জীবনানন্দ ও তাঁর কাল – হরিশংকর জলদাস
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০১৭
উৎসর্গ
মহি মুহাম্মদ
ও
মাসুদ চৌধুরী
.
লেখকের কথা
বালকবেলার হাতেগোনা মধুময় কয়েকটা বছর বাদ দিলে জীবনানন্দ দাশের প্রায় গোটা জীবন দারিদ্র্যে ও বিপন্নতায় কেটেছে। দরিদ্রতা ও বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তাঁর অবিরাম প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু তাঁর সে সকল প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে বারবার। আজীবন একটা বিমর্ষতাকে সঙ্গী করে তিনি পথ চলেছেন।
ত্রিশের কবিদের নিয়ে আমি যখন একটু একটু করে ভাবতে শিখছি, তখন জীবনানন্দ অন্যদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এবং আমার ভাবনার একমাত্র কবি হয়ে উঠেছেন। এরকম একজন মানুষ, যিনি আপাদমস্তক কবি, আমার চিন্তা ও শ্রমের বিষয় হয়েছেন। তাই তাঁকে নিয়ে লেখা।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় তিন-চারটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। ‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’-এর মতো একটা বই লেখার চিন্তাটা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অগ্রজ-প্রতিম অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক। বেশ কয়েক বছরের পরিশ্রমের ফসল এই গ্রন্থটি। গ্রন্থটি রচনার পেছনে আমার মেধা নয়, পরিশ্রমই কাজ করেছে বেশি।
আজ পর্যন্ত জীবনানন্দকে নিয়ে নানা ধরনের বই লেখা হয়েছে। কেউ তাঁর কবিতার নান্দনিকতা নিয়ে বই লিখেছেন, কেউ জীবনানন্দের ওপর পাশ্চাত্য প্রভাব কতটুকু—তা নিয়ে তাঁদের বইতে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর জীবনীও লিখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু ‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’-এর মতো গ্রন্থ বোধ হয় এই প্রথম। উল্লেখ্য, এই বইটি তত্ত্বমূলক নয়, তথ্যবহুল।
এই গ্রন্থে জীবনানন্দের ৫৫ বছরের জীবনকে সালওয়ারি বিন্যস্ত করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে কেন্দ্রভূমিতে জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে থাকলেও সম-সময়ের অন্যান্য সাহিত্য-কুশীলবরা এই গ্রন্থে উপেক্ষিত হননি। তথ্য গ্রন্থনার পাদপ্রদীপে চলে আসা অন্যান্য সাহিত্যিকরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, প্রেমেন্দ্র, সঞ্জয়, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, সুধীন্দ্রনাথ, সজনীকান্ত, নীরেন্দ্রনাথ প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্রহ্মবাদী’, ‘পূৰ্ব্বাশা’, ‘ঊষা’, ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘নিরুক্ত’, ‘প্রগতি’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শনিবারের চিঠি’ ইত্যাদি পত্রিকাও আলোকিত জায়গা পেয়েছে এই বইতে।
জীবনানন্দের সমকালের ভারতবর্ষ ও বহির্বিশ্বের রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমরনীতি, সাহিত্যচিন্তা এই গ্রন্থে সংগ্রথিত হয়েছে। উল্লিখিত কাল-পরিধির মধ্যে ভারতবর্ষে ও পাশ্চাত্যে কী কী বিখ্যাত গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়েছে, কারা কারা সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, নোবেল কমিটি তাঁদের সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন—এ সবের তথ্য আছে ‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’ বইটিতে।
সর্বোপরি, জীবনানন্দের সমাজ, তাঁর পরিপার্শ্ব, তাঁর পরিবার-পরিজন—সবই এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। মূলত জীবনানন্দ দাশকে সামগ্রিকভাবে এই বইতে উপস্থাপন করার চেষ্টা আছে।
গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে নানা পত্রপত্রিকা, গ্রন্থাদি থেকে অকৃপণভাবে তথ্য গ্রহণ করেছি। গ্রন্থমধ্যেই তার উল্লেখ আছে। প্রভাতকুমার দাসের ‘জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থটি আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
বইটি লেখার সময় নানা মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন আমার শিক্ষক প্রফেসর ময়ুখ চৌধুরী। এই গ্রন্থের ইংরেজি অংশগুলোর ব্যাপারে আমাকে সবিশেষ সাহায্য করেছেন অধ্যাপক মুজিব রাহমান; তাঁর কাছে আমি ঋণ স্বীকার করছি। প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করে জীবনানন্দ-বিষয়ে নানা অস্পষ্ট ধারণা স্পষ্টতর হয়েছে।
প্রত্যেক মানুষ তাঁর সমকালীন ইতিহাস ও নিজের রহস্যময় ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ও সংঘাতের ফসল। জীবনানন্দ দাশও তা-ই। সমকালকে তিনি কীভাবে নিজের জীবনে ও সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন তার একটা হদিস দেওয়ার চেষ্টা আছে ‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’ গ্রন্থে। তবে এ চেষ্টা সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন নয়। তার জন্যে যদি কোনো অপ্রশংসা থাকে, তবে তার ভাগীদার আমি।
গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে। ২০১৪ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। বইটি বাজারে ছিল না অনেকদিন। এ বছর ‘অবসরের স্বত্বাধিকারী জনাব আলমগীর রহমান বইটির সংযোজিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে আমার কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন।
হরিশংকর জলদাস
ফেব্রুয়ারি ২০১৭
সাথভিক, নন্দন কানন
চট্টগ্রাম
Leave a Reply