ট্রেজার আইল্যান্ড – রবার্ট লুই স্টিভেনসন
গল্পটি বলছে কিশোর জিম। ওদের সরাইখানা অ্যাডমিরাল বেনবোয় এসে উঠল বেয়াড়া, কর্কশ স্বভাবের এক নাবিক। কাদের ভয়ে যেন আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে লোকটা সারাক্ষণ। জিমকে বলল, এক-পা খোঁড়া কোন নাবিক দেখলে যেন চট করে খবর দেয় তাকে। কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হল না। বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারল না বেচারা, ঠিকই খুঁজে বের করল ওকে দুর্ধর্ষ একদল জলদস্য।
এরপর থেকে আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল জিমের জীবনে। শেষে জাহাজে চেপে চলল সে রত্নদ্বীপে। এমন সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করল, যা বর্ণনা করে অমর হয়ে গেছেন স্টিভেনসন।
জিম হকিন্সের বিবৃতি
০১. বুড়ো নাবিক
অনুরোধ এড়াতে পারলাম না কিছুতেই। হাজার হলেও স্কয়ার ট্রেলনী এবং ডাক্তার লিভসী ভদ্র, গণ্যমান্য লোক। আমারও যে লেখার ইচ্ছে একেবারেই নেই, তা নয়। এমন ঘটনা তো আর হরহামেশা ঘটে না। অনেক রোমাঞ্চকর মজার মজার গল্প-কেচ্ছা শুনেছি, কিন্তু গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বাস্তবে সঞ্চয় করে বসব, ভাবিনি।
সত্যিই কিন্তু কিছু ধনরত্ন এখনও রয়ে গেছে ট্রেজার আইল্যান্ডে। লোভের হাত বাড়িয়ে আবার গিয়ে সেই দ্বীপে পাইকারি খুনখারাবি করুক রহসন্ধানী মানুষ, কিছুতেই চাই না। আর চাই না বলেই ঠিকানাটা গোপন রাখতে বাধ্য হচ্ছি। সতেরোশো সালের-তারিখ। এক অশুভক্ষণে আমাদের সরাইখানা অ্যাডমিরাল বেনবো-য় এসে হাজির হল বুড়ো।
হঠাৎ, নিতান্ত অস্বাভাবিকভাবেই আমাদের সরাইখানায় এসে উঠল বুড়ো নাবিকটি। গালে একটা গভীর কাটা দাগ। লম্বা, বলিষ্ঠ দেহ। চামড়ার রঙ রোদে পোড়া তামাটে। কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে কালো চুলের খাটো করে বাঁধা বেণী। রুক্ষ দুই হাতে ক্ষয়ে যাওয়া আঙুল। নখগুলো ভাঙা, কালো। ধারাল তলোয়ারে কেটে যাওয়া গালের দাগটা বীভৎস রকমের সাদা। গায়ে পুরানো ময়লা নীল কোট।
যেন মাত্র গতকাল ঘটেছে ঘটনাটা। পরিষ্কার মনে পড়ছে, এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সরাইখানার দরজার দিকে এগিয়ে আসছে সে। পেছনে ঠেলা গাড়িতে বয়ে আনা হচ্ছে তার সিন্দুকটা। শিস্ দিতে দিতে আসছে বুড়ো। সুরটা অচেনা। কিন্তু ওই অচেনা সুরই পরে দারুণ চেনা হয়ে গিয়েছিল আমার। গানটাওঃ
মরা মানুষের সিন্দুকটায়
চড়াও হল পনেরো নাবিক
আরেক বোতল রাম নিয়ে আয়
ইয়ো-হো-হো কী যে মজা।।
ভাঙা ভাঙা কিন্তু চড়া বুড়োটে গলায় সে গায় এই গান। জাহাজীদের গান।
দরজার কাছে এসে হাতের ছোট লাঠি দিয়ে পাল্লায় ঠক ঠক আওয়াজ তুলল লোকটি। বাবা উঁকি দিল। কর্কশ গলায় এক গ্লাস রামের অর্ডার দিল সে। পানীয়টা এলে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে পাহাড়ের চুড়োর দিকে তাকাল। তাকাল আমাদের সাইনবোর্ডটার দিকেও।
দারুণ জায়গা! মন্তব্য করল লোকটি, তা এখানে লোকজন আসে কেমন?
খুবই কম আসে, আফসোস করে জানাল বাবা।
ভাল, বলল লোকটি। আমার উপযুক্ত জায়গা। ঠেলাওয়ালার দিকে ফিরল সে, সিন্দুকটা তুলে দাও। এখানে কিছুদিন থাকব। বাবাকে বলল, সাদাসিধে মানুষ আমি। শুয়োরের মাংস, ডিম আর রাম হলেই চলে যাবে। ঘর কিন্তু ওপরতলায় চাই। জাহাজের আসা-যাওয়া দেখব। আর হ্যাঁঁ, আমাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকবে… পকেট থেকে গোটা চারেক মুদ্রা বের করল। মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, শেষ হয়ে গেলেই জানাবে। জাদরেল কমান্ডারের ভঙ্গি তার।
পোশাকের দুরবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন গোছের অফিসার বলে মনে হয় না তাকে। কিন্তু কর্কশ গলা আর বাচন-ভঙ্গিতে বোঝা যায় আদেশ দিতে এবং দুর্ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত এই লোক। ঠেলাওয়ালার কাছ থেকে জানতে পারলাম ডাকগাড়িতে করে সকালে এসে রয়াল জর্জে নেমেছে বুড়ো। সৈকতের কাছাকাছি নির্জন সরাইখানার খোঁজ করছিল। অ্যাডমিরাল বেনবোর নাম শোনে ওখানেই এবং পছন্দ করে ফেলে। এর বেশি আর কিছু জানে না ঠেলাওয়ালা।
সময় যায়। লোকটার ব্যবহারে অবাকই হচ্ছি শুধু। সাংঘাতিক চাপা স্বভাবের মানুষ। সারাটা দিন দোতলার বারান্দায় কিংবা কাছের পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে থাকে। পিতলের দূরবীন দিয়ে চেয়ে থাকে সাগরের দিকে। সন্ধ্যা হলেই এসে ঢোকে সরাইয়ের হলে। একেবারে আগুনের পাশে এসে বসে। কড়া মদ গেলে। কারও সঙ্গেই কথা বলে না। কেউ কোন প্রশ্ন করে ফেললে চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়। মানে মানে সরে যায় কৌতূহলী প্রশ্নকর্তা। সরাইখানায় যারা আসর জমাতে কিংবা অন্য কাজে আসে, শিগগিরই বুঝে গেল, এই বিশেষ লোকটিকে না ঘটানই সবদিক থেকে নিরাপদ।
আমার সঙ্গে অবশ্য একআধটা কথা বলে আজব নাবিক। রোজই পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, অন্য কোন নাবিক সরাইখানায় এসেছে কিনা। কিংবা এই পথ ধরে গেছে কিনা।
প্রথমে অনুমান করেছি, বুঝি তার কোন সঙ্গীর আসার কথা আছে, তারই কথা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু তা নয়, পরে বুঝতে পেরেছি। ব্রিস্টলে যাবার পথে কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের সরাইতে কোন নাবিক এলে খেয়াল করেছি, হলঘরের পর্দা ফাঁক করে দেখে নেয় ক্যাপ্টেন। এমনিতেই সে কথা বলে কম, তখন একেবারে চুপ মেরে যায়।
আচমকা আমাকে একদিন ডেকে বলল ক্যাপ্টেন, কোন খোঁড়া নাবিকের দেখা পেলে যেন তাকে অবশ্যই জানাই। এর জন্যে মাসে চার পেনি করে বেতন দেবে সে আমাকে।
যতটা না পয়সার জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতূহল মেটাবার জন্যে একুপেয়ে নাবিকের সন্ধানে রইলাম। সরাইখানায় লোক আসে, লোক যায়। কিন্তু খোঁড়া নাবিক আর আসে না।
সারাক্ষণই খোঁড়া নাবিকের কথা ভাবি। তার চেহারা চালচলনের নানারকম ছবি আঁকি মনে মনে। ফল যা হবার হল। দুঃস্বপ্নে দেখা দিতে আরম্ভ করল এক ভয়ানক চেহারার একপেয়ে নাবিক। এই দুঃস্বপ্ন বেশি দেখি দুর্দান্ত ঝড়ের রাতে। প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার তাড়া খেয়ে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে পাথুরে পাহাড়ের গোড়ায়। কেঁপে কেঁপে উঠে যেন গুটিসুটি মেরে যায় আমাদের দ্বিতল বাড়িটা। কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে কম্বলের তলায় লুকোই আমি। দুঃস্বপ্নে ভয়াল দানবের মতই ক্রাচে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে তাড়া করে আমাকে খোঁড়া নাবিক। প্রাণপণে দৌড়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না-পা পিছলে যায়; এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে সে, কোন বাধাকেই বাধা মনে করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার, এতসব দুঃস্বপ্নের পরিবর্তে মাসিক চার পেনি কিছুই না।
ক্যাপ্টেনকে আমি তেমন ভয় না করলেও আর সবাই করে। প্রায় প্রতি রাতেই প্রচুর রাম খেয়ে মাতলামি শুরু করে সে। কাউকে পরোয়াই করে না এই সময়। বিচ্ছিরি সব গান ধরে। কখনও কখনও উপস্থিত শ্রোতাদের জন্যে মদের অর্ডার দেয়, তারপর শঙ্কিত লোকগুলোকে গল্প শুনতে কিংবা তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কোরাস গাইতে বাধ্য করে। তার সেই গান ইয়ো-হো-হো, কী যে মজার ঝংকারে কেঁপে ওঠে আমাদের বাড়ি। ভয়ে ভয়ে তার সঙ্গে গানে যোগ দেয় সবাই। কার চেয়ে কে বেশি চেঁচাতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতা চলে। আচমকা হয়ত থেমে যায় নাবিক। জোরে টেবিলে চাপড় মেরে শব্দ করে থামিয়ে দেয় অন্যদেরও। তারপর শুরু হয় গল্প। তার কথার মাঝে কেউ প্রশ্ন করে বসলে খেপে যায়। আবার সবাই চুপচাপ থাকলেও রেগে ওঠে সে-ধরে নেয় তার গল্পের প্রতি অবহেলা দেখানো হচ্ছে। কাউকেই ঘর থেকে বেরোতে দেয় না সে এই সময়। গেলাসে চুমুক দিতে দিতে একটানা গল্প বলে যায়, যতক্ষণ না নেশায় জড়িয়ে আসে তার কণ্ঠ, যতক্ষণ না ঢলে পড়ে যায়। তারপর ছুটি পায় শ্রোতারা।
ক্যাপ্টেনের গল্প শুনে দারুণ ভয় পায় লোকে। ভয়ানক সে-সব গল্প। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার বিবরণ, দূর সাগরে প্রচন্ড ঝড়ের বর্ণনা, স্পেনীয় সাগরে ভয়াবহ নৃশংসতার কাহিনী, ইত্যাদি হল তার বিষয়বস্তু। বিবৃতি থেকেই বোঝা যায় সাগরবক্ষে ভয়ঙ্কর সব পিশাচ-মানুষের সঙ্গে জীবন কেটেছে তার। ভয়াবহ এসব কাহিনী শুনতে শুনতে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় আমাদের গেঁয়ো লোকেরা। বাবার আশঙ্কা, ক্যাপ্টেনের ভয়ে সরাইয়ে খরিদ্দার আসা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা অন্যরকম। রোমাঞ্চকর গল্প শুনতে ভালবাসে মানুষ। তাছাড়া ক্যাপ্টেনের পয়সায় মদ গিলতে পেয়ে বরং খুশিই হয় গ্রামবাসীরা। কিছু কিছু যুবক তো নাবিকের ভক্তই হয়ে উঠেছে। দুর্দান্ত জাহাজী, পোড়-খাওয়া বুড়ো, ইত্যাদি খেতাব দিয়েছে ক্যাপ্টেনকে তারা। এইসব নাবিকই নাকি ইংল্যান্ডের গৌরব।
সময় যায়। কাটে দিন, পেরিয়ে যায় সপ্তাহ, আসে মাস। একে একে কেটে যায় কয়েক মাস। জমানো টাকা সব খরচ হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের। সরাইয়ের বিল বইয়ে তার নামে বাকি পড়তে লাগল। কিন্তু যাবার নাম নেই নাবিকের। টাকাও চাওয়া যায় না। চাইলেই নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে চোখ পাকিয়ে তাকায়। হাত কচলে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া তখন আর কিছুই করতে পারে না বাবা। বাবার অকাল মৃত্যুর এটাও একটা কারণ হতে পারে।
ক্যাপ্টেনের সবকিছুই অদ্ভুত। সরাইয়ে আসা পর্যন্ত কক্ষনও পোশাক বদলাতে দেখলাম না তাকে, কেবল মোজা ছাড়া। এখানে এসে কোন পোশাক কেনেওনি, ওই মোজা ছাড়া। টুপির একটা ধার ভেঙে গেল একদিন, কিন্তু সারাল না। আর কোটের তো চেহারাই বদলে ফেলল তালি মেরে মেরে। ছিড়ে গেলেই সুইসুতো নিয়ে বসে যায়। নিজেই তালি লাগায় ছেড়া জায়গায়। আসা পর্যন্ত কাউকে চিঠি লিখল না সে, কারও কাছ থেকে চিঠি পেলও না। নেশার ঘোরে ছাড়া পারতপক্ষে কথাও বলতে চায় না লোকের সঙ্গে। আর সিন্দুকটা, ঈশ্বরই জানেন কি আছে ওতে-ক্যাপ্টেনকে খুলতে দেখলাম না কখনও।
নতুন ঘটনা ঘটল একদিন। বাবার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। সাঁঝের পরে তাকে দেখতে এলেন ডাক্তার লিভসী। রাত হয়ে গেল। ডাক্তার চাচাকে খেয়ে যেতে বলল মা। এড়াতে না পেরে আমাদের এখানেই ডিনার সারলেন তিনি। তারপর বিদায় নিয়ে নেমে এলেন হলরুমে। আমাদের আস্তাবল নেই, ঘোড়াও নেই। নিজের ঘোড়া আসার অপেক্ষায় আছেন তিনি। ছিমছাম পোশাক পরা, বুদ্ধিদীপ্ত এই লোকটির উজ্জ্বল কালো দুই চোখের তারায় হাসি যেন উপচে পড়ে। আমাদের গেঁয়ো প্রতিবেশী আর নোংরা, কাকতাড়ুয়ার মত চেহারার নাবিকের পাশে বড়ই বেমানান এই গণ্যমান্য লোকটি। তবে যে কোন লোকের সঙ্গে সহজ ভাবে মেশার ক্ষমতা তার অপরিসীম।
পাইপ টানতে টানতে বুড়ো মালি টেলরের দিকে তাকালেন ডাক্তারচাচা। দরজার কাছে একটা চেয়ারে বসে আছে বুড়ো। মালি তাঁর দিকে চাইতেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন।
টেবিলে দুহাত, ছড়িয়ে বসে আছে চুর-মাতাল ক্যাপ্টেন। বহুবার গাওয়া সেই গানটি গেয়ে উঠল হঠাৎঃ
মরা মানুষের সিন্দুকটায়
চড়াও হল পনেরো নাবিক,
আরেক বোতল রাম নিয়ে আয়
ইয়ো-হো-হো, কী যে মজা।।
প্রথমে ভেবেছি, তার ঘরের সিন্দুকটার কথাই বলে। এই চিন্তাটা দুঃস্বপ্লে খোঁড়া নাবিকের তাড়া-করা দৃশ্যের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। নাবিক আসার পর এতবার শুনেছি, শেষদিকে আর বিশেষ আমল দিই না গানটাকে। কিন্তু ডাক্তার লিভসীর কাছে ব্যাপারটা নতুন। বিরক্ত দৃষ্টিতে একবার তাকালেন ক্যাপ্টেনের দিকে। তারপর বুড়ো মালি টেলরের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন আবার।
এদিকে ক্রমেই গানে মাতোয়ারা হয়ে উঠছে নাবিক। শেষে, জোরে টেবিলে চাপড় মারল। এর অর্থ জানি আমরা। সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু ডাক্তার সাহেব জানেন না। কথা বলছেন তিনি, ফাঁকে ফাঁকে পাইপ টানছেন। চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন, তারপর আরও জোরে চাপড়াল। ধমকে উঠল, চো-ও-ও-প!
আমাকে বলছেন? চোখ তুলে তাকালেন ডাক্তারচাচা।
গাল দেবার ভঙ্গিতে বলল নাবিক, ডাক্তার চাচাকেই বলছে।
একটা কথা না বলে পারছি না আপনাকে, বললেন ডাক্তারচাচা। এভাবে রাম গিলতে থাকলে শিগগিরই একটা শয়তানের হাত থেকে বাঁচবে পৃথিবী।
ভীষণ খেপে গেল নাবিক। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুরি বের করে ফেলল! হাতের চেটোর ওপর নিয়ে ভারসাম্য পরীক্ষা করতে করতে হুঁশিয়ার করল, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ডাক্তার চাচাকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলবে।
বিচলিত হলেন না ডাক্তারচাচা। শান্ত, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে ঘরের সব লোককে শুনিয়ে নাবিককে বললেন, পকেটে ঢোকান ছুরিটা। নইলে ফাঁসিতে ঝুলবেন।
দুজনের মাঝে দৃষ্টির লড়াই শুরু হল। শিগগিরই হেরে গেল ক্যাপ্টেন। দৃষ্টি নত করল। ছুরিটা রেখে দিল। তারপর বসে পড়ে মার-খাওয়া কুকুরের মত গোঁ গোঁ করতে লাগল।
দেখুন, বললেন ডাক্তারচাচা। আপনার মত একটি জীব এই এলাকায় আছে, জেনে গেলাম। এখন থেকে নজর থাকবে আমার। কেবল ডাক্তার নই, আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেটও। কথাটা মনে রাখবেন।
একটু পরেই ঘোড়া এসে গেল। চলে গেলেন ডাক্তার লিভসী। সে রাতে আর কোনরকম গোলমাল করল না ক্যাপ্টেন। পরের কয়েক রাতেও চুপচাপই থাকল।
০২. ব্লাক ডগ
শীত এসে গেল। দ্রুত বাড়ছে ঠান্ডা। প্রচন্ড তুষারপাত তো আছেই, সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়। ক্রমেই খারাপের দিকে চলেছে বাবার অবস্থা। বোঝা যাচ্ছে, এই শীত কাটিয়ে উঠতে পারবে না। বাবা শয্যাশায়ী, ফলে, সরাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার আর মার ওপর। ব্যস্ততার মাঝে অবাঞ্ছিত অতিথিটির দিকে বিশেষ নজর দিতে পারছি।
জানুয়ারি মাসের একদিন। ভোর হয়েছে। ভয়ঙ্কর শীত। পাহাড়ের পাথুরে পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎ-ছল শব্দ। দিগন্তে উঁকি দিয়েছে সূর্য। রশ্মিগুলো সাগরের পানি ছুঁয়ে ছুটে এসে স্পর্শ করেছে পাহাড়ের চূড়া। অন্যান্য দিনের চেয়ে আগে উঠেছে ক্যাপ্টেন। ছুরিটা কোটের তলায় লুকিয়ে, বগল তলায় পিতলের দূরবীন নিয়ে সাগর তীর ধরে এগিয়ে চলেছে। হ্যাটটা পেছন দিকে হেলানো। কনকনে বাতাসে ধোঁয়া হয়ে বেরোচ্ছে তার নিঃশ্বাস। পাথরের বড় চাইটা পেরোবার সময় নাকের ভেতর থেকে বিচিত্র কুদ্ধ শব্দ উঠল, যেন ডাক্তার লিভসীর কথা মনে পড়ে গেছে তার।
মা উপরে, বাবার কাছে। ফিরে এলে খাবে, তাই ক্যাপ্টেনের জন্যে নাস্তার জোগাড় করছি আমি। এই সময় হলঘরের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল একজন লোক। তাকে এর আগে কখনও দেখিনি। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে, লম্বাটে গড়ন। বাঁ হাতে দুটো আঙুল নেই। সঙ্গে একটা ছুরি। কিন্তু মারামারি খুব একটা করতে পারে বলে মনে হল না। জাহাজীদের দিকে আমার কড়া নজর, আগেই বলেছি। লোকটাকে ঠিক জাহাজী মনে হচ্ছে না, কিন্তু গায়ে সাগরের গন্ধ একেবারেই নেই, তাও বলা যায় না।
তার জন্যে কি করতে পারি জিজ্ঞেস করলাম। রাম চাইল সে। অর্ডার সরবরাহের জন্যে রওনা দিলাম। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল আগন্তুক। ফিরে চাইতেই ইশারায় কাছে ডাকল আমাকে। তোয়ালেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কাছে এস, খোকা, ডাকল সে। এই এখানে।
এক পা এগোলাম।
চোখের ইঙ্গিতে ক্যাপ্টেনের জন্যে সাজানো টেবিল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওগুলো আমার বন্ধু বিলের জন্যে, না?
বললাম, আমি তার বন্ধু বিলকে চিনি না। তবে খাবারগুলো আমাদের একজন খরিদ্দারের জন্যে। তাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকি আমরা।
বিলকে ক্যাপ্টেন ডাকা যায়। ডান গালে একটা কাটা দাগ আছে তার। ব্যবহার চমৎকার, মাতাল হলে তো কথাই নেই। সে যাকগে। তা দোস্ত কি ঘরেই আছে?
বেড়াতে বেরিয়েছে, জানালাম।
কোন দিকে?
পাহাড়ের দিকে নির্দেশ করলাম। কোন্ পথে, কখন ফিরতে পারে, ধারণা দিলাম। এটাওটা আরও কিছু প্রশ্নের জবাবও দিতে হল।
তা ভাল, বলল আগন্তুক।
মুখের ভাব দেখে কিন্তু ভাল বোধ হল না। কি করব, বুঝতে পারছি না। সরাইয়ের বাইরে বেরোল আগন্তুক। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে উঁকি মেরে সরাইয়ের কোণের ওদিকে দেখছে। ইদুরের জন্যে যেন অপেক্ষা করছে বেড়াল। আমিও বেরোলাম। রাস্তায় উঠতে যাচ্ছি, ডেকে ফেরাল আমাকে। দ্বিধা করায় রাগের চিহ্ন ফুটল চেহারায়। বকা দিল। দ্রুত ফিরে এলাম। রাগের চিহ্ন মুছে গেল আবার তার চেহারা থেকে। পিঠ চাপড়ে বলল, এই তো লক্ষ্মী ছেলে। খুব ভাল তুই। তোর মত আমারও একটা ছেলে আছে। তাকে নিয়ে আমার গর্ব। কিন্তু কি জানিস, ছোটদের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে বড়দের কথা মেনে চলা। বিলের জাহাজে কাজ করলে অনেক আগেই শিখে যেতি এসব•••ওই তো, আসছে বিল। ওমা, হাতে দূরবীনটাও আছে দেখছি! তা চল তো বাবা, কোথাও লুকোই। ওকে চমকে দিতে হবে।
আমাকে ঠেলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আগন্তুক। ঘরের কোণে লুকাল। আমাকে রাখল তার পেছনে। অস্বস্তি বোধ করছি। ভয়ও পাচ্ছি। দেখে মনে হল লোকটাও ভয় পাচ্ছে। এতে ভীতি আরও বাড়ল আমার। হাতল ধরে টেনে খাপের ভেতরে ছুরির ফলাটা আলগা রাখল সে। গলায় যেন রুটির দলা আটকেছে, বারবার ঢোক গিলছে।
ঘরে ঢুকেই পেছনে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল ক্যাপ্টেন। ডানে-বাঁয়ে কোনদিকে তাকাল না। সোজা তার জন্যে রাখা খাবারের দিকে এগিয়ে গেল।
বিল! জোর করে গলার স্বর গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে আগন্তুক।
পাঁই করে ঘুরল ক্যাপ্টেন। বিবর্ণ হয়ে গেল মুখ। নাকের ডগা নীলচে হয়ে উঠল। সামনে যেন ভূত দেখছে সে। এক মুহূর্তে যেন আরও বেশি বুড়িয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার জন্যে বলতে কি, করুণাই হল আমার।
পুরানো জাহাজী বন্ধুকে চিনতে পেরেছ তো, দোস্ত? বলল আগন্তুক।
ব্ল্যাক ডগ! গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না ক্যাপ্টেনের।
তো আর কে? সহজ হয়ে আসছে আগন্তুক। নাটকীয়ভাবে বলল, ব্ল্যাক ডগই আমি, এসে হাজির হয়েছি অ্যাডমিরাল বেনবোয়। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে, দোস্ত? কি দিনই ছিল সে-সব! হাতের আঙুল দুটো হারালাম আমি, বাঁ হাতটা তুলে দেখাল সে।
তা চট করে বলে ফেল তো, কি জন্যে এসেছ?
বলছি, বলল ব্ল্যাক ডগ। কিন্তু আগে এক গেলাস রাম খাওয়া যাক। খোকা… আমার দিকে চাইতেই রওনা দিলাম। ক্যাপ্টেনকে বলছে ডগ, দারুণ ছেলে!
রাম নিয়ে ফিরে এলাম। টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসেছে। দরজার দিকে পাশ ফিরে বসেছে ব্ল্যাক ডগ। বন্ধুর ওপর চোখ রাখতেও সুবিধে, দরকার পড়লে চট করে পালিয়ে যাওয়াও সহজ।
আমাকে চলে যেতে বলল ব্ল্যাক ডগ। হুঁশিয়ার করে দিল, যেন কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে ওদের দিকে চোখ রাখার কিংবা কোন কথা শোনার চেষ্টা না করি।
বারের ভেতরে চলে এলাম। কান খাড়া রাখলাম ঠিকই। নিচু গলায় কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে স্বর চড়তে লাগল। দুএকটা শব্দ বুঝতে পারছি এখন। গালাগালি করছে ক্যাপ্টেন।
হঠাৎ শুরু হল চেঁচামেচি। ধাতব শব্দ হল। ছিটকে পড়ল চেয়ার টেবিল। একটা আর্তনাদ শোনা গেল। বারের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি দরজার দিকে ছুটছে ব্ল্যাক ডগ। তার পেছনে খোলা ছুরি হাতে তাড়া করছে ক্যাপ্টেন। ব্ল্যাক ডগের হাতেও ছুরি। কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ব্ল্যাক ডগ। ধরতে পারবে না বুঝে ছুরি ছুঁড়ে মারল ক্যাপ্টেন। লাগলে ওখানেই শেষ হয়ে যেত ডগ। কিন্তু তার কপাল ভাল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সাইনবোর্ডটায় গিয়ে বিধল ছুরি। আজও সেই চিহ্ন আছে আমাদের সাইনবোর্ডে।
আধ মিনিটেই পাহাড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল ব্ল্যাক ডগ। কিছুক্ষণ সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন। চোখের ওপর হাত বোলাল কয়েকবার। তারপর ফিরে দাঁড়াল। আমাকে বলল, জিম, রাম! জলদি! বলতে বলতে টলে উঠল সে। দেয়ালে হাত রেখে কোনমতে সামলে নিল।
কোথাও লেগেছে? রাম! রাম আনো জলদি! পালাতে হবে আমাকে!
রাম আনতে ছুটলাম। ব্যাপারটার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছি। একটা গেলাস ভাঙলাম। মাথার ভেতর কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। বসার ঘরে ভারি কিছু পতনের শব্দে চমকে বার থেকে দৌড়ে বেরোলাম। দেখি, মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন।
হট্টগোল শুনে দোতলা থেকে নেমে এসেছে মা। দুজনেই ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে। পাশে বসে তার মাথাটা তুলে ধরলাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ক্যাপ্টেনের। মুখ ফ্যাকাসে, চোখ বন্ধ।
কি যে শুরু হল ছাই! কেঁদেই ফেলবে যেন মা, এদিকে তোর বাবার এই অবস্থা!
কি করে সাহায্য করব ক্যাপ্টেনকে বুঝতে পারছি না। মারপিট করতে গিয়ে শরীরের কোথাও মারাত্মক আঘাত পেয়েছে? রাম এনে গেলাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বদ্ধ দাঁতের ফাঁক দিয়ে গেলানো গেল না। এই সময় বাবাকে দেখতে এলেন ডাক্তার লিভসী। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
দেখুন তো, বললাম সমস্বরে। কোথায় চোট লেগেছে?
চোট-ফোট কিছু না। আসলে স্ট্রোক হয়েছে ওর। আগেই সাবধান করেছিলাম। মিসেস হকিন্স, আপনি ওপরে চলে যান। আপনার স্বামী অসুস্থ। কোন কথা জানাবেন না তাকে। একে কি করা যায় দেখছি আমি। জিম, একটা বোল নিয়ে এসো তো।
বোল নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম, ক্যাপ্টেনের কোট-শার্টের আস্তিন ছিড়ে ফেলেছেন ডাক্তারচাচা। পেশিবহুল হাত বেরিয়ে পড়েছে। হাতে উল্কিতে লেখা রয়েছেঃ হিয়ারস লাক, এ ফেয়ার উইন্ড, বিলি বোস হিজ ফ্যান্সি। বাহুর ওপরে, কাঁধের কাছে আঁকা একটা ছবি। ফাঁসিতে ঝুলছে একজন মানুষ। জলদস্যুদের সাংকেতিক চিহ্ন, ছবিটা দেখিয়ে মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। জিম, রক্ত দেখলে ভয় পাবে না তো?
জ্বী, না।
গুড। বোলটা ধরো, বলেই নাবিকের হাতের শিরায় ডাক্তারী-ছুরি দিয়ে খোঁচা মারলেন।
অনেকখানি রক্ত বেরিয়ে যাবার পর চোখ খুলল ক্যাপ্টেন। ঘোলাটে চোখে তাকাল চারদিকে। ডাক্তারচাচার দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকাল। আমার দিকে চেয়ে খানিকটা স্বস্তি পেল যেন। কিন্তু হঠাৎই আবার বিবর্ণ হয়ে গেল চেহারা। শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করে বলল, ব্ল্যাক ডগ? কোথায়?
ওসব ডগ-ফগ কিছু নেই এখানে, বললেন ডাক্তাচাচা। স্ট্রোক হয়েছিল আপনার। বেশি রাম খাবার ফল। ইচ্ছা একেবারেই ছিল না, তবু গোর থেকে ফিরিয়ে আনা হল আপনাকে এইমাত্র। তা বোনস…
…আমার নাম বোনস নয়, বাধা দিয়ে বলল নাবিক।
তর্ক করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। নামটা আপনার হাতে লেখা রয়েছে। সে যাকগে। আবার হুশিয়ার করছি, এরপর রাম খেলে… তা এক-আধ গেলাস খেলে তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু আপনি তো খেতেই থাকবেন। তাহলে আর সাগর দেখতে হবে না বেশিদিন। বোঝা গেছে?
হ্যাঁ-না কিছুই বলল না নাবিক।
চলুন, আরেকটু সাহায্য করি আপনাকে, আমার দিকে ফিরলেন ডাক্তারচাচা। জিম, এসো, হাত লাগাও।
ধরে কোনমতে দোতলায় তার ঘরে নিয়ে গেলাম নাবিককে। বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বালিশে মাথা রেখে একেবারে নেতিয়ে পড়ল সে। জ্ঞান হারাল নাকি?
না, হারায়নি। ডাক্তারচাচার কথায় চোখ মেলেছে, আবারও সাবধান করছি, রাম ছাড়ুন। নইলে খুব দ্রুত পৌঁছে যাবেন কবরে।
আমাকে নিয়ে নাবিকের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তারচাচা। বাবাকে দেখতে যাবেন এবার।
বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, জিম, যে কোন লোক যত খারাপ হোক, অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে তার একটাই পরিচয়। রোগী। শোন, ওকে রাম দিও না আর। ড্রিংক চাইলে, শরবত দেবে। ওর পুরোপুরি রেস্টের প্রয়োজন এখন। আর একটা স্ট্রোক হলেই শেষ…
০৩. কালো মার্কা
বারোটা নাগাদ শরবত আর ওষুধ নিয়ে গেলাম নাবিকের ঘরে। তেমনি পড়ে আছে নাবিক। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে একেবারে। সাংঘাতিক দুর্বল। কিন্তু চেহারায় পরিষ্কার উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম।
বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ মেলল নাবিক। ক্লান্ত মৃদুকণ্ঠে বলল, তুমি ছাড়া এখানকার সবাই অমানুষ, জিম। তাই তোমার সঙ্গে সব সময় ভাল ব্যবহার করি। অসহায় মানুষের একটা অনুরোধ রাখবে? করুণ আবেদন নাবিকের চোখের তারায়। আমাকে…খানিকটা রাম এনে দেবে? এই ইকটুখানি?
কিন্তু ডাক্তারচাচা…
ওসব ডাক্তার-ফাক্তারের কথা ছাড়, মৃদু গলায় বলল নাবিক। এরা কি জানে? দুনিয়া দেখেছি আমি। পাথরফাটা গরম দেখেছি…পীতজ্বরে তল্লাট সাফ হয়ে যেতে দেখেছি… ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে যেতে দেখেছি… আর ওই ব্যাটা ডাক্তার, হুঁহ! …জিম, লক্ষ্মী ছেলে, একটুখানি এনে দাও না আমাকে! ভাল হয়ে উঠলে আরও অনেক মজার গল্প শোনাব। সোনার পুরো একটা গিনি দেব। দাও না!
দেখুন, ডাক্তারচাচার অনুকরণে হুঁশিয়ার করলাম আমি নাবিককে। বেশি রাম খেলে মরবেন। হোটেলের বদনাম হয়ে যাবে। এদিকে বাবার শরীর খুবই খারাপ। এই অবস্থায় যে কোন ধরনের উত্তেজনা তার জন্যে মারাত্মক। ঠিক আছে, এনে দিচ্ছি এক গ্লাস আর চাইলে এক ফোটাও পাবেন না।
এনে দিলাম। চকচক করে উঠল নাবিকের চোখ। বালিশে ভর দিয়ে কোনমতে আধশোয়া হল। গেলাসটা তুলে দিলাম তার হাতে।
ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে জ্বলন্ত তরল পদার্থটুকু গিলে ফেলল নাবিক। আহ, চমৎকার! জানটা বাঁচল! একটু শক্তিও পাচ্ছি মনে হচ্ছে। তা দোস্ত, ডাক্তার কি বলে? কতদিন শুয়ে থাকতে হবে এভাবে?
কমপক্ষে এক হপ্তা।
তারমানে কোনদিনই আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব না! এর আগেই তো ব্ল্যাক স্পট দিয়ে দেবে আমাকে ওরা। আমি কোথায়, কেমন আছি, নিশ্চয়ই ফাঁস হয়ে গেছে এতক্ষণে। নিজেদের ভাগ শেষ করে আমার দিকে নজর পড়েছে ওদের। তোমাকে চুপিচুপি বলছি…কিছু টাকা আছে আমার। অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছি। ওগুলো লুট করে নিতে চাইবে ওরা এবার। কিন্তু সেটা হতে দিচ্ছি না আমি কিছুতেই!
বিছানা থেকে মাটিতে পা নামাল নাবিক। উঠে দাঁড়াল। টলে উঠল পরক্ষণেই। পড়ে যাচ্ছিল, লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। আমার কাঁধ খামচে ধরে কোনমতে টাল সামলাল সে। তারপর ধপাস করে বসে পড়ল বিছানায়। হ্যাচকা টানে উবু হয়ে পড়লাম। দুহাতে খামচে ধরলাম বিছানার কিনারা।
ব্যাটা ডাক্তার! গালাগাল দিল নাবিক। ওই ব্যাটাই আমার এই অবস্থা করেছে। ইসস, কান ভোঁ ভোঁ করছে!
আমার সাহায্য নিয়ে বালিশে মাথা রেখে আবার ঠিক হয়ে শুলো নাবিক। মিনিটখানেক চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর অবস্থা বিশেষ ভাল ঠেকছে না আমার।
চোখ খুলল নাবিক। আবার সেই পুরানো প্রশ্ন, জিম, খোঁড়া কোন জাহাজীকে দেখেছ?।
এদিক-ওদিক মাথা নাড়লাম।
দেখনি। কিন্তু ব্ল্যাক ডগকে তো দেখলে? পাজির পা-ঝাড়া! যারা তাকে পাঠিয়েছে, তারা তো এক একটা সাক্ষাৎ শয়তান। আমার শরীরের যা অবস্থা, যে-কোন সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। তোমাকে সেক্ষেত্রে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। ওদের নজর এটার ওপর, ঘরের কোণে রাখা সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল নাবিক, ওরা এলে ঘোড়া নিয়ে দ্রুত চলে যাবে অপদার্থ ডাক্তারটার কাছে। ম্যাজিস্ট্রেট সে। পুলিশ নিয়ে এসে যেন গ্রেপ্তার করে ফ্লিন্টের দলের সবকটাকে। জানো, ফ্লিন্টের জাহাজে ফার্স্ট মেট ছিলাম আমি… একমাত্র আমিই চিনি সেই জায়গাটা! সাভান্নায় মরতে বসেছিল ফ্লিন্ট। তার রোগশয্যার পাশে ছিলাম আমি। তখনই আমাকে জিনিসটা দেয় সে… তা, যাকগে ওসব কথা। আমি যা বলছি করবে শুধু ওরা ব্ল্যাক স্পট দিলে, তবেই। আবার ব্ল্যাক ডগ এলে… আর হ্যাঁ, খোঁড়া নাবিকের দেখা পেলেও জানাবে ডাক্তারকে। এই খোঁড়াটা আরও বেশি পাজি।
ব্ল্যাক স্পট কি, ক্যাপ্টেন?
মৃত্যু সমন। এলে জানাব তোমাকে। সন্দেহজক লোকের ওপর চোখ রাখবে এখন থেকে। কসম খাচ্ছি, আমার যা কিছু আছে, তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব।
আরও কিছুক্ষণ বকবক করল নাবিক। ক্রমেই গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসছে। ডাক্তারচাচার দেয়া ওষুধ দিলাম তাকে। বাচ্চা ছেলের মতই আমার হাত থেকে নিয়ে খেল। বলল, সত্যিই, ওষুধ বড় দরকার এখন আমার। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল নাবিক। গভীর ঘুম। ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
সেদিনই সন্ধ্যায় মারা গেল বাবা। ক্যাপ্টেনের চিন্তা সাময়িকভাবে আমার মন থেকে মুছে গেল। প্রচন্ড শোক তো আছেই, তার ওপর প্রতিবেশীদের আসা যাওয়া, শেষকৃত্য, সরাইখানার দৈনন্দিন কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে সাংঘাতিক ব্যস্ত রইলাম।
পরের দিনই কিন্তু নিচে নামল ক্যাপ্টেন। খেলও, কিন্তু অতি সামান্য। তবে রাম খেল প্রচুর। বারে গিয়ে নিজে নিয়েই খেল। তার মেজাজ দেখে বাধা দিতে সাহস করল না কেউ। বাবার শেষকৃত্যের আগের দিন রাতে তো গলা পর্যন্ত মদ গিলল। কুৎসিত গানটাও গাইল। নোংরামির চুড়ান্ত করে ছাড়ল একেবারে। শরীরের ওপর এই অত্যাচারে সাংঘাতিক রকম দুর্বল হয়ে পড়ছে সে ক্রমেই। আশঙ্কা হল, যে-কোন সময় ঢলে পড়ে মরে যেতে পারে। এদিকে ডাক্তারচাচাও নেই। দূরে কোথায় রোগী দেখতে গেছেন, বাবা মারা যাবার পর, এখনও ফেরেননি।
দুর্বল শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করে ক্যাপ্টেন। কখনও দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে সাগর দেখে, বাতাসে ভেসে আসা নোনাপানির গন্ধ নেবার চেষ্টা করে জোরে জোরে শ্বাস টেনে। আমার সঙ্গে কথা বলাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। মেজাজ হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক রুক্ষ। মরে মরে অবস্থা, কিন্তু তবু হলঘরে বসে ছুরিটা খুলে টেবিলে রাখা তার বদভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। মানুষজনের যাতায়াত নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। চিন্তায় ডুবে থাকে।
বাবার শেষকৃত্যের পরের দিন। বিচ্ছিরি রকমের কুয়াশা পড়ছে। কনকনে ঠান্ডা। বেলা তিনটে নাগাদ কোন কারণ ছাড়াই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবার জন্যে মনটা কেমন করছে। এই সময়ই দেখলাম লোকটাকে। ধীর পায়ে এগোচ্ছে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে। চলার ধরন দেখে অনুমান করলাম, সে অন্ধ। চোখ আর নাক সবুজ আচ্ছাদনে ঢাকা। সামনের দিকে কুঁজো হয়ে হাঁটছে। পরনে জাহাজীদের পুরানো শতচ্ছিন্ন জোব্বা। বিকলাঙ্গও মনে হচ্ছে তাকে। তীব্র ঠান্ডায় কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা লোকটাকে এক আজব প্রাণী বলে মনে হল আমার।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। তীক্ষকণ্ঠে যেন বাতাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, গড ব্লেস কিং জর্জ। অন্ধ মানুষ আমি। দেশের কাজে চোখ হারিয়েছি। কেউ যদি বলে দিত, কোথায় এসেছি!
এটা অ্যাডমিরাল বেনবো ই্ন, বললাম। জায়গার নাম ব্ল্যাক হিল কোভ।
বাচ্চা ছেলের কথা শুনলাম? হাতটা একটু ধরবে, বাবা? হাত বাড়িয়ে দিল সে।
ধরলাম। চমকে উঠলাম পরক্ষণেই। প্রচন্ড জোরে আমার হাত চেপে ধরেছে আগন্তুক। ব্যথা লাগছে। হাত ছাড়িয়ে নেবার জোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ঝটকা মেরে আমাকে একেবারে গায়ের ওপর এনে ফেলল লোকটা। বলল, আমাকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চল!
আঁ…আমি পারব না…আমাকে মেরে ফেলবে।
ওসব শুনতে চাই না! চাপা গলায় ধমকে উঠল অন্ধ, জলদি চল্! নইলে দিলাম কব্জি ভেঙে…। প্রচন্ড জোরে আমার কব্জি মুচড়ে দিল সে।
অস্কুট আর্তনাদ করে উঠলাম যন্ত্রণায়। অন্ধকে থামাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, সব সময় ছুরি সঙ্গে রাখে ক্যাপ…ওহহ…।
আমিও ছুরি রাখি, কব্জির ওপর হাতের চাপ বাড়াল আবার অন্ধ। ধানাই-পানাই বাদ দিয়ে চল জলদি! ভয়ঙ্কর কর্কশ হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। জীবনে শুনিনি এমনটি। সত্যিই ভয় পেলাম এবার। আর দ্বিরুক্তি না করে নিয়ে চললাম তাকে।
আমার শরীর ঘেঁষে, সাঁড়াশির মত কঠিন আঙুলে কব্জি চেপে ধরে পাশে পাশে চলল অন্ধ। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমাকে হুঁশিয়ার করল, কোনরকম চালাকি নয়। যেখানে নিয়ে যেতে বলছি, সোজা সেখানে…
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। দরজা খোলার শব্দেও চোখ তুলল না। ডেকে বললাম, ক্যাপ্টেন, দেখুন কে এসেছে!
কে? চোখ মেলল ক্যাপ্টেন। অন্ধের ওপর চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল ঘোলাটে দৃষ্টি। দ্বিধা, তারপর ভয়, সবশেষে আতঙ্ক ফুটল নাবিকের চোখের তারায়। চকিতে যেন বয়েস আরও বেড়ে গেল তার। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে রোগশীর্ণ মুখে। ঢলে পড়ে যাবে যেন যে-কোন সময়। এসে গেছ! ফিসফিস করে বলল ক্যাপ্টেন।
হ্যাঁ, আমার কব্জিতে আবার আঙুলের চাপ বাড়াল অন্ধ। বলল, এই ছোঁড়া, ওর পাশে নিয়ে যা আমাকে।
ক্যাপ্টেনের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল অন্ধ। আমার কব্জি ছেড়ে দিল। একলাফে পিছিয়ে এলাম আমি। কব্জি ডলতে লাগলাম।
তোমার ডান হাতটা, বিল, আদেশ দিল অন্ধ।
অভিভূতের মত হাত বাড়াল ক্যাপ্টেন। কি একটা জিনিস গুঁজে দিল ক্যাপ্টেনের মুঠোয় অন্ধ। ধরল সেটা নাবিক, কিন্তু দেখার প্রয়োজন বোধ করল না।
জিনিসটা দিয়েই ঘুরে দাঁড়াল অন্ধ। লাঠিটা মাটিতে ঠুকে ঠুকে পথ চিনে নিয়ে নির্ভুলভাবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। সিঁড়িতে তার লাঠির শব্দ মিলিয়ে যেতেই ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে।
এতক্ষণে মুঠো খুলে চাইল ক্যাপ্টেন। এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখাঃ দশটায়! আর মাত্র ছয় ঘন্টা পরে!!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। পরক্ষণেই হাত চলে গেল গলার কাছে। অদ্ভুত ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। কয়েক মুহূর্ত নিজেকে খাড়া রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। তারপর দড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে।
চেঁচিয়ে মাকে ডাকলাম। ছুটে এল মা। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। করার আর কিছুই নেই।
লোকটাকে কোন সময়েই ভাল লাগেনি আমার। কিন্তু আশ্চর্য! তার মৃত্যুতে অঝোর কান্না রোধ করতে পারলাম না কিছুতেই। কেন, নিজেও বুঝিনি সেদিন।
০৪. জাহাজী-সিন্দুক
অন্ধের নিয়ে আসা কাগজের টুকরোটা পড়ল মা। আমি আগেই পড়ে ফেলেছি। শঙ্কিত হয়ে পড়ল মা। সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে আসছে, মায়ের মত আমিও বুঝতে পারছি। ক্যাপ্টেন নিজেই আমাকে বলেছে, তার কিছু জমানো টাকা আছে। থাকলে ওগুলো আছে ওই সিন্দুকেই। এটা নিশ্চয় অনুমান করে ফেলেছে দস্যুরা। সুতরাং ওরা আসবে। ব্লাক ডগ আর অন্ধ দস্যুর মত লোকেরা খামোকা সময় নষ্ট করতে আসেনি নিশ্চয়।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মোতাবেক এখন ডাক্তার লিভসীকে খবর দেয়া দরকার এবং তাহলে আমাকেই যেতে হবে। কিন্তু মাকে একা রেখে যাই কি করে? ঘরের নিস্তব্ধতার মাঝে দেয়াল ঘড়িটার টিক টিক বড় বেশি করে কানে বাজছে। ফায়ারপ্লেসে জ্বলন্ত গনগনে লাল কয়লাগুলো যেন জলদস্যুর ভয়ঙ্কর রক্তচক্ষু। আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। ফিসফিস করে যেন কথা বলছে কারা আমাদের চারপাশে। মেঝেতে পড়ে থাকা ক্যাপ্টেনকে যেন আবার জাগিয়ে তুলতে চাইছে অজানা অশরীরীরা। শিউরে উঠলাম। একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল শিরদাড়া বেয়ে।
খুব দ্রুত কিছু করতে হবে আমাদের। বাইরে কুয়াশাঢাকা হিমেল সন্ধ্যা নামছে। আর দেরি করলে আগামী সকালে এসে আমাদের মৃতদেহ উদ্ধার করবে গ্রামবাসীরা।
মা আর আমি পরামর্শ করে গ্রামবাসীদের খবর দেয়াই ঠিক করলাম। ঘনায়মান সন্ধ্যার কুয়াশায় ঢাকা আকাশের নিচে নেমে এলাম আমরা। মাথায় টুপি পরতে পর্যন্ত ভুলে গেছি।
সরাই থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে গ্রাম। অন্ধ ডাকাতটা এসেছিল উল্টোদিক থেকে। আশা করলাম, ওদিকেই আবার চলে গেছে সে। দ্রুত পা চালালাম। মা আর আমি, দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে আছি। যে-কোনরকম অস্বাভাবিক শব্দের জন্যে খাড়া রয়েছে কান। কিন্তু পাহাড়ের পাথুরে পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎছল শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
গ্রামে এসে পৌছুলাম। সন্ধ্যাবাতি জ্বালছে সবাই। দরজা-জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা হলদে-লাল আলোর মৃদু রশ্মি প্রাণের সঞ্চার করল যেন আমাদের দেহে।
গ্রামবাসীরা আমাদের কথা মন দিয়ে শুনল। কিন্তু কেউই সরাইয়ে যেতে রাজি হল না। প্রাণের ভয় সবারই আছে। আসলে আমিই ভুল করেছি। ক্যাপ্টেনের মুখে শোনা ফ্লিন্টের নাম বোকার মত বলে বসেছি গ্রামবাসীদেরকে। আমি নামটা শুনেছি ক্যাপ্টেনের কাছে, কিন্তু গ্রামের কোন কোন প্রাচীন লোক আগেই শুনেছে ওই নাম। শোনামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তারা। কেউ কেউ জানাল, দুপুরের দিকে কয়েকজন অচেনা লোককে পাহাড়ের ওদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। দুজন জেলে জানাল, কিটস হোল-এ অচেনা একটা ছোট জাহাজ দেখেছে। ওদের মতে, দলবল নিয়ে এসে পড়েছে দুর্দান্ত জলদস্যু ফ্লিন্ট।
সরাইয়ে যেতে রাজি না হলেও ডাক্তার লিভসীর বাড়িতে যেতে রাজি হল দুএকজন।
অনেক অনুনয়-বিনয়, অনুরোধ-উপরোধ করেও কাউকে অ্যাডমিরাল বেনবোয় যেতে রাজি করাতে পারল না মা। শেষে রেগেমেগেই বলল, তোমরা পুরুষ মানুষ বলে বড়াই কর আবার! ঠিক আছে, কেউ যেতে না চাও, না যাবে। আমি মেয়ে মানুষ, তবু যাব। মরতে হলে বাধা দিয়ে মরব। ডাকাতেরা সব লুটপাট করে নিয়ে গেলে ছেলেটাকে নিয়ে পথে বসতে হবে আমাকে। এতদিন ভাবতাম তোমরা আমার প্রতিবেশী, বিপদে-আপদে সাহায্য পাব। কিন্তু ভুল। ভীতু কাপুরুষদের ওপর নির্ভর করার কোন মানে হয় না। চল, জিম, আমার হাত ধরে টানল মা, চল যাই।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গ্রামবাসীরা। আমাদের এভাবে বিপদের মুখে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না ওদের, অথচ ভয়ে সঙ্গেও যেতে পারছে না। আমরা রওনা হতেই ডেকে থামাল একজন বুড়ো। গুলিভর্তি একটা পিস্তল দিল আত্মরক্ষার জন্যে। ঘোড়া দিয়েও সাহায্য করতে চাইল, কিন্তু নিল না মা। একজন যুবক গেল ডাক্তার লিভসীকে খবর দিতে।
হিম-রাতের অন্ধকারে আবার পথে নেমে এলাম মায়ের সঙ্গে। কুয়াশা ভেদ করে একটা লালচে আভা দেখা যাচ্ছে দিগন্তে। চাঁদ উঠছে৷ কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। চলার গতি দ্রুত করল মা। শিগগিরই ধূসর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে পথঘাট। কাছেপিঠে থেকে থাকলে সহজেই আমাদের দেখে ফেলবে দস্যুরা।
পথের দুইধারে ঝোপঝাড়। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে প্রতিটি ঝোপের ভিতর গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে বুঝি ডাকাতেরা। যে কোন মুহূর্তে আমাদের ওপর চড়াও হতে পারে। সরাইখানার সদর দরজাটা চোখে পড়তেই অনেকখানি সাহস ফিরে পেলাম।
ঘরে ঢুকেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিল মা। দ্রুত হেঁটে এসেছি। কনকনে ঠান্ডায়ও ঘেমে নেয়ে উঠেছে আমাদের শরীর। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। দরজার কাছেই, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দম নিলাম আমরা। তারপর গিয়ে খুঁজেপেতে মোমবাতি বার করল মা। জ্বালল। একটি মাত্র মোমের আলোয় ঘরের অন্ধকার দূর তো হলই না, চারপাশ থেকে আরও যেন চেপে ধরল। দেয়ালে কাপছে ধূসর ছায়া। হাত ধরাধরি করে নাচছে যেন অসংখ্য দস্যু।
হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল মা। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ফিসফিস করে বলল, চল, আগে ক্যাপ্টেনের ঘরে যাই। তার সিন্দুকটা খুলে দেখতে হবে। মাকে সাহসী বলেই জানতাম, কিন্তু এতটা সাহসী বুঝিনি।
দুরুদুরু বুকে গিয়ে ক্যাপ্টেনের ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। ঠেলা দিয়ে পাল্লা খুলল মা। মেঝেতে তেমনি পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। ভেতরে ঢুকেই বলল মা, জিম, দরজাজানালাগুলো বন্ধ করে দে। কে জানে আমাদের ওপর ওরা নজর রাখছে কিনা!
শেষ জানালাটা বন্ধ করে সবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এমনি সময় ঢং ঢং করে উঠল ঘড়ি। চমকে চোখ তুলে চাইলাম। ছটা বাজে। ফিসফিস করে বললাম, আর মাত্র চার ঘন্টা সময় আছে, মা!
সঙ্গে আনা মোমের আগুনে লণ্ঠন ধরিয়ে ফেলেছে মা ইতিমধ্যেই। আমাকে বলল, চাবিটা বার কর। ক্যাপ্টেনের পকেটেই আছে হয়ত।
অন্য সময় হলে কি করতাম জানি না, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় নির্দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে লাশের পাশে বসে পড়লাম আমি। ক্যাপ্টেনের কোটের পকেটে হাত ঢোকালাম। সবকটা পকেট হাতড়ে একে একে বের করে আনলাম কিছু খুচরো পয়সা, একটা আঙটি, সুতোর বান্ডিল, বড় সুঁচ, এক টুকরো তামার তার, একটা ছোট কম্পাস, আর একবাক্স দেশলাই। কিন্তু কোন চাবি নেই।
কি যেন ভাবল মা। তারপর বলল, ওর গলার কাছে দেখ তো।
আছে। মা কি করে অনুমান করল জানি না, তবে আছে চাবিটা। গলায় সুতো দিয়ে ঝোলানো, লকেটের মত করে। সুতো ছিড়ে চাবিটা খুলে নিলাম। এগিয়ে গেলাম সিন্দুকের দিকে। কতদিন কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছি এই সিন্দুকটার দিকে। আজ দেখতে পাব কি আছে ভেতরে।
আমার পাশে এসে দাঁড়াল মা। হাত বাড়াল। চাবিটা আমার কাছে দে।
তালায় তেল দেয়া আছে। চাবি ঢুকিয়ে একবার মোচড় দিতেই খুলে গেল। আস্তে করে ডালা তুলে উঁচু করে ধরল মা।
পুরানো তামাক আর আলকাতরার তীব্র গন্ধ সিন্দুকের ভেতর। উপরের দিকে কিছু কাপড় চোপড় ভাঁজ করে রাখা। দামি জিনিস, অব্যবহৃত। কাপড়গুলো বের করে আনল মা। নিচে নানারকম জিনিসঃ একটা কোয়াড্র্যান্ট, একটা টিনের প্যানিকিন, তামাক, পিস্তলের চমৎকার দুটো খাপ, একটা রূপার বাঁট, পুরানো একটা স্প্যানিশ ঘড়ি, দুটো কম্পাস, গোটা পাঁচেক সুদৃশ্য ঝিনুকের খোলা এবং আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। অবাক হলাম। এসব সাধারণ জিনিসই তার কাছে এত মূল্যবান ছিল!
আরও নিচে পাওয়া গেল নৌকার পালের খানিকটা। নোনাপানির দাগ জায়গায় জায়গায়। বিরক্ত হয়ে টান মেরে কাপড়টা তুলে ফেলে দিল মা। বেরিয়ে পড়ল আসল জিনিস।
অয়েলক্লথে মোড়া একটা প্যাকেট। আর একটা ক্যানভাসের ব্যাগ। ব্যাগটা নাড়াতেই ভেতরে ধাতব শব্দ উঠল। সেই প্রথম দিনে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়া মোহরের আওয়াজ কেমন, মনে আছে। ব্যাগের ভেতরের শব্দ তাই অচেনা লাগল না।
আমার মুখের দিকে তাকাল মা। ইচ্ছে করলে সবই নিতে পারি আমরা। কিন্তু চোর তো নই। তাই ক্যাপ্টেনের কাছে আমাদের যা পাওনা হয়েছে তার বেশি একটা মুদ্রাও নেব না। যা তো বাবা, একটা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে আয়।
ব্যাগ খুলে মোহর বার করল মা। গুনে গুনে আমার হাতে দিতে লাগল। ব্যাপারটা এত সহজ নয়, বেশ সময়সাপেক্ষ। কারণ, মোহরগুলো বিভিন্ন দেশের। সঠিক মূল্য নির্ণয় করা কঠিন।
অর্ধেক কাজ এগিয়েছে, হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলাম। চেপে ধরলাম মার হাত। কুয়াশাঢাকা রাতের স্তব্ধ বাতাসে ক্ষীণ আওয়াজটাও ঠিকই এসে কানে পৌঁছেছে আমার। তুষার-ঢাকা রাস্তায় লাঠির ঠকঠক আওয়াজ। এগিয়ে আসছে ক্রমেই। মা-ও শুনতে পেয়েছে শব্দটা। স্তব্ধ হয়ে রইলাম দুজনেই।
সরাইয়ের দরজায় লাঠি ঠোকার আওয়াজ হল। ঘনঘন ধাক্কা দেয়া হল দরজায়। কিন্তু ছিটকিনি তোলা থাকায় দরজা খুলতে পারল না। খিস্তির আওয়াজ কানে এল। তারপর আবার ঠকঠক শব্দ। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে শব্দটা। শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল একেবারে।
মা, বললাম। এভাবে গুনে নিতে গেলে হয়ত আর যাওয়াই হবে না আমাদের। চল সব নিয়ে যাই। বেশ বুঝতে পারছি, একা এসেছিল অন্ধ। দরজা খুলতে ব্যর্থ হয়ে চলে গেছে। কিন্তু ফিরে আসবে শিগগিরই। দলবল নিয়ে দরজা ভাঙার জন্যে তৈরি হয়ে।
কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না মা। তার পাওনা থেকে এক পয়সা বেশি নেবে না। বলল, সাতটা বাজেনি এখনও। সুতরাং সময় আছে হাতে। আবার শুনতে শুরু করল।
মৃদু শিসের শব্দ কানে এল এই সময়। পাহাড়ের ওদিক থেকেই যেন এল শব্দটা।
আমারও কাজ শেষ, কান পেতে শিসের শব্দটা শুনে বলল মা।
চারপেনি করে আমারও কিছু পাওনা হয়েছে ক্যাপ্টেনের কাছে, অয়েলক্লথে মোড়ানো ছোট প্যাকেটটা তুলে নিতে নিতে বললাম। কাজেই আমি এটা নিচ্ছি। কি ভেবে নিষেধ করল না মা।
সঙ্গে করে আনা মোমটা শেষ হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে অনুমানে অন্ধকারেই চললাম আমরা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম কয়েক সেকেন্ড। সন্দেহজনক যে কোন শব্দের জন্যে কান খাড়া রাখলাম। নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলল মা। বাইরে বেরিয়ে এলাম আবার।
অনেকটা ওপরে উঠেছে চাঁদ। দ্রুত সরে যাচ্ছে কুয়াশা। ইতিমধ্যেই অনেকখানি হালকা হয়ে এসেছে। হলদে-ধূসর জ্যোৎস্নায় নাওয়া পথঘাট। তুষার ঢাকা পাথরের পাহাড়টা বেয়ে যেন তরল সোনার বান নেমেছে। অপরূপ এই রূপ উপভোগ করার মত সময় কিংবা মানিসক অবস্থা কোনটাই এখন নেই আমাদের। পিচ্ছিল পথ ধরে দ্রুত ছুটছি। গ্রাম আর সরাইয়ের মাঝের অর্ধেক পথ পেরিয়েছি, এমনি সময় কানে এল বুট পরা পায়ের শব্দ। কয়েক জোড়া। পেছনে ফিরে তাকালাম। ছোট্ট একটা আলো দুলছে। লণ্ঠন নিশ্চয়।
হাঁপিয়ে উঠেছে মা, আর পারছে না। আমার দিকে মোহরের থলেটা বাড়িয়ে ধরে বলল, তুই পালা, বাবা! আমি আর পারছি না!
সাংঘাতিক রাগ হল গ্রামবাসীদের ওপর। জীবিত থাকতে ওদের কম সাহায্য করেনি বাবা। অথচ এই বিপদে আমাদের দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়াল ওরা! মাকেও দোষী সাব্যস্ত করলাম মনে মনে। এত দুঃসাহসের কি প্রয়োজন ছিল? আর সাহস করে সরাইয়ে যখন গিয়েছেই, টাকা-পয়সা আর মুদ্রাগুলো নিয়ে ঝটপট কেটে পড়লেই হয়ে যেত। এত সততা দেখাতে গেল কেন?
মা আর হাঁটতে পারছে না। কিন্তু তাকে ফেলে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে আমিও মরব, কিন্তু মাকে রেখে যেতে পারব না কিছুতেই। একহাতে থলেটা ধরে অন্য হাতে মার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। ভর রাখতে বললাম আমার কাঁধে। তারপর কোন রকমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পৌঁছলাম ছোট ব্রিজটার কাছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমিও। সেই বিকেল থেকে কম পরিশ্রম তো করিনি। তারওপর প্রচন্ড উত্তেজনা। ঠান্ডা তো আছেই।
তুষারের ওপরই বসে পড়ল মা।
০৫. অন্ধের পরিণতি
লোকগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মাকে নিয়ে নেমে ব্রিজের তলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। কৌতূহল দমন করতে না পেরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে চলে এসেছি সরাইয়ের কাছে। গা-ঢাকা দিয়ে বসেছি একটা ঝোপের ভেতরে। মুখটা বের করে রেখেছি শুধু। সরাইয়ের দরজাটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছি। সাত আটজন লোক দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে সরাইয়ের দিকে। একটা লোককে দুদিক থেকে ধরে নিয়ে এগোচ্ছে দুজন লোক। মাঝের লোকটা অন্ধ দস্যু।
দরজার কাছে এসেই আদেশ দিল অন্ধ, তার কণ্ঠ পরিষ্কার শুনতে পেলাম। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল কর্কশ কণ্ঠ, ভেঙে ফেল দরজা!
তিনজন লোক এগিয়ে গেল। হাত রাখতেই খুলে গেল ভেজানো পাল্লা। কথা শুনেই বোঝা গেল, বিস্মিত হয়েছে ওরা।
জলদি, জলদি ঢোক ভেতরে! গর্জে উঠল অন্ধ। হারামজাদা বিল পালিয়েছে হয়ত!
দুজন সহকারীর সঙ্গে বাইরে রয়ে গেল অন্ধ। অন্যেরা সবাই ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে, বিল মরে গেছেরে!
গাল দিয়ে উঠল অন্ধ। মরেছে, কাজ কমেছে হাঁদারামের দল! ওর শরীর তল্লাশি কর! সিন্দুকটা বের করে নিয়ে আয়! জলদি! তর সইছে না আর ডাকাতটার।
প্রচন্ড হাঁকডাক শুরু করেছে ডাকাতেরা। বাড়ির ভেতরে জিনিসপত্র হেঁচড়ানো আর ভাঙার আওয়াজ উঠছে। দাপাদাপি শোনা যাচ্ছে সিঁড়িতে। এক ঝটকায় খুলে ফেলল কেউ ক্যাপ্টেনের ঘরের জানালার একটা পাল্লা। শার্শির কাচ ভাঙল ঝনঝন শব্দে। খোলা জানালায় একটা লোকের কাঁধ-মাথা দেখা গেল। অন্ধকে ডেকে বলল সে, পিউ, সিন্দুকটা খোলা। তছনছ হয়ে আছে ভেতরের জিনিসপত্র।
ওটা আছে কিনা দেখ, গাধা কোথাকার! রাগে ফুসছে অন্ধ।
মোহরগুলো আছে।
টাকার কথা বলছি না, শুয়োর কোথাকার! নকশাটা আছে কিনা দেখ!
আধ মিনিট নীরবতার পর আবার জবাব দিল লোকটা, না নেই।
দেখ, বিলের শরীরে কোথাও আছে কিনা!
আবার নীরবতা। তারপর আবার জবাব এল, নেই!
হুহ! বুঝতে পেরেছি, ওই হারামজাদা ছেলেটার কাজ! ইসস, কেন যে চোখ দুটো তখন গেলে দিইনি! চেঁচিয়ে বলল পিউ, একটু আগে যখন এসেছিলাম, দরজা বন্ধ ছিল। দেখ কোথায় ব্যাটা। খোঁজ খোঁজ, খুঁজে বের কর!
তুমুল কান্ড শুরু হল সরাইয়ের ভেতরে। বুটপরা ভারি পায়ের ধুপধাপ, আসবাবপত্র ছুঁড়ে ফেলার শব্দ, দরজায় লাথি মারার আওয়াজ উঠছে। কয়েক মিনিট চলল এই অবস্থা। তারপর একজন লোক উঁকি দিল সরাইয়ের দরজায়। পিউকে জানাল, আমাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ এই সময় হুইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল। গ্রামের ওদিক থেকে এসেছে শব্দটা।
পুলিশ! চেঁচিয়ে উঠল অন্ধের পাশে দাঁড়ানো একজন। এই তোরা সব বেরিয়ে আয়… ডার্ক, কোথায় তোরা? পুলিশ আসছে!
পালাবি কেন, ভীতুর ডিম কোথাকার! ধমকে উঠল পিউ। আফসোস করল, ইসস, আজ যদি আমার চোখ থাকত!
সরাইয়ের ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল ডাকাতেরা। সরাইয়ের আশেপাশের ঝোপঝাড়ে আমাদের খোঁজার নির্দেশ দিল অন্ধ। পুলিশ আসছে তাই দ্বিধা করল দস্যুরা। আবার ভীতু কাপুরুষ বলে গাল দিল অন্ধ।
লক্ষ-কোটি টাকা তোদের হাতের নাগালে, বোঝানোর চেষ্টা করেছে পিউ। এই সুযোগ ছেড়ে দিবি? দেখ দেখ, জলদি খুঁজে দেখ ছোঁড়াটা কোথায়। নকশাটা বের করতেই হবে।
নকশা-ফকশার দরকার নেই, পিউ, বলল এক ডাকাত। মোহরগুলো পেয়েছি, এতেই চলবে।
খামোকা চিল্লাচিল্লি করে লাভ নেই, প্রথমজনের সমর্থনে বলল আরেক ডাকাত। চল কেটে পড়ি।
ভয়ঙ্কর খেপে গেল অন্ধ। চেঁচিয়ে গাল দিতে শুরু করল। কিন্তু এতেও কোন কাজ হচ্ছে না দেখে এলোপাতাড়ি বাড়ি মারতে লাগল লাঠি ঘুরিয়ে। দপাদপ কয়েক ঘা খেল লাঠির আওতায় দাঁড়ানো ডাকাতেরা! ভয়ংকর দাঁত খিচিয়ে পিউকে গালাগাল দিয়ে উঠল ওরা। সরে গেল লাঠির আওতার বাইরে।
ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল এই সময়। গ্রামের ওদিকে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে নেমে আসছে একাধিক ঘোড়া। পিস্তলের আওয়াজ হল সরাইয়ের পেছনের পাহাড়ে। মনে হল, আলোর ঝলকও দেখতে পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করল ডাকাতেরা কিটস হোলের দিকে। বুঝলাম, পিস্তলের শব্দ করে কেউ ওদের পালাবার ইঙ্গিত করেছে।
অন্ধকে ফেলে রেখেই পালিয়েছে ডাকাতেরা। এইবার নিজের বিপদ বুঝতে পারল পিউ। লাঠি ঠুকে ঠুকে পথ খুঁজে নিয়ে ছোটার চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারছে না। বার বার হোঁচট খাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে ডাকল, ওরে ভাইয়েরা, আমাকে ফেলে যাসনে! আমাকে নিয়ে যা, ভাই, নিয়ে যা…।
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। আবার ছুটতে শুরু করল পিউ। ভুল করে গ্রামের পথে ছুটছে।
ঠিক এই মুহূর্তে উল্টো দিকের পাহাড়ের ওদিক থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন অশ্বারোহী। চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি ওদের। ঢাল বেয়ে নেমে আসছে দ্রুত।
ছুটছে পিউ। হঠাৎ তুষারে পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। অশ্বারোহীরাও এসে পড়েছে। পথের ওপর পড়ে যাওয়া মানুষটাকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল সামনের ঘোড়সওয়ার। আকাশ ফাটানো আর্তনাদ করে উঠল অন্ধ। তাকে মাড়িয়ে চলে গেল সবকটা ঘোড়া। চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম, নড়ছে পিউয়ের দেহটা। কাত হল, তারপর চিৎ হয়ে গেল আস্তে আস্তে। আর নড়ল না।
অশ্বারোহীরা আরও কাছে এসে যেতেই লাফিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। সামনের আরোহী একজন অফিসার, মিস্টার ডানস কিটস। গ্রাম থেকে যে যুবকটি গিয়েছিল ডাক্তার লিভসীকে খবর দিতে, সে-ও আছে সঙ্গে। পাহাড়ের ওদিকে সাগরে সন্দেহজনক জাহাজের কথা দুপুরেই কানে গিয়েছে কিটসের। তদন্ত করতে আসছিলেন। পথে গ্রামের যুবকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
পিউ মরে গেছে। চোখের সামনে সবুজ আচ্ছাদন খসে পড়েছে। আকাশের দিকে চেয়ে আছে যেন কালো কোটর দুটো। বীভৎস!
আমাকে দেখে থামলেন ডানস কিটস। যুবকটাও থামল। দুএক কথা জিজ্ঞেস করে, একজন পুলিশকে আমার কাছে রেখে দলবল নিয়ে ডাকাতরা যেদিকে গেছে, সেদিকে ধাওয়া করলেন কিটস। পরে ফিরে এসে তিনি জানিয়েছেন, ছোট পালতোলা জাহাজটা নিয়ে পালিয়েছে ডাকাতেরা। ধরতে পারেননি কাউকে।
পুলিশ এবং যুবকের সহযোগিতায় মাকে নিয়ে এলাম সরাইখানায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ব্রিজের তলায়। খানিকটা রাম ঢেলে দিলাম তার মুখে। গরম সেঁক ইত্যাদি দিয়ে গা গরম করে জ্ঞান ফেরানো হল।
মার জ্ঞান ফিরলে আমি ঘরদোরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তাকানো যায় না। ডাকাতেরা জিনিসপত্র কিছুই আর আস্ত রাখেনি। ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেছে সবকিছু। দেয়ালের ঘড়িগুলো পর্যন্ত খুলে নিয়ে আছড়ে ভেঙেছে।
ইতিমধ্যে কিটসও ফিরে এসেছেন। তাঁর আর উপস্থিত অন্যান্য লোকদের সব খুলে বললাম। বিকেলে অন্ধ পিউয়ের প্রথম সরাইয়ে আগমন থেকে ডাকাতেরা পালানো পর্যন্ত সব কথা।
কিটস বললেন, কিন্তু মোহরগুলো তো পেয়ে গেছে, আর কিসের খোঁজ করছিল ওরা?
হঠাৎই প্যাকেটটার কথা মনে পড়ে গেল আমার। জামার ভেতরের পকেটে রেখেছি। ওটা বের করে এনে বললাম, হয়ত এটার খোঁজ করছিল। অন্ধকে বার বার ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের নকশার কথা বলতে শুনেছি।
দেখি? হাত বাড়ালেন মিস্টার ডানস।
আমি ভাবছিলাম মিস্টার লিভসীর কাছে জমা দেব এটা…
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বললেন কিটস, ওঁকেই দিও। উনিই আগে খুলে দেখবেন, কি আছে ভেতরে। কি যেন ভাবলেন ডানস, তাহলে চল যাই, ডাক্তার সাহেবের ওখানে। দেরি না করে আজই জমা দিয়ে দেয়া উচিত। নিশ্চয় মূল্যবান কিছু আছে প্যাকেটে, নইলে ওটার জন্যে এমন পাগল হয়ে উঠত না অন্ধ।
কিটসকে ধন্যবাদ দিলাম।
একজন লোককে নির্দেশ দিলেন কিটস, ডগার, তোমার ঘোড়াটা ভাল। ছেলেটাকে তোমার সঙ্গেই নাও।
মায়ের কাছে একজন লোককে রেখে সে-রাতেই ডাক্তার লিভসীর বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা।
০৬. মানচিত্র
বাড়িতে পাওয়া গেল না ডাক্তার লিভসীকে। চাকরাণী জানাল, বিকেলে বেরিয়ে গেছেন ডাক্তার। হল-এ গেছেন। রাতের খাওয়াটা জমিদার বন্ধু ট্রেলনীর ওখানেই সারবেন।
সেখানেই যাব, বললেন ডানস।
রাস্তা বেশি না। চাঁদের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথের দুপাশে সারি সারি গাছ, পাতা ঝরে গেছে। চাঁদের আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে নিষ্প্রাণ গাছগুলোকে। সবকিছুতেই যেন জলদস্যুর ছোঁয়া লেগে আছে।
এক বিরাট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন ডানস। হাত তুলে পেছনের সবাইকে থামার ইঙ্গিত করলেন। তারপর নামলেন ঘোড়া থেকে। আমরাও নামলাম সবাই।
বেল টিপে ডাকতেই দরজা খুলে দিল বেয়ারা। পথ দেখিয়ে ট্রেনীর লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল আমাদের। ঘরে ঘরে সারি সারি আলমারি, সবগুলোতে বই ঠাসা। প্রতিটি আলমারির ওপরে রাখা আছে বিখ্যাত সব লোকের একটি করে আবক্ষ মূর্তি। ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে আছেন ডাক্তার লিভসী আর স্কয়ার ট্রেলনী। দুজনেরই হাতে পাইপ।
এত কাছে থেকে এর আগে কখনও ট্রেলনীকে দেখিনি আমি। অনুমান করলাম, ছফুটের বেশি হবে উচ্চতা, সেই অনুপাতে স্বাস্থ্য। চেহারায় সপ্রতিভ ভাব, কিন্তু চামড়া রুক্ষ। কপালে বয়েসের বলিরেখা। কুচকুচে কালো ভুরু দেখলেই মেজাজের আঁচ পাওয়া যায়, তবে বদমেজাজী নয়। চোখের তারায় আবেগ আর উত্তেজনার মিশ্রণ। শুনেছি, দুর্গম অঞ্চলে ঘোরার সাংঘাতিক বাতিক আছে এই জমিদারের।
আরে ডানস যে! খুশি খুশি গলায় আপ্যায়ন করলেন ট্রেলনী, এসো, এসো। তারপর, কি মনে করে?
আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন ডাক্তার লিভসী। জিম, তুমি এত রাতে! ব্যাপার কি?
অল্প কথায় সব গুছিয়ে বললেন ডানস কিটস। শুনতে শুনতে ট্রেলনী, ডাক্তার চাচা, দুজনেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ট্রেলনী তো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চুল খামচাতে লাগলেন। খুলে এল তার মাথার পরচুলাটা। বেরিয়ে পড়ল ছোট করে ছাটা চুল। চেহারাটাই পাল্টে গেল নিমেষে।
কিটসের কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন ট্রেলনী, কানা বদমাশটাকে মেরে একটা দারুণ কাজ করেছ তুমি, কিটস!
হাত বাড়ালেন ডাক্তার চাচা, প্যাকেটটা দাও, জিম।
এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা তুলে দিলাম তার হাতে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ডাক্তারচাচা। ভেবেছি, দেয়া মাত্র খুলে দেখবেন ভেতরে কি আছে, কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে প্যাকেটটা পকেটে রেখে দিলেন তিনি। জমিদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ট্রেলনী, খাওয়াটা সেরে নেয়া যাক। ডানসের আবার ডিউটি আছে, তাকে আটকে রাখা ঠিক হবে না। আমাকে দেখিয়ে বললেন, আর এই ছেলেটারও নিশ্চয় পেট জ্বলছে…
আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাওয়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, ঘন্টা বাজিয়ে ভৃত্যকে ডাকলেন জমিদার।
সবার জন্যেই খাবার এল। আস্ত একটা পায়রার মাংস এল আমার জন্যে। দারুণ খিদে পেয়েছে, গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।
খাওয়া শেষ হল। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডানস কিটস। ফায়ারপ্লেসের পাশে গিয়ে আবার আরাম করে বসলেন ডাক্তারচাচা। পাশে গিয়ে বসলেন ট্রেলনী। আমিও গিয়ে বসলাম তাদের পাশে।
প্যাকেটটা খুলে দেখা যাক এবার, বললেন ট্রেলনী।
মৃদু হাসলেন ডাক্তারচাচা। অত অধৈর্য হচ্ছ কেন? তা আগে বল তো, ফ্লিন্ট সম্পর্কে কি জানো।
ফ্লিন্ট? গম্ভীর হয়ে গেলেন ট্রেলনী, আমি যার নাম শুনেছি সে একজন দুর্দান্ত জলদস্যু। ভয়ঙ্কর খুনী। ওর তুলনায় ব্ল্যাক বিয়ার্ডও নিতান্তই শিশু। স্পেনীয় সাগরে তো নাবিকেরা ওর নাম শুনলেই মূৰ্ছা যায়। আমি কিন্তু মনে মনে গর্বই অনুভব করেছি ফ্লিন্টের জন্যে। ইংরেজ তো। ওকে দেখিনি কখনও, কিন্তু ত্রিনিদাদে ওর জাহাজ দেখেছি, তা-ও দূর থেকে। আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল, একটা কাপুরুষ। ফ্লিন্টের জাহাজের ফ্ল্যাগ দেখেই সোজা ছুটল। পোর্ট অভ স্পেনে। যাওয়ার আগে আর পেছন ফিরে তাকাল না।
আমিও শুনেছি তার নাম, বললেন ডাক্তারচাচা। আচ্ছা, তার কি খুব টাকাকড়ি ছিল?
তো সারাজীবন ডাকাতি করেছে কেন? কিসের জন্যে অত জাহাজকে তাড়া করে বেড়িয়েছে? এত খুনখারাবিই বা কিসের জন্যে? উত্তেজিত মনে হচ্ছে জমিদারকে।
তোমার সঙ্গে কথা বলাই এক ঝকমারী! সারাক্ষণ মাথাটা গরম! আরে বাবা, ডাকাতি করে তো ডাকাতরা পয়সার জন্যেই, সে-কি জানি না? আসলে আমি জানতে চাইছি, জমানো টাকা-পয়সা, ধনরত্ন কেমন ছিল ফ্লিন্টের?
প্রচুর! ঘোষণা করলেন জমিদার। দুহাত ছড়িয়ে বললেন, এই এত্ত…
কে জানে এতে ফ্লিন্টের জমানো রত্নের সন্ধানই আছে কিনা! পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন ডাক্তারচাচা। তার পায়ের কাছেই রাখা ডাক্তারী-ব্যাগটা। সেটা খুলে একটা কাঁচি বার করলেন, দেখি খুলে! কাপড়ের প্যাকেটের ভেতর থেকে দুটো জিনিস বের হলঃ একটা ডায়েরী, আর সিল-করা একটা খাম।
এটাই পড়ি আগে, ডায়েরীটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা। পাতা ওল্টালেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ডাক্তারচাচার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। প্রথম পৃষ্ঠায় কতকগুলো হিজিবিজি আঁকা আর কিছু অদ্ভুত শব্দ—ক্যাপ্টেনের হাতে উল্কিতে যেমন লেখা ছিলঃ বিলি বোনস হিজ ফ্যান্সী, মিস্টার ডব্লিউ বোনস, মেট, নো মোর রাম, অফ পাম কী হি গট ইট ইত্যাদি। এছাড়াও আরও কিছু ছোটখাটো শব্দ আছে, যেগুলোর অর্থ উদ্ধার করা রীতিমত কঠিন। একটা শব্দে-পিঠে ছুরির আঘাত জাতীয় কি যেন বোঝাচ্ছে!
তেমন কিছু নেই, পাতা উল্টে গেলেন ডাক্তার চাচা।
পরের দশ-বারোটা পাতা অদ্ভুত লেখায় ভরা। এক পাতায় একটা লাইনের প্রান্তে একটা তারিখ রয়েছে, অন্যপ্রান্তে টাকার অংক—সাধারণ হিসেবের খাতায় যেমন থাকে। তারিখটা ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন, টাকা ৭০ পাউন্ড-কার কাছে যেন পাওনা। নিচে লেখাঃ কারাক্কাস থেকে সামান্য দূরে। একটা অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমাও দেয়া আছে—৬২.১৭২০ ৯.২৪০।
এরপরের কয়েকটা পৃষ্ঠায় শুধুই টাকার হিসেব। ক্রমেই বেড়েছে যোগফল। শেষ যোগফলটার তলায় লেখাঃ বোনস, তার সঞ্চয়।
মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বললেন ডাক্তারচাচা।
কিন্তু না বোঝার কিছু তো নেই, বললেন ট্রেলনী, কিছু জাহাজের নাম আছে, এগুলো ডুবিয়েছে দস্যুরা। টাকার অঙ্কগুলো বোনসের বখরার হিসেব। কারাকাস থেকে সামান্য দূরে নিশ্চয় কোন জাহাজ আক্রমণ করেছিল ওরা! ঈশ্বর নাবিকদের আত্মাকে শান্তি দিন…
ঠিকই বলেছেন, সায় দিলেন ডাক্তারচাচা। দেখেছেন, টাকার অঙ্ক ক্রমেই বেড়েছে!
এর পরের একটা পাতা বাদে পুরো ডায়েরীটাই ফাঁকা। ওই একটা পাতায় একটা তালিকা। তাতে ফরাসী, ইংরেজি আর স্পেনীয় মুদ্রার পারস্পরিক মূল্যায়ন করা।
দারুণ হিসেবী ছিল তো বোনস, মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। ঠকেনি নিশ্চয় কখনও। ডায়েরীটা আবার পকেটে রেখে দিলেন তিনি।
খামটা খোল এবার, বললেন জমিদার।
সিলমোহর করা খামের ভেতর থেকে বেরোল একটা দ্বীপের মানচিত্র। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, পাহাড়, খাড়ি, উপসাগর ইত্যাদি পরিষ্কার দেখানো আছে। নমাইল দৈর্ঘ্য আর পাঁচ মাইল প্রস্থের মোটাসোটা ড্রাগন-আকৃতির এই দ্বীপ। সাগর থেকে উঠে গিয়ে দ্বীপে মিশেছে একটা পাহাড়—দুপাশে দুটো চমৎকার নেচারাল পোর্ট। পাহাড়টার নাম দেখা যাচ্ছে ম্যাপে দি স্পাই-গ্লাস। ম্যাপের তিন জায়গায় লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া আছে। দুটো চিহ্ন দ্বীপের উত্তর অংশে, তৃতীয়টা রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। এই চিহ্নটার নিচে কালো কালিতে ছোট কিন্তু পরিষ্কার অক্ষরে লেখাঃ ধনরত্নের স্তুপ এখানে। লেখাটা ক্যাপ্টেন বোনসের হাতের নয়।
ম্যাপের উল্টো পিঠে একই হাতের লেখা আছেঃ টল ট্রি, স্পাইগ্লাস শোল্ডার, উত্তরে উত্তর-পূর্বের উত্তরে এক জায়গায়। স্কেলিটন আইল্যান্ড পূর্বে দক্ষিণ-পূর্বের পূর্বে। দশ ফুট। রূপার বাট উত্তরের গুপ্তস্থানে। পূর্বে ঢিবি ধরে এগিয়ে দক্ষিণে ষাট ফুট গেলে সামনে পড়বে। বালি পাহাড়ে, বাহু দুটো সহজেই পাওয়া যাবে, উত্তর বিন্দুতে উত্তর অন্তরীপের প্রবেশ পথে…
—জে. এফ.
হুমম! উফুল্ল হয়ে উঠেছেন জমিদার, এটা জন ফ্লিন্টের গুপ্তধনের ঠিকানা, ঠিকই অনুমান করেছি। ডাক্তারচাচার দিকে ফিরে বললেন, ডাক্তার, আগামীকালই ব্রিস্টল রওনা হচ্ছি আমি। দিন দশেকের মধ্যেই সেরা জাহাজ আর সেরা নাবিক জোগাড় করে ফেলতে পারব। আমি খবর পাঠালেই আপনি আর জিম চলে যাবেন ব্রিস্টলে। তারপর বেরিয়ে পড়ব আমরা ট্রেজার আইল্যান্ডের উদ্দেশে। আপনি জাহাজের ডাক্তারের কাজ চালাবেন, জিম কেবিন বয় আর আমি হব অ্যাডমিরাল। আর হ্যাঁ, রেডরুথ, হান্টার, জয়েসকেও সঙ্গে নেব। অনুকূল বাতাস পেলে…ঠিকানা তো জানাই আছে, দ্বীপে পৌছতে বেশিদিন লাগবে না। তারপর…তারপর বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে…
কাটানো যাবে, এই তো? বললেন ডাক্তারচাচা, কিন্তু…
আবার কিন্তু কিসের? ভুরু কোঁচকালেন জমিদার।
জলদস্যুদের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? এই নকশার জন্যেই আজ বেনবো সরাইয়ে আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। নিশ্চয় তক্কে তক্কে থাকবে…ব্রিস্টল থেকে আমাদের জাহাজ নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে বেরোতে দেখলেই বুঝে নেবে সব। ভাববেন না আমরা ওদের চোখের আড়াল হতে পারব। দূরে, সাগরেই আমাদের খুন করবে ওরা। জাহাজ সুদ্ধ ডুবিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্যই নকশাটা ছিনিয়ে নেবে আমাদের কাছ থেকে…
তারমানে, এই মুহূর্ত থেকে মুখে কুলুপ এটে ফেলতে হবে আমাদের। নকশা সম্পর্কে কোন কথাই কারও কাছে উচ্চারণ করা চলবে না। আমার দিকে ফিরলেন জমিদার ট্রেলনী, জিম, বুঝতে পেরেছ তো?
মাথা ঝাকালাম।
০৭. ব্রিস্টলে
দশদিনে জাহাজ-নাবিক জোগাড় করতে পারলেন না জমিদার ট্রেলনী, তারচেয়ে অনেক বেশি সময় লেগে গেল।
১৭…সালের ১ মার্চ, ব্রিস্টলের ওল্ড অ্যাংকর সরাইখানা থেকে ডাক্তার লিভসীর কাছে একটা চিঠি লিখলেন ট্রেলনী। চিঠিটা হলঃ
প্রিয় লিভসী,
জাহাজ কেনা হয়েছে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কেনা হয়ে গেছে। চমৎকার স্কুনার। সহজেই চালানো যায়। পরিবহণ ক্ষমতা দুশো টন। নাম, হিসপানিওলা।
জাহাজটা জোগাড় করে দিয়েছে আমার পুরানো বন্ধু, পর্যটক ব্ল্যান্ডলি। আমার জন্যে সাংঘাতিক পরিশ্রম করেছে সে। ব্রিস্টলের আরও অনেকেই সাহায্য করেছে আমাকে। তারা জেনেছে গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছি আমি।
ব্ল্যান্ডলির কথাঃ খুব কম দামে পাওয়া গেছে জাহাজটা। কিন্তু দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই। তারা বলছেঃ আসলে এটা ব্ল্যান্ডলিরই জাহাজ ছিল। আমাকে বোকা পেয়ে খুব চড়া দামে বিক্রি করেছে, বলেছে জাহাজের মালিক অন্য লোক। মধ্যস্থতার নামে খুব ঠকিয়েছে নাকি সে আমাকে। সে যাই হোক, জাহাজটাকে খারাপ বলতে পারছে না কেউ।
যতটা ভেবেছিলাম, তত সহজে নাবিক জোগাড় হয়নি। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে সিলভারকে না পেয়ে গেলে তো নাবিকই জোটাতে পারতাম না। লোকটা বুড়ো, এককালে জাহাজে চাকরি করত। এখন ব্রিস্টলে একটা সরাইখানার মালিক। আমি নাবিক খুঁজছি শুনে একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে হাজির। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, লোকটার একটা পা নেই।
লোকটার পুরো নাম লঙ জন সিলভার। অমর বীর হুকের অধীনে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিল সে, পা খোয়ায় ওই যুদ্ধেই। নাবিক এবং যোদ্ধা ছাড়াও আরেকটা পরিচয় আছে তার, চমৎকার রাঁধুনী। যেচে পড়ে এল, হিসপানিওলার বাবুর্চির কাজটা তাকেই দিয়ে দিলাম। ডাঙায় থেকে থেকে শরীর খারাপ হয়ে গেছে নাকি তার, দূর সাগরের নোনা হাওয়ায় যদি স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, এই আশায়ই বুড়ো বয়সে জাহাজে চড়তে চাইছে সিলভার। হুট করে তাকে চাকরি দেয়ার আরও একটা কারণ আছে। আমাকে আশ্বাস দিল, হিসপানিওলার জন্যে নাবিক জোগাড় করে দিতে পারবে সে। সত্যিই, কথা রেখেছে একপেয়ে নাবিক।
দেখতে দেখতে নাবিক জোগাড় করে ফেলেছে সিলভার। যে-সে নাবিক নয়, রীতিমত কাজের লোক প্রত্যেকে। চেহারা ওদের খারাপ, অস্বীকার করছি না, কিন্তু চেহারা দেখে তো বেতন দেব না। কাঁচা লোক নই আমি, বাজিয়ে দেখে নিয়ে তবেই চাকরি দিয়েছি। অদম্য ওদের মনোবল। দরকার পড়লে লড়াই করানো যাবে ওদের দিয়ে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন নিয়োগ করেছি যাকে, সে তো একটি রত্ন। মেজাজটা অবশ্য একটু কড়া, কিন্তু ক্যাপ্টেনের মেজাজ কড়া না হলে নাবিকেরা তাকে মানবে কেন? খোঁজ পেয়ে নিজেই এসেছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু মেট অ্যারোকে আবিষ্কার করেছে সিলভার। সারেঙ লোকটার গুণ আছে, বাঁশি বাজাতে পারে।
সিলভারের কথা আরও কিছু বলে নিই। লোকটা হিসপানিওলায় ছোট চাকরি নিয়েছে বটে, কিন্তু তাকে যা-তা ভাবা ঠিক হবে না। ব্যাংকে মোটামুটি টাকা আছে তার নামে। সরাই চালাবার ভার স্ত্রীর ওপর দিয়েছে। মেয়েলোকটি ইংরেজ নয়। সিলভার অবশ্য বলেনি কিছু, কিন্তু কারও কারও ধারণা বৌয়ের দাপট সইতে না পেরেই নাকি পালিয়ে বাঁচতে চাইছে খোঁড়া বাবুর্চি। হাওয়া পরিবর্তনের কথাটা আসলে একটা বাহানা। সে যাই হোক, ওসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার কোন কারণ নেই।
ট্রেলনীর চিঠিটা আমাকেও পড়তে দিলেন ডাক্তারচাচা। জাহাজ আর নাবিক জোগাড় হয়ে গেছে জেনে দারুণ খুশি হলাম। এই খবরের আশায়ই তো আছি। কিন্তু একটা ব্যাপার মোটেই ভাল লাগল না আমার। জমিদার নিজেই বললেন, গুপ্তধন আর নকশা সম্পর্কে কাউকে কিছু বলা হবে না, অথচ তিনি নিজেই কথাটা ফাঁস করে দিয়ে বসে আছেন!
পরদিন গোধূলি বেলায় রয়াল জর্জে এসে দাঁড়াল ডাক গাড়িটা। রেডরুথ, হান্টার আর জয়েগের সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসলাম।
ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে কনকনে হাওয়া এসে ঢুকছে ভেতরে। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে চলেছি। বাড়ির কথা মায়ের কথা মনে পড়ছে বারে বারে। মনে পড়ছে আমাদের সরাই অ্যাডমিরাল বেনবোর কথা। বাবার স্মৃতিটা কেন যেন আজ বড় বেশি মনে আসছে, সেই সঙ্গে ভাবছি সরাইয়ের আশেপাশের পাহাড় আর সাগরের কথা। ক্যাপ্টেন বোনসও এসে চড়াও হচ্ছে মনের পর্দায়। নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলেছি। আর কি কোনদিন ফিরে আসতে পারব অ্যাডমিরাল বেনবোয়?
ঠিক কতক্ষণ পরে জানি না, পাজরে রেডরুথের কনুইয়ের খোঁচায় তন্ময়তা ভাঙল। বলল সে, নেমে পড়। ব্রিস্টলে এসে গেছি।
নামলাম। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসে পৌঁছলাম শহর থেকে দূরে, ডকইয়ার্ডে। সারি সারি জাহাজ নোঙর করে আছে। দেশ-বিদেশের নাবিকেরা কোলাহল করছে, গান গাইছে, কাজ করছে। নোনা হাওয়ায় মেশানো আলকাতরার গন্ধটা একেবারে অপরিচিত ঠেকল না। এই গন্ধ আগেও পেয়েছি। ক্যাপ্টেন বোনসের সিন্দুকের ভেতরে।
কানে মাকড়ি, দু-গালের জুলফি পাকিয়ে পাকিয়ে গোল-করা, রঙওঠা পোশাকপরা মাঝবয়েসী এক নাবিককে অবাক চোখে দেখছি, এই সময় সেখানে এসে দাঁড়ালেন ট্রেলনী। জমিদারকে দেখে প্রথমে তো চিনতেই পারলাম না। স্বাস্থ্য অনেক ভাল হয়েছে। পরনে নীল রঙ মোটা কাপড়ের নাবিকের পোশাক। কথা, হাসি, চলাফেরার ভঙ্গি ইত্যাদি সব কিছুতেই নাবিকদের অনুকরণ করছেন।
কেমন আছ, জিম? আমার হাত ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন জমিদার।
আমি ভাল আছি জানাতেই বললেন, কাল রাতে ডাক্তার লিভসীও এসে পৌঁছেছে। সে-ও ভাল আছে।
আমরা কবে রওনা হচ্ছি, স্যার?
আগামী কাল।
০৮. স্পাই গ্লাস
পরদিন সকালে নাস্তার পর পাই গ্লাস সরাইয়ে যেতে বললেন আমাকে ট্রেলনী। জন সিলভারকে দেবার জন্যে একটা চিঠি দিলেন আমার হাতে। সরাইয়ের ঠিকানাটা বুঝিয়ে বললেনঃ ডকের ধার ধরে যেতে যেতে সাগরের পাড়েই একটা ছোট্ট বাড়ি, দেয়ালে মস্ত দূরবীনের ছবি আঁকা, ওটাই স্পাই গ্লাস সরাইখানা।
বেরিয়ে পড়লাম। উত্তেজনা আর আনন্দে মশগুল। আরও জাহাজ, আরও নাবিক, নতুন জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছি, এই তো আমি চাই। কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড় ডকে। তাদের পাশ কাটিয়ে, মালপত্রের স্তুপ এড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম সরাইটার সামনে। ঠিকই বলেছেন জমিদার, সহজেই পাওয়া গেল স্পাই গ্লাস সরাইখানা।
সরাইয়ের বাইরের জায়গাটুকু সুন্দর ছিমছাম। নতুন আঁকা সাইনবোর্ড। জানালায় টকটকে লাল পর্দা। ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
এক কামরার একটা বাড়ির মাঝখানে দেয়াল তুলে দুভাগ, অর্থাৎ দুটো ঘর করা হয়েছে। মেঝে পাকা নয়, চমৎকার করে বালি বিছানো। মালিকের আজব কিন্তু চমৎকার রুচির পরিচয় পাওয়া যায় এতে। তামাকের ধোয়ায় আচ্ছন্ন ঘরের খদ্দেররা বেশির ভাগই নাবিক। জোরে জোরে কথা বলছে ওরা, এভাবেই হয়ত কথা বলতে অভ্যস্ত নাবিকেরা।
দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এইসময় ওপাশের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু সে কে বুঝতে অসুবিধে হল না। বাঁ পা-টা উরুর কাছ থেকে কাটা, বগলে ক্ৰাচ। প্রায় নিঃশব্দে আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে হাঁটে লোকটা। একটা পা-যে নেই, তাতে যেন কোন অসুবিধেই হচ্ছে না তার। লম্বা বলিষ্ঠ দেহ। প্রকান্ড মুখটা ফ্যাকাসে, হয়ত বয়সের ভারেই, কিন্তু হাসি লেগেই আছে মুখে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। টেবিলগুলোর পাশ দিয়ে চলছে ফিরছে লোকটা, প্রতিটি টেবিলের পাশে থেমে কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে, কারও কারও পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে আন্তরিক ভঙ্গিতে।
নাহ্, যা সন্দেহ করেছিলাম তা নয়। লোকটা একপেয়ে ঠিকই, নাবিকও ছিল এককালে, কিন্তু সে ক্যাপ্টেন বোনসের সেই ভয়ঙ্কর লোক নয়। আমার দুঃস্বপ্নে দেখা দানব নয় সে। এই হাসিখুশি চমৎকার লোকটা আর যাই হোক, জলদস্যু হতে পারে না। সিলভারের ব্যবহার দেখে তাই মনে হচ্ছে আমার।
এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে ডাকলাম, মিস্টার সিলভার, স্যার?
ফিরে চাইল লোকটা। মিস্টার ট্রেলনী দিয়েছেন, চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে বললাম।
চিঠিটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সিলভার, তুমি কে, খোকা? তারপর হঠাৎই যেন অনুমান করে নিয়ে বলল, ওহহো বুঝেছি, তুমি সেই। মানে কেবিনবয়। ভাল, খুশি হলাম তোমাকে দেখে। বিশাল এক থাবা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
হঠাৎই ওপাশের ঘর থেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল একটা লোক। আমাকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখে ফুটল বিস্ময়, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশে।
সিলভারের থাবা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, আরে, ওই তো! ব্ল্যাক ডগ!
কে? কি নাম বললে? আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে চেয়েছে সিলভার।
ছুটে গেলাম দুই ঘরের মাঝের দরজার কাছে। পলকের জন্যে চোখে পড়ল বেরিয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাক ডগ। ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সিলভার। ডগের পেছনটা দেখতে পেয়েছে সে। আরে, আমার পয়সা না দিয়েই চলে যাচ্ছে! হ্যারি, এই হ্যারি, জলদি ধর ব্যাটাকে!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দরজার কাছে বসা একজন লোক।
হাঁ করে আছ কেন, জলদি যাও! তাড়া লাগাল সিলভার।
আমার দিকে ফিরে বলল, কি নাম যেন বললে?
ব্ল্যাক ডগ! জলদুস্য!
আমার সরাইয়ে ডাকাত! ব্যাটার সাহস তো কম নয়! এই বেন, আরেকজন লোককে ডেকে আদেশ দিল সিলভার। তুমিও যাও। যে করেই হোক ধরে নিয়ে এস ব্যাটাকে। জলদস্যু! বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব! আমাকে চেনে না! ঘরের ভেতরের দিকে একটা টেবিলে বসা লোকের দিকে চেয়ে হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল সে, এই, এই মরগান, তোমার পাশেই তো বসেছিল ও! এসো, এদিকে এসো!
হতচকিত হয়ে পড়ল মরগান। উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে এল সিলভারের কাছে। পোশাক-পরিচ্ছদে মনে হচ্ছে নাবিক। মাথার চুল পেকে গেছে, মেহগনি রঙের, চামড়ায় ঢাকা মুখ। হাতের তামাকের ডেলাটা গোল করতে করতে কাঁচুমাচু মুখে এসে দাঁড়াল সিলভারের সামনে।
ওই ব্ল্যাক ডগ না কি নাম বলল…ওর সঙ্গে পরিচয় আছে?
জ্বী, না!
তবে যে বড় গল্প করছিলে তখন?
মদের টেবিলে যে-কোন অপরিচিত নাবিক পরিচিত হয়ে যায়, আপনিও তো জানেন। সত্যি বলছি, আমি ওকে দেখিনি এর আগে।
এবং বেঁচে গেলে এই জন্যেই। এরপর থেকে যদি দেখি ওই ধরনের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করছ, ঝেটিয়ে বার করব আমার সরাই থেকে! তা কি বলছিল তোমাকে? সাগর… জাহাজ… ক্যাপ্টেন, এমনি সব শব্দ কানে আসছিল?
এসব নিয়েই তো আলোচনা করে নাবিকেরা…
হু, যাও। বসোগে…
ধীরে ধীরে গিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়ল মরগান। সিলভারের দিকে চোখ তুলে চাইতে সাহস হচ্ছে না। তামাকের ডেলাটা গোল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল সিলভার, মরগান লোক খুব ভাল, কিন্তু হদ্দ বোকারাম।
দরজার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল সিলভার, তারপর আমার দিকে চেয়ে আপনমনেই মাথা নাড়ল, ব্ল্যাক…ব্ল্যাক ডগ…দেখেছি আগেও লোকটাকে…আচ্ছা, ওর সঙ্গে একটা অন্ধ লোককে দেখেছ কখনও? বিচ্ছিরি চেহারা?
নিশ্চয়ই! উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আমি, ওই ব্যাটাও ডাকাত ছিল। নাম, পিউ।
হ্যা হ্যাঁ, পিউ, সায় দিয়ে বলল সিলভার। দুই হারামজাদাই আমার দোকানে হরদম আসে যায়, ইদানীং অবশ্য কানাটাকে দেখি না!..ইসস, আগে যদি জানতাম…
পিউ তো মারা গেছে। ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে গিয়েছিল…
এই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল হ্যারি আর বেন। তাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল সিলভার।
ওকে…ধরতে পারলাম না… ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে হ্যারি, ব্যাটা এক্কেবারে গায়েব হয়ে গেছে…
তোমাদের দুই গাধাকে দিয়ে কোনদিন কোন কাজ হয়েছে? খেঁকিয়ে উঠল সিলভার। ইসস, এখন আমি কি জবাব দেব মিস্টার ট্রেলনীর কাছে! আমার সরাইয়ে ডাকাতদের আড্ডা, যদি শোনেন তিনি আমাকে কি আর চাকরিতে রাখবেন! আর আমিই বা কি করি যুদ্ধে গিয়ে তো একটা পা খোয়ালাম… পা থাকলে, আরে গাধারা, তোমাদের মত গায়ের জোর থাকলে, ওই হারামখোর আমার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচে?
যাক যা হবার, হয়েছে, অভয় দিলাম। আমি সব কথা বুঝিয়ে বলব মিস্টার ট্রেলনীকে। আপনার কোন দোষ নেই, দেখতেই তো পেলাম। তাছাড়া সরাইয়ে কত লোক আসে যায়, কি করে বুঝবেন কে ডাকাত আর কে সাধু?
বুদ্ধিমান ছেলে! হাসিতে ভরে গেছে সিলভারের মুখ। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, তোমার সম্পর্কে যা শুনেছি, দেখছি মিথ্যে নয়। এসো, এক গেলাস রাম খাও… হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেল কথাটা তার। আরে তাই তো, ডাকাতটা যে আমার তিন গেলাস মদের দাম না দিয়েই চলে গেল…যাকগে, এসো, যা হবার হয়েছে… আপ্যায়ন করে নিয়ে আমাকে একটা চেয়ারে বসাল সিলভার।
রাম নয়, চা নিলাম আমি। ইতিমধ্যে ট্রেলনীর চিঠিটা পড়ে ফেলেছে সিলভার। ট্রেলনীর সঙ্গে তাকে দেখা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমার পাশে বসে বলল সিলভার, একটা কথা কি জানো, বুড়ো আর বাচ্চাদের মাঝে খাতির হতে সময় লাগে না। বুঝতে পারছি, তোমার সঙ্গে আমার বনিবনা ভালই হবে। তাছাড়া দুজনের কাজও প্রায় একই ধরনের। তুমি কেবিনয়, আমি বাবুর্চি… বক বক করেই চলল সিলভার।
আমার চা খাওয়া শেষ হলে উঠে দাঁড়ালাম। সিলভারও উঠল। সরাই থেকে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে।
ডকের পথটা ধরে চলতে চলতে আমার সঙ্গে আলাপ আরও জমে উঠল সিলভারের। চমৎকার গল্প বলতে পারে সে, অল্পক্ষণেই বুঝে গেলাম। জাহাজ নাবিক। সাগর সম্পর্কে জ্ঞানও তার অপরিসীম। চলার পথে যে কটা জাহাজ দেখলাম, সবকটার গঠন, কোন্ জাতের কোন দেশের জাহাজ ওগুলো, কি মাল বহন করে, কোন কোন্ সাগর পথে যাতায়াত, ইত্যাদি সব বলল আমাকে। এরই ফাঁকে ফাঁকে নাবিকদের সম্পর্কেও ছোটখাটো গল্প শোনাল। খুশি হয়ে উঠলাম। সিলভারকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি, জাহাজে সময় আমার ভালই কাটবে।
ডকের ধারেই একটা সরাইয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তারচাচা আর ট্রেলনী। আমাদের দেরি দেখে লাঞ্চ শুরু করে দিয়েছেন।
কেন দেরি হল, সব বুঝিয়ে বলল সিলভার। প্রচুর উৎসাহের সঙ্গেই ব্ল্যাক ডগকে ধাওয়া করার ঘটনা বর্ণনা করল। মাঝে মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আমার দিকে তাকাচ্ছে, সায় দিচ্ছি আমি।
ব্ল্যাক ডগ ধরা না পড়ায় আফসোস করলেন ডাক্তারচাচা আর ট্রেলনী, কিন্তু ঠিকই বুঝলেন, সিলভারেরও কিছু করার ছিল না। সে তো সঙ্গে সঙ্গেই লোক পাঠিয়েছে। ডাকাতটাকে ওরা ধরতে না পারলে খোঁড়া মানুষটার কি করার আছে?
আজ বিকেল চারটেয়, কাজের কথায় এলেন ট্রেলনী। আবার বলছি, বিকেল চারটেয় নাবিকদের হিসপানিওলায় গিয়ে তৈরি থাকতে বলবে।
জী, আচ্ছা, ঘাড় কাত করল সিলভার।
তাহলে যাও এখন। সিলভারের চলার পথের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন ডাক্তারচাচা। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্, লোকটার ওপর কোন সন্দেহ হচ্ছে না আমার।
সন্দেহ মানে? ওর মত চমৎকার লোক হয় নাকি! বললেন ট্রেলনী। তা আর দেরি কেন? খাওয়া তো হল, চল যাই তোমাকে দেখাই জাহাজটা।
হ্যাঁ, চল যাই, আমাকে দেখিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা। জিম আসবে সঙ্গে? ও-ও তো দেখেনি জাহাজটা।
নিশ্চয়! আসবে না মানে, একশোবার আসবে! চল জিম, তুমিও চল।
০৯. বারুদ-বন্দুক
জাহাজে উঠতেই এগিয়ে এসে আমাদের সালাম জানাল মেট অ্যারো। চামড়ার রঙ তামাটে, চোখ ট্যারা, কানে ইয়ারিং। কোন এক সময় নৌবাহিনীতে ছিল হয়ত। ট্রেলনীর সঙ্গে তার সদ্ভাব, সহজেই বোঝা যায়।
অ্যারোর সঙ্গে কথা বলছেন ট্রেলনী, এই সময় কয়েকজন নাবিকের পেছনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন হিসপানিওলার ক্যাপ্টেন। রুক্ষ কিন্তু ধারাল চেহারা। সারাক্ষণই যেন রেগে আছেন। ভদ্রতার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না ক্যাপ্টেন, এসেই শুরু করলেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে, মিস্টার ট্রেলনী।
ও, ক্যাপ্টেন স্মলেট? ভুরু কুঁচকে গেছে জমিদারের, কি কথা?
সোজাসুজিই বলছি। এই জাহাজের লোকজনদের মোটেই ভাল লাগছে না আমার।
জাহাজটাও নিশ্চয় ভাল লাগছে না আপনার? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল রেগে গেছেন ট্রেলনী।
জাহাজটা সত্যিই ভাল কি মন্দ, জানি না এখনও। না চালিয়ে কোন মন্তব্য করব না।
জাহাজ পছন্দ নয়, নাবিকেরা ভাল নয়, তাহলে নিশ্চয় হিসপানিওলার মালিককেও আপনার সুবিধের মনে হচ্ছে না?
তর্কবিতর্ক খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে, বুঝে, হাত তুলে থামালেন দুজনকে ডাক্তারচাচা, আরে কি শুরু করলেন আপনারা? ক্যাপ্টেনের পক্ষ নিয়ে বললেন তিনি, ক্যাপ্টেন স্মলেট একটা কথা বলেছেন, সেটা সত্যি কি মিথ্যে না জেনে খামোকা তর্ক বাধাচ্ছ কেন, স্কয়ার? জাহাজের ভার যখন তার ওপর, ভালমন্দ সব বিষয়েই কথা বলার অধিকারও আছে। হ্যাঁ ক্যাপ্টেন, বলুন, কেন আপনার পছন্দ নয়?
চাকরি দেবার সময় আমাকে বলা হয়েছে, একটা গোপন মিশনে চলেছে হিসপানিওলা। কিন্তু জাহাজে উঠে দেখি, ওমা, নাবিকেরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে। কেন, কোথায় যাচ্ছে জাহাজ, সব জানে! এটা কেমন ধরনের কথা, স্যার?
ভুল বলেননি আপনি, ক্যাপ্টেনের স্বপক্ষে রায় দিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা।
আরও কথা আছে। নাবিকেরা বলাবলি করছে, গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছে এই জাহাজ। নাবিকদের মুখে কথা ছড়ায় বেশি। কোথায় কোন্ ডাকাতের দল শুনবে কথাটা, ব্যস, পিছু নেবে…বেঁচে আর ফিরে আসতে হবে না। আপনিই বলুন, জেনেশুনে কে মরতে যায়?
আপনার এই অভিযোগও ফেলনা নয়, বললেন ডাক্তারচাচা। কিন্তু নাবিকদের পছন্দ করছেন না কেন?
দেখুন, স্যার, শুনেছি আপনি ডাক্তার। রোগীর চেহারা দেখেই ভেতরের অনেক কিছু আঁচ করতে পারেন। আমি নাবিক, সারাজীবন নাবিকদের মাঝে কাটিয়েছি। চোখ দেখে ওদের চরিত্র অন্তত কিছুটা বুঝব না, ভাবলেন কি করে? কথাটা যখন উঠেই পড়ল, তো বলি, এই জাহাজ সামলানোর দায়িত্ব আমার। নাবিকদের ভারও থাকবে আমারই ওপর। কাজেই নাবিক জোগাড়ের ভারটাও আমার ওপর দিলেই ভাল করতেন।
আপনার কথায় যুক্তি আছে, বললেন ডাক্তারচাচা। কিন্তু কাকে কাকে পছন্দ হয় আপনার, বলুন তো? মেট অ্যারোকে কেমন মনে হয় আপনার?
নাবিক হিসেবে খারাপ না। তবে তার স্বভাব অফিসারের মত নয়। মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে বসে মদ খায়…
মদ খেলে কি হল! আপনি খান না? খেঁকিয়ে উঠলেন ট্রেলনী।
খাই, কর্কশ হয়ে উঠেছে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ, কিন্তু আমার বক্তব্য সেটা নয়। আমি বোঝাতে চাইছি, মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া জাহাজের অফিসারদের জন্যে বেমানান।
পরিষ্কার করে বলুন তো, ক্যাপ্টেন, কি বলতে চান আপনি? প্রশ্ন করলেন ডাক্তারচাচা।
সত্যিই এই অভিযানে যাবার ইচ্ছে আপনাদের আছে?
নিশ্চয়! বললেন জমিদার। তার রাগ কমেনি, নইলে এত খরচাপাতি কিসের জন্যে?
বেশ। তাহলে বলছি, যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে আমার আদেশেই সব কিছু চলবে হিসপানিওলায়। কান্ডটা দেখুন তো! নিচে সুন্দর স্টোররূম থাকতে জাহাজের সামনে এনে জমা করেছে সব গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র! ওগুলো সরাব আমি ওখান থেকে। তাছাড়া যে চারজন লোককে ওই গোলাবারুদের পাহারায় রাখা হয়েছে, তাদের কোন দরকার নেই। ওরা থাকবে নিজের নিজের কোয়ার্টারে।
ঠিক আছে, মেনে নিলাম, বললেন ট্রেলনী। আর কিছু বলবেন?
বলব। হিসপানিওলা কোথায়, কেন সব জানাজানি হয়ে গেছে…
ঠিকই বলেছেন আপনি, ক্যাপ্টেন, সায় দিলেন ডাক্তারচাচা।
নিজের কানে শুনেছি আমি, আপনাদের কাছে দ্বীপের ম্যাপ আছে। সেই ম্যাপে চিহ্নিত করা আছে কোথায় গুপ্তধন মিলবে। দ্বীপটার অবস্থানও জানি, মানে শুনেছি… গড়গড় করে অবস্থানটা সঠিক আউড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।
আশ্চর্য তো! বললেন জমিদার, আমি এ কথা কাউকে জানাইনি!
অথচ হিসপানিওলার নাবিকদের কারও অজানা নেই! থমথমে গম্ভীর ক্যাপ্টেনের মুখ।
কে বলল তাহলে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার আমার একবার ডাক্তারচাচার মুখের দিকে তাকালেন জমিদার।
বেশি কথা বলি না আমি, তুমি জানো, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ডাক্তারচাচা। আর জিমও বেঁফাস কথা বলার ছেলে নয়।
কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন জমিদার, কিন্তু তার আগেই বলে ফেললেন ক্যাপ্টেন, কার কাছে আছে ম্যাপটা জানি না, জানতে চাইও না। কিন্তু দেখবেন, খুইয়ে না বসেন ওটা।
গুপ্তধন…ম্যাপ…গোলাবারুদ, ক্যাপ্টেন, আপনি কি বিদ্রোহের আশঙ্কা করছেন? জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তারচাচা।
এ-ব্যাপারে খোলাখুলি এখুনি কিছু বলতে পারব না, মাপ করবেন। আমার সন্দেহ হয়েছিল, জানালাম, পরে যেন দোষ না দিতে পারেন আমাকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন আমি, জাহাজের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাই আমার। আমাকে পুরো স্বাধীনতা আর জাহাজের শাসন ক্ষমতা দিতে হবে। নইলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই মুহূর্তে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না আমার।
একবার জমিদারের দিকে তাকালেন ডাক্তারচাচা, তারপর ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ক্যাপ্টেন স্মলেট, আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না আর।
আপনি বুদ্ধিমান শুনেছি, বললেন কাপ্টেন। ঠিকই শুনেছি।
ডাক্তার যখন বলছে, বললেন জমিদার। আমার বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়।
বড় বড় কথা বলে ফেললাম, মাপ করবেন আমাকে, মিস্টার ট্রেলনী, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন। আমাকে আমার মত কাজ করতে দিন, কথা দিচ্ছি, কোন ফাঁকি কিংবা অবহেলা পাবেন না। আর একটাও কথা না বলে ঘুরে চলে গেলেন স্মলেট।
দুজন খাটি লোক পেয়েছ হে তুমি, জমিদার, বললেন ডাক্তারচাচা। একটি ওই জন সিলভার, আরেকটি এই ক্যাপ্টেন।
এটার চাইতে সিলভার অনেক ভাল, মুখ গোমড়াই রয়েছে জমিদারের। এই ব্যাটা তো ব্যবহারই জানে না। ইংরেজের বাচ্চা অমন হতে দেখিনি কখনও!
হয়েছে, হয়েছে, শান্ত হও, বললেন ডাক্তারচাচা।
জাহাজের সব ব্যবস্থা আবার ঢেলে সাজানো শুরু হল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু তদারক করছেন ক্যাপ্টেন, তাঁকে সাহায্য করছে মেট অ্যারো।
জোর কাজ চলছে, এই সময় একটা নৌকায় করে কয়েকজন লোক এল। হিসপানিওলার চাকুরেই ওরা, সর্বশেষ আগমন। তাদের মধ্যে সিলভারও আছে।
একটা পা নেই, কিন্তু ঝোলানো দড়ি বেয়ে বানরের মত ক্ষিপ্রতায় ডেকে উঠে এল সিলভার। উঠেই প্রশ্ন করল, একি? কি হচ্ছে?
গোলাবারুদ সরাচ্ছি, বলল একজন নাবিক।
কেন? দেরি হয়ে যাবে যে তাহলে? আজকের জোয়ার ধরতে পারব না!
এই, তোমার এত মাতব্বরী কেন? ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন, রান্নাঘরে যাও! খাওয়ার ব্যবস্থা করগে…যত্তোসব… গজ গজ করে উঠলেন তিনি।
মাপ করবেন, স্যার, এই যে যাচ্ছি… তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের উদ্দেশে চলে গেল সিলভার।
মনে হচ্ছে কথা একটু বেশি বলে, মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। তবে লোক ভাল..ব্যবহারেই বোঝা যায়।
হবে হয়ত! বললেন স্মলেট। কথাবার্তা শুনতে একটু বেশিই এগিয়েছিলাম, ক্যাপ্টেনের নজরে পড়ে গেলাম। খেঁকিয়ে উঠলেন, এই, এই ছেলে, তুমি এখানে কি করছ? যাও, রান্নাঘরে যাও। বাবুর্চিকে সাহায্য করগে।
তিলমাত্র বিলম্ব না করে রওনা হলাম। পেছনে ক্যাপ্টেনের গজগজ শোনা গেল, কোন সুপারিশ, পেয়ারের লোকটোক চলবে না আমার জাহাজে। কাজ করতে হবে…
স্কয়ার ট্রেলনীর সঙ্গে সেই মুহূর্তে একমত হলাম আমি। অসহ্য লোক ক্যাপ্টেন স্মলেট। তাঁর প্রতি গভীর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল আমার মন।
১০. সমুদ্র যাত্রা
কর্মব্যস্ততার মাঝে কাটল সারাটা রাত। এক রাতে এর অর্ধেক কাজও কখনও করিনি অ্যাডমিরাল বেনুবোয়। নতুন সংসার গোছানোর মতই ক্যাপ্টেনের আদেশে হিসপানিওলার মালপত্র গোছগাছ করতে হল আমাদের। এর ওপর অতিথিদের অভ্যর্থনা আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা যেন গোদের ওপর বিষফোড়ার মত অবস্থা করে ছাড়ল। অতিথিরা সবাই ব্রিস্টলের লোক। মি. ব্ল্যান্ডলি আর স্কয়ার ট্রেলনীর নতুন বন্ধু বান্ধব বিদায় জানাতে এসেছে। ভোরের আগে যখন কাজ শেষ হল, জাহাজ ছাড়ার প্রথম সঙ্কেত জানাল সারেঙ ভেঁপু বাজিয়ে, নোঙর তোলার জন্যে তৈরি হল মাঝিমাল্লারা, আমার সারা শরীর ভেঙে এল দারুণ ক্লান্তিতে। ঘুম জড়িয়ে এল দুচোখে, কিন্তু ডেক ছেড়ে যেতে মন চাইল না। যা কিছু দেখছি শুনছি, ওপরওলাদের নির্দেশ, নাবিকদের হাঁক ডাক, হুইসেলের তীক্ষ্ন আওয়াজ, লণ্ঠনের আলোয় জাহাজের ডেকে লোকের চলাফেরা, ইত্যাদি সবই যেমন অভিনব আমার কাছে, তেমনি চিত্তাকর্ষক।
এই সময় একজন নাবিক বলে উঠল, এই বারবিকিউ, একটা গান ধর তো, নইলে জমছে না!
পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বলল, সেই পুরানো গানটা, যেটা গাইতাম এককালে…
ঠিকই বলেছিস। গান গাওয়া দরকার এখন, রান্নাঘর থেকে ডেকে কখন বেরিয়ে এসেছে লঙ জন, দেখিনি। তার ক্রাচের আওয়াজও শুনিনি। লোকটা চলে ছায়ার মত নিঃশব্দে। তার আরেক নাম তাহলে বারবিকিউ!
গেয়ে উঠল সিলভার। চমকে উঠলাম আমি, ভীষণভাবে। এই গান, এই সুর আমার অতি পরিচিত। সিলভার শুরু করতেই তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কোরাস ধরল সবাইঃ মরা মানুষের সিন্দুকটায় চড়াও হল পনেরো নাবিক…। রেলিঙ ধরে দাঁড়ানো নাবিকেরা। ইয়ো হো হো কী মজা! বলার সময় রেলিঙে জোর ধাক্কা মারল। উত্তেজনা প্রকাশ পেল ওদের ভঙ্গিতে।
অ্যাডমিরাল বেনবোয় ভেসে গেল আমার কল্পনা। মনে হচ্ছে এই গায়কদের মাঝে ক্যাপ্টেন বোনসের কণ্ঠ শুনছি।
ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে আদেশ পেয়েই নোঙর তুলতে শুরু করল নাবিকেরা। বিচিত্র শব্দে ক্যাপস্টান-এ জড়াচ্ছে শিকল, পানি থেকে উঠে আসা অংশটুকু থেকে পানি গড়াচ্ছে। রেলিঙে পেট ঠেকিয়ে নিচে উঁকি দিলাম। ধীরে ধীরে নোনাপানির তলা থেকে উঠে এল তেমাথা নোঙরটা, আবছা ধূসর আলোয় মনে হল কোন দানবের বাকানো নখ উঠে আসছে আমাদের ভাগ্যকে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিতে। কেমন যেন ছম ছম করে উঠল গা।
পাল খাটানো হয়ে গেল। ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করল হিসপানিওলা। ডকের অন্যান্য জাহাজগুলোর কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসছে। পুবের আকাশে ধূসর আলোর আভাস। ক্রমেই হোট হয়ে আসছে জাহাজগুলো। আর দাঁড়াতে পারছি না, কিছুতেই খোলা থাকতে চাইছে না চোখের পাতা। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেবিনে গিয়ে ঢুকতে হল।
সেই দিনটা এবং তার পরের দিনও একঘেয়ে ভাবেই কেটে গেল। কোন নতুনত্ব নেই। চারদিকে কেবল পানি আর পানি। তীর থেকে যতই দূরে সরে যাচ্ছে হিসপানিওলা, পাখির সংখ্যাও কমতে লাগল। শেষ পর্যন্ত আর একটাকেও দেখা গেল।
জাহাজের পরিবেশে প্রথম নতুনত্ব আনল মেট অ্যারো। ক্যাপ্টেনের কথাই ঠিক, লোকটা মোটেও সুবিধের নয়। কাজকর্ম করতেই চায় না, খালি ফাঁকি দেয়ার তালে থাকে। নিজেকে মাঝিমাল্লাদের সমকক্ষ মনে করে, হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কিতে মেতে ওঠে ওদের সঙ্গে। প্রায় সারাক্ষণই মদ গিলে মাতাল হয়ে থাকে। এহেন লোককে দিয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারের কর্তব্য করানোর চেষ্টা বৃথা।
অ্যারোকে অনেক রকমে সাবধান করলেন ট্রেলনী, ছোটখাটো শাস্তিও দিলেন, কিন্তু ফল হল না। আরও বেশি উশৃঙ্খল হয়ে উঠল সে। মাতাল অবস্থায় একদিন ডেকে এসে দড়ির স্তুপ কিংবা অন্য কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে কপাল কাটল, পায়ের গোড়ালি মচকাল, দুএকজনের সঙ্গে মারপিটও বাধাল। ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে জোর করে শুইয়ে দিল নিজের বাংকে।
অ্যারোকে মদ সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দেবার আদেশ দিলেন ট্রেলনী, আদেশ পালনও করল সিলভার। কিন্তু কোন কাজই হল না। কোথা থেকে যেন ঠিকই মদ আসে অ্যারোর কাছে! মেটের ওপর লক্ষ্য রাখার ব্যবস্থা হল, কিন্তু রহস্যের সমাধান হল না। আগের মতই মদ খায়, মাতাল হয়ে থাকে অ্যারো, গোলমাল বাধায়। কোথায় মদ পায় সে, জিজ্ঞেস করলে কথা বলে না, শুধু হাসে। তার মাতলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মাঝিমাল্লারা। অ্যারোকে বেঁধে রাখার কথা ভাবলেন ট্রেলনী, কিন্তু তার দরকার হল না।
এক অন্ধকার ঝড়ের রাতে জাহাজ থেকে গায়েব হয়ে গেল মেট অ্যারো। কিন্তু এতে অবাক হল না কেউই। মাতাল অবস্থায় হয়ত খোলা ডেকে উঠে এসেছিল, রেলিঙের ধারে গিয়েছিল, ঝড়ো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছে পানিতে।
গম্ভীর মুখে বললেন ক্যাপ্টেন, আপদ গেছে। ভালই হয়েছে।
নামেমাত্র একজন ছিল এতদিন, এখন আর তা-ও রইল না, অথচ একজন মেট দরকার। কাজেই ভেবেচিন্তে সারেঙ জোব অ্যান্ডারসনকে এই পদ দেয়া হল। অবশ্য সারেঙের কাজও তাকেই করতে হবে। সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করে গেল অ্যান্ডারসন। তাকে সাহায্য করলেন ট্রেলনী। কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন অ্যাডমিরাল হবেন, কিন্তু আসলে ক্যাপ্টেন হবার যোগ্যতাও তার নেই। তবে সাগরে ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে প্রচুর। জাহাজের ছোটখাট অনেক কাজ বেশ ভালমতই চালাতে পারেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে এমনকি গার্ডের কাজ করতেও দ্বিধা করেন না।
পরিণত বয়স্ক, সাবধানী, চতুর এবং সাগর সম্পর্কে অভিজ্ঞ নাবিক ইসরায়েল হ্যান্ডস। কোন কাজের দায়িত্ব তার ওপর দিয়ে নির্ভর করা যায়। ইসরায়েলকে দারুণ পছন্দ সিলভারের, বিশ্বাসও করে খুব।
বাবুর্চি হিসেবে সিলভারের তুলনা হয় না। ধীরে ধীরে জানলাম, শুধু রান্নাই নয়, জাহাজের অনেক কাজই সে জানে। একটা পা নেই, তবু তার স্বচ্ছন্দ চলাফেরা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। জোর বাতাস বইলে সাগরে উথালপাতাল বড় বড় ঢেউ ওঠে, বাদামের খোসার মত দুলতে শুরু করে জাহাজটা। এই দুলুনির মাঝেই ক্রাচ বগলে চেপে ধরে খোলা ডেকে যেভাবে স্বচ্ছন্দে হাঁটে সিলভার, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
হিসপানিওলার নাবিকেরা বলে, সাধারণ মানুষ নয় বারবিকিউ। আমাদের মত অশিক্ষিতও নয়, ছেলেবেলায় ভালই লেখাপড়া শিখেছে। আর সাহস? না দেখলে বিশ্বাস করবে না, খোকা। সিংহের বিরুদ্ধেও খালি হাতে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি ওকে!
নাবিকেরা সবাই সম্মান করে সিলভারকে। আর আমি তো ভালইবাসতে শুরু করেছি। আমাকে দারুণ স্নেহ করে সে। জোর করে আমার হাত থেকে নিয়ে ডিশটিশগুলোও ধুয়ে দেয়। হাতে কাজ না থাকলে পুরানো দিনের গল্প শোনায়। একটা পোষা তোতাপাখি আছে তার। সেটা থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার রান্নাঘরের এক কোণে, খাঁচায়।
গল্প বলার সুযোগ পেলেই আমাকে ডাকে সিলভার, জিম, এসো, তোমাকে গল্প শোনাই। একদিন বলল, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে, জিম। আর ওই তোতাটাকেও ভালবাসি আমি। ওর নাম কি রেখেছি জানো? ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট। চমকে উঠলে? ওই জলদস্যুর নাম তাহলে তোমারও জানা। গুড, তোতাপাখিটার দিকে চেয়ে বলল সে। ক্যাপ্টেন, আমাদের অভিযান সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেছে সিলভার!
কথা বলে উঠল তোতা, পিসেস অভ এইট, পিসেস অভ এইট… বার বার এই কথাটাই আউড়ে গেল পাখিটা। খাঁচার গায়ে রুমাল ছুঁড়ে পাখিটাকে থামাল সিলভার।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পাখিটার বয়েস কত হবে, জিম? দুশো হলেও অবাক হব না। এরা নাকি অমর! আমার এই তোতাটা কিন্তু অনেক দেখেছে জীবনে। অনেক হাত ঘুরে শেষে আমার সম্পত্তি হয়েছে। বিখ্যাত জলদস্যু ক্যাপ্টেন ইংল্যান্ডের সঙ্গে জাহাজে জাহাজে ঘুরেছে। মাদাগাস্কার, মালাবার, সুরিনামা, প্রভিডেন্স, পোর্তোবেলোয় গিয়েছে। ডুবে যাওয়া একটা জাহাজ তুলতে দেখেছে একবার। ভেঙে যাওয়া জাহাজটায় সাড়ে তিন লাখ মুদ্রা ছিল। মুদ্রাগুলোকে পিসেস অভ এইট বলছিল নাবিকেরা। শুনেছে, ব্যস মুখস্থ করে বসে আছে! তোতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন, বারুদের গন্ধ পেয়েছ?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল পাখি, পালানোর জন্যে তৈরি থাক!
জন সিলভার আর তোতাটার মাঝে এই ধরনের কথাবার্তা দুর্বোধ্য ঠেকে আমার কাছে।
চমৎকার বলেছ হে, বলে পকেট থেকে চিনি বার করে খেতে দিল পাখিটাকে সিলভার। মাঝেমধ্যে খাঁচার শিক ঠোকরাতে ঠোকরাতে জঘন্য গালাগালি শুরু করে আজব পাখিটা, কোন কারণ ছাড়াই। আমি সামনে থাকলে লজ্জিত হাসি হাসে সিলভার, বদলোকের সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে তো, গালাগালিগুলোও দিব্যি রপ্ত করে বসে আছে! হায়রে কপাল! নিজের কপালে আলতো করে চাপড় মারে বাবুর্চি। নাহ্, লোকটা নেহায়েতই ভালমানুষ, মনে হয় আমার। পাখিটার গালাগালিও অভদ্রতা মনে হচ্ছে তার কাছে।
এদিকে ক্যাপ্টেন আর জাহাজের মালিক ট্রেলনীর মাঝে একটা বিরাট ফাঁক রয়েই গেছে। এব্যাপারে অবশ্য জমিদারের কোন মাথাব্যথা নেই, তার জাহাজ ঠিকমত চললেই হল। ক্যাপ্টেনও যেচে এসে কোন কথা বলেন না মালিকের সঙ্গে। ট্রেলনী কখনও কোন কথা জিজ্ঞেস করলে, কাটা কাটা জবাব দেন ক্যাপ্টেন। রেগে যান জমিদার। থমথমে মুখে পায়চারি করতে থাকেন সাড়া ডেকে। মাঝে মাঝেই মুখ তুলে তাকান এই সময় আকাশের দিকে। বিড়বিড় করে ওঠেন কখনও, ব্যাটাকে এবার তাড়াতে হবে! অসহ্য…
প্রচন্ড ঝড় উঠল একদিন। জাহাজটা দেখতে যেমনই হোক, তার গুণের পরিচয় পাওয়া গেল এই সময়। ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের মাঝে দোল খেল হিসপানিওলা, বাতাসের ঝাপটায় কাত হয়ে গিয়ে ডোবে ডোবে অবস্থা হল, কিন্তু ডুবল না। কোন ক্ষতিই হল না জাহাজের। সাংঘাতিক শক্ত কাঠামো।
জাহাজটা ভাল, এতদিনে স্বীকার করলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু মালিকের বাড়াবাড়ি আরও অসহ্য হয়ে উঠছে, এটাও জানালেন। অনিশ্চিত অভিযানে চলেছে হিসপানিওলা, কবে ফিরবে ঠিক নেই। এই অবস্থায় নাবিকদের প্রচুর মদ খাওয়ার অনুমতি দেয়া একেবারেই উচিত হয়নি ট্রেলনীর, ক্যাপ্টেনের ধারণা। আর কি জমিদারী ব্যবস্থা! দুদিন যেতে না যেতেই জাহাজসুদ্ধ লোককে দামি খাবার খাওয়ানোর ঘটা। ফলমূলের ব্যাপারে তো দরাজ ব্যবস্থার অন্তই নেই। বিশাল এক পিপে আপেল রেখে দেয়া হয়েছে ডেকে। যার যখন খুশি নিয়ে খেতে পারে, সেরকম নির্দেশ আছে ট্রেলনীর।
আর সবার মত আমিও ইচ্ছে হলেই পিপে থেকে আপেল নিয়ে খাই। সেদিন আপেল খেতে গিয়েই জেনে ফেললাম, কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে চলেছে।
স্বচ্ছন্দ গতিতে ভেসে চলেছে হিসপানিওলা। পালে জোর হাওয়া লেগেছে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ট্রেজার আইল্যান্ড চোখে পড়বে, আশা করছেন ক্যাপ্টেন। আমি, ডাক্তার লিভসী, স্কয়ার ট্রেলনী সবাই খুশি। নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছতে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ।
সূর্য অস্ত গেছে। ধূসর সন্ধ্যাকে গিলে খাওয়ার জন্যে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে রাতের অন্ধকার। সারাটা দিন খেটেছি, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে শরীর। সকাল সকালই শুতে যাবার ইচ্ছে। আগামী সকালে উঠেই হয়ত দেখতে পাব দ্বীপের গায়ে ভেড়ানো আছে জাহাজ। কর্মব্যস্ততা বাড়বে তখন। কাজেই আজ রাতে বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।
ডেকের ওপর দিয়ে নিজের বাংকে যাবার সময় পিপেটার ওপর চোখ পড়ল। একটা আপেল খেলে মন্দ হয় না। এগিয়ে গেলাম।
প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আপেল। বিশাল পিপের তলায় পৌঁছে গেছে একেবারে। হাত বাড়িয়ে নাগাল পেলাম না আমি। খেতে হলে পিপের ভেতরে নামতে হবে আমাকে। ঢুকেই পড়লাম। ওখানে বসেই খেলাম একটা আপেল। তারপর তুলে নিলাম আরও একটা। এই সময় কে একজন এসে ধপ করে বসল পিপের গায়ে হেলান দিয়ে। আরও পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সব কজনই এগিয়ে এসে বসে পড়েছে পিপেটার কাছে। বেরিয়ে আসব, এমনি সময় কথা বলে উঠল সিলভার। যা বলল, শুনে চমকে গেলাম। বসে পড়লাম আবার। দুরু দুরু করতে লাগল বুক। কান পেতে শুনতে লাগলাম ওদের কথা।
১১. পিপের ভেতরে বসে শোনা কথা
না না, আমি না। ফ্লিন্ট ছিল ক্যাপ্টেন, সিলভারের গলা শোনা গেল। আমি ছিলাম কোয়ার্টার মাস্টার। সেবারই পা হারিয়েছি আমি। পিউ হারিয়েছিল চোখ…
তার মানে ফ্লিন্টই ছিল সর্দার? একজন প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, বলল সিলভার। ভয়ঙ্কর লোক ছিল। তার দলের সবাই ছিল তারই মত বেপরোয়া, নিষ্ঠুর, খুনী। ওই পিউ ছিল ফ্লিন্টের সহকারী। অথচ দেখ, পিউ, এমনকি ফ্লিন্টও আমাকে পরোয়া করে চলত। ভয়ে ভয়ে থাকত সারাক্ষণ, কখন,আবার ফ্লিন্টকে খুন করে তার সর্দারি নিয়ে নিই। কিন্তু সেরকম কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। সর্দার হলেই ঝামেলা বাড়ে। তারচেয়ে এমনিতেই যখন সবাই সমঝে চলত আমাকে, কেন খামোকা ঝুঁকি নিতে যাই?
তোমার নাম শুনেছি আগেই, বলল আগের লোকটা। জাহাজে সবচেয়ে কম বয়েসী নাবিক সে। জলদস্যুর দলে ছিলে, তা-ও শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এতদিন।
এখন তো জানলে? এগিয়ে গেল সিলভার। এসো, হাত মেলাও।
বুঝলাম, এই অল্পবয়েসী নাবিকটি আগে ডাকাতদলে ছিল না, কিন্তু আজ থেকে তাকে নিজের দলে টেনে নিল জন সিলভার।
খুব ভাল, ডিক, নাবিকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল অন্য একজন। গলা শুনেই বুঝতে পারছি, ইসরায়েল হ্যান্ডস। আমাদের দলে এসে ভাল করেছ। এই নাবিকগিরি করে আর কয় পয়সা কামাতে? এখন ঠিকমত কাজটা উদ্ধার করতে পারলেই টাকার বিছানায় ঘুমাবে, সিলভারকে বলল, তা বারবিকিউ, আর কতদিন? ক্যাপ্টেন ব্যাটাকে আর সহ্য করতে পারছি না। এভাবে কদিক থাকব আর?
তোমার মাথায় গোবর পোরা, বরাবরই বলে এসেছি, বিরক্ত শোনাচ্ছে সিলভারের গলা। টাকা কি ছেলের হাতের মোয়া, চাইলেই পেয়ে যাবে? সহ্য করতে হবে। দেরি আছে এখনও…
কেন, দেরি কেন? দ্বীপটা তো এসে গেল…
দেরি এই জন্যে, তোমরা কেউ জাহাজ চালাতে জানো না। ওই অসহ্য ক্যাপ্টেনটাকেই সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এখন তো বটেই, ফিরতি পথেও দরকার হবে স্মলেটকে। তাছাড়া, গুপ্তধনের নকশাটাও তো এখনও হাতে পেলাম না। আমি জানি, ট্রেলনী কিংবা ডাক্তার, এদের কারও কাছেই আছে ওটা। এখুনি চোটপাট শুরু করলে বলা যায় না, নকশাটা ধ্বংস করে ফেলতে পারে ওরা। সেক্ষেত্রে সবই মাটি।
নকশার ব্যাপারটা নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন? ওকে কেন দরকার হবে? আমরা জাহাজ চালাতে পারি না কে বলল? নাবিক নই আমরা? এখন কে চালাচ্ছে, শুনি?
তোমরা গতরে খাটছ শুধু, ব্রেনটা ক্যাপ্টেনের। হিসেব জানো? ম্যাপ দেখে বলে দিতে পারবে কোথায় আছ এখন? বলতে পারবে কয়েক ঘন্টা পর কোনদিকে বইবে বাতাস, কতটা জোরে? পারবে না। এজন্যে লেখাপড়া জানা দরকার। জাহাজের হাল ধরা, দাঁড় বাওয়া কিংবা পাল খাটানোর কাজে তোমাদের জুড়ি নেই, কিন্তু পুরো একটা জাহাজকে কন্ট্রোল? সেটা তোমাদের দিয়ে হবে না।
কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি?
এই জন্যেই বলেছিলাম। মাথায় গোবর পোরা আছে। জীবনে অনেক দেখেছি আমি, অনেক ভুগেছি। জাহাজে করে দুর্গম সাগর পাড়ি দিয়েছি, পাহাড়ে চড়েছি, মরুভূমি পেরিয়েছি। অনেক, অনেক লোক দেখেছি, তারা কেউ বোকা, কেউ বা বুদ্ধিমান। অনেক বুদ্ধিমানকে দেখেছি, সামান্যতম ভুলের জন্যে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ভুল কি করেছে জানো? তাড়াহুড়া। কাজেই সাবধান!
কিন্তু একটু রাম খেয়ে হৈ-হুল্লোড়ও করতে পারি না, কুত্তার মত এসে ঘেউ ঘেউ শুরু করে স্মলেট। ব্যাটার ঘাড় ধরে পানিতেই ফেলে দেব একদিন! গজগজ করে উঠল ইসরায়েল।
আরেকটা জিনিস এই রাম! ইসরায়েলের কথায় কান দিল না সিলভার। পিউয়ের কি কম টাকা ছিল? অথচ ভিখিরি হয়ে মরেছে। কেন জানো? রাম গিলে গিলে। ফ্লিন্টের মৃত্যুর কারণও ওই রাম!
তাহলে কি করব আমরা এখন? জানতে চাইল কম বয়েসী নাবিক ডিক।
আপাতত কিছুই না। চুপচাপ শুধু দেখে যাব। জাহাজ দ্বীপে ভেড়াবে ক্যাপ্টেন, নকশার সাহায্যে গুপ্তধন খুঁজে বার করবে ডাক্তার আর ট্রেলনী, তারপর শুরু হবে আমাদের কাজ। প্রথমেই ট্রেলনী আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের খতম করে ফেলব। আমাদের হয়ে জাহাজটাকে আবার নিরাপদ কোন জায়গায় নিয়ে যাবে স্মলেট, এমন কোথাও, যেখান থেকে সহজেই কেটে পড়তে পারি আমরা। সেই সময়, বুঝলে, সেই সময়…
মুন্ডটা ছিড়ে নেব আমি ব্যাটার…
নিও, বলল সিলভার।
ডাকাতদের কথা শুনে বুক কাঁপছে আমার। বুঝতে পারছি, একপেয়ে নাবিক বলতে লঙ জন সিলভারের কথাই বলেছিল বোনস। কি পরিমাণ বিপদে পড়েছি, অনুমান করে আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছে আমার।
এই সময় আবার শোনা গেল সিলভারের কথা, যাক, অনেক তো কথাবার্তা হল। এই ডিক, কয়েকটা আপেল বার কর না পিপে থেকে, খাই।
কাঠ হয়ে গেলাম। আর রক্ষে নেই। এখুনি আমাকে খুন করে পানিতে ফেলে দেবে ডাকাতেরা। উঠে পিপে থেকে বেরিয়ে দৌড় দেবার কথা ভাবছি, এমন সময় বলে উঠল ইসরায়েল, আপেল টাপেল খেয়ে এখন কাজ নেই। তারচে কিছু রাম নিয়ে এসো, মৌজ করি!
ঠিক আছে, বলল সিলভার। এই নাও চাবি। রান্নাঘরের দেরাজে তালা দেয়া আছে। বের করে নিয়ে এসো।
মেট অ্যারোকে কে মদ সরবরাহ করত, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না আর। চেষ্টা করেও হয়ত নিজের দলে তাকে টেনে নিতে পারেনি সিলভার। চালাকি করে অ্যারোর মাতলামিকে কাজে লাগিয়েছে তখন। অন্ধকার ঝড়ের রাতে ঠেলে ফেলে দিয়েছে তাকে জাহাজ থেকে।
রাম নিয়ে এল ডিক। ফ্রিন্টের স্মরণে আর নিজেদের স্বাস্থ্য কামনা করে মদ গিলতে লাগল ডাকাতগুলো।
পিপের ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠছে। চাঁদের আলোয় বেরিয়ে যে পালাব সে উপায়ও আর নেই এখন। দস্যুদের নজরে পড়ে যাব।
কি করব ভাবছি, এই সময় শোনা গেল চিৎকার, ডাঙা, ডাঙা!
১২. যুদ্ধ-আলোচনা
লাফিয়ে উঠে পড়ল ডাকাতেরা। ছুটোছুটি শুরু করে দিল। যার যার জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। এই সুযোগে টুক করে বেরিয়ে এলাম পিপে থেকে। ছুটলাম জাহাজের পেছনে। ডাক্তার লিভসী আর হান্টারের দেখা পেলাম ওখানেই।
একে একে অনেকেই এসে জড়ো হল সেখানে। ছোট্ট মেঘের আড়ালে ঢুকে গিয়েছিল চাঁদ, লুকোচুরি খেলে যেন বেরিয়ে এল আবার। দূরে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে কালো মেঘের মত দেখা গেল দ্বীপটা।
স্বপ্নের ঘোরে আছি যেন এখনও। মাত্র দুই মিনিট আগে শোনা ডাকাতদের কথাগুলো এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে মনকে। দুঃস্বপ্নের মাঝেই যেন শুনতে পেলাম ক্যাপ্টেন স্মলেটের গলা! জাহাজের মুখ কোনদিকে ফেরাতে হবে নির্দেশ দিচ্ছেন সারেঙকে। দ্বীপের পুব দিকে নিয়ে গিয়ে জাহাজ ভেড়ানোর ইচ্ছে তাঁর।
এর আগে দ্বীপটা দেখেছ কেউ? উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
আমি দেখেছি, বলল জন সিলভার। একটা সদাগরী জাহাজের বাবুর্চি ছিলাম তখন। নিতান্ত দুর্ঘটনার জন্যেই এই দ্বীপে জাহাজ ভেড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন।
ম্যাপে দেখলাম, দ্বীপের পেছনে একটা উপদ্বীপে জাহাজ ভেড়ানোই নিরাপদ। জানো কিছু?
ঠিকই দেখেছেন। ওই উপদ্বীপটার নাম স্কেলিটন আইল্যান্ড। জলদস্যুদের আড্ডা ছিল ওটা। এর উত্তরে একটা পাহাড় আছে, ফোরমাস্ট হিল বলে ওটাকে। প্রধান দ্বীপটার এক প্রান্তে, সাগরে নেমে যাওয়া পাহাড়ের নাম স্পাই-গ্লাস। উঁচু পাহাড়, ওখান থেকে ডাকাতেরা চারদিকের সাগরের দিকে লক্ষ্য রাখত। নামটা ওই জন্যেই হয়েছে।
একটা ম্যাপ আছে আমার কাছে, বলতে বলতে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন ক্যাপ্টেন। একজন নাবিকের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, এই, একটা ল্যাম্প নিয়ে এসো তো।
লণ্ঠনের আলোয় ম্যাপটা দেখল সিলভার। কাছে সরে এসেছি আমি। দেখলাম, চোখ দুটো চকচক করছে ডাকাতটার। বোনসের সিন্দুকে পাওয়া ম্যাপ নয় এটা, তবে তার অবিকল নকল। নকলটা করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই জমিদার ট্রেলনী। সাঙ্কেতিক কথাগুলো লেখা হয়নি, আর লাল কালির ক্রস চিহ্নগুলোও দেয়া হয়নি এই নকলটাতে। জাহাজ চালাতে দরকারও নেই ওগুলোর।
বল তো এখন, সিলভারকে বললেন ক্যাপ্টেন। এই ম্যাপটা ঠিক আছে?
ঠিকই আছে, ঘাড় কাত করে বলল সিলভার। শুধু আমি বুঝলাম, হতাশ হয়েছে সে। নতুন কাগজ দেখে ঠিকই বুঝেছে, বিলি বোনসের সিন্দুকে পাওয়া ম্যাপ নয় এটা। মুখে বলল, চমৎকার ম্যাপ। পরিষ্কার দেখানো আছে সবকিছু। ম্যাপের এক জায়গায় আঙুল রেখে বলল, এই যে, এই জায়গাটাকে ওরা বলত ক্যাপ্টেন কিডের অ্যাঙ্কোরেজ। দক্ষিণ ঘেঁষে বইছে প্রবল স্রোত। চলতে চলতে পশ্চিম তীরের ওদিক থেকে এগিয়েছে উত্তরে। এদিক দিয়ে এসে, ভালই করেছেন ক্যাপ্টেন, দ্বীপে নামতে এদিক দিয়েই সবচেয়ে সুবিধে।
ধন্যবাদ। যাও এখন। দরকার হলে ডাকব আবার, বললেন ক্যাপ্টেন।
ট্রেজার আইল্যান্ড সম্পর্কে সিলভারের জ্ঞান সত্যিই বিস্মিত করল আমাকে। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল সে। ধক করে উঠল বুক। মৃদু হেসে আমার কাঁধে হাত রাখল সিলভার। মাঝে মধ্যেই এভাবে আমাকে আদর করে সে। আজ কিন্তু গা-টা ঘিন ঘিন করে উঠল আমার। দারুণ ভন্ড এই লোকটার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন। কিন্তু তবু কাঁধের ওপর থেকে সিলভারের হাতটা সরিয়ে দিতে সাহস হল না। যদি কিছু সন্দেহ করে বসে?
চমৎকার দ্বীপ ওটা, জিম, বলল সিলভার। ঝর্না কিংবা সাগরের টলটলে পানিতে গোসল করবে, বুনো ফল খাবে, ছাগল শিকার করবে, আর ছাগলের মতই ঘুরে বেড়াবে পাহাড়ে-জঙ্গলে। ইসস, আবার যদি তোমার বয়েসে ফিরে যেতে পারতাম! অন্তত পা দুটো ঠিক থাকলেও চলত! হ্যাঁ, যদি দ্বীপের ভেতরে কোথাও যাও, সারা দিনের খাবার নিয়ে যেও আমার কাছ থেকে।
অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে ক্রাচে ভর দিয়ে চলে গেল সিলভার।
জাহাজের পেছন দিকে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কথা বলছেন ট্রেলনী আর ডাক্তারচাচা। কাছেপিঠে আর কেউ নেই, সবাই চলে গেছে যার যার কাজে। এগিয়ে গেলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে সাবধানে বললাম, ডাক্তারচাচা, কথা আছে। ক্যাপ্টেন আর জমিদারচাচাকে নিয়ে কেবিনে যান। কোন ছুতোয় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি আমরা! আমি যাই, রান্নাঘরেই থাকব।
মিনিট কয়েক পরেই আমার ডাক এল। কেবিনে গিয়ে দেখলাম, টেবিল ঘিরে বসে আছেন জমিদার, ডাক্তারচাচা আর ক্যাপ্টেন। টেবিলে রাখা এক বোতল স্প্যানিশ মদ আর একটা পাত্রে কিছু কিসমিস। ওগুলোর দিকে খেয়াল নেই কারও। সমানে পাইপ টেনে চলেছেন ডাক্তারচাচা। পরচুলাটা খুলে রেখে বসেছেন জমিদার। পেছনে, খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে চাঁদ দেখছেন ক্যাপ্টেন।
বলে ফেল, জিম, আমাকে দেখেই বললেন জমিদার।
দরজার কাছে গিয়ে বাইরেটা একবার ভাল করে দেখে এলাম। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সংক্ষেপে বললাম সব। আমার কথা শেষ না হওয়ার পর্যন্ত টু শব্দটি করলেন না কেউ। চুপচাপ শুনে গেলেন।
আমার বলা শেষ হলে নড়েচড়ে উঠলেন ডাক্তারচাচা। বোতল থেকে মদ ঢেলে এগিয়ে দিলেন জমিদার আর ক্যাপ্টেনের দিকে। নিজেও নিলেন এক গেলাস। এক মুঠো কিসমিস তুলে বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে। নিলাম।
আমার স্বাস্থ্য কামনা করে গেলাসে চুমুক দিলেন তিনজনেই। কয়েকটা কিসমিস মুখে পুরে দিলাম আমি।
মাপ করবেন আমাকে, ক্যাপ্টেন স্পলেট, বললেন জমিদার। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। আমিই আসলে গাধা। তা এখন কি করা যায় বলুন তো?
আমিও কম গাধা নই, বললেন ক্যাপ্টেন। নাবিকদের দলপতি, অথচ দলের লোক কে কেমন বুঝতে পারিনি। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি বিদ্রোহ ঘটবে জাহাজে। ইস, এক্কেবারে ছাগল বানিয়ে ছেড়েছে ওরা আমাকে!
অসামান্য লোক ওই জন সিলভার! বললেন ডাক্তারচাচা, জলদুস্য, কিন্তু কি আশ্চর্য সংগঠন ক্ষমতা!
লোকটাকে সামান্যতম সন্দেহ করলাম না আমি! বললেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু শুধু এসব আলোচনায় তো কাজ হবে না। কিছু একটা করতে হবে আমাদের এবং শীঘ্রি।
আপনি জাহাজের ক্যাপ্টেন, এতদিনে পথে এসেছেন জমিদার। যা ভাল বোঝেন করুন।
আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, বললেন ক্যাপ্টেন। যেমন যাচ্ছি, ঠিক তেমনি। ডাকাতদের বুঝতে দিলে চলবে না, ওদের আসল রূপ জেনে গেছি আমরা। বোঝা যাচ্ছে, গুপ্তধন না পাওয়া পর্যন্ত আপনাদের খুন করবে না ওরা। আমার ওপর হাত তুলবে আরও পরে। কাজেই কিছুটা সময় আমাদের হাতে আছে। তবে আগে হোক পরে হোক, ওদের সঙ্গে লাগতেই হবে আমাদের। এখানে আমরা বারোজন, এছাড়াও আরও তিনজন আছে আমাদের পক্ষে মিস্টার ট্রেলনীর সঙ্গে যারা এসেছে আর কি। আমরা সংখ্যায় কম, কাজেই আমাদেরকেই আগে আক্রমণ চালাতে হবে। জমিদারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন, মিস্টার ট্রেলনী, আপনার লোক তিনজনের ওপর নির্ভর করা যায়?
নিশ্চিন্তে, বললেন জমিদার। তার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেনের কথার ভঙ্গি থেকেই বুঝে নিলেন।
তাহলে ওরা তিনজন, আর আমরা এই চারজন—অবশ্য জিমকে একজন ধরলে আর কি, হলাম গিয়ে সাতজন। আক্রমণ আমরাই আগে করব, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত চোখ রাখতে হবে ডাকাতদের ওপর। ওদের মতিগতি জানার জন্যে একজন স্পাই দরকার আমাদের। জিমই এই কাজ ভাল পারবে। চটপটে ছেলে, তাছাড়া দলের নেতা সিলভারের সঙ্গে তার দারুণ ভাব। পারবে তো, জিম?
মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম।
সাবধান, জিম! আমাকে হুঁশিয়ার করলেন ডাক্তারচাচা। গুপ্তচরের কাজ কিন্তু সাংঘাতিক কঠিন! মারাত্মক ঝুঁকির কাজ!
তোমার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, জিম… বললেন ট্রেলনী।
অস্বস্তি বোধ করছি। এত বড় বড় লোক আমার ওপর নির্ভর করছেন। নিজেকে অত্যন্ত অসহায় মনে হল। আগামী বিপদের কথা মনে করে বুক কাঁপছে। হিসপানিওলায় এখন মোট লোকের সংখ্যা ছাব্বিশ। তাদের উনিশ জনই বিদ্রোহী। এতগুলো খুনে ডাকাতের বিরুদ্ধে কদিন টিকে থাকতে পারব আমরা?
১৩. দ্বীপে নামলাম
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম বিছানা থেকে উঠেই চলে এলাম ডেকে। রাতের বেলা অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে হিসপানিওলা, দ্বীপের দক্ষিণ-পুবে নিচু তীরের প্রায় আধ মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে।
ভালমতই চোখে পড়ছে এখন দ্বীপটা। বেশির ভাগই ধূসর জঙ্গলে ছাওয়া। নিচু জমিতে ইতস্তত ছড়ানো বালিয়াড়ির হলদে রঙ কিংবা বনের মাথা ছাড়ানো তালজাতীয় বড় বড় গাছের জন্যে এই ধূসরতা কোথাও কোথাও ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু সেটা খুব বেশি জায়গায় নয়। কেমন যেন হতাশা জাগায় মনে এই রঙ। পাথুরে পাহাড় চূড়া বিশাল গাছেরও মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে উঠে গেছে। সবচেয়ে উঁচু পাহাড় স্পাই গ্লাস, সিলভার ঠিকই বলেছে, সাগর-সমতল থেকে হাজার চারেক ফুট উঁচু। মস্ত ছুরি দিয়ে কুচ করে কেটে নিয়েছে যেন কেউ খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়টার চূড়া।
তীরে আঘাত খেয়ে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছে বড় বড় ঢেউ। দুলে দুলে উঠছে হিসপানিওলা। জাহাজের এখানে-ওখানে যেখানেই কাঠের জোড়ায় সামান্যতম ফাঁক আছে, কিংবা নড়বড়ে হয়ে গেছে পেরেকের গাঁথুনি, সেখানেই বিচিত্র ক্যাচকোচ শব্দ উঠছে প্রচন্ড দুলুনিতে। ছলাৎ-ছল ছলস করে ঝাপটা মারছে ঢেউ জাহাজের কাঠের খোলসে। সব মিলিয়ে একটা আজব আর্তনাদ ছড়াচ্ছে। দুলুনির চোটে মাথা ঘুরছে আমার। ডেকের রেলিঙ চেপে ধরে কোন মতে সামলে রেখেছি নিজেকে। দুরন্ত ঢেউয়ে এমন দুলুনিতে এই প্রথম পড়েছি তো, কেমন যেন অসহ্য ঠেকছে। তার ওপর খালি পেট, নাড়িভুড়িসুদ্ধ যেন বেরিয়ে আসবে এমনি মোচড় মারছে পেট।
কিন্তু তবু ডেক ছেড়ে যেতে মন চাইল না। সূর্য উঠেছে সবে। সোনালি হয়ে উঠেছে বনের শিশির ঢাকা গাছপালার মাথায় পাতার চাঁদোয়া। পাখপাখালির কলকাকলি এত দূর থেকেও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তবু কেন যেন বনের বিষণ্ণ ভাবটা কাটছে না। পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণি আর ফেনার সৃষ্টি করেছে লোনা পানি। কে জানে, হয়ত এই দৃশ্যই আমার মনে জলদস্যদের চিন্তার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, আর এই জন্যেই প্রকৃতির এমন চোখ জুড়ানো রূপও বিস্বাদ ঠেকছে আমার চোখে।
হিসপানিওলায় নতুন আরেক দিন শুরু হয়েছে। সামনে প্রচুর কাজ। বাতাসের চিহ্নমাত্র নেই। মাইল তিন-চার ঘুরে খাঁড়ি ধরে গিয়ে স্কেলিটন আইল্যান্ডে নোঙর ফেলবে জাহাজ, কিন্তু তার আগেই নৌকাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নামাতে হবে।
ক্রমেই ওপরে উঠছে সূর্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রচন্ড গরম। এই সকালেই দর দর করে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে আমার কপাল বেয়ে।
নাবিকেরা পরিষ্কার করল নৌকাগুলো। পুলিতে আটকানো দড়িতে বেঁধে নিচে নামাল। কয়েকজন নাবিক গিয়ে উঠল কয়েকটা নৌকায়। আমাকে নৌকায় ওঠার আহ্বান জানাল একজন। এগিয়ে গেলাম। আমি নৌকায় নামতে না নামতেই কোথায় যেন কি একটু ভুল হল, গালাগাল দিয়ে উঠল অ্যান্ডারসন নামে এক নাবিক।
লক্ষণ খারাপ। এতদিন সবাই একটা বিশেষ নিয়মে বাঁধা ছিল, কিন্তু দ্বীপে পৌঁছতে না পৌঁছতেই কেমন যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে নাবিকেরা। অথচ জাহাজের গায়ে এখনও নৌকাগুলো বাঁধাই আছে। হালের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে জন সিলভার। বাবুর্চির কাজ নয় এটা, কিন্তু দ্বীপটা সিলভারের চেনা বলে তাকেই পথ দেখাতে আদেশ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সিলভার।
খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে জাহাজ। নিচে নৌকায় থেকেই শুনতে পেলাম সিলভারের গলা, ভাটায় টান পড়েছে। এখন তো যাচ্ছে, কিন্তু আগে কিছুতেই এখান দিয়ে ঢুকত না জাহাজ। কোদাল দিয়ে কেটে গভীর করা হয়েছে এই পথ।
ম্যাপে দুটো প্রাকৃতিক বন্দর দেখানো আছে। একটা বন্দরের কাছে নিয়ে আসা হল জাহাজ। জায়গাটার এক দিকে দ্বীপের মূল ভূখন্ড, অন্যদিকে স্কেলিটন আইল্যান্ড। দুটোই এখান থেকে সমান দূরে। কাচের মত স্বচ্ছ এখানে পানি, তলাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। চমৎকার বালি বিছানো।
নোঙর নামানোর আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। শেকলের বিচ্ছিরি কিচকিচ শব্দে কাছের গাছপালার শাখা থেকে উড়াল দিল ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। ওগুলোর চিৎকারে শেকলের শব্দ ঢেকে গেল। নোঙর নামানো শেষ হতেই আবার একে একে গিয়ে গাছে বসে পড়ল। থেমে গেল কোলাহল।
পানির কিনারে নেমে এসেছে গাছপালা। জোয়ারের পানি কতটা উঠে, সীমানা মেপে দিয়েছে যেন। অসংখ্য সরু সরু খাল ঢুকে গেছে বনের ভেতরে।
ম্যাপে দেখানো আছে, বনের ভেতরে এদিকেই কোথাও দুর্গ আছে একটা, কিন্তু গাছপালার জন্যে চোখে পড়ছে না। কেমন যেন একটা আদিম ছাপ রয়েছে এখানকার গাছপালা পাহাড় জঙ্গল সাগরে। ম্যাপটা না থাকলে ঠিক মনে করতাম, এই এলাকায় এই প্রথম মানুষের পা পড়ল।
বাতাস একেবারেই বন্ধ। কোলাহলমুখর প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বেলাভূমিতে কিংবা পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়া ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কেমন একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে, পাতা আর গাছের গুড়ি পচলে যেমন হয়।
শুধু নোঙরের ওপর ভরসা করা গেল না। তীরের একটা বড়সড় গাছের কাছে নৌকা নিয়ে গেল অ্যান্ডারসন। কাছির এক মাথা শক্ত করে গাছের সঙ্গে বেঁধে অন্য মাথা বেঁধে দেয়া হল জাহাজের ডেক সংলগ্ন একটা মোটা খুঁটিতে। জোয়ার এলে যেন ভেসে যেতে না পারে জাহাজ এর জন্যেই এই ব্যবস্থা।
জাহাজে ফিরে এলাম আবার। ডেকের রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছেন ডাক্তারচাচা, মুখচোখ বিকৃত। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, গুপ্তধন কি আছে আছে ঈশ্বরই জানে, কিন্তু এখানে রোগ ছড়াবার উপকরণ আছে প্রচুর!
নাবিকদের ব্যবহার ক্রমেই আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে। যে-কোন সামান্য ব্যাপারেও মেজাজ দেখাচ্ছে ওরা। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মানতে চাইছে না কেউ। বিদ্রোহের চাপা আগুন জ্বলছে ভেতরে ভেতরে। যে কোন মুহূর্তে দাউ দাউ করে বেরিয়ে আসবে লকলকে শিখা।
দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লঙ জন। এখুনি যাতে কেউ কিছু না করে বসে এই জন্যে বোঝাচ্ছে নাবিকদের। রান্নাঘরের কাজ বাদ দিয়ে ক্রাচ বগলে চরকির মত পাক খাচ্ছে সারা ডেকে। চূড়ান্ত ভদ্রতা দেখাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার সহযোগিতার অন্ত নেই।
সকাল তো গেছেই, দুপুরও গেল প্রচন্ড চাপা উত্তেজনার মাঝে। এল বিকেল। প্রকট হয়ে উঠল কেমন এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা। আমাদের চেয়েও যেন বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে জন সিলভার।
কেবিনে আমাদের সভা বসল। আমাদের মানে, আমি, ডাক্তারচাচা, জমিদার ট্রেলনী, ক্যাপ্টেন স্মলেট, হান্টার, জয়েস আর রেডরুথ এই সাতজন।
কি করা যায়, জমিদারের এই প্রশ্নের জবাবে বললেন ক্যাপ্টেন, আপাতত কিছু করার নেই। নাবিকদের যে-কোন খারাপ ব্যবহার এখন সহ্য করতে হবে মুখ বুজে। এমনিতেই খেপে আছে ওরা, বারুদে আগুনের ফুলিঙ্গ ছোঁয়ানো যাবে না কিছুতেই। যেকোন মুহূর্তে যা খুশি করে বসতে পারে ওরা এখন। বিদ্রোহ দমন করতে পারে এমন একটা লোকই আছে এখন জাহাজে।
কে সে? জিজ্ঞেস করলেন জমিদার।
লঙ জন সিলভার। ওই একপেয়ে লোকটাই শুধু দমন করে রাখতে পারবে নাবিকদের।
কিন্তু হঠাৎ এমন পাগল হয়ে উঠল কেন ওরা?
ওরা ভাবছে, সারাটা দ্বীপে ছড়িয়ে আছে শুধু সোনা আর সোনা। আসলে দ্বীপে নেমে যেতে চাইছে ওরা। কার আগে কে ধনরত্ন কুড়িয়ে নেবে এই ভাবনা। ওদেরকে এখন নামতে দেয়াই উচিত। সবাই নামবে না অবশ্যি। কিন্তু যারা নামবে তারা খালি হাতে ফিরে এলেই সবার মাথা ঠান্ডা হবে। কোন ছুতো দেখিয়ে ওদের দ্বীপে নামার নির্দেশ দিই, কি বলেন, স্যার?
জমিদার আর ডাক্তারচাচার দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেনের কথাই মেনে নেয়া হল। আমাদের সাতজনকেই একটা করে গুলিভরা পিস্তল দিলেন ক্যাপ্টেন। মীটিঙ শেষ হল।
ডেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন না, খানিকক্ষণ খামোকই ঘুরলেন সারা ডেকে! নাবিকদের বোঝাতে চাইলেন, প্রচন্ড গরমে অস্বস্তি বোধ করছেন। তারপর একজন নাবিককে ডেকে বললেন অন্যদেরকে ডেকে নিয়ে আসতে। এল সবাই। কারও মুখ গোমড়া, কেউ বা গজ গজ করছে।
বললেন ক্যাপ্টেন, সাংঘাতিক গরম পড়েছে আজ! জাহাজে তো টিকতেই পারছি। এক কাজ কর, দ্বীপে নেমে বেড়িয়ে এস খানিকক্ষণ। গাছপালার ছায়ায় অনেক ঠান্ডা। শোনো, সূর্য ডোবার আধঘন্টা আগে ব্লাঙ্ক ফায়ার করব আমি। শব্দ শুনলেই কিন্তু চলে আসবে আবার। কি, যাবে?
সমস্বরে প্রচন্ড চিৎকার করে উঠল নাবিকেরা, আনন্দে। নিমেষে বিরক্তিভাব দূর হয়ে গেল ওদের চেহারা থেকে। পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে উনিশজন লোকের সম্মিলিত জোরালো চিৎকার। আবার গাছের ছায়া ঢাকা ডাল ছেড়ে আকাশে উঠে গেল পাখির দল। পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে আর চেঁচাচ্ছে ওরা।
কেউ কেউ গিয়ে রেলিঙ টপকেছে, নৌকায় নামবে। ধমকে তাদের ফেরাল সিলভার। সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে ফিরে এলেন বুদ্ধিমান ক্যাপ্টেন। নাবিকদের দলপতি সিলভার, এটা তিনি জেনেও না জানার ভান করছেন যতটা সম্ভব। সবাই যেতে চাইছে দ্বীপে, কিন্তু বারণ করল সিলভার। ঠিক হল, সিলভারসহ তেরোজন যাবে, বাকি ছজন থেকে যাবে জাহাজে। রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে সবই দেখলাম, শুনলাম আমি।
দুর্বুদ্ধিটা মাথায় ঢুকল এই সময়ই। সিলভার তো যাচ্ছে, আমিও যাই না কেন সঙ্গে? আড়ালে লুকিয়ে ওরা কি বলাবলি করে শুনব? আশা করছি সিলভার আমাকে সঙ্গে নেবে।
এগিয়ে গিয়ে সিলভারকে জানালাম আমার ইচ্ছে। সানন্দেই রাজি হল সে।
একে একে নৌকায় নেমে গেলাম সবাই। সিলভারের নৌকায় উঠলাম আমি। মরা মানুষের সিন্দুকটায়… সমস্বরে গান ধরল ডাকাতেরা, দাঁড় বাইতে লাগল সমান তালে। আমাদের নৌকাটা তীরের ঘাট ছুঁতে না ছুঁতেই লাফিয়ে নেমে পড়লাম। নৌকা থেকে চেঁচিয়ে উঠল সিলভার। কিন্তু তার সমস্ত সাবধান বাণীকে আগ্রাহ্য করে ছুটে ঢুকে পড়লাম ঘন গাছপালার অরণ্যে।
১৪. প্রথম আঘাত
জনবসতিশূন্য দ্বীপ। জীবনে এই প্রথম অজানা অচেনা এলাকায় ঘোরার রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। পেছনে নাবিকদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে চললাম। কতগুলো গাছ দেখতে ওকের মত, কিন্তু আসলে ওক নয় ওগুলো। পাতাগুলো অনেকটা উইলোর মত। অজানা ফুলের গন্ধ বাতাসে। ডালে ডালে বিচিত্র রঙের, বিভিন্ন আকারের পাখি, তদের কিচির মিচিরে মুখরিত হয়ে আছে বনের ভেতরটা। চলতে চলতে মৃদু হিসস শব্দে চোখ মেলে চাইলাম। গাছের কোটর থেকে মাথা বের করে আছে একটা সাপ। চোখে সন্দেহ নিয়ে আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখল সাপটা। তারপর আস্তে আস্তে আবার কোটরের ভেতর গুটিয়ে নিল নিজেকে।
হঠাৎই বেরিয়ে এলাম জঙ্গল থেকে। একখন্ড ফাঁকা জায়গা। লম্বায় মাইল খানেক হবে, প্রস্থে সামান্য কম। চিকচিকে বালিতে ঢাকা। ওপরটায় ছোট ছোট ঢেউ খেলানো। সাগরের তলা থেকে দ্বীপটা জেগে ওঠার পর প্রথম প্রথম নিশ্চয় জোয়ারের পানি পৌঁছত এখানে। চিকচিকে বালির ওপারে একটা পাহাড়, সাদা পাথরে ছাওয়া চূড়ায় ঝলমল করছে বিকেলের রোদ। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করলাম প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ।
আবার এসে ঢুকলাম বনে। মোড় নিয়ে ফাঁকা অঞ্চলটুকুকে পাশে রেখে এগিয়ে চললাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নাম না জানা গাছের এক বিশাল ঝোপের কাছে। ঝোপের নিচে মাটি নয়, বালি। হয়ত অনেক নিচে রস আছে, সেই রস টেনেই লতিয়ে উঠেছে লতাগুলো, ছোট ছোট গাছকে ঘিরে জট পাকিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ঝোপের। ওপারে আরেকটা ছোট পাহাড়, টিলাই বলা উচিত। একপাশে, টিলার পাদদেশ ঘেঁষে একটা জলা। প্রখর রোদে হালকা বাষ্প উঠছে জলা থেকে। দেখা যাচ্ছে দূরে স্পাই-গ্লাস পাহাড়। বাষ্পের ভেতর দিয়ে দেখছি তো, মনে হচ্ছে কাঁপছে পাহাড়টা।
এতক্ষণ নিস্তব্ধ ছিল, আচমকা চঞ্চলতা জাগল ঝোপঝাড়ের ভেতর। একটা বুনো হাঁস বিচিত্র ডাক ছাড়তে ছাড়তে উড়াল দিল আকাশে। তার পেছন পেছন উড়ে গেল আরেকটা, তারপর আরও একটা। কয়েক মুহূর্তেই ঝোপের ওপরের আকাশে শুধু হাঁস আর হাঁস, পাক খেয়ে উড়ছে ওরা আর চেঁচাচ্ছে। পাখিগুলোর নিরাপদ বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে কেউ।
আমার অনুমান মিথ্যে নয়। আধ মিনিট পরেই ঝোপের একপাশে জঙ্গলের ভেতরে মানুষের গলার আওয়াজ শুনলাম। নাবিকেরা আসছে নিশ্চয়। আরও কাছে এলে সিলভারের গলার স্বর চিনতে অসুবিধে হল না। প্রকৃতি দেখতে দেখতে এতক্ষণ ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এগিয়ে গেলাম গুড়ি মেরে। ওদের আলোচনা শুনতেই তো এসেছি আমি।
নিঃশব্দে পা ফেলে ঝোপের একপাশে একটা বিশাল গাছের গোঁড়ায় এসে দাঁড়ালাম। কথা শোনা যাচ্ছে কয়েক গজ সামনে। কার ওপর যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে সিলভার। ধমকাচ্ছে আর শাসাচ্ছে সে কর্কশ গলায়। ভয় পাচ্ছি, কিন্তু তবু আস্তে করে পাতার বাধা সরিয়ে উঁকি দিলাম। দেখা যাচ্ছে না কিছু। উপুড় হয়ে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে গেলাম আরও গজখানেক। আস্তে করে লতাপাতা সরিয়ে আবার চাইলাম ওপাশে। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম এবার।
সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছে সিলভার। মাটিতে তার পায়ের কাছে পড়ে আছে হ্যাট। ঘামে ভেজা মুখটা চকচক করছে বিকেলের রোদে। তার চেহারা দেখে কেউ বলবে না, ভয়ঙ্কর এক ডাকাতদলের সর্দার সে।
সিলভারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন নাবিক, তার নাম টম।
সিলভার বলল, দেখ টম, বড় বেশি কথা বল তুমি! তোমাকে ভাল লোক মনে করতাম, তাই দলে টানতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি রাজি নও…এর অর্থ কি জানো?
জানি, মৃত্যু, দৃঢ় গলায় বলল টম, কিন্তু তাই বলে আমাকে দিয়ে অসৎ কাজ করাতে পারবে না তুমি। তুমি কি বল, মিস্টার ট্রেলনীর চাকরি নিয়ে এসে, তার নুন খেয়ে, তারই সঙ্গে বেঈমানি করি? আর যেই করুক, জন, আমি করব না। মোহরের লোভ আমার নেই।
এই প্রথম জানলাম, উনিশজন নাবিকের সবাই ডাকাত নয়। একজন ভাল লোককে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। ইস, আগে জানলে তাকেও পিস্তল দিয়ে দিতে পারতেন জমিদার!
কি বলতে যাচ্ছিল সিলভার, কিন্তু বাধা পেল। জলার ওদিক থেকে ভেসে এল একটা দীর্ঘ আর্তচিৎকার। ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে পাহাড়ে। আবার চিৎকার করে আকাশে উঠে পড়ল পাখির দল।
কান পেতে চিৎকারটা শুনল টম। শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতেই লাফিয়ে উঠল, অ্যালান না তো!
হ্যাঁ, অ্যালানই, হাসল সিলভার। ক্রাচে ভর রেখে আরাম করে দাঁড়িয়েছে, তোমার মতই আরেক ভালমানুষ। গেল বোধহয়।
কিন্তু সত্যিকার নাবিকের পরিচয় দিয়েছে সে। ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। জাহাজে এখনও কিছু সৎ লোক আছে নিশ্চয়। তাদের হুঁশিয়ার করতে হবে। তার জন্যে যদি তোমাদের হাতে কুত্তার মত মরতে হয় আমাকে, মরব… দৃঢ় পায়ে ঘুরে দাঁড়াল টম। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে লাগল।
ম্প্রিঙের মতই লাফিয়ে উঠল খোঁড়া ডাকাত। ক্রাচটা তুলে নিয়ে নিচের দিকটা সামনে বাগিয়ে ছুঁড়ে মারল জোরে। শেষ মুহূর্তে টের পেয়ে বোধহয় ঘুরেই দাঁড়াতে যাচ্ছিল টম, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। প্রচন্ড গতিতে গিয়ে ঘাড়ের নিচে ঠিক মেরুদন্ডে আঘাত করল ক্রাচের শক্ত মাথা। কট করে বিচ্ছিরি একটা শব্দ হল। মেরুদন্ড ভাঙার। দড়াম করে ঘাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল সে। মরল না বেহুঁশ হল বুঝলাম না।
আমাকে বিমূঢ় করে দিয়ে এক পায়েই লাফাতে লাফাতে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে গেল সিলভার। টমের পিঠে চেপে বসল। কোমর থেকে ছোরা বার করে বসিয়ে দিল ঘাঁচ করে। আওয়াজ বেরোল না টমের মুখ থেকে। একটানে ছোরাটা টমের পিঠ থেকে বের করে আনল সে। আবার বসাল। দ্বিতীয়বার টেনে বের করে এনে পিঠ থেকে উঠে পড়ল। সবুজ ঘাসে মুছে নিল ছোরার রক্তাক্ত ফলা। আবার কোমরে গুজল ওটা। ক্ৰাচটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বগলে ঠেকাল, যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে টমের পিঠ থেকে। লাল রক্তে ভিজে গেল সবুজ ঘাস।
চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল আমার। মিনিটের ব্যবধানে খুন হল দুজন লোক! একজনের আর্তনাদ শুনলাম, আরেকজন তো চোখের সামনেই পড়ে আছে। দেখতে পাচ্ছি। সংবিৎ ফিরল আমার সিলভারের হুইসেলের শব্দে।
বিচিত্র কাঁপা তীক্ষ্ণ সুরে বাজল হুইসেল। ছড়িয়ে গেল দিকে দিকে। প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে। আবার উড়ল পাখিরা। ওগুলোর শান্তি নেই আজ। হুইসেল বাজিয়ে কোন ধরনের সঙ্কেত করছে সিলভার। কিসের সঙ্কেত? টমকে খতম করা হয়েছে। এটা জানাল? হবে হয়ত। কিন্তু আমার আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয় এখানে। যদি সিলভার বা ডাকাতদের কারও চোখে পড়ে যাই, টম আর অ্যালানের মতই মরতে হবে আমাকেও।
হামাগুড়ি দিয়ে সাবধানে পিছিয়ে এলাম আবার। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি লোপ পায়নি। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম ঝোপের প্রান্তে। এখন সাগর তীরে পৌছতে হবে, কিন্তু পথ তো চিনি না। ভেবেচিন্তে খোলা জায়গাটায় যাওয়া ঠিক করলাম, ওখান থেকে যাহোক একটা ব্যবস্থা হয়ত করতে পারব।
ছুটলাম। এমন দৌড় জীবনে দৌড়াইনি। লতায় পা জড়িয়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম কয়েকবার। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে আমার পেছনে ছুটে আসছে ডাকাতেরা। ভয়ে পেছনে তাকাতে পারছি না। সারাদিনে এই প্রথমবার পাখিগুলোকে ধন্যবাদ দিলাম। ওদের চেঁচামেচিতে আমার পায়ের শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে।
ছুটতে ছুটতে এসে পড়লাম ফাঁকা জায়গাটায়। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। গলা শুকিয়ে কাঠ। ধপ করে বসে পড়লাম বালির ওপরেই। একটু বিশ্রাম না নিলে মনে হচ্ছে বুকটা ফেটেই যাবে।
হঠাৎ শব্দ হল পেছনে। চমকে উঠলাম। ধড়াস করে এক লাফ মারল হৃৎপিন্ডটা। ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেলাম প্রচন্ড আতঙ্কে।
১৫. দ্বীপান্তরের আসামী
একটা পাইন গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে সে। বনমানুষ না ভালুক, বোঝার উপায় নেই। মাথার লালচে, জট পাকানো লম্বা লম্বা চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। হাতে পায়ে বড় বড় নখ। ছাগলের ছালে ঢেকে রেখেছে শরীর। চামড়ার রঙ সাদা।
কি করব আমি এখন? একদিকে ডাকাতের দল, অন্যদিকে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে শ্বেতাঙ্গ বনমানুষটা। সামনে পাহাড়। কোন্ দিকে যাই?
লাফিয়ে উঠে পাহাড়ের দিকেই ছুটলাম। জান তো বাঁচাই, তারপর পথ খুঁজে নিয়ে জাহাজে ফেরার ব্যবস্থা করব।
কিন্তু আমি কয়েক পা যেতে না যেতেই ছুটে এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল বনমানুষ। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি মানুষ।
থমকে গেলাম। এই বন মানুষটা তাহলে ইংরেজ!
কে তুমি?
আমি বেন গান। হতভাগ্য এক ইংরেজ নাবিক। গত তিনটে বছর ধরে পড়ে আছি এই দ্বীপে, একা।
জাহাজডুবি হয়েছিল বুঝি?
না। আমাকে দ্বীপান্তর দিয়ে গেছে ওরা।
এধরনের ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা আমি শুনেছি, জলদস্যুদের মাঝে এই প্রথা প্রচলিত। দলের কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি হিসেবে একটা নির্জন দ্বীপে নির্বাসন দিয়ে যায় ডাকাতেরা। একটা বন্দুক, কিছু গুলি আর সামান্য খাবারও দিয়ে যায়। কিন্তু এতে আর কদিন চলে? খাবার আর গুলি ফুরিয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না খেয়ে মারা যায়। নির্বাসিত লোকটি।
তিন বছর ধরে ঝিনুক, ছাগলের মাংস আর বুনো ফলমূল খেয়ে বেঁচে আছি আমি, আবার বলল বেন গান। কিন্তু ইংরেজদের সত্যিকারের যে খাবার..ইসস, মেট, কতদিন চোখে দেখিনি। কতদিন পনিরের জন্যে মনটা আইডাই করেছে, কতদিন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি টেবিলে পনিরের স্তুপ, কিন্তু ঘুম ভেঙে যে-কে সেই। সেই আঁশটে ঝিনুক…এসব খাওয়া যায় সব সময়? শুধু বাঁচার তাগিদে গিলেছি।
আমি জাহাজে ফিরতে পারলে পেট পুরে পনির খাওয়াব তোমাকে, বললাম।
ফিরতে পারলে মানে? রোমশ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চাইল বেন গান।
পথ হারিয়েছি।
কোন ভয় নেই। পুরো দ্বীপটা আমার চেনা। জঙ্গলের প্রতিটা গাছ, পাহাড়ের গুহা, খানাখন্দ, ঝর্না, সব চিনি আমি। কোথায় তোমার জাহাজ?
স্কেলিটন আইল্যান্ডের ওদিকে।
তাহলে তো কাছেই। চল আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু আরও ব্যাপার আছে… দ্বিধা করলাম। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, জলদস্যুরা আছে আশপাশে।
জলদস্যু! এই দ্বীপে আবার জলদস্যু!
হ্যাঁ, লঙ জন সিলভার ওদের সর্দার।
সেই একপেয়ে বদমাশটা না তো?
ঠিকই ধরেছ, সে-ই। কিন্তু তুমি চেন ওকে?
চিনব না মানে? ফ্লিন্টের দলেই তো ছিলাম আমি। সে-ই তো নির্বাসন দিয়েছে আমাকে এখানে। আমার আরও কাছে এল বেন গান। মুখটা একটু নামিয়ে বলল, কিন্তু সর্দার তো ছিল ফ্লিন্ট! সিলভার হয় কি করে?
ফ্লিন্ট নাকি মারা গেছে। বেশি মদ খেত…
মরবেই! কিন্তু খুশি হতে পারলাম না এ কথা শুনে। ফাঁসিতে ঝুলে মরা উচিত ছিল ব্যাটার। কি লাভ হল শুধু শুধু মানুষ খুন করে? টাকা জমালি ঠিকই, কিন্তু ভোগ করতে পারলি? আমাকে নির্বাসন দিয়েছিস, এদিকে তোর টাকার সন্ধান পেয়ে বসে আছি আমি…
টাকা?
হ্যাঁ, ফ্লিন্টের ধনরত্ন তো সব এই দ্বীপেই লুকানো… আচমকা থেমে গেল বেন গান। সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল আমার দিকে, কিন্তু তোমাকে এসব বলা উচিত হচ্ছে না, সিলভারের দলের লোক তুমি।
না না, আমি সিলভারের দলের নই, তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ওদের ভয়েই তো পালাচ্ছিলাম। এই তো, কিছুক্ষণ আগেই দুজন লোককে খুন করেছে সিলভার আর তার লোকেরা আমাদের গুপ্তধনের সন্ধানে আসার ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানালাম বেন গানকে।
চুপ করে সব শুনল বেন গান। আমার কথা শেষ হলে বলল, বুঝেছি, তোমাকে বলা যায়। ফ্লিন্টের জাহাজের নাম ছিল ওয়ালরাস। ওটাতে করেই সমস্ত জমানো ধনরত্ন নিয়ে এই দ্বীপে এসে হাজির হয় একদিন সে। জাহাজ নোঙর করে একটা মাত্র বোট নামানোর আদেশ দেয় ফ্লিন্ট। নৌকা নামানো হল। সেই নৌকায় নেয়া হল তার সমস্ত ধনরত্ন। তারপর ছয়জন বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা ভাসাল সে। ধনরত্নগুলো নিয়ে ঢুকে গেল ওরা জঙ্গলে। কয়েক ঘন্টা পরেই নৌকা নিয়ে ফিরে এল ফ্লিন্ট, একা। আমাদের জানাল, ছজন অনুচর নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছে। ধনরত্নগুলো কোথায়, কি করেছে সে, কিছু বলল না। আমরাও সাহস করে কিছু আর জিজ্ঞেস করলাম না। হ্যাঁ, ওয়ালরাসের মেট ছিল কিন্তু বিলি বোনস…ওই যার কথা বললে আর কি, তোমাদের সরাইতে গিয়ে উঠেছিল যে… থামল একটু বেন গান। তারপর সামনে ঝুকে আমার হাত দুটো চেপে ধরল, এক কাজ কর না, মেট, আমাকে তোমাদের জাহাজে নিয়ে চল। মিস্টার ট্রেলনীকে বুঝিয়ে বল সব। ধনরত্নের হদিস আমি দেব, বিনিময়ে আমাকে ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেবেন ট্রেলনী, পুলিশকে কিছু বলবেন না, আর এক হাজার পাউন্ড দেবেন। বলবে?
অবশ্যই বলব, চল।
বুনো ছাগলের মতই নিঃশব্দ দ্রুত পদক্ষেপে গাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটল বেন গান। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে ঘাম ছুটে গেল আমার।
বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসব, এই সময় শোনা গেল কামানের গোলার আওয়াজ। তারপরেই কয়েকবার গর্জন করে উঠল বন্দুক।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বেন গান। তার পাশে এসে দাঁড়ালাম আমিও। গাছের ফাঁক দিয়ে সামনে তাকালাম। কামানের গোলাটা কোন দিকে গেল দেখার চেষ্টা করতেই চোখে পড়ল ওটা।
বড় জোর সিকি মাইল দূরে একটা গাছের মগডালে উড়ছে একটা ফ্ল্যাগ, ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা।
১৬. ডাক্তার লিভসীর বিবৃতি
দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুটো বোট। কেবিনে বসে ক্যাপ্টেন আর ট্রেলনীর সঙ্গে কথা বলছি আমি। সকালের মতই বাতাস স্তব্ধ। সামান্যতম হাওয়া নেই। পালে বাতাস লাগাতে পারলে জাহাজে থেকে যাওয়া ছজন ডাকাতকে শেষ করে এক্ষুনি নোঙর তুলে পালাতাম এখান থেকে। কিন্তু নেই বাতাস। তার ওপর হান্টারের কাছে শুনলাম, আমাদের অনুমতি না নিয়েই দ্বীপে চলে গেছে জিম হকিন্স।
আলোচনা তেমন জমছে না। প্রচন্ড গরমে কেবিনে বসে দর দর করে ঘামছি। শেষে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম। বদ্ধ বাতাসে দুর্গন্ধ যেন আরও বেশি ছড়াচ্ছে। জ্বর আর আমাশয়ে পড়ার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছি।
ডেকে, একটা পালের নিচে ছায়ায় বসে আছে ছয় ডাকাত। ওদিকে ডাঙায় বোট দুটো বেঁধে প্রতিটি বোটে একজন করে ডাকাতকে পাহারায় রেখে জঙ্গলে ঢুকে গেছে অন্যেরা। জিমকেও দেখা যাচ্ছে না। কি বোকামিই না করল ছেলেটা! অস্বস্তিকর পরিবেশে পায়চারি করতে লাগলাম ডেকে।
এভাবে আর ভাল লাগছে না। কিছু একটা করা দরকার। মনে মনে ঠিক করলাম হান্টারকে নিয়ে বেরিয়েই পড়ব। জলিবোটটায় করে যেতে পারব দ্বীপে।
ক্যাপ্টেন কিংবা ট্রেলনী বাধা দিল না। জলিবোটে করে চললাম আমি আর হান্টার। আমাদের যেতে দেখে একটু যেন চঞ্চল হয়ে উঠল দুই প্রহরী ডাকাত। এতক্ষণ শিস দিচ্ছিল, বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে তাকাল আমাদের দিকে। সন্দেহ হয়েছে।
ডাকাতেরা যেখানে নেমেছে, সেখানে নামলাম না আমরা। মোড় নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। বাঁক ঘুরতেই ডাকাতদের নৌকাদুটোকে আর দেখা গেল না। নৌকার সামনের দিকটা তীরে ঠেকতেই লাফিয়ে নামলাম আমি। জাহাজ থেকে দুটো পিস্তল নিয়ে এসেছি। প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্যে হ্যাটের সামনের কার্নিসের তলায় একটা বড় রুমাল ঢুকিয়ে কায়দা করে কপাল ঢেকে নিলাম। এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়লাম বনের ভেতর।
শখানেক গজ এগোতেই চোখে পড়ল দুৰ্গটা। একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝর্না বইছে। সেই ঝর্নাটার ধারে চূড়ার কাছাকাছি একটা মজবুত কাঠের বাড়ি। চল্লিশ জন লোক সহজেই এতে থাকতে পারে। দুর্গের কাঠের দেয়ালে একটু পর পরই ফোকর, ভেতর থেকে এগুলোর মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে বাইরের শত্রুদেরকে গুলি করার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এই বাড়িটার বাইরেটা ঘিরে ছফুট উঁচু কাঠের গুঁড়ির দেয়াল। এতই মজবুত, কামানের গোলার আঘাতেও যথেষ্ট কঠিন হবে ভাঙা। চমৎকার জায়গায় রীতিমত পরিকল্পনা করে তৈরি হয়েছে এই বাড়ি। এমনিতেই পাহাড়ের চুড়ায় বসা শত্রুর বন্দুকের কাছে নিচের লোকেরা অসহায়, তার ওপর ওই দুর্গ। ওটার ভেতরে থেকে ছজন সশস্ত্র লোক পুরো এক পল্টন সৈন্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।
আমার সবচেয়ে ভাল লাগল ঝর্নাটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, এই সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেল। খুনের অভিজ্ঞতা নতুন নয় আমার কাছে। সৈনিক ছিলাম এক সময়। যুদ্ধ করেছি। আহতও হয়েছি। আর্তনাদটা শুনে প্রথমেই জিমের কথা মনে হল আমার। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে ডাকাতদের হাতে শেষ হয়ে যায়নি তো ছেলেটা!
সৈনিক কিংবা ডাক্তারের জীবনে গড়িমসির কোন স্থান নেই। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলাম। বন থেকে বেরিয়েই এসে উঠলাম জলিবোটে। হান্টার বসেই আছে, আমার নির্দেশ পেয়ে সামান্যতম সময় নষ্ট না করে দাঁড় বাইতে শুরু করল সে। জাহাজের গায়ে বোট ভিড়তেই দড়ি বেয়ে উঠে এলাম।
ক্যাপ্টেন আর স্কোয়্যার ডেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে-চোখে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা। বনের ভিতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ ওরাও শুনছে। আমাকে দেখেই ছুটে এল দুজনে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করল আমাকে। কিন্তু আমিও ওদের মত চিৎকারই শুনেছি, দেখিনি কিছু।
পালের তলায় বসা ছজনের একজন নাবিককে ইঙ্গিতে দেখিয়ে ফিসফিস করে বললেন ক্যাপ্টেন, লোকটা নতুন। দেখছেন না, মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে, আর কেমন উসখুস করছে?
দেখলাম। তারপর ক্যাপ্টেন আর জমিদারকে নিয়ে কেবিনে চলে এলাম। আলোচনা করে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
কয়েক মিনিটেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম আবার কেবিন থেকে।
কেবিনের পাশে বন্দুক হাতে পাহারায় রাখা হল রেডরুথকে। জাহাজের পেছন দিকে জলিবোটটা এনে বাঁধল হান্টার। তাতে জাহাজের ভাড়ার থেকে নিয়ে টিনের খাবার, বিস্কুট, মাংস, এক বাক্স কন্যাক মদ, ওষুধের বাক্স ইত্যাদি তুলে দিলাম। আর্মারী থেকে নিয়ে এসে তুললাম বারুদ আর বন্দুক। আমাকে সাহায্য করল জমিদার। ডেকের সামনের দিকে রয়েছেন সশস্ত্র ক্যাপ্টেন।
জলিবোটে জিনিসপত্র তোলা শেষ হতেই ডেকে ফিরে এলাম। আমাকে দেখেই পকেট থেকে পিস্তল বের করলেন ক্যাপ্টেন। এগিয়ে গেলেন ডাকাতগুলোর দিকে। কর্কশ গলায় বললেন, এই হারামজাদারা, এটা কি দেখেছিস? তোদের কান্ডকারখানা সবই জানা হয়ে গেছে আমাদের। কাজেই হুঁশিয়ার…
বোকা বনে গেল ছয় ডাকাতই। আমরা ওদের পরিচয় জেনে গেছি, বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে কেবিনের দিকে তাকাল ওরা। কেবিনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসা বন্দুক হাতে রেডরুথকে দেখল। বুঝে গেল, আটকা পড়ে গেছে। করার আর কিছুই নেই ওদের।
জয়েসকে নিয়ে নৌকায় নেমে এলাম। দাঁড় বাইতে শুরু করল হান্টার। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম প্রথমবারে যেখানে নেমেছিলাম, সেখানে। হান্টার আর জয়েসের সাহায্যে দ্রুত ডাঙায় নামালাম মালপত্র। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। এখন দলবল নিয়ে সিলভার এদিকে এসে পড়লে সর্বনাশ।
মালপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে ছয় ফুট বেড়ার ওপর দিয়ে ভেতরে ফেলে দিলাম, মদের বাক্সটা ছাড়া, বোতলগুলো ভেঙে যাবে। জয়েসকে বন্দুক হাতে সেখানে পাহারায় রেখে আবার ফিরে এলাম জাহাজে। আবার জিনিসপত্র বোঝাই করে নিয়ে রেখে এলাম দুর্গে। এভাবে কয়েকবার যাওয়া-আসা করে খাবার-দাবার, বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে নিয়ে গিয়ে রাখলাম দুর্গে। অস্ত্রশস্ত্র আমাদের যা দরকার নিয়ে বাকিগুলো রেলিঙ ডিঙিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম, যেন ওগুলোকে কাজে লাগাতে না পারে ডাকাতেরা।
ভাটা শুরু হয়েছে। আর বেশি দেরি করা যাবে না। তাহলে নৌকা নিয়ে দ্বীপে পৌঁছা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। আর মালপত্র যাবে না, এবারে যাবে লোকজন। প্রথমেই নৌকায় নামল রেডরুথ। জমিদার নামল তারপর। ক্যাপ্টেন নামতে যাবেন, এমন সময় লাফিয়ে উঠে ছুটে এল উসখুস করতে থাকা নাবিকটা, ওর নাম আব্রাহাম গ্রে। আক্রমণ করতে আসছে মনে করে পিস্তল তুললেন ক্যাপ্টেন।
চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, দোহাই স্যার, আমাকে মারবেন না! আমি আপনাদের দলে আসতে চাই!
ক্ষণিকের জন্যে কি ভাবলেন ক্যাপ্টেন। তারপর ডাকলেন, এসো, উঠে পড় নৌকায়! জলদি!
আব্রাহামের পর পরই নৌকায় উঠে এলেন ক্যাপ্টেন। পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক লোকের ভারে টালমাটাল অবস্থা ছোট্ট নৌকার। তার ওপর আরও কিছু মালপত্র, যেমনঃ বারুদ, মাংস, রুটির ব্যাগ তোলা হয়েছে জলিবোটে। বার বার কাত হয়ে যাচ্ছে নৌকা, পানি উঠছে। ওদিকে ভাটা শুরু হয়েছে। পশ্চিমে বয়ে চলেছে। একটা প্রবল স্রোত, তারপর চলে গেছে দক্ষিণমুখো। তারমানে নৌকার গতিপথে কোনাকুনি এসে বাঁধা দিচ্ছে এই স্রোত।
দাঁড় টানছে রেডরুথ আর ক্যাপ্টেন, আমি হাল ধরেছি। জোর করে নৌকার গতিপথ ঠিক রাখতে গিয়ে আধ মিনিটেই হাতের পেশীতে ব্যথা হয়ে গেল আমার। না বলে পারলাম না, ক্যাপ্টেন, আরেকটু জোরে টানা যায় না?
না, বললেন ক্যাপ্টেন। তাহলে বেশি দুলবে বোট, ডুবে যাবে।
ক্রমেই গতিপথ থেকে সরে আসছে বোট, পশ্চিমে মোড় নিতে চাইছে।
আমি কিন্তু আর পারছি না, বলেই ফেললাম।
কি বলতে গিয়েও জাহাজের দিকে চোখ পড়ায় থেমে গেলেন ক্যাপ্টেন। চোখ কুঁচকে গেছে। বদলে গেছে গলার স্বর, কামান!
জাহাজের দিকে পেছন ফিরে আছি আমি। বললাম, দুর্গে কামান দাগার কথা ভাবছেন তো? সেটি পারছে না ওরা কিছুতেই। অত ভারি কামান দ্বীপে আনতেই পারবে না…
দুর্গের কথা ভাবছি না আমি, প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বললেন ক্যাপ্টেন, পেছনে চেয়ে দেখুন!
চমকে উঠলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা। চকিতে ঘাড় ফেরালাম। তৎপর হয়ে উঠেছে জাহাজে রয়ে যাওয়া ডাকাতেরা। ডেকে বসানো কামানের ওপরের তেরপল তুলে নিয়েছে। গোলা আর বারুদ বয়ে আনছে দুজনে। ইস, কেন যে কামানের গোলাবারুদগুলো পানিতে ফেলে আসিনি!
ইসরায়েল, কামানের কাছে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখিয়ে বলল গ্রে, ফ্লিন্টের গোলন্দাজ ছিল!
পেশীর ব্যথা অগ্রাহ্য করে জোরে হাল চেপে ধরলাম। প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগলেন ক্যাপ্টেন আর রেডরুথ। নৌকা ডুবে গেলে নাহয় সাঁতরে দ্বীপে যাবার চেষ্টা করব, কিন্তু তার আগেই যদি কামানের গোলা এসে পড়ে তো টুকরো টুকরো হয়ে যাব।
কামানের পেছনে চেম্বারে গোলা ভরতে আরম্ভ করেছে ইসরায়েল।
বন্দুকে কার নিশানা সবচেয়ে ভাল? আমাদের জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
জমিদারের, ট্রেলনীকে দেখিয়ে বললাম।
ব্যাটাকে শেষ করে দিন, ট্রেলনীকে বললেন ক্যাপ্টেন।
পায়ের কাছে রাখা বন্দুকটা তুলে নিল জমিদার। গুলি ভরাই আছে।
তাড়াহুড়ো করবেন না, বললেন ক্যাপ্টেন। তাহলে নৌকা উল্টে যাবে।
দাঁড় টানা বন্ধ করে দিলেন ক্যাপ্টেন, রেডরুথকেও বন্ধ করতে বললেন, এতে নিশানা ঠিক থাকবে ট্রেলনীর। আমি শক্ত হাতে হাল ধরে রইলাম।
ওদিকে কামানে গোলা ভরে ফেলেছে ইসরায়েল। কামানের নলের মুখ ধীরে ধীরে ঘুরছে নৌকার দিকে। গুলি করলেন ট্রেলনী। কিন্তু সজাগ লোক ইসরায়েল। জমিদারকে বন্দুক নিশানা করতে দেখেই বসে পড়ল। তার মাথার ওপর দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের লোকটাকে আঘাত করল গুলি। আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা।
শুধু জাহাজ থেকেই নয়, চিৎকার উঠল তীর থেকেও। চমকে চেয়ে দেখলাম বন থেকে বেরিয়ে এসেছে ডাকাতেরা। নৌকা দুটোয় গিয়ে উঠছে। জাহাজের দিকে খেয়াল থাকায় এতক্ষণ সেদিকে দেখিনি।
ক্যাপ্টেন, চেঁচিয়ে উঠে বললাম। তীরের দিকে দেখুন!
দেখলেন ক্যাপ্টেন। নৌকার অন্যেরাও দেখল।
হুহ, বললেন ক্যাপ্টেন। মিস্টার ট্রেলনী, যে কটাকে পারেন, সাবাড় করে। ফেলুন। দ্বীপে পৌঁছতে পারব কিনা আর, কে জানে!
দ্বীপের কাছাকাছি এসে গেছে আমাদের জলিবোট। আর তিরিশ-চল্লিশবার দাঁড় টানতে হবে বড় জোর। কিন্তু এতক্ষণও টিকতে পারব কিনা সন্দেহ। প্রচন্ড হাঁক ছেড়ে তীর বেগে এগিয়ে আসছে ডাকাতেরা। ওদিকে আবার কামান তাক করছে ইসরায়েল।
নৌকা দুটো লক্ষ্য করে গুলি চালাল জমিদার। দাঁড় বাইছে আবার ক্যাপ্টেন আর রেডরুথ। ধকল সইতে পারল না আর নৌকাটা। কাত হয়েই তলিয়ে গেল পানিতে। ঠিক এই সময় গর্জে উঠল কামান। নৌকাটা ডুবে যাওয়ায় ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে সামনে পানিতে পড়ল গোলাটা। ছিটকে উঠল কাদা আর পানি। ঢেউয়ের প্রচন্ড ঝাপটা খেয়ে উল্টে ডুবে গেলাম। নাকানি-চুবানি খেয়ে বেশ খানিকটা কাদাটে নোনাপানি গিলে ভেসে উঠে দেখলাম, ভিজে বেড়ালের মত অন্যেরাও মাথা তুলছে পানি থেকে। পানির গভীরতা এখানে ফুট তিনেক। কাজেই এগিয়ে যেতে অসুবিধে হল না আমাদের।
দুটো বন্দুক ছাড়া নৌকার আর কোন মালপত্রই বাঁচানো সম্ভব হল না। সবই পানিতে ভিজে অকেজো হয়ে গেল। তীরের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। ভিজে কাপড়-চোপড় নিয়ে কাদা পানি ভেঙে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ওদিকে নৌকা নিয়ে আরও কাছে এসে গেছে ডাকাতেরা।
হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনমতে তীরে এসে উঠলাম আমরা। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, একেবারে কাছে এসে গেছে ডাকাতেরা। ছুটে ঢুকে পড়লাম বনের ভেতরে।
দুর্গের দিকে ছুটেছি আমরা। পেছনে ডাকাতদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। তীরে নামছে ওরা। ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে দুর্গে পৌছতে পারব কিনা সন্দেহ। কাজেই বাধা দেবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দুটো বন্দুকের একটা গ্রে-র হাত থেকে নিলাম আমি, অন্যটা তো ট্রেলনীর হাতে আছেই।
এই সঙ্কট মুহূর্তে সবাই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, ট্রেলনী ছাড়া। জমিদার একেবারে শান্ত। এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে তো তার। কোমর থেকে ছোরা বের করে গ্রে-র হাতে তুলে দিল জমিদার।
ছোরাটা নিল গ্রে। ওপর দিকে ছুঁড়ে মারল একবার। বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে আবার নিচে পড়তে লাগল ছোরা। ক্ষিপ্র অভ্যস্ত হাতে সেটা লুফে নিল সে। বুঝলাম, ছুরি খেলায় হাত পাকা এই লোকের।
আবার ছুটতে শুরু করলাম আমরা। গাছপালার ওপাশ থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে ডাকাতেরা। এগিয়ে আসছে আরও কাছে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে সামনে দুৰ্গটাও দেখতে পাচ্ছি। বড় জোর আর চল্লিশ কদম দূরে আছে। একবার ওতে ঢুকে যেতে পারলেই বেঁচে যাব।
ওদিকে বসে বসে সময় নষ্ট করেনি হান্টার, কিছু কাজ করেছে। খুঁজেপেতে দুর্গে ঢোকার প্রবেশ পথ আবিষ্কার করেছে। আমাদেরকে উধ্বশ্বাসে ছুটে আসতে দেখেই এগিয়ে এল সে। পেছনে এই সময় হৈ হৈ করতে করতে গাছপালার এপাশে বেরিয়ে এল ডাকাতেরা। সংখ্যায় সাতজন, নেতৃত্ব দিচ্ছে জোব অ্যান্ডারসন।
আমরা বেড়ার কাছে চলে এসেছি, এই সময় গুলি করল ডাকাতেরা। আমার কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। আর্তনাদ করে উঠল রেডরুথ। পাশে চেয়ে দেখলাম, মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে হতভাগ্য লোকটা।
হান্টারের দেখানো পথে ছুটে ঢুকে পড়লাম দুর্গের আঙিনায়, বেড়ার ভেতরে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বেড়ার ফোকরে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিয়ে সমানে গুলি চালালাম। আমার পাশে জমিদার। ক্যাপ্টেন, হান্টার আর জয়েসও বন্দুক তুলে নিয়েছে। দুর্গের আশ্রয়ে থেকে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছি আমরা, বেশিক্ষণ সইতে পারল না ডাকাতেরা। ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার বনের ভেতরে গিয়ে গা ঢাকা দিল।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর বেড়ার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি, রেডরুথের কি অবস্থা হয়েছে দেখতে হবে। রক্তে ভিজে গেছে মাটি, তার ওপর চুপচাপ পড়ে আছে বেচারা। একবার দেখেই বুঝলাম, আশা নেই। ইতিমধ্যে জমিদারও এসে বসেছে আমার পাশে। দুজনে মিলে ধরাধরি করে মুমূর্ষ রেডরুথকে বেড়ার ভেতরে নিয়ে গেলাম।
কয়েক মিনিট পরেই মারা গেল বেচারা। নিঃশব্দে। যেন আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
কেঁদেই ফেলল জমিদার। দীর্ঘদিন তার কাছে কাজ করেছে রেডরুথ। মায়া বসে যাওয়া স্বাভাবিক।
রেডরুথের পাশ থেকে উঠে এলাম। পায়চারি করছেন ক্যাপ্টেন। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, তার পকেটগুলো যেন বেশি ফোলা। আমাকে বার বার চাইতে দেখে একদিকের পকেট থেকে একটা ছোট সাইজের বাইবেল বের করে আনলেন ক্যাপ্টেন। রেডরুথের দিকে বাড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কি বললেন, তারপর আবার পকেটে ভরলেন বাইবেলটা। ওদিকে রেডরুথের হ্যাটটা বেড়ার বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে। জমিদার। লাশের মুখটা ঢেকে দিল হ্যাট দিয়ে।
পকেট থেকে একে একে আরও কিছু জিনিস বের করলেন ক্যাপ্টেন। ব্রিটেনের একটা পতাকা, খুব শক্ত খানিকটা দড়ি, কালির দোয়াত, কলম, ডায়েরী আর কিছু তামাক। নিচে মাটিতে জিনিসগুলো রেখে হান্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যেই বেড়ার ভেতরে ঢোকার পথটা বন্ধ করে ফেলেছে হান্টার।
আঙিনার এক জায়গায় একটা বড়সড় ফার গাছ আছে। হান্টারের সাহায্যে সেটার চূড়ার ডালপালা হেঁটে নিলেন। তারপর নিজে গাছে উঠে খাড়া মগডালে পতাকাটা বেঁধে দিলেন। একটা প্রধান কাজ যেন সেরে এলেন এইমাত্র, এমনিভাবে হাত ঝাড়লেন ক্যাপ্টেন। তারপর আমাদের নিয়ে আসা মালপত্রের হিসেব করতে বসলেন।
হিসেবপত্র শেষ করে আরেকটা পতাকা নিয়ে রেডরুথের দিকে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। লাশের শরীর ঢেকে দিলেন পতাকা দিয়ে। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালেন এভাবে ক্যাপ্টেন। লাশের পাশেই বসে আছে জমিদার, দুচোখে পানি। হাত ধরে তাকে টেনে তুললেন ক্যাপ্টেন, সান্ত্বনা দিলেন। তারপর কাজের কথা শুরু করলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারসাহেব, কদিনের মধ্যে না ফিরলে আপনাদের সন্ধানে জাহাজ আসবে ইংল্যান্ড থেকে?
আগস্টের মধ্যে, বললাম আমি, ব্ল্যান্ডার্স আসবে।
মাথা চুলকালেন ক্যাপ্টেন, ততদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়!
মানে?
গোলাবারুদ যা আছে, চলে যাবে। কিন্তু খাবার? বড় জোর দিন দশেক চলবে আর…
এই সময় কামানের গর্জন শোনা গেল। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল গোলাটা। দুর্গ সই করে জাহাজ থেকে কামান দাগছে ডাকাতেরা!
চালিয়ে যাও, বাপধনেরা, খুশি খুশি গলায় বললেন ক্যাপ্টেন। এভাবে গোলাই খরচ করবে শুধু, কাজের কাজ কিছু হবে না। চালাও, শেষ করে ফেল গোলা…
চমকে থেমে গেলেন ক্যাপ্টেন। হাসি মুছে গেল মুখ থেকে। দ্বিতীয় গোলাটা এসে পড়েছে বেড়ার বাইরে! ধুলোর মেঘ উড়ল।
ওই পতাকা, বলল জমিদার, জাহাজ থেকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়! নইলে নিশানা করছে কি করে? ওটা নামিয়ে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ…
পতাকা নামাবো! প্রায় চেঁচিয়েই উঠলেন ক্যাপ্টেন, কিছুতেই না! ওই পতাকাই জানিয়ে দিচ্ছে, ওদেরকে পরোয়া করি না আমরা।
সাঁঝের অন্ধকার না নামা পর্যন্ত কামান দেগে চলল ডাকাতেরা, কিন্তু কোন ক্ষতি করতে পারল না আমাদের। দুৰ্গটা জাহাজ থেকে অনেক দূরে। অত দূর থেকে নিশানা ঠিক রাখা দুষ্কর। গোলার পর গোলা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল, কিংবা এসে পড়ল বেড়ার বাইরে এদিক ওদিক। প্রচন্ড অস্বস্তি আর উত্তেজনার মধ্যে রাখা ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষতিই করতে পারল না ওরা।
অন্ধকার নামতেই কামান দাগা বন্ধ হয়ে গেল। একটা প্রস্তাব দিলেন ক্যাপ্টেন, ভাটার টানে পানি নেমে গেছে। ডুবে যাওয়া জলিবোটটা নিশ্চয় বেরিয়েছে। চলুন না, টিনের খাবারগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসি?
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। জাহাজ থেকে নিয়ে আসা মালপত্রগুলো ইতিমধ্যেই দুর্গের ভেতরে জায়গামত সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলেছি আমরা। কাজেই যে-কোন দুজন লোক দুর্গ পাহারায় থেকে অনন্যরা খাবার উদ্ধারে যেতে পারি।
তৈরি হয়ে এল গ্রে আর হান্টার। দুর্গ পাহারায় রইল জমিদার আর জয়েস।
বন থেকে বেরিয়েই কিন্তু থমকে গেলাম আমরা। আমাদের মতই খাবারগুলোর কথা ভেবে ফেলেছে ডাকাতেরা। সিলভারের নেতৃত্বে একটা বোট এগিয়ে আসছে জলিবোটের খাবার আর গোলাবারুদ নিয়ে যেতে। একটা করে বন্দুক আছে সবারই হাতে। কিন্তু কোথায় পেল ওরা এই বন্দুক? আমাদের সাথে নিয়ে আসা কয়েকটা ছাড়া তো জাহাজের আর সব বন্দুকই পানিতে ফেলে দিয়ে এসেছি!
জলিবোটের জিনিসপত্র আর আমাদের উদ্ধার করা সম্ভব হল না। এখন এগিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। ফিরে এলাম।
সবে বেড়ার ভেতরে ঢুকেছি, এমনি সময় বাইরে কার ছুটে আসা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রবেশ পথটা বন্ধ করার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল জিম।
১৭. দুর্গ
আবার জিম হকিন্সের বিবৃতি
আশ্চর্য তো! বলল বেন গান, জলদস্যুদের পতাকা নয় এটা! তোমার বন্ধুরা উড়িয়েছে নিশ্চয়!
কিন্তু…জাহাজ ছেড়ে ওখানে গেল কেন ওরা?
একটা দুর্গ আছে ওখানে। নিশ্চয় জাহাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে ওখানে আশ্রয় নিয়েছে।
তাহলে তো জাহাজটা দখলই করে নিয়েছে ডাকাতেরা!
হয় তো…
এই সময় আবার কামান গর্জে উঠল, থেমে গেল বেন গান। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কামানের গোলা। দুর্গের দিকে এগোতে গেলাম। হাত ধরে টেনে আমাকে থামাল সে। বনের ভেতরে গাছপালার আশ্রয়ে থাকাই এখন নিরাপদ।
গোলাগুলি থামলে আমাকে দুর্গে পৌঁছে দিয়ে পরে আসবে বলে চলে গেল বেন গান।
দুপুরে আমি জাহাজ ছেড়ে আসার পর কি কি ঘটেছে, সংক্ষেপে জানিয়ে ডাক্তারচাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, হিসপানিওলা দখল করেই নিল তাহলে সিলভারের লোকেরা?
আমি চলে যাওয়ার পর কি কি ঘটেছে, আমাকে সংক্ষেপে জানালেন ডাক্তারচাচা।
দুজনেরই কাহিনী পরস্পরকে জানানো হলে, উঠে দাঁড়ালাম। দুর্গের ভেতরটা দেখতে লাগলাম মশালের আলোয়। পাইনের অসমান গুঁড়ি আর কান্ড পর পর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে দুর্গ। ছাদও পাইন কাঠের তৈরি। ঝর্না থেকে সরু নালা কেটে নিয়ে আসা হয়েছে ভেতরে। পাইপের সাহায্যে এই নালা থেকে একটা বিশাল লোহার গামলায় পানি আনার ব্যবস্থা আছে। ঘরে এক কোণে একটা বিশাল চ্যাপ্টা পাথর রাখা আছে। কাঠপোড়া কয়লার স্তুপ ওতে। ফায়ারপ্লেস হিসেবে পাথরটা ব্যবহার করত ডাকাতেরা, বোঝা যাচ্ছে।
সারা রাত বাইরেই পড়ে থাকবে নাকি রেডরুথের লাশটা? এক সময় বললেন জমিদার। ওটার সত্ত্বার করা উচিত না? পাথরের ফায়ারপ্লেসের কাছ থেকে এসে দাঁড়ালাম তাদের কাছে।
নিশ্চয়ই, বললেন ডাক্তারচাচা। চল যাই, কবর দিয়ে আসি তাকে।
আঙিনার এক জায়গায় কবর খোঁড়া হল। বালি খুঁড়তে বেগ পেতে হল না মোটেও। লাশের মাথার দিকে ধরলেন ট্রেলনী, পায়ের দিকে হান্টার! জয়েসও সাহায্য করল। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে এনে কবরে নামাল লাশ। পকেট থেকে বাইবেল বের করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে পাদ্রীর কাজ সারলেন ক্যাপ্টেন।
রেডরুথের লাশ মাটি চাপা দেয়ার পরও কয়েক মিনিট কবর ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। আঙিনার বাইরের পাইন আর ফারের জঙ্গলে জমাট অন্ধকার। মুঠো মুঠো জোনাকির আলোয় অন্ধকার যেন আরও চেপে ধরেছে বনভূমিকে। নতুন কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে কেমন যেন গা ছম ছম করে উঠল আমার। কাঁটা দিয়ে উঠল।
দুর্গের ভেতরে, বালির ওপর বসে মশালের আলোয় নীরবে রাতের খাওয়া শেষ করলাম।
কম্বল গায়ে দিয়ে বন্দুক হাতে দুর্গের আঙিনায় বেরিয়ে এলাম আমরা। দূরে জাহাজে ডাকাতদের উন্মত্ত-মাতাল চিৎকার এত দূরেও ভেসে এল। অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ বনভূমি।
১৮. সন্ধির প্রস্তাব
উত্তেজিত কথাবার্তায় সকালে ঘুম ভাঙল আমার। কে একজন বলে উঠল, একি! এ যে সিলভার!
খোঁড়া ডাকাতটার নাম কানে যাওয়ামাত্র ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে এলাম আঙিনায়। বেড়ার ফোকরে চোখ ঠেকিয়ে দেখছে আমার সঙ্গীরা সবাই। আমিও এগিয়ে গিয়ে একটা ফোকরে চোখ রাখলাম।
বেড়ার বাইরে, গাছপালার সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। একজন সিলভার, তার হাতে একটা সাদা পতাকা। দোলাচ্ছে সেটা।
হিমেল সকাল। আর খানিকক্ষণ পরই যে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে আবহাওয়া এখন সেটা ভাবাই যায় না। আকাশ উজ্জ্বল, নির্মেঘ। সূর্যের সোনালী আলো সবে গাছের ডগা ছুঁয়েছে। আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে বনভূমি।
চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন, কেন এসেছ?
শান্তি চাই আমরা, সিলভারের কণ্ঠ শোনা গেল। সন্ধি করতে এসেছি!
ব্যাটাদের কোন চাল! আস্তে করে বললেন ক্যাপ্টেন। ডাক্তারচাচাকে বললেন, বন্দুকে গুলি ভরে নিন। আপনি সামনের দিকটায় খেয়াল রাখুন। মিস্টার ট্রেলনী, আপনি দেখুন উত্তরটায়। জিম, তুমি চোখ রাখ পুবদিকে, গ্রে পশ্চিমে। জয়েস, হান্টার, তোমরা আমাদের বন্দুকে গুলি ভরে দেবার জন্যে তৈরি থাক। সাবধান! চেঁচিয়ে আবার সিলভারকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই শুভবুদ্ধি কেন হল হঠাৎ?
খামোকা রক্তারক্তি বারবিকিউর পছন্দ না! জবাব দিল এবার সিলভারের সঙ্গী।
তাই নাকি? বড় মজার কথা তো! কবে থেকে সাধু হল খোঁড়াটা?
দয়া করে ভুল বুঝবেন না, ক্যাপ্টেন! সিলভার বলল, সত্যিই কিছু কথা বলতে চাই আমি। দুদলে একটা বোঝাপড়া হওয়া ভাল। কিন্তু দূর থেকে চিৎকার করে কিভাবে সব বলি?
ভাবলেন ক্যাপ্টেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, কাছে এসো। কিন্তু সাবধান, ছয়টা বন্দুকের নল চেয়ে আছে তোমাদের দিকে।
বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল দুই ডাকাত। ক্ৰাচটা বেড়া ডিঙিয়ে এপাশে ছুঁড়ে ফেলল সিলভার। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে উঁচু বেড়াটা ডিঙিয়ে চলে এল এপাশে। অন্য ডাকাতটাও বেড়া ডিঙিয়ে এসে নামল আঙিনায়। প্রবেশপথটা অন্যপাশে। এতটা ঘুরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করল না ওদের কেউ।
পাহারার কথা ভুলে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে ক্যাপ্টেনের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সিলভারের পরনে এখন বাবুর্চির পোশাক নেই। তার বদলে দামি পোশাক পরেছে। তামার বোতাম বসানো মোটা নীল কাপড়ের তৈরি কোটের ঝুল হাঁটু পর্যন্ত নেমেছে। চমৎকার লেস লাগানো হ্যাটটা মাথার পেছন দিকে হেলানো।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। কি বলবে, বলে ফেল চট করে।
বসতে বলবেন না? সিলভারের গলায় অনুযোগ।
ইচ্ছে করলে বালির ওপর বসতে পার। তোমার মত ডাকাতের ওই-ই উপযুক্ত জায়গা, নিস্পৃহ ক্যাপ্টেনের গলা।
অঅ!
ভেবেছিলাম বসবে না, কিন্তু ঠান্ডা বালির ওপরই সঙ্গীকে নিয়ে বসে পড়ল সিলভার। চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, চমৎকার জায়গা। আমার ওপর চোখ পড়তেই হাসল, আরে, জিম, তুমি এখানে!
কিছু বলার থাকলে বলে ফেল! কর্কশ গলায় বললেন ক্যাপ্টেন।
সরাসরি ক্যাপ্টেনের চোখের দিকে চাইল সিলভার। ক্যাপ্টেন, ফ্রিন্টের সমস্ত ধনরত্ন আমার চাই। আর আপনারা নিশ্চয় বেঁচে নিরাপদে দেশে ফিরে যাওয়াটাই সবদিক থেকে বিবেচ্য মনে করবেন। একটা ম্যাপ আছে আপনাদের কাছে, না?
থাকলে?
ওটা দিতে হবে আমাকে।
বাজে বকছ, পকেট থেকে পাইপ বের করলেন ক্যাপ্টেন। ধীরেসুস্থে তামাক পুরে ধরালেন। নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এটা তোমাকে দেবার জন্যে এত কষ্ট করে ট্রেজার আইল্যান্ডে আসেননি মিস্টার ট্রেলনী। পারলে অবশ্য ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে দেখতে পার, কিন্তু সফল হবে না। সেটা তুমি ঠিকই বোঝ, নইলে এখানে মিন মিন করতে আসতে না।
চুপচাপ কি ভাবল সিলভার। হাসল। বলল, আপনাকে দেখে আমারও পাইপ ধরাতে ইচ্ছে করছে।
কোন কথা বললেন না ক্যাপ্টেন। সিলভারকে পকেটে হাত দিতে দেখেও নীরব রইলেন। পকেট থেকে পাইপ আর তামাক বের করে ধরাল সিলভার। নীরবে দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পাইপ টেনে চলল। মজার দৃশ্য!
আগে কথা বলল সিলভারই, ক্যাপ্টেন, এভাবে জেদাজেদি করে কারোই কোন লাভ হবে না। আমার প্রস্তাব দেখুন পছন্দ হয় কিনা। আপনারা সমস্ত ধনরত্ন আমাকে দিয়ে দেবেন। কথা দিচ্ছি, আপনাদের নিরাপদ কোন জায়গায় পৌঁছে দেব হিসপানিওলায় করে। যদি এটা পছন্দ না হয়, অন্য উপায়ও আছে। প্রয়োজনীয় সমস্ত মালপত্র আমরা দুদলের মধ্যে ভাগ করে নেব। তারপর গুপ্তধন নিয়ে চলে যাব আমরা। আপনারা দ্বীপেই থেকে যাবেন। কথা দিচ্ছি এবারেও, পথে প্রথম যে জাহাজটাকে দেখব, আপনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পাঠাব।
পোড়া তামাকটুকু ফেলে দিলেন ক্যাপ্টেন। পাইপের মাথার দিকটা ঠুকলেন বাঁ হাতের চেটোয়। মুখ না তুলেই সিলভারকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলার আছে তোমার?
না।
তাহলে আমার প্রস্তাব শোন এবার। পুরো নিরস্ত্র হয়ে একজন একজন করে দুর্গে আসবে তোমরা। লোহার হাতকড়া পরিয়ে বিচারের জন্যে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাব তোমাদের। আর যদি তাতে রাজি না হও, তোমাদের শেষ লোকটাকে খুন না করা পর্যন্ত আমি, ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার স্মলেট, এই দ্বীপ ছেড়ে নড়ছি না। কোন ভরসায় শর্ত রাখতে এসেছ? তোমাদের আছে কি? ম্যাপ নেই, গুপ্তধন পাচ্ছ না। জাহাজ আছে, কিন্তু ক্যাপ্টেনের অভাবে দ্বীপ ছেড়ে দশটা মাইলও যেতে পারবে না। মারা পড়বে। ভাল যোদ্ধা, সেটাই বা বলি কি করে? পাঁচ পাঁচজনে একটি মাত্র লোক আব্রাহাম গ্রে-কে আটকাতে পারনি। শোন সিলভার, এরপরের বার যদি আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে আস, কোনরকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই কপাল ফুটো করে দেব। বোঝা গেছে? নাউ, গেট আউট।
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সিলভারের চেহারা। হাসি হাসি ভাবটা অদৃশ্য হয়ে গেছে আগেই। দুচোখে আগুনের ঝলক। জোরে জোরে বালিতে পাইপ বুকে জ্বলন্ত তামাকটুকু ঝেড়ে ফেলল সে। পকেটে রেখে দিল আবার পাইপ। পায়ের কাছে পড়ে থাকা ক্ৰাচটা তুলে নিয়ে ওটাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর থুক করে বালিতে থুথু ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আর এক ঘন্টার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করছেন আপনারা। যাদের ভাগ্য ভাল, আমার হাতে ধরা পড়ার আগেই মারা যাবে! ক্রাচে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সিলভার। সঙ্গীকে নিয়ে এগিয়ে গেল বেড়ার কাছে।
পেছন থেকে ওকে ভয়ঙ্কর এক দানবের মত মনে হল আমার।
১৯. আক্রমণ
সিলভার চলে যেতেই আমাদের দিকে চোখ পড়ল ক্যাপ্টেনের। একমাত্র আব্রাহাম গ্রে ছাড়া কেউই নিজেদের জায়গায় নেই, সবাই চলে এসেছে কথা শুনতে। রেগে আগুন হয়ে গেলেন শ্মলেট।
যার যার নিজের জায়গায় যান! কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। মিস্টার ট্রেলনী, ডাক্তার লিভসী, আপনাদের কর্তব্যজ্ঞান দেখে অবাক হচ্ছি আমি। আপনারা নাকি যোদ্ধা ছিলেন? এই ডিসিপ্লিন নিয়ে! আপনাদের দল যে হারেনি এটাই আশ্চর্য! হাত তুলে গ্রে-কে ডাকলেন। গ্রে কাছে আসতেই বললেন, তোমার কথা ডায়েরীতে লিখে রাখছি আমি। দায়িত্বশীল নাবিকের মতোই কাজ করেছো তুমি। তোমার প্রমোশনের ব্যবস্থা আমি নিজে করব। যাও, পাহারায় যাও।
লজ্জিতভাবে মাফ চাইলেন ডাক্তারচাচা আর জমিদার ট্রেলনী। দ্রুত চলে গেলেন যার যার নিজের জায়গায়। অন্যেরাও চলে গেল।
আমি যেতে যেতে শুনলাম, বিড়বিড় করছেন ক্যাপ্টেন, ভীষণ কড়া কথা বলেছি। সিলভারকে। ও সহ্য করবে না কিছুতেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হানা দেবে দুর্গে, জানা কথা। সংখ্যায়ও বেশি। অবশ্য আমরা দুর্গের ভেতর থাকছি। তবুও…এই, এই জিম, সবাইকে ডাক তো এখানে…
আবার সবাইকে কেন ডাকছেন ক্যাপ্টেন, ঠিক বুঝলাম না, কিন্তু আদেশ পালন করলাম। সবাই এসে জড়ো হলে বললেন, যুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু খাওয়াই হয়নি এখনও। আগে কিছু খেয়ে নেয়া যাক। তারপর নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। ওরা আসবেই…
দুর্গের ভেতরে এসে ঢুকলাম সবাই। খাবার তৈরি করে পরিবেশনের ভারটা পড়ল আমার ওপর।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল সবাই। গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললেন ক্যাপ্টেন, ডাক্তার লিভসী, দুর্গের দরজা পাহারা দেবেন আপনি। আড়ালে থাকবেন, যেন কিছুতেই ডাকাতেরা আপনাকে দেখে না ফেলে। হান্টার, পুবের ভার নেবে তুমি। জয়েস, তুমি থাকবে পশ্চিমে। মিস্টার ট্রেলনী, আপনার নিশানা সবচেয়ে ভাল। গ্রে-ও ভালোই যুদ্ধ করতে পারবে, বুঝে নিয়েছি আমি। আপনারা দুজনে সামলাবেন উত্তর দিকটা। বিপদ ওদিকেই বেশি। জিম, তুমি কেবল খালি হয়ে যাওয়া বন্দুকে গুলি ভরবে। তোমাকে আমিও সাহায্য করব। বুঝেছেন আপনারা।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল সবাই।
ঠান্ডা কেটে গেছে। প্রচন্ড গরম পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। গাছপালার মাথার ওপর উঠে এসেছে সূর্য। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বালি। দুর্গের কাঠের রজন গলতে শুরু করেছে রোদ পড়ে। জ্যাকেট খুলে ফেলেছি আগেই। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলাম।
যার যার জায়গায় পাহারায় নিযুক্ত হল যোদ্ধারা। বন্দুক আর গোলা বারুদ জড়ো করে গুলি ভরতে লাগলাম। আমাকে সাহায্য করছেন ক্যাপ্টেন। একেকটা বন্দুকে গুলি ভরা হতেই নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিলাম একেকজন যোদ্ধার হাতে।
কেটে গেল এক ঘন্টা।
কথা রাখল সিলভার। ঠিক একঘন্টা পর গর্জে উঠল কামান। আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই নিজের জায়গায় থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল জয়েস, ক্যাপ্টেন, ডাকাতদের দেখামাত্রই গুলি করব?
অবশ্যই!
কিন্তু গুলি করার মত কাউকেই দেখা গেল না।
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। সবাই সতর্ক আমরা। কেটে যাচ্ছে সময়। হঠাৎই গুলি করে বসল জয়েস। সঙ্গে সঙ্গেই বনের ওদিক থেকে পর পর কয়েকবার গর্জে উঠল বন্দুক। তারপরই শুরু হল একটানা গুলিবর্ষণ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ, সব দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে গুলি। বিধছে কাঠের দেয়ালে। কিন্তু একটা গুলিও কাঠ ভেদ করে দুর্গে ঢুকতে পারছে না। আধ মিনিট পরে হঠাৎই আবার থেমে গেল গুলির আওয়াজ।
কাউকে লাগাতে পেরেছ? জয়েসকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
মনে হয় না!
আপনার ওদিকে কজনকে দেখেছেন, ডাক্তারসাহেব?
তিনটে বন্দুক গর্জেছে।
আপনার? ট্রেলনীকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
সাতটা হবে, ঠিক বলতে পারছি না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পূব আর পশ্চিম থেকে মাত্র একটা গুলি এসেছে। ক্যাপ্টেনের অনুমানই ঠিক। উত্তর থেকেই আসবে আসলে আক্রমণ। অন্য তিন দিকে দুয়েকজন করে রয়েছে শুধু আমাদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে।
আবার সব চুপচাপ। তারপর হঠাৎই শোনা গেল একটা হুল্লোড়। উত্তরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দুর্গের দিকে ছুটে আসছে একদল ডাকাত। ছুটতে ছুটতেই গুলি চালাচ্ছে।
সমানে গুলি চালাচ্ছেন ট্রেলনী আর গ্রে। ফোকরে চোখ রেখে দেখলাম, তিনজন ডাকাত পড়ে গেল। কতটা আহত হয়েছে, দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না, তবে মরেনি কেউই। কারণ, নিজেদের টেনে হিচড়ে নিয়ে আবার গাছপালার আড়ালে চলে গেল তিনজনেই।
মুহুর্মুহু গুলিবৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বেড়ার কাছে চলে এল ডাকাতেরা। ফোকরের ভেতর দিয়ে পুরো একশো আশি ডিগ্রী ঘোরানো যায় না বন্দুকের নল। কাজেই নলের মুখ আর এখন ডাকাতদের দিকে নিশানা করতে পারছে না। সোজা ধেয়ে এল ওরা বেড়ার কাছে। নেতা জোব অ্যান্ডারসন।
এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোকরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে থাকা হান্টারের বন্দুকের নল ধরে ফেলল এক ডাকাত, জোরে ঝাকুনি দিয়েই পিছনে ধাক্কা মারল। চোয়ালে বন্দুকের বাটের প্রচন্ড গুঁতো খেয়ে পেছনে উল্টে পড়ল হান্টার। জ্ঞান হারিয়েছে। ফোকর গলিয়ে বন্দুক বের করে নিল ডাকাতটা।
ওদিকে বেড়া ডিঙোতে শুরু করেছে কয়েকজন ডাকাত। ধপ করে লাফিয়ে নেমে খোলা ছুরি হাতে ডাক্তারচাচাকে আক্রমণ করল একজন।
বদলে গেছে পরিস্থিতি। আমাদের কায়দা করে ফেলেছে ডাকাতেরা। চিৎকার, হুল্লোড়, পিস্তল-বন্দুকের আওয়াজ ছাপিয়ে একটা আর্তস্বর শোনা গেল। একটা ছুরি নিয়ে ছুটে গেলাম শব্দ লক্ষ্য করে।
ফাঁকা জায়গায় ছুরি হাতে লড়ছেন ডাক্তারচাচা। আক্রমণকারী দস্যুর গালের একদিকে ছুরির আঘাতে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি কাছে যাবার আগেই আবার ছুরি চালালেন ডাক্তারচাচা। ফেরাতে গিয়ে বাহুতে আঘাত খেল লোকটা। বুঝে গেল, ডাক্তারচাচার সঙ্গে পেরে উঠবে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল, তারপর ঘুরেই ছুটল ঢাল বেয়ে। তাড়া করে ধেয়ে গেলেন ডাক্তারচাচা।
দুর্গের পেছনে যান সবাই, ক্যাপ্টেনের উত্তেজিত আদেশ শুনতে পেলাম।
ডাক্তারচাচার পেছনে ছুটতে গিয়েও থমকে গেলাম। মোড় নিয়ে ঘুরে ছুটলাম দুর্গের পেছনে। কিন্তু কয়েক গজ এগিয়েই একেবারে অ্যান্ডারসনের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ছুরিটা বাগিয়ে ধরে আমার দিকে তেড়ে এল অ্যান্ডারসন। ছুরির আঘাত বাঁচাতে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এলাম। কিন্তু কিসে যেন পা বেধে গিয়ে পড়ে গেলাম উল্টে। ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করল আমার দেহ। এতে ভালোই হল। আমাকে ছেড়ে গ্রে-কে আক্রমণ করল সে।
ছুরি খেলায় অ্যান্ডারসনের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ গ্রে। সহজভাবে অ্যান্ডারসনের আঘাত প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অ্যান্ডারসনের হাত আর গাল বেয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল।
ওদিকে একজোট হয়ে ডাকাতদের আক্রমণ করেছেন ডাক্তারচাচা, জমিদার আর জয়েস। দুর্গের পেছনে সবাই। বেড়ার ধারে মাটিতে বসে দেখছি। অল্পক্ষণেই পিছু হাঁটতে আরম্ভ করল ডাকাতেরা। এদিকে অ্যান্ডারসনকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে গ্রে।
উঠে পড়লাম। ছুরিটা পড়ে গেছে হাত থেকে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ডাক্তারচাচার কাছে ছুটলাম। তেমন কিছুই করতে পারব না জানি, কিন্তু তবু যদি কিছু সাহায্য করতে পারি? কিন্তু তার দরকার হল না। রণে ভঙ্গ দিয়ে বেড়ার দিকে ছুটেছে ডাকাতেরা। ইতিমধ্যেই বেড়া ডিঙোতে শুরু করেছে অ্যান্ডারসন। আর পাঁচ সেকেন্ড পর একজন জ্যান্ত ডাকাতও রইল না বেড়ার এপাশে।
ডাকাতরা পালিয়ে যেতেই লোকজন কতটা কি ক্ষতি হয়েছে জানা গেল। বেড়ার কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এখনও হান্টার। জয়েসের কাছে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন জমিদারচাচা। এগিয়ে গেলাম। ডাক্তারচাচা বসে পড়ে জয়েসকে একবার পরীক্ষা করলেন। তারপর হতাশভাবে মাথা নাড়লেন এদিক-ওদিক, সব সাহায্যের বাইরে চেলে গেছে!
স্তব্ধ হয়ে গেলেন জমিদার ট্রেলনী। চব্বিশ ঘন্টাও পেরোয়নি, এরই মাঝে দুজন বিশ্বস্ত অনুচরকে হারালেন চিরকালের মত।
সামান্য আহত হয়েছেন ক্যাপ্টেন। গুলি খেয়েছেন কাঁধের কাছে। তেমন কিছু না। ডাক্তারচাচা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। তিনিও আহত হয়েছেন। ছুরির আঘাত। হান্টারেরও জ্ঞান ফেরানো হল। আমার কব্জি থেকেও রক্ত ঝরছে, এতক্ষণ পরে খেয়াল করলাম।
কজন ডাকাত মারা পড়েছে, গুনলাম এবার। বেড়ার ভেতরে আর বাইরে পড়ে থাকতে দেখলাম পাঁচটা লাশ।
২০. আবার সাগরে
বেলা বারোটা নাগাদ লাশগুলোকে কবর দেয়া শেষ করলাম আমরা। তারপর লাঞ্চ সেরে নিলাম। খাওয়ার পর জমিদার ট্রেলনীর সঙ্গে পরামর্শ করে একটা বন্দুক, দুটো পিস্তল, একটা ছুরি আর ম্যাপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডাক্তারচাচা। বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিলেন। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে হেটে গিয়ে ঢুকে পড়লেন পাহাড়ের গোড়ার জঙ্গলে।
আঙিনায় বসে সবই দেখলাম আমি আর আব্রাহাম গ্রে। কোথায় গেলেন ডাক্তারচাচা, ভেবে অবাক লাগল! দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা সরিয়ে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল গ্রে, গেলেন কোথায় ডাক্তার সাহেব?
কোন মতলব আছে নিশ্চয়! বললাম আমি।
বেন গানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন কিনা, কে জানে!
তীব্র কিরণ ছড়াচ্ছে সূর্য। তেতে উঠেছে বালি। আর বসা যাচ্ছে না আঙিনায়। বনের ভেতর গাছপালার ছায়া আছে। ঠান্ডাও বেশ ওখানে। ডাক্তারচাচার পিছু পিছু গেলে মন্দ হয় না! সূর্যের আঁচ থেকে বাঁচতে পারব, কৌতূহলেরও অবসান হবে। পেট ভরাই আছে। দুটো পিস্তল আর কিছু বিস্কুট পকেটে ভরে নিলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম বেড়ার বাইরে। সোজা ছুটে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলে, ডাক্তারচাচা যেখান দিয়ে ঢুকেছেন।
তাকে দেখলাম না। ঘন জঙ্গলের কোথায় হারিয়ে গেছেন, কে জানে! এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু বৃথা। দুর্গে ফিরে যেতে মন চাইছে না। একবার সাগরের দিক থেকে ঘুরে আসার ইচ্ছে চাপল মনে।
গাছপালার ভেতর দিয়ে, ঝোপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি। গাছে গাছে গান গাইছে পাখিরা, ঝোপের ভেতরে পোকামাকড়ের ডাক, পাইনের মিষ্টি গন্ধ, শীতল ছায়া আর বুনো ফুলের চোখ ধাঁধানো রূপ উপভোগ করছি সারাক্ষণ। চলেছি দ্বীপের দক্ষিণ ধারে, ডাক্তারচাচাকে যখন পেলামই না অন্তরীপ পর্যন্ত ঘুরেই আসি।
সামনে সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাতাস বইতে শুরু করল হঠাৎই। এমনিতেই শীতল ছায়ার ভেতর দিয়ে চলেছি, তার ওপর বাতাসে জুড়িয়ে গেল শরীর। সাগরের নোনা গন্ধ মেশানো বাতাস জোরে জোরে টেনে নিলাম ফুসফুসে। একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠল শরীর। একটুও ক্লান্তি অনুভব করছি না।
আরও খানিকটা যেতেই গাছপালার ভেতর দিয়ে চোখে পড়ল ঢেউ খেলানো নীল সাগর। সাদা ফেনায় ঝিলমিল করছে দুপুরের রোদ। এখানকার সাগরের সুন্দর রূপ এই প্রথম দেখলাম। জোর বাতাসে বিশাল সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে। ছল-ছলাৎ শব্দে ফিরে যাচ্ছে আবার ঢেউ, ভেজা বালিতে রেখে যাচ্ছে নোনা ফেনা। অপূর্ব!
আনন্দে শিস দিতে দিতে সাগরের ধার ধরে এগিয়ে চলেছি। অনেকখানি দক্ষিণে গিয়ে বাঁক নিয়েছে তীরভূমি। আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। সাগর এখন আমার পেছনে। সামনে সম্ভবত স্কেলিটন আইল্যান্ড-কঙ্কাল দ্বীপ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম আবার! এতটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে জঙ্গল, ভাবিনি। আরে, এ কোথায় এলাম! সামনেই তো নোঙর করে আছে হিসপানিওলা। সারাক্ষণ একই জায়গায় ঘুরেছি। অথচ আমি ভেবেছি বুঝি বা কতটা পথ পেছনে ফেলে একেবারে দক্ষিণে চলে এসেছি।
হিসপানিওলার মাস্তুলে পতাকা রয়েছে এখনও, তবে ব্রিটেনের পরিবর্তে জলদস্যুদের জলিরোজার ফ্ল্যাগ। জাহাজের দুপাশে বেঁধে রাখা হয়েছে নৌকা দুটো। ডেকের ওপর রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিলভার। লাল টুপি পরা একটা ডাকাতের সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে দুজনেই। লাল টুপির পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও একজন। খানিকক্ষণ কথা বলে পাশের লোকটাকে নিয়ে একটা নৌকায় নামল লাল টুপি। বাঁধন খুলে দাঁড় বাইতে লাগল। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তরীপের দিকে। হ্যাঁ, এইবার অন্তরীপ কোথায় মনে পড়ে গেছে, আর ভুল হবে না। নৌকাটাকে অনুসরণ করার জন্যে আবার বনের ভেতর ঢুকে এগিয়ে চললাম।
কতক্ষণ হেঁটেছি, বলতে পারব না। বেরিয়ে এলাম আবার খোলা জায়গায়। স্পাইগ্লাস পাহাড় দেখা যাচ্ছে। অবাক হয়েই দেখলাম, পাহাড়ের দিকে হেলে পড়েছে সূর্য। পাদদেশের জঙ্গলের মাথায় হালকা ধোঁয়ার মত কুয়াশা জমছে। লালটুপির নৌকাটাকেও হারিয়ে ফেলেছি, দেখতে পাচ্ছি না আর। ওদিকে সাঁঝ হতে বেশি বাকি নেই। রাতের অন্ধকার নামলে ডাকাতের নৌকার দেখা পাওয়া তো দূরের কথা দুর্গে ফেরাই মুশকিল হবে। কিন্তু দুৰ্গটা কোথায়? আঁতকে উঠে উপলব্ধি করলাম, পথ হারিয়ে ফেলেছি।
সাগরের তীর ধরে এগিয়ে চললাম। ইচ্ছে, হাঁটতেই থাকব। এক সময় না একসময় দুর্গের কাছাকাছি পৌছুবই। দূর থেকে পতাকাটা দেখতে পেলে আর অসুবিধে হবে না।
ফার্লংখানেক পেরোতেই একটা প্রকান্ড সাদা মত পাথরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। এটাকে এর আগে কখনও দেখিনি। আসলে এর আগে কখনও এদিকে আসিইনি, দেখব কি করে? এগিয়ে গিয়ে পাথরের রুক্ষ গায়ে হাত বোলালাম। সাঁঝ হয়ে এসেছে। তবে অন্ধকার নামতে কিছুটা দেরি আছে। ধূসর আলোয় পাথরের নিচের ছোট গুহাটা নজরে পড়ল। ঘাস আর লতাপাতায় ঢাকা গুহামুখের চারদিকটা। ভেতরে কি আছে? সাপখোপ? কে জানে কোন ধরনের হিংস্র জানোয়ারও থাকতে পারে এখানে। উবু হয়ে বসে পড়লাম। উঁকি দিলাম ভেতরে। কালো মত কি জানি দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হল। ঈশ্বরের নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। একটু এগিয়ে বুঝে ফেললাম, কালো জিনিসটা কি। একটা তাবু। ছাগলের চামড়ায় তৈরি। ব্রিটেনের জিপসীরা এই ধরনের তাঁবুতেই রাত কাটায়।
তাঁবুটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোন দরজা বা ঢোকার পথ নেই। বসে পড়ে একটা ধার ধরে টান দিলাম। উঠে গেল ওপরের দিকে। ও, কাঠামোটার ওপর কায়দা করে চামড়া বসিয়ে দেয়া হয়েছে শুধু। কেউ নেই। বেন গানের ছাড়া আর কারও তাবু নয় এটা, অনুমান করে নিতে অসুবিধে হল না! তাঁবুর ভেতরে একটা ছোট নৌকা রাখা আছে। ছাগলের চামড়ায়ই তৈরি। ব্রিটেনের অধিবাসীরা চামড়া দিয়ে এমন নৌকা বানায়। এদেরকে ওরা বলে কোরাল। হালকা জিনিস, সহজেই বহন করা যায়। হালকা কাঠের তৈরি একটা দাঁড়ও পড়ে আছে নৌকার পাশে।
নৌকাটা দেখে নতুন এক মতলব এল আমার মাথায়। এতে চড়ে হিসপানিওলায় চলে গেলে হয়ত ডাকাতদের আগামী পরিকল্পনা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনে ফেলতে পারি।
আঁধার নামছে বাইরে। বিস্কুটগুলো খেয়ে নিলাম! পিস্তল দুটো একবার পরীক্ষা করে নিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর নৌকাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে।
যে পথে এসেছি, সেই পথে হাঁটা শুরু করলাম। সাগরের ধার ধরে হাঁটছি, কাজেই হিসপানিওলা কোথায় নোঙর করা আছে খুঁজে পেতে অসুবিধে হবার কথা নয়। অগত্যা যদি না-ই পারি, নৌকা ভাসিয়ে তীর ধরে বেয়ে যাব। একসময় না একসময় জাহাজটা দেখতে পাবই। তাছাড়া রাতের বেলা আলো জ্বলবে জাহাজে, দূর থেকেও চোখে পড়বে এই আলো। আর হিসপানিওলাকে একবার খুঁজে পেলে দুৰ্গটা খুঁজে পাওয়াও সহজ হবে।
হালকা হলেও কতই বা হালকা হবে একটা নৌকা। তার ওপর একটা দাঁড়ও সঙ্গে আছে। বেশিক্ষণ বয়ে নেয়া সম্ভব হল না আমার পক্ষে। অগত্যা পানিতে ভাসিয়ে তীর ধরে বেয়ে চলাই ঠিক মনে করলাম। ভাটাও শুরু হয়ে গেছে। কাদা পানি ভেঙে একটু বেশি পানিতে নিয়ে গিয়ে নৌকা ভাসালাম। নৌকায় চড়েই টের পেলাম এই জিনিস সামলানো বড় কঠিন।
দাঁড় বেয়ে চলেছি। কিন্তু পথ আর ফুরায়ই না। কতক্ষণ চলেছি জানি না, অন্ধকারে হিসপানিওলাকে প্রায় এড়িয়েই চলে যাচ্ছিলাম। আলো জ্বালেনি জাহাজে ডাকাতেরা। অন্ধকারে আবছা কালো এক বিশাল দানবের মত হিসপানিওলার অবয়ব হঠাৎই ফুটে উঠল চোখের সামনে। নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
নৌকা ঠেকালাম জাহাজের গায়ে। জাহাজের কোথায় নৌকা বাঁধতে হয় জানি। কোরাটাকে বাঁধতে গিয়েই খেয়াল হল আমার, বোট নেই। কে জানে, ওদিকে বাঁধা আছে হয়ত। কিন্তু তা তো নিয়ম নয়!
কোরাকটাকে বেঁধে দাঁড়টাকে ফেললাম নৌকার খোলে। দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠতে যাব এই সময় উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল ডেক থেকে। চমকে উঠলাম। গলাটা ইসরায়েলের। কারও সঙ্গে তর্ক বাধিয়েছে সে। দ্বিতীয় লোকটার কর্কশ কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে চেঁচামেচি। একটা ব্যাপারে অবাক লাগল, মাত্র দুজন লোকের গলাই শোনা যাচ্ছে, তৃতীয় আর কেউই নেই। বাতিও নেই জাহাজে। ব্যাপারটা কি?
হঠাই শোনা গেল ধাতব শব্দ। আঁতকে উঠলাম। এই শব্দ আমার চেনা। ছুরির সঙ্গে ছুরির ঘষা। সেই সঙ্গে তুমুল গালাগালি। জড়িত কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে, দুজনেই মাতাল। আচমকা আর্তনাদ করে উঠল একজন। তীক্ষ্ণ, লম্বিত আর্তকণ্ঠ। ধপ করে একটা আওয়াজ হল, ময়দার বস্তা কাঠের ডেকে গড়িয়ে পড়লে যেমন হয়। তারপরেই সব চুপ। খুন হয়ে গেল নাকি একজন লোক?
আর দ্বিধা না করে তাড়াতাড়ি উঠে এলাম। রেলিং ধরে তীক্ষ্ণ চোখে ডেকের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে আবছা মত দেখা গেল চিত হয়ে ডেকের ওপর পড়ে আছে। একজন লোক। আরেকজন বসে কুকুরের মত হাঁপাচ্ছে। তার হাঁপানির শব্দও শুনতে পাচ্ছি পরিষ্কার। ইসরায়েল হ্যান্ডস বেঁচেই আছে।
পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলাম। অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি জাহাজে আর কোন লোক নেই। ডেকে পড়ে আছে একটা ডাকাতের লাশ। জীবিত বলতে ইসরায়েল হ্যান্ডস আর আমিই আছি এখন জাহাজে। অন্য লোকগুলো কোথায় গেল? বোট নেই। তারমানে এই দুজনকে পাহারায় রেখে দলবল নিয়ে দ্বীপে চলে গেছে সিলভার।
নিঃশব্দে রেলিঙ টপকালাম। তারপর নিঃশব্দেই হেঁটে এসে দাঁড়ালাম ইসারালের পেছনে। মৃদু কণ্ঠে বললাম, যেখানে আছ বসে থাক, ইসরায়েল, নইলে খুলি উড়ে যাবে!
কে? আঁতকে উঠে ঘাড় ফেরাল ইসরায়েল। অন্ধকারে আমাকে চিনতে একটু সময় নিল। ফিসফিস করে বলল, জিম না?
হ্যাঁ, আমি জিমই! জাহাজে আর কে আছে?
আর কেউ নেই। জিম, আমি আহত। প্লীজ, একটা বাতি ধরাও। একটু রাম আনবে…
পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। বাতি আর দিয়াশলাই কোথায় আছে, জানি আমি। অন্ধকারেই দুটো জিনিস খুঁজতে গিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকল। যে জিসিটা যেখানে থাকার কথা, নেই। তবে ওয়াল কেবিনেটের ড্রয়ারে দিয়াশলাই খুঁজে পেলাম। একটা কাঠি জ্বালতেই কেবিনের ভেতরটা দেখতে পেলাম। তছনছ লন্ডভন্ড করে রাখা হয়েছে পুরো ঘরটা। তন্নতন্ন করে কিছু খোঁজা হয়েছে। বোধহয় ম্যাপটাই খুঁজেছে সিলভার।
লণ্ঠন নিয়ে ডেকে বেরিয়ে এলাম আবার। তেমনিভাবে বসে আছে ইসরায়েল। গাল আর কপালের চামড়া কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। হাতেও রক্ত। ডান উরু থেকে নিচের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে।
জিম, বলল ইসরায়েল। ডান পা-টা বোধহয় ভেঙেই গেছে! আহ! একটু রাম এনে দেবে আমাকে?
ইসরায়েলের হাতখানেক দূরে পড়ে থাকা লাশটার দিকে তাকালাম। বুকে বিঁধে আছে একটা বড় ছোরা। গত কয়েকদিনে এত খুনোখুনি দেখেছি, এই লাশটা দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া হল না আমার। লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে ভাড়ারের দিকে চললাম। পুরো জাহাজটাকে লন্ডভন্ড করে ফেলেছে ডাকাতেরা। প্রচন্ড এক ঝড় বয়ে গেছে যেন ছিমছাম হিসপানিওলার ওপর দিয়ে।
মদ এনে দিলাম ইসরায়েলের হাতে। এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে ফেলল সে। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে আমার অনেক গুণগান করল। তাতে মজলাম না আমি। ইসরায়েলকে উঠে দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু পা ভেঙে যাবার দোহাই দিয়ে উঠল না সে। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম না। সন্দেহ হচ্ছে আমার। পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে তাক করলাম। ওই কেবিনে চল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হেঁচড়েই চল!
পিস্তলটার দিকে একবার তাকাল ইসরায়েল। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও নড়ল। দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ঢুকল কেবিনে। খুঁজেপেতে একটা তালা এনে দরজা বন্ধ করলাম। রাতটা কেবিনেই কাটাক ইসরায়েল, সকালে দেখা যাবে কি করা যায়। এই সময় আর দুর্গে ফিরতে ইচ্ছে হল না আমার। তাছাড়া অন্ধকারে পতাকাটা দেখা যাচ্ছে না, খুঁজে পাব না দুৰ্গটা। জাহাজেই রাত কাটানো স্থির করলাম। সিলভার ফিরে এলে দূর থেকেই তার নৌকা দেখতে পাব। লুকিয়ে পড়তে পারব তখন কোথাও। কাজেই একটা গদি এনে কেবিনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম। সারাটা দিন ভয়ানক পরিশ্রম করেছি। আরাম পেয়ে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দুচোখ…
চোখেমুখে রোদের ছটা লাগতে ঘুম ভাঙল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। রাতের বেলা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। না, সিলভার ফিরে আসেনি। তাহলে এত বেলা পর্যন্ত এভাবে ঘুমোতে পারতাম না।
চোখ ডলতে ডলতে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাহাড়টাকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একি? এ তো পাই-গ্লাস পাহাড় নয়! আশপাশের বন আর তীরভূমিও কেমন যেন অচেনা। পাহাড়টা একটা অন্তরীপের ওপারে। গাছপালা তেমন নেই। চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট উঁচু উঁচু বড় বড় পাথরে ছাওয়া অন্তরীপ। জাহাজ থেকে তীর বড় জোর সিকিমাইল দূরে। কিন্তু এখানে কে আনল জাহাজ।
নোঙর পরীক্ষা করতেই বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা। কোন কারণে নোঙর তুলে ফেলা হয়েছে হিসপানিওলার। মাতাল অবস্থায় নিশ্চয় এই কাজ করেছে ইসরায়েল। ভাটার সময় জায়গামতোই ছিল জাহাজটা। কিন্তু জোয়ার আসতেই দক্ষিণা স্রোতের টানে ভেসে চলে এসেছে অন্তরীপের কাছে, রাতের বেলা।
কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইসরায়েল কেমন আছে জানা দরকার। পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলতে গিয়েও একটা কথা মনে পড়ায় ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে ইসরায়েল। তারমানে তার পা ভাঙেনি, মিছে কথা বলেছে।
হাত দিয়ে পকেটের পিস্তল স্পর্শ করে নিলাম একবার। তারপর খুলে দিলাম তালা। দরজা খুলেই দেখি, মেঝেতে বেকায়দা ভঙ্গিতে বসে আছে ইসরায়েল। আমাকে দেখেই পা ভাঙার অভিনয় শুরু করেছে আবার। আরও সাবধান হতে হবে, নিজেকে হুঁশিয়ার করলাম।
ইসরায়েল জানাল, খিদে পেয়েছে তার। ওকে বসতে বলে খাবার আনতে ভাড়ারে গেলাম। রাম আর নেই। খুঁজেপেতে একটা ব্র্যান্ডির বোতল বের করলাম। কিন্তু সামান্যই অবশিষ্ট আছে তাতে। কিছু বিস্কুট নিলাম, আর নিলাম ভিনিগারে ভেজানো ফল, কিছু কিসমিস আর এক টুকরো পনির। ফিরে এলাম কেবিনে। তেমনি বসে আছে ইসরায়েল। এ বোতলটা আর কিছু খাবার তুলে দিলাম ইসরায়েলের হাতে। তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসলাম আমি।
জাহাজটা এখন আমার দখলে, খেতে খেতে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলাম ইসরায়েলকে। খেয়ে উঠেই পতাকাটা বদলে ফেলব।
খাওয়া শেষ করে কেবিনেট খুঁজে একটা পতাকা বের করলাম, ব্রিটেনের পতাকা। তারপর গিয়ে জলি রোজার খুলে ফেলে তার জায়গায় দেশের পতাকা ওড়ালাম। পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত থাকার সময় কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েল, টের পাইনি। আচমকা ঘাড়ের কাছে শীতল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ঘুরতে যেতেই ইসরায়েলের ভয়ঙ্কর গলা শোনা গেল, খবরদার! নড়বে না। আমার পকেটে তার হাত ঢুকে গেল। পিস্তল দুটো বের করে নিল। তারপর বলল, পতাকা যেটা খুশি ওড়াও, ওসব পাগলামিতে কিছু যায় আসে না আমার! ঘাড়ের কাছে থেকে ছুরিটা সরিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সে।
ঘুরে তাকালাম। তেমনি ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বলল সে, জাহাজ এখন আমার দখলে। যা বলছি, শোন। নোঙর তুলে দাও। পাল ওড়াও। তারপর আমি যেদিকে বলব, নিয়ে যাবে।
কি আর করব। পালগুলো জায়গামত খাটানোই আছে। দড়িগুলো টান টান করে বেঁধে দিলেই হল। দিলাম। স্রোতের টানে এমনিতেই ভাসছিল জাহাজ। বাতাস লেগে ফুলে উঠল পাল। গতি বেড়ে গেল। হাল ধরলাম আমি। সত্যিই, জাহাজটা চালানো তেমন কঠিন নয়, জমিদার ট্রেলনী ঠিকই বলেছেন। কিন্তু জীবনে এই প্রথম হাল ধরলাম, ভুল হতেই লাগল। তবু এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলল জাহাজ।
অনুকূল বাতাস আর স্রোতের টানে দুপুর নাগাদ দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে গেলাম। দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে নর্থ ইনলেটের মুখ পর্যন্ত চলে এলাম সহজেই। পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করছে ইসরায়েল।
খাড়ির মাইল দুয়েক ভেতরে ঢুকতে হবে এবার। প্রবেশ পথ খুবই সঙ্কীর্ণ। সাবধান না থাকলে যে-কোন সময় চড়ায় আটকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে জাহাজ। হাল ধরল এসে ইসরায়েল। নিপুণ হাতে চালিয়ে নিয়ে চলল। খুব ধীরে সমস্ত বাধাবিপত্তি এড়িয়ে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। এদিক-ওদিক বার বার মোড় নিতে হচ্ছে। একটা মোর ঘুরতেই সামনে পড়ল বালির চড়া। আর এগোনো যাবে না।
থামাতে দেরি করে ফেলল ইসরায়েল। ঘটে গেল চরম বিপত্তি। প্রচন্ড জোরে বালির চড়ায় ধাক্কা খেল হিসপানিওলা। একটা পাশ উঠে পড়ল বালিতে। কাত হয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী। ভয়ানক জোরে নড়ে উঠল হাল, ঘুরে গিয়ে বাড়ি মারল ইসরায়েলের চোয়ালে-মাথায়। রেলিঙ টপকে ছিটকে গিয়ে পানিতে পড়ল লোকটা। অগভীর পানির তলায় চকচকে বালিতে বেকায়দা ভঙ্গিতে বেঁকে পড়ে রইল সে। ভাবলাম, উঠে পড়বে কিন্তু উঠল না। মাথার কাছ থেকে কালচে-লাল তরল পদার্থের একটা সূক্ষ্ম ধারা রঙিন ধোয়ার মত উঠতে লাগল। বিমূঢ়ের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
আধ মিনিট পরেই ইসরায়েল হ্যান্ডসের দেহের ওপর এসে স্বচ্ছন্দে নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল ছোট ছোট মাছ।
২১. শত্রু শিবিরে
জাহাজে আমি এখন একা। ভাটা শুরু হয়েছে আগেই। পশ্চিম আকাশে ঢলেছে সূর্য। অ্যাংকোরেজের ওপর দিয়ে পশ্চিম উপকূল পেরিয়ে এসে জাহাজের ওপর নকশাকাটা ছায়ার সৃষ্টি করেছে বড় বড় পাইনের ছায়া। পড়ন্ত বিকেলের মৃদু বাতাসে অজানা বুনো ফুলের সুবাস। পুবের পাহাড়ে বাধা পেয়ে আসা ঝিরঝিরে বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে জাহাজের পাল। পুরো হিসপানিওলাকে কেমন যেন ভূতুড়ে জাহাজের মত মনে হচ্ছে এখন আমার। আর থাকা যায় না এখানে। দুর্গে পৌঁছানোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এবারে আর পথ হারাব না, চেনা হয়ে গেছে। দ্বীপের ধার ধরে ধরে এগিয়ে সহজেই পৌঁছে যেতে পারব স্কেলিটন আইল্যান্ডের ধারে। আসার সময় বার বার দেখে নিয়েছি কোন্ দিক দিয়ে যেতে হবে। কাছাকাছি যেতে পারলে পৌঁছানো কঠিন হবে না।
কাত হয়ে থাকা জাহাজের দড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলাম ভেজা বালিতে। কাদাপানি ভেঙে এসে উঠলাম তীরে। আরেকবার জাহাজটার দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটা দিলাম।
পুরো অ্যাংকোরেজে সাঁঝের ছাঁয়া নামছে। পুবের আকাশে সোনালী আলো, ধীরে ধীরে গাঢ় লাল রক্তের রঙে রূপ নিচ্ছে। আধ মাইল মত এগোতেই হালকা হয়ে এল জঙ্গল। ডুবে গেল সূর্য।
গোধূলির ধূসর আলোতে ছায়াঢাকা বনের বাইরে দ্বীপের তীর ধরে এগিয়ে চলেছি। একটা ছোট পাহাড় পেরোলাম। ছোট একটা নদী পেরোলাম। পেরিয়ে এলাম দুটো ছোট পাহাড়ের মাঝের উপত্যকা। চলেছি তো চলেছিই, বিরাম নেই।
রাত হয়েছে। কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে রত্নদ্বীপ। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলেছি। কালো অন্ধকারে সাদাটে বালির সৈকত আবছা ধূসর দেখাচ্ছে। আকাশে রাশি রাশি তারার মেলা। কালো আকাশের চাঁদোয়ায় মণি-মুক্তোর কাজ করেছে যেন কোন নিপুণ শিল্পী।
পথে এক জায়গায় একটা ঝর্নার ধারে বসে, জাহাজ থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা বিস্কুট আর কিসমিস বের করে খেলাম। তারপর আবার শুরু হল চলা।
মাঝরাত পেরোল। হঠাৎই খেয়াল করলাম, কালো অন্ধকার কেটে গেছে। কেমন ধুসর হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। পুব আকাশে হলুদ আলোর আভাস। চাঁদ উঠছে, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। খুশি হয়ে উঠল মনটা। এবারে পথ চলা অনেকখানি সহজ হবে।
ক্রমেই আরও ওপরে উঠে এল চাঁদ। গাছপালার মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গায় পড়েছে এসে জ্যোৎস্না। পরিষ্কার সাদা বালির রঙ হয়ে উঠেছে হলদেটে।
স্কেলিটন আইল্যান্ডে পৌঁছুতে হল না, একেবারে দুর্গেই পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের মাথায় কাঠের দুৰ্গটা চাঁদের আলোয় কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম মুহূর্তের জনন্য। বাড়ি ফেরার আনন্দ অনুভব করছি। ছুটলাম।
এক ছুটে এসে দাঁড়ালাম বাইরের বেড়ার প্রবেশ পথের কাছে। তারপর ঢুকে পড়লাম। দুর্গের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ ভেসে এল। ডানা ঝটপটানির শব্দ। ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে।
অন্ধকার ঘর। আলো জ্বলেনি কেন? দুই পা এগিয়েই হোঁচট খেলাম, শুয়ে থাকা কারও গায়ে পা পড়েছে। কে! উত্তেজিত কণ্ঠে ধমকে উঠল লোকটা।
আশ্চর্য তো! কে এই লোক!
ঠিক এই সময়ই ধাতব কণ্ঠে ডাক শোনা গেল, পিসেস অভ এইট…পিসেস অভ এইট…পিসেস অভ এইট…
চু-উ-প! কর্কশ কষ্ঠে ধমকে উঠে পাখিটাকে থামাল সিলভার। পরক্ষণেই জ্বলে উঠল দিয়াশলাইয়ের কাঠি।
মশালের রক্তিম আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ভেতরটা। কাঠের দেয়ালে ছায়া কাঁপছে। মোট ছয়জন লোক দেখতে পাচ্ছি।
সিলভারের কাঁধে চড়ে বসেছে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট, অর্থাৎ তোতা পাখিটা। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে পালকগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে। আগের চেয়ে রুগ্ন হয়ে গেছে লঙ জন সিলভার, চেহারা ফ্যাকাসে। পরনে সেই তামার বোম লাগানো নীল কাপড়ের বুল-কোট। আমাকে দেখে হাসল, আরে, জিম হকিন্স যে! আকাশ থেকে নামলে মনে হয়! কিছু বললাম না।
পাইপ বের করে তামাক ঠাসল সিলভার। তারপর ডাকল, এই ডিক, একটু আগুন দাও তো!
পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে টানতে টানতে বলল, তুমি হুট করে এসে ঢুকে পড়লে যে? জানো না নাকি কিছু?…ও, তোমার জানার তো কথা নয়…তা এসো, তোমাকে বন্ধুভাবেই নেব। একটু থেমে মশালের আলোয় আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, মনে হয় অনেক পথ পেরিয়ে এসেছ, অনেক ধকল গেছে। প্রথমেই বুঝেছিলাম চালাক ছেলে, কিন্তু এতটা চালাক, বুঝিনি! তা চালাক হওয়া ভাল। মাথা ঝাকাল সিলভার।
চুপ করে রইলাম।
পাইপে জোরে জোরে কয়েকটা টান দিল সিলভার। দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা সরিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, জিম, চালাক ছেলে আমার পছন্দ। হোটবেলায় তোমারই মত চঞ্চল ছিলাম আমি, রোমাঞ্চ ভাল লাগত। …তা এক কাজ কর না, আমার দলে চলে এসো। ট্রেজার আইল্যান্ডের ধনরত্ন আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নাও। কে জানে একদিন হয়ত তুমি নিজেই একটা জাহাজ কিনে নিয়ে ক্যাপ্টেন হতে পারবে। …আসবে?
এখুনি বলতে হবে? আমাকে এখনও মোটামুটি ভাল চোখেই দেখে সিলভার, জেনে সাহস পেলাম কিছুটা।
ভেবেচিন্তেই বল।
তাহলে তার আগে জানতে হবে ডাক্তার লিভসী, স্কোয়্যার ট্রেলনী, ক্যাপ্টেন স্মলেট…এরা কোথায়।
তা তো ছাই আমিও জানি না! সিলভার সত্যি কথাই বলছে, মনে হল আমার।
ও। কিন্তু তোমার দলে গিয়ে লাভ কি, সিলভার? তোমাদের অবস্থা এখন শোচনীয়। লোকজন বেশির ভাগই মারা পড়েছে, ম্যাপ নেই, গুপ্তধনের আশাও গেছে, জাহাজটাও হারালে…ওহহো, বলেই নিই, ব্রায়ানকে খুন করেছে ইসরায়েল। রাতের বেলা বোধহয় মাতাল হয়েই ওরা নোঙর তুলে ফেলেছিল, স্রোতের টানে ভেসে যায় জাহাজ। আমিও ছিলাম তখন ওতে, তোমাকে খুঁজতেই গিয়েছিলাম। তারপর জোর করে আমাকে জাহাজ চালিয়ে নিতে বাধ্য করে ইসরায়েল। তারপর আচমকা এক বালির চড়ায় ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে গেছে জাহাজ। হালের বাড়ি খেয়ে বোধহয় ঘাড় ভেঙেই মারা গেছে ইসরায়েল।
বোকার মত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সব কটা ডাকাত। জোর দিয়েই বললাম, ভেড়ার দলে কেন আসব…
তবে রে! কোমর থেকে ছুরি খুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠল এক ডাকাত। মরগান। স্পাই-গ্লাস সরাইখানার সেই লোকটা।
খবরদার, মরগান! চেঁচিয়ে উঠল সিলভার, বাড়াবাড়ি আমি একদম পছন্দ করি না! ফিরে এসো বলছি!
দাঁড়িয়ে পড়ল মরগান। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল এক ডাকাত, কেন ঠিকই ত করছে মরগান। পুঁচকে শয়তানটা আমাদের ভেড়ার পাল বলে…
হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই করছে ও, মরগানের পক্ষে সায় দিল আরেকজন।
ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকাল সিলভার। চোখে আগুন। চাপা ভয়ঙ্কর গলায় বলল, কি হল, আমাকেই ধরে মারবি মনে হচ্ছে? ঠিক আছে, আয় দেখি, আয় ছুরি নিয়ে আয়, দেখি কার ঘাড়ে কটা মাথা! আয়…কি হল হাঁদার দল, আয়!
সিলভারের এই ভয়ঙ্কর মূর্তি এর আগে নিশ্চয় ওরই ডাকাতগুলোও দেখেনি। ফুটো বেলুনের মত চুপসে গেল ওরা।
কি হল আসিস না কেন? কর্কশ কণ্ঠে বলল সিলভার। প্যান্ট খারাপ করে ফেললি? আহ, কি বাহাদুর রে একেকজন। শুনে রাখ, এই ছেলেটিকে পছন্দ করি আমি, কাজেই ওর ওপর কারও হাত তোলা চলবে না। তোদের যে-কারও চেয়ে ভাল সে।
কোন কথা নেই আর কারও মুখে। মশালের আলোয় বিস্মৃত সব ছায়া নাচছে কাঠের দেয়ালে। বুকের ভেতরটা দুপদাপ করছে আমার, কিন্তু তবু ক্ষীণ একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আমাকে খুন করবে না সিলভার।
রূপ পাল্টে গেছে সিলভারের। দাঁতের ফাঁকে পাইপ, হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা, মুখের ভাব শান্ত, কাঁধে চুপচাপ বসে থাকা তোতাপাখি, ইত্যাদি সব মিলিয়ে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে ওকে। আর যাই হোক, অন্তত ডাকাতের মত নয়।
ফ্যাকাসে মুখ তুলে বার বার সিলভারের দিকে তাকাচ্ছে ডাকাতেরা। উসখুস করছে।
অনেকক্ষণ একটানা চুপচাপ পাইপ টানল সিলভার। তারপর দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা বের করে থুথু ফেলল মাটিতে। সঙ্গীদের সবার মুখের দিকে তাকাল একবার করে। শেষে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে মনে হচ্ছে, তোমরা?
দেখ সিলভার, একজন বলল, কিছু প্রশ্ন আছে আমাদের। তোমাকে নেতা মেনেছি, জবাব তোমাকে দিতেই হবে। দয়া করে যদি বাইরে আস… উঠে দাঁড়াল লোকটা। তারপর ধীর শান্ত পায়ে হেঁটে ঘরের বাইরে চলে গেল। একে একে তাকে অনুসরণ করল অন্য ডাকাতেরা। ঘরে রয়ে গেলাম কেবল আমি আর সিলভার।
লক্ষণ খারাপ, মৃদু কণ্ঠে বলল সিলভার। আমাকেও মানতে চাইছে না এখন ওরা। নাহ, আর কোন আশাই নেই… এদিক-ওদিক মাথা দোলাল সে।
মানে? জিজ্ঞেস করলাম।
ধনরত্ন তো পেলামই না, গলাটাও ফাঁসির দড়ি দেখছে। তার আগে ওই ব্যাটারাই হয়ত শেষ করে দেবে আমাকে। ওদের মত লোক নিয়ে দল গড়লে পরিণতি এমনি হবে, আগেই বোঝা উচিত ছিল! আমিও এমন ভুলটা করলাম!
হুট করে বলে বসলাম, এই মুহূর্তে তুমি মরলে, আমিও বাঁচতে পারব না। এসো, আমরা দুজনে মিলে রুখে দাঁড়াই।
চমৎকার! এই তো কাজের ছেলের মত কথা! তোমার কানাকড়ি বুদ্ধি আর সাহস ওই হারামজাদাদের ঘটে থাকলেও এমনভাবে হেরে যেতাম না।
পাইপের পোড়া তামাকটুকু ফেলে দিয়ে নতুন করে তামাক ভরল সিলভার। ধরাল। কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, জানি, কথাটা শুনলে হাসবে তুমি! কিন্তু বিশ্বাস কর, এই মুহূর্ত থেকে জমিদার ট্রেলনীর দলে যোগ দিলাম আমি। তুমি সাক্ষী। কি, আমার হয়ে বলবে তো জামিদারের কাছে?
বলব, নির্দ্বিধায় জবাব দিলাম।
বেশ, সত্যি কথাটা বলা যায় এবার তোমাকে। সকালে আমার কাছে এসেছিলেন ডাক্তার লিভসী। ম্যাপটা দিয়ে গেছেন। বুদ্ধু বনে গিয়েছিলাম তখন! ঈশ্বরই জানে, ব্যাপারটা কি!
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমিও। বোকার মত চেয়ে রইলাম সিলভারের দিকে।
এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, বুঝল সিলভার। শ্রাগ করল। নড়েচড়ে উঠে আবার যুত করে বসল কাঁধের তোতাটা।
বাইরে আমি যাচ্ছি না, জিম, বলল সিলভার। আসলে খুন করতে ডাকছে ওরা আমাকে। যুদ্ধের জন্যে তৈরি থাক।
২২. আবার ব্ল্যাক স্পট
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ডাকাতটা, মরগানের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে। বাইরে থেকেই ভয়ে ভয়ে চাইল সিলভারের দিকে।
ডাকাতটার দিকে একবার চোখ তুলে চেয়েই আবার ফোকরে চোখ রাখলাম। বাইরে ডাকাতেরা কি করছে দেখছি। আঙিনার এক জায়গায় আগুন ধরিয়েছে ওরা, গোল হয়ে ঘিরে বসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দূত পাঠিয়েছে। যে ছুরিটা নিয়ে আমাকে তেড়ে এসেছিল মরগান, ওটা এখনও হাতে আছে ওর। বাব বার বালিতে গাঁথছে, বের করছে। উত্তেজিত চেহারা। চাঁদের আলোয় বাইরের জঙ্গলকে কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।
এসো, ঢুকে পড়, দরজায় দাঁড়ানো ডাকাতটাকে ডাকল সিলভার। দূতকে খেয়ে ফেলি না আমি।
একবার হাস্যকরভাবে অঙ্গভঙ্গি করল লোকটা, দারুণ ভয় পাচ্ছে সিলভারের কথায়। একটু যেন ভরসা পেল, ঢুকেই পড়ল। আস্তে করে ডান হাতটা বাড়াল। মুঠোয় আছে কিছু।
কি ওটা? আমাকে বলল সিলভার। এই জিম, নাও তো দেখি।
এগিয়ে গিয়ে নিলাম। একটা কাগজের ছোট টুকরো। সিলভারের কাছে নিয়ে এসে দিলাম।
মশালের আলোয় জিনিসটা দেখল সিলভার। আমিও দেখলাম। একি?
হুমম, ঠিকই অনুমান করেছিলাম, বলল সিলভার। আমাকে ব্ল্যাক স্পট দিয়েছে! আরে, বাইবেলের পাতা ছিড়ে লিখেছে দেখছি!
হ্যাঁ, সায় দিয়ে বলল দূত।
কোন ব্যাটা ডাকাত আবার বাইবেল সঙ্গে রাখে?
ডিক।
ব্যাটা হাঁদারাম! বাইবেলটা পড়তে বলগে ওকে, মরার আগে প্রার্থনা করে নিক।
উল্টো দিকেও লেখা আছে, বলল দূত।
কাগজের টুকরোর উল্টো পিঠে হাতে লেখা কথাগুলো পড়ল সিলভার। হাসি ফুটল মুখে, বা-বা-বা! আমাকে পদচ্যুত করেছে! মাথামোটা গাধারা এছাড়া আর কি-ইবা করবে! চমৎকার জিনিস নিয়ে এসেছ হে তুমি, জর্জ!
তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে, সিলভার। ব্ল্যাক স্পট তো পেলেই, বলল জর্জ। দেখে নিয়েছে সে, সিলভারের হাতে ছুরি নেই।
তোমাদের ব্ল্যাক স্পটের কোন দামই নেই আমার কাছে, গম্ভীর হয়ে গেছে সিলভার।
আছে, এখন আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তোমাকে ব্ল্যাক স্পট দেবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই অভিযানটা তুমিই ভন্ডুল করেছ, এক নাম্বার। শত্রুদেরকে দুর্গ থেকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছ, দুই নম্বর ওদের আক্রমণ করতে চাও না, কেন কে জানে! এই হল তিন নাম্বার। আর চার নাম্বার হল, এই বিচ্ছু ছেলেটাকে বাঁচাতে চাইছ। কেন?
আর কিছু বলার আছে তোমার?
তোমাকে ব্ল্যাক স্পট দিতে এইই যথেষ্ট।
ঠিক আছে, চারটে কারণেরই উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছি। অভিযান আমি পন্ড করিনি, করেছ তোমরা। আমার কথামত চলনি, চললে আজ এই অবস্থায় পড়তে না। শত্রুদেরকে কেন ছেড়ে দিয়েছি, জিজ্ঞেস করছ? তোমরা তো মারামারি করে কেউ মাথা ফাটিয়েছ, কেউ শরীরের ওপর অত্যাচার করে রোগ বাধিয়েছ, ওই ডাক্তার লিভসী কি তোমাদের ওষুধ দেননি? সকালে দয়া করে তোমাদের না দেখলে এতক্ষণে দুনিয়ায় থাকতে কিনা, সন্দেহ। আর ক্যাপ্টেন স্মলেটকে ছাড়া দেশে ফিরবে কি করে শুনি? এখন এই বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে পড়েছ। একে মেরে ফেললে কি লাভ হবে? বরং এ বেঁচে থাকলেই আমাদের লাভ। ও আমাদের পক্ষে দুচার কথা বললেও বলতে পারে। কে জানে, দয়া করে আমাদের ছেড়েও দিতে পারেন স্কোয়্যার ট্রেলনী, কাঠের দুর্গে গম গম করছে সিলভারের ভরাট কণ্ঠস্বর। একটানা কথা বলে থেমে দম নিল খোঁড়া দস্যু। তারপর কোমরের বেল্টের খোপ থেকে অয়েল ক্লথে মোড়ানো একটা ছোট প্যাকেট বের করল। এই প্যাকেট আমার অতি পরিচিত। নাও, দেখ, বলে প্যাকেট খুলে হলদেটে ম্যাপটা বের করল সে। এগিয়ে এসে ওটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল জর্জ। একবার দেখেই চেঁচিয়ে ডাকল সঙ্গীদের।
কে কার আগে ঢুকবে, ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে এসে ঢুকল ডাকাতগুলো। বেড়াল যেমন ইঁদুরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তেমনি ওরাও ম্যাপটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। একজনের হাত থেকে আরেকজন ছিনিয়ে নিচ্ছে, গালমন্দ করছে, হি হি করে হাসছে, একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে লোকগুলো।
হ্যাঁ, এক্কেবারে আসলটা! বলল মরগান। ওই তো, জে. এফ. লেখা রয়েছে!
কিন্তু ধনরত্ন পেলেই বা লাভ কি! হঠাৎই যেন ম্যাপের ওপর থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে জর্জ, ওগুলো নিয়ে দেশে ফিরব কি করে? জাহাজ কই?
তাই তো! মুখ তুলল মরগান।
এবার কিন্তু আর আমাকে দোষ দিতে পারবে না, বলল সিলভার। ধনরত্ন চেয়েছিলে তোমরা, সন্ধান দিয়েছি আমি। কি করে, কাকে নিয়ে দেশে ফিরবে, আমি কিছু জানি না।
প্লীজ, সিলভার! বারবিকিউ! মরগান ছাড়া অন্য সবাই হাতজোড় করতে লাগল, তুমিই আমাদের ক্যাপ্টেন! এভাবে আমাদের ঠেলে দিও না!
গুড গুড! হাসল সিলভার। এই তো লক্ষ্মী হয়ে উঠেছে ছেলেরা! তোমাদের মত হিংসুটে নই আমি, তাই বেঁচে গেলে। তাহলে জর্জ, মরগান, এই ব্ল্যাক স্পট ছিড়ে ফেলতে পারি?
আলবৎ! অবশ্যই পার! সমস্বরে বলে উঠল সবাই, মরগান ছাড়া। আমতা আমতা করছে সে।
মাঝে থেকে খামোকা বাইবেলের পাতা ছিড়লাম, ডিকের কণ্ঠে আক্ষেপ। আচ্ছা বারবিকিউ, যদি বাইবেলটায় চুমু খাই এখন, পাপ কাটবে?
তার জন্যে ঈশ্বরের কাছে মাফ চাইতে হবে তোমাকে।
সে রাতে আমার আর সিলভারের পাহারায় রইল জর্জ। খোলাখুলিই সঙ্গীদের জানিয়ে দিল সে, কেউ আমার বা সিলভারের কোন ক্ষতি করতে চাইলে খুন করে ফেলবে।
কাজেই নিরাপদেই কেটে গেল বাকি রাতটুকু।
সকালে আমার ঘুম ভাঙল ডাক্তারচাচার ডাকাডাকিতে। আমি ডাক্তার এসেছি হে, দুর্গবাসীরা, ওঠ, ওঠ, উঠে পড়। আন্তরিকতায় ভরা তার কণ্ঠস্বর।
উঠে গিয়ে ডাক্তারচাচাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসছে সিলভার। এক ছুটে বেরিয়ে এলাম। বাইরে কুয়াশা কাটেনি এখনও। ঘোলাটে আলো পুবে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলের মাথায় কুয়াশা জট পাকিয়ে আছে যেন, তারই ভেতর থেকে ভেসে আসছে ভোরের পাখিদের কলরব।
আরে জিম যে! উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ডাক্তারচাচা আমাকে দেখে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে লাগলাম। তাদেরকে না জানিয়ে বেরিয়ে গিয়ে নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তার মাঝে রেখেছিলাম, সেজন্যে লজ্জা লাগছে এখন।
ঠিক আছে, পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে, বললেন ডাক্তারচাচা। আগে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে নিই।
দুর্গের ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তারচাচা। এক নজর চোখ বোলালেন, বাহ্, সেরে উঠেছে মনে হচ্ছে সবাই! এই তো চাই! এমন রোগী না হলে ডাক্তারী করে সুখ আছে? জর্জের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই জর্জ, মুখটা শুকনো কেন? লিভারের ওষুধ খেয়েছিলে ঠিকমত?
জী, খেয়েছিলাম।
তাহলে মুখ অত শুকনো কেন?
সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে তো, তাই, বলল ডিক।
কিন্তু তোমার কিছু যেন হয়েছে? ভয় পাচ্ছ যেন? এস তো, জিভটা দেখি।
কিছু হয়নি ওর, ডাক্তারসাহেব, বলল মরগান। বাইবেলের পাতা ছিড়েছিল, এখন পাপের ভয়েই বেচারা আধমরা।
ভুরু কোঁচকালেন ডাক্তারচাচা। সংক্ষেপে ব্যাপারটা ব্যক্ত করল জর্জ। ডিকের মুখের দিকে চাইলেন ডাক্তারচাচা তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। একে একে হাসিটা সংক্রমিত হল সবার মাঝেই, সিলভার ছাড়া। চিন্তিত ভাবটা কাটছে না ওর চেহারা থেকে।
আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গেল সিলভার। ফিসফিস করে বলল, ওদের বিশ্বাস করতে মানা কর ডাক্তারকে। ব্যাটাদের এক বিন্দু বিশ্বাস করি না আমি!
সবার সঙ্গে কথা শেষ হলে আমার দিকে ফিরলেন ডাক্তারচাচা। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেতেই চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললাম।
দুর্গ থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম আমরা। ডাকাতেরা যাতে কিছু সন্দেহ করতে না পারে এমন ভঙ্গিতে। আমি দুর্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গত রাতে ফিরে আসা পর্যন্ত সব কথাই বললাম তাকে। সবশেষে একটু আগে সিলভারের হুঁশিয়ারির কথাও জানালাম। চিন্তিত চোখে দুর্গের দিকে ফিরে চাইলেন ডাক্তারচাচা। আমিও চাইলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেছে সিলভার। কাঁধের তোতাটাকে দানা খাওয়াচ্ছে।
ঘুরে দ্রুত হেঁটে বনের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ডাক্তারচাচা। আমি চললাম দুর্গের দিকে।
২৩. ফ্রিন্টের সঙ্কেতিক নিশানা
গুপ্তধনের সন্ধানে যাব এবার আমরা, জিম, আমি কাছে যেতেই বলল সিলভার। কিন্তু মোটেও ভাল লাগছে না আমার ব্যাপারটা। মোহর দেখামাত্রই পাগল হয়ে উঠবে জানোয়ারগুলো। এদিকে যদি যেতে না চাই, তাহলেও খেপে যাবে। আমাদের সারাক্ষণই হুঁশিয়ার থাকতে হবে, বুঝেছ?
ঘাড় নাড়লাম।
এই সময় আগুনের কাছ থেকে ডাকল একজন, নাস্তা তৈরি। এগিয়ে গিয়ে আর সবার পাশে বসে পড়লাম। বিস্কুট আর কিছু শুকনো ফল দিয়ে নাস্তা সারা হল।
ডাক্তারচাচা চলে যাবার পর থেকেই একটা কথা সারাক্ষণ খোঁচাচ্ছে আমাকে। তখনি জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ডাকাতদের হাতে দুর্গের ভার দিয়ে কোথায় চলে গেছেন ওঁরা? কেন? থাকছেন কোথায়? আবার যে ম্যাপ সম্বল করে এত দূর আসা হয়েছে, সেটাই বা হুট করে ডাকাতদের হাতে তুলে দিলেন কেন? এসব ব্যাপার একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে।
রওনা হলাম সবাই। আমাদের দলটা অদ্ভুত। আমি ছাড়া সবারই পরনে নাবিকের ময়লা পোশাক, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। সিলভারের সঙ্গে দুটো বন্দুক, পকেটে দুটো পিস্তল, কোমরে ঝোলানো ছুরি, কাঁধে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট। সারাক্ষণই বকর বকর করছে তোতাটা, দুর্বোধ্য বুলি আওড়াচ্ছে।
বড় এক বান্ডিল দড়ি বইবার ভার পড়েছে আমার ওপর। দড়ির একটা প্রান্ত ধরে আমার পেছনে পেছনে কিছুক্ষণ হাঁটল সিলভার, যেন আমি সার্কাসের এক নাচিয়ে ভালুক। এই রসিকতায় হো হো করে হাসল ডাকাতেরা।
অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও সকলেই কিছু না কিছু জিনিস বয়ে নিচ্ছে। কারও হাতে মাটি খোড়ার জন্যে শাবল, কারও হাতে দুপুরের খাবার জন্যে রুটি-মাংসের ঝোলা, কারও হাতে মদের বোতল, কারও হাতে গোলা-বারুদ। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসও আছে কারও কারও হাতে।
সার বেঁধে গাছের ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে বনের বাইরে সাগর তীরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। নৌকা দুটো খুঁটিতে বাঁধা আছে। বনের ভেতর থেকে বেরোতেই প্রচন্ড রোদ ঝাপটা মারল চোখেমুখে।
নৌকার কাছে এগিয়ে গেলাম। দুটোকেই নড়বড়ে করে ফেলেছে ডাকাতেরা। একটা নৌকার হালের কাছটায় ভাঙা, মাঝির বসার জায়গা নেই। একটু নড়লেই পানি ওঠে। এই নৌকায় করে একটানা বেশিক্ষণ চলা অসম্ভব। কিন্তু ওগুলোতে চড়েই অ্যাংকোরেজ পর্যন্ত যাওয়া স্থির হল।
নৌকায় বসেই ম্যাপের সাঙ্কেতিক নিশানা নিয়ে আলোচনা করল সিলভার। লাল ক্রস দিয়ে চিহ্ন রাখা হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কার নয়। আর পেছনের লেখাটা সহজবোধ্য নয়। গুপ্তধনের সঙ্কেত সহজেই বোঝা যাবে, এটা আশাও করা যায় না অবশ্য।
টলট্রী বা লম্বা গাছ, পাই-গ্লাস শোল্ডার, মানে স্পাই-গ্লাসের কাঁধ, ইত্যাদির মানে তেমন বোঝা না গেলেও একটা ব্যাপার পরিষ্কার, স্পাই-গ্লাসের কোথাও একটা লম্বা গাছ আছে, সেটা প্রধান নিশানা।
আমাদের সামনেই ক্যাপ্টেন কিডের অ্যাংকোরেজ, একে ঘিরে আছে শ তিনেক ফুট উঁচু এক মালভূমি। উত্তরে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে স্পাই-গ্লাসের দক্ষিণ কাঁধ। তীরে নৌকা ভিড়িয়ে নামলাম সবাই।
মালভূমির চুড়ায় ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন, বড় গাছগুলোর উচ্চতা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে, চারাও আছে প্রচুর। এগুলোর ভেতর থেকেই বের করে নিতে হবে সব চেয়ে লম্বা গাছটা। ব্যাপারটা সহজ নয়।
নেতৃত্ব দিচ্ছে সিলভার, স্বভাবতই সঙ্কেত পড়ে নিশানা ঠিক করার ভারও তারই ওপর। হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। একটা, তারপর আরেকটা নদী পেরিয়ে, দ্বিতীয় নদীটার মোহনার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্পাই-গ্লাস পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা নদীটার দুই তীরে ঘন জঙ্গল।
বাঁয়ে মোড় নিয়ে খাড়া মালভূমির দিকে উঠতে লাগলাম। নদীর তীরের মাটি ভেজা, আঠালো। শক্ত মাটিতে শেকড় গেড়ে লতিয়ে লতিয়ে এই মাটির ওপর নেমে এসেছে নানা ধরনের লতাগুল্ম। কোনটার কাঁটা আছে কোনটার নেই। এগুলোর মধ্যে দিয়ে পথ চলতে ভারি অসুবিধে হচ্ছে। তবু একটু একটু করে এগিয়ে চললাম আমরা।
ক্রমেই আরও খাড়া হয়ে উঠছে পথ। শক্ত হয়ে আসছে মাটি, তার ওপর পাথর বিছানো। গাছপালা আর জঙ্গলের রূপও পাল্টাচ্ছে। সামনে মাঝে মাঝেই ফাঁকা। চমৎকার এখানকার প্রকৃতি। পথের পাশে সবুজ ঘাস, মাঝে মাঝে জন্মেছে নাম না জানা বুনো ফুলের গাছ। গাছে গাছে রঙিন ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি উড়ছে। ঘাস-বনের পাশে নাটমেগের ঝোপ, এদিক-ওদিক বিশাল লালচে পাইন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ফুলের সুবাস, নাটমেগের তীব্র ঝাঁঝ আর পাইনের মিষ্টি গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। প্রকৃতির মাধুর্যে, এখানে, অনেকখানি ম্লান হয়ে এসেছে যেন রোদের তীব্রতা।
প্রচন্ড হাকডাক হৈ হুল্লোড় করতে করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগিয়ে চলেছি সবাই। সবার পেছনে সিলভার, আর তার আগে চলেছি আমি। ডাকাতেরা আমাদের বেশ অনেকখানি সামনে।
পায়ের নিচে বাড়ছে নুড়ি পাথরের সংখ্যা। সারাক্ষণই পা পড়ছে ওগুলোতে, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পাথর। পাশে পাহাড়ী নদীর মধুর কুলকুল আওয়াজ, যেন জলতরঙ্গের শব্দ।
খোঁড়া, তাই আলগা নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে চলতে স্বভাবতই কষ্ট হচ্ছে সিলভারের, আমি সাহায্য করছি তাকে মাঝেমধ্যে। নইলে পা ফসকে নিচে গড়িয়ে পড়ত সে অনেক আগেই।
মালভূমির চূড়ার কাছাকাছি এসে গেছি আমরা, এই সময় মহা চিৎকার শুরু করে দিল সব চেয়ে আগের লোকটা। কি ব্যাপার? সবাই ছুটলাম তার কাছে।
আমার ডান পাশ থেকে ছুটতে ছুটতে বলল মরগান, ব্যাটা অমন করছে কেন!
গিয়ে দাঁড়ালাম লোকটার পাশে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই আঙুল তুলে দেখাল। চাইলাম। একটা বিশাল পাইনের নিচে সবুজ লতাপাতায় জড়িয়ে পড়ে আছে একটা কঙ্কাল, হ্যাঁ মানুষেরই। অ্যাডমিরাল বেনবোয় ক্যাপ্টেন বোনসের অশুভ পদক্ষেপের পর থেকে অনেক বীভৎস মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু তবু কেন যেন ঠান্ডা ভয়ের একটা স্রোত শির শির করে নেমে গেল আমার শিড়দাড়া বেয়ে।
সাহস দেখাল জর্জ মেরি। কঙ্কালটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পায়ে ঠেলে কঙ্কালের ওপরের কিছু লতাপাতা সরাল। ন্যাকড়ার মত হেঁড়া পুরানো কাপড় জড়িয়ে লেগে আছে। হলদেটে হাড়ের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল জর্জ, তারপর মন্তব্য করল, লোকটা নাবিক ছিল। পোশাকটাও এককালে দামি ছিল।
এখানে নাবিক ছাড়া অন্য কেউ আসবে, আশাও করা যায় না! চিন্তিত শোনাল সিলভারের কণ্ঠ। কিন্তু কঙ্কালটার পড়ে থাকার ভঙ্গি একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?
তাই তো! এতক্ষণ তো খেয়াল করিনি! একেবারে সিধে হয়ে পড়ে আছে কঙ্কাল। শুধু তাই নয়, দুটো হাতই মাথার ওপর দিকে লম্বালম্বি হয়ে আছে। কিছু নির্দেশ করছে তো?
পকেট থেকে একটা কম্পাস বার করল সিলভার। কঙ্কালটার অবস্থান আর কম্পাসের কাটার দিক নির্দেশ মিলিয়ে দেখল ভাল করে। তারপর আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল, ঠিকই আন্দাজ করেছি। কঙ্কালটা আসলে একটা সঙ্কেত দিচ্ছে। হাত দুটো যেদিকে দেখাচ্ছে, নিশ্চয় সেদিকে কিছু আছে। কিন্তু ফ্লিন্টের রসিকতাটা দেখেছ? কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু দিয়ে সঙ্কেত বানাতে পারেনি! এ নিশ্চয় তার ছয় সঙ্গীর একজন! কিন্তু কোন জন? এগিয়ে গিয়ে কঙ্কালটার পাশে বসে পড়ল সিলভার।
খুলিতে শুকিয়ে লেগে আছে চামড়া, এখনও। তাতে চুলও লেগে আছে। সেই চুলগুলোই ভাল করে দেখল সিলভার। হাত দিয়ে মেপে দেখল কতখানি লম্বা কঙ্কাল। তারপর মুখ তুলে চাইল, অ্যান্ডারাইস। আমি শিওর।
ভয়ঙ্কর খুনী ছিল ও! গলা কেঁপে গেল মরগানের। ধার হিসেবে অনেক টাকা নিয়েছে আমার কাছ থেকে। কিন্তু চাইতে পারতাম না। চাইলেই ছুরি দেখাত! ভাবছে সে। ফ্লিন্টের সঙ্গে শেষবার এখানে আসার সময় আমার ছুরিটা নিয়ে এসেছিল! কোথায় ওটা?
আশেপাশে তো দেখছি না! বলল এক ডাকাত, পাখিরা নিশ্চয়ই ছুরি খায় না!
তাহলে কোথায় ওটা! সিলভারকে আগের মতই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
কঙ্কালের আশপাশ থেকে লতা সরিয়ে ভাল করে খুঁজে দেখল জর্জ। এদিক ওদিক মাথা দোলাল, নাই, কিছু নেই! একটা তামাকের বাক্স পর্যন্ত নেই! একেবারেই অস্বাভাবিক!
ফ্লিন্টের এটা কেমন ধরনের রসিকতা! বলল সিলভার। বুঝতে পারছি, ছয় সঙ্গীকেই খুন করে রেখে গেছে ব্যাটা। কিন্তু লাশের সঙ্গে এই ব্যবহার কেন?
এটা তো আর নতুন কিছু নয়, বলল মরগান, জানই তো, ভয়ানক লোকটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিত এভাবেই। আমাদের কপাল ভাল, মরে ভূত হয়ে গেছে ব্যাটা, নইলে এই দ্বীপে গুপ্তধনের জন্যে আসা…হুঁহ্! হাতের আঙুলে চুটকি বাজিয়ে বাকি কথাটুকু বুঝিয়ে দিল সে।
ফ্লিন্টকে দেখিনি, কিন্তু তার সম্বন্ধে ডাকাতদের কথাবার্তা শুনে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম। তার নিষ্ঠুরতার নিদর্শন তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
যাকগে, ওসব ভেবে আর লাভ নেই, বলল সিলভার। ফ্লিন্ট মারা গেছে, আর কোনদিন জ্বালাতে আসবে না। এখন চল, যে কাজে এসেছি, শেষ করি।
কঙ্কালের নির্দেশিত দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। আশেপাশের দৃশ্য এখনও আগের মতই সুন্দর, কিন্তু আর হৈ-চৈ করছে না ডাকাতেরা। প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে পাশাপাশি মেপে মেপে পা ফেলছে ওরা, একে অন্যের থেকে আলাদা হতে ভয় পাচ্ছে। কথা বলতেও চাইছে না পারতপক্ষে। ফ্লিন্ট শুনে ফেললে আক্রমণ করে বসতে পারে, এই ভয় যেন চেপে ধরেছে সবাইকে।
২৪. কে! কে কথা বলে?
মালভূমির পশ্চিম অংশে সামান্য হেলে থাকা জায়গায় এসে বিশ্রাম নিতে বসলাম আমরা। এখানে, উঁচুতে বসে নিচের অনেক কিছুই চোখে পড়ছে। সামনে, ঢালে জন্মে থাকা গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে নিচে দেখা যাচ্ছে অন্তরীপ, ঢেউয়ের সাদা ফেনা জমেছে। পেছনে, অ্যাংকোরেজ পেরিয়ে, স্কেলিটন আইল্যান্ড ছাড়িয়ে সাগরের ঘোট ছোট ঢেউ কড়া রোদ প্রতিফলিত করে চোখ ধাঁধাচ্ছে আমাদের। একপাশে স্পাই-গ্লাস পাহাড়, চূড়ার কাছে ক্বচিত কদাচিত এক আধটা পাইন দাঁড়িয়ে, কালো কুৎসিত পাথুরে উপচুড়াগুলোর পাশে নেহাতই বেমানান। তীব্র রোদের হাত থেকে গা বাঁচাতে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে পাখিরা, ডাকাডাকি বন্ধ। শুধু দূরে নিচ থেকে ভেসে আসছে ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জন। প্রকৃতির এই বিশালতায় নিজেকে একেবারেই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
কম্পাসে চোখ রেখে একমনে কি হিসেব করছে সিলভার। তারপর মুখ তুলে বলল, ম্যাপ অনুসারে, স্পাই-গ্লাস পাহাড়ের কাঁধ নিশ্চয় ওই জায়গাটা, পাহাড়ের একটা দিকে আঙুল তুলে দেখাল সে। ঘুরে খাবারের ঝোলাটার দিকে তাকাল, পেট জ্বলছে। গুপ্তধন পরে খোঁজা যাবে, এসো আগে পেট ঠান্ডা করি।
খিদে নেই, বলল মরগান।
কেন?
কঙ্কালটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে।
ও।
নীলমুখো শয়তানটার কথা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় এখনও। হ্যাঁ, ফ্রিন্টের কথাই বলছি।
অতিরিক্ত রাম গেলার ফল, বলল জর্জ। মুখ তো নীল হবেই।
ব্যাটা সত্যিই মরেছে তো? সন্দেহ ডিকের গলায়।
বিলি তো বলেছে, মরেছে। লাশের চোখের ওপরে নাকি দুটো তামার পয়সাও রেখে দিয়েছিল বিলি। ওই ব্যাটাও ফ্লিন্টের চেয়ে কম যেত না। শেষ পর্যন্ত ও-ও মদ খেয়েই মরল… আচমকা বাধা পেয়ে থেমে গেল মরগান।
আমাদের সামনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে হালকা গলায় কাঁপা কাঁপা গানের সুর। সেই গানঃ
মরা মানুষের সিন্দুকটার…
মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে ডাকাতদের। আতঙ্কে বড় বড় হয়ে উঠেছে চোখ।
ফ্লিন্ট! ফিসফিস করে বলল মরগান। কোটর ছেড়ে যে কোন সময় ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন তার চোখ দুটো, হলপ করে বলতে পারি, এ ফ্লিন্ট ছাড়া কেউ না!
যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি আচমকা মাঝপথেই থেমে গেল গান। গায়কের মুখ চেপে ধরেছে যেন কেউ! পাহাড়ের ঢালে পাইনের সবুজ মাথায় কড়া রোদ, প্রকৃতির মহান বিশালতা, পেছনে মাটিতে আর ঝোপের ওপরে পাইনের ছায়ার আলপনা, স্তব্ধ দুপুর, এই সময় এই আচমকা গান শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কেমন যেন ভৌতিক অনুভূতির ছোঁয়া লাগাল সবার মনে। এমনিতেই অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছে ফ্লিন্টের চিন্তা আর ওই কঙ্কাল, এখন এই গান একেবারে বিমূঢ় জড় করে দিল যেন সবাইকে। স্তব্ধ হয়ে গেছে বেশি কথা বলা তোতাটাও।
রক্তশূন্য পাঁশুটে ঠোঁটে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে এমনকি সিলভারেরও, এত ভয় পেলে চলবে না! প্রেতাত্মা গান গাইতে পারে না, এ নিশ্চয় কোন জ্যান্ত মানুষ! ফ্রিন্টের স্বর নকল করছে!
আবার শোনা গেল গান! না না, গান নয়, কান্নার সুরে চেঁচিয়ে কথা বলছে কেউ! ডারবি ম্যাগ্র! ডারবি ম্যাগ্র! হঠাৎই যেন গালাগালি দিয়ে উঠল কণ্ঠস্বরটা, রাম নিয়ে আয়, ডারবি?
এর বেশি আর সইতে পারল না একজন ডাকাতের স্নায়ু। কেঁদে ফেলল সে, আর না, আর না, বারবিকিউ, আর এগোব না! চল ফিরে যাই!
ঠিক এভাবেই, এই সব কথাই বলত ফ্লিন্ট! ফিসফিস করে বলল মরগান।
বাইবেল বের করে মন দিয়ে পড়তে শুরু করেছে ডিক, কাপছে থরথর করে।
পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকা আজব কণ্ঠস্বর গভীর মনোযোগ শুনছে সিলভার। তারপর হঠাৎ হেসে উঠল হো হো করে, ব্যাটা জমিয়েছে ভাল! এই, এই মরগান, ও ফ্লিন্ট নয়। কিন্তু অনেকটা ফ্লিন্টের মতই বলছে। বল তো, মানুষের গলা আর বলার ভঙ্গি নকলে ওস্তাদ আমাদের মাঝে কে ছিল?
একটু ভাবল মরগান। মুখ তুলে সিলভারের দিকে চাইল, বেন গান নয়ত?
হ্যাঁ, বেন গানই, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সিলভার। ওই হারামজাদাই। আমাদের ভয় দেখাচ্ছে শুয়োরটা।
চল, কর্কশ চাপা কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল জর্জ মেরি। চল যাই! ব্যাটাকে প্যাদানি দেয়া দরকার আচ্ছা করে!
সবারই মুখে রক্ত ফিরে এসেছে আবার, ডিক ছাড়া। এখনও বাইবেলের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করছে ও, মাঝেমধ্যে মুখ তুলে তাকাচ্ছে নিচে, পাহাড়ের পাদদেশের দিকে।
কপাল ভাল তোমার, ও বেন গান, টিটকিরি মারল সিলভার। নইলে, ফ্রিন্টের ভূত হলে তোমার ঘাড়ই আগে ভাঙত। শুনেছি, পাতাছেঁড়া বাইবেলকে ভয় পায় না ভূতেরা। হাসল আবার সে। কিন্তু তবু হাসতে পারছে না ডিক।
ক্ৰাচটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল সিলভার। আমাদের নিয়ে রওনা দিল আবার।
খাড়াই বেয়ে ওঠার চেয়ে নামা সহজ। কাজেই চলার গতি দ্রুত হয়েছে আমাদের। ছোট বড় পাইনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। ম্যাপ দেখে দেখে একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল সিলভার। আকাঙিক্ষত লম্বা পাইন গাছ খুঁজছে। বেশি খুঁজতে হল না। ঝোপের মাথা ছাড়িয়ে আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে যেন দানবীয় পাইন, দুশো ফুটের কম হবে না লম্বায়।
ক্রাচে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে গাছটার কাছে এসে দাঁড়াল সিলভার। নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে কি যেন দেখছে। গুপ্তধন পেয়ে গেল নাকি?
ছুটে গেলাম। ডাকাতেরাও ছুটে এসে দাঁড়াল গাছের গোড়ায়। কিন্তু একি!
পাগলের মত মাটিতে ক্রাচ ঠুকছে সিলভার। জোরে জোরে মাথা নাড়ছে এদিকওদিক।
গাছের গোঁড়ায় মাটিতে বিশাল এক গর্ত। গর্তের ভেতর পড়ে আছে মরচে পরা একটা কোদাল। প্যাকিং বাক্সের ভাঙা কাঠ ইতস্তত ছড়ানো। একটা কাঠের টুকরোর গায়ে লোহা পুড়িয়ে ছ্যাকা দিয়ে নাম লেখা রয়েছেঃ ওয়ালরাস।
ফ্লিন্টের জাহাজের নাম! চাপা কুদ্ধ গলা মরগানের। কিন্তু গুপ্তধন কোথায়? নিয়ে গেছে কেউ!
টপাটপ গর্তের ভেতরে লাফিয়ে নামতে শুরু করল ডাকাতেরা।
বিপদটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারল সিলভার। আস্তে করে সরে এল কয়েক পা। পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল, নাও, রাখ এটা। ব্যবহারের সময় এসেছে।
পাগলের মত গর্তের তলায় ধনরহের সন্ধানে ব্যস্ত ডাকাতেরা। কিন্তু কিছু নেই। সোজা হয়ে দাঁড়াল মরগান। তীব্র দৃষ্টিতে চাইল সিলভারের দিকে। দুচোখে আগুন। ভয়ঙ্কর গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, এই তোমার মোহর! বারবিকিউ, আর না, এইবার তোমাকে শেষ করব আমি।
তাই, না? হাসছে সিলভার। কিন্তু খোঁজা তো শেষ হয়নি। আরও ভাল করে দেখ দোস্ত, আলুটালু কিছু পেয়েও যেতে পার। আর কিছু না হোক, পুড়িয়ে তো খেতে পারবে।
লাফ দিয়ে পিস্তল বেরিয়ে এল মরগানের হাতে। খবরদার, শুয়োরের বাচ্চা! তোর জন্যেই আজ এই অবস্থা আমাদের!
মোহর খোঁজা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডাকাতেরা। জর্জের হাতেও পিস্তল বেরিয়ে এসেছে। আমি বা সিলভার কেউই পিস্তল বের করতে পারিনি, পকেটেই রয়ে গেছে।
ক্রাচে ভর দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সিলভার। চোখের পাপড়ি পর্যন্ত কাঁপছে না তার। স্থির চেয়ে আছে মরগানের পিস্তলের দিকে। ধীরে ধীরে বলল, উই, আমার নয়, তোমাদের ভুলেই আজ এই অবস্থায় পড়েছ। মোহর তো পেলেই না, প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পার কিনা দেখ!
সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল জর্জ, বন্ধুরা, এই ল্যাঙড়া হারামজাদা ঠকিয়েছে আমাদের! ওকে শেষ করে দেয়া উচিত, এখুনি। আর ওই বিচ্ছুটার চোখ উপড়ে না নিলে শান্তি পাব না। ওটাই আসলে যত নষ্টের মূল…
ঠিক এই সময় গর্জে উঠল বন্দুক। আমাদের একপাশে ঝোপের ভেতর থেকে গুলি করছে কারা যেন। উল্টে গর্তের ভেতরে পড়ে গেল জর্জ। তার পাশে দাঁড়ানো ডাকাতটাও দুই হাত শূন্যে তুলে চিত হয়ে পড়ল কাটা কলাগাছের মত। কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সিলভারের কাঁধের তোতাটা।
চকিতে যা বোঝার বুঝে নিল মরগান। পাক খেয়ে ঘুরেই ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল পাশের ঝোপটার ভেতরে। তার সঙ্গে সঙ্গেই ঝোপে ঢুকে গেল অন্য দুই ডাকাত। ঝোপঝাড় ভেঙে তাদের দ্রুত ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পালাচ্ছে।
গর্তের ভেতর নিথর পড়ে আছে একটা ডাকাত। আহত জর্জ মেরি হাত-পা ছুঁড়ছে, পিস্তলের এক গুলিতে তাকেও সঙ্গীর মতই নিথর করে দিল সিলভার।
ওদিকে নাটমেগ ঝোপের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছেন ডাক্তারচাচা, হাতের বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে এখনও। তার পেছন পেছনই বেরিয়ে এল বেন গান আর গ্রে।
পালিয়ে যাওয়া তিন ডাকাতের গমনপথের দিকে নির্দেশ করে বললেন ডাক্তারচাচা, ওদের পালাতে দেয়া যাবে না। নৌকা দুটো দখল করে নিলে সর্বনাশ হবে! নৌকা ছাড়া আমরা অচল। বলেই ছুটলেন।
গ্রে আর বেন গান ছুটছে ডাক্তাচাচার পিছু পিছু। আমিও ছুটলাম। ক্রাচে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সিলভার। তার কাঁধের তোতাটা সমানে চেঁচাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে নৌকা দুটোর কাছে এসে দাঁড়ালাম আমরা। কিন্তু তিন ডাকাতের দেখা নেই। অন্য কোন দিকে পালিয়েছে ওরা, কিংবা গা ঢাকা দিয়েছে আশেপাশেই।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওদের পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, অন্যদিকে সরে পড়েছে।
বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পিটিয়ে আধভাঙা নৌকাটার তলাটা একেবারেই খসিয়ে দিলেন ডাক্তারচাচা। আমাদের পাঁচজনের জন্যে মোটামুটি অক্ষত বাকি একটা নৌকাই যথেষ্ট। নৌকায় চেপে বসলাম আমরা।
চলতে চলতে ডাক্তারচাচা জানালেন, এখন আমরা বেন গানের গুহায় চলেছি। ওখানেই মাটির তলায় ফ্লিন্টের সমস্ত ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছে বেন গান। পাইনের গোঁড়া থেকে ওগুলো ও-ই তুলে নিয়ে গেছে, আমরা ট্রেজার আইল্যান্ডে আসার অনেক আগেই। দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে এই কয়দিন তারা বেন গানের গুহাতেই থেকেছেন। ডাকাতদের নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার জন্যে, বিশেষ করে খামোকা খুনখারাবি বন্ধ করার জন্যেই গুপ্তধনের নকশা সিলভারের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন ডাক্তারচাচা। তাছাড়া তখন আর নকশাটার কোন মূল্য ছিল না, কারণ ধনরত্ন তো সব আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি সঙ্গে না থাকলে ডাকাতদেরকে গুলি করারও কোন প্রয়োজন পড়ত না। ডাকাতদের ভয় পাইয়ে দেবার জন্যে ফ্রিন্টের অনুকরণে বেন গানের ডাকাডাকির কৌশলটা সত্যিই অভিনব, স্বীকার করলেন ডাক্তারচাচা।
গুহার ভেতর বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন জমিদার ট্রেলনী, ক্যাপ্টেন স্মলেট আর জয়েস, কোন উপায়ে ডাকাতেরা গুহা আর ধনরত্নের খোঁজ জেনে গিয়ে যদি গুহায় হানা দেয়, তো বাধা দেবেন। আমাদের দেখে বেরিয়ে এলেন তাঁরা।
এরপরে কি হল, সংক্ষেপে শেষ করছি। মাটি খুঁড়ে সমস্ত ধনরত্ন আবার বের করা হল। অসংখ্য সোনার বাট, তার দাম অনুমান করা আমার সাধ্যের বাইরে। তাছাড়া আছে ছোট ছোট কয়েক বস্তা মোহর। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের মোহরই আছেঃ ইংল্যান্ড, ফরাসী, স্পেন, পর্তুগাল ইত্যাদি সব দেশের। আছে জর্জ, লুই, ডাবলুন ইত্যাদি সব জাতের, বিচিত্র আকারের বিচিত্র ওজনের সব মোহর। রাজরাজড়াদের ছবি খোদাই করা ওগুলোতে। কোনটা গোল, কোনটা চারকোণা। কোন কোনটাতে আবার ফুটো করা, ভেতরে চেন ঢুকিয়ে গলায় ঝোলানোর জন্যে।
মোহর, সোনার বাট নিয়ে গিয়ে হিসপানিওলায় তুললাম আমরা। জোয়ার আসায় চরা থেকে নেমে গিয়েছে জাহাজটা, ভাটার সময় আবার আটকেছে, এমনি করে গেছে গত কয়েকটা দিন। প্রায় বদ্ধ খড়ির সঙ্কীর্ণ মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে যেতে পারেনি, কাজেই এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গিয়েছি আমরা।
পাহাড়ি ঝর্না থেকে প্রচুর মিঠে পানি বোঝাই করে নিয়েছি জাহাজের পিপেগুলোতে। খাবার হিসেবে নিয়েছি শিকার করা বুনো ছাগলের ধোঁয়ায় শুকানো মাংস। আর নিয়েছি প্রচুর বুনো ফলমূল।
মরগান আর তার দলবল আমাদের আক্রমণ করতে আসেনি আর। সাহসই করেনি। আর করবেই বা কি করে? ওদের গোলাবারুদ নেহাতই সামান্য। এত অল্প রসদ নিয়ে আমাদের আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখায়নি আর। ওদেরকে দ্বীপেই নির্বাসন দিয়ে এসেছি আমরা। ডাক্তারচাচা অবশ্য অনেক দয়া দেখিয়েছেন। আসার সময় দুর্গে কয়েক বস্তা ময়দা, প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, ওষুধ, কিছু গুলি, বারুদ ইত্যাদি রেখে এসেছেন তিন ডাকাতের জন্যে। এই দিয়ে যে কয়দিন বাঁচতে পারে তারা, বাঁচুক। সিলভারকে কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছি আমরা।
দেশে ফিরে ধনরত্ন সব ভাগাভাগি করা হয়েছে আমাদের মাঝে। আমাদের বলতে আমি, ডাক্তারচাচা, জমিদার ট্রেলনী এই তিনজন। ক্যাপ্টেনকে অভিযানের কয়েক মাসের পুরো বেতন প্রচুর বোনাসসহ বুঝিয়ে দিয়েছেন জমিদার। বেন গানকে এক হাজার পাউন্ড দেয়া হয়েছে, কিন্তু তিন সপ্তাহের মধ্যেই মদ খেয়ে আর জুয়া খেলে সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছে সে, তারপর পথের ভিখিরি। ভিক্ষে করেই কাটিয়েছে জীবনের বাকি দিনগুলো।
আব্রাহাম গ্রেকেও কিছু টাকা দেয়া হয়েছে। সত্যিই ভাল হয়ে গিয়েছে সে। মোটামুটি পড়ালেখা শিখেছে, ব্যবসাও করেছে কিছু দিন। তারপর একটা চমৎকার জাহাজের আংশিক মালিকানা কিনে নিয়েছে। ওই জাহাজেই মেটের কাজ করে এখন। বিয়ে করেছে, সন্তানের পিতা হয়েছে। সুখেই আছে সে।
যেহেতু আমার প্রাণ রক্ষা করেছে লঙ জন সিলভার, দেশে ফিরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন না ডাক্তারচাচা। বরং কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন, পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিলেন। তবে এই বলে শাসিয়ে দিলেন, যদি আমাদের এলাকায় তাকে আবার কখনও দেখা যায়, ভাল হবে না। এরপর আর ছাড়বেন না, পুলিশের হাতে দেবেনই। সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে সিলভার, আর কোন খোঁজ পাইনি তার।
আজও, ভয়ঙ্কর ঝড়ের রাতে যখন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সাগর, ফুঁসে উঠে তীরে এসে আছড়ে পড়ে উত্তাল ঢেউ, ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি আমি। খোঁড়া এক জলদস্যু ক্রাচ বগলে নিয়ে তাড়া করে আমাকে। সেই ডাকাতের চেহারার সঙ্গে সিলভারের কোন মিল নেই। কিন্তু আশ্চর্য! খোঁড়া দানবের কাঁধে সিলভারের ক্যাপ্টেন ফ্রিন্টের মতই একটা তোতাপাখি বসা থাকে। কুৎসিত কর্কশ গলায় একটানা চেঁচাতে থাকে ওটাঃ পিসেস অভ এইট, পিসেস অভ এইট, পিসেস অভ এইট…
***
Leave a Reply