ছেলেকে হিসট্রি পড়াতে গিয়ে – মল্লিকা সেনগুপ্ত
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৫
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: সুব্রত চৌধুরী
.
দূর্বা আর শ্রীজাতকে
.
ছেলেকে হিসট্রি পড়াতে গিয়ে
হিসট্রি ইজ নাথিং বাট ম্যানস অ্যাকটিভিটি
ইন পারসুইং হিজ এইমস’— কার্ল মাকর্স, দি হোলি ফ্যামিলি
আমরা হিসট্রি থেকে জানতে পেরেছি
প্রথম মানুষ ছিল জাভা ম্যান, ক্রোম্যাগনন
নিয়েনডার্থাল ম্যান, ওরা সব বর্বর পুরুষ,
প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিল
ভোঁতা পাথরের অস্ত্রে ভাল্লুক মেরেছে
বাঁশের ফুঁটোর মুখে বাজাতে শিখেছে আড়বাঁশি
ওরাই বানিয়েছিল ম্যান মেড এই সভ্যতাকে
ছায়া ছায়া মানবীরা পাশে ছিল, তবুও ছিল না
প্যালিওলিথিক ম্যান সরে গেলে প্রস্তর সময়
পাথর যুগের সব মানুষেরা স্টোন এজ ম্যান
আয়রন এজ ম্যান লোহা হাতে নিয়ে
এই আদি মানুষেরা সবাই পুরুষ
আমরা হিসট্রি থেকে জানতে পেরেছি।
পূর্ব পুরুষেরা একা, একা একা উত্তরপুরুষ
উত্তরমানুষ নেই, পূর্বনারী নেই আমাদের,
হিসট্রি তো শৌর্যবীর্যে ভরা ‘হিজ স্টোরি’
সেই ইতিহাসে কোনও নারীর উল্লেখ নেই বলে
আমরা বুঝেছি নারী ছিল না তখন;
জাভাপুরুষের গর্ভে পুরুষের জন্ম হয়েছিল
নিয়েনডার্থাল ম্যান শিশুদের স্তন্যদায়িনী
জাভা বা নিয়েনডার্থে মানুষেরা শুধুই পুরুষ
পুরুষ একাই ছিল ভগবান আর ভগবতী
পুরুষ জননী ছিল পুরুষ জনক
পুরুষ স্বয়ং সুর এবং বাঁশরি
পুরুষ স্বয়ং লিঙ্গ এবং জরায়ু
আমরা হিসট্রি থেকে এরকমই জানতে পেরেছি
আসলে হিজরে ছিল ইতিহাসবিদ।
আমার কবিতা আগুনের খোঁজে
আমার কবিতা আলোর চাতক, অন্ধকারের মুনিয়া
আমার কবিতা ছোট পরিবার, বাইরে বিরাট দুনিয়া
কবিতা আমার ঘরসংসার
নদী পাহাড়ের গল্প
আমার কবিতা পারমানবিক
যুদ্ধ অল্প অল্প
কবিতা আমার ঘরের যুদ্ধ, যুদ্ধশেষের কান্না
আমার কবিতা গণধর্ষিতা, উনুনে চাপানো রান্না
আমার কবিতা দাঙ্গাশিবির
গুজরাট থেকে বাংলা
কবিতা আমার পড়তে বসেছে
অবনের বুড়ো আংলা
আমার কবিতা অসহায় যত পাগলি মেয়ের প্রলাপ
আমার কবিতা পোড়া ইরাকের ধ্বংসে রক্তগোলাপ
কবিতা আমার মেধা পাটকর
শাহবানু থেকে গঙ্গা
আমার কবিতা অলক্ষ্মীদের
বেঁচে থাকবার সংজ্ঞা
কবিতা আমার বিশ্বায়নের মার্জারসরণিতে
কবিতা আমার সুন্দরবনে হেঁটে যায় মধু নিতে
আমার কবিতা মৈত্রীমিছিল
সমানাধিকার কর্মী
আমার কবিতা পথে পথে ঘোরে
অসুখ সর্দিগর্মি
আমার কবিতা ফুটপাথ শিশু, গর্ভে নিহত কন্যা
কবিতা আমার ঝড় দুর্যোগ মহামারী ধস বন্যা
আমার কবিতা যুদ্ধবিরতি
প্রথম চুমুর লজ্জা
কবিতা আমার গর্ভের কোষে
নবজাতকের তরজা
আমার কবিতা মণিপুর জুড়ে নগ্নমিছিলে হাঁটে
আমার কবিতা রান্নাঘরের উচ্ছে বেগুন কাটে
কবিতা আমার ছেলের দু’ঠোঁট
বাবার স্মৃতির স্পর্শ
কবিতা আমার দুঃখের ভাষা
প্রিয়বিরহের বর্ষ।
কবিতা আমার মর্জিমাফিক যুদ্ধের সঞ্জয়
কবিতা আমার বারবার হারে বারবার পরাজয়।
কবিতা আমার দিনান্তে ডাল
গরম ভাতের গর্তে
আমার কবিতা বাঁচতে শিখেছে
নিজেই নিজের শর্তে।
সেলাম সেলাম জিভ-কাটা-খনা, ব্যাস, বাল্মীকি, দান্তে
আমার কবিতা আগুনের খোঁজে বেরিয়েছে কাঠ আনতে।
আমার বাবার মুখ
ওঁ দ্যৌ শান্তি অন্তরীক্ষং শান্তি
সর্ব্বাপ শান্তি পৃথিবী শান্তি
আজ তিনি ছেড়েছেন ইহলোকধাম
যাঁর বীজ থেকে আমি জন্মেছিলাম
হে আকাশ, হে পৃথিবী, শান্তি দিয়ো তাঁকে
অন্ধকারে তাঁর পথে যেন আলো থাকে।
আমার বাবার পথে বৈতরিণী পুণ্যশ্লোক হোক
যেভাবে গঙ্গার জলে ভেসে আসে মাঙ্গলিক শ্লোক।
যিশুর শোণিতে ভেজা ক্রুশকাঠ যেরকম ব্যথায় মহান
আমার বাবার শব ব্যথাকাঠে সেরকম চিতায় শয়ান।
গঙ্গেচ যমুনেচৈব গোদাবরী সিন্ধু সরস্বতী
আমার বাবার মাথা ধুয়ে দাও ধুয়ে দাও নদী।
চাল ডাল ঘি লবণ বাগানের সবুজ ফসল
আমার বাবার পাতে বেড়ে দিয়ে যাও অন্নজল।
মহানিম কৃষ্ণচূড়া শাল সেগুনের মহাদ্রুম
পৃথিবীর যত গাছ আমার বাবাকে দাও শান্ত ছায়াঘুম।
তাঁর কাধে চড়ে আমি পর্যটন করেছি প্রথম
অনেক হাঁটার শেষে তাঁর কাঁধে ঘুমে ঢলে মোম
দু’ কাঁধে দু’ ছেলেমেয়ে, শক্ত হাতে স্ত্রীকে ধরে নিয়ে
তিস্তার বন্যার জলে খরস্রোতে একাকী দাঁড়িয়ে
ঘোলা জল বুকে ঠেলে হেঁটেছেন ডাঙার আশায়
শবানুগামীর পিছে জীবনসঙ্গিনী আজ একাকী দাঁড়ায়
ছোট পরিবারটুকু পিঠে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একাশি বছর ধরে হেঁটেছেন তিনি
আজ তাঁকে কাঁধে নিয়ে ভাইবোন আমরা চলেছি
মহাপ্রস্থানের পথে সিরিটি শ্মশানে
তিরিশে নভেম্বর দু’হাজার তিন
আমার বাবার মুখে আলো মৃত্যুহীন।
বীরপুরুষের মা
মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে
খোকাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে!
একলা মা আর একলা ছেলে
ডাকাতগুলো দেখতে পেলে
কী হবে বল্ বীরপুরুষ খোকা?
তুই করবি যুদ্ধ আর আমি রইব বোকা!
স্পষ্ট বলছি, তা হবে না আর
তুই ওদের তির ছুড়লে আমিও দেব মার।
১০০ বছর পার করে ‘মা’ বদলে গেছে রোরো
এখন মায়ের পিঠে চড়েই দেশবিদেশে ঘোরো।
তবু তেমন তেপান্তরের মাঠে
ডাকাত এলে আগুন জ্বেলে মাঠে
মা আর ছেলে দু’জন লড়ব যুদ্ধ
হারব জিতব আমরা অনিরুদ্ধ
ওদের এ কে ফর্টিসেভেন থাক
ভয় পাব না, আমরা দেব হাঁক
জনমানুষ জোট বাঁধুন গ্রামশহর থেকে
আওয়াজ পেলে পালাবে প্রত্যেকে
তুই বলবি, মা গো, তোমার কী জোর দুই হাতে!
আমি বলব, ভাগ্যে রোরো ছিল আমার সাথে!
গুরুচণ্ডালি
গুরু ছিল উঁচুলোক, উঁচু উঁচু ভাষা
নিচু ভাষা মেয়েদের, চণ্ডাল, চাষার
গুরুভাষা গুরুবার গুরু সংকীর্তন
গুরুভারে নুয়ে পড়ে শিষ্যের জীবন।
আমরা চণ্ডাল লোক, গুরুও শিখেছি
ঠুসে দিই চণ্ডালিকে গুরুর গভীরে
যেভাবে আলুর মধ্যে কাঁচালঙ্কা ঠুসি
চণ্ডালিকা গুরুজির ভাষা করে জুসি।
গুরু আর চণ্ডালির এই ফিউশনে
নিচুলোকেদের মুখে ভাষা জেগে ওঠে
দলিত মেথর মুচি নমশূদ্র নারী
গুরুচণ্ডালিতে বলে আনাড়ি খিলাড়ি।
নারী ও শূদ্রের জন্য প্রাকৃত এবং
দলিত দেহাতি হিন্দি, নেটিভ নিগার
অং বং শিখে তবে দিয়েছে কামড়
আজ তারা হাইব্রিড, দিল মাঙ্গে মোর।
আমাদের বর্ণমালা হিংলা বাংরেজি
আমাদের গুরু ছিল পুরুষ ব্রাহ্মণ
মহাগুরু ইংরেজ টম ডিক হ্যারি
গুরুমারা বিদ্যে দিয়ে তাহাদেরই মারি।
সময় অসময়ের কবিতা
পাড়ারিয়া গ্রামে কাল সারারাত পুলিশের গণধর্ষণ
ধুলোবালি টিলা খাদ জঙ্গল পাহাড়ে
পড়ে আছে ইতঃস্তত মেয়েদের অচেতন দেহ
কুঁড়ে ঘরে ভাঙা চাঁদ, মেঠোপথে দেহাতি সংগীত
চাঁদের আলোর নীচে রুপোলি জরিতে
পৌরাণিক পাখিটির ভাঙাচোরা শরীর বিভঙ্গে
ধরা পড়ে আমাদের আদি বিপন্নতা
কেলু তার বউটিকে খুঁজে পায় ধুলোর ভেতর।
ধুতি ও ফতুয়া পড়া দেহাতের নিরীহ যাদব
লাঠি হাতে তুলে নেয় নিজেকে বাঁচাতে
লেলিন, স্টালিন, মার্কস, মাও, হো চি মিন
নিঃশব্দে দাঁড়ান এসে তাদের পেছনে
প্রতিশ্রুতি শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন স্বপ্নসমাজের
তখনই পুলিশ এসে গুলি ছোঁড়ে রাষ্ট্রের ইঙ্গিতে
কুঁড়েঘর পুড়ে যায়, ধরা পড়ে বিপ্লবের নেতা
বেকসুর ছাড়া পায় পাড়ারিয়া ধর্ষণকারীরা;
আমাদের গ্রাম পথে দেহাতে জঙ্গলে
আমাদের শহরের অলিতে গলিতে
ছাড়া পাওয়া বেকসুর ধর্ষণকারীরা
ধুলোমাখা মেয়েদের খুঁজতে বেরোয়।
কবিতার মুহূর্ত
কবিতা পড়া শুরু হলেই ছলাৎছল
থমকে যায় কোলাহলের কথার ছল
নদীর জল যেভাবে পাড়ে আছড়ে পড়ে শব্দরাশি নিয়ে
জলতরঙ্গ সেভাবে তাঁর গলায় চলকিয়ে
ভাঙতে থাকে ডাঙার মাটি আর্ত হাহারবে
যেভাবে বনে আগুন জ্বলে পাথরে চকমকি
কবির গলায় ঠিক সেরকম আগুন জ্বলে, আর্তনাদ ও কী!
যখন কোনও নদীর জলে ভাসতে থাকে দাঙ্গা ভেজা লাশ
যখন কোনও কিশোরীদল গাছকে বাঁচায় কুঠারে পেতে শ্বাস
যখন কোনও মেয়েকে ওরা টানতে থাকে জবার লাল রঙে
যখন খুন আরওয়ালে, যখন গুজরাটে
যখন কোনও আর্ত মেয়ে মায়ের কাছে আগুন চায় রাতে
তখন তাঁর কবিতাগুলি রক্তে ভেজে, বাঁচতে চায়, কুঠারে মাথা পাতে;
মাঠভর্তি মানুষ যারা মঞ্চ ঘিরে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা শুনছিল
তারাই যেন তমসা নদী, তীরে দাঁড়ান নতুন বাল্মীকি
শতাব্দীর কবিতাপাঠ শুরু করেন আজ শঙ্খ ঘোষ
আমরা শুনি বজ্রপাত, বিদ্যুতের মন্ত্রনির্ঘোষ।
টিম ইন্ডিয়া
অনাহার খরা বন্যার দেশে
এগারোটি ছেলে ভরসা
পেটে কিল মেরে রয়েছি আমরা
গ্রীষ্ম শরৎ বর্ষা;
গুজরাট আসে গুজরাট যায়
আমরা তবুও আশায় আশায়
কাইফ পাঠান সৌরভদের
মতোই আমরা একজোট ফের;
যতই কাজিয়া থাকুক না ঘরে
থাকুক অভাব আকাল
আমরা তো জানি সোনা এনে দেবে
এগারো তরুণ রাখাল;
ওদের জন্য আকাই পেপসি
লাল টুকটুকে অলটো
ওদের জন্য ভুলেছি আমরা
শত দুঃখের গল্প;
শাশুড়ির খোঁটা শুনেও বউটা
ভাবছে রাহুল দ্রাবিড়
কিশোরীর মুখে যুবরাজ এসে
মাখিয়ে দিয়েছে আবির;
যে বাবলা আজও চাকরি পায়নি
প্রেমিকা ছেড়েছে যাকে,
বাবা মরে গেছে যে ইমানুলের
চায়ের দোকানে থাকে,
তারা সকলেই মনে মনে জানে
আমরা পারি বা না পারি
সেহবাগ ঠিক ছককা মারবে
স্বপ্নের দেশে পাড়ি;
আজকে যাদের মাথায় তুলেছি
কাল তার গায়ে কাদা,
আজকে শচীন দেবতা আমার
কালকে ভিলেন দাদা;
সাধারণ লোক আমরা এমনই
কখনও বোদ্ধা কখন মুখ্যু
শচীনের খেলা দেখে মিটিয়েছি
না পাওয়ার যত দুঃখু;
প্যাভিলিয়নের ঘেরাটোপ থেকে
টিম ইন্ডিয়া বেরোলে
জনগোষ্ঠীর উচ্ছ্বাস জাগে
কার্গিল থেকে কেরলে।
কী চাই আমরা। এক কাপ অওর!
পাই বা না পাই কাপটা
ক্রিকেট লিখছে সংহতিগান
দেশপ্রেমের ঝাপটা।
পুরুষ রূপকথা
পুরুষ আমি তো এখনও সেকথা ভুলিনি
তোমাকে প্রথম দেখেছি বাবার মধ্যে
বাবার কাঁধের ওপর ঘুমোতে ঘুমোতে
ঘুমপারানিয়া গানের আমেজে এ বি সি
এ বি সি আমার পুরুষ বর্ণমালা
আ-নখ-শিরের যাবজ্জীবন ইজারা
তবুও বাবার বুলিতে শিখেছি বাংলা
তোমাকে দেখেছি দৈত্য দানোর গল্পে
পুঁচকে ভায়ের জন্মকথার সকালে
বেড়ে উঠবার দামাল দুপুরবেলায়
পুরুষ তোমাকে দেখেছি ক্রমশ সন্ধেয়
তোমাকে দেখেছি মাঠে ঘাটে প্রান্তরে
কাশফুলে আর হাসনুহানার গন্ধে
রাঢ়বাংলার রুক্ষ মাটির আলাপে
পুরুষ আমি তো এখনও সেকথা ভুলিনি।
ঠাকুমার ঝুলি তোমার গল্পে গল্পে
এঁকে দিয়েছি রাজপুত্রের ছবিটা
দিগন্তে ধুলো উড়িয়ে সে ঘোড়সওয়ার
আসবে যখন দৈত্যপুরীতে কন্যা
ঘুমিয়ে থাকবে মরণকাঠির জাদুতে।
আমিও তেমনই ঘুমিয়ে ছিলাম, সহসা
জিয়নকাঠির স্পর্শে কে যেন জাগাল
সে ছোঁয়ায় কোনও রাজপুত্তুর অথবা
ঘুঁটেকুরানির ছেলেও কিন্তু ছিল না
মাটি পৃথিবীর মাটিপুরুষেরা আমাকে
আদর সোহাগ দিয়েছে পীড়ন করেছে
জীবনটা কোন রূপকথা নয় সেকথা
বুঝতে পেরেই ঘুম ভেঙে গেছে রাত্রে
পুরুষ তোমার সঙ্গে এখন শর্ত
সমান সোহাগ, সমান সমান যুদ্ধ।
ভালবাসা
ভালবাসা টকে গেলে ছোবল মারবে
একথা জেনেও তুমি ভালবাসা থামাতে পারবে!
স্বপ্নের কথামালা
স্বয়মের জন্য
আমরা গাইব স্বপ্নের কথামালা
আর ভাবব না দুঃখ কষ্ট জ্বালা
অনেক তো বোন দুঃখের কথা হল
এবার আমরা গাইব খুশির শোলোক
পরস্পরের হাতে হাত রেখে ঘুরব
একই সঙ্গে হাসব, খেলব, পুড়ব
আজ আমাদের লড়াই জেতার পালা।
আমরা একক, আমরা কয়েক হাজার
আমরা চালাই ঘর সংসার বাজার
আমরাই বুনি নকশি কাঁথার পাড়
একজোট হলে আর মানব না হার
আজ আমাদের সমানাধিকার পালা
আমরা গাইব স্বপ্নের কথামালা
আমরা গড়ব আমাদের সংসার
ভালবাসা দিয়ে শাসন করব আর
মাথা নোয়াব না কারও কাছে বারবার
অনেক তো বোন দুঃখের কথা হল
এবার তোমরা শপথের কথা বোলো
এসো মেলে ধরি শক্তির ডালপালা
আমরা গাইব স্বপ্নের কথামালা।
মীরাবাঈ
‘ম্যনে চাকর রাখ জি, ম্যনে চাকর রাখ জি
চাকর রহসুঁ বাগ লাগাসুঁ, নিত উঠ দরশন পাসুঁ’
মীরাবাঈ গান গায়, গান গায় মীরা
বুকে তার ভালবাসা দহনের পীড়া
ঘেরাটোপ ছেড়ে মীরা বেরোয় রাস্তায়
পিছু পিছু প্রাসাদের অনুচর ধায়
অন্দরমহল জুড়ে কানাকানি হয়
মীরার দহনজ্বালা গোপন না রয়
‘মেরে তো গিরিধর গোপাল
দুসরো ন কোই॥
যাকে সির মোর মুকুট
মেরো পতি সোই॥’
ময়ূরপালকে ঘেরা দেবতার প্রেমে
গহন নদীর জলে মীরা যায় নেমে
দেবতার আবডালে মানুষের ছায়া
আছে কি না আছে শুধু জানে চাঁদমায়া
কানাঘুষো রক্তচোখ সমাজদহন
দু’হাতে জড়িয়ে মীরা লেখেন ভজন,
‘ম্যনে চাকর রাখ জি, ম্যানে চাকর রাখ জি।’
জারিনা
স্বয়মের জন্য
তালাক তালাক তালাক
খসমটা বড় চালাক
যেই না পুরনো হয়েছে জারিনা
তার মনে হয় আর তো পারি না
নতুন শাদির ধরেছে পেখম
বিবিকে তাড়িয়ে নতুন বেগম
জারিনা বরং পালাক
তালাক তালাক তালাক
কোথায় পালাবে বোঝে না জারিনা
বাপের ভিটেয় তার তো বাড়ি না
খোরপোষটুকু দেবে না মরদ
উধাও হয়েছে আবেগ দরদ
তবু তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন
পঞ্চায়েতের দিদিরা
জারিনার হয়ে ওরাই কাজিয়া চালাক
তালাক তালাক তালাক
সব মেয়েদের লড়াই সাহস
আদায় করেছে কিছু খোরপোষ
তাতেই সামলে নিয়েছে জারিনা
মেয়েরা কখনও লড়াই ছাড়ি না
পাজি খসমটা আজকে বরং পালাক
তালাক তালাক তালাক।
মার
স্বয়মের জন্য
আর কতদিন মার খাবি মুখ বুঁজে!
মুখটা তোর দিয়েছে কেউ কাঠকয়লায় গুঁজে।
পণের জন্য দিয়েছে গায় ছ্যাঁকা
ঘরের কোণে কাঁদিস বসে একা
আমরা যত বোনের দলে ঠিক নিয়েছি খুঁজে।
আর কতদিন মার খাবি মুখ বুঁজে!
প্রতিশোধের জোর আনরে খুঁজে
লড়তে হবে সবাই মিলে, আমরা আছি পাশে
তোরও আছে সমান দাবি আকাশ মাটি ঘাসে
আমরা নেব যুঝে
আর কদিন মার খাবি মুখ বুঁজে!
দুনিয়াটাকে শর্তে নিজের নিতেই হবে বুঝে।
ফুটপাথরে
আমরা ছিলাম আলোর বৃত্তে
মলিন জামা একটি শিশু
বসল এসে আমার পাশে
তার সঙ্গে একটু আধটু
আলাপচারি শুরু হতেই
থাকিস কোথায়? —ফুটপাথরে
চমকে বলি সেটা কোথায়?
ওইদিকে ওই রাস্তাটাতে
ফুটপাথরে গাছের তলায়
তোর সঙ্গে আর কে থাকে?
থাকে আমার অন্ধ বাবা॥
আমার মনে ছায়া পড়তে
বলল মেয়ে, শোন গো দিদি
আমার মা ঠিক তোমার মতো,
কিন্তু তুমি সাজ করেছ
কী সোন্দর দেখাচ্ছে তাই।
বুকের ভেতর ধাক্কা লাগে
আলোর বৃত্তে খালি চেয়ার
কখন ওরা ভরিয়ে তোলে,
মলিন টি শার্ট, কাটা চুলের
ফুটপাথরের সুমিত্রারা
বাংলা ওরও মাতৃভাষা।
যুদ্ধশেষে নারী
জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত,
যুদ্ধশেষে বললেন চেঙ্গিস খান,
বিজিত শত্রুর প্রিয় নারীকে জড়িয়ে
শত্ৰুপুরুষের চোখে দেখা অপমান।
প্রতিটি যুদ্ধের শেষে চলে মহাভোজ
হারেমে হারেমে চলে রানিদের খোঁজ।
যুদ্ধ হয় দেশে দেশে রাজায় রাজায়
শেল ঢোকে মেয়েদের রক্তাক্ত মাজায়।
যুদ্ধে আহত সেনা দেশের নায়ক
যুদ্ধে ধর্ষিত মেয়ে যেন মহাশোক!
পণ্যা মেয়ে আজও আসে সন্ধ্যাদীপ দিতে
সেনাদের ছেড়ে আসা শিবিরগুলিতে।
যুদ্ধের পরে
মেসোপটেমিয়া ছিল এখন ইরাক
কুড়িদিন প্রতিরোধে জ্বেলেছে চিরাগ
বসরাই গোলাপের ওপরে শিশির
বোমারু বিমান দেখে কাঁপে তিরতির
স্বদেশের পথে পথে ভিক্ষাপাত্র ধরে
ইরাকের শিশুগুলি খালিপায়ে ঘোরে
ট্রাকের ওপরে ছিল মৃত্যু মিশাইল
তার ওপর বালকের হাসি অনাবিল
ইরাকি বালিকা মেয়ে টলটলে চোখ
না জানি তাকেও মারে ট্যাঙ্ক টোমাহোক
পর্দা ঢাকা যে মেয়েকে সূর্যও চেনে না
যুদ্ধ শেষে তাকে নিয়ে লোফালুফি পরদেশি সেনা
রাজায় রাজায় যুদ্ধ, উলুখাগড়ার প্রাণ নিয়া
উড়ে যায় ব্যাবিলন, মুছে যায় মেসোপটেমিয়া।
স্বাধীনতা
স্বর্ণজয়ন্তী আমার স্বাধীনতা
কপালে জয়টিকা ডাকের সাজ
তোমার ইতিহাসে হারিয়ে গেছে শুধু
দুঃখী মেয়েদের দীর্ঘশ্বাস
দলিত হরিজন বর্ণ হিন্দুর
সবার ঘরে ঘরে জেনানা খুন
অপারেশন ঘরে রক্ত কান্নায়
বিস্ফারিত হয় কন্যাভ্রূণ
তোমার জয়রথে পক্ষপাত কেন
ক’জন লেখাপড়া, কে ভরপেট!
ক’জন মেয়ে জানে জীবন সীমাহীন
হলুদ প্রজাপতি সর্ষেখেত।
তোমার কিছু ছেলে মাফিয়া মস্তান
কিছু বা ক্রীতদাস যৌতুকের
কয়েকজন ভাল, বউকে ভালবাসে
সমান অধিকার কৌতুকের।
চায়নি নারী কিছু, কিছুই চায়নি সে
এবার বলি শোন, আমার চাই
আমার শাখাগুলি ভরুক শত ফুলে
আমার মাটি ফেটে বাড়ুক বনসাই
যে দেশে বেড়ে উঠি যে দেশে সন্তান
গর্ভে ধরি আর গর্ভক্ষয়
যে দেশ আমারই জরায়ু থেকে জাত
আমার স্বাধীনতা কেবলই ভয়।
কাঁচামিঠে
পুরনো মদের মতো নেশা তুই, গলা বুক জ্বলে
পালানো প্রেমের মতো তেতো তুই, তবু মনে পড়ে
চিলতে আয়না আছে, নেই তোর চিলতে চাউনি
অতল খাদের পাশে মোহবশে পেতেছি ছাউনি
মান অভিমান রাগ চোখ ভরা জল
সব কি বানানো তোর, গোলাপের ছল!
চোখের নেশায় তোর দিতে চাই ডুব
মনে পড়ে মনে পড়ে মনে পড়ে খুব
তোর মনে পড়ে কিনা কী করে বা জানি
মনের ভেতরে চলে কার কানাকানি
কাঁচামিঠে তারুণ্যের উষ্ণতার আঁচে
মরে যাই পুড়ে যাই, কী জানি কে বাঁচে!
কবির প্রতি প্রশ্ন
পীনবক্ষা ক্ষীণকটি সুমধ্যমা বিপুল নিতম্বী
তোমাদের মনোমতো নারীবর্ণনার এই ছাঁচে গড়া
যেসব মেয়েরা সেই মহাকাব্য থেকে
হেঁটে আসছেন আজ একুশ শতকে
তাদেরও মগজ ছিল ভুলে গেছ, ও পুরুষ কবি?
যাদের ফিগার অত মাপমতো নয়
যারা নারীবর্ণনার ওই ছক ছুড়ে ফেলে দিল
যে নারীরা বিপরীত রমণ চেয়েছে,
যে নারীরা সঙ্গিনীর রতিতে বিভোর
পুরুষ সঙ্গীকে যারা প্রভু বলে মানতে নারাজ
যে মেয়ে কবিতা লেখে, তর্ক করে, বিদদ্ধ, বিদূষী
যে মেয়েরা ধান বোনে, ইট তোলে, অফিস চালায়
তাদের বর্ণনাযোগ্য শব্দ নেই তোমার কলমে
অর্ধেক বুঝেছ তুমি মহাকবি, মেয়েদের অর্ধেক বোঝনি।
ঠোঁট শোষণ
ঠোঁটের মধ্যে নরম নোনতা
তোমার দু’ঠোঁট কী কথা বলছে!
তোমার ঠোঁটের তামাক গন্ধ
জ্বালিয়ে দিচ্ছে আমার কলজে
শরীর আমার পিপাসা কলসি
রস টেনে নিই যেন ঘুমবনে
তুলে নিই ঠোঁটে তোমার অহং
তোমাকে শুষছি ঘন চুম্বনে
নুন
লিয়র নামের তার বৃদ্ধ পিতাটিকে
নুনের দানার মতো ভালবেসেছিল কর্ডেলিয়া
পৃথিবীতে নুন এক আশ্চর্য সম্ভার
প্রতিটি দানায় তার রূপ রস গন্ধ অলৌকিক
এক চিমটে নুন দিলে পরমান্ন অমরতা পায়
গরম গার্গল নুন জলে, চোখ উঠলেও নুন
নুন বিশ্বময়
তবুও বিপদ নুনে
ক্লিনিকে ক্লিনিকে শোন সাবধানবাণী
পাতে নুন বেশি খেলে প্রেশার বাড়বে
মেদ বা থাইরয়েড
নুন আর ভাত ছাড়া বাঙালি তো কিছুই চায়নি
তবুও নুনের জলে ভেসে যায় কাকদ্বীপবাসী
নোনা স্রোতে ক্ষয়ে যায় জেলেদের গ্রাম
জীবন আলুনি হলে বড় শীত লাগে
নুন তবু জোঁক মারে, জোঁক মারে শুধু!
বিহারের গ্রামে গ্রামে দুখনি দাইরা
সদ্যজাত কন্যাদের গলার ভেতরে
একদলা নুন দিয়ে মুখ চেপে ধরে
পঁচিশ টাকার জন্য, পঁচিশটা মাত্র টাকা আর
অনভিপ্রেত সে মেয়েটির জন্য একরাশ ঘৃণা
কালান্তক হয়ে ওঠে নুনের দানায়
শত শত কর্ডেলিয়া খুন হয় মারণ লবণে।
ধর্ষণের দেশে
আমার প্রতিবাদের ভাষা নগ্নতা নগ্নতা
কখনও আমি আগুন আমি তরল খরস্রোতা
যে দেশে মেয়ে জন্মেছিল সে দেশ ধর্ষকের
মানুষজন ভুলেই গেছে সময় আজ শোকের
কখনও আমি সত্যবতী, আগুনডিঙির নেয়ে
কখনও একা ইম্ফলের বিদ্রোহিনী মেয়ে
ধর্ষণের স্ট্যাটিসটিকস গুমরে পরে কাঁদে
পাতা উলটে লোকে বলছে আসল দোষ কাদের?
সৈন্যদের ধর্ষিতা সেই মনোরমার শব
আঙুলে ছুঁয়ে শপথ করি আগুন উৎসব
জ্বলব নিজে, জ্বালিয়ে দেব মুখোশ শান্তির
ছুড়ব ধর্ষকের দিকে বিষমাখানো তির
আমাকে রক্তাক্ত দেখেও যদি আমার দেশে
প্রতিবাদের আগুন ভাষা নদীতে যায় ভেসে
আমরা একা গাইতে চাই বিপ্লবের গান
জ্বলে উঠুক নদীর জল, জ্বলুক পাকা ধান
যে ধানখেতে গুম হয়েছে নাবালিকার দেহ
যে নদী বয় ধর্ষিতার গোপন সন্দেহ
ছ’বছরের বালিকাটিকে লজেন্স দেবে বলে
গোপন ঘরে খুন করার পরে পোশাক খোলে
আমার প্রতিবাদের ভাষা নগ্নতা নগ্নতা
মণিপুরের আগুনে আমি জ্বালব কলকাতা।
বৃষ্টি আর আগুন
তুমি আমার আগুন আমি সতীদাহের ঝাঁপ
তুমি সোনার আংটি আমি নেহাত মনখারাপ
আমি যখন শুকনো ঘাস খরার মাঝমাঠে
দাবানলের আগুন তুমি জ্বালিয়ে দাও রাতে
তোমার আঁচে পুড়ে পুড়েই বয়স ঝলসাল
এখনও তুমি ইচ্ছে হলে জ্বালাতে পার আলো
আমি মোমের বাতি আমার পুড়লে রূপ খোলে
আগুন আজও জ্বলবে যদি পোড়াই দুঃখলেশ
তবু আগুন, ত্রাস আগুন, ভাল আগুন তুমি
মাঝেমাঝেই পুড়িয়ে দাও ভালবাসার ভূমি
তাইতো আমি বৃষ্টি হয়ে নিভিয়ে দিই তোকে
ভালবাসার আগুন বুঝি কেউ কখনও রোখে!
যখন গ্রাম শহর পোড়ে অগ্নি উৎসবে
যখন বউ মেয়েরা পোড়ে কেরোসিনের টবে
আমি তখন বৃষ্টি আমি দমকলের ধারা
বৃষ্টি আর আগুনে চলে লড়াই দিশাহারা
আমি আবার রান্না করি তুমি চুলার আঁচ
উনুন ঘিরে জমতে থাকে মানুষ আর মাছ
অথবা যদি নতুন করে লিখতে শুরু করি
আমিই হব আগুন তুমি আগুন লাগা দড়ি।
Mrs. বাংlishএর আত্মবিলোপ
একদা গোধূলিলগ্নে বাংলা আর ইংরেজির বিয়ে হয়েছিল
ইংরেজি office থেকে ফিরে এলে গৃহবধূ বাংলা
তাকে fridge থেকে জল দেয়, লুচি তরকারি আনে,
তারপর গরম চা সহযোগে গরম gossip
বাংলা medium আর চলছে না, Mrs. ব্যানার্জি
বলছিলেন মেয়েকে 2nd language হিন্দি দিয়েছেন।
কর্তা Mr ইংরেজি চায়ে sip করে বললেন,
আনন্দবাজার আর আজকালটা ভাবছি বন্ধ করে দেব,
হিন্দুস্থান Times কিংবা এশিয়াn Age, Telegraph
শ্ৰীমতী বাংলা, মানে বিয়ের পর Mrs. বাংlish
বললেন, ঠিক আছে, sacrifice করছি, বাংলা পড়ব না
ইংরেজি না পড়লে তো global হওয়া যাবে না!
কর্তা বললেন, আমি জানতাম, তুমি কিছু মনে করবে না,
সংসার সুখের হয় রমণীর sacrificeএ
নিজেকে বিলোপ করে দিয়েছ বলেই এত সুখী গৃহকোণ!
পরম আয়েশ করে কর্তা গিন্নি TV দেখছেন
এমন সময়ে ছেলে একটা লাঠি উঁচিয়ে বলল
Expecto Patronum! মা papa সবাই vanish
পোকেমন master হব! সারা world rule করব!
quidditch চড়ে fly করে অর্ণবকে kill করব
লাফিয়ে ওঠেন শুনে Mr. English
এই তো diaspora! hybrid ভাষা!
দেখ এতদিন পরে বাংলার ঘরে ঘরে সত্যি বকচ্ছপ!
আমাদের ছেলে হবে একই সঙ্গে global, গোপাল
শ্ৰীমতী বাংলার বড় দুঃখ হয়, তবু মেনে নেন
বাঙালি ঘরের দিদা ঠাকুমার কাছে শুনেছেন
সাত চড়ে রা কাড়ে না বাংলার মেয়েমানুষেরা
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, শুনে এসেছেন, শিখেছেন
ইংরেজির বশ মেনে ভাল বউ হতে পারলেই
ছেলে হবে corporate দুনিয়া শাসক
শ্ৰীমতী বাংলার এই sacrifice এর জেরে এরপর থেকে
Mr. English আর Mrs. বাংlish
অতঃপর মহাসুখে ঘরকন্না করতে লাগল।
উপোসি
শরীরে শরীর ছোঁয়া লেগে গেলে বিদ্যুৎচমক
শরীরে শরীর ছোঁয়া লেগে গেলে কুছ্ কুছ্ হয়
শরীরে শরীর ছোঁয়া লেগে গেলে সোহাগ শর্বরী
শরীরে শরীর ছোঁয়া গেলে লেগে কলঙ্কের ভয়
এই বনে কতদিন রোমাঞ্চক পুরুষ আসেনি
বনের গোলাপ আর লতাগুল্ম সকলে বিমর্ষ
কতদিন খাঁ খাঁ মাটি, ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎ ঘটেনি
উন্মুখ প্রতীক্ষা করে ঠোঁট, স্তন, উপোসি টরসো
শরীর শরীর চায়, মন চায় শরীরের মন
শরীর শরীর চায় নোনা মিঠে তেতো ও কষায়
শরীর শরীর চায় আলিঙ্গন, প্রগাঢ় সংযোগ
শরীর শরীর চায় শীত গ্রীষ্ম বসন্ত বর্ষায়
প্রোষিতভর্তৃকা মেয়ে প্রতিরাতে ছটফট করে
মাটির দেয়াল জুড়ে দিন গোনা খড়ির আখর
কখনও কি আসবে না মনোমতো রোমাঞ্চ পুরুষ!
তার শরীরের থেকে দূরে চলে গিয়েছে নাগর
এ শরীরে কতদিন বৃষ্টি নেই, খড়খড়ে রোদ
এ শরীরে কতদিন ঠান্ডা নেই, কেবল প্রদাহ
এ শরীরে কতদিন রোদ নেই, বৃষ্টি স্যাঁতস্যাঁতে
এ শরীরে কতদিন দাহ নেই, শীতল প্রবাহ।
যে পাখি উড়ে গেছে
সকাল সন্ধেয় দিনের পর দিন
পাখিকে ভোলাজল দিয়েছি হাতে করে
তবুও পাখি আজ আমাকে গেছে ভুলে।
আমারই দোষ, আমি স্নেহের বশে ওর
বেসুরো সরগমে দিয়েছি হাততালি
ভেবেছি, আহা, ও যে এসেছে নদীকূলে।
ব্যস্ত সময়ের প্রান্ত থেকে খসা
মুহূর্তের হাসি, অলস কথামালা
দিয়েছি পাখিটিকে অবুঝ ফন্দিও।
পাখি তো একা থাকে, দেখার কেউ নেই
পুড়িয়ে হাত নিজে রান্না করবে না
আমার সঙ্গেই দু’মুঠো খেয়ে নিও।
তোমার ফোন নেই! যা কিছু দরকার
আমার ফোন থেকে বলো না প্রেমিকাকে!
দিনের পর দিন মায়ার জাল বোনা।
মানুষ হতে যদি, হয়তো রাগ করে
দিতাম অপবাদ নেমকহারামির,
কিন্তু পাখি তোকে কিছু বলব না।
শুধু চোখ
চোখ শুধু ভেসে আছে শরীর ডুবেছে
মুছে যাওয়া এস এম এস তরুণী বয়স
হারানো প্রেমের চিঠি যৌবনের দিন
চোখ শুধু ভুলে যায় বয়স বেড়েছে
চড়াই পাখির মতো দুটি চোখ আজও
ছটফট করে ওঠে সময় বিশেষে।
চিঠি
হঠাৎ বিকেলবেলা মনে এল চিঠি
আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল পিঠোপিঠি।
বলো নি তো কোনওদিন আমাদেরও বাড়বে বয়েস!
জানলে সামলে নেব ভুলভাল, বেভুল চয়েস।
জানো, আজ সারাদিনে মনেই পড়েনি,
ঘরের কোণেই ছিল হাতুড়ি ও ছেনি।
রোরোদের কারপুল টাকা বাড়িয়েছে
মালিককে ফোন কোরো রাতে বাড়ি এসে।
আমি যে নশ্বর তাও কবে গেছি ভুলে
নিয়তির পাঞ্জা লড়ি একা নদী কূলে।
চিনির বিরুদ্ধে লড়ি মরণ লড়াই
ধমনিতে মিশে গেছে চিনির কড়াই।
তোমাকে হয়নি বলা ফোন এসেছিল
তুমিও বলোনি আদা ষাট টাকা কিলো।
চশমাটা ফেলে গেছ, ঘড়িও পারনি
কার কথা ভাবছিলে আজ সোনামণি।
মেট্রোরেলে দেখা হল, গড়িয়াতে থাকে
কবিতা পাগল তবু চেনে না আমাকে!
সন্ত্রাস
সন্ত্রাস তোমার মুখ হাজার দুয়ারি
তোমাকে দেখেছি আমি রণাঙ্গনে বিজিত শিবিরে
তোমাকে দেখেছি দেশে মহাদেশে পাড়ার গলিতে
তোমার সন্ত্রাস মুখ আধো আলো ছায়া
দেখেছি পরের ঘরে, ঘরের ভেতরে।
কখনও তোমার মুখে শান্তির পতাকা
কখনও বা অনাবিল আদরের ছল
সন্ত্রাস তোমাকে দেখি রাজদ্বারে শ্মশানে সংসারে
তোমাকে দেখেছি আমি বাগদাদে পথের কিনারে
যে ছাত্রীটি ক্লাস শেষে বোরখা পরে রাস্তায় নামবে
সন্ত্রাস তোমাকে দেখি শবনম বানুর সেই সাদা ভিরু চোখে
অধ্যাপক বর রোজ সিগারেট ছ্যাঁকা দেয় যাকে
সেই তন্দ্রা মুখার্জির সন্তানের মুখে দেখি সন্ত্রাস তোমাকে
দারুণ দাঙ্গায় দেখি
প্রাণ ভিক্ষারত কুতুবুদ্দিনের আর্ত দুই হাতে
জলপাইগুড়ির বন্যা, আটষট্টি, কোজাগরি রাতে
আমার যুবক বাবা বন্যার স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন
কাঁধে ছেলেমেয়ে নিয়ে, স্ত্রীকে হাতে ধরে
হঠাৎ বানের জলে ভেসে আসে জলের সন্ত্রাস
ধরা পড়া সাদ্দামের দাড়ি চুলে মুখের গহ্বরে
ডাক্তারি পরীক্ষা চলে, সন্ত্রাস জ্বলে ওঠে টর্চের আলোয়
পাগল পালিয়ে গেলে যেরকম সন্ত্রাস বাজে সাইরেনে
নার্সারি শিশুর হাতে যেরকম ফুটে ওঠে বেতের সপাৎ
যেভাবে গোপন ছুরি বিদ্রোহীর মুখ বন্ধ রাখে
ধর্ষিতা যেভাবে কাঁপে ধর্ষণকারীর যন্ত্র দেখে
বন্দুকের নলে নলে যেমন সন্ত্রাস চলে পাহাড়ে জঙ্গলে
প্রভুর গোপন হাত যেভাবে সুতোর টানে নাচায় দাসীকে
পেন্টাগন যেরকম অনায়াসে দাদাগিরি হুমকি পাঠায়
তেমনই সন্ত্রাস আছে, হুমকি লুকিয়ে বসে আছে
ইহকাল পরকাল আমাদের বাংলা কবিতায়।
আমরা শান্তিবোনেরা
(কমলা ভাসিন, সইদা হামিদ, মোহিনী গিরি, সীমানাপারের বোনেরা এবং উইপসা আয়োজিত ভারত থেকে বাংলাদেশে শান্তি অভিযানের [মে ২০০৩] সঙ্গিনীদের উৎসর্গীকৃত)
আমরা এসেছি শান্তি খুঁজতে খুঁজতে
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ছড়ানো
প্রতিটি মেয়ের তরফে এসেছি আমরা
বোরখা বিন্দি কাজলে এসেছি
গ্রন্থসাহিবে গীতায় কোরানে
কার্ল মার্কস, কেট মিলেটেও
পরম্পরায় আর প্রতিবাদে এসেছি,
এসেছি ঐক্যমত্যে এবং বিরোধে
নানামুখি এক খুশিতে আমরা এসেছি
এসেছি, এসেছি, এসেছি।
আমরা এসেছি মুক্তির কথা বলতে
সীমান্ত, গ্রামে নুরুন্নেসা যে দশবছরের বালিকা
যার ছাগলের বাচ্চাটা গেছে ওপারে পালিয়ে
ছাগল খুঁজতে খুঁজতে বালিকা
ধরা পড়ে গেছে বি এস এফে আর
নরকের মতো সাতদিন ধরে আটক রয়েছে
নুরুন্নেসার তরফে আমরা এসেছি।
আমরা এসেছি খোলা সীমান্ত চাইতে
দুশো তেরো জন নারী ও পুরুষ জিপসি দলের তরফে
প্রতিবেশী দুই বাংলাদেশের মধ্যে
সাতদিন টানাহেচড়ায় যারা মহানীলে
হারিয়ে গিয়েছে তাদের তরফে এসেছি
আমরা এসেছি ভালবাসা নিয়ে
মুসকান আর সফিকুল্লার তরফে
পরদেশি দুই প্রেমিক প্রেমিকা যাদের
দুঃসহ ছিল এক মুহূর্ত বিরহ
অথচ যাদের ছিন্ন করেছে নিজের স্বদেশবাসীরা
এসেছি আমরা বাতাস, মাটি ও জলের তরফে এসেছি
এসেছি আমরা
কবিতা, নাচ ও গানের তরফে এসেছি
এসেছি আমরা
হাসি, চুম্বন, চোখের জলের তরফে
আমরা এসেছি
পুরুষ নারী ও শিশুর তরফে এসেছি
আমরা এসেছি
ভালবাসা আর বন্ধুতা আর শান্তির খোঁজ করতে
শান্তি বোনেরা এসেছি।
নষ্ট বাতিঘর
চলো আজ নষ্ট হই মধ্যরজনীতে
মৃগশিরা নক্ষত্রের মায়াবাস্তবতা
তারাভরা সমুদ্রের কোলে ওই নষ্ট বাতিঘরে
পাগল চুম্বনে চলো ছিঁড়ে ফেলি সব পিছুটান।
ভালবাসা ক্ষয়ে যায়, আবেগ শুকায়
পুরনো প্রাসাদগুলি ভেঙে পড়ে বোমার আঘাতে
চা বাগানে কতদিন উনুন জ্বলে না
বাগদাদে বিষ খায় সঙ্গহীন মার্কিন সেনানি
সমস্ত মানুষ একা মরুঝড় বুকে নিয়ে ঘোরে
যাদেরকে ভালবাসি তারা কেউ মনেই রাখে না
চোরাশিকারির ভয়ে সাবধানী এই বেঁচে থাকা
চল না ভরিয়ে তুলি উন্মত্ত আবেগে।
আমি যে সমুদ্রঝড়ে দিক হারিয়েছি
কে আমাকে নিয়ে যাবে ওই বাতিঘরে
চল চল চল চল। কাকে বলি চল!
নষ্ট হতে চাই কিন্তু, পুরুষ কোথায়!
মৃণালিনী কোলাজ
জোড়াসাঁকোর রবি
রবির তখন একুশ বাইশ, উন্নত শির ধীমান যুবক
মেধায় হৃদয়ে নতুন গানের স্পর্শ
আগুনের মতো রূপবান যুবা, মনকুঠুরিতে আনা তড়খড়
তিন চারখানি কবিতার বই বেরিয়েছে সবে
মাদুর বিছানো তেতলার ছাদে কাদম্বরীর শিউলি ছোঁয়ায়
নির্ঝর সবে স্বপ্ন ভাঙছে ‘জাগিয়া উঠেছে প্রাণ’
আকাশ ভাবছে পৃথিবী ভাবছে তারামণ্ডলে ঈশারা
এমন সময়ে দখিন দিহির গ্রামীণ বালিকা মেয়েটি
এসে দাঁড়ালেন ঠাকুরবাড়ির দুয়ারে
আগুনের সাথে বিয়ে হল এক কলমিলতার
বাসরে বসল ভাঁড়কুলো খেলা,
সব ভাঁড়গুলো উল্টে দিলেন রবীন্দ্রনাথ
এই চব্বিশে অগ্রহায়ণ সব যে উল্টে পাল্টে যাচ্ছে জানো না তোমরা!
দক্ষিণদিহির ভবতারিণী
ঠাকুরবাড়ির পাঠক্রমে ঢুকল এসে নতুন বউ
লরেটো স্কুল বিলাতি পাঠ সাজপোশাকে লাগল ঢেউ
সদলবলে একজিবিশন দেখে যান মিউজিয়াম
ভবতারিণী পাল্টে যান এখন তার নতুন নাম
নয়ানশুক গাউন আর মাথাঘষার রেশমসোপ
অঙ্কবই লেখার খাতা লাগল মনে নতুন ছোপ
ওদিকে কোন অবুঝ রাগে কাদম্বরী সঙ্গহীন
আফিম খেয়ে ঘুমিয়ে যান তেতলাঘরে শোক গহীন
মৃত্যু এত সামনে আর বাজায়নি এ করুণ সুর
শ্মশান থেকে সব হারিয়ে ফিরে আসেন রবিঠাকুর
তখন থেকে বেদনা তার সঙ্গী হল জীবনভর
নতুন গৃহ স্থাপন করে সাজাতে চান নতুন ভোর
রবিঠাকুর পঁচিশ আর মৃণালিনীর তের বছর
মাধুরীলতা জন্ম নিল কার্তিকের সন্ধে ঘোর।
সাহাজাদপুর থেকে রবির চিঠি
ভাই ছোটবউ, তুমি গালমন্দ না পাঠালে চিঠি দাওনা
ঘরে একদল লোক, চিঠি এল, উচাটন, খুলতে পারি না
আজও বই পাঠালে না! আম যা পাঠিয়েছিলে শেষ হয়ে এল
আজ এক দারোগাকে ভাঙা গলা সারানোর ওষুধ দিলাম
হোমিওপ্যাথিতে কিছু রোজগার করে খেতে পারি, দেখছ তো!
এখানে সবুজ খেতে তিমির বর্ষার রূপ বড়ই সুন্দর
আমার প্রবাসে আজ একমাস, আর তো পারি না
বাড়ির দিকেই মন টানছে এখন। তুমি নিয়ম কানুন
সব মানছ তো ঠিক! রোজ ছাতে পায়চারি করার বদলে
কেদারায় পা ছড়িয়ে নভেল পড়ছ না তো! সন্দেহ হচ্ছে
আমি না থাকলে বেলা বেচারা তো ভালমন্দ খেতেই পাবে না
এত চিঠি লিখে লিখে তোমার অভ্যেস খুব খারাপ করেছি
তাও কৃতজ্ঞতা নেই! হপ্তায় দুখানা চিঠি লাখতে পার না!
রবি
শিলাইদহ থেকে মৃণালিনীর চিঠি
তোমাদের ছবি এল। তোমার ছবিটা খুব ভাল
খোকার ছবিটা অত ভাল নয়। পত্রপাঠ বাবুর্চি পাঠিও,
খাওয়াদাওয়া সত্যি আর চলছে না, রোজ মুরগি মুরগি
তাও নেহালের রান্না! নিতু পাখি শিকারের জন্য যাচ্ছিল
থামিয়ে রেখেছি আমি। বাবুর্চির সঙ্গে সস দিও, আর কিছু
বোতলের ফল, রোজ পুডিং খাওয়া যায় না। আর শোন, তুমি
মানকচুর জিলিপি খেতে চেয়েছিলে তার রন্ধনপ্রণালী
বানিয়েছি। তুমি এলে রান্না হবে। বাগানের শাকসবজির
ভাগ প্রত্যেক কর্মীর গৃহে পাঠিয়েছি। মূলা সিং দারোয়ান
দুঃখে ছিল। তার রোজ চারসের আটা লাগে, আয়ে কুলায় না
আমার ভাণ্ডার থেকে তাকে রোজ আটা দিতে ব্যবস্থা করেছি
তোমার ঢাকাই ধুতি উত্তরীয় পশ্চিমের দেরাজে রয়েছে
বিশেষ সভায় গেলে পরে যেও, ভারি ভাল মানাবে তোমাকে
খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে, শুধু মুগ ছোলা সিদ্ধ খেয়ে দিন যাবে?
সিঁড়িতে পড়বে যেই মাথা ঘুরে, শিক্ষা হবে ঠিক।
বোঠানের মতো আমি কবিতা বুঝি না, আমি বিবির মতো না
দইয়ের মালপো আর আমের মেঠাই দিয়ে তোমাদের মন
ভরিয়ে তুলতে চাই, তুমি খাওয়া ছেড়ে দিলে কষ্ট হয়, ছুটি।
জোড়াসাঁকো থেকে রবির চিঠি
ভাই ছুটি, আজও চিঠি দাওনি যে! চিঠি দূরে থাকবার সুখ
জিনিসটি অল্প বলে দাম বেশি। দু চারটে কথা হাতে ধরে
রাখা দায়। কাল রাতে স্বপ্নে দেখি রাগ করে বকছ আমাকে,
মনটা খারাপ হল। ৭ই পৌষের লেখা আজও হল না।
রথিটা আসবে কবে? বাগানে কড়াইশুঁটি কতদিনে হবে?
আমার সুখের জন্য তুমি বেশি চেষ্টা করো না
ভালবাসা থাকলেই হবে। তোমাতে আমাতে যদি সব কাজ
লেখাপড়া, কাব্যরুচি মিলেমিশে হত, বেশ হত, কিন্তু আমি
জোর করতে চাইনে, আমি যা শিখতে চাই তুমি যদি তাই
শেখ ভাল হয়, কোন ক্ষেত্রে আমি অতিক্রম করতে চাইনে
ভয় হয় পাছে ইচ্ছা অনুরাগে নির্যাতন করি
আমার কবিতা যদি মনে নাই ধরে তবে মানুষ রবিকে
যত্ন দিয়ে দুঃখ থেকে রক্ষা করো, বহুমূল্য হবে সেই দান,
এখন নাইতে যাব। আজ লিখতেই হবে। হামি নিও, রবি
মৃণালিনীর ঘুমের ঘোর
তেরশো আট সালে বিদ্যালয় হল শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষ
ঠাকুর পরিবারে সবাই ধরে নেয় কাণ্ডজ্ঞানহীন রবিঠাকুর
বিদ্যালয় সব অর্থ খোয়াবেন। সঙ্গে ছোটবউ অবিবেচক
সকল কাজে তার স্বামীর সঙ্গিনী না হতে পারলেও ছুটকি বউ
গয়না বেচে দিয়ে শক্তি শ্রম আর জীবন দিয়ে
ত্যাগের সঙ্গিনী আদর্শের সাথি উঠছিলেন হয়ে ক্রমেক্রমেই
ছাত্রগণ যেন নিজের সন্তান, জননী মৃণালিনী রাঁধেন ভাত
রাঁধ তে রাঁধতেই অসুখে পড়ে যান। অসুখ বেড়ে চলে দিনকে দিন
শিয়রে সারারাত পাখার হাওয়া দেন, স্বয়ং রবিবাবু নিঃসহায়
বেয়াল্লিশ তাঁর বয়স হল সবে, বছর উনত্রিশ গিন্নিটির
তেরোশো নয় সালে ৭ই অঘ্রাণ মৃত্যু হলো তাঁর মৃণালিনীর।
অবিরত চণ্ডালিকা
একটি সংলাপ কবিতা
মাধব চতুর্বেদীর নৃত্যাঙ্গন। নাচ শিখতে আসা কিশোরীরা আপনমনে মহড়া দিচ্ছে। পাশে দূরে কোণঠাসা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে দেখে নাচ তোলার চেষ্টা করছে।
মাধবজির নাচের স্কুলে কিশোরী একদল
আপনমনে হিল্লোলিত ভঙ্গি তুলে ধরে
ওদের দেখে মাহারদের মেয়েটি কোণঠাসা
ও যে শুধুই শিখতে চায় উঁচুজাতের ভাষা।
গানের ফাঁকে একটি মেয়ে
কোণঠাসাকে আঙুল তুলে বলে—
কেন যে তুই দাঁড়াস এসে রোজ
নাচের টানে গানের পিছু টানে
এই স্কুলে তো অপাংক্তেয় তবু
আসিস যে রোজ আছে কি কিছু মানে?
অন্য এক সাজুনি মেয়ে নাচ থামিয়ে দিয়ে
কোণঠাসাকে হুল বিঁধিয়ে হাসে—
দুই কান কাটা তোর বেশরম ছুঁড়ি
তুই বড় ছোঁচা মেয়ে প্রকৃতি মাহার
আমাদের দলে তোর ঠাঁই হয় না কি!
কাকের ময়ূরপুচ্ছ খোলে না বাহার।
প্রকৃতি ওর কুকথা শুনে দু’হাতে মুখ ঢাকে
মুচড়ে ওঠে জন্মচাপা দুঃখগুলি আজও,
তোমরা কেন অমন করে কষ্ট দাও বল,
তোমাদের তো অনেক আছে, অনেক সুখে সাজো
আমি গরিব মাহার মেয়ে একা
তোমার ভাষা শিখতে চাই, তোমার মতো নাচ
তোমার যারা সোনা চামচ, রুপো চামচ মেয়ে
তোমরা যারা বামুন মেয়ে আগুনরঙা আঁচ
আমি অনেক কষ্ট করে নকল করে দেখি
ওই আগুনের ছিটেফোঁটাও শিখতে পারি কি না
তোমার ওই সুশিক্ষিত রূপ গুণের পাশে
আমি তো মাটি, আমি তো জল, তৃণের চেয়ে তৃণা।
বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত!
গর্জে উঠে দু’জন মেয়ে মারতে চায় ওকে
তখনই গেট ধাক্কা মেরে খুলে
ঘরে ঢোকেন মাধব চতুর্বেদী
মুহূর্তেই পরিস্থিতি সমঝে নিয়ে তিনি
আঙুল তুলে বলেন, না, না, না, না,
‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি
গুরুর গানে গলা মেলায় অবুঝ মেয়েগুলি
সবাই মিলে তাড়া লাগায় মুখে জাতের বুলি—
গুরু মাধব চোখ রাঙিয়ে বলেন ওরে ছুঁড়ি
এ দরজাতে আর কখনও পা রাখবি না ভুলেও
প্রকৃতি তবু সজল চোখে মিনতি করে ওকে
মাধবগুরু আমি তো আসি নাচ শেখার ঝোঁকে
আমি তো আপনারই গান অঙ্গে চাই নিতে
আমি তো চাই শিষ্যা হতে গ্রীষ্ম আর শীতে।
আপনি যা যা শেখান ওই দিব্য মেয়েদের
আমি তো তাই নকল করে শিখতে চাই ফের
পায়ের নীচে অন্ধকারে জন্ম হল বলে
গুরুর ঘরে আলোর টানে নিজেই আসি চলে
লাথি মেরেও অহল্যাকে শেখাও গান শুরু
আমাকে শুধু আলোর পথ বাতলে দাও গুরু।
মাধবগুরু মুখ বেঁকান, বাঁকায় অন্যরা
জানিস তুই জন্মেছিস পঙ্গু আর খোঁড়া!
জাতপাতের বিচার সব উঠিয়ে দিলে হবে!
তোকেই যদি শেখাতে যাই, কোথায় যাবে ওরা।
চাঁড়াল আর মাহার যদি দেবভাষায় বলে
হরিজনের মেয়েরা যদি আমার নাচে ঢলে
তোকে না যদি তাড়াতে পারি আমার স্কুল থেকে
রামরাজ্য ধুলোয় পড়ে খাবেই হাবুডুবু
আমি তো চাই রামের রাজ, ব্রাহ্মণের রাজ
ডুবতে হলে তুইই ভোব, গণতন্ত্র ডুবুক।
দু’চোখে তোকে দেখতে হল এই আমার ভুল
এক্ষুনি যা এখান থেকে, আমার চক্ষুশূল।
তোর ছায়ায় পা পড়ে গেছে আসতে হবে নেয়ে
কি কুক্ষণে তোর মা তোকে জন্ম দিল মেয়ে!
প্রকৃতি কাঁদে অপমানের জ্বালায় কাঁদে মাটি
জাতপাতের উঠোনে আজও গান্ধীজির স্বপ্ন মাথা কোটে
যেতে যেতেও হরিজনের মেয়েটি একগুঁয়ে
শিখবে নাচ শিখবে গান ফুটবে দেবভাষাও তার ঠোঁটে।
একুশ শতকে এসে ছোঁয়াছুঁয়ি মানো
আমার একটি কথা মনে মনে জানো।
আজ হরিজন বলে হেলা কর যাকে
কাল সেও প্রতিশোধে জ্বলে ওঠা জানে,
ওগো গুরু তুমি এত রামের পূজারি
জানো নাকি কবীরের সাখিটির মানে!
‘হরি সে তু জনি হেত কর, করি হরিজনসে হেত।
মালমুলুক হরি দেত হ্যাঁয়, হরিজন হরি হি দেত॥
হিন্দু তুর্ক এক রাহা হ্যায়, সৎগুরু ইহাই বাতাই।
কহৈঁ কবীর শুনহ সন্ত, রাম না কহেও খোদাই॥’
কবীরের সাখি গাইতে গাইতে প্রকৃতি মাহার মাধবগুরুর নৃত্যাঙ্গন থেকে বিদায় নেয়।
দুই
প্রকৃতি মাহার বারো বছর পরে দারুণ রেজাল্ট করে সংস্কৃত নিয়ে এম এ পাশ করে। মধ্যপ্রদেশের সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে তপশিল জাতির কোটায় সে অধ্যাপনার চাকরি পায়।
যে ভাষা তাদের অধরাই ছিল
যুগযুগান্তে বলতে পারেনি বাপঠাকুর্দা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ্পা গলায় ঝুলিয়ে
সেই ভাষাতেই বিদূষী কন্যা পড়াতে চলল
একথা মাহারপাড়ার সবাই বলাবলি করে
গর্বে তাদের বুক ভরে যায়।
ওদিকে, উচ্চবর্ণ এখন রেগেই আগুন
তাদের ছেলেরা বামুন ছেলেরা
দেবনাগরীর পাঠ নিতে যাবে মাহারের কাছে!
চলতে পারে না এসব উল্টোপাল্টা নিয়ম
কে দিল চাকরি! মগের মুলুক!
যারা ব্রাহ্মণ, তারা জোতদার, তারাই এম এল এ
জাত ও ধর্ম, শাসন অর্থ সবই পকেটে
উঠে পড়ে লাগে তারা এইবার
নানা অভিযোগ, নানা কলকাঠি
চাকরিটা ওর কেড়ে নিতে হবে।
সনাতন যত নিয়মকানুন সব উঠে যাবে
তা কি হতে পারে!
চরমে উঠল শোরগোল যেই মাধবগুরুর ছেলেটা
ছাত্র হিসেবে পড়তে বসল প্রকৃতির ক্লাশে।
খেপে উঠলেন মাধব, এবার হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
প্রকৃতি যখন দেবনাগরীর হরফ লেখেন বোর্ডে
কালো আকাশের রূপালি তারার মতো অক্ষর জ্বলছে
কুমুদ চতুর্বেদীর হৃদয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলনা
মাধবের ছেলে মাধবের মতো কৌলিন্যের গর্ব
তবু মনে হয়, মাহার দিদিটা পড়ায় যখন তখনই
সংস্কৃতের শ্লোকগুলি যেন আরও ভাষা পায় ছন্দে
ছাত্রছাত্রী একদল তাকে পছন্দ করে গোপনে
বাইরে স্লোগান তখন— ‘প্রকৃতি মাহার নিপাত যাক’
‘প্রকৃতি মাহার গো ব্যাক’
মিছিলের হাতে গেরুয়া ঝাণ্ডা ত্রিশূল
মিছিলের চোখে বর্ণাশ্রম চতুষ্পাঠীর স্বপ্ন
মিছিল ঘিরছে মাহার মেয়ের চাকরি
মিছিলে কাঁপছে মাহার জীবনমৃত্যু
কাগজে খবর, খবর হচ্ছে এন ডি টিভির চ্যানেলে
তেহাল্কা ডট কমে’র লোকেরা খুঁজছে আসল ঘটনা।
লড়াকু মেয়েটি গ্রামের লোককে ডাকছে
ওরা তো কিছুতে বোঝে না কীভাবে লড়বে
লড়াই করে কি জেতা যায় নাকি উঁচুলোকদের সঙ্গে!
মাহারপাড়ার লোকেরা কখনও ইনভার্সিটি দেখেনি।
এত যে কষ্ট করেছে এখানে আসতে প্রকৃতি মাহার
তবুও লড়াই শেষ হয় না যে, গান গেয়ে ওঠে
বিষাদ কন্যা একলা ঘরের কোণায়—
‘যে আমারে পাঠালো এই অপমানের অন্ধকারে’
তিন
রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে জাতীয় সংস্কৃত সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য ডাক আসে প্রথম সংস্কৃতজ্ঞ মাহার কন্যা প্রকৃতির। আনন্দে উদ্বেল হয়ে সে দিল্লি যায়।
রাষ্ট্রপতি ভবনের সমাবেশে প্রকৃতি মাহার
এসে পৌঁছলেন যেন স্বর্গ খসা দেবী সরস্বতী
অভিনন্দনের বানে ভেসে যায় বিষণ্ণ মেয়েটি
রাষ্ট্রপতি তাকে দেন বিশেষ পদক
সারা দেশ থেকে আরও নানা গুণীজন
কেউ নাক সিটকায়, কেউ বা পাথর
প্রকৃতিকে বলা হল, অন্য গুণীদের
পরিচয় করানোর ভার নিতে হবে।
বাঁহাতে মাইক ধরে অনভ্যস্ত প্রকৃতি মাহার
একে একে সকলের বায়োডাটা পড়তে থাকেন।
পঁচিশ নম্বরে এলে চেনা মুখ চেনা অবয়ব
প্রকৃতি বিস্ময়ে দেখে সামনেই দাঁড়িয়ে মাধব।
বাকরুদ্ধ প্রকৃতির সম্বিত ফিরলে
কে যেন ভেতর থেকে কথা বলে ওঠে।
এই সেই মহাগুরু যার কাছে আমি
শিখেছি জীবনপাঠ, শিখেছি লড়াই
ইনি যদি লাথি মেরে তাড়িয়ে না দিতেন আমাকে
আজ এই চৌকাঠে দাঁড়াবার যোগ্যতা হত না
দর্শক আসন থেকে প্রৌঢ়া মাকে ডেকে এনে বলে
ইনিই জননী, ওই মহাগুরু জনক আমার
বখাটে যৌবনে ইনি আমার মায়ের গর্ভাশয়ে
আমাকে রোপন করে পালিয়েছিলেন।
তখন জাতের বাধা কোনও বাধা ছিল না হয়তো,
উঁচু জাত বলে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি
আজ সুবিচার চাই এ মহাসভায়
গুণীজন বলে দিন কী আমার সত্য পরিচয়
গুরুর জারজ কন্যা নাকি আমি একা
এই সমাবেশে আজ দাঁড়িয়েছি আত্মপরিচয়ে?
প্রকৃতি মাহার ও মাধব চতুর্বেদীকে নিয়ে ক্যামেরাম্যানদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মঞ্চে চাঞ্চল্য। মাধব অধোবদন, রাষ্ট্রপতি এগিয়ে এসে প্রকৃতির মাথায় হাত রাখেন।
এই মেয়ে আমাদের নতুন ভারত
এই মেয়ে আমাদের আগুন প্রতিভা
তার সব অপমান আগুনে পুড়েছে
নিখাদ সোনার মতো প্রকৃতি মাহার
আজ তার জন্য আমি গর্ব বোধ করি
প্রকৃতি স্বয়ংসিদ্ধা আত্মপরিচয়ে।
এই মেয়ে স্বদেশের নতুন পতাকা।
আমার দুর্গা
তালাক তালাক তালাক, যখন তখন তালাক
গ্রামের বিবিরা অতিষ্ঠ হয়ে পঞ্চায়েতেই জানাক
পঞ্চায়েতের জাম্মা বেগম শপথ নিয়েছে সত্যি
ঘোচাতেই হবে মরদগুলোর দমফাই প্রতিপত্তি
তালাক প্রথার বদল লিখতে চাইছে বেগম জাম্মা
গ্রামে গ্রামে যত জোট বাঁধছেন বিবিরা এবং আম্মা।
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু সর্বধর্মে সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ঝান্ডারূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ॥
পাহাড়ের মেয়ে উমাপার্বতী গিরি
দার্জিলিঙের শীতে সে ধরায় বিড়ি
মদ খেয়ে খেয়ে বরটা ভেগেছে নীচে
কাজের আশায় গেছে মুম্বাই বিচে
আর সে ফেরে না চিঠিও লেখে না তাকে
উমা তাই একা নিজের পায়েই থাকে
স্কোয়াশ ফলায়, নিজেই নিজের টঙ্কা
স্বয়ংসিদ্ধা সে জয় করেছে শঙ্কা।
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু গিন্নিরূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লিঙ্গসাম্যে সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কন্যাভ্রুণে সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ॥
রেলস্টেশনের বগিতে মেয়েটি কী রোগা!
ঘুমিয়েছিল তা জানত কেবল দারোগা
অবসরমতো বলাৎকারের জন্য
গেলেন দারোগা, লোকেরা ভাবল অন্য
ধর্ষণ শেষে দারোগা হাওয়াস মেটাল
পাড়ার মেয়েরা দারোগাকে ঝাঁটা পেটাল
দিনকাল সব এমন হয়েছে বাব্বা
মেয়েরা আইন হাতে নেয় মারহাব্বা!
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু আন্দোলনে সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু বিশ্বায়নে সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ধর্ষিতাতে সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ॥
তোমাকে আহ্বান করি দেবী দুর্গা, হে মহামানবী
একুশ শতকে এই বাংলার অলিতে গলিতে
মেয়েলি পুকুরঘাটে পা ডুবিয়ে গল্প করি চল
শিউলি ফুলের গন্ধে জেগে ওঠে মহাবিশ্বায়ন
মহালয়া সেজে ওঠে মহাদেবী দুর্গাবন্দনায়
যদিও পেটের ছেলে ঢেকে রাখে মাতৃপরিচয়
যদিও সেনসাস থেকে মেয়েদের সংখ্যা কমছে
তেত্রিশ শতাংশ দিতে সংসদের বুক ফেটে যায়
প্রাসাদে জঙ্গলে গ্রামে ফুটপাথে ঢাকের নির্ঘোষে
দিকে দিকে আবাহন বেজে ওঠে আনন্দময়ীর
হে মহামানবী দুর্গা তোমাকে আহ্বান করি আমি
প্রতিটি নারীর মধ্যে জেগে ওঠো পরমা ক্ষমতা॥
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লড়াইরূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু গৰ্ভরূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শিক্ষারূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ॥
উপোসে রোগাটে মেয়ে পাহাড়ের নেপালি পার্বতী
কয়লা খনিতে খাটা কালিমাখা নিরক্ষর মেয়ে
হে দেবী মোহিনী শক্তি, মহামায়া, লক্ষ্মী, সরস্বতী
হে নারী গৃহিণী শক্তি, কর্মময়ী, পতিতা, ধর্ষিতা
অগ্নিবর্ণা অগ্নিদৃষ্টি উপকথা মানবী কল্পনা
নিজেকে বাঁচাও তুমি আকস্মিক ঠেলা গুঁতো থেকে
হাত তোর খড়্গ হোক, বুদ্ধি হোক খোলা তলোয়ার
আগুনসম্ভবা তুমি, নারী হাতে প্রথম ক্ষমতা
তুমি সেই প্রতিবাদী উঁচু মাথা আশ্চর্যমানবী
দেবীর মুখোশে তুমি নারীমুখ লাজুক দজ্জাল॥
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কন্যারূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কর্ত্রীরূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ॥
আবু ঘ্রাইবের কারাগারে, গুজরাটের নাড়োরাপাতিয়ায়, হেতাল পারেখের ঘরের মধ্যে, ধানতলার মাঠে, দেহাতে জঙ্গলে, বিশ্বচরাচরে যখন অশুভ অন্ধকার নামে, মানুষ যখন নিষ্ঠুর নৃশংসের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত, শিশুরা ভয়তাড়িত, পাখিরা ত্রস্ত, অরণ্যানী শঙ্কিত, তখন সেই দারুণ মুহূর্তে আমরা, ভীত, সন্ত্রস্ত, আক্রান্ত জনসাধারণ, সেই মহাদেবী, মহামানবী, পরমাক্ষমতার আবাহন করি। লৌকিক থেকে অলৌকিকে, বচন থেকে অনির্বচণীয়ে, মাটিপৃথিবী থেকে দিব্যলোকে, সাধারণ থেকে ভক্তজনে, মানবী থেকে দেবীত্বে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। দুর্গা আসেন পৃথিবীতে॥
প্রার্থনা শ্লোক
যিনি ছিন্না দশভূজা ঘরে ও বাইরে
সব অশুভের দিকে বিষদৃষ্টি যিনি
দুই হাতে বন্দি করে চুল মুঠো ধরে
বর্শা বিঁধে দেন যিনি ধর্ষকের বুকে
যিনি বিন্ধ্যপর্বতের থেকে বাংলার
আঁধারনাশিনী যিনি আগুনের শিখা
যিনি সমুদ্রঝড়ের মুখে বাতিস্তম্ভ
দিকভ্রান্ত পথিকের দিশারী কম্পাস
যিনি মুমূর্যুর কাছে শেষবিন্দু জল
প্রতারিত মানুষের ন্যায়দণ্ড যিনি
যিনি গরিবের ঘরে শেষ উৎসব
সেই দেবী দুর্গা তুমি বরাভয় দাও
রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং দেহি মে
আমাকে ক্ষমতা দাও, প্রতিরোধ দাও
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি মে
আমাকে সাম্য দাও অধিকার দাও
রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং দেহি মে
আমাকে আশ্রয় দাও, মনোবল দাও
রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং দেহি মে
আমাকে ওষুধ দাও, অসুখ সারাও
রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং দেহি মে
আমাকে আইন দাও, সুবিচার দাও
রূপং দেহি ধনং দেহি ভাগ্যং দেহি মে
আমার শত্রুর মুখ আগুনে পোড়াও
আমার সন্তান যেন বিদ্যা বুদ্ধি পায়
আমার মা বাবা যেন শান্তিতে থাকেন
আমার বন্ধুরা যেন ঈর্ষা না করেন
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি॥
আমার পুরুষ যেন ভালবাসা আনে
আমার নারীরা বাঁচে মুক্ত পৃথিবীতে
আমার জীবন যেন কর্মময় থাকে
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি॥
আমার কবিতা যেন নব ভাষা পায়
আমার দেশের মাটি যেন শস্যে ভরে
আমার বিশ্বাস যেন আহত না হয়
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি॥
আমার সকল দেশ যেন খেতে পায়
আমার সকল লোক যেন জামা পায়
আমার সকল গ্রাম যেন ছাদ পায়
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি॥
জয় হয় মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে
অয়ি রণদুর্মদ শত্ৰুবধোদিত দুর্দ্ধর নির্জ্জর শক্তিভৃতে
জঙ্গলে জঙ্গলে তুমি টেররিস্ট মেয়ে
মানববোমার মতো নির্ভীক সাহসী
তুমি তির, তুমি শূল, কালাশনিকভ
ইটের ভাঁটায় তুমি লুকানো ছুরিকা
তোমার দুন্দুভি ড্রাম বাজে দ্রিমি দ্রিমি
মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে বাংলাব্যান্ড বাংলা কবিতা
জয় জয় মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে
অয়ি রণদুর্মদ শত্ৰুবধোদিত দুৰ্দ্ধর নির্জ্জর শক্তিভৃতে॥
হে দেবী এবার জাগো অন্ধকার মেট্রোপলিসে
হে দেবী এবার জাগো নারোড়াপাতিয়া মণিপুরে
ইটের রাস্তায় পড়ে থাকা মেয়েটির পাশে
তোমার ত্রিশূল ছুড়ে ধ্বংস কর আমাদের লোভ
ধ্বংস কর আমাদের ঈর্ষারিপু হিংস্রতা দানব,
আমাদের যুদ্ধবাজ দাঙ্গাবাজ ফেরেব্বাজ মুখ।
জয় জয় মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে
অয়ি রণদুর্মদ যুদ্ধ বিনাশ কর প্রতিরোধ জাগাও বসুতে॥
কার্গিলে রণচণ্ডী, অপরূপা কুমারসম্ভবে
পঞ্চায়েতে নেত্রী তুমি, পাহাড়ের পেলব অপর্ণা
হে দেবী যখন তুমি মল্লদের সঙ্গে যুদ্ধ কর
তোমার পশম বস্ত্রে দোলা লাগে মল্লিকাফুলের
দোলা লাগে সালোয়ারে, উড়ে আসা লাল দোপাট্টায়
ট্রামে বাসে মেট্রোরেলে রূপে তুমি যখন মানবী।
জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী ক্ষমতান্বিত নারীশক্তি
অয়ি নারীশক্তিমতী, নারীকর্মময়ী, নারীবিশ্বজয়া, নিরাসক্তি॥
দেবালোকের মহাপরাক্রম যোদ্ধাগণ, শাশ্বত প্যাট্রিয়ার্ক পুরুষগণ যখন দানবের কাছে পরাজিত ও বিধ্বস্ত, যখন দৈত্যের রণহুঙ্কারে বিশ্বচরাচর কম্পমান, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের পরামর্শে এক অপরূপ রণদেবী নির্মিত হলেন, নারীগর্ভজাত সাধারণী নন, তিনি পুরুষের রণোন্মাদ আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্ট মহিষাসুরমর্দিনী। পুরুষ দেবতারা একে একে তাঁর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন, পরাজিত দেবতাদের তেজপুঞ্জ থেকে তিনি হয়ে উঠলেন তেজস্বিনী পরমারূপবতী জ্যোতির্বলয়। দেবগণের কার্যসিদ্ধির জন্য তিনি সজ্জিত হলেন। পিতা হিমালয় দিলেন সিংহবাহন, বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র, নীলকণ্ঠ দিলেন শূল, যম আনলেন তালদণ্ড, কালদেব দিলেন খড়্গ, চন্দ্র দিলেন অষ্টচন্দ্ৰশোভা চর্ম, সূর্য দিলেন ধনুর্বাণ, বিশ্বকর্মা অভেদবর্ম, ব্রহ্মা কমণ্ডলু, কুবের রত্নহার, আর ভক্তজন দিলেন ফুল ফল অর্ঘ্য। দেবপুরুষগণ অস্ত্র ও অলঙ্কারে সেই মহামানবীকে রণদেবী সাজিয়ে রণদুন্দুভিতে দশদিক নিনাদিত করে ধ্যানমন্ত্রে অভিনন্দিত করলেন।
বন্দনা শ্লোক
অমরাবতীতে যিনি ইন্দ্রাণী, বরুণালয়ে যে অম্বিকা
যমালয়ে যিনি কালরূপা আর কুবেরভবনে শুভা
যে মহানন্দা অগ্নিকোণে, যে বায়ুকোণে মৃগবাহিনী
নৈঋতে যিনি রক্তদন্তা, ঈশানের শূলধারিণী
বাংলায় যিনি কালিকা এবং ব্রজের কাত্যায়নী
শুক্লপক্ষে যিনি একাদশী কৃষ্ণপক্ষে নবমী
সর্বজনের খিদে যার পেটে, সব সাগরের তৃষ্ণা
ঘরে যে ঘরণী, পথে ভিখারিনী, নারীগর্ভের কন্যা
অফিসে কর্ত্রী, বিমানচালিকা, মহাগ্রন্থের লেখিকা
জাগো জাগো দেবী হে মহামানবী, পৃথিবীর হাসি কান্না।
আবাহন শ্লোক
জাগো দেবী যশোমতী দুর্গতিনাশিনী
জাগো দেবী শক্তিরূপা স্বাধীনচারিণী॥
জাগো দেবী জলেস্থলে শহরে জঙ্গলে
যেখানে যেখানে বউ অগ্নিকাণ্ডে জ্বলে॥
জাগো দেবী রান্নাঘরে, জেনানা ফাটকে
জাগো দেবী শিল্পঘরে, কবিতা নাটকে॥
জাগো দেবী বিলকিস বানুর দুর্দিনে
জাগো দেবী গুজরাটে কুতুবুদ্দিনে॥
কেওনঝড়ের মৃত বিশপের মেয়ে
যদি ফিরে আসে দেবী জাগো গান গেয়ে॥
একুশ শতকে এই বাংলার ঘরে
এস দেবী শীত বর্ষা অনাবৃষ্টি ঝড়ে॥
জাগো জাগো শস্যদেবী, তোমার বাঁহাতে
আমলাশোলের থালা ভরে দাও ভাতে॥
আমাদের ঘরে ঘরে হেতাল পারেখ
ধর্ষণ না ঘটে যেন আবার আরেক॥
ঝাঁটা ও ডান্ডা নিয়ে যেসব কন্যায়
আদালতে ঢুকে পড়ে ধর্ষক পেটায়॥
হাতা ও খুন্তি হাতে যেসব মায়েরা
লড়াই জীবনপণ চলে মুশায়েরা॥
জাগো মা জাগো মা আজও অসুরদলনী
আজ বলো সেই কথা যে কথা বলনি॥
জাগাও তোমার যত কন্যাদের ও মা॥
জাগো সাধারণ মেয়ে দেবীর উপমা॥
কুমারসম্ভবের শৃঙ্গার কল্পনা ছিল পুরুষ কবির আকাঙক্ষানির্মিত। লজ্জারুণ নববিবাহিত উমার লজ্জাভঙ্গ করে, পুরুষের কামনায় তাকে বশ করে, সুরাপানের মদিরতায় তাঁকে বিবশ করে, কুমারীর কৌমার্যভঙ্গ করে চিরন্তন পৌরুষের প্রতিষ্ঠা হয় কালিদাসের কলমে। সেই শৃঙ্গার কল্পনার চূড়ান্ত মুহূর্তে নারী বিজিত হয়, নারীর ওপর পুরুষের শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশ শতকের নারীর কল্পনায় দুর্গা অন্য শৃঙ্গারের কথা বলে।
শৃঙ্গার শ্লোক
ইচ্ছাগাছের পাতার ওপরে জোছনা
চাঁদ পান করে মাতাল পদ্ম ফুটছে
চাঁদের তরল শিবলিঙ্গকে জাগাল
অসময়ে শিব জাপটে ধরেন উমাকে
মদিরার মতো লালচে উমার দুঠোঁট
মহেশ সেখানে ঢালেন সুরার কলসি
মদপান করে পার্বতী রতিপ্র তিমা
তিলক মুছল, লজ্জা ভাসল সোহাগে
মেখলা খুলল, উরুতে নখের চিহ্ন
সুরা ও শিবের বশ মানলেন দুর্গা।
একুশ শতকে দুর্গারা বশ মানে না
শৃঙ্গারে চাই সমান সমান সঙ্গী
শিবলিঙ্গের অমোঘ শাসনদণ্ড
এতদিনধরে ফুলবেলপাতা পেয়েছে
পার্বতী যোনি দলিত নিম্নবর্গ
অপেক্ষা করে বিপ্লব কবে ঘটাবে
বিশ্ব এবং নারীপৃথিবীকে এখনও
যোনিপথ ধরে শাসন করেন লিঙ্গ
উমার রাজ্যে উল্টোরতির রাজ্যে
অবাধ্য নারী ক্ষমতা বদল চাইছে।
মাতৃকাদেবীর পূজা হয়, কিন্তু মানবী মাতৃকারা সেই পূজার পুরোহিত হতে পারেন না, ঋত্বিক হন অনিবার্যভাবেই ব্রাহ্মণ পুরুষ। মেয়েরা শুধু ফলমূল কাটবেন, উপচার সাজাবেন, মালা গাঁথবেন অর্থাৎ মেয়েদের ভূমিকা পুরুষের সহকারিণীর। কেন এই বৈষম্য? নারীর মাতৃত্বশক্তিকে অস্বীকার করার জন্যই কি? তেজ থেকে, ব্রাহ্মণত্ব থেকে, বৃত্তি, অর্থ, শিক্ষা, সঞ্চালনা, মালিকানা থেকে, সন্তানের অভিভাবকত্ব থেকে নারীকে সুকৌশলে সরিয়ে রেখে দেবীমাতৃকার পূজা করার অর্থ কি? গড়ে উঠুক নতুন নিয়ম। প্রাগৈতিহাসিক নিয়ম আর যেন আমাদের শাসন না করে।
ইতরজনের শ্লোক
উঠল সেজে আজ দুর্গামণ্ডপ
মাটির ভাঁড়ে আর বাঁশের কারুকাজে
পুতুল পট দিয়ে মূর্তি দুর্গার
সবুজ কলাবউ তাঁতের শাড়ি সাজে।
বাঁকুড়া থেকে এসে রহিম পটুয়ারা
দুর্গাপট আঁকে পরম স্নেহ ভরে
পটের ভাঁজে ভাঁজে তুলিতে লেখা হয়
কী ভাবে প্রতিদিন রক্ত ঘাম ঝরে।
গরিব তাঁতিবউ গোপনে বুনে রাখে
প্রতিটি বালুচরি শাড়ির নকশায়
কীভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়ে যায় ধীরে
কীভাবে গ্রাম ভেঙে গঙ্গা পাল্টায়।
আলোর রোশনাই পুরস্কৃত হয়
অন্ধকারে ডোবে গরিব ধানকল
এদিকে উৎসব ওদিকে হাহাকার
তিস্তা বানভাসি মালদা নদীজল।
পলির স্তর মাখা ভিখারি শিশুটির
আঁজলা ভরা ফল প্রসাদ, মুখে ওর
চলকে উঠছিল চিলতে বিদ্যুৎ
বোধন সার্থক দুর্গা মা গো তোর
প্রতিমা গড়ে যারা, সাজায় মণ্ডপ
পটের ছবি আঁকে, মাটির কারিগর
বছর ভর যারা খেয়েছে আধপেটা
পুজোয় হেসে ওঠে তাদের বাড়িঘর।
দু’জনে ঢাকে বারি, ঢমনা ঢমা ঢম
অল্প রোজগার খরচ বারোমাসে
পঞ্চা ঢাকি তার বালক ছেলেটিকে
দূরের গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসে।
জননী দুর্গার ত্বকের জৌলুসে
যৌনকর্মীর দ্বারের মাটি জল
শ্বশুর বাড়ি যার অসহ বারোমাস
নিজে সে উপচার নিজেই কাটে ফল।
তবুও পুজো ঘিরে প্রবল জাতপাত
ম্লেচ্ছ, হরিজন, কুড়িয়ে আনা মেয়ে
পুজোর অধিকার না পায় আজও যদি
কেন মা তোর নামে খুশির ঢল নামে!
বামনি একা কেন দেবীর ভোগ রাঁধে?
দেবীর পুরোহিত শুধুই ব্রাহ্মণ?
বাগদি চণ্ডাল পতিতা গৃহবধূ
মন্ত্র পড়ি চল ইতর জনগণ।
আজ আমরা অশুভদলনী পরমাক্ষমতা সেই মহামানবীর নামে শপথ নেব অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের, হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলনের, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতার। দুর্গা আমাদের আঁধারজয়ের প্রতীক, দুর্গা আমাদের তিমির বিনাশী যুদ্ধ, আমাদের অপরাজেয় মানবতা। আমাদের ক্ষমতায়ন।
গৃহিণীর শ্লোক
রাগে গনগনে হয়ে যে মেয়েটি ত্রিশূল ধরেছে
অন্যায় অশুভ সব ধ্বংস করে দিতে
এয়োতিরা তার সিঁথি রাঙিও না সতীন সিঁদুরে;
পুরুষ দিয়েছে যাকে অস্ত্ৰদীক্ষা এক এক করে
মহারণে প্রস্তুত সে মানবীর মন খুব দৃঢ়
আগমনী অশ্রুগানে সেই মন নরম করো না;
দেবীর পুজোয় তুমি এলেবেলে, ঠুঁটো জগন্নাথ
নেহাতই অশুচি তুমি, পৈতেহীন সাধারণ মেয়ে
তবুও বিশ্বাস এত মন্ত্র তন্ত্র মাটির প্রতীকে!
ভেঙে ফেল ওই ঘট, যা তোমাকে ঘট বানিয়েছে
উপবীত নামধারী ওই সুতো আর কতদিন
তোমাকে শাসন করে না-মানুষ বানিয়ে রাখবে!
ওই বীর মেয়েটির হাত ধরে বাড়ি নিয়ে এসো
বাহু থেকে শক্তি নাও, অস্ত্র থেকে রণবিদ্যা নাও
দুর্গাকে বাঁচাও ওই পুরুততন্ত্রের হাত থেকে
বরং নিজেই তুমি হয়ে ওঠ অসুরদলনী।
আশ্বিনের এক প্রাগৈতিহাসিক সকালে শত্ৰুবিজয়ের প্রাক মুহূর্তে শ্রীরামচন্দ্র যে দুর্গার বোধন করেছিলেন, স্বর্গের দেবপুরুষণগণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে রণদেবীকে অসুরনিধনে পাঠিয়েছিলেন, সেই দুর্গাই একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়ন। সেই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা আজ আগুন হয়ে জ্বলে উঠুন। দিব্যমানবী, আজ নতুন মন্ত্রে তোমার বোধন হোক, তোমার মহাতেজ চিরজাগরুক আগুন হয়ে জ্বলে উঠুক মাটিপৃথিবীর প্রতিটি নারীর মধ্যে। হে মহামানবী তোমাকে সেলাম।
কন্যা শ্লোক
মেয়েটির নাম দুর্গা সোরেন বটেক
মায়ের ছিল না অক্ষরজ্ঞান ছটেক
সর্বশিক্ষা অভিযানে পেয়ে বৃত্তি
দুর্গা হয়েছে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি
সাঁওতালি ডান, ইংরেজি ভাষা বাঁ হাতে
কমপিউটারে শিখেছে ই-মেল পাঠাতে
অঙ্কের স্যার ভুল হলে যোগবিয়োগে
গায়ে হাত দেয় পড়া শেখানোর সুযোগে
দুর্গা জানে না কোনটা যৌন লাঞ্ছনা
স্যারটা নোংরা বটেক, কথাটা মানছ না!
শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা
মুচড়ে দিয়েছে দুর্গা মেরেছে ঝাপটা
ওড়ে অর্ধেক আকাশে মাটিতে শ্যাওলা
আকাশে উড়বে হবে কল্পনা চাওলা
যদি না বিমান ভেঙে পড়ে তার দুর্দার
মহাকাশচারী হবেই বটেক দুর্গা॥
বিশ্বায়নে পণ্যায়নে খণ্ডখণ্ড মানচিত্রে বাংলা-বিহার-রাজস্থানে সাধারণী নমস্তুতে
বেশ্যাব্রতে পত্নীব্রতে মোহমুদ্রা ধ্বংসমুদ্রা প্রযুক্তিতে গৃহকর্মে সাধারণী নমস্তুতে॥
আমার দুর্গা পথেপ্রান্তরে ইস্কুলঘরে থাকে
আমার দুর্গা বিপদে আপদে আমাকে মা বলে ডাকে
আমার দুর্গা আত্মরক্ষা, শরীর পুড়বে, মন না
আমার দুর্গা নারীগর্ভের রক্তমাংস কন্যা
আমার দুর্গা গোলগাল মেয়ে, আমার দুর্গা তন্বী
আমার দুর্গা কখনও ঘরোয়া কখনও আগুন বহ্নি
আমার দুর্গা মেধা পাটকর, তিস্তা শীতলাবাদেরা
আমার দুর্গা মোম হয়ে জ্বালে অমাবস্যার আঁধেরা
আমার দুর্গা মনিপুর জুড়ে নগ্ন মিছিলে হাঁটে
আমার দুর্গা কাস্তে হাতুড়ি আউশ ধানের মাঠে
আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে স্বর্গে এবং মর্তে
আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে।
আন্দোলনে উগ্ৰপন্থে শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে রান্নাঘরে আঁতুরঘরে, মা তুঝে সালাম
অগ্নিপথে যুদ্ধজয়ে লিঙ্গসাম্যে শ্রেণীসাম্যে দাঙ্গাক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে, মা তুঝে সালাম॥
মা তুঝে সালাম
মা তুঝে সালাম॥
______
Leave a Reply