জীবন বড় সুন্দর – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – অক্টোবর ২০০৩
উৎসর্গ – ছাত্রজীবনে প্রেমিক প্রেমিকাদের এবং আপন ভাই ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যারা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত।
১. “আর যদি মুসলমানদের দুই দল পরস্পর (ঝগড়া-বিবাদ) যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পড়ে, তবে তাহাদের মধ্যে মীমাংসা ও পূণর্মিলন করিয়া দাও, অনন্তর যদি তাহাদের এক দল অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তবে সেই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর-যেই দল বাড়াবাড়ি করে যে পর্যন্ত না তাহারা আল্লাহর আদেশের দিকে ফিরিয়া আসে, অতঃপর যদি তাহারা প্রত্যাবর্তিত হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ন্যায়ের সহিত সন্ধি করাইয়া দাও; আর সুবিচারের প্রতি লক্ষ্য রাখিও; নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বানদিগকে পছন্দ করেন।”
আল কুরআন-সূরা-হুঁজুরাত, আয়াত-৯ পারা-২৬।
২. “যে কোনো বস্তু বেশি হইয়া যাওয়ার পর স্বভাবতই তার মূল্য কমিয়া যায়। একমাত্র বিদ্যাই এমন বস্তু, তার যতই প্রাচুর্য হয় ততই মূল্য বৃদ্ধি পাইতে থাকে।”
–ইবনে সীনা
৩. “কোনো দুর্বলের উপর জুলুম করিলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি নিজেও তোমার চাইতে প্রবল কতৃক লাঞ্ছিত হওয়ার অপেক্ষা করিও।”
-ইবনুল জাওফী
.
লেখকের অন্যান্য উপন্যাস
যেতে নাহি দেব ০ অমর প্রেম ০ মনের মতো মন ০ জীবন বড় সুন্দর ০ ফুটন্ত গোলাপ ০ বিদেশী মেম ০ ক্রন্দসী প্রিয়া ০ কি পেলাম ০ জ্যোৎস্না রাতে কালো মেঘ ০ বিলম্বিত বাসর ০ প্রেমের পরশ ০ শরীফা ০ প্রেম বেহেশতের ফল ০ শ্রেয়সী ০ অচেনা পথিক ০ স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ০ জোকা (কিশোর গল্প) ০ অনন্ত প্রেম ০ শেষ উপহার ০ কলঙ্কের ফুল ০ শহরের মেয়ে ০ তুমি সুন্দর ০ বিয়ে বিভ্রাট ০ কালো মেয়ে ০ পলাতকা ০ বিয়ের খোঁপা (ছোট গল্প) ০ কামিনী কাঞ্চন ০ বিকেলে ভোরের ফুল ০ প্রেম ও স্বপ্ন ০ তোমার প্রত্যাশায় ০ হৃদয়ে আকা ছবি ০ ভাঙ্গাগড়া ০ কে ডাকে তোমায় ০ স্বর্ণ তুমি ০ মেঘলা আকাশ ০ বধূয়া ০ বহুরূপিনী ০ হৃদয় যমুনা ০ ভালবাসার নিমন্ত্রণ ০ আমি তোমার ০ বড় আপা ০ প্রেমের ফসল (ছোটগল্প) ০ প্রতিবেশিনী ০ বাসর রাত বড় কে (কিশোর গল্প) ০ পল্লীবালা ০ আধুনিকা ০ ধনীর দুলালী ০ কেউ ভোলে কেউ ভোলে না ০ হঠাৎ দেখা ০ প্রেম যেন এক সোনার হরিণ ০ পথে পরিচয় ০ ধূমায়িত পথ ০ সংসার ০ একটি ভ্রমর পাঁচটি ফুল ০ বিদায় বেলায় ০ পাহাড়ী ললনা ০ বালিকার অভিমান ০ অবাঞ্ছিত উইল ০ চেনা মেয়ে ০ কাঙ্ক্ষিত জীবন ০ অলৌকিক প্রেম ০ মানুষ অমানুষ ০ প্রতিক্ষা ০ অবশেষে মিলন ০ অসম প্রেম ভালবাসি তোমাকেই ০ প্রেম ০ সে কোন বনের হরিণ ০ ফুলের কাঁটা ০ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে ০ আমিও মানুষ ০ তুমিও মানুষ ০ নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস ০ আগুনের মানব ০ শ্রাবণী ০ রাগ অনুরাগ ০ মেঘের কোলে রোদ ০ জোনাকির আলো ০ যেখানে কেউ নেই।
এক
ফরিদপুর টাউনের দক্ষিণ পাশে কইজুরী গ্রাম। এই গ্রামের খায়েরা সম্ভ্রান্ত বংশ। জাহেদুল ইসলাম এই বংশের অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। ওনার দুই ছেলে। বড় আমিরুল ইসলাম আর ছোট আনোয়ারুল হক।
আমিরুল স্কুল কলেজে পড়লেও নিজের চেষ্টায় অনেক ধর্মীয় বইপত্র পড়ে সেইমতো মেনে চলে। কিন্তু আনোয়ারুল বেশি লেখাপড়া যেমন করেনি তেমনি ধর্মীয় জ্ঞান না থাকায় ধর্মের বিধি-বিধান তেমন একটা মেনে চলে না। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকে সে একটু গোঁয়ার টাইপের।
আমিরুলের স্ত্রী আনোয়ারা শিক্ষিতা ও ধার্মিক। সাংসারিক কাজ কর্মের সাথে সাথে শ্বশুর-শাশুড়ীর দিকে খুব লক্ষ্য রাখে, ওনাদের সেবা যত্ন করে। আমিরুলও মা বাবার দিকে খুব লক্ষ্য রাখে।
আনোয়ারুলের স্ত্রী রিজিয়া ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। খুব হিংসুটে, রাগি ও বদমেজাজী। শাশুড়ী ও বড় জায়ের সঙ্গে সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে, কোনোদিন শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা যত্ন করে না।
সংসারের শান্তির জন্য জাহিদুল ইসলাম দুই ছেলেকে সমান সমান জমি জায়গা দিয়ে ভিননা করে দিলেন। কিছু জমি-জায়গা রাখলেন নিজের ও স্ত্রীর ভরণ পোষণের জন্য।
ভিনো হওয়ার পরও বড় বৌ আনোয়ারা আগের মতো শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা যত্ন করতে লাগল। শাশুড়ীকে রান্না করতে দেয় না। নিজেদের রান্নার সঙ্গে তাদের জন্যও রান্না করে।
তাই দেখে রিজিয়া হিংসায় জ্বলতে লাগল। একদিন কি নিয়ে বড় জা-এর সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে বলল, আমরা কিছু বুঝি না মনে করেছ? শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর খিদমত করছ তাদের সম্পত্তি পাওয়ার জন্য।
ঝগড়ার সময় আনোয়ারা বেশিরভাগ সময় বোবার ভূমিকা পালন করলেও সম্পত্তির কথা শুনে বলল, আমরা আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) কে খুশী করার জন্য তাদের হুকুম পালন করছি, ওনাদের সম্পত্তি পাওয়ার আশায় নয়।
তা হলে নিজের সংসার রেখে ওনাদের সম্পত্তির ফসল তোমরা ভোগ করছ কেন? ওতে আমাদেরও তো হক আছে।
সেটা ওনাদের ব্যাপার। তোমরা ওনাদেরকে বলবে, আমাদেরকে বলছ কেন?
ওনাদের আর বলে কি হবে? তোমরা তো তাবিজ করে বশ করে রেখেছ।
আনোয়ারা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
রিজিয়া অনেক কিছু বলে তাদেরকে দোষারোপ করতে লাগল।
এমন সময় আনোয়ারুল ঘরে এসে স্ত্রীর হয়ে শুধু বড় ভাবি নয়, আব্বাকেও অনেক দোষারূপ করতে লাগল।
জাহিদুল ইসলাম নিজে খোঁজ খবর নিয়ে আনোয়ারাকে বড় বৌ করে আনেন। আনোয়ারা জাতঘরের শিক্ষিত মেয়ে। আদব কায়দা শিক্ষা পেয়েছে। স্ত্রী সায়রা খাতুনের কথামতো তিনি শালার মেয়ে রিজিয়াকে ছোট বৌ করে আনেন। রিজিয়া জাতঘরের মেয়ে হয়েও আদব কায়দা শিক্ষা পায়নি। তার আচার ব্যবহারে জাহিদুল ইসলাম খুবই অসন্তুষ্ট।
সায়রা খাতুন কার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হবে ভাইঝিকে বোঝান, কিন্তু রিজিয়া ফুপির কথায় কান দেয় না। বরং উল্টে তাকে দোষারূপ করে। ফুপা ফুপির সেবা যত্ন করা দূরের কথা, তাদের কোনো কথাই সহ্য করতে পারে না। ফুপি ভালো মন্দ কিছু বললে বলে, “আমি তোমার আপন ভাইঝি, আমাকে কাছে না টেনে বড় বৌ পরের মেয়ে হলেও কাছে টেনে নিয়েছ। আমি একটা কিছু বললেই দোষ হয়ে যায়, বড় বৌ যত কিছুই বলুক তার কোনো দোষ হয় না। সে যেন ধোয়া তুলসি পাতা।
সায়রা খাতুন জানতেন। ভাইঝি ছোটবেলা থেকে একটু মুখরা ও ঝগড়াটে স্বভাবের। বৌ করার সময় মনে করেছিলেন এখন বড় হয়েছে, স্বামীর ঘরে এসে স্বভাবের পরিবর্তন হবে। বড় আশা করে তাকে বৌ করে এনেছেন বুড়ো বয়সে পরের বেটি বড় বৌ তাদের সেবা যত্ন করুক বা না করুক ভাইঝি নিশ্চয় করবে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। বরং বড় বৌ পেটের মেয়ের থেকে বেশি সেবা যত্ন করে।
তাই ভাইঝি রেগে গেলে নিজের মান সম্মান বাঁচাবার জন্য চুপ করে থাকেন, ছেলেকে বলে কোনো কাজ হয় না। সে ম্যাগের ভেড়য়া। স্ত্রীকে কিছু বকাঝকা করা তো দূরের কথা, উল্টে তার হয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে।
জাহিদুল ইসলাম ছোট ছেলে ও ছোট বৌ-এর উপর এত অসন্তুষ্ট হলেন যে, গোপনে সমস্ত সম্পত্তি বড় ছেলের নামে আর বাস্তু থেকে প্রায় দেড়শ ফুট দূরে যে দু’বিঘে ডাঙ্গাজমি ছিল, সেটা বড় বৌ আনোয়ারার নামে উইল করে দিলেন।
এই সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। তখন আমিরুলের তিন চারটে ছেলেমেয়ে। প্রথম দিকে আমিরুল মুক্তিযুদ্ধ মেনে নিতে পারল না। ভাবল, ভারতের হিন্দুরা সামান্য কারণে দাঙ্গা বাধিয়ে নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে কচুকাটা করছে। যে ভারত পাকিস্তানের চিরশত্রু, তাদের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র কায়েম করা কি উচিত হচ্ছে। তা ছাড়া একথা তো চিরসত্য, “মুসলমানদেরকে হিন্দুরা কোনো দিন সুনজরে দেখেনি।” তাদের কথায় ও তাদের সাহায্য নিয়ে মুসলমান হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করা কি উচিত হচ্ছে? এইসব কথা বলে সমবয়সীদের সঙ্গে প্রথম দিকে খুব তর্ক-বিতর্ক করল । তারপর যখন দেখল, পাক বাহিনী নির্মমভাবে এদেশের মানুষকে কুকুর বিড়ালের মতো গুলি করে মারছে, গ্রামে-গঞ্জের সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নিরপরাধ তরুণ ও যুবকদেরকে মুক্তিবাহিনী মনে করে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে, প্রাণের ভয়ে পলায়নপর নারী পুরুষ ও ছেলেমেয়েদের নির্বিচারে গুলি করে মারছে তখন আর স্থির থাকতে পারল না আমিরুল। বাড়ির সবাই বাধা দেবে ভেবে কাউকে কিছু না বলে মুক্তিফৌজে নাম লেখাল। ট্রেনিং শেষে একদিন গভীর রাতে বাড়িতে এসে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আল্লাহ যদি ফিরিয়ে আনেন, তা হলে আবার দেখা হবে। তুমি দোয়া করো, “আল্লাহ যেন দেশকে স্বাধীন করার তওফিক আমাদের দেন।” কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো আমাদের গ্রামেও হানাদার বাহিনী এসে পড়বে। তুমি আব্বা আম্মা ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে তোমার বাপের বাড়ি চলে যেও। ওটা প্রত্যন্ত অঞ্চল। ওখানে হানাদার বাহিনী যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আনোয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার পেটে আট মাসের বাচ্চা। কোন স্ত্রীই এ অবস্থায় স্বামীকে কাছ ছাড়া করতে চায় না। কিন্তু তবু আমি তোমাকে বাধা দেব না। আল্লাহ তোমাকে বিজয়ী করে ফিরিয়ে আনুক এই দোয়া সব সময় করব।
পরের দিন সকালে আনোয়ারা শ্বশুর-শাশুড়ীকে স্বামীর কথা জানাল।
জাহিদুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমিরুলের ব্যাপারে ভালো মন্দ কিছু বলব না। তাকে আল্লাহ সহিসালামতে ফিরিয়ে আনুক এই দোয়া করব। আর তুমি ছেলেদের নিয়ে তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও, আমরা যাব না। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে এবং যখন যেখানে যেভাবে মউত লিখে রেখেছেন তখন সেখানে সেভাবেই হবে। আমাদের জন্য তুমি চিন্তা করো না। তোমাকেও যেতে নিষেধ করতাম, কিন্তু তোমার স্বামী যখন যেতে বলেছে তখন আর নিষেধ করব না। কারণ মেয়েদের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) এর হুকুমের পরেই স্বামীর হুকুম মেনে চলা উচিত। এটাও ইসলামের হুকুম। আনোয়ারুল তো বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে আগেই চলে গেছে, তুমিও চলে যাও।
এর দুদিন পর আনোয়ারা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। দু’মাস পর সেখানে ছেলে সন্তান প্রসব করল। ছেলের নানা নাম রাখলেন কামরুল ইসলাম।
কইজুরী গ্রামে হানাদার বাহিনী এসে কোনো বাড়িতে বুড়ো বুড়ি ছাড়া কাউকে পেয়ে কোনো কিছু করল না। তবে গ্রামের মুরুব্বীদের ডেকে বলল, আমরা যতদিন থাকব ততদিন আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ আগুন জ্বালিয়ে সমস্ত বাড়িঘর নষ্ট করে দেয়া হবে।
হানাদার বাহিনী গ্রামে আসার আগেই মুরুব্বীরা মিটিং করে শান্তি কমিটি করেছেন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বিচক্ষণ ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। তিনি সবার পক্ষ থেকে হানাদার বাহিনীর কথায় রাজি হয়ে গ্রামকে রক্ষা করলেন। মুরুব্বীদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন তাদের মধ্যে রায়হান মজুমদার একজন। তিনি গোপনে যেসব ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে তাদের ও তাদের বাপদের নাম লিখে গোপনে হানাদার বাহিনীকে দিলেন।
হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন হানিফ শিক্ষিত ও ধার্মিক। একদিন চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনকে ডেকে পাঠিয়ে রায়হান মজুমদারের দেয়া নামের লিস্টটা ওনার হাতে দিয়ে বললেন, এদের ছেলেরা নাকি মুক্তিযুদ্ধে গেছে?
মোশারফ হোসেন লিস্ট পড়ে বুঝতে পারলেন, তাদের মধ্যে কেউ এটা করেছে। কি বলবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
কি হল, কিছু বলছেন না কেন? শুনেছি আপনি খুব ধার্মিক, সত্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করছেন কেন?
লিস্টের নামের অনেকের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেলেও সবার ছেলেরা যায়নি। তারা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ সুযোগ পেয়ে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের বাবাদের নাম লিস্ট করে আপনাকে দিয়েছে।
যাদের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের নামগুলোতে টিক চিহ্ন দিন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেব।
তা নিতে পারেন, তবে আমি জানি, যে সব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে তাদের বাবারা পাকিস্তানের সাপোর্টার। তারা ছেলেদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে নিষেধ করেছে, কিন্তু ছেলেরা শোনে নি। আর একটা কথা না বলে পারছি না, আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন
“আর যেই ব্যক্তি সৎপথে চলে, সে নিজেরই হিতার্থে সৎপথে চলিয়া থাকে, আর যেই ব্যক্তি বিপথে চলে, বস্তুতঃ সেও নিজেরই অনিষ্ঠের জন্য পথভ্রষ্ট হইয়া থাকে; আর (আমার নীতি এই যে,) কেহই কাহারও বোঝা বহন করিবে না”। [সূরা-বনি ইসরাঈল, আয়াত-১৫, পারা-১৫]
মুসলমান হিসাবে কারোরই উচিত নয়, ছেলের অন্যায়ের জন্য বাবাকে শাস্তি দেয়া।
কুরআনের বাণী শুনে ক্যাপটেন হানিফের মন নরম হল। বললেন, ঠিক আছে, আপনি এখন যান।
ঐদিন রাতে মোশারফ হোসেন শান্তি কমিটির মেম্বারদের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সবাই আসার পর বললেন, আমরা পাকবাহিনীদের হাত থেকে গ্রামের মানুষদের বাঁচাবার জন্য শান্তি কমিটি গঠন করেছি। আমাদের মধ্যে অনেকে যেমন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করি তেমনি অনেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাপোর্ট করি। আমাদের ছেলেদের মধ্যেও দুই পক্ষের সাপোর্টার রয়েছে। পাকসৈন্যদের হাত থেকে গ্রামকে বাঁচাবার জন্য শত্রু-মিত্র ভুলে মিলেমিশে থাকবো কমিটি গঠন করার সময় আমরা ওয়াদা করেছিলাম, কিন্তু কেউ একজন সেই ওয়াদা ভঙ্গ করে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেনদের কাছে যাদের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, তাদের বেশ কয়েকজনের নামের লিস্ট করে দিয়েছে।
আমাকে ক্যাপ্টেন ডেকে পাঠিয়ে লিস্ট দেখিয়েছেন। আমি তাকে যতটা বোঝাবার বুঝিয়ে বলেছি। জানি না, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে কি রেখেছেন। ওয়াদা ভঙ্গ করা শক্ত গুণাহ। কথাটা মনে রেখে আর যেন ওয়াদা ভঙ্গ না করি এটাই আমার একান্ত অনুরোধ। এবার আপনারা আসুন।
.
দীর্ঘ নয় মাস পর দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে আমিরুল ও গ্রামের অন্যান্য যেসব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল সবাই ফিরে এলেও মোশারফ হোসেনের ছেলে ফিরল না। কারণ যুদ্ধ করার সময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে। কথাটা শুনে মোশারফ হোসেন খুব দুঃখ পেলেন কেঁদে কেঁদে ছেলের রুহের মাগফেরাতের জন্য আল্লার কাছে দোয়া করলেন।
গ্রামের মুরুব্বীরা শান্তি কমিটি করে হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করেছেন জেনে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকসন নিতে চাইল।
আমিরুল মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিল। সে এসেই শান্তি কমিটির কথা শুনে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করেছে। তাই এ্যাকসনের কথা জানতে পেরে গ্রামের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একদিন বৈঠক করে বলল, মুরুব্বীরা যা কিছু করেছেন, গ্রামের সবার ভালোর জন্য করেছেন। অন্যান্য গ্রামের লোকজনের মতো মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু করেনি। বরং মুক্তি বাহিনীর বাড়িঘর ও তাদের ফ্যামিলির জীবন রক্ষার জন্য করেছেন। ওনারা যদি তা না করতেন, তা হলে আমরা ফিরে এসে মা-বাবাদের পেতাম না। বাড়ি-ঘরও পেতাম না। হানাদার বাহিনী সব ছারখার করে দিত। তাই ওনাদেরকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে আগের মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করতে হবে। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদেরকে জানিয়ে দিতে হবে, ওনারা যেন আগের চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। জানাবার পরও যদি ওনারা শুধরে না যান তখন এ্যাকসন নেব।
সবাই ক্যাপ্টেনের কথা মেনে নিল।
এরপর থেকে আমিরুল গ্রামের মধ্যমণি হয়ে গেল। ছোট বড় সবাই শ্ৰেণীমতো তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে লাগল। গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদি বা যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমিরুলকে ছাড়া সমাধান হয় না।
আমিরুলের যশ যত বৃদ্ধি পেতে লাগল তার ছোট ভাই আনোয়ারুল হক। হিংসায় ফেটে পড়তে লাগল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যে আমিরুলের মা সাহারা খাতুন হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জাহিদুল ইসলাম খুব মুষড়ে পড়লেন এবং কিছুদিনের মধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আমিরুল বড় ডাক্তার এনে চিকিৎসা করতে লাগল। আনোয়ারা দিন রাত শ্বশুরের খিদমত করতে লাগল।
ছোট ছেলে ও ছোট বৌ দিনে একবার বাবাকে দেখতে এলেও চিকিৎসার ব্যাপারে নাক গলায় না।
একরাতে আমিরুল ও আনোয়ারা যখন জাহিদুল ইসলামের হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল তখন তিনি তাদেরকে উইলের কথা বললেন।
শুনে স্বামী স্ত্রী দুজনেই চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমিরুল দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আব্বাকে বলল, এ আপনি কি করেছেন? এটা করা আপনার ঠিক হয় নি। আনোয়ারুল আপনার ছোট ছেলে। আপনার সম্পত্তির অর্ধেক হকদার। আল্লাহ কুরআন পাকে কার কি হক বাতলে দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে কি জওয়াব দেবেন? আপনি কালকেই আমাদের দু’ভাইয়ের নামে নতুন করে উইল করে দেবেন।
জাহিদুল ইসলাম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন আমি তোমার কাছে এটাই আশা করেছিলাম। আনোয়ারুল ও তার বৌ আমার ও তোমার মায়ের মনে অনেক দুঃখ দিয়েছে। তাই এই উইল করেছি। আমি মারা যাওয়ার পর তুমি যা ভালো বুঝো করো। তবে বড় বৌমা আনোয়ারাকে যে ডাঙ্গাটা লিখে দিয়েছি সেটা তার। সে নিজের মেয়ের থেকে বেশি আমাদের সেবা যত্ন করেছে। তাকে আমি খুশী হয়ে দিয়েছি। কথা দাও, ঐ ডাঙ্গাটার অংশ কাউকে দেবে না।
স্বামী কিছু বলার আগে আনোয়ারা বলল, কিন্তু আব্বা, ছোট ভাই ও তার স্ত্রী এমনিই আমাকে দেখতে পারে না। আপনি আমাকে ডাঙ্গাটা লিখে দিয়েছেন জেনে কি করবে আল্লাহকে মালুম। আপনি বরং ওটা আমার ও ছোট বৌ দু’জনের নামে করে দেন।
না বড় বৌমা, তা আমি কিছুতেই করব না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে আর কিছু বলে না। তারপর আমিরুলকে বললেন, ডাঙ্গাটার ব্যাপারে তুমিও কিছু করবে না। কথা শেষ করে ছটফট করতে করতে বললেন, খুব অস্থির লাগছে, একটু পানি দাও।
আনোয়ারা চামচে করে পানি খাওয়াল।
জাহিদুল ইসলাম পানি খেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে একবার চমকে উঠে নিথর হয়ে গেলেন।
আমিরুল বুঝতে পারল, আব্বা মারা গেছেন। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন” পড়ে স্ত্রীকে বলল, আনার, আব্বা আর নেই। আমিরুল স্ত্রীকে আনার বলে ডাকে।
স্বামীর কথা শুনে আনোয়ারা ও “ইন্না…রাজেউন” পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমিও তা বুঝতে পেরেছি। তুমি ছোটদের খবর দাও।
পরের দিন দাফন কাফনের পর আনোয়ারুল বড় ভাইকে বলল, আব্বার সিন্দুকের চাবি কোথায়?
আমিরুল বলল, চাবি আব্বার কোমরে ছিল, গোসল করানোর আগে আমি খুলে রেখেছি। তারপর ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পাড়ার ও আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজন মুরুব্বী ডেকে তাদের সামনে সিন্দুক খুলল। মায়ের গহনা ও টাকা পয়সা যা ছিল মুরুব্বীরা সমান দু’ভাগ করে দু’ভাইকে দিলেন। তারপর জাহিদুল ইসলামের উইল করা দলিল পড়ে আত্মীয়দের মধ্যে যারা মা বাবার প্রতি আনোয়ারুল ও তার স্ত্রীর দুর্ব্যবহারের কথা জানতেন তারা ছাড়া সবাই অবাক হলেন। আর আনোয়ারুল রেগে আগুন হয়ে বলল, এটা বড় ভাই ও ভাবি আব্বাকে ফুসলিয়ে করেছে।
রিজিয়াও চুপ করে রইল না। পাঁচজনের সামনেই ভাসুর ও বড় জাকে যা-তা বলতে লাগল।
আমিরুল তাদেরকে চুপ করতে বলে বলল, আমরা কেউ এ ব্যাপারে আব্বাকে কিছুই বলিনি। এমন কি এই উইলের কথাও জানতাম না। আব্বা ইন্তেকাল করার আগে আমাকে যখন জানালেন তখন আমি মেনে নিতে পারি নি। তাই বললাম, কালকেই আমাদের দু’ভাইয়ের নামে আবার নতুন উইল করে দেবেন। আব্বা বললেন, “বেশ তাই করে দেব। তবে যে ডাঙ্গাটা বড় বৌমাকে দিয়েছি সেটা তারই থাকবে। আমার স্ত্রী সেখানে ছিল। আব্বার কথা শুনে সেও আপত্তি করে বলেছিল, “ওটা আমাদের দু’জায়ের নামে করে দিতে।” আব্বা রাজি না হয়ে বললেন, “এই ডাঙ্গাটা আমি তোমাকে খুশী হয়ে দিয়েছি। ওটা তোমার একার থাকবে। ওটাতে আমিরুলেরও হক নেই”। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আব্বা ইন্তেকাল করেন। এখন আপনারা যা বলবেন, আমি তাই করব। আর ডাঙ্গার ব্যাপারেও যা বলবেন, আমার স্ত্রীও তাই করবে।
আমিরুল ও তার স্ত্রী যে সৎ ও ধার্মিক, তা মুরুব্বীরা জানেন, তাই তার কথা অবিশ্বাস করতে পারলেন না। ওনাদের মধ্যে জাহিদুল ইসলামের চাচাত ভাই আজিজুল খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি বললেন, উইল মোতাবেক আমিরুল পিতার সমস্ত সম্পত্তির মালিক। তবু সে ভাইকে অর্ধেক সম্পত্তি দিতে চেয়ে উদার মনের পরিচয় দিয়েছে এবং যে ডাঙ্গাটা জাহিদুল ইসলাম আমিরুলের স্ত্রীকে দিয়েছে, সেটা তারই। তবু দু’জায়ের নামে করে দিতে বলে সেও উদার মনের পরিচয় দিয়েছে। আমার বিচারে বলে ঐ ডাঙ্গা জমিটা আমিরুলের স্ত্রীর একারই থাক। আর বাকি সমস্ত সম্পত্তি থেকে আমিরুল অর্ধেক সম্পত্তি আনোয়ারুলকে লিখে দেবে।
আজিজুল হকের কথা শুনে অনান্য মুরুব্বীরা কয়েকবার মারহাবা মারহাবা বলে। বললেন, এর থেকে সুবিচার আর হতে পারে না। উনি হক বিচার করেছেন।
ওনারা থেমে যেতে আমিরুল বলল, আমি আপনাদের বিচার মেনে নিলাম। কিন্তু আপনাদের কাছে আমার একটা নিবেদন আছে।
আজিজুল হক বললেন, বল তোমার কি নিবেদন?
আমি আব্বার রুহের মাগফেরাতের জন্য একবিঘে ধানিজমি আমাদের গ্রামের মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করে দিতে চাই। তারপর বাকি সম্পত্তি দু’ভাইয়ের নামে অর্ধেক অর্ধেক দলিল করব আর কয়েকদিনের মধ্যে আপনাদের সামনে মা বাবার ব্যবহারিক সবকিছু ভাগ করে নেব।
তার কথা শেষ হতে সবাই আবার মারহাবা মারহাবা বলে উঠলেন। আজিজুল হক বললেন, এটা খুব ভালো কথা, আমরা তোমার নিবেদন মঞ্জুর করলাম। তারপর একে একে সবাই চলে গেলেন।
দুই
পঁচিশ বছর পরের ঘটনা। বাবা মারা যাওয়ার পর আমিরুল ইসলাম বেশিদিন বাস্তুতে থাকতে পারেন নি। যে যার সংসার আলাদা হলেও প্রায় প্রতিদিন ঐ ডাঙ্গাটার প্রসঙ্গ তুলে আনোয়ারুল হক ও রিজিয়া খাতুন বড় ভাই ভাবির সঙ্গে ঝগড়া করতেন। তাই বাধ্য হয়ে আমিরুল ইসলাম জমি বিক্রি করে ঐ ডাঙ্গাটায় দু’কামরা করে চার কামরা দু’তলা পাকা বাড়ি করেছেন। ফরিদপুর টাউনে দু’কাঠা জমি কিনে বাড়িও করেছেন। পুকুর কাটিয়ে চার পাশের পাড়ে নানারকম ফলের গাছ লাগিয়েছেন। সেসব গাছ এখন ফলছে। সৎ ও ধার্মিক জেনে লোকজন ভোট দিয়ে তাকে ফরিদপুর এক নাম্বার ওয়ার্ডের দু’বার কমিশনার করেছে। ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। বড় ছেলে জহুরুল, বি.এ. পাশ করে হাই স্কুলে শিক্ষকতা করছে। মেজ ছেলে হাসানুজ্জামান আয়শা একাডেমীর অধ্যক্ষ। ছোট কামরুল ক্লাস নাইনে পড়ে। এখন আমিরুলের অবস্থা অনেক উন্নত।
বড় ভাইয়ের সব কিছু দেখে শুনে ছোট ভাই আনোয়ারুল হক ও তার স্ত্রী রিজিয়া খাতুন হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছেন। রিজিয়া খাতুন আজও ঐ ডাঙ্গাটা নিয়ে বড় জাকে গালি-গালাজ করেন। তাদের তিন ছেলে এক মেয়ে। সবার বড় ছেলে নাম শিহাব। সে ইন্টারে পড়ে মেয়ে শামিমা ক্লাস সেভেনে পড়ে।
শামিমা মা বাবার মতো একগুঁয়েমী স্বভাব পেলেও তার মনে এতটুকু হিংসা নেই। তাই বড় চাচিকে মা যখন গালাগালি করে তখন তার খুব খারাপ লাগে। ছোটবেলায় কোনো কারণে মা বকাবকি বা মারলে কাঁদতে কাঁদতে বড় চাচির কাছে। যেত। আনোয়ারা বেগম তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে আদর করে কান্না থামিয়ে এটা সেটা খেতে দিতেন।
সে কথা জানতে পেরে রিজিয়া খাতুন একদিন মেয়েকে রাগারাগি করেন, ওদের ঘরে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু একথা সবাই জানে, ছোট ছেলেমেয়েকে যে কাজ করতে নিষেধ করা হয়, সেটাই তারা বেশি করে। শামিমার বেলায়ও তাই হল। মা রাগ করবে জেনেও যেত। ফলে তাকে মায়ের হাতের চড় চ্যাপটা প্রায়ই খেতে হত।
শামিমা এখন তরুণী ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। ছোটবেলা থেকে মাকে রাগি ও বদমেজাজী দেখেছে। বড় চাচা ও বড় চাচির মতো তাকে মা-বাবা আদর করে না। আরো দেখেছে, মা বড় চাচিকে যতই গালি-গালাজ করুক, বড় চাচি কোনোদিন তার মাকে গা ন-গালাজ করে না। তাই বড় চাচি শামিমার কচি মনে। গভীর দাগ কাটে। তার ম ন হয়, বড় চাচির মতো মেয়ে আর হয় না।
আজ স্কুল থেকে এসে মা বড় চাচিকে উদ্দেশ্য করে গালি-গালাজ করছে শুনে শামিমার মন খারাপ হয়ে গেল। কিছু বললে মা আরো রেগে গিয়ে তাকে বকাবকি করবে জেনেও বলল, মা, তুমি বড় চাচিকে গালি-গালাজ করছ কেন? সে কি এমন করেছে?
রিজিয়া কেঁঝিয়ে উঠলেন, সে কথা তোর জানার দরকার নেই। যা, বই-এর ব্যাগ রেগে খেতে যা।
মায়ের বকুনি খেয়ে শামিমার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে খেতে খেতে চিন্তা করল, বড় চাচি কত ভালো, তবু যে মা কেন তাকে ছোট বড় কথা বলে গালাগালি করে বুঝতে পারে না। চাচাত ভাই ভাবিরাও তাকে কত আদর করে। তাদেরকেও মা দেখতে পারে না। ছোটবেলায় বড় চাচিদের ঘরে গেলে মা তাকে বকাবকি ও মারধর করত কেন তা আজও শামিমা বুঝতে পারে না।
জহুরুল ইসলামের বড় মেয়ে কুলসুমও সেভেনে পড়ে। শামিমার সঙ্গে তার খুব ভাব। স্কুলে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে। পড়াশোনায় দু’জনেই ভালো। ফুপু ভাইঝি সম্পর্ক হলেও সই পাতিয়েছে। তাই শামিমা তার সঙ্গে তাদের ঘরে যায়, একসঙ্গে চলাফেরা ও খেলাধুলা করে। কুলসুমও মাঝে মধ্যে শামিমাদের ঘরে আসে। কেন কি জানি রিজিয়া খাতুন কুলসুমকে যেমন আসতে নিষেধ করেন না, তেমনি মেয়েকেও তাদের ঘরে যেতে নিষেধ করেন না। শামিমা ভেবেছে, সে বড় হয়েছে বলে হয়তো মা এখন আর কিছু বলে না।
একদিন সকালে কামরুল ভাইঝি কুলসুমকে অঙ্ক করাচ্ছিল। এমন সময় শামিমা এলে কুলসুম তাকে বলল, আয় বস, চাচার কাছে অঙ্কগুলো করে নিয়ে খেলবো।
কামরুল শামিমাকে জিজ্ঞেস করল, এই অঙ্কগুলো তুই করেছিস?
শামিমা তাকে কামরুল ভাই বলে। তার মনে হয় নিজের ভাই শিহাবের চেয়ে কামরুল ভাই তাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে, প্রায় দিন স্কুলে চানাচুর বা বাদাম ভাজা কিনে কুলসুমকে ও তাকে দেয়। এক এক দিন তাদেরকে নদীর পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যায়, নদীর পাড়ে বসে গল্প করে।
এখন তার কথা শুনে কুলসুমের পাশের চেয়ারে বসে বলল, না করিনি। রাতে মাস্টারের কাছে করব। স্কুলের মাজেদ মাস্টার শামিমাকে রাত্রে পড়ায়।
কামরুল বলল, ওকে অঙ্কগুলো বুঝিয়ে দিয়ে করাচ্ছি। তুইও বুঝে নে। তারপর একটা অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে কুলসুমকে বলল, ওকে তোর একটা খাতা কলম দে, শামিমাও অঙ্কটা করুক।
ঘন্টাখানেক অঙ্ক করার পর কামরুল বলল, কাল বাকিগুলো বুঝিয়ে দেব, আজ এ পর্যন্ত থাক। লঞ্চঘাটে চল, তোদেরকে আজ নৌকায় চড়িয়ে ঘোরাব।
কুলসুম বলল, আমি যেতে পারব না। মায়ের রাত থেকে জ্বর, শুয়ে আছে। ছোট বোনের পায়খানা পেসাবের কথা পড়ে আছে ধুতে হবে। তুমি শামিমাকে নিয়ে যাও, আমি অন্য দিন যাব।
তাই যাস বলে কামরুল শামিমাকে নিয়ে রওয়ানা দিল।
লঞ্চঘাটে এসে শামিমা বলল, কামরুল ভাই, নৌকায় চড়তে আমার ভালো লাগে না। তারচেয়ে জমিদার বাড়ি দেখতে যাই চল, আমি একবারও জমিদার বাড়ি দেখিনি।
ঠিক আছে তাই চল বলে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এককালে ফরিদপুর পরগনার জমিদার ছিলেন গহর খাঁ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও প্রজাহিতৈষী। আগেকার বেশিরভাগ জমিদার প্রজাদের ভালো মন্দের দিকে নজর রাখতেন না। তারা প্রমোদ কাননে বাইজীদের নাচ-গানের আসর নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, মদ খেয়ে বাইজীদের নিয়ে ফুর্তি করতেন। আর তাদের সরকার গোমস্তা ও পাইক-পেয়াদারা প্রজাদের উপর নানান অজুহাতে অত্যাচার করে খাজনা আদায় করত। যে বছর ফসল হত না, সে বছর প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে। তাদের গরু, ছাগল, ঘটি, বাটি জোর করে নিয়ে নিত।
গহর খা কিন্তু তাদের মতো ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রজাদের মা-বাপ। ছেলেমেয়েদের ঠিক মতো খাওয়া-পরার ও স্বাস্থ্যের দিকে যেমন মা বাবারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে, গহর খাও তাঁর প্রজাদের দিকে তেমনি দৃষ্টি রাখতেন। যে বছর মাঠে ফসল হত না,সে বছর পাইক-পেয়াদের দিয়ে ঢেড়া পিটিয়ে বলে দিতে বলতেন, “এ বছর খাজনা মাফ।” শুধু তাই নয়, কার বাড়িতে চুলো জ্বলেনি দেখার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের কথামতো যে সব বাড়িতে চুলো জ্বলেনি, সে সব বাড়িতে চাল ও কাঁচা তরি-তরকারি পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন। এ সব করেও ওনার মনে শান্তি হত না। গভীর রাতে একজন পাইককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন, কার কি অসুবিধে আছে জানার জন্য। অতি সাধারণ পোশাক পরতেন। অচেনা কোনো মানুষ দেখলে ভাবতেই পারত না, উনি জমিদার গহর খা। খুব লম্বা চওড়া শরীর ছিল। দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন। সবার সঙ্গে খুব মিষ্টিস্বরে কথা বলতেন। গরিব ধনী বাচ বিচার করতেন না। বিয়ে-শাদি বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান হলে আত্মীয়দের সাথে সাথে গ্রামের গরিবদেরকেও দাওয়াত দিতেন এবং সবাইকে একই মজলিসে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আজকাল তো ধনী ও আত্মীয়দের ছাড়া গরিবদের কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয় না। কেউ কেউ দিলেও গরিবদের খাওয়ানোর জায়গা আলাদা করা হয়, সবার সঙ্গে খাওয়ান হয় না। গহর খাঁ কিন্তু তা করতেন না। প্রতিদিন আসরের নামাযের পর মসজিদের সিঁড়িতে বসতেন। সে সময় প্রজারা নির্বিঘ্নে তাদের সুবিধে অসুবিধের কথা জানাত। জানার পর তিনি তাদের অসুবিধে দূর করার ব্যবস্থা করতেন। কেউ কারো বিরুদ্ধে নালিশ করলে সত্য মিথ্যা যাচাই করে সুষ্ঠু বিচার করে দিতেন।
জমিদার গহর খাঁর আমল এক দেড়শ বছর আগের হলেও আজও তার সুখ্যাতির কথা এই অঞ্চলের লোকের মুখে মুখে। জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। দূর দূর গ্রাম থেকে আজও লোকজন জমিদার বাড়ি দেখতে আসে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে জমিদার বাড়ি। চারপাশে উঁচু পাকা পাঁচিল ছিল। পাঁচিলের নমুনা এখনও আছে। বাড়ির পশ্চিম পাশে বিরাট পুকুর ছিল। দুটো সানবাঁধান ঘাট ছিল। নদীর ভাঙ্গনে পুকুরটা নদীতে চলে গেছে। বাড়ির অর্ধেক লোকজন নদীর ভাঙ্গন দেখে ঢাকায় গিয়ে বাড়ি-ঘর করে বাস করছে। কেবল মাত্র আবু খাঁ শহরে যান নি। তিনি ধ্বংসাবশেষের এক পাশে দু’রুমের পাকা ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছেন। বোরহান খাঁ ওনাদের একমাত্র সন্তান। সে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকে। মা-বাবাকে ঢাকায় নিজেদের কাছে রাখতে চায়, কিন্তু আবু খাঁ ও তার স্ত্রী যেতে চান নি। অবশ্য বোরহান খা মা বাবার সমস্ত খরচ বহন করে।
কইজুরী থেকে জমিদার বাড়ি প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার। কামরুল সমবয়সীদের সঙ্গে দু’তিনবার জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছে। প্রথমবার এসে আবু খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আবু খকে কামরুলের খুব ভালো লাগে। তাই সেইদিনই ওনাকে দাদু বলে ডাকে। আবু খাঁ ও তাকে নাতির মতো মনে করেন। তাই ছুটির দিনে মাঝে মাঝে কামরুল আবু খাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। আবু খাঁর বৌ কেসিমন খানমও কামরুলকে খুব স্নেহ করেন। সে এলে তাকে আদর করে কিছু খেতে দেন। খাওয়ার সময় কামরুল আবু খাঁর কাছে জমিদার গহর খার ইতিহাস শুনে।
আজ শামিমাকে নিয়ে এসে প্রথমে জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখবার সময় কোথায় কি ছিল বলল, তারপর আবু খাঁ ও তার বৌ-এর কথা বলে ওনাদের ঘরের দিকে আসার সময় দেখল, আবু খাঁ একটা জলচৌকিতে বসে আছেন আর দুজন কামলা কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। কাছে এসে কামরুল সালাম দিয়ে বলল, দাদু কেমন আছেন?
আবু খাঁ সালামের উত্তর দিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, আল্লাহর মেহেরবাণীতে খুব ভালো আছি। তারপর শামিমাকে দেখিয়ে বলল, সঙ্গিনীর পরিচয় বলবে না?
আমার চাচাত বোন শামিমা। জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছিল। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে জেনে আলাপ করতে এসেছে।
আবু খাঁ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, তা হলে ঘরে চল, তোমার দাদির সঙ্গেও আলাপ করবে।
কেসিমন খানম কামরুলের সঙ্গে শামিমাকে দেখে খুশী হলেন। নাস্তা পানি করিয়ে বিদায় দেয়ার সময় শামিমাকে কামরুলের সঙ্গে আবার আসতে বললেন।
গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাধারণত খালি পায়ে চলাফেরা করে। ওরাও খালি পায়ে এসেছিল, ফেরার পথে কামরুলের পায়ে কাঁটা ফুটতে উহ করে বসে পড়ল।
কি হল বলে শামিমাও তার পাশে বসে পড়ল।
কামরুল বলল, পায়ে বোধ হয় কাঁটা ফুটেছে। তারপর আঙ্গুলে থুথু নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে বলল, কাঁটাটা বেশ গভীরে চলে গেছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, বের না করলে হাঁটতে পারব না। তুই এক কাজ কর, ঐ খেজুর গাছ থেকে একটা সালকাঁটা তুলে নিয়ে আয়। ওটা দিয়ে বের করব।
শামিমা সালকাঁটা নিয়ে এসে বলল, আমি কাঁটা বের করে দিই?
কামরুল বলল, আমাকে দে, তুই পারবি না।
তুমি দেখ না আমি পারি কি না। তারপর অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও বিফল হল। ততক্ষণে কামরুলের পা থেকে রক্ত বেরিয়ে পড়ল। শামিমা ওড়না ছিঁড়ে রক্ত মুছে আবার চেষ্টা করল।
কামরুল খুব ব্যথা পেলেও অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে লাগল।
তার অবস্থা দেখে শামিমার চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁটাটা বের করে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে তার হাতে দিয়ে বলল, দেখ, কত বড় কাটা? তারপর রাস্তার ঢাল থেকে কয়েকটা মালেরিয়া গাছের পাতা ছিঁড়ে এনে দু’হাতের তালুতে রগঢ়ে রক্ত পরিষ্কার করে সেখানে চেপে ধরে বলল, এক্ষুনি রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে আর ব্যথাও করবে না। তুমি এটা একটু চেপে রাখ, আমি বেঁধে দিই। তারপর ওড়না থেকে খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে বেঁধে দিল।
কামরুল টগবগে তরুণ। এতক্ষণ শামিমার সবকিছু লক্ষ্য করছিল। তার চোখের পানিও দেখেছে। বলল, কাঁটা বের করার সময় কাঁদছিলি কেন?
শামিমা লজ্জামিশ্রিত মৃদু হেসে বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে।
আমার কষ্ট হলে আমি কাঁদব, তুই কাঁদবি কেন?
আমি তোমাকে ভালবাসি বলে। লজ্জা পেয়ে শামিমা জিব কেটে মুখ নিচু করে নিল।
কথাটা শুনে তরুণ কামরুলের মনে অজানা এক শিহরণ বইতে শুরু করল। অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কবে থেকে ভালোবাসিস?
হঠাৎ কথাটা বলে ফেলে শামিমা ভয় পেয়েছিল। মনে করেছিল, ভালবাসার কথা শুনে কামরুল ভাই তাকে হয়তো বকাবকি করবে। তা না করে কবে থেকে ভালবাসে জিজ্ঞেস করতে ভয় কিছুটা কমলেও একেবারে গেল না। তাই মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ছোটবেলা থেকে।
কামরুল মৃদু হেসে বলল, ছোটবেলায় ভালবাসা কি জিনিস কেউ জানে বুঝি?
ছোটবেলায় ভালবাসা কি জিনিস না জানলেও তোমাকে আমার খুব ভালো লাগত। যখন হাই স্কুলে সিক্সে ভর্তি হলাম তখন থেকে ভালবাসি। কথাটা শেষ করে আবার মুখ নিচু করে নিল।
ছোটবেলা থেকে শামিমাকে কামরুলেরও ভালো লাগত। নাইনে ওঠার পর ভালবেসে ফেলে। কিন্তু চাচাঁদের সঙ্গে তাদের মনোমালিন্যের কথা ভেবে তাকে জানায় নি। এখন শামিমার কথা শুনে সে কথা ভুলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিবুক ধরে তুলে বলল, আমিও তোকে ভালবাসি কি না জানতে ইচ্ছা করছে না?
ততক্ষণে শামিমার ভয় সম্পূর্ণ কেটে গেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হা করছে।
তা হলে শোন, আমিও তোকে ছোটবেলা থেকে ভালবাসি। কদিন ধরে চিন্তা করছিলাম, কথাটা তোকে বলব। কিন্তু তার আগেই তুই বলে ফেললি। এবার ঘরে যাই চল। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করে বলল, একথা এখন কাউকেই বলবি না। এমন কি তোর সই কুলসুমকেও না।
আচ্ছা কামরুল ভাই, বাবা ও বড় চাচাতো আপন ভাই, তবু তোমাদের সঙ্গে আমাদের মিলমিশ নেই কেন? মা প্রায়ই বড় চাচা ও বড় চাচিকে যা-তা করে বলে কেন?
নিশ্চয় কারণ আছে, শুধু শুধু তো কেউ কাউকে যা তা করে বলতে পারে না।
তুমি কারণটা জান?
জানি।
কারণটা বলবে? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। মাকে অনেকবার জিজ্ঞাস। করেছি, বলে নি।
বললে বিশ্বাস করবি?
কেন করব না? তুমি বল।
কামরুল সবকিছু বলে জিজ্ঞেস করল, কিরে, বিশ্বাস হয়?
শামিমা বলল, কেন হবে না? তবে অন্য কেউ বললে বিশ্বাস করতাম না।
আমিও তো মিথ্যে করে বলতে পারি?
তা পার, তবে আমার কাছে তুমি কখনও মিথ্যে বলতে পার না।
আমাকে তুই এত বিশ্বাস করিস?
হ্যাঁ করি।
কেন বলতো?
তোমাকে যে ভালোবাসি। যে যাকে ভালোবাসে, তাকে বিশ্বাসও করে। নচেৎ তাদের ভালবাসা খাঁটি নয়।
বাহ! তুই তো দেখছি খুব পেকে গেছিস। আমি জানতাম তুই এখনও কাঁচা আছিস।
কাঁচা পাকা বুঝি না, আমি আমার মনের কথা বলেছি।
হ্যাঁ, তোর কথা ঠিক, “যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালবাসা ও নেই।”
তিন
শামিমা ও কামরুল যত বড় হতে লাগল তাদের ভালোবাসাও তত গম্ভীর হতে লাগল। তারা কথাটা কাউকে না বললে ও তাদের মেলামেশার কারণে গ্রামের সবাই জেনে গেল। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে মাথা ঘামাল না। এমন কি শামিমার মা রিজিয়া খাতুন ও বাবা আনোয়ারুল হক এবং আমিরুলদের বাড়ির সবাই সবকিছু দেখে শুনেও কিছু বলে না। তাই গ্রামের লোকজনও আত্মীয়স্বজন ভাবলেন, ওদের বিয়ের মাধ্যমে হয়তো ভাই-ভাইয়ের এতদিনের গোলমাল মিটে যাবে।
এবছর দু’জনেই ভালো রেজাল্ট করে শামিমা এইটে ও কামরুল টেনে উঠলে।
কুলসুম পাশ করে এইটে উঠলেও তার রেজাল্ট ওদের মতো হয় নি। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কুলসুম শামিমাকে বলল, সই, তুই আমাকে খুব ভালবাসিস তাই না?
শামিমা বলল, সে কথা তুই জানিস না?
জানি, তবু তোর মুখ থেকে শুনতে চাই।
হ্যাঁ, ভীষণ ভালবাসি, এবার হল তো?
না হয়নি, কারণ কথাটা তুই ঠিক বলিস নি।
শামিমা অবাক হয়ে বলল, আমার কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
না।
কেন?
কারণ যে যাকে ভালবাসে তাকে বিশ্বাস ও করে এবং মনের কথা গোপনও করে না।
কুলসুমের চেয়ে শামিমা বেশি চালাক। তার কথা শুনে বুঝতে পারল, কেন কুলসুম কথাটা বলেছে। বলল, হ্যাঁ, তুই ঠিক কথা বলেছিস। একটা কথা তোর কাছে গোপন করেছি। তুই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস, তোর ছোট চাচা ও আমি একে অপরকে ভালবাসি। কথাটা তোকে অনেক আগেই বলতাম, কিন্তু তোর ছোট চাচা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল, তাই বলিনি। তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, এতে যদি আমার দোষ হয়ে থাকে মাফ করে দে।
কুলসুম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ছোট চাচার নিষেধের কথা বললি বলে মাফ করে দিলাম, নচেৎ করতাম না। তারপর হেসে উঠে বলল, এবার থেকে তোকে সই চাচি বলে ডাকব।
তা হলে যতবার বলবি ততবার এরকম বখশীস পাবি বলে শামিমা তার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল।
কুলসুম উহ করে উঠে বলল, লাগে নি বুঝি?
লাগবার জন্যেই তো এই বখশীস, নচেৎ মনে থাকবে না।
আর ছোট চাচা যখন তোকে বিয়ে করে ঘরে আনবে তখন?
তখন ছোট চাচি বলবি।
এখন সবার সামনে সই বললে ও আড়ালে আবডালে কিন্তু সই চাচি বলব।
তা বলতে পারিস।
.
আনোয়ারুল হকের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে রহিমার স্বামী মনিরুল প্রায় পাঁচ বছর সৌদি আরবে ছিল। এবছর একেবারে চলে এসেছে। তার বাড়ি কুইজুরীর পাশের গ্রামে। সে যখন সৌদী আরবে যায় তখন শামিমা বেশ ছোট ছিল। দেশে ফিরে তরুণী শামিমাকে দেখে ছোট ভাইয়ের বৌ করার মনস্থ করে একদিন কথাটা স্ত্রীকে জানাল।
আজিজুল রহিমার দেবর। আর শামিমা রহিমার চাচাত বোন। সেই সুবাদে আজিজুল ও শামিমা বিয়াই বিয়ান সম্পর্ক। রহিমা শামিমাকে খুব স্নেহ করে। তাই রহিমার বিয়ের পর শামিমা প্রায়ই তার শ্বশুর বাড়িতে যেত। সে সময় আজিজুলের সঙ্গে গল্প করত। মাঝে মাঝে লুডু অথবা ক্যারাম খেলত।
শামিমা যখন সেভেনে আজিজুল তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে। সেই সময় আজিজুল শামিমাকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু সে কথা তাকে বলে নি।
শামিমা ক্লাস এইটে ওঠার পর যখন বেশ কিছুদিন তাদের বাড়িতে এল না তখন একদিন আজিজুল ভাবিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি শামিমাকে কিছু বলেছ?
রহিমা অবাক হয়ে বলল, তাকে আবার কি বলব?
না, মানে অনেকদিন আসে নি-তাই জিজ্ঞেস করছি।
রহিমা দেবরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বলল, সে আসে নি বলে তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে?
আমার মন খারাপ হবে কেন?
সে কথা আমি বলব কি করে? তোমার মুখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। কেন আসে নি কইজুরী গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে পার।
আমার খোঁজ নেয়ার দরকার নেই বলে আজিজুল সেখান থেকে চলে গেল।
তার দিকে তাকিয়ে রহিমা চিন্তা করল, সে শামিমাকে বোধ হয় ভালবাসে। আরো চিন্তা করল, শামিমাকে দেবরের বৌ করে আনলে ভালই হবে।
স্বামী দেশে আসার পর তাকে কথাটা বলবে ভেবে রেখেছিল। তার আগেই স্বামীকে বলতে দেখে খুব খুশী হল। বলল, আমারও খুব ইচ্ছা শামিমাকে এ বাড়ির ছোট বৌ করে আনার। চাচাতো বোন বলে বলছি না, সত্যি, শামিমার মতো মেয়ে হয় না। কিন্তু চাচা চাচি কি এখন শামিমার বিয়ে দেবে? ওতো এখনও বিয়ের উপযুক্ত হয় নি।
আমিও এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাচ্ছি না। এখন কাবিন করে রাখতে চাই। আজিজুলের ডিগ্রী পাশ করতে দু’বছর লাগবে। ততদিন শামিমাও এস. এস. সি পাশ করবে। তারপর অনুষ্ঠান করে বৌ ঘরে তুলবে।
তাই যদি ভেবে থাক, তা হলে আমি তোমার সাথে একমত। চাচা চাচিকে প্রস্তাব দিতে পার।
কয়েকদিন পর মনিরুল স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে একসময় চাচা শ্বশুর ও শাশুড়িকে কথাটা জানাল।
আনোয়ারুল হক মনিরুলদের সবকিছু ভালো জেনেও বললেন, শামিমা পড়াশোনায় খুব ভালো। আমার ইচ্ছা ওকে বি.এ পর্যন্ত পড়াব। তা ছাড়া বিয়ে বল আর কাবিন বল, কোনটাতেই এখন সে কিছুতেই রাজি হবে না। তোমরা আমাদের মেয়ে জামাই, তোমাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। তাই এতটুকু বলতে পারি, এস. এস. সি. পরীক্ষার পর কাবিন হবে এবং বি.এ. পাশ করার পর তোমরা বৌ তুলবে। ততদিন আজিজুল পড়াশোনা শেষ করে রুজী রোজগার করতে শিখুক।
মনিরুল বলল, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আপনার কথা মেনে নিলাম। তবে কথা পাকা করার জন্য আমরা শামিমাকে আংটি পরিয়ে এজ্ঞেজমেন্ট করে রাখতে চাই।
রিজিয়া খাতুন ভাসুরঝি রহিমার মুখে তাদের সবকিছু আগেই শুনেছেন। তাই জামাই প্রস্তাব দিতে খুব খুশী হয়েছিলেন। তারপর স্বামীর কথা শুনে অসন্তুষ্ট হয়ে এতক্ষণ রেগে ছিলেন। আংটি পরিয়ে এজ্ঞেজমেন্টের কথা শুনে স্বামী কিছু বলার আগে বললেন, হ্যাঁ, তা করা যায়। তারপর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কি বল?
না, তা করা যায় না। এজ্ঞেজমেন্ট, কাবিন বা বিয়ে কোনোটাই এখন করা যাবে না। করলে ছেলেমেয়ে দু’জনেরই পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আর শামিমাকে এসব কথা এখন বলাও ঠিক হবে না। তারপর ভাইঝি ও জামাইকে উদ্দেশ্য করে। বললেন, তোমরা কিছু মনে করো না। শামিমা এস. এস. সি পরীক্ষার পর কি করব না করব তোমাদেরকে জানাব। তারপর স্ত্রীকে বললেন, মেয়ে জামাইকে নাস্তা পানি দাও। আমি একটু ওপাড়ায় যাব বলে আনোয়ারুল হক বেরিয়ে গেলেন।
নাস্তা খেয়ে ফেরার সময় রহিমা চাচিকে বলল, শামিমা অনেকদিন আমার কাছে যায় নি, ওকে যেতে বলবেন।
রিজিয়া খাতুন বললেন, আজ কালের মধ্যে যেতে বলব।
.
শামিমা ও কামরুল প্রতি বৃহস্পতিবারে জমিদার বাড়িতে গিয়ে আবু খাঁ ও তার বৌ কেসিমন খানমের কাছে কিছুক্ষণ গল্প-সল্প করে বাড়ি ফেরে।
জমিদার বাড়ি থেকে লোকবসতি বেশ একটু দূরে। গ্রামের লোকজন যেমন আবু খাঁর সঙ্গে মেলামেশা করে না, তেমনি আবু খাঁও তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন না। শুধু শুক্রবার জুম্মার নামায পড়তে গ্রামের মসজিদে গিয়ে কিছু গণ্যমান্য লোকজনের সঙ্গে ভালো মন্দ আলাপ করেন। শামিমা ও কামরুলকে প্রতি সপ্তাহে আসতে দেখে তাদের প্রতি একটা মায়া এসে গেছে। তাই বৃহস্পতিবার ওনারা তাদের অপেক্ষায় থাকেন। আসার পর কেসিমন খানম তাদেরকে নাস্তা খেতে দেন। কোনো কোনো দিন ভাতও খাওয়ান। যেদিন ভাত খাওয়ান সেদিন নিজেরা না খেয়ে থাকেন। ওরা আসার পর একসঙ্গে খান।
আজ বৃহস্পতিবার। সকাল থেকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকলেও বৃষ্টি হয়। নি। তাই আবহাওয়া খুব গুমোেট। দুটোর সময় স্কুল ছুটি হওয়ার পর কামরুল শামিমাকে বলল, চলো জমিদার বাড়ি যাই। শামিমা এইটে ওটার পর বেশ সেয়ানা হয়েছে। তাই কামরুল তাকে তুমি করে বলে।
শামিমা বলল, দেখছ না মেঘ করেছে? পথে বৃষ্টি হলে ভিজে যাব। আজ না যাওয়াই ভালো।
সকাল থেকে মেঘ করে আছে, কই, বৃষ্টি হয়েছে? আর যেতে যেতে বৃষ্টি হলে হবে। একদিন ভিজলে কিছু হবে না।
শামিমা চলতে শুরু করে বলল, বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার যদি অসুখ হয়, তা হলে তো পড়ার ক্ষতি হবে। সে কথা ভেবে বলেছি।
আর তোমারও যদি অসুখ হয়, তা হলে তোমার পড়ার ক্ষতি হবে না?
আমার ক্ষতি হলেও তেমন কিছু হবে না, কিন্তু তোমার হলে ফার্স্ট হতে পারবে না।
কামরুল হেসে উঠে বলল, আমার জন্য তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে, অসুখ করলেও ইনশা আল্লাহ ফাষ্ট হবই।
জমিদার বাড়ির কাছাকাছি এসেছে, এমন সময় বেশ জোরে বৃষ্টি নামল। ওরা ছুটে এসেও ভিজে গেল।
আজ মুরগির মাংস ও পোলাও রান্না হয়েছে। তাই আবু খাঁ ও কেসিমন খানম তাদের জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বৃষ্টি নামতে কেসিমন খানম বললেন, আজ হয়তো ওরা আসতে পারবে না, এসো আমরা খেয়ে নিই।
আবু খাঁ ঘড়ি দেখে বললেন, বৃষ্টি এখন নামল, স্কুল ছুটি হয়েছে এক ঘন্টা আগে। এতক্ষণ হয়তো কাছাকাছি এসে গেছে। এমন সময় তাদেরকে আসতে দেখে আবার বললেন, ঐতো এসে গেছে।
কামরুল ও শামিমা সালাম দিয়ে বারান্দায় উঠে এল।
আবু খাঁ সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাদের কথাই হচ্ছিল। বালতিতে পানি আছে মগ ডুবিয়ে পা ধুয়ে নাও। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তোমার একটা শাড়ি ও আমার একটা লুংগী গামছা এনে দাও। ওদের জামাকাপড় ভিজে গেছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে গল্প করার সময় আবু খাঁ ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা যে প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে আস, তোমাদের মা বাবা জানে?
কামরুল বলল, না, জানে না।
দেরিতে বাড়ি ফেরো, তারা কিছু জিজ্ঞেস করে না।
করে। আমরা কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে কাটিয়ে দিই।
তোমরা তা হলে মা বাবাকে মিথ্যে কথা বল?
কামরুল কিছু না বলে চুপ করে রইল।
শামিমা বলল, সত্যি কথা বললে তো আমাদেরকে এখানে আসতে দেবে না।
তাই বলে তোমরা মিথ্যা বলবে? এটা ঠিক না। জান না, মিথ্যা বলা হারাম। তা ছাড়া ছাত্র অবস্থায় মিথ্যা বলা অভ্যাস থাকলে বড় বেলায় আরো বেশি বলার অভ্যাস হয়ে যাবে। ন্যায় অন্যায় যা কিছু কর না কেন, সব সময় সত্য বলবে। তোমাদেরকে স্টাডি করে দেখেছি তোমরা একে অপরকে ভালোবাস। কিন্তু এর পরিণতির কথা ভেবেছ বলে মনে হয় না। তোমাদের মা বাবা যদি ব্যাপারটা জেনে যায়, তা হলে কি হবে সে কথাও মনে হয় চিন্তা কর নি। তোমরা এখন বড় হয়েছ, এভাবে মেলামেশা করাও তোমাদের ঠিক হচ্ছে না। তোমাদেরকে আমরা খুব স্নেহ করি। তোমাদের কারণে তোমাদের বাবা মায়ের মনোমালিন্য হোক তা আমি চাই না। আগে ছোট ছিলে, তখন দোষের কিছু না হলেও এখন ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন অন্যায় তেমনি সমাজের কাছেও অন্যায়। তবে তোমরা যদি ভবিষ্যতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক এবং তোমাদের মা বাবার কোনো আপত্তি না থাকে, তা হলে অবশ্য অন্য কথা। আমার কথায় তোমরা মনে কষ্ট নিও না। তোমাদের ভালোর জন্য কথাগুলো বললাম।
“মনিরুল বলল, আপনি তো খুব ভালো কথা বলেছেন মনে কষ্ট হবে কেন? অবশ্য আপনার প্রথম কথাটা ঠিক।” আমরা ছোটবেলা থেকে একে অপরকে ভালোবাসি এবং ভবিষ্যতে বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মা বাবাদের আপত্তি থাকবে কিনা জানি না। তবে তাদের আপত্তি থাকলেও আমরা বিয়ে করবই।
আবু খাঁ হেসে উঠে বললেন তোমরা দুজনেই ছেলে মানুষ। তোমাদের জ্ঞান বুদ্ধিও কম। এখনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। বিয়ের উপযুক্ত হওয়ার পর এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
আপনি মুরুব্বী মানুষ, আপনার বুদ্ধি অনেক। তাই হয়তো ঠিক কথা বলেছেন। কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে তো ভালোবাসা হয় না, ভালোবাসা মনের ব্যাপার। মনের মিল হলে ভালোবাসা জন্মায়। সেখানে বয়স বা জ্ঞান বুদ্ধির কথা অবান্তর।
আবু খাঁ খুব অবাক হয়ে বললেন, আরে ভাই তুমি তো দেখছি খুব জ্ঞানের কথা বলছ? ভালো খুব ভালো। তবে এটা বোধ হয় জান না। ভালোবাসার মঞ্জিলের পথ খুব দুর্গম। সবার ভাগ্যে সেই মঞ্জিলে পৌঁছান থাকে না। তাই অনেকে বাধা পেয়ে পথ ভ্রষ্ট হয়, অনেকে প্রতিহিংসার বশবর্তি হয়ে প্রেমিকার মুখে এসিড মারে, আবার অনেকে ধর্ষণ করে প্রেমিকার জীবন ধংস করে দেয়। আবার অনেকে আত্মহত্যা করে। আসলে কি জান ভাই, যারা এরকম দুষ্কর্ম করে, তারা প্রকৃত প্রেমিক নয়। যারা খাঁটি প্রেমিক তারা কোনোদিন প্রেমিকার এতটুকু ক্ষতি করা তো দূরের কথা নিজের জীবন দিয়ে হলেও তাকে সুখী করতে চায়। সমাজে এরকম ঘটছে দেখে তোমাদেরকে সাবধান করার জন্য কথাগুলো বললাম। আরো বড় হও, আরো জ্ঞান বুদ্ধি হোক তখন আমার কথাগুলোর সততা বুঝতে পারবে।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। কামরুল বলল, দাদা ভাই, আমরা এবার আসি। বৃষ্টির জন্য অনেক দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে চিন্তা করছে।
আবু খাঁ বললেন, তা তো করবেই; কিন্তু তোমাদের জামা কাপড়তো এখনও শুকায়নি। ভিজে জামা-কাপড় পরে এতটা পথ গেলে অসুখ করবে। এক কাজ কর, যা পরে আছ সেটা পরে যাও আর ভিজে কাপড়গুলো ব্যাগে করে নিয়ে যাও। পরে একদিন আমাদের কাপড়গুলো দিয়ে যেও।
কামরুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই কেসিমন খানম বললেন, উনি ঠিক কথা বলেছেন। তোমরা একটু অপেক্ষা কর। তারপর একটা পলিথিন ব্যাগে তাদের ভিজে কাপড় নিয়ে এসে কামরুলের হাতে দিয়ে হাসি মুখে বললেন, আজও মা বাবাকে নিশ্চয় মিথ্যে কোনো অজুহাত দেখাবে?
কামরুল বলল, না দাদি, দাদা ভাই যে কথা বললেন, তারপর আর কখনও মিথ্যা বলব না। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে শামিমাকে বলল, চলো।
ফেরার পথে শামিমা বলল, তুমি না হয় বাড়িতে সত্যি কথা বলবে, কিন্তু আমি সত্যি কথা বললে মা খুব বকাবকি করবে।
কামরুল বলল, তবু সত্যি কথাই বলবে। মায়ের বকাবকি চুপ করে হজম করবে। দাদাভাই বললেন শুনলে না, প্রেমের পথে অনেক বাধা?
শামিমা হেসে ফেলে বলল, আজ থেকেই তা হলে বাধা ঠেলে প্রেমের পথে চলার চেষ্টা করতে হবে তাই না?
কামরুলও হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ, তাই।
গ্রামে ঢুকে কামরুল বলল, এই কাপড় পরে ঘরে যাওয়া ঠিক হবে না। কাদের চাচার বাগানে ঢুকে তুমি জামা কাপড় পাল্টে নাও, আমিও তাই করব।
শামিমা বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
ওরা যখন বাড়ি ফিরল তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে। কামরুলকে দেখে আনোয়ারা বেগম রাগের সঙ্গে বললেন, স্কুল ছুটি হয়েছে দু’টোয়, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
কামরুল বলল, জমিদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, বৃষ্টির জন্য ফিরতে দেরি হয়ে গেল। তারপর মাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কাপড় পাল্টে নামায পড়তে মসজিদে চলে গেল।
শামিমা বৃহস্পতিবার দেরিতে ফেরে রিজিয়া খাতুন জানেন। কিন্তু আজকের মতো এত দেরি কোনোদিন করে নি। ভাবলেন, বৃষ্টির জন্য হয়তো দেরি হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও যখন ফিরল না তখন চিন্তিত হলেন। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে স্বামী বা বড় ছেলে ঘরে নেই যে, তাদেরকে কথাটা জানিয়ে খোঁজার জন্য পাঠাবেন। এমন সময় শামিমাকে ফিরতে দেখে ঝেঝিয়ে উঠলেন, তোর কি আক্কেল বলতে কিছু নেই? এতক্ষণ কোথায় ছিলি? এদিকে আমি চিন্তায় মরি।
শামিমা মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, আমার জন্য অত চিন্তার কি আছে? আমি কি ছোট, যে হারিয়ে যাব? এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য ফিরতে দেরি হয়ে গেল।
আজ রহিমা ও তার স্বামী মেয়ের বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছিল বলে সকাল থেকে রিজিয়া খাতুনের মন ভালো থাকলেও মেয়ের ফিরতে দেরি দেখে রেগে ছিলেন। এখন তার কথা শুনে ভাবলেন, সেয়ানা মেয়েকে রাগারাগি করা ঠিক হবে না। রাগ সামলে নিয়ে নরম মেজাজে বললেন, তুই তো বেশ কথা বলতে শিখেছিস? যা, ভিতরে গিয়ে ভিজে কাপড় পাল্টে ফেল ।
শামিমা ভেবেছিল, আজ মা তাকে খুব রাগারাগি করবে। তা করল না দেখে। স্বস্তীর নিঃশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল।
রাতে খেতে দিয়ে রিজিয়া খাতুন মেয়েকে বললেন, তোর রহিমা বুবু। জামাইকে নিয়ে সকালের দিকে বেড়াতে এসেছিল। বলল, তুই নাকি অনেকদিন তাদের ঘরে যাস নি। তাকে যেতে বলেছে।
রহিমার শ্বশুরবাড়ি স্কুল থেকে আধ ঘন্টার পথ। শামিমা আগে প্রায় প্রতি সপ্তায় একদিন যেত। ক্লাস এইটে ওঠার পর কামরুলের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরতে যায়। তা ছাড়া কামরুল তার সারামন জুড়ে থাকে সব সময়। তাই রহিমা বুবুর কথা ভুলেই গেছে। এখন মায়ের মুখে তার কথা শুনে বলল, ঠিক আছে, কাল স্কুল বন্ধ, কালকেই যাব।
চার
আজিজুল ভাবির কাছে জেনেছে, আজ ভাইয়াও সে বিয়ের প্রস্তাব দিতে শামিমাদের ঘরে যাবে। তাই দুপুরে খাওয়ার পর ভাইয়া যখন ঘুমাচ্ছিল তখন এক ফকে ভাবিকে বলল, যে কাজে গিয়েছিলে তার রেজাল্ট বল।
রহিমা বলল, রেজাল্ট ভালো ও মন্দ দুটোই।
এটা আবার কি রকম কথা স্পষ্ট করে বলবে তো?
“ভালো বললাম এজন্য, তারা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। মন্দ বললাম এজন্য, প্রস্তাব গ্রহণ করলেও এখন ওনারা কাবিন বা বিয়ে কোনোটাতেই রাজি নন। শামিমা এস. সি. পরীক্ষার পর যা করার করবেন। তারপর যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে। বলল।”
ভাবির কথা শুনে আজিজুলের মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, অন্তত কাবিন করা থাকলে শামিমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও মেলামেশা করা যেত। কথাটা ভাবিকে বলেও ছিল।
দেবরের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রহিমা বলল, মন খারাপ করছ কেন? কথাবার্তা এক রকম পাকা করেই এসেছি। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে যাবে। তা ছাড়া শামিমাকে আসার জন্য চাচি আম্মাকে বলে এসেছি। আসার পর সে যাতে বার বার আসে সে ব্যবস্থা তুমি করবে। একজন কলেজ পড়ুয়া যুবক হয়ে একটা তরুণীর মন জয় করতে পারবে না। এ কেমন কথা?
তোমার বোন যদি কাউকে মন না দিয়ে থাকে, তা হলে তার মন জয় করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। যদি দিয়ে থাকে, তা হলে আমিও যেমন কিছু করতে পারব না, তেমনি তোমাদের চেষ্টাও ব্যর্থ হবে।
কি বাজে বকছ? ও এখন মন দেয়া নেয়ার কি বোঝে যে, কাউকে মন দেবে? সেরকম জ্ঞান এখন ওর হয়ই নি।
তোমার কথা কতটা সত্য জানি না, তবে ওকে মাঝে মাঝে ওর চাচাতো ভাই কামরুলের সঙ্গে নদীর পাড়ে বেড়াতে দেখেছি।
চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে হয়তো নদী দেখতে গিয়েছিল, এতে দোষের কি দেখলে?
দু’একদিন হলে কোনো কথা ছিল না, প্রায়ই দেখি। তা ছাড়া বেশ কয়েকবার জমিদার বাড়ি যেতেও দেখেছি।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কি? একদিন নানাবাড়ি থেকে ফেরার পথে ওদের সঙ্গে দেখা। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে বলল, জমিদার বাড়ি দেখতে। তারপর আরো কয়েকদিন যেতে দেখেছি।
কথাটা আমাকে আগেই জানান উচিত ছিল। তা হলে আজ চাচি আম্মার কানে তুলতাম। তুমিতো জান না, পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে ওদের দুই ফ্যামিলীর মধ্যে অনেকদিনের মনোমালিন্য। শামিমা কামরুলের সঙ্গে এখানে সেখানে বেড়াতে যায় শুনলে চাচি আম্মা শামিমাকে সাবধান করে দেবে। কথাটা জানিয়ে তুমি খুব ভালো করেছ। দু’একদিনের মধ্যে শামিমা নিশ্চয় আসবে তুমি ওর মনের খবর জানার চেষ্টা করবে। আমি কয়েকদিন পরে গিয়ে চাচি আম্মাকে কথাটা জানিয়ে যা আলাপ করার করব।
পরের দিন বেলা দশটার সময় শামিমা রহিমাদের বাড়িতে এল।
আজিজুল নাস্তা খেয়ে তার রুমে পড়ছিল। জানালা দিয়ে তাকে আসতে দেখে মনের মধ্যে পুলক অনুভব করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
বাড়িতে ঢুকে রহিমাকে বারান্দায় আনাজ কুটতে দেখে কাছে এসে শামিমা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ বুবু?
আগে কোনোদিন শামিমা সালাম দেয়নি। আজ দিতে দেখে বেশ অবাক হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এতদিন পরে বুবুর খোঁজ নিতে এসেছিস? তারপর কাজের বুয়াকে ডেকে বলল, আনাজগুলো কুটে ফেল। দেখছিস তো কে শামিমা বলল, মায়ের কাছে শুনলাম তুমি ও দুলাভাই কাল গিয়েছিলে। স্কুলে গেলে তোমাদের সঙ্গে দেখা হত।
রহিমা তাকে ঘরে নিয়ে এসে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, আমরা তো মায়েদের ঘরে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে বৃষ্টি থামার পর। ফিরেছি। মনে করেছিলাম, স্কুল থেকে ফিরে খবর পেয়ে তুই আসবি। আসলে আগের মতো তুই আর আমাকে ভালবাসিস না।
একথা তুমি বলতে পারলে বুবু? কয়েকদিন আসব ভেবেছি, কিন্তু পড়াশোনা ও কাজের চাপে আসতে পারি নি। দুলাভাই কোথায়?
জমিতে কামলারা কাজ করছে, তাদের কাছে গেছে। কাল আজিজুল তোর কথা বলছিল।
শামিমা ভাবল, কাল কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে জমিদার বাড়ি যেতে দেখে হয়তো বলেছে। বলল, বিয়াই আমার কথা কি এমন বলেছে?
তুই অনেকদিন আসিস নি, তাই আমি তোকে আসতে নিষেধ করেছি কিনা জিজ্ঞেস করল।
তাই নাকি? বিয়াই ঘরে নেই?
আছে, তার রুমে পড়ছে। যা দেখা করে আয়, আমি নাস্তা বানাই।
নাস্তা খেয়ে এসেছি বানাতে হবে না। একেবারে দুপুরে ভাত খাব বলে শামিমা আজিজুলের রুমে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, বিয়াই কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে আজিজুল বলল, ভালো। তারপর বসতে বলে বলল, কেমন আছ?
শামিমা সামনের চেয়ারে বসে বলল, ভালো না হলে এলাম কি করে?
মনে হয় এতদিন খারাপ ছিলে, তাই আস নি?
তা ঠিক নয়, না আসার অন্য কারণ ছিল।
কারণটা জানতে পারি?
সব কারণ সব সমায় বলা যায় না। তা পড়াশোনা কেমন চলছে?
ভালো। আশাকরি, তোমারও ভালো চলছে?
হ্যাঁ, ভালো চলছে। এসে হয়তো পড়াশোনার ডিস্টার্ব করলাম, এবার আসি পরে আবার দেখা হবে বলে শামিমা দাঁড়িয়ে পড়ল।
আরে দাঁড়ালে কেন? পড়া ছেড়ে বাইরে যাব ভাবছিলাম, ডিস্টার্ব হয়নি। বস, অনেক দিন পর এলে ক্যারাম খেলব। তুমি আস না, তাই ক্যারাম খেলা হয় না।
কেন? বুবুর সঙ্গে খেলতে পারতেন?
ভাবি সাংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া সে কাঁচা প্লেয়ার, কাঁচা প্লেয়ারের সঙ্গে খেলে আনন্দ পাওয়া যায় না।
ঠিক আছে, আপনি বোর্ড রেডি করুণ, আমি বুবুকে বলে আসি।
খেলতে বসে শামিমা লক্ষ্য করল, আজিজুল খেলায় বেশ অমনযোগী। ফলে প্রথম গেমটা খুব সহজেই শামিমা জিতে গেল। পরের গেমের জন্য গুটি সাজাবার সময় বলল, কি ব্যাপার বিয়াই, আজ এত সহজেই হেরে গেলেন যে? মনে হচ্ছে খেলায় মন নেই, অন্য কিছু ভাবছেন? অথচ আপনিই খেলার কথা বললেন।
খেলায় মন আছে। তবে একটা কথা বার বার মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে অন্য মনমনস্কতা এনে দিচ্ছে।
ততক্ষণে গুটি সাজান হয়ে গেছে। স্ট্রাইকটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে শামিমা বলল, আগে মনের উঁকি দেয়া কথাটা বলে ফেলুন। তারপর খেলা শুরু করবেন।
কথাটা আজই বলা ঠিক হবে কি না তার মুখের দিকে তাকিয়ে আজিজুল চিন্তা করতে লাগল।
কি হল? কথাটা বলছেন না, খেলাও শুরু করছেন না, চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন?
ভাবছি না, দেখছি।
কি দেখছেন?
তোমাকে।
আমাকে আবার নতুন করে দেখার কি হল?
আছে বলেই তো দেখছি।
হেঁয়ালী রেখে স্পষ্ট করে বলুন।
শুনে যদি মাইন্ড কর?।
মাইন্ড করার মতো কথা বললে সবাই-ই মাইন্ড করে। তবে আমার ধারণা, আপনি মাইন্ড করার মতো কথা বলতে পারেন না।
‘তা অবশ্য ঠিক। তবে কি জান, মানুষের ধারণা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল হয়।
শামিমা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে বলুন, মাইন্ড করব না।
আজিজুল খুব চালাক ছেলে। শামিমার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েও “আমি তোমাকে অনেকদিন থেকে ভালোবাসি” না বলে বলল, অনেক আগে থেকে তোমাকে আমার খুব পছন্দ। পড়াশোনা শেষ করে উপার্জনক্ষম হওয়ার পর তোমাকে বিয়ে করব ভেবেছি। কথাটা এখন বলতাম না। হঠাৎ মনে হল, উপার্জনক্ষম হওয়ার আগেই যদি কাউকে মন দিয়ে ফেল অথবা তোমার মা বাবা অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। তোমার মতামত পেলে ভাইয়া ভাবি তালই ও মাওই সাহেবের সঙ্গে পাকা কথা বলে রাখবে।
তার কথা শুনে শামিমা খুব রেগে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ করল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিন্তা করল, এইজন্য বোধ হয় রহিমা বুবু দুলাভাইকে নিয়ে কাল আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আজিজুল বলল, কি বিয়ান, আমার কথায় মাইন্ড করলেন না কি?
শামিমা আজিজুলের চেয়ে চালাক। মৃদু হেসে বলল, পছন্দ হয়েছে তাই বলেছেন। এতে মাইন্ড করার কি আছে? তবে বিয়ে করার কথা যে বললেন, সে ব্যাপারে বলব তৃকদিরে থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। এবার নিন শুরু করুণ।
আজিজুল হীট করে রেডসহ ছয়টা গুটি ফেলার পর সাতটার বেলায় ফসকে গেল,
আজিজুলের কথা শোনার পর থেকে শামিমার মন খারাপ। তাই খেলাতে মন বসাতে পারল না, সহজেই হেরে গেল।
আজিজুল হাসতে হাসতে বলল, এবার আমি যদি বলি তুমি ইচ্ছা করে এই গেমটা হেরে গেল?
তা ঠিক নয়, আসলে খেলতে আর ভালো লাগছে না, তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বলল, যাই, বুবুর সঙ্গে দেখা করে ঘরে চলে যাব।
আজিজুল বুঝতে পারল। তার পছন্দ করার ও বিয়ের কথা শুনে মন খারাপ হয়েছে। নচেৎ যে শামিমা ক্যারাম খেলতে বসলে বারবার হেরেও খেলা ছেড়ে উঠে না, সে কিনা দুটো গেম খেলে আর খেলতে চাচ্ছে না? বলল সে কি? এক্ষুনি চলে যাবে কেন? তা ছাড়া ভাবি তোমাকে যেতে দিলেতো যাবে। বস, খেলতে ভালো না লাগলে গল্প করি এসো।
শামিমা মাকে বলেই এসেছে বিকেলে ফিরবে। তা ছাড়া জানে রহিমা বুবু তাকে কিছুতেই এবেলা যেতে দেবে না। আজিজুলের কথা শুনে থাকতে ইচ্ছা করছে না বলে চলে যাওয়ার কথা বলেছে। কি করবে ভাবতে লাগল।
কি বিয়ান, দাঁড়িয়ে থাকবে? বস না।
শামিমা একরকম বাধ্য হয়ে বসল।
আজিজুল বলল, তুমি কিন্তু আমার একটা কথার উত্তর দাও নি।
কোন কথার?
ঐ যে বললাম, তোমার মতামত পেলে ভাইয়া ও ভাবি তালই ও মাওই সাহেবের সঙ্গে কথা পাকা করে রাখবে।
রাগে শামিমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে গেল। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, আপনি আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, তাই পছন্দ করার মতো জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে। আমার বয়স কম, তাই পছন্দ করার মতো জ্ঞান বুদ্ধি এখনও হয় নি। যখন হবে তখন জানাব।
তোমার কথা আংশিক সত্য হলেও পুরোটা নয়। ছেলেদের জ্ঞান বুদ্ধি পনের বছর থেকে শুরু হলেও মেয়েদের বার বছর থেকে শুরু হয়। তোমার বয়স নিশ্চয় বার থেকে বেশি?
আপনার কথাও আংশিক সত্য। কারণ সবার ক্ষেত্রে কথাটা ঠিক নয়।
কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, পছন্দ অপছন্দ করার মতো জ্ঞান বুদ্ধি। তোমার যথেষ্ট হয়েছে। আমার কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এসব বলছ।
কি জানি, হয়তো আপনার কথা ঠিক। যাই হোক, এ নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না। যাই, বুবু কি করছে দেখি বলে শামিমা চলে গেল।
রহিমা রান্না শেষ করে পুকুরে গোসল করতে যাওয়ার জন্য শামিমাকে ডাকতে যাচ্ছিল, তাকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, গোসল করবি?
শামিমা বলল, আমি সকালে গোসল করে এসেছি।
তা হলে ঘরে গিয়ে বস আমি গোসল করে আসি।
দুলাভাই কখন ফিরবে?
তার ফেরার কোনো ঠিক নেই। কামলাদের কাজে লাগিয়ে কোথাও হয়তো গেছে।
বিকেল চারটের দিকে শামিমা রহিমা বুবুদের বাড়ি থেকে ঘরে ফিরে এল। রহিমা বুবু ও দুলাভাই থাকতে বলেছিল, সে থাকে নি। তবে কথা দিতে হয়েছে। সামনের শুক্রবার আসবে।
শামিমা চলে যাওয়ার পর একসময় রহিমা দেবরকে বলল, অনেকক্ষণতো আলাপ করলে, কিছু কাজ হল?
কাজের কাজ কিছুই হয় নি।
তুমি একটা অপদার্থ।
যতটা অপদার্থ ভাবছ ততটা আমি নই। তারপর শামিমার সঙ্গে যা আলাপ হয়েছে বলে বলল, এরপরও আমাকে অপদার্থ বলবে?
হ্যাঁ, বলব। কারণ শামিমাকে তোমার মনের কথা জানাতে পারলেও তার মনের খবর আদায় করতে পার নি।
একেবারে যে পারি নি তা নয়, সরাসরি অমত প্রকাশ না করে যা বলেছে, তাতেই বুঝতে পেরেছি আমাকে তার পছন্দ নয়।
পছন্দ না করার কারণ বুঝতে পার নি?
কেন পারব না, আমার দৃঢ় ধারণা ও কামরুলকে ভালবাসে।
শুধু ধারণা করে কারো সম্পর্কে কিছু বলতে নেই। ঠিক আছে, আমি এ ব্যাপারে চাচি আম্মা ও আমার ভাইয়েদের সঙ্গে আলাপ করব।
.
একদিন কামরুলের রুম পরিষ্কার করার সময় আনোয়ারা বেগম খাটের নিচে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট দেখে খুলে একটা শাড়ি ও একটা লুংগী দেখে খুব অবাক হলেন। ভাবলেন, এগুলো তো আমাদের কারো নয়, ওর খাটের নিচে এল কি করে?
এক সময় কামরুলকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর খাটের নিচে কাগজে মোড়া কার শাড়ি ও লুংগী?
কামরুল বলল, আবু খাঁ ও তার বৌ-এর।
আবু খাঁ আবার কে?
উনি জমিদার বংশের লোক।
ওনাদের কাপড় তোর কাছে কেন?
গত বৃহস্পতিবার জমিদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় বৃষ্টিতে ভিজে যাই। ওনারা ওগুলো আমাদেরকে পরতে দিয়েছিলেন। ফেরার সময় আমাদের কাপড় শুকোই নি, তাই এগুলো পরে এসেছিলাম।
তোর সঙ্গে আর কে ছিল?
.
শামিমা।
কিছুদিন আগে ওদের মেলামেশার কথা পাড়ার মেয়েদের মুখে শুনে আনোয়ারা বেগম কামরুলকে শামিমার সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। এখন তার কথা শুনে রেগে উঠে বললেন, শামিমার সঙ্গে তোকে মিশতে নিষেধ করেছি না? তবু তাকে নিয়ে জমিদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলি কেন? আর কখনও এমন কাজ করবি না। তোর চাচা চাচি জানতে পারলে শামিমাকে মারধর করবে আর আমাদেরকেও যা তা করে বলবে। শোন্, কাপড় দুটো লন্ড্রিতে দিয়ে আয়। একদিন সময় করে দিয়ে আসবি।
কামরুল কিছু না বলে মায়ের কাছ থেকে চলে গেল।
আগে যখন তখন কুলসুমের সঙ্গে শামিমা তাদের বাড়িতে এলেও এখন আর আসে না। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় কুলসুম তাকে বলল, তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না কেন?
শামিমা বলল, আমাকেও তোর ছোট চাচাকে নিয়ে লোকজন কানাকানি করছে। মায়ের কানেও কথাটা গেছে। মা আমাকে সে কথা জানিয়ে বলল, কামরুলদের সঙ্গে মেলামেশা করবি না আর তাদের ঘরেও যাবি না।
তারপর থেকে তা হলে ছোট চাচার সঙ্গে তুই মেলামেশা করিস না?
না করে কি থাকতে পারি? তাই স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে তার সঙ্গে দেখা করি। সে সময় চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিই কখন কোথায় আমাদের দেখা হবে।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এভবে কতদিন চলবে? তোদের ব্যাপারটা প্রায় সবাই জেনে গেছে। একদিন না একদিন কারো না কারো নজরে পড়ে যাবি।
তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস। কামরুল ভাইকে কথাটা বলে দেখি সে কি বলে।
হ্যাঁ, তাই বলিস। তোদের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্য, তা তুইও জানিস। তোদের দুজনকে নিয়ে বাপ চাচাঁদের মধ্যে পুরানো মনোমালিন্য আরো বেড়ে যাবে। আমার মতে তোরা আর গোপনে দেখা সাক্ষাৎ করিস না। যা কিছু চিঠি লেন দেনের মধ্যে করতে পারিস। এ ব্যাপারে আমি তোক সাহায্য করব। ছোট চাচা বি.এ. পাশ করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে তুই ও লেখাপড়া চালিয়ে যা। তারপর না হয় ছোট চাচা গার্জেনদের জানিয়ে যা করার করবে। গার্জেনরা রাজি না হলে গোপনে তোরা কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেলবি। তারপর কিছু গোলমাল হলেও একসময় না একসময় গার্জেনরা মেনে নেবে।
আমিও তাই চিন্তা করেছি। গতকাল কামরুল ভাইকে বলবো, ভেবেছিলাম, কিন্তু বলার সুযোগ পাই নি। আজ টিফিন পিরিয়ডে বলতাম, কিন্তু সে আসে নি।
ছোট চাচা তো স্কুলেই আসে নি, আজ সকালে দাদিকে নিয়ে তার বড় মামাকে দেখতে গেছে। ওনার অবস্থা খারাপ। মনে হয় বাঁচবেন না।
তাই না কি? আল্লাহ ওনাকে সুস্থ করুক। জানিস সই, আর একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি।
কিসের ঝামেলা?
কাল রহিমা বুবুদের বাড়ি গিয়েছিলাম, তার দেবর আজিজুল বিয়াই আমাকে পছন্দ করে।
তোকে কে বলল?
আজিজুল বিয়াই নিজেই বলেছে।
তুই কি বললি?
শামিমা তাকে যা কিছু বলেছে সেসব বলল।
তা হলে তো তুই সত্যিই ঝামেলায় পড়েছিস। রহিমা বুবু তোকে কিছু বলেছে না কি?
না। তবে ঐ দিন থাকতে বলেছিল, আমি থাকি নি।
এই ব্যাপারটাও ছোট চাচার সঙ্গে আলাপ করবি।
তুই না বললেও করতাম।
.
কামরুলের বড় মামা মারা গেছেন। তাই চার দিন পর মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপর স্কুলে শামিমার সঙ্গে দেখা করে বলল, বড় মামার অবস্থা জেনে মা আমাকে নিয়ে তাদের বাড়ি গিয়েছিল। তোমাকে বলে যাওয়ার সুযোগ পাই নি, কিছু মনে কর নি তো?
শামিমা বলল, না, করি নি। কুলসুমের মুখে কথাটা শুনেছি। তোমার সঙ্গে বেশ কিছু আলাপ আছে, চলো কোথাও গিয়ে বসি।
স্কুলের পিছনে সেক্রেটারীর নানারকম ফলের বাগান। সেখানে এসে বসার পর কামরুল বলল, বল কি আলাপ করবে।
আমাদের ব্যাপারটা শুধু দু’ফ্যামিলী না, সারা গ্রামের লোকজন জেনে গেছে। তাই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করতে হবে। চিঠির মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ রাখব।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা না করা পর্যন্ত আমাদেরকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। নচেৎ চাচা মচি জেনে গেলে হয়তো তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন।
গত বৃহস্পতিবার রহিমা বুবু দুলাভাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয় নি। আমি তখন স্কুলে ছিলাম। আমাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মাকে অনেক করে বলে গিয়েছিল। পরের দিন আমি গিয়েছিলাম। তার দেবর আজিজুলকে তো তুমি ভালভাবেই চেনো। তারপর আজিজুল ও তার মধ্যে যা কিছু কথা হয়েছে বলে বলল, আমার কি মনে হয় জান, রহিমা বুবু ও দুলাভাই আজিজুলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।
তোমার অনুমান হয়তো ঠিক। আচ্ছা, চাচি আম্মা তোমাকে কিছু বলেছে নাকি?
না বলে নি। শুধু ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে বলেছে।
কামরুল অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কি হল, কিছু বলছ না কেন?
রহিমা বা তার স্বামীর কথায় সেরকম কিছু বুঝতে পেরেছ?
তারা এ ব্যাপারে কিছু বলে নি। তবে তারা থাকার জন্য খুব জিদ করেছিল। আমি থাকতে রাজি না হতে সামনের শুক্রবারে আসার ওয়াদা করিয়ে আসতে দিয়েছে।
খুব চিন্তার কথা। আজিজুল ছেলে হিসেবে ভালো। তাদের অবস্থাও ভালো! তার এক চাচা আমেরিকায় সেটেল্ড। সেখানে স্বপরিবারে থাকেন। তিনি আজিজুলকে খুব ভালবাসেন। দু’একমাস ছাড়া তার পড়ার খরচ বাবদ অনেক টাকা পাঠান। প্রস্তাব পেলে চাচা চাচি রাজি হয়ে যাবে।
আমি আমার মা বাবাকে চিনি। মা রাজি হলেও আব্বা এখন আমার বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি হবে না। এবারের রেজাল্ট দেখে আব্বা বলল, ভালো করে পড়াশোনা করে আরো ভালো রেজাল্ট করবি। আমি তোকে বি.এ. পাশ করাব।
তোমার কথা ঠিক হলেও নিশ্চিত হতে পারছি না। যদি তারা এখন কাবিন করে রাখতে চায়?
তারা চাইলেও আমি কিছুতেই রাজি হব না। আগেও কয়েকবার বলেছি, আবার আজও বলছি, দুনিয়ার কোনো মানুষ আমাকে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। যদি জোর করে নেয়, তা হলে আমার লাশকে নেবে।
তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কামরুল বলল, ছি! এমন কথা আর কখনও বলবে না। তোমার লাশ হওয়ার কথা শুনে আমিও তা হলে লাশ হয়ে যাব। যা বলছি শোন, আমাদের দুজনকেই আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদেরকে নিয়ে গ্রামের কেউ যেন কানাকানি না করে এখন থেকে সেই ভাবেই আমরা চলব। তুমিতো রহিমাদের বাড়িতে শুক্রবার যাওয়ার ওয়াদা করে এসেছে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু যেতে মন চাইছে না।
মন না চাইলেও যাবে। আজিজুল যদি আবার কিছু বলে, তা হলে এমন কথা বলবে, সে যেন বুঝতে পারে আমার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই এবং আমাকে তুমি পছন্দও কর না।
আর রহিমা বুবু যদি কিছু জিজ্ঞেস করে?
কাবিন বা বিয়ের কথা নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবে না। আজিজুলের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, এ ব্যাপারে আব্বা আম্মা যা করবে তাই।
বেশ, তুমি যখন বলছ তখন তাই হবে। এবার যাই ক্লাশ শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে, বলে শামিমা দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপর থেকে তারা নিজেদের প্ল্যান মতো চলতে লাগল। ফলে ক্রমশঃ তাদের কথা সবাই এরকম ভুলেই গেল।
পাঁচ
এবছর শামিমা ফার্স্ট হয়ে ক্লাস টেনে উঠল। আর কামরুল এস. এস. সিতে খুব ভালো রেজাল্ট করে কলেজে পড়ছে। এটা তার ফাইনাল ইয়ার।
ততদিনে আজিজুল বি.এ. পাশ করে তার চাচার কথামতো আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ইচ্ছা যাওয়ার আগে শামিমার সঙ্গে বিয়ে অথবা কাবিন করার। একদিন সে কথা ভাবিকে জানিয়ে বলল, তুমি ভাইয়াকে নিয়ে ওর মা বাবার কাছে যাও। আমার মনে হয় এখন আর অমত করবে না। বিয়েতে রাজি না হলেও কাবিন করতে রাজি হবেই। দু’বছর পরে যখন ছুটি নিয়ে আসব তখন অনুষ্ঠান করে ঘরে তোলার কথা বলবে।
রহিমা বলল, শামিমা যদি কোনো কিছুতেই রাজি না হয়? ওতো আমাকে বলেই দিয়েছে বি. এ. পাশ না করে বিয়ে করবে না।
সেকথা দু’বছর আগে বলেছিল এখন আর বলবে বলে মনে হয় না। বিয়েতে রাজি না হলে কাবিনে রাজি হবেই।
এত জোর দিয়ে বলছ যে, তোমাকে সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছে না কি?
আজিজুল কিছু দিন আগে বিয়ে অথবা কাবিন করে রাখার কথা শামিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
কামরুলের কথা মতো এতদিন আজিজুলের সঙ্গে শামিমা মৌখিক প্রেমের অভিনয় করে এসেছে। তাই তার কথা শুনে রেগে গেলেও বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিল, বি. এ পাশ করার আগে কিছুতেই আমি বিয়ে করব না। তবে কাবিনের ব্যাপারে মা বাবা যা করবে তাই মেনে নেব।
শামিমার পিহাসি আজিজুল বুঝতে পারে নি। কাবিনের কথা শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে তার দুটো হাতে চুমো খেয়ে বলেছিল, তুমি শুধু সুন্দরী নও, বুদ্ধিমতীও।
এখন ভাবির কথা শুনে আজিজুল বলল, হ্যাঁ কাবিনে রাজি আছে।
রহিমা আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, দু’এক দিনের মধ্যে আমরা যাব।
একদিন রহিমা স্বামীকে নিয়ে চাচাঁদের বাড়িতে গিয়ে আজিজুলের আমেরিকা যাওয়ার কথা বলে কাবিন করে রাখার কথা বলল। আরো বলল, দু’বছর পর
আজিজুল ছুটি নিয়ে যখন দেশে আসবে তখন অনুষ্ঠান করে বৌ ঘরে তুলব।
বছর দুই আগে কামরুল ও শামিমার সম্পর্কের কথা আনোয়ারুল হকের কানেও পড়েছিল। কিছু করার আগে তাদের সম্পর্ক নেই জেনে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। এখন মেয়ে জামাইয়ের কথা শুনে ভাবলেন, এখন ওরা আরো সেয়ানা হয়েছে। গোপনে যদি কিছু করে ফেলে? তার চেয়ে একাজটা করে ফেলাই উচিত।
স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে রিজিয়া খাতুন বললেন, মেয়ে জামাইয়ের কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? এত চিন্তা করারই বা কি আছে।
আনোয়ারুল হক বললেন, সবকিছু চিন্তা করেই করা উচিত। তা ছাড়া শামিমা সামনের বছর এস. এস. সি. পরীক্ষা দেবে।
রিজিয়া খাতুন রাগের সঙ্গে বললেন, রাখ তোমার চিন্তা। ছেলে বিয়ের পর আমেরিকা চলে যাবে। দু’বছর পর ফিরবে। এর মধ্যে শামিমা শুধু এস, এস. সি. না এইচ. এস. সি. ও পাশ করতে পারবে। তারপর মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি ঠিক বলি নি।
রহিমা চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চাচি আম্মা ঠিক কথা বলেছে। আপনি আর অমত করবেন না।
আনোয়ারুল হক বললেন, আমিতো অমত করছি না, শুধু এস, এস, সি পরীক্ষার কথা বলেছি। ঠিক আছে, ছেলে আমেরিকা যাওয়ার আগেই কাজটা মিটিয়ে ফেলব। তবে বিয়ে নয়, শুধু কাবিন হবে। শামিমার মতামত নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে তোমাদেরকে জানাব।
স্বামীর প্রথম কথায় রিজিয়া খাতুন রেগে গিয়েছিল। এখন তার কথা শুনে রাগ পড়ে গেল। নরমস্বরে বললেন, শামিমার মতামত নিতে হবে না। সে যে আজিজুলকে পছন্দ করে, তা আমার জানা আছে।
আনোয়ারুল হক বললেন, তাই নাকি?
রহিমা বলল, হ্যাঁ চাচা আমিও সে কথা জানি।
তা হলে আমার কিছু বলার নেই। কয়েকদিন পরে আমি খবর পাঠাব তোমরা এসো, কথাবার্তা বলা যাবে।
মনিরুল বলল, আজিজুলের ভিসা এসে গেছে। আজ মাসের দশ তারিখ। সামনের মাসের পনের তারিখে ওর ফ্লাইট। আমরা চাচ্ছি এমাসের বিশ তারিখের মধ্যে কাজটা করে ফেলতে।
আনোয়ারুল হক বললেন, বেশ তো তা হলে বিশ তারিখে কাবিন হবে। এরমধ্যে একদিন এসে কিভাবে কি করবে আলাপ করে যেও।
মেয়ে জামাইকে নাস্তা খাইয়ে বিদায় করার পর আনোয়ারুল হক স্ত্রীকে বললেন, তুমি শুধু শামিমাকে কাবিনের কথা জানিয়ে মতামত নিও। তা না হলে মত থাকলেও মনে কষ্ট পাবে।
রিজিয়া খাতুন বললেন ঠিক আছে ওকে জানাব।
আজও শামিমা স্কুলে যাওয়ার পর রহিমা ও মনিরুল এসেছে। তাই সে এসব কিছুই জানতে পারল না।
স্কুল থেকে ফেরার পর রিজিয়া খাতুন মেয়েকে খেতে দিয়ে বললেন, রহিমা জামাইকে নিয়ে এসেছিল। আজিজুল সামনের মাসের পনের তারিখে আমেরিকা চলে যাবে। তাই এমাসের বিশ তারিখে তোর সঙ্গে আজিজুলের কাবিন করার কথা বলে গেল।
কথাটা শুনে শামিমা যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। খাওয়ার কথা ভুলে মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
রিজিয়া খাতুন ভেবেছিলেন, কাবিনের কথা শুনে শামিমা খুব খুশী হবে, লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে যাবে। তা না হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যেতে দেখে ও তাকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলেন সে রাজি নয়। বললেন, কি হল এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস কেন? ভাত খাবি তো।
ততক্ষণে শামিমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আমার মতামত না নিয়ে তাদেরকে কথা দেয়া তোমাদের ঠিক হয় নি। সামনে আমার টেস্ট পরীক্ষা। এসময় কোনো কিছুই করা যাবে না ।
এখন তো বিয়ে হচ্ছে না, কাবিন হবে। দু’বছর পর আজিজুল ছুটি নিয়ে দেশে আসবে। তখন অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলবে।
চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শামিমা বলল, তুমি বুঝতে পারছ না কেন, কাবিন মানেই বিয়ের সব কাজ সারা। আজিজুল প্রায় দিন আসবে। এমন কি দু’চার দিনের জন্য হলেও রহিমা বুবু আমাকে নিয়ে যাবে। এসব করলে আমার পড়ার খুব ক্ষতি হবে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করাতো দূরের কথা পাশ করতে পারব কি না সন্দেহ।
তুই ওসব নিয়ে কিছু ভাবিস না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। রহিমা চাইলেও আমরা তোকে তাদের বাড়ি এখন পাঠাব না। আর কাবিনের পরে আজিজুল যেন না আসে, সেকথাও কাবিনের আগে পাকা করে নেব।
তোমরা যা ইচ্ছা তাই কর বলে না খেয়ে শামিমা নিজের ঘরে এসে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল।
রিজিয়া খাতুন মেয়ের পিছন পিছন এসে তার পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বললেন এত কাদার কি আছে? এখন কাবিন করার তোর আব্বার ইচ্ছা ছিল না। রহিমা বলল, তুই আজিজুলকে পছন্দ করিস, তাই সে রাজি হয়েছে।
শামিমা উঠে বসে চোখ মুছে বলল, রহিমা বুবু বুঝতে ভুল করেছে। আজিজুল বিয়াই হয়, তাই তাদের ওখানে গেলে তার সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি, ক্যারাম খেলি। ঐসব দেখে রহিমা বুবু কথাটা বলেছে। আমি তো তোমাদেরকে বলেছি বি. এ. পাশ না করে বিয়ে করব না। তবু কেন এখন কাবিন করতে চাচ্ছ?
কাবিনের কথা বাদ দে, সত্যি করে বলতো তুই আজিজুলকে পছন্দ করিস কি না।
না, করি না।
আজিজুল সোনার টুকরো ছেলে। তার মতো ছেলে পাঁচ দশ গ্রামে আছে কিনা সন্দেহ, আর্থিক অবস্থা ভালো, তবু তুই তাকে পছন্দ করিস না কেন?
পছন্দ হয় কিনা জিজ্ঞেস করেছ; তার উত্তর দিয়েছি। কেন পছন্দ করি না। বলতে পারব না। আমার সাফ কথা বি. এ. পাশ না করে কিছুই করব না। কথাটা আজ কালের মধ্যে তাদেরকে জানিয়ে দিতে বলো আব্বাকে।
মেয়ের কথা শুনে রিজিয়া খাতুন চিন্তা করলেন, তা হলে কি দু’বছর আগে ওকে ও কামরুলকে নিয়ে যে কথা গ্রামে রটেছিল তা সত্য? কথাটা চিন্তা করে খুব রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন তুই কি অন্য কোনো ছেলেকে পছন্দ করিস?
সে কথা তোমাদের জানার দরকার নেই।
তুই আমাদের একটাই মেয়ে, তোর সবকিছু জানা আমাদের যেমন দরকার তেমনি তোর ভালো-মন্দ চিন্তা করাও আমাদের দরকার। যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে।
এখন তুমি যাও, পরে একদিন জানাব।
রিজিয়া খাতুন দৃঢ়স্বরে বললেন, পরে নয়, এক্ষুনি বল। শোনার পর ভালো বুঝলে তোর আব্বাকে এ কাজ ভেঙ্গে দিতে বলব।
হ্যাঁ পছন্দ করি।
কাকে পছন্দ করিস?
শামিমা জানে কামরুল ভাইয়ের কথা বললে মা আরো রেগে যাবে এবং আব্বাকে জানিয়ে আজিজুলের সঙ্গে জোর করে শুধু কাবিন নয়, বিয়ের সব কাজ মিটিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। তাই মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
কি হল? ছেলেটার নাম বলবি তো?
এখন বলা সম্ভব নয়, বি. এ. পাশ করার পর বলব।
রিজিয়া খাতুন বুঝতে পারলেন, তার অনুমানই ঠিক। তা না হলে ছেলেটার নাম বলতে চাচ্ছে না কেন? খুব রাগের সঙ্গে বললেন, এখনই বলতে হবে। নচেৎ ভালো-মন্দ জানব কি করে?
তোমাদেরকে ভালো-মন্দ বুঝতে হবে না। তুমি এখন যাও আমার মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।
তা হলে শুনে রাখ, এই মাসের বিশ তারিখে আজিজুলের সঙ্গে তোর কাবিন হবেই। কথাটা বলে রিজিয়া খাতুন মেয়ের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
মায়ের কথা শুনে শামিমা চিন্তা করল, বেশি প্রতিবাদ করলে মা বাবা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তা হলে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। আরো চিন্তা করল, মা বাবার কথায় আপাতত রাজি হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তা হলে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে সুযোগমতো আলাপ করে যা করার করা যাবে।
মাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শামিমা মৃদু হেসে বলল, সামনে পরীক্ষা। পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে যাতে তোমরা এখন কাবিন না কর সেজন্য আজিজুল ভাইকে পছন্দ হয়নি ও অন্য ছেলেকে পছন্দ করার কথা বলেছি। আসলে তার মতো ভালো ছেলে আমি আর দেখিনি।
মেয়ের কথা শুনে রিজিয়া খাতুন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বললেন, আমি জানতাম শেষমেস তুই রাজি হবি। যাক, আল্লাহ আল্লাহ করে কাজটা ভালোভাবে মিটে গেলেই ভালো। শোন, একথা এখন কাউকে বলবি না। কুলসুমের সঙ্গে তো তোর খুব ভাব, তাকেও বলবি না।
শামিমা মনে মনে হেসে বলল, ঠিক আছে তুমি যাও তো; আমি একটু ঘুমাব।
তাই ঘুমা। ঘুমালে মাথার যন্ত্রণা ভালো হয়ে যাবে। কথা শেষ করে রিজিয়া খাতুন চলে গেলেন।
মা চলে যাওয়ার পর শামিমা কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর উঠে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চিঠি লিখতে বসল।
কামরুল ভাই,
সালামান্তে জানাই যে, এই মাসের বিশ তারিখে আজিজুলের সঙ্গে আমার কাবিন হওয়ার ব্যবস্থা একরকম পাকাপাকি। মা যখন কথাটা জানায় তখন প্রথমে মাথা গরম হয়ে যায় এবং মায়ের সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটি করি। পরে তোমার সাবধান বাণী মনে পড়তে রাজি হওয়াতে মা খুব খুশী হয়েছে। এর মধ্যে যা করার তুমি করবে আর আমাকে কি করতে হবে চিঠি দিয়ে জানাবে। আজ থেকে পড়াশোনা, খাওয়া ও ঘুম কিছুই হবে না, শুধু তোমার চিঠির অপেক্ষায় প্রহর গুনব। আল্লাহ আমাদের উপর রহম করুক ও আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুক, সুবুদ্ধি তোমাকে দিক এই দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি, তোমার প্রেয়সী
শামিমা।
রাতে ঘুমাবার আগে আনোয়ারুল হক স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েকে কাবিনের কথা বলেছিলে?
রিজিয়া খাতুন বললেন, হ্যাঁ বলেছি। শুনে প্রথমে খুব রেগে গিয়ে কান্নাকাটি করে। আমি বুঝিয়ে বলতে রাজি হয়েছে। তবে দুটো শর্ত দিয়েছে। প্রথম শর্ত হল কাবিনের পর আজিজুল ওর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে এখানে আসবে না। দ্বিতীয় শর্ত দু’বছর পরে অনুষ্ঠান করার আগে ওদের বাড়িতে যাবে না।
আনোয়ারুল হক হেসে উঠে বললেন, তাই না কি?
শুধু তাই নয়, কাবিনের আগেই যেন শর্তগুলো তাদেরকে জানান হয় সেকথাও বলেছে।
ঠিক আছে, তাই হবে। শর্ত দিলেও রাজি যে হয়েছে সেটাই খুশীর কথা।
.
কুলসুম প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় তৈরি হয়ে শামিমার জন্য অপেক্ষা করে। আজও ছিল। তাকে মন খারাপ করে আসতে দেখে এগিয়ে এসে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, কিরে আজ তোর মন খারাপ কেন? মনে হচ্ছে ছোট চাচার চিন্তায় ঘুমাতে পারিস নি?
কাল স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। ইয়ার্কি করবি না রেগে যাব।
ঠিক আছে করব না। এবার মন খারাপের কারণটা বল।
শামিমা আজিজুলের সঙ্গে কাবিনের কথা বলল।
কুলসুম চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ! এখন তা হলে কী করবি?
আমি আবার কি করব? যা করার তোর ছোট চাচা করবে।
সে জানে?
না। তারপর কান্নাজড়িত স্বরে বলল, জানিস সই, মায়ের মুখে কথাটা শোনার পর থেকে শুধু কান্না পাচ্ছে।
তুই লেখাপড়ার কথা বলে প্রতিবাদ করতে পারতিস। অন্তত ফাইন্যাল পরীক্ষা পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে পারতিস। তা হলে ছোট চাচা চিন্তা ভাবনা করে কিছু একটা করতে পারত।
তুই কি মনে করেছিস মা বলল আর আমি রাজি হয়ে গেলাম? অনেক যুক্তি তর্ক করে পিছাতে ছেয়েছিলাম; কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। শেষে চিন্তা করলাম, বেশি জিদ ধরলে আমাকে যদি ঘরে আটকে রাখে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়, তা হলে তোর ছোট চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করব কি করে? তাই রাজি হয়ে গেলাম। তারপর চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, এটা তাকে দিয়ে বলবি, “আজই যেন চিঠির উত্তর লিখে তোকে দেয়।” কাল স্কুলে আসার সময় আমাকে দিবি।
ততক্ষণে তারা স্কুলে পৌঁছে গেল। ক্লাসে ঢোকার সময় কুলসুম বলল, তুই না বললেও আমি বলতাম। তারপর খামের মুখ খোলা দেখে বলল, তুই আমার হাতে যত চিঠি দিয়েছিস সবগুলোর খামের মুখ গাম দিয়ে বন্ধ করে দিস। এটা খোলা কেন? আমার তো পড়তে ইচ্ছে করছে।
ইচ্ছা করলে পড়িস। এখন চুপ কর স্যার আসছে।
স্কুল থেকে ফিরে কুলসুম ছোট চাচার খোঁজ করল। না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, কলেজে কি একটা ফাংশান আছে, ফিরতে রাত হবে।
রাত দশটার সময় ভাত খেতে আসার আগে কুলসুম ছোট চাচার রুমে গিয়ে দেখল, সে পড়ছে।
তাকে দেখে কামরুল বলল, কিরে কিছু বলবি?
কুলসুম চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, আজ রাতেই এটার উত্তর লিখে আমাকে দিতে বলেছে শামিমা।
খামের মুখ খোেলা দেখে কামরুল জিজ্ঞেস করল, তুই খুলেছিস?
না। এভাবেই শামিমা দিয়েছে এবং আমাকে পড়ার অনুমতিও দিয়েছে। কথা শেষ করে দ্রুত ফিরে যেতে লাগল।
দাঁড়া, যাস না।
কুলসুম দাঁড়াল, কিন্তু তার দিকে ফিরল না।
কামরুল বলল, উত্তর লিখে রাখব, সকালে এসে নিস।
ঠিক আছে বলে কুলসুম চলে গেল।
চিঠি পড়ে কামরুলের আক্কেল গুড়ুম। এস, এস, সি পরীক্ষার পরপর তারও ফাইন্যাল পরীক্ষা। কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। একদিকে পরীক্ষা অন্য দিকে শামিমা। কোনটা রক্ষা করবে চিন্তা করতে করতে কখন এগারটা বেজে গেল খেয়াল নেই।
রাতে ভাত খাওয়ার পর কামরুল পড়তে পারে না। ভাত খেলেই তার ঘুম পায়। তাই বড় ভাবি ওয়াসিমা ভাত বেড়ে তার রুমে ঢাকা দিয়ে রেখে যায়।
ওয়াসিমার পুরো নাম আরিফা ওয়াসিমা। এই নামের অর্থ ধার্মিকা সুন্দরী। নামের পূর্ণ প্রতীক ওয়াসিমা। যেমন ধর্মিক তেমনী সুন্দরী। কুলসুম তারই মেয়ে। সেও মায়ের মতো হয়েছে। ক্লাস সেভেন থেকে বোরখা পরে স্কুলে যায়। তার সঙ্গে মেলামেশা করে শামিমাও ধার্মিক হয়েছে এবং সে ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে বোরখা পরে স্কুলে যায়। নতুন বৌ-এরা শ্বশুরবাড়ি এসে প্রথম দিকে বেশ কিছু দিন পর্দা মেনে চলে। পরে আর মেনে চলে না। কিন্তু ওয়াসিমা আজ মোল সতের বছর এবাড়িতে বৌ হয়ে এলেও এখনও পর্দা মেনে চলে। শ্বশুর, ভাসুর, দেবর কারো সামনেই ঘোমটা না দিয়ে আসে না। এমন কি সে যখন বড় বৌ হয়ে এবাড়িতে আসে তখন কামরুল পাঁচ বছরের। তাকে ছোট ভাইয়ের মতো মানুষ করলেও পনের ষোল বছর হওয়ার পর থেকে তাকেও পর্দা করে চলে। এনিয়ে অনেকে খোটা দিলেও গায়ে মাখে না। বরং তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) পর্দার ব্যাপারের যা বলেছেন,–শুনিয়ে দেয়।
আজ রাত এগারটার সময় দেবরের ভাত নিয়ে এসে তাকে একটা কাগজ হাতে চিন্তামগ্ন দেখে বলল, ছোট ভাই, পড়া বাদ দিয়ে চুপ করে কি এত চিন্তা করছ?
বড় ভাবির গলা-পেয়ে সম্বিত ফিরে পেয়ে কামরুল তাড়াতাড়ি চিঠিটা হাতের মধ্যে লুকিয়ে বলল, কিছু বললে?
ওয়াসিমা মৃদু হেসে বলল, পড়া বাদ দিয়ে কার ধ্যান করছিলো।
তুমি যে কি বড় ভাবি, কার আবার ধ্যান করব?
হাতের মধ্যে কি লুকালে।
চিঠি।
কার চিঠি?
বলা যাবে না।
নিশ্চয় যে চিঠি দিয়েছে তার ধ্যান করছিলে? মেয়েটা কে?
প্লীজ বড় ভাবি, তুমি এখন যাও। তোমার কোনো কথার উত্তর দিতে পারব না।
কেন?
উত্তর দিতে হলে মিথ্যে বলতে হবে। নিশ্চয় তুমি তা চাইবে না।
ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দু’একটা কথা বলে যাই, প্রেম ভালবাসা মোহ ছাড়া কিছুই না। এই মোহে পড়ে অনেক ভালো ভালো ছেলে মেয়ের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশেষ করে ছাত্র-জীবনে প্রেম-ভালবাসা অভিসম্পাত ডেকে আনে। তুমি খুব ভালো ছাত্র। প্রেমের কারণে তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক তা চাই না। আর আজকাল প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে শয়তানী প্ররোচনা থাকে। তাই সাবধান করার জন্য তোমাকে কথাগুলো বললাম। আমার কথায় মনে কিছু করো না। পড়তে ইচ্ছা না করলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড় বলে ওয়াসিমা চলে গেল।
কামরুলের চোখে বড় ভাবির মতো সুন্দরী, ধার্মিক ও কর্তব্যনিষ্ঠ মেয়ে আর পড়ে নি। তাই তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। মেজ ভাবির সঙ্গে ইয়ার্কি ঠাট্টা করলেও তার সঙ্গে কখনও করে নি। আর বড় ভাবিকেও কোনো দেবরের সঙ্গে কখনও ইয়ার্কি ঠাট্টা করতে দেখে নি। এখন তার কথা শুনে চিন্তা করল, শামিমাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া তাকে বাঁচান যাবে না। তাকে বাঁচাতে গেলে নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। আম্মা আব্বাদের বললে, তারা এখন কিছুতেই শামিমাকে বৌ করে আনবে না। আনা সম্ভবও নয়। কারণ আম্মা আব্বা রাজি হলেও শামিমার মা বাবা কিছুতেই রাজি হবে না। কি করবে না করবে চিন্তা করতে করতে পেঁচার ডাক কানে পড়তে চমকে উঠল। দাদির কাছে শুনেছিল, পোঁচার ডাক অশুভ। ঘড়ি দেখল, রাত দু’টো। হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল। ক্ষিধে থাকা সত্বেও খেতে পারল না। কয়েক লোকমা খেয়ে সবকিছু চাপা দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে এসে শুয়ে পড়ল; কিন্তু চোখে ঘুম এল না। এপাশ ওপাশ করতে লাগল। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তোমাদের এতদিনের ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়া উচিত নয়। তা ছাড়া তুমি ছেলে হয়ে বিসর্জন দিতে পারলেও শামিমা মেয়ে হয়ে তা পারবে না। তুমি কিছু না করলে সে আত্মঘাতী হবে, এ কথা তো সে আগেই বলে রেখেছে। শামিমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হবে ভাবছ কেন? উজ্জল ও হতে পারে? ভুলে যাচ্ছ কেন আল্লাহ তকৃদিরে যা লিখে রেখেছেন, তা হবেই। তা হলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শামিমার ইহকাল-পরকাল ধ্বংস করা কি উচিত হবে? তোমার কারণে শামিমা আত্মঘাতী হলে তুমি ভবিষ্যৎ জীবনে চরম উন্নতি ও স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করলেও সারাজীবন এতটুকু শান্তি পাবে না। সব সময় তার স্মৃতি তোমার মনে কাঁটার মতো বিধতে থাকবে। এমনও হতে পারে সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অথবা তাকে আত্মঘাতী করার পাপের ফলে তুমি পাগল হয়ে যেতে পার।
এইসব চিন্তা সহ্য করতে না পেরে কামরুল দিশেহারা হয়ে পড়ল। এমন সময় মসজিদের মাইকে শুনতে পেল, হাই-ইয়ালাস সালাত/হাই-ইয়ালাল ফালাহ (নামাযের জন্য এস/শান্তির জন্য এস) আস-সালাতু খায়রুম মিনাল নাউম/(ঘুমের চেয়ে নামায উত্তম)।
সারারাত যেন এক আযাবে ভুগছিল। আজানের এই শব্দগুলো শুনে কামরুল মনের মধ্যে শান্তি অনুভব করল। উঠে বাথরুমের কাজ সেরে মসজিদে নামায পড়তে গেল।
নামায শেষে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে মোনাজাত করার সময় আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইল। তারপর ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসল।
শামিমা,
সালামান্তে জানাই যে, তোমার চিঠি পেয়ে সবকিছু জানলাম। তকৃদিরের কথা স্মরণ করে ধৈর্য ধর। হাতে এখনও কয়েকদিন সময় আছে। এতটুকু দুশ্চিন্তা না করে নরম্যাল থাকার চেষ্টা কর। আল্লাহ আমাদের জোড়া করে থাকলে এরমধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারব ইনশাআল্লাহ। কি ব্যবস্থা করব, দু’দিন পর চিঠি দিয়ে জানাব। এখন বেশি কিছু লিখলাম না। ভালো থাকার চেষ্টা করো, আমিও তাই করব।
আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সহিসালামত কামনা করছি আর তিনি যেন তোমাকে ধৈর্য ধরার তওফিক দেন, সেই দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি—
চিঠিটা একটা সাদা খামে ভরে মুখবন্ধ করছে, এমন সময় কুলসুম এসে বলল, চিঠিটা দাও।
কামরুল চিঠিটা তার হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কি আমার ও শামিমার সম্পর্কের কথা তোর মাকে কখনো বলেছিস?
কুলসুম বলল, না, বলি নি। অনেক আগে আম্মাই একদিন আমাকে বলল, শামিমা তোর সই, তোর ছোট চাচার সঙ্গে সে যে মেলামেশা করে, এখানে সেখানে যায়, তা তুই জানিস?
আমি সেদিন মাকে বরং মিথ্যে করে বললাম, কই, আমিতো এসব জানি না? তুমি কার কাছে শুনেছ?
আম্মা বলল, তোর আব্বা তাদেরকে কয়েকদিন জমিদার বাড়ির দিকে যেতে দেখেছে।
বললাম, আমাকেও একদিন জমিদার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেদিন তোমার শরীর খারাপ ছিল বলে যাইনি। তারপর আম্মা কিছু জিজ্ঞেস করে নি।
ঠিক আছে, এখন তুই যা।
.
চিঠি পেয়ে শামিমা কিছুটা স্বস্তি পেল।
এর দুদিন পর রহিমা ও মনিরুল এসে শুক্রবার কাবিন করার জন্য পাকা। কথাবার্তা বলে গেল।
ঐ দিন সারারাত শামিমা ঘুমাতে পারল না। পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় কুলসুম তাকে কামরুলের চিঠি দিল।
শামিমা যেতে যেতেই পড়ল, আজ রাত তিনটের সময় আমি তোমাদের বাড়ির সামনে জামরুল গাছের তলায় থাকব, তুমি আসবে। আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। পরে অবস্থা বুঝে ফিরে আসব। অনেক চিন্তা ভাবনা করে এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ পেলাম না। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক।
ইতি–
চিঠি পড়া শেষ করে শামিমা দাঁড়িয়ে পড়ে কুলসুমকে বলল, তুই যা, আমি আজ যাব না।
কুলসুম বলল, ছোট চাচা কি লেখেছে দেখি, তারপর তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়ে ফেরৎ দিয়ে বলল, এরপর আর স্কুলে যাওয়া তোর পক্ষে সম্ভব নয়।
শামিমা ছলছল চোখে বলল, পরীক্ষা দেয়া হবে না ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে।
কুলসুম বলল, ছোট চাচারও পরীক্ষা দেয়া হবে না। সেজন্য তারও কি কম কষ্ট হচ্ছে? এই কদিন চিন্তায় চিন্তায় তার মুখ শুকিয়ে গেছে। আম্মা বোধ হয় কিছু বুঝতে পেরেছে। আজ সকালে ছোট চাচাকে বলতে শুনলাম, তোমার কি হয়েছে? রাতের খাবার অর্ধেক পড়ে থাকে। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাও।
ছোট চাচা বলল, না বড় ভাবি, আমার কিছু হয় নি। রাত জেগে পরীক্ষার পড়া তৈরি করছি, তাই ক্ষিধে মান্দা হয়েছে।
শামিমা বলল, এবার তুই যা। আরো দেরি করলে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
কুলসুম ঘড়ি দেখে বলল, হ্যাঁ যাই।
শামিমা বলল, সই, তোর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না। দোয়া করিস, আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দেন।
তাতো করবেই বলে কুলসুম হাঁটতে শুরু করল।
মেয়েকে ফিরে আসতে দেখে রিজিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, ফিরে এলি কেন?
শামিমা বলল, হঠাৎ মাথার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, তাই স্কুলে যেতে মন চাইল না।
না গিয়ে ভালই করেছিস। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। কিছুক্ষণ ঘুমালে যন্ত্রণা কমে যাবে।
রাত জাগতে হবে বলে শামিমা সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাল। রাত এগারটার সময় একটা কাপড়ের সাইড ব্যাগে ভালো ভালো কয়েক সেট সালওয়ার কামিজ ও ওড়না এবং টুক-টাক প্রসাধনীর জিনিস গুছিয়ে রাখল। আব্বা তাকে মাঝে মাঝে বিশ পঞ্চাশ টাকা হাত খরচ দেয়। সেগুলো খরচ না করে জমাত। প্রসাধনী বা খাতা কলম মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কিনত। এখন সেই টাকাগুলো গুনে দেখল, দু’হাজার। ভাবল, এরকম অবস্থায় পড়বে জানলে আরো বেশি টাকা জমাবার চেষ্টা করত। টাকাগুলো ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে চিন্তা করতে লাগল, কামরুল ভাই তাকে নিয়ে কোথায় যবে? কিভাবে বিয়ে করবে? তার কাছে টাকা পয়সা আছে কিনা? থাকলেও কত টাকা আছে? যত রাত বেশি হতে লাগল তত তার ভয় করতে লাগল।
শামিমাকে নিয়ে পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কামরুল আগেই টাকার ব্যবস্থা করেছে। তার কাছে মাত্র তিনশ টাকা ছিল। এই সামান্য টাকা নিয়ে বেরোনো উচিত হবে না। তাই কলেজে লাগবে বলে আব্বার কাছ থেকে এক হাজার নিয়েছে। তার দু’বোনের অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হয়েছে। বিশেষ দরকার আছে বলে তাদের কাছ থেকেও পাঁচশ করে একহাজার নিয়েছে। শেষে মায়ের কাছ থেকে একই কথা বলে একহাজার নিয়েছে।
ঠিক রাত তিনটের সময় কামরুল শামিমাদের বাড়ির সামনে জামরুলগাছের তলায় এসে দাঁড়াল। সে আসেনি দেখে ভাবল, নিশ্চয় এক্ষুনি এসে পড়বে। পঞ্চমীর চাঁদ রাত নটার দিকে ডুবে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার ঘুট ঘুট করছে। সামান্য দূরের কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। যত সময় যেতে লাগল তত অস্থির হয়ে উঠল। ভাবল, তা হলে কি ব্যাপারটা চাচা চাচি জেনে গিয়ে ওকে ঘরে তালা দিয়ে রেখেছে? আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ওর রুমের জানালার কাছে গিয়ে দেখবে কিনা চিন্তা করছিল, এমন সময় শামিমা এসে বলল, চল।
কামরুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যেতে যেতে বলল, তোমার দেরি হল কেন? আমার যা চিন্তা হচ্ছিল।
কি করব বল? তিনটে বাজার পাঁচ মিনিট আগে বেরোতে যাব, এমন সময় মায়ের রুমের দরজা খোলার শব্দ হতে জানালা দিয়ে দেখি, মা বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। ফিরে এসে মা রুমে ঢুকে দরজা লাগাবার পরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপর ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে বেরিয়ে আসি। তারপর জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
প্রায় দশ বার মাইল দূরে রামনগরে আমার মামাত বোনের বাড়ি। ওখানেই বিয়ের কাজ সারবো, তারপর আল্লাহর যা মর্জি।
ওরা যদি আমাদেরকে আটকে রেখে বাড়িতে খবর দেয়, তা হলে?
না, তা করবে না। দুলাভাই ভালো মানুষ ও রসিক লোক। আব্বাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আমাকেও খুব ভালবাসে। তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না।
ফরিদপুর টাউনে এসে শামিমা বলল, এখন তো বাস নেই, যাব কিসে?
বাস চলবে সকালে। ততক্ষণ এখানে থাকলে ধরা পড়ে যাব। তাই যতটা সম্ভব হেঁটে যাব। তারপর বাস এলে উঠে পড়ব। তুমি বোরখা এনেছ?
হ্যাঁ, সাইড ব্যাগে আছে।
খুব ভালো করেছ। দুলাভাই বেপর্দা মেয়ে দেখতে পারে না।
কামরুলের মামার মেয়ে রাবিয়ার বিয়ে হয়েছে রামনগর গ্রামে। স্বামীর নাম হাবিব। অবস্থা স্বচ্ছল। ওরা যখন তাদের বাড়ি পৌঁছাল তখন বেলা নটা।
বেলা ওঠার পর শামিমা বোরখা পরে নিয়েছে।
হাবিব নাস্তা খেয়ে ক্ষেতে কামলাদের কাছে যাওয়ার পথে ওদেরকে দেখে খুব অবাক হলেও খুশী হল। বলল, আরে, বড় কুটুম যে? তারপর সালাম ও কুশল। বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, সঙ্গিনীর পরিচয় বলবে না?
আগে ঘরে চলুন, তারপর বুবুর সামনে বলব,
ঘরে এসে হাবিব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি দেখবে এস কারা এসেছে।
স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর রাবিয়া সবেমাত্র থালা বাসন ধুতে পুকুরঘাটে এসেছে। স্বামীর কথা শুনে সেগুলো ঘাটে রেখে এসে ওদেরকে দেখে অবাক হয়ে কামরুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে বাড়ির সব খবর ভালো তো?
কামরুল বলল, হ্যাঁ বুবু ভালো।
ঘরে এসে শামিমা মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, একে তো চিনতে পারছি না, পরিচয় করিয়ে দিবি তো।
ও শামিমা, চাচাতো বোন। বুবু, বিপদে পড়ে খুব কষ্ট করে তোমাদের কাছে। এসেছি। আমরা খুব ক্লান্ত। এখন আমাদের বিশ্রাম দরকার।
ঠিক আছে, তুই তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঐ রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নে।
তারপর শামিমাকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। তোমরা নাস্তা খেয়ে তারপর বিশ্রাম নেবে।
নাস্তা খাওয়ার পর কামরুল সংক্ষেপে তাদের আসার কারণ বলে বলল, আজ কালের মধ্যে তোমরা আমাদের বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করবে।
হাবিব বলল, তোমার সাথে বোরখাপরা মেয়ে দেখেই যা সন্দেহ হয়েছিল, সেটাই ঠিক হল। এভাবে চলে আসা তোমাদের উচিত হয় নি। আর তোমাদেরকেই বা দোষ দিয়ে কি হবে? যারাই প্রেম করে তারাই উচিত অনুচিতের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তোমরা মারাত্মক অন্যায় করেছ, তোমাদের গুরুতর শাস্তি। হওয়া উচিত।
রাবিয়া স্বামীকে কপট রাগের সঙ্গে বলল, আর যারা প্রেম করে নি, তাদের বুঝি উচিত অনুচিতের জ্ঞান খুব টনটনে?
নিশ্চয়, আমিই তার প্রমাণ। প্রেম করিনি বলেই উচিত অনুচিত জ্ঞান আমার প্রখর।
থাক, অত আর নিজের প্রশংসা নিজে করো না। শালা-শালী বিপদে পড়ে সাহায্যের আশায় ওনার কাছে এসেছে, আর উনি কিনা সাহায্য না করে উল্টে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছেন। এটাই বুঝি তোমার উচিত অনুচিতের টনটনে জ্ঞান?
আহ-হা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ কেন? আমি কি বলছি ওদেরকে সাহায্য করব না? দুলাভাই হয়ে যদি শালা শালীকে বিপদে সাহায্য না করি, তা হলে কে করবে? তাই বলে ছোটরা অন্যায় করলে তাদেরকে শাসন করতে হবে না?
ঠিক আছে, শাসন করলে পরে করো, এখন ওদেরকে বিশ্রাম নিতে দাও। আর শোন, এশার নামাযের পর বিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করবে। মসজিদের ইমাম সাহেবকে কথাটা জানিয়ে এখানে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিবে। তারপর কামরুলকে বলল, তুই পাশের রুমে ঘুমাতে যা, শামিমা আমার ঘরে ঘুমাবে।
ওরা চলে যাওয়ার পর হাবিব বলল, শালা-শালীর বিয়ে, একটু ধূমধাম করলে হত না?
কে তোমাকে ধূমধাম করতে নিষেধ করছে। পাড়ার লোকদের শালা-শালীর বিয়ের কথা জানিয়ে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দাও। ঘরে বড় খাসি আছে জবাই কর।
তা হলে মালপানি ছাড়, কামলাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাজারে যাব। কি কি আনতে হবে বল, লিস্ট করে নিই।
তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটা বড় নাম আবু সালেহ। এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়ের নাম শামীহা। ক্লাস নাইনে পড়ে। তাদের ফুপা ফুপি বেড়াতে এসেছিল। স্কুল ও কলেজ বন্ধ থাকায় গত পরশু তাদেরকে নিয়ে গেছে।
রাবিয়া টাকা ও বাজারের ব্যাগ স্বামীর হাতে দিয়ে বলল, বাজারে যাওয়ার আগে কাজের ছেয়েটাকে ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসতে পাঠাও।
তুমি খুব ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে এক্ষুণি পাঠাচ্ছি বলে হাবিব বেরিয়ে গেল।
ছয়
কামরুল ও শামিমা রাত তিনটেয় বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় কেউ না দেখলেও মসজিদের ইমাম সাহেব তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য অযু করে মসজিদে আসার সময় তাদেরকে দেখেছেন। কিন্তু কামরুল বা শামিমা ইমাম সাহেবকে দেখে নি।
তিনি প্রায় বিশ পঁচিশ বছর এই মসজিদে ইমামতি করছেন এবং কুরআনিয়া মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের কুরআন ও নামায পড়া শেখান। কামরুল ও শামিমা ওনার কাছেই ছোট বেলায় কুরআন ও নামায পড়া শিখেছে। তিনিও তাদের সম্পর্কের কথা জানেন। তাই রাতের অন্ধকারেও চিনতে পারলেন।
কামরুলের বাবা আমিরুল ইসলাম মসজিদে ফজরের নামায পড়তে এলে ইমাম সাহেব তাকে বললেন, নামাযের পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন কথা আছে।
নামায শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে ইমাম সাহেব আমিরুল ইসলামকে কথাটা জানিয়ে বললেন, ওদেরকে টাউনের দিকে যেতে দেখেছি।
দু’বছর আগে আমিরুল ইসলামের কানেও ওদের মেলামেশার কথা পড়েছিল। তখন ভেবেছিলেন, ঘটনা সত্য হলে শামিমাকে ছোট বৌ করে ঘরে তুলবেন। তা হলে আনোয়ারুলদের সঙ্গে মনোমালিন্য আর থাকবে না। সেই কথা ভেবে ওদের সম্পর্কের কথা জেনেও মাথা ঘামান নি। গতকাল রহিমা স্বামীকে নিয়ে এসে দেবরের সঙ্গে শামিমার কাবিন করার কথা পাকা করে গেছে, সে কথা ঐদিন এশার নামাযের পর ইমাম সাহেবের কাছেই শুনেছেন। এখন ওনার কথা শুনে ভাবলেন, সামনের শুক্রবার কাবিন হবে জেনেই দু’জনে পালিয়েছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একথা আর কাউকে বলবেন না। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব বলে ঘরে এলেন।
আনোয়ারা বেগম নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। স্বামীকে পাশে বসতে দেখে কুরআন বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বলবে?
আমিরুল ইসলাম ইমাম সাহেবের কথাটা জানিয়ে বললেন, দেখতো ও ঘরে আছে কি না।
আমি অযু করতে যাওয়ার সময় নামায পড়ার জন্য ওকে জাগাতে গিয়ে দেখি ঘরে নেই। মনে করেছিলাম মসজিদে নামায পড়তে গেছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ইমাম সাহেব ঠিক কথাই বলেছেন।
কেন ঠিক মনে হল?
গতকাল কলেজে দরকার আছে বলে আমার কাছ থেকে একহাজার টাকা নিয়েছে।
তাই নাকি? ঐ কথা বলে আমারও কাছ থেকে একহাজার নিয়েছে। কাজটা ও ভালো করে নি। সামনে ওর ফাইন্যাল পরীক্ষা। শামীমারও সামনে পরীক্ষা। তা ছাড়া ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে আমার মান ইজ্জত ডুবে যাবে। আমি সবার বিচার করি। আমার মান ইজ্জতের কথা একটু চিন্তা করল না। ওকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না।
উত্তেজিত হয়ো না তো? উত্তেজিত হলে মানুষ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যা হয়ে গেছে তা ফেরাতে পারবে না। এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা কর, কি করলে তোমার মান ইজ্জত বাঁচবে।
আমার মাথায় তো কিছু আসছে না।
তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ, তাই মাথায় কিছু আসছে না। আমি যা বলছি শোন, তুমি এক্ষনি আনোয়ারুলের কাছে গিয়ে কথাটা জানিয়ে ওদের বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। রাজি না হলে বংশের মান ইজ্জত রক্ষা করার কথা বলে বোঝাবে। বস, চা নাস্তা করে দিই, খেয়ে তারপর যাবে। খালি পেটে মানুষ তাড়াতাড়ি রেগে যায়, মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে না।
আনোয়ারুল হক ও রিজিয়া খাতুন আগে নামায না পড়লেও রমযান মাসে রোযা রাখতেন। বছর খানেক হতে চলল, শামিমা তাদেরকে নামায পড়ার ও না পড়ার ফলাফল বলে নামায ধরিয়েছে।
আজ রিজিয়া খাতুনের ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ভাবলেন, দেরি হলে সূর্য ওঠার আগে শামিমা জাগিয়ে দিয়ে নামায পড়ার কথা বলে। আজ জাগাল না কেন? আবার ভাবলেন, অনেক রাত জেগে পরীক্ষার পড়া তৈরি করে তাই হয়তো ঘুম ভাঙ্গে নি। জাগাবার জন্য তার রুমের দরজার কাছে গিয়ে কয়েকবার নাম ধরে ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে দরজায় কড়া নাড়া দিতে গেলে খুলে গেল। দেখলেন, নেই। হয়তো বাথরুমে গেছে ভেবে সেদিকে তাকিয়ে বাথরুমের দরজা খোলা দেখে চিন্তা করলেন এত সকালে কোথায় যেতে পারে? রুমের সবকিছু আগোছাল দেখে কিছু একটা সন্দেহ হতে নিজের রুমে এলেন।
আনোয়ারুল হক তখনও ঘুমাচ্ছিলেন।
রিজিয়া খাতুন স্বামীকে জাগিয়ে বললেন, শামিমাকে পাচ্ছি না।
আনোয়ারুল হক উঠে বসে হাই তুলে বললেন, বাথরুমে গেছে হয়তো।
বাথরুমের দরজা খোলা।
তা হলে অন্য কোথায় গেছে।
অন্য কোথায় আবার যাবে?
পড়াশোনার ব্যাপারে কুলসুমের কাছে যেতে পারে।
এক বছরের বেশি হয়ে গেল, ওদের বাড়িতে নিষেধ করেছি বলে যায় নি, আর কুলসুমও আসে নি। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
কি সন্দেহ হচ্ছে?
পালিয়ে গেছে।
কি যা তা বলছ? পালাবে কেন?
রহিমা ও জামাই যে দিন এসে কাবিন করার কথা বলে গেছে, সেদিন থেকে ওকে খুব গম্ভীর দেখেছি। সব সময় কি যেন চিন্তা করে।
ও কিছু নয়। কাবিন করতে রাজি ছিল না। তার উপর সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করতে পারবে কিনা চিন্তা করে। •
প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজিজুলকে ও পছন্দ করে না, করে কামরুলকে। কাবিনের দিন ঠিক হয়ে গেছে জেনে কামরুলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
আনোয়ারুল রেগে উঠে বললেন, তা একেবারেই অসম্ভব। কামরুলের এত বড় সাহস হবে না, শামিমাকে নিয়ে পালাবে। যদি তোমার কথা সত্য হয়। তা হলে কামরুলের কি করি দেখে নিও।
চিল্লাচিল্পী না করে কাউকে দিয়ে কামরুল ঘরে আছে কি না খোঁজ নাও। তারপর যা করার করো।
আনোয়ারুল হক কিছু না বলে বাথরুমের কাজ সেরে এসে গায়ে জামা দিয়ে বেরোবেন, এমন সময় বড় ভাইকে আসতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমিরুল ইসলাম কাছে এসে বললেন, ঘরে চল কথা আছে।
বড় ভাইকে দেখেই আনোরুল হকের সন্দেহ হল।ঘরে এসে বারান্দার চেয়ারে বসতে বলে নিজেও বসলেন।
ভাসুরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসতে দেখে রিজিয়া খাতুনের সন্দেহটা দৃঢ় হল। মাথায় কাপড় দিয়ে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন।
তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে আমিরুল ইসলাম বললেন, কামরুল ও শামিমা রাত তিনটের সময় পালিয়ে গেছে। কেন পালিয়েছে তা তোমারও যেমন জান, আমরাও তেমনি জানি। আমাদের বংশের মান সম্মান রক্ষার জন্য গ্রামের লোকজন জানাজানি হওয়ার আগে ওদেরকে ফিরিয়ে এনে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। নচেৎ মানুষের কাছে মুখ দেখান যাবে না।
আনোয়ারুল হক খুব রাগের সঙ্গে বললেন, এটা একেবারেই অসম্ভব। তুমি ভাবলে কি করে কামরুলকে আমরা জামাই করব? রহিমার দেবরের সঙ্গে ওর সামনের শুক্রবার কাবিন। তাদের কাছে আমাদের মান ইজ্জৎ থাকবে?
স্বামী থেমে যেতে রিজিয়া খাতুন উঁচু গলায় বললেন, দুনিয়া একদিক হয়ে গেলেও কামরুলের সঙ্গে শামিমার বিয়ে দেব না। শামিমার কাবিন হওয়ার কথা জেনে আপনি ছেলেকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছেন। ভালো চানতো আমাদের মেয়েকে ফিরিয়ে এনে দেন।
আমিরুল ইসলাম বললেন, তোমার ধারণা ভুল। কামরুল এরকম করবে আমি কল্পনাও করি নি। তোমরা ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো চিন্তা করে দেখ, আমি ভালো বলছি, না মন্দ বলছি। তারপর আনোয়ারুল হককে উদ্দেশ্য করে বললেন, বড় ভাই হিসাবে বলছি, তোমরা আমার কথা মেনে নিলে সব কুল বজায় থাকবে।
আনোয়ারুল হক বললেন, না, আমরা তোমার কথা মানবো না। তুমি চলে যাও। আর কখনও এ ব্যাপারে কথা বলতে এস না।
তোমরা এত অবুঝ কেন? শামিমা শুধু তোমাদের মেয়ে নয়, আমাদেরও মেয়ে। তার নামে দুর্নাম রটুক তা আমরা চাই না। আর তোমরা আমাদেরকে ভুল বুঝতেছ।
স্বামী বলার আগে রিজিয়া খাতুন বললেন, এখন ভাইঝীর জন্য দরদ উথলে উঠছে। আগে যখন কামরুলের সঙ্গে ওকে নিয়ে গ্রামের লোকজন কানাকানি করত তখন দরদ কোথায় ছিল? যান, চলে যান। আমাদের মেয়ের দুর্নাম রটুক আর যাই রটুক, তাকে ফিরিয়ে এনে যেখানে কাবিন হওয়ার কথা হয়েছে সেখানেই হবে।
আমিরুল ইসলাম আরো অনেককিছু বলে বোঝালেন, কিন্তু আনোয়ারুল হক ও রিজিয়া খাতুন কোনো কিছু বুঝ মানলেন না। বরং অনেক ছোট বড় কথা শুনিয়ে দিলেন।
তাদেরকে কোনো রকম বোঝতে না পেরে আমিরুল ইসলাম বিষণ্ণ মনে ফিরে এলেন।
স্বামীকে মন খারাপ করে ফিরতে দেখে আনোয়ারা বেগম যা বোঝার বুঝে গেলেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে, ছোট ভাই রাজি হয় নি?
আমিরুল ইসলাম বললেন, ওরা দুজনেই খুব অবুঝ। আমার কোনো কথাই শুনল না। এখন কি করব ভেবে পাচ্ছি না।
এক কাজ কর গ্রামের গণ্যমাণ্য লোকদের নিয়ে আবার একদিন যাও। ওনাদের কথায় রাজি হতে পারে।
ওদের দুজনকেই তো তুমি ভালোভাবেই চেন, দু’জনেরই শূওরের মতো গো। গণ্যমান্য লোকদের কথাও মানবে না।
মানতেও তো পারে? চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?
ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ তাই করব।
ঘটনাটা এক কান দু’কান করে ঐ দিনই রহিমাদের কানে পড়ল।
আজিজুল জেনে কামরুলের উপর খুব রেগে গেল। ভাবিকে বলল, হোটবেলা থেকে চাচাত ভাইবোন হিসেবে কামরুলের সঙ্গে শামিমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, কিন্তু বড় হয়ে শামিমা আমাকে ভালবেসে ফেলে। কামরুল তা জানতে পেরে ক্যাপচার করার জন্য ওকে ফুসলাতে থাকে। সামনের শুক্রবার কাবিন হবে শুনে ওকে নিয়ে পালিয়েছে। আমি ওকে ছেড়ে কথা বলব না।
রহিমা বলল, অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? তোমার ভাইয়াও কি ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছ? ধৈর্য ধরে দেখ, তোমার ভাইয়া কি করে। তারপর একসময় স্বামীকে আজিজুলের কথাগুলো জানিয়ে বলল, কি করবে না করবে কিছু ভেবেছ?
মনিরুল বলল, ভাবা-ভাবির কি আছে? কামরুলদের সবাইকে জেলে না পাঠিয়েছি তো আমি বাপের বেটা নই। কাল সকালেই শামিমার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে যা করার করব।
পরের দিন স্ত্রীকে নিয়ে মনিরুল শামিমার মা বাবার সঙ্গে দেখা করে বলল, আমরা খরবটা শুনে এলাম। এখন কি করবেন ভেবেছেন?
আনোয়ারুল হক বললেন, এখন থানায় কেস করতে যাব ভাবছি।
তাতো করবেনই, আমরা জানতে চাচ্ছি কাবিন করার ব্যাপারটা।
এ ব্যাপারে আমার আর কি বলার আছে বাবা? শামিমা যে এরকম করবে ভাবতেই পারছি না।
চাচা-চাচিকে কি বলবে মনিরুল আসার সময় স্ত্রীকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই চাচার কথা শুনে রহিমা বলল, এরপর তো আমরা শামিমাকে বৌ করতে পারি না।
স্ত্রী থেমে যেতে মনিরুল বলল, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওরা অনেক আগে থেকে একে অপরকে ভালোবাসে। নিশ্চয় আপনারাও জানতেন। জেনেও কেন আমাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন, সেকথা আপনাদের মেয়ে রহিমা আমাকে বলেছে। তাই বলছি এক কাজ করুন কামরুলের সঙ্গেই ওর বিয়ে দেন। তবে তার আগে ওদের কাছ থেকে পাঁচলাখ টাকা দাবি করবেন। বলবেন, এই টাকাটা না দিলে আমরা কামরুলকে জামাই করব না।
পাঁচলাখ টাকার কথা শুনে লোভে রিজিয়া খাতুনের চোখ চিকচিক করে উঠল। ভাবলেন, শ্বশুরকে ভুলিয়ে বড় জা যে ডাঙ্গাটা নিয়েছিল, তার বদলা নেয়া হবে।
টাকার অঙ্ক শুনে আনোয়ারুল হকেরও লোভে চোখ চকচক করে উঠল। বললেন, কথাটা তুমি মন্দ বল নি। কিন্তু অতটাকা কি ওরা দেবে?
মনিরুল বলল, পাঁচলাখ না দিলে তিনলাখতো দেবেন। তার কমে কিন্তু রাজি হবেন না।
রহিমা বলল, আপনাদের জামাই ঠিক কথা বলেছে। আপনারা তিনের নিচে নামবেন না। যদি টাকা দিতে রাজি না হয়, তা হলে নগদ চার পাঁচ লাখ টাকা ও পঞ্চাশ হাজার টাকার দু’সেট সোনার গহনা নিয়ে নাবালিকা শামিমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কামরুল পালিয়ে গেছে। আর এটা করিয়েছে কামরুলের বড় ভাই ও তার বাবা আমিরুল ইসলাম। এইসব উল্লেখ করে থানায় কেস করুন। দেখবেন, ওনারা তিন বা পাঁচলাখ টাকা দিয়ে মিমাংসা করার জন্য নিজেরাই আসবেন।
আনোয়ারুল হক কৃপণ স্বভাবের লোক। ওনার অবস্থা খুব স্বচ্ছল নয়। তিনি পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের শ্রমিক নেতা। তাই মামলা করার কথা শুনে বললেন, কিন্তু মামলা করলে তো অনেক টাকা আমাদেরও খরচ হবে?
মনিরুল বলল, খরচ তো কিছু হবেই। ও নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না। যত টাকা লাগে আমি দেব। মিমাংসা হয়ে গেলে আপনারা যখন টাকা পাবেন তখন দিয়ে দেবেন। আমার মনে হয় তেমন বেশি খরচ হবে না। মামলার সমন পেয়ে ওনারা তাড়াতাড়ি আপোষ মিমাংসা করার জন্য আপনাদের কাছে আসবেন। তখন আপনারা টাকার দাবি করলে মেনে নিতে বাধ্য হবেন।
আনোয়ারুল হক চিন্তিত গলায় বললেন, যদি তারা আপোষ মীমাংসার জন্য না আসে; তা হলে মামলা তো অনেক দিন চলবে। তখন আরো বেশি টাকা খরচ হবে।
যত টাকই খরচ হোক আমি দেব, টাকার চিন্তা করবেন না।
এবার রিজিয়া খাতুন স্বামীকে একটু গরম মেজাজে বললেন, জামাই যখন মামলার খরচ দেবে বলেছে তখন টাকার চিন্তা করছ কেন?
রহিমা বলল, চাচা, আপনাদের জামাই যা বলল, তাই করুন। দেখবেন, আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।
আনোয়ারুল হক বলেন, গতকাল বড় ভাই এসেছিল ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার কথা বলতে। তারপর তাদের দুজনের মধ্যে যা কিছু কথা হয়েছে বলে বললেন, সে কি আবার আসবে?
মনিরুল বলল, একবার যখন এসেছেন তখন মুরুব্বীদের নিয়ে আবারও আসতে পারেন। যদি না আসেন তা হলে যে কথা বলে মামলা করতে বললাম, সেইসব উল্লেখ করে মামলা রুজু করবেন।
তাতো করবই, কিন্তু আমি তো মামলা টামলার কিছু বুঝি না, তোমাকেই সবকিছু করতে হবে। আমি শুধু সঙ্গে থাকব।
আমিই যখন মামলা করার পরামর্শ দিলাম তখন আপনি না বললেও থাকতাম। কি হল না হল আমাকে খবরটা শুধু দেবেন। তারপর যা করার আপনাকে সঙ্গে নিয়েই করব।
মনিরুলের বাবা সাবুদ্দিন দু’বার কমিশনার প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু দু’বারই আমিরুল ইসলামের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। শেষবারে হেরে যাওয়ার খরব শুনে তিনি হার্টফেল করে মারা যান। মনিরুলের ধারণা আমিরুল ইসলামের কারণেই তার বাবা হার্টফেল করেন। তাই সেই থেকে আমিরুল ইসলামের উপর মনিরুলের খুব রাগ। এখন সুযোগ পেয়ে বাবার মৃত্যুর বদলা নেয়ার জন্য আনোয়ারুল হককে পাঁচলাখ টাকার দাবি করতে বলেছে এবং টাকা না দিলে মামলা করতে বলেছে।
আমিরুল ইসলাম ঐদিন বিকেলে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গ্রামের পাঁচ ছয়জন গণ্যমান্য লোক নিয়ে আনোয়ারুল হকের কাছে এসে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
চেয়ারম্যান ও গন্যমান্য লোকেরা আনোয়ারুল হককে প্রস্তাব মেনে নিতে বললেন,
ওনাদের আসতে দেখে রিজিয়া খাতুন স্বামীকে বলেছেন, বিয়ের কথা তুললে তুমি কিছুতেই রাজি হবে না। তখন আমি টাকার দাবি করব।
তাই আনোয়ারুল ওনাদের কথা শুনে বললেন, মাফ করবেন, আমি আপনাদের কথা মেনে নিতে পারলাম না।
চেয়ারম্যান বললেন, হয়তো আপনাদের দুভায়ের মধ্যে কোনো ব্যাপারে। মনোমালিন্য থাকতে পারে। এখন ছেলেমেয়ের বিয়ের মাধ্যমে তা মিটিয়ে ফেলাই তো উচিত। ভাই ভাই ঠাই ঠাই। ভাইয়েদের মধ্যে বেশি দিন মনোমালিন্য থাকা উচিত নয়।
রিজিয়া খাতুন দরজার আড়াল থেকে বললেন, কামরুল আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় নগদ ও সোনার অলঙ্কার মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো নিয়ে গেছে। কামরুলের আব্বা যদি নগদ পাঁচ লাখ টাকা দেন, তা হলে আমরা বিয়ে দিয়ে মিমাংসা করতে রাজি আছি।
রিজিয়া খাতুন যে মিথ্যে বলেছেন তা সবাই বুঝতে পারলেন। আমরা বুঝতে পারলেন, তার কদর্য মনের পরিচয়। কারণ সবাই জানে এতটাকা আনোয়ারুল হকের নেই।
কেউ কিছু বলার আগে মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, ভাইয়ে ভাইয়ে টাকা নিয়ে মীমাংসা, এ কেমন কথা? তারপর চেয়ারম্যান সহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা যদি অনুমতি দেন, তা হলে দু’একটা কথা বলি?
বেশ তো, বলুন কি বলতে চান।
আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন “তোমাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কিরূপ আত্মীয়তার বন্ধন রাখিতে হয়, তাহা তোমাদের পূর্বপুরুষদের নিকট হইতে শিক্ষালাভ কর। কেন না আত্মীয়তার বন্ধন পরিবারের মধ্যে ভালবাসার উপায়, ধর্ম বৃদ্ধির উপকরণ এবং মৃত্যু বিলম্ব করার উপায়। [বর্ণনায় : আবু হোরায়রা (রাঃ) তিরমিযী]
এই হাদিস জানার পর প্রত্যেক মুসলমানের উচিত আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করা। টাকা দাবি করে আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয় না। বরং ছিন্ন হয়। তবে সত্যি যদি শামিমা মা বাবার টাকা ও সোনার অলঙ্কার নিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সেগুলো আমিরুল ইসলামের ফেরত দেয়া উচিত এবং উনি যে তা করবেন, তা আমরা জানি।
রিজিয়া খাতুন রাগের সঙ্গে বললেন, আমি অতশত বুঝি না। ফেরৎ দিক না দিক, আত্মীয়তার কারণে দু’লাখ না হয় বাদই দিলাম। অন্তত তিনলাখ টাকা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো কিছুতে রাজি হচ্ছি না।
চেয়ারম্যান বললেন, আসলে আপনারা মেয়ের বিয়ে কামরুলের সঙ্গে দিতে চান না। তাই টাকার বাহানা তুলেছেন। তারপর অনেক কিছু বলে তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরাও বিয়েটা মেনে নিতে বললেন, কিন্তু ওনাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল।
শেষে আমিরুল ইসলাম ছোট ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীকে অনেক অনুরোধ করলেন, কিন্তু কিছুতেই তারা যখন রাজি হলেন না তখন বললেন, তোমরা রাজি না হলেও আমি শামিমাকে ছোট বৌ হিসেবে ঘরে তুলব। দেখি, তোমরা কি করতে পার। তারপর সবাইকে নিয়ে ফিরে এলেন।
.
রাবিয়া ও হাবিবের ছেলেমেয়ে আবু সালেহ ও সামীহা ফুপুর বাড়ি থেকে ফিরে মায়ের কাছে সবকিছু শুনে খুশী হল। তারা কামরুলকে চিনলেও শামিমাকে চিনে না। সামীহা শামিমার সমবয়সী। তাই মা পরিচয় করিয়ে দিতে সামীহা তাকে নিয়ে নিজের রুমে এসে গল্প করার সময় তাদের প্রেম কাহিনী জানতে চাইল।
শামিমা যতটুকু বলার বলে বলল, আমাকে না জানিয়ে শুক্রবার মা বাবা এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে কাবিন করার দিন ঠিক করে। তাই আমরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।
সামিহা বলল, তুমি খুব সাহসী মেয়ে, আমি হলে ভয়ে মরেই যেতাম।
শামিমা বলল, প্রেমে পড়লে ভীতু মেয়েরাও সাহসী হয়ে যায়।
তাতো জানতাম না।
তুমিতো প্রেমে পড়নি, জানবে কি করে?
প্রেমে পড়লে যদি এরকম ঝামেলায় পড়তে হয়, তা হলে কারো প্রেমে পড়া উচিত নয়।
আরে ভাই প্রেমে কেউ কি ইচ্ছা করে পড়ে আপনি আপনি হয়ে যায়। তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। তুমি যদি কোনোদিন প্রেমে পড়, সেদিন আমার কথা সত্য না মিথ্যে জানতে পারবে।
আবু সালেহ ও কামরুল একেতো সমবয়সী, তার উপর আগের থেকে জানাশোনা।তাই আবু সালেহও কামরুলের কাছ থেকে সবকিছু জানার পর বলল, তবু বলব কাজটা তুমি ভালো কর নি।
কামরুল বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তবে একথা সত্য, সামনের শুক্রবার কাবিনের দিন ঠিক না হলে আমরা পালিয়ে আসতাম না। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার জায়গায় তুই হলে কি করতিস?
আমিতো প্রেম করে তোমার মতো পরিস্থিতিতে পড়ি নি, বলব কি করে?
ধর ঐ রকম পরিস্থিতিতে পড়েছিস?
আবু সালেহ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কাজি অফিসে গিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলতাম। আর ওকে শিখিয়ে দিতাম মা বাবা অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে বা কাবিন করার কথা বললে বলবে, আমি ও সালেহ কাজি অফিসে বিয়ে করেছি।
তারপর পরিস্থিতি কি হবে চিন্তা করবি না।
কি আর চিন্তা করব? দুজনকেই গার্জেনদের অত্যাচার সহ্য করতে হত।
এই বেটা, মনে হচ্ছে তুইও প্রেমে পড়েছিস?
আবু সালেহ হেসে উঠে বলল, কি করে বুঝলে?
তোর কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে।
না-মামা, প্রেম-ট্রেম আমি পছন্দ করি না। আজকাল প্রেমের ছড়াছড়ি ও তার ফলাফল দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। তা ছাড়া ইসলামে প্রেম-ভালবাসা যায়েজ নেই, বড় হওয়ার পর মা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।
তোর মা খুব ভালো কথা বলেছে। বিশেষ করে ছাত্রজীবনে প্রেম ভালবাসা করা মোটেই উচিত নয়।
আবু সালেহ আবার হেসে উঠে বলল, তাই যদি জানতে, তা হলে প্রেমের পথে পা বাড়ালে কেন?
কামরুলও হেসে উঠে বলল, আরে বেটা, আগে জানলে কি এই পথে পা বাড়াতাম।
বিয়ের আগেই তা হলে তুমি অনুতপ্ত।
প্রেম বা বিয়ে নিয়ে অনুতপ্ত নই। আর যদি পড়াশোনা করার সুযোগ না হয়, সেকথা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
এতক্ষণ তোমাকে বাজিয়ে দেখলাম এবার বলি, তুমি যা করেছ ভালো করেছ। কারণ তোমাদের অবস্থা এরকম নয় যে, মামীকে নিয়ে সংসার করার খরচের কথা ভাবতে হবে। নানাজীকে যতটুকু জানি, তিনি বৌও ঘরে তুলবেন এবং তোমাকে পড়াশোনার সুযোগও দেবেন।
কামরুল হাসতে হাসতে বলল, তুই তো দেখছি খুব পেকে গেছিস।
আবু সালেহও হাসতে হাসতে বলল, পাকলেও খুব পাকিনি। তুমিই বরং পেকে খয়ের হয়ে গেছ। নচেৎ উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র হয়ে এরকম কাজ করতে পারতে না।
এমন সময় রাবিয়া সেখানে এসে ছেলেকে বলল, মামার সঙ্গে গল্প করলে হবে? ওদিকে কত কাজ, তোর আব্বা কটা সামলাবে? যা তার কাছে, তোকে কখন থেকে খুঁজছে।
ঐদিন রাতে হাবিব বেশ ধূমধামের সঙ্গে শালা-শালীর বিয়ের ব্যবস্থা করল। কাজি সাহেব আসার পর প্রথমে কাবিন লেখা হল, তরপর শরামতে বিয়ে পড়ান হল।
খোরমা বিলি করার সময় হাবিব কামরুলকে বলল, কালকেই কাবিনটা কোর্ট থেকে এফিটেভিড করিয়ে নিতে হবে।
.
বড় ভাই আমিরুল ইসলাম লোকজন নিয়ে চলে যাওয়ার পর আনোয়ারুল হক স্ত্রীকে বললেন, আজই থানায় কেস করব।
রিজিয়া খাতুন বললেন, শুধু কেস করলে হবে? যাতে কামরুলের জেল হয় সেজন্য থানায় টাকা খাওয়াবে। যাওয়ার সময় মনিরুল জামাইকে সঙ্গে নিয়ে যেও।
সেকথা তোমাকে বলতে হবে না বলে আনোয়ারুল হক ড্রেস চেঞ্জ করে মনিরুলদের বাড়ি রওয়ানা দিলেন। কিছুদূর আসার পর তাকে আসতে দেখে। দাঁড়িয়ে পড়লেন। কাছে আসার পর বললেন, আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম।
মনিরুল সালাম বিনিময় করে বলল, কি খবর বলুন।
চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গ্রামের গণ্যমান্য লোক বড় ভাই নিয়ে মিমাংসার জন্য এসেছিল। তারপর যা কিছু কথা হয়েছে বলে বললেন থানায় কেস করার জন্য তোমার কাছে যাচ্ছিলাম।
মনিরুল বলল, আমিও কথাটা বলার জন্য আপনার কাছে আসছিলাম। চলুন যাওয়া যাক।
থানায় গিয়ে আনোয়ারুল হক নাবালিকা মেয়ে অপহরণের কেস দিলেন। কেসের এজহারে উল্লেখ করলেন,
‘কইজুরী গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে কামরুল ইসলাম আমার মেয়ে শামিমাকে রাতে পড়াত। ১৯৯৬ সালে ২রা মে তারিখে পড়াতে এসে রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার সময় কামরুল শামিমাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শামিমা নাবালিকা, ক্লাস নাইনের ছাত্রী, তার বয়স চৌদ্দ বছর। শামিমার মা রিজিয়া খাতুন তাদের সাড়া শব্দ না পেয়ে রুমে গিয়ে দেখেন তারা নেই। শামিমার বেশ কয়েক খানা জামাকাপড় ও জুতা নেই, ট্রাঙ্কের তালা খোলা। সন্দেহ হতে ট্রাঙ্ক খুলে দেখলেন কাপড়ের নিচে রাখা চার লাখ টাকা ও আঠাত্তর হাজার টাকার সোনার অলঙ্কার নেই। এইসব টাকা ও সোনার অলঙ্কার নিয়ে নাবালিকা শামিমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কামরুল অপহরণ করেছে। এইকাজে সহযোগীতা করেছে কামরুলের বাবা আমিরুল ইসলাম, বড় ভাই জহুরুল ইসলাম ও তার দুজন দুলাভাই।
এজাহার দেয়ার পর দারোগাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন, কামরুলের যাতে জেল হয় আর টাকা ও সোনার অলঙ্কার যেন ফেরৎ দেয়, সেই ব্যবস্থা করবেন। তা যদি করতে পারেন, তা হলে আপনাকে আমরা আরো অনেক টাকা দেব।
প্রায় দু’মাস মামাতো বোনের বাড়িতে বেশ আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে কামরুল শামিমাকে নিয়ে।
একদিন শামিমা কামরুলকে বলল, আর কতদিন দুলাভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে? আমার খুব লজ্জা লাগছে।
কামরুল বলল, আমিও কথাটা চিন্তা করেছি। কিন্তু বুবু দুলাভাই কি যেতে দেবে।
না দিলেও অন্য কোথাও যাওয়ার ব্যবস্থা কর।
ঠিক আছে, বুবুকে আজই বলব।
রাবিয়া শুনে বলল, কোথায় আবার যাবি? যতদিন না গোলমাল মিটে এখানেই থাকবি।
কিন্তু এখানে থাকলে কোনো খবরই পাব না। তা ছাড়া এভাবে এখানে কতদিনই না থাকব?
ঠিক আছে, কাল তোর দুলাভাইকে কইজুরী পাঠাব। ফিরে আসার পর যা হয় করা যাবে।
একসময় রাবিয়া স্বামীকে কামরুলের কথা জানিয়ে বলল, ফুপা ফুপীও খুব চিন্তায় আছেন। তুমি একদিন গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা কর। পরিস্থিতি ভালো বুঝলে ওদের বিয়ের ও এখানে থাকার কথা জানাবে। আর শামিমাদের বাড়ির পরিস্থিতিও ফুপার কাছ থেকে জেনে আসবে।
হাবিব বলল, কথাটা ভালই বলেছ। কালই কইজুরী যাব।
পরেরদিন হাবিব ফুপা শ্বশুরবাড়ি যখন এসে পৌঁছাল তখন সমন্ধি জহুরুল ও হাসানুজ্জামান বাড়িতে ছিল না। আমিরুল ইসলাম ছিলেন। তাকে দেখেই অনুমান করলেন, ওদের বাড়িতে নিশ্চয় কামরুল শামিমাকে নিয়ে উঠেছে। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর আপ্যায়নের সময় জিজ্ঞেস করলেন, কামরুলের কির্তীকলাপ কিছু শুনেছ?
জি শুনেছি।
ওরা কি তোমাদের বাড়িতে আছে?
হাবিব এখানকার পরিস্থিতি এখনও বুঝতে পার নি। সত্য কথা বলাটা ঠিক হবে কি না চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমিরুল ইসলাম আবার বললেন, তুমি কিছু না বললেও বুঝতে পারছি ওরা তোমাদের বাড়িতে আছে। এবার বল, ওরা কি বিয়ে করেছে?
জি।
নিশ্চয় তুমি ও রাবিয়া বিয়ের ব্যবস্থা করেছ।
জি, আমরাই করেছি।
কাজটা কি ভালো করেছ?
না, ভালো করি নি। তবু করেছি ওদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। আপনিও নিশ্চয় ওদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ক্ষমার চোখে দেখবেন।
যে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই ধ্বংস করল তার জন্য কি চিন্তা করব? ও ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছে।
তবু আপনাকে ক্ষমা করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ যাতে ধ্বংস হয়ে না যায়, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
ও আমার মান-সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। শামিমার বাবা টাকা ও সোনার গহনাসহ নাবালিকা মেয়ে অপহরণ ও নির্যাতনের মামলা দায়ের করেছে। পুলিশ ওকে খুঁজছে।
তাই নাকি? তা হলে তো আমাদের বাড়িতে বেশিদিন রাখা যাবে না। আচ্ছা ফুপাজী, মামলাটা আপোষ মিমাংসা করা যায় না?
সে চেষ্টা অনেক আগেই করেছি। শামিমার বাবা পাঁচলাখ টাকা দাবি করেছে।
বলেন কি পাঁচলাখ টাকা!
তবে আর বলছি কি? চেয়ারম্যান মেম্বার ও গ্রামের গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে মিমাংসার জন্য গিয়েছিলাম। তাদের কাছেই পাঁচলাখ টাকার কথা বলেছে। আমরা রাজি হয় নি। তুমি ফিরে গিয়ে ওদেরকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলবে। নচেৎ কোন দিন না কোনদিন খোঁজ পেয়ে এরেষ্ট করার জন্য পুলিশ গিয়ে হাজির হবে। তারপর কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, এটা কামরুলকে দিও।
হাবিব ফিরে এসে কামরুল ও শামিমার সামনে স্ত্রীকে সবকিছু বলে কামরুলকে টাকাটা দিল।
শামিমা বলল, টাকা ও সোনার অলঙ্কারের কথা আব্ব মিথ্যে বলেছে। ওসব আমার রুমে ট্র্যাঙ্কে ছিল না। তা ছাড়া অত টাকা ও গহনা আমাদের নেই।
হাবিব বলল, সেকথা সবাই জানে। এখন ওসব কথা বাদ দাও। যা বলছি শোন, ফুপাজী বলেছেন এখানে পুলিশ আসতে পারে। তোমাদের অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। কামরুল বলল, সেকথা তো আমি আগেই বুবুকে বলেছি।
রাবিয়া বলল, কিন্তু তোরা যাবি কোথায়? যেখানেই যাবি সেখানেই পুলিশ তোদের খোঁজে যাবে।
হাবিব বলল, আমার খালার বাড়ি নারিকেল বাড়িয়া। খালাত ভাই ইজাজের সঙ্গে আমার বোন যীনতের বিয়ে হয়েছে। ওটা খুব প্রতন্ত অঞ্চল। পুলিশ বা অন্য কেউই তোদের খোঁজ পাবে না। ওখানে গিয়ে থাক। পরে অবস্থা বুঝে তোমাদেরকে কি করতে হবে জানাব। ইজাজ খুব ভালো ছেলে। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। সবকিছু জেনে তোমাদেরকে খুব খাতির যত্ন করে রাখবে। ওদের অবস্থা খুব ভালো। যতদিন ইচ্ছা ওখানে তোমরা থাকতে পারবে।
নারিকেল বাড়িয়ায় নয় দশ মাস থাকার পর হাবিব একদিন এসে বলল, আমি কয়েকদিন আগে কইজুরী গিয়েছিলাম। ফুপাজী তোমাদেরকে ফিরে যেতে বলেছেন।
কামরুল বলল, কেসের ব্যাপারে কিছু বলেন নি?
বলেছেন, কোর্টে হাজির হলে জামিন নেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
প্রায় এক বছর পর কামরুল শামিমাকে নিয়ে দেশে ফিরল।
মা, বাবা, ভাই ভাবিরাও তাদেরকে কিছু বলল না। বরং শামিমাকে তারা আদরের সঙ্গে গ্রহণ করল।
পরের দিন কামরুল কোর্টে হাজির হয়ে উকিলের মারফত জামিনের আবেদন করল।
আনোয়ারুল হক কেস করার পর আমিরুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম ও আমিরুল ইসলামের দুই জামাই কোর্টে হাজিরা দিয়ে জামিন নেন এবং কামরুলের নামে ওয়ারেন্ট বেরোয়।
শামিমার মা রিজিয়া খাতুন মেয়েকে নাবালিকা প্রমাণ করার জন্য কোর্টে দাঁড়িয়ে বিচারকের সামনে বলেছিলেন, আমার মেয়ে শামিমা ইয়াসমিন নাবালিকা। আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শামিমা ইয়াসমিন সর্বকনিষ্ঠ। সেইমতে ওর বয়স চৌদ্দ বছর। ওর জন্ম হয় ১৯৮২ সালে। ওর জন্মের পর পর মার্চ মাসে ফরিদপুর পরিবার করিকল্পনা অফিসের মাধ্যমে লাইগেশন করি। তারপর আমার আর ছেলেমেয়ে হয় নি। তারপর লাইগেশন করার ভূয়া কাগজপত্র দাখিল করেন।
আনোয়ারুল হকও মেয়েকে নাবালিকা প্রমাণ করার জন্য বলেছিলেন আমার স্ত্রীর কথা সত্য। আমি নিজে তাকে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে লাইগেশন করবার জন্য নিয়ে গিয়াছিলাম।
প্রায় ছয় সাত মাস কেস চলার পর মামলার রায়ে কামরুলের সাত বছরের জেল হয়। আর প্রমাণের অভাবে অমিরুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম ও কামরুলের দুজন দুলাভাই নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় বেকসুর খালাস পান।
প্রায় একবছর পর কামরুল ফিরে এসে কোর্টে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করলে বিচারক জামিন মঞ্জুর না করে এ্যারেষ্ট করে জেলে পাঠিয়ে দিলেন।
শামিমা ও স্বামীর সঙ্গে এসেছিল। সে কোর্টে রীট পিটিশান দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকে গেল।
আমিরুল ইসলাম হাইকোর্টে আপীল করলেন, শুনানির দিন হাইকোর্টের বিচারপতি সব কাগজপত্র দেখে শামিমাকে হাজির করতে বললেন।
শামিমা কোর্টে হাজির হয়ে বিচারপতির আদেশক্রমে বলল, আমার সাথে আসামী কামরুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি এখন সাবালিকা। আমার জন্ম ১৯৭৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে। যখন আমরা বিয়ে করি তখন আমার বয়স উনিশ। আমার বাবা ও শ্বশুর আপন ভাই হলেও দু’পরিবারের মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল…যা এখনও বিদ্যমান। আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আমার মা বাবা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে। তাই আমরা দু’জন স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে রামনগরে আমার স্বামীর মামাত বোনের বাড়ি উঠি এবং ওনারা সেখানেই আমাদের বিয়ে দেন। আমি কামরুলকে এত ভালোবাসি যে, তাকে ছাড়া বাঁচব না। আমার মা রিজিয়া খাতুন ও বাবা আনোয়ারুল হক নিম্ন আদালতে যা কিছু বলেছেন সব মিথ্যে। আমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় টাকা পয়সা বা কোনো সোনার অলঙ্কার নিই নি। আমার স্বামীর যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হয়, তবুও আমি আমার স্বামীর ভীটে ছাড়ব না, শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে থাকব। আমার। যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা হলে আমার বাবা আনোয়ারুল হক ও মা রিজিয়া খাতুন দায়ী থাকবেন। কারণ তারা আমার সুখ চায় না। অপরের কথামতো মামলা করে আমাদের হয়রানী করে চলেছে। যে মা বাবা নিজের মেয়ের সুখের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে, সেই মা বাবার সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না। তা ছাড়া আমি এখন আট মাসের অন্তসত্ত্বা। আমার সন্তানের পরিচয় হবে পিতা কামরুল ইসলাম।
বাইস দিন জেলে থাকার পর কামরুল জামিন পেয়ে বেরিয়ে এল।
প্রায় দেড় বছর মামলা চলার পর হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে কামরুলকে বেকসুর খালাস দিল।
মেয়ে অপহরণের মামলায় কামরুলের কিছু করতে না পেরে ও বড় ভাইয়ের উন্নতি ও সুখ্যাতি সহ্য করতে না পেরে আনোয়ারুল হক ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। তাকে ইন্ধন যোগাতে লাগল মনিরুল। কি ভাবে এর প্রতিশোধ নেয়া যায়, তারা পরামর্শ। করে সিদ্ধান্ত নিলেন, কামরুলের বাবা আমিরুল ইসলামকে মারধর করে পঙ্গু করে দেবেন। সেই কাজের জন্য টাকা খাইয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসীকে নিযুক্ত করলেন। তারা সুযোগের অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগল।
১৯৯৯ সালে ১১ই আগষ্ট আমিরুল ইসলাম ওনার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে ইসরাইলকে নিয়ে পাশের গ্রামে শালিশে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় গ্রামের সীমানার ব্রীজের কাছে এলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে অতর্কিত হামলা চালাল। আমিরুল ইসলাম গুরুতর জখম হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে খুনীরা মারা গেছে ভেবে পালিয়ে গেল। ইসরাইল প্রাণপণে বাধা দিলে সন্ত্রাসীরা তাকেও মেরে আহত করে তার টাকা পয়সা, একটা সোনার চেইন ও হাতঘড়ি ছিনিয়ে নিল। খুনীরা চলে যাওয়ার সময় বলল, থানায় কেস করলে পরিবারের সবাইকে খুন করে ফেলব।
খবর পেয়ে আমিরুল ইসলামের তিন ছেলে ঘটনাস্থলে এসে অজ্ঞান অবস্থায় বাবাকে তাড়াতাড়ি ফরিদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল।
ইসরাইল আহত হলেও গুরুতর হয় নি। হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দেন।
পরেরদিন আমিরুল ইসলামের অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারদের পরামর্শমতো ঢাকা পি. জি. হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। কিন্তু চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলেন না। চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেলেন। শনিবার ময়না তদন্তের পর ছেলেরা লাশ নিজবাড়ি কইজুরী নিয়ে এসে জানাজা পড়ে দাফন করল।
বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দশ বার জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করল। তাদের মধ্যে শামিমার বড় ভাই শিহাব ও চাচাতো দুলাভাই মনিরুলকে প্রধান আসামী বলে উল্লেখ করল।
পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তিনজন আসামীকে গ্রেফতার করল। অন্যদের গ্রেফতারের জন্য ব্যাপক অভিযানের প্রেক্ষিতে ছয়জন আসামী জামিনের জন্য কোর্টে হাজিরা দিলে ম্যাজিষ্ট্রেট জামিন না মঞ্জুর করে কোর্ট হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। মনিরুল ও শিহাব গ্রেফতার এড়ানর জন্য ফরিদপুর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেল।
আসামীদের আত্মীয়-স্বজনেরা মরহুম আমিরুল ইসলামের ছেলেদেরকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য পরিবারের সবাইকে হত্যা করার হুমকী দিতে লাগল।
জহুরুল ইসলাম থানায় হুমকীর কথা জানিয়ে জি.ডি. করল। তারপর নিরাপত্তার কারণে পরিবারের সবাইকে নিয়ে টাউনের বাড়িতে বাস করতে লাগল।
প্রেম করে বিয়ে করার ফলে বাবাকে প্রাণ দিতে হল ভেবে কামরুল নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে করে বিবেকের চাবুকে জর্জরীত হতে লাগল। শামিমার সামনে এলে সামলাতে পারে না। তার দিকে তাকালেই চোখে পানি এসে যায়। তখন। তার মনে হয়, ওকে বিয়ে করে আমিই বাবাকে খুন করলাম। মা, ভাই, ভাবিও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মুখ দেখাতে পারে না। একদিন ভাই ও ভাবিদের সামনে মায়ের দু’পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার কারণেই আব্বাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হল, তোমরা সবাই আমাকে মাফ করে দাও। আমি দুনিয়ার সমস্ত ছেলেমেয়েদের জানিয়ে দেব, তারা যেন ছাত্র অবস্থায় প্রেম ভালোবাসা না করে, মা বাবার মতামত না নিয়ে গোপনে যেন বিয়ে না করে।
মা কিছু বলার আগে বড় ভাই জহুরুল ইসলাম বলল, এখন এসব বলে কি হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
আনোয়ারা বেগম বললেন, এসব কথা ভেবে কেঁদে আর লাভ কি? বরং প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া কর, তিনি যেন তোর আব্বার সোণাহখাতা মাফ করে জান্নাত নসীব করেন, তার কবরকে বেহেশতের বাগান করেন।”
আব্বা খুন হওয়ার পর থেকে কামরুল স্ত্রীর কাছেও সহজ হতে পারছে না। তাকে দেখলেই অপরাধবোধটা প্রবল হয়। তাই তাকে এড়িয়ে চলছে। এমন কি দু’বছরের মেয়েকেও…আগের মতো আদর করে না।
শ্বশুর খুন হওয়ার জন্য শামিমাও নিজেকে কম অপরাধী মনে করল না। স্বামীর মতো তারও মনে হয়, প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার ফলে শ্বশুরকে প্রাণ দিতে হল। তখন মা বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হয়। কোনো মা বাবা যে মেয়ের এতবড় সর্বনাশ করতে পারে কখনও কল্পনা করে নি। আজ তিন বছর হয়ে গেল তারা মেয়ের খোঁজ নিল না। দু’বছর হয়ে গেল নাতনি হয়েছে, তারও খোঁজ নিল না। এক নজর দেখলও না। এই দুর্ঘটনার পর থেকে স্বামী তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে না। এক বিছানায় ঘুমায় না। শাশুড়ী আগের মতো আদর করে না। ভাসুরেরা ওজায়েরা তাকে এড়িয়ে চলে! কুলসুমের বিয়ে হয়ে গেছে। আব্বা খুন হওয়ার কথা শুনে স্বামীর সঙ্গে এসেছিল। সে যে কয়েকদিন ছিল, প্রাণের সই হয়েও তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তার সুখের সংসারে মা বাবা আগুন জ্বালিয়ে ছারকার করে দিল। তাদের উপর ক্ষোভে দুঃখে নীরবে চোখের পানি ফেলে শামিমা দিন কাটাতে লাগল।
স্বামী একই রুমে অন্য ঘাটে ঘুমায়। সে যে রাতে ঘুমাতে পারে না, সারারাত শুধু এপাশ ওপাশ করে আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, তা বুঝতে পেরেও কি বলে তাকে প্রবোধ দিবে ভেবে না পেয়ে তার কাছে যেতে সাহস হয় না।
এভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর। এক গভীর রাতে স্বামী যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বুঝতে পেরে তার কাছে গিয়ে দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার কারণে আব্বাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হল, আমার কারণে এই সংসারে অশান্তি এসেছে। তুমি যে অশান্তির আগুনে জ্বলছ, তার কারণও আমি। সবকিছুর মূলে আমি। আমাকে তুমি গলাটিপে মেরে ফেল। এতদিনে হয় তো আত্মহত্যা করে ফেলতাম, শুধু…মা মনির কথা ভেবে তা করি নি। কি করলে তুমি শান্তি পাবে বলো, প্রাণের বিনিময়ে হলেও তাই করব। তোমার দুঃখ যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
স্ত্রীর কথা শুনে কামরুল নিজের ভুল বুঝতে পারল। আব্বার মৃত্যুর জন্য আমি যেমন নিজেকে অপরাধী ভাবছি, শামিমাও তাই ভাবছে। এতদিন তার সঙ্গে স্বভাবিক আচরণ না করে অন্যায় করেছি। উঠে বসে তাকে ধরে পাশে বসিয়ে বলল, শুধু নিজেকে অপরাধী ভাবছ কেন? অপরাধ হলে আমাদের দুজনেরই হয়েছে। তা ছাড়া এটাই ভবিতব্য ছিল। তুমি আত্মহত্যার কথা বলতে পারলে? আত্মহত্যা করলে আমার কি হবে ভেবে দেখছ? তা ছাড়া শয়তান মানুষকে চিরজাহান্নামী করার জন্য আত্মহত্যা করার প্রেরণা দেয়। আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা চাইবে। জীবনে যতই দুঃখ কষ্ট আসুক না কেন কখনও আত্মহত্যার কথা মনে স্থান দেবে না। আমি মানসিক বিপর্যয়ের কারণে এতদিন তোমাকে এড়িয়ে চলে অন্যায় করেছি। সে জন্য তোমার কাছে আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।
শামিমা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ক্ষমা চেয়ে আমাকে আরও বেশি অপরাধী করো না। তুমি এতটুকু অন্যায় করনি। এরকম অবস্থায় পড়লে সব মানুষই স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে যায়, আমারও তাই হয়েছে। তাই তো আমিও এতদিন তোমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারি নি। সেজন্য বরং আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।
অপরাধ আমরা কতটা করেছি তা আল্লাহ ভালো জানেন। তাঁর দরবারে আমাদের ক্ষমা চাইতে হবে আর দোয়া করতে হবে, তিনি যেন আব্বাকে বেহেশত নসীব করেন।
তাতো আমি সব সময় করছি। যতদিন বাঁচব করেও যাব। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে লাগল।
মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে কামরুল শরীরের চাহিদার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এখন স্ত্রীর আদরে সেই চাহিদা অনুভব করে সেও প্রতিদানে মেতে উঠল।
সাত
মনিরুলের চাচা নাজিমউদ্দিন আমেরিকায় চাকরি করতেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা হোটেল করেছেন।
আজিজুল নির্দিষ্ট সময়ে আমেরিকায় এসে চাচার বাসার পরিবেশ দেখে তার আশা নিরাশায় পরিণত হল। সে ভেবেছিল, চাচার কাছে থেকে আরো পড়াশোনা করবে আর আনন্দ ফুর্তি করে বেড়াবে। কিন্তু চাচা ও তার পরিবারের সবাইকে ইসলামের খুব পাবন্দ দেখে নিরাশ হলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না। চাচি আমেরিকান হলেও খুব পর্দানশীন ধার্মিকা। তাদের একমাত্র সন্তান সুমাইয়া পারীভনও মায়ের মতো পর্দানশীন ও ধার্মিকা।
নাজিমউদ্দিন আমেরিকার যে অফিসে চাকরি করতেন সেই অফিসের আমেরিকান মুসলিম মেয়ে আসমা নাওয়ারকে ভালবেসে বিয়ে করেন। আসমা নাওয়ার নামের অর্থ অতুলনীয় ফুল। আসলে সত্যিই তিনি অতুলনীয় ফুলের মতো। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন এবং স্বামীকেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। সেই সাথে আর্থিক সাহায্য করার কথাও বলেন।
নাজিমউদ্দিন স্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে একটা বাড়ি কিনে হোটেল করেন। এবং স্বামী স্ত্রী দু’জনেই এটা পরিচালনার কাজ করতেন। হোটেলের নাম দেন বাংলাদেশ মুসলিম হোটেল। এখানে বাংলাদেশী ও বিদেশী দু’রকম খাবার তৈরি হয়। ফলে আশ-পাশের ও অনেক দূরের বাঙালীরা এখানে খেতে আসে।
একবার বাংলাদেশ থেকে তবলীগ জামাতের এক দল ঐ ঐলাকায় আসেন এবং ঐ হোটেলে খেতে এসে নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। জামাতের যিনি আমির তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং তার বাড়ি ফরিদপুর জেলার কানাইপুর গ্রামে।
পরিচয় হওয়ার পর নাজিমউদ্দিন জামাতের লোকদের খাওয়ার বিল নিলেন না। এমন কি প্রায় পনের দিন জামাতের লোকদের হোটেলে ফ্রি থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
ইঞ্জিনিয়ার আমির ওনাকেও ওনার স্ত্রীকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে দ্বীনের কাজ করার জন্য নসীহত করলেন। আরো নসীহত করলেন, কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়ার জন্য।
মাত্র পনের দিন তবলীগ জামাতের খেদমত করে ও তাদের সংস্পর্শে থাকার ফলে আল্লাহ ওনাদেরকে হেদায়েত দান করেন। প্রায় ছয় বছর পূর্বে দাম্পত্য জীবন শুরু করলেও তখন পর্যন্ত ওনাদের কোনো সন্তানাদি হয় নি। জামাতের বিদায় কালিন মোনাজাতের আগে নাজিমউদ্দিন সে কথা আমির সাহেবকে বলে অনতত একটা সন্তানের জন্য দোয়া করতে বলেন। তারপর থেকে ওনারা পূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী জীবন যাপন করার চেষ্টা করছেন।
এই ঘটনার দু’বছর পর সুমাইয়ার জন্ম হয়। আসমা নাওয়ার মেয়েকে নিজের মতো করে গড়েছেন।
সুমাইয়া এখন গ্রাজুয়েশন নিচ্ছে। মাকে সঙ্গে নিয়ে যেখানে কোনো মুসলিম ফ্যামেলী থাকে সেখানে গিয়ে মেয়েদের ধর্মীয় তালিম দিচ্ছে।
আমেরিকায় সুমাইয়ার উপযুক্ত ছেলে পাওয়া অসম্ভব ভেবে ও পুত্র সন্তান না থাকায় নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নাজিমউদ্দিন স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ভাইপো আজিজুলকে আনিয়েছেন তাকে সুমাইয়ার উপযুক্ত করে তার সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য।
আজিজুল দেশে তেমন একটা ধর্মীয় বিধি নিষেধ মেনে চলত না। এখানে এসে সবকিছু মেনে চলতে বাধ্য হল।
আসার দুদিন পর নাজিম উদ্দিন ভাইপোকে হোটেলের ম্যানেজারের পোষ্টে বসিয়ে কাজকর্ম বুঝিয়ে দিলেন।
বাসায় সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া ও আলাপ আলোচনা হলেও চাচাত বোনকে পর্দা মেইনটেইন করতে দেখে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের দেশের মেয়েরাতো চাচাত, মামাত, ফুপাত ও খালাত ভাইয়ের সঙ্গে পর্দা মেইনটেইন করে না। আর সেটাকে কেউ দোষেরও মনে মরে না, তুমি করছ কেন?
সুমাইয়া মৃদু হেসে বলল, তোমার কথার উত্তর পরে দিচ্ছি। তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও। মিথ্যে বলা, চুরি করা, মা-বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, মদ, সুদ, খুষ খাওয়া ব্যাভিচার করা এগুলো ইসলামে নিষেধ কিনা?
নিশ্চয় নিষেধ।
তা হলে মুসলমানরা করছে কেন?
অজ্ঞানতার কারণে।
কথাটা ঠিক হলেও পুরোটা নয়। কারণ যারা ঐসব গর্হিত কাজ করে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষিত এবং এগুলো যে গর্হিত কাজ তাও জানে। তবু কেন করছে জান? মুসলমানরা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবনে ও রাষ্ট্রীয় শাসনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর বিধি বিধান অমান্য করে যারা মুসলমানদের চিরশত্রু তাদের রীতি-নীতি অনুস্বরণ করছে। কিন্তু তারা যে পথের পথিক হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির চরম শিখরে উঠে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছে, মুসলমানরা সেই পথে অগ্রসর না হয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত। তাই পৃথিবীর অন্যান্য জাতি পশ্চাদপদ মুসলমানদেরকে একদিকে যেমন শোষণ করছে, অপরদিকে তেমনি চোখ রাঙিয়ে শাসনও করছে। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর দিই। চাচাত, মামাত, খালাত, ফুপাত ভাই, এমনকি দেবর, ভাসুর ও বিয়াই-এর সঙ্গে মেয়েদের পর্দা করা ইসলামের হুকুম। তোমাদের দেশের মেয়েরা জেনে বা না জেনে ইসলামের এই হুকুম মানে না। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল, অধিকাংশ মুসলমান, মুসলমান কারা ও ইসলামের প্রকৃত তথ্য জানে না। কিছু মনে করো না, মনে হচ্ছে তুমিও জান না। তাই অনুরোধ করছি, মুসলমান কাকে বলে ও ইসলামের প্রকৃত তথ্য জানার জন্য পড়াশোনা কর। তা হলে তুমিও বুঝতে পারবে মুসলমানরা আজ এত পশ্চাদপদ কেন? কেন তারা অন্যান্য জাতির কাছে উৎপীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে।
এভাবে দিনের পর দিন সুমাইয়ার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার ফলে। আজিজুল একদিকে যেমন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তেমনি তাকে ভালবেসে ফেলল।
আমেরিকায় আসার সময় বড় ভাই ও ভাবিকে বলে এসেছে কামরুলকে শায়েস্তা করার জন্য যত টাকা লাগে আমি পাঠাব। তাই প্রথম কয়েক মাস তার মাসোহারার টাকা বড় ভাইকে পাঠিয়ে শামিমাকে অপহরণের মামলার খবর জানতে চেয়েছে। এর মধ্যে সুমাইয়ার সংস্পর্শে ও ইসলামের উপর পড়াশোনা করার ফলে বুঝতে পারল, কামরুলকে শায়েস্তা করার কথা বলা তার উচিত হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা অন্যায়। তারপর ভাইয়ার চিঠিতে যখন জানতে পারল, মামলায়। কামরুল বেকসুর খালাস পেয়েছে তখন শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছে। তারপর ভাইয়াকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে, সে যেন শামিমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে এবং কামরুলের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা না করে। যদি অনুরোধ না রাখে, তা হলে সে কোনো টাকা পয়সা পাঠাবে না।
আজিজুলের চিঠি পেয়ে মনিরুল খুব রেগে গেল। তার অনুরোধে উপেক্ষা করে শামিমার বাবা আনোয়ারুল হকের সঙ্গে পরামর্শ করল, কিভাবে কামরুলদের শায়েস্তা করা যায়।
আজ তিন বছর হয়ে গেল আজিজুল আমেরিকায় এসেছে। দেশে বড় ভাইকে নিয়মিত টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে ।
প্রতিদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর নাজিমউদ্দিন সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করেন। আজ আলোচনা শেষে সুমাইয়া চলে যাওয়ার পর আজিজুলকে বললেন, আমরা তোমার সঙ্গে সুমাইয়ার বিয়ে দিতে চাই। তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পার।
এখানে আসার কিছুদিন পর আজিজুল বুঝতে পেরেছে চাচা কেন তাকে এখানে আনিয়েছেন। তারপর সুমাইয়া ও চাচির কথাবার্তা ও আচার আচরণে বুঝতে পারে তারাও জানে কেন তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। সবকিছু বুঝতে পেরে আজিজুলের এতটুকু দুঃখ বা মনকষ্ট হয়নি। বরং সুমাইয়ার মতো মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়া সৌভাগ্য মনে করেছে।
এখন চাচার কথা শুনে তার তনু-মমুতে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করল, চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে রইল। কিছু বলতে পারল না। হঠাৎ বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়াতে মুখটা ম্লান হয়ে গেল।
নাজিমউদ্দিন ভাইপোর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তার চেহারায় দুরকম পরিবর্তন দেখে বললেন, বিয়ের ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করার অধিকার ইসলাম পুরুষ ও নারীকে দিয়েছে। তাই সুমাইয়ার মতামত নিয়ে কথাটা বলেছি। চুপ করে থেকে রাজি আছ কিনা বল।
বিয়ের ব্যাপারে আমার কোনো অমত নেই। তবে তার আগে আমি একবার দেশে যেতে চাই।
আমাদের ইচ্ছা, বিয়ের পর আমরা সবাই মিলে যাওয়ার। তোমার চাচি ও সুমাইয়ার বাংলাদেশ দেখার খুব সখ।
চাচা চাচি যাবে শুনে আজিজুল খুব খুশী হল। বলল, তা হলে আমার কিছু বলার নেই, আপনাদের মতামতই আমার মত।
মনিরুলের বাবা সাবুদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। তার উপর মনিরুল কয়েক বছর সৌদি আরবে থেকে বাবাকে অনেক টাকা পাঠিয়েছে। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার আরো উন্নতি হয়েছে। তা ছাড়া নাজিমউদ্দিন আমেরিকায় থাকায় তার ভাগের বিষয় সম্পত্তি ভোগ দখল করছে। আজিজুলও আমেরিকায় গিয়ে অনেক টাকা পাঠিয়েছে। এখন মনিরুল গ্রামের সব থেকে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে চার কামরা দোতলা পাকা বাড়ি ও বেশ বড় বৈঠকখানা করেছে। বাস্তুভিটা বেশ বড়। চারপাশে পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গাড়ি ঢোকার মতো গেট। ফরিদপুর টাউনের ও আশপাশের গ্রামের লোকজন তাকে সমীহ করে চলে।
সাধারণত মানুষের বেশি টাকা হলে অহঙ্কারী হয়। যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়। শয়তান তাকে দিয়ে নানারকম গর্হিত কাজ করায়। মনিরুলেরও তাই হয়েছে। নিজেকে কেউকেটা ভাবে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তাই নিজের টাকা ও আধিপত্য দেখাবার জন্য আনোয়ারুল হককে কামরুলদের ক্ষতি করার যেমন পরামর্শ দিচ্ছে তেমনি টাকা দিয়েও সাহায্য করছে। শেষে আমিরুল ইসলামকে সন্ত্রাসীদের দ্বারা খুন করায়। আমিরুল ইসলামের ছেলেরা তাকে আসামী করলে থানায় অনেক টাকা দিয়ে আসামীদের নামের তালিকা থেকে তার নাম কাটার চেষ্টা করে। থানার ওসি অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় এবং তাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম বাধ্য হয়ে ফরিদপুর থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে যায়।
বিয়ের পর আজিজুলের দেশে আসার কথা থাকলেও বিভিন্ন অসুবিধের কারণে আসতে পারে নি। আমেরিকায় আসার পর প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় স্ত্রী ও চাচা চাচিকে নিয়ে দেশে ফিরল। দেশে ফেরার কথা দুদিন আগে আজিজুল বাড়িতে ফ্যাক্স করে জানিয়ে তাদেরকে ঢাকা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আসতে বলেছিল।
সুমাইয়াকে বিয়ে করার কথা এখনও ভাইয়া ভাবিকে জানাইনি। স্ত্রী ও চাচা চাচি আসছে। সেকথাও ফ্যাক্সে জানাল না সারপ্রাইজ দেবে ভেবে।
স্বামী খুনের আসামী হয়ে আজ এক বছরের বেশি ঘর ছাড়া। কোথায় আছে, কেমন আছে, শেষমেস কি হবে ভেবে রহিমার চিন্তার শেষ নেই।
বছর দুই হল তার একটা ছেলে হয়েছে। মনিরুল গরু জবাই করে খুব ধূম ধামের সঙ্গে গ্রামের লোকজন খাইয়ে নাম রেখেছে শরীফুল ইসলাম। ডাকনাম শরীফ। রহিমা শরীফকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানিতে দিন কাটাচ্ছে। আজিজুল আসছে জেনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল ও নিশ্চয় ভাইয়ার জন্য কিছু করবে।
নাজিম উদ্দিন জানেন,আজিজুল তাদের কথা মনিরুলকে জানিয়েছে। তাই প্লেন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার পর বাইরে বসে আজিজুলকে মাইক্রোবাস ভাড়া করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, মনিরুল গাড়ির ব্যবস্থা করে আসে নি?
.
আজিজুল নিশ্চিত ছিল, ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে গাড়ির ব্যবস্থা করে তাকে রিসিভ করতে আসবে। কিন্তু তাদেরকে দেখতে না পেয়ে মাইক্রোবাস ভাড়া করছিল। চাচার কথা শুনে বলল, মনে হয় কোনো কারণে আসতে পারে নি।
বাড়িতে যখন পৌঁছাল তখন রাত নটা। বাড়ি-ঘর দেখে সবাই খুশী।
রহিমা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। গাড়ির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এসে সবাইকে দেখে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। দাড়ি টুপিওয়ালা আজিজুলকে চিনতে পারলেও অন্যদের চিনতে পারল না।
আজিজুল মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে পরিচয় করিয়ে দিল।
রহিমা সেরকমই অনুমান করেছিল। তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে শ্বশুর শাশুড়ীকে কদমবুসি করে সুমাইয়া হাত ধরে সবাইকে বৈঠকখানায় বসাল। তারপর দেবরকে মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, ফ্যাক্সে এনাদের কথা জানাওনি কেন?
আজিজুল হাসি মুখে বলল, তোমাদেরকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বলিনি।
রহিমা বলল, আমি তোমার জন্য শুধু একটা রুম রেডি করে রেখেছি। ওনারা আসবেন জানালে আরো একটা রুম রেডি করে রাখতাম। এখন কিছুক্ষণ কষ্ট করে অপেক্ষা কর, আরো একটা রুম রেডি করে আসছি।
তা না হয় করলাম; কিন্তু ভাইয়াকে দেখছিনা কেন? সে কি ঘরে নেই?
আজিজুল একা হলে রহিমা তার ভাইয়ার কথা বলত, কিন্তু আসার সাথে সাথে সবাইয়ের সামনে বলা উচিত হবে না ভেবে বলল, না নেই। কেন নেই পরে শুনো। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
আসমা নাওয়ার নাজিম উদ্দিনকে বিয়ে করার পর তার কাছে অল্প অল্প বাংলা শিখেছেন। বাংলা ভাষায় কেউ কিছু বললে বুঝতে পারেন। কিন্তু বলতে পারেন না।
সুমাইয়া বাবার কাছে বাংলা যতটা শিখেছিল, আজিজুল যাওয়ার পর তার কাছে আরো বেশি শিখেছে। লিখতে পড়তে পারে ।
রহিমা চলে যাওয়ার পর নাজিম উদ্দিন ভাইপোকে বললেন, আমাদের আসার কথা না জানিয়ে খুব ভুল করেছে। বৌমা একা, তাকে কষ্টে ফেলে দিলে। তুমি সুমাইয়াকে নিয়ে যাও, তাকে সাহায্য কর।
বাবার কথা শুনে সুমাইয়া হ্যাঁ চল বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আজিজুল তাকে বলল, তোমাকে যেতে হবে না, বস। আমি যাচ্ছি বলে চলে গেল।
সুমাইয়া শুনল না বোরখা খুলে রেখে তার পিছু নিল।
রহিমা বিছানায় চাদর বিছাচ্ছিল। তাদের দেখে বলল, তোমরা আবার এলে কেন? তারপর বোরখা ছাড়া সুমাইয়ার দিকে একাবর তাকিয়ে বলল, তা হলে এই হুরকে পেয়েই ভাই ভাবির কথা পাঁচ বছর ভুলে ছিলে?
সুমাইয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রহিমার ততক্ষণ চাদর বিছান হয়ে গেছে। মাথার ও পাশ বালিশ জায়গামতো রেখে খাট থেকে নেমে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার সাহেব আমেরিকায় গিয়ে খুব ফাজিল হয়ে গেছে। তা না হলে সবার আসার কথা না বলে শুধু নিজের কথা বলল কেন? দেখ না ভাই, আমি একা মানুষ ক’দিকে সামলাব? কাজের দুটো মেয়ে আছে। তারা তো আর এ কাজ পারবে না। তাই তাদের রান্নার জোগড়ে বসিয়েছি। একটা রুম হল।
সুমাইয়া বলল, সেজন্যই আব্বা ওকে বকা দিয়ে আমাদেরকে পাঠাল আপনাকে সাহায্য করার জন্য।
রহিমা বলল, তোমাদের কিছু করতে হবে না। তারপর আজিজুলকে বলল, তুমি ওনাদের ডেকে নিয়ে এস, এটা ওনাদের রুম। আর তুমি আমার সঙ্গে এস তোমাদের রুমটা ঠিক মতো সাজান হয়েছে কিনা দেখবে। তারপর সুমাইয়ার একটা হাত ধরে পাশের রুমে ঢুকল।
রুমের চারপাশে তাকিয়ে সুমাইয়া বলল, এ রুমতো ঠিক আছে। আর কিছু করতে হবে না। যতটুকু করার আমি করে নিচ্ছি। আপনি বরং চা নাস্তার ব্যবস্থা করুন। চা নাস্তা খেয়ে রান্নার কাজে আমিও আপনাকে সাহায্য করব।
রহিমা বলল, তোমার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছি। তোমরা সবাই এখন ক্লান্ত, নাস্তা খেয়ে রেষ্ট নাও। ফ্রীজে সবকিছু আছে, ওরা এতক্ষণ কেটে কুটে রেড়ি করে ফেলেছে। আমি শুধু রান্নাটা করে নেব। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল। একটু পরে আজিজুল ল্যাগেজ নিয়ে ফিরে এল।
সুমাইয়া বলল, আমাদের আসার কথা না জানিয়ে সত্যিই তুমি অন্যায় করেছ। এত রাতে ভাবি একা ক’টা সামলাবেন?
আজিজুল বলল, হ্যাঁ, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে। ড্রেস চেঞ্জ করে অযু করে নিই এস, নাস্তা খেয়ে এশার নামায পড়ে নেব।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে সাড়ে এগারটা বেজে গেল।
চাচা চাচি রুমে চলে যাওয়ার পর আজিজুল বলল, ভাইয়া কোথায় গেছে? এত রাত হল, এখনও ফিরল না তো?
রহিমা বলল, তোমরা রুমে যাও, আমি একটু পরে আসছি।
সুমাইয়া ও আজিজুল রুমে আসার কিছুক্ষণ পর রহিমা তাদের কাছে এল।
আজিজুল তাকে বসতে বলে বলল, এবার বল, ভাইয়া কোথায় গেছে।
রহিমা বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আজিজুল আতঙ্কিত স্বরে বলল, ভাইয়ার কথা না বলে কাঁদছ কেন? সে কি কোনো বিপদে পড়েছে?
রহিমা কিছু না বলে ফুপাতেই থাকল।
স্বামী আবার কিছু বলতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সুমাইয়া হাতের ঈশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বলল।
কিছুক্ষণ পর যখন ফুপাননা কমল তখন সুমাইয়া তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি আপনার ছোট বোনের মতো। যদি সত্যি সত্যি ভাইয়া বিপদে পড়ে থাকেন অথবা সাংসারিক কোনো ব্যাপারে আপনার উপর রাগ করে কোথাও গিয়ে থাকেন, তা হলে এতটুকু দ্বিধা না করে বলুন। আল্লাহ যখন আমাদেরকে নিয়ে এসেছেন। তখন এর একটা মীমাংসা করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
স্ত্রী থেমে যেতে আজিজুল বলল, হ্যাঁ ভাবি, কি হয়েছে বলো, সুমাইয়া যা বলল, তা যেমন করে হোক করব ইনশাআল্লাহ।
রহিমা চোখ মুখ মুছে বলল,তোমার ভাইয়া খুনের আসামী হয়ে আজ এক বছরের বেশি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাকে ধরার জন্য খুঁজছে।
আজিজুল চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, ভাইয়া খুনের আসামী? কাকে খুন করেছে?
তোমার ভাইয়া খুন করেনি? শত্রুতাবশে তাকে খুনের আসামী করেছে?
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু কে খুন হয়েছে বলবে তো?
কামরুলের বাবা আমিরুল ইসলাম।
আজিজুল আর একবার চমকে উঠে বলল, কারা খুন করেছে ওনাকে?
আমি বলব কি করে?
যারা খুন করেছে তাদের সঙ্গে ভাইয়ার নিশ্চয় যোগাযোগ ছিল। তা না হলে শুধু শুধু তাকে আসামী করবে কেন? ভাইয়া তোমাকে কিছু বলে নি?
রহিমা সবকিছু জেনেও স্বামীর দোষ ঢাকার জন্য বলল, না বলে নি। তবে। আমার অনুমান মেয়ে অপহরণের মামলায় আনোয়ারুল চাচা হেরে গিয়ে লোকের দ্বারা নিজের বড় ভাইকে খুন করিয়েছে। তুমিতো জান, ঐ মামলায় তোমার ভাইয়া ও আনোয়ারুল চাচার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই খুনের ব্যাপারেও তোমার ভাইয়া আনোয়ারুল চাচার সঙ্গে জড়িত আছে ভেবে তাকে আসামী করেছে।
অপহরণের মামলায় শামিমার বাবা হেরে যাওয়ার খবর জেনে আমি যে চিঠি দিয়ে ভাইয়াকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলাম, তা কি তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি।
এবার সত্যি করে বলতো ভাবি, আমার ঐ চিঠি পাওয়ার পর ভাইয়া শামিমার বাবার সঙ্গে মেলামেশা করত কিনা?
হ্যাঁ করত।
তুমি নিষেধ কর নি?
করেছি, তোমার ভাইয়া শোনে নি।
ঠিক আছে, যা বোঝার বুঝে গেছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না। কাল চাচার সঙ্গে আলাপ করব কি করে ভাইয়াকে বাঁচান যায়। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে, আমরাও ঘুমাব।
রহিমা চলে যাওয়ার পর সুমাইয়া বলল, ঘটনাটা কিছুকিছু বুঝতে পারলেও পুরোটা পারি নি। পুরোটা বলতে শুনি।
শামিমার সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব, কামরুলের সঙ্গে শামিমার সম্পর্ক ও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা, আনোয়ারুল হকের মেয়ে অপহরণের মামলা করার কথা ও তার ফলাফল এবং ভাইয়া কেন খুনের আসামী হল আজিজুল সবকিছু বলার পর বলল, নিষেধ করা সত্ত্বেও ভাইয়া যে কেন শামিমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল বুঝতে পারছি না। আমার নিষেধ যদি ভাইয়া শুনতো, তা হলে আজ খুনের আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হত না।
সুমাইয়া বলল, নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল। তাই….
তাকে থামিয়ে দিয়ে আজিজুল বলল, রাত কটা বেজেছে খেয়াল করেছ? আর কোনো কথা নয়, ঘুমিয়ে পড়ি এসো।
পরের দিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পর আজিজুল চাচি ও সুমাইয়ার সামনে চাচাকে বলল, ভাইয়া খুনের আসামী হয়ে এক বছরের বেশি গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও আত্মগোপন করে আছে।
নাজিমউদ্দিন চমকে উঠে বললেন, কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ চাচা, অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্য।
নাজিমউদ্দিন চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলেন। এক সময় ওনার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
চাচার অবস্থা দেখে আজিজুলের চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা যখন এসে পড়েছি তখন ভাইয়াকে বাঁচাবার চেষ্টা করব।
নাজিম উদ্দিন সোজা হয়ে চোখ মুছে বললেন, আল্লাহ তোমার মনের বাসনা পূরণ করুক। তুমি কি ঘটনাটা জান?
জি, জানি।
কোনো কিছু গোপন না করে পুরো ঘটনা বল।
আজিজুল সুমাইয়াকে বলল, তুমি চাচি আম্মাকে নিয়ে রুমে যাও।
তারা চলে যাওয়ার পর আজিজুল বলল, বি.এ. পরীক্ষা দেয়ার পর ভাইয়া তার চাচাত শালীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তারপর কেন বিয়ে হল না, মেয়ে অপহরণের মামলা ও মামলায় হেরে যাওয়া থেকে আমুিল ইসলাম খুন হওয়া, এবং কেন ভাইয়া আসামী হয়ে পালিয়ে আছে সবকিছু বলল।
তুমি এসব আগে থেকে জানতে?
আমি আমেরিকা যাওয়ার পনের বিশ দিন আগে অপহরণের মামলা রুজু হয়। ছয় মাস মামলা চলার পর মেয়ের বাবা হেরে যায়। সেকথা ভাইয়া আমাকে চিঠি দিয়ে জানাতে আমি ঐ মেয়ের বাবার সঙ্গে ভাইয়াকে যোগাযোগ রাখতে চিঠি লিখে নিষেধ করে দিই। তা সত্ত্বেও কেন যে মেয়ের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল জানি না।
নামিজউদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, প্রায় ত্রিশ বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। দেশের ও দেশের লোকজনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে অনেকে মারা গেছেন। যারা ছোট ছিল তারা বড় হয়েছে। তারা যেমন আমাকে চিনবে না, আমিও তেমনি তাদেরকে চিনব না। আমি এই গ্রামের ও মনিরুলের শ্বশুরদের গ্রামের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। তুমি ঐ ছেলে ও মেয়ের বায়োডাটা লিখে আমাকে দেবে। আমি তাদের সবার সঙ্গে আলাপ করে মিমাংসা করার চেষ্টা করব। দেখি, আল্লাহ কোন পথে রাজি। তুমি শুধু গ্রামের লোকজনদের আমার আসার কথা ও বেশ কিছুদিন থাকব, সেকথা জানিয়ে দেবে।
আজিজুল বলল, ঠিক আছে, তাই করব।
আট
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আজিজুল নিজেদের গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের এবং ফরিদপুর টাউনের আত্মীয়-স্বজন ও জানাশোনা লোকদের সঙ্গে দেখা করে চাচা নাজিম উদ্দিনের আসার ও থাকার কথা জানিয়ে দিল।
নাজিম উদ্দিন আজিজুলকে সঙ্গে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামের গণ্যমান্য মুরুব্বীদের এক একজনের সঙ্গে আলাপ করে আমিরুল ইসলামের হত্যার খোঁজ নিতে লাগলেন।
মনিরুলের শ্বশুর আব্দুল আলিম খবর পেয়ে একদিন নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
আজিজুল তখন বাড়িতে ছিল না। নাজিমউদ্দিন তাকে একজন উকিলকে ডেকে নিয়ে আসতে টাউনে পাঠিয়েছেন। তিনি বৈঠকখানায় বসে একটা হাদিসের বই পড়ছিলেন।
আব্দুল আলিম ওনাকে না চিনলেও অনুমান করলেন, ইনি মনিরুলের চাচা। সালাম দিয়ে বললেন, বিয়াই সাহেব, কেমন আছেন?
নাজিম উদ্দিন হাদিসটা বন্ধ করে সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বললেন, আপনি নিশ্চয় মনিরুলের শ্বশুর?
জি, আপনার অনুমান ঠিক। তারপর একটা চেয়ারে বসে বললেন, আপনি নিশ্চয় মনিরুলের চাচা?
আপনারও অনুমান ঠিক। আমার নাম নাজিম উদ্দিন।
আপনার?
আব্দুল আলিম।
নামের অর্থ জানেন?
আব্দুল আলিম লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, জি, না।
আব্দুল অর্থ গোলাম আর আলিম অর্থ মহাজ্ঞানী। মহাজ্ঞানী হলেন আল্লাহ। তাই আপনার নামের অর্থ হল আল্লাহর গোলাম। তারপর বাড়ির চাকরকে ডেকে বললেন, বৌমাকে খবর দাও তার আব্বা এসেছেন। এখানেই নাস্তা পানি দিতে বল। তারপর বিয়াইয়ের সঙ্গে ভালোমন্দ আলাপ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রহিমা নিজে নাস্তা নিয়ে এসে আব্বা কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ আব্বা? ঘরের সব খবর ভালো?
আব্দুল আলিম বললেন, আমাদের সব খবর ভালো। জামাই এর কোনো খবর পাস নি?
না আব্বা, পাই নি।
নাজিম উদ্দিন বিয়াইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, খাবার সামনে নিয়ে কথা বলতে নেই। আপনার সঙ্গে আমারও কিছু আলাপ আছে। খেয়ে নিন, আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি। কথা শেষ করে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
রহিমা আব্বাকে নাস্তা পরিবেশন করে বলল, আমার চাচি শাশুড়ী এসেছেন, উনি আমেরিকান মেম। ওনাদের একমাত্র মেয়ে সুমাইয়াকে আজিজুল বিয়ে করেছে। সেও এসেছে। মা মেয়ে পরীর মতো দেখতে। খুব পদানশীল।
আব্দুল আলিম বললেন, তাই নাকি? আমি মনে করেছিলাম, শুধু জামাই ও তার চাচা এসেছে।
আমার জা বলছিল, ওর বাবা নাকি যেমন করে হোক তোমাদের জামাইকে নির্দোষ প্রমাণ করিয়ে খালাস করাবেন। তাই তো আজিজুলকে একজন উকিলকে ডেকে নিয়ে আসতে পাঠিয়েছেন।
শুনে খুশী হলাম। আমিও ঐ ব্যাপারে ওনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি। তাঁরে আমার নানাভাই কোথায়?
একটু আগে ঘুম পাড়িয়ে দোলায় দিয়েছি। জেগে থাকলে আমাকে একটা কাজ করতে দেয় না। যত বড় হচ্ছে দিন দিন তত দুষ্ট হচ্ছে।
তা হলে এখন জাগাবার দরকার নেই। তোর চাচা শ্বশুরের সঙ্গে আলাপ করার পর ওর কাছে যাব ।
ততক্ষণে আব্দুল আলিমের নাস্তা খাওয়া শেষ। হাত মুখ ধুয়ে বললেন, তোর জা ও চাচি শাশুড়ী খুব পর্দানশীল বললি, তা হলে তো ওরা আমার সামনে এসে কথাবার্তা বলবে না?
ওনারা সবাই আমেরিকায় তবলীগ জামাত করেন। সামনে আসবে না, তবে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে পারেন। তারপর চাচা শ্বশুরকে ফিরে আসতে দেখে রহিমা বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেল।
নাজিম উদ্দিন এসে বসার পর বললেন, বেয়াই সাহেব, আপনার জামাই যে খুনের আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সে ব্যাপারে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছেন?
আব্দুল আলিম বললেন, আমি তো চিন্তা-ভাবনা করে কূল-কিনারা পাচ্ছি না। তাই আপনার আসার কথা শুনে পরামর্শ নিতে এলাম।
আমার পরামর্শ নিতে হলে যা কিছু জিজ্ঞেস করব সত্যি কথায় উত্তর দিতে হবে।
কি যে বলেন বেয়াই সাহেব, শেষ বয়সে মিথ্যে বলে ইমান নষ্ট করতে যাব কেন? আপনি কি জানতে চান বলুন, সত্যি কথায় উত্তর দেব ।
আপনার জামাই কি খুনীদের সঙ্গে জড়িত?
জি, জড়িত।
ব্যাপারটা আপনি কি আগে থেকে জানতেন?
খুন করবে জানতাম না। তবে ওদের ক্ষতি করার চেষ্টা করত জানতাম।
যিনি খুন হয়েছেন উনি তো আপনার চাচাত ভাই। সে হিসাবে উনি মনিরুলের চাচা শ্বশুর। জামাই হয়ে তবু কেন খুনীদের সঙ্গে ছিল?
সেকথা বলতে গেলে পাঁচ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছে সেসব বলতে হবে। অত কথা কি আপনার শোনার সময় হবে?
হবে, আপনি বলুন।
আব্দুল আলিম শামিমার সঙ্গে আজিজুলের বিয়ের প্রস্তাব থেকে শুরু করে মেয়ে অপহরণের মামলায় রায় পর্যন্ত বলে বললেন, শামিমার বাবা আনোয়ারুল হক এই খুনের আসল হোতা।
সেসব তাদের ভাই-ভাই-এর ব্যাপার। অনেক কারণে ভাই-ভাই-এ শত্রুতা থাকে, যদিও ইসলামে এটা যায়েজ নেই। কিন্তু শামিমার সঙ্গে কামরুলের সম্পর্ক জানার পর মনিরুলের তো বিয়ের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়ে আনোয়ারুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল। তা না করে তার সঙ্গে যোগাযোগই রাখল কেন? আর কামরুলের বাপের খুনের সঙ্গে জড়ালই বা কেন?
সে কথা আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনো উত্তর দেয়নি।
ঠিক আছে আপনার কাছে আর কিছু জানার নেই। এবার যা বলছি শুনুন, আমি মনিরুলকে নির্দোষ প্রমাণ করিয়ে খালাস করার চেষ্টা করব। সে ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন তো?
নিশ্চয় করব। কি করতে হবে বলুন।
শুনলাম, আনোয়ারুল হকের ছেলে শিহাবও ঐ খুনের আসামী হয়ে পলাতক এবং আপনার কাছে জানলাম, তার বাবা আনোয়ারুল হক ঐ খুনের হোতা। তাই তার সঙ্গে আমার আলাপ করা অত্যন্ত দরকার। আপনি দু’একদিনের মধ্যে ওনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। তবে সাবধান, আজ আপনার সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে, সে কথা তাকে বলবেন না। ওনার সঙ্গে আলাপ করার পর কামরুল ও তার ভাইয়েদের সঙ্গেও আলাপ করব। ওরা তো এখন শহরের বাড়িতে থাকে তাই না?
জি।
আমার কথা মনে থাকবে তো?
জি, থাকবে।
এমন সময় আজিজুল ফিরে এসে বৈঠকখানায় ওনাদেরকে দেখে ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে আব্দুল আলিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, তালই সাহেব, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুল আলিম বললেন, আল্লাহ একরকম রেখেছে, বাবা। তা তুমি ভালো আছ?
জি ভালো।
নাজিমউদ্দিন আজিজুলকে জিজ্ঞেস করলেন, যে কাজে গিয়েছিলে তার কি হল?
উনি বিকেল পাঁচটায় যেতে বলেছেন।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
আজিজুল চলে যাওয়ার পর বিয়াইকে বললেন, আজ থাকবেন তো?
আব্দুল আলিম বললেন, আমাদের মসজিদে বড় এক জামাত এসেছে। ঐ জামাতের আমীর কানাইপুর গ্রামের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। রাতে ওনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই থাকতে পারব না।
দেশে ফেরার দু’তিন দিন পর নাজিমউদ্দিন আজিজুলকে কানাইপুরে পাঠিয়েছিলেন তবলীগ জামাতের আমীর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে আনার জন্য। আজিজুল ফিরে এসে জানিয়েছিল, পনের দিন আগে তিনি তিন চিল্লায় বেরিয়ে গেছেন। এখন বিয়াই-এর কথা শুনে খুশি হয়ে মনে মনে আল্লার শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর বললেন, তা হলে তো আপনাকে যেতেই হবে।
জোহরের নামাযের পর খাওয়া দাওয়া করে বেলা তিনটের দিকে আব্দুল আলিম বাড়ি চলে গেলেন।
রাতে নাজিমউদ্দিন আজিজুলকে বললেন, কাল আমরা কুইজুরী জামে মসজিদে জুম্মার নামায পড়ব। ওখানে বড় এক জামাত এসেছে। কানাইপুরে যাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছিলাম, উনি ঐ জামাতের আমীর। আমরা কাল সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যাব।
পরের দিন নাজিমউদ্দিন আজিজুলকে নিয়ে বেলা দশটার সময় কুইজুরী জামে মসজিদে এলেন।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ওনাকে চিনতে পেরে সালাম বিনিময় করে মোসাফাহা ও মোয়ালাক করলেন। তারপর নানান বিষয়ে আলাপ করতে লাগলেন।
নাজিমউদ্দিন এক সময় আমিরুল ইসলাম খুন হওয়ার কারণ ও ভাই পো মনিরুল ইসলাম ঐ খুনের আসামী হওয়ার ঘটনা ও আমিরুল ইসলামের ও তার ভাই আনোয়ারুল হকের মধ্যে বিভেদের কারণ বলে বললেন, আমি এই বিভেদ মিমাংসা করার চিন্তা ভাবনা করছি।
আলহামদুলিল্লাহ, এটা খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে কামিয়াব করুক।
এ ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা চাই।
ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় করব। বলুন, কি ধরনের সহযোগিতা চান?
আজ জুম্মার নামাযের পর মুসুল্লীদের কিছুক্ষণ থাকতে বলবেন এবং নামাযের পর মুসলমানের পরিচয়, কর্তব্য, আত্মীয়স্বজনের হক, লোভ ও হিংসা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) কুরআন ও হাদিসে কি বিধি-নিষেধ দিয়েছেন, সে সব বয়ান করবেন।
ইনশাআল্লাহ করব। তা সঙ্গের ছেলেটি কে?
যে ভাইপো খুনের আসামী হয়েছে বললাম, তার ছোট ভাই আজিজুল। ওর সঙ্গে আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমেরিকায় আমার ব্যবসা দেখাশোনা করে।
কতদিন থাকবেন?
সেকথা আল্লাহ ভালো জানেন। তবে যে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা শেষ করে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।
এখানে তো আপনার বড় ভাইপোর শ্বশুর বাড়ি, আপনার আসার কথা ওনারা জানেন?
না, জানেন না।
তা হলে দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবেন। আমরা আজ চারটের সময় এখান থেকে চলে যাব।
বেয়াদবি মাফ করবেন, যে কাজের জন্য এসেছি, সে ব্যাপারে বিয়াই-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তারপর বিদায় নিয়ে বিয়াই বাড়ি গেলেন।
আব্দুল আলিম ওনাদেরকে দেখে আনন্দিত হয়ে সালাম বিনিময় করে বৈঠকখানায় বসালেন। তারপর বললেন, আজ আসবেন কাল বললেন না কেন?
নাজিম উদ্দিন বললেন, আপনি চলে আসার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আব্দুল আলিম বললেন, জুম্মার নামাযের সময় হয়ে আসছে, নামাযের পরে আলাপ করা যাবে। একটু বসুন বলে আপ্যায়ন করানোর জন্য বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।
জুম্মার নামাযের পর জামাতের আমীর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বয়ান শুরু করলেন
আল্লাহর প্রশংসা ও নবী (দঃ) এর উপর কয়েকবার দরুদ পাঠ করে প্রথমে প্রশ্ন করলেন, আমাদের পরিচয় কি?
মুসুল্লীরা বলে উঠল, আমাদের পরিচয় আমরা মুসলমান।
মুসলমানদের ধর্ম কি?
ইসলাম।
মুসলমানের পরিচয় কি?
একজন মুসুল্লী দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমীর সাহেব তাকে বসতে বলে বললেন, মুসলমানের পরিচয় হল, ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলা। যেমন–নামায পড়বে, রোযা রাখবে, ধনী হলে যাকাত দেবে, হজ্ব করবে, এতীম মিসকীনদের দান করবে, গরিব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করবে, কারো প্রতি হিংসা করবে না, কারো এতটুকু ক্ষতি করবে না, মিথ্যা বলবে না, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, কোনো কারণেই তাদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করবে না, বড়দের সম্মান করবে, ছোটদের স্নেহ করবে, মদ, জুয়া, ব্যাভিচার, সুদ, ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, থেকে দূরে থাকবে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো ইসলামের বিধান কিনা আপনারা বলুন?
মুসুল্লীরা সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ, এগুলো ইসলামের বিধান।
তা হলে আসুন আমরা চিন্তা করে দেখি, শুধু আমাদের মধ্যে নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে কয়জন ইসলামের বিধান মেনে চলছি? অথচ আমরা মুসলমান বলে পরিচয় দিই এবং পরকালে জান্নাতের আশা করি। অবশ্য জান্নাতের আশা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও জানা অবশ্য কর্তব্য যে, জান্নাত পেতে হলে ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে।
আজকাল মুসলমান ছেলেমেয়েরা কলেজ, ভার্সিটিতে শিক্ষা গ্রহণ করে ইসলামের বিধি-নিষেধ শুধু যে মানছে না তাই নয়, এগুলো মধ্যযুগের জন্য প্রযোজ্য ছিল, এখন ওসব মেনে চললে মুসলমানরা সভ্যতার মুখ দেখতে পাবে না, মধ্যযুগের বিধিবিধান এ যুগে অচল মনে করে।
একটা কথা মনে রাখবেন, কোনো মুসলমান যদি আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) এর যে কোনো বিধি নিষেধকে অস্বীকার করে অথবা মন্দ ভাবে, তা হলে সে নিজেকে যতই মুসলমান বলুক না কেন, তার ঈমান থাকবে না।
তবে হ্যাঁ, যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ)-এর বিধানকে সত্য বলে স্বীকার করে; কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় কোনো বিধান লঙ্ন করে ফেলে, তা হলে তার গুরুতর পাপ হবে, তবে তার ঈমান নষ্ট হবে না। খাঁটি দিলে তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেবেন।
কিভাবে আমরা প্রকৃত মুসলমান হতে পারব তা জানার জন্য আমাদেরকে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আল্লাহপাক এই জ্ঞান অর্জন করাকে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয করেছেন। তাই বলে ইসলামিক জ্ঞান ছাড়া অন্য জ্ঞান অর্জন করতে ইসলাম নিষেধ করেনি। বরং মানুষের কল্যাণের জন্য জ্ঞান সাধনাকে উৎসাহ দিয়েছে।
ইসলামিক জ্ঞান না থাকার কারণে শয়তান আমাদের ঈমান নষ্ট করার জন্যে নানারকম প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। ভাই-ভাই-এর মধ্যে হিংসা-বিদ্বেস ঢুকিয়ে দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা, এমন কি খুন-খারাবী পর্যন্ত করাচ্ছে। তাই আল্লাহপাক বান্দাদের সাবধান করার উদ্দেশ্যে কুরআনে বলিয়াছেন, “হে ঈমানদারগণ তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসারী হইও না, বাস্তবিকই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা-বাকারা, আয়াত-২০৮, পারা-২]
আমাদের নবী (দঃ) হিংসা সম্পর্কে বলিয়াছেন, “তোমরা হিংসা ত্যাগ কর, কেননা অগ্নি যেমন জ্বালানী কাষ্ঠকে ধ্বংস করে, তেমনি হিংসা সগুণাবলীকে ধ্বংস করে।” [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রা)–আবু দাউদ]
একটা কথা জেনে রাখুন, হিংসুক ব্যক্তি এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পায় না, সব সময় হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে।
শয়তান মানুষের মনে হিংসার মতো অহঙ্কারের বীজ বপন করে তাকে জাহান্নামের পথে চালিত করে। তাই আল্লাহ কুরআন মজিদে বলেছেন। আর আল্লাহ কোনো উদ্ধৃত অহঙ্কারীকে পচ্ছন্দ করেন না”। [সূরা হাদিদ ২৩ নং আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা-২৭]
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, “যাহার অন্তরে একটি সরিষার বীজ পরিমাণ ঈমান আছে, সে দোযোখে যাইবে না, আবার যার অন্তরে একটি সরিষার পরিমাণ অহঙ্কার আছে সে বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায় : হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)—মুসলীম]
আমরা সামান্য জায়গা-জমি বা তার সীমানা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হই, মামলা মোকাদ্দমা করি। এসব করা যে ইসলামে নিষেধ, তা জেনেও না জানার ভান করে করছি। অথচ সাহাবায়ে কেরামগণ এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই জানার পর একে অপরের জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন। একটা ঘটনা বলছি শুনুন
আবু জাহাম বিন হুজাইফা (রাঃ) বলেন, ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী আমার চাচাত ভাইয়ের খোঁজে বের হলাম। হয়তো পিপাসার্ত থাকবে ভেবে এক মশক পানি সঙ্গে নিলাম। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দেখলাম, একদিকে খুব আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, মুমূর্ষ অবস্থা, প্রাণ বার। হওয়ার উপক্রম প্রায়। জিজ্ঞেস করলাম, পানি খাবেন? তিনি ইশারায় সম্মতি জানালেন। এমন সময় দেখতে পেলাম অনতিদূরে একজন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আহা-উঁহু করছেন। চাচাত ভাই তার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে আমাকে পানি নিয়ে তাঁর কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমি তার কাছে গেলাম। তিনি ছিলেন হিশাম বিন আস (রাঃ)। তাঁর কাছে পানি নিয়ে গিয়ে দেখি, অদূরে আর একজন মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছেন আর কাতরাতে কাতরাতে ছটফট করছেন। হিশামকে (রাঃ) আমি পানি খাওয়াতে গেলে তিনি প্রথমে যেতে ইশারা করলেন মৃত্যু পথযাত্রী সেই অদূরবর্তী লোকটির কাছে। আমি খুব তাড়তাড়ি তাঁর কাছে নিয়ে দেখলাম, এইমাত্র প্রাণবায়ু বাহির হয়ে গেছে। সাথেসাথে হিশামের (রাঃ) কাছে ফিরে এসে দেখলাম, তিনিও প্রানত্যাগ করেছেন। তখন মনে দারুন আশঙ্কা নিয়ে ছুটলাম আমার চাচাত ভাইয়ের কাছে। কিন্তু আল্লাহর কি মর্জি দেখলাম, ইতিমধ্যে তিনিও জান্নাতবাসী হয়েছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন।”
এই ঘটনা থেকে বর্তমান যুগের মুসলমানদের শিক্ষা নেয়া উচিত। ওঁনারা আপন ভাই বা আত্মীয়ও ছিলেন না। তবু মৃত্যু যন্ত্রণায় পিপাসার্ত হয়েও নিজের চেয়ে অন্যের কষ্ট বেশি হচ্ছে মনে করে একজন অন্যজনকে পানি খাওয়াতে চেয়েছেন। আর আমরা আপন ভাই বা আত্মীয়দের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করাতো দূরের কথা, তাদের আরো ক্ষতি করার চেষ্টা করি।
আল্লাহপাক তার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে যেমন শ্রেষ্ঠ করেছেন, তেমনি তার অবয়বকেও শ্রেষ্ঠ সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। একথা আল্লাহ কুরআন পাকে নিজেই বলিয়াছেন, “নিশ্চয় আমি সৃষ্টি করিয়াছি মানুষকে সুন্দর অবয়বে।” [সূরা ত্বীন, আয়াত নং-৪, পারা—৩০]
সেই সুন্দর অবয়বে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ যাতে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং আখেরাতেও যেন অনন্তকাল সুখ শান্তিতে থাকতে পারে, সেজন্য মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)। পর্যন্ত এক লাখ বা দু’লাখ চব্বিশ হাজার নবী, রাসূল ও পয়গম্বর আল্লাহপাক পাঠিয়েছেন তাঁর বাণী নিয়ে। যারা সেই বাণীর উপর ঈমান এনেছে এবং বাণীর বিধান মোতাবেক কাজ করেছেন। আল্লাহ তাদের পার্থিব জীবন যেমন সুন্দর করেছেন, তেমনি পারলৌকিক জীবনও সুন্দর করবেন।
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও তার অনুশীলন অনুস্বরণ না করার ফলে শয়তান মানুষের অন্তরে কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা, মোহ ও মাৎসর্যের প্রভাব খাঁটিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে মাছ ভাজার মতো ভাজছে। তবু মানুষের জ্ঞানের চোখ খুলছে না। আল্লাহ আমাদেরকে সবকিছু বোঝার ও ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলার তওফিক দিক।
হ্যাঁ, আর একটা কথা, পুরুষরা ওয়াজ মাহফিলে আলেমদের কাছ থেকে অথবা মসজিদের ইমাম সাহেবদের কাছ থেকে কুরআন হাদিসের অনেক বাণী শুনে থাকে; কিন্তু মেয়েরা সে সুযোগ পায় না। তাই পুরুষদের উচিত, আলেম ও মসজিদের ইমামদের কাছ থেকে শুনে এসে বাড়িতে মেয়েদের কাছে সেসব বলা। আজ এখানে যা কিছু শুনলেন, আশা করি, ঘরে নিয়ে মেয়েদের কাছে শোনাবেন।
আপনারা অনেকে না খেয়ে আছেন, তাই আর বেশি কিছু বলে কষ্ট দেব না। আপনারা এবার আসুন, আসোলামু আলায়কুম।
মুসুল্লীরা সালামের উত্তর দিয়ে চলে যাওয়ার পর আজিজুল ও নাজিম উদ্দিনকে নিয়ে আব্দুল আলিম বাড়িতে এলেন।
খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে নাজিম উদ্দিন বললেন, বিয়াই সাহেব, চাচাত ভাই আনোয়ারুল হকের সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
আব্দুল আলিম বললেন, বেশতো চলুন।
পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ারুল হকের মনোমালিন্য থাকলেও মেয়ে অপহরনের মামলা করার খুব জোরাল ইচ্ছা ছিল না। স্ত্রী ও চাচাত ভাইয়ের জামাই মনিরুলের প্ররোচনায় মামলা করেছিলেন। সে মামলার খরচও মনিরুল দিয়েছিল। মামলায় হেরে গিয়ে রাগে ও অপমানে বড় ভাইয়ের ক্ষতি করার মনস্থ করেন। এই ব্যাপারেও স্ত্রী ও মনিরুলের প্রধান ভূমিকা ছিল এবং মনিরুল সন্ত্রাসীদেরকে টাকা দিয়ে আমিরুল ইসলামকে মারধর করে পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ী আঘাতের ফলে গুরুতর আহত হন এবং তিন দিন চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। আনোয়ারুল হকের বড় ছেলে শিহাব কলেজে পড়াশোনা করলেও এ-ব্যাপারে জড়িত ছিল।
আনোয়ারুল হকের বাড়িতে পৌঁছে আব্দুল আলিম তার সঙ্গে নাজিম উদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে আনোয়ারুল হক আদর যত্ন করে আপ্যায়ন করালেন।
আপ্যায়নের পর আলাপ করার সময় নাজিম উদ্দিন আনোয়ারুল হককে বললেন, বিয়াই সাহেব, আপনার বড় ভাইয়ের খুনের মামলার সব কিছু জেনে আমি শিহাব ও মনিরুলকে নির্দোষ প্রমাণ করিয়ে বেকসুর খালাস করাতে চাই। তাই সে ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।
একেতো বড় ভাইকে খুন করার ইচ্ছা আনোয়ারুল হকের ছিল না। তা ছাড়া ছেলে শিহাবের জন্যও খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তার উপর মনিরুল ফেরার হওয়ার পর থেকে মামলার টাকা তাকে খরচ করতে হচ্ছে। তাই নাজিম উদ্দিনের কথা শুনে খুশী হলেন।
আনোয়ারুল হকের স্ত্রী রিজিয়া খাতুন কপাটের আড়াল থেকে তাদের আলাপ শুনছিলেন, স্বামী কিছু বলার আগে বললেন, ওরা মামলা তুলে নিলে সবকিছু মিটে যাবে। যাতে ওরা মামলা তুলে নেয়, আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।
নাজিম উদ্দিন বললেন, উকিলের সঙ্গে আলাপ করে সে চেষ্টাও করেছি, কিন্তু এখন আর মামলা তুলে নেয়া সম্ভব নয়। সামনের তারিখে হয়তো রায় হয়ে যাবে। তাই যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। নচেৎ সবারই ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন জেল হয়ে যেতে পারে।
রিজিয়া খাতুন দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তা হলে বাপের মতো তিন ভাইয়ের পরিণতি হবে।
নাজিম উদ্দিন বুঝতে পারলেন, বিয়ান সাহেবা খুব কঠিন মহিলা। পেটে এতটুকু দ্বিনী এলেমও নেই। বললেন, বিয়ান সাহেবা, কথাটা বলা উচিত হয়নি। কাউকে খুন করা জঘন্যতর অপরাধ। দুনিয়াতে শাস্তি পাবেই, আখেরাতে আরো কঠিন শাস্তি পাবে। তা ছাড়া তিন ভাইকে খুন করলে ছেলেকে তো বাঁচাতেই পারবেন না, বরং বিয়াই সাহেবেরও হয়তো একই পরিণাম হবে। আপনি বোধ হয় জানেন না, আত্মীয়ের সঙ্গে শত্রুতা রাখা ইসলামে নিষেধ। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার রাখার জন্য ইসলাম কঠিন নির্দেশ দিয়েছে। আত্মীয়তার বন্ধন রাখাই সৌভাগ্যের মূল এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাই দুর্ভাগ্যের মূল। এই বন্ধনের শথিলতাই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবনতির কারণ হয়। হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “যে ইচ্ছা করে যে, তার উপার্জন বৃদ্ধি হউক এবং তাহার মৃত্যু বিলম্বে হউক, সে যেন তাহার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” [বর্ণনায় : হযরত আনাস (রাঃ)-বুখারী, মুসলীম]
সেই নবীর উম্মত হয়ে আমরা যদি তার হুকুম না মানি, তা হলে কীয়ামতের ময়দানে কি নাজাত পাব?
আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাহার। নামে তোমরা পরস্পরের নিকট (স্বীয় হকের) দাবি করিয়া থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) হইতেও ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সকলের খবর রাখেন।” [সূরা-নিসা, প্রথম আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা-৪]
যা বলছি শুনন, অতীতে কি ঘটেছে না ঘটেছে, সেসব মন থেকে মুছে ফেলুন, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মিলেমিশে থাকুন, ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলুন। তা হলে দুনিয়াতে যেমন সুখ শান্তি পাবেন, আখেরাতেও তেমনি তার-থেকে অনেক বেশি সুখ-শান্তিতে থাকবেন।
আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “নিঃসন্দেহে যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং নেক কাজ করিয়াছে তাহারাই উৎকৃষ্টতর সৃষ্টি। তাহাদের প্রতিদান তাহাদের প্রতিপালকের নিকট সর্বদা অবস্থানের বেহেশতসমূহ রহিয়াছে, যাহাদের নিম্নদেশে। নহরসমূহ বহিতে থাকিবে, যেখানে তাহারা অনন্তকাল অবস্থান করিবে, আল্লাহ তাহাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকিবেন এবং তাহারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকিবে। ইহা সেই ব্যক্তির জন্য, যে নিজের রবকে ভয় করে।” [সূরা-বায়্যিনাহ, আয়াত-৭৮, পারা-৩০]
মনিরুল ও আপনারা যেমন আমার আত্মীয় কামরুলরাও তেমনি আমার আত্মীয়। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর হুকুম মোতাবেক ও পরকালের কথা চিন্তা করে আত্মীয়দের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-কলহ ভুলে গিয়ে আমাদের। মিটমাট করে ফেলা একান্ত উচিত। সেই একান্ত উচিত কাজটা করার জন্য আমি এসেছি।
কুরআন হাদিসের বাণী এবং ছেলে ও স্বামীর পরিণামের কথা শুনে রিজিয়া খাতুনের মন একটু নরম হলেও স্বামী কি বলে শোনার জন্য চুপ করে রইলেন।
আনোয়ারুল হকের মন কিন্তু সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, এতদিন যা কিছু করেছেন সব ভুল ও অন্যায়। তবু চাচাত ভাই আব্দুল আলিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বল?
আব্দুল আলিম বললেন, বিয়াই সাহেবের সঙ্গে আমি একমত।
আনোয়ারুল হক নাজিম উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
নাজিম উদ্দিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তা হলে আপনারা ওয়াদা করুন, যা কিছু বলব মেনে নেবেন।
প্রথমে আব্দুল আলিম ওয়াদা করলেন।
আনোয়ারুল হক কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
নাজিম উদ্দিন ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কিছু বলেছেন না কেন?
আমিও ওয়াদা করলাম; কিন্তু টাকা পয়সা চাইলে দিতে পারব না। খুনের মামলায় অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই।
নাজিম উদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, আমি আপনাদের কাছে টাকা পয়সা চাইব, শুধু আমার কথামতো কাজ করলেই হবে।
বেশ, বলুন কি করতে হবে?
আপাতত প্রত্যেক নামাযের পর মোনাজাত করার সময় মরহুম মা বাবা ও বড় ভাইয়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন, ওনাদের প্রতি যা কিছু খারাপ ব্যবহার করেছেন, সেজন্য তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন। আর প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাযের পর ওনাদের কবর জিয়ারত করবেন।
প্রত্যেক ছেলের উচিত প্রতি সপ্তাহে মরহুম মা বাবা ও মুরুব্বীদের কবর জিয়ারত করা। তারপর আব্দুল আলিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও করবেন। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “আমি তোমাদিগকে কবর জিয়ারত করিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, তাহা জিয়ারত করিও। কেননা, ইহা দুনিয়ার
প্রতি বৈরাগ্য শিক্ষা দেয় এবং পরলোককে স্মরণ করাইয়া দেয়।”
আপাতত আমার এই কথাগুলো মেনে চলুন। পরেকি করতে হবে জানাব। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে নাজিম উদ্দিন আজিজুলকে জিজ্ঞেস করলেন। কামরুলদের টাউনের বাসা চেন?
জি, চিনি।
চল, ওদের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরব।
.
কামরুল এস.এস.সি. পাশ করে কলেজে পড়ার সাথে সাথে হোমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেছে। এক বছর বাড়ি ছাড়া ছিল। তাই এক বছর লেটে বি. এ. ও ডি. এইচ. এম. এস. পাশ করেছে। এখন সে তাদের টাউনের বাড়ির কাছে থানার সামনে স্ত্রীর নামে “শামিমা হোমিও হল” সাইন বোর্ড দিয়ে হোমিও ফার্মেসী খুলেছে। ফার্মেসীর সামনের রাস্তা দিয়ে তাদের বাসায় যেতে হয়।
নাজিম উদ্দিন ও আজিজুল টাউনে পৌঁছে আসরের আযান হচ্ছে শুনে মসজিদে গেল নামায পড়ার জন্য।
কামরুলরা তিন ভাই নামায পড়তে এলেও কেউ কাউকে খেয়াল করল না।
নামায শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আজিজুল চাচাকে কামরুলের হোমিও ডাক্তারী করার কথা জানিয়ে বলল, প্রথমে ফার্মেসীতে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি চলুন।
নাজিম উদ্দিন বললেন, বেশতো, তাই চল।
ফার্মেসীটা বেশ বড়। এক পাশে মেয়েদের বসার জায়গা পর্দা দিয়ে ঘেরা। অন্যপাশে পুরুষদের বসার জন্য কয়েকটা বেঞ্চ ও চেয়ার রয়েছে।
তিন ভাই নামায পড়ে এসে ফার্মেসীতে বসে মামলার ব্যাপারে আলাপ করছিল।
নাজিম উদ্দিন ও আজিজুল এসে সালাম দিল।
বড় ভাই জহুরুল ইসলাম সালামের উত্তর দিয়ে রুগী মনে করে বসতে বলে ছোট ভাই কামরুলকে বলল, আমরা এখন যাই, পরে বাসায় আলাপ করা যাবে। তারপর মেজ ভাই হাসানুজ্জামানকে বলল, চল।
তারা চলে যেতে উদ্ধত হলে আজিজুল বলল, আপনারা যাবেন না, আমার চাচা আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তারপর চাচার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ইনারাই মরহুম আমিরুল ইসলামের ছেলে।
পাঁচ বছর পরে দেখা, তার উপর আজিজুল দাড়ি রেখেছে, টুপিও মাথায়, তাই কামরুল তাকে প্রথমে চিনতে পারেনি। গলা শুনে চিনতে পেরে বলল, তুমি আজিজুল বিয়াই না?
আজিজুল বলার আগে নাজিম উদ্দিন বললেন, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক বলেছ ও আজিজুল। আমি ওর চাচা। আমেরিকা থেকে কয়েকদিন হল এসেছি। তোমরা আমার পুত্রা, তাই তুমি করে বলছি। কিছু যেন আবার মনে করো না।
তিন ভাই খুব রেগে গেলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জহুরুল ইসলাম বসতে বলল। বসার পর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কাছে কেন এসেছেন?
নাজিম উদ্দিন বললেন, তোমরাও বস, বলছি।
তিন ভাই মুখ চাওয়া-চায়ি করে বসল।
নাজিম উদ্দিন বললেন, আমরা এসেছি বলে তোমরা যে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছ, তা বুঝতে পারছি। অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু আশা করব, আমাদের আসার উদ্দেশ্য মন দিয়ে শুনবে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে কামরুল বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী ভেবে খুব মর্মাহত। আজিজুলকে চিনতে পারার পর থেকে তার উপর ভীষণ রেগে আছে। এতক্ষণ সহ্য করে থাকলেও আর পারল না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আপনার কোনো কথা আমরা শুনতে চাই না। আপনারা চলে যান। নচেৎ কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।
আজিজুল ভয় পেলেও নাজিম উদ্দিন পেলেন না। খুব নরমসুরে বললেন, তোমার রাগের কারণ আমি জানি। তবু বলব, আল্লাহ রাগকে হজম করতে বলেছেন। আমরা তোমাদের কাছে এসেছি, তোমরা আমাদেরকে যা খুশী করতে পার। তবু বলব, আমার কথা শোনার পর করো।
জহুরুল ইসলাম কামরুলের হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, ওনাকে বলতে দে। তারপর নাজিম উদ্দিনকে বললেন, বলুন কি বলতে এসেছেন।
নাজিম উদ্দিন বললেন, সেকথা বলার আগে আমার নিজের কথা বলে নিই। তোমরা যেমন আমাকে চেনে না, জানো না, তেমনি আমিও তোমাদেরকে চিনি না, জানিনা। প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমি আমেরিকা চলে গিয়েছিলাম, তারপর আর দেশে আসিনি। পাঁচ বছর আগে ভিসা পাঠিয়ে আজিজুলকে নিয়ে যাই এবং আমার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিই। আমার স্ত্রী আমেরিকান মুসলমান। আজিজুল আমার মেয়েকে নিয়ে দেশে বেড়াতে আসতে চাইলে আমরা সবাই আসি। আসার পর তোমাদের বাপ চাচাঁদের মনোমালিন্যের কারণ, তোমাদের বাবা খুন হওয়ার কারণ ও কারা খুন করিয়েছে সবকিছু জানার পর খুব দুঃখ পেয়ে এসেছি। কেন এসেছি তোমাদের মায়ের উপস্থিতিতে বলব। তোমাদের বাসায় আমাদেরকে নিয়ে চল।
ওনার কথা শুনে তিন ভাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল।
তাই দেখে নাজিম উদ্দিন বললেন, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমরা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসি নি। বরং আমার ভাইপো মনিরুল যে জঘন্য অপরাধ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এসেছি। আরো এসেছি যে কাজ করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) খুশী হবেন, সেই কাজ করার জন্য। তাই যা কিছু বলার তোমাদের মায়ের উপস্থিতি বলতে চাই।
চাচা থেমে যেতে আজিজুল বলল, পাঁচ বছর আগে ইসলামকে না জানার কারণে আমার ভাইয়াকে সহযোগিতা করে আমিও অপরাধ করেছি। যখন থেকে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত করেছেন তখন থেকে সব রকমের অপরাধ না করার জন্য, বিশেষ করে আপনাদের চাচার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে চিঠি দিয়েছি। তবুও এতকিছু ঘটে গেছে ভাইয়া আমাকে তার কিছুই জানায় নি। আমিও এসেছি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে। আল্লাহর কসম খেয়ে আমিও বলছি, আমরা কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসি নি।
জহুরুল ইসলাম বলল, আপনারা একটু বসুন। তারপর ছোট দু’ভাইকে নিয়ে বাইরে এসে শলা-পরামর্শ করে ঠিক করল, ওনাদের বাসায় নিয়ে যাবে।
এমন সময় জাহিদ এসে সালাম দিল।
জাহিদ কামরুলের বন্ধু। সদ্য হোমিও কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে কামরুলের ফার্মেসীতে বসে কম্পাউন্ডিং করে।
কামরুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুই ভিতরে গিয়ে বস, আমি একটু বাসায় যাচ্ছি। তারপর নাজিম উদ্দিন ও আজিজুলকে বলল, আসুন আমাদের সঙ্গে।
বাসায় এসে ড্রইংরুমে সবাইকে বসতে বলে জহুরুল ইসলাম ভিতরে গিয়ে মাকে নাজিম উদ্দিন ও আজিজুলের পরিচয় জানিয়ে ওনাদের আসার কথা বলল।
আনোয়ারা বেগম বললেন, কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করিস নি?
করেছি, আজিজুলের চাচা বললেন, ভাইপো মনিরুলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছেন।
তাই নাকি? তা কিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবেন বলেছেন?
না, বলেন নি। শুধু বললেন, যা কিছু বলার তোমাদের মায়ের সামনে বলব।
আমি ওনার সামনে যাব ভাবলি কি করে?
তুমি সামনে যাবে কেন? কপাটের আড়ালে থাকবে।
কোনো খারাপ মতলব নিয়ে আসেন নি তো?
উনি ও আজিজুল আল্লাহর কসম খেয়ে বলেছেন, কোনো খারাপ মতলব নিয়ে আসেন নি।
তা হলে চল বলে আনোয়ারা বেগম ড্রইং রুমের কপাটের আড়ালে এসে দাঁড়ালেন।
জহুরুল ইসলাম ভিতরে ঢুকে মায়ের আসার কথা বলল।
নাজিম উদ্দিন সালাম জানিয়ে বললেন, বিয়ান সাহেবা, আপনার বড় ছেলে নিশ্চয় আমার পরিচয় ও কেন এসেছি আপনাকে বলেছে। বিস্তৃত বলার আগে আমার প্রথম জীবনের কিছু কথা আপনাদের জানা দরকার মনে করে বলছি।
প্রথম জীবনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর বিধি নিষেধ তেমন জানতাম না। যতটুকু জানতাম তাও মেনে চলতাম না। তারপর কিভাবে তবলীগ জামাতের অসিলায় হেদায়েত হলেন এবং আজিজুল আমেরিকায় যাওয়ার পর কিভাবে হেদায়েত হল, সেসব বলার পর বললেন, মুসলমানরা কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন না করে ও ইসলামের বিধি নিষেধ না মানার ফলে শয়তান তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন গর্হিত কাজসহ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হত্যা ও মামলা-মোকদ্দমা করাচ্ছে। আল্লাহ পাক কুরআন মজিদে বলিয়াছেন, “আর আপনি আমার বান্দাদের বলিয়া দিন, তাহারা যেন এইরূপ কথা বলে যাহা উত্তম, শয়তান মানুষের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে, বস্তুতঃ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা-বণি ইসরাইল, আয়াত-৫৩, পারা-১৫]
আল্লাহর বিধান জেনে অথবা না জেনে এবং ধর্মের চর্চা ও অনুশীলন না করার কারণে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে বেশির ভাগ মুসলমান নানারকম গর্হিত কাজ করছে। ফলে তাদের দীলের ঈমানের নূর পাপের কালিমায় ঢাকা পড়ে গেছে। আনোয়ারুল হক ও মনিরুলের অবস্থাও তাই হয়েছিল। তাই তারা আপনজনকে খুন করার মতো জঘন্য কাজ করতেও তাদের বিবেকে বাধেনি। আল্লাহ মেহেরবাণী করে আমার মতো এক নাদান বান্দার অসিলায় আনোয়ারুল হকের ও তার স্ত্রীর বিবেকের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। ওনারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত এবং আপনাদের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের মনোমালিন্যসহ সবকিছু মীমাংসা করতে রাজি হয়েছেন। ইনশাআল্লাহ মনিরুল ও শিহাব নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। আত্মীয় বা অনাত্মীয়দের মধ্যে বিবাদ মীমাংসা করে দিলে আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) খুশী হন। তাদেরকে খুশী করার জন্য আমি এসেছি আপনাদের বিবাদ মীমাংসা করে আত্মীয়তার বন্ধন যাতে দৃঢ় হয় সেই ব্যবস্থা করতে।
হত্যাকান্ড লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে একটা হাদিস বলছি, “হযরত জরীর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বিদায় হজ্বের সময় আমাকে আদেশ করিলেন, সকলকে চুপ থাকিতে বল। তারপর ফরমাইলেন, হে মুসলমানগণ! আমার পরে তোমরা কাফেরদের কার্যকলাপে লিপ্ত হইও না যে তোমরা একে অপরকে হত্যা করিতে আরম্ভ কর।” [বুখারী]
ইসলামে হত্যার বদলে দিয়াত দেয়ার নিয়ম আছে। দিয়াত হল, হত্যাকারী অনুতপ্ত হয়ে যাকে হত্যা করেছে তার ওয়ারীসনকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করে ক্ষমা চাওয়া। মনিরুল ও শিহাব আপনাদের আব্বাকে হত্যা করার বদলে তাদের পক্ষ থেকে আমি দু’লক্ষ টাকা দিয়াত দেব। আপনারা ওদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং মামলায় ওরা যেন বেকসুর খালাস পায়, সেই ব্যবস্থা করার জন্য এসেছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
ওনার কথা শুনে সবাই খুব অবাক হয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
নাজিম উদ্দিন আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে ভিজে গলায় বললেন, বিয়ান সাহেবা, আপনার স্বামী মরহুম আমিরুল ইসলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওনাকে খুব ভালো লোক বলে জানতাম। আল্লাহ ওনাকে বেহেশত নসীব করুক। তারপর চোখ মুছে আবার বললেন, আপনি ছেলেদের চেয়ে জ্ঞানী। একথা নিশ্চয় জানেন, ক্ষমা প্রার্থীকে ক্ষমা করলে আল্লাহ খুশী হন। রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর তরবারির উপরে এই বাক্যগুলো লেখা ছিল, “যে তোমার প্রতি অন্যায় করে, তাহাকে ক্ষমা কর, শক্তিশালী হইয়াও যে ক্ষমা করে, সে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি।”
আনোয়ারা বেগম কপাটে টকটক শব্দ করতে জহুরুল ইসলাম মায়ের কাছে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, আম্মা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) কে খুশী করার জন্য ওদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর দিয়াত বাবদ যে টাকা আপনি দিতে চাচ্ছেন, তা আমাদের গ্রামের মাদ্রাসায় দান করে দিতে বলেছেন।
সুবহান আল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নাজিম উদ্দিন বললেন, নোক মুখে ওনার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তারচেয়ে বেশি দেখলাম। আল্লাহ ওনাকে তাঁর প্রিয় বান্দিদের অন্তর্ভুক্ত করুক। এবার তোমরাও ওদেরকে ক্ষমা করে দাও বাবা।
তিন ভাই একসঙ্গে বলল, আম্মা যে কারণে ক্ষমা করলেন, আমরাও সেই কারণে ক্ষমা করে দিলাম।
নাজিম উদ্দিন আর একবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, টাকাটা কার কাছে দেব?
জহুরুল ইসলাম বলল, আগে আব্বা মাদ্রাসার সেক্রেটারী ছিলেন। ওনার নামে একাউন্ট ছিল। ওনার ইন্তেকালের পর মাদ্রাসার কমিটি আমাকে সেক্রেটারী করেছে। ঐ একাউন্ট এখন আমার নামে। তারপর একাউন্ট নাম্বার লিখে দিয়ে বলল, এই নাম্বারে জমা দেবেন।
ঠিক আছে, দু’একদিনের মধ্যে টাকাটা আমি জমা দিয়ে দেব। এবার তা হলে আমরা আসি।
এমন সময় আবার কপাটে টকটক শব্দ শুনে জহুরুল ইসলাম মায়ের কাছে গিয়ে একটু পরে ফিরে এসে বলল, আম্মা বললেন, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেছে। নামায পড়ে চা-নাস্তা খেয়ে তারপর যাবেন।
নয়
নাজিম উদ্দিনের মুখে কুরআন হাদিসের কথা শুনে আনোয়ারুল হকের মনের পরিবর্তন হলেও রিজিয়া খাতুনের মন একটু নরম হওয়া ছাড়া কোনো পরিবর্তন হয় নি বরং রেগে গিয়েছিল। তাই ওনারা চলে যাওয়ার পর বেশ রাগের সঙ্গে স্বামীকে বললেন, তুমি যে মনিরুলের চাচার কথা মেনে নিলে, সেটা কি উচিত হল? সবদিক থেকে তোমার ভাইপোদের জিত হল। ওদের কাছে ও গ্রামের লোকজনের কাছে আমরা কত ছোট হয়ে গেলাম। সবাই টিটকারী করবে। আত্মী-স্বজনের কাছে মুখ দেখাবে কি করে?
আনোয়ারুল হক খুব রেগে উঠে বললেন, এ ব্যাপারে একটা কথা বলবে না। এতদিন তোমার কথা শুনে অনেক অন্যায় করেছি। বাপ হয়ে মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে দুষমনী করেছি, ছোট ভাই হয়ে বড় ভাইকে খুন করিয়েছি, তিন বছর হতে চলল, নানা হয়েছি; কিন্তু নাতি কি জিনিস জানি না, গ্রামের লোকজন ও আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এসব তোমার কারণে হয়েছে। আর নয়, বিয়াই সাহেব আজ আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছেন। এখন থেকে তোমার কোনো কথাই শুনব না। বরং তুমি আমার কথা শুনবে। যদি না শোনো, তা হলে চিরকালের জন্য বাপের বাড়ি চলে যাও।
রিজিয়া খাতুন স্বামীকে তার প্রতি এত রেগে যেতে কোনোদিন দেখেন নি। তাই মনে খুব আঘাত পেয়ে কাঁদাদ গলায় বললেন। এরকম কথা আমাকে বলতে পারলে?
কেন পারব না? যে স্ত্রী স্বামীকে অন্যায় করতে দেখে বাধা না দিয়ে আরো উস্কানী দেয়, যে স্ত্রী মেয়ের সুখ-শান্তি না চেয়ে তার সর্বনাশ করতে চায়, আজ তিন বছর নানি হয়েও যে নাতির মুখ দেখে নি, বড় ছেলেকে খুনের আসামী করে দেড় বছর ঘর ছাড়া করেছে, যে স্ত্রী স্বামীকে বেহেশতের পথ না দেখিয়ে জাহান্নামের পথ দেখায়, সেরকম স্ত্রী থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আমি বিয়াই সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। তুমিও ওনার কথা ও আমি যা করতে বলব, অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। নচেৎ এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না। যদি থাকতে চাও, এক্ষুনি অযু করে নামায পাটিতে বসে আল্লাহর কাছে তওবা করে ওয়াদা কর, ভবিষ্যতে কোনো অন্যায় করবে না আর আমাকেও করতে বলবে না। আমিও মসজিদে গিয়ে তাই করব বলে আনোয়ারুল হক চোখের পানির মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
নাজিম উদ্দিনের মুখে কুরআন হাদিসের কথায় রিজিয়া খাতুনের মনের পরিবর্তন না হলেও স্বামীর কথায় হল। চোখ মুছতে মুছতে অযু করে এসে নামায পাটি বিছিয়ে তওবা করতে বসল।
নাজিম উদ্দিন পরের দিনই টাউনে এসে জহুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে দু’লাখ টাকা জমা দিলেন। তারপর মনিরুল ও শিহাব যাতে বেকসুর খালাস পায় এবং মামলার রায় তাড়াতাড়ি হয়, সে ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করলেন।
আগে আনোয়ারুল হক নামায পড়লেও ঠিকমতো পড়ত না। সব ওয়াক্তে জামাতে নামায পড়ার জন্য আসতও না। ইদানিং পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামায পড়তে দেখে ও প্রতি জুম্মার নামাযের পর মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে দেখে গ্রামের লোকজন বেশ অবাক হল। তারা বলাবলি করতে লাগল, আল্লাহ কখন কাকে হেদায়েত দেয় কেউ বলতে পারে না।
মসজিদের ইমাম সাহেবের চোখেও ঘটনাটা ধরা পড়ল।
তিনি গ্রামের কে কেমন লোক জানেন। তাই একদিন আনোয়ারুল হককে বললেন, আপনার পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। দোয়া করি, আল্লাহ যেন আপনাকে তার খাস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
আনোয়ারুল হক চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ যদি আরো আগে আমাকে হেদায়েত করতেন, তা হলে বড় ভাইকে খুন করাতাম না। আচ্ছা হুজুর, আল্লাহ কি আমার খুনের অপরাধ ক্ষমা করবেন?
কেন করবেন না? তিনি অসীম দয়ালু, তা না হলে কোনো বান্দাকে অপরাধ করার পর রেহাই দিতেন না, সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতেন। হাদিসে আছে, “রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রত্যেক আদমসন্তানই পাপাসক্ত এবং সর্বপেক্ষা উত্তম ঐ ব্যক্তিগণ যাহারা অনবরত ক্ষমা প্রার্থনা করে।” [বর্ণনায় : হযরত আনাস (রাঃ)-তিরমিযী]
হাদিসে আরো আছে, “তিনি বলিয়াছেন, যখন কোনো বান্দা পাপ স্বীকার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাহার প্রার্থনা কবুল করেন।” [বর্ণনায় : হযরত আয়েশা (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম]
মাস খানেকের মধ্যে মামলার রায় হয়ে গেল। যে সাতজন আসামী এ্যারেষ্ট হয়ে হাজতে ছিল, তাদের যাবজ্জীনব জেল হল। আর পলাতক আসামী শিহাব ও মনিরুল খুনীদের সঙ্গে ছিল, এরকম কোনো সাক্ষি না থাকায় তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেল।
রায় শুনে সবাই খুশী হলেও যারা জানত, মনিরুল ও শিহাব সন্ত্রাসীদের দ্বারা আমিরুল ইসলামকে খুন করিয়েছে, তারা বলাবলি করতে লাগল, মনিরুলের চাচা আমেরিকা থেকে এসে যদি তদবীর না করতেন, তা হলে তাদেরও যাবজ্জীবন জেল হত।
রায় শোনার জন্য গ্রামের বহু লোকজন কোর্টে এসেছিল। মনিরুল, আনোয়ারুল হক ও মরহুম আমিরুল ইসলামের বাড়ির মেয়েরাও বোরখা পরে এসেছিল। গ্রামের লোকজন চলে যাওয়ার পর নাজিম উদ্দিন তাদের সবাইকে নিয়ে কামরুলদের টাউনের বাসায় এলেন। তারপর পুরুষদের ড্রইংরুমে ও মেয়েদেরকে পাশের রুমে বসতে বললেন। বসার পর বললেন, আমি অনেক দিন হল দেশে এসেছি, দু’একদিনের মধ্যে চলে যাব। যাওয়ার আগে আপনাদের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না। তাই কয়েকটা কথা বলার জন্য আপনাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছি।
আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করার জন্য কুরআন হাদিসে যে পথে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, মানব জাতি সেই পথে না চলে শয়তানের নির্দেশিত পথে চলছে বলেই সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ, মারামারি, খুনো-খুনী, চুরি-ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, অপহরণ ও ধর্ষণ প্রভৃতি জঘণ্য অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কথা বাদই দিলাম, যে মুসলমানদের আল্লাহ খলিফা (প্রতিনিধি) করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন, তারা কেন এইসব জঘণ্য অপরাধ করছে? এর একমাত্র কারণ হল, মুসলমানরা ইসলামের কৃষ্টি, কালচার ও নিজেদের পরিচয় জানে না, হাদিসে আছে, “যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে চিনেছে।”
নিজেকে চিনতে হলে সব রকমের শিক্ষা লাভের সাথে সাথে কুরআন হাদিসের শিক্ষাও অর্জন ও তার অনুশীলন করতে হবে। মুসলমানরা তা করছে না বলে। তাদের নৈতিক চরিত্রের এত অবক্ষয়। তাই মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে অর্থাৎ প্রতিটি মুসলমান নর-নারীকে কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করতেই হবে এবং ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলতেই হবে। নচেৎ ইহজগতে যেমন অশান্তির আগুনে জ্বলবে, পরজগতেও তেমনি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
বাংলায় কুরআন হাদিসের তরজমাসহ ব্যাখ্যা বেরিয়েছে। দামি দামি পোশাক ও প্রসাধনীর পিছনে টাকা খরচ না করে ঐসব কিনে নিজেরা পড়ুন, সেইমতো অনুশীলন করুন এবং ছেলেমেয়েদের সেইমতো অনুশীলন করিয়ে মানুষ করুন। তা হলে দেখবেন, তারা বড় হয়ে স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়াশোনা করলেও শয়তানের পথ অনুসরণ করবে না। ভবিষ্যৎ জীবন তাদের সুখের ও শান্তির হবে।
আশা করি, এখন থেকে আপনারা শয়তানের পথ পরিত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ)-এর নির্দেশিত পথে চলার চেষ্টা করবেন। তারপর আনোয়ারুল হককে উদ্দেশ্য করে বললেন, বিয়াই সাহেব, এবার ভিতরে গিয়ে বিয়ান সাহেবকে নিয়ে আপনার ভাবির কাছে ক্ষমা চান, আর মেয়ে, জামাই ও ভাইপোদেরকে সন্তুষ্ট করে আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় ও ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবন সুন্দর করার চেষ্টা করুন। তারপর কামরুলদের তিন ভাইকে বললেন, তোমরাও ভিতরে যাও। আর একটা বিশেষ অনুরোধ করছি, শিহাব ও মনিরুল ফিরে আসার পর আপনারা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে কাছে টেনে নেবেন এবং তাদেরকেও আল্লাহ ও তাঁর। রাসূল (দঃ) এর নির্দেশিত পথে চালাবার চেষ্টা করবেন।
Leave a Reply