ডানাওলা মানুষ – বিনোদ ঘোষাল
ডানাওলা মানুষ – বিনোদ ঘোষাল / প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৫
বাবাকে
লেখকের কথা
আমাদের বাড়িতে ড্রেসিং টেবিলে বাবার একান্ত নিজস্ব একটি ড্রয়ার ছিল। তার চাবি থাকত বাবা পইতেয় বাঁধা। মাঝেমধ্যে ওটা খুলে গোপনে কী সব খুটখাট করত। আমার, মা-র, দিদির কারও অধিকার ছিল না সেই ব্যক্তিগত দেরাজে উঁকি দিই। ছোট্টবেলা থেকে আমার ভীষণ কৌতূহল ছিল দেরাজটির ভেতর কী আছে জানার। কিন্তু কোনওদিন সেই সুযোগ মেলেনি। শ্মশানে বাবার শরীর থেকে চাবি সমেত পইতেটা ছিঁড়ে নিয়েছিলাম। ঘাটকাজের দিন রাত্রে হঠাৎ চাবিটার কথা মনে পড়ল। ড্রয়ারটা খুলতে গিয়ে কেমন শিরশির করেছিল আমার গোটা শরীর, মনে হচ্ছিল এই যেন বাবা ধমকে উঠবে। খুললাম ওটা। বাবার গায়ের গন্ধ দেরাজটার ভেতর। হাত বাড়িয়ে একে একে বার করতে থাকলাম কিছু পুরোনো তামার পয়সা, ঠাকুর-দেবতার ছবি, কিছু পুরোনো চাবি যাদের তালা নেই, কয়েকশো টাকা, বাবার নিজের লেখা একটা ডায়েরি আর…আর ক্লিপে আটকানো একগাদা বিভিন্ন মাপের খাতার, ডায়েরির কাগজ।
যে লেখাগুলো আমি লিখে অপছন্দ হত বলে দলা পাকিয়ে ঘরের এখানে-ওখানে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম—বাবা কখন যে সেগুলোকে আমার আড়ালে তুলে নিয়ে নিজের প্রিয় দেরাজে যত্ন করে রেখে দিত। সেজন্যই কি আমাকে মাঝেমধ্যে বলত, ভালো না লাগলেও ফেলিস না কোনওদিন কাজে লাগবে। কেন জানি না তারপর থেকেই বোধহয় আমি কোনও লেখা পছন্দের না হলেও ফেলি না, কোথাও রেখে দিই। নিজের বইয়ের ভূমিকা লিখতে বসে আচমকা সবার আগে কেন কে জানে এই ঘটনাটাই মনে পড়ল! আর কী লিখব ভূমিকায়?
ছোট থেকে শখের নাটক (পরে গ্রুপ) আর ছবি আঁকতেই ভালোবাসতাম। আর একটু বয়স বাড়ার পর ছবি আঁকা কমে গিয়ে কবিতা এল। তারা স্রেফ ডায়েরির মধ্যেই থাকত। কোনওদিন সূর্যের আলো দেখেনি। কলেজ পাশ করে বন্ধুরা সব দু-বেলা পাড়ার রিকশা স্ট্যান্ডে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে বিড়ি টানি আর আড্ডা দিই। আমাদের এক বন্ধুর মা মারা গেল। ক্যান্সার হয়েছিল। খুব সুন্দর দেখতে ছিল কাকিমাকে। হাসপাতাল থেকে যখন বাড়িতে আনা হল তার মৃতদেহ, তাকিয়ে দেখি চেনা যাচ্ছে না। মৃত্যুর পর কাকিমার অমন সুন্দর মুখটা কেমন যেন হয়ে উঠেছে। সহ্য হয়নি আমার দৃশ্যটা। তারপর শ্মশানে গেছি। কাকিমাকে দাহ করে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু মাথার ভেতর কী যেন একটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কী সব যেন বলার জন্য ভেতর থেকে ঠেলা দিচ্ছে। ক’দিন পর গলগল করে বেরিয়ে গেছিল একটা লেখা। গল্পই। লিখে বেশ হালকা লাগল। পড়েই রইল লেখাটা। তার বেশ কিছু কাল পর আমার এক দাদা স্থানীয় সাহিত্যিকবন্ধু আমাকে নিয়ে গেল এক সাহিত্যসভায়। বলল নিজের কোনও লেখা থাকলে নিয়ে আসবি। পড়বি।
কোনও লেখা তো নেই। মনে পড়ল ওই লেখাটা। ওটাই নিয়ে গেলাম। পড়লাম। সবার ভালো লাগল। বলল ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠাতে। পাঠিয়ে দিলাম। মাসে কয়েকের মধ্যে ছেপেও গেল সেটা। আমার প্রথম গল্প, ‘একটু জীবনের বর্ণনা’। যেদিন দেশ পত্রিকার চিঠি এসেছিল বাড়িতে, বাবার সে কী আনন্দ! বার বার চিঠিটা খুলে পড়েছিল। হাতে নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর করেছিল। সেই থেকেই শুরু। সেটা দু-হাজার তিন সাল।
কী লিখতে চাই। কেন লিখি। এই সব প্রশ্ন নিজেকে করলে উত্তর পাই না। ভেতরটা চুপ মেরে থাকে। সারা দেয় না। কাজেই ওসব প্রশ্ন থাক। শুধু এটুকু মনে হয় আসলে আর সব মানুষের মতন আমিও বড় অসহায়। আর সেই অসহায়তাটা বার বার নানাভাবে নিজের কাছে লুকোতে গিয়ে বার বারই ধরা পড়ে যাই। এই কষ্টটাই মাঝেমধ্যে লিখে ফেলি। খুব যে লিখতে পারি তা নয়। চেষ্টা করি।
কৃতজ্ঞ থাকব সেই সব পাঠকদের কাছে, যারা একবারের জন্য হলেও আমার প্রথম বইটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখলেন, কিংবা চোখ ছোঁওয়ালেন। অথবা এসব কিছুই করলেন না।
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে
ডানাওলা মানুষের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের দাযিত্ব নিলেন খুব স্বাভাবিকভাবেই পত্র ভারতীর ত্রিদিবদা। ‘খুব স্বাভাবিকভাবেই’ এই কারণে বললাম, প্রকাশক এবং সুলেখক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় আমার মতো তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতে সবসময় একপা এগিয়ে। সব থেকে বড় কথা একজন তরুণ লেখকের বই প্রকাশ করার আগেও সেই বই নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা এবং যত্ন দেখবার মতো।
এই বইয়ের নতুন সংস্করণ নিয়েও অনেক আলোচনা পরিকল্পনা তার সঙ্গে সাক্ষাতে এবং টেলিফোনে হয়েছে। কীভাবে বইটিকে আরও সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করা যায় সে বিষয়ে তাঁর ভাবনা আবারও আমাকে অবাক করেছে।
বইটি নতুন চেহারায় প্রকাশিত হল। পাঠকদের ভালো লাগলে কৃতিত্ব অবশ্যই প্রকাশকের।
বিনোদ ঘোষাল
কলকাতা বইমেলা ২০১৫
নবগ্রাম, হুগলি
Leave a Reply