জুল ভের্ন অমনিবাস ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
জুল ভের্ন অমনিবাস ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : অগ্রহায়ণ ১৩৯৯, নভেম্বর ১৯৯২
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
.
কত-যে বিচিত্র
এটা অনেক সময়েই দেখা যায় যে কোনো লেখক যদি বিশেষ- কোনো-এক ধরনের লেখা লিখে পাঠকদের মন জয় ক’রে থাকেন, তাহ’লে অনবরত প্রকাশকের কাছ থেকে ঠিক সেই ধরনেরই আরেকখানা লেখা তৈরি ক’রে দেবার জন্যে তাগাদা আসে : ‘ঐ-রকমই আরেকখানা বই লিখে দিন আমাদের, মসিয় ভের্ন।’ এবং, অনেক সময়েই, যদি লেখকের ইচ্ছে না-থাকে ও-রকম আরেকখানা বই লিখবার, নিজেকে যদি তিনি পুনরাবৃত্তি করতে না-ও চান, যদি মনে হয় নিজের সাফল্যের চর্বিতচর্বণের চাইতে বরং নতুন-কোনো উদ্ভাবনের দিকে নজর দেয়া উচিত, তবু অনেক সময় উপরোধে—লোকে তো উপরোধে ঢেঁকিও গেলে—প’ড়ে লেখককে আবার আগেকার বইয়েরই মতো আরেকটা বই লিখে দিতে হয়, বিশেষত লেখাই যদি তাঁর জীবিকা হয়, আর জীবিকা নির্বাহের জন্যে প্রকাশকের মন জুগিয়ে চলা যদি অনেক সময়েই জরুরি হ’য়ে পড়ে। যাঁরা সমগ্র জুল ভের্ন তন্নতন্ন ক’রে পড়েছেন—এবং তেমন পণ্ডিতের খুব-একটা অভাবও নেই পৃথিবীতে—তাঁরা তখনও লক্ষ করেছেন জুল ভের্ন কিন্তু সত্যি-সত্যি কখনোই পুরোপুরি নিজের চর্বিতচর্বণ করেননি— আরেকখানা ও-রকম বই লিখতে গিয়েও এমন-সমস্ত চমক ও বিস্ময়ের অবতারণা করেছেন যা নতুন লেখাটিকে আগের লেখার সঙ্গে অনেক মিল সত্ত্বেও একেবারে নতুন ক’রে দিয়েছে। শুধু-যে নিজের লেখাকেই খোলনলচে পালটে নতুন ক’রে উপস্থাপিত করতে হয়েছে তা-ই নয়—অনেক সময় আরো-সব বিখ্যাত লেখারও মজার মজার প্যারডি বা লালিকা লিখেছেন।
জুল ভের্ন -এর আমলে অনেকের লেখাই পাঠকের হাতে-হাতে ঘুরতো এমন অনেক বিখ্যাত লেখক ছিলেন, জুল ভের্ন নিজেও তাঁদের খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তিনি ভাবতেন যে তিনি নিজে যদি লেখাটি আবার লিখতে সুযোগ পান তবে তাকে তিনি নিশ্চয়ই অন্যরকমভাবে লিখতেন। তাঁর ভালো লাগতো আলেকাদ্র দ্যুমা, এডগার অ্যালান পো, ওয়ালটার স্কট, ইয়োহান হিবস, ডানিয়েল ডিফো – আর নিশ্চয়ই স্বয়ং জুল ভের্নকেও। এই কথাটি মনে রাখলেই আমরা বুঝতে পারবো তাঁর দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালায় কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞান কাহিনীই ছিলো না, ছিলো অনেক ধরনেরই অ্যাডভেনচার উপন্যাস : সমসায়মিয়ক ইতিহাসকে জড়িয়েই অনেক কাহিনী ফাঁদতেন জুল ভেন, বিশেষ ক’রে ইওরোপের বাইরে নানান মহাদেশে এত-যে এবং কত-কী রুদ্ধশ্বাস ও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তা তাঁর মনের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলতো; ফলে বারে বারেই পটভূমি বদলে যেতো তাঁর লেখায় : কখনও অফ্রিকা, কখনও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, কখনও-বা আমেরিকা (উত্তর ও দক্ষিণ—দুইই),
দক্ষিণ—দুইই), তাছাড়া এসিয়া তো আছেই—বিশেষ ক’রে চিনদেশ আর ভারতবর্ষ। তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে তিনি কখনও আমাদের নিয়ে গেছেন সমুদ্রের তলায়, কিংবা আকাশের অসীমে—তাঁর সঙ্গে আমরা গেছি পৃথিবীর তলায়—একেবার কেন্দ্রে, অথবা কামানের গোলায় চেপে (এ-কালে লিখলে তা হ’তো রকেট—কামানের বদলে থাকতো অন্য কোনোরকম উৎক্ষেপক) চাঁদের দিকে, কিন্তু সেই সঙ্গে মাটির পৃথিবীরও কোনো কোনা বাকি থাকেনি, অজানা থাকেনি আমাদের। এমনকী আমরা চেনা সমুদ্রের মধ্যে নাম-না-জানা কত-যে অজ্ঞান আজব দ্বীপে গিয়েও হাজির হয়েছি। কত জায়গার তাজ্জব সব কাহিনী লিখেছেন জুল ভের্ন, তাদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা প্রধানত বই প’ড়ে, ভূগোল আর প্রকৃতিবিদ্যার বই আর ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি যেন গুলে খেলেছিলে। এবং মার্কো পোলো বা মাঙ্গো পার্ক বা ক্রিস্তোবাল কোলোন তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে অনেক আজগুবি বেঘোরবিভ্রমের কথা লিখলেও—কিংবা ছিক গুলগাপ্পা দিয়ে পাঠকদের বিস্ময় উদ্রেক ক’রে দিতে চাইলেও— জুল ভের্ন কিন্তু জীবজন্তু, গাছপালা, ঋতুচক্রের বর্ণনায় যতদূরসম্ভব পণ্ডিত ও গবেষকদের নির্ভরযোগ্য বইয়েরই আশ্রয় নিতেন। তিনি নিজে সে-সব দেশ চোখে দ্যাখেননি ব’লেই, সে-সব দেশকে যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য ক’রে দেখাবার দায় ছিলো তাঁর। ‘নিজের চোখে দেখেছি’ এই বলে বাই ক’রে যত গুল দেয়া যায়, নিজের চোখে না-দেখলে কিন্তু আদপেই তেমনভাবে চোখেমুখে অবিশ্রাম বানানো কথা ব’লে যাওয়া যায় না।
অর্থাৎ, তৎকালীন জ্ঞানবিজ্ঞান যা-যা তথ্য (অথবা সত্য) ব’লে মেনে নিতো জুল ভের্ন তা-ই শুধু ব্যবহার করতেন তাঁর বর্ণনায়। কিন্তু রহস্য পাকানো মানে তো দুটি গল্প লেখা। একটাতে দমআটকানো সব পাকিয়ে- যাওয়া জট, অন্যটায় তাকেই খুলে দেয়া—ঘটনা পর ঘটনায় রহস্য জমিয়ে, সাজিয়ে, ক্রমাগত চমকে দিতে-দিতে কাহিনী নিয়ে এগুনো—শেষটায় বিস্ময়কর কোনো তথ্যের অপ্রত্যাশিত উদ্ঘাটন করে সব জট খুলে দিয়ে থাক লাগিয়ে দেয়া হবে—এ যেন কোনো বাজিকরের মতোই করতে পারতেন জুল ভের্ন । ঘটনা আর চরিত্রকে নিয়ে যেন সহাস্যে লোফালুফি খেলতেন, যেমন ভাবে ওস্তাদ কোনো বাজিকর বল নিয়ে লোফালুফি খেলে।
এককালে বিজ্ঞান ছিলো ভরসার স্থল, মানুষের বন্ধনমুক্তির উপায়—অন্তত জুল ভের্ন -এর তা-ই মনে হ’তো গোড়ায়; কিন্তু বিজ্ঞানকে সমাজ, সরকার বা কোনো-কোনো মানুষ যেভাবে ব্যবহার করছিলো তা দেখে হতশ্রদ্ধায় জুল ভের্ন লজ্জায় অধোবদনও হ’য়ে যাচ্ছিলেন। তবু, শেষ পর্যন্ত, মানুষ বা মানুষের প্রযুক্তিবিদ্যার ওপর থেকে সমস্ত বিশ্বাস হারাতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। মানুষ মারণকল বানাতে পারে, তবে এই কলের প্রয়োগ কে করবে, কেমন ক’রে, তাও তো মানুষেরই ভেবে নেয়া উচিত।
অথচ এ-সব হিংটিংছট হাতকামড়ানো প্রশ্ন না-করে মজা মেশানো রুদ্ধশ্বাস রহস্য-অ্যাডভেনচার লিখতেই যে তিনি বেশি ভালোবাসতেন তারই নজির বেশি পাই তাঁর লেখায়। কিন্তু যে-বৈচিত্র্য তাঁর প্রত্যেকটি নতুন লেখাকে আগ্রহে ও প্রত্যাশায় পাঠককে উদ্দ্গ্রীব ক’রে রাখতো, সেই বৈচিত্র্যেরই সন্ধান দেবার জন্যে এই অমনিবাস গ্রন্থমালার পরিকল্পনা ৷ কত ধরনের অ্যাডভেনচার কথা যে ভেবেছিলেন জুল ভের্ন, আর কেমনসব ? ওস্তাদের মতো সে-সব নিয়ে খেলা ক’রে গেছেন তারই ইঙ্গিত রইলো এখানে।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
১ অগ্রহায়ণ ১৩৯৯
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : কলকাতা ৭০০ ০৩২
Leave a Reply