জন-অরণ্য – শংকর
লেখকের জবানবন্দি
আমর প্রথম ত্রয়ী উপন্যাস সম্পর্কে কিছু জবাবদিহি প্রয়োজন।
শ্রদ্ধেয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, ‘যা এক কথায় বলা যায় তার জন্যে কখনও তিন কথা খরচ করবে না।’ যে-বক্তব্য একখানা উপন্যাসে পেশ করা উচিত তার জন্যে কেন তাহলে এই তিন উপন্যাস?
আমার এক রসিক বন্ধুর বক্তব্য : তিনের প্রতি বহুজনেরই বিশেষ দুর্বলতা থাকে। সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী, ত্রিনয়ন, ত্রিভুবন, ত্রিকাল-ত্রয়ীর প্রতি মানব-মানবীর বিচিত্র আকর্ষণ নাকি ইতিহাসের ঊষালোক থেকেই আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সর্বত্র ত্রিকোণ, ত্রিস্তর ও ত্রিভুজের জয়-জয়কার! গ্রীক, লাতিন, রুশ থেকে শুরু করে সুইডিশ, আইরিশ, ইংলিশ সর্বত্রই ত্রিসংখ্যার ত্রিগম্ভীর উপস্থিতি আমার এই বহু-ভাষাবিদ বন্ধুটি লক্ষ্য করেছেন। এই বন্ধুর কাছেই জানলাম, যুগেযুগে ত্রয়ীর দুর্বার আকর্ষণ কবি, শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞের ত্রিতন্ত্রীতে সাড়া জাগিয়েছে। সুর, সাহিত্য ও শিল্পের অঙ্গনে ত্রিযামা যামিনী, ত্রিপদী ছন্দ ও ত্রিবর্ণের নিত্য আনাগোনা। মানব-মানবীর নিবিড় সম্পর্কের ত্রিসীমাতেও এয়ীর নিঃশব্দ উপস্থিতি—তিনকন্যা, তিনসঙ্গী, ত্রিবলিত নাভি; প্রেমের ত্রিভুজ, মিলন-বিচ্ছেদ-বিরহের সোনালি ত্রিকোণ অথবা স্বর্গ মর্ত পাতালের ত্রিজগৎ।
বোঝা যাচ্ছে, যতদিন চন্দ্র-সূর্য-তারা উঠবে ততদিন ত্রিমোহ থেকে মানুষের মুক্তি নেই। বই-পত্তর ঘেঁটে বন্ধু আরও খবর দিলেন, যুগে-যুগে লেখকরাও এই ত্রিমোহে মুগ্ধ হয়েছেন। ইউরোপীয় সাহিত্যের আদিতে গ্রীক নাট্যকার ইসকাইলাস সেই যে ট্রিলজি রচনার ফাঁদে পা দিলেন দু হাজার বছর পরেও লেখকরা তার থেকে মুক্তি পেলেন না।
যথাসময়ে এসব জেনে-শুনেও ত্রিমোহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারলাম—প্রয়োজন হলো, এই ‘স্বর্গ মর্ত পাতাল’ রচনার।
একের মধ্যে তিন এবং তিনের মধ্যে এক এই উপন্যাসত্রয়ীর সূত্রপাত ১৯৭০-এর গোড়ায়। এর পিছনে পুরো এক দশকের নানা চিন্তা-ভাবনাও জড়ো হয়ে ছিল। এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তর অপর নাম চাকরিজীবী। চাকরিভিত্তিক কর্মজীবনে যে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে, যে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় ও মান-অপমানের অকথিত কাহিনী হাজার-হাজার মানুষের হৃদয়ে পাথরের মতো জমা হয়ে আছে সে-সম্বন্ধে সাহিত্য-পাঠককে অবহিত করার জন্যই প্রথম এই কাজে হাত দিই। বিরাট বিচিত্র এই কর্মোদ্যমকে একজনের চোখে দেখানো সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনজন যুবককে তিনখানি উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে বসাতে হলো।
সময়সূচী অনুযায়ী প্রথম লেখা হয়েছিল ‘সীমাবদ্ধ’, তারপর ‘আশা-আকাক্ষা’ এবং সবার শেষে ‘জন-অরণ্য’। কিন্তু একত্রে গ্রন্থবন্দী করতে গিয়ে ‘জন-অরণ্য’র কর্মহীন সোমনাথকে প্রথমে টেনে আনতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেই অনুযায়ী, সোমনাথের জীবন দিয়েই এই ত্রয়ী-উপন্যাসের সূচনা হলো—অর্থাৎ স্বর্গ মর্ত পাতালের সিঁড়ি ভাঙা—স্বর্গ থেকে শুরু না করে পাতাল থেকেই আরম্ভ হলো।
আমাদের এই সমাজ আদর্শের স্বর্গ থেকে ক্রমশ নরকে অধঃপতিত হচ্ছে, এমন নিরাশার। কথা কেউ-কেউ তুলছেন। কেউ কেউ আবার সমসাময়িকতার উত্তেজনায় অসত্যের স্লিপিং পিল খেয়ে স্বপ্ন দেখছেন আমরা সবাই স্বর্গলোকের সুখী বাসিন্দা। আমার মনে হয়, স্বর্গ মর্ত পাতালের সিঁড়ি বেয়ে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দিকে গমনাগমন করছেন; এবং কেউকেউ অচেনা পথের তেমাথায় এসে গন্তব্যস্থানের ঠিকানা হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছেন। সত্যসন্ধানী পাঠক-পাঠিকারা এইসব পথভ্রষ্টদের জটিল জীবনে এর দৃষ্টিপাত করলে আমার এই চেষ্টা সফল মনে করবো।
শংকর
উৎসর্গ
জন-অরণ্য ও সীমাবদ্ধর
বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার
শ্রীসত্যজিৎ রায় শ্রদ্ধাস্পদে
Leave a Reply