খুশবন্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান
অনুবাদ – আবু জাফর
প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬
অনুবাদকের কথা
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস ট্রেন টু পাকিস্তান পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তি সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ঐ সময় ভারত ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়। ভারত ও পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশের অত্যুদয় এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু নয়। দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িকতার নগ্নরূপ সাধারণ মানুষের জীবনকে যেভাবে আলোড়িত করে তা বিশ্বের অন্য কোন দেশে সংঘটিত হয়েছে কি-না তা আলোচনার একটা বিষয় হতে পারে। এদিকে বাংলা আর ওদিকে পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে দু’টো অংশ যুক্ত হয়। ভারত আর পাকিস্তানের সঙ্গে। ধর্মের কারণে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে যাওয়ার সময় কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত লোক সর্বস্বাস্ত হয়েছে, অপমানের শিকার হয়েছে কত মা-বোন তার হিসাব হয়ত কোন দিন পাওয়া যাবে না। হেঁটে, গাড়িতে চড়ে বা ট্রেনে করে যাওয়ার সময় কত লোক যে সারাজীবনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়ার পথেই বা কত লোক নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয় তার হিসাবই বা কে দেবে! মানব ইতিহাসের এ ট্রাজেডি নিয়ে যে সব উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ট্রেন টু পাকিস্তান নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। অনেকে এ উপন্যাসকে সামাজিক দলিল হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
কেউ বলেছেন, ক্লাসিক সাহিত্যের দাবি করতে পারে এই উপন্যাসটি। এর লেখক খুশবন্ত সিং নিজেও ছিলেন পাকিস্তানের অধিবাসী। দেশ বিভাগের সময়কার সেই উত্তল তরঙ্গের দিনগুলোতে তিনি তাঁর পরিবারের অন্যদের সাথে ভারতে চলে যান। একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসাবে তিনি এখন সবার কাছে পরিচিত। তাঁর অসংখ্য লেখা প্রতিদিনই কোন কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখা পড়েননি এমন লোক ভারতে খুঁজে পাওয়া ভার। তাঁর সেক্স ঘেঁষা ব্যঙ্গাত্মক লেখা সব বয়সের লোকের কাছেই প্রায় সমান প্রিয়। সুপণ্ডিত ও প্রতিভাধর এই লেখক সমগ্ৰ উপমহাদেশেই খ্যাতিমান।
দীর্ঘদিন ভারতে একটি নাম করা শহরে অবস্থানের সময় যে দুজন লেখকের লেখা পেলে আমি না-পড়ে শান্তি পেতাম না, তার মধ্যে একজন হলেন এম জে আকবর এবং অন্য জন খুশবন্ত সিং। বয়স আশির ওপর। কিন্তু বয়স এখনও মিঃ সিংকে কাবু করতে পারেনি। ভারতের প্রতি প্রান্তে তিনি ঘুরে বেড়ান। আশপাশের দেশে তিনি কখন যান, কখন আসেন, খোঁজ রাখা প্রায় অসম্ভব। বছরে দু-চারবার ইউরোপ-আমেরিকা না ঘুরলে তাঁর যেন সময় কাটে না। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লেখার সময় করে নেন। ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় নিয়মিত। খুব বড় নয়, ছোট ছোট লেখা। কিন্তু পড়লে মনে হয়। কত গভীর। সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ সচেতনতা, খেলাধুলা- কোন বিষয় বাদ নেই। অতি জটিল বিষয়ের সরল সমাধান তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে অতি সাধারণ কথায়। তরুণ-তরুণীর প্রেম, দাম্পত্য কলহ এবং সেক্স ঘেঁষা সরস আলোচনা তাঁর লেখার যেন প্ৰাণ।
খুশবন্ত সিং ও তাঁর স্ত্রীর সাথে দুবার সাক্ষাতের এবং তাঁদের সাথে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঐ শিখ দম্পতির সাথে সে সময় অনেক কথাই হয়েছিল। তাঁর বাকপটুতা, হাস্যরস আর অমায়িকু ব্যবহারে আমি শুধু মুগ্ধ নয়, তাঁর এক ভক্তে পরিণত হই। সারা ভারতে এই পরিচিত ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানসমৃদ্ধ এক বিরল _প্রতিভা আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছেন একের পর এক, এ কথা এখন আমার ভাবতেও ভাল লাগে। ঐ দিন তিনি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের লোকদের একটা সাধারণ গুণের (!) কথা বলেছিলেন হাসতে হাসতে। এরা ভাল খেতে চায়, ভাল পরতে চায়, ভাল ঘর বানাতে চায়, সুন্দরী বিবি চায় কিন্তু কাজ করতে চায় না। ঐ শিখ দম্পতির সাথে সাক্ষাত হওয়ার মাস তিনেক পরে ট্রেন টু পাকিস্তান পড়ার সুযোগ হয়। আমার। বইখানি এমন যে, পড়া শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না। অতি সাধারণ কথায় এমন সাবলীল বর্ণনা, গ্রামের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সত্যি তুলনাহীন। দেশ বিভাগের সময়কার জটিল পরিস্থিতিতে গ্রামের সাধারণ লোক কিভাবে আলোড়িত হয়েছে, প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষ কিভাবে লুষ্ঠিত হয়েছে, কিভাবে তাদের জীবন বিপন্ন হয়েছে, কিভাবে মেয়েরা সাধারণ পণ্যের মতো ব্যবহৃত হয়েছে-মানুষ দ্বারা মানুষের সেই চরম অবমাননার কাহিনী নিয়ে রচিত উপন্যাসখানি সত্যি একটা সামাজিক দলিল।
বিশিষ্ট অনুবাদক বন্ধুবর জাফর আলম প্রথমে উপন্যাসটির বঙ্গানুবাদের উদ্যোগ নেন এবং লেখকের কাছ থেকে অনুমতিও নেন। পরে শারীরিক কারণে একাজ সম্পন্ন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় এবং এ ব্যাপারে আমার আগ্রহের কথা তাঁর জানা থাকায় তিনি আমাকে এই বইটি অনুবাদের জন্য উৎসাহিত করেন। এ কাজে কিছুটা বিলম্ব হলেও বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে বইখানির বঙ্গানুবাদ তুলে ধরতে পেরে আমি আনন্দিত।
ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসখানি প্রথমে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়। এজন্য এ পত্রিকার উপদেষ্টা-সম্পাদক জনাব তোয়াব খান এবং সহকারী সম্পাদক জনাব নাসির আহমদ-এর অকৃত্রিম সহযোগিতার কথা আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি। উপন্যাসখানি পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যাপারে। জনাব বদিউদ্দিন নাজিরের উদ্যোগ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইউপিএল-এর কর্ণধার জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আবদার রহমান এই বই প্রকাশে সবরকম সহযোগিতা করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
আবু জাফর
ঢাকা, ১৪ জুন, ১৯৯৬
Leave a Reply