তিন তিরিক্ষে ভয় – মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : ২০২১
প্রচ্ছদশিল্পী : কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
.
ইতি মুখার্জ্জী ও সঞ্জয় মুখার্জ্জীকে এবং
স্বর্গত বাবা শ্রী গোপীকৃষ্ণ মুখার্জ্জীকে
কৃতজ্ঞতা
সুরজিৎ পাল, অনির্বান ব্যানার্জ্জী, প্রীতম দাস যারা আমাকে গল্পের রসদ জোগান দিতে সাহায্য করেছে৷ শুভঙ্কর রাউত, দেবব্রত অধিকারী, অভিজিৎ দাস এই তিনজনের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ৷ কৌশিক মজুমদার, মনীষ মুখোপাধ্যায়, তমোঘ্ন নস্কর, দীপ্তজৎ মিশ্র, সায়নী মিত্র, নীলোর্মি যশ, অভিষেক ঘোষ, পার্থসারথী রায়চৌধুরী, অমলেন্দু চক্রবর্তী, সুকল্যান কর্মকার, চৈতন্য পাল এরা আমার দাদা, দিদি, শিক্ষক৷ সময়ে অসময়ে যারা আমাকে সাহায্য করেছে৷ সঞ্জয় মুখার্জ্জী, ইতি মুখার্জ্জী আমার দাদা, মা যাদের ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নেই৷
ভূমিকা
“ভয়” বড় গোলমেলে একটা শব্দ। কেউ ভয় পায় অন্ধকারে, কেউ ভয় পায় বাজ পড়াকে, কেউ আবার আরশোলা বা টিকটিকি দেখলে লাফিয়ে ওঠে। আবার কেউ ভয় পায় কাছের মানুষটিকে হারাবার। দেখতে গেলে আমাদের প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজস্ব একটা করে ভয় আছে, একবার কিছুক্ষণের জন্য ভেবে দেখুন তো আপনার ভয় কোনটা?
বইটার ভূমিকা লেখার দায়িত্ব যখন আমার উপর এসে বর্তাল তখন আমি যত না আন্দন্দিত হয়েছিলাম তার চেয়ে চিন্তিতই হয়েছিলাম বেশি। সেই কোন মেয়েবেলা থেকে গল্পের বই পড়ার নেশা থাকলেও লেখালেখির অভ্যাস নেই বললেই চলে। কাজেই ভূমিকা লেখার মত গুরুদায়িত্ব পালন করার কথা যখন দিয়েছি রাখতে তো হবেই। বহু বিনিদ্র রাত ধরে বিভিন্ন ভূমিকা পাঠ করে, ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হয়ে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তবে লিখতে বসলাম।
ধরুন আপনি শত প্রচেষ্টার পরেও আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেন না বা আপনি যেটা চাইছেন সেটা পেলেন না, তাহলে আপনি কি করবেন? হাল ছেড়ে দেবেন, না চেষ্টা করবেন? নাকি এমন কিছুর আশ্রয় নেবেন যা হয়তো নিষিদ্ধ, যা হয়তো খারাপ! যার একটা রক্ত জল করা দৃশ্য মানুষের প্রাণ পাখিকে খাঁচাছাড়া করে। যদি ভেবে দেখেন, এইসব কিন্তু আমাদের মধ্যেই আছে। আমরা চাইলেই হাল ছেড়ে দিতে পারি, চাইলে চেষ্টাও করে যেতে পারি, আবার চাইলে অন্যায়ের প্রশ্রয় নিতে পারি অনায়াসে, কিন্তু আদৌ কি সেটা আমাদেরকে যোগ্য স্থানটুকু পাইয়ে দেয়? নাকি টেনে নিয়ে যায় ভয়ঙ্কর অন্ধকার কোন কুপের ভিতর, আরো ডুবিয়ে ফেলে অন্ধকারে!
আমাদের জীবনের সবচাইতে ভালো অনুভূতি হল কাউকে ভালোবাসা। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও না কোথাও একটা ভয় কাজ করে। মানুষটি ছেড়ে চলে যাবে না তো,তার কোনো ক্ষতি হবে নাতো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সুন্দর একটা অনুভূতি– তবুও ভয় কে সঙ্গে নিয়েই এগোয়। দেখতে গেলে কোনো অনুভূতিই ভয় কে ছাড়া চলতে পারে না, কারণ ভয় সাবধান করে বুঝিয়ে দেয় যে সামনে বিপদ আছে।
তবুও এই সাবধান বাণী উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় মানুষ কোন রহস্যের টানে? এমন কী রহস্য লুকিয়ে আছে এরমধ্যে, যে একটা মানুষকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে? ঠিক কতটা ভয় পেলে একটা মানুষ আত্মঘাতী হতে চায়? কোন অতিলৌকিক শক্তির মাধ্যমে বইয়ের শেষ পাতায় ছেপে ওঠে সেই নোট?
সায়নী মিত্র
০৯ বৈশাখ ১৪২৮
.
আত্মপক্ষ
স্মৃতি হাতড়ালেও এখন মনে করতে পারব না যে ঠিক কখন থেকে আমার ভূতে আসক্তি৷ সেই সময় বর্ণময় দৈনন্দিনের তরে এতো রসদ আসেনি। বিনোদনের মূল রসদ বলতে ছিল গল্পের বই আর গল্প শোনা।
আমি তখন বেশ ছোট। পড়ন্ত দুপুরে বাড়ি বাড়ি কাজ সেরে জেঠিমা ফেরার পথে পা বাড়াত, আর আমি জানালার গ্রিল ধরে আবদারের সুরে ডাকতাম৷ জেঠিমা আসত, মায়ের সাথে গল্পের ফাঁকে শোনাত অদ্ভুত সব গল্প৷ কখনও সবুজ বোতলে ভূত বন্দির তো কখনও ডাইনি বুড়ির গল্প৷ বেশ ভয় পেতাম৷ এমনভাবে উপস্থাপন করত সেগুলো গল্প বলে মনেই হতো না৷
এই যে ‘ভূত’… এই শব্দটুকুই কানে প্রবেশ মাত্র যে আতঙ্কটা মনে চাড়া দিত এটাই ছিল উপভোগ্য বিষয়৷ কিছু জানা ভয়, কিছু অধরা রহস্য আবার কিছু কল্পনা সবকিছু মিলেমিশে রূপ নিত বিশেষ এক অনুভূতির৷ যেটা গুটিকয়েক শব্দে ব্যখ্যা করা যায় না৷ হ্যাঁ তবে প্রাণ খুলে মন ভরে উপভোগ করা যায়৷
দেখতে দেখতে বড় হলাম৷ কিন্তু সেই ভূতের ভয়টা রয়েই গেল৷ ‘ভয়’ শব্দটা ছোট্ট কিন্তু প্রভাব সুদূরপ্রসারী৷ যাকে বলে ‘Engraving Impact’৷ আমি বিশ্বাস করি না যে, ভয় পায় না এমন কেউ আছেন বলে৷ সবাই কোন না কোন ভাবে ঠিক ভয় পায়৷ আর এরকমই অনেক ভয় আমার গল্পের রসদের জোগান দিয়েছে৷ কখনও প্রীতম, বুবাই বা তোফার মুখ থেকে শোনা তাদের ভয়ের কথা, কখনও দেবব্রত, শুভঙ্কর, অভির পাল্লায় পড়ে রাতবিরেতে শ্মশানে যাওয়া, কখনও বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে ঘটে যাওয়া ভয়ানক দুর্ঘটনা৷
কবে ঠিক জানি না, কি একটা বই পড়তে পড়তে হঠাৎ মাথায় এল একটা ভূতের বই লেখার কথা৷ যেখানে নৃশংসতা, ভয়, আতঙ্ক, রক্ত, লাশ সব মিলেমিশে শিহরণ জাগাবে পাঠকের মনে৷ যেখানে পাঠক ভয়কে মরমে মরমে উপলব্ধি করবে৷ যেখানে গল্প চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে বাস্তবতা৷
যেমন ভাবনা তেমনি কাজ৷ লোকমুখে শোনা তাদের গল্পের সাথে মিশল আমার কল্পনার রঙ৷ মাথায় যুথবদ্ধভাবে ভিড় জমালো একগাদা গল্প৷ রঙ তো মেশালাম, ক্যানভাসও প্রস্তুত কিন্তু এই কলম তুলির আঁচড় কাটব কি ভাবে? একটা আস্ত বই লেখা কি আর মুখের কথা? কিন্তু ওই যে, থেমে থাকা বা ভয়ে দমে পড়াটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ৷ হোক না ভুল, শুরু তো করি৷ তাছাড়া ঠিক-ভুলের বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডিতে মনের ভাবকে আবদ্ধ করে রাখব কেন৷ মুক্ত বাতাসে ওদেরও শ্বাস নিতে দিতেই হত, নইলে পাঠকদের ভয় পাওয়াতো কিভাবে? লিখতে গিয়ে অনেক জায়গায় হোঁচট খেলাম৷ শরণাপন্ন হলাম কৌশিক দা, মনীষ দা, তমোঘ্ন দা, নীলোর্মি দি, দীপ্তজিৎ এদের৷ টোটকা যা পেলাম তাতে চটজলদি ঘা শুকিয়ে এল৷ পাশে থাকা প্রেরণাদাতা মানুষগুলোর কথা না বললেই নয়, তাঁরা আমার পথ প্রদর্শক- অমলেন্দু স্যার, অভিষেক দা, পার্থ দা, সুকল্যান দা আর চৈতন্য দা৷ আবার ভয়কে জয় করতে উদ্যত হলাম৷ এভাবেই একসময় মস্তিষ্কপ্রসূত নয়টি গল্প দেখতে দেখতে রূপ নিল৷ পাঠক যাতে সহজেই গল্পের রসস্বাদন করতে পারে, মন খুলে ভয় পেতে পারে বা বুঝতে পারে তারজন্য গল্পগুলোকে যথাসম্ভব তাদের স্বচ্ছতা, উজ্বলতা ও সাবলীলতা বজায় রেখে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছি৷ গল্পের স্বার্থে কিছু জায়গার ও ব্যক্তির মূল নাম ব্যবহার করতে হয়েছে, কিছুক্ষেত্রে অবস্থানের বিকৃতি ঘটাতে হয়েছে৷ ভুল-ক্রুটি হলে পাঠককুল আমাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবে এমন আশা রাখি৷
ব্লু-রোজ প্রকাশনের কর্ণধার সায়েদ আরসাদের অকুন্ঠ সহযোগিতা ছাড়া এই বইটি প্রকাশ করা দুরূহ হয়ে উঠত৷
বেশি কথা বলে পাঠকদের আর বিরক্ত করব না৷ সর্বপরি কয়াকটা কথা বলে শেষ করব৷ গল্পগুলো পড়ে পাঠকরা আশাকরি সেগুলোকে স্বাধীন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচার করবে৷ কঠোর নিয়মের বেড়াজালে বা নির্মম বিশ্লেষণের সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ করবে না৷ কারণ স্বয়ং গুরুদেব(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) তাঁর দুটি প্রবন্ধে বলেছেন “সাহিত্যের যথার্থ বাজে রচনাগুলি কোন বিশেষ কথা বলিবার স্পর্ধা রাখে না৷” (বাজে কথা) “পনেরো-আনা অনাবশ্যক এবং এক আনা আবশ্যক৷” (পনেরো-আনা) তাই আমার সৃষ্টি হোক ‘পনেরো-আনা বাজে৷’
Starter হিসেবে পাঠকদের জন্য রইল একটি অনুগল্প~
চোখটা খুলতেই দেখি চারপাশের দেওয়াল জুড়ে ইতস্ততভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে৷ না, ঠিক ছুটছে না, যেন সাঁতার কাটছে৷ আর যাই হোক তাদের কেউ মানুষ নয়৷ কোন জীব, নাকি পরলোকের প্রেতাত্মারা?
বিছানা ছেড়ে উঠতে যাব এমন সময়ে ওঘর থেকে শোনা গেল হৈ হৈ রব৷ পরমুহূর্তেই মা এসে উপস্থিত৷ কিছু বলার আগেই আর্তনাদ করে এগিয়ে এল আমার দিকে৷ আমি অবাকবিষ্ময়ে দেখছি৷ মা ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিছানায়৷ পিছন ফিরতেও দেখি বিছানায় আমার দেহ৷ ফ্যানটা একপাশে পড়ে আছে৷ থেঁতলে যাওয়া বুক থেকে গড়িয়ে পড়া তরল তাজা রক্তে বিছানার চাদর জ্যাবজ্যাব করছে…
মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
Leave a Reply