চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর
(প্রথম প্রকাশ ১৯৭২)
প্রথম প্রকাশের মুখবন্ধ
বাঙলাদেশের রাজনীতিতে কৃষক সমাজের কোন অস্তিত্ব বর্তমান শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত প্রায় ছিল না বললেই চলে। তৎকালীন রাজনীতির সমস্যাসমূহ ছিলো সর্বাংশে উপরতলার সমাজের এবং সেখানে কৃষকদের কোন প্রয়োজন অথবা প্রবেশাধিকার ছিল না। এই অবস্থার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে ঊনিশশো বিশের দিকে খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দেলনের মাধ্যমে। এই পরিবর্তনের আর একটি কারণ ছিলো এই পর্যায়ে রাজনীতিক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের আবির্ভাব।
কিন্তু খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন এবং কমিউনিস্টদের আবির্ভাব সেই প্রাথমিক পর্যায়ে সামগ্রিক রাজনীতির মধ্যে কৃষক সমাজকে অথবা তার সমস্যাসমূহকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ করতে পারে নি। সেটা ছিলো বাঙলাদেশের রাজনীতিক্ষেত্রে কৃষক সমাজের প্রথম পদক্ষেপের যুগ।
এই যুগে কৃষক রাজনীতির মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব মোটেই উল্লেখযোগ্য ছিল না। উপরন্তু এ রাজনীতি ছিলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে সামন্ত শ্রেণীর আয়ত্তাধীন। এ জন্যই আমরা দেখি বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে কৃষক সম্মেলনগুলি অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো সেগুলিতে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং কিছু কিছু কমিউনিস্ট উপস্থিত থাকলেও তাতে সামন্তবাদী নেতারাই ছিলেন সংখ্যায় গরিষ্ঠ।
এরপর এলো ম্যাকডোনাল্ড রোয়েদাদ, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এই আইন অনুযায়ী ছয় আনা কর দেনেওয়ালা কৃষকরা পরিণত হলেন ভোটারে। সকল প্রাপ্তবয়স্ক কৃষক ১৯৩৫ সালের সংবিধানে ভোটদানের অধিকার লাভ করলো। এবং সেই হিসেবে সামন্ত বুর্জোয়া রাজনীতির বাজারে কৃষক সমাজের দর বাড়লো। শুরু হলো বাঙলাদেশে কৃষকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বুর্জোয়া রাজনীতির অগ্রযাত্রা।
বাঙলাদেশের কৃষকদের মধ্যে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরাই ছিলেন অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের ওপর জোতদার-মহাজনদের নির্যাতনও ছিলো নিদারুণ। এ জন্য মুসলমান সামন্ত বুর্জোয়া রাজনীতিবিদেরা নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে কৃষকদের ওপর সাওয়ার ছিলেন। তাদের দাবী-দাওয়ার প্রশ্ন তুলে, সেগুলিকে ভিত্তি করে নির্বাচন আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে শুরু করলেন সভা-সম্মেলন। কংগ্রেসের ভূমিকা এদিক থেকে ছিল অনেকখানি স্বতন্ত্র। তার কারণ বাঙলাদেশে জমিদার, জোতদার, মহাজনদের মধ্যে বর্ণ হিন্দুদের ছিলো ব্যাপক প্রাধান্য। এই বর্ণ হিন্দুরাই ছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বে। সেই হিসেবে কৃষক আন্দোলন ছিল তাঁদের শ্রেণীস্বার্থের পরিপন্থী। এবং সেই কারণেই ঊনিশশো তিরিশের দিকে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় অথবা কংগ্রেস কৃষক সমস্যা অথবা কৃষক রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় নি ১৯৩৫ সালের নোতুন সংবিধান অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে বাঙলাদেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তাতে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি মুসলমান ভোট লাভের জন্য কৃষক সমাজের ত্রাণকর্তা হিসেবে মুসলিম লীগের সাথে প্রতিযোগিতায় নামলো। ১৯২৯-৩১ সালে বিশ্ব আর্থিক সংকট বাঙলাদেশের কৃষকদেরকে ভয়ানকভাবে আঘাত হেনেছিল। তাঁরা উত্তরোত্তরভাবে মহাজনদের ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে জমি হারাচ্ছিলেন এবং আরও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। কৃষকদের এই সমস্ত বাস্তব সমস্যাগুলি তুলে ধরে ফজলুল হক বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভাসমিতি ও সম্মেলন করলেন, তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের জন্যও কৃষক সমাজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।
নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম না হলেও মুসলমান ভোটের ক্ষেত্রে ফজলুল হকের এক বিরাট সাফল্য হলো এবং মুসলিম লীগের সাথে একজোট হয়ে তিনি মন্ত্রীত্ব গঠন করলেন। মুসলিম লীগের সাথে তাঁর এই সম্মিলিত মন্ত্রীসভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদ সম্পর্কে কোন সত্যিকার পদক্ষেপ তো নিলোই না, উপরন্তু অন্যান্য বহু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করে বসলো। মুসলিম লীগের সাথে পরবর্তী পর্যায়ে বিচ্ছেদ হওয়ার পর ফজলুল হক আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে মন্ত্রীত্বে গাঁটছড়া বাঁধলেন। এই সমস্ত নানা কৌশল এবং নীতিগত হেরফেরের ফলে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্ব ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কোন রকমে টিকে থাকলো কিন্তু কৃষক সমাজের বিশেষ কোন উন্নতি তাঁর দ্বারা হলো না। কৃষকপ্রজা-পার্টির কিছু সংখ্যক নেতা ও কর্মীর চাপে পড়ে তিনি মহাজনী আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ করলেও সেটা কৃষকদের অবস্থার মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হলো না। নিজের রাজনীতির মাধ্যমে ফজলুল হক কৃষকদেরকে উপযুক্তভাবে সংগঠিত করতেও পারলেন না। শুধু তাই নয়, তিনি বাঙলাদেশের কৃষকদেরকে বস্তুতপক্ষে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং শ্রেণীগত রাজনীতির উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করলেন।
ফজলুল হক সাময়িকভাবে মুসলিম লীগ কর্তৃক বাঙলাদেশের রাজনীতি থেকে ১৯৪৩ এর পর অপসারিত হলেন এবং তারপর মুসলিম লীগও ঐ একইভাবে কৃষকদেরকে নিজেদের সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে কাজে লাগালো।
এসব সত্ত্বেও বাঙলাদেশে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মস্ত ব্যতিক্রম এনেছিল কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন কৃষক সভা। এই সংগঠনটির মাধ্যমে এ দেশের কৃষক সমাজের এক ব্যাপক অংশ শ্রেণীগতভাবে সংগঠিত হয়েছিলেন। কৃষক সভা নেতারা নির্বাচন জয়ের মতলবে কৃষক রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেন নি। তাঁরা কৃষক রাজনীতির মাধ্যমে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কৃষক শ্রমিক ঐক্য, এর মাধ্যমে তাঁরা চেয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতির প্রধান মিত্র এবং মূল শক্তি হিসেবে কৃষকদেরকে সংগঠিত করতে। এজন্যই তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সত্যিকার কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করা, তেভাগাকে একটি জঙ্গী আন্দোলন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে বাঙলাদেশের সামন্ত স্বার্থের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা। এ আন্দোলনের অনেক ভুল-ত্রুটি থাকলেও এই আন্দোলনই আজ পর্যন্ত বাঙলাদেশের সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবময়।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ এবং বাঙলাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি সংকীর্ণ খাতে কৃষক রাজনীতিকে পরিচালনা করার যে প্রচেষ্টা করে তা সর্বাংশে ব্যর্থ হয় এবং তারপর কৃষকদের ওপর বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পর্যায়ে কৃষক সমিতি নোতুনভাবে গঠিত হয় এবং কমিউনিস্টরা বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়ভাবে কৃষকদেরকে সংগঠিত করার কাজে কিছুটা সাফল্য লাভ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক সমিতির নেতৃত্ব মোটামুটিভাবে এ সময়ে মওলানা ভাসানীর হাতেই থাকে। তিনি ফজলুল হকের মতো নির্বাচনী স্বার্থে কৃষক সমাজকে কোনদিন ব্যবহারের চেষ্টা করেন নি, কৃষক স্বার্থের প্রতি তাঁর একটা আন্তরিক দরদ ও সহানুভূতির অভাবও কোনদিন থাকে নি। কিন্তু তিনি যেভাবে কৃষক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন সে পদ্ধতি বরাবরই ছিলো ব্যক্তিনির্ভর এবং পেটি বুর্জোয়া। এর ফলে কৃষক সমাজকে তার নিজের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে লড়াই চালানোর মতো উপযুক্তভাবে সংগঠিত করার কোন প্রচেষ্টা তিনি করেননি। কাজেই এই অবস্থায় কৃষক রাজনীতি নির্ভরশীল থেকেছে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনীতির ওপর।
মওলানা ভাসানীর এই রাজনীতি কৃষক সমাজের পক্ষে খুব সুফলপ্রসূ হয় নি। তিনি অনেক সভা করেছেন, সম্মেলন করেছেন, বাঙলাদেশের মাঠে, ঘাটে, বাটে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার ফলে কৃষকরা রাজনীতিগতভাবে কিছুটা সচেতন হলেও তাদের মধ্যে সাংগঠনিক চেতনার তেমন কোন উন্মেষ ঘটেনি।
পূর্ব বাঙলার মাটি থেকে পাকিস্তান উচ্ছেদ হওয়ার পর রাজনীতি এ দেশে আরও নোতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব দিক দিয়ে অনেকখানি তরল হলেও বাঙলাদেশের মৌলিক সামাজিক শক্তিগুলি এরপর ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করবে। এবং কৃষক সমাজও সেদিক থেকে পিছিয়ে থাকবে না।
এই অবস্থায় কৃষক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং কৃষক সমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আজ সরাসরি বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহ এগিয়ে আসছে। তারাও কৃষকদেরকে নিজেদের রাজনীতির আওতার মধ্যে আটকে রেখে তাদের সংগ্রামী চেতনাকে বিপথগামী করার জন্য নানাভাবে সচেষ্ট হবে। শ্রমিক শ্রেণী, ছাত্র সম্প্রদায় যেমন বিভিন্ন ধরনের রাজনীতির চাপে পড়ে বহুধাবিভক্ত হয়েছে সেইভাবে কৃষক সমাজকেও রাজনীতিগত ও সংগঠনগতভাবে বিভক্ত করে রাখার নোতুন নোতুন কৌশলও অবলম্বিত হবে। কৃষকদেরকে আজকের এবং ভবিষ্যতের বাঙলাদেশে সত্যিকার প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতির মূলশক্তি হিসেবে সংগঠিত করতে হলে তাদেরকে এইসব বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কবলমুক্ত করতে হবে। তার অর্থ অবশ্য
এই নয় যে, সকল স্তরের বুর্জোয়াদের সাথে তাকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে অথবা সেই সংঘর্ষকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। এর সহজ অর্থ এই যে, কৃষক রাজনীতির নেতৃত্ব বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত থেকে নিয়ে আসতে হবে কৃষক শ্রেণীর দৃঢ়তম মিত্র শ্রমিক শ্রেণী এবং তার পার্টির হাতে।
কৃষক রাজনীতির যে সমস্ত সংগঠক এই মৌলিক দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাফিলতি করবেন অথবা ব্যর্থ হবেন তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙলাদেশে বুর্জোয়া নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তিই করবেন।
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বাঙলাদেশে যে সমস্ত প্রগতিশীল কর্মী কৃষক সমাজের মধ্যে রাজনীতি করবেন এবং তাঁদেরকে বুর্জোয়া শ্রেণীর পরিবর্তে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব সংগঠনের নেতৃত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন তাঁদেরকে বাঙলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার চরিত্র এবং কৃষকদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে যথাযথভাবে পরিচিত হতে হবে। এই পরিচিতির অভাবে অতীতে রাজনৈতিক কর্মীরা কৃষক সমাজের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নানা বিভ্রান্তির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু কতকগুলি তাত্ত্বিক সূত্র আয়ত্ত করে কোন দেশেই বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে নি, বিপ্লবী রাজনীতি সংগঠিত হয় নি। এইসব কাজের জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের জ্ঞান, বিভিন্ন দেশের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান, তেমনি প্রয়োজন নিজেদের দেশের জনগণ, তাদের আর্থিক জীবন ও আকাঙ্ক্ষা এবং হাজারো বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে সঠিক ও তথ্যপূর্ণ ধারণা। বস্তুতঃপক্ষে নিজের দেশ সম্পর্কে এই জ্ঞান এবং তার সাথে উপযুক্ত পরিচয়ের অভাবই আমাদের দেশের প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিবিধপ্রকার বিড়ম্বনা ও ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ।
কৃষক সমাজের মধ্যে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙলাদেশের সাথে যে তথ্যভিত্তিক পরিচয় দরকার সে পরিচয় লাভ সহজসাধ্য নয়। কোন একটি বিশেষ পুস্তক প্রকাশ অথবা পাঠের দ্বারা সেটা সম্ভব হতে পারে একথা মনে করাও এক মারাত্মক ভ্রান্তি। এই বিষয়ে বহু তথ্যপূর্ণ বইপত্র প্রকাশের মাধ্যমেই বর্তমান রাজনৈতিক সাহিত্যের দারিদ্র্যও দূর করতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, তার বিভিন্ন পর্যায় এবং সাধারণভাবে এ দেশের কৃষক সংগ্রাম সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য রাজনৈতিক কর্মী ও প্রগতিশীল পাঠক সমাজের কাছে উপস্থিত করছি। আশা করি, আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সমাজ-সচেতন পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে আসবেন এবং যে বিষয়গুলি নিয়ে এই পুস্তকে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি সম্পর্কে আরও তথ্যপূর্ণ ও সন্তোষজনক রচনা প্রকাশ করবেন।
এ বইটিতে আমি ভূমি ব্যবস্থা এবং কৃষক সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও সংগ্রাম সম্পর্কে আলেচনা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত টেনে এনেছি। পাকিস্তানী আমলের পূর্ব বাঙলায় মুসলিম লীগ ও সামরিক সরকারের ভূমি নীতি, তখনকার কৃষক সমস্যা ও আন্দোলন সম্পর্কে এর পরবর্তী একটি বইয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো এই আশা করি। সে জন্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষককে’ পরবর্তী আলোচনার ভূমিকা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানী আমলের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে ধারাবাহিক ও তথ্যপূর্ণ ইতিহাস আজ পর্যন্ত কেউ রচনা না করলেও শ্রদ্ধেয় শ্রী সত্যেন সেন ও জিতেন ঘোষ তাঁদের বিভিন্ন পুস্তকে কাহিনী এবং খণ্ড আলোচনার আকারে যে সমস্ত তথ্য উল্লেখ করেছেন সেগুলি ভবিষ্যতে কৃষক সংগ্রামের যে কোন ইতিহাস রচয়িতার পক্ষেই সহায়ক হবে। আমি নিজে তাঁদের রচনা থেকে যে সাহায্য পেয়েছি তার জন্য তাঁদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা ছাড়া অন্যান্য অনেক শ্রদ্ধেয় কৃষক নেতার সাথে সাক্ষাৎ আলাপের মাধ্যমে কিছু কিছু তথ্য তো পেয়েছি বটেই উপরন্তু আমাদের দেশের কৃষক আন্দোলনের চরিত্র সামগ্রিকভাবে বোঝারও অনেক সুবিধা হয়েছে। এঁদের সকলের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। যাঁদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কোন তথ্য এ বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁদের নাম উপযুক্ত চিহ্ন সহকারে ‘তথ্যনির্দেশ’ শিরোনামায় বইয়ের শেষের দিকে উল্লেখিত হয়েছে।
নানা অসুবিধা সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যে বইটি ছেপে বের করার জন্য আতিকুল মাওলার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
১৫.০৫.১৯৭২
.
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’-এর দ্বিতীয় সংস্করণের মূল অংশে কোন পরিবর্তন করা হয়নি। ইচ্ছে ছিলো কয়েকটি অংশের আলোচনাকে আরও তথ্যপূর্ণ এবং বিস্তারিত করার। কিন্তু সে কাজের জন্যে যে সময় ব্যয় করা দরকার সেটা আপাতত সম্ভব নয়। প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর দ্বিতীয় সংস্করণের মুদ্রণ ইতিমধ্যে অনেক বিলম্বিত হয়েছে। কাজেই বইটি প্রকাশ করতে আরও বিলম্ব ঘটানো ঠিক নয় মনে করে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না করেই আবার ছাপা হলো। এই সংস্করণের পরিশিষ্টে আমার যে প্রতিবাদমূলক প্রবন্ধটি প্রকাশ করা গেলো সেটি ইতিপূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘বাঙলাদেশ’ (বৈশাখ ১৩৮১) এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক সংস্কৃতিতে (বৈশাখ ১৩৮১) প্রকাশিত হয়েছে।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
২২.১.১৯৯৫
Md. Mahbubul Haque
অসাধারণ লেখা, আমি আরো পড়তে চাই।