ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – নবনীতা দেব সেন
প্রথম প্রকাশ – সেপ্টেম্বর ১৯৮৪
উৎসর্গ
নীললোহিত ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে
গৌরচন্দ্রিকা
এই নিয়ে সাতবার হল, আমি তাওয়াং-এর গল্পটা লিখতে বসেছি। বারবার লিখতে শুরু করেছি, আর ছেড়ে দিয়েছি। খানিকদূর এগিয়ে, কলম তুলে নিয়েছি। মন বলছে “হচ্ছে না, হচ্ছে না”। কতগুলো দমকা বাতাস, কয়েকটা মেঘ-ছেঁড়া তির্যক আলোর ছটা এমনিভাবে জীবনের ওপরে এসে পড়ে, যার দ্বিরাগমন অসম্ভব, যাকে ‘পুনরাগমনায় চ” বলে বিদায় জানানো যায় না, বরং—”ইহজীবনে এই শেষবার, এই প্রথমবার, হে আশ্চর্য, তোমাকে জানলুম। আমি কৃতার্থ,”-বলে কুর্নিশ করতে করতে পিছু হটে সরে আসতে হয় তার কাছ থেকে।
এই সব অভিজ্ঞতা নানান সাজে আসে। কখনও তার পোশাক ভয়ানক দুর্দৈবের, আবার কখনও বা গুরুকৃপার। দুটোই যে বিশুদ্ধ ঈশ্বরী মায়া, যখন ঘটে, যার জীবনে ঘটে, তার বুকের ভেতরে ঠিক জানান দিয়ে যায়।
আমার জীবনে কুম্ভমেলায় যাওয়া যেমন। আবার এই তাওয়াং যাওয়াও তেমনি। পরম আশ্চর্যের, পরম পরিতৃপ্তির। লিখতে গেলেই সব যেন নষ্ট হয়ে যায়। জিবে নোন্তা চায়ের স্বাদ, পাহাড়ের বাঁকে চমরী গাইয়ের ঝাঁক, বৃক্ষহীন উপত্যকা, পত্রপুষ্পহীন আশ্চর্য উদ্ভিদ, আর কূজনহীন সূর্যোদয় নিয়ে বুনো তাওয়াং এই পাঁচ বছর আমার বুকের মধ্যে শেকল-বাঁধা, গজরাচ্ছে।
লিখি, লিখছি, লিখলুম বলে।
কিন্তু পারছি কই?
লেখা আর হয়ে উঠছে না।
কেন? হচ্ছে না কেন?
কেন না, লিখতে গেলেই মনে হয় বুঝি ফুরিয়ে গেল। একবার লেখা হয়ে গেলেই ব্যস, এজমালি সম্পত্তি হয়ে গেল। তখন তাওয়াং সবার। এ তো কুম্ভযাত্রা নয়।
কুম্ভমেলা দশকোটি মানুষের যাত্রা। তাওয়াং কেবল একটি মানুষের।
একলা আমার। থাকুক, কেবল আমার হয়েই থাকুক। কী হবে, সব কিছু লিখে ফেলে? কী হবে সবকিছু সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে? যদি না পারি?
যদি না পারি সবাইকে আমার বুকের মধ্যে পুরে তাওয়াং পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে?
এ তো কুম্ভ নয় যে, যে যাবার সে পায়ে-পায়ে আপনিই চলে যাবে। কুম্ভস্নানের পুণ্যফল আমি হাতে হাতেই পেয়েছি—চোখের পলকে অনেকজনের ভালবাসায় আমার হৃদয়ের অমৃতকুম্ভ পূর্ণ হয়েছে। এখনও ভরে চলেছে, অফুরান। কিন্তু তাওয়াং অন্য গল্প!
অবশ্য এও ভালবাসার গল্প। আমার সব গল্পই তাই। প্রেমের গল্প লিখতে পারি না বলে দুঃখু নেই, ভালবাসার গল্পই তো লিখি। আমি মহা ভাগ্যবতী কিনা
নিশ্চয়ই সে মহা ভাগ্যবতী যার না আছে হাতে পায়ে বেড়ি, না বুকের ভেতর চাবি তালা। মানুষের কাছে আমি অনেক পেয়েছি, প্রাপ্তির যেন শেষ নেই। এত সমাদর এত অনাদর এত ভালবাসা এত প্রতারণা জীবনের একূল-ওকূল ভাসিয়ে দিয়েছে যে, আমার যে-কোনওদিনই মনে হয় আজই যদি মরি, তবে কোনও দুঃখু থাকবে না! আমার মতো সুখী, সুভগা আর কে?
বাসনা, সে তো মিটবার নয়। বাসনার স্বভাবেই বাসনা চিরকিশোরী, চির-অপূর্ণা। কিন্তু আমার তো সামনে কোনও লক্ষ্য নেই যে, “মরবার আগে অন্তত এইটে যেন করে যেতে পারি”—পিরামিড না হোক, কুতুবমিনার? কুতুব না হোক, টাটাসেন্টার! নাঃ। তেমন বাসনা সত্যিই নেই। আমি মনেপ্রাণেই নশ্বর–অমরতার স্বপ্ন আমার নেই। দায়-দায়িত্ব? কীসের দায়? কীসের ভাবনা? তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার। হালের কাছে মাঝি আছে—এটা অস্থি-মজ্জায় জানি। ঠিক তরী পার করে দেবে। আমার জন্যে কেউ পড়ে থাকবে না অনুত্তীর্ণ। তবে কেন মনে এত অস্থিরতা আমার? কালতরঙ্গে উচ্চাশার সপ্তডিঙা মাধুকরী যে সাজায়নি, তার তো নৌকোডুবির ভয়ও নেই। তার মনে তো অক্ষয় শান্তি, অখণ্ড স্থৈর্য থাকার কথা।
কিন্তু তা তো নয়? আমি অত্যন্ত চঞ্চল। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে আমি ভাসিয়ে দিই কলমের লগি দিয়ে ঠেলে কাগজের নৌকো। আবার তারই উলটে পড়া নিয়ে আমার উদ্বেগ। যদিও জানি এ নৌকো নৌকোই নয়—এ কোথাও যাবে না।
.
এতই যদি জানি, তবে তো আমিও মুক্তপ্রাণী। যদি আমি মুক্তপ্রাণী তবে আমার প্রাণে শান্তি নেই কেন? আমাকে এমন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় পিঁজরার মধ্যে আটকা পড়া বুনো জানোয়ারের মতো কোন বদ্ধ বাতাস?
সত্যিকারের মুক্তপ্রাণী কেউ আছে কি?
যারা ঘরে, অর্থাৎ সংসারী জীব, তাদের নানা ঝক্কি। কে না জানে, অখণ্ড স্বাধীনতা তাদের নেই? আর যারা পারের, অর্থাৎ সাধু সন্ন্যাসী, ছাপ-মারা মঠ মিশনের জীব, তাদের তো ঝক্কি আরও বেশি। তারা সবাই শিবঠাকুরের আপনদেশের লোক, তাদের আইনকানুন আরও সব্বোনেশে। না পায় তারা ইহলোকের স্বাধীনতা, না আছে তাদের পরলোকের উদ্বেগে এপারে শান্তি।
কেবল যারা ঘরেও নহে পারেও নহে, তাদের জন্যেই সারাটা পৃথিবী খোলা পড়ে আছে। আর ঘরেও নেই, পারেও নেই, এহেন জনমনিষ্যি ত্রিভুবনেও বেশি নেই। ভাগ্যিস নেই? তাই ‘ঘর’ ব্যাপারটায় এত মায়া, আর ‘পার’-এর এত টান।
আমি বড় চঞ্চল। বড় অস্থির। কখনও এস্পার, আবার কখনও ওস্পার। এই ছিলুম ঘরে, এই বসেছি পারে। আর ভেতরে ভেতরে? না ঘরের, না পারের, স্রেফ পারাপারের সওয়ারি।
তেমনিই এক পারাপারের গল্প এই তাওয়াং। এক্কেবারে সত্যি গল্প। এরই অন্য নাম, ইতি হ আস।
“মুহূর্তম্ জ্বলিতম্ শ্রেয়ো
ন তু ধূমায়িতম্ ক্রোরম্।।
[সঞ্জয়কে বিদুলা]
জগতে আনন্দযজ্ঞে কি সবারই নিমন্ত্রণ থাকে? মহত্ত্ব করে কবি যাই বলুন, থাকে না। আনন্দযজ্ঞে চিরন্তন গেস্টকন্ট্রোল, শর্ট লিস্টেড হতে হয়। নিতান্তই রেসট্রিকটেড নাম্বার্স। জগতে শুধু এলেই তো হল না, সে তো সবাই আসে। আনন্দযজ্ঞের খোঁজটি পাওয়া চাই, সেটা সবাই পায় না। আর যজ্ঞ মানেই আগুন আর আহুতি। আনন্দযজ্ঞ সোজা ব্যাপার তো নয়, অশ্বমেধের ঘোড়ায় হবে না, সর্বস্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। আঁটো গাঁঠ ছিঁড়ে। সেটা নিজে নিজে সব সময়ে পেরে ওঠা যায় না। জীবনই কখনও কখনও দয়া করে আঁটো গাঁঠটা খুলে দেয় এক একজনের—যাতে তারা বেরিয়ে পড়তে পারে। আর সেইটেই হল নেমন্তন্নের চিঠি।
জগতের আনন্দযজ্ঞে একবার যার নেমন্তন্ন এসে যায়, তার কিন্তু সংসার সুখের পংক্তিভোজে আর নেমন্তন্ন থাকে না। তাই ঘরে যদিও বৃদ্ধ এবং বালক, দুই কাঁধেই আমার দুই জাতের সময়ের ভার, আমি জানি আসলে ‘তো ভার আমার নয়। ভেতরে ভার বইছেন অন্য একজন। আমার তাই উড়নচণ্ডে হতে অসুবিধে নেই।
মুক্তপক্ষ হওয়া-না-হওয়া অনেকটা নির্ভর করে নিজেকে কে কী ভাবছে তার ওপরে। তুমি যদি মনে করো তুমি মুক্তপ্রাণী, তোমাকে বদ্ধপ্রাণী করতে পারে, এমন সাধ্যি কারুর নেই। ছোট থেকেই শুনে আসছি আমি জংলি, আমি বুনো, আমি খ্যাপাটে, আমি অসভ্য। বেশ বাবা তাই সই। বন্যপ্রাণীরও তো কতগুলো সুবিধে আছে? গৃহপালিত প্রাণীর যা নেই। সভ্য যখন হওয়া গেল না, তখন জংলিই হওয়া যাক।
সেবার অন্ধ্রের বন্যায় সমুদ্রের মধ্যে ভেসে যাওয়া শ’খানেক পোষা গোরু জীবিত অবস্থায় যখন স্রোতের টানে কূলে এসে ভিড়ল, তখন তারা গোয়াল খুঁজে না পেয়ে বনে জঙ্গলে চলে গেল। কয়েকটা বছরের মধ্যেই সেই গাভিরা এখন পুরোপুরি বন্য পশু হয়ে উঠেছে। ঝাঁক বেঁধে, হিংস্র শিং নেড়ে, মানুষের পরোয়া না করে পালে পালে বন থেকে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষও মাঝে মাঝে যখন কূলে এসে ঠেকে, তখন বালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ঘর না পেয়ে জঙ্গলে চলে যায়।
একা।
আর বেপরোয়া।
—”কী ব্যাপার? নবনীতা যে? এদিকে কোথায়?”
—”এই যে একটু জোড়হাটে” …প্রণাম করতে করতে বলি। আশীর্বাদ করতে করতে উনি বলেন—”শিবসাগরে? আমিও সেখানেই। অসম সাহিত্য সভায় তো?”
—”শিবসাগরে নয় তো, জোড়হাটেই। এটা হচ্ছে শুধু মেয়েদের। অসম মহিলা সাহিত্যিক সম্মেলন।”
—”ওই একই প্লেনে যেতে হবে আমাদের।”
জায়গাটা গৌহাটি এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ, সময় ১৯৭৭, অক্টোবরের শেষ হপ্তা। হঠাৎ দেখা ডাঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। দুজনেই তখন সিকিউরিটি চেকিংয়ের ঘরে যাচ্ছি। কথা বলতে বলতেই চেকিং সারা, বেরিয়ে প্লেনের দিকে চললুম আমরা। অন্তরীক্ষে ঘোষণা হচ্ছে, এবার জোড়হাটের যাত্রীরা প্লেনে উঠে পড়ুন।
দমদম থেকে এসে, ঘণ্টাখানেক থেমেছিলুম গৌহাটিতে। প্লেন বদল করে জোড়হাটের প্লেনে চড়তে হবে এবারে। শিবসাগরে যেতে হলেও সেই জোড়হাট দিয়েই। ডাঃ ভট্টাচার্যকে দেখে খুবই আহ্লাদ হয়েছে, পথে চেনা মানুষ পেলে কার না আহ্লাদ হয়? ডাঃ ভট্টাচার্যকেও অখুশি বলে মনে হচ্ছে না। প্লেনে উঠে পাশপাশি বসে দুজনে গল্প জুড়ে দিলুম মনের আনন্দে।
হঠাৎ খেয়াল হল, ওপাশে এক ভদ্রলোক একদৃষ্টে আমাদের দেখছেন। কীরে বাবা? এত দেখাদেখির আছেটা কী? আমি কি ওঁকে চিনি? না তো! তবে? আরেকটু বাদে মনে হল যে উনি তো দেখছেনই, আশপাশের অন্যান্য যাত্রীরাও সকলেই আমাদের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছেন। এ তো ভারি অভদ্র একটা প্লেন! ডাঃ ভট্টাচার্য শুক্ল কেশ, সৌম্যদর্শন, বয়স্ক ভদ্রলোক। যার সঙ্গেই কথা বলুন না কেন, তাঁকে কখনওই বেমানান লাগতে পারে না। এত হাঁ করে দেখার কী হল? আমার দিকেও এভাবে কটমট করে চেয়ে থাকার কিছু নেই। তবে? অন্য কোনও কারণ বোধ হয়। বড্ড বেশি জোরে জোরে গল্প করা হয়ে যাচ্ছে কি? প্লেনটা যেন আমার পৈতৃক ভিটে? সবিনয়ে ভদ্রলোককে বলি—”Sorry, বড্ড জোরে জোরে কথা বলছি, না?”—ভদ্রলোক যেন অকূলে কূল পেয়েছেন এমনভাবে বলে ওঠেন—
—”শুনুন, সে কথা হচ্ছে না, কিন্তু আপনারা দুজনে বোধ হয় জোড়হাটে যাচ্ছেন?”
—”আজ্ঞে হ্যাঁ।” সবিনয়ে বলি।
—”এই প্লেনটা তো দমদমে যাচ্ছে কি না? তাই ভাবছিলুম—”
—”দম—দম?”—এবার দ্বৈতকণ্ঠের আর্তনাদ।
—”হ্যাঁ, হ্যাঁ, দমদম! দমদম!” প্লেনসুদ্ধু লোক এবার গাঁক গাঁক করে ওঠে—”নেমে যান, নেমে যান, এ প্লেন নয়।”
আশুতোষবাবু আর আমি তো অবাক।
—”কিন্তু এই প্লেনেই তো পাঠিয়ে দিল আমাদের”—
—”না না, এটা নয়, ওপাশে আরেকটা আছে—ওইদিকে, নেমে যান, দৌড় লাগান, ছেড়ে দিল বোধ হয়”—
হুড়মুড় দুড়মুড় করে তো নেমে পড়ি, দুজনের হাতেই ছোট সুইসে তাই সমস্যা নেই। তারপর দে ছুট ছুট। ডাঃ ভট্টাচার্যের বয়স হলেও ভালই দৌড়োতে পারেন দেখা গেল। অদূরেই একটি পুঁটিমাছের মতো এরোপ্লেন, আদুরে বেড়ালছানার মতো গুরগুর শব্দ করছে, সামনের পাখাটাখা বাঁই বাঁই করে ঘুরতে শুরু করছে।
—”অ্যাইও, অ্যাইও! এটা কি জোড়হাটের প্লেন? জোড়হাট জায়গা তো?”
—”রোককে! রোককে! জেনানা হ্যায়!”
দু জনে দুরকমের ধ্বনি দিতে দিতে ঊর্ধ্বশ্বাসে গিয়ে ধরে ফেললুম উড়ুক্কু পুঁটিমাছ। ছোট ছোট ক’টা সিঁড়ি বেয়ে উঠে, দেখি দুটোই মাত্র খালি সীট আছে, প্লেন ভরতি। হাঁপাতে হাঁপাতে তো বসে পড়েছি দুজনে। বসবামাত্র ইউনিফর্ম পরা একজন স্মার্ট ভদ্রলোক কোথা থেকে উদয় হয়ে গটগট করে তেড়ে এসে আমাদের প্রীতি সম্ভাষণ জানালেন, প্রায় বনলতা সেনের মতো ভাষায়—”এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?” পাখির বাসা নয়, বাঘের গুহার মতো চোখ! —”মানে, ওই ভুল প্লেনে উঠেছিলাম আর কী। আরেকটু হলেই—”
সত্যি! কী হত, আরেকটু হলেই? অসম সাহিত্য সভার দুজন গণ্যমান্য অতিথি। সেই রাত থাকতে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে ট্যাক্সি ধরে কত কসরত করে রওনা দিয়ে, দমদম গিয়ে প্লেনে চড়ে গৌহাটি এসেছেন। আরেকটু হলেই—দুজনে গম্ভীরভাবে ফের দমদমেই নেমে, ভাবতুম—”বাঃ, জোড়হাট তো দারুণ বড় এয়ারপোর্ট? গৌহাটিকে হার মানিয়েছে।” ভেবেই কুলকুল করে হাসি পেতে লাগল কিন্তু টেরিয়ে দেখে নিলুম ডাঃ ভট্টাচার্য হাসছেন না। গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। এত সিকিওরিটি চেকিং এত বাক্স-ওজন-করা এত প্লেন বদলাবদলি করে শেষ পর্যন্ত দমদমে নামলেই হয়েছিল আর কী! আশুতোষবাবু এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন; – “ওই মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। বড্ড বাজে বকবক করে। সেজন্যেই তো এইরকম হল!”—কথাটা ঠিকই। আমি সারাক্ষণই অন্যমনস্ক, ফলে সর্বদাই নানান গোলমালে পড়ি। ডাঃ ভট্টাচার্যের নিশ্চয়ই জীবনে কখনও এমন বাজে ঝামেলা হয়নি, কেন না ভদ্রলোকদের এসব কদাচ ঘটে না। নেহাত আমি সঙ্গে ছিলুম বলেই—
জোড়হাট বিমানবন্দরে নেমেই মনটা হেসে উঠল। হালকা-পলকা সাদা-হলুদ বেগমবাহার শাড়ি পরা প্রজাপতির ঝাঁক উড়ছে শয়ে শয়ে দীর্ঘ সবুজ ঘন ঘাসের বনে। জমকালো কালো কমলা কাঞ্জিভরম শাড়ি পরা আরেক জাতের বড় বড় প্রজাপতিও ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই তো আমাদের অভ্যর্থনা সমিতি! চমৎকার। অতবড় প্রকাণ্ড একটা চাদরের মতন শূন্য এরোড্রোমটা যেন রুপোলি কিংখাব। রোদে ঝমঝম করছে, যেন ধানকলের উঠোন! চারিপাশে দীর্ঘ সবুজ ঘাসের পাড়, তাতে পাখি—প্রজাপতির চুমকি বসানো। শুধু তো বড় বড় প্রজাপতিই নয়। ছোট ছোট এক রকম মৌটুসি ধরনের খুদে খুদে কালো-বাদামি পাখি ফড়িঙের মতন নাচানাচি করে ঘাসের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। খেলতে খেলতে কিচিরমিচির ঝগড়া! যেন বিকেলবেলা পার্কে বাচ্চাদের চেঁচামেচি। আর এই কার্তিক মাসের মাঝামাঝি, ঠিক দুরে, কোথা থেকে একটা আপঢ় কোকিল (কিছু জানে শোনে না, কোন ঋতুতে কী করতে হয় ) তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে। বোধ হয় ওকেও অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য করা হয়েছে, ও বলছে ‘স্বাগতম্! আশুবাবু! স্বাগত নবনীতা!’
মাঠের পাশে একটা তাঁবু খাটানো আছে। যেমন তেমন নয়, রীতিমতো লাক্সারি তাঁবু, ভেতরে টেবিল-চেয়ার, সোফাকৌচ সাজানো, শতরঞ্চি পাতা। যেন বেদুইনদের দেশে এলুম। চেয়ারে মানুষ, আর মেঝেয় বাক্সপ্যাঁটরা বোঝাই। আমাদেরও সেইখানেই বাক্সসমেত জমা করে দেওয়া হল। যথাকালে বাস আসবে। আমাদের লোকালয়ে পৌঁছে দেবে। ততক্ষণ এটাই ঠিকানা। এই তাঁবু, এই প্রজাপতির ঝাঁক, এই পাখির দল, এই ঘাস, রোদ আর শুকনো ঝকঝকে সিমেন্টে নৈঃশব্দ্যের বাজনা।
তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে গেছে। তাঁবুতে কি একটু জল নেই? নাঃ জল নেই। ইস। সত্যই কি এটা বেদুইনের দেশ নাকি? কখন শহরে যাব?
Leave a Reply