জ্বলন্ত পাহাড় – কাজী মাহবুব হোসেন
সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৩
০১. সামনে বিশাল বিজন প্রান্তর
সামনে বিশাল বিজন প্রান্তর, পিছনে একদল সশস্ত লোক। প্রত্যেককেই ফাঁস তৈরি করা দড়ি নিয়ে তাড়া করে আসছে। উদ্দেশ্য একটাই-‘শক্ত-পাল্লা’কে ফাঁসিতে ঝুলাবে। যুবককে পরিচিতেরা ওই নামেই ডাকে। দাঁড়িপাল্লা মার্কা ঘোড়ায় চড়ে বলেই তার ওই নামকরণ। দাড়ি-পাল্লা’র জায়গায় ‘শক্ত-পাল্লা’ কেন ডাকা হয়, তা ওকে কিছুটা চিনলে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না।
একা বলে ভয় পাবার মানুষ সে নয়। প্রচুর শক্তি, ধৈর্য আর একটা আত্মবিশ্বাসী শক্ত মন আছে তার। তা ছাড়া সামনের জনহীন এলাকা সম্বন্ধে কিছুটা জানা আছে বলেই যেন ওর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে।
যারা ওর পিছনে ধাওয়া করেছে তারা খারাপ লোক না। রুক্ষ দেশের কট্টর রীতিনীতি ওদের কঠিন করেছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে। কোন ক্ষমা বা দয়া দেখানো হবে না। মরু-এলাকার মানুষ-এই একটা ক্ষেত্রে ওরা মরুভূমির মতই নির্মম আর নিষ্ঠুর
অ্যারিজোনা সীমান্তের কাছে চলে এসেছে শক্ত-পাল্লা। উত্তর দিকে দিগন্তে ওপাশে রয়েছে ইউটাহ অঞ্চল। সামান্ত পেরুতে হলে খটখটে শুকনো একটা মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে। যদি সে পালানোর সিদ্ধান্তই নেয়, তবে আজ পর্যন্ত মরুভূমিতে বেঁচে থাকার যত কৌশল সে রপ্ত করেছে, সবই কাজে লাগবে এবার
শক্ত-পাল্লা’কে যারা ধাওয়া করেছে তাদের কেউ ওই সীমান্তের কথা জানে। ওদের কাছে সীমান্ত হচ্ছে ম্যাপের উপর অর্থহীন একটা দাগ। আইনের সাথে বেআইনের, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের আর সত্যের সাথে মিথ্যার সীমারেখাই কেবল চেনে ওরা। ওদের মতে সেই সীমা লঙ্ঘন করেছে শক্ত-পাল্লা। মুখ বুজে যা সহ্য করা যায় না, তাই করেছে সে।
সামনাসামনি মোকাবিলায় কেউ কাউকে গুলি করে হত্যা করাটা ওদের চোখে কোন অপরাধ নয়। ইউরোপেও আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য জুয়েলের চল ছিল।
কিন্তু পিছন থেকে গুলি করে কাউকে হত্যা করা অবশ্যই কঠিন অপরাধ। ওদের বিশ্বাস শক্ত-পাল্লা তাই করেছে। শাস্তি: ফাঁসিতে ঝুলতে হবে তাকে।
‘শক্ত-পাল্লা’ ওদের এই ধারণার কথা ভাল করেই জানে-বোঝেও। যারা ওর পিছু নিয়েছে তাদের কাউকেই সে ব্যক্তিগত ভাবে চেনে না। ওদের মধ্যে ভাল লোকও নিশ্চয়ই আছে, জানে সে-ভিন্ন পরিস্থিতিতে সে নিজেও ওদের একজন হতে পারত। ওদের মত মানুষের পাশে দাড়িয়ে হাতে হাত মিলিয়ে বহুবার বহু কাজ সে করেছে। একসাথে লড়েছে। পরিশ্রমী খেটে খাওয়া মানুষ ওরা। তাদের যা বিশ্বাস সেই অনুযায়ী উচিত কাজই করছে তারা।
এখন হয় তাকে পালাতে হবে নতুবা রুখে দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করে ওদের ঠেকাতে হবে। যুদ্ধে নামলে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে-অথচ ওদের কারও সাথে তার শত্রুতা নেই। ওদের চেনেই না সে।
.
লোকটা যাচ্ছে কোথায়?
কোথায় আর যাবে-সম্ভবত বাড়ি ফিরছে। তবে বেশিদূর যাবার মত রসদ ওর সাথে নেই। শিগগিরই ওকে ধরে ফেলব।
ব্যাটা কোথাকার লোক?
জানি না। এদিককার কেউ চেনে না ওকে। দোকানে জানা গেল পালাবার আগে ব্যাটা মেয়েদের একটা মাথার ক্লিপ ছাড়া আর কিছুই সাথে নেয়নি।
চুলের ক্লিপ?
হ্যাঁ, বিশ্বাস করো, স্প্যানিশ মেয়েরা মাথার চুলের কারুকাজ করা চিরুনির মত যেসব ক্লিপ ব্যবহার করে, সেইরকম একটা ক্লিপই কেবল নিয়েছে।
সূর্যের প্রখর আলোয় চোখ ছোট করে দূরে দিগন্তের দিকে চাইল কীথ। লোকটার ঘোড়াটা খুব ভাল। চমৎকারর মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে চলেছে।
ঘোড়াটাকে দেখেছি আমি-বড় বাকস্কিন। ঘোড়ার মার্কা হচ্ছে দাঁড়িপাল্লা। এই মার্কা আগে কখনও দেখিনি।
কয়েক মিনিটি কেউ আর কথা বলল না। কেবল ঘোড়ার খুর আর চামড়ার জিন মোচড় খাওয়ার শব্দ হচ্ছে।
মনে হচ্ছে অনেকখানি পথ এগিয়ে গেছে লোকটা, দলের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য ইউজিন মন্তব্য করল। শুধু সর্বকনিষ্ঠই নয়, এই এলাকায় মাত্র চার বৎসর হলো এসেছে সে।
ওদের মধ্যে গিবনই ছাপ আর চিহ্ন দেখে অনুসরণ করায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ। প্রথম থেকেই একটা ব্যাপার খেয়াল করে বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছে সে-সামনের আরোহী একবারও তার ঘোড়াটাকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দুটায়নি। ঘোড়ার পায়ের ছাপ থেকে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা, একটুও তাড়াহুড়ো করছে না। তার মানেই অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার মতলব আছে ওর। অস্বস্তিভরে ভাবছে সে, অনেকটা সেধেই ঝামেলা কাঁধে নিয়েছে ওরা।
ঘাগু লোক, গিবনের মনের কথাটাই যেন ব্যক্ত করল লী। ঘোড়াকে অযথা বেশি হয়রান না করে পথ চলতে জানে। তা ছাড়া এসব এলাকাও ওর অপরিচিত নয়।
খুর থেকে ধুলো উড়ছে। উত্তপ্ত রোদে ওদের পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। তেতে উঠছে বিস্তীর্ণ পাথুরে প্রান্তর। খটখটে শুকনো জমির উপর তাপের ঢেউ দূর থেকে ঠিক পানির মত দেখাচ্ছে। আরও দূরে পাহাড়ের নীল মিছেই প্রাণ-জুড়ানো শীতলতার আশ্বাস দিচ্ছে।
বালির উপর দিয়ে, ঘোড়ার পায়ের ছাপ ট্রেন-লাইনের মত সোজা সামনে এগিয়ে গেছে। পথে বড় পাথরের চাঁই বা কাটা ঝোঁপ এড়াতে দু’একবার একটু বাঁক নিয়ে সামান্য ঘুরে গেছে। ছয়জনের অনুসরণকারী দলটা কিছুটা অনিশ্চিত ভাবেই সামনের লোকটার মনে কী আছে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছে।
চিহ্ন দেখে দেখে কাউকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করলে লোকটা সম্পর্কে অনেক কিছু আপনাআপনি জানা হয়ে যায়। মাটির উপরকার দাগ দেখেই লোকটার কোমলতা, নিষ্ঠুরতা, অজ্ঞতা, চাতুরী, শক্তি, সাহস আর দুর্বলতার অনেক আভাস পাওয়া যায়। ছাপার অক্ষর পড়তে না জানলেও কেউ কেউ চিহ্ন দেখেই একজনের নাড়িনক্ষত্র বলে দিতে পারে।
ফ্রীডম শহর ছেড়ে বেরিয়ে শক্ত-পাল্লা’র পিছু নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক কিছুই জেনেছে ওরা-তবু জানার এখনও প্রচুর বাকি।
ব্যাপারটা কীভাবে শুরু হলো? প্রশ্ন করল ওদের একজন।
হাতের ঘাম মুছতে অন্য হাতে রাইফেলটা ধরল গিবন। বাতাসে পিছনের লোকটা যেন শুনতে পায় এমন ভাবে একটু ঘাড় ফিরিয়ে সে জবাব দিল, লোকটা দোকান থেকে খাবার কিনছিল, এইসময়ে ডেরিক কিছু একটা মন্তব্য করলে লোকটা খেপে যায়। ডেরিকের কোমরে পিস্তল থাকলেও লোকটা ছিল নিরস্ত্র। তাই ডেরিক ওকে পিস্তল সহ তৈরি হয়ে আসতে বলেছিল। শাসিয়েছিল ফিরে না এলে তাকে খুঁজে বের করে কুকুরের মত গুলি করে মারবে সে
ও যখন ফিরে আসে ডেরিক তখন বারে দাঁড়িয়ে। ঠেলা দিয়ে বারের দরজা খুলেই ডেরিকের পিঠে পরপর দু’বার গুলি করে সে। বারে মদ খাচ্ছিল ডেরিক। ততীয় গুলিতে একটা হুইস্কির বোতল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
এক মুহূর্ত নীরব থেকে ইউজিন জানতে চাইল, আমরা ওকে ফাঁসি দেব ডেরিককে মারার, নাকি হুইস্কির ভরা বোতল ভাঙার অপরাধে?
প্রশ্নটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু ওর প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজেদের খেলো করল না কেউ।
সামনে সাদা আর তামাটে রঙের প্রান্তরে বিক্ষিপ্ত ভাবে একবার চোখ বুলাল ইউজিন। কোথাও গভীর ফাটল, কোথাও বা পুরোনো লাভা স্রোতের কালো ধারা জমিতে ছেদ ঘটিয়েছে।
কাউকে ধরে বেঁধে হত্যা করা সমর্থন করে না ইউজিন। তা ছাড়া যার পিছনে ধাওয়া করা হচ্ছে তাকে চেনা তো দূরের কথা কোনদিন চোখেও দেখেনি সে। মিলেমিশে থাকতে হলে প্রতিবেশীদের সুখে দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, তাই নেহায়েত কর্তব্য পালন করতে এসেছে ও
ফ্রীডম শহরে কোন আইন-আদালত নেই। জনমতই ওখানকার আইন। প্রত্যেকে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিখে নেয় ছেলে বেলাতেই। দরকার পড়লেই অস্ত্র ব্যবহার করে ওরা। পশ্চিমের এই ধরনের শহরেই সাধারণত বেআইনী ডাকাত আর বন্দুকবাজ লোকেদের আস্তানা গড়ে ওঠেকিন্তু ফ্রীডমের বেলায় তা ঘটেনি।
গোলাগুলিটা কে দেখেছে? হঠাৎ প্রশ্ন করল ইউজিন।
আসলে এত দ্রুত ঘটে গেছে যে কেউই ঠিক দেখেনি কেমন করে কী ঘটল। বারের অন্যদিকে কাজে ব্যস্ত ছিল ফ্রেন্ড। তবে এটা ধরেই নেয়া যায় লোকটা ডেরিককে কোন সুযোগই দেয়নি-পিস্তলে ডেরিকের খুব ভাল হাত ছিল।
কথাটা ইউজিনকে মনে মনে স্বীকার করতেই হলো। পিস্তল চালনায় রীতিমত ওস্তাদ ছিল ডেরিক। এ নিয়ে বেশ গর্বও ছিল তার। তবে নতুন লোকের সাথে ডেরিকের একটু বেয়াড়া ব্যবহার করার অভ্যাস ছিল।
বাতাসে ধুলোর পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অন্যদের দেখাদেখি ইউজিনও মুখে রুমাল বেঁধে নাক মুখ ঢেকে নিল। ঘোড়ার সাথে বাধা পানির বোতলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পানির পিপাসা প্রবল হয়ে উঠছে তার। কিন্তু দলের প্রবীণ কেউ এখনও পানি ছোঁয়নি-তা ছাড়া পানির স্বাদও এখন ঝাঁঝাল আর গরম হবে ভেবে ওই চিন্তা বাদ দিল সে।
কীথ, লোকটাকে দেখলে চিনতে পারবে তুমি? প্রশ্ন করল লী
মনে হয় পারব। তিরিশের কাছাকাছি বয়স-শক্ত-সমর্থ মাঝারি গড়ন। দোকানের লোকজনের ধারণা লোকটা খুব শক্তিশালী। সেইজন্যেই ওকে শক্ত পাল্লা নাম দিয়েছে ওরা।
লী নিজেও দড়ির মত পেশীওয়ালা শক্তিধর পুরুষ। অত্যন্ত পরিশ্রমী লোক সে। ফ্রীডম শহরে এসে প্রথম বছরেই অমানুষিক পরিশ্রম করে নিজের পশু খামারটাকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে ও। প্রতিবেশী হিসাবেও সে খুব ভাল। ইউজিনের বাসার কাছে যখন বনে আগুন লেগেছিল তখন লী-ই প্রথম ছুটে এসেছিল সাহায্য করতে।
লী পৌঁছানোর প্রায় সাথে সাথেই কীথও ওয়্যাগন ভর্তি ভিজে ছালা আর কোদাল নিয়ে হাজির হয়েছিল। গত বছর গিবন ভাঙা পা নিয়ে যখন বিছানায় পড়ল তখনও কীথই কঠিন শীতের মাসগুলোতে নিজের পশুর জন্য তুলে রাখা খাবার খাইয়ে গিবনের গরু-মহিষগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এজন্য ওকে প্রচুর বাড়তি পরিশ্রমও করতে হয়েছিল।
লী-র বন্ধু ছিল ডেরিক। লী-কে ওর পশু তাড়িয়ে আনতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই এসেছিল সে। এদিকে একটা পছন্দসই জায়গা পেয়ে শেষ পর্যন্ত এখানেই থেকে যায়।
ডেরিক ছিল যেমন দুঃসাহসী তেমনি বখাটে। তামাশার খাতিরে অন্যের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করত না। তবু লোকটা খুব ফুর্তিবাজ ছিল বলে সবাই বেশ পছন্দ করত ওকে। কারও বুনো ঘোড়া পোষ মানানোর দরকার পড়লে নিজে থেকেই এগিয়ে যেত সে। নিছক উত্তেজনা আর চ্যালেঞ্জের টানেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিনে পয়সায় অন্যের ঘোড়া বশ করে দিত। চতুর পিস্তলবাজ ছিল সে। সামনাসামনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওর সাথে কারও পারার উপায় ছিল না।
ফ্রীডমে এসে ইউজিন তার মিষ্টি স্বভাব দিয়ে সবার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে নিতে দেরি করেনি। ওহাইওতেও খামারের কাজই করত। পশ্চিমের আচার আর রীতির সাথে নিজেকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়েছে সে। পশ্চিমী নিয়মে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যখন তাকেও দলের একজন হিসাবে নির্বাচন করা হলো, গর্বে ওর বুকটা ফুলে উঠেছিল। ওরা যে তাকে নিজেদের একজন করে নিয়েছে, এ বিষয়ে এখন সে নিঃসন্দেহ।
কিন্তু ইউজিনের মনে পড়ে সে এই এলাকায় যখন নতুন, ডেরিক কিছুতেই তাকে সহ্য করতে পারত না। লী আর অন্যান্য সবাই ওকে মেনে নেওয়ায় বাধ্য। হয়েই শেষে চুপ হয়ে গেছিল ডেরিক। অবশ্য, ওর যত দোষই থাকুক না কেন, পিঠে গুলি করে ওকে মারা খুবই অন্যায় হয়েছে আগন্তুকের।
ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চলছে লোকটা। হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল লী।
লোকটা খুব চালাক, মন্তব্য করল গিবন। বেশ ভোগাবে বলেই মনে হচ্ছে।
হয়তো ওর ঘোড়াটা খোড়া হয়ে গেছে, বলল ক্লাইভ।
না, খুঁড়িয়ে চলার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা মতলব আছে ওর।
ধীরে ধীরে আরও মাইল দুয়েক পথ এগিয়ে গেল ওরা। বালির বদলে এদিকটায় পুরু ধুলো। একটা জায়গায় ধুলোর উপর পাশাপাশি দুটো চাপড়া দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু যেন ছলকে পড়েছে। ওদিকে এগিয়ে গিয়েছিল বার্ট। পানি, জানাল সে।
সাবধানে খরচ না করলে পানির টান পড়বে ওর, বলল ইউজিন।
বাজি রেখে বলতে পারি পানি দিয়ে ঘোড়ার নাক মুছিয়েছে লোকটা, বলল লী। এই ধুলো ঘোড়ার শ্বাসের খুব ব্যাঘাত ঘটায়। এর মধ্যে দিয়ে কেউ ঘোড়া ছুটিয়ে চললে ঘোড়া মারা পড়তে পারে।
ওরা যাকে অনুসরণ করছে সে তার ঘোড়াকে স্বাভাবিক গতিতেই এতক্ষণ চালিয়ে এসেছে। কিন্তু তাকে যদি ওরা ধরে ফেলার উপক্রম করে তবে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাবে, সন্দেহ নেই। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে ঘাম মুছল ইউজিন। বিশেষ করে ওর জন্যই পাথরের জগে দুধ রাখে ওর বৌ-ঠাণ্ডা থাকে। বাড়ি ফেরার জন্য ওর মনটা কেমন যেন ছটফট করে উঠল।
সূর্যের দিকে চাইল সে। এতক্ষণ ওটা ডাইনে ছিল-হঠাৎ করে কী করে যেন সেটা তাদের বায়ে চলে এসেছে। খেয়াল করে দেখল ট্রেইলটা এখানে এসে এত চক্রাকারে ঘুরে গেছে। গিবন নেতৃত্ব দিচ্ছিল-একটা গালি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া সে
সবাই ওর পাশে পৌঁছে দেখল অল্প কিছু দূরে শুকিয়ে যাওয়া খালের মত একটা জায়গা। যেখানে ঘোড়া বাধার চিহ্ন রয়েছে। তার পাশেই পাথর চাপা দেওয়া একটা কাগজ বাতাসে শব্দ তুলে উড়ছে
ঘোড়া চালিয়ে নীচে নেমে কাগজটা তুলে নিয়ে এল লী। কাগজের উপর চোখ বুলিয়ে মুখে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে ওটা গিবনের দিকে এগিয়ে দিল সে। চিরকুটটা ওদের উদ্দেশেই লেখা হয়েছে।
গোলাগুলিতে আমার দিক থেকে কোন অন্যায় হয়নি-তবু আমার পিছনে লেগেছ কেন? আর লাগতেই যদি চাও মোটে ছয়জন এলে কেন? ফিরে যাও, আরও লোকজন নিয়ে এসো। ছাইয়ে রঙের ঘোড়াটার জিনের পেটি এখনই শক্ত করে বাঁধা না হলে ওর পিঠের দশা খুব খারাপ হবে।
লেখাটার নীচে কোন সই নেই।
আসপর্ধা! বিড়বিড় করে বলল বার্ট। কিন্তু ওর রাইফেলের মুখে মাত্র চল্লিশ গজের মধ্যে আমাদের সবাইকে পেয়েছিল লোকটা!
লজ্জায় লাল হয়ে ঘোড়ার জিনের পেটি শক্ত করে বেঁধে নিল ইউজিন। কিন্তু ওকে লক্ষ করছে না কেউ। সবাই তার মতই অপ্রস্তুত হয়েছে ওই চিরকুটটা ওদের সবার জন্যই অপমানজনক। ওতে কিছু ভাল উপদেশ থাকলেও চটেছে সবাই। কিন্তু চটলে কী হবে-সেই সাথে একটা অজানা ভীতিও ওদের মনে ঢুকছে। এত কাছে থেকে ইচ্ছা করলে লোকটা সহজেই ওদের কয়েকজনকে ঘায়েল করতে পারত!
শক্ত-পাল্লা’ ওদের খেলাচ্ছে! আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে ওদের। ওরা ধরেই নিয়েছিল যে লোকটা ওদের সামনে রয়েছে-প্রাণভয়ে পালাচ্ছে সে। ওরা যে কতটা অসতর্ক তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায় ওরা মনে মনে খেপেছে।
অন্যায় হয়নি! বললেই হলো? ফুসে উঠল ক্লাইভ। পেছন থেকে পিঠে গুলি করে এখন সাফাই গাইছে ব্যাটা!
অত্যন্ত সাবধানে আবার এগোল ওরা। একবার ওদের হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেও পরেরবার লোকটা কী করবে বলা যায় না।
অনুসরণ করা এখন কঠিন হয়ে উঠছে। নানা রকম ফন্দি খাটিয়ে লোকটা ধোকার সৃষ্টি করছে। চিরকুটটা পাওয়ার পর থেকেই আরও সাবধানী হয়েছে ওরা। ফাঁদ পাতা যায় এমন প্রতিটি জায়গায় ওরা খুব সতর্কতার সাথে নিশ্চিত হয়ে তবে এগোচ্ছে। বারবার দেখা যাচ্ছে মিছেই ভয় পেয়েছে ওরা-কিন্তু বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে মরতে রাজি নয় কেউ।
একটা উপত্যকার ভিতর দিয়ে চলেছে ওরা। একটু আগে মাঝে-মধ্যে দমকা হাওয়া বইছিল-এখন তাও নেই। দু’পাশের দেয়াল আর মাটি থেকে আভেনের মত ভাপ বেরুচ্ছে। তাপে গা ঝলসে যাচ্ছে-ঘামের লবণে জ্বলছে চোখ। শরীরের ভাজে ধুলো জমে ঘামের সাথে মিশে লেই-এর মতো চাপড়া বেঁধেছে-চুলকাচ্ছে। তবু এগিয়েই চলল ওরা।
আর একটু সামনে দেখা গেল উপত্যকাটা চওড়া হয়ে বিস্তৃত একটা গামলার আকার নিয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে মাঝখানে একটা লেকের সৃষ্টি হয়েছে। বদ্ধ পানি, ক্ষারে ভরা
শক্ত-পাল্লার’ পায়ের ছাপ লেকের পানিতে নেমে মিলিয়ে গেছে। বোকার মত সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওরা।
এর ভিতর দিয়ে কিছুতেই পাড়ি দেয়নি লোকটা, বলে উঠল গিবন। মাঝখানে অনেক পানি-তা ছাড়া কাদায় ঘোড়া ফেঁসে যাবার সম্ভাবনাও আছে।
দু’টো দলে ভাগ হয়ে লেকের পাড় দিয়ে দু’দিকে রওনা হলো ওরা। পাঁচশো গজ যেতে না যেতেই পিছন থেকে ডাক শুনে ইউজিন ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। লী। ওদের হাতের ইশারায় ফিরে যেতে বলছে। লোকটা ঘোড়া নিয়ে কোথায় পানি থেকে উঠে এসেছে তা খুঁজে পেয়েছে লী।
খুব সহজ সাধারণ একস্টা চালাকি। কিন্তু ওদের এতে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হলো। ভিতরে ভিতরে রেগে উঠছে ইউজিন। ছিপে মাছ খেলানোর মতই ওদের খেলাচ্ছে লোকটা!
রওনা হবার সময়ে ভেবেছিল কাজ শেষ করে আজ রাতেই নিজের র্যাঞ্চে ফিরতে পারবে সে কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে ওর কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে যে কাজটা মোটেই সহজ হবে না। ওরা রাতে কোথায় কখন ক্যাম্প করে একটু বিশ্রাম নেবে সেটা পর্যন্ত ওই লোকটার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে এখন। ওরা না জানলেও শক্ত পাল্লা ঠিকই জানে সে কোথায় চলেছে। ইচ্ছা করেই সবচেয়ে কঠিন আর দুর্গম পথ সে বেছে নিয়েছে। হয়তো আশা করছে অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে যাবে ওরা।
খুরের ছাপগুলো দ্রুত বাঁ-দিকে ঘুরে পাহাড়ের ঘন ঝোঁপগুলোর দিকে এগিয়ে গেছে।
ব্যাটা যাচ্ছে কোন চুলোয়? অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল লী। আমি তো এর মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝছি না।
ওর কথার জবাব দিল না কেউ। লম্বা সার বেঁধে ক্লান্ত দেহে আবার এগিয়ে চলল ওরা। সবার আগে কীথ। চলতে চলতে হঠাৎ রাশ টেনে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। পাহাড়ের ফাটল থেকে ছোট্ট একটা পানির ধারা ফোঁটায় ফোঁটায় নীচে পড়ে পাথরের বাটির মত একটা জায়গায় জমা হচ্ছে।
কী আশ্চর্য! বলে উঠল গিবন। আমি ভাবতেও পারিনি এখানে পানি আছে।
ঘোড়া থেকে নামল কীথ। ওর দেখাদেখি অন্যেরাও। খুব তেষ্টা পেয়েছে আমার-সাধ মিটিয়ে পানি খেয়ে নিই। পাথরে ঘেরা পরিষ্কার পানি দেখিয়ে সে বলল, মনে হচ্ছে এটা যেন নতুন তৈরি করেছে কেউ।
আশপাশটা ঘুরে দেখছিল গিবন। নতুন পুরোনো সব রকম পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে দেখে সে মন্তব্য করল, এটা ওরই কাজ। কিন্তু অবাক লাগছে। ভাবতে যে ব্যাটা এই জায়গাটা খুঁজে পেল কীভাবে?
আমার মনে হচ্ছে এই এলাকা লোকটার চেনা, বলল বার্ট।
শব্দ করে হেসে উঠল গিবন। সত্যি শক্ত-পাল্লায়ই পড়েছি আমরা। পথ দেখিয়ে আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যে বাধ্য হয়ে দেরি করতেই হবে। দু’টো ঘোড়াকে খাওয়াতেই পানি শেষ হয়ে যাবে। অন্য ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে কতক্ষণে আবার পানি ভরবে সেই আশায় আমাদের বসে থাকতে হবে।
চালাকি সবই জানা আছে ব্যাটার-ধড়িবাজ লোক, নিজের মতামত প্রকাশ করল ক্লাইভ।
তোমার কি মনে হয় নোকটা রুখে দাঁড়িয়ে ফাইট করবে? প্রশ্ন করল বার্ট।
সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী, মুরুব্বিয়ানা চালে জবাব দিল লী। আমিও তাই চাই-দেখতে চাই কত বড় বাহাদুর সে।
ওর রাগে লাল হওয়া চেহারাটা চট করে একবার দেখে নিয়ে নিচু স্বরে গিবন বলল, তোমার মত না পারলেও কারও রেখে যাওয়া চিহ্ন দেখে মানুষটাকে আমিও মোটামুটি চিনতে পারি। পুরোপুরি বুঝে কথাটা বলছ তো?
জিভ দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁট চেটে একেএকে সবার মুখের দিকে চাইল ইউজিন। কেউ যেন একটা কঠিন শীতল স্রোত বইয়ে দিয়েছে মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে। স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে ওদের প্রত্যেকের চেহারায়।
নিজের উপর লোকটার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সে জানিয়ে দিয়েছে ন্যায়সঙ্গত ভাবেই মরেছে ডেরিক। ওদের সবাইকে হাতের মুঠোয় পেয়েও কেবল চিঠি দিয়ে সাবধান করেই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা করলে সে সবাইকে ওখানে গুলি করে হত্যা করতে পারত। বোঝাই যাচ্ছে যদি রুখে দাঁড়াতেই হয়, তবে নিজের সুবিধা মত, আর ওদের জন্য সবচেয়ে বেকায়দা জায়গা বেছে নিয়েই সে তা করবে।
কাপুরুষ নয় ইউজিন। কিন্তু জেনেফারের কথা ভেবে মনে মনে খুব দমে গেছে সে। র্যাঞ্চে তার স্ত্রী একা। আজ যদি সে এখানে মারা যায় তবে জেনেফার চলবে কী করে? তাকে ছাড়া যে কিছুই বোঝে না সে-ওই ছোট খামারটাকে ঘিরে ওদের দুজনের এত আশা, এত পরিকল্পনা সব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সবকিছু বেচে দিয়ে তাকে বাপ-মার কাছে ফিরে যেতে হবে।
সূর্যের প্রচণ্ড তাপ কিছুটা কমে এসেছে। অস্ত যাবার আগে সূর্যটা যেন একটু নরম আর রঙীন শুভেচ্ছার প্রলেপ মাখিয়ে দিচ্ছে উত্তপ্ত মরুভূমির উপর। দূরে কোথাও একটা তিতির পাখি ডেকে উঠল। ওদের ডান দিক থেকে আর একটা তিতির তার জবাব দিল
ক্ষান্ত দিলেই তো হয়-ভাবল ইউজিন। উপায় থাকতে থাকতেই তাদের ফেরা উচিত।
মনে মনে ভাবলেও কথাটা কাউকে জানাল না সে। হয়তো কথাটা অন্যদের মনেও উদয় হয়েছে, কিন্তু মুখে কেউ তা বলল না। একটা কাজ নিয়ে বেরিয়েছে ওরা, এর শেষও ওদেরই দেখতে হবে। অন্যায়কারীকে শাস্তি দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লোকটা আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, বলল লী।
যাকে অনুসরণ করা হচ্ছে সে-ই যেন শুরু থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। পালাবার সময়ে বেশির ভাগ লোকই কোনমতে প্রাণ নিয়ে বাচার চিন্তায় থাকে, পিছনে যারা ধাওয়া করছে তারা কী ফন্দি আঁটছে, এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এই লোকটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। কোন তাড়াই যেন নেই ওর। নিশ্চিত মনে নিজের খুশি মত ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দেরি করাচ্ছে, খেলাচ্ছে।
অস্বস্তির মধ্যে সবার মনে ঘুরে ফিরে বারবার একই ভাবনা হচ্ছে-এর শেষ কোথায়? লোকটা যখন আবারও নিজের ইচ্ছামত ওদের মুঠোর মধ্যে পাবে, তখন কী ঘটবে? ওদের কয়জন মারা পড়বে?
ন্যায়নিষ্ঠাই ওদের ফিরে যেতে বাধা দিচ্ছে। ডেরিকের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন দিয়েই দেনা শোধ করতে হবে লোকটাকে।
আবার জেনেফারের কথা ইউজিনের মনে পড়ে গেল। এখন নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছে সে, আর মনে মনে তার কথা ভাবছে। কখন সে ফিরবে এই আশায় আভেনে তার খাবার গরম রাখছে। এমন ঘটবে তা কেউই আশা করতে পারেনি। সবাই মনে করেছিল সামান্য গোলাগুলির পরে সহজেই কাজ উদ্ধার করে ফিরতে পারবে ওরা।
চিন্তিত হলো ইউজিন। শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ফিরতে যদি পারেও, অন্তত সপ্তাহখানেক বাইরেই কাটাতে হবে তাকে।
০২. আবার এগিয়ে চলল ওরা
আবার এগিয়ে চলল ওরা। ঘোড়ার পায়ের ছাপ পাহাড় ঘেঁষে সীডার আর স্প্যানিশ বেরোনেটের ছোট ঝোঁপগুলোর দিকে গেছে। ঝড় বাদলে ক্ষয়ে যাওয়া ফাটল আর প্রান্তরের উপর দিয়ে আগ্নেয়লাভার কালো স্রোত সরু আঙুরের মত দেবাচেছ-মনে হচ্ছে কেউ যেন একটা বিশাল কালো হাত বাড়িয়েছে নীচের লোকটাকে ধরার জন্য।
শক্ত-পাল্লার কোন তাড়া নেই। রেড ইন্ডিয়ানদের মত দক্ষতার সাথে এগিয়ে চলেছে সে। ঘোড়ার চলতে সুবিধা হবে জেনেও সোজা পথ না ধরে কঠিন। পথে চলছে লোকটা। নিজের অজান্তেই ওদের মনে একটা অজানা ভয় ঢুকেছে-সবাই ভাবছে, ওই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী লোকটার সামনাসামনি দাড়ালে কী। ঘটবে?
ছোট মেসাটার (mesa-মালভূমির মত জায়গা) মাথায় উঠে ঘোড়াটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য থামল লী। অল্পক্ষণের মধ্যেই দলের বাকি সবাই ওকে ঘিরে দাড়াল। প্রত্যেকেই ওরা পরিশ্রমী লোক, কিন্তু নিজের র্যাঞ্চ ছেড়ে এর আগে আর এতদূর উত্তরে আসেনি কেউ।
লোকটার মতলবটা কী বলো তো, গিবন? প্রশ্ন করল লী। আমি যতদূর জানি ওদিকে কিছুই নেই-একেবারে ফাঁকা।
পশ্চিমে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না-ওদিকটায় গভীর খাড়া খাদ। ওদিক দিয়ে যেতে হলে বন্ধুকে পাখা গজিয়ে উঠে যেতে হবে। সামান্য একটু পানি মুখে নিয়ে কুলি করল গিবন। তারপর আবার বলল, ওদিকটায় কিছু নেই বলেই জানি আমরা-কিন্তু কে জানে? একমাত্র শক্ত-পাল্লাই বলতে পারবে ওখানকার খবর। পানির বোতলটা আবার সাবধানে ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখল সে। মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। কঠিন লোকের পাল্লায় পড়েছি-সহজে ধরা যাবে না ওকে।
যত কঠিনই হোক, ওকে ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে কোনমতেই ফ্রীডমে ফিরছি না আমি, মনের ক্ষোভ প্রকাশ পেল লী-র কথায়
কোন স্থির সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারেনি ইউজিন। সে জানে শহরের অধিবাসী হিসাবে তারা নিজেরাই সেখানকার আইন-শৃঙ্খলার জন্য দায়ী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারলে স্বেচ্ছাচার আর বিশৃঙ্খলার মাঝে বাস করতে হবে তাদের। এগিয়ে যাওয়ার পিছনে জোরাল যুক্তি অবশ্যই আছে-তবু মন থেকে উৎসাহ বা সায় পাচ্ছে না সে। অন্যান্য শান্তিপ্রিয় লোকের মত সেও চায় নিঝঞ্ঝাটে স্ত্রীকে নিয়ে জীবনটা উপভোগ করতে। পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার স্বাদ গ্রহণ করতে চায় সে।
লী-র দিকে চেয়ে ইউজিনের নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। অন্যান্য সবার মত নিষ্ঠা কেন নেই তার? এটা তো সত্যি কথাই যে কঠিন হাতে আইন রক্ষা করতে না পারলে কারোই জানমালের কোন নিরাপত্তা থাকবে না। তবু তার মনে হচ্ছে এই কাজে তাকে নিজে উপস্থিত থাকতে না হলেই যেন ভাল হত। এই ভীরু মনোভাবের জন্য মনে মনে লজ্জা পাচ্ছে সে-কিন্তু শহরে সবাই ভোট দিয়ে একজন মার্শাল নিযুক্ত করে তার উপরই এসব কাজের দায়িত্ব দিলেই তো পারে?
মেসাটা প্রায় বর্গাকার। দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে দু’দিকেই প্রায় সিকি মাইল হবে। ঘোড়ার খুরের চিহ্ন মাঝে মধ্যে দেখা যায়। একটা অস্পষ্ট সাদা আঁচড়ের দাগ রয়ে গেছে পাথরের উপর। লোকটা মেসা থেকে কোন্ পথে নেমেছে তা খুঁজে বের করতেই ওদের প্রায় আধঘণ্টা সময় লেগে গেল।
নীচে নামার পথে বিজ্ঞের হাসি হেসে গিবন বলল, ওর মাত্র কয়েক মিনিট লেগেছে-কিন্তু আমাদের অনেক বেশি সময় লাগল। ঘনঘন এরকম চাল চালতে পারলে ওর আর ছুটে পালাবার দরকার পড়বে না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিচু জায়গাগুলোতে অন্ধকার ছায়া নেমেছে। আকাশে চলেছে বিচিত্র রঙের খেলা। ওদের সামনে যতদূর দেখা যায় ছোট বড় সারি সারি অগুনতি বালির ঢিবি। তারপরই প্রায় হাজার ফুট উঁচু একটা মেসা।
আমাদের ভাগ্য ভাল লোকটা ওঁৎ পেতে বসে নেই, বলল গিবন। থাকলে নিজের খুশি মত এক এক করে সাবাড় করতে পারত আমাদের।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বিকট শব্দের সাথে একটা গুলি ছুটে এসে পাথরে বাড়ি খেয়ে আর এক দফা গর্জে উঠল। ছুটাছুটি করে ওরা যে যেখানে পারল আশ্রয় নিল।
বার্ট তার ঘোড়া থেকে গড়িয়ে নীচে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটা বালির স্তূপের আড়ালে লুকাল। ঘোড়াটা হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। জিনের পিছনে পানির পাত্রটা উঁচু হয়ে রয়েছে। আবার গুলি হলো। ঘট করে একটা বুলেট গাথার শব্দ হতেই ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠল।
অশ্রাব্য গালি বেরিয়ে এল বার্টের মুখ দিয়ে। ঘোড়াটাকে যদি মেরে ফেলে। তা হলে…’
একটু অস্থিরভাবে নড়ে উঠে অক্ষত অবস্থায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল ঘোড়াটা। ফুটো পাত্র থেকে দ্রুত ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।
কাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়বে ওরা? চারদিক খুঁটিয়ে চেয়ে দেখেও কাউকেই ওদের নজরে পড়ল না। ট্রেইল অনুসরণ করে একটা বালির ঢিবির আড়ালে চলে। এসেছে ওরা। ঢিবির, ওপাশ থেকেই এসেছে গুলি।
পানির বেগ কমে গিয়ে এখন কেবল ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। গুলিটা পাত্রে না লেগে কারও মাথায় লাগলে মাথাটারও ওই অবস্থা হত।
সবাই বেশ বুঝতে পারছে ওদের পানির পাত্র খালি হবার পরিণাম কী হতে পারে। ঝর্ণা থেকে সবাই নিজেদের পাত্র ভরে নিয়েছে সত্যি, পানির টান পড়ার কথা নয়-কিন্তু যার পিছু ওরা নিয়েছে সে ছাড়া, কত পথ ওদের চলতে হবে তা কারোই জানা নেই। নিশ্চয়ই অকারণে নোকটা ওটা ফুটো করেনি।
কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ছে না। ঢিবির আড়ালে ছায়ায় এখন কিছুটা কম হলেও যথেষ্ট গরম। সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে।
অনেক আগেই কেটে পড়েছে লোকটা, আর চুপ করে থাকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মন্তব্য করল ক্লাইভ। কিন্তু ওর কথাটা সত্যি কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার আগ্রহ কেউ প্রকাশ করল না। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে একটা পাথরের পিছন থেকে সামান্য উঁচু করে তুলে ধরল সে। কিছুই ঘটল না। অনেকক্ষণ হ্যাটটা শূন্যে ধরে থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে ওটা নামিয়ে নেওয়ার সাথে সাথেই একটা গুলি এসে ওর খুব কাছেই বালি ছিটিয়ে মাটিতে ঢুকল। নিজের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল শক্ত-পাল্লা’-সেই সাথে আরও একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল, এসব ফালতু ছেলে ভুলানো চালাকিতে কাজ হবে না।
ওদের ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বিশ্রাম নিচ্ছে। উত্তপ্ত বালির উপর শুয়ে ওদের আরও গরম বোধ হচ্ছে। অত্যন্ত ক্লান্ত ইউজিন। একটু একটু করে ছায়ার দিকে সরে গিয়ে বিশ্রামের চেষ্টায় দেহটাকে শিথিল করে ছেড়ে দিয়েছে সে।
আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কিছুই ঘটল না দেখে গিবন সাহস করে ধীরে ধীরে ক্রল করে ঘুরে টিলার পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আরও অনেকক্ষণ সময় পার হলো। দূর থেকে একটা ডাক শুনে ইউজিনের ঝিমুনি ছুটে গেল। যেখান থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে সেখানে দাড়িয়ে গিবন হাতের ইশারায় ওদের ডাকছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে গিবনের দিকে এগিয়ে গেল সবাই।
বালুর উপর পাশাপাশি তিনটে ব্যবহৃত পিতলের কার্তুজ পড়ে আছে। আঁচড় কেটে মাটিতে একটা তীর চিহ্ন আঁকা। নীচে লেখা-চিহ্ন দেখে এগোও।
রাগে মাথা থেকে হ্যাট খুলে লেখাটার উপর ছুঁড়ে মারল লী। স্পর্ধা দেখে গা জ্বলে যায়। শালা হারামীর বাচ্চা! পা দিয়ে ঘষে লেখাটা মুছে ফেলল সে।
লোকটা টিটকারি মেরে খেলো করতে চাইছে আমাদের, তিক্ত ভাবে বলে উঠল বার্ট। ব্যাটার উচিত শাস্তি হওয়া দরকার!
আবার রওনা হলো ওরা। পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেছে সামনের লোকটা। জায়গায় জায়গায় আবার ভাঙা ডালপালা বা পাথর দিয়ে তীর চিহ্ন এঁকে রেখে গেছে।
প্রত্যেকেই ওরা দায়িত্বশীল লোক-গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরিয়েছে। এই ধরনের ইয়ার্কি ফাজলামি ওদের অক্ষমতার জ্বালা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটা শুধু ওদের বোকা বানিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে, সেটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে ওর সাথে যে জাতের ঘোড়া রয়েছে তাতে চলতে জানলে কয়েকদিন কেন, কয়েক সপ্তাহও একটানা চলতে পারবে সে।
বিশাল ঢালের মাঝখানে ছোট লেকটাকে পিছনে ফেলে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে ওরা। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ সূর্যের আলোয় একটা ঝাঁপসা বেগুনী পর্দার আড়ালে হারিয়ে গেছে ওটা। সামনেই একটা ছোট পাহাড়ের গায়ে একটা বড় পাথরের উপর খড়িমাটি দিয়ে লেখা রয়েছে-ছায়া, এখানে বিশ্রাম নিলে সর্দিগরমির ভয় নেই।
ক্লান্ত অবসন্ন অবস্থায় নির্বাক হয়ে লেখাটার দিকে চেয়ে রইল ওরা। ঘোড়াগুলোও ক্লান্ত, এগোতে চাইছে না আর। ঘুরে পিছন দিকে চাইল ইউজিন।
বিস্তীর্ণ মরু এলাকা পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। পাহাড় আর ঢিবিগুলোর চূড়ায় সোনালী ছোঁয়া লেগেছে। পশ্চিম দিক থেকে গাঢ় লাল রেখা বেরিয়ে আসছে আকাশ চিরে। অনেক দূরে ইউজিনের র্যাঞ্চের দরজায় ফ্রীডম শহর থেকে ফেরার পথে তারই অপেক্ষায় চেয়ে রয়েছে জেনেফার। নিরাশ হয়ে শেষে আস্তাবলের ঘোড়াগুলোকে খাইয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াবে সে। আজ রাতের খাবার একাই খেতে হবে ওকে। খেতে বসেও বার বার বুকভরা আশা নিয়ে পথের দিকে চাইবে বেচারী।
কতদিন যে তাকে এমনি বাইরে বাইরে কাটাতে হবে তার কোন ঠিক নেই। কোনদিনই যদি ওরা আর ফিরতে না পারে? হঠাৎ এই অশুভ চিন্তায় ইউজিনের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠল।
কেমন লোক ওই সামনের মানুষটা? বারবার ওদের বোকা বানিয়ে চলেছে কিন্তু একবারও কাউকে মারার চেষ্টা করেনি। লোকটা যদি পিঠে গুলি করার মত
দুর্নীতিবাজই হবে, তবে এত সুযোগ পেয়েও ওদের ছেড়ে দিচ্ছে কেন?–ক্লাইভ আর কীথ সবার আগে পাশাপাশি চলছিল; হঠাৎ ওরা দুজনেই থেমে দাঁড়াল। অন্যান্য সবাই এগিয়ে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়াল। দু’পাশের পাহাড় ওদের সামনে খুব কাছাকাছি ঘেঁষে এসেছে। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা খুব সরু পথ সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মাটির উপর পাথর দিয়ে তৈরি একটা তীর চিহ্ন ওই পথটাই নির্দেশ করছে। ওরই ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। ওখান দিয়ে এগোতে হলে পাশাপাশি দু’জনের যাবার উপায় নেই-এক এক করে এগোতে হবে।
পকেট থেকে তামাক বের করে একটা সিগারেট বানিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশটা জরিপ করে দেখল কীথ।
তুমি কী বলো, গিবন? প্রশ্ন করল সে।
লোকটা এখনও সেই চেষ্টা করেনি বটে, কিন্তু যদি রুখে দাঁড়াবার মতলব থেকে থাকে তবে আমার মনে হয় উপযুক্ত জায়গাই বেছে নিয়েছে সে। আমরা যদি ওর ভিতরে একবার ঢুকি তা হলে রাইফেল চালাতে জানা যে কোন লোক মুঠোর মধ্যে পেয়ে যাবে আমাদের।
আমার মনে হয় না সে তা চায়, কোন কিছু না ভেবেই কথাটা বলে ফেলল ইউজিন।
কী বলতে চাও তুমি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল লী। ওর গলাটা খুব রুক্ষ শোনাল।
না, মানে….’ কথাটা যে কারণেই সে বলে থাকুক, লী-র কঠিন দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেল ইউজিন। আমি বলছিলাম যে সুযোগ তো সে আগেও পেয়েছিল কিন্তু কাউকে মারেনি।
কেউ ওর কথায় আমল দিল না। কিন্তু মন্তব্য যখন একটা করেই ফেলেছে, ওদের শুনিয়ে আর কিছু না বললেও নিজের মনে মনে সে তার স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করল।…হ্যাঁ, তাই তো। প্রথমবার যখন লোকটা ওদের চিঠি দিয়ে সাবধান করেছিল তখন সে চাইলে অন্তত কয়েকজনকে অবশ্যই শেষ করতে পারত।
পানির বোতলটা গুলি করে ফুটো করার সময়ে সে অন্তত তিনশো গজ দূরে ছিল। অতদূর থেকে সে কী করে জানল ওটা পানিরই বোতল? তবে কি ওর কাছে বিনকিউলার আছে? হতে পারে এই মুহূর্তে সে ওটা দিয়ে সবার চেহারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে-ঠোঁট নড়া দেখে আন্দাজ করে নিচ্ছে কে কী বলছে?
যা হবার হবে, বলেই রাইফেল বাগিয়ে ধরে সরু পথটার দিকে এগিয়ে গেল। গিবন। অগত্যা অন্যান্য সবাই একে একে ওর পিছু নিল।
ভিতরটা বেশ অন্ধকার। পথটা অপ্রশস্ত। চলতে গিয়ে ইউজিনের রেকার ঘষা খাচ্ছে পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের সাথে। উপরে সরু এক চিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছে। আরও অনেক উপরে একটা-দু’টো তারা দেখা যাচ্ছে।
প্রতি মুহূর্তেই তার ভয় হচ্ছে এই বুঝি প্রচণ্ড শব্দ করে একটা গুলি ছুটে এল-কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। এঁকেবেঁকে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে আলো দেখা গেল। গিরিপথের শেষে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এসেছে ওরা। একটা উজ্জ্বল তারা দেখা যাচ্ছে-তারা নয়, ওটা ক্যাম্পের আগুন।
ছড়িয়ে পড়ে ধীর গতিতে অত্যন্ত সাবধানে এগিয়ে চলেছে ওরা। প্রত্যেকেরই রাইফেল কক করা-তৈরি।
ইতস্তত কয়েকটা বড় গাছ, কিছু ছোট ছোট ঝোঁপও রয়েছে। কাঁটা ঝোপে বাধা পাচ্ছে ওদের দৃষ্টি-সবটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। গালির তুবড়ি ছুটেছে লী-র মুখ থেকে-সে-ই প্রথম আগুনের কাছে পৌঁছেছে।
ছোট্ট পানির ধারার পাশে আগুন জ্বালা হয়েছে, কাছেই আগুনে দেওয়ার জন্য কিছু কাঠও মজুদ রাখা আছে। দুটো পাথর চাপা দিয়ে বিছানো একটুকরো কাগজের উপর দু’টো ছোট তূপে রাখা রয়েছে কফি আর চিনি।
হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে ওরা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপটাকে হজম করার চেষ্টা করছে। লোকটা তাদের ছেলেমানুষ ঠাউরেছে! কয়েকজন নাবালকের দেখাশোনা করছে যেন!
ওই কফি আমি কক্ষনো খাব না! রাগে ফেটে পড়ল, বার্ট।
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গিবন বলল, ক্ষতি কী? সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করাই ভাল। তা ছাড়া এই রাতের অন্ধকারে তো আর ওকে অনুসরণ করা যাবে না।
নীরবে ঘোড়ার পিঠ থেকে কেতলি নামিয়ে ঝর্না থেকে পানি ভরে আগুনে চাপিয়ে দিল কীথ। বাস্তব চিন্তাধারা ওর-কফির প্রতি আসক্তিও তার খুব বেশি।
জিন নামিয়ে ঝর্ণার ধারে সামান্য একটু যা ঘাস জন্মেছে তার উপরই চরার জন্য ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হলো। কারও থলেতেই বেশি খাবার নেই-ওরা লম্বা। সময়ের জন্য তৈরি হয়ে বেরোয়নি। বুঝেশুনে চলতে হবে।
বার্টের রাগ পড়ে গেছে। এখন সে অদ্ভুত বিস্মিত দৃষ্টিতে ঝর্নার পানি যেখানটায় পড়ে জমা হচ্ছে সেদিকে চেয়ে রয়েছে। এবার মনে পড়েছে, অভিভূতের মত বলল সে। এই জায়গার গল্প অনেক শুনেছি আমি-এটাই সেই কিংবদন্তীর ‘মরমন কুয়া’।
আগুনে কাঠ দিচ্ছিল গিবন। বার্টের কথা শুনে সিধে হয়ে দাঁড়াল সে। খুঁটিয়ে চারদিক ভাল করে লক্ষ করে দেখল। শহরে, ক্যাম্পে যে-সব গল্প সে শুনেছে তার সাথে মনে মনে মিলিয়ে নিয়ে সে বলল, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে ঠিকই ধরেছ তুমি-সবই মিলছে।
আচ্ছা, লোকটা আমাদের এখানে কেন নিয়ে এল বলতে পারো? জিজ্ঞেস করল ক্লাইভ।
ইউজিন বোকার মত সবার মুখের দিকে একবার করে চেয়ে দেখে শেষে প্রশ্ন করল, মরমনের কুয়া আবার কী? আগে শুনিনি তো?
কেউ ওর কথার জবাব দিল না। বার্ট কুয়ার পাশটা ভাল করে ঘুরে দেখে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, বোকা লোকটা সত্যিই আমাদের পথ দেখিয়ে মরমনের কুয়ার কাছে নিয়ে এসেছে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি ব্যাটা এই ঘটনার কথা কিছুই শোনেনি।
গিবনের চোখে ঈষৎ কৌতুকের আভাস দেখা দিল। ক্লাইভের প্রশ্নেরই পুনরুত্থাপন করল সে। তা হলে লোকটা আমাদের এখানে কেন এনেছে?
লী তিক্ত স্বরে বলল, ওসব মরমন কুয়া-টুয়া গাঁজার আসরের গল্প।
তুমি কী জানো? খেপে উঠল বার্ট। তুমি বললেই হলো? ওই গুপ্তধনের বাক্স থেকে আনা এক খণ্ড সোনা আমি নিজের চোখে দেখেছি! নিজের হাতের তালু চিৎ করে খুলে আবার বন্ধ করল সে। এই হাতের মুঠোয় আমি ধরেছি তা। আমি বিশ্বাস করি এখান থেকে কয়েক মাইলের মধ্যেই সোনা রয়েছে। এত সোনা, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
সোনা? বিস্মিত ইউজিনের গলা দিয়ে মাত্র একটা শব্দই বেরুল।
গল্পটা তোমারই সবচেয়ে ভাল জানা আছে, গিবন, বলল ক্লাইভ। তুমিই শোনাও ওকে।
গল্পের সময় এটা নয়। তোমরা কি বুঝতে পারছ না জেকব ব্যাটার মতলব? আমরা যদি এখন সোনা খোজায় মন দিই তবে ওর কথা ভুলে যাব-এটাই সে চাইছে। সুন্দর কেটে পড়তে পারবে তা হলে।
গোপনে এই কুয়া খুঁজে বের করার লোভে এ-পর্যন্ত অন্তত ডজনখানেক লোক প্রাণ হারিয়েছে-আর ভাগ্যের ফেরে আমরা কিনা আজ খোদ জায়গা মত হাজির!
নিজের নিজের চিন্তায় সবাই ব্যস্ত। কেউ কথা বলছে না। নীরবতা ভঙ্গ করে বার্টই প্রথম কথা বলল। ঠিক আছে, আমরা পরেও আবার এখানে ফিরে আসতে পারব। জেকবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ফিরে আসব আমরা। ওর গলায় উৎসাহের। অভাব সুস্পষ্ট।
ক্লাইভ একটু নড়েচড়ে উঠল। একবার এই জায়গায় ছেড়ে গিয়ে কেউ আবার এটা খুঁজে পেয়েছে বলে শুনিনি আমি। যারা সোনা লুকিয়ে রেখে গেছিল স্বয়ং তারাও পায়নি। মরমনের কুয়া আজ পর্যন্ত আলেয়াই রয়ে গেছে।
একটু বুদ্ধি কেন খাটাও না?অস্থির উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল লী। সত্যিই যদি সোনা এখানে লুকানো থাকত তবে কি লোকটা সেটা নিজে না নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসত?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, বলল ইউজিন। এখানে কি কোথাও সোনা পুতে রাখা আছে?
বিজ্ঞের হাসি হেসে গিবন বলল, বোঝা যাচ্ছে জেকবের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এবার অনায়াসে পালাতে পারবে শয়তানটা।
তোমরা মানুষ, না আর কিছু? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লী। কল্পনার নাঙীন ফানুসের পিছনে ছোটার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ। ভুলেই গেছ যে জেকবকে ফাঁসিতে ঝুলাবার উদ্দেশ্যেই আমরা বেরিয়েছিলাম।
ভুলিনি, প্রতিবাদ করল ইউজিন। কিন্তু গল্পটা শুনতে দোষ কোথায়?
লী, কেলভিনের কথা তোমার মনে আছে? প্রশ্ন করল গিবন।
হঠাৎ ওর কথা তোমার মনে পড়ল কেন এখন?
এই এলাকাটা চিনত কেলভিন। অনেক বছর ধরে সে হারানো ওয়্যাগনগুলো খুঁজেছে এখানে। নাভাজো ইন্ডিয়ানদের চেয়েও ভাল করে চেনে সে এদিককার এলাকা। এটা মরমন কুয়া হলে ঠিক এইখানটায় হচ্ছে মার্শ-পাস। একটা গাছের চিকন ডাল দিয়ে বালিতে আঁচড় কেটে এঁকে দেখাল গিবন। শক্ত-পাল্লা জেকব পুবে কিংবা উত্তর-পুবে যেতে চাইলে তাকে এই মার্শ-পাস দিয়েই যেতে হবে। তা হলে ওকে নদীটা পার হতে হবে-আর নদী পার হওয়া এখানে মাত্র দু’টো জায়গাতেই সম্ভব। দু’টোই এখান থেকে আরও পশ্চিমে।
আমার মনে হয় দুই ফেরির মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে আমাদের ফাঁকি দিয়ে ঘুরে এসে কাছের ফেরি অর্থাৎ ফাদার্স ফেরিতেই নদী পার হবে সে, মন্তব্য করল লী।
লী-র কথায় বাধা দিতে গিয়েও চুপ করে গেল ইউজিন। লক্ষ করল গভীর মনোযোগের সাথে বালির উপর আঁকা ম্যাপটা দেখছে লী। যাই হোক, তাদের শিকার অত্যন্ত দুর্গম এলাকার দিকেই এগিয়ে চলেছে। অবশ্য কলোরাডো আর স্যান জুয়ান ক্যানিয়ন ওর পথ অনেকাংশে রোধ করবে।
সামনে এগিয়ে গিয়ে ওর পথ আটকালে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল ক্লাইভ।
এই এলাকায়? অসম্ভব! বলল গিবন। এখানে একবার ওর ট্রেইল হারালে সারা জীবনেও তা আর খুঁজে পাব না আমরা।
বলা যায় না, এবার মুখ খুলল ইউজিন। আমি ওই মাথার ক্লিপটার কথা ভাবছি।
ক্লিপ?
হ্যাঁ, বেছে বেছে যে ক্লিপটা সাথে এনেছে জেকব। বোঝাই যাচ্ছে পৃথিবী উল্টে গেলেও ক্লিপটা যার জন্যে আনা, তার সাথে দেখা করবেই ও।
চোখ তুলে ইউজিনের দিকে চাইল গিবন। ঠিকই বলেছ। বুদ্ধিমানের মত বেশ চমৎকার একটা নতুন লাইন বের করেছ তুমি!
সবার সামনে একটু ব্ৰিত বোধ করলেও মনে মনে খুশিই হলো সে। নতুন উদ্যম নিয়ে লী আর গিবন ঝুঁকে পড়ল ম্যাপটার উপর। মেয়েটাকে যদি এদিকে কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকে তবে অবশ্যই সে তার কাছেই যাবে প্রথমে। কিন্তু মাথা খারাপ না হলে কেউ নিজের প্রিয়তমাকে এই এলাকায় বেশিদিন একা ছেড়ে যাবার সাহস পাবে না।
আর কী করতে পারত সে?
সবাই চিন্তা করছে। মেয়েমানুষকে একা র্যাঞ্চে রেখে যাওয়ার অসুবিধাগুলো ওদের সবার ভাল করেই জানা আছে। তবে সুবিধা এই যে ওদের বন্ধু-বান্ধব আছে। কারও যদি বাধ্য হয়ে বৌকে একা রেখে কোথাও যেতে হয় তার প্রতিবেশী খোঁজ-খবর নেয়, দেখাশোনা করে। কিন্তু এই লোকের বেলায়। মেয়েটাকে কে দেখবে? কে তার সাহায্যে পাশে এসে দাঁড়াবে?
শেষ পর্যন্ত ওরা স্বীকার করে নিল যে শক্ত-পাল্লার মত তার প্রেমিকা বা স্ত্রীরও অসাধারণ আর স্বাবলম্বী হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
আমরা যখন ওর নাগাল পাব তখন সে একা নাও থাকতে পারে। হয়তো এই কারণেই সে মোটেও চিন্তিত নয়। হয়তো সে আমাদের একটা ফাঁদের দিকেই নিয়ে চলেছে। কে বলতে পারে?
গিবনের দিকে চাইল বার্ট। ওর মুখের ভাব বিমূঢ়। সবার মনেই একই চিন্তা-জেকবকে ফাঁসিতে ঝুলাতে বেরিয়েছে ওরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরাই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে কী? জেনেফারের কথা ইউজিনের মনে পড়ল আবার। এ কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল সে?
কিছুক্ষণ পরে লী বলল, শোনো, আমাদের অন্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করতে হবে। দেশে আইন আমাদেরই বজায় রাখতে হবে। তা যদি আমরা না পারি তবে শেষ পর্যন্ত কেউই রেহাই পাব না। অন্যায় আর অবিচার পায়ের নীচে পিষে মারবে আমাদের এক এক করে।
ইউজিন ভাবছে অন্য কথা। লোকটাকে তাড়িয়ে ধরায় আর তার মন নেই। সে ভাবছে অসংখ্য ওয়্যাগন ভর্তি তাল তাল সোনার কথা। ভাগ্যে যা আছে তা তো ঘটবেই-একটু কল্পনা বিলাসে ক্ষতি কী? অন্তত স্বপ্নে রসগোল্লা খাওয়ার মত, স্বপ্ন না ভাঙা পর্যন্ত তো ভাল লাগবে? তার নিজের ভাগের সোনা দিয়ে সে নতুন একটা বাড়ি বানাবে খুব সুন্দর করে-নতুন আসবাবপত্র থাকবে তাতে। কোন কিছুরই আর অভাব থাকবে না তাদের। জেনেফারের বাপ-দাদার কত করিৎকর্মা লোক ছিল, এসব কথাও আর মুখ বুজে শুনতে হবে না তাকে।
সুখ-স্বপ্ন দেখা শেষ করে ইউজিন বলল, ভাবছি আসলে জেকব লোকটা কেমন।
তাতে আর কিছু আসে যায় না এখন, জবাব দিল লী। আমার একমাত্র চিন্তা ওকে ফাঁসিতে ঝুলাব কী করে!
০৩. পানি থেকে উঠে পাড়ে দাঁড়িয়ে
পানি থেকে উঠে পাড়ে দাঁড়িয়ে দু’হাতে লম্বা সোনালী চুল পেঁচিয়ে চিপে পানি ঝরাচ্ছে মেয়েটি। ওর প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালন অপূর্ব ছন্দময়। গায়ে কাপড় নেই বলে মোটেই সঙ্কোচ বোধ করছে না। তার শুভ্র সুঠাম দেহ সকালের তাজা পরিবেশে অপূর্ব দেখাচ্ছে।
এমন সুস্থিরতার সাথে আগে তার পরিচয় ছিল না। জলপ্রপাতটাও যেন শব্দ না তুলে সন্তর্পণে জলাশয়ে পড়ে ছোট ছোট ঢেউ তুলে মিলিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গীত; হা, সঙ্গীতকেই সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে তার। এখানে একমাত্র ওটারই অভাব। বহুদূরে তার আগৈকার জীবনের সাথে সঙ্গীত বিসর্জন দিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এখন নতুন করে আবার শুনতে শিখেছে সে তার মনের মানুষের কাছে।
শোনো, ডালিয়া, বলেছিল সে। শোনার মত মন থাকলে বাতাসই তোমার জন্যে বাজাবে, গাইবে।
সবচেয়ে ভাল শোনা যায় কোন মালভূমির ওপর-স্কেলিটন মেসা বা টল মাউন্টেনের ধারে। ক্যানিয়নে আছে আর এক ধরনের গীত। বাতাস বইলে সাথে বয়ে নিয়ে আসে সীডার বা সেজ-এর হালকম সুগন্ধ-আবার কখনও বা শুধু একটা গরম ভাপ
ওর মনে হয় এখানকার প্রতিটি আনাচ-কানাচের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। না, তার স্মৃতি নয়-সে তো মাত্র ইদানীং এসেছে এই নগ্ন নির্জন পাথুরে এলাকায়। তার প্রিয়তমের স্মৃতিও নয়। বহুঁকাল আগে এখানে যারা বাস করত তাদেরই স্মৃতি যেন লুকিয়ে আছে ক্যানিয়নের খাড়া দুর্গম দেয়ালগুলোর খাঁজে খাজে। কেমন যেন একটা অজানা টান অনুভব করে সে। আচ্ছা, তার এই অদ্ভুত অনুভূতির কথা জানলে ও কী বলত?
একটা নিছক পাগলামির বশে সে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একজন লোকের হাত ধরে চলে এসেছে এই বিজন মরু এলাকায়। ঝড়ের রাতে ঝড়ের মতই সে এসেছিল তার জীবনে। কামরায় ঢুকে একবার তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে তাকে নিজের বলে দাবি করেছিল।
কে তুমি? সেই রাতে প্রশ্ন করেছিল ডালিয়া।
বিন্দুমাত্র কাঁপেনি তার চোখ। ডালিয়ার চোখে চোখ রেখে সে জবাব দিয়েছিল, বোকার মত প্রশ্ন হলো-দু’মিনিট আগেই তুমি জেনেছে আমি কে।
আমি কী করব তাও তুমি জানো।
আর আমি?
আগামীকাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। বলেছিল সে, প্রথম সুযোগেই ধর্মীয় মতে গির্জায় বিয়ে হবে আমাদের।
ডালিয়ার খুব কাছ ঘেঁষে আগুনটার দিকে এগিয়ে গেল জেকব। ওর বাকস্কিনের জামা থেকে সীডার, পাইন আর ঘোড়ার গায়ের মিশ্র একটা গন্ধ অজানা ডাক দিয়ে এল ডালিয়ার কাছে।
আগুনে শক্তিশালী তামাটে রঙের হাত দুটো গরম করছে জেকব। নিকোলাস লক্ষ করছে ওকে খুদে খুদে সাপের মত ঠাণ্ডা চোখে। ভয়ে ডালিয়ার বুকের ভিতরটা টিপটিপ করছে।
দুশ্চিন্তা তার নিজের জন্য নয়। আগন্তুক নিকোলাসের স্বরূপ দেখিনি বলেই তার এই ভীতি। পশ্চিমে এসে পৌঁছবার আগে সে-ও নিকোলাসকে ঠিক চিতে পারেনি
এগিয়ে গিয়ে নিকোলাসের সাথে বসল ডালিয়া। এই লোকটাকে বিয়ে করবে বলেই সে পশ্চিমে এসেছে। কিন্তু বারবারই তার চোখ ঘুরে ফিরে গিয়ে পড়ছে আগুনের পাশে দাঁড়ানো অপরিচিত আকর্ষণীয় পুরুষটার উপর। দুচোখ ভরে কেবল ওকেই দেখছে ডালিয়া
পিছন থেকে কে যেন কাকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে?
আগে দেখিনি কোনদিন। ওর ঘোড়ায় দাঁড়িপাল্লার মার্কা রয়েছে। সেটাও এখানে অপরিচিত।
আবার চোখ তুলে লোকটার দিকে চাইল ডালিয়া। মেয়েটির চোখে দম আটকানো পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুল মিনতি দেখতে পেল জেকব
বলিষ্ঠ শক্তি-প্রাচুর্যে ভরা জেকবের গড়ন। নিজের দেশে অনেক সমর্থ পুরুষ দেখেছে ডালিয়া। চিনতে ভুল করেনি সে। নিকোলাসের মত বিশাল না হলেও লোকটার যে পেটা শরীর তাতে সন্দেহ নেই।
কামরায় মোট নয়জন মানুষ। ডালিয়াকে নিয়ে তিনজন মহিলা, আর বাকি সবাই পুরুষ। কিন্তু সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ডালিয়া! অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা ও দৈহিক কাঠামোর অধিকারিণী সে। নিজের দেশ হাঙ্গেরিতে ঘোড়া চালিয়ে আর স্কি করে স্বাস্থ্য অটুট রেখেছে মেয়েটা।
নিজেকে সে ভাল করেই জানে; চেনেও। কিন্তু ভাগ্যে যে কী আছে জানা নেই তার। নিজ দেশের সাথে এদেশের রীতি-নীতির আকাশ পাতাল তফাৎ। অত্যন্ত সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে ডালিয়া-অথচ এখানে সেটা কত অবান্তর!
তার বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। পারিবারিক মর্যাদা ছাড়াও নিজের যোগ্যতায় তিনি ছিলেন সম্মানীয়। অথচ আজ ডালিয়ার কারণেই তিনি মৃত।
লোকটার সাথে প্রথম তার দেখা হয় ভিয়েনায়। এবং পরে আবার প্যারিসে। প্রেমে পড়ে যায় ডালিয়া। মানে ক্ষণিকের মোহকেই সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। লোকটা যে বিবাহিত তা জানত না সে। ওর সম্পর্কে একটা অপমানকর উক্তি লোকটা করেছিল। সেটা বাবার কানে যেতেই তিনি তাকে ডুয়েলে আহ্বান করেন এবং ওই লোকটার হাতেই নিহত হন।
এরপরেই ডালিয়া ইউরোপ ছাড়ে। আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, সমাজ সবকিছু ছেড়েই পালিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু পালিয়ে আসার আগে শেষবারের মত একবার তার প্রেমিকের সাথে দেখা করেছিল।
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে তাকে ঘরে একাই পেয়েছিল ডালিয়া। কাবার্ড থেকে গ্লাসে মদ ঢালছিল সে। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠেছিল, ‘ডালিয়া!’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু ডালিয়া হাত তুলে তাকে থামিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল।
তার চোখে চোখ রেখে ডালিয়া বলেছিল, তোমার ভাগ্য ভাল। আমার কোন ভাই থাকলে সে তোমাকে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে পিটিয়ে শায়েস্তা করত। বাবার বয়স হয়েছিল হাত কাঁপত তার।
ডালিয়া! বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি তার।
কিন্তু আমার হাত কাপবে না, বলে সে ধীরে ধীরে হাতের পিস্তলটা তুলে তাক করে গুলি করল। তারপর তার মৃতদেহের পাশে পিস্তলটা ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল।
পরিচিত এক জেলের নৌকায় ডেনমার্কে পৌঁছে ডালিয়া-সেখান থেকে সোজা আমেরিকায়।
পুবের একটা শহরে নিকোলাসের সাথে পরিচয় হয় তার। হাঙ্গেরিয়ান ভাষা জানে নিকোলাস। অল্প আলাপেই ডালিয়া কেমন ঘরের মেয়ে বুঝতে পেরে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সে। টাকা পয়সা ফুরিয়ে আসছিল ডালিয়ার, তাই বিয়ের প্রস্তাবে সে আপত্তি করেনি। কথা ছিল নিকোলাস পশ্চিমে এসে একটু গুছিয়ে নিয়েই তাকে ডেকে পাঠাবে। সে এলেই ওদের বিয়ে হবে। জেকবের আকস্মিক উপস্থিতি ওদের সব পরিকল্পনা বানচাল করে দল।
.
নিচু আর লম্বা ঘরের শেষ মাথায় ফায়ার-প্লেস। মাঝখানে ছোট একটা বার। সাথেই লাগানো দুটো কামরায় বিছানা পাতা। একটা মেয়েদের অন্যটা পুরুষের
জেকবের পিঠের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিকোলাসের সাথে চোখাচোখি হলো ডালিয়ার। ওর চোখে এই দৃষ্টি সে আজ দুপুরেই দেখেছে-এখানে সে। পৌঁছবার অল্পক্ষণ পরেই। দুপুরে সে মুঠোয় লোহার আংটা পরে নিজের ঘোড়াটাকে বেঁধে নির্দয় ভাবে পিটিয়েছে। তখনও তার চোখে এই ভাবটাই ফুটে উঠেছিল।
আগুনের পাশ থেকে সরে বারে গিয়ে দাড়াল জেকব। ডালিয়ার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জেকবের দিকে চাইল নিকোলাস। ডালিয়ার মনে হলো যে সে আগন্তুকের সাথে কথা বলবে।
হুঁ, লোকটাকে তা হলে তোমার মনে ধরেছে? ভেঙচি কেটে বলল নিকোলাস। ঠুনকো লোক, কোন চাল-চুলো নেই।
চুপ করে রইল ডালিয়া। ওর নীরবতায় নিকের রাগ আরও বেড়ে গেল।
তোমাকে ঘরে তোলার পর একটু দুরস্ত করে নিতে হবে দেখছি! যাক, আমার কিছুটা আনন্দের খোরাকই হবে সেটা।
তোমার সাথে আমি নাও যেতে পারি!
হেসে উঠল সে। ঠিকই যাবে। আমাকে বিয়ে করতেই এসেছ তুমি। এখানে এমন কোন লোক নেই যে আমাকে বাধা দেবে। কারও সাধ্যি নেই ঠেকায়
বড় বড় নীল চোখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিকোলাসের দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় সে বলল, সাহায্যের দরকার হবে না আমার। নিজেরটা নিজেই সামলাতে জানি আমি।
তুমি? হো হো করে হেসে উঠল নিক। ভাবটা এমন যে ডালিয়া রসিকতা করছে তার সাথে।
নীরবে ওর দিকে একটু চেয়ে থেকে উঠে ফায়ার-প্লেসের দিকে রওনা হলো সে। আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পিছন থেকে ডালিয়াকে ধরে ফেলল নিক। ওকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চড় তুলল সে।
ছেড়ে দাও ওকে।
শূন্যেই থেমে গেল হাত-ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিল নিক। চোখ দু’টো খুনের নেশায় জ্বলছে। জেকব ওর দিকে ফিরে দাঁড়াল। এতক্ষণে নিকোলাস টের পেল কথাটা জেকব বলেনি-বলেছে স্টেজ স্টেশনের ম্যানেজার।
শুকনো পাতলা চেহারা। বয়স হয়েছে লোকটার। সারা মুখে ওর চোখ দু’টোই কেবল জীবন্ত। বারে রাখা শটগানের উপর রয়েছে ওর একটা হাত।
তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছ!
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি আমি-এই ঘরে কেউ কোনদিন কোন মহিলার সাথে দুর্ব্যবহার করেনি-তোমাকেও অভদ্র হতে মানা করছি।
অবজ্ঞার সাথে কাঁধ ঝাঁকাল নিক। এখানে সারা রাত থাকবে না মেয়েটা। এখনই ওকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি আমি।
নিকের উপর সতর্ক নজর রেখেই ডালিয়ার উদ্দেশে ম্যানেজার বলল, স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে জোর করে কেউ তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না-ভয় নেই। লোকটা কি তোমার স্বামী?
না।
ওকেই জিজ্ঞেস করো সে এখানে কেন এসেছে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল নিক।
ওকেই বিয়ে করতে এসেছিলাম আমি। তখন জানতাম না সে কেমন। আজ দুপুরে ওকে নির্দয় ভাবে নিজের ঘোড়াকে পেটাতে দেখে বুঝলাম ভবিষ্যতে হয়তো আমার গায়েও হাত তোলার চেষ্টা করতে পারে।
চেষ্টা!
হ্যাঁ, চেষ্টা তুমি করবে জানি। কিন্তু তার আগেই আমার হাতে খুন হয়ে যাবে!
ঘরের সবাই নীরব। কথাটা ডালিয়া যেভাবে বলল তাতে উপস্থিত কারও মনে সন্দেহ রইল না কথাটা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করবে সে।
পরের কথাগুলো নিকোলাসের দিকে চেয়ে বললেও আসলে কথাটা বাকস্কিনের জ্যাকেট পরা লোকটার উদ্দেশেই বলা। তোমাদের দেশে আমি নতুন; জীবনে কোনদিন আমাকে দুঃখ কষ্ট পেতে হয়নি, কিন্তু কেউ যদি আমাকে ভালবাসে, আমার সাথে মার্জিত নম্র ব্যবহার করে-তার জন্যে আমি সব রকম কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি। কিন্তু তুমি সেই লোক নও, নিকোলাস।
বারৈ দাড়ানো লোকটা নড়ে উঠল। মাথা থেকে হ্যাটটা নামিয়ে সে শান্ত স্বরে বলল, তুমি আমার সাথে এলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব আমি। এখান থেকে ষাট মাইল পশ্চিমে গির্জায় ধর্মীয় মতে আমদের বিয়ে হতে পারে।
পরস্পরের দিকে চেয়ে দু’জনে নীরবে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর জবাব দিল ডালিয়া, আমি যাব তোমার সাথে। সকালেই তোমার সঙ্গে রওনা হব আমি।
মুখ খুলতে গিয়েও আবার চুপ করে গেল নিকোলাস। তারপর হঠাৎ ঘুরে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে।
স্টেশন ম্যানেজার বন্দুকটা চোখের আড়ালে যথাস্থানে রেখে দিয়ে জেকবকে বলল, যোগ্য সাথী পেয়েছ তুমি। তবে ওকে দেশটাকে জানার কিছু সুযোগ দিয়ো।
একটু অপ্রস্তুত হয়েই তাড়াতাড়ি ডালিয়ার দিকে এগিয়ে গেল জেকব। ঘরের সবাই মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে ওদের জন্য যথাসম্ভব নির্জনতার সুযোগ করে দিল।
অন্য এলাকায় জমির খোঁজে চলেছি আমি, বলল সে। আমার কোন র্যাঞ্চ নেই, বাড়িও নেই। অনেক দূরে একটা জায়গা দেখেছি, একজনের পক্ষে ওখানে নতুন করে ঘর বাঁধা সম্ভব।
ঠিক আছে।
জিনিসপত্র সব সাথে আছে তোমার?
হ্যাঁ, হাতের ইশারায় ঘরের কোণে রাখা মালপত্র দেখাল ডালিয়া। অনেক জিনিস। অসুবিধা হবে? স্বভাবজাত কৌতূহলবশেই ঘরে উপস্থিত মেয়ে দুটো ওদিকে চাইল। ঘরের এক কোণে রাখা রয়েছে অত্যন্ত দামী ছোট একটা ট্রাঙ্ক, সাথে আরও জিনিসপত্র রযেছে-প্রত্যেকটাই মূল্যবান।
ব্যবস্থা হয়ে যাবে, জবাব দিল জেকব।
.
স্টেশন ম্যানেজার এই দেশটাকে ভালমত বুঝে দেখার জন্যে, তোমাকে কিছুটা সময় দিতে বলেছিল-উপদেশটা খারাপ নয়।
সময় সে দিয়েছে। অবশ্য এতটা অপরিচিত নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময়ের দরকারও ছিল ডালিয়ার। এখানকার সবকিছুই নতুন। এমনকী এখানকার নগ্ন পাহাড়গুলোও তার দেশের পাহাড়ের মত নয়।
ওদেরও কিছুটা সময় দাও, বলেছিল জেকব। দেখবে ধীরে ধীরে ওরাও তোমারই একটা অংশ হয়ে উঠেছে।
কেবল ওর জিনিসপত্র বইবার জন্যই জেকবকে তিনটে গাধা কিনতে হয়েছে তবে এজন্য তার মধ্যে কোন বিরক্তি দেখা যায়নি। বরং খুব সাবধানতার সাথেই এক এক করে গাধার পিঠে সব মাল তুলেছে সে।
ইচ্ছা করলে ওগুলো ফেলে দিতে পারো তুমি, বলেছিল ডালিয়া। ওর প্রতি আমার কোন মোহ নেই। ওই জীবনটা পিছনে ফেলে এসেছি আমি।
ওগুলো তোমারই, নরম কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল জেকব। কিছু কিছু স্মৃতি সাথে থাকা ভাল।
কোন বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একটা ছোট শহরে বিয়ে হলো ওদের। একজন স্বল্পভাষী নিষ্ঠাবান ধর্মযাজক তাদের বিয়ে পড়ালেন। একত্রে নয়, পাশাপাশি শুয়ে রাতটা কাটাল ওরা।
পরদিন সকালে ওরা আবার রওনা হলো। ডালিয়া খেয়াল করল জেকব বারবার পিছন ফিরে চাইছে।
কাউকে আশা করছ নাকি তুমি? প্রশ্ন করল সে।
এই দেশে যে-কোন সময়েই অপ্রত্যাশিত অতিথি কেউ আসতে পারে বা কোন ঘটনা ঘটতে পারে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
লম্বা যাত্রা ক্লান্তিকর হলেও ডালিয়ার উদ্যম কমেনি। তৃতীয় দিনের পর ক্লান্তিও আর অনুভব করছে না সে।
ক্যাম্পিং সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে ওর। তবু জেকবের প্রতিটি কাজে সে বুঝতে পারছে ক্যাম্পিং-এ কীরকম অসাধারণ পটু সে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রকাশ পাচ্ছে ওর প্রতিটি কাজে-অথচ যেন দৈনন্দিন রুটিন, এমনি সহজভাবে সে তা করে চলেছে।
চতুর্থ দিন আগুন জ্বেলে ওপাশে,ডালিয়ার দিকে চেয়ে সে বলল, একদিন আমাদের খোঁজে কেউ আসবে বলে আশা করছি আমি।
অপেক্ষা করে রইল ডালিয়া। বাড়তি কথা বলার শিক্ষা সে পায়নি।
নিকোলাস আসবে, বলল সে।
নিকোলাসের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ডালিয়া। হঠাৎ বুকের ভিতরটা ঘঁাৎ করে উঠল ওর। ভয়টা মোটেও অহেতুক নয়। ইদানীং নতুন দেশ আর জেকবকে ঘিরেই কেবল চিন্তার জাল বুনেছে। লোকটাকে কিছুটা যেন বুঝতে পারে সে এখন-হয়তো কিছুটা ভালও বেসে ফেলেছে।
তুমি জানতে চাইলে না কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তোমার সাথেই তো যাচ্ছি আমি?
কয়েকটা কাঠ আগুনে চাপিয়ে দিয়ে সে বলল, নাভাজোরা ছাড়া আর কেউ কখনও যায় না ওখানে।
ওরা ইন্ডিয়ান না?
মাথা ঝাঁকাল সে। অনেক আগে, হয়তো কয়েকশো বছর আগে ওখানে অন্যান্য আরও ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল। ক্লিফের ওপর ওদের বাড়িঘর এখনও দেখা যায়। কিন্তু কেন জানি না-ওই এলাকা ছেড়ে সবাই ওরা চলেছে গেছে।
ওখানে তুমি কী করবে?
যখন সঙ্গতি হবে কিছু গরু-মহিষ পালব। একটা ঘর বানাব; আমাদের দু’জনের জন্যে।
অনেক জ্ঞানীগুণী শিক্ষিত লোকের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে ডালিয়ার, কিন্তু জেকবের মত সহজে গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে আর কাউকে দেখেনি।
কী করে যেন সে বুঝে ফেলল ডালিয়া কী ভাবছে। কিন্তু নিজের মনোভাব বুঝতে না দিয়ে বলল, এই দেশে যাদের সাথে তোমার পরিচয় হবে, তাদের ভুল বুঝো না। তারা তোমার নিক্তিতে না হলেও এখানে বাঁচার জন্যে যে সব শিক্ষা দরকার তা তাদের আছে। কেউ কেউ আবার প্রচুর ঘুরে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। আমি একজন লোকের সাথে মহিষ শিকার করেছি-সে ছিল গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একজন সোবোনের গ্র্যাজুয়েটের সাথে পাশাপাশি যুদ্ধও করেছি আমি-কিন্তু মজার কথা কি জানো? ওরা দুজনেই পশ্চিমা লোকের মত কাউবয়দের ঢঙেই কথা বলত।
ট্রেইল ছেড়ে আরও দুর্গম, নির্জন মরু এলাকা আর ক্যানিয়নের ভিতর দিয়ে যাবার পথে ডালিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় সে আমাদের আর খোঁজ পাবে?
আজ হোক, কাল হোক, পাবেই, জবাব দিয়েছিল ও।
কতদিন আগের কথা সেটা? বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে-সময়ের হিসাব আর রাখে না সে। এখানে সেটা যেন অর্থহীন।
.
পানির ধারে দাঁড়িয়ে গা মুছে এক এক করে জামা কাপড় পরে নিল ডালিয়া। জেকবের দেওয়া উইনচেস্টারটা তার পাশেই রাখা।
তুমি গুলি ছুড়তে জানো? প্রশ্ন করেছিল সে।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিয়েছিল ডালিয়া। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ভয় কোরো না, কোথায় লাগাতে হবে না দেখে আমি গুলি করি না-যখন করি তখন সেটা জায়গা মতই লাগে।
দুদিন পরে সে ঘোড়ায় চেপে চলে গিয়েছিল।
যাবার আগের মুহূর্তে সে বলেছিল, যদি আমার কিছু হয়, ফিরতে না পারি, এখান থেকে বেরিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে যেয়ো। অনেক পথ যেতে হবে, কিন্তু ট্রেইল ধরে গেলে প্রেসকটের সাইনপোস্ট দেখতে পাবে।
ঠিক আছে, বলেছিল সে। তারপর তার বড় বড় নীল চোখ ওর চোখে রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কতদিন অপেক্ষা করব?
অন্তত দুই সপ্তাহ। ওই সময়ের মধ্যে বেঁচে থাকলে আমি হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এসে হাজির হব।
আজ পনেরো দিন হলো সে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে মাঝেমাঝে এখানেও সময়ের হিসাব রাখার দরকার পড়ে।
০৪. জায়গাটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে
জায়গাটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে এসে রাশ টেনে ঘোড়াটাকে থামাল লী। গতরাতে যে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ওরা এপাশে পৌঁছেছে, সেটা বিশাল দেয়ালের মতই দাঁড়িয়ে আছে ওদের পিছনে। অবিচ্ছিন্ন ভাবে মাথা উঁচু করে একটানা উত্তরে এগিয়ে গেছে ওটা। পুবের এবড়োখেবড়ো জমির ওপর বুটি-বুটি সীডারের ঝোঁপ দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণে যেখানে সীডারের ঝোঁপ শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বালুর ঢিবির সারি।
তোমার কী মনে হয়? লোকটা ক্লিফ ঘেঁষে উত্তর দিকে গিয়ে পাহাড় পেরিয়ে ফিরে যায়নি তো? প্রশ্ন করল বার্ট।
পাহাড় ফুড়ে যাবার উপায় ওর জানা থাকলে অবশ্য অন্য কথা, বলল লী। তবে যে পথ দিয়ে আমরা এসেছি সেদিক দিয়ে যে সে যায়নি, আমি শিওর। ভোর হতেই আমি ওদিকটা দেখে এসেছি। ওর ফেরার কোন চিহ্ন নেই ওখানে।
ইউজিন এখনও কম্বল ছেড়ে ওঠেনি। গতরাতে ভাল ঘুম হয়নি তার-চোখ বুজলেই কেবল জেনেফারের চিন্তিত মুখটা বারবার ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়।
এলাকাটা একেবারে শুকনো, বিজন। আজ সকাল থেকে আকাশে একটা শকুন ছাড়া আর কোন প্রাণের সাড়া ওদের নজরে পড়েনি। শকুনটা মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে হয়তো তার সম্ভাব্য ডিনার হিসাবেই চিহ্নিত করে গেল ওদের।
আজ সকালে বিভ্রান্ত বোধ করছে ওরা। যাকে তাড়া করে এতদূর এসেছে। তার ট্রেইল এখানে হারিয়ে গেছে। এখন লী আর গিবনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা। করছে সবাই।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গিবন তার মত প্রকাশ করল। একটা ভাগ্যের জুয়া খেলতে হবে আমাদের, লী। লোকটা রেড-ইন্ডিয়ানদের মতই চতুর আর সাবধানী। ও যদি দক্ষিণে গিয়ে থাকে তবে আর ওর চিহ্ন খুঁজে পাব না আমরা। ওই বালুর টিবিগুলো বাতাসে সর্বক্ষণ সরে সরে যাচ্ছে। ওখানে ঘোড়ার পায়ের ছাপ বাতাসে খুব অল্প সময়েই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জুয়ার কথা কী বলছ?
ও যে কোনদিকে গেছে সেটা আন্দাজ করে নিয়ে ছুটে এগিয়ে গিয়ে ওর পথ রোধ করে দাঁড়াতে হবে।
আর আমাদের আন্দাজ ভুল হলে?
তা হলে উপায় নেই-ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে হবে।
মনস্থির করে ফেলল লী। আমরা সোজা ফাদার্স ফেরির দিকে যাব। ওখানে যদি শিগগিরই ওর দেখা না পাই, তা হলে ভাটির দিকে অন্য ফেরিতে ওকে খুঁজতে যাব।
লী পথ দেখিয়ে দেখিয়ে আগে আগে চলল। পথে জেকবের কোন চিহ্ন ওদের চোখে পড়ল না।
পরদিন ফেরিঘাটে পৌঁছেও জেকবের কোন পাত্তা মিলল না।
ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, বলল ক্লাইভ। ব্যাটা আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ভেগেছে।
অসম্ভব! বলল লী, ওকে যেমন করে তোক রতেই হবে-পালাতে দেয়া চলবে না।
সে যা-ই হোক এখন ঝটপট অন্য ফেরিতে পৌঁছে কিছু খেয়ে না নিলে উপোস করেই আমাদের মরতে হবে, মন্তব্য করল গিবন।
আমিও এ-ব্যাপারে একমত, কথাটা সমর্থন করে একসাথে বলে উঠল ইউজিন আর ক্লাইভ।
দক্ষিণে রওনা হলো ওরা। নদী থেকে বেশ একটু দূর দিয়েই এগোবে ওরা। তাতে নদীর বাঁকে বাঁকে ঘোরা পথে না চলে সোজা পথে এগোতে পারবে। গিবন। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড নাভাজো পাহাড় মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। ওই পাহাড়ের মাথা থেকে প্রায় গোটা দেশটাই দেখা যায়, বলল সে।
.
নাভাজো পাহাড়ের চূড়ায় শুয়ে দূরবীন চোখে লাগিয়ে একে একে ছয়জনকে দেখল জেকব। অন্য ফেরির উদ্দেশে রওনা হলো ওরা! সন্দেহ নেই ওখানে ওরা খাবার আর অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করবে। কিন্তু নিজের খামারের ক্ষতি করে কতদিন বাইরে কাটাতে পারবে ওরা?
ওদের উপর নজর রেখে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বোঝাই যাচ্ছে, তার ট্রেইল হারিয়ে ফেলেছে ওরা। ডালিয়াকে সে যে ক’দিন সময় দিয়ে এসেছিল তা পেরিয়ে গেছে। এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে রয়েছে ডালিয়া। একা একা মেয়েটা কী করছে কে জানে? এই এলাকার কিছুই চেনে না সে, তবু তার কথামত একা একাই সে পথে বেরিয়ে পড়েছে কি?
খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে ‘ওয়ার গড’ ঝর্ণায় নিজের বোতলে পানি ভরে ঘোড়াটাকে পানি খাইয়ে নিল জেকব। পাহাড় থেকে কিছুটা নেমে মালভূমি ধরে দক্ষিণ-পুবে এগোল সে। প্রথম বারো মাইল নির্বিঘ্নেই কাটল। পিউটে পাহাড়ে বিকেলের সূর্য যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
পুরোনো একটা ইন্ডিয়ান ট্রেইল ধরে এসেছে জেকব।
ঘোড়াটা অবসন্ন হয়ে পড়েছে, সে নিজেও খুব ক্লান্ত-তবু এগিয়েই চলল। খুরের চিহ্ন লুকাবার জন্য সোজা রাস্তায় না গিয়ে এবার বন্ধুর পাথুরে পথ বেছে নিল সে। আকাশে চাঁদ উঠতে উঠতে টল মাউনটেন-এর ধারে পৌঁছে গেল জেকব।
ষোলো দিনের দিন ঘোড়ায় চড়ে দু’টো ক্যানিয়নের সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়াল ডালিয়া। অন্ধকারে ঘোড়ার পিঠে বসেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে সে। তার মাথার উপর একটা বাদুড় চক্কর দিচ্ছে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনার জন্য উত্তর্ণ হয়ে আছে সে।
মনের গভীরে তার স্থির বিশ্বাস জেকব আসবেই। কখনোই সে ধোকা দেবে তাকে। প্রথমে একটু সন্দেহ ছিল-অন্ধকার নেমে আসার পর সেটা দূর হয়ে গেছে-আর ভয় করছে না তার। এখন সে স্থির নিশ্চিত, যদি জেকব না ফেরে, তার মানে হয়তো নিকোলাস তাকে খুঁজে পেয়েছে। অথবা আর কিছু ঘটেছে।
নিকোলাস যে ওদের পিছু নেবেই এতে কোন সন্দেহ নেই তার। লোকটার শিরায় শিরায় রয়েছে হিংসা আর জিদ। সে আসবে। আর এলে লোক-লস্কর নিয়েই আসবে।
শেষ পর্যন্ত আজও নিরাশ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। জিন নামিয়ে ঘোড়াকে খেতে দিল ডালিয়া।
কয়েক ঘণ্টা পরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল সে। তার ঘোড়াটাই শব্দ করে ডেকে উঠেছে। তাড়াতাড়ি জেকবের দেওয়া রাইফেলটা হাতে তুলে নিল ডালিয়া। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থেকে খুরের শব্দ শুনতে পেল সে। রাইফেলটা উত্তেজিত ভাবে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করছে ও। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে-বুকের ভিতরটা টিপ ঢিপ করছে।
হঠাৎ লোকটার গলা কানে এল। ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে দিয়ে সে বলছে, শাবাশ বেটা, বাড়ি পৌঁছে গেছি আমরা।
আনন্দের আতিশয্যে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল ডালিয়া।
০৫. কালো একটা ঘোড়ায় চড়ে
কালো একটা ঘোড়ায় চড়ে স্কেলিটন মেসার উপর উঠল জেকব। ক্লিফের পুব দিকের উঁচু জায়গায় পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামল সে। এখানে কোন চূড়া নেই, কিন্তু জায়গাটা যথেষ্ট উঁচু। এখান থেকে ক্যাসেল বুটের উপত্যকা, মার্শ-পাস আর বালির ঢিবিগুলো অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। দূরবীন বের করে নিয়ে অপেক্ষায় বসল সে।
দিনের আলো এখনও ফোটেনি। একটু ধোঁয়া, বা ধুলো ওড়া, কিংবা কোন ধাতুর উপর সকালের আলো পড়ে একটু ঝিলিক দিয়ে ওঠা-এই ধরনের কিছু একটা দেখার আশাতেই সে এখানে এসেছে আজ। কিন্তু আসলে ওসব কিছু দেখতে না পেলেই খুশি হবে-নিঝঞ্ঝাটেই থাকতে চায় সে।
একঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অনেক কিছুই তার চোখে পড়ল। অনেক দূরের ইকো ক্লিফ ধীরে ধীরে সোনালী রঙ নিল, থিফ রক এখনও আঁধারে-সূর্যের আলো যেন পৌঁছতে পারছে না ওখানে।
একটা চিল…একদল বুনো ঘোড়া…কয়েকটা তিতির পাখি। কিন্তু কোন ঘোড়সওয়ার বা মানুষ তার নজরে পড়ল না।
দূরবীন খাপে ভরে ডালিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে ফিরে চলল জেকব। মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলেনি ওকে। প্রথম দর্শনেই জেকবের মনে হয়েছিল ডালিয়ার জন্মই হয়েছে তার প্রেয়সী হবার জন্য।
কেউ কোথাও নেই, ডালিয়ার সপ্রশ্ন দৃষ্টির জবাবে বলল জেকব। মনে হয় ওরা বাড়ি ফিরে গেছে।
ওরা কি আবার আসবে?
মনে মনে ভেবে দেখল সে। বালির ঢিবির পিছনে শুয়ে কাছে থেকে দেখা মুখগুলো ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। হাওদের মধ্যে অন্তত একজন আসবেই।
অখণ্ড অবসর ওদের-চারদিকে নজর রাখার জন্য অবশ্য এর মাঝেও প্রত্যেকদিনই দুবেলা একবার করে জেকবকে মেসার উপর যেতে হয়। বাকি সময়টা দু’জনে কপোত-কপোতীর মত গল্প করে কাটায়। চাষ করা যাবে এমন একটা ছোট জায়গার কথা একদিন কথায় কথায় উল্লেখ করল ডালিয়া। শহর থেকে খাবারের সাপ্লাই আনতে পারেনি জেকব। জমানো খাবার কমে আসছে-কোমর বেঁধে লেগে গেল সে। এক সপ্তাহের মধ্যেই জমিটা পরিষ্কার করে কুপিয়ে তাতে বীজ বুনে ফেলল। বড় মাটির দলগুলো ভেঙে গম, শিম, বরবটি, আর মটর বুনতে ওকে সাহায্য করল ডালিয়া।
অন্য কোনখান থেকে খাবার আনতে হলে আবার ডালিয়াকে একা রেখে বেরুতে হবে তাকে। উপায় থাকলে সে আর তা করতে চায় না। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনুসরণকারী দলটাকে ফ্রীডমে ফিরতে দেখল নিকোলাস। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে একে একে ঘোড়া থেকে নেমে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেবার জন্য সেলুনে ঢুকল ওরা।
বারটেন্ডার ফ্রেড পিছনের ঘর থেকে বিশেষ উপলক্ষে তুলে রাখা একটা বোতল বের করে এনে ওদের সামনে রাখল। চেহারা দেখেই যাত্রার ফলাফল আঁচ করে নিয়েছে সে।
পালিয়ে গেছে, সবার পক্ষ থেকে লী জানাল। স্রেফ ফাঁকি দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে লোকটা
তবে রসদের জন্যে একদিন না একদিন ওকে আবার ফিরতেই হবে, নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার চেষ্টা করল কীথ।
ওদের পিছন পিছন নিকোলাসও বারে এসে ঢুকেছে। বারে হেলান দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছে। জেকবের পিছু নিয়ে ওকে অনুসরণ করেই এই শহরে পৌঁছেছে সে। এখানে গোলাগুলি, ডেরিকের মৃত্যু ইত্যাদি সব ঘটনাই শুনেছে।
লোকটা কোথায় অদৃশ্য হয়েছে জানো? উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য একটু থামল ক্লাইভ। মরমন কুয়ার কাছে!
বারের পিছনে একটা গ্লাস পালিশ করছিল ফ্রেড। কথাটা শুনে কাজের মাঝেই হাত থেমে গেল ওর। মরমন কুয়ায়?!
হ্যাঁ। আমাদের পথ দেখিয়ে ওই পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে হঠাৎ হাওয়া হয়েছে লোকটা।
বেশি ফটফট করা তোমার একটা বদ-অভ্যাস, ওকে বকল বার্ট। ক্লাইভের এমন করে হাটে হাঁড়ি ভাঙাটা মোটেও পছন্দ হয়নি তার।
মরমন কুয়া-ওটাই তো হারানো সোনার ওয়্যাগনগুলোর চাবিকাঠি। কথা বলতে বলতে বারে কনুই রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল ফ্রেড। তোমরা তো রাতারাতি বড়লোক হয়ে যেতে চলেছ। কবে ফেরত যাচ্ছ ওখানে?
সত্যি কথা বলতে কি, নিজের গ্লাসটা বারের উপর নামিয়ে রাখল ক্লাইভ। আমরা এখনও…’
তোমরা তা হলে লোকটাকে পালাবার সুযোগ দিচ্ছ? ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল নিকোলাস।
এতক্ষণে অপরিচিত লোকটার দিকে চোখ পড়ল সবার। লী ছাড়া আর সবাই বোকা বনে গেছে এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে। কর্কশ স্বরে লী জবাব দিল, কক্ষনো না। দরকার হলে নরক পর্যন্ত ওকে ধাওয়া করে যাব-কিছুতেই ওকে ছাড়ব না আমি।
তোমাদের সবারই বাড়ি-ঘর আর খামার রয়েছে সেখানে তোমাদের কাজও রয়েছে প্রচুর, আর আমি হচ্ছি একজন হাত-পা ঝাড়া লোক, বলল নিকোলাস।
তোমার এ-কথার মানে? জানতে চাইল লী
তোমাদের ওই খুনীটাকে ধরে আনার জন্যে টাকা দিয়ে একজন লোক রাখাই সবদিক দিয়ে যুক্তিসঙ্গত হবে। আমাকে কাজটা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে তোমরা নিজেদের খামারের কাজ দেখতে পারবে। তা ছাড়া লোকটা যে কে তা জানি আমি।
তুমি চেনো ওকে?
হ্যাঁ, ওর নাম জেকব রাইট। দাড়ি পাল্লা মার্কা ঘোড়া ওর।
বাইরের কোন সাহায্য আমাদের দরকার নেই, প্রতিবাদ করল গিবন। আমরা নিজেরাই ওকে খুঁজে বের করব।
আমার নাম নিকোলাস পামার। বসবাস করার মত কোন সুন্দর জায়গা পেলে থাকব বলে পশ্চিমে এসেছি। এই শহরটা আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে-আমাকে যদি কিছু অধিকার আর ক্ষমতা দেয়া হয় তবে তার বদলে তোমাদের এই কাজটা আমি করে দিতে রাজি আছি।
কী অধিকার আর ক্ষমতা চাও তুমি?
তোমাদের কথার ওপর একটা লোককে খুঁজে বের করে হত্যা করা ঠিক দেখায় না। কিন্তু তোমরা যদি আমাকে মার্শাল নিযুক্ত করো, তবে কথাটা অন্যরকম দাড়ায়।
ওদের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই ধরনের প্রস্তাব ওদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন আর অপ্রত্যাশিত। লী কোন কথা বলছে না-গিবনও নীরব রয়েছে। বাকি সবাই ওই দুজনের মতামতের অপেক্ষা করছে।
কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে গিবনই প্রথম কথা বলল। শান্তিপূর্ণ শহর এটা। এখানে আমাদের কোন মার্শালের দরকার নেই।
ইউজিন কোন কথাই বলেনি। কতক্ষণে বাড়ি ফিরে যাবে এই চিন্তাই ওকে ব্যস্ত করে রেখেছে। জেকবের খোঁজে আবার বেরুবার দায়িত্ব থেকে রেহাই পেলেই সে বেঁচে যায়। তাই নিকোলাসের প্রস্তাবটা ওর কাছে ভালই মনে হচ্ছে। কিন্তু আবার এই বেয়াড়া রকম কঠিন চেহারার লোকটাকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে গিবনও একই কারণে আপত্তি জানিয়েছে।
একটা মিটিং ডেকে শহরের সবার মতামত নেয়া দরকার, একটু ভেবে নিয়ে মন্তব্য করল লী। দু’একজনের মতামতের ওপর কোন সিদ্ধান্ত নেয়া আমাদের ঠিক হবে না।
গ্লাসের বাকি মদটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে নিক বলল, নদীর ধারে তাঁবু ফেলেছি আমি-দরকার হলে খবর দিয়ো। বারের উপর গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল সে।
সেলুনের ব্যাট-উইং দরজার কবাট দুটো কয়েকবার এপাশ ওপাশ দুলে স্থির হয়ে গেল। কেউ কথা বলছে না দেখে ইউজিন মুখ খুলল এবার বাড়ি ফিরতে হয়-দেরি দেখে বউ খুব দুশ্চিন্তা করবে।
হ্যাঁ, চলো আমিও উঠছি, বলল গিবন।
সোজা হয়ে দাঁড়াল লী; নিকোলাসকে কাজে লাগাতে আমাদের কী অসুবিধা? আমার তো মনে হয় এতে বরং আমাদের সুবিধাই হবে। আমরা নিজেদের কাজ দেখব-লোকটাকে খুঁজে বের করে নিকোলাস আমাদের খবর দিলে তখন সবাই মিলে গিয়ে কাজটা শেষ করে আসব। এতে আপত্তি করার কী আছে?
ওকে আমরা কেউ চিনি না, লী, যুক্তি দেখাল গিবন।
তাতে কী? বার্ট নিজের মত প্রকাশ করল। দরকার হলে আবার আর একটা মিটিং ডেকে ওকে বরখাস্ত করব। তা ছাড়া আমার মনে হয় না এদিকে থাকতে এসেছে সে।
ওই ধারণা তোমার কী করে হলো?
একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে। জেকবকে আগে থেকেই চেনে লোকটা। আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছি সবই জানত সে। আমার মনে হয় জেকবের সাথে কোন শত্রুতা আছে ওর-পিছন পিছন ওকেই অনুসরণ করে এখানে পৌঁছেছে সে।
তা হলে আর টাকা দিয়ে ওকে রাখার কী দরকার? বলেই যাবার জন্য উঠল গিবন। চলো, ইউজিনকে বলল সে, একসাথেই যাই। তোমার খামার পেরিয়েই যেতে হবে আমার।
ওদের দুজনকে দরজার দিকে এগোতে দেখে কঠিন চোখে চাইল লী। তার মানে তোমরা লোকটাকে কাজে নেয়ার বিপক্ষে?
থেমে দাঁড়াল গিবন। মাথা নিচু করে পুরো এক মিনিট চিন্তা করে সে জবাব দিল, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ লী, লোকটাকে পছন্দ হয়নি আমার। ওকে বিশ্বাসও হয় না। আমার মতে নিজেদের সমস্যা নিজেরা মেটানোই ভাল।
ক্ষুব্ধ হয়ে ঘুরে ওদের দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়াল লী। একটু অপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল ওরা।
বার থেকে বেরিয়ে কাঠের রেলের সাথে বাঁধা ঘোড়ার লাগাম খুলতে খুলতে ইউজিন বলল, লী-র যে কী হয়েছে জানি না, মনে হয় যেন অনেক বদলে গেছে সে।
ও কিছু নয়, ইউ, আমাদের অন্যান্য সবার মত সে-ও ক্লান্ত, তেতো বিরক্ত হয়ে উঠেছে ওর মন। ঠিকমত বিশ্রাম পেলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
গিবন তাকে নিশ্চিন্ত করতে চাইলেও ইউজিন স্পষ্ট বুঝতে পারছে গিবন নিজেও এ-ব্যাপারে চিন্তিত। লী সবসময়ই একটু কঠিন প্রকৃতির লোকই ছিল। কিন্তু ইদানীং সে যেন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে! ওর কাছে কোন উনিশ-বিশ নেই-সব কিছুই ওর কাছে হয় হ্যাঁ কিংবা না। ওর ধারণা, সে যেটা ঠিক মনে করে সেটাই ঠিক। ওটা যে আর কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায় তা মানতে সে। রাজি নয়।
০৬. জেকব রাইটের অনেক আশা-আকাক্ষা
জেকব রাইটের অনেক আশা-আকাক্ষা আছে, কিন্তু তার মনে কোন আকাশ কুসুম কল্পনা স্থান পায়নি। সে কী চায় এ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা তার আছে।
যেখানে ভাল ঘাস আর পানি আছে এমন র্যাঞ্চ চাই তার। তাতে বিক্রি করার জন্য কিছু গরু-মহিষ থাকবে। ঘোড়াও থাকবে, কিন্তু তা সে ঘোড়া ভালবাসে বলেই রাখবে। হঠাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল সম্পত্তি পাওয়া, বৌ-এর টাকায় বড়লোক হওয়া অথবা লুট করে টাকা বানানোর মতলব নেই ওর। এর যে-কোন শর্টকাট বা সহজ পথ নেই তা সে জানে। নিজেরটা নিজেই গড়ে নিতে চায় জেকব, তাই নিজের সবকিছু নিজেই দেখাশোনা করে সে।
আত্মরক্ষা করার জন্য এবার লড়তে হবে তাকে। বিভিন্ন দিক থেকে তার উপর আক্রমণ আসতে পারে। নিজের বিপদ যদি ওরা ডেকে আনতে চায় তা হলে লড়তে আসুক-উচিত শিক্ষা দিয়ে দেবে সে।
তার জীবনে ডালিয়ার আগমন নিতান্তই আকস্মিক। তার পাশে চলার জন্য, তার জীবন-সঙ্গিনী করার জন্য মনে মনে কল্পনায় যে মেয়ের ছবি সে এঁকেছিল, ডালিয়া যেন ঠিক সেই মেয়েটি। সে জানত যে জীবন সে কাটাতে চায়, কোন মেয়ের পক্ষে তার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া খুবই কঠিন। ডালিয়াকে দেখামাত্রই বুঝেছে একেই এতদিন খুঁজছিল সে।
কেমন বাড়িতে থাকবে ওরা তাও কল্পনায় ঠিক করে রেখেছে জেকব। কিন্তু বাড়ি এখনও তৈরি হয়নি, তার আগেই মনের মানসীকে পেয়ে গেছে সে বাড়ি বলতে এখন যা আছে তা হচ্ছে ঝর্ণার পাশে পাহাড় থেকে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের নীচে একটা ছোট্ট গুহা।
প্রত্যেকদিন পাহাড়ে উঠে চারদিকে নজর রাখার সময়ে একা বসে অনেক কথাই ভাবে সে। পরবর্তীতে কী করবে, কোথায় যাবে এসব নিয়েই বেশি ভাবে। তার বিশ্বাস সব মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট কর্মপন্থা থাকা দরকার। মানুষ একটা জাহাজের মত। চলার পথে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বহুবার তাকে দিক পরিবর্তন করতে হয়। স্রোতে অনিশ্চিতভাবে ভেসে না বেড়িয়ে পরিকল্পিত গতি নিয়ে তাকে এগিয়ে চলতে হয়।
শেষ পর্যন্ত নাভাজো এলাকায় বাস করার ইচ্ছা জেকবের নেই। তার ইচ্ছা দক্ষিণ-পশ্চিমে হোয়াইট মাউনটেনের কাছে গাছপালাবহুল সবুজ এলাকায় সরে যাবে। কিন্তু তার আগে কলোরাডোতে একটা বিশেষ বন্য ঘোড়ার দল থেকে কয়েকটা ঘোড়া তার চাই। বিশেষ করে ওই সোনালী রঙের বড় কোল্টটা ওর মন কেড়ে নিয়েছে।
নাভাজো বা ইউটে ইন্ডিয়ান কারও চোখে ওটা পড়ে থাকলে ওরা নিশ্চয়ই ঘোড়াটা ধরে নিয়ে যাবে। তবে ওরা এদিকটায় খুব কমই আসে, তাই জেকবের মনে এখনও আশা আছে। কপাল ভাল থাকলে এখান থেকে যাবার সময়ে ওই ঘোড়াটার সাথে আরও কয়েকটা ভাল ঘোড়া নিয়ে যেতে পারবে সে।
ওদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবার। ফ্রীডমে রসদ আনতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে ওকে।
কিছু মাংসও ওদের দরকার। আগামীকাল দু’জনে মিলে কিছুটা ঘুরে আসার ইচ্ছা আছে ওর। পথে একটা বিগহর্ন বা হরিণ শিকার করতে পারলে ওদেরসমস্যা মিটবে কিছুটা।
ডালিয়া ছোট্ট ঝিলটার ধারে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাদের রাতের খাবার তৈরি করে রেখেছি, বলল সে। কিন্তু ওদের কারোই খেতে যাবার কোন তাড়া দেখা গেল না। দুই পাহাড়ের ফাঁকে লাল সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে লালচে রোদ আগুনের শিখার মতই দেখাচ্ছে। একটা জ্বলন্ত পাহাড় যেন। নীরবে পাশাপাশি বসে আলোর রঙ বদলানোর খেলা দেখছে ওরা। দূরে বিষণ্ণ স্বরে একটা তিতির ডেকে উঠল। ওদিক থেকে আর একটার জবাব শোনা গেল
এই স্তব্ধ পরিবেশ আমার খুব ভাল লাগে, বলল ডালিয়া। মনে হয় যেন এই ব্যাপ্তি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে নিজের সাথে আমাকে একাকার করে নিচ্ছে। এই বিশালত্বের সাথে এক হয়ে পার্থিব জ্বালা-যন্ত্রণা, অসন্তোষ সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়।
রাতে খাওয়ার পরে একা একা বসে দূরের উঁচু পাহাড়টার দিকে চেয়ে জেকব তাদের বর্তমান আস্তানাটার কথাই ভাবছিল। জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর-এটা ছেড়ে চলে যেতে তার বেশ খারাপ লাগবে।
নীরবে ডালিয়া এসে বসল ওর পাশে।
পরিচিত প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে এখানে এসে দম আটকে আসে না তোমার?
সেটাই স্বাভাবিক হত, জবাব দিল ডালিয়া, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এখন আর আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না অন্য কোন জগৎ আমি কোনকালে চিনতাম। পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষ আমি-সেই কারণেই হয়তো এইসব বিজন এলাকা আমার কাছে আপন বলে মনে হয়।
পরদিন সকালে ওরা ঝোঁপ আর পাহাড় থেকে খসে পড়া পাথরের আড়াল দিয়ে ঘোরা পথে নিজেদের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। ক্লিফের পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে চলতে চলতে দু’বার দূরে হরিণ দেখতে পেল জেকব। ঘোড়ার পায়ের কাছ থেকে একটা খরগোশ লাফিয়ে উঠে পালিয়ে যাচ্ছিল, তৃতীয় লাফের সময়ে জেকবের গুলিতে মারা পড়ল ওটা।
খরগোশের মাংস খেতে খেতে পেটে চর পড়ে গেছে, বলল সে। কিন্তু মাংস তো বটে?
দু’বার ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখতে পেল ওরা। দাগগুলো খুব মনোযোগের সাথে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল জেকব। একবার কয়েক মাইল পর্যন্ত ওই দাগ অনুসরণ করে এগিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো ক্যানিয়নের আরও গভীরে চলে গেছে দেখে ফিরে এল।
যে দলটাকে আমি খুঁজছি ওরা আরও উত্তরে চড়ে বেড়ায়, চলো এগিয়ে যাই।
বুট মেসার বাঁক ঘোরার সময়ে ঘোড়াগুলো দেখতে পেল ওরা। মুনলাইট ক্রীকের দিক থেকে এসে সমতল জমিটার উপর ইতস্তত ছড়িয়ে ঘাস আর ছোট ছোট ঝোঁপের পাতা খাচ্ছে।
কয়েক মিনিট পরে সোনালী স্ট্যালিয়নটাকে দেখা গেল একটা ঢিবির উপর। নিশ্চল হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে-কান দু’টো সতর্ক ভাবে খাড়া।
দূরত্ব ওদের থেকে এক মাইলেরও বেশি হবে। দূরবীন চোখে লাগাল জেকব। ঠিক কাঁচা সোনার রঙ, বলল সে। কোমরের ওপর একটা সাদা ছোপ। এই দলটাকেই খুঁজছি আমি।
এবার অন্য ঘোড়াগুলোর দিকে মনোযোগ দিল জেকব। মোট পঁচিশ তিরিশটা হবে। কয়েকটারই কাঁধে ও পাছায় সাদা ছোপ রয়েছে।
দেখা শেষ করে ডালিয়ার দিকে দূরবীন বাড়িয়ে দিল জেকব। ওই স্ট্যালিয়নটাকে দেখো। ওটার সাথে আরও কয়েকটাকে ধরব আমি।
ডালিয়া ঘোড়াগুলোকে দেখার ফাঁকে জেকব বলে চলল, বৎসর কয়েক আগে একজন মরমন এসেছিল এই এলাকায়, সাথে করে কয়েকটা উঁচু জাতের ঘোড়া এনেছিল সে। তার নাম ছিল এড লিনেট। ঘোড়াগুলো ওর বাবা স্বয়ং ভার্জিনিয়া আর কেনটাকি থেকে এনেছিল। তারপর এড আইডাহোর নেজ পেরেজ থেকে একটা চমৎকার স্ট্যালিয়ন আর কয়েকটা মেয়ার জোগাড় করে।
এগুলো বুনো ঘোড়া না?
অবশ্যই। একেবারে জংলী। পোষা একটা ঘোড়া খুঁজতে এসে এডকে একটা ভালুকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ভালুকটা তার ঘোড়াকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। দেখে ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সে। ভালুকটা ওর হাতে মারা পড়েছিল বটে কিন্তু মরার আগে তাকেও শেষ করেছিল।
অসাধারণ লোক তো!
হ্যাঁ, ওজনে মাত্র একশো বিশ পাউন্ড হলে কী হবে, শক্ত লোক ছিল সে। ঘোড়ার কোনরকম ক্ষতি সে সহ্য করতে পারত না। ভালুকটা ওকে খামচে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেললেও ওর চামড়ায় নয়-দশ জায়গায় ছুরির মারাত্মক জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছিল।
কথায় কথায় আবার এগিয়ে চলল ওরা একটা ওয়াশ ধরে। বর্ষার পানির তোড়ে পাথর কেটে তৈরি হয়েছে ওয়াশ। সাবধানে এগোতে হচ্ছে, ঘোড়াগুলোর অলক্ষ্যে ওদের কাছে যেতে চাইছে জেকব। এত কিছুর মাঝেও পিছন থেকে কেউ আসছে কিনা সেটা বারবার খেয়াল করে দেখছে সে। এদেশে বেঁচে থাকতে হলে বন্দুক হাতের কাছে রাখা, আর পিছন দিকে নজর রাখা সবচেয়ে দরকারী।
সোনালী ঘোড়াটাকে এখন ধরার ইচ্ছা নেই ওর। কোন এলাকায় ওটা চলাফেরা করে, কোথায় চলে, কোথায় পানি খায় এসব জানতে চায় সে। সবচেয়ে বেশি চায় দেখা দিয়ে ওর সাথে একটু পরিচিত হতে-জেকবের তরফ থেকে ওর কোন বিপদ আসবে না এই বিশ্বাস ওর মনে জন্মাতে পারলে কাজ অনেক এগোবে।
সূর্যাস্তের আগে দু’বার ঘোড়াগুলোর আধ মাইলের মধ্যে গেল ওরা। কিন্তু দু’বারই আরও কাছে যাবার চেষ্টা না করে আবার দূরে সরে এল। মাথা উঁচু করে, নাক ফুলিয়ে, কান খাড়া রেখে শেষবার মাথা কয়েকশো গজ দূর থেকে স্ট্যালিয়নটা ওদের ফিরে যেতে দেখল।
রাতে হসকিনিনি মেসার একটা খাজে ওরা ক্যাম্প করল। ঝোঁপ আর পাথরের আড়ালে আগুন জ্বালাল যেন দূর থেকে দেখা না যায়। খাওয়া সেরে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময়ে টের পেল সেই ঘোড়াগুলোই বেশ কাছে দিয়ে ওদের পেরিয়ে যাচ্ছে। মাঝ পথে সম্ভবত ওদের গন্ধ পেয়েই একবার থমকে দাঁড়িয়েছিল-পরে গন্ধটা চিনতে পেরে আবার নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে গেল। যাবার আগে একটা ঘোড়া যেন একটু বেশি ইতস্তত করল।
ওই ঘোড়াটা, নিচু স্বরে বলল জেকব, আগুন আর মানুষের গন্ধ চেনে বলে মনে হচ্ছে। খুব সম্ভব অল্পদিন আগেই ওটা আবার জংলী জীবনে ফিরে গেছে।
ডালিয়া ঘুমিয়ে পড়ার পরেও অনেকক্ষণ আকাশের তারাগুলোর দিকে চেয়ে দেখেই কাটাল জেকব। ফ্রীডম থেকে যারা তাড়া করে এসেছিল, তাদের কথাই ভাবছে সে। ওদের চেহারা মনে করার চেষ্টা করছে-প্রত্যেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লোক-সহজে হাল ছাড়বে না। ভাবতে ভাবতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল জেকব।
.
ফ্রীডম বা তার আশেপাশের কেউ সহজে লী-কে চটাতে সাহস পায় না। তারা সবাই জানে লী খুব পরিশ্রমী, সৎ আর দুঃসাহসী। ওকে চটালে উপায় নেই। একটু কঠিন আর অধৈর্যও সে। কোন কাজের সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেললে সেটা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ওর স্বস্তি নেই।
পরদিন সকালে সেলুন খোলার সাথে সাথেই বারে হাজির হয়ে গেল লী। সাত-সকালে ওকে দেখে সাবধান হলো ফ্রেড। গতরাতেই আঁচ করেছে সে আজ গোলমাল বাধতে পারে।
নিকোলাস এদিকে এসেছিল আজ? প্রশ্ন করল লী
ওর সাথে জড়াতে চাচ্ছ কেন? লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবটাই বিষাক্ত বলে মনে হয় আমার।
কঠিন চোখে ফ্রেডের দিকে চাইল লী। বিপদ “শক্ত-পাল্লার” আমাদের কী?
হয়তো…আমাদের বিপদ আনতে পারে সে।
মন্তব্যটা অগ্রাহ্য করল লী। মনস্থির করে ফেলেছে ও-কোন বাধাই আর মানবে না। বলল, ওকে পছন্দ করতেই হবে এমন কোন কথাই নেই–এনপ্রিয়তায় প্রতিযোগিতায় নামছে না সে।
তুমি কি টাউন মার্শাল পদের জন্যে ওর নাম প্রস্তাব করবে?
সে তাই চায়। জেকবকে ধরে আনতে পারলে ওকে কী পদ দেয়া হলো তাতে কিছু আসে যায় না আমার।
ব্যাপারটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, লী।
লী বিরক্তি ভরা চোখে ওর দিকে চাইল। পছন্দ না হলে তুমিই যাও না, শক্ত-পাল্লাকে ধরে নিয়ে এসো?
ফ্রেডের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল। জবাব না দিয়ে চট করে ঘুরে চলে গেল সে। মানুষকে কিছু কিছু ব্যাপারে একটু সহনশীল হতেই হয়। হাজার হোক ডেরিক ছিল লী-র বন্ধু। পশ্চিমের সবখানেই বন্ধুত্বের উপযুক্ত দাম দেওয়া হয়।
দরজা ঠেলে ডিক আর ডেভ সেলুনে ঢুকল। দুজনে একই টেবিলে বসল ওরা। সচরাচর ওদের বারে ঢুকতে দেখা যায় না। ফ্রেড ওদের অর্ডার মত দুই জ্বলন্ত পাহাড় গ্লাস বিয়ার পৌঁছে দিয়ে এসে আবার শুকনো তোয়ালেটা তুলে নিয়ে গ্লাস পালিশ করতে লাগল। একটু পরেই অ্যালেন আসবে…টাউন মার্শালের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে ওরা। খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চাইল ফ্রেড। গিবন আর ইউজিনের র্যাঞ্চে যাবার পথ ওটা। গিবন এখনও আসছে না কেন? এই মুহূর্তেই গিবনের ঠাণ্ডা মাথা আর বিচক্ষণ মতামত ফ্রীডমের দরকার।
একজন মার্শাল আমাদের নিশ্চয়ই দরকার, ডিককে বলতে শুনল ফ্রেড। বখে যাওয়া বাউণ্ডুলে লোকজনের আনাগোনা আজকাল অনেক বেড়ে গেছে শহরে। এই সেদিনের গোলাগুলির ঘটনাই ধরো-লোকটা ছিল বাজে গোছের একটা অকম্মার ঢেঁকি।
নিঃসন্দেহে ওকথা বলতে পারো না তুমি, ডেভ তার দাঁতে ধরা চুরুটটা নামিয়ে বলল। দোকানের ওরা তো বলছে বেশ বড় সাপ্লাই-এর অর্ডার দিয়েছিল লোকটা।
হাসল ডিক। বলল, তুমিও ওই কথা বলছ? আমার তো মনে হয় আর দু’একটা কথার পরেই সে বাকি চেয়ে বসত। লোকটার এদিকে কোন জায়গা জমি থাকত, তবু বুঝতাম-এসব ঢের দেখেছি।
বারে ঢুকে ওদের টেবিলেই বসে একটা বিয়ারের অর্ডার দিয়ে অ্যালেন বলল, আচ্ছা, লী, তুমি যে লোকটার কথা বলছ এই কাজের জন্যে সে উপযুক্ত হবে বলে মনে হয় তোমার?
আড়চোখে ওর দিকেচাঁইল লী। কাজটা সে নিজেই নিতে চেয়েছে, তা ছাড়া লোকটাকে দেখে তো শক্ত-সমর্থ বলেই মনে হয়।
পালিশ করা শেষ করে গ্লাসটা পিছনের তাকে রেখে আবার জানালা দিয়ে বাইরে চাইল ফ্রেড। নাহ, এখনও গিবন বা ইউজিনের দেখা নেই। লোকগুলো একটা বোকামি করতে যাচ্ছে,ফ্রীডমে আজ পর্যন্ত নিজেরা সামলাতে পারে না। এমন কিছু ঘটেনি।
আলোচনার টুকরো টুকরো অংশ ফ্রেডের কানে আসছে। নিকোলাস তো অবশ্যই তার চির শত্রু হয়ে দাঁড়াবে, লী-ও ব্যাপারটা অপছন্দ করবে-কিন্তু যা। হবার হবে, সে এর বিরুদ্ধেই ভোট দেবে। আসল মুশকিল হচ্ছে এই শহরের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যায় এক তৃতীয়াংশ জমির মালিক উপস্থিত থাকলেই ভোটের মাধ্যমে একটা স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ মাত্র বারোজন উপস্থিত থাকলেই চলবে? এখন লী, ডিক, ডেভ, অ্যালেন এরা যদি নেতৃত্ব দেয় তবে বাকি কয়েকজনও সহজেই জুটে যাবে।
ক্লাইভ আর বার্ট বারে ঢুকে এক বোতল মদ কিনে নিয়ে একটা আলাদা টেবিলে গিয়ে বসল। একটু পরেই ফ্রেড লক্ষ করল, পেনসিল দিয়ে টেবিলের উপর একটা নক্সা এঁকেছে বার্ট। নক্সার উপর একটা কাটা চিহ্ন এঁকে সে বলল, ঠিক এইখানটায় হচ্ছে মরমন কুয়া। আমরা যদি…’ গলার স্বর হঠাৎ নিচু করে ফেলায় আর শুনতে পেল না ফ্রেড। আর শোনার দরকারও নেই-হারানো ওয়্যাগনের আলাপই করছে ওরা।
লী উঠে এগিয়ে গেল ওদের টেবিলের দিকে। তোমার সাথে আমার জরুরী আলাপ আছে, বার্ট, বলল সে।
নিকোলাসকে মার্শাল করার ব্যাপারে তো? সে যদি শক্ত-পাল্লাকে ধরে আনবে বলে অঙ্গীকার করে-আমি ওকেই ভোট দেব।
আমিও, বলল ক্লাইভ।
নিজের টেবিলে ফিরে গেল লী। সবই ফ্রেডের কানে আসছে… কিন্তু গিবন কী করছে? সে আসছে না কেন এখনও?
০৭. বিশদ পরিকল্পনা নিয়েছে জেকব
বিশদ পরিকল্পনা নিয়েছে জেকব। সোনালী স্ট্যালিয়ন, আর সেই সাথে ওই দলের আরও কয়েকটা ঘোড়া ওর চাই। একটু দূরে দূরে থেকে নিজের উপস্থিতি স্বাভাবিক বলে মানিয়ে নিতে চাইছে সে। এক সপ্তাহ পিছন পিছন ঘুরে ওদের স্বভাব-চরিত্র মোটামুটি জেনে নিয়েছে ও। এমনকী খুরের চিহ্নগুলোও ওর চেনা হয়ে গেছে। এই কদিনে দু’টো হরিণও মেরেছে সে।
এর মধ্যে ডালিয়াকে আর কাছছাড়া করেনি জেকব। সবসময়ে পাশেপাশে রেখেছে। রোদ আর বাতাসে ওর চামড়ার সাদাটে ভাবটা কেটে গিয়ে সুন্দর তামাটে রঙ, ধরেছে। নির্জন জীবনযাত্রায় নিজেকে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে ডালিয়া। ইউরোপের জগক্টাকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে এখানে প্রতিটি দিন আলাদা করে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাকেই এখন পুরোপুরি উপভোগ করছে সে।
দশম দিন কফি ফুরিয়ে যাওয়ায় ওরা আবার ফিরে এল পুরোনো আস্তানায়। ঢোকার আগে অত্যন্ত সতর্কভাবে আশপাশটা বারবার পরীক্ষা করে দেখল জেকব। ক্লিফের পাশ দিয়ে সবটা জায়গা ভাল করে খুঁজে দেখে কেউ ওদের জন্য লুকিয়ে ওত পেতে বসে নেই নিশ্চিত জেনেও কয়েক ঘণ্টা পরে একাই সে ক্যানিয়নে প্রবেশ করল।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে মাল বোঝাই গাধাগুলোকে ডালিয়ার জিম্মায় রেখে একাই সে আবার ক্যানিয়নের মুখটার কাছে ফিরে গেল। মার্শ-পাসের সাথে মিশেছে ওটা। ঘোড়া থেকে নেমে মোকাসিনের একজোড়া জুতো পরে নিয়ে পায়ে হেঁটে ট্রেইলের উপর গিয়ে নতুন চলাচলের চিহ্নগুলো পরীক্ষা করে দেখল।
তারা এই এলাকা ছেড়ে যাবার পর মাত্র অল্প কয়েকটা নতুন চিহ্ন হয়েছে দেখল জেকব। বেশির ভাগই ইন্ডিয়ান টাটু আর জংলী ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন। ফিরে আসবে, হঠাৎ একটা বুটের ছাপ তার চোখে পড়ল। ছাপটা বেশ বড়-ভারি মানুষের। অল্প খুঁজতেই নতুন নাল লাগানো ঘোড়ার পায়ের দাগ দেখতে পেল সে।
লোকটা এখানে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল। সন্দেহ নেই কান খাড়া করে অপেক্ষা করছিল সে। তারপর আবার মার্শ-পাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে।
নিকোলাসের পায়ের ছাপ কখনও দেখেনি জেকব। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে এগুলো তারই। ওজন আর আকারেও মিলছে-পদক্ষেপের দূরত্ব দেখে উচ্চতা অনুমান করছে সে। ফেরার সময়ে সাবধানে বেছে বেছে পাথরের উপর পা ফেলে কোনরকম ছাপ না রেখে ফিরল জেকব
ডালিয়া দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। ওকে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল।
ওখানে কিছু চিহ্ন দেখলাম, বলল জেকব। আমার মনে হয় ওগুলো নিকোলাসের পায়ের ছাপ।
ও কি আমাদের খুঁজে পাবে?
কাঁধ ঝাঁকাল জেকব। ক্যাম্পটা হয়তো খুঁজে পাবে, ওখানে আমাদের অসংখ্য চিহ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু ওখান থেকে আমরা কোন্ পথে বেরিয়েছি তা সে খুঁজে পাবে না। বেরিয়ে আসার চিহ্নগুলো সব এমন ভাবে মুছে দিয়ে এসেছি যে দেখে মনে হবে ওখানে অন্তত কয়েক বৎসরের মধ্যে কারও আনাগোনা হয়নি।
.
সোজা উত্তর দিকে এগিয়ে সোনালী স্টালিয়নের এলাকায় পৌঁছে গেল। রাত কাটাবার জন্য মুনলাইট ক্রীকের ধারে পাথরের ফাঁকে ক্যাম্প করল ওরা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তের দিকে ডালিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করল জেকব
দিগন্ত রোধ করে প্রায় বারো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল প্রশস্ত স্তম্ভ। ওটা নো ম্যানস মেসা, বলল সে। ওর সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা আশেপাশে চারদিকের জমি থেকে অন্তত হাজার ফুট উঁচু। ওটার প্রত্যেকটা ধারই উচ্চতায় কম পক্ষে পাঁচশো ফুট হবে। লম্বায় নয় মাইল আর পাশে সিকি মাইল থেকে দেড় মাইল চওড়া। মানুষের পক্ষে ওখানে ওঠা অসম্ভব মনে হয় বলেই ওটার ওই নাম হয়েছে। তবে আমার ধারণা উপরে ওঠার একটা পথ আছে। ওর পশ্চিম ধার ধরে অর্ধেকের কিছু বেশি গেলে একটা ব্যাজ আছে, ওখান দিয়ে উপরে ওঠার একটা চেষ্টা করতে চাই আমি। যদি কোন কারণে আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়, যেখানটায় ক্লিফটা বাঁক নিয়ে পুব দিকে ঘুরে গেছে, সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা। করো তুমি। ওখানেই আবার মিলিত হব আমরা।
পরদিন ঘোড়াটার দেখা পাওয়া গেল। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে ওদের একেবারে সামনাসামনি পড়ে গেল সোনালী স্ট্যালিয়ন।
পশ্চিমে অরগ্যান রকের দিকে এগোচ্ছিল ওরা; পাহাড়ের ভিতর একটা সরু পথ ধরে ছুটে বেরিয়ে এসেই থমকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল সে। ওদের মাঝের দূরত্ব মাত্র গজ পঞ্চাশেক। সামনের জমিটা মোটামুটি সমতল। ইচ্ছা করলে এখনই ওটাকে ধরার চেষ্টা করতে পারত জেকব। খুব বেগে ছুটে গিয়ে ল্যাসো ছুঁড়ে হয়তো ধরা সম্ভব হবে, কিন্তু অত ঢালু, আর নরম বালুর উপর দিয়ে জোরে ছুটতে গিয়ে ওর ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙে যেতে পারে। ব্যর্থ হলে এতদিন কাজ যতটা এগিয়ে ছিল সব পণ্ড হয়ে যাবে
স্ট্যালিয়নটাকে দেখে সম্মোহিত হয়ে চেয়ে রইল জেকব। কাছে থেকে ওটাকে আরও সুশ্রী দেখাচ্ছে রঙটা ঠিক উজ্জ্বল সোনার মোহরের মত। পাছায় আর তিনটে পায়ে সাদা ছোপ, কিন্তু তার মধ্যেও আবার সোনালী বুটি রয়েছে। গলাটা গর্বিত ভঙ্গিতে বাঁকানো।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে জেকব আর ডালিয়াকে দেখল সে। সাথের অন্য ঘোড়াগুলো দ্রুতবেগে বেরিয়ে এসে ওর পাশে থেমে দাঁড়াল।
ওদের চলার গতি মুহূর্তের জন্য থমকে যেতেই বন্ধুসুলভ স্বরে জেকব ডেকে উঠল, ও বেটা, বন্ধুত্ব করবি?
সজোরে মাথা নেড়ে শব্দ করে নাক ঝাড়ল ঘোড়াটা, তারপর আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাথরের ভিতর দিয়ে অন্যদের পথ দেখিয়ে ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দলে বাকি পুরুষ ঘোড়াগুলো ওর সাথে একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে ওকে অনুসরণ করছে।
নীচের সমতল জমির উপর দিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটতে ছুটতে চোখের আড়ালে চলে গেল। ডালিয়ার দিকে ফিরে জেকব জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে?
সত্যি, মৃদু গলায় জবাব দিল সে। সত্যিই অপূর্ব।
ধীর গতিতে ঘোড়াগুলো যেদিকে গেছে সেদিকেই এগিয়ে চলল ওরা।
এদিকে একটা গল্প চালু আছে-কিছু সোনাভর্তি ওয়্যাগন এদিকে হারিয়ে গেছে-অনেক সোনা নাকি ছিল ওতে। সোনা চাই না, ওই স্ট্যালিয়নটা আর ওই দলের কয়েকটা ঘোড়া পেলেই আমি খুশি।
হঠাৎ চট করে নিজের ঘোড়া ঘুরিয়ে ডালিয়ার ঘোড়ার পথ রোধ করে থেমে দাঁড়াল জেকব। ট্রেইলের চিহ্ন দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ডালিয়ার চোখ। জেকবের দৃষ্টি অনুসরণ করে মাটির দিকে চাইল সে।
ওদের সামনেই তিনটে নাল পরানো ঘোড়ার পায়ের ছাপ। বুনো ঘোড়ার দলটা দাগগুলো মাড়িয়ে কিছুটা অস্পষ্ট করে গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে দাগগুলো খুব পুরোনো নয়।
গতরাতের ছাপ, বলল জেকব। জলদি লুকিয়ে পড়তে হবে আমাদের।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বুনো ঘোড়াগুলো যেপথ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল দ্রুত সেদিকে চলল ওরা।
হসকিনিনি মেসার তলায় কপার ক্যানিয়নের মুখের কাছে থামল জেকব। ঘুরে চারদিকে চেয়ে দেখল সে-কোন দিকেই ধুলো ওড়ার কোন চিহ্ন দেখা গেল না।
নতুন নাল লাগানো ঘোড়ায় চড়া তিনজন লোক, বলল জেকব।
ওরা কি আমাদের খুঁজছে?
কাঁধ ঝাঁকাল সে। কে জানে? হয়তো তাই?
অনেকক্ষণ সমতল প্রান্তরের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে, ধীরে ধীরে সঙ্গীকে নিয়ে কপার ক্যানিয়নে ঢুকল জেকব। পশ্চিমে এগিয়ে চলল ওরা। বিকেলের দিকে পিউটে মেসার নীচে ক্যাটল ক্যানিয়নে ক্যাম্প করল।
পাথরের আড়ালে ছোট্ট একটা আগুন জ্বেলে ডালিয়াকে খাবার তৈরি কাজে ব্যস্ত রেখে চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে বেরুল জেকব।
রাতে খাবার খেতে বসে ডালিয়া বলল, জে, তুমি কিন্তু সেই সোনার ওয়্যাগনের গল্পটা আমাকে এখনও বলেনি
বলব, জবাব দিল সে। শোনো, আসলে আমার মনে হচ্ছে এদেরই একজনের পায়ের ছাপ আমি মার্শ-পাসে দেখেছি। ওরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের বেশ কয়েকদিন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে থাকতে হবে।
খাবার কিন্তু বিশেষ কিছুই নেই।
জানি…একটু কষ্ট করে থাকতে পারবে না?
হাসল সে। নিশ্চয়ই, তুমি পারলে আমিও পারব।
খাওয়া শেষ হতেই আগুনটা নিভিয়ে দিল জেকব। তারপর পাথরের মাঝে একটা ভাল আশ্রয় খুঁজে নিল। সহজে কারও ওখানে ঢোকার সাধ্য হবে না। একটা গর্ত মত জায়গায় ঘোড়া আর গাধাগুলোকে রাখা হলো-বাইরে থেকে কারও নজরে পড়বে না ওগুলো।
সব কাজ সেরে অবার ডালিয়ার পাশে এসে বসল জেকব। তুমি হারানো সোনার ওয়্যাগনগুলোর থা জিজ্ঞেস করছিলে না? সে এক পুরোনো গল্প, আরম্ভ করল সে। পশ্চিমে মাটিতে পোঁতা গুপ্তধনের কথা অনেক শোনা যায়-কিছু পাওয়া গেছে, বাকিগুলো গুপ্তই রয়ে গেছে। ইন্ডিয়ানদের ভয়ে বা আক্রমণের মুখে অনেক সময়ই সাথে নিলে বোঝা, বাড়বে বলে সোনা-দানা মাটিতে পুঁতেছে মানুষ। কখনও মালিক প্রাণ হারিয়েছে, আবার কখনও বা ফিরে আসার সাহস হারিয়েছে। সোনা দেখতে যত সুন্দর আর জ্বলজ্বলে হোক না কেন, কয়েকশো মাইল ফোস্কাপড়া গরম আর অ্যাপাচি ভরা মরুভূমির কথা মনে পড়লে অনেকেই ফেলে আসা সোনার চাকচিক্যের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে।
সতেরোজন লোক ছয় গাধার দুটো গাড়ি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে রওনা হয়েছিল। ওদের প্রত্যেকের সাথেই ছিল নিজস্ব ঘোড়া আর প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র। গাড়ি দু’টোতে খাবার আর অন্য জিনিসপত্রের সাথে ছিল সোনা-অনেক সোনা।
সোনা যে ঠিক কতখানি ছিল তা কেউ জানে না। খুবই ধনী ছিল ওরা। কয়েকটা চালায় ভরে সোনার তাল, বার আর মুদ্রা-অর্থাৎ ওদের যথাসর্বস্ব নিয়ে স্যান ফ্রানসিসকো গিয়ে বসবাস করবে ঠিক করেছিল ওরা।
মোহেড ইন্ডিয়ানের সাথে যুদ্ধে একজন মারা পড়ে কলোরাডোয়। বীলি ম্প্রিং-এর কাছে এসে আরও একজন অক্কা পেল। কলোরাডোর যুদ্ধে তীর খেয়ে। জখম হয়েছিল লোকটা। বেশ দুর্বল হয়ে পড়লেও কেউ আশা করেনি লোকটা শেষ পর্যন্ত মারা যাবে।
দূরে উত্তর-পুবে স্যান ফ্রানসিসকোর পাহাড়ের চূড়া দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়ে রাতের মত ওরা বিশ্রাম নেয়ার জোগাড় করছে, এমন সময়ে একদল কয়োটেরো অ্যাপাচি ওদের আক্রমণ করল। তিনদিন ধরে যুদ্ধ চলল-খুব একটা ক্ষতি হলো না ওদের-একজন মরল আর দু’জন আহত হলো। মারাত্মক জখম হয়নি কেউ।
কিন্তু সেই রাতে আহতদের একজন মারা গেল। এবারও লোকটার মৃত্যু হবে কেউ আশা করতে পারেনি। সামনেই কিছু কঠিন পথ পার হতে হবে ওদের, সমৰ্থ সবকয়টা লোকের সাহায্য দরকার। পরপর দু’জন লোক অমন অপ্রত্যাশিত ভাবে মারা যাওয়ায় কেমন একটা ভয় ঢুকে গেছে ওদের মনে। কুসংস্কার বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে ওরা।
মাত্র তেরোজন সমর্থ লোক আর দু’টো মন্থর গতি গাধার গাড়ি নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে জানে ওরা। আহত লোকটার হাত জখম হয়েছে-ঘোড়ায় চড়তে অসুবিধে নেই তার-কিন্তু দু’দুজন জখম লোককে পটল তুলতে দেখে অসম্ভব ভয় পেয়েছে লোকটা-স্বাভাবিক।
পরবর্তী তিনদিন নির্বিঘ্নেই কাটল ওদের। কিন্তু তার পরেই সেই আহত লোকটাও হঠাৎ রাতের বেলা মারা গেল। দলের মধ্যে একজন স্প্যানিশ লোক। প্রতিদিনের ঘটনা ডায়েরীতে লিখে রাখত। মৃতদেহটাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে রবার্তো খেয়াল করল লোকটার কানের কাছে এক ফোঁটা রক্ত দেখা যাচ্ছে। ভাল করে পরীক্ষা করে সে দেখল কানের ভিতর দিয়ে একটা স্টীলের তার মগজে ঢুকিয়ে লোকটাকে খুন করা হয়েছে। তারটা তখনও কানের ভিতরেই রয়েছে। রবার্তো ধরে নিল অন্য দু’জন আহত লোককেও একই উপায়ে মারা হয়েছে। যে-ই মেরে থাকুক, সে এই দলেরই কেউ।
কতদিন আগের ঘটনা এটা?
পনেরো-ষোলো বছর হবে। এখানকার জন্যে ওটা খুব দীর্ঘ সময়। সে যাক, রবার্তো ভয়ে কুঁকড়ে রইল। কাউকেই কথাটা জানাল না। খুনীর উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট-সোনা।
রাতে আগুনের ধারে বসে সবার সামনে ঘটনা খুলে বলল রবার্তো-জানাল তাদের মধ্যেই রয়েছে খুনী। পরদিন সকালে সবাই আবার রওনা হলো বটে, কিন্তু এখন আর কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রবার্তো আর ওর সাথে দলের আর একজন তোক সামনে এগিয়ে চারদিকে খেয়াল রাখছিল, বহুদূরে কয়োটেরোর একটা বিরাট দল দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে সবাইকে সাবধান করল ওরা। ওই ইন্ডিয়ান লোকগুলো ওদের দেখেছে কিনা বলতে পারল না রবার্তো।
ওরা ঠিক করল প্রায় অব্যবহৃত একটা ট্রেইল ধরে উত্তর-পুবে সরে গিয়ে ইন্ডিয়ানদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে যাবে। যুদ্ধ ওরা এড়িয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু সেইসাথে সোনাগুলোও হারাল।
বালুর ঝড়ের মধ্যে পড়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলল। একটা গাধা পাথরে হোঁচট খেয়ে পা ভেঙে বসল। ওটাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হলো ওরা। অনেক সগ্রাম করে পুব দিকে এগিয়ে শেষ পর্যন্ত মরমন কুয়ার কাছে পৌঁছল সবাই।
অবশ্য কুয়াটা তখন ওই নামে পরিচিত ছিল না..নাম থেকে থাকলে ওটার হয়তো ইন্ডিয়ান কোন নামই ছিল। এই মরু এলাকায় প্রচুর পানি পেয়ে খুশিতে সব ভুলে গেল ওরা। সেই রাতেই ওদের আর একজন মানুষ অদৃশ্য হলো। আগুনের জন্য ক্যাম্পের কাছেই কাঠ আনতে গেছিল লোকটা। অনেক পরে সবাই টের পেল কাঠ আনতে গিয়ে লোকটা আর ফেরেনি।
ওর আর দেখা পাওয়া যায়নি। কিছু পায়ের ছাপ অবশ্য পাওয়া গেছিল, কিন্তু কতগুলো পাথরের কাছে এসে চিহ্ন মিলিয়ে গেছে।
একটু চুপ করে কান পেতে শব্দ শোনার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জেকব আবার আরম্ভ করল, এগারোজন বাকি রইল আর। বিজন ক্যানিয়নে পথ হারিয়ে অসহায় বোধ করছে সবাই। কয়েকবার চেষ্টা করে প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত কানা গলির মাথা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। ওয়্যাগনসহ চলা খুব কষ্টসাধ্য হচ্ছে। এই সময়ে ওদের আর একটা গাধা খোড়া হয়ে গেল।
বদমেজাজী হয়ে উঠেছে সবাই। কয়েকবার নিজেদের মধ্যেই মারপিট হবার জোগাড় হলো। ওদের সাথে একজন চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সের ছেলে ছিল; ক্যালিফোর্নিয়া থেকে রওনা হবার সময়ে শেষ মুহূর্তে ওদের সাথে যোগ দিয়েছিল সে। এই ছেলেটাই ভাগ্যক্রমে ওখান থেকে বেরোবার একটা পথ খুঁজে পেয়ে যায়। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে খুব সরু একটা পথ। ওই পথ ধরেই খোলা মরুভূমিতে বেরিয়ে পাহাড় ঘেঁষে অস্পষ্ট পুরোনো ইন্ডিয়ান ট্রেইল ধরে দক্ষিণে রওনা হলো ওরা।
কতদূর এগিয়েছিল তা কেউ বলতে পারে না। পথের মধ্যেই কয়োটেরোর আক্রমণ হলো। আক্রমণটা অপ্রত্যাশিত ভাবে এলেও চট করে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে গেল তারা। ইন্ডিয়ানরা ওদের বেশির ভাগ পশুই তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। যুদ্ধের শেষে দেখা গেল মাত্র চারজন বেঁচে আছে। আর সেই ছেলেটা।
ওই চারজনের মধ্যে রবার্তো ছিল একজন। সে বেঁচে না থাকলে তার ডায়েরী থেকে এসব কথা আর জানা যেত না। যুদ্ধ শেষ হতেই ওদের ভিতরই আর একটা লড়াই বেধে যাবার উপক্রম হলো। মন্টি নামের ছেলেটাকে খুন করার জন্যে খেপে উঠল একজন। অন্যেরা অনেক কষ্টে তাকে থামাল।
ছেলেটাকে মারতে চাইল কেন?
কারণ যুদ্ধের সময়ে ছেলেটা একটা গর্তের ভিতর লুকিয়ে ছিল সারাক্ষণ-বিন্দুমাত্র সাহায্যও সে করেনি।
কিন্তু মন্টি যে ছেলেমানুষ!
পশ্চিমে ছেলেমানুষ বলে কিছু নেই। ওর চেয়েও অনেক কম বয়সের ছেলেদের এখানে বড়দের সাথে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি যুদ্ধ করতে হয়। অন্যান্য বিপদেও তাদের বড়দের সাথে সমান ঝুঁকি নিয়ে সবার দুঃখ-দুর্দশার সমান ভাগ। নিতে হয়।
পশুগুলো সব হারানোর পরে ওয়্যাগন দু’টো ওখানেই ফেলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় রইল না। যে কয়টা বাড়তি ঘোড়া ছিল তাদের পিঠে সোনা বোঝাই করে কঠিন পাথুরে উঁচুনিচু পথ ধরে পাহাড়ের দিকে ফিরে গেল ওরা।
বেশিদূর যাবার সাহস তারা পায়নি-কাছেই এক পাহাড়ের ভিতর একটা গর্তে সোনা লুকিয়ে রাখল। ওদের ভয় ছিল যে-কোন মুহূর্তেই আবার ইন্ডিয়ান আক্রমণ আসতে পারে, মোটে এই ক’জনে আর একটা আক্রমণ কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না ওরা।
লোকালয়ে ফিরে কুলিমজুর ভাড়া করে ওখান থেকে সোনা উদ্ধার করে নিয়ে যেতে যা খরচ পড়বে তার জন্যে যথেষ্ট সোনা মজুদ রেখে বাকিটা লুকিয়ে রাখা হলো। ওদের সবার চোদ্দ-পুরুষ হেসে খেলে রাজার হালে কাটিয়েও শেষ করতে পারবে না এত সোনা। কিন্তু মন্টির কাপুরুষতার জন্যে ওকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওর হাত-পা আর চোখ বেঁধে সোনা লুকিয়ে রেখে এল ওরা।
ওদেরই কেউ বাকি দু’জন বা তিনজনকে খুন করেছিল। ছেলেটা খুন হয়েছিল কি বেঁচে আছে জানা যায়নি।
মাঝে মাঝে ঘোড়া বদল করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে শেষ পর্যন্ত ওরা সান্তা যে পৌঁছল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না বলে শহরে পৌঁছে আলাদা হয়ে গেল সবাই। পরদিন সকালে রবার্তো আর একজনকে সাথে নিয়ে সাথীর খোঁজে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেখল বুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় নিজের কামরায় মরে পড়ে আছে লোকটা।
কথা ছিল শহরে পৌঁছেই লোকজন জুটিয়ে সোনা উদ্ধার করে নিয়ে আসবে ওরা। কিন্তু ভাব-গতিক দেখে বিকেলের আগেই সরে পড়ল রবার্তো-যথেষ্ট ধকল গেছে ওর উপর-সোনার ভাগ আর চায় না সে। ল্যাস ভেগাস হয়ে সেইন্ট লুই চলে গেল সে। আর ফেরেনি-অন্যদের কী হলো তাও আর খোঁজ করার চেষ্টা করেনি।
ওর সাথীরা নিশ্চয়ই সোনার জন্যে ফিরে এসেছিল?
হয়তো-কিন্তু গুপ্তধন-শিকারীদের ধারণা ভিন্ন। অবশ্য তার কারণও আছে। আসলে রবার্তোর ডায়েরীটা না থাকলে এসব কিছুই জানা যেত না। যতদূর জানা গেছে ওর সঙ্গীরা খুন হয়েছে।
সবাই?
পকেট থেকে পাইপ বের করে তাতে তামাক ভরে সে জবাব দিল, হ্যাঁ, কেবল সেই ছোট ছেলে মন্টি ছাড়া আর সবাই মৃত।
ওদের কে খুন করল তা জানা যায়নি?
না।
জে, আমরা একটু খুঁজে দেখলেই তো পারি? এই এলাকাটা তোমার ভালই চেনা আছে। ভাল করে খুঁজলে হয়তো পেয়েও যেতে পারি!
সুইটি, ওই সোনালী ঘোড়াটা আমার চোখে সোনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর আর লোভনীয়। তা ছাড়া এই নির্জন এলাকায় ওটা সোনার চেয়ে অনেক বেশি কাজে আসবে। ওই সোনার কথা ভুলে যাওয়াই ভাল-ওর পিছনে ছুটে এ পর্যন্ত অনেক লোক মারা পড়েছে।
এই এলাকাতেই কোথাও লুকানো আছে সোনা, তাই না?
অন্ধকারে কয়েক সেকেন্ড কান পেতে শুনল সে। ডালিয়াও জবাবের জন্য তাগাদা দিল না। সে জেনে ফেলেছে এটা ওর অভ্যাস। কথার ফাঁকেও বারবার জেকব ঘোড়াগুলোর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করে দেখছে, লক্ষ করেছে ডালিয়া। বিপদ এলে ঘোড়াই মানুষের আগে তা টের পাবে।
কেলভিন ওই সোনা অনেকদিন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে-পায়নি। রবার্তোর মৃত্যুর পরে ওই ডায়েরীটা ওর ভাগনের হাতে পড়ে। সে সোনার খোঁজে এখানে এসেছিল, ওর সাথেই কেলভিন প্রথম এই এলাকায় আসে। এখন সম্ভবত এই এলাকা সম্বন্ধে ওর চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।
ওরা তা হলে সোনা খুঁজে পায়নি?
না তবে একদল পিউটে ওদের খুঁজে পেয়েছিল। ইন্ডিয়ান যোদ্ধার একটা দল ডার্টি ডেভিল হয়ে কলোরাডোতে ঢোকে। আক্রমণ করে রবার্তোর ভাগনে আর কেলভিনকে জখম করে ওদের ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছিল ইন্ডিয়ানরা।
একমাস আধপেটা খেয়ে পায়ে হেঁটে বহু কষ্ট সহ্য করে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে ফিরেছিল ওরা। রবার্তোর ভাগনের সোনার লোভ পুরোপুরি মিটে গেছিল ওই একমাসে। মামার ডায়েরীটা কেলভিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুবে চলে যায় সে। মিসিসিপির পশ্চিমে কেলভিন ছাড়া সম্ভবত এক মাত্র আমিই ওই ডায়েরীটা নিজের চোখে দেখেছি।
উঠে ঝোঁপের ভিতর দিয়ে ওপাশে চলে গেল জেকব। উৎকর্ণ হয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করছে সে। ডালিয়া কিছুতেই বুঝে পায় না লোকটা কী করে ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে এমন নিঃশব্দে যাতায়াত করে।
ঝোঁপের ভিতর একা চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল জেকব-শুনছে। মনের মধ্যে নিজেদের পরিস্থিতিটা পর্যালোচনা করে নিচ্ছে সে।
ফ্রীডমের লোকগুলো সহজে তার পিছু ছাড়বে না-ওদের চেহারা দেখে সে বুঝেছে ওরা সবাই দৃঢ়সংকল্পের অধিকারী। নিকোলাসের কথাও ভাবছে সে। ওই লোকটাও ছাড়বে না তাকে। হঠাৎ তার মনে হলো দু’টো দলের তো একই উদ্দেশ্য-তাকে খুঁজে বের করা, ওরা একত্র হয়ে কাজে নামেনি তো? চতুর লোক নিকোলাস। শক্তি বাড়াবার সুযোগ কোনমতেই ছাড়বে না সে।
ইচ্ছা করেই ফ্রীডমের লোকগুলোকে মরমন কুয়ার কাছে নিয়ে গিয়েছিল জেকব। সে ভেবেছিল সোনার লোভে পড়ে ওর কথা ভুলে লোকগুলো সোনা। খুঁজতে লেগে যাবে। কিন্তু ঘটানচক্রে মনে হচ্ছে তার ফন্দিটা ঠিক কাজে লাগেনি।
এই এলাকাটা বিরাট, কিন্তু এতগুলো লোক যদি একসাথে তাকে খুঁজতে শুরু করে, তবে ঠিকই বের করে ফেলবে।
ওই স্ট্যালিয়নটার সাথে ওই দলের আরও কয়েকটা ঘোড়া ধরতে হলে জেকবের কিছু সময় দরকার। ওগুলো কোথায় পানি খায়, কোথায় ওদের ফাঁদে ফেলে ধরতে সবচেয়ে সুবিধা হবে, এসব সঠিক জেনে নিতে ওর অন্তত পক্ষে তিরিশ-চল্লিশ দিন সময় লাগবে-বেশিও লাগতে পারে।
বিকল্প একটা উপায় বের করতে হবে ওকে। যে করেই হোক ওদের ধোকা দিয়ে বোঝাতে হবে যে সে এই তল্লাট ছেড়ে চলে গেছে।
ভাবতে ভাবতেই সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল জেকবের ঠোঁটে। একটা পথ বের করে ফেলেছে সে।
০৮. টিউবা সিটির দিকে পা
ইচ্ছা করেই এতদিন টিউবা সিটির দিকে পা বাড়ায়নি জেকব। ওর পক্ষে ফ্রীডম শহরের চেয়ে টিউবা যাওয়া অনেক সোজা হত-কাছেও পড়ত। তবু সে টিউবা যায়নি কারণ ওখান থেকে রসদ আনতে গেলে তার এই অঞ্চলে উপস্থিতির খবর অ্যারিজোনার শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
কিন্তু এখন ঠিক তাই সে চাইছে।
সব গুছিয়ে নাও, ডালিয়াকে বলল জেকব। আমরা এদেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রেসকটের দিকে রওনা হব।
ডালিয়ার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে আবার সে বলল, অন্তত সেই রকমই ভাব দেখাব আমরা। প্রেসকটের দিকে রওনা হয়ে যেন সত্যি ওই দিকেই যাচ্ছি এমন ভান করব-পরে বালির পাহাড়গুলো ঘুরে আবার এদিকে ফিরে আসব। বালুর ওপর আমাদের সব ছাপ খুব জলদি মিলিয়ে যাবে।
তুমি ওদের বোঝাতে চাও যে আমরা চলে গেছি?
কিছু সময় খরচ হবে, কিন্তু অনেক ঝামেলা থেকে আমরা বেঁচে যাব।
কিন্তু ওরা যদি টিউবা সিটিতেই আস্তানা গেড়ে থাকে? ওদিক দিয়েই তো যেতে হবে আমাদের?
হতে পারে। সম্ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদি তাই হয়, তবে ওখানেই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। ভাগ্যে থাকলে তাই হবে।
মানুষে মানুষে একটা অদৃশ্য নিয়তির যোগসূত্র থাকে। সেই টানেই হয়তো সেদিন রাতে হঠাৎ লী-র ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে শুয়ে থেকেই নিজের দুই হাতের উপর মাথা রেখে অন্ধকার রাত্রির দিকে চেয়ে রইল সে।
নিকোলাসের উপর নির্ভর করে আর বসে থাকা যায় না। আগামীকাল কী। তার র্যাঞ্চের কাজ শেষ করে কিছুদিন ফুরসত পাবে-ইউজিনও আসবে ওর সাথে।
ইউজিনের কথা মনে পড়তেই একটু বিরক্তি বোধ করল লী। ওর গা জ্বালানো উদ্ভট মন্তব্য, আর শেষের দিকে এই মিশনের প্রতি আস্থার অভাবই লী-র এই বিরক্তির কারণ। চুলোয় যাক ওর কথা…এমনিতে অবশ্য লোক হিসাবে ইউজিন খুব খারাপ নয়।
লী-র চিন্তাধারা উত্তরে মোড় নিল এবার। টিউবা সিটি..হা ওখানেই যাবে সে। নাভাজো এলাকায় কেউ থাকলে টিউবা সিটিতে ঠিকই তার খবর পাওয়া যাবে। আর তা ছাড়া রসদের দরকার হলে, ফ্রীডমে আসার পথ যখন বন্ধ, জেকবকে টিউবা সিটি থেকেই তা সগ্রহ করতে হবে। ফ্রীডমে না ফিরে আগেই ওদের টিউবা গিয়ে জেকবের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত ছিল।
অন্ধকার কাটেনি, তবু বিছানা ছেড়ে উঠে জামাকাপড় পরে নিল লী। আগুনটাকে একটু উস্কে দিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালাল সে। তারপর উইনচেস্টারটা নামিয়ে পরিষ্কার করতে বসল। ওর সামনে আগুনের শিখা যুদ্ধের নাচ নাচছে।
আরও উত্তরে পাহাড়ের একটা খাঁজের ভিতরে লকলকে ফণা তুলে নাচছে আর একটা আগুন। আগুনের পাশে কুঁজো হয়ে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন নিকোলাস। ওর সঙ্গী দু’জনের একজন এখনও ঘুমাচ্ছে, অন্যজন সজাগ রয়েছে। একবার ওদিকে চেয়ে দেখল নিকোলাস।
টিউবায় ফিরে যাব আমরা, বলল নিক। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথেই রওনা হব।
ঠিক আছে, লম্বা চিকন মুখো লোকটা সাড়া দিল। যুবকের চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল। ওদের দুজনকে ধরার পর মেয়েটাকে কে পাচ্ছে? প্রশ্ন করল সে।
নিকের প্রকাণ্ড মাথাটা ধীরে ধীরে ওর দিকে ঘুরল। চোখে-চোখে চেয়ে আছে লোকটার দিকে সে-ঠাণ্ডা আর স্থির ওর চোখ দুটো। আমি, শান্ত গলায় জবাব দিল নিকোলাস। আমার আশ মিটে গেলে ইচ্ছা করলে তুমি ওকে পেতে পারো। তবে একটা কথা, আমাদের কাছ থেকে কোন অবস্থাতেই ওকে জীবিত ফিরতে দেয়া চলবে না।
অবজ্ঞাভরে কাঁধ ঝাঁকাল যুবক। তাতে আপত্তি নেই আমার, বলে আগুনের কাছ থেকে একটু সরে স্থির দাঁড়িয়ে দূরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল সে। সেই চোখা চূড়াটা উত্তর দিকে দেখা যাচ্ছে। তা হলে…
ফিরে চাইল সে। আগুনটাকে একটু খুঁচিয়ে দিচ্ছে নিক। ওকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না যুবক। এতে ওই বিশাল লোকটার একটা মতলব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা কী তা জানার কোন আগ্রহ তার নেই। সে-ও একটা নিজস্ব পরিকল্পনা আর উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছে এখানে।
উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। ঘুমাতে যাচ্ছি আমি। তুমি আমাদের ঘোড়াগুলোর একটু দেখাশোনা করো, মন্টি।
.
যাযাবর নাভাজোদের তৈরি পরিত্যক্ত কঁচা ঘরগুলো নিয়েই গড়ে উঠেছে টিউবা সিটি ব্যবসা কেন্দ্র। একজন হোপি চীফের নামেই এই শহরের নাম।
জেকব তার পিস্তলের ট্রিগার থেকে চামড়ার বেল্টটা সরিয়ে ফেলল। ঘোড়ার পিঠে খাপে ভরা উইনচেস্টার রাইফেলটাও সহজে বেরিয়ে আসে কিনা একবার পরখ করে দেখল সে।
টিউবা পোস্টের দিকে এগিয়ে উত্তর দিককার বালির ঢিবির মধ্যে দিয়ে ঘুরে পশ্চিমে গিয়ে ভাল করে পরিস্থিতিটা বুঝে নিল। মাত্র একটা ক্লান্ত দুর্বল ইন্ডিয়ান টাট্ট বাঁধা রয়েছে পোস্টের বাইরে। শান্ত পরিবেশ-সকালের স্তব্ধ বাতাসে চিমনির ধোয়া অলস গতিতে পাক খেয়ে উপরে উঠছে।
ঘরটা কাঁচা বলে ভিতরটা বাইরে থেকে অনেক ঠাণ্ডা। একটা লিকলিকে পাতলা লোক কাউন্টারে বসে চামড়ার ফিতে দিয়ে বেণী গেঁথে বেল্ট তৈরি করছে। আগুন নেভানো ফায়ার-প্লেসের কাছে আর একটা চেয়ারে পা তুলে দিয়ে বসে আছে একজন শক্তিশালী পেশীওয়ালা মানুষ। লোকটার কঠিন তামাটে মুখে দু’টো গভীর লম্বা ক্ষত চিহ্ন।
দোকানদারির কাজ কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকে আমার, অসন্তোষ প্রকাশ করল রোগা লোকটা। কিন্তু তবু কিছুটা স্বস্তি, নাভাজো ইন্ডিয়ানের দল ওদের ছাগল নিয়ে সরে গেছে আরও ভিতর দিকে পাহাড়ের উপর। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে আর কোন ইন্ডিয়ান দেখিনি আমি।
ষণ্ডা-মার্কা লোকটা পাইপ হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। সব সময়েই বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যায় এমন জায়গায় ওর বসার অভ্যাস। বদ্ধ পরিবেশে দম আটকে আসে ওর।
তুমি কি আবার সোনার খোঁজে বেরুবে, কেলভিন? কথা বলার সঙ্গী পেয়ে পাতলা লোকটা খুব খুশি। চুপ করে থাকতে শেখেনি সে-বলার কিছু না থাকলেও বকবক করাই চাই
হু, জানালা দিয়ে দুজন মানুষকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখে সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিল কেলভিন। উত্তর দিক থেকে পৌঁছেছে ওরা, অথচ এখন আসছে পশ্চিম থেকে। অর্থাৎ ঘরের বাইরে কয়টা ঘোড়া বাধা আছে দেখে নিয়ে তবেই আগে বেড়েছে। ওদের মধ্যে একজন মেয়ে। পাশ ফিরে জিনে বসার ভঙ্গি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। এদেশে মেয়েদের সচরাচর ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে দেখা যায় না।
এক মিনিট পরে পাইপ ধরিয়ে তাতে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে কেলভিন বলল, দু’জন অতিথি আসছে। নিজেকে একটু দুরস্ত করে নাও-ওদের একজন আবার মহিলা।
চমকে উঠে কাউন্টার থেকে নেমে তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে উঁকি দিল সে। তাই তো? এ যে দেখছি সত্যিই একজন জলজ্যান্ত ভদ্রমহিলা!
ঘোড়া বাঁধার রেলের কাছে পৌঁছে নিচু গলায় মহিলাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল পুরুষ লোকটা। মেয়েটি ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল।
ঝামেলা, বলে উঠল কেলভিন।
বুঝলাম না, কী বললে?
কিছু না। নিজের মনেই কথা বলছি। তুমি এদিকে কান দিয়ো না।
রাইফেলের ব্যারেল দিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল জেকব। এতে ওর উই চেস্টারটা কাউন্টারের দিকে তাক করা থাকল। কিন্তু ওটা কোমরের কাছে। ধরা রয়েছে বলে ভিতরে বসা লোকের কাছে আপত্তিজনক বা অশোভন দেখাল না।
কেলভিনের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও আবার পাইপ মুখে দিয়ে চুপ করে গেল সে। জেকব ওর দিকে এমনভাবে চাইল যেন ওকে চেনেই না সে।
এখানে মহিলাদের হাত-মুখ ধোয়ার কোন জায়গা আছে? আমার স্ত্রীর জন্য বলছি।
নিশ্চয়ই, ব্যস্ত হয়ে উঠে হাত দিয়ে তার পিছনের দরজাটা দেখাল রোগা লোকটা। মালিকের থাকার ঘরটায় সব ব্যবস্থাই আছে-এটা ব্যবহার করতে পারে তোমার স্ত্রী।
ঘাড়টা সামান্য ফিরিয়ে ডালিয়াকে ভিতরে আসতে বলে ঘরে ঢুকল জেকব। ওকে ঘোড়া থেকে নামাতে গেলে ভিতরের দিকে পিঠ ফেরাতে হবে-কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে। কেলভিনের সাথে গত কয়েক বছরে তার আর দেখা হয়নি, তবু ওর তরফ থেকে বিপদ আশা করছে না জেকব।
আমাদের কিছু রসদ দরকার, যত্ন করে লেখা একটা তালিকা কাউন্টারের উপর রাখল সে। এদিকে পশ্চিমে সবচেয়ে কাছে পড়বে প্রেসকট, তাই না?
হুঁ। দরজার দিকে চেয়ে ছিল লোকটা, ডালিয়াকে ঢুকতে দেখে চোখ দু’টো ওর উপরই আটকে গেল। মেয়েটার উপস্থিতি এই সাদামাঠা ঘরটার চেহারাই পালটে দিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় চলেছ? ডালিয়ার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই জেকবকে প্রশ্ন করল লোকটা।
না, প্রেসকটের আশেপাশেই কোথাও..হয়তো স্কাল ভ্যালিতে যাব।
দরজার ওপাশে হাত-মুখ ধুতে গেল ডালিয়া। তালিকা অনুযায়ী মালপত্র জড়ো করায় ব্যস্ত হলো লোকটা। ফায়ার-প্লেসের কাছে গিয়ে দাড়াল জেকব
এখান থেকে পশ্চিমের পথটা কেমন? কেলভিনকে প্রশ্ন করল সে।
মাঝবয়সী কেলভিন কৌতুকপূর্ণ চোখে ওর দিকে চেয়ে জবাব দিল, দু’একবার ওদিকে গেছি আমি..রাস্তাটা মোটামুটি ভালই।
নিচু গলায় সে প্রশ্ন করল, ফ্রীডমের লোকটাকে তুমিই মেরেছ?
হ্যাঁ।
চেহারার বর্ণনায় তোমার সাথে মিল আছে…কিন্তু ঘটনার বর্ণনায় নেই।
বারের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে ছিল সে। সামান্য ঘুরেই গুলি করে লোকটা। আমার প্রথম গুলি লাগে ওর বাম কাঁধের পিছনে, ঠিক মেরুদণ্ডে। দরজাটাকে বাঁ দিকে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল, চালাকি করে সামনের দিকে কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে বাম কনুইয়ের তলা দিয়ে গুলি চালিয়েছিল সে। অন্যায়ভাবে ওকে মারিনি।
সে বিষয়ে কখনোই সন্দেহ করিনি আমি।
কাউন্টারের লোকটা মাপজোখ করে প্যাকেট গুছাচ্ছে।
ওরা তোমাকে ধরার জন্যে একজন কঠিন চেহারার অপরিচিত লোককে মার্শাল নিযুক্ত করেছে।
নিকোলাস?
চমকে মুখ তুলে চাইল কেলভিন। তুমি চেনো ওকে?
একটু আড়াআড়ি আছে আমাদের, বদ্ধ দরজাটা দেখিয়ে সে বলল, ওকে নিয়ে।
কিছুটা সময় নীরবে কাটল। লিস্ট দেখে প্রত্যেকটা জিনিসই খুঁজে বের করতে হচ্ছে। বেচারী নতুন মানুষ। মালিক ওর উপর ভর দিয়ে ব্যবসার কাজে প্রেসকট গেছে। দেরি হচ্ছে, কিন্তু জেকবের তাড়া নেই।
ওদিকে তিনজন লোক রয়েছে, ওদের চেনো তুমি?
একটু ইতস্তত করে কেলভিন বলল, না,…ঠিক চিনি বলা যায় না। ওদের একজন সম্ভরত নিকোলাস।
আরও অনেক লোকই আসবে এখন। আমি ওদের মরমন কুয়ার কাছে নিয়ে গেছিলাম।
শুনেছি। মেঝেতে পা নামিয়ে বসল, কেলভিন। তাতে ওদের কোন কাজ হবে না। বহু বছর আগে থেকেই জায়গাটা চিনি আমি-লাভ হয়নি। হঠাৎ কী মনে করে সে আবার বলল, তুমিও কি সেই হারানো ওয়্যাগনগুলো খুঁজছ নাকি?
আমি? আরে না! আমিও সোনার আশাতেই ঘুরছি, তবে আমার সোনা চার খুরের ওপর দাঁড়ানো একটা স্ট্যালিয়ন।
দু’একবার আমার চোখেও পড়েছে। সত্যি, ওটা একটা ঘোড়ার মত ঘোড়াই বটে!
কেউ জানতে চাইলে বোলো প্রেসকটে স্কাল ভ্যালিতে গেছি আমি। ওখানেই বাস করব।
সুন্দর জায়গা।
অযাচিতভাবে প্রশ্ন করা বা কিছু বলা, কেলভিনের স্বভাববিরুদ্ধ। জেকব যে প্রেসকটে যাচ্ছে না তা আগেই আন্দাজ করেছে সে। নিজে যেমন নেশার ঘোরে সোনার পিছনে ঘুরছে, জেকবও তেমনি ঘুরছে ঘোড়ার পিছনে। ঘোড়া ছেড়ে নড়বে না ও।
ডালিয়া এঘরে ফিরে এল। ওর দিকে চেয়ে নতুন করে বিস্মিত হলো কেলভিন একেই বলে রূপ! ঈশ্বর, তুমি মহান!
ছালায় বাঁধা রসদ তুলে নিয়ে বাইরে মালবাহী গাধাগুলোর কাছে গেল জেকব। ট্রেইলের দিকে চেয়ে দেখল। পাহাড়ের ভিতর ঢোকার আগে পর্যন্ত স্বস্তি পাবে না সে। গাধার পিঠে বোঝাটা তুলে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা শেষ হতেই ডালিয়া এগিয়ে গেল ওর দিকে। দোকানির সাথে কেলভিনও দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছে।
ডালিয়াকে ধরে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিয়ে ওদের দিকে ফিরে জেকব বলল, স্কাল ভ্যালির ওদিকে যদি কখনও তোমরা যাও, আমার ওখানে অবশ্যই এসো-তোমাদের দু’জনেরই দাওয়াত রইল।
কেউ আসছে, বলল কেলভিন। দু’জন ঘোড়সওয়ার।
আতঙ্কিত কণ্ঠে ডালিয়া ডাকল, জে!
ভয় পেয়ো না।
মাত্র দু’শো গজ দূরে, পশ্চিম দিক থেকে আসছে ওরা-অর্থাৎ ওরা ফ্রীডমের লোক হওয়াও বিচিত্র নয়। স্বাভাবিক নিশ্চিন্ত গতিতে এগিয়ে আসছে। একটু একটু করে কিছুটা সরে গেল জেকব। এখন গোলাগুলি হলে ডালিয়ার গায়ে লাগার ভয় নেই।
কাছে এসে ঘোড়ার গতি কমিয়ে দিয়েছে ওরা। জিনের পেটি বাঁধার ছলে নিজের ঘোড়ার আড়ালে রইল জেকব
এসে পড়ল ওরা। ওদের দুজনকেই চিনতে পারল জেকব। তার পিছনে ধাওয়া করে যে দলটা গেছিল, এরা সেই দলে ছিল।
নিজের ঘোড়াটা কাঠের রেলের সাথে বেঁধে রেখে দরজার দিকে চাইল বার্ট। দেখল কেলভিন সন্ত্রস্তভাবে ওখান থেকে সরে দাড়াল। ওর হাবভাবে ঝট করে মাথা ঘোরাল বার্ট। তার ভয় হচ্ছে হয়তো এই সেই লোক।
এই অবস্থায় ওর পক্ষে দ্রুত পিস্তল বের করে গুলি করা অসম্ভব। লক্ষ্য ভেদ করতে হলে তাকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে তাক করে গুলি ছুঁড়তে হবে। ক্লাইভ যে ঠিক কোথায় আছে দেখতে পাচ্ছে না-সে তার পিছনেই বাম দিকে কোথাও আছে।
জেকব যেখানে রয়েছে সেখান থেকে ওদের দুজনকেই গুলির আওতায় পাচ্ছে। এসব কিছুই না বুঝে নিশ্চিন্ত মনে জিনের পেটি খুলছে ক্লাইভ। বার্ট ঘামছে।
বেশ, বেশ, এই তো চাই, কর্কশ চড়া সুরে বলে উঠল বার্ট। ঘোড়ার খুব যত্ন নেয় এমন লোকই আমার পছন্দ!
তোমার আবার হঠাৎ কী হলো? ক্লাইভের গলায় বিস্ময় প্রকাশ পেল। আমি
এতক্ষণে জেকবের দিকে চোখ পড়ল তার। একেবারে স্থির হয়ে জমে গেল ক্লাইভ। জেকব যে তৈরি হয়ে আছে তা বুঝিয়ে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
তোমরা দু’জন পিস্তলের বেল্ট দুটো খুলে ফেলল, শান্ত গলায় বলল জেকব। শান্তিপূর্ণ জায়গা এটা, একে গোলাগুলি করে রক্তাক্ত করা ঠিক হবে না। লক্ষ্মী ছেলের মত বেল্ট খুলে মাটিতে ফেলে দাও।
এই যে শোনো, শুরু করল ক্লাইভ। আমি…’
চুপ করো, ধমকে উঠল বার্ট। যা বলা হচ্ছে, তাই করো!
দু’টো বেল্টই মাটিতে পড়ল। দোকানির উদ্দেশে জেকব বলল, বেল্ট দু’টো তুলে নিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান, আমাদের মাঝখানে দাড়িয়ো না যেন-ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।
ওগুলো উঠিয়ে নেওয়া হতেই ঘোড়ার পিছন থেকে বেরিয়ে এল জেকব। এবার একটু পিছনে সরে স্থির হয়ে বসো। বাইবেলের বাণী শোনাব আমি।
সংক্ষেপে ডেরিকের মৃত্যুর ঘটনাটা সে বর্ণনা করল। শেষে বলল, আমার পিছনে ধাওয়া করার জন্যে তোমাদের দোষ দিই না আমি, কারণ তোমরা আসল ঘটনা জানতে না। এখন জানলে।
অর্থাৎ কী বলতে চাও তুমি? উদ্ধত কণ্ঠে প্রশ্ন করল বার্ট।
মানে এর পরেও যদি আমার পিছনে তোমাদের ঘুরতে দেখি তা হলে ধরে নেব বন্ধুত্ব চাও না তোমরা।
তোমার পিছনে ঘুরছি কে বলল? প্রতিবাদ করল ক্লাইভ। আমরা দু’জন তো সোনা খুঁজতে এসেছি!
সেটা তোমাদের খুশি। কিন্তু মনে রেখো আবার আমার পিছনে লাগতে আসলে চিরদিনের মত তোমাদের জন্যে ছয়ফুট মাটির ব্যবস্থা আমি করব।
ইচ্ছা করেই ওদের দিকে পিছন ফিরে ঘুরে নিজের ঘোড়র কাছে এগিয়ে গেল জেকব। ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল দুজনের কেউ বিন্দুমাত্র নড়েনি।
চুপ করে থাকার মানুষ নয় বার্ট। সে বলে উঠল, তুমি খুব বাহাদুর, কিন্তু তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। এটা জেনো, মরণ লেখা আছে তোমার কপালে। লী যদি তোমাকে শেষ করতে নাও পারে, নিকোলাস অবশ্যই করবে।
ওর কথায় কান না দিয়ে ডালিয়াকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল জেকব। একবার পিছন ফিরে দেখল ওরা দু’জন তখনও বসেই আছে। ওরা ছোট পাহাড়টার ধারে পৌঁছা’নো পর্যন্তও দু’জনে বসেই রইল। যখন উঠল তখনও কোন তাড়াহুড়া দেখা গেল না ওদের মধ্যে।
তোমাকে দেখে ভয়ে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল ওরা, বলল ডালিয়া।
না, লিয়া, ভীতু নয় ওরা। ওদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলাম আমি। ওই অবস্থায় নেহাত হাঁদারাম ছাড়া ঝুঁকি নেবে না কেউ। ভিন্ন পরিস্থিতিতে ওরা আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবে না।
তুমি যা করলে তাতে শক্ত নার্ভের দরকার।
নিজের কর্তব্য মানুষকে করতেই হয়।
সোজা পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল ওরা। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে কেউ অনুসরণ করছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখছে জেকব। কিন্তু ধুলো ওড়ার কোন চিহ্ন দেখা গেল না।
ওই লোকটার সাথে তোমার আগের পরিচয় ছিল?
কেলভিনের সাথে? হ্যাঁ, ওকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি। হারানো ওয়্যাগনের সোনা যদি কেউ খুঁজে বের করতে পারে, তবে কেলভিনই পারবে।
নিশ্চিত হয়ে অমন কথা কেউ বলতে পারে না। যে কেউ পেতে পারে। অপ্রত্যাশিত ভাবেও বেরিয়ে পড়তে পারে ওগুলো। বলেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ডালিয়া। উদ্বিগ্ন স্বরে সে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় ওরা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? মনে করবে আমরা সত্যিই দেশ ছেড়ে চলে গেছি?
আশা করতে দোষ নেই। এবারে ওই ঘোড়াগুলোর জন্যে ফিরে যাব আমরা।
ঘোড়া নিয়ে প্রেসকটে ফিরলে তো ওরা ওখানের হামলা করতে পারে?
হয়তো। কিন্তু আমার ধারণা ওরা প্রেসকটে আমাদের খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়ে ওই এলাকায় আর খুঁজতে যাবে না।
ছায়া দেখে সময় অনুমান করার চেষ্টা সরল জেকব। সামনে একটা জায়গা আছে যেখানে মুহূর্তের জন্যও বালু স্থির থাকে না। রাতের অন্ধকারে সে ওখানে। পৌঁছতে চায়। তা হলে ওদের পায়ের ছাপ তো থাকবেই না, উপরন্তু অন্ধকারে ওরা যে কোনদিকে গেছে সেটা কারও দেখে ফেলারও ভয় থাকবে না।
০৯. ওয়ার গড প্রিং-এর পাহাড়ের উপর
ওয়ার গড প্রিং-এর পাহাড়ের উপর থেকে দক্ষিণ দিকের ভাঙা-ভাঙা জমিটা খুঁটিয়ে দেখছে জেকব। দূরবীন চোখে লাগিয়ে ঈষৎ অন্ধকার ছায়া থেকে শুরু করে ওই এলাকার প্রতিটি ফাটল আর খাজ এক এক করে খুঁটিয়ে দেখল সে। টিউবা সিটির দোকান থেকে বেরিয়ে আজ দশ দিনের মধ্যেও কারও অনুসরণ করার আভাস পায়নি-স্ট্যালিয়নটারও দেখা মেলেনি।
বোঝাই যাচ্ছে কোন কারণে ভয় পেয়েই এই পথে যাতায়াত বন্ধ করেছে-কিন্তু ওরা গেল কোথায়? এদিককার তাজা ঘাস আর চমৎকার টলটলে পানির লোভে ঘোড়াগুলো প্রায়ই এদিকে আসে, জানে জেকব। আজ সকাল থেকেই সে অনুভব করছে কেউ যেন তাদের উপর নজর রাখছে। কেবলই মনে হচ্ছে তার অজান্তে যেন কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু তার এই দুশ্চিন্তার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই-ধোয়া বা ধুলো কিছুই তার চোখে পড়েনি। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রটা চোখ থেকে নামিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল সে।
এতক্ষণ যেদিকটা খুঁটিয়ে দেখে ফিরল, সেদিকেই বহুদূরে বাতাসে সামান্য একটু ধুলো উড়ে হালকা হয়ে প্রায় মিলিয়ে গেল। তারপরে আবার ধুলো উড়তে উড়তে সেটা সরলরেখায় উত্তর-পুবে এগিয়ে চলল।
আগুনের পাশ থেকে ডালিয়া মুখ তুলে চাইল। বলল, জে, আমি অনেক ভেবে দেখলাম, অরগ্যান রকে ঘোড়াগুলোকে আমরা শেষ দেখেছি, ওখানেই আমাদের ফিরে যাওয়া দরকার।
ওখানে কেন?
আমার মনে হয় ওই দলের লীডার দলটাকে পথ দেখিয়ে বিশেষ কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিল-আমাদের দেখেই সে তখনকার মত ঘুরে অন্যদিকে চলে গেছিল। ওখানে গেলে এখনও হয়তো কিছু পায়ের চিহ্ন পাওয়া যাবে।
চিন্তাধারাটা যুক্তিসঙ্গত, স্বীকার করল জেকব। জন্তুরা একটু একরোখা স্বভাবের হয়। একবার কোথাও যাবার ইচ্ছা জাগলে যতক্ষণ না যেতে পারবে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়েই যাবে।
মুশকিল হলো এখান থেকে অরগ্যান রকে পৌঁছা’নোর একটা সোজা পথ হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু জেকবের তা জানা নেই। চেনা পথে যেতে হলে আর দক্ষিণ দিকে ফিরে যেতে হবে, অবাঞ্ছিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। আর উত্তরে পড়বে স্যান জুয়ান নদী-নদীটা বেশ চওড়া আর গভীর।
কফির স্বাদটা খুব ভাল হয়েছে। কাপটাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ডালিয়ার দিকে চেয়ে সে বলল, আচ্ছা, তুমি তো এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নও। হাঁপ ধরে যায়নি তোমার?
হাসল ডালিয়া। জে, তোমাকে তো বলেছি, যার জন্যে পিছুটান থাকতে পারে এমন কোন মূল্যবান জিনিস আমি পিছনে ফেলে আসিনি। অবশ্য আমার পরিচিত লোকজন কে কী করছে মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করে-কিন্তু ফিরে যাবার ইচ্ছা আমার মোটেও জাগে না। বাবা বলতেন আমার মধ্যে নাকি আমাদের ভাইকিঙ পূর্ব পুরুষদের প্রভাবটা বেশি।
একটু এদিক ওদিক চেয়ে আবার জেকবের দিকে চোখ ফেরাল ডালিয়া। বিশ্বাস করো, জীবনে এত আনন্দের স্বাদ আর আমি পাইনি। প্রকৃত সুখের সংসান আমি পেয়েছি এখানে।
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই একটা আবছা ইন্ডিয়ান ট্রেইল ধরে রেইনবো প্ল্যাটুর উপর দিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা। পরে একটা ফিরতি ট্রেইল ধরে পিউটে ক্রীকে নেমে এল।
জেকবকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। তার উদ্বেগের কারণ ডালিয়ার কাছে প্রকাশ করল সে। এই এলাকাটা আমার পরিচিত নয়, লিয়া। এদিক দিয়ে পিউটে মেসায় পৌঁছবার কোন পথ খুঁজে না পেলে আবার আমাদের দক্ষিণে ফিরে যেতে হবে।
পশ্চিমে মহিলাযাত্রী সাথে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চলাফেরা করা মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা। ডালিয়া, ভালর জন্যই জেকবের ভাবনা হচ্ছে, সে একা থাকলে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দরকার পড়ত না। এখানকার যতরকম কষ্ট, ক্ষুধা, পিপাসা, গরম আর ঠাণ্ডা সবকিছুর সাথেই তার পরিচয় আছে–সহ্য করার ক্ষমতাও আছে। কিন্তু ডালিয়া সাথে আছে বলেই তার এই উদ্বেগ।
নাকিয়া ওয়াশের তলায় কিছুটা বৃষ্টির পানি জমেছে। ঘোড়াগুলোকে ওখানে একটু বিশ্রাম দিল জেকব। পথ চলা এখনই বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে, হয়তো সামনে আরও কষ্টসাধ্য হবে। এখানে দক্ষিণ দিক থেকে যে ট্রেইলটা এসেছে সেটা বেশ স্পষ্ট। সম্ভবত এটাই মেসার উপর ইন্ডিয়ান বসতির ধ্বংসাবশেষে গিয়ে শেষ হয়েছে।
পানির কাছ থেকে ঘোড়াগুলোকে বেশ কিছুদূর হাঁটিয়ে নিয়ে ঝোঁপ থেকে একটা পাতাসহ ডাল ভেঙে আবার ফিরে গেল জেকব। ডাল দিয়ে ঘষে পায়ের চিহ্নগুলো মুছে তার উপর বালু ছিটিয়ে দিল সে।
প্রায় মিলিয়ে যাওয়া আবছা একটা ট্রেইল ধরে ক্লিফের ধারে পৌঁছল ওরা। উত্তর দিকে তার বিরাট দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নো ম্যানস মেসা
প্রায় তিরিশ মাইল পথ চলেছে ওরা আজ। নীচে কোথাও বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা খুঁজে নিতে হবে। ওদের পশুগুলো বেশ ক্লান্ত, ওগুলোরও বিশ্রাম দরকার।
উপর থেকে ওদের ঠিক উল্টো দিকে ক্যানিয়নটার ওপাশে হাজার ফুট নীচে নাকিয়া মেসার ছাদ দেখা যাচ্ছে। ক্যানিয়নটার অন্যধারে গাছের আড়ালে একটা গর্ত মত খাজ দেখা যাচ্ছে। জায়গাটা ওদের জন্য, বেশ নিরাপদ একটা আশ্রয় হতে পারে।
ওই খাজটার কাছে যখন ওরা পৌঁছল তখন আকাশে তারা উঠেছে। নিজে নেমে তাড়াতাড়ি ডালিয়াকে ঘোড়া থেকে নামাতে গেল জেকব। হাত বাড়াতেই ক্লান্তিতে ডালিয়া প্রায় এলিয়ে পড়ল ওর উপর।
ইশ, একী দশা হয়েছে তোমার! দু’হাতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল জেকব। আমি সত্যিই দুঃখিত, মৃদু স্বরে বলল সে।
কি সুখে, কি দুঃখে…বিয়ের সময়ে শপথ করেছি আমরা, মনে নেই? জেনেশুনেই স্বেচ্ছায় বরণ করেছি তোমাকে। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি-বিশ্রাম পেলেই আবার ঠিক হয়ে যাব।
ডালিয়াকে ঘোড়াগুলোর কাছে রেখে অন্ধকারে অদৃশ্য হলো জেকব। প্রায় সাথে সাথে ফিরে এসে পশুগুলোকে একটু উপরে পাহাড়ের একটা বড় পাথরের আড়ালে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে এল সে।
পাথরের আড়ালে এক কোণে আগুন জ্বেলে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলল ডালিয়া। এতক্ষণ জেকব তার রাইফেল আর পিস্তলে তেল লাগিয়ে পরিষ্কার করে নিল।
খেতে বসে ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হয় ওরা আমাদের খুঁজে পাবে, জে?
হ্যাঁ, পাবে।
তা হলে আমরা কী করব?
সেটা ওরা এলে পরে দেখা যাবে।
ভোরের দিকে হঠাৎ জেকবের ঘুম ভেঙে গেল। জেগেই ঘোড়াগুলোর দিকে চাইল সে। মাথা উঁচিয়ে কান খাড়া করে রয়েছে ওরা।
প্রথমে কিছুই শুনতে পায়নি সে; পরে দূর থেকে একটা শব্দ ওর কানে এল। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ঘোড়ার শব্দ। অনেকগুলো ঘোড়া ছুটে চলেছে।
সকালে ডালিয়ার নাস্তা তৈরি করার ফাঁকে ক্যানিয়নের ভিতর গিয়ে তিরিশ চল্লিশটা বুনো ঘোড়র পায়ের ছাপ দেখতে পেল সে। ওদের মধ্যে সোনালী স্ট্যালিয়নটার ছাপও রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলো উত্তর দিকে নাকিয়া ক্যানিয়নের দিকেই গেছে।
তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
.
খেপে রয়েছে লী। অগ্নি দৃষ্টিতে ইউজিনের দিকে চেয়ে সে বলল, মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় শক্ত-পাল্লাকে খুঁজে পাওয়ার কোন দরকারই অনুভব করো না তোমরা।
গত কয়েক সপ্তাহ জেকবের খোঁজে অনবরত ঘোড়া ছুটিয়ে ইউজিনের মেজাজও বেশ চড়ে আছে। এই কয়েকটা সপ্তাহে ওর মনের বয়স অনেক বেড়ে গেছে। এতদিন সে সবসময়ে লী-র মন বুঝে চলার চেষ্টা করেছে-কিন্তু আর নয়। সারা জীবন অন্যের মত অনুযায়ী চলতে গেলে মানুষের আর নিজস্ব সত্তা বলে কিছু থাকে না।
একটা মানুষকে হত্যা করার উদ্দেশে আমি তোমাদের সাথে আসিনি। লোকটা যদি ডেরিককে কাপুরুষের মত পিছন থেকে গুলি করে মেরে থাকে তবে অবশ্যই তার ফাঁসি হওয়া উচিত। কিন্তু ওর পক্ষটাও আমাদের শুনতে হবে। সে দাবি করেছে অন্যায়ভাবে হত্যা করেনি সে।
দাবি? লী-র গলার স্বরটা কুৎসিত শোনাল। তুমি কি আশা করো? সাধু পুরুষের মত সে তার দোষ স্বীকার করবে?
অনেক সুযোগই সে পেয়েছে, ইচ্ছা করলেই আমাদের কয়েকজনকে সে হত্যা করতে পারত-কিন্তু করেনি। সত্যি কথা বলতে কি আমরা সবাই জানি ডেরিক একটু ঝগড়াটে প্রকৃতির ছিল, গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে পছন্দ করত সে। পিস্তলে ভাল হাত ছিল বলে নিজেকে বাহাদুর মনে করত।
ডেরিক সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দিতে চাও তুমি? তোমার আমি
শান্ত হও, লী, দৃঢ়সংযত কণ্ঠে বাধা দিল কীথ। ইউজিনের ওপর তোমার এভাবে চড়াও হবার কোন মানে হয় না।
কীথের দিকে ঘুরে চাইল লী। তুমিও?
ইউজিনের ওজন কম, ওকে পাত্তা না দিয়ে অবজ্ঞা করা চলে, কিন্তু কীপের বেলায় তা করা যায় না। কঠিন লোক কীথ। সে কারও সাতে-পাচে থাকে না বটে, কিন্তু ওর সাথে কেউ লাগতে গেলে একেবারে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে লী নিজের রাগ সামলে নিল। কথও আর কোন কথা বলল না, আশ্বস্ত হয়ে কনুই-এ ভর দিয়ে কাত হয়ে বসল।
রাতের নিস্তব্ধতায় কেবল আগুনে কাঠ পোড়া পটপট শব্দ উঠছে মাঝে মাঝে। আগুনে আরও কয়েকটা কাঠ চাপিয়ে দিয়ে নীরবতা ভাঙল ইউজিন। ন্যায় বিচার হোক, সেটা চাই বলেই আমি এসেছি। ডেরিকের মৃত্যুর ঘটনাগুলো জানি
আমরা-ওই লোকটাকেও চিনি না। দূর থেকে দেখে আমি যেটুকু বুঝেছি তাতে ওকে কাপুরুষ কখনোই মনে হয়নি। ডেরিক শেষ পর্যন্ত যার সাথে পারবে না এমন লোকের সাথেই লাগতে গেছিল
অসম্ভব, ডেরিকের মত পিস্তল চালাতে আর কেউ জানে না। প্রতিবাদ করল লী, কিন্তু তার গলায় এখন আর আগের ঝাঁঝ নেই।
কেউ না? জিম কোর্টরাইট, ক্লে অ্যালিসন কিংবা ওয়াইল্ড বিল, কেউ পারে?
ওই লোকটা আর ওয়াইল্ড বিল এক হলো?
তুমি কী করে জানো? ট্রেইল থেকে যেটুকু বোঝা যায় তাতে তো শক্ত পাল্লাকে শক্ত-পাল্লা বলেই মনে হয়।
এ কথার কোন জবাব দিল না লী। বাতাসে কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ল। আগুনের শিখাটাও একপাশে একটু হেলে গেল।
কাজ শেষ করার আগেই টের পাওয়া যাবে কত ধানে কত চাল, মন্তব্য করল কীথ
ভেবে দেখো, লী। নতুন একটা শহর গড়তে যাচ্ছি আমরা। স্বীকার করি এটা সবেমাত্র শুরু-কিন্তু একদিন এখানেই সুন্দর একটা শহর গড়ে উঠবে। আমাদেরই ছেলেমেয়েরা হেসে-খেলে বড় হবে ওই শহরে। একজন নির্দোষ মানুষকে যদি শুরুতেই আমরা বিনা বিচারে হত্যা করি, তার ফল কি শুভ হবে?
এবারেও জবাব দিল না লী। তার চোয়ালের পেশী দু’টো শক্ত হয়ে উঠল। মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে ওকে হাজারো যুক্তি দেখিয়েও কিছু কাজ হবে না-মনস্থির করে ফেলেছে ও
জ্বালানি কাঠ জোগাড় করে আনতে উঠল ইউজিন। কোমরে দু’হাত রেখে কয়েক মিনিট ভাবুকের মত আকাশের তারার দিকে চেয়ে রইল সে। যাক, মনে যা ছিল বলে ফেলে ভিতরটা অন্তত হালকা হয়েছে। বন্ধু সে নিশ্চয়ই চায়, কিন্তু মোসহেবি করে বন্ধুত্ব রক্ষা করার মানে হয় না। তার মানে হচ্ছে: মুখ বুজে চুপ করে না থেকে যাদের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে তারা সবাই মুখ ফুটে তা জানালে সম্ভবত পৃথিবীর অর্ধেক ঝামেলাই মিটে যেত।
সেলুনে যে ঠিক কী ঘটেছিল তা একমাত্র ডেরিক আর শক্ত-পাল্লা ছাড়া কেউ জানে না। সবাই একমত যে শক্ত-পাল্লার পিস্তল নিয়ে ফেরত না এসে উপায় ছিল না। গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে যায়নি তোকটা-ডেরিকই ভীমরুলের চাকে খোঁচা দিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছে।
কাঠ নিয়ে ফিরে আসার সময়ে দূর থেকে লী-র কথার শেষটুকু ওর কানে গেল। …খুব বাড় বেড়েছে।
মিছেই ওর সাথে খোঁচাখুঁচি করছ তুমি, ওর পক্ষ সমর্থন করে বলছিল কীথ, ছেলেটা নির্ভেজাল। ওর সাথে লাগতে গেলে শেষ পর্যন্ত তোমার ওকে গুলি করতে হবে, নয়তো গুলি খেতে হবে।
ওই পুঁচকে ছোড়া?
লী-র স্বরে তাচ্ছিল্যের স্পষ্ট ইঙ্গিতে রাগে আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠল ইউজিনের মুখ। ওখানেই থেমে দাঁড়াল সে।
কীথ জবাব দিল, গাধার মত কথা বোলো না, লী। নতুন নতুন ছেলেটা নরম ছিল-যে যা বলেছে তাই শুনতে হয়েছে ওকে। কিন্তু এখন কঠিন মাটিতে সগ্রাম করে টিকে থেকে কঠিন হয়েছে। এখন থেকে নিজের মত মতই চলবে সে।
রাতে ওরা যখন ঘুমাবার আয়োজন করছে, নিকোলাস তখন তার দুই সঙ্গীকে ক্যাম্প করার নির্দেশ দিল। ওদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র এগারো মাইল। তিনটে ক্যাম্প মিলে একটা সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে। তৃতীয় ক্যাম্পে আছে ডালিয়া আর জেকব।
.
গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠল জেকব। পুবের আকাশটা ভোরের আলোয় ফিকে হয়ে এসেছে। একটা ঘোড়া নাক দিয়ে হাচি দেওয়ার মত শব্দ করে ওকে জাগিয়ে দিয়েছে। ঘুম থেকে জেগে উঠেই অভ্যাস মত নিজের বাকস্কিনটার দিকে চাইল জেকব। ঘোড়াটা মাথা উঁচু করে নাক ফুলিয়ে খাজের মুখটার দিকে চেয়ে আছে।
রও! রও! ঘোড়াটাকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে রাইফেল হাতে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে বাইরের দিকে এগোল জেকব। ধারের কাছে পৌঁছে উঁকি দিল-কিছুই চোখে পড়ল না। কোন শব্দও নেই।
শার্ট আর বুট ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে ও। একবার ভাবল ফিরে ওগুলো পরে আসা দরকার। বুট ছাড়া এই অঞ্চলে চলাফেরা করা অসম্ভব। ফিরতে যাবে, ঠিক এই সময়ে আবছা ভাবে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখল সে। একটা ছায়া-একটু আগেও ছায়াটা ওখানে ছিল না-নাকি মনের ভুল?
বুট শার্ট আর কার্তুজের বেল্টসহ ডালিয়া উপস্থিত হলো ওর পাশে। ডালিয়াকে ছায়াটা দেখিয়ে ওদিকে নজর রাখতে বলে বুট আর বেল্ট পরে নিল জেকব। তৈরি হয়ে উঠে দাঁড়াতেই রাইফেলটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিল ডালিয়া। অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পায়নি সে।
কিন্তু কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল ওখানে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার ওদিকেই আরও দূরে চাইল সে। হ্যাঁ, কিছু বা কেউ ছিল ওখানটায়। রাইফেলটা গাছের সাথে ঠেকা দিয়ে রেখে শান্তভাবে শার্টটা পরে নিল সে।
তা হলে লোকগুলো এসে পৌঁছে গেছেওদের মোকাবিলা করার ঝামেলা এড়ানোর অনেক চেষ্টা করেছে, ফল হয়নি। এবার থেকে আর এড়িয়ে চলবে না সে। মানা করার পরেও যখন এসেছে, ওদের যোগ্য মাশুল দিতে হবে।
হঠাৎ একটা লোককে ওদিক থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। কমবয়সী, অপরিচিত।
লোকটার মাথায় একটা ভাজ-পড়া ময়লা টুপি। কোমরের দুপাশে দুটো পিস্তল ঝুলছে। পিস্তলের মাথা ফিতে দিয়ে উরুর সাথে বাধা। হাতে একটা হেনরি রাইফেল। মাটির উপর কিছু একটা খুঁজছে লোকটা! কোন পরিচিত চিহ্ন।
নীরবে দাঁড়িয়ে ওরা লোকটাকে লক্ষ করছে। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে। পিছন ফিরে একবার মেসাটা ভাল করে দেখে নিয়ে ঘুরে উপর দিকে মুখ তুলে ওরা যেখানে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সোজা সেদিকেই চাইল। আড়ালে রয়েছে বলে জেকবদের দেখতে পাচ্ছে না লোকটা।
পায়ের ছাপ দেখে এগোচ্ছে না ও, বলল জেকব। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, লোকটা আমাদের খুঁজছে না।
তা হলে কী খুঁজছে লোকটা? হারানো ওয়্যাগন খুজছে না তো?
এতদূরে এখানে কী করে থাকবে ওগুলো? বেশ কয়েক মাইল দক্ষিণে ছিল ওয়্যাগন-এখান থেকে অন্তত দশ পনেরো মাইল দূরে। কিন্তু তাই কী? লোকটার আচরণে মনে হয় সে যেন কিছু একটা জানে। এদিক ওদিক খেয়াল খুশিমত খোঁজাখুঁজি না করে বিশেষ কোন চিহ্ন বা জায়গা খুঁজছে সে।
পিছন থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ জেকবের কানে এল। পাথরে মোটা কাপড় ঘষা খাওয়ার আওয়াজ। চট করে বাম হাঁটু গেড়ে বসে ঘুরেই রাইফেল তুলে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হলো সে।
মাথার উপর হাত তুলে দাড়িয়ে আছে কেলভিন
রাইফেলটা স্থিরভাবে তাক করে বসে রইল জেকব। কেলভিন এগিয়ে এল। ওর পিছনে ওর ঘোড়া-তার পিছনে মালটানা একটা ঘোড়া। বিশ গজ দূরে। থাকতেই ওকে থামাল জেকব
পথ হারিয়েছ নাকি?
তুমি তো আমাকে চেনো, হাসল কেলভিন। ওয়্যাগনগুলোই হারিয়েছে এখনও খুঁজছি।
যেসব লোক পিছন থেকে আমার দিকে আসে, তাদের পছন্দ করি না আমি
সেজন্যে তোমাকে দোষ দিই না; তবে আমাকে পছন্দ না করেও তোমার উপায় নেই। কারণ দেখা যাচ্ছে একমাত্র আমিই তোমার শুভাকাক্ষী।
অর্থাৎ?
তুমি যাওয়ার পরে লী এসে হাজির। সাথে কীথ আর ইউজিন। বার্ট আর ক্লাইভ তোমাদের কাল ভ্যালিতে যাওয়ার কথা জানালে লী হেসেই উড়িয়ে দিল কথাটা।
যাক, চেষ্টা যা করার করেছি আমি।
নিকোলাসও তার দু’জন সঙ্গীসহ এই এলাকাতেই আছে।
হাতের ইশারায় নীচের দিকে দেখাল জেকব। ওই লোকটা কি ওর সঙ্গীদের একজন?
এগিয়ে এসে ঝুঁকে উঁকি দিল কেলভিন। ওর মুখ দিয়ে আপনাআপনি একটা গালি বেরিয়ে এল। ওই লোকটাই মন্টি, জেকব। হারানো ওয়্যাগনের দলটার সাথে ছিল ও।
কোনদিকেই খেয়াল না করে জেকবদের মেসার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মন্টি। দেখো! ফিসফিস করে বলল কেলভিন। জায়গাটা চিনতে পেরেছে ও! নিশ্চয়ই কোন চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। সেই রকমই মনে হচ্ছে। মন্টির মধ্যে উত্তেজিত ভাব সুস্পষ্ট। বেশ জলদি হাঁটতে শুরু করছে সে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠল। সেই সাথে চিৎকার শোনা গেল, মন্টি! মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?
স্বাস্থ্যবান আর বেঁটে একটা অপরিচিত লোককে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখল জেকব। লোকটা নিকোলাসের অপর সঙ্গী।
জলদি ফিরে যাও তুমি। না বলে না কয়ে হাওয়া হয়ে গেছ দেখে বস্ খেপে আগুন হয়ে আছে। এদিকে কী খুঁজছ?
ছাপ খুঁজে বেড়াচ্ছি-মনে হলো যেন কী একটা দেখলাম।
ঠিক আছে, চলো এবার ফেরা যাক।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হলো লোকটা। সে পিছন ফিরতেই ওর পিঠ লক্ষ্য করে রাইফেল তুলল মন্টি। তারপর আবার কী ভেবে সেটা নামিয়ে নিল।
জেকবের দিকে আড়চোখে চেয়ে কেলভিন বলল, লোকটা জানতেও পারল মৃত্যুর কত কাছ থেকে আবার ফিরে এল সে।
হয়তো এই লোকটাই ওর সঙ্গীদের খুন করেছিল, বলল জেকব।
মন্টি? বিস্ময় প্রকাশ পেল কেলভিনের স্বরে। কিন্তু তার মনেও একই সন্দেহ উঁকি দিয়েছে তাই যতটা অবাক হওয়া উচিত ছিল, ততটা অবাক হলো না সে। কিন্তু তখন তো ও একেবারেই ছেলেমানুষ ছিল।
মানুষ খুন কমতে কত বড় হওয়া লাগে? শুকনো গলায় প্রশ্ন করল জেকব। তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, আমি ইন্ডিয়ানদের সাথে প্রথম যুদ্ধ করেছি বারো বৎসর বয়সে।
ঘোড়ায় চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কেলভিন। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
এর মানেটা বুঝতে পারছ তো? এতদিন সবাই মনে করেছিল জায়গাটা আরও অনেক দক্ষিণে, তাই সবাই ওই দিকেই খোঁজ করেছে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি মন্টি কিছু একটা চিহ্ন দেখে জায়গাটা চিনেছে।
প্রথমে ডালিয়ার দিকে পরে জেকবের দিকে চাইল কেলভিন। তারপরে উল্লসিত ভাবে সে বলল, বুঝতে পারছ তো, আমি শিগগিরই বড়লোক হতে যাচ্ছি।
আমার মনে হয় সোনা খোঁজার কাজে অনেক প্রতিযোগী পাবে তুমি। ওখানে যারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সোনার গন্ধ পেলে তারাও সবাই ছুটে আসবে সোনা খুঁজতে। এখন তুমি ওই সোনা পেলে তাতে তোমার বিপদের সম্ভাবনাই বেশি।
জেকবের কথা কেলভিনের কানে যায়নি। উত্তেজিত ভাবে সে বলে চলল, ভেবে দেখো, মন্টিকে ওরা বেঁধে রেখে সোনা লুকাতে গিয়েছিল। তার মানে যেখানে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছিল তারই আশেপাশের কোন চিহ্ন দেখে সে জায়গাটা চিনেছে। আনন্দে বিভোর হয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাল সে। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি এখান থেকে এক মাইলের মধ্যেই কোথাও ওই সোনা লুকানো আছে। এমনকী আরও কাছেও থাকতে পারে!
লোক দুটো যেদিকে অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে চেয়ে রয়েছে জেকব। এই মন্টিই যদি সেই ছেলেটা হয়ে থাকে তবে সে গুপ্তধনের এত কাছে থেকে কিছুতেই এই এলাকা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইবে না। তা হলে কী করবে সে? সঙ্গীদের চোখে ধুলো দিয়ে কেটে পড়বে-নাকি আগের মত আবার খুন করবে? যাই ঘটুক, ফাঁসির দড়িটা তার গলাতেই এঁটে বসছে।
এখান থেকে কোনদিকে যাবার পথ নেই। উত্তর দিকে স্যান জুয়ান ক্যানিয়ন। দুই ধারেই বিশাল উঁচু ক্লিফ। ওর ভিতর দিয়ে নির্দিষ্ট একটা দিকেই কেবল যাওয়া সম্ভব। পুব দিকে গৌতিক স্মৃতিসৌধের উপত্যকা, মাইলের পর মাইল খোলা জায়গা। ওদিকে গেলে সহজেই ধরা পড়ে যাবে ওরা।
একটা মেয়ে সঙ্গে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া এখন ওর আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। কপাল ভাল থাকলে ওরা হয়তো অন্যদিকে চলে যাবে।
আমি নীচে যাচ্ছি, বলে রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়াল কেলভিন। কিন্তু সে পা বাড়াবার আগেই জেকব বলে উঠল, তোমাকে এখন আর ঝুঁকি নিয়ে যেতে দিতে পারি না আমি-তোমাকে আমাদের সাথেই থাকতে হবে।
কেলভিনের দিকে তাক করে ধরা রয়েছে জেকবের পিস্তল।
১০. ঘটনার আকস্মিকতায়
ঘটনার আকস্মিকতায় বড় বড় চোখে স্বামীর দিকে চাইল ডালিয়া। রাইফেল হাতে কেলভিন জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনাগুলো বিচার করে আপাতত নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে রাইফেল ঘুরিয়ে ট্রিগার খুঁজে নিয়ে কক্ করে তবে গুলি করতে হবে-না, কোন উপায় নেই তার।
কী ব্যাপার, জেকব? আমি তো ভেবেছিলাম আমরা পরস্পরের বন্ধু।
এখনও তাই। আমার চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তোমার কোনদিন ছিল না। কিন্তু সোনার নেশায় তোমার বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তুমি এখন নীচে গেলে তোমাকে দেখতে পাবে ওরা-কিংবা তোমার চিহ্ন দেখতে পেয়ে বুঝে নেবে এদিকে তুমি কী খুঁজছ। সবাই মিলে এসে হাজির হবে এখানে। আর ওরা এখানে এসে পৌঁছলে আমাদের ধরা পড়তে হবে। এই কারণেই তোমাকে বাধা দিচ্ছি।
আশ্বস্ত হলো কেলভিন। তাই সলো। তুমি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে, ভেবেছিলাম ওই সোনা তুমি নিজেই নেয়ার তালে আছ। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে জেকবের দিকে চাইল সে। সেরকম কোন মতলব নেই তো তোমার?
ঘোড়া ছাড়া এদিকে আর কিছুর ওপর আমার নজর নেই।
ঠিক আছে, পিস্তল নামিয়ে নিতে পারো তুমি। ওরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমি তোমাদের সাথেই থাকব। তবে ওদের কেউ যদি ওই সোনা খুঁজে পায়। তখন কিন্তু আমি আর কোন চুক্তি মানব না।
সেটা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই, কেলভিন। ওই সোনার খোঁজে তুমি এতকাল যেভাবে হন্যে হয়ে ঘুরেছ, কষ্ট করেছ, তাতে আমার মতে তোমার একটা দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ঘটনা সেরকম দাড়ালে তুমি গুলি ছুড়তে ছুড়তে সোনা উদ্ধার করতে ছুটে যেয়ো…আমরাও নিজের পথ দেখব।
একটা গাছের ছায়ায় বসে কেলভিন নিজের রাইফেলটা দ্রুত ব্যবহারের জন্য কোলের বা পাশেই মাটিতে শুইয়ে না রেখে গাছের সাথে ঠেকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। অভিজ্ঞ লোক, কোন ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ রাখার পাত্র সে নয়।
জেকবের দিকে চেয়ে সে বলল, তুমি ঝট করে নিমেষে কোথা থেকে যে পিস্তলটা বের করলে-ব্যাপারটা যাদুমন্ত্রের মত লাগল আমার কাছে। আমার ধারণাই ছিল না কোল্ট ব্যবহারে তোমার হাত এত চালু।
কাঁধ ঝাঁকাল জেকব। প্র্যাকটিস করলে সবই হয়-কারও জলদি হয়, কারও দেরিতে।
পিস্তলের বাঁটে কয়টা আঁচড় পড়েছে?
যাদের বড়াই করা অভ্যাস, তারাই ওসব করে। নেহাত দায়ে না পড়লে পিস্তল ব্যবহার করি না আমি।
চুপচাপ বসে আছে ডালিয়া। ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। এখনকার মত মেঘ কেটে গেলেও ওদের চারপাশ থেকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝে ফেলেছে সে। কেলভিনের তরফ থেকেও বিপদ আসতে পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করে আটকে রাখাটাকে কী সহজ ভাবে নিতে পারবে সে?
প্রতীক্ষার মধ্যে দিয়ে কয়েকটা ঘণ্টা কেটে গেল। গাছের তলায় মৌমাছির গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই..প্রায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। মাঝে মধ্যে ঘোড়াগুলো মাটিতে পা ঠুকছে বা লেজ নেড়ে মাছি তাড়াচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।
ওরা কি এতক্ষণে চলে গেছে, জে? প্রশ্ন করল ডালিয়া
না।
অন্তত মন্টি যে এত সোনা ফেলে কিছুতেই বেশিদূর নড়বে না, একথা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, বলল কেলভিন।
মাথার পিছনে দুই হাত রেখে গা এলিয়ে ক্লিফলোর দিকে চেয়ে ভাবছে কেলভিন। সোনা কোথায় লুকানো থাকতে পারে? ওদের হাতে সময় ছিল কম, তা ছাড়া এমন জায়গাতেই ওরা গিয়েছিল সেখানে ঘোড়ার পিঠে করে সোনা বয়ে নেওয়া যায়। এই এলাকায় মাত্র কয়েকটা নির্দিষ্ট দিক ছাড়া আর যাবারই উপায় নেই।
লোকগুলো যে কতক্ষণ সময় নিয়েছিল সেটা জানতে পারলেও…মন্টি নিশ্চয়ই সেটা জানে। উল্টো দিকের ক্লিফে যায়নি ওরা-পিউটে মেসা অনেক উঁচু। না, ওটার পিছনে নাকিয়া মেসাতেই কোথাও সোনা লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনাই বেশি।
জেকবেরও তাই ধারণা, কিন্তু সে এখন ভাবছে কেলভিনের কথা। ওই এলাকাতেই কোথাও রয়েছে নিকোলাস, মন্টি আর অন্য লোকটা। লী আর তার সঙ্গের লোকজনও এখানেই কোথাও আছে। ক্লাইভ আর বাটও যোগ দিয়েছে। ওদের সাথে।
খিদে পেলেও কেউ আর খাবার কথা তুলছে না। আগুন জ্বালালেই ধোয়া উঠবে-ওদের অবস্থান জেনে ফেলবে সবাই
কেলভিন চিনতে পেরেছে মন্টিকে। জেকবের মনে হঠাৎ খটকা লাগল। কথাটা মনে মনে উল্টেপাল্টে বিচার করে দেখল সে-সমাধান মিলছে না। মন্টিকে কী করে চিনল কেলভিন?
তা হলে হয় সে ওই সতেরো জনের একজন, নয়তো সান্তা ফে শহরে মন্টিকে দেখেছে সে।
জেকবের চারদিকেই ছড়িয়ে রয়েছে শত্রু। তার নিজের ক্যাম্পেরই একজন হয়তো তার শত্রু। যা-ই ঘটুক কেলভিনের কথা ভোলা চলবে না তার।
জে…?
মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল ডালিয়া সামনের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। রুদ্ধশ্বাসে সে চেয়ে দেখল সেই সোনালী স্ট্যালিয়নটা তার দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে নীচের খোলা জায়গায়।
চেয়ে দেখো, কেলভিন। সব ভুলে গেল জেকব। পৃথিবীর সব সোনা তুমি নিতে পারো-কিন্তু ওই ঘোড়াটা আমার চাই।
ওদের থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে পাহাড়ের একটা সরু ফাটলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল ঘোড়াগুলো
সত্যি, লর্ড হ্যারির কসম, সম্ভ্রমের সাথে বলল কেলভিন। তোমার দোষ নেই, লোভ লাগার মতই ঘোড়া বটে!
হঠাৎ উত্তেজিতভাবে সে আবার বলে উঠল, ওই পিছনের মেয়ারটা…যেটার কাঁধে ক্ষত দাগ আর পায়ে তিনটে সাদা মোজার মত ছোপ…ওটার কিন্তু বয়স হয়েছে।
তাতে কী? ওই দলে অনেক নবীন ঘোড়াও আছে।
ঘোড়া ছাড়া আর কিছু ভাববার অবসর ওর এখন নেই। কিন্তু হঠাৎ ঘোড়ার প্রতি কেলভিনের এত আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে ডালিয়া খেয়াল করল, ওই সোনালী স্ট্যালিয়নটার দিকে মোটেও নজর নেই ওর-পিছনের বুড়ো মেয়ারটাকেই বিস্ফারিত চোখে দেখছে সে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব আমরা, বলল জেকব। ওরা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে পরে ওদের পিছু নেব। আমি দেখতে চাই ওরা কোথায় যায়।
.
উত্তর দিকে যেতে যেতে ইন্ডিয়ানদের দেখে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল লী। একজন ইন্ডিয়ান মহিলা আর দু’জন বাচ্চা সহ মোট পাঁচজন। পুরুষ দুজনের মধ্যে কমবয়সী লোকটা লী-র পরিচিত। সব সময়েই তার গায়ে পড়ে সস্তায় কাজ করে দেওয়ার আগ্রহ দেখে লী ওর নাম দিয়েছে সস্তা জনি। একসময়ে লী-র র্যাঞ্চে কাজও করেছে সে। খুব খাটতে পারে লোকটা। লী নিজেও যেমন খাটে, তার প্রত্যেকটা কাজের মানুষকেও সে তেমনি হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিয়ে নেয়। তবে এটা সত্যি, এই এলাকায় তারচেয়ে ভাল খাবার কেউ কর্মচারীদের খাওয়ায় না।
জনি, ট্র্যাকিং-এর একটা কাজ করবে তুমি? জিজ্ঞেস করল লী।
নাভাজো লোকটা মাথা নাড়ল। টিউবা সিটিতে যাচ্ছি আমি। একে একে সবাইকে দেখে নিয়ে আবার লী-র দিকে চাইল জনি। তোমরা শিকারে বেরিযেছ?
আমাদেরই একজন মানুষকে খুঁজছি-ওর সাথে হয়তো একটা মেয়ে থাকতে পারে।
একটু ইতস্তত করল জনি। সেধে কাউকে কিছু জানানো ইন্ডিয়ানদের ধর্ম নয়। কিন্তু এই লোকটা তার পরিচিত। বন্ধুও বলা যায়, কারণ সাদা চামড়ার লোকেরা সাধারণত ইন্ডিয়ানদের কাজে নিতে চায় না।
ওই দিকে, পিউটে মেসার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল সে। চিহ্ন দেখেছি আমি-পাঁচ-ছয়টা পশু, দু’জন আরোহী।
ওরা চলে যেতেই উল্লসিত হয়ে লী বলল, শুনলে তো? এবার ওদের বাগে পেয়েছি আমরা।
ইউজিন মুখ খুলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত চেপে গেল। এখন কিছু বলে লাভ নেই। যা বলার তা সে সময় মতই বলবে।
সে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, শক্ত-পাল্লাকে কি লী তার স্ত্রীর সামনেই ফাঁসিতে ঝুলাবে? কিন্তু ওকে যে ওরা ধরতে পারবে তাই বা কী করে বলা যায়? এখন পর্যন্ত সামনাসামনি হয়নি লোকটা, কিন্তু এবার যে সে রুখে দাঁড়াবে না তাই বা কে জানে? সবারই ধৈর্যের একটা সীমা আছে।
দূরে ক্লিফের ধারে খানিকটা ধুলো উড়তে দেখা গেল। খুব বেশি নয়, তবে একসাথে বেশ কয়েকটা ঘোড়া চলছে বোঝা যায়।
ইউজিন, তোমার কী মনে হয়? প্রশ্ন করল লী।
বুনো ঘোড়া। ওদের মধ্যে ইউজিনেরই দৃষ্টি সবার চেয়ে তীক্ষ্ণ। বেশ বড় একটা দল, ধীর গতিতে চলেছে।
আরও আধঘণ্টা পরে লী দেখতে পেল ওদের।
কয়েকটা গাধা সহ তিনজন মানুষ ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো যেদিকে গেছে সেদিকেই এগোচ্ছে ওরা।
এবারে ওদের হাতের মুঠোয় পেয়েছি! উত্তেজনা চাপার বৃথা চেষ্টা করে বলে উঠল লী। ওই যে, দেখা যাচ্ছে ওদের!
ওখানে তো তিনজন মানুষ দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদ করল ইউজিন। ওদের দু’জন যদি শক্ত-পাল্লা আর তার স্ত্রী হয় তবে তৃতীয় লোকটা কে?
ওর কথার জবাব দিল না কেউ। ওদের পিছু নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে লী বারবার আউড়ে চলল, এইবার! খোদার কসম, এইবার!
টিউবা সিটিতে জেকবের সতর্ক বাণীর কথা বার্টের মনে পড়ে গেল। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। ভিতরটা কেমন যেন কুঁকড়ে আসছে। লোকটা স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিয়েছে এর পরে ওরা পিছু নিলে ওদের ভাগ্যে কী ঘটবে।
ওকেই আগে শেষ করতে হবে আমার, মনে মনে ভাবল বার্ট। আমাকে মারার আগেই মারব শালাকে-গুষ্টি মারি ফাঁসির-আগেই গুলি করব আমি।
পিছিয়ে ক্লাইভের পাশে চলে এল বার্ট। লোকটা মিথ্যা ভয় দেখায়নি, ক্লাইভ! যা বলেছে তাই করবে সে।
তা হলে এখন উপায়?
ওকেই আগে শেষ করতে হবে-প্রথম সুযোগেই গুলি করব আমরা।
কিন্তু লী যে ওকে ফাঁসি দিতে চায়; দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে।
বাদ দাও ওর কথা।
তা হলে কী করতে চাও?
লোকটার সাথে মেয়েলোক আছে। মেয়েটাকে বাঁচাতে কথা বলতে চাইবে ও। লী-কে কথা বলতে পাঠিয়ে পিছন থেকে গুলি করব আমরা।
নিকোলাস এখানে থাকলে ভাল হত, বলল ক্লাইভ।
বার্টের মনে ছিল না ওর কথা, কিন্তু এখন আর সে কথা ভেবে লাভ নেই। ও যখন নেই, যা করার আমাদেরই করতে হবে।
পাঁচজনে ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলেছে ওরা। সারারাত ঠাণ্ডার পর সকালের রোদটা বেশ লাগছে। কীথের পিছনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইউজিন। তার উপর বিপদ ঘনিয়ে আসছে জানে সে। প্রতিবাদ জানানো সোজা-কিন্তু কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে হয়তো সশস্ত্র মানুষের মোকাবিলা করতে হতে পারে। লী-র যা মনোভাব তাতে তাদের মধ্যে গোলাগুলি হওয়াও বিচিত্র নয়। কথাটা। ভেবে মনে মনে একটু দমে লে ইউজিন। এখানেই তার দুর্বলতা। মিথ্যা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চায় সে। কিন্তু কাউকে মারতে গেলে দ্বিধা বোধ করবে ও, অথচ অন্ধবিশ্বাসী লোকের কোন বিকারই হবে না।
কীথের দিকে চাইল ইউজিন। ও কোন পক্ষ নেবে? শক্তসমর্থ লোক কীথ। একমাত্র ওর পক্ষেই লী-কে ঠেকানো সম্ভব। অতীতে এটা প্রমাণও হয়েছে।
ক্লিফের উপর দিয়ে চলেছে ওরা। ঘোড়ার পায়ে লেগে একটা নুড়ি পাথরে বাড়ি খেতে খেতে গড়িয়ে নীচে পড়ল। আর একধাপ নেমে ক্যানিয়নের তলায় পৌঁছে গেল সবাই। বুটের গোড়ালিতে বাঁধা স্পারের খোঁচা খেয়েই লী-র ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠে উপত্যকার ভিতর দিয়ে উত্তর দিকে ছুটল। ওদের বামে উঁচু দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে পিউটে মেসা। ডান দিকে নাকিয়া ক্যানিয়ন, আরও সামনে নো ম্যানস্ মেসা তার কালো অশুভ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
রাশ টেনে ঘোড়ার গতি কমাল জেকব। বুনো ঘোড়াগুলোর কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। ওগুলোকে ভয় পাইয়ে ক্লিফের ওপাশে স্যান জুয়ানে চলে যেতে বাধ্য করতে চায় না জেকব। সে দেখতে চায় নিজের ইচ্ছায় ওরা কোথায় যায়।
ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছে ও। অস্বস্তিটা ঘোড়ার ব্যাপারে নয়। পিছন ফিরে চাইল সে।
কিছুই না
তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? ডালিয়ার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল জেকব।
মাথা নাড়ল সে। কিন্তু ওর শান্ত সুন্দর মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছায়া দেখতে পেল জেকব। ডানদিকে একটা ছোট শাখা ক্যানিয়ন দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় চিন্তা না করে হঠাৎ মোড় নিয়ে ওর ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। অন্যেরা অনুসরণ করল তাকে।
এদিকে এলে কেন? প্রশ্ন করল কেলভিন। ঘোড়াগুলোর কী হবে?
বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।
নীরবেই ওর দিকে একবার চাইল ডালিয়া। কিন্তু কেলভিন আপত্তি তুলল, ঘোড়াগুলোর পিছনে এতদূর এসে এখন ছেড়ে দেয়ার কী মানে থাকতে পারে?
ওর কথায় কোন জবাব না দিয়ে ওখান থেকে বেরুবার আর একটা পথ খুঁজল জেকব। তাড়াহুড়ায় অন্ধ-গলির মত ক্যানিয়নে ঢুকে পড়ছে কিনা দেখে নিচ্ছে সে। ক্যানিয়নটা মনে হয় নো ম্যানস্ মেসা পর্যন্ত চলে গেছে। ধীরে এগিয়ে চলছে ওরা। দক্ষিণের দেয়ালটা যেখানে বেশ নিচু হয়ে এসেছে সেখানে ওদের অপেক্ষা করতে বলে আবার ক্যানিয়নের মুখের দিকে ফিরে গেল জেকব
মোড় নিয়ে ওরা এই পথে চলে আসার কিছু চিহ্ন রয়েছে সেখানে। বেশি কিছু করা সম্ভব হলো না, তবু, যতদূর পারা যায় চিহ্নগুলো মিটিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেয়ালের খাড়া ধার বেয়ে সাবধানে পথ দেখিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল জেকব।
এতে তোমার খুব একটা সুবিধা হবে না, মন্তব্য করল কেলভিন। এখন ওই ক্যানিয়নটা রইল তোমার পিছনে, আর একটা ক্যানিয়ন রয়েছে দক্ষিণে। এখান থেকে বেরুবার একটাই পথ আমার জানা আছে-সেটা হচ্ছে নাকিয়ার ভিতর দিয়ে।
থামল ওরা। আশেপাশে সামান্য কিছু মরু অঞ্চলের গাছপালা আর দু’একটা ভাঙা পাথরের চাই আছে, কিন্তু ভাল কোন আশ্রয় নেই। জমিটা ধীরে ধীরে নো ম্যানস মেসার দিকে উঠে গিয়ে বিরাট উঁচু ক্লিফের ধারে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে।
এই সময়ে ওদের দেখতে পেল সে। একই সাথে ওই দলের সামনের লোকটাও মুখ তুলে উপর দিকে চেয়ে জেকবদের দেখল। চমকে উঠে সে এত জোরে লাগাম টেনে ধরল যে ঘোড়াটা পিছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে থেমে দাঁড়াল। দলের সবাই চেয়ে দেখল ওদের।
ডালিয়া…ওকে বাচাতেই হব। তোমরা এখানেই দাঁড়াও, দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিল সে। যাবার আগে ডালিয়াকে বলল, গোলাগুলি শুরু হলে আর এখানে থেকো না। কোথায় দেখা হবে তা আগেই বলেছি-সোজা ওখানেই চলে যেয়ো তুমি। তারপর বাকস্কিনটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওদের সাথে বোঝাপড়া করতে আবার নীচে নামতে শুরু করল জেকব।
১১. উজ্জ্বল ঝলমলে দিন
উজ্জ্বল ঝলমলে দিন। বিপক্ষদলের সবকটা লোককে অবাক করে দিয়ে একাই ওদের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে জেকব। ধী। সমান গতিতে এগোচ্ছে বাকস্কিন। জিনের উপর নির্বিকারভাবে বসে আছে শক্ত-পাল্লা। বাম হাতে লাগাম-ডান হাতটা অলসভাবে উরুর উপর রাখা।
বাকস্কিনটাও টের পেয়েছে। ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে তা বুঝতে পারছে জেকব।
ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে চায়নি সে। ওরাই বাধ্য করছে তাকে। ডালিয়ার গায়ে গুলি লাগার ঝুঁকি সে নিতে চায় না বলেই একা এগিয়ে যাচ্ছে। কেলভিনের সাহায্য নেওয়ার কথা একবারও ভাবেনি, কারণ এটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা, এর সমাধানও তার নিজেরই করতে হবে।
দূরত্ব কমে আসছে। নির্দিষ্ট কারও দিকে তাকিয়ে নেই জেকব। একসাথে ওদের সবার চাল-চলন লক্ষ করছে তার চোখ। দু’জন পিছিয়ে পড়ে একপাশে সরে গেল। এর মানে কী: ওরা কি গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই ঝামেলায় থাকতে চায় না বলে সরে গেল? নাকি পাশ থেকে আক্রমণ চালাবে?
ওদের মধ্যে দূরত্ব একশো গজ থাকতেই রাশ টেনে থেমে দাঁড়াল শক্ত পাল্লা। ওর বায়ে রয়েছে পাথরের ধার থেকে গজানো কয়েকটা গাটওয়ালা সীডার গাছ-ফুট তিনেক উঁচু। ডানদিকে আরও সামনে পাথরে একটা সরু ফাটল। একটু সামনে এগিয়ে ওটা প্রায় খাড়াভাবে নীচের ক্যানিয়ন পর্যন্ত নেমে গেছে।
রেকাব থেকে পা দুটো আলগা করে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। তৈরি হয়ে আবার আগে বাড়ল সে। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ থাকতে সে চিৎকার করে নির্দেশ দিল, ব্যস! ওইখানেই দাঁড়াও!
ওরা থেমে দাঁড়াতেই সে আবার বলল, তোমাদের আগেই বলেছি কাপুরুষের মত পিঠে গুলি করে আমি মারিনি ওকে। বরং তোমাদের ঝগড়াটে বন্ধুই মরদের মত না লড়ে পেটের কাছে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে বেআইনী ভাবে দেহের আড়াল থেকে চোরাগুলি চালিয়ে আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিল। বেশি চালাকি করতে গিয়েই পাশে আর পিঠে গুলি খেয়েছে সে।
কক্ষনো না! মিথ্যে কথা! চেঁচিয়ে উঠল লী। তুমি খুন করেছ ওকে। এখন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নিজে বাঁচতে চাইছ। ফাঁসিতে ঝুলবে তুমি। কয়েক কদম এগিয়ে আবার লাগাম টানল সে। পিস্তলে জনিকে হারানোর মুরোদ তোমার থাকতে পারে না!
প্রমাণ চাও, বন্ধু? বিদ্রূপ করল জেকব। এসো তবে, কেবল তুমি আর আমি সামনাসামনি দাঁড়াই-তুমি নিজেই পরখ করে দেখো ডেরিককে হারাবার মত হাত আমার আছে কি না! সবাই দেখুক? আমি মিথ্যা বলছি কিনা তার প্রমাণ হোক?
বেকায়দায় পড়ে গেল লী। সমর্থ লোক সে-লড়াই-এর ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে নিজের লড়াই সে নিজেই লড়ে। কিন্তু দলগত ভাবে একটা কাজ করতে এসে এরকম ফেঁসে যাবে ভাবতেই পারেনি সে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে তাকেই শক্ত-পাল্লার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে!
চালাকি করে জেকব পুরো দায়িত্বটা সুন্দর ভাবে লী-র কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। অন্য সবাই বাদ পড়ে গেছে। এখন যদি লী মারাও যায় তবু ন্যায়সঙ্গতভাবে তার দলের কারও আর জেকবকে কিছু বলার মুখ থাকবে না।
তবে তাই হোক, হতচ্ছাড়া পাজি! চিৎকার করে উঠল লী। বেঈমানীর উচিত শিক্ষাই আমি দেব। আমি…’
জেকবের পিছন থেকে কে যেন চিৎকার করে কিছু বলল। সাথেসাথেই ওর বুকের উপর কেউ একটা প্রচণ্ড ধাক্কা মারল। ঘোড়াটা পিছনের দু’পায়ের উপর লাফিয়ে উঠল। রেকাব থেকে পা ফসকে মাটিতে পড়ল সে।
বাঁচাব তাগিদে হামাগুড়ি দিয়ে, হেঁচড়ে কোনমতে ফাটলটার দিকে এগিয়ে চলল জেকব। পায়ে চোট লেগেছে-বুকটা অবশ-টপটপ করে রক্ত পড়ছে পাথরের উপর।
ফাটলের ভিতর পৌঁছে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে ক্ষতের গর্তটার উপর ঠেসে দিল। টাইট শার্টের চাপে রুমালটা জায়গাতেই রইল। আহত হয়েছে-কিন্তু জখমটা মারাত্মক কিনা এখনও বুঝতে পারছে না সে।
পিছন থেকে চিৎকার শোনার পরে কী হয়েছে তা নিমেষের মধ্যেই দেখে নিয়েছিল জেকব। যে লোক দু’টো পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল তারাই গুলি করেছে ওকে। তাদের রাইফেল তুলতে দেখেছে সে…কিন্তু তখন আর সময় ছিল না-দেরি হয়ে গেছে।
কে যেন চিৎকার করে বলছিল, এটা কী করলে তুমি?
আমরা ওকে মারতে এসেছিলাম, তা না; লোকটা মরেছে-আর কী চাও? জবাব দিয়েছিল বার্ট।
কঠিন চোখে বার্ট আর ক্লাইভের দিকে চেয়ে ইউজিন বলেছিল, ছিঃ, এমন নোংরা…
কথাটা শেষ করার সুযোগ পায়নি সে। পাহাড়ের উপর থেকে একটা রাইফেল গর্জে উঠল। বুলেট গাঁথার শব্দের সাথে সাথে বার্টকে উল্টে পড়ে যেতে দেখল ইউজিন। দ্বিতীয় গুলিতে ক্লাইভের ঘোড়াটা ছাগলের বাচ্চার মত লাফাতে আরম্ভ করল।
ছত্রভঙ্গ হয়ে পাথরের আড়ালে নিরাপদ আশ্রয় নিল ওরা।
রাইফেল নামিয়ে নিল ডালিয়া। ওর শান্ত নীল চোখ দুটো নীচের দিকে গুলি করার মত আরও লক্ষ্য বস্তু খুঁজছে।
ম্যাডাম, বলল কেলভিন, আমার বান্ধবী হয়ে আমার সাথে পালিয়ে যাওয়াই এখন তোমার সবদিক থেকে ভাল।
যাও। ঠাণ্ডা গলায় বলল ডালিয়া, দূর হও তুমি আমার সামনে থেকে।
ভাল চাও তো আমার কথা শোনো! হাত বাড়িয়ে ডালিয়ার ঘোড়ার লাগাম ধরল কেলভিন।
হাতের রাইফেলটা প্রচণ্ড বেগে ঘুরাল ডালিয়া। ব্যারেলটা গিয়ে লাগল ওর মুখে। ঘোড়া থেকে উল্টে নীচে পড়ে গেল কেলভিন। সামলে নিয়ে উঠে বসল সে। ঠোঁট থেঁতলে রক্ত বেরুচ্ছে। ওর দিকে রাইফেল তাক করে ধরে আছে ডালিয়া। একেবারে স্থির হয়ে গেল কেলভিন। মুখে বলল, শোনো, তুমি ভুল বুঝছ। আমি…’।
সোজা নিজের ঘোড়ায় উঠে বিদেয় হও-আমার আশেপাশে আর তোমাকে দেখতে চাই না আমি।
ওই লোকগুলো তোমাকে খুন করে ফেলবে। তুমি বুঝতে পারছ না, ওদের একজনকে গুলি করেছ তুমি-কিছুতেই ওরা তোমাকে ছাড়বে না।
জেকব রয়েছে ওখানে, বলল ডালিয়া। আমিও নীচে যাব। তুমি বসে বসে তামাশা দেখলে, ওদিকে তোমার বন্ধুকে ওরা গুলি করে মারল। তুমিও তো লোক দুটোকে দেখেছিলে-জানতে ওরা কী করতে যাচ্ছে!
ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁটের উপর হাত বোলাল কেলভিন। তারপর বলল, জেকব মরে গেছে। তুমি নিজের চোখেই পড়তে দেখেছ ওকে। যে মরে গেছে তার জন্যে মিছে ভেবে কী লাভ? এদেশে মেয়েদের পক্ষে একা চলা অসম্ভব। বিশেষ করে তোমার মত মেয়ের একজন শক্ত পুরুষের দরকার। আমি…’।
কথার মাঝেই ঘোড়াটাকে ওর পিছন দিকে হটিয়ে নিয়ে হঠাৎ তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে ঝোঁপ আর পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ডালিয়া।
উঠে দাড়িয়ে চারপাশটা একবার ভাল করে দেখে নিল সে। জেকবের বাকস্কিনটা ছুটে কয়েক গজ সামনে চলে গিয়েছিল-এখনও সেটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। জেকবের মৃতদেহ বা অন্য কারও দেহ ওর নজরে পড়ল না
জেকবের মাল-বোঝাই গাধাগুলো ছড়িয়ে পড়ে ডালিয়ার পিছু পিছু ছুটল। এই পরিস্থিতিতে গাধাগুলোর জন্য আর মেয়েটা থাকবে না।
পশুগুলোকে একত্র করে নিজের কাজে লাগাতে পারবে কেলভিন। অনেক খাবার আছে ওদের পিঠে-ওই খাবারে একজন লোকের এই মরু এলাকায় অনেকদিন চলবে।
ঘোড়ার পিঠে উঠল কেলভিন। ঠোঁট দুটো ব্যথায় টনটন করছে। হাতের তালুতে একটু পানি নিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেলল সে। বজ্জাত মেয়ে। এমন হঠাৎ করে মেরে বসল..মোটেও আশা করতে পারেনি সে। বড্ড দেমাগ! তার সাথে থাকতে অস্বীকার করল-এখন বুঝবে মজা। পাহাড়ের মধ্যে একা একা কয়দিন টিকতে পারবে সে?
আবার নীচের দিকে চাইল কেলভিন। জেকবের ঘোড়াটা এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্য খারাপ ওর…লোকটা ভাল ছিল…কিন্তু বুলেট তো আর ভাল-খারাপ বোঝে না? বুলেটের কাছে সবাই সমান।
বোকা মেয়েটার মাথায় এটা ঢুকল না যে জেকবের দম ফুরিয়েছে। মরা মানুষ আর মাটির ঢেলায় কোন তফাৎ নেই।
কেলভিন তার ঘটনাবহুল জীবনে আজ পর্যন্ত অনেক মৃত্যুই দেখেছে। মৃতের পিছনে অযথা সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী সে নয়। জেকবের সাথে ভাল খাতির ছিল তার-কিন্তু এটা ছিল তার ব্যক্তিগত লড়াই-ওর করার কিছুই ছিল না এতে। কথাগুলো খাঁটি সত্যি, কিন্তু তবু একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে সে ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে ভাবতেই এখন লজ্জা করছে তার। কিন্তু লোকটা যখন মরেই গেছে তখন ওই মালগুলোর অপচয় করা বোকামিতা ছাড়া জেকবের মালটাও খাসা!
জিভ দিয়ে একবার ঠোঁট চেটে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে রওনা হলো সে।
.
ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে ইউজিন সতর্কভাবে মাথা তুলে চারদিকে। তাকাল। যেখান থেকে গুলি এসেছে সেদিকটাতেও কেউ নড়ছে না-কোন শব্দ নেই।
কীথ উপস্থিত হলো ওর পাশে। বার্ট আহত হয়েছে…অবস্থা খারাপ ওর, বলল কীথ।
ইউজিন ওর দিকে ঘুরে বসে মাথা থেকে হ্যাট নামিয়ে আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করল। ওর মুখটা গম্ভীর আর কঠিন দেখাচ্ছে। খুব অন্যায় কাজ আমরা করেছি, কীথ। লোকটা কাপুরুষ ছিল না।
না।
পাথরের উপর পায়ের আওয়াজ তুলে লী এসে দাঁড়াল। ওকে আরও বয়স্ক দেখাচ্ছে। ওদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। মাটির দিকে চেয়েই লী প্রশ্ন করল, তোমরা তোমরা ঠিক আছ তো?
বার্ট গুলি খেয়েছে। ক্লাইভ ওর সাথে আছে।
মুখ তুলে চাইল লী। আচ্ছা, ওদের মাথায় কি ভূত চেপেছিল? ওরা হঠাৎ গুলি করতে গেল কেন?
ক্লাইভ বলেছে শক্ত-পাল্লা নাকি ওদের টিউবা সিটিতে হুমকি দিয়েছিল আবার ওরা পিছু নিলে মারা পড়বে। তাই ভয় পেয়ে প্রথম সুযোগেই গুলি করেছে ওরা।
ওকে আমিই সামলাতে পারতাম। ডেরিকের নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার উপযুক্ত সাজা দিতে পারতাম।
কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল কীথ। মিথ্যা বড়াই কোরো না, লী। ওর মুখোমুখি হলে মারা পড়তে তুমি। যাক, ও যে মিথ্যা বলছে কী করে জানো তুমি?
লোকটা যে সত্যি বলছে তারই বা প্রমাণ কী? ও কি মরে গেছে।
দেখিনি আমি। তবে এত কাছে থেকে ওদের মিস করার কথা নয়।
তেজ ছিল লোকটার। হয়তো আমারই ভুল-আমি ওকে কাপুরুষ মনে করেছিলাম। সিধে হয়ে বসল লী। এখন মেয়েটাকে খুঁজে বের করে নিরাপদে এখান থেকে নিয়ে যাওয়াই আমাদের পক্ষে একমাত্র দ্রচিত কাজ হবে।
ইউজিন আড়চোখে চাইল ওর দিকে। যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন ভদ্রতা দেখিয়ে আর কী লাভ? তবু লী ঠিকই বলেছে-মেয়েটাকে নিকোলাসের খপ্পরে একা ফেলে চলে যাওয়া ঠিক হবে না।
নেকেড়ে নিকোলাসকে আর আমাদের দরকার নেই। এই কাজ থেকে ওকে সরিয়ে নিতে হবে।
শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে লী একটু ঝাঁঝাল স্বরেই বলল, ঠিক আছে, ওকে বিদায় করা যাবে। যেভাবেই হোক আমাদের কাজ তো শেষই হয়ে গেছে। নিজের ঘোড়ার দিকে রওনা হলো সে। মেয়েটাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে-ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন আমাদের কর্তব্য।
আমরা ওর খোঁজ পাওয়ার আগে সে-ই হয়তো আমাদের খুঁজে বের করতে চাইবে, বলল কীথ।
তার মানে?
ওই মেয়েটাই বার্টকে গুলি করেছে।
মাথায় দোষ আছে তোমার।
আমি নিজের চোখে দেখেছি। লাফিয়ে নীচে না পড়লে ক্লাইভেরও একই দশা হত।
ঘোড়ায় চড়ে দলের অন্য ঘোড়াগুলোর কাছে এগিয়ে গেল ওরা। দু’বার। পিছন ফিরে চেয়ে লী বলল, হতে পারে শক্ত-পাল্লা আহত হয়ে পড়ে আছে। আমাদের খুঁজে দেখা দরকার।
বাদ দাও, ছোট্ট জবাব দিল কীথ। যদি বেঁচে থাকে গুলি চালাবে সে। আর এর থেকে ও জীবিত ফিরলে নিজেদের জন্যে দুর্গ তৈরি করতে হবে আমাদের।
অন্য দুজনের কাছে এগিয়ে গেল ওরা। মাটিতে শোয়ানো বার্টের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাইভ। হয়তো বাঁচবে বার্ট, বলল ক্লাইভ। গুলিটা আর একটু ডানদিকে লাগলেই আর উপায় ছিল না। নিজের রাইফেলটা হাতে তুলে নিল ক্লাইভ। তোমরা ওর দেখাশোনা করো, আমি শক্ত-পাল্লাকে খুঁজতে যাচ্ছি।
আর কত? বলে উঠল ইউজিন। যথেষ্ট করেছি আমরা, এবার রেহাই দাও ওকে।
ক্লাইভ ঘুরে চাইল ওর দিকে। তোমার যা খুশি তুমি করো গিয়ে, শক্ত-পাল্লা মরেছে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। নইলে আমার পিছনে লাগবে ও-সবাইকেই শেষ করবে।
কিন্তু আগে মেয়েটাকে নিরাপদে শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতিবাদ করল লী। ওকে এখানে ফেলে যাওয়া যায় না।
রাগের সাথে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল ক্লাইভের মুখে। গোল্লায় যাও তুমি! চিৎকার করে উঠল সে। তুমিই না শক্ত-পাল্লাকে ফাঁসি দেয়ার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছিলে? এখন আবার সুর পাল্টাচ্ছ কেন? ওই মেয়েটাই তো গুলি করে বার্টের এই অবস্থা করেছে-আমাকেও মারতে চেয়েছিল। আমার ঘোড়াটার অবস্থা কি হয়েছে দেখেছ?
ঘোড়াটার কাঁধের কাছে চামড়ায় ঘষা খেয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। দাগটা লাল হয়ে রয়েছে। আমি বার্টের ঘোড়াটা নিয়ে যাচ্ছি, লী। তুমি যদি সত্যিকার পুরুষ হয়ে থাকো তবে তুমিও আমার সাথে এসো। আমরা যেটা শুরু করেছি তার। শেষও আমাদেরই করতে হবে।
বাদ দাও, লী, নিজের মত প্রকাশ করল ইউজিন।
দোটানায় পড়ল লী। কাজটা এখন আর ভাল মনে না হলেও সে-ই এর হোতা। যাবার জন্য পা বাড়িয়েও আবার ইতস্তত করল সে। ভুল করছে কিনা বুঝতে পারছে না লী। এতগুলো লোকের মোকাবিলা করতে শক্ত-পাল্লার একা এগিয়ে আসা-তারপরে লী-কে সম্মুখ যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করা-এতেই মনে সন্দেহ জেগেছে তার-বুঝেছে লোকটা কাপুরুষ তো নয়ই, বরং অত্যন্ত সাহসী। সে যেমন বলেছে ঠিক সেভাবেই ডেরিকের মৃত্যু ঘটেছে কিনা তার প্রমাণ নেই। দেখা যাচ্ছে ওর সাথে একটা নারীর ভাগ্যও জড়িত ছিল। অন্যায়ভাবে যে উপায়ে লোকটাকে মারা হয়েছে তাতে ঘেন্না ধরে গেছে তার। কিন্তু ক্লাইভ যা বলেছে সেটাও সত্যি। এইসব কিছুর মূলেই ছিল লী। তবে ডেরিক ছিল তার বন্ধু-ওপারে দেখা হলে তখন বন্ধুকে সে কী জবাব দেবে?
কিন্তু লোকটা মরে গেছে। কীভাবে পড়েছে তাতে তুমিও নিজের চোখেই দেখেছ। তুমি আর বার্ট-তোমরাই তো খুন করেছ ওকে। লী-র স্বরে তিক্ততা প্রকাশ পেল।
সেজন্যে আমাকে দোষ দিচ্ছ তুমি? ক্লাইভের সুর চড়া শোনাল। টউবা সিটিতে লোকটা আমাদের শাসিয়েছিল আবার ওর পিছু নিলে একেবারে শেষ করে ফেলবে। মিথ্যা-হুমকি দেয়নি সে-কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম বলেই ওকে সেই সুযোগ না দিয়ে আগেই গুলি করেছি। এখনও আমার বিশ্বাস সে যদি বেঁচে থাকে তবে আমাদের ঘুম হারাম করে ছাড়বে।
ইতস্তত করছে লী। কীথ পকেট থেকে একখণ্ড চিবানোর তামাক বের করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে একটা টুকরো দাঁতে কেটে নিল। কথাটা ক্লাইভ ঠিকই বলেছে, লী, বলল কীথ। শুরু আমরাই করেছি, এখন পছন্দ হোক আর না হোক, শেষও আমাদেরই করতে হবে।
এর মধ্যে, আর আমাকে টেনে না, বলল ইউজিন। প্রথম থেকেই ব্যাপারটা ভাল ঠেকেনি আমার-এখন তো আর প্রশ্নই ওঠে না।
ঠিক আছে, তুমি বাদ, ঝাঁঝের সাথে বলল লী। সবার ছোট হলেও ওর সিদ্ধান্তটাই দেখা যাচ্ছে ঠিক-এটা সহ্য করতে পারছে না ও। তুমি সবকিছু থেকেই বাদ-তুমি দুধ-ভাত
হ্যাঁ, এখন তো তা বলবেই! লাগাম টেনে ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে নিল ইউজিন। আমি যাচ্ছি-মেয়েটাকে খুঁজে বের করে সে যদি আমার সাথে যেতে রাজি হয় তবে ওকে নিয়ে শহরে ফিরে যাব আমি। তোমাদের যা খুশি তাই করো।
একবারও পিছনে না চেয়ে ইউজিন রওনা হলো। চিন্তাযুক্ত মুখে ওর দিকে চেয়ে রইল কীথ।
একসাথেই শক্ত-পাল্লার বাকস্কিনটার দিকে এগিয়ে গেল তিনজন। একটা গুলি জিনের মাথায় লেগে ছিটকে চলে গেছে। সন্দেহ নেই বুলেটের ধাক্কাতেই ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠেছিল। চামড়ার একটা জায়গায় রক্ত লেগে রয়েছে। মাটিতেও রক্ত দেখা যাচ্ছে।
মাটির উপর দিয়ে একটা রক্তের রেখা ফাটলটার দিকে এগিয়ে গেছে। ওখানে পৌঁছে নীচের দিকে চেয়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। ফাটলটা একটু নীচে নেমে ঘুরে গেছে-একটা অন্ধকার গহ্বর দেখা যাচ্ছে। শক্ত-পাল্লাকে খুঁজে বের করতে হলে ওখানে নামতে হবে-কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিয়ে আগে বেড়ে গুলি খেতে রাজি নয়। কিন্তু কে জানে? হয়তো বা সে আগেই ওদিক দিয়ে নীচের ক্যানিয়নে নেমে সরে পড়েছে?
ধারে গিয়ে উঁকি দিল কীথ। এখানে ক্যানিয়নটা বেশি গভীর নয়। নীচে বালু আর কিছু ছড়ানো পাথরের টুকরো দেখা যাচ্ছে।
ফিরে এসে কীথ বলল, শক্ত পাল্লা যদি ওই গর্তের ভিতর থেকে থাকে তবে আর আমাদের করার কিছু নেই। আমি নীচে নেমে দেখে আসি ব্যাপারটা কী।
দুজনের কেউই কোন জবাব দিল না দেখে সে আবার বলল, ক্লাইভ, তুমি এখানে বসে গর্তটা পাহারা দাও। তারপর লী-র দিকে চেয়ে বলল, লী, তুমি কি আসবে আমার সাথে? নাকি তুমিও শক্ত-পাল্লার জন্যে আজীবন এখানে বসেই অপেক্ষা করতে চাও?
চলো! ঘোঁৎ করে উঠল লী। দু’জনে পাহাড়ের নিচু জায়গাটায় পৌঁছে না, নামতে শুরু করল।
ফাটলের নীচে পৌঁছে পাথরের উপর রক্তের দাগ দেখতে পেল ওর। বালি, উপর রক্তের দাগ নেই বটে কিন্তু ওরা জানে চিহ্ন ঢাকার বিভিন্ন রকম কৌশল শক্ত-পাল্লার জানা আছে। আশেপাশে নরম বালুর উপর ঘোড়ার খুরের অনেক চিহ্নই আছে-কিন্তু নতুন তৈরি বুটের কোন ছাপ ওদের নজরে পড়ল না।
দু’হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে কীথ জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মনে হয়, লী?
মরেনি। কেটে পড়েছে ব্যাটা, মন্তব্য করল লী। কিন্তু ওর কথা শুনে খুব নিশ্চিত মনে হলো না তাকে। হয়তো এটাকে একটা সম্ভাবনা ধরে নিয়েই কথাটা বলেছে। নইলে এখানে রক্ত এল কীভাবে? এখন কোন্দিকে যেতে চাও তুমি? প্রশ্ন করল সে।
কাঁধ ঝাঁকাল কীথ। ক্যানিয়ন ধরে যে-কোন দিকেই গিয়ে থাকতে পারে ও। তারপর একটু ভেবে বলল, পানির দরকার হবে ওর। আমার মনে হয় নাকিয়া ক্যানিয়নের দিকেই যাবে লোকটা।
ক্যানিয়ন ধরে রওনা হলো ওরা। যেতে যেতে কীথ বলল, কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে ক্লাইভ। আমরা যা শুরু করেছি-তা শেষ করার দায়িত্বও আমাদেরই ওপর।
লোকটা যা বলেছে তা সত্যি হলে সে নির্দোষ! কিন্তু প্রমাণ যখন নেই তখন ডেরিকের মৃত্যুর বদলা আমাকে নিতেই হবে।
সতর্ক চোখ রেখে পথ চলছে ওরা। কিন্তু কোনরকম চিহ্নই ওদের নজরে পড়ল না ওদের সামনে যতদূর দেখা যায় ক্যানিয়নটা একেবারে নির্জন। কোন শব্দ নেই-কিছুই নড়ছে না।
১২. ঘনিয়ে আসা আঁধারের বিরুদ্ধে
ঘনিয়ে আসা আঁধারের বিরুদ্ধে সমস্ত মনোবল দিয়ে লড়ছে জেকব। চেষ্টা করে চোখ খুলল। তবু অন্ধকার। স্থির হয়ে শুয়ে রইল সে।
কোথায় আছে ও? সে কি মরে গেছে? জীবন্তই কবর দেওয়া হয়েছে ওকে।
ব্যথাটা রয়েছে। তাহলে বেঁচেই আছে। নড়ার চেষ্টা করতেই কোমরের কাছে। নতুন একটা ব্যথা আবিষ্কার করল সে।
ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে তার। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। গুলিতে আহত হয়েছে সে। পড়ার পর খাজটার ভিতর ঢুকে পড়েছিল-তারপরেই জ্ঞান হারিয়েছে জেকব। কিন্তু তার আগে একটা কাজ করেছে-হ্যাঁ, রক্ত। এখানে ঢুকে পড়ার আগে রুমাল চিপে কিছুটা রক্ত নীচে ফেলেছে সে।
হাতড়ে দেখল পিস্তলটা এখনও তার সাথেই আছে। পড়ার আগে নিজের অজান্তেই পিস্তলের উপরকার চামড়ার বাধুনীটা এঁটে দিয়েছিল সে। ছুরিটাও তার সাথেই রয়েছে।
এখন রাত-বাতাসে রাতের ঠাণ্ডা ভাব টের পাচ্ছে জেকব।
ডালিয়া…ডালিয়ার কাছে যেতে হবে তার। নো ম্যানস মেসার কাছে তার জন্য অপেক্ষা করবে ডালিয়া। এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরেই সেই জায়গা। ওকে যতটুকু চিনেছে তাতে সে নিশ্চিত জানে বেঁচে থাকলে ডালিয়া অবশ্যই ওখানেই তার জন্য অপেক্ষা করবে। অবশ্য সে যদি বন্দী থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
নড়তে হবে, এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ওরা নিশ্চয়ই খুঁজবে তাকে, পেলে আবার এখানেই ফিরে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক।
ওরা কি কাউকে পাহারায় রেখে গেছে? হ্যাঁ, আবছাভাবে মনে পড়ছে, উপরে কাদের যেন কথাবার্তা বলতে শুনেছে সে। পাথরের উপর বুটের আওয়াজও কানে এসেছে তার।
নীচে নামলে বেশিদূর যেতে হবে-উপরে ওঠাই বরং সহজ। তা ছাড়া একটা ঘোড়া দরকার-তার বাকস্কিনটা উপরেই কোথাও আছে। খুব সাবধানে হাতে চাপ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। একটু একটু করে উঠে বসল সে।
আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। ধোয়ার গন্ধ এল ওর নাকে।
গুলির শব্দ শুনেছিল মনে আছে-হয়তো ডালিয়া বা কেলভিনের গুলিতে ওদের একজন আহত হয়েছে। আশেপাশে ওদেরই কেউ আগুন জ্বেলেছে। হাতে কোন চোট লাগেনি তার। পাথর আঁকড়ে ধরে একটু একটু করে নিজেকে টেনে তুলল সে। উপরে মাথা বের করার আগে কান পেতে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল। খুব সতর্কতার সাথে মাথাটা সামান্য তুলে উঁকি দিল সে।
বিশ গজ দূরে আগুনটা জ্বলছে। আগুনের ধারে বসা লোকটার মুখে আলো পড়েছে কিন্তু চেনা যাচ্ছে না। ওদিকে লক্ষ্য রেখে অপেক্ষা করছে জেকব। ভাবছে হামাগুড়ি দিয়ে যদি সে বেরিয়ে পড়ে, আর লোকটা তখনই এদিকে ফিরে তাকায়-সাথেসাথেই ধরা পড়ে যাবে ও।
সাবধানে আশেপাশে চাইল জেকব। ঘোড়াগুলো কোথায় আছে খুঁজছে সে। নিজের জখমের কথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করছে ও। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বুকের কাছে কেমন ভেজা-ভেজা লাগছে-বুঝতে পারছে তার ক্ষত থেকে আবার রক্ত বেরুচ্ছে। তার দেহের একপাশে কিছু অসুবিধা হচ্ছে। কোমরের কাছে জায়গাটা শক্ত আর আড়ষ্ট বোধ হচ্ছে। কয়েক ফুট উঠেই সে বুঝতে পারছে চট করে কোন নড়াচড়া এখন তার পক্ষে অসম্ভব।
গর্তের মধ্যে ফিরে লাভ নেই। সকাল হলেই ভাল করে খোঁজাখুঁজি করবে ওবা। ঠিকমত বাতাস বইলে ধোয়া দিয়েই বের করবে তাকে। না, কোন উপায় নেই। তাকে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। পিস্তল ব্যবহার করতে পারবে না, তাহলে শব্দে অন্যরাও এসে হাজির হবে।
হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে উপরে তুলল জেকব। তারপর কোমরের ব্যথাটাকে বাঁচিয়ে একটু একটু করে এগোতে শুরু করল।
উৎকণ্ঠায় ঘামছে জেকব। আগুনের ধারে বসা লোকটা কোন কারণে একবার এদিকে চাইলেই সব শেষ। অথচ তিরিশ গজের মধ্যে আর কোন আড়াল নেই। একেবারে ফাঁকা।
খুব ধীরে নিঃশব্দে এগোচ্ছে সে। তার টেনে চলার সাথে তাল মেলাতে মুহূর্তগুলোও যেন টেনেটেনে চলছে। বারবারই তার মনে হচ্ছে, এই বুঝি লোকটা তাকে দেখে ফেলবে, কিংবা আওয়াজ শুনল। পরনের মোটা জামা পাথরের সাথে ঘষা খেয়ে একটা হালকা খসখস শব্দ তুলছে-কিন্তু এটা ঠেকাবার কোন রাস্তা নেই।
দুই হাত আর একটা হাঁটু ব্যবহার করে প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছে-আরও একটু এগোল সে। আর একটু সামনেই একটা ঝোঁপের ছায়া পড়েছে। তাড়াতাড়ি ওখানেই পৌঁছতে চেষ্টা করল। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে জেকব। বুকের কাছে ছুরি বেঁধার মত যন্ত্রণা হচ্ছে।
বুলেটটা ফুসফুস ছোঁয়নি-নইলে শ্বাস ধীর হয়ে আসত। যেমন আশঙ্কা করেছিল সেই হারে রক্তক্ষরণ হয়নি-তবে তাকে বেশ দুর্বল করে ফেলার মত রক্ত সে হারিয়েছে।
প্রথমে হাত, পরে ওর সম্পূর্ণ দেহই ছায়ার উপর পৌঁছে গেল। এতক্ষণে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেল জেকব। আড়চোখে চেয়ে দেখল লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। কাছে থেকে এবারে লোকটাকে চিনতে পারল। টিউবা সিটিতে যে দু’জনের সাথে ওর দেখা হয়েছিল, লোকটা তাদেরই একজন। একবার জেকবের দিকে চেয়ে আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল লোকটা। এগিয়ে গিয়ে আরও দু’টো কাঠের টুকরো আগুনে চাপিয়ে দিল সে।
এতক্ষণ আগুনের দিকে চেয়ে বসেছিল বলেই ছায়ায় শোয়া জেকবকে দেখতে পায়নি লোকটা। পাথরের উপর দিয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে সীডার গাছের আড়ালে চলে এল। তারপর আবার এগিয়ে চলল সে।
ঘোড়ার গায়ের গন্ধ পেল জেকব। পরক্ষণেই ওগুলোকে দেখতে পেল সে। একটা ঝোঁপের ধারে বাঁধা রয়েছে। আরও একটু এগোল-একটা ঘোড়া ভয় পেয়ে নাক দিয়ে শব্দ করে উঠল। মনে মনে গালি দিয়ে যতদূর সম্ভব কোমল নিচু স্বরে সে বলল, রও বেটা! রও!
ঘোড়াটা গলা টান দিল। সশব্দে নড়ে উঠল ঝোঁপ। ক্রল করে আরও এগিয়ে গেল জেকব। ঘোড়াশুলোকে চেনার চেষ্টা করছে সে। একটা ঘোড়া মাথা ঝুঁকিয়ে ওকে শুকল। দু’হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়াল জেকব। অন্ধকারেও সে চিনতে পেরেছে এটা তারই বাকস্কিন।
অনেক কষ্টে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে টান দিয়ে বাঁধনটা খুলে দিল। কিন্তু দুর্বল শরীরে তার মনে হচ্ছে পড়ে যাবে সে। পড়লে আবার ওঠার শক্তি আর থাকবে না। উপুড় হয়ে শুয়ে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরল জেকব।
কানের কাছে ফিসফিস করে নির্দেশ দিতেই ধীর পায়ে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে শুরু করল বাকস্কিন। লাগাম ধরে ঘোড়ার গতি নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টা করল না সে। নিজের উপর আধ শোয়া থাকার চেষ্টাতেই ওর সব শক্তি খরচ হচ্ছে। নিজের খুশি মতই নীচের দিকে নামতে শুরু করল ঘোড়াটা।
.
সহজাত প্রবৃত্তিতেই দূরে পালিয়ে যাবার জন্য ছুটেছিল ডালিয়া। মাইল খানেক যাবার পর মাল-বোঝাই গাধাগুলোর কথা মনে পড়ল তার। গতি কমিয়ে পিছন ফিরে চাইল সে। ছড়িয়ে পড়ে ডালিয়াকে ধরার জন্যে ছুটছে গাধাগুলো।
মোট চারটে গাধা এসে পৌঁছল। ডালিয়ার ঘোড়াকে অনুসরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ওরা। পিছনে কোথাও আরও তিনটে রয়ে গেছে। দরকারী জিনিসপত্র সব এগুলোর পিঠেই আছে-তাই বাকিগুলোর অপেক্ষায় আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চলল সে।
কখনও ওদের ছাড়াছাড়ি হলে নো ম্যানস মেসার একটা বিশেষ জায়গায় তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল জেকব। কিন্তু সেই জায়গা আর ডালিয়ার মাঝখানে রয়েছে কেলভিন আর ফ্রীডমের সেই দলটা। সম্পূর্ণ মেসা ঘুরে উল্টো দিক থেকে ওখানে পৌঁছা’নোর সিদ্ধান্ত নিল সে। ঘোড়া থেকে নেমে মাল-টানা জম্ভগুলোকে দড়ি দিয়ে নিজের ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিয়ে আবার রওনা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় কপার ক্যানিয়নের ট্রেইল ধরল সে।
রাত হয়ে আসছে। একটা তারা উঠল আকাশে…একটা বাদুড় ওর মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে গেল। শূন্য মরুভূমিতে বহুদূর থেকে একটা কয়োটির ডাক ভেসে এল।
রাইফেলটা শক্ত করে ধরে আছে ডালিয়া। এই নির্জন এলাকায় জেকবের অনুপস্থিতিতে রাইফেলটাই ওর সাহস জোগাচ্ছে। ঘোড়াটাই কেবল নির্ভয়ে ট্রেইল চিনে এগিয়ে চলেছে।
ক্যানিয়নের দু’পাশে দেয়ালগুলো আরও উঁচু হলো। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। স্তব্ধ রাত। মাথার উপরে ওই এক চিলতে আকাশের তারাগুলোই কেবল একটু মিটমিট আলো দেখিয়ে ওকে আশ্বাস দিচ্ছে।
ক্লান্ত ঘোড়াটা সমান তালে এগিয়ে চলেছে। গাধাগুলো এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিছন পিছন আসছে। শক্ত পাহাড়ী ঘোড়া বলেই এখনও এগোতে পারছে। ঘোড়ার পিঠে এতক্ষণ বসে থেকে ডালিয়া নিজেও অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সময়ের সব রকম বোধ লোপ পেয়েছে তার। হঠাৎ পরিশ্রান্ত ঘোড়াটা থেমে থেমে লাফিয়ে একটা ক্লিফের উপর উঠতে শুরু করল। শেষ মাথায় প্রায় পা পিছলে পড়তে পড়তেও সামলে নিল। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ লাগল ডালিয়ার মুখে। ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা।
পথে একবার থেমে ঘোড়াকে পানি খাইয়ে খালি বোতলগুলো ভরে নিয়েছে সে। ওখানে কিছু খেয়ে ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে নিয়েছে ডালিয়া
ভোরের দিকে নো ম্যানস মেসার ধার ঘেঁষে মোড় নিল সে। একটু থেমে কান পেতে শুনল-তারপর আবার এগোল।
মেসার ধার ঘেঁষে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে যাচ্ছে সে। খুব কাছে না এলে কেউ দেখতে পাবে না ওকে। জেকব তাকে যে খাজটার কথা বলেছিল, তার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। কিন্তু ওদিক থেকে যেকোন মুহূর্তে কেলভিন, নিকোলাস ফ্রীডমের দলটা এসে পড়তে পারে। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে ওকে। ধুলো না উড়িয়ে পাথরের উপর দিয়ে চলছে সে।
হঠাৎ একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। ক্লিফের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে দূরে মিলিয়ে গেল শব্দটা। তাড়াতাড়ি আরেকটা বাকের কাছে এগিয়ে সাবধানে উঁকি দিল সে। দেখল নীচে আধমাইল দূরে একটা ঘোড়া পাগলের মত ছুটছে-ঘোড়ার জিনে আরোহী নেই-শূন্য। বুকটা ধড়াস করে উঠল-ওটা জেকবের ঘোড়া নয়তো? রেকাবের উপর দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। বারবার মনকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, ভুল দেখেছে সে-এতদূর থেকে চেনা সম্ভব নয়।
ধুলো উড়ছে ওখানটায়। আরও কয়েকটা গুলির শব্দ উঠল। অনেক দূরে রয়েছে ডালিয়া। ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেও সাহায্যের জন্য সময় মত ওখানে পৌঁছতে পারবে না। কিছু করার নেই। জেকব যদি এই বিপদ থেকে রক্ষা পায় তবে সোজা তার কাছেই আসবে। পিছন থেকে একটা শব্দে ফিরে তাকাল সে।
তিনজন ঘোড়-সওয়ার!
জেকব বলেছিল নিকোলাসের সাথে দু’জন লোক আছে। সম্ভবত তার ঘোড়ার চিহ্ন খুঁজে পেয়ে তাকেই অনুসরণ করছে ওরা। দেখে ফেলেছে কিনা ঠিক বুঝতে পারল না ডালিয়। তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল সে।
মেসার ধারটা এখানে দ্রুত ঘুরে কিছুটা ভিতরে ঢুকে গেছে। মাঝে একটা খাজ দেখা যাচ্ছে। আশপাশে ঘন গাছ-পালা জন্মেছে। আরও একটু নীচে ক্যানিয়নের শুরু। ঘোড়া আর গাধাগুলোকে একত্র করে খাজের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে রাইফেল হাতে মাটিতে শুয়ে পড়ল ডালিয়া।
এখানেই আসবে বলেছিল জেকব। যতদিন সে না আসে, কিংবা ওর মৃত্যু সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হয়, ততদিন ডালিয়া এখানেই অপেক্ষা করবে।
চারপাশটা এবার ভাল করে চেয়ে দেখল সে। জেকব নেই-ওর উপস্থিতির কোন চিহ্নই নেই এখানে। বুকের ভিতরে কেমন যেন একটা অপার শূন্যতা অনুভব করছে ও। সুদীর্ঘ পথ চলতে চলতে আশা নেই জেনেও ভেবেছিল এখানে এলেই সে জেকবের দেখা পাবে। হয়তো আহত অবস্থাতেই দেখবে, কিন্তু দেখা সে পাবেই। এখানে পৌঁছে তার যত্নে পুষে রাখা আশা একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন ভাবপ্রবণ হলে চলবে না-তার পিছনে ধাওয়া করে আসছে নিকোলাস।
নিজেকে সামলে নিল ডালিয়া।
জায়গাটা বেশ ভাল। ক্লিফটা ঢালুভাবে উঠে গেছে উপর দিকে। বৃষ্টির সময়ে মনে হয় এই পথেই উপর থেকে জলপ্রপাতের মত পানি নামে-এখন শুকনো। পাঁচ-ছয় ফুট জায়গা জুড়ে এখনও কিছুটা পানি জমে রয়েছে।
আশেপাশে কিছু বুনো ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কেউ যেন বাতাস আড়াল করার জন্য বা আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য পাথর জড়ো করে একটা আশ্রয় তৈরি করে রেখেছে। নিজের পাশে সার বেঁধে কার্তুজ সাজিয়ে হাটু গেড়ে পাথরের আড়ালে বসল সে।
বেশ দূরে নিকোলাসকে দেখা গেল। বিনা দ্বিধায় রাইফেল তুলে ঘোড়ার পায়ের কাছে গুলি বেঁধাল ডালিয়া। চমকে লাফিয়ে উঠে ঘোড়াটা দাপাদাপি শুরু করল। ওর সঙ্গী লোক দুটো চোখের আড়ালে লুকাল।
ঘোড়াটা শান্ত হবার পর কঠিন চোখে যেখান থেকে গুলিটা এসেছে সেদিকে চাইল নিক। কে গুলি করেছে তা ভাল করেই জানে সে।
কোন লাভ নেই, ডালিয়া, বলল নিক। শেষ পর্যন্ত ধরা দিতেই হবে। তোমাকে না নিয়ে এখান থেকে নড়ব না আমি।
জবাব দিল না ডালিয়া।
আমি জানি তুমি কোথায় আছ। ভাল চাও তো বেরিয়ে এসো-নইলে আমরাই তোমাকে ধরতে আসব।
পকেট থেকে তামাক বের করে সিগারেট বানাতে শুরু করল নিক। কোন লাভ নেই, আবার বলল সে।
ওরা জেকবকে ছাড়বে না, খতম করবে ওকে। আর তা না হলে কাজটা আমিই শেষ করব। তুমি এখন একা-আমাকে ছাড়া তোমার কোন গতি নেই।
ডালিয়া টের পেল কথার ফাঁকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে নিক। ঘোড়াটা অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে-কিন্তু কৌশলে ওটাকে এগিয়ে নিয়ে আসছে বদমাইশ লোকটা
আবার গুলি করল সে।
লাফ দিয়ে ঘোড়াটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হলো। ওর পায়ের তলা থেকে পাথর ছিটকে উঠল। বুলেটটা এবার নিকের মাথার মাত্র দু’ইঞ্চি দূর দিয়ে হ্যাটের কোণায় লেগে বেরিয়ে গেছে! মাথা থেকে খুলে মাটিতে পড়েছে হ্যাট।
হুড়মুড় করে আছাড় খেয়ে পড়ল ঘোড়াটা। গালি দিয়ে উঠল নিক। কিন্তু ওই শব্দের সাথে দূরে নীচে থেকেও একটা শব্দ এল না?…নাকি ওর মনের ভুল?
ডাইনে-বাঁয়ে চাইল ডালিয়া। রাতের অন্ধকারে ওদের এগিয়ে আসা কী করে ঠেকাবে সে?
ওর তিনদিকে মেসার দেয়াল-ডাইনে, বয়ে আর পিছনে। এখান থেকে বেরিয়ে উপরে ওঠার কোন পথ সত্যিই আছে কিনা দেখতে যাবারও সাহস হচ্ছে না তার। কান খাড়া করে ওখানেই বসে রইল সে।
সময় কাটছে…এক ঘণ্টা…দু’ঘণ্টা কিন্তু কিছুই ঘটল না। সূর্যের তাপ ওর পেশীগুলোকে শিথিল করে দিচ্ছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। কয়েকবার নড়েচড়ে বসল-কিন্তু বারবারই ক্লান্তিতে ঝিমানি এসে যাচ্ছে তার। সিধে হয়ে বসল সে। দূরের পাহাড়গুলো পড়ন্ত রোদে জ্বলন্ত পাহাড়ের মত দেখাচ্ছে।
সে বুঝতে পারছে রাতের অন্ধকারে তাকে আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। মুহূর্তের জন্য পাশের সীডার গাছটার সার্থে মাথা ঠেকিয়ে একটু চোখ বুজল সে। রাজ্যের ঘুম নেমে এল ওর দু’চোখে
আমিষ-খেকো পাখি ধীর অলস গতিতে চক্কর দিচ্ছে আকাশে। সীডার গাছের তলায় গাধাগুলো অবসন্নভাবে মাথা নীচের দিকে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডালিয়ার ঘোড়াটা খোলা জায়গায় এগিয়ে গিয়ে পাথরে আটকা স্থির ঠাণ্ডা পানিতে চুমুক দিল।
.
ক্যানিয়নের ভিতরে পিছনে ফেলে আসা একটা মাইল কোনমতে হোঁচট খেয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে আর ক্রল করে এগিয়েছে জেকব। নাকিয়ার কাছে, যেখানে সোনালী স্ট্যালিয়নটা বেরিয়ে এসেছিল-সেখানকার নরম বালির কথা জেকবের মনে ছিল। তার বাকস্কিনটা ওখান দিয়ে ছুটে যাবার সময়ে পানির বোতল আর রাইফেল হাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়েছে সে।
মেসার দেয়ালে সেই খাজটার সিকি মাইলের মধ্যে এসে গেছে জেকব। কথাগুলো বুঝতে না পারলেও নিকোলাসের চেঁচিয়ে কিছু বলা, তারপরেই গুলির শব্দ, সব শুনেছে সে। দ্বিতীয় গুলির পরে এখন সব নীরব।
ডান পা-টা টেনে টেনে চলছে সে। তার প্যান্টের কাপড় রক্ত জমে শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে। ভিতরে কোন হাড় ভেঙেছে বলে তার মনে হচ্ছে না। বুকের গুলিটা তাকে সোজা এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে। রক্ত হারিয়ে বেশ দুর্বল হয়ে পড়লেও মনে হচ্ছে এতে ওর দেহের মারাত্মক কিছু ক্ষতি হয়নি। কঠিন মাটিতে সংগ্রাম করে বাঁচতে অভ্যস্ত জেকব। কষ্ট সহিষ্ণুতা ওর দ্বিতীয় ধর্ম উপায় নেই, এখন তাকে এগিয়েই যেতে হবে। নইলে অবধারিত মৃত্যু।
ডালিয়ার কাছে পৌঁছতে হবে তাকে। ওর কাছে গাধার পিঠে রয়েছে ওষুধ আর খাবার। ওর এখন সবচেয়ে বেশি দরকার খুব গরম আর কড়া এক কাপ কফি। পিস্তল আর রাইফেলের গুলির বাক্সগুলোও রয়েছে ডালিয়ার কাছে। অবশ্য বেশি গুলি খরচ হয়নি তার। এখনও ওর কাছে প্রায় ত্রিশ রাউন্ড গুলি রয়ে গেছে।
আরও একশো গজ সহজেই এগোল সে। তারপর একটা শুকনো জলপ্রপাত বেয়ে মোলা ফুট উপরে উঠল। তার ভাগ্য ভাল যে প্রপাতটা একবারে সোজা না নেমে ধাপে ধাপে তিনচার ফুট করে নেমেছে। পানির পাত্রটা বারবারই বাধার সৃষ্টি করছে-ওটা নিয়ে ক্রল করে চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, কিন্তু ওকে যদি বেকায়দায় কোথাও আটকা পড়তে হয় তবে ওই পানিই হয়তো ওর প্রাণ বাঁচাবে। খাবার ছাড়াও চলতে পারবে সে-আগেও চলেছে।
ওখানে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইল জেকব। হাঁপাচ্ছে সে। একটু বিশ্রাম নিয়ে একটু পানি মুখে ঢেলে ভিতরটা ভাল করে ভিজিয়ে গলা দিয়ে ওটা নীচে নামাল।
সে বুঝতে পারছে ওরা এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলবে সে কোথায় আছে। ওর খালি ঘোড়াটা কিছুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করেই চালাকিটা বুঝতে পেরে আবার ফিরে আসবে ওরা। ঘোড়া থেকে সে কোথায় নেমেছে সেটা খুঁজে বের করতে ওদের বেশি সময় লাগবে না। তারপরই ক্যানিয়ন ধরে সোজা এগিয়ে আসবে।
সময়ের হিসাব অনেক আগেই হারিয়েছে জেকব। চলতে চলতে বারবার মাটিতে পড়েছে, উঠেছে, আবার পড়েছে কিন্তু তবু এগিয়েছে। এখন আর ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে এগোচ্ছে না সে-যন্ত্রের মত চলছে।
ডালিয়া…ডালিয়া আমার জন্যে একটু দাঁড়াও। ভাঙা গলায় ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করল জেকব। কথাটা এই নিয়ে কতবার বলেছে সে?
পিছনের লোকগুলো পিছু ছাড়েনি। শক্ত মানুষ ওরা! আজ সারাটা দিনে বহুবার টের পেয়েছে জেকব-ওদের সহজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। ওই কঠিন লোকগুলোর একটাই উদ্দেশ্য-শক্ত-পাল্লাকে শেষ করতে হবে। এবারে আদা-জল খেয়ে লেগেছে ওরা। ফেরানো যাবে না।
ওদের কথা মনে পড়তেই আবার এগোতে শুরু করল জেকব। কিছুদূর এগিয়েই আবার পড়ে গেল সে। ধীরে ধীরে উঠে বসতে চাইল।
সামনেই বালুর উপর রয়েছে ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন। নালবিহীন ছাপ-বুনো ঘোড়ার! ওগুলো এখানে কীভাবে এল? তবে কি এখানে পৌঁছবার আর কোন সোজা পথ আছে যেটা তার চোখে পড়েনি? এখানেই বা কেন এসেছিল ওরা?
রাইফেলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল জেকব। খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলল সে। প্রতি পদক্ষেপেই হোঁচট খাচ্ছে, প্রায় পড়ে যাবার অবস্থা হচ্ছে। কতগুলো পাথরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আরও সামনে নো ম্যানস মেসার খাজটা দেখতে পেল। ওটা উপর দিকে ধীরে ধীরে সরু হয়ে গেছে। আরও একটা জায়গায় আবার ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখা গেল।
এখানে নিশ্চয়ই পানি আছে কোথাও। ঠিক-ওই পানির আশেপাশেই কোথাও অপেক্ষা করবে ডালিয়া।
আবার পড়ে গেল জেকব। হাতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল করল বালুর উপর রক্ত। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সেখান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। পিছন থেকে পাথরের উপর খটর খটর আওয়াজ হচ্ছে। চমকে উঠে পিছন ফিরে চাইল। কেউ-কিছু একটা ওর দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে।
১৩. পাথরের উপর বুটের ঘষা
পাথরের উপর বুটের ঘষা খাওয়ার শব্দে ডালিয়ার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলেই একজোড়া বুট দেখতে পেল সে। ওদিক থেকে কেউ একজন হেসে উঠল।
কী আশ্চর্য! কত ভয়ে ভয়ে এগিয়েছি আমরা…আর এদিকে উনি দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন!
মেয়ের ফর্মাটা ভাল। নিক বলেছে তার কাজ শেষ হলে ওকে আমাদের হাতে তুলে দেবে…চমৎকার প্রস্তাব। আমাদের সবাইকে একাই অনেক আনন্দ দিতে পারবে মেয়েটা।
আধশোয়া অবস্থায় পাথরে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে রয়েছে ডালিয়া। সব শেষ-বিফল হয়েছে সে। সম্পূর্ণ বিফল। কত সাবধানে ছিল, সবকিছুই ঠিক ঠিক করেছিল। জায়গাটা খুঁজে বের করে সময় মতই পৌঁছেছিল। ওরা কীভাবে যেন টের পেয়ে পিছু নিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু স
আজ কত ঘন্টা একটানা জেগে থাকার পরে ঘুমিয়েছে সে? এর আগেও কত রাত তাকে শুধু নামমাত্র ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে? তার শরীরের উপর অবিরাম যাত্রার ধকল কতদিন ধরে যাচ্ছে? নিজেকে এইসব প্রশ্ন করছে না-অজুহাত খুঁজে লাভ নেই। এই অবস্থা থেকে রেহাই পাবার একটা উপায় বের করতে হবে।
রাইফেলটা আর তার পাশে নেই। ওরা সরিয়ে রেখেছে। মোট তিনজন ওরা। ওদের বিরুদ্ধে একা কী করতে পারে সে?
পাথরের উপর বুটের আওয়াজ উঠল। তারপর নিকোলাসের গলা শোনা গেল, কোথাও নেই। মনে হচ্ছে ব্যাটা মরেছে, নইলে এখানে ওকে নিশ্চয়ই দেখা যেত।
মরুকগে ও ছুঁড়ীটা তো বেঁচে আছে?
ডালিয়ার দিকে চেয়ে ওকে বুট দিয়ে তো দিল নিক। ওঠো, মটকি মেরে পড়ে থেকে কোন লাভ নেই।
বিনা প্রতিবাদে শান্তভাবেই উঠে দাঁড়াল ডালিয়া। একে একে সবার দিকে চেয়ে ওদের মুর ভাব লক্ষ করল। ভাবছে সে…মন্টির মুখে দয়া মায়ার কোন আভাস নেই। ওর কাছ থেকে কোনরকম সাহায্যই আশা করা যায় না।
অন্যজন একটু বেঁটে-খুব শক্ত গড়ন, তবু হয়তো…কিন্তু পরমুহূর্তেই সে যেমন লোলুপ দৃষ্টিতে ডালিয়ার দিকে চাইল, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ থাকল না।
খুব বড় রকম বিপদে জড়িয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারছে। মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করার চেষ্টা করছে সে। জেকবকে যে সে আশা করছে তা ওদের বুঝতে দেওয়া কিছুতেই চলবে না। আর যে ক্যানিয়ন ধরে সে আসবে, সেদিক থেকে ওদের নজর অন্যদিকে ফিরাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কোথায় সে? প্রশ্নটা এমনভাবে করল নিকোলাস যে মনে হলো তাতে ওর কিছুই যায় আসে না।
ওরা মেরে ফেলেছে ওকে। ওই ফ্রীডমের দলটা। ওদের সাথে কথা বলতে ঘোড়ার পিঠে করেই এগিয়ে গেছিল সে-দু’জন একপাশে দাঁড়িয়েছিল-ওরাই গুলি করেছে ওকে। মনে হয় ওদের একজনকে খতম করেছি আমি।
তুমি মেরেছ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল বেঁটে লোকটা। কীভাবে?
ওটা দিয়ে, হাত তুলে সরিয়ে রাখা রাইফেলটা দেখাল ডালিয়া। অন্য লোকটাকে পেলে ওকেও শেষ করব আমি।
খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল সে। তারপর নিকোলাসের দিকে চেয়ে বলল, এই মাগীর ওপর সতর্ক নজর রাখতে হবে, নিক।
চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি নিজেই নজর রাখব।
কয়েক পা সরে গিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ক্লিফ, ঝোঁপ আর গাছগুলো লক্ষ করছে নিক। উপর দিকে যেখান থেকে বৃষ্টির সময়ে পানি পড়ে, সেই জায়গাটা অনেকটা গাছপালা আর আগাছায় ঢাকা পড়ে আছে। পিছনে সাদা ক্ষত চিহ্নের মত নগ্ন ক্লিফের পাথর উঁকি দিচ্ছে। ওদিকে একবার চেয়ে আবার ফিরে এল সে।
লোকটা যদি মরেই গেছে, তবে তুমি এখানে ফিরে এসেছ কেন?
মানে? অবাক হবার ভান করল ডালিয়া। ওর মৃতদেহ খুঁজে বের করে ওকে কবর দেব বলেই ফিরে এসেছি। ওই লোকগুলো চলে গেলেই আমি ওর দাফনের ব্যবস্থা করব। সোজাসুজি নিকোলাসের চোখের দিকে চাইল সে। ওর দেহটাকে শিয়াল শকুনে ছিড়ে খাবে, এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারব না আমি।
হয়তো মরেছে সে..হয়তো মরেনি। নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা। ডালিয়ার দিকে চাইল নিক। তুমি থাকায় সময়টা আমার আনন্দের মধ্যে দিয়েই কাটবে।
দূরে উপত্যকার দিকে ডালিয়ার চোখ পড়ল। উপত্যকার একটা সমতল অংশ বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওখান থেকে। হঠাৎ ঘোড়াগুলোকে দেখতে পেল সে। সোনালী স্ট্যালিয়নটাই দলের সবাইকে পথ দেখিয়ে আগে আগে ছুটছে।
ডালিয়ার হার্ট বিট বেড়ে গেল। বুনো ঘোড়ার দল। বাতাস এদিক থেকে ডালিয়াদের দিকে বইছে। পথে কোন বাধা না পেলে সোজা এখানেই আসবে ঘোড়াগুলো! গন্ধ পাবে না।
কী ঘটবে? ওরা কি পাশ কাটিয়ে যাবে? নাকি সোজা এখানেই এসে ঢুকবে? ওদের দেখে আবার ছুটে পালিয়ে যাবে? আতঙ্কিত হয়ে ঘুরপাক খাবে-নাকি ওদের উপর দিয়েই চার্জ করে এগিয়ে যাবে?
আমি কিছু খাবার তৈরি করব ভাবছি, বলল ডালিয়া। তোমাদের আপত্তি আছে?
না, জবাব দিল নিক।
গাধার পিঠের থেকে যা যা দরকার বেছে নামাতে শুরু করল ডালিয়া। তাড়াহুড়া করছে না। ভাবছে, ঘোড়াগুলো যদি এখানেই আসে কতক্ষণ সময় লাগবে ওদের পৌঁছতে? ওরা যে মাঝেমাঝে এখানে আসে তা জেকবের কাছে শুনেছে সে। ওদের পায়ের ছাপও দেখেছে।
জেকবের পিছনে যারা তাড়া করেছিল তারা ওই দিকেই কোথাও আছে। ওদের দেখে ভয় পেয়ে ঘোড়ার দলটা মোড় নিয়ে ক্যানিয়ন ধরে উপরে উঠে আসাটাই স্বাভাবিক।
জিনিস ক’টা ওখানেই মাটিতে নামিয়ে রেখে ঘুরে ফিরে লাকড়ি জোগাড় করতে শুরু করল ডালিয়া। কেউ ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না। ওর দিকে কামুক চোখে চেয়ে চেয়ে ওরা ভবিষ্যৎ সুখ-স্বপ্ন দেখছে। এটাই চাইছিল ডালিয়া.. মনে মনে প্রত্যাশা সে-ও করছে। গাধার পিঠে অন্যান্য মালের সাথে জরুরী অবস্থায় ব্যবহারের জন্য একটা ছুরিও রাখা আছে।
আগুন জ্বালাবার জন্য সগ্রহ করা কাঠ নামিয়ে রেখে আবার গাধাগুলোর কাছে ফিরে গেল। যতক্ষণ সম্ভব আগুন জ্বালা স্থগিত রাখতে চাইছে-ধোয়ার গন্ধ নাকে গেলে আর ঘোড়াগুলো এদিকে আসবে না। জিনিসপত্রের ভিতর হাত ঢুকিয়ে মুঠো করে ছুরির বাটটা অনুভব করল। পাশেই ওর ঘোড়াটা রয়েছে।
ঠিক সেই সময়ে ক্যানিয়নের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকারের সাথে সাথে দ্রুত এগিয়ে আসা খুরের শব্দ শোনা গেল। ছুরি হাতে ঝট করে ঘুরে দাড়াল ডালিয়া
ধুলোর মেঘ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘোড়ার উপর চড়ে বসল।
নিকোলাস ওকে চিৎকার করে থামতে বলল। কিন্তু ততক্ষণ ঘোড়াগুলো ঢুকে পড়েছে ওদের ক্যাম্পে। চট করে ঘুরে লাফিয়ে ঘোড়ার পথ থেকে সরে যেতে গিয়ে নিক হোঁচট খেয়ে পড়ল পাথরগুলোর ফাঁকে। মন্টি সীডার ঝোঁপের আড়ালে নিরাপদেই আছে। কিন্তু বেঁটে লোকটা ওই ঘোড়াগুলোর পথের মাঝখানে পড়ে গেল।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে সোনালী ঘোড়াটার দিকে পিস্তল তুলল সে। কিন্তু গুলি করার আগেই অন্যদিক থেকে একটা গুলির শব্দ উঠল। ঘুরে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর পায়ের তলায় উপুড় হয়ে পড়ল লোকটা।
এতগুলো বুনো ঘোড়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে ডালিয়ার ঘোড়াটাও ওদের সাথে ছুটতে শুরু করল। উপরে সীডারের ঝোঁপগুলোর দিকে লাফিয়ে এগিয়ে গেল স্ট্যালিয়ন। পাথরের দেয়ালটার কাছে একা একটা বড় পাথরের পিছন দিয়ে ঘুরে সরু একটা পথ ধরে উপরের দিকে ছুটল। ডালিয়ার ঘোড়াটাও হোঁচট খেতে খেতে ছুটছে ওদের সাথে। ঝোঁপের ভিতর দিয়ে যাবার সময়ে একটা নিচু ডালের সাথে বাড়ি খাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মাথা নুইয়ে কোনমতে ওটাকে কাটাল ডালিয়া। আপ্রাণ চেষ্টার পরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মেসার ধার টপকে পার হয়ে গেল ঘোড়াটা। নো ম্যানস মেসার মাথায় উঠে এসেছে ওরা!
শক্ত হাতে লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে ফেরাল ডালিয়া।
জেকব!
নিজের বাকস্কিনের পিঠে চড়েই ওদের সাথে উপরে উঠে এসেছে জেকব। লাফিয়ে নীচে নেমে ওর কাছে ছুটে গেল ডালিয়া। নামতে গিয়ে ডালিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল জেকব। শার্টের সামনের দিকটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। মড়ার মত দেখাচ্ছে ওকে।
রাইফেল, হাঁপ টেনে বলল সে। ওদের ঠেকাও!
বাকস্কিনটাকে ধরে কোনক্রমে দাঁড়াল সে। ওর হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে মেসায় ওঠার মুখটার দিকে ছুটে গেল ডালিয়া। কাউকেই দেখতে পেল না। তবু ভয় দেখানোর জন্য রাইফেল তুলে নীচের দিকে একটা গুলি করল। এখন আর সহজে আগে বাড়তে সাহস পাবে না ওরা।
ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে ডালিয়ার পাশে এগিয়ে এল জেকব। একটা পা সোজা রেখে এক হাঁটুর উপর ভর করে বসল। তারপর কেবল হাতের সাহায্যে নিজেকে টেনে শিলার উপর তুলল।
বন্য ঘোড়াগুলো উপরে উঠে গাছপালার ভিতর এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। মেসার উপরটা সীডার আর পাইন গাছে ভর্তি। অন্য গাছগুলো চিনতে পারল না ডালিয়া। এখানে ওখানে মাঝারি আকারের মাঠগুলোতে সুন্দর ঘাস জন্মেছে। বোঝাই যাচ্ছে ঘোড়াগুলো এখানে নিয়মিতই আসে।
রাইফেলটা জেকবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাধাগুলোর কাছে এগিয়ে গেল ডালিয়া। ঘোড়াগুলোর সাথে ওরাও ছুটে উপরে উঠে এসেছে।
তাড়াতাড়ি একটা আগুন জ্বেলে পানি বসিয়ে দিল সে। তারপর জেকবের কাছে এসে ওর শার্টের বোতামগুলো খুলে ফেলল।
বুকের ক্ষতটা কিছুটা ফুলে উঠে কুৎসিত দেখাচ্ছে। যত্ন করে অল্প গরম পানিতে ওটা ধুয়ে দিল সে। কোমরের জখমটা সামান্যই-গুলিটা আঁচড় কেটে হাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ঘোড়া থেকে পড়াতেই পায়ে চোট লেগেছে বেশি। নীল হয়ে আছে ওর উরু! ওটাও ধুয়ে পরিষ্কার করা শুরু করতেই ওকে বাধা দিল জেকব।
ওই যে গাছটা দেখছ, বলল সে। যেটায় ঘিরে রঙের ফুল ধরে আছে-ওটা এনে ঘেঁচে পানিতে ফুটিয়ে নাও।
কী গাছ ওটা?
ক্লিফ রোজ। এসব মেসায় ওই গাছ প্রচুর জন্মায়। হোপি ইন্ডিয়ানরা ওটা দিয়ে জখম ধোয়-বেশ কাজ হয় ওতে।
জেকবের নির্দেশ মতই কাজ করল ডালিয়া। পিউটে মেসার দেয়ালটায় অস্তগামী সূর্যের রঙ লেগেছে। নো ম্যানস মেসার ছায়াটা ধীরে ধীরে আরও লম্বা হচ্ছে।
এখন আমরা কী করব? প্রশ্ন করল ডালিয়া।
আগুনটাকে জিইয়ে রাখতে হবে। ওই গাছটার তলায় আমাকে শুইয়ে দাও। যতক্ষণ আক্রমণ না আসে, কিংবা ঘণ্টা দুই আমাকে ঘুমাতে দাও, তারপর তুলে দিয়ে এরপরে আমি পাহারায় থাকব। আগুনটা যদি জ্বেলে রাখা যায় তা হলে কারও পক্ষে অলক্ষ্যে উপরে উঠে আসা অসম্ভব।
একটু পরে জেকবকে শক্ত করে ধরে দাড় করাল ডালিয়া।
জেকব হঠাৎ বলে উঠল, আমার বাকস্কিনটা বুনো ঘোড়ার দলের সাথে গিয়ে মিশেছিল। একেবারে অবসন্ন অবস্থায় পড়েছিলাম, আর এক পা-ও এগোবার শক্তি ছিল না আমার। আমাকে খুঁজে পেয়ে ওর কী খুশি-ঠিক ছোট্ট কুকুরের বাচ্চার মত করছিল। কোনমতে ওর পিঠে চড়ে বসেছিলাম।
ওরা কি ওপরে ওঠার চেষ্টা করবে, জে? ওকে ধরে গাছটার তলায় শুইয়ে। দিয়ে জিজ্ঞেস করল ডালিয়া।
লিয়া…তুমি দেখো। আমি…’ কথা জড়িয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল জেকব।
চারদিক নিস্তব্ধ। সূর্য ডুবে গেছে। আগুনে দেওয়ার জন্য অনেক শুকনো ডালপালা জোগাড় করে স্তূপ করে রাখল ডালিয়া।
পায়ে সাদা মোজার মত ছোপওয়ালা বুড়ো ঘোড়াটা কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের কাছ থেকে সরে যাবার বড় একটা তাগিদ নেই ওর। মনে হয় ক্যাম্পের ধোয়ার গন্ধে পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসছে তার।
রাইফেলটা চেক করে তাতে আবার গুলি ভরে নিল সে। জেকবের পিস্তলেও খালি ঘরগুলোতে গুলি ভরে রাখল। আগামীতে কী হতে যাচ্ছে ভেবে একটু ভয় ভয় করছে ওর-কিন্তু ঠিক ভয়-ও বলা যায় না একে। জেকব পাশে থাকতে তার আবার ভয় কীসের? হোক না সে আহত-পাশে জেকব থাকলে কাউকে সে ভয় পায় না।
গভীর কালচে নীল রঙ ধারণ করল আকাশ। একটা দুটো করে তারা ফুটে উঠছে। আশেপাশের ছোটবড় পাহাড়গুলোকে কালো আর রহস্যময় দেখাচ্ছে। রাতের ঠাণ্ডা ফুরফুরে হাওয়ায় চাঙ্গা বোধ করছে ডালিয়া। গাধার পিঠ থেকে কম্বল এনে জেকবের দেহটা ঢেকে দিল সে।
অস্থির বোধ করছে। ক্লিফের ধারে গিয়ে কিছুক্ষণ কান পেতে রইল। নীচে ওদের ক্যাম্পে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।
দক্ষিণ দিকে চাইল সে। ওদিকে দূরে গুহার মত দেখা যাচ্ছে। ওরা দু’জনে মিলে যেখানটায় সজি বাগান করেছিল সেখানেও মেসার উপরে এইরকম গুহা ছিল। সাধের বাগানটা ছেড়ে আসতে বেশ খারাপ লেগেছিল ওর।
আজ রাতেই আক্রমণ আসবে। মনে মনে এটা নিশ্চিত জানে ডালিয়া। কিন্তু এবারে সে তৈরি থাকবে।
১৪. ঘোড়ার পিঠে বাঁধা বার্টের দেহ
ঘোড়ার পিঠে বাঁধা বার্টের দেহটা নিয়ে ফ্রীডমে পৌঁছল ইউজিন। সোজা ফ্রেডের বারের সামনে গিয়ে থামল সে
এরমধ্যেই লোক জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। গিবন, ডিক, ডেভ, অ্যালেন সবাই উপস্থিত। আড়ষ্টভাবে ঘোড়া থেকে নামল ইউজিন।
হা, এই লোকটাই বার্ট, বলল সে। মারা গেছে ও। আর এখনই যদি অন্য সবাইকে ঠেকানো না হয় তবে আরও লোক মারা পড়বে। নিরপরাধ শক্ত-পাল্লার সাথে ওর স্ত্রীকেও হত্যা করবে ওরা।
স্ত্রী? প্রশ্ন করল গিবন।
হ্যাঁ, সে-ই বার্টকে গুলি করেছে। লী-র সাথে কথা বলছিল শক্তপাল্লা, বলছিল ডেরিক ওর দিকে পিঠ দিয়ে গোপনে কোমরের সামনে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে বগলের তলা দিয়ে ওকে গুলি করার চেষ্টা করেছিল বলেই ওর গুলি ডেরিকের পিঠে লেগেছে। কিন্তু ওকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই আত্মসম্মানহীন ইতরের মত বার্ট আর ক্লাইভ ওকে গুলি করে।
মরেনি সে? কে যেন প্রশ্ন করল।
মনে হয় না।
অন্য সবাই কী করছে? জটলার ভিতর থেকে প্রশ্ন এল। ও যদি সত্যি কথা বলে থাকে? আর একজন বলল। কোন প্রমাণ তো নেই? সবাই একসাথে কথা বলছে-কারও কথা কেউ শুনছে না।
চুপ করো! চিৎকার করে ধমকে উঠল গিবন। সবাই একসাথে কথা বললে কোন লাভ হবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। সবাই চুপ করলে ইউজিনের দিকে ফিরল সে। লী-র কী মত?
ওর ধারণা নিজেকে বাঁচাবার জন্যে শক্ত-পাল্লা এখন ওই কথা বলছে-ডেরিক অমন করতেই পারে না।
বার থেকে বেরিয়ে এসে এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল ফ্রেড। এবার এগিয়ে এল সে। প্রমাণ আছে। বোমার মত শোনাল কথাটা। আমি নিজের চোখে ডেরিককে পেটের কাছে পিস্তল খুঁজতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করতেই ধমক দিয়ে আমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলেছিল সে।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে অন্যায়ভাবে পিঠে গুলি করে হত্যা করা হয়নি ওকে, চিন্তিত গম্ভীর স্বরে বলল গিবন।
কিন্তু এটা শুধু আমরা বুঝলে কী লাভ? ওদের বোঝাবে কে? ওরা যদি ভুল বুঝে দু’জন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে তবে আমাদের শহরের এই কলঙ্ক আর জীবনেও ঘুচবে না, হতাশ সুরে বলল ইউজিন।
যে করেই হোক ওদের ঠেকাতেই হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল গিবন। ফ্রেড, দোকানের ভার আর কারও কাছে দিয়ে তুমিও চলো আমাদের সাথে। এক্ষুণি রওনা হচ্ছি আমরা।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই গিবন, ইউজিন আর ফ্রেডের সাথে আরও তিনজন রওনা হয়ে গেল।
.
দুই ঘণ্টা কেটে গেছে। তবু জেকবকে ঘুম থেকে জাগায়নি ডালিয়া। আহত হওয়ার পরে এই প্রথমবারের মত বিশ্রাম নিচ্ছে সে। ডালিয়া যখন বুকের ড্রেসিং বদলে দিয়েছে তখন জাগেনি ও। আরও ক্লিফ রোজ ব্যবহার করেছে সে। ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে কী যেন বলে উঠেছিল, কিন্তু ঘুম ভাঙেনি তার।
এর মধ্যে দু’বার সে ক্লিফের ধারে গিয়ে আগুনে কাঠের জোগান দিয়ে এসেছে। দু’বারই খুব সাবধানে এগিয়েছে-ধারের কাছে গিয়ে কান খাড়া করে থেকেছে, কিন্তু নীচে থেকে কোনরকম শব্দই তার কানে আসেনি।
রাত বাড়ছে। সেই সাথে আরও সতর্ক হয়ে উঠছে ডালিয়া। অনেক আগেই রাত বারোটা বেজে গেছে। আর পারছে না সে-তার ভয় হচ্ছে আবারও ঘুমিয়ে পড়বে আগের মত। তা হলে আর রক্ষা নেই, ঘুমের মধ্যেই খুন হয়ে যাবে ওরা। আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে এক কাপ গরম কফি হাতে জেকবকে ডেকে তুলল।
একটু নড়ে কয়েকবার মিটমিট করে চোখ খুলল জেকব। ডালিয়াকে দেখে একটু হেসে কাপটা হাতে নিয়ে উঠে বসল। একদিনেই তার স্বামীর চোখ-মুখ একেবারে বসে গেছে। কিন্তু কফি শেষ করে বিনা সাহায্যেই উঠে দাড়াল জেকব।
বাতাসে আগুনের তেজ কমে এসেছে। দূরে মেঘের গর্জন শোনা গেল। ঘুরে আকাশের দিকে চাইল জেকব। আকাশের একটা অংশ কালো হয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে মেঘ। চারদিক আলো করে দূরে একটা পাহাড়ের মাথায় বাজ পড়ল।
রাইফেলটা তুলে নিল জেকব। গাধাগুলোকে একত্র করে সামলে রাখতে হবে, বলতে বলতেই বৃষ্টির কয়েকটা বড় ফোঁটা পড়ল। আগুনটা এখনই নিভে যাবে।
একটু খুঁড়িয়ে বাকস্কিনটাকে কাছে এগিয়ে নিয়ে এল। তারপর হঠাৎ কী মনে করে জিন তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিল সে। গাধাগুলোকে জড়ো করে এনে ডালিয়া দেখল তার ঘোড়াও সাজা হয়েছে। ডালিয়াকে গাধাগুলোর পিঠে সব মাল তুলতে বলে আগুনের উপর বেশ কিছু কাঠ চাপিয়ে দিল জেকব।
নিজেকে টেনে জিনের উপর বসিয়ে মেসার উপর দিয়ে উত্তরে রওনা হয়ে জেকব বলল, নীচে থেকে মাইলখানেক উত্তরে কিছু ভাঙাচোরা নিচু জমি দেখেছি আমি-ওখানে হয়তো একটা আশ্রয় মিলতে পারে। তা ছাড়া নিচু জায়গায় আমাদের ওপর বাজ পড়ার সম্ভাবনা কম।
ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সেই বুড়ো ঘোড়াটাই ওদের আগে যাচ্ছে। জেকবের ঘোড়ার সাথে বাঁধা গাধাগুলো পিছন পিছন চলেছে!
সামনের ঘোড়াটাই যেন ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে কয়েকটা ভাঙা জায়গা পড়ল। ওরই একটা বেছে নিয়ে ঘোড়াটা নীচে নামতে শুরু করল। প্রায় দু’শো ফুট নামার পরে বাঁক নিয়েই বিশাল গুহাটা দেখতে পেল ওরা।
বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। জিন আর মালপত্র নামিয়ে পশুগুলোর জন্য একপাশে জায়গা করে দিল জেকব। অন্যদিকে ডালিয়া বিছানা পেতে ফেলেছে।
আবার মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ঘনঘন বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। পাশাপাশি শুয়ে ডালিয়াকে আরও কাছে টেনে নিল জেকব! এই ঝড়বাদলের মধ্যে কেউ ওদের খুঁজতে আসবে না। আর এলেও, খুঁজে পাবে না-বৃষ্টিতে ওদের সব চিহ্ন ধুয়ে মুছে যাবে। পরস্পরের নিশ্চিন্ত সান্নিধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
.
ভোর বেলা লী, কীথ আর ক্লাইভ এসে হাজির হলো মেসার ধারে নিকোলাসের ক্যাম্পে। ওদের দেখে খুশি হওয়ার কোন ভাব দেখাল না নিক। ওদের সাথে কেলভিনকে দেখে মন্টির মুখের ভাবও কঠিন হয়ে উঠল।
ওরা কোথায়? পালিয়ে গেছে? প্রশ্ন করল লী।
ওর কথার কোন জবাব না দিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে পিছনে উপরদিকে দেখাল নিক।
ওখানে উঠল কীভাবে? উপরে ওঠার কোন রাস্তা আছে বলে তো শুনিনি? প্রশ্নটা নিককে করলেও কেলভিনের চোখ মন্টির উপর। ওর আশেপাশে কিছুটা জায়গা বেশ খুঁটিয়ে দেখল সে। ও যে কী ভাবছে তা বোঝা মুশকিল।
রাস্তা একটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, মন্টি বলল। কতগুলো বুনো ঘোড়ার পিছু পিছু সোজা উঠে গেছে।
তোমরা ওপরে ওঠোনি?
উপায় ছিল না। মেসার ওপর কিনারা ঘেঁষে আগুন জ্বেলে রেখেছিল ওরা। বৃষ্টিতে নিভে গেছে। আগুনটা আর জ্বালা হয়নি-মনে হচ্ছে ওখান থেকে অন্যদিকে কোথাও সরে গেছে ওরা।
কীথ ওকে থামিয়ে বলে উঠল, তোমরা তিনজন ছিলে না? আর একজন কোথায় গেল?
ঘোড়াগুলো ওপরে ওঠার সময়ে ওকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলেছে। অবশ্য তার আগে জেকব গুলি করেছিল ওকে। ওর মৃতদেহ ওদিকে নিয়ে রেখেছি আমরা।
ওদিকে একবার চেয়ে দেখল সবাই কিন্তু কেউই ওর মরদেহের কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করল না। ওকে এই এলাকার সবাই চেনে। অত্যন্ত নিচু জাতের বদমাইশ ছিল লোকটা। ওর মৃত্যুতে ভাল বই খারাপ হবে না কারও।
তা হলে আর দেরি কীসের? বলল লী। চলো উপরে উঠে ওকে শেষ করে আসি?
নিকোলাস নড়ল না। তোমরা কাজের ভারটা আমার ওপর দিয়েছ, বলল সে। ওটা আমার দায়িত্ব।
আমরা সবাই যখন আছি এখানে-চলো একসাথে যাই।
সাহায্যের দরকার হবে না আমার, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল নিক।
ওপরে ওর সাথে যে মেয়েটা আছে ডেরিকের মৃত্যুতে ওর কোন হাত ছিল–ওকে শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাব আমরা, বলল কীথ
ওই মেয়ের ব্যবস্থাও যা করার আমিই করব, জবাব দিল নিক।
জীবনে প্রথমবারের মত অনিশ্চিত বোধ করছে লী। নিকোলাস একজন ভয়ানক লোক সন্দেহ নেই, ওকে ভয় পাচ্ছে না সে-সে ভাবছে লোকটাকে সে-ই ক্ষমতা দিয়ে মার্শালের পদে বসিয়েছে। সে-ই উদ্যোক্তা হয়ে ওকে এই কাজটা দিয়েছিল।
ওই মেয়েটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমরা আমাদের কর্তব্য মনে করি, বলল কীথ। আমরা ওকে ফ্রীড়মে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে স্টেজ কোচে তুলে দেব।
এখানে যা করার আমিই করব। তোমাদের সাহায্যের দরকার নেই আমার-তোমরা, এখান থেকে বিদেয় হও এবার।
গুষ্টি মারি ওই ছুঁড়ীর! খেপে উঠল ক্লাইভ। হারামজাদী বার্টকে খুন করেছে-আমাকেও মারতে চেয়েছিল।
আমরাও তোমার সাথে যাব নিকোলাস, দৃঢ় স্বরে বলল লী।
আমি তোমাদের নির্বাচিত আইনসম্মত প্রতিনিধি, বলল নিক। আমার কাজে বাগড়া বাধাতে এলে তোমাদের গ্রেপ্তার করব আমি।
সে সাহস তোমার হবে না, ফুসে উঠল কীথ
তোমাকে বরখাস্ত করা হলো, নিকোলাস, দাঁতে দাঁত চেপে বলল লী। ফ্রীডমে ফিরে যেতে পারো তুমি।
হাসল না নিক। তাচ্ছিল্যের স্বরে সে বলল, আমাকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। তোমাদের ভোটের নিয়ম আমার জানা আছে।
মন্টি এক পাশে সরে গেছে। লী জানে ওখান থেকে ওদের সবাইকেই বন্দুকের নলের মুখে পাচ্ছে সে। কিন্তু এত কথার পরে পিছিয়েও যেতে পারছে না
আমি এর মধ্যে নেই, বলে উঠল ক্লাইভ। ওই মাগী মরলেই বরং আমি খুশি হব।
তর্ক করে কী লাভ? বলল মন্টি। ওকে সবাই পালা করে ভোগ করলেই তো হয়?
রেগে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল লী, কিন্তু ওকে বাধা দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কীথ বলল, ছাড়ো, লী। ওই মেয়েকে নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। চলে, যাওয়া যাক। ফিরে কীথের দিকে চেয়ে ওর চোখে বিপদ সঙ্কেত দেখতে পেয়ে চুপ করে গেল লী।
অনেক হয়েছে, চলো এবার ফেরা যাক, আবার বলল কীথ।
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল লী। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, মরো। গে যাও-চলো, কীথ, বলেই ঘোড়া আগে বাড়াল সে
পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গিয়েই কীথের দিকে ফিরে বলে উঠল লী, তুমি যদি মনে করে থাকো যে আমি…’
চুপ করো, লী, নিচু গলায় ধমক দিয়ে বলল কীথ। ওরা শুনতে পাবে। মাথা গরম করে বোকার মত প্রাণটা ভোয়ালে কার কী লাভ হবে? ওই লোকটার হাতে শটগান ছিল, দেখোনি?
ভয় আমি পাইনি, কীথ, এভাবে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসাটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
ভয় তুমি পাওনি জানি। কিন্তু মিছেমিছি ওদের সাথে বিরোধে গিয়ে কী দরকার? একটু মগজ খাটাও। একবার একটা কিছু তোমার মাথায় ঢুকলে তুমি আর বিকল্প কোন উপায়ের কথা ভাবতেই চাও না। ওরা যাক না উপরে, ওরা উঠে যাবার অল্পক্ষণ পরেই আমরাও উঠব-কে বাধা দেবে?
সত্যিই তো! নিজের বোকামির জন্য নিজের উপরই রাগ হলো। এই সোজা কথাটা ওর মাথায় আসেনি কেন?
ক্লাইভ আপত্তি জানাল। তোমরা যদি ভেবে থাকো তোমাদের সাথে আমি উপরে উঠব, খুব ভুল করেছ। আমি
আর সহ্য করতে পারল না লী, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল সে। তোমাকে আমার খুব চেনা হয়ে গেছে। আমাদের ফ্রীডম শহরে তোমার মত লোকের কোন জায়গা নেই। তুমি নিজে থেকে না গেলে তোমাকে ঘাড়ে ধরে বিদায় করার ব্যবস্থা আমি করব।
একঘণ্টা পরে লী কীথ নো ম্যানস মেসার উপরে উঠল। কেলভিন নিকোলাসদের সাথেই থেকে গিয়েছিল, আর ক্লাইভ ফিরে গেছে।
বৃষ্টিতে সব চিহ্ন ধুয়ে গেছে। কোনদিকে যাবে মনস্থির করতে পারছে না ওরা। ঠিক এই সময়েই গুলির শব্দ শোনা গেল।
১৫. খুব ভোরে জেকবের ঘুম ভেঙে গেল
খুব ভোরে জেকবের ঘুম ভেঙে গেল। বেশ চাঙ্গা বোধ করছে সে এখন। হোপি ইন্ডিয়ান ওষুধে খুব ভাল কাজ হয়েছে। শুয়ে শুয়েই পা-টা নাড়াতে চেষ্টা করল-আশ্চর্য! ব্যথা প্রায় নেই বললেই চলে। ডালিয়াকে না জাগিয়ে সন্তর্পণে কম্বলের নীচ থেকে বেরিয়ে এল সে।
শেষ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে আজ। তৈরি হতে হবে ওকে। কিন্তু তার আগে গতরাতে ঘুমাবার পূর্ব মুহূর্তে যে সম্ভাবনার কথা তার মনে উঁকি দিয়েছিল সেটা চেক করে দেখতে হবে।
গুহার ভিতরে একটু খেয়াল করতেই যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেল। অবাক চোখে সে লক্ষ করল বাইরের চিহ্নগুলো মুছে গেলেও গুহার ভিতরে কয়েকটা নাল লাগানো ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
তবে কী…?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। বেশি খুঁজতে হলো না। গুহার এক কোণায় পাথরের আড়ালে রাখা রয়েছে হারানো ওয়্যাগনের সোনা। চারটে মাঝারি আকারের বাক্সে রয়েছে সোনার বার, আর নয়টা বড় থলেতে স্বর্ণমুদ্রা আর কিছু অত্যন্ত দামী হীরার অলঙ্কার।
যে ঘোড়াগুলোর পিঠে চাপিয়ে সোনা আনা হয় বুড়ো ঘোড়াটা নিশ্চয়ই তাদেরই একটা। জায়গাটা আগে থেকেই ওর চেনা ছিল বলে বৃষ্টিতে আশ্রয় নিতে সোজা এখানে চলে এসেছে।
কিন্তু সোনার পিছনে আর মিছে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তার বিশ্বাস মানুষের জীবনে সোনা কেবল অনর্থই ডেকে আনে।
ডালিয়ার দিকে চাইল সে। বেচারী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অনেক ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে, তবু মুখে বিন্দুমাত্র অসন্তোষের ছাপ নেই। ঘুমন্ত অবস্থায় ওর মুখটা আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু আজ শেষ পর্যন্ত ওর ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
বাইরে বেরিয়ে গেল জেকব। দিনের আলোয় আশেপাশের জায়গাটা খুব ভাল করে চিনে নিতে হবে তাকে। এতগুলো লোকের সঙ্গে একা লড়ে জিততে হলে যুদ্ধক্ষেত্রের সুবিধা-অসুবিধাগুলো তার জানা থাকতেই হবে।
আধঘণ্টা পরে আবার গুহায় ফিরে এল সে। ডালিয়া এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর মাথার কাছে বসল জেকব। ঘুমের মধ্যেও যেন টের পেয়েই চোখ খুলল ডালিয়া। ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল সে।
যে-কোন সময়ে এসে হাজির হতে পারে ওরা। ডালিয়াকে যা বলার তা সময় থাকতে এখনই বলে ফেলা দরকার। শোনো লিয়া, আজ ওদের সাথে শেষ বোঝাপড়া হবে আমার। ফলাফল কী হবে কিছুই বলা যায় না। আজ যা-ই ঘটুক না কেন, এটা জেনো, তোমাকে সত্যিই ভালবাসি আমি।
আমিও! বলে উঠল ডালিয়া। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।
হাত বাড়িয়ে ওর গাল দুটো আদর করে একটু টিপে দিল জেকব। জানো, হারানো ওয়্যাগনের সোনা এই গুহার মধ্যেই আছে। তুমি সোনা খুঁজতে চেয়েছিলে-ওগুলো সব আমি তোমাকে দিলাম।
উঠে বসে জেকবের মাথাটা দু’হাতে নিজের বুকে চেপে ধরল ডালিয়া। না, সোনা আমি চাই না, জে। পৃথিবীর সব সোনার বদলে আমি শুধু তোমাকে চাই।
দূরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেল। চোখ বুজে আরও কয়েক সেকেন্ড শক্ত করে জেকবকে বুকে আঁকড়ে ধরে রেখে ওকে ছেড়ে দিল ডালিয়া।
ঢালের মাথায় তিনজন ঘোড়ওয়ারকে দেখা যাচ্ছে।
তিনজন? তবে কি লী-র সঙ্গীরাও যোগ দিয়েছে নিকোলাসের সাথে? বাকি লোকগুলো কোথায়?
তুমি এখানেই থাকো লিয়া, গোলাগুলির মধ্যে বেরিয়ে পোড়ো না। এগিয়ে গেল জেকব। ওরাও নীচে নামছে। তিনশো গজের ব্যবধান। প্রায় সমতল জায়গাটায় এসে ঘোড়া থেকে নামল ওরা। আরও এগিয়ে যাচ্ছে জেকব।
তৃতীয় লোকটাকে এবার চিনতে পারল সে। কেলভিন। ওর আসল পরিচয়ও এখন আর অজানা নেই তার। এই সতেরোজনের দল থেকে এই লোকটাই মরমন কুয়ার কাছে এসে অদৃশ্য হয়েছিল। সোনার উপর প্রথম থেকেই চোখ ছিল তার, কিন্তু ঘুমের মধ্যে খুন হয়ে যাবার ভয়েই আগে থেকে সরে গিয়েছিল সে।
ওদের থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরে এসে থামল জেকব। জেনেশুনেই এই ঝুঁকি নিয়েছে সে। দূর থেকে রাইফেল দিয়ে একবারে একজনের বেশি লোককে ঘায়েল করা যাবে না-বাকি দুজন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়বে। তখন আর এই বদ্ধ জায়গা থেকে বেরুবার কোন উপায় থাকবে না। কিন্তু সামনাসামনি ওর দুই পিস্তল দিয়ে দুজনকে ঘায়েল করতে পারলে বাকি থাকবে একজন-একজনকে চালাকি করে ফাঁদে ফেলা তার পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না।
নিকোলাসই প্রথম মুখ খুলল। মরণের ডাক এসেছে তোমার, তাই স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখে এগিয়ে এসেছ!
ওর কথার কোন জবাব না দিয়ে কেলভিনের উদ্দেশে বলল জেকব, তুমি সারাটা জীবন বৃথাই সোনার পিছনে ঘুরে কাটালে।
ওকথা বলছ কেন? আমি জানি এই মেসার ওপরই কোথাও আছে ওগুলো।
আমি জানি কোথায়-কিন্তু মন্টিও কি তোমাকে চিনতে পারেনি?
চট করে মন্টির দিকে ফিরে চাইল কেলভিন।
নিঃসন্দেহ হলে জেকব। তোমার গালের কাটা দাগগুলোর জন্যে হয়তো ও চিনতে পারেনি তোমাকে। মরমন কুয়ার কাছ থেকে তুমিই অদৃশ্য হয়েছিলে।
শটগান হাতে কেলভিনের দিকে ঘুরেই পরপর দু’টো গুলি করে খালি বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মন্টি।
গুলির শব্দে চকিত হলে পিস্তল বের করল নিকোলাস। কিন্তু তার আগেই জেকবের গুলিতে নিকোলাস আর মন্টি এক সাথে ধরাশায়ী হলো।
ঘোড়ার খুরের শব্দ পেল জেকব। আরও দু’জন অশ্বারোহীকে দেখা গেল ঢালের মাথায়। দ্রুত নেমে আসছে লী আর কীথ। দুজনেরই রাইফেল তৈরি।
শান্তভাবে পিস্তল খাপে ভরে রাখল জেকব। কীথ কাভার করে আছে ওকে। নীচে নামল লী
বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছি আমি-তৈরি হও, বলল সে।
ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছে সে তো বলেছি তোমাদের-এরপরেও কেন মিছে ঝামেলা করছ?
যদি তুমি নিজেকে বাঁচাবার জন্যে মিথ্যে বলে থাকো? পরপারে বন্ধুর কাছে আমি কী জবাব দেব?
এই কারণে তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করবে? দেখেছ ওদের কী অবস্থা হয়েছে? মৃতদেহগুলো দেখাল জেকব।
তোমার কথার কোনরকম কোন প্রমাণ থাকলে তোমাকেও বন্ধু বলে মেনে নিতে আপত্তি ছিল না আমার-তোমার সাহস আছে স্বীকার করি। কিন্তু আমি নিরুপায়
ডেরিকের বন্ধু-ভাগ্য দেখে হিংসা হচ্ছে আমার। সে যদি তোমার মত সরল হত তবে আজ এই পরিস্থিতি দাঁড়াত না।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই-তৈরি হও!
তোমাকে অযথা হত্যা করতে চাই না, লী। আমি সত্যি কথাই বলেছি। বিশ্বাস করো।
বাজে কথা রাখো। প্রমাণ যখন নেই, তোমার কোন কথাই মানি না আমি। আর বলব না, এবার তৈরি থেকো।
মেসার উপরে এই সময়ে একসাথে অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া গেল। লী-র দিকে চেয়ে আছে জেকব। মেসার ধারটাতে ছয়টা ঘোড়া এসে দাড়িয়েছে। একটা ঘোড়া দ্রুত ছুটে নীচের দিকে এগিয়ে আসছে।
থামো, লী! চিৎকার করে বলল ইউজিন। প্রমাণ পাওয়া গেছে!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। পিস্তল বের করে ফেলেছে লী। দেখল জেকব তখনও তেমনি দাঁড়িয়ে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারল না লী। ভোজবাজির মত পিস্তল চলে এল জেকবের হাতে, পিস্তলের মুখে ধোয়া। প্রচণ্ড বাকি লেগেছে লী-র ডান হাতে। হাত ধরে বসে পড়ল সে। পিস্তলটা ছিটকে পড়ে গেছে মাটিতে।
ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ওর পাশে নামল ইউজিন। প্রমাণ পাওয়া গেছে লী! ডেরিককে পিস্তল লুকাতে দেখেছে ফ্রেড। ওর মুখেই শোনো।
বিস্ফারিত চোখে বোকার মত ইউজিনের দিকে চাইল লী। বিশ্বাসই করতে পারছে না সে এখনও বেঁচে আছে। যেভাবে দ্রুত পিস্তল বের করে গুলি করেছে জেকব তাতে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ইচ্ছা করলেই গুলিটা পিস্তলে না লাগিয়ে অনায়াসে ওর হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিতে পারত শক্ত-পাল্লা।
হাত বাড়িয়ে জেকবের দিকে এগিয়ে গেল ইউজিন। ওর সঙ্গীরা নীচে নেমে লী-র পশে দাঁড়াল।
জেকব, আমার নাম ইউজিন। তোমাকে আমরা ভুল বুঝে এত হয়রানি করিয়েছি বলে আমি খুব দুঃখিত।
ফ্রেডের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনল লী। তারপর, এগিয়ে এল, সব আমার দোষ! আমিই সবাইকে উস্কে তোমার পিছনে লাগিয়েছিলাম। আসল ঘটনা জানলাম এখন। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমি তো জানিই তোমরা ভুল করছ, তোমার ওপর রাগ থাকলে আমার গুলি অন্যখানে লাগত, জবাব দিল জেকব। ডালিয়া পিছন থেকে ছুটে এসে একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর অন্য হাতে ধরা রয়েছে জেকবের দেওয়া রাইফেলটা।
নিকোলাস, কেলভিন আর মন্টি, তিনজনই মারা পড়েছে। এর মধ্যে কেলভিনের মৃত্যুটাই সবচেয়ে বীভৎস। কাছে থেকে শটগানের দু’দুটো গুলিতে ওর দেহটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
সবাইকে গুহার ভিতরে ডেকে নিয়ে জেকব বলল, হারানো ওয়াগনের সোনার কথা তো তোমরা সবাই শুনেছ। দেখবে সেই সোনা?
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে সবাই। বাক্স আর থলেগুলো বের করে এনে মেঝের উপর রেখে একেএকে সব ক’টাই খুলল জেকব। এত সোনা ওরা একসাথে কেউ কোনদিন চোখেও দেখেনি।
সত্যিই ভাগ্যবান তুমি, জেকব, মন্তব্য করল কীথ।
হ্যাঁ, কেলভিন সারাজীবন হন্যে হয়ে খুঁজেও যা পায়নি, ভাগ্যক্রমে সেটাই আজ আমার হাতে। ডালিয়া এগিয়ে গিয়ে ওর কানে কানে কী যেন বলতে মাথা কেঁকিয়ে সায় দিয়ে সে আবার বলল, আমার স্ত্রী বা আমার, কারোই ধন-সম্পদের প্রতি লোভ নেই। তাই আমরা ফ্রীডমের সবাইকে আমাদের শুভেচ্ছা সহ এগুলো উপহার দিলাম।
কথাটার পুরোপুরি মর্ম বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় পার হয়ে গেল। সবাই বিস্ময়ে অভিভূত-কারও মুখে টু শব্দটি নেই।
সবার পক্ষ নিয়ে লী-ই প্রথম মুখ খুলল। বলল, জেকব, তোমাদের প্রবটা খুবই উদার আর মহৎ। সবার কথা আমি বলতে পারি না, তবে আমি নিজে কিছুই তোমার এই প্রস্তাব মানতে পারব না।
গিবনও যোগ দিল ওর সাথে। তোমার অনেক ক্ষতি আমরা করেছি, জেকব, কিন্তু আর না। আমাদের আর ছোট কোনো না তুমি।
ইউজিন বলে উঠল, আমারও তাই মত। কিন্তু জেকব দম্পতির মহত্ত্বকে ক্ষুণ্ণ করার ও কোন অধিকার আমাদের নেই। তা ছাড়া ওদের সোনার প্রতি লোভ না থাকলেও নতুন জীবন শুরু করতে হলে, একটা খামার, গরু-মহিষ-ঘোড়া, এসব কেনার জন্যেও সোনার যথেষ্ট দরকার আছে। সবদিক বিবেচনা করে আমি বলতে চাই যে নিজেদের জন্যে অন্তত অর্ধেক রেখে বাকিটা ফ্রীডমের লোকদের দান করলে ব্যাপারটা মানানসই হয়। তোমরা কে কী বলো?
ইউজিনের প্রস্তাবটাই মেনে নিল সবাই।
সব কিছুরই এমন সুন্দর মীমাংসা হয়ে গেল দেখে সব ভুলে আনন্দে জেকবকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল লী। ব্যথায় ককিয়ে উঠল জেকব।
আবারও ভুল করেছে বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে ক্ষমা চাইল লী।
এই নিয়ে একই দিনে দু’বার হলো–গুণল ইউজিন। একটু মুচকি হেসে সে ভাবল: তবে কি শক্ত-পাল্লার পাল্লায় পড়ে ভাল হয়ে গেল লী?
Leave a Reply