চাণক্য শ্লোক ও চাণক্য নীতিসূত্র – কৌটিল্য প্রণীত । ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্ম/শাস্ত্রি বেদান্তভূষণ কর্তৃক অনূদিত (শ্লোক ও আত্মোন্নয়ন) / প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ২০২১ । Chanakya Sloke O Chanakya Nitistrho. by Kautilya. Translated by Isshorchandro Shommo
.
ভূমিকা
চাণক্য সূত্র নামক নীতিশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থটি চাণক্য রচিত বলে সামান্য প্রমাণ পাওয়া যায় এই গ্রন্থের অন্তিম তিনটি শ্লোকের মধ্যে। এই সামান্যতম প্রমাণটিকে সম্বল করে গ্রন্থের রচয়িতা সম্পর্কে দৃঢ়তার সঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা বাতুলতার নামান্তর। চাণক্যের নীতিবিষয় শ্লোকসমূহের যে ছয়টি সংকলন গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে ‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থের কোনোরূপ উল্লেখ নেই এবং সেগুলোর অধ্যায় সংখ্যা ও শ্লোকসংখ্যার সাদৃশ্যও পাওয়া যায় না। পূর্বনির্ণীত গ্রন্থগুলোর পরিচয় উল্লেখ করলে এই তথ্যটির সত্যতা দৃঢ়তর হবে। যেমন–
১. চাণক্যনীতি দর্পণ: ১৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত; শ্লোকসংখ্যা মোট ৩৪২টি
২. বৃদ্ধ চাণক্য: ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত; মোট শ্লোকসংখ্যা হলো সংস্কারণভেদে ১০৯-১৭৩
৩. চাণক্য নীতিশাস্ত্র : অধ্যায় বিভাজন নেই, মোট শ্লোকসংখ্যা ১০৮টি
৪. চাণক্য সারসংগ্রহ বা বোধিচাণক্য: ৩টি শতকে বিভক্ত; মোট শ্লোকসংখ্যা ৩০০
৫. লঘু চাণক্য: ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত; মোট শ্লোকসংখ্যা ৮৩ থেকে ৯৭টি
৬. চাণক্য রাজনীতি শাস্ত্র: ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত; মোটি শ্লোকসংখ্যা ৪৭২ থেকে ৬৫৮
কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং মোট সূত্র আছে ৬২৯টি
চাণক্যসূত্র গ্রন্থের সূত্রগুলো শ্লোকের এক একটি পাদের অনুরূপ সূত্রগুলো যথার্থ গদ্য বা পদ্যে রচিতও বলা যায় না। সূত্রগুলো প্রায়ই ছন্দোবদ্ধ কিন্তু একপাদবিশিষ্ট।
ভাবের বিচারে চাণক্যের নীতিবিষয়ক গ্রন্থগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকায় চাণক্যরচিত বলে স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা বিশেষ উল্লেখ্য যে, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও লোকব্যবহার নীতিতে পারঙ্গম কোটিল্য বা চাণক্যের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র তো বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল পর্যন্ত নামেই পর্যবসিত ছিল। আর শ্যামশাস্ত্রী মহাশয়ের অসাধারণ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলেই খ্রীষ্টপূর্বকালে রচিত গ্রন্থ মাত্র ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জনগণের দৃষ্টিপথে আসে। সুতরাং চাণক্যসূত্র গ্রন্থটিও যে এককালে ছিল–একথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার অধ্যাপক লুদভিক স্টার্নবাগ (Ludwik Sternbag) বিশ্ব পরিক্রমা করে চাণক্যনীতিসূত্র সম্পর্কে বহু দুমূল্য তথ্য সংগ্রহ করে সমস্ত গ্রন্থে ও নিবন্ধে সরবরাহ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাণক্য নীতি শাখা সম্প্রদায় (Chanakya Niti Tex Tradition) এবং দি স্প্রেডিং অব চাণক্যজ্ আফরিজ্মস্ ওভার গ্রেটার ইন্ডিয়া (the Spreading of Chanaky’s Aphorisms over Greater India) পূর্বোক্ত গ্রন্থটি তিন খণ্ডে সম্পাদিত হয়েছে এবং এই তিন খণ্ডে নিবন্ধ বচনগুলোকেই তিনি আবার ছয়টি সংকলনে বিভক্ত করেছেন–১. বৃদ্ধ-চাণক্য (সরল), ২. বৃদ্ধ-চাণক্য (অলঙ্কৃত, ৩. চাণক্য সার সংগ্রহ, ৪. লঘু চাণক্য, ৫. চাণক্য নীতিশাস্ত্র এবং ৬. চাণক্য রাজনীতি শাস্ত্র। এগুলোর মধ্যে চাণক্যসূত্রের উল্লেখ না থাকায় গ্রন্থটি চাণক্যের রচিত বলে স্বীকার করতে অনেকেরই সংশয় জাগে।
তবে একথা স্বীকার্য যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছরে রচিত ব্যক্তির সমস্ত রচনা যথার্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা এক ব্যক্তির পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। কালসমুদ্রের তরঙ্গের অভিঘাতে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। আবার তরঙ্গান্দোলনে দুলতে দুলতে কোনো কোনো সময় কারো হাতে এসে পড়ে যায়।
আমাদের জাতির জীবনসর্বস্ব বেদেরও হারিয়ে যাওয়া বহুশাখার কিছু কিছু অংশ সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর ঐ দীর্ঘদিনের অদর্শনকে ভিত্তি করে যেমন সেগুলোকে বেদ নয় বলে অস্বীকার করা যায় না, সেরূপ স্টানবাগ কর্তৃক সংকলিত ছয়টি সংকলনে ‘চাণক্যসূত্রে’র নাম না থাকায় চাণক্যের নাম থেকে গ্রন্থটিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া একপ্রকাশ ভ্রান্তিই হবে। বিশেষ করে আজ থেকে চুয়ান্ন বছর আগে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে বহু গ্রন্থের অনুবাদক ও সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা এই গ্রন্থটি প্রথম সম্পাদন করায়, গ্রন্থটি যে চাণক্য কর্তৃকই রচিত, সে সম্পর্কে ধারণা পোষণ করার একটি হেতু পাওয়া যায়।
বর্তমানে সমাজ ও শিক্ষাভূমি থেকে সংস্কৃত উচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সংস্কৃতের প্রতিটি গ্রন্থেরই রচয়িতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করা ভারতীয়দের একটি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা মহাশয় যখন গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করেন, তখন এরূপ প্রাচীন লুপ্ত গ্রন্থ উদ্ধারের প্রবণতা বহু শিক্ষাবিদের মধ্যেই দেখা গেছে। এই সাধুপ্রবণতাই ভারতীয় বিদ্যাকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছিল। এ গ্রন্থটির মধ্যে যদি মৌলিকতা না থাকতো, তাহলে তঙ্কালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গবেষক ও সমালোচকদের কটাক্ষেই গ্রন্থটি অনঙ্গত্ব লাভ করতো। তার পরিবর্তে দেখা যায়, গ্রন্থটি সমাজে সমাদরের সঙ্গে গৃহীত হয়েছিলো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সংকলনটির সংস্করণের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আর একটি প্রমাণস্বরূপ প্রক্ষিপ্ত শ্লোকও লক্ষণীয়–
মূলসূত্রং প্রবক্ষ্যামি চাণক্যেন যথোদিতম্।
যস্য বিজ্ঞানমাত্রেণ মূর্খোভবতি পণ্ডিতঃ ॥
‘চাণক্যসূত্র’, গ্রন্থটি যদি কুটিলমতি কৌটিল্য বা চাণক্যের রচিত বলে প্রমাণসিন্ধ না হতে পারে, তাহলেও অপূর্ব রচনা বৈশিষ্ট্য ও ভাবসমৃদ্ধিতে ভারতীয় আদর্শ ও নীতিমূলক সূত্রগ্রন্থ হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃত হয়েছিল এবং আগামী দিনেও হবে। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা মহাশয় এই গ্রন্থটির সংস্কৃত ভাষায় একটি তত্ত্ব ও তথ্য নির্ভর টীকা, বঙ্গানুবাদ ও টীকার ভাবানুবাদ সংযুক্ত করে গ্রন্থটির প্রামাণিকতা ও লোক্যমান্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সূত্রের লক্ষণ সম্পর্কে শাস্ত্রকারগণ বলেছেন–
অল্পাক্ষরমসন্দিপং সারব বিশ্বতোমুখম।
অস্তোভমনবদ্যঞ্চ সূত্রং সূত্রবিদো বিদুঃ ॥
‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থে নিবন্ধ সূত্রগুলোতে উক্ত লক্ষণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান বললে অত্যুক্তি বা অতিশয়োক্তি হবে না। কারণ বহুবিভক্ত নীতিবাক্যগুলো এখানে মাত্র আটটি থেকে বারোটি বর্ণের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। চাণক্যের যে বড় বৈশিষ্ট্য, দুর্বোধ্য রাজনীতি থেকে আরম্ভ করে সাধারণ লোকব্যবহার নীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া–সেই পরিচিত বৈশিষ্ট্যও এই গ্রন্থে আছে। চাণক্য নিজে অর্থকৌলীন্যের শিকার হওয়ায় তার নীতিশাস্ত্রের সকল গ্রন্থেই যেমন সে সম্পৰ্কীয় শিক্ষণীয় নীতি নির্দেশ করেছেন, এখানে তা থেকে বিরত থাকেন। একাধিকবার অর্থের কার্যকারিতাকে স্মরণ করিয়ে অনেকগুলো সূত্র প্রণয়ন করেছেন। অর্থ, বিদ্যা ও রাজনীতি বিষয়ক সূত্রগুলো দর্শন বা পাঠ করলে চাণক্যের হাতের স্পর্শ ভালোভাবেই অনুভব করা যায়।
যা হোক, এই গ্রন্থটি ভারততত্ত্বের আর একটি দিক উদ্ঘাটন করলো–একথা অনস্বীকার্য। আমরা ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ বিষয়ক সূত্র বহু পেয়েছি। ব্যাকরণ তো সম্পূর্ণই সূত্রনির্ভর, বামন প্রভৃতির দ্বারা রসশাস্ত্রেরও সূত্র রচিত হয়েছে। কিন্তু নীতিশাস্ত্র বিষয়ে শ্লোকাকারে বহু বাক্যের নিদর্শন মিললেও এরূপ সূত্রগ্রন্থ দুর্লভ। ঈশ্বরের কোনো ঐশী প্রেরণায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে ঈশ্বরচন্দ্র এই অনুপম গ্রন্থটি সম্পাদনা করে ভারতীয়দের কৃতার্থ করেছিলেন। তার যথার্থ মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। তবে প্রকাশক মহোদয় আমার মতো অকৃতীর হাতে এটি পুনরায় সম্পাদন। ও বিশ্লেষণের ভার দিয়ে যুগপং আমাকে ধন্য ও আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থে ৬২৯টি বাক্যমৃত যেভাবে সূত্রাকারে বিধৃত আছে, তা বিস্ময়াবহ। কতো বিস্তৃত বাক্যকে এবং কতো জটিল তত্ত্বকে সামান্য ও সংক্ষিপ্ত এক একটি বাক্যের মধ্যে প্রকাশ করা যায়, তার একটি নিদর্শন হলো এই গ্রন্থটি। আমরা অচেতন ও সচেতনভাবে ভারতের বহু রত্নই হারিয়েছি। সেক্ষেত্রে প্রকাশক যে ‘হৃত রত্নের উদ্ধার কেন্দ্ররূপে’ অবস্থান করে নানাজনকে ডুবুরি হিসেবে নিয়োগ করে, একের পর এক রত্ন উদ্ধার করে চলেছেন। এই পবিত্র প্রকাশনা সংস্থার হৃতরত্ন উদ্ধারের তালিকায় ‘চাণক্যসূত্র’ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করবে। যা করলে এই গ্রন্থটির আদ্যোপান্ত পাঠ-অবশ্যই এর গুরুত্ব অনুভূত হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি সূত্র রচনায় যে কাব্যিক সৌন্দর্য আরোপ করা হয়েছে, তাও সহৃদয়বেদ্য বলে স্বীকার করে নিতে কোনোরূপ অসুবিধা হবে না। বরং তখন আর কারো রচনা বলে বিতর্ক না করে, সূত্রগুলোর ভাবসমৃদ্ধি আহরণ করারই প্রবৃত্তি জাগবে।
‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থটি প্রথম এই পশ্চিমবাংলার মাটিতে বাংলা লিপিতে বাংলা ভাষানুবাদসহ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই রীতি অনুসরণ করেই এবারও সম্পাদনা করা হয়েছে। এবারে অতিরিক্ত সংযোজন থাকছে লেখক পরিচয় ও বিষয় পরিচয় বাদ থাকছে সংস্কৃত টীকাটি। বর্তমানে মহামান্য সরকারের অনুকূল্যে জনমানসে সংস্কৃতভীতি যথেষ্ট প্রকট হয়েছে। সংস্কৃত টীকার আতঙ্কে হয়তো আসল রত্নমালাটিকেই জনগণ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন এই আশঙ্কাতেই ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা রচিত তথ্য সমৃদ্ধ সংস্কৃত টীকাটি সংযুক্ত করা হলো না, তার প্রদত্ত প্রতি শ্লোকের মমার্থ প্রায় সংস্কৃত টীকার মূল বিষয় নিয়েই রচিত হয়েছে।
গ্রন্থে বর্তমানে নিবন্ধ ‘বিষয় পরিচয়’ অংশটিতে গ্রন্থের প্রায় সমস্ত প্রতিপাদ্য অংশটি সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ সূত্রগুলোর অধ্যায় ও শ্লোকসংখ্যাসহ উদ্ধৃত করা হয়েছে। সাধারণ ও কর্মব্যস্ত পাঠকগণ বিষয় পরিচয়টি পড়েও সময় গ্রন্থের অন্তত-এক দশমাংশ আয়ত্ত করে নিতে পারবেন। এই অংশে গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং তার সঙ্গে সূত্রগুলোর প্রসঙ্গও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গ্রন্থটি নিজের ভাব সমৃদ্ধিতেই অত্যন্ত মূল্যবান তথা সকলের আদরণীয়; তথাপি ‘বিষয় পরিচয়’ অংশটি চাণক্যের নীতিমূলক সূত্রগুলোর ভাব ও প্রসঙ্গের ব্যাখ্যানাত্মক আলোচনাপূর্ণ হওয়ার গ্রন্থটিকে পাঠ ও আয়ত্ত করার আগ্রহ সৃষ্টি করবে। চাণক্য নীতিশাস্ত্র পাঠ করে মানুষকে যতোগুলো বর্ণ মনে রাখতে হয়, তার এক-চতুর্থাংশ বর্ণ মনে রাখতে পারলেই চাণক্যের প্রায় সমস্ত নীতিগুলোকেই আয়ত্ত করা যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, গ্রন্থ পাঠে অলস ও অনাগ্রাহী ব্যক্তিত্বের কাছে নীতিশিক্ষা ব্যাপারে ‘চাণক্যসূত্র’ অত্যন্ত সারবান আদর্শ গ্রন্থ। সুতরাং নবকলেবরে প্রকাশিত গ্রন্থটি মানুষের মনে বিষয়ে সংস্কৃত নবজাগরণে উন্মেষ ঘটাবে বলে আশা করি।
পরিশেষে চিরন্তন নীতি হিসাবে জানাতে হয় যে, গ্রন্থটির প্রথম সম্পাদক ঈশ্বর চন্দ্র শর্মা মহাশয় বিগত দিনে গ্রন্থটি সম্পাদন করায় সমগ্র দেশবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এরপরই উল্লেখ করতে হয়, প্রকাশক মহোদয়ের সংস্কৃতের প্রতি প্রীতি ও প্রাচীন গ্রন্থ বিষয়ে আন্তরিকতার কথা। এই অপ্রচলিত বিলুপ্ত গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যাপারে প্রকাশক যে আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে, তা ধন্যবাদাহ।।
সর্বশেষ প্রার্থনা, ‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থরূপ ভারতরত্নটি ঘরে ঘরে সমাদরে গৃহীত ও রক্ষিত আবাল-বৃদ্ধ বনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত হোক। নীতিহীনতাই সম্প্রতি মানুষকে বিশৃঙ্খল উন্মর্গগামী করছে–একথা অত্যন্ত দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও মেনে নিতে বাধ্য হবে। আর সে কারণেই ‘চাণক্যসূত্র’ গ্রন্থটি প্রতিটি মানুষের আত্মরক্ষা সম্পাদক শাস্ত্র হিসাবে গ্রহণীয়। সুতরাং চাণক্য প্রণীত নীতিগুলো যথার্থ মনুষ্যত্ব প্রণয়নে সক্ষম, তথা সুদৃঢ় কৃতি হিসেবে জনগণের স্বীকৃতি লাভ করলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সার্থক হবে এবং নিজেদের ধন্য কৃতার্থ ভেবে অনাস্বাদিত সুখ অনুভব করবো।
ইত্যলম
–অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
.
সূচনা
প্রাচীন ভারতের খ্যাতিমান কূটনীতিজ্ঞ, রাজনীতিবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করলে চাণক্যের নাম প্রথমেই স্মরণ করতে হয়। মানুষের জীবনে কীভাবে চলা, বলা ও বাস করা উচিত, সে সম্পর্কে কোনো নীতিশিক্ষা দিতে গেলে প্রায়শই চাণক্যের নীতিবাক্যই এসে যায়। এই চাণক্য সম্পর্কে কয়েকটি উক্তি যেমন–
চাণক্যমাণিক্যমমূল্যরত্নম,
স্বদেশজংষৎ ত্রিদিবেহপ্যলভ্যম্। (তারাশৰ্মা)
বুদ্ধিরের জয়ত্যেকা পুংস: সবার্থসাধনী।
যদ্বলদেব কিং কিং ন চক্রে চাণক্য ভূসূরঃ ॥ (রবিনতক)
মন্ত্রিত্বে তস্য চাত্যৰ্থ বৃহস্পতি সমংধিয়া।
চাণক্যং স্থাপয়িত্বা তৎস মন্ত্রী কৃতকৃত্যতাম্ ॥ (কথাসরিৎসাগর)
নীতিশাস্ত্ৰমৃতং ধীমানর্থ শাস্ত্রমহোদধেঃ।
সমুদ্দধ্রে নমস্তস্মৈ বিষ্ণুগুপ্তায় বেধসে (কামন্দক)
প্রভৃতি অসংখ্য প্রশস্তিবাক্য পাওয়া যায় এবং এই গ্রন্থেরও পরিসমাপ্তিতে ধৃত ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রী কর্তৃক লিখিত।
নানাসন্দর্ভ সারোখং গভীরার্থ প্রকাশকং
বালানামান্তবোধায় কৌটিল্যেন কৃতং পুরা ॥
নানাশাস্ত্রোদ্ধৃতং বক্ষ্যে রাজনীতি সমুচ্চয়ম্।
সর্ববীজমিদং শাস্ত্ৰং চাণক্যং সার সংগ্রহম্ ॥
এরূপ তিনটি প্রশস্তি বাক্য পাওয়া যায়, সেরূপ আবার চাণক্য সম্পর্কে আধুনিক গবেষকদের সংশয়েরও অভাব নেই। তথাপি চাণক্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।
চাণক্য সমস্যা বিবাদ হয় অর্থশাস্ত্র প্রণেতা কৌটিল্য ও নীতিশাস্ত্র প্রবক্তা চাণক্য এক ব্যক্তি বা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এই নিয়ে। বিভিন্ন প্রমাণের মাধ্যমে অর্থশষ্ট্রে রচয়িতা কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত ও মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্য একই ব্যক্তি বলে অধিকাংশ পণ্ডিত স্বীকার করেন। দুটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো যে অর্থশাস্ত্র কৌটিল্যের রচনা বলে প্রসিদ্ধ, সেই অর্থশাস্ত্রের সমাপ্তিকার্যে গ্রন্থকার লিখে গেছেন–
দৃষ্ট বিপ্রতিপত্তিং বহুধা শাস্ত্রে ভাষ্যকারাণাম্
স্বয়মেব বিষ্ণুগুপ্তশ্চকার সূত্ৰং ভাষ্যং চ ॥
দ্বিতীয় উল্লেখ্য প্রমাণ হলো, হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে–
‘বাত্স্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চণকাত্মজঃ।
দ্রামিলঃ পক্ষিল্যস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ ॥’
‘পক্ষিল’ নাম হয়েছে চাণক্য তার্কিক ছিলেন বলে। রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে তিনি ‘কৌটিল্য’। জোতির্বিদ্যার গ্রন্থে তাঁর নাম ‘বিষ্ণুগুপ্ত’। কামশাস্ত্রের গ্রন্থে নাম ‘বাৎস্যায়ন’। নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থে নাম ‘চাণক্য’। বিরাট যোদ্ধা হিসেবে নাম হয়েছে ‘মল্লানাগ’। ‘অঙ্গুল’ শব্দের পরিবর্ত পাঠ ‘আশুল’। তার অর্থ বলবান বৃষষ্কন্ধ প্রভৃতি হতে পারে। তার ডাক নাম ছিল খণ্ডদৎ। মায়ের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে তিনি তাঁর একটি দাঁত উপড়ে ফেলেন–এরকম সব প্রবাদ আছে।
চণকস্য মূনেঃ গোত্ৰাপত্যং–এই অর্থে চাণক্যপদ সিদ্ধ হয়। চণক শব্দের উত্তর ষ্যঞ প্রত্যয়ের দ্বারা। ‘গোত্ৰাপত্য’ বলতে পৌত্রাদি বোঝায়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পূত্রাদিকেও বুঝিয়ে থাকে। সুতরাং ব্যাকরণ অনুসারে চণকমুনির বংশে জাত পূত্র পৌত্রাদির কেউ চাণক্য হবেন–এরকম বলা চলে। ‘দশরূপকে’র, অবলোক, টীকায় ধনিক বৃহৎকথা থেকে যে শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে ‘চাণক্য’ নাম আছে। ‘চাণক্যনাম্মা তেনাথ…’। কথাসরিৎসাগরে সোমদেবভট্টও ‘চাণক্য’ নাম গ্রহণ করেছেন ‘চাণক্যং স্থাপয়িত্বা.. ॥’ পঞ্চতন্ত্রাদিতেও চাণক্য নাম। ‘স্কন্দপুরাণে’ ও ‘চাণক্য’ নামই দেখা যায়। ‘ততোহপি দ্বিসহস্ৰেষু দশাধিকশতত্রয়ে। ভবিষ্যৎ নন্দরাজ্যং চ চাণক্যো যান্ হনিষ্যতি।’
কৌটিল্য নামের ব্যুৎপত্তি ‘উপাধ্যায়নিরপেক্ষা’ টীকায় এভাবে দেওয়া হয়েছে ‘(কুটল) কুটিলত্বাৎ (কুটোঘট) কুটিঘাট উচ্যতে। তং ধান্যপূর্ণং (ভূতং) লান্তি সংগৃহুন্তি প্রাতঃসময়ে হোমাদ্যর্থং নাধিকং, অধিকং তু ব্রাহ্মণানুদ্দিশ্য সদ্য: প্রক্ষালয়ন্তি ইতি কুটিলাঃ। কুম্ভীধান্যা ইতি প্রসিদ্ধা। অতএব কুটিলনাম্যপত্যং বিষ্ণুগুপ্তঃ কৌটিল্যঃ।’ কুট ধান্যপূর্ণ ঘট। যারা তা সঞ্চয় করেন, তাঁরা কুটল। সেই বংশেজাত ব্যক্তি কৌটিল্য। কুটল শব্দের অন্য আরেক অর্থ কুম্ভীধান্য। যাঁরা এক বছরের জীবনধারণের মতে খাদ্যশস্য সঞ্চয় করেন, তারা কুটল। সেই বংশে জাত ব্যক্তি কৌটিল্য।
মহামহোপাধ্যায় গণপতি শাস্ত্রী ‘কুটলগোত্রে জাত ব্যক্তি’ এই অর্থে কৌটল্য নাম করেছেন, কোটিল্য নয়। কিন্তু ‘কৌটিল্য’ নামই বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে, যেমন বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ কামন্দকের ‘নীতিসার’, ‘বিষ্ণুপুরাণ’, ‘ভাগবত’ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়। চাণক্য অসাধারণ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। কুটিলমতি হওয়ার কারণে ‘কৌটিল্য’ নামে তিনি খ্যাত হন–এরকম ব্যাখ্যা অনেকে দিয়েছেন। ‘মুদ্রারাক্ষসে’ আছে ‘কৌটিল্যঃ কুটিলমতিঃ স এষঃ’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চাণক্যের ‘কৌটিল্য’ এই অপবাদসূচক নামের সঙ্গে ‘বাহুদস্তিপুত্র’ (ইন্দ্র) ‘বাতব্যাধি’ (উদ্ধব), ‘কৌণপদস্ত’ (ভীষ্ম), ‘পিশুন’ (নারদ) ইত্যাদি নাম তুলনীয়। ‘দ্রাবিল’ নাম হওয়ার কারণ, যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান। ‘দ্রাবিল’ পদের পরিবর্তে দ্ৰামিল পাঠও আছে। চাণক্য দাক্ষিণাত্যে জন্মগ্রহণ করেন বলে (যদিও তিনি তক্ষশীলায় আবির্ভূত হন বলেই অধিকাংশের ধারণা) তার এই নামকরণ–এরকম বলা হয়ে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কৌটিল্য স্বয়ং তার নাম বিষ্ণুগুপ্ত বলেছেন।
কামন্দক তাঁর গ্রন্থে এই নামই ব্যবহার করেছেন ‘সমুদ্দধ্র নমস্তস্মে বিষ্ণু গুপ্তায় বেধসে।’ ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক বিশাখদত্তও চাণক্যের আসল নাম বিষ্ণুগুপ্ত–এরকম বলেছেন। শিশুবয়সে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কৃপায় কোনো গুরুতর অসুখ বা সঙ্কট থেকে রক্ষা পাওয়ায় এই নাম দেওয়া হয়েছিল বলে অনুমান করা চলে।
চাণক্যের ‘অঙুল’ নামকরণের সার্থকতা দেখাতে গিয়ে অনেকে বলেছেন–সুধম্বা যোগানন্দ তার মন্ত্রী শকটালের সঙ্গে বিবাদ করে রাক্ষসকে নিযুক্ত করেন। শকটাল তখন চাণক্যের সঙ্গে মিলিত হন। আঙুল দিয়ে যেমন জিনিসপত্র তোলা হয়, তেমনি নন্দবংশ ধ্বংস করার জন্য শকটালও চাণক্যকে আঙুলের মতো ব্যবহার করেন। তাই তার নাম হয়েছিল অঙুল।
.
আবির্ভাব কাল ও বংশ পরিচয়
চাণক্য অবিভক্ত ভারতের তক্ষশীলায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তক্ষশীলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ‘চণকমুনি’ স্বয়ং গান্ধার দেশের অধিবাসী হলেও তার পুত্র চাণক্য ভারতের দাক্ষিণাত্যের কোনো প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে কেউ কেউ অনুমান করেন।
চাণক্য ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কামন্দকের ‘নীতিসার’, গ্রন্থে আছে যে, চাণক্য ঋষিদের মতো বিশাল এবং উচ্চবংশের অপ্রতিগ্রাহী ব্রাহ্মণগণের বংশে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ‘বংশে বিশালবংশ্যান্যমৃষীনামিব ভূয়সাম্। অপ্রতিগ্রাহকাণাং যো বভূর ভুবি বিশ্রুতঃ।
চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকাল খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৪ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ। সুতরাং চাণক্যের আবির্ভাবকাল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক।
.
জীবনবৃত্তান্ত
চাণক্যের বিচিত্র জীবনকথা রবিনকের ‘চাণক্যকথা’ সোমদেবভট্টের কথাসরিৎসাগর; বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, কামন্দকের নীতিসার’ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যলাভ এবং নন্দবংশ ধ্বংসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কামন্দকের ‘নীতিসারে’ আছে–
যস্যাভিচারমন্ত্রেণ বজ্ৰজ্বলনতেজসঃ।
পপাত মূলতঃ শ্রীমা সুপর্বানন্দপর্বতঃ।
একাকী মন্ত্ৰশক্ত্যা যঃ শক্ত্যা শক্তিধরোপস্।
আজহার নৃচন্দ্রায় চন্দ্রগুপ্তায় মেদিনীম্ ॥
নীতিশাস্ত্রমৃতং ধীমানর্থশাস্ত্রমহোদধেঃ।
সমুদ্রে নমস্তস্মে বিষ্ণুগুপ্তায় বেধসে ॥
দশরূপকের টীকা ‘অবলোকে’ বৃহকথার দুটি উদ্ধৃতি আছে–
চাণক্যনাম্না তেনাথ শকটালগৃহে রহঃ।
কৃত্যাং বিধায় সহস্য সপুত্রো নিহতো নৃপঃ ॥
যোগানন্দে যশঃশেষে পূর্বনন্দসুতস্ততঃ।
চন্দ্রগুপ্তঃ কৃতো রাজা চাণক্যেন মহৌজসা ॥
মগধের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ৷ জরাসন্ধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ। জরাসন্ধের পর অনেকে মগধের সিংহাসনে বসলেন। অবশেষে হলেন মহাপদ্মনন্দ। মহাপদ্মণেন্দর মহিষী রত্নাবলির গর্ভে নন্দ প্রভৃতি আট পুত্রের জন্ম হয়। মহাপদ্মণের মুরা নামে এক দাসী ছিল। মহাপদ্মনন্দ এবং মুরার সন্তান চন্দ্রগুপ্ত। মুরার পুত্র বলে চন্দ্রগুপ্তের বংশ মৌৰ্য্যবংশ নামে খ্যাত হয়। [এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, রবির্তকের চাণক্যকথায় চন্দ্রগুপ্তকে মুরার পৌত্র বলা হয়েছে। মুরার পুত্র মৌৰ্য্য। মৌর্যের শতপুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ চন্দ্রগুপ্ত। রবিনতর্কের গ্রন্থটি পদ্যে লেখা। মোট ৩৫২টি শ্লোক। গদ্যে লেখা কোনো একটি গ্রন্থকে তিনি পদ্যে রূপান্তরিত করেন। ‘চাণক্যস্য কথা সেয়ং বিদ্যতে গদ্যরূপিণী। অথ তাং পদ্যতাং নেতুমুদ্যতো রবিনৰ্তকঃ।’] মহাপদ্মনন্দের পুত্রদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তই জ্যেষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু দাসীর পুত্র হওয়ায় তিনি পিতৃরাজ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। মহাপদ্মনন্দের অন্যান্য সন্তানেরা চন্দ্রগুপ্তের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতো এবং তার প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলো। চন্দ্রগুপ্ত তাদের অত্যাচারে পাঞ্জাবে পালিয়ে গেলেন। মহাপদ্মনন্দের পর রাজা হলেন নন্দ। তার রাজধানী হলো পাটলিপুত্র। চন্দ্রগুপ্তের পাঞ্জাবে অবস্থিতির সময় চাণক্যের সঙ্গে তার সাক্ষ্যৎ হয়। গ্রিক সম্রাট, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিকার নিয়ে আলেকজান্ডারের দুই সেনাপতির তুমুল বিবাদ হয়। ইতিমধ্যে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের কূটবুদ্ধির জোরে পাঞ্জাবের অনেক অংশ নিজের অধিকারে আনেন।
রবিনৰ্তক প্রণীত চাণক্য কথামতে–মুরার পুত্র মৌর্যের একশত পুত্রের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত সর্বকনিষ্ঠ। নন্দের অপর পত্নীর দ্বারা চন্দ্রগুপ্ত বঞ্চিত হলো। শতপুত্র সমেত মৌর্য গুপ্তকক্ষে নিহত হন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত কোনোক্রমে রক্ষা পান। তার অন্তরে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। ঘটনাক্রমে নন্দের দ্বারা চাণক্য অপমানিত হয়ে নন্দবংশ ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করেন। কালক্রমে তিনি নন্দবংশের উচ্ছেদ করে চন্দ্রগুপ্তকে পাটলিপুত্রের রাজা করেন।
মহারাজ নন্দের অন্যতম দুই মন্ত্রীর নাম শকটার এবং রাক্ষস। শকটার শূদ্র এবং রাক্ষস ব্রাহ্মণ ছিলেন। শকটার উদ্ধতস্বভাব এবং প্রভুবিদ্বেষী–রাক্ষস তার সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজা নন্দ্র শকটারের ব্যবহারের ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে সপরিবারে বন্দি করেন। কারাগারে অত্যন্ত পরিমাণ আহার্য বরাদ্দ দেখে পরিবারের অন্যরা প্রাণত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কালক্রমে মারা যায়। শকটার জীবিত থাকেন এবং পরে কোনো কারণে মুক্তিলাভ করেন। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই শকটার নন্দবংশ ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করেন। ইতিমধ্যে একদিন নগরের বাইরে এক প্রান্তরে একজন কদাকার, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ব্রাহ্মণকে একাগ্রচিত্তে কুশের গোড়ার তক্রসেচন। (তক্র = ঘোল) করতে দেখলেন। জানা গেল ব্যক্তিটি চাণক্য। তাঁর বিবাহ স্থির হয়েছিল; কিন্তু যাবার পথে কুশের আঘাতে পায়ে ক্ষত হয়েছে। ফলে বিবাহ বন্ধ হয়েছে। সমস্ত ক্ষোভ পড়েছে এখন ঐ কুশের উপর। শকটার দেখলেন এরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অধ্যবসায়শীল লোকই তার উদ্দেশ্যসিদ্ধিতে সহায়ক হবে। গোপনে তিনি চাণক্যকে নিজের ঘরে নিয়ে রাখলেন। সেই প্রান্তর চাণক্যের তুষ্টি বিধানের জন্য কুশশূন্য করে দিলেন। নগরে চতুষ্পঠীতে চাণক্যকে অধ্যাপক পদ দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে নন্দের পিতৃশ্রাদ্ধের দিন উপস্থিত হলো। শকটার চাণক্যকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের গেলেন এবং তাকে প্রধান ব্রাহ্মণের আসনে বসালেন। রাজা নন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে এক কদাকার ব্রাহ্মণকে সেই আসনে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে শিখা ধরে আসন থেকে তুলে দিলেন। তখন চাণক্য শিখা উন্মুক্ত অবস্থায় প্রতিজ্ঞা করলেন, নন্দবংশ ধ্বংস না করে তিনি আর শিখা বন্ধন করবেন না। শকটারের উদ্দেশ্যসিদ্ধ হলো। এই সময়েই চন্দ্রগুপ্তও তাদের সঙ্গে মিলিত হলেন।
এরপর চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত এবং নিজের শিষ্যদের সঙ্গে করে তপোবনে গেলেন এবং সহপাঠী জীবসিদ্ধির সঙ্গে মিলিত হলেন। জীবসিদ্ধিকে ক্ষপণকবেশে রাক্ষসের কাছে পাঠানো হলো। জীবসিদ্ধি রাক্ষসের বিশ্বাসভাজন হলেন। অতঃপর চাণক্য এক অভিচারক্রিয়া (অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে করা যাগযজ্ঞ) করেন, এবং তার প্রসাদ শকটারের মাধ্যমে নন্দের কাছে পাঠান। শীঘ্রই রাজা এবং তার পুত্ররা নিহত হলেন। শকটারের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হলো। কিন্তু নিজের অপরাধবোধে পীড়িত হয়ে বনে গিয়ে অনশনে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। মন্ত্রী রাক্ষস প্রভুর শোকে কাতর হয়েও মহারাজ নন্দের ভাই (অথবা বন্ধু) সর্বার্থসিদ্ধিকে সিংহাসনে বসিয়ে সাবধানে রাজকার্য চালাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে চাণক্য মহারাজ পর্বতক এবং অন্যান্য ম্লেচ্ছারাজাদের নন্দের রাজত্বের অর্ধেক দেবেন–এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তাদের দিয়ে রাজধানী অবরোধ করালেন। রাজা স্বার্থসিদ্ধি পরাস্ত হলেন এবং বৈরাগ্য অবলম্বন করে বনবাসী হলেন। রাক্ষসও আত্মসমর্পণ করলেন। তারপর রাক্ষস পর্বতকে সহায়তায় স্বার্থসিদ্ধিকে রাজা করায় চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চাণক্যের কূটনীতিতে রাক্ষস ক্ৰমশঃ বিপর্যস্ত হয়ে শেষে চাণক্যের প্রস্তাবমতো চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রিত্ব গ্রহণে সম্মত হলেন। চাণক্যের সমস্ত কার্যই সিদ্ধ হয়।
[তবে চাণক্যের পারিবারিক জীবন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে গেছে]
.
রচনার প্রভাব ও গুরুত্ব
চাণক্যের নীতিশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ ও নীতিসূত্রগুলো গুরুত্ব ও প্রভাবাতিশয্যে এতোই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে, সেগুলো ভারতের তথাকথিত সীমানা অতিক্রম করে ‘বৃহত্তর ভারত’ অর্থাৎ নেপাল, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ, সিংহল, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়, জাভা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই সমস্ত অঞ্চলের সাহিত্যে চাণক্যের নীতিসূত্রগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এমনকি সুদূর আরব, পারস্যের সাহিত্যেও চাণক্যনীতির নজির মেলে, সিংহল প্রভৃতি দেশের সাহিত্যে শুধু যে চাণক্য নীতিসূত্রের প্রতিফলনই লক্ষ করা যায় তাই নয়, অনেক সময় অবিকল চাণক্যসূত্রের উদ্ধৃতিও মেলে। পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থে উদ্ধৃত চাণক্যের নীতিবাক্যগুলো খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠশতাব্দীতে পঞ্চতন্ত্রের পহলটী অনুবাদের এবং পরে সিরীয় ও আরবি অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিম ভূখন্ডে প্রবেশ লাভ করেছিল। সুতরাং তার এই নীতিসূত্র সংকলনটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতভূমিতে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে–সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
.
বিষয় পরিচয়
‘চাণক্যসূত্র’-গ্রন্থটিতে ছয়টি অধ্যায়ে ৬২৯টি সূত্র আছে। ভারতের যাবতীয় অর্থশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রের অনুশাসনমূলক বাক্যগুলো এখানে সূত্রাকারে নিবন্ধ হয়েছে। এমনকি মহাভারত ও পুরাণাদিতে নিবন্ধ রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ক উপদেশগুলোরও কিছু কিছু সঙ্কেতিত রূপ-এর মধ্যে লক্ষ করা যায়।
‘চাণক্যসূত্রের’ অধ্যায় অনুসারে বিষয়বস্তুগুলোর সন্নিবেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম অধ্যায়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে সূত্রাকারে গ্রথিত হয়েছে। যেমন প্রথম অধ্যায়ে দ্বিতীয় সূত্র থেকে ১৯শতম সূত্র পর্যন্ত যথাক্রমে রাজ্যের গুরুত্ব, রাজ্য পালনে রাজার শিক্ষণীয় বিষয় ও করণীয় কর্মের নির্দেশ আছে।
২০তম সূত্রে মন্ত্রীর গুণগুলো উল্লেখ করে পরবর্তী পনেরটি সূত্রে মন্ত্রণা বিষয়ে রাজনীতি-শাস্ত্রবিষয়ক যাবতীয় গ্রন্থের বাক্যগুলিকে নিবন্ধ করা হয়েছে। মন্ত্রগুপ্তি বিষয়ে ‘ষটকর্ণেমন্ত্র-শ্চিদ্যতে’ সূত্রটি যেন কেবল রাজাদের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো বিষয়ী মানুষের কাছেও শিক্ষণীয় প্রবচনস্বরূপ। ৩৬তম ও ৩৭তম সূত্র রাজার বল সংগ্রহের উপযোগিতা উল্লেখ করেই ছয়টি সূত্রে রাজার আলস্যে যে সমস্ত হানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা রাজার সম্পর্কে নির্দেশ করা হলেও সেগুলোর মধ্যে বিশ্বজননীতা নিহিত আছে। তারপর রাজ্যতন্ত্রায়ত্তং নীতিশাস্ত্রম্ সূত্রটির কার্যকারিতাগুলো পাঁচটি সূত্রে প্রদর্শন করা হয়েছে। এরপর মনুনির্দিষ্ট রাজমণ্ডলটিকে মাত্র তিনটি সূত্রে নির্ণয় করা হয়েছে। ৫৩তম সূত্র থেকে ৬৩তম সূত্র পর্যন্ত এগারোটি সূত্রে সন্ধি, বিগ্রহ, যান আসন, দ্বৈধও সংশ্রয়-ষাড়গুণ্য অবলম্বনের জটিলতত্ত্বগুলো প্রকাশ করা হয়েছে। রাজাদের শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য অপরের আশ্রয় গ্রহণ করা বিষয় নীতিনির্ধারণ সম্পর্কে সূত্র রচনাকালে উপমাধর্মী বাক্যগুলো লক্ষণীয়, কাব্যগুণসমদ্ধ। এখানে অনুরূপ একটি সূত্র উদ্ধৃত করা হচ্ছে–‘আমপাত্রং আপেনসহ বিনশ্যতি’। অর্থাৎ কাঁচাপাত্রে জল রাখলে সে পাত্রটিও জলের সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায়। এরপর তিনটি সূত্র মহাভারতে বিরাট পর্বে নিবন্ধ ধৌম্যের স রাজ বসতিং বসেৎ প্রসিদ্ধ রাজনীতি বিষয়ক উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়। ৬৭তম থেকে ৭৬তম সূত্র পর্যন্ত দশটি সূত্রে রাজলক্ষী বিঘাতক ব্যাসন ও তজ্জন্য ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করানো হয়েছে। এরপর রাজধর্ম প্রকরণে যেটি বিশেষ আলোচ্য, তথা গুরুত্বপূর্ণ সে দণ্ড সম্পর্কে মহামতি চাণক্য তেরটি সূত্র রচনা করেছেন। দণ্ডের গুরুত্বমেনু ও বিশেষভাবে স্বীকার করেছেন। চাণক্যও সূত্রে গুরুত্বগুলো দুই একটি সূত্র দ্বারা বুঝিয়ে যেন সমস্ত শাস্ত্রের সার নিষ্কাশন করেছেন। যেমন বলা হয়েছে—’দণ্ডাভাবে ত্রিবর্গাভাবঃ’। আবার ঘুরিয়ে রাজার আত্মরক্ষা দণ্ডের অধীন বলেই, একটি সর্বজনীন নীতি রচনা করেছেন–‘আত্মনি রক্ষিতে সর্বং রক্ষিতং ভবতি’। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথার মধ্য দিয়ে মনুপ্রণীত রাজধর্মের সূর শুনতে পাওয়া যায় ‘দুর্বলোহপি রাজা নাবমন্তব্য’। ৮৯তম সূত্র থেকে এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত অর্থনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ক আলোচনা। অর্থনীতি ও সমাজনীতি ব্যতীত রাজনীতি কখনো পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। আর অর্থনীতি যে মানবজীবনের সমস্ত নীতির শীর্ষস্থানে থাকে তা গ্রন্থের প্রারম্ভে একবার দেখানো হয়েছে—’সুখস্য মূলম্ ধর্মঃ’ আর ‘ধর্মস্য মূলম্ অর্থঃ’। আবার এই অধ্যায়ের সমাপ্তি পর্বে বলা হয়েছে ‘অর্থমূল্যে ধর্ম কামৌ’(১।।৯০), ‘অর্থমূলং কার্যম্’ (১।।৯১)। অনুরূপ উক্তিই কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে–অর্থমূলৌ হি ধর্ম কামাবিতি (১।।৭)। একথা সর্বকালে সর্বজনস্বীকৃত যে সমস্তপ্রকার সুখ ও প্রতিষ্ঠালাভের মূল উপাদান অর্থ। অর্থহীনের জীবনধারণ নিরর্থক। সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে গেলে প্রথম ও সবসময় যে জিনিসটির প্রয়োজন, তার নাম হলো অর্থ। তাই চাণক্য জীবকুলকে সর্বদা সে বিষয়ে সচেতন রাখার জন্য বলেছেন ‘অর্থমূলং কার্যম্’। অর্থাৎ সাংসারিক সকল কার্যের মূল হলো অর্থ।
তবে অর্থ সকল কাজের মূল, একথা নিরন্তর চিন্তা করে অবসন্ন হয়ে গেলেও অর্থ আসবে না। তার জন্য যথার্থ চেষ্টা, উদ্যমের প্রয়োজন। সে কথাটিও সূত্রকার স্মরণ করাতে বিস্মৃত হননি। সেই সঙ্গে হতাশ মানুষের মনেও আশায় সঞ্চয় করবার জন্য বলেছেন, ‘উপায়পূর্বং কার্যংন দুষ্টকরং স্যাৎ’। (১।।৯৩) অর্থাৎ কাজ যতই কঠিন হোক, প্রকৃত উপায় অবলম্বন করলে কার্যসিদ্ধ হবেই। কার্যসাধনের জন্য দৈব সহায় না হলে বাধাবিপত্তি আসে সত্য, কিন্তু প্রকৃত উপায় অবলম্বন করে নিজ পুরুষকারের সাহায্যে অগ্রসর হলে প্রায়ই মানুষ ব্যর্থ হয় না। নীতশাস্ত্রবিদদের এই উপদেশের সারটিই এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, পুরুষকারমনু বৰ্ততে দৈবম্। (১।।৯৭) সেই সঙ্গে নিরুদ্যমের সম্বন্ধে সতর্কবাণী করেছেন ‘অর্থহীনমানস্য বৃত্তির্ণ সম্পদ্যতে’। মানুষকে জীবনধারণের জন্য জীবিকা অর্জন করতে হলে যে, চেষ্টা ও উদ্যমের কোনো বিকল্প নেই, সে কথাই এই সূত্রটির দ্বারা বুঝিয়েছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে মোট ১১৬টি সূত্র আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্রগুলো সর্বসাধারণের শিক্ষণীয় স্মরণীয় হওয়ায় নিঃসংশয়ে সর্বজনীন বলা যায়। আরও লক্ষণীয় যে, সচরাচর নীতিশ্লোকে প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে না। চাণক্যের নীতিশাস্ত্রে পুরাপুরি প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এ সূত্রগ্রন্থটিতে সে ক্রুটি অনেকাংশে পরিশুদ্ধ হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ের শেষ মুহূর্তে যে কার্যের প্রসঙ্গ সূচিত হয়ে কার্য সম্পাদনের প্রধান উপাদান চেষ্টা ও কার্যোদ্যমের উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় অধ্যায় সেখান থেকেই আরম্ভ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই কার্য সম্পাদনের দ্বিতীয় উপাদান ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে সূত্র রচিত হয়েছে। উপায়ের থেকে অপায় সম্পর্কে মানুষের ধারণা থাকা সর্ব ব্যাপারেই ফলপ্রদ বলে ক্ষিপ্রতার শুভ দিকটিকে আড়াল করে ক্ষিপ্রতার অভাবে অবশ্যম্ভাবী অশুভগুলোর দিকে অঙুলিসঙ্কেত করেছেন। প্রথম সূত্রটিই হলো–কার্যান্তরে দীর্ঘসূত্রতা ন কর্তব্য। কারণ হিসেবেও সূত্র রচিত হয়েছে–কালতিক্রমাৎ কাল এব তৎকলং পিবতি’ (২॥৭)। সূত্রকারের এই নির্দেশ দুটি মনে রাখলে সাংসারিক জীবনে মানুষ সহজেই সর্ব ব্যাপারে ক্লান্তি, অবসাদ ভুলে কর্মে লিপ্ত হয়ে থাকবে এবং কর্মসাধনের জন্য তৎপর হবে। অনেক মানুষ আবার কার্যে প্রবৃত্ত হয়েও সেই কাজের মধ্যে নানা প্রকার দোষ আবিষ্কার করে কার্য থেকে বিরত হয়ে থাকে। সেটা কিন্তু সুস্থ চিন্তার লক্ষণ নয়। তার ফলে সেই মানুষ ক্রমে ক্রমে নিষ্কর্মা হয়ে যায়। এই প্রকার মানুষকেও কর্মে ব্যাপৃত করবে চাণক্যের একটি সূত্র–দোষবর্জিতানি কার্যানি দুবর্লভানি। (২॥৪) অর্থাৎ দোষ রহিত কাজ জগতে দুর্লভ। যে দানের এতো প্রশস্তি, সেই দান করেও তো বলিরাজ বন্দি হয়েছিলেন। সুতরাং সংসার-যাত্রা নির্বাহকালে যে যে কার্য করণীয় হিসেবে আসে সেগুলোর দোষগুণ নিরূপণ না করে সম্পাদন করাই মানুষের কর্তব্য।.তাই আমাদের শিরোধার্য নির্দেশাত্মক সূত্র হলো–
‘ক্ষণং প্রতিকালবিক্ষেপং ন কুর্যাৎ সর্ব কৃত্যেষূ’ (২॥৮)। অর্থাৎ সমস্ত কাজেই একটি মুহূর্তও কালক্ষেপণ করা উচিত নয়। সাধারণ সাংসারিক মানুষের কাছে এর থেকে বেশি কর্মচোদ্দনামূলক নির্দেশ বিরল। তবে এই প্রেরণা থেকে অবিমৃশ্যকারিতা অর্থাৎ হঠকারিতা জন্মাতে পারে। তাতে আবার কার্য সম্পাদনের পরিবর্তে কার্যহননের সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তাই মানুষকে কাজ যেমন করতেই হবে, তেমনি আবার স্থান-কাল-পাত্রও পর্যালোচনা করে কার্যে অগ্রসর হতে হবে। কার্য সম্পাদনে দেশ, কাল ও তার পরিণাম সম্পর্কে পর্যালোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। যারা এগুলো পর্যালোচনা না করেই কর্মে প্রবৃত্ত হয়, তাদেরই অবিমৃশ্যকারী বা অবিবেচক বলা হয়।
অবিমৃশ্যকারীরা যে কখনো ‘কৃতী’ নামে চিহ্নিত হতে পারে না, সে সম্পর্কে সূত্রকারের নিপুণ সঙ্কেত হলো ‘ভাগ্যবন্তমপ্যপরীক্ষ্যকারিণং শ্রী পরিত্যজতি’। অর্থাৎ কোনো ভাগ্যবান ব্যক্তিও যদি হঠকারিতার বশে কার্য করে থাকে, তাহলে অর্থ উৎপাদনের যে মূল উপাদান কার্য–সেই কার্যও অর্থ উৎপাদন দূরের কথা অর্থনাশ করে থাকে। তবে জগৎ হচ্ছে বৈচিত্র্যের লীলাভূমি, তথ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন ব্যভিচার হয়ে থাকে; সেরকম কখনো অপরীক্ষিতভাবেও কার্য সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সূত্রকার আচার্যের ভূমিকা নিয়ে জগদ্ববাসীকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এটি আদর্শ বা গ্রহণীয় নয়। ব্যতিক্রম মাত্র। তাই ঐরূপ কর্মী ও তার কর্ম কখনই অভিনন্দনীয় নয়। সূত্রটি হলো—’অজ্ঞানিরা কৃতমপিন বহুমন্তব্যম্। (২॥১৮) অর্থাৎ দেশ, কাল প্রভৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির কার্য কোনো সময় সম্পন্ন হলেও তাকে আদর করবে না। এই সূত্রটির সরাবত্তা প্রদর্শনের জন্য একটি উপমাধর্মী সূত্র করেছেন, যা সাহিত্যরসিকদের সমাদরণীয়–যাদৃচ্ছিকত্বাৎ কৃমিরপিরূপান্তরাণি কিং ন করোতি। (২॥২৯) অর্থাৎ ভাবনাচিন্তা না করেও কৃমি প্রভৃতি অতি নিকৃষ্ট প্রাণীও কোনো সময় দর্শনীয় রূপান্তর ঘটিয়ে থাকে। সেজন্য নিশ্চয় তাকে সমাদর করা হবে না।
এরপর ৩৪টি সূত্রে কর্মী সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার এমন সূত্র রচনা করা হয়েছে, যেগুলো বিশ্লেষণ করলে সমস্ত নীতিশাস্ত্রের নিপূঢ় তত্ত্বগুলোকে একত্র দর্শন করা যায়। প্রথমেই যেমন প্রকৃত কর্মী হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্যটি বলা হয়েছে, সিদ্ধস্য কার্যস্য প্রকাশনং ন কর্তব্য। (২॥২১)।
অর্থাৎ কার্যসিদ্ধ হওয়ার পুর্বে বা পরে নিজমুখে তা প্রকাশ করতে নাই। কারণ তাতে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়, তার ফলে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র না হয়ে অশ্রদ্ধার পাত্র হতে হয়। তারপর অনেক সময় মানুষ অপরের দোষাবিষ্কারের ভয়ে কর্ম থেকে বিরত হয়; ফলে কর্ম সাধনে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মপদবাচ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে কর্মীগুণসম্পন্ন মানুষের উৎসাহব্যঞ্জক নির্দেশ হলো– জ্ঞানবতামপিদৈব মানুষ দোষং কার্যাণি দুষ্যন্তি। (২॥২২) অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞানী বা সুধীব্যক্তিদের কার্য দৈবদোষ ও মনুষ্যকৃত দোষ দুষ্ট হয়ে থাকে। সুতরাং লোকনিন্দার ভয়ে কর্ম থেকে দূরে সরে আসা কোনো মানুষেরই উচিত নয়। বিশেষ করে যারা কর্মসাধনে প্রবৃত্ত তাদের পক্ষে তো নয়ই। এ সম্পর্কে আরও উৎসাহিত করতে প্রণীত সূত্র–কার্যবিপত্তৌ দোষাণ্ বর্ণয়ন্তি বালিশাঃ’। (২॥২৫) অর্থাৎ কার্যে বিঘ্ন ঘটতেই পারে। তার জন্য যারা প্রকৃত সুধী তারা কখনো দোষ কীর্তন করেন না। মূর্খরাই দোষ কীর্তন করে থাকে। সজ্জনা গুণামিচ্ছস্তি দোষমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ–পূর্ব নীতিবাক্যের অর্থবাহীই হলো এই সূত্রটি এবং তার দ্বারা কর্মীকে এভাবে উৎসাহ দেওয়া হলো যে, মূখের কথায় কর্ণপাত করার কোনোরূপ প্রয়োজন নাই। আবার কার্যবিপত্তিতে অনেকে ভাগ্যের দোষ দিয়ে নিজের দোষ ক্ষণস্থলনের চেষ্টা করে কিন্তু নিজের সংশোধন করার কথা ভাবে না। প্রকৃতপক্ষে কার্যে বিপত্তি ঘটলে আত্মপর্যালোচনা করা প্রধান কর্তব্য। তাহলে পরবর্তীকালে সেই ভুলগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয় এবং কার্যেও সাফল্য আসে। এই নিগূঢ়তত্ত্বটি বুঝবার জন্য সূত্রকার ভিন্ন সুরে বলেছেন–নাস্তি দৈবাৎ কার্য বিপত্তিঃ। (২॥২৮) অর্থাৎ দৈব হতে কার্যে বিপত্তি হয় না। সমস্ত বিপত্তির মূল নিজের ভ্রান্তি। যারা তা না বুঝে দৈবকেই দায়ী করে তাদের কার্যে প্রবৃত্ত না হওয়াই উচিত। কারণ নিজের দোষত্রুটিগুলো দূর না করে আবার কার্যে প্রবৃত্ত হলে অনুরূপ বিপত্তিই আসবে।
অতএব কার্যে বিপত্তি নাশের জন্য পূর্বনির্দিষ্ট দেশ, কাল প্রভৃতি বিষয়ে পরীক্ষাই যে প্রধান সহায় তা বিশেষভাবে বুঝতে দুটি সংক্ষিপ্ত সূত্র রচনা করা হয়েছে ‘ন পরীক্ষা কারিণাং কার্য বিপত্তি’ ও ‘পরীক্ষা তাৰ্য্যা বিপত্তিঃ’। (২-৩৩।।৩৪)। পূর্ব প্রসঙ্গেরই আরও পরিপূরক হিসেবে বলা হয়েছে যাদের লোকনিন্দা, বিপত্তি প্রভৃতি নানা বিষয়ে নানাপ্রকার ভয় থাকে, তাদের কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ ভীরুতাই তাদের সাফল্যের প্রধান অন্তরায় হবে। তাই মহামতি চাণক্য ভীরুতাকে অকর্মণ্যতার নামান্তর হিসাবে বলেছেন, ‘নাতিভীরো কার্যচিন্তা।’ (২॥৩৮)। অর্থাৎ যারা ভীরু, তাদের কার্য সম্পর্কে হয় না। ভীরু মানুষ কার্য থেকে দূরে থাকে। এককথায় ভীরুমাত্রই অকর্মণ্য। বিপরীতপক্ষে আবার বলা হয়েছে ‘সাহসে খলু শ্রীধসতি’। (২০।।৫০)। অর্থাৎ এই কর্মসঙ্কুল জগতে কর্ম সম্পাদনের সহায়ক মানুষের যাবতীয় গুণাবলি আছে, সেগুলোর মধ্যে সাহসই প্রধান। সাহসের অভাব ভীরুতা। অতএব ভীরুতা মানুষকে যেরূপ অকর্মণ্য করে তোলে, বিপরীত পক্ষে সাহস সেরূপ মানুষকে কর্মী করে, তোলে আর তার ফলে কর্ম সম্পাদনের দ্বারা সেই মানুষের কাছে সম্পদ হয় সহজলভ্য। এই তত্ত্বটিই উক্ত সূত্রে নির্ধারিত হয়েছে।
এরপরও মানুষকে প্রকৃত সৎপথে রেখে কার্যে প্রবৃত্ত করার জন্য দর্শনীয় প্রয়াসের নিদর্শনমূলক সূত্র ব্যাসনাতো বিস্মরত্য প্রবেশন। এখানে এই ছোট্ট সূত্র দ্বারা বোঝানো হয়েছে, যে সমস্ত মানুষ মৃগয়া, পাশাখেলা, দিবানিদ্রা, ঈর্ষ, পরনিন্দা, কাম, নৃত্যগীতে বৃথা ভ্রমণ প্রভৃতি ব্যাসনে আসক্ত হয়, সে সমস্ত মানুষ কার্যের কথাও চিন্তা করতে পারে না, অর্থাৎ তারা প্রকৃত কার্য করতে পারে না। অর্থাৎ কার্যনিষ্ঠ হতে হলে মন্বদিশাস্ত্র নির্দিষ্ট ব্যাসনগুলো পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। ব্যাসনগুলো পরিহারের উপকারিতা সম্পর্কে উক্ত সূত্রটিও বিশেষভাবে স্মরণীয়– নাস্ত্যনন্ত-রায় কালক্ষেপণঃ। (২॥৫২)।
এরপর ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে রচিত সূত্রগুলো প্রতিটি মানুষের জীবনের মূল মন্ত্রস্বরূপ। উপনিষদের বাণীও এই গ্রন্থে সূত্রকারে গ্রথিত হয়েছে। তেনত্যক্তের ভূঞ্জীথা। ‘মা গৃধকস্যস্বিদ ধনম’ এই উপনিষদ্ বাক্য এখানে সূত্রাকারে ধ্বনিত হয়েছে–অপর ধনানপেক্ষং কেবলমর্থদানং শ্রেয়ঃ। (২॥৫৪)।
অর্থাৎ জীবনের সব কিছুর মূল বলে যেকোনো প্রকারে অর্থ উপার্জন করা যে মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য নয়, সে সম্পর্কে সূত্রটি বেদবাণীতুল্য সদা শাশ্বত ও সর্বজনমান্য–ন্যায়াগতোইৰ্থ। (২॥৫৫)। অর্থাৎ সদুপায়ে অর্জিত অর্থই প্রকৃত অর্থ, আর তা না হলে–তদ্বিপরীতোহর্থাভাস। (২॥৫৬) সেটি অর্থের মতো হলেও প্রকৃত অর্থ নয়। সুতরাং এই সূত্রদুটির সাহায্যে সূত্রকার জগদ্বাসীকে সর্বক্ষেত্রে ন্যায় পথে চালিত হওয়ার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করেছেন।
সেই সঙ্গে কাম বা বিষয় বাসনা–যা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, সে সম্পর্কে যে দুটি সূত্র রচিত হয়েছে–তার প্রকৃত মূল্যায়ন করে যদি কোনো পুরুষ জীবনপথে চলতে পারে, তাহলে সে পুরুষ মহাপুরুষে রূপান্তরিত হতে পারে। যো ধর্মাথৌ নিপীড়য়তি সকার্মঃ’। (২॥৫৭) এবং তদ্বিপরীত। কামাভাসঃ’। (২॥৫৮) অর্থাৎ সেই কাম বা বিষয়বাসনাই যথার্থ, তথা শাস্ত্র ও সমাজানুমোদিত হয়, যে কামের দ্বারা ধর্ম ও অর্থ বিঘ্নিত হয় না। যে বিষয় বাসনা দ্বারা ধর্ম প্রতিপালিত এবং সদুপায়ে অর্থও অর্জিত হয়, সেই বিষয়বাসনাই কাম্য। আর তা না হলে যে কামনাবাসনা দ্বারা ধর্ম বিঘ্নিত হয়, অর্থ হানি হয়, সে কাম ব্যসন, তা বর্জনীয়।
এরপর এই জটিল সংসারবর্তে পতিত মানুষ যাতে সহজে জীবনসমুদ্র উত্তরণে সমর্থ হতে পারে, সেস সম্বন্ধে ক্রমিক কয়েকটি সূত্র রচিত হয়েছে। মানুষকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে ভৃত্যপরিজনের উপর নির্ভর করতেই হয়, কিন্তু এই ভূত্যপরিজনদের সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন ও সতর্ক থাকা কর্তব্য কারণ হিসাবে সূত্র; ঋজুস্বভাবঃ পরিজনো দুর্লভ।
কখনো কোনো দোষে দুষ্ট হওয়া উচিত নয়। যেমন এক অগ্নি সবকিছুকে ভস্মসাৎ করতে পারে, সেরূপ একটি দোষ বহু গুণকে নষ্ট করে দেয়। কোনো গুণী ব্যক্তি ভুলক্রমে একটি দোষ করলে, অপরে তার সমস্ত গুণের কথা ভুলে ঐ দোষটির কথাই আলোচনা করে থাকে। এই তত্ত্বটিকে একটি সূত্রে গেঁথেছেন, বহুনপিগুলোকে দোষাঘসতে। (২॥৬১)
.
জীবনে সবসময় প্রতিযোগিতামূলক আচরণ বা প্রতিস্পর্ধা সুখকর নয়।
পরানুকরণও বাঞ্ছনীয় নয়। নিজের স্বভাবানুরূপ আচরণ করাই বিধেয়। নিজের স্বভাবকে লুকিয়ে ক্ষণিকের জন্য অপরের মতো আচরণ করা যায়, কিছু তা কখনই স্বাভাবিক হয় না। পরে নিজের স্বভাব প্রকাশ পাবেই, তাতে বরং অধিক মাত্রায় অপদস্থ হতে হয়। স্বভাব যে দুরতিক্রম্য তা উদাহরণদৃষ্টে প্রকাশিত—’ন ক্ষুধাতোহপি সিংহ স্তণঞ্চরতি।’ (২॥৬৪)।
বিশ্বাস জীবনযাত্রায় একটি বড় সহায়। মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে অথবা নিজের বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেললে, কোনো কিছুর দ্বারাই সুখশান্তি কিছুই পাওয়া যায় না। এই চিরন্তন সত্যটির প্রকাশ ঘটেছে ‘প্রাণাদপি প্রত্যয়য়া রক্ষিতব্যঃ।।’ (২॥৬৫) সূত্রে।
মনু ব্যাস প্রভৃতি শাস্ত্রকারগণ বার বার স্মরণ করিয়েছেন যে, শিক্ষাগ্রহণে বর্ণ, বয়স প্রভৃতি বিষয়ে কোনোরূপ বিচার করা উচিত নয়। শিশু হোক, বৃদ্ধ হোক, উচ্চবর্ণ হোক, নীচবর্ণ হোক–সকলের কাছ থেকেই উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। উপনিষেদেও এই নীতিবাক্যমূলক আখ্যান আছে। সেই তত্ত্বমালাই এখানে একটি সংক্ষিপ্ত সূত্রে গাঁথা হয়েছে–‘বালাদপ্যথ জাতং শুশূয়াৎ।’ (২॥৬৭) অর্থাৎ শিশুর কাছ থেকে সদ্বিষয়গুলো শুনবে।
জগতে খল ব্যক্তির কোথাও স্থান নাই। এমন কি বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র পূর্জিত হয় একথা সর্বকালে সত্য। কিন্তু যদি সেই বিদ্বান খল হয় তাহলে তার কোথাও আদর নাই, তাকে সকলেই বর্জন করে। এ কথার সার হলো ‘পিশূন শ্রোতা পুত্রদারৈরপি ত্যজ্যতে।’ (২॥৬৬) সংসারে বাস করতে পারস্পরিক আচরণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আচরণ কেবল কার্যানুষ্ঠানমূলক নয়। কথোপকথনমূলক। পারস্পরিক আচরণের অধিকাংশ স্থান অধিকার করে থাকে কথোপকথন বা পরস্পরের বাক্যালাপ। সেই বাক্যালাপ সম্বন্ধে শিক্ষা সর্বাগ্রে গ্রহণীয়। সে বিষয়ে প্রথম ও প্রধান শিক্ষাসূত্র ‘সত্যমপ্যশ্রদ্ধেয়ং ন বদেৎ’। (২॥৬৮) ‘মাব্রুয়াৎসত্যম প্রিয়ম্’। এই ভগবদুক্তির প্রতিধ্বনি।
কারও দোষ বিচার করা যথার্থ মানবিকতার লক্ষণ নয়। বাংলায় প্রবাদ আছে, চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। অর্থাৎ মানুষমাত্রেরই দোষ থাকবে। নির্দোষ জীব জীবজগতে নেই। তাই কে কার দোষ বিচার করবে? এই তত্ত্বগর্ভ সূত্রটি হলো–নাস্তি রত্নমখণ্ডিতম্। সূত্রটি যেন একটি সরল প্রবাদবাক্য।
সংসারে কেউ একাকী বাঁচতে পারে না। বিশেষ করে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। বহুজনকে নিয়েই সমাজ গঠিত হয়। এই বহুজনের মধ্যে থেকেও মানুষকে মানুষ নির্বাচন করতে হয় সে কার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি করবে? এইভাবে সঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই সঙ্গ নির্বাচন করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। কারণ সঙ্গগুণ অত্যন্ত প্রবল। সঙ্গের ফলে একের গুণ বা দোষ অপরের মধ্যে সঞ্চায়িত হয়। তাই নীচ সঙ্গে নীচতা ও সৎসঙ্গে সততা জন্মায়। সচেতন মানুষমাত্রই সঙ্গ ও পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দেয় এই কারণেই। চাণক্য এই শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সূত্র সৃষ্টি করলেন ‘ক্ষীরশ্রিতমুদকং ক্ষীরমেব ভবতি।’ (২॥৭৭) অর্থাৎ দুধমিশ্রিত জল দুধ নামে পরিচিত হয়। ‘রজতমপি কনকসম্পর্কবৎ কনকমেব ভবতি।’ (২॥৭৯)।
সংসারে যা মন্দ, অহিত বা নিন্দনীয়, তা চিরকালই মন্দ, অহিত ও নিন্দনীয়। তার যথার্থ হিতকর রূপান্তর কখনো হয় না। সুতরাং সর্বকালেই এগুলো পরিত্যাজ্য। সূত্রের ভাষায় বলা হয়েছে, ‘বিষং বিষমে সর্বকালম্।’ (৩॥৮৯)।
সংসারের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষণ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ মানুষ সাধারণত স্বার্থপর। তার ফলে প্রায় সমস্ত সম্বন্ধই হয় অর্থনির্ভর। ‘অর্থাধীন এব নিয়তসম্বন্ধঃ’। (২॥৯৩)।
সংসারে বাস করতে মানুষকে কতো প্রকার শিক্ষা নিতে হয় তা গণনা করা সম্ভব নয়। তবে সেগুলির মধ্যে কতকগুলো বিষয় এমন গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলো শিক্ষা না করলে জীবন দুর্বহ হয়ে ওঠে।
সেরকম একটি শিক্ষা হলো–‘আত্মচ্ছিদ্রৎ ন প্রকাশয়েৎ’। (২॥৯৬)। মর্মার্থ হলো যে, মানুষ মাত্রই দোষ থাকবে। আর এই বন্ধুর জীবন পথে মানুষের পদস্খলনও হবে, তবে সেগুলো কখনো নিজ মুখে প্রকাশ করতে নেই। কারণ ‘অজাতশত্ৰু মানুষ’ আমরা সকলে শত্রুপরিবেষ্টিত হয়েই সংসারে বাস করি। নিজ মুখে নিজের দোষত্রুটি, দুর্বলতা ব্যক্ত করলে শত্রুর পক্ষে আঘাত হানা সহজ হয়। তাই নিজের দোষ গোপনই করতে হয়।
তিতিক্ষা ক্ষমা–মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। এই গুণ অর্জনের জন্য শিক্ষা ও অনুশীলনের আবশ্যক আছে। চাণক্য এই দৃষ্টি দৈবীসম্পদস্বরূপ গুণকে অর্জন করারও শিক্ষাসূত্র রচনা করেছেন।
কঞ্চিদপি পুরুষ নাবমন্যেত। (২॥১০৯)। ক্ষমন্তে ইতি পুরুষাণ ন বাধয়েৎ। (২॥১১০)
ধৈর্য মানুষের একটি বিশাল ঐশ্বর্যস্বরূপ। ধৈর্যশীল ব্যক্তি যেমন কপর্দক শূন্য অবস্থা থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারে, অপরপক্ষে ধৈর্যহীন ব্যক্তি বিপুল ঐশ্বর্যশালী হয়েও সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। সে সম্পর্কেও সূত্রকার অনবধানতা প্রদর্শন করেননি।
এবার মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে নির্দেশাত্মক একটি তত্ত্বনির্ভর সূত্র—’দানং নিধানমনুগামি’ (৩॥১৩) । নিজের ধন অনুসারে দান করা উচিত। অর্থাৎ নিজের সাধ্যের অতীত কোনো কাজে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নয়, নিজের সম্পদের অতিরিক্ত দান করতে গেলে যেমন ঋণভারে জর্জরিত হয়ে অবমাননার পাত্র হতে হয়, অনুরূপ সাধ্যাতীত কার্যে প্রবৃত্ত হলে উপহাসিত হওয়া ছাড়া অন্য ভালো কিছু প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
এই কার্যসঙ্কুল সংসারে সব সময়ই কোনো না কোনো কার্য থাকেই, সে সময় বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু এমন সময়ও আছে, যখন একাধিক কাজ যুগপৎ এসে যায়। তখনই সমস্যা কোন কাজটি করবে আর কোনটিকে উপেক্ষা করবে। এক্ষেত্রে চাণক্যের সহজ নির্দেশাত্মক সূত্র—’কাৰ্যবহুত্বে বহুলমায়তিকং বা কুর্যাৎ’ (৩॥১৬) অর্থাৎ সে স্থলে মানুষের বিচার্য হবে, যে কোনো কাজটির পরিণাম ভালো–ফল সুদূরপ্রসারী, সেই কাজটিই তখন করণীয়।
পৃথিবীতে ধর্ম ব্যতীত কোনো কিছুর সার্থকতা সম্ভব নয়। মানুষ যে সুখ, সুখ করে সুখের খোঁজে জীবনপাত করে চলেছে, সেই সুখেরও মূল হলো ধর্ম। সূত্রের ভাষায়–সুখস্য মূল্যং ধর্ম। (১॥২)। তাই কোনো মানুষের কখনো ধর্মকে অবজ্ঞা করে ধর্ম ত্যাগ করা বা ধর্মের হানি ঘটানো উচিত নয়। আচার্য মানুষকে ধর্মে প্রবৃত্ত ও অনুরাগী করতে ধর্মের শ্রেষ্ঠতামূলক প্রণয়ন করেছেন, ‘ধর্মেণ ধার্যতে লোক’ (৩॥২৩) ধর্মের দ্বারা জগৎ বিধৃত। ধ্রিয়তে অনেন ইতি ধর্ম–সুতরাং যার দ্বারা জগৎ বিধূত–তাকে তো আর কেউ ছাড়তে পারে না। তবে জগদাধার ধর্মকে রক্ষণ ও পালনের দ্বারা মানুষের নিজেকে মনুষ্যত্বের অধিকারী করা উচিত। এই তত্ত্বটি অনুভব করাবার জন্য আচার্য ধর্মের প্রশস্তি তথা বৈশিষ্ট্যমূলক সূত্র প্রণয়ন করলেন, ‘প্রেতমপি ধর্মাধর্মাবনুগচ্ছতঃ’। ‘ধর্মমূলে সত্যদানে’। ‘ধর্মের জয়তি লোকান্’। (৩॥২৪॥২৬॥২৭)।
ধর্ম পালনে যদি তথাপি কেউ নিরস্ত হয়, তাই তার বিপরীতটি কীরূপ? তাও সূত্রাকারে বিধূত হয়েছে—’ধর্মাদ্বিপরীতঃ পাপ’। (৩॥৩১)। তার ফল? ‘মহতী প্রসজ্যেত’। (৩॥৩২)। অর্থাৎ সে ধর্ম থেকে সুকীর্তি জন্মায় সেই কীর্তি-দাতা ধর্মের অবমানন্য ঘটে। আর পাপ নিজের বিনাশ পর্যন্ত সূচনা করে। ‘আত্ম বিনাশং সূচয়ত্যধর্ম বুদ্ধিঃ’। (৩॥৩৫)
সংসারে বাস করতে হলে যেমন সঙ্গ নির্বাচনে প্রয়োজনের প্রয়োজন আছে, সেরূপ কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে পরিহার করবে সে সম্পর্কেও জ্ঞান আবশ্যক। আচার্য সে সম্পর্কে শিক্ষাসূত্র করেছেন—’নাস্তি চোরেষু বিশ্বাস’। (৩॥৪৪)
দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হয়েছে ধৈর্যহীনতার অপবাদ সম্পর্কে। তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে ধৈর্যের অর্থবাদমূলক সূত্র দিয়ে–ধূত্যা জয়তি রোগান্। (৩॥৪) ধৈর্য মনুষ্যত্ববিকাশের উল্লেখযোগ্য সহায়। ধৈর্য শক্তির দ্বারাই মানুষ কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি অন্ত রিপুগুলোকে জয় করতে পারে। আর তার ফলে মানুষ হয় সুস্থ, সবল। সুতরাং এইটি কেবল সূত্র নয়, এটি মানুষের জীবনে মন্ত্রস্বরূপ।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে সঙ্গ সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বনির্ভর সূত্র রচিত হলেও এস্থলে সূত্রকার সরাসরি নির্দেশ দিয়ে সূত্র করেছেন—’ন দুর্জন সহ সংসর্গই কর্তব্যই’। (৩॥৪)। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সঙ্গ থেকে দোষগুণ সংক্রমিত হয়। তাই মানুষের দুর্জনের সঙ্গ সর্বদা পরিত্যজ্য–একথা সকল নীতিশাস্ত্রজ্ঞ স্বীকার করেন। এ বিষয়ে শাস্ত্র স্তরেও কোনো মতবৈষম্য নেই।
এরপর জীবের জীবনরক্ষার যেটি অপরিহার্য উপাদান–আহার সে সম্পর্কে নির্দেশ ও অপরিহার্য মনে ভেবে আচার্য সূত্র রচনা করেছেন, ‘মিতভোজনং স্বাস্থ্যম্।’ (৩॥৯৭) মানুষ মাত্রই অন্নগত প্রাণ, তাই প্রাণ রক্ষার জন্য অন্ন গ্রহণ আবশ্যিক কার্য। আবার এ কথাও স্মরণীয় যে, মানুষের স্বাস্থ্যই সম্পদ। বিশেষ করে ‘শরীরমাদ্যং খলুধর্মসাধনম’–এই কবিবাক্যও উপেক্ষণীয় নয়। সুতরাং আহার্য কীভাবে গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যনামক সম্পদটি অক্ষুণ্ণ থাকে, সে সম্বন্ধে রচিত আচার্যের সূত্রটি সর্বজনস্বীকার্য। কেবল পরিমিত আহারই নয়, সেই সঙ্গে মানুষের ভক্ষাভক্ষ্য সম্বন্ধে বিচার করারও আবশ্যক আছে। ‘ভক্ষ্যমপ্য পথ্যং নাম্নীয়াৎ’। (৩॥৮)
আহার জীবন রক্ষা করে আবার সময় বিশেষে জীবনকে গ্রাস করে সে সম্পর্কে সতর্কতামূলক সূত্র—’অজীর্ণে ভোজনং বিষম্’। (৩॥১০) অর্থাৎ ভূক্তদ্রব্য পরিপাক না হলে যদি ভোজন করা হয়, তাহলে পুষ্টিদায়ক খাদ্যও বিষতুল্য কার্য করে।
শরীরভিত্তিক আর একটি বিশেষভাবে মনে রাখার মতো সূত্র হলো শরীরে বর্ধমানো ‘ব্যাধিনোপেক্ষ্যেত’। (৩॥১১)। মানুষের বা কিছু করণীয়–সবই সম্পন্ন হয় শরীর দ্বারা, যতো কিছু ভোগবিলাস সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্য সমস্তই শরীর-আধারে থাকে। সেই শরীরটিতে যদি ব্যাধি এসে উপস্থিত হয়, তাহলে কখনই উপেক্ষা করা উচিত নয়। কারণ ব্যাধি দেহমন্দিরটিকে বিধ্বস্ত করে দিলে হাজার সুখের উপাদানও সুখ সৃষ্টি করতে পারে না।
অর্থকে অনর্থের মূল বলা হলেও, অর্থই যে আবার প্রকারান্তরে পরমার্থের মূল সে বিষয়ে আচার্য প্রথমেই সূত্র রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে পুনরায় প্রসঙ্গক্রমে অর্থোপার্জনে মানুষের জড়তা ও ঔদাসীন্য দূর করবার জন্য অন্যান্য নীতিশাস্ত্রকারের অনুরূপ সূরে নীতিসূত্রে রচনা করেছেন—‘অজরামরবদর্থমর্জয়েৎ’। (৩॥৪৭) অর্থাৎ অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকার জন্য কোনো অজুহাতই স্বীকার্য নয়। সেক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে অজর, অমর ভেবে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাবে। এই সূত্রটির মধ্যে কর্মপ্রেরণাও নিহিত আছে। এখানে মানুষকে অর্থ লাভে উৎসাহিত করার জন্য অর্থের অর্থবাদমূলক হলেও জাগতিক সত্য বিষয়ক তিনটি সূত্র প্রণয়ন করেছেন–১. ‘অর্থবার্ন সর্বলোকস্য বহুমত’। (৩॥৪৮)। ধনী ব্যক্তিকে লোকে আদর করে। ২. ‘মহেন্দ্রমপ্যথ হীনমবমন্যতে লোক’। (৩॥৪৯) ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী হয়েও অর্থহীন হলে লোকে অবজ্ঞা করে। ৩. ‘বিরুপোহপ্যর্থবান সুপুরুষ’। (৩॥৫০) অর্থবান লোক কুৎসিত দেখতে হলেও লোকে তাকে সুপুরুষ বলে থাকে। অর্থাৎ এক অর্থ বহু জিনিসের ন্যূনতা ও হীনতাকে নাশ করতে পারে। জগতে নিজের সুখ প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এ শিক্ষা অবশ্য গ্রহণীয়। নারায়ণ শর্মাও অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন—’ধনবান্ বলবান্ লোকে ধনাদ্ভবতি পণ্ডিত’।
চৌর্যবৃত্তি প্রায় মানুষের সহজাত বৃত্তি। কিছু এই দোষটি মানুষকে সমাজে নিন্দিত ও অবিশ্বস্ত করে তোলে। তাই এই বৃত্তিটিকে মানুষ মাত্রেরই দমন করা উচিত। ‘পরবিভবাদবো বিনাশমূলম’। (৩॥৫৬) পরের সম্পদে আদর ও আসক্তি থেকেই চৌর্যবৃত্তির জন্ম। তাই পরদ্রব্যে কখনো আসক্তি বা আদরকে মনে স্থান দিতে নেই। কারণ চৌর্যবৃত্তি জন্মালে আত্মনাশ অবশ্যম্ভাবী। সে কথাটিও আচার্য স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি—‘পরদ্রব্যাপহরণমাত্মদ্রব্যবিনাশহেতু’ (৩॥৫৮) অর্থাৎ চৌর্যবৃত্তির ফলে পরের দ্রব্য হরণ করে যা আহরণ করে, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে নিজের দ্রব্যের হানি ঘটবে। কারণ তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ার ফলে তার জীবিকার্জনের সমস্ত পথই বন্ধ হয়ে যাবে। ক্রমে ক্রমে তাকে অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে হবে। চাণক্যের উক্ত সূত্রগুলো তমসাচ্ছন্ন জীবনপথে উজ্জ্বল দীপালোকের তুল্য। কেবল জীবনধারণের জন্য বলে যে চুরির স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে, তাদের সে যুক্তিনাশের খড়গতুল্য সূত্র—’যবাগুরপি প্রাণধারণং করোতি কালে’। (৩॥৬০)। সময়ে যবের কণা আহার করেও প্রাণধারণ করা যায়। চরম ও শেষ নির্দেশ ‘ন চৌর্যাৎ পরং মৃত্যু পাস’। (৩॥৫৯) চৌর্যবৃত্তির থেকে মৃত্যুপাশ অধিক ক্ষতিকর নয়। অর্থাৎ মানবজীবন ধারণ করে পরের দ্রব্য হরণ করার থেকে মৃত্যুবরণ শ্রেয়ঃ। আচার্যের এ নির্দেশ জনমনে যতো বেশি মাত্রায় প্রতিফলিত হবে, ততই আমাদের সমাজ, সংসার সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। বর্তমানে আচার্যের এ নির্দেশ সমাজের অধিকাংশ মানুষই ভুলে গিয়ে অসামাজিক হয়ে সমাজকে ধ্বংস করছে।
ভারতীয় শিক্ষার একটি বৈশিষ্ট্য হলো–অধিকারী ভেদে শিক্ষাদান। বৈদিক যুগ থেকে ভারতীয় শিক্ষানীতিতে এই রীতির প্রচলন আছে। আধুনিককালের মানুষ প্রাচীন শিক্ষানীতির এই তত্ত্ব না জেনেও দেখা পদ্ধতির হেরফের ঘটিয়ে বহু ক্ষেত্রে এই রীতিকে মেনেও প্রকৃত ভারতীয় শিক্ষা অর্থাৎ, বেদাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংরক্ষণ’ মৌলবাদ প্রভৃতি কতকগুলো শেখানো বুলি আউড়ে ভারতীয় শিক্ষানীতির মুন্ডপাত করে থাকে। কিন্তু জয়েন্ট এন্ট্রান্স সেলেট, নেট প্রভৃতি পরীক্ষাগুলোও অধিকারী নিৰ্ণায়ক। সকলকেই তো চিকিৎসাবিদ্যা কারিগরি বিদ্যা, বাস্তুবিদ্যা, প্রভৃতির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। না দেওয়াই স্বাভাবিক এবং যথার্থ। সকলের দ্বারা সকল রকম বিদ্যাশিক্ষা সম্ভব নয়। অধিকারী অনুসারে বিদ্যা গ্রহণ করলে বিদ্যা যথার্থ ফলবর্তী হয়, না হলে বৃথা শ্রম বা বিপরীত ফলদান করে। আচার্য এই তত্ত্বটি একটি ছোট্ট সূত্রে প্রকাশ করলেন ‘নীচস্য বিদ্যা পাপকর্ম না যোজয়তি’। (৩॥৬৩) এই সূত্রটি আধুনিক রাষ্ট্রনেতা ও শিক্ষানীতি রচয়িতাদের জানা থাকলে শিক্ষার ক্রমাবনতি দূর হতো।
ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যায় উন্নতি ঘটিয়ে শিল্পো যথেষ্ট প্রাধান্য বিস্তার করলেও উন্নতির মূলসূত্রটি নিহিত আছে কৃষিতে। এই সত্যটি ভারতবাসীর সর্বদা স্মরণে রাখার জন্য আচার্য সূত্র প্রণয়ন করলেন, ‘ন হি ধান্য সমোহৰ্থঃ’ (৩॥৬৬)। ধানের সমান কোনো অর্থ হয় না। নিজেদের নৈসর্গিক এই সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই সম্পদকে বর্ধিত করার জন্য এই সূত্ররূপ মন্ত্রটি প্রতিটি ভারতবাসীর স্মরণে রাখা উচিত।
জীবনমাত্রেরই ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি এমন কতকগুলো স্বাভাবিক ধর্ম থাকে, যেগুলোর নিবৃত্তি না করা পর্যন্ত জীব তৃপ্তি পায় না। সেই স্বাভাবিক ধর্ম বা প্রবৃত্তিগুলোর নিবৃত্তি সাধন করতে অনেক সময়ই জীব অধম আচরণ করে থাকে। এরূপ নিবৃত্তি পরায়ণতা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য প্রণীত হয়েছেন ‘ন ক্ষুধাসমঃ শত্রু’। (৩॥৬৭)। ‘কারণ নাস্ত্যভক্ষ্যং ক্ষুধিতস্য’ (৩॥৬৮) ক্ষুধা জীবের এমন একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, যাকে জয় করা যায় না, এবং ক্ষুধার আতিশয্যে জীব ভক্ষ্য অভক্ষ্য, ধর্মাধর্ম বিচার করে না। কিন্তু ক্ষুধাকে জয় না করা গেলেও সাময়িক রোধ করা সম্ভব। তাই প্রতিটি মানুষেরই ক্ষুধার্ত হয়েও অভক্ষ্য গ্রহণ করা উচিত না, আচার্যের ‘ন ক্ষুধাসমঃ শত্রু’ সূত্রটি মনে রেখে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেও স্বধর্ম পালনই মানুষের কর্তব্য।
.
জরা সম্পর্কে রচিত সূত্রদৃষ্টিতে কামশাস্ত্রের সারকথা হিসাবে গ্রহণ করা যায়।
ইন্দ্রিয় জয় মানুষের বড় গুণ। সমস্ত ইন্দ্রিয় জয় করা রোগীদের দ্বারাও অনেক সময় সম্ভব হয় না, সাধারণ মানুষের কথা তো ছার। তবে যে রিপুটি মানুষকে অধিকমাত্রায় ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়, তার নাম কাম। এই কামকে সর্বতোভাবে জয় করা না গেলেও সাংসারিক মানুষের উচিত সম্পূর্ণরূপে কামের পরাধীন না হওয়া। সে কথারই সংকেতমূলক সূত্র হলো– অগম্যগমনাদায়ুর্ষশঃ পুণ্যানি ক্ষীয়ন্তে। (৩॥৭৬)।
পরবর্তী ক্ষতিকারক রিপু অহংকার। সেটিকে যতদুর সম্ভব সংযত করার জন্য নির্দেশাত্মক সূত্র ‘নাহংকারসম শত্রু’। (৩॥৭৭)
চতুর্থ অধ্যায়ের প্রারম্ভেই দারিদ্র্যের অপবাদমূলক সূত্র দিয়ে আচার্য মানুষকে দারিদ্র্য জয় করার জন্য সচেষ্ট হতে নির্দেশ দিয়েছেন। আচার্যের সূত্র ‘হিতমপ্য-ধনস্য বাক্যং ন গুণোতি’। (৪॥২) নির্ধনের হিতকর বাক্যও কেউ শোনে না। এবং ‘ধনহীন স্বভার্ষয়া অবমন্যতে’। (৪॥৩)। দরিদ্রকে নিজের স্ত্রী অবজ্ঞা করে। তৃতীয় অধ্যায়ে অর্থ প্রসঙ্গে সূত্রকার বলেছেন অর্থ না থাকলে ইন্দ্রের তুল্য শক্তিশালী ব্যক্তিকেও মানুষ আদর মনে করে না। এখানে আরও কঠোরভাবে বলা হচ্ছে যে, প্রাণের প্রিয়তমা ভার্যা সেও অর্থহীনকে অবহেলা করে। অর্থাৎ সূত্রকার দারিদ্র্যের অপবাদমূলক পরপর চারটি সূত্র প্রণয়ন করে জগদ্ববাসীকে এই শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন যে, নিজের পুরুষকার সাধ্যমত নিয়োগ করে যেন দারিদ্র্য থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। দারিদ্র্য মনুষ্যজীবনের একটি দুর্বহভার বা দুঃসহ অভিশাপ।
তারপর চারটি সূত্রে আছে বিদ্যার অর্থবাদ। বিদ্যাপ্রশস্তি চাণক্যের নীতিশাস্ত্রে আরও বহুসংখ্যক আছে। এটি যেহেতু সূত্রগ্রন্থ, তাই এখানে পরিমিত অক্ষরে পরিমিত সংখ্যায় সে কার্যটি সম্পাদন করা হয়েছে। মানুষ মাত্রেই অর্থ ও যশ কামনা করে। সেই সঙ্গে মানুষ চায় যে, ঐ দুটি জিনিস যেন তার কোনোভাবে নষ্ট না হয়। চাণক্য মানুষকে এই কামনা চরিতার্থ করার জন্য বিদ্যারদিকে সংকেত করেছেন ‘বিদ্যা ধনমধনানাম্’। (৪॥৫) যার পার্থিব কোনো সম্পদ না থাকে, তার বিদ্যাই সম্পদ। কারণ বিদ্যা থাকলে ধন অবশ্যই তার অনুগমন করবে। আবার ‘বিদ্যুয়াখ্যাতিঃ’। (৪॥৭) বিদ্যা থেকেই যশঃপ্রাপ্তি ঘটে। বিদ্বদজনের কীর্তিকথা শত্রুও কীর্তন করে। আর বিদ্যা প্রতিপাদ্য অর্থ ও যশের কখনো বিনাশ হয় না, কারণ বিদ্যা চোরেও চুরি করতে পারে না। ব্যয়েও ক্ষয় হয় না। অতএব এই সূত্রত্রয়ের মূল লক্ষ্য হলো—’মানুষের বিদ্যার্জনে অবহেলা করা উচিত নয়।’
এরপর দুষ্টি নিবৃত্তিমূলক সূত্র—’নীচস্য বিদ্যা নাপ্তব্যা।’ এবং ‘ন ম্লেচ্ছ ভাষণং শিক্ষেত।’ (৪-১২॥১৩) অর্থাৎ চৌযাদি নীচ বিদ্যাগুলো শেখা উচিত নয়। কারণ তার থেকে খ্যাতির পরিবর্তে অখ্যাতিই আসে। আর যে ভাষায় শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনো পরিচয় নিহিত নাই–সে ভাষা শিক্ষাও বৃথাশ্রমমাত্র। তাই এ দুটি বিষয় থেকে মানুষের নিবৃত্ত থাকাই বিধেয়।
দুটি নিবৃত্তিমূলক সূত্রের পরই আছে দুটি প্রবৃত্তিমূলক সূত্র—’শত্রোরপি সদ্গুণোগ্রাহ্য। বিষাদপ্যমূতং গ্রাহাঃ।’ (৪॥১৪-১৫)। শত্রুরও গুণটিকে গ্রহণ করবে এবং বিষ থেকেও অমৃতটুকু নেবে। অর্থাৎ মানুষকে সব সময় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে কাজ করতে হয়। মানুষের উচিত, যা কিছু ভালো তাকে গ্রহণ করা। গুণকে মর্যাদা দিয়েই মানুষ গুণী হতে পারে। শত্রু হোক মিত্র হোক– যার যতোখানি গুণ আছে ততোখানি মর্যাদা না দিলে নিজের বিচারবুদ্ধিরই অভাব দেখানো হয়। আর উত্তম জিনিস পাওয়ার জন্য ক্ষেত্র বিচার্য নয়। বস্তুটিরই গুণ বিচার্য। পদ্ম পাঁকে হয়েও যেমন উত্তম গুণ ও সৌন্দর্যবশত সকলের গ্রহণীয়, সেরূপ যেকোনো উত্তম বা বস্তু যে ক্ষেত্রেই থাকুক না কেন, তাকে নিঃসংশয় গ্রহণ করা উচিত। এরূপ আচরণের দ্বারা নিজের বুদ্ধির উৎকর্ষণই প্রকাশ পায়।
এরপর কয়েকটি বিধিনিষেধমূলক সূত্র মিশ্রিত হয়ে আছে। সেই সঙ্গে কয়েকটি পরিচিতিমূলক সূত্র আছে যা কণ্ঠে ধরে রাখার উপযোগী। যেমন—’ন স্ত্রীরত্মৎ সমং রত্নম’। (৪॥২০)। ‘অযশোভয়ং ভয়েষু’। (৪॥২৫) যতপ্রকার ভয় আছে সেগুলোর মধ্যে অপযশটি বড় ভয়। কারণ অন্য ভয়ের প্রতিকার আছে, এ ভয়ের কোনো প্রতিকার নেই। এ সূত্রের মূল উদ্দেশ্য-অপযশমূলক কার্য থেকে মানুষ যেন সর্বদা বিরত থাকে।
স্ত্রীজনের প্রতি আসক্তি পুরুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির অনুরূপ। তার ভয়াবহ পরিণতি যে চিন্তা করে না, তাকেই দুর্গতি ভোগ করতে হয়। এরূপ দুর্গতি থেকে মুক্ত থাকার মতো শুভ বৃদ্ধি সঞ্চয় করার উদ্দেশ্যে সূত্রকার বলেছেন, ‘স্ত্রিয়োহপি স্ত্রৈণমবমন্যন্তে।’ (৪॥২৮) যারা সর্বদা রমণীতে আসক্ত থাকে, তারা কামুক এবং অসচ্ছরিত্র বলে পরিচিত হয়। তাই তাদের প্রতি রমণীরাও আদরশীলা হয় না, উপরন্তু অবজ্ঞা ঘৃণা প্রদর্শন করে। সুতরাং পুরুষের কখনো অনুরূপ দোষদুষ্ট হওয়া উচিত নয়।
চরিত্র গঠনের উপযোগী একটি সূত্র—’ন মহাজন্যে হাস্যকর্তব্য।’ (৪॥৩১)। মহাজনকে পরিহাস করা উচিত নয়। মহাজনের আচরিত পথে চলেই মানুষ কীর্তিমান হবে–এই নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ। সেই নির্দেশটিই সূত্রকার নিষেধাত্মক সূত্র দ্বারা প্রকাশ করেছেন।
নীতিশিক্ষার সঙ্গে মহামতি চাণক্য জ্যেতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষালাভ করা বাঞ্ছনীয় সেই কথাটি বোঝানোর জন্য সম্ভবত দুটি সূত্র প্রণয়ন করলেন, নক্ষত্রাদি-নিমিত্তানি বিশেষয়ন্তি। (৪॥৩৪)। ন ত্বরিতস্য নক্ষত্র পরীক্ষা। (৪॥৩৫)।
স্বভাব সম্পর্কে সূত্রকার পুনরুক্তি করেছেন ‘স্বভাবো দুরতিক্রমঃ’। (৪॥৩৮)। সমাজে পরিপূর্ণ সামাজিকরূপে পরিচিত হতে হলে পরস্পর বাগবিনিময় পদ্ধতি জানা অত্যাবশক। এ প্রসঙ্গে চাণক্যের ‘কথানুরূপ প্রতিবচনম’। (৪॥৪০)। সূত্রটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
দানের যথেষ্ট প্রশস্তি থাকলেও অপাত্রে দানের কোথাও প্রশংসা নেই। সমস্ত নীতিশাস্ত্রেই সৎপাত্রে দানের উল্লেখ আছে। সে কথাটিই কৌটিল্য স্মরণ করিয়েছেন, ‘পাত্রানুরূপং দানম্। (৪॥৪৪) সূত্রটির দ্বারা।
সমাজে বসবাসকারী মানুষের অঙ্গসজ্জার অর্থাৎ সাজ-পোশাক, প্রসাধন প্রভৃতির কিছু বিচার বৈশিষ্ট্য আছে। বয়স, বৃত্তি প্রভৃতি অনুসারে বেশভূষা ধারণের রীতি সর্বজনস্বীকৃত। একটি কিশোরকে যে পোশাকটি সুন্দর করে তোলে, সেই পোশাকটি বৃদ্ধকে করে পরিহাসের পাত্র। তাই বেশভূষা ধারণের জন্য চাণক্যের ‘বয়োনুরূপো বেশঃ’। (৪॥৪৫)। সূত্রটি সমাজবিজ্ঞানের নীতিসূত্র হিসেবে স্বীকার্য।
সমাজ তথা সংসারে তখনই সুখ ও শান্তি বিরাজ করে, যখন পরস্পর পরস্পরের অনুকূল হয়। এই আনুকূল্যের একটি সমাজানুমোদিত রীতি আছে। সেই রীতিটি হচ্ছে–বশ্যতা। কে কার বশীভূত হলে সংসার শান্তির নীড় বা আনন্দ-কানন হয়, সেকথা সামাজিকদের মনে রাখার জন্য চাণক্য পর পর তিনটি সূত্র রচনা করেছেন। ‘ভর্তা বশবর্তিনী ভার্যা’। ‘গুরুবশানুবর্তী শিষ্য’ ও ‘পিত্যবশানুবর্তী পুত্রঃ’। (৪॥৪৭-৪৯)। এই সূত্র তিনটি নারী-পুরুষ মনে রাখলে সমাজে উদ্ধৃঙ্খলতা কখনই প্রবেশ করতে পারবে না।
সন্তানের ভুল ধারণার বশে অনেক সময় মাতা-পিতার প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মায়। যা সন্তান ও সংসারের প্রতি অত্যন্ত অমঙ্গলকর। সন্তানের সেরূপ ভ্রান্তি অপনোদনমূলক সূত্রটি হলো ‘স্নেহবতঃ স্বল্লোহপি রোষঃ’। (৪॥৫__?) রুষ্ট পিতার প্রতি সন্তান অনেক সময় বিদ্রোহী হয়ে পিতার বিরুদ্ধাচরণ করে সংসারে অশান্তির দাবদাহ সৃষ্টি করে। কিন্তু যে সন্তান চাণক্যের এই সূত্রের মমার্থ উপলব্ধি করতে পারে, সে কখনো পিতার ক্রোধ দেখে নিজেকে অশান্ত বিদ্রোহী করে তোলে না। সে জানে যে, পিতার ক্রোধ ক্ষণস্থায়ী এবং সে ক্রোধ কখনো সন্তানের অমঙ্গল করে না।
প্রবচনের মতো কণ্ঠে ধরে রাখার যোগ্য একটি লক্ষণমূলক সূত্র ‘আত্মচ্ছিদ্রং ন পশ্যতি পরচ্ছিদ্রমেব বালিশঃ।’ (৪॥৫৩)। এই মূর্খের লক্ষণটির বাস্তবে বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হয় না। যে যতো বড় মূর্খ, সে ততোখানে পরনিন্দুক হয় এবং নিজের প্রতিপদে কৃত দোষ দেখতে পায় না। সুতরাং এরূপ আচরণ দ্বারা মানুষ চেনাও সহজ হয়।
মহামতি চাণক্য পূর্ববর্তী অধ্যায়েই কার্যে ক্ষিপ্রত্যয় সুফল এবং দীর্ঘসূত্রতার কুফল সম্পর্কে কয়েকটি সূত্র প্রণয়ন করেছেন। এখানে প্রায় সেই কথাগুলো সামান্য ভিন্নভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, যেমন আগামীকাল হাজারকড়ি পাওয়ার আশার থেকে আজকের পাওয়া একটি কড়িও ভালো। ‘স্বঃ সহস্রদদ্য কাকিনী শ্রেয়সী’ ‘শ্বো ময়ুরাদণ্য কপোতা বরঃ’। (৪॥৫৮॥৫৯)। এছাড়াও এই অধ্যায়ে ক্ষমা ও উদ্যম সম্পর্কে যে দুটি সূত্র আছে, সেগুলো পূর্বসূত্রের প্রতিধ্বনির মতো।
ঐশ্বর্য মানুষের সকল কামনাকে চরিতার্থ করতে সাহায্য করে। ঐশ্বর্যবিহীন জীবন অত্যন্ত বিড়ম্বনাময়। মানুষের কাম্য চতুর্বর্গের মধ্যে ঐশ্বর্য কেবল অন্যতমই নয়, অপর ত্রিবর্গের সাধকও। কিন্তু সেই ঐশ্বর্যের মধ্যে থাকার মনুষ্যত্ব বিঘাতক দোষও আছে। ঐশ্বর্য যেমন সুখ-শান্তি দান করতে পারে, সেরূপ আবার দম্ভ, অহংকার প্রভৃতি আসুরিক গুণগুলো সৃষ্টি করে মানুষকে অধোগামী করে। ঐশ্বর্যের ঐ দুষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো মনে রাখলে নিজেকে সংযত করার একটা চেষ্টা থাকে। তাই চাণক্যের ‘নাস্ত্যপিশাচমৈশ্বর্যম্’। (৪॥৬৫)। সূত্রটিকে ধনবানদের অবশ্যই মন্ত্রের মতো মনে ধরে রাখা উচিত।
যায় যতো ঐশ্বর্য তার কার্যবহুল্যও ততো বেশি। কিন্তু ঐশ্বর্যবান হলেই তো আর কার্তবীর্যানের মতো সহস্র বাহু হবে না, যে নিজেই হাজার হাতে সমস্ত কার্য করবে। তাই ভৃত্য অনুচর প্রভৃতি নিয়োগ করতেই হয়। সেক্ষেত্রেও ঐশ্বর্যশালীদের ‘যস্মিন কর্মাণি যঃ কুফলঃ স তস্মিন নিযোক্তব্যঃ’। (৪॥৬৮)-এই চাণক্য সূত্রটিকে অক্ষরে অক্ষরে মান্য করা উচিত।
৭৬তম থেকে ৮০তম পর্যন্ত সূত্রগুলোতে অলঙ্কার অর্থাৎ কার কোনটি শোভাবর্ধন সেই কথাগুলো নিহিত আছে। যেমন ‘বিপ্রাণাং ভূষণং বেদঃ’। ‘স্ত্রীণাং ভূষণ লজ্জা’। ‘সর্বেষাং ভূষণং ধর্মঃ’। এই সূত্রগুলো আবার সভায় প্রযুক্ত বচনের ভূষণস্বরূপ।
মানুষের আহার ও বাসস্থান অপরিহার্য। কেবল আহার পেলেই মানুষের পক্ষে জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। বনের পশুদের ঘরবাড়ি না থাকলেও একটি নির্দিষ্ট বাসস্থান থাকে। নিকৃষ্ট প্রাণী পোকামাড়ক, পিপড়া প্রভৃতির বাসস্থান আছে। ক্ষেত্রে মানুষের বাসস্থান থাকা অবশ্য বিধেয়। তবে পশুপক্ষীদের বাসস্থান নির্ধারণের একটি মাত্র শর্ত, স্থানটি তার পক্ষে নিরাপদ হওয়া চাই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একাধিক শর্ত থাকে। চাণক্য সেই শর্তগুলো সূত্রাকারে উল্লেখ করেছেন–১. ‘অনুপদ্রবং দেশমাবসে’। ‘সাধুজনবহুলো দেশঃ’ (৪॥৮১-৮২) এই সূত্রগুলো মনে রেখে বাসস্থান নির্ধারণ করলে বাসভূমিকে কখনো বিষয়ভেবে স্থানান্তরে যাওয়ার চিন্তা করতে হয় না।
সামাজিক মানুষকে হাজার রকম আচারবিধি মেনে চলতে হয়। সমাজের স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা নির্ভর করে আচরণের উপরই। মানুষ যদি ক্রমাগত আচরণবিধি লঙ্ঘন করে স্বেচ্ছাচারী হতে থাকে, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা স্বতঃই সৃষ্টি হবে। তাই চাণক্য বিভিন্ন বিষয়ে সূত্র রচনার মধ্যে মধ্যে শ্লোকে যতির মতো আচরণবিধি সম্পর্কিত সূত্র প্রণয়ন করেছেন। যেমন—’রিক্তহস্তোন রাজানমভিগচ্ছেৎ’। ‘গুরু দৈবষ্ণ’। (৪॥৮৬-৮৭) সুসামাজিক হিসেবে পরিচিত হতে চাণক্যসূত্রে বিস্তৃত এই আচরণমূলক সূত্রগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। সুসামাজিক হওয়ার বিধিবোধক আর একটি সূত্র, ‘কুটুম্বার্থং পুত্রস্ত্যজ্যতে’। (৪॥৯৫)।
আবার সাংসারিক জীবনে কর্তব্যমূলক বিধি সম্পকীয় সূত্র—’পুত্ৰা বিদ্যানাং পারংগময়িতব্যাঃ’। (৪॥১০০) অর্থাৎ সন্তানকে কেবল পেটপুরে খাবার ও পছন্দমতো চাকচিক্যময় পোশাক দিলেই পিতার কর্তব্য পালন করা হয় না। পিতার সর্বাগ্রে কর্তব্য পুত্রকে সুশিক্ষিত করা। কারণ পুত্ৰই একমাত্র বংশকে প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর কয়েকটি বিক্ষিপ্ত সূত্র আছে, এগুলোর মধ্যে কোনোরূপ প্রাসঙ্গিকতা অর্থাৎ প্রসঙ্গের নিয়মানুবর্তিতা নেই। তবে তত্ত্বসৌন্দর্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।
চাণক্যসূত্র গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে মোট ১১৩টি সূত্র আছে। সূত্রগুলো সমাজনীতিবিষয়ক। মুখ্যতঃ রাষ্ট্র হলো সমাজেরই বৃহত্তমরূপ। তাই নীতিসূত্রকারের অন্তরে রাষ্ট্রচিন্তার স্থান হলেও সমাজনীতিকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি জানতেন যে, মানুষ যদি যথার্থ সামাজিক হতে না শেখে, তাহলে মানুষ কখনই সুনাগরিক হতে পারবে না। তিনি সমাজনীতিবিষয়ক সূত্র রচনার শুরু করেছেন সংসারের একেবারে প্রধান অঙ্গটিকে অবলম্বন করে। সমাজ সৃষ্টিরও গোড়ায় আছে ব্যষ্টিরূপে সংসার। আর সেই সংসারের প্রধান অঙ্গ হলো স্বামী-স্ত্রী। সেই স্ত্রীর উপযোগিতা সম্পর্কে সূত্র হলো ‘পুত্ৰার্থাহিস্ত্রিয়’। (৫॥১)। দারপরিগ্রহ আত্মসুখ চরিতার্থের জন্য নয়, স্ত্রী গ্রহণ করা হয় বংশরক্ষার জন্য বিধাতার সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে সার্থকতা দানের জন্য।
সংসারে সুখ-দুঃখ দুই থাকবে। এ দুটিকে স্বীকার করে নিয়েই মানুষকে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতে হয়। এই সাধারণ সত্যটিকে বোঝার জন্য ‘নাস্তি দেহিনাং সুখ-দুঃখাভাব’। (৫॥৪) সূত্রটিকে মনে ধারণ করা উচিত।
পরোপকার করা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। এই গুণটির দ্বারা মানুষ সকলের মনের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। তথাপি পরের উপকার করার সময় যার উপকার করতে হবে তার স্বভাব-চরিত্র বিচার করতে হয়। তার কারণ হিসেবে একটি বিশেষ সূক্ষ্মানীতিমূলক সূত্র হলো, ‘উপকারোহনার্যেচ্ছকর্তব্য।’ (৫॥৭)।
পরোপকার সম্পর্কে সূত্রকারের বাক্যে যদি কারও সংশয় বা অশ্রদ্ধা জন্মায়, তার সম্পূর্ণ নিরসন হবে অষ্টম সূত্রে ‘প্রত্যুপকারভয়াদনার্য শত্ৰুৰ্ভবতি’। এর বিপরীতদিকটি প্রদর্শন করেছেন পরবর্তী সূত্রে।
চাণক্য রাজনীতি, সমাজবিষয়ক নীতি, অর্থনীতি, সংসারবিষয়ক নীতি সম্বন্ধে বহু সূত্র রচনা করলেও ধর্মনীতিকে উপেক্ষা করেন না। ১০তম সূত্রটি সম্পূর্ণ ধর্ম বিষয়ক—’ন কদাপি দেবতা অবমন্তব্যা’।
জ্ঞাতব্য দুটি সূত্রের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। চক্ষু সম্পর্কে দুটি সূত্রের মধ্যে কোনো নির্দেশ না থাকলেও উক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেই চক্ষুর প্রতি মানুষমাত্রই যত্ববান হবে। ১৪তম ও ১৫তম সূত্রটি সম্পূর্ণ নির্দেশাত্মক। ১৮শতম সূত্রটি ব্যঞ্জনধর্মী। ‘অগ্নাবগ্নিং ন নিক্ষিপেং’। ৫॥১৮। সূত্রটির বাচ্যার্থ হলো অগ্নিতে অগ্নি নিক্ষেপ করবে না। ব্যঙ্গার্থ হলো প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে কামনার অগ্নি নিরন্তর প্রজ্বলিত হচ্ছে, তার উপর আবার কামনাকে উদ্দীপ্ত করা উচিত নয়।
বৈদিক যুগ থেকে সমস্ত শাস্ত্রই সত্যের প্রশস্তিতে মুখর। বিশেষ করে সত্য এমন একটি জাগতিক বিষয়, যার কোনোরূপ অপবাদ নেই। সেই সত্যের অর্থবাদমূলক সূত্র রচনা থেকে কৌটিল্য অর্থনীতিবিদ হয়েও নিরস্ত হননি। এ বিষয়ে ২৪তম সূত্র থেকে ২৮তম পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি সূত্র রচনা করেছেন। কিন্তু ঐ পাঁচটি অতি সংক্ষিপ্ত বাক্যের দ্বারা সত্য সম্পর্কে সকল শাস্ত্রে বর্ণিত সকল প্রশস্তিই প্রকাশ করেছেন। বিপরীতে পক্ষে মিথ্যার যাবতীয় নিন্দাও একটি সূত্রে প্রকাশ করেছেন–
‘নানৃতাৎ পরং পাপম্’ ॥৫॥২৯ এরপর ৩৮তম সূত্রে সদাচারের প্রশস্তিমূলক বাক্যটি বর্তমানে উন্মার্গগাানী মানুষদের বিশেষ স্মরণীয় ‘আচারাদায়ু বৰ্থতে কীতিশ্চ’। মানুষ মাত্রই দীর্ঘ দিন বাঁচতে চায়। দীর্ঘদিন বললেও ভুল হয়, মরতে চায় না। আবার সেই সঙ্গে যেমন মানুষই হোক, যশ সকলেই চায়। এই দুটি সর্বজনকাম্য বিষয় মানুষ যে অতিসহজেই পেতে পারে–সে কথাই চাণক্য এই সূত্রটির দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। সদাচারের জন্য মানুষকে অতিরিক্ত অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হয় না। কেবল শুভ ইচ্ছাটুকু মনে রাখলেই এটি সম্ভব। আর তার দ্বারা এই একান্তভাবে চাওয়াটিও পাওয়া যায়।
সমাজে সুখে-শান্তিতে বাস করতে হলে কখনই বহুজনের সঙ্গে বিরোধিতা করতে নেই। বহুজনের সমর্থিত মতের বিরোধিতা করলে নিজের মত তো প্রতিষ্ঠিত হয়ই না, উপরন্তু শত্রুবৃদ্ধি পায়। ফলে নিজের জীবনযাত্রানির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। জীবনে নেমে আসে অসহ্য দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তি। এই শিক্ষামূলক সূত্রটি অবশ্যই শিক্ষা করা উচিত, ‘বহু জন বিরুদ্ধমেকং নানুবর্তেত’।
‘শ্রিয়া দেয়ম্ হিয়া দেয়ম্’। শ্রুতিবাক্যটি সহজ কথায় সূত্রকার বলেছেন, ‘নার্থিষু অবজ্ঞা কার্যা’। (৫॥৪৫)। শ্রুতিবাক্যটি বোঝার জন্য গুরুমুখ থেকে যে ব্যাখ্যাটি শোনার প্রয়োজন ছিলো, সেই প্রয়োজনটি পূরণ করা হয়েছে উক্ত সূত্রটির দ্বারা।
সাধারণ প্রবচন শোনা যায়, রোগ আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই। অর্থাৎ এগুলোকে নির্মূল করতে হয়। নচেৎ এগুলো মানুষকে ধ্বংস করে। সূত্রকার এই লৌকিক নীতি অতি কম কথায় আরও বিস্তৃত করে আরও অনেকখানি বড় করে বলেছেন, ‘ঋণাগ্নি-শত্রু বাধিষ্ণশেষঃ’। (৫॥৪৩)।
বারশক্তি যে মানুষের কার্যসাধনের পক্ষে বিশেষ সহায়-সে তত্ত্বটি চাণক্য ৪৮তম থেকে ৫৪তম পর্যন্ত সাতটি সূত্রে প্রকাশ করেছেন। এখানে প্রকাশ ভঙ্গিমাটিও বিশেষ লক্ষণীয়। বারশক্তির মূল প্রকাশ স্থল হলো জিহ্বা। তাই মানুষের অভ্যুদয় ও বিনাশে বাক্যের কার্যকারিতা যে অসীম তা প্রকাশ করতে সূত্রকার মূলটিকে লক্ষ করে বলেছেন, জিহ্বায়ত্তেী বুদ্ধি-বিনাশৌ (৫॥৪৮)। আবার সাধারণের মধ্যে একটি চলিত প্রবচনে আছে মুখে বিষ এবং মুখেই মধু থাকে। এ প্রবচন যেন চাণক্যের সূত্রের ভাবানুবাদ। আর এই সূত্র থেকে মানুষের শিক্ষণীয় হলো যে, জিহ্বা দ্বারা মানুষের ভাব প্রকাশ করে অপরের কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত এবং বিপরীত পক্ষে কৃতঘ্ন করে তোলে। সুতরাং জিহ্বা অর্থাৎ বাকশক্তিকে অত্যন্ত সাবধানে প্রয়োগ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে পরের সূত্রে জিহ্বাকে সংযত করার সুফল সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রিয়বাদিনো না শত্রু’। (৫॥৪৯) প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। এটি মানুষের উন্নতি বিধায়ক গুণবিশেষ। সেকথাটি বোঝাতে সূত্রকার ফলশ্রুতি দেখিয়ে সূত্র প্রণয়ন করলেন, ‘স্তুতা দেবা অপি চিরং তুষ্যন্তি’। (৫॥৫১)
স্বধর্ম পালনের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে মাত্র তিনটি পদ ব্যবহার করেছেন, ‘স্বধর্মহেতু সৎপুরুষঃ’। (৫॥৫৬)। গীতাদিশাস্ত্রে যে কথা বহু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাও সে সূত্রাকার নিবন্ধ করা সম্ভব–তারই নিদর্শন এই তাৎপর্যবাহী সূত্রটি।
রূপের সাদৃশ্য লাভ করলেও গুণের সাদৃশ্য লাভ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে গুণই আদরণীয়। অনেকে আদরটিকে লক্ষ্য করে রুপের অনুকরণ করে, কৃত্রিম উপায়ে রুপের সাদৃশ্য সৃষ্টি করে ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের মতো হলেও, তাতে গুণ পরিবর্তিত হয় না, ফলে আদরও পাওয়া যায় না। তাই পরের রূপের অনুকরণ করা বৃথা, তাতে আদর অপেক্ষা অনাদরই অধিকমাত্রায় আসে। আচার্য কৌটিল্য এই তত্ত্বটি নানা উদাহরণনির্ভর দশটি সূত্রে ব্যক্ত করেছেন।
এরপর চাণক্য মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কীয় দৈনন্দিন আচরণ সম্বন্ধে দুটি সূত্র রচনা করেছেন-ন রাত্রিচারণং কুর্যাৎ। (৫॥৭৩) নচার্ধরাত্রং স্বপেৎ (৫॥৭৪)। রাত্রি জাগরণ ও রাত্রিতে অধিক বিচরণ যে স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর সে সম্বন্ধে সকল চিকিৎসাশাস্ত্রে একমত। চাণক্য সূত্র রচনার মধ্যে নীতি আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার মাঝে মাঝেই স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে অবহিত করাতে, দু একটি সূত্র প্রণয়ন করেছেন। তার এই রচনাবৈশিষ্ট্য দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল তত্ত্বকথা শুনিয়ে নিজের বিজ্ঞতার পরিচয় দেননি। সেই সঙ্গে সকল বিষয়ে। মানুষকে সচেতন রেখে তিনি নিজেকে মানবদরদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
মানুষের বৃত্তি গ্রহণ সম্পর্কে চাণক্যের সূত্রগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনুষ্যসমাজ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মানুষ যতোই বৈচিত্র্যের প্রতি আসক্ত হোক না কেন, মুখ্যত মানুষ গতানুগতিকের দাস এবং দাসত্বেই মানুষের জীবনধারণ সহজ ও স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সাধারণের মধ্যে এরূপ তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি না থাকায়, অনেক সময় গতানুগতিকতাকে লঙ্ঘন করে ভিন্নমুখে ধাবিত হয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহের পথটিকে পর্যন্ত দুর্গম করে তোলে। এই বৈচিত্র্যজ চাপল্য নষ্ট করার প্রয়াসে চাণক্য পঞ্চম অধ্যায়ে ৮২তম ৮৩তম সূত্র দুটি প্রণয়ন করেছেন।
চাণক্য তার নীতিশাস্ত্রেও স্ত্রীচরিত্র সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এখানে সূত্র গ্রন্থেও তার সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলন ঘটেছে। পঞ্চম অধ্যায় চারটি সূত্রে স্ত্রীচরিত্র সম্পর্কে আলোচনা আছে। এগুলোর মধ্যে ৮৮তম সূত্রটি কোনোমতেই স্বীকার্য নয়। এ সূত্রটি পুরুষশাসিত সমাজের স্পর্ধাসূচক বাণীয় মতো। ৮৭তম সূত্রে যে কথাটি বলা হয়েছে, তা সর্বাংশে শাস্ত্র ও সমাজবিরুদ্ধ। ‘স্ত্রী নাম সর্বাশুভানাং ক্ষেত্রম্’। অর্থাৎ স্ত্রী সকল অশুভের উৎপত্তিস্থল। একথা সম্পূর্ণ নারীবিদ্বেষী ব্যতীত কারও দ্বারা উচ্চারিত হওয়া সম্ভব নয়। সকল উৎপত্তির মূল প্রকৃতিই তো নারী। যে এরূপ উক্তি করে, তার জন্মদাত্রীও তো নারীই। আমাদের শাস্ত্রসমূহে সামাজিক চেতনায়–নারী হলো সর্বকল্যাণদাত্রী, শক্তিরূপিণী স্নেহময়ী জনীন রূপা। তাই যেখানে স্নিগ্ধতা, কোমলতা, সৃজনশীলতা দৃষ্ট হয়, সেখানেই মাতৃরূপা রমণীকে কল্পনা করা হয়। যেমন নদী, ভূপ্রতিকে আমরা নারী জননীরূপে চিন্তা করি। ক্রান্তদর্শী আচার্য কেন এ স্থলে একপ্রান্তদর্শী সাধারণ অজ্ঞ মানুষের মতো উক্তি করলেন, তার যুক্তি নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে দৃষ্টে নারীকে বিচার করা হলে আমাদের আরাধ্যা দেবীগুলোকেও নস্যাৎ করে দিতে হয়।
কাজের জন্য কাল নির্ণায়ক সূত্র দুটি সূত্রকারের জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞানের পরিচালক। ১০১ ও ১০২তম সূত্র দুটি হলো নিশান্তে কার্যৎ চিন্তয়ে; ‘প্রদোষে ন সংযোগ কর্তব্য’। অর্থাৎ রাত্রিশেষে ব্রাহ্মমুহূতেই কার্যারম্ভ হবে। এ সময় তার কালক্ষেপ নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রেও সূর্যোদয়ের চারদণ্ড পূর্বেই কার্যে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য স্নানের নির্দেশ করেছে। আর দিনের শেষ ও রাত্রের সূচনা (প্রদোষে) কালে সমস্ত কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ জ্যোতিষশাস্ত্রেও পাওয়া যায়। সেখানে এই সময়টিকে রাক্ষসী বেলা নাম দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ‘রাক্ষসী নাম সা বেলা গর্হিত সর্বকর্মসু’। অতএব কালনিৰ্ণায়ক ভারতীয় শাস্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করে অল্পকথায় মানুষকে যেভাবে সময় সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে, তা বিশেষ লক্ষণীয়।
এরপর ১০৮ থেকে ১১৩ পর্যন্ত ছয়টি সূত্রে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো সূত্রাকারে নিষদ্ধ হয়েছে। এর দ্বারা মানুষকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বলবত্তা প্রদর্শন করা হয়েছে। ছয়টি সূত্রের মধ্যে এই অধ্যায়ের অন্তিম সূত্রটি বেদবাক্যের ন্যায় চিরন্তন শাশ্বত সত্যঃ অর্থাৎ ‘প্ৰবততে লোকঃ’। (১১৩)। অর্থাৎ মানুষ অর্থের জন্যই কার্যে প্রবৃত্ত হয়। সামান্য বিচার করলেও দেখা যায়, মানুষ মাত্রেরই চরম লক্ষ্য হলো অর্থ। কর্মভূমি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া খেলাধুলা, কলা, শিল্প নানা বিদ্যা আয়ত্ত করে চলে, কিন্তু সেই বিদ্যায় পারঙ্গমতা লাভের চেষ্টায় পিছনে সব সময় অর্থ ক্রিয়াশীল থাকে। যে বিদ্যায় অর্থাগমের সম্ভাবনা থাকে না, সে বিদ্যা মানুষ কখনো স্বেচ্ছায় আয়ত্ত করতে প্রবৃত্ত হয় না। আবার অন্যদিক থেকেও দেখা যায়, যদি কোনো মানুষ বিশেষ কোনো বিদ্যায় পারঙ্গম হয়েও অর্থ উপার্জন করতে না পারে তা হলে তাকে অপরে আদর করে না, বরং যথাসম্ভব অবজ্ঞাই করে। তাই মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টায় আকাঙ্ক্ষিত ফল হলো অর্থ। কর্মে সাফল্য লাভ না করেও যদি মানুষ অর্থ লাভ করে, তা হলে তুষ্ট বা পরিতৃপ্ত হয়, অসাফল্যের জন্য ক্ষোভ বা দুঃখ প্রকাশ করে না। কিন্তু যদি কর্মে সফল হয়েও অর্থলাভে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে সাফল্যের সুখ তৃপ্তি কিছুই অনুভব করতে পারে না। তখন অর্থ অবাপ্তির জ্বালাতেই সে দগ্ধ হয় এবং অপরেও সে সাফল্যকে তাৎক্ষণিক অভিনন্দন জানালেও পরবর্তীকালে তাকে ভুলে যায়। অতএব মানুষের কর্মের লক্ষ্য একটিই, তার নাম অর্থ। চাণক্যের এই সূত্রটি মানুষের জীবন প্রবাহের মূল সূত্রস্বরুপ।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৮৩টি সূত্র নিবন্ধ আছে। এই অধ্যায়ে মানবজীবনের খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যগুলোই মূলতঃ সূত্রাকারে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন প্রথম পাঁচটি সূত্রে মানবজীবনের একটি বিশেষ দিকের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। মানবজীবনে ‘আশা’ অত্যন্ত ক্রিয়াশীলা। শিশুর জ্ঞান সঞ্চারের পর থেকেই আশাও সঞ্চায়িত হতে থাকে। শিশুর কথা বলতে শেখা, চলতে শেখা সমস্তই আশার প্রভাবেই ঘটে থাকে। পরবর্তী জীবনে তো মানুষের জীবন আশাপাশে বাঁধা হয়ে থাকে। আশা না থাকলে মানুষ নিজেকে কোনোভাবেই গড়তে পারতা না। লোভ ও মোহ বশতঃ মানুষ দুরাশায় অনুগামী হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয় সত্য। কিছু আশাই মানুষকে ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য প্রবৃত্তি দান করে। এই জটিল আশা তত্ত্বকে সূত্রকার ব্যক্ত করলেন, ‘আশয়া বধ্যতে লোকঃ’। (৬॥১১)। কিন্তু সূত্রকার এর পরবর্তী যে চারটি সূত্র রচনা করেছেন, তাতে আশাকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তা মুখ্যত কামনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আশা ও কামনা পুরাপুরি সমার্থক নয়। চাণক্য তৃতীয় সূত্রে বলেছেন—’নাস্ত্য শা পরে ধৈর্যম্’। (আশাপরায়ণ লোকের ধৈর্য থাকে না)। একথা কিন্তু স্বীকার্য নয়। আশাই মানুষকে ধৈর্যশীল করে। যখন কোনো ব্যর্থতা এসে মানুষকে বিপর্যস্ত করে দেয়, তখন মনের মধ্যে নব নব সঞ্চারিতা আশাই আবার সেই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে মানুষকে কর্ম পথে সঞ্চারিত করে। তবে কামনা মানুষকে অস্থির করে তোলে। সুতরাং এক্ষেত্রে সূত্রকার আশা পদটিকে কামনা অর্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন বলে ধরে নিলে উক্তিটির যথার্থতা পাওয়া যায়।
আটসংখ্যক সূত্রটি ‘মা দিবা স্বাপ্সী’ প্রসিদ্ধ শাস্ত্রীর নির্দেশের প্রতিধ্বনি—’ন দিবা স্বপ্নং-কুর্ষাৎ’। সূর্য সর্ব কর্মের সাক্ষীরূপে যখন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে বিরাজ করেন, অর্থাৎ দিবাভাগে যেরূপ কাজ করা যায়, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর সেরূপ করা কখনই সম্ভব নয়। তাই নিদ্রা দ্বারা সেই অমূল্য সময়টিকে নষ্ট করা কখনই উচিত নয়।
১০তম থেকে ১৩তম সূত্রে সাংসারিক জীবনে সাধারণ আচরণবিধিগুলো প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন ‘স্ত্রীণাং ন ভর্তর্ম পরং দৈবতম্’। (নারীদের স্বামী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতা নেই)। ‘অতিথিমভ্যাগতং পূজয়েদ যথাবিধি’। (১২)। (অতিথি ও অভ্যাগতদের যথাবিধি সকার করবে)। ‘নিত্যং সম্বিভাগী স্যাৎ’। (১৩)। (সব সময় বিভাজনপরায়ণ হয়ে কার্য করা উচিত)। অর্থাৎ কার্যে সফল হতে হলে সময়, সম্পদ সহায় সমস্ত কিছুকে যথাযথ ভাগ করে নিয়ে কাজ করতে হয়। যেমন কোন কাজটি কোন সময়ে করতে হবে, তার জন্য কাল নিরূপণ করতে হয়। সেই সঙ্গে কোন কাজে কতো পরিমাণ অর্থ ও লোকবল প্রয়োজন-তাও বিচার্য। এভাবে কাল, সহায় ও সম্পদ বিভাজন করে কর্মে প্রবৃত্ত হলে কর্মে ব্যর্থতার সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং ক্রয়োদশ সংখ্যক সূত্রটি সকলে মানুষেরই শিক্ষণীয়।
বুদ্ধিহীন ব্যক্তির অপবাদ মূলক সূত্র দুটি বিশেষ স্মরণীয়। ‘দুমেসাং মহচ্ছাং বুদ্ধি মোহয়তি’। (৬॥১৮)। (মেধাহীনের কঠিন শাস্ত্রপাঠে বুদ্ধি ভ্রম হয়)। এই সূত্রটি বর্তমানে সন্তানের পিতামাতাদের বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সম্প্রতি প্রায় প্রতিটি পিতামাতাই তাদের সন্তানদের মেধা সম্পর্কে কোনোরূপ ভাবনাচিন্তা না করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিশেষ মেধাসম্পন্ন ছাত্রদের পাঠ্য বা শিক্ষণীয় বিষয়ে নিয়োগ করেছেন। ফলে তাদের ঐ বিশেষ বিদ্যা তো অর্জিত হলোই না, উপরন্তু সাধারণ বিদ্যা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং চাণক্যের উক্ত সূত্রটির মর্মার্থ জানা থাকলে মাতাপিতারা সন্তানকে প্রতিযোগিতায় নামাবার পূর্বে একটু পরীক্ষা করে দেখবেন, যে বিষয়ে তাকে নিয়োগ করা হচ্ছে, সে বিষয়টি তার সাধ্য না অসাধ্য।
দ্বিতীয়টি মানুষ মাত্রেরই সর্বদা মনে রাখার মতো—’ধীহীনঃ—পিশাচাদনন্যঃ’। (৬ ॥২৭)। (ধীশক্তিহীন ব্যক্তি পিশাচ থেকে ভিন্ন নয়)। অর্থাৎ সকলেরই স্মরণীয় যে, মূর্খকে কোনো কাজে নিয়োগ করলে বা কোনো কাজে সহায় হিসাবে গ্রহণ করলে, নিজেকেই বিপদে পড়তে হবে। বুদ্ধিহীনতার ফলে ভালো-মন্দ বিচার করতে না পারায় সে এমন কাজ করবে, যাতে সম্পদের পরিবর্তে বিপদই আসবে।
আর একটি সন্তানের মাতাপিতাদের বিশেষ শিক্ষণীয় সূত্র—’ন পুত্ৰস্তোতব্য’। (৬॥২৯)। পুত্রের স্তব অর্থাৎ প্রশংসা করা উচিত নয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সূত্রকারের অভিপ্রায় সন্তানের নিকট সন্তানের প্রশংসা করবে না। তার কারণ, শিশুর জীবনে তখন বহু শিক্ষণীয় বস্তু পড়ে আছে, সেগুলোকে আয়ত্ত করার জন্যই মাতাপিতার উপদেশ করা উচিত, তাহলে শিশু তার ন্যূনতা বুঝে নিজেকে আরও গুণের অধিকারী করার জন্য চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি তার সামনে তার প্রশংসাই করা হয়, তাহলে তার মনে একরকম অহংকার, সবজান্তা ভাব জাগে–তার ফলে সে আর তার অনধিগত বিদ্যাগুলো লাভ করার চেষ্টাও করে না। বর্তমানে মাতাপিতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ভুলটিই করে থাকেন। নিজের সন্তানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, পরবর্তীকালে আবার ঐ পিতামাতাদের সন্তানের ঔদ্ধত্য ও উদ্ধৃঙ্খলতার জন্য আক্ষেপ করতে দেখা যায়। সূত্রকার আলোচ্য সূত্রটির মর্মার্থ জানা থাকলে উপলব্ধ করা সহজ যে, সন্তানের ঐ নিন্দনীয় পরিণতি তার মাতা-পিতাই সৃষ্টি করছেন।
এরপর আবার কততগুলো সূত্র আছে রাজতন্ত্রকালীন প্রকা ও রাজকর্মচারীদের আচরণ সম্বন্ধীয়। অবশেষে চাণক্যর আত্মবিচক্ষণতা প্রদর্শনমূলক একটি শ্লোক দিয়ে গ্রন্থের পরিসমাপ্তি হয়েছে।
Leave a Reply