জুল ভের্ন অমনিবাস ৪ (চতুর্থ খণ্ড)
জুল ভের্ন অমনিবাস ৪ (চতুর্থ খণ্ড)
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৪০০, জানুয়ারি ১৯৯৪
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
.
পৃথিবী যখন বাড়ে
কুবায় জন্মেছিলেন ইতালো কালভিনো, কিন্তু এস্পানিওলে না-লিখে লিখেছিলেন ইতালীয় ভাষায়, সম্ভবত যুদ্ধোত্তর ইতালির সবচেয়ে উত্তেজক ও উন্মাদক লেখক, যাঁর মধ্যে ছিলো একটা অত্যন্ত-সজীব অন্তহীন ছেলেমানুষির ভাব, যার ফলে যখন তিনি গভীর-গম্ভীর দার্শনিক বিষয়ের অবতারণা করতেন, তখনও তা থাকতো কৌতুকে আর রঙ্গে ভরা । কেউ-হয়তো কোনো-একদিন বলবেন জুল ভের্ন কতটা মাতিয়েছিলেন ইতালো কালভিনোকে, কালভিনোর ছেলেবেলায় ; কিছু-কিছু তাঁরও আছে কল্পবিজ্ঞান কাহিনী কিন্তু একেবারেই অন্যরকম, সম্পূর্ণ ভিন্ন তার স্বাদ ।
জুল ভেন-এর দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা আজ পড়তে-পড়তে কখনও- কখনও ইতালো কালভিনোর কথা মনে না-প’ড়েই পারে না । তাঁর একটা ছোট্ট বই আছে, অদৃশ্য-সব নগরী, আশ্চর্য আর বারে বারে পড়ার মতো একটি বই ; তাতে একজন রাজার কাছে ব’সে ব’সে আশ্চর্য সব দেশে-বিদেশে ঘোরার বিবরণ দিচ্ছেন বিখ্যাত একজন পর্যটক, আর যতই তিনি একের পর এক সেই-সব কোন-দূরের শহর-নগরের কথা বলতে-বলতে চাক্ষুষ, আর সজীব ক’রেই রাজার কাছে কথার মধ্য দিয়েই ভাষার মধ্য দিয়েই সে-সব শহরকে উপস্থিত ক’রে দিচ্ছেন, আর রাজার অভিজ্ঞতার মধ্যে ভিড় ক’রে আসছে একের পর এক শহর – আর, অবাক কাণ্ড ! – যতই রাজার অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢুকে পড়ছে নতুন দেশ নতুন নগর, সম্প্রসারিত হ’য়ে যাচ্ছে রাজার পৃথিবী, ততই সে-সব হারিয়ে যাচ্ছে পর্যটকের কাছ থেকে, তার পৃথিবী হ’য়ে উঠছে হ্রস্ব, ছোট্ট, একরত্তি ।
না, জুল ভের্ন এমনতর কোনো গল্প সত্যি লেখেননি, কিন্তু আমাদের মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে যায় তাঁর সমকালীন পাঠকদের কথা, যারা ফ্রান্সের গাঁয়ে-গঞ্জে ব’সেই দৈনন্দিন কাজকর্মের ফাঁকে-ফাঁকে গোগ্রাসে প’ড়ে যাচ্ছিলো এইসব দুর্বার অভিযানের দ্বিশতাধিক বই, আর ছয় মহাদেশে ছয় মহাদেশেই বা কেন বলি জলে-স্থলে- অন্তরিক্ষে পাঠকরা বেরিয়ে পড়ছিলো কাল্পনিক সব চরিত্রদের সঙ্গে ; এ-সব পর্যটকদের কেউ-বা অনিচ্ছুক, কেউ-বা উৎসুক, আর ক্রমেই বড়ো হয়ে যাচ্ছিলো পাঠকদের পৃথিবী ; ফ্রান্সের গাঁয়ে ব’সেই তারা পৌঁছে যাচ্ছিলো আফ্রিকার নিবিড় অরণ্যে, আমাজোনের অববাহিকায়, হিমালয়ের চুড়োয়, দানিউবের তীরে । জুল ভের্ন-এর নিজের পৃথিবী কি তার ফলে ছোটো হ’য়ে যাচ্ছিলো ? একই জায়গায় দু-বার তিনবার চারবার যদি তিনি তাঁর পাঠকদের নিয়ে যান, তবে কি তারা বলে উঠবে না, এ-কী, নতুনত্ব কই ? এ-তো চেনা, পড়া, একই কাহনের পুনরাবৃত্তি ! জুল ভের্নকে তাই অনবরতই ভাবতে হচ্ছিলো নতুন জগতের কথা – নতুন পৃথিবী, অচেনা পৃথিবী, কোনো রোমাঞ্চকর পৃথিবী – যেখানে কখনও কোনো মানুষের পা পড়েনি, কিংবা যেখানে মানুষ গিয়ে এমন হুলুস্থুলু কাণ্ড ফেঁদেছে যে পুরোনো পৃথিবীর আগাপাশতলা খোলনলচে সব বদলে-বলে যাচ্ছে ।
সে-ই কবে, ১৬৩৬ সালে, চমৎকার বাঁধাই ক’রে জেরাল্ড মেরকাটোর আর ইয়ন হার্ট প্রকাশ করেছিলেন মানচিত্রের একটি সংগ্রহ, কার্টোগ্রাফির এক বিস্ময়কর প্রস্তাবনা, যার মুখপত্রে ছিলো বিশালদেহী অ্যাটলাস-এর ছবি, আস্ত জগৎটাকেই সে ধ’রে রেখেছিলো তার কাঁধের ওপর । সম্ভবত সেই-থেকেই, মানচিত্রের বইয়ের একটা প্রতিশব্দ হ’য়ে উঠেছিলো অ্যাটলাস । সেই সময়, সপ্তদশ শতাব্দীতে, শুধু-কেবল বিশাল বড়োলোকরাই কোনো অ্যাটলাসের‘বিলাসিতা’ করতে পারতো । ওলন্দাজ কার্টোগ্রাফাররা তখন তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে রোজ, নিত্য, এমন-এক জগৎ উপস্থাপিত করছিলো, সমুদ্রে-যারা-ঘুরে-বেড়ায় সেই নাবিকেরা যে-জগতের দিগন্তকে ক্রমশই – এবং দ্রুতবেগেই – বিস্ফারিত ক’রে দিচ্ছিলো । কিন্তু বইয়ের পাতায় রেখা-রং-তুলির বাহার- ফোটানো দেশবিদেশের ছবি কখনও কারু জানবার স্পৃহাকে সম্পূর্ণ চরিতার্থ করতে পারেনি – যতই কেন-না তাতে থাক অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশর উল্লেখ – কিংবা যতই কেন-না ভিন্ন-ভিন্ন রঙে আঁকা হোক নদীসমুদ্র পাহাড়পর্বত কুমেরু-সুমেরু, যতই কেন- না ভূত্বকের স্তরপরস্পরাকে দেখানো হোক বর্ণালির বিচ্ছুরণে ! লোকের ঔৎসুক্য বা কৌতূহল কতটাই-বা মিটতো শুধু মানচিত্র দেখে-দেখে ? যারা জগতের খবর জানবে ব’লে বুভুক্ষু, প্রুস্তের কথামতো বাড়ি থেকে এক-পা না-বেরিয়েও যারা ঘুরে আসতে চায় সারা জগৎ, তারা ইংরেজিভাষার কবি ডিলান টমাসের ভাষায় অ্যাটলাস-খাদক যদি বা হয়ও, কতটা তাদের মেটে এই সাধ : দেখবো এবার জগৎটাকে… ।
অন্য অনেক ধরনের রচনায় হাত পাকাবার পর, একদিন কোনো-এক শুভক্ষণেই সম্ভবত জুল ভের্ন ভেবেছিলেন এই ক্রম-সম্প্রসার-প্রবণ জগৎকে ফুটিয়ে তুলবেন তাঁর লেখায়, আর শুধু-যে লোকে তাঁর উদ্ভাবিত চরিত্রদের সঙ্গে-সঙ্গে নানা উপায়ে বেলুনে, ডুবোজাহাজে, শাম্পানে, আকাশযানে, কামানের গোলায়…–জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে হানা দেবে তা নয়, তারা রোমাঞ্চিত হবে, উদ্বেলিত হবে, আশা-নিরাশায় ছটফট করবে বিভিন্ন দুর্ধর্ষ অভিযানে – অ্যাডভেনচারে ।
আর তাদের পৃথিবী ক্রমেই বড়ো হ’তে-হ’তে হয়তো সব কল্পনাকেও ছাপিয়ে যাবে !
এই-যদি বেলুনে চেপে আমরা উধাও হ’য়ে গেছি আফ্রিকার বনে-জঙ্গলে, নীলনদের অববাহিকায়, আরব-বেদুয়িনের দেশে, পরক্ষণেই আমরা চ’লে এসেছি ভারতবর্ষে – হাতির পিঠে চ’ড়ে (সে-হাতিও আবার সত্যিকার হাতি নয়, কলের হাতি, বাষ্পে-চলা হাতি ), দেখেছি নেপালের তরাই বা ফল্গুনদীর তীর্থযাত্রীদের । যদি আমরা কখনও ডুবোজাহাজ-আকাশযান-স্বতশ্চল শকটে কল্পনাকেও হারমানানো দ্রুতবেগে ছুটে গেছি, আমেরিকার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত, মার্কিন মুলুকের সীমানা ছাড়িয়ে চ’লে গেছি গাল্ফ অভ মেহিকোতে, তবে পরক্ষণেই, সবিস্ময়ে, আবিষ্কার করেছি নীল দানিউবের জল কিন্তু সত্যি-সত্যি নীল নয়, বরং গেরি, আর ভিয়েনা থেকে দৌড় দিয়েছি – প্ৰায় কৃষ্ণসাগর লক্ষ্য ক’রেই – দূরে-কোথাও ।
আর তা তো আমরা একসময়ে করিনি । যদি ১৯০২ সালে, বিংশশতাব্দীর গোড়ায়, উঠে পড়েছি একের-ভেতরে-তিন কোনো বাহনে, যেটা সমান-অনায়াসে চলবে জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে তবে অন্য বইতে এসে পড়েছি সিপাহি বিদ্রোহের অব্যবহিত পরের ভারতবর্ষে, তখনও উত্তাল তখনও বিক্ষুব্ধ, তখনও নানাসাহেবের সন্ধানে ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে ইংরেজ ফৌজ, এবং তার পরেই হয়তো তারও একশো বছর পেছিয়ে গেছি ইতিহাসে, এসে পৌঁছেছি হাঙ্গেরিতে, যখন এবং যেখানে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের রমরমা সত্ত্বেও হাঙ্গেরীয়দের সঙ্গে আলেমানদের খুব-একটা সদ্ভাব আর বনিবনাও ছিলো না ।
কল্পবিজ্ঞান অ্যাডভেনচার ফাঁদতে ব’সে জুল ভের্ন কিন্তু জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষেই শুধু আমাদের নিয়ে যাননি, নিয়ে গেছেন ইতিহাসেরই বিভিন্ন চোরাগলিতে – কিংবা উদ্বেল মুহূর্তে । আর, শুধু কি ভাবছিলেন বিজ্ঞান কতটা দিতে পারে আমাদের ? এও কি ভাবেননি যে, প্রয়োগ আর পৃষ্ঠপোষকতার চাপে বিজ্ঞান কতটা সর্বনাশও করতে পারে আমাদের শুধু যে একক মতিচ্ছন্ন ব্যক্তিবিশেষই সর্বনাশের আয়োজন করতে পারে, তা-ই নয়, রাষ্ট্র বা কোনো দুষ্কৃতকারীদের সংঘও হাতিয়ে নিতে পারে সব আবিষ্কার আর তা ব্যবহার করতে পারে অন্য অনেক মানুষের বিরুদ্ধে ।
বিজ্ঞান অনেক দেয়, অনেক নেয় । একের পর এক অচেনা ভূখণ্ডে যাচ্ছি অনবরত এই দুর্বার-সব আশ্চর্য অভিযানে, সেইসঙ্গে কষ্টও কি হচ্ছে না যে ঠিক এইভাবে আর- কখনও এ-সব জায়গায় আমরা পা ফেলতে পারবো না কেননা উদ্ভাবনীনৈপুণ্যে- বলীয়ান জুল ভেনকে প্রতিবারেই নতুন ক’রে ভাবতে হচ্ছে আবার কীভাবে কী ক’রে পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমিকে বাদ দিয়ে – পাঠককে নিয়ে-যাওয়া যায় নতুন- নতুন জায়গায়, অতীতে বা ভবিষ্যতে ।
আমরা কিন্তু অমনিবাসের এই চতুর্থ খণ্ডে ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া–এই চার মহাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি, আর অ্যাটলাস-খাদক জুল ভের্ন-এর কল্পনার উদ্ভাবনীনৈপুণ্য দেখে বারে-বারেই মুগ্ধ হ’য়ে গেছি ।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৯ পৌষ ১৪০०
কলকাতা
Leave a Reply