জুল ভের্ন অমনিবাস ১ (প্রথম খণ্ড)
জুল ভের্ন অমনিবাস ১ (প্রথম খণ্ড)
অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ ১৩৯৯, এপ্রিল ১৯৯২
প্রচ্ছদ : পূর্ণেন্দু পত্রী
.
পৃথিবী ছাড়িয়ে
জুল ভের্ন-এর আগে চমকপ্রদ কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেছেন লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, ওলস্টোনক্র্যাফট্ শেলি বা এডগার অ্যালান পো – অথচ তবু কল্পবিজ্ঞান গল্প কথা উঠলেই আজ জুল ভের্নকেই সাহিত্যের এই শাখার জনক ব’লে যে ঘ’রে নেয়া হয়, তার কারণ এ-রকম বিচিত্র ও বিভিন্ন এতগুলো কল্পবিজ্ঞান গল্প তাঁর আগে আর-কেউ লেখেননি। দুশোর ওপর বই লিখেছিলেন জুল ভের্ন, আর তার সবই যে ছিলো কল্পবিজ্ঞান কাহিনী তাও নয় – লিখেছিলেন সমকালীন দেশবিদেশের ইতিহাসের পটভূমিকায় রোমাঞ্চকর, রগরগে ও রুদ্ধনিশ্বাস উপন্যাস, আর তাদের পটভূমি হিশেবে এসেছে মার্কিন মুলুকের দাসপ্রথা রোধের গৃহযুদ্ধ, ভারতবর্ষের সিপাহি-বিদ্রোহ, বিভিন্ন স্লাভদেশের জাগরণ, চিনের তাইপিং বিদ্রোহ, অথবা রুশ দেশের সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থান; গোড়ায় লিখেছিলেন নাটক, কাব্যনাটক বা অপেরার কাহিনী, তার কোনো-কোনোটা সফল ও জনপ্রিয়ও হয়েছিলো তখন, কিন্তু তাদের জন্যে তাঁকে কেউ মনে রাখেনি — সারা বিশ্বে এখন তাঁর একটাই পরিচয় : জুলভের্ন – অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞান গল্পকে যিনি সাহিত্যে জাতে তুলেছেন সিরিয়াসভাবে লিখে গেছেন এতগুলো দুর্বার অভিযান, যাকে তিনি নিজে নাম দিয়েছিলেন ‘আশ্চর্য অভিযান গ্রন্থমালা’, কেননা ইতিহাসের পটভূমিকায় ফাদা কাহিনীগুলোও ছিলো অ্যাডভেনচারেরই বই, কাহিনীর দুর্বার গতি, রুদ্ধনিশ্বাস সাসপেন্স, শেষমুহূর্তে তাক লাগিয়ে দেয়া তথ্যের উন্মোচন আজও আমাদের সে-সব গল্পে চুম্বকের মতো আটকে রাখে।
ব্যবহারজীবী পিয়ের ভের্ন-এর ছেলে জুল ভের্ন-এর জন্ম হয়েছিলো বিস্কে উপসাগরের কাছে ফ্রান্সের ছোটো একটি মফস্বল শহরে ( আর মৃত্যু ২৪ মার্চ, ১৯০৫ আমিয়েন্স শহরে )। মফস্বলের এই ছোট্ট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবেন ব’লে ছেলেবেলায় একবার জাহাজে ক্যাবিন-বয় হ’য়ে সাগর পাড়ি দেবারও চেষ্টা করেছিলেন জুল ভের্ন, বাবার কাছে ধরা প’ড়ে গিয়ে পৃথিবী চ’ষে বেড়াবার সাধ আর তাঁর মেটেনি, মফস্বল থেকে বেরিয়ে এসে তরুণ ভুল ভের্ন কুড়ি-একুশ বছর বয়সে রাজধানী পারিতে আস্তানা পেতেছিলেন, মনের মধ্যে যদি-বা গোপন ইচ্ছে থেকেও থাকে জীবনে আর কখনওই ফ্রাসের বাইরে পা দেয়া হয়নি তাঁর – কিন্তু কল্পনায় দেশবিদেশে পাড়ি দিতে আপত্তি কী? আর তাই কল্পবিজ্ঞান গল্পগুলোর মধ্য দিয়েই কল্পনায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পাঁচ মহাদেশে, দুই মেরুতে, কত মরুভূমির দেশে, দুর্গম অরণ্যে, দুরারোহ পর্বতচূড়ায়, জনমানবহীন নানা দ্বীপে–শুধু তা-ই নয়, পাড়ি দিয়েছেন আকাশে ও অন্তরিক্ষে কল্পনা করেছেন চাঁদে কীভাবে যাওয়া যায়, গেছেন সমুদ্রের তলায়, পৃথিবীর একেবারে নিচে ( তার কেন্দ্রে, তাঁর মনে হয়েছিলো পৃথিবীটা বুঝি ফাপা – মাটির কঠিন ত্বক ভেদ ক’রে সেই ফাঁপা পৃথিবীর তলায় মাঝখানকার ফাকা জায়গাটায় চ’লে যাওয়া যায় ) ।
পারি আসার পর থেকে লেখাই তাঁর ধ্যানজ্ঞানজীবিকা হ’য়ে উঠেছিলো, কিন্তু তাঁর দুর্বার ও আশ্চর্য অভিযানের মধ্য দিয়ে ঘরকুনো গৃহবন্দী ভুল ভের্ন পৃথিবী ছাড়িয়েও দূরে-বহুদূরে – চ’লে গিয়েছিলেন। তাঁর কল্পনার এই বাহাদুরিতে আমাদের তাক না-লেগে পারে না। তাঁর উদ্ভাবিত অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই পরে ঘটেছে – হয়তো তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন সেভাবে নয় – তবু সম্ভাবনা- গুলো আজ আর নিছক সম্ভাবনার স্তরেই নেই, বাস্তত্ত্ব ও সত্য । জুলভের্ন-এর কৈশোরে ইয়োহান সি-এর ‘সুইস ফ্যামিলি রবিনসন’ হৈ-হৈ ফেলে দিয়েছিলো —এখনও ছোটোদের কাছে যে-বইয়ের কদর একফোটাও কমেনি। এই বই থেকে প্রেরণা পেয়ে কতবার যে অজানা নির্জন দ্বীপে আমাদের নিয়ে গেছেন জুল ভের্ন — কখনও কেউ গেছে একা, রবিনসন ক্রুসোর মতো, কখনও দল বেঁধে, অনেকে — কিন্তু এইসব অজানা অচেনা দ্বীপ কত যে রহস্য ও রোমাঞ্চ লুকিয়ে রাখতো যে তাঁর লেখা প্রতিবারই নতুন হ’য়ে উঠতো, কখনও একটা আরেকটার পুনরাবৃত্তি হ’তো না। এমনকী একবার ‘সুইস ফ্যামিলি রবিনসন’-এরও উপসংহার লিখেছিলেন জুল ভের্ন ।
আর সবসময়েই ছিলেন সমাজসচেতন । উপনিবেশবাদের বিপক্ষে লিখেছেন, দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আগুন ঝরিয়েছেন, যেখানেই শোষকশাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান, সেখানেই ছিলো তাঁর সমর্থন । সেদিক থেকে তিনি ফরাশি বিপ্লবেরই সন্তান। গোড়ার দিকে তাঁর কল্পবিজ্ঞানকাহিনী ছিলো বিজ্ঞান কারিগরিবিদ্যার নানা সম্ভাবনার জয়গানে তরা – সেগুলো ছিলো তাঁর ‘ব্লুমস-ডে বুক’ ; কিন্তু মোহভঙ্গ হবার পর, বিজ্ঞানকে লোকে কীভাবে জীবনবিরোধী মানবতা- বিরোধী শক্তি হিশেবে ব্যবহার করছে এটা দেখবার পর, তিনি যে নিরাশাজটিল ও ক্রুদ্ধ বইগুলো লিখেছিলেন সেগুলো ছিলো তাঁর ‘ডুম্স-ডে বুক’– শুধু যে খ্যাপা বৈজ্ঞানিকের অধঃপতনই দেখিয়েছেন তা নয়, দেখিয়েছেন পুঁজিবাদ ও একনায়ক-তন্ত্রের বিভীষিকাও ।
অমনিবাসের বিভিন্ন খণ্ডে আমরা এই ভিন্ন-ভিন্ন জুল ভের্নকেই উপস্থাপিত করবো, আর এটাই দেখাবার চেষ্টা করবো যে তাঁর কল্পবিজ্ঞান গল্প ছকে লেখা একই কাহিনীর ধরাবাধা পুনরাবৃত্তি ছিলো না- বরং সাহিত্যের এই নবীন শাখায় তিনি নিত্য-নূতন রূপকল্প ও সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন, আর সেগুলো প্রতিবারই হ’তো দুর্বার ও আশ্চর্য ।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
২২ ফাল্গুন ১৩৯৮
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : কলকাতা
.
সূচীপত্র
- টোয়েন্টি থাউজ্যাণ্ড লিগস আণ্ডার দি সী
- অ্যাড্রিফট ইন দি প্যাসিফিক
- পারচেজ অব দি নর্থ পোল
- জার্নি টু সেন্টার অব দি আর্থ
- এ সায়ান্টিস্ট কিডন্যাপড
Leave a Reply