জুল ভের্ন অমনিবাস ৫ (পঞ্চম খণ্ড) – অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
জুল ভের্ন অমনিবাস ৫ (পঞ্চম খণ্ড)
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : জ্যৈষ্ঠ ১৪০১, মে ১৯৯৫
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
.
ডুমসডে বুক
প্রসঙ্গটা, সম্ভবত, এই পঞ্চম খণ্ডে এসেই পড়া যায়, এখন।
কী-কী বই পড়তেন জুল ভের্ন? বিজ্ঞানের বই, ইতিহাসের বই, ভূগোলের বই, নৃতত্ত্বের বই – পড়তেন অ্যাটলাস, ব্র্যাডশ, জাহাজ কম্পানির রুট, কোথায় কোন নতুন রেললাইন হ’লো, ট্রেনে-ট্রেনে যোগাযোগব্যবস্থা কেমন, ইত্যাদি-ইত্যাদি। এগুলো তো না-বললেই চলে এগুলো না-পড়লে তিনি তাঁর দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা-র কাহিনীগুলো হয়তো ফাঁদতেই পারতেন না। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন যাত্রাপথের খুঁটিনাটি ঠিকঠাক দিতে না-পারলে বিশ্বাসযোগ্যই হ’তো না তাঁর অ্যাডভেনচার। এ-সব কল্পনায় ছাড়া ঘটেনি কখনও, কিন্তু ঘটতো যদি, তবু বিশ্বাসযোগ্যই হ’তো—সব চমক এবং বিস্ময় সত্ত্বেও।
কিন্তু আর কী-কী বই পড়তেন?
তাঁর নিজের রচনা থেকেই চমৎকার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাঁর পড়াশুনোর—কিংবা ঘুরিয়ে এও বলা যায় এমন কোনো-কোনো লেখক ছিলেন, যাঁরা তাঁর খুবই পছন্দ ছিলো। যেমন আলেকজান্ডর দুমা, যেমন ওয়ালটার স্কট, যেমন এডগার অ্যালান পো। তালিকা বাড়িয়েই যাওয়া যায়। কীভাবে তিনি লিখতেন জারের দূত মিখায়েল স্ট্রগফের কাহিনী, যদি রুশী গল্প-উপন্যাস তাঁর আদৌ পড়া না-থাকতো ?
জুল ভের্ন—মনে রাখতে হবে—তাঁর এই দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা প্রণয়ন করার আগে লিখেছিলেন নাটক, অপেরা, গান। কোনো-কোনো রচনা পড়লে তো বোঝাই যায় হাতপাকাবার সময় এই-যে লেখাগুলি লিখেছিলেন, সেগুলো তাঁর কোনো-কোনো রচনায় ছাপ ফেলে গিয়েছে। ইন সার্চ অভ দ্য কাস্টঅ্যাওয়েজ তিন মহাদেশ জুড়ে দুর্বার গতিতে বিভিন্ন সব বিপদআপদের মধ্য দিয়ে এগোয়, আর জাক পাঞয়ল—ইজিচেয়ারের অন্যমনস্ক ভূগোলবিদ—সারাসময়েই ধারাভাষ্য চালিয়ে যান—কিন্তু মেরি আর রবার্ট গ্রান্টকে নিয়ে জাক পাঞয়ল আস্ত একটি চলচ্চিত্রে গানের পর গান গেয়ে প্রায় একটা অপেরার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের—আর জাক পাঞয়লের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মরিস শেভালিয়ে। এরাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ একবার দিনের পর দিন অপেরা হিশেবেই ফরাশি মঞ্চে প্রযোজিত হয়েছিলো, আর যতদিন সে-অপেরা চলেছিলো, দর্শকসংখ্যা নাকি কখনও হ্রাস পায়নি। আজ তো এটা জানি যে কত ভাষায় কত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিলো তাঁর এইসব কাহিনী নিয়ে—আর কোনো-কোনো কাহিনী চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছিলো একাধিকবার।
এমনিতে অনেক বিষয়েই খুঁটিনাটি দেন জুল ভের্ন, কিন্তু সাহিত্য সম্বন্ধে কিছুই বলেন না—যদি-না তিনি সরাসরি উপসংহার লিখতে বসেন এডগার অ্যালান পো-র ন্যারেটিভ অভ আর্থার গর্ডন পিম-এর অথবা ইয়োহান দে, হ্রিস-এর সুইস ফ্যামিলি রবিনসনের। সে-সব বইতে সর্বজ্ঞ কথক আমাদের পূর্ববর্তী বইগুলোর কথা বারে বারেই মনে করিয়ে দিতো। কিন্তু সরাসরি হয়তো সম্ভবই ছিলো না অন্য-কোনো কবি-সাহিত্যিককে নিয়ে আলোচনা করার–বা এমনকী তির্যকভাবে হ’লেও তাঁদের কথা উল্লেখ করার। কেননা এমন-কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে তাঁদের সম্বন্ধে বলাতে হবে, যার জবানে এই কবিদের উল্লেখ অস্বাভাবিক হ’তো না । কিন্তু যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই তাকে কাজে খাটিয়েছেন বৈ-কি।
যেমন, দ্য বারজাক মিশন উপন্যাস। সেখানে কথক একজন সাংবাদিক—আমেদে ফ্লরেঁস। আজ আমরা জানি, অনেক দিন ধ’রে এই উপন্যাস লিখছিলেন জুল ভেন, তার আগে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরেও গিয়েছেন, অসম্ভব জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও। রাজনীতি একটি অন্যজাতের খেলা। আর জীবদ্দশায় এই বই প্রকাশিত হোক, এই অভিপ্রায়ও তাঁর ছিলো না, ফলে এই বই বেরোয় ১৯০৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর পর। এখানে জুল ভের্ন আমেদে ফ্লরেঁসের জবানিতে রোমান্টিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা বলেছেন, যখন আমেদে ফ্লরেঁস একবার স্মরণ করেছেন মাজেপ্পার কথা। হাঙ্গেরীয় ফেরেন্ৎস লিশ্ট (১৮১১-৮৬) মাজেপ্পা রচনা করেছিলেন, পিয়ানোর জন্যে, ১৮৪৭-এ, আর পরে অর্কেস্ট্রার জন্যে ১৮৫১তে। আর লিশ্ট-এর নির্ভর ছিলো বায়রন আর ভিক্তর উগোর কবিতা। মাজেপ্পাকে বুনোঘোড়ার সঙ্গে নগ্ন বেঁধে ঘোড়াটি ছুটিয়ে দেয়া হয়েছিলো, আর সে এই ভীষণ শাস্তি সত্ত্বেও মারা যায়নি, পরে বরং কশাকদের সর্দার হ’য়ে উঠেছিলো। পরে চাইকোভস্কি অপেরা লিখেছিলেন মাজেপ্পাকে নিয়ে, মস্কোতে সেটা প্রথম প্রয়োজিত হয়েছিলো ১৮৮৪তে, আর চাইকোভস্কির অপেরার গান লিখেছিলেন ভি. পি. বুরেনিন—এবং তাঁদের অবলম্বন ছিলো পুশকিন। মাজেপ্পা (১৬৪৪-১৭০৯) ইতিহাসের চরিত্র, সে পিটার দ্য গ্রেট-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। জুল ভের্ন তাঁর প্রথমপ্রেম সংগীত ও অপেরা যে কখনও ভুলে যাননি, এখানে মাজেপ্পার কথা উল্লেখ করাতেও তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু এই অর্কেস্ট্রা বা অপেরার অবলম্বন যে-কবিরা, তাঁরা আরো চিত্তাকর্ষক—বায়রন, উগো, পুশকিন–রোমান্টিক আন্দোলন সম্বন্ধে যা-ই আমরা ভাবি না কেন—তিন দেশের এই তিন কবিকে বারে বারেই আমাদের স্মরণ ক’রে নিতে হবে। কবিরা বা সাহিত্যিকরা যে কোত্থেকে জোগাড় করেন উপকরণ, মালমশলা। আমরা জানি, সমুদ্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হবার আগেই জাঁ-আর্তুর র্যাঁবো তার “মাতাল তরণী” লিখেছিলেন জুল ভেন-এরই টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সী প’ড়ে, সমুদ্রের বর্ণনা প্রতিচরণেই স্মরণ করেছে জুল ভের্নকে। জুল ভের্ন নিজেকে শেষঅব্দি, আবারও, রোমান্টিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন তাঁর এই শেষ উপন্যাসে একাধিক স্থলে মাজেপ্পা-র উল্লেখ করে।
আমরা আগেই বলেছি, জুল ভের্ন-এর রচনাবলি প্রথম থেকে অণুসরণ করে এলে আমরা দেখতে পাবো বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর ধারণা কীভাবে বারে-বারে পালটেছে : ব্লুমসডে বুক থেকে ডুমসডে বুক। সত্যি বলতে, ঔপনিবেশিকতা নিয়ে যা-ই বলুন না কেন—অন্তত বিজ্ঞান বিষয়ে জুল ভের্ন তাঁর ধারণা কী, সেটা রেখে-ঢেকে প্রকাশ করেননি। দ্য বারজাক মিশনেই একজায়গায় স্পষ্ট বলা আছে, প্রথম যে-লোক রিভলভার বানিয়েছিলো, সে যদি কখনও ন্যাকা সেজে বলে সে জানতো না কীসের জন্যে ব্যবহার করা হবে এই আগ্নেয়াস্ত্র, তবে তার মতো মিথ্যেবাদী আর দুটি নেই। যতই আমরা শান্তির জন্যে পরমাণু ফাটাই না কেন, আমরা যাতে হাঁদা সেজে এ-কথা কখনও না-বলি যে আমরা জানতুম না কত ধানে কত চাল—কী থেকে কী হয়। জানতুম না এই হবে—এ-কথা ব’লে দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। আইনের চোখে অজ্ঞতা কখনও যথার্থ ওজর বা কৈফিয়ৎ ব’লে গণ্য হ’তে পারে না। কিন্তু আইনের চোখ নয়—মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও কী বলে, সেটাই আসল। পাশ্চাত্যের বিচারের দেবীর চোখ বাঁধা। কিন্তু চোখ-কান খুলে রেখেই এখন যে সবকিছু দেখতে হবে, জুল ভের্ন-এর আধুনিক প্রমেথিউসদের কাহিনী তা-ই বলে।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
১২ বৈশাখ ১৪০১
কলকাতা
Leave a Reply