জন্মভূমি মাতৃভূমি – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৮৮
ফুলদা ডাঃ অজিতকুমার চৌধুরীর আনন্দময় স্মৃতির উদ্দেশে
১
মার্চের দশ তারিখ হয়ে গেল। কিন্তু এখনও দেখছি দু এক দিন অন্তর অন্তরই ব্রুকলিনের আকাশ তুষার ঝরিয়ে চলেছে। পনেরটা শীতের মধ্যে তেরটাই আমাদের কেটেছে দক্ষিণে যেখানে কর্কটক্রান্তি নিকটবর্তী হওয়ার দরুন আবহাওয়া অনেকটা নম্র। শীতটা শুধু একটু কড়া। দিল্লির শীতের মতো। তা-ও জানুয়ারীর পরই শীত পাততাড়ি গুটোয়। এতো তুষার বা ব্লিজার্ড আমাদের অভ্যেস নেই। বৃষ্টিপাতের মতো তুষারপাতও আমার মতে কাচের আড়াল থেকে উপভোগ করবার জিনিস। বেরোতে হলেই চমৎকার! গত বছরটা শীতের মরশুমে পালিয়েছিলুম অস্ট্রেলিয়ায়। একা। সাত সপ্তাহের মতো লেকচার ট্যুর। দক্ষিণ পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার কিছুটা ওই সুবাদে ঘুরে আসাও গেল, উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের শীতের কামড়টাও এড়ানো গেল। আমি বরাবর শীতকাতুরে। আমার স্ত্রী কমলিকার আবার গরম সয় না। হিউসটনের গরমটা একেক সময় ট্রপিক্যাল হীটের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তার ওপরে আছে গাল্ফ্ অফ্ মেক্সিকো থেকে ছুটে আসা নখদন্তবিশিষ্ট হারিকেন। হিউসটন থেকে নিউ ইয়র্ক—প্রথম ঝোঁকে আবহাওয়া বদলটা তাই মন্দ লাগেনি। আমার বন্ধু জ্যোতি বরাবরই এখানে। ব্রঙ্কস্-এর হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত ব্যস্ত ডাক্তার। ও আশ্বাস দিয়েছিল স্প্রিং সেমিস্টারের মধ্য ও অন্ত্যভাগে খুব সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া যাবে। শহরের উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত বীথিকাগুলোর মধ্য দিয়ে শুধু ড্রাইভ করতেও তখন খুব ভালো লাগে।
এবারেই কি তা হলে ব্রুকলিনের চরিত্র পাল্টে গেল? আমি তো দেখছি ছলনাময়ী এ য়িহুদি ললনা। রহস্যগুণ্ঠনে নিজেকে আবৃত রেখেছে। শীত তো বটেই। হাওয়াও এলোমেলো। সবচেয়ে মজার কথা এই শীতের মাঝখান থেকে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে এসেছে এক একটা উষ্ণ সোনালি দিন ফ্রেশ ফ্রম দি ওভ্ন্ বেক্ড্ চিংড়ির মতো। তখন খুলে ফেলতে হয়েছে গ্রেট কোট, গ্লাভ্স্, মাফলার। ছুটি আর কই? তবু ছুটির মেজাজ এসে গেছে, মনে হয়েছে ওদের সবাইকে ডাকি, বলি—‘চলো আজ স্কুল-টুল, অফিস-টফিস নয়, আজ হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলবো বাফেলোর দিকে। দুপাশে পড়বে অনবদ্য সব শহরতলি। জলরঙে আঁকা মফঃস্বল, গ্রামাঞ্চল। মোটেলে মোটেলে কয়েকটা অযান্ত্রিক লঘু প্রহর কাটিয়ে, সকালে কোনও ফাস্ট ফুড জয়েণ্ট থেকে মোটা সোটা হাম বার্গার আর সন্ধের মুখে তিন চার কোর্সের ইস্পাহানী ডিনার খেয়ে আবার ফিরে আসা যাবে গুহায়।’ কিন্তু এসব খেয়ালখুশীর কথা এখানে উইক-এণ্ড ছাড়া বলা যায় না। ও ভাষাই এ মহাদেশে অচল। নিয়ম করে এই আনুষ্ঠানিক উইক-এণ্ড পালনে আবার আমার প্রচণ্ড অনীহা। বাধ্যতামূলক হলে রিল্যাক্সেশন কি আর রিল্যাকসেশন থাকে?
উত্তরের শীত দেখছি বেশির ভাগই আমাদের ক্ষেত্ৰী বন্ধু বর্মনের বউয়ের তৈরি দহি-বড়ার মতো ভারি-ভারি, ভিজে-ভিজে। রসে টই-টম্বুর। টক আর ঝাল রস। এই রসের প্রভাবেই কি না জানি না তুমুল তর্ক করেছি সেদিন আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে। ওর বউ মেরিয়ানের চোখের নিষেধ গ্রাহ্যও করিনি। মেরিয়ান বলে আলেকজাণ্ডারের ধারণা ভারতীয়রা, বিশেষতঃ বাঙালিরা নাকি আগ্নেয় মেজাজের হয়। এতে ভারতীয়র সঙ্গে কাজ করেছে ও যে বাংলাদেশীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গীয়, গুজরাটির সঙ্গে মারাঠী তফাত করতে পারে। ওর বিষয় হওয়া উচিত ছিল অ্যানথ্রপোলজি। এমনিতে ও খুব পছন্দ করে বাঙালিদের, অনুপম দে সরকার বলে জনৈক ভদ্রলোক ওর কাছে কাজ করে গেছেন। এখনও আলেকজাণ্ডার তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কল্পনাশক্তির সঙ্গে বুদ্ধির এমন মিশ্রণ না কি চট করে আর কারো মধ্যে দেখতে পায় না। কিন্তু এই মেজাজের আভাস দেখলেই শুনেছি ওর ভেতরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মেরিয়ানের আবার আমার ওপর খুব পক্ষপাত। ‘বন্ধ হবো-হবো দরজাটার সামনে ও দেখি সতর্ক প্রহরা দেয়। কেন আমি কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে মনে হয় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা নিয়ে বেচারি খুব মুশকিলে পড়েছে। একমাথা রুপোলি চুল, কচি মুখের এই মোটাসোটা প্রৌঢ়া আলেকজাণ্ডার রাটলেজের হাইস্কুল সুইট হার্ট। হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পড়াশোনা করবার সুযোগ পায়নি। এদিকে আলেকজাণ্ডার একমুঠো দামী ডিগ্রি নিয়ে এখন নিউ ইয়র্ক মেডিক্যাল সেণ্টারের বায়ো কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান। খুব সম্ভব মেরিয়ানের যৌবনের সবটাই ব্যয়িত হয়েছে বরের উচ্চশিক্ষার মাশুল যোগাতে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে। সেই চার ছেলেমেয়ের একজনের সঙ্গেও এখন বৎসরান্তে দেখা হয় না। আলেকজাণ্ডার এখন সাতান্ন বছরের যুবক, আর মেরিয়ান বেচারি সাতান্ন বছরের বৃদ্ধা। আলেকজাণ্ডার অল্পবয়সী ছাত্রীদের সঙ্গে খুব রোমিওগিরি করে দেখি, আবার ওয়েডিং অ্যানিভার্সারিতে বউকে হীরের আংটিও কিনে দেয়। তুখোড় খেলোয়াড়, দু হাতে খেলে যাচ্ছে। মেরিয়ান আমাকে ওর জীবনের অনেক কথাই বলে থাকে। যত হাসি তত কান্না বলে গেছে রামশর্মা। বলে একটা প্রবাদ আছে আমাদের ভাষায়, মেরিয়ানের বোধ হয় সেই ব্যাপার। স্কুল-জীবনে চুটিয়ে প্রেম করেছে, এখন শুধু বর্ণহীন দিনযাপন। খুব সম্ভব আমি ওর কাছে পুরুষদের বিশ্বস্ততার একটা প্রতীক ট্রতীক হবো। আগে আমায় রীতিমতো জেরা করতো ‘শ্যারন গিলারির সঙ্গে তোমার কিছু নেই! মিছে কথা! তা হলে বোধহয় তুমি নিজের দেশের মেয়ে ছাড়া পছন্দ করো না, হোয়াট অ্যাবাউট দ্যাট ডক্টর্স ওয়াইফ?’ আমার মজা-পাওয়া হাসি দেখে ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। সব মেয়ের স্বামীই যদি ওর স্বামীর মতো ভ্রমরস্বভাব হত তাতে ওর একটা সান্ত্বনা ছিল! যাই হোক, ও চায় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো থাকুক। আমাদের ইনফর্ম্যাল আলাপচারিগুলোও ও খুব নিপুণ হাতে মনিটর করে। করুক। শী মে হ্যাভ হার ওন রীজনস। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই নিষিদ্ধ প্রদেশে পা ফেলি। আর কি করবে আমার? মেরিয়ানের চোখে বিপদসঙ্কেত জ্বলে ওঠবার পরও আমি বেশ মেজাজে ঝগড়া করে যাই। আলেকজাণ্ডারও কিন্তু সৌভ্রাত্র্যসহকারেই আলাপ চালিয়ে যায়। ও শীতল হলেই যে আমার অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ হয়ে যাবে এমন কথাও আমি দিতে পারি না। যাই হোক, অবশেষে মেরিয়ানের ভাণ্ডার থেকে তো বেরিয়ে আসবেই হুইস্কি অন দা রক্স্। সব ধুয়ে মুছে সাফ। সে ফুটন্ত লাভাই হোক আর হিমশীতল হাডসনের জলই হোক।
আমাদের রাস্তাটায় মেপল বেশি। দু চারটে চেরিও আছে। মেপল্-এর বড় বড় বাহারে ডালের ওপর ফ্রস্টের একটা পাতলা মসলিন আস্তর পড়েছে দেখতে পাচ্ছি। খুবই মনোহর। কিন্তু আশপাশে তাকালে জীবনে অনীহা আসে। সুন্দর শুধু ওই প্রাকৃতিক বিন্দুগুলোই। এবং বেরোতে না হলে। প্রথম যখন এসেছিলুম নিউ ইয়র্ক এখন তার চেয়েও মলিন হয়ে গেছে। বরফ-কাদা মেখে থাকলে সর্দিমাখা বাচ্চার মতো ঘিনঘিনে লাগে। এরকম সময়ে কলকাতায় আমাদের বাল্য-কৈশোরের রিমঝিম বর্ষার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। অতীত মানেই রোমাণ্টিকতার মোড়কে মোড়া স্মৃতি। কলকাতার বর্ষার জমা জলে গো এবং মানবকৃত ময়লা কি আর ভাসত না? কিন্তু মোড়ক খুলে দেখছি রয়ে গেছে শুধু কাগজের নৌকো আর রবীন্দ্রনাথ: “জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের পরে, আজ মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে।’ সেসব দিনের অকালসন্ধ্যায় অফিসযাত্রীরা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে এক হাতে জুতো আর হাতে জোড়া ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আমার বাবাও তাদের মধ্যে থাকতেন। পায়ে কাদা, মুখে হাসি। রেনি-ডের ফলে আমরা স্কুল-বিচ্ছুরা অনেক আগেই বাড়ি ফিরে দাপাদাপি করছি। ঠনঠনেতে কোমর জল। বড়দা মেজদা কলেজ যেতেই পারেনি। সুতরাং দুপুর-খেলা চলছে। বড়দা-মেজদা ক্যারম, খেলতে খেলতে মাঝে মাঝেই বড়দা চড়া গলায় গেয়ে উঠছে, ‘এই কি গো শেষ দান!’ ‘না না, বিরহ দিয়ে যাইনি’—বেশ মিড় দিয়ে শেষ করছে মেজদা। অর্থাৎ নেক-টু-নেক ফাইট চলছে। এদিকে আমি, দিদি, ছুটকি আর সুমিত টোয়েণ্টিনাইন। ছুটকিটা দেদার আজেবাজে ডাক দিচ্ছে, আমি রেগে মেগে পার্টনার বদল করতে চাইলেই সরু গলায় চেঁচিয়ে উঠছে—‘প্লীজ, আরেকবারটি চান্স দে সেজদা।’ শেষ দুপুর পেরিয়ে গেছে, বিকেল মেঘের পেছনে, সন্ধে, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ইলিশমাছ ভাজার গন্ধে মাতাল হাওয়া। পড়ে রইল ক্যারম বোর্ড, তাসের প্যাকেট। ইলশে-গন্ধ আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচে, রান্নাঘরে। বড়মার তোলা উনুন ঘিরে আমরা কজন। সুকৃতকে মনে পড়ছে না। ও কি তখন খুব ছোট ছিল? আমাদের হাতে মাতৃবাহিত প্লেটে গরম গরম ডিমভাজা মাছভাজার প্রেলিউড। বুঝতেই পারছি রাতটা জমবে ভালো।
আজকের এই ঝিরিঝিরে বরফের দিনটা ওই বার্ষাসন্ধ্যারই মার্কিনি সংস্করণ। কিন্তু ইলিশি উপহারের কোনও মার্কিন বিকল্প নেই। নেই হঠাৎ-ছুটির রোমাঞ্চ। গাড়িগুলোকে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই রকম একখানা গাড়ির অন্দরে আপাদমস্তক ঢাকা গরিলার মতো আমাকে দেখা যাবে। মোটেই সুখপ্রদ অবস্থা নয়।
আজ আরাত্রিকার জন্মদিন। প্রতি বছর এ দিনটা একবার করে আসেই, এটা পুরনো কথা। এবার কিন্তু একটু নতুনভাবে আসছে। তের পূর্ণ হয়ে চোদ্দয় পড়ল ও। এইরকম অর্থপূর্ণ সময়ে ব্লিজার্ড ট্রিজার্ডের প্রাকৃতিক আয়োজন দেখে প্রাচীন প্রাচ্য সংস্কার কেমন ঘাবড়ে যাচ্ছে। হাক্সলির কোন বইয়ে যেন পড়েছিলুম, মানুষ সব সময়ে নিজেকে জগতের কেন্দ্র ভাবে। অথচ সে কেউ নয়। তাকে ভেবে কিছু ঘটছে না। যদিও ভীষণ আত্মসচেতনভাবে অবিরাম সে তাই-ই ভেবে যাচ্ছে। এ এক রকমের অহষ্কৃত বোকামি। আবার সান্ত্বনাও। হাক্সলি কথিত ওই ধরনের অমোঘ মনস্তাত্ত্বিক ভ্রান্তিতে পড়েছি নিশ্চয়। প্রকৃতির ওপর নাটুকেপনা আমিই চাপাচ্ছি। প্রকৃতি কোনও অ্যাবসার্ড নাটক উপস্থিত করছে না। প্রকৃতির নাটক এমনিতেই অ্যাবসার্ড। তা হলে? এভাবে ভাবছি কেন? তবে কি এখনও আঁধার যায়নি? এখনও বাধা রয়েছে? এবং দ্বিধা। অথচ আমাকে তো সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে।
কমলিকা জিজ্ঞেস করেছিল—‘লোকে পাঁচের মাল্টিপ্ল্ বছরগুলোকে বিশেষ চোখে দ্যাখে, তুমি হঠাৎ এই আনলাকি থার্টিনটা নিয়ে এতো মাতামাতি করছ কেন?’ আচ্ছা, ওরই তো বেশি করে বোঝা উচিত ছিল কেন এই তের এতো জরুরি। ওর নিজের রক্তমাংসে গড়া মানুষীটির অভ্যন্তরে জীবনের প্রথম বীজটি ফাটছে। তার জন্য শরীরের মধ্যে কত আয়োজন! পুরো এণ্ডোক্রিন সিস্টেমটা ঝড়ের বেগে কাজ করে চলেছে। জীবন এবার সমুদ্রগামী নদীর মতো কলকল্লোলে ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত সত্তায়। দেহের রসায়নে বিপ্লব। ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে উঠে বসবে একটা আনকোরা নতুন মানুষ। তার হাসি-কান্নায় নতুন মাত্রা। অনুভবে নতুন স্বাদ, খেলা কি আর শুধু খেলাই থাকবে? সযত্নে গড়ে তোলা ছেলেমানুষি পৃথিবীর গণ্ডি ফেটে বেরিয়ে যেতে থাকবে হিসেবের বাইরের অতিরিক্ত জীবন। সে অপচয়ে কি আনন্দ! কি রোমাঞ্চ! এই প্রাচুর্য ওকে কি শুধু উচ্ছ্বাসই দেবে? না প্রগাঢ়তা! কিভাবে এই যৌবনকে ও গ্রহণ করবে, ব্যবহার করবে তারই ওপর তো নির্ভর করছে সব কিছু! তা ছাড়া তেরকে শুধু শুধু আনলাকিই বা ভাবতে যাবো কেন? আমাদের ঐতিহ্যে যতদূর জানি তেরকে অপয়া ভাবার কোন নজির নেই। এখন আন্তর্জাতিকত্ব প্রাপ্ত হয়ে আমরা ক্রীসমাস আর দুর্গাপুজো, পায়েস আর পুডিং সবই চার হাতে ভোগ করছি খুব ভালো কথা। কিন্তু কুসংস্কারে কুসংস্কার যোগ করা বোধ হয় ঠিক না। আমাদের ত্রয়োদশীর চাঁদে একটি একটি করে কলা যোগ হবে। এই সময়ে ঠিকমতো পরিচালিত করতে না পারলে পরে মুশকিল আছে না?
কমলিকা ঠাট্টা করছিল—‘তোমার মতো বাবা কোটি কোটি আছে। তাদের মধ্যে শতকরা দু চারজনও তো তোমার মতো বোদ্ধা! তারা তো কেউ নিজের মেয়ের বড় হওয়া নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না!’
‘প্রথমত তুমি জানলে কি করে যে তারা ঘামাচ্ছে না! দ্বিতীয়ত আমার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেই পরিস্থিতিই আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে।’
—‘জ্যোতি, দীপঙ্কর এদের পরিস্থিতি তোমার চেয়ে ভিন্ন? ওদেরও তো একটা করে মেয়ে রয়েছে, না নেই? দীপঙ্করের তো একমাত্র। ওরা কেউ কোনদিন এইসব আজগুবি অবসেশনের কথা তোমাকে বলেছে? ছেলেমেয়ে নিয়ে দীপালির সঙ্গেও আমার কম আলোচনা হয় না। ওরা তো এসব ভাববারই সময় পায় না। এতো কাজের মধ্যে তুমি কী করে পাও সেটাই আশ্চর্য।
—‘দীপঙ্করের কথা আলাদা। অ্যানকে বিয়ে করে ও একেবারে অ্যামেরিকানাইজড্ হয়ে গেছে। না হয়ে উপায়ও নেই। আর জ্যোতি তো সিটিজেনশিপ নিয়েই নিয়েছে।’
—‘তুমিই বা নিচ্ছো না কেন?’
কমলিকা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কার্পেটের ফুল খুঁটছে। অর্থাৎ এ প্রশ্নটা ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারে না।
আমি চুপ করে গেলুম। ভাবতে হবে, সত্যিই আমাকে আরও আরও ভাবতে হবে। সেদিন দীপালির সঙ্গে ও বাড়ির ব্যাপারে গিয়েছিল। নিউ জার্সিতেই বাড়ি কেনবার পরামর্শ দিচ্ছে জ্যোতি। আমি ব্রুকলিনের এই অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে আপাতত নড়বার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আমার ইন্সটিটিউট এখান থেকে খুব কাছে, কাছে আরাত্রিকার স্কুলও। কমলিকাকেই একটু দূরে যেতে হয়। নিউ জার্সি গেলে আরও দূর হয়ে যাবে। বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ওকে আমি বারণ করে দিলুম। সেই থেকে অকথিত একটা প্রশ্ন অশরীরীর মতো আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেন আমি এখনও লোভনীয় মার্কিন নাগরিকত্ব নিচ্ছি না। কেন এখনও সেটল করছি না। জ্যোতির মতো, দীপঙ্করের মতো, শরদ পারেখ কি বর্মনের মতো! এই একটা ব্যাপারে কমলিকার সঙ্গে আমার মতের অমিল। সারা জীবন যা বলেছি বেচারি বেদবাক্যের মতো পালন করে এসেছে। ওর এই প্রশ্নহীন বাধ্যতা ও তন্ময়তার সঠিক মূল্য আমি দিতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করেছি। ও অসুখী হয়েছে এমন কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি করিনি কখনও। বরং অসুখ থেকে, সমস্যা থেকে বাঁচিয়েই এসেছি ওকে বরাবর।
আমি জানি, আসলে দেশে কমলিকা অসুখী ছিল। যা রোজগার করতুম তাতে যৌথ পরিবারের পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে হাতে বিশেষ কিছু থাকত না। কমলিকা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল উপরন্তু ছোট পরিবারের মেয়ে। খুবই সুখ স্বাধীনতার মধ্যে মানুষ। ওর তাতে অসুবিধে হত। যদিও সেকথা মুখ ফুটে ও কোনদিনও আমাকে বলেনি। আমি অনেক লোভনীয় চাকরি প্রত্যাখ্যান করে গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকতুম। ব্যাপারটা বড়রা কেউই ভালো চোখে দেখতেন না। কমলিকা গান করত। ওর ওই রেডিওয় গাওয়া-টাওয়া কারো পছন্দ ছিল না। উপরন্তু ও তখন সবেমাত্র পাশ করেই ইউ. জি. সি. স্কলারশিপ পেয়েছে। আমি ওকে দুটো জিনিসই সিরিয়াসলি নিতে বলেছিলুম। মেয়েদের বিশেষতঃ বিবাহিত মেয়েদের স্কলারশিপ বড় একটা কেউ দিতে চায় না। সব গাইডেরই এক অভিযোগ। মেয়ে মানেই বিয়ে, তারপর বাচ্চা, কাজের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। মাঝখান থেকে স্কলারশিপের টাকাটা আটকে যাবে। অভিযোগ মিথ্যে নয়। আমার দেখা বহু মেয়ে সহকর্মী ও ছাত্রী এইভাবে মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। মেয়েদের পক্ষে পরিবেশগত বাধা কাটিয়ে ওঠা বড় সহজ নয়। আমাদের বাড়িতেই দেখেছি। যার জন্য দিদির অমন কেরিয়ারটাই মাটি হয়ে গেল। কমলিকার ব্যাপারটা কেউ সহানুভূতির চোখে দেখত না। মার কথা বলতে পারি না। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। বড়মা বুঝতেন না। অযথা নানারকম বিরূপ মন্তব্য করতেন। মা যদি কোনও মত প্রকাশ করেও থাকেন সেটা হয়ত নিজস্ব নয়। বড়মার অপছন্দের প্রতিক্রিয়া। বউদি দুজনেরও কোথায় যেন একটু গ্রাজ ছিল। কেন, কী বৃত্তান্ত অত মেয়েলি সাইকলজির মধ্যে প্রবেশ করার সাধ্য বা সাধ কোনটাই আমার নেই। তবে কমলিকা যুগপৎ দুটো বিপরীত কমপ্লেক্সে ভুগত এটা লক্ষ্য করেছি। ও যে অন্যদের মতো নয়, একটু অন্যরকম, এতে ওর আত্মপ্রসাদ আর সঙ্কোচ দুইই ছিল। ওই তো বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম মহিলা তার ওপর শিল্পী। আমার বধূ-নির্বাচন হয়ত বড়মা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, তাইই সাত তাড়াতাড়ি নিজের মনোনীত পাত্রীর সঙ্গে সুমিতের বিয়ে দিয়েছিলেন। যদ্দুর জানি, সম্পর্ক ভালো হলেও রীণার সঙ্গে কমলিকার ঠিক জমেনি। টাকা পয়সার চূড়ান্ত অভাবও আমায় কাবু করতে পারত না যদি কমলিকা বেচারি অতটা কাবু না হত। ও সব সময়েই ভাবত। ছায়াভরা দিঘির মতো গভীর চোখগুলো ওর সবসময়ে বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আমাদের প্রথম সন্তান বাবুকে প্রতিদিন ডিম-কলা-পরিজের ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে না পারলে ও চোখের জল ফেলত। কিছুতে বুঝত না আমাদের দেশের সত্তর পার্সেন্ট বাচ্চা পেট ভরে খেতেই পায় না। ডিম-কলার ব্রেকফাস্ট খেয়ে মানুষ হতে হবে এ এক ধরনের সংস্কার। ইন ফ্যাক্ট, আমি নিজেই হইনি। আমাদের বাড়ির বারোয়ারি জলখাবার ছিল আটা বা ময়দার হাতরুটি। কি সকালে, কি বিকেলে। তাতে কি আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু কম হয়েছে? না স্বাস্থ্য কিছু খারাপ হয়েছে? কিন্তু ও কিছুতে বুঝতে চাইত না। ও নিজে ডিম-কলা খেয়ে মানুষ হয়েছে সুতরাং ওর ছেলেকেও ঠিক তাইই খেতে হবে। ডিম হল কমপ্লিট ফুড। ওই ওর এক কথা। আমি এভাবে ভাবি না। কোনরকম স্টিরিওটাইপ্ড্ জীবনযাত্রায় আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু নিজের বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার সাধ্যই বা আমার কই! কমলিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কে একটা ছাত্র-অধ্যাপক গন্ধ থেকে গেছে। ওর গাইড ডক্টর মালিক কতকগুলো বায়ো-কেমিক্যাল ডেটার জন্য ওকে বারবার আমার কাছে পাঠাতেন। আমার প্রতি এতো নির্ভরশীল, এতো বাধ্য বোধহয় ও সেইজন্যেই। কিন্তু আমিও ওর প্রতি কম নির্ভরশীল নই। সেটা সারাজীবন একটু একটু করে হয়েছি। অথচ আমার মতো স্বনির্ভর বাঙালি ছেলে কমই আছে। মেয়েলি কোন কাজই আমার আটকায় না। আমাদের বউবাজারের বাড়িতে আমি ইলেকট্রিক ওয়ারিং সারাইও করেছি আবার মা-বড়মাকে রুটি লুচি পর্যন্ত বেলে দিয়েছি। বাড়িতে মুরগী রান্না হলে রান্না এবং পরিবেশনের ভার আমাকেই নিতে হত। উঠোনে জ্বল জ্বলে রোদের মধ্যে অচ্ছুৎ উনুনে অচ্ছুৎ বাসনে কোমর বেঁধে মুরগী রান্না, তারপর কলাপাতায় করে রোয়াকে বসে ভক্ষণ এবং পরে আপাদমস্তক স্নানের কথা মনে পড়লে কি হাসিই না পায় এখন। সুমিতটার সর্দির ধাত ছিল বলে ওর স্নানটা মাপ ছিল। জামাকাপড় বদলাবার পর গঙ্গার জল ছিটিয়ে ওকে ঘরে তোলা হত।…কিন্তু কমলিকার মধ্যে কোথায় যেন একটা জোর আছে। নিজের বিশ্বাসের প্রতি ও নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে পারে বোধইয়, বাইরে থেকে যতটা নমনীয় মনে হয়, ততটা নয়। আমার ক্ষেত্রে আবার জিনিসটা ঠিক উল্টো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেও ভেতরে প্রশ্ন আমার থেকেই যায়। কারো কাছে সে দ্বিধা প্রকাশ করতে পারি না বলে ভেতরে মানসিক চাপ কখনও কখনও অসহ্য হয়ে ওঠে। আমেরিকায় আসার সিদ্ধান্ত নেবার পর, এমনকি এখানে চলে এসে পুরোপুরি বসবাস করতে আরম্ভ করার পরও আমার এ দ্বন্দ্ব যায়নি। রাত্রে প্রায় মাকে স্বপ্ন দেখতুম, ম্লান মুখে কি যেন বলবার চেষ্টা করছেন, বাবা যেন অনেক দূরে কোথায় চলে যাচ্ছেন। গায়ে ঢোলা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে তালতলার চটি, হাতে ছাতা। আমি বাবার পেছন পেছন ছুটছি। ধরতে পারছি না, ‘বাবা, বাবা যাবেন না’ বলে চেঁচাচ্ছি, বাবা শুনতে পাচ্ছেন না। হঠাৎ একসময়ে পেছন ফিরলেন, দেখলুম ওটা আদৌ বাবা নয়, স্বর্ণেন্দু ওই রকম মেক-আপ নিয়েছে। কি অদ্ভুত ছেলেমানুষি স্বপ্ন! তবে ওর মধ্যে আমার অপরাধবোধ এবং দুর্ভাবনার ফোক্যাল পয়েন্টগুলোকে ঠিকই ধরা যায়। যাইহোক, জীবন সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তই আমি কমলিকাকে জিজ্ঞেস না করে নিতে পারি না।
শুনতে পাচ্ছি, প্রাত্যহিকের টুং-টাং আরম্ভ হয়ে গেছে। আমার দাড়ি কামানো শেষ। পনের বছর ধরে একই নিয়মে হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে ইনস্টিটিটিউট যাচ্ছি। আজও যাবো। আজ একটা স্নো-বুট আর রেনকোট লাগবে। এক্স-রে ক্রিস্ট্যালোগ্রাফার শ্যারনের সঙ্গে আজ খুব জরুরি কাজ আছে। কমলিকা কি একবার ডাকল?
কোটটা কাঁধে ফেলে কিচেন আর ডাইনিং রুমের মাঝখানে ছোট্ট পরিসরটুকুতে পাতা ব্রেকফাস্ট টেবিলের দিকে চলে গেলেন সুদীপ। ব্রেকফাস্ট টেবিলটা ছোট, চৌকো। চারজন বাদে পাঁচজনের জায়গা হয় না। আজ টেবিল জমজমাট।
সাদা কালোয় দাবার ছকের মতো স্কার্ট আর সাদা পোলো নেক ব্লাউস পরে আরাত্রিকা সার্ভ করতে আরম্ভ করেছে। ওর চুল কপাল থেকে উল্টে বাঁধা। একটা মাঝারি পনিটেল। বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল—‘হাই বব্স্!’
সুদীপ বললেন—‘প্লীজ মণি।’
—‘আচ্ছা, দুঃখিত। কেমুন আছো বাবা! রাতে ঘুম ভালো ছিল তো!’
হাতে সার্ভিং চামচ। মণি ঘাড় বেঁকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসছে, ওর কানের পাশের চুলগুলো একটু একটু গুটিয়ে আছে, মণির মা নীল সিল্কের ওপর ছোট ছোট সাদা জিপসি ছাপ শাড়ি পরে, নেভি ব্লু এপ্রন এঁটে রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে হাতে এগিয়ে আসছে, দার্জিলিঙ চায়ের সুগন্ধে সমস্ত ঘর বাড়ি মাতোয়ারা—এই দৃশ্য বর্ণগন্ধময়, বহুকাল পর্যন্ত অন্য অনেক জমকালো দৃশ্য, হুল্লোড়ের ছবি, এমনকি নিভৃত সুখের দৃশ্য ছাপিয়েও সুদীপের মনে ছিল। কেন কে জানে! কোন্ দৃশ্যটা মনের ঠিক চাবিতে আঘাত করে তাকে বরাবরের জন্য স্মৃতির ভাঁড়ারে পাঠিয়ে দেয়, কে বলবে?
খেতে বসে সুদীপ খুঁত খুঁত করতে লাগলেন—‘বাবুর খালি চেয়ারটা একটা পড়ে যাওয়া দাঁতের মতো বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে। তুমি ওকে ফোনে ঠিক পেয়েছিলে তো?’
কমলিকা বললেন—‘কতবার বলবো পেয়েছি। ও যেরকম বলল তাতে মনে হয়েছিল কাল রাতেই পৌঁছে যাবে। আমার মনে হয় ওয়েদারের জন্য ও কাল এলো না। ভালোই করেছে। তবে জন্মদিনের পার্টির জন্যে ওকে এতো দূরে টেনে আনা কিন্তু তোমার একটু বাড়াবাড়ি।
সুদীপ খেতে খেতে নিজের মনেই হাসলেন, তারপর বললেন, ‘ইস এইসব ভালো ভালো বাঙালি খানা বানিয়েছ। বাবুটা খেতে পেল না! খেয়ে থাকে তো শুধু টুনা স্যান্ডউইচ আর হট ডগ। এলো না?
কমলিকা হেসে ফেললেন—‘কেন? ছেলে না খেলে স্বাদ পাচ্ছো না? আদর্শ ভারতীয় পিতা দেখছি! সেই সংস্কৃত শ্লোকটা জানো না? আমরা ছোটবেলায় স্কুলে প্রেয়ারে গাইতাম…“পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ!” আপাতত তুমি খেলেই ছেলের খাওয়া হবে। বাবু এলে তাকে খাওয়াতে আজ আমি রয়েছি।
—‘তুমি আজও ছুটি নিলে?’
—‘না হলে চলবে কী করে? সপ্তাহের মাঝ মধ্যিখানে?’
আরাত্রিকা বলল—‘ইসস্ আমি তোমাদের কি বিপদেই ফেললাম না মমস্?’ বলেই হঠাৎ লম্বা করে জিভ কাটল—‘একদম ভুলে গেছি।’
—‘কী ভুলে গেছিস রে?’
কমলিকার কথা শেষ হতে না হতেই ও ঘুরে এসে প্রথমে সুদীপকে, পরে কমলিকাকে প্রণাম করল।
সুদীপ বললেন, ‘আশীর্বাদ ও প্রার্থনা তোমার আয়ুর প্রতিটি মুহূর্ত যেন জাস্টিফায়েড হয়।’
কমলিকা বললেন—‘হাতে করে খাচ্ছিলি, যা হাতটা ধুয়ে আয়। জুতোর হাত।’
—‘বাবার জুতো তো।’
—‘আরে বাস! বাবার জুতো তো আর বাবা নয়।’
সুদীপ বললেন বাবার পায়ের ধুলোও বাবা নয়, হাতটা ধুয়ে এসো মণি।’
আরাত্রিকা কাঁটা-চামচ তুলে নিল, কিছুতেই হাত ধুতে গেল না।
এইসব মুখরোচক খাদ্যাখাদ্য করা আমিই কমলিকাকে শিখিয়েছি। শুধু এগুলো কেন, সবই। বাবা-মার আদুরে মেয়ে ছিল। কিছুই প্রায় জানত না। অথচ আমি একের নম্বরের ঔদরিক। তা এখন দেখি ওর গুরুমারা বিদ্যে হয়ে গেছে। হিউসটনের বুকের ওপর নটেশাকের চচ্চড়ি খাইয়েছে শিম বরবটি মটরডালের বড়ি দিয়ে। অবিকল মায়ের হাতের চচ্চড়ির মতো স্বাদ। কোথা থেকে শিখল, কোথা থেকে যোগাড় করল বলতে চায় না, মিটি মিটি হাসে। এনিওয়ে, ডলার গ্যাজেট আর কমলিকার দৌলতে ভোজন ব্যাপারটা নিয়ে আমার আর কোনও খেদ রইল না।
বেরোবার সময় আরেকটা সারপ্রাইজ দিল ব্রুকলিন এইট্টি-ওয়ান। রেনকোটটা গলাচ্ছি, মণি চেঁচিয়ে উঠল—‘বাবা শীগগীরই দেখবে এসো।’ বেরিয়ে দেখি চোখ-ধাঁধানো রোদ উঠেছে। গাছের ডাল থেকে বরফ-গলা জল ঝরছে টুপটাপ করে। রাস্তায় বরফ কাদা। যাক, ফ্রস্টের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাবার বিশ্রী অভিজ্ঞতাটা আজ বাদ থাকল। মণি পাশে এসে বসে বলল—এটা আরাত্রিকা মুখার্জীর থার্টিন্থ্ বার্থ-ডে স্পেশ্যাল, না বাবা?’ অর্থাৎ আমি যে ভুল করেছি, আমার মেয়েও সেই ভুলই করছে। মনে করছে সমস্ত জগৎ ব্যাপারের কেন্দ্র ও নিজে। এই ভ্রান্তি আমাদের ডারউইন-পূর্ব বায়োলজির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গড ক্রিয়েটেড ম্যান ইন হিজ ওন ইমেজ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। জানি ভুল, তবু এই রমণীয় ভ্রান্তি-জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি না। ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
পা দুটো মণি ছড়িয়ে দিয়েছে সামনে। এতো সুন্দর, সোজা, নরম, যেন জীবন্ত মোমের তৈরি পা এই চরণ-সচেতন দেশেও চট করে চোখে পড়ে না। মণির গলা, আঙুল, বাহু সব কিছুরই একটা ক্ল্যাসিক্যাল সৌন্দর্য আছে। হালকা বাদামি, সাটিনের মতো নিদাগ, নিখুঁত, চকচকে ত্বক। হিউজটনে থাকতে ওকে হোম-কামিং কুইন করেছিল স্কুলে। এখানে ওদের স্কুল ইয়ারবুকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সফোমোর বলে যার ছবি দিয়েছিল, বিশুদ্ধ আমেরিকান মেয়েটি। বলা উচিত নয় ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়ার মতো মুখ, লম্বা লম্বা দাঁত, মাড়ি বার করে হাসছে। মণি খুব নিষ্পাপ মুখে বলেছিল—‘বব্স্, ডোণ্ট য়ু থিঙ্ক শী ইজ রিয়্যাল বী!’ কে জানে হবেও বা। আসলে আমি মণিকে অনেক স্কুল ইভেন্টে যোগ দিতে দিই না। হঠাৎ দেখি, কমলিকা দৌড়ে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাটিওটা পার হল। আমি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চুপ করে বসে আছি। গাড়ির মধ্যে উঠে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ও মণিকে চুমু খেল, বলল—‘তুই যখন প্রণাম করলি তখন আমার দু হাত জোড়া ছিল মাগো।’ দেখি ওর দু চোখ টলটল করছে। আমার দিকে একবারও ফিরল না। কেন বুঝলুম না।
২
—‘হ্যালো, হ্যাল্ লো!’
—‘কে রে সোনাটা? কচি গলা মনে হচ্ছে!’
—‘অ্যাটম স্পিকিং। মাসিয়া না কি? মা শপিং-এ বেরিয়েছে। পনের মিনিট আগে ফোন করলেও পেতে।’
—‘তুই যে আজ বাড়ি?’
—‘প্রজেক্ট-ওয়ার্ক ছিল মাসিয়া অনেক রাত জেগেও শেষ করতে পারি নি। আজ মেড সার্টিফিকেট দেবো।’
—‘সে কি রে? এখন করছিস তো?’
—‘ওহ শিওর। আমারটা সবচেয়ে দারুণ হবে। মাকে কয়েকটা জিনিস আনতে দিয়েছি ইলাসট্রেশনের জন্য। বেটার লেট দ্যান আর্লি।’
—‘তাই?’
নিশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিই। দীপালি বাড়ি নেই। শপিং-এ। দীপালির শপিং মানে একটা বিস্তারিত ব্যাপার। হয়ত নিউজার্সিতে আদৌ নেই। মানহাটান চলে এসেছে। ফেরবার পথে আমার এখানে ঢুঁ মারতেও পারে, অন্য কোথাও ড্রপ ইন করল তো হয়ে গেল। ওকে যা বলার তা অবশ্য আমি ফোনেই বলতে চাই। একটা আড়াল থাকলে আমার সুবিধে হয়। খুব একা লাগছে। এরকম আগে কখনও হয়নি। দীপালির সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। জ্যোতি সম্প্রতি নিজের চেম্বার করেছে ব্রঙ্কস-এ নিউ জার্সিতে প্রাসাদোপম বাড়ি। অজন্তার মতো প্যানেল ওর লিভিং রুমে। দেশ থেকে করিয়ে এনে লাগিয়েছে। মাঝে মাঝে যখন পার্টি দেয় এদেশীরা ওই প্যানেলের ধার থেকে সরতে চায় না। ‘হাউ লাভলি’? ‘ফ্যানটাসটিক’-এর ফোয়ারা ছোটে। ওরা স্বামী-স্ত্রী মিলে অজন্তার গল্প করেই জমিয়ে রাখে অর্ধেক সময়। বিরাট ডেন। কখনও তানির গ্রুপ রোলিং স্টোন শুনছে, কখনও অ্যাটম-বুলেটের গ্রুপ কুস্তি দেখছে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও করে যাচ্ছে। দীপালিটা পারেও ঝামেলা নিতে। গার্ডেনিং-এর বই দেখে অপূর্ব বাগান করেছে। হাউজ-প্লান্টই ওর কতো! আবার একটা পোষা ম্যাকাও। ম্যাকাওটার ঝামেলাই কি কম নাকি? পাঁচটা বেডরুম, তার পাঁচ রকম অঙ্গসজ্জা। অল-হোয়াইট, অল-ব্লু, অল-পিঙ্ক। বাড়ির জন্যে এটা-সেটা কিনতেই যে কত ডলার মাসে খরচ করে! নিজের চেম্বারে যখন বসে থাকে জ্যোতি, আত্ম-প্রত্যয়ের জন্য সত্যিই তখন ওকে পরিত্রাতা বলে মনে হয়। ওর পেশেন্টরা সব এখানে ওকে আদর করে ‘সেভিয়র’ বলে ডাকে। এখানকার মেডিক্যাল শিক্ষা আমার খুব অসম্পূর্ণ মনে হয়। এতো যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ছাত্রগুলোকে যেতে হয় যে দু-বছরের ইনটার্নশিপের আগে ওরা প্রায় সত্যিকার ডাক্তারির কিছুই শেখে না। বেশিরভাগই তো দেখি বায়ো-মেডিক্যাল লাইনে চলে যায়। ইংল্যান্ডের ডাক্তার তো বটেই, ভারতীয় ডাক্তারদেরও এখানে খুব খাতির। নীলরতন সরকারের সেই মুখচোরা জ্যোতির্ময় এখন মানহাটানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রেসিডেন্টের হাউজ-ফিজিশিয়ান গ্রুপের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। জ্যোতি মজা করে বলে ওয়াটারগেটের সময়ে নাকি নিক্সনের ব্লাড-প্রেশার চেক করার জন্যেও ওকে ফি সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডি সি ছুটতে হয়েছে।
একসময় জ্যোতির সঙ্গেই আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। হৃদয়ঘটিত কোনও ব্যাপার ছিল না। বাবার বন্ধুর ছেলে। বাবার এবং সুধাময়কাকারও বোধহয় মনে মনে ইচ্ছে ছিল। ওঁদের ইচ্ছেটা প্রকাশিত হবার আগেই আমার তরফ থেকে অন্য ইচ্ছে প্রকাশ পেয়ে গেল। জ্যোতিই প্রথম সুদীপকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে। সুদীপের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ায় জ্যোতির কোনও আক্ষেপ আছে কিনা বলতে পারি না। মাঝে মাঝে যেভাবে ওল্ড টাইমস ওল্ড টাইমস করে! তবে দীপালির বর হবার পর ওর আর কোনও আক্ষেপ থাকার কথা নয়। দীপালি যদ্দূর জানি, মিরান্ডা হাউজের সেরা সুন্দরীর পোস্টটা দখল করে ছিল চার বছর ধরে, স্বভাব সুন্দরী পাঞ্জাবি ও সিন্ধিললনাদের হারিয়ে। নামকরা ফ্যামিলির মেয়ে। এ ধরনের কনেকশন তো যে কোনও ছেলেরই বাঞ্ছনীয়। এম আর সি পি এফ আর সি এস করে ইংল্যান্ড থেকে ফেরবার পরই ওদের বিয়ে হয়। তার পর বছরখানেকের মধ্যেই বোধহয় নিউ ইয়র্ক। দীপালি মেয়েও খুব ভালো। জ্যোতি নিশ্চয় বিজয়ী ও সুখী। দীপালিটা বড্ড মোটা হয়ে যাচ্ছে ইদানিং। গলায় ডাব্ল চিন দেখা দিয়েছে ভালো মতো। আমার থেকে দু বছরের ছোট। একদিন বলেছিলাম ব্যায়াম করার কথা। বলল—‘এসব সুখের লাইনিং বুঝলে? আমি ওসব স্লিমিং ট্রিমিংএ বিশ্বাস করি না। সপ্তাহে ক পাউণ্ড আইসক্রিম কনজিউম করি জানো?’
—‘কেন করো?’
—‘আরে বাবা, মিল্ক্ প্রোডাক্ট্স ছাড়া এদেশে খাবার মতো কিছু আছে?’ জ্যোতি বলল—‘কুমু কিন্তু ঠিকই বলেছে। আমি আজকাল তোমাকে বেড়ে পাচ্ছি না।’
দীপালি বলল—‘কুতুব মিনারের কাছে সেই লৌহস্তম্ভটার কথা মনে আছে? বেড়ে যে সম্পূর্ণ ধরতে পারবে তার আর সুখের সীমা থাকবে না! ওল্ড্ দিল্লির মেয়ে বাবা আমি। তোমাদের মতো মিচকে পটাশের হাতে সুখের পাত্তরটা পূর্ণ করে তুলে দিয়ে মরি আর কি!’
অতি সামান্য ছুটির কোটা থেকে দুটো দিন তুলে নিয়েছি। রান্না-টান্না বেশিরভাগই সারা হয়ে গেছে। তার জন্য নয়। আসলে আমার একটু দরকার ছিল। ভাববার অবসর। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, লিভিং রুমের কোণে ইয়েলো ড্র্যাগনের পাতাগুলো দেয়ালে ছায়া ফেলে, মধুবনী পেন্টিং-এর স্ক্রোল থেকে প্রসাধনরত কালো মেয়েটি চিবুক ঈষৎ তুলে টেরাকোটার ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন ঘরের মধ্যে কেমন একটা অতিরিক্ত স্পেস তৈরি হয়, যার মধ্যে আমি আমার ভাবনাগুলোকে পাঠাতে পারি। ভেতর থেকে কিছু যেন একটা মুক্তি পায়, আজকাল এই মুক্তি মাঝে মাঝেই দরকারি মনে হচ্ছে।
পনের বছর এদেশে কেটে গেল। নিরঙ্কুশ তা বলব না। জ্যোতির্ময় দীপালির মতো ‘রোজেস, রোজেস অল দা ওয়ে’ হয়নি। সমস্যাহীন, সম্পূর্ণ দুঃখহীন জীবন আমি আশাও করি না। কিন্তু মোটের ওপর ভালো আছি এ কথা স্বীকার না করলে অপরাধ হবে। প্রথম যখন আসি, কি অনিশ্চয়তার মধ্যে সে আসা ভাবলেও এখন ভয় করে। নিউ-ইয়র্ক ওয়াই এম সি এর ঘরে বসে সুদীপের কোলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। স্যাঁতসেঁতে, জঘন্য একটা বৃষ্টিঝরা দিন ছিল সেটা। হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা। রাস্তায় তো বাবু শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছিল। এতো শীতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আমরা আসিনি। গ্রীন কার্ড হাতে মরিয়ার মতো অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া। ওয়াই এম সি এর ঘরে বসেই ও বলেছিল কথাটা। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ ফেলাডেলফিয়া যারা ওকে স্পনসর করায় ও গ্রীন কার্ড পেলো। তারা নাকি আসার মুখেই ওকে জানিয়েছে ওরা ফেডার্যাল গ্রান্ট পাচ্ছে না, ওদের ওখানে কাজ অনিশ্চিত। এদেশে ইউনিভার্সিটিগুলো বড় কোনও স্কীম বা প্রোজেক্দের জন্য অধিকাংশই কেন্দ্রীয় অনুদানের ওপর নির্ভর করে। সুদীপ সেদিন নিজের ভেতরের দুশ্চিন্তা চেপে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল—‘ভয় নেই, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিঠিপত্র অনেক ছেড়েছি। ডিগ্রিগুলো আমার ভালোই আছে কমলিকা।’ এদিকে শরদ পারেখ বলে এক গুজরাটি বন্ধুর কাছে কিছু ডলার পাবার কথা ছিল আমাদের। কেনেডি এয়ারপোর্টে সে মোটে টার্ন আপই করেনি। এয়ার-পোর্টের বিশাল চত্বরে নাকানি-চোবানি খেয়ে অবশেষে ওয়াই এম সি এ। প্রায় কপর্দকহীন। তখনই মনে পড়েছিল জ্যোতি-দীপালির কথা। গাইড খুঁজে খুঁজে ওদের নিউজার্সির ফোন নম্বর। আধঘন্টার মধ্যে দুজনে এসে হাজির। ভীষণ অবাক এবং ওদের না জানানোর জন্য ভীষণই আহত। ওয়াই এম সি এ থেকে সোজা ওদের বাড়ি। সেখানে কী আশ্চর্য ব্যাপার তারপর। আমি আর দীপালি বাবুকে খাইয়ে দাইয়ে শোয়াচ্ছি, সুদীপ স্নানে ঢুকেছে, কে যেন এলো জ্যোতির সঙ্গে কথা বলছে শুনতে পাচ্ছি—‘আরে ডক্টর, মহা মুশকিলে পড়েছি। সাড়ে দশটার ফ্লাইটে এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আসার কথা। স্ত্রী বাচ্চা রয়েছে সঙ্গে। আসেনি। কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব দুশ্চিন্তা।’
আমি তখন ছিটকে বেডরুম থেকে লিভিংরুমে। জ্যোতি বলল—‘যদ্দূর মনে হচ্ছে পারেখ এই হল তোমার সেই বন্ধুর স্ত্রী। বাচ্চা কেঁদে কেঁদে এখন ঘুমোচ্ছ। তোমার ইন্ডিয়ান বন্ধু সাঙ্ঘাতিক ঘাবড়েছে। বাথরুমে।’
শরদ পারেখকে আমি সেই প্রথম দেখলাম। আমাকে নমস্কার করে বললেন—‘কি ব্যাপার বলুন তো? আমি এতক্ষণ এয়ার পোর্ট তোলপাড় করে ফেলছি। আপনারা এসেছেন কখন, কিসে?’ সব শুনে বললেন—‘বাঃ আপনারা প্যান-অ্যামে আসছেন জানাবেন তো! প্যান অ্যামের বিল্ডিংই তো আলাদা!’
আসলে কেনেডি এয়ারপোর্ট যে এতো বিশাল সে ধারণাই আমাদের ছিল না। আসার কথা ছিল এয়ার-ইন্ডিয়ায়। টাইম মোটামুটি একই বলে আর জানাবার দরকার মনে করিনি। এর ক’দিন পরেই হিউসটনের চাকরিটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। সব কটা ঘটনা পর পর ঘটে গেলে সুদীপ প্রাণ খুলে হেসেছিল, বলেছিল—‘দেখলে তো, কেঁদে-কেটে, ভাবনা করে কি কাণ্ডই না করছিলে! আরে বাবা হ্যাভ ফেথ ইন হাজব্যান্ড অ্যান্ড গড। সব ঠিক হো যায়গা।’ বাবু তখন ঠিক সাত বছরের।
হিউসটনেই কি কম সমস্যা! আইনস্টাইন মেডিক্যাল সেন্টারে ও কাজে যোগ দিয়েছে। আমি বাড়ি বসা। যাবার আগেই আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম নতুন দেশে মানিয়ে নিতে আমার আর বাবুর খানিকটা সময় লাগবেই। গিয়েই আমি কাজে লাগতে পারবো না। বাড়ি পাইনি তখনও, আছি দীপঙ্কর গুপ্তর বাড়ি। খুব অস্বস্তি। ওর বউ আমেরিকান। সে বেচারির কোনও দোষ নেই। আমাদের সে সমানেই আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করত। কিন্তু আমার সঙ্কোচ লাগত। নিজেদের মাস্টার বেডরুমটাই ওরা আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আরও অস্বস্তি তাই। বাড়ির খোঁজ পাচ্ছি, যাচ্ছি, কেঁচে যাচ্ছে। শেষে একদিন দীপঙ্কর এসে হাসতে হাসতে বলল—‘তোমরা অ্যাপার্টমেন্ট পাচ্ছো না কেন জানো সুদীপ? হাইলি ইমমরাল লাইফ লীড করো।’
সুদীপ আর আমি তো অবাক!
দীপঙ্কর বলল—‘ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছো। অতবড় ছেলে নিয়ে শোও। ইমমর্যাল ছাড়া কি!’
দুঘরের অ্যাপার্টমেন্ট নেওয়া হল অতঃপর। কিন্তু বাবুকে আলাদা শোয়াতে পারতাম না, কাঁদত, ভয় পেত। দু তিন দিন খাট থেকে দুমদাম পড়ে গেল। নীচের ফ্যামিলি দেখি বাড়ি ছেড়ে চলেই যাচ্ছে। কি ব্যাপার! না ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি মাঝ রাতে ভূত নামায়। আমার বাবুর জন্য কষ্ট হত। একে ও দিদুকে ছেড়ে এসেছে। তাঁর কাছেই শুত তো দেশে। বহুদিন পর্যন্ত বাবুর আমাদের মাঝখানে শোয়ার অভ্যাস ছিল। আমার নাইট-ড্রেসের ফ্রিলগুলো মুঠো করে ধরে থাকত। তারপর একটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার হল। বাবুর সঙ্গে খেলা করত রয় জেনকিন্স্ বলে একটা বাচ্চা। ওর চেয়ে কিছু বড়। প্রতিবেশী ছিল আমাদের। তার বাবা-মার মধ্যে কি হল জানি না, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। একদিন সকালে উঠে রয় দেখল নেই। বাবা ওইটুকু ছেলেকে বলল—‘য়ু প্যাক আপ অ্যান্ড গেট আউট অফ হিয়ার। ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমাদের বাড়ি হাজির। ওর আর্জি আবার আমাদের কাছেও নয়। বাবুর কাছে। বাবুকেই গিয়ে ওর বাবাকে বোঝাতে হবে। আমাদের তো খুব মুশকিল। বলতে পারি। কিন্তু কিভাবে নেবে কে জানে? খুব কড়া মেজাজের লোক বলে শুনেছি। খুব সম্ভব বউকে ধরে পিটত, সেও পাল্টা পিটুনি দিত। মানমর্যাদা পকেটে পুরে সুদীপ ওর বাবার সঙ্গে কথা বলল। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবা ছেলেটাকে রেখে দিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার দ্বিতীয় মা এসে হাজির। রয় ছেলেটাকে আমরা স্নেহ করতে আরম্ভ করি। একেবারে ব্লন্ড। মাথাভর্তি সোনালি চুল। ভুরু, চোখের পাতা সব সোনালি। চোখগুলো নীল। কি যে সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা ছিল ছেলেটার। আমাদের বাড়ি এলে আর যেতে চাইত না। রাত্তিরের ঘুমটা বাদে সব এখানে। মাঝে মাঝে বোধহয় ওর বাবার মানে লাগত। একটা মস্ত মোটা চেন নিয়ে এসে হাজির হত। ওইটে দিয়ে নাকি মারবে। অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠাণ্ডা করে ছেলেকে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতাম, প্রতিজ্ঞা করিয়ে যে মারবে না। সুদীপ বলত—‘মায়া বাড়াচ্ছো কমলিকা, কষ্ট পাবে ভীষণ ভবিষ্যতে।’ ভবিষ্যৎ কি! তখনই ছেলেটাকে দেখলে আমার বুক হু হু করত। অথচ সব সময় বাবুর সঙ্গে পাকা-পাকা কথা বলত। বিশ্রী স্ল্যাং ছিল মুখে, চার অক্ষরের অশ্লীল শব্দগুলো পর্যন্ত অবলীলায় উচ্চারণ করত। বুঝে কি না বুঝে ঈশ্বর জানেন। বাবুকে ওর সঙ্গে মিশতে দিতে মন চাইত না। কিন্তু মুখ ফুটে বলতেও পারতাম না সে কথা। ভেবে ভেবে কূলকিনারা পেতাম না। অবশেষে রয়ের বাবাই সমস্যার সমাধান করে দিল। একদিন আমাদের কাছে এসে বলে গেল চলে যাচ্ছি, যাবার আগে ছেলেটাকে ওর মা’র কাছে ডাম্প করে দিয়ে যাবো। খোঁজ পেয়েছি তার।’ লিজ অর্থাৎ ওর নতুন বউ নাকি বাচ্চা-কাচ্চার ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। সেই সনাতন দ্বিতীয়পক্ষ-সতীন-সৎমা সমস্যা!
কী যে হল বাবুর! এরপর থেকে আর আমাদের কাছে শুতে চাইত না। ভীষণ চাপা স্বভাব ওইটুকু ছেলের। বুঝতে পারতাম আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। সামান্যতম কথা কাটাকাটি হলেও রি-অ্যাক্ট করত তখন। খেতে চাইত না। জ্বর এসে যেত। ভুল বকত। জ্বরের মধ্যে ফিট। সে এক দিন গেছে আমাদের।
ফোনটা বাজছে দেখছি।
—‘কমলিকা বলছি—’
—‘সে তো গলা শুনেই বুঝতে পারছি! এমন বুলবুল-কণ্ঠ আর এখানে কই? সবই তো হাসকি ভয়েস! দুচোখে দেখতে পারি না।’
—‘দুকানে শুনতে পারি না বলো।’
—‘ওই হলো।’
—‘ও কথা কিন্তু আর বলো না। জুডি বলে যে মেয়েটির সঙ্গে শর্মার বাড়ি আলাপ হল, মনে আছে? কানট্রি গায়! আমাদের এখানে এসেছিল, রসমালাই খেয়ে ফ্ল্যাট। কিন্তু লতার লন্ডনের ক্যাসেটটা শুনে কী বলল জানো? “ওহ্, শী স্কুইকস ফ্রাইটফুলি!” সন্ধ্যা মুখার্জী আমি আর বার করতেই সাহস পাই নি!’
—‘ওই জুডির কথা শুনে তুমি ঘাবড়ে গেলে? হিউসটনে তোমার গানের স্কুল কি রকম পপুলার ছিল, কটা মার্কিন ছাত্র-ছাত্রী ছিল, বলেছ? ওর ব্যাপার কি জানো? আঙুর ফল টক। আড়াল থেকে জুডির গলা শুনে আমার তো মনে হয়েছিল কোনও রাগী যুবক কথা কইছে। যাক তোমার আজকের অ্যারেঞ্জমেন্ট কদ্দূর এগোল?’
—‘কাবাবগুলো ভাজবার সময়ে তুমি হাজির থাকবে তো ঠিক?’
—‘নিশ্চয়! লুচি বানাচ্ছো না।’
—‘উঁহু অত লুচি করতে হলে, তোমাকে আমাকে কিচেনেই থাকতে হয়। তাছাড়া লুচির গ্যাসে ঘরদোর ভরে যাবে একেবারে।’
—‘আমি একটা সারপ্রাইজ ডিশ নিয়ে যাবো কমলিকা। আগে থেকে জিজ্ঞেস করবে না খবর্দার। আমি পেট-আলগা মানুষ, এখুনি সব বলে ফেলব তাহলে।’
—‘শোনো, দরকারি কথা আছে দীপালি। জ্যোতিদাকে বলো ও মনে মনে কিছু একটা ভাঁজছে। কথায় কথায় সেটা যেন বার করে নেয়।’
—‘কীভাবে? গিলিয়ে না কিলিয়ে?’
—‘ঠাট্টা নয়। আমি কিন্তু ভীষণ ফ্যাসাদে পড়েছি।’
—‘ব্যাপারখানা কী বলো তো? সুদীপদার পেটের কথা জানবার জন্য জ্যোতির দরকার হবে কেন? দাম্পত্য-কলহ চলছে নাকি?’
—‘ও বোধহয় বরাবরের মতো দেশে ফিরে যাবার কথা ভাবছে দীপালি। আমার মনের কথা ও ভালোভাবেই জানে। তাই এখনই ভাঙতে চাইছে না।’
—‘তা হয় না কি? তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে নিয়ে যাবে? সুদীপদা? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে কমলিকা।’
—‘আমিই বা ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে এখানে রাখি কী করে বলো? তা ছাড়া ও তো জোর করবে না। আমাকে কনভিন্স্ করবে। আমিও কনভিন্স্ড্ হবো।’
প্রচণ্ড হাসছে দীপালি। উত্তর দিচ্ছে না।
—‘দীপালি! দীপালি! হেসো না। ওর চেষ্টাটাকে আমি শুরুতেই থামাতে চাই। কতকগুলো পয়েন্ট আছে যেখানে আমি কোনও কথা বলতে পারি না। খুব ডেলিকেট।’
—‘দ্যাখো কমলিকা, আমরা সুযোগ পেলে বলবো ঠিকই। কিন্তু সেটা কোনও কাজের কথা নয়। তুমি ফ্র্যাঙ্কলি তোমার আপত্তির কথা ওকে বলো। বাইশ তেইশ বছরের বিবাহিত বরের কাছে আবার সঙ্কোচ কি? দরকার হলে কষে ঝগড়া করো। আমিও কোমর বাঁধছি। তোমরা চলে গেলে আমাদের কী হবে বলো তো? আচ্ছা, সেই সারপ্রাইজটা তৈরি করতে হবে। আমি এখন রাখছি কমলিকা। ঘাবড়িও না।’
বোঝে না। ওরা কেউ আমার কথা বুঝবে না। দীপালি প্রায় গোড়ার থেকেই একা। শ্বশুর বাড়ি বা বাপের বাড়ি কারো কোনও দায় স্বীকার করবার মেয়েই নয়। খুব অনায়াসে হাসতে হাসতে সব দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই নিউ ইয়র্ক। দু তিন বছর অন্তর অন্তর নিয়ম করে দেশে যায়। সুধাময়কাকার ঘর বিদেশি জিনিসে ভরে গেছে। কাছে থাকে শুভময়। ওঁর ছোট ছেলে। দীপালির কাছ থেকে ওঁদের আর কোনও প্রত্যাশা বোধহয় নেই। এতো স্বাভাবিকভাবে দীপালি এসব করে যে স্বার্থপর বলে ওকে সমালোচনা করাও হাস্যকর। আসলে দীপালিরা ঠিক মধ্যবিত্ত সমাজের নয়। ওর বাবা ছিলেন মিলিটারিতে, এয়ার ফোর্সে খুব বড় পোস্টে কাজ করতেন। অন্যরকম মানসিকতায় গড়া ওরা। বাইরে ঘরোয়া দেখালেও ভেতরে ভেতরে আমাদের থেকে আলাদা। ওদের বাড়িতে সন্ধেবেলা নিয়মিত সুরার আসর বসত। ওর বাবা দাদা সব একসঙ্গে। দীপালির মা-ও যোগ দিতেন বোধহয় মাঝে মাঝে। ‘মধ্যবিত্ত’ এই কথাটার ব্যঞ্জনা যে কি সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। কত জটিলতা, কত মানসিক বাধা নিষেধ ওই শব্দটায়। এখানে এসে যখন বাবুর নানারকম অসুখ হতে লাগল আমি ভাবতাম আমার শাশুড়ির অভিশাপে হচ্ছে এসব। অভিশাপ কথাটার হয়ত ঠিক ব্যবহার করলাম না। ভাবতাম ওঁদের অমতে এখানে চলে আসায় আমার পাপের ফলে হচ্ছে এসব। ভেবে ভেবে আমি নিজেও দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন হতো যে রাতে ঘুম হত না। মাঝ রাতে উঠে ট্রাংকুইলাইজার খেতে হত। শেষে শনি মঙ্গলবার করতে শুরু করলাম। প্রথমটা ও ধরতে পারেনি। তারপর এক শনিবার ও নিজে হাতে বীফ স্টেক করেছে, বার্বেকিউড। বাগানে বসে রাই-ব্রেড আর মাখনে-ডোবানো ব্রাসেল্স্ স্প্রাউট দিয়ে খাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে ক্রীম শেরি। দীপঙ্কররা আছে। আমি না খেতে বোধহয় ব্যাপারটা ওর কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে। ওরা চলে গেলে জেরার পর জেরা। কবে থেকে শনি-মঙ্গলবার করছি। কেন? তবে আমার মানসিক দুর্বলতার আসল কারণটা কিন্তু ও আঁচ করতে পারেনি। বাবুর অসুখটাই কারণ বলে ধরে নিয়েছিল। শেষে আমাকে নিজমুখেই আমার পাপবোধের কথা বলতে হয়েছিল। ও আশ্চর্য।—‘সে কি? এখানে আসার সিদ্ধান্ত তো আমার! তুমি তো আসতে চাওনি! সবাই সেটা জানেও। কেউ তোমায় দোষ দিচ্ছে না। গালাগাল খেলে আমারই খাওয়া উচিত। তুমি মিছিমিছি এইসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছো? একটা উচ্চশিক্ষিত মেয়ে তুমি। এতো দুর্বল!’
উচ্চশিক্ষার সঙ্গে এইসব ধারণা, মনে হওয়া এসবের কোনও যোগ নেই। সুদীপ সেটা বুঝতে পারে না। কতকাল থেকে আমাদের রক্তে এসব রয়েছে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্তি বুদ্ধির কারবার। হৃদয়, সংস্কার এসবে সে হাত দিতে পারে না। দেশে সাড়ম্বরে ষষ্ঠী করতে হত। দুর্গা ষষ্ঠী, শেতল ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠী, তার ওপরে অঘ্রাণ মাসে ইতুপুজোর পালনী, জ্যৈষ্ঠ মাসে জয় মঙ্গলবার। তখন আমার তিতিবিরক্ত লেগে যেত। মুখে যদিও কিছু বলতাম না। আমার শাশুড়ি অনেকসময় বড়মাকে বলতেন—‘থাক না দিদি, বাইরে বেরোতে হয়, হাজার কাজ, আমি করলেই ওর করা হবে।’ বড়মাকে টলানো যেত না; বলতেন—‘তুমি করছো তোমার ছেলে, তোমার স্বামীর জন্যে, ওর ছেলে আর তোমার ছেলে, কি এক?’ এখানে এসে আমি নিয়ম করে ষষ্ঠীগুলো করি। কেন জানি না। প্রত্যেক বছর দেশ থেকে বাংলা ক্যালেন্ডার আনাই। সুদীপ হাজার বাধা দিলেও আমি এসব বন্ধ করতে পারি নি। কিরকম বুক দুবদুর করে।
সেদিন ও দীপালির তুলনা দিয়েছিল। কথায় কথায় ও দীপালির তুলনাটা আমাকে দিত। আমি জানি, দীপালি খুব সুন্দরী, সপ্রতিভ, কোথাও কোন দিনও অসুবিধে হবে না এমনভাবেই তৈরি। কিন্তু তুলনাটা আমার ভালো লাগত না। মনে হত সুদীপ যেন দীপালিকে একটু বেশি বেশিই অ্যাডমায়ার করছে। সেদিন কেমন রাগ হয়ে গিয়েছিল, বলেছিলাম— ‘ভেবে দ্যাখো, দীপালির সঙ্গে কিন্তু আমার তুলনা চলে না। দীপালিকে কি চাকরি করতে হয়? এখানকার সংসার চালিয়ে, ভবিষ্যতের সঞ্চয় রেখে দেশে কত পাঠানো যায় তার হিসেব কষতে হয়! জ্যোতি এতই ডলার ম্যানুফ্যাকচার করে…’ আমি ঠোঁট কামড়ে থেমে গিয়েছিলাম। বাস্তবিক, আমার কথাগুলো তো অপ্রাসঙ্গিক! দীপালির সঙ্গে তুলনা করে ও আমায় কষ্ট দিয়েছে। জ্যোতির ডলারের কথা তুলে, দেশে টাকা পাঠাবার বাধ্যবাধকতার কথা তুলে আমি তাই ওকে পাল্টা কষ্ট দিয়েছি। ভেবে-চিন্তে দিইনি। অভিমানে দিয়েছি। কিন্তু ও বুঝল না। গুম হয়ে গেল।
বহুদিন ও এমনি গুম হয়ে ছিল। সুদীপের গুম হয়ে থাকাটা একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস। যে মানুষের মুখে সব সময়ে হাসি, ঠোঁটের আগায় সর্বদা ঠাট্টা। সে যদি দিনের পর দিন মুখ কালো করে থাকে, নিতান্ত দরকার ছাড়া কথা না বলে, মনের আগুনে শুকিয়ে যেতে থাকে, তাহলে তার স্ত্রীর পক্ষে ব্যাপারটা কি মারাত্মক হতে পারে আমার অবস্থায় যে পড়েনি সে বুঝবে না। খোলাখুলি কোনও বোঝাপড়ার প্রশ্নই নেই, এমন অচল অবস্থা। একদিন চেষ্টা-চরিত্র করে বলে ফেললাম, ‘আমার ভুল হয়েছে, আমি তোমার কাছে মাপ চাইছি।’
‘কিসের জন্য? ওঃ হো, সেই কথা! ছাড়ো তো! তাছাড়া তুমি তো ঠিকই বলেছ। একদম ঠিক।’ এমন করে ও আমার গাল টিপে দিল যেন আমি বাচ্চা মেয়ে। অথচ চোখে হাসি নেই। ওর মুখের সেই কালচে ভাব দূর করার জন্যে আমার সে কি মর্মান্তিক চেষ্টা! আমি সোনালি রঙের শাড়ি পরলে ওর ভালো লাগে, দেশি নিরামিষ রান্না ওর খুব পছন্দ…। কিছুতেই কিছু না। শেষকালে আমি অসুস্থই হয়ে পড়লাম। নার্ভাস ব্রেক-ডাউন। বুকের মধ্যে আঁকড়ে-ধরা ভয়। ও বোধহয় আমাকে ডিভোর্স করবে। গা শিরশির করত সব সময়ে। মাথাটা ফাঁকা। জ্যোতি এখান থেকে গেল, ও-ই ডায়াগনোজ করল। বলল, ‘চাকরিটা যদি তোমার খুব স্ট্রেইন মনে হয়, ছেড়েই দাও না কুমু, পরে আবার দেখা যাবে।’ তখনই দেখলাম সুদীপের মুখে এক রকমের মেঘ সরে অন্যরকম মেঘ জমছে। সেই কটা বিশ্রামের দিন আমার কি সুখেই যে কেটেছিল! সক্কালবেলা ইনস্টিট্যুটে যাবার আগে ব্রেকফাস্ট-ট্রে হাতে সুদীপ বিছানায় হাজির। ছোট ছোট হাতে বাবু গরম জল এনেছে। ‘উঁহু মা, তুমি একেবারে উঠবে না।’ প্রতিদিন ব্রেকফাস্টের সঙ্গে সুদীপ ট্রেতে ফুল আর একটা মেসেজ গুঁজে দিত। সেটা আবার তক্ষুণি পড়লে হবে না। ও বেরিয়ে যাবার পর পড়তে হবে। পড়তে-পড়তে আমার মুখ লাল, হাসিও পেত ওর ছেলেমানুষি দেখে, ভালোও লাগত ভীষণ। এতে মনোযোগ কজন স্ত্রী পায়? বিয়ের এত বছর পরে? দীপালি যে পায় না, সেটা অন্তত জানি। জ্যোতির স্বভাবে অত সূক্ষ্ম শিল্প নেই। দীপালি অবশ্য গ্রাহ্যও করে না। খেলো দেলো, হইহই করে বেড়িয়ে এলো, ঘর সাজালো, কাজকর্ম করল, ব্যস ফুরিয়ে গেল। তাই-ই বলছিলাম ‘মধ্যবিত্ত’ ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। এই মানসিকতা আমাদের একটা পঞ্চম মাত্রা দেয় যা উচ্চবিত্ত ফ্যাশনের মহলের বাসিন্দাদের থাকে না। সেই সময়কার ভালোবাসার ফুলই মণি, আরাত্রিকা। বাবু বাঞ্ছিত, কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট। মণিকেই আমরা সচেতনভাবে আমাদের নিবিড় সমঝোতা আর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে গড়েছি। সুদীপ যে আমায় কতখানি বোঝে তা এখন আরও স্পষ্ট হয়েছিল আমার কাছে। মেয়ে হওয়ার পর যখন জ্ঞান হল, তখন অনেক রাত। কী হয়েছে তাও জানি না। নার্স আমার কাছে একগোছা কারনেশন আর একটা সুন্দর কার্ড নিয়ে এলেন, কার্ডে লেখা, ‘উই হ্যাভ এ বেবি গার্ল। শী ইজ অল আওয়ার্স।’ শেষের কথাগুলো পড়তে পড়তে আমার গায়ে কাঁটা দিল, কেঁদে ফেললাম। ওকে আমি কোনদিনই বলিনি, কিন্তু ও চিরদিনই জেনেছে বাবুকে আমি পুরোপুরি পাইনি। আমার প্রথম সন্তান বাবু যেন পুরোপুরি আমার ছিল না। শাশুড়িকে মা ডাকত। আমাকে বলত বউমা। ডাকটা আমার অসহ্য ছিল। এখানে এসে অনেক চেষ্টা করে ওকে মা ডাকতে শিখিয়েছি। কি লজ্জা ওর মা ডাকতে আমাকে! সিস্টার বললেন, ‘ডোণ্ট ক্রাই। য়ু আর দা প্রাউড মাদার অফ আ মোস্ট বিউটিফুল ডটার। শী উড গ্রো আপ টু বি আ প্যারাগন।’ আমার চোখদুটো মুছিয়ে দিলেন উনি। দু চোখ ভরে তখন আমার শুধু বাবুরই ছবি। বাবু! আমার প্রথম সন্তান! কত কষ্ট করে তাকে পেয়েছি। এখন কী করছে ও! মধ্যবিত্ত মানসিকতার তাড়নায় আবার সেই পাপবোধ। শী ইজ অল আওয়ার্স। তাই কি মেয়েকে আমি বেশি বেশি ভালোবাসবো! বাবু কি দূরে সরে যাবে! বাবু। তুই কি এখন আগের মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছিস? ভাবিস না বাবু, আমি তোকেই কিন্তু বেশি ভালোবাসি। তারপরই মনে হল ছোট্ট পুঁচকিটা পৃথিবীতে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব কথা ভাবছি! ছি ছি পাপ! আমার পাপে আবার না কিছু হয়!
বিত্তের ওপর কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতা সব সময়ে নির্ভর করে না। সেটা আমার জ্যাঠতুতো ননদ, যাকে সবাই ছুটকি বলে ডাকে, তাকে দিয়েই বুঝেছি। ও বড়দেরও ছুটকি, ছোটদেরও ছুটকি। আবার এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও ওকে ছুটকি ডাকে। আমার থেকে সামান্য ক মাসের বড়; আমিও ছুটকিই ডাকতাম। কি কাণ্ডটাই না করে বসল। সাক্ষাৎ ফাস্ট কাজিন, নিজের মাসতুতে দাদা—তাকে বিয়ে করে বসল। আবার ফিল্ম অ্যাকটর। জ্যাঠা-শ্বশুর তখন গত হয়েছেন, আমার শ্বশুরমশাই-ই বাড়ির কর্তা। ছুটকিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। লিবার্যালও ছিলেন মোটামুটি। না হলে আমার সঙ্গে সুদীপের বিয়ে হওয়া শক্ত ছিল। দৃশ্যটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে। ছুটকিকে ধরে আনা হয়েছে। মাথায় একগাদা সিঁদুর। উশকো খুশকো চুল। ছোট্ট মিষ্টি মুখখানা। রোয়াকে চেয়ারের ওপর বসে আছে। শ্বশুরমশাই বলছেন, ‘এ বিয়ে অসিদ্ধ ছুটকি, এ পাপ, এ হয় না। তুই এসব সিঁদুর-টিদুর মুছে ফ্যাল মা। আমি তোর জন্যে খুব ভালো পাত্র দেখেছি।’
আমরা সব ঠকঠক করে কাঁপছি। ছুটকি মুখ তুলে বলল, ‘তুমি যা বললে সেসব কথা রিলেটিভ কাকা। আমাদের ছাড়া আর সব সমাজেই কাজিনকে বিয়ে করার রীতি আছে। আমি কোনও অন্যায়ও করিনি। পাপও করিনি।’
বড়দা এই সময়ে এগিয়ে এসে ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মারলেন। আঙুলের দাগ তক্ষুণি ওর নরম গালে দাগড়া হয়ে ফুলে উঠল। মাথাটা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। সুদীপ গিয়ে তাড়াতাড়ি ধরল। শ্বশুরমশাই বড়দাকে ধমক দিলেন, ‘ছিঃ সুধী, মেয়েদের গায়ে হাত তুলছ? এভাবে? কী করলে দেখো তো!’ ছুটকিকে উনি বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বড়মা রান্নাঘরের চৌকাঠ থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওকে যে ভাগাড় থেকে এনেছিলি সুধী, সেই ভাগাড়েই ফিরিয়ে দিয়ে আয়। ডোম-ডোকলা। এদিকে ঢুকলে সর্বস্ব ধোয়া-পাকলা করতে হবে।’ মা বটে বাবা! ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। ব্যস, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
আমরা কিন্তু থাকতে পারতাম না। চুপি-চুপি কলেজ-ফেরৎ অনেক সময় ওর বাড়ি গেছি। মার বাড়ি, মাসির বাড়ি উভয় দিক থেকেই তাড়া খেয়ে ও আর স্বর্ণেন্দুদা তখন ডোভার লেনে একটা ছোট্ট দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকত। সুন্দর ছবির মতো সাজিয়ে রাখত ফ্ল্যাটটা। সুদীপ তো মাসে একবার করে যাবেই, বলত, ‘অসামাজিক কাজ একটা করে ফেলেছে, অত আদরের বোন, ফেলে দিতে তো পারি না! সবাই মিলে এইভাবে তাড়না করলে ওরা বাঁচবে কী করে?’ আমার বাপের বাড়ি থেকে কাছে। আমি প্রায়ই ওখান থেকে যেতাম। সিনেমা-পত্রিকাগুলো উল্টে পাল্টে বলতাম, ‘ছুটকি, তোমার ভয় করে না? সত্যি করে বলো তো?’
ও খুব হাসত, বলত, ‘সেজদা এতো ছাত্রী পড়ায়, গাইড করে তোর ভয় করে না সেজ বউদি?’
‘বারে, তা হবে কেন?’
‘আমারই বা হবে কেন? এক এক পেশার চাহিদা এক একরকম। একটু আনকনভেনশ্যন্যাল বলে মেনে নিতে প্রথমটা দেরি হয়, বউদি। তোদের আর দোষ কি? না আমার ভয়-টয়, জেলাসি-টেলাসি হয় না। তাছাড়া শুটিং দেখেছিস কখনো? এতো লোকজন, আলো-টালোর মাঝখানে, জায়গা মেপে, চোখে গ্লিসারিন দিয়ে প্রেমালাপ করতে হয় যে প্রেমের বাবা পালিয়ে যাবে, বুঝলি? নে, চা খা।’
সত্যিই ও দিব্যি ছিল। মনে কোনও খেদ বা গ্লানি ছিল না। আমাদের সবারই ধারণা ছিল এ বিয়ে টিকবে না। স্বর্ণেন্দুদা তখন বাংলা ছবির হিট রোম্যাণ্টিক নায়ক একজন, চুপি চুপি বাড়িতে না বলে ওর ছবি দেখতে যেতাম আমি আর সুদীপ। পর্দায় কি কাণ্ড করছে না করছে তার ওপর চোখ রাখা। অভিনয় দেখে আমার গা শিরশির করত। কিন্তু এখনও ওরা তেমনি সুখেই আছে। আমাদের নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়। স্বর্ণেন্দুদা বোধহয় আজকাল নায়কের দাদা-বাবা গোছের কিছু সাজে। প্রচুর পয়সা করেছে। নানান কোম্পানির শেয়ার-হোল্ডার। বড় মেয়ে লায়লীর বিয়ে দিল কদিন আগে। আমরা এখান থেকে সব কসমেটিকস্ আর দুজনের ঘড়ি পাঠাবো লিখলাম। তা ওসব বিদেশি জিনিস-টিনিস বোধহয় ওদের কাছে নস্যি। জানাল সব যোগাড় হয়ে গেছে। ডুপ্লিকেট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত ভেবে-চিন্তে সাড়ে সাতশ’ ডলারের ড্রাফট্ পাঠাল ও। মামার বাড়ি থেকে কিছু পাবে না মেয়েটা! আশীর্বাদ বলেও তো একটা জিনিস আছে!
বরং বড়দির জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। খুব ট্যালেণ্টেড ছিলেন শুনেছি। লীলাবতী বলত কলেজে। প্রথমে উত্তরটা লিখে তারপর তলা থেকে ওপরে অঙ্ক কষতে পারতেন নাকি। এতো মেধা! জ্যাঠাশ্বশুর জোর করে বি-এ পাশ করার পরই বিয়ে দিয়ে দিলেন। বংশ, রূপ আর টাকা দেখে বিয়ে। বিয়েতে নাকি অসাধারণ জাঁকজমক হয়েছিল। কিন্তু ও বাড়িতে দিদির গুণের আদর বোধহয় হয়নি। পড়বার অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর পরই বাচ্চা। দু বছর পর আবার। পাঁচ বছর পর দিদি এম-এ-তে বসে উঠে এলেন সেকেন্ড পেপার দিয়ে। ঊনত্রিশ নম্বর কিছুতেই উত্তর করতে পারেননি। পরদিন আর পরীক্ষা দিতে গেলেন না। সন্ধেবেলায় য়ুনিভার্সিটির ম্যাথমেটিকস্ ডিপার্টমেণ্টের তিনজন দিকপাল আমাদের বাড়ি। সুচিত্রা পরীক্ষা দিতে যায়নি কেন! দিদি বললেন, ‘ঊনত্রিশ নম্বর সেকেন্ড পেপারে উত্তর করতে পারিনি, আর পরীক্ষা দিয়ে কী করব?’ ওঁর মাস্টারমশাইরা বললেন, ‘সে কি! তোমার একবারও অকার করল না সুচিত্রা চ্যাটার্জী যা উত্তর করতে পারেনি তা আর কেউই পারবে না।’ শোনা গেল, ওই ঊনত্রিশ নম্বর আর কেউ তো উত্তর করতে পারেইনি। এই তিন দিকপাল সারা দিনরাত মাথা ঘামিয়ে বার করেছেন ওর মধ্যে একটা জটিল ভুল ছিল। এরপর আর দিদিকে কেউ পরীক্ষা দেওয়াতে পারেনি। দুটি ছেলের একটিও দিদির প্রতিভা পায়নি। বড়টি তো নকশাল মুভমেণ্টে নিরুদ্দেশ, ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নেই। ছোটটি জামাইবাবুর ব্যবসা দেখে। পুতুপুতু করে তাকে একেবারে নাড়ুগোপাল বানিয়ে রেখেছেন জামাইবাবু। বড়দির অসীম কষ্ট, ডিপ্রেশান বুঝতে পারি। কিন্তু উনি নিজে কোনদিন অভিযোগ, অভিমান, আক্ষেপ করেননি। আঁচলে হলুদের দাগ, শান্ত, নীরব দিদিকে দেখে কে বলবে ইনি একসময়ে ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটির ডাকসাইটে ছাত্রী ছিলেন, বাঘা বাঘা মাস্টারমশাইদের কান কাটতে পারতেন। বড়দির জীবনটা জ্যাঠাশ্বশুর নষ্ট করে দিলেন।
কমলিকা উঠে স্টিরিওটা চালিয়ে দিলেন। নারায়ণ রাও ব্যাসের বৃন্দাবনী সারং। কমলিকা অন্যমনস্ক হয়ে গান শুনতে পারেন না। নারায়ণ রাওয়ের পেছন পেছন যাচ্ছে গলা। এইসব সপট তান আজকাল গলায় আটকে যাচ্ছে। হিউসটনে নিজের বাড়িতে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটা ছোট্ট ক্লাস নিতেন। স্থানীয় ভারতীয়দের সবারই ছেলে বা মেয়ে তালিম নিত। তিনটি মার্কিন ছাত্রছাত্রী ছিল। সান্ড্রা বলে একটি মেয়ে তাঁদের ‘ইন্ডিয়ান কালচার্যাল সোসাইটি’র বার্ষিক অনুষ্ঠানে দিব্যি ভজন গেয়েছিল। উচ্চারণটা কিছুতেই বাগে আনতে পারেনি।
‘মীরা খে প্রাভু, গিড়ঢড় নগড়’ শুনে সবাই মুচকি মুচকি হেসেছিল। কিন্তু সুরটা গলায় তুলেছিল সুন্দর। বিচ্ছিরি হেঁড়ে গলা ছিল কার্সন বলে আর একটি ছেলের। কিন্তু ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অন্ধ ভক্ত। কমলিকাকে বলত, ‘তুমি শুধু আমার বেসিসটা তৈরি করে দাও। তারপর আমি ইন্ডিয়ায় চলে গিয়ে একজন গুরু খুঁজে নেব। শুনেছি, শিখতে হলে হাত পা মাসাজ করতে হয়, জল বয়ে আনতে হয়। তবে নাকি শেখায় ওরা। তাই করব।’ পাগল সব!
আরেক পাগল বাবু। বেছে বেছে ব্ল্যাক অ্যামেরিকানদের সঙ্গে ভাব করে। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘হোয়াইট্স্? একটা দেশের আসল বাসিন্দাদের মেরে ধরে তাদের বিলিয়নস অ্যান্ড বিলিয়নস অফ একার জমি দখল করে নিয়েছে, আরেকটা দেশ থেকে মানুষকে জানোয়ারের মতো ধরে এনে জানোয়ারের মতই খাটিয়েছে, বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে আরেকটা দেশের ওপর আবার অ্যাটম বোমার এক্সপেরিমেন্ট করেছে, ওদের সম্পর্কে আমার ইন্টারেস্ট কম মা!’
কমলিকা ইতিহাস ভালো জানেন না। কিন্তু মনে হয় সব দেশের অতীত ইতিহাসই তো এই! মহেঞ্জোদারোর দ্রাবিড়দের ধ্বংস করেই তো আর্যরা এসেছিল। ব্রিটনদের তাড়িয়ে রাইন উপত্যকার সেই তিন দুর্ধর্ষ জাতি অ্যাঙ্গল্স্, স্যাক্সনস অ্যান্ড জুট্স্। আর, আমেরিকার ইতিহাসে যেমন ট্রুম্যানরা আছে তেমন লিঙ্কনরাও তো আছেন! লিঙ্কনের কঠোর সংকল্প ছাড়া কি কালো আমেরিকা মুক্তি পেতো? যে যাই বলুক, আমেরিকার সাধারণ মানুষদের কিন্তু বেশ লাগে। বড় বড় ডিগ্রিধারী, বড় বড় চাকরি করছে সব, কিন্তু এক্কেবারে সরল মন, নিজের গণ্ডিটির বাইরে আর কিচ্ছু জানে না, টিভির সোপ অপেরাগুলো হাঁ করে দেখে, কারো সাতে নেই, পাঁচে নেই। হিউসটনে প্রতিবেশী ছিল লিণ্ডা আর হ্যারি প্রেস্টন। লিণ্ডা অবলীলায় জিজ্ঞেস করত, ‘তোমরা দুজনেই প্রোফেশন্যাল, এতো আর্ন করো, একখানা গাড়ি কেন। ইমপোর্টেড কারই বা কেননি কেন? দুজনেই পি. এইচ. ডি? কি সাংঘাতিক বিদ্বান তোমরা? মেল রিপ্রোডাকটিভ সেলের ওপর কাজ করছ? হাউ ফ্যানটাসটিক! ওমা! ইন্ডিরা গ্যান্ডি মহাটমা গ্যান্ডির ডটার-ইন-ল নয়?
প্রেস্টনরা কমলিকাকে বাগান করতে শিখিয়েছিল। জেক, ওদের ছেলে বেড়া মেরামত করে দিয়ে হাসতে হাসতে মজুরি নিয়ে গেল। লিণ্ডা পরের দিনই চীজ পেস্ট্রি করে হাজির। অনেকটা সরপুরিয়ার মতো খেতে। পেছনের দরজা দিয়ে হেঁকে বলল, ‘কমলিকা, প্লীজ সি ইফ ইয়োর হাবি ইজ প্রেজেন্টেবল্।’ সুদীপ ইনস্টিট্যুট থেকে ফিরেই পাজামা পরে ফেলতেন। সেই অবস্থায় কোন লেডিকে অভ্যর্থনা করা ওদের কাছে অকল্পনীয়। এদিকে মেয়েগুলো যা-খুশী পরে ঘুরবে।
পাড়াতে ব্ল্যাক এলেই কিন্তু বাড়িগুলো বিক্রি হয়ে যেত ঝপাঝপ। দক্ষিণের লোক এখনও কালোদের দেখতে পারে না। গ্রীষ্মকালের এক রবিবারের সকালে অবাক হয়ে গার্ডেনিয়ার ফুল দেখছেন সুদীপ আর তিনি। দেশের গন্ধরাজ কি অপূর্ব স্বাস্থ্যমণ্ডিত মহিমায় ফুটেছে টেক্সাসের মাটিতে! বাবু গুঁড়ি-গুঁড়ি চুল, চ্যাপটা নাক, অনবদ্য ফিগারের একটি কালো মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকল, ‘মা, মীট মাই ফ্রেন্ড ক্যাথি।’ গন্ধরাজের সৌরভে বুঁদ হয়ে ছিলেন দুজনে, বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠেছিল। এই পশমী চুল কৃষ্ণকন্যাকেই যদি স্টেডি ডেট-টেট করে বসে ছেলে!
৩
আজ বিকেলে ব্যালে স্কুল আছে। সেটা বাঙ্ক করতে হচ্ছে! অ্যারাবেস্কে পৌঁছে গেছি, খুব মজা! মাদাম বলে আমার বালোঁ না কি খুব ভালো। অর্থাৎ বেশ হালকা ভাবে অনায়াসে হাত পা ছড়াতে পারি। এটা-ওটা বাঙ্ক করা আমার হ্যাবিট হয়ে যাচ্ছে, বলছিল ব্যাথশেবা। লট্স্ অফ্ বিগ-সিসটারিং করে রিয়্যালি! আসলে, আই লাভ টু টেক ইট ইজি। সব সময় রোলার স্কেটে চড়ে আছি, গোয়িং প্লেসেজ—এইটা আমার আসে না। আজ সকালে বিগ ডিস্যাপয়েণ্টেমেণ্ট, প্রথমে দেখি বারে! মেপল গাছে চেরি ব্লস্ম্ এসেছে, কি সুন্দর! ফ্রস্ট! লাস্ট থার্সডে রিসেস আওয়ারে স্টীভ, আমি আর ব্যাথশেবা স্নোবলিং করেছিলাম। আজ বেরিয়ে দেখি যাঃ, সব বরফ গলে গেছে। গত বছর এ সময়ে স্প্রিং এসে গিয়েছিল। তানিদের বাড়ি গিয়ে দেখি বাগানটা ওভারনাইট গজার্স হয়ে গেছে। ক্যামেলিয়া, কারনেশন, পিওনি, রেড ক্লোভার। বরফ সরতেই সব টুক টুক করে মাথা তুলে ফেলেছে। আমাদের হিউসটনের বাগানে বেশ বড় বড় গাছ ছিল—গার্ডেনিয়া, ওলিয়েণ্ডার। মা বলত, গন্ধরাজ, করবী। ব্লু বনেট ফুটে নীল হয়ে থাকত বাগানের ডান দিকটা। আমি দাদা দুজনে বাগানে মাটি কোপাতাম, জল দিতাম, ঘাস ছাঁটতাম, লনে বসা হত বসন্তকালে, গরমকালে। বাবা খেত রাম উইথ কোক, ক্র্যাকারের সঙ্গে, আমাদের হনিডিউ কি ক্যান্টালুপ হাফ করে দিত। এখানে বাগান নেই বলে স্প্রিং বা সামার পুরোপুরি এনজয় করা যায় না। আমরা সেন্ট্রাল পার্কে যাই চেরি-ব্লস্ম্ দেখতে। মা বলেছে আজ আমার বন্ধুদের ডাকবে না। কি রকম মিস্টিরিয়াস গলায় বলল মা। কাকে কাকে ডাকছে আমি জিজ্ঞেস করিনি। দীপালি-মাসি জ্যোতিকাকু তো আসবেই। তানি, বুলেট, অ্যাটম। তানি পঞ্চাশ, বুলেট অ্যাটম দুজনে দু’শ। দীপঙ্কর কাকুরাও আসবে। প্রিয়াঙ্কা মার হট ফেভারিট। শশাঙ্ক জেঠু না এলে তো পার্টি জমবেই না। পারেখদের, মেহরাদের বলেছে কিনা সেটা মা’র ব্যাপার। গ্রোন-আপদের পার্টি যখন। ওই মিস্টিরিয়াস গলাটার জন্য ভাবছি কিছু একটা থ্রিল মা সার্ভ করবে নিশ্চয়। ড্যাড টু হ্যাজ সামথিং আপ হিজ স্লীভ। ভাঙছে না, খালি অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অক্টোবরে ব্যাথশেবার জন্মদিনের পার্টিতে ওরা ড্রিঙ্ক করেছিল। বেশিরভাগই আউট। আমরা প্রচণ্ড নেচেছিলাম। সেটা অবশ্য ড্রিঙ্ক করবার আগে। না হলে মুশকিল ছিল। ব্যাথশেবাদের পলিশড্ পার্কে ফ্লোরের ওপর সবগুলো ঠ্যাং ভাঙত। আমি কোন কথা মা-বাবাকে লুকোই না। এসে বলে দিই। সেদিন যা মজা হয়েছিল বলার নয়। তবে স্টীভ আমাকে বিশ্রীভাবে চুমু খেতে আমার গা বমি করেছিল। ভীষণ ভীষণ। স্কুল ড্যান্সে তো ওরা এরকম করেই। আমি যাই না। এটা, মানে স্টীভের এই ব্যাপারটা আমি মা-বাবাকে বলে দিইনি। এটা আমি নিজেই ট্যাকল করতে পারব। কাউকে আঘাত দিতে আমার খারাপ লাগে, স্টীভকে দিতে হল, উপায় নেই। বললাম, ‘স্টীভ, তুমি ব্যাড ব্রেথের অ্যাডটা দেখেছো?’ ও কিন্তু আঘাত পেল না। বলল, ‘সরি, আমি রোজ ব্রাশ করি, হানি, তবে আজকে চেন স্মোক করেছি তো, তাইতে হয়ত টোব্যাকোর স্মেল এসে থাকবে। ওয়াজন’ট ইট ম্যাস্কুলিন?’ কি পাকা! অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বলে সিনিয়র ছেলেটা আমাদের জেমির সঙ্গে স্টেডি যাচ্ছে। জেসির বাড়ির কাছে গাড়ি নিয়ে এসে বসে থাকে রাত ন’টার পর। রোজ। জেসি আর ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে কী এতো বলে! হাসাহাসি করছিলাম আমরা। ব্যাথশেবা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ওরা কী করছে সেটা ওদের ব্যাপার। উই শুডন’ট ইনটারফিয়ার।’ আমি আর আবলাফিয়া বললাম, ‘আমাদের মা বাবা আমাদের মেরে ফেলবে।’ ব্যাথশেবা অবাক হয়ে বলল, ‘বাবা-মায়ের এ ব্যাপারে বলার কী আছে? ডোন্ট দে লিভ দেয়ার ওন লাইফ!’
হার্ড ড্রিঙ্কস্-এর কথা বলতে বাবা খুব পার্টাব্ড্ হয়ে পড়ল। আমি বুঝতে পারছিলাম। মা বলল, ‘তুমি খেয়েছ! আরাত্রিকা?’ রেগে গেলে মা আমাকে মণি বলে না, বলল, ‘দেখি হাঁ করো, নিঃশ্বাস ছাড়ো!’ মা এমন সুইট না! সুইটি পাই। আমি বললাম, ‘আমি একটা এত বড় মেয়ে যদি ড্রিঙ্ক করে সেটাকে তোমাদের থেকে লুকোতে চাই, তাহলে নিশ্চয়ই পেরে যাবো।’ বাবাকে সাক্ষী মানতে গেলাম, দেখি কি বাবা নেই। নিজের ঘরে চলে গেছে। মানে সাংঘাতিক রাগ এসেছে। এমন সময় দাদার ফোন এলো, মা বাবা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তাইতেই তখনকার মতো ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। কিন্তু বাবা যে মোটেই ভোলবার মানুষ নয়, সেটা বোঝা গেল রাত্রে। ডিনারের পর বাবা বলল বাবার ঘরে যেতে, মাকে বলল, ‘আজ তোমাকে হেল্প করছে না মণি, অসুবিধে হবে না তো?’ মা বলল, ‘ইউ গো অ্যাহেড।’ হাসছে মা। দুজনে ষড় করেছে। বাবা খুব সফ্ট-স্পোকন। অনেকক্ষণ খালি স্মোক করেই যেতে লাগল, শেষে বলল, ‘আচ্ছা মণি, তুই এটা অ্যাপ্রুভ করিস?’
‘কোনটা বাবা?’ আমি ‘কাটার ওন্ট মেল্ট ইন হিজ মাউথ।’ বাবা আবার স্মোক করছে, করেই যাচ্ছে। শেষকালে আমার খুব দুঃখ হল সুইট ড্যাডটার জন্যে, বললাম, ‘তুমি কেন অত নাভার্স হয়ে যাচ্ছো বাবা? আমি ড্রিঙ্ক করিনি, করবও না।’
‘কিন্তু একটা কথা। অনেক সময় দলে পড়েও তো তোরা অনেক কিছু করে ফেলিস!’
ঠিক এই কথাটা আমি বাবাকে বুঝিয়ে পারি না। বাবা আমাকে স্যাডি হকিন্স ড্যান্সে যেতে দিল না, বলল, ‘তুই যেতে চাস? সিরিয়াসলি?’ স্যাডি হকিন্সে মেয়েরাই পার্টনার চুজ করে। বাবা বলল, ‘ধর তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করলি, সে যদি তোকে রিফিউজ করে? এসব ফর্ম্যাল ব্যাপারে সাদারা সাদাদের প্রেফার করে, কালোরা কালোদের, তাছাড়া মনে কর ছেলেটা তোর সঙ্গে নাচলও, এদিকে অন্য যে সাদা মেয়েটার তাকে পছন্দ সে গেল তোর ওপর চটে। প্রতিদিনকার স্কুল-লাইফে তার রিফ্লেকশন পড়বেই। তুই অপমানিত হোস বা শুধু শুধু মুশকিলে পড়িস আমি চাই না।’
কথাটা অবশ্য ভাববার। নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রালের ছেলেমেয়েগুলো দারুণ স্নব। এগিয়ে এসে আলাপ জমায় না। আমার একটা ছোট্ট সেট হয়েছে অবশ্য। কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের সঙ্গে কোনও টার্মস নেই। আগে থেকে স্টীভকে বলে কয়ে অবশ্য যাওয়া যেত। কিন্তু আমি ডাকবার আগেই যদি কেউ স্টীভকে ডেকে নিত! বাবার কথায় আমার কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে গেল। আমি তো এমনিতে একটা স্কুল বলেও যাই না। ক্রিসমাস বল, প্ল্যানটেশন বল, সব বাদ। হিউসটনে ড্রামা স্টেজ করল আমাদের ওয়েস্টবেরি হাই। আমাকে ওরা কাউণ্টেস ড্র্যাকুলার রোল দিয়েছিল। বাবা কিছুতেই করতে দিল না। স্কুল এক্সকার্সন গেল ফ্লোরিডায় ডিজনিওয়ার্ল্ড দেখতে। বাবা বলল, ‘আমি কি তোমায় ডিজনিল্যান্ড দেখাইনি আরাত্রিকা!’ আগে আগে কারণটা আমি বুঝতাম না। এখন বুঝি, বাবা আমাকে ছেলেদের কনট্যাক্ট-এ আসতে দিতে চায় না। কিন্তু স্কুলে সবাই যে রকম চলছে আমি যদি সেই রকম না চলি তো ওরা আমাকে আরোই কাট করবে না? স্যাডি হকিন্সে যাইনি বলে অনেকেই আমায় জিজ্ঞেস করেছিল। পরে আমার মনে হয়েছিল বাবার ভয়টা একেবারে বেসলেস। গ্রুপ-অ্যাকটিভিটিতে যোগ না দেবার অসুবিধের কথা বলতে বলল, ‘তোরা এখন সবে জীবন আরম্ভ করেছিস মণি, যা কিছু দেখছিস সবই তো তোদের কাছে নতুন, একসাইটিং। এখনই যদি তোরা হার্ড ড্রিঙ্কস-এর কৃত্রিম উত্তেজনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়িস তো পরে কী করবি? বন্ধুদের বোঝাতে পারিস না?’
বন্ধুদের বোঝানো? মানে সার্মন দেওয়া? ওরে বাবা! প্রথমত ওদের ‘ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’ করা হবে। দ্বিতীয়ত ওরা বলবে, ‘জানো তো বড়রা নিজেরা সবরকম মজা করবে। আমাদের বেলাতেই খালি ট্যাবু।’ ওরা খুব খারাপ খারাপ কথা বলে। সেইজন্যেই স্টীভকে আমার আজকাল একদম ভালো লাগে না। ব্যাথশেবার সঙ্গে সেদিন কথা হচ্ছিল ওকে বাবার কথাগুলো বললাম। ও বলল, ‘আঙ্কল কিন্তু ঠিকই বলেছেন। বীয়িং গ্রোন আপ ইজ নো ইজি জব। দেখো না আমার কাজিন জ্যাকি অ্যাট দা এজ অফ সেভেনটিন একটা বেবির জন্ম দিয়ে কী রকম পস্তাচ্ছে। ওর বর স্যাম তো দিব্যি মজা করে এ কোর্স ও কোর্স পড়ে চলেছে। এদিকে ওকে চাকরি করতে হচ্ছে, আবার বাচ্চাটাকেও দেখতে হয়, ওর মুখে রিঙ্কল্স্ এসে গেছে। বেচারি! আই ডোণ্ট ওয়াণ্ট টু বি গ্রোন আপ।’
ব্যাথশেবার কাছে নাকি পাঙ্করা অ্যাপ্রোচ করেছিল। একদিন আমায় বলছিল, ‘পাঙ্ক হয়ে গেলে কেমন হয়?’
আমি বললাম, ‘তুমি এরকম উল্টোপাল্টা চিন্তা করছ কেন?’ ব্রোক্ন্ হোমের ছেলেমেয়েরা এইরকম চিন্তা করে ওর কি প্রবলেম! ও তো জু। ওর বাবা মা খুব কনজারভেটিভ।
আসলে ও একটু বোর্ড্ হয়ে যায় চট করে। মুডিও আছে। যখন ক্লাস অফিসার ইলেকটেড হল কি খুশি! কিন্তু স্কুল অর্কেস্ট্রায় ওকে নিল না, ওর চেয়ে ভালো ভায়োলিনিস্ট আমাদের ক্লাসেই রয়েছে তো! ও ড্যাম্প হয়ে গেল। যাই বলুক আর তাই বলুক, ও গ্রোন আপই হয়ে যেতে চায় চট করে। গ্রোন-আপ হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা যে কি! চাকরি করা, নিজে নিজে জিনিস কেনাকাটা করা, একা একা বেরোনো, বেড়ানো, বিয়ে-করা, বাচ্চা হওয়া, এ ছাড়াও বোধহয় কিছু আছে। আমরা ঠিক ধরতে পারি না ব্যাপারটা। বাবাকে জিজ্ঞেস করব। সব কথার উত্তর বাবার কাছে আছে। মা-ও জানে, কিন্তু বলে না। ড্যাড ইজ রিয়্যাল গেম। হি হ্যাজ অ্যান আনসার ফর এভরিথিং। আজ জন্মদিনে আমার বন্ধুদের ডাকা হয়নি বলে আমি একরকম খুশিই হয়েছি। বেশিরভাগই রাউডিজ। বাড়িটা যেন জিম। বেসবল খেলা হচ্ছে! এমনি চেঁচাবে, হুল্লোড় করবে। সাম হাউ আই ফীল অকওয়ার্ড বিফোর ড্যাড। তারপর ওরা এক্সপেক্ট করবে ওদের বাড়িতে বার্থডে পার্টির যেমন হয়, আমাদেরটাও তেমনি হবে। বড়রা স্রেফ বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। আমাদের বাড়ির অ্যাটমসফিয়ার আলাদা ওরা জানে, কেউ কেউ অ্যাপ্রিসিয়েটও করে, কিন্তু ওয়ান্স দে আর ক্যারেড অ্যাওয়ে দেয়ার্স নো নোয়িং∙∙∙। এই টানাটানিতে আমার আনন্দটা মাঝখান থেকে মাটি হয়ে যাবে। তারপর আর একটা কথা। দাদা তো নিশ্চয়ই আসবে। দাদা হ্যাজ পুওর ওপিনিয়ন অ্যাবাউট মাই প্যাল্স্। আর দাদাকে আমি ভীষণ অ্যাডমায়ার করি। দাদার যদি খারাপ লাগে ওদের তো আমি ভীষণ হার্ট হবো। বন্ধুদের বলেছি পরে একদিন হবে। ওরা আ বিট ডিস্যাপয়েণ্টেড। সে কিছু না। নো প্রবলেম। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মায়ের হাতের রসগোল্লা আর সামোসা খেলেই ওদের সব অভিমান জল হয়ে যাবে। রসগোল্লার পোকা একেবারে। তাছাড়া এবার থেকে আমি ঠিক করেছি সেট একটু পাল্টাবো। স্টীভ, রকহার্ট, ইভন ব্যাথশেবা সামহাউ আমাকে আজকাল অ্যাপীল করে না। আমি জানি এটা দাদার ইনফ্লুয়েন্স। গতবার যখন দাদা এসেছিল তখন ব্যাথশেবা ডে স্পেন্ড করেছিল আমাদের বাড়ি। চলে যাবার পর বলল, ‘হু’জ দ্যাট জাঙ্ক?’ প্রথমটা আমার খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। পরে যতবা ব্যাথশেবার সঙ্গে দেখা হয় ব্যাথশেবা অ্যান্ড হার ট্রিঙ্কেটস, কানে ঝুলছে, গলায় ঝুলছে, চুলে ঝুলছে, দাদার কথাটা মনে পড়ে যায় ‘হু’জ দ্যাট জাঙ্ক?’ স্টীভ আর রকহার্টকে তো ও স্ট্যান্ড করতেই পারে না। সোজাসুজিই বলে, ‘তোর এই প্লে-বয় বন্ধুগুলোকে ছাড় তো মণি! ডোণ্ট য়ু এভার মিট এনিবডি ওয়ার্থ মিটিং!’ প্রথমটা রাগলেও দাদার কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যাই। সব বাজে, সিলি লাগতে থাকে। কী করব! দাদাটা এমন! এইট্টিতে স্কুলে স্প্রিং-ক্লীনিকের সময় মিশেল, স্যারা, এমিল, যোয়ান এদের সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি ওদের কালটিভেট করিনি। স্যারাকে খুব ডাউডি মনে হত। এখন দেখি ও আসলে ভীষণ ইনটেলিজেণ্ট। কোয়াণ্টাম থিয়োরির ওপর একটা বই পড়ছিল একদিন। অ্যাডভান্সড ম্যাথস্ নিয়েছে। সবগুলোই প্রায় জু ওরা। নিউইয়র্ক সেন্ট্রালের বেস্ট স্টুডেন্টস। টেম্পারামেণ্ট আলাদা। ফিজিক্যাল এডুকেশন যেটুকু করতে হয় করে। আমাদের মতো জিমে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে না। আমারও অবশ্য খেলা অত আসে না। টীমে চান্স পাওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু চীয়ার্স তো দিতে পারি! ব্যাথশেবা, লরা, আমি আর নাওমি মিলে চীয়ারলীডার্স গ্রুপ তৈরি করেছি। যখনই কোনও টুর্নামেন্ট কি অ্যাথলীটস্ মীট হয় আমরা ফ্যান্সি ড্রেস পরে চীয়ার্স দিই। চীয়ারিং, লিয়ারিং, লীপিং, লিফটিং, গ্র্যাবিং, গ্রিপিং, ফ্লাইং, ফ্লিঙ্গিং সিঙিং, গ্লীমিং, যা মজা হয় না! মাদামের কাছে শেখা পিরুয়েৎ আতিতিউদ, কাব্রিওল গুলো ওই সময়েই কাজে লাগে আমার। নিউ ইয়র্ক ব্যালে গ্রুপ-এ কি আর বাবা কোনদিন নাচতে দেবে?
৪
অ্যালাবামার একশ আঠার নম্বর গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে চলেছি। আমি আর কুপার। মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছি। আপাতত দু পাশে শুধু গাঢ় সবুজ প্রকৃতি। বাইরে প্রচণ্ড গরম বুঝতে পারছি। কুপারের ওল্ডসমেবিলটার ভেতরে বসে স্বভাবতই কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অ্যান মারের কানট্রি সঙ্ বাজছে। শুনতে শুনতে ভাবছি নার্ভ বাউল কিম্বা ভাটিয়ালি এই পরিবেশে কি রকম খাপ খেত। খুব সম্ভব কুপারের নার্ভ আরও শান্ত হয়ে যেত তাতে। পশ্চিমে সাধারণত প্রাচ্য সঙ্গীত পছন্দ করে না। সমারসেট মমের কোনও একটা গল্পে ব্রেন-ফিডার-বার্ড-এর একঘেয়ে ডাকের সঙ্গে প্রাচ্য সঙ্গীতের তুলনা পড়েছিলুম। কিন্তু ভাটিয়ালি বা বাউলের একটা আন্তর্জাতিক আবেদন থাকতে বাধ্য। সঙ্গীতের ভাষা এমনিতেই আন্তর্জাতিক। এবং ভাটিয়ালি যেহেতু নদীর ভাষা আর বাউল গ্রাম্য প্রকৃতির অন্তরতম সত্তার ভাষা তাই বাউল-ভাটিয়ালি সর্বত্র জয়ী হতে বাধ্য। গরমে একটা কাঁপা কাঁপা ধোঁয়া মাটি থেকে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। বেশি কিছু পরিকল্পনা না করেই বেরিয়ে পড়েছি। সঙ্গে কুপারের কলি কুকুর রোভার ছাড়া কেউ নেই। কুপার বলল, ‘ভীষণ তেষ্টা সডি, আর কতক্ষণ?’। ঠিক তখনই মাটি থেকে ওঠা তাপের কম্পমান শিখাটার পেছনে দোকানটা দেখতে পেলুম, ‘ফিলিপস মেমারি স্টোর।’ কাঠের তক্তা জুড়ে জুড়ে করা। যেন একখণ্ড ড্রিফ্টটড্ কেউ রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ওপরে লাল বোর্ডে লেখা কোকা-কোলা। নীচে লেখা ‘এনজয় সুগার-ফ্রি কোলা।’ ঠিক জায়গাতেই এসেছি। গাড়ি থামিয়ে আমরা ছুটে গেলুম। পৰ্চটা পার হয়ে, নীল ওভার অল পরা কৃষাণটিকে ছাড়িয়ে। কাউণ্টারের পেছনে মোটা সোটা মহিলাটির অবাক চোখের সামনে আমরা আমাদের ট্যাণ্টালাস বা অগস্ত্য-তৃষ্ণা মেটাতে লাগলুম। আধ গ্যালন কমলালেবুর রস, দুজনে মিলে চার বোতল কোক, আধ গ্যালন গ্রেপফ্রুট, এক গ্লাস করে ঠাণ্ডা দুধ, তারপর ঢকঢক ঢকঢক করে খালি জল। গ্যালন দুই তো হবেই। পেট জয়ঢাক একেবারে। একটা হোস টেনে নিয়ে রোভারের গায়ে জল ছাড়তে লাগল কুপার। রোভার গা ঝাড়ছে আরামে আর চারদিকে বাষ্পবিন্দু ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লম্বা দুটো স্টুল নিয়ে বসে পড়েছি দুজনে। রোভারটা জিভ বার করে সামনের প্যানে রাখা জল চাটছে। আর মাঝে মাঝে কুপারের দিকে চেয়ে জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে। ওকে এভাবে কষ্ট দেবার জন্যে কুপারকে জিভ ভেঙাচ্ছে কিনা বুঝতে পারলুম না।
জ্যাক কুপার একজন ভীষণ উদ্বিগ্ন মার্কিন যুবক। নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে কনেকটিকাটের গ্রীনিচ্ গ্রামে জন্ম। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার সঙ্গে আলাপ। এই প্রথম একজন আমেরিকানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল। কুপারের ব্যাপারটা হল অনেক দিন ধরেই ওর মার্কিন আত্মবিশ্বাসে চিড় খেয়ে যাচ্ছিল। ছাত্র আন্দোলন, শান্তি মিছিল, জাত নিয়ে হিংস্রতা, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারী এই সমস্তর মধ্যে দিয়ে ষাট সত্তর দশকে বেড়ে উঠেছে ও। ওর মনে হয়েছে ওর দেশ বুঝি অকূল পাথারে ভেসে যাচ্ছে। ভীষণ অশান্তি। রোজই রাত্তিরে এসে আমার ঘরে টোকা দিত। শেষে একদিন বলল, ‘সডি, নিজের দেশ নিয়ে চিন্তা হয় না তোমার?’
আমার দেশ? আমার দেশের অসুখ যে কত গভীরে কিভাবে আমি কুপার নামের এই বালকটিকে বোঝাই? ও শুধু ওর মায়ের স্কার্টে একটা ফুটো দেখেই এমন করছে যেন সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। শতচ্ছিন্ন আঁচলে লজ্জায় মুখ-ঢাকা আমার মাতৃভূমির কথা ও কি বুঝবে? বাবা-মা সব সময়ে যেতে না পারলেও আমি কিন্তু বারে বারে একা-একা ফিরে গেছি দেশে। দুর্নীতির কি পচা ঘা থিকথিক করছে ওপর তলায় নীচ তলায়! দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধি! দাদু বলছিল, মাসের শেষে স্যালারি চেক নিতে গেলে ঘুষ দিতে হবে। এমন দিন আসলেও অবাক হবো না। রাজনীতি আর শো-বিজে এখন কোনও তফাত নেই। নিজস্ব সংস্কৃতির নামে যে যার কায়েমি স্বার্থ আঁকড়ে আছে, দরকার হলে সংসার আলাদা করবে তবু সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়বে না। ভিন্ন দেশের গুপ্তচরবৃত্তি করবে তবু স্বদেশের সংবিধান-সিদ্ধ কাজে হাত মেলাবে না। আর ল্যাবরেটরীর নোংরা রাজনীতির সঙ্গে আপস করতে না পেরে পালিয়ে আসছে বিজ্ঞানীরা, প্রযুক্তিবিদরা। আমেরিকা তাদের চাঁদি দেখিয়ে ডাকছে। গ্রেনাডা-ক্যারিবিয়ান সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তী যা বলেছেন, প্রবাসী ভারতীয়দের সম্পর্কে সেই কথাগুলোই কেন জানি না আমার মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
এই দ্বীপে আছে আজো যারা ভারতীয়
আড়কাঠি সাম্রাজ্যের ছলনায় আনা
জায়ফল ঘন বনে ছায়া-প্রায় তারা সর্বহারা
ভাষা-সংস্কৃতিও ক্লিন্ন ক্ষীণ।
কে বা জানে তাদের নির্বিতি
ধিকি ধিকি আসবে কবে ইতিবৃত্ত ভোলা এ সংসারে;
দূরের ভারতবর্ষ আজো উদাসীন অসহায়।
টাকাকড়ির দিক দিয়ে তারা সর্বহারা নয় ঠিকই। কিন্তু ওইসব মূল্যবান মস্তিষ্ক যখন ফলপ্রসূ হবে হতভাগ্য ভারত জানতেও পারবে না। সে ফলের অংশীদার হওয়া তো দূরের কথা। স্বদেশের চিহ্ন এই ক্ষুদ্র সমাজে মেয়েদের শাড়ির বাক্সয়, কিছু পুরুষের রাত্রিবাসে, চোখমুখের আদলে বেঁচে আছে। আর একটা প্রজন্ম পরেই ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সেই জনের আত্মপরিচিতিহীন নিয়তির অন্ধকারে কিছু না জেনেই প্রবেশ করবে সে। ওই ক্ষীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে বাটিকের দুর্গাঠাকুর পুজো করে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বাংলা সাইক্লোস্টাইল পত্রিকায় বাঙালি আড্ডার ইতিহাস পর্যালোচনা করে। বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে। নিজমূল থেকে উৎপাটিত এই সংস্কৃতি পরের প্রজন্ম কখনও গ্রহণ করবে না। এসব বিদ্যা শিখতে হয় চীনেদের কাছ থেকে। যেখানেই যায় বানিয়ে নেয় চায়না টাউন। আমাদের একদেহে লীন হয়ে যাবার সহজ মন্ত্রটা জানা আছে। আত্মস্বাতন্ত্র্যের মশাল জ্বালিয়ে রাখবার কৌশলটা আমরা জানি না। লীন হয়ে গেলেই যে চমৎকার একটা বিশ্বজনীন সভ্যতার সব পেয়েছি জিমনাসিয়ামে ঢুকে পড়ে ইচ্ছেমতো খেলাধুলো করা যাবে তা কিন্তু নয়। প্রতি পদে আইডেনটিটির সঙ্কট আমাদের বিদ্ধ করবে, বধ করবে।
কুপারের সঙ্গে সেবার সেই আমেরিকা-আবিষ্কার যাত্রায় বেরিয়ে আমার কিন্তু একটা সত্যিকার লাভ হয়েছিল। ছোটবেলার মার্কিন পরিপার্শ্ব থেকে যে ঘৃণা সংগ্রহ করে বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছিলুম, তার অনেকটাই মুছে গিয়েছিল। নিউ অর্লীন্স থেকে যাত্রা শুরু করি। অ্যালাবামা নদীর যাত্রাপথ ধরে অরভিল, সেলমা, তারপর পুবদিকে সরে বার্মিংহাম, শেফীল্ড, সামারটাউন, রবিন্সভিল। সেখানে গাড়ি বিক্রি করে অ্যাপালেচিয়ান পর্বতশ্রেণীতে ট্রেকিং। ব্লুফিল্ডে ব্লিজার্ড। তারপর আবার সমতল, ছোট শেনানডোয়া নদীর নীলচে সবুজ জল। শেনানডোয়া ন্যাশনাল পার্কের প্রাণবন্ত সবুজ। তারপর পশ্চিমে বেঁকে ওয়াশিংটন ডিসি। ভাগনার্স গ্যাপে, প্রায় ১৪৭৯ ফুট উঁচুতে মাথার ওপর দিয়ে বুলেটের মতো ছুটে যাচ্ছিল হক আর ফক্ন্। সে যে কি দারুণ অভিজ্ঞতা! ফিলিপ’স মেমরি স্টোরের মোটাসোটা মালকিন ডরোথি এবং তাঁর স্বামী, ছেলে ফিলিপকে হারিয়ে তার স্মৃতিতে দোকান দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাদের মনের শান্তির জন্য প্রার্থনা করবেন। গাড়িতে ভরে দিয়েছিলেন কমলালেবুর রসের ক্যান, লাল চুনীর মতো জ্বলজ্বলে আপেল, জলপাই, অ্যাভোক্যাডো। অ্যাপালেশিয়ানে ওঠার আগে মার্ফি বলে একটা জায়গায় তিন চারদিন থেকে যেতে হয়, কুপারের পা মচকে গিয়েছিল। আমাদের আশ্রয় দেয় ‘টেক্সানা’ নামে এক কৃষ্ণগোষ্ঠীর একটি পরিবার। ওদের মেয়ে হল বংশের প্রথম কলেজ গ্র্যাজুয়েট। কুপার বলল—ওর বোনের নামও মেরি এলিজাবেথ। ‘মাই ব্ল্যাক সিসটার অ্যাণ্ড মাই হোয়াইট সিসটার’··ভাবে বুঁদ হয়ে থাকত তখন আমার বন্ধু কুপার। আমেরিকান ঐক্য, আমেরিকান সংহতির সন্ধান ও খুব সম্ভব এমনিভাবেই পায়। গ্রীনিচে ফিরে পাক্কা দেড়দিনের বিশ্রাম ঘুম নিয়ে কুপার বলল, ‘খবরের কাগজওয়ালারা, এমন কি সমস্ত মাস মিডিয়া যে একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যেবাদী এতে ওর কোনও সন্দেহই নেই। ওর মাতৃভূমির কোনও অসুখ নেই।
সেই থেকে কুপারের আর আমার নেশাই হয়ে গেল ঘোরা। ক্যানিয়নল্যাণ্ডটা পুরো হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখেছিলুম। প্রকৃতির অদ্ভুত সৃষ্টি কলোরাডো নদী খাত গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন। আমরা য়ুটার দিকে গিয়েছিলুম রক আর্ট দেখতে। ক্যানিয়নের বুকে আদি মানবদের শিল্পকীর্তি। কিছুটা বাদে বাদে লম্বা লম্বা ছায়া ছায়া মূর্তি সব। যেন প্রেত। প্রকৃতির কোলের এই লুভরে হোলি গোস্ট অ্যাণ্ড ফ্যামিলি নামে খ্যাত ত্রিমাত্রিক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল যারা এসব করেছিল, কোন সুদূর অতীত যুগে তারা বোধহয় মনুষ্যজাতির উৎসর আদিতত্ত্বটা জানত। কিছুই নেই থেকে সব কিছু এর মধ্যেকার মিসিং লিঙ্কটা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল।
এই বিশ্বজনীন মানবসভ্যতা, বিশাল ইতিহাস, অকল্পনীয় কীর্তি, ঐতিহ্য—এর উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা কিই বা করলুম? ছুটছি অথচ পৌঁছতে পারছি না, ছুটছি অথচ সোজা না গিয়ে নানান বাঁকা পথে দৌড়চ্ছি, সভ্যতার এই কালক্ষেপকারী ম্যারাথন দৌড় শেষ হবে কবে?
মা ফোন করেছিল মণির বার্থডে, যেতে হবে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। মণির বার্থডেতে আমাকে কেন? ওর পিয়ার-গ্রুপটা একেবারে যাকে বলে বিদঘুটে। মা-বাবাকে অনেকদিন আগেই বলেছি আমার মতো ওকে প্রাইভেট স্কুলে দিতে। ব্রুকলিনে একটা ফরাসী মিশনারি স্কুল আছে, সেটাতে অনায়াসেই দিতে পারত। পাবলিক স্কুলগুলোর সাঙ্ঘাতিক টাকা। স্টেট গ্রাণ্ট, এ গ্রাণ্ট, ও গ্রাণ্ট। সবই ট্যাক্সপেয়ারদের টাকা অবশ্য। কিন্তু তাই দিয়ে ওরা ভীষণ একটা ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দেয়। টিপিক্যাল মার্কিন মানসিকতা আর জীনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েগুলো। আমাকে বাবা হিউসটনে একটা মিশন স্কুলে দিয়েছিল। খুব শান্ত পরিবেশ। রক্ষণশীল। একটু বেশি ধর্ম-ধর্ম বাই। কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় নি। ক্রুস কাঠে ছেলেমানুষ যিশু বেচারার আত্মহত্যার দৃশ্যটা কল্পনা এবং চিন্তাশক্তিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। বাবা মণির বেলায় ভিন্ন নীতি নিল কেন জানি না, বোধহয় ঠিক করেনি।
ঘরোয়া বার্থ ডে ভালো। পারিবারিক বার্থ ডে। অনেক লাল গোলাপ নিয়ে মণির হাতে তুলে দিতুম। মা রান্না করত সেমুইয়ের পায়েস, তাতে কলার বড়া। সুক্তুনি বলে একটা জিনিস মা করে, দিদুর মতো পারে না কিন্তু অন্ততপক্ষে দিদুকে মনে তো করায়! টোম্যাটো-স্টাফ করতো মা চিংড়ি মাছের পুর দিয়ে। বাবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বলত, ‘শেম বাবু, এখনও তোকে বেল্ট দিয়ে ন্যাশন্যাল ড্রেস পরতে হচ্ছে?’ আমি বলতুম, ‘কেন বাবা “হাঁস ছিল সজারু ব্যাকরণ মানি না, হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না” ঠিক তেমনি বেল্ট দিয়ে ধুতি পরে, “অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি”। মা গম্ভীর হয়ে বলত, ‘একটা সামান্য সুবিধে অসুবিধের ব্যাপারকে তোরা তোদের সিনিসিজম দিয়ে কি বেঁকিয়েই দেখিস।’ আমি বলতুম, ‘না মা, আসল বকচ্ছপ আমি কলকাতার রাস্তাতেই দেখে এসেছি। অঙ্গে ফেডেড জীনস্, ওপরে চড়িয়েছে কাজকরা রঙিন লক্ষ্ণৌ পাঞ্জাবি, পইতের মতো করে পরা লেডিজ কাশ্মিরি স্কার্ফ, বেগুনি রঙ, ডান হাতে স্টিলের বালা, গলায় রুপোর চেন, চুলে বারান্দা কাট।’ মণি হাসতে হাসতে বলত, ‘কবে দেখলি? গত বছর? স্কেচ করে এনেছিস? বারান্দা কাট কি রে?’
আমাদের ঘরোয়া বার্থ ডে পার্টির চেহারা এই। কিন্তু মার কথা শুনে মনে হল বিগ পার্টি থ্রো করছে। তার মানেই লোক্যাল গ্রুপ। ডলারের হিসেব। বাড়ির হিসেব। গাড়ির হিসেব। ব্রুকলিনের ইহুদি গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিকতা আছে তারাও দারুণ কূপমণ্ডুক। তার চেয়ে আমার য়ুনিভার্সিটির পরিবেশ অনেক জীবন্ত। তিনটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হল সেদিন। লাইব্রেরিতে ছিলুম। কুপার টেনে আনল। বলল, ‘সডি, মিট সাম ইণ্টারেস্টিং পীপ্ল। ছেলে দুটি পুয়ের্তোরিকান, মেয়েটি আমেরিকান, নাম এডিথ। মেয়েটি বলল, ‘তুমি খুব অসুখী।’ আমার ভেতরের দ্বন্দ্ব মুখের ওপর ছাপ ফেলেছে ভেবে আমি তক্ষুনি মুখটা উদাস করবার চেষ্টা করছি। একটি ছেলে বলল, ‘বেট য়ু আর ট্রাইং টু পুট অন ইয়োর মাস্ক্।’ ক্লেভার গেস না সরল সাইকলজির জ্ঞান বুঝলুম না। অন্য ছেলেটি বলল, ‘নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো। তুমিও পারবে যদি টি. এম করো।’ এই টি. এম কথাটা এখন স্টেটস-এর শহরে শহরে ছড়িয়ে গেছে। ডাক্তাররা পর্যন্ত প্রেসক্রাইব করছে টি. এম। আমাকে এই প্রথম কেউ অ্যাপ্রোচ করল। ক্যারিয়িং কোল টু নিউকাস্ল্। ওদের বললুম না এটা আধুনিকতার মার্কিনি খোলস পরানো বিশুদ্ধ ভারতীয় ধ্যানতন্ত্র। যেন কতই কৌতূহলী এই ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কি করতে হবে। ওরা দুটো ফর্ম বাড়িয়ে দিল। নিজদের সম্পর্কে সব তথ্য লিখে দিতে হবে তাতে। সেই অনুযায়ী ওদের এক্সপার্টের কাছ থেকে একটা মন্ত্র পাবো। সেটা ধ্যান করতে করতে কিছুদিনের মধ্যেই এই অসুখী ভাবটা চলে যাবে। তারপর পরের ধাপ। ভাগ্যে থাকলে অ্যাসট্রাল বডিতে মহাকাশেও ঘুরে আসতে পারি। কুপার তৎক্ষণাৎ ফর্ম ভর্তি করতে বসে গেল। আমেরিকান সংহতি সম্পর্কে ওর প্রত্যয় এখনও যথেষ্ট দৃঢ় হয়নি দেখা যাচ্ছে। কিম্বা এ-ও হতে পারে, ও নিজের সিসটেমটাকেই দায়ী করছে এ জন্য। তাই ট্রানসেনডেনটাল মেডিটেশন-এর ব্যাপারে এত আগ্রহ। কিন্তু কুপারের স্থির হবার জন্য অস্থিরতাটাই এতো বেশি যে মনে হয় ও সব কিছুই চাখবে একটু একটু। মায়াপুর, নবদ্বীপে নাকি মার্কিন বৈষ্ণবদের বিরাট আখড়া বসেছে। সেইখানে সাহেব বৈষ্ণব হয়ে টার্ন আপ করবে দেখছি শেষপর্যন্ত। ভালোই। শতাব্দীর পর শতাব্দী খেতে পরতে দেবার চাকরি দেবার লোভ দেখিয়ে আমাদের ধর্ম-টর্ম কেড়ে নিয়েছ। এখন নিজেরাই আমাদের ধর্ম এবং তার বহুবিধ ডালপালা নিয়ে নাচো। দেখো বৈচিত্র্য সাধনে কি মুক্তি! তোমাদের ক্রিশ্চানিটি যতই বলো বড় একঘেয়ে ভাই!
কুপার ফর্ম ভরছে। এই সুযোগে আমি টুক করে কেটে পড়েছি। আমার গাড়িটা ক্যাথি নিয়েছে। ওর ফোক্সওয়াগনটা নিয়ে যাচ্ছি, একটা নোট লিখে রেখে গেলাম ঘরে। একলা একলা এইভাবে ড্রাইভ করতে আমার আজকাল বেশি ভালো লাগে। য়ুনিভার্সিটি থেকে সী বীচ। রাস্তাঘাটের জ্যামিতি পার হতেই দূরে আদি জননী সিন্ধু।
নীলচে সবুজ প্যাসিফিক। সাদা ঝালর। অনেক দূরে একটা ইয়াট ভাসছে। সমুদ্র, পাহাড়, আকাশ, অরণ্য, হাই-ওয়ে, মরুভূমি, জলপ্রপাত। জিজ্ঞাসায় কেউ অস্থির, কেউ স্থির।
আমাদের চেয়ে ভালো করে প্রশ্নগুলো করতে পারে বলেই উত্তরের জন্য ওদের কাছে আসা। এসে বসা। দাদু লিখেছেন: ‘তুমি যখন আসো, তোমার খুব কষ্ট হয় ভাই, আমার কিন্তু খুব আনন্দ হয়।’ কথাটা আমাকে কাল সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল। কষ্ট? হ্যাঁ কষ্ট আছে। পাওয়ার কাট, মশা, ড্রেনের দুর্গন্ধ, ব্যাকটিরিয়াভর্তি পানীয় জল। কার্বন মনোক্সাইড ভর্তি নিশ্বাসের হাওয়া, বাসে-ট্রামে ভিড়, নিঃসাড় টেলিফোন, কানের কাছে বিকট শব্দ লাউডস্পিকারে আজান, গ্রন্থসাহেব, গীতা। কষ্ট আছে। কিন্তু একজন বৃদ্ধ, দাদুর বোধহয় সত্তরের ওপর বয়স হল, এখানে দীর্ঘদিন থেকে বুঝেছি, এই রকম এক বৃদ্ধের কিছু থাকে না আক্ষেপ ছাড়া, সেই আক্ষেপেও কদাচ প্রাণ থাকে, তিনি আমার সান্নিধ্যে নির্ভেজাল আনন্দ পান। এই আনন্দ খুব দামী, সন্দেহ নেই। স্বার্থ চিন্তা নেই, প্রত্যাশা নেই, মানুষের বিশুদ্ধ সত্তার সঙ্গে বিশুদ্ধ সত্তার মুখোমুখি হওয়ার আনন্দ। কষ্টটার ওজন বেশি! না আনন্দটার? দিদুরও আমি আনন্দ ছিলুম। দিদুর মৃত্যুটা আমার কাছে এমন একটা শক যা বোধহয় আমি কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারব না। সাত বছর বয়সে চলে এসেছি। কিন্তু দু এক বছর পর পরই হয় শশাঙ্ক জেঠুর সঙ্গে, নয় জ্যোতিকাকাদের সঙ্গে ফিরে ফিরে গেছি। মা-বাবা বুঝত। আমাকে না পাঠিয়ে উপায় নেই। আমার শেকড় বউবাজারের বাড়ির উঠোনে প্রোথিত আছে। পুরোপুরি উপড়ে আনলে বাঁচানো যাবে না। যে ছোটবেলাটা বউবাজারে কাটিয়েছি সেটাতে মা-বাবা আগন্তুক, অতিথি। বাবার বাড়ি ফিরতে আটটা নটা। মা ইউনিভার্সিটির পর যেতো গানের ক্লাসে। আমি দিদুর পেছন পেছন ঘুরতুম আর গল্প শুনতুম। বোকা কুমির, বুন্ধু বাঘ, চালাক শেয়াল, দেড় আঙুলে, ঘুমন্ত রাজকন্যা, বুন্ধু ভুতুম, রঙিন মাছের গল্প আলাদীন, আলিবাবা। আমি পাঁচ বছর বয়সেই ভালো বাংলা পড়তে শিখে গিয়েছিলুম। কিন্তু দিদুর মুখের পানের রসে জারিয়ে না এলে গল্পগুলো যেন ঠিক জমত না। দিদু বলত, ‘তুই তো আমার আসল ছেলে, নাতি নোস তো! ছেলেদের কি আর আমি মানুষ করেছি। কত ছোটতে হয়েছে সব। ছেলে মানুষ করার কিই বা জানতুম তখন। তুই আমার সুদ নোস রে, সুদশুদ্ধ আসল।’ সেই আমি যখন দিদুকে ছেড়ে এলুম, কেউ জানে না, শুধু আমি জানি আর দিদু জানে আমাদের দুজনের কি ভীষণ লেগেছিল। উপায় ছিল না মা-বাবার, ছোট্ট মাথা দিয়ে বুঝতুম আমি তখনও। কিন্তু মা বাবাকে মনে হত অচেনা লোক, ধরে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেধরার মতো। ট্যাকসিতে ওঠানো যাচ্ছিল না আমাকে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। দিদু বলল, ‘যাও বাবু, যাও, আমি বলছি যাও।’ দু বছর পর ফিরে গিয়ে দেখলুম সে দিদু আর নেই। মুখে আঁচড়, চোখে কালি। আমার মুখে ‘দিদু’ ডাক শুনে কেমন চমকে উঠলো, আগে মা বলতুম তো। বললে, ‘না না, ঠিকই হয়েছে।’ দাদু ছিলেন, বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই সুন্দর।’ যে কদিন ছিলুম, বলতো, ‘আসবি তো ঠিক?’ গিয়েই তো ছিলুম। তবু ওই আকুতিতে দিদু কি প্রার্থনা রাখতো আমার কাছে ভালো করে বুঝতে পারতুম না।
দু বছর বাদে বাদেই ফিরে গেছি দিদুর কাছে। কত কথা বলতো দিদু। তখন তার কিছুই ভালো বুঝতে পারতুম না। এখন চিন্তা করলে কিছু কিছু বুঝতে পারি। তারপর একদিন বড় জ্যাঠার কাছ থেকে ফোন পেয়ে আমি আর বাবা ছুটে গেলুম। সোনারঙের দিদু এবার লাল-নকশা পাড় শাড়ি পরে শুয়ে রয়েছে। মুখের আঁচড় মিলিয়ে গেছে, কিন্তু আর কথা বলছে না। জমাট স্নেহ। ত্রিমাত্রিক ফ্রীজ শটে দিদুকে সেই শেষ দেখা, শেষ বোঝা। আমার ধারণা, মা বাবা কাকা কাকীরা এমন কি দাদুও ঠিক বুঝতে পারতেন না দিদুকে। আমাদের বউবাজারের পারিবারিক বাসগৃহে চীফ হলেন বড়দি। বাবাদের জ্যাঠাইমা। সবাই মানে, কথা শোনে, ভয় করে। এই বড়দিকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমার চোখ ফিরে গেল মহাসাগরে। গড়াতে গড়াতে চলে যাচ্ছে ঢেউ, ফিরে আসছে ঢেউ। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে দেখতে বিকেলটা বেশ গাঢ় হয়ে এলো। কাছাকাছি দু একজন বালির ওপর তোয়ালে পেতে শুয়েছিল। কখন উঠে গেছে। যারা আছে তারা বহু দূরে, বিন্দুর মতো। লাইফ-সেভারের স্ট্যাণ্ডটা খালি। আমার নিজের নিশ্বাসের ছন্দের মধ্যে দেখছি মহাসাগরের চলনের ছন্দ ঢুকে গেছে। এই ঢেউ-গড়া আর ঢেউ ভাঙা তাহলে সমুদ্রের নিশ্বাসপ্রশ্বাস! আমার বাইরে একটা সমুদ্র। ভেতরে আর একটা সমুদ্র। দুটো এখন সমান তালে দুলছে। হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে যা কিছু দেখছি বালুকণা, জল, বাতাস, নুড়ি সবই যে কম্পনশীল অণুর সমষ্টি—ফিজিক্সের এই মৌলিক তত্ত্বটা যেন আমার চোখের সামনের বিরাট প্রাকৃতিক ল্যাবরেটরিতে ডেমনস্ট্রেটেড হচ্ছে। সব কাঁপছে, যেমন আকর্ষণ তেমন বিকর্ষণ! শেষ বিকেলের আলোর দিকে তাকালুম—আবহমণ্ডলের ঠিক বাইরেটায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে মহাজাগতিক রশ্মি। গ্রাফ না, ডায়াগ্রাম না। গণিতের থিয়োরি না। প্রপাতের মতো আছড়ে পড়তে দেখলুম স্বয়ং শক্তিকে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে। ছন্দে ছন্দে। আমার ব্রুকলিনের ঘরে আছে আড়াই ফুট একটা পেতলের নটরাজ। বড় পিসি উপহার দিয়েছিল। সেই নটরাজই যেন বিরাট থেকে বিরাটতর আবার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে আমার চারপাশে আমাকে ভেতরে নিয়ে তার সৃষ্টির নাচ নাচতে লাগল। শুধু আমি নই, সকলকেই সেই নাচের বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান দেখলুম। আমার বাবা, মা, বোন, আমার বন্ধুরা, মুখ চেনা কত লোক, বড়দি, জ্যাঠা, কাকা, ছোটকাকা, টুলটুল, দিদু, ক্যাথি, দিদিমা, দাদাই, কুপার—সব সব। এই নাচের তাল কাটলে ভয়ানক ব্যাপার হবে বুঝতে পারছিলুম। সমস্ত পদার্থ ভেঙে চুরচুর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তথাকথিত বিগ ব্যাং-এর ঠিক আগের মুহূর্তে ফিরে যাবো বুঝি। যাকে পৌরাণিক ভাষায় বলে, মহাপ্রলয়।
‘হা-ই! ফীলিং লোনলি?’ মেয়েলি গলার স্বর।
লোনলি! হায় রে। আমি এইমাত্র বিচরণ করছিলুম আসমুদ্র হিমাচল পৃথিবীর প্রতিটি অণুর সঙ্গে, আমায় বলছে লোনলি! গায়ে-পড়া আর হাই-ব্রাও এই দুয়ের মাঝামাঝি মার্কিন কি ওই ডিসকভারি যাত্রা ছাড়া আর মিলবে না! পাশে এসে বসেছে। বিশ্রী পোশাক। হঠাৎ আমাকে চমৎকৃত করে দিয়ে বলল, ‘হা-ই। তোমার মনে হয় না পৃথিবীটা গোল্লায় যাচ্ছে?’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আরও বলল, ‘সেই সঙ্গে তুমিও গোল্লায় যাচ্ছো!’
আমি বললুম, ‘আমি গোল্লায় গেলে তোমার এতো মাথাব্যথা কিসের? আর গোল্লায় যাবার কী কী লক্ষণ তুমি আমার মধ্যে দেখলে?’
হেসে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা। মণির থেকে হয়ত সামান্যই বড় হবে। নির্ঘাত টেনে এসেছে। চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি, বললে, ‘মিট লুসিয়ানা বয়।’ আশেপাশে আর তো কেউ নেই দেখি, তাহলে উনিই লুসিয়ানা। আবার বলল, ‘আমি এতদূর এগিয়ে এলাম (যেন আমি এগোতে বলেছি) তুমি তোমার নামটাও বলবে তো?’ তখনও চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘ওক্কে, আমি তোমার রিয়্যাল নামটা যখন জানিই তখন আর এ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কি! আমি অবাক। লুসিয়ানা আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোমার নাম গ্যালাহাড। এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিই। এক নম্বর, তুমি গোল্লায় যাচ্ছো এতে আমার খুব খারাপ লাগছে। অ্যাজ এ ফেলো হিউম্যান বীয়িং। আমি তোমাকে সেভ করে দিতে চাই। দু নম্বর, গোল্লায় যাচ্ছো তার সিমটম হল অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি। দেখছি তুমি ভীষণ মোরোজ। ডিপ্রেসড্।’ বলেই মেয়েটি সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। তারপর ক্রমশ ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে বহু দূরে চলে গেল। একটা সময় আমি বুঝতে পারলুম মেয়েটা ডুবে যাচ্ছে। তখন আমি ‘হেলপ হেলপ্’ করে ছুটোছুটি করে কোনমতে লাইফ সেভার আর একটা তাগড়া ট্রাক-ড্রাইভারকে যোগাড় করলুম। তিনজনে মিলে মেয়েটাকে বীচে এনে উপুড় করে দিতেই বেশ খানিকটা জল ওগরালো। বোধহয় বিশেষ কিছু হয়নি। ড্রাইভারসাব হিপ পকেট থেকে রামের বোতল বার করল। কয়েক ঢোঁক খেয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলল মেয়েটা, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বা-ই!’ টলতে টলতে চলে যাচ্ছে দেখে ড্রাইভারটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইদার য়ু ডু সামথিং অর আই ডু সামথিং অ্যাবাউট হার।’ ড্রাইভারটাকে গোড়া থেকেই ভালো লাগেনি। লুসিয়ানাকে একরকম জোর করেই গাড়িতে তুললুম। গাড়িতে জল গড়াচ্ছে। য়ুনিভার্সিটি ক্যামপাসে গিয়ে ওর ব্যবস্থা হবে। যদি খুব বেশি দূরে থাকে তো ক্যাথিকে বলব, ও ব্যবস্থা করবে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোথায় থাকো!’
—‘বলব না।’
—‘সে কি?’
—‘বুঝতে পারছো না আমি পালাচ্ছি?’
—‘কোথা থেকে?’
—‘ফ্রম দেম?’ —‘কারা? কাদের কাছ থেকে’—এ নিশ্চয়ই কোনও বিপজ্জনক র্যাকেটের খপ্পরে পড়েছে।
—‘ফ্রম মাই পেরেণ্টস।’ মেয়েটা জবাব দিল।
—‘সে কি? কেন?’
—‘দে হ্যাভ আ ন্যাস্টি ডিজীজ।’
—‘কী হয়েছে?’
মেয়েটাকে জেরা করে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। কিছুদিন ধরেই চতুর্দিকে একটা নতুন রোগের নাম শুনতে পাচ্ছি। গে রিলেটেড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি। এটা নিয়ে আমাদের য়ুনিভার্সিটিতে কিছু কিছু ডাক্তার লেকচার দিয়ে গেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, টেক্সাস সর্বত্র নাকি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ।
সমকামীদেরই হয় বলে শুনেছিলুম প্রথমে। তারপরে শোনা গেল যৌন সংক্রমণ তো হয়ই। তাছাড়াও ব্লাড ট্রানসফিউশন, ইনট্রাভেনাস ইনজেকশন এ সব থেকেও হতে পারে।
বললুম, ‘মা বাবার দুরারোগ্য অসুখ করেছে, তুমি পালাবে? কীরকম মেয়ে তুমি?’
‘পালাবো না?’ মেয়েটা ফোঁস করে উঠল ‘যখন ইণ্ডিয়ান ইয়োগীটার কাছে দুজনে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিল আমার কথা কেউ ভেবেছিল?’
‘কী বলতে চাইছো?’
‘ইণ্ডিয়ান ইয়োগীটার ফলোয়ার্সরা সবাই মিলে একট অন্ধকার ঘরে বসে কী করত। বিকট বিকট জানোয়ারের মতো আওয়াজ আসত ঘরটা থেকে। আমি বাইরে থেকে শুনেছি। সেখান থেকেই নিয়ে এসেছে রোগটা।
‘কী করে জানলে সেখান থেকে?’
‘নিজেরাই তো ঝগড়া করতে করতে বলল সে কথা। মাম বলল ড্যাডকে, ড্যাড বলল মামকে। ড্যাড বলল, “আমি তোমাকে অনেকবার বারণ করেছিলাম এসব জায়গায় যেতে।” মাম বলল, “তুমি তো আমাকে ছাড়াই পরে যেতে শুরু করলে। কেন সে আমি জানি।” বলতে বলতে মাম কেঁদে ফেলল। এই পর্যন্ত শুনতে শুনতেই আমি প্যাক আপ করে ফেলেছি। ওদের বললাম, “উলরির বাড়ি থেকে কদিন ঘুরে আসছি।” তারপর ছুটতে ছুটতে বাস, তারপর এই সী-বীচ। নাউ, তুমি আমায় বলো পৃথিবীটা গোল্লায় যাচ্ছে কি না।”
আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম মা বাবাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া ওর উচিত হচ্ছে না। ও রোগ ওভাবে সংক্রামিত হয় না। কে কার কথা শোনে। ‘আই ডোণ্ট ওয়াণ্ট টু লিভ উইথ গ্রিড।’ ডাক্তার নাকি নিজে বলেছেন, এ রোগের চিকিৎসা নেই। তিলে তিলে মারা যাবে রোগী। শরীর ফুলে, মুখে চামড়ায় দুর্গন্ধ ঘা হয়ে।
মাঝ রাস্তায় খুব সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নামটা কি বলো তো?’
‘সেটা তো তুমি জেনেই গেছো।’
‘টাইটল কি তোমার?’
শুনে বলল, ‘ইণ্ডিয়ান। তুমি ইণ্ডিয়ান!’ ভয়ে দেখি ঠকঠক করে কাঁপছে—‘এদিকে আমি ভাবছি তুমি মেক্সিকান? হায় হায়! তুমি তো দেখছি নির্ঘাত সেই ইয়োগীটার চ্যালা! হ্যাঁ, এই তো স্যাফ্রন কালার্ড সার্ট পরেছো!’ বলতে বলতে আমার একটু অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হঠাৎ দরজা খুলে বিপজ্জনকভাবে দৌড় দিল মেয়েটা। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।
কী চায় এরা? এদের দেখে দেখে মনে হয় মানুষের আর কিচ্ছু হবে না। ইভলিউশন শেষ হয়ে গেছে। জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি বিজ্ঞান আর সম্পদ প্রতিদিন এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সোজা পথে উপভোগটা বড় সহজপ্রাপ্য হয়ে গেছে। তাই বক্ৰগতিতে চলেছে সব। ফলে তৈরি হচ্ছে অশান্ত কুপার, অবুঝ লুসিয়ানা, লুসিয়ানার হতভাগ্য মা বাবা। শেষ পর্যন্ত দেহের জ্বালায় জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মনের জ্বালায় উদ্দেশ্যহীন নেমে যাচ্ছে পথের ধারে। হিপি, পাঙ্ক! দা ম্যালাডি অফ সারফিট! আর আমার দেশ! শুধু দুটি খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতেই অর্ধেক মানুষের জীবন কাবার। বোধহয় সেই ভালো। সম্পদের শেষ চেহারাটা দেখা হয়ে গেলে বোধহয় আর কিছু থাকে না অধঃপাত ছাড়া। অন্তত সাধারণ মানুষের জন্যে না। প্রগতি। প্রগতি মানে তো শুধুই দৈহিক-বিলাসের বন্দোবস্ত। সম্পদ বৃদ্ধি। সম্পদ-বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু নয়।
৫
স্কুল থেকে ফিরে আরাত্রিকা দেখল দাদা এসে গেছে। যোধপুরী পাজামা আর খাদি সিল্কের পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে। মায়ের মুখেও তাই একটু অন্যরকম হাসি। দাদার আসাটা আজকাল বেশ বিরল ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। ছুটি পড়লেই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কোথায় কোথায় ঘুরতে চলে যায়। আর নয় তো দেশ। এই নিয়ে কমলিকার খুব চিন্তা। এখানে সবাই ছেলেমেয়েদের যতদিন পারে বাড়িতে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। কাছছাড়া হয়ে গেলেই হাতছাড়া। কাছাকাছি তো কত য়ুনিভার্সিটি ছিল, কর্নেল, কলম্বিয়া, প্রিন্সটন, নিউ ইয়র্ক স্টেট য়ুনিভার্সিটি। ও জোর করে রয়ে গেল ক্যালিফোর্নিয়ায়। কমলিকা বেশি ভাবনা করলে সুদীপ বলেন, ‘তুমি বাবুর জন্য অনর্থক চিন্তাটা ছাড়ো। ও যথেষ্ট ম্যাচিওর।’
‘এই যে দিনের পর দিন বাড়ি আসে না, কোথায় কোথায় কার না কার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, এ নিয়ে তোমার নিজের চিন্তা হয় না?’
‘না। চিন্তাটা আমার বাবুকে নিয়ে আদৌ নয়।’ অর্থাৎ ওঁর চিন্তা মেয়েকে নিয়ে। সেটা সব সময়ে ভেঙে না বললেও বুঝতে পারেন কমলিকা।
দীপালি এসেছেন অনেকক্ষণ। দীপালি, বাবু আর কমলিকা মিলে অ্যাপার্টমেণ্টটার চেহারা পাল্টে ফেলেছেন। লিভিংরুম আর বাবুর ঘরের মধ্যেকার পার্টিশনটা গুটোনো। একটা চিকমিকে পর্দা সেখানে। ঘরভর্তি গোলাপ, টুকটুকে লাল সব। নতুন ব্যাপার হল, কাঠের একটা চৌকো বোর্ডে আলপনা দিয়েছেন কমলিকা। পিলসুজ-প্রদীপ, শঙ্খ এসেছে। দুর্গাপুজোর জিনিস এগুলো। দীপালির কাছে থাকে।
আরাত্রিকা চিত্রিত পিঁড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘এটা কী হবে দীপালিমাসি? পুজোটুজো আছে নাকি? শাঁখ, প্রদীপ কেন?’
দীপালি বললেন, ‘চালাকি নয়! কেক কেটে কেটে আর মোমবাতি জ্বেলে জ্বেলে ফোরেন বার্থ ডে আর চলবে না। এবার থেকে কষ্ট করতে হবে। সব্বাইকে হাঁটু মুড়ে খেয়ে তারপর বজ্রাসনে বসতে হবে। না হলে আর্থরাইটিস হয়ে মরবে বুড়ো বয়সে, তোমাদের জ্যোতিকাকু বলেছে।’
‘তো আলপনা দেওয়া পীসটা কি করবে?’
দীপালি বললেন, ‘তোর আজকে বিয়ের অ্যাপ্রেনটিসশিপ। বুঝতে পারছিস না? খাঁটি বৈদিক বিয়ে। আলপনা দেওয়া পিঁড়িতে বসবি, প্রদীপ জ্বলবে, শাঁখ বাজবে, তবে খেতে পাবি। “ভোজন আমার আহুতি প্রদান” এই স্পিরিটে খাবি, তোর বাবার হুকুম।’
কমলিকা বললেন, ‘অ্যান বেচারা কি করবে আমি শুধু তাই ভাবছি। ওইভাবে বসে খেতে বাধ্য করাটা ওর ওপর রীতিমত অত্যাচার বলে মনে হচ্ছে আমার।’
দীপালি বললেন, ‘ভেবো না। ক্যালিফর্নিয়ায় ও পাক্কা দেড়বছর সেতার শিখেছিল। পেরে যাবে।’
আজ আরাত্রিকার জন্য বাবা-মার উপহার পাটোলা শাড়ি।
দীপালি বললেন, ‘ওইটুকু মেয়েকে শাড়ি পরাচ্ছো, জড়িয়ে না পরে।’ কাঁথা-স্টিচ দিয়ে খুব সুন্দর একটা স্কার্ট করে এনেছেন তিনি আরাত্রিকার জন্য। খুব জমকালো। ইচ্ছে, সেটাই পরে।
কমলিকা বললেন, ‘উঁহু ওর বাবার মেয়েকে শাড়ি পরানোর শখ আজ। ভালোই হল। পাটোলা আমার ছিল না একটাও। ওর নাম করে হয়ে গেল।’
বয়স আন্দাজে আরাত্রিকা লম্বা খুব। দীপালি যখন ওকে শাড়ি পরিয়ে বার করলেন, দেখা গেল খুবই মানিয়েছে। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘য়ু শিওর লুক লাইক আ ফেয়ারি প্রিন্সেস মণি!’
বাবু বলল, ‘প্রিয়াঙ্কা ইজ পুলিং ইয়োর লেগস মণি। আসলে তোকে খানিকটা কাকতাড়ুয়া-কাকতাড়ুয়া লাগছে। শাড়িটা কাঁধ থেকে কিরকম হেলপ্লেসলি ঝুলছে দেখ্। মুখটা তোর ভালো, কিন্তু টর্সোটা অবিকল স্কেয়ার-ক্রো।’
তানি বলল, ‘স্বদেশদা, তুই নিজে কি রে? চুলগুলো কতদিন কাটিসনি, দাড়ি রেখেছিস ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। একটু ট্রিম পর্যন্ত করিসনি। তুই-ই আসল স্কেয়ার-ক্রো।’
শশাঙ্ক জেঠু এসে পড়েছিলেন। বললেন, ‘উঁহু; মুশকিল আসান বইল্যা একটি খাঁটি আমাগো দ্যাশের চরিত্রের মতো দ্যাখায় উয়ারে। লাগব শুধু একখান কালো জুব্বা, আর একখান লম্ফ। কালিজুলিও কিছু মাখাইতে লাগব।’
আরাত্রিকা বলল, ‘সত্যি কিন্তু মা, এই ব্লাউসটা আমার ঠিক ফিট করেনি।’ সেলাই-ফোঁড়াই যা কিছু কমলিকা বাড়িতেই করেন। মেয়েও করে। নিজের বেশ কয়েকটা ড্রেস তৈরি করেছে ও। কিন্তু ব্লাউসের জন্য ঠিকমতো সাহায্য পাওয়া যায় না। একটু আলগা, স্কার্টের ব্লাউসের মতো ফিটিং হয়। কমলিকার নিজের একটা দেশ থেকে করিয়ে-আনা পেপার কাটিং আছে। তাইতে চলে যায়। কিন্তু আরাত্রিকার জন্য এখানকার ডিজাইনগুলোর ওপরই নির্ভর করতে হয়। কমলিকা তাকিয়ে দেখলেন কাঁধের ওপর ছোট্ট একটা করে টান পড়েছে। হাতার প্রান্তগুলো তিনকোণা হয়ে উঠে আছে। ইন্দিরা-গান্ধী ছাঁট। আসলে মণির কাঁধগুলো বেশ চওড়া, একটু চৌকো মতো। কাঁধে যেখানে পিন করেছে সেখান থেকে পেছনের আঁচল সামনে এসে ঝুলছে। তার ওপর মাথার খাটো সোজা চুল তুলে দীপালি কিরকম জাপানি-জাপানি হেয়ারস্টাইল করে দিয়েছে। ‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।’ কমলিকার চোখে মেয়েকে কোনও রোম্যান দেবীর মতো লাগছে। তাঁর নিজের ছাড়া আর কারো চোখে এই ভাস্কর্য ধরা পড়ছে না দেখে তাঁর একটু আশ্চর্যই লাগল। তানি পরেছে গলায় বুকে শলমার কাজ করা লম্বা লাল চুড়িদার। তানি দীপালির মতো জ্বলজ্বলে সুন্দরী নয়। জ্যোতির মতো ময়লা, ছোটখাটো মিষ্টি চেহারা। হঠাৎ দেখলে ওকে আরাত্রিকার চেয়ে ছোট মনে হয়। মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করলে তবে বয়সের পার্থক্য ধরা যায়। আরাত্রিকার মুখে একটা অকপট সারল্য, তানি বুঝি বুদ্ধি আর মিষ্টতা দিয়ে অনেক কিছু ঢেকে রেখেছে। ওকে দেখলে কেন কে জানে ছুটকির কথা মনে পড়ে তাঁর। প্রিয়াঙ্কা গুপ্ত ওর মায়ের মতো লম্বা। সুইডিশদের মতো চেহারা। বরফের মতো সাদা। পাতলা সোনালি ঠোঁট। চিবুকের কাছটা লম্বাটে। ঠোঁটটা সরলরেখার মতো। খড়ের রং ওর চুলে। অ্যানের চুল আরও গাঢ় সোনালি। সব মিলিয়ে প্রিয়াঙ্কাকে খুব বিবর্ণ লাগে। আজকে সবাই শাড়ি পরে এসেছে। অ্যান বললেন সুদীপ নাকি ফোনে রিকোয়েস্ট করেছেন, পুরোপুরি ইন্ডিয়ান স্টাইলে অনুষ্ঠান হবে, ইন্ডিয়ান ড্রেস পরে আসতে হবে।
এইগুলো কমলিকার বাড়াবাড়ি মনে হয়। তাঁকে বলেছেন, তিনি পিঁড়ি আলপনা প্রদীপ শঙ্খ এসবের ব্যবস্থা করেছেন। মেঝেতে কাঠের প্ল্যাংক পেতে খাওয়া হবে, পাগলামি যদিও, তা-ও নাহয় হল। পোলাও, পায়েস, চিংড়ির মালাইকারি, সুক্তো সব কিছু যেমন দেশে হয় তারই বন্দোবস্ত হয়েছে। ঠিক আছে, কিন্তু অতিথিদের ওপর এমন নিয়ম জারি করা কেন? অ্যান প্রিয়াঙ্কা দুজনেই একেবারে তুষারধবল। শাড়ি পরলেই কেমন শ্বেতি-শ্বেতি লাগে। যে যার পছন্দমতো পোশাক পরুক না কেন, ও যে কেন এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত অনুরোধ করে! দুর্গাপুজোর সময়েও ও সব্বাইকে গরদ পরিয়ে ছেড়েছিল। তাতে অবশ্য এদেশী ওদেশী সব মেয়েরই রূপ খুলে গিয়েছিল। খালি দীপালি খড়খড়ে গরদের মধ্য থেকে হাঁসফাঁস করেছিল। বেচারি! সুদীপের এই নিজস্ব সংস্কৃতি নিজস্ব সংস্কৃতি বাতিক একেক সময় অস্বাভাবিক মনে হয় কমলিকার। সংস্কৃতি কি কোনও স্থাবর, বদ্ধ জিনিস! বাঁচতে বাঁচতে যেসব নান্দনিক অভ্যাস আপনা থেকে গড়ে ওঠে, তাই-ই তো সংস্কৃতি! সুদীপের মনোভাব ঠিক হলে আদিবাসী কালচারকেই টিকিয়ে রাখা উচিত সর্বত্র। কোনরকম পরিবর্তন পরিবর্ধন না করে! পরো এখন সাঁওতাল রমণীদের মতো হাঁটুর ওপর কাপড়, টপলেস, বাঁকানো খোঁপায় গুঞ্জা ফুলের মালা, সন্ধে হলেই মাদলে চাঁটি, মেয়েপুরুষ সবাই মত্ত হয়ে নাচো!
অতিথিরা সবাই এসে গেছেন। অল্পই লোক আজ সুদীপের নির্দেশমতো। বাবু বলল, ‘মণি, তোর সেই বিশাল পিয়ার-গ্রুপটা ট্রমবোন বাজাতে-বাজাতে আসবে না?’ আরাত্রিকা রাগ-রাগ মুখে বলল, ‘তুই-ই বেশি মিস্ করছিস মনে হচ্ছে?’
শশাঙ্ক জেঠু বললেন, ‘তাইলে কথার পিঠে কথা, তার পিঠে কথা, তার পিঠে আরও কথা এইভাবেই কি চলব? না যে নূতন ম্যাজিকগুলান শো দেওনের কথা চিন্তা করছিলাম, সেগুলান দ্যাখবা?’
আরাত্রিকা বলল, ‘অ্যাটম-বুলেটকে ডাকি তাহলে?’
দীপালি বললেন, ‘থাক মণি, জানিসই তো ওরা কোন না কোনরকম অ্যাক্রোব্যাটিক্স্ ছাড়া থাকতে পারে না। শশাঙ্কদার ম্যাজিকের থলির বারোটা বাজিয়ে দেবে।’
নিজের ঘরে উঁকি দিয়ে আরাত্রিকা দেখল অ্যাটম এবং বুলেট পরস্পরের দিকে খুব রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে অবিরাম ডিগবাজি খেয়ে যাচ্ছে। রাগী-রাগী চোখ মানেই যে সত্যি-সত্যি লড়াই করবে তা কিন্তু নয়। আসলে খুব প্রতিযোগিতার মেজাজে আছে। কিসব রেকর্ড ভাঙাটাঙার কথা বলছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে।
শশাঙ্ক জেঠু বললেন, ‘ম্যাজিকের এট্টা কি বলে স্যাঙ্কটিটি আছে মণি, বালখিল্য দুইটার সে-সব গ্রাইহ্য নাই। আমি উয়াদের ম্যাজিক দেখাইতে উৎসাহ পাই না।’
বললে কি হবে, যে মুহূর্তে শশাঙ্কজেঠু তাঁর নানারঙের তালিমারা ম্যাজিশিয়ানের জোব্বা আর উল্টোনো তালপাতার বাঁশির মতো ট্যাম-ও-শ্যান্টার টুপি পরে ঝুলি থেকে তাস বার করেছেন। দুজনেই দেখা গেল ডিগবাজি ভুলে, কুইক মার্চ করে এসে ঘরের এক কোণে বসে গেছে আসনপিঁড়ি হয়ে। গালে হাত রেখে খুব তীক্ষ্ন চোখে নিরীক্ষণ করতে করতে বুলেট বলল, ‘কি রকম চীট করছে দেখেছিস এ যাদুকরটা! হার্টস-এর ওই তিরিটার মাঝখানের ফোঁটাটা লুস তো, টুক করে সরিয়ে ফেলবে, দেখবি দুরি হয়ে যাবে।’ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলবার চেষ্টা করলেও বুলেটের গলায় ষাঁড়ের জোর, বেশ ভালো করেই শোনা গেল ওর কথা।
শশাঙ্ক জেঠু কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ম্যাজিকের স্যাঙ্কটিটি নষ্ট হইয়া যায় দীপালি, তর বীজকলাইগুলান সামলা।’
দীপালি বললেন, ‘পাগলে কি না বলে শশাঙ্কদা। আমরা ওসব অপবিত্র কথা কানে তুলছি না। আপনি চালিয়ে যান।’
‘তাইলে আমি এবার ছুট্ট হইয়া যাওনের সেই খেলাটা দেখাই!’
‘সেটা আবার কী খেলা জেঠু?’ বাবু জিজ্ঞেস করল।
‘কি ব্যাপার সেইটা ঘটলেই দ্যাখা যাইব। অত ব্যস্ত কি? ওষুধ খাইয়া অ্যালিসের তালগাছের মত হওন, আবার ছুট্ট কুট্টিটি হওনের কথা তো আর ক্যারলসাহেবের বানানো না! ওসব ঘটে। তবে তোমারে এট্টু সাহাইয্য কইরতে লাগব। বাতিগুলান নিভাও। বাঁশি বাইজলেই জ্বালবা। আর তফাৎ থাকবা সব।’
ঘরের আলো নিভে গেল। ঘোর অন্ধকারে লম্বা ঘরের শেষ প্রান্তে সোফার পেছন থেকে রহস্যময় নানারকম আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা ভুতুড়ে শিস। বাবু শশাঙ্কজেঠুর নির্দেশমতো এদিকের একটা আলো জ্বেলে দিল। দেখা গেল সোফার মাথায় এক অদ্ভুত প্রাণী দাঁড়িয়ে। ছোট্ট কোট, ছোট্ট প্যান্ট, আর লম্বা লম্বা জুতো পরা ছোট্ট শশাঙ্ক জেঠু, চোখে প্যাঁশনে। ‘আবোল তাবোল’-এর কোনও খিচুড়ি প্রাণীর মতোই দেখাচ্ছে অবিকল।
তানি বলল, ‘ইস, কি প্যাথেটিক দেখাচ্ছে, না?’
জ্যোতি বললেন, ‘আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে ভাই। শশাঙ্কদাটা ওষুধ খেয়ে এরকম ‘ছোট্ট কুট্টিটি’ হয়ে গেল, আর কি আগের মতন হবে? আর কি ‘আমাগো তগো’ করবে?’
দীপঙ্কর আর জ্যোতি দুজনে মিলে শোকপ্রকাশ করতে লাগলেন। কখন যে অ্যাটম গুটিগুটি ওদিকে চলে গেছে কেউ লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ চিৎকার করে বলল, ‘ওমা! শশাঙ্কজেঠু হাতে জুতো আর প্যান্ট পরেছে। ছোট্ট হয়েছে না আরও কিছু। এই তো লম্বা লম্বা পা দুটোকে সোফার পেছনে গুটিয়ে রাখা হয়েছে। হাতকে পা বানানো হয়েছে! হুঃ!’
সোফার পেছন থেকে অসহায় যাদুকরকে টানাটানি করতে করতে দু ভাই বলতে লাগল, ‘তুমি একটা ফার্স্টক্লাস চিট। চোট্টামিতে গোল্ড মেডল পাবে। এসব চলবে না। চলবে না।’
ঘরভর্তি হাসি মধ্যে শশাঙ্ক সরকার ঘোষণা করলেন অদ্যই শেষ রজনী। এই বিচ্ছুদুটি থাকলে তিনি আজই তাঁর যাদুকর জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করছেন।
অ্যাটম বলল, ‘বেশ তো হুডিনির মতো আসল ম্যাজিক দেখাও না। তোমাকে আমরা একটা বাক্সে পুরে ঝপাং করে হাডসনের জলে ফেলে দেবো। তুমি গুনে গুনে সাড়ে সাতচল্লিশ মিনিট পরে উঠে আসবে।’
বুলেট বলল, ‘ওই আয়রন চেস্টের চাবিটা আমার কাছে থাকবে কিন্তু।’
শশাঙ্কজেঠু কাতর চোখে দীপালির দিকে চেয়ে বললেন, “আবোল তাবোল” পড়ছস?’
‘পড়েছি বোধহয়!’
‘“বাপ রে কি ডানপিটে ছেলে” মনে পড়ে? “কোনদিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে?” মহাপুরুষ আওনের বহু পূর্বেই বার্তা রটে দীপালি। কত বস্ছর পূর্বেই সুকুমার রায় মহাশয় তর মহাপুরুষ ছাওয়াল দুইটার আওনের কথা ঘোষণা করছেন, সাবধানে থাকস ভাই।’
কমলিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে বললেন, ‘আটটা বাজলো জ্যোতিদা একবার ইনস্টিট্যুটে ফোন করবে নাকি? আমাকে কিন্তু এবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
জ্যোতি বললেন, ‘তা করছি। কিন্তু খাওয়ার আগে একটু গান টান হবে না? প্রিয়াঙ্কা আরম্ভ করুক···’
নীচে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। বাবু এক দৌড়ে নেমে গেল। একটু পরেই কমলিকা অবাক হয়ে দেখলেন দু হাতে দুটো চামড়ার সেকেলে সুটকেস নিয়ে বাবু ঢুকছে। তারপরে ধবধবে ফর্সা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পেছনে আরেকটা সুটকেস হাতে সুদীপ।
হেসে কেঁদে কমলিকা বললেন, ‘মা! বাবা! তোমরা আসছ আমি কিছু জানতে পারিনি তো!’
সোমনাথবাবু বললেন, ‘সুদীপের তোকে সারপ্রাইজ দেবার শখ খুকি, চিঠিপত্র সব খালি ওর অফিসের ঠিকানায় দিতে বলে। আমিও বুড়ো বয়সে জামাইয়ের কথায় একটু লুকোচুরি খেলে নিলুম মেয়ের সঙ্গে। ও কি! কাঁদছিস কেন!’
কমলিকা ততক্ষণে বসে পড়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছেন। এ কান্না আনন্দের না অভিমানের তিনি জানেন না। সুদীপ হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘এবারের জন্মদিনে এই-ই তোমার আসল উপহার মণি।’ কমলিকার দিকে আড়চোখে চেয়ে বললেন, ‘এখন যে যতখুশি কাঁদতে পারে, কি বলো দীপালি! তবে আমার আর জ্যোতির ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ হলেই কিন্তু আমরা হাসতে থাকি।’ বলে সত্যি-সত্যি অট্টহাস্য করে উঠলেন সুদীপ। অর্কেস্ট্রার কনডাক্টরের মতো হাত ছুঁড়তে লাগলেন, ফলে সরু মোটা নানান গলায় হাসির শব্দ উঠল।
অ্যানও হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রিয়াঙ্কার ডরকার ঠাকছে না। মণি, এইটা টোমার প্রপার বার্থ ডে কনসার্ট হোছে।’
সম্মিলিত হাসির ঐকতানের মধ্য থেকে কমলিকার চোখে মুখেও হাসি, বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে দেখা গেল। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ প্রার্থনা করলেন, উত্তমর্ণ রক্ত এবার স্বাভাবিক নিয়মে তার নিজের পাওনা আদায় করে নিক। শ্বশুর-শাশুড়িকে ব্রুকলিনের পার্থিব সমৃদ্ধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার মাঝ মধ্যিখানে একটা জীবন্ত স্মারকলিপির মতো পেশ করা গেছে। যুক্তি দিয়ে যেখানে কিছু হয় না, বুদ্ধি দিয়ে যেখানে বোঝানো যায় না, রক্ত সেখানে নিজের নিয়মে ফুসফুসীয় ধমনীর দিকে বয়ে যায়। বিশুদ্ধায়নের পর হৃৎ-কেন্দ্রে এখন সেই রক্তের সঞ্চয় বাড়ছে। বাড়ুক। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন সেই শুভক্ষণটির জন্য যখন কমলিকার অন্তর হাহাকার করে বলে উঠবে, ‘আমাকে আমার নিজের সাগরে নিয়ে চলো।’
লিভিংরুমের কার্পেটের ওপর স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে ওরা। আদৌ শুতে যাবার ইচ্ছে ছিল না। দীপালিরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে পারেননি। প্রিয়াঙ্কা গেছে খুব অনিচ্ছুক মুখে। মণির দাদু-দিদিমা এসেছেন অতএব ওদেরও ভাগ চাই। আদর-টাদরের সম্ভাবনা দেখলেই সব কটা ছেলেমেয়ে বুভুক্ষুর মতো পাতা পেতে সেখানে উপস্থিত। সবাইকার জন্য উপহার এসেছে। জ্যোতির ছেলেমেয়েদের ভালোই চেনেন সোমনাথ-যূথিকা। ছবিতে-চিঠিতে দীপঙ্করের মেয়েও চেনা। জয়পুরী মিনের গয়না, র’ সিল্কের পীস, টাঙাইল শাড়ি। অনেকক্ষণ কাড়াকাড়ি হল সেগুলো নিয়ে। আরাত্রিকা দিদিমাকে ওদের হিউসটনের কালচার্যাল প্রোগ্রামের টেপ শোনাবেই।
কমলিকা বললেন, ‘ওসব শুনিয়ে কী হবে? ভালো ভালো ভজন আছে শুভলক্ষ্মীর, শুনবে মা?’
সোমনাথ বললেন, ‘ওসব তো শুনছিই। ওই নিয়েই তো আছি রে। আজ এখন তোদের শুনি।’
সুদীপ বললেন, ‘যা বলেছেন। এরা সব চব্বিশ ঘন্টা কোন না কোন নয়েজ ছাড়া থাকতে পারে না।’
সোমনাথ বললেন, ‘এটা খুব সম্ভব যুগেরই হাওয়া। আমাদের ওপর তলায় অবিনাশবাবুর নাতি-নাতনিরাও দেখি স্টিরিও চালিয়ে দিয়ে অঙ্ক কষছে। কখনও শুনেছো?’
‘আমরা সব পড়াশোনা করতুম পিন-ড্রপ সাইলেন্সে, বলুন বাবা?’ ছোটদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন সুদীপ।
অ্যাটম বলল, ‘মিউজিক হ্যাজ আ সুদিং এফেক্ট অন নার্ভস!’
সুদীপ বললেন, ‘আহা, কি মিউজিক রে! ঝমাঝ্ঝম্ জ্যাং ঝুং ঝাং, ঝুং ঝাং জ্যাম্। আসল কথা, তোদের নার্ভস্ নেই, ও সিস্টেমটাই তোদের বাদ। আমরা ছোটবেলায় কি সব শুনতুম আহা! সায়গল! আঙুরবালা! কি বলুন বাবা!’
সোমনাথবাবু সুদীপের মিটিমিটি হাসি দেখতে পাচ্ছিলেন না। স্মৃতিবিধুর গলায় বললেন, ‘রাধিকা গোস্বামীর গান তো আর শোননি সুদীপ! কি নাদ! কি গমক গলায়! সাবলাইম!’
অ্যাটম বুলেট তক্ষুণি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিল। ‘ঠিক আছে। জ্যাজ দাদুর ভালো না লাগতে পারে। কিন্তু ব্যারি মেনলো কি বারবারা স্ট্রাইসেন্ড শুনলে দাদু ফ্ল্যাট হয়ে যাবেন। যেতেই হবে।’
কমলিকা মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন, ‘এই ক’ বছরেই তোমার চেহারা এতো খারাপ হয়ে গেল কী করে মা? কী হয়েছে তোমার?’
‘বয়স হয়েছে কুমু, বয়স। আবার কী হবে? চেহারা কিছুই খারাপ হয়নি। আটষট্টি বছর বয়স হল। চামড়া কুঁচকোবে না? মোটা ছিলুম তো গুচ্ছের! ঢিলে হয়ে গেছে সব!’
‘পঁচাত্তরে যখন গেছি তখন তো এমন ছিলে না!’
‘মাঝখান দিয়ে ছ’ ছটা বছর কেটে গেছে। বুড়ো বয়সে ছ বছর কি কম?’
‘দাদার কী খবর?’
‘লালটু সাকেতে ফ্ল্যাট করেছে। ভালোই করেছে। কুড়িটা বচ্ছর তো কাজেকর্মে ওখানেই কেটে গেল।’
‘তা তোমরা তো দাদার কাছে চলে গেলেই পারো, মা! বুড়ো হয়েছ, একা-একা থাকার দরকার কি?’
যূথিকা চুপ করে রইলেন। সোমনাথবাবু বললেন, ‘বুড়ো বয়সে নিজের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার বড় অসুবিধে খুকি। তাছাড়া অবিনাশবাবুর ছেলেগুলি খুব ভালো হয়েছে। খুব দেখাশোনা করে।’
ঘূথিকা বললেন, ‘এই যে চলে এলুম চাবি ওদের কাছে। ঘরদোর খুলিয়ে রোজ ঝাড়পোঁছ করাবে, যখন ফিরে যাবো, সব টিপ-টপ পাবো। বউগুলিও যেমনি কাজের, তেমনি ভালো। বাড়িঅলা বলে মনেই হয় না। না রে, আমরা ভালোই আছি।’
কমলিকা নিঃশ্বাস ফেলে চুপিচুপি বললেন, ‘আমাদের জন্যে তোমার মন কেমন করে না মা? না, অভ্যেস হয়ে গেছে?’
যূথিকা বললেন, ‘এসব কি কখনও অভ্যেস হয় কুমু? আপন কেউ কাছে থাকে না। আমাদের বুড়ো-বুড়ির দিন কিভাবে কাটে আমরাই জানি। উনি আমায় সেঁক-তাপ দিচ্ছেন, আমি ওঁর বাতের তেল মালিশ করে দিচ্ছি। এই তো অবস্থা! তবে কি জানিস! তোরা সব যে যার জায়গায় সুখে আছিস, ভালো আছিস, এর চেয়ে সুখ আর আমাদের কিছুতে নেই!’
‘বারে’ আস্তে আস্তে বললেন কমলিকা, ‘আমরা সুখে থাকলেই তোমাদের সুখ! তোমাদের কোনও নিজেদের আলাদা আনন্দ আলাদা সুখ থাকবে না?’
সোমনাথবাবু বললেন, ‘না খুকি, ছেলেমেয়েরা নাতি নাতনিরা কাছে থাকলে তাদের জীবনে একটা আলাদা জীবন পাওয়া যায়। নইলে বৃদ্ধ বয়সের পৃথিবী বড় বিবর্ণ। জঞ্জাল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না মা। মৃত্যু ছাড়া কোনও প্রার্থনাও জাগে না আর। তবে, বুড়োবুড়ির মধ্যে যে আগে যাবে সুখে যাবে। কে পড়ে থাকবে সেই ভাবনা। তোদের শেষ দেখা দেখবার জন্যই তো আসা!’
মা বাবা ঘুমিয়ে পড়বার পরও অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না কমলিকার। দিনগুলো কিভাবে কেটে যায়! এই তো সেদিন মা না বলে বাথরুমে গেছেন বলে ছোট্ট কুমু পরিত্রাহি চিৎকার করছে। না বলে কয়ে বাথরুমে যাবারও উপায় ছিল না মায়ের। মেয়ের হাতে কি বন্দীদশা! চিন্তা করা যায় এখন? পেপার পড়তে পিট্সবার্গ গেলেন, ভেবেছিলেন মণিকে দীপঙ্করের বাড়ি রেখে যাবেন। চার বছরের মণি অনায়াসে ছোট্ট ছোট্ট হাতে তাঁকে টাটা করে দিল। পিটস্বার্গ হোটেল থেকে প্রথমেই বাড়িতে ফোন, সুদীপ বললেন, দুধের বোতল আর পুতুল নিয়ে সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে, খালি একবার জিজ্ঞেস করেছে, মা পড়া দিতে পারবে তো? মায়ের আঁচল মুখে পুরে ঘুমোবার বদভ্যাস ছিল কুমুর। রাতে ঘুম ভেঙে মাকে কাছে না পেলে সাংঘাতিক কাণ্ড হত! লোক না এলে মা যখন বাসন মাজতেন কুমুর বুকটা ফেটে যেত। আকুল হয়ে কাঁদতে থাকত, ‘ওসব থাকগে পড়ে, তুমি শীগগির চলে এসো।’
‘সে কি রে? বাসন না মাজলে তোরা খাবি কিসে?’
‘মেঝেতে খাবো।’
‘রাঁধতেও তো হবে। রাঁধবো কিসে?’
‘মেঝেতে রাঁধবে।’
বাড়িতে একটা স্থায়ী তামাশা হয়ে গিয়েছিল ‘মেঝেতে রাঁধা মেঝেতে খাওয়া।’ সেই কুমু আজ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার! সেই মা, সেই বাবা বৃদ্ধ, নির্বান্ধব। বাড়িঅলার ছেলে, ছেলের বউদের ভরসায় দিনযাপন করছেন। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে কমলিকার। কলেজ থেকে কাটা ফল খেয়ে এসে কলেরা হয়েছিল কমলিকার। মায়ের সে কী পরিশ্রম! উদ্বেগ! দাদার দুবার টাইফয়েড রিল্যাপ্স্ করল। বাঁচার আশা ছিল না। মা বাবার সেই অমানুষিক সেবা ছাড়া বাঁচা সম্ভব ছিল না। এতদিন এই কান্না কোথায় ছিল? নিজের ছেলে-মেয়ে-স্বামী বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে কমলিকা যখন কোনও রবিবার সন্ধ্যায় গান-হাসি হইহল্লা সহযোগে ইটালিয়ান লাজানিয়া খাচ্ছেন, লবস্টার ইন ব্ল্যাক বীন সস অনুপান আছে, মেয়েদের জন্যে জিন অ্যান্ড টনিক, ছেলেদের ভডকার সঙ্গে টোম্যাটো সস মিশিয়ে ব্লাডি মেরি, মাইনরদের কোক তখন ধোঁয়াশায় ভরা ভবানীপুরের গলির একতলায় মুখোমুখি বসে নিঃসঙ্গ মা বাবা। নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কমলিকা উঠে বাথরুমে গেলেন। ফিরে দেখেন সুদীপ বসে আছেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি ঘুমোও নি?’
সুদীপ বললেন, ‘তুমিও তো দেখছি জেগে আছো।’
কমলিকার মাথা সুদীপের বুকের ওপর। মাথার চুলে ঠোঁট রাখলেন সুদীপ, বললেন, ‘তুমি যে আমাকে থ্যাঙ্কস দিলে না?’
‘দিয়েছি ঠিকই। মুখে না বললে দেখছি আজকাল তুমি ধরতে পারো না।’
‘ঠিকই। আমি আজকাল ব্লান্ট হয়ে যাচ্ছি, তার মানে ফুরিয়ে যাচ্ছি, কমলিকা।’
সুদীপের কানের কাছে পাকা চুলগুলো টানতে টানতে কমলিকা বলেন, ‘এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেলে চলবে কেন? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না। ভাবতেও ভালো লাগে না।’
সুদীপ খুব মৃদু ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘বয়স তোমার ভালা লাগালাগি বিচার করে আসবে না কমলিকা। এজ ইজ রিয়্যালিটি। আর কে যে কখন ফুরিয়ে যাবে আগে থেকে বলা যায় না। তবে সারাজীবনই খুব হেকটিক লাইফ কাটিয়েছি। এই র্যাট রেস আমার আর ভালো লাগছে না। অনেক দিন যৌবন ভোগ করেছি, আমি এবার প্রৌঢ়ই হতে চাই। গত পনের বছরে কটা পেপার পাবলিশ করেছি হিসেব আছে? পনের দুগুণে তিরিশটা প্লাস পাঁচটা। এর মধ্যে গোটা বারো করেছি আমার নিজের আনন্দে, নিজের তাগিদে। বাকি সব ওই র্যাট রেস আমার ঘাড় ধরে করিয়ে নিয়েছে। এভাবে শুধু কাজের জন্য কাজ আমি আর পারবো না। এ অবস্থাটার চেঞ্জ হওয়া আমার পক্ষে ভয়ানক জরুরি। আমার পক্ষে, তোমার পক্ষে, ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখ চেয়ে, শুধু মেয়ে বড় হচ্ছে বলে নয়। যদিও সেটাও একটা বড় কারণ।’
সুদীপের কোলে মুখ গুঁজে কমলিকা বললেন, ‘তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো। আমি কিছু বলব না।’
‘তা হয় না কমলিকা। আমি যা ভালো বুঝি তা আমি মোটেই করব না। তোমার যদি ভেতর থেকে সম্মতি না আসে, এখানেই থেকে যাবো। হিউসটনে কেস করেছি, চেয়ারম্যানশিপ পাবার জন্যে। এখানে এসে আবার আবিষ্কার করলুম একই পোস্টে অ্যামেরিকানদের মাইনে আমার দেড়া। আলেকজান্ডারকে আমি এখনও রাজি করাতে পারিনি। বললেই বলে—‘তুমি তো চাওনি’। আসলে দরাদরিটা আমার গোড়াতেই করে নেওয়া উচিত ছিল। ও সেটারই সুযোগ নিচ্ছে। হিউসটনের মামলার পরও আমার সরল বিশ্বাস থেকেই গেছে। দেখো আমরা এশিয়ানরা আন্দোলন করে ‘মাইনরিটি স্টেটাস’ পেয়ে গেছি। তবু এই বৈষম্যময় আচরণ ওদের রক্তে। বাইরে থেকে কিচ্ছু বুঝবে না। আমি ওহায়োতে চিঠিপত্র লেখালেখি করছি। তুমি যদি ফিরতে রাজি না থাকো তো ওখানেই চলে যাবো। ওখানে না পোষালে অন্য কোথাও, এইভাবেই চলবে। তুমি যা বলবে।’
—‘আমি সত্যি সত্যিই মন থেকে বলছি, চলো আমরা ফিরেই যাই।’
—‘না কমলিকা, তোমার সম্মতিতে আন্তরিকতা নেই। তুমি আমার কথা ভেবো না, ছেলের কথা না, মেয়ের কথাও না। মনে করো আর তিন চার বছরের মধ্যে মেয়ে কলেজ হোস্টেলে, বলা যায় না হয়ত কোনও ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করছে, বাবু চাকরি করছে অন্য কোনও স্টেটে, কিম্বা দেশে ফিরে গেছে। তুমি এইরকম একটা কৌটোর মতো অ্যাপার্টমেন্টে একা। আমি····আমি হয়ত নেই আর····।’
কমলিকা সুদীপের মুখ চেপে ধরলেন। প্রথমটা কিছুই বলতে পারলেন না। অনেকক্ষণ পর স্বর ফিরে পেয়ে বললেন –‘তুমি আমাকে এইভাবে ভয় দেখাবে তাই বলে? আমি আন্তরিকভাবেই সম্মতি দিয়েছি। আর সত্যিই তো, যখন আসি থেকে যাবার প্ল্যান তো আমাদের ছিল না। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই, আবার পরিবর্তনে ভয় লাগে।’
সুদীপ বললেন ‘তোমার ভয় লাগার কোনও কারণ নেই। দেখো। মণির নাইনথ গ্রেডটা হয়ে যাক। ততদিন মা-বাবা এখানেই থাকুন। আমারও অনেক ব্যবস্থা করার আছে।’
দূরের ঘণ্টা বাজছে সুদীপ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। চুলে-ভরা মাথাটা কোলের ওপর পড়ে রয়েছে পরম ভরসায়। ছোট্ট একটা নিশ্বাস পড়ল শুধু। তাও খুব সন্তর্পণে।
৬
ভারতবর্ষে নতুন স্কুল সেশন শুরু জানুয়ারিতে। আসতে আসতে সুদীপদের কিন্তু মার্চ হয়ে গেল। অন্তত শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যেও নিউ ইয়র্কের শীতটা এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এত বিলিব্যবস্থা করার ছিল যে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়ে উঠল না। ফলে, পুরো শীতটা ওঁরা অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী হয়ে কাটালেন। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এ একেবারে সরাসরি যাত্রার বন্দোবস্ত করতে হল। ওঁদের স্বাস্থ্যে কুলোচ্ছে না। ইউনাইটেড স্টেটস, মেক্সিকো, কানাডার কিছু কিছু ঘুরেই ওঁরা ক্লান্ত। সুদীপের ইচ্ছে ছিল ইউরোপের কিছু কিছু ঘুরে যাবেন, হল না। বাবু বলে প্রকৃত উত্তর আমেরিকা মহাদেশ ছড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল কৃষিজমি, খামার আর গ্রামাঞ্চলে। মরুভূমি, প্রেইরি, অরণ্য আর পর্বতে। এসব না দেখলে শুধু কয়েকটা স্কাই-স্ক্রেপার আর মিউজিয়াম দেখলেই উত্তর আমেরিকা দেখা হয় না। মনুষ্যসৃষ্ট বিস্ময়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ল্যান্ড আর প্রকৃতির বিস্ময়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নায়াগ্রা। তা এই দুই বিস্ময়বিন্দু সোমনাথ আর যূথিকা দেখে এসেছেন। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক আমেরিকা এমন কি ইয়োরোপ পরিদর্শন করবারও উৎসাহ তাঁদের নেই।
—‘চেষ্টা করলেও বিশাল এই পৃথিবীটার কতটুকু দেখতে পারবো বল তো?’
—‘যেটুকু দেখার সুযোগ পেলে সেটুকুও তো দেখলে না’, দাদাইয়ের কাছে অনুযোগ করেছিল মণি।
—‘আমার হল বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন ভাই!’
—‘মানে?’ দাদাই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে মণি বলল— ‘ওসব কুঁড়েদের একসকিউজ। তোমাদের সমস্ত শাস্ত্র ভর্তি শুধু কুঁড়ে আর অকর্মাদের জন্যে এক্সকিউজ লেখা আছে।’ যূথিকা কিছু বলেন না, খালি হাসেন।
—‘দেখো দিদিমা, দেখো, কত রুমাল উড়ছে।’ আরাত্রিকা বলল। এতক্ষণে নড়ে চড়ে বসলেন দিদিমা। সারাক্ষণই ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। যাবার সময়ে নাকি কোল্ড ড্রিঙ্কস্ ছাড়া কিছুই খাননি। প্লেনে উঠলেই দিদিমার গা-বমি করে, কেমন গন্ধ লাগে। এবারে তাই কমলিকা সন্দেশ, বিস্কিট এইসব শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন। আরাত্রিকা বলল— ‘দেখো দিদিমা, অ্যাবাউট দা মিড্ল্ যে রুমালগুলো উড়ছে ওইগুলো আমাদের।’ হাসিমুখে দিদিমা বললেন—‘কী করে বুঝলি?’
—‘গেস।’
ছবছর আগে যখন এসেছিল তখন দাদু, বড় জ্যাঠা, টুলটুলদি, বড় পিসি, রূপকদা, ন কাকা, ন কাকী, ছোট কাকা অনেকে এসেছিল। দুটো গাড়ি ভর্তি করে। মামা-মামীও ছিলো সেবার। লাউঞ্জে ওদের ঘিরে রীতিমতো জনতা। তখন শীতকাল। সে হলুদ রঙের স্ন্যাকস্, ডাফ্ল্ কোট আর হলুদ টুপি পরে প্লেন থেকে নেমেছিল। ন কাকিমা জড়িয়ে ধরে বলেছিল— ‘সেজদিভাই তোমার মেয়েটা তো দিব্যি গাবলুগুবলু হয়েছে!’
মা হেসে বলেছিল—‘ওরা শীতকালে মোটা হয় রীণা, কোট খুলে নিলেই পাঁজরা বেরিয়ে পড়বে।’
সত্যি তখন আরাত্রিকা ভীষণই রোগা ছিল। ন কাকিমার গায়ে কি সুন্দর গন্ধ একটা। ভারতবর্ষের গন্ধ। ন কাকিমাকে আর টুলটুলদিকে দেখতে পাবে বলে উত্তেজনায় ওর পেটের ভেতরটা কেমন করছে। আগেরবারে অবশ্য আনন্দে কোনও খাদ ছিল না। এবারে সামান্য, খুব একটু মন খারাপ। ব্যাথশেবা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদেছিল—‘আমরা একসঙ্গে ডিগ্রি নিতে যাবো না স্কুল গ্র্যাজুয়েশনের? হাউ জুয়েল অফ য়ু!’ স্টীভ বলেছিল—ওর স্কুল ডেজগুলো নাকি মাটি হয়ে গেল আরাত্রিকার জন্য।
জীবনে এই দ্বিতীয়বার উৎপাটিত হল আরাত্রিকা। হিউসটনে ওয়েস্টবেরি স্কুলে ছোট থেকে শিক্ষা-দীক্ষা। সবরকম স্কুল-অ্যাকটিভিটিতে যোগ না দিলেও খুব জনপ্রিয় ছিল ও ক্লাসে। নাইন্থ্ গ্রেডে চলে এলো নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল। মানিয়ে নিতে সময় গেছে। টীচাররা কেউ কেউ গোলমেলে ছিলেন। মিঃ স্যামুয়েল ছিলেন দারুণ উন্নাসিক। অঙ্ক দ্বিতীয়বার বুঝিয়ে দিতে বললে নাকে কি রকম একটা শব্দ করতেন। ওরা নাম দিয়েছিল ‘স্মর্টিং স্যাম।’ একদিন রেগে মেগে স্কুল কাউন্সেলর এমিলি ফার্গুসনের কাছে চলে গিয়েছিল ও। তারপর থেকে বরাবর মিসেস ফার্গুসন ওকে রক্ষা করে এসেছেন। অন্য টীচারের ক্লাসে পাঠিয়েছেন ওকে। একটু দেরি হলেও নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রালের বন্ধুত্বগুলো আরও পাকা। বিশেষত স্টীভ আর ব্যাথশেবার সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিনই নষ্ট হবে না। মিসেস ফার্গুসনের ঠিকানাও নিয়ে এসেছে ও।
নামতে নামতে আরাত্রিকা বুঝতে পারল সে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। সে একা নয়। মা-ও, বাবা-ও। দিদিমা আর দাদাই খালি ওসব অনুভূতি থেকে মুক্ত। চুপিচুপি সে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করল কেমন লাগছে এখন।
দিদিমা বললেন—‘হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম আর কি!’
—‘কেন দিদিমা ও দেশ তোমার ভালো লাগেনি?’
—‘ভালো লাগবে না কেন ভাই! তবে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে তোমাদের আঁচলে বেঁধে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে আরো ভালো লাগছে।’
কাস্টম্স্ চেকিং, কাগজপত্র দেখাদেখি, লাগেজ ক্লিয়ারেন্স, ছোটকাকা, ছোট কাকিমা, টুলটুলদি, ইস্স্ কি বড় হয়ে গেছে! পুঁচকে মতন ওটা কে রে? ছোটন? আগেরবারে ওনার পৃথিবীতেই আগমন হয়নি। আরাত্রিকা একছুটে গিয়ে টুলটুলের হাত ধরল। ‘হা-ই!’
সুদীপ বললেন, ‘বাবা কই?’
—‘বাবা আসতে চাইলেন না। টাইমটা অড তো! কতক্ষণে তোমরা ছাড়া পাবে, ফিরতে কত রাত হবে! ন বউদিও বারণ করল। চলো ও বাড়িতে, বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে দেখা করে, তারপর আমার ওখানে যাবে।’
সুদীপ বললেন—‘তোর ওখানে বলতে?’
সুকৃত বলল—‘বালিগঞ্জে ওনারশিপ ফ্ল্যাট কিনেছি। মাস দেড়েক হল শিফট করেছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দোব বলে আর বলিনি।’
সুদীপ বললেন—‘ভালো করেছিস। বউবাজারে তো আগে চল। তারপর কোথায় থাকবো না থাকবো দেখা যাবে।’
বউবাজারে দোতলায় কোণাকুনি ঘরটা সুদীপদের। দক্ষিণ খোলা। জানালার শার্শিগুলো লাল, নীল, সবুজ। কাচের মধ্যে দিয়ে রোদ ঘরে ঢুকলেই ঘরটা সমুদ্রের তলা। সুদীপের বিয়ের আগে ওটা মা বাবার ঘর ছিল। খুব ছোটবেলায় পালঙ্কের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে মা বাবার চিঠি পড়ছেন, জেল থেকে আসা চিঠি। লাল নীল সবুজ আলোয় ঘরটা ভাসছে, দুলছে। মা তার মধ্যে দুঃখিনী জলকন্যা।
আরাত্রিকা জিজ্ঞেস করলো ‘বাবা গরুর গাড়ি দেখছি না তো! আর রিক্সা!’ সুকৃত হেসে বললেন—‘ভি-আই পি রোডটা পার হতে দাও। তারপর শুধু গোরুর গাড়ি আর রিকশাই দেখবে মা! আমাদের এই গাড়িটাও গরুর গাড়িই হয়ে যাবে মন্ত্রবলে।
সুদীপ বললেন—‘কেন রে, জ্যাম নাকি?’
—হচ্ছে রোজই। দেখো তোমাদের লাক কি বলে!’
কমলিকা ছিলেন মা-বাবার সঙ্গে পেছনের ট্যাকসিতে। সুকৃত বলেছিলেন একেবারে ওঁদের ভবানীপুরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বউবাজারে যাবেন। সোমনাথবাবু ঘোর আপত্তি জানালেন। অতটা পথ উজিয়ে গিয়ে আবার ফিরতে হবে। বেয়াই-মশাই জেগে থাকবেন। কমলিকার একবার মনে হল বলেন মা-বাবা একা একা অতদূর যাবেন। তিনি না হয় আজ মণিকে নিয়ে ওঁদের সঙ্গেই চলে যান। ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে সোমনাথবাবু বললেন—‘না খুকি, সেটা ঠিক হবে না।’ মানিকতলার মোড়ে পৌঁছে পেছনের ট্যাকসি থেকে কমলিকা সামনে সুকৃতের গাড়িতে চলে এলেন। বেশ ঠাসাঠাসি হয়ে গেল। তিনি কল্পনায় দেখছিলেন বউবাজারের চকমিলোনো বাড়ির কোথাও একটা পাঁচিল উঠেছে। পঁচিলটা ঠিক কোথায় উঠতে পারে এই স্থাপত্য সমস্যাটা আপাতত তাঁকে খুব ভাবাচ্ছিল। তাঁর ঘরটা কি রীণা এখনও গুছিয়ে, তালা দিয়ে রাখে? সুদীপ জেদ ধরলে ওখানেই থেকে যেতে হবে। বাথরুম একতলায়। গাড়িটা দুতিনবার লাফিয়ে উঠল। মাথার তালুতে ঘা খেয়ে প্রথমটা আরাত্রিকা হেসে উঠেছিল, দ্বিতীয়বার ‘আউচ্’ বলে থেমে গেল। বেশ চোখ গোল গোল করে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে মেয়ে। পেভমেন্টে খালি ঝুড়ি মাথার কাছে নিয়ে চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছ মাথায় বিঁড়ে এক মজুর। সার্কুলার রোড আড়াআড়ি পার হয়ে গেল কুঁজঅলা হাতির মতো একটা ষাঁড়। জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে সেটার গতিপথ খুব কৌতূহলের সঙ্গে নিরীক্ষণ করল আরাত্রিকা। মানুষের ভারে একদিকে কাত হয়ে কাতরাতে কাতরাতে গেল একটা বাস। আরাত্রিকা বলল—‘হাউ ডেঞ্জারাস! বাবা, বাসটার কী হবে?’
সুকৃত বললেন—‘ভয় নেই রে! অ্যাকসিডেন্ট হবে না, কলকাতার ড্রাইভাররা দারুণ এক্সপার্ট!’ ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থেমে। একদম নাঙ্গা একটা জটাজুটধারী পাগল হাতে একটা বাঁখারি নিয়ে লাফিয়ে গাড়ির জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, বাঁখারি নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে করে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল—‘দিদিরা, মায়েরা, এ দেশের জন্যে কিস্যু করবেন না আর। কি না করেছে এ শর্মা। গঙ্গার ওপরে ক্যান্টিলিভার পুল, ময়দানে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জনতা কাপড়, সয়াবীনের মাংস, মাদারের দুধ ··· তবু এদেশের আম-জনতা আমায় ভোট দিলে না। ধারে কাঠ হয়ে বসেছিলেন কমলিকা। সুকৃত মুখ না ফিরিয়ে বললেন—‘ভয় পাবেন না সেজ বউদি, যা হোক কিছু পয়সা-টয়সা হাতে ফেলে দিন, এই ভোট পাগল আসলে খুব নিরীহ।’ ব্যাগ থেকে কিছু বার করবার সাধ্য কমলিকার ছিল না। তিনি ভয়ে সিঁটকে ছিলেন। ওদিক থেকে সুকৃতের স্ত্রী নীতা হাত বাড়িয়ে একটা দশ পয়সার কয়েন দিল, পাগলের হাতে সেটা দেবামাত্র সে নোংরা দু হাত বাড়িয়ে কমলিকার হাত দুটো জড়িয়ে ধরল—‘দিলেন দিদি? ভোটটা শেষ পর্যন্ত দিলেন তাহলে? রে রে রে রে ···’ বাঁখারি হাতে ট্রাফিকসঙ্কুল রাস্তার মাঝখানে পাঁই পাঁই করে ছুটে গেল পাগল। কমলিকা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন—‘সুকৃত তুমি যে বললে ও নিরীহ পাগল!’ আরাত্রিকা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল, এখন বলল—‘মম্স্, ওনলি লুক অ্যাট দ্যাট ট্র্যাজিক কমেডিয়ান। হাতটা ধুয়ে নিলেই তোমার হাতের ময়লা চলে যাবে। বাট দ্যাট ম্যান! কাকু! ওর একটা ব্যবস্থা করা যায় না?’
সুকৃত হেসে বললেন—‘ওর ব্যবস্থা হয়েই আছে মা।’
—‘কী ব্যবস্থা কাকু?’
নীতা বলল,—‘তুমি চুপ করো তো! না রে মণি, ওর কিছু হবে না। ও নিজে নিজেই আবার নিজের আস্তানায় ফিরে যাবে।’
আরাত্রিকা চুপ করে গেল। টুলটুল বলল—‘তুমি আমার হাতটা এত জোরে চেপে ধরেছো কেন মণি? ভয় পেয়েছো?’
হাতের মুঠো আলগা করে আরাত্রিকা জানাল—না।
বিবর্ণ দরজার ঠিক মুখটাতে বাঁ ধার ঘেঁষে একটা ছোটখাটো জঞ্জালের ঢিবি।
দুটো তিনটে বেশ সবল নেড়িকুত্তা সেখানে ঘনঘন ল্যাজ নাড়তে নাড়তে মনোমত খাবার-দাবার খুঁজছে। আশপাশের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সহদেববাবু রোয়াকে দাঁড়িয়েছিলেন। কমলিকার ইঙ্গিতে আরাত্রিকা নেমে দাদুকে প্রণাম করল।
সহদেববাবু বললেন—‘তোমরা তো তাড়াতাড়িই এসে গেছ।’
সুকৃত বললেন—‘হ্যাঁ, ফরচুনেটলি।’
গাড়ির শব্দে ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকজন। আরাত্রিকা দেখল বাবলুদা অনেক রোগা আর লম্বা হয়ে গেছে, চিনতে পারা যাচ্ছে না এত বদলে গেছে। সুমনের ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফের আভাস। ও-ও পাল্টে গেছে।
সুদীপ দেখছিলেন তাঁর ছেলেবেলা, কৈশোর এবং যৌবন। শীতকালের দুপুরে ক্রিকেট খেলা হত রাস্তায়। মুস্তাফিদের বাড়ির বারান্দার ওপর কাচ আজও তেমনি ভাঙা। সুদীপের বাউন্সারে পুলকের ওভার-বাউণ্ডারি। দোতলার কার্নিশ থেকে লম্বা হাত বাড়িয়েছে বেশ পুষ্ট একটা অশথ। বারান্দাটা এত সরু আগে কখনও মনে হয়নি। ঝুলিয়ে কাপড় শুকোতে দেবার কর্মটি ছাড়া আর কোনও ব্যবহারিকতা নেই এ বারান্দার। সিমেন্ট চটা ভাঙা উঠোনের এক ধারে এঁটো বাসন। রোয়াক থেকে উঠোনে যাবার সময়ে দরজার মাথা থেকে ঘুণ ধরা কিছু বালি, কাঠের গুঁড়ো মাথার ওপর ঝরে পড়ল। এই ষোল বছরে বোধহয় একবারও বাড়ির গায়ে হাত পড়েনি। রীণা বেরিয়ে এলো, পেছনে সুমিত, খুব সম্ভব খাচ্ছিল, ডানহাতটা মুঠো করে আছে।
রীণা বলল, ‘মণি কই? আরে ওই তো মণি? এত্তো লম্বা!’
টুলটুলকে হাত বাড়িয়ে ধরে আরাত্রিকা বলল, ‘টুলটুলদিও তো লম্বা হয়ে গেছে কাকিমা।’ ওর মুখে লজ্জা। অনেকদিন পর পুরনো মানুষদের নতুন করে দেখার লজ্জা।
সুদীপ বললেন, ‘বড়দা মেজদাকে দেখছি না?’
রীণা বলল, ‘আছেন কোথাও। রাত তো মন্দ হল না।’
সহদেববাবু বললেন, ‘যাও, বড়মার সঙ্গে দেখা করে এসো খোকা।’
রীণা বলল, ‘মণি, জুতো খুলে যেও, হ্যাঁ!’
‘ও হ্যাঁ’, আরাত্রিকা নীচু হয়ে জুতো খুলতে লাগল।
বড়মা ছিলেন ভাঁড়ার ঘরে। উঁচু তক্তাপোশের একদিকে বিছানা; চারপাশে কৌটো-বাটা, খবরের কাগজের তাড়া। শুয়ে ছিলেন ওপাশ ফিরে। কমলিকা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘রীণা, ঘুমটা না-ই বা ভাঙালাম।’
এইটুকু শব্দেই এ পাশ ফিরলেন বৃদ্ধা। আস্তে আস্তে উঠে বসে চশমা তুলে নিলেন।
‘এসো, এসো, থাক থাক,’ সবাইকার প্রণামের উত্তরেই ওই একই কথা।
সুদীপ বললেন, ‘বড়মা, চিনতে পারছো তো!’
‘পারছি বই কি! যাও বিশ্রাম করো গিয়ে।’
বাইরে বেরিয়ে রীণা চুপি চুপি বলল, ‘আমাদের সঙ্গে রিলেশন ভালো না সেজদিভাই, কিছু মনে কর না।’
‘তাই বড়দা মেজদা, দিদিদের কাউকে দেখছি না?’ আরাত্রিকার কান বাঁচিয়ে বললেন কমলিকা।
‘তাই-ই।’
সুদীপের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মুখটা কালো হয়ে গেছে। মনে কেমন একটা আত্মপ্রসাদ হল তাতে। বোঝ এখন! দূর থেকে ভূগোলক খুব নিটোল সুন্দর মনে হয়। কাছে এলে বোঝা যায় কত খানা-খন্দ, কত বিপজ্জনক ঢাল!
দোতলায় রীণার ঘরে এসে বসলেন সবাই। আরাত্রিকাকে দেখা গেল না। টুলটুলদের সঙ্গে কোথায় অদৃশ্য হয়েছে। সুদীল বললেন, ‘তোরা তো এসব কিছু লিখিসনি, সুমিত?’
‘এসব ফ্যামিলি পলিটিকস নিয়ে তোমাদের বিব্রত করতে কি ইচ্ছে করে? আসলে বরাবরের মতো আসছো শুনে ওদের ভয় হয়েছে ভাগীদার আরও একজন বাড়ল।’
‘অর্থাৎ?’
সহদেববাবু বললেন, ‘দাদা আমি উভয়ে বাড়িটা করেছিলাম। ইদানীং পার্টিশনের ব্যাপারে দাদার কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে দাদার হাতে লেখা একটা উইল পাই। উইলে দাদা তাঁর নিজের অংশ পুরোপুরিই আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন। আমি যা ভালো বুঝব তাই করব এই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা। উইল মিথ্যা প্রমাণ করতে সুধী মামলা করে। পারেনি কিছু করতে। আমি বৌঠানকে বহুবার বলেছি ওঁদের কোনও ভাবনা নেই। আমি এ বাড়ি সমান পাঁচ ভাগ করে দিয়ে যাবো। কিন্তু তাতে ওদের ভীষণ আপত্তি। দাদার আর আমার অংশ সমান দু ভাগ হলে ওরা দুজন, আর তোমরা তিনজন, সুতরাং ওরা সামান্য কিছু ইট-কাঠ বেশি পায়, এই আর কি।
সুদীপ বললেন, ‘জ্যাঠামশাই এরকম অদ্ভুত কাণ্ডটাই বা করতে গেলেন কেন?’
সহদেববাবু থেমে থেমে বললেন, ‘বাড়িটা তো বলতে গেলে আমারই করা। তোমাদের ঠাকুর্দাদার আমলে এখানে একটা মাঠকোঠা ছিল, সেটা বন্ধক ছিল ওঁর কাছে। সে ধার শোধ হয়নি। বন্ধকও ছাড়াতে পারেনি খাতক। সেই সূত্রে জমিটা আমরা পাই। একটু একটু করে এই বাড়ি তুলি আমরা। সে সময়ে আমার বিয়েও তো হয়নি। রোজগারের সমস্ত টাকা দাদার হাতে তুলে দিয়েছি। বাড়ি করবার জন্যে ইনসিওরেন্স থেকে লোন নেওয়া, প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড ভাঙানো, উপরি রোজগারের জন্য শেয়ার মার্কেটের দালালি করা সবই করেছি। উপরন্তু তোমার মায়ের গয়না পর্যন্ত দিয়েছি। দাদার কনট্রিবিউশন খুব সামান্যই ছিল।’
‘বড়মা এটা জানেন?’ সুদীপ বললেন।
‘জানেন না? ভিত্ হল তোমাদের ঠাকুরমার গয়না-বিক্রির টাকা দিয়ে। তিনিই সে সময়ে বলেছিলেন বউঠানকে “বাড়ি লক্ষ্মী, দরকার হলে তোমার গয়না দিও ছেলেদের, আমি যেমন দিলুম।” তখনও তো তোমার মা আসেননি। দোতলাটা যখন টাকার অভাবে আটকে গেল, দাদা গয়নাটা আগে বউঠানের কাছেই চেয়েছিলেন। তখনকার বাজারে লাখ দেড়েক টাকার গয়না তো বউঠানের ছিলই। উনি তো কিছুতেই দ্যাননি! তোমাদের মা দিলেন। সে যাই হোক, আমি ওঁদের ইচ্ছেমতো ভাগাভাগি করতে চেয়েছি। কিন্তু ছেলেরা আমায় করতে দ্যায় না।’
সুজিত বললেন, ‘যা হকের, বাজে চাপে পড়ে তা ছাড়ব কেন? আমার মায়ের গয়না ইঁট কাঠে কনভার্টেড হয়ে গেছে, আমরা তাই-ই নেবো। ওদের মায়ের দেড় লাখ টাকার গয়না আজকের ভ্যালুয়েশনে কত দাঁড়ায়, ভেবে দ্যাখো তো! বেশি ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে আমি বড়দিকে, ছুটকিকেও ইনভল্ভ্ করবো, জ্যাঠামশাইয়ের সম্পত্তিতে ওদেরও লীগ্যাল শেয়ার আছে, কি বলো দাদা!’
সুদীপ খুব বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘এখুনি এতো সব ভাবতে পারছি না। আমি ওদের একবার ডেকে দেখি। এতদিন পর এলুম।’
সুমিত মুখ নীচু করে আছে। সুদীপ, কমলিকা দুজনেই দালানে বেরিয়ে গেলেন। সুদীপ চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘বড়দা! মেজদা! বউদি সব কোথায় গেলে?’
বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম চোখে উঠে এলেন সুধীন, কোমরে লুঙ্গি। খালি বুকে কাঁচাপাকা চুল।
‘আরে সুদীপ যে! তোরা আসছিস জানতুম না তো! তাই কিছুক্ষণ আগে একটা গাড়ির আওয়াজ পেলুম?’
‘মেজদারা কোথায়? বউদি?’
‘সুবীররা সিমলেয় গেছে। মেজ বউয়ের মায়ের খুব বাড়াবাড়ি। তোর বউদির শরীরটা খারাপ। শুয়ে পড়েছে।’
সুদীপ কমলিকা দালানের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সুমিত বললেন, ‘এটা মেজদা ঠিক করল না।’
সহদেববাবু বললেন, ‘কি জানি। হয়ত এর থেকে তোমাদের সমস্যার সমাধানও হয়ে যেতে পারে।’
সুদীপ অস্বস্তির সঙ্গে দেখলেন বউদির কিরকম থপথপে ফোলা ফোলা চেহারা।
‘কি খবর বউদি! কতদিন চিঠিপত্র দাও না।’
‘আমাদের আর থাকা!’ সুধীন বললেন, ‘বেঁচে আছি এই পর্যন্ত।’
মাধুরী বললেন, ‘দ্যাখো না শরীর, সমানে জল হয়। এখানে ওখানে টিউমারের মতো। ভালোয় ভালোয় বুলিটার বিয়ে হয়ে গেছে, এইটুকুই ভালো খবর। তা তোমরা কি এখানেই থাকবে?’
কমলিকা দৃঢ় গলায় বললেন, ‘না, আমরা সুকৃতের ওখানে যাচ্ছি।’
সুদীপ একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপাতত আমরা আসছি বউদি। আপনার শরীরে জল হবার ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। শীগগিরই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’
ডালহৌসিতে পড়ে সুদীপ সুকৃতকে বললেন, তুই ফ্ল্যাট ট্ল্যাট করলি কি এই জন্য?’
যাক, বুঝেছ তাহলে! ফ্যামিলি পলিটিকস অতি মারাত্মক জিনিস সেজদা। বাড়ির ছোটদের, বউদের কুরে কুরে খেয়ে দেয়। তাই বাড়ি ভাগ-টাগের ব্যাপারে বোকামি করছি জেনেও দূরে সরে গেছি। সুদীপ মৃদুস্বরে বললেন, ‘আস্তে বল, একজন আছে।’
‘ওসব কথা এখন থাক না’, গলা চড়িয়ে সুকৃত বললেন, ‘মণি, কলকাতা কীরকম লাগছে মা?’
আরাত্রিকা বলল, ‘বড্ড গরম কাকু! আর বড্ড ধুলো।’
‘মেট্রো রেল হচ্ছে তো! একটু আধটু ধুলো টুলো উড়বেই। পরে শুনেছি বিলেত-আমেরিকাই হয়ে যাবে।’
‘কোনদিকে মেট্রো হচ্ছে কাকু!’
‘এখান থেকে দেখতে পাবে না। আমরা এইবার রেডরোডে ঢুকছি, বাঁ দিকে বেশ খানিকটা গেলে দেখা যেত।’
সুদীপ মেয়েকে আকাশবাণী ভবন আর ফোর্ট উইলিয়াম চিনিয়েছেন। এখন ফ্লোরেসেণ্টের আলোয় দেখা গেল দুদিকে কৃষ্ণচূড়ায় ফুল এসেছে। রং ভালো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ফুলে ভরে গেছে দু পাশের গাছ। ফাল্গুনের হাওয়া দমকা ঝড়ের মতো কমলিকার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। সুদীপের সঙ্গে প্রথম যেদিন একলা দেখা হয়েছিল, মেট্রো সিনেমার টিকেট কাউণ্টারের কাছ থেকে হাঁটতে-হাঁটতে রেড রোড। সুদীপ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কমলিকা নাম কে দিয়েছিল?’ ‘রবীন্দ্রনাথ।’ ‘আচ্ছা! কি করে!’ ‘দিদিমা ছিলেন ওঁর পরিচিত, তখন উনি বারবারই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দিদিমার আবদার রেখে বলেছিলেন, “অস্তাচলে যাবার আগে রবিকর যে কমলটিকে ফুটিয়ে দিয়ে গেল, রবির ক্লান্তি তাকে যেন স্পর্শ না করে।”
‘বাঃ, মুখস্থ করে রাখা হয়েছে!’
‘ছোটবেলা থেকে শুনছি, আপনা থেকেই মুখস্থ হয়ে গেছে।’
‘তা মহামানবের আশীর্বাদ সফল করা হবে তো!’
‘তা কী করে বলব? তবে আপনি আমাকে তুমি করে বললেও কেউ কিছু মনে করবে না।’
দুজনেই হেসে ফেলেছিলেন। ঠিক সেই গাছগুলোই কি এখনও রেড রোডে পুষ্পবৃষ্টি করছে? ‘কৃষ্ণচূড়ার ফুলে বনানী গিয়েছে ছেয়ে, শিমূল পলাশ আগুন লাগাল বনে বনে’। ঠোঁটের আগায় উঠে আসা সুরকে প্রাণপণে থামিয়ে কমলিকা নীতাকে বললেন, ‘বসন্তকালটা কলকাতায় এখনও সুন্দর, না নীতা?’
নীতা বলল, ‘শুধু বসন্ত কেন, সেজদিভাই, একটু ফাঁকা প্ল্যানড জায়গায় কলকাতার সব ঋতুই সুন্দর। এমন কি গ্রীষ্মও।’
সুদীপ বললেন, ‘আমার ফ্ল্যাটের কদ্দূর রে?’
‘জানলা-দরজার রঙ শেষ। ইলেকট্রিসিটি এসে গেল বলে। খালি লিফটা দেখছি এখনো হয়নি।’
‘না হোক, শিফট করতে পারবো তো?’
‘ইলেকট্রিসিটি এসে গেলে এনি ডে। কিন্তু আগে তো ফার্নিশ করে নেবে? কটা মাস আমার কাছেই থেকে যাও না! না কি ভয় করছে? সেজবউদি?’
কমলিকা অন্যমনস্ক ছিলেন, বললেন, ‘আমায় বলছো?’
হ্যাঁ। আমার বাড়িতে কটা মাস কাটাতে হলে কি ভয়টয় করবে না কি আপনার? আপনাদের?
‘কিসের ভয়?’
‘এই বাথরুম-টাথরুম। কিচেন-টিচেন! ভয় নেই বউদি “ফোরেন” না হলেও ও ব্যাপারগুলো আমার বাড়িতে পরিষ্কারই। কিরে মণি, ছোট্ট ভাইটার সঙ্গে থাকতে পারবি না!’
‘হাউ সিলি।’ ছোটনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরাত্রিকা, ‘পারবো না কেন, কাকু?’
সুদীপ বললেন, ‘সেট্ল্ যখন করতেই হবে, যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি কালই তোর সঙ্গে কমলিকাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রীট যাবো একবার। অবশ্য যদি তুই সময় দিতে পারিস। ফার্নিচারগুলোর ব্যবস্থা হয়ে গেলেই শিফ্ট্ করবো। আমার জয়েন করতে আছে মাসখানেকেরও কম। তারই মধ্যে যা করবার করে ফেলতে চাই। পাখাগুলো কিনেছে সুমিত?’
‘আমিই কিনেছি। আমার বাড়িতেই রাখা আছে। দেখবে গিয়ে।’
৭
হা-ই ক্যালকাটা! য়ু আর হাইলি ইণ্টারেস্টিং। খালি তুমি ম্যাস্কুলিন না ফেমিনিন, বাচ্চা না বুড়ো সেইটা ভেবে পাচ্ছি না। ভোরবেলা যখন আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে সারি সারি সাইকেল চলে যায়, ট্র্যাক সুট পরে লেকের ধারে ছুটতে বেরোয় খেলোয়াড় ছেলেমেয়েরা, যখন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আইসক্রিম আলোয় গাছপালাগুলো আহ্লাদেপনা করে তখন মনে হয় তুমি নেহাতই বাচ্চা। এখনো প্লাসটিকের রঙিন বল আর বেলুন ওড়াতে ভালোবাসো। আবার কোন কোনদিন গ্র্যাণ্ডের সামনের পেভমেণ্ট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি ঝমর ঝমর বাজনা বাজছে। লাল নিশান, রুপোলি রাংতামোড়া বাকস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে লেপারের দল। বড় বড় অফিস-বিল্ডিংগুলো তখন খালি ঘামছে। গলগল করে ঘামছে। ওপরদিকে মুখ। তলায় সেপাইপুতুলের লড়াই দেখাচ্ছে রবারের সুতো টেনে-টেনে একটা খুব রোগা লোক অনেকে ভিড় করে দেখছে কেউ কিনছে না, মিউজিয়ামের কাছ দিয়ে কাটা-হাঁটু ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে যাচ্ছে দুটো কনুই তুলে আরেকটা মানুষ। তখন বুঝতে পারি আসলে তুমি একটা বুড়ি, অ্যান ওল্ড উওম্যান ইন র্যাগ্স্। তোমার হৃদয় আছে না নেই, ব্রেইন আছে না নেই সেটা এখনও ধরতে পারিনি। য়ু আর আ হামিং বার্ড। মিডনাইট পর্যন্ত সবসময়ে একটা বজ্জ্জ্ মম্ম্ম্ শব্দ হয়েই চলে, হয়েই চলে। ফড়িয়াপুকুরে বড়পিসির বাড়ির কাছে পেভমেণ্টে ভর্তি বাজার। গড়িয়াহাটেও তাই। জিনিস কেনাকাটা দরাদরির আওয়াজে গমগম করছে। ওইরকম একটা স্টলের দোকানদার আর একটা দোকানদারের সঙ্গে সেদিন কি মারামারিটাই করল। দুজনেরই ডিগডিগে চেহারা। একজন আরেকজনের পেটে এমন স্ম্যাশ করল সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এলো। এতো ভায়োলেণ্ট এরা! এত নিষ্ঠুর! অথচ দেখলে মনে হবে প্রাণশক্তি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। কলকাতা, তুমি তোমার প্রাসাদ, সুপার মার্কেট, স্টক-এক্সচেঞ্জ, মাল্টি ন্যাশন্যাল কোলে করে বসে আছো, এদের এমন কিছু দিতে পারো না যাতে এই নিষ্ঠুরতা এই হিংস্রতা চলে যায়! হাওড়া কদমতলায় ছোটকাকিমার বাপের বাড়ি যেতে যেতে হাওড়া ময়দান বলে একটা জায়গায় আমি আরেকটা পাগলকে দেখলাম। নেকেড। মাথার চুলে জটা। একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র নিয়ে রাস্তার এধার থেকে ওধারে গড়িয়ে যাচ্ছে। কোনও চাহিদা নেই, কারো দিকে তেড়ে যাওয়া নেই, অখণ্ড মনোযোগে খালি গড়িয়েই যাচ্ছে, গড়িয়েই যাচ্ছে, যেন গড়িয়ে যাওয়ার ইভেণ্টে দেশের জন্য সোনাটা ওকে অলিম্পিক থেকে আনতেই হবে। সেদিনই দেখলাম একটা বুড়ি শুয়ে রয়েছে পথের ধারে, চোখেমুখে মাছি ভিনভিন করছে। মরে গেছে। বাবা বলেছিল বৃদ্ধদের নাকি খুব সম্মান ইণ্ডিয়ায়। কথাটা কী করে সত্যি হবে? বাবাকে বলতে বাবা খুব করুণ মুখে বলল, ‘যার আপনার জন নেই তার অবস্থা সর্বত্রই এক মণি। নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেণ্টে পচে ঢোল না হয়ে এই আত্মীয়হীন বৃদ্ধা পথে পড়ে মরেছে। কিছুক্ষণ পরই মিউনিসিপ্যালিটি ব্যবস্থা করবে।’ অথচ একটা রাস্তায় দেখলাম ইঁট দিয়ে পুতুলের ঘরের মতো একটা ঘর বানিয়েছে একটা লোক। পাশেই, একটা গাছের সঙ্গে অন্তত পনের ষোলটা স্ট্রে ডগ বাঁধা। একটা সানকিতে ভাত মেখে নিজেও খাচ্ছে, কুকুরগুলোকেও খাওয়াচ্ছে। বউবাজারে যেদিন ন কাকিমার কাছে ছিলাম, সেদিন রাত্রে ওদের পাড়া দিয়ে একটা ফিউনার্যাল প্রোসেশন গেল। সে কি চিৎকার! ‘বলো হরি, হরি বোল’-তিন চারজনে মিলে হেঁকে উঠছে ‘বলো হরি’, বাকি সবাই জবাব দিচ্ছে ‘হরি বোল।’ নাচতে নাচতে যাচ্ছে। যেন ভীষণ মজার আনন্দের ব্যাপার ঘটেছে একটা। এতো অশ্লীল কিছু আমি কখনও দেখিনি। মৃত্যু নিয়ে অশ্লীলতা? টুলটুলদি বলল, ‘ওরা আসলে ভয় কাটাচ্ছে।’ বাবলুদা বলল, ‘ভয় কাটাচ্ছে না আরও কিছু মাল টেনেছে।’
‘মাল টেনেছে’, মানে কি রে বাবলুদা?’
টুলটুলদি হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, ‘এইসব স্ল্যাং-এর এ বি সি ডি এবার ওকে হাত ধরে শেখা বাবলু।’
বউবাজারে খানিকটা কাঁচা গলি পেরিয়ে তবে বাঁধানো গলি, সেটা পেরিয়ে তবে রাস্তায় পড়তে হয়। আমি ট্রামরাস্তা পেরিয়ে ওদিকে ওষুধের দোকানে যাচ্ছিলাম কয়েকটা ছেলে পেছনে আসতে আসতে বলছিল, ‘মালখানা রসালো, প্যাঁজ রশুন, লঙ্কাবাটা দিয়ে রাঁধলে যা হবে না! জুত্তো জুত্তো’ সোজা আমার দিকে চেয়ে বলছিল। অর্থাৎ, আমাকেই বলছিল। এই স্ল্যাং-এর আবার কি মানে? ‘মাল’ মানে মদও হয় আবার ‘মেয়ে’ও হয়? মাকে এসে একেবারে ওয়ার্ড ফর ওয়ার্ড রিপ্রোডিউস করলাম, মার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, বলল, ‘যা-তা ছেলে সব। কলকাতার কি কালচারই হয়েছে! ছি, ছি, তুমি আর একলা বেরিও না।’
একলা বেরোব না! ফড়িয়াপুকুর কি বউবাজার কি কদমতলার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দুধারের লোক এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন আজব কোনো চীজ দেখছে। ন কাকিমা বলল, ‘মণি, তুমি বড্ড সুন্দর তো! আর একটু অন্যরকম সুন্দর। তুমি এদিকে আর একলা বেরিও না, বিশেষ করে প্যাণ্ট বা মিনি-স্কার্ট পরে।’
বেরোব না! বন্দী থাকবো! যা পরে আমার স্বস্তি হয়, তা পরব না? তাহলে আমি ওদিকে আর যাবোই না।
কাকুদের বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে খুব চুপচাপ একফালি কলকাতা দেখা যায়। আর আমাদের পাঁচতলার বারান্দা থেকে সবুজ গাছপালা। আড়ালে লেকের জল চিকচিক করে। সবুজের একটা ফালি আমাদের রাস্তাটার মাঝখানেও। অনেক গাছপালা সেখানে। সেদিকে তাকিয়ে আমার মেপল অ্যাভেন্যুয়ে ফল আসার কথা মনে পড়ে। কমলা, লাল, হলুদের আগুন-লাগা হৈমন্তী মেপ্ল। আমাদের এই লম্বা সবুজ দ্বীপটার ধারে হাতে-টানা রিকশাপুলাররা থাকে। গল্প করে, গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খায়। দোতলা বাস যায় অনেক উঁচু ছুঁয়ে। বিজ্ঞাপনে ঢাকা লম্বা লম্বা বাস যায়। লী রোডে ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশন্যাল স্কুলে পড়ছি। ও লেভেল দিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারি পড়তে হবে। এখানকার কোনও স্কুল আমায় নিল না। পড়তে হলে দু বছর নষ্ট করে পড়তে হবে। প্রথম থেকে কোনও সাবজেক্ট না পড়লে, তাকে আর ভবিষ্যতে ছোঁয়া যায় না এ দেশে। বাড়িতে আমি চিরকালই মা-বাবা-দাদার সঙ্গে বাংলা বলে এসেছি। মা বাড়িতে ইংরেজি বলা পছন্দ করত না। আমি কোনদিন বেবি-সিটারের কাছেও থাকিনি। কিন্তু সবাই বলে আমার কথায় খুব টান। টুলটুলদি একদিন বলল, ‘তুই একটু চাল মারিস মণি, যাই বলিস। ওইরকম জিভে চুয়িংগাম রাখার মতো ছাড়া তুই বাংলা বলতে পারিস না আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘চাল কী?’
‘চাল? কেন রাইস? রাইস জানিস না?’ টুলটুলদি মিটিমিটি হাসছে। বাবলুদা বলল, ‘যাঃ ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছিস কেন? বেচারি। না রে মণি, চালও একটা স্ল্যাং বলতে পারিস। মানে এই একটু কায়দা করা, একটু অ্যাফেকটেশন।’
ছোটনের সঙ্গে কথা কইতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে আজকাল। টুলটুলদি একেক সময় এমন সিলি কথা বলে! দুজনে মিলে পূরবী হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, বলল, ‘তোর সঙ্গে আর হাঁটব না। লোকে তোকেই দেখে। আমার দিকে ফিরেও চায় না।’
আমি বললাম, ‘তোমার এইসব বাজে কমপ্লেক্সের কোনও মানে হয়? লোকে দেখলেই বা কি, না দেখলেই বা কি? ওরা তো জাস্ট লোক!’ ও চুপ করে বসে দাঁতে নখ কাটতে লাগল। ওই আর এক ব্যাড হ্যাবিট। ছোটনটা খুব মজার। বলে, ‘তোকে দিদি বলব না, তুই তো মণি। যখন ছোট ছিলুম বলতুম টুলটুলদি, ছর্মিদি, এখন বড় হয়ে গেছি এখন তোকেও মণি বলব, আর ছেজজ্যাঠাকেও ছেজদা বলব এবার থেকে।’
ও সব বলতে পারে খালি ‘স’টাকে ‘ছ’ বলবে। আমি হাসতে হাসতে বললুম, ‘আমার মাকে কি বলবি তাহলে? সেজবউদি?’
বলল, ‘কেন, কমলিকা বলব। ছেজদা কি ছুন্দর বলে, কমলিকা ছুনছো!’ এমনি পাকা না বাংলা নিয়ে আমি কেনদিনই নাকি পড়তে পারবো না। এইরকমই এখানকার সিসটেম। লেখার স্ট্যাণ্ডার্ড অবশ্য খুবই হাই। হঠাৎ স্ট্যাণ্ডার্ডটা ধরতে পারতাম কি না জানি না। রবীন্দ্রনাথ আমি যা সামান্য পড়েছি, কবিতাই। পূজারিণী, দেবতার গ্রাস, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, গানভঙ্গ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। দাদা গোগ্রাসে গিলত, আর গড়গড় করে মুখস্থ বলতো। খুব ভালো লাগত, বিশেষ করে বাবা কিম্বা মা বুঝিয়ে দিলে। ‘শ্যামা’ ‘চিত্রাঙ্গদা’ ‘চণ্ডালিকা’র ক্যাসেট শুনেছি। কি সুন্দর কথাগুলো! পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি/যদি পার্শ্বে রাখো মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি/যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সঙ্কটে সম্পদে/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/সহায় হতে/পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’ কিন্তু প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে আমার অবস্থা কাহিল হল। মারাত্মক শক্ত। লেখাটা অভ্যেস করিনি একদম। হাতের লেখা বাচ্চাদের মতো। কম্পোজিশন কাঁচা। ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল নাচ আমার ভীষণ ভালো লাগে। ভরতনাট্যম আর ওড়িষিতে ভীষণ পা মোড়ার ব্যাপার। মাস্টারমশাই বলছেন অত পা মোড়া আমার আসবে না, ব্যালে শেখার জন্যেই না কি এটা হয়েছে। কত্থক দেবেন আমাকে। কিন্তু ব্যালের অনেক ফিগারেই হাঁটু মোড়া ছিল প্লিয়ে বা আতিতিউদ এ হাঁটু মুড়তে হত, কখনও সামনে, কখনও পেছনে। কত্থক অবশ্য খুব ড্রামাটিক। কিন্তু আমার ওড়িষি সবচেয়ে ভালো লাগে। ফরাসীর জন্য আমায় রামকৃষ্ণ মিশনে যেত হয়, সবটাই আমি সাইকেলে চলি। এক বছরে দু তিন বছরের কোর্স কভার করতে হচ্ছে, স্কুলে, খুব খাটুনি। সারাটা দিন বাবা-মার সঙ্গে দেখাই হয় না বলতে গেলে। বাবা আগে বেরোয়, তারপর আমি, শেষে মা।
মা আবার বাড়ি এসে সন্ধেবেলা খুব রান্না নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। ছোটকাকী আর মা মিলে নাকি রান্নার বই লিখবে একটা। মা কণ্টিনেণ্টাল, ছোটকাকী মোগলাই, দেশী, ন কাকিমাও দিদুর কাছ থেকে, বড়দির কাছ থেকে শেখা দেশী রান্না সাপ্লাই দেবে। মা বলছিল দিদিমার কাছ থেকে পুরনো দিনের রান্না উদ্ধার করবে। বাবা প্রায়ই কলেজ-ফেরত বউবাজার যায়। বাবার খালি কাজ। বাবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জব নিল বলে মা বকাবকি করে। বাবা বলে, ‘আজকাল কেউ প্রিন্সিপ্যালের চেয়ারে যেতে চাইছে না, চেয়ারটা গরম। আমিও যদি না যাই, কে আর যাবে বলো!’
‘যেখানে যত ঝামেলা তোমাকে নিতে হবে?’
বাবা এখনও আমাকে ছোট বলে ট্রীট করে। এটা আমি হতে দিচ্ছি না। বাবার প্রবলেম আমায় বুঝতে হবে। মনমরা হয়ে থাকে কেন? দাদা নেই, আমি একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব বোধ করি। দাদা যদি এসে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবার চোখের তলায় কালি কেন রে মণি?’ আমি কি জবাব দেবো? ইন ফ্যাকট দাদা না থাকাতে আমি খুব অসহায় বোধ করি। ওকে লিখেওছিলাম। ও লিখেছে এইটেই নাকি আমার নিজেকে গড়বার সুযোগ। তবে ও আসছে। একেক সময়ে ওর সার্মনগুলো আমার অসহ্য লাগে। লিখেছে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নাকি ওর ইমপ্রেশন সেভেনটি ফাইভ বহাল আছে। এখনকার ছবিগুলো যেন আমি ওকে সাপ্লাই করি। আমি কি ওকে লিখব দাদা, তোর ইণ্ডিয়া বড্ড টেম আবার বড্ড ভায়োলেণ্ট, সব ছবিই আমার হয় ওভার এক্সপোজার নয় আণ্ডার-এক্সপোজারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করে ভাইবোনদের নিয়ে অন্ততপক্ষে কলকাতা আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়ি। তা টুলটুলদি বড্ড ভিতু, টু ফেমিনিন, বাবলুদা ভীষণই নিরীহ এবং নিজের পড়াশোনা নিয়ে ভাবিত, শর্মিটা গাড়ি এবং অভিভাবক ছাড়া এক পা এগোতে পারে না। সুমন তো এতো লাজুক যে কথাই বলে না, বউবাজারের বাড়ি গেলেই কোথায় লুকিয়ে পড়ে। আমি একেক সময় অগত্যা ছোটনকে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। লাভের মধ্যে একগাদা খুচরো জিনিস আর মিষ্টি কেনা হয়ে যায়। স্টলের দোকানদাররা এমন করে কেনার জন্যে পীড়াপীড়ি করে যে আমি না কিনে পারি না। রুমাল, টেপ, কাফতান, যা মোটামুটি পছন্দ হয়, কিনে ফেলি। মিষ্টিগুলো বেশির ভাগই আমাতে ছোটনেতে মেরে দিই, বাকিগুলো মুখ মুছে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাবাকে বলেছিলাম, একদিন একা একা ঘুরতে যাবো। বাবা পরের রবিবারই আমাদের সবাইকে নিয়ে বেলুড়মঠ, দক্ষিণেশ্বর ঘুরে এলো। এভাবে কি আর কিছু আবিষ্কার হয়?
৮
শুক্রবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখি ছুটকিরা এসেছে। ছুটকি, স্বর্ণেন্দু, আর শর্মি। ওরা কিছুতেই শনি রবিবার আসবে না। ও বাড়ি থেকে যদি কেউ এসে পড়ে! বাবাকেও ওদের ভয়। যত বোঝাই, বড়দা-মেজদারা কেউ আসবে না। বাবার পক্ষেও আমি নিয়ে না আসলে আসা সম্ভব নয়, তবু ওরা শনি-রবিবার এড়ায়। কমলিকা বলল, ‘তাড়া করো না, ওরা খেয়ে-দেয়ে যাবে।’
ছুটকি বলল, ‘একটা সিরিয়াস কনট্রাকট করে যাবো আজ সেজদা।’
‘বলিস কী রে? ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস যে!’
‘প্রতি রবিবার তোরা আমাদের ওখানে যাবি। হই-হই হবে।’
‘মুশকিলে ফেলে দিলি।’
‘কেন মুশকিলের কী আছে? ঠিক আছে আসিস না।’ ছুটকিটা অবিকল আগের মতো তড়বড়ে আর অভিমানী আছে।
বললাম, ‘না রে, একমাত্র রবিবারটাই আমার ছুটি। বউবাজারে যেতে হয়, দিদি রয়েছে, মামাদের অভিমান মা মারা যেতে ওঁদের আমরা ভুলেই গেছি। শ্বশুর-শাশুড়িও একেবারে একলা।’
‘এদিকের সোশ্যাল ডিউটিগুলো তুই আর সুকৃত ভাগ করে নে। তোকে একাই বা করতে হবে কেন?’
কমলিকা বলল, ‘জানো ছুটকি, রবিবারের ছুটির দিনটাও ওর একরকম কাজের দিনই। বড়দিভাইয়ের ওষুধপত্র, বড়মার দেখাশোনা সবই আজকাল ও করছে।’
ছুটকি বলল, ‘কেন? বড়কা মেজকা দুটো পাশ কাটাচ্ছে বুঝি? মহা চালু!’
স্বর্ণেন্দু বলল, ‘তোমাদের বড়দা মেজদা কিন্তু দেশের জমি-জমা, বাগান পুকুর, গাছ-টাছ সব বিক্রি করে ফাঁক করে দিয়েছেন। তোমরা তো আর দেখাশোনা করলে না! সেই বাবদ বিরাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দুজনের। বড়দা ক বছর হল রিটায়ার করেছেন, মেজদাও করব-করব। কিন্তু আর্থিক-অসুবিধে ওঁদের কিছু নেই। সলিড একেবারে!’
কমলিকা বলল, ‘সে কি! এতো টাকা! অথচ বড়দিভাইয়ের চিকিৎসাটাও ভালো করে করাননি এতদিন?’
স্বর্ণেন্দু চোখ নাচিয়ে বলল, ‘ক্রনিক রোগ, তারপর বোধহয়, রাজরোগই। কি বলো সুদীপ! বড়দা বোধহয় মনে-মনে ভালোই জানেন। ধনে-প্রাণে মেরে রেখে যাবে। তাই দাদা আমার প্রাণটা ছেড়ে ধনটিই সামলাচ্ছেন।’
কমলিকা বলল, ‘ছি! ছি!’
আরাত্রিকা ফিরেছে। বোধহয় ফ্রেঞ্চ ক্লাস থেকে। লম্বা স্কার্ট পরেছে। আজকাল ও চুল রাখছে, বেশ লম্বা একটা বেণী হয়েছে দেখছি।
‘ছুটকি’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পিসির গলা জড়িয়ে ধরল।
স্বর্ণেন্দু বলল, ‘এই যে মেমসাহেবের বাচ্চা, এদিকেও একজন আপনজন রয়েছে তোমার। সব আদর পিসিতে আর পিসির মেয়েতেই খরচ করে ফেলো না।’
মণি এসে হাসতে হাসতে স্বর্ণেন্দুর গালে গাল রাখল, ‘পিসে, তুমি একদম ব্যাকডেটেড হয়ে গেছো। এইরকম পাঁউরুটির মতো গাল, আর কুমড়োর মতো ভুঁড়ি আজকাল নায়কের বাবারও চলছে না।’
শর্মি ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, ‘জানিস তো, রিসেন্টলি বাবার ময়রা আর মুদীর রোলের অফার আসছে। সেইজন্যেই রিটায়ার করতে চাইছে। প্রোডিউসার হবে এবার।’
স্বর্ণেন্দু মণিকে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও আমার ফার্স্ট প্রোডাকশনেই তোমাকে হিরোইনের রোলে নামাচ্ছি।’
কমলিকা তাড়াতাড়ি বলল, ‘প্লীজ স্বর্ণেন্দুদা। এসব কথা ওর সামনে বলবেন না।’
মণি স্বর্ণেন্দুর গলা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা, তোমরা আর কতদিন আমাকে বাচ্চা করে রাখবে? আমি কি শূগার ডল যে এই আলোচনা হলে গলে যাবো!’
শর্মিকে ডেকে নিয়ে ও বারান্দায় চলে গেল।
স্বর্ণেন্দু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘সরি ম্যাডাম, আর কখনও এসব বলে আপনাকে বিপদে ফেলব না।’
আমি বললাম, ব্যাপারটা কি জানো? ওদেশে চোদ্দ বছর বয়স হয়ে গেলেই সব একরকম অ্যাডাল্ট হয়ে যায়। সেই ধারণাটা ওদের শিক্ষা-দীক্ষার মধ্য দিয়েই হয়ে গেছে। এদিকে আমরা সনাতন বাবা-মার রীতি অনুসরণ করে এখনও সীমা মেনে চলেছি। ওর বোধহয় আত্মসম্মানে লাগছে।’
কমলিকা বলল, ‘আমি তো ওকে কিছুই বলিনি। বলেছি স্বর্ণেন্দুদাকে। এত প্রখর আত্মসম্মানবোধ ও যদি আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিয়ে এসে থাকে তো ওকে এখানে গ্রাফ্ট্ করা মুশকিল হবে।’
শেষ কথাটা ও বলল, বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এই ছোট্ট সমস্যাটার কথা এখন আদৌ আমার মাথায় নেই। আমি একটা বৃহত্তর পারিবারিক সমস্যার কথা ভাবছি। বড়বউদির রোগটা ধরা যাচ্ছে না, রক্তাল্পতা, ঘুষঘুষে জ্বর, ঘাড়ে, পেটে কতকগুলো লাম্প মতো হয়েছে। ডাক্তার এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না। খুব সম্ভব হজকিনস ডিজিজ। তাই যদি হয় ভোগাবে, ব্যয়সাধ্য ব্যাপারও। বড়দা চোখে জল নিয়ে হাত উল্টে বলছে, ‘আমার কিচ্ছু নেই রে। পি এফ থেকে তুলে পাত্রপক্ষের দাবী মেটাতে হয়েছে বুলির বিয়েতে। আর টাকা কই? আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। নিজে সুখে থাকবো, আর জীবনের প্রথম বউদি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন? হতে পারে জ্ঞাতি। কিন্তু সেভাবে তো আমরা কখনও মানুষ হইনি। বড়মার কড়া শাসন ছিল, খবর্দারি ছিল। মা ছিলেন তাঁর আজ্ঞাবহ। কিন্তু দাদা-দিদি বোন এদের কখনও পর ভাবিনি। সুমিত এদিকে ভীষণ রাগ করছে। মেজদার ছেলে এনজিনিয়ার। ধানবাদে ভালো চাকরি করে, সেও তো সাহায্য করতে পারে। মেজদার তো আর কোনও দায়ই নেই। বাবাও মৌন থেকে সুমিতের কথায় সায় দিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় পয়েণ্ট, বড়মার একদার দেড় লাখ টাকার গয়না এখন দশ লাখে তো পৌঁছেচে বটেই! তবু কেন এই কার্পণ্য, অন্যের ওপর নির্ভর করা। আমি খানিকটা কমিট করেই বসে আছি এদিকে। স্বর্ণেন্দুর কথাটা আমার কাছে রীতিমতো শকিং।
জিজ্ঞেস করলুম, ‘কথাটা কি সত্যি স্বর্ণেন্দু?’
‘কোন কথাটা? দেশের জমি বিক্রির কথাটা? সেণ্ট পার্সেণ্ট সত্যি।’
‘আমি সরেজমিন ব্যাপারটা দেখে আসতে চাই। তারপর বড়দার সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলব। পরের রবিবারই তুমি যদি সময় করতে পারো, তোমার সঙ্গে যাবো। এদেরও নিয়ে যাবো। নিজের চোখে দেশ দেখে আসুক। আউটিংও হবে একটা।’
খাওয়া-দাওয়া করে অনেকদিন পর ড্রিঙ্কস নিয়ে বসা হল। মেক্সিকান কাহ্লুয়া স্বর্ণেন্দুর হট ফেবারিট। সবাইকেই একটু একটু খাওয়ালুম। শর্মি এবং মণিকেও। বড়দের জগৎ থেকে আলাদা থাকবার গ্লানি আর অভিমানটা যদি কেটে যায় তাতে। লিকিঅর তো! একটু খেলে কিছু হবে না।
আমি কি দেশে ফিরে ভুল করেছি? যেসব অসুবিধের জন্যে প্রথমত বিদেশ যাওয়া, সেসব ব্যাপারে এবার সতর্ক ছিলুম। আমার আর কমলিকার সোশ্যাল সিকিওরিটি, থ্রিফট ফাণ্ড ইত্যাদি আছে। কমলিকা, বিশেষত মণির যাতে এতটুকু কষ্ট না হয় সেইভাবে বাড়ি-টাড়ির ব্যবস্থা করেছি। কমলিকা কয়েকদিন মাত্র পুল অফিসার ছিল, তারপরেই রীডার পোস্টে কাজ পেয়ে গেছে। পড়াতে পেরে ও খুব খুশি। ছাত্রছাত্রীরা ওকে খুব অ্যাডমায়ার করছে। শিক্ষক হিসেবে, নারী হিসেবে, গায়িকা হিসেবে। কমলিকার যে খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চুপচাপ, বেশি কথা বলে না, কিন্তু চারপাশে বেশ ভক্ত শিষ্য-শিষ্যামণ্ডলী হয়ে গেছে। এতো সমাদর, এতো উছ্বাস কি ও নিউ ইয়র্কে পেতো। ওর গান সেখানে কজন বুঝতো! কজন ভালোবাসত! রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে শীগগিরই। একটা পরিপূর্ণ জীবন হবে ওর। মা বাবা প্রায়ই এসে থাকেন। বুড়ো বয়সে মা-বাবার জন্য কিছু করতে পারার সৌভাগ্য এবং সন্তোষ কি কম! ছুটকি, রীণা, নীতা সবাইকে নিয়ে ও বেশ সুন্দর একটা মহিলামহল গড়ে তুলছে দেখতে পাই। বাবার সঙ্গে সামান্য দূরত্ব আছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে দূরত্ব তো সবারই। আস্তে আস্তে কমলিকা একটা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাই আমি চেয়েছিলুম।
আমার নিজের জন্যেই একেক সময় সংশয় জাগে। চলে না এসে আমার উপায় ছিল না। হিউসটনে থাকতে আমি অ্যাসিস্ট্যাণ্ট প্রোফেসর পোস্টে ছিলুম। কিছুতেই আর প্রোমোশন হয় না। আমাদের এশিয়ান পীপলস অ্যাসোসিয়েশন ছিল। সেখানে আলাপ আলোচনা করে বুঝলুম অনেকেই কর্মক্ষেত্রে একই ব্যবহার পাচ্ছে। দীপঙ্কর তখন ছিল নাসায়। আমরা সবাই মিলে কেস করি। ফলে হিউসটন স্টেট য়ুনিভার্সিটি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মেডিক্যাল সেণ্টার, আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেল। ফেডার্যাল গ্রাণ্ট বেশ কয়েক বছর বন্ধ হয়ে গেল ওদের। যতই আইনের সাহায্য নিই না কেন ইনস্টিট্যুটের ওপর বাঙালিসুলভ মমতা জন্মেছিল। ওখানে থাকতে আর ইচ্ছে করল না। টেক্সাসের তেলের রোয়াবও তখন ভেঙে এসেছে। দীপঙ্কর চলে এলো, আমি চলে এলুম। ন্যু ইয়র্ক। কিছুদিন পর টের পেলুম প্রোফেসর পোস্টে আছি ঠিকই, কিন্তু একই পোস্টে আমেরিকানরা আমার দেড়া মাইনে পায়। আমার হর্তা-কর্তা আলেকজাণ্ডার রাটলেজ অম্লানবদনে বলত, ‘তুমি তো চাওনি।’ যখন শুনল চলে আসছি অনেক অনুনয় করেছিল, কাজের উচ্চ প্রশংসা, থার্ড ওয়ার্ল্ডে কাজের অসুবিধে, টাকার অসুবিধে, আরও অনেক ডলারের লোভ। কিন্তু আমি তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আলেকজাণ্ডার বলেই রাখল আবার যদি ফিরে যেতে চাই, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে যেন ওঁকে লিখি। ওর বাড়ির ফেয়ারওয়েল পার্টিটা সর্ব অর্থেই ভিজে পার্টি হয়েছিল। ওর বউ মেরিয়ান তো কেঁদেই আকুল। ওদের ওই আক্ষেপ, আমন্ত্রণ, অনুশোচনা শিরোধার্য করে ফিরে আসাই ভালো নয় কি? ইদানীং এক একটা প্রজেক্ট শেষ হলেই মনে হত ডি. এন. এর এই ডাবল হেলিক্স আর কতদূরে নিয়ে যাবে আমায়! যতই এগোই, লক্ষ্য আরও পিছিয়ে যায়। মেথুসেলার আয়ু দরকার যে। ভেতরে অ-বৈজ্ঞানিক সুলভ ক্লান্তি। গবেষণায় গোটা যৌবনটা সমর্পণ করে কি পেয়েছি! বায়ো-কেমিস্ট্রি থেকে জেনেটিক এনজিনিয়ারিং। গোটা পৃথিবীর পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু দিতে পারলাম কি! আর কিছু করিনি। ছোটবেলায় খুব ভালো আঁকার হাত ছিল। প্রশ্রয় দিইনি। টেব্ল টেনিসে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করবার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্রয় দিইনি। শিল্পসৃষ্টির মধ্যে যে মুক্তি আছে, খেলাধুলোর মধ্যে যে বিশুদ্ধ প্রাণাবেগজনিত আনন্দ আছে তার থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করেছি। কমলিকা ওই মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে, আমার ভাগ্যে খালি হতাশা।
প্রিন্সিপ্যাল হয়ে যে কলেজে ফিরলুম সেখান থেকেই একদা বি. এসসি ডিগ্রি নিয়েছিলুম। আমাদের আমলের বিশাল মেহগনির দরজা-জানলার পালিশ উঠে গেছে। হলের চারপাশে নোংরা লেখা। চতুর্দিকেই শুধু জবাব দাও আর ভোট চাই। কাকে যে এরা ভোট দিতে বলে, কিসের সুরাহা তাতে, কিসের জবাবদিহি যে কে কার কাছে চায়! ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল সন্তোষবাবু এতদিন কাজ চালাচ্ছিলেন। প্রোফেসর্স রুমে সবার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে বললেন, ‘নিন আপনাদের কর্ণধার এসে গেলেন। সাহেবমানুষ। আপনাদের আর দুঃখ থাকবে না।’ কথার ধরনে মনে হল দুঃখটা অন্যদের ছেড়ে এবার ওঁকে ভর করবে। কয়েকজন মৃদু হেসে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
আমার ঘরে কাঠের পার্টিশনের ওধারে আমার স্টেনো বসে। সন্তোষবাবুর জন্য এ ঘরেই ভিন্ন টেবিল। তবে উনি সাধারণত অফিসেই বসেন। কাজ করতে গিয়ে দেখছি পর্বতপ্রমাণ জমে আছে। এতদিন এরা করছিল কি? সকাল থেকে গিয়েই আমায় স্টেনোকে নিয়ে বসতে হয়, তারপর আসে স্তূপীকৃত ফাইল। সন্তোষবাবুকে একদিন মৃদুভাবে জিজ্ঞেস করেছিলুম, এতো কাজ জমে আছে কেন? বললেন, ‘ক্ষমতা নেই অথচ দায়িত্ব আছে এমত অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর দ্বিতীয় কী পন্থা নিতে পারে ডক্টর মুখার্জী?’ কাজের ফাঁকে ফাঁকেই দেখি ছাত্ররা নানারকম কাজেকর্মে আসছে, যাচ্ছে। এটাই কি ওদের অভ্যাস। এরকম করলে কাজ করব কি করে? ওদের দেখা করার সময় নির্দিষ্ট করে দিলুম। প্রতিদিন দুটো থেকে তিনটে।
আজ দুপুরের দিকটা ঢুকেছিলেন বৃদ্ধ উমেশ ভট্টাচার্য। সংস্কৃতের প্রোফেসর। শুনেছি অগাধ পণ্ডিত। কিন্তু এখন তো দুটি তিনটি ছাত্র মোটে ক্লাসে। এক্সটেনশন চলছে। কান চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘বৃদ্ধ বলে কথাটা বলছি, মনে কিছু করবেন না ডকটর মুখার্জী। ভয়ানক রাজনীতি। কি ছাত্র কি মাস্টার, কি ক্লাস ফোর স্টাফ সবাই খালি দলাদলি করছে। পঠন-পাঠন? দেবা ন জানন্তি। দেখুন যদি কিছু করতে পারেন, তবে গো স্লো।’
উনি থাকতে থাকতেই ঢুকলেন একজন তরুণ অধ্যাপক বিকাশ সিংহ। ‘আসবো না কি স্যার?’ উমেশবাবু দেখলুম আড়চোখে চেয়ে আবার কান চুলকোতে থাকলেন। চেয়ার টেনে বসে পড়লেন প্রোফেসর সিংহ, মনে হল বেশ অনেকক্ষণ কথা বলবেন। উমেশবাবু উঠলেন না। কাচের তলায় রুটিনটা ফেলা আছে। এটা আমি এসেই তৈরি করিয়েছি। প্রত্যেকের নামশুদ্ধু টাইম-টেবিল। প্রতিদিনকার আলাদা আলাদা শীট। প্রোফেসর সিংহর এখন অনার্স ক্লাস।
হেসে বললুম, ‘আপনার ছাত্ররা কি আজ আসেনি নাকি?’
আমার চোখ অনুসরণ করে উনি রুটিনটা দেখলেন। তারপর বললেন, ‘পরপর দুটো ক্লাস তো! একটু দেরি করে না গেলে নব্বই মিনিটের লেকচার হজম করতে ওদের পেটের গোলমাল হয়ে যাবে স্যার। ··· তা আপনি তো দুনিয়ার সবচেয়ে প্রগতিশীল দেশ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন ডক্টর মুখার্জী, আপনি কি সত্যিই মনে করেন টীচিং ব্যাপারটা কোয়ানটিটেটিভ! দুএক মিনিটে সত্যিই কি কিছু আসে যায়?’
আমি বললুম, ‘দুনিয়ার প্রগতিশীল দেশগুলোর থেকে আমাদের পরিস্থিতি এতই আলাদা প্রফেসার সিনহা, যে ঠিক ওখান থেকে কোনও অ্যানালজি টানা চলে না। ওখানে হায়ার এডুকেশন ভীষণ এক্সপেনসিভ। ছাত্ররা বেশিরভাগই নিজেদের রোজগারের টাকায় পড়ে। ভীষণ ডলার-কনশাসও ওরা। প্রফেসারদের কাছ থেকে পুরো খরচ উশুল করে নেওয়াটা তাদের দায়। এখানে তো দেখছি, আমরা সরকারের কাছ থেকে মাইনেটা পাচ্ছি বলে নিজেদের জাস্টিফিকেশনের জন্যই ক্লাসে আমাদের উদ্যোগী হতে হয়। ছাত্রদের অভিভাবক নামমাত্র দক্ষিণা দিয়ে খালাস, অত অল্প দামের পণ্যের জন্য আর কষ্ট করে লাভ কি! এই ধরনের একটা মানসিকতা এ যুগের ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, যেটা আমাদের সময়েও একেবারেই ছিল না।’
‘তাহলে সরকারকেই দায়ী করছেন বলুন,’ বিকাশ বললেন। উমেশবাবু প্রচণ্ড গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন।
বললুম, ‘কে যে ঠিক দায়ী, সরকার না আমি-আপনি, না ছাত্ররা, না আমাদের ইতিহাস, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।’
বিকাশ সিংহ চলে গেলেন। উমেশবাবু কান চুলকোতে চুলকোতেই বললেন, ‘সব রকম পলিটিকসের পাণ্ডা ইটি। দলে রাখতে পারলে আপনার ভালো।’
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বক্তৃতায় ছাত্রদের কাছে আবেদন রেখেছিলুম। বিল্ডিং গ্রান্টের টাকায় কিছুদিনের মধ্যেই নতুন রং পালিশ ইত্যাদি হয়ে চকচকে হয়ে উঠবে তাদের কলেজ। যেন দেয়ালে দেয়ালে লেখাটা বন্ধ করে। নেহাৎ প্রয়োজন হলে পোস্টার মারতে পারে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে, সেগুলো তুলে ফেলা হবে। বিদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা তুললুম। শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে পড়াশোনা করার সুবিধের কথাও বললুম। এই কলেজ কত দিনের ঐতিহ্য বহন করছে, সে কথাও উল্লেখ করতে ভুললুম না। চুপচাপ শুনল সবাই। জানি না কোনও ফল হল কিনা। তবে ভাইস-প্রিন্সিপাল সন্তোষবাবু বললেন, ‘আদর্শ দিয়ে কাজ হবে না। ভয় দেখান। আর খোসামুদি করুন। আগের প্রিন্সিপ্যাল ওপন ডোর পলিসি ফলো করতেন। যে ছাত্র যখন চায়, ঢুকে পড়ছে কোনও বাধা নেই। অন্যায় করলে বেশ মিঠে-মিঠে করে শুনিয়ে দিতেন। ছাত্রদের হাতে না রাখলে পপুলার হবেন কী করে? টীচিং কমিউনিটিকে শায়েস্তা রাখবেন কী করে?’
কমলিকা আশা করি এর চেয়ে ভালো আবহাওয়ায় আছে।
দেশে ফিরে ভুল করেছি কি না সত্যিই বুঝতে পারছি না। একমাত্র ছুটকিকে ছাড়া আর কাউকে কি খুসী করতে পেরেছি! ছুটকি প্রায়ই আসে। এলে যেতে চায় না। বলতে গেলে আমরাই ওর একমাত্র আত্মীয়। সুকৃতও আছে অবশ্য। কিন্তু আমার সঙ্গে ছেলেবেলার যে সময়টা ওর কেটেছে সেই স্মৃতির ছেলেবেলায় সুকৃতের ভূমিকা ছিল খুব নগণ্য। ছুটকি বলে—‘আমাদের জীবনের শেষ দিনগুলো তোমরা ভরে দিলে সেজদা-সেজোবউদি।’
বাবাকে কিন্তু খুব বিষণ্ণ দেখি। মা যাবার পর বাবাকে আমি হিউসটনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি অনেক। কিছুতেই পারিনি। প্রায় প্রতি উইক এন্ডেই ও বাড়ি যাই। আগেকার আবহাওয়াটা খুঁজতে যাই। চার ভাইয়ে আড্ডা। রাসেল, শ, সোয়াইটজার, হ্যালডেন, র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম্, সুপ্রামেণ্টাল···বাবাও যোগ দিচ্ছেন। বড়মা তাড়া দিচ্ছেন। জ্যাঠামশাইয়ের খড়মের শব্দ। শেষকালে মা বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা গল্প করলেই হবে? আমাদের খেতে-টেতে হবে না?’ কত টুকরো টুকরো ঘটনাই মনে পড়ে। যত বয়স বাড়ছে মনে হচ্ছে প্রথম যৌবনটাই একমাত্র সময় যখন আমরা ঠিকঠাক বাঁচি।
বাবার সঙ্গে সেদিন বসেছিলুম ছাদে। চুপচাপ দুজনেই। বাবা হঠাৎ বললেন, ‘খোকা, তোর মনে পড়ে তোকে আকাশের তারা চেনাতুম।’
‘পড়ে বই কি! শ্বেতবামন, লালদানব এসব তো আপনার কাছেই শেখা। ভেগা নক্ষত্র আর তের হাজার বছর পর ধ্রুবতারার মতো হয়ে যাবে, সে নিয়ে একটা বিরাট কবিতা লিখেছিলুম তখন।’
‘কেন চেনাতুম জানিস খোকা! শুধু বিজ্ঞান-সচেতন করার জন্য নয়। ভেতরে ভেতরে বৃহতের একটা চেতনা গড়ে দিতে। তা নয়ত পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুদ্রতার সঙ্গে টক্কর দিতে পারবি না বলে। কি জানিস খোকা, সেই বৃহৎকে আজ নিজের ভেতরেই হারিয়ে বসে আছি। সামান্য একটু সাহস দেখানো, উদ্যোগ নেওয়া এ আর আমার হয়ে ওঠেনি। কোনদিন তোর বড়মার মুখের ওপর, জ্যাঠার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনি। স্বাস্থ্য ছিল, জ্ঞানের স্পৃহা ছিল, সুনামও ছিল খুব। যেমন দুহাতে উপার্জন করেছি, তেমনি নিঃশেষে সব দিয়ে দিয়েছি। দাদার প্রতি ভক্তিটা আমার ছিল মাত্রাছাড়া। এখন মনে হয়, তোর মার প্রতি কর্তব্য করতে পারিনি। এ সংসারে সে ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এখন খালি আক্ষেপ হয়। দ্যাখ না ইঁটকাঠ আগলে পড়ে আছি। সত্যিই তো বলতে পারিস কী করব?
বললুম, ‘বাবা আপনি ভাববেন না। আপনার পুরো হাফটা সুমিত নিক। বাকিটা আপনি ওদের দিয়েই দিন। যা ইচ্ছে করুক।’
‘সুকৃত রাজি হবে না।’
‘ঠিক আছে। সুকৃতকে রাজি করাবার ভার আমার। আর একটা কথা। আপনি কিছুদিন আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন চলুন। আপনার একটু পটবদলের দরকার হয়ে পড়েছে।’
খুব সঙ্কোচের সঙ্গে বাবা বললেন, ‘কি জানিস খোকা, অত ঐশ্বর্য, অত নিয়মকানুনের মধ্যে বাস করা তো অভ্যাস নেই। বেশ ফ্রি হতে পারব না।’
আমি বললুম, ‘বাবা, শেষপর্যন্ত আপনার মধ্যে এই কমপ্লেক্স? এটা আমি আপনার কাছে আশা করিনি। আপনাকে যেতেই হবে।’
আরও সঙ্কুচিত হয়ে বাবা বললেন, ‘জোর করিসনি খোকা। মণি ওদেশে মানুষ। বউমাও অনেকদিন বিদেশে কাটিয়ে এল। ওদের পোশাক, আশাক, চালচলন একটু অন্যরকম তো! আমার সামনে ওরা সঙ্কুচিত হয়ে থাকবে। সেটা আমার খারাপ লাগবে।’
নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, ‘যা ভালো বোঝেন।’
বাবা বললেন, ‘তুই কিছু মনে করলি না তো? আমি কিন্তু কোনও খেদ নিয়ে বলিনি কথাটা। একেবারে প্র্যাকটিক্যাল যা তাই বলেছি। সেটা কি অন্যায়?’
আমার কষ্ট হল। আমার যদি ঐশ্বর্য হয়েই থাকে তো আমার নিজের জন্মদাতা পিতার সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে পারব না? ইচ্ছে থাকলেও? বললুম, ‘বাবা, অন্য কিছু না। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে লাইফ-স্টাইলটা হয়ত সামান্য বদলেই গেছে। আপনি কিছুদিন থাকলে অভ্যেস হয়ে যেত। উগ্রতা তো ওদের কারো মধ্যেই নেই। আপনার অভ্যেসগুলোকেই বা এই বয়সে আমরা পাল্টাতে বলব কেন? আপনার ব্যাপার আপনি বুঝুন, তবে থাকলে আমাদের ভালো লাগত।
বাবা বললেন, ‘তুই বললি, আমারও থিয়োরিটিক্যালি যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বউমাকেও তো বেরোতে হয়। আমি একটা রিটায়ার্ড লোক। ওর দিকটাও তো দেখা দরকার।’
হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করলুম, ‘বাবা, কমলিকা কি কখনও আপনাকে যেতে বলেনি!’
‘না মানে তা নয়, মানে না বললেই বা কি! আচ্ছা বাবু কবে আসবে বলো তো!’
অর্থাৎ বাবা কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন।
ফেরবার সময়ে বড়দা-বউদির সঙ্গে দেখা করে এলুম।
আজকাল আর আগেকার মতো অভ্যর্থনা মিলছে না। দেশে গিয়ে সত্যি সত্যিই দেখে এসেছি আমাদের যৌথ সম্পত্তি—দুতিনখানা বাগান, একশ পঁচিশ বিঘে ধান জমি, প্রচুর মেহগনি গাছ। পাঁচখানা পুকুর, বাস্তু সবই বড়দা মেজদা বিক্রি করে দিয়েছে। বউদির সামনেই দাদার সম্ভাব্য ব্যাঙ্ক ব্যালান্সটার কথা উল্লেখ করে তাকে ধিক্কার দিলুম। এরপর থেকে বড়দার সঙ্গে বাক্যালাপ নেই আমি অবশ্য গ্রাহ্যও করি না। সোজা ঢুকে বউদির খবরাখবর নিয়ে আসি। কথা না বলুক। চিকিৎসাটা তো চলছে! কেমোথেরাপি আরম্ভ হয়েছে।
কমলিকা আজকাল এদিকে আসতে চায় না। বলে, ‘তোমার দাদা, তোমার বউদি। আমার কে? আমি কেন শুধু শুধু অপমান হজম করব?’ রীণা সায় দেয়। বড়দার ছেলে নেই, একটি মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। মেজদারও ওই একটিই ছেলে। চাকরিসূত্রে থাকে অন্যত্র। অথচ এই বাড়ির ঠিক আধাআধি ভাগ পাবার জন্য ওদের লালসা আমার যে কি অস্বাভাবিক লাগে!
৯
আজকে বন্ধুরা বলেছে একটা জয়েন্টে নিয়ে যাবে। খুব মজা হয় নাকি সেখানে। সত্রাজিৎ, নবনীতা, পায়েল, কিটু। ইনটারন্যাশন্যাল স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কিটুই টিকে আছে। বাকিরা সব এইচ্ এস-এর। একটা জিনিস আমার খারাপ লাগে। বন্ধুরা সবাই এখানে আমাকে ডাক নাম ধরে ডাকে। আমার অত সুন্দর নামটা অব্যবহৃত পড়ে পড়ে মরচে ধরছে। ‘আরাত্রিকা’ মানে আরতির প্রদীপ, শিখিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিল—কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা বলছি না। প্রদীপ ধরে দেতাকে পথ দেখানো হয়। তুমি নিজেকে এইরকম একটা স্পিরিট মনে করবে যে বড় কোনও আদর্শকে সর্বদাই স্বাগত জানাচ্ছে।’
মা হেসে বলত—‘আদর্শ-আদর্শ করে ওকে তুমি একেবারে এ-যুগের অনুপযুক্ত করে তুলবে দেখছি।’
এরকম কথা শুনলেই বাবা বলত—‘চরিত্রের গভীরে কোনও আদর্শের শেকড় না থাকলে ওর ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে কি করে?’
বাবা-মা অনেক সময়েই আমায় আরাত্রিকা বলে ডাকত। আই ওয়জ প্রাউড অফ মাই নেম। ভিকি, জেসি, স্যাডি, এইসব অর্থহীন চিহ্নের মাঝখানে আমার নামটা যেন জ্বলজ্বল করত। ওরা উচ্চারণ করতে পারত না, অ্যারাট্রিকা বলতে ওদের প্রাণ বেরিয়ে যেত; কিন্তু সকলেই স্বীকার করত নামটা ওয়ান্ডারফুল। একটা ক্ল্যাসিক্যাল ধ্বনি-গাম্ভীর্য আছে। অনেকে ভাবত নামটা কোনও রোম্যান দেবীর। কিছুতে বোঝাতে পারি না নামটা বিশুদ্ধ সংস্কৃত। অর্থ প্রদীপ। বিশেষ ধরণের প্রদীপ। হিন্দু রিচ্যুয়ালের একটা কাব্যময় চিত্রময় দিক ধরা আছে শব্দটাতে, আবার প্রতীক হিসেবেও নিতে পারা যায়। বাবা বলত—‘যাই বলো আর তাই বলো, নামে ঠিকই আসে যায়। ছেলেমেয়েকে যারা পুঁটি, পটলা, গোবরা, খেঁদি এই সব নামে ডাকে আমি তাদের দলে নেই। আমার নামকরণের মধ্যে সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধাও থাকবে।’
ওরা নামটা উচ্চারণ করতে না পারলে ওদের আড়ষ্ট জিভকে আমি ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু এখানে শর্মি যখন প্রথম একটা জয়েন্টে নিয়ে গেল নাম শুনে ওরা হেসেই অস্থির। একটি মেয়ে, নাম শিরিন, বলল—‘ডোণ্ট মাইন্ড ভাই, আমাদের এখানে অতবড় নাম চলবে না। তোমাকে ট্রিকসি বলে ডাকব।’
সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ছেলে, নাম শুনলাম অম্রীশ, বলল—‘কেন ট্রিংকা আরও গ্ল্যামারাস হবে।’
শিরিন বলল—‘আই প্রেফার ট্রিকসি, বেট শী নোজ ট্রিক্স্। এনিওয়ে, ইউ উইল স্যুট হার হোয়েন শী ইজ টিপসি।’ ন্যাকা-ন্যাকা সুর করে কথাগুলো বলল শিরিন।
ব্যাথশেবার আমার মায়ের নাম ভীষণ পছন্দ ছিল। আবার টেগোরের দেওয়া ওরা অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে তেমন চিনত না। ইন্ডিরা গ্যান্ডি পর্যন্ত ওদের দৌড়। আমরাই চিনিয়েছিলাম। ব্যাথশেবা বলত ওর মেয়ে হলে নাম রাখবে কমলিকা। জিজ্ঞেস করেছিলাম—অত বড় নাম উচ্চারণ করতে পারবে?’
ব্যাথশেবা বলেছিল, ‘সর নামেরই শর্ট ফর্ম আছে। যদি মেয়েকে কিম বলে ডাকি মনে করবে কিছু?’
দ্যাখো কাণ্ড। যে মেয়ে ওর এখনও হয়ইনি, হবে কিনা তাও জানা নেই, তার ডাক নামের জন্য ও আগাম অ্যাপলজি চেয়ে রাখছে! হাউ সুইট অফ হার!
কিন্তু শর্মির বন্ধুরা নামটার মানে শুনে বলল, ‘নেভার মাইন্ড।’ ওদের শর্টনিং-এ আপত্তি জানাতে বলল, ‘ডিড উই আস্ক ফর ইয়োর ওপিনিয়ন? গিভ ইট হোয়েন য়ু আর আসক্ড।’
এখানে আসার পর অনেক দিন হয়ে গেল। এই ক বছরে আমি যথেষ্ট বাংলা শিখে গেছি। এরা কি? নিজেদের মাতৃভাষার সম্পর্কে এদের কোনও শ্রদ্ধা নেই? আমার যখন যা মনে হয় বলে দিই। বললাম, ‘আমি অ্যামেরিকান, আমি উচ্চারণ করতে পারছি আর তোমরা কলকাতার বুকে বসে পারছো না? কি লজ্জা! শিরিন নামটা তো ফারসি আর তোমার নামটা নিশ্চয় অম্বরীষ, অবাঙালিদের মতো অম্রীশ বলছ কেন? আর য়ু অ্যাশেম্ড অফ ইয়োর বেঙ্গলি আইডেনটিটি?’
শিরিন হা-হা করে হেসে চোখ মটকে বলল, ‘কি অম্রীশ বলেছিলাম না ও ট্রিক্স জানে!’ অম্রীশ কাঁধ নাচালো। তারপর ওরা দুজন তথাকথিত ইনটেলেকচুয়াল কথাবার্তায় মেতে গেল। শর্মি চুপিচুপি বলল, ‘তুই ওদের এক হাত নিয়েছিস তো, এবার ওরা তোকে এক হাত নেবার চেষ্টা করছে।’ সল বেলো, আইজেনস্তাইন, নাভ্ৰাতিলোভা, মিক জ্যাগার, চাইকোভ্স্কি··· শুনতে পেলাম। এমন করে কথা বলছে, যেন মিক ওদের পয়লা নম্বর দোস্ত্। আর নাভ্ৰাতিলোভা এই সেদিনের বাচ্চা মেয়ে, গাল টিপে দিলেই হয়।
আমি সেদিন ওখান থেকে চলে আসতে আসতে শর্মিকে বলে ছিলাম, ‘শর্মি তুই এদের সঙ্গেই খালি মিশিস নাকি রে? এরা যে নীদার ফিশ নর ফ্লেশ নর গুড রেড হেরিং! কি সাংঘাতিক ড্রেস করেছে সব। এখানে এসে থেকে মা বাবাকে আমাকে খালি টিকটিক করছে ড্রেস নিয়ে। গোড়ায় আমি শুনিনি। তারপর রাস্তায় ঘাটে বিশ্রী বিশ্রী মন্তব্য শুনে নিজে নিজেই ড্রেস পাল্টে নিয়েছি। হোয়েন য়ু আর ইন রোম ডু অ্যাজ দা রোম্যানস্ ডু। এখানে এরা কিন্তু হট প্যান্ট ট্যান্ট পরে বসে আছে।
আজকে আবার দেখি নবনীতা, সত্রাজিৎরা কোন জয়েন্টে নিয়ে যায়। মাকে বললাম, ‘মা আজ আমার দেরি হবে, কলেজ থেকে এক জায়গায় যাব।’···
মা যথারীতি বলল, ‘ঠিকানাটা দিয়ে যা। আমি ফেরবার সময়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেবো!’
‘আচ্ছা মা, তুমি কি মনে করো, তোমার একার মেয়ের জন্য চারদিকে সব কিডন্যাপাররা ওৎ পেতে বসে আছে?’
মা আস্তে আস্তে বলল, ‘হ্যাঁ রে মণি, আমি ঠিক তাই মনে করি। আমার মেয়েকেই কিডন্যাপ করার জন্যে কিছু নোংরা লোক ফাঁদ পেতে বসে আছে।’
আমি খুব খানিকটা হাসলাম। মা বলল, ‘হাসিস না। আমি অনেক ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছি। তোকে বলতে পারব না। কাগজের কাটিং রেখে দিয়েছি। চাস তো দিতে পারি।’
কাগজ আমিও পড়ি। কাগজ পড়লে মনে হয় মেয়েরা এদেশে খুবই বিপন্ন। বিশেষত দিল্লিতে। তবে এটা তো দিল্লি নয়। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে মা আমি সকাল সকাল ফিরব।’
কি করব পুজোর পর এখনও ভাল করে ক্লাস আরম্ভ হয়নি। আমার হাতে অনেক সময়। নবনীতা, সত্রাজিৎ, কিটু এল। নাদিয়াও এসেছে। নাদিয়া চুড়িদার পরেছে, নবনীতা আর সত্রাজিৎ জীন্স-এর ওপর পাঞ্জাবি, কিটু মিডি স্কার্ট, আমি আজ সম্বলপুরি শাড়ির সঙ্গে চপ্পল পরেছি। সত্রাজিৎ বলল, ‘তুমি আজ খাঁটি সাংস্কৃতিক ড্রেস দিয়েছ আরাত্রিকা, নাচতে হলে পারবে?’ আমি বললাম, ‘কত ফাস্ট নাচ? দেখো পারি কি না!’
বাসটা কয়েক স্টপ যেতে বললাম, ‘চলো না ময়দানের দিক থেকে ঘুরে আসি। কি সুন্দর হয়েছে আজকের দিনটা। ময়দানে গাছগুলোর কি অদ্ভুত শেপ। নাচের ফিগারের মতো। চলো না।’
সত্রাজিৎ বলল, ‘আরাত্রিকা তুমি এরকম কবি-কবি হয়ে গেলে আমরা পুওর ফেলোজ কী করব? ইকো স্ট্যাট্স্ ম্যাথ্স্ নিয়ে পড়ছো। এদিকে গাছের শেপটেপ কি সব আলতু ফালতু বকছ?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘দুটোর মধ্যে কোনও কনট্র্যাডিকশন আছে বুঝি?’
নবনীতা বলল, ‘সিওর। এটা স্পেশালাইজেশনের যুগ। লেট কবিজ টক অ্যাবাউট গ্রীনস্ অ্যান্ড ট্রীজ। আমরা খালি ডিমান্ড সাপ্লাই ইনপুট-আউটপুট করব।’
গলির মধ্যে গলি, তারও মধ্যে গলি। একটা পড়ো মতো বাড়ির সামনে ওরা দাঁড়ালো। ম্যাজানিনে উঠতে হবে।
আমি বললাম, ‘এরকম ডেজার্টেড লুক কেন রে বাড়িটার?’
ওরা বলল, ‘চলই না।’
মেঝেতে একদিকে ঘাসের মাদুর বিছোনো ছিল। তার ওপর কয়েকটা কুশন। প্রচুর অ্যাশ ট্রে। রঙ চটা দেয়ালে দেখলাম ব্রুসলি, বর্গ, অমিতাভ বচ্চনের পোস্টার। হার্ড রকস্ বাজছিল। দেখলাম প্রচণ্ড নাচছে সব। হার্ড রকসের সঙ্গে আমি নিজে ভালো নাচতে পারি না। সফ্ট সোল মিউজিকের সঙ্গে নাচতে নাচতে আমি স্বর্গে চলে যাই। নিউইয়র্ক সেন্ট্রালের অ্যাডাম রকহার্ট বলে ছেলেটা দারুণ নাচে। এদের নাচ কেমন এলোমেলো, বেতালা লাগল। একটু পরেই একটা ছেলে আমাকে একটা সিগারেট অফার করল। এদের এখানে ইনট্রোডাকশনের বালাই নেই। আমি সিগারেটটা রিফিউজ করতে অস্বাভাবিক লাল চোখে আমার দিকে চাইল, বলল, ‘ইদার য়ু স্মোক অর ইউল বি থ্রোন আউট অফ হিয়ার উইদাউট ইওর ক্লোদস্!’ কি স্পর্ধা! সত্রাজিৎ মিনমিন করে বলল, ‘দাও না একটা টান, কিছু হবে না।’ নবনীতা ইঙ্গিতে জানাল যে ছেলেটা ওইসব বলল সে একেবারে আউট হয়ে গেছে। কিছু যেন মনে না করি। আমি ভেতরে রাগ নিয়েও শুদ্ধু ওদের চ্যালেঞ্জটা নেব বলে একটা টান দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সাংঘাতিক কাশি। বিশ্রী গন্ধ একটা বুকের মধ্যে পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। গন্ধটা আগেও পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘরটা বন্ধ, অতজনে স্মোক করছে তাই বোধহয়। রেগে লাল হয়ে বললাম, ‘এর ভেতরে মারিহুয়ানা আছে। আমার সঙ্গে চালাকি করছ, না? জানো আমার বাবা পর্যন্ত একদিন এক কথায় স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছেন? তোমাদের শুট করা উচিত!’
আমি আর দাঁড়াইনি। বন্ধুদের দিকে তাকাইনি। স্রেফ দৌড়তে দৌড়তে চলে এসেছি। পেছনে অনেকগুলো হাত আমাকে ধরতে আসছে। তখনই দেখলাম বেশ কয়েকজন বয়স্কও রয়েছে দলে। বীভৎস শয়তানের মতো মুখগুলো। কে বললে, ‘স্পাই ধরো ধরো!’ কয়েকটা আঙুল আমার কাঁধের ওপরে···। লোকগুলো নেশাগ্রস্ত বলেই আমার পক্ষে বেরিয়ে আসা সম্ভব হল। রাস্তাটা ভাল চিনি না। কিছুদূর আসতে মনে হল এটা টাউনসেন্ড রোড। তার মানে দিদিমার বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। তারপর দেখি রাস্তা দিয়ে উল্টোপাল্টা লোক ছুটছে। একজন ছুটতে ছুটতে বলে গেল ‘ইন্দিরা গান্ধী মার্ডার্ড, খুন হয়েছেন নিজের বাড়ির হাতায়, দেহরক্ষীরা খুন করেছে।’ সকালে একবার যেন শুনেছিলাম ওঁকে গুলি করা হয়েছে, কিন্তু সেটা যে এতো সিরিয়াস তা তো বলেনি। ছুটতে ছুটতে ঢুকে গেলাম বকুলবাগান রো। ‘দাদাই দাদাই!’ দিদিমা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘মণি, এমন অসময়ে!’ দাদাই বললেন, ‘ভালো করেছিস। এখন কোথায় দাঙ্গা-টাঙ্গা লাগবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যা একবার ওপরে, যা, তোর মা-বাবাকে ফোন কর। নিশ্চিন্ত করে দে ওদের।’
দাদাই রেডিও নিয়ে বসে আছেন। শুনতে শুনতে আমার ভয় হল দিদিমা যদি আমার শাড়িতে গাঁজার গন্ধ পান। বাথরুমে ঢুকে জামা কাপড় ভিজিয়ে ফেললাম। মুখ ধুলাম ভালো করে। দাঁত মাজলাম, দিদিমা বললেন, ‘ও কি রে?’
‘ভিজিয়ে ফেলেছি দিদিমা, তোমার শাড়ি দাও।’
দিদিমার শাড়ি, পেটিকোট আর ডবল সাইজের ব্লাউজ পরে বাবাকে ফোন করতে গেলাম। মানুষ-মাকড়সার স্পর্শগুলো দিদিমার শাড়ি পরতে তবে গেল গা থেকে।
এই তাহলে ইন্ডিয়া! যেসব বিকৃতি আমেরিকাকে স্পর্শ করছে, সেগুলো সাত তাড়াতাড়ি এরা পিকআপ করছে কাঙালের মতো! যেন ফ্যাশন! ট্রাইং টু বি মোর অ্যামেরিকান দ্যান অ্যামেরিকানস্! এদের পোশাক-পরিচ্ছদ কথা-বার্তা সংস্কৃতি সবই তো দেখি মার্কিন-মার্কা! আমরা আমাদের ছোট্ট ভারতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে একটা অবিকৃত ভারতবর্ষকে অটুট রাখবার চেষ্টা করতাম। আমাদের মা-বাবারা কত কাজের মধ্যে সময় করে আমাদের বাংলা শেখাতেন। মাতৃভাষা নিয়ে বেশ একটা গর্বের ভাব দেখতাম ওখানে। শশাঙ্কজেঠু ওঁর ঢাকাই বাংলা পর্যন্ত আমদানি করবার চেষ্টা করতেন। অথচ উনি বরাবর কলকাতায় মানুষ। কিন্তু এরা? এরা প্রাণপণে ভোলবার চেষ্টা করছে যে বাস এদের কলকাতায় তথা ভারতে, এবং ভাষা বাংলা। বাঙালিদের মধ্যে আবার অবাঙালিদের নকল করার চেষ্টা। কি সুন্দর হত আমাদের টেক্সাসের দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান! এখানে এত চিৎকার করে পাড়ায় পাড়ায় লাউড-স্পিকার লাগায় যে গান শোনা তো দূরের কথা, কিছুক্ষণ পরই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। একজন মহিলাকে, হোন না তিনি প্রধানমন্ত্রী, তাঁকে এভাবে ষোল না কত রাউন্ড গুলি করে মারবে! তাঁর নিজের রক্ষীবাহিনীর লোক! কি কাপুরুষ! এরা কি কাপুরুষ! নৈরাজ্য আর কাপুরুষতার কি লজ্জাকর নিদর্শন! বাবা সেদিন মার সঙ্গে কলেজের প্রবলেমের কথা বলাবলি করছিল! দেয়ালে পোস্টার। মুখে অসভ্য ভাষা, লেখাপড়া ছাড়া সব কিছু হয়, সবচেয়ে বেশি হয় পলিটিক্স। বলতে বলতে বাবার মুখ থমথম করছিল। মা বলল, ‘দোহাই তোমার, তুমি জানপ্রাণ লাগিয়ে এসব সিস্টেম ঠিক করার চেষ্টা করতে যেও না। আমাদের কথা ভাবো!’
এই ইন্ডিয়া! এরই জন্য অত কষ্ট করে অতদূর থেকে আমার জন্মভূমি ছেড়ে আমি এলাম!
কমলিকা ফোন করেছিলেন সুদীপকে। আরও অনেককে লিফ্ট দিতে দিতে ওঁরা যখন বকুলবাগানে পৌঁছলেন, তখন মণি ঘুমিয়ে আছে। বাথরুমে বালতিতে ওর নতুন সম্বলপুরি শাড়ি, ব্লাউজ সব ভেজানো। দিদিমার চওড়া পাড় সাদা শাড়ি আর ঢোলা ব্লাউজ পরে মণি ঘুমোচ্ছে, কুঁকড়ে। কমলিকা ঝুঁকে পড়ে দেখলেন ওর গালে জলের দাগ। মণি কি কেঁদেছে? ইন্দিরা গান্ধীর জন্য? মণি তো সহজে কাঁদবার মেয়ে নয়!
১০
আজ একটা বিশ্রী খবর পেলাম। সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছিলাম। জবা চিঠিটা দিয়ে গেল। নিউ ইয়র্কের ছাপমারা চিঠি। দেখলেই মন হু হু করে, চলে যাই সেন্ট্রাল পার্ক, ব্রডওয়ে। গ্যালভেস্টন সমুদ্রতীরে পারিবারিক পিকনিক। ফরেস্ট হিলস্-এ-টেনিস দেখতে যাওয়া। জ্যোতির হাতের লেখা। লিখেছে:
প্রিয় সুদীপদা-কুমু,
আমার জীবনে এই ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি। দীপালি আর নেই। মানহাটান থেকে জার্সি সিটিতে ফিরছিল একগাদা বাজার সেরে। লিঙ্কন টানেল দিয়ে। ও একাই ছিল গাড়িতে। গাড়ির মধ্যেই সেরিব্র্যাল অ্যাটাক হয়। ন্যাচারালি আরও দু চারখানা গাড়ি হুড়মুড় করে পড়ে। অ্যাকসিডেন্টে একটা হাত চলে গিয়েছিল, স্ট্রোকে আরেকটা। পাঁচ ঘণ্টা অজ্ঞান অবস্থায় যুঝেছিল। ইদানিং বড্ড মোটা হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক বছরই তো নিজে সব চেক-আপ করতুম। তোমরা থাকতে তোমাদেরও করেছি। ওর প্রেশারটা বড্ড ফ্লাকচুয়েট করত। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এতোটুকু সাবধান হত। আমি বোধহয়, যতটা জোর করা উচিত, করিনি। সংসারের যাবতীয় ঝামেলা সবই তো ওর। ও-ই বাড়িতে সভারেন। কখন কি খাচ্ছে না খাচ্ছে আমি অতটা খেয়াল রাখিনি। এটাই ওর প্রথম স্ট্রোক। তানি গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছে, বুলেট-অ্যাটমের জন্য ওকে বাড়িতে এসে বসতে হয়েছে। ওরা স্বাবলম্বী হলে, তবে ছুটি দিতে পারবো তানিকে। এখন ওকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছেলে দুটো অবশ্য খুব শান্ত হয়ে গেছে। তানি আমাকে বাচ্চা ছেলের মতো কনট্রোল করছে। যেসব সাবধানতা দীপালির অবলম্বন করা উচিত ছিল, সেগুলো আমার ওপর দিয়ে চালাচ্ছে। বেচারা! শুভময়ের স্ত্রী অফার দিয়েছিল ওদের দেশে নিয়ে যাবে। আমাকেও ফিরে যেতে পরামর্শ দিচ্ছে সবাই। ভেবে দেখলুম সেটা আর সম্ভব নয়। তিন ছেলে মেয়ে শিক্ষার তিন পর্যায়ে আছে, সব্বাইকে উপড়ে নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত কাজ হবে। ছেলে দুটোর স্কুলিং হয়ে গেলেই তানির ছুটি। বিয়ে করুক, চাকরি করুক, কোনও কোর্স নিক। যা ইচ্ছে। ওখানে গিয়ে মানাতে পারবে বলে মনে হয় না। তারপর এই সাত ঘরের প্রাসাদে আমি একা। এই একাকিত্ব তো আমরা প্রত্যেকে অনেক কষ্ট করে উপার্জন করলুম, তাই না? সুদীপদা, তোমার খবর বলো। আশা করি সাবধানে আছো। তোমার ট্রাবলটা ঘুমিয়ে আছে। আমাকে লিখতে দ্বিধা করো না। টেনশন ফ্রি থাকবার চেষ্টা করো। ডক্টর রায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগটা রেখে যাও।”
চিঠিটা পড়ে চুপ করে বারান্দায় বসে রইলাম। এখনও সুদীপ আসেনি। মণি কলেজ থেকে যাবে ফরাসী ক্লাসে। ফিরতে সাড়ে সাতটা তো হবেই। কাজের মেয়েটির নাম জবা। খুবই ভালো, বুদ্ধিমতী। আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে এক কাপ কফি দিয়ে গেল। পায়ের কাছে বসে আস্তে জিজ্ঞেস করল – ‘কিছু খারাপ খবর আছে, না মা?’ আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম।
বাবা দু বছর দিল্লিতে পোস্টেড ছিলেন। সেই সময়ে নেহাত ভাগ্যচক্রে দীপালির সঙ্গে আলাপ। আমি আর ও একই গাড়িতে লিফ্ট্ নিয়েছিলাম। দুজন অল্পবয়সী মেয়ে একত্র হলে যা হয়, বক বক বক। দু বছর পর কলকাতায় ফিরে এসেছি, একদিন নিউ মার্কেটে দীপালির সঙ্গে দেখা। ওর বাবা রিটায়ার করে নিউ আলিপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন। এয়ার-ফোর্সে খুব বড় পোস্টে ছিলেন ওর বাবা। নিউ আলিপুরে ওদের বাড়িটা ছিল আমার একটা স্থায়ী আড্ডাখানা। ও আমার গান শুনতে ভালোবাসত, আর ওর সরস ব্যক্তিত্ব আকর্ষণ করত আমাকে। জ্যোতির সঙ্গে ওর বিয়েটা বলতে গেলে আমিই ঘটাই। যতদিন বিদেশে ছিলাম জ্যোতি দীপালি ছিল আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সত্যি কথা বলতে কি আমি এখানে এসে নিউ ইয়র্ক আর ততটা মিস করি না, যতটা করি ওদের। মাঝে মাঝেই ওদের লিখেছি ‘তোমরাও চলে এসো না, দারুণ মজা হয় তাহলে।’ দীপালিরও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জ্যোতি জানিয়ে ছিল ডাক্তারের প্র্যাকটিস চট করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তুলে নিয়ে যাওয়া যায় না।
বেল বাজল। সুদীপ খুব সম্ভব। আমি মুখ ফেরাইনি। জবা কিছু বলে থাকবে। আমার কোলে পড়ে থাকা চিঠিটা ও তুলে নিল। চোখের জলে আমার সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সুদীপ বলল ‘ইস্স্ দীপালি একি করল?’ ও বসে পড়েছে একেবারে, মাথায় হাত, কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দিকে বিহ্বলের মতো চেয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল কুয়াশায় সাঁতার কাটতে কাটতে একটা চেনা মুখ একটা প্রিয় ভঙ্গি যেন ভেসে আসছে। চোখ মুছে ঝুকে পড়লাম।
—‘ও কি ও যে বাবু।’
সুদীপ বলল —‘কই?’ ও ঝুঁকে পড়েছে। বাবু আমাদের দেখতে পেয়েছে, হাত নাড়ছে।
দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছি। জবাকে বললুম, ‘একটু চীজ স্যান্ডউইচ আর কালো কফি করো, তোমার দাদা আসছে।’ সিঁড়িগুলো লাফাতে লাফাতে উঠে আসছে বাবু। তবু কতদূর! দোতলা, তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা এখনও ওরা লিফ্ট্টা করে দিল না। সরকারি কানুনকে কলা দেখিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির মুখে বাবু। সেই আদি অকৃত্রিম ব্লু জীনস্, একটা সাদা ভেস্ট, কলারে হাতায় সরু লাল-নীল ডোরা কাটা। মাস্লগুলো ফুলে আছে ভেস্টের হাতের তলায়। ওর হাতে সুটকেসটা যেন একটা খেলনার বাক্স। মুখে এখনও দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। তবে ছেঁটেছে। মাথার চুলগুলো ফুলে রয়েছে। ওই রকম সিংহের কেশরের মতো চুল হলে তাকে পরিপাটি রাখা মুশকিল। আমি অর্ধেক ছুটে গেলাম। বাবুর বুকে মাথা রেখে কাঁদছি। ছেলে বড় হয়ে যাওয়ার কি সুখ! অনেক অনেকদিন এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলাম যেন। সুদীপ বলছে—‘আচ্ছা ইয়ে হয়েছিস তো তুই? খবর-টবর কিচ্ছু না দিয়ে···’
বাবু বলল – ভয়ে খবর দিইনি বাবা। তুমি যেরকম একটার পর একটা অর্ডার দিয়ে যাচ্ছো! শেষকালে বলবে পোস্ট ডক্টর্যালটাও নিয়ে নে। এদিকে আমি তোমাদের না দেখে·····মণি কই?’
আমার একচোখে জল। একচোখে হাসি। বাবু বলল—‘ভেরি স্যাড মা। আমি জ্যোতিকাকুর সঙ্গে দেখা করেই আসছি। বলেছি ছেলের দরকার হলে আমি আছি। ঠিক বলেছি বাবা?’
—‘নিশ্চয়! ভেতরে আয়।”
—‘ফ্ল্যাটটা তো দারুণ! বাবু ঢুকেই বলল —‘নাঃ আমাদের গৃহভাগ্যটা ভালোই। বউবাজারের বাড়ির ঘরটাও বোধহয় পুব দক্ষিণ খোলা, ষোলো বাই যোলো ছিল, নামা?’
জবা চীজ স্যান্ডউইচের প্লেট আর কফি ট্রেতে নিয়ে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে। বাবু হাত টাত না ধুয়েই একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে কামড় দিয়ে বলল—‘তুমি করেছ? জবা তোমার নাম, না? ওয়ান্ডারফুল হয়েছে ভাই। মণি কোথায়? মণি?’
মাঝরাত্তিরে কমলিকার ঘুম ভেঙে গেল। ঘটনার বাহুল্যে কি যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। বেডসাইড টেবিলে চাপা দেওয়া ছিল জ্যোতির চিঠিটা। ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে আবার পড়লেন। কী লিখেছে এটা জ্যোতি? ‘তোমার ট্রাবলটা ঘুমিয়ে আছে।’ আস্তে সুদীপকে ঠেলা দিলেন কমলিকা। ‘শুনছো! শুনছো!’ অনেকক্ষণ পর একটু চোখ মেললেন সুদীপ।
—‘কী হল? কী ব্যাপার?’
—তোমার কী হয়েছে?’
—‘আমার? কী হবে আমার দিব্যি ঘুমোচ্ছিলুম। দিলে তো ঘুমটা ভেঙে।’
—‘জ্যোতি তোমার কি ট্রাব্ল্-এর কথা লিখেছে? কী হয়েছে তোমার? আমায় কিছু বলোনি তো’!’
—‘এই জন্যে তুমি আমায় মাঝ রাত্তিরে···নাঃ···কবে একটা ব্রীদিং ট্রাব্ল মতো হয়েছিল। সে তো জ্যোতি তখনই সারিয়ে দিয়েছে····।’
—‘সারিয়ে দিয়েছে, খুব ভালো কথা। কিন্তু আমায় বলোনি কেন?
—‘বলার মতো কিছু হলে নিশ্চয় বলতুম।’ সুদীপ কাছে সরে এলেন।
—কমলিকা হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন —‘তোমার বয়সটা বাড়ছে, খেয়াল রেখো। ডেস্ক ওয়ার্ক করে বেশ ভুঁড়ি বাগিয়েছ, জুলপি একদম পেকে গেছে। আমাকে কথাটা বলতে তোমার কী হয়েছিল? আমি চিরকাল মুখ বুজে তোমার সব কথা শুনে যাবো আর তুমি··।’
—‘বাবাকে একবারও এখানে এসে থাকতে বলেছিলে, কমলিকা?’
—‘সে আবার কি? উনি কি বলেছেন আমি বলিনি?’
—‘তা বলেননি। কিন্তু কেন একবারও এখানে এসে থাকতে চাইলেন না, বুঝলুম না।
—‘তেমনভাবে হয়ত বলিনি। আসলে আমার খেয়াল হয়নি। সর্বদা এতো রকমের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। ঠিক আছে, বলব এবার। এ নিয়ে এতো নাটক করবার দরকার কি ছিল?’
এ ঘরে ভোর পাঁচটাতেই রোদ ঢুকে পড়ে। সুদীপ ঘুমোচ্ছেন। কমলিকার সেই থেকেই ঘুম আসে না। শ্বশুরমশাই খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু কতকগুলো বদভ্যাস আছে। প্রচণ্ড স্মোক করেন। আর স্মোকারদের অনেকেরই যা হয়। ভীষণ কাশি। বুড়ো বয়স বলেই হয়ত কাশিটা বেশি। যখন তখন থুতু ফেলেন। বউবাজারের বাড়িতে একটা দশাসই পেতলের পিকদান আছে। তাতেই ফেলেন। সেটা হাতের কাছে না থাকলে জানলা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে। এ দেশে যেমন একই সঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দী আর বিংশ শতাব্দী অবস্থান করে, তেমন শিক্ষা সংস্কৃতি মহানুভবতা সহাবস্থান করে সামান্যতম নাগরিকত্ববোধের অভাব, সংকীর্ণতা স্বার্থপরতার সঙ্গে। একজন এম এস সি এল এল বি গলা খাঁকারি দিয়ে সশব্দে থুতু ফেলছেন বাড়ির বারান্দা অথবা জানলা দিয়ে, একজন খুব রোম্যান্টিক গজল গায়ক সন্ধের ঝোঁকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের তলপেট হালকা করে নিচ্ছেন এইসব এবং আরও অনেক আপাতবিরোধী অবিশ্বাস্য দৃশ্য এখানে দেখা যায়। এই তো সেদিন গড়িয়াহাট মিনি চারমিনারের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলেন জনৈক সুবেশ ভদ্রলোক, মনে হয় কোনও মার্চেন্ট অফিসের অফিসার। ছাই রঙের সুট। র সিল্কের টাই। ‘নো স্মোকিং’ বিজ্ঞপ্তিটার ঠিক সামনের সিটেই বসেছিলেন। কমলিকা পেছনে। আপত্তি জানাবেন ভেবেছিলেন, মুখ খুলেই চুপ করে যেতে হল, অবিনাশবাবুর, মানে বাবা মার বাড়িঅলার বড় ছেলে। অসুখ বিসুখ করলে ডাক্তার ডেকে আনা, রাত জাগা পর্যন্ত করেছেন ভদ্রলোক। বাবার ছানি পড়ার থেকে বাজারে যেতে দ্যান না, বলেন —‘আমি তো যাচ্ছিই, আপনি আর খামোখা কষ্ট করতে যাবেন কেন কাকাবাবু।’ শ্বশুর মশাইয়ের এই অভ্যাসটাকে কমলিকা ভয় পান। বারান্দা দিয়ে থুতু ফেললে এখানে তলার ফ্ল্যাটে পড়বে। তলার ফ্ল্যাটের মিসেস বড়ুয়া হয়ত তখন ঊর্ধ্বমুখে চুলের জট ছাড়াচ্ছেন···। আর পিকদানি কে পরিষ্কার করবে? জবা করবে না। দুর্গা বলে যে ঠিকে লোকটি কাজ করে চামচিকে মরে পড়ে থাকলেও সে ঘেণ্ণায় মূর্ছা যায়। তাহলে বাকি রইলেন তিনি।
এই ছোট্ট অথচ জরুরি সমস্যাটার কথা কাউকে বলা যাবে না। একমাত্র ভরসা শ্বশুরমশাইয়ের নিজেরই যদি জিনিসটা খেয়াল হয়। সুদীপ বেরোবার সময়ে বলে গেলেন—‘বাবু এসেছে এই উপলক্ষ্য করে যদি বাবাকে আনা যায়। তুমি ফোন করে রেখো। আমি আসার পথে নিয়ে আসবো।’
বাবু বলল—‘আমি তো ও-বাড়ি যাচ্ছিই। আমিই নিয়ে আসবো এখন। তুমি সোজা বাড়ি চলে এসো। আমি ব্রেকফাস্ট করেই চলে যাচ্ছি।’
কমলিকা বললেন—‘তুই না বলে গেলে রীণার অসুবিধে হতে পারে। লাঞ্চ করে যাস।’
বাবু কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিল—‘খাওয়াটা আবার একটা প্রবলেম মা! তারপর দিলে তো একগাদা ব্রেকফাস্ট!’
একগাদা ব্রেকফাস্ট! ছেলেটা কি আজকাল অ্যামেরিকান কলেজীদের মতো ডোনাট চিবিয়ে আর কোক গিলে থাকে না কি? হেভি ব্রেকফাস্ট মণির জন্যই বিশেষ করে করতে হয়। সারাদিনের জন্যই একরকম বেরিয়ে যায় ও। সুদীপকেও তাই দ্যান কমলিকা। বয়স হচ্ছে। ভাতটাত বেশি খাওয়া ভালো না। ভুঁড়িটা সত্যিই বেড়েছে। ওদেশে সবজিগুলো হত পেল্লাই। কিন্তু খেতে ঘাসের মতো। মাংস তো বীফ বা পর্ক ছাড়া খাওয়াই চলে না। এখানে গুচ্ছের ভালো সবজি। প্রচণ্ড খাওয়ার ঝোঁক। পছন্দসই রান্না হলে একথালা ভাত মেরে দেবে। সবার অভ্যাস পাল্টালো, ওর পাল্টালো না।
১১
ফেব্রুয়ারির শেষ। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া। সহদেববাবু বৈঠকখানার ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে কাগজ পড়ছিলেন। ছাই রঙের আলোয়ানটা কাঁধ থেকে আলতো ঝুলছে। সকালে একবার এ-ঘরে আসে কাগজটা। কাগজঅলা এখানেই দিয়ে যায়। তারপর ভেতরে যায়। সুমিতের পড়া হয়ে গেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার সময় পান তিনি। বাড়ির ভেতর থেকে রান্নার শব্দ এবং গন্ধ মাঝে মাঝে তীব্রভাবে ভেসে আসে। ডালে সম্বরা দেবার গন্ধ। পাকা লঙ্কা ফোড়নের ঝাঁঝ। সদর দিয়ে একবার দুধ নিয়ে, আরেকবার বাজার নিয়ে চলে গেল দুই নাতি। নিস্তব্ধ সকালবেলা, দু’ চারটে শব্দের ফোড়নে যেন আরও শুনশান। সেন্টার স্প্রেডটা ভালো করে পড়া হয়ে গেল। কানট্রি নোটবুক। লেটার্স টু দি এডিটরে প্রায় লেখেন। সেই চিঠি নিয়ে বিকেলবেলা তুমুল আলোচনা হবে। আশুবাবু আসবেন, গৌতম চাটুজ্জে আসবে। আজও একটা বেরিয়েছে। আসাম-সমস্যা নিয়ে। আসামের সমস্যা তো পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা কিছু নয়! অথচ আগাপাশতলা অনুপ্রবেশকারী নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই বাসের মতো বিপজ্জনকভাবে এখনও তো পশ্চিমবঙ্গ চলছে! আর্তনাদ করছে কিন্তু কই রক্তচক্ষু তো দেখাচ্ছে না? তাহলে বাঙালির মধ্যেই কি শুধু মানবধর্ম বেঁচে আছে? নাঃ, ইংরেজিটা এখনও ভালোই লেখেন তিনি। লেখার মধ্যে বেশ জোর আছে। অল্পবয়সে রাজনৈতিক বক্তৃতা করেছেন তো ভেতরের এই শক্তির জোরেই! আহা! কি দেশ কি হয়ে গেল! কত আশা, কত ভরসার স্বাধীনতা! কিভাবে শুধু মুষ্টিমেয় কটা মানুষকে গদীতে বসাবার জন্যে ভারত ভাগ করলে এরা। মহাত্মাজীর নীরবতায় কি গভীর আঘাতই পেয়েছিলেন সেদিন! কথা দিয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভারত ভাগ হবে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের লজ্জা তাঁকে স্পর্শ করেনি? সেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরও তো রাজনীতিতে মাথা গলাতে ছাড়লেন না। কিভাবে আত্মকলহের সুযোগ নিল ইংরেজরা। ছি! ছি! এই কি এডমাণ্ড বার্ক, ডেভিড হেয়ার, উইলিয়াম জোনসের দেশের লোকের কাজ! একবার ভাগাভাগির পথটা দেখিয়ে দিয়েছে, আর···। সামনে ছায়া পড়ল। কে? সদর খোলা। রোদ এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্যে দীর্ঘ ছায়া। সহদেববাবু চোখ তুলে অবাক হয়ে গেলেন।
‘স্বদেশ নাকি? নাতিবাবু?’ উঠে দাঁড়ালেন সহদেবাবু। বাবু মাথা নীচু করবার আগেই তাকে ধরে ফেলেছেন। বিজয়া দশমীর কোলাকুলি করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন, সহদেব মুখার্জি। বড় আদরের দেশ তাঁর। দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত, সমস্যাপীড়িত, রুগ্ন তবু নিজের দেশ। ছেলেবেলার ভক্তি, যৌবনের ধ্যানজ্ঞান। নিজের এই দেশের কথা মনে করেই প্রথম নাতির নাম রেখেছিলেন। এই স্বদেশ যুবক, অকপট, বুদ্ধিমান। তেজস্বী অথচ নম্র। তাঁর দেশকে এই রকম চেহারায় আসতে দেখলে সুখে মরতে পারবেন।
বাবু হাসিমুখে বলল—‘দাদু, তোমার পাঞ্জা আগের মতন আছে তো? লড়ব কিন্তু।’
—‘তা লড়ো না ভাই। তবে জয়পত্রী আমি আগে থেকেই তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।’
সাড়া পেয়ে রীণা ভেতর থেকে উঁকি মেরেছে। হাতে মাছভাজার খুন্তি। শাড়ির খানিকটা মাথায়, খনিকটা কোমরে জড়ানো। বাবু বলল—আরে বাস, ন কাকিমা তুমি যে এখনও সুইট সেভেনটিনেই রয়ে গেছো। টুলটুল কোথায়? বাবলু? সুমন?’
—‘টুলটুল ভেতরে, পড়ছে। বাবলু কলেজ। সুমন কোচিংয়ে। তুই এরকম হঠাৎ।
—‘আমি এরকম হঠাৎই আসি।’
বাবু একলাফে রীণাকে পেরিয়ে গেল। জুতোটা খুলে দুতিন লাফে দোতলার সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদ। রীণা সিঁড়ির দিকে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে ছিলো, মুখে হাসি। বাবু তো তারও ছেলের মতো। মা-বাবা ছাড়া আমেরিকা থেকে যখন আসত তখন শাশুড়ি আর তার কাছেই তো থাকত।
চিলেকুঠুরিটা এককালে ঠাকুরঘর ছিল। তাছাড়াও আগে এ-ঘরে প্রচুর আচার আমসত্ত্ব থাকত। যমুনাপিসি বলে একজন পুরনো লোক ছিল এ-বাড়ির। সে সারা শীতকাল অজস্র আচার করত। এখন এখানে থাকে রাশি রাশি ঠাকুর দেবতার মূর্তি, মানুষেরও ছবি। পুজো হয় না, পরিষ্কারও হয় না, মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে সব। যে দু’ একটা মূর্তি পুজো করা অত্যাবশ্যক বলে মনে হয়েছে সেগুলো এখন বড়মার ভাঁড়ার ঘরে। এ-ঘরের দেবকুল, পিতৃকুল সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বাবু খুঁজতে লাগল। শীতলা, তারা, চতুর্ভুজ বিষ্ণু, রাধাকৃষ্ণ, সরস্বতীর পট, কমলে কামিনী, লক্ষ্মী। ওই তো পেছন দিকে বেঁকে রয়েছে দিদুর ছবি। এটা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সের। যে সময়ে ছ সাত বছরে বাবু তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরত। এই দিদুকে বাবু ভালো করে চেনে। মাথায় আধঘোমটা। একদিক থেকে চুলের রাশ বুকের ওপর এসে পড়েছে। কপালে সিঁদুর টিপ। শাড়ির পাড় লাল। রঙ করা ছবি। বুদ্ধিভরা, মায়াভরা চোখ দিদুর। চিবুকে কি গভীর মমতা। মা যাহা ছিলেন। বাবু ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ফিসফিস করে বলল—‘আমি এসে গেছি দিদু। একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু তুমি তো এখনও আছে, তাই না?’
—‘কে? কে ওখানে?’
চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে বাবু দেখল—ভীষণ ফ্যাকাশে, অদ্ভুত দর্শন এক মহিলা, মাথার চুলগুলো উঠে গেছে। কপাল অবধি ঘোমটা তুলে দিয়ে ঘরের দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘আমি বাবু, স্বদেশ। এ-ঘরে দিদুর ছবি খুঁজতে এসেছিলুম।’
—‘আমি তোমার বড় জ্যাঠাইমা। চিনতে পারছো না, না? কী করে পারবে? রোগে রোগে শরীর এমনি হয়েছে।’
পেছনে মেজজেঠী এসে দাঁড়িয়েছেন, বললেন,—‘থাক দিদি, সবে এসেছে। কী বলছো ওকে।’
হঠাৎ মনে পড়ল, নীচু হয়ে দুজনকে প্রণাম করল বাবু।
বড় জেঠিমা বললেন—‘আহা, কি সুন্দর ছেলে রে শান্তি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দ্যাখ শান্তি, কতদূর থেকে এসে ও আগে ঠাকুর পেন্নাম করছে। আমি ঠাকুরঘরের মোটে যত্ন নেইনি। তাই-ই বোধহয় আমার এ রোগ হল।’
বাবু বলল—‘কী বলছো জ্যাঠাইমা! এসব ভাবনার কোনও মানে হয়?’
মেজ জেঠিমা বললেন, ‘কতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে? নীচে চলো। তোমার বড়দির সঙ্গে দেখা করবে না?’
দুজনে আস্তে আস্তে ধরে ধরে বড় জ্যাঠাইমাকে নামিয়ে ওঁর ঘরে শুইয়ে দিল। বাইরে আসতে আসতে মেজ জেঠিমা বললেন—‘দিদির মাথাটাও আস্তে আস্তে কেমন হয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকেই আমায় বলবে ওপরে ঠাকুরঘরে নিয়ে যেতে। এইসব উল্টো-পাল্টা ভাবছে তা তো বুঝিনি। আসছে পুন্নিমেয় সত্যানারায়ণের শিন্নি দিতে বলছে।’
বাবু খুব অভিজ্ঞ লোকের মতো বলল—‘দাও না জেঠিমা, যাতে ওঁর মনে শান্তি আসে তাই করো। শান্তিটাই আসল।’
একটা বাড়ি এতো বিবর্ণ, প্রাণহীন হতে পারে, ভেতরকার আবহাওয়া এমনি কবরখানার মতো ভয়াবহ রকমের শীতল হতে পারে, না এলে, না দেখলে বিশ্বাস করতুম না। মণি লিখেছিল, কিন্তু মণি একেক সময় ভাবাবেগে বড্ড অতিকথন করে। তাছাড়া মণি হঠাৎ এখানে এসে এ-বাড়িতে প্রাণশক্তি অনুভব করবে এটা আশা করাও অন্যায়। ও তো এখানে আরোপিত! কিন্তু এখন দেখছি মণির কথাই ঠিক। আমার ছোটবেলার স্মৃতির বাড়ি, যেখানে আমি বারবার ফিরে এসেছি, সে অন্যরকম। অনেক বড়, অনেক খোলামেলা। রোদ, হাওয়া, ফুলগাছ। ঝারি করে জল দিতুম আমরা। আমি, সুনীলদা, শুচিদি। সবাই চলে গেছে। সুনীলদা ধানবাদে। শুচিদি মধ্যপ্রাচ্যে। বড়পিসি নিয়মিত আসে না। বাড়ি নদীর মতো। প্রিয় মানুষদের যাওয়া-আসা না থাকলে স্রোতহীন নদীর মতো মজে যায়। এ-বাড়িটাও বোধহয় তাই। বাড়িটা অনেকগুলো ভুল করেছিল, সেই ভুলের স্বরূপ কি আমি জানি না। কিন্তু সেই জন্যেই এ-বাড়ির স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে। ওপরের ওই ঠাকুরঘরটায় কিছু মূর্তি আর পট ছিল, নিয়মিত পুজো হত। তাই ঘরটা থাকত পরিষ্কার, ফুল ধূপ আর ধুনোর গন্ধে ভরপুর। ছাদে এলে কত কথা বলতেন দিদু। তিয়াত্তর সালে দিদুকে শেষ দেখেছি। বলতেন—‘জানিস বাবু, এই ঠাকুরঘরটা এক হিসেবে আমাদের জীবনের কেন্দ্র। কেন না এখানে আমাদের মনোযোগ, ধ্যান, ভক্তি আর প্রার্থনা আমরা সমর্পণ করছি। বদলে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস, শান্তি। ঠাকুর-দেবতারা নিজেরা, তাঁদের চারটে করে হাত, একাধিক মুখ, আয়ুধ এ সব আসল নয়। আসল হল এর পেছনে যে মহৎ কল্পনাশক্তি কাজ করেছিল সেটা, সেই ভাবটা। অন্যায়, অবিচার, হিংস্রতা, লোভ—এসবকে আমি হত্যা করছি, আকাশের মতো এক বিরাটত্বকে আমার মধ্যে আসন পেতে বসাচ্ছি—এই ভাবটা নিয়ে আমি এখানে বসি। আমার তো আর কিছু করার জো নেই! তোরা এগুলোকে হাতে-কলমে করবার সুযোগ পাবি।’ একটু মুখ উঁচু করে দিদু কথাগুলো বলতেন, আমার মনের মধ্যে কেটে কেটে বসে যেত কথাগুলো। হিউসটনে আমার মিশন স্কুলে যিশুকে কেন্দ্র করে কত কি-ই হত। যিশু একজন ঐতিহাসিক মানব। আর পাঁচজন মানুষের মতো, অথচ বড়। তাই আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগত দিদুদের এই অদ্ভুত দর্শন দেবতাদের পুজো করায়। দিদু ছোট বলে মোটেই আমাকে, আমার প্রশ্নকে তুচ্ছ করতেন না। এইভাবে উত্তর দিতেন। আমার মনে হত দিদুর আরও অনেক কথা বলার আছে, আমি বুঝব না বলে বলেন না। সেই না-বলা-কথাগুলো দিদুর কপালে, ঠোঁটে কি এক রহস্যময় আলো ফেলত। একমাত্র ছাদে বা ঠাকুরঘরেই এই দিদুকে দেখা যেত। নীচে নামলেই দিদু অন্যরকম। ঘোমটা-মাথায় এ-ঘর-ও-ঘর করছেন, রান্না করছেন, বড়দির ধমক খাচ্ছেন, আমি পেছন-পেছন ঘুরছি। দিদুর বাবা স্বাধীনতা-আন্দোলনে মারা যান। আমার দাদুও কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। দিদু বলতেন—‘তের বছর বয়সে নোলকপরা ছোট্ট পিতৃহীন মেয়েটি, সবাই বিয়ে দিয়ে দিলে। আরেকটা জীবন পেলে নিশ্চয় অন্যভাবে কাটাতুম।’ বড় পিসির ছেলে দীপকদা যখন নকশাল হয়ে গেল, দিদু ওকে চুপিচুপি টাকা দিতেন, ওর পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র নিজের তোরঙ্গে শাড়ির তলায় রেখে দিতেন আমি জানি। দীপকদা নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে, দিদু গুম হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বলতেন—‘দীপককে ওরা মেরে ফেলেছে এ কখনও সত্যি হতে পারে না। দীপকের মধ্যে আগুন আছে।’
দাদুকে দেখে আজ একটা কথা আমার মনে হল, দাদু খুব ভালো, কিন্তু দাদু একচক্ষু হরিণ। দেশের মুক্তির জন্য যারা লড়াই করে নিজেদের অন্তঃপুরের মানুষদের মুক্তির জন্য তারা একটু লড়াই করবে না? আর এ লড়াই তো বেশির ভাগটাই নিজের ভেতরকার স্বার্থপরতার সঙ্গে লড়াই! দিদুর দুহাতে একটা কিসের শৃঙ্খল ছিল, একটু ইচ্ছে করলেই দাদু সেটা ভেঙে দিতে পারতেন। এই যে বড়জেঠি, মেজজেঠি ওঁদের হাতেও শেকল। শেকল স্বভাবের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ওঁরা বোঝেন না, একটা বোবা কষ্টের মধ্যে থাকেন।
টুলটুল কথায় কথায় বলল—‘জানো বাবুদা, আমি এই অন্ধকার বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
টুলটুলের ওপর আমার অনেক ভরসা ছিল। ছোটবেলায় টুলটুলটা খুব জলি ছিল। ও আমি আর বাবলু মিলে দিদু আর কাকিমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। খুব দুরন্ত ছিল ও। আমাদের সঙ্গে সমান তালে ক্রিকেট-ফুটবল খেলত। এখন খুব শান্ত হয়ে গেছে। শান্তও না, মন মরা।
আমি বললুম—‘চাকরি-টাকরি করলে, আর্থিক স্বাধীনতা পেলে দেখবি সব অন্যরকম লাগবে।’
টুলটুল বলল—‘সে-ও তো আরেক রকমের দাসত্ব। তার চেয়ে আমার বাবাকে বলো বিয়ে দিয়ে দিতে।’ একটু লাজুক চোখে চেয়ে বলল—‘বিদেশ যাবার চান্স আছে এমন বর দেখতে বোলো, হ্যাঁ?’
আরে রাম রাম! এ বলে কি? আমরা, এতো কষ্ট করে শেকড় ছিঁড়ে-খুঁড়ে এদেশে এলুম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন হাওয়ার বেগে একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে দেবেন। আর এখানকার মেয়ে কি না বিদেশে পালাতে চাইছে!
টুলটুল আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল—‘তোমাদের পূর্বপুরুষেরা লোকের হাতের রান্না খেতে পারেন না। মা কতদিন মামার বাড়ি যায় না জানো? অত বাঁধাবাঁধি আমার ভালো লাগে না। বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের ডাকতে পারি না। দাদু এমন করে তাদের ঠিকুজি-কুলুজি নিতে শুরু করেন যে আমার লজ্জা করে।’
মাকে ফোন করে আমি ন কাকীর কাছে থেকে গেলুম দিনটা। মার বোধহয় অভিমান হল, ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিল।
এতগুলো বছর বিদেশবাসের পর, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সব চেয়ে মূল্যবান বলে চিনেছি। সেই হিসেবে এই নাগরিক সভ্যতায় ক্রমেই মরুভূমি তার জিহ্বা বিস্তার করছে। প্রাইভেসি-রক্ষার তাগিদে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে পরিবারের সীমা। শেষ পর্যন্ত শুধু একটি জীবনবিন্দু। বৃদ্ধাবাস। মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিস কি আর নেই। প্রোফেসর সোয়েনগার্টেন আর তাঁর স্ত্রী এলসা ছিলেন হার্ভার্ডে। আগেকার কালের গুরুপত্নীর মতো এলসা প্রোফেসরের সমস্ত ছাত্রের খোঁজ খবর রাখতেন। ফ্লু হয়েছে, মাথা তুলতে পারছি না, তিনদিন নিজের ঘরে বড়ি গিলে শুয়ে আছি। হঠাৎ জ্ঞান হতে দেখি এলসা গরম দুধের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। থিসিস শেষ হবার পর আমার সম্মানে পার্টি দিলেন প্রোফেসর। রবিনসভিলে নিজে হাতে কাঠের কুটির বানিয়ে থাকেন ন্যাচারর্যালিস্ট ডেরেক। নিজের আনন্দে নিজেই মগ্ন হয়ে আছেন, পুরো রবিনসভিল গ্রামটাই ওঁর পরিবার। ওঁর অসুখ করলে পুরো গ্রামটাই ওঁর দেখাশোনা করে। আমার বন্ধু কুপারের পরিবার ছিল অবিকল একটি হিন্দু যৌথ পরিবারের মতো। গ্রীনিচ্ গ্রামে বিশাল খামার ওদের। তিন ভাই তিনটে কটেজ। এক একদিন এক এক জনের কুটিরে খাওয়া-দাওয়া হয়। কুপারের মা ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ মহিলা!
আমি আপাতত এই ভূতের বাসায় থাকব। দেখব এদের অসুখটা কোথায়। কি অসুখে এত বড় বাড়ি মানুষ থাকলেও জনহীন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রাণ নেই। দাদু দেখছি নিজের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ নিয়েই মশগুল। একই সঙ্গে উনি সপ্তদশ আর বিংশ শতকে পা রেখে চলেছেন। চারপাশে যে কিছু প্রিয়জন রয়েছে, তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক যে কখনও বজ্ৰ-আঁটুনিতে, কখনও অতি-উদাসীনতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে চেতনা দাদুর নেই।
সন্ধেবেলায় মেজ জেঠু অফিস থেকে ফিরলে গল্প হল অনেক। আমাকে দেখে খুব খুশী। বললেন—‘আর কটা মাস পরেই রিটায়ার করছি, কি যে করবো!’
—‘সুনীলদার কাছে ধানবাদে চলে যাবে!’
—‘ওরে বাবা ওখানে যা ভয়াবহ গরম আর পাথুরে শীত! ও আমার সইবে না।—’
—‘তাহলে নেশা করো।’
—‘সে কিরে? ও কি বলছিস?’
আমি হেসে বললুম—‘ভ্রমণের নেশা। দুজনে মিলে থেকে থেকেই বেরিয়ে পড়বে। সব সময়ে যে খুব দূরে যেতে হবে তার মানে নেই। পশ্চিমবঙ্গ টুরিস্ট ব্যুরোতে খোঁজ নাও। অনেক ছোটখাটো জায়গা আছে কাছাকাছি।’
—‘এটা তো মন্দ বলিসনি? তবে তোর জেঠি পারবে না। সংসারও আছে।’
আমি বললুম—‘মেজজেঠিমার আবার সংসার কী? ওঁকে না নিয়ে গেলে তোমার ভ্রমণ নেশায় আমার আপত্তি আছে।’
—‘মাকে দেখাশোনা করবে কে?’
—‘বড়দি এখনো যথেষ্ট সক্ষম আছেন। নিজেরটা এখনও নিজে চালিয়ে নিতে পারেন।
—‘বউদি!’
—‘কেন বড়জ্যাঠা করবেন। দুচারদিনের জন্য সবাই পারবেন, পারতে হবে।—’
ছাত্রজীবনের কথা বলতে লাগলেন মেজজেঠু। বললেন, ‘জানিস। বাবার হাতে পায়ে ধরেছিলুম। এঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্যে। বলেছিলেন—মিস্ত্রি হবার জন্যে অত টাকা কে দেবে। ফিজিক্সে হাই সেকেন্ড ক্লাস পেলুম। বাবা এম-এস-সি পড়তে দিলেন না—চাকরি পাচ্ছো, ঢুকে যাও। ওই এক কথা। আমার সেই ফিজিক্সের ডিগ্রি মার্চেণ্ট অফিসের কোন্ কাজে লাগল? তোরা সুযোগ পাচ্ছিস। তোদের বাবারা তোদের জন্য করছে। তোদের ভাগ্যই আলাদা।’
জীবনের এতগুলো দিন কাটিয়ে এসেও এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না পারার দুঃখ মেজজেঠু বেচারির যায়নি।
আমি বললুম—‘আমার কিন্তু ছোট্ট একটু আনন্দের কারণ আছে। স্কুলের পর আর বাবা মার পয়সা খরচ করতে হয়নি আমার জন্য।’
—‘স্কলারশিপ পেতিস?’
—‘তা-ও পেয়েছি। চাকরিও করেছি। গ্যারাজে চাকরি করেছি। ব্যাঙ্কে করেছি। কুলির কাজ পর্যন্ত করেছি দরকার পড়লে।’
মেজজেঠু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ ওদেশে এরকম অনেকেই করে শুনেছি। ভালো ভালো। আমাদের এখানে কেউ ভাবতেও পারে না। সুনীলের জন্যে আমার হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। বিয়েতে কাকাবাবু পণটনও নিতে দিলেন না কিছুতেই যে পুষিয়ে নেবো।’
খুব হাসি পেয়ে গেল আমার। এইটা দাদুর বিংশ শতকে পা-রাখা চেহারা।
একটু পরে সুমন আর বাবলু এসে বসল। তক্তপোশের একধারে বসে মেজজেঠিমা উল বুনছেন। সুমনটা খুব ছেলেমানুষ। বলল—‘বাবুদা, তুমি কোথায় শোবে?’
আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললুম—‘বড়দির কাছে।’ ওর চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বড়দির কাছে যে কেউ স্বেচ্ছায় শুতে পারে ওর ধারণায় বোধহয় সেটা আসে না।
মেজজেঠিমা বলেন—‘তুই না হয় এ বেলা আমার কাছে খা।’
আমি বললুম, ‘এই দ্যাখো, মুশকিল করলে। নকাকিমা আবার সকালবেলায় নাকি জমিয়ে খাওয়াতে পারেনি, এবেলা কিসব রাজসূয় আয়োজন করেছে। কাল সকালে তোমার কাছে খাব এখন।’
—‘কি তুই ভালোবাসিস বল!’
‘এনিথিং অ্যান্ড এভরিথিং।’
‘তার মানেই আমাদের কিছুই তোর ভালো লাগে না।’
‘কী করে তুমি এমন একটা কনক্লুশনে এলে গো জেঠিমা। য়ু আর গ্রেট। তবে একটা জিনিস খাওয়াতে পারো। মানকচু আর নারকোল দিয়ে দিদু একটা কি ব্যাপার করত। দারুণ খেতে হত। ঝাল-ঝাল, মিষ্টি-মিষ্টি!’
‘ঠিক আছে দেখি পারি কিনা। তাছাড়া চেতল মাছ আনতে দেবো এখন। মুঠ খাবি চেতল মাছের।’
আমার মুখে এসে গিয়েছিল বাবলু, টুলটুল, আর সুমনও খাবে জেঠিমা। খুব সামলে নিয়েছি। ওঁদের একরকম ব্যবস্থা। স্বতস্ফূর্তভাবে যা করছেন তার ওপর কিছু চাপাতে গেলে হয়ত ওঁর আনন্দটুকু মাটি হয়ে যাবে। অতএব নিজের আনন্দ কুরবানি দিয়ে আমাকে এই ব্যবস্থাই মেনে নিতে হবে। যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি। চাকরি করছি। বাজার থেকে নিজেই মাছ-টাছ এনে বলতে পারতুম, ‘লাগাও জেঠিমা, ন কাকিমা, বুলবুল হাত লাগা, আমিও লাগাচ্ছি।’ কিন্তু মনে হচ্ছে ওরকম কিছু করতে গেলেই মেজজেঠু বলে উঠবেন, ‘চুপ করো জ্যাঠা ছেলে।’
টুলটুলের সঙ্গে গল্প করলুম রাত পর্যন্ত। ও এবার এম-এ ফাইনাল দেবে। রেজাল্ট বেরোতে এত দেরি করেছে যে ওর প্রায় দুবছর দেরি হয়ে গেল। ওর খালি এক কথা কিছুই ভালো লাগে না। ধমক দিলুম, এতো ডিপ্রেস্ড্ হয়ে থাকার জন্য। বলল, ‘ভালো লাগবে কী করে বলো তো? কিছুই তো পারি না। গান-বাজনা-খেলাধুলো কিচ্ছু না। কোনরকমে পাশ করতে পারি আর হাতা-খুন্তি নাড়তে পারি।’
টুলটুলটা বেঁচে থাকায় কোনও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের মধ্যে অস্তিত্বের কৈফিয়ৎ খুঁজছে। কি যে করা যায়! মস্ত বড় কিছু একটা করতে না পারলে জীবন বৃথা এই ধরনের একটা অবসেশন এদের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটা কাটাতেই হবে। ও ঘুমোতে চলে গেলে আমি উঠে পড়লুম। আমাকে যেন কিসের নেশায় পেয়েছে। যত রাত হয়, যত চারদিক নিঝুম হয় তত একটা অন্য শব্দ কায়াহীন বৃষ্টির মতো রিম্ঝিম্ করতে করতে ভাঙাচোরা চকমিলোনো বাড়িটার আনাচ-কানাচ থেকে ঝরে ঝরে পড়ে। কখনও মনে হয় অনেক ঘোড়ার খুরের শব্দ পাচ্ছি। হাওয়ায় তরোয়াল চালানোর শাঁই শাঁই শব্দ। কারা যেন হুড়মুড় করে পালাচ্ছে। দূরে কোথাও কামান গর্জন করে উঠল। ছপাৎ ছপাৎ করে জলে লাফিয়ে পড়ছে কারা। অস্পষ্ট সব শব্দ উড়ে বেড়াচ্ছে। দালানে, বড় হল ঘরটায়, শব্দ শুধু শব্দ। বড়দির পাশে একটা শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লুম। বড়দি শুধু একবার চেয়ে দেখলেন, কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ পরেও দেখি বড়দি বসেই আছেন, বসেই আছেন।
‘ঘুমোবে না বড়দি।’
‘ঘুম আসে না দাদা।’
‘তবে গল্প করো।’
‘গল্প কোথায় পাবো?’
‘তোমার ছোটবেলার গল্প করো।’
বড়দি হেসে উঠলেন, ‘আমার ছোটবেলা? আমি তো জন্ম থেকেই বুড়ি রে।’
‘বলো না বড়দি প্লীজ। ধরো তোমার বাবা-মার কথা, তোমার বিয়ের আগেকার কথা।’
‘তারাপ্রসন্ন আচার্যির নাম শুনেছিস?’
শুনিনি কিন্তু খুব উৎসাহের সঙ্গে বললুম—‘হ্যাঁ।’
‘সেই বাবু তারাপ্রসন্নর দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে ছিলুম। আট মহলা বাড়ি, মাটিতে পা পড়তো না, এ মহল থেকে ও মহলে যেতে পালকি আসত। গা ভরা ঝমর ঝমর গয়না। কোলে পুতুল। কাঁখে পুতুল। আমার মা ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী আর বিদূষী। সংস্কৃত জানতেন, ইংরেজি জানতেন। বাড়িতে টুলো পণ্ডিত রেখে, মেম রেখে শেখানো হয়েছিল সব। বাবা দুম করে মারা যেতে সব্বাই একধার থেকে বলল অত বিদূষী বলেই বেধবা হল। মারও মাথা মুড়িয়ে দিল, আমাকেও তোর বুড়ো দাদুর সঙ্গে বে দিয়ে দিল। ব্যস, ছেলেবেলা শেষ।’
‘বুড়ো দাদু কেন বড়দি? তোমার সঙ্গে যখন বিয়ে হয় বড়দার কত বয়স ছিল!’
‘আমার আট আর তার উনিশ।’
আমি হো হো করে হেসে উঠলুম—‘বাবলুর বয়সী এক ছোকরাকে তুমি বুড়ো বলছ?’
‘এই মোচ্ কুস্তিগীরের মতো চেহারা। চোখ যেন বাঘের মতো। বুড়ো বলব না? বুড়ো কি আর দেহে হয় রে? মনে হয়। রসকষ বলতে কিচ্ছুটি ছিল না। খালি শাসন খালি শাসন। পুতুল খেলনা আমার ছুঁড়ে ফেলে দিত। শাশুড়িকে সব সময় নালিশ। মা ব্যাটার কাছে আর ব্যাটা মায়ের কাছে সদাসর্বদা চুকলি কাটছে। ছোটটি পেয়ে তিনি কি মারটাই দিতেন। তার ওপর ছিল যখন তখন ছড়াকাটা।’
‘ছড়া? কীরকম ছড়া বড়দি?’
‘শুনবি? ‘বড় মানুষের কালো ঝি/ তার মুয়ে আবার এত বচন কি?
‘বড়মানুষের কালো বিটি/ তার অমন মুখে ঝাঁটা পিটি।’
‘রীতিমতো কবি ছিলেন তো দেখছি তোমার শাশুড়ি!’
ফোকলা মুখে দুষ্টু হাসি হেসে বড়দি বললেন, ‘আমিও ছড়া কাটতে কম যেতুম না। শুনবি?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ আমি উৎসাহের চোটে উঠে বসলুম।
বড়দি বললেন, ‘কটা মায়ের কটা ব্যাটা
হাতে আবার লাঠি সোঁটা
চোর পিট’ গে’, ডাকু পিট গে,’ গোরা পিট গে’ যা।
তা না মায়ের মুখে চুকলি খেয়ে বউয়ের পিঠে ঘা?’
দুজনে মিলে খুব খানিকটা হাসলুম।
বড়দি বললেন, ‘ছেলেমেয়ে কতকগুলো হয়ে হয়ে মরে গেল। শাশুড়ি বলতেন, ‘বাঁচবে কি? রাক্ষুসীর পুত রাক্ষুসী নিজেই গিলে খায়।’ ভয়ে কান্না পর্যন্ত গিলে ফেলতুম!’
‘কেন বড়দি? তোমার অত বিদূষী মা; তোমার অত ধনী বাপের বাড়ি কেউ দেখাশোনা করত না?’
‘ওরে না রে না, সেসব দিনে সব বউ ঝিকে শ্বশুরবাড়ির খোয়ার সহ্য করতে হত। আর মা যে এদের রকম সকম দেখে আমার এক সিন্দুক গয়না আটকে রেখেছিলেন! আমাকে খালি বলত—গয়নার বাক্সের চাবি দাও। আর আমি বলতুম, চাবি মায়ের কাছে। তাইতে তো আরও চটে যেত মায়ে ব্যাটায়। একে তো ওই খোয়ার, তার ওপর ইস্ত্রীধন গয়নাটুকু হাতে তুলে দিয়ে মরি আর কি!’
‘তবে তো তুমি খুব বড়লোক বড়দি!’
‘তা বই কি! দশ লাখ টাকার গয়না তো হবেই কমপক্ষে। বেশি তো কম নয়, বড়দি উদাস গলায় বললেন, বাউটি, পৈছে, বাজু, খাড়ু, মফ্ চেন, সীতে হার, কাঁকন, কণ্ঠী, চিক, সে কত! সোনাই তাল তাল, তা পরে ছিল হীরে, পান্না, চুনী, সব আলাদা আলাদা সেট।’
‘ছিল কেন বলছো, বড়দি। সব দিয়ে দিয়েছ?’
‘দিয়ে দিয়েছিই বটে, তোকে চুপিচুপি বলছি দাদা, কারুকে বলিসনি। আমার সে গয়না যে দিয়েছিল সেই গর্ভধারিণী মা-ই নিয়েছে।’
‘সে কি?’
‘আহা, মায়ের আমার শেষ জীবনে সে কি কষ্ট! জ্ঞাত-গুষ্টি যা ছিল সব লুটেপুটে নিচ্ছে। বিদ্যে থাকলে কী হবে? ভালোমানুষ বেধবা কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারতেন না। শেষ বয়সের আতপান্ন আর একটু দুধ-কলা। আফিম খেতেন। সেই আফিম, সে-ও বুঝি যোগাড় হয় না। আমার গচ্ছিত গয়না দিয়েই মার জীবন চলল। মা মরতে সিন্দুক খুলে দেখি ভোঁ ভাঁ। তা হয়েছে, হয়েছে বেশ হয়েছে। ও জন্যে আমি দুঃখু করি না।
আমি অবাক হয়ে রইলুম। এই বড়দি নাকি স্বার্থপর, দোর্দণ্ডপ্রতাপ! দজ্জাল! আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলুম—‘আমার দিদুর কথা বলো বড়দি!’
‘তোর দিদু ছিল রাঙা টুকটুকে। এই চোখ, এই নাক, এ-ই কোঁকড়া চুল। সে আসতে বুঝি তোর বড়দা আর তার মার দুঃখু ঘুচল। বড় হয়ে যখন ঘর করতে এলো চা দেবে ছোট বউমা, পান সেজে দেবে ছোট বউমা। আপিস থেকে ফিরে সে মানুষ আগে আদর করবে তোর বাবাকে। সে কি আদর! তোর বড়জ্যাঠা বললে—ডাক্তারি পড়ব, —না। মেজ বললে—এঞ্জিনিয়ারি পড়ব—না।’
আমার চোখের সামনে থেকে কুয়াশা সরে গেল। কালোকালো নোলকপরা বড়লোকের আদরের দুলালী। অনাদরে, অবহেলায়, অপমানে পাগল-পাগল, দু চোখে হিংসার পান্না ঝলসাচ্ছে। ভেতরে কঠিন সব সংকল্প জন্মাচ্ছে। দাঁতে দাঁত। প্রতিহিংসা। ছোট্ট এতটুকু সংসারের পরিসর। তারই মধ্যে সে ব্লাডি মেরি, ক্যাথারিন দা গ্রেট। কী করবে? যা পেয়েছে সুদসুদ্ধু তাকে তো তা ফেরত দিতে হবে! আমি বড়দির ফাটা পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলুম। চিরকালই একা ছিলেন, এখন আরো একা। দিদুর তবু আমি ছিলুম। সুনাম ছিল। বাড়িসুদ্ধু ছেলে-মেয়ে বউয়ের ওপর অধিকার আর শাসন জারি করেও বড়দি একেবারে নিঃস্ব। আস্তে আস্তে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। বড়দির ঘরে রাজ্যের পুরনো জিনিসের গন্ধ। এত জিনিস জমিয়ে রেখেছেন অথচ সুখস্মৃতির কোন সঞ্চয় নেই। তবু গন্ধটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। বুক ভরে সেই পুরনো-পুরনো একাকিত্বের গন্ধ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম। অন্ধকার দালানে আবার সেই ঝিন ঝিন ঝিন ঝিন শব্দ চারিদিকে। ফাঁকা মাঠ দিয়ে পালকি চলছে, রে রে করে যেন সশস্ত্র ডাকাত পড়ল। কারা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। খুব ঢাকঢোল বাজছে কোথাও, বাতাসে মানুষের চামড়া পোড়ার দুর্গন্ধ। বাইরের দিকে এলুম। কার্নিশে পায়রাগুলো বু বু বু আওয়াজ করছে। ওদিকের ঘর থেকে দাদুর কাশির শব্দ ভেসে এলো। দোতলায় চলে এলুম। তারপর ছাদ। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া। ভাগনার্স গ্যাপে মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার বাজপাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ছুটে চলেছে। ঠাকুরঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে আলো জ্বেলে দিলুম। ঝুল পড়া বাল্বটা থেকে আলোর চেয়ে ভুতুড়ে একটা আবছায়াই হল বেশি। লক্ষ্মীর পটের পেছন থেকে দিদুর চোখ আমার দিকে চেয়ে হেসে উঠল। বাঁ দিকের দেয়ালে বড়দাদু। ওপর দিকে মালা জপছেন একজন শুষ্ক বৃদ্ধা। নিশ্চয় দাদুদের মা।
বড়দাদু বললেন, ‘আমরা অনেক ভুল করেছি ভাই। তোমরা কোরো না।’
‘করেছ? স্বীকার করছো তাহলে?’
‘নিশ্চয়। অনেক অন্যায়, অনেক অবিচার করেছি। তাতে করে মানুষ পাল্টে গেছে। যার যা হবার কথা ছিল সে তা হয়নি।’
দিদুর দিকে চাইলুম। দিদু বললেন, ‘তুই আমার মুক্তি, তুই এদেরও মুক্তি বাবু। তোর ওপর থেকে আমি আমার একার দাবীর হাত তুলে নিলুম।’
নীচে নেমে এসে দাদুর পাশে শুয়ে পড়লুম। দাদু চিত হয়ে শুয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছেন গলায়। আস্তে পাশ ফিরিয়ে দিলুম। ভোর রাত্রে খুব সুন্দর এক পশলা ঘুম হল। সকালে খেতে বসে দেখি টুলটুল, সুমন, বাবলুরও নেমন্তন্ন। কি আনন্দ! চার ভাইবোনে মেজজেঠিমাকে খুব শাবাশ দিয়ে খেলুম। তারপর দাদুকে নিয়ে বাড়ি।
১২
সন্তোষ বাবু আশ্চর্য লোক! অফিসের কাছে একটা লিস্ট চেয়েছিলুম। লেকচারারদের অনেকেরই সরকারের কাছে অনেক বকেয়া পাওনা হয়ে গিয়েছিল। তারই লিস্ট। লিস্ট আসার একটু পরেই সন্তোষদা এলেন।
‘লিস্ট নিয়ে কি করবেন ডাঃ মুখার্জি?’
‘কেসগুলো ঠিকঠাক করে পাঠাতে হবে সন্তোষদা, এতদিনের এরিয়ার এভাবে পড়ে থাকা ঠিক না।’
‘আপনি কি চান, বলুন দিকি সত্যি করে?’
আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘লেকচারারদের লয়্যালটি আপনি চান তো?’
‘মানে?’
‘যদি চান তাহলে আমার কথাটা রাখুন। বহুদিনের অভিজ্ঞ লোক আমি। ওসব করবেন না। যে মুহূর্তে এরিয়ার মিটে যাবে, সব আপ-টু-ডেট হয়ে যাবে আর আপনাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনবে না দেখবেন।’
‘তাই বলে এতগুলো এরিয়ার ফেলে রেখে দেবো? তা হয় না সন্তোষদা।’
উনি তখন লিস্টটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘কতকগুলো স্টার মার্ক দিয়ে রেখেছি, এই কেসগুলো অন্তত ঝুলুক।’
দেখলুম তার মধ্যে সেই বিকাশ সিংহর নামও রয়েছে। কথা বাড়াতে ইচ্ছে হল না। বললুম, ‘অবনীকে পাঠিয়ে দিন।’
অবনী ডীলিং ক্লার্ক। ওর সঙ্গে বসে কেসগুলো ঠিকঠাক করতে আমার দিনদুই লাগল। নিজেই রাইটার্সে নিয়ে গেলুম। সহপাঠী সুভাষ ছিল, বলল, ‘মাসখানেকের মধ্যে করে দিচ্ছি।’
আজ সেই টাকাটা এসেছে। সবশুদ্ধ জনাসাতেক ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে বিকাশ সিংহও ছিলেন। বললুম, ‘আপনাদের টাকা আপনারা পেয়েছেন। আরও আগে পাওয়া উচিত ছিল।’
একজন বললেন, ‘সেটাই তো কথা। পাবার কথা কিন্তু পাইনি। আপনার জন্যে পেলুম।’
আমার আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তর্কাতর্কির কথা, হিউসটনের মামলাটার কথা মনে পড়ল। হাসি এলো। বললুম, ‘এ নিয়ে অনর্থক সেণ্টিমেণ্টাল হবার দরকার নেই। আমি সর্ব অর্থেই কলেজটার একটু ক্লীনিং আপ চাইছি। আপনারা আমার সঙ্গে থাকবেন।’
‘নিশ্চয়, নিশচয়।’ ওঁরা উঠে গেলেন। থেকে গেলেন বিকাশ সিংহ!
‘একটু কথা ছিল স্যার।’
‘বলুন।’
‘এ কলেজের যা স্ট্রাকচার তাতে করে ডাঃ মুখার্জী, আপনার একটা কনফিডেনশিয়াল সেল চাই। যে সেল আপনার কাজগুলো করে দেবে। ধরুন অ্যাডমিশন, পরীক্ষা···।’
আমি হেসে বললুম, ‘আপনারা সকলেই তো আমার কনফিডেনশিয়াল সেলের মেম্বার প্রফেসর সিন্হা। ইতিমধ্যেই তো অনেক এই ধরনের কাজে আপনাদের সবার সাহায্য আমি পেয়েছি।’
বিকাশ সিংহ চলে গেলেন। আমার কথা স্পষ্টই ওঁর পছন্দ হয়নি। ভর্তির সময়ে সব ডিপার্টমেণ্টাল হেডদের নিয়ে কমিটি করেছিলুম। পরীক্ষা চালান কখনও সন্তোষদা, কখনও আমি, কখনও নির্মলেন্দু দত্ত বলে আরেকজন সিনিয়র লোক। কোথাও তো কোনও অসুবিধে দেখছি না। বিকাশ একাই বোধহয় ওই কনফিডেনশিয়াল সেলের সদস্য হতে চান। কাজ ভালোই এগোচ্ছে। বায়ো-সায়েন্সের ল্যাবটা নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছি। আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রচুর এসেছে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেণ্টে। কো-কারিকুলার কতকগুলো লেকচারের ব্যবস্থা করেছি। নানান য়ুনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপকরা আসছেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একটা ভালো সেমিনারের আয়োজন করেছিলুম। কলেজে ভারা চেপেছে, বিল্ডিং বাড়বে এবং সমস্ত রং হবে। সেমিনারের ব্যাপারে বিকাশকে আমি ডেকেছিলুম। কলেজের কাজে অধ্যাপকদের সাহায্য আমার খুব একটা দরকার হয় না। যেটুকু দরকার হয়, তাতে সব অধ্যাপকেরই যাতে পালাক্রমে ডাক পড়ে সেদিকে আমি সচেতন থাকি।
আজকাল একজন পার্ট টাইম ড্রাইভার রেখে দিয়েছি। কমলিকার পক্ষে কলকাতার ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো খুবই বিপজ্জনক, ক্লান্তিকরও বটে। ওর আর আমার বেশিরভাগই টাইম এক। যেদিন তা না হয় কমলিকা মিনি বাস ধরে, আমার কথা শোনে না।
আজ বাড়ি ফিরে দেখি ওরা তিনজনেই এসে গেছে। মণি বলল, ‘দারুণ একটা সুখবর আছে বাবা।’ কমলিকার মুখে চাপা হাসি দেখে বুঝলুম খবরটা ওর। ইচ্ছে করে বললুম, ‘মণি, তোর বুঝি রেজাল্ট বেরোল?’
মণি বলল, ‘তুমি যেন জানো না কার রেজাল্ট বেরোবে!’
জবা কফি নিয়ে এসেছে। মণি বলল, ‘জানো তো টিভি থেকে মার ইণ্টারভ্যু নেবে। হিউসটনে মায়ের গানের স্কুল ছিল। আমেরিকানদের কাছে ইন্ডিয়ান কালচার প্রচার করেছে। বিবেকানন্দ, রবিশঙ্কর, আলি আকবর, কৃষ্ণমূর্তি, মা সব এক ক্যাটিগরির।’
কমলিকা বলল, ‘কি দুষ্টুমি হচ্ছে মণি!’
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি যে সিলি প্রশ্ন করে সব! আগে ক্ল্যাসিকাল করতাম, এখন অনভ্যাসে পারি না। রেওয়াজ নেই। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরেছি। এসব বলা যায়?’
বললুম, ‘কথাটা কি তাই? আসলে ওরা আমাদের ভাষা বুঝত না। বিশুদ্ধ সুর দিয়ে তাই ওদের সঙ্গে কমিউনিকেট করাটা সহজ হত। এখানে এসে তোমার কথাও বলতে ইচ্ছে যায়। আর, তোমার কথা তোমার চেয়েও ভালো করে আর কে বলবে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া?’
কমলিকা মন দিয়ে শুনছিল, বলল, ‘ভালো বলেছ তো! থ্যাঙ্কস। সত্যিই হিন্দুস্তানী মিউজিকে মালকোষের গানটাই ভাবো, ‘মুখ মোড্ মোড্ মুসকাত যাত।’ অর্থাৎ, মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে যাচ্ছে। ভাবা যায়? স্পিরিটে আর গানের ভাষায় কি আকাশ পাতাল তফাৎ! পাশাপাশি ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ যেন মালকোষের ভাবটাকেই পুরো ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।’
কমলিকার দিকে তাকিয়ে আমার খুব আনন্দ হল। ফিরতে ওরই সবচেয়ে আপত্তি ছিল। কিন্তু ওর ফেরাটাই সবচেয়ে সার্থক হয়েছে। আত্মীয়তা, আদানপ্রদান, বাবা মার দেখাশোনা করতে পারছে। বাবা থেকে গেলেন দিনসাতেক। আশাকরি, বাবার অহেতুক ভয়টা গেছে। আমারই পেছনে রাহু লেগে রইল। হাত বাড়িয়ে বললুম—‘অভিনন্দন।’
বাবু এসেও আমাদের পরিবারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বড়দা মেজদা তো বটেই বড়মা পর্যন্তও এক সপ্তাহ না গেলেই খোঁজ করেন। আজকাল ও বাড়িতে প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ হয় বউদির জন্য। বাবু শান্তির জল নেওয়া পর্যন্ত অখণ্ড মনোযোগে বসে থাকে বউদির হাত ধরে। অপরের বিশ্বাসে বিশ্বাস মেলানো—এইভাবে আমি আর দেখিনি—নিজেও পারি না। বউদি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। এখন অনেকটা শান্ত। জবা এসে বলল, ‘ফোন এসেছে বাবার। ছোটপিসি করছেন।’
‘হ্যালো ছুটকি, কী খবর রে?’
ওদিকটা চুপচাপ।
কমলিকাকে বললুম, ‘দ্যাখো তো কি ব্যাপার!’
কমলিকা ফোন ধরেছে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। শর্মি কথা বলছে বোধহয়।
কমলিকা বলল, ‘কী হয়েছে? ডাক্তার ডেকেছিস? সে কি রে? এখুনি যাচ্ছি।’ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘স্বর্ণেন্দুদার শরীর খারাপ। ছুটকি কথা বলতে পারছে না ভয়ে। শর্মি ডাক্তারকে ফোন করেছে। শীগগির চলো।’
বাবু আমি আর কমলিকা সঙ্গে সঙ্গেই ওর ক্যামাক স্ট্রীটের বাড়ির দিকে রওনা দিলুম। যেতে যেতে কমলিকাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী হয়েছে কিছু বললো?’
‘কিছুই তো বললে না। খালি বলে কেমন করছে।’
পথ যেন কাটতে চাইছে না। ছুটকি অত শক্ত মেয়ে। কথা বলতে পারছে না ভয়ে?
ওদের ফ্ল্যাট সাততলায়। লিফট আছে অবশ্য। আমাদেরটা এখনও দিল না। এবারে কেস ঠুকে দেবো। দরজা খোলাই ছিল। শোবার ঘরে ঢুকে দেখি স্বর্ণেন্দু খাটের ওপর বেঁকে শুয়ে। চোখ বন্ধ। কষ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখের পাতা টেনে টর্চের আলো ফেলে পরীক্ষা করছেন ডাক্তার। বললেন, ‘এখুনি হসপিটালে রিমুভ করতে হবে।’ ফোনের দিকে ছুটলুম। সমস্ত ব্যবস্থা করে পিছন ফিরে দেখি স্থির। ডাক্তার ইঙ্গিতে জানালেন শেষ। ছুটকি বুঝতে পেরেছে। স্থির হয়ে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেজদা, মাকে আর কাকাবাবুকে একবার দেখব।’ বলে টলে পড়ে গেল।
আবার চলেছি। সঙ্গে শুধু বাবু, মণি থাকতে পারেনি, এসে গেছে। শর্মি ভীষণ কাঁদছে, মণি ওর পাশে। বউবাজারে ঢুকতে বুক কাঁপতে লাগল। বড়মার বয়স চুরাশি। বাবা আটাত্তর।
বাইরের ঘরে বসেছিলেন বাবা। শুনে কেমন অস্থির হয়ে বললেন, ‘আমি গিয়ে কি করবো? আমাকে যেতে বলো না। তার ভরা সংসারে কোনদিন গিয়ে দাঁড়ালুম না! না···না। আমাকে যেতে বলো না।’
বাবু বলল, ‘দাদু, য়ু ডোণ্ট রিয়্যালাইজ, সেণ্টিমেণ্ট বা আক্ষেপের ব্যাপারই নয়, ছুটকি নীডস্ য়ু।’
বাবা বললেন, ‘বউঠানকে জিজ্ঞেস করো। তাঁর মেয়ে। ডিসিশন তাঁর।’
আমি দাঁড়িয়ে ভাবছিলুম, চুরাশি বছরের বৃদ্ধা, শুনে কি প্রতিক্রিয়া হবে। বাবু বোধহয় বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘যাও যাও, বলো। দীর্ঘ জীবন হলে শক্ত কথা মাঝে মাঝে শুনতে হবেই।’
বড়মা তাঁর সনাতন চৌকির ওপর বসে কৌটোবাটা পরিষ্কার করছেন। বাবু বলল, ‘বড়দি, ছোটপিসের খুব অসুখ। তোমায় দেখতে চাইছে।’
কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে খানিকটা সময় নিলেন বড়মা।
বললেন, ‘ঠিক করে বল কথাটা, আছে না নেই?’
‘নেই বড়দি।’
‘তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর, কি করা উচিত।’
আমি আর বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। এই দীর্ঘ পঁচিশ বছর কি এই দুটি মানুষ এ ওর মতামতের মুখ চেয়ে বসে ছিলেন?
বাবু বলল, ‘দাদু যাচ্ছেন।’ বলেই বড়মাকে টপ করে কোলে তুলে নিল। বয়সে ছোট্ট হয়ে গেছেন মানুষটা। সেই দাপট আর আমাদের থরহরি কম্পনের কথা মনে করলে এখন দুঃখ হয়।
ওঁদের দুজনকে নিয়ে যখন ক্যামাক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে পৌঁছলুম তখন দিদি, সুকৃত সবাই এসে গেছে। ফিল্ম্ জনতা আসতে শুরু করেছে। সুকৃত ফোনটা ধরে বসে। অনেক কাজ এখন। বাবু আর রূপককে নিয়ে স্বর্ণেন্দুর ঘর থেকে বেরোবার সময়ে শেষ দৃশ্য দেখে এলুম—বড়মা কাঁদছেন, জীবনে আমার চোখের সামনে এই প্রথম, আর ছুটকি তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার বাবা স্বর্ণেন্দুর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। যখন বাবার আশীর্বাদের হাত ও কপালে অনুভব করতে পারত, তখন কিছুতেই দেননি। এখন দিচ্ছেন। স্বর্ণেন্দুর আত্মা যদি দেহ থেকে বেরোতে পেরে থাকে, যদি এ দৃশ্য দেখতে পায়, তবে কি সে হাসবে, না কাঁদবে?
১৩
আজ আমার মার্কশীট বেরোল। রেজাল্ট আগেই পেয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। সেকেণ্ড ডিভিশন। আজ মার্কশীটটা পেয়ে বুঝতে পারলুম কেন। আর যারই হোক এ মার্কস আমার নয়, হতে পারে না। যে সব সাবজেক্টে সত্তরের ওপর আশা করছি, সেসব জায়গায় দেখছি পঞ্চাশ, বাহান্ন, সবচেয়ে অদ্ভুত মার্কস ইংলিশের। শতকরা সাঁইত্রিশ। ন্যুইয়র্ক সেন্ট্রালে আমার অ্যাডভান্সড্ ইংলিশ ছিল। মিলটন আর ওয়াল্ট হুইটম্যানের ওপর প্রজেক্ট ওয়ার্ক করতে হয়েছিল। আমাদের স্কুল কাউনসেলর মিসেস ফার্গুসন পেপার দুটো পাঠান প্রিন্সটন য়ুনিভার্সিটির ডক্টর স্টোকারকে। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রিন্সটনই ওখানকার সব স্কুল পরীক্ষা পরিচালনা করে। আমি আজ সাইকেলে বাড়ি ফিরতে পারছি না। সত্রাজিৎকে বললাম, আমায় ডাব্ল-ক্যারি করতে। সত্রাজিৎ ছাড়ল না, একেবারে ওপর অবধি আমায় পৌঁছে দিল। পাঁচটা তলা আমি আর উঠতে পারছি না। উঃ, আর কতদূর! আমাদের লিফ্ট্টা এরা কোন্ নিয়মে আটকে রেখেছে! নীতি-নিয়মকানুন বলে কি এদেশে কিচ্ছু নেই! সত্রাজিৎকে বিদায় দিচ্ছিলুম, ও শুনল না। আমার ঘরে চলে এলো। বলল, ‘আরাত্রিকা, প্লীজ এরকম ভেঙে পড়ো না। আমাদের খাতা লট কে লট মুদির দোকানের ঠোঙা হয়ে গেছে খবর বেরিয়েছিল। বিশ্বাস করিনি। এখন করছি। স্বার্থপরের মতো তখন ভেবেছি ও কোনও গ্রাম-ট্রামের খাতা হবে। জানো, ইংরেজিতে আমি উত্তর করেছিলুম একশ পঁয়ত্রিশের মতো। পেয়েছি সেভেনটি থ্রি পার্সেণ্ট। তার মানে একশ ছেচল্লিশ। আর কিছু বলবে?’
‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
‘তোমাদের এই সিস্টেমটাকে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলতে পার না? তোমাদের ছাত্রদের হাতে তো এখন এতো ক্ষমতা যে কলেজ গভর্নিং বডি, সেনেটে পর্যন্ত যাচ্ছো। দলীয় রাজনীতি করবার জন্য এক পার জায়গায় দশ পা এগিয়ে যাচ্ছ। আর যে পরীক্ষাযন্ত্র এভাবে তোমাদের সর্বনাশ করছে, তার কিছু করতে পারো না?’
সত্রাজিৎ বলল, ‘যা মার্কস পেয়েছি, তাতে ইকো কেউ দেবে কিনা সন্দেহ। এতো ইনভল্ভ্মেণ্ট আমাদের যে বিপ্লবে দেবার মত সময় নেই। তুমি একেবারে একা নও, এইটাই সান্ত্বনা বলে মনে করো। আর, যতই বলো, ছেলেদের কেরিয়ার মেয়েদের চেয়ে অনেক ভাইটাল। আই নেভার ফেল্ট সো ভায়োলেণ্ট ইন মাই লাইফ।’
সত্রাজিৎ চলে গেল। ও ছিল আমাদের ক্লাসের নাম্বার ওয়ান। আমি নাম্বার টু।
অনেকদিন পর একটা হার্ড রক্স-এর ক্যাসেট চালিয়ে দিলাম। বাইরের পোশাকেই শুয়ে আছি। শুনতে শুনতে কখন উঠে পড়েছি, কখন নাচতে লেগেছি জানি না। যখন খেয়াল হল, দেখলাম আলমারির আয়নায় একটা অচেনা মেয়ের ছায়া পড়েছে। চুল খোলা, প্যাণ্টের পটি পর্যন্ত নেমেছে চুল। দারুণ নাচছে মেয়েটা। এতো ভালো কখনও নাচিনি। শরীরের প্রত্যেকটি গ্রন্থি বাজনার তালে ইচ্ছেমতো বেঁকছে, রূপ সৃষ্টি করছে, শরীরটা পাতার মতো হালকা, অথচ রবারের মতো একটা নমনীয়তা তাতে। আমি যেন আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি। ভালো কিছু করার জন্য মানুষের বোধহয় একেবারে একা হওয়া দরকার। অনুভূতির দিক থেকে। রকহার্ট থাকলে এখন কী করত? ও-ই একমাত্র আমার সঙ্গে তালে তাল মেলাতে পারত। দাদা এসে ঘরে ঢুকল। ‘কী রে মণি, দারুণ মুড তো!’ দাদাও নাচতে শুরু করে দিল। বাঃ রে! দাদা এত ভালো নাচে আমি তো জানতাম না! ওঃ ওয়াণ্ডারফুল! রকহার্টের মতোই, কি তার চেয়েও ভালো। দাদার মধ্যে একটা চাপা আবেগ কাজ করছে। চোখ জ্বলজ্বল করছে। দাদার চোখ যেন অন্য কিছু দেখছে। আমি বুঝতে পারছি আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ, একটা দারুণ জিঘাংসা, চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আলো ঢুকে এলো, গোলাপি। তারপরে ধূসর। ভস্ম রঙের আকাশ, ঘর, আসবাবপত্র, মানুষ, আমি, আমার অন্তর। মা বাবা আসতে নাচ থামালাম। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নিজেকে বিছানায়। ঘরে এসে টেবিলের ওপর থেকে মার্কশীটটা তুলে নিল বাবা, মা। আমার দিকে একবার তাকাল। মা বলল, ‘রিভিউ করাবো।’
বাবা বলল, ‘লাভ কী? ওরা তো ঘোষণাই করে দিয়েছে, যে কোনও রিভিউ ট্যাবুলেটর পর্যন্ত পৌঁছবে। আসল খাতাগুলো তো নেই-ই। রি-এগজামিনেশন তো হবে না! অবস্থা এতো সাংঘাতিক, আমি ধারণাও করতে পারিনি। আমাদের কলেজের দুটি সেরা ছেলেরও এই হয়েছে। ফিজিক্সে চান্স পাবে না। ভালো ছেলে সব। পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়তে চায়। জয়েণ্ট দ্যায় নি। দুজনে পরামর্শ করে আত্মহত্যা করেছে।’
মা শিউরে উঠে বলল, ‘চুপ করো। কী বলছো?’
আমি হেসে উঠলাম, ‘ভয় নেই মা। আমি সুইসাইড করব না। আই অ্যাম স্টিল অ্যান অ্যামেরিকান। সত্রাজিৎ পঁয়ষট্টি উত্তর করে ইংরেজিতে তিয়াত্তর পেয়েছে। আমি আশির ওপর আশা করে পেয়েছি থার্টি সেভেন।
দাদা বলল, ‘বাবা, সত্রাজিৎ আর মণির মার্কস উল্টে যায় নি তো, সেভেনটি থ্রি, আর থার্টি সেভেন। লক্ষ্য করেছো?’
মার গলা ধরা-ধরা। বলল, ‘যে যাই বলুক, আমি রিভিউ করাবো।’
বাবা বলল, ‘চলো আমরা সবাই বারান্দায় গিয়ে বসি। জবাকে বলো, আজ আমাদের বারান্দায় ডিনার হবে। ভালো কিছু লাগাও।’
আমি বললাম, ‘আমি একটু একা থাকবো বাবা। প্লীজ ডোণ্ট মাইন্ড। খাওয়ার সময়ে ডেকো। আমার কতকগুলো কাজ আছে।’
দরজাটা বন্ধ করে চিঠি লিখতে বসলাম। একের পর এক চিঠি। বারান্দার দিকের জানলা খোলা। পর্দা দুপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি। মা, বাবা, দাদা নিশ্চয় উদ্বিগ্ন। ওরা দেখুক আমি আত্মহত্যা করছি না।
১৪
স্বর্ণেন্দু হঠাৎ এইভাবে সেরিব্র্যাল অ্যাটাকে মারা যাবে, ভাবতেও পারি নি। একেবারে সুস্থ সবল মানুষটা। অথচ শরীর ভরা যন্ত্রণা নিয়ে এখনও দিন চলছে বড় বউদির। যতবার যাই বলেন, ‘সেজোঠাকুরপো এবার আমায় ছেড়ে দাও, আর পারছি না।’ বাকি জীবনটা খুব নিশ্চিন্তে আপনজনদের মধ্যে কাটাব বলে এসেছিলুম। বাবার বড় ছেলে। বিদেশে গিয়ে সব সময়ে ভেতরে একটা কাটা খচখচ করত। বুঝি নিজের কর্তব্যে গাফিলতি করেছি। সেই যন্ত্রণা থেকে, পাবলিশ অর পেরিশের তাড়না থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু মুক্তি যাদের পাবার নয়, তাদের হাতকড়া বোধহয় ফাঁকা আকাশ থেকে পড়ে। বাবাকে আমি সুখী করতে পারলুম না। বাধাটা ওঁর নিজেরই মধ্যে কোথাও আছে। স্বাস্থ্য ভালো আছে এখনও, ইচ্ছে করলেই জীবনটাকে উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু ভেতরে কোথাও মানসিক জটিলতা আছে, আমরা নাগাল পাই না। বাবা এখনও লিপ্ত থাকতে ভালোবাসেন। মাসখানেক ছুটকির ওখানে ছিলেন। বরাবরের চাপা স্নেহ ছিল ওর ওপর। কতকটা সংস্কারবশে, কতকটা বড়মার ভয়ে দূরে সরেছিলেন। এখন বোধহয় মনে মনে আফসোস করেন। কিন্তু মাসখানেক পর আবার সেই বউবাজারের বাড়ি। রীণা আর সুমিতের সংসার এখনও বাবার মর্জিমতো চলে। কষ্ট হয় ওদের জন্য। বাইরে বাবা কত উদার, আমাদের কাছে কত ন্যায়পরায়ণ। কিন্তু ওই গর্তটুকুর মধ্যে বাবা এখনও গর্তের ব্যাঙের মতোই ব্যবহার করেন। টুলটুলকে একা ছাড়বেন না। কোনও অল্পবয়সী ছেলের বাষ্প বাড়িতে দেখলেই অস্থির হয়ে পড়েন। রীণা বেচারি একেবারে নড়তে পারে না বাড়ি থেকে। বাবু মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে থাকে, ওখান থেকেই ইনস্টিট্যুটে যায়। বাবু থাকলে রীণা এবং সুমিতের ছেলেমেয়েরা আনন্দে থাকে। আমি তাই বাধা দিই না। কমলিকাও মনে হয় ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুকৃত বা আমার কাছে বাবা একেবারেই থাকতে চান না। ওঁর কি ইচ্ছে ছিল নিউইয়র্ক থেকে ফিরে আমরা ও বাড়িতেই থাকি? সুকৃতের ফ্ল্যাট কিনে চলে যাওয়াটাও বাবা ভালো মনে নিতে পারেননি। অথচ, একসঙ্গে তাল পাকিয়ে থাকলে ঠোকাঠুকি ছাড়া আর কিছুই হয় না। ও বাড়ির পার্টিশন আমিই জোর করে করালুম। বাবার যেন তেমন ইচ্ছে ছিল না। বলেছিলুম, ‘দেখো, এবার বড়দা-মেজদার ব্যবহার পাল্টে যাবে।’
ম্লান মুখে হেসেছিলেন বাবা। আমরা আসার দিন বাবা বলেছিলেন, বাড়িটা বলতে গেলে ওঁরই করা। জ্যাঠামশাইয়ের শেয়ার কমই ছিল। সেই নিয়েই কি কোনও খেদ রয়ে গেল বাবার মনে? আমি এসে কতকগুলো পারিবারিক সমস্যার মধ্যে মাথা গলিয়ে বাবাকে অসুখী করলুম কি না বুঝতে পারছি না। আমার দিক থেকে মনে করছি সব কেমন ঠিকঠাক করে দিলুম! কত আত্মত্যাগ করলুম! সুকৃতকেও রাজি করিয়েছি, কত কৃতিত্ব আমার! ওদিকে হয়ত ওই বৃদ্ধ ভাবছেন সারা জীবনের সঞ্চয়, স্ত্রীর সম্পত্তি দিয়ে তিল তিল করে গড়া বুকের পাঁজরের মতো ওই বাড়ি বেহাত হয়ে গেল। বাবাদের পৈতৃক যা কিছু ছিল বড়দা মেজদা তো সবই আত্মসাৎ করেছেন! একজনের উপকার করতে গেলে অন্যদের ওপর অবিচার করা হয়ে যায়। কর্মচক্র এমনই এক দুষ্টচক্র। আমি চাইলুম সুমিতের তিনটি ছেলেমেয়ে, একটু ছড়িয়ে ভালোভাবে থাক। সুকৃত একবার ক্ষীণস্বরে বলেছিল, ‘ফ্ল্যাট করেছি ঠিকই দাদা, কিন্তু জমি বলে তো কিছু নেই!’ মত দিল অবশ্য। কিন্তু হয়ত বাধ্য হয়েই দিল। চক্ষুলজ্জায়। এইসব পারিবারিক জটিলতার প্রশ্ন ওখানে ছিল না। ছুটকির পুনর্বাসন চেয়েছিলুম আমাদের বাড়িতে। হল। কিন্তু আমার হাত দিয়ে নয়, মৃত্যুর হাত দিয়ে।
অ্যালবার্ট সোয়াইটজার সভ্যতার অর্থ করেছেন রেভারেন্স ফর লাইফ। আমরা তাঁর চেয়ে ছোটমাপের মানুষ, তাঁর এই সংজ্ঞার দিকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিয়ে চেয়ে থাকি। অতটা পারি না। কিন্তু আশপাশের যেসব মানুষের সঙ্গে জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে, বিবাহসূত্রে, বসবাসসূত্রে জড়িয়ে পড়েছি তাদের জন্য কিছু করতে না পারলে জীবনের অর্থ কী? অথচ করতে চাইলেই কি পারা যায়? বড় বউদির চিকিৎসার ব্যবস্থা করলুম, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার মাধ্যমেই তিনি জানতে পারলেন, তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছিলেন, স্বামীর অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও। এই ভয়ানক কথা জানবার পর, চিকিৎসিত হয়েও বউদি একেবারে মলিন হয়ে গেছেন। তাহলে কি মিথ্যেটাই ভালো ছিল? বেশি কথা কি? নিজের মেয়ের জন্যেই কিছু করতে পারলুম না। মণি খুব একটা ধাক্কা খেয়েছে। হঠাৎই যেন ও খুব বড় হয়ে গেছে। ওর কাছে, বাবুর কাছে আমার আজকাল নিজেকে খুব শিশু মনে হয়। মণির ডিপ্রেশন দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। ও এবং কমলিকা কি এই শিক্ষা-ব্যবস্থায় ওকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে মনে মনে দোষী করে? নিজের সুখের জন্য আমি কি মণির অসুবিধে ঘটালুম? কিন্তু ও যে সেই বিপজ্জনক বয়ঃসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যখন ওদেশে ছেলেমেয়েরা নিজস্ব জীবনযাপন করতে আরম্ভ করে! ওদের ভাবতে শেখানো হয় ওরা সব জেনে ফেলেছে, জীবনটা এবার বাবা-মার হাত থেকে বুঝে নিক। মা বাবা হাত ধুয়ে ফেলে। কৈশোরের ওই স্পর্শকাতর দিনগুলোর এমনি বোঝা মাথার ওপর পড়ায় অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেক ছেলেমেয়ে দেখেছি যাদের ষোলতে মনে হয় ছত্রিশ কি ছেচল্লিশ। মুখে রেখা, চোখে স্বপ্নহীন শূন্যতা; ঠোঁটে চাপা কাঠিন্য। কেউ কেউ হয়ত স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী হয়। কিন্তু বেশিরভাগই প্রথম দলের।
আচ্ছা, মণি তো এভাবেও জিনিসটা নিলে পারে! এই পরীক্ষা-ব্যবস্থার শিকার লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে। ওর কেসটা আলাদা কিছু না। ওর সমবয়স্কদের সঙ্গে ও যদি একাত্ম হয়ে থাকতে পারে, তাহলে কষ্টটা ওর আপনি কমে যাবে। এসব জিনিস আপনা-আপনিই মনের মধ্যে ঘটতে থাকে। বুঝিয়ে হয় না। যুক্তি মানেই প্রতি-যুক্তি। তর্ক মানেই তকাতর্কি। মন তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশীল। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য তার মধ্যে যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়ে আছে তার ওপরই আমার ভরসা বেশি। ওর বন্ধুগুলো তো বেশ! সত্রাজিৎ, নাদিয়া, নবনীতা! ইতিমধ্যে আমি আর কি করতে পারি! হাসিতামাশা করে বাড়ির আবহাওয়াটা হালকা রাখতে পারি, যাতে অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ওর পক্ষে সহজ হয়।
ছুটকির জন্যও আমার এই চেষ্টা। কাল ছুটকি প্রথম এল ওই ঘটনার পর। শর্মি সঙ্গে আছে। ওর বড় মেয়ে বোম্বাইতে থাকে, খবর পেয়ে এসেছিল, ছিলও অনেকদিন। এখন চলে গেছে। দেখলুম, ছুটকি কালো পাড় সাদা শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউস। ওর রং চাপা, মাথা-ভর্তি কোঁকড়া চুল, মুখটা খুব সুগঠিত, সুডৌল, নাক চোখ মুখ যেন কেউ যত্ন করে কেটে কেটে বসিয়ে দিয়েছে। বড়মার মুখশ্রীর তীক্ষ্ণতাটা ওর আছে, কাঠিন্য নেই। বয়সের তুলনায় অনেক ছেলেমানুষ লাগে। অনেক যত্ন, অনেক ভালোবাসা পেলে তবে মেয়েদের চেহারায় এমন শ্ৰী আসে। ওর আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। স্বর্ণেন্দু তাই দশহাতে ওকে ঘিরে রেখেছিল। স্বর্ণেন্দু মারা যাবার পর থেকেই ওর এই বেশ দেখছি। প্রথমটা কিছু বলতে বাধো-বাধো ঠেকেছিল। কাল বললুম, ‘হ্যাঁরে ছুটকি, তুই তো খুব সাহসিকা, আনকনভেনশনাল অনেক কিছু করিস। তা এটা কি করছিস?’
‘কোনটা সেজদা?’
‘এই সাদা কাপড়, কালো পাড়। তোকে একদম মানাচ্ছে না।’
শর্মি বলল, ‘বলো তো মামু, মা আমার কথা একদম শোনে না।’
আমি বললুম, ‘তুই হয়ত বলার মতো করে বলতেও পারিস না।’
ছুটকি বলল, ‘বলাবলির কী আছে? বয়সটা তো আমার বাড়ছে বই কমছে না।’
আমি বললুম, ‘এসব করিসনি। হাস্যকর আজকালকার দিনে। আমরা প্রাণপণে তোদের কাঁধ থেকে জোয়ালগুলো নামাতে চাইছি। আর তোরাও প্রাণপণে বোকা বলদের মতো সেগুলো আঁকড়ে আছিস।’
মণি ছিল, বলল, ‘ছুটকি! লোকের চোখে নিজেকে দাগী করে রেখে তুমি কি সুখ পাও? তোমাদের সমাজ তোমাকে এইরকম আত্মনির্যাতন থেকে আনন্দ পেতে শিখিয়েছে, না? নিজেকে এভাবে অপমান করো না প্লীজ।’
ওর কথা শুনে আমি অবাক। অবশ্য ও অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক এতটা আমি ওর কাছ থেকে আশা করিনি। বাংলাটাও সুন্দর বলছে! কিন্তু ‘তোমাদের সমাজ’ কথাটা আমার কানে খট্ করে লাগল। ওটা কি কথার কথা? না এখনও এদেশের সঙ্গে ও একাত্ম হতে পারেনি!’
বাবু ফিরেছে, ও একপ্লেট পকৌড়া নিয়ে বারান্দায় বসে পড়ল।
‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের?’
কমলিকা সারাক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। ছুটকি এলেই ওর চোখ ছলছল করে। এখন বাবুর কফি আনবার ছল করে উঠে গেল। এই অপ্রিয় প্রসঙ্গের মধ্যে বোধহয় ও থাকতে চায় না। বাবুর ব্যক্তিত্বে কেমন একটা সহজ আপন-করা ভাব আছে, সবাই ওকে কাছে টানে, ওকে দেখলে আজকাল আমার ভরসা বাড়ে। আমি বললুম, ‘ছুটকির এইসব সাদা কাপড়-টাপড় পরা তুই অ্যাপ্রুভ করিস? কিছু বল তো!’
বাবু বলল, ‘টকটকে ফর্সা রঙে সাদা সবচেয়ে মানায়। যেমন, বড়পিসি, যেমন দিদিমা। যাদের গায়ের রং একটু গাঢ় তাদের সাদা অ্যাভয়েড করাই ভাল। তাছাড়া, পিসে ওর ওয়ার্ডরোবটা অত যত্ন করে সাজিয়ে দিয়ে গেল, ও যদি সেটাকে পুরোপুরি ইগনোর করে, তাহলে···।’
ছুটকি কেঁদে ফেলল।
বাবু যেন লক্ষ্য করল না। একই ভাবে বলে চলল, ‘আচ্ছা ছুটকি, তুমি বরাবর হালকা নীল, পীচ, লাইল্যাক এই সবের পক্ষপাতী ছিলে না? তোমার এসথেটিক সেন্স আমার দারুণ মনে হয়েছে। তোমাদের ফিলম ওয়ার্ল্ডের যেসব ডল আসতো তোমাদের বাড়ি পার্টি উপলক্ষ্যে, তাদের পাশে তোমাকে একদম তাজা ফুলের মতো দেখাত। এক ঘর কাগজের শস্তা ফুলের মাঝখানে। আমার কথা যদি শোনো তো সব সময়ে ইউনিফর্মের মতো সাদাটা পরোনা। মাঝে মাঝে পরবে।’
শর্মি, বাবু আর মণি চলে গেল। আজকাল মণির এই এক ঝোঁক হয়েছে, ক্যাসেট চালিয়ে, দরজা বন্ধ করে এখন তিনজনে নাচবে।
অন্ধকার হয়ে গেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না ভাল। ছুটকির সাদা কাপড় শুধু অন্ধকারের মধ্যে ফুটে রয়েছে। ছুটকি ধরা গলায় বলল, ‘সেজদা তুমি হঠাৎ আমার আনকনভেনশন্যালিটির কথা তুললে কেন? তুমিও কি মনে করো আমাদের পাপের জন্যই ও এভাবে চলে গেল?’
‘ছি ছি! তুই কি কথার কী মানে করলি? পাপ-টাপ কি বলছিস রে? আর “তুমিও” বলছিস কেন? কেউ কি তোকে এসব বলেছে না কি?’
‘বলেনি, তবে ভাবে বোধহয়।’
‘কে?’
‘মা, কাকাবাবু। সে সময়ে কাকাবাবু পাপ কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন সেজদা, সারাজীবন ভুলতে পারিনি। স্বর্ণেন্দুকে এতো ভালোবাসতুম, ও ছাড়া আমার উপায় ছিল না। ভীষণ ইনভলভড্ হয়েও পড়েছিলাম। কিন্তু কাকাবাবুর কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে ছিল সারাজীবন। দাম্পত্য সুখ যাকে বলে, সেজদা সত্যি বলছি তোমায় কোনদিন ভালো করে এনজয় করতে পারিনি। ওকে কষ্টই দিয়েছি শুধু।’
আমি বললুম, ‘বড়মার স্বামী আর কাকাবাবুর স্ত্রী তাহলে কোন্ পাপের ফলে অকালে গত হলেন বল?
তো বোধহয় ষাট পূর্ণ হয়নি।
ছুটকি চুপ করে রইল।
আমি বললুম, ‘কার আয়ু কখন শেষ হয় কে বলতে পারে। আমরা সবাই তো প্রোগ্র্যাম্ড্!’
কমলিকা মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি আবার কবে থেকে অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠলে?’
আমি চমকে বললুম, ‘অদৃষ্টবাদ বলতে পুরোপুরি যা বোঝায় সেভাবে আমি কথাটা বলিনি কিন্তু। অদৃষ্টবাদের সঙ্গে আরও কতগুলো গাদাবোট আছে। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে চলে। যা ঘটার তা ঘটবেই, যাই করো না কেন, নিয়তিকে আটকানো যায় না। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের সিস্টেমের কর্মক্ষমতার একটা সীমা আছে তো, ফুরিয়ে যাবার সময়টা ধার্যই করা থাকে!’
কমলিকা বলল, ‘স্বর্ণেন্দুদা অত রিচ ফুড খেতেন। ওদের বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন লঙ্কাবাটা ছাড়া রান্না হত না। এই গরম দেশে প্রতিদিন মাংস। তাতে বাটি বাটি ঘি। না হলে স্বর্ণেন্দুদা চেঁচামেচি করতেন। ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্কও ভালোই করতেন। ছুটকির কথা তো একেবারেই শুনতেন না। আমি তো মনে করি সেইজন্যেই উনি এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। প্রোগ্র্যাম্ড্ না আরও কিছু। তোমরা আমাদের কথা ভাবো না। ভীষণ স্বার্থপর আসলে, এবং অসংযমী।’
‘বাঃ, তুমি তো বেশ জেনারালাইজ করে ফেললে! থার্ড পার্সন থেকে চট করে সেকেন্ড পার্সন-এ চলে এলে তো বেশ?’
কমলিকা বলল, ‘কেন এলাম তুমি ভালোই জানো। ব্রীফকেসে ওষুধ নিয়ে ঘুরছো। পকেটে কার্ডিওলজিস্টের প্রেসক্রিপশন। অথচ আমি বিন্দু-বিসর্গ জানি না। জীবনটা কি ছেলেখেলা?’
ছুটকি বলল, ‘সে কি রে সেজদা! তোর হার্টের গোলমাল হয়েছে, কাউকে জানাসনি? সেজবউদি জানে না? তোদের হল কি?’
‘তেমন কিছু তো নয়। সামান্য একটু অ্যানজাইনার ব্যথা। যবে থেকে জ্যোতি বলেছে আমি নিয়মিত চেকআপ করাই। বলবার মতো কিছু নয় বলেই বলিনি।’
কমলিকা বলল, ‘উঁহু। বলোনি কারণ তাহলেই আমি তোমার খাওয়া-দাওয়ার ধরা-কাট করব। গতিবিধির ওপর পাহারা বসাবো···’
আমি বললুম, ‘তা ঠিক নয়। সাবধান তো আমি নিজেই হয়েছি। স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছি বললেই হয়। তবে অসুস্থ লোকের মতো থাকতে আমার একেবারে ভাল লাগে না, এটা ঠিক।’
‘তাই বলে তুমি বউদিকে লুকোবে?’ ছুটকি ভীষণ ব্যস্ত ও বিরক্ত হয়ে বলল। কমলিকা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বুঝতে পারছি মুখটা থমথম করছে।
কেন লুকিয়েছি ওকে কি বোঝাবো? আমি নিজেই যে জানি না। বাবার বড় ছেলে। আমাদের বাড়ির বড়মা-তন্ত্রে বাবা পর্যন্ত অসহায় বালকের মতো বাস করতেন। সেখানে স্বাধীন চিত্তবৃত্তির সঙ্কল্প টিকিয়ে রাখতে গিয়ে অনেক সংযম, অনেক স্বাবলম্বন স্বভাবের মধ্যে ঢুকে গেছে। অসুখের কথা কি ছেলেবেলাতেও কাউকে বলতুম? খুব ছোটতে মা ধরে ফেলতেন। কিন্তু তারপর থেকে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছি। কমলিকা জেনে গেল ব্যাপারটা। আমি কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। আজ আমার কপালে দুঃখ আছে।
আসলে আমি সবাইকে খুব সুখী, হাসিখুশী দেখতে চাই। আমার জন্য কারো মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ুক এ আমি চাই না। জীবন তো একটাই। চারপাশে যেসব অশুভ ছায়া নাছোড়বান্দার মতো ঘোরাফেরা করছে তাদের অগ্রাহ্য করাটা তাই ভীষণ জরুরি। আমার অসুখের কথা শুধু কমলিকার কাছ থেকেই নয়, আমার নিজের সচেতন মনের কাছ থেকেও আমি গোপন করে রাখি। যা করার করব, কিন্তু নিজেকে কোনমতেই সুস্থ সবল মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবব না। এ চিন্তাধারা কি ভুল? ভুল হলেও আমার কিছু করার নেই। আমি যে এভাবেই তৈরি!
১৫
সুদীপ আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেলেন। কমলিকাকে বলে রাখলেন ফিরতে একটু দেরি হতে পারে, জরুরি মিটিং আছে।
কমলিকা বললেন, ‘তোমাদের সেই ইনটার্মিনেব্ল জি. বি. মিটিং? তাহলে আমি আজ সোজা ভবানীপুর চলে যাবো।’
‘বেশ তো মণিকেও নিয়ে যেও, যদি পারো।’
চৌরঙ্গিতে ভীষণ জ্যাম। মেট্রো চালু হয়ে গেছে টালিগঞ্জ থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত। তা-ও কিন্তু ধুলো কমেনি। দারুণ গ্রীষ্ম এখন, ধুলো উড়ছে ঘুরে ঘুরে। গাছপালাগুলো ময়লা। যেন অনেকদিন না-কাচা জামাকাপড় পরে রয়েছে। পিচের ওপর গাড়ির চাকার দাগ। অর্থাৎ এরই মধ্যে পিচ গলেছে। মহেশকে আজ কিভাবে সময়টা দেবেন ভাবছিলেন সুদীপ। ও তো হোল-টাইমার নয়। অন্যত্রও কাজ আছে। খানিকটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি আজ সাড়ে সাতটা নাগাদ আমায় তুলতে যেও। পারবে তো?’
মহেশ বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমার একটু দেরি হয়ে যেতে পারে। মজুমদার সাহেবের কাছ থেকে ফিরতে সাধারণত পৌনে আট হয়।’
কলেজে গাড়ি ঢুকতে সুদীপ অবাক হয়ে দেখলেন নতুন রং-করা ঝকঝকে কলেজ বিল্ডিং-এর সমস্ত দেয়ালে বিশ্রী হাতের লেখায় স্লোগান লেখা। “কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও”, ‘জবাব চাই, জবাব চাই’, ‘মুর্দাবাদ, মুর্দাবাদ’, ইত্যাদি কিছু মার্কামারা শব্দ সাঁজোয়া গাড়ির মতো চোখের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। গতকাল বিকেলেও তো এসব ছিল না! তবে কি রাতে লিখেছে! কলেজ-গেট খোলা পেল কোথা থেকে? কেয়ার-টেকার-কাম-দারোয়ান বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে! আগে কলেজে কোনও কেয়ার-টেকার ছিল না। তিনিই বাহাদুরকে কেয়ার-টেকার পদে প্রমোশন দিয়ে কলেজের ভেতর কোয়াটার্স দিয়েছেন।
সব কটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা আছে তাঁর কলেজে। ক’মাস আগে ইউনিয়নের নির্বাচনে ওরা যে-সব পোস্টার লাগিয়েছিল সেগুলো আগেকার চুক্তিমত লোক দিয়ে খুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখন হঠাৎ এরকম লেখার মানে কি? কোনদিকে না তাকিয়ে রাগত মুখে সুদীপ নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। বেয়ারা শ্যামাকে বললেন বাহাদুরকে ডেকে আনতে। শ্যামা খবর আনল বাহাদুর নাকি রাতে বহোৎ বেমার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ওর জেনানাও সেখানে। ছোট ছেলেটা হাতে ছুটির দরখাস্ত রেখে গেছে। ছাত্রনেতা সমীরণ ঘরে ঢুকল, ‘আসব স্যার?’ টেবিলের ওপর একটা লম্বা কাগজ মেলে ধরে বলল, ‘আমাদের বারো দফা দাবির মেমোরান্ডাম আপনার কাছে দিয়ে যাচ্ছি স্যার, জি. বি.র সব মেম্বারদের কাছে কপি পাঠানো হয়ে গেছে।’
হঠাৎ বোমা ফাটার মতো ফেটে পড়লেন সুদীপ, ‘দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে স্লোগান লিখেছ কেন? তোমাদের সঙ্গে কী চুক্তি ছিল আমার?’ পেছু হঠতে হঠতে সমীরণ বেরিয়ে গেল। চোখে এখন কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেন না সুদীপ। সামনে বারো দফা দাবীর কাগজটা পড়তে পারছেন না। হাঁফ ধরছে। চুপ করে বসে আছেন। সামনে ক্রোধের অন্ধকার।
বৃদ্ধ উমেশ ভট্টাচার্য ঘরে ঢুকলেন। দুজনেই চুপচাপ বসে আছেন। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে উমেশবাবু বললেন, ‘আজকের দিনটা একটু সাবধানে কথাবার্তা বলবেন ডক্টর মুখার্জী।’
‘কেন বলুন তো?’
‘হাওয়া ভালো নয়। ছাত্রদের মধ্যে খুব উত্তেজনা। আসবার সময়ে, দেয়ালে কী লেখা আছে দেখেছিলেন?’
‘কি সব কালো হাত টাত দেখছিলুম বটে। সর্বদা সর্বত্র যেমন থাকে···।’
‘হ্যাঁ লিখেছে “সি আই এ-র কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও” ওই সি আই এ-টি কে জানেন? আপনি।’
‘কেন? স্টেটস্ থেকে ফিরেছি বলে?’ সুদীপ শব্দ করে হাসলেন।
‘সেইরকমই রটানো হচ্ছে।’
‘রটানো হচ্ছে কী রকম।’
‘ডক্টর মুখার্জী আপনি বড়ই সৎ এবং সরল মানুষ। নিজের ঘরটিতে বসে মুখ বুজে কাজ করে যান। ওদিকে স্টাফরুমে কি হয় না হয় খোঁজ রাখেন না। তার সুযোগ নিয়ে এরা নানারকম গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টায় আছে।’
‘কেন উমেশদা! টীচারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হবার কোনও কারণ তো ঘটেনি?’
‘বাঃ, আপনি প্রতিদিন বার দুই করে করিডোরে টহল দিচ্ছেন। অধ্যাপকদের সময়মতো ক্লাসে যেতে হচ্ছে। ছাত্ররা গুলতানি করার সুযোগ পাচ্ছে না। পারচেজ, নিজের হাতে রেখেছেন। কোটেশন দেখে দেখে নিত্য নতুন পার্টি বহাল রেখেছেন। আপনি আসার আগে সন্তোষ আর ওই বিকাশ ছোকরার মধ্যে প্রিন্সিপালের পোস্টটা নিয়ে লড়াই চলছিল। কারোরই হয়নি। দুজনেই আপনার ওপর ক্ষেপে আছে।’
‘সন্তোষদার ব্যাপারটা আমি আন্দাজ করতে পারি অবশ্য। কিন্তু উনি বয়সে বড়। ওঁর সঙ্গে মোটামুটি আলোচনা করেই তো আমি চলি!’
‘কোথায় চলেন? বিকাশ সিন্হার বকেয়া আটকে রাখতে বলেছিল সন্তোষ, শুনেছিলেন?’
সুদীপ আর কথা বাড়ালেন না। এই ঘৃণ্য কূট-কচালি আর ভাল লাগছে না। ছাত্রদের দাবীর ওপর চোখ বুলোতে লাগলেন।
ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলবে না।
কলেজ বিল্ডিং সাধারণের সম্পত্তি, অধ্যক্ষের পিতৃসম্পত্তির মতো ব্যবহার করা চলবে না।
ফিজিক্সে খারাপ রেজাল্ট-এর কৈফিয়ত চাই।
সরকারী গ্রাণ্টের সিংহভাগ অধ্যক্ষের ডিপার্টমেণ্টে যায় কেন?
বহিষ্কৃত ছাত্র সর্বশ্রী অংশুমালী রায়, ধীমান শিকদার ও সুধন্য হোমচৌধুরীর ওপর থেকে বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।
বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল ছাত্রদের ক্লাসে তুলে দিতেই হবে।
সুদীপের মাথায় আস্তে আস্তে রক্ত চড়তে লাগল। কয়েকমাস আগে ছাত্র-ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষ্যে কলেজের করিডরে এরা সোডার বোতল ছোঁড়াছুঁড়ি করেছিল। ক্লাস টুয়েলভের একটি বাচ্চা ছেলে সাংঘাতিক আহত হয়, অল্পবিস্তর আঘাত আরও অনেকেরই। পকেট থেকে ছুরি বার হয়েছিল ছাত্রদের। পুলিশে খবর দিচ্ছিলেন। অধ্যাপকরা হাতে-পায়ে ধরে থামিয়েছেন। তিনটি সবচেয়ে হিংস্র ছেলে, যারা হাতেনাতে ধরা পড়ে তাদের তিনি এক্সপেল করেছিলেন। কোনরকম চাপে পড়েই তিনি আর এদের কলেজে ঢোকার অনুমতি দিতে পারেন না। এদের পকেটে ছুরি ছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল নিষিদ্ধ নেশার ট্যাবলেট। এই হল তাঁর রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কলেজ-বিল্ডিং পরিষ্কার রাখবার চেষ্টা করছেন, অতএব সেটা হল সর্ব সাধারণের সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তির মতো ব্যবহার করা। শিক্ষক-সংসদের মিটিং-এ প্রায় প্রত্যেক অধ্যাপক মত দেন বার্ষিক পরীক্ষা আটকানো যবে থেকে উঠে গেছে সেদিন থেকে ছাত্রদের মধ্যে বিশৃংখলা, পড়াশোনার অমনোযোগ দেখা দিয়েছে। তারা নিয়মিত ক্লাস করে না। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে পর্যন্ত গাফিলতি করে। সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয় বার্ষিক পরীক্ষায় এবার থেকে স্ক্রীনিং হবে। সেশনের শুরুতেই ছাত্রদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, ক্লাসে ক্লাসে সার্কুলার ঘোরানো হয়েছিল তিনদিন। বায়োলজি, জুলজি, বটানি—এসব ডিপার্টমেণ্টে রেকারিং এক্সপেন্স বেশি হবেই। তার ব্যাখ্যা হল অধ্যক্ষের ডিপার্টমেন্ট সরকারী অনুদানের সিংহভাগ পায়।
কাগজটা মুড়ে চাপা দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন সুদীপ। বেলটা বাজালেন একবার। মিটিং-এর জন্য আজ তিনটে থেকে ক্লাস বন্ধ। শ্যামাকে বললেন নোটিসটা ঘুরিয়ে এনে সন্তোষবাবুকে একবার ডেকে আনতে।
কিছুক্ষণ পরে শ্যামা এসে বলল, ‘আসেননি স্যার।’
শিক্ষক সংসদের সেক্রেটারি অনুপ এবং চারজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠালেন সুদীপ। আধঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করে এসে শ্যামা বলল, ‘কেউই আসেননি এখনও। সামনের টেবিলে, কাচের তলায়, আজকের টাইম-টেবল পড়ে রয়েছে, সুদীপ দেখলেন পাঁচজনেরই আজ ফাস্ট কিংবা সেকেন্ড আওয়ারে ক্লাস।
তিনটের সময়ে যখন গভর্নিং বডির মিটিং আরম্ভ হল তার মিনিটখানেক পরেই এসে ঢুকলেন চার শিক্ষক প্রতিনিধি। ছাত্র-প্রতিনিধি সমীরণ বলল ‘আমাদের বারো দফা দাবী নিয়ে আলোচনাটা আগে হোক।’
সুদীপ বললেন, ‘ওটা তো আমার হাতে পৌঁছেছে মাত্র আজ। অ্যাজেন্ডাভুক্তই করবার সুযোগ পাইনি। পরের বারে ওটা নিয়ে আলোচনা হবে।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বাইরে থেকে একটা তুমুল গোলমাল উঠল। বেশ কিছু উত্তেজিত ছাত্র ঢুকে পড়েছে ঘরে। প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়ালেন, রাগত গলায় বললেন, ‘তোমরা বাইরে যাও। বিশৃংখলার সৃষ্টি করো না।’
ছাত্রদের মধ্যে থেকে রব উঠল, ‘সি আই –এ-র দালাল নিপাত যাক।’ সমীরণ হাত উল্টে বলল, ‘ওরা আনরুলি হয়ে গেছে স্যার, ওদের কথা না শুনলে মিটিং চলতে দেবে না।’
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমরা মিটিং মুলতুবি রাখছি।’
সারবেঁধে বেরোতে লাগলেন সবাই। সুদীপ দেখলেন ছাত্রদের ভিড়ের ঠিক প্রথম সারিতেই রক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে সেই তিন ধনুর্ধর—অংশুমালী, ধীমান আর সুধন্য। কলেজ কম্পাউন্ড ভর্তি খালি কালো কালো মাথা। সবাই বেরিয়ে যাবার পর সুদীপ দেখলেন তাঁর বেরোবার পথ বন্ধ। কয়েক পা হটে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়তে হল তাঁকে। সমীরণ চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি ঘেরাও হলেন স্যার, যতক্ষণ না আমাদের কথা দিচ্ছেন এদের ওপর থেকে বহিষ্কারের আদেশ তুলে নেবেন, অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রদের তুলে দেবেন ততক্ষণ এই ঘেরাও বহাল থাকবে।’
সুদীপ চুপ করে বসে রইলেন। প্রেসিডেন্টসমেত গভর্নিং বডির সদস্যরা এই জটলার বাইরে আছেন, তাঁরা যা হয় করুন। হাতের সামনে অনেক ফাইল রেখে গিয়েছিল শ্যামা। সেইগুলো দেখতে লাগলেন সুদীপ। ওভারহেড ট্যাঙ্ক বসানো হবে একটা। চারতলায় একসারি টয়লেট। নতুন কমনরুমের ছাদ ঢালাই হবে, চিঠিপত্র, কোটেশন। ফার্নিচারের বিল এসেছে অনেকগুলো। শুধু সই করে দিলেই চুকে যায়। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনেক সময়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলাতে লাগলেন সুদীপ সেগুলো। মন দিয়ে কাজ করছিলেন। হঠাৎ মনে হল নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। বিশ্রী গুমোট, ভ্যাপসা গরম। ঘামের দুর্গন্ধ। মুখ তুলে দেখলেন ছাত্রদের ব্যূহটা প্রায় তাঁর গায়ের ওপরে। হাওয়া ঢুকছে না সেই গরম বৃত্তের মধ্যে। কয়েকজন সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপরে উঠে বসেছে। তিনি ফোনটা তুলে নিলেন। ধীমান লাফিয়ে এসে ফোনের তার কেটে দিল। হাতে চকচকে ছুরির ফলা। তাঁর দিকে চেয়ে বলল, ‘সময় খুব খারাপ স্যার, এক্সপেল করে আমাদের কেরিয়ার নষ্ট করে দেবেন না বলছি। এখনও সময় আছে।’
সুদীপ বললেন, ‘এক্সপেলই করেছি, রাসটিকেট তো করিনি। অন্য কলেজে যাও।’
‘কেউ নিতে চাইছে না। আপনার এক্সপালশন অর্ডার আছে সবাই জেনে গেছে।’
সুদীপ বললেন, ‘তোমাদের কাছে আমি চেয়েছিলুম তোমরা লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর কখনও এসব করবে না কথা দাও। সেটা তো করোনি!’
ধীমান বলল, ‘হীট অফ দা মোমেন্ট কি হতে কি হয়ে গেছে, কথা কি করে দিই স্যার, কথা-টথা দেওয়া সম্ভব নয়। বাড়াবাড়ি একটু হয়ে গিয়েছিল। সে না হয় মাপ চাওয়া গেল।’
‘মাপটা লিখিতভাবে চাও। সেটার রেকর্ড রাখতে হবে আমাকে। আর তোমরা কথা না দিলে আমার পক্ষেও কোন কথা দেওয়া সম্ভব নয়। হীট অফ দা মোমেন্টে সোডার বোতল কি আকাশ থেকে পড়ে? ছুরি মাটি থেকে গজায়? যাই হোক, আমার আর দেরি করিয়ে দিও না। এ নিয়ে অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলি, তারপর ছাত্রপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসা যাবে। আমাকে প্রেশার দিয়ে কিছু করিয়ে নেবার চেষ্টা করো না।’
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে চিৎকার করে উঠল, ‘তোর বাপ করবে।’
দু-একজন ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘এই কি হচ্ছে? এটা কি হচ্ছে?’
সুদীপ সামনের টেবিলটা জোর করে ধরে নিজেকে সামলালেন। যতদূর দেখতে পাচ্ছেন খালি মাথা আর মাথা। তাঁর ঘরে যারা রয়েছে, সব বসে। বাইরে কিছু দাঁড়িয়ে, কিছু বসে। তাঁর সন্দেহ হল, এতো ছেলে, এরা কখনও তাঁর কলেজের নয়, বাইরে থেকে ভাড়াটে গুণ্ডা, মস্তান ডেকে এনেছে এরা। কলেজের একজন বেয়ারা, একজন লেকচারারকেও এদিকে আসতে দেখলেন না।
সাড়ে সাতটার সময়ে সুদীপ বাথরুমে যাবার জন্য উঠলেন। ধীমান লাফিয়ে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। সুদীপ বললেন, ‘বাথরুমেও যেতে দেবে না?’ হেসে উঠল ধীমান। সুদীপ আবার বসে পড়লেন। ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে সাতটার সময়ে মহেশকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছেন। কি করছে কে জানে? এখন তাঁর হাতে এই একটাই মাত্র রঙের তাস। ছেলেটি করিৎকর্মা।
ঠিক আটটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিটে পুলিসের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। চমকে উঠে হিংস্র মুখে ধীমান তাঁর দিকে তাকাল—‘কখন পুলিসে ফোন করলেন?’
‘তুমি তো তার কেটেই দিলে, ইচ্ছে থাকলেই বা করতে পারলুম কই?’
ধীমান বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বললে, ‘অনুপ মিত্তির, বিকাশ সিনহা, সর্বেশ্বর দাশগুপ্ত সব ব্যাটা মীরণ, মীরজাফর।’
অংশু কেটে কেটে বলল, ‘ওদের বানাতে হচ্ছে শালা নেক্সট টাইম।’
পুলিসের গাড়িতে উঠে বসেছেন সুদীপ। কলেজ কম্পাউণ্ডে একটিমাত্র জোর বাতি জ্বলছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন কেয়ারটেকারের ঘরে এখনও তালা। মহেশ এবং তাঁর নিজের প্রিমিয়ার পদ্মিনীর চিহ্নমাত্র নেই। ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা খবর পেলেন কী করে?’
‘আপনার ড্রাইভার মহেশ দত্ত হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে এলো। না হলে আজ সর্বনাশ হয়ে যেত।’
সুদীপ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনও ফোন যায়নি? আর কেউ যায় নি কলেজ থেকে?’
ইন্সপেক্টর আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কই না তো? আমার তো ধারণা কলেজ আওয়ার্সের পর, অফিস-টফিস বন্ধ হয়ে যাবার পর এই ব্যাপার। আপনারা কেউ-কেউ এতো কাজ-পাগল স্যার যে এ যুগে এদেশে ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকে। তা আপনার পার্সোন্যাল বেয়ারা কোথায়? কেয়ারটেকার? কাণ্ড দেখে পালিয়েছে না কি? ছি ছি!’
সুদীপ রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। চৌরঙ্গীতে পড়েছে পুলিশের গাড়ি। জীবনে এই দ্বিতীয়বার পুলিসের গাড়িতে চাপা। প্রথমবার চড়েছিলেন পুলিসভ্যানে। বাড়িতে চুরি হয়ে গিয়েছিল। বাসনপত্র, গয়না, বেশ কয়েকহাজার টাকার জিনিস। থানায় ডায়েরি করতে গিয়ে পুলিস ভ্যানেই ফিরেছিলেন। ছুটকি আর সুকৃতের সে কি লজ্জা!
বহুতল প্রাসাদটার সামনে গাড়ি থামতে আস্তে আস্তে সুদীপকে নামালেন ইন্সপেক্টার। ‘দেখুন স্যার, ঠিক আছেন তো?’
‘আছি বলেই তো মনে হচ্ছে।’
‘এখন অন্তত দশ দিন আর ও মুখো হবেন না। সতেরজনকে অ্যারেস্ট করেছি। তাদের ব্যবস্থা হোক আগে।’
সুদীপ ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আটকে রেখে আর কী করবেন? আরও ফেরোশাস হয়ে যাবে লাভের মধ্যে।’
‘আটকে রাখবো না? বলেন কী? নিজের চোখে আপনাকে অ্যাসল্ট করতে দেখেছি। কলার ধরে সাংঘাতিক ঝাঁকুনি দিচ্ছিল, কি যেন নাম বললেন ছেলেটির? ধীমান, না? দে মাস্ট সাফার ফর ইট।’
সুদীপ কিছু বললেন না। এখন আর কিছু বলতেও পারছেন না, ভাবতেও পারছেন না। এখন অনেক সিঁড়ি ভাঙার আছে। কমলিকার কাছে, মণির কাছে, বাবুর কাছে পৌঁছতে হলে এখনও অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে। পঞ্চাশটা ফ্ল্যাটের মালিক মিলে আবেদন করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত কেস ঠুকেছেন, তবুও খাঁচার মধ্যে তৈরি লিফট্টা অনড়ই রয়ে গেছে, ওটার ব্যাপারে এখনও কিছুই করা গেল না। প্রত্যেকটা ল্যান্ডিং-এ থামতে থামতে দম নিয়ে ওপরে তাকাচ্ছিলেন সুদীপ। কত দূর? আর কতদূর? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ওই তো দাবার ছকের মতো সাদা-কালো স্কার্ট আর সাদা পোলো নেক ব্লাউজ পরে তাঁর প্লেটে খাবার তুলে দিতে আসছে মণি, মুখে দুষ্টু হাসি কিচেনের দরজার কাছে নীল জমিতে সাদা ফুল ছাপ শাড়ি আর ঘোর নীল এপ্রন পরে চায়ের ট্রে হাতে কমলিকা। অরেঞ্জ পিকোর গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক! হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে খাঁচার মধ্যে বন্ধ লিফ্ট্ চালু হল। প্রথমটা পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার কষ্ট। শূন্যের পাতলা বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট। তারপর আহ্! বিনা আয়াসে শাঁ শাঁ করে অনেক তলা ওপরে উঠে গেলেন।
ঠিক চার আর পাঁচতলার মাঝখানের চওড়া ল্যান্ডিংটার ওপর স্বামীকে পেয়ে গেলেন কমলিকা। সঙ্গে মহেশ, মণি, বাবু। বাহাদুর মানুষ! পৌঁছেই গিয়েছিলেন! শুধু একটুর জন্য বাড়ি অবধি ওঠা হয়ে উঠল না। কমলিকা দেখলেন—ডানহাতে আঁকড়ে ধরেছেন বুকের জামা। সিঁড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। রাস্তার দিকের ঝিলিমিলি দিয়ে তীব্র এক ফালি তির্যক আলো পিঠের ওপর পড়ে ছিটকে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে লিকলিকে একটা ছুরি কে বিঁধিয়ে দিয়েছে পিঠের ওপর। রক্ত ছিটকোচ্ছে। কথার কথায় বলতেন, ‘আমি খুব ভাগ্যবান মানুষ, কত পেয়েছি জীবনে! যারা পায় নি, যারা আমার চেয়ে কম ভাগ্যবান, তাদের জন্য কিছু করব না!’
১৬
ওম্, পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকা
দেবি ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা
ত্বং চ ধারয় মাং নিত্যং
পবিত্রং কুরু চাসনম্।
অর্থহীন ঘুমপাড়ানি গান। শুনতে শুনতে ঢুল আসছে। ঘুম আসছে। স্বপ্নের ঘোর। কোটি কোটি যোজন দূরের, ঊর্ধ্বের কোনও লোক থেকে আবহমণ্ডলের ধূলিজাল ভেদ করে অস্ফুট শব্দ। মাঝে মাঝে ঘণ্টাধ্বনির মতো গম্ভীর, অনুরণনময়, আবার মৃদু হয়ে যাচ্ছে, মন্দ্র হয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট দৃশ্য। জলের তলায় বুঝি নাগলোকে মুণ্ডিতমস্তক বালক, শিখাধারী বৃদ্ধ। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে একজন, বলছে একজন। ওরা কারা? নচিকেতা-যম? শ্বেতকেতু-উদ্দালক? সতত আবর্তমান জন্মমৃত্যুক্রমের কোন ঘূর্ণনপর্বে যেন ওদের সঙ্গে দেখা? ···নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেঽস্মিন সন্নিধিং কুরু। তোমার ব্যবহৃত আজকের এই জলে গঙ্গা-যমুনা-গোদাবরী সরস্বতী-নর্মদা-সিন্ধু-কাবেরী এই সপ্ত নদী এসে অধিষ্ঠিত হলেন। আসনশুদ্ধি, জলশুদ্ধির পর অর্থাৎ কিনা তোমার সমস্ত পরিবেশ পবিত্র করে নিয়ে তবে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করবে। শ্বেতপুষ্প, শ্বেত চন্দন, শ্বেত পরিধেয়, কৃষ্ণ তিল, শয্যা, কাংস্য পাত্র···রৌপ্য পাত্র··· ভোজ্য···।
সাদা শাড়ির আঁচল গায়ের ওপর টেনে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল আরাত্রিকা। বড়পিসি বললেন, ‘সব রকম ফল, সব রকম মিষ্টি, লুচি, ভাজা ধরে দিয়েছি। আর যা যা ভালোবাসত তোর বাবা, মনে কর মণি, যদি দিতে চাস।’
আরাত্রিকা রান্নাঘরে গেল, অরেঞ্জ পিকোর কৌটোটা পাড়ল তাক থেকে। হ্যাপিভ্যালি থেকে সরাসরি এসেছে এই চা। বাবার বিশেষ প্রিয়। টিউলিপ ফুলের মতো আকারের সাদা বোন চায়নার কাপে ঢালল সোনালি চা। ট্রেতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। রান্নাঘর আর হলঘরের মাঝখানের ছোট্ট পরিসরটায় দাঁড়িয়ে সে উন্মনা, গোটা হলঘর সুগন্ধে ভরে গেছে। কবে কোথায় যেন এমনি, ঠিক এমনি একটা দৃশ্য? গন্ধ? আরাত্রিকা বলল, ‘বড়পিসি আর একটু দাঁড়াও।’ ফ্রিজ থেকে গাঢ় কফি রঙের পানীয়র বোতল বার করল। স্বচ্ছ কাঁচের ছোট্ট পাত্রে মাপ করে ঢেলে দিল। মেক্সিক্যান লিকিঅর কালুয়া। সুচিত্রা বললেন, ‘এটা··· এটা দিবি মণি?’
আরাত্রিকা বলল, ‘দাও বড়পিসি।’
কলেজ থেকে সন্তোষ চ্যাটার্জি, বিকাশ সিন্হা, অনুপ মিত্র, সর্বেশ্বর দাশগুপ্ত আরও অনেকে এসেছেন। এসেছে জুলজি, বটানির ছাত্ররাও। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর সাদা গোলাপ সবার হাতে। বিকাশ সিন্হার হাতে মালা। ছোটপিসি সুরূপা সেগুলো হাত পেতে নিলেন, মৃদুস্বরে বললেন, ‘মণি, এগুলো রান্নাঘরের সিঙ্কে রেখে দিয়ে আয়। রক্তমাখা নোংরা ফুল পুজোর কাজে লাগে না।’ মহেশকে বললেন, ‘ওদিকের ঘরে গিয়ে ওঁদের মিষ্টিমুখ করিয়ে দাও গে মহেশ। শর্মি, টুলটুল, তোরাও যা, সাহায্য কর্।’
অগ্নিদগ্ধ ও আত্মীয়বান্ধবহীনদের জন্য প্রথম পিণ্ডটি দান করো। যেষাং ন মাতা ন পিতা ন বন্ধুর্নৈবান্নসিদ্ধির্নতথান্নমস্তি···। প্রযান্তি লোকায় সুখায় তদ্বত্।··· বিছোনো কুশের ওপর দক্ষিণ হস্তের তর্জনী আর অঙ্গুষ্ঠের মাঝখান দিয়ে পিণ্ডটি এমনি করে ফেলে দাও। হ্যাঁ। হাত ধুয়ে আচমন করো। এখন দক্ষিণ কর্ণ স্পর্শ করে বলো··· ওম্, পিণ্ডদানমহং করিষ্যে।··· বন্ধ চোখের সামনে কতকগুলো অস্পষ্ট ছায়া। আলো না ছায়া বোঝা যায় না। কম্পমান কতকগুলো চৈতন্যময় শিখা। অস্ফুট কণ্ঠে তারা হাহাকার করছিল, ‘সংকল্প দাও, সিদ্ধি দাও, প্রত্যয় দাও। আমরা তোমার ব্যর্থ পিতৃপুরুষ। তুমি পূর্ণ হলে তবে আমরা পূর্ণ হবো।’
সুকৃত বললেন, ‘নীতা, সেজবউদির য়ুনিভার্সিটি থেকে সব এসেছেন, ডাকো একবার।’
নীতা ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে বলল, ‘সেজদিভাই চোখ বুজিয়ে রয়েছে, আমি এখন ডাকতে পারব না।’
সুকৃত বললেন, ‘কর্মস্থলের ব্যাপার, খানিকটা ফর্ম্যাল তো হতেই হবে।’
নীতা চাপা গলায় বলল, ‘হতে হলে তুমি হও। ওঁরা এসে বসুন না। আমি বলছি বসতে।’
ফলের থালা, ফুলে ভর্তি তামার টাট, বিছোনো কুশ···সব কিছু পেরিয়ে কমলিকার কাছে পৌঁছনই দুষ্কর।
সুকৃত ডাকলেন, ‘সেজ বউদি! সেজবউদি!’
‘আঃ।’ আরক্ত চোখ মেলে তাকালেন কমলিকা। এরা যে কেন তাঁকে বিরক্ত করে এতো! তিনি এইমাত্র অগ্নিপ্রদক্ষিণ সেরে বসলেন। একটা হাতের মধ্যে আরেকটা হাত এখন। গম্ভীর গলায় কে আবৃত্তি করছে— ‘মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মম চিত্তং অনুচিত্তং তেস্তে ··· মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মম ব্রতে···’ কান ফেটে যাচ্ছে আওয়াজে। সভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললেন কমলিকা। কার ব্ৰত? কেন ব্রত? কিসের?
সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ডক্টর সম্বরণ বোস সুকৃতকে বললেন, ‘ডাকবার দরকার নেই ভাই। যেমন আছেন থাকতে দাও। বড় ভালো মেয়ে। ডেকে সাড়া পাই নি এমন তো হয়নি কখনও!’
আরাত্রিকা অবাক হয়ে দেখল মায়ের সহকর্মীদের পাশ কাটিয়ে জ্যোতিকাকু ঢুকছেন। একবার বাবুর দিকে তাকালেন, একবার বেদীর ওপর ছবিটার দিকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল আরাত্রিকা, ‘জ্যোতিকাকু তুমি?’
ডানহাতে আরাত্রিকাকে জড়িয়ে ধরে জ্যোতির্ময় বললেন, ‘তোর মা কই?’
‘মা’—ফিসফিস করে ডাকল আরাত্রিকা—‘মা, জ্যোতিকাকু এসেছে।’
খুব সুন্দর স্বপ্ন-শংকা-সম্মোহঘন আলো জ্বলছিল ঘরে। ঘর ভরে যুঁইয়ের গন্ধ। যে শানাই থেমে গেছে, ভিজে হাওয়ায় এখনও তার চাপা রেশ। মুক্তোর আংটি পরিয়ে দিচ্ছেন সুদীপ ডান হাতের অনামিকায়। সেই হাত জোর করে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে হল কমলিকাকে। অনেকক্ষণ বসে বসে পা ধরে গেছে। মণি সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে এলো। সুদীপের ঘরে বসে আছেন জ্যোতির্ময়। কমলিকা আসতে উঠে দাঁড়ালেন।
‘কুমু!’
ক্লান্ত গলায় কমলিকা বললেন, ‘দীপালি কোথায়? দীপালিকে আনলে না?’ হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে শূন্য চোখে কাকে খুঁজছেন কমলিকা? সুদীপকে? না দীপালিকে? জ্যোতি হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মণি দেখল মা বালিশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে। সে ফিসফিস করে ধরা গলায় বলল, ‘জ্যোতিকাকু, তুমি এখন কোথাও যেও না। মা এতদিনে এই প্রথম কাঁদল।’
১৭
হেমন্ত এসে গেছে। সামনের রাধাচূড়া আর নিমের কালচে সবুজ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথাগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে এবার। বারান্দার অনেক নিচে দেখা যায় রাস্তাটা ভরে আছে ঝরা পাতার স্তূপে। মাঝে মাঝে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যায় কর্পোরেশনের জমাদার। নইলে ওই শুকনো পাতার গদীর ওপর বসে খেলা করে কতকগুলো উলঙ্গ বাচ্চা। বাতাসে এরই মধ্যে বেশ টান। অগাস্টের পর থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে হয়ে বোধহয় শুকনো হয়ে গেছে বাতাস। আজ সুদীপের জন্মদিন। কমলিকা, বাবু, মণি বারান্দায় বসে। গাছপালার মাথা টপকে লেকের জল। মাথার ওপরে কালচে আকাশ। আজকাল সাতটার মধ্যেই খাওয়া হয়ে যায়। দরকার থাকলে কিছুক্ষণ পড়াশোনা, যে যার কাজ, তারপর তিনজনে বারান্দায় এসে বসে থাকে। আরও রাতে জবা চকোলেট দেওয়া দুধ দিয়ে যাবে।
বাবু সন্তর্পণে বলল, ‘মা গান শুনবে না?’
কমলিকা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘শোনা।’
‘ঘরে যাবে? না এখান থেকেই শুনবে?’
‘এখানেই তো বেশ আছি। জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দে। ভল্যুমটা একটু বাড়িয়ে দিস।’
বাবু হোল্ডার থেকে বেছে বেছে বার করল একটা বিশেষ ক্যাসেট। বাবা-মার যৌবনের প্রিয় বাংলাগান সব। অনেক ধৈর্য ধরে বাবা পুরনো রেকর্ড থেকে টেপ করে রেখেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বাবার প্রিয় ব্যসনই ছিল এইসব গান শোনা।
বোতাম টিপতেই হৈমন্তী কলকাতার ভারী বাতাসে উদাস সুর ছড়িয়ে পড়ল—‘কোন দূর বনের পাখি বারে বারে মোরে ডাক দেয়’··· ‘কূল ছেড়ে এসে মাঝ দরিয়ায় পিছনের পানে চাই,’ ··· ‘বালুকা বেলায় কুড়াই ঝিনুক মুকুতা তো কভু মেলে না···।’ বাবু আর মণি আগে ঠাট্টা করত—এগুলো ‘বাবা-মার’ গান। খুব মন দিয়ে কোনদিন শোনেনি ওরা। আজ সায়ন্তনী বারান্দায়, বিরহবিধুর হেমন্তে মাথা নিচু করে শুনতে লাগল বাবার সঙ্গে, মার সঙ্গে। কোনোটা সোজা সরল, কোনোটা ছোট ছোট মুড়কি কাজে ভরা, কিন্তু অব্যর্থভাবে স্মৃতি-জাগানিয়া। রোম্যান্টিক। ‘তোমার চরণ চিহ্ন ধরি পথ যে আমার কাঁদে···’ দরাজ গলার সুর খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে দরদী হাতের স্পর্শ রাখতে লাগল মাথায়। সুদীপ বলতেন বাংলা গানে কথাটা খুব ইমপর্ট্যান্ট। বাণী দরিদ্র হয়ে গেলেই বাংলা গান গেল, যতই সুরের বৈচিত্র্য আনো।
হঠাৎ টান-টান হয়ে উঠে বসল তিনজনে। স্পীকারে পরের গানের বদলে গমগম করে উঠেছে সুদীপের কণ্ঠস্বর:
‘আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো পৃথিবী
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।
তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষগুলো উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো একটি আসনের
সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে।
হে উদাসীন পৃথিবী
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।’
গান থেমে গেছে। কবিতা থেমে গেছে। ফ্লোরেসেন্ট আলোয় শুধু ধাবমান গাড়িগুলোর চকচকে মাথা। হর্নের শব্দ টেনিস বলের মতো ওপরের বারান্দায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে হাওয়া। আরাত্রিকা বলল, ‘মা আমি কর্নেলে অ্যাডমিশন পেয়ে গেছি।’
চমকে কমলিকা বললেন, ‘সে কী রে? কবে?’
‘দিন তিনেক হল চিঠি পেয়েছি। প্যাসেজের ব্যবস্থা করবেন মিসেস ফার্গুসন। মনে আছে আমাদের ন্যু ইয়র্ক সেন্ট্রালের কাউন্সেলর ছিলেন? যাঁকে তুমি একটা র সিল্কের ড্রেস করে দিয়েছিলে। হার্ভার্ডেও পেয়েছিলাম, কিন্তু ডক্টর স্টোকার, যাঁর কাছে আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে, তিনি এখন কর্নেলেই আছেন।’
‘আগে বলিস নি তো। তুই কি গ্র্যাজুয়েশনটা এখানে শেষ করবি না?’
‘না।’
‘কী পড়তে চাইছিস?’
‘প্রধানত লিটরেচার। তারপর দেখি··· এখুনি চাকরি করতে হচ্ছে না। ডক্টর স্টোকারের চেষ্টায় স্কলারশিপ পেয়ে গেছি ভালো। প্রায় আঠার হাজার ডলার।’
বাবু বলল, ‘কবে এতো সব করলি মণি?’
‘হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকেই চিঠি লেখালেখি করছি। “স্যাট”-এর পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। আমার নাম ছিল সবার ওপরে। সারা এশিয়ায়। ‘অ্যামেরিকান ন্যাশন্যালস লিভিং অ্যাব্রড’ এই খাতে স্কলারশিপটা পেয়ে গেলাম। হায়ার সেকেন্ডারির পরই ঠিক করেছিলাম দেশে ফিরে যাব।’
বাবু, কমলিকা দুজনেই চমকে উঠলেন।
কমলিকা খুব আস্তে বললেন, ‘আমাকে ফেলে চলে যাবি?’
আরাত্রিকা মায়ের হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, ‘বিদেশে পড়তে গেলে তো যেতেই হত মা। বিয়ে হয়ে গেলেও যেতে হত। তাছাড়া ওখানে পৌঁছেই তোমাদের যাবার ব্যবস্থা করে ফেলব শীগগিরই। দাদা তো এনি ডে চাকরি পেয়ে যাবে। তোমার জন্য আমি আলেকজান্ডারের সঙ্গে কথা বলব। প্রথমটা তোমরা গিয়ে জ্যোতিকাকুর কাছে উঠবে। জ্যোতিকাকুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে আমার।’
বাবু বলল, ‘কিন্তু মণি, আমি তো যাচ্ছি না।’
আরাত্রিকার গলায় ঝাঁজ, ‘এখনও, এতো কিছুর পরও তুই যাবি না দাদা? বলতে পারলি কথাটা?’
বাবু বলল, ‘তোর মতো বয়সের আরও কতো ছেলেমেয়ে এমনি হতাশায় ভুগছে এখানে, বিশ্বাসঘাতক শিক্ষা-যন্ত্রের শিকার হচ্ছে রোজ, বাবার মতো কত সৎ আন্তরিক মানুষ প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে, হতে পারে। মার্কিন নাগরিকত্বের সব-খোল চাবি তো তাদের হাতে নেই! তাদের ফেলে আমি কোথায় যাবো?’
‘থেকে কি তুই তাদের জন্য কিছু করতে পারবি? একা-একা আন্দোলন করবি না কি?’
‘চেষ্টা তো করবো। কিছু না পারি এক দুর্ভাগ্যও তো ভাগ করে নিতে পারি! আফটার অল আমি তো ভারতীয়ই!’
‘তুই তো এখন থেকেই হবু-শহীদের মতো কথাবার্তা বলছিস!’
‘না রে মণি, আমি এইভাবে দেখি জিনিসটাকে। ধর, টাইটানিকের মতো বিশাল একটা জাহাজ ডুবছে, তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার মতো একজন সক্ষম যুবক যাত্রী কি লাইফবোট নিয়ে সেখান থেকে পালাতে পারে? না পালানো উচিত?’
‘জাহাজটা ডুবছে এটা স্বীকার করছিস তাহলে?’
‘ওটা একটা উপমা। উপমা দিয়ে কিছুটা বোঝানো যায় মণি। সবটা তো যায় না! ডুবন্ত টাইটানিকের এস. ও. এস. তো কেউ শোনে নি! আমাদের সাহায্যপ্রার্থনা যে নিজেদের রক্তেরই কাছে। বাঁচব বাঁচব। বাঁচাব বাঁচাব। প্রতিটি রক্তবিন্দু এখন জপ করে চলেছে। হয়তো এ টাইটানিক শেষ পর্যন্ত ডুববে না। তাছাড়া, ছুটকি, শর্মি, দাদু, বড়মা, আমার মা এরা তো সব এখন অভিভাবকহীন। এদের ফেলেই বা আমি যাবো কোথায়?’
‘মা তো যাচ্ছেই।’
কমলিকা আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব নয় মণি। তোদের নতুন যৌবন, উৎসাহ বেশি, শক্তি বেশি। তোদের প্রজন্মের সঙ্গে কি আমি তাল মেলাতে পারি? তার চেয়ে আমার নিজের সময়ের মানুষরা যাঁদের সঙ্গে আমি এক স্মৃতি ভাগ করে নিয়ে বাঁচতে পারি তাদের কাছে থাকাই আমার ভালো। তোর দিদিমা, দাদাই, পিসিরা, কাকীরা, তোর বাবা···।’
আরাত্রিকা বলল, ‘তুমি এমন স্মৃতি-স্মৃতি করছ যেন তুমি এখুনিই ফুরিয়ে যেতে পারলে বাঁচো।’
‘ইচ্ছে করে কি আর কেউ ফুরিয়ে যায় রে! ওটা তো অনিবার্য ঘটনা! তবে সেভাবে ফুরিয়ে যাবার কথা কিন্তু আমি বলিনি। এখন আর বিদেশে থাকতে ভালো লাগে না মণি। এখানে আমার কাজকর্ম, বাড়িঘর, আপনজন সবই তো আছে। সবার সঙ্গে ভালই থাকব। তোর যদি একান্তই যেতে হয়, যাবি। আমার কথা ভাবিস না।’
বাবু বলল, ‘মা, তুমি মণির ওপর অভিমান করছ কেন? ওর তো এখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার ইচ্ছেটা না থাকাই স্বাভাবিক। ওর দিকটাও দেখো। পড়াশোনা শেষ করে আসুক না! চার পাঁচ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। প্রতি বছর হয় আমরা যাবো, নয় ও আসবে একবার।’
আরাত্রিকা চুপ করে রইল। চোখ ছলছল করছে। কিন্তু ভেতরে সংকল্প অনমনীয়। মনে মনে বলল, ‘হ্যাঁ আসব ঠিকই। এই পরবাসে আমার মা পড়ে রইল, দাদা পড়ে রইল, এখানকার মাটিতে আমার বাবাকে রেখে যাচ্ছি। বারে বারে আসতেই হবে। কিন্তু সে শুধু আসাই, ফেরা নয়। জন্মভূমি আর মাতৃভূমির এই দড়ি-টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত জিতুক আমার জন্মভূমির মাটি। মানুষের পক্ষে সব রকম বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আছে অভ্যাসের বন্ধন, স্বভাবের বন্ধন, সময়ের বন্ধন, সব শেষ এই রক্তের, ভালোবাসার বন্ধন। কিন্তু যে-মেয়ে জীবনের চোদ্দটা বছর তার জন্মভূমির দুরন্ত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে বড় হয়েছে, এবং তারপর বুকভরা আশা নিয়ে বাবা-মার দেশে এসে পদে পদে সেই স্বাধীনতা খণ্ডিত হবার ভয়ানক অভিজ্ঞতায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সে সর্বদাই হাতে মুক্তির মশালটা জ্বালিয়ে রাখবার কথা স্মরণে রাখবে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো।
‘মুক্তির দায়িত্ব আছে। যন্ত্রণা আছে। আছে নৈঃসঙ্গ। কিন্তু এইসব দায়িত্ব, যন্ত্রণা, একাকিত্বের শরিকানা তো অনেকের! আছে স্টীভ, ব্যাথশেবা, তানি, অ্যাডাম রকহার্ট, প্রিয়াঙ্কা। আছে এমিলি, জ্যোতিকাকু।
‘এখন নিশ্চয়ই আমার জন্মভূমির পত্রমোচী অরণ্যে ফল এসেছে। লাল-বাদামি-কমলা-গোলাপি-সোনালি-হলুদ। আদিগন্ত ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রাণবান স্বাস্থ্যবান গাছ সব। নভেম্বরের অন্তিম বৃহস্পতিবার ভালো ফসলের কৃতজ্ঞতায় থ্যাঙ্কস গিভিং ফেস্টিভ্যালে টার্কির রোস্ট ঘিরে বসবে সবাই। ইয়াম, ব্রকোলি, মিষ্টি আলু, ব্রাসেল্স স্পাউট···। তারপরই আস্তে আস্তে শীতের চাদরে ঢেকে যাবে উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের শহর গ্রাম। স্তব্ধ হয়ে যাবে নায়াগ্রা। মহিমময় সে স্তব্ধতা। হাডসন, কলোরাডো, মিসিসিপির বুকে যখন কল্লোল জাগবে, পথের ধারে মাথা দোলাবে বেগুনি সাদা, কলামবাইন রক্তলাল কারনেশন কিংবা বাটারফ্লাই ভায়োলেটরা তখন পিঠে রুকস্যাক আরাত্রিকা মুখার্জি হয়তো বেরিয়ে পড়বে পূর্ব সমুদ্রতটে কমলালেবুর কুঞ্জে ভরা বসন্তের ফ্লোরিডা কিংবা পশ্চিম সমুদ্রতটে গোল্ডেন গেট সেতু পেরিয়ে স্যানফ্রানসিসকো উপসাগরের ভিজে ভিজে হাওয়া গায়ে মেখে আরও দক্ষিণে। নেভাদা মরুর মাঝখানে তৈলদানবের তৈরি বিলাসপুরী ক্যাসিনো-শহর লাস ভেগাস, ডেট্রয়েটের বেগুনি আকাশে রাতভর কারখানার জ্বলন্ত মশাল। রকির মুকুটিত ছায়ায় পাইন স্প্রুসের জঙ্গলে ঝরে-পড়া কোনের পুরু গালচের ওপর বসে বসে গাছে হেলান দিয়ে বিশ্রাম। সঙ্গে থাকতে পারে বহুদিনের বন্ধু ব্যাথশেবা, স্টীভ, কিংবা অ্যাডাম রকহার্ট, থাকতে পারে কৌতূহলী কোনও হিচ্-হাইকার যে তারই মতো জন্মভূমিকে সত্যি-সত্যি চিনতে চায়। কিন্তু কে থাকলো, কে থাকলো না, তাতে খুব বেশি আর এসে যাবে না। কারণ একজন সব সময়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন, বুকের মধ্যে নির্ভয় আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে। তিনি লিবার্টি। আমার দেশে নাগরিকের ইচ্ছেমতো, মানুষের মতো বাঁচবার স্বাধীনতা কেউ কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয় না।
Leave a Reply