চর্যাগীতি-পদাবলী – সুকুমার সেন
চর্যাচর্যটীকা সমেত
প্রচ্ছদ: জয়ন্ত ঘোষ
প্রকাশকের নিবেদন
‘চর্যাগীতি-পদাবলী’র আনন্দ সংস্করণ প্রকাশ উপলক্ষ্যে দু একটি কথা বলা প্রয়োজন। এই গ্রন্থে পদগুলিকে বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)-এ চর্যাপদগুলিকে বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনরূপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। উৎসাহী পাঠক এই গ্রন্থের সহযোগে ঐ পুস্তকের আনন্দ সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন।
পৃ ১৩১ পংক্তি ৭ (টীকাকারের মতে ‘নেড়া ব্রাহ্মণ বালক’)-এর বদলে শুদ্ধ পাঠ হবে, নাগরী (টীকার পাঠ ‘নারিয়া’ অনুসারে)।
প্রুফ সংশোধনে সাহায্য করেছেন শ্রীমতী সুনৃতাবরী সেন।
ভূমিকা
১৯৫৭ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁহার দোহাকোশে রাহুল সাংকৃত্যায়ন কতকগুলি নূতন চর্যাগান ছাপাইয়াছিলেন। সেগুলি স্পষ্টত পরবর্তী কালের রচনা এবং কতকগুলি পুরানো চর্যাগান ভাঙ্গিয়া রচিত। এই কারণে প্রস্তুত পুস্তকের আগেকার সংস্করণে আমি এই নূতন চর্যাগানগুলির আলোচনা করি নাই। তবে এগুলিকে সর্বত্র উপেক্ষাও করি নাই। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে এবিষয়ে যথাযোগ্য আলোচনা করিয়াছিলাম ।
দেখিতেছি, এই দীর্ঘকাল (১৯৫৭-৭৩) মধ্যে কোন পণ্ডিত এই চর্যাপদগুলির পাঠ আলোচনা করিতে এবং এগুলির অর্থ নির্ণয় করিতে অগ্রসর হন নাই। অর্বাচীন হইলেও এ চর্যাগানগুলি মূল্যহীন নয়। এবং এগুলির আলোচনা না করিলে চর্যাগীতির সমগ্র আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে। এই কারণে প্রস্তুত সংস্করণে দ্বিতীয় পরিশিষ্টটি যোগ করিলাম। সাংকৃত্যায়ন একটি ছাড়া সব ফোটো প্লেটই দিয়াছেন। কিন্তু তা খুব ভালো নয়। সুতরাং সেগুলির সাহায্যে প্রকৃত পাঠোদ্ধার অনেকখানি বাধাগ্রস্ত হইয়াছে। সুতরাং আমার গৃহীত পাঠ এবং তদনুযায়ী অর্থ কোনক্রমে চরম নয়।
কলিকাতা
শ্রীসুকুমার সেন
২৫ মে ১৯৭৩
নিবেদন
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় কর্তৃক আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত “বৌদ্ধগান”-গুলি, তাঁহার সংগৃহীত আর একটি চর্যাগীতি এবং চর্যাচর্যটীকায় ও সেকোদ্দেশটীকায় লব্ধ চর্যাপদগুলি একত্র সংকলন করিয়া চর্যাগীতি-পদাবলী নামে প্রকাশ করিলাম। এই চর্যাগীতি ও পদগুলি কয়েক বছর আগে ‘চর্যাগীতিকোষ’ নামে ইংরেজী অনুবাদ ও পাঠনির্দেশ সহ প্রকাশ করিয়াছিলাম Indian Linguistics পত্রিকার একটি খণ্ডরূপে। তাহাতে সেকোদ্দেশটীকা হইতে আরও কয়েকটি পদ তুলিয়া দিয়াছিলাম। এই বইয়ে সেগুলি বাদ দিয়াছি, যেহেতু এ পদগুলির ভাষা প্রায় পুরাপুরি অবহট্ঠ। এই কারণে এখানে বজ্রগীতিও সংকলন করি নাই। স্বৰ্গত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মহাশয় তাঁহার দোহাকোশে (১৯৫৭) কয়েকটি চর্যাগান ছাপাইয়াছেন। তাহাতে তিনটি নূতন চর্যাগীতিকবির নাম পাইয়াছি। এগুলি লইয়া আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ড প্রথমার্ধে আলোচনা করিয়াছি। এখানে বাদ দিলাম। তাহার কারণ এগুলি অর্বাচীন এবং অনেকটা কৃত্রিম রচনা।
চর্যাগীতির আলোচনায় তিনজনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। প্রথম চর্যাগীতির আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। দ্বিতীয় চর্যাগীতির বৈয়াকরণ শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তৃতীয় চর্যাগীতির তিব্বতী অনুবাদের আবিষ্কর্তা প্রবোধচন্দ্র বাগচী । শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাগীতিগুলিকে বাংলা ভাষায় প্রথম অবস্থার রচনা বলিয়া অনুমান করিয়াছিলেন (১৯১৬)। সে অনুমান অভ্রান্ত, কিন্তু সে অনুমানের মধ্যে বেশ কিছু ফাঁক ছিল। তিনি চর্যাগীতিগুলির সঙ্গে দোহাকোষ দুইটিকে এবং ডাকার্ণবকেও পুরাপুরি বাংলা রচনা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। যে পুরানো বাংলা ভাষার সঙ্গে আমরা তখন পর্যন্ত পরিচিত ছিলাম তাহার রূপ “বৌদ্ধ” গানগুলিতে চেনা যায় নাই। অনেক আবার এগুলির প্রাচীনত্ব স্বীকারেও কুণ্ঠিত হইলেন। এমন অবস্থায় সুনীতিবাবু চর্যাগানগুলির ভাষা আলোচনা করিয়া দেখাইলেন (১৯২৬) যে উহা বাংলা নিশ্চয়ই, বাংলার প্রত্ন মূর্তি—অবহট্ঠের সদ্যোনির্মোকমুক্ত রূপ—উহাতে আছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা সুনীতিবাবুর যুক্তি ও সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়া লইলেন। তখন বাধ্য হইয়া প্রাচ্য পণ্ডিতেরা চুপ হইয়া গেলেন। সুনীতিবাবু শুধু চর্যাপদগুলির ভাষা বাংলা প্রতিপন্ন করিয়াই চুকাইয়া দেন নাই। তিনি বহুস্থানে খাঁটি পাঠ নির্ণয় করিয়া চর্যাগীতির সাদা মানে বুঝাইয়া দিয়াছেন।
তবুও অনেকটা জট রহিয়া গিয়াছিল। তাহার উন্মোচনে দুইজনের প্রচেষ্টা স্মরণীয়। প্রথম প্রবোধচন্দ্র বাগচী। ইনি চর্যাগীতিগুলির সম্পূর্ণ তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার ও প্রকাশ করিলেন (১৯৩৮)। দ্বিতীয় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। ইনি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের যে নকল শাস্ত্রী মহাশয় করাইয়াছিলেন তাহার সহিত ছাপা পাঠ মিলাইয়া এবং অন্য উপায়ে কয়েক স্থানের প্রকৃত পাঠ নির্ণয় করিলেন (১৯৪২)।
মূল চর্যা পড়িবার প্রয়োজনীয়তা বাড়াইবার জন্য এবারে অনুবাদ টিপ্পনীর মধ্যে দিয়াছি। অনুবাদে বাহ্য এবং সন্ধা দুই অর্থই দিয়াছি। চর্যাকারদের সদৃশ উক্তি উদ্ধৃত করিয়া তাঁহাদের বক্তব্য তাঁহাদের কথাতেই বুঝাইতে প্রযত্ন করিয়াছি। শব্দকোষে প্রত্যেক পদের অর্থ ও যথাসম্ভব ব্যৎপত্তি দিয়াছি। কয়েকটি বিশিষ্ট শব্দের ব্যুৎপত্তি সুগম হইয়াছে জিপ্সী ভাষার সাহায্যে। ডোম জাতি জিপ্সী-ভাষীদের ভারতীয় পূর্বপুরুষ। প্রাচীন ভারতীয় ডোম্ব শব্দই জিপ্সী ভাষায় “রোম” হইয়াছে এবং ডোম্বদের ভাষা *ডোম্বিনী হইয়াছে উহাদের ভাষা “রোমনী”।
ভূমিকায় চর্যাগীতি-পদাবলীর বিষয় ভাব ভাষা ছন্দ ইত্যাদি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইয়াছে। চর্যাকর্তাদের সময় নিরূপণে অপরীক্ষিত “তথ্য” ও অনুমিত আপ্তবাক্য দুই-ই অগ্রাহ্য করিয়াছি। আনুমানিক অধস্তম ও ঊর্ধ্বতম কাল নির্দেশ ছাড়া এখানে আপাতত কিছু করিবার নাই। সুতরাং “জেতই বোলী তেতবি টাল”। চর্যাকর্তাদের সাধনমতের আলোচনায় তাঁহাদেরই উক্তির উপর নির্ভর করিয়াছি। তীলো, সরহ ও কাহ্ণের দোহাকোষ হইতে চর্যাগীতির অনেক স্থানের অর্থ পরিষ্কার হইয়াছে। যাঁহারা বরাবর বলিয়াছেন—গুরু বোবা শিষ্য কালা, তাঁহাদের গোপন কথার নিগূঢ় ইঙ্গিত বুঝাইয়া দিবার মতো অধ্যাত্মবোধ অথবা দিব্যদৃষ্টি কোথায় পাইব। সুতরাং আপন, মনের কুয়াসা ও চোখের ঘোর দিয়া পরের চক্ষুদান করিতে যাই নাই। এ বিষয়ে অক্ষমতা স্বীকার করিলাম।
চর্যাগীতির পুথির লিপিকর যে মূলের ও টীকার জন্য দুইটি স্বতন্ত্র পুথি ব্যবহার করিয়াছিলেন সে অনুমানের অতিরিক্ত একটি প্রমাণ যথাস্থানে বলা হয় নাই, এখানে বলিতেছি। টীকার পুঁথিতে মূল ছিল না, তাই একটি চর্যার টীকার পরেই অপর চর্যার টীকা আরম্ভ করিতে গিয়া টীকাকার প্রায়ই লিখিয়াছেন “তমোবার্থং প্রতিপাদয়তি” ইত্যাদি বলিয়া। মধ্যে মূল চর্যার ব্যবধান থাকিলে এমন লিখিতেন না।
এবারে মূল পুঁথির ফটো-প্রতিলিপির সাহায্যে মূলের ও টীকার মিলাইয়া দিয়াছি। পাঠে কোন হস্তক্ষেপ করি নাই। পুঁথির কয়েকটি পৃষ্ঠার ছবি দেওয়া হইল। তাহাতে অনুসন্ধিৎসুর পক্ষে মিলাইয়া দেখিতে সাহায্য হইবে। মূল পুঁথির ফটো-প্রতিলিপি আমি ডক্টর শ্রীমান্ ৎসুয়োশি নারীর সৌজন্যে ব্যবহার করিতে পারিয়াছি। সেজন্য ডক্টর নারা আমাদের সকলের ধন্যবাদার্হ।
কলিকাতা শ্রীসুকুমার সেন
১৮ মে ১৯৬৬
দ্রষ্টব্য গ্রন্থ
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা, বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ, কলিকাতা, ১৩২৩।
শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Developement of the Bengali Language, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা ১৯২৬। দ্বিতীয় সংস্করণ জর্জ এলেন এন্ড আন্উইন লিমিটেড লন্ডন ১৯৭০।
প্রবোধচন্দ্র বাগচী, Dohakosa, Part I Calcutta Sanskrit Series No 25C, Calcutta.
প্রবোধচন্দ্র বাগচী, Materials for a Critical Edition of the Old Bengali Caryapadas (A comparative study of the text and the Tibetan translation) Part I, Journal of the Department of Letters, Vol. XXX, Calcutta University, Calcutta, 1938.
মহম্মদ শহীদুল্লাহ্, Buddhist Mystic Songs, Dacca University Studies, Dacca.
শ্রীসুকুমার সেন, Index Verborum of the Old Bengali Carya Songs and Fragments, Indian Linguistics, Vol. IX, Calcutta, 1947.
শ্রীসুকুমার সেন, Old Bengali Text of Caryagitikosa, Indian Linguistics, Vol. X, Calcutta, 1948
শ্রীসুকুমার সেন, An Etymological Dictionary of Bengali: C. 1000-1800 A.D., ইস্টার্ন পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৭১।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দোহাকোশ, বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ্, পাটনা, ১৯৫৭।
শ্রীতারাপদ মুখোপাধ্যায়, The Old Bengali Language and Text, Calcutta University, Calcutta, 1963.
শ্রীসুভদ্রকুমার সেন, Proto-New Indo-Aryan, ইষ্টার্ন পাবলিশার্স, কলিকাতা ১৯৭৩।
মোজাম্মেল হক
ভালো