জুল ভের্ন অমনিবাস ৩ (তৃতীয় খণ্ড)
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৩৯৯, জানুয়ারি ১৯৯৩
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
.
কেউ না
যখন কেউ তার স্বাধীনতা হারায়, সাম্রাজ্যবাদী পুলিশ যখন তাকে হন্যে হ’লে খুঁজে বেড়ায়, আত্মগোপন করবার জন্য তাকে যখন শেষকালে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় এতকাল যা ছিলো মানুষের অগম্য কোনো জলে বা ডাঙায়, তখন সে কে ? কেউ- না । নামহীন, দেশগোত্রহীন, পরিচয়হীন – শুধু স্পর্ধাই তার আছে তখন, আর আছে অন্য যে-সব দেশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের উদ্দেশে বাড়ানো সাহায্যের দক্ষিণ হাত। ‘চলন্তের মধ্যে সচল’ নটিলাস জাহাজের কাপ্তেন সম্বন্ধে এই রকমই ভেবেছিলেন জুল ভের্ন ।
কিন্তু টোয়েন্টি থাউজ্যাণ্ড লিগস আণ্ডার দি সী-র গল্প যে-ভাবে ফাঁদা হয়েছিলো, শ্লেষ্মাকুল অধ্যাপক আরোনার জবানিতে, উত্তমপুরুষের-উক্তিতে, রচিত আখ্যান তাতে সবদিক সামলে-সুমলে সব খেই ধরিয়ে দিয়ে সব জট খুলে ফেলে নটিলাসের কাপ্তেনের জীবনবৃত্তান্ত খুব সহজে বলা যেতো না সম্ভবত—তখন জরুরি ছিলো ডুবোজাহাজ, জলের তলা দিয়ে আস্ত পৃথিবী ঘুরে-আসা, ডাঙার বদলে জলের প্রাণীবৈচিত্র্যের বিবরণ যথাসম্ভব চিত্তাকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক ক’রে তুলে ধরা। আর পাণ্ডিত্যের ব্যায়ামবিদ্ অধ্যাপক আরোনার সঙ্গে জুটিয়ে দিতে হয়েছিলো ডাকাবুকো অকুতোভয় ভিমিশিকারি ক্যানাডার নেড ল্যাণ্ডকে । একজন ধীর, স্থির, শান্ত, জ্ঞানান্বেষী— অন্যজন করিৎকর্মা, চঞ্চল, অস্থির, টগবগে—এই দুই আপাতবিরোধী স্বভাবের দুজনকে দিয়ে একটা জুটি বাঁধিয়ে দিয়ে মজা দেখাও ছিলো জুল ভের্ন-এর খেয়াল — সঙ্গে আরো যদি কেউ থাকে তবে সে হবে অনুগত পরিচারক, অযথা তর্কে সময় নষ্ট না-ক’রে, বিনাবাক্যব্যয়ে, যে চট ক’রে সবকিছু হাসিল ক’রে দেবে— কেননা পরিচারকটি যদি সারাক্ষণই পায়ের তলায় চাকা লাগিয়ে রোলার কোস্টারে চেপে খেলা দেখায়, তবে যে কী হয় তা তো দেখা যাবে যখন ফিলিয়াস ফগ বাজি ধ’রে আশি দিনে আস্ত পৃথিবীটাকেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ডাঙার ওপর দিয়ে ঘুরে দেখতে বেড়াবেন ।
টোয়েন্টি থাউজ্যাণ্ড লিগস… -এর জট-না-খোলা রহস্যগুলো দাবি করছিলো অন্তত আরো-একখানা চনমনে রুদ্ধশ্বাস কাহিনী-যাতে এই কেউ-না-কাপ্তেনটির পরিচয় আমরা জানতে পারি । আবারও অধ্যাপক আরোনাকে দিয়ে বলানো যেতো না এই নতুন গল্প, কেননা তাঁকে যদি কাপ্তেন সব ব’লে দিতে চাইতেন তবে আগেই তো সব ব’লে দিতে পারতেন; তা ছাড়া উত্তমপুরুষের বয়ান, তার আদর্শ বা তাত্ত্বিক চিন্তা, সেটা তখন অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকতো । জুল ভের্নকে তাই ভাবতে হচ্ছিলো সম্পূর্ণ অন্য কুশীলবের কথা—আর এটাও ঠিক ক’রে নিতে হয়েছিলো এবার গল্পের কোনো চরিত্র গল্পটা বলবে না । কী হবে তাহ’লে এই চরিত্ররা, এই নতুন- সব কুশীলব ?
জুল ভের্ন এবার গল্প ফেঁদেছিলেন মার্কিন মুলুকের গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায়, যেখানে তাঁর চরিত্ররা হবে দাসপ্রথার বিরোধী দলের মানুষ । জুল ভের্ন তখনও অব্দি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বাধীনতায়— ব্যর্থ ফরাশি বিদ্রোহের মূল বাণী তখন তাঁর মনে হচ্ছিলো সকলেরই আদর্শ হওয়া উচিত । তাছাড়া নটিলাসের কাপ্তেন যাদের সাহায্য করবেন তাদের স্বাধীনতার পক্ষে না-হ’লে চলবে কেন ?
বেলুনে ক’রে ঝড়ের আকাশে উড়াল, দৈনন্দিন জীবনযাপনের বেলায় উপযোগী বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো, অক্লান্ত পরিশ্রম মারফৎ স্বাবলম্বী হ’য়ে ওঠার বিবরণ—এইসব মিস্টিরিয়াস আইল্যাণ্ডকে রুদ্ধশ্বাস ক’রে রেখেছে । আর আড়ালে থেকে তাদের যিনি সাহায্য ক’রে আসছেন—তিনি অন্যকোনো গ্রহের জীব নন, দেবতা বা অপদেবতাও নন—তিনি সেই নটিলাসের কেউ-না—পরিচয়বিহীন কাপ্তেন । জুল ভের্ন স্বভাবতই দানিকেন নন, তাই ভিন্ন গ্রহের জীব এসে দেবতা সেজে কিছু ক’রে যায়নি । এবং শেষ অব্দি কীভাবে কাপ্তেন নেমোর পরিচয় বেরিয়ে পড়লো—সেটাও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয় । সঙ্গে আছে পাপ, অনুতাপ, শোধন— এই নিয়ে একটি নৈতিক কাহিনী, ফাউ । আর আরম্ভটা ছিলো অন্য-একটি উপন্যাসে, ইংরেজিতে যার নাম ইন সার্চ অভ দ্য কাস্টঅ্যাওয়েজ, যেটা পরের কোনো খণ্ডে বেরুবে এই অমনিবাস পর্যায়ে।
অন্য কাহিনীটিতে আবার বলটিমোরের গান-ক্লাব : ইম্পে বার্বিকেন এবং তাঁর সহযোগীরা । এবারে চাঁদে যাওয়ার গল্প, : ব্যারন মুনখাউসেনের মতো নয়, তৎকালীন বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাকে ব্যবহার ক’রে মোটামুটি সম্ভাব্য একটা উপায়ে নিয়ে যেতে হবে মানুষকে চাঁদে ।
ফ্রম দি আর্থ টু দ্য মুন প্রথম আবির্ভাবেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো । বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে চাঁদে যাবার জন্য অন্য পরিকল্পনা করেছে, হাউইনির্মাণবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে । হয়তো কামানের গোলা থেকে নিক্ষিপ্ত আকাশযানে ক’রে কেউ এখন অন্তরিক্ষ বিজয়ে বেরুবে না—তবু মোটামুটি যানটাকে তীব্রগতিতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের পাল্লা থেকে বার ক’রে দেবার পরিকল্পনাটা জুল ভের্ন-এর উদ্ভাবনী শক্তি ও অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষম কল্পনারই পরিচায়ক । জুলভের্ন বৈজ্ঞানিক ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্যিক । বৈজ্ঞানিকের তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হ’লে নাকচ হ’য়ে যায়—সাহিত্যিকের কল্পনায় তৈরি উপাখ্যানের সেই বিপদ নেই । নেই যে, তার প্রমাণ ফ্রম দি আর্থ টু দ্য মুন ।
জুল ভের্ন-এর কৌতুক সরল, সুমধুর, অনেক সময়েই নেহাৎ মজা — অন্তত এখনও পর্যন্ত । পরে জুল ভের্ন বিজ্ঞানের অপব্যবহার দেখে রূঢ়কঠোর পরিহাস আমদানি করবেন তাঁর রচনায়—নিছক কৌতুকহাস্য তা আর থাকবে না । রহস্য কথাটির সর্বাঙ্গীন অর্থে তাই এই রচনাগুলো জ’মে উঠেছে—কেননা রহস্য মানে তো শুধু ধাঁধাজাগানো জটপাকানো রোমাঞ্চ নয়, কৌতুকও।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৯ পৌষ ১৩৯৯
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : কলকাতা
.
সূচীপত্র
- ফ্রম দি আর্থ টু দ্য মুন
- ক্লিপার অভ দ্য ক্লাউডস
- দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যাণ্ড
- অ্যালবাট্রস
Leave a Reply