জরুরি কিছু লেখা – সুভাষচন্দ্র বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৭
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: জয়ন্ত ঘোষ
.
সম্পাদকের নিবেদন
“ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান—এই মহাদেশে লোকশিক্ষার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করিয়া পাপক্লিষ্টা ধরণীকে পবিত্র করিয়াছেন এবং প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্মের ও সত্যের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন। ভগবান মানব দেহ ধারণ করিয়া নিজের অংশাবতার রূপে অনেক দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু এতবার তিনি কোন দেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই—তাই বলি আমাদের জন্মভূমি ভারতমাতা ভগবানের বড় আদরের দেশ।”—
মায়ের কাছে ১৯১২ সালে লেখা একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র বসু এই কথাগুলি লিখেছিলেন।
সারাজীবন মাতৃভূমির সেবার অতিবাহিত করার পর ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবাসীর উদ্দেশ তার শেষ বার্তায় নেতাজি বললেন:
“ভারতবর্ষের নিয়তির ওপর মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস হারিও না। বিশ্বে এমন কোন শক্তি নেই যা ভারতবর্ষকে পদানত করে রাখতে পারে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই এবং অচিরেই হবে।”
জনমানসে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ধারণা আছে যে তিনি একজন সমরনায়ক এবং বিপ্লবী নেতা। তিনি দুঃখ কষ্ট ও আত্মত্যাগের জীবন বরণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলার সময়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য এক মহান সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। আমরা অনেক সময়ে ভুলে যাই যে তাঁর সংগ্রামী জীবনের মাঝখানেও সমকালীন ভারতবর্ষের ও বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা ও লেখালেখিতেও তিনি যথেষ্ট সময় দিতেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে নিমজ্জিত হয়ে থাকা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস নিয়ে বই লিখছেন এবং স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তাঁর যে চিন্তাধারা তা অত্যন্ত স্পষ্ট—একদিকে তা যেমন কোন বৈষয়িক-ব্যাপার উদাসীন আধ্যাত্মিক পরিব্রাজকের মতবাদ নয় অন্যদিকে তেমনি বাইরে থেকে ধার করা কোন সংকীর্ণ বিপ্লববাদও নয়। সুভাষচন্দ্র তাঁর দার্শনিক মন দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীর বিচার করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতা সরাসরি অর্জন করেছেন। সমসাময়িক ভারতবর্ষে আর কোনও নেতার জীবনে এমন দেখা যায় না। চব্বিশটি সংখ্যায় পরিব্যাপ্ত সুভাষচন্দ্রের সমগ্র রচনাবলী থেকে বিশেষভাবে চয়ন করে সুভাষচন্দ্র বসুর জরুরি কিছু লেখা একটি জন্মশতবর্ষ গ্রন্থে সংকলিত হল। ভারতবর্ষের অগ্রগণ্য জাতীয়তাবাদী সমরনায়কের জীবন ও চিন্তাধারার পরিচয় এই একটি গ্রন্থে বিধৃত।
জওহরলাল নেহরু ভারতবর্ষকে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন অনেক পরিণত বয়সে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র নিতান্ত বালক বয়সেই ভারতবর্ষের দুঃখ কষ্টের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রের জন্ম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জগতের আলোড়নের প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিল। আবার ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েই তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন।
স্কুল ও কলেজে পড়ার সময়ে বিবেকানন্দের আদর্শে বিশ্বাসী সুভাষচন্দ্রকে আমরা দেখি মানবতাবাদী, পরিব্রাজক ও সমাজসংস্কারক রূপে। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর উত্তরণ ঘটল। ১৯১২-১৩ সালে মাকে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে আমরা দেখি সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেমের মধ্যে অধ্যাত্মবাদের স্পর্শ রয়েছে, দেশভক্তিকে তিনি মাতৃপূজার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। দেশের এবং ধর্মের বর্তমান দুরবস্থা দেখে তিনি বিচলিত—‘আজকাল যেখানে ধর্মের নাম সেখানেই যত ভণ্ডামি এবং যত অধর্ম।’ সুভাষচন্দ্র মাকে জিজ্ঞাসা করছেন—“আমাদের দেশের অবস্থা কি দিন দিন এইরূপ অধঃপতিত হইতে থাকিবে—দুঃখিনী ভারতমাতার কোন সন্তান কি নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়া মা-এর জন্য জীবনটা উৎসর্গ করিবে না?”
সুভাষচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে গ্র্যাজুয়েট হবার পর দর্শনশাস্ত্র পড়তে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিলেন। ততদিনে কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব পূর্ণ প্রকাশিত এবং তাঁর জীবনের কী লক্ষ্য সে বিষয়ে তাঁর মনে আর কোনও সন্দেহ নেই। জীবনের সেই লক্ষ্যে চলার পথে কোন আপসের প্রশ্ন আর নেই। সুভাষচন্দ্র ১৯৩৭ সালে যে অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিলেন তাতে মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুকে ১৯২১ সালে লেখা অনেকগুলি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে তাঁর মনের গতি প্রকৃতি কী রকম ছিল এই চিঠিগুলিতে তার বিশদ প্রকাশ আছে। তিনি এই ঘৃণ্য চাকুরি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন বলছেন, তিনি দাসত্বের চিহ্ন বহন করবেন না। সিভিল সার্ভিসের নিয়মাবলীর সঙ্গে জাতীয় বা আধ্যাত্মিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা একেবারেই মেলে না। সে সময়ে তিনি অরবিন্দ ঘোষের আত্মত্যাগের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ‘একমাত্র আত্মত্যাগ ও দুঃখবরণের ভিত্তির উপরই জাতীয় সৌধ গড়ে তোলা সম্ভব’—একথা তিনি বিশ্বাস করতেন।
অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে তাঁর রাজনৈতিক গুরু হিসেবে বরণ করলেন। দেশের মুক্তির জন্য একই আদর্শে যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর কাছেই সুভাষচন্দ্র নিজেকে সমর্পণ করলেন। তবে তাঁর এই শিষ্যত্ব ছিল ক্ষণস্থায়ী কারণ তাঁর গুরু অকালে ১৯২৫ সালে দেহরক্ষা করলেন। সুভাষচন্দ্র তখন মান্দালয় জেলে বন্দী। শোকের আঘাতে তিনি স্তব্ধ। বর্মার বন্দীশালায় ১৯২৪ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে সুভাষচন্দ্র যেন শিষ্যত্ব থেকে নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হলেন। বর্মার কারাবাসের সময়ে মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসু, মেজবৌদিদি বিভাবতী বসু, দিলীপকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের কাছে লেখা অসংখ্য চিঠিপত্রের মধ্যে সুভাষচন্দ্র শিল্পকলা, সঙ্গীত, সাহিত্য, প্রকৃতি, শিক্ষা, লোকসংস্কৃতি, নগর উন্নয়ন, অপরাধতত্ত্ব, অধ্যাত্মবাদ এবং অবশ্যই রাজনীতি বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। কারাবাসের দুঃখকষ্ট তিনি নির্বিকার চিত্তে এবং সকৌতুকে সহ্য করেছেন। তিনি বলছেন, “এখানে না এলে বোধহয় বুঝতুম না সোনার বাংলাকে কত ভালবাসি। আমার সময়ে সময়ে মনে হয় বোধ হয় রবিবাবু কারারুদ্ধ অবস্থার কথা কল্পনা করে লিখেছিলেন ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।”
কারাগারে কর্মহীন অবসর যাপন করার সময়ে অবশ্য তাঁর এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে সাধনার মূল ভিত্তি হচ্ছে কর্ম। ধ্যানী শ্রীঅরবিন্দের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল কিন্তু তিনি একথাও মনে করতেন যে দীর্ঘ দিন নিভৃত জীবনযাপন করলে মানুষের কর্মক্ষমতা পঙ্গু হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। “নানা কারণে আমাদের জাতির কর্মের দিকটা শূন্য হয়ে এসেছে, তাই এখন আমাদের দরকার রজোগুণের ‘double dose’.”
দেশবন্ধুর উপর ১৯২৬ সালে তিনি একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। এই লেখায় সুভাষচন্দ্রের মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক পরিচয় আমরা পাই। দেশবন্ধু সম্পর্কে তিনি বললেন “ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধু মতে ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেহ ছিলেন বলিয়া আমার মনে হয় না—তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসিতেন যে, তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না। এইজন্য তিনি ইসলামকে ভালবাসিতে পারিতেন।” ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি এই উদারতা অন্যান্য অনেক জননেতার কাছে আশা করা যেত না। সুভাষচন্দ্র এ বিষয়ে দেশবন্ধুর অনুগামী ছিলেন।
আরও একটি বিষয়ে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর মতের বিশেষ অনুগামী ছিলেন। “ভারতে স্বরাজের প্রতিষ্ঠা হইবে উচ্চশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, জনসাধারণের উপকার ও মঙ্গলের জন্য”—দেশবন্ধুর এই বিশ্বাসের প্রতি সুভাষচন্দ্রের পূর্ণ আস্থা ছিল। “মানবজাতির সংস্কৃতি এক না বহু”—এই একটি প্রশ্নেও সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর সহিত সহমত ছিলেন। মানব সংস্কৃতি একও বটে বহুও বটে। জাতীয় সংস্কৃতিকে বর্জন করে বিশ্বমানবের সেবা সম্ভব নয়। দেশবন্ধুর স্বদেশপ্রেমের পরিণতি বিশ্বপ্রেমে, কিন্তু স্বদেশপ্রেমকে বাদ দিয়ে তিনি বিশ্বপ্রেমিক হবার চেষ্টা করেননি। দেশবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নই জাতির প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার, সুভাষচন্দ্র তাই মনে করতেন।
১৯২০ সালের শেষে ও ১৯৩০-এর গোড়ায় আমরা দেখি জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে বামপন্থী ও তরুণদের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। মাঝে মাঝেই সুভাষচন্দ্র কারাগারে রয়েছেন। যখন তিনি কারাগারের বাইরে তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র, যুবক বা শ্রমিকদের সমাবেশে বক্তৃতা করে বেড়াছেন।
মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনে ১৯২৮ সালের মে মাসে তিনি বললেন, গণতন্ত্র একটি পাশ্চাত্য ভাবধারা একথা সত্য নয়, গণতন্ত্র সকল মানবজাতির। তিনি জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষেও তাঁর বক্তব্য রাখলেন। তাঁর মতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদে কোন বিরোধ নেই। তিনি এক ধরনের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন যা কখনোই সংকীর্ণ, স্বার্থপর বা আগ্রাসী হবে না। তার মধ্যে থাকবে সেবার মনোভাব, মানুষের সৃষ্টিশীলতা তার থেকে পাবে অনুপ্রেরণা।
সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন শ্রমিক ও ভারতের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়। শ্রমজীবীদের মধ্যে তিনি কৃষককেও অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। তাঁর মত ছিল ভারতবর্ষকে একটি ফেডারেল রিপাবলিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভারতের জাতীয়তাবাদীদের তিনি সাবধান করেছিলেন যে তাঁরা যেন রাজনীতিতে গণতন্ত্রবাদী অথচ সমাজনীতিতে রক্ষণশীল হয়ে না পড়েন। তিনি বললেন : “আমরা যদি সত্যই ভারতবর্ষকে মহৎ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে চাই তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর এক রাজনৈতিক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে। জাতি ধর্ম বা জন্মের জন্য কেউ কোনও বিশেষ সুবিধা পাবে না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য থাকবে সমান সুযোগ। মেয়েদের জন্য সমাজে উচ্চ ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েরা যাতে জনসেবার ক্ষেত্রে উৎসাহ পান তার জন্য তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে।”
সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য এড়াবার জন্য কিছু জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থাতে তাঁর যে আপত্তি ছিল তা নয় কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন সাংস্কৃতিক মিলনের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের পুনঃস্থাপন। তাঁর দুঃখ ছিল ভারতে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজেদের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ। তিনি বলেছিলেন সাংস্কৃতিক মেলামেশার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল গোঁড়ামি। গোঁড়ামি থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় হল ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা। সম্ভবত এই প্রথম সুভাষচন্দ্র ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি ব্যবহার করলেন। তবে মনে রাখতে হবে তাঁর কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের বিরোধিতা নয়। তিনি চেয়েছিলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক অন্তরঙ্গতা।
সাইমন কমিশনকে বয়কটের ডাক দিয়ে সুভাষচন্দ্র ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর তিনটি মূলমন্ত্র জ্ঞাপন করলেন: সার্বভৌমত্ব জনগণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে, সকলের নাগরিকত্বের সমান অধিকার থাকবে এবং গঠিত হবে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের যুবসমাজকে নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের সেবা করবার ডাক দিয়ে তিনি বললেন : “আমাদের দেশে তিন শ্রেণীর মানুষ একেবারেই বঞ্চিত—নারীসমাজ, তথাকথিত ‘backward’ শ্রেণীর মানুষ, এবং শ্রমিক সম্প্রদায়। তাঁদের কাছে গিয়ে আমাদের বলতে হবে আপনারাও মানুষ, সমস্ত মানবাধিকার আপনাদের প্রাপ্য। জেগে উঠুন। আপনাদের যা প্রাপ্য তা ছিনিয়ে নিন।”
১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেসে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ প্রস্তাব পাশ হওয়ার দু’ মাস আগেই ওই একই শহরে অনুষ্ঠিত এক ছাত্ৰসম্মেলনে সুভাষচন্দ্র পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুললেন। দুই মহান শহীদ যতীন দাস এবং ভগৎ সিং-এর তিনি স্মৃতিচারণ করলেন। ছাত্র আন্দোলনকে তিনি ‘ভবিষ্যতের নাগরিকদের পাঠশালা’ হিসেবে চিহ্নিত করে এই মত জ্ঞাপন করলেন যে ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক ও মহিলা আন্দোলনই কংগ্রেসের শক্তির উৎস হওয়া উচিত। ছাত্রদের তিনি একটি মন্ত্র দিলেন: ‘স্বাধীনতা কেড়ে নাও, অথবা সেই মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দাও।’
১৯৩০ সালে যখন অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটল সুভাষচন্দ্র তখন জেলে বন্দী। জেলে থাকাকালীন তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হলেন। কিছুদিন পরে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সেই পদ গ্রহণ করলেন। কিন্তু ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র ঘোড়সওয়ার পুলিশের আক্রমণে গুরুতর আহত অবস্থায় ফের গ্রেফতার হলেন। জেলে বসে গান্ধী-আরউইন চুক্তির খবর পেয়ে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত বিচলিত হলেন। ১৯৩১ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত করাচি কংগ্রেসের প্রাক্কালে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোগীদের ফাঁসি হয়ে গেল। একই সময়ে করাচিতে অনুষ্ঠিত হল অখিল ভারতীয় নওজওয়ান ভারত সভার অধিবেশন। ভগৎ সিং-অনুপ্রাণিত এই যুব সংগঠনের সভায় সভাপতিত্ব করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর অভিভাষণে সুভাষচন্দ্র পাঁচটি মূলতত্ত্বের বিশ্লেষণ করলেন—ন্যায়, সমতা, মুক্তি, একাগ্রতা ও প্রেম—যেগুলি তাঁর মতে জাতীয় জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর হওয়া উচিত। তিনি বললেন যে বল্শেভিক চিন্তাধারা মানবসমাজের পক্ষে অত্যন্ত দূরদর্শী হলেও যে কোনও একটি চিন্তাধারা বিশ্বের সর্বত্র একইভাবে প্রয়োগ করা যায় না। সেহেতু ভারতবর্ষে তিনি এক নতুন ধাঁচের সাম্যবাদী চিন্তাধারার উদ্ভব কামনা করলেন। সুভাষচন্দ্র সংগ্রামী যুবসমাজকে উপদেশ দিলেন যে বিদেশ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করলেও কোনও বিদেশী মতবাদকে অন্ধভাবে অনুকরণ করা উচিত নয়, বরং সেই সমস্ত মতবাদকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার অঙ্গীভূত করে নেওয়া প্রয়োজন। সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভায় সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র দেশে এবং বিদেশে বেকারি সমস্যারও পর্যালোচনা করলেন। কংগ্রেসী দক্ষিণপন্থী এবং মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সমালোচনা করে তিনি এক বিকল্প পথের হদিশ দেবার চেষ্টা করলেন। সাম্যবাদে পরিপূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেও সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষে এক নতুন ধরনের সাম্যবাদী মতাদর্শ উদ্ভূত করার উপর জোর দিলেন।
১৯৩২ সাল সুভাষচন্দ্র দেশের বিভিন্ন জেলেই কাটালেন। কখনো সিউনি, কখনো জব্বলপুর, কখনো বা মাদ্রাজ, ভাওয়ালি বা লক্ষ্ণৌ। বন্দীদশায় তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়ল। শেষপর্যন্ত ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপে গিয়ে তিনি চিকিৎসা করাবেন বলে তাঁকে বোম্বাই থেকে ইউরোপগামী এক জাহাজে তুলে তবেই মুক্তি দেওয়া হল। ১৯৩৩ সালের মার্চ থেকে ১৯৩৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউরোপে নির্বাসনের দিনগুলিতে তিনি যেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দূত হয়ে দেশে দেশে সফর করে বেড়ালেন। জীবনের এই অধ্যায়ে তিনি নেতা থেকে রাষ্ট্রনেতার পদে অধিষ্ঠিত হলেন। ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র অক্লান্তভাবে ভারতের একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত ঘুরে বেড়ালেন। ইউরোপের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের মৈত্রী সংঘ গড়ে তুললেন। বিভিন্ন শহরে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে তিনি বক্তৃতা করে বেড়ালেন। অন্যান্য দেশের মধ্যে তিনি অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, ইজিপ্ট, ফ্রান্স, জার্মানী, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক ও যুগোশ্লাভিয়া পরিদর্শন করেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটু ভুল বুঝিয়েছিলেন যেন তাঁর ব্রিটেনে যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ১৯৩৩-এর জুন মাসে লণ্ডনে যে তৃতীয় রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল তাতে সুভাষচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে তাঁর লেখা অভিভাষণ পঠিত হল। এই বক্তৃতাটি ‘লণ্ডন থিসিস’ নামে পরিচিত। এতে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের আগে এটিই হল আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। এতে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের এক মূল্যায়ন ও সমালোচনা আছে। আর রয়েছে সাম্যবাদ-এর আদর্শের পর্যালোচনা। সমাজতন্ত্র নিয়ে ইউরোপে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল তার দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হলেও সুভাষচন্দ্র কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা বোঝাতে গিয়ে এমন একটি ভারতীয় এবং বৌদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেছিল যার মধ্যে রয়েছে সাম্য ও সামঞ্জস্যের ভাব। বিশ্বের সভ্যতায় ভারতবর্ষের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে এ বিষয়ে তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল।
“সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংলন্ড তার শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের কথা বলে বিশ্বের দরবারে এক বিশিষ্ট অবদান রেখেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স তার সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণীর মধ্য দিয়ে বিশ্বসংস্কৃতিতে এক অবদান রেখেছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানী তার মার্কসীয় দর্শনের মাধ্যমে বিশ্বকে এক সেরা উপহার দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া তার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বসংস্কৃতি ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছিল। বিশ্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এর পরবর্তী অবদান রাখার আহ্বান আসবে ভারতবর্ষের কাছে।”
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লেখা তাঁর বই ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ ১৯৩৫-এর গোড়ায় প্রকাশিত হল। এই বইয়ের শেষে একটি অধ্যায়ে উনি ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। মহাত্মার একনিষ্ঠ দেশসেবা, অদম্য মানসিক শক্তি, অক্লান্ত পরিশ্রম—এ সবকিছুর জন্য সুভাষচন্দ্র তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি সমালোচনা করেছেন যে গান্ধীজি তাঁর শত্রুপক্ষের চরিত্র সঠিক অনুধাবন করতে পারেননি, তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। সুভাষচন্দ্রের মতো মহাত্মা গান্ধী ব্যর্থ হয়েছিলেন কারণ বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী স্বার্থকে একটা কাল্পনিক ঐক্যের আবরণে জুড়ে দিলে তা রাজনৈতিক সংগ্রামকে দুর্বল করে, শক্তি যোগায় না।
তাঁর ইউরোপ প্রবাসের দিনগুলিতে সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক রাজনীতি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট দলগুলির সাংগঠনিক ক্ষমতা তাঁকে অল্পবিস্তর প্রভাবিত করলেও প্রকৃতপক্ষে শ্রীমতী কিটি কুরটি যেমন লিখেছেন তাঁর মনে নাৎসীদের সম্পর্কে এক তীব্র ঘৃণা ছিল। জার্মানীর জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তিনি বারবার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছেন, বিশেষ করে তাদের ভারতবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। একবার হিটলার একটি বিশেষ রকম ভারতবিদ্বেষী বক্তৃতা করার পর তিনি জার্মানীর সঙ্গে সবরকম বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন যে ইতালির বিরুদ্ধে অন্তত আমাদের ভারতীয়দের স্বার্থবিরোধী কাজ করার অত অভিযোগ নেই। কিন্তু জার্মানীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। ইউরোপ ছেড়ে আসার আগে ১৯৩৬-এর মার্চে ডঃ থিয়েরফেলডারকে লেখা একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র জার্মানীর নব্য জাতীয়তাবাদের তীব্র নিন্দা করলেন। তিনি বললেন এই জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ, স্বার্থপর এবং দাম্ভিক। তবে তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখলেন যে হিটলারের সরকারের শীঘ্র পতন হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য যদি যুদ্ধ বেধে যায় এবং যুদ্ধে জার্মানী দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে সরকারের পতন হবে নচেৎ হবে না।
সুভাষচন্দ্রের ইউরোপ প্রবাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল তাঁর আয়ারল্যান্ড সফর। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আয়ারল্যান্ডে যান ও ইমন ডি. ভ্যালেরার সঙ্গে তিনবার সাক্ষাৎ করেন।
সুভাষচন্দ্র দেখলেন আয়ারল্যান্ডের সব রাজনৈতিক দলই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি নিজে চিরদিনই আইরিশদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রায় দুঃখ করতেন যে ভারতীয়রা বছরের পর বছর ইংলন্ডে কাটায় কিন্তু তারা ইংলন্ডের সবচেয়ে পুরনো উপনিবেশ আয়ারল্যান্ডে যায় না। ইংলন্ডের চেয়ে আয়ারল্যান্ড যে একেবারে অন্য রকম তা তারা সেখানে গেলে বুঝতে পারত।
ইউরোপে নির্বাসনের দিনগুলি যখন শেষ হয়ে আসছে তখন দেশে ফিরে আবার বন্দীদশার সম্ভাবনার চেয়ে ইউরোপে যে নারীর প্রেম তাঁকে অধিকার করেছিল তাঁকে ছেড়ে যাওয়াটাই তাঁকে পীড়িত করছিল বেশি। তিনি ১৯৩৪ সালের জুন মাসে অস্ট্রিয়ান দুহিতা এমিলি শেঙ্ক্লের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন এবং পরের দু বছরে তাঁদের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যখন তিনি ফেরার প্রস্তুতি করছিলেন তখন তিনি একটি চিঠি এমিলিকে লেখেন যাতে তাঁর মনের কথা খুবই খুলে বলেছিলেন। তিনি চিঠিটির প্রথমেই লিখেছিলেন, “হিমশৈলও কখনও কখনও গলে এবং আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে”—তিনি আগেই তাঁর “প্রথম প্রেম”—তাঁর স্বদেশের কাছে নিজেকে “বিকিয়ে দিয়েছেন” এবং তার কাছে তাঁকে ফিরে যেতে হচ্ছে। স্বভাবতই আবার অজানার পথে এক যাত্রা :
“ভবিষ্যতে আমার ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। হয়ত আমার জীবনটা জেলেই কেটে যাবে, অথবা আমাকে গুলি করা হবে বা ফাঁসি দেওয়া হবে। যাই হোক না কেন, আমি তোমার কথা চিন্তা করব এবং আমার প্রতি তোমার প্রেমের জন্য নীরবে তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা নিবেদন করব। তোমার সঙ্গে আমার হয়ত আর দেখা হবে না—ফিরে যাবার পর হয়ত আমি তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না—কিন্তু বিশ্বাস রেখো আমার হৃদয়ে, চিন্তায় এবং স্বপ্নে তুমি সর্বদাই বিরাজ করবে। যদি ভাগ্য এ জীবনে আমাদের মিলিত হবার আর সুযোগ না দেয় পরের জীবনে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
তিনি আগে কখনও ভাবেননি যে নারীর প্রেম তাঁকে এভাবে বেঁধে ফেলতে পারে। তিনি আরও লেখেন: “এই প্রেমের কি কোনও পার্থিব সার্থকতা আছে? আমরা ত দুই ভিন্ন দেশের লোক—আমাদের মধ্যে কি কোনও সমতা আছে? আমার দেশ, আমার জাতি, আমার ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, আমাদের জলবায়ু—এক কথায় সবই তোমার থেকে একেবারেই ভিন্ন…এই মুহূর্তে আমাদের দুই দেশের মধ্যে যে সব পার্থক্য আছে সবই আমি ভুলে গিয়েছি। আমি ভালবেসেছি তোমার ভিতরে যে নারী আছে, যে অন্তরাত্মা আছে।”
১৯৩৬-এর ৬ এপ্রিল বোম্বাই-এ পৌঁছানমাত্র সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তিনি এক বছর বন্দী রইলেন। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের তিনি কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ঐ আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে নির্বাচন হয়ে যাবার পরই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৩৭-এ তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন। বিশেষ করে, দুটি প্রামাণ্য প্রবন্ধ তিনি ঐ সময় লেখেন, একটি ইউরোপের ঘটনাপ্রবাহ ও অন্যটি পূর্ব এশিয়া সম্বন্ধে। “ইউরোপ—আজ ও আগামী কাল” শীর্ষক প্রবন্ধটি ঐ ভূখণ্ডে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা। তিনি ১৯৬৭-এর আগস্টে ভবিষ্যদ্রষ্টার মতো লিখেছিলেন, “যুদ্ধ বাধবে যখন জার্মানী পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের স্থিতিশীল রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু যুদ্ধ বাধবে কি? এর উত্তর মূলত ব্রিটেনের হাতে। জার্মানী ১৯১৪ সালের ভুল আবার করবে না, এবং যদি দেখে ব্রিটেন তার বিরুদ্ধে যাবে সে যুদ্ধে যাবে না। ১৯১৪ সালের মতো সে যুদ্ধের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে এই ভেবে যে ব্রিটেন যুদ্ধ করবে না।”
রাশিয়ার বিরাট শক্তি সম্বন্ধে তাঁর শেষ মন্তব্য খুব কৌতূহলোদ্দীপক: “রাশিয়া নেপোলিয়নকে ব্যর্থ করেছিল, হিটলারকেও কি তাই করবে?”
১৯৩৭ সালে লেখা পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়েন সম্বন্ধে তাঁর বিশ্লেষণ ছিল একই রকম আবেগমুক্ত, কিন্তু লেখার শেষের দিকে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করেননি। লেখাটির শেষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতকগুলি নীতিগত কথা তিনি বলেছিলেন: “পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। ভারতবর্ষ সিদ্ধান্ত নিক যে প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতির পরিপূর্ণ বিকাশ আমাদের লক্ষ্য হোক—কিন্তু অন্যান্য কোন দেশের ক্ষতি করে নয়, এবং স্বার্থপরতা ও সাম্রাজ্যবাদের পথে নয়।”
১৯৩৭-এর অক্টোবর মাসে কলকাতায় সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের সময় জানা গেল যে মহাত্মা গান্ধী সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে মনোনীত করতে চলেছেন। পরের মাসেই তিনি গান্ধীজির আশীর্বাদ নিয়ে নিজেই স্থির করলেন যে কিছুদিনের জন্য ইউরোপ যাবেন। ১৯৩৭-এর ২২শে নভেম্বর থেকে ১৯৩৮-এর ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রায় দেড় মাস তাঁর প্রিয় স্বাস্থ্যনিবাস অস্ট্রিয়ার বাদগাসটাইন-এ ছিলেন। এমিলি শেঙ্ক্ল সেখানে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। বাদগাসটাইন-এ ১৯৩৭-এর ডিসেম্বরে দশ দিনে তিনি তাঁর আত্মজীবনীর দশটি অধ্যায় লেখেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনটি মৌলিক অধ্যায় লেখার—‘আমার জীবন দর্শন’, ‘আমার রাজনৈতিক আদর্শবাদ’, ও ‘আমার অর্থনৈতিক মূল্যবোধ’। এর মধ্যে কেবল প্রথমটিই তিনি শেষ করতে পেরেছিলেন এবং সেটি তাঁর আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায় হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। উপসংহারে তিনি বলেছিলেন : “আত্মাই হচ্ছে সত্য, যার সারই হচ্ছে প্রেম এবং অনন্তকাল ধরে দ্বন্দ্ব ও সমাধানের মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ পাচ্ছে।”
১৯৩৮-এর জানুয়ারিতে লন্ডনে রজনী পাম দত্তের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন : “আজ আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে এক ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্টে গড়ে তুলতে হবে এবং তার লক্ষ্য হবে দুইটি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা এবং সমাজবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা।” ডি. ভ্যালেরা ও ইংলন্ডের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তিনি নিজের ৪১তম জন্মদিন ১৯৩৮-এর ২৩ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন এবং কংগ্রেসের সভাপতি রূপে তাঁর নির্দিষ্ট দুটি লক্ষ্য পূর্ণ করায় কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। হরিপুরা যাবার প্রাক্কালে একদিনে কলকাতায় বসে লেখা তাঁর সভাপতির অভিভাষণে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শক্তি ও দুর্বলতার বিশ্লেষণ করেন এবং সাম্যের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের রূপরেখা তুলে ধরেন। ভাষণে আমাদের শাসকশ্রেণী সম্বন্ধে কোনরকম বিদ্বেষের ভাব প্রকাশ পায়নি—তিনি কেবল তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন তারা তাদের সাম্রাজ্যকে একটি “স্বাধীন রাষ্ট্রপুঞ্জে” পরিণত করুক। তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ “সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন” অর্জন করার পর “ব্রিটিশ জাতির সঙ্গে অতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক” গড়ে তোলার পথে কোন বাধা নেই।
বিভেদ সৃষ্টি করে রাজত্ব চালানোর ও আমাদের আন্দোলন দুর্বল করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের নানারকম কৌশল ও ফন্দি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন যে রাজন্যবর্গ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একই মঞ্চে বসবার নীতির মধ্যে দেশভাগের অঙ্কুর রয়েছে এবং সেজন্য তিনি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল অংশটির আপসহীন বিরোধিতার প্রস্তাব করেন। যদি ঐ পরিকল্পনাটি অগ্রাহ্য হয়, তাঁর দুর্ভাবনা ছিল যে ব্রিটিশ সরকার ভারতবিভাগের অন্য কোন ফন্দি খুঁজে বার করবে যার ফলে ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার বিভেদনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নিজেদের দু’মুখো রাজনীতির ফলে ভারতে, প্যালেস্টাইনে, মিশরে, ইরাকে অথবা আয়ারল্যান্ডে নিজেদের জালে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং তিনি জরুরি ভিত্তিতে ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রশ্নের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ধর্মের প্রশ্নে ‘নিজে বাঁচো, অপরকেও বাঁচতে দাও’ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে সার্বিক বোঝাপড়ার নীতি গ্রহণ করতে বলেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ‘সেক্যুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি যদিও ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রশ্নে এক উদার নীতির প্রবক্তা তিনি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তথাকথিত “অনুন্নত শ্ৰেণী” যেন ন্যায় বিচার পায়। “দেশের ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় মানুষ কৃষ্টিগত স্বাধিকার” যাতে পায় এই দাবি করে সুভাষচন্দ্র জোর দিয়ে বলেছিলেন যে হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণ রোমান হরফে লিখিত হিন্দুস্থানী রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হোক। ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে “শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার”-এর অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে যার ফলে “সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিভিন্ন রাজ্যগুলি সন্তুষ্ট থাকবে এবং শাসন ও কৃষ্টিগত ব্যাপারে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।” এই দূরদৃষ্টি কংগ্রেসের অন্য অনেক নেতাদের মতে জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী ছিল, যাঁদের মধ্যে নেহরু ও প্যাটেলও ছিলেন এবং যাঁরা কৃষ্টিগত ভিন্নতাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন না।
স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল এবং সুভাষচন্দ্র “স্বাধীন ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এক কর্মসূচী” দেশের সামনে রাখলেন। দারিদ্র্য দূরে করার জন্য তিনি প্রস্তাব করলেন যে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রকে আমাদের সামগ্রিক কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উৎপাদন ও বণ্টনকে ধীরে ধীরে সমাজীকরণ করার এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ১৯৩৮ সালে তিনি বিশ্বাস করতেন যে কংগ্রেস দলকে মরে যেতে দেওয়া হবে না। বরঞ্চ স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে দলকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে “অনেকগুলি আরও দল থাকার ফলে এবং কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভারতীয় রাষ্ট্রকে একনায়কতন্ত্রী হতে দেবে না।” দেশের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এটাও “নিশ্চিত করবে যে নেতা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না, নীচের থেকে নির্বাচিত হবে।”
পরবর্তী ঘটনাগুলি থেকে শীঘ্রই বোঝা গেল সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র সম্বন্ধে আশা নিতান্তই দুরাশা ছিল। কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে অধিভুক্ত করার এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব কংগ্রেসের ভিতরে তাঁর অনেক সহকর্মীদের কাছে গ্রহণীয় ছিল না।
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র তাঁর হরিপুরার কর্মসূচীর অনেকগুলিকে কার্যকর করার চেষ্টা করেছিলেন। তার মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অক্টোবরে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন। নেতৃস্থানীয় যেসব ব্যক্তি যাঁরা উৎসাহের সঙ্গে দেশের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিসিদ্ধ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ আদর্শগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অবদানগুলিকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন যা গান্ধীজি ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেবল দু’জনকে ‘আধুনিক’ বলে মানতেন—জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু। জওহরলালকে সুভাষচন্দ্র জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি সভাপতি করায়, রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন যে সুভাষচন্দ্রকে দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি করা হোক। ১৯৩৯ সালে জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি হবার ঠিক পূর্বে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে সম্বর্দ্ধনা দেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষণের উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেন:
“আমরা যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করি, আমরা মর্মে মর্মে আমাদের অন্তরের দৈন্য অনুভব করি। প্রাণের দিক দিয়ে যে সম্পদ না পেলে মানুষ বা জাতি বড় হতে পারে না, সেই সম্পদ, সেই প্রেরণা আমরা চাই। কারণ আমরা জানি, সে প্রেরণা, সত্যের সেই আভাস যদি প্রাণের মধ্যে পাই তাহলে আমাদের কর্মজীবনের ও বহির্জীবনের সাধনা সাফল্যমণ্ডিত ও সার্থক হবে। আপনার কাছ থেকে সে প্রেরণা আমরা চাই।”
১৯৩৯-এর ২৯ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। গত কয়েকমাসে কেন্দ্রে ইংরাজ সরকারের যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার আপসহীন বিরোধ, সমাজতান্ত্রিক নীতি ও কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্নে গান্ধীবাদী দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ ক্রমাগতই বাড়ছিল। গান্ধীজি এখন গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে নির্বাচিত সভাপতির বিরুদ্ধে অসহযোগের অস্ত্র ধারণ করেন। যখন সুভাষচন্দ্র ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন কংগ্রেসের মধ্যে সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং জওহরলাল নেহরু ও শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া আর সকল কংগ্রেসে কার্যকরী সমিতির সদস্যরা একযোগে ২২শে ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। মার্চের প্রথমে ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থতার জন্য তাঁর অভিভাষণ পাঠ করতে না পারায় তাঁর অগ্রজ শরৎচন্দ্র সেটি পাঠ করেন। খুবই অস্বাভাবিক সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসকে আমাদের জাতীয় দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাজে চরমপত্রের আকারে পেশ করতে বলেন এবং যদি সদুত্তর না পাওয়া যায় ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করতে বলেন।
সুভাষচন্দ্র চাইলেন যে দেশীয় রাজন্যদের অধীন রাজ্যগুলিতে গণআন্দোলন কংগ্রেসের নেতৃত্বেই চালিত হোক। তিনি কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলিকে পুরোভাগে রেখে সারা দেশে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন।
ত্রিপুরী কংগ্রেসে দলের দক্ষিণপন্থীরা একটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিতে সমর্থ হন যে কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটি গান্ধীজির মত অনুযায়ী স্থাপন করতে হবে। কিন্তু গান্ধীজি তা সত্ত্বেও কমিটির সদস্যদের নিযুক্ত করতে অস্বীকার করায় নিরুপায় সুভাষচন্দ্র ১৯৩৯-এর ২৯ এপ্রিল কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দলের অভ্যন্তরীণ এই সঙ্কটে নেহরু মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন এবং বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন কার্যকরী কমিটি থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র নেহরুর দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলার এই কর্মপন্থাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলেই চিহ্নিত করেন। সুভাষচন্দ্র নেহরুকে নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতা-স্বরূপ মনে করতেন। এবং নেহরুর এহেন আচরণ তিনি রাজনৈতিক বিরোধিতার সামিল বলেই মনে করলেন। নেহরুকে তিনি চিঠি লিখলেন যে “আমাদের একতা সুস্পষ্ট কর্মপন্থার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে।”
১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনের সময়ে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে পাল্টা ‘আপস-বিরোধী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হল। আপস-বিরোধী সমাবেশে সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করলেন: “সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হতে চলেছে। মুক্তি, গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের যুগ আজ আমাদের সামনে। ভারতবর্ষের ইতিহাস আজ এক চূড়ান্ত লগ্নে উপস্থিত।” কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্বের ভীরুতার কঠোর ভাষায় নিন্দা করলেন সুভাষচন্দ্র, এবং সারা দেশে এক ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন যে, “বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থার মর্ম হল আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা⋯ভবিষ্যতের বামপন্থী আন্দোলন হবে ভারতবর্ষে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।”
১৯৪০ সালের ২ জুলাই হল্ওয়েল মনুমেন্ট বিলোপ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ফের গ্রেফতার হলেন সুভাষচন্দ্র। নভেম্বর মাসে নিজের মুক্তির দাবিতে অনশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ২৬ নভেম্বর তারিখে এ বিষয়ে সুভাষচন্দ্র বাংলার ব্রিটিশ গভর্নরকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেমের একটি অনন্য দলিল। সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “দেশের মুক্তির জন্য কষ্ট এবং আত্মত্যাগ স্বীকার করে কেউ কখনো কিছু হারায় না। হারাতে পারে না। এই পার্থিব জীবনের যদি কিছু খোয়াও যায়, শহীদের অমরত্ব লাভের তুলনায় তা কিছুই নয়।” ইংরেজ সরকার অতঃপর ৫ ডিসেম্বর তারিখে সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এই সিদ্ধান্তও নেওয়া হল যে তাঁর স্বাস্থ্য একটু সেরে উঠলেই তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হবে। এলগিন রোডে তাঁর বাসভবনে কড়া পুলিশি পাহারা মোতায়েন করা হল। তা সত্ত্বেও ১৯৪১ সালের ১৬-১৭ জানুয়ারি রাত্রে সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণ ঘটল। ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার তাঁকে গাড়ি চালিয়ে গোপনে কলকাতা থেকে বিহারের গোমো জংশনে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে সুভাষচন্দ্র দিল্লি কাল্কা মেল ধরলেন সুদূর পেশোয়ারের পথে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সহকর্মী মিঞা আকবর শাহের সহায়তায় তিনি এর পর আফগানিস্তানে প্রবেশ করলেন। কাবুলে দেড়মাস অতিবাহিত করবার সময়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘কাবুল থিসিস’ রচনা করেন। এই প্রবন্ধে তিনি ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থার সংজ্ঞা দুই পর্যায়ে ভাগ করেন—বর্তমানে আপসহীন সাম্রাজ্যবিরোধী সংগ্রাম এবং পরের পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন। কংগ্রেসের ভিতরে সদ্যোজাত চরমপন্থী গোষ্ঠী ফরওয়ার্ড ব্লককে পিছনে ফেলে তিনি যখন সশস্ত্র অভিযানের পথ বেছে নিলেন তখন তিনি কেবল এই আশাই ব্যক্ত করেছিলেন যে “ইতিহাস নকল থেকে আসলটিকে বেছে নেবে—মেকি বামপন্থীরা সাচ্চা বামপন্থীদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে।” নিজের হাতে লেখা এই প্রবন্ধটি সীমান্ত পার হবার সময় তাঁর সাথী ভগৎরাম তলওয়ার কলকাতায় মার্চ মাসের শেষে শরৎচন্দ্র বসুর হাতে তুলে দেন।
সুভাষচন্দ্র ১৯৪১-এ ইউরোপ গিয়েছিলেন প্রধানত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ফৌজের ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার উদ্দেশ্যে—যাঁরা জার্মানী ও ইতালির হাতে যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। তিনি বহুদিন ধরে বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয় সৈন্যদের ব্রিটিশ রাজের প্রতি আনুগত্য নষ্ট করাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া চাই। তিনি জোরের সঙ্গে তাঁর বেতারভাষণে বলতেন যে তাঁর নিজের আনুগত্য কেবলমাত্র ভারতবর্ষের কাছেই ছিল এবং তাঁর আর্থ-সামাজিক মতামত ঠিক তাই ছিল যা তিনি দেশে প্রচার করে গেছেন। প্রবাসী ভারতীয় ও ছাত্রদের সাহায্যে তিনি স্বাধীন ভারত সংস্থা গড়ে তুললেন এবং ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে ভারতীয় লিজিয়ন স্থাপিত হল। তিনি রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও স্মারকলিপি লেখা চালিয়ে গেলেন এবং সেগুলি তাঁর সম্পাদিত “আজাদ হিন্দ” পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল। ১৯৪২ সালে তিনি বলেছিলেন, “এখন থেকেই ভবিষ্যতের ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র সম্বন্ধে তাত্ত্বিক ভাবে কিছু বলা ভুল হবে।” তিনি অবশ্য বলেছিলেন যে প্রাথমিক পর্যায়ে একটি “শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার” এবং “একটি সুসংবদ্ধ শৃঙ্খলাপরায়ণ সর্বভারতীয় দল” থাকবে। রাষ্ট্র “সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে পূর্ণ ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।” তিনি বলেছিলেন, “যখন নতুন রাষ্ট্র স্থিতিশীল হবে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ভালভাবে চলতে থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং প্রাদেশিক সরকারগুলিকে বেশি দায়িত্ব দেওয়া হবে।”
প্রথমে নেতাজি পরিকল্পনা করেছিলেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্যে ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর-পশ্চিম থেকে সশস্ত্র অভিযান চালানো হবে। কিন্তু ১৯৪১-র জুন মাসে জার্মানী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করায় তাঁর সব হিসাব গোলমাল করে দেয়। তিনি সোজাসুজি জার্মান সরকারকে বলেছিলেন যে ঐ আগ্রাসনের ফলে জার্মানী ভারতের বন্ধুত্ব হারাবে। শেষপর্যন্ত ১৯৪৩-এর ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ইউরোপ ত্যাগ করতে সমর্থ হন এবং নব্বই দিনের সাবমেরিন যাত্রার পর পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছোন। পূর্ব এশিয়ায় তিরিশ লক্ষ ভারতীয় থাকায় তাঁর আন্দোলন প্রশস্ত সামাজিক ব্যাপ্তি লাভ করে। ১৯৪৩-এর ৫ জুলাই নেতাজি সিঙ্গাপুরে ভারতের মুক্তি সেনা—আজাদ হিন্দ ফৌজ—স্থাপনার কথা ঘোষণা করেন। পরের কয়েক মাসে তিনি হিন্দুস্থানীতে বক্তৃতার মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় সমাজ ও সৈন্যদের মধ্যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন এবং তাঁর “সর্বাত্মক প্রস্তুতি”র ডাকে অভাবনীয় সাড়া পান। ১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর তিনি স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করেন—সেই প্রথম দুশো বছর দাসত্বের পর ভারতীয়রা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের আস্বাদ পান। ঘোষণাপত্রটি তিনি ২০শে অক্টোবর রাত্রে নিজেই রচনা করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসকে ভিত্তি করে এবং আয়ারল্যান্ড ও আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রগুলি থেকে কিছু উপাদান ব্যবহার করে তিনি লিখেছিলেন: “কপটতার দ্বারা ভারতীয়দের মরিয়া করে তুলে এবং লুঠতরাজের মাধ্যমে তাঁদের অনশন ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে, ভারতে ব্রিটিশ রাজ ভারতবাসীর বন্ধুত্ব সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছে এবং এখন অতি কষ্টে বেঁচে আছে। ঐ অপশাসন ধ্বংস করার জন্য এখন চাই একটি স্ফুলিঙ্গ। ঐ আগুন জ্বেলে দেবার দায়িত্ব ভারতের মুক্তি ফৌজের।” শেষের অনুচ্ছেদে ছিল ভারতবাসীর প্রতি তাঁর উদ্দাত্ত আহ্বান:
“ঈশ্বরের নামে, আমাদের পূর্বসূরীরা যাঁরা ভারতবাসীদের এক সূত্রে বেঁধেছেন তাঁদের নামে এবং যে-সব শহীদরা আমাদের জন্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ঐতিহ্য রেখে গেছেন তাঁদের স্মরণ করে আমরা ভারবাসীদের আহ্বান করছি আমাদের পতাকার নীচে সঙ্ঘবদ্ধ হোন এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করুন।”
“চলো দিল্লী” ধ্বনি মুখে নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৪-এর ১৮ মার্চ ভারত-বর্মা সীমান্ত অতিক্রম করে এবং ভারতের মাটিতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ভারতের বাইরে নিজের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা বিশদভাবে বলে নেতাজি ১৯৪৪-এর ৬ জুলাই মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশে একটি বেতার ভাষণ প্রচার করেন। গান্ধীজি “ভারত ছাড়” আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেবার পর দুই নেতা আদর্শে ও লক্ষ্যে কাছাকাছি এসে পড়েন। নেতাজি “জাতির পিতা”র কাছে ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে যে “ধর্মযুদ্ধ” চলছিল তার সাফল্যের জন্য তাঁর “আশীবাদ ও শুভেচ্ছা” প্রার্থনা করেন।
নেতাজি শেষবারের মতো ভারতের মৌলিক সমস্যাগুলি সম্বন্ধে তাঁর মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পান যখন ১৯৪৪-এর নভেম্বরে তাঁকে টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
তিনি টোকিয়ো বক্তৃতায় এই যুক্তি দেন যে ভারতের সৃষ্টিশীল শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করে যে জাতি হিসাবে ভারতবর্ষ প্রাণশক্তি হারায়নি। বক্তৃতাটিতে কতকগুলি দূর্বল দিক ছিল, যেমন ভারতের জাতপাতের সমস্যা সম্বন্ধে বিচার। কিন্তু একটি বিদেশী শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে পরিষ্কারভাবে ভারতের তিনটি মূল সমস্যা সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য রাখতে পেরেছিলেন যথা, প্রতিরক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা।
১৯২০ সাল থেকে নেতাজি জাতির পুনর্গঠন সম্বন্ধে যেসব পরিকল্পনা করেছিলেন স্বাধীন ভারতে সেগুলির রূপায়ণের সুযোগ তিনি পাননি। তাঁর আজাদ হিন্দ আন্দোলনে তিনি দেখাতে পেরেছিলেন কীভাবে হিন্দু মুসলমানকে একসূত্রে বাঁধা যায় এবং নারীজাতিকে জনজীবনে যথাযোগ্য স্থান দেওয়া যায়, যে দুটি আদর্শ তিনি সারাজীবন সামনে রেখে কাজ করেছেন। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের দিল্লী অভিযান ইম্ফলে স্তব্ধ হয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের বসন্তে নেতাজি তাঁর ফৌজের পুরুষ ও নারীদের সঙ্গে নিয়ে এক ঐতিহাসিক যাত্রা করলেন, প্রথমে বর্মা থেকে থাইল্যান্ড, পরে থাইল্যান্ড থেকে মালয়। ১৫ই আগস্ট একটি বিশেষ হুকুমনামায় তিনি বললেন, “দিল্লীর পথ বিবিধ এবং দিল্লীই আমাদের লক্ষ্য।” পূর্ব এশিয়ায় তাঁর দেশবাসীর কাছে এক বার্তায় তিনি বললেন: “আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তোমাদের আশীর্বাদ করবে এবং গর্বের সঙ্গে মাতৃভূমির চরণে তোমাদের সেবার কথা এবং তোমাদের কীর্তির কথাও বলবে।”
১৯৪৫ সালে যুদ্ধের পরে ভারতে স্বাধীনতার আন্দোলনে পুরোপুরি ভাঁটা পড়েছিল। সেই মুহূর্তে নেতাজির আজাদি সৈন্যদের দিল্লীর লালকেল্লায় প্রত্যাবর্তন ভগবানের এক আশীর্বাদের মতো এল। নেতৃস্থানীয় তিনজন আজাদি অফিসারের বিচার নেতাজি ও তাঁর ফৌজের কীর্তিগাথা দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল। গান্ধীজি বললেন, “সারা দেশে এক নবজাগরণ হয়েছে, এমনকি সরকারি সৈন্যবাহিনীর মধ্যে নতুন এক রাজনৈতিক চেতনা এসেছে এবং তারা স্বাধীনতার কথা ভাবতে শুরু করেছে।” নেতাজি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের বদলে দেশের স্বাধীনতার প্রতি এক নতুন আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের প্রধান অস্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধের চরম মুহূর্তে তাঁর আত্মবলিদানের ফলে তাঁর আদর্শ ও নীতিগুলি স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনে কোন মর্যাদাই পেল না।
স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশতমবার্ষিকীতে দেশ এক চরম অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষ আবার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিতে উপস্থিত। এই সঙ্কট মুহুর্তে নেতাজির জীবনকথা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা এবং ভারতের নিয়তির প্রতি তাঁর অগাধ ও দৃঢ় বিশ্বাস আবার জাতির মনে জাগ্রত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক অনন্য চরিত্র, একদিকে ভারতের প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্যে তাঁর ছিল গভীর বিশ্বাস। অন্যদিকে জগতের যে কোন প্রান্তে বিজ্ঞানের যা কিছু দান আছে সেগুলিকে সাদরে গ্রহণ করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। ঔপনিবেশিকতাবাদের যুগে তাঁর জাতীয়তাবাদ মানবমুক্তি ও সৃষ্টির বাণীতে সমৃদ্ধ ছিল এবং তিনি জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ, আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র পুরোপুরি আগ্রাহ্য করেছিলেন। গান্ধীজির চুলচেরা নাস্তিবাদের পরিবর্তে তিনি স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণা অকপটে বলেছিলেন। কখনও কখনও তিনি স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের কথা বলেছিলেন যাতে আমূল আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনগুলি রূপায়িত করা যায়। তাঁর সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে কিন্তু কোন গোঁড়ামি ছিল না, যে সমাজতন্ত্রবাদ ভারতের স্বার্থ ও আশা-আকাঙক্ষার অনুকূল হবে। কেন্দ্রের ক্ষমতার ব্যাপারে আলোচনায় তিনি সর্বদাই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন ও বিভিন্ন এলাকার নানা ভাষাভাষী গোষ্ঠীদের জন্য সরকারি ও কৃষ্টিগত ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। নেতাজির সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলবার পরিকল্পনা ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক সম্প্রদায়গুলির সঙ্গে বোঝাপড়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে নেহরু ও প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ছিল অনেক উদার। আসলে নেতাজি কৃষ্টিগত বিভেদ অস্বীকার করতে অথবা দমিয়ে রাখতে চাননি। পরন্তু বিবিধ কৃষ্টির ধারাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে ঐক্যের সৌধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বুঝেছিলেন যে শ্রেণী, জাতিভেদ ও বিশেষ করে নারীজাতির অবনমন দেশে এক গভীর আলস্যের জন্য দায়ী তা দূর করতে হবে। তিনি বলেছিলেন ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে জগতে যত বৈপ্লবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে সেগুলি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে সমন্বয়ের ভিত্তিতে এক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। নেতাজি যে সাম্যবাদ চেয়েছিলেন সেটা ছিল এক নতুন বিকল্প। তিনি সাগ্রহে প্রায়ই বলতেন, “ভারতের মুক্তির মানে মানবসমাজের মুক্তি।” রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তিনি ভারতের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন। এক চিন্তাবিদ হিসাবে তিনি মানবসমাজে এক নতুন নীতিবোধ আনতে চেয়েছিলেন। নেতাজির জন্মশতবার্ষিকীর সূচনায় ১৯৯৬ সালে সংকলিত তাঁর জরুরি, প্রধান ও মুখ্য রচনার এই বই আমরা দেশের নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিলাম—নেতাজির দৃষ্টিতে তাঁরা যাতে ভারতবর্ষকে নতুন করে আবিষ্কার করেন।
শিশিরকুমার বসু
সুগত বসু
নেতাজি ভবন
১লা জানুয়ারি ১৯৯৭
Leave a Reply