জননী – উপন্যাস – শওকত ওসমান
আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলি চাষী।
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এখানেই সরলরেখায় গ্রাম-গ্রামান্তরের দিকে চলিয়া গিয়াছে। ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই সরু গ্রামের পথ। কয়েক মিনিট হাঁটিলেই প্রথমে পড়ে আলী আজহার খাঁর বস্তি। সম্মুখে একটি বড় দহলিজ। বাম পাশে ছোট ডোবা। পূর্বধারে প্রতিবেশীদের খড়োঘর। কয়েকখানা কলাগাছের নীলাভ পাতা চালের ভিতর উঁকি মারিতেছে। উঠানে কেহ বোধহয় কলাগাছ রোপণ করিয়াছিল। আসন্ন বৈকালে এই অঞ্চল ভয়াবহ ঠেকে। জনবিরল গ্রাম। অরণ্যানীর ছায়াভাস আগাছার জঙ্গলে সর্বক্ষণ কালো দাগ আঁকিয়া রাখে। বর্ষাকালে পথঘাট দুর্গম। ঝড়ে পাতাপুতি, হেলানো বাঁশবনের কঞ্চি আর কাদায় রাস্তা চলা বিপজ্জনক। বেতবনের ঝোপ-নিষ্ক্রান্ত বিষাক্ত সাপ দিনেও আশেপাশে বিচরণ করে।
আলী আজহার খাঁকেও এই পথে হাঁটিতে হয়। লাঙল কাঁধে হালের বলদ দুটিকে ভর্ৎসনার আহ্বান দিতে দিতে বহুদিন দেখা গিয়াছে সে আনমনে পথ হাঁটিতেছে।
আজ এই খাঁ-পরিবারের কোনো ছেলেকে দেখিয়া বুঝা মুশকিল, একশ বছর আগে তাহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙালি ছিলেন না। আলী আজহার খাঁর চেহারা পাট্টা জোয়ানের। রঙ ফর্সা। শুধু এই অবয়বে অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে সে বৈশিষ্ট্য-পৃথক। নচেৎ কিষাণ-পল্লীর ভিতর তার অন্য কোনো মাহাত্ম্য-গুণ নাই, যার জন্য শতজনের মধ্যে সে প্রথমে কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে।
আলী আজহার খাঁ জানে, তার পূর্বপুরুষেরা এই গাঁয়ের বাসিন্দা ছিলেন না।
দহলিজের ডোবার পাশ দিয়ে আর একটা সরু সড়ক কিছুদূর সোজাসুজি পশ্চিমে জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার মধ্যে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছে। ভিটার তিনদিকে ঘন ফণীমনসার কাঁটার ঝোঁপ। আর একপাশে বেউড় বাঁশ আর বেত এবং অন্যান্য আগাছার রাজত্ব। ভিটার আশেপাশেও বহু খণ্ড আর চুর্ণ ইট পড়িয়া রহিয়াছে। অতীতে এখানে ইমারত ছিল তার প্রমাণ ইট ছাড়া আরো বহু উপাদান আছে, গ্রামের জনপ্রবাদ-ইতিহাসকে নানা রঙে যা সঞ্জীবিত রাখে। দুপুরে সাপের ভয়ে এইদিকে কেউ আসে না। খাঁ-পরিবারের লোকেরা অবশ্য ভয় করে না। জ্বালানির জন্য এই ভিটার ঝোঁপঝাড় শুধু তাহারাই সাহস করিয়া কাটে। ইহা আর কাহারো সহ্য হয় না। কোনো-না-কোনো বিপদ জড়াইয়া আসে এই রাজ্যের জ্বালানির সঙ্গে। মহেশডাঙার শেখেরা একবার একটি চারা অশথগাছ তুলিয়া তাহাদের উঠানে রোপণ করিয়াছিল। চার বছর পর সেই বাড়ির মুরুব্বি নাকি বজ্রাঘাতে উঠানেই মারা যায়। আরো বহু দুর্ঘটনার জন্য খাঁ-পরিবার এই রাজ্যচ্যুতির আশঙ্কা হইতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ভিটার চাতালের গাছপালা তাহারাই ভোগ করে।
ভিটা সংলগ্ন একটি বড় পুষ্করিণী ছিল। বর্তমানে মজা পুকুর মাত্র। পাড়ে কাঁটাবন দুর্ভেদ্য। কয়েক বছর আগেও পদ্মপাতায় পুকুরের সামান্য পানিও দেখা যাইত না। বর্তমানে জীবনের দ্বিতীয় নামও অন্তর্হিত হইয়াছে। খাঁর পুকুরে পীরের কুমির ছিল। সেই প্রবাদ এখনও মুখে মুখে ফেরে।
আলী আজহার খাঁর নাম পিতৃ-প্রদত্ত। নামের মাহাত্ম্য তারা বোঝে। আজহার খাঁর পিতা আলী আসগর খা সামান্য লেখাপড়া জানিতেন। তবে পারসিতে তার দখলের যথেষ্ট সুনাম ছিল এই অঞ্চলে। আজহার খাঁ পিতার এই মহিমা-গুণ কিছুই পায় নাই। তার পিতামহ আলী আমজাদ খাঁ নাকি আরো পারদর্শী পণ্ডিত ছিলেন। সওয়া-শ বছর আগে তাঁর প্রপিতামহ মজহার খাঁ এই গ্রামে অকস্মাৎ নাজেল হইয়াছিলেন। এই বংশের তিনিই আদি-পিতা। শান্-শওকত দবৃদবা তাঁর আমলেই ছিল। তারপর স্ব-পরিবারের অধঃপতনের যুগ। ইমারতের আকাশ হইতে আলী মজহার খাঁর বংশধরেরা আজ খড়োঘরের মাটিতে নামিয়াছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সব নিরুদ্দিষ্ট। মাটির কাছাকাছি আসিয়া আলী আজহার খাঁও অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ইতিহাসের স্বপ্ন তার কাছে ধূসর মরীচিৎকার মতো মাঝে মাঝে জীবন-সংগ্রামের নিরাশাক্লিষ্ট ক্ষুব্ধ মুহূর্তে ভাসিয়া আসে বৈকি!
আলী আজহার খাঁর রক্তে পূর্বপুরুষদের যাযাবর নেশা আছে যেন। আবাদের পর আর কোনো কাজ থাকে না। ফসলের অনিশ্চয়তা নীড়ে কোনো মোহ জাগায় না। আজহার তাই রাজমিস্ত্রির কাজও শিখিয়াছিল। তখন সে দূরে ভিন গাঁয়ের দিকে কন্নিক আর সূতা হাতে চলিয়া যায়। এমনি আজহার খাঁ নিরীহ। প্রতিবেশীদের কাছে সে সাধু ও সজ্জন নামে খ্যাত। আলী মজহার খাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষের একটি যুবক নির্জীবতার জন্য নিরীহ এমন অপবাদ দেড়শ বছর আগে কেহ মুখে উচ্চারণেও সাহস করিত না। কর্মময় জীবনের ক্ষেত্রে, সাংসারিকতার নাগপাশ, দাসত্বের বেড়ি, পলিমাটির অদৃশ্য যোজনাশক্তি, কোথায় কিরূপ এখানে কাজ করিয়াছে, কেহ তার ইতিহাস জানে না।
আলী মজহার খাঁর রক্তেও কি এমন ধরা-দেওয়া নির্জীবতার ধারা ছিল?
অতীতের সঙ্গীত-তরঙ্গ কলধ্বনি তুলে। সব সেখানে একাকার হইয়া যায়। বিরাট সমুদ্র-স্তনিত পৃথিবী, স্থাবর-জঙ্গমের গতিশীল যাত্রাধ্বনি, শত-মন্বন্তরের পদক্ষেপ, মানুষ আর মানবীর কীর্তিত মিছিল, কালের প্রান্তর-মর্মর। তবুও ভবিষ্যৎ দিচক্রবালের মতো মানুষের নয়নপটের সম্মুখে আঁকা। তাইত এই পথ চলা– যে-পথের বার্তা অতীত বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎ, ত্রিকালের সমাহারে অপূর্ব সমারোহ-ধ্বনি ভাঙা-গড়ার খঞ্জনিতে বাজায়।
আলী আজহার খাঁর সাতবছর বয়সের পুত্র আলী আমজাদ খাঁও হারানো বাছুর খুঁজিতে আসিয়া স্তিমিত বৈকালে তারই হানা-রেশ পাঁজরের গলিতটে বারবার যেন শুনিতে পায়।
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই রাজপথ। শেরশার বিজয় বাহিনীর যাত্রাপথ। পাঠান সম্রাট আর নবাবদের ঐশ্বর্য-দ্রষ্টা ধূলি সড়ক। সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ আত্মগোপন করিতেছে। পত্রপুষ্পের আবরণে দিনের আলো বাধাপ্রাপ্ত। অন্ধকার অবোধ বালকের মুখেও ছায়া ফেলে। দূরে মলিন আকাশ আর দেখা যায় না। শীতের হিমাচ্ছিন্ন রাত্রির আবাহনী শিরীষের ডালে বাজিয়ে থাকে।
এই রাজপথ বাহিয়া সওয়া-শ বছর আগে আলী মজহার খা পনেরো জন সহচর, আরো কয়েকটা ঘোড়া লইয়া মহেশডাঙার অন্ধকারে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। চারিদিকে গাছপালার অরণ্য। ইংরেজ শাসকদের অস্ত্র-বর্ম-সজ্জিত কোনো প্রহরী অন্তত কিছুদিন তাহাদের সন্ধান পাইবে না। বিরাট কর্তব্যের অনুশাসন চতুর্দিকে, মজহার খা বোর শ্লথ করিয়াছিলেন ঘোড়ার। কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে অশ্বপৃষ্ঠে। শুষ্ক রুটি ও ছোট মশকের পানি মাত্র আহার। বিহারের কাছে কোম্পানির একদল সিপাহী তাহাদের পশ্চাৎ অনুসরণ করিয়াছিল। মজহার খা ভীরু নন। পাঠানের সন্তান বুদিল হয় না কোনোদিন। অনেক সময় আত্মগোপন নিজেকে বিরাটরূপে বিকাশেরই প্রাথমিক উপায় মাত্র। মজহার খাঁ তাই সেদিন পনেরো জন অনুচরসহ বহু জনপদ ও দুর্গম পথে পাড়ি দিয়াছিলেন। বাংলা মুলুকে হয়ত বহুদিন কাটাইতে হইবে। বাংলার মুসলমানের সঙ্গে তাঁর অনেক বুঝাপড়া আছে।
অন্ধকার রাত্রি, শীতের হিম-হাওয়া পথে পথে বাজিয়া যায়। ঘোড়াগুলিকে ঘাস খাইতে দিয়া মজহার খাঁ ও তাঁর সঙ্গীরা রুটি সেঁকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রতি কার্যে অসম্ভব রকম ক্ষিপ্রতা। আহার সমাপনান্তে মজহার খা একবার ঘোড়র উপর উঠিয়াছিলেন,আবার অবতরণ করিয়াছিলেন তখনই।
মজহার খাঁ বলিয়াছিলেন, ভাইয়ো, ঠৈরকে, মাই আতা। হাঁটু অবধি নাতিদীর্ঘ পাজামা পরিধানে, কোমরে তলোয়ার, বাম বাজুর দিকে গাদা-বন্দুক। মজহার খা মহেশডাঙার অন্ধকারে একাকী ঝাপাইয়া পড়িয়াছিলেন।
সঙ্গী দু-একজন অনুগমন করিতে চাহিল, তিনি বাধা দিলেন। আসহাব, মাই খোদ্ জানে-ওয়ালা।
মহেশডাঙার এইসব অঞ্চল তখন জনবিরল। মুসলমান পরিবার নিতান্ত নগণ্য। আলী মজহার খাঁকে অনিশ্চয়তা বোধ হয়, সেদিন দৈব কিছু সাহায্য করিয়াছিল নচেৎ আকস্মিকভাবে তিনি আরিফউদ্দীন মুনশীর বাড়িতে প্রথমে পৌঁছিয়াছিলেন কিরূপে?
গ্রামে পশ্চিম-দেশীয় ব্যক্তি মাঝে মাঝে আসে। অগাধ রাত্রে মুনশী আরিফউদ্দিন দহলিজে আসিয়া বিস্মিত হইলেন। জনবিরল অঞ্চলে দস্যুর প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিক। মুনশী সাহেব নবাব দপ্তরে বহুদিন কাজ করিয়াছেন। পারসি জবানেই মজহার খাঁর পরিচয় গ্রহণ শুরু হইয়াছিল। এক প্রহরের মধ্যে দুই বিদেশী মুসলমানে অন্তরঙ্গতা আরম্ভ হইয়াছিল। একজন যুবক আর একজন বৃদ্ধ। মুনশী সাহেবের যুবক-পুত্র শরিফউদ্দিন পিতার নিকট উপস্থিত হইলেন।
রাত্রির মধ্যে আয়োজন চলিতেছে। কিসের আয়োজন?
মুনশী সাহেব বলিলেন, মেরা এহি এক ল্যাড়াকা। ওয়াস্তে দীন-কে। খোদাকে রাহ্ পর। আহ্বানে কি সেই তৃষ্ণা মিটিয়া গেল? একটি নারীর কাঁকনের কনকন ধ্বনির স্রোতে কি জিন্দানের সহস্র কোটি জিঞ্জিরের আওয়াজ স্তব্ধ করিয়া দিল?
নীড়ের বন্ধন স্বীকার করলেও আলী মজহার খর দিগন্তের পিপাসা কোনোদিন নিবৃত্ত হয় নাই। সে অন্য কাহিনী। ইংরেজ সিপাহীর সঙ্গে আবার তাঁহার মোকাবিলা ঘটে। শহীদি কবরগাহেই তাঁর শেষ সমাধি খোদিত হইয়াছিল।
.
আলী মজহার খাঁর অধঃস্তন পঞ্চম পুরুষ আলী আমজাদ খাঁ বাছুর খুঁজিতে আসিয়া শহীদি কবরগাহের সম্মুখে হঠাৎ দাঁড়াইল। আনমনা সে এই পথে চলিয়া আসিয়াছে।
চারদিকে আগাছা আর খেজুরের জঙ্গল। আলী মজহার খাঁ এইখানে শুইয়া আছেন। তারই পূর্বপুরুষ। রক্তে ছিল যার সিংহের বিক্রম, বুলেটের আঘাতে তাঁর শহীদ রুহ, এইখানে বিশ্রাম লাভ করিতেছে। আলী আমজাদ খাঁ তা জানে না। আলী মজহার খার রুহ কোনোদিন মাগফেরাত প্রার্থী নয়। গিধড় অধঃস্তন বংশধরদের ধিক্কার ও অভিশাপ দেওয়ার জন্য অন্তত তার মাগফেরাতের কোনো প্রয়োজন হইবে না।
Leave a Reply