ছায়াচরাচর – সন্মাত্রানন্দ
মধুসূদন সরস্বতীর উপাখ্যানমঞ্জরী
প্রথম প্রকাশ – মহালয়া, আশ্বিন ১৪২৫, অক্টোবর ২০১৮
.
বন্দউঁ গুরুপদ পদুম পরাগা।
সুরুচি সুবাস সরস অনুরাগা।।
পূজা করি তাঁর মনুনদীর জলে…
.
গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত হইতেছিল। অস্তসূর্যের বিদায়ী আভা সোনালি উত্তরীয়ের ন্যায় গঙ্গাবক্ষে পতিত হইয়া আশ্চর্য বর্ণসুষমা সম্পাদন করিয়াছে। বরাহনগরের কুঠিঘাটে বসিয়া সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখিতেছি। সুখস্পর্শ গঙ্গাবারিকণা বাতাসের সহিত মিশিয়া গাত্রোপরি উড়িয়া পড়িতেছে। পরপারে গৃহ, প্রাসাদ, মঠ, দেবদেউল আসন্ন সন্ধ্যার মায়াকুহকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হইতেছে। শঙ্খঘণ্টার মৃদু মৃদু ধ্বনি বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছে। শীঘ্রই মন্দিরে মন্দিরে সন্ধ্যারতি হইবে। আকাশ কোথাও বর্ষার সজলকৃষ্ণ মেঘভারে, কোথাও-বা আরক্তিম নীরদমালায় সজ্জিত। নদী এক্ষণে ধীরগামিনী। তাহার স্রোত তীরোপরি মন্দ মন্দ আঘাত করিতেছে। পারাপারের জন্য যাত্রীকুল অপেক্ষমান; সন্ধ্যার খেয়ানৌকা এখনই আসিয়া পড়িবে।
দেখিলাম, যাত্রীদলের ভিতর গৈরিক পরিহিত, মুণ্ডিতশির এক সন্ন্যাসীও বসিয়া আছেন। তিনিও ওপারে যাইবেন কি না জানি না। দূর হইতে দেখা গেল, একটি নৌকা এইদিকেই অসিতেছে। যাত্রীগণ সকলেই শশব্যস্ত হইয়া উঠিল। সকলেই প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকাটি আসিয়া ঘাটে ভিড়িল। সকলের কোলাহল আমার কর্ণমূলে প্রবেশ করিল। আমি কোথাও যাইব না, তাই উদাসীনভাবে কয়েক মুহূর্ত তীরোপরি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বসিয়া রহিলাম।
চক্ষু মুদিয়া কী খেয়াল হইল, ভাবিতে বসিলাম। ভাবিতেছিলাম, সেই সন্ন্যাসী কি এখন নৌকায় আরোহণ করিয়াছেন? তিনিও কি পারার্থী জনতার সহিত পরপারে চলিলেন? নাকি, ঘাটের উপরেই বসিয়া রহিলেন? যতক্ষণ চক্ষু মুদিয়া থাকিব, উহা আমি জানিতে পারিব না। সন্ন্যাসী নৌকায় উঠিতে পারেন, সে-সম্ভাবনা আছে। আবার সন্ন্যাসী আমারই ন্যায় ঘাটেও বসিয়া থাকিতে পারেন, সে-সম্ভাবনাও বর্তমান। হয় তিনি নৌকায় করিয়া পরপারে যাইবেন, নয়তো ঘাটেই বসিয়া থাকিবেন—ইহাই আমাদের প্রচলিত সাধারণ ধারণা। কিন্তু একদল উচ্চশ্রেণীর পদার্থবিদ দার্শনিকগণ বলিবেন, যতক্ষণ না চক্ষু উন্মীলন করিতেছি, ততক্ষণ ওই সন্ন্যাসী একই সঙ্গে তীরেও বসিয়া আছেন, আবার নৌকায় করিয়া পরপারেও যাইতেছেন। ইহা আমাদের নিকট বড়ো অদ্ভুত, বড়ো অসম্ভব ঠেকিবে। পদার্থবিদ দার্শনিকগণ আরও বলিবেন, যেই না আমি চোখ খুলিব, অমনি ওই দুই প্রকার সম্ভাবনার কোনো একটি আমার নিকট সত্য বলিয়া প্রতিভাত হইবে। অন্য সম্ভাবনাটি আমি দেখিতে পাইব না, যদিও সেই অপর সম্ভাবনা অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্সে ঘটিয়া চলিতে থাকিবে।
চক্ষু উন্মুক্ত করিলাম; দেখিলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে তীরের একপার্শ্বে সন্ন্যাসী পূর্বের ন্যায় বসিয়াই আছেন। উপরের কথাগুলি যদি স্বীকার করিয়া লই, তবে অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বে সন্ন্যাসী কিন্তু নৌকোযোগে পরপারে চলিতেছেন। সেই অন্য বিশ্বে এতক্ষণে সন্ন্যাসীটির অন্য কোনো জীবনলীলা সংঘটিত হইতে থাকিবে। আচ্ছা, এ বিশ্বের গঙ্গাতীরে উপবিষ্ট সন্ন্যাসীর সহিত যদি সেই অপর সমান্তরাল বিশ্বের পরপারগামী সন্ন্যাসীর কোনোভাবে কোথাও দেখা হইয়া যায়? একে অপরের প্রতিবিম্ব; এক-একজন এক-এক প্রকার সম্ভাবনার ফল। দেখা হইলে কেমন হয়? একজনের অপূর্ণতা অন্যজনের ভিতর সফল হইয়াছে দেখিয়া উহাদের কী মনে হইবে? বিস্ময়? কাতরতা? ক্রোধ? প্রেম? শান্তি? কীপ্রকার ভাব উদিত হইবে? ভাবিতে বড়ো ইচ্ছা হইতেছে।
সন্ধ্যার অন্ধকার গঙ্গাপ্রবাহের সহিত মিশিয়া সম্মুখে বহিয়া যাইতেছে। অন্তহীন সম্ভাবনার উত্তাল বাতাসের ভিতর আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। মনে তবুও দোলাচল চলিতে লাগিল। কল্পনায় যেন এক অন্য কালের অন্য নদীতীর প্রত্যক্ষ করিতে লাগিলাম। কাহারা যেন অন্য এক নদীপথে নৌকায় ডাব, আম্র প্রভৃতি ফল পূর্ণ করিয়া ভরিয়া লইয়া কোথায় যেন যাইতেছে… প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বের এক পিতা তাঁহার পুত্রের সহিত দূর কোনো দেশে যাত্রা করিয়াছেন…
Leave a Reply