ঝড়ের খেয়া – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৪
ইলিনা বণিককে
স্নেহ ও শুভেচ্ছা
—বাণীদি
এক
মেয়েটা নিপাট ভিজছিল।
পেছনে ক্রমশ হাইজ্যাক হয়ে যেতে থাকা ময়দান।
সামনে গ্র্যান্ড হোটেল, আরও কিছু গ্র্যান্ড দোকান পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত।
পুব থেকে এক একটা প্রবল অথচ সূক্ষ্মবিন্দু বায়ুতাড়িত বৃষ্টির ঝাপটা আসে, আর সমস্ত জলরঙের ইমপ্রেশনিজম হয়ে যায়।
অজস্র গাড়ি, মিনিবাস, সারাই হতে থাকা রাস্তার টিনের উঁচু ঘের, বিপদে পড়া পিঁপড়ের মতো ছত্রভঙ্গ পদাতিকের দল। সমস্তটাই জঙ্গম।
গাড়িগুলো থেমে আছে। ট্র্যাফিক লাইটে। কিন্তু জঙ্গমতা তাদের যন্ত্র-শরীরে উন্মুখ যেমন উড়ব-উড়ব পাখির শরীরে থাকে।
একমাত্র স্থাবর বিন্দু কতকগুলো ডাকাতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে যাওয়া গাছ।
আর ওই ফুটকি।
দুটো ঝাপটার হাইফেন-পথে বোঝা যাচ্ছে ওর অঙ্গে সালোয়ার কামিজ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। বাস। আর কিছু না এবং কেউ না।
এত বড় করে ক্যানভাসটা আঁকবার দরকার ছিল না। এক ফুটকি তো একটা মেয়ে! কিন্তু ওই যে টলস্টয় একটা অর্ধসত্য বলে গিয়েছিলেন! মানুষের নাকি সাড়ে তিন হাত জায়গা লাগে! আরে সে তো কফিনের মাপ, শবের মাপ! জীবিত, জ্যান্ত, জিয়ল মানুষকে গোটা পৃথিবীটা ধরে দিলেও অনেক সময়ে কম পড়ে যায়। কার কতটা জায়গা লাগবে বলতে পারে সে যার জায়গা লাগবে, এবং হয়তো আরও ভাল করে সে যে তাকে দেখে, তার প্রয়োজনের চেহারাটা ছবির মতো ফুটে উঠতে দেখে। যেমন আজকে অদিতি দেখছিল। এই হট্টগোলময় কেজো যন্ত্রজগৎ, ওই খাবলা খাবলা ময়দান, রম্য প্রাসাদের এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রভুত্ব, জ্যাম-জট, অক্টারলনি-শহীদ মিনার, এই ঝরো ঝরো ঝরিছে— সব সব দরকার ছিল একটা একফোঁটা মেয়ের চুপচাপ নিপাট ভেজার দৃশ্যটা দেখবার জন্য, বোঝবার জন্য।
স্টিয়ারিং হাতে অদিতির চোখে কেমন একটা ঘোর লেগে যায়। ব্লচ, ব্লচ, ব্লচ, ওয়শ, ওয়শ। প্রায় নীল-সাদার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রায়-সবুজ, প্রায়-ধূসর, প্রায়-সাদা এবং আরও প্রায়-রং। মিশে যাচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে, তবু থাকছে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে অস্থির জলের তলার প্রতিবিম্বের মতো। ওই কম্পমান প্রতিবিম্বের মূল্য যেমন তার উপকরণের মিশ্র-বহুতায়, ঠিক তেমনই ওই একফোঁটা নিশ্চলতায়। ওটাই কেন্দ্রবিন্দু। যদিও সত্যি-সত্যি ও কেন্দ্রে নেই, একটু ডান দিকে সরে আছে। তাতেও ওর কেন্দ্রীয়ত্ব থেকে কিছু কম পড়ছে না।
হঠাৎ ঘোর কেটে যায়, এক্ষুনি ট্র্যাফিক লাইট বদলাবে। বাঁ দিকের ধোঁয়াটে কাচটা ঝুঁকে পড়ে নামাল সে— তাড়াতাড়ি উঠে এসো, উঠে এসো শিগগিরই।
ঝাপসা চোখ-মুখ, কেমন, কোথাকার, কী বৃত্তান্ত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে ফিরেছে।
শিগগির উঠে এসো— বিপজ্জনকভাবে দরজা খুলে ধরে অদিতি। সালোয়ার পায়ে সেঁটে গেছে। কাঁধ বেয়ে ভিজে চুল, চুপচুপে। এক পা, দু’ পা করে এগিয়ে এল— আমাকে বলছেন?
—আর কাকে?
—আমি তো…
—আগে তো উঠে এসো, তো-টো পরে হবে। কুইক।
কেমন একটা অগত্যা-ভঙ্গিতে উঠে এল। মোটেই বাব্বাঃ বাঁচা গেল ভঙ্গিতে নয়। খুলে-ধরা দরজাটার বাধ্যতামূলকতার ফাঁদে পড়ে যেন। চালিকার মান রাখতে, বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে। তেমন করে ডাকতে পারলে উঠে আসবেই এই বিশ্বাস।
আস্তে আস্তে ছাড়ছে, অদিতি প্রস্তুত, সমস্ত মনোযোগ সামনে, কানে এল— আপনার গাড়ি তো নদী হয়ে গেল।
—তুমি নিজেও তো নদী হয়ে গেছ। ঘাড় না ফিরিয়ে সে জবাব দেয়।
—সত্যি বলছেন? কেমন একটা খুশির হাসি চলকে উঠল গলা থেকে। ও কি নদী টদি হতে চেয়েছিল নাকি? কোনও কোনও মানুষের আবার মানব-অস্তিত্বকে বড় সীমাবদ্ধ মনে হয়। তারা কেউ রোদুর হতে চায়, কেউ আকাশ হতে চায়, কেউ ঝরনা, এ মেয়েটি তা হলে নদী হতে চাওয়া, সীমাবদ্ধ-মানবতা থেকে মুক্তি পেতে চাওয়া কোনও মানুষ! নাকি অদিতি একটু বেশিই ভেবে ফেলছে।
—তোমাকে কোথায় নামাব?
—তুললেন কেন? মানে তুললেনই বা কেন?
—আচ্ছা—এবার সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ভেতর ঢুকে পড়া গেছে। অতএব ফিরে তাকাবার একটু অবসর। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে অল্প বয়সের নিশ্ছিদ্র মসৃণ, শপশপে ভিজে চুল সেঁটে গেছে মাথার সঙ্গে। লেপটে আছে। কানে, কপালে। বেশ লম্বা চুল, তলার দিকটা কেমন কোঁকড়া মতো, এত ভিজেও যখন সোজা হয়নি, তখন পার্লারি নয়।
—একা একা ভিজছ! আকাশ থেকে তো গোটা গঙ্গা-গোদাবরীই ঢালছে মনে হচ্ছে, তুলব না?
—বা, বিপদে পড়তে পারেন না?
—এখনও সন্ধে হতে দেরি। ছেলে-ছোকরাও নয়, তুলতে অসুবিধে কী? পিস্তলধারিণী বালিকা দেখতে আমার এখনও বাকি আছে।
পাশ থেকে একটা ছোট্ট হাসি এল।
—কোনও ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠতে কিন্তু তোমাকেও ভাবতে হত। অপর পক্ষে ভদ্রলোককেও। এ ক্ষেত্রে সে সব ঝামেলা নেই…যাক তোমাকে কোথায়…।
—এখানেই নামিয়ে দিন না, একটু বাঁ দিক ঘেঁষে রাখুন…আমি নেমে যাচ্ছি।
—আশ্চর্য, অমনি তোমার রাগ হয়ে গেল! আমি কি তোমাকে যেখানে-সেখানে নামতে বলেছি! তোমার বাড়ি বা গন্তব্য, যাই হোক, সেখানেই নামাব। এখানে পথের মাঝখানে! বৃষ্টি তো তুমুল!
—তাতে কী হয়েছে!
এবার হেসে উঠল, বেশ শব্দটা হাসির। বলল, নামাবেন কোথায়? আমি তো এদিকে থাকিই না!
—তবে?
—সাউথে। আপনি নর্থে না ইস্টে?
—নর্থ। তুমিও তো নর্থের দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়েছিলে… যা ভিজেছ এ অবস্থায় বাড়ি ছাড়া আর কিছুর কথা কেউ ভাবে না… ন্যাচার্যালি… আমিও…
—আপনি তা হলে বাড়ি ফিরছেন?
—হ্যাঁ। কেন?
—যদি অসুবিধে না হয় আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন?
ভেতরে ভেতরে খুব চমকে গেল অদিতি। বলে কী? পাগলটাগল নয় তো? কিংবা ডাকাতদলের চর?
নিজের ভাবনায় অবশ্য নিজেরই হাসি পেয়ে গেল তার।
পাগল এ নয়। অন্তত পুরো পাগল তো নয়ই। সিকি পাগল হলেও হতে পারে। আর ডাকাতদল? ডাকাত দলের চরণী এমন যোগসাজশ করল যে তাকে গাড়ি থামাতে হল। চরণীর কোনও আবেদন ছাড়াই তাকে তুলতে হল! সে ক্ষেত্রে তো রীতিমতো লং ডিস্ট্যান্স সম্মোহন প্র্যাকটিস করতে হয় এই খুদে ডাকাতকে। নয়তো ম্যাজিক। সেই তাসের খেলা আছে না? তোমাকে যে-কোনও একটা তাস টানতে বলবে। কিন্তু পুশ করার এমনই কায়দা যে ম্যাজিশিয়ানের চেনা তাসটাই তুমি টানবে!
—তোমার যদি কোনও অসুবিধে না থাকে, আমারও নেই। তবে আমার কিন্তু বাড়ি-ভরতি লোক। একটা বিছানা তোমাকে দিতে পারব, কিন্তু তেমন প্রাইভেসি হয়তো… অনেকের আবার খুব কৌতূহলও।
আবার একটু ছোট্ট হাসি, বলল, আমার সবকিছু অভ্যেস আছে।
—বেশ।
লাল আলো, হাঁড়ল হাঁড়ল গর্ত। বৃষ্টিতে চটা-উঠে-যাওয়া রাস্তা, রোড বাম্প। বেজায়গা দিয়ে পার হতে থাকা বেআক্কিলে। ভাববার আর সময় নেই। তলিয়ে ভাবতে গেলে সামনের গাড়ির বাম্পারে নির্ঘাত ভিড়িয়ে দেবে। তাই ওপর-মন দিয়ে খুব আলতো করে ছাড়া ছাড়া ভাবতে লাগল সে।
ট্রপিক্যাল-মেডিসিন এসে গেছে… এককথায় রাজি হয়ে গেল সে?… ডান দিকের ঝুপড়িতে গরম গরম ভাঁড়ের চা খাচ্ছে কিছু কুলি শ্রেণীর লোক। ঝুপড়িটা কিছুটা তেরপলের, কিছুটা প্লাস্টিকের, ভেতরে উনুনের গনগনে আঁচ। তার আলোয় এক থুত্থুড়ে বুড়ির মুখ, চা খাচ্ছে। এই ইয়াং কুলিদের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক? মা? না ও-ই চা-ওয়ালি! উনুনের ধারে বসে রয়েছে যখন! আপাদমস্তক কালো একটা বিরাট কেটলির ঢাকনাটা খুলে ভেতরে একটু গুঁড়ো দুধ ছিটিয়ে দিল… একটা অজানা অচেনা উটকো, কিছুর মধ্যে কিছু নেই ভিজছে। সাউথে থাকে বলছে। অথচ ডেফিনিটলি নর্থের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল… ফলঅলা পলিথিনে ঢাকা ফলের ঝুড়ি সরাতে গিয়ে কাত করে ফেলেছে, পেভমেন্টে গড়াচ্ছে মুসাম্বি… আপেল— দুটো ভিজে-কাক বাচ্চা হেসে লুটোপুটি… চৌরঙ্গিতে একা একা ভিজছে.. গন্তব্য নেই.. খুব গোলমেলে কিছু হলে? মেয়েটা যদি তার বাড়িতে গিয়ে সুইসাইডফাইড করে? ‘হ্যাঁ’ বলল কেন? কেন সে রাজি হল? নিঃসংকোচ চাওয়ার জবাবে অন্য কিছু বলতে পারেনি। তাই?
হবেও বা। এ কথা সত্যি যে সে অনুরোধ এড়াতে পারে না। দুম করে মুখের ওপর এ রকম একটা অনুরোধ কেউ করতে পারে, সেটাই ধারণায় ছিল না। এই না গাড়িতেই উঠতেই চাইছিলি না! উঠতে-না-উঠতেই একেবারে গেস্ট হওয়ার অনুরোধ? অনুরোধও নয়। যেন প্রচ্ছন্ন দাবি! বসতে পেলে শুতে চায়!
হঠাৎ সে বেকায়দায় পড়ে গেছে।
হেদুয়া পেরিয়ে যাচ্ছে, এপারে বেথুন ওপারে স্কটিশ চার্চ।
—এ জায়গাটা চেনো?
হাসছে। —আপনি আমাকে কী ভাবেন?
—কোথায় পড়াশুনো করেছ?
—এখানে নয়।
প্রত্যেকটি কথার জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে।
—বাড়ি থেকে পালিয়েছ নাকি বলো তো! মুখে একটা হালকা হাসি টেনে অদিতি ছুঁড়ে দিল, সে খুব ভাবিত। এই খুব-ভাবনাটা যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে।
—তা হলে তো আপনাকে আবার গাড়ি ঘুরোতে হয়।
—কেন?
—ভবানী ভবন? বাড়ি পালানোদের তো সেখানেই— খুঁক খুঁক করে হাসতে লাগল। ফাজিল খুব।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল গাড়িটা।
—নামো, এসে গেছি- অদিতি বলল।
রাস্তাটা কচ্ছপের পিঠের মতো, ধারে স্রোতের মতো জল বইছে। ওপরেও হালকা জল। তবে বৃষ্টি যেভাবে চলছে তাতে শিগগিরই ডুবে যাবে, কোনও সন্দেহ নেই।
—তুমি চট করে সিঁড়িটায় উঠে সদর দরজার কাছে দাঁড়াও। আমি গাড়িটা গ্যারাজ করে আসছি।
বহুকালের পুরনো বাড়ি। একশো বছর হবে বোধহয়। বয়স সঠিক হিসেব করতে হলে ঠিকুজি নিয়ে বসতে হয়। বাইরের ঝুল-বারান্দাগুলোর লোহার ফ্রেম তুবড়ে মরচে মেখে একেক্কার। তিনতলা বিরাট বাড়িটার গায়ে আগাগোড়া খোসপাঁচড়ার মতো ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া দাগ। কোথাও চটা উঠে যাওয়া, কোথাও চুনবালির চাঙড় খসে পড়া, কোথাও আবার স্রেফ বৃষ্টিটিষ্টির একটা কালচে শ্যাওলা ছাপ। কতদিন সারাই-ঝালাই হয়নি, কে জানে! খুব ছোটবেলায় একবার সব খসিয়ে নতুন করে দেয়ালটেয়াল হয়েছিল আবছা মনে পড়ে। বালি দিয়ে খেলার স্মৃতিটা একটা ছোট্ট লাল টিপের মতো মনের ভেতরে।
—চলো। অদিতি বুঝতে পারছে অদিতির সঙ্গে বাড়িটাকে মেলাতে পার বছে না খুদেটা। মনে মনে সে খুব খানিকটা হেসে নিল।
ভেতরে ঢুকে, একটু বাঁয়ে একটা চৌকোনা বড় উঠোন, মাটির, তাতে গুচ্ছের আগাছা, শ্যাওলার ওপর যদি পা পড়ে তো হড়াস্। একটা মাঝারি সাইজের হৃষ্টপুষ্ট ছাতিম গাছ। পাশেই নিমের পাতা বৃষ্টিতে ঝুরছে। উঠোনের তিন দিক দিয়ে বাড়িটা উঁচিয়ে উঠেছে, নিম-ছাতিমের মগডাল ছাড়িয়ে। উঠোনের চারপাশে চওড়া রোয়াক। বাঁ দিকে ঘুরেই সেকেলে কাঠের সিঁড়ি। ওদের পাশ দিয়ে দুটো হুলো বেড়াল তীব্র গতিতে ফ্যাঁশ্শ্ আওয়াজ করে নেমে গেল। এক্ষুনি বৃষ্টিটা থেমে গেলেই উঠোনটাতে ধুন্ধুমার ঝগড়া শুরু করবে। হুলো দুটোর অহি-নকুল সম্পর্ক।
দোতলায় উঠে কোলাপসিবলের তালা খুলল সে। কোলাপসিবলের পেছনে দরজাটা সাবেক নয়। চাবি ঘুরিয়ে খুলল—এসো।
তার বারান্দার লাল সিমেন্ট জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু বাকিটুকু অদ্ভুত চকচকে। বাঁ দিকে কিছুটা গিয়ে একটা দরজার তালা খুলল অদিতি। হেসে উঠল ভেতরটা।
ফুটকি বলল— আপনি ভাল ড্রাইভ করেন না।
—শোনো এ ঘর থেকে বেরিয়ে ডান দিকের দরজাটাই বাথরুম। তোয়ালেটোয়ালে আছে। আমার একটা বাথরোব আছে—কাচা। শুকনো হয়ে নাও। ওটা পরতে পারো। আমি একটু আসছি।
এই সময়ে কালো কি ছবি কাউকে পাওয়া গেলে ভাল হত। কিন্তু এই বৃষ্টিতে কোনও আশাই নেই। অন্য হাতের তৈরি চা খাওয়ার বিলাস আজ হবার জো নেই। রান্নাঘরে গিয়ে অতএব কফির জল-দুধ চাপাল গ্যাসে। তারপর সিঙ্কে ভাল করে হাত ধুতে লাগল। রান্নাঘরটা খুবই বড়। আসলে তো এটা রান্নাঘর নয়, শোবারই ঘর। ছোটকাকুর। অবিবাহিত ছোটকাকুর ঘরটা আদরের ভাইঝির ভাগে পড়েছে। এটা খাবার ঘরও। পাথরের টপওয়ালা গোল টেবিলের চার পাশে তিনটে চেয়ার। টেবিলটা প্রাচীন, চেয়ারগুলো আধুনিক।
চিঁড়ে-বাদাম-কাঠি ভাজার সাড়েবত্রিশ ভাজাটা একটা বড় স্টিলের বাটিতে ঢালল অদিতি। স্টিলের পটে কফি, দুটো কাপ-ডিশ, দুটো বড় চামচ।
ফুটকি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। একেবারে মাঝখানে, গোল জাজিমটার ওপর, চারপায়া সেন্টার টেবিলটার পাশে। এ রকম জায়গায় দাঁড়াবার একটাই মানে হয়। পাখাটা পাওয়া। কিন্তু ও চালায়ইনি। অদিতি টেবিলের ওপর ট্রেটা রেখে বলল— ফ্যানের সুইচটা ওই দিকে দরজার পাশে। চুলটা ভাল করে মুছেছ? তবে আমার ড্রায়ার আছে, চট করে তো শুকোবে না, আগে খেয়ে নাও একটু…ঠান্ডা হয়ে যাবে। বসো।
গোলাপি তোয়ালের বাথরোবের মধ্যে ছোট্ট শরীরটা ডুবে গেছে, ভিজে চুলের গোছায় মুখটা প্রায় ঢাকা। বসল। এখনও সেই অগত্যা ভঙ্গিতে।
—তোমাকে ক’ চামচ?
—যা হোক।
কফি ঢেলে কাপটা এগিয়ে দিতে হঠাৎ বলল—আমার ভিজতে ভাল লাগছিল।
—তাই? রাগ করেছ?
—না, তা নয়, এটাও বেশ ভাল।
একমুঠো চিঁড়েভাজা মুখে পুরে অদিতি বলল—চামচটামচ দিয়ে মুড়ি-চিঁড়েভাজা পোষায় না। যাই বলো। মুঠো করে তুলে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে এক ধাক্কায় চালান করে দিতে হয় ভেতরে। তুমি কী বলে? খাও! আচ্ছা তো! একটু নিল, চামচে করে। এক চুমুক কফি।
—ভাল হয়েছে কফিটা?
—কী জানি, ভাল-মন্দ কিছু বুঝতে পারছি না।
মানুষ তো ভদ্রতার খাতিরেও ভালটাল বলে! এর সে বালাই নেই।
—তোমার জামা কাপড়গুলো মেলে দিয়েছ তো? ভাল করে নিংড়ে?
—হ্যাঁ বাথরুমে একটা রড ছিল।
—সে কী! বাইরে বারান্দায় দেখছ না? কত বড় দড়ি টাঙানো রয়েছে! ওইখানে দাও। হাওয়ায় শুকিয়ে যাবে।
—কালকের আগে শুকোচ্ছে না।
অদিতি মনে মনে ভাবল—যাক, কমনসেন্স ফিরে আসছে তা হলে।
মুখে বলল— জলটা টেনে যাক, তারপর ঝেড়ে ইস্ত্রি করে দেব। আমার শাড়ি বার করে দিচ্ছি, যদিও ব্লাউজ তোমার হবে না। পরে, কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে নিতে পারো। ওটা অবশ্য ফ্যাশনেবল নয়, আই নো।
কোনও উত্তর দিল না। আনমনে চিঁড়েভাজা খেয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝেই কফিতে লম্বা চুমুক। এবার বোধহয় আরাম লাগছে কফিটা খেতে। কিছু জিজ্ঞেস না করেই ওর কাপে আর একটু ঢেলে দিল, চিনি দিল, নিজেও নিল।
এই সময়ে আবার দ্বিগুণ জোরে একেবারে ঝমাঝঝম শব্দে বৃষ্টি নামল। বিরাট একটা বাজের ডাক আকাশের এ মোড় থেকে ও মোড় পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই চোখ-ঝলসানো ঝিলিক ঢুকল ঘরের ভেতর।
—আজ কলকাতা ভেসে যাবে— অদিতি উঠে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাল— জানলা ভরতি কালো মেঘ। নড়বার লক্ষণ দেখছি না। ফিরে বলল ইশ্। কী করে যাবে?
—যেভাবে এসেছিলাম…
—আমি তোমাকে একটা ছাতা দিতে পারি। শাড়িটাড়িও…কিন্তু এ বৃষ্টিতে কি ছাতা কোনও কাজে লাগবে?
—ওসব দরকার নেই।
—তার মানে?
—চলে যাব ঠিক।
—আমি কিন্তু তোমাকে চলে যাবার কোনও ইঙ্গিত টিঙ্গিত দিইনি। ডোন্ট মিসান্ডার্স্ট্যান্ড মি। এই সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কেউ কোথাও যেতে পারে না। জল যা জমেছে, হাঁটু পর্যন্ত। তুমি যা পলকা। জল ঠেলতেই পারবে না। সন্ধে হয়ে আসছে, আসছে কেন এসে গেছে। পড়ে যাবে, ডুবে যাবে…. যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। আমি অ্যাকচুয়ালি ভাবছিলুম তোমার বাড়ির কথা। দে’ল গেট ওয়ারিড।
ওদিক থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।
অদিতি বলল— তুমি বরং বাড়িতে এইবেলা একটা ফোন করে দাও। আমার নম্বর আর ঠিকানাটা দিয়ে দেবে।…এইবেলা, কেননা এত বৃষ্টি হলে দেখেছি আমাদের ফোনটা চলে যায়।… কী হল কিছু বলছ না যে? এ ছাড়া কোনও উপায় নেই— ইউ’ল হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট— রাইট?
এবারও কোনও উত্তর নেই। সে হেয়ার-ড্রায়ারটা বার করে আনল। প্লাগটা লাগিয়ে দিয়ে বলল—শুকিয়ে নাও চুলটা। অতটা চুল, ভিজে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা, এক কাজ করো, বাথরুমে লাগিয়ে দিচ্ছি। ওখানেই শুকিয়ে নাও। এখানে তারটা সোফা পর্যন্ত যাচ্ছেই না। চলো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি…
হাতটা বাড়াল। ড্রায়ারটা নিল, বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরুমে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে দু’ কদম এগিয়ে ওর চামড়ার মুখবন্ধ ঝোলাটার চেন চররর করে খুলে ফেলল অদিতি। দুটো কবিতার বই, একটা রিলকে অনুবাদ, আর একটা অক্সফোর্ড বুক অব ইংলিশ ভার্স। একটা পার্স। হ্যাঁ এই যে একটা শক্ত মলাটের ডায়েরি। চটপট ডায়েরিটা খুলে দেখল—অনোহিতা সাহা রায়। ফোননম্বর মনে হচ্ছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডটোড হবে। যথাস্থানে ডায়েরিটা ঢুকিয়ে রেখে সে বাথরুমের দরজা পেরিয়ে ওদিকের শোবার ঘরে চলে গেল। চটপট ডায়াল করল। বাজছে…বাজছে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাহা রায় স্পিকিং…সরি টু হ্যাভ মিসড ইয়োর কল। প্লিজ লিভ ইয়োর ফোননাম্বার অ্যান্ড মেসেজ। ওয়েট ফর দা বিপ। থ্যাঙ্কস ফ’ কলিং।
সামান্য একটু ছায়া নেমেছিল তার মুখে। পরক্ষণেই বিপটা শোনা যেতে সে তাড়াতাড়ি বলে গেল— অনোহিতা আজ আমার বাড়িতে থাকছে। বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল। লিফ্ট দিয়েছিলুম। আমি অদিতি সরকার। ফোন ২৫৫৫-৩৯১৯। — বাস, মা-বাবা রাতে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন। একটা ফোন তাকে নিশ্চয়ই করবেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন না বলুন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ব্যাপারটা থাকছে না।
আলমারি থেকে একটা ছাপা শাড়ি, ব্লাউজ আর পেটিকোট বার করে ফেলল। তারপর বাথরুমের দরজায় টোকা দিল। খুলে গেল দরজাটা। দাঁড়িয়ে রয়েছে। হেয়ার-ড্রায়ার হাতে, চুপচাপ। শাড়ি ব্লাউজগুলো সে র্যাকে রাখল। তারপর ড্রায়ারের সুইচটা টিপে ওর হাতে দিয়ে বলল নাও, শুকোও। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল হাওয়ায় বাদামি চুল উড়ছে। বিলি কাটছে ও চুলের ভেতর। ড্রায়ারটাকে ভালই তো বাগিয়েছে! শাড়ি-ব্লাউজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল— পরে নিয়ো। একটু অসুবিধে হবে। কিন্তু কী আর করা যাবে।
এতটা চুপচাপ কেন? বৃষ্টিতে অসাগর ভিজছিল। সঙ্গে এল, কিন্তু বাধ্য হয়ে, অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে। দেখলে খানিকটা সম্পন্নই মনে হয়, চেহারায় অল্পবয়সি লালিত্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা মার্জিত ছাপ। তা ছাড়া ব্যাগের বইগুলো তো বলেই দিচ্ছে— ভালই শিক্ষিত। ইংরিজিতে এম এ টেম এ পড়ে হয়তো। আপাতদৃষ্টিতে উড়নচণ্ডী। কিন্তু নোঙরহীন মনে হয় না ওকে। মেয়েটা কি খুব শকটক পেয়েছে? মা-বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে? পরীক্ষায় ফেল? প্রেম চটকে গেছে?… এগুলো ছাড়া আর তো কিছু মনে আসছে না। যাক, ওই বৃষ্টিতে যে বেপরোয়া মেয়েটা ভেসে যায়নি, কিংবা বদ হাতে পড়েনি এটাই যথেষ্ট। অদিতির জায়গায় যদি কোনও ভূপতি টুপতি ওকে লিফটটা দিত, এবং এমনি না-না করে ও সেটা নিত, লোকটার যদি বদ মতলব থাকত, আনমনা মেয়েটা যদি নিজেকে বাঁচাতে না পারত, তা হলে এতক্ষণে এ পুলিশ-কেস। এতগুলো ‘যদি’ লাগিয়ে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল অবশ্য।
খুট করে শব্দ হল। দু’ সেকেন্ড পরেই লাল ছাপের শাড়ি ঢিলে ব্লাউজ পরে, বাদামি চুল এলো করে এলেন। ঢিলে ব্লাউজটাকে ঢাকবার চেষ্টাও করেনি। ফ্যাশন অ-ফ্যাশনে ওর কিছু যায়-আসে না, যেমন কফিতে চিনি ঠিক আছে কি নেই তাতে বা বৃষ্টিতে ভিজে কাক হয়ে এসপ্ল্যানেডের শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকতেও কিছু এসে যায়নি। কিছু মেয়ে!
—নামটা জানতে পারি কি? আমি অদিতি সরকার।
‘তোমার নাম কী খুকিটা’ই ঠিক হত। কিন্তু এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, মেজাজি নিশ্চয়! একটু অসরাসরি জিজ্ঞেস করাই ভাল। নামটা সে জানে, মিলিয়ে নিতে পারবে— মিথ্যে বলছে কিনা।
ঠিক! নাম ভাঁড়াচ্ছে, গম্ভীর মুখে বলল— তনিকা।
—তনিকা?
—আমি পদবি ইউজ করি না।
এ বয়সে সবাই অল্পবিস্তর বিদ্রোহী থাকে। তারও অনেক রকম বিদ্রোহ ছিল। কিছুতেই কাউকে প্রণাম করত না। এক বিজয়ার দিন ছাড়া। দিদিমা ব্যাপারটা খেয়াল করে একদিন বলেছিলেন কী রে বনি, আমার পায়ে হাত দিলি না?
—তোমার পায়ে কি আর তুমি আছ দিদিমা! আছে যত রাজ্যের গরগরে ধুলো।
—‘পায়ের ধুলো’ নেওয়াই তো বলে কথায়!
—পা যদি ধুলো প্রোডিউস করত, গুরুঠাকুরদের ম্যাজিক-ভস্মের মতো, তা হলে ভেবে দেখতুম দিদিমা। কিন্তু ও ধুলো জীবাণু আর নোংরায় ভরতি রাস্তার ধুলো। লক্ষ্মীটি।
বলেটলে অবশ্য সে এক ছুটে দিদিমার গলা জড়িয়ে চুমু খেয়েছিল, বলেছিল, তুমি তো আমার প্রাণের বন্ধু, দিদিমা, বন্ধুকে কেউ প্রণাম করে?
দিদিমা নিজের গালে আঙুল রেখে বলেছিলেন—আর এই যে তুই তোর মুখামৃত দিয়ে আমার গালটা এঁটো করে দিলি? সেটা বুঝি নোংরামি নয়!
—একটি ফোঁটাও পাবে না। বেশ চলো। সাবান-ডেটল দিয়ে তোমার গাল ধুয়ে দিই!
দিদিমা বলেছিলেন— দেখিস রাণু তোর এই সৃষ্টিছাড়া মেয়েটা নির্ঘাত সাহেব বিয়ে করবে।
দিদিমা জেনে গেলেন না তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
পদবি ব্যবহার বা অব্যবহার নিয়ে অদিতি কোনও হালকা মন্তব্য করল না। কে জানে বাবা, কী ভাবে নেবে!
—একটু শুয়েটুয়ে নেবে? —সে বলল
—যখন-তখন শুই না।
—তো করবেটা কী? কথাই তো বলছ না! বাড়ি কোথায়?
—সাউথে, বললাম তো!
—সাউথ তো অনেকখানি! ঠিক আছে না বলতে চাও না-ই বললে। তবে কারণটা বুঝলুম না। আমি তো একজন ভদ্রমহিলা। কোনও ভদ্রলোককে ঠিকানা টিকানা না দেওয়াই ভাল। কিন্তু…
কোনও উত্তর দিল না। উঠে র্যাকের বইগুলো দেখতে লাগল। অদিতি আঘাত-পাওয়া মুখে বসে আছে। ছদ্ম অবশ্য। তার একটু মজা লাগতে শুরু করেছে।
হঠাৎ ফিরে ফিক করে হাসল।
—হাসলে যে?
—হাসিরও এক্সপ্লানেশন দিতে হবে?
—তা দিতে হবে বই কী! কারণ ছাড়া হাসলে তাকে পাগল বলে।
—ব্ল্যাকমেল করছেন? ইমোশন্যাল? যদি এইসব বিশেষণের চাপে বলে ফেলি।
—আরে! আমি তো সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করলুম। আচ্ছা মেয়ে তো তুমি!
—কৃতজ্ঞতা নেই, বেপরোয়া, ছন্নছাড়া…আধপাগলা না?
ঝিলিক ঝিলিক হাসতে লাগল।
যাক বাবা হাসছে। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি তা হলে! তবে চালাক খুব। খুব কটকটেও আছে!
—ক্যাঁটক্যাঁট করে কথা বলে, না?— অদিতি চমকে তাকাল। মুখটা খুঁজে খুঁজে দেখল— হাসি হাসি ভাবটা নেই, তবে দুঃখী দুঃখীও নয় ঠিক। কী রকম যে তা তার বোধগম্য হল না।
—তোমার খিচুড়ি চলে?
—আমার কথার উত্তর দিলেন না তো!
—দ্যাখো অনো…মানে তনিকা, তোমার কৃতজ্ঞতা আছে কি নেই, পরোয়া করো কি করো না, ক্যাঁটক্যাঁটে কি ক্যাঁটকেঁটে নয় এসব বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলুম জাস্ট অপরিচিত কারওর সঙ্গে দেখা হলে ওটাই স্বাভাবিক তাই। আর কোনও কারণ…
—চলে— ও বলে উঠল।
—চলে? কে চলে?
—কেউ নয়। আমার খিচুড়ি চলে। আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন না?
—তা হলে, এখন ধরো আটটা, আর আধঘণ্টা পরে চাপিয়ে দেব, হবে তো?
—খুব— যাক, এতক্ষণে একটা সোজা কথার সোজা জবাব পাওয়া গেল।
—তুমি বরং বইটই দেখো। আমি একটু কাজ করে নিই।
কম্প্যুটার খুলে গোটা তিনেক ই-মেল পেল সে৷ একটা মনীষার। অদিতি চলে আসবার পর থেকেই তার নাকি একদম ভাল লাগছে না। সে-ও ফিরে আসবে ভাবছে।
সর্বনাশ! মনীষা বড্ড নাছোড়বান্দা আর সেন্টিমেন্টাল টাইপের মেয়ে। তার ওপর খ্যাপাটে। চলে আসবে মানে? পাবলিশিং হাউসের অমন চাকরিটা ছেড়ে দেবে? এই নিয়ে তা হলে তিনবার হবে।
দ্বিতীয়টা আঁদ্রের। শিগগির দিল্লি আসছে ‘মাতিস’-এর কাজ নিয়ে। ফরাসি আর ভারত সরকারের মধ্যে সংস্কৃতির আদান-প্রদান, কাজটার ভার পেয়েছে সে। কলকাতা ইনটারেস্টেড কিনা জানতে চেয়েছে। আশ্চর্য! দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করতে অদিতিকে দরকার পড়ল না, কলকাতা বলেই দরকার পড়ে গেল? এখানে সরকার নেই? সে তো নিজেই এসেছে— চার বছর পোরেনি এখনও। নিজের আতলিয়ে গড়তেই দিন গেছে। তেমন যোগাযোগ এখনও হল কই? প্রথম দেড় বছর মা ছাড়া আর কিছু ভাবেনি সে।
তৃতীয়টা রাজর্ষির। এটাই সবচেয়ে বিরক্তিকর। রাজর্ষির মা বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরে থাকেন, তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে। অদিতি কি একবার যেতে পারবে? অবশ্যই যেন যায়। রাজর্ষি খুব চিন্তিত হয়ে আছে। এ অনুরোধ মানেই আজ্ঞা। এর আগেও দু’বার এ আজ্ঞা পালন করেছে সে, এইভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় ও। সে ভালই বোঝে। কিন্তু রাজর্ষির মাকে সে একেবারে পছন্দ করে না। কেন করে না তার অনেক কারণ আছে, তবে স্থূলতম কারণটা হল উনি একদিন তার সম্পর্কে বলেছিলেন—‘সাহেবের এঁটো।’ ছিঃ। এ কথা যে মহিলা বলতে পারেন তাঁকে অপছন্দ করবার হক তার আছে। এমনকী ঘেন্নাও। কিন্তু মুশকিল হল—ঘেন্না জিনিসটা তার চট করে আসে না। ইংরেজিতে সে বলতে পারে আই হেট দিস, হেট দ্যাট, বা আই হেট য়ু। কিন্তু ইংরেজি হেট আর বাংলা ঘেন্নার অনেক তফাত। সে যাই হোক, ঘেন্নার জায়গায় তার যে অনুভূতিটা হয় সেটা হল বিরক্তি। দূর দূর! তা রাজর্ষির সংক্রান্ত সব ব্যাপারেই তার এই ‘দূর!’টা মনে হয়। ধু—র!
মনীষাকে জবাবটা দিয়ে দিল চটপট। না হলে মুশকিল আছে। দিবারাত্র অদিতির কাছে এসে মড়াকান্না কাঁদবে। একবার যদি এসে পড়ে। ওটাই মনীষার স্বভাব। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। ওকে প্রথম স্কলারশিপটার খোঁজ দিয়েছিল অদিতিই। মড়াকান্নায় অস্থির হয়ে গেল। প্রথমটা ডগোমগো। দারুণ ভাল, দারুণ ভাল সব। দারুণ কাজ করছে। তখন অদিতি গ্লাসগোতে স্কুল অব আর্টে ট্রেনিং নিচ্ছে, মনীষা লন্ডনে পোস্ট ডক্। ও মা, কাউকে বলা নেই, কওয়া নেই, কাজকর্ম ডকে তুলে চলে গেল ইন্ডিয়ানা, খুব নাকি ভাল অফার পেয়েছে। ছ’মাসও গেল না, বিয়ে করে ফেলল ইন্ডিয়ানারই আর এক প্রফেসারকে, অন্ধ্রের লোক প্রফেসর রাও, দারুণ ভাল। বিয়ে যে কী জিনিস! কিছুদিনের মধ্যেই অদিতিকে লম্বা চিঠি, বিয়ে করে ভীষণ ভুল করেছে, এক পেশার লোককে কক্ষনও বিয়ে করতে নেই। অদিতি যেন ও ভুল না করে। রাও ওকে চাকরি ছেড়ে দেবার জন্যে চাপ দিচ্ছে। ও সংসারে মন দিচ্ছে না—এই নালিশ করছে অহরহ। ডিভোর্স করল, ইন্ডিয়ানা ছাড়ল, তারপর খুঁজে পেতে প্যারিসে এসে অদিতির ঘাড়ে চাপল। কোন পাবলিশারের অফিসে কাজ করছে, থাকার পয়সা কম পড়ছে, অদিতি যদি ওর ঘরটা শেয়ার করে। লাইফ হেল করে দিয়েছিল একেবারে। বড্ড অব্যবস্থিতচিত্ত আসলে। খুব স্বার্থপরও। এবং ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। কথায় কথায় ঠোঁট ফোলানো টাইপ। তুই বোধহয় আমায় পছন্দ করছিস না।
অদিতি আমি আবার না তোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াই। — এই রকম, আর এখন অত ভাল চাকরি করছে! ছেড়ে দেবে?
মনীষাকে অগত্যা খানিকটা স্তোক এবং খানিকটা মিথ্যে কথা লিখতে বাধ্য হল। এতদিনে একটা মনের মতো চাকরি হয়েছে। সেবার পোস্ট ডক্টা ছেড়ে টিচিংয়ে আর আসতে পারলি না। এবার যদি কাজ ছাড়িস জীবনে তোর মুখ দেখব না। কলকাতায় যা পলিউশন তাতে তোর মতো হেঁপো রুগি— মাসখানেকও টিঁকবে না। শুধু কলকাতা নয়, দিল্লি, মুম্বই চেন্নাই সর্বত্র পলিউশন লেভেল ভয়াবহ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনীষা একেবারে যাকে বলে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। কিন্তু ওই অস্থির পরনির্ভর স্বভাবের জন্য এখনও কেমন না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে রয়েছে। নামকরা প্রকাশকের এডিটোরিয়াল বোর্ডে রয়েছে। তবু পালাই পালাই।
কম্প্যুটারটা বন্ধ করে, পেছন দিকে তাকাল। ঘরের মধ্যে নেই, বুকের মধ্যেটা ঢিপ করে উঠল। নাঃ ওই যে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কী দেখছিস বাবা? শ্যাওলা?—দ্যাখ! সে রান্নাঘরে চলে গেল। ফ্রিজ থেকে রম্-এর বোতলটা বার করল, কোকের সঙ্গে পরিমাণ মতো মিশিয়ে তৈরি করে ফেলল ড্রিঙ্কটা। একটু একটু করে খেতে খেতে হয়ে যাবে রান্নাটা।
—আমি হেলপ করব?
তনিকা-অনোহিতা রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ পানীয়র গ্লাসের দিকে। অদিতি পাত্তা দিল না। বলল— তুমি পারো?
—কিছু কুটতে হলে ছুরি লাগবে।
গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে অদিতি বলল আমিও তো ছুরিই ব্যবহার করি। দিচ্ছি। ক্রিসপারটা দেখল। নাঃ খিচুড়িতে দেবার মতো কিছু নেই। কটা ফ্রেঞ্চ বিন পড়ে আছে। দিয়ে ফেলা যাক। টোম্যাটো বার করল। আলুর ঝুড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল— আলু আর বিন ছাড়া আর কিছু তো নেই দেবার। আলু কয়েকটা ছাড়িয়ে আধখানা করে ফেলো। পেঁয়াজ? না, পেঁয়াজ আমি কেটে নিচ্ছি।
—থ্যাংকিউ।
চাল-ডাল ধুতে লাগল অদিতি। জল বসিয়ে দিল গ্যাসে।
—আপনি এইভাবে রান্না করেন?
—অর্থাৎ?
গ্লাসটার দিকে চিকচিকে চোখে তাকাল।
—চেখে দেখবে? অত বৃষ্টিতে ভেজার পর ভাল।
—চলবে।
আর একটা গ্লাস তৈরি করল অদিতি। বলল—ধীরে ধীরে খাবে।
নিজের গ্লাসটা অদিতির গ্লাসে ঠেকিয়ে খুব অভ্যস্ত গলায় বলল ‘চিয়ার্স’। পাকা পক্বান্ন একেবারে। তারই বোঝা উচিত ছিল। আজকালকার মেয়ে। সে যখন ‘আজকালকার’ ছিল তখন এসব কেউ কল্পনাও করতে পারত না। মেজদা সেবার স্কটল্যান্ড থেকে একটা অপূর্ব পারফিউম পাঠিয়েছিল। কলেজ যাবার সময়ে ঢেলেছিল একফোঁটা। মা স্তম্ভিত চোখে চেয়ে বলেছিলেন—তুত্তুই সেন্ট মেখে কলেজ যাচ্ছিস? এটা তাদের বাড়ির বাড়াবাড়ি। কিন্তু এই রকমই। ওদিক থেকে বলে উঠল—কই?
—কী কই?
—ওই যে, আপনার বাড়ি-ভরতি লোক?
হেসে ফেলল অদিতি, রান্নাঘরের দরজার দিকে ইশারা করে বলল—ওই দিকে। অনেক। এদিকে আমি একা।
চাপা হাসিতে মুখটা ঝিকিয়ে উঠল।
—আর কৌতূহল?
—নেই।
দু’জনেই হেসে ফেলল।
পরের দিন বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে দরজা খুলতে গিয়ে দেখল উঠোনটা রোদে ভাসছে। বৃষ্টি বলে কোনও জিনিসই যেন ছিল না কোনওদিন।
কালোকে পাশের ঘরেও এক কাপ চা দিতে বলে সে বাথরুমে গেল। কিছুক্ষণ পরে কানে এল— কই গো দিদি, এ ঘরে তো কেউ নেই?
তাড়াতাড়ি বেরোল অদিতি। শোবার ঘরের খাটের ওপর তার শাড়ি ব্লাউজ সব পাট করা। পায়ের কাছে কাঁথাটাও। ভাঁজটা অসমান, সে এভাবে করে না। মানে শুয়েছিল। সকাল হতেই নিজের আধ-ভিজে জামাকাপড়গুলো গলিয়ে পালিয়েছে।
যাবি তো যা! ঠিক আছে। আসতে আসতেই তো যাই যাই করছিলি? আজ সকালে যে চলে যাবি সে তো জানা কথাই। তাই বলে এমন না বলে কয়ে! ভদ্রতা বলেও তো একটা জিনিস আছে!
দুই
মনের মধ্যে একটা আলপিন ফুটে থাকে। নড়েচড়ে। কী রে বাবা। জেনারেশনে জেনারেশনে এমন দুর্লঙ্ঘ্য তফাত? দুর্লঙ্ঘ্য এবং দুর্বোধ্য! সে খুব বেশি দিন পশ্চিমি দুনিয়ায় ছিল বলেই কি তার বেশি খারাপ লাগছে? কিন্তু থ্যাংকস আর সরি-র বাইরেও যে একটা ভারতীয় ভদ্রতা আছে! সেটাও কি এমনি বদলে যাবে?
এদিকে আবার কী রকম শরীর খারাপ হয়েছে ভদ্রমহিলার কে জানে! হার্টের গণ্ডগোল, বয়সও তো পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে বোধহয়। একদম একা, একটি দিবারাত্রের মহিলাকে নিয়ে থাকেন। বিরাট হাতা-ওয়ালা বাড়ি। কোনওদিনই অবশ্য অনেক লোকের বাস ছিল না। কিন্তু বহু লোক শ্বশুরমশাইয়ের কাছে যেত, তাদের অনেক সময়ে থেকে যেতেও হত। এখন কেউ নেই। অত বড় বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। কে জানে মহিলার কেমন লাগে! একা একা!
আজব কথা। সে নিজেও তো একা। তার এই বাড়ি তো এক যৌথ পরিবারের বাড়ি! তার বিদেশ যাওয়া পর্যন্ত গমগম করত। খ্যানখ্যানও করত অনেক সময়ে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা তাদের, অন্তত তাদের প্রজন্মের কাছে খুব মজাদার ছিল। এখন বুঝতে পারে, মায়েদের হয়তো খুব ভাল লাগত না। খাটতে হত বেশি। নিজের পছন্দমতো কিছু করার উপায় ছিল না। ভেতরে সবাইকারই চাপা অসন্তোষ বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কাজ করত। তা নয়তো দাদা মারা যাবার ছ’মাসের মধ্যে বাড়িটাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গেল কেন? সে যাই হোক ওইরকম একটা যৌথ পরিবারে কাটিয়েও তো সে একা-একা থাকছে। তার কী লাগে? শেষ ট্রাম চলে যাচ্ছে বিধান সরণি দিয়ে, জানলায় ঝুলে আছে তৃতীয়ার চাঁদ। সেই চাঁদের আধা-ভৌতিক আলো তার বারান্দায়, উঠোনে। কুকুরদের কামড়াকামড়ি শুরু হল। স্তব্ধতা চিরে দিচ্ছে, কিন্তু মোটেই খুব সুখশ্রাব্য নয় এই আওয়াজ। সে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় এ ঘর থেকে ও ঘর। কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। আবার খালি খালিও লাগে। গান চালিয়ে দেয়, শান্ত হওয়ার বদলে একেকদিন উত্তাল হয়ে ওঠে বুক। এক্ষুনি যেন হাড়ের খাঁচা, চামড়া, ব্লাউজ টাউজ কেটে বেরিয়ে যাবে। পালিয়ে যাবে কোথাও। গান যত চড়ে, সরগম যত দ্রুত হয়। তত দ্রুত হয়ে যায় রক্তের চলা। অবশেষে মাঝরাতে সে তুলি তুলে নেয়। রং ঢালে, পিগমেন্টের সঙ্গে টারপেনটাইন মেশায়, লিনসিড মেশায়, ক্যানভাসের ওপর আস্তে আস্তে স্থির হতে থাকে আঙুল, মন, হৃদয়। বেল বাজে, ঘুম ভেঙে দেখে ভোর সকালের আলো বারান্দায়। সে সারারাত তার ছবিঘরের কৌচে ঘুমিয়েছিল, হাতটা বাইরে ঝুলছে। শরীরটা কোনওক্রমে জড়ো।
তার আর্তি আছে। দমবন্ধ আছে। আবার একেকদিন এমন বেয়াড়া হাওয়া দেয় যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এ যেন সেই সুখু-দুখুর হাওয়া। ঠিক তুলোর মতোই হালকা সে, তাকে উড়তে হয় সেই হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা অদ্ভুত আলো, সেটাও আলো না হাওয়া বোঝা যায় না! প্রত্যেকটা ঘর তার খুঁটিনাটি নিয়ে তখন এমন জীবন্ত হয়ে যায় যে তাদের সঙ্গে প্রায় কথা বলে ফেলে সে।
—এই দক্ষিণের দেওয়াল, মিষ্টি খাচ্ছি, বুঝেছিস? সরপুরিয়া।
—খা। আমার ত্রিসীমায় ফেলিসনি, পিঁপড়ে হবে।
—এই ফ্রিজ, একটা ইনস্টলেশন আজ শেষ করলুম, কেমন হয়েছে রে?
—উঃ আমি যে হাঁটতে পারি না, সে কথা বারবার ভুলে যাওয়া হয় কেন?
—ওহ সরি, সরি, আমি এনে দেখাব এখন।
এনে অবশ্য দেখায় না। সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পাগলামি ছেলেমানুষি কিংবা একরকমের ন্যাকামি। কথা বলতে পারলেই হল। নিজের সঙ্গে। দেওয়ালের সঙ্গে।
কিন্তু সে তখন তার পুরনো মাৰ্বল টেবিলের গায়ে হাত বুলোয়। কতকাল বেঁচে আছিস তোরা, পাষাণ রে, কত কী-ই না দেখলি জীবনে! বল তো বিয়ের দিনে মেজদার আমাকে মনে পড়েছিল কিনা? বল তো বাবা যখন মারা গেলেন, কথা বন্ধ হয়ে গেল, তখন কি বনি-বনি করে ডাকতে চেয়েছিলেন, নাকি মৃত্যু তখনই তাঁকে সব মমতার ওপারে পৌঁছে দিয়েছিল?
এই সব সময়ে একাকিত্বটাকেই উপভোগ করে সে। সেই সময়ে যদি ছবি কি কালো এসে পড়ে, সে ভেতরে ভেতরে গোমড়া হয়ে যাবে, কোনও বন্ধুবান্ধব, বা ক্রেতা— কেউই অবশ্য না ফোন করে আসে না, তবু যদি দৈবাৎ এসে পড়ে তার ভাল লাগে না।
একাকিত্বের এই আলোছায়া, চাঁদের এ পিঠ ও পিঠ কি মাধুরী দেবীর জানা? সব সময়ে যদি অমাবস্যা থাকে তা হলে তো সে ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার। এমন সন্তান হয় কেন মেয়েদের? মা বুড়ো হচ্ছেন, শেষ পাঁচ বছর রাজর্ষি একবারের জন্যও আসেনি। না এসেছিল। বাবা মারা যেতে শ্রাদ্ধ করতে। সে বরং ঘুরে গেছে। আর ইদানীং তো…। ওঁর সত্তর পঁচাত্তর হল। দুটোতে বিরাট ফারাক। তবু একবার মাকে দেখতে এল না!
* * *
আপাতত সে সবে ‘মাধুরী প্রকাশে’র প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তার কাঁধে একটা ওভারনাইট ব্যাগ। শাড়িটা লাট খেয়ে গেছে। চুলগুলো আলুথালু। চিরুনি তো সব সময়ে সঙ্গেই থাকে, এবং ছোট চুল এলোমেলো হয়ে থাকে, কেন আঁচড়ে নেয়নি, সে জানে না, এখনও জানে না সে আলুথালু। কেননা, এই বাড়িও একরকম স্মৃতির মহেঞ্জোদরো যাতে সে প্রত্ন সব নিদর্শনে ডুবে আছে।
এক্স-শাশুড়ি এক্স-বউমাকে বললেন—এসেছ? এত দেরি হল যে! কী বুক ধড়ফড় কী বুক ধড়ফড়! সুবোধ ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়ে কোনওমতে জিইয়ে রেখেছে। এখানে আর থাকা যাবে মনে হচ্ছে না। দু’দিন অন্তর ধড়ফড় ধড়ফড় ..
—কোথায় থাকবেন? —অদিতির মুখে কোনও ভাব নেই।
চোখটা সরিয়ে নিলেন উনি। সত্যি কথাই, কী বিপদেই পড়েছেন! কলকাতায় ওঁদের কোনও আস্তানা নেই। থাকতে হলে এক্স-বউমার কাছেই থাকতে হয়।
শ্বশুরমশাই ছিলেন ষোলোআনা বিষ্ণুপুরী। চাকরি-জীবনে দিল্লি-কলকাতা করলেও কখনও আস্তানা গাড়েননি। বিষ্ণুপুরেই ওঁর আসল কাজকর্ম। পুরো ইতিবৃত্তটা ছিল হাতের মুঠোয় ধরা। শ্যামরায়ের মন্দির জোড় বাংলা, রাধাগোবিন্দ, টেরাকোটা মন্দিরগুলোর পোড়ামাটির প্লেট, পঞ্চরত্ন মন্দির—এসব নিয়ে যেমন, এখানকার সংগীত ঘরানা, তাঁত শিল্প, মৃৎ-শিল্প, রেশম এসব নিয়েও তেমন তাঁর বিশদ কাজকর্ম ছিল। শেষ করে যেতে পারেননি। দুটো খণ্ড পাওয়া যায়। তৃতীয় খণ্ডের কাজ করবার সময়েই হঠাৎ স্ট্রোকে চলে গেলেন। তার ধারণা ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখেশুনেই এমনটা হয়েছিল। প্রেশারের রোগী— টেনশন, মনঃকষ্ট, আত্মগ্লানি, রাগ—এর কোনওটাই তো শরীরের পক্ষে ভাল নয়।
এখন ইনি বুঝুন! অবশ্য বুঝবেনই বা কী! ছেলে নিজে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে হলে হবে কী! মায়ের সব প্রয়োজনের বিলিব্যবস্থা রিমোট কন্ট্রোলে করে যায়। তা ছাড়া অদিতি তো আছে! এক্স-বউমা! সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা পর্যন্ত অদিতির উকিলই করে দিলেন। বউমাকে এত অবিশ্বাস করেছিলেন, কার্যকালে দেখা গেল তার ওপরেই দিব্যি জোরজুলুম!
—আপনার ছেলে আসুক। সে দেখেশুনে করবে এখন।
—রাজা? তা হলেই হয়েছে! সে গুড়ে বালি। সব চুরিচামারি হয়ে যাবে। তার কী বউমা! সে তো আর আসছে
না!
—আমাকে বউমা ডাকবেন না।
—অ। তা ঠিক। কিন্তু অভ্যেস যেতে চায় না। মনে কিছু কোরো না।
জীবনের যে-কোনও ঘটনা সুখেরই হোক, দুঃখেরই হোক, ভুলে যাবার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল স্মৃতির চিত্রময়তা। স্মৃতি সবকিছুই আলমারিতে, দেরাজে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দেয়। এক ড্রয়ারে খেলাধুলো, শৈশবসঙ্গী,—হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চায়।
—বনি বনি বনি। তুই আমার দলে।
—না না কাল ও তোমার দলে ছিল, আজ আমার।
চু-কিতকিত খেলায় তার নাম কইমাছ, কেননা সে পিছলে পালায়, ধরা পড়ে না, ধরা দেয় না, নট আউট ব্যাটসম্যানের মতো শেষ পর্যন্ত না-মোর, অধরা।
আরেক ড্রয়ারে আছে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন।
জ্বর হয়েছে। বেশ জ্বর। লালচে মুখ। চোখ ছলছল। মা নেই। মা কোথায় কোন দাদার সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসতে গেছেন। রাউরকেলা কি?
—মা, ও মা, মা! বনির ঘ্যানঘ্যান প্রায় কান্নার আকার নিচ্ছে।
বাবা মাথার কাছে। জলপটি লাগিয়ে প্রাণপণ হাওয়া করছেন। অনেকক্ষণ সান্ত্বনা দেবার, ভোলাবার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। অবশেষে অভিমানী স্বরে বলছেন,
—কেন মা, আমি তো আছি! আমি কি কেউ নই!
বাবার সেই আহত মুখচ্ছবি ড্রয়ার-ভেতর থেকে চেয়ে থাকে। কোনও তাকে স্কুলের, কোনও তাকে কলেজের অসমাপ্ত দিনগুলো কেমন ধোপদুরস্ত তোলা থাকে। তার পাটে পাটে কত রঙিন ফ্যাব্রিক পেন্টিং, লকারে থাকে কিছু গোপন একান্ত সঞ্চয়। কিন্তু আলমারির তলার তাকে গোঁজা থাকে সব গরমিল, দুঃখ, হতাশা, ক্লান্তি, ধাক্কা, ধিক্কার। অনেকদিন পার হয়ে গেলেও সেগুলো ধোপার বাড়ি পাঠানো হয় না। থাকে তেমনই মলিন, বিবমিষাময়। মগজে অমাবস্যা, হৃদয়ে অগ্ন্যুৎপাত।
যখনই এই মহিলা, অর্থাৎ শ্রীমতী মাধুরী গুপ্তর সঙ্গে ফোন বা দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তলার তাকের ময়লা কাপড়গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। খুব ইচ্ছে করে এক্ষুনি ওই পুরো বোঝাটা লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো দুর্গন্ধমুক্ত হয়ে যেতে। হয় না, কী অসীম শক্তি যে ওই ময়লা তাকের!
বাইরের চওড়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে। দূরে কয়েকটা খেজুর গাছের জট। পাশ থেকে শুরু হয়েছে রাঢ় দেশের বিখ্যাত শাল। ধূলিধূসরিত, কিন্তু স্বাস্থ্যবান, মর্যাদাময়। ওইখানে গেলেই তার গান, কবিতা আসত। ছুটিছাটাতে যখনই বিষ্ণুপুরে আসত, সন্ধেরাত্তিরগুলো কাটত শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। নিবিড় মনোযোগে। আর ভোরের আলো ফোটার আগে, কিংবা গোধূলি-বিকেলে সে ছুটে যেত সবার অলক্ষ্যে ওই শালের পরিধিতে। অনেক সময়ে কাঠফাটা দুপুরেও। বাঁকুড়ার শুকনো তাত, বেকিং আভেনের মতো। কাকচিল যখন ডাকে না—
‘ছুটে কে তুলিলে শালবন, বাহুবন্ধন চারিধারে।.. ঘন বন্ধন চারিধারে।’ সে সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আপাদমস্তক বোঝা যেত। বিস্ময়, হর্ষ, রোমহর্ষ। এই বাহুবন্ধনের ছবি সে এঁকেছিল। ধূসরের মধ্যে থেকে শত শত বাহু উঠে দাঁড়াচ্ছে, মুঠির কাছটা গাছ, ধূলিবসন শালপ্রাংশু মহাভুজ। ‘ইকোলজিক্যাল স্টেটমেন্ট’ বলে ছবিটার নাম হয়েছিল খুব। ‘আর্মস অ্যান্ড দা ট্রি’ নাম দিয়েছিল বোধহয়। কোনও পরিবেশবাদী সংস্থা অনেক দাম দিয়ে সেই বাহুবন্ধন কিনে নেয়।
—চা দিয়েছি বউমা! —শীলাদি। সেই মহিলা যার সঙ্গে আজ অনেক বছর হল মাধুরী দেবীর দিনরাত।
বিরক্ত চোখে তাকাল অদিতি। এই বিরক্তির মানে যোলোআনা বোঝে শীলাদি। চোখ নিচু করল— তুমি পাতলা পরোটা দিয়ে আলুচচ্চড়ি খেতে ভালবাসো।
—এত সবের কী দরকার ছিল? —এ বাড়ির আত্মীয়তা সে চায় না।
—বাঃ, এতখানি পথ! কত যে যত্নআত্তি পাও সে তো চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। —শীলাদি ছাড়বে না।
বুকের ভেতরটা কেমন কুলকুল করে ঠান্ডা বয়। শীলাদি। শ্বশুর গেল, শাশুড়ি গেল, শ্বশুর-শাশুড়ির ছেলে গেল— বাড়ির হাউসকিপার, সব কাজের কাজি শীলাদির জন্যে এই কুলকুলে ঠান্ডা। শ্বশুরমশাই ডাকতেন—শীলাবতী-ই। শীলাবতী-ই!
—তাড়াতাড়িতে তোমার জর্দা আনা হয়নি, শীলাদি।
—না হোক গে।
—জর্দা অবশ্য খুব ভাল জিনিস নয়।
—ওই একটাই তো জোর, টিঁকিয়ে রাখে মা!
খুব সাবধানে এবার বউমাটা এড়াল শীলাদি। আরাম চেয়ারটার ক্যাম্বিসের দিকে চেয়ে বলল— তুমি বসো। আমি একটা টিপাই আনছি।
—দরকার নেই। হাতে করেই হয়ে যাবে।
—প্লেট ধরেছ, আবার চা ধরবে কোন হাতে?
—তা-ও তো বটে। চা-টা বরং পরে এনো।
—তা হয় না। একটু করে গলা না ভিজিয়ে তুমি কি খেতে পারো?
সব মনে আছে শীলাদির। স-বই কি? পুরনো সম্পর্ক, পুরনো স্নেহ-ভালবাসার সূত্র ধরে এখনও এই যত্ন, এখনও এমনি করে মনে রাখা। কে জানে শীলাদির আলমারিতে ক’টা তাক আছে অদিতির জন্য? শীলাদিদের লকারে কোনও গোপন তাকে কি? বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো প্রকাশ গুপ্তর বাড়ি আশ্রয় পেয়ে বর্তে যাওয়া বালবিধবা! সমস্ত স্মৃতিই কি ওর গুপ্ত পরিবারের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়ানো? ভাবতে খুব কষ্ট হয় একটা মানুষের নিজস্ব কোনও অস্তিত্ব নেই, নিজস্ব সুখ-দুঃখ, স্মৃতি-বিস্মৃতি নেই। কী অসম্ভব রিক্ততা! সে তুলনায় এত অপমান এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজেকে তার খুবই ঐশ্বর্যশালিনী বলে মনে হল।
—খুব ভাল হয়েছে শীলাদি। কী করে এমন পাতলা করো গো!
—ও মাখার ওপরে, করতে করতে আন্দাজ হয়ে যায়। বাবা ভালবাসতেন…তুমি… খোকা…ইতস্তত করে থেমে যায় শীলাদি।
—আর এই আলুচচ্চড়িও। এটা আমার লোকেরা করতে পারে না একদম। কী রকম শক্ত শক্ত থাকে।
—বোধহয় নুন-হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নেয় না গোড়ায়। মোটা মোটা করে আলুর খোসাও দিতে হয় চাট্টি। তারপর যেমন কালোজিরে কাঁচালঙ্কা …
অন্যমনস্কভাবে অদিতি বলল—বলব ওদের। শুনবে কিনা জানি না অবশ্য। আদৌ রান্না জানে কিনা…কী যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল শীলাদি।
প্রথম যখন এ বাড়িতে আসে তাকেই শাশুড়ি ভেবে প্রণাম করতে গিয়েছিল সে। এত সৌম্য, ভদ্রদর্শন, তবে রাজর্ষির মা হবার পক্ষে একটু বেশি অল্পবয়সি। তবে সে সময়েও তো অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হত, মা হতে হত। বলা উচিত নয়, মাধুরী দেবীকেই সে তুলনায় নিম্নপদস্থ মনে হত। খেঁকুরে-মার্কা, ঝগড়াটি ভাবটা চাপা দেবার জন্যেই কি মুখটা শক্ত করে থাকতেন?
বিষ্ণুপুরে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে মা তাকে স্ল্যাকস-টপ ছাড়ালেন। এলোমেলো ছোট চুলের ভেতর থেকে অল্প একটু সিঁথি বার করে সিঁদুর পরালেন। আর কড়া গলায় বললেন— সব বড়দের প্রণাম করবে। বিদেশে যা করেছ তা করেছ। এঁরা আবার একরকম গ্রামের লোক। ভুলেও কোনও আধুনিক অসভ্যতা করবে না।
শীলাদির পরনে ছিল চওড়া ভোমরা-পাড় শাড়ি, কালো চুল সারদা মায়ের ছবির মতো ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সামনে এসে পড়েছে। জর্দার গন্ধে ভুরভুর করছে চারদিক।
—ও কী করছ বউমা…ছি ছি…পা সরিয়ে শীলাদি ততক্ষণে পগার পার। কী কুক্ষণেই পাঁকাটি জ্বালিয়ে দুধ ওথলাতে গিয়েছিল।
সকলেই অপ্রস্তুত। সমবেত মহিলাদের মুখ হাঁড়ি। শ্বশুরমশাই ওরই মধ্যে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলছেন—সে কী কথা! বউমার যদি তোমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়, নিশ্চয় করবে। তুমিই তো আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে-বর্তিয়ে রেখেছ। তবে হ্যাঁ, অদিতি, আগে তোমার মাকে প্রণাম করো … তার পর। বুদ্ধিমান লোক, অদিতিকে বুঝিয়ে দিলেন … সে-ও বুদ্ধিমতী মেয়ে, বুঝে নিল— ইনি কে! কী! কিন্তু শাশুড়িকে দেখে তার কেমন একটা প্রিমনিশন হয়েছিল। চেহারার ওপর তো মানুষের হাত নেই! একশোবার। মাধুরী দেবী এককালে তো বেশ ঝরঝরেই ছিলেন ছবিতে দেখেছে। সুন্দর নয়, কিন্তু সপ্রতিভ, মার্জিত চেহারা, লম্বা, বেশ সুন্দর ব্যক্তিত্ব। ভুগতে ভুগতে, ক্রমাগত মেজাজ খারাপ করতে করতে মনটাও গেছে, শরীরটাও গেছে। অথচ সেই ভাঙা শরীর নিয়েই, স্বামীর বিরহ, ছেলে-বউয়ের সম্পর্ক ভাঙা সবকিছু ছাড়িয়ে ছাপিয়ে দিব্যি আছেন। শীলাদিকে উদয়াস্ত ব্যস্ত রাখেন। আর মাঝে মাঝেই এই শরীর ভীষণ খারাপ। কলকাতায় না নিয়ে গেলে এখন-তখন অবস্থা। এটা ওঁর একটা বাহানা। ছেলেকে এবং পূর্বতন বউমাকে ব্যতিব্যস্ত করবার। কী সুখ যে পান! লজ্জাও করে না!
স্থানীর ডাক্তার সুবোধবাবু এসেছেন। আবার ভাল করে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখলেন। পোর্টেবল মেশিন এনেছেন, ইসিজি করলেন। বেশ সময় নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ইসিজি। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্টগুলো দেখলেন। রোগিণীকে বললেন— আরে বউদি, আপনি তো অনেক ভাল আছেন! ইচ্ছে হয়েছে কলকাতা ঘুরে আসুন। কিন্তু আপনার ইসিজি ভালই। এখন আন্ডার কন্ট্রোল।
হাত ধুতে যাবার ছল করে অদিতির সঙ্গে কথা বললেন উনি— দেখো বউমা, এনলার্জড হার্ট, হাই প্রেশার, মাঝে মাঝে প্রবলেম হবেই। কিন্তু এ তো তোমার পেসমেকারের কেস নয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি টাস্টিরও নয়। বড় নার্সিংহোমের আরাম খেতে ওঁর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়। বয়সটাও তো অবুঝপনারই। এটুকু করেই দাও।
সুবোধ ডাক্তারবাবু তাদের সম্পর্কের ডিটেল কিছুই জানেন বোধহয়। কোথায় সুদূর প্যারিসে কী ঘটেছে, আপাতদৃষ্টিতে ব্যবস্থাপনার কোনও বদল না হলে তিনি বুঝবেনই বা কী করে! হাঁকডাক করে তো কিছু করা হয়নি। ছেলে বিদেশে মহাব্যস্ত, বউ কর্মোপলক্ষে কলকাতায় থাকে, শাশুড়ির সঙ্গে তেমন বনিবনা নেই— এটুকুই তাঁর জানা। ভাল, এটুকু সে করেই দিচ্ছে মানবিকতার খাতিরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির অ্যাম্বুল্যান্স ঠিক করা হল। সুবোধ ডাক্তার নিজে একজন নার্সসহ সঙ্গে যাবেন। এস.টি.ডি করে নার্সিংহোমের কেবিন বুক করল অদিতি। এই নিয়ে তৃতীয়বার হল। ওঁরাও চিনে গেছেন। বললেন— মিসেস মাধুরী গুপ্তা, ওহ্ ইয়েস, কেবিন নাম্বার টু?
সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর একটা নতুন কাজ করল অদিতি। শীলাদিকে বলল— ওঁর সঙ্গে তুমিও একবার ঘুরে আসবে চলো শীলাদি।
শীলাদি বোধহয় এমন কথা কখনও শোনেনি। তার জীবনকাল কেটে গেছে বাঁকড়ো জেলায় সোনামুখীতে ছোটবেলা … তারপর বিয়ে হয়ে কিছুদিন শিহড়। তারপর আবার সেই সোনামুখী। বাবা-দাদার গলগ্রহ। তারপর একধরনের মুক্তি। বাঁকুড়া শহরের উপান্তে এই গুপ্ত বাড়ি। ওঁরা কত জায়গায় ঘুরেছেন, বেড়িয়েছেন, শীলাবতী সব সময়ে ঘর আগলে থেকেছে। কাজের লোক ঠিকমতো ঘর পরিষ্কার করল কিনা, কর্তা-গিন্নির ফেরবার সময়ে সব ঘরের বিছানা, জাজিম, কুশন-কভার সব কাচা ঝকঝক করবে, রান্নাঘর দেখলে মনে হবে ব্যবহার হয় না—শুধু সাজানো আছে। এই ফাঁকে বইয়ের আলমারিগুলো ঝাড়াঝুড়ি— এ সমস্তই শীলাবতীর দায়িত্ব।
—আমি? —শীলাদি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
—ঘরদোরের কী হবে বউমা?
—কেন? দীনুদা তো রয়েছে। একদিন অন্তর তোমাদের লোকটিকে দিয়ে সব পরিষ্কার করিয়ে রাখবে।
—মা ছাড়বেন কেন বউমা!
—সেটা আমার ভাবনা।
—মা তো গিয়ে হাসপাতালে ভরতি হবেন। আমাকে সেখানে থাকতে দেবে?
—না, সেখানে থাকতে দেয় না। কোথায় থাকবে-না-থাকবে সেটাও আমায় ভাবতে দাও।
—আমি কখনও যাইনি।
—জানি।
—মা যদি রাগ করে?
—কী আশ্চর্য, বললুম তো ওটা আমার ভাবনা।
তিন
আনসারিং মেশিনে তিনটে মেসেজ পেল অদিতি। একটা অবধারিতভাবে রাজর্ষির। মাকে যোগাযোগে পাচ্ছে না, ই-মেল করেছে তাকে, তারও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তাই সরাসরি ফোন। মায়ের খবর কী? ব্যবস্থা হল? বাবার মৃত্যুদিবস আগামী ঊনিশে, সে কি মনে করে একটা ইনসার্শন দেবে কাগজে! দিলে স্মরণকারীদের নামের মধ্যে যেন অদিতির নামটাও থাকে। অদিতিকে বাবা ভালবাসতেন।
মজা মন্দ নয়, হঠাৎ কেমন রাগ চড়ে গেল মাথায়। অদিতিকে বাবা ভালবাসতেন! হুঁ! যদিও তাঁর ছেলে বাসে না। ইনসার্শনটাও তাকে দিতে হবে কেননা বাবা তাকে ভালবাসতেন। মায়ের অসুখ করলেই ছোটো বিষ্ণুপুর, নিয়ে এসে ভরতি করো নার্সিংহোমে। রোজ ফলমিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যাও। তারপরে আবার তিনি নিজেকে সুস্থ মনে করলে বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। কেন? না তাঁকে দেখবার কেউ নেই, এবং ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও অদিতি মানবিক মানুষ। তার মানবিকতাটাকে সমানে এক্সপ্লয়েট করে চলেছে লোকটা। চিরকাল।
পরের মেসেজটা নাছোড়বান্দা মনীষা দেবীর। তিনি ই-মেলটা পেয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী মেলের উত্তর পাচ্ছেন না। কী গণ্ডগোল আবার হল রে কম্প্যুটারটার? মনীষা দেবী কৃতজ্ঞ চিরদিনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু অদিতির সুপরামর্শে। তিনি অর্থাৎ মনীষা দেবী মাঝে মাঝেই অমন অস্থির হয়ে যান। তখন তাঁকে স্টেডি করতে কাউকে দরকার। যতদিন না তিনি যোগ্য বান্ধব পাচ্ছেন, ততদিন অন্তত অদিতি যেন এমনি করে তাঁকে সাহায্য করে।
যাক। বাঁচা গেল। মনীষা আসছে না। মনীষাকে ঠেকাতে অদিতি সবকিছু করতে পারে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি ও দেশেই একটা বর/বান্ধব জুটিয়ে দিতে পারে। রাজর্ষিকে অনুরোধ করবে নাকি? এত কথা সে রাখছে লোকটার, তার একটা অনুরোধ কি আর ওর রাখা উচিত নয়? আবার মনীষা তো ওরই ক্লাস-মেট। তবে ভরতের আত্মীয় যত, সকলই ভরতের মতো। রাজর্ষির সাঙ্গোপাঙ্গরাই বা কী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হবে? মনীষাও খুব সুবিধের ব্যাপার নয়! সে যেমন মনীষাকে ভয় পায়, বহু লোকেরই তেমন ভয় পাওয়া সম্ভব। ওর সুবিধে হচ্ছে ও বড্ড সুন্দর। বান্ধব পেতে ওর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিউটি অ্যান্ড ব্রেন দুটোই এই মাত্রায় থাকলে বান্ধব যেমন তেমন, বিবাহিত বরই কি বেশিদিন সহ্য করবে? বিশেষত এত অ্যাডভান্টেজ থাকার যত মন্দ ফল সবই মনীষাতে বর্তেছে। অভিমান যা অহংকারেরই ও পিঠ তা পুরোপুরি বর্তমান। কোনও শারীরিক পরিশ্রম সে একেবারে যোলোআনা বাধ্য না হলে করবে না। হাউসকিপিং, হোম-মেকিং ওসব ফুঃ ফুঃ। সে সেবা পেতে ভালবাসে। আদায় করে নেবার জন্যে যত খুশি নীচে নামতে পারে।
তৃতীয় মেসেজটা অনোহিতার মায়ের। মিসেস সাহা রায়। অদিতি সোজা হয়ে বসল। থ্যাংকস জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি অদিতির সঙ্গে কথা বলতে চান, মুখোমুখি, না বাড়িতে নয়, কোনও রেস্তোরাঁয় হতে পারে। অদিতি যেন রিং ব্যাক করে।
কিন্তু আসল লোকটির কোনও খবর নেই। অর্থাৎ তনিকা ওরফে অনোহিতা। একটা খবর। চলে যাচ্ছে, অদিতি ঘুমোচ্ছে। তাই জাগাচ্ছে না ইত্যাদি, একটা শুকনো ধন্যবাদ পর্যন্ত না। অথচ অদিতি ওকে নিজের বাথরোব ব্যবহার করতে দিয়েছে। না দিতেই পারত। কাউকে সে দেয় না। নিজের হাতে রান্না করে খিচুড়ি-ডিমভাজা খাওয়াল। খিচুড়িতে প্যাকেটের মটরশুঁটি যতটা ছিল সবটাই সে দেয়। তদুপরি ডিম ফেটাবার পরে কর্নফ্লেক্স গুঁড়িয়ে দেবার একটা কায়দা সে নিজে আবিষ্কার করেছে। খুব ফোলে। বড়ও হয়। সেইভাবে তৈরি ডবল ডিমের ডিমভাজা সে নিজে ভেজে গরম গরম ওকে খাইয়েছে।
ভাবতে গেলে এটাই অবশ্য ওর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায়। নদী হতে চায়। বৃষ্টিতে উপুরচুপুর ভেজে। অচেনা মহিলার বাড়ি যেচে অতিথি হয়, অথচ তাকে নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। দিদি বলে ডাকা তো দূরের কথা। গুজগুজেমতো অথচ হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠে। মেজাজ খারাপ বা গোপনীয়তার চিহ্নমাত্র নেই সে হাসিতে। দিব্যি কায়দা করে ড্রিংকটা চেয়ে নিল! প্রবলেম গার্ল। স্বভাবতই তার মা অদিতির সঙ্গে আড়ালে কথা বলতে চেয়েছেন।
—ও কী শীলাদি। তুমি দাঁড়িয়ে আছ এখনও! বাকসটা রাখো! শীলাবতী দাম পুরনো চামড়ার সুটকেস হাতে বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ি! বাঁকুড়ার মতো ছড়ানো বাগানঅলা দোতলা এ নয়। একশো বছরের পুরনো জীর্ণ ভাঙাচোরা বাড়ি। অত বড় মানুষের ছেলের বউ। অত বড় মানুষের বিয়ে করা শাস্তরের মন্তর-পড়া বউ! এর এই দশা? সে যতদূর শুনেছিল বউমাও মা-বাপের একমাত্র সন্তান। সম্পত্তি পেয়েছে। নিজেও কাজকর্ম করে ভাল! এ-ই?
উঁচু চৌকাঠ পার হয়ে হাঁ করে কাঁচা উঠোন। তাতে বেড়ালের ঝগড়া, ছন্নছাড়া দুটো গাছ, শ্যাওলা, জায়গায় জায়গায় ব্লিচিং পাউডারের ছাপকা! কোলাপসিবলের তালা খুলে দরজা খুলে যখন ভেতরে ঢুকল, বসবার ঘরে নিয়ে গেল, তখন অবশ্য সে একটু সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেলে। না ভেতরটা ভালই। তাদের ‘মাধুরী-প্রকাশ’ বাড়ির মেঝে চকচকে লাল সিমেন্টের। কিন্তু মাঝে মাঝে ফাটল ধরেছে। বউমার বাড়ি একেবারে রাজবাড়ির মতো রুইতন রুইতন সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে মোড়া, দু’-দুটো বসার জায়গা আর দেওয়ালময় ছবি ছবি ছবি। ছবির সামনে থেকে আলো।
—চলো তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিই।
আগে নিজের শোবার ঘরে ঢুকল অদিতি।—তোমার বাকসটা হাত থেকে নামাও! ঘরটা কালো একটু ঝেড়েঝুড়ে দিতে গেছে। বসো শীলাদি, ওই চেয়ারটাতে বসো।
শীলাবতীর চোখে জল টলটল করছে। দেরাজের ওপর বউমা আর খোকার ছবি— বিয়ের আগের, বিয়ের সময়ের, বিয়ের পরেকার। একটাই ফ্রেমে বাঁধানো। চমৎকার ফ্রেমটা, বিলিতি বোধহয়। দেখে মনে হচ্ছে না সময় গেছে, অন্যায় অবিচার প্রেমহীনতা বিচ্ছেদ জীবন সব, সব বয়ে চলে গেছে সময় বেয়ে।
একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। শীলাদি এগিয়ে গিয়ে ছবিটা তুলে নিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুছল যত্ন করে।
—বউমা! তার রুদ্ধ গলা।
—শুধু শুধু কান্না খরচ করছ কেন শীলাদি! অদিতি নরম সুরে বলল।
—এ রকম হয়। কত হয়। না বনলে এ রকম আলাদাই ভাল, বোঝবার চেষ্টা করো।
—তা হলে এটা? ছবিটা বাড়িয়ে ধরল শীলাদি।
—এবার? এবার কী করে বোঝাবে সে? এ যে অতি জটিল মনস্তত্ত্ব! এর গিঁট খুলতে সে অপারগ। চেষ্টাও করে না। ছবিগুলো যখন তোলা হয়েছিল তখনকার আনন্দটা তো এখনও সময়ের পুটে কোথাও-না-কোথাও ধরা আছে! ধরা আছে তার অন্দরেও। ওই রাজ এক আলাদা মানুষ, তাকে অদিতি চেনে। গাঢ় আবেগে বন্ধুতায় আপ্লুত হয়ে ভালবাসে। এখনও তাকে স্বপ্নে দেখে সে। কখনও উৎকণ্ঠা, কখনও রোমান্টিক, কখনও একেবারে সরাসরি যৌন স্বপ্ন। আর্দ্র হয়ে যায়। ঘুম ভাঙলে বাস্তবে ফিরতে সময় লাগে। দারুণ বিপদের সময়ে তার কাঁধে মাথা রেখেছে। সে-ই ভুলিয়েছে। পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে। এখনকার রাজর্ষি গুপ্তর সঙ্গে ওগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যিই নেই। এ রাজর্ষি জাস্ট পরিচিত মানুষ। তার বেশি কিছু নয়। এত কথা শীলাদিকে বোঝানো সম্ভব নয়। দরকারই বা কী! প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার জগৎ আছে। স্বতঃস্ফূর্ত। তার কোনও ঠিক বেঠিক নেই।
সে হেসে বলল— রয়ে গেছে!
* * *
ডক্টর রায়চৌধুরী বললেন— শুনুন মিস সরকার, সিচুয়েশন খুব ভাল নয়, আপনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। —হার্ট ডাইলেটেড হয়ে গেলেই তার কাজটা মন্থর, কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। তার ওপর কোলেস্টেরেল হাই। আর্টারিগুলো থিক হয়ে গেছে। ব্লাডপ্রেশার হাই। সমস্ত অর্গ্যানগুলোর কাজগুলোই ক্রমশ ধীর হয়ে যাচ্ছে। আপনি সাবধানে রাখতে পারেন। নিয়ম করে মাপা খাওয়াদাওয়া, ওষুধ যা দেওয়া হল খাওয়া। হালকা চলাফেরা। প্রথম ক’দিন এখান থেকে গিয়ে বেড রেস্টে রাখবেন। কিন্তু ওই…যে-কোনও সময়ে…।
কোনও উপায় নেই। পালাবার পথ নেই। স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, কর্তব্যবোধের কথা ছেড়েই দাও…একবার মানবিকতার জালে পড়েছ তো তুমি পঞ্চতন্ত্রের জালবদ্ধ মৃগ। কিছুতেই ছাড়া পাবে না। স্টিয়ারিংয়ে হাত, মনে অসীম বিরক্তি, সেই সঙ্গে নিরুপায় করুণা, —একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে যায় অদিতি। আঁদ্রের সঙ্গে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল! এই রকম, এই রকম একটা অনুভূতি হয়েছিল। অবিকল নয়, কিন্তু কাছাকাছি। অদিতিকে না ছাড়লে সে পিতৃসম্পত্তি পাবে না, অনেক সে সম্পদ। ওর বাবা ওকে মার্কেট ইকনমি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে ঘুরঘুর করত গ্যালারিতে গ্যালারিতে। ল্যুভ-এর ক্লাসে। আর্টিস্ট পাড়ায়। হয়ে গেল ডাকসাইটে শিল্পবোদ্ধা। দু’ হাতে ছবি কেনে, ক্রমশ নিজস্ব গ্যালারি বা সাঁল করে ফেলল। যখন আর্টিস্ট পাড়ায় নীলচোখ-সোনালি চুল আর শ্যাম রং-কালো চোখের দেখা হত, নিছক উৎসাহে, উভয়ের আবেগের জিনিস শিল্পের সম্পর্কে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হঠাৎ আঁদ্রের চোখ স্থির হয়ে যেত কালো চোখের ওপর। যেন প্রসঙ্গ ভুলে গেছে, —কী হল? কী যেন বলছিলে?
—ও হ্যাঁ, না… অপ্রস্তুত নীরবতা।
তারপর একদিন বলেই ফেলল— চলো আজ রাতটা আমরা একসঙ্গে কাটাই।
অদিতি ততদিনে নীল চোখে সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। কিন্তু ক্ষীণ, অতিক্ষীণ একটা সংস্কারের স্বর তার ভেতরে কথা বলছিল। বলে যাচ্ছিল। প্রেম নিবেদন নয়, দুটো রোমাঞ্চের কথা নয়, প্রথম পদক্ষেপেই যখন আঁদ্রে রাত কাটাতে চাইল, সে এত ক্ষুব্ধ, এত অপমানিত বোধ করেছিল যে ভাষায় তা প্রকাশ করা চলে না। সে কাঁপা কাঁপা হাতে তার ব্যাগটা তুলে নিয়ে, ছাইমাখা মুখে উঠে গিয়েছিল। আঁদ্রে পিছু ডেকেছিল, উঠে এসেছিল, সে শুধু একবার পিছু ফিরে বলেছিল— সিন ক্রিয়েট কোরো না।
অন্তত সপ্তাহখানেক সে নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোয়নি। একোলে বা মঁমার্তে যাওয়া তো দূরস্থান। সেই সময়টা অনেক ভাবনা-চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছিল। ভেবে দেখতে গেলে আঁদ্রে কোনও অন্যায় করেনি, তাকে সস্তা মেয়েটেয়ে ভেবে কোনও অপমানও সম্ভবত না। এখানে এসব জলভাত। যখন-তখন যে-যার সঙ্গে ইচ্ছে থাকতে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন কেউ কারও সঙ্গে ধারাবাহিক থেকে গেলেও কোনও অধিকার জন্মায় না। আর তার দিক থেকে তো কোনও ভুল নেই-ই। সে ভারতীয়। আর্টিস্ট পাড়া সোজাসুজি এমন প্রস্তাব না দিলেও আকারে ইঙ্গিতে তো বহু দিয়েছেও। ল্যুভ-এ পিকাসো মিউজিয়ামে সব ক্ল্যাসিক স্টাডি করছে তারই মধ্যে। তার কঠিন মুখ, কিংবা প্রসঙ্গ পালটানোর ধরন দেখে ঘাবড়ে গেছে। আর এই ছেলেটা যে যখন-তখন তার চোখে হারিয়ে যায়, গালে এনে দেয় লাল, এই ছেলেটা, নিঃশেষে যার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য সে প্রস্তুত, সে কিনা একবার হাতটা ধরল না, একবার ভালবাসার কথা বলল না, একটা চুম্বনের জন্যও কোনও আর্তি দেখাল না, যখন তাদের চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় চুম্বনের স্রোত বয়ে চলেছে, মঁমার্তে, পোঁ দ্য লা কঁকর্দে, প্লাস দ্য ফ্রুস্তাবের ছোট্ট রেস্তোরাঁয়, একেবারে শয্যায় নিয়ে তোলবার কথা তুলে ফেলল! ইন টার্মস অব বেড! হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ভারতীয় মনে ভালবাসার সঙ্গে আগে মিশে থাকে মন, তখন শরীর-মন আলাদা করে চেনা যায় না। পরে, সামান্য পরে শরীরী প্রেম শুরু। কিন্তু ইউরোপীয় মনে হয় দুটো আসে একসঙ্গে, নয় শরীর আগে মন পরে আসে আবার আসেও না। এরা দরকারও মনে করে না। মুহূর্তে বাঁচে, মুহূর্তে লয় পায়। প্রেমের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু এতটুকু পূর্বরাগ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ও প্রকাশ করতে পারল না? ধিক, ধিক তোমাকে আঁদ্রে, ধিক আমাকে।
এমন করেই সে ভাবছিল, যখন ঝোড়ো কাকের মতো আঁদ্রের উদয় হল। দরজা খুলেই সে সাত হাত পিছিয়ে গেল আগে, কেননা ওর দেহভাষায় এমন এক প্রবল বেগ, প্রবলতর সংরাগ যেন সব বাধা ভেঙে দেবে এমন একটা ঝড় বইছে।
—ভাল দার্জিলিং চা আছে, খাবে?
হকচকিয়ে গেল আঁদ্রে। একেবারে। সে অন্য কিছু ভেবেছিল। অদিতিও ভাবেনি সে এই কথা বলবে। সে চলে প্রধানত ইনস্টিংটের বশে, কখনও বা ইনটুইশন। এই ইনস্টিংটের ভেতরে এত গভীর মনস্তত্ত্ব জ্ঞান লুকিয়ে থাকে যে তা বিশ্লেষণ করলে বোধহয় অধ্যায়ের পর অধ্যায় লিখে ফেলা যাবে। সে নিজেই লিখে ফেলতে পারবে।
আসলে ওই সহজ সুরে গতানুগতিক অন্তিথি ভাষা— আগুনের ওপর আছড়ে পড়া জল। পুরো পরিস্থিতির আগ্নেয়তা এক ঝাপটায় শেষ। আগের প্রসঙ্গ তোলা নয়, কোনও ক্ষমাপ্রার্থনার জায়গা ছেড়ে দেওয়া নয়, মান-অভিমান, ক্রোধ-অভিযোগ এসবের যে-কোনওটা ঘটাতে পারত অগ্নৎপাত। তাই তার বিধির ভেতর থেকে অমন সহজ বোধের সংকেত— ভাল দার্জিলিং-চা আছে, খাবে?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আঁদ্রে ভেতরে ঢুকে এল।
এই চা মা পাঠিয়েছে এবার। শ্রেষ্ঠ চা। দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। সুগন্ধে ম’ ম’ করছে চারদিক। এই চা-য়ের সঙ্গে সত্যি কথা বলতে কি কিছু চলে না। বিস্কিট, কুকিজ, কিচ্ছু না— রসভঙ্গ হয়। কেননা প্রত্যেক খাবারের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, সেটা দার্জিলিং চায়ের সুরভির মধ্যে ছন্দপতনের মতো ঢুকে পড়ে। তবু চায়ের সঙ্গে কিছু দেশি ডালমুট পরিবেশন করল অদিতি। এইটা আঁদ্রে খুব ভালবাসে। শুধু আঁদ্রে কেন, অনেককেই সে ডালমুট ধরিয়েছে।
একটু ডালমুট মুখে পুরে আঁদ্রে বলল— তা হলে তুমি মনে রেখেছ!
—কী! একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল অদিতি।
—এই… ডালমুট আমি ভালবাসি।
—শুধু তুমি কেন, আমার সব ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালীয় বন্ধুরাই এটা ভালবাসে।
আঁদ্রের মুখে ছায়া নামল।
—কিন্তু আমি তোমাকে পরামর্শ দেব, আগে দু’-এক চুমুক চা খাও।
—তাই?
অদিতি নিজের কাপটা মুখের কাছে তুলল। সাদা ধবধবে টিউলিপ ফুলের মতো দেখতে কাপ। সাদা ছাড়া বস্তুত এই চায়ের হালকা রংটা খোলে না। এখন টিউলিপের গা দিয়ে আভা বেরোচ্ছে।
—দারুণ। আশ্চর্য! —আঁদ্রে বলল- মের্সি,
—কথা বোলো না, শুধু উপভোগ করো।
খুব নীরবে চা-পান সমাপ্ত হল। আঁদ্রে খুব কোমল নম্র গলায় জিজ্ঞাসা করল —জাপানিদের চা-পান অনুষ্ঠানের কথা পড়েছি। ভারতীয়দেরও আছে তা জানতাম না।
ভেতরে ভেতরে অদিতির মজা লাগছিল। খুব সিরিয়াসলি বলছে। সত্যিই ভেবেছে এটা একটা রিচুয়্যাল।
—কত জিনিসই তো আমরা জানি না, জানতে চাই না। যাক, কিছু নাকি পিকাসো এসেছে অকশনে। সত্যি!
—হ্যাঁ গোড়ার দিকের আঁকিবুকি। কত তো এঁকে এখানে-সেখানে ফেলে দিত।
—কিনছ নাকি?
—নাঃ।
—কেন? ভাল ইনভেস্টমেন্ট হত!
—তুমি ভুলে যাচ্ছ অদিতি, আমি আর্টকে বিজনেস প্রপোজিশন বলে দেখি না।
অদিতি চুপ করে রইল।
একটু পরে আঁদ্রে বলল—তুমি কি ভুলে যেতে চাইছ, মনে রাখতে চাইছ না?
এইবারে অদিতির মস্তিষ্কের মধ্যে কড়কড় করে বাজ ডেকে উঠল। সেই অশনিসংকেত বেরিয়ে এল গলা দিয়ে— ভুলে যাব! সম্ভব? জীবনে কোনওদিন ভুলে যাব না, একজন সহমর্মী বন্ধু যুবক আমাকে খুব সহজে, হেলায়ফেলায় কু-প্রস্তাব দিয়েছিল।
—তোমরা প্রাচ্যদেশীয়রা খুব রক্ষণশীল আমি জানি, আঁদ্রের চোখে মিনতি।
—তোমরা পশ্চিমারা খুব উচ্ছৃঙ্খল আমিও জানি, অদিতির উত্তর সঙ্গে সঙ্গে।
—আমরা এভাবেই বড় হয়েছি। নিশ্চয় সেটা দোষ নয়।
—আমরাও এভাবেই বড় হয়েছি। সেটাও নিশ্চয় দোষ নয়!
—আমি … আমি তোমার জন্য কামনায় চুরমার, চুরমার হয়ে ভেঙে যাচ্ছি।
—আমি … আমি তোমার প্রতি বিতৃষ্ণায় চুরমার হয়ে যাচ্ছি।
—আমার এই ক্ষুধা…ক্ষুধাটাকে তুমি বুঝতে পারছ না। অদিতি তুমি না আমার বন্ধু?
—ক্ষুধা মেটাতে তোমাদের এই পারী শহরে অনেক বন্ধু আছে, তাদের কাছে যাও না আঁদ্রে।
বজ্রাহতের মতো বসে রইল আঁদ্রে। কাপ-প্লেটগুলো ট্রে-তে গুছিয়ে তুলে পেছন ফিরে রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল অদিতি। সে অনুভব করছিল একটা হতাশা, একটা সংরক্ত বিষাদ তাকে পেছন থেকে বিঁধছে।
আঁদ্রে বলতে লাগল।
—আমি … আমি স্বীকার করছি আমি ভার্জিন নই। শুধুমাত্র সেক্স হলে সেটা আমি মিটিয়ে নিতেই পারতাম। কিন্তু আমি যে প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গেছি ওদিৎ। আমার কী উপায় হবে, ভাবো … ভাবো একবার! আমি, আমি কি যথেষ্ট পুরুষ নই!
কোথায় আঁদ্রের লেগেছে এবার ভাল করে বুঝতে পারল অদিতি। ঠিক কোন জায়গাটায়। তার দয়া হল না। বিতৃষ্ণা বেড়ে গেল। সে বাসনগুলো ধুয়ে মুছে অর্থাৎ বেশ সময় ব্যয় করে তবে আবার এসে লাউঞ্জে আঁদ্রের মুখোমুখি হল। ও তেমনই বসে আছে। কিছুক্ষণ পর বলল— আমার কথার জবাব দিলে না? আমি জানি প্রবল পুরুষ না হলে ভারতীয় নারীদের আকৃষ্ট করা শক্ত। আমার মতো এ রকম…মানে নরম…চেহারার একজন যুবক …
এ ছেলেটাকে ভারতীয় নারী সম্পর্কে এত জ্ঞানগম্যি কে দিয়েছে? ভাবল অদিতি। সে যাই হোক, কী ভাবে এগোলে সে সাড়া দিতে পারবে সে সম্বন্ধে এ একেবারে অজ্ঞ। কোনও চৈতন্যই নেই। সে কি সোজাসুজি বলবে, লাভ-মেকিং বলে তোমাদের যে কনসেপ্টটা আছে, আমাদের কাছে সেটার মানে কিন্তু কূজন। অনেক শব্দ-স্পর্শ-দর্শন-শ্রবণের ফোর-প্লে পার হয়ে প্রেম, অনেক প্রেম পার হয়ে তবে তোমাদের লাভ-মেকিং। অন্ততপক্ষে প্রথম প্রথম, পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে কী হয় না হয় প্রত্যক্ষভাবে তার জানার কথা নয়। কিন্তু অনুমানে তো জানেই। চারদিকে যা দেখছে তার থেকেই জানে। সেসব ভবিষ্যতের কথা। ভেবে লাভ নেই। কিন্তু ওর ওই স্বীকারোক্তি! ভার্জিন নই! জানে তবু সে সেভাবে জানে না। পাশ্চাত্য সভ্যতায় তরুণ হওয়ামাত্র সদ্য-জাগা শারীরিক কামপ্রবৃত্তিকে তুষ্ট করতেই হবে। অন্তত কোনও বাধা নেই। যে সে কাজ করে না সেই বরং অপাংক্তেয় হয়ে যায় বন্ধুদের কাছে। এ এদের বহুদিনের ঐতিহ্য। রাশিয়ানরা মস্কোয় বা প্যারিসে পড়তে এসে রীতিমতো রক্ষিতা রাখত। না রাখলে তাদের আভিজাত্য প্রমাণ হত না। অনেকটা হুতোম প্যাঁচাদের কালের বঙ্গ যুবকদের মতো। এদের এখন আর রক্ষিতা রাখতে হয় না। তরুণী মেয়েদের মধ্যেও এখন ক্ষুধা-প্রকাশের একই তরিকা। সুতরাং কাম পেলেই শুয়ে পড়ো, কিংবা লিভ-টুগেদার করো। প্রকৃতপক্ষে সেই সনাতন প্রস্তাবই তাকে দিচ্ছে ছেলেটি।
—তোমার আর কিছু বলবার আছে?
—এত, এত, যে কী ভাবে শুরু করব, কোনখান থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
—বোঝার কাজটা শুরু করে ফেলো, যখন গুছিয়ে উঠতে পারবে তখন এসো। এখন তুমি গেলেই আমি স্বস্তি বোধ করব।
তার পরেও আঁদ্রে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বেশির ভাগটাই মাটির দিকে, কিংবা দেওয়ালময় নানান ক্ল্যাসিকের প্রিন্টের দিকে চেয়ে। পোস্টারের দিকে। অদিতিরই করা। তারপরে মিয়োনো গলায় বলল— যাই তা হলে!
—হ্যাঁ এবার যাও।
এত বোকা লোকটা, এরপর তার কাছে বিয়ের সম্মানজনক প্রস্তাব নিয়ে এল। মানে বিছানায় তোলার অধিকার।
অদিতি বলল— তুমি কি ভেবেছ আমি তোমাকে লাইসেন্স বার করতে বলেছি?
—আমি জানি ভারতীয় মেয়েরা বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের কৌমার্য রক্ষা করে।
—এক কাজ করো আঁদ্রে তুমি বরং একটা বই লিখে ফেলো।
—হঠাৎ?
—এই সাবজেক্টটার ওপরে। ভারতীয় মেয়ে। তারা কী চায় না চায়, কী রক্ষা করে না করে।
—তুমি কি আমাকে ভালবাসো না? আমার ধারণা ছিল— বাসো।
—আমারও তো তাই ধারণা ছিল।
—ছিল? মানে এখন নেই?
—আমি তোমাকে, তোমার ধরনধারণকে পছন্দ করতে পারছি না আঁদ্রে।
এতদিনে, এই এতদিনে বোধহয় আঁদ্রের সহজাত বোধে কিছু ধরা দিল। বন্ধুভাবে মেলামেশা করতে লাগল, বাড়িতে আসতে লাগল, এই বাসন ধুয়ে দিচ্ছে, এই দেওয়ালের ছবিগুলো ঠিক করে সাজিয়ে দিচ্ছে। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আলোচনা চলছে দু’জনের — কবিতা, উপন্যাস, বালজাক, জোলা, আঁদ্রে জিদ, বদলেয়র, পিসারো, সেজান। ছবি আঁকছে অদিতি সে ধৈর্য ধরে ঠায় পাশে বসে। মোড়কে করে খাবার আনছে, যাতে অদিতিকে রান্না করতে না হয়। অনেক রাত। ফেরবার সময়ে আরক্ত মুখে একবার চায়, তারপর অদিতির হাতে চুমো রাখে, চলে যায়। কোনওদিন গালে বিদায়ী চুম্বন। একেক সময়ে তার বুকটা টনটন করে। নিকট হলেই ঘিরে ধরে একটা মোহ, মুগ্ধতা, ইচ্ছে করে ওর কাঁধে মাথা রাখে। আঁদ্রে খুব বেশি লম্বা নয়, অদিতি বেশ লম্বা। দু’জনের দৈর্ঘ্যের অনুপাতটা যেন আশ্লেষের জন্যই তৈরি। তবু তবু …
চার
দরজা খুলে দিল শীলাদি। অদিতি চাবি বার করতে যাচ্ছিল অভ্যাসমতো। এমন সময়ে দরজাটা খুলে গেল। ও পাশে সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো শীলাদি। বোধহয় জানলা দিয়ে দেখতে পেয়েছে। কী যে অদ্ভুত ভাল লাগল! সেন্টিমেন্টাল নয় অদিতি। কিন্তু আজকে কেন কে জানে তার চোখ সামান্য স্বচ্ছ হয়ে এল! তাতে শীলাদির কালো পাড় শাড়ি পরা ছায়া। একা, সম্পূর্ণ একা থাকাটা যে সে শুধু মেনে নিয়েছে, ভালবাসেনি কখনও— এটা সে যেন এতদিনে বুঝতে পারল। শীলাদি কি কিছু বুঝতে পারল? খুবই সংবেদনশীল মানুষটি। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাব পরিবর্তন বুঝে ফেলতে পারে এ অদিতি অনেকবার দেখেছে। বুঝলে বুঝেছে। অদিতি নিজের সব ভাব সবার কাছ থেকে লুকোতে চায় না।
—অমন ভিড়ে ঠাসা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাও কী করে মা? প্রথমেই মনিবানির কথা থোড়ি জিজ্ঞেস করল শীলাদি। মানুষটিকে যে অদিতি তার অতিরিক্ত বিবেকী স্বভাবের জন্য সহ্য করছে শুধু, এতটুকুও ভালবাসছে না, শ্রদ্ধা সম্ভ্রম করছে না এটুকু শীলাদির কাছে জলের মতো পরিষ্কার।
—অভ্যেস হয়ে গেছে। সবাই চালাচ্ছে, আমিও চালাচ্ছি। এর মধ্যে কোনও ‘কী করে’ নেই — সে হাসল — তুমি কি দেরি দেখে ভাবছিলে আমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে!
—বালাই ষাট। ও কথা ভাবতে যাব কেন বউমা, তোমার মতো পুণ্যবতী মেয়ের কখনও ওসব হয়? ষাট ষাট!
—যারা অ্যাকসিডেন্টে যায় তারা সব তা হলে পাপী বলছ?
—অত জানি না বাপু। বললুম কথা একটা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ!
—ওই একটা ডিফেন্স যে তুমি কতবার ব্যবহার করবে!
—কী ফেনস?
—ডিফেন্স! ডিফেন্স! আত্মরক্ষা, অজুহাত, —মুখ্যুসুখ্যু!
—কেমন আছে মা?
—খুব একটা ভাল না … অদিতি অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
আর কিছু জিজ্ঞেস করল না শীলাদি। বলল চা না কফি?
—কফি করতে পারবে?
—কেন পারব না?
—তা হলে করো। তোমারও করো। নিশ্চয়ই খাওনি।
শীলাদি চলে গেল। যে ঘরে তনিকা-অনোহিতা শুয়েছিল সেই ঘরে শীলাদিকে থাকতে দিয়েছে সে। ঘরটা তার, সাজসজ্জা, আসবাবপত্র সব তার বাবা-মা’র। বাবা-মা’রও নয়, দাদা-দিদির। দাদা মারা যাবার সময়ে তাঁর যা কিছু এয়ারলুম ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। বেশ কিছু এই ধরনের অ্যান্টিক আসবাব পড়েছিল মা-বাবার ভাগে। মায়ের বিয়ের আসবাব দুটো খাট, আলমারি সব অদিতির শোবার ঘরে, এ ঘরে ওই অ্যান্টিক। শীলাদি ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়েছিল। কোণ থেকে একটা গোটানো কার্পেট টেনে নিল, বলল—আমায় দুটো চাদর দিয়ে। একটু পুরনো দেখে। কড়কড়ে জিনিসে শুয়ে আরাম পাই না।
এই ব্যাপারটা নিয়ে অদিতি একটা প্রচণ্ড দ্বিধা এবং আত্মগ্লানির মধ্যে ছিল। শীলাদি যদিও রান্নাবান্না করে বিষ্ণুপুরে, ও তো শুধু রান্নার লোকই নয়, আত্মীয়ের বাড়া। পরিষ্কারও খুব। ওকে সে একদা প্রণাম করতে গিয়েছিল। অত ভদ্র মার্জিত চেহারা শীলাদির, তা সত্ত্বেও বাবা-মা’র পালঙ্কে শীলাদিকে শুতে বলতে পারেনি সে। আধুনিকা, দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা, অনেক দেশীয় সংস্কার মুক্ত নাকি সে। কিন্তু পারেনি। নিজের ঘরে মেঝেতে একটা ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু একে তার ঘরে অন্য লোক ভাল লাগে না। উপরন্তু এ ব্যবস্থাটা শীলাদির জন্যে তার ঠিক মনে হয়নি। মায়ের পালঙ্কে … মায়ের পালঙ্কে … অথচ কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে অনোহিতাকে ওখানে শুতে দিতে তো তার একবারও ভাবতে হয়নি! নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছিল, কিন্তু যা স্বাভাবিকভাবে আসছে না, তা সে কেমন করে করবে? হিপক্রিসিকে প্রশ্রয় দিয়ে কী লাভ?
গোটানো কার্পেটটা টেনে নিয়ে শীলাদি তাকে মুক্তি দিল। সে শুধু বলল— মেঝেতে শুতে পারবে?
বিষ্ণুপুরে শীলাদির আলাদা ঘর তাতে তক্তপোশ, ভাল ধবধবে বিছানা।
—কার্পেটটাও সরিয়ে দিতে পারি, তা যদি বলো বউমা। তোমার মেঝে এত সুন্দর ঠান্ডা।
—ওসব করতে যেয়ো না, শেষকালে ব্যথাট্যথা হবে।
পুরনো আলাদা চাদর তার কোথা থেকে থাকবে! সে নিজের ভাল চাদর ও বালিশ দিয়ে খানিকটা গ্লানিমুক্তি অনুভব করেছিল।
কফি খেতে খেতে, মোড়ায়-বসা শীলাদির দিকে তাকাল অদিতি। অদ্ভুত মহিলা, সোফা, ডাইনিং চেয়ার ইত্যাদিতে বসবে না। আবার মেঝেতেও বসবে না। ঠিক যেমন কার্পেট খুঁজে নিয়েছিল তেমনই খুঁজে নিয়েছে একটা মোড়া। মোড়াটা শীলাদির সঙ্গে সঙ্গেই চলাফেরা করে।
খুব চিন্তিত মুখে ধীর গলায় অদিতি বলল— ওঁকে বোধহয় এখানেই নিয়ে আসতে হবে। ডক্টর রায়চৌধুরী এখন বিষ্ণুপুরে যেতে বারণ করছেন।
—কী হবে তা হলে? তোমার তো ভীষণ অসুবিধে … শীলাদি থেমে গেল।
—ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে! না হলে ওই রোগীকে নিয়ে তো আমি বিপদে পড়ে যেতাম। সারাদিন বাড়ি থাকি না। বাইরের আয়াটায়াকে … একলা রেখে যাওয়া …
কী আশ্চর্যের কথা! রাজর্ষি গুপ্ত, যার সঙ্গে তার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে, তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে থাকতে আসছেন তার বাড়িতে! শুধু রাজর্ষির মা বলে নয়, মহিলা চিরকাল তাকে বিষ নজরে দেখেছেন। কত আশ্চর্যই না তার কপালে ঘটল!
তার মুখ হয়তো একটু কঠিন বিরক্ত হয়ে গিয়ে থাকবে, শীলাদি বলল— একটা কথা বলব বউমা! বলল বেশ দ্বিধা ও ভয়ে—বলল— তুমি কেন এত দায় নিতে যাবে? যার মা সে ব্যবস্থা করুক। তুমি তাকে ই না এ সেই কী বলে তাই একটা করে দাও। সে আসুক, যা বোঝে করুক।
—যদি আসেও, একটু তো দেরি হবেই। ততদিন ওঁরা ওখানে রাখতে চাইছেন না। বেড আটকে রয়েছে তো!
—তা হলে দাও আবার অ্যাম্বুলেন্সে করে বিষ্ণুপুরে পাঠিয়ে। উনি ভিতু মানুষ। ওঁকে কিছু বলতে হবে না। পাঠিয়ে দাও। আমি আছি। সুবোধ ডাক্তারবাবু আছেন। কিচ্ছু হবে না। আর যদি হয়ই, দুঃখ তো কিচ্ছু নেই! বয়স হয়েছে, নানা রকম অসুখ শরীরে, মনেই কি আর শান্তি আহ্লাদ কিছু আছে! কিচ্ছু না। যদি সময় এসে গিয়ে থাকে তো যাবে! নিজের ভিটে, নিজের জায়গা। কোনও অযত্নের ভয় নেই, সে তো ভাল যাওয়া মা!
‘ভিতু মানুষ’ কথাটার একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল অদিতির মনে। একটা অনন্ত আর্তির মুখ, অনেক লোকের মুখহীন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শূন্যের দিকে চেয়ে রয়েছে। প্রতিবেশটা রেমব্রান্ট-নাইট ওয়চ, ফিগারগুলো এল গ্রেকোর, মুখটা রবীন্দ্রনাথের আঁকা। তাঁর পুরো আলোছায়া, মুখাকৃতির লম্বাটে ছাঁচ, অন্ধকার চোখ, ঘাড়ের সটান ভঙ্গি যেন পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সবটার রং, সমস্ত সুদ্ধ গোটা একটা ছবি। সে কোনও কথা বলল না, সাংসারিক কথাবার্তার মধ্যে ছবি বড্ড হারিয়ে যায়। সে স্বপ্নগ্ৰস্তর মতো উঠে আস্তে আস্তে তার স্টুডিয়োর দিকে চলে গেল।
শীলাবতী অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পেছন পেছন গেল। তারপর স্টুডিয়োর দরজায় আরও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ইজেলে টান টান করে ক্যানভাস বিছোনো। সামনে অদিতি একটা নিচু টুলে। হাতে পেনসিল। সে সাধারণত একটা খুব হালকা লাইন ড্রয়িং করে নেয়। অদিতির পেছনে, সামনে মেঝেতে কোণে ঠেস দেওয়া ছবি, বাঁধানো-না-বাঁধানো, সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ— রং রেখা ভাবের এক বিশাল সমারোহ। শীলাবতী তার একফোঁটাও বোঝে না। কিন্তু সম্ভ্রমে-বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।
এ ঘরটা তালা দেওয়া থাকে। সে এই প্রথম দেখল।
* * *
একটা বোবা কষ্ট, ভীত যন্ত্রণার্ত—এ মুখ আঁদ্রের। আঁদ্রের সত্যিই একটা মানসিক ভয়জাত পুরুষত্বহীনতা ছিল। সে ভার্জিন নয়, কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। বাহাদুরি করে কথাটা বলেছিল অদিতিকে। বিয়ের পরে প্রথম রাতেই তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয়েছিল বেচারিকে। খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। এই জন্যেই কি ওর অত তাড়া ছিল। শরীরে জোয়ার থাকতে থাকতে কূলে তরী ভেড়াবার?
—তুমি কি কাঁদছ আঁদ্রে?
—না। সে হাসল। সে হাসি কান্নার বেশি।
—শোনো, এসব কিছু নয়, আমি তোমাকে ভালবাসি। এটা তোমার একটা সাময়িক অক্ষমতা। ভয় পাচ্ছ কেন? ঠিক হয়ে যাবে।
—কিছু ঠিক হবে না অদিতি। আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। তোমাকে… তোমাকে আমি ঠকালাম। আমি তোমাকে ছাড়া… নাঃ আমি ভাবতে পারছি না।
—আশ্চর্য! তুমি আচ্ছা বোকা, ভিতু তো! এত দুর্বল তুমি? আমি বলছি ঠিক হয়ে যাবে।
—বলছ!— নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। দেবদূতের মতো নিষ্পাপ মুখ। কাঁধ অবধি সোনা সোনা চুল, তীক্ষ্ণ নাক, বেদানা রঙের ঠোঁট। ঘুমন্ত আঁদ্রেকে দেখে অদিতির মনে হয়েছিল— এ এমনই কাঁচা, কিশোর কিশোর এক মানুষ যার প্রতি কাম জাগা তার পক্ষেও সম্ভব না হতে পারে।
মাস ছ’য়েকের মতো মানসিক চিকিৎসা, কাউন্সেলিং চলল। আস্তে আস্তে ভরাট হল আঁদ্রের শরীর, পেশিতে ঢেউ, মুখে আত্মবিশ্বাস। ততদিনে ওর সালঁ দাঁড়িয়ে গেছে, রীতিমতো ব্যবসাদার। আর তখনই এক গভীর আধ-ঘুমন্ত রাতের আলোয় আঁদ্রের অলৌকিক-যাত্রা সম্ভব হল।
পরবর্তী কয়েক বছরের হাস্যোচ্ছল সবল আঁদ্রের ভেতর থেকে এই ভয়কাতর মুখশ্রী এতদিন পর তার কাছে এসে অমরত্ব যাচ্ঞা করছে? রাত প্রায় তিনটে অবধি চলল কাজ। টেনে বাড়ানো লম্বা লম্বা বাইজানটাইন ফিগার, পেছন দিকে রবিঠাকুরীয় মুখ। শেষ করতে মাসখানেক অন্তত লাগবে। কিন্তু শেষরাতে বিছানায় ঢুকতে ঢুকতে ক্লান্তিতে অসাড় শরীর মেলে দিয়ে তার মনে হল— মুখটার অভিব্যক্তি তার মনে চিরতরে খোদাই হয়ে গেছে। আর হারাবে না। কে ও? ও কি আঁদ্রে নাকি? নাকি মাধুরী গুপ্ত! নাকি শীলাবতী! তবে কি ওই সব অন্ধকার মুখের আড়ালে একটি মুখই? সে মুখটা কি তার? কাতর। অন্ধকার। কালো পৃথিবী হাতড়ে হাতড়ে অভিব্যক্তি খুঁজে ফিরছে?
* * *
বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মাধুরী গুপ্ত গোয়াবাগান যাত্রা করলেন। সন্তুষ্ট তৃপ্ত মুখ। একবারও সংকোচ প্রকাশ করলেন না। একবারও বিষ্ণুপুর যেতে চাইলেন না। অদিতির বাড়িতে এলেন যেন নিজের বাড়িতে আসছেন। দোষের মধ্যে খালি বাড়িটা অচেনা! সম্পূর্ণ অচেনা অবশ্য নয়। একবার, একবারই মাত্র এসেছিলেন, তখন মা বেঁচে, ওদিকে জেঠিমা, ছোটকাকু, দাদারা সবাই গায়ে গায়ে ছিল। ভাগাভাগি হয়েছে। কিন্তু ছোটকাকু তাঁর ভাগের ঘরটা নিয়ে মায়ের কাছেই থাকতেন। তখন সাজসজ্জা এ রকম ছিল না আদৌ। এসব ঘরের।
—তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম, এটুকু অন্তত বলবেন আশা ছিল অদিতির। কিচ্ছু না।
স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা তুলে দিল। সেই মাতৃ পালঙ্কের ওপরই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যাঁকে ভালবাসে না শ্রদ্ধা করে না, যিনি তার ভালমানুষির সুযোগ নিচ্ছেন বলে সে আপাদমস্তক বিরক্ত, তাঁকে তার পবিত্র স্মৃতিসম্পন্ন পালঙ্কে দিব্যি জায়গা দিতে পারল সে, কিন্তু যার প্রতি তার মমতা, খানিকটা ভালবাসাও আছে, আছে এক ধরনের শ্রদ্ধাও সেই শীলাদি মাটিতেই শুয়ে রইল।
পালঙ্কে শুয়ে মাধুরী দেবী প্রসন্ন চিত্তে, প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন—
এই বেশ হল। সেই নির্বান্ধব নির্জন পুরীতে কে যায়! যেন গিলতে আসে। মা গো! তোমার এ বেশ ভাল ব্যবস্থা।
—এখানেও কিন্তু পুরী নির্জনই। আমি সারাদিন বেরিয়ে থাকি। একেক দিন ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। এখানেও আপনি আর শীলাদি দু’জনে দু’জনের মুখ দেখবেন। মহা বিরক্তিতেও অদিতির হাসি পেল।
—রাত্তিরে তো ফিরবে গো, না তা-ও ফিরবে না? তোমাদের আজকালকার আর্টিস্টদের এই হয়েছে এক ঢং। কোনও নিয়ম-নীতি নেইকো।
যেন উনি সেকালের আর্টিস্টদের রীতি প্রকৃতি জানেন।
শুরু হল। অদিতি বিরক্তিতে সরে যায়।
সে যখন স্কেচবুক হাতে শালজঙ্গলের মধ্যে যেত তখন জিনস পরত। কিংবা লং স্কার্ট। ছোট চুলগুলো মাথার উঁচুর দিকে ক্লিপ দিয়ে আটকানো থাকত। মায়ের অনুশাসন সে খুব বেশিদিন মানতে পারেনি। বিষ্ণুপুরের বাড়ির মধ্যে যখন আঁকত, অনেক সময়ে বাবারই প্রয়োজনের আঁকা, তখনও একটা মিডি স্কার্ট মতো পরে থাকত। সুবিধে হত মেঝের ওপর উপুড় হয়ে আঁকতে।
প্রথমদিন দেখে উনি বললেন— এ কী? এই ধিং নারায়ণ হয়ে বাইরে যাবে? লোকে বলবে কী?
—আহ্ হা! —ওরা এসব পরেই অভ্যস্ত। শ্বশুরমশাই হয়তো বললেন।
—অভ্যস্ত? তাই বলে গুপ্তবাড়ির বউ এমন নির্লজ্জের মতো বেরোবে? কুকুর ছুটবে যে পেছনে!
—ছুটুক। ও বুঝবে। ঢিল নিয়ে যাও তো অদিতি পকেটে করে। মেরে কুকুর তাড়িয়ো।
পাঁচ
খাটের মাথার দিকের পাশে একটা মাঝারি টেবিল, তাতে ওষুধপত্র, ফ্লাস্ক, জলের বোতল, বিছানায় রাবারক্লথ, খাটের তলায় বিদেশি ফাইবারের বেডপ্যান, উলটো দিকে মেঝেয় শোবে শীলাদি। একটা আলমারি আর একটা দেরাজ ঘরে। দেরাজটার দুটো ড্রয়ার ফাঁকা করে দিয়েছে অদিতি। এঁদের দু’জনের জামাকাপড় তোয়ালে ইত্যাদি থাকে এইখানে। সে লোক রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু শীলাদি রাজি নয়। বলল— উনি আমার হাতের ছাড়া সেবা নেবেন না, বউমা—আরও আশ্চর্যের কথা যেটা শীলাদি বলল— আমিই বা কী করে ওঁকে ভাড়া করা লোকের হাতে ছাড়ি! সে আমি পারব না, আমার তো এখানে কিছুই করতে হচ্ছে না। আমার কোনও কষ্ট হবে না। — তারপরে যা বলল শীলাদি সেটা তৃতীয় আশ্চর্য বা অষ্টম আশ্চর্য যা-ই বলা যাক। বলল —আর এক উনি নিতে পারেন তোমার হাতের সেবা।
—আমার?
—না গো। তোমাকে কিছু করতে বলছি না, করতে পারবেই বা কেন?
অদিতি মনে মনে বলল— এ ভাবেই আমি মায়ের সেবা করেছি। সেবা করতেই প্রধানত চলে এসেছিলাম। যদি জানতে শীলাদি!
—মানে তুমি তো করছই। কত কাল ধরে করছ মা, বিপদে পড়লে উনি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ডাকেন না। জ্ঞাত-গুষ্টি কি আর নেই! মায়ের বাপের বাড়ির দিকেও কিছু আছে। কিন্তু না, প্রত্যেকবারই বলবে— বউমাকে খবর দাও।
খুব আশ্চর্য হয়ে, প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অদিতি চলে এল। বলে কী! তোষামোদ? সে এত করছে বলে? ভেতরে ভেতরে এত বিরক্ত বলে? শীলাদি ডিপ্লোম্যাসি করার মতো চতুর বলে কখনও মনে হয়নি তার। বোকা একেবারেই নয়। কিন্তু সরল, আন্তরিক, সংবেদনশীল এবং… এবং একেবারেই বোকা নয়।
যাক— আজকে একটা লম্বা কাজ আছে, অ্যাকাডেমিতে আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ছবির একটা অভিনব প্রদর্শনী। সে বিচারক। অন্যতম। কান্তিদা আর সে। দু’জনে আলাদা আলাদা যাবে। একেবারে পরামর্শ না করে প্রতিক্রিয়া বদলাবদলি না করে যার যার মতামত লিপিবদ্ধ করবে। তারপরে মতানৈক্য বা আর কোনও অসুবিধে হলে বসবে ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে। সকালে সে যায় তার নিজস্ব সংস্থা ‘চিত্রভানু’তে। সেখানে প্রচুর পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রী। এটা একটা ফরাসি ধরনের আতলিয়ে এখানে যে-যার ইচ্ছে মতো ছবি আঁকে। যাদের আঁকাজোকা করার জায়গা নেই তারা অনেকেই এখানে স্রেফ নিজের কাজ করবার জন্যে আসে। রং তুলি তেল সব নিজস্ব, ক্যানভাস বা নানা রকম হ্যান্ডমেড পেপার সে দেয় এবং এইসব ছবি বিপণন করে। তারই একটা ভাগ তার প্রাপ্য। কিন্তু এইসঙ্গে আছে কিছু শিক্ষার্থীও। তারা শেখে। স্টুডিয়ো সামলানো, শেখানো, এবং বিপণন তিনটে কাজই একসঙ্গে করতে হয়। সময়সাধ্য, শ্রমসাধ্যও বটে। আজই যেমন মিসেস কানোরিয়া কতকগুলো পছন্দসই ছবি নিয়ে যেতে বলেছেন। এসব করবার জন্য ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া আর কেউ নেই তার।
অন্যমনস্কভাবে খাচ্ছিল সে। ভাতের গ্রাসের সঙ্গে মুখে কী তুলল না তুলল সে খেয়ালই নেই। তার অন্যমনস্কতাকে এক চমক দিয়ে জ্ঞানে ফিরিয়ে দিল কী যেন একটা স্বাদ।
—কী রেঁধেছ ছবি? এটা?
—কোনটা?
—এক্ষুনি যেটা খেলাম!
—ও, ওটা কী যেন শীলাদি রেঁধেছে।
—কী? এটা?
—নিজেই কেটেছে, কুটেছে— আমি জানি না দিদি। ভাল?
—খুব ভাল।
—ও শীলামাসি, শীলামাসি…ই অমনি ছবির হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল।
—কী?
—কী রেঁধেছ গো! খুব ভাল লেগেছে দিদির।
—গুগলি রেঁধেছি। আমাদের ওখানে তো খুব পাওয়া যায়। বাড়িতে এনে বিক্রি করে যায়। ছাতুর সঙ্গে খুব ভাল লাগে। মায়ের মুখে সোয়াদ নেই, খেতে চাইল…
—খুব ভাল হয়েছে। তা কাকে দিয়ে আনালে? ছবি তো বলছে কিছুই জানে না।
—তোমাদের হাতিবাগানের বাজার তো এই দোরগোড়ায়। গেলুম, নিয়ে এলুম।
—কলকাতার রাস্তাঘাটে স্মার্টলি চলাফেরা করতে শিখে গেলে? শীলাদি?
লাজুক হেসে শীলাদি বলল— ওটা আবার একটা কথা হল? কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর যেতে হলে কিন্তু পারব না।
তার হালকা নীল শিফনের কুঁচি ঠিক করতে করতে অদিতি ভাবল— সত্যি তো কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বর এগুলো কলকাতার প্রধান আকর্ষণ। বিশেষ করে শীলাদিদের কাছে। মাধুরী যখন নার্সিংহোমে ছিলেন, তখনই একদিন নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। মুখ ফুটে একবার বলতে হয়! এখন রোগীকে ফেলে ও যাবে কী করে? নিজের ওপর একটু রাগও হল। যখন শীলাদিকে আসতে বলল তখন তো ওর একটু হাওয়া-বদলের জন্যই বলেছিল। কলকাতা দেখানোও। নিজের এই ভাঙা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখায়নি এখনও পর্যন্ত।
চোখের কোলে হালকা করে বাদামি পেনসিল বুলোল। চুলগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে ঝাঁকিয়ে ফুলিয়ে নিল। লম্বা আয়নায় ঘুরেফিরে দেখল নিজেকে। আজ মিসেস কানোরিয়ার ওখানে যেতে হবে। আর একটু সাজলে হত। মার্কেটিংয়ের জন্য একটু সাজগোজ দরকার হয়, বিশেষ করে মেয়েদের। ছেলেদের লম্বা চুল আর না-কামানো দাড়ি, জিনসের ওপর ছোট ঝুলের হাফ পাঞ্জাবি, কি লম্বা ঝুল খদ্দরই সাজ। কিন্তু মেয়েদের নানাভাবে নিজেকে সজ্জিত করতে হয়। অত ভাবনায় কাজ কী? সে নিজেই সাজতে বিলক্ষণ ভালবাসে। আগে এটা একটু চড়ার দিকে ছিল, সে সময়ে ‘ভাবুনি’ ‘সাজুনি’ ইত্যাদি বিশেষণ তার যথেষ্ট জুটেছে। এখন তার সাজসজ্জা আরও অনেক পাকাপোক্ত। রুচি পরিণত। মিসেস কানোরিয়ার ঘরের দুগ্ধশুভ্র দেওয়ালের পটে তার এই হালকা নীল বড় ভাল খুলবে। একটা সময় ছিল যখন সে প্রাইমারি কালারগুলো ছাড়া পরত না। সে এক দিন গেছে। বন্ধু-বান্ধবরা চেঁচামেচি করত কলাভবনের সেইসব দিনগুলোতে— আজও হলুদ, তুই কি চির হেমন্ত নাকি রে, বনি? —তারপর তার গোপন পলিসিটা আবিষ্কার করে ওদের সমবেত সংগীত— আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে— সে গান আর থামতে চায় না— অরুণিকা, মেহের, শিল্পশ্রী, তুষার, রঙিন, মাধবন, কাদের… সব স-ব।
মুখে একটু, সামান্য একটু হাসি ফুটেছিল। ছবি বলল—দিদি ফোন। আশ্চর্য! এত মগ্ন ছিল সে রুদ্রপলাশের রঙে যে রিং শুনতেই পায়নি। এমনই তার হয়। এই তদ্গত তন্ময়তা, তখন কোনও কিছু দেখে না, শোনে না। শুধু সেই এক অদ্বিতীয় ধ্যানবস্তু ছাড়া। যেমন এখন রুদ্রপলাশ! শান্তিনিকেতনের বসন্ত-ভরতি রুদ্রদর্শন নয়, অথচ রুদ্রপলাশ।
—হ্যালো।
—আমি মিসেস সাহা রায় বলছি। আপনি অদিতি সরকার তো?
—হ্যাঁ।
—আপনি কি আমার মেসেজ পাননি?
—হ্যাঁ পেয়েছিলাম। স্যরি মিসেস সাহা রায়। আসলে আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় খুব অসুস্থ। নার্সিংহোম, ডাক্তার… এখন আবার আমার বাড়িতেই আছেন। সময় পাইনি। ভুলেও গিয়েছিলাম। খুব দুঃখিত।
—না, না, তাতে কী! অসুখ যখন। জিভে একটা চিকচিক আওয়াজ করলেন ভদ্রমহিলা সহানুভূতির, তারপরে বললেন— আজ একটু সময় দিতে পারবেন? খুবই দরকার।
—অনোহিতা কি বাড়িতে আছে?
—না। —ভদ্রমহিলার গলাটা কেঁপে গেল— সেই থেকে ফেরেনি।
—সে কী? পুলিশে খবর দিচ্ছেন না?
—পুলিশের ব্যাপার নয়। আপনি আসুন, তারপরে বলব, ফোনে কথা হবে না। অনেক কিছু এক্সপ্লেন করতে হবে। প্লিজ আজকে একটু সময় দিন।
—আজ তো… ভীষণ ব্যস্ত…।
—প্লিজ… দ্রুত ভাবতে লাগল অদিতি। কোনটাকে বাদ দিতে পারে? কানোরিয়া? নাঃ। পাগল করে দেবেন। ফসকে যেতে পারে অনেক ভবিষ্যৎ ডিল। আর্ট এগবিজিবিশনে জাজগিরি? সম্ভব নয়। আরও কয়েকদিন আছে প্রদর্শনী। কিন্তু তার মধ্যেই পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিদের গায়ে লেবেল আঁটতে হবে। একমাত্র—একমাত্র ‘চিত্রভানু’টাই বাদ দিতে পারে সে।
—মিস সরকার।
—ইয়েস, ভাবছিলুম। আপনি এক কাজ করুন। এখুনি চলে আসতে পারবেন?
—শিয়োর।
—কোথায়?
—আপনি তো নর্থে থাকেন। ওদিকে কিছু জানা নেই আমার এক কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজ…।
—আমি সাউথে যাচ্ছি। যেতে হবে থিয়েটার রোডে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে দেড়টায়। আপনি এক কাজ করুন, থিয়েটার রোডের মুখে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ আছে, কিংবা কাছাকাছি চৌরঙ্গির ওপর ‘এমব্যাসি’। এই দুটোর একটাতে চলে আসুন। প্লিজ খেয়ে আসবেন না, কারণ আমার লাঞ্চ এইমাত্র শেষ হল, রেস্তোরাঁয় কথা বলতে হলে যা-যা অর্ডার দিতে হবে সব আপনাকেই খেতে হবে কিন্তু।
—ঠিক আছে। এমব্যাসি যাচ্ছি।
—তা হলে সাড়ে এগারোটা।
‘চিত্রভানু’তে ফোন করল অদিতি। স্টুডেন্টরা কেউ আসেইনি এখনও। এসেছে শৌনক, একজন শিল্পী, সে-ই ধরল।
—আমি দিদি বলছি। আমার ক্লাসের কেউ এলে বলবে— কাল যে ছবিগুলো সিলেক্ট করেছিলাম, সেগুলো যেন ওরা ভাল করে প্যাক করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে— ২৫/১ শেক্সপিয়র সরণিতে পৌঁছে যায়। ঠিক দেড়টা নাগাদ। আগে নয়, পরে তো নয়ই। আগে গেলে অপেক্ষা করতে হবে। বুঝেছ?
—হ্যাঁ, দিদি, এটা কানোরিয়া হাউজ, না?
—হ্যাঁ।
—আমারও কিছু আছে ওর মধ্যে, না? ওর গলায় প্রচ্ছন্ন উদ্বেগ, উৎসাহ।
—হ্যাঁ, ছেড়ে দিচ্ছি।
আর দেরি করল না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অদিতি চটপট বেরিয়ে পড়ল। শীলাদি বা মাধুরী দেবীকে বলে আসতেও ভুলে গেল বেমালুম। এমনিতেও তো অভ্যেস নেই!
মিসেস সাহা রায়ের কথা সে যে কী করে ভুলে গেল! উচিত হয়নি কাজটা। বোঝাই যাচ্ছে একটা পাগলি মেয়ের মা তিনি। মেয়েটা একেবারেই খেয়ালখুশি মতো চলে। সেই থেকে ফেরেনি? কেলেঙ্কারি। ভদ্রমহিলা, পেছনে ভদ্রলোকও আছেন নিশ্চয়, তো তাঁরা এতদিনেও কিচ্ছু না করে বসে আছেন? পুলিশের ব্যাপার নয়? তার মানে ওঁরা তার খবর রাখেন, খবর পান।
মেয়েটা যে রকম রহস্যজনকভাবে চলে গেল, তখন তার অভদ্রতা মনে হয়েছিল, নিউ জেনারেশনের মার্কামারা অভদ্রতা, এখন বুঝছে রহস্যজনকই, সন্দেহজনক, আসলে ভয় পেয়েছে এর পরে আরও পরিচয় বার হয়ে পড়বে। সেটা হতে দিতে চায়নি। অনোহূত রবাহূত কেমন চলে এল? সেটাও সন্দেহজনক। ঠিক করতে পারছিল না কী করবে। রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে সব। উনি আকাশ পাতাল ভাবছেন আর কী! কোথায় গেলে কী করলে বাবা-মাকে আরও জ্বালানো যায়। তা অযাচিতভাবেই আশ্রয় মিলে গেল। রাতের মধ্যে ভাবনা-চিন্তা ইতি-কর্তব্য স্থির হয়ে গেল বোধহয়, কেটে পড়ল। বাস। আর কে কার তোয়াক্কা করে!
রেস্তোরাঁটা চলে কী করে কে জানে! সব সময়েই খুব কম লোক থাকে। এসেছে হয়তো বার পাঁচেক। খুব কনভিনিয়েন্ট জায়গাটা। আজ কিন্তু বেশ লোক। লাঞ্চ-টাইম তো! লোক জমতে শুরু করেছে। লাঞ্চের জন্য টেবিল সাজানো। কয়েকটাতে আবার রিজার্ভড নোটিস। সে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কোনও চিহ্ন, কিছু বলাবলি হয়নি। সে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল শূন্য থাকবে জায়গাটা, একটিমাত্র মহিলা সূর্যের মতো বিরাজ করবেন তার অপেক্ষায়।
কোণ থেকে একজন উঠে দাঁড়ালেন। হাত নাড়লেন।
—আসুন।
—কতক্ষণ এসেছেন?
—জাস্ট।
—অনেক দূর?
—না, আয়রনসাইড রোড।
—মোটের ওপর দূরই তো! —বলছিল আর ভদ্রমহিলাকে জরিপ করছিল অদিতি। খুব ফরসা রং। মুখ নাকগুলো একটু ভোঁতা ভোঁতা। একধরনের সৌম্যশ্রী আছে। বয়ছাঁট চুল। ঘাড়-গলা রীতিমতো বলিষ্ঠ। ভাস্করদের পছন্দসই। পুরো চেহারাটার মধ্যেই একটা শক্তির ছাপ আছে। রাফ পাথরে তৈরি করলে দারুণ হবে। সিমেন্টে চিপস মিশিয়ে বা সুরকি ধরিয়ে শৌনক মাঝে মাঝে করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় অনোহিতা মায়ের কিছুই পায়নি। একেবারেই পলকা-হালকা। রং মাজা। চোখমুখের বিচার করা অত সোজা নয়। কেননা মেয়ে এখনও ধারালো, মা খানিকটা তো ধেবড়ে গেছেনই। যাই হোক, কোনও আদল নেই।
উনি বললেন— আপনি আর্টিস্ট অদিতি সরকার, না?
—হ্যাঁ।
—আমি আপনাকে টিভি-তে কোনও চ্যাট শোয়ে দেখেছি। ফোটো, এমনি এগজিবিশনেও… অ্যাকচুয়ালি আমি ছবি ভালবাসি।
অদিতি মুখে একটা আলগা হাসি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
—অনোহিতাকে আপনি কোথায় কীভাবে পেলেন?
অদিতি বলল সব। কীভাবে। কখন। কোথায়। খালি কেনটাই তার জানা নেই।
—ভিজছিল? একা? —একাটার ওপর খুব ঝোঁক দিলেন ভদ্রমহিলা।
—ওর কি একা থাকার কথা নয়? একটু ইতস্তত করে সে জিজ্ঞেসই করে ফেলল।
—কী জানেন— অদিতি… বলতে খুব খারাপ লাগছে— কিন্তু ও প্রায় ওর বাবার বয়সি এক বিবাহিত ভদ্রলোকের কাছে আছে আমরা জানি। এই নিয়েই ওর বাবার সঙ্গে, আমার সঙ্গে খুব… চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ওর বাবা খুব মেজাজি। মেয়েও তাই।
—মেয়ে তা হলে মাকেও মানে না।
—মা থাকলে তো মানবে?
—আপনি ওর মা নন?
—না। আমি ওর মায়ের বন্ধুস্থানীয়। ওর মায়ের মৃত্যুর পর, বছর দুয়েক পর আমরা, মানে আমি আর ওর বাবা বিয়ে করেছি।
এইবার সমস্যার আসল জটিলতার জায়গাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
—আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। কিন্তু এই বিয়েটার আগে ও আমাকে ওর মায়ের চেয়েও ভালবাসত।
কেন যে অতিরঞ্জন করছেন ভদ্রমহিলা! বুঝছেন না এতে ওঁর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। মা’র থেকে ভাল কেউ কাউকে বাসে?
—ওর মা, আমার বন্ধু খুব ভালমানুষ ধরনের। ভিতু, নির্বিরোধী ধরনের মেয়ে ছিল। মানসিক সাহায্যের জন্য ও আমার কাছেই আসত।
এবং আপনি পুরোপুরি তার সুযোগ নিতেন। ভাবল অদিতি।
—অনোহিতা একমাত্র সন্তান। ওর বাবা খুবই ব্যস্ত। বড্ড আদুরে, মানে একটু স্পয়েল্টই বলা যায়।
সৎমাদের কাছে সৎমেয়েরা সব সময়েই স্পয়েল্ট হয়। এই ছকটা অদিতির চেনা। স্ত্রীয়ের বন্ধু। ক্রমশ জাল বিস্তৃত করছে। ইনি তো সব কথা ভাঙবেন না!
—আমি ওদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যালও। বড্ড উইলফুল, রাগী, আমাকেই একমাত্র মানত। ওর সঙ্গে আমার একটা স্পেশ্যাল রিলেশনশিপ ছিল।
—সেটা কি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে?
—খুব সম্ভব।
—আপনি ওর বাবাকে বিয়ে করেছেন বলে?
—খুব সম্ভব।
—ওর মা হঠাৎ, বয়স তো…।
—আমার মতোই হবে, স্কুল থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি আমরা, শারীরিকভাবেও খুব কমজোরি ছিল শ্রীলা। হিসটেরেকটমি করতে হয়েছিল। মারা গেল। থ্রু আউট আমি… আমি একা তখন… আর কোথাও… কেউ…
ভদ্রমহিলা চুপ করে গেলেন। ওঁর নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। অদিতি মুখ নিচু করে চিকেন চাওমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল। এই গলা ধরে যাওয়া শোকটা সত্যি, অভিনয় মনে হল না।
—ওর বাবা ছিল লন্ডনে। আর ও বন্ধুদের সঙ্গে এক্সকারশনে গিয়েছিল।
—মায়ের অপারেশনের কথা জেনেও?
—জেনেও— দ্যাটস দা প্রবলেম উইথ হার, শি ইজ ভেরি ভেরি সেলফিশ। তা ছাড়া আমার ওপর এমন একটা ফেথ ছিল। জাস্ট বলে গেল— তুমি মাকে দেখো, আমি জাস্ট দু’দিনের জন্যে…
—একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
—হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
—আমার অনধিকারচর্চা হচ্ছে মিসেস সাহা রায়। কিন্তু মেয়েটি যখন একরাত আমার বাড়ি কাটিয়ে গেছে এবং সেই সূত্রে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। জেনেও যে আমি আর ওর সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না…
—আপনাকে অত কৈফিয়ত দিতে হবে না। উনি একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন—কী জানতে চান জিজ্ঞেস করুন।
—ওর বাবা কেন সে সময় ছিলেন না?
—আপনি কি কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের প্রেশারের কথা কিছু জানেন? ওরা কিচ্ছু মানে না, যেতে হবে তো যেতে হবেই। এখন, হিসটেরেকটমি একটা মেজর অপারেশন হলেও, মোটামুটি রুটিনই তো! ভাল ডাক্তারের হাতে ছিল। আমার ওপরও ও খুব নির্ভর করত। কিছু করতে পারলাম না।…তবে কী জানেন—ক্ষতি যা হয়েছে সবচেয়ে বেশি আমারই…।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল অদিতি।
—আপনি বুঝতে পারবেন না, শ্রীলা আর আমি ঠিক কী জাতীয় বন্ধু ছিলাম। আমি তো অনেকদিনই উইডোড্। একা থাকতাম। বন্ধুদের ফ্যামিলি তাদের ছেলেমেয়ে এটা আমার পৃথিবীর একটা…
—বুঝলাম। আমি এখন কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি সেইটাই বুঝতে পারছি না।
—আপনি অদিতি সরকার। আপনি হয়তো পারবেন। আপনি ভাস্কর চক্রবর্তীকে চেনেন নিশ্চয়ই।
—হ্যাঁ। কেন বলুন তো? —আশ্চর্য হয়ে বলল অদিতি।
—উনিই সেই লোক যাঁর মোহে ও…
বেশ কিছুক্ষণ অদিতি কথা বলতে পারল না। অবশেষে ধাক্কা-খাওয়া গলায় বলল, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না মিসেস…
—আমার নাম সর্বাণী, আমি আপনার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়, ইচ্ছে হলে দিদি ডাকতে পারেন।
—ভাস্করদা তো আমার চেয়ে অনেক বড় বটেই, আপনার চেয়েও বড়।
—হ্যাঁ, প্রায় ওর বাবার বয়সি। একটু জুনিয়র। বন্ধু।
অদিতি সেই একইভাবে চিকেন চাওমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু ভাবতেই পারছে না। বলা তো দূরের কথা। চারদিকের পৃথিবী ধূসর। চোখে ভাসছে কাঁচা মেয়েটার মুখ। বৃষ্টিতে ভিজছে। গলে যাচ্ছে মাটির পুতুলের মতো।
—আপনি আর্টিস্ট অদিতি সরকার, শিয়োর হয়েই আমি আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছি। যদি ভাস্করকে বলে কিছু করতে পারেন। ওর বাবা এখন এখানে নেই। ছ’মাসের জন্যে লন্ডন গেছেন। এর মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে।…
ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে কাচের বাসনের মতো। শুধু কোনও শব্দ নেই।
* * *
মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদের দেখা হলেই যদি সামান্যতম চেনাশোনা থাকে, শাড়ির প্রসঙ্গে উঠবেই।
কুসুম কানোরিয়া হুইল চেয়ারে বসেছিলেন। বয়স বছর ষাট। চুলে মেহেন্দি করেন। একটা আগুনে কমলা বড় মাথা। উজ্জ্বল রং, উজ্জ্বল চেহারা, নাক এবং চোখ তীক্ষ্ণ। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকঠাক, কোনও একটা নার্ভের রোগে গত দশ-বারো বছর বেচারি এমন হয়ে গেছেন। এত ধনী, সারা পৃথিবী ঘুরে এসেছেন চিকিৎসার জন্যে, কিন্তু কিছু হয়নি।
উনি বললেন— ইয়ে শিফন বহোৎ বড়িয়া হ্যায়, অদিতিজি আপনার ওপর খুব ভাল লাগছে। খরিদ কিধারসে কিয়া? পার্কি স্ট্রিট?
—প্যারিস থেকে।
—দ্যাটস ইট।
—এখানেও শিফন আজকাল চমৎকার পাওয়া যাচ্ছে কুসুমজি।
—আপনাকে লাগছেও খুব সুন্দর। ফ্রেশ।
—আপনি চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। কিন্তু আপনাকে দেখলে কেউ বলবে না আপনার কোনও অসুখ আছে। একদম ফ্রেশ।
অসুখের ব্যাপারটা নিয়ে আগেও ওদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, তাই এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারল অদিতি। কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, বা হীনম্মন্যতা নেই ভদ্রমহিলার। খুবই সাহসিনী। এত প্রফুল্ল থাকেন যে কে বলবে ওঁর একটা এত বড় অক্ষমতা আছে। জন্মগত নয়। সারা জীবন চমৎকারভাবে ছোটাছুটি করে যদি শেষ-চল্লিশে কারও পা অকেজো হয়ে যায়, কী দারুণ ডিপ্রেশন আসতে পারে মানুষের আন্দাজ করা যায়। সে ডিপ্রেশন গোড়ার দিকে ওঁর নিশ্চয় ছিল, কিন্তু অনেকদিন কাটিয়ে উঠেছেন। উনি ছবি ভালবাসেন। কিন্তু খুব একটা বোঝেন না। এ বিষয়ে অদিতির ওপর নির্ভর করেন উনি। ওঁর একটা বড় গুণ ছবি-বিষয়ে উনি বড় বড় নামের পেছনে ছোটেন না। উঠতিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কুসুম কানোরিয়ার রুচি খুবই বিশেষত্বের দাবি রাখে। উনি সংগীত ভালবাসেন। বড় বড় উস্তাদ তো নিশ্চয় শোনেন। কিন্তু শিক্ষার্থী, খানিকটা শিখেছে, তালিমে আছে এখন, অল্প বয়স—এদের গান শুনতে উনি অসম্ভব ভালবাসেন। এখনও একটা চালানো ছিল। ভোরের কোনও রাগ। অদিতি অত চেনে না, কিন্তু ভোর আর মধ্যরাতের রাগগুলোর সময় বুঝতে পারে, কেননা সময়কে নির্ভুল ধরে এইসব রাগ।
ছবির বোঝাটা কুসুমের লোক কার্পেটের ওপর নামিয়ে গেছে, অদিতি বসল মুখোমুখি রাখা একটা চেয়ারে। কুসুম বললেন— শুনেছেন, কী ফ্রেশ ভয়েস! একদম পিয়োর, নোটগুলো ছুঁচ্ছে দেখুন, কেয়া সিনসিয়ারিটি! আলাপ, উও সির্ফ আলাপ করেগা, ঔর কুছ নহি।
—কে ছেলেটি?
—কেউ না অদিতিজি, উও তো কোই নহি অব, জানতি নহি কোই হোগা ইয়া নহি। বাট আই ডোন্ট কেয়ার। মেরে লিয়ে এহিই কাফি হ্যায়।
ভোরের সুরে সত্যিই মিসেস কানোরিয়ার নাতিআসবাব ঠান্ডা ঘরে গ্রীষ্মের সাদা বেল জুঁই ফুটছিল। একটা সুরবলয়। নিজের চারধারে এই রকম একটা বলয় তৈরি করে বসে থাকেন কুসুমজি। ছবি…গান…পছন্দসই সঙ্গ…।
—ওয়া, ওয়া, বহোৎ খুব। মাথা নেড়ে বলে উঠলেন।
গান শেষ হওয়া অবধি বসে থাকতেই হল তাকে। ভাল লাগছিল খুব। এই আবহ অতি সুন্দর, শরীর-মনকে সুখে আরামে লালিত্যে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু তার ভেতরে আর এক তাড়া। পৌঁছোতে হবে অ্যাকাডেমিতে, তিনটে গ্যালারি ভরতি কাজ। মতামত দেওয়ার আগে তো তাকে দেখে উঠতে হবে সব। তারপর… তারপর ভাস্করদা…ভাস্কর চক্রবর্তী…। কী বলবে, কেমন করে বলবে। কিছুই জানে না এখনও। ভাবতেও চায় না। ভাস্করদা শুধু চিত্রশিল্পী নন। আবার কবিও। বেশ নাম আছে। টিভি-তে কোনও সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে— মাথাভরতি ঝিলিক দেওয়া সাদা চুল, কানের শুধু লতি বেরিয়ে আছে, সিগারেটে প্রায় কালো ঠোঁট, তীক্ষ্ণ নাসা, বসা চোখ, হিলহিলে চেহারার ভাস্কর চক্রবর্তীকে সেই বোকা বোকা প্রশ্নটা সে করতে শুনেছে— আঁকেনও আবার লেখেনও? কী করে মেলান?
—মেলাই না তো! মেলে না আদৌ।
—তবে? ঘাবড়ে গেছে পুতুল পুতুল মেয়েটি।
—কবিটা আর আঁকিয়েটা আলাদা। কবিটা কথা বলায় আর আঁকিয়েটা তুলি চালায়।
অদিতির মনে হয়েছিল কবিতায় আর চিত্রশিল্পে তো মাধ্যমগত ছাড়া আর কোনও ফারাক নেই? যদি কোনও কবি আবার কর্পোরেট হাউজের ব্যস্ত এগজিকিউটিভ হন, তখন এ প্রশ্নটা করা যেতে পারে। কিন্তু কবিতা আর ছবি পরস্পরের সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ। সে দিক দিয়েই গেলেন না ভাস্করদা। শোম্যানশিপে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। যেমন পাবলিক রিলেশন, তেমনই শোম্যানশিপ। বরঞ্চ এই প্রশ্নটা ওঁকে করা যেত, কবিতা বা চিত্র যে মগ্নতা, যে ধ্যান চায়, তা তাঁর মতো বাজারসন্ধানী জনসংযোগসর্বস্ব মানুষ কী করে দ্যান। বা উলটোটা। তবে এসব বলেও ওঁকে কায়দা করা যাবে না। নির্ঘাত বলবেন— কবিরে/ শিল্পীরে পাবে না তার জীবনচরিতে।
—শঙ্কর পরসাদজির নাম শুনেছেন? হুইল চেয়ার চালিয়ে মিউজিক ডেকটার দিকে গেলেন কুসুমজি, বন্ধ করে দিলেন।
—না না, উনি কে? আমি ঠিক…
—উনি সারেঙ্গির উস্তাদ। পহেলা সারের নয়, অনেকেই চিনে না। লেকিন বহোৎ হোনহার টিচার উনি, ওঁর সঙ্গে আমাদের জান-পহচান অনেকদিন। আমার ছোট বোন ওঁর কাছে শিখত। সরোজ চাঢ্ঢা, মোটামুটি নাম ছিল একসময়ে। এখন সব ছেড়ে দিয়েছে। তো ওঁর কাছ থেকে কেসেট করিয়ে আনি। বেনারসে থাকেন। এ ছেলে আপনাদের বঙ্গালি কিন্তু। সাম মজুমদার ঔর তরফদার। মনে হচ্ছে না তো! সাম দার। আচ্ছা…আপনার দামের সময় নষ্ট করছি, অদিতিজি ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ, অকেলি ঔরত…দুসরি মিললো তো বহোৎ বকবক করল।
অদিতি একটা শুভ্র হাসি হেসে ওঁকে আশ্বস্ত করে। তারপরে ছবিগুলো একে একে বার করে, যেটা দূরে নিয়ে যাবার যায়। দেওয়ালের ওপর রেখে, আলোর তলায় দেখায়, যেটা কাছ থেকে দেখবার পাশে বসে ওঁর কোলের ওপর রাখে।
—এইটার স্পেশ্যালিটি কী অদিতিজি। জাস্ট একটা সফেদ কাগজ। এক দিকে একটা মুখের আউটার শেপ দেখছি।
—ওই ওইটুকু দিয়েই মুখটা, তার টুপি, তার ঘাড়ের কাছে চুলের ছাঁট, একজন ফপ-টাইপের লোক আর কী…এটা ফুটিয়েছে। উইথ দা ভেরি মিনিমাম।
—ওয়েল আই ডোন্ট লাইক দিস ফপ-ম্যান। এ খুব চলছে কি?
—যার যে রকম পছন্দ। আপনাকে আলাদা আলাদা স্টাইল দেখাব বলে এনেছি।
—আরে! মহাত্মা গাঁধীকে ক্রুসে দেখিয়েছে? ভেরি ক্লেভার অব হিম।
—দেখুন কুসুমজি এ ছেলেটি একটা সিরিজ এঁকেছে, মহামানবেরা ক্রুসবিদ্ধ—এই বুদ্ধ, এই রবীন্দ্রনাথ, কত রকম অ্যাঙ্গল থেকে এঁকেছে দেখুন! এই বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র…
—ওয়ান্ডারফুল, মোস্ট ওয়ান্ডারফুল…
শৌনকের সিরিজটা পঞ্চাশ হাজারে বিক্রি হয়ে গেল।
—কেয়া মাস্লস্ দিয়া রবীন্দ্রনাথকো ইনহোনে। বুডঢা থে না টেগোর?
অদিতি হেসে ফেলল— চিরকাল তো টেগোর বুড্ঢা ছিলেন না কুসুমজি, তা ছাড়া উনি ছোটবেলায় কুস্তি করতেন। ওঁর ত্রিশের ঘরে বয়সের একটা ছবি আছে সেটা অনেকটা খ্রিস্টেরই মতো। খালি ওঁর চোখে গভীর অতল বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ছাপ৷
—সমঝ গিয়া। লেকিন উও তো সফেদ দাড়ি সফেদ বাল হি দিয়া না ইনকো!
—ইয়া— কুসুমজি বোঝবার চেষ্টা করুন এই শিল্পী শৌনকের এটা ভিশন অব রবীন্দ্রনাথ। হ্যাঁ বৃদ্ধ, সাদা রুপোলি চুলদাড়ি। কিন্তু পেশিময় দীপ্ত শরীর, —ওঁকে বীরপুরুষ হিসেবে দেখেছে শিল্পী। আ কারেজাস ম্যান অ্যান্ড ওয়রিয়র, ওঁর বার্ধক্যটা যেন সভ্যতার এই সংকটের জন্য বীর-শরীরে এসে যাওয়া এক বিষাদ-বার্ধক্য।
—ওয়ান্ডারফুল—কুসুমজির বিস্ময় ও প্রশংসা আর ফুরোতে চায় না।
নিজের ছাত্রছাত্রীদের কয়েকটা ছবিও বিক্রি করল অদিতি। নন্দিনী মিনিয়েচার আঁকে। কিন্তু ওর মডেলরা একেবারে আধুনিক। কত্থক নর্তকী, গণেশ, মা-শিশু, সাজানো বাগান। খুবই অদ্ভুত এফেক্ট ছবিগুলোর।
অবধারিতভাবে একটা ইমপ্রেশনিস্টিক ল্যান্ডস্কেপও কিনলেন কুসুমজি। কিনবেনই। প্রত্যেকবার। ইমপ্রেশনিজম নিয়ে ওঁর মুগ্ধতা আর কাটতে চায় না। খুবই ভাল কাজ করেছে অবশ্য রোশন। খুব খেটেছে। তক্ষুনি তক্ষুনি ক্যাশে পেমেন্ট করে দিলেন উনি। লোহার আলমারির লকার খুললেন আর দিয়ে দিলেন। ভাল, ভাল। ছেলেমেয়েগুলো হাতে-গরম কাঁচা টাকাগুলো পাবে। কবে বিখ্যাত হবে, তখন লক্ষপতি, কোটিপতি হওয়ার কাল, আদৌ হবে কি না…সবাই তো হতে পারে না। অথচ জীবনকে চলতে হবে।
চটপট একবার ‘চিত্রভানু’তে ফেরা যাক। টাকাগুলো হাতে পেলে বড় খুশি হবে, নিশ্চিন্ত হবে ছেলেমেয়েগুলো। নন্দিনী তো আকাশে উড়বে। এখনও তো শিক্ষানবিশি শেষ হয়নি। এ রকম আরও কত আছে আর্টের ইতিহাসে। দালি তো প্রচলিত কোনও শিক্ষা, রীতিনীতিরই ধার ধারেননি৷ কিছুই পছন্দ হয় না। কিচ্ছু না। স্কুলে বলে প্রচণ্ড প্রতিভা কিন্তু একেবারে উন্মাদ এ ছেলে। প্রকৃতপক্ষে, শৌনকের ক্রুসবিদ্ধ মহামানবদের সিরিজের মধ্যে দালি বিশেষভাবে আছেন। ‘ক্রাইস্ট অব দা সেন্ট জন অব দা ক্রস’, ‘লাস্ট সাপার’। বিবেকানন্দর ক্রুসটা আবার মিকেলেঞ্জেলোর ‘লাস্ট জাজমেন্ট’-এর অটল-অচল ক্ষমাহীন, বীরপুরুষ ক্রাইস্টের কথা মনে করিয়ে দেয় যিনি করুণাময়ী মাতা মেরির অনুনয়ও উড়িয়ে দিচ্ছেন। যথার্থ পাপীদের তিনি যথার্থ শাস্তি দেবেনই। ছবিগুলো বর্তমান সভ্যতার সংকটে খুবই প্রাসঙ্গিক। এই ক্রুসের প্রতীকটা খুব সাবলীলভাবে আসে ছেলেটার, হয়তো ক্রিশ্চান বলেই।
শৌনক মেঝের ওপর একটা ডিগবাজি খেল। বোলার ব্যাটসম্যানকে আউট করলে যেমন একটা মুঠি পাকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গি করে, সেই রকম করে বলল— মার দিয়া কেল্লা। দিদি তোমায় একটা চুমু খাব?
—খা! অদিতির মুখটা শক্ত করে ধরে দু’গালে চকাস চকাস করে চুমো খেল শৌনক, তারপর মাটিতে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত।
রোশন বলল— আমারটা কী করে পুশ করলে দিদি। মোস্ট কনভেনশন্যাল…।
—তাতে হয়েছেটা কী! ভাল লাগা মানে ভাল লাগা। তোর এই সূর্যাস্তের রং লাগা গাছপালা ঘরবাড়ি অলিগলি এসব তো আমি নতুন করে দেখছি। এঁকেবেঁকে থাকা ভিখারিটা ভাল করে লাইন ড্রয়িং করে নিয়েছিলি না? আর রিকশাওলা?
—হ্যাঁ। তো উনি ওটা নিজে নিলেন না তুমি…
এই রোশনের বড্ড দোষ। একেবারে আত্মবিশ্বাস নেই। সেই জন্যে শৌনকের মতো বোল্ড আইডিয়া এখনও ওর মাথায় আসতে পারছে না। ও সেই গায়কের মতো যে তার শিক্ষকের কিংবা যে-কোনও গায়কের গান অবিকল গলায় তুলে নিতে পারে। কে জানে হয়তো ও ক্ষতিগ্রস্ত ছবি উদ্ধার কিংবা কপি করার পেশা নেবে। তাতেও ভাল টাকা। খুবই ভাল।
নন্দিনী ঢুকতেই বাকিরা হইহই করে উঠল— পুটপুটি, চুনোপুঁটি। নন্দিনীর মিনিয়েচারদের এবং তাদের দরুন নন্দিনী বেচারিরও নাম ওই—পুটপুটি। চুনোপুঁটি।
তোরা তোদের টাকাপয়সাগুলো নিয়ে আমায় ছাড়।
—আইসক্রিম আনতে দিয়েছি, না খেয়ে কোথাও যাচ্ছ না।
—টাকাগুলো এভাবে বাজে খরচ করিসনি। জমা। এখনও বটগাছের ছায়ায় আছিস, বুঝছিস না! রং-তুলি আর বিড়ি-সিগারেটের খরচটা সরিয়ে রেখে বাকিটা জমা।
এই শেষ উপদেশ বা পরামর্শ দিয়ে সে যখন বেরোল তখন পাঁচটা বেজে গেছে। সাতটায় প্রদর্শনী শেষ। চল্লিশে স্পিড তুলল অদিতি। কিন্তু পোস্ট-পাঁচটা চৌরঙ্গিতে চল্লিশও রাখা যায় না, বারবার ব্রেক, বারবার গোঁত্তা। হঠাৎ কেন কে জানে মনে পড়ে গেল—আপনি কিন্তু ভাল ড্রাইভ করেন না।
ছয়
বর্ষা এসে গেছে। বেশ গুমোট আজকে। অ্যাকাডেমিতে ঢুকতে কিন্তু খুব ভাল লাগল। আজকাল গ্যালারি অনেক হয়েছে। প্রদর্শনীও যথেষ্ট হয়। কিন্তু ভিড়গুলো হয় নামকরা আর্টিস্ট থাকলে। সেখানে সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিক, কাঁধে ভিডিয়ো ক্যামেরা। আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রদর্শনীতে সে প্রত্যেকবার যেত বাবার সঙ্গে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে। খুব ভাল লাগত। সেখানেই প্রথম দেখে গোইয়ার ‘অ্যালিগরি অব স্পেনে’র সুষমা, ক্লোদ মনের ‘বেদার্স অ্যাট লা গ্র্যানুয়ালিয়ের’-এর রঙিন আলোছায়া, রেনোয়ার আমব্রেলাজ-এর ভিজে নীল, লত্রেকের মুল্যাঁ রুজের মত্ত ছন্দ। এইসব ক্লাসিক কপি করা শিল্পশিক্ষার একটা বড় ধাপ৷ বেঙ্গল স্কুলের ধাঁচেরও প্রচুর ছবি থাকত— অবনীন্দ্র-নন্দলাল। একবার গগনেন্দ্রনাথের কপি দেখে সে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। কত কিউবিস্ট ছবি দেখল, কিন্তু গগনেন্দ্রনাথ মস্তিষ্কের মধ্যে দৃঢ় গাঢ় রঙে ছাপা হয়ে রয়ে গেছেন।
যাক, এখনও এদের ছবি দেখতে দিব্যি ভিড় হয়। পাঁচটার পরটাই বেশি, কেননা অফিস-কলেজ কাজ ফেরত আসতে হচ্ছে। ঢুকেই বাঁ দিকের চেয়ার-টেবিলের জটলায় রুপোলি ঝিলিক মাথায় নিয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী। যেন একটা বাম্পে ধাক্কা খেল অদিতি। উনি উঠে এলেন —দুপুর দুপুর আসবে তোর ফাঁকা তখন। এখন কাজ করতে খুব অসুবিধে হবে। উনি তার কাঁধে একটা অন্তরঙ্গ হাত রাখলেন।
অদিতি খুব চেষ্টা করে একটা শুকনো মতো হেসে মাথা নাড়ল। না, অসুবিধে হবে না। সরে গেল।
—কান্তি তো তিনটে নাগাদ চলে গেল। এখন ছেলেমেয়েগুলোও তোমাকে লক্ষ করবে।
খুব ব্যস্ত হবার ভান করে অদিতি নিজের ব্যাগ খুঁজতে লাগল, একটা নোটবই আর পেনসিল।
সে দ্রুত চলে গেল। জলরং, জলরং, প্যাস্টেল, জলরং, টেম্পারা, কালির স্কেচ, অয়েল, অয়েল, হঠাৎ তার চোখ-বোধ-মন-মস্তিষ্কের ওপর একটা প্রকাণ্ড আক্রমণ হল। সাউথ গ্যালারির ডান দিকের দেওয়াল থেকে তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে দুটো গাবদা বেড়াল বা বেড়ালের ভূত। সবুজ চোখের মণিতে মারাত্মক জ্বালা। কেমন আগুনে লাল রং বেড়ালগুলোর। যেন খেপে উঠেছে। এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। রং ঢেলে দিয়েছে দুটো গাছে, বেগুনি-গোলাপি ছাতিম আর কটকটে সবুজ নিম। আর মেঝেতে নীল শ্যাওলা—তাতে ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ব্লিচিংয়ের ছাই-সাদা দাগ, কতকগুলো অসমান বৃত্তের মতো। মোজেইক ছড়িয়ে রয়েছে। সে জানে তাই। নইলে এগুলো অত্যাধুনিক খামখেয়ালিপনা বলেই মনে করবে যে-কেউ। একদম কোণে আধখানা ভারমিলিয়ন সূর্য। চব্বিশ বাই তিরিশ ইঞ্চির মতো লম্বাটে ক্যানভাসটার ওপর ঝুঁকে পড়ল অদিতি। কোণে লেখা ‘তনিকা’। ক্যাপশন ‘আ ফেলাইন মর্নিং।’
মাথা ঝিমঝিম করছে। কোথাও একটা বসতে পারলে হত। এ ছবি কোনও দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে রাখা উচিত ছিল। প্লেসিং ঠিক হয়নি।
—ইট’স প্যাশনেট, রিয়্যালি— পাশ থেকে কে বলে উঠল। এক শ্বেতকায় যুগল।
ছেলেটি মেয়েটিকে বলল— ডোন্ট য়ু থিঙ্ক ইট ইজ টেরিবলি সেক্সি?
নট রিয়্যালি, মাথা নাড়ল মেয়েটি। আই ফিল ইট ইজ অ্যাঙ্গার। লুক অ্যাট দা আইজ অব দোজ ক্যাটস্! অ্যান্ড দা রেডিশ অরেঞ্জ বডি।
মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিল অদিতি। ছবিটার আক্রমণ তাকে মোহগ্রস্ত করেছে। বেরিয়ে আসতে না পারলে সে অন্য ছবিগুলোর ওপর সুবিচার করতে পারবে না।
এখন প্রায় সাড়ে সাতটা। জনাকীর্ণ, যানাকীর্ণ চৌরঙ্গি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে অদিতি। নিতান্ত অভ্যাসে কাজ করে যাচ্ছে। হাত-পা-চোখ। তার জাজমেন্ট শিটটা সে ভাস্কর চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে এসেছে। বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদা নম্বর। যোগ করে দেখা যাচ্ছে— ‘আ ফেলাইন মর্নিং’—ফার্স্ট এসেছে। ভাস্কর চক্রবর্তী বললেন, ওই ফোব্ ছবিটা তোমার এত ভাল লাগল? হোয়াট অ্যাবাউট দ্যাট ‘সানি ডে ইন সেপ্টেম্বার!’
—ভাল। দিয়েছি তো। ওটা বোধহয় থার্ড এসেছে, আ ক্লোজ থার্ড।
—তোমার কাছে দেখছি সেকেন্ড এসেছে ধরমভির— ‘আড্ডা ইন টোয়াই লাইট৷’ কান্তি এটাকেই ফার্স্ট দিয়েছে। ‘সানি ডে’ সেকেন্ড, তোমার ‘ফেলাইন মর্নিং’ ওর কাছে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছে। থার্ড ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব সিভিলাইজেশন।’
অদিতি ভুরু কুঁচকাল। ছাড়া ছাড়া ভাবে কতকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপার এঁকে দিয়েছে এ ছেলে। ফাঁকিবাজ নাম্বার ওয়ান। শেষকালে একটা নিউক্লিয়ার বম্বিংয়ের ব্যাঙের ছাতা মেঘ। আইডিয়াটা ভালই। কিন্তু এটা একটা হিস্ট্রির এগজিবিশন হলে যেত ভাল। চার্ট। ছবি নয়।
—কী দেখলে তুমি ওই ‘ফেলাইন’-এ?
অদিতি মনে মনে বলেছিল— তুমি কী বুঝবে? সারাজীবন বিকৃত ন্যুড এঁকে গেলে, তোমার সব ছবি সিনিসিজমের চূড়ান্ত। সিনিসিজম দিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আর্ট হয় না।
মুখে বলল—পেন্টিংয়ের ব্যাপারে মতভেদ থাকবেই ভাস্করদা।—আপনার যা ভাল লাগে তা আমার না-ও লাগতে পারে।
—ঠিক। কিন্তু যত ব্যক্তিগত হোক না কেন— ড্রয়িং, কম্পোজিশন, কালার, মানে ব্যাকরণসম্মত একটা কমন গ্রাউন্ড তো থাকবে।
—আছে তো! নিশ্চয় আছে। সত্যি কথা বলতে কী খুবই ভাল ভাল কাজ দেখলাম আজ। জাজমেন্ট দিতে খারাপই লাগছিল। তবে এ কথাও তো ঠিক, নতুন বৈপ্লবিক তুলি নিয়ে যখনই যাঁরা এসেছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, হননি? দিন গেলে সেই মাতিস, সেই রেনোয়া-পিসারো-মোনে, সেই ভ্যানগগ-গগ্যাঁকে নিয়েই মাতামাতি করেনি লোকে?
—‘ফেলাইন’ তা হলে তোমার মতে কলকাতা—থুড়ি ভারতবর্ষের পোস্ট-মডার্ন মাতিস৷
অদিতি কাঁধ নাচাল। —ফাইনাল জাজমেন্ট তো আপনারই হাতে ভাস্করদা। এত তর্কাতর্কির কী আছে? এসব কথা তো সবাই জানে!
সে যে বিরক্ত হয়েছে, একটু ক্ষুব্ধ অপমানিতও তা বেশ স্পষ্ট।
—আরে চটছ কেন, চটছ কেন? ওই মেয়েটা একটা পাগলি!
—পাগলি! তা হলে আর্টিস্টকে চিনে সেই চেনা দিয়ে ছবির বিচার করা হচ্ছে নাকি আজকাল? বাই দা ওয়ে— ও মেয়েটি কে? পাগলি! তনিকা?
—কে আবার, জাস্ট একজন ছাত্রী! ফাইনাল ইয়ার হয়ে গেল ন্যাচারালি৷ খেয়ালি, মেজাজি, তুমি ঠিকই বলেছ— রেবেল টাইপ। কিন্তু রেবেল হলেই তাকে প্রতিভা হতে হবে এ লজিকে আমি বিশ্বাস করি না।
—থাকে কোথায়? এখানে আছে নাকি? কাছাকাছি।
—আমি কী করে জানব? অফিস-রেজিস্টারে ঠিকানা থাকবে। কেন তুমি প্রোমোট করবে নাকি? চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন— না এখানে নেই।
—প্রোমোট করলে আপনার আপত্তি আছে? এনিওয়ে আপনাদের নিয়মে যদি না আটকায় ছবিটা আমি কিনছি।
বস্তুত সে আর্ট কলেজের নিয়মকানুন সেভাবে জানে না। কলেজে এক বছর শেষ করেই চলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। কলাভবনের শেখানোর পদ্ধতি আলাদা। তার পরেই স্কলারশিপ নিয়ে প্রথমে কয়েক মাস গ্লাসগো স্কুল অব আর্ট, তারপর প্যারিস—‘একোল দে বোজার’-এ। এঁদের খুব একটা বুঝে চলবার দরকারও হয় না। তার নিজের ছবি সাধারণত বিক্রি হয় ইউরোপে। আঁদ্রে তার এজেন্ট। এখানেও হয়। কিন্তু এখানে সে তার ‘চিত্রভানু’কেই যথাসম্ভব পাদপ্রদীপের আলোয় আনবার চেষ্টা করে। ভালই ক্রেতা পেয়ে যাচ্ছে তো। আসলে বিপণনের নিয়মকানুন তরিকা সে নিজেরই অজান্তে আঁদ্রের কাছ থেকে শুষে নিয়েছে। খোশামোদ করে না, নিজের ডাঁটে থাকে, কিন্তু সাধারণ ক্রেতাকে ছবির গুণাগুণ বুঝিয়ে তার মন গলাতে অদিতির জুড়ি নেই। আজকাল ছবি সম্পর্কে মানুষের একটা সচেতনতা এসেছে। অনেকেই ছবি কিনে ঘর সাজাতে চান। প্রিন্ট নয়, ক্রাফট নয়, মৌলিক ছবি, অথচ অত পয়সা নেই। এঁদের লক্ষ্য করেই সে প্রধানত তার বিপণন-পদ্ধতি ঠিক করে। কুসুম কানোরিয়ার মতো উদার খেয়ালি ধনী কমই আছেন। সব্বাইকার নজর ইনভেস্টমেন্টের দিকে।
কিন্তু তনিকা তা হলে সত্যিই তনিকা! নাম ভাঁড়ায়নি? মিথ্যে নামে ছবিতে যদি বা সই করা যায়, স্কুল-কলেজে তো চলবে না! এবং সে ঠিকই ধরেছিল—মেয়েটা খুবই খেয়ালি। এত খেয়ালি যে তার মাস্টারমশাইরাই তাকে পাগলি বলছেন। এবং অনোহিতা যে নাকি তার বাবা ও সৎমায়ের আশ্রয় থেকে বাউন্ডুলের মতো পালিয়ে বাপের বয়সি সিনিক এই শিল্পীর কাছে চলে এসেছে সে আলাদা মানুষ। তনিকা এবং তার ছবি ওই সময়টায় তাকে এমন অধিকার করে রেখেছিল যে ভাস্করদাকে অনোহিতার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অত লোকের মাঝখানে কী-ই বা জিজ্ঞেস করত! যা ঠোঁট কাটা লোক, বলতেই পারতেন আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি বন্ধুকন্যার আত্মনিবেদন নিয়েছি। সে মেয়েও সাবালিকা। তাতে তোমার বাপের কী?
তনিকা ও অনোহিতা আলাদা। অনোহিতা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সে স্বার্থপর, মেজাজি। আপাতত বাবা মাতৃবন্ধুকে বিয়ে করায় ক্ষুব্ধ, রুষ্ট। আর, তনিকা এগজিবিশনে ছবি দেয়, ভাল আঁকে খুবই, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী, পরীক্ষা দিয়েছে আর্ট কলেজে। খামখেয়ালি, পাগলি টাইপ। তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা এই মুহূর্তে জানা যাচ্ছে না, তবে বাড়িতে না বলে-কয়ে যখন সারারাত অন্যের বাড়ি থাকতে পারল তখন চূড়ান্ত বোহেমিয়ান, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কও আলগা। এবং …এবং যে ভাবেই হোক অনোহিতার সঙ্গে তনিকার সম্পর্ক আছে। কেননা অনোহিতার ডায়েরি তনিকার ব্যাগে। বই ছিল। বইয়ের ভেতর খুলে সে দেখেনি। ইশ্শ্ ওখানে কোনও ব্লু থাকতে পারত! ডায়েরিটা পেয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল।
কী আশ্চর্য! সে অদিতি সরকার, অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা তার জীবনে, মরছে নিজের জ্বালায় সে কিনা গোয়েন্দার মতো ক্লু সাজাচ্ছে দুটি অজানা মেয়ের পরিচয় ও তাদের সম্পর্ক জানবার জন্য!
এই সময়ে সে সেই জায়গাটায় পৌঁছোল। ডান দিকে গ্র্যান্ড, বাঁ দিকে ময়দান। ওই তো ঠিক ওই জায়গাটায় ফুটকি দাঁড়িয়ে ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার! তার অন্তরাত্মা ওকে চিনতে ভুল করেনি একটুও। ও একা, ও অন্য রকম, ও প্রাকৃতিক ঘটনা ও দৃশ্যাবলীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে, চায়, এবং ও নির্ভীক ও মৌলিক।
—তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন বউমা? শীলাদির নজর তীক্ষ্ণ। চা দিল। সুন্দর করে চিজ-ওমলেট ভেজে দিল। একটু মুড়ি দিল বাটিতে করে। —বাঁকুড়ার মুড়ি খেয়ে দেখো। ভাজা জিনিসের সঙ্গে মুড়ি খেলে অম্লদোষ কেটে যায়।
অদিতির জীবনে কোনওদিন শারীরিক অম্লদোষ ছিল না। ভাগ্যে ছিল অম্লদোষটা। কিন্তু তাকে যে কুসুমজি অত ফ্রেশ ট্রেশ বললেন, দেড়টার সময়ে? দেড়টা থেকে প্রায় সাড়ে আট। কুসুমজির বাড়িতে এ. সি তার গাড়িতে এ. সি। সে কেন শুকিয়ে গেল তা হলে? এত কী দুশ্চিন্তা দুটো পাগলিকে নিয়ে?
—কী বউমা, কিছু বলছ না যে? কিছু হয়েছে?
আজকাল আর শীলাদির বউমা ডাকে সে বাধা দেয় না। একটা ডাক তো শুধু! ও কী-ই বা বলবে? অদিতি? মা? মা-টা অবশ্য মাঝে মাঝে বলে। কিন্তু একটা সম্পর্ক ধরে কতদিন ‘বউমা’ ডেকেছে, এখন ওর জিবে শব্দটা এসেই যায়।
—না, কী আবার হবে? অনেক ঘোরাঘুরি করেছি তো!
—সে তো একশোবার। কোন সকালে সেই একমুঠো খেয়ে বেরিয়েছ।
অদিতি হাসল। ভালও লাগে, আবার এক এক সময়ে কেমন বিরক্তও লাগে। যেমন এখন। এত খবরদারি তার অনেকদিন অভ্যাস নেই।
—মা কেমন আছেন?
—আজ দুপুরবেলা তো খুব বুক ধড়ফড়। তুমি কোথায় জানি না। ‘বউমাকে ডাকো বউমাকে ডাকো’ করে হাঁপাচ্ছে। আমি প্রেসক্রিপশন দেখে ডাক্তারকে ফোন করলুম মোবাইলে। উনি ওষুধ বলে দিলেন।
—ছিল?
—হ্যাঁ, ঘুমের ওষুধ।
—তা তুমি তো দারুণ স্মার্ট হয়ে গেলে শীলাদি! নিজে নিজে প্রেসক্রিপশন দেখে নম্বর বার করা। বুদ্ধি করে মোবাইলে ফোন করা, এক্সপার্ট যে একেবারে!
শীলাদি বলল— এটুকু পারব না, বলো কী বউমা? কতদিন এই মানুষকে নিয়ে একলা একলা ঘর করছি বলো তো?
—তা ঠিক।
মাধুরীর ঘরে ঢুকল অদিতি। ঘুমটা ছেড়েছে। একটা কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। উনি জড়ানো গলায় বললেন— কে এলি? শীলা? দূর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে। তোর ও কালামুখ আমি আর দেখব না। আমারই খাবি আমারই সব্বোনাশ করবি…
ঘোরে আছেন। কথাগুলো আস্তে আস্তে আরও জড়িয়ে যাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখল শীলাদি থম মেরে দাঁড়িয়ে
আছে। চোখে জল।
—আরে দূর— ফিসফিস করে বলল অদিতি, ঘোরের মধ্যে রোগী অমন অনেক কিছু বলে থাকে। তুমি কি একটু ছাতটাত থেকে ঘুরে আসবে? আমি না হয় বসছি।
—মাথা খারাপ? সারা দিনের পর কোথা না কোথা থেকে ঘুরে এলে, এখন তুমি রুগি সামলাবে? ঘরে যাও, বিশ্রাম করো বউমা। আমার তো কোনও কাজই নেই। যাও। — একটু যেন জোর দিয়েই বলল শীলাদি।
* * *
বেড়াল দুটো কী বিশ্রী চিৎকার করে ঝগড়া করছে। রীতিমতো গর্জন। গোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ ফ্যাঁচ। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ গোঁ-ও-ও। দু’জনে দু’জনের শরীর তাক করে ঘুরে যাচ্ছে। দ্বন্দ্বযুদ্ধে টুদ্ধে যেমন যায়। কী বিশ্রী সবুজ চোখ। যেন সবুজ আগুন জ্বলছে। সবুজের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা থাকে, এদের সে বালাই নেই। সাদা রঙের বেড়ালগুলো আস্তে আস্তে রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে, আগুন রঙা, নীল শ্যাওলার পিচ্ছিলে থাবা রেখে ঘুরে যাচ্ছে। কই বেড়াল তো নয়! দুটো মেয়ে, চোখ-মুখ কিছু বোঝা যায় না। অস্পষ্ট, পোশাকটা বোঝা যায়, জিনস আর ঝোলা টপ। নন্দিনী বা চৈতালি যেমন পরে। কিন্তু ওরা অমন করছে কেন? যেন পরস্পরকে মারবার সুযোগ খুঁজছে। পেছন থেকে এক ঝাপটায় নিমগাছটা হুড়মুড় করে পড়ল। অদিতির ঘুম ভেঙে গেল। একটা প্লেন চলে গেল দমদমের দিকে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে আশ্চর্য হাওয়া দিচ্ছে, তারাদের উড়িয়ে নিয়ে অন্য কোনও মহাশূন্যে ফেলবে যেন। তখন এ আকাশ নক্ষত্রহীন— আদি অন্ধকারে রাত্রি থাকবে সম্পূর্ণ তামসী।
কী যে আবোলতাবোল দেখল, আর ঘুম আসছে না। শুয়ে শুয়ে ভেড়া গুনতে লাগল অদিতি। ভেড়াগুলো ক্রমে গাড়ি হয়ে যেতে লাগল, রকমারি গাড়ি, বড়, ছোট, মাঝারি, তারপরে সমস্ত আধো-জাগর চেতনা জুড়ে বৃষ্টি নামল। ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বাত্যায় বৃষ্টির ধারা, উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে…। অদিতি আর অপেক্ষা করে না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, পা টিপে টিপে স্টুডিয়োয় চলে যায়। অসমাপ্ত ক্যানভাসের পাশে আর একটা ছোট ইজেলে কাগজ আঁটে। অনন্য অভিনিবেশে এঁকে যায়, ভেজায়, টেনে নেয় গুলে নেয় জল রং, গড্ডলিকা এবং গাড়ি, গড্ডলিকা এবং গাড়ি এবং সবই বৃষ্টিতে মুছে মুছে দেয়। মাঠ, ঘাস, প্রাসাদ, সব। মোছা মোছা জলে, প্রায় প্রবহমান একটা মূর্তি, ফিগার সমস্তটাকে আলিঙ্গন করে জেগে থাকে দিগন্ত ছুঁয়ে।
ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। ঘুমের নেশায় চক্ষু লাল, হাত থেকে তুলি খসে পড়ে, টুলে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। টুলময় ছড়িয়ে থাকে বাদামি চুল। হাত দুটো দিয়ে মাথাটা ঘেরা। রাতপোশাক-পরা শরীরটা শিথিল, অথচ শিথিল নয়।
সাত
আজকে লেবেল সাঁটা হবে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, পাঁচটা সান্ত্বনা পুরস্কার আছে। ভাস্করদা ডেকেছেন। এখনও এগজিবিশন খোলেনি, শূন্য দরজা ও বন্ধ ঘরে একটা ছোট টেবিলের তিন দিকে তিনজনে একহাতে পেনসিল নোটবই ও হাতে।
কান্তিদা বললেন— অদিতি য়ু আর রাইট। ওই সিভিলাইজেশনটা জাস্ট একটা গিমিক। ওকে বাদ দিয়ে দাও।
—কিন্তু প্লেস তো দিয়েছিলেন প্রথমে! সেটা কেন? আপনার যুক্তিটা শুনি। নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছিলেন…।
—আসলে কী জানো? খুলেই বলি। আমার বন্ধুর ছেলে। মহা বদমাশ। কোনও দায়িত্ববোধ নেই, ধৈর্য নেই, গুণ একমাত্র এই আঁকার ক্ষমতা, ড্রয়িংটা খুবই স্ট্রং লক্ষ করেছ নিশ্চয়। ছেলেটা এমন যে কৃতিত্বের কোনও স্বীকৃতি না পেলেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বাপের ব্লাড প্রেশার বাড়াবে। তাই একটা থার্ড পোজিশন দিয়েছিলাম। আফটার অল টিচার তো আমরা। এদের ভাল-মন্দের একটা নৈতিক দায় থেকেই যায়। হি হ্যাজ গট আইডিয়াজ। এই গাঁটটা যদি পেরোতে পারে, ওর বাবা হয়তো ওকে কম্প্যুটার গ্রাফিকসের একটা চাকরিতে ফিক্স করতে পারবে। বাস, আমি পরিষ্কার সব বলে দিলুম ভাই। এবার আমি হাত ধুয়ে ফেলছি। তোমরা যা বলবে তাই হবে।
অদিতি অনেকক্ষণ পর ভাল করে হাসল। বলল—বুঝলাম কান্তিদা। আই আন্ডারস্ট্যান্ড য়ু পার্ফেক্টলি। কিন্তু একটা কথা ভাবুন, এর পরিস্থিতির বৃত্তান্ত আপনি জানেন বলে করুণাবশত আপনি ওকে একটা ফেভার করছেন। অন্যদের কার কী পরিস্থিতি তা তো আপনি জানেন না। আরও খারাপ হতে পারে।
ভাস্করদা বললেন— রাইট। ওই ফাঁকিবাজটা কিন্তু চালাক কম নয় কান্তি। ও জানে ও ফাঁকি দিয়েছে। ও বুঝবে তুমিই ওকে ওই থার্ড পোজিশনটা পাইয়ে দিয়েছ। হেনসফোর্থ ও সব সময়ে ফাঁকি দিয়ে জিততে চাইবে। অর্থাৎ তোমার ‘নৈতিক দায়’-এর যুক্তিটা খাটল না। ভাল করতে গিয়ে তুমি ছেলেটার ক্ষতিই করবে। আর সত্যিই ওর কিন্তু আইডিয়া আছে, ও কেন কমার্শিয়াল নিয়ে পড়ল না আমি জানি না। তুমি ওর বাবাকে এই কমার্শিয়ালের আইডিয়াটা দিতে পারো। এনি ওয়ে ওকে কি পাঁচটার মধ্যে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে? অদিতি তুমি একমাত্র এক্সটারন্যাল। তুমি না বললে আমরা পক্ষপাতিত্বের দায়ে পড়ব।
অদিতি বলল— ঠিক আছে। কী করা যাবে কান্তিদা আপনার মান আমি রাখছি। ও একটা কনসোলেশন পেতে পারে।
—আচ্ছা এবার অদিতি তোমার যুক্তি আমি শুনব, ওই ‘ফেলাইন’কে তুমি ফার্স্ট কেন দিলে?
—আপনাদের যদি মনে হয় সে মেরিট ওর নেই, তা হলে দেবেন না। অদিতি হাসি হাসি মুখে বলল, যদিও ভেতরে ভেতরে সে রাগে জ্বলে যাচ্ছিল।
—আহা চটছ কেন? ভাস্করদা বললেন— কান্তি তার ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করেছে। তুমি তোমারটা করো।
—টেকনিক ছাড়ুন। টেকনিক ছাড়িয়ে মেয়েটা একটা বিশুদ্ধ প্যাশনের জায়গায় পৌঁছেছে। ওর রঙের ব্যবহার, কনট্রাস্ট, তারপর ওই হুলো বেড়ালের ইমেজারি। ইট হ্যাড আ ট্রিমেনডাস ইমপ্যাক্ট অন মি। দ্যাটস অল।
—শেষ বিচারে অবশ্য ইমপ্যাক্টটাই আসল—কান্তিদা বললেন, আসলে এত যত্ন করে কষ্ট করে আমরা লাইন-ড্রয়িং, রং মেশানো, মেলানো, কমপোজিশনের হার্মনি শেখালুম। সব উলটে দিয়েছে গো!
—মানে আপনাদের কোনও ছাপ নেই, এই তো? অদিতি বলল —আমি তর্ক করব না— আমার যুক্তি আমি বলেছি। এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত। যতই এক্সটারন্যাল হই, আমার একার কথায় কিছু হতে পারে না, আমি সেটা চাইব না।
—ঠিক হ্যায়, ছবিটা হিস্টিরিক, কিন্তু পাওয়ারফুল। ওকে আমরা সেকেন্ড পোজিশনটা দিচ্ছি, কান্তি ঠিক আছে? তোমার ‘আড্ডা’ যেমন প্রথম ছিল, প্রথম রইল, খালি ‘সেপ্টেম্বরের মর্নিংটা’, চলে যাচ্ছে তৃতীয় স্থানে—কী কান্তি? অদিতি?
—অবশ্যই ঠিক আছে। অদিতির যুক্তি আমি মানছি। অদিতি ‘আড্ডাটা’ ভাল না?
—খুবই ভাল। এবার আমি যাই?
—খুশি হয়ে যাচ্ছ তো? কান্তিদা বললেন।
—দেখো আবার আমাদের নিন্দে কোরো না। —ছদ্ম ভয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী বললেন।
—ও হো, লেবেল সাঁটা হতে থাক, আর চারটে কনসোলেশন ঠিক করে ফেলি। অদিতি আর দশ মিনিট।
—প্লিজ কান্তিদা আমার ‘চিত্রভানু’ হাঁ করে বসে থাকবে। ওটা আপনারা ঠিক করুন। আমার সম্মতি রইল।
—তা হলে সইগুলো করে দিয়ে যাও।
—ও হ্যাঁ। আচ্ছা ওই ছবিটা আমি পেতে পারি কি? একটু ভেবে বলবেন।
দুই মাথা একত্র হয়ে ‘সান্ত্বনা’র ব্যবস্থা করছেন এই দৃশ্য দেখে অদিতি চলে এল। সে ভাস্করদার ব্যবহারে একটা অস্বস্তি লক্ষ করেছে। কে জানে, হয়তো কল্পনা হতে পারে। কিন্তু তার কেমন মনে হচ্ছিল— তনিকার ওপর উনি খুশি নন। মেয়েটার বৃহস্পতি কুপিত। নিজের মনেই হাসতে হাসতে ফিরল অদিতি।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ‘চিত্রভানু’র ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আবার অ্যাকাডেমিতে আসতে হল। ওদের দেখা উচিত। শৌনকরাও ছিল জনাচারেক।
ঢোকবার মুখে বাইরের কফি স্টলটা দেখে আহ্লাদি নন্দিনী বলল, —দিদি, কফি খাব।
—দেখছ না কী ভিড়, খুব দেরি হবে।
—কিচ্ছু না। আমি আর শৌনকদা যাচ্ছি। যেতে গিয়ে একটি বিরাট লম্বা-চওড়া ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল শৌনক। স্যরি বলে এগিয়ে যাচ্ছে। অদিতি শুনল— আই হেট ফুচকা। তোরা কী করে খাস বল তো!
—আরে ওই তো দাদফাদ চুলকে সেই হাতে আলু মাখে লোকটা, —মোটা ছেলেটা হে হে করে হেসে বলল— দাদ আবার অস্থানে কুস্থানে হয়, জানিস তো! তাতেই সোয়াদটা বেড়ে যায়।
—দু’-তিনটে হাত উঠে মোটা ছেলেটার ওপর আবোলতাবোল পড়তে লাগল, ছেলেটা হাসতে হাসতে মাথাটা নিচু করছে, ঘাড় গুটিয়ে নিচ্ছে। অদিতি একটু এগিয়ে গিয়ে বলল— তনিকা।
ডেনিমের মিডি-স্কার্ট পরা, লম্বা চুল জড়িয়ে হাতখোঁপা বাঁধা তনিকা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে বলল আ… আপনি?
—এই শৌনক, নন্দিনী, এদিকে এসো… তনিকা এরা আমার বন্ধু। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করাও। —অদিতি এমন করে বলল যেন কত দিনের চেনা। ভেতরে ভেতরে অবশ্য সে জাল পাতছে।
—এ-এ সুবীর, ও নয়না, এটা রাস্না, জগদীশ এদিকে আয়। এ-ই বাবুল…
সুবীর বলে মোটা ছেলেটি বলল— ম্যাডাম নমস্কার। আমরা আজকে একটা জিনিস সেলিব্রেট করছি। এবার উন্মাদিনী একটা মেডেল ঝেঁপেছে।
—তনিকা চেঁচিয়ে উঠল— খবর্দার বলছি সুবীর…
—আরে মাকড়াটা তোকে সেকেন্ড প্রাইজ দিল শেষ পর্যন্ত, ভাবতে পারিস? —ওহ্ স্যরি ম্যাডাম।
হাসি চেপে অদিতি বলল, আমি খাওয়াচ্ছি— কতজন আছ?
সুবীর বলল, উঁহু ওটি হবে না ম্যাডাম। খাওয়াব বলেছি খাওয়াব।
নয়না বলে মেয়েটি বলল— সুবীরের বাবার অনেক টাকা ম্যাডাম, স্মাগলার তো!… সব্বাই হা হা করে হাসতে লাগল, খালি শৌনকরা এবং তনিকা অপ্রস্তুত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কফি খাওয়া হতে, প্লাস্টিকের কাপগুলো জড়ো করতে করতে সুবীর জিজ্ঞেস করল, আপনার পরিচয়টা ম্যাডাম… ঠিক…
—আমার নাম অদিতি সরকার।
—অ-দিতি? ম্যাডাম আপনি কোন অদিতি? আর্টিস্ট?
শৌনক বলল হ্যাঁ, উনি অদিতি সরকার। তোমাদের এই কমপিটিশনটাতে এক্সটারন্যাল—
অদিতি বলল, আহ শৌনক। চলো ছবি দেখতে যাওয়া যাক।
একটু এগিয়ে পেছন ফিরে বলল— তনিকা, সুবীর তোমরা এসো! সে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না তনিকা আসে। ওকে সে আজ পাকড়াও করবেই।
যেহেতু অত বড় একটা দল ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছে, অন্যান্য আর্টিস্ট-ছাত্ররাও তুরন্ত এসে যোগ দিল।
—হু ইজ শি? রাস্না!
—অদিতি সরকার।
—সেই অদিতি সরকার? মানে অদিতি বোর্দো সরকার? এক্স?
—উঁহু অদিতি বোর্দোগুপ্ত সরকার, যিনি…
—ওরে বাবা। কী বলছেন অত?
—ওঁর ছাত্রছাত্রীদের এগজিবিশন দেখাতে নিয়ে এসেছেন।
এগজিবিশনে যারা ছবি দিয়েছে তাদের অনেকেই আজ উপস্থিত। ‘চিত্রভানু’র প্রাচীর ডিঙিয়ে তারা সেইখানে পৌঁছোতে চায় যেখানে ‘আড্ডার’ ফর্ম নিয়ে ‘পোট্রেট অব আ বেগার’ ‘মস্তানি’ ‘দা ফুড-লাভার্স’ প্রত্যেক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন, অন্যদের মন্তব্য শুনছেন, জিজ্ঞাসাবাদ করছেন অদিতি সরকার।
যে মেয়েটি এইমাত্র এসে পৌঁছোল, একটা বাটিকের র্যাপ অন আর ঝোলা গুজরাতি কাজ করা টপ পরে, যথেষ্ট উমনোঝুমনো হওয়া সত্ত্বেও সে বড় মুগ্ধকর। কীসে ঠিক যে তার এই লাবণ্যের চাবিকাঠি বোঝা শক্ত। চোখ কি? বড় বড় নয়, ভাসা ভাসা নয়, একটু বরং বসা-ই। চোখের চার পাশে একটা হালকা কালিমা। এই বয়সে এ রকম কালিমা স্বাভাবিক নয়। হয় মেয়েটি রাত জাগে, তা নয়তো সর্বক্ষণ পড়াশোনা করে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে, আর তা নয়তো চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা অনিয়মে সে নিমজ্জিত। আবার এ সবের কোনওটাই ঠিক না হতে পারে। অনেকের এ রকম থাকে। টিভি অ্যাডে চোখের কালি দূর করবার জন্য অনেক রকম অব্যর্থ মলমের খোঁজ পাওয়া যায়। কাগজেটাগজে কত রকমের সৌন্দর্য উপদেষ্টার কাম বেরোয়। শশা কিংবা আলু চাকা চাকা করে কেটে চোখের ওপর চাপা দিয়ে আধঘণ্টা শুয়ে থাকুন। তারপরে গোলাপজলে মিশ্রিত ঠান্ডা জল দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন জোরে ঝাপটা দেবেন না কিন্তু। চোখের ক্ষতি হবে। আলতো করে ধোন। বারবার করে। এ ছাড়া অ্যাপ্রিকট বেটে নিয়ে একের চার ভাগ মুসুরডাল বাটার একটা মিশ্রণ তৈরি করুন। সামান্য এক ফোঁটার মতো ডক্টর্স ব্র্যান্ডি মিশিয়ে নিলে ভাল হয়। এই মিশ্রণটি তর্জনীর ডগা দিয়ে আলতো করে চোখের চারপাশে লাগিয়ে দিন ঘুমোবার ঠিক আগে। গোলাপ জলে তুলো ভিজিয়ে বন্ধ চোখের ওপর চাপা দিন। দেখবেন আবার যেন ঘুমিয়ে পড়বেন না। আধঘণ্টাটাক পরে ঘুম আসার আগে তুলেটি খুলে ফেলুন। ঠান্ডা জলে ভেজা তুলো কিংবা নরম কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন। এবার শুয়ে চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর তর্জনী রেখে হালকা মাসাজ করুন। ক্লক-ওয়াইজ, অ্যান্টি ক্লক-ওয়াইজ।
মেয়েটি কি টিভি দেখে না? বিউটিশিয়ানদের কলাম, সুন্দর প্রসাধন-প্রজ্ঞাবতী অভিনেত্রীদের কলাম পড়ে না? আশ্চর্য! ওর কি পুরুষ নয়নের মুগ্ধ সম্পাতের লোভ নেই? আকাঙক্ষাময় কর্কশ আঙুল ছুঁয়ে যাবে ত্বক, চোখের ওপর নেমে আসবে কামাতুর চুম্বন! এই যে নারীজীবনের নারীরূপের একমাত্র সার্থকতা তা কি মেয়েটি জানে না? সবাই জানিয়ে দিচ্ছে, তবু জানে না?
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, খঞ্জন গতিতে। কয়েক পায়ে এগিয়ে এল জটলাটার পাশে। চাপা গলায় হিসহিস করে ডাকল—তনি! এই তনি!
প্রথমে শুনতে পায়নি, পরক্ষণে কোনও বন্ধুর ঠেলায় পেছন ফিরল তনিকা।
—আমার ডায়েরিটা দিয়ে দে।
এতজন মানুষ জমে আছে, তবু কোনও পরোয়া নেই।
—দিবি, না দিবি না?
—আমার কাছে নেই।
—নেই? লায়ার! —ঠিক একটা কেউটে সাপের মতো তনিকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটি। চড় মারছে, খামচে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে বলছে— নেই, না? দেখাচ্ছি কেমন নেই।
তনিকা প্রথমটা দু’ হাত তুলে নিজেকে আড়াল করবার চেষ্টা করল। তারপর সে-ও পালটা মার দিতে থাকল।
হতচকিত ভিড়ের মধ্যে থেকে সুবীর আর শৌনক দু’জনকে ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, অদিতি এগিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল— অনোহিতা, এটা মারামারি করবার জায়গা নয়।
এক হাতে তনিকার খোঁপা খুলে-যাওয়া চুলের গোছা। অনোহিতা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল। আর সামনে ঢোলা প্যান্টের ওপরে সাদা চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি গায়ে, অফ-হোয়াইট রঙের এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা দাঁড়িয়ে, মাথায় এলোমেলো বাঙালি-বাদামি চুল, একটু পুরু ঠোঁটে গোলাপি মায়া, কালো চোখে শান্ত বিদ্যুৎ।
সে যদি নাগিনী হয় এ তা হলে রানি নাগিনী।
পেছনে সভাসদবৃন্দ।
পশ্চাৎপটে খুনে লাল দুটো হুলো, চোখে সবুজ আগুন। পেছনে বেগুনি-গোলাপি সপ্তপর্ণীতে নিরাসক্ত আত্মস্থতা, কটকটে সবুজ নিয়ে উচ্চকিত অট্টহাসি।
পেছল শ্যাওলায় পা হড়কে যায়। অপার বিস্ময়ের চোখে মহিলার দিকে তাকিয়ে পিছু হটতে লাগল মেয়ে। তারপর এক ঝটকায় পেছন ফিরে চলে গেল, দুলতে লাগল অবিন্যস্ত চুল মাঝ-পিঠ পর্যন্ত। ঝুলতে লাগল কাঁধের বাঁধনি-কাজের ঝোলা।
আট
আমার যা খুশি করব। ইচ্ছে হলে খাব, নইলে খাব না, মদ খাব, বারে গিয়ে চুরমার করে দেব টেবিল-চেয়ার, লম্বা-ডাঁটির মদ-গেলাস, বোতল। গোপন ডিসকোয় যাব। উন্মাদ নাচব। তারপর হাশিস-সিগারেট ফুঁকে শুয়ে পড়ব, ড্রাগার্ডগুলো হামলে পড়বে। আমি খুলে দেব স্কার্ট, একটানে ছিঁড়ে ফেলে দেব ব্লাউজ। আর যেই হামলে উঠে আসবে কোনও খচ্চর, দেব এক থাপ্পড়। থাপ্পড়ের পর থাপ্পড়। থাপ্পড়ের পর থাপ্পড়। এই ট্যাক্সি, হেই ট্যাক্সি— হে-ই।
দরজা খুলে দমকা হাওয়ার মতো উঠে পড়ল সে।
—থামাচ্ছিলেন না কেন? মারমুখী প্রশ্ন।
—সুনা নেই।
—কানে কালা? চোখে কানা? হাতে-পায়ে বাত? ব্রেক চাপতে পা কনকন করে? ঝড়ের ঝাপটা।
—আরে এ ক্যা লড়কি? বদ্তমিজ! উতার যাও। উতার যাও—ঘ্যাঁচ করে ট্যাক্সি থামল হাজরার ধার ঘেঁষে।
অনেকটা পথ উড়ে এসেছে সে। মুখ লাল। ঘাম ঝরছে। কপালে কানে লেপ্টে গেছে চুল।
নেই জায়গা?
দাড়ি চুমরে সর্দারজি বলল— কিধর, ঠিকসে বোলো।
—তারাতলা রোড।
—উও তো জাদা দূর হ্যায়।
—তো কেয়া?
—জেব মে রুপেয় হ্যায় ক্যা?
রাগে কথা বলতে পারল না সে। অনেক কষ্টে পার্সটা সর্দারজির মুখের ওপর ছুড়ে মারবার লোভ সংবরণ করল।
দিল না? দিল না ডায়েরিটা? নেই ওর কাছে? আর কার কাছে যাবে? ঝোলা-মার হয়ে গেল নাকি? কবে কবে সে ভিড় বাসে, মিনিতে উঠেছিল? সাধারণত সে অটো চড়ে। মারমার কাটকাট করতে করতে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে যায় অটোগুলো। এমন ব্রেক কষে যে তুমি হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সামনের লোহার রডে ঠুকে যাবে মাথা। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে আলু। তারাবাজি। রোজই সে আশা করে নাক সোজা করে অটোটা কোনও মিনিফিনির সঙ্গে ধাক্কা লাগাবে। ড্রাইভার ফিনিশ, প্যাসেঞ্জার ফিনিশ, সে-ও ন্যাচার্যালি ফিনিশ। চেপটে যেতে কেমন লাগবে? সে কি বুঝতে পারবে? না তার আগেই হাওয়া গাড়ি!
এই যে অনেক লোক মরছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও, অর্থাৎ রীতিমতো ডজনখানেক মরণসঙ্গী পাচ্ছে সে—এই আইডিয়াটার একটা তীব্র আবেদন আছে তার কাছে।
কিন্তু মহিলাটি কে? একতাল কনকনে বরফের চাঁই যেন তার আর ওই বিশ্বাসঘাতকটার মাঝখানে নামিয়ে দিলেন! সে সেটা পার হতে পারল না। এ রকম তার হয় না। ও সব পার্সন্যালিটি ফ্যালিটি অনেক দেখা আছে তার। আসল কথা, ওসব কিছু নয়, অপরিচিতা মহিলার মুখে নিজের নাম শুনে হড়কে গিয়েছিল সে। কী করে জানলেন? যে-ই হোন উনি। অবভিয়াসলি ছবিটবিতে ইনটারেস্টেড। তনিই নিশ্চয় বলেছে তার কথা। একদম একপেশে একটা গপ্পো। স্পর্ধা কী! কিন্তু এমন কোনও মহিলার কথা কোনওদিন তনির মুখে কখনও শোনেনি তো? তনির হাড়হদ্দ তার চেনা। এমন কোনও কথা নেই যা তনি তাকে বলেনি। তবে তনি বলে অল্প কথায়, তার মতো উদগীরণ ওর হয় না। হয়তো কোনও সময়ে আভাসে-ইঙ্গিতে বলেছে। সে খেয়াল করেনি৷ বাঁ গলার কাছটা জ্বলছে, আঁচড়ে দিয়েছে রাক্কুসিটা। বড় নখ রাখছে নাকি আজকাল ন্যকাচণ্ডীগুলোর মতো! চেঞ্জ করে যাচ্ছে আস্তে আস্তে তনিকা। কে জানে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আন্টি-মাসির মতো হয়ে যাবে। ওই আরেক মহিলা! ওকে দেখে নেবে সে।
—তারাতলা তো মিল গিয়া। অব কিধর জানা! সর্দারজি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
—আর একটু। ততোধিক গম্ভীর গলায় উত্তর দিল সে।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট…ম্যারিন এঞ্জিনিয়ারিং….আই আই সি পি … বাস রোকো।
—মিটারটা গলা বাড়িয়ে দেখল, টাকাগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে গুঁজে দিল সর্দারজির হাতে।
—মিলা? আপকো রুপেয়া? রুপেয় দেখাতা হ্যায়! হুঁ।
—রইস লোগোঁকে বেটি ক্যা? তমিজ সিখো, তমিজ।
—দরজাটা দমাস করে বন্ধ করে নেমে দাঁড়াল। মুখ নাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে ঝগড়াটির মতো বলল—তুমহারা ক্যা? হাঁ? তুমহারা ক্যা?
হুস করে গাড়ি ছেড়ে দিল সর্দারজি।
চতুর্দিক থেকে উপদেশ বর্ষণ হচ্ছে। নাঃ। এরা পাগল করে ছেড়ে দেবে তাকে! গ্রিলের লোহার আংটাটা খুলে সে ভেতরে ঢুকল। ঘাস মাড়িয়ে গেল কিছুটা। ঘাসের ওপর লম্বা ঢ্যাঙা একটা খেঁকুরেপানা মূর্তি। স্কালপচার। ভাস্কর্য! হুঃ। ও রকম অনেক সো-কল্ড স্কালপ্চার তার দেখা আছে। ফুঃ! দু’ধাপ উঠে চাবি ঘোরায় সে। প্রথমে কোলাপসিব্লের তালা, তারপর দরজার চাবি।
ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। নতুন রংয়ের একটা উগ্র গন্ধ ঘরে। ছড়ানো কতকগুলো মোড়া আর একটা ডিভান। চটি দুটো পা থেকে ছুড়ে ছুড়ে কোণের দিকে পাঠাল। ঝোলাটা নামাল ডিভানের ওপর। তারপর পাশের ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই চোখ পড়ল আড় করে রাখা ইজেলটার ওপরে। দেওয়ালে ঠেস দেওয়া আছে, ছবি। গুটোনো, পাইল করা। ইজেলের ছবিটা খুব অদ্ভুত। সোজাসুজি ঝাঁপিয়ে আসছে একটা ন্যুড। মুখ কাঁধ, হাত দুটো, অর্ধেকটা বিশাল, ঝাঁপাচ্ছে তো! পা পর্যন্ত পুরো বাকি বডিটা ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে গেছে। হাতের পাতা দুটো এত বড় যেন এখুনি এসে গলা টিপে ধরবে। বুক দুটো মাটির দিকে মুখ, ঝুলন্ত। বৃন্তদুটো ডগডগ করছে রঙে। পার্পল মনোক্রোম ছবিটা। শুধু চোখের তারা আর স্তনবৃন্ত দুটো একটা অদ্ভুত দ্যুতিময় লাল।
ছবিটার দিকে জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে, তারপর ছুটে চলে যায় রান্নাঘরে, ড্রয়ার থেকে বার করে আনে আনাজ-কাটা ছুরিটা, তারপর এ কোণ থেকে ও কোণ চড়চড় করে কেটে দেয় ছবিটা। কাটাকুটি পুরো। ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা মাতাল মতো হাসি হাসে, ঢকঢক করে জল খেয়ে নেয় আধ বোতল, তারপর কোণের সরু তক্তপোশটার ওপর ঢেলে দেয় শরীর। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। খুব বিপজ্জনক কিনারে, প্রায় সিকি ভাগ ঝুলছে। চুলগুলো অর্ধেক মাথার পেছনে চেপটে, অর্ধেক ঝুলছে।
রাত আট-সাড়ে আট হবে, দরজার চাবির খুট শব্দ হল। দ্বিতীয় কেউ ঢুকল। চটি-পরা দুটো শক্তপোক্ত পা পার হল প্রথম ঘর। হা-হা করে আলো জ্বলছে একদিকে, বনবন করে পাখা ঘুরছে। মেয়েটা মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। স্কার্টের ঘের উঠে গেছে, পা দুটো প্রায় মড়ারই মতো। শুকনো চ্যালাকাঠ যেন। ঘুমোক। হা-ঘরের মতো ঘোরে দিনমান। পা-ভরতি মাথা-ভরতি ধুলো, ময়লা। ঘুমের মধ্যে মানুষের ত্বক শিথিল, মসৃণ হয়ে যায়, এর ত্বকে, ভুরুতে চিবুকে এখনও ভাঁজ।
রান্নাঘরে গেলেন। বেসিনে হাত ধুলেন। আধ বোতল জল রয়েছে, গলায় ঢাললেন আস্তে। ঝোলার থেকে একটা-দুটো প্যাকেট বার করলেন। প্লেট নামালেন দুটো। এক্ষুনি বার করবেন না। ঠান্ডা হয়ে যাবে। এখানে তিনি রোজ আসেন না। চাল-ডাল-আনাজপাতি-ডিম-পেঁয়াজ, চাও-ফাও কিনে রেখে যান। যা পারে রান্না করে খাক। কিন্তু যেদিন যেদিন আসেন ভাল জায়গা থেকে ভাল ভাল জিনিস কিনে আনেন। আজ এনেছেন বিখ্যাত দোকানের চিকেন বিরিয়ানি। ও মাটনটাই ভালবাসে কিন্তু তাঁর আজকাল রেড মিট চলছে না। সুগন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে। এবার ওকে তুলতে হবে। রান্নাঘর পেরিয়ে ফিরতি পথে থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের আবছা দিকটায় আড় করে রাখা ইজেলটার দিকে নজর পড়ল। বিস্ফারিত হয়ে গেল চোখ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রায় দুই লাফে পৌঁছে গেলেন। হতভম্বের মতো লাট খাওয়া ছিন্ন ক্যানভাস তুলে তুলে দেখছেন। ছেড়ে দিলেন, মুখ ফেরালেন। ক্রমে চোখে রক্ত ছুটে আসছে। চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললেন।
—কে কেটেছে? কে কেটেছে ছবি? বল হারামজাদি বল।
কালীর হাতে নরমুণ্ডের মতো ঝুলছে মাথাটা। আচমকা হ্যাঁচকা। কিছু বুঝতে পারছে না। টালুমালু চোখে তাকাচ্ছে। কোনওক্রমে চোখ ওপরে তুলে এবার স্থির হয়ে গেল। পলক পড়ছে না। ঠিক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো একটা ভয়াল মুখ।
—চুল ছাড়ো, ছাড়ো বলছি চুল। ছাড়ো,—কবজিতে আচমকা মারে ডান হাতের পাঞ্জার ধার দিয়ে। কারাটে শিখেছে নিশ্চয় কোনও এক সময়ে।
—এটা কী করেছিস? কেন?
—এ রকম জঘন্য করে আঁকবে কেন তুমি আমাকে? কেন? কেন? মাথা ঝাঁকিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে।
—কে বলেছে ওটা তুই?
—আমি জানি।
—চিনতে পারিস তা হলে? ওটা তোর ভেতরটা, ওয়াইল্ড, বুনো জান্তব—
—মুণ্ডু তোমার। তোমার মুণ্ডু! জন্তু কে? তুমি তো! তুমি তো! তুমি! কে আমাকে… সবলে মুখ চেপে ধরলেন।
—তুই কম নাকি? এইটুকু একফোঁটা মেয়ে, ছেনালিতে বেশ্যাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারিস! লজ্জা করে না!
লাফিয়ে উঠে সপাটে একটা চড় মারল, ঝাঁপিয়ে পড়ে, খামচে-খিমচে পাঞ্জাবি ছিঁড়ে…।
ফিরতি চড় এল একটা। গরম জল বেরিয়ে এল চোখ থেকে। পাগলের মতো রাগী কান্না কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
—তুমি আমাকে মারলে? মারলে…।
—আমার কী ক্ষতি করলি জানিস? একটা ফাইভস্টার হোটেলের লবির জন্যে আঁকছিলুম। অনেক টাকার কাজ।
—আরেকটা আঁকবে। আমি যেমন তেমন করে।
—তুই কেমন তুই জানিস?
—আমি সুন্দর। ইউক্যালিপটাসের পাতার মতো, আমার গায়ে ইউক্যালিপটাস গন্ধ, আমি নেপালি কুকরির মতো, বাঁকা, ঝকঝকে, বেজায় ধার, প্রতিপদের চাঁদ যেমন হয় তেমন যদি সূর্য হত আমি সে রকম…।
—থামলি কেন? বলে যা বলে যা…।
—যথেষ্ট বলেছি।
—এক কাজ কর, নিজেকেই নিজে আঁক তা হলে। আর একটা পুকুরের পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে, জলে নিজের ছায়া দ্যাখ। আমাকে এবার ছেড়ে দে। ওফফ।
তক্তপোশে শুয়ে পড়ে দুটো হাত জড়ো করে তার ওপর মাথা রাখলেন।
—স্যরি কাকু।
—ওই তো একটাই সভ্য কথা শিখেছিস জীবনে। ভেতরে কোনও সার নেই। তুই এবার বাড়ি ফিরে যা মিমি প্লিজ। আমি আর পারছি না। কী ভীষণ বদনাম হয়ে যাচ্ছে আমার জানিস?
—শিল্পীদের ও রকম একটু-আধটু বারদোষ থাকে। সবাই জানে। দুশ্চরিত্তির। যত বুড়ো হবে তত রস, যত বাচ্চা হবে তত লাল। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে একেবারে। …শয়তানির মতো হাসি হেসে বলল।
—এ সব কথা যে বলছিস, কিছু করেছি আমি তোকে? সে রকম কিছু?
—অন্য কেউ হলে পারতে। নেহাত কাকু কাকু ছোট্ট থেকে। চকলেট, লজেন্স… পুতুল ফুতুল… তাই আটকে গেল। তনিকা হলে আটকাত না। তনি, তনিকা!—হেসে উঠল। তেতো তির্যক হাসি।
পাশ ফিরে হাতে মাথা রেখে তাকালেন—আমার মতো একটা আধবুড়োকে নিয়েও তোর জেলাসি? আচ্ছা তো!
—আধবুড়ো সেটা স্বীকার করলে তা হলে? ধরনধারণ দেখলে তো মনে হয় নব-কার্তিক! লাল পাঞ্জাবি, কালো শার্ট, পাঞ্জাবির গায়ে কাঁথা কাজ গুর্জরি কাচ, নেহাত চুলটাই যা রং করোনি। নোয়িং ফুললি ওয়েল যে চুলগুলো সেক্সি। মেয়ে ধরতে, খদ্দের ধরতে কাজে লাগবে। ডিজাইনার পাঞ্জাবি, ডিজাইনার চুল।
চোখে সামান্য কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল, বললেন—খিদে পেয়েছে তো? খেয়ে নে। বিরিয়ানি এনেছি।
—খিদে পেয়েছে কিন্তু খাব না।
—কেন?
—মেরেছ কেন? খারাপ খারাপ কথা বলেছ, কান জ্বালা করছে আমার।
—তুই আমাকে মারিসনি? আঁচড়ে কামড়ে দিসনি? হাতে তোর দাঁতের দাগ বসে আছে। আর খারাপ কথা? তুই কী বলতে বাকি রেখেছিস? শোন, রান্নাঘরে যা। এতক্ষণে বিরিয়ানিটা ঠান্ডা হয়ে গেল। একটু গরম কর। তারপর দ্যাখ তোকে কেমন খাইয়ে দিই। আমি একটু বাইরে গিয়ে হাওয়া খেয়ে আসি। ওফফ্!
সদর দরজাটা লক করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পকেটে হাত দিলেন। মোবাইলটা নেই তো! কোথায় ফেললেন? কাছেই একটা ফোন বুথ, তিনি ছুটে গিয়ে কাচ-দরজা বন্ধ করলেন। নম্বর ঘোরাচ্ছেন।
—সর্বাণী! আমি ভাস্কর কথা বলছি।
অন্যদিকে নীরবতা।
—শোনো, ওকে লক করে রেখে এসেছি, গিয়ে খাব। খেতে একটু সময় লাগবে। তার মধ্যে চলে এসো, কুইক। নিয়ে যাও।
—কী করে?
—যে ভাবে হোক। আমি মরে যাচ্ছি। সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে আমার।
—বাঃ। নিয়ে যেতে পারলে একেবারে ছিনিয়ে, এখন তোমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে বলে আমাকে নিয়ে আসতে হবে?
—ওফ। আমার উপায় ছিল না। বোঝবার চেষ্টা করো। একটা সাবালক মেয়ে যদি নিরাশ্রয় হয়ে আমার স্টুডিয়োয় এসে হামলা করে কী করতে পারি বলো?
—নিরাশ্রয়?
—ওই হল। ও ভাবছে যে ও নিরাশ্রয়।
—আমি কী করে আনব ওকে? ওর বাবা আসুক। পুলিশ নিয়ে যাবে একেবারে…।
—পুলিশ নিয়ে কিছু করতে পারবে না। ও স্বেচ্ছায় চলে এসেছে সৎমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে—এমনটাই বয়ান দেবে ও। তুমিই বরং বিপদে পড়ে যাবে। এনিওয়ে কাল থেকে ও সত্যিই নিরাশ্রয় হবে। নতুন তালা কিনে চাবি দিয়ে যাব। ঢুকতে পারবে না। আমাকেও কোথাও খুঁজে পাবে না। তালা মেরে আমি একটা ওয়ার্কশপ করতে চলে যাব—বম্বে।
—কী বলছ সব বুঝতে পারছি না। একটা ক্রস কানেকশন হচ্ছে তখন থেকে। তোমার ফোনে।
—উহুঁ তোমার। হ্যালো হ্যালো করছে, রেখে দিতে বলছে। শুনুন, আপনি গোল্লায় যান। ছাড়ুন একটু ফোনটা। জাস্ট দু’মিনিট। তারপর যত খুশি বকম বকম করতে পারবেন।
নীরব হয়ে গেল তৃতীয় আওয়াজ।
—সর্বাণী শুনছ! মিমিকে নিয়ে যাও। আমি হেলপ করছি। ধরো যদি জলের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিই। এনিওয়ে ওর ট্রাংকুলাইজার লাগবেই। প্রচণ্ড হাইপার। কথা শোনো, ও ঘুমিয়ে পড়বে। তুমি গাড়ি নিয়ে আসবে। আমি তুলে দেব। সঙ্গেও যাব এখন।
—তারপর? ঘরে লক করে রেখে দেব? রাখা যায়?
—শোনো, ডাক্তার কনসাল্ট করো, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। উনিই বলবেন কী করতে হবে।
রেখে দিলেন, আর কথা বাড়াতে চান না। বাড়ালেই বাড়ে। কে ভেবেছিল, যে কিশোরী মেয়েটিকে মাঝেমাঝেই বাচ্চার মতো কোলে বসিয়ে আদর করতেন, কাকু-আদরের ছলে নরম তুলতুলে গালে, পিঠে, ঠোঁটে। শেষ পর্যন্ত নাভিতে এবং জানুতেও চুমো দিতেন সে এরকম ভয়ংকর দাবি নিয়ে একদিন ওলোটপালট করে দিতে চাইবে জীবন-ছক? এমন প্রিয় নকশা জীবনের? কিছুটা গৃহী, কিছুটা সন্ন্যাসী, কিছুটা দেহময়, কিছুটা মনোময়? চমৎকার ব্যালান্স ছিল একটা।
সর্বাণী ফোন নামিয়ে রাখছিলেন। ওদিক থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল—মিসেস সাহা রায়, আমি অদিতি সরকার বলছি। অনেকক্ষণ থেকে ট্রাই করছি, যদি বা পেলাম ক্রস কানেকশন…এনিওয়ে আমি হাল ছাড়িনি, লোকটি হুমকি দিচ্ছিল ছেড়ে দেবার জন্য… আপনাকে খবর দিই, অনোহিতাকে আমি দেখেছি। আজকে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ। আমার কাছে যে ছিল সে নয়। সেই মেয়েটির সঙ্গেই মারামারি করছিল। আচ্ছা ওর বয়স কত?
—তেইশ মতো।
—খুব ছোট তো নয়! দেখায় পনেরো-ষোলো। কিছু মনে করবেন না—ও কি স্বাভাবিক? দশ-বারো বছরের বাচ্চার মতো মারামারি করছিল।
—ওর হিস্ট্রি তো খানিকটা আপনাকে বলেইছি। তাতে যতটা স্বাভাবিক মনে হয়!
—আমি এখনও ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। খুব শিগগির বলব।
—তার আর দরকার নেই। উনি ফোন করেছিলেন মিমিকে উনি আর রাখতে পারছেন না। আমাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলছেন।
—মানে?
—উনি বলছেন—উনি কাল বম্বে চলে যাচ্ছেন। স্টুডিয়োয় তালা দিয়ে যাচ্ছেন। ও ঢুকতে পারবে না। আমি যেন নিয়ে আসি।
—ওই গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঘুমের ওষুধ-টষুধ… উনিই কথা বলছিলেন নাকি?
—উনিই। ভাস্কর চক্রবর্তী। এখন আমি কী করি বলুন তো! ওর বাবা বাড়ি নেই। আছে একটি সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে আর আমি। ড্রাইভার থাকে নীচে। একটা অত বড় মেয়েকে ধরে নিয়ে এসে আটকে রাখতে পারি?
—এত সহজে উনি দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেললেন?
—ও বলছে ওর দোষ নেই, মেয়ে যদি ওর কাছে গিয়ে থাকতে চায় ও কী করবে?
—বাঃ। এক কাজ করুন আপনি স্টুডিয়োর ঠিকানা আর লোকেশনটা একটু বলুন। আমি যাচ্ছি।
—আপনি… আসছেন?
—আপনি আমার হেল্প চাননি?
—হ্যাঁ কিন্তু এই এত রাতে!
—রাত-টাত কোনও ব্যাপারই না। আমি সারারাত জেগে কাজ করতে পারি। সারা রাত গাড়ি চালাতে পারি। বাট আই ওয়ন্ট দ্যাট স্কাউন্ড্রেল টু ফেস মি।
ফোনটা রেখে দিয়ে তার মনে হল কাজটা কি সে ঠিক করল? সত্যি কী করবে কীভাবে হেল্প করবে সর্বাণী সাহা রায়কে সে এখনও জানে না। খুব কঠিন সমস্যা। মেয়েটির, তার দ্বিতীয় মায়ের। কী ভাবেই বা ভাস্কর চক্রবর্তীকে শায়েস্তা করবে? খুব উদ্ভট উদ্ভট জিনিস তার জীবন ঘিরে। কিন্তু বলেছে যখন যেতে তো হবেই। ঠিক এই মুহূর্তে তার নাগালের মধ্যে কোনও জায়গায় হয়তো অন্য সমস্যা ধোঁয়াচ্ছে। প্রকৃতিটা এক না-ও হতে পারে কিন্তু। খুব খুব জরুরি। অন্য কেউ হয়তো সর্বাণী বা অনোহিতা সাহা রায়ের চেয়েও বেশি বিপদের মধ্যে। সে কিছু করতে পারছে না, কেননা জানে না। জানলে কি একসঙ্গে তিন-চার জায়গায় দমকল নিয়ে ছুটে যেত! দমকল নামটা তাকে রাজর্ষি দিয়েছিল। তোমার দোষ কি জানো বনি? ইউ রাশ টু টেক কেয়ার অব পিপল হু শুড বি এবল টু টেক কেয়ার অব দেমসেলভস। একে বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
রাত দশটা বেজে পাঁচ। তিন নম্বর আয়রনসাইড রোডে একটা বাড়ি। একজন মাত্র মহিলা। একটি ড্রাইভার আছে সহায়। তাঁর উপস্থিতি, অবস্থান এই বাড়িতে খুব অনিশ্চিত। স্বামী বিদেশে, তাঁর পূর্বপক্ষের তরুণী মেয়ে রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। এই রাতে খবর এসেছে, তাকে তারাতলার একটা জায়গা থেকে এক্ষুনি নিয়ে আসতে হবে। হিংস্র মেয়ে একটা। সবচেয়ে বেশি রাগ ওই মহিলারই ওপর। সে যখন জানে, যখন তাকে জানানো হয়েছে যাওয়া ছাড়া তার গতি কী।
অদিতি মোবাইলটা বার করে একটা নম্বর টিপল। যদি মোবাইল অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে থাকে, তা হলেই হয়ে গেল।
—শৌনক বলছি। কী ব্যাপার দিদি?
—আমার সঙ্গে তারাতলা রোডে একটি জায়গায় যেতে পারবি? এক্ষুনি?
—অব কোর্স। ঠিকানা দাও আমি পৌঁছে যাচ্ছি।
একবারও জিজ্ঞেস করল না—কেন, কী হয়েছে, এক পায়ে খাড়া একেবারে। এতটা আনুগত্য কেউ কারওর থেকে আশা করে না। কিন্তু পেয়ে যাচ্ছে সে। অদিতি শীলাদিকে ডেকে জানিয়ে দিল সে বেরোচ্ছে।
—এত রাতে?
—এখন, তোমাকে সবটা বোঝাবার সময় নেই শীলাদি। আসছি। সে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গাড়ি বার করল।
কেন? এত আনুগত্য! ছবি আঁকার জায়গা, পরিবেশ দিয়েছে বলে? তার বিনিময়ে মূল্যও তো সে নেয়! ছবি বিক্রি করে দেয়। খুব সফল মার্কেটিং করে। তার জন্যও একটা পার্সেন্টেজ পায় সে। সামান্য, তবু পায়। এই সবের জন্য কি? এর আগে একবার বাঁকুড়ায় যেতেও শৌনকের সাহায্য নিতে হয়েছিল তাকে। বেশ কতকগুলো ফরমাসি জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। তার প্রবল জ্বর। তখন সে টিকিট কাটতে দিচ্ছিল এজেন্টকে। শৌনক বলেছিল—দিদি তোমার ভাইর্যাল ফিভার, কোথায় যাবে? সব শুনে অনোয়াসে বলে দিল—অ্যাড্রেসটা দিয়ে দাও। আমি চলে যাচ্ছি। যাই হোক ছেলেটা বড় ভাল।
—শৌনক। রাস্তায় নেমে দাঁড়াও, তোমায় তুলে নিচ্ছি।
—দরকার ছিল না, জায়গাটা আমি বুঝতে পেরে গেছি, ওখানে ভাস্কর চক্রবর্তী বছর দুই হল একটা স্টুডিয়ো করেছেন।
—ওখানেই।
—আচ্ছা। তোমাকে ঘুরতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি— ফোন অফ হয়ে গেল।
আচ্ছা ছেলে তো? ভেবে দেখতে গেলে, ও থাকে বেহালাতেই। তারাতলা চলে যাওয়া ওর পক্ষে সোজা তবে এত রাতে যদি ট্যাক্সি না পাওয়া যায়? শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখন ট্যাক্সি যেতে চায় না। এ শহর এখন বিভীষিকা নগরী। প্রায়ই ট্যাক্সি চালক খুন হয়, ছিনতাই করে নিজেদের প্রয়োজনমতো গাড়ি ও ড্রাইভারকে ব্যবহার করে গুন্ডারা। যাক, একটা সমর্থ জোয়ান ছেলে সে যা-হয় একটা ব্যবস্থা করবে। সে বিরলযান পথ দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে ক্রমশই স্পিড বাড়াবার আনন্দ অনুভব করতে থাকে। আশুতোষ কলেজের পর থেকে শুরু করে পুরো চেতলা মাঝেরহাট ব্রিজ। দুর্গাপুর ব্রিজ গাঁটহীন। তারাতলায় হাঁড়ল হাঁড়ল গর্ত। একটাতে পড়ে হেঁচকি তুলে সতর্ক হয়ে যায় সে। বাঃ, জায়গাটা বেশ তো! গাছপালা, চওড়া রাস্তা, বড় বড় ইনস্টিট্যুট-বিল্ডিং।
লোকবসতি নেই যতদূর দেখা যাচ্ছে। অদিতির বিদেশি অভ্যেস। কখনও কাউকে রাস্তা বা ঠিকানার বিশদ বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করে না। দুটো রোড ম্যাপ আছে কলকাতার। তাই দিয়েই চালায়। সল্ট লেক, যোধপুর পার্ক, লেকটাউন, লেক গার্ডেনস এসব জায়গায় একটু অসুবিধে হয়। ওখানে পারলে সে আগে থেকে ল্যান্ডমার্কগুলো জেনে রাখে। এই তারাতলা রাস্তায় সে আগে কখনও আসেনি। জায়গাটা বেশ, আবার গাছপালার বাড়বৃদ্ধি তেমন নিয়ন্ত্রিত নয় বলে এই ঝুপসি রাতে একটু ভুতুড়েও বটে।
ওই তো শৌনক! একেবারে প্রায় মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে।
—দিদি! দিদি!
মসৃণভাবে গাড়ি থামায় অদিতি। শৌনকের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ফুটকি। প্যান্ট আর টপ। মাথার চুলগুলো ঘাড়ের কাছে পুঁটলি পাকানো।
এখনও অবাক হবার সময় পায়নি অদিতি। ছায়ায় দাঁড়ানো একটা কালো হন্ডা। কালো বলেই চোখে পড়েনি। সর্বাণী এগিয়ে এলেন।—আমি এই পাঁচ মিনিট হল পৌঁছেছি। এখনও ভেতরে ঢুকিনি। কীভাবে কী করব…
এত বড়সড় চেহারার দস্তুরমতো ব্যক্তিত্বঅলা মহিলাকে এমন উদভ্রান্ত দেখে, হঠাৎ অদিতির ভেতরে ভেতরে একটা রাগ হতে লাগল। এই পরিস্থিতিটা যে তৈরি হতে পারে উনি কি একেবারেই ভাবেননি? মেয়েটিকে তো উনি গোড়া থেকেই চেনেন! এ-ও আশ্চর্য, এই একুশ শতকে কত লোক বদলে যেতে থাকা সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে, অথচ অত্যাধুনিক পরিবারের একটি মেয়ে, নেহাত বাচ্চা নয়, সাবালক, নিজের পায়ে দাঁড়াবার বা বিয়েটিয়ে করার সময় হয়ে গেছে, সে বাবা আর মায়ের বান্ধবীর বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না?
পেছন থেকে তনিকা এসে দরজার বেলটা দিল। পরমুহূর্তেই খুলে গেল দরজা। ভেতরের আলো যেটুকু পাশ-মুখে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে উৎকণ্ঠিত।
—তুমি?
—হ্যাঁ, মিমিকে নিতে এলাম।
—আমি তো… মানে সর্বাণী…
—ওই যে। পেছন দিকে আঙুল দেখাল তনিকা।
সর্বাণী খুব থতমতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, শৌনক সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
—কে? সর্বাণী, ড্রাইভার বদলেছ?
সর্বাণী কোনও উত্তর দিলেন না। এরপর অদিতিকে দেখে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন লোকটি। মুখে কোনও কথা নেই।
আধখোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল সবাই। কেউই লোকটির মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। তনিকা বাঁদিকের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তক্তপোশের ওপর দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে অনোহিতা। সেই দুপুরের পোশাকে। ঘাম আর ময়লা বসে সমস্ত চেহারাটার ওপর একটা কালো ছাপ বসে আছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। বলল—কে এল কাকু?—জড়িয়ে যাচ্ছে গলা।
—আমি। মিমি আমি রে, দ্যাখ—তনিকা ওকে ঝাঁকাল।
হঠাৎ মাথাটা ঝাড়া দিয়ে চোখ মেলে দেখল ও—তনিকা, তুই?
—কাকু বুঝি তোকে…
—আরে তোর কাকু তোকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন অজ্ঞান করবার জন্য।
—কেন?—ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে— ও ফোকাস করতে পারছে না।
—যাতে তোকে তুলে এখান থেকে ফেলে দিতে পারেন! হোয়াট এলস!
—অ্যাঁ।
—তনিকা, এসব তুমি কী বলছ? হুড়মুড় করে এগিয়ে এলেন ভাস্কর।
—চুপ, ঠিক বলছি। আর একটাও কথা বলবেন না। তনিকা তর্জনী তুলল। তারপর বলল—মিমি আমার সঙ্গে আয়। অনেক চেষ্টায় তক্তপোশ থেকে মাটিতে পা নামাল অনোহিতা। কিন্তু দাঁড়াতে পারল না। শৌনক এগিয়ে গিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলে গেল। একবার মুখ ফিরিয়ে বলল—দিদি, কালো গাড়িতে তুলব তো?
—হ্যাঁ।
সর্বাণী বললেন— কী দিয়েছ ওকে? ওর তো চোখ উলটে যাচ্ছে দেখছি। কী দিয়েছ?
—তেমন কিছু নয়, ওর খাওয়ার অভ্যেস নেই তাই এফেক্টটা বেশি। তা ছাড়া একটু অ্যালহোকল…।
—এগুলো লিখে দাও কোনটা কত দিয়েছ…
—মুখে বলছি তো!
—না লিখে দিলে বোঝা যায় না—এই নাও। সর্বাণী নোটবুক বার করলেন একটা।
—লেখো, কী ওষুধ, কী পাওয়ার—
ভাস্কর লিখলেন।
—লেখো, অ্যালকোহল কী দিয়েছ, কতটা।
—সেটাও দরকার? ও তো রাতদিন খাচ্ছে।
—ঠিক আছে। এটা আমার জ্ঞাতসারে। জানতে চাই। লিখতে লিখতে ভাস্কর বললেন—ওই জন্যেই ও তোমার কাছ থেকে পালায়। অতবড় মেয়ে, খবরদারিটা ছাড়ো।
এখন লজ্জাটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। সর্বাণী বললেন—তোমার নামটা তলায় লেখো।
—আরে! কেন? কী আশ্চর্য!
—ধরো তোমার অটোগ্রাফ নিচ্ছি! এতবড় শিল্পী।
—ঠাট্টা করছ?
—ঠাট্টা করার অবস্থা আমার নয়, ভাস্কর। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার মেয়ের দায়িত্বটা আমার, সেটাই পালন করছি।
—তার জন্য সই?
—সইটা দিতেই বা তোমার এত আপত্তি কেন বুঝছি না তো!
কঠিন মুখ করে অদিতি এবার তাকাল—সর্বাণী বললেন, এটা তো ফ্যাক্ট যে তুমি এই জিনিসগুলো ওষুধ, অ্যালকোহল ওকে দিয়েছিলে, না কি?
—সে তো এখানে থাকতেও দিয়েছিলাম।
—বেশ তো যে পিরিয়ডটা ও এখানে থেকেছে সেটাও লিখে দাও।
—আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।
—বোঝবার আছেটা কী? আমাকে ওর বাবার কাছে জবাবদিহিটা তো করতে হবে। সে তো বলতেও পারে, সবটাই আমার মনগড়া।
—আচ্ছা গোঁয়ার তো! দাও সই করে দিচ্ছি।
খসখস করে কায়দার সইটা করলেন ভাস্কর চক্রবর্তী।
নোটবইটা তুলে নিয়ে সর্বাণী বললেন—ওর যদি কিছু হয়, কাঠগড়ায় কী করে তুলতে হয় তোমায়—আমি জানি।
বেরিয়ে গেলেন, পেছন পেছন অদিতি।
—অদিতি!
সে পেছন ফিরে তাকাল।
—তুমি বোঝবার চেষ্টা করো। কেসটা খুব কমপ্লিকেটেড। মেয়েটা একেবারে স্পয়েল্ট। ছোট্ট থেকে চিনি। বাবার বিয়েতে এত্ত আপসেট হয়ে গেছে…
অদিতি একবার তাকাল। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
এতক্ষণে তার সর্বাণীর প্রতি একটু শ্ৰদ্ধা হচ্ছে। যতটা ন্যাকা-বোকা দেখাচ্ছিল ততটা নয়।
সে বলল—এবার? সর্বাণীদি!
—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দিলে বোধহয় ছোট করা হবে আপনাকে, আপনি… আপনারা না থাকলে…
—এবার ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে…
তনিকা যাচ্ছে সঙ্গে। তনিকা ওর ভীষণ বন্ধু। যতদিন না সুস্থ হয় তনি থাকবে বলেছে। আশা করি সামলাতে পারব।
—কোনও অসুবিধে হলে আমি… আছি। অদিতি বলল।
গাড়িতে উঠে শৌনক বলল—দিদি, কেসটা কী? কিছুই তো বুঝলাম না।
অদিতি এবার সত্যিই একটু হেসে ফেলল—কেস তোরা যাকে বলিস—জন্ডিস।
নয়
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অদিতি ভাবল—আমি আছি। অসুবিধে হলে আমি আছি—এই বাক্যটা তার খুব চেনা-চেনা লাগছে। খুব চেনা। যেন অনেকবার শোনা। কে বলেছিল, কে? কাকে? তাকে কি? কিন্তু তার অসুবিধেতে তো কেউ ছিল না, কেউ নেই! তা হলে? তা হলে এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কে দিয়েছিল? সুদ্ধু একটা কথার কথা? জাস্ট? ওঃ হো। কথাটা সে-ই অসংখ্যবার বলেছে। তারই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে বাক্যটা। এইটাই তার সবচেয়ে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। কথার কথা হিসেবেও বলা নয়। সাধ্যমতো সে কথাটা রাখতে চেষ্টা করে। সেটাও আবার তার স্বভাব। অস্তিত্বের ভেতরে কোথাও একটা নিজ প্রজাতি আপামর মনুষ্যসাধারণের কাছে একটা দায়বোধ। যেন নিজে টিকে থাকার জন্যও। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যে মানুষের জ্ঞান, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রকৃতিবিরোধী হবার জন্য প্রচণ্ড প্রতিরোধ, তার ফলে নেমে আসে প্রকৃতির করাল প্রতিহিংসা। তার বিরুদ্ধে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে একটা পারস্পরিকতার সম্পর্ক চাই। এইটাই যেন জৈব মানুষকে ছাড়িয়ে ওঠা মনোময় মানুষের ভেতরের দায়। তারই ফলে একজন আরেকজনকে সাহায্য করে।
কিন্তু এই কথা সে কতবার বলেছে? কত যে অদ্ভুত-অদ্ভুত পরিস্থিতিতে! আঁদ্রে তাকে, তার বিবাহিত স্ত্রীকে ছাড়তে চাইছে না। তার বাবাও পণ করেছেন—এই বিয়ে নাকচ না হলে আঁদ্রে তাঁর সম্পত্তি পাবে না। বাবা প্রায় মৃত্যুশয্যায়, সমস্ত চলে যাবে—ভাগনের হাতে আর চ্যারিটিতে। মা কাতর অনুনয় করছেন। মায়ের অনুনয়টা তার কাছেও পৌঁছেছিল। মধ্যযুগীয় প্রায়। তবে তাঁর প্রস্তাবটা ছিল আরও অদ্ভুত। আঁদ্রে তাকে ডিভোর্স করে বাবার কাছে জিফ-সুর-ইভেৎ-এ চলে যাক। বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারটা চুকে যাক, বাবা মারা গেলে, ও আবার ফিরে এসে অদিতিকে বিয়ে করুক। মায়ের কোনও আপত্তিই নেই। একটা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্রোচ যাকে বলে। চালাকি? চালাকিই তো! ওর মায়ের কাছে ব্যাপারটা যত প্র্যাকটিক্যাল মনে হয়েছিল, আঁদ্রের অবশ্য তা হয়নি। সে ততদিনে অদিতিকে, তার মানবতার দায়গুলোকে বুঝতে শুরু করেছে। অদিতি শুধু বলেছিল—আমি তৈরি।
—আমি তৈরি নই!
—কিন্তু তুমি যদি আমার জন্যে এত মান সম্মান, বিষয়সম্পত্তি হারাও, একদিন না একদিন তোমার আমার ওপর রাগ হতে থাকবে আঁদ্রে।
—আমার প্রকৃতির সবই কি তুমি জেনে গেছ?
—তোমার নয়, সাধারণভাবে মানব প্রকৃতি। আমার সহজ বোধ। তোমার স্যাক্রিফাইসটা আমি বইতে পারব না আঁদ্রে।
—তা হলে মা যা বলছেন তাতেই তুমি রাজি?
—সে পরে দেখা যাবে। আগে তো ডিভোর্সটা করো।
—মানে? তুমি কথা না দিলে আমি ওদিকে যাবই না।
—আমি কোনও কথা দিতে পারছি না আঁদ্রে। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তুমি টাকাপয়সার লোভ করছ না, আমি জানি, কিন্তু তোমার মা-বাবার জিনিস সব বাবার বোনের ছেলের হয়ে যাবে—এইটা মেনে নিতে পারছ না। —কী ঠিক না?
আঁদ্রে আর্দ্র গলায় বলেছিল—তোমার চেয়ে বেশি আমায় কেউ বোঝে না।
—তা হলে ডিভোর্সটা নাও।
—তুমি কথা দাও আগে।
—পরে দেখা যাবে, বললুম তো, আমি তো আছি!
আঁদ্রে কী বুঝল কে জানে। ‘আমি তো আছি’র ভরসায় ডিভোর্স করে চলে গেল। পরবর্তী দশ মাসের মধ্যে আসতে পারল না। মেট্রোতেই তো চলে আসা যেত। কতটুকুই বা দূর! বাবা তো তাঁর গ্রামের বাড়িতেই রোগশয্যায় ছিলেন। বোর্দোতে তো ছিলেন না! কতগুলো কাতর চিঠি এসেছিল সে সময়ে, কিন্তু অদিতি ততদিনে অন্য ঠিকানায় চলে গেছে। বুকের ভেতর কী পাথর! কী পাথর! সমস্ত বুঝেও! আঁদ্রের তার প্রতি আন্তরিক টান বুঝেও। কেউ বলেনি সে সময়ে আমি তো আছি। ভেতর থেকেও কোনও ভরসার স্বর শুনতে পায়নি। বাবা-মা তো দুঃখিত ছিলেনই। কোনওদিনই আঁদ্রের সঙ্গে বিয়েটা সেভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের ডিভোর্সের খবর শুনিয়ে কষ্ট বাড়াতে সে চায়নি। এই অতি সাম্প্রতিক তাঁদের ফরাসি জামাই সম্পর্কে সহনশীলতাটুকু তৈরি হয়েছিল। এরই মধ্যে তাঁদের ধারণা সত্যি হয়ে গেল।
বাবার মৃত্যুর পর খুঁজে খুঁজে অদিতির ঠিকানায় হাজির সে।
—ঠিকানা বদলালে কেন?
—ওখানে থাকতে আর ভাল লাগছিল না। তার সংক্ষিপ্ত, সহজ উত্তর।
চুপ করে মুখ নিচু করে রইল কিছুক্ষণ।
—উনি ভাল আছেন?—সে জিজ্ঞেস করল।
—কে?
—তোমার বাবা!
—কেন? তুমি কাগজে পড়োনি? উনি চলে গেছেন। একটু থেমে বলল—শেষ পর্যন্ত। দাঁতে দাঁত চেপে বলা শেষ কথাগুলো। কী করা যাবে? শুধু রক্তের সম্পর্কের খাতিরে কোনও শ্রদ্ধা, কোনও ভালবাসা জিইয়ে রাখা যায় না। তিনি যদি ছেলের সুখের পথে এমনি অনৈতিক ব্ল্যাকমেল খাড়া করে থাকেন তো এই দাঁতে দাঁত চাপা আক্রোশ, তাঁর মৃত্যুতে সন্তানের এই নিষ্কৃতি বোধ তাঁর পাওনা। কড়ায়গণ্ডায়।
—অদিতি! আমি তা হলে নোটিশ দিই?
—র’সো র’সো। আরে বাবা হুট বলতেই তো আর সব হয়ে যায় না।
মুখটা রক্তহীন হয়ে গেল। এই ফরসা লোকেদের এইটাই মুশকিল। রক্তহীন হওয়া, রক্তবর্ণ হওয়া সমস্তই মুখের চামড়ায় ফুটে ওঠে। কিন্তু অদিতির দয়া হয়নি।
—তাড়াতাড়ি করতে আপত্তি কোথায়?
—তাড়াতাড়ির দরকারই বা কী?
আরও চেপে ধরলে সে বলেছিল—তোমার বাবার শর্তটা কিন্তু অত হালকা ছিল না আঁদ্রে। বোঝবার চেষ্টা করো। তিনি বিদেশিনীকে পছন্দ করতে পারেননি, নিজের সম্পত্তির বিনিময়ে তিনি তো আমার থেকে তোমার মুক্তিই চেয়েছিলেন! তিনি যদি তোমাকে অবিশ্বাস করতেন, তা হলে কিন্তু শর্তটা আরও কড়া হত। কোনওদিনই আমাকে বা তাঁর অপছন্দের কাউকে বিয়ে না করার শর্তটাও লেখা থাকত। তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। এক হিসেবে আমাকেও বিশ্বাস করেছিলেন।
—আমিও তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আঁদ্রে ক্রোধে কষ্টে আরক্ত হয়ে বলেছিল।
—আমি কি ভুল করেছিলাম তোমায় বিশ্বাস করে?
—না, তা নয়, নিজের অস্বস্তি গোপন করতে সে ঠান্ডা করা হোয়াইট ওয়াইন এবং মেওয়া নিয়ে এল।
কোনও কিছুই ছুঁল না আঁদ্রে।
—মা-ও কিন্তু…
—হ্যাঁ মা-ও। মা-ই। কী ভাববেন বলো তো আমাকে? সাগরপারের একটা নীতিজ্ঞানহীন মেয়ে যে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ভোগ করার লোভে মুর্মূর্ষ মানুষের সঙ্গে একটা চালাকি খেলেছে।
—মা তা ভাববেন না। আঁদ্রে ঘুঁষি মারল একটা টেবিলে। ছিটকে গেল কয়েকটা আখরোট। ছলকে গেল ওয়াইন।
—এবং সত্যিই যদি তা ভাবেন, তাতেও আমার, আমাদের কিছু আসে যায় না। যেতে পারে না। জীবনটা আমাদের। ভালবাসাটা আমাদের। ওঁর, ওঁদের নয়। ওঁদের ভাবনার জন্যে আমি আমার জীবন নষ্ট করতে পারি না। পারি কি?
—আঁদ্রে, তুমি জানো আমি কত অহংকারী। আমি যা নই, লোকে আমাকে তা ভাবলে আমার গায়ে ছ্যাঁকা লাগে।
—তবে কি আমাকে মায়েরও মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে?
অদিতি হতভম্ব।—তুমি বলছ কী? কী বলছ জানো?
—জানি। মা-বাবা আমার অতীত, তুমি আমার বর্তমান।
—কিন্তু ভবিষ্যৎ-ও কি? এ কথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।
—তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে একটা কথার খেলা খেলে যাচ্ছ অদিতি। এটাও চালাকি। এটাই আসল চালাকি। অন্যটা ছিল ভীমরতি ধরা এক বৃদ্ধকে ছেলে-ভুলোনোর প্রশ্ন। এটা, তোমার এই চালাকিটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এটা একটা সুস্থ, সবল, প্রেমিক স্বামীকে দূরে রাখবার চালাকি।
—এ চালাকি আমি করব কেন? অদিতিও তেতে উঠতে শুরু করেছে।
—কেন সেটা তুমিই ভাল বলতে পারবে। তবে শুনতে পাই রাজর্ষি গুপ্তার সঙ্গে তোমাকে খুব দেখা যাচ্ছে আজকাল।
—মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আঁদ্রে। রাজর্ষি আমার কলেজের বন্ধু।
—জাহান্নমে যাক তোমার কলেজের বন্ধু! রাজর্ষি মালকে আমার চেনা আছে। কত রাত কাটিয়েছ ওর সঙ্গে?
এক মুহূর্ত বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়েছিল অদিতি। তারপর খুব শান্ত গলায় বলেছিল, ইভেৎ নদীর ধারে ফিরে যাও কিংবা তোমাদের বোর্দোর রিফাইনারিতে বাবার সম্পত্তির অনেক বিলি ব্যবস্থা লাগবে, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।
সে ঠান্ডা পায়ে নিজের শোবার ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আঁদ্রের শত প্রার্থনাতেও আর দরজা খোলেনি।
কত ছোট ছোট কথায় কত বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মানুষ! কথা, কথা, কথার হুল সাংঘাতিক। অসহ্য বেঁধে, কিছুতেই ভুলতে দেয় না। বিঁধেই থাকে।
দরজা খুলে দিল শীলাদি। ঘুম চোখ।
—যাও শীলাদি, ঘুমোতে যাও।
—কারও কোনও বিপদ-আপদ তো নয়?
—নাঃ।
বিপদ-আপদ তো বটেই। কিন্তু শীলাদির তো জানবার দরকার নেই। এইসব সময়গুলোতে সামান্য বিরক্তি হয় তার। এই অনর্থক জানতে চাওয়া, এগুলো ভারতীয় অভ্যাস। তার মা হলে জানতে চাইতে পারতেন। কিন্তু শীলাদি কেন? ইশ্শ্। লজ্জায় জিভ কামড়ে ফেলল অদিতি। রুক্ষ, রূঢ় শোনায়নি তো তার ‘নাঃ’টা? রুক্ষ না হলেও রূঢ় তো বটেই। তোমার ব্যাপার নয়, তোমার শোনবার দরকার নেই। বিনা কারণে তো রাত দশটায় কেউ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় না! এখানে!
আমি কি একাচোরা, একালষেঁড়ে, দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছি? নিজেকে শুধোয় সে। বিছানার আশ্রয়ে এমন একটা স্বপ্নহীন অথচ বিক্ষিপ্ত ঘুম আসে যা অনেকদিন আসেনি। ভুরু কুঁচকে আছে। ভেতরে অনেক প্রশ্ন, জবাব চাই, জবাব দাও। তুমি কে? কেমন? কোনটা তোমার প্রকৃত অন্বেষা? তুমি যা যা করেছ সবই কি অন্যের ব্যবহারের প্রেক্ষিতে? প্রতিক্রিয়ায়? তোমার নিজের কোনও দায় নেই? সত্যি কি তুমি আঁদ্রের প্রতি একটা কৃপামিশ্রিত ক্রোধ হতাশা পোষণ করোনি? যখন দেখতে আঁদ্রে তার বাবা বা মায়ের চিঠি নিয়ে বসে আছে। মাঝরাতে উঠে বারবার টয়লেট যাচ্ছে। একটা হুইস্কি নিয়ে বসল, হঠাৎ কথার জবাব দিল না, শুনতেই পায়নি, তখনই তো তুমি বুঝেছিলে সে চিন্তিত, ভীষণ। চিন্তার কারণ বই কী! কিন্তু তার স্ত্রীর যদি তার প্রথম চিন্তা হত তা হলে তো ওই মাঝরাতে হুইস্কি নিয়ে বসাটা হত না। দ্বন্দ্ব? দ্বন্দ্ব কেন থাকবে? আমি অনেক ভালবেসে, বেশ দুরূহ কোর্টশিপের সিঁড়ি পার হয়ে বিয়ে করেছি। কেউ যদি দাবি করে তুমি তাকে ত্যাগ না করলে তার সম্পত্তি পাবে না, তাতে তুমি ভাববে? ভাববার কী আছে এতে? সিদ্ধান্তই বা কী! এমন নয় যে আঁদ্রে বোর্দো তুমি দরিদ্র ছিলে। দিব্যি শিল্প ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলে, কখন কোনটা বাজারে কাটে ভাল তা পর্যন্ত বুঝে ফেলতে শুরু করেছিলে। ‘ত্রোঁপ এস্প্রি’ অর্থাৎ মানসিক ধাপ্পা যাকে বলে। কে একটা ছোঁড়ার বুদ্ধি রোগা ও ব্রায়েন একটা ছোট ছেলেকে নানান তেল রং মাখিয়ে ক্যানভাসের ওপর দিয়ে টেনে নিচ্ছিল। সেটা যে বাজারে ধরবে তা তো তুমি বুঝে গিয়েছিলে, সে ছেলেটাকে কম তোলোনি। কাজেই তোমার অর্থকষ্ট ছিল না, আমি তখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নই, কিন্তু নিজেরটা তো নিজে চালিয়ে নিতে পারতুমই। মনে কেন দ্বন্দ্ব আসবে আদৌ?
—এইটাই ভেতরে ভেতরে ওয়ার্নিং বেল হয়ে বেজেছিল। এ যে ভাবছে! অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে! বারবার চিঠিগুলো পড়ছে রে! উত্তর দিচ্ছে, অদিতিকে পড়েও শোনাচ্ছে আবার—বাবা, এভাবে রি-অ্যাক্ট করাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। অদিতি আমার বিবাহিত স্ত্রী। তোমার উত্তরাধিকার পাবার জন্য আমি তাকে ত্যাগ করব? তা হয় নাকি? তা ছাড়া, অদিতি কত ভাল মেয়ে তা তুমি জানো না।
চিঠিটা তো এরকম হতে পারত: বাবা, অদিতি আমার স্ত্রী, তাকে কোনও কারণেই কখনও আমি ত্যাগ করব না। তোমার টাকা-পয়সা নিয়ে তুমি যা-খুশি করো গে যাও। মা?—ঠিক আছে, মা যদি আইনত কিছু না-ও পায়, আমি মাকে দেখতে পারব, কিন্তু আমি জানি—মা পাবেই। আর আমাকে এরকম চিঠি দ্বিতীয়বার লিখো না। মাকেও বারণ করে দিয়ে লিখতে।
কিন্তু চিঠি তো এসেই যাচ্ছিল, এসেই যাচ্ছিল। ফোন আসছিল মা’র কাছ থেকে। দীর্ঘ, অনুনাসিক ফোন! ঠিক আছে আঁদ্রে তুমি আস্তে আস্তে পোড়-খাওয়া ব্যবসাদার হয়ে উঠছিলে। তুমি শ্যাম কুল দুটোই রাখতে চেয়েছিলে। হয় না।
ব্যস সেই যে অদিতি তোমার মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধল, ঘুরতে-ফিরতে খচখচ করত! দুধটা টকে গেল। হতে পারে অহংকার। কিন্তু এটুকু অহংকার তো যে-কোনও আর্থিক স্বাধীনতাসম্পন্ন চিন্তা-কল্পনা-মেধা সম্পন্ন মেয়ের থাকবেই। তুমি তাকে কথা দিয়েছিলে ‘তুমি তো আছ।’ সে কথাটার খেলাপ তো তুমি করোনি! আঁদ্রেকে দ্বিতীয়বার গ্রহণ করা তোমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না, কিন্তু অন্য সব রকম সাহায্য তো তুমি করেছ! তার সালঁ সাজানো, ছবি বাছা, অকশনে যাওয়া, মার্কেটিংয়ে সাহায্য করা, যা থেকে তুমি নিজেও আজ মার্কেটিংটা এত ভাল শিখেছ। আঁদ্রে তোমার ওপর থেকে যদি ভালবাসা হারিয়ে থাকি, তা হলে তা কিন্তু আমার কৃপণতা নয়। কোনওখানে দোকানদারি ঢুকে পড়লে ভালবাসা দোকানদারিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আর ফেরে না। তোমার মুখের কথা ছিল—‘না।’ কিন্তু মনে মনে যে তুমি দ্বিধায় কম্পমান তা বুঝতে কি অদিতির বাকি ছিল? কাজেই ওসব কথাটথা নয়, চালাকিও নয়। যা একেবারে অন্তর্গত সত্তার সত্য তাকেই আমি স্বীকার করেছি আঁদ্রে। নিজেকে ভোলাইনি, তোমাকেও ভোলাইনি। আমি এটুকু আজ পরিষ্কার উচ্চারণে বলতে পারি আঁদ্রে, তোমাকে ধরে রেখেও আমি বিয়েটা বাঁচাতে পারতুম না। তুমিই নিষ্কারণে হারাতে আমার ওপর থেকে তোমার আকর্ষণ। সেই দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়বার আগেই সরে এসেছি। আর পরে জোড়া লাগানো? আমার দ্বারা হল না আঁদ্রে। দুঃখিত।
দশ
বাইরে ফটফট করছে সকাল। এ ঘরে এখনও পরদা-টানা ঠান্ডা অন্ধকার। এ সি চলছে, পাখা চলছে। ঘুমের মধ্যেই সাবধানে গরম জলে বাথ সল্ট মিশিয়ে স্পঞ্জ করিয়ে দিয়েছেন। হাত-পাগুলো থেকে ধুলো-ময়লা তোলা আরও কয়েক দিনের ব্যাপার। ড্রেস বদলে দিয়েছেন, সারা গা পাউডারে সাদা। ঠিক ওইভাবেই ঘুমোচ্ছে এখনও। পাশ থেকে সাবধানে উঠে এসেছে তনিকা।
—আন্টিমাসি!
—কী রে! উঠল?
—না।
—আর কতক্ষণ?—সর্বাণীর মুখে উদ্বেগের ছায়া।
—ঘুমোক না, যতক্ষণ খুশি।
—তা অবশ্য। ওষুধের এফেক্টটা পুরো কেটে যাবার আগে তুললে হ্যাং-ওভার থেকে যাবে। তখন খিটখিটোনি শুরু হবে।
—আমি একটু ঘুরে আসি!
—কোথায়? কেন?—ভীষণ ত্রস্ত হয়ে বললেন সর্বাণী।
—জামাকাপড় আনিনি তো কিছু! তা ছাড়া বোঝোই তো মিসেস উইলিয়ামস ভাববেন। শেষকালে ঢুকতে না দিলে বিপদে পড়ব।
—জামাকাপড় তো মিমিরই পরতে পারিস ক’দিন। আর উইলিয়ামসকে তো ফোন করে দিলেই হয়।
—ফোন করে দিলে বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। যা সন্দেহবাতিক! আগে একদিন হয়েছিল। সকালে ফিরতে ওয়ার্ডরোবের ভেতরে টাঙানো জামাকাপড়গুলো হিঁচড়ে হিঁচড়ে ফেলে দিতে লাগলেন।
—অত কীসের তনিকা। চলে আয় না এখানে, অসুবিধে কী তোর? আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হই।
—তা হয় না। আমিও পারব না। ও-ও না। জানো তো সবই।
হঠাৎ সর্বাণীর কানে বাজতে লাগল—অনোহিতা আমার কাছে আছে, আমার নাম অদিতি সরকার, ফোন—।
বললেন—আমিই ফোন করে দিচ্ছি বরং। তা হলে ভাববেন না। সত্যি এটা আমার আগে ভাবা উচিত ছিল।
তিনি নম্বরটি পেলেন। ওদিকে বেজে যাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে, তারপরে কণ্ঠস্বর শোনা গেল—মি. অ্যান্ড মিসেস উইলিয়ামস স্পিকিং। উই আর নট অ্যাভেলেবল জাস্ট নাও। লিভ ইয়োর মেসেজ… হ্যালো… পুরুষ কণ্ঠ। মানে মি. উইলিয়ামস।
—আমি মিসেস সাহা রায় বলছি। হ্যাঁ অনোহিতার মা। তনিকা আমার কাছে কালও ছিল, আজও থাকবে। ক’দিনই থাকবে। আসলে অনোহিতা খুব অসুস্থ। হ্যাঁ, মিসেস উইলিয়ামসকে বলে দেবেন। আমার শুভেচ্ছা জানবেন দু’জনে। তনিকার খেয়াল রাখার জন্য আপনাদের কত যে ধন্যবাদ দেব।
ফিরে দেখলেন তনিকা মুচকি মুচকি হাসছে।
—সুযোগ পেয়ে খুব তেল দিয়ে নিলে। এক যুগ প্রিন্সিপ্যালগিরি করে কী করে পারো আন্টিমাসি!
—আমার কপালটাই ওই রকম, সর্বাণী হেসে বললেন— অভিভাবকদের সঙ্গে, টিচারদের সঙ্গে ছাত্রীদের সঙ্গে সবার সঙ্গেই এইভাবে চলে এসেছি। না হলে তনিকা—অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, তারপর হঠাৎ বললেন—ক’দিন আগে আনসারিং মেশিন চালিয়ে ঠিক এই এক মেসেজ পেয়েছিলাম— অনোহিতা আমার কাছে আছে। ভাববেন না। আমি অদিতি সরকার, ফোন নং এই। মিমি কিন্তু ছিল না। উনি মিমি বলে কাকে ভুল করলেন বল তো!
—আমাকে, তনিকা মুচকি হেসে বলল—উনি নিশ্চয়ই আমার ব্যাগ ঘেঁটেছিলেন, মিমির ডায়েরি ছিল। তার থেকে যা নাম, ফোন নম্বর পেয়েছেন ফোন করে দিয়েছেন। ভাবলেন খুব একটা চালাক চালাক মুভ নিলাম। তা হলে ওই জন্যেই ওঁকে তুমি ডেকেছিলে?
—হ্যাঁ। তো ব্যাগ ঘাঁটতে হবে কেন? তুই কি ওঁকে তোর নাম-ঠিকানা বলিসনি?
—নামটা বলেছিলাম। আর কিছু বলতে চাইনি। আন্টিমাসি আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি বলব না। আর ভুলেও ডায়েরিটার কথা উচ্চারণ করবে না।
—বেশ। আমি আমার লক্ষ্মণের গণ্ডি জানি। বিষণ্ণ মুখে বললেন সর্বাণী।
—ওখানে তোকে ওরা কী ব্রেকফাস্ট দেয়?
—ওই ডিম কলা টোস্ট, টোস্ট ডিম কলা, কলা ডিম…
—কী খাবি?
—যা হোক।
—দুধ কর্নফ্লেক্স? ফ্রেঞ্চ টোস্ট, টোম্যাটো-চিজ অমলেট?
—এনিথিং। তোমার যেটা সুবিধে। খাবার-দাবার নিয়ে ফাস করতে আমার ভাল লাগে না।
এ-ও এক ধরনের লক্ষ্মণের গণ্ডি। সেকেলে মা-ই হন, আর এ-কেলে মা-ই হন, যখন ঘরকন্না করতে নেমেছেন, তখন কে কী খাবে, খেতে ভালবাসে জানতে চাওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। দু’-তিনটে বিকল্প যখন তিনি দিতে পারছেন, পারবেন বলেই তো দিচ্ছেন, বিশেষত অতিথি, কন্যাসম, যার কাছে স্বামীর মেয়েটির কাছেও যেমন, তেমনই নিজেকে প্রমাণ করবার দায় তিনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছেন। কিন্তু, এই, স্নাবিং খাচ্ছেন অনবরত। আন্টিমাসি হিসেবে, অর্থাৎ এদের জুনিয়র স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল এবং অনোহিতার মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সূত্রে যে শ্রদ্ধা ভালবাসা তিনি অনোয়াসে পেয়েছিলেন, অনোহিতার সৎমা হিসেবে তার সবটাই যেন ধূলিসাৎ। এই মেয়েটি, অনোহিতার বন্ধু, তাঁর যেমন শ্রীলা। এ-ও তাঁকে কথার থাবড়া মারে। অবশ্য শ্রীলা সর্বাণীর বন্ধুত্বের সঙ্গে অন্য কোনও বন্ধুত্বের, আগেকার বা আজকের, তুলনা হয় কি না, তিনি জানেন না। তাঁদের মধ্যে এতটুকুও ঈর্ষা, ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার ছিল না। তিনি হলেন সবল মেয়ে। শ্রীলা দুর্বল। শারীরিক ও মানসিকভাবে। বরাবর তিনি শ্রীকে রক্ষা দিয়ে এসেছেন। শ্ৰী উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে তাঁর কাছে। একটা সময়ে তাঁরা হোস্টেলে থাকতেন। শ্রীর বাবা টাটায় চাকরি করতেন, বরাবর মেয়েকে কলকাতায় রেখে পড়িয়েছেন। আর তাঁর বাবার সরকারি চাকরি ছিল। দু’বছর অন্তর নিয়ম করে বদলি৷ এই হোস্টেলই, হোস্টেল-জীবনই পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় কতটা পরিপূরক তাঁরা পরস্পরের। সে সময়ে তিনি অ্যাথলিট হিসেবে খ্যাত ছিলেন। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির গণ্ডিতে। শ্রী-ও ওই গণ্ডিতেই গায়িকা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। প্রত্যেকবার তাকে কলেজ-সোশ্যালে গাইতে হত, স্টেজে ওঠবার আগে বলত—দ্যাখ সর্বাণী, আমার হাত-পা কেন ঠান্ডা হয়ে গেছে। এদিকে কান দুটো গরম! কী গরম!
—যা তো ওঠ গিয়ে, চোখ বুজে গেয়ে দিবি।
প্রত্যেকটা গান উতরোত কিন্তু প্রত্যেকবার তার ওই একই রকম হাত-পা ঠান্ডা। তিনি আগুনের মতো ফরসা। দীর্ঘাঙ্গী, শক্তপোক্ত, তখন থেকেই চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ। আর শ্রী পাতলা, শ্যাম, অনির্বচনীয় তার মাধুর্য, তার লাজুক নম্রতা। তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের একটা ভুল ব্যাখ্যা সে সময়ে করেছিলেন হোস্টেলের সুপার। শ্রীর কথা তো ওঠেই না, তিনিও জানতেন না এ রকম হয়। হতে পারে। জ্ঞানোদয় হল সুপারের কথায়। দু’জনেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পরমূহুর্তেই শ্রী ধপাস। জল আন। বাতাস কর, ডাক্তার ডাক।
ডাক্তার আসতে তিনি সোজা সুপারের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন—ডক্টর মজুমদার, জেনে রাখুন এই ভদ্রমহিলা আমাদের দু’জনের বন্ধুত্বকে নিয়ে খোলাখুলি এমন বিশ্রী কথা বলেছেন, যে আমার মতো শক্ত নার্ভ স্পোর্টস-উওম্যানের মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল, আর শ্রীর কথা তো জানেনই, লো-প্রেশার, লো-শুগার, ভিতু, অত্যন্ত ভদ্র টাইপের মেয়ে। ডাক্তার সুপারের দিকে চেয়ে বলেন—মিসেস সিং আপনি যে এত বড় কথাটা টপ করে বললেন, আপনার হাতে কোনও প্রমাণ ছিল?
—এ টাইপগুলো আমার জানা। একজন পুরুষালি, একজন মেয়েলি।
—তা থেকেই এমন একটা কংক্লুশনে এসে গেলেন? বলতে পারলেন? লজ্জা করল না? আপনি জানেন না, এই বয়সের মেয়েদের, ছেলেদের মধ্যে খুব নিবিড় বন্ধুত্ব ডেভেলপ করেই থাকে। ইনসেপারেবল কাপল খুব দেখা যায়। কিন্তু তার মানে অত সরল সোজা নয়। তার জন্য জন্মগত প্রবণতা চাই। সুপার আছেন, এদের ভালমন্দের দিকে নিশ্চয় নজর রাখবেন। কিন্তু হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়া অনুমানের ওপর নির্ভর করে এসব…
জ্ঞান ফিরতে শ্রী বলেছিল—আমি আর তোর সঙ্গে এক ঘরে থাকব না সর্বাণী।
—কিন্তু তাতে তো ওই মহিলা জিতে যাবেন।
—কে জিতল না জিতল তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
—কিন্তু তাতে প্রমাণ হয়ে যায় যে ওঁর কথায় সত্যি ছিল।
—কী করে?
—তুই-ই ভাব।
শেষ পর্যন্ত নতুন আসা ফার্স্ট ইয়ারের একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ওরা থ্রি-সিটার করে নেয় ঘরটাকে। সেই মেয়ে গার্গী— এখনও ক্যালিফর্নিয়া থেকে তাঁকে চিঠি লেখে। শীলা হয়তো বন্ধুত্ব বাঁচাতে অতটা পটু ছিল না। তার মনের মতো, তার বিশ্বাসের যোগ্য হওয়া বড় শক্ত ছিল।
কিন্তু সেই জোর, সেই ব্যক্তিত্ব আজ কোথায় তাঁর? অতদিন, প্রায় পনেরো-ষোলো বছর অধ্যক্ষগিরিও তো করেছেন, বাচ্চারা মেনেছে, তাদের বাবা-মা’রা মিসেস সেনের ব্যবহারে খুশি, তাঁর কাছে অভিভাবকদের যতটা প্রশ্রয় ছিল, অতটা তো সাধারণত এসব স্কুলে থাকে না! বাইরে থেকে চেহারাটা যতই গম্ভীর জোরালো মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তো তা আর নেই তিনি! বাইশে বিয়ে সাতাশে স্বামীহারা সন্তানহীন। সেই সময়ে একদিকে স্কুল একদিকে মা, ক্যান্সারের রোগী নিয়ে তিনি কতটা ভেঙে গিয়েছিলেন সেকথা শ্রী জানত। শ্রী-ও তো এক হিসেবে তাঁর আশ্রয় ছিল। আবার শ্রীর স্বামী যে তাকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখে, মেয়েকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছে, অতিরিক্ত মদ্যে ও নারীতে ডুবে থাকে তা-ও তিনি জানতেন। একমাত্র তাঁকে, তাঁকেই শ্রীর স্বামী নবগোপাল কিছুটা শ্রদ্ধা-সমীহ করতেন। যে-কোনও বড় সিদ্ধান্তে তাঁর মতামত নিতেন। নবগোপালকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এমন একটা বিশ্বাস শ্রীর ছিল। বলত—কী জানিস, ও ভেতরে ভেতরে খুব দুর্বল, ইনসিকিওর, অনাথ ছেলে, খুব স্ট্রাগল করে এত উঁচুতে উঠেছে, আমার কাছ থেকেও তেমন কোনও জোর পেল না। তারপর একটু থেমে বলত—আমার জায়গায় তুই থাকলে ওর ভাল হত। সেই ভালটার কথা যে কত দিন কতভাবে বলেছে শ্রী।—মেয়েটাকে আমায় অবজ্ঞা করতে শেখাচ্ছে সর্বাণী, কীভাবে কথা বলে!
—ঠিক আছে আমি দেখছি—
—বাড়িতে মাতাল হয়ে ঢুকছে, লোকজন সব দেখছে, মেয়ে দেখছে… কী লজ্জা, কী চিন্তা সর্বাণী!
—ঠিক আছে আমি দেখছি…
—মোটে চোদ্দো বছর… মেয়েটা একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে বিশ্রীভাবে ঘুরছে। ওর বাবাকে বলতে গেলে বলে— সভ্য উন্নত দেশে চোদ্দো থেকেই ছেলেমেয়েরা যৌন-স্বাধীনতা পায়। এটা তাদের যৌবনোদ্গমের সময়। এখন তো নতুন পাওয়ার আনন্দ, শখ মেটাতে চাইবেই।
—আমি দেখছি।
সে সময়ে কিন্তু পেরেছিলেন। নবগোপাল একটু যেন ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতেই বলত—ছেড়ে দেব, আস্তে আস্তে সব ছেড়ে দেব, দেখো সর্বাণী। একটা রুগ্ণ, ভিতু, সিঁটকে থাকা, প্রাণহীন মহিলা যদি স্ত্রী হয় তা হলে মানুষের এই অবস্থাই হয়।
—ও-ও তো বলতে পারে নবগোপাল, একটা রুক্ষ, রূঢ়ভাষী, মদ্যপ মানুষ স্বামী হলে মেয়েদের এই অবস্থাই হয়!
—তা অবশ্য বলতে পারে। মানলাম। কিন্তু অত ভুগলে কি চলে? তুমিই বলো, বিয়ের অভিজ্ঞতা তো তোমারও আছে।
—ভুগছে সেটা কি ওর দোষ? ওর শরীরটাই ডেলিকেট। যাতে জোর পায় তার জন্য ডাক্তার-টনিক, সবার বড় শান্তি-টনিকের ব্যবস্থা করো। কী ব্যবহারই করো—দেখতে পাই না মনে করেছ নাকি?
—দেখো সর্বাণী, ওর শরীর ডেলিকেট, মন ডেলিকেট সেটা তো আমার দোষ নয়। আমি কেন তার জন্য ভূগব। আমি বাড়িতে যা না পাই, স্ত্রীর কাছ থেকে যা না পাই—তা অন্য জায়গায় পেলে আদায় করে নেব।
একটা ডোন্ট কেয়ার বারফাট্টাইয়ের মতো করে বলেছিল কথাগুলো। তিনি রাগে ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শ্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হত রোজই। যে সময়ে নবগোপাল থাকত না সেই সময়ে। দশ-বারো দিন পর দুম করে স্কুলে এসে হাজির।
—তুমি?
—কী হল হঠাৎ তোমার? যাচ্ছ না! বন্ধুর শরীর মন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা সব ভ্যানিশ?
তিনি চুপ করে কাজ করতে লাগলেন।
—তোমরা দু’জনে দু’জনকে বিয়ে করলে না কেন সর্বাণী? পার্ফেক্ট জুটি।
—আচ্ছা, সত্যি বলো তো তোমাদের মধ্যে কোনও লেসবিয়ান রিলেশন ছিল কি না।
ভেতরে ভেতরে চমকালেও তিনি অখণ্ড মনোযোগে কাজ করে যেতে থাকলেন।
—শনি-রবিবার সন্ধেগুলো যা হোক একটু খোলামেলা গল্পগুজব করে হাসি-ঠাট্টায় সময়টা কাটছিল। আর কাটবে না। উইকএন্ডগুলো ক্লাবেতেই… নবগোপাল উঠে পড়ল—আচ্ছা তুমি কাজ করো। আমি উঠি।
আর তখনই সর্বাণী বুঝতে পারলেন প্রথম, কোনও অজ্ঞাত কারণে নবগোপালের ওপর তাঁর একটা প্রভাব আছে।
অপারেশন থিয়েটারে ঢোকবার আগে শ্রী বলেছিল—স্বামী নেই, মেয়ে নেই, তুই শুধু তুই-ই আছিস আমার। সর্বাণী কেউ আমায় না চাইলেও আমি তো ভাবনা এড়াতে পারি না। মানুষটা অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে-তুই বাঁচা।
গেল, আর ফিরল না।
দু’বছর সমানে যাতায়াত করেছেন, শ্রীর সংসারটাকে একেবারে মাথায় করে রেখে দিয়েছিলেন। দিব্যি চলছিল সব, নবগোপাল বাড়ি আসছিল, মাতাল হচ্ছিল না, মেপে মেপে খেত, তিনিও একটু-আধটু খেতেন। আর মিমি? অনোহিতা! নামটা তাঁরই দেওয়া। অনেক ভালবেসে। জরথুস্ত্রীয় ধর্ম সম্পর্কে পড়তে পড়তে পারস্যের প্রাচীন সব দেব-দেবীর প্রসঙ্গে পেয়েছিলেন নামটা। অনোহিতা। জরথুস্ত্র-পূর্ব সময়ের দেবী। অনেকটা আমাদের সরস্বতীরই মতো। গল্প করছিলেন শ্রীর কাছে। তোর মেয়ে হলে নাম রাখব—অনোহিতা। দারুণ পছন্দ শ্রীর। তা সেই অনোহিতা মায়ের মৃত্যুর পর একটু তো সমঝেছিল। তাঁকে ভয়ও করত, মানতও আর ভালবাসত বলেই তো তিনি জানেন। কোনও জানাটাই সম্পূর্ণ নয় দেখা যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে বিয়ের পর খ্যাপা, উন্মাদ মতো হয়ে গেল। অথচ নবগোপাল যখন প্রস্তাবটা দিয়েছিল তখন ওদের দু’জনকেই বাঁচাবার, ওদের একটা ঘর দেবার তাগিদ থেকেই তো তিনি রাজি হয়েছিলেন। তাঁর নিজের দিক থেকেও কি একেবারে কিছুই ছিল না? একলা থাকতে কার ভাল লাগে! শুকনো জীবন কার ভাল লাগে? এ একটা গড়া সংসার, চেনা মানুষ, অনেকটা তাঁরই হাতে গড়া। একমাত্র নবগোপালের সঙ্গে নিভৃত সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁর একটা গূঢ় শুচিবাই ছিল।
—কী করে? প্রিয়তম বন্ধুর স্বামী যে!
—আমি আসছি যাচ্ছি। বেশ তো চলছে, চলুক না!
নবগোপাল অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেছিল—তুমি কি জানো সর্বাণী, গত পাঁচ-ছ’বছর শ্রীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না! আর পাঁচ বছরই বা কেন, সারা জীবন কতটুকুই বা পেয়েছি! আমার কি স্ত্রীর মতো স্ত্রী পাবার অধিকারও নেই?
খুব অপ্রস্তুত সর্বাণী। দ্বিধা কাটিয়ে বলেছিলেন—তোমার চরিত্র নিয়ে ও যা শুনত তাতে বিতৃষ্ণা আসাই সম্ভব।
—তুমি যদি আসো, শুনবে না।
—কথা দিতে পারো?
—হানড্রেড পার্সেন্ট।
—ড্রিংক, স্মোকিং?
—স্মোকিংটা তো তেমন কিছু ব্যাপার নয়, ড্রিংকটাই। ছেড়ে দেবার ইচ্ছে আছে। শরীর, অভ্যাস বাদ সাধে। আমি চেষ্টা করছি। করব।
—তোমার ওই উদ্ভুটে-বিদঘুটে ধারণাগুলো মেয়ের মাথায় ঢোকাবে না?
—দিস ইজ ডিফিকাল্ট। ঢুকিয়ে ফেলেছি যে! এখন উলটো আচরণ করলে ও … আমি জানি না—সর্বাণী চেষ্টাটা তুমিই করো। আমি হেল্প করব।
* * *
—তোরা আমাকে আনলি কেন?
পরদাগুলো সরিয়ে এখন যথেচ্ছ আসতে দেওয়া হচ্ছে পাকা আপেলের মতো সকালের রোদকে। একটা চেয়ারে বসে তনিকা একটা বই পড়ছিল। শুনতে পেল ক্ষীণ গলায়—তোরা আমাকে আনলি কেন?
তনিকা মুখ তুলে তাকাল—ফেরত যাবি? যা! অ্যালকোহলের সঙ্গে কড়া ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে বাড়ির থেকে বাইরে কোথাও ডাম্প করে দিচ্ছিল। নেহাত আমরা জানতে পারি তাই। যেতে চাস যা। আপাতত তালা ঝুলছে। ভাম বম্বে গেছে।
—কেন?
—মালা জপতে বোধহয়। কোনও হাই-টেক গুরুর কাছে মেডিটেশন শিখবে।
—এখানে আনলি কেন?
পাতা উলটিয়ে তনিকা বলল—এটাই তোর বাড়ি বলে। সবচেয়ে সোজা কারণ।
—এটা আমার বাড়ি নয়।
—তোর বয়সটা এখন আর বাও কি তেও নেই, এটা বুঝতে চেষ্টা কর।
—বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্টে হিয়ার।
—বেশ তো আমার ঘরে থাকবি? পার্ক সার্কাস? মিসেস উইলিয়ামসের গাউনচ্ছায়ায়।
—ওই ভদ্রমহিলা কে রে?
—কোনজন?
—ওই যে অ্যাকাডেমিতে আমার নাম ধরে ডাকলেন— অনোহিতা, এটা মারামারি করার জায়গা নয়।
—উনি একজন বেশ নামকরা চিত্রশিল্পী।
—উনি কী করে আমাকে চিনলেন?
—আন্দাজে।
—মানে?
—নিশ্চয়ই আমি ওঁকে কিছু বলেছিলাম যা থেকে ক্লেভার-গেস করে নিয়েছেন একটা।
—কতদিন জানিস ওঁকে?
—খুব অল্প, দু’-এক দিন!
—তারই মধ্যে আমার কথা নাম-ধাম বলে দিলি? বন্ধুত্বের মধ্যে একটা প্রাইভেসি থাকবে না?
—নামের মধ্যে প্রাইভেসি থাকে আমার জানা ছিল না। ওইসব ছোটা সাকিল, রাজু ভাই, আফতাব ভাই—এদের নামেতে অবশ্য থাকে। তুই ভেবে দ্যাখ তুই কোন শ্রেণীতে।
—তুই নিশ্চয়ই শিগগিরই বম্বে যাচ্ছিস!
—কে বললে? কেন? এবার আশ্চর্য হয়ে তনিকা মুখ তুলল।
—না, ওই ভাম যাকে বলছিস তার সঙ্গে ভাব জমাবার জন্যে, তোর কেরিয়ার, তোর ছবি, এগজিবিশন-টন, বিক্রি … সবই তো…।
—আমার এসবের জন্যে ভাম লাগবে না। তোর লাগতে পারে অবশ্য।
—কাকুর স্টুডিয়োতে তুই গিয়েছিলি—আমি জানি, আমাকে তোদের রাস্নাই বলেছে।
—যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে? আমার টিচার। তাঁর ছবি আঁকার প্রসেস দেখবার জন্যে তিনি যদি উদার আহ্বান জানান—প্রত্যাখ্যান করাটা কি ঠিক?
—তারপর ‘আ গলে লাগ যা—‘’
—মিমি, তোকে একটা কড়া কথা বলবার সময় হয়েছে। আমি তোর মতো সস্তা, মিন নই।
—আমি সস্তা? আমি মিন?
—মূলত না। কিন্তু যেভাবে চলছিস, তাতে লোকের এই ধারণাই হবে, আর ধারণা হলে লোকে ক্রমশ তোর সস্তামির মিননেসের সুযোগ নেবে। যেমন নিচ্ছে।
—ঠিক আছে আপাতত তোর কথাগুলো হজম করলাম। পরে উত্তর পাবি।—আপাতত বল ভাস্কর চক্রবর্তীর
স্টুডিয়োতে গিয়ে তুই কী পোজ দিলি!
—আমি কোনও পোজ দিইনি তো! তুই দিয়েছিস দেখলাম। দু’-চারটে চারকোল স্কেচ, ইংক স্কেচ, আমি নিজে ছবি আঁকি, মডেল নিয়েও এঁকেছি। কিন্তু তোর পোজগুলো আমার ভাল লাগেনি। আর পোজ, তোর ভাস্কর চক্রবর্তীর পোজও দেখলাম, বাথরুমে চান করতে ঢুকে বললে—তনিকা, আমার পিঠটাতে একটু সাবান ঘষে দেবে?
—তারপর?
—তারপর তো আমি আর জানি না! প্রচণ্ড বৃষ্টি আসছিল। রাগে পাগলার মতো হুড়মুড় করে বেরিয়ে যে বাসে পারলাম উঠে পড়লাম। এসপ্ল্যানেডে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম ভিজতে লাগলাম ভিজতে লাগলাম … সারা রাত ভাবতে লাগলাম ভাবতে লাগলাম … ভাবতে লাগলাম …
—কী এত ভাবলি?—ছোট একটু হাসি ওর গলায়।
—এই, তুই কোথায় চলেছিস … আমি কোথায় চলেছি … জীবন … পৃথিবী কোথায় চলেছে!
—এত ভাববার কী আছে! জীবন … পৃথিবী কিছুর ওপরই আমাদের কোনও কন্ট্রোল নেই। মাঝখানে একটা হাইফেনের মতো আমাদের জীবন। যে যেরকম ভাবে পারি এনজয় করব। এর মধ্যে ভাবনার জায়গা কোথায়?
—আমার মনে হয় ভাবনার আছে, তোর মনে হয় নেই— এটাই আমাদের তফাত। তোকে ভাস্কর চক্রবর্তী কোলে বসিয়ে চুমো খেল। তুই তার গলা জড়িয়ে ধরলি, আমাকে পিঠে সাবান ঘষতে বলল—আমি ঘেন্নায় অপমানে পাগল হয়ে গেলাম। … এখন মুখ-টুখ ধো, খাওয়া-দাওয়া কর। মনে হচ্ছে অনেকদিন কিছু জোটেনি।
—কে বললে? কালই সুলেমনের বিরিয়ানি খাইয়েছিল, ড্রিংকটার পরে। দা-রুণ। অনোহিতা ফিক করে হাসল।
রাগত চোখে, প্রায় অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে তনিকা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাইরে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে বলল— পঞ্চমীদি, মিমি উঠেছে ওর খাবারটা …
—কী খাবে?
—যা খায় সাধারণত, তাই দাও না! অত কী!
ট্রের ওপর সব সাজিয়ে দিল পঞ্চমী। ট্রেটা নিয়ে অনোহিতার ঘরে ঢুকল। মুখে ব্রাশ, নাইটিটা কাকতাড়ুয়ার জামার মতো ঢলঢল করছে, অনোহিতা বলল—যাগ, তুই হেঠেঠিৎ। ভয় করথিল হাবার টিনি না আঠেন। অর্থাৎ যাক তুই এসেছিস। ভয় করছিল আবার তিনি না আসেন।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ট্রেটা টেবিলে রাখল তনিকা।
মুখ-টুখ ধুয়ে তিনি এলেন—চোঁ করে দুধটা খেয়ে নিলেন— আঃ, ঠান্ডা দুধ, ভ্যানিলা দেওয়া—কতদিন খাইনি রে! তা নবগোপালের মিস্ট্রেসটি এখন কী করছে?
এক সেকেন্ড উত্তর দিতে দেরি হল তনিকার—ভাল করে চোখ ধুসনি মিমি। তোর বাঁ চোখে পিচুটি লেগে আছে!
—ইঃ খারাপ খারাপ কথা বলিস কেন? চোখে ময়লা বললেও তো বোঝা যায়।
—বেশ করেছি বলেছি, যে নিজের মাকে নবগোপালের মিস্ট্রেস বলে, তার চোখে পিচুটিই হয়, তার কানে খোল নাকে শিকনি।
—আর হাতে কুষ্ঠটা বললি না? ভুলে গেলি?
—সব মুখ দিয়ে কি আর অভিশাপ বেরোয়?
—তা মন্দ কী বলেছি? ও আমার নিজের মা কবে থেকে হল?
—তোর নিজের কথাই কোট করছি, নইলে সত্যিই তো নিজের মা নন।
—কোট? কী কোট?
—নিজের মায়ের ওপর তো নালিশের শেষ ছিল না তোর। সব সময়ে শুয়ে থাকে, একটা ভাল কিছু খাবার বানিয়ে দিতে পারে না। বাবা রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরলে কাছে যেতে দেবে না। আন্টিমাসি যদি আমার নিজের মা হত! — বলিসনি! আমার মাথার ক্যাসেট রিপ্লে করলাম। নিজেরটা রিভিউ করলে তুইও পেয়ে যাবি।
—বলেছিলাম বুঝি! তা হবে! আসলে তখন তো মাকড়সা জাল বুনছে—মাদিটা ধরা পড়েই আছে, মদ্দাটাও পড়ো পড়ো। কাজেই খুদে মাছিটার জন্যেই যত জাল। আর দ্যাখ তনিকা, মা সম্পর্কে ও রকম অনেক নালিশই ছেলেমেয়েরা করে, তার মানে এই নয় তারা মাকে ভালবাসে না। কেমন চালাকিটা করল? নবগোপালকে সরিয়ে দিল লন্ডন, মিমিরানিকে এক্সকার্শনে পাঠিয়ে দিল সুন্দরবন। কোস্ট ক্লিয়ার, এবার প্রাণের বন্ধু শ্রীর নাক থেকে অক্সিজেন-মাস্কটা খুলে নিয়ে প্রাণটা বেরিয়ে গেলে আবার পরিয়ে দাও। কম্নো ফতে! না কী বলে কেল্লা ফতে!
শুনতে শুনতে তনিকার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছিল। সে একটু পরে বলল— তুই যখন সেবার সুন্দরবনের বাঘ দেখতে গেলি— তখন তো একবারও তোর মুখে শুনিনি কেউ তোকে জোর করেছে। এমনকী মাসির অপারেশন হবে তা পর্যন্ত জানতাম না।
—ঠিক যেমন অপারেশনটার কথা জানতিস না, তেমনই মিমি দু’ দিনের জন্যে তো যাচ্ছিস, ঘুরে আয় না, আমি তো আছি— টাও জানিস না।
—তো তার থেকে তুই এই কংক্লুশনে এসে গেলি যে … তুই একটা রাক্কুসি মিমি। ঠিক একদিন তোর রাক্কুসিটা তোর চেহারার ওপর ফুটে উঠবে।
—ছবির ওপর ফোটে, আসল চেহারায় না, ‘ডরিয়ান গ্রে’ পড়িসনি? ‘পিকচার অব ডরিয়ান গ্রে?’ বলতে বলতে ওমলেট দিয়ে পাউরুটির টুকরো গেঁথে মুখে পুরল অনোহিতা।
—ও হ্যাঁ, তনিকা বলল— তোর রবি শাস্ত্রীকে আমি ছেড়ে দিয়েছি।
তাড়াতাড়ি পাউরুটিটা গিলতে গিয়ে বিষম খেল অনোহিতা। তনিকা জলের বোতল আনল।
—ছেড়ে দিয়েছিস?
—ধরিইনি কোনওদিন, ও-ই তনিকা তনিকা করে আসত, আমার ভাল লাগত ওকে। হ্যাঁ একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করেছি, কিন্তু যেদিন বুঝতে পারলাম ও তোর সঙ্গে ইনভল্ভড্ আর ঘেঁষতে দিইনি।
—তুই কি আরমানের কথা বলছিস?
—ইয়া। হু এলস্।
চোখ সরু করে অনোহিতা বলল— ও রবি শাস্ত্রী কবে থেকে হল?
আমাদের আর্ট কলেজের ছেলেরা ওকে তা-ই বলত। এই তনিকা, রবি শাস্ত্রী তোর খোঁজ করছিল, এই তনিকা কাল রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিলি— এই।
চোখ আরও সরু করে অনোহিতা বলল— ও আমার সঙ্গে ইনভল্ভড্ তোকে কে বলল? জানলি কী করে?
—ও-ই বলে থাকতে পারে!
—বলে থাকতে পারে? তার মানে বলেনি। তনিকা তুই? তুই?
—যে ভাবেই হোক জেনেছি। ব্যস, এরপর আর আমার সঙ্গে কোনও রকম বেয়াদবি করবি না। আমি আন্টিমাসি নই। সহ্য করব না।
ফোন বাজছে, তড়াক করে উঠে পড়ল অনোহিতা — বাপি, নিশ্চয় বাপি।
—বাপি আমি মিমি বলছি।
—মিমি কি তোমার ডাকনাম?
—হ্যাঁ। আপনি?
—আমার নাম অদিতি সরকার। তোমার বন্ধু তনিকা আমায় চেনে। তুমি ভাল আছ?
—ভাল থাকব না কেন?
—না, কালকে তোমাকে খু-ব খারাপ অবস্থায় দেখেছি তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
—কাল … আপনি … আমাকে ..
—ভাস্করদার তারাতলার স্টুডিয়োয়, রাত তখন প্রায় এগারোটা। একরকম অচৈতন্য ছিলে, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম।
—আ … আমি ঠিক হয়ে গেছি।
—আর একটু ভাল হয়ে ওঠো, তারপর একদিন তনিকা আর তুমি আমার স্টুডিয়ো ‘চিত্রভানু’তে আসবে, হ্যাঁ? নিমন্ত্রণ রইল। ঠিক আছে, রাখছি।
ফোনটা থপাস করে রেখে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল অনোহিতা।
তনিকা বলল— তুই কী করে ভাবলি তোর বাবার ফোন, আই.এস.ডির রিং ও রকম হয়?
—উনি … উনিও কালকে ওখানে গিয়েছিলেন?
—কে?
—অদিতি সরকার?
—হ্যাঁ, তা ছাড়া ওঁর স্টুডিয়োর আর একজন আর্টিস্ট শৌনক ভিভিয়ান বিশ্বাস। খুব প্রমিসিং …
—ও-ও?
—হ্যাঁ।
—কেন?
—তুই জানিস না মিমি কী মেস তুই করেছিস। চতুর্দিকে কী সাঙ্ঘাতিক স্ক্যান্ডাল?
ভাস্কর চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে ওঁর স্ত্রী ছেলে আন্টিমাসিকে দিনের-পর-দিন গালিগালাজ করেছেন। তোর সো- কলড্ কাকু—আন্টিমাসিকে রাত দশটায় ফোন করে বলেন— এ বেয়াদপ, বেহায়া ছুঁড়িটা আমার স্টুডিয়ো থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। আমার ওপর হামলা করছে, আমার জীবন, কেরিয়ার সব সর্বনাশ করে দিল। ওকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছি। তোমরা নিয়ে যাবে তো যাও। না হলে মাঝরাতের ট্রাক-ড্রাইভাররা তুলে নিয়ে যাবে। তা উনি কী করবেন—একা? তার ওপর এই তো রিলেশন করে রেখেছিস। উনি অদিতিদির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমার সঙ্গেও। অদিতিদি শৌনককে নিয়ে এসেছিলেন।
অনেকক্ষণ অনোহিতা বড় বড় চোখ করে শুনল। তারপর এক ছুটে বিছানায় গিয়ে মুখ গুঁজে আছড়ে পড়ল।
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তনিকা। পিঠটা কি কাঁপছে? কাঁদছে? না। সুদ্ধু মুখটা এই মুহূর্তে দেখাতে পারছে না। যাক লজ্জাটা তা হলে এখনও ওর আছে!
এগারো
আজ আর একটা ই-মেল পাঠাল সে রাজর্ষিকে। —মা আমার কাছে আছেন। কিন্তু ভাল নেই। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসো। শিগগির জানাও কী ঠিক করলে।
এই নিয়ে তিনটে চিঠি গেল। আগের দুটোর উত্তর পায়নি। তবে কি রাজর্ষি বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই? তা হলে তো এই চার-পাঁচদিনের মধ্যে তার এসে যাওয়ারই কথা!
—বউমা!
—বলো।
—মা তোমায় ডাকছেন।
তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। যতদিন এখানে আছেন মাধুরী গুপ্ত একদিনও কোনও অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। শীলাদি বুঝতে দেয়নি—বাড়িতে দু’জন অতিরিক্ত মানুষ, তার মধ্যে আবার একজন সংকটাপন্ন রোগী। এবং আশ্চর্যের কথা, চরম আশ্চর্যের কথা, কথাটা এক্ষুনি তার মনে হল, তার একদিনের জন্যও কোনও বিরক্তি, অভিমান … এসব হয়নি। এবং বাড়ি ফিরতে খুব ভাল লেগেছে। রোজ। রোজ। প্রকৃতপক্ষে আয়নায় কালকে নিজের চেহারাটা দেখে চমকে উঠেছিল সে। বেশ ফরসা ফরসা। একটু কি পুরেছে? বেশ সুন্দরভাবে চারিয়ে গেছে অতিরিক্ত মেদটুকু। ‘বউমা’ ডাকটাও কানে লাগে না আজকাল।
রাত মন্দ হল না। ন’টায় খাওয়া শেষ করে একটু ঘুরে ফিরে কম্প্যুটারে বসেছিল সে। মাতিস নিয়ে আদ্রেঁ দিল্লি আসছে। কলকাতাতেও আসবে সে ব্যবস্থা হয়েছে। অদিতিকে বাদ দিয়েই। মাধুরী দেবীর ঘর থেকে এ সময়ে আর কোনও সাড়াটাড়া পাওয়া যায় না। তার খাওয়ার একটু পরে শীলাদি এসে খেয়ে নেয়। অনেকদিন অদিতি বলেছে তারই সঙ্গে খেতে। শীলাদি এখন বুঝে গেছে একসঙ্গে খেতে গেলে এক জায়গায়ও খেতে হবে। অদিতির সঙ্গে এক টেবিলে চেয়ারে বসে ওভাবে খেতে অস্বস্তি আছে তার। তাই ঠিক সেই গোটানো কার্পেট আর মোড়াটার মতো খাওয়ার সময়টা নিয়েও একটু চালাকি করেছে সে। অদিতি সেটা মেনে নিয়েছে। জোরাজুরি করে শ্রেণীবৈষম্য কি সে ভাঙতে পারবে? শীলাদির মধ্যে? তার নিজের মধ্যে?
এ সময়ে তো ওঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা। অনেকদিন অবশ্য টেবিল ল্যাম্পের আলোয় শীলাদি কিছু পড়ে শোনায় ওঁকে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। যে দিন সে সারারাত ছবি আঁকে, দেখে তখনও অন্ধকার কাটেনি, ও ঘরে আলো জ্বলে উঠল। অর্থাৎ ওঠেন যথেষ্ট ভোরে। এই সকাল সকাল উঠে পড়া এ ওঁদের খোলামেলায় থাকবার দরুন অভ্যাস। বাঁকুড়ার বাড়িতে তেমন পরদার বালাই ছিল না। বিশেষত জানলায়। সকালে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আলো ঝাঁপিয়ে আসত। সকাল হয়ে গেল? উঠে পড়ে মুখটুখ ধুয়ে দেখে আরে সাড়ে পাঁচটা। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক। —উপুড় হয়ে শুতে শুতে রাজর্ষি বলত— জানলাগুলোয় একটু তোমার শাড়িফাড়ি কিছু টাঙিয়ে দাও না! উঃ। একটু ঘুমোতেও দেবে না এরা।
—মা ডাকছিলেন? নিজের মুখে নিজের মা-ডাক ফিরে গিয়ে নিজের কানে ধাক্কা দিল। অনেকদিন বলেনি। আজ খুব স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এসেছে।
—এসো, একটু বসবে?
—এই তো! শীলাদি বেরিয়ে গেছে। শীলাদির মোড়াটা টেনে নিয়ে সে বসল।
—বউমা, বলছিলুম কী শীলাকে একটু কলকাতার দেখবার শোনবার জিনিসগুলো মানে ধরো কালীঘাট, ভিক্টোরিয়া, দক্ষিণেশ্বর, মা কালীর ওপর খুব ঝোঁক ওর।
—কথাটা আমার আগেই মনে হয়েছে। কিন্তু নিয়ে যেতে হলে আমাকেই যেতে হয়। সে না হয় গেলুম। কিন্তু আপনার কাছে কে থাকবে? আমার এ লোকগুলো তো বাড়ি-বাড়ি কাজ করে বেড়ায়। ওরা তো সময় দিতে পারবে না। যদি বা দু’-চারদিন পারেও আমি ওদের ওপর নির্ভর করতে পারি না। আমি ভাবছিলুম … রাজর্ষি আসুক … তখন … চিঠি তো আজও আরেকটা দিলুম।
—আগেও দিয়েছ তো!
—হ্যাঁ আপনি এখানে আসার পরে চারটে দিয়েছি সবসুদ্ধ। প্রথমটার জবাব পেয়েছিলুম— যত শিগগির পারি আসছি। তারপর তো আর … মনে হচ্ছে ও নেই … কম্প্যুটার খুলছেই না। হয়তো স্টার্ট করে গেছে, দিন সাতেকের মধ্যে এসে যাবে।
—কী জানো বউমা, যে সাত বছরের মধ্যেও এসে উঠতে পারল না, সে সাত দিনের মধ্যে এসে পড়বে এ আশা আমি আর করি না।
অদিতি স্তব্ধ হয়ে গেল।
উনি বললেন— নাড়ির সুতো কেটে গেছে। তা ছাড়া … একটু চুপ করে থেকে বললেন— যে স্ত্রীয়ের সঙ্গে বেইমানি করে সে যে মায়ের সঙ্গেও বেইমানি করবে না— তার কী গ্যারান্টি আছে? বলো? … কী, বলো?
অদিতি আস্তে আস্তে বলল— আর যদি এসে পড়ে, তখন? তখনও কি এত অভিমানের কথা বলতে পারবেন?
—অভিমান টভিমান নয় বাবা, এ হল লোকচরিত্র জ্ঞান। আমি তোমাকে বাজি ধরে বলতে পারি রাজা আসবে না, ক’দিন পরে কোনও একটা খবর দেবে, কাজ পড়েছিল, কি অসুখ করেছিল … আসছি … আবার তুমি লিখবে … আবার জবাব পাবে না। … এই করতে করতে তোমার এখানে আমি শেষ নিশ্বাস ফেলব, তারপর হয়তো বাড়িঘর টাকাপয়সার বিলি-বন্দোবস্ত করতে আসতে পারে।
—এ কী বলছেন? কেন?
—কী বলছি! ওই বললুম— নির্ভুল লোকচরিত্র জ্ঞান। কোনওদিনই তোক চিনতে ভুল হয়নি আমার। আর কেন? —তোমার সঙ্গে যে বেইমানিটা করল তারপর বাবার বা মায়ের সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস হয়নি ওর। হবে না। উনি মারা যেতে চক্ষুলজ্জায় শ্রাদ্ধশান্তি করে গেছে। তখন তো আমার সঙ্গে মুখোমুখি বসবার দরকার হয়নি! সেটা আসা নয়। এবার এলে আসাও হবে, মুখোমুখিও হতে হবে।
—উনি মাধুরী গুপ্ত এই ধরনের কথা তাকে অদিতি সরকার, এক্স-বউমাকে বলবেন— এ কথা সে কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি।
মাধুরী বললেন— তুমি ভাবছ— বউ-কাঁটকি শাশুড়ি— এসব কী বলছে। তাই না? কী জানো অদিতি … প্রত্যেক মায়ের সাধ থাকে তার একটি মনোমতো বউমা হবে, পায়ে পায়ে ঘুরবে। মা বলে শ্রদ্ধা করে আদর করে ডাকবে। তো আমারও তেমন ছিল, তোমার সঙ্গে সে ছবি মেলেনি। তুমি ভাবো, একমাত্র ছেলে, বিদেশে প্রায় বলতে গেলে না-জানিয়ে এক সাহেবের ডিভোর্সি বউকে বিয়ে করেছে। আমি গ্র্যাজুয়েট ছিলুম হয়তো, কিন্তু তার মানেই যে খুব লিবার্যাল হয়ে গিয়েছিলুম তা কিন্তু কখনও নয়। ওটা তোমরা ভুল করো। তাই হয়তো গোড়ায় গোড়ায় একটু কড়া ছিলুম। তুমি তো মা মুখ্খু শাশুড়ির দিকে কোনওদিনও সেভাবে ফিরে তাকাওনি। বিদ্বান, পণ্ডিত, বিখ্যাত শ্বশুর— তাঁকে নিয়েই মগ্ন থাকতে। এখন বোঝো, তুমিও আমাকে কিছু দিতে পারোনি, আমিও তাই তোমাকে কিছু দিতে পারিনি। দোষ দিচ্ছি না, শোনো অদিতি তোমরা দেশ-বিদেশ ঘোরা বিদ্বান অশেষ গুণী মেয়ে, একজন সাধারণ গ্রাম্য গ্র্যাজুয়েট শাশুড়িকে তোমরা কী দেবে? কীভাবে কমিউনিকেট করবে? আমার তো কোনও রূপ গুণ ছিল না!
—মা, আপনি … আপনার সঙ্গে আমার জগতের অনেক তফাত ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মা-ও তো আপনারই মতো …
—কিন্তু তিনি তোমার নিজের গর্ভধারিণী মা, তাঁকে কি কেউ এভাবে দেখে? তাঁর সঙ্গে কমিউনিকেশনে কোনও বাধা। হয় না! কিন্তু শোনো মা, আমি তোমাকে চিনতে ভুল করিনি। যতদিন গেছে তত বেশি করে চিনেছি। দায়িত্ব, কর্তব্য, শত মানসিক কষ্টেও অবিচলিত থেকে নিজের কাজ করে চলেছ দিনের-পর-দিন…বাইরের জগৎকে কোনওদিন বুঝতে দিলে না…দু’ দুটো লোক তোমার সঙ্গে কত বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! আর আজকে যে লোকটা তোমার অনুপস্থিতিতে তোমারই বন্ধুকে নিয়ে নিজের ঘরে তুলেছে দিনের-পর-দিন … তারপরে লজ্জাকরভাবে ধরা পড়ে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়েছে, তারই মাকে দিনের-পর-দিন … দিনের-পর-দিন … মাধুরী দেবীর গলা বুজে গেল কান্নায়!
অদিতি হাতটা রাখল ওঁর মাথার ওপর, সে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল— মা আপনার শরীর ভাল নয়। এখন এত কথা বলবেন না।
—তুমি কি আমাকে মাফ করলে?
—যে অপরাধ আপনি করেননি, তার জন্য আপনাকে মাফ করার প্রশ্ন উঠছে কেন?
—জানি না। নিজের ভেতর অপরাধবোধে আমি দিনের-পর-দিন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছি মা। তার বাইরের প্রকাশটা ভাল হচ্ছে না, বুঝেও আমার কিছু করার ছিল না। কিন্তু আমি সারা জীবনে তোমাকে যত ভরসা করেছি, আর কাউকে ততটা করিনি … তোমার শ্বশুরকেও না।
—আচ্ছা, অনেক হয়েছে মা, আপনি এবার চুপ করুন … আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড়ুন।
একটু ছটফট করলেন। অনেক সংকোচে তার হাতটা মাঝে মাঝে ধরলেন তারপর নিবিড়ভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন।
শীলাদিকে ডেকে দিয়ে বাইরে চলে এল অদিতি। চাঁদের আলোয় ভুতুড়ে হয়ে আছে তার উঠোন, নিমের পাতা কেমন চলকাচ্ছে, সপ্তপর্ণী তার পাতার অঞ্জলিতে যেন চাঁদের টুকরো ভরে ভরে রাখছে। তলায় যে শ্যাওলা তা বোঝা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্না সবকিছুকে অলৌকিক করে দিয়েছে। একদিক থেকে দেখতে গেলে ভূতুড়ে, যাকে বলে অকাল্ট, যেন মরজীবনের ঠিক ওপারে যে একটা অশরীরী স্তর আছে, সেটাই যতদূর সম্ভব দৃশ্যমান হয়ে ওই উঠোনটায় পড়ে রয়েছে এখন, অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে অদিতি একটা ছায়ার জগতে চলে যেতে থাকল। সেখানে কখনও রোদ ওঠে না, আলো জ্বলে না, কোনও স্পষ্ট আকার নেই কিছুর, জেলির মতো অর্ধতরল কিছু পদার্থ বয়ে যেতে যেতে এক একটা ফর্ম নেয়। আবার ফর্ম ভেঙে আর একটা, আর একটা। তরঙ্গ উঠছে ছায়ার, তরঙ্গ ভাঙছে, কী এসব? কারা? আমাদের সঙ্গে কী সম্পর্ক? অদিতি বুঝতে পারল সে আজ ঘুমোতে পারবে না। স্টুডিয়ো-ঘরের দরজা খুলল। তালা খোলার একটা শব্দ হল, ভেতরে ঢুকে দরজার দিকে ফিরে দেখল, মায়ের ঘরের দরজায় শীলাদির ছায়া। আওয়াজ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। অদিতি আজ বিরক্ত হল না। শীলাদির সাদা কাপড়ের ওপরও টুকরো টুকরো চাঁদ। নানান বিভঙ্গে। মাথাটা অন্ধকার, অথচ ধড়টা আছে। কবন্ধ। ঘর বন্ধ করে দিল অদিতি। ফ্রেমে আটকাল একটা কাগজ, তার ওপরে ফেভিকল লেপে দিল কোথাও পাতলা কোথাও মোটা করে। অনন্যমন। সমর্পিত ঘোরে ফোটাতে লাগল ছায়ার জগৎ, সেই ছায়ারা যারা নিজেরাই বোঝে না নিজেদের প্রকৃতি, বারে বারে গতি বদলায়, গাঢ়তা বদলায়, আকার বদলায়। বদল শুধু বদল, কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়, নির্দিষ্ট নয়।
ভোরের আলো এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে আলো আরও উজ্জ্বল হয়, আরও উজ্জ্বল, ছায়ারা মিলিয়ে যেতে থাকে, অলীক মরীচিকা-প্রতিম মনে হয়। সমস্ত ঘর ঝলমল করছে। রোদের একটা তির্যক কিন্তু নরম রেখা এসে পড়েছে ঘরের মাঝখানে। অদিতির পেছন ফেরা চুল, ঘাড় পিঠ বেয়ে ভেঙে যাচ্ছে রেখাটা। তুলি নামিয়ে রাখল। সময় লাগেনি বেশি, সারারাত, এগারোটা থেকে পরদিন সাতটা। সাতটাই কি? আট ঘণ্টা। অনেক সময়ে আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রায় কোনও কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে কোনও বিমানবন্দরে এতক্ষণই বসে থাকতে হয়। শুকোক। এবার সে বুভুক্ষুর মতো ঘুমোবে।
* * *
—শৌনক একটা কাজ করে দিতে পারবি?
—শিয়োর। বলো।
শৌনক ভিভিয়ান লম্বা লিকলিকে একটু আলগা আলগা হাত-পায়ের ছেলে। কাটা কাটা চোখ-মুখের, কিন্তু অবয়বগুলো এমন যেন কাচের, শক্ত করে ধরলে ভেঙে যাবে। কিন্তু ওই কাচের মতোই নিরেট তার শক্তি, সহবৎ। রীতিমতো পেশিদার ছেলে। আসলে ওর প্রধান ভালবাসা ছিল—ভাস্কর্য। পাথর, ব্রোঞ্জ নিয়ে কাজ করতে করতে নিজেই শক্ত ধাতুর হয়ে গেছে। একমাথা চুল, খুব এলোমেলো থাকে। ভাস্কর্য বিকোয় না চট করে। সময়ে সময়ে ফরমাশি কাজ করে, কাজে সহায়তা করে, ছবিই আঁকছে আজকাল। ওর ছবিতে ভাস্কর্যের প্রকৃতি পুরোপুরি বজায় থাকে। কিন্তু ভাস্কর্যই ওর প্যাশন। বেচারা তাই অস্থির থাকে একটু।
—কাজটা কিন্তু খুব আনইনটারেস্টিং।
—কেন? আবার কোনও খুকিকে ভাস্কর চক্রবর্তীর স্টুডিয়ো থেকে তুলে আনতে হবে নাকি? হাসি চিকচিক করছে কালো মুখে। হাসতে গিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল অদিতি। কী যেন? কে যেন? এই রকম, কালো, চাঁদ চিকচিক? ওঃ হো। ও তো সেই সেদিনের ছবিটা! এই মুহূর্তে শৌনকের অকাল্ট ধরা দিল দিনের আলোয় তার চোখে। সেদিন সে দেখেছিল শীলাদির কবন্ধ। এইভাবেই দেখতে দেখতে কোনও-না-কোনওদিন আয়নায় ধরা পড়বে তার অন্ধকার, তার নিজের অকাল্ট।
—কী বলছিলে দিদি!
—বলছিলুম কাজটা খুব আনইনটারেস্টিং।
—ঠিক আছে। বলোই না।
—আমাদের বাড়ির শীলাদিকে দেখেছিস তো?
—ওই তোমার শাশুড়ির কম্প্যানিয়ন?
—হ্যাঁ তাই। ওকে একটু দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় ঘুরিয়ে আনবি? উইক-এন্ডে, ধর শনিবার, কি রবিবার।
—অসুবিধে কী? রোববার হলে তো ভালই হয়।
—আমার খুব খারাপ লাগছে। তোর ছুটিটা…আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?
—কী?
—ধর তুই একা কেন? তুই, কাজল, নন্দিনী যে ক’জন যেতে চায় একসঙ্গে শীলাদিকে নিয়ে চলে যা। একটা গাড়ি ভাড়া করে দেব।
—তোমার গাড়িটা কি এনগেজড্ থাকবে?
—না। কিন্তু আমার তো ড্রাইভার নেই।
খুব লজ্জিত, সংকুচিত হয়ে শৌনক বলল—আমার কিন্তু ড্রাইভ করতে খুব ভাল লাগে। পারি-ও ভাল।
—তাই?
—অন্যের গাড়ি চালাতে চাওয়া উচিত নয়। কেউ দেয়ও না। তবু বলে ফেললাম, তোমার ইচ্ছে না থাকলে কিন্তু সংকোচ করবে না, স্পষ্ট বলবে।
—ইচ্ছে নেই শৌনক রিয়ালি, কিন্তু তুই একদিন চাইছিস…
—তোমার জেনটা যা স্লিক না? লোভ লাগে। প্লিজ দিদি।
—ঠিক আছে নিয়ে যা। কিন্তু তা হলে তোকে নিয়ে চারজনের বেশি না। আর সাবধান। তুই কত দিন চালিয়েছিস?
—আরে অনেক দিন। এখনও চালাই। জেঠুর গাড়ি তো জেঠু সব সময়ে ড্রাইভ করতে পারে না আজকাল, চায় না। আমাকে ডেকে নেয়।
—ঠিক আছে।
বাঁ হাতের পাতায় ডান হাতের ঘুঁষি মেরে শৌনক চেঁচিয়ে উঠল—ইয়ে-এ-এ।
—কী হচ্ছে?
—বাঃ, টেলিভিশন শেখাচ্ছে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, শিখতে হবে না?
অদিতি হেসে ফেলল, ফাজিল, তোর বয়স কত?
তোমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোট।
—ইয়ারকি! ফক্কুড়ি!
—সত্যি বলছি দিদি। স্পিরিট। আসল কথা স্পিরিট, তোমার থেকে একটু, জাস্ট একটু কম।
আসলে, অনেক ভেবে এই সমাধানটাই বার করতে পেরেছে অদিতি। মাধুরী চান না অদিতি শীলাকে নিয়ে ঘোরে, অদিতিও ওঁকে ঠিকে লোকেদের ভরসায় রাখতে পারবে না। অথচ শীলাদির মুখ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এ জন্মে বোধহয় আর মা কালী হল না!
বারো
উইলিয়ামসদের বাড়ির মেজানিনে বসে আকাশের দিকে অব্যক্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটি। ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে মনে হয় তার কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু চুল আর গাত্রত্বক নিয়ে একটু আছে মনে হয়। ছোট্টখাট্টো, পাঁচ ফুট বড় জোর। মাথার প্রচুর চুল শ্যাম্পু করা, মাথায় তোয়ালে বাঁধা। মুখে বোধহয় একটা কোনও প্যাক লাগিয়েছে।
মিমিকে নিয়ে ক’দিন যা গেল! কবে যে মেসো আসবেন। ইতিমধ্যে পাগলটাকে ধরে রাখতে পারলে হয়। আপাতত এত অপুষ্টিতে ভুগছে, শরীর এত দুর্বল, হাঁউ হাঁউ করে খাচ্ছে খালি। তার ওপর তনিকা ওকে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বলেছে—মিমি তোর চেহারা এত খারাপ হয়ে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড, তোকে একটা ভিখিরির মতো দেখাচ্ছে।
সে তো দমবার মেয়ে নয়, বলল—বেগার মেড? তাদের স্কুল পাঠ্য ছিল টেনিসনের এই ন্যাকা ন্যাকা কবিতাটা। ভিখারিনি এসে দাঁড়াল, তার রূপে রাজসভা আলো হয়ে গেল। রাজা তাকে নিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।
—রাজা মানে কতকগুলো গ্ল্যামারাইজড লোচচা। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই লাল ঝরবে, সিংহাসনে বসাল না আরও কিছু—কোলে বসিয়েছিল বোধহয়। ভিক্টোরীয়গুলো আবার কোলটোল শব্দ উচ্চারণ করতে লজ্জা পেত।
—না, না বেগার মেড নয় রে একেবারে কলকাতার রাস্তার ধারে, ফ্লাই-ওভারের তলার ভিখিরি। সত্যি কথা বলতে কী মেয়ে না ছেলে তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
—ইয়ারকি?
—সত্যি। আয়না দ্যাখ! নিজেই দ্যাখ না!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ টেনে টেনে, গালের চামড়া টেনে টেনে দেখল।
—কী কালি! খসখসে কালো লাগছে।
—খসখসে নয়, বলে খসকা। খসকা কালো, ভুসকো কালো!
—কী হবে? আমি কি লুম্পেন হয়ে গেলাম?
—তুই কিছুদিন বিশ্রাম নে। একদম এই দারুণ গ্রীষ্মের রোদ গায়ে লাগাবি না। কিপ ইনডোর্স। ভাল করে খাওয়াদাওয়া কর। শরীরের যত্ন নে, আর মিমি, মনেরও। মনটাকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। যা তা ভাবলি, মুখে যা এল বলে দিলি এতে করে মুখে একটা সাতবাড়ি ঠিকে কাজ করা ঝি-ঝি ভাব এসে যায়।
এইভাবে ওকে মোটিভেট করে সে চলে এসেছে। কারও বাড়িতে থাকতে তার ভাল লাগে না। মিমির বাড়িতে তো আরওই নয়। ওদের বাড়ির একটা গন্ধ আছে, দুঃখের গন্ধ, উচ্ছৃঙ্খলতার গন্ধ, হয়তো বা বিকৃতির গন্ধও। বাড়িটা যখন প্রথম হয়েছিল চারপাশে বোধহয় তেমন বাড়িঘর হয়নি। এখন হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট ঘর কেমন অন্ধকার অন্ধকার, সাজসজ্জা সেই কোন কালের, আন্টিমাসি কিছু বদলাতে গেলেই মিমি তুলকালাম করে, মেসো বলেন—থাক না থাক, ও যখন চাইছে না। ওর ভাল লাগছে না বলে বাড়ি রং করা হবে না, সোফার কভার, পরদা, নতুন অন্য রঙের করা চলবে না, এইগুলোতে নাকি ওর মায়ের চিহ্ন আছে, ছোঁয়া আছে। শুনলে হাসি পায়। আর সেইসব আদ্যিকালের অন্ধকার অন্ধকার জিনিসের দরুন বাড়িটা কেমন মনমেজাজ দমিয়ে দেয়। মিমি নিজেই সহ্য করতে পারে না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। বলে—দূর! এখনও ওখানে ওষুধ আর অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ ঝুলে আছে।
তার ঘরে সে সাদার ওপর কমলালেবু ফুটকি ফুটকি মিকি ডোনাল্ড মেশানো পরদা টাঙিয়েছে। মেঝের ওপর বিছিয়ে রাখে রঙিন চৌকানা দরি। তার সিঙ্গল খাটে, খাটটা বেশ বড়ই, একদিন-দু’দিন মিমিকে নিয়ে শোয়াই যায়, কিন্তু তার বেশিদিন শুতে হলে তার অসুবিধে হবে। খাটটার ওপর সে একটা চৌখুপি টুকরো টুকরো কাপড়ের খুব সুন্দর কাঁথা বিছিয়ে রাখে। তলায় ধবধবে চাদর। দুটো তিনটে পাতলা রঙিন কুশন। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার আছে, এক একটা ক্ল্যাসিকাল ড্যান্স নিয়ে এক একটা পাতা। তার নিজের আঁকা জল রং আছে একটা দু-ফুট দু’ ইঞ্চি বাই এক ফুট।
সেবার কলেজ থেকে নিমডি বলে একটা জায়গায় গিয়েছিল তারা। আদ্রা-চক্রধরপুরে রাত দশটায়। ভাঙাট পাহাড়। পেছনে দূরে দলমা রেঞ্জ। তখন বেশ গরম বসন্ত। পলাশ আর কুসুম দেখে নেশা লেগে যায়। এত অপূর্ব পলাশ সে শান্তিনিকেতনেও দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? দোলের বেশ আগে থেকে ওরা সমস্ত পলাশ মুড়িয়ে তুলে নিয়ে যায়, ফ্রিজে রেখে দেয় বসন্তোৎসবে পরবে বলে। এখানকার পলাশে কেউ হাত দেয় না। উদ্যত অঞ্জলির মতো পুষ্পবান স্বাস্থ্যবান দীর্ঘ পলাশবৃক্ষরা দাঁড়িয়ে থাকে। তার সঙ্গে থাকে কুসুম গাছের লাল, সমস্ত পাতা লাল হয়ে যায়। ওরে বাবা, সে এক মোহগ্রস্ত দৃশ্য। গাছগুলো, দলমা, ধু ধু মাঠ, সরু কপিলা নদী, উঁচু-নিচু পথ সব যেন লাল স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছে। সেটাই সে জল রঙে এঁকেছিল হ্যান্ডমেড পেপারের ওপর। অনেক কিছুই জানত না তখন। ছবিটা একটু যেন ফেড করে গেছে। কিন্তু এ ছবিটা তার বিশেষ প্রিয়। কেন? ওই দৃশ্য, ওইসব দিন মনে পড়ে। রুদ্রাংশু মানে রুদ্রাংশুদার সঙ্গে ওখানেই খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধে থেকে তাদের বেড়ানো আর যেখানে-সেখানে বসে পড়া শুরু হত। এক এক দিন মাঝরাত শেষ হয়ে ভোরে খুব ভোরে শুকতারার সঙ্গে সঙ্গে মুচকুন্দ চাঁপা ফুটতে দেখত। কী সুবাস! মৃদু কিন্তু মাতাল করা। তখন অনিবার্যভাবেই সে রুদ্রাংশুর খুব কাছে চলে গিয়েছিল, সারা রাত কত কথা! এর কোলে ওর মাথা, ওর মাথা এর কোলে। একদিন এই ভাস্কর চক্রবর্তী দেখে ফেলেছিলেন। বাস! কী দুর্নাম, কী দুর্নাম, তনিকা একটা বখে-যাওয়া ক্যারেকটারলেস মেয়ে। রুদ্রাংশু তখন ঝুমুর শিল্পীদের নিয়ে একটা সিরিজ আঁকছিল। ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন—তুমি যে এমন ওম্যানাইজার-টাইপ তা তো জানতুম না। তোমাকে তো ওইসব জায়গায় ছাড়া যাবে না। বলেছিলেন এই ভাস্কর চক্রবর্তী। এই লোকটাই। রুদ্রাংশু কেমন ঘাবড়ে গেল। তার কিন্তু ভয়ডর ছিল না। সে একদিন এক বোঝা কলার বাসনা না কী বলে টানতে টানতে ওদের থাকবার জায়গায় ঢুকল, একটা বড় চত্বর সেটা। কত গাছ, কত—এখানে-ওখানে মাটির ঘর, খড়ের চালা। একটা আশ্রম। লোকাল মাহাতোরা ওখানে হাতের কাজ শিখতে আসত। সব্বাই বললে—কী নোংরা, কী উদঘুটে বিদঘুটে! কী করবি এটা দিয়ে? স্টিল লাইফ আঁকব। এক বোঝা কলার বাসনা, পাখির বাসা পড়ে আছে পাশে, একটা লাল প্লাস্টিকের মগ মুচকুন্দ চাঁপার তলায়। কেন তোদের গোল টেবিলের ওপর চিনেমাটির ফুলদানে সূর্যমুখী ফুল আর অ্যাশট্রের ওপর সিগারেট ছাড়া স্টিল লাইফ হয় না! অ্যাক্রিলিকে করেছিল ওটা ক্যানভাসে। কী সাংঘাতিক যে হয়েছিল! কলা বাসনার এলোমেলো বোঝার মাঝে মাঝে শেড, কী রকম গামছার বুনটের মতো ধারগুলো। বাঁধনটার মোটা গিঁট, পাখির বাসাটা যেন বাসনাগুলোর পাশে গুনগুন করে কাঁদছে, আর লাল মগটার অট্টহাসি।
পীযূষ তো দেখে মুগ্ধ—নাঃ তোর হবে তনিকা, হবে।
—নতুন কথা কী বললি? তনিকা আধখানা মুখ তুলে বলেছিল।
রুদ্রাংশু বলল—কী জানিস তনিকা তোর কোনও ইনহিবিশান নেই।
কী বলতে চেয়েছিল রুদ্রাংশু, সে আলাদা করে জিজ্ঞেস করেনি। ওটা কি প্রশংসা না নিন্দা? এই সরল ঋজু প্রকাশকে কি তুমি পছন্দ করছ? ভালবাসছ? মুগ্ধ হচ্ছ? না কুঁকড়ে যাচ্ছ? রুদ্রাংশুর কথার টোনে মনে হয়েছিল দ্বিতীয়টা। নিন্দাসূচক বা বলা ভাল অস্বস্তিসূচক মন্তব্যটা। সে কিছু বলেওনি, মুখও তোলেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব খেপে গিয়েছিল। তারপর যখন রুদ্রাংশু এখানে এসেও সম্পর্কটাকে চালাতে চাইল সে খুব শীতল মুখে বলেছিল—কোথায় যাচ্ছিলিস যেন রুদ্র? রবীন্দ্র সদন? একাই যা। আমার সময় হবে না।
—কেন কী করছিস? রাজকার্য? আমি তো কিছু দেখছি না তেমন।
—আমার কাজের তুই কী বুঝবি? জানলার ধারে বসে থাকাটাও আমার কাজ, শুয়ে থাকাটাও কাজ। আমার সময়। নেই, হবে না, যা।
—যা বাব্বা! রাগটাগ নাকি? কেন?
সে কোনও জবাব দেয়নি। বেশিক্ষণ তার ঘরে কোনও ছেলে থাকলেই মিসেস উইলিয়ামস একবার এসে পড়তেন। সেদিনও এলেন। অনর্থক গল্প জুড়লেন। রুদ্রাংশু পালাতে পথ পেল না। তার পরেও অনেকবার চেষ্টা করেছে রুদ্রাংশু, কিন্তু সে আর মুখ ফেরায়নি। সময়টা তখন খুব খারাপ গেছে তার। মন অন্ধকার হয়ে থাকত, সেই মুচকুন্দ চাঁপার তলার তারাজ্বলা মাঝরাতগুলো মনে পড়ত। খুব কষ্ট হত। কিন্তু তবু সে রুদ্রাংশুকে আর কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কেননা তার কাছে যেটা পজিটিভ ইতিবাচক, রুদ্রাংশুর চোখে সেটাই নেগেটিভ। এটা হল স্বভাবের মৌলিক তফাত।
এই যে ইতিবাচক এই ব্যাপারটা ওই অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকারের আছে। তবু, দু’বার বিয়ে করলেন, দু’বারই কেস কেঁচে গেল? প্রথম যেদিন উনি বৃষ্টির সন্ধেতে তাকে গাড়িতে তুললেন, সেদিন অনেকক্ষণ সে কোনও রকম লক্ষই করেনি ওঁকে। তার ভেতরটা তখন এমন জ্বলছে! এমন জ্বলছে! মনে হচ্ছে—বৃষ্টিতে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকলেও অপমান ধোবে না। কী মনে করে কি লোকগুলো নিজেদের? একটু নামটাম হয়েছে, অধ্যাপক হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মুঠোর মধ্যে রেখে দেবে? সেই জন্যে তাদের নিজের ব্যক্তিগত লোভ মেটাবার জন্যে ইউজ করবে? লজ্জা করে না নিজেদের নাঙ্গা চেহারাটা ছোটদের সামনে বেরিয়ে পড়লে? অদিতিদি কি জানতেন লোকটা ওই রকম? সেদিন কী রকম ঠান্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন? ভামটা যা শক খেয়েছিল না! একেবারে যাকে বলে হিসি করে ফেলেছিল। আশ্চর্য! সে অদিতি সরকারের নাম জানত ঠিকই, কিন্তু কখনও ছবি দেখেনি বলেই কি না কে জানে, বুঝতে তো পারেইনি! ওঁর বাড়ির দরজায় নেমপ্লেট ছিল। প্লেট নয় ঠিক, পেতল দিয়ে টানা হাতের লেখায় ছিল নামটা, সে লক্ষও করেনি। যাঁর বাড়িতে এসে উঠল তিনি কে এ সম্পর্কেও তখন তার কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এটা যেন প্রতিদিনের সাত-পুরনো ঘটনাগুলোর একটা। অচেনা মহিলা তাকে লিফ্ট দেবেন। বাড়িতে নিয়ে যাবেন। তার জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করবেন। খাওয়াবেন নিজে রেঁধে। ওঁর বাড়িতে অনেক ছবিও দেখেছিল সে। কোনওদিকে তাকায়নি। কোনও ভাবনাই দেয়নি বাড়িটাকে। একমাত্র তার অদ্ভুত উঠোনটাকে ছাড়া গুরুত্ব দেয়নি তার মালিককে, কোনও সভ্যতা-ভদ্রতা করেনি। অমন গরম গরম অভ্যর্থনার পরও নিজে ঠান্ডা থেকেছে, নির্বেদ জিইয়ে রেখেছে। উনি কোনও জোরাজুরি করেননি। মানুষটা যে অন্য মানুষকে চট করে অনুভব করতে পারেন, তা খুব স্পষ্ট। সে ফিক করে হেসে ফেলল—তার ব্যাগ থেকে ঝপ করে ডায়েরিটা পেয়েই অনোহিতার বাড়িতে ফোন। কী লাড্ডু! বাপ রে বাপ! ভেবে দেখতে গেলে সেদিনের সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটেছিল শ্ৰীমতী অনোহিতার সৌজন্যে। মিমি যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে তা সে জানতই। মিমি কবে কোনখান থেকে তাকে খবর দেবে তার জন্যে সে রেডি ছিল। শেষ তো তার সঙ্গেই দেখা হয়। তার সঙ্গে নিউ মার্কেটের ম্যাগনোলিয়ায় দেখা করল। চোখগুলো ঢুকে গেছে, হিংস্র মুখ—তনি বাড়িতে আমাকে খুঁজবি না। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।
—কেন?
—কেন তুই জানিস না? ন্যাকামি হচ্ছে? বাড়িতে পেতনি বসে ঘাড় মটকানোর মওকা খুঁজছে আমি ওই বাড়িতে থাকব? বাবা ফিরে এলে দেখা যাবে।
—কোথায় আছিস?
—তোর সব কথায় দরকার কী? নিজের কেস-হিস্ট্রি আমায় দিস? দরকার হলে আমি যোগাযোগ করে নেব।
এল, মিল্কশেক খেল, মিল্কশেকের গোঁফ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে চলে গেল।
—আমি বেরোবার পাঁচ মিনিট পরে বেরোবি। বেশি চালাকি করে, গোয়েন্দাগিরি করবার চেষ্টা করবি না।
—আমার বয়ে গেছে। যা তুই জাহান্নমে যা।
জাহান্নমে গেল, কিন্তু জাহান্নমটিকে ম্যাগনোলিয়ার সিটে ফেলে গেল। একটা মোটা ব্রাউন ডায়েরি। তা সেটা না তুলে নিয়ে তনিকা কী করে? সেটা না পড়েই বা সে কী করে? আর পড়ে চমৎকৃত না হয়েই বা সে কী করে থাকে!
মাসিকে ফোন করল। উনি বললেন—ও ওর ভাস্করকাকুর কাছে আছে। ওঁর সঙ্গে…থাকছে…। এইভাবে ইতস্তত করে দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলেছিলেন আন্টিমাসি।
তা সেই ভাস্কর চক্রবর্তী যখন তনিকাকে নিজের স্টুডিয়োয় তাঁর আধুনিকতম টেকনিক দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেন, সে প্রথমেই প্রস্তাবটা নিয়ে নিল, কেননা, নিজের চোখে দেখতে পাবে মিমি সত্যিই ওখানে রয়েছে কি না। আর যদি থাকে, তবে মিমি থাকা সত্ত্বেও ভাস্কর চক্রবর্তী যদি তাকে ডাকতে পারেন…তা হলে ‘ও…ওঁর সঙ্গে…থাকছে’—এই ধারণাটা ঠিক নয়। কৌতুহলে, প্রায় মতলব নিয়ে বলা চলে—গিয়েছিল। মিমির চিহ্নও দেখল না, মাঝখান থেকে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে কী কমপ্লিকেটেড এচিং করছেন দেখিয়ে, গাবিয়ে বললেন—তনিকা, তুমি একটু বসো।
—ভীষণ গরম আর ক্লান্ত লাগছে। চান করে আসি। এসে তোমাকে চা খাওয়াব।
সে ভালমানুষের মতো বলেছিল—আমি চা করছি, আপনি চান করে আসুন না সার!
—করবে? করো! যেন হাঁফ ছাড়লেন।
রান্নাঘরে গিয়ে ও মিমিকে দেখে। সিঙ্কে শুকনো প্লেট নামানো, ডিমের কুসুম আর আলুর খোসা পড়ে আছে। এখানে চায়ের কৌটো ওখানে কফির প্যাকেট। রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুখ আটকানো। চিনি ছড়ানো তাকে। থিকথিক করছে পিঁপড়ে। তার বন্ধুর চেহারাটা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। উপরন্তু তার একটা চেনা ঘাঘরা, একটা দড়ি থেকে লটপট করে ঝুলছে।
সে সব গুছিয়ে নিয়ে, চায়ের জলটা ফুটিয়ে, চা পাতা দিচ্ছে। ‘তনিকা তনিকা’ ভাস্কর চক্রবর্তী জলের আওয়াজের ওপর গলা তুলে কেমন করে যেন ডাকছেন। সে ঘাবড়ে গেছে, কী রে বাবা স্ট্রোক টোক হল না কি?
ছুটে গিয়ে দ্যাখে বাথরুমের দরজা হাট। শাওয়ারের তলায় ভাস্কর চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে, পরনে তোয়ালে। —তনিকা আমার পিঠটাতে একটু সাবান ঘষে দেবে? সে পিছু হটে এসেছিল। ওর মুখ ওদিকে ছিল দেখতে পায়নি। ভেবেছিল, ফাইন্যাল পরীক্ষা সবে শেষ। এখন ছাত্রীকে পিঠে সাবান কেন, গা মুছিয়ে, পাউডার মাখিয়ে পাজামা পরিয়ে দিতে বললেও দেবে। ওর চরিত্ৰজ্ঞান মিমির থেকে প্রাপ্ত কিনা। মিমিকে ও ওই বয়সের মেয়েদের প্রতিনিধি ভেবে নিয়েছে।
সদর দরজা বন্ধ করে নিমেষের মধ্যে সে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তখন প্রকাণ্ড একটা ধূম্র পাহাড়ের মতো মেঘ সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলছে। যা পেয়েছে উঠে পড়েছে। টলি-ব্রিজ পার করে নেমে পড়েছে। ধুন্ধুমার বৃষ্টি। কোথায় তার বাড়ি? ও পার্ক সার্কাস। এখন পার্ক সার্কাস সে যাবে না। আরমান? উঃ আরমানের কথা যা মিমির ডায়েরিতে পড়ল, তার পর আর তার কাছে যাওয়া যায় না। সে সামনে ট্রাম পেল তারপর রাসবিহারী, গড়িয়াহাটের মোড়। এসপ্ল্যানেডের বাস ধরল। ভিজে চুপচুপে। এসপ্লানেডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল। ভিজতে লাগল…ভিজতে লাগল। কোনও চৈতন্য নেই, প্রথম শক—মিমি। দ্বিতীয় শক মিমির ডায়েরির হঠাৎ উলটে-পড়া পাতা, তৃতীয় শক—ভাস্কর চক্রবর্তী দা গ্রেট। সেই একই ঘোরে কাটছিল ক’দিন, তারপর চতুর্থ শক—অ্যাকাডেমি… ‘ফেলাইন মর্নিং’ সেকেন্ড এসেছে, বন্ধুদের হাল্লাবাজি, হঠাৎ এক অলক্ষ দেওয়ালের ওপার থেকে—তনিকা!
ভাবতে গেলে—তার ওই নির্লিপ্ত ব্যবহারের পরও উনি— তনিকা! ছবিটা ভাল লেগেছে দ্বিতীয় নির্বাচন করেছেন ঠিক আছে। বুঝতেও তো নির্ঘাত পেরেছেন ওই তনিকাই এই তনিকা, কিন্তু বিচারপতি অধ্যাপকের অহমিকা নিয়ে তো এড়িয়ে যেতেই পারতেন। বিশেষত যখন তার ভদ্রতার অভাব নির্লিপ্তি দেখতে পেয়েছেন, বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু খুঁজে বার করলেন বন্ধুদের পাহাড় ডিঙিয়ে, সুবীরের পাহাড় ডিঙোনো তো যে-কোনও মানুষের পক্ষেই শক্ত! এবং সোজাসুজি শাঁখ বাজিয়ে দিলেন—তনিকা!
সেই প্রতিধ্বনির কথা আছে না! পাহাড়ের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি। তোমার চারপাশ ঘিরে পাথুরে দেওয়াল, তুমি গান গাইলে, সে গান যেমন প্রত্যেকটা দেওয়াল আবার তোমায় শুনিয়ে দেয়, দিতে থাকে। এও সে রকম। তার হৃদ্বস্তুর অলিন্দ-নিলয়গুলো তাকেও ফিরিয়ে ফিরিয়ে শোনাচ্ছে যেন একটা উদাত্ত পিট সিগার বা গ্রামীণ লোকসংগীত। খোলা গলায় গাওয়া খোলা আকাশ বাতাস মাঠের মধ্যিখান থেকে।
ভাস্কর-ঘোরটা কেটে গেছে। এই ঘোরটা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসলে এই ঘোরটাই ভাস্কর-ঘোরটাকে কাটাতে সাহায্য করেছে, নইলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে সেটা বহুদিন চলে। বহু দিন।
উনি ঠিক কী? কী রকম? অন্তরঙ্গ হলে কেমন লাগবে? ওঁর ছাত্রছাত্রীরা তো মনে হল খুব ঘনিষ্ঠ, একটা পূজার ভাবও আছে, প্রেমের ভাবও আছে। কিন্তু কোনও বাঁধা খালের মৃদু একমুখী স্রোতে গা ভাসাতে তার ভাল লাগে না। ওদের মতো করে সে কিছু পারবে না। তার ভাল লাগে প্রকৃতি পর্যায়। নদীতে জোয়ার এসেছে জোয়ারের জলে ফুলে ফুলে ওঠো। ভাটির টান…ফিরে চলো ধীর সুখে সমুদ্রের দিকে, দুরন্ত পদ্মার পাড় ভেঙে ভেঙে পড়ছে, আতঙ্কে নীল হয়ে তুমিও ভেঙে পড়ছ, তারপর আবার দুর্দম চড়া হয়ে জেগে উঠছ। বেগুনি আকাশে হারিয়ে গেলে সন্ধেবেলা, প্রথম সূর্য হয়ে ফুটলে। রোদ হয়ে উঠলে তারপর হঠাৎ গুরু গুরু গুরু গুরু স্বননে বেজে উঠলে মেঘ ঘর্ষণের দামামা থেকে। দামাল বৃষ্টিপাত।
হঠাৎ তার মনে হল এইখানে, ঠিক এইখানেই তার মিমির সঙ্গে মিল। এই জন্যেই সে মিমিকে বোঝে। মিমিও তাকে ধরতে পারে খানিকটা। কিন্তু কেউই কাউকে পুরোটা নয়। মানুষে মানুষে কিছু তফাতের রহস্য তো থাকবেই! রহস্য থাকে থাক, কিন্তু একই প্রকৃতির মধ্যে এত তফাত কেন? কেন সে মিমির মতো হয়েও মিমির মতো নয়! কেন মিমি তার মতো হয়েও তার মতো নয়? শ্রীলামাসির সঙ্গে আন্টিমাসির বন্ধুত্বের কথা সে শুনেছে। দেখেওছে। ওঁদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি ছিল না। আর শ্রীলামাসি তো প্রতিটি ব্যাপারে বন্ধুর ওপর নির্ভর করতেন, পরামর্শ চাইতেন। ‘সর্বাণী এল না কেন? এখনও কী করছে? সাতটা বেজে গেল যে!’ একথা যে কতবার শুনেছে ওদের বাড়িতে গিয়ে! তখনও পরদা-টরদার রংগুলো জ্বলে যায়নি, সোফাকভার, কুশন সব ঠিকঠাক পরিষ্কার হত। ছবিগুলো বাঁকা থাকত না। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলাত। শ্রীলামাসি তো সবটা দেখে উঠতে পারতেন না, আন্টিমাসিই বেশিটা দেখতেন। এখন উনি থাকা সত্ত্বেও বাড়িটা ঠিকঠাক নেই। কেন? না মিমির ঝগড়ুটে চিৎকার যার ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। শ্রীলামাসির সামনে, তার সামনে ধেড়ে মেয়ে মিমি তখন চকাস চকাস করে আন্টিকে কত চুমু খেয়েছে। কাল আসোনি কেন? এ রোববার সারাদিন আমাদের কাছে থাকতে হবে।—সবই তো তার দেখা! যেন কোলে বসে বাচ্চার মতো আদর খাবার বায়না করবে এক্ষুনি। আর কী আবদার! কী আবদার!—আজ এই রান্না করে দাও, কাল ওই করে দাও। খাওয়া নিয়ে কিছু ফাস করতে পারত ওই মেয়ে! শ্রীলামাসি তখন ক্ষীণ স্বরে বলতেন আজকে ওকে ছেড়ে দাও মিমি। ইয়ার এন্ডের ঝামেলা সেরে এসেছে। সর্বাণী আজ বড় ক্লান্ত।
—তুমি কেন সবেতে বাগড়া দাও বলো তো, আন্টিমাসি বলুক ও ক্লান্ত, ওর কথা ও বলতে পারবে। তোমাকে বলতে হবে না।
—সত্যিই আমি আজ পারছি না রে, পঞ্চমীকে ডাক আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি ঢাকাই পরোটা কী করে করতে হয়। ও-ই করে দেবে।
—নাঃ আমার দরকার নেই। ঠোঁট ফুলিয়ে দুমদাম করে চলে গেল একটা আঠারো উনিশ বছরের না তার চেয়েও বড় মেয়ে।
আন্টি উঠতে যাচ্ছেন। শ্রীলামাসি হাত চেপে ধরলেন— উঠতে পারবি না সর্বাণী। একদম না।
আন্টি হেসে বলতেন—যদি না খায়।
—না-ই খাক। বাজে আবদার শোনা হবে না তাই বলে। দিন দিন বড় হচ্ছে না ছোট হচ্ছে?
আন্টি বলতেন—এই শক্তটা আগে হলে পারতিস শ্রী।
কত সুন্দর সুন্দর আলাপ-আলোচনা চলত দু’জনের মধ্যে। গান বাজাতেন শ্রীলামাসি। যখন শরীরটা খুব খারাপ হত, কথা বলতেন না, দু’জনে চুপ করে শুধু বসে থাকতেন। কত সুন্দর দৃশ্য দেখেছে সে। রাতে সে ওদের বাড়ি থাকবে বলে গেছে। মিমি এত ঝিং-চ্যাক বাজাচ্ছে আর এত নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে পাগলামি করছে যে তার শেষ পর্যন্ত বিরক্ত লাগছিল। একবার বলেছিল মাসির শরীরটা খুব খারাপ আজ, এত আওয়াজ করিস না।
—ওহ, তা হলে কোনওদিনই কিছু করা হবে না —আবার শুরু করে দিল, এবার হিন্দি ঝিং চ্যাক।
দরজা বন্ধ করে সে নীচে চলে এসেছিল। মাসির ঘরের পাশেই একটা বড় লাউঞ্জ মতো, সেখানে একটা টিভি থাকে, কয়েকটা বুক শেলফ। ঝাড়বাতিটা জ্বালিয়ে সে অনেকক্ষণ সেদিন পড়েছিল—কী যেন! ‘তাও অব ফিজিক্স।’ কী অদ্ভুত বইটা। কাপরা বলে একজন বিজ্ঞানী সমুদ্রের ওপর আমাদের নটরাজের নৃত্য উপলব্ধি করেছেন। সৃষ্টি, সৃষ্টি হচ্ছে। কত অদ্ভুত অদ্ভুত বই ও বাড়িতে। কে আনত! কতকগুলো বইয়ে শ্রীলামাসির নাম লেখা। কিন্তু বেশিরভাগই নাম-না-লেখা। রমাঁ রল্যাঁর ‘লাইফ অব শ্রীরামকৃষ্ণ’; ‘ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট’ বলে একটা বই। ‘দা ম্যান হু ডায়েড’—দারুণ! সমান দারুণ গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘গীতা ভাষ্য’। সে অবশ্য ভূমিকাটার পর আর বেশি পড়েনি। কিন্তু ওইটুকুতেই চমৎকৃত। বেশ রাত্তির। সে উঠে মাসির ঘর পার হয়ে ওদিকে যাবে, তার খিদে পেয়েছে, দেখল মাসির ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে, মাসি শুয়ে, পাশে আন্টিমাসি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ডান দিকের মুখটা দেখা যাচ্ছে আন্টির। গালটা কেমন চকচক করছিল, উনি কি কেঁদেছিলেন? কী যে মমতামাখা! তারপর আস্তে গায়ের চাদরটা মাসির গায়ে টেনে দিলেন। মুখ নিচু করে খুব আলতো করে কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে মাসির কপালে একটা চুমু খেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছেন দেখে সে তাড়াতাড়ি আবার লাউঞ্জে ফিরে যায়। আন্টি এসে বললেন— তোরা খাবি না?
—মিমি খাবে কিনা জানি না, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি দেখছি কী আছে, খেয়ে নিচ্ছি।
—চল ওকে একটু ডেকে দেখি!
ওদের বাড়ি সবাই একসঙ্গে খেতে বসত কমই। বেশিরভাগ সময়েই যে যার মতো টেবিল থেকে নিয়ে খেয়ে নিত।
আন্টির সেই আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলোনো, সেই সাবধানে চাদর টেনে দেওয়া আর সেই নিচু হয়ে দীর্ঘক্ষণ চুমো খাবার দৃশ্যটা সে স্মৃতির ঘরে আলো জ্বাললেই দেখতে পায়। কেমন ঘুম এসে যায় তখন। খুব মমতার, খুব গভীর স্নেহের, প্রেমের দৃশ্য সেটা। মা যেমন মেয়েকে, কিংবা প্রেমিক যেমন প্রেমিকাকে…কোনটা ঠিক ঠিক তুলনা হবে সে বুঝতে পারেনি। আজও পারে না।
মিমি যাবে কিনা জানে না, আপাতত মিমি না গেলেই সে খুশি হবে। আর দু’-একদিনের মধ্যেই সে ‘চিত্রভানু’তে যাচ্ছে।
তেরো
আকাশ নীল দোপাট্টাটা অদিতি গলা থেকে আলগা করে নিল। খুব গরম হচ্ছে। অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে প্রচুর লোক। দু’-একজন মাঝে মাঝেই উঠে গিয়ে ফোন করছে। এক ভদ্রমহিলার বিশাল বুক থেকে একটি ক্ষীণকায় বাচ্চা থেকে থেকে ঝুঁকে পড়ছে— ড্যাডি, ড্যাডি কব আয়গা! হুঁ-উঁ-উঁ কান্নার সুর ধরে বাচ্চাটা।
—আয়গা আয়গা। অব্ভি আ জায়গা। বাস, বাস, রোও মৎ রাহুল বেটা, বাস করো। অন্যমনস্কভাবে শুনতে শুনতে অদিতির মনে হল—আরে! যে যেখানে আছে সব আজকাল রাহুল হচ্ছে! এ কি রাহুল দ্রাবিড় নামে ক্রিকেটারটির সৌজন্যে? বুদ্ধদেবের ছেলের জন্য এ ফ্যাশন নিশ্চয় নয়। কোনও ফিল্মস্টার টার আছে নাকি এই নামে? কত রকম স্টার সুপারস্টার হয়েছে আজকাল। এতবড় ভারতবর্ষ, এত লোকসংখ্যা। পিলপিল করছে লোক। কিন্তু বাঁচে খালি স্টাররা। ফিল্ম স্টার, ক্রিকেট স্টার, পলিটিক্যাল স্টার, ইদানীং রাইটার স্টারও হচ্ছে। সেলিব্রিটি-পাগল দেশটা, যা-কিছু ভালবাসা টাকাপয়সা সব উজাড় করে দেয় সেলিব্রিটিদের পায়ের তলায়। নিজেদের আর বেঁচে দরকার নেই। নিজেদের জন্য কোনও মান-সম্মান দরকার নেই। খাবার জিনিস, ওষুধ, নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর দাম রোজ রোজ বেড়ে যাচ্ছে। ঝপ ঝপ করে বছরে তিন-চারবার করে দাম বাড়ছে এটা ওটা সেটার। রান্নার গ্যাস, ইলেকট্রিকের ইউনিট, ফোন। এরা একরকম সুদ ঘোষণা করে মাঝপথে সুদ অর্ধেক করে দেয়, এক পলিটিক্যাল পার্টির টিকিটে দাঁড়িয়ে জিতে আর এক পার্টির ল্যাজ ধরে এগোয়, এমন বেইমানি একটা দেশের নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে করছে, করে যাচ্ছে, কিন্তু জনগণেশের হেলদোল নেই। তারা সচিন-সৌরভের গন্ধ পেলেই দৌড়োবে, এই ঘুঁটের মালা পরাচ্ছে, তো ওই সেই একই ব্যক্তির নামে রাস্তা, অঞ্চল, মন্দির-টন্দির বানাচ্ছে। বম্বে থেকে কোন ফিল্মস্টার বম্বের ফ্লাইটটায় এল আজ। কী নাকি ফিল্ম করেছে প্রোমোট করবে, চারদিক থেকে কমান্ডো পরিবেষ্টিত হয়ে খোলা গাড়িতে হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল নায়ক-নায়িকা। এয়ারপোর্টে আজ আসতে কী বেগ পেতেই না হয়েছে তাকে। উল্টোডাঙা থেকে শুরু করে পুরো ভি.আই.পি রোড দলে দলে ছেলে, বুড়ো সব চলেছে ফিল্মস্টার দেখতে। বেশ ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছে এরা দেশভরতি লোককে। মাথায় হাত বুলোচ্ছে। বোধহয় আড়ালে হো-হো করে হাসে। ফ্রান্স হলে তো বটেই, ব্রিটেন হলে, জার্মানি বা ইউ.এস.এ হলেও ঝান্ডা উঠে যেত শত শত। এই জিনিসগুলো ইদানীং লক্ষ করছে সে। কয়েক বছর হল পাকাপাকি বাস করছে। কিন্তু আসলে সেভাবে বাস করেনি। কেননা সে আসলে প্যারিসেই বাস করছিল। ইয়োরোপে। আদৌ ভারতবর্ষে বা কলকাতায় নয়। তার বাড়িটাই তো একটা পুরনো ইউরোপীয় বাড়ির মতো। মাত্র কয়েক মাস হল হঠাৎ ও ভারতীয় কলকাত্তাই বাস্তবতায় জেগে উঠতে শুরু করেছে। সমস্ত দেশটা জোচ্চুরিতে ভরে গেছে। জোচ্চোর আর গুন্ডা। মাঝে সেলিব্রিটি-পাগল জনতা। আর মুষ্টিমেয় লোক প্রাণপণে নিজের কাজটা করে যাচ্ছে। থাকতে পারব তো এখানে আমরণ? মা চলে যাবার পর তো সে ফিরেই যাচ্ছিল নিউইয়র্ক কলেজ অব ভিসুয়াল আর্টসে। অফার পেয়েছিল ভাল। কী রকম লাগবে দেখতে একবার ঘুরে এল। ভাল লাগল না। প্যারিস, প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায়, একোলে, নোৎর, ল্যুভ-এ, লিল দ্য লা সিতেয় নোৎর দাম, চিত্রিত মেট্রোপথ, সবুজ কান্ট্রিসাইডে তার জীবন পড়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিন সেখানে রাজর্ষি আর সুজানের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। কী অপ্রস্তুত! কী অপ্রস্তুত! যেসব রোডসাইড কাফেতে সে কতবার রাজর্ষির সঙ্গে সন্ধে কাটিয়েছে সেখানে রাজর্ষির সঙ্গে সুজান, যে ব্রিজ দিয়ে সে পার হয়েছে সেন নদী রাজর্ষির সঙ্গে, সেখানে রাজর্ষির কনুই ধরে সুজান। তারই বন্ধু। যার সঙ্গে ইয়ুথ হোস্টেলে হোস্টেলে সারা ইয়োরোপ একসময় চষে বেড়িয়েছে সে। সেই সুজান যে ভিয়েনা থেকে তাকে ফোন করামাত্র সিতে ইউনিভার্সিতের গেস্ট হাউসে জায়গা থাকা সত্ত্বেও সে নিজের বাড়িতে বাস করবার জন্য ডেকেছিল।
—যতদিন একটা পাকাপাকি আস্তানা না পাই, বুঝলে অদিতি।
—শিয়োর। তোমাকে শেকড় গাড়তে তো সময় একটু দিতেই হবে!
সুজান একটু লালু-ভুলু প্রিটি-প্রিটি দেখতে মার্কিন মেয়ে। এই রকম চেহারার এখন আর কদর নেই সারা পাশ্চাত্য দেশে। চুলে কার্ল। গালে লাল। কে জানে অত মনস্তত্ত্ব বা সেক্সোলজি সে জানে না। কিন্তু সুজান গ্লাসগোর ইনস্টিট্যুটে নিজের কাজে, সাধারণ্যে, কোনও ছাপই ফেলতে পারেনি। সে যখন প্যারিসে এল, তখন তার দুটো বিয়ে ভেঙে গেছে, একটা বাচ্চাকে বাবা-মা’র কাছে রেখে দিয়েছে। ঝাড়া হাত-পা। দিনের পর দিন রাজর্ষি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেছে, দিনের পর দিন সে অনুপস্থিত থেকেছে, কিচ্ছু তো মনে হয়নি তার? তার ধারণা সুজানও তখন তার আতলিয়েতে কাজে ব্যস্ত।
একদিন রোজকার মতো ফিরে চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল দু’জনে তারই বিছানায়। সে দাঁড়িয়েই ছিল, দাঁড়িয়েই ছিল। পুরো ব্লু-ফিল্মটা অসীম আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে দেখছিল! তারপর ফিল্ম চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছোবার আগেই রাজর্ষি মুখ তুলে তাকে দেখতে পেল। ব্যস একেবারে চিত্রার্পিত। এদিকে সে—ঝোল্লা পাঞ্জাবি আর জিনস পরা। কানে বড় বড় মাকড়ি। এলোমেলো চুল। কাঁধে মস্ত বড় ঝোলা, হাতে পার্স। ওদিকে দুটি নাঙ্গা মানব-মানবী। রাজর্ষি নিজেকে কী করে ঢাকবে বুঝতে পারছিল না, সুজান তো চিত, তার মাথা অদিতির দিকে পেছন ফিরে।
সে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকেই বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। প্রবল বমি। জীবনে প্রথম নীল ছবি দেখার বমি।
—কী হল? কী হল? —রাজর্ষি ছুটে আসছে।
সে শান্ত হাতে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল—কমোডের ওপর বসে পড়েছিল। বিনবিন করে ঘাম দিচ্ছে সারা শরীরে। উঠতে পারছে না। সোজা হয়ে বসতেও পারছে না। ভেতর থেকে। প্রবল একটা বেগ বেরিয়ে আসছে। কাঠ বমি। কিছু বেরোচ্ছে না শুধু সারা শরীরে আলোড়ন। অকথ্য আলোড়নের যন্ত্রণা। তারপর একটা সময় এল যখন সে বাথরুমের মেঝের ওপরই শুয়ে পড়ল। তারপর কী হল কে জানে—নীলফুল, লালফুল, বেগুনি, হলুদ চরকি।
জ্ঞান ফিরতে দেখল সে হাসপাতালে—লাপিতাল স্যাঁ নেকের। তাদের বাড়ির কাছেই। মাঝরাত বোধহয়, মৃদু একটা আলো জ্বলছে। ভ্রমণরত কোনও সিস্টার বোধহয় বুঝতে পারলেন—সে জেগেছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন— কেমন বোধ করছ?
—আমার কি স্ট্রোক হয়েছে?
—পাগল? তোমার একটা বিশ্রী স্টম্যাক আপসেট হয়েছে। আজ ড্রিপ চলছে চলুক, কাল তোমাকে খেতে দেব।
সকালবেলায় সিস্টার আসতেই সে বলল—আমার পার্স?
—পার্স কোথায় পাব!
—আমার কাছে ছিল তো!
—আপনি ভুল করছেন মিসেস গুপ্ত, আপনি তো ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন না? আপনার স্বামী আপনাকে এখানে ভরতি করে দিয়েছেন। কেন? পার্সের খোঁজ করছেন কেন?
—না, ওর মধ্যে আমার ক্রেডিট কার্ড, টাকাপয়সা ছিল। আমি আপনাদের পে করে বেরিয়ে যেতে পারতাম। আমি এখন এক্কেবারে ঠিক হয়ে গেছি।
—বেশ তো! তাড়ার কী আছে? সকালেই আপনাকে ছেড়ে দেব। উনি আসুন।
—উনি আসবার আগেই আমি বেরিয়ে যেতে চাই।
—সো, আপনারা ঝগড়া করেছেন?
—আমাকে একটা ফোন দিতে পারেন? আছে আপনার কাছে?
—এনে দিচ্ছি।
সে মনীষাকে ফোন করল—একটা চেঞ্জ আর ক্রেডিট কার্ডটা নিয়ে শিগগিরই চলে আয়—
—সে কী রে! তুই হাসপাতালে? কী হয়েছে? কী কাণ্ড? রাজর্ষি কি বাইরে গেছে, নেই?
—না।
—কে ভরতি করল? নিজে এসেছিস? কখন হল? কী?— একঝাঁক প্রশ্ন।
অদিতি বলল—তুই যেমন আছিস তেমনি চলে আয়। মনীষা আমি আর বকতে পারছি না।
ব্যস, সেই শেষ। মনীষা গিয়ে নিয়ে এসেছে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। প্যাকারদের দিয়ে প্যাক করিয়ে তিনদিনের মধ্যে সে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে। চারদিকে সবুজ নিবিড়।
রাজর্ষি এসেছে, সুজান এসেছে … মনীষার বাড়ি। কিছুতেই যাবে না তাকে না নিয়ে।
—বিশ্বাস করো অদিতি এটা কেমনভাবে হয়ে গেল। আমাকে মাফ করো।
—অদিৎ, আমি তোমাদের বাড়ি থেকে চলে গেছি।
অদিতি চুপ করে বসে থেকেছে যেন ওখানে কেউ নেই। কিছু নেই। কেউ কোনও কথা বলছে না।
—মনীষা ওকে একটু বল! —রাজর্ষির কাতর অনুনয়!
মনীষা বলেছিল— তুই যদি এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে না যাস রাজর্ষি, আমি এক কেটলি গরম জল তোর মুখের ওপর ছুড়ে মারব। যা! যা! কুকুর-কুকুরি!
মা খুব রাগ করেছিলেন। —ভুলটা তো তোরই বনি। একটা মেয়ে তার ওপরে আবার ও দেশের, কোনও ঘেন্না-পিত্তি থাকে না ওদের। কিছুর মধ্যে কিছু না, তাকে বাড়িতে এনে তুললি! চারদিকে জনমনিষ্যি নেই! ছি! ছি! নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মেরেছিস।
তখনও সে কিছু বলেনি। কী বলবে? মাকে কি বোঝাতে পারবে, কুড়ুলটা তার অনেক আগেই মারা হয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধুর জায়গায় যদি ওর কোনও বন্ধু থাকত! মাঝে মাঝে তো থাকতই, হয়তো সপ্তাহান্তে, কিংবা এখনও বাসস্থান খুঁজে পায়নি। রাজর্ষি তখনও ফেরেনি, সে ফিরেছে, রাজর্ষির বন্ধু ডেরেক, রজার, পিয়ের সুনন্দ এদের কারও-না-কারও সঙ্গে কি তাকে অনেক ঘণ্টা একা কাটাতে হয়নি! দু’জনে পোর্নো কি পোর্ট হাতে বসেনি কি মুখোমুখি! শোনেনি কি দুর্দান্ত পুরুষ গলার স্তুতি? ভাল লাগে। খারাপ তো লাগে না। কিন্তু তোমার মধ্যে তো সেই তুমিটা বসতি করে আছে, যে জানে তুমি কার ডাকে সাড়া দেবে! মানুষকে কি অমন জৈবভাবে দেখা যায়?
টিভি স্ক্রিনে অনেকক্ষণ থেকেই ভাসছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের দিল্লি-কলকাতা ফ্লাইটটা এসে পৌঁছে গেছে। ঠিক কী ব্যবস্থা করেছে আঁদ্রে? ছবিগুলো কি ওর সঙ্গেই কারগোতে আসছে?
পরে ছাড়াবে নিশ্চয়, নয়তো ওর অনেক দেরি হবে। কেন বলল এয়ারপোর্টে আসতে?
—ওদিৎ, ওদিতি!
ওই তো আঁদ্রে!
ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। হাতে একটা স্যুটকেস কাঁধে ট্র্যাভলিং ব্যাগ, আঁদ্রে দু’ কদম এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল চুমু খেল। তারপর দু’হাতে তাকে একটু দূরে সরিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল—দেখি! দেখি! আমার সেই ওদিৎ কালো চোখের, অনির্বচনীয় রঙের ওদিৎ কী রকম হয়েছে! একটু কি গায়ে লেগেছে?
—হবে! তুমি কিন্তু আরও বলিষ্ঠ হয়েছ, মানে মাসকিউলার। তা ছবি?
—মাথা খারাপ? এখনও আসেনি। কাস্টমস থেকে ছাড়াতে দিন দুয়েকের মধ্যে আসব।
—কী রকম হল দিল্লিতে? গভর্মেন্ট গ্যালারিতে?
—না। ললিতকলা।
ললিতকলায় করা উচিত হয়নি। ওখানে সিকিউরিটি ভাল না।
—ছিল। ভালই ছিল।
—কেমন হল!
—ভাল। বেশ ভাল। তবে ওই।
—মানে?
—ওই বোদ্ধারা, ললিতকলার সঙ্গে জড়িত লোকজন, সরকারি আমলা, হু’জহু, ব্যবসায়ী বড়লোক। সার্টন গ্রেসফুল উইমেন, অ্যান্ড দেয়ার ডিসগ্রেসফুল হাজব্যান্ডস্।
—তা তো বটেই। ময়ূর জাতি তো ময়ূরীকে সুন্দরী দেখবেই! —অদিতি হাসল।
—কোথায় তোমার বুকিং?
—যদি বলি অদিতি আন্ডারস্কোর এম.অ্যাট.হট মেল.কম্।
—বললেই হল, আমার শাশুড়ি এখন ওখানে রোগশয্যায়।
—শাশুড়ি? তুমি আবার বিয়ে করলে কবে? —আঁদ্রের মুখটা কালো হয়ে গেল।
—আবার নয়, পুরনো।
—অর্থাৎ?
—রাজর্ষির মা। বাঁকুড়া বলে একটা টাউনে থাকেন। তা অসুস্থ হলে তো আমিই দেখাশোনা করি!
—আচ্ছা! আর রাজর্ষির কী খবর? সেই সন অব আ বিচ?
—রাজর্ষিকে ওই পরিচয় দিলে কিন্তু ওর মায়ের গায়েই বেশি লাগবে আঁদ্রে।
—ঠিকই।
নিজের সোনালি খুদে খুদে দাড়ি গজানো চিবুকটাতে একবার হাত বুলিয়ে নিল আঁদ্রে।
—আমার এজেন্ট এই হোটেলটায় বুকিং করেছে। পকেট থেকে পার্স বের করে বলল— ত্যাজ ব্যাংগ্ল্। অদিতি হেসে বলল, তাজ বেঙ্গল।
—চেনো?
—চিনি বই কী!
—ঠিক তেমনই, তেমনই আশ্চর্যজনক আছ তুমি ওদিৎ। ঠিক তেমনই। তুমি সব জানো, সব পারো, সব সময়ে আছ, আছ না? আমার জন্য?
হেসে ফেলল দু’জনেই। আঁদ্রে কি হাসির আড়ালে একটু বিঁধল? বিঁধতেই পারে।
কেন যেন তাজ বেঙ্গলের স্যুইটের লাউঞ্জে দু’জনের মাঝখানে একটা নীরবতা নেমে এসেছে। আঁদ্রে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী এত দেখছে? এ রকম চোখ এখন আর সহ্য করতে পারে না অদিতি। কী যেন বলতে চাইছে, বলতে পারছে না। অদিতির ভেতর তেমন কোনও প্রতীক্ষা নেই। একটা ধূসর আনন্দ আছে। কতদিন পরে দেখা, সেই আঁদ্রে যার সঙ্গে তার প্রথম এবং একমাত্র কৈশোর প্রেম, বয়সের হিসেবে কৈশোর না হলেও তো সে কৈশোরই। প্রথম রোম্যান্টিক প্রেম। সব প্রেমের মধ্যেই রোমাঞ্চ নিশ্চয় আছে। প্রেম জিনিসটাই তো একটা বিচিত্র ম্যাজিক। তবু যেন রোমাঞ্চে রোমাঞ্চে সামান্য তফাত হয়। অনভিজ্ঞ তারুণ্য। প্রেমের লাবণ্য সেখানে কী নিবিড় রোমহর্ষেই না ফোটে। পরে সে আরও অভিজ্ঞ, শরীরে ও মনে। অব্যক্ত আকুলতাগুলোর মানে বুঝতে শুরু করেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া, সুগন্ধ গোলকধাঁধায় নিঃশেষে হারিয়ে যাওয়া আর তো হয় না।
রাজর্ষিকে তো সে তার কলেজ-জীবন থেকে চেনে। দারুণ ডিবেট করত। একটু চৌকো ধরনের কর্কশমতো চেহারা, মেয়েরা খুব পছন্দ করত। অদিতির সঙ্গেও যথেষ্ট তর্কাতর্কি হয়েছে। জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে। তারপরে তো এক বছর পরেই ও কলাভবনে চলে গেল। দু’জনের পথ একেবারে আলাদা হয়ে গেল। সেই পথ আবার প্যারিসে এসে মিলবে কে ভেবেছিল?
—হাই অদিতি!
—আরে রাজর্ষি! তুই কোত্থেকে?
—এসে পড়লাম। কর্নেল থেকে পোস্ট-ডক করলাম। কাছাকাছি পেয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু প্যারিস, খোদ প্যারিসে, পাস্তুর ইনস্টিট্যুটে কাজ করতে পারব— ধারণা ছিল না। তা ছাড়া জানতাম তো তুই আছিসই।
—হ্যাঁ আমি তো আছি। তাতে কী? তোর কোনও অসুবিধে হচ্ছে?
—ধুর। অসুবিধে আবার কীসের? আরে তুই আছিস বলেই তো খুঁজে খুঁজে চলে এলাম।
—ইয়ারকি মারছিস?
—অনেস্ট। এইভাবেই তো এগোল আঁদ্রের সঙ্গে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। সময়টা তো খুব যন্ত্রণাহীন কাটেনি। যত সে যন্ত্রণা পেয়েছে, তত কাছে এসেছে রাজর্ষি। সে তার কাঁধে মাথা রেখেছে নীল মুখে। রাজর্ষি তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছে।
তারপর একদিন বলল—যদি বা আমার সুদিন এল, তুই এমন করছিস যে আমার সব মাটি হয়ে যাচ্ছে।
—সুদিন? কী হয়েছে তোর? আরও বেশি অফার পেয়েছিস?
—নাঃ অফার আর পেলাম কোথায়! অফার করছি নিজেকে। কবে থেকে তোর পেছনে ছুটছি অদিতি তুই ফিরেও তাকাচ্ছিস না! তোর জন্যে ডক্টরেট করলাম, ফেলোশিপ নিয়ে বস্টন গেলাম। নিজেকে সর্বগুণান্বিত করে ফেলেছি হেনকালে অঘটন। অদিতি সরকার আর সরকার নেই, বোর্দো হয়ে গেছে। ভাবতে পারছিস আমার অবস্থাটা!
—আমি তো এসব কোনওদিন জানতুম না!
—তুই ছাড়া আর সবাই-ই জানত বোধহয়। মৃণাল, নন্দন, শমিত সব কী নাম দিয়েছিল জানিস আমার?
—কী?
—এ.ও.আর।
—মানে?
—অদিতি-অবসেসড রাজর্ষি। ফুট করে এমন কেটে পড়লি! মনীষার কাছে অনেক পরে জানতে পারলাম তুই সেজান হতে গেছিস।
কতক্ষণ চুপ করে বসেছিল অদিতি। তার জীবনের এত বড় ঘটনাটা তার অজান্তে ঘটে যাচ্ছিল।
আস্তে, খুব আস্তে, রাজর্ষিকে নিতে পেরেছিল সে। যা প্রথমে পারস্পরিক ছিল না, একান্তভাবেই রাজর্ষির ছিল, তা তার নিজের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেরি হয়েছে, কেননা সে ইতিমধ্যেই পোড়-খাওয়া। কিন্তু যখন একবার নিল, তখন মনেপ্রাণে নিয়েছিল। খুব উজ্জ্বল, আনন্দময় ছিল সেসব দিন। কত কাজের সকাল, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি দু’জনে মিলেমিশে করা, তাকে আস্তে আস্তে ছবি চেনানো, কত সাহিত্য পড়াল রাজর্ষি তাকে। ক্ল্যাসিক। বিজ্ঞানের লোক হলেও অক্লান্ত সাহিত্য পড়ুয়া ছিল সে। কত ভ্রমণ! খুঁটে খুঁটে ফ্রান্স দেখা। ইয়োরোপ দেখা ছিল না রাজর্ষির। আবার তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখা। একটা অসম্ভব বন্ধুতায় পূর্ণ কানায় কানায় ভরা দিঘির মতো সম্পর্ক। নষ্ট হয়ে যায়? এসব নষ্ট হয়ে যায়? যেতে পারে? রাজর্ষি যেন আলাদা কেউ নয়, তার নিজের হাত-পা’র মতো একান্ত নিজস্ব। কেউ কি ভাবতে পারে সেই হাত সেই পা একদিন নিজ শরীরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? কেউ কি ভাবে তাকে এইভাবে কেটে বাদ দেওয়া যায়? এবং তখন সে অঙ্গ এমন অসাড় যে কোনও ব্যথা লাগে না!
তুমি একটা অলীক মানুষের সঙ্গে বাস করছিলে অদিতি। একটা ধারণার সঙ্গে, সে ধারণা মানুষটির আচরণ থেকেই তৈরি হয়ে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তবু তুমি তার ভেতরে মিথ্যে মানুষটাকে দেখতে পাওনি। সবটাই মিথ্যে কি! রাজর্ষি মনীষার কাছে পরে কান্নাকাটি পর্যন্ত করে গেছে, অদিতিকে ছেড়ে সে থাকতে পারছে না। সে অদিতিকে ভালবাসে। ওটা একটা ভুল। পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়েছিল সে। তুই বনিকে বল, বল।
—আমি বলতে পারব না রাজ, তুই হয়তো বাসিস, আমি তোকে বিশ্বাস করছি। কিন্তু বনি আর তোকে বাসে না। কী করবে বল। ট্রমা, একটা মারাত্মক ট্রমা ওকে তোর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। তা ছাড়া বুঝিস না কেন, ও একেবারে অন্য রকম। সেন্ট পার্সেন্ট সিনসিয়ার, সরল, অথচ আবার এত ওস্তাদ খেলোয়াড়ও। ও বুঝতে পারে, প্রথমে না পারলেও পরে পারে। একটা গা-ছমছমে ক্ষমতা আছে ওর। তখন নিজেকে নানা কৌশলে সরিয়ে নেয়। মরে যাবে তবু মিথ্যেকে কখনও সহ্য করতে পারবে না ও। কম্প্রোমাইজ করবে না।
তখন অদিতি শিল্পীমহলে বেশ পরিচিত নাম। কত যে গুণমুগ্ধ ছিল! প্রচণ্ড স্ক্যান্ডাল হল। সবাই ভীষণ দুঃখিত। আহত অদিতির তরফে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছিল— এসব অদিতির বাড়াবাড়ি। এ রকম মুখ বদলানো তো মানুষ মাত্রেরই স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক তাকে তো স্বীকার করাই ভাল। আঁদ্রেই একমাত্র বলেছিল— ওদিৎ খাদ্য বা খাদক-জাতীয় নয়। কী করা যাবে! শি কান্ট হেল্প হারসেলফ, ক্যান শি?
কোনও-না-কোনও মিথ্যা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে আজ সে এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কলকাতায়, তার নিজের পোড়ো বাড়িতে, দ্বিতীয় স্বামীর মাকে শেষ শয্যায় সেবা করছে। আর তাজ বেঙ্গলের এই সজ্জিত ঘরে— এখন তার সামনে বসে তার প্রথম স্বামী আঁদ্রে বোর্দো। যার সুবাদে ‘সাহেবের এঁটো’ নামটি তার জুটেছিল! আর যার জন্য কলকাতার বিদগ্ধ কলারসিক মহলে আড়ালে মাঝেসাঝেই তার উল্লেখ করা হয় অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকার বলে। বস্তুত অনেক শিল্পী-দাদা ভাবেন খুব সহজেই তাঁরা অদিতি নামে মেয়েটিকে পেয়ে যেতে পারেন কেননা সে তো দু’বার বিয়ে করেছে, দু’বার বিয়ে ভেঙেছে, এবং তার সন্তানও নেই। এ অপ্সরী ক্লাস না হয়েই যায় না!
—কী হল ওদিৎ, কোথায় বিচরণ করছ? স্মৃতিতে কি?
—বোধহয় সত্তায়। কী হয়ে গেল, কেন হল, কী লাভ হল এসবে, মানে কী এর? খুঁজছি নিজের মধ্যে। বোধহয়। আঁদ্রে আমি ঠিক জানি না। —অদিতি হাসল।
—ওদিৎ, আমি কিন্তু সম্প্রতি মাতৃহীন হয়েছি। আমি কি তোমার করুণা পেতে পারি না?
—নিশ্চয়। খুব দুঃখিত আমি আঁদ্রে। তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। আমারও মা তো আমার হাতের ওপরেই গেলেন!
দু’জনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আঁদ্রে বলল— কষ্টটা কার জন্যে হচ্ছে বুঝতে পারি না ওদিৎ। বোধহয় স্মৃতির মা। যিনি সবুজ ঘাসের ওপর টলটল করতে করতে পড়ে গেলে ধুলো ঝেড়ে আবার তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেন। যিনি মাঝরাত্তিরে উঠে এসে দেখে যেতেন, ছেলে ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে কিনা। অসুখ করলে যিনি পাশে বসে থাকতেন।
—আমি যে মায়ের জন্য কষ্ট পাই আঁদ্রে তিনি সর্বক্ষণ আমার ভেতরে থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছেন। তাই আমার কিছু হয় না জানো? কিন্তু সেই মাকে যে আমি আর বাইরে দেখতে পাই না, ছুঁতে পারি না— এই কষ্টে মাঝরাতে কেঁদে উঠি। সকাল হলে আবার কাজে যাই। হইহল্লা, কাজকর্ম। এই ধরো এখন তোমাকে আনলুম— গল্প করছি এখন কেমন।
—তোমার মাঝরাত্তিরের কষ্টে আর কেউ নেই ওদিৎ?
—স্বপ্নে আছ আঁদ্রে, কষ্টে আর নেই।
—রাজর্ষির জন্য কষ্ট কি আমার জন্য কষ্টকে চাপা দিয়ে রেখেছে! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না আমার জন্যে তোমার কোনও কষ্ট নেই।
অদিতি সোজা হয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে হাসল, তারপরে বলল—কী করে বললে কথাটা, তোমরা ছেলেরা বড় ইনসেনসিটিভ।
—কেন?
—তুমি বুঝতে পারো না রাজর্ষি আমার অ-সুখ নয়? আনহ্যাপিনেস নয়, ও আমার এক রোগ, ডিজিজ। রোগকে
কেউ মনে রাখে? রাখে, যে রোগের শিয়রে মা, তাকে নিশ্চয়ই মনে রাখে।
—রাজর্ষি যদি তোমার মৃগী রোগটোগ হয়ে থাকে, আমি তা হলে আবার জার্মান মিজল্স্ নই তো?
হাসতে হাসতে কথা শেষ হল তখনকার মতো। আঁদ্রে চান করতে গেল। ঘরে খাবার আনিয়ে দু’জনে নানান গল্প করতে করতে খেল। আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসতে লাগল। অদিতি তার নীল ওড়না গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে বলল— আমি চলি। মা আবার ভাববেন।
—মা?
—রাজর্ষির মা।
—ও—হ্।
—আঁদ্রে, আমরা বন্ধু, কেমন?
অদিতি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। আঁদ্রের মুখের ছায়া সে দেখতে চায় না। আবার তা হলে সে ছায়া স্বপ্নে তাকে তাড়া করবে। আবার একটা ছায়ার ছবি! এত ছায়া-ছবি সে আঁকতে চায় না। চায়নি কোনওদিনই। তার সামনে বরাবর লাফাত ছটফটে হলুদ সকাল। পাখির গোলোকধাঁধায় উড়ে উড়ে বেড়াবার নবীন আহ্লাদ, তার সামনে ফুটে উঠত অলৌকিক গাছেরা, ঘাস ঝরত জ্যোৎস্নার মতো। নদীরা এপাশ-ওপাশ করত তার চিত্রী-চেতনায়, মজুর মেয়ের ভালবাসা আবক্ষ নুয়ে পড়ত মজুর যুবকের প্রতি। আঁদ্রে বলত, আরও অনেকেই বলত— তুমি আনন্দের শিল্পী ওদিৎ। প্যারাসলের তলায় পানরত প্যারিস নাগর-নাগরীদের চুম্বন, ভেজিটেব্লসে্র এইসব রং, শাগালের মতো মমতাময়, কত রকম নীল তোমার সমুদ্রে তোমার আকাশে। দেখো আবার পুরোপুরি বিমূর্তে চলে যেয়ো না।
চোদ্দো
একটা চমৎকার শান্তি আজ! তাঁর হৃদয়টা এবার স্থির হয়ে এসেছে। আত্মবিশ্বাস বরাবরই আছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা খায়। মানুষ জীবন কাটাতে কাটাতে কোথাও না কোথাও তো ভুল করে ফেলে। অন্যায় করে ফেলে, ফেলতেই পারে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই সে একটা কৈফিয়ৎ খাড়া করে। সেই অন্যায়ই প্রকৃত অন্যায় যার জন্য নিজের মনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। পার পাওয়া যায় না। খুব ভাল করে মনের আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখেন তিনি অনেক সময়ে। তেমন কিছু করেছেন কিনা। ভুল তো অনেক করেছেন। ভুল করেছেন খেলা ছেড়ে দিয়ে বা বলা ভাল খেলার সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে দিয়ে। কেননা খেলা তো তিরিশের পরে ছাড়তেই হয়। দম নিচ্ছেন, দম নিচ্ছেন, মাটিতে হাত। হুইস্ল বাজল, মুহূর্তে বন্দুকের ভেতর থেকে গুলির মতো ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সবাই। পাশে পাশে দৌড়োতে থাকছে খড়ির রেখা। কী আরাম! আহ! পৌঁছে গেছেন! দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়াতে লম্বা লাফ, বালিতে কোলে করে নিয়েছে এখন। পর্যাপ্ত, পর্যাপ্ত আহ্লাদ। লেখাপড়ায় যদি আর একটু খারাপ থাকতেন তা হলে বোধহয় স্পোর্টস-কেরিয়ারটা চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা তো ভালই হচ্ছিল। আরও মনোযোগ দাবি করছিল। দিতে ভালও লাগত। তা ছাড়া রোখ ছিল। দাদা বলেছিল— তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, ওই হনুমানের মতো লম্ফঝম্প করেই জীবন কাটবে। এখন সেই দাদা কোথায়? তাদের আদরের বনির যখন বিয়ে দিয়েছিল বিশাল অঙ্কের ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে, তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেটা আরেকটা ভুল। পাঁচ বছর, মাত্র পাঁচ বছর, চেনাশোনা হতে-না-হতেই কী অজ্ঞাত রোগে সাগরেই চলে গেল। তারপর তিনি বি. এড. করলেন। এক মারোয়াড়ি বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা নার্সারি স্কুল করলেন। দু’-এক বছরের মধ্যেই স্কুল যখন রমরম করে দাঁড়িয়ে গেল, তখন একদিন স্কুলের টয়লেটে যেতে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কার মুখ? একজন গম্ভীর গম্ভীর, খুব ফ্যাশনদুরস্ত হেডমিস্ট্রেস। প্রিন্সিপ্যাল। চোখে ভাবনা, ঠোঁট চাপা, ফরসা রং উজ্জ্বলতর, কেননা এখন আর মাঠে যান না। সন্ধেবেলায় সাউথ ক্লাবে টেনিস। ব্যস, এইটুকু। তাতে শরীরটা ফিট থাকে, কিন্তু কোথায় সেই প্রাণোচ্ছ্বল, হাসিতে ফেটে পড়া টেবল-চাপড়ানো অ্যাথলিট মেয়ে!
কিন্তু শ্রীলার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া? এটা কি তাঁর ভুল, না অন্যায়? তিনি পাশে পাশে না থাকলে শ্রীলা যেটুকু পেরেছে সেটুকুও কি পারত? দু’জনেরই ভাল ভাল বিয়ে হবে কী খুশি দু’বন্ধু! গলাগলি করে হাসছে। আদতে দেখা গেল সর্বাণী চিরবিরহের জালে বন্দিনী। আর শ্রীলা যেন তেমন মধুর হাসে না আর। চেহারাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, হাসিটা কেমন ধরা-পড়ে-যাওয়া ছিঁচকে চোরের মতো। চোখ খরগোশের মতো চকিত কখনও, কখনও নিবে-যাওয়া প্রদীপের মতো ম্রিয়মাণ। কী হয়েছে রে শ্রী? কিছু তো হয়নি! তুই তো… তোর বর তো দিনের পর দিন জলে। তুই আমার কাছে ছুটির দিনে সারা দুপুর, সারা সন্ধে থাক সর্বাণী।
থাকতে থাকতে বুঝতে পারলেন কী এক অনির্দেশ্য গরমিল এদের দু’জনের মধ্যে। কিছুতেই যেন একটা বিন্দুতে এসে মিলতে পারে না। তাঁর শৈবাল অমন ছিল না। যখন বাড়ি আসত, কতটা প্রতীক্ষা নিয়ে আসত। আর যখন তিনি ওর সঙ্গে ভাসতেন, তখনও কী আনন্দ! কোথাও কোনও খিঁচ ছিল না। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিল, তাঁর যদি বাইশ তো তার ছত্রিশ, সাঁইত্রিশ। চমৎকার স্বাস্থ্য, টেনিসে তো ও-ই স্থিত করাল তাঁকে। বলত, আর তেরোটা বছর চাকরি করব ব্যস। তারপর একটা ছোটখাটো কিছু ব্যবসা করব, আর লাইফ এনজয় করব। সে সুযোগ হল না। তাঁকে ‘ধনী বিধবা’ করে রেখে সে পাঁচ বছরের মধ্যে চলে গেল। নবগোপালকে শ্রীর যত খারাপ লাগত তাঁর কোনওদিনই তত খারাপ লাগেনি কিন্তু। আসল কথা নবগোপালের একটা স্পোর্টস ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। ক্রিকেট খেলত, পরে টেনিসে বেশি ঝোঁক এসে যায়। অনেক স্পোর্টসম্যানের একটা স্থূল একরোখা সব উড়িয়ে দেওয়া স্মার্টনেস থাকে। সূক্ষ্ণ ভাবনা-চিন্তা, পড়াশোনা, এসবের ধার ধারে না। কাঠখোট্টা। নবগোপাল ছিল ওই রকম। একত্রে টেনিস খেলতে খেলতে বোধহয় তাঁদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে যায়। তাই অসুখী শ্ৰীলা আর অশান্ত নবগোপালের মধ্যে হাইফেনের মতো তিনি বিরাজ করতেন। শ্রীলার সব সুখে দুঃখে তিনি তার পাশে থেকেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, ওদের দাম্পত্য-সংকটে মধ্যস্থতা করেছেন কতবার। মিমি যতটা শ্রীর হাতে ততটা তাঁর হাতেও মানুষ হয়েছে। মাঝখানে বাবার অনুপস্থিতির বড় বড় ফাঁক আর সেই ফাঁক আদরে প্রশ্রয়ে ভরিয়ে দেওয়া। দু’জনেরই। কী যে আঁকড়ে ধরেছিল শ্রী মিমিকে! ফুটফুটে মেয়ে-বাচ্চা সারা বাড়ি যেন ভরে রাখত, কোথায় উধাও তখন অশান্তি, ভয়, অস্থিরতার সেই চাপা হাওয়া। ঝলমল করছে সমস্ত বাড়ি। যত বড় হল, তত অন্য রকম হয়ে গেল। স্কুলে যখন ঝগড়া করত, এর চুলের ঝুটি ধরে, ওকে ভেঙিয়ে, তিনি শুধু সামনে এসে দাঁড়ালেই শান্ত। কত ভালবাসত তাঁকে?
নবগোপাল যেদিন বিয়ের প্রস্তাব করল সেদিনই তাঁর খুব বিভ্রান্ত একটা অবস্থা হয়েছিল। তবে কি নিজের অজান্তে তিনি এই পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছিলেন? শ্রীর স্বামীকে কি তিনি ভেতরে ভেতরে কেড়ে নিচ্ছিলেন? তাঁর নিজের না হলেও নবগোপালের কি তাঁর ওপর আসক্তি জন্মাচ্ছিল? খুব গোপনে! কখনও প্রকাশ পায়নি। কক্ষনও না! শ্রী কি কিছু ভেবেছিল? আন্দাজ করেছিল? একদিন যখন শ্রীর সামনেই ওই পাগলি মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল— তুমি কেন আমার মা হলে না আন্টিমাসি? ওর মুখের অবস্থা তক্ষুনি কী হয়েছিল তা তো তিনি দেখতে পাননি। তিনি তখন হালকা করে বকলেন ওকে—আমি মা? তা হলে আর তোমাকে এত আবদার আর শয়তানি করতে হত না মিমি!
পরে কিন্তু শ্রী বলেছিল— ও ঠিকই বলেছে। আমি কারও মা হবার যোগ্য নই সর্বাণী।
—ও-ই কি মেয়ে হবার যোগ্য? —মেয়েরও কিছু দায়িত্ব থাকে।
—আমি যেমন মানুষ করেছি। দুর্বল হাত দুর্বল মন।
—ছোট বয়সটা কেটে গেলে কিন্তু এসব চলে যায় রে শ্রী! ওর যাচ্ছে না। এটা ওর নিজের স্বভাবের ব্যাপার।
এই পর্যন্তই। আর সেই ও.টি-তে নিয়ে যাবার আগে— আমার কেউ নেই, মেয়ে, স্বামী… শুধু তুই-ই আছিস। কিন্তু আমাকে কেউ না চাইলেও আমি তো ভাবনা এড়াতে পারি না। মানুষটা অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে— তুই বাঁচা।
অপারেশন টেবলেই চলে গেল। কী বিবর্ণ সন্ধে! তিনি অপেক্ষা করে বসে আছেন। একা। বন্ডে সই করে চলে গেছে নবগোপাল। থাকত, কিন্তু জরুরি কল, যেতেই হবে— লন্ডন। বলে গেল— তুমি তো আছ!
মিমি এসে আবদার ধরল—এক্সকার্শন, সুন্দরবন অঞ্চলে তিনদিন। সব নাকি ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
—যাই আন্টি?
—মায়ের যে অপারেশন রে!
—ও তো কিছুই না। আর তুমি তো আছ! জাস্ট দু’দিন।
গিয়ে মুখ দেখলেন। শান্ত, করুণ, মধুর, যেমন কলেজের দিনগুলোতে, হোস্টেলের দিনগুলোতে ছিল। এই সূক্ষ্ম অতিভঙ্গুর মোমের মানুষটাকে কেউ বুঝল না? তাঁর শৈবাল বলত— মেয়েরা সাধারণত এমন হয় যে তাদের রক্ষা করা একটা খুব সুন্দর দায় হয়ে থাকে আমাদের। বেশিরভাগ ছেলেই এমনি বউ চায়। আমি চাইনি। কেননা আমার সে দায় নেবার উপায় নেই। তোমাকে খুব ভাল লেগেছিল, আকর্ষণীয়। কিন্তু একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম— ইউ ক্যান টেক কেয়ার অব ইয়োরসেল্ফ। এইটেই আমার কাছে তোমার সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট। তা শ্রী তো সেই রকম মেয়েই ছিল যাকে রক্ষা করতে আগলাতে ভাল লাগে নবগোপালদের। তা হলে? লন্ডনে ফোন গেল। শব রইল ঠান্ডাঘরে। বিপর্যস্ত নবগোপাল এসে প্রথম কথাই বলল— পারলে না? পারলে না বাঁচাতে! —তার গলাতে তখন আকুল খেদ। অনুশোচনা।
কিন্তু এ কী কথা! তিনি বাঁচাবার কে? সবাই মিলে যাকে তিলে তিলে মেরেছ, তার মৃত্যু আমি আটকাব কী করে নবগোপাল?
কথাটা তিনি বলেছিলেন নবগোপালকে।
মাথা ঝুলিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ।
যাক তবু পোস্ট-মৃত্যু অনুশোচনাটুকু পেল শ্রী।
আর মেয়ে? —কী হিস্টিরিয়া! কী হিস্টিরিয়া! —মা তুমি ফিরে এসো আর তোমাকে বকব না। মা তুমি ফিরে এসো তোমার সব কথা শুনব। হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।
শ্রীর আলমারির চাবি তো তাঁর কাছে ছিল না। কত শাড়ি সেখানে না-পরা পড়ে রয়েছে। তিনি নতুন কালো নকশা পাড় টাঙাইল কিনে পরিয়ে দ্যান। লাল মোটে পছন্দ করত না শ্রী!
—ওঠো মিমি, এবার ওঠো!
—পারলে না! তোমার কাছে রেখে গেলাম! কত নিশ্চিন্তে গিয়েছিলাম!
শ্রী মারা গেল, তার শেষ সময়ে স্বামী কন্যা কেউ ছিল না, সুতরাং তিনি অপরাধী। কী অদ্ভুত এদের প্রতিক্রিয়া!
তারপর প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে, স্কুল থেকে ফেরবার সময়ে একবার করে ওদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসা। তখন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এসেছে মিমি। বাচ্চা মেয়ের মতো তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত এক এক দিন কলেজ থেকে ফিরে এসে। কী নিশ্চিন্ত নির্ভর! ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা তাঁর বড় প্রিয় ছিল। যদিও তার ধরনধারণ পছন্দ করতে পারছিলেন না। একটু একটু করে কঠিন হচ্ছিলেন। খুব একটু একটু। বাগেও আসছিল কিন্তু।
—অ্যাডভার্টাইজিং পড়লি, এবার একটা চাকরিটাকরি কর, দেখবি খুব ভাল লাগবে। আর বিয়ের ব্যবস্থা তো তুই বললেই করতে পারি।
—খবরদার আন্টিমাসি। বিয়ে আমি নিজে করব, যাকে ইচ্ছে, পছন্দ না হলে ছুড়ে ফেলে দেব। আবার করব, না-ও করতে পারি। এই জায়গায় কেউ হাত দিতে আসবে না।
—তা বেশ। কিন্তু একটা কাজ নিয়ে তো থাকবি। তনিকা যেমন দ্যাখ ছবি নিয়ে মজে আছে!
—সে তনির ট্যালেন্ট আছে। আমার যদি না থাকে তো আমি কী করতে পারি!
—তা হলে তোর এখন প্ল্যান কী!
—দেখি, ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটা করব ভাবছি।
মনে মনে বললেন— কবে তোমার কোর্স শেষ হবে মিমি! যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু কোনওটা ভাল করে করবে না। এক একটা পড়তে যাবে, আলাদা আলাদা বন্ধু জোটাবে আর হি-হি হা-হা। আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছে দশটা। এগারোটা একদিন। সেটা দেখেন বিয়ের পর।
বাবার বিয়ের পরই খেপে গেল একেবারে। দু’জনে রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন বিছানা লন্ডভন্ড। চতুর্দিকে ভাঙা বাসন পড়ে আছে, রক্তাক্ত পায়ে মিমি বসে আছে।
—এ কী! পঞ্চমী! মিমি এতটা পা কেটেছে! কী করে?
পঞ্চমী বলল— কী জানি, যেই তোমরা বেরিয়ে গেলে মাসি, অমনি সব ভাঙচুর শুরু করল। আমি তো নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম ভয়ে।
ডাক্তার ডাকা হল, পা থেকে টুকরো টুকরো কাচ বার হল, ওষুধ হল, ব্যান্ডেজ হল। ক’দিন ঘরবন্দি। বেরোতে পারছে না। তিনি খাবার দিতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিল।
বলল— পঞ্চমী দেবে।
তিনি নবগোপালকে বললেন— সামলাও এবার।
—এ রকম করবে তো বুঝতে পারিনি! তুমি পেরেছিলে!
—একটুও না।
নবগোপাল গিয়ে রাগ রাগ গলায় ডাকলেন— মিমি!
উত্তর নেই।
—এ রকম করেছ কেন? ভাঙচুর, চুরমার, নিজের পা-ফা কেটে একসা।
—যাও যাও, নতুন বউয়ের কাছে যাও।
—মারব এক থাবড়া। অসভ্যতা করবে না একদম। আমার নতুন বউ হতে পারে কিন্তু ও তোমার অনেক পুরনো মা, মনে রেখো। ও করতে চায়নি। আমিই জোর করেছি। আমার সংসার ভেসে যাবে, তুমি ভেসে যাবে বলে।
—আমার কথা কাউকে ভাবতে হবে না— ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।
নবগোপাল মাথায় গিয়ে হাতটা রাখলেন, নরম গলায় বললেন— তোমার মা তো কিছুতেই আর ফিরে আসবে না। আমাদের স্বার্থে আর তুমি ভালবাসো বলে তোমার মাসিকেই এনেছি। এ নিয়ে কোনও কম্প্লিকেশন আমি কিন্তু সহ্য করব না। তুমি ছেলেমানুষ নও। উইটনেস হিসেবে তোমাকেও আমরা ডাকতে পারতাম। তোমার ওপর এত কনফিডেন্স ছিল আমাদের। তুমি সবই জানো, বলে রেখেছি, এমনকী কাউকে খাওয়াইনি পর্যন্ত। তোমাকে নিয়েই আমরা আজ খেতে যেতাম। এ কী? এ রকম করবে তাই বলে?
মুখ গুঁজে ছিল, মুখ তোলেনি, খায়ওনি।
—আনপ্রেডিক্টেবল— নবগোপাল বলেছিলেন।
সকালে অবশ্য ফ্রিজ দেখে সর্বাণী বুঝেছিলেন ও খেয়েছে ঠিকই। পাউরুটির প্যাকেট খোলা, মাখন পড়ে আছে টেবিলে। দুধের গ্লাস সিঙ্কে নামানো, আইসক্রিমের থেকে স্ল্যাব কাটা, আপেল মনে হল একটা কম।
যাক। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হচ্ছিল না। তার ওপর ভাস্কর চক্রবর্তীর ব্যাপারটা বোধহয় বহুদিনের। শ্রীই প্রথম বলেছিল— খুব মিমি মিমি করে আদর করে, চকলেট আনছে, খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে, আমার ভাল লাগে না সর্বাণী।
—বলিস কী রে? বাবা অর্ধেক সময়ে থাকে না, মেয়েটা বাবাকে পায় না, একটা কাকু পেয়েছে বলে তো খুব খুশি ছিলি।
—তখন বুঝতে পারিনি। এখন কেমন সন্দেহ হয়। তখন মিমি ছোট ছিল। এখন বড় হয়ে গেছে, ওর বাবার বন্ধু ওর কাছে আসবে কেন। বল তো? আর আর্টিস্ট মানুষ ওর অত কী গল্প ওই একটুকরো মেয়ের সঙ্গে!
এমন নয় যে সবাই একসঙ্গে কোনও গল্পগাছা হত না। হয়তো শ্ৰী তিনি ভাস্কর সবাই আছেন, পঞ্চমী চা-টা দিয়ে গেল। মিমি ঢুকল একটা র্যাপ অন পরে, অক্সিডাইজ্ড্ দুল ঝুলছে কান থেকে—কাকু উ-উ—ব্যাগটা একদিকে চটি দুটো আরেক দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিল। দুই গালে চকাস চকাস করে চুমু। ব্যস তারপরেই সে একা কথা বলবে কাকুর সঙ্গে। মা বা মাসি কথা বলতে চেষ্টা করলেই—দূর চলো তো আমার ঘরে কাকু। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে।
—আহ্, আহ্— কী হচ্ছে মিমি… এখানে তো বেশ সবাই গল্প হচ্ছিল।
—দূর যত বুড়োটে বুড়োটে গল্প।
—আমাদের বুড়ো বানিয়ে দিলি?
আহ্, আহ্, করলে কী হবে, ভাস্কর চলে ঠিকই যেতেন।
—ওপরে গিয়ে একবার দেখে আসব? শ্রী?
—শ্ শ্ শ্— শ্রী মুখে আঙুল রেখেছে। বলবে আমার ওপরে স্পাইগিরি করছ?
তখন সর্বাণী পঞ্চমীকে ডেকে মিমির খাবার, আর তার কাকুর জন্যে আরও এক কাপ চা ওপরে পাঠিয়ে দিতেন।
—পঞ্চমী, পায়ের শব্দ করতে করতে যাবি না। ভাল লাগে না।
পঞ্চমী নেমে এল, কাগজ দেখতে দেখতে খুব সহজ গলায় সর্বাণী বলতেন—কী করছে রে মিমি?
—ওহ, মিমির কথা আর বোলো না, বক বক বক বক। যত বকবকানি কাকুর সঙ্গে।
—শুয়ে পড়েছে বোধহয় মিমি।
—না তো! খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বক্ বক্…।
দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসতেন। শ্রী বলত— ওহ্ মিমিটা না!
সর্বাণী বলতেন— খাবার পছন্দ মিমির? ভাস্করবাবুকে চা-টা কোথায় দিলি?
—কোথায় আবার? পড়ার টেবিলে। ওখানেই তো বসে আছেন উনি। খাবার আবার পছন্দ হবে না, তুমি নিজের হাতে করেছ না? পুডিং তো আগে এক চামচ কাকুকে খাইয়ে দিল।
—ওঁকে তো এখানে সবই দিয়েছি।
—দিলে হবে কী! সে তো উনিও বলছেন। ও আহ্লাদি কি শুনবে?
এই রকম। শ্রী চলে যাবার পর বাড়াবাড়িটা নবগোপাল নিজের চোখে দেখলেন।
—আচ্ছা ভাস্কর তুই এখনও সেই রকম ইয়ে রয়ে গেলি? মিমিটা পাগলি বলে তুইও কি ওর সঙ্গে পাগল হলি৷ কোলে বসবে কী রে তোর? একুশ-বাইশ বছরের মেয়ে।
—একুশ-বাইশ? তোর মেয়ে দশ-এগারোর পর আর বাড়েনি।
—ঠিকই— চিন্তিত মুখে বললেন নবগোপাল। সিগারেট ধরালেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন— বলেছিস ঠিকই। কিন্তু তুই তো আর নব কার্তিকটি নোস। বি কেয়ারফুল ভাস্কর। আই ডোন্ট লাইক হোয়াট আই সি।
সবটা মিমির সামনেই হচ্ছিল। মিমিকে শুনিয়েই।
ভাস্কর মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে হেলাফেলার সঙ্গে বলেছিলেন— দেখছিস মিমি। আর এসব মানায় না। বড় হয়ে গেছিস। বোঝ একটু!
তারপর একদিন নবগোপালের পুনর্লন্ডনযাত্রা। প্রতিদিন অবাধ্যতা, উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়ে যাচ্ছে যেন সর্বাণীকে দেখিয়ে দেখিয়ে। তিনটে ছেলে এল। ঘর বন্ধ করে তিনঘণ্টা কী করল কে জানে। দরজা খুলতে ভক ভক করে বিশ্রী সিগারেটের গন্ধ। আর তো সহ্য করা যায় না।
—মিমি! —ছেলে তিনটে চলে গেছে। তিনি ডাকলেন— মিমি!
চোখ তুলে তাকাল।
—কে ওরা?
—কে আবার? বন্ধু! তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।
—দরজা বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?
—বেশ করেছি।
—এখন বড় হয়ে গেছ, ছোটবেলার শাস্তিগুলো কিন্তু ভুলো না। আর একদিনও যেন না দেখি!
—কে? কে তুমি এসব বলবার? আমাকে!
—আমি কেউ হই বা না হই কথাগুলো শোনো। শুনে রাখো।
—আমার মায়ের জায়গা কেড়ে নিতে লজ্জা করেনি?
—মায়ের সঙ্গে দিনের পর দিন চূড়ান্ত অসভ্যতা করতে তোমার লজ্জা করেনি? মায়ের কথা তুমি বোলো না। তোমার এ সমস্ত নাটুকেপনা আমি বুঝি।
—লাগাবে? লাগাবে বোধহয় এবার বাবাকে! সৎ-মা গিরি শুরু হয়ে গেল। আমি এখানে থাকব না।
পরদিন সকালে দেখলেন নেই। সর্বনাশ!
তিনি হতভম্ব। চেনাশোনা যত বন্ধুর নম্বর ছিল তাদের ফোন করলেন, তনিকার কাছে যায়নি, রমিতার কাছে যায়নি, অর্ণব, সৌকান্ত, অনীশ কেউ জানে না, তিনি ভাবছেন— এবার পুলিশে খবর দেবেন নাকি। ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠল।
—আপনি কে আমি জানি না জানতে চাই না। আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর স্ত্রী। আপনাদের বাড়ির একটা শয়তান মেয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে থাকছে তার স্টুডিয়োতে। মিস্ট্রেস। জানালাম। যা বিবেকে বলে— করবেন।
যাক। এতদিনে ধাক্কা খেয়ে সেই ঘৃণ্য অধ্যায়টা শেষ হল।
পনেরো
তনিকা পরেছে একটা নাগাল্যান্ডের র্যাপ অন। টপটা অবশ্য বিদেশি। টপও ঠিক নয়। স্লিপ গোছের, হাত-কাটা। ওপরে একটা লেস লেস উপরাংশ আছে তার, কিন্তু সে সেটা পরেনি। অক্সিডাইজ্ড্ ধাতুর ওপর লাল পুঁতি বসানো ঝোলা দুল, গলায় দু’-তিন ছড়া পুঁতির মালা, হাতে পরেছে একটা কাঠের মোটা বালা, কোনও একটা ট্রেড-ফেয়ার থেকে কিনেছিল। লাল রং। রাজস্থানি গালার বালা একটা, সেই সঙ্গে অক্সিডাইজ্ড্ মোটাসোটা চুড়ি-বালার মধ্যবর্তী কিছু। পায়ে একটা ফটাস ফটাস চটি গলিয়ে নেয়। চেহারাখানা দেখবার মতো। লম্বা আয়না এ ঘরে নেই। মিসেস উইলিয়াম্সের কাছে ওপরে চলল। শুকনো ঝাড়ন দিয়ে মুছে মুছে কাচ পালিশ করছেন উইলিয়াম্স।
—আন্টি, তোমার ঘরে কেউ আছে?
—কী? —আমি একজন ভদ্রমহিলা, এই সকালে আমার ঘরে কে থাকবে?
—উঃ! তনিকার ঠোঁট দুটো একটু প্রসারিত হয়, —আমি তোমার লম্বা আয়নাটায় নিজেকে একটু দেখব।
—ফ্র্যাঙ্ক! ফ্র্যাঙ্ক! বেরিয়ে এসো।
তড়বড় করতে করতে সাদা ভুরুর ফ্র্যাঙ্ক বেরিয়ে আসেন।
—কী ব্যাপার? কী ব্যাপার? ডাকাত?
—টনিকার আজ সকাল থেকে পার্টি। শি হ্যাজ ড্রেসড্ আপ।
—আরে দেখি দেখি! —ফ্র্যাঙ্ক ভাবলেন— তাঁকে পার্টি-সাজ দেখতে ডাকা হচ্ছে, তাড়াতাড়িই বেরিয়ে এলেন, চশমা গলাতে গলাতে।
—আহ্! জংলি কোনও পার্টি নাকি? উইথ অল সর্টস অব ট্রাইব্যাল্স্! ইতিমধ্যে তনিকা শুট করে ঢুকে গেল। লম্বা আয়নাটা দেওয়াল থেকে ঝুলছে। পুরো চেহারাটা দেখা যায়। দুটো আঙুল ঠোঁটের ওপর চাপা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এদিক-ওদিকে একটু ঘুরল। ফ্র্যাঙ্ক আঙ্কল-ই অবশ্য আয়নার কাজটা করে দিয়েছেন। এইটাই তার পছন্দ। ঠিক এইটাই। র্যাপ অনটার সঙ্গে টপটা একেবারে যাচ্ছে না। তার সরু সরু হাতে অনেকগুলো চুড়িবালা। বেশ ঢলঢল করছে। প্রথমেই তার হাতের ওপর চোখ পড়বে লোকের। চোখের কাজলটা সে একটু ধেবড়ে নিল। এবার মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। যেটুকু বা যত্নের ছাপ ছিল, এবার সেটা চলে গিয়ে একটা বেশ ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ গোছের এফেক্ট। সে আন্টিদের হাত নেড়ে একছুটে নীচে নেমে যায়। তনিকা আজ ‘চিত্রভানু’তে যাচ্ছে।
ঝড় বৃষ্টি গরম— সবই চূড়ান্ত হয়ে গেল বেশ কয়েকবার। পার্ক সার্কাসের রাধাচূড়াগুলো কিন্তু এখনও সমান সতেজ। লেক পেরিয়ে সে চিত্রভানুতে যাবে। দু’ধারে কৃষ্ণচূড়া। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে বলল গাড়িটা একটু লেক-ক্লাবের দিকে রাখুন না।
—কী করবেন?
—আমি না আপনি। ওই যে ওই বেঁটে কৃষ্ণচূড়াটা! ওর তলার ডাল থেকে আমাকে একটু ফুল পেড়ে দেবেন?
—আচ্ছা, আপনি গাড়ির মধ্যে বসুন।
দিব্যি এনে দিল। একঝাঁক উজ্জ্বল হাসির মতো কৃষ্ণচূড়া।
যখন নামল, বুকের ওপর ফুলগুলো আঁকড়ে নামল সে।
একটা পার্কের ধারে বাড়িটা। বাইরে কিছু লেখা আছে নিশ্চয়। ঠিকানাটা সে জানে। কিন্তু এইসব অঞ্চলে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া দায়।
ওঃ ওই তো! একটা কাঠের দরজা, তার সারা অঙ্গে ছবি আঁকা। নিশ্চয় ওইটা। শিয়োর, ওরই ভেতরে লেখা ‘চিত্রভানু’।
দরজাটা আধখোলা ছিল। ঢুকেই সিঁড়ি। ডানদিক দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখল, একটা মস্ত বড় ঘেরা দালান, চারদিকে কাচ বসানো বড় বড় জানলা। দুটো-তিনটে ইজেলের সামনে কাজে মগ্ন দু’-তিনজন। পাশে উঁচু টুলের ওপর রঙের পেলেট।
পেছন থেকে মনে হল— ওটাই শৌনক। ইচ্ছে করে চটিটাতে একটু শব্দ করে এগোল সে। একজন পেছন ফিরল।
—দিদি আছেন?
এবার শৌনক ফিরে তাকাল।
—তুমি… সেদিনের তারাতলার সেই… মিমি…।
—আমি তনিকা। —একটু ক্ষোভের সঙ্গেই বলল সে। কেন যে তার সঙ্গে মিমিকে লোকে গুলিয়ে ফেলে! একই ধরনের চেহারা ঠিকই, কিন্তু তারা তো এক দেখতে নয়! ইমপ্রেশনটাও এক হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া তার এই এতখানি লম্বা-চওড়া চুলটাই তো প্রথম দর্শনে তাকে চিনিয়ে দেয়!
—স্যরি, আমার নামটাই গুলিয়ে গিয়েছিল। তোমাকে তো আগেও দেখেছি সেই অ্যাকাডেমিতে— দুর্দান্ত ছবিটা এঁকেছিলে… লাল বেড়ালের। ভার্মিলিয়নের সঙ্গে ঠিক কী কী মিশিয়েছিলে বলো তো? ব্যাপক, বীভৎস।
—দিদি নেই?
—আসছেন! জাস্ট একটু পরে।
আরও কতকগুলো ছেলেমেয়ে উঠে এল। কলবল করতে করতে একটা ঘরে ঢুকে গেল।
তুমি…চটিটা— শৌনক বলল।
—ওহ্ স্যরি।
সে সিঁড়ির এক পাশে চটি জোড়া খুলে এল। একটু বেশি নীচে নামতে হল, কেননা, প্রত্যেক ধাপে একজোড়া করেই জুতো বা চটি।
বেশ শৃঙ্খলা। এই রকম ভাল লাগে তার। ছড়ানো-ছিটোনো ব্যাপার তার দুটি চক্ষের বিষ। তবে হ্যাঁ বিশৃঙ্খলাও আবার। বিশৃঙ্খলা নয় বৈষম্য— যেমন তার ড্রেস।
—ফুলটা কি দিদির জন্য এনেছ?
—তোমার জন্যে নিশ্চয় নয়।
তুলি রেখে ছেলেগুলো সব ঠা-ঠা করে হেসে উঠল। ভেতরের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে এল—আমাদের বাদ দিয়ে কী এত হাসি মারছিস রে? ডেকে নিবি তো! এবার ভাল করে চোখ পড়ল তনিকার ওপর। দু’-তিনজন ওকে চিনতে পারল বোধহয়? শৌনক বলল— এই কাজল, ওই রুদ্ধ মানে অনিরুদ্ধ আমরা রুদ্ধ বলি, এটা গিয়াস— গিয়াসুদ্দিন বলবন আর কী! প্রাক্তন সম্রাট। আর রুদ্ধ অ্যান্ড কোং এই তনিকা। আগামী দিনে আমাদের ভাত মারতে আসছে।
—সত্যি, তনিকা তুই ‘চিত্রভানু’তে আসছিস! একটি মেয়ে বলল— কী ভাল হয়! জানিস তো এখানে আমরা মাইনরিটি। আমি আর চৈতালি ছাড়া আর কোনও মেয়ে নেই। এইবার দুই থেকে তিন হলাম।
—এক ঘড়া গঙ্গাজলে তিন ফোঁটা চোনা— কাজল বলে ছেলেটা বলে উঠল…
হংস মধ্যে বক বলতে পারতিস তো! রুদ্ধ বলল, এটাই চূজ করলি কেন?
—আরে বক, হংস, হংসবলাকা ও সব এখন রবিঠাকুর থেকে হেমন্ত মুখোর গানে ঢুকে বসে আছে। লোকসাহিত্য থেকে এইটেকে টেনে তুললাম। পোস্ট-মড বলতে পারিস।
—এই-এই-এই কাকে এত হিড়িক দিচ্ছিস রে… বলতে বলতে ওপরে উঠে এলেন অদিতি। সেই প্যান্ট আর কুর্তা। আঁকাআঁকির মধ্যে থাকলে বোধহয় উনি এমন ড্রেসই পরেন।
—আরে! অনো… দূর তনিকা… সমস্ত মুখে একটা দীপ্তি ছড়িয়ে গেল।
—আপনি আসতে বলেছিলেন…।
—এই এই— দিদিকে আপনি বলছে রে! গিয়াস বলল— এবার বোধহয় আমাদেরও পেন্নাম করবে।
—এই পেন্নাম বলতে নেই, বল কদমবুসি৷ পলিটিক্যালি কারেক্ট।
—চন্নামিত্তিরও খেতে পারে। —কাজল উদাসভাবে বলল।
—দিদি আমি যাচ্ছি। —তনিকা রেগে লাল হয়ে পেছন ফেরে..।
—না, না কোথায় যাবে? তাড়াতাড়ি এসে হাত ধরলেন। শরীরের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল একটা।—ওদের কথা বাদ দাও। ওরা সব পাগল। খ্যাপা।
—শেয়ানা পাগল! তনিকা বলল, ভাবলেশহীন মুখে।
খুব একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল ‘চিত্রভানু’তে।
—এই যে বাবা, পথে এসো, এতক্ষণে ‘পাস-ওয়ার্ড’টা বললে। —কাজল চোখ দুটো মজার মতো করে বলল।
—তা তুই-ও তো খ্যাপা কম না তনিকা, আর… আর… বেশ শেয়ানাও। হেসে ফেললেন অদিতি— চল তোকে সব দেখাই।
ভেতরে তিনটে ঘর, একটা পুরোই পার্মানেন্ট প্রদর্শনী এটা।
—দ্যাখ ওদের ফিনিশ্ড ছবিগুলো এখানেই থাকে, ক্লায়েন্ট এলে দেখাই। অনেক সময়ে নিয়েও যাই।
—দিদি! অবাক চোখে তনিকা চেয়ে আছে—দেওয়ালে ওর ‘ফেলাইন মর্নিং।’
—ওটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছেন তোমার মাস্টারমশাইরা। আমি চেয়েছিলাম। কিনতেই চাই। কিন্তু ও রকম নিয়ম বোধহয় নেই, কলেজের সম্পত্তি নাকি। ওঁরা উপহার দিয়েছেন। আর এখন আমি ওটা চড়াদামে এক ফরাসি আর্ট কালেক্টরকে বিক্রি করব…
—ফরাসি! …তনিকার চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে।
—হ্যাঁ ফরাসি। দামটা হাঁকব খুব… উনি প্রোমোটও করেন শিল্পীদের। আর ওই টাকাটা তুমি পাবে।
—আমি? আমি কেন?
—বা ওটা তো তোমারই।
এখন তো আপনার!
যদি বিক্রি করার সুযোগটা না পেতুম, তা হলে ওটা আমারই থাকত। কিন্তু ওই ভদ্রলোক—এই ডিসপ্লেটা দেখে গেছেন। বেশ কয়েকটা পছন্দ করেছেন। এদের সবার মন আজ খুব ভাল তাই। ছবিটা যেখানে ছিল চুপচাপ থেকে যেত। এবার ছবিটা দেশভ্রমণ করবে। তুমিও। নিশ্চয়। টাকাটা তোমারই প্রাপ্য।
—না, তা…।
—এ রকম গাঁইগুঁই করলে কিন্তু শুধু ছবি আঁকাই হবে তনিকা, ছবি বিকোনো হবে না। আমি যতটা আর্টিস্ট, তার চেয়ে বেশি এখন আর্ট প্রোমোটার। রাইট?
ঠিক আছে। আত্মসংযম, ডোন্ট কেয়ার… সব সত্ত্বেও তনিকার মনটা ভরে যাচ্ছে। কেমন একটা ডানা মেলে শাঁ শাঁ করে উড়ে যাবার ইচ্ছে। নিজের হাতে ছবি এঁকে রোজগার! পাশ করার পর প্রথম বছরেই! এর আগে কয়েকটা ওয়ার্কশপে বা বড় কাজের মধ্যে অন্যতম শিল্পী হিসেবে কাজ করে রোজগার হয়েছে তার। কিন্তু এটা দাদা-বউদিকে একটা মস্ত চমক দেওয়া হবে। দাদার একেবারে ইচ্ছে ছিল না সে ফাইন আর্টসে আসে। কিছু না হোক অন্তত কমার্শিয়াল! কিন্তু সে জেদ ধরে ছিল। বউদিও বলে—ওর অত ভাল হাত। করুক না! এখন কিন্তু আগেকার সে সব দিন আর নেই!
সে বলেছিল—বাবা আমার বিয়ের জন্যে যে টাকাপয়সা, গয়না রেখে গেছে, সেই থেকে দে। তোকে দিতে হবে না!
—তোর বিয়ের টাকা দিয়ে তোর পড়াশোনা! আঁকাজোকা!
বউদি খুব রাগ করে… দ্যাখ তনি, তোর দাদা তোর চেয়ে অনেক বড়। বেশি চালাকি করবি না।
—ইন এনি কেস, আমি তো ডাউরি দিয়ে তোক খাইয়ে বিয়ে করব না! ওসব গয়নাও আমি পরি না।
—সে তখন যা ইচ্ছে কোরো। এখন ও টাকাতে, গয়নাতে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও উচ্চারণ কোরো না।
—বন্ধুর কী খবর?
—ভাল।
অদিতি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। স্বল্পভাষী মেয়েটির ওই ছোট্ট করে বলা ‘ভাল’টুকু অনেক কথা বলে। ওদের মধ্যে নির্ঘাত। ঝগড়া হয়েছে। যেমন তার আর মনীষার মধ্যে হত, আর… আর… তার আর সুজানের মধ্যেও। সুজানের ভাবনা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না সে, মন থেকে ছিঁড়ে উপড়ে ফেলতে চায় ওর স্মৃতি। আশ্চর্য! ও মেয়ে, ও জানে মেয়ে সাধারণত অসহায়, তবু মেয়ের ওপরেই ওর রাগ। কেন? রাজর্ষির জায়গাটা অসাড় হয়ে গেছে, কিন্তু সুজানের জায়গাটা হয়নি। কেন? বোধহয় মেয়েদের ওপরেই বেশি ভরসা বেশি বিশ্বাস বলে।
—তোরা কাজ কর আমি একটু আসছি।
অদিতি তনিকাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
—চলো তোমাকে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যাই।
—কিছু চলছে? আপনার?
—উঁহু, ‘মাতিস’ আসছে। যেমন তোমাদের ‘লাগান’ আসে ‘শ্বশুরবাড়ি-বাপের বাড়ি’ আসে।
মিটিমিটি হাসি তার মুখে। তনিকা বলল—সত্যি? —ও তো দিল্লিতে এসেছে।
—ছিল, এবার কলকাতায় আসছে। এখনও তেমন প্রচার ঘোষণা এসব হয়নি। আমি বারণ করেছি। সিকিউরিটির কারণেও বটে।
—সিকিউরিটি বুঝলাম, তা ছাড়া?
—তুমি তো রদ্যাঁর ভিড় দেখোনি। রদ্যাঁ এসেছিল, এই বিড়লাতেই। কিউ গিয়েছিল পুরো শরৎ বসু রোড পার হয়ে। আগে থেকে জানালে লোকে হয়তো সাতদিন আগে থেকেই পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বসে পড়বে।
—আমরা ও রকমই—তনিকা একটু গোঁয়ারের মতো বলল।
—অমনি গায়ে লেগে গেল? মোটেই তুমি ও রকম নয়। তুমি বেশ অহংকারী। চলো, এখন ছবিগুলো ক্রেট থেকে বেরোচ্ছে, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গেও তোমার আলাপ করিয়ে দেব।
—কে?
—যিনি তোমার ছবিটা কিনছেন। আঁদ্রে বোর্দো।
চমকে উঠল তনিকা। অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকারটা তার শোনা ছিল। চমকটা চোখ এড়াল না অদিতির।
—চেনো?
মাথা নাড়ল তনিকা।
—নামটা জানো, না?
খুব জোরে মাথাটা আবার নেড়ে দিল তনিকা।
—ঠিক যেমন জানো না নিজের পদবি, ঠিকানা, নয়? — দিদি হাসছেন সে বুঝতে পারে গলার স্বরে, কিন্তু চলতে চলতে অতটা হাইটের তফাতে চকিত হাসি দেখা যায় না।
অদিতি ভাবে—এই মেয়ের গোপনতাপ্রিয়তা আর তার আকাশ-বাতাসের মতো বেআব্রু জীবন। দুটো যেন দুই মেরুতে। সে কখনও লুকোতে চায়নি তার একদা বোর্দো বা গুপ্ত পরিচয়। রাগও সে পুষে রাখতে পারে না। একটা দাগ রেখে চলে যায় রাগ, জায়গাটা অনুভূতিশূন্য, খালি শূন্য হয়ে থাকে।
বিড়লা অ্যাকাডেমির দোতলায় গ্যালারিতে কাজ চলছে। মাঝখানে বসে আছে, মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়াল জরিপ করছে আঁদ্রে। পেছন থেকে অদিতি গিয়ে পিঠে হাত রাখল।
—ওদিৎ! আঁদ্রে অ্যাবাউটটার্ন করে প্রথমেই তাকে জড়িয়ে ধরল, গালে চুমো। তারপরে তার নজর পড়ল পাশে।
—আঁদ্রে এই সেই তনিকা যার বেড়ালের ছবিটা তুমি…
—ওহ, দিস কিউতি! রিয়্যালি। শি হ্যাজ সাচ ত্রিমেন্দাস পাওয়ার!
তনিকার গালে হালকা চুমো খেল আঁদ্রে, নিচু হয়ে।
—ওকে তোমার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিয়ে গেলাম, সাজাও তোমরা, আলাপ করো। আমি কাজ ফেলে এসেছি। তনিকা, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ, কাজ শেখবার। তুমি যেন না কোরো না। আঁদ্রেদার কাছ থেকে তুমি অনে—ক শিখতে পারবে।
আঁদ্রে নয়, মঁসিয়ে বোর্দো নয় আঁদ্রেদা। এত স্বাভাবিক এত সুন্দর শোনাল ডাকটা অদিতিদির মুখে! তার সমস্ত সংকোচ নতুন আলাপের আড়ষ্টতা উধাও হয়ে গেল।
—ক্রনোলজিক্যালি রাখবেন? আঁদ্রেদা? —‘আঁদ্রেদা’র সংগীতটা ফুরোবার আগেই সে যেন সুরটা ধরে নিল।
—না, আমার সেটা… বেশ তো তোমার মত কী বলো? কী সহজ ভদ্রলোক। তার মতো একজন শিক্ষার্থীকে কত সহজে জিজ্ঞেস করছেন!
তনিকা একটু, খুব সামান্য থতমত খেল। তারপর বেশ স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল—আমার কোনও মত নেই। আমি তো জানি না… আপনি বলুন…।
—আমি আসলে বিষয় অনুযায়ী রাখতে চাইছিলাম।
আঁদ্রেদা কথা বলেন ইংরেজিতে, টবর্গীয় ব্যঞ্জনবর্ণগুলো নরম উচ্চারণে। কোনও ব্রিটিশ বা মার্কিন অ্যাকসেন্ট নেই। এবং সবচেয়ে মজা, খুব বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন। আমি রিয়্যালি রাখতে চাই অ্যাকর্দিং তু বিষয়। এমনিতেই ফরাসি উচ্চারণে ইংরেজি শুনতে খুব ভাল লাগে, তার ওপর বাংলার পাঁচফোড়ন, মোহিত হয়ে যেতে হয়।
* * *
অদিতিদি এত চেষ্টা করে সুন্দর বাংলা শিখিয়েছেন। এত সুন্দর বন্ধু, যেমন সহজ অথচ সাহসিক ব্যক্তিত্ব অদিতিদির, তেমনই মধুর অথচ বলিষ্ঠ এই আঁদ্রে বোর্দো। দু’জনে যখন কথা বলেন, আঁদ্রেদাকে কী রোম্যান্টিক লাগে, যেন ভিক্টর হুগো কিংবা আলেকজান্ডার দুমার পাতা থেকে উঠে এসেছেন। একদম প্রেমে পড়ে যাবার মতো লোক! অদিতিদি অতটা রোম্যান্টিক না হলেও, কেমন স্বচ্ছ, একটা কাকচক্ষু দিঘির মতো ব্যাপার আছে ওঁর মধ্যে। কী অদ্ভুত একটা আস্থা হয়, ভরসা হয়, কোনও বাড়াবাড়ি নেই অথচ মুহূর্তে আপন করে নিতে পারেন। তাকে কী রকম বিনা দ্বিধায় গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন! নিজের বাথরোব জামাকাপড়…সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়েকে যে ঠিকানা বলতে চাইছে না। খিচুড়ি খাওয়ালেন নিজে রেঁধে। খাওয়া নিয়ে তার অত প্যানপ্যানানি নেই, কিন্তু ওঁর খিচুড়িটা খুব ভাল হয়েছিল।
কী হল দু’জনের মধ্যে? শুধু দেশের, সংস্কৃতির তফাতের জন্যই কি এমনটা হল? কিন্তু সে যতটা দেখেছে, বুঝেছে, অদিতিদি কেমন একটা আন্তর্জাতিক মানুষ। সে অবশ্য সমুদ্র পারে কখনও যায়নি, কিন্তু ফিল্মে, ডিসকভারি চ্যানেলে, বইয়ের পাতায় তো অনেক দেখেছে। শুনেছে! তার মনে হয় অদিতিদি সব জায়গায় স্বচ্ছন্দে মানিয়ে যাবেন। রেনোয়ার ‘সুইং’ ছবিটাতে আঁদ্রেদা আর অদিতিদি থাকলেও ভারী সুন্দর একটা চিত্রসংগীত রচিত হত। সে কোনও-না-কোনও দিন তার এই আন্তর্জাতিক অনুভূতির কথা ছবিতে লিখবে। আরণ্য আলোছায়ার মধ্যে তার ভাললাগা দু’জন মানুষ। আদ্রেঁদাকে কি বাঙালি ফুলবাবু সাজাবে? কুঁচনো ধুতি আর কাঁথা-কাজ করা পাঞ্জাবিতে? উঁহু কুঁচনো ধুতিটা সামহাউ তার পছন্দ হয় না। কেমন লম্পট বাবু-বাবু দেখায়। এক কাজ করা যায়, প্যান্টের ওপর একখানা পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলে হয়, আর দিদি? দিদি কি শাড়ি পরবেন? ‘সুইং’টার গাউনের এফেক্টটা শাড়িতে আসবে ভাল। দিদিকেও প্যান্ট পরালে… না ছবিটা অন্য রকম একটা মেসেজ দেবে—ইউনিসেক্স, ইউনিসেক্স। তারা সবাই পোশাকেআশাকে এখন একলিঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু শাড়ির মহিমা কে অস্বীকার করবে! আঁদ্রেদার সোনালি চুলের পাশে দিদির ডার্ক ব্রাউন যা মানাবে না! যেন ‘আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা, গড়িব না।’ সত্যিই, যতই রোম্যান্টিকই দেখাক আঁদ্রেদাকে, কাজের মধ্যে এমন একটা মগ্নতা, দায়িত্ববোধ! আর দিদির? কমিটমেন্টেই যেন দিদির চেহারা বেশি খোলে! যখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ঘোরেন, তাদের ছবি বিক্রির জন্য দৌড়োদৌড়ি করেন, যখন… যখন… যখন… যে সব সময়ে সে ওঁকে দেখেনি, সে সব সময়েও যেন সে দেখেছে ওঁকে। তবে এই স্বপ্নের অভীষ্ট ছবি আঁকতে হলে তাকে টেকনিক আরও আয়ত্ত করতে হবে। সে জানে তার আইডিয়া খুবই শক্তিশালী, রং-ও তাই, রঙের ব্যবহার নিয়ে তার নিজের প্রতি কোনও নালিশ নেই। কিন্তু টেকনিক। টেকনিক আরও শিখতে হবে। কোথায়, কোথায় সোজাসুজি ক্ল্যাসিক্সগুলোর কপি করতে পারবে? নিউ ইয়র্ক? ন্যাশনাল আর্ট? নাকি সুবিখ্যাত স্মিথসোনিয়ান? নাকি বিখ্যাততম, চিত্রকরের স্বপ্ন ল্যুভ? ভেতর থেকে একটা লকলকে উৎসাহ আর আনন্দের শিখা বেরিয়ে আসে।
—মাতিস সম্পর্কে তোমার রেসপন্স কী, তনিকা? — আঁদ্রেদা জিজ্ঞেস করলেন।
—দেখো, মাতিস তো আসলে একজনই। কেউ সেভাবে ওঁকে ফলো করেনি, যেমন করেছিল মানের ইমপ্রেশনিজম, পিকাসোর কিউবিজম। যদিও ব্রাক বা পিকাসো তাঁদের কিউবিস্ট ছবিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি, তবু পৃথিবী ভরে গেল কিউবিস্ট ছবিতে। এদিকে মাতিস বেচারি! সত্যিকারের মৌলিক শিল্পী, চাপা পড়ে গেলেন জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের তলায়।
—সেটা তো ভালই আঁদ্রেদা। ওঁকে কেউ নকল করল না, উনি অদ্বিতীয় রয়ে গেলেন।
—সত্যিই রইলেন কি? আঁদ্রেদা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
তনিকার মুখটা একটু লাল হল—আমার ছবিটা কি একেবারেই মাতিসের কপি হয়েছে?
—আরে না না, একেবারেই না। টেম্পারামেন্টের দিক থেকে তোমার মাতিসের সঙ্গে মিল। দেখো, এ রকম হয়েই থাকে, খুব বন্যভাবে রং ব্যবহার করেছ, উগ্রতা আছে। বিদ্রোহ আছে, চিৎকারও আছে, কিন্তু তুমি জানো তুমি কী করছ। তোমার নিয়ন্ত্রণ একেবারে চমৎকার। তবে কী জানো, মাতিস এই সময়ে আবার সমাধি থেকে উত্থিত হচ্ছেন।
ক্রেট থেকে ছবি নেমেছে অনেকগুলো। আঁদ্রেদা তুলে নিলেন ‘জিপসি ওম্যান’। চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
—লেৎ আস স্তার্ত উইথা ব্যাং, কী বলো? আঁদ্রেদা ওর অভিভূত মুখের দিকে চেয়ে বললেন।
সবুজ, হলুদ, লাল, নীল, সাদা কালো কী নেই এই একখানা আবক্ষ ছবিতে। বাঁকা হাসি, ফুল্ল চোখ। একই সঙ্গে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আবার উপহাস করছে। মোটা মোটা পোঁচড় রঙের। যাযাবর জীবনের বর্ণময় উৎসবে ভরতি ছবি।
—এরপর কি একটা নরম রঙের ছবি দেব, তনিকা?
—না আঁদ্রেদা, এই রকমই পোট্রেট-টাইপ দিন। জিপসিটা দেখলে আরও আরও রং-চং-সঙের জন্য খিদে জাগবে। অন্তত আমার।
—ওয়েল, এই প্রদর্শনী শুধু তোমারই জন্যে হোক। বলে আঁদ্রে বোর্দো বাছলেন —আ ওম্যান উইথ আ হ্যাট। টুপি কী? রঙের ফোয়ারা।
—দেখো এবার মাদাম মাতিসের ছবি রাখছি। তারপর অঁরি মাতিসের সেলফ পোর্ট্রেট।
লাল পোশাক-পরা ঘন নীল চুলের ব্যক্তিত্বশালিনী মাদাম যাঁর অর্ধেক মুখে গোলাপি উদ্ভাস, বাকি অর্ধেকে সবুজ হলুদ।
মাতিসের নীল সবুজের সংগীতপূর্ণ আত্মপ্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে তনিকা বলল—উনি নিজেকে স্বপ্নের মতো, দূরের ভাবুক দেখতেন কিন্তু আঁদ্রেদা। আর দেখুন এই যে দির্যাঁর পোর্ট্রেট এঁকেছেন এর মধ্যে কিন্তু আবার জিপসির বর্ণোৎসব ফিরে এসেছে। খানিকটা মুখোশ-মুখোশ ব্যাপার।
—বর্ণোৎসব, আঁদ্রে চেষ্টা করে উচ্চারণ করেন, সেটা কী?
—বর্ণ তো আপনি জানেন, তারপর উৎসব, সন্ধি হয়ে গেছে, ফরাসিদের তো সন্ধি চট করে ধরতে পারার কথা।
—ঠিক… বলতে বলতে আরও দুটি বিখ্যাত ছবি বেরোল— ‘লাক্সারি: কাম অ্যান্ড ভোলাপচুয়াস,’ এবং ‘ওম্যান উই থা প্যারাসল’। প্রথমটা সমুদ্রতীর। মহিলারা নানা ভঙ্গিতে কেউ ভিজে চুল উঁচু করে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন, কেউ হাত ফিরিয়ে বাঁধবার উদ্যোগ করছেন। কেউ শুয়ে আছেন পাশ ফিরে হাতের ওপর ভর, চূড়ান্ত শৈথিল্য… পিকনিকের আয়োজন… এইভাবেই বার হল— ‘হার্মনি ইন রেড’, ‘স্টিল লাইফ ইন ভেনিশিয়ান রেড’, ‘রেড অনিয়নস’ —কোথাও রঙের নিমন্ত্রিত হোলি, কোথাও স্বপ্নিল পশ্চাৎপটে আঁচড় দিয়ে দিয়ে রঙের বিন্যাস।
চারপাশে রং, শুধু রং। তার মাথার চিন্তাগুলো সুদ্ধ রঙিন হয়ে যাচ্ছে। নীল হতাশা, সবুজে-লালে অনন্ত ঊর্ধ্বে ওঠার আর্তি, ধূপছায়া রঙের প্রেমাকাঙক্ষা তার। প্রত্যেকটি চিন্তা, মনোভঙ্গি, মেজাজের রং সে চিনতে পারছিল আলাদা আলাদা করে। এভাবে এত কাছ থেকে এত নিভৃতে একজন সত্যিকার রসিক ও বোদ্ধার সঙ্গে ছবি দেখা, মৌলিক ছবি একেবারে! মাত্রাটাই আলাদা। মাতিসের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে এ সব ক্যানভাসে, এ এক অলৌকিক অনুভূতি। কী আশ্চর্য এই আঁদ্রেদা, কোয়াইট ডেফিনিটলি এখন থেকে রুদ্রাংশুরা আউট, আঁদ্রেদা প্রবল ভাবে ইন। ভাস্কর চক্রবর্তী ফুঃ, অদিতি সরকার ওহ্ ফ্যানটাস্টিক। ওরা সব ঠিকঠাক শিল্পী নয়। ছন্দ মিল আয়ত্ত করলেই যেমন কবিতা হয় না, ড্রয়িং আর রং লাগাবার টেকনিক জানা থাকলেই তেমন শিল্পী হয় না। তার মনের গভীরে কোথাও বিশ্বাস আছে সে মৌলিক এবং সে শিল্পী। স্তর কী সেটা আলাদা কথা, কিন্তু সে শিল্পী। না হলে এমন চিত্রময় কেন তার জগৎ! এই যে কিছুক্ষণ আগে ‘চিত্রভানু’তে দেখে এল দৃশ্যটা! চার-পাঁচটি ছেলে তন্ময় হয়ে ইজেলের সামনে। এই ছবিটা এখনও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চুলোয় যাক ড্রয়িং, সে মোটা মোটা ব্রাশ-স্ট্রোক দিয়ে বহুবর্ণ করে আঁকবে ওই ছবি আঁকার ছবি। শৌনক পেছন ফিরে, কাজলের তদ্গত পাশ মুখ, গিয়াস রং মেশাচ্ছে, অনিরুদ্ধই বোধহয়, সিলিংয়ের দিকে মুখ। কিছু ভাবছে, হাতে উদ্যত তুলি যেন উদ্যত রিভলভার। একটা বিস্ফোরক ছবি। কেন বিস্ফোরক! সে জানে না। যা-ই আঁকুক তার মধ্যে একটা প্রবল আত্মঘোষণা থাকে তার, যেন কুরুক্ষেত্র শুরু হবে পাঞ্চজন্য বাজছে, নেপোলিয়নের সঙ্গে জারের যুদ্ধ, রণতূর্য বাজছে, বিউগলের আকাশফাটানো নৃশংস সুর। এত চড়া সুর কি হওয়া খারাপ! আড়চোখে দির্যাঁর পোর্ট্রেটটা দেখে সে, ‘জিপসি’টা দেখে। কোথায় একটা তুমুল সমর্থন, একটা উত্তাল উদ্বেল ভরসা পেতে থাকে। এমন একটা আলোড়ন, যা তার মনের অস্পষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলোকে সামনে দাঁড় করিয়ে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান করে তাদের। চোখ দুটো কাচ-চকচক হয়ে ওঠে। চোখ লুকোতে সে ক্রেটের পরবর্তী ছবিগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সাবধানে।
—ছবিতে তিয়ার্স পড়লে কিন্তু মিলিয়ন দলার্স ফাইন।
তনিকা ঝট করে মুখটা ফিরিয়ে নেয়। লজ্জা পেয়ে যায় খুব, কিন্তু উত্তেজনাময় আবেগের চুড়ো থেকে তক্ষুনি নামতে পারে না। খুব লজ্জার সঙ্গে রুমাল বার করে, জানলার দিকে চলে যেতে থাকে। কী হবে, কী বলবে আঁদ্রেদা যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন। এই কান্নার মধ্যে কি আঁদ্রে বোর্দোও নেই! অদিতি সরকারও নেই! দুটো দারুণ জোরালো চুম্বক-ব্যক্তিত্ব যা তাকে লোহাচুরের মতো টেনে নিচ্ছে অন্য এক আবহমণ্ডলে।
কিন্তু আঁদ্রে বোর্দো কিছুই জিজ্ঞেস করেন না। মহৎ এবং প্যাশনেট শিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের ভেতরের নিরুদ্ধ আবেগ এভাবে বেরিয়ে আসে তিনি জানেন। ভ্যান গগ্-এর সানফ্লাওয়ার্স চাক্ষুষ দেখার পর, পিকাসোর গ্যেরনিকা প্রত্যক্ষ করার পর কি তিনি কাঁদেননি! হতে পারে এই কান্নার মধ্যে মেয়েটির কোনও ব্যক্তিগত দুঃখও আছে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ছবি আর তার দর্শকের মধ্যে একটা নিরন্তর দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ছবি দিচ্ছে, এটা তো বোঝাই যায়, কিন্তু প্রত্যেকটি সমঝদার দর্শকও কিছু দিয়ে যায় ছবিকে, তাদের স্ফুরণের ঐশ্বর্যে আরও মণ্ডিত হয়ে ওঠে ছবি, যেমন অজন্তা হয়েছে, মুঘল মিনিয়েচার হয়েছে। দিল্লি থেকে কতদূর অজন্তা। কিন্তু তিনি তো না দেখে থাকতে পারেননি। আর সেই ক্ষীয়মাণ অলৌকিক শিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে জলের ধারা বয়েছিল অঝোরে।
অনেকদিন আগে, অদিতি গুপ্তর একটা ছবি দেখেছিলেন, কোনও প্রদর্শনীতে। শুধু কতকগুলো বলিষ্ঠ রঙিন রেখায় আঁকা সঙ্গমী নরনারী, নারীর মুখ পাশ ফেরানো। একটি মাত্র বিরাট চোখ, দৃষ্টি অনুসরণ করলে দেখা যায় বেশ কিছু ভারতীয় পাম, যাদের বলে কোকোনাট পাম, পেছনে ম্লান তারার দল ঝরে পড়ছে। ‘দা পাম-লাভার’। লাভার্স নয়, লাভার। অর্থাৎ পামের দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি মেয়েটিই ওই ছবির বিষয়, সঙ্গম নয়, পুরুষও নয়। মেয়েটি যেন বলছে, তুমি যখন শরীর নিয়ে এমন উন্মাদ, তখন আমি কেন পাম-যূথের দিকে, অস্ফুট তারাদের দিকে কাতর চেয়ে থাকি, কখনও ভাবো কি? সেবারও তার সোনালি গাল বেয়ে নেমে এসেছিল জলের ধারা। পুরুষ ও নারীর যৌনতার মধ্যে কী বিশাল ফারাক—ছবিটা ছন্দে বলেছিল। ছন্দে এবং ছন্দোভঙ্গে। চেষ্টা করেও ছবিটা কিনতে পারেনি সে। কোনও সুইডিশ আর্ট কালেক্টরের কাছে আগেই চলে গিয়েছিল।
—হয়তো স্পষ্ট জানি না, কিন্তু কুয়াশার মতো বুঝি ওদিৎ কেন তুমি অমন সময়ে পামগুচ্ছ আর তারার দিকে তাকিয়ে থাকো। তুমি আর তোমার মতো মেয়েরা।
সন্তর্পণে গলার আর্দ্রতা মুছে নিয়ে তনিকা বলল—আঁদ্রেদা, আপনি কি মনে করেন আমার ড্রয়িং নিয়ে আরও মাথা ঘামানো উচিত?
—একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
—আমার আর্ট কলেজের সাররা কেউ কেউ বলতেন। বন্ধুরাও কেউ কেউ বলে রং চাপিয়ে আমি ড্রয়িংয়ের উইকনেস ঢাকি?
—তনিকা। আমি কিন্তু শিক্ষক জাতীয় নই। তোমার সৃজনের মধ্যে যদি সত্যি সৃষ্টি থাকে তা হলে আর ভাববার দরকার নেই। ও সব প্রি-ইমপ্রেশনিজ্ম-এর যুগের ভাবনা। তবে একটা কথা, পিকাসো, ব্রাক বা মাতিসেরও দ্রয়িং কিন্তু খুব খুব স্ত্রং।
ষোলো
বাইশে শ্রাবণ শীলাদিরা জোড়াসাঁকো যাচ্ছে। দেখে, রবীন্দ্রসদন থেকে গান শুনে ফিরবে। নন্দিনী, চৈতালি, আর শৌনক সঙ্গে যাচ্ছে। আজ মাধুরীর শরীরটা ভাল লাগছে না, শীলাদি যেতে চায়নি, কিন্তু মাধুরীই জোর করে পাঠিয়েছেন। অদিতিকে থাকতেই হচ্ছে তাঁর কাছে। তার অবশ্য আপত্তি নেই। প্রত্যেক রবিবারেই শীলাদিকে তার ছাত্র সহযোগে এখান-ওখান পাঠাচ্ছে সে। ফলে শীলাদি অসম্ভব স্মার্ট হয়ে গেছে আজকাল। অল্পবয়সিদের হইহল্লার সঙ্গে ঘোরবার জন্য কিনা কে জানে, একটু যেন বেশি হাসিখুশি, বয়স যেন কমে গেছে।
কবির প্রয়াণপক্ষে দুর্দান্ত ভ্যাপসা গরম! এই বাড়ির গাঁথনি আগেকার বলে, বিশ ইঞ্চি মোটা দেওয়াল আর উঁচু সিলিংয়ের মধ্য দিয়ে তাত তেমন আসতে পায় না, এই রক্ষা। জানলাগুলোতে খসখসের পরদা লাগানো থাকে। সহনীয় গরম ঘরে। বাইরে থেকে এলে মনে হয় বুঝি বাতানুকূলিত। অদিতি একটা ইজেল টেনে আনে এ ঘরে, বসে বসে আঁকে। তার ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলে। এ সময়টা খেলা-খেলা আঁকা। আজকে একটা স্কেচবুক নিয়ে বসেছিল। অলস আঙুলে স্কেচ করতে করতে মাধুরীর দিকে চোখ পড়ল। উনি একটা আরাম চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন, পায়ের কাছে একটা মোড়া, পা তুলে দিয়েছেন তার ওপরে। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে অর্ধেক মুখে। মুখটা খুব অদ্ভুত। এতদিন সে খেয়াল করেনি। রবীন্দ্রনাথের রহস্যময়ী নারী যেন ওঁর চামড়ার তলা থেকে ফুটে উঠছে। উলটোদিকের দেওয়ালের দিকে মুখ, আপাতদৃষ্টিতে শান্ত। কিন্তু কীসের যে অত কাটাকুটি মুখে। সারাজীবন খুব দুঃখ পেলে, সে দুঃখ নিজের ভেতরে অবিরত আটকে রাখলে চাপা কষ্টে, রাগে এমন চেহারা হতে পারে। সাধারণত প্রতিকৃতি সে আঁকে না। হঠাৎ মনে হল এমন জীবন্ত বিষয় সামনে, আঁকলেই তো হয়! একটা ছবি কম্পোজ করতে হলে আইডিয়ার জগতে মগ্নচৈতন্যের ঘরে বড় হাতড়াতে হয়। লাগে অনেকটা তন্ময়তা। আপাতত তার মন বড় বিক্ষিপ্ত। সে পারছে না। এই সময়ে বিষয় যদি সামনে উপস্থিত থাকে তা হলে মনের, আঙুলের একটু সুবিধে তো হয়ই। আর যেহেতু বিষয় ভেতরের নয়, বাইরের, তাই একটা মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’ যাকে বলে। দ্রুত হাতে কয়েকটা রেখা টানল সে। মাধুরী যেন চটকা ভেঙে জেগে উঠলেন।
—আজকে ইজেলের সামনে তো বসলে না বউমা!
—না, এমনি স্কেচ করছি।
—তোমার শ্বশুরের জন্যে কত স্কেচ করে দিয়েছ মনে আছে!
ছবির রেখার দিকে মন, অদিতি বলল—হ্যাঁ—অ্যা! ওঁর বইয়ে সেগুলো তো বেরিয়েওছে। মন্দিরের রোয়াকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা… মা মুখটা প্লিজ একভাবে রাখুন।
—কেন? আমাকে আঁকছ নাকি?
—আপনি রাখুন না মুখটা। অমনি নয়, ঠিক আগের মতো। একটু বাঁদিকে হেলে… —হ্যাঁ…
—তা হলে কথা বলতে বারণ করছ?
—কথা বলুন না, ভঙ্গিটা ঠিক রেখে। থ্রি ফোর্থ আসছে। মুখটা।
—কী আঁকছ? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এখন আঁকবার কী অবশিষ্ট আছে? অদিতি হেসে ফেলল —মা। ছবি হল ছবি। বাইরের আকৃতি, ভেতরের প্রকৃতি যেই মিলব মিলব করে অমনি একটা ভাল ছবি হয়। তার সঙ্গে বয়স বা দৈহিক সৌন্দর্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
—সর্বনাশ! তুমি কি আমার ভেতরটা আঁকবে নাকি?
—ভেতরটা আঁকা কি খুব সহজ মা? আঁকলেও সেটা হয়তো আপনার ভেতর হবে না। আমারই ভেতর হবে। ইন্টারপ্রিটেশন যাকে বলে।
—বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে দাও।
—ধরুন, আপনিই একটা উদাহরণ দিন রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়রের চরিত্র থেকে, এগুলো তো আপনি খুব পড়তেন!
—কে বলল?
—কে আবার বলবে, আমি দেখেছি। তা ছাড়া বাবাও বলতেন।
—কী বলতেন?
—এই, রবীন্দ্রনাথ আপনার কণ্ঠস্থ মুখস্ত। শেক্সপিয়র ভালবাসতেন বলে বাবা আপনাকে কত পড়িয়ে দিয়েছেন শেক্সপিয়র।
—এইসব কথা তোমাদের হত?
—হত না?
—আর কী বলতেন? মেয়েটি আমার প্রথম…তার কথা।
—নিশ্চয়। এ তো তাঁরও চাপা কষ্ট ছিল!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— কী যে উদাহরণের কথা বলছিলে?
—ইন্টারপ্রিটেশন বোঝাবার জন্যে। যে-কোনও একটা চরিত্র বলুন, রবীন্দ্রনাথ থেকেই হোক, শেক্সপিয়র থেকেই হোক…
—তা হলে ধরো ডেসডিমোনা…
—আচ্ছা বলুন ডেসডিমোনাকে আপনার কী লাগে? কী মনে হয়? অন্যে কে কী বলে—ছাড়ুন। আপনার কথা বলুন।
—তা যদি বলো অদিতি ডেসডিমোনাকে আমার খুব বোকা মনে হয়, ওই আরেকটা মেয়ে জুলিয়েট! —ও দুটোই রামবোকা। তবে কী জানো! কতই বয়স! ভুল করবারই বয়স! বেঘোরে চলে গেল। ও তোমার রোমিও-ও যেমন পাঁঠা, ওথেলোও তেমন একটা নিষ্ঠুর, গোঁয়ারগোবিন্দ। আবার এ-ও বলি, বেশ কিছু বোকা আর গোঁয়ার না মিললে একটা ট্রাজেডিও হয় না। কে তোকে বউয়ের কথা শুনে ডানকানকে খুন করতে বলেছিল? কী করতে যাচ্ছিস তা তো ভালই বুঝেছিলি! এমনও নয়, তোর ব্যক্তিত্ব বউয়ের চেয়ে কিছু কম! একবার একটা মার্ডার করার পরে তো তুই বউয়ের গাউনের তলা থেকে বেরিয়েই এলি! তখন তো তার একটি কথাও আর শুনলি না!
—বাঃ—অদিতি মুখ ভাসিয়ে হেসে বলল। আপনার প্র্যাকটিক্যাল ইনটারপ্রিটেশন। এটা আপনার নিজস্ব। আপনি গল্পের সারটুকু নিয়ে তার থেকে আপনার ব্যাখ্যাটা দাঁড় করিয়েছেন। এটাই আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যা। ছবির ক্ষেত্রে ব্যাপারেও যদি কোনও পোর্ট্রেট আঁকি, মানুষটার যে ভাব আমার কাছে ধরা পড়ছে সেটাই আমার ছবিতে ফুটে উঠবে। ফুটিয়ে তুলব। ধরুন খুব সুন্দর বা সুন্দরী কাউকে যদি আমার অন্তঃসারশূন্য মনে হয়, আমার আঁকা ছবিতে সেটা ধরা পড়বে। না পড়লে সে ছবির কোনও মানে থাকবে না।
—তা আমার এই জীর্ণ মুখখানার কী ব্যাখ্যা তুমি দিচ্ছ?
—সেটা আমি এখনও জানি না মা। একটা রাফ স্কেচ আগে করে নিই। তার ওপর ভিত্তি করে ছবিটা আঁকব। আপনার মুখ আমার কাছে কী ভাবে ধরা দেবে তা তো জানি না! আচ্ছা এবার আপনার ফলের রসটা আনি।
রসটা তৈরি ছিল, ফ্রিজ থেকে বার করে ঠান্ডাটা কাটানো হচ্ছিল এতক্ষণ। উনি রসের গ্লাসটা হাতে ধরে বললেন—কার কাজ! কে করে!
এ কথার কোনও উত্তর হয় না।
—আমার মেয়েটা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তার সেবা পেতাম। তবে সে-ও যদি বিয়েথা হয়ে দূর দেশে চলে যেত তবে…
অদিতি মুখ তুলে তাকাল—চোখে যেন একটা দুষ্টু হাসি… বলল… এ হল বউমারই কাজ!
এ কথারও উত্তর হয় না।
উনি বললেন—কী হল কিছু যে বললে না?
—কী বলব?
—তোমার কখনও মনে হয় না, কী অদ্ভুত এই পরিস্থিতি! আমি তোমার ছেড়ে দেওয়া বরের মা, তোমার বাড়িতে বসে তোমার হাত থেকে সেবা নিচ্ছি। …আর আর বউমা, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে। তোমার খুব বিরক্ত লাগছে, আমি জানি।
—না, আপনি ভুল ভাবছেন। অদিতি একটু স্নেহের হাসি হেসে বলল—গোড়ায় গোড়ায় হতাম। পরিস্থিতিটা তো সত্যিই অদ্ভুত। কিন্তু এখন আর কিছু লাগে না।
—কেন বলো তো? অভ্যাস?
—তাই হবে বোধহয়।
—না, বউমা। অভ্যাস নয়। তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে, তুমি আরও একটু তলিয়ে ভাবলে ধরতে পারতে, এটা শুধু অভ্যাস নয়। যে তোমার সঙ্গে বেইমানি করেছে, সে আমারও সঙ্গে বেইমানি করেছে। এই থেকেই আমাদের সম্পর্ক…
—কিন্তু মা ওটা আপনার ভাবনা, আমি ওভাবে ভাবি না। আর কেনই বা ভাবছেন ও আপনার সঙ্গে বেইমানি করেছে! দূর থেকে ও কি খেয়াল রাখছে না?
—অমন খেয়ালের আমার কী দরকার বলো? আমি একলা মানুষ, রাজার বাবা আমার জন্যে যা রেখে গেছেন, তা-ই আমার যথেষ্ট। আমি কি ওর ডলারের তোয়াক্কা করি নাকি! ছেলের কাছে মায়ের কি শুধু ডলারই পাওনা? —কী রকম একটা বিতৃষ্ণার মুখ করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন উনি। অদিতি শুনছিল। কিন্তু দেখছিল আরও মন দিয়ে। লোকে মুখে কথা বলে বিতৃষ্ণা জানায়। কিন্তু উনি মুখের রেখায় রেখায় বিতৃষ্ণা জানাচ্ছেন। খুবই অভিনব এই অভিব্যক্তি। যদি ছবিতে সে তুলতে পারে তা হলে এ হবে এক চিরন্তন প্রশ্নচিহ্ন। এই বৃদ্ধা কি রাগ করছেন? ঘৃণা করছেন? ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন? নাকি তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা করছেন কাউকে? কাকে? কোনও নিকট সম্পর্ককে? নাকি সারা পৃথিবীকেই, সভ্যতাকে? মোনালিসার হাসির কী মানে? উনি কি দাঁত তুলিয়েছিলেন? উনি কি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন? নাকি হাসলে ওঁর মুখের পেশিগুলো ওইভাবেই বিন্যস্ত হত?
মুসাম্বিটা শেষ করে উনি পাশের টেবিলে রাখলেন।
—আমি একটু উঠি এবার। একটু হাঁটাহাঁটি করি। না না তোমায় ধরতে হবে না। চেয়ারের হাতলে ভর রেখে উনি উঠে দাঁড়ালেন। ক’দিন এইটুকু হাঁটাহাঁটি করছেন। ডাক্তার বলেছেন। তবে সব সময়ে কারও-না-কারও উপস্থিতিতে। আস্তে আস্তে ঘর পার হয়ে বাইরে এলেন। বারান্দার পাটি ধরে ধরে বেশ এগোচ্ছেন।
—বেশ বাড়ি তোমার। সেখানে যেন অত বড় বাড়িটা হাঁ-হাঁ করে খেতে আসে।
অদিতি মনে মনে বলল—আমাকেও যে এ বাড়ি খেতে আসে না মাঝে মাঝে তা নয়। তবে কাজের মধ্যে থাকলে, নিয়মিত বেরোলে অত খারাপ লাগে না।
—কোথায় ছবি আঁকো, ঘরখানা দেখাবে?
—চলুন।
ছবির ঘরে এসে উনি বসলেন। এখানেও একটা আরামচেয়ার আছে, আর একটা ডিভান। আরামচেয়ারে বসলেন গিয়ে উনি। বললেন—তোমাদের বেশিরভাগ ছবিই আমি বুঝি না মা। …কী এঁকেছ ওটা কালো কালো সাদা সাদা, ভূত প্রেত নাকি?
—তা ভূতই একরকম। আচ্ছা এটা দেখুন তো!
বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকা পথ গাছপালা, গাড়ি… আর ওপরে ভাসমান প্রবহমান এক খুব তন্বী মূর্তির আভাস।
—অতশত না বুঝলেও ভাল লাগছে। রংগুলো লাগালেই যদি তবে আবার যেন ধুয়ে দিয়েছ! কেন?
—ভাল লাগছে বলছিলেন যে!
—আচ্ছা অদিতি আমার ছবি তো আঁকতে চাইছ, শীলার একখানা আঁকো না!
—আমার আঁকতে ইচ্ছেটা তো হওয়া চাই!
—অমন সুন্দরী, ওকে ছেড়ে আমাকে?
—আমি তো আগেই বললুম মা, বাইরের আকার কিছু নয়।
—তা হলে তুমি বলছ ওর ভেতরটায় তেমন কিছু নেই।
—তা বলিনি। এখন এই মূহূর্তে আপনার মুখটাই আমার আঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে।
—তবু, তুমিই তো একদিন আমাকে ফেলে ওকেই প্রণাম করতে গিয়েছিলে মা!
সর্বনাশ! সেই কথা এখনও মনে রেখেছেন উনি? ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ পুষে রেখেছেন? সেই জন্যেই কি অমন রুক্ষ ব্যবহার করতেন?
সে বলল— শীলাদিই বরণডালা হাতে সামনে ছিল মা।
—না, না, দুধ ওথলাচ্ছিল। বরণডালা রোয়াকের পাঁচিলে রাখা ছিল। তুমি খেয়াল করোনি, আমার বড় জা তোমায় বরণ করেছিলেন পরে।
—সে যাই হোক, সামনে রয়েছে, দেখতেও ভদ্র, আমি কী করে জানব! তারপর বাবা বুঝিয়ে দিতেই…
—একটা কথা আমাকে বলবে?
—কী?
—কথা দাও এই বৃদ্ধাকে মিছে কথা বলবে না!
—মিছে কথা? কেন?
—কথা দাও, কিছু মনে করবে না?
কী জিজ্ঞেস করবেন উনি? অদিতি মাথা হাতড়ায়। রাজর্ষির সঙ্গে তার বিচ্ছেদের কারণ তো উনি জানেন। বেইমানি। কিন্তু কী ধরনের বেইমানি তা হয়তো জানেন না। বেশ, উনি যদি এ কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সে-ও বিবৃত করতে পারবে। কিন্তু কথাটা হল ব্যাপারটা তার ভাল লাগবে না। মনমেজাজ খিঁচড়ে যাবে। দিনের পর দিন ভুষোকালিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে পৃথিবী।
—মিছে কথা বলে আমার কী লাভ বলুন! আর মনে করা? তার ওপর তো আমার কোনও হাত নেই! তেমন কিছু হলে না হয় না-ই বললেন!
—এতখানি বয়সেও যদি বুকের কথা বুকে চেপে রাখতে হয়, মরণের আগে যদি প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তরগুলো না পাই, তুমি মনে করো না আমার মৃত্যুতেও কোনও শান্তি থাকবে না! সান্ত্বনা থাকবে না!
—বলুন, বলে ফেলুন। অদিতি ওঁকে এতটা বিচলিত দেখে হেসে ব্যাপারটা সহজ করে দিতে চায়।
—এই যে রাজ তোমার অনুপস্থিতিতে একটা কাজ করে বসল। জঘন্য কাজ, তোমার কখনও মনে হয়নি— এটা ওর তোমরা যাকে বলে জেনেটিক? অদিতি চমকিত হল। জঘন্য কাজ! তা হলে উনি নীল দৃশ্যটার কথা জানেন?
সে বলল— জেনেটিক? এক অর্থে তো বটেই! পুরুষরা মোটের ওপর একটু অসংযত প্রকৃতির হয়। বেসামাল। মেয়েরাও যে হয় না তা নয়, কিন্তু তারা সংযমকে মূল্য দিতে শিখেছে মা অনেক যুগ ধরে।
—না। আমি জিজ্ঞেস করছিলুম রাজ কি তার বাবার থেকেই স্বভাবটা পেয়েছিল?
—বলছেন কী মা! ও কথা ভাবতে যাব কেন? দোষ করল একজন। সে দোষের দায় চাপাব তার পিতৃপিতামহের ওপর?
—তুমি কি সত্যিই মনে করো তোমার শ্বশুরের কখনও মতিভ্রম হয়নি। হতে পারে না!
অদিতি এবার বুঝতে পারল, কেন উনি মনে না করার কথা তুলেছিলেন। তার নিজের বাবা-মা’র বাইরে অদিতি সত্যিই এতটা শ্রদ্ধা আর কাউকে করেনি। তার বাবা-মা দুজনেই খুব স্নেহশীল ছিলেন। চরিত্রের জোর ছিল। ব্যক্তিত্ব ছিল। তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ভালবাসা তাঁরা মা-বাবা বলেই। কিন্তু প্রকাশ গুপ্ত অগাধ পণ্ডিত, নিরভিমান, অথচ বলিষ্ঠ মনের মানুষ। তাঁকে সে সম্পর্কের কারণে তো শ্রদ্ধা করেনি, করেছিল তিনি বলেই। আর ভালবাসত, তিনি ভালবাসার মতো আচরণ করেছিলেন তাই। ইনি কি সে জন্যে এতই ঈর্ষাতুর যে… তার মুখটা কঠিন হয়ে যেতে থাকল। এ কেমন মহিলা যিনি শ্রদ্ধার সম্পর্ক বুঝতে পারেন না, স্নেহের সম্পর্ক বুঝতে পারেন না!
খুব কাতর গলায় মাধুরী বললেন— তুমি কি সত্যিই মনে করো শীলার সঙ্গে ওঁর কখনও কিছু হয়নি!
প্রায় বজ্রপাতের মতো এল কথাটা। বজ্রপাত তো তর জীবনে হয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত ভালবাসার ক্ষেত্রে। শ্রদ্ধা-ভক্তির ওপর এমন আঘাত! …যদি আজ কোনও খ্রিস্টভক্ত শোনে— যিশুখ্রিস্ট পতিতালয়ে যেতেন নিয়মিত; কিংবা রবীন্দ্রনাথ লম্পট ছিলেন…।
—কিছু বলছ না যে? রাগ করলে! অদিতি কিছু মনে কোরো না, তুমিও ওই ডেসডিমোনা, জুলিয়েটের ধরনের বোকামেয়ে! নইলে কেউ মাসি নয় পিসি নয়, একটা যুবতী মেয়েকে এনে ঘরে তোলে? অমন সুন্দর সুযোগ করে দেয়!
তার মনে হল, ভাগ্যে সে তথাকথিত সুযোগটা করে দিয়েছিল। তাই তো সময় থাকতে রোগটা ধরা পড়ল!
মাধুরী বললেন— আমি তোমার মতো অতটা সরল না হলেও কিন্তু বিশ্বাস করতুম। মেয়ে গেছে, ছেলে থাকে দূরে দূরে বোর্ডিংয়ে, কিন্তু উনি আছেন, আমার মস্ত ভরসা। কিন্তু যেদিন কোথা থেকে একটি সুন্দরী অল্পবয়সি বিধবা এনে আমাকে বললেন— এ-ই এবার থেকে রান্নাবান্না করবে মাধু— আমি কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, তখন শীলার আরও অল্প বয়স। সত্যিকারের রূপসি। না-ই রইল তোমাদের মতো শহুরে পালিশ। ওকে ডেকে ওর সব ইতিবৃত্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিই। উনি গিয়েছিলেন সোনামুখী… ওখানকার রেশম সম্পর্কে কিছু খবরাখবর নিতে। সেখানেই নাকি শীলার দাদা ওঁকে ধরে পড়ে, বোনটির একটি গতি করে দিতে। তা গতি উনি আর কোথায় করবেন? অগতির গতি এই আমারই ঘাড়ে এনে ফেললেন। সারা জীবনটা আমার কী যে আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় কেটেছে আর কাউকে সে কথা বলতে পারিনি। এই প্রথম বললাম তোমাকে। এই শেষ। মরণের আগে জেনে নিতে চাই, যে মানুষটাকে আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা বিশ্বাস দিয়েছিলাম সে তার যোগ্য ছিল কিনা। ও সব বিদ্যা গুণ ঢের ঢের দেখা আছে অদিতি। যার যত বিদ্যা সে তত বিদ্যাধর, ওসবের মূল্য আমার কাছে কানাকড়িও নেই। আসল কথা মানুষটা হৃদয়ে কেমন। মানুষটা আমার কাছ থেকে যে বিশ্বস্ততা পেয়েছিল, দাবি করত, ততটাই আমাকে দিতে পেরেছিল কিনা। অদিতি আমাকে ভাল ভাবো, মন্দ ভাবো, তাতেও আর আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু একমাত্র তোমার বুদ্ধিবৃত্তির ওপরই আমার আস্থা আছে। তুমি এই কাজটুকু আমার করে দাও। সান্ত্বনা নয়, মিথ্যে নয়। একেবারে তুমি যা ঠিক বলে বুঝছ তাই। যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয়, তাতেও আমার কিছু দুঃখ নেই। বিশ্বাস করো, শেষ জীবনে এই তুমি আর ওই শীলা-ই আমার সত্যিকারের আপনজন। ওকে এ কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তোমাকে তাই…।
কী অদ্ভুত পরিহাস! যে শীলাকে চিরদিন সন্দেহ করে এসেছেন, ঈর্ষা করে এসেছেন, সেই শীলাই ওঁর আপনজন! যে অদিতিকে উনি উঠতে-বসতে বকাঝকা করতেন সেই অদিতিই আজ ওঁর একমাত্র আস্থার পাত্র! আশ্চর্য।
—প্রথমেই আপনাকে বলে দিই মা, —সে সামান্য গম্ভীর হয়ে বলল— আপনার সন্দেহটা আমার একেবারে অবাস্তব লাগছে। আর দ্বিতীয় কথা গোয়েন্দাগিরি করতে আমি যে খুব পটু নয় সে কথা তো আপনি জানেনই। তার ওপরে ফেলে-আসা দিন চলে-যাওয়া মানুষ নিয়ে এমন গোয়েন্দাগিরি!
—তুমি যদি মনে করো, তা হলে পারবে। সেই বুদ্ধির ধার তোমার আছে।
ছবি-আঁকার মেজাজ তার একেবারেই চলে গেছে। সকাল ঘন হচ্ছে। দু’জনেরই চান সারা। খাওয়ার সময় হল। তার ভেতরটা কেমন অস্থির-অস্থির লাগছে। তোলপাড় হয়ে গেল। বোধ-বুদ্ধি। যা মনে হয়নি কখনও, যা জানার তার দরকারও নেই, তারই চিন্তায় তাকে নামতে হবে?
খাবার টেবিলের দু’পাশে দু’জন। মুখোমুখি।
—ওই জন্যেই কি শীলাদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বেড়াতে? সে মুখে ভাত তুলতে তুলতে বলল।
—এই তো বুঝতে শুরু করেছ, তোমাকে বলতেও আমাকে একটু সাহস করতে তো হয়েছেই? তবে ওকে একটু ছুটি দেওয়া, আনন্দ দেওয়া এ-ও আমার ইচ্ছে বই কী! কী পেয়েছে ও জীবনে?
অদিতি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। —যদি জানতে পারেন, আপনার সন্দেহ সত্যি নয়, তবু ধরুন যদি সত্যি হয়, তা হলেও কি ওর প্রতি এই করুণা আপনার থাকবে?
—করুণা কী গো? —উনি হাত থামিয়ে বললেন— আমি যে ওকে আমার ছোট বোনের মতো দেখি! সইতেও পারি না। একেক সময়ে, আবার ফেলতেও পারি না। শুধু নিজের স্বার্থে মনে কোরো না কিন্তু। আজ যদি ও চলে যায়, আমি হয়তো ওরকম সেবা কারও কাছে পাব না, তবু কিছু-না-কিছু ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারব। কিন্তু আমি রয়েছি, অথচ ও সেখানে নেই… না। এ আমি ভাবতেও পারি না। বড় দুঃখী বঞ্চিত, অনেক ছোট ও তো বটে!
একটু পরে গলাটা পরিষ্কার করে সে জিজ্ঞেস করল— আপনার সন্দেহের মূলে কিছু যুক্তি নিশ্চয় আছে। সেগুলো যদি বলেন… আমার খুব সংকোচ হবে শুনতে…।
—আমার ছিয়াত্তর বছর বয়স হল মা। কালরোগে ধরেছে, যে-কোনও সময়ে চলে যেতে পারি। আমার কোনও সংকোচ নেই। মানুষের জীবন আর কতটুকু! যে-ই ইহকাল থেকে পরকালে পাড়ি দেয় অমনি সব শেষ। যেটুকু থেকে যায় সে শুধু অন্য মানুষের মনে। কত স্নেহ, কত দরদ, কত বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল মানুষটার। মগজে একজন যত বড়ই হোক, মগজ দিয়ে তার মনুষ্যত্ব আমি মাপি না। সে কতটা খাঁটি ছিল তাই দিয়েই মাপি৷ রাজের ওপর কি আর আমার মাতৃস্নেহ নেই! এতদিন অব্যবহারে তাতে খানিকটা মরচে পড়ে গেছে, কিন্তু আছে। তবু সে যদি একবারও আমার কাছে এসে ক্ষমা না চায়, তার আসায় আমার কোনও দরকার নেই। সে একটা মিথ্যে মানুষ। ভুল মানুষ। আমার যে ছেলেকে আমি চিনি, গড়ে তুলেছি, সে নয়। তার খোলসে অন্য কেউ। যাকে তোমরা বলো— ইমপস্টর।
ওঁর দিকে একবার তাকাল অদিতি। জটিল মানুষ, কিন্তু কুটিল নন। বিদ্বান নন, কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধি। চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আবেগের কী অদ্ভুত সঙ্গতি ওঁর!
—তোমার শ্বশুর অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতেন একেক দিন। একটা-দুটো। আমি দশটার সময়ে ঘড়ি ধরে শুয়ে পড়তাম। আবার অনেকদিন উনি খুব ভোরে উঠে যেতেন, ধরো সাড়ে তিনটে, চারটে। শীলা শুত একতলায়। আমি কিন্তু কখনও নিশ্ছিদ্র ঘুমোতাম না। বিশেষ করে উনি না থাকলে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হত। একদিন মনে হল তিনটে বেজে গেছে, উঠে দেখি সাড়ে তিনটে। এত দেরি তো কখনও করেন না! কী হল? পড়ার ঘরে গিয়ে দেখি নেই। তারপর দেখি নীচ থেকে উঠে আসছেন। —‘কোথায় গিয়েছিলে? এত রাতে?’ —‘মাথাটা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল, একটু বাইরে বাগান থেকে ঘুরে এলাম’ —‘চলো শুতে চলো’ আমি বলি। শুয়ে আছেন কিন্তু ঘুমোচ্ছেন না, এপাশ-ওপাশ করছেন। ‘কী হল? ঘুমোও!’ হঠাৎ পাশ ফিরে আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। তারপর যেন… ছিঁড়েখুঁড়ে ফেললেন। এই প্রকাশ গুপ্ত আমার অচেনা। একেবারে অচেনা।
চোখ নিচু করে রইল অদিতি। একটু পরে বলল— আর কিছু?
—নাঃ, আর তেমন কিছু… ওই থেকে থেকেই শীলাবতী, শীলাবতী-ই। সে-ও বাবার সুবিধে-অসুবিধেয় একপায়ে খাড়া।
‘বাবা’, শব্দটা খট করে লাগল তার কানে। বলল—শীলাদি ওঁকে ‘বাবা’ বলত মনে রাখবেন মা। এটা একটা মস্ত প্রমাণ। এই ডাকের দেওয়াল কেউ ডিঙোতে পারে বলে আমার জানা নেই।
—কিন্তু উনি তো মেয়ে বলতেন না। উনি তো ডাকতেন— শীলাবতী-ই শীলাবতী-ই।
—কোনও অবৈধ সম্পর্ক হলে অত সহজে আদরের নাম ধরে ডাকতে পারতেন না মা।
—তা হলে ওঁর চোখে অনেক সময় যে অপরাধের ছাপ দেখেছি তা মিথ্যে বলছ? —আমি সেদিনের পর থেকে তো খুব সাবধান হয়ে যাই। দোতলার গেটের কোল্যাপসিব্ল লাগিয়ে চাবি রেখে দিতাম নিজের বালিশের তলায়।
—পরদিন কেউ জিজ্ঞেস করেননি, হঠাৎ এই ব্যবস্থা কেন?
—নাঃ!
—করেননি? শীলাদি না, বাবা না?
—নাঃ।
—টের পেয়েছিল?
—নিশ্চয়। আমি বেশ শব্দ করেই গেটটা বন্ধ করতাম তো! ওঁর শুনতে পাবার কথা। আর শীলা পরদিন ভোর-ভোর এসে ফিরে গেছে। আবার এসেছে পরে। কেন গেট বন্ধ, তো কই একবারও জিজ্ঞেস করল না!
—চলুন এবার শুতে চলুন।
আস্তে আস্তে ঘরে গেলেন। খাটটা তো ইংলিশ খাট নয়, পালঙ্ক। একটু উঁচু। উনি তারই মতো লম্বা মানুষ বলে পারেন উঠতে। তবু একটু ধরল অদিতি।
—আমার স্যুটকেসটা একটু খোলো তো মা!
—এখন?
—হ্যাঁ, এখনই। দেখো স্যুটকেসের একেবারে তলায় একটা ফাইল আছে। পেয়েছ?
—হ্যাঁ।
—ওটা নিয়ে এসো।
নীল রঙের কভার ফাইল। হাতে করে উনি বললেন— এই ফাইলটা আমি চলে যাবার পর খুলবে। ওতে কিছু নির্দেশ আছে। না, না, নিয়মকানুন… কী ভাবে…কী… সে সব কিছু নয়। তবে আগে দেখো না। একটু পরে বললেন— তোমারও খটকা লেগেছে, না?
চমকে উঠে অদিতি বলল— খটকা? না, ভাবছি…।
—এই যে ভাবছ, আমাকে স্তোক দিলে না— এই জন্যেই তোমায় ভরসা করি মা। তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখে জল এসে গেল তার। সে আবেগপ্রধান মানুষ নয়। তার অন্তরের যা কিছু নিহিত আবেগ সে প্রকাশ করে তার ছবিতে। কিন্তু মাধুরীর সুপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এমন একটা প্রতিবিম্ব দেখতে পেল! ভাল কিছু খুব নিজস্ব কিছু যদি সহসা খানখান হয়ে ভেঙে যায়! বড় কষ্ট হয়! সে কষ্টের অভিজ্ঞতা তার আছে। হয়তো পার হয়ে এসেছে। অনেকটা। কিন্তু অসর্তক মুহূর্তে জ্বালা করে। বড় জ্বালা করে।
সতেরো
পরদা, কুশন কভার সব পালটে দিয়েছেন এবার। উজ্জ্বল কমলা রঙে ঝলমল করছে বাড়ি। বদলেছেন পাপোষ। তোয়ালে। শক্তি বলে একটি ছেলে মাসে মাসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় সব। মেঝে ঝকঝক করছে। পেতলের টব, ফুলদানি থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। আসবাবপত্র সব ভাল করে মুছে চকচকে করে দিয়ে গেছে। অন্ধকার বাড়ি! অন্ধকারে আর ঢুকতে হবে না নবগোপালকে। যতই ভালবাসুন শ্রীকে, এ বাড়ির আবহাওয়া, চেহারা কোনওদিনই ভাল লাগেনি তাঁর।
—হ্যাঁরে শ্রী, পরদাটরদা কাচতে দিস না?
—ও হ্যাঁ তা মাঝে মাঝে দিই তো, পঞ্চমীকে বলা আছে।
—বললেই হবে! নিজে একটু-আধটু দেখলেও তো হয়।
—ধোপার বাড়ি দিলেই কেমন রং জ্বলে যায়, বুঝলি!
—ধোপার বাড়ি দিবি কেন। ওয়াশিং মেশিনে কাচা।
—কে মেশিন চালাবে রে! পঞ্চমীকে বলব, হয়তো মেশিন বিগড়ে বসে থাকবে, তখন ধুন্ধুমার বকুনি খাব।
—মেয়ে তো যথেষ্ট বড় হয়েছে, ওকে ইনভল্ভ কর।
—ও না হলে, হতে চাইলে আমি কী করব বল।
—একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে শুধু হোটেলের মতো ব্যবহার করবে বাড়িটাকে? কোনও মায়া মমতা রুচি
কিচ্ছু থাকবে না? ওর ঘরটা দেখেছিস?
—আগে দেখেছি। অনেক শিখিয়েছি। শি রিফিউজেস টু লার্ন।
—শ্রী, ওর কি একটু কাউনসেলিং দরকার? বয়সটা টিন এজ পেরোচ্ছে তো? ভেতরে কোনও জটিলতা তৈরি হচ্ছে না তো? তুই নবগোপালের সঙ্গে কথা বল।
—তুই-ই বল না সর্বাণী।
—আমি বলবার কে? তুই থাকতে তোর মেয়ের কথা আমি বলব?
—তুই এ-বাড়ির অনেক। আর আমি মা হতে পারি। কিন্তু তুই তো ওর টিচারও!
শ্ৰীলার কোনও শখ, ইচ্ছাশক্তি কিছু ছিল না। এমন অদ্ভুত চরিত্র আর দেখেননি সর্বাণী। যেহেতু নবগোপালের সঙ্গে বনিবনা হল না, তার বাড়ি-সংসার কিছুকেই কোনওদিন আপন মনে করতে পারল না শ্রী। একমাত্র মেয়েটি ছিল তার দায়, তার আনন্দ। সেই মেয়েও যখন দূরে সরে যেতে থাকল, গোঁয়ার, উচ্ছৃঙ্খল, স্বার্থপর হয়ে উঠতে লাগল—শ্রী দ্বিতীয় দফায় সরিয়ে নিল নিজেকে। আর যেন তার কোনও কর্তব্য রইল না। নিজে ডুবে যেতে থাকল নিজের গভীরে। সেখানে কোনও ইতিবাচক কিছু ছিল কিনা তা বুঝতে পারেননি সর্বাণী। পরলোকে বা পরজন্মে বিশ্বাস। ঈশ্বর অথবা ঠাকুরদেবতা। দুর্বল, হতাশ মানুষরা যখন ঠাকুরদেবতা, ধ্যান-পূজা এসব আঁকড়ে ধরে, তখন এক হিসেবে বেঁচে যায়। কেননা কোথাও-না-কোথাও মানুষের একটা নোঙর থাকা দরকার, নোঙর অথবা শেকড়। শ্রীর কোনওটাই ছিল না। জামশেদপুরের মেয়ে। ওর মা ওর বিয়ের অল্প পরেই মারা যান। বাবার দেখাশোনা করতে মাঝে মাঝে জামশেদপুর যেত শ্রী। নিজের সংসার যে সামলাতে পারে না, সে বিপত্নীক প্রৌঢ় বাবার ছোট্ট ফ্ল্যাটের সংসারটি কেমন সুন্দর সাজিয়ে রাখত। হাতের কাছে সব, লোকজনেদের কড়া নির্দেশ, কেউ দিদির কথা অমান্য করবার সাহস পেত না। অবশ্য, ওর বাবাও খুব গুছোনো ধরনের মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন টিসকোয় কাজ করেছেন। জীবনটা একটা ছন্দে বাঁধা। তাঁরও স্ত্রী খুব জোরালো ছিলেন না। এই অক্ষম শরীর-মন কি শ্রী মা’র কাছ থেকেই পেয়েছিল?
যাই হোক মিমির বছর দশ-এগারো বছর বয়সের সময়ে তিনিও মারা গেলেন। এইবারে শ্রীর আর কোনও আশ্রয় রইল না।
—চল তোদের সোনারির ফ্ল্যাট থেকে ক’দিনের জন্যে ঘুরে আসি। তুই, আমি আর মিমি।
—ও ফ্ল্যাট তো বিক্রি হয়ে গেছে সর্বাণী।
—কেন?
—কে দেখবে? বাবার সব ফার্নিচার বইটই সবসুদ্ধু বিক্রি হয়ে গেছে। নবগোপাল বলল ওর পক্ষে দেখাশোনা সম্ভব নয়।
—কেমন সুন্দর একটা বেড়াবার জায়গাও তো ছিল আমাদের।
—তো চল না, পুণে, গোয়া, বাঙ্গালোর, উটি—নব সব ব্যবস্থা করে দেবে, তুচ্ছ জামশেদপুরি ফ্ল্যাট তোকে কী ছুটির স্বাদ দেবে রে সর্বাণী! কিচ্ছু না! তা ছাড়া টাকাটাও তো আমারই অ্যাকাউন্টে জমানো আছে। যা খুশি করতে পারি।…একটু থেমে বলেছিল, খালি আমার সেই খুশিটার কোনও দেখা নেই।
বাইরে থেকে দুর্বল। কোনও প্রতিরোধ নেই। প্রতিকূল পরিবেশকে বাগে আনবার কোনও ইচ্ছেই নেই। পরিবেশটা যে প্রতিকূল এটাই তার অভিমান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেদ। দাওনি যখন পাবেও না, গ্রহণ যখন করোনি, তখন আমারও কোনও গ্রহণ করার প্রশ্ন নেই। সারা জীবন ধরে এমন জেদ এই মনোভঙ্গি টিকিয়ে রাখতেও তো কম শক্তি লাগে না, কম অহংকার লাগে না। সর্বাণী এমনটা ভাবতে পারেন না। তাঁর দর্শন হল—ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট। জীবনকে হাসিখুশি ঝলমলে মালিন্যহীন রাখবার চেষ্টা করো, যেন একটা খেলার মাঠ। উঁচু-নিচু সব ভেঙেচুরে সমান করা হয়েছে। চারপাশে গ্যালারি, অথবা গ্যালারিহীন শান্ত ভোরবেলা। পায়ের তলায় উচ্ছ্বসিত সবুজ। এইবারে তুমি সেই ঘাস-না-ছাঁটা সমান পথ পরিক্রমা করো। খড়ির দাগ আছে। গণ্ডি আছে। তুমি যদি মসৃণ ছোটো তা হলে তুমি ঠিকঠাক নিজস্ব ট্র্যাকেই ছুটবে। গণ্ডিটার কথা ভুলে যাও। ভোরের হাওয়া তোমার ঘামে এসে লাগছে। ভেতরে তোমার রক্ত জোরসে ছুটছে। ধমনী বেয়ে নির্ভুল পথে হৃদয়ে। স্বাস্থ্যকর ছন্দে গাইছে হৃৎপিণ্ড। তোমার শরীরে স্বাস্থ্য, প্রাণে শক্তি, মননে স্বচ্ছতা, হৃদয়ে দরদ। ব্যস এবারে তুমি মোকাবিলা করতে পারবে সব রকম সমস্যার। জীবনে কোনও সমস্যা হবে না, তা তো আশা করা যায় না! হবেই! কিন্তু শরীর, প্রাণ, মন, হৃৎ যদি স্বচ্ছন্দে চলে তা হলে মুখোমুখি হওয়া যায় সব বিপদের। বিপদে আমি না যেন করি ভয়। ওই যে ওই মেয়েটি অদিতি সরকার! তনিকার কাছে শুনেছেন ওর জীবনের বাইরের কথাগুলো । দু’বার ডিভোর্স হয়েছে। তনিকাও জানে না কেন, তিনিও না। কিন্তু যে কারণেই হোক, ওর নিজের কারণে না হওয়াই সম্ভব। এত স্থিরবুদ্ধি, এতটা সাহায্যশীল। নমনীয় বলেও মনে হয়েছে তাঁর। এ যে কাউকে ক্ষমার অতীত বলে মনে করতে পারে তা যেন ধারণায় আসে না। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছেন তিনি শুনে যে এখন ওর বাড়িতে ওর দ্বিতীয় স্বামীর মা। রোগশয্যায়। আর মানুষ কী করতে পারে!
—তনি তোদের বয়স অল্প, তাতেই অনেক কথা জেনে গেছিস। আমরা হয়তো এতটা জানতাম না। কিন্তু জানা মানেই জানা নয়…জানতে হলে দৃষ্টান্ত দিয়ে জানতে হয়, অভিজ্ঞতা দিয়ে জানতে হয়। যদি তা প্রত্যক্ষ হয় ভাল। কিন্তু যদি হয় পরোক্ষ, তা হলে অন্যের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের মনের গভীরে নাড়াচাড়া করতে হয়। এ কথা যদি তোদের ধাঁধার মতো লাগে তা হলে বুঝতে হবে তোরা অপরিণত আছিস। বড় হয়েছিস শুধু। অনেক তথ্য তাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু মনটা কাঁচা।
মিমিও ছিল। নিঃশব্দ। ওপরের দালানে বসার জায়গায় একটা গুর্জরি দোলনা আছে। তাইতে বসে আস্তে আস্তে দুলছিল। তিনি তনিকেই বলছিলেন। কিন্তু মিমিকে তো বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু এই জায়গায় মিমি একলাফে দোলনা ছেড়ে উঠে ঘরে চলে গেল।
—যাই বলিস আর তাই বলিস। মেয়েটিকে আমার বড় ভাল লেগেছে। অত নামকরা আর্টিস্ট! প্যারিসের বিখ্যাত স্কুলের অ্যাওয়ার্ড পাওয়া মেয়ে, কী নিরভিমান! ওগুলো যেন ওর বাইরে পড়ে আছে। ও হল আসলে একটা মানুষ যে ছবি আঁকে।
—তা সবাই-ই তো তাই আন্টিমাসি—একজন মানুষ যে ছবি আঁকে। একজন মানুষ যে লেখে…
—না, একটা সূক্ষ্ম তফাত আছে। তো দের ওই ভাস্কর চক্রবর্তী! ও হল আগে ছবি আঁকিয়ে, তার পরে মানুষ, অদিতি আগে মানুষ পরে তার ছবি।
—তুমি তো ওঁর ছবি দেখোনি মাসি, ওঁর আঁকার সময়েও ওঁকে দেখোনি, তখন এই যে এত মিশুকে, এখান থেকে ওখান দৌড়ে বেড়াচ্ছেন—এসব বোঝা যায় না।
—কেমন তখন?
—একেবারে মগ্ন। কে পাশে দাঁড়িয়ে আছে টের পাবেন না। আমি একদিন গেছি, শীলাদি বলে ওঁর বাড়িতে একজন থাকেন, তিনি বললেন—আঁকার ঘরে আছে। তুমিও তো আঁকো। যাও না, যাও। আমি পাশে একটা মোড়া টেনে বসলাম। একটু পেছন দিকে। ডান দিকে টুলের ওপরে রঙের বাটি বসানো। একটা পোর্ট্রেট করছিলেন অয়েলে। উনি মগ্ন হয়ে থাকলে মনে হয় উনি কারও নন। উনি ছবির। সেই মুহূর্তের ছবিটার।
—সে তো হবেই। তোর হয় না?
—আমি? খানিকটা আঁকব, তারপর জল খাব, আবার কাজ করছি, হঠাৎ উঠে পড়লাম। একটু ঘুরে এলাম। আমার ছবি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় মাসি। না হলে আমার ধৈর্য থাকে না।
—তাই কি অমন ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ছবি আঁকিস?
—আসলে আমি ছবি আঁকি না মাসি, আমি একটা… মানে… একটা মেজাজ, একটা মানসিক অবস্থা আঁকি।
—অন্যের মেজাজও আঁকিস বোধহয়। নিজের ঘরের দরজার কাছ থেকে মিমি বলল।
—মেজাজ?
—ওই যে তো র সুবীর রাস্না সব বলছিল সে দিন তো দের চুলোচুলির ছবিটা চুলোচুলির আগেই আঁকলি কী করে?
—সে আবার কী!
—ওই যে সেই দুটো বিচ্ছিরি বেড়াল এঁকেছিলি! প্রাইজ পেলি। যেদিন অ্যাকাডেমিতে তোর সঙ্গে আমার একহাত হয়ে গেল।
—ও, যেদিন রাতে ভাস্কর চক্রবর্তীর স্টুডিয়ো থেকে তোকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনা হল? উনি দূর করে দিয়েছিলেন রাতে? সেদিন?
কুটিল চোখে তার দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল মিমি।
—খ্যাপাচ্ছিস কেন শুধু শুধু?—সর্বাণী বললেন।
—খ্যাপাচ্ছি না, মনে করিয়ে দিচ্ছি।
উঠে গিয়ে দরজায় টোকা দিল তনিকা—মিমি, মিমি…দরজা খোল। একটু পরে খুলে দিল—এবার আবার কার কথা মনে করাতে এলি? তস্কর?
—না, তনিকা হেসে বলল—তোকে নিয়ে ‘চিত্রভানু’তে যেতে বলেছিলেন অদিতিদি। আমি ঘুরে এসেছি। যাবি?
চোখ সরু করে মিমি বলল—ও ঘুরে আসা হয়ে গেছে? আমার নামে আরও এক দফা বলে এলি বোধহয়।
—তোর কথা কাউকে, আবার অদিতির মতো সেলিব্রিটিকে বলা যায়?
—যেখানে যেখানে আমার যাওয়ার থাকে, ঠিক আগে আগে পৌঁছে যাস, না?
আবার একটা কথা কাটাকাটি শুরু হতে যাচ্ছে দেখে, সর্বাণী বলেছিলেন—নীচে আয়, রান্না রেডি। দেরি করবি না। ডাক্তার মিমিকে খুব সময়ে খাওয়াদাওয়া করতে বলেছেন। ওর কিন্তু আলসারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তিনি নেমে গেলেন। শুনতে পেলেন মিমি বলছে—তনি, তোকে হাত করে নিল, বাবাকে হাত করে নিল। কিছু করতে পারলাম না। এখন ডাক্তারগুলো কেও হাত করে নিচ্ছে।
মিটিমিটি হেসেছিলেন তিনি। এত সহজে রসবোধ যায় না ওঁর।
দুঃখের বিষয়, বেরোতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আবার অনিয়মিত হয়ে যেতে শুরু করেছে মিমি। শরীরটা সেরেছে। কী সুন্দর দেখায় আজকাল। পোশাক পরিচ্ছদগুলো সব ড্রাই ক্লিন করিয়ে দিয়েছেন। সেই রকম জিপসি জিপসি পোশাকই পরে, কিন্তু এখন ওগুলো বেশ ঝকঝক করে। কিছুটা টিফিন নিতে ওকে বাধ্য করেন তিনি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। কিন্তু আজ এখনও ফিরল না।
—এত রাত? মিমি?
খাবার টেবিলের ওপর হাত রেখে বসেছিলেন। মেয়ে ঢুকতে একদিন বললেন। পঞ্চমী দরজা খুলে দিয়ে চলে গেছে।
কোনও জবাব দিল না।
—দেখো মিমি, রাত এগারোটা বাজছে। এসব চলবে না। যদি কিছু হয়, আমার নিজের ভাবনাচিন্তা টেনশনের কথা ছেড়েই দাও। তোমার বাবাকে কী কৈফিয়ত দেব বলো তো! একটু বোঝবার চেষ্টা করো । কলকাতা এখন খুব আনসেফ। আমার ভয় করে।
—আমি খেয়ে এসেছি। আমার জন্যে এত রাত অবদি না খেয়ে বসে থাকবার দরকার নেই। আমার নিজের মা-ও বসত না। আমি এসব পছন্দ করি না।
বলতে বলতে তিন লাফে ওপরে চলে গেল মিমি।
এই গেল একদিন।
আজ সকাল ন’টার সময় কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে। বাড়ি ঢুকল রাত দশটা।
—মিমি কাউকে কিছু বলে যাওনি কেন? ঘরে ঘরে খুঁজছি আমরা। এইভাবে ভাবাবে আমাকে? আমি কিন্তু এবার স্টেপ নেব।
বলে চলে এলেন। ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না। রাত তিনটে নাগাদ ফোন করলেন—
—হ্যালো।
—সর্বাণী বলছি। আমি মিমিকে হ্যান্ডল করতে পারছি না। আমার খুব ভয় করছে।
—কেন? কী হল আবার।
—এত ক্যাজুয়ালি কথা বোলো না নবগোপাল। ও আমাকে একেবারেই মানছে না। এত রাত করে বাড়ি ফেরে আমার প্রচণ্ড টেনশন…
—আরে, মিমি কি তোমার সেই স্কুলের মেয়েটি আছে? শি ইজ কোয়াইট এব্ল টু টেক কেয়ার অব হারসেলফ।
—ও যে মাস দেড়েকের ওপর ভাস্করের কাছে চলে গিয়েছিল ওর স্টুডিয়োতে ছিল—ও কথা তোমাকে জানাইনি।
এখন জানিয়ে দিলাম। অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি।
—হোয়ট?
—হ্যাঁ, অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি। খুব শরীর ভেঙে গিয়েছিল। সেরে উঠেছে, আবার উচ্ছৃঙ্খলতা শুরু করেছে।
তুমি শিগ্গিরই এসো।
ফোন নামিয়ে খাটে বসতে গিয়ে দেখলেন জ্বলন্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক যেন একটা কেউটে সাপ।
—কাকে? কাকে ফোন করছ?
কথার কোনও জবাব দিলেন না। ভেতরে ভেতরে চমকে গেছেন খুব।
—কী লাগাচ্ছিলে, বাবার কাছে? আমার বাবার কাছে। আমার বিষয়ে?
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কেমন একটা ঘাম দিচ্ছে তাঁর। তিনি কথা না বলে শুয়ে পড়লেন।
দু’পা এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল হঠাৎ। আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে, চুল ধরে হিড়হিড় করে টানছে—কে তোমাকে বলেছিল বাড়ি সাজাতে, কেন সাজিয়েছ আমাকে জিজ্ঞেস না করে?
সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে দূরে ঠেলে দিলেন তিনি। যথাসম্ভব ঠান্ডা চোখে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, তুমি আলোচনা করলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হত না। কিন্তু ঢুকলে কী করে ঘরে?
—বাবাকে কী বলছিলে, বলো?
—সে কথা জেনে তোমার লাভ নেই। তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি যা করার কাল সকালে করব। যা-ও।
—কী করবে? পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেবে? চমৎকার। মাকে খুন করেছ, এবার মেয়েকে পাগল বানাচ্ছ। চমৎকার খেলছ!
—কী বলছ! আমার ধৈর্য চলে যাচ্ছে। চলে যাও বলছি।
—মায়ের মুখের অক্সিজেন মাসক খুলে নাওনি? খাবি খেতে খেতে মরে গেলে আবার রিপ্লেস করে রাখোনি? আমি কিছু জানি না মনে করেছ, না? বাবা আসুক তোমার কীর্তির কথা সমস্ত ফাঁস করে দিচ্ছি।
তিনি বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিচ্ছু ঢুকছে না মাথায়, কী শুনছেন? কে বলছে? এ কী? এসব কী?
হঠাৎ তাঁর শরীরে একটা প্রচণ্ড বেগ এল। মন কাজ করছে না, শুধু শরীর। তিনি ড্রয়ার খুলে গাড়ির চাবিটা নিলেন। উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেলেন। ঝড়ের মতো দরজা খুললেন। একটার পর একটা দরজা খুললেন। শব্দ হতে লাগল। পঞ্চমী ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। নিজের গাড়িটা বার করলেন। তারপর বেরিয়ে গেল গাড়ি।
—কী হল? পঞ্চমী চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল— কার কাছে? কোথায় যাচ্ছে মাসি? কারও কোনও খারাপ খবর… মিমি!
মিমি তখন সিঁড়ির ধাপে আস্তে আস্তে বসে পড়ছে।
—মাসি যে নাইটি পরে বেরিয়ে গেল গো? বাবুর কিছু হয়নি তো? এয়ারপোর্ট থেকে কিছু…
মিমি আস্তে আস্তে সিঁড়ির ওপর শুয়ে পড়ছে।
—কী হল মিমি? তোমার তোমারই শরীর খারাপ? না কি? মিমির গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কথা বলতে পারছে না।
খবরটা সকালে পড়ল অদিতি। রেড রোডে অদ্ভুত অ্যাকসিডেন্ট। শেষ রাতে একটা নেভি ব্লু সান্ট্রো রেড রোডে ছোটাছুটি করছিল। তারপর স্কিড করে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সাদার ওপর নীল ফুল ফুল নাইটি-পরা এক ভদ্রমহিলাকে মারাত্মক আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনও ব্যাগ, কোনও পরিচয় বা লাইসেন্স কিচ্ছু নেই। তাঁকে এস. এস. কে. এম.-এ সংকটজনক অবস্থায় ভরতি করা হয়েছে। ছবিটা দেখবামাত্র চিনতে পারল অদিতি। মিসেস সর্বাণী সাহা রায়।
আর তারপরেই ফোনটা বাজল…
—দিদি আমি তনিকা বলছি। মিমি মানে অনোহিতার বাড়ি থেকে।
—দেখেছি—সংক্ষেপে বলল অদিতি,—কী ব্যাপার বলো তো?
—দিদি আমরা আপনার কাছে এক্ষুনি যাচ্ছি। আপনি একটু শৌনককে যেতে বলবেন? আমাদের তো হাসপাতালে যেতে হবে।—তনিকার গলা কাঁপছে।
—এসো—অদিতি চায়ের কাপটা তুলে আবার নামিয়ে রাখল। কাগজটা আবার তুলে ধরল। ইনি শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এত তাড়া, এত বিপদ যে নাইটি-টা পর্যন্ত বদলাননি। কিন্তু উনি কোথাও যাচ্ছিলেন না। রেড রোডে ওঁর গাড়িটা ছোটাছুটি করছিল। উনি হঠাৎ কোনও কারণে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। কোনও চৈতন্য ছিল না। না হলে অন্তত…বড় অস্থির লাগছে।
আজ প্রথম আঁদ্রে তার বাড়িতে আসছে। ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন করেছে সে। ছবি দেখাবে, মাধুরী ও শীলার সঙ্গে পরিচয় করাবে। বলে রেখেছে ওঁদের। শীলাদি চান করে উঠেই জলখাবারের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। ওকে কি ফোন করে বারণ করে দেবে? মাথাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। টেবিলের ওপর মাথাটা রাখল সে। এত নার্ভাস বোধহয় কখনও হয়নি। মেয়েটি একেবারে একা…তার বাবা বাইরে কোথাও। খুব গোলমেলে মেয়ে!
—কী হল বউমা? শীলাদি মাথায় হাত রেখে আস্তে জিজ্ঞেস করল, চা খেতে খেতে নামিয়ে রেখেছ?
সে কোনওমতে কাগজটা দেখিয়ে বলল—চিনি। এঁকে। কাগজটা তুলে নিল শীলাদি।
—বলো কী? তোমার চেনা? যেন চেনা না হলে অ্যাকসিডেন্টটা কম মারাত্মক হত।
মাথা নাড়ল সে।
দরজার বেল বাজল। খুলে দিতে চলে গেল শীলাদি। এত তাড়াতাড়ি এসে গেল মেয়ে দুটো? না। বিদেশি গলা শুনতে পেল। আঁদ্রে বলছে—একটু সকাল সকাল এসে গেছি। ভোরবেলায় কলকাতা দেখতে বেরিয়েছিলাম। তোমাদের কোনও অসুবিধে করলাম না তো?
শীলাদি কোনও উত্তর দিচ্ছে না। একটু পরে মাথায় ঘোমটা শীলাদি আর তার পেছন পেছন আঁদ্রে এসে ঢুকল তার বসবার ঘরে।
সাহেব আসবে বলে ক’দিন ধরেই খুব বাড়ি সাফ করছে শীলাদি। উঠোনটাকে একেবারে শ্যাওলা-মুক্ত, পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছে। অদিতির বসবার ঘরে একটা বিরাট রাজস্থানি কলসি ছিল। পাথরের ওপর মিনে কাজ করা। সেইটা নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছে নিমতলায়। কয়েকটা ফুলের টব, বোধহয় ফুলসুদ্ধু কিনে এনেছে। জড়ো করে রেখে আড়াল করে দিয়েছে পেছনে ড্রেনের অংশ, আর কিছুতেই পরিষ্কার না হওয়া উঠোন আর ভাঙা রোয়াক।
—অদিতি!
ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে অদিতি। চুপ করে বসে আছে। শান্ত। একটু ফিকে হেসে আঁদ্রেকে বসতে বলল।
—কী হয়েছে? তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে!
—কিচ্ছু না। চলো আমার শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করবে। শীলাদির সঙ্গেও পরিচয় করাল। —ইনি ওঁর বোনের মতো। সব সময়ে সঙ্গে থাকেন।
তারপর শীলাদিকে বলল— যা হয়েছে খাবার দিয়ে দাও।
শীলাদি চোখ তুলে তাকাল একবার তার দিকে।
চোখে চোখে তার দিকে চেয়ে অদিতি বলল—দাও।
আঁদ্রে বলল—অনেকটা হেঁটেছি। খিদেও পেয়েছে খুব। বলে হাসতে গিয়ে আবার চাইল—তুমি যেন ভীষণ ডিসর্টাবড মনে হচ্ছে? ওদিৎ কী হয়েছে বলো তো?
কী আশ্চর্য কতদিন পরে এলে। গল্প করো না! উত্তরে সে বলল, —কী রকম দেখলে কলকাতা?
—খুব স্বাস্থ্যচর্চা হচ্ছে, দেখলাম রাস্তার সাইডওয়াকে লোক হাঁটছে। ইয়াং পিপল দৌড়োচ্ছে দেখলাম। দারুণ উৎসাহ। স্পোর্টস প্রায়রিটি পাচ্ছে এখানে দেখছি।
—আমাদের এখানে খুব বেশি খোলা জায়গা তো নেই!
—জানি। জানি। তোমাকে তোমার শহরের হয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে না।
শীলাদি খাবার নিয়ে ঢুকেছে। সাজিয়ে দিয়েছে দুটো প্লেটে।
—বাঃ এটা কী? স্টফ্ড্ ডাম্পলিং মনে হচ্ছে?
একটা মাংসের শিঙাড়া তুলে নিয়ে বলল, এটা দিয়েই শুরু করি!
—এটা চাটনি। এইটে দিয়ে খাও— শুকনো হেসে বলল অদিতি।
—তুমি খাও।
—আমার আর সেই আগের অভ্যেস নেই আঁদ্রে। ব্রেকফাস্ট বেশি খেতে পারি না। তোমাকে সঙ্গ দিতে খাচ্ছি একটু। এখানে আমরা সামান্য লাঞ্চ খেয়ে কাজে বেরোই।
—কী খাও?
—ভাত, ডাল, মাছ।
—ওহ্ দারুণ সুস্বাদু তোমাদের মাছ। খাচ্ছি ক’দিনই। মনে আছে সাঁজেলিজে গেলেই তুমি ভেন্ডরদের থেকে ক্রেপ কিনে খেতে?
—আর রাত্তিরে রান্নার ভয়ে বাগেৎ আর চিজ নিয়ে বাড়ি ফেরা!
—রান্নার ভয় তোমার ছিল, আমার ছিল না। আমি তোমার জীবনে আসবার আগে তুমি ড্রাই ফ্রুটস, ক্রোয়সোঁ আর চিজ বাগেৎ খেয়েই দিন কাটিয়ে দিতে। আর ফল। তাই না?
—দুধ। দুধও খেতাম। আইসক্রিম।
—তাই বেশ গোলগাল ছিলে। এখন অনেক কালো হয়ে গেছ ওদিৎ। রোগাও।
শীলাদি চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকল।
অদিতি চা ঢেলে দিল। নিজেও এক কাপ তুলে নিল।
—তুমি যে আমার জন্য আবার আলাদা করে ড্রেস করোনি, তোমার হাউজকোটেই দেখা দিয়েছ, এ জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। একটু নিচু গলায় বলল আঁদ্রে।
—কেন?
—না, এই ইনফর্ম্যাল আচরণ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি সেই আগেকার ওদিৎ, আমি সেই আগেকার আঁদ্রে। মাঝখান দিয়ে আদ্রিয়াতিক, ভূমধ্য সাগরের জল বয়ে গেছে, কিন্তু আমরা বদলাইনি।
—তুমি আমাকে কাপড় বদলাবার সুযোগ দিলে কোথায়? হাসিটা তার মুখে ফুটব ফুটব করেও ফুটল না পুরোপুরি। একটা সৌজন্যের ভঙ্গির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
—চা-টা কিন্তু তোমার সেই চায়ের মতো অত দুর্ধর্ষ নয়।
—কী চা?
—ওই যে চা দিয়ে বলেছিলে চুপ করে খাও, কথা বলো না …
—বাৎ হোয়াৎস্ রঙ্ মা শেরি!
টুকরো টুকরো জবাব দিয়ে, আঁদ্রের খাওয়াটা সে শেষ করাতে পেরেছে। বলল— আঁদ্রে আসলে সকালে কাগজে একটা খবর পড়ে আমি বড় অস্থির হয়ে পড়েছি।
—কী খবর?
কাগজটা তুলে ওর হাতে দিল অদিতি, বলল— আমি এঁকে চিনি। খুব ভাল করে! ওঁর কাছে হসপিটালে যেতে হবে আমাকে, এক্ষুনি।
—শিয়োর। চলো যাওয়া যাক। —মুখের ভাব বদলে গেল, উঠে দাঁড়াল আঁদ্রে।
—না, তুমি নয়। আমাদের হাসপাতালের চেহারা তুমি দেখতে পারবে না আঁদ্রে। তোমাকে আমি দেখাতে চাই না। তুমি আজ ফিরে যাও। আবার একদিন গল্পসল্প হবে।
—নেভার। কখনও না। তোমাকে এত কষ্টের মধ্যে, বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে, নোংরার ভয়ে হাসপাতালে যাব না, এতটা স্বার্থপর তুমি আমাকে পাওনি। তুমি কিছুতেই আমাকে এড়াতে পারবে না। কে ইনি?
—ধরো, আমার একরকম দিদি!
—তুমি কাপড় বদলে এসো, আমি বসছি।
এর চেয়ে বেশি তর্কাতর্কি করবার এখন ক্ষমতা নেই তার। সে চট করে তার ঢোলা প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে, চুলে চিরুনি চালিয়ে ক্লিপ দিয়ে মাথায় আটকে নিল। আরও কয়েক মিনিট অস্থির হয়ে বসবার পর বেল বাজল। কয়েক কদম এগিয়ে দরজা খুলে দিল সে। তনিকা। একা।
—ও কোথায়?
—হিস্টিরিক হয়ে গেছে দিদি, খালি বলছে আন্টিমাসি মরে যাবে, বাবা আমায় দূর করে দেবে, আমার আর কেউ রইল না। পঞ্চমীদির কাছে ওকে রেখে আমি ছুটে এসেছি। শৌনককে পেয়েছি। ও সোজা এস.এস.কে.এম-এ চলে গেছে। … দিদি আপনি কি যাবেন?
—তোমার সন্দেহ আছে? কিন্তু নিজের আত্মীয় কারও যাওয়া দরকার। না হলে হাসপাতালে অসুবিধে হবে।
—আমি … আমি মেয়ে ধরুন!
—তাতে কি হবে, তনিকা?
বুকে প্রচণ্ড জখম। একবারের জন্যই জ্ঞান ফিরেছিল। কাউকে খুঁজেছিলেন। কাকে? কে জানে? তারপর একটা হেঁচকি তুলে চলে গেলেন। ক্লিয়ার কেস অব সুইসাইড। বডি মর্গে যাচ্ছে।
অদিতি হাসপাতালের করিডরে কাঠের বেঞ্চির ওপর বসে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তনিকা দু’ হাতে মুখ ঢেকেছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে প্রপাত। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীরটা। আঁদ্রে শৌনককে নিয়ে চলে গেছে। পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক কথা বলাবলি, ব্যবস্থাদি আছে।
দাহকার্য সেরে শুকনো মুখে নবগোপাল বললেন— আপনাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব, জানি না, আপনারা আমাদের কেউ নন, তবু বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তনি তোমাকে আর কী বলব! ভাল থাকো মা।
গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। একটু অপেক্ষা করলেন— অনোহিতা এল না। হুস করে গাড়ি ছেড়ে গেল।
ফ্যাকাশে মুখে অনোহিতা বলল— বাবা আর আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আমি কোথায় যাব?
—চলো, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি— অদিতি বলল।
নবগোপাল ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে আছেন। একবারও মেয়ের দিকে তাকাননি। একটা কথাও তার সঙ্গে বলেননি। পঞ্চমী তাঁকে খাবার সময়ে খাবার দিয়ে আসছে ঘরে। একটু ফাঁক দরজা, তার ভেতর দিয়ে দেখা যায়, সেই এক পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসে। সামনে টেবিলের ওপর হুইস্কির বোতল ও গ্লাস।
—তনি … বাবাকে বারণ কর। এত হুইস্কি খেলে বাবা মরে যাবে।
—মরে গেলে তো ভালই মিমি। তোকে আর কেউ কোনও বিষয়ে বাধা দেবে না। ভাল থাকবি।
—তনি এমন করে আমাকে বলিস না … আমার বুকের ভেতরটা যে কী হচ্ছে!
—ন্যাকামি করিস না মিমি। শোন, কাল সকালে আমি চলে যাব। তারপরে এটা তোর সংসার, তোর বাবা, তুই সামলা।
—আমি পারব না। পারি না।
—পারতে হবে। সামনে আর কোনও বিকল্প নেই!
—অদিতিদিকে ডেকে দিবি?
—তোকে নম্বর দিয়ে দিচ্ছি, তুই ডাক। আমি এর মধ্যে নেই।
—আমার সাহস হচ্ছে না।
—তা হলে ডাকিসনি! আমি শুতে যাচ্ছি।
অনেক রাতে গুটিসুটি হয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ল মিমি। ঠিক পাঁচ দিন পর সামান্য শ্রাদ্ধকার্য শেষ হয়ে গেলে আবার লন্ডনে ফিরে গেলেন নবগোপাল। নিজের স্যুটকেসটা তুললেন, চলে গেলেন।
পঞ্চমী বলল— আমাকে ছুটি করে দাও মিমি। আমি আর এখানে কাজ করব না।
—কেন? পঞ্চমীদি!
—আমার সব সময়ে মনে হয় মাসি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ করছে!
—ও তোমার মনের ভুল। এ রকম একটা কাণ্ড হলে ভয় হয়।
—বেশ আমার তাই হচ্ছে। তুমি মাইনে দেবে দিয়ো। নইলে আমি চললুম। ওহ্— জলজ্যান্ত মানুষটা গো! আজ বিশ বছর ধরে … কী করাটাই না …
মুখে কাপড় দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল পঞ্চমী।
কেউ জানে না ঠিক কী হয়েছিল। জানে একমাত্র তনিকা। দুর্বল মুহূর্তে প্রবল কষ্টে অনুশোচনায় তাকেই শুধু বলে ফেলেছিল। তা ছাড়া এ কথাটা সে আগেও তনিকাকে বলেছে। অনেকভাবে আঘাত সে মাসিকে করেছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। কোনখানে আঘাত করলে মাসির বিষদাঁত ভেঙে যাবে সে ঠিক বুঝতে পেরেছিল। ফল হবে এতেই। কিন্তু যা হল তা তার ধারণাতেও ছিল না। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। স্পষ্ট করে জানে না কার জন্য। নিঃশব্দে। কেননা এখন তার চিৎকার আর কেউ শুনবে না।
আঠারো
—মেয়েটি তা হলে মারাই গেল? বউমা?
—হ্যাঁ মা।
—এইটুকুনি বয়সে …
—কোনও কোনও সমস্যা থাকে মা মৃত্যু ছাড়া তার হয়তো আর কোনও সমাধান থাকে না। এ-ও হয়তো তেমনই কিছু।
—সৎমেয়ে সৎমাকে সহ্য করতে পারছিল না?
—তেমনই তো শুনছি!
—অথচ তুমি তোমার বিশ্বাসঘাতক ছেড়ে-যাওয়া বরের মায়ের সেবা করছ। এ কি সম্পর্কে সম্পর্কে তফাত? না মানুষে মানুষে?
—আমি জানি না মা।
—তুমি একটু আমার কাছে সরে এসো।
পালঙ্কের কাছে সরে বসল অদিতি যাতে উনি হাত পান। মাথায় হাত রাখলেন। —বড্ড ঘা খেয়েছ, না? মাথায় হাত বুলোচ্ছেন।
চোখের জলে বিছানা ভিজে যাচ্ছে।
কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। আঁদ্রেকে ছাড়তে, রাজর্ষির ব্যবহারে, কাঁদেনি অদিতি। মায়ের মৃত্যুর পর তিন বছর আগে তার শেষ কান্না। আর আজ এই। নিষ্পর একটা মানুষ, যার সঙ্গে মোটে দু’দিন সেভাবে দেখাশোনা। ফোনে কথা হয়েছে অবশ্য বেশ কয়েকবার। কিন্তু দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার, কিন্তু এমন ব্যক্তিগত সংকটের মুহূর্তে, মানুষের কাছে মানুষের আর আবরু থাকে না। এই যে বিপদে, সংকটে, বেআবরু সাক্ষাৎ এবং পাশাপাশি অতি বিপজ্জনক সমস্যার মোকাবিলা করা … এতে বোধহয় পুরো এক জন্মের পরিচয় হয়ে যায়। খুব বিপদে পড়ে তো তিনি অদিতির সাহায্য চেয়েছিলেন! এবারও তো চাইতে পারতেন! অন্ধকার রাত, তারাতলার বৃক্ষচ্ছায়ায় ঝুপসি বাংলো, স্বল্পালোকে দাঁড়িয়ে বলছেন—জিনিসগুলো ওকে তুমিই দিয়েছ তো! তা হলে লিখে দিতে আপত্তি কীসের?…ওর যদি কিছু হয় কাঠগড়ায় তোমাকে কী করে তুলতে হয় তা আমি জানি।
অত শক্ত ধাতের মানুষটা! রাতের পোশাক পরে উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এসেছেন। ওই রকম মানসিক অবস্থায় দুরন্ত বেগে গাড়ি চালিয়েছেন, কোনও গন্তব্য ছিল না। কাগজে লিখেছিল— সান্ট্রো গাড়িটা রেড রোডে ছোটাছুটি করছিল, ছোটাছুটি? গাড়িটা নয়। গাড়ির চালকই তো সেটা। ‘ওগো শোনো, ওগো শোনো, ওগো শোনো/ আছো কি বীর কোনও?’— আবেদন, এ রকম একটা মূক আবেদন কি ওঁর অস্থির উন্মত্ততার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল? ওঁর কি একবারও মনে হল না চূড়ান্ত বিপদে উনি একজনের সাহায্য চেয়েছিলেন, একজনকে ডেকেছিলেন! সে সাড়া দিয়েছিল এক ডাকে! সম্পূর্ণ বুদ্ধিভ্রংশ না হলে এ রকম কেউ করে? কী হয়েছিল? তনিকা বলছে— মিমির সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল, আচ্ছা, তেইশ বছরের একটা অপরিণত মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, তার ডবল বয়সি কোনও মহিলা এই রকম উন্মাদ হয়ে যাবেন?
যত আদর করছেন মাধুরী ততই কান্না বেড়ে যাচ্ছে তার। যেন বহুদিনের অবরুদ্ধ গুমোট ভেঙে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামল। এসব বুঝি তার জমানো ছিল। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যার কাছে এভাবে কাঁদা যায় বলে। মনীষা! সে সমসাময়িক, বন্ধু, কিন্তু কঠিন, রাগী, স্বার্থপর, সে বাইরের আচরণটা অপমানটা দেখে, অপমানের উত্তরে ঘৃণা করার, ঘৃণা শেখাবার শক্তি জোগায়, আর কিছু নয়। আঁদ্রে তুমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারোনি। মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি দাবি করা অন্যায়, করতে নেই জানি। কিন্তু আমার মা-বাবার মতামতের আমি পরোয়া করিনি। দারুণ দুঃখ দিয়েছিলাম তাদের, লিখেছিলাম—মা, আমি তোমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাদের প্রতি আমার ভালবাসায় কোনও খাদ নেই, কোনওদিন থাকবে না। কিন্তু কন্যা-পরিচয়ের বাইরেও যে আমার একটা অন্য পরিচয় আছে। অন্য জগৎ আছে। সেখানে যে আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে। যদি ভুল করি করব, তার শাস্তিও পাব, কিন্তু সে আমার ভুল। তোমাদের নয়। ভুল করবার স্বাধীনতা আমাকে দাও মা।
তা তাঁরা দিয়েছিলেন। না দিয়ে উপায়ই বা কী! কে তোয়াক্কা করছে স্বাধীনতা দেওয়ার বা না দেওয়ার! তাই যখন সে ভুলই প্রমাণিত হল, মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে পারেনি, বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা চাইতে পারেনি। … তুমি কিন্তু আঁদ্রে, এই ত্যাগ করতে পারোনি। অথচ তোমার কোনও অসুবিধে ছিল না। তা ছাড়া তোমাদের সমাজে এমনিতেই প্রেম-ভালবাসা-বিয়ের ব্যাপারে কেউই মা-বাবার তোয়াক্কা করে না। কত সীমাবদ্ধ ছিল তোমার হৃদয়ের ক্ষমতা! আর রাজর্ষি! সে ঘটনার পর পাছে কেউ তাকে করুণা করে, কৃপা করে, কিংবা কৌতুক করে তাই সে কঠিন-গম্ভীর কাজে-মগ্ন ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেউ যেন তার ক্ষতি, তার ক্ষত দেখতে না পায়। বুঝতে না পারে! তার মন কি আর কাঁদেনি? ‘আছো কি বীর কোনও?’— এ আবেদন কি তার অন্তরাত্মা থেকেও উঠে আসেনি? সে তার গলা টিপে রেখেছে। মা তখন থেকেই অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর শোক কাটাতে পারছেন না। মা তার কাছে কাঁদবেন, না সে মা’র কাছে? তখন তো তাকে মায়ের মা হয়ে উঠতে হয়েছে। তা ছাড়া ব্যাপারটাতে মা তার নির্বুদ্ধিতাই দেখতেন, তার বিশ্বাসের আন্তরিকতা তার মনুষ্যত্ব তো তিনি দেখতে চাইতেন না! পারতেন না!
কোনও কোনও শোক থাকে তার এমন তাপ যে ভেতরের দীর্ঘদিনের শৈত্য গলিয়ে দেয়। হিমবাহ গলে ঝরনা হয়ে, নদী হয়ে নামতে থাকে। নিষ্পর সর্বাণীদির শোকে নিষ্পর মাধুরীর মিতবাক্য সান্ত্বনা সেই উত্তাপ। সুতরাং, অদিতি সারা জীবনের কান্না একসঙ্গে কাঁদছে।
রাত হয়ে যাচ্ছে। একটু স্যূপ খেয়ে শুয়ে পড়েছে অদিতি। ফোনটা বাজল। মোবাইল এস.এম.এস. —দিদি কাল সক্কালে আপনার কাছে একবার যাব। তনিকা।
* * *
বড় ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখল অদিতি। স্বপ্ন বলে সে বুঝতেও পারেনি। প্রাণগোপালবাবু বলে একজন এসেছেন। একটা প্রদর্শনী হচ্ছে। উদ্বোধনের জন্য নিয়ে যাবেন তাকে। সে একটা জমকালো ওড়িশি সিল্ক পরেছে। শাড়িটা কিন্তু তার আদৌ নেই। কোনও ওড়িশি নৃত্যশিল্পীকে এই শাড়িতে দেখেছিল বোধহয়। কেমন চোখে লেগে গিয়েছিল। এ শাড়িটা তার সংগ্রহে কী করে যে এল! নীল রং, হালকা, তাতে লালচে পাড়, বমকাই কাজের। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কেন? ওদের কি আর গাড়ি নেই? সেই অ্যাম্বুলেন্সটা না? যেটা বাঁকুড়া থেকে মাধুরীকে এনেছিল? একটা প্রাসাদের সামনে গাড়ি থেমে যায়, সে নামে, সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচারে করে প্রাণগোপালবাবু। আশ্চর্য! নেমেই সটান উঠে দাঁড়ান। ভেতরে ঢুকছে। আরে এ যে সেই ফরাসি শাতো! উঁচু উঁচু ওক কাঠের প্যানেল, তার ওপর ছবি, পাথরের মেঝেতে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কার্পেট।
—বেসমেন্টে।
—বেসমেন্ট!
—হ্যাঁ।
একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে, পেছনে আলো হাতে প্রাণগোপালবাবু। বেসমেন্ট টেন্ট নয়, এটা একটা অন্ধকুঠি। সেলার-জাতীয়— তবে তার চেয়ে অনেক বড়।
সামনে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ঘরের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো আছে চৌকোনা কতকগুলো বাকস। সাদা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে মোড়া। সে গিয়ে খুলছে— ভেতরে একটা ভাঁজ-করা শব। ঠিক যেভাবে শাড়ি ভাঁজ করা হয় আঁচলটা ওপরে রেখে! মুখটা ওপরে রেখে পুরো শরীরটা তেমনি ভাঁজ করা রয়েছে। পেট বুকের ওপর পা দুটো তারপর ওপর থেকে পাটে পাটে নেমে এসেছে হাত। সমস্ত বাকসগুলো খুলে গেছে। প্রত্যেকটাতে একটা করে শব আলাদা আলাদা লোকের। আঁদ্রের, মাধুরীর, তনিকার, অনোহিতার, মায়ের, বাবার … চেহারাগুলো ঠিক ওদের নয়, তবু সে জানে ওদেরই। তার শরীর ভয়ে কেমন-কেমন করছে, একটা চিৎকার করল, চিৎকার ফুটল না। জেগে উঠল, জল খেল অনেকটা। কী অদ্ভুত স্বপ্ন! সুররিয়্যালিস্ট ছবির মতো! দালি কি এই রকম স্বপ্ন দেখেই ছবি আঁকতেন?
চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। ঘুম আর আসবে না। জানলা দিয়ে দক্ষিণ আকাশে তাকাল, ওইখান দিয়ে ফুটতে দেখবে ভোরের আলো। একদা বাবা বলেছিলেন—কী রে ঘুমের মধ্যে চেঁচাচ্ছিলি? কী স্বপ্ন দেখছিলি?
—বাবা, দেখলুম—তুমি আর মা মরে গেছ! আমার ভয় করছে। ভীষণ …
দূর পাগল, কারও সম্পর্কে খারাপ স্বপ্ন দেখলে কী হয় জানিস তো?
—কী?
—যার সম্পর্কে খারাপ দেখলি— তার ভাল হয়, উন্নতি হয়।
* * *
ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মানুষের শরীরে মনে আর কত সয়! বাবা চলে গেছে। তাকে একটা কথাও বলে যায়নি। হয়তো আর ফিরবে না। হয়তো লন্ডনের শাখাতেই থেকে যাবে এবার থেকে। টাকা পাঠাবে কি? বোধহয় পাঠাবে না। এখানে তার দুটো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট আছে। একটা মায়ের সঙ্গে, আরেকটা … আরেকটা আন্টিমাসির সঙ্গে …। পঞ্চমীদিকে কিছুতেই ধরে রাখা গেল না। তনিকা কাল নিমডি যাবে। পুরুলিয়ার বর্ষা দেখতে। আঁকতে যাবে, সবাই। ‘চিত্রভানু’র। চলে গেছে। তনিও বোধহয় চলে গেছে। এত বড় বাড়িটাতে সে একা। মেজানিনে খালি বিশ্বেশ্বর থাকে, তাদের ড্রাইভার। ঘুম যদি বা আসে, ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখে সে।
একটা পথ দিয়ে যাচ্ছে। এমন চকচকে পথটা যে তলায় আয়নার মতো তার ছায়া পড়েছে। হঠাৎ দেখে সে সমুদ্রের মধ্যে এসে পড়েছে। পথটা ভেসে আছে … দু’পাশে ঢেউ, যতদূর দেখা যায় জল। ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে পথটা। সে জলের মধ্যে পড়ে গেল। প্রাণপণে সাঁতরাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কোনদিকে যাবে? চারিদিকে শুধু জল, শুধু জল। হাবুডুবু খেতে খেতে সে উঠে বসল। জল খেল। টয়লেট গেল। ওপরের লাউঞ্জের এক কোণে বাবার সেলার। খোলা। খুঁজে পেতে এক বোতল হুইস্কি পেল। ঢালল গ্লাসে, একটু চুমুক দিল। মুখটা কড়া ওষুধ-ওষুধ স্বাদে বিকৃত হয়ে গেল। এভাবে হুইস্কি খেতে সে অভ্যস্ত নয়। সে খায় ওয়াইন, কিংবা ককটেল। বেসিনের মধ্যে ঢেলে দিল হুইস্কিটা। ফিরে দাঁড়াল।
বিশেষ কিছু খায়নি রাতে। পেটের ভেতর থেকে একটা টক জল উঠে আসছে। গা গুলিয়ে উঠল। ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম বার করল৷ খেতে খেতে গা-বমি ভাবটা কেটে গেল। ফিরে দাঁড়িয়েই সামনে ছবি। সমুদ্র, সমুদ্রতটে বালির ওপর হাওয়া খেলে গেছে, ছোট ছোট অসমান ঢেউ উঠেছে, একদিকে একগুচ্ছ পাম গাছ। একটা পোস্টার এটা। আরেক দিকে আর একটা ছবি, একটা বিরাট গাছের গুঁড়ি চারপাশে হলুদ হলুদ ফুল ঝরে রয়েছে, কেমন মোটা পাপড়ির হালকা হলুদ ফুলগুলো। একটা টকটকে লাল মগ। একবোঝা কলার থোড়ের খোলা, একটা পাখির বাসা। এটা তনি দিয়েছিল বেশ কিছুকাল আগে। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে, শূন্য চোখে। উঠে পড়ে। সব আলো জ্বেলে দেয়, নীচে নামে। মায়ের ঘর। সর্বত্র উজ্জ্বল কমলারঙের পরদা দুলছে। মেঝেটা অনেককাল পরে ঝকঝক করছে, আসবাবগুলোতে পালিশ। আলো পিছলে পড়ছে। মায়ের ঘরে একটা গেরুয়া রঙের কার্পেট পাতা, বিছানায় চিত্রবিচিত্র জাজিম। ড্রেসিংটেবিল একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খালি তার বুকে কোনও বস্তু নেই— ট্যালকাম পাউডার, কিংবা ও ডি কলোন, পার্ফুম মাখত না মা। একদিকে দেরাজ। এর ভেতরেই মায়ের জামাকাপড় সব থাকত। দেরাজটার ওপর তিনটে ছবি। একটা সে খুব ছোট্ট, স্বর্গীয় শিশু একটা স্বর্গীয় হাসি হাসছে। আর একটা মা আর আন্টিমাসি, মা বসে মাসি দাঁড়িয়ে, দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসছে, এটা মায়ের কলেজ-দিনের ছবি! মা কী সুন্দর এক তরুণী, তারই মতো বয়স হয়তো তখন, কিংবা আরও ছোট। দেখাচ্ছে একেবারে রোম্যান্টিক। আর আন্টি, সতেজ, সজীব, শক্তি আর স্ফূর্তির গাছ যেন একটা। তৃতীয় ফটোটা তাদের পুরো পরিবারের। পেছনে বাবা দাঁড়িয়ে, পাঞ্জাবি পরা। কাঁধে লম্বা উত্তরীয়। তখনও বেশ পেটা ছিল চেহারাটা। বসে, খুব কাছাকাছি মা আর মাসি, দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে। মাসির কোলে হেলান দিয়ে। সাত-আট বছর বয়স বোধহয়।
মা-মাসির ছবিটা তুলে নিল সে। মায়ের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ছবিটা দু’হাতে করে দেখছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। শুধু দেখছে নির্নিমেষে। কী দেখছে? মাকে, মাসিকে? না বন্ধুত্বকে? এত বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা তার নেই। দেখতে দেখতে আবার কখন চোখ জুড়ে এসেছে।
একটা বিকট মুখ। এমন মুখ কখনও দেখেনি সে। কী রকম একটা আক্রমণের ভঙ্গি করল মুখটা সঙ্গে সঙ্গে সে যেমন আছে তেমন বেরিয়ে গেল। ড্রয়ার থেকে বাড়ির চাবিটা নিল। সে একটা গাড়িতে বসে। গাড়ি চালাচ্ছে। নাইট ড্রেস পরে। চালাচ্ছে দিশেহারা আতঙ্কে। যতটা জোরে সে চালাচ্ছে তার চেয়েও জোরে চলছে গাড়িটা। গাড়িটার ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তার। হুড়মুড় করে চলেছে ভীষণ বেগে, একটা জোর ধাক্কা খেল। তার সামনে পড়ে আছেন অদিতি সরকার। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। সে চিৎকার করল— আন্টিমাসি!!! আন্টিমাসিই!!!!
উঠে বসল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ। ..চেম্বারটার ভেতরে গনগনে আগুন। শিখা নেই। শুধু আগুনে আলো। ঢাকাই শাড়ি-পরা ওঁর শরীরটা ঢুকে গেল। দপ্৷ শাটার পড়ে গেল। সে দেখল, মা-মাসির ছবিটা মাটিতে পড়ে গেছে। ইশ্শ্, যাঃ। খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে চটি পরল, ঘরের কোণ থেকে ঝাঁটা নিয়ে কাচগুলো জড়ো করে তুলল। তারপর সেগুলো ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে দিল। ছবিটা মুছে দেরাজের ওপর রেখে দিল। তারপর আস্তে খুব আস্তে মোবাইলটা তুলে নিল।
* * *
সাড়ে ছটা মতো বাজে। অদিতি মুখ ধুয়ে নিয়েছে। চুলে একটু চিরুনি চালিয়ে হাউসকোটটা গলিয়ে নিয়েছে। বসবার ঘরে বসেছে, সামনে চায়ের পট, এখনও সে হাত দেয়নি। একবার ঘড়ি দেখল। এইবার বাজছে। বেল। শীলাদি বলল— বসো বউমা, আমি খুলে দিচ্ছি।
ঘরে এসে ঢুকল অনোহিতা। একটা জিনসের ওপর আলগা একটা টপ পরেছে। মুখে যেন এখনও জল চকচক করছে। খুব শান্ত মুখটা। কোনও ধার নেই। কেমন অবর্ণনীয়। দু’পাশ দিয়ে চুল ঝুলে আছে।
—বসো।
—দিদি আমি মাসিকে খুন করেছি। আমি পুলিশের কাছে যাব। ধরা দেব।
—কী বলছ?
—হ্যাঁ এমন কথা মাসিকে বলেছি যে মাসি পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।
—কী বলেছিলে অনোহিতা?
—বলেছিলাম—তুমি মাকে খুন করেছ অক্সিজেন মাস্কটা খুলে, মা মরে গেলে আবার পরিয়ে দিয়েছিলে কিছুক্ষণ পর।
চমকে অদিতি বলল—কোনও কারণ ছিল বলার? এ কথা কেন মনে হল তোমার?
—একটা আক্রোশে বলেছি। টিভি. সিরিয়ালে দেখায় না? আমার মা অপারেশন টেবিলেই মারা যায়।
—আক্রোশ? আক্রোশ কীসের?
—আমি জানি না। আন্টিমাসিকে আমি খুব ভালবাসতাম। কিন্তু আমার বাবার পাশে … সহ্য করতে পারিনি। রাগ হত ভয়ানক।
—মাকে পারতে? সহ্য করতে?
—বোধহয় পারতাম না। ভাল লাগত না। বোধহয়।
—তা উনি যখন জানেন কথাটা মিথ্যে এবং তুমি ওঁকে এত … ট্রাবল দিচ্ছ … দিয়েই তো যাচ্ছ … উনি ও রকম জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন কেন?
—আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি…অমন হবে। আসলে মাসি মাকে যত ভালবাসত অমন আর কাউকে বাসত না। মা-ও তাই। অদ্ভুত একটা লয়্যালটি! আমি জ্ঞান হয়ে থেকে দেখছি।
মুখ নিচু করল সে— একটু পরে মুখ তুলে বলল— মা আর মাসি যেন যমজ। মাসি খুব স্ট্রং ছিল। আমি বুঝিনি ওই কথায় মাসির … অমন লাগবে। আমি বুঝিনি …। আমার থানায় যেতে খুব ভয় করছে। আপনি একটু সঙ্গে যাবেন?
—চা নাও। এক কাপ সে এগিয়ে দিল অনোহিতার দিকে।
—নাও! বসে থেকো না।
কাপটা তুলে নিল, আঙুলগুলো কাঁপছে। কোনওক্রমে মুখে ঠেকাল। তারপর নামিয়ে রাখল।
—বাড়িতে এখন কে কে আছেন?
—কেউ নেই। বাবা লন্ডনে চলে গেছে। আমাদের লোক পঞ্চমীদি চলে গেছে। ক’দিন সারারাত আমি বাড়িতে একা কাটিয়েছি। পঞ্চমীদি চলে গেল তো!
—খাওনি?
—হ্যাঁ, ফ্রিজে রুটিমাখন ছিল, আইসক্রিম … খেয়েছি।
—তুমি রান্না করতে পারো না?
—পারি। কিন্তু এখন পারছি না।
—অনোহিতা, একা বাড়িতে ফিরে গিয়ে তোমার কাজ নেই। এখন। তুমি বরং বাবাকে ফোন করে জেনে নাও কবে আসবেন। ততদিন অন্য কোথাও … একটু হালকা সুরে বলল অদিতি।
—বাবা আসবে না। আমাদের কাউকে না বলে চলে গেছে। আমার কেউ নেই কলকাতায়। বাবার খুড়তুতো ভাই থাকেন হুগলিতে। ওঁরা জানেনও না খবরটা।
—আত্মীয়স্বজনকে খবর দাওনি?
—কোথায় আত্মীয়? মামার বাড়িতে তো দাদু-দিদা নেই! আন্টিমাসির কারা যেন থাকেন কোথায় কোন দেশের বাড়িতে। নদিয়ার দিকে। খুব অসুস্থও। ওঁদেরও কোনও খবর… এক যদি কাগজ দেখে…
—শোনো,—বাবাকে ফোন করো। যতদিন না আসেন আমার কাছে থাকো।
—আমাকে থানায় যেতে হবে না?
—না, ও কেস ক্লোজড হয়ে গেছে। শোনো তুমি একটু কিছু খাও, তারপর বাবাকে…
—বাবাকে ফোন করার আমার সাহস নেই দিদি। তার গলা মৃদু, তাতে শীত লাগার কাঁপন।
—আচ্ছা আমি যোগাযোগ করছি। আমাকে দাও নম্বরটা। শোনো, কিছু খাও। কী খাবে। বলো? আইসক্রিম?
পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ল মেয়েটি।
সে আইসক্রিম কেটে এনে ওর সামনে রাখল।
একটু একটু করে খেল। খেয়ে নিল।
—এবার একটু ঘুমোও, হ্যাঁ!
—ঘুমোব? এখন তো সকাল!
—ঘুমোচ্ছ না তো কদিন, একটু ঘুম দরকার।
—ওষুধ দেবেন? ঘুমের?
—হ্যাঁ, দাঁড়াও …
সে মাধুরীর ঘর থেকে ওষুধ নিয়ে এল।
—তুমি দেখে নাও অনোহিতা কী দিচ্ছি! এই যে অ্যালজোলাম। মোটে .5। খেয়ে ঘুমোও। চলো। সে নিজের ঘরের একটা খাটে ওকে শুইয়ে দিল। পরদা টেনে অন্ধকার করে দিল ঘর। একটা সেতার চালিয়ে দিল বিলায়েৎ খানের। পাশে বসে রইল অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তনিকাকে একটা ফোন করল।
—তনিকা শোনো তোমার পুরুলিয়া যাওয়া হচ্ছে না। চলে এসো আমার এখানে। এখুনি।
তারপর লন্ডনের নম্বরটা টিপল।
এখন মাঝরাত, কিন্তু কী করা যাবে?
—হ্যালো, কে বলছেন? ভারী, বিরক্ত কণ্ঠ।
—আমার নাম অদিতি সরকার, আমি সর্বাণীদির বন্ধু।
—বলুন।
—আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ।
—কী হয়েছে?
—মানসিকভাবে। অনেকদিন ধরেই ওর এই মানসিক প্রবলেমটা— আপনারা কেউ কেন লক্ষ করেননি জানি না। কবে আসবেন জানান। যত শিগগির সম্ভব। ততদিন আমি রাখছি। আমার নম্বরটা নিন। কাইন্ডলি প্রতিদিন ফোন করবেন, যতদিন না আসছেন। নম্বর বলে সে ফোন নামিয়ে রাখল।
এমনিতেই আজ ‘চিত্রভানু’ যাওয়ার ছিল না। ওরা নিমডি যাবে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে, বর্ষার দলমা দেখবে, আঁকবে। কোথায় একজন ডাক্তার পাওয়া যায় এক্ষুনি? একজন মনোবিদ! কুসুমজি একজনের কাছে কাউনসেলিংয়ের জন্য যেতেন। প্রথম প্রথম প্যারালাইজড্ হয়ে যাবার পর। এখনও বোধহয় মাঝে মাঝে যান। কাউনসেলিং! ঠিক ডাক্তার তো নয়! সে বুঝতে পারছে না, মনোবিদদের কাছে যেতে হবে কিনা। এঁদের আবার একটু ভয়ই করে। একগাদা ট্র্যাংকুইলাইজার … দিয়ে … দিয়ে…। তেমন রিসক্ সে নিতে পারে না ওর বাবা না আসা পর্যন্ত। দুঃখের বিষয়, ওর বাবার ওপরও তেমন ভরসা করা যায় না। যিনি একমাত্র মেয়েকে অমন ট্রমার মধ্যে ফেলে, কথা নয়, বার্তা নয়, বিদেশ চলে যেতে পারেন তিনি কতটা পরিণতমনস্ক, ঘোর সন্দেহ আছে। পুরো বাড়িটাতে একমাত্র ম্যাচুয়োরিটি ছিল সর্বাণীদির। তিনি হঠাৎ এমন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেলেন? ওঁর উচিত ছিল এর গালে কষে একটা থাপ্পড় কষানো। উনি তো নিজে শিক্ষকও ছিলেন, ছোট্ট থেকে দেখে আসছেন ওর যা কিছু নষ্টামো! আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, শক্ত, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আড়ালে কোথায় ছিল এই দুর্বল চিত্ত? এ কেমন বন্ধুত্ব যা উটকো দোষারোপে এমন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়! খুব জটিল —এ মনস্তত্ত্ব! সে সামান্য সংশয়ে ভোগে, কিন্তু স্থির আঙুল কিছুর ওপর রাখতে পারে না।
—কী ব্যাপার দিদি? শৌনক ঢুকল প্রথমে। পেছনে পেছনে তনিকা।
—আস্তে শৌনক, আস্তে।
—খ্ খী ব্যাপার? —শৌনক ফিসফিস করে বলে আবার।
—তনিকা, তুমি না ওর বন্ধু! ওকে একা ফেলে কী করে চলে এলে?
—কেন? কী হয়েছে দিদি? —তনিকার চোখে উদ্বেগ।
—হতে পারত। হতে পারত ভয়ানক কিছু। এখন ও আমার ঘরে ঘুমোচ্ছে। থাক এখানে কিছুদিন, তুমি এক কাজ করো। ওর ব্যাগ থেকে বাড়ির চাবিটা নিয়ে চলে যাও। সব বন্ধটন্ধ করে চলে এসো। কেউ নেই ওখানে।
—কেউ নেই? পঞ্চমীদি? বিশ্বেশ্বররদা?
—পঞ্চমী মেয়েটি নেই, বিশ্বেশ্বরদা কী ভাবে থাকে আমার জানা নেই।
—ও মেজানিনে থাকে দিদি। নিজেই রান্না করে খায়।
—বিশ্বাসী?
—তাই তো জানি।
—ঠিক আছে তোমরা দু’জনে চলে যাও, সব ঠিকঠাক করে ওর কিছু জামাকাপড় চাবিটাবি নিয়ে চলে এসো।
নিচু হয়ে অনোহিতার ব্যাগ থেকে চাবি নিতে গিয়ে, তনিকার ঝোলা থেকে একটা ব্রাউন রঙের শক্ত মলাটের ডায়েরি পড়ে যায়। তনিকা তুলে নিতে গেলে অদিতি বলল— থাক, ওটা থাক, অনোহিতার, না?
—হ্যাঁ, মুখ নিচু করে রইল তনিকা, ইতস্তত করে অবশেষে বলেই ফেলল —দিদি আমি তো ওর বন্ধু, আমার কাছেই থাক ওটা।
—বন্ধু তো আমিও হতে পারি!
—দিদি ওটা আপনি … পড়বেন … না।
—সে আমি বুঝব। তোমরা চলে যাও।
ডায়েরিটার দিকে ভীত করুণ চোখে চেয়ে চলে গেল তনিকা, পেছন পেছন শৌনক। অদিতি তুলে নিল ডায়েরিটা।
দু’জনের আসা এবং চলে যাওয়ার ধরন দেখে কেমন মনে হল, ওদের মধ্যে একটা নতুন সম্পর্কের বীজ উপ্ত হয়েছে। কাছে আসুক, দুঃখে, বিপদে, নিজেদের যদি না-ও হয়, অন্যের। তবে হয়তো শক্ত হবে পরিচয়ের ভিত। কারও কারও চারপাশে অনেকে থাকে, অথচ সত্যিকার কেউ থাকে না। যেমন অনোহিতা। কারও আবার আশেপাশে কেউ না থাকলেও সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে থাকে। একটা সমঝোতা। যেমন তনিকা।
ডায়েরিটা সে ওলটায়। উলটেপালটে দেখে। এই মুহূর্তে কেউ নেই। কী এমন লেখে ও!
* * *
—আর এর সঙ্গে হলদিয়া গিয়েছিলাম। দারুণ কাটল। এই আমার প্রথম সেক্স। আরও অনেকবার চান্স এসেছে। হতে হতে হয়নি। আরমান দারুণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম— অভিজ্ঞতা আছে নাকি রে?
—তুইও যেমন—এসব ইনস্টিংট। অভিজ্ঞতা লাগে নাকি?
—বাজে কথা ছাড়। যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে। অভিজ্ঞতা আছে কি না? ইয়েস অর নো।
—আমার তো মনে হচ্ছে তোরই অভিজ্ঞতা আছে।
—উলটো চাপ দিচ্ছিস! তবে রে?
আমাদের ঝগড়াটা অবশ্য আর একটায় শেষ হল। ও বলল— তোর মধ্যে থেকে তোদের ঠানদিরা কথা কয়ে উঠছে কেন? যদি অভিজ্ঞতা থাকে, তোর কি আমার, কী এসে যায়? মোদ্দা কথা আমরা পরস্পরকে এনজয় করছি কি না।
ধুর— সো-কলড্ ঠানদি কিনা জানি না। আমার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। আরমান আমার। অন্য কারও হবে কেন?
* * *
আসল মজা, মজার মতো মজা কাকুর সঙ্গে। হি ইজ ফান। এই দেখছ ছবি আঁকছে। ন্যুড হয়ে বোস তো! হ্যাঁ এইভাবে। পায়ের ওপর পা ক্রস কর। দু’হাতে পেছন দিকে ভর দে। আঁকার প্রথম স্কেচটা হয়ে গেলেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসবে। বুড়ো একটা। কিন্তু দুর্ধর্ষ সেক্সি। তবে কাকু বোধ হয় ইমপোটেন্ট। দুটো ধেড়ে ধেড়ে ছেলেমেয়ে আছে, ওর বউটা যা খেপি! মনে হয় ও ইমপোটেন্ট হয়ে গেছে ইদানীং। ব্যাড লাক।
অদিতি ডায়েরিটা বন্ধ করল। ড্রয়ারের মধ্যে রেখে চাবি দিল।
ঘুমন্ত মানুষকে বড় নিষ্পাপ দেখায়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আঁটো জিনস্ পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বালিশের ওপর মুখটা এক কাতে ঝলে পড়েছে, তাতে দেখাচ্ছে আরও অসহায়। করুণা জাগায়। কে জানে, হয়তো এই রূপটাই সত্য। ঘুমের মধ্যে যা দেখায় তা-ই তার আসল পরিচয়। স্বপ্নে। ভয়ের, ভালবাসার, উদ্বেগের, কষ্টের এই অনুভূতিগুলোই মানুষের আসল। বাইরে অপরিচিত পৃথিবী তার জটিল সমাজ, প্রশাসন, পারিবারিক দাবি সমস্ত নিয়ে আক্রমণ করে। তখন আসল মানুষটা কুঁকড়ে যায়, বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। শুধু স্বপ্নে বাঁচে। সুস্বপ্নে এবং দুঃস্বপ্নে। সেই বাঁচা ফুটে ওঠে ঘুমন্ত মানুষের মুখের আদলে, শরীরের সমর্পিত শিথিলতায়।
ওর একটা হাত ঝুলছিল। খুব সাবধানে তুলে দিল।
উনিশ
—আমি তোমাকেই আঁকব। এই যে দেখো, ওই দিদার ছবি এঁকেছি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভাল লাগছে কি না দেখো তো? সে যেন কোনও বাচ্চাকে বলছে, কিন্তু ভঙ্গিটা বড়দের।
—আমি ছবি বুঝি না।
—ভাল না লাগলে ‘না’ বলো।
—এই বুড়ো মুখ আমার ভাল লাগছে না।
—তনিকা তোমার?
—হলুদের মনোক্রোম করে দিদি এমন একটা আলো এনে ফেলেছেন ছবিটার মধ্যে মনে হচ্ছে … মনে হচ্ছে … বার্ধক্য একটা— কী বলব … সুন্দর জিনিস … শ্ৰদ্ধার … ভালবাসার।
—অনোহিতা এই হলুদ আলো তোমার ভাল লাগছে না?
—না
—এত এঁকেছি, দেখো কোনওটাই কি পছন্দ হচ্ছে না তোমার? আমি কিছু মনে করব না।
—ওই বৃষ্টিটা ভাল লেগেছে। অতগুলো গাড়ি … ওটা কোন রাস্তা?
—একটু দেখো বুঝতে পারবে।
—চৌরঙ্গি? শহিদ মিনারটা বেঁকে গেছে কেন?
—বৃষ্টিতে।
—একটা হিউম্যান ফিগার রয়েছে, ওটা কার?
—কার আর। এই বৃষ্টির সঙ্গে যে বৃষ্টি হয়ে যেতে চায় তার! অদিতি তনিকার দিকে আড়চোখে তাকাল। তনিকা অপ্রস্তুত হেসে মাথা নিচু করল।
—আমার ছবি আঁকবেন না। আমার ভেতরটা খুব বীভৎস। সেইটাই সবাই আঁকে।
—আচ্ছা আগে তো আমি আঁকি খানিকটা পরে যদি তোমার অপছন্দ হয়, তা হলে না হয় মুছে দেব।
দ্রুত হাতে চুল, চুলের প্রান্তরেখা, মুখের ডৌল প্রায় একটানে এঁকে, গ্রীবার কাছে এসে থামল অদিতি। বলল—ওই ঘরে যে দিদা আছেন, ওঁকে কি তোমার বুড়ো বলে ভাল লাগে না?
—তা নয়। উনি তো মানুষ। কিন্তু ওঁর ছবিটা শুধু … শুধুই বুড়ো।
—বুড়োমানুষ নয়?
—না।
—আচ্ছা তোমায় আঁকি। দেখো এটা কেমন মানুষ হয়!
—আমি তো মানুষ নই, আমাকে মানুষ করে আঁকবেন কী করে?
অবাক হয়ে অদিতি বলল— তুমি মানুষ নও? তুমি তবে কী? বৃষ্টি, রোদ, হাওয়া?
—আমি ওয়াইল্ড, জন্তু একটা।
—আমার তো তোমাকে একটা গাছের পাতার মতো মনে হয়। ধরো ইউক্যালিপটাস।
চমকে উঠল অনেহিতা।
—পাতলা, ধারালো পাতা। ভীষণ ডেলিকেট। কিন্তু ক্ষুরধার। আর ভীষণ সুগন্ধ।
শান্ত হয়ে বসে রইল অনাহিতা।
—আপনি কী করে জানলেন?
—কী?
—যে আমি ইউক্যালিপটাস পাতার মতো!
—মনে হল। কবিদের, শিল্পীদের এ রকম অনেক কিছু মনে হয়। মানুষের সঙ্গে গাছ, নদী, বৃষ্টি সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ঘটনার আদল খুঁজে পায় তারা।
একটা সম্পূর্ণ মুখের ছবি আঁকল অদিতি ঘণ্টা দুই ধরে। তারপর তনিকাকে বলল—শেষ করো। আমি একটু মাকে দেখে আসি।
উনি খেতে বসেছেন। আরামচেয়ারটার দুটো হাতলের ওপর একটা কাঠের ট্রে বসানো হয়েছে। তার ওপরেই ছোট থালাবাটিতে ওঁর সামান্য খাবার। অদিতিকে দেখে বললেন— কী করছে, ওরা?
—একজন আরেকজনকে আঁকছে।
খাওয়া হয়ে গেলে শীলাদি সব তুলে নিয়ে মুখ ধুইয়ে গেল, উনি ন্যাপকিনে মুখ মুছে বললেন—এ সৎমা তো সে সৎমা নয় বউমা?
—কেমন তা হলে?
—দ্যাখো মা, জীবন বড় বিচিত্র—সব সৎমাই কিছু স্নো- হোয়াইট কি সিন্ডারেল্লার সৎমা নয়। ইনি নিশ্চয় খুবই অসাধারণ মা ছিলেন, নইলে মেয়েটির এমন অবস্থা হয়? একটু না হয় ঝগড়াই হল। আদুরে মেয়ে কী বলতে কী বলে ফেলেছে তার জন্যে একেবারে আত্মহত্যা? কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল বলো তো? মেয়েটার, তার বাবার, তাঁর নিজেরও কি কম ক্ষতি হল? কী চমৎকার মেয়ে, একটু বুঝে চলতে হয়! ডিপ্লোম্যাসি সংসারে বারে বারেই লাগে। লাগে না?
—নিশ্চয়! অদিতি একটু হেসে বলল।
—কিন্তু তোমাকে আমার অন্য কয়েকটা কথা বলার আছে।
—বলুন।
—একটা এখন বলছি, আরেকটা সময় হলে বলব।
—এখনকারটা তো বলুন।
—তুমি আঁদ্রের সঙ্গে চলে যাও।
চমকে একটু চুপ করে রইল সে। তারপর অনিচ্ছুকভাবে বলল— মা ওই যে বলছিলেন জীবন বড় বিচিত্র, সৎমাও যেমন একরকম হয় না, অন্য সম্পর্কগুলোর মধ্যেও তেমন অনেক হেরফের থাকে।
—কেন? অসুবিধে কী? বোঝাও তোমার হেরফের, যদি নেহাত বোকাসোকা মা বলে মনে না করো।
অদিতি বলল—আপনি তো এখন একটু বেড়াবেন? উঠুন দেখি।
একটু বেড়ালেন, তারপর বললেন—জানি মা তোমরা আজকালকার মেয়েরা নাক-গলানো পছন্দ করো না। কিন্তু কী করি! মা তো! কতকগুলো জিনিস পরিষ্কার জলের মতো দেখতে পাই।
—যেমন?
—যেমন, ওই ছেলেটি ওই সাহেবটি তোমাকে সত্যিকারের ভালবাসে। ও বোধহয় বলতে পারছে না। আর…
—আর?
—তুমিও কিন্তু ওকে ভালবাসো। কেন বোঝে না জানি না।
—আপনি এবার শুয়ে পড়ুন। ওঁকে শুইয়ে অদিতি খাবার ঘরে গেল। টেবিলে তিনজনের প্লেট পড়ে গেছে। ছবি ভাতের ফ্যান গালছে। শীলাদি জিজ্ঞেস করছে—কোনগুলো এবেলার, কোনগুলো ওবেলার বলবি তো?
—তনিকা, অনোহিতা খাবে এসো। সে ডাকল।
শীলাদিতে ছবিতে ছোটখাটো একটা ঝগড়া লেগে গেছে।
—তুই কোনদিন থাকিস বল। আমিই তো সব গুছিয়ে দিই, জানিস? কোনটা দিতে হবে। কী গো বউমা তুমি কাচের এই বড় গোল বাটিটাতে মাংস রাখতে বলো না? আর এই ডিমের মতো ছাঁচের এটাতে স্যালাড।
—ঠিক, একদম ঠিক।
তনিকা বলল— ছবিদি রেঁধে যাবে, শীলাদি পরিবেশন করবে। এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান, আর এক কন্যে গোঁসা করে বাপের বাড়ি যান।
অনোহিতার চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। কীসে, কোনটাতে ওর লাগল কে জানে!
আজ বেলুড় দক্ষিণেশ্বর যাবার পালা অদিতির। শীলাদি থাকবে মাধুরীর কাছে। বিকেল তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বে। আঁদ্রে আসবে। ক’দিনই যেখানে যাচ্ছে আঁদ্রে যাচ্ছে সঙ্গে। তাকে কলকাতা দেখানোও একটা কাজ। তনিকা, অনোহিতা রেডি হয়ে গেছে। আঁদ্রে এসে গেছে, অনোহিতা বলল, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।
—যেতে ইচ্ছে করছে না? আঁদ্রে বলল—তোমায় কাঁধে করে নিয়ে যাব।
—না, আঁদ্রেদা। আজ থাক।
—না আঁদ্রেদা আজই হয়ে যাক।
দক্ষিণেশ্বর ঘুরে এসে বেলুড়ে পৌঁছোল, তখন সাড়ে ছ’টা। আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যারতি শুরু হবে।
গঙ্গার ধারে বসল কিছুক্ষণ।
—এত বড় চওড়া নদী আমাদের নয়, বুঝলে তনিকা। সেন নদী এর আর্ধেকেরও কম। তার ওপর কিছুটা অন্তর অন্তরই ব্রিজ। আমরা বলি পোঁ, পোঁ দ্য ইয়েনার, পোঁ দ্য কঁকৰ্দ।
—আমার খুব ইচ্ছে করে যে জায়গাটা মোনে এঁকেছিলেন সেইটা আঁকব। তনিকা বলল।
—দুঃখের বিষয় সে জায়গা আর সে রকম নেই।
—ওল্ড প্যারিসে ও রকম জায়গা কিছু পেতেও পারো— অদিতি বলল।
—আমরা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তিরতিরে জল দেখতাম। সন্ধের ছায়া, নদীর গভীরে আলো জ্বলে উঠল, তবু নদী সেই আলো গিলেই শুয়ে থাকে অজগরের মতো। নাপোলিয়াঁ বলতেন এই নদীই পারীর প্রকৃত রাজপথ।
—প্যারিসের জন্য আমার মন কেমন করে— বলল তনিকা।
—তুমি কবে গিয়েছিলে?
—গত জন্মে।
—কী ছিলে?
—একজন ব্যর্থ পেন্টার আঁদ্রেদা, আমি তুলুজ লত্রেকের সঙ্গে কাজ করতাম। এত যাচ্ছেতাই করতেন আমাকে উনি। বড্ড খিস্তি করতেন। স্যরি দিদি!
—আচ্ছা! তা সত্ত্বেও এ জন্মে মনে রেখে দিয়েছ? কোনও ভালবাসার কথা আমুর-এর কথা মনে নেই?
—নাঃ। আর্টিস্টদের ভালবেসে কাজ নেই। এত উড়নচণ্ডী হয় না?
অনাহিতা উঠে পড়ল, আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। কখন কীসে ওর লেগে যাচ্ছে!
সন্ধ্যারতির সময়ে বিশাল হলে গমগমে সংগীতের মধ্যে বসে আছে চারজন। অদিতি, তনিকা দু’জনেই গাইছে। আঁদ্রেও চেষ্টা করছে সুরটা ধরবার। অনোহিতা খালি মূক। কিন্তু অন্যমনস্ক নয়, শুনছে। কিছুক্ষণ পরে তার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
কীসে যে ওর কান্না পায়! অন্যরা শুধু অন্যদিকে চেয়ে থাকে। না-দেখার ভান করে। কেউ কারও দিকে চায় না। চোখের জল গালে শুকিয়ে যায়। একটা ময়লা মতো দাগ লেগে থাকে।
আঁদ্রে বলল— ওর একটা হাওয়া বদল দরকার, বুঝলে ওদিৎ!
—বুঝছি। কিন্তু নিজের দায়িত্বে সেটা করতে পারি না। ওর বাবাকে আসতে দাও।
আঁদ্রে হেসে বলল— এনি ওয়ে দায়িত্ব তো অনেকটাই নিচ্ছ! সেটারও ঝুঁকি আছে। তোমাদের এখানে ছেলেমেয়েদের ওপরে বড্ড গার্জেনগিরি করতে হয়!
—হ্যাঁ, তা হয়।
—কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলে!
—থেমে যাওয়াই তো ভাল। আটকে যাচ্ছে যখন!
—তবু!
—কী জানো আঁদ্রে এই যে গার্জেনগিরি এটা কিন্তু শুধু ইনটারফিয়ারেন্স নয়, এর ভেতর অভিজ্ঞ স্নেহ-ভালবাসার একটা মস্ত বড় ভূমিকা থেকে যায়। আত্মহত্যা, ভ্রূণহত্যা, ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়া … এগুলো তোমাদের মধ্যে বেশি বেশি ঘটে। কেউ দেখে না। দেখবার কেউ নেই।
—তার মানে দেখো, অ্যাডভেঞ্চারের কোনও স্থান নেই তোমাদের জীবনে।
—আছে ঠিকই। বাড়ি থেকে একসময়ে খুব পালাত ছেলেমেয়েরা। তবে সেটা স্বভাবে থাকত বলে। সঠিক পথ দেখাবার লোকের অভাবে, যত্ন নেওয়া বা ভালবাসার অভাবে সব সময়ে নয়। তা ছাড়া তোমাদের মধ্যেও তো পারিবারিক মূল্যবোধ যথেষ্ট দৃঢ়। তোমরাই কি বাবা-মার গার্জেনি মেনে নাও না? যার বাবা-মা’র চালচুলো নেই সে হয়তো নেয় না। ধনী বাবা-মা’র সন্তান হলে তাকে তাঁদের নির্দেশ মেনে চলতেই হয়।
অনেকক্ষণ বিবর্ণ মুখে চুপ করে রইল আঁদ্রে। ওরা বসেছিল ময়দানে ঘাসের ওপর। অদূরে প্রেস ক্লাবের তাঁবু। এখনও সন্ধে হল না, জ্বলজ্বল করছে আকাশ। তনিকা আর অনোহিতা গেছে আইসক্রিম খেতে। ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে ওদের একা একা থাকতে দেয় সে। জনাকীর্ণ এই গর্জমান রাজপথ দিয়ে দু’জনে হেঁটে যাক। দোকানে দোকানে পসরা। খদ্দের। রেস্তোরাঁগুলো উপছে পড়ছে। লোভনীয় খাদ্যের গন্ধ ভাসছে বাতাসে— ‘আমাদের জন্যে দুটো চিকেন রোল আনিস।’ চতুর্দিকে বহতা জীবনধারা প্রবেশ করুক ওর মধ্যে। ‘কোনও কথা কাটাকাটির মধ্যে যাবি না, কোনও পুরনো কথা তুলবি না, ও কী বলতে চায় শুনবি।’
আঁদ্রে বলল— এই একটা কারণে তুমি এখনও আমার ওপর রেগে আছ?
—আমি রাগিনি তো!
—ঠিক আছে। রাগোনি। দুঃখ, শক। এইজন্যে সারা জীবন আমায় কষ্ট দেবে?
—না তা-ও না।
—তবে?
—আমার মধ্যে কী যেন একটা মরে গেছে আঁদ্রে। তোমাকে সত্যি খুব ভালবাসি। খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু দু’জনে নতুন করে জীবন শুরু করতে আমি ঠিক উৎসাহ পাই না। যা হয়ে গেছে, তা তো হয়েই গেছে!
—না, হয়ে যায়নি। তুমি কি জানো এই এতগুলো বছর আমি শুধু তোমার অপেক্ষা করে আছি। রাজর্ষির সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে শুনে, তিনদিন আমি ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। যখন আমাকে রিফিউজ করলে তখন থেকে মায়ের সঙ্গে দরকারের বেশি কথা বলিনি একটাও।
—এ রকম কেন করলে আঁদ্রে? মায়েরও তো মন আছে! ছেলে হয়ে মাকে কষ্ট—
—অত হিসেব করে কি মানুষ চলতে পারে? নিজের আবেগকে কি বোঝানো যায়? অনুভূতিকে বোঝানো যায়? তুমি পারো? পারছ? তুমি খুব ভাল করে জানো আসলে তুমি আমারই স্ত্রী। মাঝে রাজর্ষির দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে মাত্র। তবু তোমার যে এই কুঁকড়ে যাওয়া, পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়া নিয়ে দ্বিধা— এটা তোমার একটা ফিলিং। এটাকে বোঝাও। নিজে আগে পেরে দেখাও। তারপর আমাকে উপদেশ দিতে এসো।
আঁদ্রে উঠে পড়ল। উত্তেজিত। রেগেও গেছে বোধহয়।
দূর থেকে দুটো ফুটকিকে আসতে দেখা গেল। হাতে মোড়ক।
—এই নাও, আঁদ্রেদা খেয়ে দেখো, কেমন!
—দেখব মানে? আমার ইতিমধ্যে অনেকবার দেখা হয়ে গেছে। আমার নেশা লেগে গেছে। আর কিছু না হোক, এই রোলের ব্যবসা করলেই ইন্ডিয়ানরা লাল হয়ে যাবে। ফ্রান্স আমেরিকায়, কনটিনেন্টে ইন জেনারল।
—তোরা কী খেলি, অনোহিতা!
—রোল খেয়েছি, তা ছাড়া আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছিলাম। আমি একটা মিল্ক শেক খেয়েছি।
—আমার পরে, দুধ ভালবাসে এমন মেয়ে আমি খালি তোকেই দেখছি।
একটু ইতস্তত করে অনোহিতা বলল— মা-ও, আর … মাসি-ও বাসত।
—তোর সঙ্গে তা হলে খুব মিল বল। মায়ের চেহারাটা তো হুবহু পেয়েছিস।
অনোহিতা চুপ। কাঁদছে না, কিন্তু কান্না থমকে আছে, মেঘাচ্ছন্ন মুখ।
* * *
রাতে অনোহিতার বাবার ফোন এল। রোজ না হলেও ক’দিন অন্তর অন্তরই করছেন। কথা অদিতির সঙ্গেই হয়।
—মিস সরকার। আমি নবগোপাল সাহা রায় বলছি।
—বলুন।
—ও কেমন আছে?
—শোকটা সামলে উঠতে এখনও পারেনি। তবে শান্ত।
—আর সিন ক্রিয়েট করছে না?
—না।
—যাক, শেষ পর্যন্ত শ্মশানের শান্তি তা হলে এল আমার জীবনে। ও কি আমার সঙ্গে কথা বলবে?
—দেখছি। … অনোহিতা বাবা ডাকছেন।
তনিকা বলল— ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
অদিতি ফোনের মধ্যে বলল— ওকে কাইন্ডলি একটা চিঠি দিন। সব যোগাযোগ ফোনে হয় না। একটু সাহস একটু স্নেহ দিন।
মিমি,
জীবনে এই প্রথম তোমাকে চিঠি লিখছি। চিরকাল এত সংক্ষেপে, এত মুখোমুখি কথা বলে আমরা অভ্যস্ত যে চিঠিতে কী লিখব, কেমন করে এটা একটা সমস্যা। তুমি যদি আমাকে একটা পালটা চিঠি দাও, তা হলে হয়তো ব্যাপারটা আমার কাছে সহজ হয়ে যাবে। আমি একলা একটা হোটেলের ঘরে আছি, একটা লবি আছে অবশ্য। আমি ভাবছিলাম— তুমি যদি চলে আসো, তা হলে কিছুদিন এখানে কাটিয়ে আমরা একটু কনটিনেন্ট ট্যুর করতে পারি। কী বলো?
বাবা।
অনোহিতা চিঠি লিখল না। তবে এবার ফোন এলে ধরল।
—মিমি! কতদিন পর তোমার গলা শুনলাম।
—বাবা, কেমন আছ?
—ভাল।
—তুমি?
—ভাল।
—আমার চিঠির কী হল?
—তোমার পড়ার সময় হবে না বাবা।
—আমি ঠিক সময় করে নেব।
—তোমার যদি বা সময় হয়, আমার ইচ্ছে হয় না।
—কী করে সময় কাটাও?
—জানি না। কথা বলি নিজের সঙ্গে। আর… আর ঘুমোই… খুব ক্লান্ত লাগে। অনেকটা ঘুমোতে ইচ্ছে করে।
—খুব বেশি ট্র্যাংকুলাইজার খাচ্ছ নাকি?
—একটুও খাচ্ছি না তো! কিন্তু তুমি! তুমি কি স্মোকিং আর ড্রিঙ্কিং বন্ধ করতে পেরেছ?
—চেষ্টা করছি। স্মোকিং তো বন্ধই হয়ে গেছে প্রায়। ড্রিংক্স নিয়ে একটু বসি এই পর্যন্ত।
—ড্রিংক্সে, অফিসকে সময় দিয়ে যখন তোমার হাতে আমার জন্যে সময় থাকবে তখন যাব।
—ঠিক আছে।
* * *
—মিস সরকার?
—বলুন?
—আমাকে একটা ছবি মানে ফটো কে মেল করল বলুন তো! আপনি?
—না তো! কী ফটো?
—আমার স্ত্রী আর সর্বাণী, মানে দুই স্ত্রীর একসঙ্গে একটা ফটো। পেছনে আমি। ওদের কোলের কাছে মিমি। তখন বাচ্চা।
—ও-ই পাঠিয়ে থাকবে!
—ওকে কি একটু জিজ্ঞেস করবেন?
—কী দরকার! বোঝাই যাচ্ছে ও-ই পাঠিয়েছে।
—তাতে কি বুঝব ও সর্বাণীকে শেষ পর্যন্ত, তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর, মেনে নিল? মানে এই দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা!
—আপনি বোঝেননি। ও অনেকদিনই মেনে নিয়েছে। ওর তো মাসির ওপর প্রধান রাগটা তিনি ওকে কন্ট্রোল করতেন বলে, আর… আর… আপনি ওর কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছিলেন বলে।
—আমি!
—হ্যাঁ আপনাদেরও মেয়ের বড় হয় ওঠার সময়ে একটা দায় থেকে যায়! আচ্ছা রাখি।
* * *
আঁদ্রেদার সঙ্গে দুই বন্ধুকে ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম দেখতে পাঠিয়েছে অদিতি। ‘চিত্রভানু’ পুরুলিয়া থেকে এসে গেছে। কিন্তু সে একটু ঢিলে দিচ্ছে। ব্রাউন মলাটের ডায়েরিটা সে খুলে ধরে—
—আমি তনিকে ভালবাসি। কিন্তু হিংসেও করি। বেশি বেশি ভালমানুষি দেখিয়ে মায়েদের কনফিডেন্স আদায় করে নিতে ওস্তাদ। মায়েরা ভাবে তনিকার মতো ভাল মেয়ে হয় না! কত গুণ! কত বিবেচনা! বাধ্যতা! আসল রূপটা একদিন হাট করে খুলে দেখিয়ে দেব! বুঝবে মজা! ওদের আর্ট কলেজের কতগুলো ছেলের সঙ্গে যে ওর লটঘট। ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। নির্দোষ, নিষ্পাপ বন্ধু সব। এনি ওয়ে, ওই ছেলেগুলোকে নিয়ে আমার কোনও হিংসে নেই। কেমন ন্যাকা ন্যাকা! আমার কাছে ঘেঁষতে এলে দেখিয়ে দিতাম। তবে শ্রীমতী তনিকা সব জায়গা থেকেই যে অমন সার্টিফিকেট জোগাড় করে কী করে জানি না। আমার আগের বয়ফ্রেন্ড সন্দীপন বলছিল—ও নাকি ভীষণ অ্যাট্রাক্টিভ। ড্রিমি। অল্প কথা বলে। ও নাকি কবিতার মতো । অর্ধেকটা বোঝা যায়, অর্ধেকটা যায় না। ভাল বাবা, তোরা কবিতা থাক আমাদের ভাগ্যে শূন্য খাতা।
* * *
খুব অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল সন্দীপন। অনেকদিন আগে। বলল কী তোর মা আর মাসি লেসবিয়ান। আমি ওকে একটা চড় মারি। গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল—আজকাল আমরা রকমসকম দেখে বুঝতে পারি। তোর বাবা-মা’র রিলেশন ঠিক হল না কেন?—ওই জন্যে। তোর মাসি কেন মাকে আগলে পড়ে থাকে? ওই জন্যে। খেয়াল রাখিস একদিন বুঝতে পারবি। আমি অবশ্য খেয়াল রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। একদিন বাড়ি ফিরেছি ন’টা। পঞ্চমী বলল—মায়ের শরীর ভাল না। অজ্ঞানমতো হয়ে গিয়েছিল নাকি। আমি যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল পা টিপে টিপে যাই। দেখি তো!
মাসি বলছে—আর কথা বলিস না—এবার ঘুমো শ্রী। আমি আলো টা নিভিয়ে দিই।
মা বলল—আমি তো সব কথা বলতে পারি না সর্বাণী! সাধ্য নেই! তুই একটু বসে থাক। এই আলোয়। তোর মুখে, তোর চোখে যে কী ভরসা!
তারপর মা মাসি দু’জনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মাসিরটা দেখতে পাচ্ছিলাম না, মায়ের চোখে অত আকুল দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি।
আমার ভীষণ ভয় করল। চট করে ঢুকে পড়লাম। —মা তোমার কী হয়েছিল?
—খুব মাথা ঘুরে গিয়েছিল মিমি।
মাসি বলল—ডাক্তার বলছে প্রেশার বড্ড লো। বলে মাসি মায়ের মাথায় হাত বুলোতে লাগল। মা তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, মাসি মায়ের কপালে একটা চুমো খেল।
—ঘুমো শ্ৰী, ঘুমো।
বলতে বলতে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
চুমু খাওয়াটা লেসবিয়ান? কপালে তো! লুকিয়েচুরিয়েও নয়! তবে তনি আর আমি দু’জনে স্কুল ডেজ থেকে ভীষণ বন্ধু। কিন্তু কেউ কখনও অন্যজনকে চুমু খাইনি।
* * *
একটা কবিতা পড়লাম। ‘ফনের দিবাস্বপ্ন’। মনটা কেমন অন্য রকম হয়ে গেল। আমি কবিতা, গান, ছবি… এসব নিয়ে ন্যাকামি করতে পারি না। ভাল লাগলে লাগবে। এনজয় করব, না হলে করব না। স্রেফ চলে আসব, বইয়ের পাতা উলটে যাব। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা কে কী আঁকিবুকি কেটেছে দেখাও আমার ধৈর্যে নেই। কাকু যে ছবিগুলো আঁকে আমার জঘন্য লাগে। আমি কাকুকে বলি এগুলো তোমার অবদমিত কাম। আর কিচ্ছু না। একটা অপূর্ব সুন্দর হিউম্যান ফিগার আঁকো তো! চারপাশে গাছপালা, তার মাঝখানে আর একটা প্রাকৃতিক বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষ-মূর্তি। কিংবা অনেক উঁচুতে আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে।
কাকু বলল—ও তো কিছুই না। একটা অ্যাপলো কিংবা ডেভিড তো এঁকে দেওয়াই যায়। আমি অবিশ্বাসে হাসি—চেষ্টা করো, পারবে না। তুমি ওই ডিস্টর্শনই আঁকতে পারো।
কাকু বলল—তুই ছবির কিছুই বুঝিস না মিমি। ডিস্টর্শনটা বাইরের পৃথিবীতে, আমি শুধু সেটা দেখতে পেয়েছি। ইটস মাই রেসপনস টু রিয়্যালিটি। পিকাসো মাত্র পনেরো বছরে বয়সে নিজের মায়ের একটা প্যাস্টেল এঁকেছিলেন, ন্যাচারালিস্টিক। দাঁড়া তোকে দেখাই। অ্যালবামটা ঘেঁটে ছবিটা দেখাল কাকু। কী সুন্দর! সফট ফোকাসে ছবি তুললে যেমন একটা নরম এফেক্ট হয়, মায়ের ড্রেস, তাঁর বাঁধা চুল, কানের টপ…। এগুলো সবই আছে কিন্তু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া।
—এ রকম তুমি আঁকতে পারবে? —ফুঃ!
আমি এরকম তাচ্ছিল্য করলে লোকটা খেপে যায়। তখন আমার ভারী মজা লাগে। এই লোকটা ছোট্ট থেকে আমার সঙ্গে এমন করেছে, যে আমি… ঠিক বুঝি না, আমার ওর প্রতি, ওর বডিটার ওপর কেমন একটা প্রচণ্ড লোভ জন্মে গেছে। ওর আঙুল দেখলে আমার গা শিরশির করে। ওর চুল দেখলে আমার ভেতরটা লাফিয়ে ওঠে। চশমার ভেতর দিয়ে যখন তাকায়, আমার তখন ইচ্ছে করে, একটা দুরন্ত ইচ্ছে করে। কিন্তু ও থেমে যায়। কিছু দূর এগিয়ে থেমে যায়। আমার ভেতরটা রাগে কাঁপতে থাকে, মনে হয় ওকে মেরে দুমড়ে মুচড়ে দিই। আর তাই সন্দীপন কি আরমান কি সুরেশ ভাটিয়া যার সঙ্গেই প্রেম করতে যাই, যে-ই দেখি বুকের মাঝখানে চুল নেই, কিংবা ঘন চুল, কিংবা দুটো তিনটে পাকা চুল, যেই দেখি মুখগুলো মসৃণ, কোথাও কোনও ভাঁজ নেই, আমার ইচ্ছে উবে যায়। …আর লোকটাকে ওই জন্যে আমি ঘেন্নাও করি। এটাই আমার রেসপন্স টু রিয়্যালিটি, রিয়্যালিটি, লাভ অ্যান্ড ফিজিক্যাল প্যাশন। এই ঘেন্না আর টানের দড়ি টানাটানিটা বেশ উপভোগ করি আমি। ভাল এককাপ কফির মতো। কি চিজের মতো!
কুড়ি
মেয়েটাকে বোঝবার একমাত্র চাবিকাঠি তা হলে কি এই ডায়েরিটা? সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন এটা একটা পার্সন্যালিটি ডিজঅর্ডার। ওকে কতকগুলো সিটিং দিতে হবে অ্যানালিস্টের কাছে, যদিও এখন রেজিস্টার্ড অ্যানালিস্টের খুবই আকাল৷ ওর ভেতর থেকে লুকোনো কথাবার্তা অনুভূতি বাসনা কামনা সব নাকি বেরিয়ে আসবে, তাতেই সবচেয়ে উপকার। কিন্তু এই ডায়েরিতে তো ও সব প্রকাশ করে ফেলেইছে। খুবই ইনটারেস্টিং ডায়েরি। আঠারো বছর বয়স থেকে বোধহয় লিখছে। অনিয়মিত। যখন কোনও কিছু বলবার ইচ্ছে হচ্ছে, ডায়েরির সঙ্গে কথা বলছে। সে অনোহিতার ডায়েরিটা ড্রয়ারে কাগজপত্রের তলায় রেখে চাবি দিয়ে দিল। তারপর আর একটা ড্রয়ার খুলল। ছাত্রছাত্রীরা, ভক্তরা, ক্রেতারা নানা রকম টুকটাক জিনিস উপহার দিয়ে থাকেন। টেবিল ক্যালেন্ডার আর ডায়েরির তো পাহাড়। বেশিরভাগই সে বিলিয়ে দেয়। কিছু থাকে। একটা ভাল দেখে ডায়েরি সে বার করল। গাঢ় নেভি ব্লু মলাট। স্পঞ্জ দেওয়া। বেশ হ্যান্ডি। ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়াই যায়। ভেতরে লিখল—অনোহিতাকে—অদিতিদি, জন্মদিনে। খাটের পাশের সাইড টেবিলে রেখে দিল, পাশে নিজের একটা খুব ভাল পেন। এটা দিয়েছে আঁদ্রে। রেখেই মনে হল আঁদ্রের দেওয়া কলম সে উপহার দিয়ে দিল? তবে কি আঁদ্রের সম্পর্কে তার কোনও অধিকারবোধ নেই? অধিকারবোধ ছাড়া পৃথিবীর ভালবাসা দাঁড়ায়?
কেন যে এ রকম হয়! এ রকম হচ্ছে কেন? যে বিশ্বাসের জায়গাটা আঁদ্রে হারিয়েছে, সেটা কিছুতেই ফিরে পাচ্ছে না কেন? তার ভেতরটা এত কেন ঠান্ডা? গতকাল খুব মুখ চুন করে সে চলে গেল। অদিতির বুক ফেটে যাচ্ছিল। আঁদ্রেকে সে এত বন্ধুত্বে পেল এ ক’মাস আর এর আগে পেয়েছে এত করুণায় যে আঁদ্রে ওদিৎ বলে এসে দাঁড়াবে না, তার দায়িত্ব এই মেয়ে দুটিকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, আলোচনা এসব করবে না, বেড়াতে যাবে না, ‘চিত্রভানু’তে তার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওর্য়কশপ করবে না, প্যারিসের দীর্ঘদিনের সাঁল ঐতিহ্য, মঁমার্ত ঐতিহ্য, তার সঙ্গে জড়িত চিরায়ত সব শিল্পীদের বিশেষত্ব, তাঁদের জীবন নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ সে সব সেশন! মাতিস দেখাতে এসে সে একমাসের জায়গায় আড়াই মাস কাটিয়ে গেল! এই ক’মাসে তার কত অজানা দিক অদিতি জেনেছে। যেমন সে অনেক অনেক পরিণত। অনেক শিখেছে। জীবিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সেখানে সে প্রায় জ্ঞানতপস্বী, বিশেষজ্ঞ, ভালবাসা ও সংরাগে সে ছবির জগৎকে দেখে। এবং জিফ্-সুর-ইভেৎ-এ তার শাতো, তার আপেলবাগান, কমলাবাগান, তার বোর্দোর বিষয়সম্পত্তি, সবই এখন শিল্পের সেবায় নিযুক্ত।
ওই বাগানে সেবার অতিরিক্ত ফলন হয়েছিল। তার মনে পড়ে। অদিতি, মনীষা গিয়েছিল। ছিলেন আঁদ্রের মা, বাবা আরও তার অনেক কাজিন। তখন তো আঁদ্রে শুধুই এক সদ্য-যুবক, প্যাংলা চেহারা, দাড়ি অল্পস্বল্প, ছাঁটে না, নীল চোখ দুটো একেবারে নিষ্পাপ। অদিতি মনীষা আরও ছোট। মনীষা ধারালো সুন্দরী। পাতলা শাণিত নাক, শাণিত চোখ, পাতলা ঠোঁট, ও যেন কতকটা ইরানিদের মতো দেখতে ছিল। আর অদিতি? নিজেকে তো নিজে দেখা যায় না, সে ছিল শ্যামলা, ছিপছিপে, নেহাত কিশোরী-কিশোরী চেহারার। মাথায় তখন লম্বা চুল, একটা কিংবা দুটো বিনুনি করত। খুব সাজুনি ছিল বলেই আয়নায় নিজের ছায়াটা তার মোটামুটি মনে আছে। ফটোর সাহায্য লাগছে না। সে একটা ছোট্ট টিপ পরত। বিন্দুর মতো । সেটা তার ফরাসি বন্ধুদের খুব পছন্দ ছিল। নিজের মুখে আলাদা করে তেমন কোনও সৌন্দর্য সে দেখতে পেত না। লিপস্টিক লাগাবার সময়ে বুঝত ঠোঁট দুটো খুব করুণ, কেন কে জানে, এমন মনে হত। চোখে কাজল দেবার সময়ে দেখত সমঝদারি জ্বলজ্বল করছে তাতে, তীক্ষ্ণতা ও অভিনিবেশ। ওরা বলত সে নাকি খুব ব্রাইট লুকিং, উজ্জ্বল, দীপ্ত কিন্তু সেই সঙ্গে মধুর। আঁদ্রেদের আপেলবাগানে সেবার সবাই মিলে আপেলগুলোর সদগতি করতে লেগে গিয়েছিল। কেননা ফ্রস্টে সব নষ্ট হয়ে যাবে। জ্যাম হচ্ছে, মোরব্বা হচ্ছে, সে এক কাণ্ড! সে খুব সাড়া জাগিয়েছিল, কেন তাও জানে না। আঁদ্রের এক মাসতুতো বোন বলেছিল—তোমার কী সুন্দর গায়ের রং, কী মখমল কোমল! আঁদ্রের মা-বাবাও খুব সুন্দর ব্যবহার করেছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল খুব পছন্দ করছেন। সেই তাঁরাই…। যে সর্বাণীকে সে অত ভালবাসত— তাঁকেই মা হিসেবে একদম নিতে পারল না অনোহিতা! অধিকারবোধ যেমন ভালবাসার একটা বৈশিষ্ট্য, তেমন কি ঘৃণারও? অপছন্দেরও? সর্বাণী কি চলে গেলেন অনোহিতার সমস্ত বিকার, অসুস্থতা সঙ্গে নিয়ে? আঁদ্রের মা কি চলে গেলেন। অদিতির পথ পরিষ্কার করে? আঁদ্রের মায়ের জন্যে বড্ড খারাপ লাগছে! মা-বাবাদের সঙ্গে সন্তানদের ব্যক্তিগত সুখের এত বিরোধ কেন? তার মা-বাবাও বড় কষ্ট পেয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে, বড় আদরের। সে বিদেশে বিদেশি বিয়ে করল মানেই সে নিজেও বিদেশি হয়ে যাবে, তার সন্তানরা হবে বিদেশি। বয়স হলেই মানুষ পরিচিতের গণ্ডির বাইরে দিশাহারা হয়ে যায়। সে বেশ দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল সে আঁদ্রেকেই বিয়ে করবে। কত কষ্ট না জানি মা-বাবা পেয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সয়ে যায়। আঁদ্রেকে নিয়ে সে যখন এক বছরের মাথায় এল, তার ব্যবহারে এবং অদিতির প্রতি তার ভালবাসায় বাবা-মা খুবই গলে গিয়েছিলেন। আঁদ্রে আবার মাকে সান্ত্বনা দেয়— আপনি মনে করছেন এখানেই থাকবেন? তা হবে না— আপনাদের আমরা নিয়ে যাব, এখানেও থাকবেন, ওখানেও থাকবেন। আঁদ্রের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা সে মা-বাবাকে জানায়ইনি। তারপর রাজর্ষির সঙ্গে বিয়ের সময়ে অগত্যা জানাতেই হয়! কী যে মলিন হয়ে গিয়েছিল মা-বাবার মুখ! আর রাজর্ষির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সময়ে বাবা বেঁচে ছিলেন না। মা দারুণ ধাক্কা খেয়েছিলেন। মেয়ের জন্যে ভাবনায় কাতর হয়েই মারা গেলেন। বিশ্বাস করে গেলেন না মেয়ে একা-জীবনের হাল ধরতে তৈরি। পারবে। কেন অমন গোঁ ধরলেন মঁসিয়ে ও মাদাম বোর্দো! ছেলের আনুগত্য পেলেন, ভালবাসা হারালেন।
সে তার ছবিঘরে কোলের ওপর বোর্ড বসিয়ে— ছোট ছোট পেনসিল স্কেচ করে। ল্যান্ডস্কেপ, ফিগার, গ্রাম-জীবনের নানা দৃশ্য। একটা তিনখণ্ডের বইয়ের জন্য ছবি আঁকার অনুরোধ এসেছে। গবেষণামূলক বই। সেই শ্বশুরমশাইয়ের ‘বিষ্ণুপুর-বৃত্তান্ত’র পর এই দ্বিতীয়বার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন। মন অন্যত্র। কিন্তু হাত এখন মনের কাজটা অনেকটাই ধরে নিয়েছে। খসখস করে পেনসিল চলছে আপন খেয়ালে।
বেল বাজছে। ওরা এল বোধহয়।
গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শৌনকের গলা না?
—দিদি, ব্যস্ত আছ?
—না, না আয়!
শৌনকের ছবি বেশ বিক্রি হচ্ছে। কতকগুলো বরাত পাচ্ছে ভাল। একটা নিয়মিত রোজগারে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। ওর মুখ-চোখের চেহারা এখন অনেক উজ্জ্বল। বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখতে লাগে। ওর সেই ক্রুশবিদ্ধ মহামানবদের ভাস্কর্যপ্রতিম ছবি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শিল্প সমালোচকরা খুব খুশি নয়। কিন্তু দর্শকদের নজর কেড়েছে। আজকাল বলা হচ্ছে— শৌনক ভিভিয়ান বিশ্বাসের ছবি নাকি ‘পেন্টিং উইথ আ স্টেটমেন্ট।’ নানান শহরের টাউন হলে, প্রেক্ষাগৃহে, বিমানবন্দরে ওর এই স্টেটমেন্টমূলক ছবির চাহিদা বেশ। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা— ও মঞ্চসজ্জার জন্য খুব ডাক পাচ্ছে। এবং এই কাজটা ওর খুব ভাল লাগছে।
—তোদের সেই ‘রৈভ্য’র ব্যানার রেডি হল?
—তা তো হচ্ছে, প্রায়। কিন্তু দিদি আজ একটা পরামর্শ করতে এসেছি।
—কী বল! —কালো! কফি দিয়ে যা… শৌনকদার জন্যে। —সে আঁকাজোকা সরিয়ে রাখল।
—আঁদ্রেদা ফ্যাক্সে একটা ফর্ম পাঠিয়েছে। বলেই গিয়েছিল। ওদের ওখানে কোথায় একটা বিরাট ম্যুরাল হবে। বোধহয় কোনও থিয়েটার হলে। সেইটাতে কাজ করার জন্যে।
—তো ভাল তো । ফিলআপ করে পাঠিয়ে দে।
—কিন্তু এদিকে একটা ভাল ফরমাশ পেয়েছি যে!
—কী?
—এই গঙ্গার ধার বিউটিফাই করবে পুরসভা। কিছু ভাস্কর্যের কথা ওরা ভাবছে। ওগুলো স্পনসর করবে কতকগুলো কর্পোরেট হাউজ। আমাকে প্রথমে একটা করতে বলছে। সেটা যদি পছন্দ হয়, তা হলে আরও কয়েকটা পেতে পারি।
—ক্ল্যাশ করছে?
—বুঝতে পারছি না। আঁদ্রেদার কাজটার কনট্র্যাক্ট ছ’মাসের। এদিকে এটাও মাস দু’য়েকের মধ্যে দিতেই হবে। তুমি তো জানো, স্কালপচার করতে পেলে আমি কী রকম আনন্দ পাই।
—তুই এক কাজ কর না, একটা ছোট কাজ কর। ধর তিনফুট মতো। এমনিতেও তো ওটা স্ট্র্যান্ড। খুব বড় কিছু ভাল লাগবে না। তুই লম্বাটা বড় কর। অন্যগুলোর জন্যে দু একটা মাকেট করে দিয়ে যা। গিয়াসরা বড় করবে।
—তা সত্ত্বেও প্যারিসের কাজটাতে আমি এখনই যোগ দিতে পারছি না। অথচ, বুঝতেই পারছ ওটা নিতেও আমার ভীষণ ইচ্ছে। প্যারিস যাবার সুযোগ। আঁদ্রেদা না হলে কি পেতাম?
—তুই আঁদ্রেকে একটা ই-মেল করে দে। ও নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।
—আমি একটা ব্যবস্থার কথা ভেবেছি।
—বল।
—তুমি কি জানো, তনিকার কাজ দেখে উনি খুব ইমপ্রেস্ড্? উনি তনিকাকে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে দেবেন বলেছেন। দেবেন যখন বলেছেন, তখন দেবেনই। কিন্তু একটু তো সময় লাগবে! ইতিমধ্যে যদি এই কাজটাতে ও-ও যোগ দেয়, আমি পরে গিয়ে জয়েন করি… অত বড় ম্যুরাল, আর্টিস্ট লাগবেও তো অনেক।
—তুই বলে দ্যাখ!
—উনি কিছু মনে করবেন না তো!
—কী মনে করবেন?
—এই তনিকাকে পুশ করছি।
—সে তো করছিসই। অদিতি মিটিমিটি হেসে বলল— ছ’মাস প্যারিসে থাকবি, নির্বান্ধব দেশ, একজন কেউ, জাস্ট একজন সঙ্গে গেলে…। পুশ করাকে পুশ করা মনে করলে আপত্তি করলে চলবে? তবে কী জানিস, তোদের মতো সমসাময়িক শিল্পীরা কখনও একজন আরেকজনকে পুশ করে না। গুরুই শিষ্যকে সাহায্য করে না। যদি খুব ট্যালেন্টেড হয়! তুই করছিস, ব্যক্তিগত কারণেই হয়তো, তবু এটা সুন্দর।
শৌনক ভিভিয়ানের মুখ লাল হয়ে গেছে।
—শৌনক, দু’জনে এক প্রফেশনে থাকলে খুব প্রবলেম হয় রে! একটু সতর্ক হস।
—এক প্রফেশনে না থাকলেই কি হয় না, দিদি?
ও কি অদিতিরই কথা বলছে! অদিতির জীবনের কার্যগুলো ওরা জানে। কারণগুলো জানে না।
—তা অবশ্য হয়, আমি শুধু তোকে চেতাবনিটুকু দিয়ে রাখলুম। আজ আমাদের সঙ্গে খেয়ে যা। ওরা এক্ষুনি এসে যাবে।
—বেশ। ততক্ষণ তোমার স্কেচগুলো দেখি। …কীসের ইলাস্ট্রেশন দিদি!
—‘পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম: জীবন ও শিল্প’। গত একশো বছরের। এগুলো জেনার্ল্ স্কেচ। কিছু কিছু ল্যান্ডমার্কস ওরা ফটো পাঠিয়ে দেবে। সামান্য কিছু ফিল্ড ওয়ার্ক আমাকে করতে হবে, বুঝলি?
—এতে ওদের যা খরচ হবে, পোষাবে? না তোমাকে দিয়ে মাগনা খাটিয়ে নেবে? ‘দিদি, দিদি, আপনারা যদি এত কমার্শিয়াল হন, আমরা কোথায় যাই…’ বলে কেঁদে পড়ল হৃষ্টপুষ্ট একটা দামড়া, অমনি তুমি গলে গেলে, সেবার সেই একটা ফিলমে যেমন করেছিল!
—অত সোজা নয়। অদিতি সরকার কোনওদিনই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না, বুঝলি? তবে হ্যাঁ মাঝে মাঝে গুড কজের জন্যে একটু বিবেচনা করতে হয়। দাঁড়া আমি মাকে একটু দেখে আসি।
শৌনক বসে দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। রোল খুলে খুলে। তার মনটা এখন একটা অদ্ভুত মন খারাপে আক্রান্ত। সে চলে যাবে, তনিকা তো মিল হি গয়া। মিল গয়া। তনিকা উচ্ছৃঙ্খল নয়, কিন্তু ভীষণ স্বাধীন মনের মানুষ। তার ওপরে খুব কুয়াশাচ্ছন্ন, এখনও তনিকার তল সে খুঁজে পায়নি। এখন তাকে খুব পছন্দ করছে তনিকা। কিন্তু একদিন কী যেন একটা বলেছিল সে… অত রাত অবধি আড্ডা দিস না।
—কত রাত?
—এই ধর দশটা!
—দশটায় না পৌঁছোলে মিসেস উইলিয়াম্স্ আমায় ঢুকতে দেবেন না, তা জানিস? কাজেই দশটা অবধি আড্ডা দেওয়ার আমার উপায়ই নেই। না হলে একদিন উধাও হয়ে যেতাম।
—উধাও! সর্বনাশ! কোথায়!
—যেখানে ইচ্ছে! ধর হরিপাল, হুগলি জেলায়। লোকেদের ঘরের পাশে ধানখেত। অমন আমি কোথাও দেখিনি। ধানখেতের ধারে সারাদিন ছবি আঁকব, বকেরা বসে আছে ঠ্যাং তুলে। লম্বা পুকুরে কচুরিপানা, চিকচিক করে ব্যাঙাচি যাচ্ছে এদিক ওদিক। শালুক খুব দেখবি কলকাতা ছাড়ালেই। আর নিম, শিরীষ, এমনকী অশ্বথ, চিনতে পারবি না। কী বিরাট মহীরুহ এক একটা তেঁতুল! ইউক্যালিপ্টাসের মতো সাদা গুঁড়ি অশ্বত্থের। ইউক্যালিপ্টাসকে ওরা বলে সাহেব গাছ। ঘুরব, বসব, আঁকব, গাইব, কবিতা পড়ব। বাঁশের খুঁটির ওপর একচালা দোকান, সেখানে থেকে কড়া দুধ দেওয়া চা আর গাবদা মতো পাউরুটি খাব।
—থাকবি কোথায়?
—তা তো ভেবে দেখিনি!
—এর আগেও এমন ঘুরেছিস নাকি!
—শিয়োর!
—একা একা!
—না, ছিল একজন কুশল বলে, তারপর সুবীরটা, মহা বেরসিক তবু ওর সঙ্গে গেছি। কাউকে না পেলে একা একা যাব।
—যাসনি ও রকম, তনিকা!
—দ্যাখ, কর্তাত্বি ফলাবি না আমার ওপর। আমি আমি তুই তুই। এই তফাতটা মেনে বন্ধু হতে চাস ঠিক আছে।
শৌনক ভিভিয়ান আরও অনেক গৃহস্থ স্বভাবের ছেলে। কাজ ভালবাসে, নিপুণ অভিনিবেশে করে, ভাবে, প্রচুর পড়ে, কিন্তু শৈশবে বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের প্রতি তার একটা দায়িত্ব বর্তেছে। মা একটা ছোট বাচ্চাদের স্কুলে কাজ করেন বটে, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত শৌনকের দায়। মাকে গভীর ভালবাসে সে। দু’জনে দু’জনকে আঁকড়ে দিন কাটিয়েছে। জ্যাঠামশাই আছেন ভিন্ন বাড়িতে, একটু-আধটু দেখাশোনা সাহায্যও যে করেন না তা নয়। কিন্তু মায়ের শেষ ভরসা শৌনকই। সে তনিকার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে তো? প্যারিসে যদি তারা দু’জনেই যেতে পারে তা হলে ওর সঙ্গে আরেকটু ঘনিষ্ঠতা হবে। আর একটু বুঝতে পারবে পরস্পরকে। আর একটা কথা। দিদি। অদিতিদি। সে জানে না এটা কী!! দিদির সম্পর্কে এমন একটা ফিলিং তার! একটা অন্য সম্পর্ক। দিদিও তার একটা দায়। দিদি হয়তো চান না। কিন্তু যে মুহূর্তে আর সবাইকে ছেড়ে তাকেই ডাকেন, তারই ওপর নির্ভর করেন, তার ভেতরটা কেমন একটা আনন্দে ফুলে ওঠে। দিদি যেন এক মানুষ-দেবী, মাতা মেরি বড় সুদূরের, তিনি শুধু শিশুকে স্তন্য দিতে পারেন, ক্রুশ থেকে বাঁচাতে পারেন না। কিন্তু এই দিদি…এই দিদি কী? কে? মা না দেবী? না দেবী-প্রেয়সী। সরস্বতীকে দুর্গাকে যে মন নিয়ে পুজো করে হিন্দুরা, সেই মন নিয়ে সে যেন দিবারাত্র দিদির ভক্ত হয়ে আছে। দিদির কাছ থেকে চিরবিচ্ছেদ সে কি সইতে পারবে? তনিকাও দিদি সম্পর্কে খুব মুগ্ধ। ও অল্প কথার মানুষ। উচ্ছ্বাসের মধ্যে নেই। কিন্তু দিদির কাছে ওর সমর্পণ দেখে মনে হয় ও-ও দিদির মধ্যে কিছু একটা দেখে, কিছু একটা পায় যার কোনও ব্যাখ্যা নেই, যাকে অস্বীকার করা তো যায়ই না। মোট কথা, দিদি হাতের কাছে না থাকলে তার বুকের মধ্যে কেমন একটা খামচে ধরবে। দিদিকে বাদ দিয়ে যে তনিকা নিরুদ্বেগ স্বভাবের, তাকে আয়ত্ত করতেও তাকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হবে।
* * *
কোনও খবর দ্যাননি আগে। নবগোপাল সাহা রায় অদিতির বাড়িতে এসে নিশ্চুপ বসে আছেন। তনিকা নিজের ডেরায় চলে গেছে। তবুও অনোহিতাকে সময় দেয়। আজ ম্যাটিনিতে সিনেমা গেছে।
—চা খাবেন?
—হ্যাঁ… তা… দিন। …আপনাকে আমি আগে মানে হাসপাতাল, শ্মশানেরও আগে কোথায় যেন দেখেছি!
—বলতে পারব না, আমার মনে পড়ছে না আপনাকে।
—এতদিন আমার মেয়েকে রাখতে হয়েছে বলে কি আপনি খুবই…।
—আমি খুবই… কিন্তু আপনার মেয়েকে রাখতে হয়েছে বলে নয়, আপনি ওকে ফেলে চলে গেছেন বলে। … ডোন্ট মাইন্ড… কী করে পারলেন?
—শোক… মিস সরকার… আমি অত শোক… চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। মাঝারি লম্বা। একটু অ্যালকোহলিক ফ্যাট তো হয়েইছে। আবার অ্যালকোহল তার সঙ্গে রঙের, চেহারার একটা জেল্লাও দিয়েছে। মাথায় প্রচুর কাঁচাপাকা চুল। প্যান্ট আর একটা টি শার্ট পরে এসেছেন।
নিজেকে সামলাচ্ছেন। —আপনি এতদিন ধরে ওকে… নিশ্চয়ই সব জানেন। সর্বাণী… সর্বাণী আমার কী ছিল আর কী ছিল না… আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। —মানুষটা আমি খুব সহজ-সরল, নই… ও আমাকে বুঝত। কী যে হতাশা… আর ওই মেয়ে কী ট্রাবল যে দিয়েছে! সর্বাণীই ওকে সামলাত। যখন… মা ছিল না তখন থেকেই…! কী যে হল! খুব শক্ত ধাতের মানুষ ছিল সর্বাণী, পজিটিভ। অপটিমিস্টিক! কী এমন ঝগড়া হল, কী বলল মিমি… আমি কিছুতেই ওকে মাফ করতে পারছি না।
—একটু পরেই ও আসবে। দেখুন মাফ করতে পারেন কিনা। ওর ভেতরে একটা শূন্যতা আছে। বাবা হয়ে একটু খেয়াল করলেন না? কিছুই নয়! সামান্য ব্যবহারের হেরফের একটু স্বাভাবিক ফ্যামিলি-লাইফ! পৃথিবীতে ওকে একা ছেড়ে দিলেন!
—সর্বাণী তো ছিল, ওর মা ছিল!
—সবাইকেই থাকতে হয় মিঃ সাহা রায়। সব্বাইকে। মন তো সকলের সমান হয় না। সবাই এই ভ্যাকুয়াম সইতে পারে না। ভ্যাকুয়াম অন্য কিছু দিয়ে ভরাতে চেষ্টা করে, সে চেষ্টাটা সব সময়ে সমাজের অনুমোদিত হয় না, শুভও হয় না!
—আপনি কি মনোরোগের ডাক্তারও?
—না, আমি সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি। পুরো হিস্ট্রি দিয়েছি। একবার ভদ্রলোককে বাড়িতে ডেকেও ছিলুম। বুঝতে না দিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছেন।
—ও কি তা হলে পাগল বা আধা-পাগল?
—ও আধা-সিকি কোনও রকমের পাগলই নয়! তবে আপনাকে মানে বাবাকে সারা জীবন খুব মিস করেছে।
চায়ের সঙ্গে শীলাদি কয়েক রকমের বাড়িতে তৈরি বিস্কুট দিয়েছে।
অনাহিতা এসে ঢুকল। একটা গোলাপি বাটিকের সুতি সালোয়ার-কামিজ পরেছে। কাঁধ থেকে একটা ফোমের ব্যাগ ঝুলছে। সে ঢুকল, বাবার দিকে তাকাল, কিন্তু তার চোখে কোনও চমক ছিল না। নবগোপাল খুব সহজ হবার চেষ্টা করে বললেন— কাল এসেছি মিমি বুঝলি? লোক ডাকিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করাই। ওঃ যা ধুলো হয়েছিল! হ্যাঁ আজ বিশ্বেশ্বর একজন কুক, আরও দু’জন কাজের লোক জোগাড় করেছে, ভাল বলেই তো মনে হচ্ছে। তুমি প্যাকট্যাক করে নাও, এবার তো যেতে হবে!
—দিদি, আপনার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে? অনোহিতা খুব শান্ত অনুৎসাহিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
—না, একেবারেই নয়, আমার খুব ভাল লাগছে। কিন্তু বাবা তো তোমাকে নিতে এসেছেন। তুমি না গেলে…
—ফর দা রেস্ট অব মাই লাইফ আ’ল হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ মেন। বাবা অর নো বাবা।
নবগোপাল বোকাটে ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইলেন।
—দিদি, আমার দুই মা আমাকে অনেক টাকা দিয়ে গেছেন। ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটা শুরু করেছিলাম। ওটা শেষ করে, কোনও-না-কোনও কাজ পেয়ে যাব। অ্যাডের কোর্সটাও তো আমার করাই আছে! আমার কোনও অসুবিধে নেই। আপনার অসুবিধে হলে আমি কোনও পি.জি. অ্যাকমোডেশন নিয়ে নেব।
—মিমি, তুই, তুই আমার ওপর এতটা রাগ করেছিস? আমার দিকে একবার ফিরে তাকা! আমার অবস্থাটা বোঝ। বোঝবার চেষ্টা কর।
—রাগ করিনি বাবা, তোমার জীবনে আমি কোনওদিনই কোনও ফ্যাক্টর ছিলাম না। সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তাই বোধহয়…। সে যা হোক, এখন আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। তুমি লন্ডনে থাকো কি নিউ ইয়র্কে থাকো, তোমার সঙ্গী হোক ড্রিঙ্কস কি অন্য কিছু, অন্য কেউ। তুমি চিরকাল যেভাবে বেঁচে এসেছ, এখনও সেভাবেই বাঁচো। নিশ্চিন্তে। আমি রইলাম না। মা রইল না। মাসি রইল না। তুমি আরেকটা বিয়েও করতে পারো। যাই হোক, যেভাবে হোক। আমি তো বড় হয়ে গেছি। আমার জন্যে আর তোমায় ভাবতে হবে না। —তার কোনও কথার মধ্যেই বাড়তি উত্তেজনা নেই। অভিমান রাগ এসব নেই। অনোহিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অদিতি অবাক হয়ে বসে রইল।
নবগোপালের মুখটা কালো হয়ে গেছে। উনি হাঁটুর ওপর কনুই রেখে মাথাটা দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে বসে রইলেন।
অদিতি একটু পরে নিচু গলায় বলল— মিঃ সাহা রায়, আপনি এতটা হতাশ হবেন না। এটা ওর ফার্স্ট রি-অ্যাকশন। ওকে এমন অবস্থায় আপনি একা ফেলে গিয়েছিলেন…। ইউ হ্যাভ টু উইন ইয়োর ডটার ব্যাক। ইতিমধ্যে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ও আমার কাছে রইল। আর… আর ও যা বলছে আপনাকে নিজের মতো লাইফ কাটাবার স্বাধীনতা দিচ্ছে… সেটাও আপনি… মানে শি মিনস ইট। এখন আপনার বুদ্ধিবৃত্তি যা বলে!
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন ভদ্রলোক। তারপর খুব মিয়োনো গলায় বললেন— ঠিকই… আমি ওকে তেমন… মানে আদর দিয়েছি খুব… টয়েজ, ড্রেসেজ, টাকাপয়সা… কিন্তু শি ইজ সো গ্রোন-আপ নাও। আমি এখন কী করি! আমার জবটাই তো এমনি। আমাকে ঘুরতে হবেই।
অদিতি বলল— যতদিন আছেন রোজই রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে খান। স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন। ওকে একটু সময় দিন। আপনার ওপর ভরসাটা ওর একেবারে চলে গেছে।
একুশ
আজ আবার ঝড় উঠেছে। বিলম্বিত কালবৈশাখী। রাস্তা ধুলোয় ধুলোয় অন্ধকার। আকাশ লাল। গাছপালা ভীষণ দুলছে। ট্রাফিকে আটকে বসে সে দেখছে। ডান দিকে ধবধবে গ্র্যান্ড হোটেল। আরও কিছু গ্র্যান্ড দোকান পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত। বাঁ দিকে অক্টারলনি শহিদ মিনার, তার দর্শনে যা ক্রমাগত লম্বা তালগাছের মতো নুইছে। রাস্তা জুড়ে যতদূর চোখ যায় গাড়ি গাড়ি গাড়ি মিনিবাস মোটরসাইকেল স্কুটার… সব আটকে রয়েছে। তবু জঙ্গমতা ওদের শরীরে থমকে, যেন উড়ব-উড়ব পাখির মতো। সমস্তটা একটা উধাও স্রোত, ঠিক ভ্লামিংকের ছবির মতো। বাঁ দিকে ধু ধু ময়দান। বৃষ্টি নামছে। ধুন্ধুমার বৃষ্টি। এদিক থেকে ওদিক উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কলকাতা। খুব গরমের পর মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা বৃষ্টি। অনেক চেষ্টা করলেও ছাতা-ছাতা-ছাতা রেনোয়া ছবির মাঝখান থেকে বিপুল পরিসর, সমুদ্রসমান আকাশ আর একটি ছোট্ট প্রাণীর নিশ্চিন্ত নীরব অবিচল বৃষ্টিস্নান দেখা যায় না। ওই ছবি বুঝি জীবনে একবারই দেখা যায়। কিংবা বুঝি একযুগে। কেননা বিষয়, দ্রষ্টা আর প্রেক্ষিত এই সবক’টা শর্ত ক’বারই বা মেলে? জীবনানন্দের কবিতা, নন্দলালের ছবি আর ক’বারই বা ঘটে?
তনিকা স্কলারশিপ পেয়ে গেছে ল্যুভ-এর আর্ট-স্কুলে। স্বপ্ন দেখেছিল, সত্যি হবে ভাবেনি। শৌনক ভিভিয়ান কাজ করছে আঁদ্রের সালঁয়। তবে শোনা যাচ্ছে শিগগিরই ফিরে আসছে। তার জীবনে মায়ের টান শিল্পের টানের থেকে অনেক বেশি। মাস ছয়েকের মতো নাকি একসঙ্গে ছিল ওরা— তনিকা আর শৌনক। তারপর পথ বেঁকে গেছে দু’জনের দু’দিকে। কেউই অবশ্য কিছু বলেনি তাকে। সংবাদদাতা—মনীষা। তনিকা প্যারিস-মুগ্ধ কান্ট্রি-সাইড মুগ্ধ চিঠি লেখে। রোদ্যাঁ মিউজিয়াম, পিকাসো মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, সুড়ঙ্গ পথে আলোকিত বৈভব, পোস্টার, বিখ্যাত শিল্পীদের মাস্টারপিস দিয়ে সাজানো, ঐতিহাসিক সেতু পোঁ আলেকসান্দ্রা, আলোয় ঝলমল সাঁজেলিজে, প্লাস দ্য লা কঁকর্দ, বৃক্ষচ্ছায়া? মনোরম বুলেভারের পর বুলেভার। আর্ক দ্য ত্রিঁয়োঁফ থেকে প্রশস্ত অ্যাভিনিউ, প্লাস ভাঁদোম। নোৎরাদামের স্থাপত্য, মাইয়লের ভাস্কর্য… পড়তে পড়তে মনে হয় সে ফিরে গেছে তার পঁচিশ বছর বয়সে। যেন কেউ তখনকার লেখা তার এক রোজনামচার বই পর্বে পর্বে পাঠাচ্ছে তার কাছে।
শৌনক ই-মেলে ব্যাকুল শ্রদ্ধা জানায়। তার লেখা ছত্রগুলোর তলে তলে অব্যক্ত কিছু খুঁজে পায় অদিতি, অস্পষ্ট একটা শিহরন, শুধু শ্রদ্ধা নয়, শুধু আনুগত্য নয়, প্রেম কি? না, তা-ও বুঝি নয় সবটা। ব্যাখ্যার অতীত কোনও জটিল অনুভূতি অদিতি যার পরিচয় জানে না, কিন্তু মেল সামনে ধরে সে বসে থাকে মন কেমন করা এক গোপন বসন্তের বাতাস-লাগা প্রত্যূষ গোধূলিতে, আমূল মুকুলিত, কিন্তু বিষণ্ণ। শৌনক তুই ভাল থাকিস। ব্যাখ্যা হয় না এমন কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়িস না। যদি পড়িসও তো শিল্পে তার স্বাক্ষর রেখে যা। ভাল থাকিস শৌনক।
গত মাসে মাধুরী মারা গেলেন। চমৎকার ছিলেন। রাতে একটু খই-দুধ আর নরমপাকের ছানার মিষ্টি খেলেন। তারপর অদিতিকে ডাক পাঠালেন। সে তো যেতই আর একটু পরে, শুভরাত্রি জানাতে, কিন্তু উনি ডাকলেন।
বললেন— তোমাকে একটা গোয়েন্দাগিরি করতে বলেছিলাম, মনে আছে বউমা?
—হ্যাঁ মা, অদিতি একটু ইতস্তত করে বলল— এমন সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়লাম যে…।
—আমার সে অনুরোধ আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি মা। যা মৃত তাকে মৃত থাকতে দেওয়াই ভাল। কোনও দুঃখ আমার আর নেই।
অদিতির হাত জড়িয়ে ধরে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়লেন উনি। এখানে থাকতে থাকতে কিছুটা যেন চিকন হয়েছেন। সামান্য একটু মাস লেগেছে শরীরে। মুখের রেখাগুলো তেমন তীক্ষ্ণ নেই আর। এখন ওঁর পোর্ট্রেট করলে সেটা হবে একটা অন্য পোর্ট্রেট, হয়তো আগের ছবিটার উত্তরসূরি বলে তাকে চেনাই যাবে না।
ক’দিন পর ভোরবেলায় শীলাদি এসে জানাল উনি ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন। তখনও গা গরম। রাজর্ষি তড়িঘড়ি এসেছিল মৃত মুখে আগুন দিতে, নির্ভুল চরিত্ৰজ্ঞানে ঠিক যেমনটি উনি বলেছিলেন। কাজকর্ম করে চলে গেছে।
যাবার সময়ে অদিতিকে বলে গেল— তুমি বোধহয় জানো না বনি, এই সময়টা আমার কেমন কেটেছে, সুজান চলে গেছে, একটা বাচ্চা হয়েছিল, ছেলে। রোনাল্ড গৌতমকে নিয়ে চলে গেছে। আমার জীবনটা… শুকনো… আই টেরিব্লি মিস দ্যাট চাইল্ড।
অন্য কোনও মন কেমনের কথা বলবে বলে সে দাঁড়িয়েছিল, অদিতি তাকে সাহায্য করতে পারেনি।
***
নীল ফাইলটা খুলে দেখা গেল সেটা মাধুরী গুপ্তর উইল। তাঁর স্বামী সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিঃশর্তে স্ত্রীকে দিয়ে গিয়েছিলেন। মাধুরী দেবী বাড়ি ও সংলগ্ন বাগান দিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় কোনও মিউজিয়ামকে। গহনাও সব তাদেরই। একটি হিরের লকেট একজোড়া টপ অদিতির। আর সমস্ত সম্পত্তির ট্রাস্টি অদিতি ও সুবোধ ডাক্তারবাবু। শীলাবতী আজীবন সুদ ভোগ করবে। তার জীবনান্তে টাকাটা পুরোই চলে যাবে ওই মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণে।
লাইট হলুদ হচ্ছে। স্টার্ট দিল। ধারালো বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পথ কেটে কেটে এগোনো। ভিজে কাক হচ্ছে রাস্তার বাচ্চারা। পলিথিন ঘোমটা মাথায় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল মজুর শ্রেণীর কিছু লোক। কলুটোলার ফুটপাথে সেই ঝুপড়িটা কেন নেই কে জানে! চা ছাঁকছে না কোনও প্রৌঢ়া। ফলওলারা অনেক আগেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।
পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে। গোড়ালি জলে ছপছপ করতে করতে বাড়ি। শীলাদি দরজা খুলে দিল— মিটিমিটি হাসছে। ভেতরে গিয়ে দেখে তার গোলাপি বাথরোবটা পরে ড্রায়ারে চুল শুকোচ্ছে অনোহিতা।
—উহ দিদি, যা ভিজেছি না! নিংড়োলে একটা নদী হয়ে যাবে। খুশির হাসি। বৃষ্টিতে ভেজার ছেলেমানুষি উত্তেজনা চলকে পড়ছে হাসি থেকে। ভঙ্গি থেকে।
একটা হাঁচি এল— হ্যাঁচ্চো!
—কী রে। ঠান্ডা লাগালি নাকি, অনোহিতা!
—ওহ্, ফ্যানটাস্টিক দিদি!
—কী!
—এই তোমার মুখে অলওয়েজ অনোহিতা, মিমি বলো না কেন আমাকে? …কী মনে হয় জানো? আমি যেন আমি নই, অন্য কেউ, আমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক ভাল কাউকে ডাকছ… কেন দিদি?
—কী জানি… অন্যমনস্ক হয়ে গেল অদিতি। —মিমিটা আদরের… শিয়োর… অনোহিতাটা… কী জানি বোধহয় এক ধরনের অ্যাডোরেশন…
—সত্যি? দিদি?
—শিয়োর। তবে তোর চোখ লাল। নির্ঘাত ঠান্ডা লাগিয়েছিস…।
—ধুৎ, এইটুকুতে ঠান্ডা লাগে? চমৎকার এক কাপ কফি খাওয়াল শীলাদি। কোত্থেকে আনাও গো কফিটা? দারুণ!
—ওটা কফি-বিন্স্ থেকে। আঁদ্রে দিয়ে গিয়েছিল। আর একটা পার্কোলেটর। তো আরেক কাপ হয়ে যাক! আমি অবশ্য ঠিক নদী-নদী ভিজিনি! তবু হয়ে যাক!
এক লাফে অদিতির সোফায় ঝাঁপিয়ে তার গালে গাল রাখল অনোহিতা।
—তোমাকে এমন খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে কেন বলো তো?
—খেয়ে ফেলবি কী রে? আমার লাগবে না?
—মানে… তোমাকে আমার ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। সব সময়ে থাকবে আমার সঙ্গে। এনিওয়ে তোমার কাছে ঘেঁষে বসে যদি এমনি কাঁধে মাথা রেখে থাকি! —ন্যাকা, ন্যাকা লাগবে না তো!
—তা তো একটু লাগবেই। অদিতি হেসে বলল,— তৃতীয় ব্যক্তি দেখলে।
—লেট দা তৃতীয় ব্যক্তি গো টু হেল!
অনেকক্ষণ ওর মাথাটা তার কাঁধে রইল।
অদিতি পোশাক পালটে এল। শীলাদির কফি এসে গেছে। চুমুক দিয়ে সে বলল— অনেকদিন আসিসনি কিন্তু।
—কী করে আসব? শ্রীমান বাবা যে সন্ধে সন্ধে ফিরবেন। একটু মিমি— জাস্ট একটু… দু’ পেগ… তা তাঁর জন্যে সব ব্যবস্থা করে রাখো। কবে তাঁর রাম লক্ষ্মণ কবে আবার তাঁর উইশ কী! আবার ককটেলেরও ফরমাশ হতে পারে। তার অরেঞ্জ জুস, টোম্যাটো জুস, উর্স্টার সস, টোব্যাসকো সস্…।
—তা তুইও কম্প্যানি দিচ্ছিস নাকি?
—একটু, জাস্ট একটু, নইলে শ্রীমান বোর্ড্ হবেন।
—দেখিস, আবার না নেশা ধরে যায়!
—পাগল! তুমি জানো না হেন লিকর নেই যা আমি খাইনি। কোনওদিন ভাল লাগেনি। তবু জেদ করে খেয়েছি। আমার এসবে কিচ্ছু হয় না। এনিওয়ে দুটো জমজমাট খবর আছে।
—কী?
—এক নম্বর আমি একটা বাংলা মিউজিক চ্যানেলে অ্যাঙ্কর সিলেক্টেড হয়েছি। পরের মাস থেকে জয়েন করছি। আর দু’নম্বর আঁদ্রেদা আমাকে একটা জরুরি ই-মেল করে তোমাকে একটা কথা জানাতে বলেছে।
—তোকে? কেন? হঠাৎ?
—টপ সিক্রেট। লাস্ট মোমেন্টে জানাতে বলেছে।
—তার মানে আসছে? না? কবে?
—কালই। তিনমাস থাকবে তোমার কাছে, অন কন্ডিশন তুমি থাকবে পরের তিন মাস প্যারিসে, জিফ-সুর-ইভেৎ-এ।
—তোর বাবা বুঝি বাইরে?
—হ্যাঁ। আবার লন্ডন! আজ আমি তোমার কাছে থাকি, হ্যাঁ?
—মানে? এই বৃষ্টিতে যাবি কোথায়? শাড়ি বার করে দিচ্ছি, পর। ব্লাউজটা ঢিলে হবে। শাড়ি দিয়ে ঢেকে নিবি, ওভাবে পরা ফ্যাশনেব্ল্ নয়, আই নো।
—ছাড়ো তো! তোমার খিচুড়ি চলে? তা হলে আজ আমি রাঁধব।
অদিতি স্মৃতিবিধুর হাসি হেসে বলল—চলে!
Leave a Reply