ছেড়ে আসা গ্রাম – দক্ষিণারঞ্জন বসু
.
সমগ্র বঙ্গদেশ ও বাঙালিকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের হাতে
.
প্রকাশকের নিবেদন
ছিন্নমূল মানুষের দুর্বিপাকের কাহিনি নতুন কিছু নয়। সেই মোজেসের কিংবদন্তি থেকে শুরু করে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবিপর্যয় অবধি এই ট্র্যাজেডি বহমান। কিন্তু ছিন্নমূল তামিল অথবা ইহুদিদের নিয়ে ইতিহাস যতটা উদবিগ্ন, ততটাই উদাসীন খন্ডিত বঙ্গদেশের উৎপাটিত বাঙালি সম্পর্কে।
১৯৪৭-এর দেশবিভাগ বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ১৯৪৭-১৯৫০ এই তিন বছরে এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরেও প্রত্যেক বছরে যেভাবে লক্ষ লক্ষ বাঙালি বঙ্গদেশের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিমাংশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, বিতাড়িত হয়েছেন, তার প্রকৃত ইতিহাস আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন মর্মন্তুদ অপসারণের উদাহরণ আর নেই।
সীমান্তের অপর পারে, নতুন দেশে, তাঁরা হারালেন অতীত স্বীকৃতি, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পড়ে রইল স্মৃতি–যে স্মৃতি অশ্রুসজল। শুধু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসার বেদনা নয়, তাঁদের হৃদয় শোকসন্তপ্ত হয়ে রইল প্রিয়জনকে চিরকালের মতো ছেড়ে চলে আসার দুঃসহ কষ্টে।
দক্ষিণারঞ্জন বসু প্রণীত এই গ্রন্থ পূর্ববঙ্গের আঠারোটি জেলার চৌষট্টিটি গ্রাম থেকে ভূমিপুত্র-কন্যাদের চলে আসার বৃত্তান্তকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।
গ্রন্থের দুটি খন্ড প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তানে। পরে জিজ্ঞাসা দুটি খন্ডকে একত্রিত করে ১৩৮২ বঙ্গাব্দে প্রকাশ করে। এর চল্লিশ বছর পর এই ২০১৫ সালে পারুল প্রকাশনীর উদ্যোগে পুনঃপ্রকাশিত হল এই মহাগ্রন্থ। তাৎপর্যমন্ডিত এই পুনঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে স্মৃতিমেদুর করে তুলবে পশ্চিমবঙ্গ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ–উভয় বাংলার বাঙালিকেই।
.
ছেড়ে আসা গ্রাম
সুখের কথা, অসংখ্য পাঠকের দীর্ঘদিনের ক্রমাগত একটি চাহিদা এতকাল পরে পূরণ করা সম্ভব হল। বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা ‘জিজ্ঞাসা’ দুই খন্ডের ছেড়ে আসা গ্রাম গ্রন্থটি বহুজনের অনুরোধে একসঙ্গে প্রকাশ করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমগ্র বাঙালি পাঠকসমাজের ধন্যবাদভাজন হলেন।
শুধু পশ্চিমবাংলাই মূল বঙ্গদেশ নয়। বাঙালির ইতিহাসও শুধু পশ্চিমবাংলার ইতিহাস নয়। অনেক বড়ো তার পটভূমিকা, অনেক ব্যাপক তার বিস্তার। মূল বাংলার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গ বাকি দুই-তৃতীয়াংশ অন্য দেশ-ভারত-দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আর এক রাষ্ট্রের পূর্বাংশরূপে তার নতুন নাম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। সত্তর দশকের গোড়ায় পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গ এখন অবশ্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বলে পরিচিত। তাহলেও সে পৃথক রাষ্ট্র, ভিন্ন শাসনব্যবস্থায় সে-দেশের বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে একরূপ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু ভাবীকালের বাঙালির কাছে পল্লিহৃদয় বাংলার পূর্ব সত্যরূপ, তার সত্যকারের পরিচয় তুলে ধরার দায়িত্ব কি আমাদের নয়? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ সম্বন্ধে নানা কাহিনি সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিলাম দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই। সহযোগিতাও পেয়েছিলাম আশাতীত।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫০। বাঙালির চরম দুঃসময়ের সে-কাল। সেই পঞ্চাশের বেদনাঘন দুর্দিনে যুগান্তর-এ যখন ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গীয় উদবাস্তু নর-নারীর কাছ থেকে সংগৃহীত ছেড়ে আসা গ্রামের মর্মন্তুদ আলেখ্যসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে তখন দেশবাসীর মধ্যে এক তীব্র তুমুল আলোড়ন দেখা দিয়েছিল। সেইসব কাহিনির মধ্য দিয়ে অভিশপ্ত খন্ডিত বাংলার পূর্বপ্রান্তের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশাজড়িত ইতিহাসকে ভাষায় রূপায়িত করা হয়েছিল। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন ধারাকে কথায় ধরে রাখা, ভবিষ্যতের মানুষ যাতে ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত একদল মানুষেরই ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের ছিন্নসূত্রটুকুর সন্ধান লাভ করতে পারে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে, শুধু ভারতবর্ষেরই বা কেন, পৃথিবীর ইতিহাসেও কোনো দেশে এরূপ ব্যাপক বাস্তুত্যাগের নজির পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। একটা
দেশের লক্ষ লক্ষ সুখী শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের পিতৃ-পিতামহের পুণ্য স্মৃতিজড়িত বাস্তুভিটে, অভ্যস্ত জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ উন্মুলিত হয়ে রাজনৈতিক ঝঞ্ঝায় ঝরাপাতার মতো উড়ে এসে পড়ল সীমান্তের অপর পারে, অন্য রাষ্ট্রে। তাদের না রইল অতীত স্বীকৃতি, না রইল স্থির ভবিষ্যৎ। মানুষের ইতিহাসে এর চেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? এই বেদনা থেকেই ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’-এর অশ্রুসজল কাহিনিমালার জন্ম। কাহিনিগুলি বিভিন্ন সূত্র থেকে, অনেক শিবিরবাসী মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে রচিত। তাই কোথাও কোথাও এতে অসম্পূর্ণতা ও তথ্যঘটিত অসংলগ্নতা থাকা স্বাভাবিক। তা ছাড়া সেই অভাবনীয় রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের কালে অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন গ্রামের কাহিনি নিখুঁতভাবে সংগ্রহ করাও সহজ ছিল না। তবু আপন আপন গ্রাম-পরিচয় দিয়ে আমার যেসব সহকর্মী ও অপরিচিত বহুজন আমার এই পরিকল্পনা রূপায়ণে সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। কাহিনিগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের অনুমতি দেওয়ায় আমি যুগান্তর-কতৃপক্ষের কাছেও বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
ছেড়ে আসা গ্রাম-এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬০ সনের পুণ্য পঁচিশে বৈশাখ তারিখে। তাতে কেবলমাত্র ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল (বাখরগঞ্জ) ও ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি করে গ্রাম-চিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন থেকেই বহু অনুরোধ ও তাগিদের পর তাগিদ আসতে থাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত তখনকার পূর্ববাংলার অন্যান্য জেলার গ্রাম পরিচয়ও গ্রন্থাকারে মুদ্রণের জন্যে। নানা কারণে, বিশেষ করে কোনো কোনো জেলার (বিশেষত পাকিস্তানভুক্ত উত্তরবঙ্গের) গ্রাম-তথ্য সংগ্রহে বিলম্ব হওয়ায় ছেড়ে আসা গ্রাম গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশে বেশ দেরি হয়ে যায় এবং তা ছাপা হয় পাঁচ বছর পরের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে। এই খন্ডে ছিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, যশোহর, কুষ্টিয়া, খুলনা, রাজসাহী, পাবনা, মালদহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি জেলার পল্লিচিত্র। পূর্ব ও উত্তর বাংলার এসব স্নিগ্ধ, শ্যামল গ্রামের অশ্রুসজল বর্ণনায় একই বেদনা-মধুর সুর প্রত্যেকটিতে ধ্বনিত হলেও বিভিন্ন জেলার লোকাঁচার ও লোকসংস্কৃতির পরিচয় সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাহিনিতে।
বলে রাখা ভালো, এই গ্রন্থের কথাচিত্রগুলি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত নয়। সাধারণ গ্রামীণ মানুষের স্বপ্ন-প্রেরণা, স্নেহলালিত চেতনা ও সুখ-দুঃখ-মধুর স্মৃতি-চিন্তা প্রত্যেকটি বিবরণকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে। বস্তুত মানুষই এখানে মূলকেন্দ্র, বাস্তুত্যাগী মানুষের বিহ্বল চেতনাকে কেন্দ্র করে রচিত এক-একটি বর্ণনায় এক-একটি ছেড়ে আসা গ্রাম হয়ে উঠেছে জীবন্ত। তথাপি ইতিহাস এখানে অপ্রত্যক্ষ হলেও ভবিষ্যতের মানুষকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্রের সন্ধান দানে এই গ্রন্থে গ্রথিত গ্রাম-চিত্রগুলি হয়তো সাহায্য করবে।
দেশবিভাগের পর থেকে বছরের মধ্যে ছেড়ে আসা গ্রাম-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ দু-খন্ড বইকে সে-দেশে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ফলে, চাহিদা থাকতেও পূর্ববঙ্গে সে-সময়ে এ বই যেতে পারে না। তবু উভয় খন্ডই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-পড়া উদবাস্তু বাঙালিদের চাহিদায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যায়। তারপর পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গিয়ে সেদিন ও এদিনের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ নিজ পিতৃপুরুষের ভিটে বা জন্মগ্রামকে মিলিয়ে দেখবার বাসনায় ছেড়ে আসা গ্রাম গ্রন্থ ক্রয়ে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন ছিন্নমূল বাঙালিরা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরাও এই গ্রন্থখানি পাওয়ার জন্যে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। সবারই ইচ্ছে, একখন্ডেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হোক। বহু বাঙালি পাঠকের সেই আগ্রহ-পূরণে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা’-কতৃপক্ষ যে-সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান এই দলিল-গ্রন্থখানি প্রকাশ করতে পারলেন, সেজন্যে তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস সত্যি প্রশংসাহ। পাঠকগণ এই গ্রন্থের প্রতিটি কাহিনির অন্তরালবর্তী ভাগ্যবিড়ম্বিত ছিন্নমূল বাঙালির বেদনার্ত অন্তরের স্পর্শ অনুভব করতে পারবেন, আশা করি।
দক্ষিণারঞ্জন বসু
বড়োদিন
১৩৮২
.
সূচিপত্র
ঢাকা জেলা – বজ্রযোগিনী সাভার ধামরাই খেরুপাড়া ধামগড় আনরাবাদ শুভাঢ্যা নটাখোলা সোনারং
ময়মনসিংহ জেলা – নেত্রকোণা বিন্যাফৈর কমলপুর খালিয়াজুরি বারোঘর কালীহাতী সাঁকরাইল নাগেরগাতী সাখুয়া
বরিশাল জেলা – বাণারিপাড়া গাভা কাঁচাবালিয়া মাহিলাড়া চাঁদসী সৈওর নলচিড়া
ফরিদপুর জেলা – কোটালিপাড়া রামভদ্রপুর কাইচাল খালিয়া চৌদ্দরশি খাসকান্দি কুলপদ্দি
চট্টগ্রাম – সারোয়ালি ধলঘাট ভাটিকাইন গোমদন্ডী
নোয়াখালি – দরাপনগর সন্দীপ
ত্রিপুরা – বায়নগর চান্দিসকরা বালিয়া কালীকচ্ছ।
শ্রীহট্ট – পঞ্চখন্ড রামচন্দ্রপুর
যশোহর – অমৃতবাজার সিঙ্গিয়া
খুলনা – সেনহাটী শ্রীপুর ডাকাতিয়া
রাজসাহী – হাজরা নাটোর তালন্দ বীরকুৎসা
পাবনা জেলা – গাড়াদহ পঞ্চকোশী ঘাটাবাড়ি সাহজাদপুর
কুষ্টিয়া – শিলাইদহ ভেড়ামারা
মালদহ – কালোপুর
রংপুর – হরিদেবপুর
বগুড়া – ভবানীপুর
দিনাজপুর – ফুলবাড়ি রাজারামপুর
জলপাইগুড়ি – বোদা
Leave a Reply