তার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মনখারাপের ইন্ধন জোগাচ্ছে৷
হঠাৎই টিফিনের ঘণ্টা পড়ল৷ টিফিনের ঘণ্টার একটা বিশেষ ঢং আছে৷ ছুটির ঘণ্টারও তাই৷ ঠিক ফুটবল খেলায় হাফটাইম আর গোলের বাঁশি বাজানোয় যেমন তফাত থাকে৷
ওদের স্কুলের ঘণ্টাটা দারুণ৷ একতলার বারান্দায় সিলিং থেকে ঝোলানো বড় পিতলের ঘণ্টা—ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো৷ বৃদ্ধ বলাইদা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে সেই ঘণ্টাটা টাইমে-টাইমে বাজিয়ে দেয়৷
টিফিন হতেই গোটা ক্লাসটা স্বাধীন এবং এলোমেলো হয়ে গেল৷ কেউ-কেউ জানলার কাছে চলে গেল৷ আকাশ, বৃষ্টি আর গাছপালা দেখতে লাগল৷ বেশ কয়েকজন মেয়ে স্কুলব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বের করে টিফিন খেতে বসল৷
আজ বৃষ্টির মধ্যে অন্য দিনের মতো একতলার উঠোনে কিংবা বাগানে গিয়ে ছুটোছুটি করে খেলার উপায় নেই৷ তাই অনেকে ক্লাসরুমের লাগোয়া করিডরে গিয়ে হইহুল্লোড় করতে লাগল৷
ইলিনা টিফিনবক্সটা ব্যাগ থেকে বের করে নিল৷ তারপর তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
অনুষ্কা একটা খাতা খুলে তাতে মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছিল৷ ওর দু-পাশে পারমিতা আর সুচন্দ্রা বসে৷ এখন ওরা কেউ সিটে নেই৷ বোধহয় টিফিন খেতে বাইরের করিডরে কোথাও গেছে৷
ইলিনার কেমন একটা জেদ চেপে গেল৷ আজ ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করবেই৷ গায়ে পড়ে হলেও ওর সঙ্গে আজ আলাপ করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷
তাই ইচ্ছে আর জেদ সঙ্গী করে ও সরাসরি অনুষ্কার কাছে চলে গেল৷ ওর ডানপাশের খালি চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘কী করছ?’
অনুষ্কা চোখ তুলে তাকাল ইলিনার দিকে৷
কী সুন্দর গভীর দুটো চোখ! টানা-টানা, ঘন চোখের পাতার সীমানায় ঘেরা৷ হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কাজল পরে এসেছে৷ ওর চোখের মণির ভেতরে চক্রের মতো অনেকগুলো বৃত্ত৷ সেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় বৃত্তগুলো কোন পাতালে চলে গেছে৷
‘একা-একা বসে কী করছ?’ ইলিনা আবার জিগ্যেস করল৷
‘কিছু না৷’ নীচু গলায় অনুষ্কা বলল৷
ওর খাতার দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ সেখানে অদ্ভুত একটা ছবি বারবার আঁকা—ছোট-বড় নানান মাপে৷ একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷
দেখে কোনও একটা প্রতীকচিহ্ন গোছের ছবি বলে মনে হয়৷ অথবা কোনও ট্যাটুর নকশা৷
‘এটা কীসের ছবি?’ ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানতে চাইল৷
‘ও কিছু না…৷’
‘দারুণ হয়েছে কিন্তু৷ অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো৷ তুমি তো জানো আমি ট্যাটুর ডিজাইন আঁকি৷ খাতাটা পরে আমাকে দিয়ো—আমি ডিজাইনটা তুলে নেব৷’
কথাটা শুনেই শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল অনুষ্কা৷ কেমন একটা ভয়ের চোখে তাকাল ইলিনার দিকে : ‘না, না—এটা বাজে ছবি৷ এটার কোনও মানে হয় না৷ ওয়ার্থলেস—৷’
এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্কা ছবিগুলোর ওপরে এলোমেলো কাটা-কুটি দাগ আঁকতে লাগল৷ ছবিগুলো নিপুণভাবে নষ্ট করতে লাগল৷
‘কী করছ! কী করছ! সুন্দর ছবিগুলো নষ্ট করছ কেন?’
কিন্তু অনুষ্কা ইলিনার কথায় মোটেই কান দিল না৷ কাটাকুটি দাগ কাটতে-কাটতেই বিড়বিড় করে বলল, ‘সুন্দর নয়, বাজে ছবি…বাজে ছবি…৷’
ইলিনা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ ওর আলাপের শুরুটা এভাবে ধাক্কা খাবে ও ভাবেনি৷
প্রসঙ্গ পালটাতে ও টিফিনবক্স খুলে ফেলল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ফ্রেঞ্চ টোস্টের জিভে-জল-আনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল৷ মা-মণি টিফিনবক্সে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে৷ একটা খোপে চার পিস ফ্রেঞ্চ টোস্ট৷ তার পাশের খোপে একটা মিষ্টি৷ আর একটা ছোট পলিপ্যাকে টমেটো সস৷
‘এসো, আমার টিফিন শেয়ার করো…৷’
‘টিফিন?’ খানিক যেন দিশেহারা হয়ে ইলিনার দিকে তাকাল অনুষ্কা : ‘টিফিন তো আমার খাওয়া হয়ে গেছে…৷’
ইলিনা বেশ অবাক হয়ে গেল৷ স্কুল বসেছে সকাল এগারোটায়৷ তারপর, চারটে পিরিয়ড শেষ হলে এই টিফিন ব্রেক৷ সুতরাং টিফিন ব্রেকের আগে টিফিন খাওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷ তাহলে অনুষ্কা এসব কী বলছে? ওর টিফিন খাওয়া হয়ে গেছে!
‘কখন টিফিন খেলে তুমি! আমাকে এত বোকা পেয়েছ!’ বন্ধুত্বে ভরা মজার সুরে বলল ইলিনা, ‘নাও, ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাও! আমার মা-মণি ভেজে দিয়েছে—৷’
‘না, মানে…আমার ঠিক খিদে নেই৷’ নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ, তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না…৷’
অনুষ্কার মিষ্টি মুখে কাতর এক অনুনয় ফুটে উঠেছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা আর কিছু বলতে পারল না৷ তবে একইসঙ্গে ওর মনে পড়ল এই ছ’দিনে অনুষ্কাকে ও কোনওদিন টিফিন খেতে দেখেনি৷ অর্থাৎ, অনুষ্কা টিফিন খাচ্ছে এমন দৃশ্য ওর চোখে পড়েনি৷
মুহূর্তের মধ্যে খটকাটা ডিঙিয়ে ও ফ্রেঞ্চ টোস্ট টমেটো সস-এ ছুঁইয়ে কামড় বসাল৷ খেতে-খেতে প্রসঙ্গ পালটে চলে গেল রনিতা ম্যাডামের দিকে৷
‘রনিতা ম্যাডামকে তুমি আজ দারুণ টাইট দিয়েছ৷ আমি ভাবতেই পারিনি তুমি ওই সাডেন অ্যাটাকের মুখে ওরকম ঠিক-ঠিক আনসার দিতে পারবে…৷’
‘উঁ৷’ বলে ছোট্ট একটা শব্দ করল অনুষ্কা৷
‘কী করে পারলে বলো তো!’ ইলিনা বলেই চলল, ‘ফ্যানট্যাস্টিক! তুমি যে ক্লাসে এত মনোযোগ দিয়ে শোনো সেটা তোমাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না…৷’
অনুষ্কা শান্ত চোখে তাকাল ইলিনার দিকে৷ বলল, ‘মনোযোগ দিতে হয় না৷ আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’
ইলিনা ফ্রেঞ্চ টোস্টে কামড় দিতে গিয়ে থমকে গেল৷
‘আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে’ মানে?
সে-কথাই ও জিগ্যেস করল, ‘ ‘‘আমাদের’’ বলছ কেন? আমাদের মানে?’
চমকে উঠল অনুষ্কা৷ তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘আমাদের মানে আমার৷ আমার এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’ কথা শেষ করে হাসল৷
ইলিনা অবাক চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ একে তো অপরূপ সুন্দরী, তার ওপর এত গুণ! বাব্বাঃ! এমনিতেই সব মনে থাকে!
ভগবানের ওপরে রাগ হল ইলিনার৷ একজনকে উজাড় করে সবকিছু দেওয়ার কী দরকার ছিল? মনে থাকার ব্যাপারটা তিনি যদি কাইন্ডলি ইলিনাকে দিতেন তা হলে পরীক্ষার রেজাল্টটা অনেক ভালো হতে পারত৷ বাপি আর মা-মণির কাছ থেকে রেগুলার বকাবকি শুনতে হত না৷
জানলার ফ্রেমে বাঁধানো আকাশটা আরও কালো হয়ে গিয়েছিল৷ বিদ্যুৎ সেই কালোর ওপরে মাঝে-মাঝেই সাদা তরোয়াল ঘোরাচ্ছিল৷
ইলিনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখবে, ছুটির সময় ঠিক বৃষ্টি হবে৷ তুমি ছাতা এনেছ তো? আমি এনেছি…৷’
অনুষ্কা হাসল : ‘হ্যাঁ, এনেছি৷ ছাতা ছাড়া আমি চলতেই পারি না৷ তা ছাড়া বৃষ্টি আমার একদম ভালো লাগে না…৷’
‘কেন?’
বৃষ্টি পড়ছিল—তবে তেমন জোরে নয়৷ সেদিকে অপছন্দের চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ বলল, ‘পরিবেশবিদরা বলেন, বৃষ্টির জলে অ্যাসিড থাকে…৷’
‘যাঃ, সে তো রেয়ার! তোমার এটা ভুল ধারণা—৷’
‘ভুল ধারণা হোক আর যা-ই হোক, বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’
মেঘের গর্জন শোনা গেল আকাশে৷
.
৷৷তিন৷৷
স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান আর বেশি দূরে নেই—মাত্র দু-মাস বাকি৷ নাচ, গান, আবৃত্তি আর নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে৷ স্কুলের যে-কোনও কালচারাল প্রোগ্রামে শম্পা ম্যাডাম আর কাকলি ম্যাডাম সবসময় দায়িত্ব নেন৷
শম্পা ম্যাডাম বেশ লম্বা, খুব সুন্দর নাচতে পারেন৷ আর সবসময় মুখে হাসি৷
কাকলি ম্যাডাম মাথায় খাটো৷ মোটাসোটা৷ মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন ফাটাফাটি৷ কিন্তু ওঁর ভীষণ ভূতের ভয়৷
ইলিনাদের কালচারাল প্রোগ্রামের রিহার্সাল হয় ফেস্টিভ্যাল হলে৷ হলটা বিশাল বড়৷ ওলটানো ‘ভি’ অক্ষরের মতো টিনের চালে ঢাকা৷ অনেক সময় ছোটখাটো প্রোগ্রাম হলে এই হলঘরটাতেই সেরে নেওয়া হয়৷ কিন্তু স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান মানে ঘ্যাম ব্যাপার৷ তখন খেলার মাঠে প্রকাণ্ড প্যান্ডেল বাঁধা হয়৷
গত বছর ইলিনারা ফেস্টিভ্যাল হলে সন্ধেবেলা গানের রিহার্সাল দিচ্ছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ওদের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র গানগুলো তোলাচ্ছিলেন৷ তখন পাশের বাস্কেটবল গ্রাউন্ড থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে এসেছিল৷
স্কুলের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডটা বড় মাপের, কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো৷ তার চারপাশটা লোহার জালের উঁচু রেলিং-এ ঘেরা৷ যখন খেলা-টেলা থাকে না তখন গ্রাউন্ডে ঢোকার লোহার গেটটায় তালা দেওয়া থাকে৷ সেদিনও তাই ছিল৷ তবুও সেখান থেকে ভেসে আসছিল খটখট-খটখট শব্দ৷ যেন অনেকগুলো টগবগে ঘোড়া বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিটের মেঝেতে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে৷
এরপর ওদের গানের রিহার্সাল ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল৷
ইলিনা স্কুলের কাজের মাসি আশাদির কাছে শুনেছে, এই স্কুলটা নাকি সাহেবি আমলে সৈন্যদের ছাউনি ছিল৷ স্কুলের বিশাল এলাকার নানান সব বিল্ডিং-এ সৈন্যরা থাকত৷ আর মেইন স্কুল বিল্ডিংটা ছিল হেস্টিংস সাহেবের কোয়ার্টার৷ একসময় হেস্টিংস রাজা চন্দ্রভানুকে এই বিশাল সম্পত্তি নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেন৷
এই স্কুল ক্যাম্পাসে যে সন্ধেবেলা কখনও-সখনও ভূতুড়ে কাণ্ড শুরু হয় এমন দুর্নাম বরাবরই ছিল৷
কখনও মাঠের বড়-বড় গাছপালার ফাঁকে আলোর ফুটকি দেখা যায়৷ সেগুলো খসে পড়া তারার মতো ছুটোছুটি করে বেড়ায়৷
কখনও বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়৷
একবার ক্লাস টেন-এর একটা মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে আর-একটা মেয়েকে নীচে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল—কিন্তু মেয়েটির পড়ার কোনও শব্দ শোনা যায়নি বা একতলায় ছুটে গিয়ে কোনও বডি পড়ে থাকতে দেখা যায়নি৷
কিন্তু এতসব গুজব, রটনা কিংবা দুর্নাম থাকলেও স্কুলটা যে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার কারণ পড়াশোনা৷ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুলের রেজাল্ট বরাবরই ঈর্ষা করার মতো৷
আজ অ্যানুয়াল ফাংশানের গানের রিহার্সাল চলছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে একটা গান তোলাচ্ছিলেন৷ পাশে বসেছিলেন শম্পা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ রবিনা ম্যাডাম খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারেন৷ ইলিনাদের প্রোগ্রামে সঞ্চালনা আর আবৃত্তির ব্যাপারটা তিনিই দেখাশোনা করেন৷ ম্যাডামের বয়কাট চুল আর মুখে কয়েকটা বসন্তের দাগ আছে বলে ওঁকে একটু রুক্ষ দেখায়৷ তবে ওঁর ব্যবহার খুব মিষ্টি আর দারুণ সাহস৷ একবার নাকি হেডমিসট্রেসের ভূতের ভয় তাড়াতে সন্ধে সাতটার সময় টর্চ ছাড়াই অন্ধকারে গোটা ক্যাম্পাসটা চক্কর দিয়ে এসেছিলেন৷
রবিনা ম্যাডাম ইলিনাদের সবসময় বলেন, ‘শোন, ভূত বলে কিছু নেই৷ আসলে তোরাই এক-একটা ভূত৷’
তখন ক্লাসের আর-একটি মেয়ে, সজনী, ফোড়ন কেটে বলে উঠেছিল, ‘ভূত না, ম্যাডাম—পেতনি…৷’ তাতে ক্লাসের সবাই হেসে উঠেছিল৷ আর রবিনা ম্যাডামও হাসি চাপতে পারেননি৷
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল৷ মেঘও ডাকছিল আপন খেয়ালে৷ হলের টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ হচ্ছিল৷ খোলা জানলা দিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিক চোখে পড়ছিল৷
হলের মেঝেতে বিশাল মাপের তিনটে শতরঞ্চি পাতা৷ তার ওপরে সবাই বসেছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে গান তোলাচ্ছিলেন আর ইলিনারা দশ-বারো জন একটু দূরে বসে নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় গল্পগুজব করছিল৷
হঠাৎই ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওদের৷ মনে হল, বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিট বাঁধানো চাতালে যেন অনেকগুলো ঘোড়া এলোমেলোভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে৷
ইলিনা চমকে উঠল৷ ওর মনে পড়ল, প্রায় বছরখানেক এই শব্দটা শোনা যায়নি৷
শব্দটা যে কাকলি ম্যাডামও শুনতে পেয়েছেন সেটা বোঝা গেল৷ কারণ, তিনি গান থামিয়ে দিয়েছেন৷ আশা-আশঙ্কার চোখে রবিনা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ যেন ভূত তাড়াতে রবিনা ম্যাডামই একমাত্র ভরসা৷
ইলিনার পাশে বসে ছিল সমর্পিতা—সম্পি৷ ওর দশাসই মোটাসোটা চেহারা, আর ডাকাবুকো বলে স্কুলে বেশ খ্যাতি আছে৷
সমর্পিতা এমন লম্বা-চওড়া যে, স্কুল-ইউনিফর্ম পরে থাকলেও ওকে ইলিনাদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড় বলে মনে হয়৷ লেখাপড়া ছাড়া অন্য যে-কোনও কাজে ওর উৎসাহ অনেক বেশি৷ স্কুলের সবরকম অ্যাক্টিভিটিতে সম্পি সবার আগে হাজির৷ দিদিমণিদের কোনও ব্যক্তিগত কাজের জন্যেও ওর ডাক পড়ে৷ দিদিরা সবাই ওকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন৷ আর বন্ধুদের মতো ওর বড় মাপের নামটাকে ছোট করে ‘সম্পি’ বলে ডাকেন৷
ইলিনা সম্পির গায়ে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে বলল, ‘কী রে, কীসের আওয়াজ?’
সম্পি বলল হাত নেড়ে, ‘ছাড় তো, ও কিছু নয়৷ ওই লাস্ট ইয়ারে যেমন শোনা গিয়েছিল৷ তারপর খোঁজ নিয়ে দেখবি হয়তো কাকু কিংবা মাসিদের কোয়ার্টারে কোনও ছেলেপিলে মেঝেতে নারকোলের মালা ঠুকে আওয়াজ করে খেলছে…৷’
এটা ঠিকই যে, স্কুলের অনেক কর্মী—বলাইদা কিংবা আশাদির মতো—ক্যাম্পাসের মধ্যেই সংসার নিয়ে কোয়ার্টারে থাকে৷ টিনের চালে ছাওয়া ছোট-ছোট পাকা ঘরগুলোই ওদের কোয়ার্টার৷ ওদের কোনও ছেলেমেয়ে এই ভূতুড়ে কাণ্ড করতেই পারে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ইলিনার তেমন ভরসা হচ্ছিল না৷
যেন ওকে সাহস দিতেই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল৷ তারপর গটগট করে পা ফেলে এগিয়ে গেল খোলা জানলার দিকে৷
কাকলি ম্যাডাম ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সম্পি, কী করছ! যেয়ো না, যেয়ো না…৷’
ম্যাডামের কথা সমর্পিতা শুনল না৷ জানলার কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং ওর পিছু-পিছু রওনা হল ইলিনা, সজনী আর অঙ্গনা৷
ভয় যে ওদের করছিল না তা নয়—কিন্তু কৌতূহলটাও কিছু কম ম্যাথাচাড়া দিচ্ছিল না৷
রবিনা ম্যাডামের ভয়-টয়ের কোনও বালাই নেই৷ তিনিও কখন যেন ইলিনাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ অন্য মেয়েরা তখন শতরঞ্চিতে বসে ভয় আর কৌতূহলের চোখে ইলিনাদের দিকে দেখছে৷
জানলার বাইরে বৃষ্টি আর অন্ধকার৷ আকাশে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক৷ তারই মধ্যে নজর চালিয়ে সম্পি ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ আসছে ঠিকই, কিন্তু সাদা আলোর দু-একটা বিন্দুও চোখে পড়ছে যেন৷ মাপে জোনাকি পোকার মতো, কিন্তু অনেক উজ্জ্বল৷ বিন্দুগুলো চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক ছিটকে বেড়াচ্ছে৷
আকাশে গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকল৷ কিন্তু তাতে ঘোড়ার টগবগ শব্দ চাপা পড়ল না৷
অঙ্গনা জিগ্যেস করল, ‘ওই আলোগুলো কীসের? মনে হচ্ছে কারা যেন মিনি সার্চলাইট জ্বেলেছে৷’
একইসঙ্গে ইলিনা টের পেল অঙ্গনা ওর গায়ের কাছে সরে এসেছে৷
সমর্পিতা বলল, ‘কীসের আলো সেটা গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে৷’
কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়ামের কাছে বসেছিলেন৷ সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না, না—যাওয়ার কোনও দরকার নেই৷ তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে দেখছ না!’
রবিনা ম্যাডাম জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন৷ সেদিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘এমন কিছু বৃষ্টি পড়ছে না—৷’
এ-কথা শেষ হতে-না-হতেই সম্পি দৌড়ল হলের দরজার দিকে৷
পিছন থেকে কাকলি ম্যাডাম, অঙ্গনা, ইলিনা সবাই ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে ডাকতে লাগল৷
কিন্তু সেসব ডাক সম্পির কানে বোধহয় ঢুকল না৷ ও ততক্ষণে হলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে৷
রবিনা ম্যাডাম আর দেরি করলেন না৷ সম্পির পিছন-পিছন দৌড়লেন৷ আর ওঁর সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল ইলিনা আর সজনী৷
বাইরেটা অন্ধকার, জলে ভেজা৷ সামনে পিচের রাস্তা, তারপর ছোট্ট একটা পার্কের মতো৷ এই পার্কে পতাকা তোলার ফাংশান হয়৷
পার্কের চারপাশের রেলিং বেশ খাটো৷ ওরা দেখল, শর্টকাট করার জন্য সম্পি লাফিয়ে পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছে গেছে৷ ইলিনা আর রবিনা ম্যাডামরা পার্কটাকে পাশ কাটিয়ে সম্পিকে ধরার জন্য দৌড়ল৷
পার্ক পেরিয়ে একটা সবুজ মাঠ৷ তারপর বাস্কেটবল গ্রাউন্ড৷ সম্পি সেখানে পৌঁছে কয়েক লহমা দাঁড়াল৷ তারপর রেলিং ঘিরে দৌড়তে যাবে তখনই রবিনা ম্যাডাম ওকে ধরে ফেলল৷ একটু পরেই ইলিনা আর সজনী সেখানে পৌঁছে গেল৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের রেলিং উঁচু, তাই সেটা ডিঙোনোর প্রশ্ন ওঠে না৷ সেইজন্যই সম্পি বোধহয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ ভাবছিল এরপর কী করবে৷ তা ছাড়া ঘোড়ার খুরের আওয়াজটা এখন আর শোনা যাচ্ছিল না৷
কিন্তু সাদা আলোর বিন্দুগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷
স্কুল-ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে৷ রাস্তার একপাশে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইটপোস্ট৷ তার ঝিমিয়ে পড়া আলো অন্ধকারের সঙ্গে অসম লড়াই করছে৷
ওরা সবাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভিজছিল আর হাঁপাচ্ছিল৷ তাকিয়ে ছিল খাঁ-খাঁ বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে৷ রাস্তার আলো সেখানে ছিটকে এসে পড়েছে৷ কংক্রিটে বাঁধানো গ্রাউন্ড বৃষ্টির জল পড়ে চকচক করছে৷
রবিনা ম্যাডাম বললেন, ‘এবার ফিরে চল৷ ওই ঘোড়ার খুরের শব্দ…ওটা হয়তো ভুল শুনেছি৷ তা ছাড়া ওটা শুধু শব্দ…ভয়ের কিছু নেই৷ তোদের কাকলি ম্যাডাম একটুতেই ভয়-টয় পায়৷ চল…৷’
রবিনা ম্যাডামের কথার পিঠে সমর্পিতা বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম, ম্যাডাম৷ কিন্তু ওই আলোগুলো কীসের? এখন দেখছেন, ওগুলো কেমন এদিক থেকে ওদিকে লাফাচ্ছে!’
সত্যিই তাই৷ আলোগুলো এখন লাফিয়ে উঁচু থেকে নীচে নামছে, আবার নীচ থেকে লাফিয়ে ওপরে উঠছে৷ কখনও ওগুলো আবার দপ করে নিভে যাচ্ছে৷
রবিনা ম্যাডাম একটু ইতস্তত করলেন৷ বোধহয় ভাবলেন, ছাত্রীর কাছে সাহসের পরীক্ষায় তিনি হেরে যেতে চান না৷ তাই বললেন, ‘চল তা হলে, একবার কাছ থেকে দেখে আসি…৷’
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডকে পাশ কাটিয়ে ওরা এগিয়ে গেল৷ সামনে বড়-বড় গাছপালা, আর তার পরেই বিশাল খেলার মাঠ৷ এই মাঠে খেলাধুলো ছাড়াও স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস হয়৷ সেই মাঠটার একপাশে প্রায় তিনতলা সমান উঁচু একটা প্রকাণ্ড গাছ আছে৷ ওই গাছটা দেখলেই ইলিনার ভয় করে৷ কারণ, অত বড় গাছটায় একটিও পাতা নেই৷ শুধু অসংখ্য শুকনো ডালপালা কঙ্কালের মতো আকাশের দিকে ছড়িয়ে গেছে৷ হঠাৎ করে মনে হয়, কেউ যেন একশো হাতের পাঁচশো আঙুল আকাশের দিকে তুলে ভগবানের কাছে মুক্তি চাইছে৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ড পেরিয়ে গাছপালার গাঢ় অন্ধকার এলাকায় ঢুকে পড়ল ওরা৷ ইলিনার এবার বেশ ভয় করছিল৷ মনে হচ্ছিল, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ওরা কোনও অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে৷
গাছপালার পাতায় বৃষ্টি আটকালেও পাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছিল৷ সজনী ইলিনার হাত চেপে ধরেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এইভাবে ওদের শরীরে আর মনে ভরসার আদানপ্রদান হচ্ছিল৷
সমর্পিতা রবিনা ম্যাডামকে বলল, ‘ওই দেখুন ম্যাডাম, আলোগুলো আরও কতটা দূরে…৷’
‘মনে হয়, ওই মরা গাছটার কাছে…৷’ রবিনা ম্যাডাম বললেন৷
ওরা জলের ওপরে পায়ের ছপছপ শব্দ তুলে এগোতে লাগল৷
আরও অনেকটা এগোতেই ওরা দৃশ্যটা ঠিকঠাক দেখতে পেল৷ কারণ, সেই মুহূর্তেই আকাশে নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে, আর বাজ পড়ার শব্দ কানে আসার আগেই ওরা শুনতে পেল খিলখিল হাসির শব্দ৷
মরা গাছটা ইলিনাদের কাছ থেকে এখন অন্তত তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে৷ কিন্তু তার জন্য দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
তিনটে প্রাণী ওই মরা গাছটার ডালে নানান উচ্চতায় উবু হয়ে বসে আছে৷ তাদের প্রত্যেকের মাথায় ছাতা৷ আর ছাতার নীচের অন্ধকারে দুটো করে সাদা আলোর চোখ জ্বলছে৷
ওরা খিলখিল করে হাসছে আর বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো এ-ডাল থেকে সে-ডাল লাফাচ্ছে৷ কখনও লাফিয়ে ভিজে মাঠে নেমে আসছে, কখনও-বা মাঠ থেকে সোঁ করে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে ডালে৷ ওদের হাতে ধরা ছাতাগুলো অনেকটা প্যারাশুটের মতো লাগছে৷
সজনী ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠতেই ইলিনা চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিল৷
রবিনা ম্যাডাম মরা গাছটার দিকে চোখ রেখেই ভয়ের গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ওগুলো কী—মানুষ, না পশু?’
প্রশ্নটা কাকে লক্ষ্য করে সেটা বোঝা যায়নি বটে কিন্তু সমর্পিতা উত্তর দিল, ‘ওগুলো মানুষ নয়, ম্যাডাম৷ মনে হচ্ছে, খারাপ কিছু…৷’
সেই ‘খারাপ কিছু’-টা যে কী সেটা ওরা চারজন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল৷
এমন সময় আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল৷ ওদের হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল৷ তারপরই বাজ পড়ার বিকট শব্দে সেটা কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়ে গেল৷
ইলিনারা অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে সেই অলৌকিক সার্কাস দেখতে লাগল৷
সজনী কাঁপা গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ফিরে চলুন৷ আমার…আমার ভয় করছে…৷’
‘ফিরে যাব কেন?’ বকুনির সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রবিনা ম্যাডাম৷ আঁচলে জড়ানো হাতের মুঠোয় ধরা টর্চটা বের করে মাটির দিকে তাক করে জ্বেলে ধরলেন৷ টর্চের জোরালো সাদা আলোয় বৃষ্টি-ভেজা ঘাস আর পাতা চোখে পড়ল৷ রবিনা বললেন, ‘আমরা চারজন আছি—ভয় কীসের! আমরা সবাই মিলে তাড়া করলে ওরা…মানে, ওই অ্যানিম্যালগুলো পালাবে৷’
রবিনার কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটা চমকে ওঠা ঘটনা ঘটে গেল৷ সমর্পিতার ভেতরে কেউ যেন আচমকা সাহস এবং অ্যাকশনের সুইচ অন করে দিল৷ মেয়েটা ‘অ্যাই, তোরা কে রে?’ বলে কান-ফাটানো চিৎকার করে ভেজা মাঠের ওপর দিয়ে মরা গাছটা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচাতে লাগল৷
রবিনা ম্যাডাম ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন৷ তারপর টর্চ জ্বেলে সেটাকে সামনে পিস্তলের মতো বাগিয়ে ধরে সম্পির পিছন-পিছন ছুটতে শুরু করলেন৷ অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা চেহারায় দশাসই হলেও বেশ জোরে ছুটতে পারে দেখছি!
রবিনা ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করছিলেন আর ইলিনাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সার যাচ্ছিলেন৷
ইলিনা আর সজনী ভয় পেয়ে গেল৷ কারণ, ওদের দুই সাহসী সদস্য এখন আর ওদের পাশে নেই৷ তাই ওরাও রবিনা ম্যাডামকে লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করতে লাগল৷
ওদের চারজনের চিৎকারে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে লোকজন বেরিয়ে এল৷ কিন্তু অন্ধকার আর বৃষ্টির জন্য ওরা ভালো করে কিছু ঠাহর করতে পারছিল না৷
সম্পিদের ‘চোর! চোর!’ চিৎকারে প্রাণীগুলো কিন্তু মোটেই ভয় পায়নি৷ বরং ওদের হাসাহাসি আর লাফালাফির খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সম্পি খুব কাছাকাছি এসে পড়তেই ওরা লাফিয়ে মাটিতে নামল৷ তারপর হাসি বন্ধ করে মাথার ওপরে ছাতা ধরে স্থির হয়ে দাঁড়াল৷
রবিনা ম্যাডাম সম্পিকে প্রায় ধরে ফেলেছিলেন৷ শাড়ি পরে থাকলেও ওঁর অ্যাথলেটিক শরীর ওঁকে দ্রুত দৌড়তে সাহায্য করছিল৷
ঘোলাটে অন্ধকারে রবিনা প্রাণীগুলোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলেন না৷
সম্পি রবিনার তুলনায় খানিকটা এগিয়ে ছিল৷ কিন্তু ও-ও ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিল না৷ শুধু গাঢ় কালচে তিনটে ছাতার নড়াচড়া বুঝতে পারছিল৷
যদি ওরা প্রাণীগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পেত তাহলে আর এগোত না৷
এমন সময় আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরপর দু-বার৷
সম্পিরা দেখতে পেল ওদের৷ সঙ্গে-সঙ্গে ডাকাবুকো সম্পি আর রবিনা ম্যাডাম থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ ওঁদের চিৎকার থেমে গেল৷
ছাতার নীচে তিনটে ফ্যাকাশে সাদা বিকৃত মুখ৷ চোখগুলো পুরোটা কালো—তাতে সাদা অংশ বলে কিছু নেই৷ শুধু মাঝখানে দুটো উজ্জ্বল আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ ওদের ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল—যেন লিপস্টিকে রাঙানো৷ তিনজনেরই ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে আছে৷ আর সেই ফাঁক দিয়ে ওদের দাঁত দেখা যাচ্ছে৷ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসানো ঝকঝকে ইস্পাতের দাঁত৷ দাঁতগুলো মাপে ছোট, কিন্তু অসংখ্য৷
এরা কারা? কোথা থেকে এল এখানে?
বিদ্যুতের আলো নিভে গেল৷ চারপাশ আবার ছায়া-অন্ধকার৷
রবিনা ম্যাডামের হাত থরথর করে কাঁপছিল৷ সেই কাঁপা হাতে তিনি টর্চের আলো ছুড়ে দিলেন একজনের মুখে৷ তারপর আর-একজনের৷ তারপর…৷
আবার দেখা গেল সেই ভয়ংকর মুখ৷ আরও ভয়ংকর ওদের পোশাক৷
একজনের পরনে রঙিন শাড়ি৷ আর অন্য দুজনের গায়ে স্কুল-ড্রেস৷ সবুজ স্কার্ট আর সাদা টপ৷ মাথায় জোড়া বিনুনি করে ফিতে বাঁধা৷
টর্চের আলোয় সাদা টপে রক্তের দাগ চোখে পড়ল যেন৷
সঙ্গে সঙ্গে সম্পি ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷
রবিনা ম্যাডামের গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছিল না৷ ওঁর হাতে ধরা টর্চের আলোটা ভীষণ কাঁপছিল৷ তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল আবার৷ তারপর কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল৷ বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হল৷
তিনটে মানুষ—কিংবা অমানুষ—আচমকা শূন্যে লাফ দিল৷ হাউইবাজির মতো ছিটকে চলে গেল দূরে৷
তারপর আবার লাফ৷ আরও দূরে৷
শেষে মিশে গেল অন্ধকারে৷
এরকম লাফ মানুষ দিতে পারে না৷
একটা অদ্ভুত ‘গোঁ-গোঁ’ শব্দ করে রবিনা ম্যাডাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন৷ ওঁর হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল দূরে৷
সম্পি ওঁর শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়ে ‘ম্যাডাম! ম্যাডাম!’ বলে ডাকতে লাগল৷ পিছনে তাকিয়ে দেখল অনেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ ফেস্টিভ্যাল হলের আলো আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের আলোর পটভূমিতে মানুষগুলোর ছায়া দেখা যাচ্ছে৷
.
৷৷চার৷৷
পরদিন স্কুলে হইচই যেটা হল সেটার ধরনটা অনেকটা ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো৷
মেয়েদের মধ্যে চাপা ফিসফাস, তর্কবিতর্ক চলতে লাগল৷ আর সমর্পিতাকে ঘিরে যত উত্তেজনা, যত আলোড়ন৷ ও যেন সাহসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছে৷ ওকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ভিড়৷ তারপর হালকাভাবে ঘেরাও হয়েছে ইলিনা, সজনী, আর রিহার্সালে হাজির থাকা বাকি মেয়েরা৷
ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে কিংবা ক্লাসের মধ্যেই সম্পিকে একই কাহিনি বারবার বলতে হচ্ছে৷ অন্য মেয়েরা এক-একটা ক্লাসের পর পালা করে বসার জায়গা পালটে সম্পির পাশে গিয়ে বসছে৷ এইভাবে গতকাল রাতের ভয়ংকর কাহিনি ছড়িয়ে গেল প্রায় সব ক্লাসেই৷
স্কুলের হেডমিসট্রেস মিসেস প্রীতি দত্ত বেশ রাশভারী মানুষ৷ মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা৷ ওঁকে খুব কম সময়েই হাসতে দেখা যায়৷
তিনি সকাল থেকে প্রতিটি ক্লাসে ভিজিট করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি গুজব না ছড়ায়৷
ইলিনাদের ক্লাসে হেডমিসট্রেস এলেন৷ তখন কাকলি ম্যাডামের বাংলা ক্লাস চলছিল৷ ছাত্রীদের লক্ষ করে বড়দি বললেন, ‘শোনো, মেয়েরা৷ কাল রাতে যা হয়েছে সেটা আমার কানে এসেছে৷ ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, সিম্পলি একটা…মানে…অ্যাক্সিডেন্ট৷ একে তো রাত, তার ওপরে মেঘ-বৃষ্টি৷ বুঝতেই পারছ ব্যাপারটা হ্যালুসিনেশান…মানে, দেখার ভুল হতে পারে৷ তা ছাড়া রবিনার তো শরীর ভালো নয়—লো প্রেশারে ভোগে৷ তাই ও হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেছে…৷
‘যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে তোমরা কারও সঙ্গে আর আলোচনা কোরো না৷ বরং বেস্ট হবে, যদি তোমরা সবাই এই ইনসিডেন্টটা ভুলে যাও৷ তা না হলে কথার পিঠে কথা ছড়াবে…তারপর কোন সময় দেখবে পুলিশ আর টিভি চ্যানেলের লোকজন স্কুলে এসে হাজির হবে, আর হাজারটা কোয়েশ্চেন করে আমাদের সবাইকে জ্বালিয়ে খাবে৷ তা ছাড়া আমাদের স্কুলের একটা নামডাক আছে৷ সম্মান আছে৷
‘তা হলে মনে থাকবে তো? ব্যাপারটা আর কিছুই নয়…রাতবিরেতে দেখার ভুল৷ বুঝলে?’
ক্লাসের সব মেয়ে একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মনে থাকবে, বড়দি৷’
কাকলি ম্যাডামও কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় কাত করলেন৷
হঠাৎই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল : ‘বড়দি—৷’
প্রীতি দত্ত ভুরু কুঁচকে বড়সড় চেহারার ছাত্রীটির দিকে তাকালেন৷
ইলিনা আর সজনীর বুক দুরদুর করে উঠল৷ ওরা আঁচ করতে পারল সম্পি কী বলতে চলেছে৷ এই বোধহয় ও বড়দির বকুনি খেল!
‘বড়দি, আমি কাল রাতে রবিনা ম্যাডামের সঙ্গে ছিলাম৷’
‘হ্যাঁ৷ জানি৷ তো?’ ভুরুজোড়া আরও কাছাকাছি চলে এল৷
‘রবিনা ম্যাডাম…অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন৷ আমি হইনি৷ আমি…সবটা নিজের চোখে দেখেছি—৷’
‘হ্যাঁ, শুনেছি৷ রবিনা বলেছে৷ কিন্তু এখন আর কোনও কথা শুনতে চাই না৷ তুমি, ইলিনা আর সজনী বরং টিফিনের সময় আমার রুমে এসো—তখন সব শুনব, আর আমার যা বলার বলব৷’ চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে নাকের ওপরে বসালেন প্রীতি দত্ত : ‘মোট কথা, এ-ব্যাপারে যেন একটা শব্দও বাইরে না যায়৷ আমাদের স্কুলের সুনামই হচ্ছে প্রথম এবং শেষ কথা৷ বুঝেছে?’ শেষ শব্দটায় ধমকের সুর আরও স্পষ্ট শোনাল৷
সমর্পিতা বেশ দমে গেল৷ ওর মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল৷ আর কোনও কথা না বলে ও গুম হয়ে বসে পড়ল৷ কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে একটা রাগ তৈরি হল৷ সবকিছু ও নিজের চোখে দেখেছে৷ তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা ওকে ‘দেখার ভুল’ বলে মানতে হবে!
এটা ঠিকই যে, আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল, অন্ধকার ছিল৷ কিন্তু বিদ্যুতের আলোও তো ছিল! তার সঙ্গে টর্চের আলো৷ তা ছাড়া ওদের চোখগুলো জ্বলছিল!
বড়দি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সজনী আর ইলিনা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে সম্পির দু-পাশে এসে বসে পড়ল৷ তারপর চাপা গলায় ফুসুর-ফুসুর শুরু করল৷ টিফিনের সময় বড়দির মুখোমুখি হওয়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ কাকলি ম্যাডামের ক্লাসের দিকে ওদের আর মন রইল না৷
সম্পি চাপা গলায় ইলিনাকে বলল, ‘আমি স্পষ্ট দেখেছি, দুজনের গায়ে আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস ছিল৷ আর-একজনের ছিল শাড়ি৷’
সম্পিদের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও স্কুল-ড্রেস-এর ব্যাপারটা ইলিনা আর সজনীরও নজরে পড়েছিল৷ তাই ‘হুঁ’ বলে ওরা দুজনে ঘাড় নাড়ল৷
সম্পি বলল, ‘তার মানে, দুজন আমাদের স্কুলেরই স্টুডেন্ট—নাইন অথবা টেন-এর…৷’
ওর এ-কথা বলার কারণ, সিনিয়ার স্কুলের ক্লাস নাইন আর টেন-এর স্টুডেন্টদের ড্রেস সাদা টপ আর সবুজ স্কার্ট৷ ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত স্কুল-ড্রেসটা অন্যরকম—সাদা ফ্রক, সবুজ টিউনিক৷ আর জুনিয়ার স্কুলের বিল্ডিংও আলাদা, ড্রেসও আলাদা : সবুজ পাড় আর পাইপিং লাগানো সাদা ফ্রক৷
সম্পি আবার বলল, ‘আর শাড়িটা দেখেছিলি? ওটার রং ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি, তবে পাড়ের চওড়া ডিজাইনটা আমার মনে আছে…৷’
‘তাতে কী হয়েছে?’ ইলিনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল৷
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সম্পি ফিসফিস করে বলল, ‘কাল ওই ডিজাইনের শাড়ি পরে আমাদের একজন ম্যাডাম স্কুলে এসেছিল…৷’
ইলিনা আর সজনীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল৷
কাল ওদের একজন ম্যাডাম সেই একই ডিজাইনের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন? তারপর সেই ম্যাডাম অন্ধকার আর বৃষ্টির মধ্যে খেলার মাঠের ওই মরা গাছটার ডাল থেকে ডালে ছাতা মাথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলেন? এ কী সর্বনেশে ব্যাপার!
‘তুই জানিস কে সেই ম্যাডাম?’ উত্তেজনায় কেঁপে যাওয়া গলায় জানতে চাইল সজনী৷
‘হ্যাঁ, জানি৷’ দুষ্টুমির চোখে একে-একে ইলিনা আর সজনীকে দেখল সম্পি৷ তারপর : ‘কিন্তু নামটা তোদের এখন বলব না৷ আমি চুপচাপ থেকে ক’টা দিন ওই ম্যাডামের ওপরে নজর রেখে দেখি৷ তারপর…৷’
ইলিনা সম্পির দিকে তাকাল৷
সম্পির ফোলা-ফোলা গাল, অথচ তা সত্ত্বেও চোয়ালের শক্ত রেখা বেশ স্পষ্ট৷ ক্লাসরুমের পাখা বনবন করে ঘুরছে, কিন্তু সম্পির গালে, কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম৷
দেখে মনে হচ্ছিল, সম্পি ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো ছানবিন করবে বলে শপথ নিয়েছে৷
ইলিনার ভয়-ভয় করে উঠল৷ কারণ, কাল রাতের তিনটে প্রেতিনীর মড়ার মতো মুখ ও অস্পষ্টভাবে হলেও দেখতে পেয়েছে৷ তা ছাড়া ওই খিলখিল হাসি!
ইলিনা আমতা-আমতা করে জিগ্যেস করল, ‘বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবি?’
‘এসব কিচ্ছু বলব না৷ বলব আমি যা দেখেছি…৷’
কথাটা সম্পি আর শেষ করল না৷ কারণ, ঠিক তখনই বাংলার ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷
টিফিনের স্বতঃস্ফূর্ত হইচই আজ বেশ কম মনে হল৷ কারণ, গতকালের অদ্ভুত খবরটা ফিসফিসে প্রচারে অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে৷
অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ ও আজ আসেনি৷ সকাল থেকেই ইলিনার চোখ বারবার অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চলে যাচ্ছে৷ কেন কে জানে!
ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা তাড়াহুড়ো করে টিফিন খাওয়া শেষ করল৷ বড়দির ঘরে ডাক পড়েছে বলে তিনজনের বুক দুরদুর করছিল৷ ইলিনা ক্লাসরুমের বড় জানলা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল৷ আকাশ মেঘলা৷ তার সঙ্গে সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷
বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবে সেটা সম্পি, ইলিনা আর সজনী বেশ কয়েকবার চাপা গলায় রিহার্সাল দিল৷ সম্পি বারবার বলছিল, ‘আমি যা দেখেছি সেটাই স্ট্রেটকাট বড়দিকে বলব৷ যা সত্যি, তাই৷ লুকোনোর কী আছে?’
ইলিনা আর সজনী ওকে বোঝাতে লাগল৷
এ নিয়ে অনেক সময় কেটে গেল৷ শেষ পর্যন্ত ওরা তিনজনে প্রায় হাতে হাত ধরে বড়দির ঘরের দিকে রওনা হল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল৷
একতলায় প্রীতি দত্তর বিশাল ঘর৷ ঘরের দু-পাশে দুটো করে জানলা৷ তাদের মাপ এত বড় যে, সাধারণ বাড়ির দরজাকেও হার মানায়৷ ডানদিকের খোলা জানলা দিয়ে স্কুলের লাগোয়া ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে৷ বাগান পেরোলেই চোখে পড়ছে খাটো পাঁচিল ঘেরা এলাকা—তার ভেতরে ছোট-ছোট সার্ভেন্টস কোয়ার্টার৷
সময়ের আঁচড়ে ময়লা হয়ে যাওয়া একটা প্রকাণ্ড মাপের সেক্রেটারিয়াট টেবিল৷ তার পিছনে বড়দি মুখ ভার করে বসে আছেন৷ টেবিলের ওপরে পেন স্ট্যান্ড, রাইটিং প্যাড, একটা মোবাইল ফোন, আর রাজ্যের খাতাপত্র ছড়ানো৷ টেবিলের একপাশে একটা পুরোনো মডেলের কম্পিউটার৷ আর বড়দির সামনে একটা গোলাপি রঙের কোঁচকানো রুমাল, তার পাশে একটা প্লাস্টিকের চাকতি দিয়ে ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল৷
বড়দির মুখোমুখি চারটে হাতল-ওয়ালা কাঠের চেয়ার৷ চারটেই খালি৷ চেয়ারের পিঠ ধরে ইলিনারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বড়দির কথার অপেক্ষা করতে লাগল৷
মাথার ওপরে কাঠের ব্লেডওয়ালা ঢাউস সিলিং ফ্যান ‘ক্যাঁচক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরছিল৷ সেই বাতাসের ঝাপটায় ট্যালকাম পাউডারের হালকা গন্ধ ওদের নাকে আসছিল৷ আর বড়দির গলায় পাউডারের ছোপ চোখে পড়ছিল৷
প্রীতি দত্ত ঠান্ডা চোখে সম্পির দিকে তাকালেন৷ অন্তত দশ সেকেন্ড স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন—যেন ওকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করছেন৷
তারপর অতিরিক্ত মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘সমর্পিতা…তাই তো নাম তোমার?’
সম্পি চুপচাপ মাথা নাড়ল৷ যার মানে, হ্যাঁ৷
‘…এবার বলো তো, কাল রাতে তুমি ঠিক কী দেখেছ?’
ইলিনা বড়দির শাড়িটা লক্ষ করছিল৷ আজ বড়দি একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরে এসেছেন৷ চওড়া পাড়ে গাঢ় সবুজ রঙের নকশা তোলা৷ হালকা সবুজ জমির ওপরে গাঢ় সবুজের কলকা বোনা৷
‘মনে হয়…মনে হয়…’ মেঝের দিকে তাকিয়ে আঙুল খুঁটতে লাগল সম্পি৷ বারকয়েক হোঁচট খেয়ে বলল, ‘মনে হয়…মনে হয় আমি…ভুল দেখেছি, বড়দি৷ ওই অন্ধকার, মেঘ, তার ওপরে বৃষ্টি…৷’
ইলিনা আর সজনী অবাক চোখে সমর্পিতার দিকে তাকাল৷
এসব কী বলছে সম্পি? একটু আগেই না বলছিল, একজনের শাড়ির পাড়ের ডিজাইনটা ও লক্ষ করেছে! গতকাল একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন৷ সেই ম্যাডামের ওপরে ও নজর রাখছে৷ এবং যা সত্যি তাই বলবে বড়দিকে৷
তা হলে?
ইলিনা আর সজনীকে আরও অবাক করে দিয়ে সম্পি বড়দিকে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, বড়দি৷ কাল রাতে আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল৷ মানে, ব্যাপারটা মনে হয় আমার দেখার ভুল৷ মানে…ওই যে আপনি বললেন না…হ্যালু…৷’
‘হ্যালুসিনেশান৷’ একগাল হেসে ওকে কথাটা ধরিয়ে দিলেন প্রীতি দত্ত, ‘এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা৷ গুড গার্ল৷’ এবার তিনি ইলিনা আর সজনীর দিকে তাকালেন : ‘তোমরা কিছু বলবে?’
অবাক ভাবটা কাটিয়ে ইলিনা আর সজনী একইসঙ্গে মাথা নাড়ল : ‘না, বড়দি, আমরা কিছুই দেখতে পাইনি—৷’ ওরা তখনও আড়চোখে বারবার সম্পিকে দেখছিল৷
‘গুড৷’ খুশির গলায় বললেন প্রীতি৷ তারপর স্নেহমাখা মোলায়েম গলায় আরও বললেন, ‘তোমরা এখন বড় হয়েছ৷ স্কুলের ভালোমন্দ অনেকটাই বুঝবে৷ জানো, সুনাম তৈরি করতে বহু বছর লেগে যায়! কিন্তু দুর্নাম?’ একটু থামলেন৷ তারপর : ‘দুর্নাম হওয়ার জন্যে একটা দিনই যথেষ্ট৷ আসলে…৷’
বড়দির বক্তব্যের স্রোতে বাধা পড়ল৷ কারণ, মলিনাদি ঘরে এসে ঢুকল৷
মলিনাদি বড়দির খাসবেয়ারা৷ তা ছাড়া ক্লাসে-ক্লাসে নোটিস নিয়ে যায়৷
মলিনাদি বেশ মোটাসোটা৷ রং কালো, মাথায় কাঁচাপাকা চুল৷ চোখে কালো ফ্রেমের চশমা—তার একটা ডাঁটিতে তাপ্পি লাগানো৷
ইলিনারা লক্ষ করল মলিনাদি বেশ হাঁপাচ্ছে, আর চোখগুলো গোল-গোল৷
‘কী হয়েছে, মলি?’ কথা থামিয়ে প্রীতি দত্ত প্রশ্ন করলেন৷
বড়-বড় শ্বাস টেনে-টেনে মলিনা বলল, ‘বলাইদার ছেলে…বলাইদার ছেলে…পরান…পরান…৷’
‘কী হয়েছে পরানের? কী হয়েছে?’ বড়দি প্রশ্ন করতে-করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷
‘পরান…পরান মারা গেছে গো, দিদি, মারা গেছে!’ এ-কথা বলেই মলিনা চাকরিজীবনে কখনও যা করেনি তাই করে বসল৷ বড়দির সামনেই ধপাস করে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল এবং বুকে দু-হাত চেপে উত্তেজনাটাকে সামাল দিতে চেষ্টা করল৷
মলিনার অসংলগ্ন কথা থেকে প্রীতি দত্ত অনেক কষ্টে গোটা গল্পটা উদ্ধার করলেন৷
স্কুলের ঘণ্টা বাজায় যে-বলাইদা, সে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে৷
তার বয়েস অনেক৷ মাথার মাঝখানে টাক৷ তার চারদিকে সাদা ঝালরের মতো চুল৷ মুখে খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি৷ খানিকটা কুঁজো হয়ে থাকা বৃদ্ধ শরীর৷ ধীরে-ধীরে হাঁটা-চলা করে৷ কিন্তু বলাইদার ঘণ্টা বাজানোর জোর অবাক করে দেওয়ার মতো৷
সেই বলাইদার জোয়ান ছেলে পরান কাছাকাছি একটা রেশন-দোকানে চাকরি করে৷ অনেক সময় হিসেবনিকেশের চাপে পরান রাতে সেই দোকানেই থেকে যায়৷ কাল রাতেও সেরকম কিছু একটা হয়েছে বলে বলাইদারা ভেবেছিল৷ কিন্তু আজ সকালে পরান না ফেরায় বলাইদারা অপেক্ষা করে-করে শেষ পর্যন্ত বেলায় পরানের খোঁজ করতে সেই দোকানে যায়৷ গিয়ে শোনে, গতকাল রাতে পরান বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি রওনা হয়ে গিয়েছিল৷ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য ও দোকান থেকে শুধু একটা পলিথিনের প্যাকেট নিয়েছিল৷
তখন বলাইদারা পাগলের মতো পরানের খোঁজ করতে থাকে৷ হাসপাতালে, থানায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে—সব জায়গায়৷
কিন্তু পরানকে পাওয়া যায়নি৷
তারপর, একটু আগে, কোয়ার্টারের একটা বাচ্চা ছেলে স্কুলের পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে ‘ছোট বাইরে’ করতে গিয়ে পরানের ডেডবডি দেখতে পায়৷
চারটে বড়-বড় আমগাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছের মাঝে বৃষ্টির জলে ভেজা আগাছা আর ঘাস-পাতার ওপরে পরানের দেহটা পড়ে ছিল৷ ওর মাথাটা ছিল একটা পলিথিনের প্যাকেটে ঢাকা৷
বাচ্চা ছেলেটা বুঝতে না পেরে ‘পরানদা, পরানদা—’ বলে পলিথিনের প্যাকেটটা ধরে টান মারে৷ জলে ভেজা প্যাকেটটা খুলে আসতেই পরানের ফ্যাকাশে মুখটা দেখা যায়৷
পরানের গায়ের রং শ্যামলা হলেও দেখা গেল, ওর সারাটা শরীর সাদাটে, রক্তশূন্য৷ চোখ দুটো বড়-বড়, যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে৷ আর ঘাড়ে-গলায় চার-পাঁচ জায়গায় গভীর ক্ষতের দাগ৷ সেখানে কালচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷
এসব কথা শুনে প্রীতি দত্তের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল৷ তার ওপর মলিনাদি বলল, সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের কারা যেন বড়দির পারমিশান না নিয়ে এর মধ্যেই পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছে৷
ইলিনা, সম্পি আর সজনী ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিল৷ পরানের মৃতদেহের যে-সংক্ষিপ্ত বর্ণনা মলিনাদি দিয়েছে তাতেই ওরা রক্তশূন্য ছাইরঙা ডেডবডিটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল৷
প্রীতি দত্ত টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে দু-ঢোঁক জল খেলেন৷ কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নেওয়ার পর কিছুটা সামলে উঠলেন৷ তারপর তড়িঘড়ি সম্পিদের বিদায় দিলেন৷ আপনমনেই বললেন, ‘কী-সর্বনাশ! মনে হচ্ছে, স্কুল ক’দিন ছুটি দিতে হবে…৷’
মলিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আমি বডিটা স্বচক্ষে দেখে এলুম, দিদি৷ এ একেবারে অপঘাতে মিত্যু৷ নিঘঘাৎ ডাকিনি-পিশাচের কাজ৷ সারা শরীরটায় রক্ত নেই৷ একেবারে সাদা৷ এবারে কী হবে, দিদি?’
মলিনার আর্ত আবেদন বড়দির কানে পৌঁছল কি না বোঝা গেল না৷ তিনি তখন টেবিল থেকে মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিয়েছেন৷ কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে মলিনার উচচারণ করা মারাত্মক দুটো শব্দ নিয়ে ভাবছেন৷
এই স্কুলে ডাকিনি আর পিশাচ এল কোথা থেকে?
.
৷৷পাঁচ৷৷
তিন দিন স্কুল ছুটি দেওয়া হল৷ তার সঙ্গে রবিবার জুড়ে গিয়ে চার দিন৷ সেই চারদিনে পুলিশি তদন্ত মোটামুটি একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল৷ কিন্তু পরানের দেহের রক্তশূন্যতার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না৷ পুলিশের রিপোর্টে হায়েনা, গোসাপ কিংবা বড়সড় কোনও বেজির আক্রমণের সম্ভাবনার কথা বলা হল—যদিও পুলিশের লোকজনের কাছে প্রচুর প্রশ্নচিহ্ন থেকে গেল৷
ব্যাপারটা নিয়ে জল ঘোলা যাতে কম হয় সেইজন্য প্রীতি দত্ত পুলিশের কাছে স্টেটমেন্টে শুধু রবিনা ম্যাডামের কথা বলেছেন৷ বলেছেন, সেই রাতে ওইসব আজগুবি কাণ্ডকারখানা রবিনা ম্যাডাম একা দেখেছেন—ছাত্রীরা কেউ দেখেনি৷ তাই ইলিনারা পুলিশের জেরা থেকে রেহাই পেয়ে গেছে৷
সোমবার স্কুলে গিয়ে স্কুলটাকে নতুন চোখে দেখতে চাইল ইলিনা৷
আজ বৃষ্টি নেই৷ আকাশে মেঘের চেহারা অনেক ফিকে৷ কিন্তু সেই রাতের ঘটনাটা চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরে যাচ্ছে না৷
কালো মেঘ৷ লিকলিকে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো মরা গাছ৷ অন্ধকার রাত৷ আর সেই উজ্জ্বল আলোর চোখ৷
ঘটনার পরদিন সকালে স্কুলের দিকে আসার সময় মরা গাছটার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ইলিনা৷ ওটার চারপাশে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নজর বুলিয়েছিল৷ কিন্তু গতকাল রাতের ওই ঘটনার কোনও চিহ্ন খুঁজে পায়নি৷ তা সত্ত্বেও ওর গা ছমছম করছিল৷
তারপর, পরানের অপঘাতে মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর, ওর মনে হয়েছে, ওই ‘খারাপ’ প্রাণীগুলো কখনও চিহ্ন রেখে যায় না৷
আজ সকালেও স্কুলে আসার সময় দূর থেকে ওই মরা গাছটার দিকে ইলিনা তাকিয়ে থেকেছে৷ আর তখনই এক অদ্ভুত শিরশিরানি টের পেয়েছে শরীরে৷
আজ ক্লাসে ঢুকে অনুষ্কাকে দেখতে পেয়ে ওর খুব ভালো লাগল৷ সুন্দর টলটলে মুখটি নিয়ে চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে আছে৷ ওর মুখের ডানপাশে জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে৷ সেই আলোয় ওকে কেমন যেন স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে৷ নিজের চিন্তায় ডুবে থাকা এক রূপসী৷
অনুষ্কার দু-পাশে রেখা আর সঞ্চিতা বসে৷ দুজনের মধ্যে রেখার সঙ্গে ইলিনার রিলেশানটা বেটার৷ তাই ও রেখাকে বলে বসার জায়গা অদলবদল করল৷ পিঠের ব্যাগ হাতে নিয়ে অনুষ্কার পাশের ডেস্কে বসে পড়ল৷
‘অনেকদিন তোমাকে দেখিনি৷’ ইলিনা হেসে বলল৷
‘স্কুল তো ছুটি ছিল৷ তা ছাড়া সেই বাজে দিনটায় আমি তো আসিনি…তার পরের দিনও আসিনি৷’
না এলেও অনুষ্কা ফোনে-ফোনে সব ঘটনাই জেনে গেছে৷ বড়দি যতই বারণ করে থাকুন, এই ভয়ংকর বিচিত্র ব্যাপারটা নিয়ে চাপা কথাচালাচালি মোটেই বন্ধ হয়নি৷
ইলিনাও এই ছুটির মধ্যে অনুষ্কাকে ফোন করেছিল৷ ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইলিনার মনে হয়েছিল অনুষ্কা যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না৷
ক্লাস শুরু হতে এখনও সাতমিনিট বাকি৷ তাই গোটা ক্লাসে ভোমরার গুনগুন চলছিল৷ ইলিনা অনুষ্কার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘জানো, আমার না এখন স্কুলে আসতে ভয় করে…৷’
‘কেন?’ অনুষ্কা ভুরু তুলে তাকাল৷
‘ওই রাতটার কথা বারবার মনে পড়ে…৷’
অনুষ্কা একটা হাত রাখল ইলিনার হাতে৷ ওর ছোঁয়া ইলিনার ভালো লাগল৷ সেই ছোঁয়ায় কেমন যেন একটা ভরসা ছিল৷
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ ছুটির পর তুমি বরং আমার বাড়িতে চলো৷ বাপি গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসবে৷ তারপর বাড়িতে গিয়ে আমরা অনেক গল্প করব৷ সময়টা দারুণ কাটবে৷ তুমি—৷’
‘তোমার কোনও প্রবলেম হবে না তো!’ ইলিনা কথাটা বলল বটে, কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ সেই প্রথম দিন থেকেই ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে, বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে৷ আর আজ অনুষ্কা নিজে থেকেই ওকে ওর বাড়িতে যেতে বলছে! এই প্রথম৷
‘না, না, প্রবলেম কীসের!’ অনুষ্কা তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমিই তো তোমাকে আসার জন্যে রিকোয়েস্ট করছি৷’
‘কিন্তু বাড়িতে ফোন করে একটু বলতে হবে—নইলে মা ভীষণ টেনশান করবে৷’
স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শুধু নয়, সঙ্গে করে নিয়ে আসাটাই বারণ৷ এ নিয়ে গত বছরে একটা বড়সড় গোলমাল হয়েছিল৷ সুতরাং ইলিনার মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল৷ ওদের কারও কাছে সেলফোন নেই৷ মা-কে ফোন করে খবরটা দেবে কেমন করে!
ওর মনের কথা অনুষ্কা বোধহয় টের পেল৷ বলল, ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই৷ বাপির সঙ্গে মোবাইল থাকে৷ ছুটির পর বাপির ফোন থেকে তুমি আন্টিকে ফোন করে দিয়ো৷ তার সঙ্গে বোলো, আন্টি যেন তোমার ফেরার চিন্তা না করেন৷ বাপি তোমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসবে—অবশ্য বাপির সঙ্গে আমিও থাকব৷’ হেসে কথাটা শেষ করল অনুষ্কা৷ কিন্তু তারপরই হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ‘আমার বাড়িতে যাচ্ছ এ-কথাটা কাউকে এখন বোলো না…প্লিজ…৷’
‘বলব না৷’ মাথা হেলিয়ে বলল ইলিনা৷ ভাবল, অনুষ্কাটা এত মুখচোরা কেন কে জানে! তা ছাড়া ওর বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা গোপন করারই বা কী আছে?
ইলিনার একটু অবাক লাগছিল৷ যে-অনুষ্কা সবার সঙ্গে আলাপ-টালাপ করার ব্যাপারটা সবসময় এড়িয়ে চলে সে হঠাৎ ইলিনাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করছে! এ-ক’দিনে ও হঠাৎ পালটে গেল কেন?
সে যাই হোক, ইলিনার মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ আর তখনই স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷
একটার পর একটা ক্লাস পেরিয়ে সময়টা ক্রমশ বিকেলের দিকে গড়াতে লাগল, আর ইলিনার উৎফুল্লতা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল৷
টিফিনের সময় অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে ইলিনা বুঝল, এমনিতে সবাই চুপচাপ থাকলেও পরানের ব্যাপারটা নিয়ে ভালোরকম ফিসফাস কানাকানি হচ্ছে৷
খবরটা কোনও নিউজ চ্যানেলে দেখায়নি কিংবা কাগজেও ছাপেনি৷ হয়তো প্রীতি দত্তের অনুরোধে কিংবা প্রভাবে পুলিশ মুখে কুলুপ এঁটেছে আর মিডিয়া হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে৷ কিন্তু ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেন’ বসে থাকেনি৷
টিফিনের সময় ইলিনা একা-একাই টিফিন খেল৷ ওর শত অনুরোধেও অনুষ্কা ওর টিফিন শেয়ার করল না৷ বারবার সুন্দর করে হেসে বলল, ‘আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি৷ তা ছাড়া আমার চট করে খিদে পায় না৷’
ইলিনার বেশ খটকা লাগলেও কিছু বলল না৷
ছুটির সময় যতই এগিয়ে এল আকাশ ততই কালো হয়ে উঠল৷ মেঘও ডেকে উঠল দু-চারবার৷ অনুষ্কা অপছন্দের মুখে জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বর্ষাকালটা খুব বিচ্ছিরি৷ আমার ভাল্লাগে না৷’
ইলিনা ওর দিকে তাকাল শুধু—কিছু বলল না৷
সাড়ে চারটের সময় ছুটির ঘণ্টা পড়তেই ওরা সিঁড়ি নেমে চলে এল একতলায়৷ গাড়িবারান্দার বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ মেঘের যা চেহারা তাতে মনে হচ্ছে জলকণার ভারে মেঘের দল কাবু হয়ে পড়েছে৷ যে-কোনও মুহূর্তে মেঘের চাদর ফুঁড়ে জলের ধারা নীচে নামবে, পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে৷
অনুষ্কা ইলিনার হাত ধরে টান মারল : ‘শিগগির চলো৷ বাপি গাড়িটাকে ওপাশটায় দাঁড় করায়—৷’
পিচের রাস্তা ধরে ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি পা চালাল৷ অন্য মেয়েরাও চটপট এগিয়ে চলেছে মেন গেটের দিকে৷ কেউ-কেউ আবার ছুটছে৷ নিউ কাটের খটখট শব্দে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের ভূতুড়ে ঘোড়সওয়ারদের কথা মনে পড়ে গেল ইলিনার৷
পিচের রাস্তার বাঁ-দিকটা বলতে গেলে জঙ্গলে ঢাকা৷ আগাছার জংলা ঝোপ, আর তার মাঝে-মাঝে কয়েকটা বড়-বড় গাছ৷ গাছের পাতার আড়াল থেকে কোকিল ডাকছে৷ দুটো ফিঙে ঘূর্ণি নাচের ভঙ্গিতে উড়ছে৷ বোধহয় উড়ন্ত পোকামাকড় ধরছে৷ একটা কাঠবিড়ালি একটা বড় গাছের ডালে বসে ইলিনাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তবে সামান্য ছুতোয় ছুটে পালানোর জন্য সে বেশ তৈরি বলেই মনে হল৷ মেঘলার জন্য ঘোলাটে ছায়া থাকলেও কাঠবিড়ালিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷
অনুষ্কা কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল৷ ওর চোখে আকাঙ্ক্ষার আলতো ছোঁয়া দেখতে পেল ইলিনা৷ জিগ্যেস করল, ‘কাঠবিড়ালি তুমি ভালোবাসো?’
অনুষ্কা চমকে ঘুরে তাকাল : ‘দারুণ ভালোবাসি৷’
‘তা হলে ধরে নিয়ে চলো—পুষবে৷’
কথাটা ইলিনা খুব হালকাভাবেই বলেছিল৷ কিন্তু ওর কথা শেষ হতে না হতেই অনুষ্কা একটা আজব কাণ্ড করে বসল৷
রাস্তা ছেড়ে পলকে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে৷ এবং কাঠবিড়ালিটাকে লক্ষ্য করে শূন্যে লাফ দিল৷
কাঠবিড়ালিটা আর দেরি করেনি৷ অনুষ্কা তাকে তাক করে লাফানোমাত্রই সে গাছের ডাল বেয়ে সড়সড় করে আরও ভেতরদিকে ছুটে গেল৷
কিন্তু অনুষ্কাও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়৷ ও-ও তৎপর ভঙ্গিতে লাফের পর লাফ মেরে আগাছা আর গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল৷
ইলিনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ পিঠে স্কুল-ব্যাগের বোঝা চাপানো অবস্থায় অনুষ্কা যে-স্পিডে কাঠবিড়ালিটাকে তাড়া করল তাতে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ মনে হল, অনুষ্কা যেন লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে তুখোড় কোনও অ্যাথলিট৷
অনুষ্কার ব্যাপারটা আরও দু-চারজন মেয়ের চোখে পড়েছিল৷ তারাও মজা দেখার লোভে ইলিনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়েছে৷
আগাছার ঝোপ আর গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল৷ কিন্তু মেঘলা ছায়াতে অনুষ্কাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না৷ তবে ওর সাদা টপের ঝলক দেখা যাচ্ছিল৷
একটু পরেই অনুষ্কা গাছপালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল৷ ওর স্কার্ট আর টপের এখানে-সেখানে গাছের পাতার টুকরো-টাকরা লেগে আছে৷ আর ডানহাতের মুঠোয় ধরা একটা কাঠবিড়ালি৷ চিঁ-চিঁ করে ডাকছে৷
ইলিনা তো অবাক৷ ছুটে গিয়ে কেউ কাঠবিড়ালি ধরেছে এমনটা ও কখনও শোনেনি৷ আর অনুষ্কার ক্ষিপ্রতা কোনও শিকারি চিতাকেও হার মানাবে!
অবাক হল বাকি সব মেয়েরাও৷ ওরা অনুষ্কাকে ঘিরে কাঠবিড়ালি দেখতে লাগল৷
অনুষ্কা বাঁ-হাতে স্কার্ট ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল, ‘কী কিউট, না? এটা আমি পুষব৷’
ইলিনা বলল, ‘বাব্বা, তোমার কী স্পিড! স্পোর্টসে নাম দিলে তুমি অনেক প্রাইজ পাবে৷’
অনুষ্কা হাসল শুধু—কোনও কথা বলল না৷
এমন সময় মেঘ ডাকল আবার৷ দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল৷
সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্কা যেন শক খেয়ে চমকে উঠল৷ ‘শিগগির চলো—বৃষ্টি পড়ছে’ বলে পিচের রাস্তা ধরে ছুট লাগাল৷
অন্য মেয়েগুলো একটু অবাক হয়ে গেল৷ এ-বৃষ্টি ভেজার মতন কিছু নয়৷ তাই অনুষ্কার দৌড়টা ওদের বেখাপ্পা মনে হল৷ আর ইলিনার মনে পড়ে গেল প্রথম দিন আলাপের সময় অনুষ্কা বলেছিল, ‘…বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’
ইলিনা একটুও দেরি না করে অনুষ্কার পিছন-পিছন দৌড়ল৷
দূরে মরা গাছটা দেখা যাচ্ছে৷ সেই রাতের দৌড়টার কথা ওর মনে পড়ে গেল৷
পিচের রাস্তা ধরে বাঁ-দিকে বাঁক নিতেই সার বেঁধে পার্ক করা কয়েকটা প্রাইভেট কার চোখে পড়ল৷ তার পাশে হলদে রঙের তিনটে স্কুলবাস৷
একটা সাদা গাড়ির সামনে বড় একটা ছাতা মাথায় দিয়ে সুপুরুষ একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ ভদ্রলোকের মাথায় কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, আর মুখে একগাল হাসি৷ ওঁকে দেখতে এত সুন্দর যে, স্রেফ দেখেই বোঝা যায় উনি অনুষ্কার বাবা৷
ছুটন্ত অনুষ্কার দিকে ছাতা বাড়িয়ে ধরলেন তিনি৷ আর একইসঙ্গে গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা খুলে ধরলেন৷ ইলিনা লক্ষ করল, গাড়ির জানলায় টিন্টেড গ্লাস লাগানো৷
গাড়িতে উঠতে-উঠতে অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, ও ইলিনা—আমার ক্লাসমেট…আমার খুব বন্ধু৷ ও আমাদের সঙ্গে এখন যাবে—৷’
‘তাই?’ চওড়া করে হাসলেন অনুষ্কার বাপি : ‘গুড—ভেরি গুড৷ এসো, এসো—উঠে পড়ো গাড়িতে৷ বৃষ্টিতে ভিজো না৷’ পিছনের একটা দরজা খুলে ইলিনাকে গাড়িতে ওঠার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন৷
ইলিনা গাড়িতে উঠে পিঠের স্কুল-ব্যাগটা খুলে সিটের ওপরে রাখতেই বাপি দরজাটা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলেন৷ গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময় ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা বাপিকে দেখাল অনুষ্কা৷
‘এই দ্যাখো, বাপি, এই কাঠবিড়ালিটা স্কুলের বাগান থেকে ধরেছি৷ এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুষব…৷’
কাঠবিড়ালিটা তখন কিচকিচ করে শব্দ করছে, ওর কালো চোখের তারা চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক দেখছে৷
কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বাপি৷ তারপর জোরে হেসে বললেন, ‘ওটা আগেই আমি দেখেছি৷ বাঃ, গুড—ভেরি গুড৷ কিন্তু কত কিছুই তো তুমি পুষবে বলে ধরে আনো৷ তারপর কতটুকু কী পোষা হয় তা তুমি ভালোই জানো!’ মেয়ের দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে কী এক গোপন রসিকতায় হেসে উঠলেন৷ তারপর একপলক ইলিনাকে দেখে নিলেন৷
কাঠবিড়ালিটার গায়ে একবার আদরের হাত বুলিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন বাপি৷
অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, তোমার ফোনটা দাও৷ ইলিনা ওর বাড়িতে একটা ফোন করবে—নইলে ওর মা-বাবা চিন্তা করবে…৷’
‘ওহ শিয়োর—এই নাও৷’ জামার বুকপকেট থেকে রুপোলি রঙের একটা ছোট্ট মোবাইল ফোন বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন৷
অনুষ্কা আর ইলিনা চটপট বোতাম টিপে ফোনের কাজটা সেরে নিল৷
গাড়ির ভেতরে একটা অদ্ভুত পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিল ইলিনা৷ মনে হচ্ছিল, মিহি দারচিনি গুঁড়ো কেউ বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে৷
এই গন্ধটা ও অনুষ্কার কাছে কখনও পায়নি৷ তা হলে কি ওর বাপি এরকম অফবিট পারফিউম লাগিয়েছেন? নাকি এটা স্পেশাল টাইপের কোনও কার পারফিউম?
অনুষ্কার বাপি গাড়ি চালাতে-চালাতে নানান বিষয়ে বকবক করছিলেন আর মাঝে মাঝেই হেসে উঠছিলেন৷ তবে ওঁর বেশি আগ্রহের বিষয় যে সিনেমা আর নাটক সেটা বোঝা যাচ্ছিল৷ গল্প করার ফাঁকে তিনি থেকে-থেকেই বলছিলেন, ‘এই তো, এসে গেলাম…৷’
গাড়ি নানান রাস্তা ধরে চলছিল৷ ইলিনা কোনও রাস্তাই চিনতে পারছিল না৷ অবশ্য ওর চেনার কথাও নয়৷ ওর শুধু মনে হচ্ছিল, অনুষ্কা ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হতে চলেছে৷ আর সেই চিন্তাটা ওর মনে খুশির বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছিল৷
একটু পরেই গাড়ি যে-বাড়িতে এসে ঢুকল সেটা মাপে ছোট হলেও অনায়াসে তাকে বাগানবাড়ি বলা যায়৷ কারণ, অবহেলায় ফেলে রাখা বাগানের একপাশে একটা ছোট দোতলা বাড়ি৷ বাড়ি আর বাগান জং ধরা রেলিঙে ঘেরা৷ তার কোথাও-কোথাও এমনভাবে ভাঙা যে, কুকুর-বেড়াল কি অন্যান্য ছোট প্রাণী সহজেই ঢুকে পড়তে পারে৷
বাড়িটা পুরোনো ধাঁচের, তবে সদ্য রং করা হয়েছে৷ সেই রংটা গরিব পথশিশুর গায়ে ঝকঝকে নতুন জামা-প্যান্টের মতো দেখাচ্ছে৷
বাড়ির ছাদের কার্নিশে অনেক গোলাপায়রা বসে আছে৷ মাঝে-মাঝে পায়রাগুলো এদিকে-ওদিকে উড়ে যাচ্ছে৷
আকাশ মেঘে-মেঘে কালো৷ বৃষ্টি এখন নেই, কিন্তু যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷
গাড়ি বাড়ির কাছে গিয়ে থামল৷ ওরা তিনজনে নেমে বাড়িতে ঢুকল৷ অনুষ্কার হাতে ধরা কাঠবিড়ালিটা তখনও কিচকিচ করে শব্দ করছে৷
বাড়িতে ঢোকার সময় অনুষ্কার বাপি ইলিনাকে বললেন, ‘ওয়েলকাম, ইলিনা—ওয়েলকাম টু আওয়ার লিটল হাউস৷ যাও, অনুষ্কার সঙ্গে ওপরে যাও৷ ওর ঘরে বসে গল্প করো, টিভি দ্যাখো, চুটিয়ে আড্ডা মারো—এনজয় করো…৷’ একটু থেমে অনুষ্কার দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘দাও, ওটা আমাকে দাও৷ জায়গামতো রেখে দিই…৷’
অনুষ্কা কোনও কথা না বলে কাঠবিড়ালিটা বাপির হাতে দিল৷ ওটার মাথায় ছোট্ট করে হাত বুলিয়ে বাপি বললেন, ‘সুইট স্কুইরেল…৷’
এই কথা বলে বাপি একতলার একটা ঘরে ঢুকে গেলেন৷ আর ওরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল৷
বাড়িটা নতুন রং করা হয়েছে বলে ইলিনা রঙের গন্ধ পাচ্ছিল৷ কিন্তু তার সঙ্গে দারচিনির মিষ্টি গন্ধটাও ওর নাকে আসছিল৷
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিল ইলিনা৷ ছিমছাম সাজগোজে বাড়িটাকে যথেষ্ট আধুনিক করার চেষ্টা হয়েছে৷
দরজা-জানলায় ভারী পরদা, দেওয়ালে ওয়াল হ্যাঙার, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ পেইন্টেড পট৷
এসব দেখতে-দেখতে অনুষ্কার ঘরে পৌঁছে গেল ইলিনা৷
অনুষ্কা আলো জ্বালতেই ঘরটা চোখের সামনে প্রকাশিত হল৷
একটা আলমারি, বুককেস, এল. সি. ডি টিভি আর পড়াশোনার টেবিল৷ তার পাশে কম্পিউটার টেবিল৷ ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে পাতা সিঙ্গল খাট৷ তার বিছানার রঙিন চাদর এলোমেলো৷ তার ওপরে পড়ে আছে একটা বড়সড় হেডফোন৷
বিছানার একটু ওপরে দেওয়ালে জন আব্রাহাম আর মাইকেল জ্যাকসনের বিশাল পোস্টার৷ তার পাশেই একটা অন্যরকম ডিজিটাল প্রিন্ট৷
এই অন্যরকম ছবিটায় দেখা যাচ্ছে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া প্রান্তরে একটা বিশাল প্রাসাদ অতিকায় ডাইনোসরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রাসাদের একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে—বাকিটা ছায়া-ছায়া অন্ধকার৷
সেই ছবিটার পাশে একটা ছোট কাগজ দেওয়ালে সেলোটেপ দিয়ে লাগানো৷ তাতে লাল কালিতে একটা প্রতীক চিহ্ন আঁকা : একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ, তাদের লেজের ডগা দুটো জড়াজড়ি করে আছে৷ এই ছবিটা ইলিনা আগে অনুষ্কার খাতায় দেখেছে৷
হেডফোনটা ছুড়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে অনুষ্কা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানার কোণে রাখল৷ তারপর ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল, ইলিনাকেও বসতে বলল৷
ইলিনা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানায় নামিয়ে রাখল৷ তারপর হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল৷ কিন্তু বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছিল ফুল আর সাপের ছবিটার দিকে৷
ইলিনা স্বপ্নেও ভাবেনি হঠাৎ করে এরকমভাবে অনুষ্কা ওকে এত কাছে টেনে নেবে৷ তাই একটা অপ্রত্যাশিত খুশির ঢেউ ওকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল৷ অনুষ্কার ‘আহা মরি’ মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷
দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা দুজনে প্রাণখোলা গল্পে মেতে উঠল৷ আর তারই মধ্যে কখন যেন ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷
ওদের গল্প আর হাসাহাসির ঢেউয়ের মাঝে হঠাৎ করেই পরানের ডেডবডির কথা ভেসে উঠল৷
অনুষ্কা টেলিফোনে ব্যাপারটা জেনেছে ঠিকই, কিন্তু মনে হল তাতে ওর কৌতূহল মেটেনি৷ কারণ, ও ইলিনাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করতে লাগল৷
সেই রাতের ঘটনা খুব ধীরে-ধীরে স্লো-মোশান সিনেমার মতো পরপর দু-বার বলতে হল ইলিনাকে৷
কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে গভীর মনোযোগে ইলিনার কথামালা শুনল অনুষ্কা৷
‘তোমরা ঠিক দেখেছ, দুজন টপ আর স্কার্ট পরে ছিল? মানে, আমাদের স্কুল-ড্রেস?’
‘হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি৷’
‘আর-একজন শাড়ি?’
‘হ্যাঁ৷ আমাদের একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে সেদিন স্কুলে এসেছিল৷ পাড়ের ডিজাইনটা দেখে সম্পি চিনতে পেরেছে৷’
‘কোন ম্যাডাম?’
‘সম্পি জানে৷ ও আমাদের এখনও বলেনি৷ লাস্ট দিন যখন ওর সঙ্গে কথা হয় তখন ও বলেছিল, ম্যাডামের নামটা এখন ও কাউকে বলবে না৷ কয়েকটা দিন ও ম্যাডামের ওপরে নজর রাখতে চায়…৷’
এ-কথা শুনে অনুষ্কা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও আনমনাভাবে বলল, ‘এতে তো সম্পির বিপদ হতে পারে! যদি সেই ম্যাডাম সম্পির ব্যাপারটা জানতে পেরে যায় তা হলে…৷’
ইলিনা হাত নেড়ে বলল, ‘জানলে জানবে! সম্পির গায়ে অনেক জোর—ও কাউকে ভয় পায় না…৷’
ইলিনার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ মলিন হেসে বলল, ‘সম্পি ওদের সঙ্গে পারবে না৷ ওদের গায়ে অমানুষিক শক্তি৷ ওরা লোহা চিবিয়ে গুঁড়ো করে দিতে পারে—৷’
ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল : ‘তুমি জানলে কী করে?’
অনুষ্কা চুপ করে রইল৷ ওরা দুজনে বৃষ্টির ধারাপাত শুনতে লাগল৷
কিছুক্ষণ পর ইলিনা আবার জিগ্যেস করল, ‘তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
‘কী জানো, বলো—৷’ অনুষ্কার আরও কাছে সরে এল ইলিনা৷
‘পরান ছেলেটা কীভাবে মারা গেছে আমি জানি৷’
বাইরে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷ পড়ল ইলিনার বুকের ভেতরেও৷ উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডের ধকধক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ও৷
ফ্যালফেলে মুখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে ছিল ইলিনা৷ হোঁচট খাওয়া গলায় কোনওরকমে প্রশ্ন করল, ‘কী-কীভাবে ম-মারা গেছে পরান?’
‘ওর সব রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ…৷’
ইলিনার শীত-শীত করে উঠল৷
ঘরের দুটো জানলাতেই কাচের শার্সি লাগানো৷ বৃষ্টির ফোঁটা কাচের ওপরে আছড়ে পড়ছিল৷ তারপর কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল৷ ল্যাম্পপোস্টের ছিটকে আসা আলোয় মনে হচ্ছিল কাচ বেয়ে কতকগুলো স্বচ্ছ ব্যাঙাচি সাঁতরে নামছে৷
ইলিনা শুধু যে অনুষ্কার কথায় ভয় পেয়েছে তা নয়৷ অনুষ্কা কী করে এসব জানল সে-কথা ভেবেও ওর ভয় করছে৷ অথচ অনুষ্কার প্রতি ওর টানটাও তো মিথ্যে নয়! তাই ভয় পেলেও ইলিনা এক অদ্ভুত টানে অনুষ্কার কাছে বসে রইল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আর নানান কথা ভাবতে লাগল৷
তা হলে সেই ছাতাওয়ালা প্রাণীগুলো পিশাচ? ওরাই কি পরানের রক্ত শুষে নিয়েছে? কিন্তু ওদের স্কুলের দুজন ছাত্রী আর একজন ম্যাডাম ওরকম পিশাচ হয়ে গেল কী করে?
ইলিনার চিন্তাগুলো দিশেহারাভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল আর বারবার অদৃশ্য এক পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷
অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, তুমি ভয় পেয়ো না৷ আমি তো আছি! শুধু সম্পিকে বোলো খুব কেয়ারফুল থাকতে৷ ও যেন বেশি রিসক না নেয়৷’
ইলিনা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ দারচিনির মিষ্টি গন্ধটা ওর নাকে এল আবার৷
অনুষ্কা প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য জানলার কাচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বৃষ্টিটা যে কখন থামবে কে জানে! রেইনি সিজনটা খুব বিচ্ছিরি৷’ মুখ ফিরিয়ে ইলিনার দিকে তাকাল : ‘আমার মায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ হল না৷ মা বিকেলে কীসব কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে—মনে হয়, বৃষ্টিতে আটকে গেছে৷ একটু পরে বাপি মা-কে ফোন করে দেখবে৷ যদি মায়ের ফিরতে প্রবলেম হয় তা হলে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে বাপি মা-কে গিয়ে নিয়ে আসবে৷’
‘তোমার মা একা বেরিয়েছেন? রাত হয়ে গেলে যদি কোনও বিপদ-আপদ হয়! তার চেয়ে আমি এখনই চলে যাই—তোমার মা তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন…৷’
‘তুমি শুধু-শুধু চিন্তা করছ—’ মিষ্টি করে হাসল অনুষ্কা : ‘বিপদ-আপদকে আমরা ভয় পাই না৷ তা ছাড়া বাপি এখুনি তোমার জন্যে স্ন্যাক্স-ট্যাক্স কিছু নিয়ে আসবে৷ আর বাড়িটাও তো তোমাকে ঘুরিয়ে দেখানো হয়নি—চলো৷’ অনুষ্কা ওর হাত ধরে টানল৷ তারপর ঘর ছেড়ে ওরা চলে এল বাইরে, অলিন্দে৷
বাড়ির সব জায়গাতেই উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল৷ সাদা টিউবলাইট অথবা নানান চেহারার সি. এফ. এল.৷ দোতলার ঘরগুলো দেখাতে- দেখাতে অনুষ্কা বলল, ‘আমাদের বাড়ির দুটো ফ্লোর একই প্যাটার্নে তৈরি৷ একতলার দুটো ঘরে উলটোপালটা জিনিস বোঝাই করা আছে, আর থার্ড ঘরটায় আমার…পোষা…মানে, পেটসরা থাকে৷ কাঠবিড়ালি, পায়রা, শালিখ, চড়াই এসব৷’
দোতলার তিনটে ঘর শেষ হতেই অনুষ্কা বলল, ‘ওপাশে ওই যে দুটো ছোট-ছোট ঘর—ওগুলো টয়লেট আর কিচেন—দেখানোর কিছু নেই৷’
ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি রান্না জানো?’
‘ওরে বাবা!’ ভয় পাওয়ার কপট ভঙ্গি করল অনুষ্কা : ‘রান্না-টান্না আমি একটুও জানি না৷’
‘তোমার মা—মানে, আন্টি নিশ্চয়ই ভালো রান্না জানেন?’
‘উহুঁ—’ অনুষ্কা মাথা নাড়ল : ‘মা রান্না-টান্না তেমন জানে না…৷’
‘সে কী? তা হলে রোজ রান্না করে দেয় কে? তোমার স্কুলের টিফিন কে তৈরি করে? রান্নার মাসি?’
অনুষ্কাকে দেখে মনে হল, ও কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে৷ কী বলবে ভাবছে৷
‘না, মানে…রান্নার মাসি…আমাদের রান্নার মাটি-টাসি কেউ নেই৷’
অনুষ্কার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখেছে ইলিনা৷
এবং বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে৷
রান্নাঘর একেবারে পরিষ্কার৷ কয়েকটা থালা-বাসন ছুরি-চামচ ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই৷ তাকে মশলাপাতির কোনও কৌটো নেই৷ এমনকী কোনও উনুন, স্টোভ, গ্যাস আভেন, গ্যাস সিলিন্ডার, বা মাইক্রোওয়েভ আভেন—কিচ্ছু নেই৷
বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে ইলিনা ঘুরে তাকাল বন্ধুর দিকে৷
দুজনেই চুপচাপ৷ যেন ক্যামেরার ফ্রিজ শটে দুজনে ধরা পড়েছে৷ ওদের মুখে কোনও কথা নেই৷ শুধু বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজছিল৷
‘আমাদের রান্নাবান্নার কোনও ব্যাপার নেই৷ আমরা সবসময় কেনা খাবার খাই—৷’
অনুষ্কা এ-কথা বলতে না বলতেই ওর বাপির গলা পাওয়া গেল৷
‘ইলিনা, এই কেনা খাবারগুলো খেয়ে দ্যাখো—দারুণ লাগবে৷ খুব ফেমাস দোকান থেকে কেনা…৷’
কথার দিকে লক্ষ করে চোখ ফেরাল ইলিনা৷ এবং সরাসরি অনুষ্কার বাবাকে দেখতে পেল৷
অনুষ্কার ঘরের দরজায় বাপি দাঁড়িয়ে৷ হাতে একটা খাবারের প্লেট৷
ওরা বাপির কাছে এগিয়ে গেল৷ বাপি খাবারের প্লেটটা অনুষ্কার হাতে দিলেন : ‘নাও, বন্ধুকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াও৷’ ইলিনার দিকে তাকালেন : ‘লজ্জা কোরো না, ইলিনা—পেট ভরে খাবে৷ তা কেমন লাগছে বলো৷ এনজয় করছ তো?’
ইলিনা সামান্য হেসে ঘাড় নাড়ল৷ নীচু গলায় বলল, ‘করছি—এনজয় করছি৷’
‘গুড—ভেরি গুড৷’ জোরে হেসে উঠলেন বাপি৷ তারপর চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন : ‘হ্যাঁ, ভালো কথা৷ তুমি ফেরার সময় হলে বোলো৷ তোমাকে বাড়িতে ড্রপ পরে দেব…৷’
বাপি সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলেন৷
ঘরে ঢুকে ইলিনার সামনে প্লেটটা এগিয়ে দিল অনুষ্কা : ‘নাও—খেয়ে নাও৷’
ইলিনা প্লেটটা নিয়ে বিছানায় বসল৷ ওর খুব খিদে পাচ্ছিল৷ খাবারগুলো সামনে পেয়ে খিদেটা যেন অনেক বেড়ে গেল৷ মনজিনিসের ফিশ এনভেলাপ, চিকেন বার্গার—তার পাশে দুটো বড় সন্দেশ৷
খাওয়া শুরু করার আগে ও অনুষ্কাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি খাবে না?’
ইলিনা জানত অনুষ্কা কী বলবে৷ কারণ, স্কুলে টিফিন শেয়ার না করার ব্যাপারটা ওর মনে ছিল৷
অনুষ্কা ঠিক তাই বলল, ‘নাঃ, আমার খিদে নেই—৷’
ইলিনা চিকেন বার্গারে কামড় বসিয়ে হাসল : ‘তোমার দেখছি কখনও খিদে-টিদে পায় না৷’
অনুষ্কা অস্বস্তি পেয়ে হাসল, বলল, ‘বোধহয় তাই৷ ডাক্তার দেখাব ভাবছি—৷’
এরপর ওদের গল্প ঘুরে গেল গানের দিকে৷ বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখন অনেকটা কমে এসেছে৷
অনুষ্কা যে মাইকেল জ্যাকসনের ভক্ত সেটা দেওয়ালের পোস্টারটা দেখেই বোঝা গিয়েছিল৷ তার সঙ্গে জানা গেল ও নিজেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের চর্চা করে৷
ইলিনার গানের ‘চর্চা’ বলতে শুধু গান শোনা৷ ওর প্রিয় বিষয় হল ছবি আঁকা আর ট্যাটুর ডিজাইন৷ দেওয়ালে লাগানো পূর্ণিমার রাতের ছবিটা অনেকক্ষণ ধরেই ওর চোখ টানছিল৷ তাই ও হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘এই ছবিটা এখানে কী জন্যে লাগিয়েছ? এটার কি স্পেশাল কোনও ব্যাপার আছে?’
অনুষ্কা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘না, মানে… স্পেশাল কোনও ব্যাপার নেই৷ ছবিটা আমার ভালো লাগে, তাই—৷’
‘ওরে বাবা, আমার তো ওটার দিকে তাকালেই গা-টা কেমন শিরশির করছে! ভয়-ভয় করছে৷ ওই বাড়িটা যেন কেমন৷’
হাসল অনুষ্কা : ‘আমার ভয়-টয় একটু কম…৷’
অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ হঠাৎই ওর মনে একটা প্রশ্ন উঠে এল৷
অনুষ্কা ওকে আজ হঠাৎ বাড়িতে ‘নেমন্তন্ন’ করল কেন? আগে ও যখন গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেছে তখন অনুষ্কা এতটুকুও আগ্রহ দেখায়নি৷ অথচ আজ হঠাৎ উলটো ব্যাপার৷
তা হলে কি অনুষ্কা স্কুলের ওই ভয়ানক কাণ্ডটা ইলিনার কাছ থেকে সামনাসামনি বসে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে শুনতে চেয়েছিল? সব শোনার পর সেটা নিয়ে গোয়েন্দার মতো অনেক প্রশ্নও করেছে ও৷ ওর কথাবার্তায় ইলিনার মনে হয়েছে অনুষ্কা যেন এই রহস্যের গভীর পর্যন্ত জানে৷ কারণ, ও বলেছে, ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
খাওয়া শেষ করে ইলিনা উঠে দাঁড়াল৷ পড়ার টেবিলে রাখা একটা জলের বোতল ওর দিকে এগিয়ে দিল অনুষ্কা৷ আলতো গলায় বলল, ‘তুমি খুব সাবধানে থেকো৷’
ঢকঢক করে জল খেল ইলিনা৷ তারপর বিছানা থেকে ওর স্কুল-ব্যাগটা তুলে নিল : ‘রাত হয়ে যাচ্ছে—এবার আমি যাই…৷’
ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা দুজনে সিঁড়ির দিকে এগোল৷
.
৷৷ছয়৷৷
অনুষ্কাকে ঘিরে ইলিনার মনে কিছু প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা আর রহস্য তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু ওর প্রতি অলৌকিক এক টান এইসব দ্বিধা আর সংশয়কে ফিকে করে দিয়েছিল৷ শুধু একটা কথা ওর কানে বারবার বেজে উঠছিল : ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
ক্লাসের পড়ায় ইলিনার মন বসছিল না৷ ও একটা খাতার শেষ পাতায় একটা ট্যাটুর ডিজাইন আঁকছিল : একটা ফুল—তাকে ঘিরে দুটো সাপ৷ এই নকশাটার মধ্যে কী আছে কে জানে! এটা অনুষ্কার এত প্রিয় কেন?
ইলিনা আজ সমর্পিতা আর সজনীর মাঝে বসেছে৷ ক’দিন ধরেই তাই বসছে৷ সমর্পিতার পাশে বসলে ও কেমন যেন ভরসা পায়৷ ওর মনে হয়, কোনও বিপদ-আপদ হলে দশাসই সম্পি সেটা ঠিক রুখে দেবে৷ কিন্তু ঠিক কীরকম বিপদ-আপদ সেটা ইলিনা জানে না৷
অরুণিমা ম্যাডাম বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন৷ ওঁর ভীষণ রোগা চেহারা, মাথায় অনেক সাদা চুল৷ খুব শিগগিরই রিটায়ার করে যাবেন৷ ক্লাসে শুধু হাই তোলেন আর চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েন৷
অরুণিমা ম্যাডাম খুব ঠান্ডা আর ভালোমানুষ টাইপের৷ পড়া না পারলে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা বকাবকিও করেন না৷ শুধু ক্লাসে গোলমাল না করলেই হল৷
সেই ‘নিয়ম’ মেনে ইলিনারা চাপা গলায় কথা বলছিল৷
ইলিনা ট্যাটু আঁকা থামিয়ে হঠাৎ বলল, ‘সম্পি, তোর সেই শাড়ির পাড়ের ডিজাইনের গল্পটা তো দেখলাম অনেকেই জেনে গেছে৷ বড়দিকে তুই কী বলেছিলি মনে নেই—যে সবটাই তোর দেখার ভুল?’
সম্পি বাঁকাভাবে হাসল৷ বলল, ‘সবাই যা বলে তাই করে নাকি? আমি ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা একটু রটিয়ে দিয়েছি৷’
সজনী জিগ্যেস করল, ‘কেন রে?’
‘যাতে কথাটা সেই শয়তান ম্যাডামের কানে যায়৷ তা হলে সেই ম্যাডাম একটু চাপে থাকবে৷’
‘চাপে থাকলে কী হবে?’
‘দেখাই যাক না কী হয়৷’ ঠোঁট টিপে বলল সম্পি, ‘হয়তো শয়তান ম্যাডামটা চালে কোনও ভুল করে ফেলতে পারে…৷’
হঠাৎই সম্পি প্রসঙ্গ পালটে ইলিনাকে জিগ্যেস করল, ‘সেদিন দেখলাম তুই ছুটির সময় অনুষ্কার গাড়িতে উঠলি…৷’
ইলিনা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না৷ ওকে বলেছিলাম—তাই ও আমাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়েছে৷’
‘ওরা খুব বড়লোক, না রে?’ সজনী গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল৷
‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল ইলিনা : ‘তবে অনুষ্কা বলছিল, ও সব জানে৷ ও তোকে—’ সম্পির দিকে তাকাল ইলিনা : ‘খুব কেয়ারফুল থাকতে বলেছে, কোনও রিসক নিতে বারণ করেছে৷’
সম্পি এ-কথায় ভয় তো পেলই না, উলটে ‘ডোন্ট কেয়ার’ হাসি হাসল৷ তারপর কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করল, ‘অনুষ্কা সব জানে মানে?’
‘কী জানি! সেসব ক্লিয়ার করে বলেনি৷’
‘তোরা চিন্তা করিস না৷ ব্যাপারটার পেছনে আমি লেগে আছি৷’
‘তুই কিন্তু কেয়ারফুল থাকিস…৷’ ইলিনা ফিসফিস করে সম্পিকে আবার বলল৷
সম্পি কোনও কথা বলল না৷ শুধু চোখের ইশারায় বোঝাল, ও কেয়ারফুল থাকবে৷
বাংলা ব্যাকরণের পর আরও দুটো ক্লাস পার হয়ে গেল৷ সম্পি কেমন যেন ছটফট করছিল৷ কোনও কিছুতেই ঠিকমতো মন বসাতে পারছিল না৷
ইলিনা খেয়াল করেছে, সম্পি ক’দিন ধরেই স্কুল ক্যাম্পাসের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ওই মরা গাছটার কাছে গিয়ে তার আশপাশটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে৷ গত পরশু স্কুল ছুটি হওয়ার পর ও সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলাইদার সঙ্গে কীসব যেন কথাবার্তা বলছিল৷ তারপর গতকাল টিফিনের সময় আগাছার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক চষে বেড়াচ্ছিল৷
ব্যাপারস্যাপার দেখে ইলিনার মনে হচ্ছিল, সমর্পিতা যেন শখের গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে৷ এটা যেমন ইলিনাদের চোখে পড়ছে তেমন অন্যদেরও নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে৷ তা হলে সেই রাতের ওই ভয়ংকর তিনজন…তারাও নিশ্চয়ই সমর্পিতার পাগলামো দেখছে৷ তারপর যদি…৷
ইলিনা আর ভাবতে পারছিল না৷ অনুষ্কার রহস্যময় কথাগুলো ওর মাথার ভেতরে ঝড় তুলছিল৷
টিফিনের পরের পিরিয়ডটায় রনিতা ম্যাডামের ইতিহাস৷ তিনি ক্লাসে এসে নিজস্ব বিরক্তিকর স্টাইলে পড়াতে লাগলেন৷ তারপর আজকের ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে সম্পিকে বেছে নিলেন৷ যত কঠিন-কঠিন প্রশ্ন ওর দিকে ছুড়ে দিলেন৷
সম্পি প্রায় কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছিল না৷ ফলে ওকে হেনস্থা করার সাফল্যে রনিতা ম্যাডামের চোখ চকচক করছিল৷
সমর্পিতাকে বাঁচানোর জন্য অনুষ্কা বারবার উত্তর দিতে চেয়ে হাত তুলছিল, কিন্তু রনিতা ম্যাডাম সেটা যেন দেখেও দেখছিলেন না৷
একসময় তিনি ঠান্ডা চোখে অনুষ্কার দিকে তাকালেন৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধারালো গলায় কেটে-কেটে বললেন, ‘আমি জানি তুমি সব জানো৷ কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি কিছু জানতে চাইছি না৷’
সম্পিকে যাচ্ছেতাইভাবে নাস্তানাবুদ করার পর ওকে ভালোরকম বকাবকি করলেন রনিতা ম্যাডাম৷ তারপর বললেন, ‘তুমি ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবে৷ তোমাকে ঠিক পথে আনা দরকার…৷’
সম্পি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ল৷
ইলিনা লক্ষ করল, সম্পির মুখচোখ লাল৷ প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা৷
রনিতা ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর সম্পি ইলিনাকে বলল, ‘সবাই জানে আমি পড়াশোনায় বাজে…তাও কেন যে আমাকে রনিতা ম্যাডাম হ্যারাস করলেন কে জানে! আমার কপালে নির্ঘাত গার্জেন কল ঝুলছে৷’
ইলিনা আর সজনী ওকে ভরসা দিতে লাগল৷
আকাশে কালো-কালো মেঘের ছানা ভেসে বেড়াচ্ছিল৷ বৃষ্টি এখনও শুরু হয়নি—তবে যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷ জানলা দিয়ে বড়-বড় গাছের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছিল৷ এলোমেলো বাতাসে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে৷
সম্পিকে দেখে মনে হল, ও যেন একটু দমে গেছে৷ চুপচাপ কী যেন ভাবছে৷
ইলিনা বারবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, কী হয়েছে?’
সমর্পিতা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, কিছু না…৷’
ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ ওর মনে হল, ডাকাবুকো সম্পি ভয় পেয়েছে৷
শেষ পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে সম্পি একবার টয়লেটে যাওয়ার নাম করে বেরোল৷
ইলিনার কী মনে হল, সম্পির পিছন-পিছন ও-ও বেরিয়ে এল বারান্দায়৷ দেখল, সম্পি বারান্দার রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে ক্লাস নাইন-বি-র একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷
মেয়েটার নাম নিনা৷ সম্পিদের পাড়ায় থাকে—ওর বন্ধুও৷ আর সম্পির মতো নিনারও একটু ভয়ডর কম৷
ইলিনা চটপট ক্লাসে ফিরে এল আবার৷ একটু পরে সম্পি ফিরে এসে ওর পাশে বসল৷
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শম্পা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন৷
শম্পা ভূগোল পড়ান এবং খুব ভালো পড়ান৷ কিন্তু শেষ পিরিয়ডে ইলিনার হাই উঠছিল৷ ভাবছিল কখন ছুটি হবে, স্কুল বাসে করে বাড়ি যাবে৷
ও সম্পিকে বলল, ‘নিনার সঙ্গে কী কথা বলছিলি?’
সম্পি কী যেন চিন্তা করছিল, চটকা ভেঙে বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের কাছে যাওয়ার সময় ওকে সঙ্গে নেব ভেবেছিলাম৷ তাই ওকে বলছিলাম৷ কিন্তু ওর কাজ আছে—বাড়ি ফেরার তাড়া আছে…৷’
‘ওকে সঙ্গে নিবি কেন?’
‘না, মানে…যদি কোনও প্রবলেম হয়…৷’
‘কী প্রবলেম?’
‘যদি বকাবকি করে, মারধর করে………তারপর গার্জেন কল……৷’ একটু থেমে সম্পি আবার বলল, ‘যাকগে, যা হয় হবে৷’
‘আমি তোর সঙ্গে যাব?’ ইলিনা জিগ্যেস করল৷
সমর্পিতা একলহমা কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ‘নাঃ, থাক—দরকার নেই৷ দেখি না কী হয়!’
এরপর ও আর কোনও কথা বলল না৷ অন্যমনস্কভাবে শম্পা ম্যাডামের ভূগোল পড়ানো শুনতে লাগল৷
ইলিনা বুঝতে পারছিল, সম্পি কেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে৷ কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না৷
কিন্তু কোনও টিচার পড়া না পারার জন্য সম্পিকে টিচার্স রুমে ডেকে পাঠাচ্ছেন এটা তো সম্পির কাছে নতুন নয়! তা হলে ও এরকম ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?
এসব ভাবতে-ভাবতে ইলিনা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল৷ আকাশের কালো-কালো মেঘের ছানাগুলো কখন যেন একজোট হয়ে পড়েছে৷ এখন ওদের কালো দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে৷ ওদের ঘন কালো শরীর ভেদ করে বিদ্যুতের রুপোলি তরোয়াল মাঝে-মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে৷ আর তারপরই গম্ভীর চাপা গর্জন৷
কখন যেন ছুটির ঘণ্টা পড়ল৷ গোটা ক্লাস সঙ্গে-সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল৷ কথার ফুলঝুরি ছিটকে পড়তে লাগল চারিদিকে৷
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি রওনা হতে হবে এই চিন্তায় সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিল৷ কিন্তু সম্পি চুপচাপ বসে রইল৷ ধীর স্থির গম্ভীর৷
ইলিনা আর সজনী ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সম্পির দিকে একবার তাকাল৷ ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘কী রে, তোর সঙ্গে থাকব?’
‘না, না—তুই বাড়ি যা৷’ চটপট বলল সম্পি, ‘আমি একা ম্যানেজ করে নেব৷’
ইলিনার মনে হল, সমর্পিতা চায় না ওকে কেউ ভিতু বলুক৷
ও এখন মনের ভেতরে বাড়তি সাহস তৈরি করছে৷
ক্লাসরুম যখন ফাঁকা হয়ে গেল তখন সম্পি উঠে দাঁড়াল৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে চলে এল বাইরের অলিন্দে৷ অলিন্দ ধরে খানিকটা এগোলেই একটা বড় চৌকো চাতাল৷ তাকে ঘিরে কাস্ট আয়রনের ঢালাই করা নকশা কাটা রেলিং৷
দোতলার এই চাতালটাকে অনেকটা ছাদের মতো দেখায়৷ চাতালের গা ছুঁয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া আর একটা কাঁঠাল গাছ উঠেছে৷
চাতালের একপাশে বেশ বড়সড় টিচার্স রুম৷ সম্পি কোনাকুনিভাবে চাতালটা পেরিয়ে টিচার্স রুমের কাছে গেল৷ তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷
রুমের চওড়া দরজায় বাদামি রঙের ভারী পরদা ঝুলছে৷ পরদার পাশ দিয়ে ঘরটা একচিলতে দেখা যাচ্ছে৷ আর ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷
চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল সমর্পিতা৷ নিজেকে সাহস জোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল৷ রনিতা ম্যাডাম আর যা-ই করুন নিশ্চয়ই মারধোর করবেন না!
বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সম্পি৷ ওর হাত সামান্য কাঁপছে নাকি?
দূর! যা হয় হবে!
এক হাতে ভারী পরদা সরাল ও৷ তারপর জুতোয় শব্দ তুলেই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল৷
ঘরে মাত্র দুজন টিচার : রনিতা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ ওঁরা পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে হোম লোন আর ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট নিয়ে কীসব আলোচনা করছিলেন৷ সমর্পিতাকে দেখেই ওঁরা চুপ করে গেলেন৷ তারপর রনিতা বললেন, ‘এসো, সমর্পিতা, এসো…৷’
রবিনা ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন৷ ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সমর্পিতা ছোট্ট করে হাসল৷ কিন্তু ম্যাডাম ওর দিকে তাকালেন শুধু—হাসলেন না৷ টেবিলে রাখা নস্যি রঙের কাঁধব্যাগটা তুলে নিয়ে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ ওঁর হাবভাব দেখে মনে হল তিনি যেন সমর্পিতার ঘরে ঢোকার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷ নিশ্চয়ই রনিতা ম্যাডাম ওঁকে বলে রেখেছিলেন যে, সম্পিকে তিনি কথা বলার জন্য টিচার্স রুমে ডেকে পাঠিয়েছেন৷
টিচার্স রুমে ঢুকে সবচেয়ে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল প্রকাণ্ড একটা টেবিল৷ টেবিলটা প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া৷ মেহগনি কাঠের তৈরি, ঝকঝকে পালিশ৷ টেবিলের আটটা পায়া আটটা সিংহের থাবা৷ টেবিলের নানান নকশা আর কারুকাজ দেখে বোঝা যায় এ টেবিল ব্রিটিশ আমলের কনফারেন্স টেবল৷
ঘরের একপাশে চারটে কাঠের আলমারি, আর তার পাশে একটা স্টিলের আলমারি৷
তার ঠিক বিপরীতে একটা কাঠের র্যাক—তাতে অনেকগুলো ক্লাস রেজিস্টার, চকের বাক্স আর ডাস্টার৷ র্যাকের পাশে বড়-বড় তারিখওয়ালা একটা ক্যালেন্ডার৷
ঘরে তিনটে চার ব্লেডের সিলিং ফ্যান—তবে এখন একটা চলছে৷ তার হাওয়ায় রনিতা ম্যাডামের কানের পাশে চুল উড়ছে৷
আকাশ মেঘলা থাকায় ঘরে দুটো টিউবলাইট জ্বলছে৷ রনিতা ম্যাডামের পিছনে তিনটে বিশাল-বিশাল জানলা—সম্পিদের ক্লাসরুমের মতো৷ খোলা জানলা দিয়ে আকাশের মেঘ দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাতাসে মাথা ঝাঁকানো পাগল গাছপালা৷
কোকিলের ডাক শুনতে পেল সম্পি৷ এই ডাকটা ওকে যেন ভরসা জোগাল৷
সম্পি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বসেনি৷ কারণ, ম্যাডাম ওকে বসতে বলেননি৷
টেবিলের এপার থেকে ও রনিতা ম্যাডামকে দেখছিল৷
রনিতা ম্যাডামের সামনে তিন-চার ভাগে ভাগ করে রাখা ক্লাস টেস্টের খাতা৷ খাতার ওপরে লোহার পেপার-ওয়েট চাপানো৷ খাতার পাতার কোনাগুলো পাখার হাওয়ায় উড়ছে৷
খাতাগুলোর পাশে রনিতার কাঁধ-ব্যাগ৷ গাঢ় নীল রঙের ব্যাগ—ব্যাগের খোলা মুখ দিয়ে ছাতার রঙিন বাঁট দেখা যাচ্ছে৷
‘এদিকে এসো, সমর্পিতা—এপাশটায় এসো…৷’ হাতের ইশারায় ওকে নিজের কাছে ডাকলেন ম্যাডাম৷
‘না, ম্যাডাম—এখানেই ঠিক আছি৷’ কথা বলতে-বলতে হাতে ঝোলানো স্কুল-ব্যাগটা টেবিলের ওপরে রাখল সম্পি৷
হাসলেন রনিতা ম্যাডাম৷ বললেন, ‘কোনও ভয় নেই, সমর্পিতা— এপাশটায় এসো, আমার কাছে এসো৷ তোমাকে আমি কানও মুলব না, মারধোরও করব না৷ তবে হ্যাঁ—’ চওড়া করে হাসলেন রনিতা : ‘একটু বকাবকি হয়তো করব৷ এসো…এপাশটায় এসো—৷’
এরপর আর আপত্তি করা যায় না৷
টেবিলের পরিসীমা ধরে ধীরে-ধীরে এগোতে শুরু করল সমর্পিতা৷ ম্যাডাম মুখে বলছেন বটে ‘কোনও ভয় নেই’, কিন্তু যদি রাগের মাথায় কান-টান মুলে দেন! তা হলে কিন্তু বড় প্রেস্টিজের ব্যাপার হবে৷
‘আজকাল তোমার পড়াশোনায় একটুও মন নেই কেন বলতে পারো?’ বকুনির পালা শুরু করে দিলেন রনিতা : ‘ক্লাসে সবসময় দেখি অন্যমনস্ক৷ এরকম করলে তো তোমার রেজাল্ট অনেক নীচে নেমে যাবে!’
সমর্পিতা ততক্ষণে ম্যাডামের বেশ কাছে পৌঁছে গেছে—তবে মোটেই হাতের নাগালের মধ্যে নয়৷ কাঁচমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ও ম্যাডামের ভর্ৎসনা গায়ে মাখছিল৷
‘আজও ক্লাসে দেখলাম তুমি কোনও পড়া বলতে পারছ না৷ ইতিহাস বলে যে একটা সাবজেক্ট আছে সেটাই বোধহয় তুমি ভুলে গেছ৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন রনিতা : ‘সত্যি করে বলো তো, তোমার কী প্রবলেম হয়েছে? লেখাপড়া ছেড়ে তুমি এখন কী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?’
সমর্পিতা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ মিনমিনে গলায় বলল, ‘কিছু নিয়ে তো মাথা ঘামাচ্ছি না, ম্যাডাম—পড়ছি…৷’
‘ছাই পড়ছ!’ ধমকে উঠলেন রনিতা, ‘আসলে তুমি স্কুলের ওই অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে বড্ড বেশি ইনভলভড হয়ে পড়েছ, তাই না?’
সমর্পিতা চুপ করে রইল৷
জানলার বাইরে মেঘ ডাকল৷ বৃষ্টিও জোরে শুরু হল৷ রনিতা বৃষ্টির শব্দে জানলার দিকে একবার তাকালেন৷ তারপরই ব্যাগ থেকে ছাতাটা টেনে বের করে নিজের হাতের কাছে রাখলেন৷
সম্পিকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাডামের ধৈর্য কয়েক ডিগ্রি কমে গেল৷
‘চুপ করে আছ কেন? বলো৷ পরানের অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথটা নিয়ে তুমি একটু বাড়াবাড়ি রকমের ইনভলভড হয়ে পড়েছ না?’
সমর্পিতা আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ আলতো গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ নয়—মার্ডার৷’
‘তোমাকে কে বলেছে মার্ডার?’ ধৈর্য আরও কমে গেল : ‘পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে যা রিপোর্ট দেওয়ার দিয়ে দিয়েছে৷ তা ছাড়া সবাই জানে এই স্কুলটা একটু ইয়ে…মানে, ভূতুড়ে…একটু দোষ আছে৷ আর সেদিন রাতে তুমি বা রবিনা যা দেখেছ সবটাই—৷’
‘হ্যালুসিনেশান৷ আমাদের দেখার ভুল—তাই তো?’ ম্যাডামের কথার খেই ধরে সমর্পিতা বলল৷
সম্পির কথার সুরে ব্যঙ্গ আর বিদ্রোহের ছোঁয়া পেয়ে রনিতা খেপে উঠলেন : ‘তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! শিক্ষা-দীক্ষা পাওনি? বাজে নোংরা মেয়ে!’
সম্পির মাথায় আগুন জ্বলে গেল৷ ও ভুলে গেল কাকে কী বলছে৷ ক্ষিপ্ত গলায় ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি বাজে নোংরা মেয়ে! তুই কী? তোর সেই শাড়িটা কোথায়? ওই যে, পাড়ের কাছে শঙ্খের ডিজাইন করা৷ যেটা পরে সেদিন অন্ধকারে ছাতা মাথায় দিয়ে ওই মরা গাছটায় হনুমানের মতো লাফাচ্ছিলি৷ শাড়িটা আছে, না পুড়িয়ে ফেলেছিস?’
ঘরের ভেতরে যেন বাজ পড়ল৷ সম্পির কথাগুলো বুলেটের মতো বিঁধে গেল রনিতা ম্যাডামের গায়ে৷
.
৷৷সাত৷৷
ওঁর মুখটা অলৌকিকভাবে পালটে যেতে লাগল৷ গাল দুটো বসে গেল৷ রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল! ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গিয়ে দুটো কালো অন্ধকার গর্ত তৈরি হল৷ সেই গর্তের কেন্দ্রবিন্দুতে দুটো উজ্জ্বল সাদা ফুটকি—হাই পাওয়ারের জোনাকির মতো জ্বলছে৷
রনিতা ম্যাডাম অদ্ভুত এক কর্কশ গলায় বললেন, ‘তোর লপচপানি বড্ড বেড়েছে৷ তোকে ঠিক পথে আনা দরকার৷ আমাদের যে কতটা শক্তি তুই জানিস না…৷’
সম্পি ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল৷ গল্পে পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা আজগুবি ব্যাপারটা যে ওর চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে সেটা কিছুতেই ও বিশ্বাস করতে পারছিল না৷ ওর ভেতর থেকে সমস্ত বেপরোয়া ভাব আর সাহস চুঁইয়ে-চুঁইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল৷ ভয়ে ওর জিভ শুকিয়ে গেছে, পা দুটো মেঝেতে এঁটে বসেছে৷
খপ করে হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা একটা পেপারওয়েট তুলে নিলেন রনিতা৷ ওঁর হাতের আঙুলগুলো কেমন কালো-কালো হাড্ডিসার হয়ে গেছে৷ আর আঙুলের নখগুলো এখন কেমন লম্বা আর বাঁকানো৷
রনিতা খলখল করে হাসলেন৷ তারপর কর্কশ গলায় বললেন, ‘এটা খুব ছোঁয়াচে রোগ৷ কী করে কখন যে হয়ে গেছে একটুও টের পাইনি৷ তোর গায়ে একটা কামড় বসালে তুইও একপলকে আমাদের মতন হয়ে যাবি৷ তখন তেষ্টায় পাগল হয়ে ঘুরবি…আর যদি মরণকামড় দিই তা হলে তুই পরানের মতো শেষ হয়ে যাবি৷ সে-রাতে পরানকে শুষে শেষ করে আমরা আনন্দে ওই মরা গাছটায় নাচানাচি করছিলাম৷ তুই কি চাস আরও একবার তাই করি?’
আকাশে এমনভাবে বিদ্যুৎ চমকাল যেন মেটাল হ্যালোজেন বাতি ঝলসে উঠল৷ সমর্পিতা আর রনিতা ম্যাডামের মুখে-গায়ে সাদা আলো ঝিলিক মেরেই মিলিয়ে গেল৷
সমর্পিতা অনেক কিছুই করার কথা ভাবছিল, কিন্তু কোন এক অলৌকিক অভিশাপ ওকে যেন পায়ে পেরেক ঠুকে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷
ও একবার খোলা দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, আর-একবার জানলার দিকে৷ ও কি একছুটে বাইরের চাতালে চলে যেতে পারবে? তারপর চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারবে না? কিন্তু এখন কি ম্যাডামরা কেউ আছেন? বড়দিও হয়তো বাড়ি চলে গেছেন৷ এখন শুধু সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের লোকজনই যা ভরসা৷ কিন্তু এখান থেকে চিৎকার করলে সেই আওয়াজ কি সার্ভেন্টস কোয়ার্টার পর্যন্ত পৌঁছবে? এই বৃষ্টিতে কেউ কি আসবে?
সম্পি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল৷ ওই তো, রনিতা পিশাচটা খলখল করে হাসছে৷ ওকে ঠেকাতে কিছু একটা করতে হবে, করতেই হবে৷
সম্পি হঠাৎ কোথা থেকে শক্তি খুঁজে পেল কে জানে! ও দু-হাতের দুটো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিল টেবিলে৷ ভয়ংকর শব্দ হল৷ বিশাল টেবিলটা থরথর করে কেঁপে উঠল৷
আর রনিতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠলেন৷ তারপর বড় করে হাঁ করলেন৷
টিউবলাইটের আলোয় পিশাচের দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল৷ সম্পির দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
রনিতার দু-পাটিতেই হাঙরের মতো কয়েক সারি করে ইস্পাতের দাঁত৷ ঝকঝকে এবং ছুঁচলো৷
পপকর্ন খাওয়ার ভঙ্গিতে লোহার পেপারওয়েটটা হাঁ করা মুখের ভেতরে ছুড়ে দিলেন৷ তাপর কড়মড়-কড়মড় করে ওটা চিবোতে লাগলেন৷ ঠিক যেন তালমিছরির ডেলা চিবিয়ে গুঁড়ো করছেন৷
একটু পরেই লোহার গুঁড়ো থু-থু করে টেবিলে উগরে দিলেন রনিতা৷ তারপর পাতলা ঠোঁটের ওপরে কয়েকবার জিভ বুলিয়ে নিয়ে সম্পিকে লক্ষ করে হাসলেন৷
সম্পির শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজলের স্রোত নেমে গেল৷ এই পিশাচের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব৷ সম্পি একমাত্র পালানোর চেষ্টা করতে পারে৷ কিন্তু পা দুটো যে কিছুতেই নড়তে চাইছে না৷
টেবিলে ঘুসি মারার পর থেকেই সম্পির দু-হাতের মুঠো ব্যথা করছিল৷ ও হাত কচলে ব্যথা তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ কিন্তু ভয়…ভয়টা তাড়ানো যায় কেমন করে?
রনিতা ঘষা-ঘষা গলায় বললেন, ‘শোন মেয়ে, এই মুহূর্তে তুই যা-যা দেখছিস সবই তোর দেখার ভুল৷ এ-কথা মনে থাকে যেন! সব হ্যালুসিনেশান৷’ তারপর একটু রাগি কর্কশ স্বরে বললেন, ‘তোর সাহস তো কম নয়! আমাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে আসিস! এই দেখ…৷’
সমর্পিতাকে দিশেহারা কাবু অবস্থায় পেয়ে রনিতা যেন বেশ মজা পেয়ে গেছেন৷ ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে টিউবলাইটগুলোর দিকে একবার তাকালেন৷ তারপর ক্ষণপ্রভার গতিতে চোখের পলকে পৌঁছে গেলেন দেওয়ালে গাঁথা ইলেকট্রিক ওয়ারিং-এর কাছে৷ তারগুলোর ওপরে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷
আলোর ফুলকি ছিটকে বেরোল৷ ‘ফট’ করে একটা শব্দ হল৷ এবং ঘরের আলো নিভে গেল৷ ঘুরন্ত পাখার গতি কমতে লাগল৷
ঘরটা কেমন অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেল৷ জানলার বাইরে মেঘ আর বৃষ্টি যেন অকালসন্ধ্যা তৈরি করে দিয়েছে৷ সম্পির চোখের সামনে রনিতা ম্যাডামের অপচ্ছায়া৷ তাঁর চোখের অন্ধকার কোটরে দুটো সাদা আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ আর একইসঙ্গে শোনা যাচ্ছে চাপা খিলখিল হাসি৷
কর্কশ গলায় পিশাচটা বলল, ‘এবার বুঝেছিস, আমাদের কী শক্তি! আজকের এসব ব্যাপার কাউকে বলবি না৷ কাউকে না৷ যদি বলিস, তা হলে—যা বললাম—তুইও পরানের মতো হয়ে যাবি…৷’
এমন সময় তীব্র বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷
সেই কানফাটানো আওয়াজে সম্পির আতঙ্কের ঘোরটা হঠাৎই কেটে গেল৷ ও ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করতে শুরু করল এবং কোন এক শক্তিতে খোলা দরজার দিকে মরণপণ ছুট লাগাল৷
পিশাচটা ছুটন্ত সম্পিকে লক্ষ করে লাফ দিল৷ দু-লাফে পৌঁছে গেল দরজার কাছে৷
কিন্তু সম্পি ততক্ষণে বাইরের চাতালে এসে পড়েছে৷ ঝুপুস বৃষ্টি ওকে যেন হারানো শক্তি ফিরিয়ে দিল৷ ও ফিরে তাকাল টিচার্স রুমের দরজার দিকে৷
রনিতা ম্যাডাম সম্পিকে তাড়া করার ঝোঁকে টিচার্স রুম ছেড়ে চাতালে এসে পড়েছিলেন৷ কিন্তু বৃষ্টির জল গায়ে পড়তেই আঁতকে উঠলেন৷ এমনভাবে কাতরে উঠলেন যেন বৃষ্টির ফোঁটায় গায়ে ফোসকা পড়ছে৷
যন্ত্রণার ‘উঃ! আঃ!’ শব্দ করে রনিতা একলাফে টিচার্স রুমে আবার ঢুকে গেলেন৷
সম্পি সেটা দেখে অবাক হয়ে অঝোর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল৷ বৃষ্টির জলে কী এমন শক্তি আছে যে, এই পিশাচগুলো বৃষ্টির জলের ‘জ্বালা’ সইতে পারে না?
টিচার্স রুম এখন বেশ অন্ধকার৷ তাই রনিতা ম্যাডামকে সম্পি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না৷ কিন্তু ম্যাডাম ঘরে ঢুকে পড়ার আগে সম্পি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে৷ ওঁর শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ামাত্রই সেখান থেকে সাদা ধোঁয়া বেরিয়েছে৷ গরম লোহার শিক আচমকা জলে ডোবালে যেমনটা হয়৷
তা হলে কি সত্যি-সত্যিই বৃষ্টির ফোঁটায় এই পিশাচগুলোর ছ্যাঁকা লাগে? সেইজন্যই কি সেই ভয়ংকর রাতে এদের মাথায় ছাতা ছিল?
সম্পি তখনও চিৎকার করছিল : ‘কে কোথায় আছ, শিগগির এসো! দোতলায় আগুন লেগেছে—আগুন!’
কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাপারটা বুঝে ফেলার পর ওর হারানো সাহস খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল৷ তা ছাড়া ও লোকজনের ছুটে আসার শব্দ পাচ্ছিল৷
সম্পি আঁজলা করে বৃষ্টির জল ধরতে লাগল৷ এবং এগোতে লাগল টিচার্স রুমের দিকে৷ ওর ভেতরে এখন একটা রাগ টগবগ করে ফুটছিল৷
রনিতা ইলেকট্রিকের তারে কামড় বসানোমাত্রই শর্ট সার্কিট হয়ে স্কুল বিল্ডিং-এর অনেকটা অংশের আলো নিভে গেছে৷ সেই সময় দুজন দারোয়ান রোজকার মতো একতলার ঘরগুলোর জানলা-দরজা বন্ধ করে দরজায়-দরজায় তালা দিচ্ছিল৷ আচমকা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ওরা হকচকিয়ে যায়৷ আর তারপরই সম্পির চিৎকার ওদের কানে এল৷
সম্পির চিৎকার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারেও পৌঁছেছিল৷ সেখান থেকে বলাইদা আর মলিনাদি হন্তদন্ত হয়ে এসে দারোয়ানদের সঙ্গে জড়ো হল৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করল৷ বুঝতে পারল, চিৎকারটা দোতলার চাতাল থেকে আসছে৷
তা হলে কি দোতলাতেই আগুন লেগেছে?
কিন্তু ওরা চারজনে চাতালে এসে কাউকে দেখতে পেল না৷ আর আগুনও দেখতে পেল না৷
কারণ, সম্পি তখন বৃষ্টির জল আঁজলা করে নিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷ ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ সারা গা সপসপে ভেজা৷ মাথার চুল থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে৷ চুলের গোছা কপালের ওপরে নেমে এসেছে৷ আর সেই ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে ওর দুটো রাগি চোখ দেখা যাচ্ছে৷
‘কোথায় গেলি? আয়, সামনে আয়—’ পিশাচকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল ডাকাবুকো মেয়েটা৷
রনিতা তখন একটা আলমারির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লুকোতে চেষ্টা করছেন৷ ওঁর অন্ধকার গর্তের মতো চোখ দুটো সম্পির দিকে তাকিয়ে স্থির৷ আসলে ওরা তখন সম্পির আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের দিকে লক্ষ রাখছিল৷ অপেক্ষা করছিল, কখন সেই চুঁইয়ে পড়া বন্ধ হবে৷ অর্থাৎ মেয়েটার এক আঁজলা জল কখন শেষ হবে৷
জল শেষ হয়ে যাবে বলে সমর্পিতার মনে কিন্তু ভয় ছিল না৷ ও জানে ওর পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ বৃষ্টির জলে ভিজে সপসপে৷ এই অবস্থায় ওর পিশাচটাকে জড়িয়ে ধরার খুব সাধ জাগছিল৷
সম্পি হঠাৎই খেয়াল করল, আলমারির পাশে দাঁড়ানো রনিতার চেহারা ধীরে-ধীরে বদলে যাচ্ছে—স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে আবার৷ একইসঙ্গে দোতলার চাতালে অনেকের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে—কথা বলতে-বলতে কারা যেন টিচার্স রুমের দিকে এগিয়ে আসছে৷
সম্পির হাতের জল শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ রনিতাকে ও এখন আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল৷
রনিতা হিসহিস করে চাপা গলায় বললেন, ‘আজকে যা কিছু দেখলি কাউকে বলবি না৷ তা হলে তোর সর্বনাশ হবে৷ মনে রাখিস, আমি একা নই—আমরা সবাই মিলে তোকে অনায়াসে খতম করে দেব…৷’
রনিতা ম্যাডাম স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে এলেন৷ ঠোঁটে আঙুল তুলে ইশারায় সমর্পিতাকে চুপচাপ থাকতে বললেন৷
‘কই, কোথায় আগুন লেগেছে?’ পুরুষের গলা : ‘ঘর অন্ধকার কেন?’
‘কে অমন চিৎকার করছিল গো?’ মহিলার কণ্ঠস্বর : ‘কী-করে আগুন লাগল বলো দেখি…৷’
সমর্পিতা পিছন ফিরে চারজনকে দেখতে পেল৷ ওরা তখন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হুড়মুড় করে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷
সমর্পিতা কিছু বলে ওঠার আগেই মানুষের ছদ্মবেশে থাকা পিশাচটা বলে উঠল, ‘এই তো, এই তারটা শর্ট সার্কিট হয়ে আর-একটু হলেই আগুন লেগে যাচ্ছিল৷ ভাগ্যিস আমি এই ডাস্টারটা দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে চেপে ধরেছি—৷’
টেবিল থেকে একটা ডাস্টার তুলে নিয়ে দেখালেন রনিতা৷
সম্পি স্থির চোখে ওঁকে দেখছিল৷ পিশাচরা তা হলে অভিনয়টা ভালোই জানে!
রনিতা বললেন, ‘সমর্পিতা থাকায় একটা বড় হেলপ হয়েছে৷ ও সঙ্গে-সঙ্গে ওরকম না চেঁচালে তোমরা কি এত চটপট আসতে?’ সমর্পিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন : ‘থ্যাংক য়ু, সমর্পিতা৷ তোমাকে আমি কাল একটা রিওয়ার্ড দেব…৷’
ঠিক তখনই সাদা আলোর ঝলকানি, আর তারপরই কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷
.
৷৷আট৷৷
সমর্পিতা স্কুল বিল্ডিং-এর বাইরে এসে দাঁড়াল৷ বৃষ্টির তেজ খানিকটা কমে এসেছে৷ মেঘলা আকাশের সঙ্গে সন্ধের অন্ধকার মিশে গিয়ে ছাই রং অনেক গাঢ় হয়েছে৷
সমর্পিতার ব্যাগে ছাতা আছে কিন্তু ও ছাতা বের করল না৷ একে তো ওর সর্বাঙ্গ চুপচুপে ভেজা—ছাতা ওকে নতুন কোনও নিরাপত্তা দিতে পারবে না৷ বরং বৃষ্টির জল ওকে রনিতা ম্যাডামের মতো ভয়ংকর প্রাণীগুলোর হাত থেকে বাঁচাবে৷
সমর্পিতা বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল, থরথর করে কাঁপছিল৷ ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করে শব্দ হচ্ছিল৷ তার সঙ্গে বেশ শীত করছিল৷
ও কালো আকাশের দিকে তাকাল৷ বৃষ্টি উপহার দেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে মনে-মনে কৃতজ্ঞতা জানাল৷
স্কুল বিল্ডিং-এর কাছ থেকে পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেন গেটের দিকে৷ সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল সম্পি৷ হেঁটে যাওয়ার সময় ও বারবার বাঁ-দিকের ঝোপঝাড় আর গাছপালার দিকে তাকাচ্ছিল৷ এই গাছপালার আড়ালে রনিতা ম্যাডামের মতো কেউ লুকিয়ে নেই তো?
কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই ওর মনে হল, যেরকম জোরে বৃষ্টি পড়ছে তাতে খোলা জায়গায় ওরা থাকতে সাহস পাবে না৷ বৃষ্টিতে গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে৷ আর যদি সেদিনের মতো ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরাঘুরির কথা ভাবে তাতেও লাভ নেই৷ কারণ, এ-বৃষ্টি ছাতায় তেমন মানবে না৷
সম্পি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল৷ বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে৷ স্কুল থেকে বেরিয়েই বাস কিংবা অটো পেলে হয়৷
ভেজা পিচের রাস্তায় বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে৷ রাস্তার ধারে লাগানো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলো রাস্তায় পড়ে কমলা রঙের আলোর ফুলকি তৈরি করছে৷ স্কুলের দু-চারজন মেয়ে তাদের গার্জেনের সঙ্গে ফিরছে৷ এ ছাড়া রাস্তাটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা৷ আর দূরের খেলার মাঠটা বৃষ্টিতে ঝাপসা৷
‘এই, সম্পি—৷’
সমর্পিতা চমকে উঠল৷ বুক ধড়াস করে উঠল৷ ডাক লক্ষ্য করে ফিরে তাকাল৷
ও খেয়ালই করেনি, একটা বড় নিমগাছের নীচে দুটো মেয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
ইলিনা আর সজনী৷
ওরা দুজনে সম্পির কাছে এগিয়ে এল৷
‘তোর জন্যে চিন্তা হচ্ছিল৷ তাই বাড়ি যাইনি—ওয়েট করছি৷’ ইলিনা বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম কী শাস্তি দেয় না দেয়৷ আমি ওয়েট করব শুনে সজনীও থেকে গেল৷’
‘তুই ভিজছিস কেন? ছাতা নেই?’ সজনী জিগ্যেস করল৷
‘তুই এরকম কাঁপছিস কেন?’ ইলিনা৷
সমর্পিতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না৷ ইলিনাকে জাপটে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷
ইলিনা হকচকিয়ে গেল৷ কোনও-রকমে ছাতা সামলে সম্পির ভেজা পিঠে হাত বোলাতে লাগল আর বারবার বলতে লাগল, ‘কী হয়েছে রে, সম্পি—কী হয়েছে?’
সম্পি কাঁদতেই থাকল৷ ওর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল৷ আর একইসঙ্গে পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলতে লাগল, ‘কিছু হয়নি, কিছু হয়নি৷’
ইলিনা আর সজনী কিছুতেই ওকে শান্ত করতে পারছিল না৷
একটু পরে দু-পাশ থেকে সম্পিকে জাপটে ধরে ওরা মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল৷ ইলিনার মনে হল, রনিতা ম্যাডাম নিশ্চয়ই সম্পিকে সাংঘাতিক অপমান করেছেন, কিংবা চড়-থাপ্পড় মেরেছেন বা কান মূলে দিয়েছেন৷
ওরা যখন স্কুলের গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন একটা গাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলো ওদের চোখে-মুখে এসে পড়ল৷
আলোর দিকে তাকিয়ে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ওরা স্পষ্ট দেখতে পেল৷ কিন্তু আলোর পিছনে সব অন্ধকার—কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷
গাড়িটা ওদের দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল৷
সেটা দেখে ইলিনারা পিচের রাস্তার পাশে ঘাসজমির দিকে সরে গেল৷ কিন্তু গাড়িটা গতিপথ বদলে ওদের মুখোমুখি এসে পথ আগলে দাঁড়াল৷
ইলিনা একটু ভয় পেয়ে গেল৷ সজনীও৷ গাড়িটা ওদের পথ আগলে দাঁড়াল কেন?
ঠিক তখনই গাড়ি থেকে কে যেন ডেকে উঠল, ‘ইলিনা, এসো—সবাই গাড়িতে উঠে এসো…৷’
অনুষ্কার গলা৷
অনুষ্কা এখনও বাড়ি যায়নি? ছুটির পর এতক্ষণ ধরে ও কী করছে?
ওরা তিনজনে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ দেখল সামনের জানলার কাচটা সামান্য নামানো৷ সেখানে আবছাভাবে অনুষ্কার মুখ দেখা যাচ্ছে৷ ওর পাশেই স্টিয়ারিং-এ ওর বাবা৷
‘তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে এসো—৷’ অনুষ্কা তাড়া দিল৷ গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে গেল৷
সম্পিকে গাড়িতে উঠতে বলল ইলিনা৷ তারপর ছাতা বন্ধ করে নিজে উঠল৷
সজনী ইতস্তত করছিল৷ বলল, ‘আমি বাড়ি যাব—৷’
অনুষ্কা বলল, ‘চিন্তা কোরো না—আমি সবাইকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব৷’
ওরা তিনজনে পিছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল৷
অনুষ্কা ওর বাবার সঙ্গে সম্পি আর সজনীর পরিচয় করিয়ে দিল৷ ওর বাবা গাড়িটা ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বৃষ্টি! তোমরা সব একেবারে ভিজে গেছ দেখছি!’
ইলিনা সৌজন্যের ঢঙে বলল, ‘ও কিছু না, কাকু—বাড়িতে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেব৷’
সমর্পিতার গা ঘেঁষে বসেছিল ইলিনা৷ তাই টের পাচ্ছিল সম্পি তখনও তিরতির করে কাঁপছে৷
ও চাপা গলায়, প্রায় ফিসফিস করে, জিগ্যেস করল, ‘সম্পি তোর কী হয়েছে রে? এবার শান্ত হ৷’
সমর্পিতা অস্পষ্টভাবে বলল, ‘কিচ্ছু না—৷’
অনুষ্কা ওদের কথা শুনতে পেয়েছিল৷ ও নরম সুরে বলল, ‘এখন ওকে ডিসটার্ব কোরো না৷ আমি সব জানি৷ পরে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলব…৷’
সমর্পিতা অবাক হয়ে অনুষ্কার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না৷
ভিজে রাস্তায় গাড়ি চলতে লাগল৷
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সম্পি৷ বৃষ্টি এখনও পড়ছে৷ সেই বৃষ্টির ফোঁটার ঝিলিমিলির আড়ালে রনিতা ম্যাডামের পালটে যাওয়া মুখটা ও দেখতে পাচ্ছিল৷
আজ বৃষ্টি নেই৷ খোলা জানলার বাইরে অন্ধকার৷ বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে৷
জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অনুষ্কা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ কী দেখছিল কে জানে!
হঠাৎ করে ও ঘুরে দাঁড়াল৷ বিছানায় বসে থাকা ইলিনার দিকে সরাসরি তাকাল৷
বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর গায়ের সবুজ রঙের টপটা কোমরের কাছ থেকে ইঞ্চিচারেক ওপরে তুলে ধরল ও৷
ওর নাভির ঠিক ওপরে কালো রঙে আঁকা একটা ছবি : একটা ফুলকে ঘিরে আছে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷
ঠিক এই ছবিটাই লাগানো রয়েছে ওর ঘরের দেওয়ালে৷ এই ছবিটাই ওকে খাতার পাতায় আঁকতে দেখেছিল ইলিনা৷ তখন ওর ছবিটা ভালো লেগেছিল৷ ও তা থেকে ট্যাটুর ডিজাইন করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু অনুষ্কা তাতে সায় দেয়নি৷ বাজে ওয়ার্থলেস ছবি বলে কাটাকুটি দাগ দিয়ে ছবিটা নষ্ট করে দিয়েছিল৷
অথচ সেই ছবিটাকেই বডি ট্যাটু করে বসে আছে ও!
‘এই ছবিটাকে তুমি বাজে ওয়ার্থলেস বলেছিলে—’ অভিযোগের সুরে বলে উঠল ইলিনা, ‘আর সেই ছবিটাকেই ট্যাটু করে বসে আছ! আশ্চর্য!’
অনুষ্কা অল্প হাসল৷ টপটা তুলে ধরা অবস্থায় কয়েকটা পা ফেলে ইলিনার খুব কাছে এগিয়ে এল৷ বলল, ‘তুমি ভুল করছ, ইলিনা—এটা মোটেই ট্যাটু নয়৷ হাত দিয়ে দ্যাখো…৷’
সত্যিই ইলিনা আঙুল ছোঁয়াল ছবিটায়৷ ছবিটা যে উল্কি নয় সেটা বুঝতে চাইল : ‘ট্যাটু নয় তো এটা তা হলে কী?’
‘এটা জন্মদাগ৷ মানে, জন্মচিহ্ন৷ আমাদের সবার পেটে আছে৷’
‘জন্মচিহ্ন মানে?’
‘জন্মচিহ্ন মানে জন্মের সময় থেকেই এই দাগটা আমাদের সবার পেটে থাকে…৷’
‘আমাদের সবার মানে কারা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ইলিনা৷
‘আমি, বাপি, মা—আমাদের সবার পেটে এই ছবি আছে—জন্মদাগ৷’
‘কেন? এ কী পিকিউলিয়ার ব্যাপার!’
টপটা ছেড়ে দিল অনুষ্কা৷ ওটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিল৷ তারপর ইলিনার চিবুকে হাত দিয়ে বলল, ‘পিকিউলিয়ার নয়, ইলিনা৷ ভ্যাম্পায়ারদের এটাই নিয়ম…৷’
‘ভ্যাম্পায়ার?’ ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ইলিনা৷ অনুষ্কার হাতটা সরিয়ে দিল : ‘কী বলছ তুমি!’
‘হ্যাঁ, ইলিনা—’ নীচু গলায় বলল, ‘ভ্যাম্পায়ারদের চেনার এটাই সবচেয়ে বড় চিহ্ন৷ তা ছাড়া এই সিম্বলটা আমাদের কাছে খুব পবিত্র…’ দেওয়ালে লাগানো সাপ আর ফুলের ছবিটার দিকে দেখাল : ‘এটা আমাদের পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে৷ তাই আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়…৷ অবশ্য এটা দেখতে পেলেও সবাই ট্যাটু ভাববে৷’
ইলিনা কাঁপছিল৷ ওর চোখ বড়-বড় হয়ে গিয়েছিল৷ ও ভয়ের চোখে সহপাঠীকে দেখছিল৷
অনুষ্কা ভ্যাম্পায়ার!
‘ইলিনা, প্লিজ…ভয় পেয়ো না৷ মানুষের মতো…আমাদের মধ্যেও… ভালো-খারাপ আছে৷ আমরা ভালো, ইলিনা, বিশ্বাস করো—৷’
ইলিনার মাথা ঝিমঝিম করছিল৷ চোখে ঝাপসা দেখছিল৷ ও মাথা পিছনে হেলিয়ে বিছানায় দু-হাতে ভর দিল৷
ওর চোখ গেল দেওয়ালে টাঙানো রাতের ছবিটার দিকে৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া রাত৷ বিশাল প্রাসাদ৷ পূর্ণিমার চাঁদ৷
আগের দিন ছবিটা যেমন দেখেছিল আজ যেন একটু বদলে গেছে৷ প্রাসাদের ছায়ার পাশ থেকে চাঁদটা যেন অনেকটা দূরে সরে গেছে৷ আর আগের দিন, যতদূর ইলিনার মনে পড়ছে, বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷
আজ আলো জ্বলছে দুটো জানলায়!
নিজেকে সামলে নিল ইলিনা৷ মাথা ঝিমঝিম করলে চলবে না৷ চোখে ঝাপসা দেখলে চলবে না৷
ও তাকাল অনুষ্কার মুখের দিকে৷
এই অপরূব রূপসী মেয়েটা ভ্যাম্পায়ার!
আজ টিফিনের সময় অনুষ্কা ইলিনাকে ডেকেছিল৷
ইলিনা ওর কাছে যেতেই ও বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে৷ ভীষণ ইমপরট্যান্ট কথা৷ তুমি আজ ছুটির পর আমাদের বাড়ি চলো—প্লিজ৷’
অনুষ্কার মুখে আকুতির ভাব ফুটে উঠেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এমন সব কথা ও ইলিনাকে বলতে চায় যেগুলো না বলতে পারলে ও কষ্ট পাবে৷
ইলিনা রাজি হয়েছিল৷ একইসঙ্গে ওর মনে হয়েছিল, রনিতা ম্যাডামের সমস্যাটা যদি সমাধান করতে হয় তা হলে অনুষ্কার সাহায্য দরকার৷ কারণ, সমর্পিতার ব্যাপারটা যে ইলিনা জানতে পেরেছে সেটা শুধু অনুষ্কার জন্য৷
ওই ঘটনার পর সমর্পিতা এক সপ্তাহ স্কুলে আসেনি৷ ওর বাড়িতে ফোন করে ইলিনা জেনেছে, পরদিন ভোরবেলা থেকে সম্পির খুব জ্বর৷ সেই জ্বর এতটাই খামখেয়ালিভাবে ওঠানামা করছিল যে, সম্পির মা-বাবা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ তা ছাড়া সম্পি জ্বরের মধ্যে ভুল বকছিল৷ সবকিছু মিলিয়ে ওর মা-বাবা ভাবছিলেন ব্যাপারটা ভাইরাল ফিভার নয়—অন্য কিছু৷
ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা একদিন স্কুলের পর সম্পিকে দেখতে গিয়েছিল৷ তখন ও অনেকটা সামলে উঠেছে৷
ইলিনা আর সজনী ওকে সেদিন টিচার্স রুমের ব্যাপার নিয়ে অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সম্পি গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ ঠিকঠাক কোনও জবাব দিল না৷
ওর মা নানান কথা বলছিলেন৷
‘দ্যাখো না, যে-মেয়ে সবসময় সাহসের বড়াই করে সে কেমন ভয়ে চুপসে গেছে৷ এই তো, গত পরশু—যখন জ্বরটা খুব বেড়েছিল—তখন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিল৷ বারবার বলছিল, ‘‘বৃষ্টির জল৷ বৃষ্টির জল দিয়েই খতম করতে হবে…বৃষ্টির জল চাই…বৃষ্টি চাই৷’’
‘আমি ওকে মাথায় জলপটি দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে সাড় ফেরাতেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল৷ অনেকবার জিগ্যেস করলাম, ‘‘বৃষ্টির জল দিয়ে কী করবি বলছিলি?’’ তো ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল—কোনও জবাব দিল না৷ বলো দেখি, কী মুশকিল!
‘তা ছাড়া ক’দিন ধরে খাবারদাবার কিছু মুখে তুলছে না৷ শুধু বলছে খিদে নেই৷ তোমরা ওকে একটু বুঝিয়ে বলো তো৷ ঠিকঠাক না খেলে শরীরে জোর পাবে কেমন করে?’
সম্পির মা একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন৷ আর অনুষ্কা শান্ত চোখে সম্পির দিকে তাকিয়ে ওকে দেখছিল৷
‘ও, হ্যাঁ৷ তোমাদের একজন দিদিমণি বাড়িতে ফোন করেছিলেন৷ সম্পি কেমন আছে সে-খবর নিচ্ছিলেন৷ বললেন, সম্পি ওঁর খুব প্রিয় স্টুডেন্ট…৷’ মেয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন : ‘অ্যাই, কী নাম যেন ওই দিদিমণির? তোকে যে সেদিন বললাম…৷’
সম্পি নিষ্প্রাণ স্বরে বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম৷’
ইলিনা আর সজনী মুখচাওয়াচাওয়ি করল৷ কিন্তু কোনও কথা বলল না৷
একটু পরে সম্পির মা ঘর ছেড়ে চলে যেতেই অনুষ্কা বলল, ‘সম্পি, রনিতা ম্যাডাম তোমাকে থ্রেট করেছেন?’
সম্পি চুপ করে রইল৷ বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আঙুল খুঁটতে লাগল৷
‘আমি সব জানি, সম্পি৷ রনিতা ম্যাডাম এখন আর মানুষ নেই— অন্য কিছু হয়ে গেছেন৷ পরানের মার্ডারে রনিতা ম্যাডাম ইনভলভড…৷’
সমপির্তা চমকে মুখ তুলে তাকাল৷ ইলিনা আর সজনীও তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
‘তুমি কেমন করে জানলে?’ সম্পি অস্পষ্ট গলায় জিগ্যেস করল৷
‘আমি জানি—’ আত্মবিশ্বাসের জোর ফুটে বেরোল অনুষ্কার উত্তরে : ‘সেদিন ঠিক কী হয়েছিল আমাকে খুলে বলো৷’ অনুষ্কা সম্পির কাঁধে একটা হাত রাখল : ‘কোনও ভয় নেই৷ আমরা তোমাকে হেলপ করতে চাই…৷’
তিনজনে মিলে আরও খানিকক্ষণ বোঝাতেই সম্পি নরম হল৷ ও দুর্বল গলায় ধীরে-ধীরে সেদিনকার সব ঘটনা খুলে বলল৷
শুনতে-শুনতে ইলিনা আর সজনীর ভেতরে ভয়ের হিমেল স্রোত ছড়িয়ে পড়ল৷ এসব কী বলছে সম্পি!
ওর কাহিনি শুনতে-শুনতে অনুষ্কা উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ ওর ফরসা গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ল৷
একসময় ওরা তিনজন উঠে পড়ল৷ বাড়ি ফিরতে হবে৷ বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে৷
ক’দিন ধরেই রোজ ভালো বৃষ্টি হচ্ছে৷ রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে৷
আজ সম্পির বাড়ি আসার ব্যাপারে অনুষ্কা একটু কিন্তু-কিন্তু করেছিল৷ বলেছিল, যদি সম্পির বাড়ির রাস্তায় জল জমে যায় তা হলে কিছুতেই ও গাড়ি থেকে নামতে পারবে না৷
শেষ পর্যন্ত সেরকম বৃষ্টি হয়নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুষ্কা রেনকোট এবং ছাতা দুটোই নিয়ে বেরিয়েছে৷ এ নিয়ে ইলিনা আর সজনী ওকে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি৷ কিন্তু অনুষ্কা সেই পুরোনো কথাই বলেছে : বৃষ্টি ওর ভালো লাগে না৷
সম্পির বাড়ি থেকে ফেরার পর তিনটে দিন অনুষ্কা কীরকম যেন আনমনা ছিল৷ তারপর আজ ইলিনাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছে৷
ইলিনা অন্ধকার প্রাসাদের ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ না, ও মোটেই ভুল দেখছে না৷ আজ সত্যি-সত্যিই দুটো জানলায় আলো জ্বলছে!
‘এই ছবিটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও মিস্ট্রি আছে৷’ প্রাসাদের ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ইলিনা বলল, ‘আজ দেখছি দুটো জানলায় আলো জ্বলছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন তোমার বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন…৷’
ওকে থামিয়ে দিয়ে অনুষ্কা বলল, ‘বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷’ তারপর ইলিনার পাশে বসে পড়ল : ‘সেদিন তোমাকে বলিনি—আজ বলছি৷ এই বাড়িটা আমাদের পূর্বপুরুষের—তিনহাজার বছরের পুরোনো৷ আমাদের মতন যারা…মানে, ইয়ে…তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে এই ছবিটা লাগানো আছে৷ এই ছবিটার একটা সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ ওটা নিজে-নিজে অনেক কিছু করতে পারে—৷’
কথা বলতে-বলতে অনুষ্কা লক্ষ করল ইলিনার মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে৷ ও বিছানায় ঘষটে অনুষ্কার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে চাইছে৷
অনুষ্কা ওর হাত চেপে ধরল৷ অনুনয়ের গলায় বলল, ‘ইলিনা, প্লিজ… বিলিভ মি৷ আমি তোমার বন্ধু—বেস্ট ফ্রেন্ড৷ এটা ঠিকই যে, আমাদের লাইফ আর লাইফ স্টাইল তোমাদের চেয়ে আলাদা৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা কখনও মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারি না৷ তুমি কি বিশ্বাস করবে, আমরা প্রায় চারশো বছর ধরে মানুষের রক্তের তেষ্টা ভুলে গেছি! তার বদলে আমরা ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, চড়াই, পায়রা এসব দিয়ে খিদে-তেষ্টা মেটাই! আমার বাপি আর মা কী বলেন জানো? বলেন, আমাদের অবজেকটিভ হল রেগুলার চেষ্টা করে-করে ফাইনালি ভেজিটারিয়ান হয়ে ওঠা৷ হ্যাঁ, এটাই আমাদের চরম মুক্তি৷’
অনুষ্কার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল৷ বড়-বড় শ্বাস নিয়ে ও বলল, ‘আমাদের প্রবলেম একটাই : আমরা সেদ্ধ, ভাজা, পোড়ানো—মানে, রান্না করা খাবার একদম খেতে পারি না৷ আমাদের সিস্টেম নেয় না৷ তাই আমরা সবকিছু কাঁচা খাই৷
‘কিন্তু তা বলে আমরা হাল ছাড়িনি৷ আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি৷ মানুষের বন্ধু হতে চেষ্টা করছি৷ মানুষের মতো হতে চাইছি৷ বিশ্বাস করো, প্লিজ…৷’
অনুষ্কার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল৷ যেন হিরের কুচি ওর ফরসা গালের ওপরে চিকচিক করছিল৷
ওর দুঃখী মুখের দিকে তাকিয়ে ইলিনার মনে হল, এ চোখের জল মিথ্যে হতে পারে না৷ এর মধ্যে কোথায় যেন সত্যের ঝিলিক আছে৷
মুহূর্তের মধ্যে ইলিনার মনে এক আশ্চর্য আবেগ তৈরি হয়ে গেল৷ ও সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুষ্কাকে জাপটে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ওর চোখেও জল এসে গেল৷ কান্না জড়ানো গলায় ও বারবার বলতে লাগল, ‘তুমি আমার বন্ধু, অনুষ্কা৷ তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড…বেস্ট ফ্রেন্ড…৷’
.
৷৷নয়৷৷
সমর্পিতা যখন স্কুলে আবার এল তখন ওর জ্বর সেরে গেছে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল৷ আগের চেয়ে রোগা দেখাচ্ছে ওকে৷ পিঠের স্কুল-ব্যাগটা প্রকাণ্ড আর বেঢপ মনে হচ্ছে৷
সমর্পিতা এখন অনুষ্কার পাশে বসে৷ ফাঁক পেলেই ওর সঙ্গে গল্প করে৷ আর রনিতা ম্যাডামের ভয়ের কথা আলোচনা করে৷
অনুষ্কার অন্যপাশে বসে ইলিনা৷ অনুষ্কার পাশে বসতে ওর ভালো লাগে তাই৷
অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সমর্পিতা বুঝতে পেরেছে, অনুষ্কার বুদ্ধি অনেক তীক্ষ্ণ এবং গভীর৷
অনুষ্কার পরামর্শেই এখন ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসে৷ সেটা হয় সাইলেন্ট মোডে রাখে অথবা অফ করে রাখে৷ কারণ দিদিমণিরা টের পেলেই শাস্তি পেতে হবে৷
সেদিন অনুষ্কার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ইলিনা রাতে ঘুমোতে পারেনি৷ অন্ধকারে জেগে থেকে শুধু ওই অদ্ভুত মেয়েটার কথা ভেবেছে৷
ভ্যাম্পায়ারের গল্প ইলিনা বইয়ে পড়েছে, দু-একটা সিনেমাতেও দেখেছে৷ কিন্তু বাস্তবে ভ্যাম্পায়ার হয় বলে কখনও ভাবেনি৷ তা ছাড়া ভ্যাম্পায়াররাও যে খারাপ এবং ভালো দু-রকমের হতে পারে সেটাও কখনও ভেবে দেখেনি৷
অনুষ্কা ওকে বলেছে, ‘আমরা কখনও কারও ক্ষতি করি না৷ আমাদের ধর্মে অকারণে শক্তি ব্যবহার করা বারণ৷ আমাদের অনেকরকম সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ কিন্তু সেগুলো খুব জরুরি সিচুয়েশান না হলে আমরা ইউজ করি না৷ আমরা সবসময় চুপচাপ থাকি, কারও ব্যাপারে নাক গলাই না৷ কারণ, আমরা…আমরা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’
অনুষ্কার গোপন কথা ইলিনা কাউকে বলেনি৷ এমনকী মা-বাবাকেও নয়৷
স্কুলে অনুষ্কার পাশে রোজ বসতে পেরে ইলিনার নিজেকে অনেক বেশি সাহসী, শক্তিশালী আর বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, রনিতা ম্যাডাম—কিংবা ওইরকম কোনও পিশাচ—ওর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না৷
ইলিনা পরানের কথা ভাবছিল৷
পরান মারা যাওয়ার পর যে-ঢেউ উঠেছিল সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে সেটা থিতিয়ে গেল৷ রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল৷ এবং স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হয়ে গেল৷ হেডমিসট্রেস প্রীতি দত্ত নোটিশ জারি করে সে-কথা সব ক্লাসে জানিয়ে দিলেন৷
সমর্পিতা মাঝে-মাঝে রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে৷ বন্ধুদের বলে ইতিহাস পড়া বুঝতে যাচ্ছে৷ আসলে ও এ-কথাই বলতে যায় যে, ও সেদিনকার কথা কাউকে বলেনি৷
রনিতা ম্যাডামকে দেখে ও অবাক হয়ে যায়৷ এত স্বাভাবিক, এত স্নেহ-মাখানো ব্যবহার! সেদিন কর্কশ-স্বরে-কথা-বলা ভয়ংকর চেহারার যে-পিশাচকে সমর্পিতা দেখেছিল সেটা মনে হয় যেন সত্যি-সত্যি দেখার ভুল, হ্যালুসিনেশান৷
রনিতা ম্যাডামের ওপর নজরদারির কাজটা ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা—তিনজনে মিলে করতে লাগল৷ ওরা চোখ-কান খোলা রেখে খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগল৷ আর অনুষ্কাকে সব খবর জানাতে লাগল৷
স্কুলের পিছনদিকে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে অনেক বড়-বড় গাছ আছে৷ সেখানে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অনেক পুরোনো টিন, অ্যাসবেস্টস শিট, ভাঙা কাঠ, আর শ্যাওলা ধরা কয়েকশো ইট ডাঁই করে রাখা আছে৷
একদিন টিফিনের সময় বাইরের মাঠে অনুষ্কা আর ইলিনা গল্প করছিল৷ হঠাৎ কোকিলের মিষ্টি ডাক শোনা গেল৷
স্কুলের বাগানে সবসময়েই কোকিলের ডাক শোনা যায়৷ শুনে মনে হয় কোকিলরা শুধু বসন্তকাল নয়, বর্ষাকালেরও ইজারা নিয়ে নিয়েছে৷ ইলিনার খুব ইচ্ছে যে, ও ‘ডাকন্ত’ কোকিল দেখবে৷ ওর চোখ প্রায়ই সেই দৃশ্যটা খুঁজে বেড়ায়৷ কিন্তু সেই ‘দুর্লভ’ দৃশ্যটা ও আজও খুঁজে পায়নি৷
তাই টিফিনের সময় কোকিলের ডাক শুনেই ইলিনা একেবারে লাফিয়ে উঠল৷ ও অনুষ্কার হাত ধরে টানতে-টানতে ডাকের উৎস লক্ষ করে ছুট লাগাল৷
আন্দাজে ভর করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত ওরা চলে এল স্কুলের পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে৷ গাছপালার অঞ্চলে ঢুকে ওপরদিকে মুখ তুলে গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকে কোকিলটা খুঁজতে লাগল৷
অনুষ্কাই প্রথম দেখতে পেল পাখিটাকে৷ কুচকুচে কালো রং৷ একটা লম্বা গাছের ওপরদিকে একটা ডালের একেবারে গোড়ায় বসে আছে পাখিটা৷ ‘কু-উ, কু-উ’ করে ডাকছে৷
ইলিনা কোকিলটাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল৷ বলল, ‘আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছে আজ ফুলফিলড হল—৷’
একটু পরেই পাখিটা উড়ে চলে গেল অন্যান্য গাছের আড়ালে৷
ওরা যখন ফিরে আসছে তখনই ইলিনার চোখে পড়ল, ইট-কাঠের স্তূপের পাশে দুটো লোমশ প্রাণী পড়ে আছে৷
দেখে চেনা গেল৷ একটা কাঠবিড়ালি, আর একটা বেজি৷ দুটো প্রাণী যেন পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে৷
ওরা চট করে সেগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ ঝুঁকে পড়ে কাঠবিড়ালির দেহটা হাতে তুলে নিল অনুষ্কা৷
হালকা৷ ফাঁপা৷ বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরে সারবস্তু কিছু নেই৷ গলার কাছটায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷
ইলিনা বেজির দেহটা একবার তুলেই ফেলে দিল৷ সেটাও চরিত্রে কাঠবিড়ালিটার মতো৷
অনুষ্কা বলল, ‘বুঝতে পারছ, ডেডবডিগুলো অন্যরকম?’
‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি—পরানের মতন৷’
‘এগুলো বেশি পুরোনো নয়৷ গন্ধ থেকে বুঝতে পারছি…’ কাঠবিড়ালিটা ফেলে দিল : ‘কিছু একটা করা দরকার…৷’
ইলিনা ঘড়ি দেখল৷ এখুনি টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়বে৷ রবিনা ম্যাডামের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে৷ তাই ওরা স্কুল বিল্ডিং-এর দিকে প্রায় ছুট লাগাল৷
ওদের এই কয়েকদিনের গোয়েন্দাগিরিতে একটা ব্যাপার ওরা লক্ষ করেছে৷ ক্লাস নাইনের ‘এ’ সেকশানের একজন ছাত্রী আর ক্লাস টেন ‘সি’ সেকশানের একজন ছাত্রী প্রায়ই রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যায়৷
ইলিনা, সজনী, সমর্পিতা আর অনুষ্কা ওরা যে যখন যা জানতে পারে সেটা এস-এম-এস করে বা ফোন করে বাকিদের জানিয়ে দেয়৷
পরানের মৃত্যুর ঘটনার পর স্কুলের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে অনেকগুলো বাড়তি আলো লাগানো হয়েছে৷ স্কুল ক্যাম্পাসের রাস্তায় যেসব ল্যাম্পপোস্টের আলো খারাপ ছিল সেগুলো পালটানো হয়েছে৷ এ ছাড়া বড়দি উদ্যোগ নিয়ে জঙ্গলের কিনারায়, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড আর ফেস্টিভ্যাল হলের চারপাশে অনেকগুলো নতুন আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷
এই চেষ্টা দেখে রনিতা ম্যাডাম একদিন ব্যঙ্গ করে সম্পিকে বলেছেন, ‘আলো দিয়ে ভূত তাড়ানোর কনসেপ্ট বহুকাল হল বাতিল হয়ে গেছে৷ আলোয় আমাদের কোনও প্রবলেম নেই৷’ হাসলেন ম্যাডাম৷ তারপর : ‘যখন আমাদের তেষ্টা পায় তখন কীসের আলো আর কীসের অন্ধকার! তুই-ই বল…৷’
সম্পি কোনও জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল৷ তারপর স্কুল ছুটির সময় বাকি তিনজন বন্ধুকে খবরটা জানিয়েছিল৷ তারপর বলেছিল, ‘ওর কথার টোনে আমার মনে হয়েছে খুব শিগগিরই ওরা আর-একটা বড় কুকীর্তি করতে চলেছে…৷’
ইলিনা ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘রিহার্সাল আবার শুরু হয়েছে৷ আমার মনে হচ্ছে, ওই পিশাচটা যতই বলুক, রাতের আলোতেই ওদের অ্যাক্টিভিটি বেশি…৷’
এই দুশ্চিন্তাটা ইলিনার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল৷ চিন্তায়-চিন্তায় বহুক্ষণ একা-একা ছটফট করার পর ও অনুষ্কাকে ফোন করেছে৷
অনুষ্কা ফোন ধরতেই ইলিনা বলেছে, ‘শোনো, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব—৷’
‘বলো৷’
‘কাল থেকে অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তুমি কাল থেকে রিহার্সালে চলো…৷’
অনুষ্কা ইতস্তত করল : ‘কী করে যাই বলো তো! একে তো কোনও প্রোগ্রামে আমি নাম দিইনি, তার ওপর আমি—মানে, আমরা—মানুষদের এড়িয়ে চলি৷ নইলে ধরা পড়ে যেতে হয়৷ যেমন তোমার কাছে ধরা পড়ে গেলাম৷’
‘কিন্তু তুমি যদি হেলপ না করো তা হলে কেমন করে হয়! তুমিই তো বলেছ, তুমি সব জানো৷ তুমি ভরসা দিয়ে বলেছ ‘‘আমি তো আছি!’’ ফাংশানের রিহার্সাল রোজ সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলবে৷ যদি কারও কোনও বিপদ হয়! যদি সম্পির আবার কোনও বিপদ হয়! ও তো রনিতা ম্যাডামের টার্গেট হয়ে আছে…৷’
অনুষ্কা চুপ করে ভাবছিল৷
ইলিনা আবার বলল, ‘ওসব জানি না, তুমি কাল রিহার্সালে যাবে৷ আর কিছু না পারো অন্তত একটা আবৃত্তি করবে৷ রবিনা ম্যাডামকে বলবে৷ তুমি রিহার্সালে থাকলে আমরা সবাই ভরসা পাব…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনুষ্কা বলেছে, ‘ঠিক আছে—কাল থেকে আমি রিহার্সালে যাব৷’
আনন্দে ফুলঝুরি হয়ে গেল ইলিনা৷ বলল, ‘থ্যাংক য়ু, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড৷’
পরদিন অনুষ্কাকে রিহার্সালে দেখে অনেকেই অবাক হল৷ এই মুখচোরা ইনট্রোভার্ট মেয়েটা অ্যানুয়াল ফাংশানে পার্টিসিপেট করবে! কিন্তু ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারল না৷
ইলিনা জানে, অনুষ্কার মধ্যে এমন অনেক নাম-না-জানা গুণ আছে যার জন্য ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারে না৷
অনেকদিন পর ফেস্টিভ্যাল হলটা জমজমাট হয়ে ওঠায় ইলিনাদের খুব ভালো লাগছিল৷ ওরা সবাই মিলে কলকল করে এমন গল্পে মেতে উঠল যে, ওদের চুপ করানোর জন্য শম্পা ম্যাডাম, রবিনা ম্যাডাম, কাকলি ম্যাডামকে বেশ কয়েকবার বকুনি দিতে হল৷ তাতে গুঞ্জনের আওয়াজ কমল বটে কিন্তু থামল না৷
রিহার্সালের তদারকিতে সমর্পিতা, অঙ্গনা, সজনী, রবিনা ম্যাডাম সবাই এদিক-ওদিক ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছিলেন৷ কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তোলানো শুরু করে দিয়েছেন৷ শম্পা ম্যাডাম ক্লাস টেনের মধুরিমা আর শ্রাবন্তীকে নাচের একটা মুদ্রা বোঝাচ্ছেন৷
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হচ্ছে বটে!
একটা অশুভ ঘটনার পর রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তাই বড়দি বলেছেন তিনি রিহার্সালে আজ আসবেন—তা হলে সবাই উৎসাহ পাবে৷ তা ছাড়া আগে রিহার্সালে শুধু চা-বিস্কুট খাওয়ানো হত—আজ থেকে বড়দি টিফিন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন৷ বলেছেন, রিহার্সাল অনেকদিন বন্ধ থাকায় হাতে সময় অনেক কমে গেছে৷ তাই রোজ একটু বেশিক্ষণ ধরে রিহার্সাল করতে হবে আর সেইজন্যই ‘স্পেশাল’ টিফিন৷
রিহার্সাল পুরোদমে শুরু হয়ে গেল৷ প্রীতি দত্ত এখনও আসেননি৷ অফিসে কী যেন কাজ করছেন—সেটা সেরেই আসবেন৷ বড়দি যেহেতু রিহার্সালে কখনও আসেন না তাই ওঁর আসাটা একটা বড় ঘটনা৷
ইলিনারা বলাবলি করতে লাগল যে, এবার হয়তো রাশভারী বড়দিকে একটু-আধটু হাসতে দেখা যাবে৷ এ নিয়ে সজনী আর সমর্পিতা বাজিও ধরে ফেলল৷
আজকের সন্ধেটা খুব সুন্দর৷ কোনও বৃষ্টি নেই৷ সূর্য ডোবার পর হালকা ছাই রঙের আকাশ৷ তার ওপরে গাঢ় স্লেট রঙের লম্বা-লম্বা আঁচড়৷ বাতাসে গাছপালার পাতা নড়ছে৷
রিহার্সাল দিতে-দিতে বাইরেটা কখন যেন আঁধার হয়ে গেল৷
ইলিনা অনুষ্কার সঙ্গে গল্প করছিল৷ গত বছরের অ্যানুয়াল ফাংশানের কথা বলছিল৷ কে আবৃত্তি করতে গিয়ে কবিতার লাইন ভুলে গেছে, কে গানে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে, কাকলি ম্যাডামের গলা কী মিষ্টি—এই সব গল্প করছিল৷
এর মধ্যে আশাদিকে সঙ্গে করে প্রীতি দত্ত চলে এলেন৷ তিনি এসে পড়ায় অনেকেই তটস্থ হল, আবার খুশিও হল৷ তারপর টিফিনের প্যাকেট আর চা সবাইকে বিলি করা হল৷ সকলেই আনন্দ আর ফুর্তির মেজাজে টগবগ করছিল৷
ইলিনার বেশ ভালো লাগছিল৷ অনুষ্কাও জমজমাট ব্যাপারটা এনজয় করছিল৷ ও কখনও ভাবেনি এত মানুষের মাঝে ও এরকম অস্বস্তিহীনভাবে বসে থাকতে পারবে৷
ইলিনা লক্ষ করল, সম্পি ওর ব্যস্ততার ফাঁকে-ফাঁকে ফেস্টিভ্যাল হলের জানলার কাছে চলে যাচ্ছে৷ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দেখছে৷ হয়তো সেই বিপজ্জনক সন্ধেটার কথা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷
হলের টিনের চালে থেকে-থেকেই খড়মড় আওয়াজ হচ্ছিল৷ ইলিনা জানে, ওগুলো গাছের শুকনো পাতা আর সরু ডালপালার শব্দ৷ হল ঘিরে যেসব বড়-বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো থেকে প্রায়ই ডালপাতা খসে পড়ে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই আওয়াজগুলো ইলিনাকে অল্প-অল্প ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল৷
প্রথমদিন বলে বড়দি সাতটা নাগাদ রিহার্সাল শেষ করে দিতে বললেন৷ ভয় এড়াতে সবাই দলবেঁধে হল থেকে বেরিয়ে মেন গেটের পথ ধরল৷
ইলিনার সঙ্গে পিচের রাস্তা ধরে এগোতে-এগোতে অনুষ্কা বলল, ‘মনে হয়, ভয় কেটে গেছে৷ ওই পিশাচরা ঘুমিয়ে পড়েছে…৷’
‘কী করে বুঝলে?’ ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল বেস্ট ফ্রেন্ড-এর দিকে৷
অনুষ্কা বলল, ‘ওদের কেউ হয়তো আমাকে ফেস্টিভ্যাল হলে চিনে ফেলেছে৷ ওরা জানে, আমাদের মতো ভ্যাম্পায়াররা কখনও মানুষের প্রবলেমে ইনভলভড হয় না৷ কিন্তু আমাকে দেখে নিশ্চয়ই ওদের কেউ একজন বুঝেছে আমি তোমাদের প্রবলেমে জড়িয়ে পড়েছি—তোমাদের পাশে দাঁড়িয়েছি…৷’
‘তোমাকে ওরা এত ভয় পায়!’ অবাক হয়ে বলল ইলিনা৷
অনুষ্কা হাসল : ‘খারাপ ভ্যাম্পায়াররা ভালোদের সবসময় ভয় পায়৷ ওরা আমাদের ক্ষমতার কথা জানে৷ তবে এটাও জানে, আমরা সবসময় নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’
‘ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় না?’
‘চায়—কিন্তু পারে না৷ রক্তের তেষ্টা ওদের পাগল করে দেয়৷ মানুষের গন্ধ ওদের মাথা খারাপ করে দেয়৷ তা ছাড়া পূর্ণিমার সময় ওদের এই পাগলামিটা মারাত্মক বেড়ে ওঠে৷ তখন ওরা পশু কিংবা মানুষ মেরে তেষ্টা মিটিয়ে উল্লাসে নেচে বেড়ায়—কোনও জ্ঞান থাকে না৷’
‘যেদিন রাতে আমি ওরকম তিনটে পিশাচকে গাছে নাচানাচি করতে দেখেছিলাম সেদিন কি তা হলে পূর্ণিমা ছিল?’
‘বোধহয় ছিল৷ সেদিন মেঘ-বৃষ্টি ছিল—তাই হয়তো বুঝতে পারোনি৷’
ইলিনা কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল৷ তারপর ভয়ে-ভয়ে আকাশের দিকে তাকাল৷
দূরে খেলার মাঠের কিনারায় শুকনো মরা গাছটা দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ডালপালার আড়ালে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ প্রায় গোল হয়ে এসেছে৷ কয়েকদিন পরেই শুক্লপক্ষের শেষ—তারপর পূর্ণিমা৷
চাঁদটা অনুষ্কাকে দেখাল ইলিনা : ‘ওই দ্যাখো—ক’দিন পরেই পূর্ণিমা৷’
‘কী করে বুঝলে?’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কা জানতে চাইল৷
‘খুব সোজা৷’ ইলিনা বলল, ‘চাঁদের ওপরদিকটা যদি ডানদিকে হেলে থাকে, তা হলে শুক্লপক্ষ চলছে৷ আর যদি বাঁ-দিকে হেলে থাকে তা হলে কৃষ্ণপক্ষ৷ চাঁদের নীচের দিকের বাঁকটা সেই অনুযায়ী কৃষ্ণপক্ষের ‘ঋ’-ফলা আর শুক্লপক্ষের হ্রস্ব ‘উ’-কারের বাঁকের সঙ্গে বেশ মিলে যায়৷ এটা আমাকে মা শিখিয়ে দিয়েছে—৷’ ইলিনা হাসল৷ কিন্তু তারপরই আসন্ন পূর্ণিমার কথা ভেবে ভয়ের গলায় বলল, ‘পূর্ণিমার সময় ওরা কিছু করতে পারে…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুষ্কা বলল, ‘শুধু পূর্ণিমা কেন? ভয় তো এমনিতেই আছে, কিন্তু পূর্ণিমার সময় ভয়টা আরও বেশি—’
হঠাৎই একটা ব্যাপার মনে পড়ে যাওয়ায় ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি যে বললে তোমাকে ওরা চিনে ফেলেছে—কী করে চিনতে পারল?’
অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ রিহার্সালে আমি টিফিন খাইনি—চা-ও খাইনি৷ সেটা হয়তো ওদের কেউ লক্ষ করেছে৷ তা ছাড়া আমাদের দেখতে খুউব সুন্দর হয়৷ আর আমাদের গা থেকে একটা গন্ধ বেরোয় অনেকটা দারচিনির গন্ধের মতো…৷’
চেনার চিহ্নগুলো মনে-মনে খতিয়ে দেখল ইলিনা৷ তারপর গন্ধটার কথা ওর মনে পড়ল৷ ও অনুষ্কার গাড়িতে আর বাড়িতে এইরকম গন্ধ পেয়েছিল৷ কিন্তু গা থেকে ওরকম গন্ধ বেরোলে তো এখনও সেই গন্ধ ইলিনার নাকে আসার কথা!
ওর মনের কথা কী করে যেন টের পেয়ে গেল অনুষ্কা৷ বলল, ‘ইলিনা, তোমার সঙ্গে আমার একটা মেন্টাল ম্যাচিং হয়ে গেছে৷ অনেকটা যেন রেডিয়ো স্টেশান ধরার টিউনিং-এর মতো৷ তাই তুমি হয়তো দু-একবার আচমকা ওই স্মেলটা পেয়ে গেছ৷ আসলে ওই গন্ধটা কুকুরের নাকে ধরা পড়ে—আর ওই পিশাচদের নাকেও৷ কুকুর প্রায় ন’হাজার রকম গন্ধ চিনতে পারে, মনে রাখতে পারে৷ আমরা প্রায় পাঁচশো রকম গন্ধ চিনতে পারি৷ রনিতা ম্যাডামের মতো পিশাচরাও তাই৷ তবে…৷’
‘আর আমরা? আমরা কতরকম গন্ধ চিনতে পারি?’
হাসল অনুষ্কা : ‘কিছু মনে কোরো না৷ তোমাদের বেলায় সংখ্যাটা মাত্র সত্তর থেকে আশি৷ আর তার মধ্যে এই দারচিনির মতো গন্ধটা পড়ে না৷ যেমন, তুমি এখন এই গন্ধটা পাচ্ছ না, তাই না?’
বিহ্বলভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল ইলিনা৷ সত্যিই ওই গন্ধটা ও এখন পাচ্ছে না৷ ওই দু-বার ছাড়া কখনও পায়নি৷
হঠাৎই অনুষ্কার জন্য ভয় পেল ইলিনা৷ যদি ওই পিশাচগুলো অনুষ্কার কোনও ক্ষতি করে?
সে-কথাই জিগ্যেস করল ওকে৷
অনুষ্কা ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ সেটা কিছুতেই পারবে না৷’
ওরা গাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল৷ অনুষ্কা ইলিনাকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দেবে এরকমই কথা হয়েছিল৷ তাই দুজনেই উঠে বসল গাড়িতে৷
অনুষ্কার বাবা গাড়ি স্টার্ট দিলেন৷ হেডলাইট জ্বেলে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন, ‘কী, ফাংশানের রিহার্সাল কেমন হল?’
দুজনেই বলল, ‘ভালো—৷’
‘গুড—ভেরি গুড৷’ বলে অনুষ্কার বাবা হাসলেন৷
.
৷৷দশ৷৷
চাঁদকে দেখে পূর্ণিমা বোঝার উপায় ছিল না, কারণ, আকাশের মেঘ পুরু আড়াল তৈরি করেছিল৷ গতকাল থেকেই বৃষ্টির আশা তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু বৃষ্টি এখনও সবাইকে অপেক্ষায় রেখেছে৷
ফেস্টিভ্যাল হলে রিহার্সাল চলছিল৷ যাদের হাজির থাকার কথা তারা সবাই হাজির৷ দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে মেয়েরা কাকলি ম্যাডাম আর শম্পা ম্যাডামের কাছে তালিম নিচ্ছিল৷ রবিনা ম্যাডাম একপাশে বসে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা ওলটাচ্ছিলেন আর মাঝে-মাঝে কয়েকটা সাদা পাতায় কী যেন টুকে নিচ্ছিলেন৷
বড়দি আজ আসেননি, তবে ওঁর চালু করে দেওয়া টিফিন আর চায়ের নিয়মটা পালটায়নি৷
আজও যথারীতি অনুষ্কা চা-টিফিন খায়নি৷ ‘বাইরের জিনিস খাওয়া ডাক্তারের বারণ’ বলে এড়িয়ে গেছে৷
ও একটা কাগজ হাতে ধরে বসেছিল৷ তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা লেখা৷ রবিনা ম্যাডাম ওকে এই কবিতাটা তৈরি করতে বলেছেন৷
রিহার্সালের জন্য সামান্য হট্টগোল চলছিল৷ তার মধ্যে হঠাৎই একটা শব্দ সমর্পিতার কানে গেল৷ হলের টিনের চালে একটা জোরালো শব্দ হয়েছে৷ বোধহয় বড় মাপের কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে৷
সম্পি বোধহয় ওর ডাকাবুকো স্বভাবের পুরোটা ছাড়তে পারেনি৷ আর তার সঙ্গে ওর শখের গোয়েন্দা হয়ে ওঠার শখ৷ তাই ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ ওর ঢাউস স্কুল-ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল হলের বাইরে৷
ইলিনা ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল৷ ও অনুষ্কাকে বলল, ‘যাই, কী ব্যাপার একবার দেখে আসি—৷’ তারপর উঠে রওনা হল৷
হলের বাইরে বেশ কয়েকটা আলো লাগানো, কিন্তু উঁচু চালের কাছটায় অন্ধকার৷ চালের ওপরে গাছের ডালপালা আর পাতা ঝুঁকে পড়েছে৷ কিন্তু তারই মধ্যে কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, গাছের ডাল আর পাতা সরিয়ে খুব ক্ষিপ্রভাবে এদিক থেকে ওদিক চলাফেরা করছে৷
সম্পিকে দেখতে পেল ইলিনা৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে৷
রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে টিচার্স রুমের সেই ঘটনার পর থেকে সম্পির একটা ব্যাপার ইলিনা লক্ষ করেছে : সম্পি কখনও ওর স্কুল-ব্যাগটা কাছ-ছাড়া করে না৷
ইলিনা সম্পির কাছে গিয়ে দাঁড়াল : ‘কিছু দেখতে পেলি?’
‘হ্যাঁ—কিছু একটা হলের চালের ওপরে ঘোরাফেরা করছে৷’
‘বোধহয় ভাম-টাম কিছু হবে৷’
ইলিনা এ-কথা বলল কারণ, স্কুল চত্বরে মাঝে-মাঝে ভাম দেখা যায়৷
ওর কথার উত্তরে সম্পি বলল, ‘হ্যাঁ, ভাম হতে পারে৷ তবে প্রবলেমটা হল ভামটা আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস পরে রয়েছে৷’
ইলিনা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল সম্পির দিকে৷ তারপর মোবাইল ফোন উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘অনুষ্কাকে ফোন করে ডাকব?’
‘না, না—এখনও সেরকম কিছু সিচুয়েশান হয়নি৷’ সম্পি হাত নেড়ে বারণ করল : ‘তা ছাড়া অন্য সবাই সন্দেহ করতে পারে৷ তারপর রনিতা ম্যাডাম জানতে পারবেন…৷ চল, ফিরে যাই৷’
ওরা দুজন হলে ফিরে চলল৷
সম্পি বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের সঙ্গের দুটো মেয়েকে আমরা চিনতে পারিনি৷ তা ছাড়া এর মধ্যে কারও ঘাড়ে ওরা কামড় বসিয়েছে কি না কে জানে! সংখ্যাটা তা হলে তিন থেকে আরও বেড়ে যাবে…৷’
ইলিনার অনুষ্কার কথা মনে পড়ল৷ মনে পড়ল, পূর্ণিমার রাতে ওই পিশাচগুলো পাগলের মতো হয়ে ওঠে৷ আজ ওরা একটা কিছু করবেই৷ অনুষ্কাকে ছাড়া আর কাউকে ওরা ভয় পায় না৷ ওরা এখন বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় আছে৷
ইলিনা আর সমর্পিতা ফেস্টিভ্যাল হলে ঢুকে পড়ল৷ অনুষ্কা আর সজনীর কাছে গিয়ে বসে পড়ল৷
সম্পি চাপা গলায় চালে শব্দ হওয়ার ব্যাপারটা ওদের বলল৷
একটু পরেই সম্পি বলল, ‘অ্যাই, আমাকে টয়লেটে যেতে হবে৷’ ও ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল৷
সঙ্গে-সঙ্গে বাকি তিনজনও উঠে পড়ল, বলল, ‘চল আমরাও যাই—৷’
অনুষ্কা রবিনা ম্যাডামের কাছে গিয়ে চাপা গলায় টয়লেটে যাওয়ার পারমিশান নিল৷ তারপর ওরা চারজন আবার বেরিয়ে এল হলের বাইরে৷
আকাশে এখনও মেঘ৷ চাঁদ মেঘের আড়ালে থাকলেও চাঁদের ঘোলাটে জ্যোতি দেখা যাচ্ছে৷ বাতাস বেশ জোরে বইছে৷ বড়-বড় গাছের পাতা এলোমেলো নড়ছে, পাতায়-পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে৷
ফেস্টিভ্যাল হল থেকে বেরিয়ে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিটার দূরে টয়লেট৷ জায়গাটা স্কুল-বিল্ডিং-এর পিছনদিক৷ টয়লেটের বাঁ-দিকে রেলিং ঘেরা বাগান৷ আর ডানদিকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি৷
এই টয়লেটটা সাধারণত তালা দেওয়া থাকে৷ এখন রিহার্সাল চলছে বলে বড়দির নির্দেশে তালা খুলে দেওয়া হয়েছে৷ মাঠে যখন প্যান্ডেল বেঁধে স্কুলের কোনও ফাংশান-টাংশান হয় তখন এই টয়লেটটা গেস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়৷
ওরা চারজন টয়লেটের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল৷ ঝিলমিল লাগানো বিশাল দরজা—প্রায় দেড়মানুষ উঁচু৷ তিনটে সিঁড়ির ধাপ উঠে তারপর টয়লেটে ঢুকতে হয়৷
সম্পি বলল ও আগে যাবে৷ তখন ইলিনা বলল, ‘তোর ব্যাগটা আমার কাছে দিয়ে যা—৷’
তাতে ও স্পষ্ট জবাব দিল, ‘না রে, ব্যাগ আমার সঙ্গে থাক…৷’ তারপর দরজা ঠেলে ঢুকে গেল৷
ব্রিটিশ আমলের টয়লেট৷ তার সিলিং যেমন উঁচু, আকারও তেমনি বিশাল৷ তবে মাত্র একজন ব্যবহার করতে পারে৷
টয়লেটে চল্লিশ ওয়াটের দুটো বালব জ্বলছে৷ বাঁ-দিকের দেওয়ালে বড় ওয়াশ বেসিন৷ তার ওপরে বিরাট মাপের বেলজিয়ান আয়না৷ তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বাথটাব৷ লম্বায় প্রায় আট ফুট হবে৷ তার সাদা রং অনেক জায়গায় চটে গিয়ে জং ধরা লোহা বেরিয়ে পড়েছে৷
ডানদিকে বড় মাপের ইউরিনাল কিউবিকল, আর তার পাশে একটা ছোট ঘর হল ল্যাট্রিন৷
টয়লেটের দেওয়ালে-দেওয়ালে ঝুল-কালি আর মাকড়সার জাল দেখে বোঝাই যায় এটা খুব কম ব্যবহার হয়৷
টয়লেটের দরজা বন্ধ করল সম্পি৷ তারপর দু-পাল্লার ঝিলমিলের ওপরে কাঠের লক আটকে দিল৷
এবার ও টয়লেটের প্রতিটি আনাচকানাচ খতিয়ে দেখে নিল যে, টয়লেটে সত্যিই ও একা৷
সিলিং-এর দিকে তাকাল সম্পি৷ অনেক উঁচুতে চার দেওয়ালে চারটে বড় মাপের ভেন্টিলেটার৷ তার চারপাশে মোটা-মোটা ঝুল জমে আছে৷
সম্পির একটু ভয়-ভয় করছিল৷ ও ব্যাগটা শুকনো মেঝেতে নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ইউরিনাল কিউবিকল-এ ঢুকল৷ তখনই যেন একটা ছোট্ট কাশির শব্দ শুনতে পেল৷
ও গলা বাড়িয়ে বাইরেটা আবার দেখে নিল৷ কেউ নেই৷
ভাগ্যিস ও ভয়ে চিৎকার করে ওঠেনি! স্কুলে ডাকাবুকো বলে যার পরিচয় তাকে সবাই ভিতুর ডিম বলে ডাকুক এটা ও কিছুতেই চায় না৷
কিন্তু ইউরিনাল কিউবিকল থেকে ও যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন টয়লেটে ও একা নয়৷ টয়লেটের দরজার কাছে রনিতা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ ওঁর মুখটা এখনও পালটে যায়নি, কিন্তু দু-চোখে সাদা আলো জ্বলছে৷
ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে৷ সম্পি ওর নাম জানে না, তবে মুখটা চেনে৷ যতদূর মনে পড়ছে, মেয়েটা ক্লাস নাইনের ‘সি’ সেকশানে পড়ে৷ ওর চোখেও সাদা আলো ধকধক করে জ্বলছে৷
যতটা ভয় পাওয়ার কথা সম্পি ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, দরজার বাইরে ওর তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে আবার অনুষ্কা রয়েছে৷
কিন্তু এই পিশাচ দুটো কোথায় লুকিয়ে ছিল? সম্পি তো এদের খুঁজে পায়নি! তা হলে কি ল্যাট্রিনের ছাদের ওপরে লেপটে শুয়ে ছিল?
সম্পি চিৎকার করার কথা ভাবল৷ কিন্তু দরজার ঠিক বাইরেই যখন তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে তখন চিৎকার না করে ওদের স্বাভাবিক গলায় ডাকলেই হয়৷ তা হলে ওরা বুঝবে, সম্পি ভিতু নয়৷
সম্পি ‘ইলিনা! ইলিনা!’ বলে ডেকে উঠল৷ ডাকটা সম্পির অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকারের মতো হয়ে গেল৷
কিন্তু কোনও সাড়া পেল না৷
পিশাচ দুটো চাপা খিলখিল হাসিতে ঢলে পড়ল৷ গোপন রসিকতায় এ ওর গায়ে ঠেলা মারতে লাগল৷ রনিতা ম্যাডাম ওঁর ছাত্রীর যেন ইয়ার-দোস্ত হয়ে গেছেন৷
‘ওরা কেউ নেই রে৷ ওরা চলে গেছে৷’ হেসে বললেন রনিতা৷ ওঁর গলাটা অস্বাভাবিকরকম মিহি শোনাল : ‘আমাদের মতো আর-একজন ওদের মিছে কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে৷ তোর পাহারা থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷’
পিশাচের কথা বিশ্বাস করল না সমর্পিতা৷ ও আবার ইলিনা আর অনুষ্কার নাম ধরে জোরে-জোরে ডেকে উঠল—একবার, দু-বার, তিনবার৷
না, কেউ সাড়া দিল না৷ সম্পির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল৷
পিশাচ দুটো আবার খিলখিল করে হেসে উঠল৷ কাচের চুড়ির সঙ্গে কাচের চুড়ি ঠোকাঠুকি লাগল যেন৷ তারপর আহ্লাদে আটখানা হয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগল৷
‘কেউ নেই—’ আঙুল ঘুরিয়ে ব্যঙ্গের গলায় বললেন রনিতা, ‘তুই এখন আমাদের৷ তোর বন্ধু অনুষ্কা—ওই ন্যাকা ভ্যাম্পায়ারটা—ওকেও আজ আমরা খতম করব৷ ভ্যাম্পায়ার, কিন্তু মানুষ ধরা পছন্দ করে না৷ ন্যাকাষষ্ঠী! বেড়াল বলে মাছ ছোঁব না! তার উপর আমাদের পিণ্ডি চটকানোর প্ল্যান আঁটছে! আজ দেখব কত দৌড়!’
‘তোকে আজ কেউ বাঁচাতে পারবে না৷’ রনিতার সঙ্গী পিশাচটা বলল, ‘আজ আমাদের পূর্ণিমা ফেস্টিভ্যাল…৷’
সম্পি ঝুঁকে পড়ে ওর ব্যাগ খুলল৷ একটা জলের বোতল বের করে ছিপি খুলল৷ ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে৷
পিশাচ দুটো বিদ্যুৎঝলকের মতো লাফ দিল৷ এক লহমায় চলে এল সম্পির কাছে৷ ওর দু-পাশে ঘন হয়ে দাঁড়াল৷ লম্বা জিভ বের করে ওর ঘাড়-গলা চাটতে লাগল৷ আর মুখ থেকে জড়ানো গলায় ‘আঃ—! আঃ—!’ করে লোভের শব্দ বের করতে লাগল৷
সমর্পিতার গা ঘিনঘিন করছিল কিন্তু একইসঙ্গে আরাম কিংবা তৃপ্তির ঝিমুনি লাগছিল৷ সেই অবস্থাতেই ওর মনে প্রশ্ন জাগল : এই পিশাচগুলো কি সম্মোহন জানে?
রনিতা ম্যাডাম সম্পির হাতের জলের বোতলের দিকে তাকিয়ে নেশা-ধরা গলায় বললেন, ‘সম্পি, তোর তেষ্টা পাচ্ছে, তেষ্টা?…আমাদেরও পাচ্ছে…দারুণ তেষ্টা…তেষ্টা—আ—আ—আঃ…!’
রনিতা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলের বোতলটা ওঁর মাথায় উপুড় করে দিল সম্পি৷ তাই রনিতার শেষ দিকের ‘আঃ!’-টা আরামের শীৎকার থেকে যন্ত্রণার চিৎকারে বদলে গেল৷
মানুষের মাথার ওপরে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের বোতল উপুড় করে দিলে যে-দশা হয় রনিতা ম্যাডামের দশা তার চেয়েও দশগুণ খারাপ হয়ে গেল৷
ওর শরীর গাঢ় ধোঁয়ায় ঢেকে গেল৷ গরম তেলের ওপর জলের ফোঁটা পড়ল যেরকম চড়বড়-চড়বড় শব্দ হয় সেরকম শব্দ হতে লাগল৷ তার সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণার মরণ আর্তনাদ৷
ধোঁয়াটে রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন দলা পাকিয়ে খসে পড়ল মেঝেতে৷
বৃষ্টির জলের সত্যি-সত্যি এত শক্তি!
সম্পি তাজ্জব হয়ে গেল৷ এই পিশাচটাকে নিকেশ করার জন্য ও কতদিন ধরে বৃষ্টির জল জমিয়ে রেখেছিল৷ দুটো প্লাস্টিকের বোতলে সেই জল ভরে ও সেই কবে থেকে স্কুল-ব্যাগে বোতলগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!
আজ সেটা কাজে এল৷
ধেড়ে পিশাচ তো পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে, কিন্তু কচিটা?
সেটা তখন সম্পিকে জাপটে ধরে ইস্পাতের দাঁতের পাটি ফাঁক করেছে৷ এবং সেই ধারালো দাঁত বসিয়ে দিতে চাইছে সমর্পিতার গলায়৷
সম্পি এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল—অনেকটা যুদ্ধের ডাকের মতো৷ তারপর বোতলে যে-সামান্য জল ছিল সেটা ছুড়ে দিল দ্বিতীয় পিশাচের গায়ে৷
পিশাচটার গা থেকে ধোঁয়া বেরোল৷ ওটা চকিতে দু-পা পিছিয়ে গেল সম্পির কাছ থেকে৷
সমর্পিতা এইটুকু সময়ই চাইছিল৷ যন্ত্রের মতো নির্ভুল দ্রুতগতিতে ও ব্যাগ থেকে দ্বিতীয় জলের বোতলটা বের করে নিল৷ একলাফে আহত পিশাচটার কাছে পৌঁছে গেল৷ ছিপি খুলে বোতলের জল ঢেলে দিল ওটার মাথায়৷
ধোঁয়া৷ চড়বড় শব্দ৷ যন্ত্রণার চিৎকার৷
পিশাচটা পড়ে গেল মেঝেতে৷ ধোঁয়ায় মাখামাখি হয়ে ছটফট করতে লাগল৷
দুটো ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে পিছনে ফেলে দরজার দিকে পাগলের মতো ছুট লাগল সম্পি৷ একইসঙ্গে খ্যাপাটে চিৎকার করতে লাগল৷ হাতের খালি বোতলটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে টয়লেটের দরজার কাছে পৌঁছে গেল৷ তারপর ছিটকিনি খুলে সোজা বাইরে৷
সম্পি বাইরে এলেও ওর চিৎকার থামেনি৷ চিৎকার করতে-করতে ও ছুটে গেল ফেস্টিভ্যাল হলের দরজার দিকে৷
ওর চিৎকার শুনে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু দরজার কাছে ভিড় করে সবাই দাঁড়িয়ে৷ পুরোনো ঘটনার কথা মনে রেখে কেউই এগোতে সাহস পায়নি৷
সম্পি ছুটতে-ছুটতে এসে কাকলি ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে ওঁর ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ বিকৃত গলায় হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘পিশাচ! পূর্ণিমা! পিশাচ! টয়লেটে৷ রনিতা…রনিতা ম্যাডাম…পিশাচ!’
এটুকু শুনেই কাকলি ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷
সম্পি টাল সামলাতে না পেরে আর-একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল— কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল৷
মেয়েরা কাকলি ম্যাডামকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল৷
অন্যরা সমর্পিতাকে ঘিরে ধরে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল৷
ও বড়-বড় শ্বাস টেনে অনেক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে জড়ানো এলোমেলো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল৷
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে সম্পি টয়লেটের ভয়ংকর ঘটনা সবাইকে খুলে বলল৷ তারপর জিগ্যেস করল, ইলিনা, সজনী, অনুষ্কা ওরা কোথায়৷
কেউই কিছু বলতে পারল না৷ সবাই শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল৷ ভয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে রইল৷
হঠাৎই একটি মেয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গেই তো ওরা তিনজন হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর তো আর দেখিনি—৷’
তা সত্ত্বেও সম্পির চোখ ভিড়ের মধ্যে তিন বন্ধুকে খুঁজতে লাগল৷ কোথায় গেল ওরা? ওদের ফোন করার কোনও উপায় নেই, কারণ মোবাইল ফোন ও টয়লেটে ব্যাগে ফেলে এসেছে৷
সম্পি এতক্ষণে ভয় কাটিয়ে দম ফিরে পেয়েছিল৷ ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে জুতসই একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগল৷ ইলিনাদের খোঁজার জন্য কয়েকজনকে ও সঙ্গে নিতে চায়৷
ও সামনে দাঁড়ানো দুজন মেয়েকে বলল, ‘আমি ইলিনাদের খুঁজতে যাব৷ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?’
ওর কথায় দুজনের জায়গায় ছ’জন ওর কাছে এগিয়ে এল : ‘চলো, আমরা যাব…৷’
সম্পির চোখ সাহসী রবিনা ম্যাডামকে খুঁজল কিন্তু দেখতে পেল না৷
কয়েকজনকে জিগ্যেস করে জানল, মিনিট পনেরো-কুড়ি আগে ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে এসে রবিনা ম্যাডামকে কোথায় যেন ডেকে নিয়ে গেছে৷
সম্পি আর দাঁড়াল না৷ ওর মন কু-ডাক ডাকতে লাগল৷ ওর মনে হল, রবিনা ম্যাডাম, ইলিনা, সজনীদের খুব বিপদ৷ কারণ আজ পূর্ণিমা৷
অনুষ্কা কি পারবে সবাইকে বিপদ থেকে বাঁচাতে?
সম্পি পিচের রাস্তা ধরে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে রওনা হল৷ প্রায় সাত-আটজন মেয়ে দল বেঁধে ওর সঙ্গী হল৷ শম্পা ম্যাডাম বারবার সম্পিকে ডাকলেন, অন্ধকারে এসব খোঁজাখুঁজির কাণ্ড থামাতে বললেন৷ কিন্তু সম্পির আজ কোনও বারণ না শোনার দিন৷
নিরুপায় শম্পা ম্যাডাম তখন মোবাইল ফোন নিয়ে বড়দিকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷
সম্পিরা তখন হইহই করে এগিয়ে চলেছে৷ থেকে-থেকে ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কার নাম ধরে ডাকছে৷
আকাশের চাঁদের দিকে সম্পির চোখ গেল৷
মেঘের আড়াল সরিয়ে ফ্যাকাশে হলদে চাঁদ কখন যেন বেরিয়ে এসেছে৷
.
৷৷এগারো৷৷
উদভ্রান্তের মতো যে-মেয়েটি ওদের কাছে ছুটে এল ইলিনারা ওর মুখ চেনে, কিন্তু নাম জানে না৷ ক্লাস টেন-এর-ই অন্য কোন একটা সেকশানে যেন পড়ে৷
ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা টয়লেটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সমর্পিতার বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল৷
মেয়েটা হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তোমাদের তিনজনকে…রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন৷ তোমাদের নাম ইলিনা, সজনী আর…আর অনুষ্কা তো?’
ওরা মাথা নাড়ল৷ হ্যাঁ৷
‘তোমাদের…তোমাদের রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন…খুব দরকার৷’
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যতটুকু দেখা গেল তাতে ‘খুব দরকার’ ভাবটা মেয়েটির চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছিল৷
‘ম্যাডাম কোথায়? ফেস্টিভ্যাল হলে?’
‘না, ম্যাডাম হল থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে গেলেন৷ তোমাদের তিনজনকে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বললেন…৷’
ইলিনারা ইতস্তত করল৷ এ ওর দিকে তাকাল৷ রবিনা ম্যাডাম হঠাৎ ক্যাম্পাসের পিছনদিকে কী করতে গেলেন?
অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, সজনী—তোমরা বরং যাও, আমি এখানে থাকছি৷’
মেয়েটি অসহায়ের মতো বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম যে তিনজনকেই ডেকেছেন—বলেছেন ভীষণ আর্জেন্ট…৷’
তখন অনুষ্কা ওকে বুঝিয়ে বলল, ‘আমাদের এক বন্ধু টয়লেটে গেছে৷ আমরা ইন ফ্যাক্ট ওর জন্যেই ওয়েট করছি৷ ও বেরোলে আমরা…৷’
মেয়েটি বেশ বিপন্ন গলায় বলল, ‘তা হলে তো খুব প্রবলেমে পড়লাম! ম্যাডাম যেভাবে বললেন…৷’
ইলিনা মোবাইল ফোন বের করে সমর্পিতাকে ফোন করতে লাগল৷
রিং বেজে গেল, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না৷ তখন ইলিনা ফোন কেটে দিল৷
‘ফোন বেজে যাচ্ছে৷ ও ধরছে না—৷’
সজনী বলল, ‘ওর ফোনটা নিশ্চয়ই সাইলেন্ট মোডে আছে—৷’
অনুষ্কা বলল, ‘ঠিক আছে৷ তোমরা দুজন যাও—নিশ্চয়ই ওখানে কোনও প্রবলেম হয়েছে৷ আমি এখানে থাকছি৷ সম্পি টয়লেট থেকে বেরোলে তারপর আমি যাব৷ কোনও ভয় নেই—৷’
‘ভয়? ভয় কীসের?’ অন্য মেয়েটি কৌতূহলে জানতে চাইল৷
ইলিনা আর সজনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না—এমনি৷ চলো, যাই…৷’
ওরা দুজনে যখন মেয়েটির সঙ্গে এগোচ্ছে তখন অনুষ্কা ডেকে বলল, ‘কোনও প্রবলেম হলেই আমাকে সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কোরো৷ সম্পি বেরোলেই আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি—৷’
‘ঠিক আছে৷’ বলে ওরা জোর পায়ে হাঁটা দিল৷
দু-পাশে গাছপালা, মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা৷ ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো এখানে-সেখানে ছিটকে পড়েছে৷ অন্ধকার আর আলো দাবার ছক তৈরি করেছে যেন৷
রিহার্সালের গানের আওয়াজ কানে আসছে৷ তার সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ৷
অনুষ্কা আনমনাভাবেই আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী সুন্দর গোল আর স্পষ্ট৷ ওর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল৷ ছবির চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়েছে কি না কে জানে! প্রকৃতির সঙ্গে ওই ছবিটা সবসময় মেলে না৷
চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কার কেমন ঘোর লেগে গেল৷ ও অপলকে তাকিয়ে নিশিনাথকে দেখতে লাগল৷
হঠাৎই অনুষ্কার হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন থরথর করে কেঁপে উঠল৷ ও চমকে উঠে ফোনের পরদার দিকে তাকাল৷
ইলিনা৷
ফোন ধরতেই ইলিনার বিপন্ন গলা শোনা গেল৷ শুধু বিপন্ন নয়, ওর গলা কাঁপছে৷
‘অনুষ্কা, শিগগির এসো—সর্বনাশ হয়েছে!’
‘তোমরা কোথায়?’
‘পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে—যেখানে তুমি আর আমি কোকিল দেখতে গিয়েছিলাম৷ সেই ইটের পাঁজা…৷’
আর শোনার দরকার মনে করল না অনুষ্কা৷ ফোন কেটে দিয়ে পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে শুরু করল৷
আলো আর অন্ধকারে ওর শরীরটা একবার দেখা যাচ্ছিল, একবার মিলিয়ে যাচ্ছিল৷ যেন ওর ছুটন্ত শরীরটা জ্বলছে-নিভছে৷
ছুটতে-ছুটতে অনুষ্কার মনে হল, টয়লেটের দিক থেকে একটা মিয়োনো ডাক যেন ভেসে এল৷ ইলিনার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠল যেন৷
কিন্তু ওর সামনে দু-বন্ধুর ডাক, পিছনে এক বন্ধুর ডাক৷ তাই অনুষ্কা দৌড় থামাল না—ছুটতেই থাকল৷ সেই অবস্থাতেই ও লম্বা-লম্বা লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে উঠে অলৌকিক গতিতে দুরত্ব কমাতে লাগল৷
মনে হচ্ছিল যেন ও উড়ে চলেছে৷ অন্ধকার কিংবা গাছপালা ওর গতি রুখতে পারছিল না৷ ওকে এই অবস্থায় দেখলে যে-কেউ স্তম্ভিত হয়ে যেত, ভয় পেত৷
অকুস্থলে পৌঁছতে অনুষ্কার সময় লাগল আট সেকেন্ডেরও কম৷ রাস্তা ছেড়ে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ও৷
ওই তো, পুরোনো টিন, কাঠ আর অ্যাসবেস্টস৷ তার পাশে ইটের পাঁজা৷ ইটের পাঁজার ওপরে শুয়ে আছে ওরা দুজন কে? শুয়ে-শুয়ে ছটফট করছে? গায়ে স্কুল-ড্রেস?
জায়গাটা অন্ধকার৷ গাছপালার পাতার আড়াল থাকায় চাঁদের আলোও সেখানে ঢোকেনি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ভ্যাম্পায়ার মেয়ের দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
চিত হয়ে শুয়ে আকুলিবিকুলি করছে ইলিনা আর সজনী৷ ওরা যে চিৎকার করতে পারছে না তার কারণ স্কুল-ড্রেস পরা একটা পিশাচ ওদের ওপর উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে৷ পিশাচটার মুখ ভয়ংকর, চোখ জ্বলছে, ইস্পাতের দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে৷
কিন্তু রবিনা ম্যাডাম কোথায়?
প্রশ্নটা অনুষ্কার মনে ঝলসে গেলেও একইসঙ্গে ও প্রতিরক্ষার কাজ শুরু করল৷
ও ইলিনাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ-ছ’ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেই দূরত্বটাকে ও মোটেই কমাতে চেষ্টা করল না৷ ওখানে দাঁড়িয়েই ওর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল৷
হাতটা পলকে রবারের মতো লম্বা হয়ে গেল৷ একইসঙ্গে হাতের পেশি, শিরা-উপশিরা সব দেখা গেল৷ যেন অনুষ্কার হাতটা স্বচ্ছ কাচের তৈরি৷
পিশাচটা ততক্ষণে ইলিনার গলার খাঁজে কামড় বসিয়েছে৷ আর ঠিক তখনই অনুষ্কার হাতের চেটোতে কতকগুলো কাঁটা গজিয়ে গেছে—ছুচলো ইস্পাতের কাঁটা৷
সেই হাতে বজ্রমুঠিতে পিশাচটার ঘাড় চেপে ধরল অনুষ্কা৷ শরীর থেকে যেমন করে জোঁক ছাড়ায় সেভাবে পিশাচটাকে ইলিনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল, এক হ্যাঁচকায় টেনে নিল নিজের কাছে৷
ইলিনা আর সজনী এবার প্রাণপণ চিৎকার জুড়ে দিল৷ সেই চিৎকারে গাছপালার ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠে ডাকতে লাগল, ওড়াউড়ি শুরু করল৷
ইলিনারা টের পেল দারচিনির গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে৷
ইলিনার গলা থেকে রক্ত পড়ছিল, মাথা টলে যাচ্ছিল৷ ও কোনওরকমে উঠে বসল৷ তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
সজনীও তাকাল৷
ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইলিনার প্রিয়তম ভ্যাম্পায়ার! শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছে৷
অনুষ্কার হাতের মুঠোয় পিশাচটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ ওটা হাঁ করে বাতাস টানার চেষ্টা করছিল৷ যন্ত্রণার চিৎকার করছিল৷ ইস্পাতের দাঁতের পাটি ঝকঝক করছে৷ আর তার ফাঁকে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকানো একটা কালো রঙের জিভ৷ সেটা কখনও-কখনও লম্বা হয়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে৷
অনুষ্কার শক্তি এতটাই যে, পিশাচটা তার কানাকড়িও ডিঙোতে পারছিল না৷ তাই জেতার চেষ্টা করতে-করতে ওটা কাহিল হয়ে পড়ল৷
অনুষ্কা মোবাইল ফোন ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে পিশাচটার নাক চেপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত একটা গোঙানির শব্দ করে পিশাচটার মাথা কাত হয়ে গেল একপাশে৷
অনুষ্কা ওটাকে ছেড়ে দিল৷ ওটার নিষ্প্রাণ শরীরটা ভেজা কাপড়ের মতো খসে পড়ল মাটিতে৷ পড়েই রইল৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল৷
ইলিনা আর সজনী থরথর করে কাঁপছিল৷ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷
এই তা হলে অনুষ্কার গোপন শক্তি! অনুষ্কা না থাকলে ইলিনারা আজ বাঁচত না৷
কৃতজ্ঞতার আবেগে ইলিনার কান্না পেয়ে গেল৷ একইসঙ্গে গলার অসহ্য যন্ত্রণা ওকে অজ্ঞান করে দিতে চাইছিল৷ ও সজনীকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল৷
সজনীর অবস্থা তখন সাংঘাতিক৷ ওর বুক ধড়াস-ধড়াস করছিল৷ আধো-অন্ধকারে এইমাত্র ও কী দেখল? ওদের বন্ধু অনুষ্কা! সে কেমন পালটে ভয়ংকর হয়ে গেল! অমানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অমানুষিক লড়াই করল!
সজনীর বুক ঠেলে কান্না উথলে উঠছিল৷ একইসঙ্গে একটা অচেনা ভয় ওকে অবশ করে দিচ্ছিল৷
ইলিনা আর সজনী নেমে এল ইটের পাঁজা থেকে৷ দুজনেই ভয়ে কাঁপছে, কাঁদছে৷
ইলিনার স্কুল-ড্রেস রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ ও সজনীকে আঁকড়ে ধরে পা ফেলছিল৷ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠছিল৷
অনুষ্কা ছুটে গিয়ে ওদের জাপটে ধরল৷ ওরা তিনজনেই হাঁপাচ্ছিল৷ কাঁদছিল৷ আর সজনী শিউরে উঠছিল৷
একটু পরে অনুষ্কা সজনীকে বলল, ‘শিগগির সম্পিকে একটা ফোন করো…৷’ কথাটা বলেই ও ইলিনার গলায় নিজের রুমালটা চেপে ধরল৷ যে করে হোক রক্তটা বন্ধ করা দরকার৷
সজনী কান্না-ভাঙা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমাদের দুজনের কারও মোবাইল নেই৷ গণ্ডগোলের সময় কোথায় ছিটকে পড়েছে জানি না…৷’
‘আমার ফোন থেকে ফোন করো৷ ওই তো আমার ফোন ওখানে পড়ে আছে৷’
সজনী এগিয়ে গেল সামনে৷ অন্ধকারে হাতড়ে অনুষ্কার মোবাইলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল৷
সম্পিকে ও ফোন করতে যাবে, তখনই অনুষ্কা জিগ্যেস করল, ‘আমরা যে পিশাচটাকে খতম করলাম সেটাই কি টয়লেটের ওখানে আমাদের ডাকতে গিয়েছিল?’
সজনী নাক টেনে-টেনে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘না, ও ভালো মেয়ে৷ এখানে এসে দূর থেকে জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েই ও ছুটে আবার ফেস্টিভ্যাল হলে চলে গেছে৷ আমরা এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে খুঁজছি, তখনই ওই শয়তান পিশাচটা এগিয়ে এল৷ তারপর…৷’
সজনী কথা বলছিল আর একইসঙ্গে সম্পির নম্বর ডায়াল করে মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরেছিল৷
রিং হয়ে যাচ্ছে৷ ফোন কেউ ধরছে না৷
সে-কথাই ও বলল অনুষ্কাকে৷
অনুষ্কা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওঃ, আবার সেই সাইলেন্ট মোড! শিগগিরই চলো, ইলিনাকে এখুনি ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে৷ কুইক—৷’
ইলিনা অনুষ্কার গায়ে প্রায় এলিয়ে পড়েছিল৷ চোখ বুজে ‘ও—ওঃ! ও—ওঃ!’ শব্দ করে কাতরাচ্ছিল৷
ওকে যে করে হোক সুস্থ করে তুলতে হবে৷ অনুষ্কা ভাবল৷ আরও গাঢ় করে ইলিনাকে জাপটে ধরল ও৷
সজনীকে ডেকে নিয়ে ও এগোতে যাবে তখনই ওর মনে পড়ল রবিনা ম্যাডামের কথা৷ যাঁর নাম করে সেই মেয়েটা ওদের ডেকে নিয়ে এল সেই রবিনা ম্যাডাম কোথায়? আর কোন আর্জেন্ট কাজের জন্য তিনি ওদের তিনজনকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সজনীকে রবিনা ম্যাডামের কথা জিগ্যেস করতেই ও বলল, ‘জানি না৷ এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে আমরা একবারও দেখিনি৷ যখন ম্যাডামকে খোঁজাখুঁজি করছি তখন ইটের পাঁজার আড়াল থেকে ওই ভয়ংকর পিশাচটা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ তারপর তো তুমি এলে…৷’
ইলিনা যন্ত্রণায় রুদ্ধ গলায় কোনওরকমে বলল, ‘অনুষ্কা, রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো?’
সজনী সে-কথায় সায় দিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘আমিও ঠিক এই কথাটাই বলছিলাম৷ রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো!’
‘না রে, আমার কোনও বিপদ হয়নি৷’ উত্তর দিলেন রবিনা ম্যাডাম নিজেই, ‘এখন আমার আর কোনও বিপদের ভয় নেই…৷’
ওরা তিনজনে চমকে উঠল৷ শব্দ লক্ষ করে তাকাল৷
কাছেই একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে রবিনা ম্যাডামের দেহটা লেপটে আছে৷ মাটি থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাত উঁচুতে ওঁর শরীরটা উলটোভাবে শূন্যে ঝুলছে৷ পা ওপরে৷ মাথা নীচের দিকে৷
বোধহয় অন্ধকারে ঢাকা কোনও জুতসই ডালে রবিনা পা দুটো আঁকশির মতো আটকে রেখেছেন৷
রবিনার শরীর থেকে একটা নীলচে আভা বেরোচ্ছে৷ সেই আভার জন্যই ওঁকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উলটো হয়ে থাকার জন্য স্পষ্টভাবে চেনা যাচ্ছে না৷
রবিনার গাল বসে গিয়ে চোয়ালটা সামনে বেরিয়ে এসেছে৷ চোখ দুটো অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বর৷ আর তার কেন্দ্রে সার্চলাইটের মতো উজ্জ্বল সাদা আলোর বিন্দু৷
‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে রে…অসম্ভব পাগল করা তেষ্টা৷’ গাছের গায়ে উলটো হয়ে ঝুলে থাকা পিশাচটা বলল, ‘সেদিন রনিতাদি কী যে কামড় বসাল ঘাড়ে, তারপর থেকেই যত অশান্তি আর ভোগান্তির শুরু৷ তোরা তো আর বুঝবি না, পূর্ণিমার তেষ্টা কী জিনিস! আয়, তোরা কাছে আয়…আয়…৷’
এইসব কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে রবিনার শরীরটা পেন্ডুলামের মতো অল্প-অল্প দুলতে লাগল৷ ঠিক যেন হাওয়ায় দুলছে৷ আর ওঁর মুখটা হাঁ হয়ে গেল৷
ইস্পাতের দাঁতের পাটি দেখা গেল৷ তার ফাঁক দিয়ে একটা লম্বা কালো জিভ সাপের মতো সড়সড় করে বেরিয়ে এল৷ ঝুলে পড়ল নীচের দিকে৷ তারপর সেই দেড়ফুট লম্বা জিভটা নড়তে লাগল, দুলতে লাগল৷
পিশাচটার চোখের দৃষ্টিতে বোধহয় সম্মোহন ছিল৷ কারণ, ইলিনা আর সজনী উলটোভাবে ঝুলে থাকা রবিনার নীল আলো মাখা দেহের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল৷
অনুষ্কা ওদের হাত ধরে টেনে আটকে রাখল৷ চিৎকার করে বলল, ‘যেয়ো না—এখানে চুপ করে দাঁড়াও! যেয়ো না! আমার কথা শোনো—!’
হঠাৎই দারচিনির গন্ধে বাতাস মিষ্টি হয়ে গেল৷ এক ঝটকায় ইলিনা আর সজনীকে ছিটকে ফেলে দিল অনুষ্কা৷ তারপর ওর ডানহাত চোখের পলকে লম্বা হয়ে ছোবল মারল রবিনা ম্যাডামের গলায়৷ এবং একটানে পিশাচটাকে গাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল৷
ইলিনা আর সজনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের বন্ধুর অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখছিল৷ মনে হচ্ছিল, ওদের চোখের সামনে যা-যা ঘটে চলেছে সেগুলো বাস্তব নয়, একটা গাঁজাখুরি সিনেমা৷
সেই ‘সিনেমা’-য় অনুষ্কার হাতের ইস্পাতের কাঁটাগুলো পিশাচটার গলায় আমূল গেঁথে গেল৷ ওর হাতের টানে পিশাচটা রবারের সুতোয় বাঁধা বলের মতো ছিটকে চলে এল অনুষ্কার কাছে৷
পিশাচটা যন্ত্রণার হাহাকার তুলছিল৷ মাথাটা এপাশ-ওপাশ নাড়ছিল৷ অনুষ্কা বাঁ-হাতে খপ করে পিশাচটার নাক টিপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল পিশাচটার মরণ গোঙানি৷ বারবার হাঁ করে বাতাস নিতে চাইল৷
একটু পরেই ওটার সব লড়াই শেষ হয়ে গেল৷ সব তেষ্টা মিটে গেল৷
অনুষ্কা ছেড়ে দিতেই ওটা এক টুকরো কাঠের মতো খসে পড়ে গেল মাটিতে৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷ ও এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল৷ ঘোর কেটে যেতেই ওর বন্ধুদের কথা মনে পড়ল৷ ও ফিরে তাকাল ইলিনার দিকে, সজনীর দিকে৷ ওদের বিপদে কাজে লাগতে পেরে মনটা ভীষণ ভালো লাগছে৷ এই ভালো লাগা আগে কখনও ও টের পায়নি৷
অনুষ্কা ইলিনাকে তুলে ধরল৷ তারপর ওকে বুকে জড়িয়ে নিল : ‘শিগগির চলো, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে…৷’
সজনী নিজে থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ ও অনুষ্কার কাছে এসে ওর হাত ধরল৷ চাপা গলায় বলল, ‘থ্যাংক য়ু—৷’
ইলিনাও অনুষ্কার কানে-কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ও যা বলল, তাই…৷’
অনুষ্কার কানে এল অনেকের হইচই চিৎকার৷
ও চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী স্পষ্ট, কী সুন্দর!
চাঁদকে এই মুহূর্তে ওর ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করল৷
ঠিক তখনই সম্পির গলা কানে এল৷ ওদের তিনজনের নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছে৷
.
৷৷বারো৷৷
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷
এখন আমাকে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হবে৷
আত্মা যদি অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মার অবিনশ্বর হতে অসুবিধে কী! সুতরাং আমি অমর৷
তোমার কি মনে নেই, গীতার সাংখ্যযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷’ অর্থাৎ, কোনও শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করিতে পারে না৷ অগ্নি ইহাকে দহন করিতে পারে না৷
তিনি আরও বলেছেন, জল ইহাকে আর্দ্র করিতে পারে না, বায়ু ইহাকে শুষ্ক করিতে পারে না৷
তা হলে আমার ‘মৃত্যু’ হবে কেমন করে?
তাই আকাশে, বাতাসে ধুলোয় মিশে আবার শুরু হোক আমার পথ চলা৷
চলতে-চলতে আবার আমাকে খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়৷ নিতে হবে আবার কোনও নতুন পরিচয়৷ তারপর আবার বিশ্রাম আর আরাম৷
নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, নতুন করে শুরু হবে আমার নতুন জীবন৷
আঃ, ভাবতেই কী তৃপ্তি!
Leave a Reply