তিন ভুবনের পারে – নবনীতা দেব সেন
তিন ভুবনের পারে – নবনীতা দেব সেন
প্রথম প্রকাশ – ১লা বৈশাখ ১৩৮৬
উৎসর্গ
ডাক্তার শ্রীযুক্ত সুবোধচন্দ্র চট্টোপাদ্যায়
ডাক্তার শ্রীপুণ্যব্রত দোবে
কবিরাজ শ্রীকৃষ্ণানন্দ গুপ্ত
ডাক্তার শ্রীঅনুপম দাশগুপ্ত
আমার মায়ের শেষ মুহূর্তগুলিকে অকৃত্রিম, স্বার্থহীন, ভালোবাসার শুশ্রূষায় যাঁরা আয়ুপূর্ণ করে রেখেছিলেন—মায়ের হাতে-না-দিতে পারা এই প্রথম বইটি তাঁদের হাতেই তুলে দিচ্ছি।
আর যে মানুষগুলির হৃদয়, মমতা, শ্রম ও সেবা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না—সেই পিকো-মা, কানাই, শিবু, ইন্দু, বব, প্রতীক, কল্যাণ ঋতা, হরিকাকু, মালতী মাসিমা, বুলবুলি, রঘু, নীলু, লক্ষ্মী, আর টুম্পারানীকে সর্বক্ষণ মনে রেখে।
নবনীতা দেব সেন
“ভালোবাসা”
মকর সংক্রান্তি ১৩৯৬
.
ভণিতা
ধ্যান-তপস্যা-সাধনার যোগ্যতা আমার নেই, পুজোআচ্চা-আচার-বিচার-নিয়ম পালনের উৎসাহ বা বিশ্বাস আমার নেই, কিন্তু ধর্ম নিয়ে অসীম কৌতূহল আছে। প্রাণে গান নাই—তাই ভক্তি আসুক প্রাণে, এমন ইচ্ছেও আছে—(রবিঠাকুরের মতো পুজার গান যাতে লিখতে পারি!) কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তো আমাকে রবিঠাকুর করেননি, রজনীকান্ত-রামপ্রসাদও করেননি। হিংসুটে করেছেন। ভক্তি আছে, এমন মানুষদের দেখলেই আমার হিংসে হয়। প্রকৃত ভক্তির মতো আরাম আর কিছুতে নেই।
ইংলণ্ডে হিন্দুধর্ম নিয়ে সাহেব মেমদের ভক্তির মাতামাতি অনেকদিন ধরেই চলছে। ১৯৭০/৭১এ লন্ডনে একবার একটা পাবলিক লন্ডারেটে কাপড় কাচতে গিয়ে কিছু ভক্ত হিন্দু মেমসাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যাঁরা “গুরু মহারাজ”-এর শিষ্যা। তাঁদের মুগ্ধতা দেখে আমি অবাক। মাত্র চোদ্দ বছরের এক পাহাড়ী বালকের ছবি তাঁরা বের করে দেখালেন। একটা আস্ত এরোপ্লেন ভাড়া করে তাঁরা সদলে মার্কিন মহাদেশে যাবেন শুনলুম সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই। খুদে গুরুসমেত।
অক্সফোর্ড সার্কাসে রাস্তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে হাঁটুর কাছে শাড়ি পরা, সোনালী বিনুনী বাঁধা, চন্দন-টিপ-পরা, খালি-পা মেমেরা ও ন্যাড়ামুণ্ডু সোনালী-টিকিওলা ধুতি-চাদর-পরা সাহেবরা তখনই পথচারীকে প্রশ্ন করতেন, “তুমি কৃষ্ণনাম শুনেছ? তোমার পাপমোচন হবে, কৃষ্ণনাম কর। এই নাও প্রভুপাদের বই, কেনো—”। তাঁদের বাছবিচার ছিল না। পথচারী সাহেব মেমদের যেমন দাঁড় করাতেন, ভারতীয়দেরও তেমনিই দাঁড় করাতেন! “তুমি কি কখনো কৃষ্ণনাম শুনেছ?” অমনি হিন্দু পার্শী যিনিই হোন, সেই ভারতীয় পথচারী তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ছিটকে অন্য ফুটপাতে চলে যেতেন। আমিও গেছি, অনেকবার।
ঐ সময়ে ইংলন্ড-আমেরিকায় মহর্ষি মহেশ যোগীর যোগাশ্রম ছিল খুব জনপ্রিয়। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজে “ট্রাসেনডেনটাল মেডিটেশন” চালু হয়েছে—তার সেন্টার একাধিক। চালু হয়েছে কলকাতাতেও অবিশ্যি। হৃষিকেশে তখনও বোধহয় মহেশযোগীর বহুতল আশ্রম তৈরি হয়নি। আমি ঠিক জানি না। তবে ভারতবর্ষে তখনও মহর্ষি মহেশযোগী তত জরুরী নন, যতটা বিদেশে। রজনীশ, এবং তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ “ধর্মক্রিয়ার” কর্মতাণ্ডব তখনই শুরু হচ্ছে বোধহয় আমেরিকাতে। গুরু রজনীশের রহস্যময় ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত কোনো মানুষের সঙ্গেই আমার কখনও দেখা হয়নি, যদিও “ট্রাসেনডেনটাল মেডিটেশনে” উপকৃত হয়েছেন, এমন অনেককেই চিনি। এবিষয়ে বইপত্রও পড়েছি। নিজেও T.M. শেখার চেষ্টা করেছি। তবে আমি যা অস্থির, যা চঞ্চল, ধ্যান-ধারণা বোধহয় এজীবনে আর আমার দ্বারা হবার নয়।
আগে আগে, ইংলন্ডে থাকতে, দুর্গাপুজোর সময়ে মন কেমন করলে আমি কেম্ব্রিজ থেকে (পঞ্চাশের শেষে ষাটের গোড়ায়) লন্ডনে রামকৃষ্ণমিশনের আশ্রমে চলে যেতুম। সেখানে শান্ত, সশ্রদ্ধ, ভক্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় ঘটপুজো হত, দালানে খিচুড়ী ভোগ হত, লোকজন খুব বেশি হত না, প্রতিমাও দেখিনি। ষাটের দশকের শেষদিকেই শুরু হয়ে গেছে লন্ডনে জাঁকজমকের সঙ্গে বারোয়ারি প্রতিমায় দুর্গাপুজো। বেলসাইজ পার্কের পুজোটাতেই শুধু আমি গেছি। এখন তো শুনেছি আরো বহু দুর্গাপুজো হয়। মেলা বসে যায়। কলকাতার মতোই প্রায় রম্ রমা ব্যাপার-স্যাপার। বাংলা বইপত্তরের বইমেলা বইবাজার পর্যন্ত হচ্ছে।
কানাডায় ও নর্থ আমেরিকাতেও দুর্গাপুজো এখন প্রচুর। কি পূর্ব তটে কি পশ্চিম-তটে। প্রবাসী বঙ্গসন্তানেরও অভাব নেই, দুর্গাপুজো কমিটিরও অন্ত নেই, আর তাদের মধ্যে রেষারেষিরও কমতি নেই। যতো বঙ্গসংস্কৃতির প্রচার হচ্ছে সাত সমুদ্রের ওপারে, ততই ঝগড়া-কাজিয়া দলাদলিরও শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে সেখানে। দুর্গাপুজো আর রবীন্দ্র জন্মোৎসব এই ঘিরেই প্রবাসী বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা। হিন্দু মুসলমান এসব কথা মনেও থাকে না কারুর, ঘটনাটা যদিও দুর্গাপুজো।—বাংলাদেশী বাঙালিরাও ছুটে আসেন, নাচগান নাটকে অংশ নেন, ভোগ-প্রসাদের পংক্তি ভোজনেও অংশ নেন। অতএব মিলনও আছে। শুধুই দলাদলি নয়।
এখন তো সারা উত্তর আমেরিকা জুড়ে ইসকনের রাধাকৃষ্ণ মন্দির আর ধর্মশালা। ইসকনের আজীবন সদস্যরা সর্বত্রই বিনা খরচে থাকতে পারেন বলে শুনেছি। আর প্রসাদ তো নাকি যে কেউ পেতে পারেন। শিখ গুরুদ্বোয়ারাও আছে কানাডায় ও নর্থ আমেরিকাতে অসংখ্য। যেমন রয়েছে মসজিদ। ইদানীং দারুণ সব মসজিদও তৈরি হয়েছে। লন্ডনের ঠিক মাঝখানেই একটা—নিউইয়র্কের এধারে ওধারে বেশ কয়েকটা। সময়টা যতই অধর্ম চর্চার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই যেন ধর্ম-কর্মের বাতিকটাও বাড়ছে। মৌলবাদীরা সব ধর্মেই জাঁকিয়ে বসছে জগৎ জুড়ে। কেঁপে উঠেছে ঈশ্বরের আসন।
এখন সত্যিকারের “ধর্ম” যে কী, কেই বা জানি? ধর্মের নামে অধর্মের চাষ চলছে, বিষ ফসল ফলছে সভ্যতার বুকটাকে ঝলসে দিয়ে। এই ভয়ংকর দিনে ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে, কিছু লিখতে ভয় করে। ধর্ম এখন ঈশ্বরের নাগালের অনেক বাইরে। ধর্ম এখন শুধু ধর্ম-গুরুদের। গুরু তো জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দিয়ে আমাদের চক্ষু উন্মীলন করবেন এরকমই কথা, কিন্তু কাৰ্যত আজ তাঁরা আমাদের দৃষ্টি হরণ করে নেওয়ার দিকেই চলেছেন—ফাঁকা ধর্মের হুজুগে সত্যিকারের গুরুর যেন বড়ো অনটন। তবুও এখনও অনেকেই আছেন যাঁরা মনে প্রাণে খুঁজে চলেছেন সত্যের পথ, মুক্তির পথ। কোনও লেখকের আশু ‘শিরশ্ছেদের আদেশ জারী করাটাই যে বিংশ শতকে কোনও ধর্মগুরুর প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য হতে পারে না, সে জ্ঞান অনেক ধর্মগুরুরই রয়েছে। তবুও তো এহেন আজ্ঞা বহাল থাকে! এমনকি সেই ধর্মগুরুর মৃত্যুর পরেও তার নড়চড় হয় না। ধর্মনীতি, রাজনীতি মিশে গিয়ে এক ভয়ংকর নীতিহীনতা তৈরি হয়েছে।
হায়রে মানুষের অভিমান! মানুষের কলম কি কদাচ পরম ঈশ্বরের মানহানি করতে পারে? এতবড় ক্ষমতা কোন্ নশ্বর কলমের আছে? কোনও ধর্মেই ঈশ্বরকে গুরুর ওপরে নির্ভর করতে হয় না। শুধু যাঁর গুণগান গাওয়াই আমাদের কর্তব্য, তাঁর নিন্দা যদি কেউ করে—তার মোকাবিলা তিনি নিজেই করবেন, এটুকুও নির্ভরতা কি আমাদের থাকবে না ঈশ্বরের প্রতি? তাঁর মানরক্ষার দায় নশ্বর, মৃত্যুশাসিত ধর্মগুরুকে নিতে হবে কেন?
দিনকাল যত আধুনিক যত বিজ্ঞান-নির্ভর হচ্ছে ততই বাড়ছে ধর্মীয় অন্ধত্ব আর কুসংস্কার। সতীপুজো বন্ধ করতে হচ্ছে পুলিশ ডেকে। “রামশিলা” ইঁট আসছে প্লেনে চড়ে ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বসাতে। কোথায় আমাদের মন্ত্র দিনে দিনে উদার হবে, পাশাপাশি জগতের বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায় মিলে-মিশে অনন্য ঈশ্বরের সেবা করবো, তা না, মানুষের মনের ঝোঁক যেন দিন-কে-দিন শুধুই সংকীর্ণতর হবার দিকে। অন্ধগলির থেকে তস্য গলিতে ঢুকে পড়ছি আমরা। যে ধর্ম আমাদের ধারণ করে থাকে, যে ধর্ম আমাদের ধাত্রী, সেই ধর্ম আমাদের ধ্বংস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের ইতিহাসে এ খুবই পুরোনো হাহাকার, সভ্যতার সহোদর অন্ধকার।
আমেরিকাতে প্রাচ্যের ধর্মবাতিকের বান অনেকদিনই ডেকেছে। ইস্কন, রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়াও। (এবং রাজা রজনীশ, মহর্ষি মহেশযোগী, বালক বীর গুরু মহারাজ ইত্যাদি নিউজ ভ্যালুওয়ালা গুরুদের বাদ দিয়েও) বহু হিন্দু মঠমন্দির হয়েছে মার্কিন মুলুকময়। চাদ্দিকে ন্যাড়ামাথা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী, কিংবা পাগড়ী বাঁধা সায়েব শিখ দেখা যায়। এ গল্প তাদের গল্প নয়। এটা সব ধর্ম নিয়ে আশ্চর্য একটা গল্প। সত্যিই একটা আশ্চর্য জায়গায় ঘুরে এলুম, যেটার কাহিনী না শুনিয়েই পারছি না বন্ধুদের।
১৯৮৯-র ফেব্রুয়ারি মাস। আমি এসেছি এক সেমেস্টারের জন্যে আমেরিকার পশ্চিমে কলোরাডো স্প্রিংস শহরে কলোরাডো কলেজে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ‘মে-ট্যাগ চেয়ার’-এ নিযুক্ত হয়ে। পঠনকাল এই কলেজে ‘ব্লক-সিস্টেমে’ ভাগ করা। প্রতি সেমেস্টারে চারটি ব্লক। প্রথমে দুই ব্লকে আমাকে লেকচার দিতে হবে না, আমি তখন ‘রাইটার ইন রেসিডেন্স’। পরের দুই ব্লকে দুটি কোর্স পড়াবো। তখন আমি “প্রফেসর অব কম্প্যারেটিভ লিটারেচার।” আপাতত মজা, আমার পড়ানো নেই। ছাত্রছাত্রীরা যদি কেউ কিছু গল্প কবিতা লিখে আনে, আমাকে দেখাতে চায়, আমার কর্তব্য সেগুলি পড়ে মন্তব্য করা। যদি কেউ সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা করতে চায়, তার জন্য আমার অফিসে উপস্থিতি প্রয়োজন। বাকী সময়টা আমার নিজের লেখবার জন্য। অফিসে বসেও লিখতেই পারি, যদি না ছেলেমেয়েরা ডাকে। আমার সব বাকী সময় নিজের লেখার।
কলোরাডো স্প্রিংস ছোট্ট পাহাড়ী শহর। এককালে স্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে বিখ্যাত ছিল। যক্ষ্মা আর হাঁপানি সারাতে আসতো রুগীরা এর খোলা বিশুদ্ধ বাতাসে। ঠিক পাশের ছোট্ট শহরে প্রচুর হট্স্প্রিং ছিল, সেখানে নাইলেও শরীর সারতো এককালে। এখন স্বাস্থ্য-ব্যবসা পড়তি। আর কেউ তেমন হট্স্প্রিঙে যায় না। তার বদলে এখানে এয়ার ফোর্স অ্যাকাডেমিটাই এখন বেশি প্রসিদ্ধ। চার পাশেই সৈন্য সামন্ত, ‘ফোর্ট কার্সন’ ইত্যাদি এখানে রয়েছে বলে। ডেনভার শহর থেকে ষাট কিলোমিটার দূর কলোরাডো স্প্রিংস শহরটি।
আমি আছি ছোট্ট সুন্দর একটা একতলা বাংলো বাড়িতে। বাড়িটার একশো বছর পার হয়ে গেছে। বাড়ির মালিক কবি শ্রীমতী জোন স্টোন। তিনিও কলোরাডো কলেজে ইংরিজির অধ্যাপিকা। বাংলো বাড়িটিকে ঠিক আধাআধি করে দুটি পৃথক ফ্ল্যাট। দুটি শোবার ঘর, দুটি রান্নাঘর, দুটি স্নান ঘর, দুটি বৈঠকখানা। ব্যস্। আধাআধি। এক অংশে জোন থাকেন, অন্য অংশে আমি। আমার জানালা দিয়ে রকি মাউন্টেনের উচ্চতম শিখরের একটি—”পাইকস পীক” দেখা যায়। জোন আর আমি অনেক রাত্রি পর্যন্ত আড্ডা মারি। কবিতা পড়ি। ওর ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে আলোচনা করি। জোন এই ব্লকে “ক্রিয়েটিভ রাইটিং” ক্লাস দিচ্ছেন, মোট পনেরোজন ছাত্রছাত্রীকে। তার বেশি ছাত্র-ছাত্রী এই ক্লাসে নেওয়া বারণ। জোনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমারও আলাপ হয়ে গেছে দিব্যি। তারা এসে আমার সঙ্গেও আড্ডা দেয়, কবিতা লিখে এনে দেখায়, আমার মন্তব্য শোনে, আলোচনা করে। “রাইটার-ইন-রেসিডেন্স” হিসেবে এটা আমার কাজের মধ্যেই পড়ে। খুব আনন্দজনক কাজ। নিজে বাকী সময়টা লিখে কাটাই। জুনমাসে দেশে মার কাছে ফিরবো।
তার আগে আমার কবিতা পড়ার নেমন্তন্ন এসেছে ওয়াশিংটনের সিয়ালে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় লস এঞ্জেলেসে, ম্যাসাচুসেটসের স্মিথ কলেজে
শান্তিনিকেতনের শ্রীক্ষিতীশ রায়ের মেয়ে চিকু (শ্রীলা) আছেন ডেনভারে। তিনি ব্যবস্থা করছিলেন তাঁদের মিউজিয়ামে বাঙালি চিত্রকরদের ওপরে আমাকে দিয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়াতে। আর রুবিদি (গায়িকা শ্রীমতী বনানী ঘোষ) ও সুমিত (স্বর্গত বিকাশ রায়ের পুত্র) নেমন্তন্ন করেছেন নিউজার্সিতে মে-মাসের রবীন্দ্র মেলায় বক্তৃতা দিতে। শুনেছি অমিতাভ চৌধুরী ইত্যাদি অনেকে আসছেন দেশ থেকে। এই আমন্ত্রণগুলি রক্ষা করা শুরু হবে একে একে এপ্রিল মাস থেকেই। তারপর আমার বান্ধবী গ্লোরিয়া নেইলর (কৃষ্ণাঙ্গী ঔপন্যাসিকা) এখানে আসবেন। তাঁর সঙ্গে গাড়িতে আমরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বেড়াতে যাবো। সামনে এত সব পরিকল্পনা। মাঝে আমার ছোট মেয়েটি আসবে হাভার্ড থেকে, তাকে নিয়েও ঘোরার প্ল্যান আছে পাহাড়ে। এই রকি মাউন্টেনে একদা শত শত সোনার খনি ছিল। সেই সব ছোট্ট শহরগুলো এখন সিনেমার সেটের মত স্বপ্নিল অবাস্তব দেখায়, অথচ তারা সব জীবন্ত শহর। প্রধানত ট্যুরিস্ট স্পটই হয়ে দাঁড়িয়েছে অবিশ্যি। সেইসব জায়গায় যাবো। আর যাবো “কন্টিনেন্টাল ডিভাইড” দেখতে যে উঁচু পাহাড়ের দুদিক থেকে নর্থ আমেরিকার নদীগুলির স্রোত দুটো সমুদ্রের দিকে বয়ে যাচ্ছে—পূর্বদিকের নদীগুলি যাচ্ছে অতলান্তিকের দিকে, আর পশ্চিমের নদীগুলি প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে।—সময় মতো এইসব ‘দ্রষ্টব্য’ দেখতে যাবো, তাই কথা ছিল, হঠাৎ একটা ‘এক্সট্রা ভ্ৰমণ’ কপালে জুটে গেল। সেই ভ্রমণটি এতই আশ্চর্য, এত অনন্য চরিত্রের, যে লিখতেই হচ্ছে।
কলোরাডোতে প্রচণ্ড শীতপ্রবাহ চলছে তখন। তারই মধ্যে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে বুট-কোট-টুপি পরে রোজ রোজ বরফ ভেঙে হেঁটে হেঁটে অফিসে যাই। অফিস অবিশ্যি আমার বাড়ি থেকে দুটো রাস্তা পরেই। খুবই কাছে। কলেজ আমাকে দু’ দুটো দারুণ সুসজ্জিত অফিস দিয়েছে, একটা লাইব্রেরিতে, একটা মেন বিল্ডঙে। সেখানে বসে লেখাপড়া করতেও ভাল লাগে। এদেশের ঠাণ্ডাটা যতই বেশি হোক রোদ্দুরের তেজ নষ্ট হয় না, আত্মা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে না ইংলন্ডের মতো। তাই শীতকালেও মনমেজাজ চাঙ্গাই থাকে। এ বছর মাইনাস থার্টি ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি শীত দর হেঁকেছিল। সেই হাঁক সত্ত্বেও আমার হাঁপানি, ব্রংকাইটিস কিছুই হয়নি, এত বিশুদ্ধ পার্বত্য বাতাস এখানে। শীতভর এবাড়ি-ওবাড়ি পার্টি হয়। সবাই মোটামুটি ঘরে বন্দী, তাই ঘরে ঘরে আড্ডা হয়। বাইরে ঘোরাঘুরি বড়ো একটা করা যায় না তো বরফের অত্যাচারে। ঘরে বসে বসেই যথাসাধ্য সাধ আহ্লাদ মিটিয়ে হৈ চৈ করা। তারপর যেই না বরফ কমবে, দুটো পাতা কি একটা কুঁড়ি ফুটবে, আকাশে বাতাসে একটু খানি বসন্তের কড়ানাড়া শুনতে পেয়েই অমনি শুরু হয়ে যাবে বাইরে বাইরে বেড়াতে বেরুনোর উদ্দাম ছুটোছুটি। তিন-চারদিনের “বাসন্তী ছুটি” স্প্রিং ভেকেশনের আহ্লাদ এদেশে তুলনাহীন। কিন্তু সে তো পরের কথা, এখনও ঘোর শীত। শুধু শীত নয়, জোর শীতপ্রবাহ চলছে, বরফের পাহাড় জমেছে পীচ রাস্তার দুদিকে। হঠাৎ শুনলুম কলোরাডো কলেজের ক্রিয়েটিভ রাইটিং ক্লাস এক সপ্তাহের জন্য কলোরাডো কলেজের ‘বাকা’ ক্যাম্পাসে যাচ্ছে, আমিও যাচ্ছি।
Basu
Allow download